অলাতচক্র (প্রথমাংশ)



লেখক: তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়

॥ এক ॥

উনিশ শো পনেরো সাল। ইউরোপে প্রথম মহাসমর সবে শুরু হয়েছে। কিছু বছরের ব্যবধানে যে দুটি বিশ্বযুদ্ধ মানবেতিহাসকে আমূল বদলে সম্পূর্ণ নতুন পথে প্রবাহিত করবে, তার আভাসমাত্রও কেউ তখনো জানে না। যুদ্ধ একটা হচ্ছে বটে, যারা নিজের জনপদের বাইরে কর্মসূত্রে যাতায়াত করে, তারা খবরটা জানে। কিন্তু সে যুদ্ধ হচ্ছে অন্য মহাদেশে, ভারতে তার বিশেষ কোনো ঢেউ এসে লাগেনি। লোকপরম্পরায় শ্রুত কিংবদন্ত্রীর মত তা সামান্য ঔৎসুক জাগায় মাত্র, মানুষকে সন্ত্রস্ত বা উদ্বিগ্ন করে না। সবুজ গাছপালায় ঢাকা শ্যামস্নিগ্ধ গ্রামবাংলার জীবন চিরাচরিত ধীরলয়ে বয়ে চলেছে। হুগলী জেলার অন্তর্গত এমনই একটি ছোট গ্রামে এই কাহিনীর শুরু।

তারকেশ্বর লাইনের সিঙ্গুর স্টেশনে নেমে আট-দশ মাইল হেঁটে কিম্বা গরুর গাড়িতে গেলে পড়বে রামজয়পুর গ্রাম। গ্রামটি ব্রাহ্মণপ্রধান, কায়স্থ এবং বৈদ্যের বাসও কিছু রয়েছে। গ্রামের প্রত্যন্তসীমায় শ্রমজীবী অন্যজাতির কয়েকটি পরিবার বাস করে। কিন্তু সেই যুগে সমাজে যে জাতপাত-ঘটিত বৈষম্য বিরাজ করত, রামজয়পুরে তার নামগন্ধও ছিল না। ভাগ্যের আশ্চর্য যোগাযোগে এখানে কিছু উদার ও ভদ্র মানুষ একজায়গায় হয়েছিল। তারা হাসিমুখেই বাস করত গ্রামে। প্রতিবেশীর সুখ এবং শান্তি সচরাচর কারো সহ্য হয় না, তাই কাছাকাছি দু-একটি গ্রাম থেকে সমাজপতিদের প্রতিনিধিরা এসে মাঝেমধ্যে বিরোধ তৈরি করার প্রচেষ্টা যে করেনি এমন নয়, কিন্তু রামজয়পুর সে চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছে।

শ্রাবণ মাসের শেষের দিক। দিন তিনেক হল অবিশ্রাম বৃষ্টি হয়ে চলেছে। কখনো সামান্য ধরে আসে, একটু বাদেই আবার ঝমঝমিয়ে নামে। গ্রামের ভেতরে প্রায় সব রাস্তাতেই কমবেশি কাদা। পথে লোক চলাচল নেই। কে আর এমন দুর্যোগে অকারণে ঘর ছেড়ে বেরুবে? চাকরির জন্য কলকাতায় নিত্যযাত্রার প্রচলন তখনো এমন ব্যাপকভাবে শুরু হয়নি। হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র জীবিকার প্রয়োজনে গ্রাম ছেড়ে বেরিয়েছিল, তারা সারা সপ্তাহ কলকাতার মেসে থেকে শনিবার বাড়ি আসত, আবার সোমবার সকালে ফিরে যেত। লোকে নিজের ভদ্রাসনেই বাস করত, পারিবারিক জমিজমা আর আম-কাঁঠালের বাগানের উপস্বত্বে সংসার চলে যেত সচ্ছলভাবেই। চাহিদা কম থাকায় জীবনে সুখ ছিল।

আকাশে মেঘ থাকায় সন্ধে নেমেছে একটু তাড়াতাড়ি। সরসী চাটুজ্জের বৈঠকখানায় সান্ধ্য আড্ডা জমে উঠেছে দারুণ। বেশ বড় বাড়ি, তারপরে দুর্গামণ্ডপ আর নাটমন্দির। নাটমন্দির পার হয়ে দুদিকে দেউড়ির ভেতর দিয়ে বাড়িতে ঢোকার পথ। এরই ডানদিকে বড় বৈঠকখানা। চৌকি বা তক্তাপোশ নয়, মেঝেতে মোটা সতরঞ্চি পাতা, তার ওপর সাদা ফরাস। একসঙ্গে পনেরো-কুড়িজন বসে আড্ডা দিতে পারে। সরসী চাটুজ্জের আড্ডা এ গ্রামে বিখ্যাত। এমন ঢালাও তামাকের ব্যবস্থা আর কারো বাড়ি নেই। তাছাড়া আড্ডার মধ্যে অন্তত একবার কাঁসার বাটিতে করে সরষের তেল দিয়ে জবজবে করে মাখা মুড়ি-ছোলাভাজা আসবেই। সরসী চাটুজ্জের উঠোনে বাইশ হাত বেড়ের ধানের গোলা চারটে, ধান ছাড়াও বিভিন্ন রকমের শস্য আর সবজির চাষ আছে বহু বিঘের। আপ্যায়নের বিষয়ে তার কষ্ট হবার কথা নয়। গ্রামবৃদ্ধেরা রোজ ভিড় করেন তার বাড়িতে।

আজ হচ্ছিল গল্পের রাজা—ভূতের গল্প। বাড়ির ভেতর থেকে চালভাজা-ছোলাভাজা এসে গিয়েছে, হুঁকো ঘুরছে হাতে হাতে। ঘরের কড়িকাঠ থেকে লোহার বাঁকানো হুকে ঝুলছে হিঙ্কসের ডবল পলতের বাতি। সজল বাতাসে সেটা সামান্য দুলছে, ফলে আডডাধারীদের ছায়া দুলছে বৈঠকখানার দেয়ালে। আলোছায়ার মায়ায় জমে উঠেছে অপ্রাকৃত গল্পের আসর।

আদিনাথ চক্রবর্তী বললেন—তোমরা বেশির ভাগই শোনা কথা বলছ, নিজেরা কিছুই দেখেনি। ওসব গল্পের মূল্য কী?

নিবারণ ভাদুড়ি হুঁকোটা রাম গাঙ্গুলির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন—সরসী, এ ভ্যালসা তামাক কোত্থেকে জোগাড় করলে? গলায় একটু সেকও লাগে না ছাই! একটু ভদ্র তামাকের ব্যবস্থা করো, নইলে নিজের তামাক ট্যাঁকে গুঁজে আড্ডায় আসতে হবে। আর হ্যাঁ, আদিনাথ, তুমি তো বড় বড় কথা বলছ। নিজে কী দেখেছ বল, আমরা একটু শুনি। কেবল বাগাড়ম্বর করে তো বাজার গরম হবে না—

সরসী চাটুজ্জে বললেন—সেই ভাল। চক্কোত্তিমশাই এতক্ষণ চুপ করে শুনে যাচ্ছিলেন, এবার ওঁর গল্পই হোক—

আদিনাথ বললেন—গল্প নয়, সত্য কাহিনী।

—বেশ তো, তাই হোক।

পতিরাম মজুমদার একটু ভালমানুষ ভীতু ধরণের লোক। আড্ডায় অনেকক্ষণ ধরে ভূতের গল্প তার পছন্দ হচ্ছিল না। এবার তিনি একটু সন্ত্রস্ত হয়ে বললেন—আজ এই পর্যন্ত থাকলেই ভাল। দেখছ তো আকাশের গতিক, বেশি জোরে নামলে আর বাড়ি ফেরা মুশকিল হয়ে পড়বে। শুনছ মেঘের ডাক?

সরসী চাটুজ্জে হেসে বললেন—আরে বোসো। আমার চাকর তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে এখন –

পতিরাম হতোদ্যম হয়ে বসে পড়লেন।

আদিনাথ বললেন—তোমরা তো জানো, শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি পেয়ে আজ সতেরো বছর হল আমি এই গ্রামে এসে বাস করছি। আমার ছোটবেলা এবং বিবাহিত জীবনের প্রথম কয়েকবছর কেটেছে পৈতৃক গ্রাম বাহিরগাছিতে। সেখানে আমাদের তিনমহলা বাড়ি, বাপ-জ্যাঠা পিসি-খুড়ি আর একগাদা ছেলেপুলে নিয়ে সে বাড়ি গমগম করত সর্বদা। নিজেদের মধ্যে ভাব-ভালবাসা ছিল। এখানে বাস করতে আসি ঝগড়া করে নয়, কোনো বিরোধের জন্যও নয়। এসেছিলাম বাবার কথায়। তিনি বলেছিলেন—আদিনাথ, আমার কথা শোনো। তুমি রামজয়পুরে গিয়ে বাস করো, অন্তত কিছুদিনের জন্য। বৌমার বাবা গত হয়েছেন, রয়েছেন কেবল বেয়ানঠাকরুণ। তিনিও শয্যাগতা। তাঁকে দেখাশুনো করা তোমাদের কর্তব্য। তাছাড়া—কিছু মনে কোরো না—যতদূর জানি তাঁদের সম্পত্তির পরিমাণও কম নয়। বৌমাও তাঁদের একমাত্র সন্তান, সবকিছু তাঁরই প্রাপ্য। এ সময়ে সেখানে উপস্থিত থেকে নিজেদের জিনিস বুঝে নেওয়া ভাল। আর এই বাড়িতেও তো ক্রমেই স্থানাভাব ঘটছে দেখতেই পাচ্ছ। লোকসংখ্যা বাড়ছে, সে তুলনায় থাকার জায়গা বাড়ছে কই? যদি আলাদাও থাক, তাতে প্রীতির ভাব কমবার কারণ নেই। যাওয়া-আসা বজায় রেখো, সেটাই বড় কথা।

বাবার কথা শুনে এখানে আসি। বছরখানেকের মধ্যে শাশুড়ি ঠাকরুণ মারা গেলেন। সম্পত্তি দেখাশুনোর ভার আমারই ওপর এসে পড়ল। তবুও বছরে অন্তত একবার, পূজোর সময়ে, বাহিরগাছি যেতাম। কয়েকবছর পরে বাবাও মারা গেলেন। পৈতৃক গ্রামের সঙ্গে সেভাবে আর কোনো যোগসূত্র বজায় রইল না।

যাই হোক, যে সময়ের কথা বলছি তখন আমার বয়েস বারো-তেরো হবে। শীতকাল। দোলাই গায়ে দিয়ে বাইরের দালানে বাবার কাছে বসে পড়াশুনো করছি। বাবা বসে হিসেবের খাতাপত্র দেখছেন। এমন সময়ে একটা ভবঘুরে চেহারার লোক এসে উঠোনে দাঁড়াল।

আমি তখন নেহাৎই ছোট, মানবচরিত্র ঠিকঠাক বোঝবার মত বয়েস হয়নি। কিন্তু লোকটাকে দেখে প্রথমেই যে কারণে আমার অবাক লাগল তা হল এই—আমি লোকটার বয়েস আন্দাজ করতে পারলাম না। এ ব্যাপারটা ভাল করে বুঝে নাও। কোনো মানুষকে প্রথম দেখলে এবং তার বয়েস সঠিক না জানলে আমরা ত্রিশ কী পঁয়ত্রিশ, কিম্বা পঞ্চান্ন কী ষাট—এরকম মনে করি। অর্থাৎ কারো বয়েস একদম ঠিক বলতে না পারলেও আন্দাজটা কাছাকাছি থাকে। এই লোকটাকে দেখে মনে হল এর বয়েস ত্রিশ-চল্লিশ-পঞ্চাশ বা ষাট কিম্বা সত্তর যা কিছু হতে পারে। পরণে খাটো আধময়লা ধুতি, গায়ে তদবৎ আধময়লা ফতুয়া, কাঁধে ভাজ করা রয়েছে একটা খয়েরি রঙের মোটা চাদর। এই ভয়ানক শীতেও লোকটা সে চাদর গায়ে জড়ায়নি। গালে খোঁচা খোঁচা কাঁচাপাকা দাড়ি, মাথায় অবিন্যস্ত ঝাঁকড়া চুল। সবচেয়ে আশ্চর্য হল তার চোখদুটো। সোজাসুজি সামনে তাকিয়ে আছে, অথচ মনে হচ্ছে সে কিছুই দেখছে না। পাগলের মত, কিন্তু পাগল নয়। তার দৃষ্টিতে চিন্তাসঙ্গতির বাঁধুনি আছে।

বাবা মুখ তুলে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন—কী ব্যাপার, কোথা থেকে আসছ? কে তুমি?

খুব মোলায়েম, মৃদু গলায় সে বলল—আমি একজন পথিক! কোথাও থেকে আসছি না, আমার বাড়িঘর নেই। আমি আজ এখানে ভাত খাব।

তার কথাগুলো অসংলগ্ন। হঠাৎ এভাবে কেউ কারো বাড়ি ভাত খেতে চায় নাকি? বাবা বললেন—তোমার নাম কী? এখন বাড়ি না থাকতে পারে, কিন্তু একসময় তো ছিল, মানুষ আকাশ থেকে পড়ে না। পরিচয়টা দাও।

সে কেমনভাবে যেন হেসে বলল—আমার নাম অমর। বাবা ছিলেন পণ্ডিত মানুষ, নাম ঈশ্বরচন্দ্র সার্বভৌম। আমি আজ আপনার কাছে ভাত খাব।

—বাবা ছিলেন -- মানে কী? এখন তিনি কোথায়?

অমর ডানহাতের তর্জনী ওপরে তুলে দেখাল।

বাবা লজ্জিত হয়ে বললেন—ও, আচ্ছা, আচ্ছা। মা-ও কি—?

—মাও ওইখানে।

—ও। তা, বাড়ি কোথায় ছিল?

অনির্দিষ্ট একটা দিক দেখিয়ে অমর বলল—ওইদিকে।

তারপর একটু থেমে বলল—ভয় নেই, আমি চোর-ডাকাত না।

বাবা লজ্জা পেয়ে বললেন—না, না, আমি তা মনে করিনি। আসলে তোমার কথাবার্তা একটু অদ্ভুত ধরণের কিনা, তাই আর কি—

উঠোনে নিমগাছতলার ইঁদারা থেকে বালতি করে জল তুলে হাতমুখ ধুয়ে অমর এসে বারান্দায় উঠে বসল। বাবার ভয়ে সেদিকে বেশি তাকাতে পারছি না, কিন্তু কান খাড়া করে রয়েছি। বাবা জিজ্ঞাসা করলেন—এখন কি কিছু খাবে? রাত্তিরে কোথায় ছিলে? সকালে উঠেই হাঁটছ বুঝি?

বাবা কেন এ প্রশ্ন করলেন তা আবছা আবছা বুঝতে পারলাম। মাইল চারেক দূরে চাঁপাগাড়ি ছাড়া কাছাকাছি অন্য কোন গ্রাম নেই। তার পরের গ্রাম ময়নাচাঁদা অনেক দূর, সকালে উঠে সেখান থেকে হেঁটে আসা সম্ভব নয়। লোকটা কী বলে বাবা দেখতে চাইলেন।

অমর সহজভাবেই বলল—না, আমি এখন কিছু খাব না। একেবারে দুপুরে ভাত খাব। আর যদি থাকতে দেন তাহলে আজ রাত্তিরটাও থেকে যেতে পারি। এই ভিটেতে একটু স্বপ্ন দেখতে হবে কিনা—

এবারে আমি বাবার শাসনের কথা ভুলে অমরের দিকে তাকালাম। চোর-ডাকাত না হতে পারে, কিন্তু পাগল নিশ্চয়। স্বপ্ন দেখতে হবে মানে?

বাবা এবার একটু কড়া গলায় বললেন—পাগলামি কোরো না। আমি যা বলছি তার সোজা উত্তর দিচ্ছ না কেন? তোমার নাম তো অমর?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। অমরজীবন।

—বাবার নাম ঈশ্বর?

—সবারই বাবার নাম ঈশ্বর।

—আবার পাগলামি করে! স্বপ্নের ব্যাপার কী বলছিলে? ওর মানে কী?

অমরের কণ্ঠস্বর ভারি মৃদু, মিষ্টি আর ভদ্র। সে বলল—রাগ করবেন না, আমার কথাবার্তা একটু ওই পাগলাটে মতন, কিন্তু আমি লোকটা খারাপ নই। আপনাদের এই বাড়ির দক্ষিণ দিকের ভিত সামান্য নিচু, তা জানেন? সমস্ত বাড়িটা একটু কাত হয়ে আছে। উত্তরে উঠে, দক্ষিণে ঝুঁকে। আপনাদের বাড়িতে শালিক বসে না, খেয়াল করেছেন কখনো? আপনি তো এ বাড়ির কর্তা, আপনার অনামিকা মধ্যমার চেয়ে বড়। এ বাড়ির প্রত্যেক বড়ছেলের তাই। ঠিক বলছি তো?

আমি অবাক হয়ে গেলাম। সত্যিই তো তাই। আমার মাঝের আঙুলের চেয়ে পরের আঙুলটা বড়। মেজকাকা আর ছোটকাকার বড়ছেলেরও তাই। এই লোকটার পক্ষে সেকথা এত তাড়াতাড়ি কী করে জানা সম্ভব?

বাবা বললেন—তাতে কী?

অমর বলল—সেজন্য আমি এই বাড়িতে একটা রাত ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখতে চাই। এটাই আমার কাজ। পথে পথে ঘুরে বেড়াই, মন্দিরের চাতালে, গাছতলায় বা কোনো গেরস্তর বাড়ি আশ্রয় নিই। সব জায়গাতে কিন্তু স্বপ্ন দেখা যায় না। ওর একটা নিয়ম আর লক্ষণ আছে। সে বুঝিয়ে বলা যায় না, কিন্তু আমি ঠিক টের পাই। কাল সকালে আমি আরো অনেক কথা বলতে পারব।

বাবা কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন—তুমি তাহলে আজ রাত্তিরে এখানে থাকতে চাইছ?

—বা রে, নইলে স্বপ্ন দেখব কী করে? জেগে কি স্বপ্ন দেখা যায়?

বাবা আর কিছু বললেন না, মুখ নামিয়ে আবার হিসেবের খাতায় মন দিলেন। আমিও কাঠাকালি-বিঘাকালি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

অমর দুই হাতে হাঁটু বেড় দিয়ে তার ওপর থুতনি রেখে বসে রইল। অনেকক্ষণ পরে বারান্দা থেকে নেমে নিমগাছের গোড়ায় পড়ে থাকা একটা লম্বা কঞ্চি তুলে সেটা দিয়ে পুরো উঠোনটা মেপে ফেলল। তারপর নিজের মনে মনেই বিড়বিড় করতে লাগল— আটত্রিশ। আটত্রিশ কেন? বাকি চার কোথায় গেল? বাকি চার? তা কেমন করে হবে?

আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। বাবার মুখ খাতার দিকে নামানো, কিন্তু চোখ দিয়ে তিনি অমরের কাণ্ড দেখছেন। কীসের আটত্রিশ? আরো চার বেশি হলেই বা তাতে কী হত?

উঠোন মাপা হয়ে গেলে কঞ্চিটা অমর আবার যত্ন করে নিমগাছের তলায় রেখে এল। আমরাও (অর্থাৎ আমি এবং খুড়োতুতো ভাইয়েরা) পড়ায় মন দিলাম।

দুপুরে খেতে বসে অমরজীবন ভাত খেল খুব কম। পাড়াগাঁয়ে একটা বাচ্চা ছেলেও তার চেয়ে বেশি খেয়ে থাকে। বাবা খেতেখেতে একবার বললেন - আর ভাত নেবে না? মাছের ল্যাজা দেবে একটা?

—নাঃ, বেশি খেলে স্বপ্ন দেখা যায় না। খালি পেটমোটা হয়—

খাওয়া হয়ে গেলে গুরুজনেরা বিশ্রাম করতে গেলেন। অমর উঠোনে নেমে মনোযোগ দিয়ে নিমপাতা কুড়োতে লাগল। তার কাজ করার ভঙ্গিও খুব সুন্দর। একটি একটি করে হলুদ ঝরা পাতা তুলে ফুঁ দিয়ে ধুলো ঝেড়ে সে হাতের মুঠোয় গুছিয়ে রাখছে। অনেক পাতা জড়ো হয়ে গেলে সে বারান্দায় উঠে এসে সেগুলোকে আলপনার মত করে সাজাতে লাগল। আমরা ছেলেপুলেরা তার কাছে দাঁড়িয়ে তার কাজ দেখছি। একটু একটু করে বারান্দার ওপর নিমপাতা দিয়ে তৈরি সুন্দর একটা আলপনা ফুটে উঠল। সে মাথা একদিকে কাত করে নিজের শিল্পকর্ম দেখতে লাগল।

আমি জিজ্ঞেস করলাম—এটা কী হল?

সে আমার দিকে তাকাল, বলল—বল তো এটা কী হল?

—এটা তো আলপনা। কিন্তু এ দিয়ে কী হয়?

সরাসরি সে কথার উত্তর না দিয়ে অমর বলল—আচ্ছা, এটা দেখে তোমার মনে কী ভাব জাগছে আমাকে বল—

বললাম—ভাল লাগছে। দেখতে সুন্দর বলে আনন্দ হচ্ছে।

—বাঃ, তাহলে তো তুমি আসল জিনিসটাই বুঝে গিয়েছ। এটা দিয়ে কিছু হয় না। ভাল লাগে তাই বানালাম।

আমার খুব পছন্দ হয়ে গেল লোকটিকে। তার কথার অর্থ সবটা বুঝতে না পারলেও যেহেতু আমাদের পরিবারে কিছু কিছু জ্ঞান এবং সংস্কৃতির চর্চা ছিল, সেহেতু তার বক্তব্যের সৌন্দর্য এবং গভীরতা আমাকে স্পর্শ করল।

মাঝে মাঝে বাতাসে দু-একটা পাতা এদিক-ওদিকে সরে গেলে সে হালকা আঙুলের ছোঁয়ায় সেগুলোকে আবার ঠিক করে সাজিয়ে দিচ্ছিল।

রাত্তিরে সে কিছু খেল না। বাড়ির ভেতরে মা অবাক হয়ে বললেন—ওমা! সে আবার কী কথা। অতিথি মানুষ না খেয়ে থাকবে কী রকম?

বাবাও তাকে বললেন—বাপু, পাগলামি করতে হয় তার জন্য অন্য কত জায়গা ছিল, খামোকা আমার বাড়িতে এসে বিব্রত করা কেন?

অমরজীবন রাগও করে না, কিছুই না। কেবল মৃদু হাসে আর ঠাণ্ডা গলায় বলে—ও আমার অভ্যেস আছে। স্বপ্ন দেখার দিন রাত্তিরে মুখ এঁটো করতে নেই।

আমাদের বাড়িতে অতিথিকে যত্ন করা হত আপনলোকের মত। এমনিতেই সেই যুগে মানুষকে সম্মান করা হত, অতিথিকে মনে করা হত নারায়ণ। বাংলায় অন্নের জন্য হাহাকার ছিল না। সবার হাতে নগদ পয়সা না থাকলেও বাড়িতে ধান ছিল। কারো বাড়িতে আশ্রয় চেয়ে কেউ পায়নি এমন শোনা যেত না। সেই স্বাভাবিক সৌজন্যবশত বাবা অমরজীবনকে বৈঠকখানার ভেতরে মশারি টাঙিয়ে বিছানা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সে শুলো উঠোনের পাশে বারান্দায়।

আমি রাত্তিরে শুতাম মায়ের কাছে। ভেতরবাড়ির সেই শোবার ঘরের জানালা দিয়ে নাটমন্দিরের ওপাশে বারান্দার দিকটা কিছুটা দেখা যায়। অনেক রাত্তিরে ঘুম ভেঙে একবার তাকিয়ে দেখি নাটমন্দিরের ওধারটা যেন খুব হালকা নীল একটা আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে রয়েছে। আমার চোখে তখন গভীর ঘুম লেগে আছে। খাটের ওদিকে ঘুমন্ত মায়ের গভীর নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। ঝিমঝিম করছে দুপুর রাত। সেই আবছা চেতনার মধ্যেও অবাক হলাম কীসের আলো ওখানে? ওদিকে তো বারান্দায় সেই অতিথি লোকটা শুয়ে আছে। এইসব ভাবতে ভাবতে কখন আবার ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা।

সকালবেলা নাটমন্দিরে আসর বসল স্বপ্নকাহিনী শোনার। মোটা মোটা থামের আড়ালে মা-কাকিমারাও এসে দাঁড়িয়েছেন। পুরুষেরা বসেছেন ঠাকুরদালানের মেঝেতে। বাবা গম্ভীর গলায় বললেন—স্বপ্ন দেখেছ তাহলে কাল রাত্তিরে?

অমর বলল—আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি জানতাম দেখতে পাব।

—কী দেখলে?

অমর বলতে শুরু করল। তার বাচনভঙ্গিও পরিশীলিত এবং মার্জিত। আমরা অবাক হয়ে তার কথা শুনে যেতে লাগলাম।



॥ দুই ॥

বাবার দিকে তাকিয়ে সে বলল—কর্তামশাই, প্রথমে একটা ভাল খবর বলি। আপনার এক ভাই ছোটবেলাতে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন, কেমন কিনা?

আশ্চর্য হয়ে বাবা বললেন—হ্যাঁ, আমার সবচেয়ে ছোট ভাই। চোদ্দ বছর বয়সে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু তুমি কীভাবে—

—স্বপ্নে দেখেছি। শুনুন, আপনার সে ভাই জীবিত আছেন।

—সেকি! কোথায় সে? বেঁচে থাকলে বাড়ি ফিরে আসছে না কেন?

—উনি এখন সন্ন্যাসী। উত্তর ভারতে কোথাও আছেন, জায়গাটা ভাল ধরতে পারলাম না। তবে উনি যে আর গৃহাশ্রমে ফিরবেন না সেটা বুঝতে পারলাম। কেদারনাথ নাম ছিল, না?

বাবা ক্রমেই আরো অবাক হয়ে যাচ্ছেন। বললেন—ঠিক।

বাড়ির মেয়েরা থামের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছেন। ঠাকুমা এতক্ষণ বাড়ির ভেতরে ছিলেন, তখন তিনি বেশ বৃদ্ধা, তাকেও নিয়ে আসার জন্য একজন কাকিমা চলে গেলেন। আমি অমরের দিকে তাকিয়ে আছি। সত্যিই তো, আমরা যাকে ছোটকাকা বলি, তিনি আসলে বাড়ির ছোটছেলে নন। আমাদের ছোটকাকা কৈশোরেই উদাস প্রকৃতির ছিলেন, পনেরো বছর বয়েস পূর্ণ হতে যখন আর মাত্র কয়েকদিন বাকি, তখন একবস্ত্রে বাড়ি ছেড়ে চলে যান। তাকে আমরা কখনো দেখিনি, সে সময় বাবা বা অন্য কাকাদের বিয়ে হয়নি। আসলে আমরা সেজকাকাকে বর্তমানে ছোটকাকা বলে ডেকে থাকি। ছোটকাকার গৃহত্যাগের গল্প আমরা শৈশব থেকে শুনে আসছি। সে সময় গ্রামে সারারাতব্যাপী যাত্রার আসর বসত। ঝুলন পূর্ণিমা উপলক্ষে গাঁয়ে নিমাইসন্ন্যাস পালার আয়োজন করা হয়েছে, নবদ্বীপ থেকে খাস নারায়ণ অধিকারীর দল আসবে। লোকের মধ্যে সাজো সাজো রব। শুনেছি এই দলের যে নিমাই সাজত, তার অভিনয় দেখে দর্শকরা উন্মত্তের মত হরিধ্বনি দিয়ে দুহাত তুলে নাচতে শুরু করত। কিছুক্ষণের জন্য যাত্রার আসর সত্যি সত্যিই সংকীর্তনের আসর হয়ে উঠত। ওই অভিনয় দেখে ছোটকাকা পরের দিন সকালে আর বাড়ি ফিরলেন না। কোথায় যে গেলেন কে জানে। সে যুগে যতটা সম্ভব খোঁজাখুঁজি করা হয়েছিল, কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। তারপর যেমন হয়, যন্ত্রণার ওপর একটু একটু করে সময়ের পলি জমে কষ্টটা কমে এল। কেবল ঘটনাটা একটা পারিবারিক পুরনো গল্প হয়ে রইল।

—রাম। রাম কই? অ রাম!

ঠাকুমাকে ধরে আনছেন মেজকাকিমা। বাবার নাম রামনাথ, তিনি উঠে দাঁড়ালেন। বললেন—কী মা? এই যে, আমি এখানে—তিনি এগিয়ে গিয়ে ঠাকুমার হাত ধরে দাঁড়ালেন।

—মেজবৌমা কী বলছে রাম? ছোটকুর খবর নাকি পাওয়া গিয়েছে?

বৃদ্ধার চোখে আগ্রহের ঔজ্জ্বল্য। বাবা একটু আমতা আমতা করে বললেন—এই যে এই লোকটি—ওর নাম অমরজীবন, ও কাল থেকে আমাদের বাড়ি অতিথি—ও নাকি স্বপ্ন দেখেছে ছোটকু বেঁচে আছে, ভাল আছে। তুমি দাঁড়িয়ে কাঁপছ কেন? বোসো এইখানে—

ঠাকুমা বাবার কথায় ভ্রূক্ষেপ না করে অমরের দিকে তাকিয়ে বললেন—তুমি কে বাবা?

ঠাকুমাকে দেখে অমর দাঁড়িয়ে উঠেছিল, এবার এগিয়ে এসে প্রণাম করে বলল—মা, আমার নাম অমর। আমিও আপনার এক ছেলে—

গতকাল অমর কিন্তু বাবাকে প্রণাম করেনি, সাধারণ ভদ্রতা এবং বিনয় বজায় রেখে কথা বলেছিল বটে, কিন্তু ভক্তিতে গলে পড়ে আদিখ্যেতা করেনি। অথচ বাবা খুব রাশভারী এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। লোকে তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে সাহস পেত না। ঠাকুমাকে দেখে অমর প্রথমে উঠে দাঁড়াল, তারপর পায়ে হাত দিয়ে প্ৰণাম করল। কেন যেন তার এই আচরণ আমার খুব সুন্দর বলে মনে হল। ঠাকুমা বললেন—তুমি জানতে পেরেছ ছোটকু বেঁচে আছে? ভাল আছে?

—হ্যাঁ মা!

—কী করে জানলে?

একটু চুপ করে থেকে অমর বলল—মা, আমি ঠক-জোচ্চোর কিম্বা ধর্মের ব্যবসাদার হলে বলতাম—বিশেষ ক্ষমতায় ডাকিনী যোগিনীকে বশ করে, বা নানারকম কঠিন প্রক্রিয়া করে জেনেছি। এবার এত টাকা দিন, তাহলে যাগ-যজ্ঞ করে সে ছেলে ফিরিয়ে আনব। কিন্তু আপনাকে বাজে কথা বলব না মা, ওসব কিছুই আমি জানি না। আমার একটা জন্মগত ক্ষমতা আছে, আমি স্বপ্নে অনেক কিছু দেখতে পাই। কাল রাত্তিরে এ বাড়িতে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে জানলাম আপনার ছোটছেলের কথা—

ঠাকুমা বললেন—সে ফিরবে না বাবা?

—না মা। আর কেনই বা ফেরাবেন? তিনি ভাল আছেন, সন্ন্যাস গ্রহণ করে ঈশ্বরের আরাধনা করছেন। জানেন মা, হিন্দুধর্মে বলে কোনো বংশের ছেলে সন্ন্যাসী হয়ে গেলে সেই বংশ পবিত্র হয়ে যায়। আনন্দ করুন মা, ছেলের গৌরবে আনন্দ করুন।

ঠাকুমা অমরের মাথায় হাত দিয়ে বললেন—বাবা, যদি আমার ছোটকু ভাল থাকে, শান্তি পেয়ে থাকে, তাহলে সে না-ই বা ফিরল। তার সুখেই আমার সুখ। তুমি এটুকু খবর যে দিলে, তার জন্য ভগবান তোমার মঙ্গল করুন। তুমি আমাকে মা বলে ডাকলে, আমি তোমাকে আশীৰ্বাদ করছি—

এইসময় অমর হঠাৎ একটা অদ্ভুত কাণ্ড করল। সে বলল—মা, আপনি দেখবেন আপনার ছেলেকে? আমি দেখাতে পারি। কিন্তু কথা দিন, তাকে ফিরে আসবার জন্য আদেশ করবেন না। তাহলে হয়ত সে ফিরে আসবে, তার এতদিনের সাধনা নষ্ট হয়ে যাবে। জগতে মাতৃশক্তি একটা বিরাট শক্তি, কেউ তাকে লঙঘন করতে পারে না। কথা দিন—

বাবা এগিয়ে এসে অমরকে বললেন—দেখ ভাই, এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। মাকে সরল মানুষ পেয়ে তুমি—

ঠাকুমা বাধা দিয়ে বললেন—তুই থাম। তারপর অমরের দিকে তাকিয়ে বললেন—আমি কথা দিলাম। আমাকে কী করতে হবে বল—

—কিচ্ছু না। আপনি এইখানে বসুন—

ঠাকুমা তখন নিজে মাটিতে বসতে বা উঠতে পারতেন না। মা আর মেজকাকিমা তাঁকে ধরে আস্তে করে ঠাকুরদালানের মেঝেতে বসিয়ে দিলেন। সামনে বসল অমর। ঠাকুমার হাত আলতো করে ছুঁয়ে বলল—আমার দিকে তাকান। মন শান্ত করুন, মা। একদম হালকা করে দিন। সোজা আমার চোখের দিকে দেখুন, একদম সোজা—

কী বলব ভায়া, তখন ভর সকাল, আমরা অতগুলো লোক দাঁড়িয়ে, আমাদের সামনেই ঠাকুমা ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়লেন। মাথা হেলে পড়ল না, শরীর কাত হল না, কেবল চোখ দুখানা আস্তে আস্তে বুজে এল। সুন্দর, সমাহিত মুখ–যেন ধ্যান করছেন। অমর একদৃষ্টে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। তারও দেহ নিস্পন্দ, সমস্ত শরীরে দৃঢ় একাগ্রতার ভঙ্গি।

কত বছর আগের কথা, তবু এখনো সে দৃশ্য স্পষ্ট মনে আছে। সেই আমাদের চকমিলানো ঠাকুরদালান, বাবা-কাকা, মা-কাকিমারা আর কর্মচারীর দল ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। উঠোনে শীতসকালের সোনারঙ রোদুর এসে পড়েছে। সে উঠোনে কীসের যেন দানা খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে গোলা পায়রার দল। অতগুলো লোক দাঁড়িয়ে, কেউ কথা বলছে না।

দেখলাম ঠাকুমার মুখে সূক্ষ্ম একটা হাসি ফুটে উঠেছে। বাচ্চারা ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলে ঠিক অমন করে হাসে। দু-চার মিনিট হাসিটা রইল, তারপর ধীরে মিলিয়ে গেল। ঠাকুমা আবার শান্ত, সমাহিত, বাহ্যিক কোনো আবেগশূন্য।

অমর মৃদুগলায় ডাকল—মা, এবার জাগুন। দেখা হয়েছে তো? এবার তাকান—

আস্তে আস্তে ঠাকুমা চোখ খুললেন। যেন একটু অবাক হয়ে চারদিকে তাকালেন, কোথায় রয়েছে বুঝতে না পারলে মানুষ যেমনভাবে তাকায়। তারপর সামনে অমরকে দেখে তাঁর মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। অমর বলল—হয়েছে মা?

ঠাকুমা বললেন—হ্যাঁ বাবা, হয়েছে।

বাবা ব্যগ্র হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন—কী দেখলে মা? ছোটকুকে দেখতে পেলে?

সে কথার উত্তর না দিয়ে ঠাকুমা বললেন—বৌমারা আমাকে ধরে তোলো, আমি ঘরে যাব। ঘরে দিয়ে এসো—

দু’পা গিয়ে পেছন ফিরে তাকালেন ঠাকুমা। অমরের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট গলায় বললেন—আমি কিছুটা বুঝতে পেরেছি তুমি কে। আবার এসো মাঝে মাঝে—

অমর বলল-—আসব মা, মাঝে মাঝে আসব।

ঠাকুমা চলে গেলে বাবা বললেন—এ কী উৎপাত! কী চাও তুমি? তুমি কে?

অমর এবার মুখ তুলে বেশ ব্যক্তিত্ব মেশানো গলায় বলল—দেখুন, আমি একজন সাধারণ মানুষ। পথেঘাটে ঘুরে বেড়াই। আপনি কী আমাকে অবিশ্বাস করছেন? আমি তো আপনার কাছে কিছু চাইনি—কেবল এক রাত্তিরের আশ্রয় ছাড়া। তাহলে?

—মাকে তুমি কী দেখালে? মাও তোমাকে কী বলে গেলেন বুঝলাম না। এর মানে কী?

—কিছুই না। উনি বুড়ো মানুষ, ছেলে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ায় ওঁর মনে দুঃখ রয়েছে, সে দুঃখ মা ছাড়া কেউ বোঝে না। ওঁকে যদি একটু আনন্দ আর স্বস্তি দিতে পেরে থাকি, তাতে কী ক্ষতি হয়েছে বলুন?

—তা নয়, কিন্তু মাকে কেন হঠাৎ—মানে, বলছি যে—

—হঠাৎ নয়। কারণ আছে। বললে যদি রাগ না করেন তাহলে বলতে পারি।

বাবা একটু ইতস্তত করে বললেন—বল। রাগ করার মত কথা নিশ্চয় বলবে না।

—আপনার মা আর বেশিদিন বাঁচবেন না।

—সে তো জানা কথাই। উনি বুড়ো হয়েছেন, পঁচাশি বছর বয়েস। এটা আর তুমি নতুন কথা কী বললে? যাই হোক, তাতে কী?

অমর বলল—আজ পৌষ মাসের তিন তারিখ। এই ফাল্গুন মাসের পনেরোই শুক্ল ত্রয়োদশীর দিন সকালে উনি চলে যাবেন। ছেলের খবর জানতে পারলেন না এই কষ্ট নিয়ে যেতেন, তাই ওঁকে একটু আনন্দ দিয়ে গেলাম।

বাবা রেগে উঠে বললেন—তুমি তো অদ্ভুত লোক! আমার বাড়িতে অতিথি হয়ে আমারই মায়ের মৃত্যুর কথা বলছ? জানো, তোমাকে আমি ইচ্ছে করলে—

অমর হেসে বলল—এই দেখুন, আপনি রাগ করবেন না বলে কথা দিয়েও রাগ করছেন। আপনাদের সবাইকে রেখে ভগবানের নাম করতে করতে মা পুণ্যবতীর মত চলে যাবেন, এর চেয়ে ভাল আর কী হতে পারে? দেহধারণ করলে একদিন ছেড়ে যেতে হয়। কেউই চিরজীবী না। আর আমার এ কথা যদি না ফলে, তাহলে তো ভালই। প্রাণভরে আমাকে তখন গালাগাল দেবেন।

বাবা বললেন—তুমি আমাকে দেখাতে পারো? আমি যদি ছোটকুকে দেখতে পাই তাহলে বিশ্বাস করি। পারো দেখাতে?

—দেখুন, আপনাকে বিশ্বাস করাবার কোনো দায় আমার নেই। আপনি আমাকে অবিশ্বাস করলে তাতে আমার কিছু এসে যাবে না। অকারণে শক্তির অপব্যয় করতে নেই।

—তার মানে তোমার মধ্যে কোথাও ফাঁকি আছে। তুমি চালাকি করছ।

অমর বলল—আপনার মা কিন্তু তা মনে করেন না। আচ্ছা, একটা কাজ করা যাক। আপনার বংশের একটা হারানো জিনিসের সন্ধান আপনাকে দিয়ে যাই। তাহলে হয়ত আমাকে আর পুরোপুরি জোচ্চোর বলে মনে হবে না। কেমন?

বাবা ধরা গলায় বললেন—কী জিনিস?

—তিন-চারপুরুষ আগে আপনাদের বংশে একটা অষ্টধাতুর বিষ্ণুমূর্তি ছিল, জানেন কী?

বিস্মিত হয়ে বাবা বললেন—হ্যাঁ, ঠিক কথা। তিন বা চারপুরুষ কেন, আরো বহু-বহু আগে থেকে সে মূর্তি আমাদের গৃহদেবতা হিসেবে পূজো করা হত। কিন্তু বর্গীর হাঙ্গামার সময় সে মূর্তি আমার পূর্বপুরুষেরা কোথাও লুকিয়ে ফেলেন, অথবা হারিয়ে যায়। আর পাওয়া যায় নি। তুমি—তুমি কী বলতে চাও?

—আমি জানতে পেরেছি সে মূর্তি কোথায় আছে। আপনার লোকদের কারুকে বলুন একটা শাবল নিয়ে আমার সঙ্গে আসতে। আপনারাও আসুন।

ঠাকুরদালান থেকে নেমে দেউড়ির ভেতর দিয়ে অমর উঠোনে গিয়ে নামল, তার পেছনে পেছনে বাড়ির সবাই মিছিল করে চললাম। অমর এমনভাবে হাঁটছে যেন সে একেবারে নিশ্চিতভাবে জানে কোথায় যেতে হবে। বাড়ির উত্তর ভিতের কোণায় এসে সে থামল। গদাধর নামে আমাদের একজন কর্মচারীর হাতে ছিল শাবল। অমর তাকে বলল—এইখানে ভিত খোঁড়ো।

গদাধর বাবার দিকে তাকাল। বাবা অমরকে বললেন—কতটা খুঁড়তে হবে?

—মাটি নয়, দেয়ালের গা থেকে তিন-চারটে করে ইঁট খসাও। এই জায়গায়—

বাবা বললেন—সে কী কথা! ভিতের ইঁট খসালে বাড়ির ক্ষতি হবে না?

—কিচ্ছু হবে না। কয়েকটা ইঁট মাত্র। কালই রাজমিন্ত্রি ডেকে গাঁথিয়ে নেবেন।

—কিন্তু এখানটাতেই খুঁড়তে হবে কেন?

—কারণ এ বাড়ি উত্তরে উঁচু, আর এখানেই উত্তর ভিতের শেষ। এখানে শ্ৰীবিষ্ণু রয়েছেন বলেই এদিকটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে বসে যায়নি। জানেন তো, যে জমির ওপর বাড়ি তৈরি, তার রকম অনুযায়ী পঞ্চাশ, একশো কী দেড়শো বছরে ভিত সামান্য কিছুটা বসে যায়। আপনাদের বাড়িতেও তাই হয়েছে। কেবল বিষ্ণুর অধিষ্ঠানের জন্য উত্তর দিক সামান্য উঁচু। তাছাড়া বেয়াল্লিশ হাত হল না তো, সদর দরজা থেকে আটত্রিশ হাত মাত্র হল। তাই এখানেই নিশ্চয় থাকবে। নইলে আরো চারহাত ওদিকে হত—

বুঝলাম বাবা আর যথেষ্ট রাগ করতেও পারছেন না। ক্লান্ত গলায় তিনি বললেন—তুমি কী যে মাঝে মাঝে বল তার কোনো মানে হয় না। কীসের চার হাত কম?

—ও একটা হিসেব, আপনাকে বোঝাতে পারব না। নিন, শুরু করতে বলুন—

ভিতে প্রথম শাবলের ঘা পড়তেই আমরা সবাই ঘন হয়ে ভিড় করে গদাধরকে ঘিরে দাঁড়ালাম। গদাধর আলতো করে গাঁথুনির জোর আলগা করছে, আর আমরা রুদ্ধনিশ্বাসে অপেক্ষা করে আছি। তিনসারি ইঁট খসাতেই ভিতের ভেতরে একটা চতুষ্কোণ গহ্বর বেরিয়ে পড়ল। শাবল রেখে তার মধ্যে হাত গলিয়ে গদাধর বের করে আনল অপূর্ব সুন্দর গঠনের এক দেবমূর্তি। এতদিন অবহেলায় পড়ে থেকেও তার ঔজ্জ্বল্য নষ্ট হয়নি। প্রায় একহাত লম্বা বিগ্রহ, মাথায় ছত্র, মুখে হাসি। আগেই তো বলেছি, আমি তখন খুব ছোট, শিল্পের রস পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করার বয়েস তখনো হয়নি। তবু মূর্তিটা দেখামাত্র মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম মনে আছে।

বাবা গদাধরের হাত থেকে মূর্তিটি নিয়ে দুই হাতে মাথায় ধরে বলতে লাগলেন–জয় শ্ৰীবিষ্ণু! জয় শ্ৰীবিষ্ণু! দেবতা ফিরেছেন! কাকারা তার সঙ্গে বলতে লাগলেন—জয়! জয়! কাকিমারা উলু দিয়ে উঠলেন। বাবা বিষ্ণুমূর্তি মাথায় করে বাড়ির মধ্যে নিয়ে চললেন। সেটি তখনকার মত ঠাকুরঘরে রাখবার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হল, মেয়েরাও ভেতরে চলে গেলেন।

অমরের হাত ধরে বাবা বললেন—ভাই, তুমি আমাকে মার্জনা কর। জানি না তুমি কে, কোথা থেকে এসেছ—জানতেও চাই না। তোমার আশ্চর্য ক্ষমতার কথা আমি স্বীকার করলাম। যদি খারাপ ব্যবহার করে থাকি, তা মনে রেথো না।

সকলের অনুরোধেও অমর সেদিনটা আর থাকতে রাজি হল না। বাবা শেষে বললেন—তাহলে কী এই ধরে নেব যে, তুমি আমাকে মার্জনা করলে না?

—ছিঃ, ও কথা বলবেন না। আমি এইরকমই ভবঘুরে ধরণের, একজায়গায় দুদিন থাকতে ভাল লাগে না। তবে একটা কথা বলে যাই, আপনাদের বংশ খুব পবিত্র এবং ঈশ্বরের আশীর্বাদপূত বংশ। এক পুরুষ বাদ দিয়ে দিয়ে এই বংশে একজন করে সাধক জন্মগ্রহণ করবেন। আপনার ভাই তো সন্ন্যাসী হয়েই গিয়েছেন, এর পরের পুরুষে নয়, এখন যারা ছোট—এই এরা—এদের কারো সন্তান অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে জন্মাবে। সংসারে থেকেও সংসারী হবে না। আপনি তার জন্ম বৃদ্ধবয়সে দেখে যেতে পারবেন—

বাবা বললেন—কী করে বুঝব সে কে?

—তার জন্মের সময়ে আকাশে এক আশ্চর্য নীল উল্কাপাত হবে। নীল রঙের আলোয় ভরে যাবে চারদিক। এখনো অবশ্য তার দেরি আছে। মনে রাখবেন কথাটা। আচ্ছা, চলি তাহলে—

উঠোন পেরিয়ে, সদর দরজা পেরিয়ে অমর চলে গেল। সঙ্গে সে একটা রহস্যের পরিবেশ নিয়ে এসেছিল। সে চলে যাবার পরও সেটা কিন্তু থেকেই গেল। পনেরোই ফাল্গুন সকাল থেকে বাড়ির সবাই ঠাকুমার দিকে সতর্ক নজর রেখে বসে রইল। অমরের ভবিষ্যৎবাণী তাঁকে কেউ জানায় নি। তিনি ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে বাগানে ঘুরে ঘুরে ঠাকুরপূজোর জন্য ফুল তুললেন, তারপর পূজোয় বসলেন। পূজো হয়ে গেলে উপুড় হয়ে গৃহদেবতাকে প্রণাম করলেন।

এবং আর উঠলেন না। প্রণামরত অবস্থাতেই তার মৃত্যু হল।

দাহ সেরে সন্ধেবেলা বাবা-কাকারা বাইরের ঘরে এসে বসেছেন, পাড়ার লোকেরাও একজন দুজন করে আসছেন। এমনসময় মাধব চৌধুরী ঘরে ঢুকে বললেন—আহ্নিক সেরে আমার আসতে একটু দেরি হয়ে গেল। ওহে রামনাথ, বাইরে কে একজন তোমাকে ডাকছে। আমাকে বললে—গিয়ে বলুন আমি এসেছি। আমার নাম অমর, আসবার কথা ছিল আজ। কে হে লোকটা? এ গ্রামে দেখেছি বলে তো মনে হল না—

বাবা প্রায় লাফিয়ে উঠে বাইরে গেলেন।

কেউ নেই। কেউ না। কেবল ঝিমঝিম করছে আসন্ন রাত্রির আবছা অন্ধকার।

পরের পর্ব পড়ুন....


No comments:

Post a Comment