অলাতচক্র (পঞ্চমাংশ)

প্রথমাংশের লিঙ্ক
দ্বিতীয়াংশের লিঙ্ক
তৃতীয়াংশের লিঙ্ক
চতুর্থাংশের লিঙ্ক

লেখক : তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়

॥ বারো ॥

সেদিন তারানাথের কাছ থেকে চলে আসার ঠিক পরে পরেই কোনও ছুটির দিন ছিল না। আকর্ষণ থাকলেও তারানাথের বাড়ি যাওয়া হয়ে ওঠেনি। অবশ্য আমরা ইচ্ছে করেও মাঝে মাঝে ফাঁক দিই, বিশেষ করে একটু পুরনো আর লম্বা গল্প শোনার সময়। এ ধরনের গল্প একদিন বা দুদিনে শেষ হয় না। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ডুব দিয়ে আমরা দেখতে চাই তারানাথ গল্পের খুঁটিনাটিতে কোনও গোলমাল করে ফেলে কিনা। আজ পর্যন্ত তেমন কোনও ঘটনা ঘটেনি, তিনমাস পরে ফের শুরু করলেও সব সে ঠিকঠাক বলে। নামধাম ভুল করে না, তারিখ গুলিয়ে ফেলে না, কে কার কী হয় তা সঠিক মনে রাখে। ফলে আমরা তার গল্প এখন প্রায় বিশ্বাস করতে শুরু করেছি, আগের মত কেবল গল্পের নেশা নয়, তার সঙ্গে মিশেছে বেশ কিছুটা শ্রদ্ধা। তবে এবার গল্পের খেই ধরতে একটু দেরি হল, কারণ যে কোম্পানিতে আমি কাজ করি তারা হঠাৎ মাসখানেকের জন্য আমাকে বদলি করল বিহার আর মধ্যপ্রদেশের সীমান্তে একটা জায়গায়। সেখানে কোম্পানির নতুন কারখানা হবে, দু-তিনটে জায়গা দেখা হয়েছে। আপাতত অফিসের একজন মেজকর্তা, সার্ভেয়ার আর আমি যাচ্ছি। ঘোর পাহাড়-জঙ্গলের মধ্যে তাঁবু ফেলে থাকতে হবে। রান্নাবান্না, জঙ্গল পরিষ্কার করা, জরিপের কাজে সাহায্য—এসবের জন্য জনাপনেরো লোক স্থানীয় কোনও আদিবাসী গ্রাম থেকে জোগাড় করতে হবে। আমার কাজ হল তহবিল আর হিসেবপত্র রাখা, আর সাধারণভাবে সবকিছুর তত্ত্বাবধান করা।

বাঙালী বাড়ি ছেড়ে বেরুতে ভালবাসে না। বেশ আছি বাপু কলকাতায়, বাড়ি অবশ্য গ্রামে—তবু ইচ্ছে করলে দুই কী আড়াইঘণ্টার মধ্যে সেখানে পৌঁছতে পারি। শহরে মেসে থাকি, মেস থেকে সকালে স্নান-খাওয়া সেরে পান মুখে দিয়ে ধীরেসুস্থে সাড়ে ন’টায় বেরুলেও কোনও তাড়াহুড়ো না করেই দশটার ভেতর অফিসে হাজির হই। বিকেলে ফিরে খাওয়া, এগারোটার মধ্যে বিছানা আশ্রয়। সমস্ত ব্যাপারটার ভেতর একটা নিশ্চিত নির্ভরতা আছে, মসৃণ গতিতে এভাবে জীবন চলে গেলে কে আর যেচে জটিলতা আমদানি করে? তারপর অফিস থেকে বলছে বটে একমাস, শেষপর্যন্ত সেটা কতদিনে গিয়ে ঠেকবে বলা কঠিন। কাজ শেষ না হলে আমার ভাল লাগছে না’ বলে বায়না করলে তো আর কোম্পানি কলকাতায় ফিরিয়ে আনবে না। বন্ধু আর আড্ডা ফেলে, সিনেমা থিয়েটার আর শহরের হরেক মজা ফেলে কি জঙ্গলে যেতে ইচ্ছে করে? অফিসের নির্দেশ জানিয়ে বাবাকে চিঠি লিখলাম, আশা ছিল বাবা যদি অত দুরে জনমানবহীন জায়গায় যাওয়া নিয়ে একটুও উদ্বেগ প্রকাশ করেন, তাহলে বাবার স্বাস্থ্য ভাল নয় এই অজুহাত দেখিয়ে অফিসে দরখাস্ত করে যাওয়া ঠেকাতে চেষ্টা করব। হায় রে! নিজের বাবাকে এতদিনেও কেন ঠিকঠাক চিনিনি তা ভেবে অবাক লাগল। বাবা লিখলেন—‘স্নেহের বাবাজীবন, তোমার পত্র পাইয়া আনন্দিত হইলাম। কলিকাতার বদ্ধ বাঁচা হইতে এতদিনে কর্মের সূত্রে তোমার বাহিরে যাইবার সুযোগ ঘটিয়াছে ইহার জন্য পরমেশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই। এক জায়গায় কাদায় গুণ পুঁতিয়া পড়িয়া থাকিলে মনুষ্যত্বের সম্যক বিকাশ ঘটে না। ঈশ্বরের এই সুন্দর সৃষ্টির বৈচিত্র্য দেখিবার সুযোগ পাওয়া ভাগ্যের কথা। আমাদের যৌবনে এত সুযোগ ছিল না, আমার সারাজীবন পাড়াগ্রামেই কাটিল। যাহা আমি পারি নাই তুমি তাহা করিতে চলিয়াছ ভাবিয়া গর্বিত বোধ করিতেছি। আমার জন্য বিন্দুমাত্র চিন্তা করিও না, আমি ভালই আছি। এখনও বেশ পরিশ্রম করিতে পারি। একমাস কেন, ছয়মাস তুমি বাইরে থাকিলেও ক্ষতি হইবে না। নিয়মিত পত্ৰ দিয়া কুশল জানাইবে। ইতি, আশীর্বাদক— বাবা।’

নাঃ, বাবাকে আর মানুষ করা গেল না। সুটকেস গোছাতে শুরু করলাম।

হাতে সময় বেশি ছিল না, ভেবেছিলাম যাওয়ার আগে একবার তারানাথের সঙ্গে দেখা করে যাব, কিন্তু তার আর সময় পেলাম না। কিশোরীকে বলে গেলাম সে যেন তারানাথকে জানিয়ে দেয় খবরটা। মেসে একমাসের ভাড়া অগ্রিম দিয়ে গেলাম, ম্যানেজারকে জানিয়ে রাখলাম যদি একমাসেরও বেশি দেরি হয় তাহলে মনিঅর্ডারে টাকা পাঠাব, নইলে কিশোরী এসে দিয়ে যাবে। মেসে বহুদিন আছি, ম্যানেজারের সঙ্গে প্রায় বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে, তিনি হেসে বললেন—‘অ্যাডভান্স না দিলেও চলত। এমনিই চলে যান না, বাইরে যাচ্ছেন, হাতে বাড়তি নগদ থাকা ভাল। আমি অবশ্য শুনলাম না, যেখানে যাচ্ছি সেই জঙ্গলে পয়সা খরচ করার কোনও সুযোগ নেই। খামোকা বেশি টাকা হাতে রেখে কী করব?

রাত দশটা বেজে দশ মিনিটে হাওড়া থেকে রাউরকেল্লা এক্সপ্রেস ছাড়ে, সেই ট্রেনে রওনা দিতে হবে। পরদিন ভোররাত্তিরে রাউরকেল্লা নেমে বাস ধরে বিরমিত্রাপুর হয়ে সিমডেগা যেতে হবে। বনজঙ্গল আর পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে প্রায় ষাট মাইল রাস্তা। সিমডেগা বিহারের রাঁচি জেলায় অবস্থিত হলেও জায়গাটা বিহার উড়িষ্যা আর মধ্যপ্রদেশের প্রায় সংযোগস্থলে। বাঙালী আছে সামান্য কয়েকঘর, বেশিরভাগই বিহারী, মাড়োয়ারি আর হো মুণ্ডা ওঁরাও ইত্যাদি আদিবাসী। সিমডেগায় স্থানীয় অফিস হিসেবে একটা বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছে বটে, কিন্তু সেখানে থাকবে আপাতত একজন মালিগোছের কর্মচারী, সে বাড়িঘর দেখাশোনা করবে আর পাহারা দেবে।

বাঙালী বাড়ির বাইরে যেতে চায় না, শুনেছি বেড়াতে যাবার সময় ঘোড়ার গাড়ি ডেকে তাতে মালপত্র তুলে দরজায় তালা বন্ধ করবার সময় চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে সে মনে মনে ভাবে—না গেলেই হত। আমারও প্রথম দিকে তাই হয়েছিল বটে, কিন্তু যাবার দিন সকাল থেকে মনের বিষণ্ণতা কেটে গিয়ে বেশ একটা চনমনে ভাব মনের ভেতর ছড়িয়ে পড়ল। সত্যি বলতে কী, একবার পুরী আর একবার বৈদ্যনাথ ধাম ছাড়া সেভাবে বাইরে বেরুনো হয়নি কখনও। মনটা বিভক্ত হয়ে গিয়ে রক্ষণশীল ভাগটা বলছে—ঘরের নিরাপদ পরিবেশ ছেড়ে বেরুচ্ছ কোথায় বাপু? এসব ইচ্ছে তো ভাল নয়। আবার মুক্ত বাতাসলোভী তরুণ সত্তার অংশটা বলছে—বেরিয়ে পড়, এতবড় পৃথিবীটা শত বৈচিত্র্য নিয়ে অপেক্ষা করে রয়েছে তোমারই জন্য। সে সব না দেখে কলকাতায় কেরানীগিরি করে মরবে!

জিতে গেল তরুণ সত্তা। ইতিহাসে চিরকাল তাই জিতেছে।

রাত্রি দশটার পরে ট্রেন, কাজেই মেস থেকে রাত্তিরের খাওয়া সেরেই বেরুলাম। পৌনে দশটার মধ্যে রাউলকেল্লা এক্সপ্রেসের নির্দিষ্ট কামরার সামনে পৌছে গেলাম। সার্ভেয়ার সাহেব দেখি আগেই এসে গিয়ে দুখানা বেঞ্চিতে চাদর বিছিয়ে জায়গা অধিকার করে রেখেছেন। ট্রেনে বিশেষ ভিড় নেই, অপর দুটি বেঞ্চির মধ্যে একটিতে মধ্যবয়েসী একজন অবাঙালী ভদ্রলোক পুঁটলি খুলে সামনে চাপাটির গোছা, সবজি আর আচার নিয়ে বসে গিয়েছেন। অপর বেঞ্চিটি এখনও খালি। সার্ভেয়ার ভদ্রলোকের নাম নির্মল কাঞ্জিলাল, তিনি জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে নজর রাখছিলেন। আমাকে দেখেই চেঁচিয়ে বললেন—এই যে, এই কামরায়! চলে আসুন—

গাড়িতে উঠে সুটকেসটা বাঙ্কে তুলে দিয়ে হোল্ড-অল খুলে বেঞ্চিতে বিছানা পাততে পাততে বললাম—মেজকর্তা তো সেকেন্ড ক্লাসে যাবেন, তিনি এসেছেন তো?

—ওঃ, সে আমাদের আগে! মহা ব্যস্তবাগীশ মানুষ, এরমধ্যেই দুবার এসে আপনি পৌঁছেছেন কিনা সে খোজ নিয়ে গিয়েছেন। একটু খামখেয়ালি, কিন্তু ভাল লোক—

নির্মলবাবুর কথা শেষ হতে না হতে মেজকর্তা ফের এসে হাজির। জানালায় উঁকি দিয়ে আমাকে দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন—যাক, এসে গিয়েছেন। আপনারা মশাই ইয়ং ম্যান, আপনাদের এত দেরি হয় কী করে বলুন তো? সবিনয়ে জানালাম—খাওয়াদাওয়া করে বেরুতে একটু সময় লেগেছে।

—এঃ হে, খেয়ে এসেছেন। ট্রেন জার্নির অর্ধেক মজাই তো মাটি করেছেন। শুকনো খাবার—যেমন পরোটা, রুটি, সামান্য সবজি, গুটিকয়েক কড়াপাকের সন্দেশ—এইসব নিয়ে ট্রেনে উঠবেন। গুটগুট করে ট্রেন চলবে, আর টুকটুক করে খাবেন। তবে না মজা! তারপর গলার স্বর নিচু করে ওদিকের বেঞ্চিতে ভোজনরত অবাঙালী ভদ্রলোককে দেখিয়ে বললেন—ওই দেখুন একজন বুদ্ধিমান লোক। গলার স্বর আবার স্বাভাবিক করে হেসে বললেন—এই দেরি করে খাওয়া সারতে গিয়ে কত লোক ট্রেন মিস করে। যাক, আবার যেন নামতে দেরি করবেন না। আলো ফোটবার আগেই গাড়ি রাউরকেল্লা ঢুকে যায়। বাণ্ডামুণ্ডা পার হতে আরম্ভ করলেই জিনিসপত্র গুছিয়ে নেবেন—

বললাম—ভয় কী। এ ট্রেন তো রাউরকেল্লা ছাড়িয়ে আর যাবে না—

মেজকর্তা হেসে বললেন—তা ঠিক। আর একটা কথা, টাটানগর ছাড়াবার পর লাইনের দুদিকের দৃশ্য খুব সুন্দর, কেবল পাহাড় জঙ্গল আর ঝর্ণা। চাঁদনি রাত এখন, দেখতে খুব ভাল লাগবে। আজকে রাত দুটোর পর আর ঘুমোবেন না—

মানুষটার ওপর শ্রদ্ধা জন্মে গেল। অফিসের একঘেয়ে আর নীরস কাজের মধ্যে মেজকর্তার এই সরস ব্যক্তিত্বের দিকটা চোখে পড়ার কোনও সুযোগ ঘটেনি। বরং তাঁর খামখেয়ালিপনা নিয়ে আড়ালে আমরা সকলে হাসাহাসিই করেছি। কার মধ্যে যে কী থাকে!

ট্রেন ছাড়ল। রেলের গুমটি, শান্টিং ইয়ার্ড ইত্যাদি ছাড়াবার পর গতি বাড়িয়ে ট্রেন জোরে ছুটতে শুরু করল। প্রথম থামবে একেবারে খড়গপুরে। কিন্তু এখন সত্যিই দুদিকে দেখবার কিছু নেই। অতি সাধারণ কিছু কুশ্রী জনপদ, দোকানপাট বন্ধ, পথে মানুষ প্রায় নেই। বিদ্যুতের আলো কম, তেলের বাতি জ্বলছে কোথাও কোনও বাড়ির বারান্দায়। বড় শহরের উপকণ্ঠ যেমন নিরানন্দ আর নীরস হয়। মেজকর্তার কথা মেনে রাত দুটোর পর জাগলেই হবে এখন। মাথার পেছনে দুইহাত দিয়ে চিত হয়ে শুয়ে কামরার ছাদে কম পাওয়ারের বাতিটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ট্রেনের দুলুনিতে আস্তে আস্তে ঘুম পেয়ে গেল।

ঘণ্টা আড়াই পরে ঘুমটা আপনিই ভেঙে গেল। ঘড়িতে দেখি রাত প্রায় একটা। তার মানে সামনে খড়গপুর আসছে। কনুইয়ে ভর দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। চাঁদের আলোয় ধোয়া মাঠপ্রান্তর দ্রুতবেগে পেছনদিকে ছুটে চলেছে, মৃদু আলোয় দৃশ্যমান পরিবেশে ফুটে রয়েছে এক দৈবী মায়া। এখনও এক কী দেড়ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিয়ে উঠলেই হবে। আবার শুয়ে পড়তে যাচ্ছি, হঠাৎ একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। আকাশের অনেকখানি অংশে দীর্ঘ পথরেখা টেনে চন্দ্রালোকিত মাঠে এক বিশাল নীল উল্কা এসে পড়ল! আকাশে তার সঞ্চরণপথে এখনও আবছা নীল আভা জেগে রয়েছে। দুরন্ত গতিতে ছুটে এসে মাঠে পড়ার প্রচণ্ড অভিঘাতে বোধহয় উল্কাটা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গেল, একরাশ নীল আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছিটকে উঠল মাঠের বুক থেকে। স্কুলের পাঠ্যবইতে পড়েছিলাম প্রতিদিনই বহু উল্কা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে, কিন্তু তার ভেতর খুব কমই মাটি পর্যন্ত পৌছায়। আমিও এই প্রথম কোনও উল্কা মাটিতে পড়তে দেখলাম। তাছাড়া উল্কা কি কখনও নীল রঙের হয়? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে পড়ল একটা কথা—বহুদিন আগে তারানাথ কালভৈরবের উপাখ্যান শোনাবার সময় বলেছিল তার জন্মমুহুর্তে নাকি বিশাল এক নীল উল্কা আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত অবধি চলে গিয়েছিল ঠিক এমনি পথরেখা তৈরি করে। এবার যে গল্প অসমাপ্ত রেখে বাইরে যাচ্ছি—ফিরে নিশ্চয়ই বাকিটা শুনব—তাতেও তারানাথ একবার এই ব্যাপারটার উল্লেখ করেছিল বলে মনে পড়ল। এই দুটো ঘটনার কি কোনও যোগসূত্র আছে? নইলে আজই হঠাৎ নীল উল্কাপাত দেখলাম কেন?

অবশ্য একটা কথা ঠিক, এর আগে খুব একটা বাইরে বেরুই নি কখনও। গ্রামের পাঠশালা সাঙ্গ করে মহকুমা শহরে হোস্টেলে থেকে পড়তাম। ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে কলকাতার কলেজ, তারপর কলকাতাতেই চাকরি। আমি সত্যেন দত্ত বা নজরুলের কবিতার বাংলার দামাল ছেলে নই, সেভাবে দেখা হয়নি কিছু। জীবনে প্রথম গৃহপ্রাঙ্গণ পার হয়ে বেরুতে না বেরুতে একটা বিচিত্র জিনিস দেখে ফেললাম। এমনই অভিজ্ঞতার জনক!

আবার শুয়ে পড়তে যাচ্ছি, হঠাৎ নজরে পড়ল ওধারের বেঞ্চের দিকে। সেখানে একজন মানুষ শুয়ে ঘুমোচ্ছে। ঘুমোচ্ছে বললাম বটে, কিন্তু নিদ্রিত লোকের দেহে এক ধরনের অচেতন শিথিলতা থাকে—একে দেখে মনে হয় যেন এমনি এমনি চোখ বুজে শুয়ে রয়েছে। বছর চল্লিশেক বয়েস হবে, পরনে খাটো ধুতি আর ফতুয়া বা পিরাণ জাতীয় কিছু। মুখশ্ৰী শান্ত আর নিরীহ, সে মুখে এমন একটা কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যার জন্য বারবার তাকাতে ইচ্ছে করে। যদিও লোকটি একটু ওপাশ ফিরে শুয়ে থাকায় সম্পূর্ণ মুখটা ভাল করে দেখতে পাচ্ছি না।

কিন্তু কথা হল, লোকটি ট্রেনে উঠল কখন? হাওড়া থেকে গাড়ি ছাড়ার সময় পর্যন্ত কামরায় আমি, নির্মলবাবু আর সেই ভোজনরত অবাঙালী ভদ্রলোক ছাড়া অন্য কেউ ছিল না। গাড়িতে ঠিক গভীর ঘুম হয় না, আধো ঘুম আধো জাগরণের মধ্যে চাকার শব্দ, লাইনের ক্রসিং পার হবার ঘটাং ঘটাং আওয়াজ, কামরার দুলুনি—সব অস্পষ্টভাবে টের পাওয়া যায়। কাজেই আমি জানি ট্রেন মধ্যে কোনও স্টেশনে থামেনি। থামলে টের পেতাম। তা হলে?

অথবা থেমেছে নিশ্চয়ই, হয়তো মাঝখানে একটু গভীর ঘুম হওয়ায় বুঝতে পারিনি। নইলে আস্ত একটা মানুষ তো বাতাসে উড়ে এসে কামরার জানালা দিয়ে ঢুকে পড়েনি!

এইসব ভাবছি, গাড়ি ঢুকে পড়ল খড়গপুর স্টেশনে।

এত রাত্তিরে প্ল্যাটফর্মে ভিড় ছিল না। দু-একজন ঝিমন্ত চা-ওয়ালা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই কামরায় কেউ উঠল না। নির্মলবাবু ঘুমের মধ্যেই একবার বিড়বিড় করে বললেন—কী স্টেশন?

বললাম—খড়গপুর। বাঃ বাঃ, বেশ ’ বলে নির্মলবাবু পাশ ফিরে আবার গভীরভাবে ঘুমিয়ে পড়লেন।

ট্রেন ছাড়তে আমিও আরাম করে শুয়ে চোখ বুজলাম।

পরের বার ঘুম ভাঙল ট্রেন থামার সামান্য ঝাঁকুনিতে : রাত তখন সওয়া তিনটে। দেখলাম ছোট একটা স্টেশনে গাড়ি দাঁড়িয়েছে। আমাদের কামরার ঠিক সামনেই লোহার খুঁটির ওপর তেলের বাতি জুলছে, যদিও চমৎকার জ্যোৎস্নায় ফুটফুট করছে, বাতির কোনও দরকার নেই, তবু সরকারী আইন—গাড়ি আসবার দশ-পনেরো মিনিট আগে স্টেশনের কুলি এসে বাতি জ্বেলে দিয়ে যায়। সারারাত টানা জ্বলে না, তাতে সরকারের অকারণ খরচ বাড়ে। মাথায় পাগড়ি, গায়ে লাল কুর্তা পরা রেলের এক কুলি কামরার পাশ দিয়ে গম্ভীর হেঁড়ে গলায় বলতে বলতে চলেছে—গৈলকেরা। গৈলকেরা—

তাকে জিজ্ঞাসা করলাম—কী স্টেশন এটা, ও ভাই?

সে হাঁটতে হাঁটতেই বলল—গৈলকেরা, বাবুজি।

মেজকর্তা ঠিকই বলেছিলেন, ভারি অপূর্ব দৃশ্য তো এ লাইনের। স্টেশনের একেবারে গা ঘেঁষে একটা বনজঙ্গলে ভর্তি পাহাড় উঠে গিয়েছে ওপরদিকে। প্ল্যাটফর্মে জনমানব নেই, পরিবেশে কোথাও কোনও সাড়াশব্দ নেই, কেবল চাঁদের আলোয় হালকা স্বপ্নের রঙ দিয়ে আঁকা একখানি দক্ষ শিল্পীর তৈরি ছবি আমার সামনে মেলে রাখা আছে। হঠাৎই নৈশ মগ্নতা ভেঙে সামনের পাহাড়ের জঙ্গল থেকে কর্কশ গলায় কী একটা প্রাণী ডেকে উঠল। অবাক হয়ে ভাবছি, জিনিসটা কী হতে পারে, এমন সময় আমার পেছন থেকে নির্মলবাবুর গলা ভেসে এল—ময়ূর। ওটা ময়ুরের ডাক—

পেছনে তাকিয়ে দেখি সার্ভেয়ার সাহেব ঘুম ভেঙে উঠে বসেছেন। বললাম—হ্যাঁ। প্রথমে বুঝতে পারিনি, তারপরে মনে পড়ল কলকাতার চিড়িয়াখানায় এই ডাক শুনেছি। শহরের লোক তো, একটু ধাঁধা লেগে যায়। আপনি কী করে বুঝলেন?

একটা হাই চেপে সার্ভেয়ার সাহেব বললেন—সিনেমা দেখে।

—সিনেমা দেখে। তার মানে?

—আরে মশাই, আমিও আপনার মত শহরের মানুষ, ময়ূরের ডাক রোজ শুনব কোথা থেকে? গত মাসে ভক্ত ধ্রুব ফিলিম দেখতে গিয়েছিলাম, তাতে একটা দৃশ্যে রয়েছে—ধ্রুব জঙ্গলে চোখ বুজে বসে ধ্যান করছে, আর তার চারদিকে চরে রেড়াচ্ছে কটা ময়ূর। তারই মধ্যে একটা কয়েকবার ক্যাঁক ক্যাঁক করে ডাকল। কিন্তু সে আওয়াজে ধ্রুবর ধ্যান ভাঙল না, ডিরেকটার সেই ব্যাপারটাই দেখাতে চেয়েছিলেন। সেটা মনে পড়ে গেল—

নির্মলবাবু উঠে এসে আমার বেঞ্চিতেই জানালার ধারে বসলেন। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে এগিয়ে দিয়ে বললেন—নিন।

একসঙ্গে বাইরে বেরুলে একটা সহজ ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠে পদমর্যাদা কিংবা সামাজিক অবস্থানের পার্থক্যটুকু মুছে দেয়। তবু অফিসে নির্মলবাবু আমার ওপরওয়ালা, উনি দিচ্ছেন বলেই তো আর সঙ্গে সঙ্গে একটা তুলে নেওয়া যায় না। সসঙ্কোচে বললাম—না, না, থাক—

—থাক কেন, নিন—ধরান একটা। এখন আমাদের বেশ কিছুদিন একসঙ্গে থাকতে হবে। লজ্জা ঝেড়ে না ফেললে চলবে কী করে? আপনি স্মোক করেন তা আমি জানি—

ক্যাভেন্ডার্স নেভিকাট একখানা ধরিয়ে মাথা সোজা করতেই প্রথম নজর পড়ল ওপাশের বেঞ্চিতে। অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। সেই মাঝপথে হঠাৎ উঠে আসা রহস্যময় লোকটি আর সেখানে নেই।

আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে নির্মল কাঞ্জিলাল একবার ওপাশে তাকালেন, তারপর বললেন—কী হয়েছে? ওদিকে অমন করে কী দেখছেন?

বললাম—না, মানে—ওই ওদিকের বেঞ্চিতে একজন লোক শুয়ে ঘুমোচ্ছিল, সে গেল কোথায়?

নির্মলবাবু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন—মাঝে কোনও স্টেশনে নেমে গিয়েছে হয়তো। জিনিসপত্র কিছু নিয়েটিয়ে যায়নি তো? দেখে নিন ভাল করে, দিনকাল খারাপ পড়েছে—

—না, ঠিক তা নয়, মানে—

বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে বেশি কথা বললে নির্মলবাবু হয়তো আমাকে বাতিকগ্রস্ত ভাববেন। কথার গতি বদলে বাইরের দিকে তাকিয়ে বললাম—কী অপূর্ব দৃশ্য, তাই না? মেজকর্তা ঠিকই বলেছিলেন, বাকি রাতটুকু আর ঘুমোনো উচিত হবে না—

নির্মল কাঞ্জিলাল মানুষ ভাল, কিন্তু একটু বাস্তববাদী নীরস প্রকৃতির। ক্যাভেন্ডার্সে একটা লম্বা সুখটান দিয়ে জানালা গলিয়ে অবশিষ্টাংশ বাইরে ফেলে আবার শোয়ার উদ্যোগ করতে করতে তিনি বললেন—আপনাদের মনে অসীম কবিত্ব, জেগে বসে প্রকৃতি দেখুন বরং, আমি আরও ঘণ্টাদুই ঘুমিয়ে নিই। রাউরকেল্লা ঢোকবার মুখে ডেকে দেবেন। মেজকর্তা অমন করে বললেন, তার মুখের ওপর তো আর ‘না’ বলা যায় না। কিন্তু আমার ঘুমই ভাল—

তিনি আবার লম্বা হয়ে শুয়ে চোখ বুজলেন। অবাঙালী ভদ্রলোক সেই যে খাওয়াদাওয়া সেরে শুয়েছেন, সারারাত ট্রেনের দুলুনি বাঁকুনি বা আমাদের কথাবার্তার শব্দে তার নিদ্রার কিছুমাত্র ব্যাঘাত ঘটেনি। এসব নিশ্চিত্ত নিরুদ্বেগ মানুষ দেখলেও হিংসে হয়।

রাউলকেল্লা পৌঁছনো পর্যন্ত সত্যিই আমার আর ঘুম হল না। শুক্লা নবমীর চাঁদ পশ্চিমে ঢলে পড়েছে, সট সট পিছিয়ে যাওয়া বড় বড় গাছগুলোর দীর্ঘ ছায়া মাটিতে। হঠাৎই একটা কালো গ্র্যানাইটের টিলা লাইনের পাশেই ক্ষীণধারা ঝর্না নেমে এসেছে তার গা বেয়ে। আর সবকিছুর ওপর সেই স্নান হয়ে আসা শেষরাতের মায়াবী জ্যোৎস্না। সম্মোহিতের মত বাকি রাতটুকু জানালার পাশে বসে কাটিয়ে দিলাম।

ট্রেন যখন রাউরকেল্লা পৌঁছল তখনও ভাল করে ভোর হয়নি। আমরা তিনজন যখন স্টেশনের বাইরে এসে দাঁড়ালাম তখনও মানুষজন জাগেনি, দু-তিনটে ছোট গুমটি দোকান আছে—বোধহয় চা বা খাবারের, সেগুলো বন্ধ। কেবল মাথায় পাগড়ি জড়ানো এক বৃদ্ধ নলওয়ালা পেতলের কলসীতে করে চা বিক্রি করছে। তাকে ডেকে সবাইকে চা দিতে বলা হল। ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে মেজকর্তা বললেন– সিমডেগা থেকে জিপ নিয়ে লোক আসবার কথা ছিল, কী হল তাদের বুঝতে পারছি না তো—

প্রথম ভাঁড় শেষ করে মেজকর্তা চাওয়ালাকে বললেন— আর একবার করে দাও, এই এতেই দাও—

দ্বিতীয়বারের চায়ে যখন চুমুক দিচ্ছি, তখনই একটা রঙওঠা উইলির জিপ নানারকম শব্দ করতে করতে স্টেশন চত্বরে এসে ঢুকল। তার থেকে নেমে হনহন করে আমাদের সামনে দাঁড়াল এক অদ্ভুত চেহারার মানুষ। অদ্ভুত বলছি এই কারণে যে, লোকটি কেবলই লম্বা–তার শরীরের অন্য কোনও মাত্রা নেই। সরু সরু কয়েক টুকরো বাঁশের ওপর পোশাক-আশাক জড়ালে যেমন দেখায়, একেও ঠিক তেমনি দেখতে। ছোটবেলায় পাকাটি আর তালপাতা দিয়ে তৈরি একরকমের খেলনা সেপাই মেলায় বিক্রি হতে দেখেছি, এই মানুষটিকে দেখে সে কথা মনে পড়ে গেল।

লোকটি তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে বারদুই প্রবল হোঁচট খেয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়ে নির্ভুলভাবে মেজকর্তাকে দলপতি হিসেবে চিহ্নিত করে তাকে বলল— নমস্কার। আমি জলধর পণ্ডা।

মেজকর্তা বললেন—নমস্কার। তুমি আমাদের সিমডেগা অফিসের ওভারসিয়ার?

—আইজ্ঞা।

জলধর পণ্ডার উচ্চারণ বৈশিষ্ট্যে সে কোন অঞ্চলের মানুষ তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সে যে মানুষ ভাল তাও তার বিনীত কথা বলার ভঙ্গি আর আচরণে বোঝা যায়।

—ঠিক আছে। আমাদের মালপত্রগুলো জিপে ওঠাবার ব্যবস্থা করো। যেতে যেতে কথা হবে—

আমাদের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জিনিস কারোই খুব বেশি নেই, একটা করে তোরঙ্গ আর একটা করে বিছানার বাণ্ডিল। কেবল সার্ভেয়ার নির্মলবাবুর জরিপের কাজে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি তিনটে বড় কাঠের তালা-লাগানো বাক্সে চলেছে। দুরবীন-চেন-থিওডোলাইট এবং আরও কী কী সব। জিপের সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে বসলেন মেজকর্তা। আমি, নির্মলবাবু আর জলধর পেছনের দু-সারি মুখোমুখি সিটে ভাগ করে। গাড়ি যখন চলতে আরম্ভ করল তখন ভোরের আলো বেশ স্পষ্ট হয়ে ফুটেছে। জলধর বলল—এখনও শহরের দোকানপাট কিছু খোলেনি। চলুন, কুড়ি-বাইশ মাইল গেলে বিরমিত্রাপুর বলে একটা ছোট জায়গা পড়বে। সেটা বিহার আর উড়িষ্যার বর্ডার, সেখানে একটা খাবারের দোকানে সকালে খুব ভাল কচুড়ি আর জিলিপি ভাজে, বহু লোক ভিড় করে খেতে আসে। আমরাও ওই দোকানেই খেয়ে নেব। আপনাদের খুব খিদে পেয়ে গিয়েছে নিশ্চয়—

সামনের সিট থেকে মুখ না ঘুরিয়েই মেজকর্তা বললেন—কচুড়ির সঙ্গে কী দেয়?

একটু অবাক হয়ে জলধর বলল—আইজ্ঞা?

—বলছি কচুড়ির সঙ্গে সে দোকানে কী দেয়? ডাল, না তরকারি?

—অঃ, না তরকারি না—ডাল দেয়। বুটের ডাল—

একটা নিঃশ্বাস ফেলে মেজকর্তা বললেন—আমি ছোটবেলায় যে ইস্কুলে পড়তাম, সেই স্কুলের দারোয়ান শান্তি টিফিনের সময় ছেলেদের কাছে বিক্রি করার জন্য লুচি ভাজত। লুচির সঙ্গে দিত আলু, কুমড়ো আর পেঁয়াজ দিয়ে রান্না একটা তরকারি। সত্যি কথা বলতে কী, ওই তরকারির লোভেই আমরা শান্তির লুচি কিনে খেতাম। সে স্বাদ এখনও মুখে লেগে রয়েছে। বড় বড় সাইজের লুচি, দু-পয়সা করে দাম নিত—

বললাম—এক একজন লোকের রান্নার হাত খুব ভাল হয়। ঠিকই বলেছেন—

মেজকর্তা বললেন—এক্ষেত্রে ব্যাপারটা শুধু ভাল রান্নার নয়। এখন বুঝতে পারি দুটো কারণে শান্তির রান্না আমাদের ভাল লাগত। প্রথম কারণ, তখন অল্প বয়েস, বাড়ির আটপৌরে রান্নার বাইরে অন্য কোনও ভাল খাবার খাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল না। সেই অনভিজ্ঞ রসনায় দোকান থেকে কিছু কিনে খেলেই তা মধুর লাগত। দ্বিতীয় কারণ, রান্নায় কুমড়োর সঙ্গে পেঁয়াজের ব্যবহার, আমাদের পরিবারে, বা সাধারণভাবে বাঙালী মধ্যবিত্ত সমাজে ছিল না। সেই নতুনত্বটাও আকর্ষণ করত।

একটু থেমে মেজকর্তা আবার বললেন—বছরদুয়েক আগে কী একটা কাজে আমার ছোটবেলার সেই ইস্কুলে একবার যেতে হয়েছিল। কাজ সেরে বেরুবার সময় হঠাৎ মনে হল একবার শান্তির খোঁজ করে যাই। স্কুলের বড় ফটকের পাশে দুখানা নিচু ধরনের টালির ঘরে সপরিবারে শান্তি বাস করত। ঘরদুটো দেখলাম একইরকম আছে। ডাকাডাকি করতে একজন ন্যুব্জদেহ বৃদ্ধ বেরিয়ে এসে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল—কাকে খুঁজছেন?

বললাম—এই ঘরে শান্তি বলে একজন থাকত, এই স্কুলের দারোয়ান। অনেকদিন আগের কথা বলছি। সে এখন কোথায় থাকে বলতে পারেন? কাঁচাপাকা দাড়িওয়ালা সেই বুড়ো অবাক হয়ে একটু তাকিয়ে থেকে বলল—আমিই তো শান্তি?

ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম, হ্যাঁ, ছোটবেলায় যে শান্তিকে দেখেছি অনেকটা মিল আছে তার সঙ্গে। কিন্তু জরা তার পূর্বের চেহারাকে গ্রাস করেছে। শাস্তি বলল—আপনি কে বাবু? আমাকে কেন খুঁজছেন?

বললাম—আমি এই স্কুলে অনেকদিন আগে পড়তাম। তুমি টিফিনের সময় লুচি ভাজতে, মনে আছে? লুচি খাবার জন্য পয়সা জমিয়ে রাখতাম। ওঃ, তুমি বড্ড বুড়ো হয়ে গেছ শান্তিদা—

শান্তি হেসে বলল—তা হব না? বয়েস পঁচাত্তর হল। তোমার নাম কী খোকাবাবু?

নাম বললাম, আমাদের ব্যাচের দু-একজন ছেলের নাম বললাম। সে ভাল চিনতে পারল না। কিন্তু পুরনো ছাত্ৰ মনে করে দেখা করতে এসেছে, এতেই সে ভারি খুশি। আর চাকরির বয়েস নেই, কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ ভালবেসে পুরনো দুটো ঘরের মধ্যে একটায় তাকে থাকতে দিয়েছে। সেখানেই বাকি জীবনটা সে কাটিয়ে দেবে। আমাকে সে আবার যেতে বলেছিল। আর যাওয়া হয়নি।

বিরমিত্রাপুর এসে গেল। গরম কচুড়ি আর জিলিপি পেট ভরে খেয়ে আবার পথে। গাড়িতে ওঠবার আগে নির্মলবাবুর মতই মেজকর্তাও বললেন—শুনুন ভাই, বাইরে কাজ করতে এসেছি, এখানে আর অফিসের ফর্মালিটি টেনে আনবেন না। সিগারেট খেলে ধরিয়ে ফেলুন—

সিগারেট ধরিয়ে গাড়িতে উঠলাম। পথের দুধারে প্রান্তর, কোথাও শ্যামল শম্পাস্তীর্ণ, কোথাও প্রস্তরময়। কখনও বা নিবিড় বনভূমি, তার মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে আঁকাবাঁকা পাহাড়ী নদী। পথ কখনও চড়াই ভেঙে উঠছে, কখনও আবার নেমে আসছে সমতলে। এই আশ্চর্য সুন্দর পরিবেশের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে ঘূণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি কী অদ্ভুত অভিজ্ঞতা আগামী কয়েকদিনের মধ্যে আমার হবে।

পরের এক সপ্তাহের ভেতরেই উপলব্ধি করেছিলাম, তারানাথ আমার জীবনের সঙ্গে কতখানি জড়িয়ে গিয়েছে।

যাক, যেভাবে ঘটেছিল সেভাবেই ঘটনাটা বলি।



॥ তেরো ॥

সিমডেগা একটি প্রায় ঘুমন্ত নির্জন শহর। ছাড়া ছাড়া কিছু বাড়িঘর কয়েকটা সরকারি অফিস, কিছু দোকানপাট, একটা ইস্কুল—এই নিয়ে পুরো জনপদ। মূল নগরসীমানার বাইরে আরণ্য পরিবেশে হো, ওরাওঁ বা মুন্ডাদের গ্রাম। একটিই মাত্র পাকা রাস্তা শহরের মাঝখান দিয়ে রাচির দিকে চলে গিয়েছে। এই রাস্তারই অপর প্রান্ত দিয়ে আমরা সিমডেগায় ঢুকলাম।

সামান্য এগিয়ে বাঁদিকে একটা মোরামে ঢাকা পথে ঢুকল গাড়ি। পথের দু’পাশে বেগুনি-সাদা-কমলা ফুলওয়ালা পুটুস গাছের ঝোপ। পাহাড়ি অঞ্চলের একটা বিশিষ্ট প্রভাতী আমেজ আছে, কড়া রোদ্দুর উঠে তা এখনো নষ্ট হয়নি। রাস্তার ধারে টালিছাওয়া পাকা দেওয়ালের একখানা বাংলো প্যাটানের বাড়ির সামনে এসে আমরা থামলাম। জলধর তাড়াতাড়ি করে গাড়ি থেকে নেমে হাতজোড় করে গৃহস্বামীর মত সবাইকে বলল - বাবুরা, আসুন। থাকার ঘর সব এদিকে, ওদিকে রান্নাঘর, গোসলখানা আর ভাঁড়ার। আসুন—

আধঘণ্টার মধ্যে পোশাক বদলে হাতমুখ ধুয়ে তিনজনে এসে বসলাম বারান্দায় পাতা চেয়ারে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এসে গেল গরম চা। কোম্পানি কাজের কোনও অসুবিধা যাতে না হয় তার জন্য রান্নার লোক, ঘরদোর পরিষ্কার বা বাজার করার কর্মী সব নিয়োগ করে রেখেছে। নিজের বাড়ি গ্রামে, থাকি কলকাতার মেসে, তার তুলনায় একে রাজকীয় আরাম বলা যেতে পারে। কাজ করি বিলিতি মার্কেন্টাইল ফার্মে মধ্যমবর্গীয় করণিকের পদে, সেটা এমন কিছু গৌরব করে বলে বেড়াবার মত কিছু নয়। কিন্তু সদর দপ্তরের বাঁধাধরা নিয়মনীতির বাইরে এখানে এসে এই প্রথম চাকরির একটা স্বস্তিজনক মৃদু আরাম অনুভব করলাম। বাংলোবাড়ির বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে চা খাচ্ছি, দুজন ওপরওয়ালার সঙ্গে সমানে সমানে আচরণ করছি, কাছে-দূরে শাল-সেগুনের সারি, নীলচে পাহাড়শ্রেণী। আঃ! সুখের আর কী বাকি রইল।

জলধর পণ্ডার পেছনে যে লোকটি ট্রে-তে করে চা নিয়ে এসেছিল, সে বিনীত মুখে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। মেজকর্তা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন—তোমার নাম কী?

লোকটির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে বলল—আমার নাম ডহরু লোহার।

—বাঃ, বেশ। তুমি অনেকদিন আছ এখানে?

—আজ্ঞে, বাপ-পরদাদার সময় সময় থেকে আছি। বহুদিন হল—

জলধর বলল—এরা সব স্থানীয় লোক বাবু! চারদিকে সব পাহাড় দেখছেন না? ওই পাহাড়ের ভেতরে অনেক গ্রাম আছে। এরা সেই গ্রামে থাকে। তুমি তো মুন্ডা, না ডহরু?

ডহরু বলল—আজ্ঞে হ্যাঁ—

তার কথায় হিন্দি বাংলা ওড়িয়া এবং আমাদের অপরিচিত—সম্ভবতঃ মুন্ডারি ভাষার —মিশ্র একটা টান। জলধরকে জিজ্ঞাসা করলাম—এখানে কি বাঙালীও আছে নাকি?

—আইজ্ঞা, আছে কয়েক ঘর। সরকারি অফিসে কাজ করে। আর আছে বিশ্বাসবাবু, এখানকার ইস্কুলের মাস্টারমশাই। খুব ভাল লোক, আলাপ হয়ে যাবে আস্তে আস্তে—

ভারতের যে কোনো দুৰ্গম প্রত্যন্ত প্রদেশের মতই সিমডেগাতেও কিছু বাঙালী এসে বাস করছে বুঝতে পারলাম। তাদের সংস্পর্শে এসে ডহরুর ভাষায় বাংলার টান লেগেছে।

চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল, কাপ-ডিশগুলো আবার ট্রে-তে তুলে চলে যেতে গিয়ে হঠাৎ ফিরে দাড়িয়ে ডহরু বলল—জলধরদা, আজ সকালে আবার একটা মরা পাখি দেখলাম—

—আবার! কোথায় দেখলি?

—সকালবেলা সবজি তুলতে বাগানে গিয়েছিলাম। খিড়কির দরজার একেবারে সামনে মরে পড়েছিল। আমি তুলে বেড়ার বাইরে ফেলে দিয়েছি—

—কী পাখি? সেদিনের মত কাক?

—না, শালিক। দু-চারটে পালকও ছেঁড়া ছিল। সব গুছিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছি।

—আচ্ছা, যা এখন তুই। ডাল, ভাজি আর আন্ডার ঝোল হবে দুপুরে—

ডহরু চলে গেলে মেজকর্তা বললেন—এই পাখি মরার ব্যাপারটা কী জলধর?

—আইজ্ঞা, কিছু না। পরশুদিন বাড়ির ফটকের সামনে একটা কাক মরে পড়েছিল। আর আজকে নাকি একটা পেছনের বাগানে পেয়েছে। ও কিছু না বাবু, বেড়াল-কুকুরে কামড়ে মেরেছে আর-কি। পালক ছেঁড়া ছিল শুনলেন তো—

কথাটা সেইখানেই তখনকার মত চাপা পড়ে গেল। কিন্তু কেন যেন এই ধরনের কী একটা ব্যাপার আমি আগে শুনেছি। সেখানে এমনই মরা পাখি দিয়ে একটা ভয়ঙ্কর অমঙ্গলের পর্ব শুরু হয়েছিল। কোথায়? কোথায়?

তারপরেই বিদ্যুচ্চমকের মতো মনে পড়ে গেল তারানাথের কাছে শোনা সেই মা-কালীর কৌটোর গল্প। সেখানেও চণ্ডিকাপ্রসাদ মিত্রের বাড়িতে ঢোকবার পথে মরা চড়ুই পাখি দেখে তারানাথ ভাবী অমঙ্গলের আভাস পেয়েছিল। অবশ্য—

অবশ্য সর্বদাই কোথাও পাখি মরলে সেখানে খারাপ কিছু ঘটবে এমন মনে করাটা যুক্তিসিদ্ধ নয়। পাখি তো মরেই, নইলে সমস্ত পৃথিবী পাখিতে ভরে যেত না!

কিন্তু যতই ভোলবার চেষ্টা করি না কেন, মনের কোণে চিন্তাটা রয়েই গেল। কাক বা শালিক খুব চতুর পাখি, হঠাৎ তাদের ওপর লাফিয়ে পড়ে পালক ছিঁড়ে মেরে ফেলা বেশ কঠিন কাজ।

মেজকর্তা বললেন–নির্মলবাবু, আজকের দিনটা আমরা ছুটি করি, কেমন? সকলেই ক্লান্ত, নতুন জায়গায় এসে খাপ খাইয়ে নিতেও একটু সময় লাগে। আজ শুয়ে বসে কাটিয়ে কাল থেকে কাজ শুরু করা যাবে। জলধর, যে সাইট সার্ভে হবে সেটা এখান থেকে কতদূর?

—ছাবিবশ মাইল আইজ্ঞা। জিপে একঘণ্টা। পাহাড়ি পথ—

—সেখানে লোকজন, তাঁবু এসব পাঠাবার কী ব্যবস্থা করেছ? কাল আমরা সাইট দেখতে যাব, পরশু বা তার পরের দিন থেকে তো গিয়ে সেখানে বাস করতে হবে—

—সব ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে। তিনদিন আগে লোক পাঠিয়ে দিয়েছি, তারা জঙ্গল কেটে সাফ করে তাঁবু খাটিয়ে রাখবে। ইচ্ছে করলে কাল থেকেই থাকতে পারেন—

মেজকর্তা বললেন—দেখি। সারাটা দিন আলস্যে কেটে গেল। বাড়িটায় পাঁচ-ছখানা ঘর, আমি একটা আলাদা ঘর পেয়েছি। কলকাতার মেসে চারসিটের ঘরে থাকার পর এটাও আমার কাছে বড় বিলাসিতা। দুপুরে খাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, যখন উঠলাম তখন রোদ্দুর পড়ে এসেছে। জলধর পণ্ডা এসে বলল—বাইরের বারান্দায় চা দিয়েছি বাবু। আর বিশ্বাসবাবু এসেছেন আপনাদের কথা শুনে। আসুন বাবু—

চায়ের টেবিলের পাশে আর একখানা বেতের চেয়ার বাড়তি পাতা, তাতে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা একজন সৌম্য চেহারার মানুষ বসে আছেন। বয়েস বছর পঞ্চাশেক হবে, কিন্তু চেহারায় প্রৌঢ়ত্ব শুরু হবার বিশেষ কোনো ছাপ পড়েনি, রগের পাশে দু-একগাছা পাকা চুল ছাড়া। চোখের চাউনিতে বিবেচনার প্রকাশ।

মেজকর্তা বললেন—এই যে, আসুন। ইনিই হচ্ছেন বিশ্বাসবাবু, যার কথা আজ জলধর সকালে বলছিল। এখানকার ইস্কুলের ইংরিজির মাস্টারমশাই—

নমস্কার এবং প্রতিনমস্কারের পর বসলাম।

বাইরের প্রান্তরে আর অরণ্যে একটু একটু করে দিনাবসানের ছায়া নামছে। সকাল আর দুপুরের ঝকঝকে আলোয় যে জায়গাটা উজ্জ্বল, কবিত্বপূর্ণ বলে মনে হচ্ছিল, এখন তারই ওপরে যেন কেমন একটা ম্লান বিষন্নতা নেমে আসছে। শহরজীবন থেকে সিমডেগার রূপ মনকে একটু দমিয়ে দিল। দুপুরে খাওয়ার সময় জলধরকে জিজ্ঞাসা করে জেনেছি শহরে এখনো বিদ্যুৎ আসেনি, দু-একজন ধনী ব্যবসায়ী পরিবার জেনারেটর চালিয়ে নিজেদের বাড়িতে ইলেকট্রিক আলো জ্বালায়।

বিশ্বাসবাবু বেশ অমায়িক আর মিশুকে মানুষ। চা শেষ করে টেবিলে কাপ নামিয়ে রেখে বললেন—অরিজিনালি আমার বাড়ি মেদিনীপুর জেলায়। পানিপারুল নাম শুনেছেন? সেই পানিপারুলে আমার জন্ম হয়। এগরা নয়তো রামনগর দিয়ে যেতে হয়। কলকাতায় রিপন কলেজ থেকে পাশ করে বেরিয়ে এখানে কাজ নিয়ে চলে আসি। এক আত্মীয় ব্যবসার সূত্রে সিমডেগায় যাতায়াত করতেন, তিনিই যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন। তখন স্কুল নতুন হয়েছে, শহরেরও পত্তন হয়েছে সবে। সামান্য কিছু বাড়িঘর, দোকানপাট—এই। তারপর রাঁচি জেলার সাবডিভিশন হওয়ার পর থেকে চটপট বসতি গড়ে উঠল, ব্যবসা জেঁকে উঠল—

নির্মলবাবু জিজ্ঞেস করলেন—এখানে বেশ মন বসে গিয়েছে আপনার?

—তা গিয়েছে। এখন তো এই আমার দেশ, ঘরবাড়ি—

—কেন, মেদিনীপুরে আপনার বাড়িতে কেউ নেই এখন?

—কেউ না। বাবা-মা মারা গিয়েছেন, ভাই গুজরাটে চাকরি করে আজ বিশবছর, তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই বললেই চলে। ব্যস, দেশের সঙ্গে সম্পর্ক মিটে গিয়েছে। তাছাড়া কী জানেন, হৈ-হট্টগোল থেকে দূরে থাকতে থাকতে একটা অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। এই বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত. নির্জনতা আর পাখির ডাক—মানুষের আদি বাস তো এর মধ্যেই ছিল, তাই না? সেকথা যখন ভাবি তখন কোনো কষ্ট হয় না—

মেজকর্তা নিজে একটু ভাবুক ধরনের মানুষ, বিশ্বাসবাবুর কথাগুলো বোধহয় তার ভাল লাগল। তিনি বললেন—বাঃ, আপনি তো দেখছি রীতিমত একজন কবি! সুন্দর বলেছেন—

অসিত বিশ্বাস বললেন (নামটা একটু আগে জেনেছি)– না, না, কবি নই। তবে ঈশ্বরের এই অদ্ভুত সৃষ্টির বৈচিত্র্য দেখতে ভাল লাগে—

তারপর কথার গতি পরিবর্তন করে বললেন-আপনারা কি কালই কাজের জায়গায় যাচ্ছেন? যান, ভাল লাগবে, খুব সুন্দর জায়গা—

—সুন্দর বলতে কী অর্থে? আপনি গেছেন সেখানে?

—অনেকবার। এখান থেকে কাঠ-ব্যবসায়ীদের লরি যায়, তাতে চড়েই গিয়েছি। সুন্দর মানে রামরেখা পাহাড়ের রূপ দেখলে আপনারা মোহিত হয়ে যাবেন। নিবিড় জঙ্গল পাহাড়ের ঢালুতে, কোথাও জনমানব নেই, এত নিস্তব্ধ পরিবেশ যে পাতা খসে পড়ার শব্দ শুনতে পাবেন। সারাজীবন ধরে গল্প শোনাবার মত জায়গা—

মেজকর্তা একটু কী ভেবে বললেন—অসিতবাবু, আপনিও কাল চলুন না আমাদের সঙ্গে। প্রিয় জায়গায় আপনারও আর একবার বেড়ানো হয়ে যাবে, আমরাও একজন ভাল ভ্রমণসঙ্গী পাব। যদি খুব জরুরী কাজ না থাকে তাহলে—

অসিতবাবুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বোঝা গেল বেড়াতে যাবার আমন্ত্রণ পেয়ে তিনি খুশি হয়েছেন। আমি বললাম— চলুন না, আমার তাঁবুতে দুজনে ভাগাভাগি করে থাকা যাবে—

অসিতবাবু বললেন—বেশ তো, তাই হবে তাহলে। সামনের দু-দিন ইস্কুল ছুটি আছে, দরকার হলে আরও বাড়িয়ে নেওয়া যাবে। ছুটি তো নেবার দরকার হয় না, জমে জমে পচে যাচ্ছে—

আমি মনে মনে পুলকিত হয়ে উঠলাম। মেজকর্তা আর সারভেয়ার সাহেব দুজনেই লোক ভাল, আমার সঙ্গে অত্যন্ত ভদ্র ব্যবহারও করছেন। কিন্তু হাজার হলেও তারা আমার ওপরওয়ালা, একেবারে খোলা মনে কাঁধে হাত রেখে কথাও বলা যায় না, পুরোপুরি সহজ হতেও বাধো-বাধো ঠেকে। বিশ্বাসবাবু কবিপ্রকৃতির লোক, মাস্টারমশাই—ইনি সহজেই বন্ধু হতে পারবেন।

—কাল কখন রওনা হচ্ছেন আপনারা?

মেজকর্তা বললেন—সকাল আটটা নাগাদ। আপনি সাতটায় চলে আসুন, একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট খেয়ে বেরুনো যাবে।

অসিতবাবু সম্মতি জানিয়ে যাবার জন্য উঠলেন। বললাম –চলুন, আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।

অসিতবাবু হেসে বললেন—আমাকে? আপনি তো এখানে নতুন লোক, ফেরবার সময় আবার আপনাকে পৌঁছে দিতে আমাকে না আসতে হয়। তা চলুন, মন্দ কী? টর্চ নিয়ে নেবেন একটা, ফেরবার সময় পুরোপুরি অন্ধকার নেমে আসবে।

গোধূলির শেষ পর্যায়। পশ্চিম আকাশ থেকে সূর্যাস্তের রঙ প্রায় মিলিয়ে গিয়েছে। পাশ রাস্তায় উঠে কিছুদূর হেঁটে আবার বাঁদিকের কাঁচা পথে নামলেন বিশ্বাসবাবু। ওদিক থেকে কে যেন আসছে আমাদের দিকে, সাদা আলখাল্লার মত পোশাক পরা, লম্বা-চওড়া মানুষ। কাছে আসতে অসিতবাবু হাতজোড় করে বললেন—নমস্কার ফাদার। ভাল আছেন?

এবার বুঝলাম মানুষটি বিলিতি সাহেব, প্রায় সাড়ে ছ-ফিট লম্বা। পরণে ক্রীশ্চান ধর্মযাজকের পোশাক। তিনি নমস্কার করে বললেন—ভাল আছি। ইনি কে?

আলাপ করিয়ে দিয়ে অসিতবাবু বললেন—ইনি কলকাতা থেকে মাসখানেকের জন্য এসেছেন অফিসের কাজে, উঠেছেন নাথমল শরফের বাংলোতে। আর ইনি হচ্ছেন ফাদার ও’ব্রায়েন, এখানকার সেন্ট বার্থোলোমিউ ক্যাথলিক চার্চের যাজক—

—যাজক বোলো না, বিশ্বাস, যাজক বোলো না। বল ঈশ্বরের কর্মী—

ও’ব্রায়েনের কণ্ঠস্বর মৃদু এবং ব্যক্তিত্ব-উষ্ণ। তিনি বললেন—আচ্ছা, চলি। আবার দেখা হবে।

হাঁটতে শুরু করে টর্চ জ্বালতেই পথের একপাশে চোখ পড়ে আমার মুখ দিয়ে বিস্ময়সূচক একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল। সেদিকে তাকিয়ে অসিতবাবুও বলে উঠলেন—আরে! এটা কী?

রাস্তার ঠিক ধারেই একটা ছাতারে পাখি মরে পড়ে আছে!

ও’ব্রায়েন আমাদের কথা শুনতে পেয়ে আবার ফিরে এলেন — কী হল? কী হয়েছে? তারপর টর্চের আলোকবৃত্তির মধ্যে মরা পাখিটাকে দেখতে পেয়ে বললেন—আঃ, পুওর ক্রিয়েচার! বেশিক্ষণ না, একটু আগেই বেচারা মারা পড়েছে—

বললাম—কী করে বুঝলেন ফাদার?

ও’ব্রায়েন বললেন—বেশি আগে হলে কুকুরে কিম্বা শেয়ালে টেনে নিয়ে যেত। পাখির মৃতদেহ দেখলে আমার বড় খারাপ লাগে। জানেন, আমরা যারা ক্রীশ্চান ধর্মে দীক্ষিত, তারা পাখিদের দেবতার দূত বলে মনে করি। উইংড অ্যাঞ্জেল—

এটা অবশ্য জানতাম না। বললাম—তাই নাকি?

—হ্যাঁ। সেন্ট ফ্র্যানসিস অফ আসিসির কথা জানেন তো? যার নামে ব্রাদারহুড অফ দি ফ্র্যানসিসকান অর্ডার গড়ে উঠেছিল? তার মৃত্যুর সময় পাখির দলের ছদ্মবেশে দেবদূতরা এসেছিলেন তার আত্মাকে স্বর্গে নিয়ে যেতে। পাখি মারা গেলে আমার বড় খারাপ লাগে—

বললাম—এখানে কিন্তু খুব পাখি মরছে। কোনো রোগ বা কিছু ওদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েনি তো?

অসিতবাবু সকালে জলধরের সঙ্গে আমাদের আলোচনার ব্যাপারটা জানতেন না। তিনি অবাক হয়ে বললেন—আপনি কী করে জানলেন? আপনি তো আজ এসেছেন—

—আজ সকালে জলধর বলছিল। আমরা যেখানে আছি, সেই বাড়িটার পেছনের বাগানে, বেরুবার গেটের সামনে নাকি পরপর দুদিন দুটো মরা পাখি পাওয়া গিয়েছে—

আমার কথা শুনে ফাদার ও ব্রায়েন কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন—তার মানে এটা নিয়ে তিনটে হল। আরো হয়ত এদিক-ওদিক মরেছে, আমাদের কাছে খবর নেই। ভেরি, ভেরি ব্যাড ওমেন। জানতাম না এমন শুরু হয়েছে—

অসিতবাবু বললেন—আপনি কি এর আগে এরকম ঘটতে দেখেছেন?

—দেখেছি, একবার। বছর দশ-বারো আগে। তারপরেই স্মল-পক্সের মহামারী শুরু হয়। মনে আছে সেই এপিডেমিকের কথা? তখন তো আপনি এখানে এসেছেন—

বিশ্বাসবাবু বললেন—মনে আছে। কিন্তু এপিডেমিকের আগে পাখি মরার ব্যাপারটা জানতাম না।

ফাদার বললেন—যাই হোক, ঈশ্বর সব দুর্যোগ কাটিয়ে দেবেন। অপশক্তি যত বড়ই হোক, ঈশ্বরের শুভশক্তি তার চেয়েও বড়। আমি আজ থেকেই প্রার্থনা করব সকলের ভালোর জন্য—

ফাদার লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে শুরু করলেন। তাঁর দীর্ঘ চেহারা টর্চের সংক্ষিপ্ত আলোকবৃত্তের বাইরে মিলিয়ে এল। একটু এগিয়েই অসিতবাবুর বাড়ি, ভদ্রলোক বললেন—আসুন না ভেতরে, একটু বসে যান—

—নাঃ, আজ নয়। একটু কাজকর্ম বুঝে নিতে হবে কালকের জন্য। পরে একদিন বরং— বাংলোতে ফেরবার পথে মনের ভেতর সকালের সেই প্রফুল্ল ভাবটা আর খুঁজে পেলাম না।

রাত্তিরে ভালই ঘুম হল। আলো ফোটবার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুম ভেঙে বাইরের বারান্দায় এসে দেখলাম, কোথাও আশঙ্কার কোনো কালো ছায়া নেই, সব ঝকঝক করছে সকালের আলোয়। সার্ভে করার জিনিসপত্র, কুলিদের হাতিয়ার, আমাদের বাক্স-বিছানা, সবার জন্য রসদপত্র আর কুলিরা যাবে বলে এবার জিপের সঙ্গে একটা লরিও যাচ্ছে। কুলিদের মধ্যে কিছু আগে চলে গিয়েছে কিছু পথে একটা গ্রাম থেকে উঠবে। লরি এর মধ্যেই এসে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ডহরু আর হলধর মিলে মালপত্র তুলছে। বেশ একটা সাজো সাজো ভাব।

স্নান সেরে বারান্দায় এসে দেখি মেজকর্তা আর সার্ভেয়ার সাহেবও তৈরি। ডহরু পুরি আর আলুর তরকারির থালা এনে টেবিলে রাখছে। আমাকে দেখে মেজকর্তা বললেন— আসুন, বসে যান। একেবারে হাতে-গরম পুরি। এই তো অসিতবাবুও এসে গিয়েছেন—

সবাই মিলে ব্রেকফাস্ট খেয়ে তৈরি হয়ে নিলাম। কাঁটায় কাঁটায় আটটায় রওনা হওয়া গেল।

জিপ আগে চলেছে, পেছনে লরি। কারণ লরি আগে গেলে যে পরিমাণ লাল ধুলো উড়বে, তাতে প্রাণ ওষ্ঠাগত হবে, জামাকাপড়ের কথা বাদই দিলাম।

অসিত বিশ্বাস বললেন – যেখানে আমরা যাচ্ছি, সেই রামরেখা জায়গাটা বিহার, উড়িষ্যা আর মধ্যপ্রদেশের সীমান্ত ছুঁয়ে আছে। একটা ঝরণা আছে খুব সুন্দর, অবশ্য এখন তাতে কতটা জল আছে জানিন না। কাজের ফাঁকে ফাঁকে জঙ্গলে ঘুরবেন, ভাল লাগবে।

রাস্তা কখনো উঠছে, কখনো নামছে। এক জায়গায় একটা তিনমাথার মোড়, আমরা সোজা চললাম। বিশ্বাসবাবু বললেনন—বাঁদিকের পথটা গিয়েছে ছিন্দা নদীর ধারে কেলাঘাঘ নামে একটা জায়গায়। ছোট্ট নদী, কিন্তু বর্ষায় তার ভয়ঙ্কর রূপ হয়। পাহাড়ে বৃষ্টি হলে নদীতে ফ্ল্যাশ ফ্লাড আসে। নিয়ে যাব এখন আপনাকে একদিন।

—আর ডানদিকের পথ কোথায় গেল?

—ওটা আবার ঘুরে শহর ছাড়িয়ে কোলেবিরার কাছে রাঁচি যাবার পাকা রাস্তায় পড়েছে। কোলেবিরা থেকে আপনি গুগুমলা, লোহারভাগা হয়ে রাঁচি যেতে পারেন, কিম্বা খুঁটি হয়েও যেতে পারেন। তবে খুঁটি হয়ে গেলে রাস্তা অনেকটা কম পড়লেও ওদিকে আজকাল নানান গোলমাল চলছে বলে সবাই ঘুরপথেই রাঁচি যায়।

—কী গোলমাল?

—ওদিকে মুন্ডারা বিদ্রোহ করেছে। বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে তারা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। পরিবেশ ঠাণ্ডা থাকলে ওই পথে আপনাকে কোয়েল নদী দেখিয়ে আনতাম।

মাইল দশ-বারো গিয়ে সাম পাহাড়টোলি নামের একটা গ্রামে জিপ আর লরি থামল। এখান থেকে কুলিরা উঠবে। জলধর পথের পাশের গ্রাম থেকে তাদের ডেকে আনতে গেল।

আমি জিপের পেছন দিয়ে নেমে হালকা হবার জন্য পথ থেকে জঙ্গলে ঢুকলাম। বিশ্বাসবাবু ডেকে বললেন—কোথায় চললেন, ও মশাই?

পেছন ফিরে হেসে বাঁ হাতের কড়ে আঙুলটা দেখালাম। কয়েক পা হেঁটেই চোখে পড়ল একটা শালগাছের গোড়ায় পড়ে থাকা দুটো মরা ঘুঘু।



॥ চৌদ্দ ॥

সকালের আলো হঠাৎ যেন নিভে এল চারপাশে। নতুন কাজে নতুন জায়গায় যাচ্ছি, মনে কত আনন্দ নিয়ে বেরিয়েছিলাম। মনের ভেতরে একটা খোলা ছাতা কে যেন স্প্রিং টিপে বন্ধ করে দিল। ফাদার ও ব্রায়েনের আশঙ্কাই কি তাহলে সত্যি? অমঙ্গলজনক কিছু ঘটতে চলেছে অদূর ভবিষ্যতে?

ফিরে এসে নিজে উঠে বসলাম। কুলিরাও উঠছে লরিতে। অসিতবাবু যেন কেমনভাবে তাকিয়ে আছেন আমার মুখের দিকে। ভেতরের অশান্তি বোধহয় মুখেও ফুটে উঠেছে কিছুটা। কিন্তু উনি বুদ্ধিমান মানুষ, সকলের সামনে কোনও প্রশ্ন করলেন না। বাকি পথ পার হতে লাগল গাড়ি।

মানুষের মন বিষন্ন হয়ে থাকতে ভালবাসে না। দুঃসময় কাটিয়ে ওঠার জন্য মনের একটা নিজস্ব স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি আছে। প্রকৃতির যে আশ্চর্য সৌন্দর্যের প্রকাশ দেখতে দেখতে চলেছি তা অচিরেই আশঙ্কার মেঘ কাটিয়ে স্নিগ্ধ প্রফুল্লতা ফিরিয়ে আনল। একটা মজার ঘটনাও ঘটল প্রায় তক্ষুণি।

দু’দিকে ঘন বন, তবে ঝোপঝাড় কম, বড় বড় গাছই বেশি। মাঝখান দিয়ে মোরাম ছাওয়া লাল রাস্তা বেয়ে গাড়ি চলেছে। হঠাৎ ডানদিকের ঢালু জমি থেকে বড় বড় গাছের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল একটা বিশাল হরিণ। আকারে মোষের বাচ্চার চেয়েও বড়। মাথার দু’দিক দিয়ে শাখা-প্রশাখাওয়ালা গাছের মত শিং উঠেছে। হরিণটা বোধহয় ঢালু জমি বেয়ে দ্রুত নেমে আসছিল, যখন জিপটা দেখতে পেল তখন তার আর গতি সংযত করবার উপায় নেই—হুড়মুড় করে রাস্তায় এসে উঠল। ড্রাইভার ব্রেক কষল প্রাণপণে, খানিকটা চাকা ঘষটে থামল গাড়ি। আমরা হুমড়ি খেয়ে এ ওর গায়ে পড়লাম। মেজকর্তার কপাল ঠুকে গেল উইন্ডস্ক্রিনে।

জলধর পণ্ডা রুদ্ধশ্বাসে বলে উঠল—বড়শিঙা। বড়শিঙা।

বড়শিঙা হরিণের নাম শুনেছি, ছোটবেলায় পড়েছি শিকারের গল্পে। এই তাহলে সেই।

হরিণটা মুহুর্তের জন্য হকচকিয়ে গিয়ে পথের ঠিক মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে পড়ে তাকিয়ে আছে আমাদের জিপের দিকে। কী সুন্দর তাকে দেখাচ্ছে সকালের রোদ্দুরে! যেন জীবস্ত প্রাণী নয়, যেন অরণ্যের পটভূমিতে আঁকা একখানা ছবি।

তারপরেই হরিণটা সম্বিৎ পেয়ে তড়বড় করে দৌড়ে বাঁদিকের জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেল। গাছের গুড়ির ফাঁকে তার বাদামি চামড়া আর সাদা ফুটকি চমকে উঠল।

জিপ চলতে শুরু করল আবার। অসিতবাবু বললেন—বড়শিঙা দেখতে পাওয়া খুব ভাগ্যের ব্যাপার। এই প্রাণীরা এত লাজুক যে, মানুষের সাড়া পেলে একেবারে দৌড়ে পালিয়ে যায়। শিং দেখেছেন। যেন ডালপালাওয়ালা একখানা পুরো ঝোপ।

আরও মিনিট পঁয়তাল্লিশ বাদে রামরেখা পৌঁছলাম। যেখানে আমাদের থাকবার তাঁবু পড়েছে সে পর্যন্ত জিপ বা লরি যাবে না। প্রায় সিকি মাইল দূরে পথের ধারে গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকলাম।

কী নিবিড় অরণ্য! আমি কলকাতার অফিসে চাকরি করা নিরীহ মেসপোষ্য জীব, জঙ্গল বলতে দেখেছি শিবপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেন। এখানে গম্ভীর চেহারার বড় বড় গাছ, নিচে পুটুস, বনতুলসী আর নানারকম উদ্ভিদের ঝোপ। অসিতবাবু আর আমার একই তাঁবুতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। নিজেদের জিনিসপত্র তাঁবুতে রেখে বেরিয়ে এসে দেখি সামনের ঝোপঝাড় কেটে পরিষ্কার করা উঠোনমত জায়গায় মেজকর্তা আর নির্মলবাবু মাটিতে বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। আমাদের দেখে মেজকর্তা বললেন—আসুন, বসে পড়ুন এখানে। ডহরু, এদের চা দাও—

অর্থ এবং বড় প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক ক্ষমতা তাক লাগিয়ে দেবার মত। এই পাণ্ডববর্জিত অরণ্যের নিভৃতে দুদিনে গড়ে তোলা হয়েছে মানুষের থাকবার ব্যবস্থা। এসে পৌঁছবার পনেরো মিনিটের ভেতর হাতে চলে আসছে গরম চায়ের কাপ। কাপ বললে অবশ্য ভুল হবে, আমাদের চা দেওয়া হয়েছে এনামেলের হাতলওয়ালা ছোট মগে। অরণ্যনিবাসে এটাই প্রশস্ত, নইলে চিনেমাটির কাপ দিনে একজন করে রোজ ভাঙবে। কিছুদিন আগে কলকাতায় কিং সলোমনস মাইনস নামে রাইডার হ্যাগার্ডের সেই বিখ্যাত অ্যাডভেঞ্চার গল্পের ফিল্ম দেখতে গিয়েছিলাম মেট্রো সিনেমায়। তাতে দেখেছিলাম গল্পের নায়ক অ্যালান কোয়াটার মেইন এইরকম এনামেলের মগে চা খাচ্ছে। এখন নিজেকে অনেকটা সেইরকম লাগতে লাগল।

মেজকর্তা বললেন–নির্মলবাবু, আজ আপনার সার্ভে করার জিনিসপত্র সব বের করে গুছিয়ে রাখুন, কাল সকাল থেকে পুরো অঞ্চলের একটা খসড়া ম্যাপ বানাবার কাজ শুরু করে দিন। দক্ষ সহকারী পাবেন না, তবে জলধর আপনার সঙ্গে পিনম্যানের কাজ করতে পারবে, চেন ধরতে পারবে। আর আয়না চমকাবার জন্য একজন কুলি দেব, মালপত্রও সে-ই বইবে।

অসিতবাবু একটু অবাক গলায় বললেন—আয়না চমকানোটা কী জিনিস? সার্ভেয়ার নির্মলবাবু হেসে বললেন—ওটা আমাদের জরিপের একটা নিজস্ব চালু শব্দ। সব পেশাতেই এমন কিছু শব্দ থাকে। দূরবীন পেতে লুক থ্রু করলেও ঠিক সোজা লাইন সবসময় পাওয়া যায় না, বিশেষ করে জঙ্গলের ভেতর। তখন কেউ একজন দুই বা তিন চেন দূরে মাটিতে দাঁড়িয়ে কিংবা গাছের ওপর উঠে ছোট আয়না হাতে নিয়ে সেটাতে রোদ্দুর প্রতিফলিত করে দেখায়, তাতে কাজের সুবিধে হয়।

কী-একটা পাখি ডাকছে কোথায় বসে। অদ্ভুত ডাকটা। জলধর পণ্ডাকে জিজ্ঞাসা করতে সে বলল—ও তো হরটিই পাখি। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত খুব ডাকে, বিকেলের দিকে চুপ করে যায়। এ জঙ্গলে খুব পাখি আছে বাবু, কত ডাক শুনবেন—

এই পাখির ডাক থেমে যাওয়াটাই আসন্ন বিপদের প্রথম লক্ষণ হয়ে দেখা দিল। চা খেয়ে জঙ্গলের মধ্যে একটু ঘুরতে বেরুলাম একা। মেজকর্তা আর নির্মলবাবু মাপজোক শুরু করার উদ্যোগের জন্য রয়ে গেলেন। অসিতবাবু আবার নিয়মিত ডায়েরি লেখেন, তিনি বর্তমান ভ্রমণের ঘটনাটা শুরু করার জন্য সঙ্গে আসতে চাইলেন না। জলধর বলল—একাই বেড়িয়ে আসুন বাবু। এ জঙ্গলের খুব বড় জানোয়ার কিছু নেই। ব্রাহ্মণী নদীর ধারের বন থেকে মাঝে-মধ্যে দু-একটা হাতি ছিটকে আসে বটে, কিন্তু সে হল বনে আগুন লেগে ওদের খাবারে টান পড়লে। যান বাবু—

আজ বিকেল অবধি আমার খুব কাজ নেই। সন্ধেবেলা থেকে সারাদিনের হিসেবনিকেশ নিয়ে বসতে হবে। ফলে হালকা মনে বনের মধ্যে ঢুকে পড়লাম।

সম্পূর্ণ পাহাড়ি অঞ্চল। পথ বলে তেমন কিছু নেই, ইদানীং কয়েকদিন কুলিদের যাতায়াতে কোথাও কোথাও আবছা পথরেখা তৈরি হয়েছে বটে, কিন্তু ভাল করে লক্ষ্য না করলে তা বুঝতে পারা যায় না। ঝোপঝাড়ে ঢাকা উঁচু-নিচু জমি, এখানে ওখানে বড় বড় পাথরের চাঁই পড়ে আছে, তাদের কোনও কোনওটার গায়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল বনস্পতি আষ্টেপৃষ্টে শেকড় জড়িয়েছে। মনে হয় সৃষ্টির আদিকাল থেকে এগুলো এখানে পড়ে আছে। এরই একটাতে হেলান দিয়ে বসলাম পা ছড়িয়ে। মাথার ওপরে পত্রপল্লবের চন্দ্ৰাতপ, সুন্দর ছায়া ছায়া ঠাণ্ডা পরিবেশ। পকেট থেকে একটা ক্যাভেন্ডার্স বের করে ধরালাম। ভাবতে মাঝে মাঝে অবাক লাগছিল। সত্যিই কি আমি—সেই কলকাতার এঁদো গলির মেসে বাস করা আমি—বিহার আর ওড়িশার প্রান্তবর্তী নিবিড় অরণ্যে বসে মৌজ করে সিগারেট খাচ্ছি? কত অদ্ভুত ঘটনাই মানুষের কপালে লেখা থাকে।

আমি যেখানে বসে আছি সেখান থেকে পনেরো কী কুড়ি হাত দূরে সাদা গুঁড়িওয়ালা বিশাল একটা গাছ দাঁড়িয়ে। কী গাছ তা ঠিক চিনতে পারলাম না। গাছের গোড়ায় হাতির মত অতিকায় একখানা পাথর পড়ে। তার ওধারে বোধহয় কয়েকজন কুলি কাজ করতে করতে মৃদুস্বরে গান গাইছে। সম্ভবত মুণ্ডারি ভাষা, গানের কথা কিছুই ধরতে পারলাম না। কিন্তু সুরটা ভারি আশ্চর্য স্বপ্নময়, শুনলে কী যেন একটা কথা মনে পড়ে যায়। আর—

আর কেমন যেন একটু গা ছমছম করে।

এরকম অদ্ভুত সুর কোথা থেকে পেল বনচারী আদিবাসীরা? যেন পড়ন্ত বেলায় পশ্চিম আকাশে স্বপমেঘের গায়ে বদলে বদলে যাওয়া রঙের প্রতিফলন সুর হয়ে ফুটে উঠেছে, যেন কতদিন আগে ভোরবেলার স্বপ্নে এই সুরটা আমি কাকে বাঁশিতে বাজাতে শুনেছি।

যারা গান গাইছিল তারা গান গাইতে গাইতেই দূরে চলে যাচ্ছে। চারদিক নিস্তব্ধ। হঠাৎ আমার মনে হল—আশ্চর্য তো, আচমকা সমস্ত শব্দ একসঙ্গে থেমে গেল কী করে? এই তো কিছুক্ষণ আগেও কতরকম পাখি ডাকছিল, তারাই বা চুপ করে গেল কেন? আমার একটা সিগারেট খেতে যতক্ষণ সময় লেগেছে তারই ভেতর ঘটেছে পরিবর্তনটা। বাতাসও যেন থেমে গিয়েছে। ঝড় আসার আগে প্রকৃতি এইরকম নিঃঝুম আর শাস্ত হয়ে যায়। অবশ্য ঝকঝকে সূর্যের আলোয় দিনদুপুরে নিশ্চয়ই ঝড় আসবে না। হয়তো সবটাই আমার মনের বিভ্রম, হয়তো অরণ্যে মাঝে মাঝে এমন অকস্মাৎ নিস্তব্ধতা নামে।

যাই হোক, এরপর আর বেশিক্ষণ সেখানে বসে থাকতে ভাল লাগল না। তাঁবুতে ফিরে এসে দেখি উঠোনমত জায়গাটায় ফোল্ডিং টেবিল পেতে তার ওপর কনটুর ম্যাপ রেখে জোর আলোচনা চলেছে। পাশে দাঁড়িয়ে জলধর পণ্ডা কোনদিক দিয়ে কাজ আরম্ভ করলে ভাল হয়, কোথা দিয়ে কোথায় যাওয়া চলে—এসব বুঝিয়ে দিচ্ছে। অসিতবাবু তাঁবুর ভেতরে বিছানায় আধশোয়া হয়ে লিখছেন। আমাকে দেখে একটু হাসলেন।

দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা হল বাইরে খোলা জায়গায়। মাটিতে বসে শালপাতায় খাওয়া, বেশ বনভোজনের মত ব্যাপার। কিন্তু এখানেও পাখি ডাকছে না, সমস্ত অঞ্চলটাতেই অদ্ভুত শ্বাসরোধী ঘেরাটোপ নামছে যেন। মেজকর্তা আর নির্মলবাবুও কিছু একটা আন্দাজ করেছেন, খেতে খেতে তারাও কেমন একটু অবাক হয়ে চারদিকে তাকাচ্ছেন। ভাল কাণ্ড।‘পাখি’রা সব গেল কোথায়? জঙ্গলে এমনিতেই পরিবেশ স্তব্ধ, কিন্তু শুধু পাখি না ডাকলে সে স্তব্ধতা যে কতখানি প্রকট হয়ে ওঠে তা বুঝলাম।

তবে আমাদের পাচকের রান্না খুব সুন্দর। গরম খিচুড়ি, সোনামুগ ডালের গন্ধ ভুরভুর করছে। তার সঙ্গে উৎকৃষ্ট গাওয়া ঘি, মুচমুচে করে ভাজা বেগুনি আর ডিমের অমলেট। লরিযাত্রা এবং জঙ্গলে বেড়ানোর শ্রমে দারুণ খিদে পেয়ে গিয়েছিল, অমৃততুল্য। খাদ্য ভক্ষণ করতে করতে অন্যদিকে মন দেবার সুযোগ ছিল না।

খাওয়ার পর কিঞ্চিৎ বিশ্রাম করে কর্তারা আবার কাজে বসে গেলেন। অসিতবাবুর ডায়েরি লেখা বাকি ছিল, তিনি ফের লেখা শুরু করলেন। আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে পায়চারি করতে লাগলাম। ওপাশে তাঁবুগুলোর পেছনে মাটিতে গর্ত করে উনুন বানিয়ে কুলিরা রান্নাবান্নার ব্যবস্থা করেছিল। তারা এখন দলবেঁধে খেতে বসেছে। তাদের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি।

পায়চারি করতে করতে হঠাৎ থমকে থেমে গেলাম।

কী সুর গাইছি আমি? এ তো বনের ভেতর বড় পাথরটার ওপাশ থেকে ভেসে আসা সেই অদ্ভুত গান। কখন এ গান শিখলাম আমি? জীবনে গান শিখিনি, তাহলে এই জটিল আর কঠিন সুর গলায় এল কি ভাবে? তাছাড়া মাত্র একবার শুনে কোনও সুর শেখা যায় নাকি? থমকেই রইলাম।

ওপাশে কুলিদের কোলাহল হঠাৎ থেমে গিয়েছে। ওরাই বা চুপ করে গেল কেন? না, একেবারে চুপ করে গিয়েছে, এমন নয়, ওই তো কয়েকজন জলধরকে উত্তেজিত গলায় কী যেন বোঝাচ্ছে। কী বলছে ওরা?

মেজকর্তা একটু বিরক্ত হয়ে ডাকলেন—জলধর! কী হয়েছে? কী বলছে ওরা?

জলধর ডাক শুনে এগিয়ে এসে বলল—কিছু না আইজ্ঞা, ওরা সব জংলি লোক, কী জন্য যেন ভয় পেয়েছে। আমি কথা বলে সব ঠিক করে দিচ্ছি—

মেজকর্তা বললেন—ভয় পেয়েছে? ডাকো তো ওদের–

আমাদের কথাবার্তা শুনে অসিতবাবুও তাবু থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তার মুখে সপ্রশ্ন বিস্ময়। জলধর তিন-চারজন কুলিকে সঙ্গে নিয়ে এসে সামনে দাঁড়াল। কুলিদের মুখ শুকিয়ে গিয়েছে, তাদের চেহারায় ভয়ের চিহ্ন। মেজকর্তা জিজ্ঞাসা করলেন—কী হয়েছে তোমাদের? কী বলছিলে জলধরকে?

কুলিদের মধ্যে নেতাগোছের লোকটি দুর্বোধ্য ভাষায় কী যেন বলল। মেজকর্তা বললেন—ও কী বলছে জলধর?

জলধর বলল—ও বলছে এখানে পাসাং মারার ডাক শোনা গিয়েছে, এখানে কোম্পানি কাজ করতে পারবে না।

—পাসাং মারা আবার কী? কীভাবে কখন সে ডাকল?

জলধর প্রশ্নটা কুলি সর্দারকে বুঝিয়ে দিতে সে আবার দ্রুতবেগে ঝড়ের মত কী বলে গেল। জলধর এদিকে ফিরে বলল—ও বলচে পাসাং মারা খুব খারাপ অপদেবতা, জঙ্গলের মধ্যে যেখানে সে থাকে সেখানে বাইরের কাউকে সে ঢুকতে দেয় না। অমঙ্গল আর মৃত্যুর সুরে সে গান গায়। একটু আগে নাকি এখানে কেউ সেই সুরটা গাইছিল। তাই ওরা ভয় পেয়েছে—

মেজকর্তা অবাক হয়ে বললেন—এখানে? এখানে কেউ গান গাইছিল বটে। কে সে?

গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম—আমি একটা সুর ভাঁজছিলাম ঠিকই, সেটাই হয়তো ওরা শুনতে পেয়েছে। সুরটা সত্যিই একটু কেমন অদ্ভুত মত—

—কেমন সুর সেটা? কোথা থেকে শিখলেন?

—শিখিনি কোথাও। সেটাই মজা। খাওয়ার আগে জঙ্গলের মধ্যে বেড়াতে গিয়ে একটু পাথরের ওপাশে কুলিরা গাইছিল শুনছিলাম। কী করে যেন একবার শুনেই সুরটা মনে থেকে গিয়েছে।

—কোথায় শুনেছেন? কোনদিকে বেড়াতে গিয়েছিলেন?

আমি আঙুল দিয়ে নির্দেশ করে বললাম—ওইদিকে।

জলধর বলল—কিন্তু ওদিকে তো আজ কুলিরা কাজ করেনি।

তার দিকে তাকিয়ে বললাম—তা জানি না, কিন্তু গান আমি স্পষ্ট শুনেছি। হয়তো দু-একজন কুলি এমনি গিয়ে পড়েছিল—

জলধর কী একটা বলতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে মেজকর্তা দাঁড়িয়ে উঠে বললেন—বেশ, বেশ, ঠিক আছে। ওদের ভয় পেতে বারণ কর। আমি নিজে দেখছি ব্যাপারটা—

তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন—চলুন তো, কোথায় গান শুনেছিলেন সে জায়গাটা একবার দেখে আসি। জলধর সঙ্গে এসো, নির্মলবাবু আর অসিতবাবুও আসুন। জলধর, তুমি কুলিদের সঙ্গে আসতে বারণ কর। ওরা ভয় পেলে কাজ চালানো মুশকিল হবে।

অরণ্যে নির্দিষ্ট কোনও পথরেখা নেই তা আগেই বলেছি। এখন আন্দাজে আন্দাজে ওঁদের নিয়ে চললাম। মিনিট সাতেক হেঁটে চিনতে পারলাম জায়গাটা। হ্যাঁ, এই তো এই পাথরটায় হেলান দিয়ে আমি বসেছিলাম। কিন্তু সামনের সেই বড় গাছটা কই? হাতির আকারের বিশাল পাথরটাই বা গেল কোথায়?

আমার মুখের ভাব দেখে মেজকর্তা বললেন—কী হল আপনার?

বললাম—এই পাথরটায় হেলান দিয়ে বসেছিলাম তখন। কিন্তু সামনে ওই জায়গাটায় একটা বড় পাথর আর একটা বড় গাছ ছিল, সে দুটো দেখছি না। তারই ওপাশ থেকে গান ভেসে আসছিল। ভেবেছিলাম কুলিরা গাইছে বুঝি—

জলধর বলল—না, এদিকে কুলিরা আজ কাজ করেনি।

নির্মলবাবু বললেন—কিন্তু গাছ বা পাথরের কী হল?

মেজকর্তা বললেন—আসুন তো দেখি—

নাঃ, জায়গাটায় কোনওকালে একটা গাছ দাড়িয়ে ছিল এমন মনে হল না। কিন্তু একটা জিনিস দেখে আমাদের সকলেরই বুক অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল।

সেখানকার মাটিতে চওড়া, গভীর একটা দাগ। যেন খুব ভারি কোনও জিনিস সেখান দিয়ে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

মেজকর্তা কিছুক্ষণই সেদিকে তাকিয়ে থেকে বললেন—চলুন তো, এ দাগটা কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে দেখি—

বেশিদূর যেতে হল না। দশ-বারো গজ দূরে জঙ্গলের আড়ালে পড়ে রয়েছে বিশাল পাথরটা। যেন এখানেই পড়ে আছে আদিকাল থেকে।

আমার মনের ভেতর অমঙ্গলের বিষাণ বাজছে। ভাল নয়, ভালো নয়, এ জায়গা ভাল নয়। মনে মনেই ঈশ্বরকে স্মরণ করলাম, প্রার্থনা করলাম যেন বিপদ কেটে গিয়ে তার আশীৰ্বাদ নেমে আসে। বিশ্বাস, প্রার্থনা আর আশীর্বাদের মূল্য সম্বন্ধে তারানাথের কাছে শোনা তার প্রথম জীবনের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। তার সঙ্গে আলাপের। প্রথম দিকে শোনা গল্পটা। বেশ কিছুদিন আগে শুনেছিলাম বটে, কিন্তু হঠাৎই তার সব খুঁটিনাটি মনে ভেসে উঠল। যেন ছবির মত দেখছি সব।



॥ পনেরো ॥

প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করার যেমন অনেক আশঙ্কার দিক আছে, তেমনি আবার কিছু মজার ব্যাপারও আছে। রথের দিন আমাদের অফিসে ছুটি থাকে না। কিন্তু সে বছর হঠাৎ রথে একটা হাফ-ছুটি পাওয়া গেল। কলকাতা অফিসের বড়কর্তা বাঙালী, সকালে অফিস গিয়েই শুনলাম তিনি নোটিশ জারি করেছেন আজ দুপুর দুটোয় ছুটি। যদি কেউ ইচ্ছে করে সে মেলা দেখতে যেতে পারে। মেলা দেখার উৎসাহ থাক বা না থাক, দেওয়ালের ঘড়িতে দুটোর ঘণ্টা বাজামাত্র বেরিয়ে পড়লাম।

ছোটবেলায় সবার মুখে শুনতাম প্রতিবছর রথের দিন বৃষ্টি হবেই। আজকে সকাল থেকে আকাশ মেঘলা ছিল, এখন অফিস থেকে বেরুনো মাত্র গুঁড়ি গুঁড়ি ছাগল তাড়ানো বৃষ্টি শুরু হল। এই আসে এই যায়। মনের আনন্দে ছাতা খুলে শেয়ালদার দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। মেলাটা একবার ঢুঁ মেরে তারপর মট লেনে তারানাথের বাড়ি যাব গল্প শুনতে।

পর্বদিনে ছেলেবুড়ো সবার মনেই বোধহয় উৎসবের রঙ লাগে। দেখলাম বৃষ্টি অগ্রাহ্য করে মানুষের ঢল নেমেছে মেলাতলায়। ভিড়ের চোটে গাড়িঘোড়া সব বন্ধ। কেবল হাসপাতালের গাড়ি চলাচলের জন্য ক্যাম্বেল স্কুলের সামনে একটুখানি ফাঁক। খানিকক্ষণ ধরে ফুল-ফল-নারকেলের চারা, মাটির পুতুল, রঙিন কাঁচের চুড়ির দোকানে অল্পবয়েসী মেয়েদের ভিড়, পিঁ-পিঁ বাঁশি এসব দেখে বেড়ালাম। তবু বাল্যের সেই আনন্দ আর কই? সে ছিল স্নিগ্ধ শ্যামছায়াচ্ছন্ন পরিচিত গ্রাম, আর এ হল ইঁট-কাঠ-পাথরের অচেনা শহর। ঠোঙায় করে কিছু ফুলুরি আর গরম ভাজা জিলিপি নিয়ে হাইকোর্টমুখো ট্রামে উঠে পড়লাম। মট লেনের মুখে যখন নামলাম তখনও বৃষ্টি পড়ছেই। হন হন করে হেঁটে তারানাথের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে স্বয়ং তারানাথের গলা—আসছি হে, দাঁড়াও একটু—

ভেজা জুতো আর ছাতা বারান্দার কোণে রেখে আড্ডাঘরের পরিচিতি চৌকিতে বসে বললাম—নিন, এতে তেলেভাজা আর জিলিপি আছে। চা বলুন একবার—

ঠোঙাটা হাতে নিয়ে তারানাথ বলল—বাঃ, এ যে দেখছি এখনো গরম! চা কিন্তু ঠিক দশ মিনিট পরে বলব। কিশোরী এসে পড়ুক, একসঙ্গে খাব—

অবাক হয়ে বললাম—কিশোরী আসছে নাকি? আপনি কী করে—

তারানাথ হাসল, বলল—এখুনি আসবে। আর সাড়ে আট মিনিট—

এক প্যাকেট পাসিং শো এনেছিলাম। প্যাকেটটা এগিয়ে দিতে তার থেকে একখানা বের করে ধরালো তারানাথ। বাড়িতে সাধারণতঃ হুঁকো খায়, কিন্তু পাসিং শো ব্র্যাণ্ডটা তার খুব প্রিয়। তার কাছে গল্প শুনতে যাবার সময় আমি আর কিশোরী মট্ লেনের মোড় থেকে দশ পয়সা দিয়ে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে নিয়ে যাই। প্রতিবারই তারানাথ সস্নেহে স্বচ্ছ মোড়কওয়ালা চিমনির মত টুপিপরা ধূমপানরত সাহেবের ছবিসুদ্ধ কালচে লালরঙের প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে বলে—হ্যাঁ, এই হচ্ছে সিগারেট। নেশার আসল কথা হচ্ছে মৌজ, ছবির সাহেব কেমন মৌজ করে গোল গোল রিং ছাড়ছে দেখেছ?

সাড়ে-আট মিনিট শেষ। বাইরে ঝপ করে ছাতা বন্ধ করার আওয়াজ, তারপরই কিশোরীর গলা—চক্কোত্তিমশাই আছেন নাকি? আমি কিশোরী—

তারানাথ আমার দিকে তাকিয়ে হাসল, তারপর উঁচুগলায় বলল—এসো হে, ভেতরে এসো।

কিশোরী সেন ঘরে ঢুকে আমাকে দেখে বিশেষ একটা অবাক হল না। আসলে হঠাৎ কোনো কারণে কাজের থেকে একটু অবসর পেলে তারানাথের বাড়ি আড্ডা দিতে আসা আমাদের অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। বয়েসে অন্ততঃ কুড়ি বছরের বড় হওয়া সত্ত্বেও তারানাথ আমাদের সঙ্গে সমবয়েসী বন্ধুর মতই আচরণ করে। সাধু-সন্ন্যাসী এবং অদ্ভুতকর্ম মানুষ দেখার শখ আমার চিরদিনের। কয়েকবছর আগে কিশোরী সেনই আমাকে তারানাথের কাছে নিয়ে এসেছিল, বলেছিল—চল, একজন ভাল তান্ত্রিক জ্যোতিষীর সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দিই। মুখের দিকে তাকিয়ে ভূত-ভবিষ্যৎ সব বলে দেয়।

কৌতুহলী হয়ে কিশোরীর সঙ্গে গিয়েছিলাম। আমার সম্বন্ধে অদ্ভুত কিছু কথা বলে তারানাথ আমাকে অবাক করে দিয়েছিল। এমন সব কথা, যা আমি ছাড়া কারো জানবার সম্ভাবনা নেই। আর আকর্ষণ করেছিল তার গল্প। যৌবনে সে পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছে, হাটে মাঠে গাছতলায় শ্মশানে কাটিয়েছে, শবসাধনা করেছে। তার গল্প বলার ক্ষমতাও ভারি সুন্দর। এ ক্ষমতা সবার থাকে না। কেউ কেউ বলার মত গল্পও বাচনভঙ্গির দোষে নষ্ট করে ফেলে, আর তারানাথ নিতান্ত তুচ্ছ ঘটনা বলার গুণে চিত্তাকর্ষক করে তোলে। কত আশ্চর্য ঘটনা শুনেছি তার কাছে, সে-সবের সঙ্গে আমাদের ডাল-ভাত খাওয়া মধ্যবিত্তের প্রাত্যহিক শান্ত জীবনধারার কোনো সম্পর্ক নেই। বীরভূমের গ্রাম্য শ্মশানে হাকিনীমন্ত্রে সিদ্ধ মাতু পাগলীর কাহিনী, বরাকর নদীর বালুকাময় তীরে শালবনের পাশে শুক্লা পঞ্চমীর স্বপ্নিল জ্যোৎস্নায় মধুসুন্দরী দেবীর আবির্ভাব, শ্বেতবগলার পুজো—আরো কত কী!

আমরা বলতাম—বাব্বাঃ, এতও ঘটেছে আপনার জীবনে!

তারানাথ হেসে বলত—হবে না! আমার জন্মের সময় আকাশে নীলরঙের উল্কা দেখা গিয়েছিল। আমার তন্ত্রদীক্ষা হয়েছিল পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময়—

কিশোরী গুছিয়ে বসতে জিজ্ঞাসা করলাম—তুমিও হঠাৎ এলে যে, কী ব্যাপার!

কিশোরী বলল—আজ দুপুরে সেকশন অফিসার ভবানীপুরের দিকে একটা কাজ দিয়ে বললেন—এটা সেরে ওখান থেকেই বাড়ি চলে যাবেন বরং, আর অফিসে ফিরতে হবে না। তা সে কাজ আধঘণ্টাতেই হয়ে গেল। ট্রামে করে ধর্মতলা এসে নামতেই তোমার অফিসের রমেশ মিত্তিরের সঙ্গে দেখা। তার কাছে শুনলাম তোমাদের আজ হাফ ছুটি হয়ে গিয়েছে। রথের দিন, মেঘলা আকাশ, তারপর আবার হাফ ছুটি—মনে হল তুমি নিশ্চয় এখানে এসে জমবে। তাই চলে এলাম। এই নিন—

পকেট থেকে একটা পাসিং শো-র প্যাকেট বের করে কিশোরী তারানাথের দিকে বাড়িয়ে ধরল। তারানাথ হেসে বলল—ভাল, ভাগ্যিস গলির মুখে তোমাদের দেখা হয়ে যায়নি! এ আমার কাল পর্যন্ত চলবে—

বললাম—কিন্তু আপনি জানলেন কী করে যে কিশোরী আসছে?

কিশোরী আমার দিকে তাকিয়ে বলল—তাই নাকি? উনি বলেছিলেন আমি আসছি?

—হ্যাঁ, বললেন দশ মিনিটের মধ্যে তুমি আসবে, তারপর চা করতে বলবেন।

তারানাথ মিটিমিটি হেসে চলেছে, যেন কিশোরীর আগমনসংবাদ সে কী করে আগে থেকে জানতে পারল তার ব্যাখ্যা দেবার প্রয়োজন সে বোধ করে না। আমরাও জোর করলাম না, কিছু কিছু জিনিস রহস্যের আবরণে ঢাকা থাকাই ভাল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই চা এল। চায়ে চুমুক দিয়ে তারানাথ বলল—তোমরা জিজ্ঞাসা করলে না বটে, কিন্তু মনে কৌতুহল নিশ্চয় হচ্ছে—তাই না? আসলে কী জানো, আমিও জানি না কী করে আমি বুঝতে পারি। কিছুটা সাধনায়, কিছুটা মধুসুন্দরী দেবীর বরে এই ক্ষমতাটা আমি পেয়েছি। হঠাৎ হঠাৎ মনে কোনো কথা ভেসে ওঠে, পরে সেগুলো মিলে যায়। যেমন কিশোরী, তোমার দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে তুমি গতকাল কোথাও থেকে কিছু টাকা—এই গোটা পঞ্চাশেক—মুফতে পেয়ে গিয়েছ। ঠিক?

কিশোরীর চোখ গোলগোল হয়ে গেল। সে বলল—সত্যি, আপনাকে যত দেখছি ততই বিস্ময় বাড়ছে। গতকাল অফিসের ঠিকানায় হঠাৎ পঞ্চাশ টাকার একটা মানি অর্ডার এসে হাজির। কী ব্যাপার—না, দেশের বাড়ির আমবাগানের ইজারার টাকা থেকে আমার ভাগের অংশ জ্যাঠামশাই পাঠিয়ে দিয়েছেন। কুপনে লেখা—টাকাটা তিনি বাবাকে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাবা নাকি বলেছেন টাকাটা কলকাতায় আমাকেই পাঠিয়ে দিতে। একা মেসে থাকি, কতরকম দরকার হতে পারে। আশ্চর্য, কত টাকা তাও তো প্রায় ঠিক বলে দিলেন। ধন্য আপনাকে। তা আজকে রথের দিনটা, এমন বাদলা করেছে, আজ একটা ভাল গল্প হবে না?

একটা ফুলুরিতে পরম তৃপ্তির সঙ্গে কামড় দিয়ে তারানাথ বলল—গল্প নয়, গল্প নয়, আমার কাছে সব সত্যি কথা। মধুসুন্দরী দেবীর কথা বলতে গিয়ে একটা ব্যাপার মনে পড়ে গেল। দেবী বলেছিলেন আমি বড়লোক হতে পারবো না বটে, কিন্তু অর্থের অভাবে আমাকে কখনো নিদারুণ সঙ্কটে পড়তে ইবে না। এই প্রসঙ্গেই একটা ঘটনার কথা তোমাদের বলি।

বরাকর নদীর ধারে মধুসুন্দরী দেবীর আবির্ভাবের পর সেখানেই শালবনের মধ্যে আস্তানা বানিয়ে বেশ কিছুদিন সাধনা করেছিলাম। সে আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিন গিয়েছে। নিজের দিকে কোনো খেয়াল নেই, হয়ত পাঁচ-ছদিন স্নানই করি না, দাড়ি কামাই না—রুক্ষ চুল বাতাসে ওড়ে। কাছাকাছি গ্রামগুলোতে ভিক্ষে করে খাই, আর অপেক্ষা করে থাকি কখন রাত হবে, কখন দেবী আসবেন। নদীর ধারের বালিতে মেশানো অভ্রের কুচি সদ্যোদিত চাঁদের আলোয় চকচক করে, মৃদুমন্দ হাওয়ায় নড়ে নদীতীরের অরণ্যের শাখা-প্রশাখা। তারপর বাড়ির লোক খবর পেয়ে এসে জোর করে ধরে নিয়ে গেল, সাধনজীবনের শেষ হল না, কিন্তু ভবঘুরে জীবনের শেষ হয়ে গেল। বাড়ির লোক ধরে নিয়ে যাবার আগে শেষদিন যখন মধুসুন্দরী দেবীর সঙ্গে দেখা হয়, সেদিন দেবী ওই বর আমাকে দিয়েছিলেন।

বাড়ির লোকেরা আমাকে সংসারে বাঁধবার জন্য আর দেরি না করে ভাল মেয়ে দেখে বিয়ে দিয়ে দিল। আমার তখন কেমন একটা বিহ্বল অবস্থা, যে যা বলে তাই করি, যা পাই তাই খাই, নিজের ইচ্ছা বলে যেন কিছু নেই। দেবীকে হারিয়েছি, জীবনে অন্য নারীর আবির্ভাব ঘটলে তিনি আর দেখা দেবেন না। মনের সেই অবস্থায় কিছুতেই আর কিছু এসে যাবে না, কাজেই শূন্যমনে যন্ত্রচালিতের মত বিয়ে করলাম।

সময় একটু একটু করে সব দুঃখই লাঘব করে, বিয়ের পরে নববিবাহিতা স্ত্রীর সান্নিধ্য আমার একটা নতুন জীবন গড়ে তুলল। গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না, কাজেই আমি বৌকে নিয়ে পৈতৃক ভিটে ছেড়ে কলকাতার উপকণ্ঠে একটা আধা শহর গোছের জায়গায় বাসা নিলাম। কিন্তু যে আশায় গিয়েছিলাম তা সফল হল না। পসার জমতে সময় লাগে। হাতদেখা আর কোষ্ঠী বিচার করা জ্যোতিষী বাজারে অনেক আছে, হঠাৎ মানুষ আমার কাছে আসবেই বা কেন? একটা পনেরো সেরী ঘিয়ের খালি টিন বাজার থেকে কিনে কাটিয়ে পিটিয়ে বোর্ড বানালাম, তার ওপর আলকাতরা দিয়ে বিজ্ঞাপন লিখে টাঙালাম। তাও কেউ আসে না। বাড়ি থেকে পুঁজি যা এনেছিলাম তাই ভেঙে ভেঙে কিছুদিন চলল।

একদিন দুপুরে একজন মক্কেল এসে হাজির। খাওয়াদাওয়া সেরে বাইরের ঘরে বসে বৃহৎ পারাশরি হোরা খুলে একটু পড়াশুনো করছিলাম, হঠাৎ উঠোন থেকে কে ডাকল—এই যে! বাড়িতে কেউ আছেন নাকি?

কিছুটা বিরক্ত হয়ে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। যা অবস্থা চলেছে, তাতে এ যদি মক্কেল হয় তাহলে একে আমার খুবই দরকার। কিন্তু সব কিছুরই তো একটা সময় অসময় আছে। আমি চিরকালই একটু আয়েসী মানুষ। পথেঘাটে খুব ঘুরে বেড়াতে পারি, এককালে যথেষ্ট ভবঘুরেমি করেছি, কিন্তু দুপুরবেলা তাকিয়া ঠেসান দিয়ে বিশ্রাম করছি, এমন সময়ে লোকজন এসে বিরক্ত করলে ভাল লাগে না। শাস্ত্রে বলে ‘ভূক্ত্বা রাজবদাচরেৎ’—অর্থাৎ আহারাদির পর হাত-পা ছড়িয়ে রাজার মত আচরণ করবে। এই শাস্ত্রবাক্যটি আমি মনোযোগ দিয়ে পালন করে থাকি। যাই হোক, দেখি লোকটা কী চায়!

বেরিয়ে যাকে দেখলাম সে একজন অদ্ভুতদৰ্শন মানুষ। রোগা সিড়িঙ্গে, ধুতিটা খাটো, কিন্তু পাঞ্জাবির লম্বা ঝুল হাঁটু ছাড়িয়ে নেমেছে। পাঞ্জাবির কাপড়টা ঝলঝলে সিলকের। চুপচুপে করে তেল দেওয়া কাঁধ পর্যন্ত পাট করা চুল। বিসদৃশ লম্বাটে ঘোড়ামার্কা মুখ, এদিকে থুতনি প্রায় নেই বললেই চলে, যেন স্রষ্টা মুখখানা বানাবার সময় জায়গাটা থাবড়ে-থুবড়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। গায়ের রঙ ঘোর কালো, তার ওপর কপালে তেল-সিঁদুরের দীর্ঘ তিলক। আমাকে দেখে সে একগাল হাসল, বেরিয়ে পড়ল লম্বা লম্বা একসারি হলদে দাঁত।

দুপুরে বিশ্রামের সময় এমন চেহারা দেখলে প্রীতি জন্মায় না। বললাম—কী চাই?

—এই যে সাইনবোর্ড ঝুলছে, তারানাথ জ্যোতিষার্ণব, আপনিই কি সেই?

—কেন, তাতে কী?

লোকটা বলল—আপনিই যদি তিনি হন, তাহলে একটু কথা বলতাম, এই আর কী—

—আমিই সেই। বলুন কী বলবেন—

লোকটা জিভ কেটে বলল—ছি! ছি! আমাকে আপনি বললে খুব লজ্জা পাচ্ছি। আপনি একে ইয়ে, তার ওপর ইয়ে—বলতে গেলে আমার ইয়ের মতন। একটু বসতে পাব কি?

বুঝলাম একে সহজে বিদায় করা যাবে না। দুপুরের বিশ্রামটুকু সত্যিই গেল। তবু হিন্দুর ছেলে, গৃহস্থ মানুষ, কেউ আতিথ্য চাইলে তাকে তো আর বিমুখ করতে পারি না। বিরসবদনে বললাম—এসো, ভেতরে এসো। বেশ, তুমিই বলব। তুমিও আমার ইয়ের মতন।

রসিকতাটা মাঠে মারা গেল। ধুলোমাখা চটি দরজার সামনে খুলে ঘোড়ামুখো অতিথি বৈঠকখানায় এসে জমিয়ে বসল। জিজ্ঞাসা করলাম—তোমার নামটি কী বাপু?

আবার একগাল হেসে ঘোড়ামুখো বলল—আজ্ঞে, আমার নাম হরকীর্তন সেন্নামৎ।

অবাক হয়ে বললাম—হর—?

—কীর্তন সেন্নামৎ। পদবীটা একটু অচেনা ঠেকছে না? ওই আমরা কয়েকঘর মাত্র আছি সারা বাংলায়। একেবারে অধম নই আজ্ঞে, জল আচরণীয়—

—না, না, সেজন্য বলিনি। যাক, কী প্রয়োজনে এসেছ বল—

—আমি এই ও-পাড়ায় এক আত্মীয়ের বাড়ি এসেছিলাম। কাজ সেরে ফেরার পথে আপনার সাইনবোর্ডটা নজরে পড়ল। আমার আবার এসব দিকে একটু চর্চা করার ঝোঁক আছে। তাই ভাবলাম আপনার সঙ্গে একটু দেখা করেই যাই। তা আপনি কী মতে ভাগ্য গণনা করেন? ওখানা কী বই? পারাশরি হোরা? পড়ছিলেন বুঝি?

বললাম—হোরাশাস্ত্র জান নাকি? পড়েছ?

হরকীর্তন হাসল, বলল—তা পড়েছি। তবে কী জানেন, ওসব কিছুই কিছু নয়, যে পারে সে এমনিতেই পারে, আপনি-আপনি। সবাইকে ঈশ্বর সে ক্ষমতা দেন না—

বাঃ, এ তো দেখি ধুকড়ির ভেতর খাসা চাল। লোকটা একেবারে অপোগণ্ড নয়, জ্যোতিষের একেবারে মূল কথাটা অক্লেশে বলে দিয়েছে। বললাম—তা আমার কাছে সাইনবোর্ড দেখে ঢুকে পড়লে কেন? অদ্ভুত ক্ষমতা কিছু আছে কিনা যাচাই করবার জন্য?

—না, তা নয়। সে তো আপনাকে দেখেই বুঝেছি। এলাম একটু আলাপ-সালাপ করতে। গুণী মানুষের সঙ্গ করলে পুণ্য হয়—

—আমাকে দেখে কী বুঝেছ? বল দেখি শুনি—

ভেবেছিলাম লোকটা দুটো মন-রাখা কথা বলবে, বা গদগদ প্রশংসা করে কিছু কাজ গোছানোর চেষ্টা করবে। একেবারে বিনা কারণে আজকাল কি কেউ কারো কাছে বসে সময় নষ্ট করে? এইবারে মন তুষ্ট করে তারপর ঝুলি থেকে বেড়াল বের করবে। কিন্তু হরকীর্তন সেন্নামৎ তা করল না, সে মুখ তুলে আমার দিকে সামান্য কয়েকমুহূর্ত স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল—যেমন বুঝেছি আপনার জন্ম ভাদ্র মাসে, আপনি তন্ত্রমতে দীক্ষিত উচ্চশাখার ভূতডামর অবলম্বনে সাধনা করেছেন। আপনার তন্ত্রদীক্ষা হয়েছিল পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময়—যা খুব সৌভাগ্য না থাকলে হয় না। কিন্তু কোনো কারণে সিদ্ধিলাভের আগেই তন্ত্রসাধনা ত্যাগ করে আপনাকে সংসারজীবনে প্রবেশ করতে হয়েছিল। ঠিক বলছি?

বললাম—বলে যাও।

–কিন্তু সাধনা সমাপ্ত না হলেও আপনার জীবনে খুব অদ্ভুত কিছু একটা ঘটেছে, অলৌকিক প্রত্যক্ষ কিম্বা তন্ত্রোক্ত দেব-দেবীদর্শন গোছের কিছু—ঠিক ধরতে পারছি না—তবে ঘটেছে যে, সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। একটা কথা বলি, অপরাধ নেবেন না। আপনি খুব আনন্দে জীবন কাটাবেন, অনেক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা হবে আপনার, কিন্তু বৈষয়িক দিক দিয়ে যাকে কিছু করা বলে, সে আপনার হবে না—

এ আর নতুন কথা কী? বললাম—সে জানি জানি। কিন্তু তুমি কীভাবে বুঝলে?

হরকীর্তন বলল—জানি না। আপনাকে দেখে যা মনে হল তাই বললাম—

বললাম—যা বলেছ ঠিকই বলেছ। তোমার ভাগ্যবিচারের স্বাভাবিক ক্ষমতা আছে দেখছি। এবার তোমাকে দেখে আমার যা মনে হচ্ছে একটু বলি?

হরকীর্তন বিনয়ে গলে গিয়ে বলল—আজ্ঞে, নিশ্চয়। বলুন আপনি—

—জন্ম দিয়েই শুরু করা যাক। তোমার জন্ম চৈত্রমাসে, দিনটাও বলে দিচ্ছি— রামনবমীতে তোমার জন্ম। ভাই-বোন যমজ হয়েছিলে, জন্মের পরই বোন মারা যায়। ঠিক?

—ঠিক। তারপর?

—লেখাপড়া বেশিদূর গড়ায় নি। ইস্কুলে পড়তে পড়তে সাধুসন্ন্যাসীদের সঙ্গ করার দিকে ঝোক যায়। অনেক ঘুরে বেড়িয়েছ, কিন্তু দীক্ষা নাও নি—

হরকীর্তন বলল—ঠিকই বলেছেন। দীক্ষা নেবার উপযুক্ত গুরু পাইনি। সব ব্যাটা ভণ্ড, কেবল লোক ঠকিয়ে খাবার ধান্দা। কেবল এই এক আপনার কাছে বসে মনটা ভারি ভক্তিতে ভরে যাচ্ছে। আপনি দেবেন আমাকে দীক্ষা?

হেসে বললাম—দুর পাগল। আমিই নিজের সাধনা ঠিকমত করে উঠতে পারিনি, তোমাকে দীক্ষা দেব কী? তাছাড়া তোমার ওসবের প্রয়োজন নেই, এমনিতেই তুমি অনেক পেয়েছ।

হরকীর্তনের চেহারা যেমনই হোক, মানুষটা সে ভাল। ঘ্যান ঘ্যান করে বিরক্ত করল না। শুধু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল—নাঃ তেমন কিছু আর পেলাম কই? যা পেলে মানুষ বড় হয় তা পাওয়া হয়নি। যাক, একটা জীবন কেটেই যাবে—

—তুমি সংসার করনি?

—না, ওসব ঝামেলায় আর নিজেকে জড়াই নি। আচ্ছা, আসি তাহলে। অসময়ে খুব বিরক্ত করে গেলাম, কিছু মনে করবেন না—

—না, না, তাতে কী হয়েছে? এদিকে আবার এলে দেখা করে যেও—

তাকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেছিলাম, সে বাধা দিয়ে বলল—আপনাকে আর আসতে হবে না। এবার বিশ্রাম নিন বরং -

দরজার কাছে খুলে রাখা চটিজোড়া পায়ে দিয়ে সে সিঁড়ি বেয়ে নেমে উঠোন পার হয়ে একবার দাঁড়াল। কঞ্চির বেড়ার দরজায় একটা হাত রেখে আমার দিকে তাকিয়ে কেমন যেন অদ্ভুতভাবে বলল—শুক্রবার। শুক্রবার।

হরকীর্তন কথাটা আমার দিকে তাকিয়ে বলছে বটে, কিন্তু ঠিক যেন আমাকে বলছে না। তার চোখে হঠাৎই উদ্দেশ্যহীন শূন্যতা। সে এখানে আছে বটে, নেইও বটে।

আমি অবাক হয়ে বললাম—কী শুক্রবার? কীসের শুক্রবার?

আমার কথা যেন শুনতেই পেল না সে, পেছন ফিরে হেঁটে চলে যেতে লাগল।

লক্ষণ-প্রতিলক্ষণ ইত্যাদি নিয়েই জ্যোতিষ এবং তন্ত্রসাধনার চর্চা করতে হয়। আমি বুঝতে পারলাম হরকীর্তন কথাটা নিজের জ্ঞানে বলেনি, দৈবী আবেশে গ্রস্ত হয়ে বলেছে। কেন এবং কী ভেবে বলেছে তা ও নিজেও জানে না। যেভাবে এলোমেলো পা ফেলে সে হেঁটে যাচ্ছে, তাতে বোঝা যায় তার ঘোর এখনো কাটেনি। কী বলতে চাইল লোকটা?

আজ সোমবার, তিনদিন পরে শুক্রবার পড়ছে। কী হবে শুক্রবার?

বৈঠকখানায় ফিরে এসে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে আবার একটু বিশ্রাম আর ঘুমের চেষ্টা করলাম। কিন্তু ঘুমের রেশ একবার কেটে গেলে ফের তাকে খুঁজে পাওয়া খুব মুশকিল। হোরাশাস্ত্র পড়তে পড়তেই বিকেল গড়িয়ে গেল।

পরের দিন সকালে কোষ্ঠী লেখবার হলুদ রঙের লম্বা কাগজের ফালি তৈরি করছি, এমনসময় স্ত্রী এসে কাছে দাঁড়ালেন। বললাম—কী হল? কিছু বলবে?

আমার স্ত্রী বরাবরই খুব মৃদুভাষিণী, তারপর তখন আবার নতুন বিয়ে হয়েছে। তিনি উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলেন। বললাম—আরে, কী ব্যাপার বলোই না—

উত্তরে তিনি যা বললেন সেটা আমারই আগে খেয়াল করা উচিত ছিল। বাড়িতে চাল নেই, ডাল নেই, আনাজ-সবজি-তেলমশলা কিছুই নেই। আগের দিন অবধি তিনি যা করে হোক চালিয়েছেন, আজ আর কোনো উপায় নেই। এ বিষয়ে আমি কী ভাবছি?

শুধু হোরাশাস্ত্র পড়ে দিন কাটালে চলে না। স্ত্রীর সঙ্কুচিত অনুযোগ আমাকে বাস্তব পৃথিবীর রৌদ্রদগ্ধ প্রান্তরে দাঁড় করিয়ে দিল। থলে হাতে বেরিয়ে পড়লাম।

জনবসতির শেষদিকে যেখানে পথটা হাটতলা হয়ে মহকুমা শহরের দিকে চলে যাচ্ছে, সেখানে হারাধন নন্দীর মুদিখানা। এখানে আসার পরে এই দোকান থেকেই মাঝে মাঝে জিনিসপত্র নিয়ে যাই। হারাধন লোকটা ভদ্র, হাসিমুখ। সওদা মেপে দিতে দিতে কুশল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে, সুখদুঃখের কথা বলে। তার দোকানেই গিয়ে দাঁড়ালাম।

সে সময়টা খদ্দের কেউ নেই, দোকান খালি। হারাধন তালপাতার পাখা উলটো করে ধরে তার বাট দিয়ে পিঠ চুলকোচ্ছে। আমাকে দেখে বলল—আসুন ঠাকুরমশাই কী দেব?

তোমরা শহুরে মানুষেরা শুনলে একটু অবাক হবে, গ্রামাঞ্চলে মুদিখানায় চাল-ডাল তেল-নুন ছাড়াও আলু পিঁয়াজ কুমড়ো লাউ শাকপাতা পাওয়া যায়, অন্তত একসময় যেত। কারণ হাট বসে সপ্তাহে মাত্র দুদিন, অন্য সময়ে হঠাৎ প্রয়োজন হলে মানুষকে বিপদে পড়তে হয়। মাছ-মাংস পাওয়া অবশ্য সম্ভব নয়, তবে কিঞ্চিৎ সৌখিন খরিদ্দারদের জন্য কোনো কোনো দোকানে হাঁসের ডিম থাকে।

বললাম—কিছু চাল-ডাল, তেন-নুন-মশলা আর সামান্য সবজি—

হারাধন বলল—আপনি বলে যান ঠাকুরমশাই, আমি মেপে দিই। দিন থলেটা—

এবারেই আসল কথাটা বলতে হবে। একটু কেশে বললাম—হারাধন, একটা কথা—

—কী ঠাকুরমশাই?

—ইয়ে হয়েছে মানে—দামটা কিন্তু কয়েকদিন পরে দেব, এখন বাকি থাকবে।

একমুহূর্ত তাকিয়ে থেকে হারাধন বলল—দিন, থলেটা দিন—

তারপর একটু হেসে বলল—আমাদের সকলকেই কোনো না কোনো সময়ে ঠেকায় পড়তে হয়। অসুবিধের সময় পরস্পরকে না দেখলে কি চলে? বড় বড় কথা বলছি ভেবে রাগ করবেন না ঠাকুরমশাই, আপনি পণ্ডিত ব্রাহ্মণ, মাননীয়, কিন্তু বয়েসে আমি বড়। থলেটা দিন, আর বলুন কী কী দেব—

মানুষের ভেতরেই ঈশ্বর বাস করেন। নইলে বাংলার অখ্যাত পাড়াগ্রামের এক মুদির মনে এই সহানুভূতি আর করুণার প্রকাশ কী করে সম্ভব?

কিশোরী বলল—শুধুই ঈশ্বর?

তারানাথ বলল—দানবও। ভাল আর মন্দ, আলো আর অন্ধকার সৃষ্টির মুহুর্ত থেকেই বর্তমান, বৈপরীত্য আছে বলেই সৃষ্টির সার্থকতা আছে। দানবিকতার ওপরে ঐশ্বরিকতার প্রতিষ্ঠাই মানুষের সাধনা। যাক, শোনো—

তারানাথ আবার বলতে শুরু করল।

কৃতজ্ঞচিত্তে বাজার নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম বটে, কিন্তু বুঝতে পারলাম এই স্বস্তি মাত্র কয়েকদিনের। ধার করে তো আর মাসকাবারি বাজার করা যায় না, যা এনেছি তাতে তিনদিন চলবে। নিকট ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা বর্তমানের আনন্দকে ম্লান করে দিল।

স্বাস্থ্যনিবাস হিসেবে খ্যাতি আছে এমন শহরে ডাক্তারের পসার জমে না। আমারও হল প্রায় তাই। যেন ভয়াবহ নাস্তিকদের দেশে বাসা বেঁধেছি, সপ্তাহে অন্তত একখানা কোষ্ঠী আর পাঁচ-ছটা হাত দেখার খদ্দের খুব দুঃসময়েও পেতাম, হঠাৎ তাও বন্ধ হয়ে গেল। একটানা খরা যাকে বলে। মাঝে মাঝে মনে হত মধুসুন্দরী দেবী বলেছিলেন আমি ধনী হতে পারব না বটে, কিন্তু অনাহারে কখনো দিন কাটাতে হবে না, মোটামুটি চলেই যাবে। দেবীর আশীর্বাদ কি শেষ পর্যন্ত মিথ্যে হতে চলেছে? অনাহার তো এসে পড়ল বলে।

কিন্তু আমার যা চিরকালের অভ্যেস, বৈষয়িক দুর্ভাবনা বেশিক্ষণ করতে পারি না। চৈত্রের প্রথম, গাছে নতুন পাতা গজাতে শুরু করেছে, ঈষৎ তপ্ত বাতাস শীতের শেষে ঝরা শুকনো পাতার রাশি অস্পষ্ট মর্মর শব্দে সরিয়ে নিয়ে বেড়ায়। আমের গুটি ধরেছে গাছে গাছে, আকাশ নির্মেঘ নীল। ঋতুর এই সব সন্ধিক্ষণে মন উদ্বেল হয়ে ওঠে, মনে পড়ে যায় ছোটবেলার কথা, হারানো মানুষদের স্নেহভরা হাসিমুখের কথা। মনে পড়ে যায় প্রথম যৌবনে আমার দায়মুক্ত ভবঘুরে জীবনের কথা। এইসব অমূল্য উপলব্ধির সম্পদের মধ্যে কে দুর্ভাবনা করে বাড়িতে চাল-ডাল আছে কিনা তার জন্য?

কিন্তু মুশকিল হল বাস্তবকে নিয়ে। তিনদিন পরেই সকালে স্ত্রী জানিয়ে দিলেন বাড়িতে যা আছে তাতে টেনেটুনে আর একটা দিন চলবে, পরের দিন বাজার না আনলেই নয়। বাইরের দাওয়ায় উদভ্রান্ত মনে পায়চারি করতে লাগলাম। কি করি আমি এখন? আজ শুক্রবার। হরকীর্তন বলে গিয়েছিল মনে রাখতে, শুক্রবার একটা কিছু হবে। কি হতে পারে আজ? দিন তো শুরু হয়ে গেল।

উঠোনের ওপারে রাংচিতার বেড়ার ওপর একটা কাক কোথা থেকে এসে বসেছে। ঠোঁট ঘষছে বেড়ার গায়ে। তার ঠোঁট থেকে কী একটা জিনিস খসে উঠোনের ভেতরদিকে পড়ল। আমি প্রথমটা খেয়াল করিনি। একটু পড়ে দেখি আরেকটা কাক এসে আগেরটার পাশে বসল। তার পর আর একটা। এ দুটো কাকের মুখ থেকেও হালকা কী জিনিস ভাসতে ভাসতে উঠোনে পড়ল। একটু অবাক হয়ে বেড়ার দিকে এগিয়ে যেতে কাক তিনটে উড়ে পালাল। জায়গাটায় পৌছে আমি সবিস্ময়ে উঠোনের মাটির দিকে তাকিয়ে রইলাম।

মাটিতে পড়ে রয়েছে একখানা পাঁচ টাকার এবং দুখানা দুটাকার নোট।

আশ্চর্য। এখানে টাকা এল কোথা থেকে? কাকেরাই মুখে করে এখানে এনে ফেলে দিয়ে গেল নাকি? নিচু হয়ে টাকাগুলো কুড়িয়ে হাতে নিলাম। নোটগুলোতে শুকনো রক্ত আর মাছের আঁশ লেগে রয়েছে। ব্যাপারটা মোটামুটি বুঝতে পারলাম। আজ হাটবার, মাছের আড়ত থেকে কাক তিনটে রক্তের গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে নোটগুলো তুলে এনে বেড়ার ওপর বসেছিল। ঠোঁট ঘষবার সময় সেগুলো খসে পড়েছে।

নোট তিনটে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। হরকীর্তনের ভবিষ্যৎবাণী ফলে গেল তাহলে! অদ্ভুত ক্ষমতা তো লোকটার। কাকে মুখে করে এনে টাকা ফেলে যায় এমন কখনো শুনিনি। মনে রেখো, যে সময়কার কথা বলছি তখন নটাকা অনেক টাকা। ছোট সংসারে একমাসের বাজার হয়ে যায়। টাকাটা না পেলে আজ সত্যি বিপদ হত, আগের টাকা শোধ না করে তো হারাধনের কাছে নতুন করে ধার নেওয়া যেত না।

বিস্ময়ের তখন যে আরও অনেক বাকি তা বুঝতে পারিনি। পরের দিন থলে নিয়ে সকালবেলা হারাধনের দোকানে গিয়ে হাজির হলাম। হারাধন বলল—আসুন ঠাকুরমশাই। আজ হাটে না গিয়ে আমার দোকানে এলেন যে বড়? হাটে নানারকম জিনিস পেতেন— বললাম—হ্যাঁ, কাল আর হাটে যাওয়া হয়ে উঠল না, তাই আজ তোমার কাছেই এলাম।

হারাধন বলল—সে কী ঠাকুরমশাই! হাট তো কাল ছিল না! আপনি নতুন লোক, ভুলে গিয়েছেন হয়তো, হাট তো আজ শনিবার বসেছে। তাহলে কি হাটেই যাবেন?

মাথার মধ্যে সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল। হাট গতকাল ছিল না, আজ বসেছে! তাহলে কাক তিনটে মাছের রক্ত আর আঁশ মাখা টাকা পেল কোথা থেকে? যাই হোক, কথা না বাড়িয়ে বললাম—না হারাধন, হাটে যাবো না। যা নেবার তোমার কাছ থেকেই নিই।

সেদিন রাত্তিরে মধুসুন্দরী দেবীকে স্বপ্নে দেখলাম। আমার দিকে তাকিয়ে তিনি হাসছেন। যেমন হেসেছিলেন এক পূর্ণিমার রাত্তিরে বরাকর নদীর ধারের শালবনে।

পরের পর্ব পড়ুন....

No comments:

Post a Comment