ফকির চাঁদ
ভূতায়ন - অপারেশন বেলুন ফটাস (Bhutayan - Operatio Belun Fotas)
এছাড়া পড়ত সার্কাসের তাঁবু। বাঘ-সিংহ-হাতি-ঘোড়া-কুকুর আর জোকার। প্রচণ্ড ভিড় হত সার্কাসে। এ-ছাড়াও থাকত আজব তাঁবু, - - এক-মানুষের দুটো মাথা। মাকড়শা মানুষ। আরও কত কি!
জুয়ার তাঁবুও ছিল। তবে আমাদের সে-পাড়ায় যেতে দেওয়া হত না।
কিন্তু আমাদের বারোদোলের মেলায় ব্যবস্থাটা ছিল অন্যরকম। উত্তর ভারত থেকে একজন দোকানদার আসত ঐ বেলুনের দোকান নিয়ে। সেই বেলুনের দোকানে ভূতোদার কীর্তিকাহিনীটা এবার শোনাই।
ভূতোদা, আগেই বলেছি, অলরাউন্ড স্পোর্টসম্যান। এয়ারগান এও তার অদ্ভুত টিপ। দশবার ফায়ার করলে অন্তত ছয়বার বুলস-আইয়ের ভিতর হিট করবে। বাকি চারখানা কেন্দ্রের ছোট্ট চক্রের কানঘেঁষে বেরোবে। বারোদোলের মেলায় বেলুনের দোকানে ব্যবস্থাটা ছিল বিচিত্র। অসংখ্য বেলুন ঝুলছে, -- ছোট থেকে বড়, কাছে থেকে দূরে। প্রতিটি বেলুনের গায়ে একটা করে নম্বর। যে বেলুন যত কাছে, আকারে যত বড়, -- তার নম্বর তত কম। যে বেলুন যত দূরে আর মাপে যত ছোট, -- তার নম্বর তত বেশি। সব চেয়ে কম নম্বর হচ্ছে পাঁচ, আর সবচেয়ে দূরের অ্যাতোটুকু বেলুনটার নম্বর পাঁচ শো। ছররা গুলির দাম এক পয়সায় দুটো, অর্থাৎ টাকায় বত্রিশটা ছররা। পাঁচ-নম্বর বেলুনটা ফাটাতে পারলে দোকানদার দেবে পাঁচ দুগুনে দশ পয়সা, পাঁচশ নম্বর বেলুনটা ফাটাতে পারলে পাওয়া যাবে পাঁচশো দুগুনে হাজার পয়সা, অর্থাৎ দশ টাকা!
নগদে পাবে না কিন্তু! ঐ দোকানেই সাজানো আছে হরেকরকম মনোহারী সওদা। লজেন্সের কৌটো, বিস্কিটের টিন, নানান জাতের পুতুল, ক্রিকেট ব্যাট, টেনিস র্যাকেট, ফুটবল থেকে শুরু করে ক্যারাম বোর্ড, শৌখিন কাপডিশের সেট, মায় দেওয়াল-ঘড়ি। সে-আমলে রেস্তোরাঁয় গিয়ে পুরো আট আনার খাবার খাওয়া যেত না। সুতরাং দশ টাকায় চীনামাটির তেত্রিশ পীসের শৌখিন ডিনার সেট পাওয়া যেত।
আগেই বলেছি, ভূতোদা আমাদের লীডার। এখনও মনে আছে, ন্যাপলা যেদিন ক্লাসে বারোদোল মেলার ঐ বেলুন স্টলের গল্পটা প্রথম শোনালো, -- সেদিন ভূতোদা তো একেবারে আহ্লাদে আটখানা। বলে, চল আজ দলবেঁধে বারোদোলের মেলায় যাব। বেলুনের দোকানটা ফাঁকা করে দিয়ে আসতে হবে।
এ বিষয়ে আমাদের কোনও সন্দেহ নেই। ভূদ্দার একটা নিজস্ব এয়ারগান আছে। সেটা সে তার ভোম্বল মামার কাছ থেকে উপহার পেয়েছিল, উপনয়নের দিনে। সকালে ব্যায়াম সেরে প্রতিদিন সে নিয়ম করে গুণে গুণে পঁচিশটা ফায়ার করে। ইদানীং সে এয়ারগান ছুঁড়ে বাগানের পাকা আম পাড়ে। গুলি আমের গায়ে লাগে না, -- লাগে বোঁটায়! ভূতোদার ছোট বোন নেড়ি ধামা বাড়িয়ে ধরে। আমটা টুপ করে ধামায় পড়ে। মাটিতে পড়ে না। এ হেন লক্ষ্যভেদী অর্জুন আর অনেক আশা নিয়ে আমরা সদলবলে চললাম বারোদোলের মেলায়, -- ভূদ্দা, সুখেন, নেড়া, মন্টু, ন্যাপলা আর আমি। প্রত্যেকে চার আনা করে চাঁদা দিয়েছি। আমাদের মোট পুঁজি চার-ছয় চব্বিশ আনা; অর্থাৎ দেড় টাকা। তার মানে দেড় ইনটু বত্রিশ অর্থাৎ আটচল্লিশটা ছররা। আমরা নিশ্চিত যে ভূতোদা দোকানের সব কয়টা বেলুন ফটাস্ করে দেবে। তার মানে গুদাম-সাবাড়! ফেরার পথে বোধহয় একটা ঠেলাগাড়ি ভাড়া করতে হবে!
তিন-তিনটে সাইকেলে ডবল-ক্যারি করে আমরা ছয়জন যখন বারোদোলের মেলায় গিয়ে পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা হয়-হয়। সারা মেলায় তখন পেট্রোম্যাক্স, হ্যাজাক আর ডে-লাইট জ্বালার ধুম। তখনও শহর কৃষ্ণনগরে ইলেকট্রিক লাইটের লাইন পাতা হয়নি। মেলার প্রবেশ দ্বারে সাইকেল স্ট্যান্ডে সাইকেল জমা দিয়ে আমরা পাঁচ মস্তান গুরুজীর পিছন-পিছন বেলুন-তাঁবুর দিকে এগিয়ে চলি।
ভূতোদা ক্ষেপচুরিয়াস হয়ে ওঠে। বলে, -- তুই এখানে কেন? গজেনও রুখে ওঠে, -- কেন? এমন তো কোন আইন নেই যে, সব সাবজেক্টে ফেল করতে না পারলে বারোদোলের মেলায় আসা যাবে না?
ভূতোদা জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে দেখল শুধু। জবাব না দিয়ে তাঁবুর ভিতরে ঢুকে গেল। ন্যাপলা বলে, দিলি তো ভূদ্দার মেজাজটা বিগড়ে? এখন ও ক্রমাগত মিস্ করবে। মেজাজ খারাপ হলে টিপ কখনো ঠিক থাকে?
গজেন বলে, ও এমনিতেই মিস্ করতো। এখন বরং আমার ঘাড়ে দোষ চাপাবার একটা অজুহাত পাবে। সুখেন বলে, যাগগে মরুগগে ওসব ছেঁদো কথা! গজেন, তুই কি আমাদের দলে আসবি? চার-আনা চাঁদা দিয়ে? গজেন জানতে চায়, কিসের চাঁদা? ন্যাপলা আর ন্যাড়া ওকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেয়, -- এই বেলুন-তাঁবুর যাবতীয় সওদা বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য আমরা অপারেশন বেলুন-ফটাস্ স্কীম করেছি। শুনে গজেন তো হেসেই বাঁচে না!
বেলুন ফটাস্। নারায়ণ সান্যাল। মজার গল্প। গল্প পাঠে : অনুব্রতা Narayan Sanyal. Comedy Story Bhutayan
এই সিরিজের অন্য গল্পগুলি:
ভূতায়ন - অপারেশন শীল্ড ফাইনাল (Bhutayan - Operational Shield Final)
ওর কাকা ছিলেন স্থানীয় ওভারসিয়ার-স্কুলের ড্রইং টিচার। তিনি বলতেন, - ওর মাথা নাকি খুব সাফ। মন দিয়ে পড়াশুনা করলে ভূদ্দা নাকি অনায়াসে এঞ্জিনীয়ারিঙেও পাস করত। শোনা যায় হেডমাস্টার মশাই ওকে ডেকে একবার বলেছিলেন, - 'বাবা ভূতনাথ, মন দিয়ে পড়লে তুমি পাস করতে পার না, এটা তো আমার বিশ্বাস হয় না বাবা।'
ঘাড় চুলকে লাজুক লাজুক মুখে ভূতোদা উত্তরে বলেছিল, - 'ঐ জন্যই তো আমি মন দিয়ে পড়ি না, স্যার।' দূরন্ত বিস্ময়ে হেডমাস্টার মশাই বলেছিলেন, - 'কেন বাবা? তাহলে কি হবে?'
-'পড়লেই আমি পাস করে যাব। আর আমাদের স্কুল টীমটা একেবারে কানা হয়ে যাবে। স্যার গুরুদাস চ্যালেঞ্জ শীল্ডটা হিপ্-হিপ-হুররে করে নিয়ে যাবে ঐ সি. এম স্কুল।' গম্ভীর-প্রকৃতি হেডমাস্টার মশাই নাকি হেসে ফেলেছিলেন ওর কথা শুনে।
কিন্তু আমরা হাসিনি। হাসির কথা নয় বলেই হাসিনি। স্যার গুরুদাস চ্যালেঞ্জ শীল্ড আমরা পর পর চার বছর ঘরে আনছি। প্রতিবারই ক্রিশ্চিয়ান মিশনারী স্কুল, বা সংক্ষেপে সি.এম.এস হয় রানার্স-আপ। কতবার কত ভাবে যে ভূতোদা আমাদের স্কুলের সম্মান রক্ষা করেছে তা আর কহতব্য নয়। এককালে স্যার আশুতোষ বলতে নাকি বোঝাত বিশ্ববিদ্যালয়কে, আর বিশ্ববিদ্যালয় বলতে বোঝাত স্যার আশুতোষকে। আশ-পাশের পাঁচটা স্কুল টীমও তেমনি কলেজিয়েট স্কুল বলতে বোঝে ভূতনাথ ভট্টাচার্যকে আর ভূতনাথ বলতে বোঝে আমাদের স্কুলের পেনাল্টি ঈটার গোলী, উইকেটকীপার-কাম-সেঞ্চুরি ব্যাট এবং নির্ভুল স্ম্যাশার নেটম্যানকে।
এ বছরও শীল্ড ফাইনালে যথারীতি ওদিক থেকে উঠেছে সি.এম স্কুল আর এদিক থেকে উঠেছেন আমাদের আদি-অকৃত্রিম ভূতোদা, আরও দশটা ছানাপোনা নিয়ে।
ফাইনালের খেলাটা যাতে জমজমাট হয় তাই কর্তৃপক্ষ আমাদের এই দুটি সেরা স্কুলের টীমকে দু-দিকে গ্রুপে রেখে নকআউট প্রোগ্রাম ছকতেন। এবার ফাইনাল খেলা প্রথম দিন গোললেস্ ড্র হয়েছে। সেদিন আমি মাঠে যাইনি। এই অপরাধে ভূতোদা প্রথমেই তো আমাকে ন-ভূতো ন-ভবিষ্যতি ধমকালো। তাই দ্বিতীয় দিন ঠিক সময়ের আগেই গিয়ে মাঠে হাজিরা দিলাম।
মাঠের একপাশে সামিয়ানা খাটানো। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব এসেছেন তাঁর মেমসাহেব স্ত্রীকে নিয়ে। স্যার গুরুদাস চ্যালেঞ্জ শীল্ড আর রূপার কাপগুলো চকচক করছে পড়ন্ত আলোয়। আগের দিন গোলশূন্য ড্র হয়েছে। বাড়তি সময় খেলিয়েও কোন হিল্লে হয়নি। 'সাডেন ডেথ'-আইন তখনো চালু হয়নি। ফলে এই রি-প্লের আয়োজন। আজ তাই উৎসাহ উদ্দীপনা আরও বেশি।
এ বছর অবশ্য সি.এম. স্কুলের জিতবার সম্ভাবনাই বেশি। আমাদের গত বছরের ফুল টীমের চার চারটে ছেলে ম্যাট্রিক পাস করে বেরিয়ে গেছে। অথচ ওদের গত বছরের ফুল-টীমটাই এসেছে দেখছি। একটা বছরে ছেলেগুলো মাথায় বেড়েছে, গায়ে-গতরেও মজবুত হয়েছে আরও। তাছাড়া বোঝাপড়াটা আরও বেশি হয়েছে, হাফ-লাইনের সঙ্গে উইংসের, উইংস-এর সঙ্গে ইনের, ইনের সঙ্গে স্কোরারের। ছোট-ছোট পাসে খেলতে শিখেছে ওরা। বেশিদিন এক টীমে খেললে যা হয়। শুনলাম আগের দিন ড্র হয়েছে বটে, কিন্তু সারাক্ষণই ওরা চেপে রেখেছিল। ন্যাপলা খেলা দেখেছিল, বললে, - 'হাফমাঠের ওপাশে বল গেছে কিনা সন্দেহ। ক্রমাগত আমাদের গোলে বল কিক করেছে ওরা। ভূতোদা অন্তত আধ ডজন একেবারে অব্যর্থ গোল বাঁচিয়েছে, তার ভিতর একটা পেনাল্টি।' ন্যাপলার মতে অন্তত ছয় গোল খাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।
আগের দিন জয়ের নিশ্চিত সম্ভাবনা দেখে গেছে ওরা। আজ তাই পুরোদস্তুর তৈরি হয়ে এসেছে।
খেলা শুরু হবার আগে ভূতোদা আমার কাছে এসে কানে কানে বললে, -'কান্ডটা দেখেছিস নরেন, ওরা লরি ভাড়া করে এনেছে শীল্ড নিয়ে যাবে বলে। দ্যাখ, চেয়ে দ্যাখ, ওদের সারা স্কুলটাই এসেছে মাঠে। মাস্টার মশাইরা সবাই এসেছেন, মায় বেয়ারা-দপ্তরি-দারোয়ান ইস্তক। আর আমাদের স্কুলের? গুনে দ্যাখ, বিশটা বাছুরও আসেনি।'
রাগ তো হবারই কথা। নেপাল, নেড়া, ক্যাবলা, গজেন, গোবিন্দ আর আমি। ক্লাস টেনের বেয়াল্লিশটা ছেলের মধ্যে কুল্লে এই পঞ্চপাণ্ডব হাজির। অক্ষৌহিণীর বাদ বাকি বেপাত্তা। অন্যান্য ক্লাসেরও ঐ একই হাল। গোটা স্কুলের যে কটি ছেলেকে দেখতে পাচ্ছি তা দু-হাতের দশটা আঙুলে গোনা যায়।
সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে বলি, -'দোষ আর কাকে দেব বল ভূদ্দা? আগের দিনের খেলার নমুনা দেখে সবাই বুঝে নিয়েছে আজ পাক্কা পাঁচ-সাত গোলে হারব আমরা। জেনেশুনে কে আর তা দেখতে আসে বল?'
ভূতোদা প্রচণ্ড ধমক দিয়ে ওঠে, -'উদ্বেড়ালের মত কথা বলিস না, নরেন। খেলায় হারজিত থাকবেই। তাই বলে মাঠে আসবে না? এই তো আমি। আমি তো জানিই ফেল করব, তবু বছর বছর পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছি না? কিছুই তো করতে হবে না বাপু। সেরেফ আমাদের ফরোয়ার্ড লাইন যখন বল নিয়ে ছুটবে তখন একটু প্রাণ খুলে চিল্লাবি, একটু এনকারেজ করবি। তাও পারিস না? দ্যাখ নরেন, চেয়ে দ্যাখ। এক মাঠ অচেনা মুখ। মনে হচ্ছে, এ যেন গোয়াড়িগঞ্জ নয়, যেন টিটিকাকাতে অলিম্পিক খেলতে এসেছি।'
গজেন অমনি টুক্ করে বলে বসে, -'টিটিকাকাতে কিন্তু কোনদিন অলিম্পিক হয়নি ভূতোদা।' ভূতোদার পাতা-না-পড়া চোখ দুটো যেন রাতের ডিসট্যান্ট সিগনাল। নেড়া তাড়াতাড়ি কোন রকমে ব্যাপারটা ম্যানেজ করে নেবার চেষ্টা করে। বলে, - 'আহাহা, তোরা কথা বুঝিস্ না কেন? ভূতোদা তো বলেনি যে, টিটিকাকাতেই কখনও অলিম্পিক হয়েছে। ও একটা কথার কথা। এতদিন হয়নি বলে ভবিষ্যতেও যে কোনদিন হবে না তার তো কোন স্থিরতা নেই।'
ভূতোদার জ্বলন্ত চোখ দুটো শান্ত হয়ে আসে। আমাদেরও ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ে। গজাটার যেমন বুদ্ধি। এই ক্রিটিক্যাল মোমেন্টে, খেলা শুরু হবার ঠিক আগেই পণ্ডিতি ফলাতে গিয়ে ভূতোদার মেজাজটা খারাপ করে দিয়েছিল আর কি। টিটিকাকা নামটা কদিন আগে ভূগোল মাস্টার মশাইয়ের কাছে শুনেছিলাম মনে হচ্ছে। বেশ জুতসই নামটা। কিন্তু আমাদের বরাত খারাপ! - মারে কেষ্ট রাখে কে?
হতভাগা গজেন এর পরেও বলে বসে, -'না-ভবিষ্যতেও কোন দিন টিটিকাকাতে অলিম্পিক হবে না-'
নেড়া, গোবিন্দ আর আমি তিনজনে একসঙ্গে খেঁকিয়ে উঠি, - 'কেন হবে না? আলবৎ হতে পারে। রোমে হতে পারে, হেলসিঙ্কিতে হতে পারে, বার্লিনে হতে পারে, টোকিওতে হতে পারে, আর শুধু টিটিকাকাতেই পারে না!'
গজেন আবার বলে - 'না, পারে না। কারণ টিটিকাকা কোন দেশ বা শহর নয়। ওটা দক্ষিণ-আমেরিকায় অবস্থিত একটা হ্রদের নাম। চিল্কা, বৈকাল অথবা মানস-সরোবরে কি অলিম্পিক হতে পারে?'
যেন শুনতেই পাইনি আমরা কেউ। তাড়াতাড়ি কথাটা চাপা দিতে বলি, - 'যাকগে মরুগ্গে, ভূদ্দা তুমি কিছু ভেব না। মাথার উপর ভগবান আছেন'-
নেড়া আর এক কাঠি বাড়িয়ে বলে, -'এবং গোল-পোস্টের সামনে ভূতোদা আছেন!'
ভূতোদা কোন জবাব দেয় না। হাতের গ্লাভস খুলতে খুলতে মাঠে নেমে পড়ে।
আমি বলি, - 'গ্লাভসটা আবার খুলছ কেন এখন? এখনি তো খেলা শুরু হবে।'
ভুতোদা হেসে বলে, - 'নরেনটা একটা আস্ত অনড্বান। আমি না ক্যাপ্টেন! দস্তানা পরে শেকহ্যান্ড করা এটিকেট - বিরুদ্ধ, তাও জানিস না বলিবর্দ!'
মনটা খুশীতে ভরে ওঠে। নেড়া আর গোবিন্দও লক্ষ্য করেছে গালাগাল দুটো। নেড়া আমার কানে কানে বলে, - 'একে অনড্বান তাই বলিবর্দ! আজ আগুন ছুটিয়ে খেলবে ভূদ্দা।'
আমি তা জানি। মুড ভাল না থাকলে ভূতোদা কখনও সংস্কৃতে বকা দেয় না। যত মুষড়ে পড়ে ততই ওই ভাষাটা হয়ে পড়ে চাষাড়ে। মেজাজ একটু খুশ হলেই তার সঙ্গে সংস্কৃত প্রত্যয় যুক্ত হতে থাকে। আর মন মেজাজ যখন বিলকুল শরিফ, তখন নির্ভেজাল সংস্কৃতে বকে দেবে। সেগুলো খুব মিষ্টি আদরের; বলিবর্দ, ছুছুন্দর, দণ্ড বায়স, দেড়কানন, মার্জারমুখী; অর্থাৎ বকাবকিগুলোই হচ্ছে ভূতোদার মেজাজের ব্যারোমিটার। তাই হঠাৎ নিখাদ জোড়া সংস্কৃত শুনে আন্দাজ করি, টিটিকাকা যে হ্রদ, এই মর্মান্তিক দুঃসংবাদটা প্রফেসর অনিলচন্দ্রের খুড়োমশায়ের কর্ণগোচর হয়নি।
খেলা শুরু হল। প্রথম থেকেই সি. এম. স্কুল চেপে থাকে আমাদের গোল এলাকা। ঘনঘন আমাদের গোলে আসতে থাকে একের পর এক তীব্র শট। কিন্তু চীনের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেদ করে একবারও বলটা গোলে ঢুকতে পারে না। গোলপোস্ট দুটোর মাঝের ফাঁকটা যেন নিরেট পাথরের দেওয়ালে গাঁথা। প্রতিটি শটই প্রতিহত হয়ে ফিরে যায়। হাফ-টাইমের আগে তিন তিনটে কর্ণার-কিক পেল ওরা, কিন্তু গোল হল না। রাইট-আউটের একটা কর্ণার কিক থেকে অনিবার্য একখানা গোল হতে হতে হল না।
হাফ-টাইমের দীর্ঘ টানা বাঁশি বাজল। আমরা লেবু-বরফ নিয়ে ছুটে গেলাম মাঠে। জড়িয়ে ধরি ভূতোদাকে।
নেড়া বলে, দেখেছ ভূতোদা, - 'ওরা ব্যান্ড-পার্টি ভাড়া করে এনেছে! লরির উপর মাইক ফিট করছে, ঐ দেখ। শীল্ড নিয়ে প্রসেশন করবার সব রকম আয়োজন ওরা করছে নিশ্চিন্ত মনে, যেন খেলা জেতা হয়েই আছে। ওরা একেবারে স্যাংঙ্গুইন।'
খুন চেপে যাওয়া এক জোড়া জ্বলন্ত চোখ তুলে ভূতোদা এক নজর দেখে নিল ওদের আয়োজনটা। ব্যান্ড-পার্টি সত্যিই অপেক্ষা করছে। পাতাবাহার পাতা জড়িয়ে লরিটাকে সাজাচ্ছে ওরা। পর পর চার বছর রানার্স-আপ হয়ে আজ তারা - বিজয়লক্ষ্মীর নিশ্চিন্ত আশীর্বাদের স্বপ্ন দেখছে।
ভূতোদা বলে, -'কুছ পরোয়া নেহি, ওরা স্যাঙ্গুইন তো আমরাও স্যাঙ্গুইনারি'।
গোবিন্দ বোধ করি ধরতে পারে না ব্যাপারটা, বলে, - 'স্যাঙ্গুইনারি আবার কি?'
ভূতোদা বলে, - 'ঐ পেঙ্গুইনটাকে জিজ্ঞাসা কর। গ্রামারের এসব কূটকচালি ওর ঠোঁটস্থ।'
গজেনকে দেখিয়ে দেয় সে। গজেনকে ভূতোদা মাঝে মাঝে আদর করে পেঙ্গুইন বলে ডাকে। ম্যালেরিয়ায় ভুগে বেচারির পিলেটা একটু বড় বলেই বোধ করি এই নামকরণ। কিন্তু সে যাক্।
কিন্তু ভূতোদা কি বলতে চায়? শেষ পর্যন্ত সত্যিই একটা খুনোখুনি রক্তারক্তি কাণ্ড বাধিয়ে বসবে নাকি?
হাফ-টাইম শেষ হতেই আমরা আবার ভূতোদার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আবার চাপ পড়তে শুরু করল আমাদের গোল এলাকায়। মাঝমাঠের ওদিকেও যে আধখানা ফাঁকা মাঠ পড়ে আছে সে খবরটা যেন বলটাকে কেউ বলে দেয় নি। সি. এম. স্কুলের ছেলেরা এবার একটা নতুন কায়দা শুরু করল। ওরা বুঝতে পেরেছে যে আমাদের গোলকীপারকে চটাতে না পারলে চলবে না। রেগে মেগে যদি ভুল পজিশন না নেয় ভূতোদা, তাহলে কিছুতেই গোলে বল ঢুকবে না। খেলার প্রথম থেকেই তো ক্রমাগত হো-হো করছিল সবাই মিলে, এখন একেবারে নতুন কায়দায় শ্লোগান দিতে আরম্ভ করে।
আমরা জনাবিশেক মাত্র ক্ষীণজীবী প্রাণী। তাই ওদের মাঠজোড়া ভোঁ-র কাছে আমাদের ভেঁপু যেন বাজলই না। আমাদের গলার আওয়াজ ডুবে গেল নিঃশেষে! সারা মাঠখানাকে ওরা মাতিয়ে তুলল এই নতুন শ্লোগানে। মাঠের এ প্রান্ত থেকে জনা পঞ্চাশ ছেলে একসঙ্গে সুর করে বলে:
বাবা ভূ-তোর বয়-স ক-ত?
ওই গোলপোস্টের পিছন থেকে শত খানেক ছেলে জবাব দেয়: বায়ো-কি ত্যায়ো।
এ প্রান্ত বলে: বা-বা কী বলে?
ও প্রান্ত বলে: বা-বা বলে আ-ও-ও কম।
এ প্রান্ত বলে: আর মা কী বলে?
ও প্রান্ত বলে: মা বলে আ-ও-ও-ও-ও কম!!
আচ্ছা তোমরাই বল, এই প্রশ্নোত্তরের মধ্যে কেউ মাথা ঠান্ডা করে গোল ঠেকাতে পারে? বিশেষত যদি তার বয়স আর পাঁচটা ছেলের চেয়ে সত্যিই কিছু বেশি হয়? ওদের প্রশ্ন আর উত্তর চালাচালিতে মাঠটা যখন গমগম্ করছে, বলটা তখন আমাদের গোলপোস্টের এ কিনার থেকে ও কিনারে আছাড়ি-পিছাড়ি খাচ্ছে।
জালে আটকানো বড় কই মাছ যেমন ঘাই দিয়ে দিয়ে ওঠে, বলটাও তেমনি ওদের ফরোয়ার্ড কজনের মাথায় মাথায়, পায়ে পায়ে ঘাই মারছে অনবরত, গোলের ভিতর না ঢুকে পড়া পর্যন্ত যেন তার নিস্তার নেই। কিন্তু ভূতোদার জাল ছেঁড়া অত সহজ নয়!
ক্রমাগত কিক করে, হেড করে, পাঞ্চ করে ক্লিয়ার করে যাচ্ছে নির্ঘাত গোল। একবারও ভুল হচ্ছে না পজিশান নিতে। চটেনি ভূতোদা। ওরা তাকে চটাবার জন্য 'মা কি বলে' প্রশ্নটার জবাবে 'ও'-টাকে আরও লম্বা করে সুর টেনে টেনে বলছে: আ-ও-ও-ও-ও কম। তা বলুক। হিমালয় পাহাড়কে কি বিদ্রূপে টলানো যায়?
ইতিমধ্যে একটা কাণ্ড ঘটল।
খেলা শেষ হবার আর মিনিট তিনেক বাকি। ভূতোদার ক্লিয়ার করা একটা শট একেবারে আকাশমার্গে গিয়ে পড়ল ওদের হাফ-লাইনের কাছে। ফাঁকা মাঠ। ওদের স্টপার পর্যন্ত পজিশান ছেড়ে এগিয়ে এসেছে গোল দেবার উত্তেজনায়, নিজেদের গোল সম্পূর্ণ অরক্ষিত রেখে।
আমাদের রাইট ইন চিরঞ্জীবটা দৌড়োয় ভাল। চমৎকারভাবে অফসাইড বাঁচিয়ে বলটা পায়ে রেখে এগিয়ে গেল। ড্রিবল্ করে একজন-দুজনকে কাটিয়ে নেয়, ব্যস, আর কেউ নেই সামনে। শুধু ওদের গোলকিপার আর আমাদের চিরে। কোনওক্রমে একবার গোলে বলটা মারলেই আমাদের চিরঞ্জীব সত্যিকারের চিরঞ্জীব হয়ে থাকবে।
আমরা চীৎকার করে উঠি, - এবার গোলে মার, চিরে।
কিন্তু না, চিরঞ্জীব এ চান্স কোনক্রমেই মিস হতে দেবে না। উল্কার গতিতে সে বল নিয়ে এগিয়েই চলে। কাছে, আরও কাছে, আরও কাছে। ওদের গোলকীপার একেবারে নার্ভাস। চিরেটা তখন গোলপোস্ট থেকে মাত্র দশ গজ ঘুরে। আপ্রাণ দৌড়ে ততক্ষণে ওদের লেফট ব্যাক এসে নাগাল পেল চিরেটার। দিলে মোক্ষম একটা সাইড পুশ। কী-কেন হল, ভাল দেখা গেল না, রেফারী পেনাল্টি দিল।
অফসাইড? ফাউল? হ্যান্ডবল? কি? কিছুই কেউ বুঝতে পারি না। আসলে রেফারী নিজেও পড়ে গিয়েছিল বহু পিছনে। সে যখন ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছালো তখন বোঝা গেল ব্যাপারটা। ওদেরই হ্যান্ডবল হয়েছে। লেফট-ব্যাকের। পেনাল্টি এলাকায়। পেনাল্টি। আমরা আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠি। কিন্তু ব্যাপারটা দাঁড়ালো অন্য রকম। মাঠে তীব্র উত্তেজনা। ওদের খেলোয়াড়ের হাতে নাকি বলটা আদপেই লাগেনি। লাইনম্যান সেটা দেখেছিল। অযাচিতভাবে ছুটে এসে কী যেন বলল রেফারীকে। ওদের সারা স্কুলের ছেলেরা তখন রেফারীকে ঠেঙাবার আয়োজন করছে। রেফারী কিন্তু নিজ সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। একবার নির্দেশ দিয়ে ফেলেছেন, আর প্রত্যাহার করবেন না।
বলটা সাজানো হল পেনাল্টি কিকের চিহ্নিত স্থানে।
সারা মাঠে তখন চীৎকার-শেম, শেম, পার্শিয়ালিটি, ঘুষ খেয়েছে। রেফারীকে দেখে নেব।
চিরঞ্জীব শটটা মারবার জন্য প্রস্তুত হয়। হুইসল পড়লেই সে পেনাল্টি কিক্ করবে। কিন্তু আমাদের ক্যাপ্টেন ভূতোদা তার সাড়ে চার ফুট লম্বা উটপাখির মত পা ফেলে উল্কার বেগে এসে পৌঁছালো সেখানে। চিরঞ্জীবকে ডেকে ভূতোদা কি যেন জিজ্ঞাসা করল। কী প্রশ্ন হল তা আমরা শুনিনি; কিন্তু দেখলাম চিরঞ্জীব দৃঢ়তার সঙ্গে না-য়ের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। সারা মাঠ তখনও চেঁচাচ্ছে, -শেম শেম।
নেড়া আমার কানে কানে বলল, - 'নরেন, কেটে পড়। না হলে ওরা একেবারে আলু-কাবলি বানিয়ে ছাড়বে। হ্যান্ডবল আদপেই হয়নি।'
হ্যান্ডবল যে হয়নি তা আমিও বুঝেছি। শুধু আমি কেন সবাই, মায় রেফারী পর্যন্ত। কিন্তু ভুল আত্মমর্যাদার মোহে নিজের জেদ বজায় রাখতেই রেফারী তাঁর নির্দেশটা প্রত্যাহার করলেন না।
আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, চিরঞ্জীব নয়, ভূতোদাই স্বয়ং গোলে পেনাল্টি-কিক করছে। ওদের ক্যাপ্টেন রেফারীকে কি যেন বললে। ভূতোদার সঙ্গেও কি সব কথা হল।
পরে শুনেছিলাম, ওদের ক্যাপ্টেন বলেছিল গোলকীপারের পেনাল্টি শট্ মারার অধিকার নেই। রেফারী নির্দেশ দিয়েছিলেন -আছে।
ওরা এমনিতেই ক্ষেপে ছিল, তার উপর ভূতোদার শটের তীব্রতার কথা জেলার সব কটা স্কুলই ভাল মতো জানে। ওদের তিন চারজন খেলোয়াড় রেফারীকে ঘিরে দাঁড়ায়, বলে, - না নেই, কোন আইনে নেই।
ভূতোদা ওদের থামিয়ে দিয়ে বলেছিল, - 'না থাকে, তাহলেই তো ভালো ভাই। গোল হলেও আপনারা প্রটেস্ট করতে পারবেন। আইনে না থাকলে রি-প্লে হবে। কেমন না?'
অকাট্য যুক্তি। ওরা আর বাধা দেয় না।
বলটা সাজিয়ে রেডি হয় ভূতোদা।
আমরাও রুদ্ধ নিশ্বাসে রেডি হয়ে থাকি। সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠতে হবে: গোল!!
আর একেবারে সামিয়ানা লক্ষ্য করে উল্টো দিকে কিক করল ভূতোদা। আকাশ মার্গে উড়তে উড়তে বলটা এসে পড়ল ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের পায়ের কাছে। শীল্ডটা যেখানে সাজানো আছে তার কাছ বরাবর।
সারা মাঠ স্তম্ভিত। এ কি তালকানা রে বাবা। শুধু হাততালি দিচ্ছেন সস্ত্রীক ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব।
ড্র হয়ে গেল আবার।
খেলার শেষে বৃষ্টি নামল ঝেঁপে। আমরা কে কোথায় ছিটকে পড়লাম। নেড়া, ক্যাবলা, গজেন আর আমি ছুটতে ছুটতে গিয়ে আশ্রয় নিলাম ক্রিশ্চান পাড়ার একটা চায়ের দোকানে।
নেড়া কোঁচার খুঁটে মাথাটা মুছতে মুছতে বলে, -'ভূদ্দার কান্ডটা দেখলি? নিশ্চিত জেতা-খেলা ড্র হয়ে গেল ফের। এতবড় তালকানা দেখেছিস কখনও? কোন দিকে গোলপোস্ট আর কোন দিকে মারলে শট।'
আমি বলি, -' আমার মনে হয়, ভূদ্দা ইচ্ছে করেই উল্টোদিকে শট মেরেছিল।'
গজেন বলে, - 'বটেই তো। শেয়াল যেমন ইচ্ছে করেই টক আঙুর ফল খায়নি।'
আমি চুপ করেই যাই। নেড়া বলে, - 'কী দরকার ছিল বাপু তোর সর্দারি করতে যাবার? গোলকী আছিস্। তাই থাক না বাপু। আবার পেনাল্টি শট মারার শখ কেন? চিরেটাকে চান্স দিলে ঠিক গোল করত সে। হাজার হোক সে ফরোয়ার্ডে খেলে।'
আমার কেমন যেন খারাপ লাগে। ভূতোদাকে আমি সত্যিই ভালবাসতাম। ওকে নায়ক করে লিখব এই ছিল তখন আমার জীবনের অ্যাম্বিশান। ওর কাছে ম্যাজিকও শিখতাম লুকিয়ে। আড়ালে ওকে ডাকতাম 'গুরুদেব'। গুরুনিন্দা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল।
ক্যাবলা বলে, -'দেখ না, কাল ক্লাসে কী কান্ডটা করি। ভূদ্দার সর্দারি ভাঙতে হবে।'
বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল। আমরা যে যার বাড়ি ফিরে যাই। আমি মনে মনে ভাবছিলাম, - কেন এমন তাল-কানার মত উল্টো দিকে শট মারল ভূদ্দা? অনেক ভেবেও কোন কূলকিনারা করতে পারি না।
পরদিন স্কুলে গিয়ে আমরাই হতভম্ব!
দশটা তখনও বাজেনি। স্কুল গেটের কাছে একটা চাপ ভিড়। ছেলেরা কেউ ভিতরে ঢুকতে পারছে না। পিকেটিং হচ্ছে নাকি? তার মানে স্কুল হবে না। কিন্তু ভুলটা ভাঙলো পরমুহূর্তেই। দারোয়ানের টুলটা টেনে নিয়ে তার উপর দাঁড়িয়ে ভূতোদা বক্তৃতা দিচ্ছেন: 'গাড়োল, গিদ্ধড় কোথাকার - সব এসে জুটেছে এখানে? তোমাদের লজ্জা হয় না। এসব মস্করা করবার সাহস ওরা পায় কোথেকে। অ্যাঁ? তোমাদের ক্যাপ্টেনের বয়স 'বায়ো না তেয়ো? মা বলে আয়ো কম' - এসব কী ইতরামো? ওদের গোটা স্কুলটাই খেলার মাঠে যেতে পারে। তোমরা পার না? তোমরা মানুষ না বাছুর? বাছুর হলেও তবু কাজ হত, মাঠে গিয়ে কিছু হাম্বা হাম্বা করতে পারতে।'
বুঝতে পারি, কালকে পেনাল্টি ফস্কে যেতে মর্মান্তিক চটেছে ভূতোদা। একটাও সংস্কৃত গাল নেই ওর মুখে। ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসেন হেডমাস্টার মশাই। ডাকেন, বাবা ভূতনাথ।
টুপ করে টুল থেকে নেমে পড়ে ভূতোদা। আমচুরের মত কাঁচুমাচু মুখে বলে,- 'স্যার?'
হেডমাস্টার মশাই ভূতোদাকে কখনও ধমক দিতেন না। মিষ্টি করে বলেন,-' এসব কী হচ্ছে বাবা ভূতনাথ? তুমি নিজে পড়াশুনা না করতে চাও ক্ষতি নেই, কিন্তু এইসব সুকুমারমতি ছেলেদের মাথা খাচ্ছ কেন বাপ?'
ভূতোদা ঘাড়টা চুলকে আমতা আমতা করে, - 'ঘণ্টা এখনও বাজে নি স্যার।'
হেডমাস্টার মশাই বলেন, - 'বেজেছে বাবা। তাণ্ডব নাচতে ব্যস্ত ছিলে, তাই তোমার কানে যায়নি। তাছাড়া তোমার ঘন্টা তো এ স্কুলে বাজবে না বাবা। তোমার ঘন্টা বেজেছে স্বর্গে। কয়েক বছর ধরেই তা বেজে চলেছে।'
সবাই মুখ টিপে হাসছে। দারুণ অপমানিত হয়েছে ভূতোদা। মহিষাসুরের মত মুখটা থমথম করছে তার। আমরা ক্লাসে ঢুকে পড়ি। ভূতোদাও গিয়ে বসে ওর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের এজমালি ভূখণ্ডে, থূড়ি - কাষ্ঠখণ্ডে। লাস্ট বেঞ্চির কোণায়। আমাদের কারও সাহস হয় না ভূতোদাকে কিছু বলার। ফার্স্ট পিরিয়ডে ছিল ট্রানস্লেশন, ঘণ্টা পড়ে গেল। ন্যাপলা একবার সাহস করে ভাববাচ্যে বললে, - 'ওঃ, কাল ভূদ্দা যা খেলেছিল একেবারে আগুন ছুটিয়ে।' ভূতোদা জ্বলন্ত দৃষ্টিতে একবার তাকায় নেপালের দিকে। ভাগ্যে এ কলি যুগে ব্রহ্মতেজে মানুষ ভস্ম হয়ে যায় না। না হলে ন্যাপলা এতক্ষণে যাকে বলে সেই 'গো-ওয়েন্ট-গন'।
আমাদের আর কারও সাহস হল না ভুতোদাকে ঘাঁটাবার। পর পর দুটো পিরিয়ড কেটে গেল নির্বিঘ্নে। শেষ পর্যন্ত টিফিনের লম্বা ঘণ্টা বাজল। আমার টিফিন বাক্সে ছিল কুচো গজা আর ল্যাংচা। আমি জানতাম, ল্যাংচা বস্তুটা ভূতোদার খুব প্রিয়। ওর দিকে টিফিন বাক্সটা বাড়িয়ে ধরে বলি, - 'কাল ভূদ্দার খেলা দেখে মনে পড়ে যাচ্ছিল সেই ডালহৌসির ডেভিসকে। আর সেই ইয়র্কশায়ার টিমের সেই সাতফুট লম্বা গোলকীটাকে, - কী যেন তার নাম ভূদ্দা?'
ডালহৌসি টিমে ডেভিস বলে সত্যিই কোন গোলকীপার কস্মিনকালে ছিল কিনা তা আমার জানা নেই, ইয়র্কশায়ার টিমের খেলাও আমি জীবনে দেখিনি। নামগুলো ভূতোদার কাছে শুনে শুনে আমাদের মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। ভূতোদা নিঃশব্দে ল্যাংচাটা তুলে নিল টিফিন বাক্স থেকে। তা নিক, কিন্তু কথাই বলে না যে। অবশেষে আধখানা ল্যাংচা আমার হাতে গুরু প্রসাদী ভেঙে দিয়ে মুখভঙ্গি করে চিবোতে থাকে। ল্যাংচার পর নিজেই একমুঠো কুচোগজা তুলে নিল। কিন্তু না, কোন কথা নেই তার মুখে। গোবিন্দ আর কী করে, নিজের টিফিন বাক্স থেকে একটা পেয়ারা বের করে ভুতোদার হাতে দেয়। এটাও গ্রহণ করে ভূতোদা। মটর বলে, - 'ছুরি দেব ভূদ্দা? কেটে কেটে খাবেন?'
পেন্সিলকাটা একটা ছুরি সে পকেট থেকে বের করবার উপক্রম করে। ভুতোদা ধমকে ওঠে, -'তুই চুপ কর মর্কট।' মর্কট! কথাটা বাংলা না সংস্কৃত! কানে কানে প্রশ্ন করি গজাকে। গজা বলে, -'সংস্কৃতই হবে রে! মনে নেই সেদিন পণ্ডিতমশাই তোকে মর্কট বলেছিলেন? পণ্ডিতমশাই কখনও বাংলা গাল দেন না।'
আমাকে মর্কট বলে গাল দিয়েছিলেন! গজাটা কি ডাহা মিথ্যুক রে বাবা! কিন্তু না, নিজেদের মধ্যে খাওয়া-খাওয়ি করে কেস খারাপ করবার সময় এখন নয়। ভুতোদার মুখে সংস্কৃত-ঘেঁষা বুলি যখন শোনা গেছে, তখন ফাঁড়া এ যাত্রায় কেটে গেছে বুঝতে হবে।
সুতরাং আর ভয় নেই। সবাই মিলে চেপে ধরি ভূতোদাকে। যা হবার তা তো হয়ে গেছে। ভূতোদার ভাষায় সে সব কথা এখন 'যাকগে-মরুগ্গে। এখন আমাদের কী করতে হবে ভূতোদা বলুক। আমরা লীডারের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব।
শেষ পর্যন্ত ভূতোদা উঠে দাঁড়ায়।
টিচারের টেবিলটার কাছে উঠে গিয়ে শুরু করে বক্তৃতা।
- 'খেলার জয়-পরাজয় অনিশ্চিত। সেটা কিছু বৃহৎ কথা নহে। কিন্তু ঐ দগ্ধানন বালখিল্য বাহিনী তোমাদের ক্যাপ্টেনকে চিপিটক নিষ্পেষণ করতে চায়, এ অপমান অসহ্য। কেন? আমাদেরও কি গলা নেই, আমরা কি নিষ্কন্ঠক কবন্ধ?'
আগুন ছুটিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছে ভূতোদা। নির্ভেজাল সংস্কৃত বুলি। আমরা দু-তিন জনে জিবেগজাটার মুখ চেপে ধরে থাকি। 'চিপিটক নিষ্পেষণ' যে চিঁড়েচ্যাপ্টা আর 'নিষ্কাষ্ঠক মানে যে কাষ্ঠহীন, তা আমরা ঠিকই বুঝে নিয়েছি। শুধু ভয়, ঐ গজাটাকে কখন হয়ত বলে বসবে, সমাসটা ঠিক নয়, আর অমনি ফ্লো আটকে যাবে ভূতোদার।
ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, সে দুর্ঘটনা ঘটতে পারল না আমাদের সমবেত প্রচেষ্টায়।
ভূতোদা একনাগাড়ে বলে চলেছে- 'পণ্ডিতমশাই কী বলেন শুনিসনি? 'যত্নে কৃতে যদি ন সিদ্ধতি, স্টোভে সিদ্ধতি খলু।' তার অর্থ কি? অর্থাৎ কিনা এক হাঁড়ি ভাত যদি সিদ্ধ করতে চাও তাহলে হাঁড়ির গায়ে হাত বুলিয়ে বাপু-বাছা করলে কিচ্ছুটি হবে না। স্পিরিট ঢাল, স্টোভ জ্বালো, পাম্প কর,- ব্যস্। আর দেখতে হবে না, কাঁকরমণি চালও দশ মিনিটে সিদ্ধ হয়ে যাবে। এর তাৎপর্য কি? কষ্ট কর কেষ্ট পাবে, বসে বসে চিন্তা করলে কিছুটি হবে না।'
কিছু একটা বলার জন্যে ছটফট করতে থাকে গজা। কিন্তু আমরা চেপে ধরে থাকি তাকে।
নেড়া বলে, - 'বেশ হুকুম কর। আমাদের ক্লাসে বেয়াল্লিশটা ছেলে আছে, তুমি যদি চাও, আমরা সব্বাই যাব। চাই কি অন্যান্য ক্লাসেও গিয়ে ক্যানভাস করে আসতে পারি।'
ভূতোদা বলে, - 'দরকার নেই ও মেষযুথে। দ্বা-চল্লিশই যথেষ্ট। আমি মন্ত্র বলে ঐ দ্বা-চল্লিশকেই দশগুণ বাড়িয়ে ফোর-ফট্টি করে দেব।'
বলে কি ভূতোদা? মন্ত্র বলে সে এক টাকার নোটকে দশ টাকার নোট করতে পারে বলে বেয়াল্লিশজন ছেলেকে দশ গুণ বাড়িয়ে চারশ-চল্লিশজন করে দেবে। বিস্ময়ে একটু অভিভূত হয়ে পড়ি আমরা।
গজার মুখ থেকে অসতর্ক মুহূর্তে হাতটা আলগা হয়ে গেছে। আর তৎক্ষণাৎ ঘটে গেল সর্বনাশ। গজা সুযোগ পাওয়ামাত্র বলে বসে, বেয়াল্লিশকে দশ দিয়ে গুণ করলে চারশ চল্লিশ হয় না ভূদ্দা। ভূতোদা গর্জে ওঠে, আলবৎ হয়। ম্যাজিশিয়ান কী না পারে?
গজাও ক্ষেপে ওঠে, - 'ম্যাজিশিয়ান হয় তো সব পারে, পারে না শুধু অঙ্ক শাস্ত্রকে নস্যাৎ করতে। আমি বলছি বেয়াল্লিশকে দশগুণ করলে চারশ কুড়ি হওয়ার কথা।'
ভূতোদা এঁড়ে তর্ক শুরু করে, - 'না, তা হয় না। তা যদি হত, তাহলে কাল পেনাল্টিতে গোলও হত।'
গজা বলে, - 'হেত্তেরি? কী আবোল-তাবোল বকছ। আমি বলছি অঙ্কের কথা। ফর্টি টু ইনটু টেন ইজ্ ইক্যোয়াল টু' - মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ভূতোদা বলে, - 'ফোর-ফট্টি।'
গজাও গর্জে ওঠে,- 'আজ্ঞে না। কষে দেখ - ফোর টোয়েন্টি।'
আর যায় কোথায়? ভূতোদা যেন দক্ষযজ্ঞের আসরে নামল, - 'কী বললি? আমি ফোর – টোয়েন্টি! মানে জোচ্চোর?'
আস্তিন গুটিয়ে ছুটে আসে ভূতোদা, - 'কেন? চোরাই পেনাল্টি গোলে মারিনি বলে আমি ফোর-টোয়েন্টি? আয় তুই কত বড় জিবেগজা দেখি। না চিবিয়ে গিলেই খাব আজ তোকে।'
অনেক কষ্টে আমরা সবাই মিলে তাকে থামাই। গজাটারই দোষ। আমরা ক্লাশশুদ্ধ ছেলে জানি, ফোর-টোয়েন্টি বললে ভূতোদা খুব ক্ষেপে যায়, আর ও হতভাগাটা তা জানে না? ভাগ্যক্রমে ঠিক তখনই টিফিন পিরিয়ড শেষ হয়ে গেল। সতীশবাবু ক্লাস নিতে এলেন। এসেই বলেন, -'ভূতনাথ, অত চীৎকার করছিলে কেন? যাও সীটে গিয়ে বস।'
ভূতোদা একটু নরম হয়ে বলে, - 'আমাকে ছুটি দিন স্যার, বাড়ি যাব। - কেন? বাড়ি যাবে কেন? কি হয়েছে তোমার?'
- 'হয় নি কিছু। সের খানেক ময়দা কিনে রেখেছি, আঠা বানাতে হবে।'
-'আঠা বানাবে? কি হবে এত আঠা দিয়ে?'
- 'আজ বিকেলে যে আমাদের ফাইনাল খেলা।'
সতীশবাবু অবাক হয়ে বলেন, - 'কিছুই বুঝলাম না, বাবা ভূতনাথ। তোমারই মাথা খারাপ না আমার? ফাইনাল খেলার সঙ্গে ময়দার আঠার কী সম্পর্ক?'
-'সে স্যার আপনি বুঝবেন না। আমি যাই বরং। হেডমাস্টার মশাইকে কিছু বলবেন না; আমি কিন্তু স্যার আপনার অনুমতি নিয়েই যাচ্ছি।'
বিস্মিত সতীশবাবু কিছু বলার আগেই বইখাতা নিয়ে দিব্যি চলে গেল ভূতোদা।
আমরা কেউ হলে নিশ্চিত বেত খেতে হত। কিন্তু ভূতোদার সাত খুন মাপ।সবাই জানে, সে একটা খ্যাপাটে গোছের। ও যেন নিয়মের ব্যতিক্রম। দিব্যি পেয়ারা চিবোতে চিবোতে বাড়ি চলে গেল সে। বিকেল বেলা মাঠে গিয়ে দেখি আমাদের ক্লাসের সবাই এসেছে। অবশ্য আমরা সর্বসমেত জনাপঞ্চাশ আর ওরা অন্তত দুশ। গলাবাজিতে জিতবার কোন আশাই নেই। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব সস্ত্রীক এসে বসলেন। তিন দিন ধরেই আসছেন তিনি। শুনেছি মেমসাহেবই পুরস্কার বিতরণ করবেন।
আমাদের দলের দশজন খোলোয়াড় এসে গেছে। কিন্তু ভূতোদা কই? কী কেলেঙ্কারী। আসল লোকই গরহাজির!
সময় হয়ে গেছে। রেফারী হুইসল দিল।
দুটো টিম মাঠে নামল; আমাদের দশজন। এমন সময় একটা সাইকেলে চেপে এসে পৌঁছালো ভূতোদা। তার পিছনে পিছনে এল একটা সাইকেল রিকশা।
তাতে এক রিকশা-বোঝাই কাগজের চোঙা। আমরা তো অবাক। এত চোঙা এল কোথা থেকে? আর কোন ভূতের বাপের শ্রাদ্ধেই বা লাগবে এগুলো?
এক লহমায় ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিল ভূতোদা। অদ্ভুত ওর বুদ্ধি! ওর কাকা হচ্ছেন ওভারসিয়ার কলেজের ড্রইং টিচার। ড্রইং পরীক্ষার বড় বড় কাগজ ছিল কাকার হেপাজতে। আগের বছরের পরীক্ষার খাতা। ভূতোদা ময়দার আঠার সাহায্যে তাই দিয়ে বড় বড় চানাচুরের ঠোঙা বানিয়েছে। ভূতোদার ম্যাজিক অব্যর্থ। ফর্টিটু ইনটু টেন ইজ ইক্যোয়াল টু ফোরফর্টি। ওরা দুশ ছেলে যতটা চিৎকার করে আমরা পঞ্চাশ জনে করলাম তার ডবল, - চোঙার গুণে। দু-দশ মিনিটেই ওদের গলা গেল বসে। আগের দুদিনও ওরা এক নাগাড়ে চিৎকার করেছে। আর কত পারবে? চোঙামুখো আমরা পঞ্চাশ জনেই মাঠখানাকে সরগরম করে রাখলুম।
ওরা একবার করে গোল মিস্ করে আর ন্যাপলা চোঙা ফোঁকে: সি. এম. এস. কটা গোল মিস্ করল?
আমরা সমস্বরে বলি: বায়ো কি ত্যায়ো।
যে ছেলেটি এই মাত্র গোল মিস্ করেছে তার নাম ধরে ন্যাপলা বলে, - জগাই কি বলে?
আমরা সকলে একযোগে সুর করে বলি: জগাই বলে আ-ও-ও বেশী।
আমাদের চোঙার চিল্লানিতে ওরা একেবারে ঠাণ্ডা। একশ জোড়া ওয়েট-ক্যাট! ওদের ফরোয়ার্ড লাইনের সব কটা খেলোয়াড় এ ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে আরও নার্ভাস হয়ে পড়ে। তালকানার মতো এলোপাতাড়ি আউটে মারতে থাকে বারে বারে। গোলপোস্ট গুলিয়ে যায়।
আমরা তৎক্ষণাৎ 'ও' টাকে আরও দীর্ঘায়ত করি: মাধাই বলে আ-ও-ও-ও বেশি। শেষকালে এমন অবস্থা দাঁড়ালো যে, কেউ আর সাহস করে বলটাকে গোলে মারতেই চায় না। পাছে মিস্ করলে আমরা তার নাম ধরে বিদ্রূপ করি। গোলের কাছাকাছি এসে ফরোয়ার্ড দেয় ইনকে, ইন দেয় আউটকে, আউট ব্যাক পাশ করে হাফকে। আমাদের ডিফেন্সকে আর কষ্ট করতে হয় না। ওরা নিজেরাই পায়ে পায় বলটাকে পিছিয়ে নেয়। আমরা ওদের সে দশা দেখে হেসে বাঁচিনে।
শেষ পর্যন্ত আবার গোললেস ড্র হয়ে গেল।
স্থির হল ছ-মাস করে থাকবে শীল্ডটা এক এক স্কুলে। দু দলই যুগ্মবিজয়ী। প্রাইজ দেওয়ার সময় ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বললেন, কোন পক্ষই যে গোল করতে পারেনি, এতে আমি খুশীই হয়েছি। দু দলেরই কৃতিত্ব সমান সমান। কে আগে শীল্ডটা রাখবে সেটা আমি 'টস' করে স্থির করব।
ভূতোদা তার কন্দর্পকান্তি বপুখানিকে এক পা বাড়িয়ে বলে, - 'আমি একটা কথা বলতে পারি স্যার?'
ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব বলেন - 'হ্যাঁ, বলো-বলো।'
- 'আপনি টস্ করবেন না, স্যার।'
- 'টস্ করব না? তাহলে কাকে প্রথমে শীল্ডটা দেব?'
- 'আমি বলব স্যার। আপনি সি. এম. এস-এর ক্যাপ্টেনকেই প্রথম ছ'মাসের জন্য শীল্ডটা দিন।'
ম্যাজিস্ট্রেট পত্নী অবাক হয়ে বলেন, - 'কিন্তু কেন তুমি এমন কথা বলছ?' ভূতোদা বলে, - 'শীল্ডটা আমরা চার বছর ধরে রাখছি। আজ যদি আমরা সমান সমান হয়ে থাকি তাহলে কৃতিত্বটাতো ওদেরই। তারপর মেমসাহেবের দিকে ফিরে বলল, ধরুন স্যার, ওরা ব্যান্ড পার্টি এনেছে, লরি এনেছে, আমরা তা আনিনি। শীল্ড না পেলে ওরা দুশ'জন ছেলে হতাশ হবে, আমরা মাত্র পঞ্চাশ জন।' ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব খুশী হয়ে ওর সঙ্গে শেকহ্যান্ড করে বলেন, -' ঠিক আছে, তাই হোক।'
তারপর আমাদের দিকে ফিরে বলেন, - 'আমি শুধু একথা বলব, ফুটবলটা শুধু পা দিয়ে খেলার নয়, হৃদয় দিয়ে খেলা। তোমরা দেখেছ গতকাল রেফারী একটা পেনাল্টির নির্দেশ দিয়েছিলেন। দর্শকদের মতে নির্দেশটা ঠিক হয় নি। কিন্তু রেফারীর নির্দেশ, তা সে ঠিকই হোক আর ভুলই হোক মেনে নিতেই হবে। এই হচ্ছে খেলার আইন। নিয়মানুবর্তিতা খেলার একটা প্রধান অঙ্গ। কিন্তু সত্য ধর্মের স্থান তারও উপরে। দুর্গেশ দুমরাজের গল্প নিশ্চয় জান তোমরা। আমাদের ভূতনাথও কাল ঐ রকম একটি কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল। খেলার ধর্ম আর সত্য ধর্মের দ্বন্দ্ব সে চমৎকারভাবে মিটিয়ে দিয়েছিল উল্টোদিকে বলটাকে কিক করে। সে দেখিয়ে দিয়েছে খেলোয়াড়ি মনোভাব কাকে বলে। আমি আজ তিন বছর এই জেলায় আছি। বহুবার আমি শ্রীমান ভূতনাথের খেলা দেখেছি। শুনেছি তোমরা ওকে একটা খেতাব দিয়েছ-'পেনাল্টি-ঈটার।' আমি আজ শ্রীমান ভূতনাথকে আর একটা নতুন খেতাব দিলাম, - দুর্গেশ দুমরাজ দি সেকেন্ড!'
মিসেস্ ডি. এম. কী বুঝলেন তা তিনিই জানেন। তিনিই হাততালি দিলেন সবচেয়ে বেশি।
নিশ্চিত হারের হাত থেকে রেহাই পেয়ে ভুতোদা আগেই আহ্লাদে আটখানা হয়েছিল। নতুন খেতাব পেয়ে সে যেন যোলোখানা হয়ে গেল!
শীল্ড ফাইনাল। নারায়ণ সান্যাল। মজার গল্প। গল্প পাঠে : অনুব্রতা Narayan Sanyal. Comedy Story
ভূতায়ন - অপারেশন: ভূতের নৃত্য (Bhutayan - Operation Bhuter Nritya)
জামাইবাবু আবার হেসে ওঠেন, ভূতোদা? ওর নাম কি ভূতো? বাপস্। তাহলে তো সামলে কথা বলতে হবে। শেষকালে ভূত না লেলিয়ে দেয়।
এই সিরিজের অন্য গল্পগুলি:
ভূতায়ন - অপারেশন - মাদার্যাহমপি (Bhutayan - Operation MadarjaHamapi)
লেখক: নারায়ণ সান্যাল
খেলাধূলা ছাড়া আরও একটা বিষয়ে অদ্ভুত পারদর্শিতা ছিল ভূতোদার। চমৎকার ম্যাজিকের খেলা দেখাতো সে। আমি ছিলুম ওর সাকরেদ। ছোটখাটো অনেক ম্যাজিক সে আমাকে শিখিয়েছিল। এখন তার অনেকগুলো ভুলে গেছি। তবু আজও যখন কোন ম্যাজিক শো'তে গিয়ে পুরানো খেলাগুলো দেখি, সব মনে পড়ে যায়। তা বলে কখনও কোন ম্যাজিশিয়ানের কায়দা সর্বসমক্ষে ধরে দিই না। ভূতোদা শিখিয়েছিল-ম্যাজিক-জগতে তা নিষেধ। ওর সাকরেদি করতে করতে যখন হাত-সাফাই বেশ কিছুটা অভ্যাস হয়েছে, তখনই একদিন ভূতোদা আমাকে ডেকে বলেছিল - ম্যাজিক-ওয়ার্ল্ডে কতকগুলো অলিখিত আইন আছে, বুঝলি নরেন! সেগুলো কখনো লঙ্ঘন করিস না।
আমি বলি, সেগুলি কি? তুমি গুরুদেব, আমাকে শিখিয়ে দাও।
এই 'গুরুদেব' ডাকটা ভূতোদার ভারি পছন্দ। অমনি খুশী হয়ে ওঠে। সাদা বাংলা ছেড়ে অমনি সংস্কৃত বুলি শুরু হয়ে যায়, বলে, হ্যাঁ, তোকে এখন একে একে সব কথা বলা দরকার। এখন তুই নিজেও একজন ছোটখাট মাদারী হয়ে উঠেছিস। যখন দেখবি কোন ম্যাজিশিয়ান খেলা দেখাচ্ছে, তখন ধ্যানী-বুদ্ধর মতো চুপচাপ বসে থাকবি। কোনো শব্দ করবি না। আর যদি দেখিস তোকেই বোকা বানাতে চায় তখন নিচু গলায় বলবি: মাদার্যাহমপি।
আমি অবাক হয়ে বলি, 'মাদার্যাহমপি'? মানে? -সন্ধি বিচ্ছেদ কর। মাদারী অহম্ যোগ অপি। অর্থাৎ কিনা আমিও একজন মাদারী। বুঝলি?
ঠিক এই কাণ্ডই একবার ঘটেছিল ভূতোদার জীবনে। আমার সামনেই। আমি ছিলুম উপস্থিত ওর অ্যাসিসটেন্টরূপে। ব্যাপারটা বলি-
আমাদের জেলার ম্যাজিস্ট্রেট, সেই যিনি ভূতোদাকে 'দুর্গেশ দুমরাজ' খেতাব দিয়েছিলেন-তিনি বদলি হয়ে যাচ্ছেন। অফিসার্স ক্লাব থেকে তাঁকে বিদায় ভোজে আপ্যায়ন করা হবে। ভূতোদাকে ওরা আমন্ত্রণ করল নৈশ ভোজের আসরে, আনন্দ পরিবেশন করতে। খরচ যা পড়বে তা ওরা দেবে, তাছাড়া রাত্রে শো'র পর ওখানেই ভালমন্দ খ্যাঁটের ব্যবস্থা। মুরগীর রোস্ট, চিংড়ির পোলাও, ভেটকির ফ্রাই আর আইসক্রীম। আমি তো সাকরেদ হিসেবে এক পায়ে খাড়া। ফুলপ্যান্ট একটাই ছিল। আর্জেন্ট কাচতে দিলাম। ধোপদুরস্ত না হলে কি অমন ভোজসভায় যাওয়া যায়!
সন্ধ্যাবেলায় আমরা দুটি বন্ধু সেজেগুজে হাজির হলাম অফিসার্স ক্লাবে। একটা কালো রঙের ঝোলা ঝোলা জোব্বার মতো বেঢপ পোশাক ছিল ভূতোদার। সেটাই চড়ালো গায়ে। পাখির পালক দেওয়া পাগড়ি ছিল একটা। পায়ে নাগরা। ঐ কন্দর্পকান্তি চেহারায় সে সব সাজপোশাকে যা খোলতাই বাহার হল তা আর কহতব্য নয়।
সে বছর ক্লাবের সেক্রেটারি ছিলেন এস. ডি. ও-নর্থ। তিনি সকলের কাছে ভূতোদার পরিচয় দেবার উদ্যোগ করতে মিসেস্ ডি. এম বলে ওঠেন, - উই অল নো হিম। ও ভালো খেলোয়াড়। আচ্ছা, তুমি ম্যাজিকও দেখাতে পারো?
ভূতোদা বলে, নট মাচ। থোড়া থোড়া।
শুরু হল খেলা। তাসের খেলা। এমন খোলা জায়গায় তাসের হাতসাফাই ছাড়া আর কি দেখানো সম্ভব? স্টেজ নেই, স্ক্রীন নেই, চারিদিক ঘিরে লোক বসেছে। তবু ওরই মধ্যে চমৎকার কতকগুলো খেলা সে দেখালো। মেমসাহেব খুব খুশী। ঘন ঘন হাততালি দিচ্ছেন তিনি।
শেষে ভূতোদা শুরু করল একটা নতুন খেলা। তাসগুলো মেমসাহেবের সামনে উপুড় করে মেলে ধরে বললে, যে কোন একখানা টেনে নিন। আমাকে দেখাবেন না, অন্য সকলকে দেখান।
মেমসাহেব বললেন, অন্য কউকে টানতে বল। আমি না।
ভূতোদা বলে - না না, আপনিই নিন।
মেমসাহেব ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেবের দিকে তাকিয়ে দেখলেন। দুজনের চোখে চোখে কি যেন কথা হল। শেষে মেমসাহেব নিচু গলায় বলে, আই নো এফ. সি.। সর্বনাশ। মেমসাহেব খেলাটা জানে। 'এফ. সি.' মানে হচ্ছে 'ফোর্সিং কার্ড'। খেলাটা আর কিছুই নয়, ম্যাজিশিয়ান কায়দা করে একখানা তাস দর্শকের হাতে গছিয়ে দেয়। যে তাস টানে সে বুঝতে পারে না, ভাবে বাণ্ডিল থেকে স্বেচ্ছায় যে কোন একখানাই বুঝি নিল সে। আসলে যেটা নেয় সেটা ম্যাজিশিয়ানের পরিচিত তাস-কায়দা করে গছিয়ে দেওয়া, আর কি।
ভূতোদা বলে, কই টানুন?
কী আপদ। ভূতোদা কি মেমসাহেবের ইঙ্গিত বুঝতে পারেনি। আমি তার পেটে অলক্ষ্যে এটা খোঁচা মেরে কানে কানে বলি, মেমসাহেব: বলছেন - মাদার্যাহমপি!
আমার এমন নিখুঁত সংস্কৃত মন্ত্রতেও কাজ হল না। ভূতোদা হয় কালা, নয় সংস্কৃত ভুলে গেছে। বললে, তাতে কি? আবার মেমসাহেবের সামনেই তাসের গোছা মেলে বলে, - কই, নিন?
মেমসাহেবেরও এতক্ষণে ধৈর্যচ্যুতি হয়। হাজার হোক ষাঁড়ের ভালনা খাওয়া রক্ত তো। বললে, - অলরাইট! তোমার তাস আমি বাঁ হাতে নেব না, রাইট হ্যান্ডে নেব। আন্ডারস্ট্যান্ড? দাও তাস!
বাঁ-হাতের দুটি আঙুলে একটি বিশেষ তাসকে চেপে ধরে মেমসাহের ডান হাতে টেনে নেয় একখানা। ভূতোদা একেবারে চুপসে যায়।বলে,- আচ্ছা, আর একবার।
আবার নতুন ভাবে তাসগুলো মেলে ধরে।
মেমসাহেব হেসে বলে, - একবার নয়, একশ বার। কিন্তু কায়দাটাও আমার জানা আছে। ওকে বলে ব্যাক-হ্যান্ড পুশ। আই নো দ্যাট – ওয়েল! বাঁ-হাতে প্যাকেটটির সবচেয়ে নিচের তাসখানা চেপে ধরে বলে, শ্যাল আই টেক দ্যাট। নেব এইবার?
ভূতোদার অবস্থা তখন ছেড়ে-দে-মা-কেঁদে-বাঁচি। পরপর চার পাঁচ বার চেষ্টা করে সে। চার-পাঁচ ধরনে। সাইড-থ্রাস্ট, লেফট-হ্যান্ড-ম্যানেজ, আন্ডার হ্যান্ড পুশিং।
কিন্তু নাঃ, কিছুতেই কাবু করা যায় না মেমসাহেবকে। ভদ্রমহিলা সব কয় রকম ফোর্সিং-এর সঙ্গেই পরিচিত।
শেষে তিনি বলেন, ফোর্সিং কার্ডের নয়রকম ভ্যারাইটি আছে ভূতনাথবাবু, আমি নয়টি কায়দাই জানি। সময় নষ্ট করে কি হবে, তুমি অন্য খেলা দেখাও।
সবাই হো-হো করে হেসে ওঠে। এর বড় অপমান ভূতোদা জীবনে হয়নি। একেবারে ফ্ল্যাট হয়ে যায় সে। মেমসাহেব যেন একটা গুগুলি বলে মিডল স্টাম্পটা উপড়ে নিয়েছে ওর।
তবু চালু ছেলে তো, তা সত্ত্বেও মুখে একটা সপ্রতিভ ভাব ফুটিয়ে বলে, আপনি সত্যিই যত্ন নিয়ে ম্যাজিক শিখেছেন দেখছি। কিন্তু এই মাত্র আপনি একটা ভুল কথা বললেন। ফোর্সিং কার্ড দশ রকমের হয়, নয় রকম নয়। ভুরু কুঞ্চিত হল মেমসাহেবের।
বলেন, অ্যাবসার্ড। আমি সবরকম ম্যাজিকের বই পড়ে দেখেছি। এটাই আমার হবি।
ভূতোদা একটা ঢোক গিলে বলে, হতে পারে। ইংরেজি বইতে নয় রকম ফোর্সিং কার্ডের কথা থাকাই স্বাভাবিক।কারণ, দশম নিয়মটা এক্কেবারে ভারতীয় কায়দা। আমাদের শাস্ত্রেই বলেছে। দশমস্তমসি!
মেমসাহেব বলেন, - তার মিনিং কি হল?
তম অর্থাৎ অন্ধকার, সী মানে সমুদ্র। অর্থাৎ শাস্ত্রকার বলেছেন, এই দশ নম্বরের কায়দাটা খুব গভীর।
মেমসাহেব সেসন-জজ দাশ সাহেবের দিতে ফিরে বলেন, আপনাদের শাস্ত্রে এই কথা আছে?
দাশ সাহেব পণ্ডিতমানুষ বলে পরিচিত। তিনি একটা গলা খাঁকারি দিয়ে বলেন, এই রকম কথা ভারতীয় দর্শনে আছে বটে, তবে তার এমন শাঙ্করভাষ্য আমার জানা ছিল না।
তাঁর মুখের কথা লুফে নিয়ে ভূতোদা বলে, - তবেই দেখুন, উনি পর্যন্ত এ ব্যাখ্যা জানেন না। এই দশম কায়দাটা একেবারে ভাগবত প্রক্রিয়া। জাদুকর হুডিনিও জানতেন না। গণপতি জানতেন, পি সি সোরকার জানেন, আর জানেন ---- এবার একটা ‘বাও’করে বাকিটুকু অনুক্ত রাখল সে।
ভাবখানা, আর জানেন এই শর্মা। সকলে মুখ টিপে হাসে। মেমসাহের গালে হাত দিয়ে ওর চালবাজি লক্ষ্য করছিলেন এতক্ষণ। এবার বলেন, - তুমি সেই দশম কায়দায় আমাকে ফোর্স করতে পারো?
রুমাল দিয়ে মুখটা মুছে নিয়ে ভূতোদা বলে, পারি। তবে আজ তো হবে না। এজন্য আমাকে দুদিন হঠযোগ করতে হবে।
আপনারা যে কালই চলে যাচ্ছেন, - না হলে পরশু সে ম্যাজিক আপনাকে দেখাতাম।
মেমসাহেব বলেন, - তুমি ভুল শুনেছ ভূতনাথবাবু। আমরা পরশুর পরের দিন যাব। তুমি পরশুই আমাকে সে খেলা দেখাও। হঠযোগ অর নো হঠযোগ, আমাকে যদি তুমি ফোর্স করতে পারো তাহলে আমি একশত টাকা বাজি হারব। কেমন রাজি?
ভূতোদার চোয়ালের নিচের অংশটা ঝুলে পড়ে।
কোনওক্রমে ঢোঁক গিলে বলে, রাজি তো হতেই পারি, তবে কি জানেন, আমার কেমন যেন বিবেকে বাধছে।
-কেন? তোমার বিবেকে বাধছে কেন?
-এ যেন ছেলেমানুষের হাত থেকে মোয়া কেড়ে খাওয়া! মনে করুন, আপনার সঙ্গে কেউ বাজি রাখতে চায় যে আগামীকাল সূর্য পশ্চিম দিকে উঠবে। সে বেটিং অ্যাকসেপ্ট করতে আপনার বিবেকে বাধবে না?
ভূতোদা যতই সপ্রতিভ ভাব দেখাক, মেমসাহেব কিন্তু ওর চালাকি ধরে ফেলেছেন।এবার তিনি সবাইকে সম্বোধন করে বলেন - পরশু সন্ধ্যায় আপনারা সকলে এখানে চা খেতে আসবেন। অতি অবশ্যই। আপনাদের নতুন ডি. এম.- ও কাল আসছেন। আপনারা হঠযোগী ফোর্সিং দেখে যাবেন। যে খেলা স্বয়ং হুডিনিও জানতেন না, আশা করি সে খেলা দেখতে আপনারা সকলেই খুব উৎসুক।
তারপর ভূতোদার দিকে ফিরে বলেন, ইজ্ দ্যাট্ ও কে?
ভূতোদা একটা ম্যাজিশিয়ানি 'বাও' করে বলে, - পারফেক্টলি মাদাম।
পাশের ঘরে টেবিল পেতে আমাদের দুজনকে নিরিবিলিতে খেতে দেওয়া হল। আড়ালে পেয়ে বলি, গুরুদেব! হঠযোগী ফোর্সিং আবার কী?
গুরুদেব কোন জবাব দেয় না। চোখ বুজে কড়মড় করে মুরগির ঠ্যাঙ চিবোতে থাকে। কিন্তু আমার খাওয়া তখন মাথায় উঠেছে। বলি, - ও গুরুদেব?
চোখ বুজেই ভূতোদা বলে, - আরে খেয়ে নে। চাল মারতে গিয়ে লেঙ্গি খেয়েছি।
- কী চাল মারতে গিয়েছিলে?
- আরে দূর। আমাকে কে যেন বলল, ওরা কাল সক্কাল বেলাতেই চলে যাবে। তাই --! কিন্তু তুমি যে বললে একশো টাকা ঠকিয়ে নিতে তোমার বিবেকে বাধছে।
- তা তো বলতেই হবে। না হলে মুখ রক্ষা হত কি?
- তা এখন কী করবে?
- কী আবার করব? মুর্গির রোস্ট দিয়ে পোলাও সাঁটব। কথায় বলে, 'প্রাপ্তিমাত্রেন সাঁটয়েৎ।'
কী দুর্জয় সাহস !! আমি বলি, সে তো এখন! তারপর? কাল বাদ পরশু?
এঁটো হাত দুটোই জোড় করে ভূতোদা বলে, - এখন একটু মৌজ করে খেতে দে বাবা। পরশুর কথা পরশু।
পরদিন ক্লাসে এসে বন্ধুদের সব কথা খুলে বলতে নেড়া আর ক্যাবলা তো হেসেই বাঁচে না। আচ্ছা জব্দ হয়েছে ভূতোদা।
গজেন বলে, পীরের কাছে মামদোবাজি। মেমসাহেব ভূতোদার নাকে এবার স্রেফ ঝামা ঘষে দেবে। আজ আসুক না ভূদ্দা ক্লাসে!
কিন্তু কোথায় ভূতোদা? স্কুলেই এল না সে।
তা বলে আমার তো একটা দায়িত্ব আছে! আমি হলুম গিয়ে তার সাকরেদ।
ছুটির পরে ছুটি তার বাড়ি পানে। কিন্তু বাড়িতেও ভূতোদা নেই! ওর বোন নেড়ি বললে, - দাদা কলকাতা গেছে।
গজেন বলে, - শেষ পর্যন্ত মেমসাহেব ভূদ্দাকে একেবারে দেশান্তরী করে ছাড়ল রে?
ক্যাবলা বলে, - অতঃ কিম্। এখন কী করা যায়?
নেড়া বলে, - আয় আমরা ক'জন ভূদ্দার মহাপ্রস্থানে দু-মিনিট সাইলেন্স অবসার্ভ করি।
কিন্তু না। পরদিন বিকালের লালগোলায় চেপে ঠিক ফিরে এসেছে সে। আমি বলি, - গুরুদেব। আর একটা দিন কোনক্রমে গা-ঢাকা দিয়ে কাটিয়ে দিলেই পারতে। আজ আবার মরতে এলে কেন? কলকাতা গিয়েছিলে কি জন্যে?
ভূতোদা গম্ভীর হয়ে বলে, কলকাতায় গেছিলাম ব্যাটের অর্ডার দিতে।
- ব্যাট। কী ব্যাট?
-ক্রিকেট ব্যাট। আগামী বুধবার গিয়ে ডেলিভারী নেব। ফার্স্টক্লাস একটা ব্যাট পছন্দ করে এসেছি। পঁচাত্তর টাকা দাম।
আমি ওর কথার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারছি না দেখে বলে, - আরে বুঝলি না, আজ রাত্রেই তো নগদ একশ টাকা পাচ্ছি।
আমি বলি, তার মানে? তুমি কি এখনও আশা করছ, ঐ মাদারীসম্রাজ্ঞী মেমসাহেবকে ফোর্সিং করতে পারবে?
উত্তরে ও বলে, - না হলে পঁচিশ টাকা অ্যাডভান্স করে আসি?
আমাদের উপস্থিত হতে কিছু দেরি হয়েছিল। তার আগেই সকলে জমায়েত হয়েছেন। আমরা আর আসব না এটাই বোধহয় এঁরা ধরে নিয়েছিলেন, কারণ আমরা ঘরে ঢুকতেই সমস্বরে সকলে বলে ওঠেন: - এই তো ওরা এসে গেছে।
লক্ষ্য করে দেখি দুটি নতুন মুখের আমদানি ঘটেছে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, এঁরা হচ্ছেন নতুন ডি. এম. আর তাঁর স্ত্রী। অল্প বয়স। বেশ স্ফূর্তিবাজ মনে হল।
ভূতোদা একটা 'বাও' করে বলে, প্রথমেই একটা নতুন খেলা দেখাচ্ছি --
বাধা দিয়ে মিসেস ডি. এম. বলেন, না, না, আজ আমাদের সময় কম। তুমি শুধু তোমার যৌগিক ফোর্সিং কার্ডের খেলাটাই দেখাও।
ভূতোদা সসম্ভ্রমে বলে, - বেশ স্যার। তাই হবে, কিন্তু এঁরা আমার কোনও খেলাই দেখেননি। অন্তত এঁদের অনারে একটা খেলা আমাকে দেখাতে দিন।
মেমসাহেব 'স্যার' সম্বোধনে বিচলিত হলেন না, - বললেন, বেশ দেখাও। কিন্তু ঐ একটা খেলাই।
ভূতোদা পকেট থেকে চকচকে একটা তাসের প্যাকেট বার করে মেমসাহেবের হাতে দিয়ে বললে, চারটে টেক্কা আমাকে বার করে দিন। মেমসাহেব তাসের প্যাকেট থেকে চারখানা টেক্কা বার করে ওর হাতে দিলেন।
ভূতোদা বাকি তাসগুলো প্যাকেটে বন্ধ করে পকেটে পুরল। তারপর সে চারখানা টেক্কা চারজনকে দিল। বললে, টেক্কাগুলো আপনারা সাবধানে রাখবেন, আমি চাইলেই ফেরত দেবেন।
চারজন অফিসার যে যার পকেটে তাসগুলো লুকিয়ে রাখলেন। মুন্সেফবাবু, সিভিল সার্জেন, আর দুজন ডেপুটি। ভূতোদা এবার আগের ডি. এম-এর দিকে ফিরে বললে, - স্যার, গচ্ছিত ধন কেউ যদি ফেরত না দিতে চায়, তাহলে আইনে তার শাস্তির ব্যবস্থা আছে নিশ্চয়ই?
ডি. এম. বলেন, - নিশ্চয় আছে। কিন্তু সে কথা কেন?
- তাহলে স্যার আমি এঁদের চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনছি। সর্বসমক্ষে এঁদের আমি চারখানা তাস রাখতে দিয়েছি, এঁরা আমাকে তা ফেরত দিচ্ছেন না।
সিভিল সার্জেন আঁতকে উঠে বলেন, - আরে-আরে তুমি তো সাঙ্ঘাতিক লোক হে, ফেরত দেব না কেন? চাইলেই দেব, এই নাও।
তাজ্জব কাণ্ড! সিভিল সার্জেন তাঁর কোটের পকেট হাতড়ালেন, মুন্সেফবাবু তাঁর পাঞ্জাবির পকেট তল্লাস করলেন, - কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা! টেক্কা চারখানা বেমালুম গায়েব। কারও পকেটে তাস নেই।
ডি. এম. হেসে বলেন, - সে সব জানি না মশাই, এ ছোকরা আপনাদের তাস রাখতে দিয়েছে, আমরা সবাই সাক্ষী। গচ্ছিত সম্পত্তি আত্মসাৎ করা কঠিন অপরাধ। তাস ফেরত দিতে না পারলে শাস্তি পেতে হবে। মুন্সেফবাবু বলেন, খুব জানি। আমার কোর্টে আজ তো এই রকমই একটা কেস চলল সারাদিন।
সিভিল সার্জেন হেসে বলেন, - কী গেরো। তা দিন শাস্তিই দিন। হারিয়ে যখন ফেলেছি তখন শাস্তিই ভোগ করি। বুড়ো বয়সে ঘানি ঘোরাই।
ভূতোদা মিটিমিটি হাসছে তখন।
ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, - আমি ডিস্ট্রিক্টের চার্জ বুঝিয়ে দিয়েছি। ফলে নূতন কালেকটারকেই অনুরোধ করছি তাস উদ্ধার করে এঁদের শাস্তির ব্যবস্থা করুন।
নবাগত ডি. এম বয়সে তরুণ। রসিক ব্যক্তি। খুব এক চোট হেসে নিয়ে বলেন, - নতুন জেলার চার্জ নিয়েই আমার চার চারজন সহকর্মীর শাস্তির ব্যবস্থা করতে আমার কেমন যেন সঙ্কোচ হচ্ছে। তাই আমি মামলা আমার স্ত্রীর আদালতে ট্রান্সফার করে দিলাম।
স্ত্রীর দিকে ফিরে বলেন, - যা শাস্তি দেবার তুমিই দাও। নতুন ম্যাজিস্ট্রেট-পত্নী এতক্ষণ মুখ টিপে হাসছিলেন বসে বসে। হঠাৎ এ অনুরোধে বিব্রত হয়ে পড়েন। গুছিয়ে নিয়ে কিছু একটা বলবার উপক্রম করতেই হাঁ হাঁ করে তেড়ে আসে ভূতোদা।
হাত দুটি জোড় করে সবিনয়ে বলে, - না স্যার, তা হবে না। ওঁর এজলাসে মামলা ট্রান্সফার করা চলবে না। বাদীর তাতে ঘোরতর আপত্তি।
নতুন ডি. এম. বিস্মিত হয়ে বলেন, - কেন? আপত্তি কিসের?
-স্যার, উনি দিব্যি ভাল মানুষটির মত বসে আছেন বটে, কিন্তু আমার কাছে খবর, - বামাল সমেত উনিই পাচার করেছেন। বিশ্বাস না করেন ওর ভ্যানিটি ব্যাগ তল্লাস করার হুকুম দিন।
কী কেলেঙ্কারি!! টেক্কা চারখানা সত্যিই পাওয়া গেল নবাগত মিসেস্ ডি. এম এর ভ্যানিটি ব্যাগের ভিতর থেকে।
ভদ্রমহিলা তো অপ্রস্তুতের একশেষ।
নতুন ডি. এম. আবার তার উপর রসিকতা করে বলেন, এ হে হে। সহকর্মীদের তঞ্চকতায় হতাশ হয়েছিলাম আমি, কিন্তু সহকর্মী দূরের কথা, স্বয়ং সহধর্মিণীই যে শেষ পর্যন্ত - -
হঠাৎ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে মাঝপথেই থেমে পড়েন উনি।
হো-হো করে হেসে ওঠে সবাই।
ভূতোদা এবার টেক্কা চারখানা টেবিলের উপর রেখে, আবার পকেট থেকে বাকি প্যাকেটটা বার করলে। বললে, - আর কোনও খেলা দেখতে চান?
মেমসাহেব ব্যস্ত হয়ে বলেন, - না, না, এবার তোমার সেই যৌগিক ফোর্সিং কার্ড।
প্যাকেটের তাসগুলো বার-কয়েক শাফল করে নিয়ে ভূতোদা বললে, - বেশ কথা। আমি আপনাকে চিড়িতনের গোলাম ফোর্স করব, আগেই বলে দিলাম।
ভূতোদা একটা লম্বা শ্বাস নিল। দম বন্ধ করে আধ-বোজা চোখে সে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল মেমসাহেবের দিকে। যন্ত্রচালিতের মত মেলে ধরলে উপুড় করা তাসগুলো। মেমসাহেব তো ছার, আমিই বুঝতে পারলুম কোন তাসখানা সে গুঁজে দিতে চাইছে। প্যাকেটের তলা দিয়ে সেই তাসখানা সরসর করে এগুচ্ছে আর পিছুচ্ছে। এগুচ্ছে আর পিছুচ্ছে।
মেমসাহেব হাসল। সেই চিহ্নিত তাসখানা এড়িয়ে অন্য একটা তাস সন্তর্পণে টেনে নিলেন তিনি।
আমি ভাবলুম, যাঃ, ভূতোদা বোল্ড হয়ে গেল। কিন্তু চিৎ করতেই দেখা গেল সেটা আর কিছু নয়, চিড়িতনের গোলাম।
মেমসাহেব অবাক বিস্ময়ে শুধু বললে, স্ট্রেঞ্জ!
হুস্ করে শ্বাস ছেড়ে এতক্ষণে হঠযোগী ভূতোদা চোখ মেলে তাকায়। সকলের উপর দৃষ্টি বুলিয়ে বললে, - কি হল? চিড়িতনের গোলামই তো বটে?
কেউ আর কথা বলে না। মেমসাহেবই শেষ পর্যন্ত বলেন, - আমি বাজি হেরেছি।
ভ্যানিটি-ব্যাগ খুলে একশ টাকার একখানা করকরে নোট বার করে সেটা তিনি টেবিলের উপর রাখলেন। ভূতোদা সেটা কপালে ছুঁইয়ে সযত্নে বুক পকেটে তুলে রাখল। মেমসাহেব বোধ করি নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। বলেন, খেলাটি তুমি আর একবার দেখাবে?
ভূতোদা বলে - আজ্ঞে হ্যাঁ। টানেন।
দীর্ঘশ্বাস টেনে আধবোজা নেত্রে ধ্যানস্থ ভূতোদা আবার মেলে ধরে তাসের গোছা। মেমসাহেব অনেক বুদ্ধি বিবেচনা করে অনেক বেছে বেছে করে একটা তাস টেনে নেয়।
ক্যা তাজ্জব কী বাৎ! এবারেও সেই চিড়িতনের গোলাম। মেমসাহেব বলেন, ইটস্ রিয়ালি ওয়ান্ডারফুল। এ পদ্ধতিটি হুডিনিও জানিতেন না?
ভূতোদা বললে, - ক্যামন করে জানবেন বলুন, স্যার? এটা যে পিওর ভারতীয় যৌগিক পদ্ধতি।
মেমসাহেব বললেন, - এই দশম পদ্ধতিটি তুমি আমাকে শিখিয়ে দেবে? আমি তোমাকে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেবো।
ভূতোদা বলে, - আর পারিশ্রমিক লাগবে না। আপনি তো এইমাত্র নগদ একশ টাকা দিলেন।
- আমাকে কি প্রাণায়াম অভ্যাস করতে হইবে?
-আজ্ঞে না। এই দেখুন, - খেলাটা জলবৎ তরলং।
তাসের গোছা সে টেবিলের উপর চিৎ করে বিছিয়ে দেয়। হরি বোল! মেমসাহেব তো ছাড়, দেখে আমার মতো মাদারীরও চক্ষুস্থির। প্যাকেটের বাহান্নখানা তাসই চিড়িতনের গোলাম।
ভূতোদা বলে, - খেলাটা কিছু ব্যয়সাধ্য। পাইকারি হারে তিপ্পান্ন প্যাকেট একই রকম তাস কিনতে হবে। যে প্যাকেট থেকে আপনাদের চার টেক্কার খেলা দেখালাম সেটা এ প্যাকেট নয়।
পকেট থেকে এক প্যাকেট তাস বার করে বলে, সেটা এইটা। এটুকুই হাত সাফাই। বাকিটা আগেই বলেছি-জলবৎ তরলং।
মেমসাহেব মুখে রুমাল চাপা দিয়ে বলেন, ও। ইউ নটি বয় !!
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এই গল্পটি শুনতে হলে নিচের লিংকে ক্লিক করুন: 👇👇
অপারেশন: মাদার্যাহমপি। নারায়ণ সান্যাল। মজার গল্প। গল্প পাঠে : অনুব্রতা Narayan Sanyal. Comedy Story
এই সিরিজের অন্য গল্পগুলি: