প্রথমাংশের লিঙ্ক
দ্বিতীয়াংশের লিঙ্ক
লেখক: তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
॥ পাঁচ ॥
পাসিং শো ধরাবার জন্য তারানাথ থামল।
বাইরে সন্ধে ঘনিয়ে আসছে। মট লেনের একটু ভেতরদিকে তারানাথের বাড়ি, এখান থেকে বড়রাস্তার কোলাহল আর গাড়িঘোড়ার শব্দ খুব আবছাভাবে শোনা যায়। কলকাতার পুরনো গৃহস্থপাড়ায় দিনাবসানের একটা আলাদা মেজাজ আছে, কলকাতার বনেদি বাসিন্দারা সেটা টের পায়। তারানাথের বাড়িতে বসে এ ব্যাপারটা স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারা যায়।
তারানাথ বলল—আর একটু চা বলি, কি বল?
কিশোরী বলল—বেশ তো, বলুন। ততক্ষণে আমি বরং গলির মোড় থেকে গরম তেলেভাজা নিয়ে আসি। তেলেভাজা আর চা একসঙ্গে না হলে আবার আড্ডা কী?
—আরে না না, কেন আবার ওসব ঝামেলা— তারানাথের আপত্তিতে কর্ণপাত না করে কিশোর বেরিয়ে গেল। একটু বাদেই সে ফিরে এল হাতে বেশ বড় মাপের এক শালপাতার চাঙাড়ি নিয়ে।
—কী হে! এতসব কী এনেছ? তারানাথের সামনে চাঙাড়ি নামিয়ে কিশোরী বলল—একেবারে সদ্যভাজা বেগুনী, ঝালবড়া আর মোচার চপ। কিছু আমাদের জন্য রেখে বাকি ভেতরে পাঠিয়ে দিন—
চারি চা নিয়ে এল। আমরা বেগুনীতে কামড় দিয়ে গল্পের আশায় উৎসুকভাবে তারানাথের দিকে তাকালাম। হাত দেখা বা কোষ্ঠীবিচার জানি না, কাজেই তারানাথ কত বড় জ্যোতিষী বোঝবার ক্ষমতা আমাদের নেই। যে গল্প সে আমাদের শোনায় তার সত্যাসত্য বিচারও দুঃসাধ্য, কিন্তু একটা কথা স্বীকার করতেই হবে—গল্প বলে মানুষকে মুগ্ধ করে রাখার ক্ষমতায় তারানাথ অদ্বিতীয়। বাড়ির বাইরে জ্যোতিষ কার্যালয়ের সাইনবোর্ডটা বিবর্ণ হয়ে ঝুলে পড়েছে, পুরনো কয়েকজন বাঁধা খদ্দের ছাড়া আজকাল ভাগ্যগণনায় আগ্রহী নতুন লোক বড় একটা ভিড় করে না। সেদিক দিয়ে বলতে গেলে তারানাথের ব্যবসায় ভয়ানক মন্দা চলেছে। তাতে তারানাথের বিশেষ উদ্বিগ্নতা কিছু নেই, আর আমাদের তো ভালই হয়েছে। একদিন তারানাথ নিজেই বলল—বরাকর নদীর ধারে বালির চড়ায় পোড়া শোলমাছের নৈবেদ্য দিয়ে মধুসুন্দরী দেবীকে অর্ঘ্য দিয়েছিলাম, সে গল্প তো তোমাদের বলেছি। সেই রাত্তিরেই নদীর ধারের শালবনে স্নান অপার্থিব জ্যোৎস্নায় দেবী আবির্ভূতা হলেন। সেই অলৌকিক সৌন্দর্য মানবীর হয় না, সেই ভালবাসা পৃথিবীর নারীর পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। প্রায় এক বছর ধরে বরাকর নদীতীরের শালবন আমার তীর্থক্ষেত্র হয়ে উঠল। রোজ রাত্তিরে দেবী দেখা দিতেন। আমি চরিত্রের দিক দিয়ে শুকদেব নই, কামনা-বাসনাহীন ঋষিও নই। কাজেই মহাডামরতন্ত্রে মাতৃরূপে বা কন্যারূপে যে দেবীদের পাওয়া যেতে পারে তাদের জন্য সাধনা করিনি। গুরু বলেছিলেন কন্যারূপে কনকবতী দেবীর আরাধনা করতে। আমার সে পরামর্শ মনঃপূত হয়নি। মধুসুন্দরী দেবীকে প্রেমিক হিসেবে পেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু—
তারানাথ একটু থামল।
জিজ্ঞাসা করলাম—কিন্তু কী?
—আমরা সাধারণ মানুষ রে ভাই, প্রেমিকা হিসেবে দেবীকে সামলানো কি আমাদের পোষায়? মানুষ-বৌ নিয়েই জেরবার হতে হয়। কিন্তু এটা ঠিক, সাধকের জীবনকে দেবী স্বর্গীয় প্রেমসুধায় পূর্ণ করে দেন—
কিশোরী বলল—স্বর্গীয় বলছেন, এরা কি স্বর্গের দেবী?
—না। একেবারেই না। মহাডামরের এক বিভাগ হচ্ছে ভূতডামর। ভূতডামরে এইসব জীবেদের উল্লেখ আছে। এরা মানুষও নয়, আবার সাধারণ অর্থে প্রেতও নয়। দেবতা তো নয়ই। ভূত বলতে লোকে বোঝে পরলোকের অধিবাসী, মানুষ মরে যেখানে যায়। ভূতডামরে যাদের উল্লেখ রয়েছে, তারা মানুষ এবং তথাকথিত ভূতপ্রেতের মাঝামাঝি এক অদ্ভুত জগতের বাসিন্দা। আজন্মকাল লালিত আমাদের শুভ ও অশুভের বোধ, মঙ্গলের ধারণা, ন্যায়-অন্যায়, পবিত্রতা-–কিছুই সেখানে খাটে না। আজ যে দেবীর মহিমা নিয়ে আমাকে সেবা ও প্রেমে ধন্য করছে, মন্ত্র ও সাধনায় সামান্য ক্রটি হলে পিশাচীর মত সে আমাকে ধবংস করবে। এদের প্রেমও চরম, প্রতিহিংসাও চরম।
বললাম—প্রতিহিংসা কীসের? সাধক তো কোনো অন্যায় করেনি—
—করেছে বইকি। তোমাকে যদি কেউ তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করে খাটিয়ে নেয় তাহলে কি তোমার খুব ভাল লাগবে? তেমনি বিপুল ক্ষমতাশালী ডামরীদের তুমি মন্ত্রের বাঁধনে আটকে তোমার ইচ্ছেমত কাজ করাচ্ছ, এতে কি তারা খুশি হচ্ছে? তা নয়। কিন্তু অসহায়ের মত তারা তোমার ক্রীতদাস হয়ে আছে। আত্মরক্ষার বর্মে এতটুকু ছিদ্র পেলে তারা তোমাকে নির্মমভাবে হত্যা করবে। আমি নিজে দেখেছি—
তারানাথ যেন একটু শিউরে উঠে থেমে গেল।
কিশোরী জিজ্ঞেস করল—কী দেখেছেন?
—অসাবধানী সাধকের মর্মান্তিক পরিণতি। মাথাটা মুচড়ে ছিঁড়ে ফেলেছিল—
বিষয়টি মুখরোচক নয়। আগ্রহ হলেও আর কোনো প্রশ্ন করলাম না।
তারানাথ বলল—বাড়ির লোক খবর পেয়ে আমাকে গিয়ে ধরে আনে। তখন আমার পাগলের মত দশা। কত মাস চুল-দাড়ি কাটিনি, বড় বড় নখ, শতছিন্ন জামাকাপড়, গায়ে ময়লা। বাড়ি ফিরে আসবার আগের রাত্তিরে শেষবারের মত দেবী আমাকে দেখা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন—কিছু শক্তি তোমাকে দিলাম। যদি বুঝে ব্যবহার করতে পার তাহলে জীবনে অন্তত ভাত-কাপড়ের অভাব হবে না। আমার সঙ্গে আর দেখা না হওয়াই সম্ভব, যদি না—
কীভাবে দেখা হতে পারে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। দেবী উত্তর দেননি।
যাই হোক, আমার সাংসারিক অবস্থা তো দেখছ। কিন্তু দেবীর আশীর্বাদে একরকম করে চলে যায়। বড়লোক হতে পারিনি, কিন্তু ভিক্ষেও করতে হয়নি।
কিশোরী বলল—আমাদের সঙ্গে আলাপ হওয়ার প্রথমদিকে আপনি বীরভূমের শ্মশানবাসিনী মাতু পাগলীর কাহিনী বলেছিলেন। তার সঙ্গেও পরে আর দেখা হয়নি?
তারানাথ বলল—না। তবে আমার মনে হয় মাতু পাগলী, তন্ত্রে উল্লিখিত ডামরী, মধুসুন্দরী দেবী—এরা সব আসলে একই শক্তির বিভিন্ন প্রকাশ। মাতু পাগলী ছেঁড়া কাপড় পরে গ্রামের শ্মশানে বসে থাকত বটে, কিন্তু সে বিশাল শক্তির অধিকারিণী ছিল। এখন আমার মনে হয় সে মানুষ ছিল না। আমার খুব সৌভাগ্য তাই তার দেখা পেয়েছিলাম।
বললাম—মানুষ ছিল না বলছেন, তাহলে সাধারণ মানুষের মত হাটে-মাঠে পড়ে থাকত কেন?
—মাতু পাগলী যে পর্যায়ে উঠেছিল, সেখানে পৌঁছলে পার্থিব সুখৈশ্বর্য তুচ্ছ হয়ে যায়। শ্মশানে থাকলেও যা, রাজপ্রাসাদে থাকলেও তাই। সেসময় একটা গুজব শুনেছিলাম লোকের মুখে, তখন বিশ্বাস করিনি। শুনেছিলাম মাতু পাগলী নাকি আহার্য বা পানীয় গ্রহণ করে না। পরে ভেবে দেখেছি, সত্যিই তো, এক একদিন সকাল থেকে গভীর রাত্তির পর্যন্ত তার সঙ্গে কাটিয়েছি, কখনও তাকে সামান্য জলও খেতে দেখিনি। ছায়াটা অবশ্য খেয়াল করিনি, তখন জানতামও না—
কিশোরী বলল—ছায়া খেয়াল করা কী রকম?
—গ্রামাঞ্চলে প্রবাদ আছে জানো তো, প্রেত-পিশাচের নাকি ছায়া পড়ে না। কথাটা আংশিক সত্য, পুরোটা নয়। তাদেরও ছায়া পড়ে ঠিকই, কিন্তু গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ ছায়া পড়ে না। একটু জলমেশানো ভেজাল ছায়া পড়ে। অভিজ্ঞ সাধক দেখলে বুঝতে পারে।
ভেজাল ছায়া! কতরকম অদ্ভুত কথাই যে শুনলাম তারানাথের কাছে!
তারানাথ অনেকসময় মানুষের মুখ দেখে নির্ভুলভাবে মনের কথা আন্দাজ করে ফেলে। আমার দিকে তাকিয়ে সে বলল—বিশ্বাস করা কঠিন, না? ভাবছ, এ বুড়ো কীসব আবোলতাবোল বকে আসর জমাবার চেষ্টা করে। ব্যাপার আত সোজা নয়। দেবীর দয়ায় আর গুরুর আশীর্বাদে কিছু গুণ লাভ করেছিলাম, এসব তারই প্রকাশ। বলেছি বোধহয় তোমাদের–আমার তন্ত্রদীক্ষা হয়েছিল পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময়ে। গলায় পদ্মবীজের মালা পরে গুরু যখন বিরজা হোমের পুর্ণাহুতি দিলেন, তখন আকাশে গ্রহণগ্রস্ত সূর্য তাম্রাভ চাকার মত বিবর্ণ আর স্নান দেখাচ্ছে। গুরুই বলেছিলেন—খুব শুভযোগে তোমার দীক্ষা হল। অনেক ক্ষমতা লাভ করবে তুমি—
বললাম—বিরজা হোম কী?
—সংসার ত্যাগ করে তবে সন্ন্যাসজীবনে প্রবেশ করতে হয়। দীক্ষার পরমুহুর্ত থেকে সাধকের আর কোনও সামাজিক পরিচয় থাকে না। এমন কী, বাবা-মায়ের শ্রাদ্ধ করার অধিকার থেকেও সে বিচ্যুত হয়। দীক্ষার সময় যে বিশেষ যজ্ঞের মাধ্যমে নিজের শ্রাদ্ধ করতে হয়, তারই নাম বিরজা হোম।
বললাম—নিজের শ্রাদ্ধ করার সময় আপনার মন খারাপ হয়নি।
—খুব সামান্য। সাধনার জন্য যত ব্যগ্রই হওয়া যাক না কেন, ওটুকু মানুষী দুর্বলতা থেকেই যায়। সমাজ ও সংসারের প্রতি স্বাভাবিক যে টান। শ্রাদ্ধের চেয়ে বেশি খারাপ লেগেছিল পৈতেটা ত্যাগ করতে। সেই সময়টায় বুঝেছিলাম আজন্মলালিত বিশ্বাস ও সংস্কার কতখানি গভীরে শেকড় গেড়ে থাকে।
—পৈতে কেন ত্যাগ করতে হয়?
—বিরজা হোমের পরে তুমি আর কারও সন্তান নও, তোমার কোনও সামাজিক সম্প্রদায় নেই। তুমি ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় শূদ্র কিছুই নও। তুমি কেবল একজন সাধক। পৈতে থাকলে বর্ণশ্রেষ্ঠ হিসেবে তোমার অহংবোধ জন্মায়। সাধনার ক্ষেত্রে তা অমার্জনীয়।
বললাম—এখন তো আপনি পৈতে ধারণ করে আছেন। কেন?
তারানাথ হেসে বলল—আবার গৃহাশ্রমে ফিরে এসেছি, সেও তো বেশ অনেক বছর হয়ে গেল। মনে মনে গুরুর কাছে ক্ষমা চেয়ে পিছিয়ে এলাম। দেখলাম ভেতরে ভেতরে আমার ভোগবাসনা আর সংসার করার কামনা পুরোপুরি রয়ে গিয়েছে। দুই নৌকোয় পা দিয়ে চলা যায় না। দেখলাম ফিরে আসাই ভাল—
—কবে আবার পৈতে নিলেন?
—সেটা বেশ একটা আশ্চর্য ঘটনা। শুনবে?
বলে কী তারানাথ জ্যোতিষী! গল্প শোনার লোভেই তো ছুটির দিনে তার কাছে এসে বসে থাকি। বললাম—অবশ্যই শুনবো। বলুন—
একটা পাসিং শো ধরিয়ে দেশলাইয়ের কাঠিটা ছাইদানি হিসেবে রাখা নারকেলের মালায় গুঁজে দিতে দিতে তারানাথ বলল—এতসব অদ্ভুত ঘটনা আমার জীবনে ঘটেছে যে, ভাবলে আমার নিজেরই অবাক লাগে। আর তোমরা তো নিশ্চয় ভাবো লোকটা নির্বিকার মুখে মিথ্যে গল্প বানিয়ে বলে। তোমাদের দোষ দেওয়া যায় না, এসব কাণ্ড বিশ্বাস করা প্রকৃতপক্ষেই কঠিন।
তারানাথ খুব একটা বাজে কথা বলে নি। অদ্ভুত গল্পের নেশায় তার কাছে ছুটে আসি, যতক্ষণ সে গল্প বলে ততক্ষণ মুগ্ধ বিস্ময়ে শুনেও যাই, কোনও বিরুদ্ধ যুক্তি মনে উঁকি দেয় না। কিন্তু তার সান্নিধ্যের প্রবলতা থেকে মুক্তি পেয়ে গল্পের শেষে মট লেনের বাইরে এসে কলকাতার কঠিন ফুটপাথে পা দিলেই বিশ্বাস একটু একটু করে ক্ষইতে শুরু করে। মুগ্ধতা থাকে, বিশ্বাসটা থাকে না। তবু পরের সপ্তাহে আবার যাই। গল্পের এমনই নেশা।
তারানাথ বলল—এ ঘটনা আমার প্রথম জীবনের। আজ থেকে প্রায় তিরিশ কি পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার কথা। দীক্ষা নিয়েছি তা আট-দশ বছর হয়ে গেল, কিন্তু মনের ভেতর কোনও প্রসন্নতা অনুভব করি না। গুরুর প্রদর্শিত পথে সাধনা করবার চেষ্টা করি, আর হাটে-মাঠে ঘুরে বেড়াই।
এমনি ঘুরতে ঘুরতে একদিন দুপুরের কিছু পরে ক্লান্ত হয়ে একটা নদীর ধারে ঝাঁকড়া এক বটগাছের ছায়ায় আশ্রয় নিলাম। জায়গাটা ভারি শান্তিপূর্ণ, নদী বয়ে যাচ্ছে সামনে, মাথার ওপরে নানা ধরনের পাখির বিচিত্র ডাক। একটু বিশ্রাম করে নদীতে নেমে হাতমুখ ধুয়ে জল খেয়ে ঠাণ্ডা হলাম। এখনও বেশ রোদ, কিছুক্ষণ গাছের ছায়ায় শুয়ে থেকে তারপর পথ হাঁটলেই হবে। নদী থেকে উঠে এসে গাছের একটা শেকড়ে মাথা দিয়ে আরাম করে শুয়ে পড়লাম। ভবঘুরে জীবনের এই একটা সুন্দর দিক—কোনও দায়দায়িত্ব কিছু নেই, মুক্ত আনন্দে ঘুরে বেড়াও, ইচ্ছে হলে কোথাও দু-দিন থাকো, ইচ্ছে না হলে আবার বেরিয়ে পড়ো পথে। ভারি আনন্দের জীবন, চমৎকার জীবন—
বললাম—তাহলে আর সংসারের এই বন্ধনের মধ্যে ফিরলেন কেন?
একটু চুপ করে থেকে তারানাথ বলল—আগেই তো বলেছি সত্যিকারের বড়মাপের সাধক হওয়ার যোগ্যতা আমার ছিল না। জগৎব্যাপারে বিশাল মুক্তির মধ্যে চিরতরে নিজেকে যুক্ত করতে গেলে শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের অধিকারী হতে হয়। নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্য। তবু বলি, জীবনের ওই কটা বছর বড় আনন্দে, বড় শান্তিতে কাটিয়েছি।
ঠাণ্ডা ছায়ায় শুয়ে ঝিরঝিরে বাতাসে বোধহয় একটু ঘুম এসে গিয়েছিল। চটকা ভেঙে যেতে দেখলাম বেলা গড়িয়ে গিয়েছে, সূর্যাস্ত হতে আর খুব দেরি নেই। পথে শুনেছি আরও মাইল চারেক গেলে পড়বে জয়তলা গ্রাম। সেখানকার মুখুজ্যে জমিদাররা যাত্রীদের জন্য অতিথিশালা করে রেখেছেন। সেখানেই রাত্তিরটা থাকবো। এখনই হাঁটতে শুরু করা দরকার, কারণ চার মাইল যেতে কম সময় লাগবে না।
নদী বাঁদিকে রেখে চলেছি, সন্ধের পরে পরেই জয়তলা পৌঁছে যাব। হঠাৎই কেন যেন বাঁদিকে তাকালাম। তাকানোমাত্র এক অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ল।
সূর্য দিগন্তরেখা প্রায় ছুঁয়েছে, আর কয়েক মিনিটের মধ্যে ডুবে যাবে। সেই অস্তোন্মুখ রক্তবর্ণ সূর্যের গোলক ঘিরে একটা ঘোর কালো বৃত্ত! গতকালও এখান থেকে বারো তেরো মাইল দূরে একটা গ্রামের বাইরের মাঠে বসে সূর্যাস্ত দেখেছি। কই, এমন কিছু চোখে পড়েনি তো! কালো মেঘ বা বাতাসে হঠাৎ জমে ওঠা কালোরঙের ধুলো বলে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। এ একেবারে অন্যরকম। আকাশের গায়ে যেন একটা মোটা, চওড়া কালো অন্ধকারের গণ্ডী। অমঙ্গলের অগ্রদূত।
কিশোরী জিজ্ঞাসা করল—অমঙ্গলের অগ্রদূত বলছেন কেন? জিনিসটার তো প্রাকৃতিক ব্যাখ্যাও থাকতে পারে—
—না, তা পারে না। আসলে তোমরা ব্যাপারটা দেখ নি, দেখলে বুঝতে পারতে। দেখতে পেতে না অবশ্য, ওটা কেবল আমার কাছেই দৃশ্যমান হয়েছিল। সেটাও একটা বড় প্রমাণ যে, এর স্বাভাবিক ব্যাখ্যা হয় না—
—আর কেউ দেখতে পায়নি বুঝলেন কী করে?
—ওসব গ্রাম জায়গা, কেউ অমন অদ্ভুত কিছু দেখতে পেলে মুহুর্তে তা লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ত। জয়তলা গ্রামের দিকে হাঁটছি, চাষীরা দিনের কাজ সেরে বাড়ির দিকে ফিরছে, রাখাল ছেলেরা গরুর পাল তাড়িয়ে গ্রামে যাচ্ছে। আমি ছাড়া তাঁরা কেউই কিছু দেখতে পাচ্ছে না।
বললাম—আপনি ভয় পেলেন কেন? ওই কালো বৃত্তের মানে কী?
—ওর মানে আমার প্রতি কেউ তন্ত্রোক্ত অভিচার ক্রিয়া প্রয়োগ করেছে। কেউ আমার ভয়ঙ্কর ক্ষতি করতে চায়, পারলে প্রাণহানি করতে চায়। কিন্তু কে? কেন সে আমার ক্ষতি চায়? এসব জানবার জন্য ঠিক করলাম জয়তলা পৌঁছে একটু বেশি রাত্তিরে মনোদর্পণে বসব—
কিশোরী বলল—মনোদর্পণ আবার কী?
—তোমরা তো জান আমি চন্দ্রদর্শনে সিদ্ধ। বুড়ো আঙুল দিয়ে কান ও দুই তর্জনী দিয়ে চোখ টিপে ধরে মনোসংযোগ করে একটি মন্ত্র রোজ এক হাজারবার জপ করতে হয়। যেদিন সিদ্ধিলাভ হবে সেদিন দেখতে পাবে আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ, আর নিচে একটি গাছের তলায় দুজন পর দাঁড়িয়ে। তুমি যা প্রশ্ন করবে পরীরা তার উত্তর দিয়ে দেবে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তোমার অজানা কিছু থাকবে না। প্রশ্ন করার পরেই পরী, চাঁদ সব মিলিয়ে গিয়ে সামনেটা বায়োস্কোপের পর্দার মত খালি হয়ে যাবে। তুমি যা জানতে চাও, তা সেই পর্দায় ছবির মত ফুটে উঠবে। একেই বলে মনোদর্পণ।
—বাঃ, এ তো ভাল মজা! এতে তো ইচ্ছে করলে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী আর ধনী মানুষ হওয়া যায়। আগামীকাল রেসের মাঠে কোন ঘোড়া জিতবে, কোন শেয়ারের কত দর থাকবে—এই জানলেই তো রাজা। তাছাড়া নিজের বিপদ-আপদ, মেয়ের বিয়ে—সবই তো পরীরা বলে দেবে। আপনি রোজ বসেন না কেন মনোদর্পণে?
তারানাথ হাসল। বলল—খুব বড় আর মূল্যবান প্রশ্ন করেছ। ঠিকই তো, সপ্তাহে একবার করে আসনে বসলেই আমার আর কোনও অভাব থাকবে না। আমার সাংসারিক অবস্থা তো দেখছই, প্রতিদিনের চিন্তা প্রতিদিন করতে হয়। তাহলে রাজা হবার এমন সহজ উপায় গ্রহণ করছি না কেন? না, তা করা যায় না। এইখানেই সাধকের পরীক্ষা। ক্ষমতা লাভ করার সঙ্গে সঙ্গে সংযম অভ্যেস না করলে ক্ষমতা চলে যায়। প্রথম জীবনে শক্তি পাবার দম্ভে এসব অনেক করেছি, পরে সচেতন হয়ে সাবধান হয়ে যাই। লোভ আর প্রকৃত সাধনা একসঙ্গে হয় না।
সন্ধের কিছু পরে পরেই জয়তলা গ্রামে পৌঁছলাম। মুখুজ্যেরা কোনও একসময়ে বর্ধিষ্ণু জমিদার ছিলেন, কিন্তু বর্তমানে তাদের অবস্থা ভাল নয়। বিশাল বাড়ি মেরামতির অভাবে জীর্ণ হয়ে এসেছে। কোথাও দেয়ালের পলস্তারা খসা, কোথাও কার্নিশে বটগাছের চারা। কিন্তু সব মিলিয়ে মানুষজনের আচরণে বনেদিয়ানার ছাপ। বারবাড়িতে দেউড়ির পোশে লম্বা কাছারিঘর, সন্ধের পর এখন আর সেখানে অন্য কর্মচারী কেউ নেই, কেবল সামনে লণ্ঠন নিয়ে প্রৌঢ় নায়েবমশাই বসে কী হিসেব দেখছেন। আমি গিয়ে দাঁড়াতে খেরো থেকে মুখ তুলে বললেন—কে? কী চাই?
নাম বললাম। রাত্তিরটুকু থাকতে চাই তাও জানালাম।
নায়েবমশাই বললেন—অতিথিশালায় ভাল ঘর দিয়ে দিচ্ছি। একটা সিধে দিচ্ছি, তাতে চাল ডাল আলু ঘি লবণ থাকবে। আর আধসের দুধ। সারারাত জ্বলবার মত তেলভরা লণ্ঠন দেওয়া হবে। রঘু—রঘু!
একজন কর্মচারী এসে দাঁড়াল। নায়েবমশাই বললেন—এই একজন অতিথি এসেছেন। একে অতিথিশালায় নিয়ে যাও। পুবের ভাল ঘরটা দেবে।
রঘু আমাকে নিয়ে গিয়ে ঘর খুলে দিল। মাঝারি ঘর। একটা ন্যাড়া তক্তাপোষ আছে, তাতে বিছানাপত্র কিছু পাতা নেই। সে একদিক দিয়ে ভালই হয়েছে, অন্যের ব্যবহার করা বিছানায় বা চাদরে আমার শুতে ভারি অস্বস্তি হয়। রঘু বলল—বারান্দায় কাঠের জালের উনুন আছে ঠাকুরমশাই, আর ওইদিকের কোণের ঘরে চ্যালা করা শুকনো জ্বালানি কাঠ আছে যত দরকার হয় নিয়ে নেবেন—
সিধে এসে গেল। রান্না করতে করতে এই প্রথম উপলব্ধি করলাম যে, বিপদ প্রায় আমার ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে। বড় মাপের বিপদ।
বললাম—কী করে বুঝলেন? কোনও অনুভূতি হল?
তারানাথ বলল—আমার লন্ঠনের আলো ম্লান হয়ে কমে আসতে লাগল। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো বা তেল ভরে দিতে ভুলে গিয়েছে। কিন্তু লণ্ঠন হাতে তুলে নাড়িয়ে দেখলাম – ভেতরে কলকল করে তেল নড়বার শব্দ হচ্ছে। বনেদি জমিদারবাড়ির কেতাদুরস্ত কর্মচারী, এমন ভুল করবে না। তাহলে?
একটা কেমন ভেজা-ভেজা, সোঁদা গন্ধ আসছে নাকে। চামচিকের নাদি-ভর্তি ঘর বহুদিন বন্ধ থাকার পর খুললে যেমন গন্ধ পাওয়া যায়। ভাল নয়, একেবারেই ভাল নয়। মনে মনে অপদেবতা তাড়াবার মন্ত্র পাঠ করতে লাগলাম—ওঁ বেতালাশ্চ পিশাচাশ্চ রাক্ষসাশ্চ সরীসৃপাঃ, অপসর্পত্ত তে সর্বে গৃহাদস্মাচ্ছিবাজ্ঞয়া।
আস্তে আস্তে আলো আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল, গন্ধটাও চলে গেল।
খাওয়া-দাওয়া করে অতিথিশালার বারান্দায় বসে একটা বিড়ি খেলাম। গ্রামাঞ্চলে সাড়ে-আটটা নটার মধ্যেই নিশুতি রাত হয়ে পড়ে। কোথাও মানুষজনের কোনও সাড়া নেই, কেবল দূরে কতগুলো কুকুর ডাকছে। পথ হেঁটে আমিও ক্লান্ত। কিন্তু ঘুমোলে তো চলবে না। এখন দেহবন্ধন করে আসনে বসে মনোদর্পণে দেখতে হবে কে আমার ক্ষতি করতে চায়—এবং কেন?
চন্দ্রদর্শন আমার এমন আয়ত্তে এসে গিয়েছিল যে, চোখের সামনে পূর্ণচন্দ্র আর দুই পরীদের আনতে দশ মিনিটও লাগল না। মন্ত্র উচ্চারণ করে প্রশ্ন করতেই সামনে পরী, চাঁদ সব মুছে গিয়ে সাদা দেয়ালের মত শূন্যতা ফুটে উঠল। চৌকো সেই পদ থেকে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে একটা ভয়াবহ হিংস্র মুখ। মাঝখানে সিঁথি করা লম্বা কোঁকড়ানো চুল, কপালে তেল-সিঁদুরের ত্রিপুণ্ডক, গলায় রুদ্রাক্ষ আর হাড়ের মালা। খুব নিম্নমার্গের সাধক—মুখে সাধনার জ্যোতি নেই, রয়েছে ক্রোধ আর নিবিড় হিংসা। এদের উপকার করার ক্ষমতা নেই, কিন্তু অপকার করার ক্ষমতা অসীম।
লোকটাকে খুব চেনা-চেনা মনে হচ্ছে। কোথায় দেখেছি একে?
হঠাৎ মনে পড়ে গেল! পাঁচ-সাত বছর আগে সেই চড়ুইটিপ গ্রাম! আমার বাল্যবন্ধু বিরাজমোহনের সর্বনাশ করবার জন্য একজন কাপালিক শ্বেতবগলার পূজোর আয়োজন করেছিল। কাকের বাসার কাঠি দিয়ে, ঘোড়ার চর্বি দিয়ে যজ্ঞ করার নিয়ম। বিরাজের নাম লেখা একটা নিমপাতা যজ্ঞের আগুনে আহুতি দিলেই একমাসের ভেতর উদ্দিষ্টের মৃত্যু। আমার হস্তক্ষেপে ব্যাপারটা বানচাল হয়ে যায়। বিরাজের নিজের দাদাই সম্পত্তির লোভে ভাইয়ের প্রাণহানির জন্য কাপালিককে নিয়োগ করেছিল। পরে ব্যাপারটা খুব ভালভাবে মিটে যায়, দুই ভাইয়ে আবার মিলন হয়ে যায়। কিন্তু ব্যর্থ-মনস্কাম কাপালিক চলে যাবার সময় আমাকে বলে গিয়েছিল—কাজটা ভাল করলে না। একজন সাধক কখনও অন্য সাধকের ক্রিয়ায় বাধা দেয় না। তা নিয়ম নয়। আজ হোক, দশ বছর পরে হোক, এর প্রতিফল তোমাকে পেতেই হবে। তৈরি থেকো—
আমি বলেছিলাম--আপনার সাধনা বা কৌলিক ক্রিয়াকর্মে বাধাদান করার কোনও ইচ্ছে আমার ছিল না। কিন্তু আপনি তো সজ্ঞানে একজন নিরীহ মানুষের সর্বনাশ করার জন্য অভিচার ক্রিয়ার আয়োজন করেছিলেন। এরকম প্রচেষ্টার কথা জানতে পারলে সর্বশক্তি দিয়ে তা নিবারণের ব্যবস্থা করতে বলেছেন আমার গুরু।
চোখে আগুন ফুটিয়ে সে বলল—বেশ, আমাকে মনে রেখো।
মনে রাখিনি, ভুলে গিয়েছিলাম। আজ মনোদর্পণে এতদিন পরে তাকে আবার দেখে চিনতে পারলাম।
একটু পরেই কাপালিকের চেহারা মিলিয়ে গেল সামনে থেকে। যাক, কী ব্যাপার জানতে পেরেছি। আগামী পরশু কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী, ওই দিন একটু আসনে বসে পূজা করব। কাপালিক বুঝতে পারবে কার সঙ্গে সে লাগতে এসেছে।
কিশোরী বলল—কেন, কী ক্রিয়া করবেন আপনি?
—বীজমন্ত্র ছাড়া প্রকরণ বলছি, শুনে রাখো। কালো ছাগল, ঘোড়ার খুড়ের কাছের লোম, কালো মুরগি আর কাকের চারটে করে পালক আগুনে পুড়িয়ে, তিসির তেলে গুলে বাঁহাতের কড়ে আঙুল দিয়ে কপালে তিলক লাগিয়ে পূজার আসনে বসলে যে আমার ক্ষতি করতে চাইছে তার সব কাজ ব্যর্থ হবে। লোকটা মারা পড়বে না ঠিকই, কিন্তু দেহে ও মনে বিরাট ধাক্কা খাবে।
—বীজমন্ত্রটি কী?
তারানাথ কিশোরীর দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। তারপর বলল—গল্প শোনো, গল্প শোনো—
ঘরে এসে তক্তাপোষে শুলাম। মেঝেতে লণ্ঠনটা কমিয়ে রাখা আছে। নরম, মৃদু আলোয় আবছা আবছা সবকিছু দেখতে পাচ্ছি। পথ হেঁটে ক্লান্ত ছিলাম, একটু বাদেই ঘুম এসে গেল।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম জানি না, হঠাৎ চটকা ভেঙে তাকিয়ে দেখি ঘরের ভেতরে নিকষ অন্ধকার। এটা কেমন হল? লষ্ঠনে যথেষ্ট তেল আছে, সে তো আমি নিজেই দেখে নিয়েছি। যাক, নেমে জ্বালিয়ে নিচ্ছি।
কিন্তু ঘরের মধ্যে এমন দমবন্ধ করা ভ্যাপসা ভাব কেন? সবকটা জানালা কে বন্ধ করে দিল? জানালা তো খোলাই ছিল! এই ধরনের উপদ্রব দূর করার সহজ উপায় আর মন্ত্রগুলো অকস্মাৎ কিছুই মনে আসছে না। আলো জ্বালিলে মনের জোর ফিরে পাব—আন্দাজে আন্দাজে মেঝেতে নেমে লণ্ঠন আর দেশলাই খুঁজতে গেলাম, কোথাও খুঁজে পেলাম না। তক্তাপোষ থেকে হাত তিন-চার দূরে দরজার পাশে লণ্ঠনটা ছিল। দরজাটাই বা কোথায়? দেয়ালে হাত দিয়ে সমস্ত ঘরটা একবার পাক দিলাম। জানালা বা দরজা কিছুই হাতে ঠেকলো না!
এ আবার কী! আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে! এই অন্ধকূপে কীভাবে বন্দী হলাম আমি? এই কি তাহলে শেষ?
মনে পড়ল বাবার কথা। বাবা বলতেন—দেখ, চকোত্তি বামুনের ছেলে। যেখানে যাও, যা করো, পৈতেটা শরীরে রেখো। ভয় পেলে বা বিপদে পড়লে পৈতে আঙুলে জড়িয়ে গায়ত্ৰী জপ করতে আরম্ভ করবে। অন্ততঃ প্রাণটা রক্ষা পাবে।
অভ্যাসবশত পৈতে খুঁজতে আরম্ভ করে মনে পড়ল—পৈতে তো সেই কবেই বিরজা হোমের কুণ্ডে বিসর্জন দিয়েছি। হায়! এখন কী হবে?
অন্ধকারের ভেতরেই ঘরের ছাদের কাছ থেকে কী যেন একটা নরম, হালকা জিনিস আমার মাথায় পড়ে মেঝের দিকে গড়িয়ে গেল।
প্রথমে চমকে উঠেছিলাম। তারপর মনে হল টিকটিকি বা ওইরকম কিছু হবে। পা দিয়ে সরিয়ে দিতে গিয়ে পায়ে ঠেকলো দেশলাইটা। ভাল মজা! এতক্ষণ কিছুতেই পেলাম না, এখন আপনা-আপনি ফিরে এল। দেশলাই জ্বালতেই দেখলাম ঘরের জানালা-দরজা সব যথাস্থানে আছে। আর—
আর পায়ের কাছে মেঝেতে পড়ে রয়েছে একটি সদ্য তৈরি গ্রন্থি দেওয়া পৈতে!
হয়ত গুরু পাঠিয়েছেন আমার বিপদ দেখে। অথবা বাবার আত্মা বুঝতে পেরেছে সস্তানের প্রাণসংশয়, তাই—
যাই হোক, তৎক্ষণাৎ পৈতেটা ধারণ করে গায়ত্ৰী জপ করতে শুরু করলাম। অবাক হয়ে দেখলাম জানালা দুটোই খোলা ছিল, এখন তা দিয়ে স্নিগ্ধ, শীতল বাতাস আসছে। ঘরের ভ্যাপসা আর দমবন্ধ ভাবটা আর নেই।
জানি না কৌলিক প্রথায় আঘাত করেছি কিনা, কিন্তু সেই থেকে পৈতেটা আর ছাড়িনি। বরাবর ধারণ করে আছি।
॥ ছয় ॥
পরের দিন সকালে অতিথিশালার পরিচারক রঘু এসে ছোট বেতের ধামায় করে চিঁড়ে আর নারকেল জলখাবার দিয়ে গেল। বাঃ, বেশ নিয়ম তো এদের। অতিথির স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য সর্বদাই ব্যস্ত। বনেদিয়ানা একেই বলে।
জলখাবার খাচ্ছি, এমনসময় রঘু আবার এসে বলল—ঠাকুরমশাই, আপনি কি আজও নিরামিষ খাবেন? কাল রাত্তিরে হঠাৎ কোনও ব্যবস্থা করে ওঠা যায়নি, যদি আমিষ আহারে আপত্তি না থাকে তাহলে তার ব্যবস্থা দেখি—
হেসে বললাম—আপত্তি আর কী, আমি কি বোষ্টম যে মাছ-মাংস খাব না? কিন্তু ওসব করার দরকার নেই, আমি আজ চলে যাব—
অবাক হয়ে রঘু বলল—চলে যাবেন! কেন?
—যেতে তো হবে, তাই না? অতিথি কি চিরদিন থাকে?
মাথা চুলকে রঘু বলল—সে তো ঠিকই, ঠাকুরমশাই। তবে এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। আপনি জল খান, আমি নায়েবমশাইকে খবর দিচ্ছি—
একটু বাদেই নায়েবমশাই এসে হাজির হলেন। গোলগাল চেহারার মধ্যমাকৃতি মানুষটি। ভারি সজ্জন। হেসে বললেন—ঠাকুরমশাই নাকি আজ চলে যাওয়া স্থির করেছেন? কিন্তু তা তো হবার নয়—
বললাম—সে কী! আমি অতিথি, না বন্দী?
জিভ কেটে নায়েবমশাই বললেন—না না, অমন বলবেন না। বন্দী হতে যাবেন কেন? আসলে আপনি অতিথি হয়ে আছেন শুনে বড়কর্তা আপনার সঙ্গে একটু আলাপ করতে চেয়েছেন। কাল তো দেখা হয়নি—
–এ বাড়ির বড়কর্তা? জমিদারমশাই?
—আজ্ঞে হ্যাঁ। খুব ভাল লোক। থেকেই যান আজকের দিনটা—
থেকে গেলাম। এক এক জায়গায় অতিথি হয়ে থাকতে মন্দ লাগে না। মুখুজ্যেদের বাড়িও তাই। বেশ শাস্ত আর স্নিগ্ধ পরিবেশ, ভাঙা কার্নিশে পাখি উড়ে এসে বসছে, বাড়ির ভেতর থেকে উঁচু গলায় কথা বলার কোনও আওয়াজ আসছে না। সবচেয়ে বড় কথা, কর্মচারীরা প্রত্যেকে ভদ্র, কেতাদুরস্ত এবং মিষ্টভাষী। ভূত্যকে দেখে প্রভুকে চিনতে পারা যায়।
কিছুক্ষণ বাদে রঘু এসে বলল—চলুন ঠাকুরমশাই, বড়কর্তা এসে কাছারির বারান্দায় বসেছেন।
তার সঙ্গে গিয়ে চার-পাঁচ ধাপ টানা লম্বা সিড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠতেই বাড়ির কর্তাকে দেখতে পেলাম। দীর্ঘদেহী, ফর্সা মানুষ। উজ্জ্বল বড় বড় চোখ। কোঁকড়ানো চুলে মাঝখানে সিঁথি করা। পরনে তাঁতের ধুতি আর হাতকাটা বেনিয়ান। বয়েস বছর পঞ্চাশ কী বাহান্ন হবে। যাকে বলে সুপুরুষ। বারবার তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। হেলান দেওয়া চেয়ারে আধশোয়া হয়ে আলবোলায় তামাক খাচ্ছিলেন, আমাকে দেখে সোজা হয়ে বসে হাতজোড় করে বললেন—নমস্কার, বসুন। কাল একটু অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলাম, আলাপ করা হয়ে ওঠেনি, তাই নায়েবমশাইকে বললাম—যান, নিয়ে আসুন ওঁকে, একটু গল্প করা যাক। আজ থাকছেন তো?
হেসে বললাম—রাজার হুকুম, মানতেই হবে।
জমিদারবাবুর নাম দেবদর্শন মুখোপাধ্যায়। নামটা কিছু আগে নায়েবমশাইয়ের জেনেছি। তিনি বললেন—তামাক চলে?
—তা চলে।
—ওরে, কে আছিস। ঠাকুরমশাইকে তামাক দিয়ে যা। চলতি তামাক দিবি না, আমার থেকে দে–
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন – একনম্বর গয়ার আম্বুরি, খেয়ে দেখুন দিকি কেমন লাগে—
যে তামাক এতক্ষণ উনি খাচ্ছিলেন সেটাই যদি একনম্বর গয়ার অম্বুরি হয়, তাহলে জিনিসটা নিঃসন্দেহে ভাল। গন্ধে চারদিক আমোদিত করেছে।
চাকর তামাক দিয়ে গেল। মৌজ করে টানতে শুরু করলাম।
দেবদর্শনবাবু বললেন–রাজার হুকুম শুনলে আজ হাসি পায় বটে, কিন্তু এককালে লোকে আমাদের রাজাই বলত। ভেঙে পড়ছে বটে, তবু বাড়িটা দেখলে হয়ত সেটা কিছুটা আন্দাজ করতে পারবেন। ঠাকুরদার আমল থেকে পতনের শুরু, আর আজ এই যা দেখছেন।
এসব কথার কোনও উত্তর হয় না। চুপ করে তামাক খেতে লাগলাম।
একটু পরে দেবদর্শনবাবু বললেন—প্রায় দেড়শো বছর আগে আমার পঞ্চম উর্ধ্বতন পূর্বপুরুষ জয়দর্শন মুখোপাধ্যায় এই গ্রামের প্রতিষ্ঠা করেন। তার নামেই গ্রামের নাম। সে সময়ে আমাদের প্রতিপত্তি ভাবতেও পারবেন না ঠাকুরমশাই। জয়দর্শনের পিতা নবাবী আমলে উড়িষ্যায় কী একটা গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে দেওয়ানী করে বিপুল ঐশ্বর্য সংগ্রহ করেছিলেন। নবাবের কাজ থেকে অবসর নিয়ে তিনি এই গ্রাম এবং কাছাকাছি অনেক ভূসম্পত্তি কেনেন। অনেক অর্থসম্পদ উপার্জন করলেও নবাব সরকারে চাকরি করার ভূসম্পত্তির অধিকারী না হলে সমাজে স্থায়ী মান্যতা লাভ করা যায় না। কিন্তু সম্পত্তি কিনে লোকবসতি গড়ে তোলবার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়। সে কাজ দক্ষতার সঙ্গে শেষ করেন জয়দর্শন। সবাই বলত—রাজা জয়দর্শন। প্রজারা তাঁকে ভয়ও যেমন করত, তেমনি ভালও বাসত। শুনেছি তাঁর আমলে জয়তলা এবং আশেপাশে কখনও ডাকাতি হয়নি। হলে ডাকাতদের রেহাই ছিল না। ধুমধাম করে মুখুজ্যেবাড়ির দুর্গোৎসব হত। বোধনের দিন থেকে বিজয়ার রাত্তির পর্যন্ত গ্রামের কারও বাড়িতে উনুনে আঁচ পড়ত না। জমিদারবাড়িতে সবার নেমন্তন্ন।
এই পৰ্যন্ত বলে মুখুজ্যেমশাই থামলেন। কী একটা মনে পড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে বললেন—ভাল কথা, আপনার পাঁঠার মাংস চলে তো?
বললাম—খুব চলে। কালই নায়েবমশাইকে বলেছি—আমি মাছ-মাংস সবই খাই। আজ সকালেও রঘু জিজ্ঞেস করছিল—
—সাহস করে একটা কথা বলব? কিছু মনে করবেন না তো?
অবাক হয়ে বললাম—ও কী কথা! নিশ্চয় বলবেন—
দেবদর্শনবাবু বললেন—আপনি কি স্বপাক ছাড়া আহার করেন না?
—করি বইকি, কেন করব না? আমার ওসব বাতিক নেই—
—তবে কাল নিজে কষ্ট করে রান্না করতে গেলেন কেন? অবশ্য সে আমাদেরই দোষ, অতিথিশালার সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী আপনাকে সিধে দেওয়া হয়েছে। আপনি নিজে তো আর বলবেন না—আমিও কাল ব্যস্ত থাকায় আর—রঘু! এই রঘু!
রঘু এসে দাঁড়াতে মুখুজ্যেমশাই বললেন—শোনো, ঠাকুরমশাইকে আজ থেকে আর সিধে পাঠাবে না, উনি আমার সঙ্গে বাড়ির ভেতরে খাবেন। যাও, বাড়ির ভেতরে বলে এসো—আর হ্যাঁ, তামাক বদলে দাও।
একটু পরে রঘু এসে নতুন সাজা কলকে বসিয়ে দিয়ে গেল। বার দুই আরামের টান দিয়ে দেবদর্শন বললেন—সূক্ষ্ম বিষয়বুদ্ধি না থাকলে কোনও ঐশ্বর্যই চিরস্থায়ী হয় না। জয়দর্শন এবং তার পিতা শ্রম এবং বুদ্ধি দিয়ে যা গড়ে তুলেছিলেন, পরের দু-তিন পুরুষে তা সবই প্রায় গেল। সবচেয়ে বড় কারণ—একতার অভাব। সংসার বড় হতে লাগল, লাগাম কার হাতে থাকবে তা নিয়ে বিরোধ শুরু হল। ফলে অনিবার্যভাবে এতদিনের ঐতিহ্যপূর্ণ পরিবার টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যেতে লাগল। বর্তমানে এই গ্রাম ছাড়াও কত জায়গায় জয়তলার মুখুজ্যেরা ছড়িয়ে আছে। সন্তুষ্ট কেউই নয়, সকলেরই ধারণা সে তার ন্যায্য প্রাপ্যের চেয়ে কম পেয়েছে। আমি ঝগড়াঝাঁটি করিনি, কিন্তু বাপ-পিতামহের এই ভদ্রাসন দৃঢ়ভাবে ধরে রেখেছি। টাকা না পাই, স্মৃতি থাক।
চিরদিনই আমার গল্প শুনতে ভাল লাগে। আর ভাল লাগে এইরকম পড়ন্ত বনেদি বাড়ির পরিবেশ। এসব বাড়ির প্রতিটি ইঁটে, কার্নিশে বটগাছের চারায়, বারান্দার বাঁকে বাঁকে পুরনো দিনের গল্প মিশে আছে। কাদের যেন সব ফিসফাস কানাকানি, হঠাৎ আধো অন্ধকারে কে যেন কোথায় হেসে উঠল, মিলিয়ে আসা ধূপের গন্ধ পাক খায় আনাচে কানাচে।
দেবদর্শন আবার বলতে শুরু করলেন—আমাদের পরিবার শেষ বড় ধাক্কা খেল আমার বাবার আমলে। ঠাকুর্দাকে বাবা দেবতার মত শ্রদ্ধা করতেন। ঠাকুর্দার মৃত্যুর পর বাবা স্থির করলেন একটা অসাধারণ শ্রাদ্ধের আয়োজন করে সবাইকে দেখাবেন নিজের বাবাকে তিনি কতখানি ভালবাসতেন। খুবই ছেলেমানুষি সন্দেহ নেই, কিন্তু বাবা এটা করলেন সত্যি সত্যি ঠাকুর্দাকে ভালবেসে। তখনকার যুগে বড় বড় ধনী পরিবারে অন্নপ্রাশন বিয়ে শ্রাদ্ধ বা দুর্গোৎসব নিয়ে ভয়ানক রেষারেষি ছিল—কে কতটা জাঁকজমক বা খরচ করল সে ব্যাপারে প্রতিযোগিতা। বাবা কিন্তু এসব সামাজিক দলাদলি আর লোকদেখানো ভড়ং একদম পছন্দ করতেন না। আসলে তিনি এইভাবে ঠাকুর্দার স্বৰ্গস্থ আত্মাকে দেখাতে চাইলেন তাঁর শ্রদ্ধা কতটা বিস্তৃত আর গভীর ছিল। আপনি পণ্ডিত মানুষ, কতরকম শ্রাদ্ধ হয় নিশ্চয় জানেন। সবচেয়ে অনাড়ম্বর হল তিলকাঞ্চন শ্রাদ্ধ, তারপর ষোড়শোপচার, তারপর বৃষোৎসর্গ, তারপর দানসাগর। দানসাগরে গিয়েই সবাই থেমে যায়—মানে, ওইপর্যন্ত যারা পৌঁছতে পারে। কিন্তু এর চেয়েও বড়মাপের শ্রাদ্ধ আছে, তা হল—
বললাম—দ্বিজদম্পতি শ্ৰাদ্ধ।
দেবদর্শন একটু যেন অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন, তারপর বললেন—আপনি জানেন? অবশ্য আপনি তো জানবেনই। দ্বিজদম্পতি শ্রাদ্ধে তিলকাঞ্চন থেকে দানসাগর পর্যন্ত সবই করতে হয়। তারপর আমন্ত্রণ করে আনা এক ব্রাহ্মণ যুবক আর এক কুমারী ব্রাহ্মণ মেয়ের বিয়ে দেওয়া হয়, ওই মণ্ডপেই। তাদের ভূমিদান করতে হয়, মেয়ের গয়না, ছেলের যাবতীয় দাবির জিনিস দিতে হয়। তাদের ঘরবসত করিয়ে ভবিষ্যতের সমস্ত সংস্থান করে দিতে হয়। বুঝতে পারছেন কাণ্ডখানা? সমস্ত ক্রিয়ায় যা ব্যয় হয়, একজন ধনবান মানুষ সারাজীবনে তা উপার্জন করতে পারে না। আমার তখন খুব ছোটবেলা, বছর পাঁচেক বয়েস হবে। আবছা আবছা মনে করতে পারি দূর দূর গ্রাম থেকে নিমন্ত্রণ পেয়ে আসা ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের হাতে দানের জিনিস হিসেবে বাসনপত্র, শালদোশালা আর স্বর্ণ-রৌপ্যখণ্ড তুলে দেওয়া হচ্ছে। দ্বিজদম্পতি হাসিমুখে বসে আছেন আসরে, উপস্থিত লোকজন তাদের সাক্ষাৎ বিষ্ণু আর লক্ষ্মীজ্ঞানে প্রণাম করছে। এই গ্রামেই তাদের বসত করানো হয়েছিল। তাদের দুজনের কেউই আজ আর জীবিত নেই। তবে তাদের সন্তানেরা আছে। দক্ষিণা হিসেবে পাওয়া সেই ভূসম্পত্তির উপস্বত্ব থেকে তাদের ভালভাবেই চলে যায়। আমাকে তারা দাদা বলে ডাকে।
বললাম—আপনি ভাগ্যবান। এ জিনিস নিজের চোখে দেখেছেন।
—ঠিকই। শ্রাদ্ধ শেষ করে ভাটপাড়া থেকে আসা পুরোহিত বাবাকে বলেছিলেন–রামরূপ মিশ্রের ক্রিয়াকাণ্ডবারিধি বলে যে বিখ্যাত বই, তাতে দ্বিজদম্পতি শ্রাদ্ধের উল্লেখ পেয়েছিলাম। পরে বাবার কাছে কাজটা শিখেছি। কিন্তু সে তো পুঁথিগত বিদ্যা। দেখলাম আর নিজের হাতে করলাম আজ প্রথম। বাংলাদেশে এ জিনিস আর কোথাও হয়েছে বলে শুনিনি।
থেমে গিয়ে দেবদর্শন আবার জোরে ডাকলেন–রঘু! এই রঘু!
রঘু তার প্রভুর কখন কী প্রয়োজন সব বুঝতে পারে এবং সেজন্য আগে থেকে প্রস্তুত থাকে। ডাক শোনামাত্র সে এসে কলকে বদলে দিয়ে গেল।
এবার তারানাথ আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল—তোমরা ভাবছ, আবার কী করে পৈতে ধারণ শুরু করলাম, সে গল্প বলতে গিয়ে কোথা থেকে কোথায় চলে যাচ্ছি। তা নয়, জীবনের সব কাহিনীই একটার সঙ্গে আর একটা জোড়া—কোনও একটা বলতে শুরু করলে অন্যগুলোয় টান পড়ে। তাছাড়া বকবক করা বয়েস বাড়বার একটা লক্ষণ। আর বকব, না থামব?
সর্বনাশ! তারানাথ বলে কী! এই বকুনির লোভেই তো তার কাছে আসা। বললাম— বলতে থাকুন, বলতে থাকুন—তেমন হলে সারারাত বসে শুনব—
তারানাথ পরিতৃপ্ত মুখে নতুন পাসিং শো ধরাল। যে গল্প বলতে ভালবাসে এবং ভাল গল্প বলে, সে আগ্রহী শ্রোতা পেলে যেমন খুশি হয় তেমন আর কিছুতে নয়। সিগারেটে একটা গভীর টান দিয়ে সে আবার শুরু করল—পৈতে কী করে আবার ধারণ করলাম সে গল্প হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মুখুজ্যেবাড়ি থেকে চলে আসার আগে একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল, সেটুকু বলে নিই। তোমরা ভাব তারানাথ গল্প বললেই বোধহয় কেবল কষ্ট, দুঃখ আর ভয়ের গল্প বলে। কিন্তু সেটা সত্যি নয়। আমি জীবনের গল্প বলি, জীবন যেমন বিচিত্র উপলব্ধির মালা দিয়ে গাঁথা, আমার গল্পও তাই। কখনও মেঘ, কখনও রোদুর।
গোটা দু-চার টান দিয়ে কলকে ঠিকমত চালু করে দেবদর্শনবাবু আবার বলতে শুরু করলেন—মোটামুটি এই আমাদের পরিবারের গল্প ঠাকুরমশাই। সাধারণ গল্প, বড় পরিবারের পতনের কাহিনী আপনি নিশ্চয় আগেও শুনেছেন। আমারও বিশেষ কোনও দুঃখ নেই, কারণ আমি লোভী মানুষ না। সামান্য যেটুকু আছে তাতে সম্মান বাঁচিয়ে হয়ত বাস করা যায়, কিন্তু তার বেশি কিছু না। অথচ আমার ইচ্ছে ছিল এই বাড়িটা একটু মেরামত করার। সে তো খুব কম পয়সায় হবার নয়, বুঝতেই পারছেন। এই হাতির মত বাড়ি। আমি চোখ বুজলে হয়ত পরিবারের কে কোথায় ছিটকে যাবে, যারা থাকবে তাদের পক্ষেও এতবড় বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব হবে না। তবু এ আমার ভদ্রাসন, শৈশবের স্মৃতি দিয়ে জড়ানো বাড়ি। আমি থাকতে এ বাড়ি ভেঙে পড়ে যাবে?
মানুষটার দুঃখ আমি বুঝতে পারছিলাম। জগতে সবচেয়ে কঠিন কাজ হল পারিবারিক ঐতিহ্য আর পুরনো স্মৃতিকে ত্যাগ করা। বাস্তব দুনিয়ার নির্মম পেষণে সেটাও যখন স্বীকার করতে হয়, তখন সহৃদয়, সজ্জন মানুষের মুখের চেহারা বোধহয় দেবদর্শন মুখুজ্যের মত করুণ-বিধুর হয়ে আসে।
মুখুজ্জেমশাই বললেন—আপনাকে কেন থেকে যেতে বললাম জানেন? আমার ধারণা আপনার কৃপায় বোধহয় আমার সমস্যা কিছুটা লাঘব হবে।
অবাক হয়ে বললাম—আমি? আমি কী ভাবে—
দেবদর্শন বললেন—আজ থেকে মাসখানেক আগে একজন পাগলামত ভবঘুরে অতিথি দিনদুয়েক অতিথিশালায় এসে ছিল। পাগলামত বলছি বটে, কিন্তু তার চেহারার ভেতর কী যেন একটা ছিল, যাতে তাকে পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ভালো বংশের সন্তানের মত হাবভাব, উজ্জ্বল চোখ। দোষের মধ্যে ঐ একটু মাঝেমাঝে অসংলগ্ন কথা বলা। সে বলেছিল আমাদের অতিথিশালায় কিছুদিনের মধ্যেই এমন একজন লোক আসবে যার মাধ্যমে আমাদের পরিবারের বর্তমান আর্থিক সমস্যা অনেকটা লাঘব হয়ে যাবে। আপনি সাধক মানুষ, ভাবলাম আপনিই যদি সেই লোক হন?
আমার মনের মধ্যে তখন একটা মৃদু ঘণ্টার শব্দ বেজে উঠেছে। নৈঋত কোণে ঝড়ের মেঘের মত দ্রুত সেটা বিরাট অবয়ব নিতে লাগল। বললাম—অসংলগ্ন কথা বলত কী রকম? অসঙ্গত কিছু?
—না না, আদৌ তেমন নয়। আলোচনা করতে করতে হঠাৎ হয়ত এমন একটা কথা বলল যার কোনও মানেই হয় না। একটা ছড়া তো খুব বলত—
বললাম—কী ছড়া?
—সে থাক, সে শুনলে আপনি হাসবেন। পাগলের কাণ্ড—
—বলুন মুখুজ্যেমশাই, এর ওপরেই হয়ত আপনাদের পরিবারের ভাগ্য-পরিবর্তন নির্ভর করছে।
দেবদর্শন চমকে আমার দিকে তাকালেন, বললেন—আপনি তাই মনে করেন?
—হতে পারে। বলুন আপনি—
দেবদর্শন বললেন—প্রথম যেদিন শুনি, সেদিন জিনিসটার কোনও গুরুত্ব দিইনি। সকালবেলা কাছারিতে বসে হিসেবপত্র দেখছি, এমনসময় লোকটি হঠাৎ এসে ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল – দিকে দিকে সাগরেতে ভাই / চোখে চোখে চাঁদ খুঁজে পাই।
আমি অবাক, নায়েবমশাই অবাক, গোমস্তা-মুহুরীরা অবাক! বলে কী লোকটা? পাগল নিশ্চয়, কিন্তু পাগলে কি গুছিয়ে ছড়া বলে?
যাই হোক, এরপর সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল—এই অতিথিশালায়, এই বাড়িতে একজন আসবে শিগগিরই। সাধক মানুষ। তাকে এই ছড়া শুনিও। সে তোমার উপকার করবে—
এই ঘটনার পর আর একটা দিন সে আমাদের বাড়ি ছিল। ওই একটা দিন সে প্রায়ই ঘুরে ঘুরে আমার কাছে আসত আর বলত—মুখস্থ করে নাও, মুখস্থ করে নাও। খুব কাজে দেবে—
দেবদর্শন থামলেন। বললাম—এ লোকটির নাম কী? নাম বলেছিল?
মুখুজ্যেমশাই বললেন—বলেছিল। ব্রাহ্মণসন্তান। নাম অমরজীবন ভট্টাচার্য।
যতটা চমকানো উচিত ছিল ততটা চমকালাম না। আমি একরকম বুঝতেই পেরেছিলাম উনি এই নাম বলবেন।
কাছারিবাড়ির কার্নিশে বাসাবাঁধা পায়রার দল গলার মধ্যে কুমকুম শব্দ করছে। সুন্দর বেলাটা চড়েছে বাইরে। এ বাড়ির এখন কোনও বিপদ নেই সামনে, বরং এদের মঙ্গল হবে। শান্ত, পবিত্র পরিবেশে সেই আসন্ন মঙ্গলের প্রতিশ্রুতি। স্থানলক্ষণ বোঝবার শক্তি দিয়েছিলেন মধুসুন্দরী দেবী। তা এখনও নষ্ট হয়নি।
দেবদর্শন বললেন—ছড়াটার মানে কিছু বুঝলেন ঠাকুরমশাই?
বললাম—নাঃ, এখনও তো কিছু ধরতে পারছি না। দেখি আর একটু চিন্তা করে। তাছাড়া আমিই যে সেই লোক, যে আপনার বর্তমান অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় বলে দেবে, তাই বা জানছেন কী করে?
—না, তা ঠিক নয়, মানে—
—আমি সে লোক না হলে আরও দিন-দুই থাকতে পাবো তো?
দেবদর্শন বিস্মিত মুখে বললেন—ওমা, সে কী কথা! নিশ্চয় থাকবেন। অতিথি নারায়ণ, কত সৌভাগ্য থাকলে তবে বাড়িতে অতিথি আসে—
মানুষটি স্বচ্ছ, বুকের ভেতরটা পর্যন্ত দেখা যায়।
জিজ্ঞাসা করলাম—আচ্ছা, এই লোকটি, মানে অমরজীবন—এর বয়েস কত বলে মনে হয়েছিল আপনার? খুব বুড়োমানুষ কি?
—না, একেবারেই নয়। কত আর হবে? এই—পঁয়ত্রিশ কী ছত্রিশ—
একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশই বটে।
পরের দিন সকালে মুখুজ্যেমশাইয়ের সঙ্গে বৈঠকখানায় বসে গল্প করছি, এমন সময় একজন প্রৌঢ় মানুষ ঘরে ঢুকে জীর্ণ ছাতাখানা দরজার কোণে ঠেসিয়ে রেখে বললেন—নমস্কার রাজাবাবু। এ বছর তো আমার খেলা সামনের মাসে। আজ একখানা টিকিট দিয়ে যাই? সোমবার বিলেতের মেলে কাগজপত্র সব পাঠিয়ে দেব। এদিকে তো আর আসা হবে না। আজই দিয়ে যাই?
দেবদর্শন আমার দিকে তাকিয়ে বললেন—বিলেতের ডার্বির টিকিট। পাবো কত সে আমিও জানি, আর এই ভূষণ রায়ও জানে। তবে বছরে একখানা কিনি, অভ্যেস আর কী। দাও হে, একখানাই দাও—
গোছা থেকে একটা টিকিট বের করে ধরেছেন দেবদর্শন।
আমি ঝুঁকে পড়ে বললাম—একটু দাঁড়ান। দেখি, না—ওটা নয়, আপনি এটা নিন।
গোছা থেকে অন্য একটা টিকিট বেছে দিলাম।
দেবদর্শন যেন কেমন অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
॥ সাত ॥
আমি হেসে বললাম—বেশি ভাববার কিছু নেই। নিলে এটাই নিন—
ভূষণ রায় স্পষ্টই কিঞ্চিৎ ইতঃস্তত করছেন, একবার আমার দিকে আর একবার মুখুজ্যেমশাইয়ের দিকে তাকাচ্ছেন। পুরনো আমলের জমিদার খদ্দের, আমার কথায় তো কেবল হবে না।
দেবদর্শন দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে বললেন–ঠিক আছে, ঠাকুরমশাই যেখানা বলছেন সেখানাই দাও। নিজের পছন্দে তো অনেক দেখলাম, এবার ঠাকুরমশাইয়ের পছন্দের ফলটা দেখি—
ভূষণ রায় বললেন—তাহলে তাই দিই রাজাবাবু?
—দাও।
গোছা থেকে টিকিটখানা ছিঁড়ে দেবদর্শনকে দিলেন ভূষণ রায়। কী একটা ফর্মে নাম ঠিকানা আর নোম-ডি-প্লাম লিখে নিলেন। যে টিকিট কিনছে সে তার পছন্দ আর ইচ্ছেমত একটা সাঙ্কেতিক শব্দ ঠিক করে, সেটাকে বলে নোম-ডি-প্লাম। এর ফলে কে পুরস্কারের প্রাপক তা নিয়ে কোনও সংশয় থাকে না। একই নামে একাধিক লোক থাকতে পারে, কিন্তু গোপনে নির্বাচন করা সাঙ্কেতিক শব্দ কখনও এক হবে না।
ভূষণ রায় বললেন—নোম-ডি-প্লাম কী লিখব?
দেবদর্শন বললেন—ওটা লেখো—ইয়ে, গতবার যেন কী ছিল? মা কালী, না? এবার বরং লেখো—
আমি বললাম-—অমরজীবন।
দেবদর্শন শুধু জন্মসূত্রে বনেদি এমন নয়, তাঁর অত্বরিত, সংযত আচরণের মধ্যে দিয়ে একটা সহজ আভিজাত্য প্রকাশ পায়। আমার কথা শুনে তিনি অবাক হলেন ঠিকই, কিন্তু বাইরে তা কিছুই দেখালেন না। বললেন—ঠিক আছে, লেখো অমরজীবন—
ভূষণ রায় সবকিছু লিখে নিয়ে ফৰ্মখানা কাগজের দপ্তরের মধ্যে যথাস্থানে গুঁজে রাখলেন। বললেন—তাহলে আজ আসি রাজাবাবু? প্রণাম—
—নমস্কার। রঘু, এই রঘু! যা, রায়মশাইকে নিয়ে কাছারিঘরে যা। খাজাঞ্চিকে আমার নাম করে বল ওঁর টিকিটের দামটা দিয়ে দিতে। আচ্ছা এসো—
ভূষণ রায় চলে গেলে দেবদর্শন কিছুক্ষণ চুপ করে গড়গড়ার নলে টান দিলেন, তারপর বললেন—ঠাকুরমশাই, জানি কিছু প্রশ্ন আছে যা করতে নেই। তবু কিছুতেই কৌতুহল নিবৃত্ত করতে পারছি না বলে মার্জনা করবেন। টিকিটটা বদলে দিলেন কেন?
বললাম—এর উত্তর দেওয়া মুশকিল। বিশেষ কোনও যে কারণ আছে এমন বলতে পারি না, তবে অমরজীবনের বলা ছড়াটা একটা ছোটখাটো কারণ হলেও হতে পারে—
দেবদর্শন সোজা হয়ে বসে তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকালেন।
—আপনি কি ওই কবিতার মানে বুঝতে পেরেছেন?
—জানি না। বিলিতি লটারি খেলার ফল বেরুলে সেটা বোঝা যাবে। মুখুজ্যেমশাই, আপনি প্রবীণ এবং বুদ্ধিমান মানুষ, আপনাকে আগে থেকে মিথ্যা আশা দিয়ে ভোলাতে চাই না। একটা কিছু আন্দাজ করেই নিশ্চয় টিকিটটা বদলেছি। কিন্তু তা বলবার সময় এখনও আসেনি।
খানিকক্ষণ কী ভেবে দেবদর্শন বললেন—ঠাকুরমশাই, আপনি কিছুদিন আমার কাছে থাকবেন তো? প্রয়োজনে কীভাবে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ হবে নইলে?
—সে নিয়ে আপনি চিত্তা করবেন না। প্রয়োজন ঘটলে আমি নিজেই ঠিক যোগাযোগ করে নেব। আমি বেশিদিন কোথাও একজায়গায় থাকি না মুখুজ্যেমশাই, কিছু মনে করবেন না। বাড়িতেও মন বসেনি বলেই বেরিয়েছিলাম—
মুখুজ্যেমশাই সংযত ব্যক্তিত্বের মানুষ, এ নিয়ে বারবার অনুরোধ করে আমাকে বিব্রত করলেন না। আমার অন্য গল্প আরম্ভ করলাম। উনি আমার জীবনের অভিজ্ঞতার কাহিনী শুনতে চাইলেন। তোমরা তো জানো, সেসব পুরোনো দিনের প্রসঙ্গ একবার উঠলে আর শেষ হতে চায় না। মানুষ আগ্রহ করে শোনে, আমারও বলতে ভাল লাগে। দুপুরে খাওয়ার সময় বাদ দিয়ে সেদিনটা পুরোই গল্পে গল্পে কেটে গেল। বৈষয়িক কাজকর্ম সেদিন আর কিছুই হল না। কাছারি থেকে আমলারা ডেকে ডেকে ফিরে গেল। একসময় দেবদর্শন নায়েবমশাইকে ডেকে বললেন—আজ আর কাছারিতে বসব না। কাল ঠাকুরমশাই চলে যাবেন, আজকের দিনটা ওঁর সঙ্গে একটু গল্প করে নিচ্ছি। আপনি আজ একাই চালিয়ে নিন, আর ওদের বলে দিন বারবার যেন ডেকে বিরক্ত না করে—
তোমরা ভাবছ একই কথা এতবার বলছি কেন, কিন্তু সত্যিই এমন চমৎকার আর হৃদয়বান, উদার অতিথিপরায়ণ মানুষ আমি কমই দেখেছি। বেশিদিন তো নয়, আজ থেকে বড় জোর পঁচিশ কী তিরিশ বছর আগেকার কথা। তবু মনে হয় যেন স্বপ্নের কাহিনী, এই তিরিশ বছরে পৃথিবী ততটাই বদলে গিয়েছে। বাংলার গ্রামে আজকাল আর সেই আতিথেয়তা পাবে না।
কিশোরী বলল—গ্রামের মানুষকে দোষ দিয়ে কী হবে? এই ভয়ানক যুগের কথা ভেবে দেখুন। আপনি যে সময়ের কথা বলছেন তখন সরু পাটনাই বালাম চালের দাম সাড়ে চার কী পাঁচ টাকা, সরষের তেল পাঁচআনা সের, খাঁটি দুধ টাকায় কুড়ি সের, বড় মাপের জোড়া ইলিশ ছ-আনা। এগুলোর দাম এখন কী দাঁড়িয়েছে ভেবে দেখুন। জনসংখ্যা বাড়ছে হু হু করে, মানুষ কি ইচ্ছে করলেও আগেকার দিনের মত অতিথিপরায়ণ হতে পারে?
তারানাথ হেসে বলল—এ যুক্তি আমি অনেক শুনেছি। বাজে যুক্তি—
কিশোরী একটু রেগে বলল—বাজে যুক্তি? কোনখানটায় ভুল বলেছি দেখান তো—
—উত্তেজিত হচ্ছ কেন? উত্তেজিত হওয়া তর্কে পরাজয়ের লক্ষণ।
—বেশ তো, আমার যুক্তির ফাঁক দেখান—
তারানাথ বলল—দেখ, দিনকাল খারাপ পড়েছে ঠিকই, দ্রব্যমূল্যও আগের চেয়ে বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে সে কথাও ঠিক। কিন্তু সবচেয়ে যা প্রয়োজনীয় তা হল মানুষের সদিচ্ছা। ভালবাসা আর সদিচ্ছা থাকলে অনেক সমস্যা পার হওয়া সম্ভব। আমাদের শাস্ত্রে বাড়তি একজনের জন্য আহার্য প্রস্তুত রাখার নির্দেশ আছে। নিজে রান্না করে শুধু নিজে খেলে তাকে পামর বলে। ভাব তো, দিনকাল যতই কঠোর হোক, দ্রব্যমূল্য যতই বেড়ে থাকুক, একজনমাত্র মানুষকে খাওয়াতে কি খুব বেশি খরচ পড়ে? চার-পাঁচজনের সংসারে একজন অতিথির জন্য আলাদা ব্যবস্থা করতে হয় না, ওর মধ্যেই হয়ে যায়। তা নয়, আসলে আমরা ক্ষুদ্রচেতা হয়ে পড়েছি। এটাকে যুগধর্মও বলতে পারো। কলিযুগে অন্নময় শরীর—কেবল আমি খাব, আমি পরব এই মানসিকতা। মহাভারত ভাল করে পড়েছ? দ্বৈপায়নের তীরে ভীম যখন দুর্যোধনের উরুভঙ্গ করলেন, তখন অন্যায়যুদ্ধ করেছেন বলে ভীমকে হত্যা করবার জন্য বলরাম ক্রুদ্ধ হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁকে শান্ত করে কৃষ্ণ বললেন—দাদা, আপনি অকারণে ভীমের প্রতি ক্রোধ প্রকাশ করছেন। গ্রহবিপ্রদের ডেকে গণনা করে দেখুন, আজ থেকে দশদিন আগেই দ্বাপর শেষ হয়ে কলি শুরু হয়েছে। কলিতে নিয়ম হচ্ছে—যেমন করে হোক যুদ্ধ জয় করো, যা চাও তা ছিনিয়ে নাও, দয়ামায়া-উদারতা যেন তোমার আকাঙক্ষার বাধা না হয়। সেদিক দিয়ে ভীমসেন যুগধর্ম পালন করেছেন মাত্র, সেজন্য তাকে দায়ী করা যায় না। যুগপুরুষ কৃষ্ণের কথাই সত্য, আমিও একালের মানুষকে দায়ী করছি না। কিন্তু একথা ঠিক যে, মানুষ ক্ষুদ্রচেতা হয়ে পড়েছে, তা সে যে কারণেই হোক।
সেদিনটা দেবদর্শনের সঙ্গে গল্প করেই কাটল। ভদ্রলোক কলেজের ছাপমারা ছাত্র নন বটে, কিন্তু সাহিত্য আর ইতিহাসের খবর রাখেন প্রচুর, সেসব শুনতে আরম্ভ করলে আর থামা যায় না।
বোধহয় পরের দিন চলে যাব বলেই দুপুরে দেবদর্শন খাওয়াদাওয়ার বিপুল আয়োজন করেছেন। ওঁর আর আমার একসঙ্গেই আহারের আয়োজন করা হয়েছে ভেতরবাড়িতে রান্নাঘরের বারান্দায়। খেতে বসে আমার চক্ষুস্থির! পূজোর পরাতের মত বিশাল কাঁসার পদ্মকাটা বগিথালায় চুড়ো করা সাদা ধপধপে তুলাইপাঞ্জি চালের ভাত। ভাতের চূড়ায় ছোট্ট কাঁসার বাটিতে গাওয়া ঘি, জমবে না—ভাতের গরমে তরল থাকবে। আলাদা রেকাবিতে নুন-লেবু-লঙ্কা। জিরে জিরে করে কাটা আলুভাজা, এঁচোড়ের ডালনা, নারকেলের কুচি দেওয়া ঘন মুগের ডাল, বাশসলা ধানের চিঁড়ে দিয়ে রান্না পাকা রুইমাছের মুড়িঘন্ট, একহাত লম্বা চিতলমাছের পেটির তেলঝাল—সে পেটির লম্বা কাঁটা দিয়ে উলবোনা যায়। তারপর এল তেলকই, এক একখানা কই একবিঘত লম্বা, তেমনটি তোমরা আজকাল আর শহরবাজারে দেখবে না। কারুকে বিশ্বাস করতে বলছি না, কিন্তু এ সমস্ত পদই আমি বেশ ভাল পরিমাণে খেয়ে ফেললাম। ভাত নিলাম দুবার। তুলাইপাঞ্জি চালের ভাত খেয়েছ কখনও? তাহলে বুঝতে, এখানে রান্না করলে গলির মোড়ের লোক জানতে পারে। এই পর্ব চুকলে এল ঘনদুধের সর, ক্ষীর আর পাকা মর্তমান কলা। তাও খেয়ে ফেললাম অনেক অনেক।
মধ্যাহ্নভোজনের পর বৈঠকখানায় বসে তামাক খেতে খেতে বললাম—লোকে আপনাকে রাজাবাবু বলে সে মিথ্যে কথা নয়। রাজবাড়ি ছাড়া এমন রান্নাবান্না হয় নাকি?
দেবদর্শন বললেন—এবার তো কিছু করতে পারলাম না ঠাকুরমশাই, একটু হঠাৎ হয়ে গেল কিনা। সত্যি যদি আবার আসেন, তখন আমাদের এই অঞ্চলের কিছু ভাল রান্না আপনাকে খাওয়াব। কত রান্না তো আমরা ভুলেই গিয়েছি, বাড়ির মেয়েরা অত ঝামেলা আর করতে চায় না। পদ্মচিনি খেয়েছেন কখনও? গয়নাবড়ি ভাজা? কিম্বা তিলজাউ? সব খাওয়াব, আমার বাড়ির মেয়েরা পারে—
দু-চারবার জোরে জোরে গড়গড়ার নলে টান দিয়ে দেবদর্শন বললেন—যদি পারেন তো পূজোর সময় আসবেন। এখন অবশ্য আর সেই পুরনো দিনের জাঁকজমক কিছুই নেই, তবু নয় নয় করেও মুখুজ্যেবাড়ির দুর্গোৎসব আজ পর্যন্ত এ অঞ্চলে বিখ্যাত। বংশানুক্রমে আজ দুশো বছর ধরে একই কুমোর ঠাকুর তৈরি করে, একই পুরোহিতবংশ পূজো করে, একই ঢাকিরা ঢাক বাজায়। প্রতিমার সামনে অষ্টমীর দিন রাত্তির থেকে কবির গান, যাত্রা–এসব হয়। যদি ভাগ্য ভাল থাকে, তাহলে সন্ধিপূজোর সময় গড়ের তোপও শুনতে পাবেন—
অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম—গড়ের তোপ কী জিনিস?
মুখুজ্যেমশাই বললেন—এটা আমাদের পরিবারে প্রচলিত একটা পুরোনো প্রবাদ। এখান থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে মুকুটশিলা গ্রামে আমার মামাবাড়ি। আমার প্রপিতামহীও ওই গ্রামেরই মেয়ে ছিলেন। তাঁর বাপেরও ছিল বিশাল ভূসম্পত্তি, নদীর ধারে চওড়া উঁচু পাচিল দেওয়া এতবড় বাড়ি যে লোকে বলত ‘গড়’। সে বাড়িতে বিখ্যাত দুর্গোৎসব হত, দীয়তাং ভূজ্যতাং চলত পনেরোদিন ধরে। সন্ধিপূজোর সময়ে চারদিক কাঁপিয়ে কামান দাগা হত। লোকে বলত গড়ের তোপ। বিয়ের পর আমার প্রপিতামহী বাপেরবাড়ি যাওয়ার খুব একটা সুযোগ পেতেন না, সেকালে যেমন হত আর কি। একবার সকলকে বলে রাজি করিয়ে পূজোর সময় তিনি মুকুটশিলা যাবেন স্থির হল, কিন্তু পুজোর দশবারোদিন আগে বিষম সান্নিপাতিক জ্বরে প্রপিতামহী একেবারে শয্যাগত হয়ে পড়লেন। সঙ্কটাপন্ন অবস্থা, এখন যান তখন যান। কিন্তু সেই বিকারের মধ্যেও একটু জ্ঞান ফিরলেই বলতেন—আমার বাপেরবাড়ি যাওয়া হল না, পূজো দেখা হল না।
দীনদয়াল ভট্টাচার্য ছিলেন সে সময় আমাদের কুলগুরু। প্রপিতামহীর আক্ষেপ শুনে তিনি বলেছিলেন—মা, তোমাকে কোথাও যেতে হবে না, এইখান থেকেই তুমি সন্ধিপূজোর দিন মুকুটশিলা গ্রামের গড়ের তোপ শুনতে পাবে। এইখান থেকেই তুমি প্রণাম জানিও।
সবাই ভেবেছিল দীনদয়াল মুমূর্ষ রোগীকে সাত্ত্বনা দিলেন মাত্র, কিন্তু প্রপিতামহ কথাটা আক্ষরিক অর্থেই বিশ্বাস করেছিলেন। সন্ধিপূজোর সময় তিনি বসে রইলেন স্ত্রীর রোগশয্যার পাশে। গভীর রাত্রিতে ঠিক সন্ধিলগ্নে বহুদূর থেকে মাঠ বন খাল বিল পেরিয়ে ভেসে এল গড়ের তোপের শব্দ। গ্রামাঞ্চল তো, তারপর সেকালের ব্যাপার, হুহু করে ঘটনাটা রটে গেল চারদিকে। এখন জিনিসটা কিংবদন্তীর পর্যায়ে পোঁচেছে। প্রতি বছরেই নাকি কেউ কেউ শুনতে পায় গড়ের তোপের আওয়াজ—
বললাম—তাতে অবাক হওয়ার কী আছে? শোনাই তো যেতে পারে—
দেবদর্শন আমার দিকে কয়েকমুহূর্ত তাকিয়ে বললেন – না, তা যেতে পারে না। আগে বলিনি বোধহয়, জয়তলা থেকে মুকুটশিলার দূরত্ব চল্লিশ মাইল।
চুপ করে রইলাম। সত্যিই তো, যতই নির্জন আর শান্ত পরিবেশ হোক, চল্লিশ মাইল দূর থেকে কামানের আওয়াজ শুনতে পাওয়া সম্ভব নয়।
জিজ্ঞাসা করলাম—আপনি কখনো শুনেছেন?
মুখুজ্যেমশাই বললেন—বাল্যে দু-একবার শুনতে পেয়েছি বোধহয়, পরিষ্কার স্মৃতি কিছু নেই। বড় হবার পর তেমনভাবে কখনও নয়—
—তেমনভাবে নয় বলতে কী বোঝাচ্ছেন?
—সেভাবে কানখাড়া করে কখনও বসে থাকিনি তো। বড় হতে আরম্ভ করলে কিছু কিছু বিশ্বাসের ভিত্তি নড়ে যায়। তবে দু-একবার—যেমন আমার বিয়ের বছর—হঠাৎই শুনতে পেয়েছিলাম তোপের শব্দ। অন্যমনস্ক ছিলাম, নইলে হয়ত আরও স্পষ্ট শুনতে পেতাম। গ্রামের লোকেদের মধ্যে কিন্তু এ প্রসঙ্গে গভীর বিশ্বাস আছে, তারা অনেকেই শুনেছে গড়ের তোপ। তবে তাদের কথা আমি ধরি না, অতিরিক্ত বিশ্বাসে আর ভক্তিতে মানুষ অনেক কিছু দেখে বা শোনে যার কোনও বাস্তব মূল্য নেই।
দেবদর্শন প্রবীণ জমিদার বটে, কিন্তু সেকেলে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ নন, তার মনের মধ্যে বেশ উদার আলোহাওয়া খেলে।
গল্পে গল্পে সেদিনটা ভালই কেটে গেল। পরের দিন আবার বেরিয়ে পড়লাম পথে।
পথটাই আমার ঠিক জায়গা, ঠিকঠাক খাপ খেয়ে যায়। চিন্তাহীন, মুক্ত আনন্দে ভরা দিনগুলো। কখনও ঝড়-বৃষ্টি, কখনও নীল আকাশে ডানা ছড়ানো চিলের ওড়াউড়ি। পড়ন্ত বেলায় রাস্তার ধারের লতাপাতার ঝোপ থেকে মন-কেমন-করা কটু গন্ধ ওঠা। গ্রামের মুদিখানা থেকে মুড়ি আর মুড়কি কিম্বা বাতাসা কিনে খাওয়া, যেখানে-সেখানে রাত্তিরের আশ্রয় নিয়ে ঘুমিয়ে পড়া। তোমরা যারা সংসারী মানুষ তারা এ জীবনটাকে ঠিক উপলব্ধি করতে পারবে না। তবে আবার বলছি—মনে বল আর সাহস থাকা চাই, দুর্বল পুতুপুতু মনের লোক এ আনন্দ পাবার যোগ্য নয়।
কয়েকমাস ঘুরে বেড়ালাম বহু জায়গায়, অনেক অদ্ভূত অভিজ্ঞতাও হল। তার মধ্যে একটা তো জমিয়ে গল্প বলার মত। কিন্তু সেটা আজ বলব না, আজ বরং মুখুজ্যেবাড়ির গল্পটা শেষ করি।
শরৎকাল এসে গেল। কিছুদিনের মধ্যেই দুর্গাপুজো আসছে। একটা কালীবাড়ির নাটমন্দিরে আশ্রয় নিয়েছিলাম সে রাত্তিরে। বেশ পরিচ্ছন্ন জায়গা, মশা টশা বিশেষ নেই, কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুম ঘুম ভাব ঘনিয়ে এল। সারাদিন পথশ্রমের পর ঘুম আসার অনুভূতি ভারি আরামের।
হঠাৎ সেই অন্ধকারের ভেতর থেকে কানের কাছে কে যেন বলল—কাল সকালেই রওনা হও। মুখুজ্যেবাড়ির পুজোয় এবার তোমার থাকা দরকার।
চমকে উঠে বসলাম—কে? কে বলল কথাটা? তারার আলোয় আবছা দেখা যাচ্ছে নাটমন্দির। কই, জনপ্রাণীও তো নেই কোথাও! অথচ আমি পরিষ্কার শুনেছি—
উঠে একবার চারপাশটা ঘুরে দেখে এলাম। না, সত্যিই কেউ কোথাও নেই। তাহলে?
তারপরেই হঠাৎ একটা ধাক্কার মত মনে হল—এই গলার স্বরের অধিকারীকে আমি চিনি! তার নাম অমর। অমরজীবন। আমাদের পারিবারিক ইতিহাসের পর্বে পর্বে সে জড়িয়ে গিয়েছে। রহস্যের কুয়াশায় ঢাকা তার পরিচয়, আকাশের নক্ষত্রদের মত সে প্রাচীন। তার নির্দেশ আমাকে মানতেই হবে।
অনেক রাত্তির অবধি নাটমন্দিরের মেঝেতে থম হয়ে বসে রইলাম। গলাটা শুনতে পেয়ে মনে কোনও ভয় বা আশঙ্কা হল না, বরং মৃদু তৃপ্তি আর শান্তিতে মন ভরে গেল। যেন কয়েকবার হারিয়ে যাওয়া কোন বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছি। ঠিক করলাম পরের দিনই রওনা দেব জয়তলায়।
ঘুরতে ঘুরতে দেড়খানা জেলা পার হয়ে চলে এসেছিলাম, কাজেই ফিরতে বেশ সময় লাগল। খুব প্রাণপণ হেঁটেও পূজো আরম্ভ হবার আগে মুখুজ্যেবাড়ি পৌঁছতে পারলাম না। সপ্তমীর দিন সন্ধেবেলা পৌঁছলাম দানাবাড়ি নামে একটা গ্রামে, সেখান থেকে জয়তলা বারো মাইল পথ। খুব ভোরে উঠে বেরিয়ে পড়লে দুপুরের মধ্যেই পৌঁছে যাব।
পরের দিন মহাষ্টমী। অন্ধকার থাকতেই ঘুম ভেঙে উঠে মুখহাত ধুয়ে বেরিয়ে পড়লাম। যে গোয়ালবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম সে বাড়ির কর্তাও আমাকে এগিয়ে দেবার জন্য গল্প করতে করতে অনেক দূর এল। শরৎকালের ভোর, বাতাসে সামান্য হিমের স্পর্শ। গ্রামের সীমানায় একটা বাড়ির উঠোনে গাছের তলায় আলো করে ছড়িয়ে আছে শিউলি ফুল। তার পবিত্র গন্ধ সে জায়গার বাতাসকে আমোদিত করে রেখেছে। এখান থেকেই আমার সঙ্গী উদ্ধব ঘোষ প্রণাম করে বিদায় নিল। আমিও জোরে পা চালালাম।
পথে বারদুই সামান্য বিশ্রাম করে ঠিক বেলা দুপুরে জয়তলা পৌঁছলাম। দূরে মুখুজ্যেবাড়ির পূজোর ঢাক বাজছে। গ্রামের রাস্তাতেও খুব বেশি লোক নেই, দল বেঁধে সবাই জমিদারবাড়ি পূজো দেখতে গিয়েছে। পথের বাঁক ঘুরেই সামনে মুখুজ্যেমশাইয়ের বাড়ি। কাছারি আর অন্দরমহলের মাঝখানে বিরাট উঠোনে সামিয়ানা টাঙানো হয়েছে, তার নিচে অন্তত শ-তিনেক লোক হাতজোড় করে প্রতিমার দিকে তাকিয়ে বসে। আমি মণ্ডপে ঢুকতেই সমস্ত কোলাহল থেমে গিয়ে অতবড় আসরে স্তব্ধতা নেমে এল। সন্ধিপূজা সমাগত।
আসরের একেবারে অপর প্রান্তে ঠাকুরদালানে প্রতিমার সামনে একশো আটখানা পেতলের প্রদীপ ধকধক করে জ্বলছে। পুরোহিত একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন লোহার বেড়ের ওপর বসানো নতুন জলভরা মাটির হাড়ির দিকে। তার তলার ফুটো দিয়ে জল বেরিয়ে যাচ্ছে। সমস্তটা জল বেরিয়ে গেলে সন্ধিপুজো শুরু হবে। ভাল সময়ে পৌঁছলাম মুখুজ্যেমশাইয়ের বাড়িতে।
ওপাশ দিয়ে ক-খানা বারকোশ হাতে করে রঘু কোথাও যাচ্ছিল, সে আমাকে দেখতে পেয়ে একগাল হাসল, তারপর আসরের সামনে যেখানে দেবদর্শন বসে আছেন সেখানে গিয়ে নিচু হয়ে বোধহয় আমার কথা বলল। দেবদর্শন চমকে উঠে মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন।
তার সঙ্গে আমার চোখাচোখি হওয়ামাত্র দূর থেকে ভেসে আসা মৃদু, কিন্তু স্পষ্ট কামানের গর্জন শুনতে পেলাম। আসরের সব মানুষই নিশ্চয় শুনতে পেয়েছিল, জয়ধ্বনি দিয়ে তারা একসঙ্গে উঠে দাঁড়াল সামিয়ানার তলায়। গড়ের তোপ! গড়ের তোপ শোনা গিয়েছে!
কেবল পুরোহিতমশায় অবিচল। হাঁড়ির জল শেষ হওয়ামাত্র তিনি হাত তুললেন। মেঘের গর্জনের মত গুড়গুড় করে বেজে উঠল ঢাক।
সন্ধিপুজো শুরু হল।
পরের পর্ব পড়ুন....
No comments:
Post a Comment