লেখক: নারায়ণ সান্যাল
আজ স্বীকার করতে সঙ্কোচ হয়, কিন্তু ছেলেবেলায় আমার অবস্থাটাও ছিল ঐ রবি ঠাকুরের মতন, - 'আমি নামব মহাকাব্য সংরচনে, ছিল মনে।' ছেলেবেলায় জীবনের লক্ষ্য ছিল একটা মহাকাব্য রচনা করার। বাল্মীকির যেমন রাম, বেদব্যাসের যেমন অর্জুন, আমারও তেমনি হাতের কাছে ছিল ভূতোদা। রামের অয়ন যদি 'রামায়ণ' হতে পারে, তবে ভূতোদার কীর্তিকাহিনী নিয়ে আমার 'ভূতায়ন' বা হবে না কেন?
এখন সে কথা মনে পড়লেও হাসি আসে। ছেলেবেলার সেসব দিনগুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। যে ভূতোদা ছিল আমার গুরুদেব, আমার ধ্রুব নক্ষত্র, সে এখন কোথায় আছে, বেঁচে আছে কিনা, তাই খবর রাখি না। ছেলেটার অনেক দোষ ছিল, তবু তাকে আমরা সবাই ভালবাসতাম। ছেলেবেলায় তার কীর্তিকাহিনীগুলির কিছু কিছু আমার এখনও বেশ মনে আছে। তা থেকেই তোমাদের দু'একটা উপহার দিই। আশা করি, তোমরাও ক্রমশ ভূতোদাকে ভালবেসে ফেলবে।
ভূতোদা ছিল আমাদের ক্লাসের সেরা ছেলে। 'সেরা' মানে ফার্স্ট বয় নয়; যাকে বলে লীডার আর কি! না, ভুল বললাম; ক্লাসটা তো আমাদের নয়! ক্লাসটা ভূতোদারই।
আমরাই বরং এ বছর ভূতোদার ক্লাসে উঠেছি ক্লাস নাইন থেকে প্রমোশন পেয়ে। আগের বছরও এ ক্লাসটা ছিল ভূতোদার, নিঃসন্দেহে পরের বছরও তাই থাকবে। মাত্র একটি বছরের জন্য, সে আমাদের ক্লাসসুদ্ধু ছেলেকে, ওর ক্লাসে বসবার অনুমতি দিয়েছে ।
সত্যিই!
স্কুলের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণার ঐ ঘরখানায় শ্রীমান ভূতনাথ ভট্টাচার্যের ছিল মৌরসী-পাট্টা। একেবারে লর্ড কর্ণওয়ালিস সাহেবের হাত থেকে পাওয়া চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত অবশ্য নয়, কিন্তু ভূতোদা যখন বলত, - 'ওরে--, এই ভূশণ্ডি বায়সের বয়স নিয়ে তোরা রসিকতা করিস না। এই ত্রিকালজ্ঞ মানুষটা অক্ষয় বটের মতো অনেক - অনেক কিছু দেখেছে, আবার অনেক কিছু দেখবেও! এ ক্লাস-ঘরের সুমুখে যখন 'ক্লাস টেন' নয়, 'ফার্স্ট ক্লাস' লেখা থাকত, তখনও এ পাড়ায় আমার যাতায়াত ছিল, তা জানিস অকালকুষ্মাণ্ডের দল?'
তখন কেন যেন অবিশ্বাস করতে ভরসা হত না। অবশ্য বাড়তে বাড়তে ও যখন বলতে শুরু করে, - 'কলকাতায় তখন ঘোড়ায়-টানা ট্রাম চলত, বুঝলি? - তখন আমাদের মধ্যে কেউ কেউ মুখ নিচু করে হেসে ফেলত।
আর রক্ষে নেই।
ভূতোদা গর্জন করে ওঠে, হাসে কে? নেপাল হাসি চেপে বলে, - হাসিনি তো ভুদ্দা। আচ্ছা বিদ্যাসাগর মশাই যেবার আমাদের স্কুলে প্রাইজ দিতে আসেন, সেবার তুমি যেন কোন ক্লাসে পড়তে?
সব সাবজেক্টে ফেল হলেও ভূতোদা বুঝতে পারে, এটা নেহাৎ চ্যাংড়ামি। কথার প্যাঁচে ওকে ল্যাং মারার চেষ্টা। তাই উদাস হয়ে জবাব দেয়, - তোদের সিরিয়াসলি কিছু বললে তো বিশ্বাস করবি না, শুধুমুধু চ্যাংড়ামি করবি। বিদ্যাসাগর মশাই কি আজকের মানুষ! তাঁর আমলে আমি তো ছাড়, আমাদের এই কলেজিয়েট স্কুলটাই জন্মায়নি। তবে হ্যাঁ, স্যার আশু মুখুজ্যে মশাইকে একবার দেখেছিলাম। এই স্কুলেই। - হ্যাঁ, রিয়াল রয়াল বেঙ্গল টাইগার যাকে বলে। ইয়া বুকের ছাতি, ইয়া গোঁফ। প্রাইজ দিতে এসেছিলেন আমাদের স্কুলে। হেডমাস্টার মশাই আমার নাম ডাকতে আমি তো গুটি গুটি এসে দাঁড়ালাম তাঁর সামনে। দু-হাত তুলে নমস্কার করলাম। এক নজর তিনি আমাকে দেখে নিলেন আপাদমস্তক, তারপর বললেন, বেশ প্রমিসিং চেহারা তো ছোকরার। ভালো গোলী হবে। শিবুকে বলব, একে একটা চান্স দিতে।
নেড়া বলে, শিবু কে, - ভূদ্দা?
- তোরা চিনিস না। শিবদাস ভাদুড়ী। মোহনবাগান যেবার প্রথম আই এফ. এ. শীল্ড পায়, সেবার - -
- হ্যাঁ, হ্যাঁ, নাম শুনেছি।
হেসে ভূতোদা বলে, - নামই শুনেছিস, খেলা তো আর দেখিসনি?
গজেন চালেঞ্জ করে, - তুমি দেখেছ?
ধ্যানী বুদ্ধর মতো ভূতোদা শুধু হাসলে। জবাব দিলে না।
গজেন আবার বলে, - কত সালের কথা বল তো?
গজেনটা আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয়। কথায় কথায় সাল-তারিখ এনে হাজির করা ওর বাতিক। কোনও কথাই সহজে বিশ্বাস করতে চায় না। আসলে বিদ্যা জাহির করা আর কি!
ভূতোদা কিন্তু সাল-তারিখ এড়িয়ে বলে, - ওরে হতভাগা, সাল-তারিখই যদি মুখস্থ রাখতে পারব, তাহলে কি আর আমার এমন দশা হয়? তা পারলে তো এ্যাদ্দিনে এই কলেজিয়েট ইস্কুলে এসে তোদের পড়াতাম, কিংবা পড়ানো-টড়ানো শেষ করে রিটায়ার্ড লাইফে নাতিপুতি নিয়ে ঘরে বসে আরাম করতাম। নেহাৎ এই ফার্স্ট ক্লাসটার উপর কেমন যেন মায়া পড়ে গেছে, তাই রয়ে গেছি এখানে।
হেসে ভূতোদা বলে, - নামই শুনেছিস, খেলা তো আর দেখিসনি?
গজেন চালেঞ্জ করে, - তুমি দেখেছ?
ধ্যানী বুদ্ধর মতো ভূতোদা শুধু হাসলে। জবাব দিলে না।
গজেন আবার বলে, - কত সালের কথা বল তো?
গজেনটা আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয়। কথায় কথায় সাল-তারিখ এনে হাজির করা ওর বাতিক। কোনও কথাই সহজে বিশ্বাস করতে চায় না। আসলে বিদ্যা জাহির করা আর কি!
ভূতোদা কিন্তু সাল-তারিখ এড়িয়ে বলে, - ওরে হতভাগা, সাল-তারিখই যদি মুখস্থ রাখতে পারব, তাহলে কি আর আমার এমন দশা হয়? তা পারলে তো এ্যাদ্দিনে এই কলেজিয়েট ইস্কুলে এসে তোদের পড়াতাম, কিংবা পড়ানো-টড়ানো শেষ করে রিটায়ার্ড লাইফে নাতিপুতি নিয়ে ঘরে বসে আরাম করতাম। নেহাৎ এই ফার্স্ট ক্লাসটার উপর কেমন যেন মায়া পড়ে গেছে, তাই রয়ে গেছি এখানে।
ক্যাবলা ফোড়ন কাটে, এটা আর এখন ফার্স্ট ক্লাস নয় ভূদ্দা, এটা এখন ক্লাস টেন।
ভূতোদা বলে, - তবেই দ্যাখ, ক্লাসটা পর্যন্ত কালে-কালে পালটে গেল, তবু তোদের এই ত্রিকালজ্ঞ ভূশণ্ডি-কাকের কোনও পরিবর্তন হল না।
আমি বলি, - সে আমলে তুমি বুঝি ক্লাসে ফার্স্ট-সেকেন্ড হতে?
ভূতোদা বলে, - তবেই দ্যাখ, ক্লাসটা পর্যন্ত কালে-কালে পালটে গেল, তবু তোদের এই ত্রিকালজ্ঞ ভূশণ্ডি-কাকের কোনও পরিবর্তন হল না।
আমি বলি, - সে আমলে তুমি বুঝি ক্লাসে ফার্স্ট-সেকেন্ড হতে?
খ্যাঁকখ্যাঁক করে শেয়ালী হাসি হেসে ভূতোদা বলে, নরেনটা কী গাড়োল দ্যাখ। আরে গিদ্ধড়, ক্লাসে ফার্স্ট-সেকেন্ড হলে হাঁটুর বয়সী এই সব ছানাপোনারা কি আমার নাগাল পায়? কবেই পাস করে বেরিয়ে যেতাম না?
আমাদের সবাইকে হাঁটুর বয়সী বলায় আমরা অবশ্য কিছু মনে করিনি। বস্তুত ভূতনাথ ভট্টাচার্যের ঐ নী-কাপ পরা হাঁটুজোড়া নিশ্চয়ই আমাদের চেয়ে বয়সে অনেক বড়। ও দুটো ভূতোদার সঙ্গেই ভূমিষ্ঠ হয়েছিল এবং সাল শতাব্দীর হিসাবে সে দুর্ঘটনাটা ঘটেছিল আমাদের জন্মলগ্নের অনেক অনেক আগে। কিন্তু তাই বলে এক নিশ্বাসে আমাকে গাড়োল আর গিদ্ধড় বলবে?
আমি বলি, - তবে যে এখুনি তুমি বললে স্যার আশুতোষ তোমাকে প্রাইজ দিয়েছিলেন?
ভূতোদা বলে, -দিয়েছিলেনই তো! তবে সেটা ফার্স্ট হবার জন্যে নয় রে বোকচন্দ্র, প্রাইজ দিয়েছিলেন ম্যাক্সিমাম্ অ্যাটেন্ডেন্স্-এর জন্যে।
আবার বোকচন্দ্র! আমি চটে উঠে বলি - ও। সে আমলে তুমি বুঝি আজকালকার মতো মাসে বাইশ দিন কামাই করতে না?
আবার বনবেড়ালের মত খ্যাঁকখ্যাঁক করে হেসে ওঠে ও। বলে, আরে দ্যাখ্ তোরা, হাঁদারামের বুদ্ধির দৌড়টা দ্যাখ। আরে ছুছুন্দর! হপ্তায় এক, মাসে চারদিনের বেশি কোন ভদ্দরলোক ক্লাসে আসে?
- তবে যে তুমি বললে বেস্ট-অ্যাটেনডেন্স প্রাইজ পেয়েছ?
- নাঃ। বকিয়ে মারলে দেখছি। গোড়া থেকে না বললে এ অনড্বানটার মস্তিষ্কে কোন বার্তা প্রবেশ করবে না।
আমরা বুঝতে পারি, এটা হচ্ছে ভূতোদার ভূমিকা। ওর ভাষায় 'অবতরণিকা'। মেজাজ খোশ থাকলে ভূতোদা গালভারি সংস্কৃত ভাষা ব্যবহার করে। গল্প শুনবার জন্য আমরা ওকে প্রায়ই উসকে দিতাম। মনে মনে ভূতুড়ে গল্প বলবার জন্য যতই ইচ্ছা থাক, মুখে সে ভারি বিরক্তি প্রকাশ করত। শেষ পর্যন্ত ছোট্ট একটি ভূমিকা, মানে অবতরণিকা' সেরে আষাঢ়ে গল্পের সরোবরে অবগাহন করত।
ভূতোদা বলতে থাকে। - অনলেকে চিনিস্। চিনিস না? প্রফেসর অনিলচন্দ্র ভট্টাচার্য, রিপন কলেজে পড়ায়। 'রিপন' তো নয়, এখন আবার কী-সব নতুন নতুন নাম হয়েছে কলেজগুলোর। তা সে যাকগে-মরুকগে, - ঐ অনলে হচ্ছে আমার ভাইপো। খুড়ো-ভাইপো তখন একই ক্লাসে পড়ি। অনলেটা ছিল, যাকে বলে এক্কেবারে গুডবয়। ঐ গজাটার মতো বইয়ের পোকা। ক্লাসে ফার্স্ট হত। এনট্রান্সে স্কলারশীপ বাঁধা।
- এনট্রান্স মানে? কতদিন আগেকার কথা বলছ? বাধা দিয়ে প্রশ্ন করে বসে গজেন।
ওর দিকে একজোড়া জ্বলন্ত চোখের দৃষ্টি মেলে ভূতোদা বলে, তোরা আজ যাকে ম্যাট্রিক বলিস, তোদের বাপ- জোঠারা তাকেই 'এনট্রান্স' বলতেন, বুঝেছিস? আমরাও সে-আমলে তাই বলতাম। আই এ কে বলতাম 'ফার্স্ট- আর্টস', সিনেমাকে বলতাম 'বায়োস্কোপ', সিগারেটকে বলতাম 'বার্ডস-আই', বুঝলি? তা সে যাকগে-মরুকগে, গল্পটা শোন। সামনেই আবার প্রাইজ-ডিস্ট্রিবিউশান! অনলে ভাইপো হয়ে প্রাইজ পাবে, আর আমি খুড়ো হয়ে পাব না? এটা কি রকম অশোভন দৃষ্টিকটু ব্যাপার? অনলে সব কথা খুলে বললে হেডমাস্টার মশাইকে। হেডমাস্টার মশাই ছিলেন বিচক্ষণ ব্যক্তি। সে আমলে বয়সের সত্যিই একটা মর্যাদা ছিল। সব কথা শুনে হেডমাস্টার মশাই বললেন - 'কথাটা তো তুমি ঠিক বলেছ, বাবা অনিল, কিন্তু এ তো স্পোর্টস্ নয়, এখানে তোমার খুড়ো মশাইকে কী প্রাইজ দেব বল?' তা অনলে বলে- 'কিছু মনে করবেন না, স্যার, আপনি একটু ইচ্ছে করলেই খুড়োকে ম্যাক্সিমাম অ্যাটেনডেন্স' প্রাইজটা পাইয়ে দিতে পারেন। আপনি গত পাঁচ বছরের হাজিরার খাতা তলব করুন। দেখুন, ভূতনাথ ভট্টাচার্য ফার্স্ট ক্লাসে কতবার 'প্রেজেন্ট - স্যার' হয়েছে।'
আনা হল খাতা। কিছু পুরানো খাতা অবশ্য উইপোকায় খেয়ে ফেলেছিল, তা যাকগে-মরুকগে, তবু দেখা গেল, মাসে বাইশ দিন কামাই করেও গত পাঁচ বছরে ভূতনাথ ভট্টাচার্যের নাম তিনশ'র উপর পি। কেরানিবাবু টোটাল দিয়ে বললেন- 'থ্রি হান্ড্রেড অ্যান্ড ফট্টি টু।
আমি মাথা চুলকে একটু লাজুক লাজুক মুখে বলি, 'বলুন থ্রি হান্ড্রেড অ্যান্ড ফট্টি টু নট-আউট।' আমি এখনও ঐ ফার্স্ট ক্লাসেই আছি, ঈশ্বর জানেন, আরও কত বছর থাকতে হবে। হক কথা। প্রাইজ না দিয়ে যাবে কোথা? আমার স্কোর তখন স্যার ব্রাডম্যানের হাইয়েস্ট টেস্ট স্কোরকেও ছাড়িয়ে উঠেছে।
গজেন হতভাগা আবার বাধা দিয়ে বলে ওঠে, - ইন্ডিভিজুয়াল ইনিংসে হাইয়েস্ট টেস্ট-স্কোরার কিন্তু ব্র্যাডম্যান নন ভূতোদা!
শিশুপালের শত অপরাধ ক্ষমা করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। কিন্তু সকলেই কিছু কেষ্ট ঠাকুর নয়, অন্তত আমাদের ভূতোদা নয়। একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে ভূতোদা।
বলে, তুই চুপ করবি জিবেগজা? যে জিনিস বুঝিস না, তা নিয়ে তর্ক করিস না। এ তোর অঙ্ক-ভূগোল ইতিহাস নয়, এ হল স্পোর্টস-সাম্রাজ্য। এখানে আমিই অথরিটি।
গজেন সবচেয়ে ক্ষেপে যায় তাকে 'জিবেগজা' বললে। তখন ওর আর জ্ঞান থাকে না। ক্ষেপে ওঠে সে। বলে, - নিজেকে তুমি সব বিষয়েই অথরিটি ভাবতে পারো, কিন্তু টেস্টে হাইয়েস্ট স্কোরার হচ্ছেন গারফিল্ড সোবার্স। ওয়েস্ট ইন্ডিজের।
-আরে চুপ যা তুই। আমি যে আমলের কথা বলছি তখন সোবার্স টেস্ট খেলা শুরুই করেনি। সোবার্স তো কালকের ছেলে, লেন হাটনও তখন ভাঙেনি স্যার ব্র্যাডম্যানের রেকর্ড। আমরা ঝগড়া থামিয়ে দিয়ে বলি, - ওসব নাবালক চ্যাংড়ার কথায় কেন কান দাও ভূদ্দা। তারপর কি হল বল?
কিন্তু মুড একবার নষ্ট হয়ে গেলে ভূতোদা আর মুখ খোলে না। পকেট থেকে ছোলাভাজার ঠোঙাটা বার করে চিবুতে চিবুতে রওনা দেয় মাঠের দিকে। অর্থাৎ আমাদের গল্পটাও ঐ সঙ্গে মাঠে মারা গেল আর কি। আমরা সবাই খেপে উঠি গজাটার উপর। ক্লাসে ফার্স্ট হয় বলে সকলের মাথা কিনে রেখেছে নাকি। কী দরকার ছিল এমন জমাটি আসরটা ভেঙে দেবার?
কিন্তু গজেনও অত সহজে হার মানবার ছেলে নয়। সাল-তারিখ দিয়ে সে তার যুক্তির সারবত্তা প্রমাণ করতে চায়। হাত-পা নেড়ে চেঁচিয়ে বোঝাতে চায়, সে কিছুই ভুল বলেনি।
সত্যি গজাটা কী গাড়োল! কেমন করে যে ও হতভাগা পরীক্ষার খাতায় অত অত নম্বর পায় ? গবেটটা কি ভাবে, ভূতোদা এ গল্পগুলো আমাদের বিশ্বাস করাবার জন্য বলে? ও আনন্দ পায় বলে, আর আমরা পাই শুনে। এর মধ্যে সাল-শতাব্দী কেন রে বাবা!
আসলে ওসব কিছু নয়। তবে হ্যাঁ, ভূতোদার বয়সটা কিছু বেশি। সে-আমলে, অর্থাৎ আমি যখন স্কুলে পড়ি তখন ক্লাস টেনটাই ছিল স্কুলের শেষ ধাপ। তা সেই শেষ ক্লাসের পক্ষেও ওর বয়সটা ছিল কিছু বেমানান ধরনের। আর হ্যাঁ, এ ক্লাসের ঐ শেষ বেঞ্চটায় সে দীর্ঘদিন ধরে বসছে। অন্তত আমি নিজে ক্লাস ফাইভে যখন এ স্কুলে এসে ভর্তি হই, তখন থেকে ওকে ঐখানেই বসতে দেখেছি। মানে সেই বিরল দিনগুলিতে যখন সে ক্লাসে আসত। ভূতোদাকে প্রথম দিন থেকেই আমি চিনতাম। না চিনে উপায় নেই। সে ছিল আমাদের স্কুলের চাম্পিয়ান প্লেয়ার। এ তল্লাটের সবচেয়ে নামকরা গোল-কীপার। সত্যিই প্রাণ দিয়ে খেলত সে!
একবার আমাদের ক্লাসে বি. টি. ট্রেনিং- এর একজন কম-বয়সী মাস্টার-মশাই পড়াতে আসেন। প্রায় ভূতোদারই সমবয়সী। ভূতোদার কি একটা দুষ্কর্মে তিনি চটে উঠে বলেছিলেন, হোয়াট্স্ য়োর নেম? ইউ শ্যাল হ্যান্ড টু পে হেভি পেনাল্টিজ ফর ইয়োর ইন্সোলেন্স।
ভূতোদা দাঁড়িয়ে উঠে একগাল হেসে বলেছিল, মাই নেম ইজ 'পেনাল্টি-ঈটার' স্যার।
মিথ্যা কথা বলেনি ভূতোদা। সত্যিই ঐ খেতাব আমরা ওকে দিয়েছিলাম। ভূতোদা যে টীমের গোলকীপার সে টীম আজ পর্যন্ত পেনাল্টিতে গোল খায়নি। আনব্রোকন রেকর্ড ওর! গ্রাস-কাটিংই হোক, অথবা রেনবো শটই হোক, - প্রতিটি পেনাল্টি কিক ভূতোদা কপাৎ করে ধরে ফেলত। অনেকে ফলস্ স্টেপিং নিয়েও দেখেছে, কিন্তু ভূতোদাকে কাৎ করতে পারেনি। মানে কাৎ ভূতোদা হয়েছে, কিন্তু বে-কাৎ হয়নি। শেষ দিকে এমন অবস্থা হয়েছে যে, ভূতোদাকে গোলে দাঁড়াতে দেখলে বাঘা বাঘা সেন্টার ফরোয়ার্ডও নার্ভাস হয়ে আউটে বল মারে।
ভূতোদা হেসে বলত, - আমাকে যে পেনাল্টিতে গোল দেবে সে আজও মাতৃগর্ভে। নেটের পিছনে দাঁড়ালেও গোল দিতে পারবে না। এই কন্দর্পকান্তি চেহারাখানা দেখেই ওরা নার্ভাস হয়ে আউটে বল মারবে।
আর শুধু কি ফুটবল? দৌড়, হকি, ক্রিকেট সব খেলাতেই সে অদ্বিতীয়!
আর ভলিবলে ঐ ন্যাড়া তালগাছ-প্রমাণ মানুষটি যখন নেটে দাঁড়ায়, তখন বিপক্ষের নেটম্যান পারে তো মাথায় একটা হেলমেট পরে। দু-একবার লাফ দেবার পরেই - সে বেচারি আর নেট দেখতে পায় না, বল দেখতে পায় না, - সে শুধু দেখে বিশাল ফুলে-ভরা একটা সর্ষেক্ষেত। অদ্ভুত চৌখস ছিল ভূতোদার নেটের খেলা! গার্ডলাইন থেকে আলতো করে বলটাকে কোনক্রমে নেটে ফেলে দাও। ব্যস, আর দেখতে হবে না। ভূতোদা একটা জ্বলন্ত হাউই এর মতো উঠবে, নেট ছোঁবে না, ফলস্ করবে না, কিন্তু প্রচণ্ড স্ম্যাশে বেড়ে যাবে একটা পয়েন্ট। কিন্তু প্রতি তৃতীয় স্ম্যাশের সঙ্গে রেফারীর চোখ এড়িয়ে ওপক্ষের নেটম্যানের ব্রহ্মতালুতে চালায় একখানা পেল্লাই থাপ্পড়। এটা নাকি ভূতোদার নিজস্ব অবদান!
তা এ হেন ভূদ্দাকে লিডার করব, না তো কি - ঐ মেনীমুখো পিলে-ডিগ-ডিগ বই-পোকা জিবেগজাকে লিডার করব?
তোমরাই বল?
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এই গল্পটি শুনতে হলে নিচের লিংকে ক্লিক করুন:
এই সিরিজের পরের গল্পের লিঙ্ক -
- অপারেশন - শিল্ড ফাইনাল
- অপারেশন - মাদার্যাহমপি
- অপারেশন - ভূতের নৃত্য
- অপারেশন - বেলুন ফটাস
No comments:
Post a Comment