Showing posts with label সবুজ মন. Show all posts
Showing posts with label সবুজ মন. Show all posts

ফকির চাঁদ

লেখক : শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় 

ফকিরচাঁদ যে একজন অতি সন্দেহজনক লোক তাতে কারও কোনও সন্দেহ নেই। গঙ্গানগর গাঁয়ের শেষপ্রান্তে যে খালটা রয়েছে তার ধার ঘেঁষেই ফকিরের বাড়ি। বাড়ি বলতে যা ঠিক সেরকম নয়। বাঁশ বাঁখারি দিয়ে বানানো ঘর, গোলপাতার ছাউনি, নিতান্তই হতদরিদ্র অবস্থা। সেখানেই ফকিরচাঁদ দিব্যি আপনমনে থাকে। মুখভর্তি কালো কুচকুচে দাড়ি-গোঁফ, পরনে আলখাল্লার মতো একটা বেঢপ পোশাক, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। লোকে তাকে সাধু ভেবে গিয়ে অনেক সময়ে হাত দেখাতে চায়, তাবিজ-কবচ চায়। ফকিরচাঁদ তাদের সটান তাড়িয়ে দেয়। সে বলে, আমি সাধু সিদ্ধাই নাই বাপু, আমি একজন বৈজ্ঞানিক।

তা ফকিরচাঁদ বৈজ্ঞানিকই বটে।

সকালবেলা আলো ফুটবার আগেই সে একখানা থলি নিয়ে বেরিয়ে খালের ওধারে জঙ্গলে গিয়ে ঢোকে। সেখান থেকে রাজ্যের পাতা, ফল, শেকড়বাকড় তুলে নিয়ে আসে। তারপর হামানদিস্তায় থেঁতো করে তাতে কিসব মেশায় কে জানে। তার ঘরে কাঠের তাকে সারি সারি শিশিতে সেইসব পাতার তৈরি তরল ওষুধ, বড়ি, গুঁড়ো ভরা। সেগুলো কার কোন কাজে লাগবে তা কেউ জানে না। ফকিরও কাউকে ডেকে কখনও বলেনি যে, আমার ওষুধ খেয়ে দেখ। সে কারও কাছ থেকে কিছু চায়ও না। তবু যে তার পেট চলে তার কারণ হল, চাষীবাসীরা তাকে একটু ভয়-ভক্তি করে বলে প্রায় রোজই কিছু না কিছু সিধে দিয়ে যায়। কিন্তু ফকিরচাঁদের তাতে কোনও হেলদোল নেই। ভারী নির্বিকার মানুষ।

সনাতন বিশ্বাসের বড় পাজি হাঁপানি রোগ আছে। বহু চিকিৎসাতেও কোনও কাজ হয়নি। গাঁয়ের ডাক্তার কবিরাজ ফেল করাতে সনাতন বড় গঞ্জ শহরে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে এসেছে। বিস্তর ওষুধেও কোনও কাজ হয়নি বলে সনাতনের জীবনের ওপর মায়াটাই চলে গেছে। এই রোগ নিয়ে বেঁচে থাকাটাই তো কষ্টকর। অনেক ভেবেচিন্তে সনাতন একদিন বিকেলে গিয়ে ফকিরের ঘরে হানা দিল।

ফকির আছিস নাকি?

ফকির হাঁক শুনে বেরিয়ে এল। মুখে বিরক্তি, ভ্রূ কোঁচকানো। বাজখাঁই গলায় বলল, কি চাই?
ওরে আমি তো হাঁপানিতে মরতে বসেছি। কোনও ওষুধেই কাজ হচ্ছে না। বলি তুই কি হাঁপানির ওষুধ জানিস?

জবাব না দিয়ে ফকির ঘরের ভিতরে ঢুকে একটা শিশি নিয়ে এসে সনাতনের হাতে দিয়ে বলল, এটা সকালবেলা এক ছিপি খেয়ে নেবেন। রোজ।

শিশির গায়ে কোনো লেবেল নেই। খুব ভয়ের চোখে শিশিটার দিকে চেয়ে সনাতন বলল, ওরে, এতে কোনও বিষ- টিষ নেই তো। খেলে কিছু খারাপ যদি হয়।

ফকির নির্বিকার মুখে বলে, সে আমি জানি না। খারাপও হতে পারে। কোনও গ্যারান্টি নেই।

এটার দাম কত?

তাও জানা নেই মশাই।

সনাতন দোলাচল মন নিয়ে বাড়ি ফিরল।

ফকিরচাঁদের ওষুধের কথা শুনে বাড়ির সবাই রে রে করে উঠল, - খবরদার, ওই পাগলের ওষুধ খেও না। মারা পড়বে।

সনাতনও ভয় পেয়ে খেল না। তবে শিশিটি রেখে দিল। কিন্তু হাঁপানির কষ্ট মাঝে মাঝে এমন তুঙ্গে ওঠে যখন মনে হয় এর চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো।

তাই দিন তিনেক পরে একদিন মাঝরাতে উঠে মরিয়া হয়ে সে এক ছিপি ওষুধ খেয়ে নিল। স্বাদ একটু তেতো তেতো, আর গন্ধটাও খুব একটা ভালো নয়। খেয়ে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে রইল। বিষক্রিয়া হয়েছে কিনা বুঝতে চেষ্টা করল। কিন্তু তেমন কিছু খারাপ প্রতিক্রিয়া হল না দেখে সে একটু নিশ্চিন্ত হল। একটু ঘুমিয়েও পড়ল।

সকালে যেন মনে হল হাঁফের টানটা একটু কম। তবে সেটা মনের ভুলও হতে পারে। কিন্তু সকালে আর এক ছিপি ওষুধও খেয়ে নিল সে। সারাদিন আর কিছুই ঘটল না। কিন্তু রাতে সনাতনের ভারী সুনিদ্রা হল। হাঁপানির জন্য ঘুমোতেই পারত না এতদিন।
সকালে উঠে সে অবাক হয়ে বুঝতে পারল, তার হাঁফের টান এক্কেবারে নেই। নেই তো নেই। কোনওদিন যে ছিল সেটাই যেন বিশ্বাস হচ্ছে না।

এই ঘটনার পর গাঁয়ে একটা মৃদু শোরগোল পড়ে গেল। তবে কি পাগলটার সত্যিই কোনও বিদ্যে জানা আছে?

ডাক্তার নগেন সরকার শুনে বলল, হুঁ, হাতিঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল। ফকরেটা তো লেখাপড়াই জানে না।

সনাতন ফুঁসে উঠে বলে, দেখ ডাক্তার, হাঁপানি সারাতে তোমার পিছনে আমি কয়েক হাজার টাকা ঢেলেছি। লাভ হয়েছে লবডঙ্কা। ফকরে তো তার ওষুধের জন্য একটা পয়সাও নেয়নি।

নগেন বলল, ঝড়ে বক মরে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে। ঠিক আছে, আমার মায়ের তো পেটে টিউমার ধরা পড়েছে। সামনের মাসেই অপারেশন। খরচের ধাক্কাও কম নয়! সারাক দেখি আপনার ফকিরচাঁদ আমার মায়ের টিউমার!

ফকিরকে পরদিনই দুপুরবেলা ধরে বেঁধে নিয়ে আসা হল। ফকির সব শুনে তার ঝোলা থেকে একটা শিশি বের করে দিয়ে বলল, রোজ সকালে এক ছিপি করে।

তাতে সারবে তো?

তা কে জানে? ওসব আমি জানি না। ওষুধ চেয়েছো, দিয়েছি।

যদি ওষুধ খেয়ে রুগি মারা যায়?

যেতেও পারে। ভয় পেলে খাইও না। তোমাদের ইচ্ছে।

নগেনের মা বললেন, না বাবা, তোমাকে আমার বিশ্বাস হয়। আমি খাবো।

তিনদিন ওষুধ খাওয়ার পর মা বললেন, ওরে নগেন, আমার পেটের ভিতর সেই চাকাটা যেন নেই বলে মনে হচ্ছে।

নগেন ডাক্তারও পেট টিপে দেখল, নেই। সন্দেহভঞ্জনের জন্য শহরে নিয়ে এক্স-রে, ইউ এস জি করে দেখা গেল, সত্যিই নেই।

পরদিন সকালেই ফকিরের ঘরের দরজায় গিয়ে হামলে পড়ল নগেন ডাক্তার, ও ফকির, তোমার টিউমার সারানোর ফরমুলাটা আমাকে দাও ভাই, আমি তোমাকে হাজার টাকা দিচ্ছি।

ফকির খ্যাঁক করে উঠল, কিসের ফরমুলা? কিসের টিউমার। যাও যাও, ঘ্যানঘ্যান কোরো না।

আচ্ছা, না হয় পাঁচ-নয়, দশ হাজার টাকাই দেবো।

তোমার টাকা বেশি হয়ে থাকলে গরিব-দুঃখীর বিনা পয়সায় চিকিৎসা করো না কেন। এখন বিদেয় হও তো।

ভজহরি গুণের কর্কট রোগ। ডাক্তার জবাব দিয়েই রেখেছে। বড়জোর আর ছ'মাস আয়ু। অথচ তার বয়স বেশি নয়, মাত্র বত্রিশ। এ বয়সে কে মরতে চায়। তাই হাল ছেড়ে ভজহরি শেষের দিন শুনছিল। এমন সময় তার বাবা বলল, ফকির পাগলার ওষুধে নাকি শক্ত ব্যামো সেরে যাচ্ছে। আমাদের ভজুর জন্য একটা শেষ চেষ্টা করে দেখলে হয় না? এখন তো দৈব ছাড়া উপায় নেই।

ফকিরকে বাবা বাছা বলে একদিন ধরে আনল ভজহরির বাবা। ফকির রুগী ভালো করে দেখল না, পরীক্ষা করল না. প্রশ্নও করল না। শুধু একটা শিশি বের করে দিয়ে বলল, রোজ সকালে দুটো করে বড়ি।

আর কিছু করতে হবে না? শুধু দুটো করে বড়ি খেলেই হবে।

হ্যাঁ। এর বেশি আমার কিছু জানা নেই।

ও বাবা ফকির, একটু ভরসা দিয়ে যাও, এই ওষুধে এই ব্যাধি সারবে তো?

সারবে কিনা তা আমিও জানি না। ইচ্ছে হলে খাওয়াবেন।

কারোই ওষুধে তেমন ভরসা হল না। তবে ভজহরি ওষুধটা নিয়মিত খেতে লাগল। দিন সাতেক পরে সে টের পেল, রোজ তার পেট আর পিঠ জুড়ে যে তীব্র ব্যথাটা মাঝে মাঝে হচ্ছিল সেটা আর হচ্ছে না। আরও সাতদিন দেখল সে। পেট শান্ত। ব্যথা নেই। ভজহরিকে নিয়ে তার বাবা ছুটল শহরে। ডাক্তার পরীক্ষা করলেন। ভ্রূ কোঁচকালেন। আরও কয়েকটা টেস্ট করতে বললেন। রেজাল্ট দেখে ফের ভ্রূ কুঁচকে চিন্তিত মুখে বললেন, আশ্চর্য! কোনও কারসিনোজেসিক ট্রেস নেই! কি করে হল বলুন তো! এরকম তো হয় না।

ভজহরি আর তার বাবা ফকিরচাঁদের কথা বিশদ বর্ণনা করল। ডাক্তার অবাক হয়ে বললেন, জরিবুটি! তাতে সেরেছে! চলুন তো, আমিও লোকটার কাছে যাবো।


এইভাবেই রোজ ফকিরচাঁদের ঘরের সামনে ভিড় বাড়তে লাগল। প্রথম অল্প অল্প ভিড়। তারপর বেসামাল ভিড়।

মিটিমিটি চোখে চেয়ে ফকিরচাঁদ ভিড় দেখে, আর ভাবে। কি ভাবে তা বোঝা যায় না। মুখে কোনও অভিব্যক্তি নেই।

কিন্তু হঠাৎ এক ঝড়বৃষ্টির রাতে ফকিরচাঁদ উধাও হয়ে গেল। পরদিন লোকজন গিয়ে দেখে, ফকিরচাঁদ তো নেই-ই, ঘরটাও কেৎরে হেলে পড়েছে।

সেই থেকে আর ফকিরচাঁদের কোনও খোঁজ নেই।

ভূতায়ন - অপারেশন বেলুন ফটাস (Bhutayan - Operatio Belun Fotas)


আমরা পড়তাম কলেজিয়েট স্কুলে। সেই সময়ে সেটা ছিল নদীয়া-কৃষ্ণনগরের সবচেয়ে নামকরা স্কুল। মহাত্মা মনমোহন ঘোষের দান করা বিরাট বাড়ি। হাই স্ট্রিটের উপর মিউনিসিপ্যালিটি অফিসের উল্টো দিকে। এখন অবশ্য রাস্তাটার নাম হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রোড। কিন্তু আমি যে সময়ের কথা বলছি-- সেই 1940 সালের, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখনও জীবিত। তাই রাস্তার নাম তখন ছিল হাই স্ট্রিট। 
 
কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির বিরাট প্রাঙ্গণে সে আমলে বৈশাখ মাসে একটা বিখ্যাত মেলা বসত। নাম বারোদোলের মেলা। কৃষ্ণনগর মহারাজের আমন্ত্রণে ও ব্যবস্থাপনায় প্রায় এক পক্ষকালের জন্য দূর-দূর মন্দির থেকে দ্বাদশটি কৃষ্ণমূর্তিকে ঐ মেলায় নিয়ে আসা হত। তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন -- মদনমোহন। ঐ দ্বাদশটি বিগ্রহকে ঘিরে বসত বিরাট একটা মেলা। মেলায় বসত অসংখ্য দোকান, -- দূর দূর পল্লী থেকে সংগৃহীত কুটিরশিল্প, -- খেলনা, খাগড়াই বাসন, শান্তিপুরের ধুতি-শাড়ি, মাদুর, পাখা, চাকি-বেলুন, বড়ি-আচার-আমসত্ত্ব, -- কী নয়! এছাড়া কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পের মনমুগ্ধকর পাঁচ দশটি দোকান তো থাকতোই! তখনও কৃষ্ণনগর শহরে কোন পাকা বাইশকোপ-হল ছিল না। বাইশকোপ-হল বুঝলে তো? আমি সিনেমা হাউসের কথা বলছি! মেলাতেই তখন তাঁবু খাটিয়ে নানান জাতের সিনেমা দেখানো হত। চার্লি চ্যাপলিন, আর লরেল-হার্ডি তখন খুব জনপ্রিয়। যদিও অধিকাংশ চলচ্চিত্রই ছিল নির্বাক।

এছাড়া পড়ত সার্কাসের তাঁবু। বাঘ-সিংহ-হাতি-ঘোড়া-কুকুর আর জোকার। প্রচণ্ড ভিড় হত সার্কাসে। এ-ছাড়াও থাকত আজব তাঁবু, - - এক-মানুষের দুটো মাথা। মাকড়শা মানুষ। আরও কত কি!

জুয়ার তাঁবুও ছিল। তবে আমাদের সে-পাড়ায় যেতে দেওয়া হত না। 
 
কিছু তাঁবুকে আমরা আবার বলতাম -- এলেম তাঁবু। বন্দুক ছুঁড়ে বেলুন ফাটানো তোমরা নিশ্চয় দেখেছ। আমাদের আমলে সেটা ছিল অন্য ধরনের। এখন রথের মেলায়, গাজনের মেলায়, কলকাতা ময়দানের শিল্পমেলায়, আবার বারোয়ারি পূজা-প্যান্ডেলেও ঐ খেলার আয়োজন দেখি। একটা পিচবোর্ডে গাদাগাদি করে নানান রঙের বেলুন টাঙানো থাকে। একেবারে ঠাসাঠাসি বেলুনের ভিড়। পাঁচ হাত দূর থেকে বাচ্চারা বেলুন ফাটায়। দনাদ্দন বেলুন ফাটিয়েই তারা আনন্দ পায়। নেহাৎ ছুঁচোর মতো অন্ধ না হলে ভিড়ে-ঠাসা বেলুন মিস্ করাই কঠিন।

কিন্তু আমাদের বারোদোলের মেলায় ব্যবস্থাটা ছিল অন্যরকম। উত্তর ভারত থেকে একজন দোকানদার আসত ঐ বেলুনের দোকান নিয়ে। সেই বেলুনের দোকানে ভূতোদার কীর্তিকাহিনীটা এবার শোনাই।

ভূতোদা, আগেই বলেছি, অলরাউন্ড স্পোর্টসম্যান। এয়ারগান এও তার অদ্ভুত টিপ। দশবার ফায়ার করলে অন্তত ছয়বার বুলস-আইয়ের ভিতর হিট করবে। বাকি চারখানা কেন্দ্রের ছোট্ট চক্রের কানঘেঁষে বেরোবে। বারোদোলের মেলায় বেলুনের দোকানে ব্যবস্থাটা ছিল বিচিত্র। অসংখ্য বেলুন ঝুলছে, -- ছোট থেকে বড়, কাছে থেকে দূরে। প্রতিটি বেলুনের গায়ে একটা করে নম্বর। যে বেলুন যত কাছে, আকারে যত বড়, -- তার নম্বর তত কম। যে বেলুন যত দূরে আর মাপে যত ছোট, -- তার নম্বর তত বেশি। সব চেয়ে কম নম্বর হচ্ছে পাঁচ, আর সবচেয়ে দূরের অ্যাতোটুকু বেলুনটার নম্বর পাঁচ শো। ছররা গুলির দাম এক পয়সায় দুটো, অর্থাৎ টাকায় বত্রিশটা ছররা। পাঁচ-নম্বর বেলুনটা ফাটাতে পারলে দোকানদার দেবে পাঁচ দুগুনে দশ পয়সা, পাঁচশ নম্বর বেলুনটা ফাটাতে পারলে পাওয়া যাবে পাঁচশো দুগুনে হাজার পয়সা, অর্থাৎ দশ টাকা!


নগদে পাবে না কিন্তু! ঐ দোকানেই সাজানো আছে হরেকরকম মনোহারী সওদা। লজেন্সের কৌটো, বিস্কিটের টিন, নানান জাতের পুতুল, ক্রিকেট ব্যাট, টেনিস র‍্যাকেট, ফুটবল থেকে শুরু করে ক্যারাম বোর্ড, শৌখিন কাপডিশের সেট, মায় দেওয়াল-ঘড়ি। সে-আমলে রেস্তোরাঁয় গিয়ে পুরো আট আনার খাবার খাওয়া যেত না। সুতরাং দশ টাকায় চীনামাটির তেত্রিশ পীসের শৌখিন ডিনার সেট পাওয়া যেত।

আগেই বলেছি, ভূতোদা আমাদের লীডার। এখনও মনে আছে, ন্যাপলা যেদিন ক্লাসে বারোদোল মেলার ঐ বেলুন স্টলের গল্পটা প্রথম শোনালো, -- সেদিন ভূতোদা তো একেবারে আহ্লাদে আটখানা। বলে, চল আজ দলবেঁধে বারোদোলের মেলায় যাব। বেলুনের দোকানটা ফাঁকা করে দিয়ে আসতে হবে।

এ বিষয়ে আমাদের কোনও সন্দেহ নেই। ভূদ্দার একটা নিজস্ব এয়ারগান আছে। সেটা সে তার ভোম্বল মামার কাছ থেকে উপহার পেয়েছিল, উপনয়নের দিনে। সকালে ব্যায়াম সেরে প্রতিদিন সে নিয়ম করে গুণে গুণে পঁচিশটা ফায়ার করে। ইদানীং সে এয়ারগান ছুঁড়ে বাগানের পাকা আম পাড়ে। গুলি আমের গায়ে লাগে না, -- লাগে বোঁটায়! ভূতোদার ছোট বোন নেড়ি ধামা বাড়িয়ে ধরে। আমটা টুপ করে ধামায় পড়ে। মাটিতে পড়ে না। এ হেন লক্ষ্যভেদী অর্জুন আর অনেক আশা নিয়ে আমরা সদলবলে চললাম বারোদোলের মেলায়, -- ভূদ্দা, সুখেন, নেড়া, মন্টু, ন্যাপলা আর আমি। প্রত্যেকে চার আনা করে চাঁদা দিয়েছি। আমাদের মোট পুঁজি চার-ছয় চব্বিশ আনা; অর্থাৎ দেড় টাকা। তার মানে দেড় ইনটু বত্রিশ অর্থাৎ আটচল্লিশটা ছররা। আমরা নিশ্চিত যে ভূতোদা দোকানের সব কয়টা বেলুন ফটাস্ করে দেবে। তার মানে গুদাম-সাবাড়! ফেরার পথে বোধহয় একটা ঠেলাগাড়ি ভাড়া করতে হবে!

তিন-তিনটে সাইকেলে ডবল-ক্যারি করে আমরা ছয়জন যখন বারোদোলের মেলায় গিয়ে পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা হয়-হয়। সারা মেলায় তখন পেট্রোম্যাক্স, হ্যাজাক আর ডে-লাইট জ্বালার ধুম। তখনও শহর কৃষ্ণনগরে ইলেকট্রিক লাইটের লাইন পাতা হয়নি। মেলার প্রবেশ দ্বারে সাইকেল স্ট্যান্ডে সাইকেল জমা দিয়ে আমরা পাঁচ মস্তান গুরুজীর পিছন-পিছন বেলুন-তাঁবুর দিকে এগিয়ে চলি।
 
ঢুকতে যাব, -- সামনেই অযাত্রা। ক্লাসের ফার্স্ট বয়: গজেন।


ভূতোদা ক্ষেপচুরিয়াস হয়ে ওঠে। বলে, -- তুই এখানে কেন? গজেনও রুখে ওঠে, -- কেন? এমন তো কোন আইন নেই যে, সব সাবজেক্টে ফেল করতে না পারলে বারোদোলের মেলায় আসা যাবে না?

ভূতোদা জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে দেখল শুধু। জবাব না দিয়ে তাঁবুর ভিতরে ঢুকে গেল। ন্যাপলা বলে, দিলি তো ভূদ্দার মেজাজটা বিগড়ে? এখন ও ক্রমাগত মিস্ করবে। মেজাজ খারাপ হলে টিপ কখনো ঠিক থাকে?

গজেন বলে, ও এমনিতেই মিস্ করতো। এখন বরং আমার ঘাড়ে দোষ চাপাবার একটা অজুহাত পাবে। সুখেন বলে, যাগগে মরুগগে ওসব ছেঁদো কথা! গজেন, তুই কি আমাদের দলে আসবি? চার-আনা চাঁদা দিয়ে? গজেন জানতে চায়, কিসের চাঁদা? ন্যাপলা আর ন্যাড়া ওকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেয়, -- এই বেলুন-তাঁবুর যাবতীয় সওদা বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য আমরা অপারেশন বেলুন-ফটাস্ স্কীম করেছি। শুনে গজেন তো হেসেই বাঁচে না! 
 
ওর সঙ্গে তর্কাতর্কি না করে আমরা পাঁচজন তাঁবুর ভিতর ঢুকে যাই। ভূতোদা ততক্ষণে লাইনে দাঁড়িয়েছে। 
 
বেলুন-তাঁবুতে লক্ষ্যভেদী অর্জুনদের ভিড়। কিউ দিয়ে দাঁড়িয়ে ছররার টিকিট কিনতে হয়। ভূতোদা লোকটাকে যখন দেড় টাকা দিতে চাইল তখন লোকটা রাজি হল না। দেহাতি হিন্দির সঙ্গে বাঙলা মিশিয়ে বলল – বাবুজি, এক সঙ্গে এক রূপিয়ার য্যাদা টিকস্ হামি দিতে পারি না। সোচিয়ে, সব কোইকো তো খুস্ করনা পড়েগা না? 
 
যুক্তিপূর্ণ কথা। ভূতোদার পিছনে যারা কিউতে দাঁড়িয়েছে তারা না হলে কী করবে? ফলে একটাকায় বত্রিশটা ছররা কিনে ভূতোদা বন্দুকটা নিয়ে দাঁড়ালো। আমাদের বললে, কী কী নিয়ে যাব পছন্দ করেছিস্? নেড়া বলল, প্রথম বত্রিশটায় তোমার স্কোর কত হয় দেখি। 
 
-- তবে তাই দ্যাখ। প্রথমে ফার্স্ট সেঞ্চুরিটা তো করি। তারপর যে কাণ্ড হল,
 
-- কী বলব, -- লিখতে গিয়ে এখনো আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। ঘটনাটা অবিশ্বাস্য! ভূতোদার নয়, ভূতের ভেলকি! 
 
ভূতোদা দনাদ্দন ফায়ার করছে আর ধড়াধ্বড় মিস্ করছে। আমাদের প্রত্যাশায় যে বল ওভার বাউন্ডারী হবার কথা তা একের পর এক জমছে উইকেট-কীপারের হাতে। প্রথম দশটা ফায়ারে স্কোর-শূন্য। বিশ্বাস হয়? একটা বেলুনও ফাটেনি, দশটা ফায়ারে। এমন এক বন্দুকবাজের হাতে যাকে স্বচক্ষে দেখেছি আমের বোঁটায় ফায়ার করে আম পেড়ে নামাতে! 
 
অবশ্য একটা কারণও যে না ছিল তা নয়। না, একটা নয়, দুটো হেতু। প্রথমত ভূতোদার লক্ষ্য দূরের কোনও ছোট্ট বেলুন। যার মার্কা তিনশ থেকে পাঁচশ। কাছাকাছির বেলুন সে টিপই করছে না। দ্বিতীয় কথা, -- ভূতোদা একটা করে মিস্ করে আর কে যেন পিছনে ভিড়ের মাঝখানে খামোখা গলা খাঁকাড়ি দেয়। কে আবার? ঐ জিবেগজাটা। আমি বলি, মারি তো হাতি, লুঠি তো ভাণ্ডারের আশা ছেড়ে দাও, ভূদ্দা। একটা বিশ-পঞ্চাশী বেলুন ফাটিয়ে অন্তত বউনিটা কর দিকিন? অন্তত একটা ফটাস তো কানে শুনি! 
 
কে কার কথা শোনে? আর ভূতোদা চিরটা কাল এক নম্বর গোঁয়াড়। সে বাকি বাইশটা ফায়ার করল একটা পাঁচশো নম্বর লেখা বেলুনে। সব কটাই ফস্কালো! বত্রিশটা ফায়ার করে ওর স্কোর: ---- শূন্য। 
 
নেড়া বলে, কী হল বলতো ভুদ্দা? দোকানি কি কিছু তুকতাক করেছে? ভূতোদা বলল, তুকতাকে আমি বিশ্বাস করি না। আসল ব্যাপার হল – মাছি
 
 -- মাছি! মানে? 
 
ভূতোদা আমাদের জবাব দিল না। সোজা গিয়ে চ্যালেঞ্জ করল দোকানিকে, -- আপকে মক্ষিকামে গলতি হ্যায়। দোকানি তো আকাশ থেকে পড়ে! আমরাও। ভূতোদা তখন এয়ারগান - এর ফোরসাইট বা মাছিটাকে দেখায়। যেটা দেখে বন্দুকধারী টিপ্ করে। বলে, আপকে বন্দুকমে য়ো নিশানা গলতি হ্যায়। 
 
দোকানি তো হেসেই বাঁচে না। বলে, বাবুজী! বে-ফাজুল দিমাগ খারাপ করবেন না। মেরি বন্দুক মে কোই গলতি নহী। বলকি আপহি কা নজর ঠিক নেহী হায়, এলেম নেহী হায়, মায় ক্যা করু? 
 
ভূতোদা পকেট থেকে একটা সিকি বার করে বললে, য়ো চৌ-আনি সে আটটা ছররা খরিদিয়ে, ঔর হমকো দেখাইয়ে কি আপকা বন্দুককী নিশানা ঠিক হ্যায়। 
 
দোকানি তাতে রাজী নয়। তার যুক্তিটাও ফেলে দেবার নয়। সে হিন্দি মেশানো বাঙলায় বলে, আমি তো বলিনি যে, আমি একজন এলেমদার বন্দুকবাজ। আমি বুড়ো মানুষ। চোখে ছানি পড়েছে। আমি তো সেরেফ দোকানদার। আমি কেন বন্দুক ছুঁড়তে যাব? 
 
দোকানে আর যারা উপস্থিত ছিল তারাও দোকানদারের পক্ষ নিল। আসলে যারা লাইনে দাঁড়িয়ে ছররা কিনেছে তারা এই তর্কাতর্কিতে বিরক্ত। তারা এবার বন্দুক ছুঁড়তে চাইছে। ভূতোদা বন্দুকটা ফেরত দিয়ে দিল। 
 
ওমা, এ কী! ভূতোদার পরেই লাইনে ছিল জিবেগজা ওরফে গজেন। সে বন্দুকটা নিয়ে তাক করে ছুঁড়ল। কী দারুন বরাত! প্রথম ফায়ারেই একটা বিশ নম্বরী বেলুন ফাটলো, -- ফটাস্। জিবেগজা ভূতোদার দিকে তাকিয়ে হাসল। দোকানি বললে, দেখিয়ে বাবুজী। যিসকা নিশানা ঠিক নহী হায়..... ভূতোদা আমাদের বললে, চলে আয় তোরা। লোকটা ফোর-টোয়েন্টি। ওকে এভাবে কব্জা করা যাবে না। 
 
আমি বলি, তা পালিয়ে গেলে ওকে কীভাবে কব্জা করা যাবে? ততক্ষণে জিবেগজা দু নম্বর বেলুন ফাটিয়েছে-এটা দশ দুকুনে বিশ পয়সা। দোকানি বললে, দেখিয়ে, দেখিয়ে বাবুজী। ভূতোদা বললে, তোবা আসবি? না আমি একাই যাব? 
 
গজেন আমাকে বলে, যা যা ভূতো-জ্যেঠার পিছু পিছু যা। নইলে ভূতোজ্যেঠা ক্ষেপে যাবে। 
 
কোথায় চলেছে ভূতোদা? জানি না। তবে গুরুবাক্য বিনা প্রশ্নে মেনে নিতে হয়। আমরা পাঁচজনও ছুটতে থাকি ওর পিছু পিছু। ভূতোদা এসে থামল একটা টালিছাওয়া পাকাঘরের সামনে। বাইরে লেখা আছে -- ম্যানেজারের অফিস। 
 
এতবড় মেলায় রাজ সরকারের তরফে একজন ম্যানেজারবাবু আছেন। প্রৌঢ় মানুষ, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। সন্ধ্যা থেকেই এসে বসেন অফিসে। রাত দশটা পর্যন্ত থাকেন। ওদিকে সদর থানার দারোগাবাবুও সন্ধ্যাবেলা সপরিবারে এসে হাজির হন। তাঁর গিন্নি কাচ্চাবাচ্চাদের নিয়ে মেলায় ঘোরেন, আর কর্তামশাই অফিসে বসে শান্তিরক্ষার অছিলায় ম্যানেজারবাবুর আপ্যায়নের অত্যাচার সহ্য করেন। কোনওদিন শরবৎ, কোনদিন বা চা-সিঙাড়া। এছাড়া থাকে সন্দেশ, সরপুরিয়া, সরভাজা ইত্যাদি। 
 
আমরা আধডজন মস্তান যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছালাম তখন ঘটনাচক্রে দারোগাবাবু উপস্থিত। ভূতোদা তার অভিযোগটা ব্যক্ত করল। মেলার একত্রিশ নম্বর তাঁবুতে যে লোকটা বেলুন ফাটানোর ব্যবসা খুলেছে সে লোকটা জোচ্চোর। ম্যানেজারবাবু জানতে চান, কেন বাবা? কী করে বুঝলে? 
 
ভূতোদা তার অভিজ্ঞতা বিস্তারিত জানালো। বলল, তার এয়ারগানের টিপ্ বেশ ভালই। বলে-বলে সে বুলস্ আই হিট করে। অথচ এখানে বত্রিশটা ফায়ার করে একটা বেলুনও ফাটাতে পারেনি। 
 
দারোগাবাবু জানতে চান, তুমি কলেজিয়েট স্কুলের ফুটবল-টিমে গোলকিপিং কর, তাই না? ভূতোদা বলে, -- তা করি। আবার শীতকালে উইকেট-কীপিংও করি। কিন্তু তার সঙ্গে ঐ জোচ্চোরটার কী সম্পর্ক? 
 
ম্যানেজারবাবু বলেন, আহাহা, অহেতুক লোকটাকে জোচ্চোর ভাবছ কেন? ও যে জুয়াচুরি করছে তা তুমি বুঝলে কী করে? 
 
-- ঐ তো বললাম। বত্রিশটা ফায়ার করে একটা বেলুনও ফাটাতে না পারায়। ও নিজের বন্দুকের ঐ নিশানাটা, মানে মাছিটা হাতুড়ি মেরে সরিয়ে দিয়েছে নিশ্চয়....। ন্যাড়া ফস্ করে বলে বসে, কিন্তু জিবেগজাটা তো পরপর দুটো বেলুন ফাটালো? 
 
দারোগাবাবু জানতে চান, জিবেগজা কে? সে কখন বেলুন ফাটালো? আমিই ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললাম। জিবেগজা কে, ও কখন বেলুন ফাটিয়েছে। 
 
 ম্যানেজারবাবু বলেন, তাহলে তো ল্যাটা ঢুকেই গেল। দোকানি যদি বন্দুকের নিশানা নড়িয়ে দিয়ে থাকে তাহলে সেই খাজা-গজা কী করে বেলুন ফাটায়? ন্যাড়া বলে, খাজা-গজা নয়, জিবেগজা! 
 
-- ঐ হল। একই কথা। 
 
দারোগাবাবু বললেন, না, হল না। আমাকে ব্যাপারটা সমঝে নিতে দিন। সমস্ত কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনে দারোগাবাবু ভূতোদাকে বললেন, তুমি ঠিকই ধরেছ হে ছোকরা। ও লোকটা বন্দুকের নিশানা নড়িয়ে দিয়েছে। শোন, তুমি সাইকেলে চেপে নিজের এয়ারগান আর এক মুঠো ছররা নিয়ে এস তো ভাই। আমি ব্যাপারটা তদন্ত করে দেখতে চাই। কতক্ষণের মধ্যে ফিরে আসতে পারবে? 
 
-আঠারো থেকে বিশ মিনিট। 
 
-না। আধঘণ্টার আগে ফিরে এলে হবে না। পথে কোনও অ্যাকসিডেন্ট বাধিও না। ধীরে সুস্থে নিজের এয়ারগানটা নিয়ে এস তো দেখি? 
 
ভূতোদা ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল। 
 
ম্যানেজারবাবু বললেন, কিন্তু একটা কথা, দারোগাবাবু। লোকটা যদি ওর বন্দুকের মাছি সরিয়ে-নড়িয়ে দিয়ে থাকে তাহলে ঐ খাজা-গজা না কী-যেন নাম, সে ছোকরা কী করে বেলুন ফাটালো? 
 
দারোগা বলেন, এটা স্রেফ অঙ্কের হিসেব। ধরুন, ও লোকটা নিশানা ত্রিশ মিনিট বাঁকিয়ে দিয়েছে- 
 
ম্যানেজারবাবু বলেন, সে আবার কী কথা? ওটা কি ঘড়ি? বন্দুকের নিশানায় আবার ত্রিশ মিনিট কাকে বলে? দারোগাবাবু আমাদের দিকে ফিরে বলেন, তোমরা কেউ কিছু বুঝেছ? 
 
আমি বলি, আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনি হাফ-এ-ডিগ্রির কথা বলছেন। কৌণিক মাপ, -- মিনিটে। ষাট মিনিটে এক ডিগ্রি। - কারেক্ট। দিন তো ম্যানেজারবাবু প্যাড আর পেন্সিলটা। 
 
দারোগাবাবু একটা নকশা ছকে বললেন, মনে কর এই সরলরেখাটা হচ্ছে সঠিক পথ, -- নিশানা পালটানো না হলে যে পথে গুলি ছুটে যাবার কথা। আর এটা হচ্ছে ভ্রান্ত পথ, -- যে পথে এখন গুলিটা যাচ্ছে, মাছিটাকে সরিয়ে-নড়িয়ে দেওয়ায়। তাহলে দেখ, ভুল পথে গেলেও দশ ফুট দূরের বেলুনটা বিদ্ধ হচ্ছে। বেলুনের কেন্দ্রবিন্দুতে গুলিটা বিদ্ধ হচ্ছে না বটে, হচ্ছে এক পাশে। তবু তা ফাটবে। কিন্তু ভূতনাথ দূরের বেলুনকে বারে বারে লক্ষ্য হিসাবে স্থির করেছে। তাই বারেবারেই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। কারণ দশ ফুট দূরে গুলিটা মাত্র এক ইঞ্চি পরিমাণ লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও, ত্রিশ ফুট দূরে সেটা হয়ে গেছে তিন ইঞ্চি। যেহেতু দূরস্থিত বেলুনটা আকারে ছোট তাই লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। 
 
আমরা সবাই অঙ্কের ব্যাপারটা ভালো করে সমঝে নিতে নিতেই ভূতোদা তার নিজস্ব এয়ারগান সমেত ফিরে এল। তার পকেট-বোঝাই ছররা। 
 
দারোগাবাবু বললেন, চল তোমরা সবাই। ম্যানেজারবাবু, -- আপনিও আসুন। ম্যানেজারবাবু কাঁইকুই করেন, আবার এই বুড়ো মানুষটাকে ধরে টানাটানি করছেন কেন? 
 
-- প্রয়োজন আছে বলেই করছি। কথায় বলে, বিবাদটা থানা-আদালতে গড়িয়েছে। তা থানাতে তো পৌঁছেই গেছে। আদালতেও গড়াতে পারে। আপনাকে কিছু করতে হবে না। আপনি শুধু সাক্ষী হিসাবে উপস্থিত থাকবেন। 
 
আমরা সদলবলে ঢুকতেই দোকানি লোকটা উঠে দাঁড়ালো। সেলাম বাজিয়ে বালিয়া জেলার দেহাতি ভাষায় বলল, আঁয়ি, আঁয়ি, দারোগাবাবা -- সাহেব, ইধর পাধারিয়ে। কুছ ঠান্ডাই বোলাই? 
 
দারোগাবাবু বিশুদ্ধ বঙ্গভাষায় বললেন, হ্যাঁ, ঠাণ্ডা করে দেবার জন্যেই এসেছি। শোন হে, এই বাবুকে বত্রিশটা গুলি ছুঁড়তে দিতে হবে, -- ওর নিজের বন্দুকে, নিজের গুলি। -- এই ধর তোমার আট-আনা। 
 
বিনয়ের অবতার দোকানি রুখে ওঠে, কেঁও সাব? ক্যা মেরি বন্দুকমে কুছ গলতি হৈ? 
 
-- হৈ কি নেহী হৈ, সেটাই যাচৈ করতে চৈ, বাবা। 
 
যার হাতে বন্দুকটা ছিল, উঠতি জোয়ান একটি তরুণ, সে বললে, আপনি লাইনে দাঁড়ান। আমার পর আপনার চান্স আসবে। দারোগাবাবু বললেন, আপনি আমাকে চেনেন না, তাই ওকথা বললেন। আমি সদর থানার দারোগা। দোকানির বন্দুকের নিশানা ঠিক আছে কি না জনস্বার্থে সেটা যাচাই করতে চাই। আপনি সরে দাঁড়ান। 
 
 ভূতোদা এগিয়ে এল। এখন রঙ্গমঞ্চে সেই হিরো। বললে, নরেন, দ্যাখ তো ছোট-বড় হাতি কটা আছে, এ জঙ্গলে ....... 
 
-- হাতি? মানে? 
 
-- তুই বলেছিলি না যে মারি তো হাতি, লুটি তো ভাণ্ডার করতে? এখন আমি শুধু হাতিই মারব। জিবেগজার মতো ছুঁচো মেরে হাতে গন্ধ করব না। বেশি দামের বেলুন কটা আছে? 
 
আমি ওকে দেখিয়ে দিলাম, পাঁচশ মার্কা বেলুন আছে মাত্র একটি, সাড়ে-চারশ দুটি, আর চার শ তিনটে। ভুতোদা বললে, বাস, ব্যস, অত আমার মনে থাকবে না। দাঁড়া আগে বড় হাতির পেটটা ফটাস্ করি – 
 
টিপ করে প্রথম ফায়ারেই সবচেয়ে দূরের সবচেয়ে ছোট্ট বেলুনটা: ফটাস্। তার নম্বর পাঁচশো। আমরা পাঁচ বন্ধু চিৎকার করে উঠি, -- হুররে। 
 
ভূদ্দা বললে, গোল করিস না। কনসেনট্রেশান নষ্ট হয়ে যাবে। সে আবার দ্রাম করে ফায়ার করল। সেকেণ্ড উইকেট ডাউন! সাড়ে চারশ মার্কা প্রথম বেলুনটা। দোকানির চোয়ালের নিম্নাংশটা ঝুলে পড়ল। 
 
প্রথম দশটা ফায়ারে ওর স্কোর চার হাজারের কাছাকাছি। চার হাজার পয়েন্ট মানে একশ পঁচিশ টাকা। যে বাজারে ল্যাংড়া আমের দর তিন টাকা শ। প্রথম শটেই তো পাঁচ শ ফেটেছে। সাড়ে চার আর চার শ নম্বরী বেলুন সব খতম। এবার ও ফাটাচ্ছে সাড়ে তিনশ মার্কা বেলুন। 
 
দোকানি কাটা কলাগাছের মতো ধ্রাশ করে পড়ে গেল দারোগাবাবুর ঠ্যাং জোড়ার উপর। জান বাঁচাইয়ে দারোগা বাবা। মর যাউঙ্গা। বিলকুল মর যাউঙ্গা। বালবাচ্ছা লেকর ম্যয় ভি ফটাস হো যাউঙ্গা। 
 
ভূতোদা আমাকে বললে, তুই বাইরে গিয়ে একটা ঠেলার ইন্তেজাম কর তো নরেন। বত্রিশটা ফায়ারের পর এ তাঁবুতে ঐ বুড়োটা ছাড়া আর কিছু থাকবে না। গুদাম সাবাড় করে ছাড়ব আমি। 
 
ন্যাপলা বলে, ঠ্যালার কী দরকার ভূতোদা? এখানেই নিলামে সব ঝেড়ে দিয়ে খালি হাত পায়ে, -- কিন্তু ভর্তি পকেটে বাড়ি ফিরব। না হলে বাড়িতে কৈফিয়ৎ দিতে দিতে জান নিকলে যাবে।
 
 নেড়া বললে, ন্যায্য কথা। প্রমাণ করতে পারব না তো যে, এ গুলো চোরাই বা লুঠের মাল নয়। দারোগাবাবু বলেন, তোমার তো দারুণ টিপ হে ভূতনাথ। শুটিং কম্পিটিশনে নাম দাও না কেন? 
 
ভূদ্দা বলে, এ বছর দেব! আপাতত এর গুদামটা সাবাড় করতে দিন। 
 
কিন্তু দোকানি ওর বন্দুকের সামনে বুক পেতে দাঁড়ায়। আর গুলি ছুঁড়তে দেবে না সে। তাহলে বালবাচ্চা নিয়ে সে মরেই যাবে। দারোগাবাবুকেই সে সালিশ মানে। 
 
দারোগাবাবু বলেন, অল রাইট। আমি বিচার করে দেব। কিন্তু আমার বিচার তোমরা দুজন এক কথায় মেনে নেবে তো? পরে আপত্তি করবে না? 
 
দোকানি আর ভূদ্দা দুজনেই রাজি হল। ভূদ্দা প্রথমটা গাঁইগুই করছিল; কিন্তু শেষমেশ আমার পরামর্শ শুনল। ম্যানেজারবাবুও অনুরোধ করলেন ওকে, এই সালিশী মেনে নিতে। 
 
দারোগাবাবু দোকানিকে বললেন, প্রথম কথা, তোমার বন্দুকের নিশানা ঠিক নেই। তুমি জুয়াচুরি করছিলে এটা প্রমাণ হয়েছে। তুমি অপরাধ স্বীকার করছ? 
 
দোকানী গরুড়পক্ষীর ভঙ্গিতে জোড়হস্তে বললে, হুজুর মাইবাপ। 
 
-- সেটা কোন কথা নয়, আমি তোমার মা-বাপ, কি ঠাকুর্দা, সেটা কথা নয়, কথা হচ্ছে তুমি অন্যায় করেছ! কবুল খাচ্ছ? 
 
-- জো হুকুম, হুজুর! 
 
-- তোমার তাঁবু আমি সীল করে দিয়ে যাচ্ছি। তুমি তোমার বন্দুকটা নিয়ে কলকাতা চলে যাও। মেরামত করিয়ে নিয়ে এসে আমাকে খবর দেবে। এই ভূতনাথবাবু সেটা চেক্ করে পাস করে দিলে আবার দোকান চালু করতে পারবে। সমঝা? 
 
-- জী হুজুর। 
 
-- আর ভূতনাথ ভাই! তোমার উপর তিনটে আদেশ। প্রথম কথা, তুমি ইচ্ছেমতো তোমার পাঁচ বন্ধুর জন্য পাঁচটা স্মৃতিচিহ্ন, যে পাঁচটা তোমার পছন্দ, উঠিয়ে নাও। আর নিজের জন্য একটা। কেমন রাজি? 
 
ভূদ্দা বললে, না, স্যার। আমাকে আরও দুটো জিনিস দিতে হবে। ঐ ছয়টার উপর। ঐ মোরাদাবাদী ফুলদানিটা, -- ওটা আমি উপহার দেব ম্যানেজারবাবুকে, আর দেওয়াল ঘড়িটা। সেটা আপনাকে। 
 
দারোগাবাবু বিব্রত হয়ে বলেন, না, না। আমি বিচারক। আমার উপহার নেওয়া ভাল দেখায় না। ম্যানেজারবাবু বলেন, না, স্যার। আপনি বিচারক নন, আর্বিট্রেটার, মানে সালিশী। বিবদমান দুই পক্ষের ঝগড়া-কাজিয়া যিনি মিটিয়ে দেন তাঁর পক্ষে ফিজ নেওয়া বে-আইনী নয়। দোকানি পাদপূরণ করে, দেওয়াল ঘড়ি আপকো মেহেরবানী করকে লেনেই পড়েগা হুজুর। 
 
দারোগাবাবু বললেন, ঠিক আছে, আপনারা পাঁচজনে যখন এত পীড়াপীড়ি করছেন, তখন ঘড়িটা না হয় স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে আমি নিয়েই যাব। কিন্তু তোমার আরও দুটো কাজ আছে ভূতনাথ। 
 
-- বলুন স্যার। 
 
-- প্রথম কথা, এই দোকানদার কলকাতা থেকে বন্দুকের নিশানা ঠিক করিয়ে আনার পর তুমি তা পরীক্ষা করে সার্টিফাই করবে, 
 
-- করব। 
 
-- সেকেন্ডলি, আমি এ দোকানের সীল খুলে দিলে মেলা শেষ হওয়া তক্ তুমি এ তাঁবুতে এসে আর বেলুন ফাটাবে না। 
 
ভূতোদা গুম হয়ে বলে, এটা কেমন বিচার স্যার? কোন্ অপরাধে আমার এ শাস্তি? 
 
-- না, ভূতনাথ ভাই। কোন অপরাধের জন্য নয়। এ লোকটা অন্যায় করেছে। তার সাজা আমি ওকে দিচ্ছি। এ কয়দিনে ও যত মুনাফা করেছে তা আজকে দশ মিনিটে কর্পূরের মতো হাওয়ায় উবে গেল। লোকটার এটাই উপজীবিকা। আমি তো এক অপরাধে ওকে দু-বার শাস্তি দিতে পারি না। তুমি তোমার দুর্দান্ত টিপের জন্য পুরস্কারও পেয়ে যাচ্ছ। তোমারও উচিত লোকটাকে সৎ পথে উপার্জন করতে সাহায্য করা। ক্ষমা করা। তাই না। 
 
ভূদ্দা এক কথায় মেনে নিল। বললে, ঠিক আছে, স্যার। কিন্তু পরের বছর ও যদি বারোদোলের মেলায় আবার আসে? 
 
-- পরের বছরের হিসাব পরের বছর হবে। আমি তো এখানে পার্মানেন্ট সেটলমেন্ট করতে বসিনি। এ বছর তুমি এ তাঁবুতে এসে আর বন্দুক চালাবে না। বাকি কয়দিনে ওকে লোকসান যতটা সম্ভব পুষিয়ে নিতে দাও। 
 
ভূদ্দা বললে, -- অল রাইট, স্যার। মেনে নিলাম আপনার রায়। তাই হবে। 
 
-- গুড। এবার বল, তুমি দোকান থেকে কী কী উঠিয়ে নেবে? 
 
ভূদ্দা আমাদের পাঁচ বন্ধুর জন্য একটাই স্মৃতিচিহ্ন তুলে নিল, -- চ্যাম্পিয়ান সাইজ একটা ক্যারাম বোর্ড। আমাদের পাঁচজনের যৌথ উপহার। ম্যানেজারবাবুর জন্যে সে তুলে নিল একটা মোরাদাবাদী কাজ করা ফুলদানি। আর দারোগাবাবুর জন্য দেওয়াল ঘড়িটা। 
 
-- আর তোমার নিজের জন্য? 
 
-- ঐ ডন ব্র্যাডমানের সই ছাপা উইলো-কাঠের ক্রিকেট ব্যাটটা, স্যার। 
 
দোকানি খুশি হয়ে বললে, -- বহুৎ খুব। লে যাইয়ে আর্জান সরদার! আপকা ইনাম। 
 
ভূদ্দা বলে, আর্জান সরদার মানে? 
 
দারোগাবাবু বুঝিয়ে দেন, ও বলছে অর্জুনের কথা। দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায় যে অর্জুন লক্ষ্যভেদ করে তাঁর অব্যর্থ টিপের নমুনা দেখিয়েছিলেন। অর্জুনের নামই অপভ্রংশে, - আর্জান! সে হিসাবে ঐ ব্যাটটার নাম, --- দ্রৌপদী।
 
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এই গল্পটি শুনতে হলে নিচের লিংকে ক্লিক করুন: 

বেলুন ফটাস্। নারায়ণ সান্যাল। মজার গল্প। গল্প পাঠে : অনুব্রতা Narayan Sanyal. Comedy Story Bhutayan

ভূতায়ন - অপারেশন শীল্ড ফাইনাল (Bhutayan - Operational Shield Final)

 
একমাত্র লেখাপড়া ছাড়া আর সব বিষয়েই ছেলেটার অদ্ভুত প্রতিভা। স্পোর্টসের দিনে এক গাদা মেডেল নিয়ে বাড়ি যায়। সারা বছর খেলার মাঠে সে হাজির। ঝড়-ঝঞ্ঝা বজ্রপাত, একদিনও কামাই নেই। ছোট ছেলেদের অতি যত্ন নিয়ে শেখাত খেলা। তাছাড়া খুব ভাল ম্যাজিক দেখাতে পারত সে। প্রতি বছর আমাদের প্রাইজের দিন ভূতোদা ম্যাজিকের খেলা দেখাত। মফঃস্বল শহরের এই সরকারী স্কুলের প্রাইজ উৎসবে গণ্যমান্য ব্যক্তিরা সকলেই আসতেন। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট, মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান, কলেজের প্রিন্সিপাল। সকলের চোখের সামনে দিয়ে সে রুমালকে বানাতো পায়রা, ব্লটিং কাগজকে দশটাকার নোট। যেটাতে মন দেবে তার চরম করে ছাড়বে। এমনি ছিল ওর অধ্যাবসায়।

ওর কাকা ছিলেন স্থানীয় ওভারসিয়ার-স্কুলের ড্রইং টিচার। তিনি বলতেন, - ওর মাথা নাকি খুব সাফ। মন দিয়ে পড়াশুনা করলে ভূদ্দা নাকি অনায়াসে এঞ্জিনীয়ারিঙেও পাস করত। শোনা যায় হেডমাস্টার মশাই ওকে ডেকে একবার বলেছিলেন, - 'বাবা ভূতনাথ, মন দিয়ে পড়লে তুমি পাস করতে পার না, এটা তো আমার বিশ্বাস হয় না বাবা।'

ঘাড় চুলকে লাজুক লাজুক মুখে ভূতোদা উত্তরে বলেছিল, - 'ঐ জন্যই তো আমি মন দিয়ে পড়ি না, স্যার।' দূরন্ত বিস্ময়ে হেডমাস্টার মশাই বলেছিলেন, - 'কেন বাবা? তাহলে কি হবে?'

-'পড়লেই আমি পাস করে যাব। আর আমাদের স্কুল টীমটা একেবারে কানা হয়ে যাবে। স্যার গুরুদাস চ্যালেঞ্জ শীল্ডটা হিপ্-হিপ-হুররে করে নিয়ে যাবে ঐ সি. এম স্কুল।' গম্ভীর-প্রকৃতি হেডমাস্টার মশাই নাকি হেসে ফেলেছিলেন ওর কথা শুনে।

কিন্তু আমরা হাসিনি। হাসির কথা নয় বলেই হাসিনি। স্যার গুরুদাস চ্যালেঞ্জ শীল্ড আমরা পর পর চার বছর ঘরে আনছি। প্রতিবারই ক্রিশ্চিয়ান মিশনারী স্কুল, বা সংক্ষেপে সি.এম.এস হয় রানার্স-আপ। কতবার কত ভাবে যে ভূতোদা আমাদের স্কুলের সম্মান রক্ষা করেছে তা আর কহতব্য নয়। এককালে স্যার আশুতোষ বলতে নাকি বোঝাত বিশ্ববিদ্যালয়কে, আর বিশ্ববিদ্যালয় বলতে বোঝাত স্যার আশুতোষকে। আশ-পাশের পাঁচটা স্কুল টীমও তেমনি কলেজিয়েট স্কুল বলতে বোঝে ভূতনাথ ভট্টাচার্যকে আর ভূতনাথ বলতে বোঝে আমাদের স্কুলের পেনাল্টি ঈটার গোলী, উইকেটকীপার-কাম-সেঞ্চুরি ব্যাট এবং নির্ভুল স্ম্যাশার নেটম্যানকে।

এ বছরও শীল্ড ফাইনালে যথারীতি ওদিক থেকে উঠেছে সি.এম স্কুল আর এদিক থেকে উঠেছেন আমাদের আদি-অকৃত্রিম ভূতোদা, আরও দশটা ছানাপোনা নিয়ে।

ফাইনালের খেলাটা যাতে জমজমাট হয় তাই কর্তৃপক্ষ আমাদের এই দুটি সেরা স্কুলের টীমকে দু-দিকে গ্রুপে রেখে নকআউট প্রোগ্রাম ছকতেন। এবার ফাইনাল খেলা প্রথম দিন গোললেস্ ড্র হয়েছে। সেদিন আমি মাঠে যাইনি। এই অপরাধে ভূতোদা প্রথমেই তো আমাকে ন-ভূতো ন-ভবিষ্যতি ধমকালো। তাই দ্বিতীয় দিন ঠিক সময়ের আগেই গিয়ে মাঠে হাজিরা দিলাম।

মাঠের একপাশে সামিয়ানা খাটানো। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব এসেছেন তাঁর মেমসাহেব স্ত্রীকে নিয়ে। স্যার গুরুদাস চ্যালেঞ্জ শীল্ড আর রূপার কাপগুলো চকচক করছে পড়ন্ত আলোয়। আগের দিন গোলশূন্য ড্র হয়েছে। বাড়তি সময় খেলিয়েও কোন হিল্লে হয়নি। 'সাডেন ডেথ'-আইন তখনো চালু হয়নি। ফলে এই রি-প্লের আয়োজন। আজ তাই উৎসাহ উদ্দীপনা আরও বেশি।

এ বছর অবশ্য সি.এম. স্কুলের জিতবার সম্ভাবনাই বেশি। আমাদের গত বছরের ফুল টীমের চার চারটে ছেলে ম্যাট্রিক পাস করে বেরিয়ে গেছে। অথচ ওদের গত বছরের ফুল-টীমটাই এসেছে দেখছি। একটা বছরে ছেলেগুলো মাথায় বেড়েছে, গায়ে-গতরেও মজবুত হয়েছে আরও। তাছাড়া বোঝাপড়াটা আরও বেশি হয়েছে, হাফ-লাইনের সঙ্গে উইংসের, উইংস-এর সঙ্গে ইনের, ইনের সঙ্গে স্কোরারের। ছোট-ছোট পাসে খেলতে শিখেছে ওরা। বেশিদিন এক টীমে খেললে যা হয়। শুনলাম আগের দিন ড্র হয়েছে বটে, কিন্তু সারাক্ষণই ওরা চেপে রেখেছিল। ন্যাপলা খেলা দেখেছিল, বললে, - 'হাফমাঠের ওপাশে বল গেছে কিনা সন্দেহ। ক্রমাগত আমাদের গোলে বল কিক করেছে ওরা। ভূতোদা অন্তত আধ ডজন একেবারে অব্যর্থ গোল বাঁচিয়েছে, তার ভিতর একটা পেনাল্টি।' ন্যাপলার মতে অন্তত ছয় গোল খাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।

আগের দিন জয়ের নিশ্চিত সম্ভাবনা দেখে গেছে ওরা। আজ তাই পুরোদস্তুর তৈরি হয়ে এসেছে।

খেলা শুরু হবার আগে ভূতোদা আমার কাছে এসে কানে কানে বললে, -'কান্ডটা দেখেছিস নরেন, ওরা লরি ভাড়া করে এনেছে শীল্ড নিয়ে যাবে বলে। দ্যাখ, চেয়ে দ্যাখ, ওদের সারা স্কুলটাই এসেছে মাঠে। মাস্টার মশাইরা সবাই এসেছেন, মায় বেয়ারা-দপ্তরি-দারোয়ান ইস্তক। আর আমাদের স্কুলের? গুনে দ্যাখ, বিশটা বাছুরও আসেনি।'
 
রাগ তো হবারই কথা। নেপাল, নেড়া, ক্যাবলা, গজেন, গোবিন্দ আর আমি। ক্লাস টেনের বেয়াল্লিশটা ছেলের মধ্যে কুল্লে এই পঞ্চপাণ্ডব হাজির। অক্ষৌহিণীর বাদ বাকি বেপাত্তা। অন্যান্য ক্লাসেরও ঐ একই হাল। গোটা স্কুলের যে কটি ছেলেকে দেখতে পাচ্ছি তা দু-হাতের দশটা আঙুলে গোনা যায়।

সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে বলি, -'দোষ আর কাকে দেব বল ভূদ্দা? আগের দিনের খেলার নমুনা দেখে সবাই বুঝে নিয়েছে আজ পাক্কা পাঁচ-সাত গোলে হারব আমরা। জেনেশুনে কে আর তা দেখতে আসে বল?'

ভূতোদা প্রচণ্ড ধমক দিয়ে ওঠে, -'উদ্‌বেড়ালের মত কথা বলিস না, নরেন। খেলায় হারজিত থাকবেই। তাই বলে মাঠে আসবে না? এই তো আমি। আমি তো জানিই ফেল করব, তবু বছর বছর পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছি না? কিছুই তো করতে হবে না বাপু। সেরেফ আমাদের ফরোয়ার্ড লাইন যখন বল নিয়ে ছুটবে তখন একটু প্রাণ খুলে চিল্লাবি, একটু এনকারেজ করবি। তাও পারিস না? দ্যাখ নরেন, চেয়ে দ্যাখ। এক মাঠ অচেনা মুখ। মনে হচ্ছে, এ যেন গোয়াড়িগঞ্জ নয়, যেন টিটিকাকাতে অলিম্পিক খেলতে এসেছি।'

গজেন অমনি টুক্ করে বলে বসে, -'টিটিকাকাতে কিন্তু কোনদিন অলিম্পিক হয়নি ভূতোদা।' ভূতোদার পাতা-না-পড়া চোখ দুটো যেন রাতের ডিসট্যান্ট সিগনাল। নেড়া তাড়াতাড়ি কোন রকমে ব্যাপারটা ম্যানেজ করে নেবার চেষ্টা করে। বলে, - 'আহাহা, তোরা কথা বুঝিস্ না কেন? ভূতোদা তো বলেনি যে, টিটিকাকাতেই কখনও অলিম্পিক হয়েছে। ও একটা কথার কথা। এতদিন হয়নি বলে ভবিষ্যতেও যে কোনদিন হবে না তার তো কোন স্থিরতা নেই।'

ভূতোদার জ্বলন্ত চোখ দুটো শান্ত হয়ে আসে। আমাদেরও ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ে। গজাটার যেমন বুদ্ধি। এই ক্রিটিক্যাল মোমেন্টে, খেলা শুরু হবার ঠিক আগেই পণ্ডিতি ফলাতে গিয়ে ভূতোদার মেজাজটা খারাপ করে দিয়েছিল আর কি। টিটিকাকা নামটা কদিন আগে ভূগোল মাস্টার মশাইয়ের কাছে শুনেছিলাম মনে হচ্ছে। বেশ জুতসই নামটা। কিন্তু আমাদের বরাত খারাপ! - মারে কেষ্ট রাখে কে?

হতভাগা গজেন এর পরেও বলে বসে, -'না-ভবিষ্যতেও কোন দিন টিটিকাকাতে অলিম্পিক হবে না-'

নেড়া, গোবিন্দ আর আমি তিনজনে একসঙ্গে খেঁকিয়ে উঠি, - 'কেন হবে না? আলবৎ হতে পারে। রোমে হতে পারে, হেলসিঙ্কিতে হতে পারে, বার্লিনে হতে পারে, টোকিওতে হতে পারে, আর শুধু টিটিকাকাতেই পারে না!'

গজেন আবার বলে - 'না, পারে না। কারণ টিটিকাকা কোন দেশ বা শহর নয়। ওটা দক্ষিণ-আমেরিকায় অবস্থিত একটা হ্রদের নাম। চিল্কা, বৈকাল অথবা মানস-সরোবরে কি অলিম্পিক হতে পারে?'

যেন শুনতেই পাইনি আমরা কেউ। তাড়াতাড়ি কথাটা চাপা দিতে বলি, - 'যাকগে মরুগ্গে, ভূদ্দা তুমি কিছু ভেব না। মাথার উপর ভগবান আছেন'-

নেড়া আর এক কাঠি বাড়িয়ে বলে, -'এবং গোল-পোস্টের সামনে ভূতোদা আছেন!'

ভূতোদা কোন জবাব দেয় না। হাতের গ্লাভস খুলতে খুলতে মাঠে নেমে পড়ে।

আমি বলি, - 'গ্লাভসটা আবার খুলছ কেন এখন? এখনি তো খেলা শুরু হবে।'

ভুতোদা হেসে বলে, - 'নরেনটা একটা আস্ত অনড্বান। আমি না ক্যাপ্টেন! দস্তানা পরে শেকহ্যান্ড করা এটিকেট - বিরুদ্ধ, তাও জানিস না বলিবর্দ!'

মনটা খুশীতে ভরে ওঠে। নেড়া আর গোবিন্দও লক্ষ্য করেছে গালাগাল দুটো। নেড়া আমার কানে কানে বলে, - 'একে অনড্বান তাই বলিবর্দ! আজ আগুন ছুটিয়ে খেলবে ভূদ্দা।'

আমি তা জানি। মুড ভাল না থাকলে ভূতোদা কখনও সংস্কৃতে বকা দেয় না। যত মুষড়ে পড়ে ততই ওই ভাষাটা হয়ে পড়ে চাষাড়ে। মেজাজ একটু খুশ হলেই তার সঙ্গে সংস্কৃত প্রত্যয় যুক্ত হতে থাকে। আর মন মেজাজ যখন বিলকুল শরিফ, তখন নির্ভেজাল সংস্কৃতে বকে দেবে। সেগুলো খুব মিষ্টি আদরের; বলিবর্দ, ছুছুন্দর, দণ্ড বায়স, দেড়কানন, মার্জারমুখী; অর্থাৎ বকাবকিগুলোই হচ্ছে ভূতোদার মেজাজের ব্যারোমিটার। তাই হঠাৎ নিখাদ জোড়া সংস্কৃত শুনে আন্দাজ করি, টিটিকাকা যে হ্রদ, এই মর্মান্তিক দুঃসংবাদটা প্রফেসর অনিলচন্দ্রের খুড়োমশায়ের কর্ণগোচর হয়নি।

খেলা শুরু হল। প্রথম থেকেই সি. এম. স্কুল চেপে থাকে আমাদের গোল এলাকা। ঘনঘন আমাদের গোলে আসতে থাকে একের পর এক তীব্র শট। কিন্তু চীনের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেদ করে একবারও বলটা গোলে ঢুকতে পারে না। গোলপোস্ট দুটোর মাঝের ফাঁকটা যেন নিরেট পাথরের দেওয়ালে গাঁথা। প্রতিটি শটই প্রতিহত হয়ে ফিরে যায়। হাফ-টাইমের আগে তিন তিনটে কর্ণার-কিক পেল ওরা, কিন্তু গোল হল না। রাইট-আউটের একটা কর্ণার কিক থেকে অনিবার্য একখানা গোল হতে হতে হল না।

হাফ-টাইমের দীর্ঘ টানা বাঁশি বাজল। আমরা লেবু-বরফ নিয়ে ছুটে গেলাম মাঠে। জড়িয়ে ধরি ভূতোদাকে।

নেড়া বলে, দেখেছ ভূতোদা, - 'ওরা ব্যান্ড-পার্টি ভাড়া করে এনেছে! লরির উপর মাইক ফিট করছে, ঐ দেখ। শীল্ড নিয়ে প্রসেশন করবার সব রকম আয়োজন ওরা করছে নিশ্চিন্ত মনে, যেন খেলা জেতা হয়েই আছে। ওরা একেবারে স্যাংঙ্গুইন।'

খুন চেপে যাওয়া এক জোড়া জ্বলন্ত চোখ তুলে ভূতোদা এক নজর দেখে নিল ওদের আয়োজনটা। ব্যান্ড-পার্টি সত্যিই অপেক্ষা করছে। পাতাবাহার পাতা জড়িয়ে লরিটাকে সাজাচ্ছে ওরা। পর পর চার বছর রানার্স-আপ হয়ে আজ তারা - বিজয়লক্ষ্মীর নিশ্চিন্ত আশীর্বাদের স্বপ্ন দেখছে।

ভূতোদা বলে, -'কুছ পরোয়া নেহি, ওরা স্যাঙ্গুইন তো আমরাও স্যাঙ্গুইনারি'।

গোবিন্দ বোধ করি ধরতে পারে না ব্যাপারটা, বলে, - 'স্যাঙ্গুইনারি আবার কি?'

ভূতোদা বলে, - 'ঐ পেঙ্গুইনটাকে জিজ্ঞাসা কর। গ্রামারের এসব কূটকচালি ওর ঠোঁটস্থ।'

গজেনকে দেখিয়ে দেয় সে। গজেনকে ভূতোদা মাঝে মাঝে আদর করে পেঙ্গুইন বলে ডাকে। ম্যালেরিয়ায় ভুগে বেচারির পিলেটা একটু বড় বলেই বোধ করি এই নামকরণ। কিন্তু সে যাক্।

কিন্তু ভূতোদা কি বলতে চায়? শেষ পর্যন্ত সত্যিই একটা খুনোখুনি রক্তারক্তি কাণ্ড বাধিয়ে বসবে নাকি?

হাফ-টাইম শেষ হতেই আমরা আবার ভূতোদার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আবার চাপ পড়তে শুরু করল আমাদের গোল এলাকায়। মাঝমাঠের ওদিকেও যে আধখানা ফাঁকা মাঠ পড়ে আছে সে খবরটা যেন বলটাকে কেউ বলে দেয় নি। সি. এম. স্কুলের ছেলেরা এবার একটা নতুন কায়দা শুরু করল। ওরা বুঝতে পেরেছে যে আমাদের গোলকীপারকে চটাতে না পারলে চলবে না। রেগে মেগে যদি ভুল পজিশন না নেয় ভূতোদা, তাহলে কিছুতেই গোলে বল ঢুকবে না। খেলার প্রথম থেকেই তো ক্রমাগত হো-হো করছিল সবাই মিলে, এখন একেবারে নতুন কায়দায় শ্লোগান দিতে আরম্ভ করে।

আমরা জনাবিশেক মাত্র ক্ষীণজীবী প্রাণী। তাই ওদের মাঠজোড়া ভোঁ-র কাছে আমাদের ভেঁপু যেন বাজলই না। আমাদের গলার আওয়াজ ডুবে গেল নিঃশেষে! সারা মাঠখানাকে ওরা মাতিয়ে তুলল এই নতুন শ্লোগানে। মাঠের এ প্রান্ত থেকে জনা পঞ্চাশ ছেলে একসঙ্গে সুর করে বলে:

বাবা ভূ-তোর বয়-স ক-ত?

ওই গোলপোস্টের পিছন থেকে শত খানেক ছেলে জবাব দেয়: বায়ো-কি ত্যায়ো।

এ প্রান্ত বলে: বা-বা কী বলে?

ও প্রান্ত বলে: বা-বা বলে আ-ও-ও কম।

এ প্রান্ত বলে: আর মা কী বলে?

ও প্রান্ত বলে: মা বলে আ-ও-ও-ও-ও কম!!

আচ্ছা তোমরাই বল, এই প্রশ্নোত্তরের মধ্যে কেউ মাথা ঠান্ডা করে গোল ঠেকাতে পারে? বিশেষত যদি তার বয়স আর পাঁচটা ছেলের চেয়ে সত্যিই কিছু বেশি হয়? ওদের প্রশ্ন আর উত্তর চালাচালিতে মাঠটা যখন গমগম্ করছে, বলটা তখন আমাদের গোলপোস্টের এ কিনার থেকে ও কিনারে আছাড়ি-পিছাড়ি খাচ্ছে।

জালে আটকানো বড় কই মাছ যেমন ঘাই দিয়ে দিয়ে ওঠে, বলটাও তেমনি ওদের ফরোয়ার্ড কজনের মাথায় মাথায়, পায়ে পায়ে ঘাই মারছে অনবরত, গোলের ভিতর না ঢুকে পড়া পর্যন্ত যেন তার নিস্তার নেই। কিন্তু ভূতোদার জাল ছেঁড়া অত সহজ নয়!

ক্রমাগত কিক করে, হেড করে, পাঞ্চ করে ক্লিয়ার করে যাচ্ছে নির্ঘাত গোল। একবারও ভুল হচ্ছে না পজিশান নিতে। চটেনি ভূতোদা। ওরা তাকে চটাবার জন্য 'মা কি বলে' প্রশ্নটার জবাবে 'ও'-টাকে আরও লম্বা করে সুর টেনে টেনে বলছে: আ-ও-ও-ও-ও কম। তা বলুক। হিমালয় পাহাড়কে কি বিদ্রূপে টলানো যায়?

ইতিমধ্যে একটা কাণ্ড ঘটল।

খেলা শেষ হবার আর মিনিট তিনেক বাকি। ভূতোদার ক্লিয়ার করা একটা শট একেবারে আকাশমার্গে গিয়ে পড়ল ওদের হাফ-লাইনের কাছে। ফাঁকা মাঠ। ওদের স্টপার পর্যন্ত পজিশান ছেড়ে এগিয়ে এসেছে গোল দেবার উত্তেজনায়, নিজেদের গোল সম্পূর্ণ অরক্ষিত রেখে।

আমাদের রাইট ইন চিরঞ্জীবটা দৌড়োয় ভাল। চমৎকারভাবে অফসাইড বাঁচিয়ে বলটা পায়ে রেখে এগিয়ে গেল। ড্রিবল্ করে একজন-দুজনকে কাটিয়ে নেয়, ব্যস, আর কেউ নেই সামনে। শুধু ওদের গোলকিপার আর আমাদের চিরে। কোনওক্রমে একবার গোলে বলটা মারলেই আমাদের চিরঞ্জীব সত্যিকারের চিরঞ্জীব হয়ে থাকবে।

আমরা চীৎকার করে উঠি, - এবার গোলে মার, চিরে।

কিন্তু না, চিরঞ্জীব এ চান্স কোনক্রমেই মিস হতে দেবে না। উল্কার গতিতে সে বল নিয়ে এগিয়েই চলে। কাছে, আরও কাছে, আরও কাছে। ওদের গোলকীপার একেবারে নার্ভাস। চিরেটা তখন গোলপোস্ট থেকে মাত্র দশ গজ ঘুরে। আপ্রাণ দৌড়ে ততক্ষণে ওদের লেফট ব্যাক এসে নাগাল পেল চিরেটার। দিলে মোক্ষম একটা সাইড পুশ। কী-কেন হল, ভাল দেখা গেল না, রেফারী পেনাল্টি দিল।

অফসাইড? ফাউল? হ্যান্ডবল? কি? কিছুই কেউ বুঝতে পারি না। আসলে রেফারী নিজেও পড়ে গিয়েছিল বহু পিছনে। সে যখন ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছালো তখন বোঝা গেল ব্যাপারটা। ওদেরই হ্যান্ডবল হয়েছে। লেফট-ব্যাকের। পেনাল্টি এলাকায়। পেনাল্টি। আমরা আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠি। কিন্তু ব্যাপারটা দাঁড়ালো অন্য রকম। মাঠে তীব্র উত্তেজনা। ওদের খেলোয়াড়ের হাতে নাকি বলটা আদপেই লাগেনি। লাইনম্যান সেটা দেখেছিল। অযাচিতভাবে ছুটে এসে কী যেন বলল রেফারীকে। ওদের সারা স্কুলের ছেলেরা তখন রেফারীকে ঠেঙাবার আয়োজন করছে। রেফারী কিন্তু নিজ সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। একবার নির্দেশ দিয়ে ফেলেছেন, আর প্রত্যাহার করবেন না।

বলটা সাজানো হল পেনাল্টি কিকের চিহ্নিত স্থানে।

সারা মাঠে তখন চীৎকার-শেম, শেম, পার্শিয়ালিটি, ঘুষ খেয়েছে। রেফারীকে দেখে নেব।

চিরঞ্জীব শটটা মারবার জন্য প্রস্তুত হয়। হুইসল পড়লেই সে পেনাল্টি কিক্ করবে। কিন্তু আমাদের ক্যাপ্টেন ভূতোদা তার সাড়ে চার ফুট লম্বা উটপাখির মত পা ফেলে উল্কার বেগে এসে পৌঁছালো সেখানে। চিরঞ্জীবকে ডেকে ভূতোদা কি যেন জিজ্ঞাসা করল। কী প্রশ্ন হল তা আমরা শুনিনি; কিন্তু দেখলাম চিরঞ্জীব দৃঢ়তার সঙ্গে না-য়ের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। সারা মাঠ তখনও চেঁচাচ্ছে, -শেম শেম।

নেড়া আমার কানে কানে বলল, - 'নরেন, কেটে পড়। না হলে ওরা একেবারে আলু-কাবলি বানিয়ে ছাড়বে। হ্যান্ডবল আদপেই হয়নি।'

হ্যান্ডবল যে হয়নি তা আমিও বুঝেছি। শুধু আমি কেন সবাই, মায় রেফারী পর্যন্ত। কিন্তু ভুল আত্মমর্যাদার মোহে নিজের জেদ বজায় রাখতেই রেফারী তাঁর নির্দেশটা প্রত্যাহার করলেন না।

আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, চিরঞ্জীব নয়, ভূতোদাই স্বয়ং গোলে পেনাল্টি-কিক করছে। ওদের ক্যাপ্টেন রেফারীকে কি যেন বললে। ভূতোদার সঙ্গেও কি সব কথা হল।

পরে শুনেছিলাম, ওদের ক্যাপ্টেন বলেছিল গোলকীপারের পেনাল্টি শট্ মারার অধিকার নেই। রেফারী নির্দেশ দিয়েছিলেন  -আছে।

ওরা এমনিতেই ক্ষেপে ছিল, তার উপর ভূতোদার শটের তীব্রতার কথা জেলার সব কটা স্কুলই ভাল মতো জানে। ওদের তিন চারজন খেলোয়াড় রেফারীকে ঘিরে দাঁড়ায়, বলে, - না নেই, কোন আইনে নেই।

ভূতোদা ওদের থামিয়ে দিয়ে বলেছিল, - 'না থাকে, তাহলেই তো ভালো ভাই। গোল হলেও আপনারা প্রটেস্ট করতে পারবেন। আইনে না থাকলে রি-প্লে হবে। কেমন না?'

অকাট্য যুক্তি। ওরা আর বাধা দেয় না।

বলটা সাজিয়ে রেডি হয় ভূতোদা।

আমরাও রুদ্ধ নিশ্বাসে রেডি হয়ে থাকি। সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠতে হবে: গোল!!

 
হুইসল পড়ল।



আর একেবারে সামিয়ানা লক্ষ্য করে উল্টো দিকে কিক করল ভূতোদা। আকাশ মার্গে উড়তে উড়তে বলটা এসে পড়ল ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের পায়ের কাছে। শীল্ডটা যেখানে সাজানো আছে তার কাছ বরাবর।

সারা মাঠ স্তম্ভিত। এ কি তালকানা রে বাবা। শুধু হাততালি দিচ্ছেন সস্ত্রীক ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব।

ড্র হয়ে গেল আবার।

খেলার শেষে বৃষ্টি নামল ঝেঁপে। আমরা কে কোথায় ছিটকে পড়লাম। নেড়া, ক্যাবলা, গজেন আর আমি ছুটতে ছুটতে গিয়ে আশ্রয় নিলাম ক্রিশ্চান পাড়ার একটা চায়ের দোকানে।

নেড়া কোঁচার খুঁটে মাথাটা মুছতে মুছতে বলে, -'ভূদ্দার কান্ডটা দেখলি? নিশ্চিত জেতা-খেলা ড্র হয়ে গেল ফের। এতবড় তালকানা দেখেছিস কখনও? কোন দিকে গোলপোস্ট আর কোন দিকে মারলে শট।'

আমি বলি, -' আমার মনে হয়, ভূদ্দা ইচ্ছে করেই উল্টোদিকে শট মেরেছিল।'

গজেন বলে, - 'বটেই তো। শেয়াল যেমন ইচ্ছে করেই টক আঙুর ফল খায়নি।'

আমি চুপ করেই যাই। নেড়া বলে, - 'কী দরকার ছিল বাপু তোর সর্দারি করতে যাবার? গোলকী আছিস্। তাই থাক না বাপু। আবার পেনাল্টি শট মারার শখ কেন? চিরেটাকে চান্স দিলে ঠিক গোল করত সে। হাজার হোক সে ফরোয়ার্ডে খেলে।'

আমার কেমন যেন খারাপ লাগে। ভূতোদাকে আমি সত্যিই ভালবাসতাম। ওকে নায়ক করে লিখব এই ছিল তখন আমার জীবনের অ্যাম্বিশান। ওর কাছে ম্যাজিকও শিখতাম লুকিয়ে। আড়ালে ওকে ডাকতাম 'গুরুদেব'। গুরুনিন্দা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল।

ক্যাবলা বলে, -'দেখ না, কাল ক্লাসে কী কান্ডটা করি। ভূদ্দার সর্দারি ভাঙতে হবে।'

বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল। আমরা যে যার বাড়ি ফিরে যাই। আমি মনে মনে ভাবছিলাম, - কেন এমন তাল-কানার মত উল্টো দিকে শট মারল ভূদ্দা? অনেক ভেবেও কোন কূলকিনারা করতে পারি না।



পরদিন স্কুলে গিয়ে আমরাই হতভম্ব!

দশটা তখনও বাজেনি। স্কুল গেটের কাছে একটা চাপ ভিড়। ছেলেরা কেউ ভিতরে ঢুকতে পারছে না। পিকেটিং হচ্ছে নাকি? তার মানে স্কুল হবে না। কিন্তু ভুলটা ভাঙলো পরমুহূর্তেই। দারোয়ানের টুলটা টেনে নিয়ে তার উপর দাঁড়িয়ে ভূতোদা বক্তৃতা দিচ্ছেন: 'গাড়োল, গিদ্ধড় কোথাকার - সব এসে জুটেছে এখানে? তোমাদের লজ্জা হয় না। এসব মস্করা করবার সাহস ওরা পায় কোথেকে। অ্যাঁ? তোমাদের ক্যাপ্টেনের বয়স 'বায়ো না তেয়ো? মা বলে আয়ো কম' - এসব কী ইতরামো? ওদের গোটা স্কুলটাই খেলার মাঠে যেতে পারে। তোমরা পার না? তোমরা মানুষ না বাছুর? বাছুর হলেও তবু কাজ হত, মাঠে গিয়ে কিছু হাম্বা হাম্বা করতে পারতে।'

বুঝতে পারি, কালকে পেনাল্টি ফস্কে যেতে মর্মান্তিক চটেছে ভূতোদা। একটাও সংস্কৃত গাল নেই ওর মুখে। ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসেন হেডমাস্টার মশাই। ডাকেন, বাবা ভূতনাথ।

টুপ করে টুল থেকে নেমে পড়ে ভূতোদা। আমচুরের মত কাঁচুমাচু মুখে বলে,- 'স্যার?'

হেডমাস্টার মশাই ভূতোদাকে কখনও ধমক দিতেন না। মিষ্টি করে বলেন,-' এসব কী হচ্ছে বাবা ভূতনাথ? তুমি নিজে পড়াশুনা না করতে চাও ক্ষতি নেই, কিন্তু এইসব সুকুমারমতি ছেলেদের মাথা খাচ্ছ কেন বাপ?'

ভূতোদা ঘাড়টা চুলকে আমতা আমতা করে, - 'ঘণ্টা এখনও বাজে নি স্যার।'

হেডমাস্টার মশাই বলেন, - 'বেজেছে বাবা। তাণ্ডব নাচতে ব্যস্ত ছিলে, তাই তোমার কানে যায়নি। তাছাড়া তোমার ঘন্টা তো এ স্কুলে বাজবে না বাবা। তোমার ঘন্টা বেজেছে স্বর্গে। কয়েক বছর ধরেই তা বেজে চলেছে।'

সবাই মুখ টিপে হাসছে। দারুণ অপমানিত হয়েছে ভূতোদা। মহিষাসুরের মত মুখটা থমথম করছে তার। আমরা ক্লাসে ঢুকে পড়ি। ভূতোদাও গিয়ে বসে ওর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের এজমালি ভূখণ্ডে, থূড়ি - কাষ্ঠখণ্ডে। লাস্ট বেঞ্চির কোণায়। আমাদের কারও সাহস হয় না ভূতোদাকে কিছু বলার। ফার্স্ট পিরিয়ডে ছিল ট্রানস্লেশন, ঘণ্টা পড়ে গেল। ন্যাপলা একবার সাহস করে ভাববাচ্যে বললে, - 'ওঃ, কাল ভূদ্দা যা খেলেছিল একেবারে আগুন ছুটিয়ে।' ভূতোদা জ্বলন্ত দৃষ্টিতে একবার তাকায় নেপালের দিকে। ভাগ্যে এ কলি যুগে ব্রহ্মতেজে মানুষ ভস্ম হয়ে যায় না। না হলে ন্যাপলা এতক্ষণে যাকে বলে সেই 'গো-ওয়েন্ট-গন'।

আমাদের আর কারও সাহস হল না ভুতোদাকে ঘাঁটাবার। পর পর দুটো পিরিয়ড কেটে গেল নির্বিঘ্নে। শেষ পর্যন্ত টিফিনের লম্বা ঘণ্টা বাজল। আমার টিফিন বাক্সে ছিল কুচো গজা আর ল্যাংচা। আমি জানতাম, ল্যাংচা বস্তুটা ভূতোদার খুব প্রিয়। ওর দিকে টিফিন বাক্সটা বাড়িয়ে ধরে বলি, - 'কাল ভূদ্দার খেলা দেখে মনে পড়ে যাচ্ছিল সেই ডালহৌসির ডেভিসকে। আর সেই ইয়র্কশায়ার টিমের সেই সাতফুট লম্বা গোলকীটাকে, - কী যেন তার নাম ভূদ্দা?'

ডালহৌসি টিমে ডেভিস বলে সত্যিই কোন গোলকীপার কস্মিনকালে ছিল কিনা তা আমার জানা নেই, ইয়র্কশায়ার টিমের খেলাও আমি জীবনে দেখিনি। নামগুলো ভূতোদার কাছে শুনে শুনে আমাদের মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। ভূতোদা নিঃশব্দে ল্যাংচাটা তুলে নিল টিফিন বাক্স থেকে। তা নিক, কিন্তু কথাই বলে না যে। অবশেষে আধখানা ল্যাংচা আমার হাতে গুরু প্রসাদী ভেঙে দিয়ে মুখভঙ্গি করে চিবোতে থাকে। ল্যাংচার পর নিজেই একমুঠো কুচোগজা তুলে নিল। কিন্তু না, কোন কথা নেই তার মুখে। গোবিন্দ আর কী করে, নিজের টিফিন বাক্স থেকে একটা পেয়ারা বের করে ভুতোদার হাতে দেয়। এটাও গ্রহণ করে ভূতোদা। মটর বলে, - 'ছুরি দেব ভূদ্দা? কেটে কেটে খাবেন?'

পেন্সিলকাটা একটা ছুরি সে পকেট থেকে বের করবার উপক্রম করে। ভুতোদা ধমকে ওঠে, -'তুই চুপ কর মর্কট।' মর্কট! কথাটা বাংলা না সংস্কৃত! কানে কানে প্রশ্ন করি গজাকে। গজা বলে, -'সংস্কৃতই হবে রে! মনে নেই সেদিন পণ্ডিতমশাই তোকে মর্কট বলেছিলেন? পণ্ডিতমশাই কখনও বাংলা গাল দেন না।'

আমাকে মর্কট বলে গাল দিয়েছিলেন! গজাটা কি ডাহা মিথ্যুক রে বাবা! কিন্তু না, নিজেদের মধ্যে খাওয়া-খাওয়ি করে কেস খারাপ করবার সময় এখন নয়। ভুতোদার মুখে সংস্কৃত-ঘেঁষা বুলি যখন শোনা গেছে, তখন ফাঁড়া এ যাত্রায় কেটে গেছে বুঝতে হবে।

সুতরাং আর ভয় নেই। সবাই মিলে চেপে ধরি ভূতোদাকে। যা হবার তা তো হয়ে গেছে। ভূতোদার ভাষায় সে সব কথা এখন 'যাকগে-মরুগ্গে। এখন আমাদের কী করতে হবে ভূতোদা বলুক। আমরা লীডারের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব।

শেষ পর্যন্ত ভূতোদা উঠে দাঁড়ায়।

টিচারের টেবিলটার কাছে উঠে গিয়ে শুরু করে বক্তৃতা।

- 'খেলার জয়-পরাজয় অনিশ্চিত। সেটা কিছু বৃহৎ কথা নহে। কিন্তু ঐ দগ্ধানন বালখিল্য বাহিনী তোমাদের ক্যাপ্টেনকে চিপিটক নিষ্পেষণ করতে চায়, এ অপমান অসহ্য। কেন? আমাদেরও কি গলা নেই, আমরা কি নিষ্কন্ঠক কবন্ধ?'

আগুন ছুটিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছে ভূতোদা। নির্ভেজাল সংস্কৃত বুলি। আমরা দু-তিন জনে জিবেগজাটার মুখ চেপে ধরে থাকি। 'চিপিটক নিষ্পেষণ' যে চিঁড়েচ্যাপ্টা আর 'নিষ্কাষ্ঠক মানে যে কাষ্ঠহীন, তা আমরা ঠিকই বুঝে নিয়েছি। শুধু ভয়, ঐ গজাটাকে কখন হয়ত বলে বসবে, সমাসটা ঠিক নয়, আর অমনি ফ্লো আটকে যাবে ভূতোদার।

ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, সে দুর্ঘটনা ঘটতে পারল না আমাদের সমবেত প্রচেষ্টায়।

ভূতোদা একনাগাড়ে বলে চলেছে- 'পণ্ডিতমশাই কী বলেন শুনিসনি? 'যত্নে কৃতে যদি ন সিদ্ধতি, স্টোভে সিদ্ধতি খলু।' তার অর্থ কি? অর্থাৎ কিনা এক হাঁড়ি ভাত যদি সিদ্ধ করতে চাও তাহলে হাঁড়ির গায়ে হাত বুলিয়ে বাপু-বাছা করলে কিচ্ছুটি হবে না। স্পিরিট ঢাল, স্টোভ জ্বালো, পাম্প কর,- ব্যস্। আর দেখতে হবে না, কাঁকরমণি চালও দশ মিনিটে সিদ্ধ হয়ে যাবে। এর তাৎপর্য কি? কষ্ট কর কেষ্ট পাবে, বসে বসে চিন্তা করলে কিছুটি হবে না।'

কিছু একটা বলার জন্যে ছটফট করতে থাকে গজা। কিন্তু আমরা চেপে ধরে থাকি তাকে।

নেড়া বলে, - 'বেশ হুকুম কর। আমাদের ক্লাসে বেয়াল্লিশটা ছেলে আছে, তুমি যদি চাও, আমরা সব্বাই যাব। চাই কি অন্যান্য ক্লাসেও গিয়ে ক্যানভাস করে আসতে পারি।'

ভূতোদা বলে, - 'দরকার নেই ও মেষযুথে। দ্বা-চল্লিশই যথেষ্ট। আমি মন্ত্র বলে ঐ দ্বা-চল্লিশকেই দশগুণ বাড়িয়ে ফোর-ফট্টি করে দেব।'

বলে কি ভূতোদা? মন্ত্র বলে সে এক টাকার নোটকে দশ টাকার নোট করতে পারে বলে বেয়াল্লিশজন ছেলেকে দশ গুণ বাড়িয়ে চারশ-চল্লিশজন করে দেবে। বিস্ময়ে একটু অভিভূত হয়ে পড়ি আমরা।

গজার মুখ থেকে অসতর্ক মুহূর্তে হাতটা আলগা হয়ে গেছে। আর তৎক্ষণাৎ ঘটে গেল সর্বনাশ। গজা সুযোগ পাওয়ামাত্র বলে বসে, বেয়াল্লিশকে দশ দিয়ে গুণ করলে চারশ চল্লিশ হয় না ভূদ্দা। ভূতোদা গর্জে ওঠে, আলবৎ হয়। ম্যাজিশিয়ান কী না পারে?

গজাও ক্ষেপে ওঠে, - 'ম্যাজিশিয়ান হয় তো সব পারে, পারে না শুধু অঙ্ক শাস্ত্রকে নস্যাৎ করতে। আমি বলছি বেয়াল্লিশকে দশগুণ করলে চারশ কুড়ি হওয়ার কথা।'

ভূতোদা এঁড়ে তর্ক শুরু করে, - 'না, তা হয় না। তা যদি হত, তাহলে কাল পেনাল্টিতে গোলও হত।'

গজা বলে, - 'হেত্তেরি? কী আবোল-তাবোল বকছ। আমি বলছি অঙ্কের কথা। ফর্টি টু ইনটু টেন ইজ্ ইক্যোয়াল টু' - মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ভূতোদা বলে, - 'ফোর-ফট্টি।'

গজাও গর্জে ওঠে,- 'আজ্ঞে না। কষে দেখ - ফোর টোয়েন্টি।'

আর যায় কোথায়? ভূতোদা যেন দক্ষযজ্ঞের আসরে নামল, - 'কী বললি? আমি ফোর – টোয়েন্টি! মানে জোচ্চোর?'

আস্তিন গুটিয়ে ছুটে আসে ভূতোদা, - 'কেন? চোরাই পেনাল্টি গোলে মারিনি বলে আমি ফোর-টোয়েন্টি? আয় তুই কত বড় জিবেগজা দেখি। না চিবিয়ে গিলেই খাব আজ তোকে।'

অনেক কষ্টে আমরা সবাই মিলে তাকে থামাই। গজাটারই দোষ। আমরা ক্লাশশুদ্ধ ছেলে জানি, ফোর-টোয়েন্টি বললে ভূতোদা খুব ক্ষেপে যায়, আর ও হতভাগাটা তা জানে না? ভাগ্যক্রমে ঠিক তখনই টিফিন পিরিয়ড শেষ হয়ে গেল। সতীশবাবু ক্লাস নিতে এলেন। এসেই বলেন, -'ভূতনাথ, অত চীৎকার করছিলে কেন? যাও সীটে গিয়ে বস।'

ভূতোদা একটু নরম হয়ে বলে, - 'আমাকে ছুটি দিন স্যার, বাড়ি যাব। - কেন? বাড়ি যাবে কেন? কি হয়েছে তোমার?'

- 'হয় নি কিছু। সের খানেক ময়দা কিনে রেখেছি, আঠা বানাতে হবে।'

-'আঠা বানাবে? কি হবে এত আঠা দিয়ে?'

- 'আজ বিকেলে যে আমাদের ফাইনাল খেলা।'

সতীশবাবু অবাক হয়ে বলেন, - 'কিছুই বুঝলাম না, বাবা ভূতনাথ। তোমারই মাথা খারাপ না আমার? ফাইনাল খেলার সঙ্গে ময়দার আঠার কী সম্পর্ক?'

-'সে স্যার আপনি বুঝবেন না। আমি যাই বরং। হেডমাস্টার মশাইকে কিছু বলবেন না; আমি কিন্তু স্যার আপনার অনুমতি নিয়েই যাচ্ছি।'

বিস্মিত সতীশবাবু কিছু বলার আগেই বইখাতা নিয়ে দিব্যি চলে গেল ভূতোদা।

আমরা কেউ হলে নিশ্চিত বেত খেতে হত। কিন্তু ভূতোদার সাত খুন মাপ।সবাই জানে, সে একটা খ্যাপাটে গোছের। ও যেন নিয়মের ব্যতিক্রম। দিব্যি পেয়ারা চিবোতে চিবোতে বাড়ি চলে গেল সে। বিকেল বেলা মাঠে গিয়ে দেখি আমাদের ক্লাসের সবাই এসেছে। অবশ্য আমরা সর্বসমেত জনাপঞ্চাশ আর ওরা অন্তত দুশ। গলাবাজিতে জিতবার কোন আশাই নেই। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব সস্ত্রীক এসে বসলেন। তিন দিন ধরেই আসছেন তিনি। শুনেছি মেমসাহেবই পুরস্কার বিতরণ করবেন।

আমাদের দলের দশজন খোলোয়াড় এসে গেছে। কিন্তু ভূতোদা কই? কী কেলেঙ্কারী। আসল লোকই গরহাজির!

সময় হয়ে গেছে। রেফারী হুইসল দিল।

দুটো টিম মাঠে নামল; আমাদের দশজন। এমন সময় একটা সাইকেলে চেপে এসে পৌঁছালো ভূতোদা। তার পিছনে পিছনে এল একটা সাইকেল রিকশা।

তাতে এক রিকশা-বোঝাই কাগজের চোঙা। আমরা তো অবাক। এত চোঙা এল কোথা থেকে? আর কোন ভূতের বাপের শ্রাদ্ধেই বা লাগবে এগুলো?

এক লহমায় ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিল ভূতোদা। অদ্ভুত ওর বুদ্ধি! ওর কাকা হচ্ছেন ওভারসিয়ার কলেজের ড্রইং টিচার। ড্রইং পরীক্ষার বড় বড় কাগজ ছিল কাকার হেপাজতে। আগের বছরের পরীক্ষার খাতা। ভূতোদা ময়দার আঠার সাহায্যে তাই দিয়ে বড় বড় চানাচুরের ঠোঙা বানিয়েছে। ভূতোদার ম্যাজিক অব্যর্থ। ফর্টিটু ইনটু টেন ইজ ইক্যোয়াল টু ফোরফর্টি। ওরা দুশ ছেলে যতটা চিৎকার করে আমরা পঞ্চাশ জনে করলাম তার ডবল, - চোঙার গুণে। দু-দশ মিনিটেই ওদের গলা গেল বসে। আগের দুদিনও ওরা এক নাগাড়ে চিৎকার করেছে। আর কত পারবে? চোঙামুখো আমরা পঞ্চাশ জনেই মাঠখানাকে সরগরম করে রাখলুম।

ওরা একবার করে গোল মিস্ করে আর ন্যাপলা চোঙা ফোঁকে: সি. এম. এস. কটা গোল মিস্ করল?

আমরা সমস্বরে বলি: বায়ো কি ত্যায়ো।

যে ছেলেটি এই মাত্র গোল মিস্ করেছে তার নাম ধরে ন্যাপলা বলে, - জগাই কি বলে?

আমরা সকলে একযোগে সুর করে বলি: জগাই বলে আ-ও-ও বেশী।

আমাদের চোঙার চিল্লানিতে ওরা একেবারে ঠাণ্ডা। একশ জোড়া ওয়েট-ক্যাট! ওদের ফরোয়ার্ড লাইনের সব কটা খেলোয়াড় এ ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে আরও নার্ভাস হয়ে পড়ে। তালকানার মতো এলোপাতাড়ি আউটে মারতে থাকে বারে বারে। গোলপোস্ট গুলিয়ে যায়।

আমরা তৎক্ষণাৎ 'ও' টাকে আরও দীর্ঘায়ত করি: মাধাই বলে আ-ও-ও-ও বেশি। শেষকালে এমন অবস্থা দাঁড়ালো যে, কেউ আর সাহস করে বলটাকে গোলে মারতেই চায় না। পাছে মিস্ করলে আমরা তার নাম ধরে বিদ্রূপ করি। গোলের কাছাকাছি এসে ফরোয়ার্ড দেয় ইনকে, ইন দেয় আউটকে, আউট ব্যাক পাশ করে হাফকে। আমাদের ডিফেন্সকে আর কষ্ট করতে হয় না। ওরা নিজেরাই পায়ে পায় বলটাকে পিছিয়ে নেয়। আমরা ওদের সে দশা দেখে হেসে বাঁচিনে।

শেষ পর্যন্ত আবার গোললেস ড্র হয়ে গেল।

স্থির হল ছ-মাস করে থাকবে শীল্ডটা এক এক স্কুলে। দু দলই যুগ্মবিজয়ী। প্রাইজ দেওয়ার সময় ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বললেন, কোন পক্ষই যে গোল করতে পারেনি, এতে আমি খুশীই হয়েছি। দু দলেরই কৃতিত্ব সমান সমান। কে আগে শীল্ডটা রাখবে সেটা আমি 'টস' করে স্থির করব।

ভূতোদা তার কন্দর্পকান্তি বপুখানিকে এক পা বাড়িয়ে বলে, - 'আমি একটা কথা বলতে পারি স্যার?'

ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব বলেন - 'হ্যাঁ, বলো-বলো।'

- 'আপনি টস্ করবেন না, স্যার।'

- 'টস্ করব না? তাহলে কাকে প্রথমে শীল্ডটা দেব?'

- 'আমি বলব স্যার। আপনি সি. এম. এস-এর ক্যাপ্টেনকেই প্রথম ছ'মাসের জন্য শীল্ডটা দিন।'

ম্যাজিস্ট্রেট পত্নী অবাক হয়ে বলেন, - 'কিন্তু কেন তুমি এমন কথা বলছ?' ভূতোদা বলে, - 'শীল্ডটা আমরা চার বছর ধরে রাখছি। আজ যদি আমরা সমান সমান হয়ে থাকি তাহলে কৃতিত্বটাতো ওদেরই। তারপর মেমসাহেবের দিকে ফিরে বলল, ধরুন স্যার, ওরা ব্যান্ড পার্টি এনেছে, লরি এনেছে, আমরা তা আনিনি। শীল্ড না পেলে ওরা দুশ'জন ছেলে হতাশ হবে, আমরা মাত্র পঞ্চাশ জন।' ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব খুশী হয়ে ওর সঙ্গে শেকহ্যান্ড করে বলেন, -' ঠিক আছে, তাই হোক।'

তারপর আমাদের দিকে ফিরে বলেন, - 'আমি শুধু একথা বলব, ফুটবলটা শুধু পা দিয়ে খেলার নয়, হৃদয় দিয়ে খেলা। তোমরা দেখেছ গতকাল রেফারী একটা পেনাল্টির নির্দেশ দিয়েছিলেন। দর্শকদের মতে নির্দেশটা ঠিক হয় নি। কিন্তু রেফারীর নির্দেশ, তা সে ঠিকই হোক আর ভুলই হোক মেনে নিতেই হবে। এই হচ্ছে খেলার আইন। নিয়মানুবর্তিতা খেলার একটা প্রধান অঙ্গ। কিন্তু সত্য ধর্মের স্থান তারও উপরে। দুর্গেশ দুমরাজের গল্প নিশ্চয় জান তোমরা। আমাদের ভূতনাথও কাল ঐ রকম একটি কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল। খেলার ধর্ম আর সত্য ধর্মের দ্বন্দ্ব সে চমৎকারভাবে মিটিয়ে দিয়েছিল উল্টোদিকে বলটাকে কিক করে। সে দেখিয়ে দিয়েছে খেলোয়াড়ি মনোভাব কাকে বলে। আমি আজ তিন বছর এই জেলায় আছি। বহুবার আমি শ্রীমান ভূতনাথের খেলা দেখেছি। শুনেছি তোমরা ওকে একটা খেতাব দিয়েছ-'পেনাল্টি-ঈটার।' আমি আজ শ্রীমান ভূতনাথকে আর একটা নতুন খেতাব দিলাম, - দুর্গেশ দুমরাজ দি সেকেন্ড!'

মিসেস্ ডি. এম. কী বুঝলেন তা তিনিই জানেন। তিনিই হাততালি দিলেন সবচেয়ে বেশি।

নিশ্চিত হারের হাত থেকে রেহাই পেয়ে ভুতোদা আগেই আহ্লাদে আটখানা হয়েছিল। নতুন খেতাব পেয়ে সে যেন যোলোখানা হয়ে গেল!
 
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এই গল্পটি শুনতে হলে নিচের লিংকে ক্লিক করুন:
শীল্ড ফাইনাল। নারায়ণ সান্যাল। মজার গল্প। গল্প পাঠে : অনুব্রতা Narayan Sanyal. Comedy Story
 
এই সিরিজের অন্যান্য গল্প:

ভূতায়ন - অপারেশন: ভূতের নৃত্য (Bhutayan - Operation Bhuter Nritya)

 
তখন বয়স ছিল কম, তাই বুঝতাম না। ভূতোদাকে দেখতে মোটেই ভাল ছিল না। তালগাছের মত ঢ্যাঙা, বড়ির মত নাক, চুলগুলো খোঁচা খোঁচা। পড়াশুনাতে সে ছিল স্বয়ং বৃহস্পতি। তবু সবাই তাকে ভালবাসতো। মাস্টারমশাইরা সকলেই ওকে স্নেহ করতেন। আমরা ভাবতুম তার কারণ ও খেলাধুলায় চৌখস ছিল বলে। এখন বুঝতে পারি, --- সে জন্য নয়। তাকে সবাই ভালবাসত তার কারণ ঐ কুৎসিত-দর্শন মানুষটার হৃদয় ছিল বড়। ভূতোদা ছিল,-- যাকে বলে আউট-অ্যান্ড-আউট স্পোর্টসম্যান। খেলতে বসে কেউ যদি বলে, - তুমি জুয়াচুরি করেছ, অমনি সে খেপে উঠত। ওর মতে সবচেয়ে বড় গালাগালি হচ্ছে "চারশ বিশ" অর্থাৎ ফোর-টোয়েন্টি।
 
একবার ওকে চারশ-বিশ বলায় কি কাণ্ড ঘটেছিল এবার তাই বলব! আগেই বলেছি, --আমি ছিলুম ওর ম্যাজিকের সাকরেদ।
 
শহরের সবচেয়ে নামকরা উকিল কালিচরণবাবু। তিনি উকিলপাড়ায় মস্ত তিনতলা বাড়ি হাঁকিয়েছেন। তাঁরই বড় মেয়ে উমার বিয়েতে ডাক পড়ল ভূতোদার। ঠিক বিয়ের মধ্যে নয়, ---- অষ্টমঙ্গলাতে বর-বউ ফিরে এলে হল এই আনন্দ অনুষ্ঠান। কালিচরণবাবু শহরের অনেককেই নিমন্ত্রণ করেছিলেন। ওনার চকমেলানো উঠানে, বড় ছেলে শিবু ব্যবস্থা করেছিল একটা ভ্যারাইটি এন্টারটেনমেন্টের। কিছু নাচ-গান-বাজনা আর সবশেষে ভূতোদার ম্যাজিক। কালিচরণবাবু ভূতোদাকেও বলেছিলেন তার বন্ধু-বান্ধব কয়েকজনকে বলতে। ভূতোদা নেড়া, ক্যাবলা, গোবিন্দকে আসতে বলেছিল। আমি তো সাকরেদ হিসাবে আসবই।
 
চকমেলানো উঠোনের এক প্রান্তে আমরা কয়জনে মিলে চৌকি জোড়া দিয়ে দিয়ে একটা স্টেজ বানালাম। তারপর টানা দিয়ে স্ক্রীন করা হল। একপাশে পর্দা দিয়ে বানালাম গ্রীনরুম। ম্যাজিক দেখাতে গেলে অনেক প্রস্তুতির প্রয়োজন। সেই নেপথ্য কাজটা গোপনে করতে হয়। কিন্তু বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েদের কৌতূহল ঐ ঘেরাটোপ ঘরখানার দিকে। ওখানে আমরা আগেভাগে কী-সব লুকিয়ে রাখছি তাই দেখা চাই ওদের।
 
ভূতোদা আর আমি বারেবারে বললাম: এ রকম করলে আমরা খেলা দেখাতে পারব না। আমরা তেড়ে উঠলেই ওরা কেটে পড়ে আবার কখন গুটিগুটি ঘনিয়ে আসে। উঁকি মারে পর্দার এপাশে। শেষ পর্যন্ত ভূতোদার নির্দেশমতো আমি কালিবাবুকেই গিয়ে বললাম, -- জ্যাঠামশাই, ওরা যদি এই রকম করে, তাহলে কিন্তু আমরা খেলা দেখাতে পারব না। কালিবাবু এসে কড়া ধমক লাগালেন বাচ্চাদের। বললেন, ফের যদি কেউ ওখানে উঁকি মারতে যাও তাহলে আমি তাকে সন্ধ্যাবেলা ঘরে তালাবন্ধ করে রেখে দেব, -- ম্যাজিক দেখতে দেব না।
 
এতক্ষণে কাজ হল। ওরা সবাই মুখ কাঁচুমাচু করে পালালো। কিন্তু নতুন জামাইয়ের তাতেও হুঁশ হল না। তিনি তা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে ফিরে এসে উঁকি মারতে থাকেন। ভূতোদা দু-একবার রুখে উঠল। উনি হে-হে করে হেসে ওঠেন। যেন নির্লজ্জের মত হেসে উঠতে পারলেই সাত খুন মাপ।
 
আমি বলি, বল ভূদ্দা, আবার গিয়ে বলি কালিজ্যাঠাকে?
 
ভূতোদা বলে, তাতে কোন লাভ নেই রে, বলিবর্দ। নতুন জামাই তো আর বাচ্চা ছেলে নয়, যে তাকে তালাবন্ধ করে রাখবার ভয় দেখানো চলে।
 
নতুন জামাইয়ের নাম অমলেন্দু। চৌখস ছেলে। চোখে মুখে কথা। কলকাতার মানুষ, তাই মফঃস্বলের ছেলেদের দিকে তাকাবার ভঙ্গিটা এমন, এরোপ্লেনের যাত্রী যেমন তাকায় নিচের দিকে। শিবুর জামাইবাবু বলে আমি একটু আলাপ করতে গিয়েছিলাম প্রথমটায়। কিন্তু ওঁর চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শুনে নিজেকে গুটিয়ে নিলাম। কলকাতার কোন অঞ্চলে থাকেন প্রশ্ন করায় বললেন, গ্যাঁড়াতলায়।
 
বললাম, সেটা আবার কোথায়?
 
-- গাঁয়ের মানুষ তোমাকে আমি কেমন করে বোঝাব বাওয়া?
 
ম্যাজিকের কথায় আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলেন, এই সব গাঁইয়া ম্যাজিকও বসে বসে দেখতে হবে? বলে স্বয়ং পি. সি. সোরকারের ম্যাজিকই আমি চটপট ধরে দিই --
 
তারপর বেশ জমিয়ে শ্যালীবাহন সম্রাটের মতো আষাঢ়ে গল্প ফেঁদে বসেন। কবে নাকি উনি নিউ এম্পায়ারে একেবারে হৈ-হৈ-কাণ্ড রৈ-রৈ-ব্যাপার করে তুলেছিলেন। ম্যাজিশিয়ান যে ম্যাজিক দেখায় অমলেন্দুবাবু পটাপট তা ধরে ফেলেন। শেষ পর্যন্ত ওদের ম্যানেজার এসে অমলেন্দুবাবুর একেবারে হাতে পায়ে ধরতে থাকে। বলে, মশাই, গোটা সিজনের জন্য আপনাকে একটা বক্সের পাস দিয়ে দিচ্ছি, -- এভাবে হাটের মাঝে হাঁড়ি ভাঙবেন না। কালিবাবুর ছোট মেয়ে সীমা ন্যাকা ন্যাকা গলায় বলে, কেমন করে আপনি বুঝতে পারলেন, -- নতুনদা?
 
-- পিওর কমন সেন্স। তাছাড়া আমিও ছেলেবেলায় ম্যাজিক শিখেছিলাম।
 
ভূতোদা আর থাকতে পারে না। পর্দা সরিয়ে বাইরে এসে বলে, তাহলে আমি বলব, আপনি অন্যায় করেছিলেন। কোন ম্যাজিশিয়ান কখনও অপরের খেলায় বাধা দিতে আসে না। ম্যাজিশিয়ানদের এটাই এটিকেট। এটাই এথিক্স!
 
অমলেন্দুবাবু খ্যাঁক খ্যাঁক করে খানিক হেসে নিয়ে বলেন, বুঝেছি ভাই, বুঝেছি। আচ্ছা বেশ, তোমার ম্যাজিক না হয় হাতেনাতে ধরে দেব না।
 
ভূতোদা বলে, না দেওয়াই উচিত, -- যদি আপনি ম্যাজিশিয়ান হন। আর যদি পিওর কমনসেন্স দিয়ে ধরতে পারেন তাহলে ধরবেন।
 
শিবু ভূতোদার পক্ষে নিয়ে বলে, ভূতোদা দুর্দান্ত ম্যাজিক জানে নতুনদা, ওর সঙ্গে চালাকি চলবে না।

জামাইবাবু আবার হেসে ওঠেন, ভূতোদা? ওর নাম কি ভূতো? বাপস্। তাহলে তো সামলে কথা বলতে হবে। শেষকালে ভূত না লেলিয়ে দেয়।
 
ভূতোদা বলে, আজ্ঞে হ্যাঁ, ওটা আমার পিতৃদত্ত নাম। স্বোপার্জিত নয় আপনার 'নতুনদা' নামের মতো।
 
-- কেন নতুনদা নামটা খুব নতুন লাগছে বুঝি।
 
ভূতোদা বলে, আজ্ঞে না। আমাদের ইন্দ্রনাথেরও একজন নতুনদা ছিল, অনেকটা আপনারই মতো। তবে সে গ্যাঁড়াতলার লোক নয়, দর্জিপাড়ার।
 
অমলেন্দুবাবুর বোধকরি রসগ্রহণ হয় না। একথাতেও না হলে হে-হে করে হাসতেন না।
 
ভূতোদা সরে আসে পর্দার এপারে।
 
আমি বলি, লোকটা অসভ্য।
 
ভূতোদা বলে, শুধু অসভ্য নয়, মূর্খও। শরৎবাবুর শ্রীকান্তখানাও পড়েনি।
 
পর্দার ওপাশের কথাবার্তা সবই কানে আসছে। একজন বলে, তা সে নাম যাই হোক না কেন, চৌখস ছেলে। ফুটবল-ক্রিকেট-হকি তিনটে খেলাতেই সিদ্ধহস্ত।
 
অমলেন্দুবাবু বলেন, তিন তিনটে খেলায় বয়েল্ড-হ্যান্ড। তবে তো বনগ্রামের স্বয়ং শিবাসম্রাট।
 
আমি বলি, যাই দু চার কথা শুনিয়ে দিয়ে আসি।
 
ভুতোদা বলে, যাগ গে, মরুগ গে।
 
সন্ধ্যা হতেই লোকজন সব আসতে থাকে সেজেগুজে। জামাইবাবুও সাজটা পালটে এলেন। চুনট করা ভূঁয়ে - লোটানো ধুতি। ঘিয়ে রঙের গরম পাঞ্জাবি, হীরের আংটি আর সোনার ঘড়ি। ছাঁচি-কুমড়োর মতো পাউডারের প্রলেপ সারা মুখে ঘাড়ে। ভুরভুরে সেন্টের গন্ধ। শহরের গণ্যমান্য লোকদের সঙ্গে কালিচরণবাবু জামাইয়ের পরিচয় করিয়ে দেন, আর গ্যাঁড়াতলার জামাইবাবু ধুতির কোঁচাসমেত হাতটি তুলে নমস্কার করে।
 
প্রোগ্রাম শুরু হল। নেড়ার বোন রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইল; পাড়ার একটি মেয়ে বাজালো সেতার।
 
আমি বসেছিলুম জামাইবাবুর ঠিক পিছনেই, বন্ধুদের নিয়ে। ভদ্রলোকের যেন কিছুই পছন্দ হয় না। এর চেয়ে ওঁর ছোট বোন নাকি ভাল গায়, এক বান্ধবী ভাল বাজায়।
 
ন্যাড়া আমায় কানে কানে বলে, এক নম্বর চালবাজ!
 
মালোপাড়ার নবীন জোয়ারদার ভাল মাউথ অর্গান বাজায়। তারও একটা আইটেম ছিল। ভারি সুন্দর বাজালো নবাদা-'দূর দেশী সেই রাখাল ছেলে'।
 
শুনে গ্যাঁড়াতলার জামাইবার বললেন, ছোকরার দম নেই, স্কেল ঠিক থাকে না।
 
নেড়া আর নিজেকে সামলাতে পারে না। বলে, আপনি গানের স্কেল বোঝেন?
 
ঘাড় ঘুরিয়ে জামাইবাবু নেড়াকে এক নজর দেখে নেন। সিল্কের একখানা সুগন্ধী রুমাল বার করে ঘাড়টা মুছে নিয়ে বলেন-ইউনিভার্সিটি ইনস্টিট্যুটে আমার মাউথ অর্গান শুনে স্যার রবার্ট ক্রফোর্ড আমার অটোগ্রাফ নিয়ে গিয়েছিলেন।
 
গোবিন্দটা গবেট। বলে, রবার্ট ক্রফোর্ড কে?
 
-- তোমরা চিনবে না। নিউ অর্লিয়েন্সের টেলিভিশান প্রডিউসর। আমাকে বলেছিলেন, কেন পড়ে আছ কলকাতায়। চলে এস 'ম্যারিকায়। টেলিভিশানে রেগুলার প্রোগ্রাম তোমার বাঁধা।
 
-- তা গেলেই পারতেন?
 
-- যাব। নেক্সট সামারে।
 
নেড়া ছাড়বার পাত্র নয়; বলে, তা আমরা তো আর 'ম্যারিকা যাব না। আপনার টেলিভিশান প্রোগ্রামও শুনতে পাব না। আমাদের একটু শুনিয়ে দিন না আজ।
 
-- সরি। আমি তো মাউথ অর্গানটা আনিনি।
-- কেন ঐ নবাদার অর্গানেই বাজান!
 
খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে ওঠেন জামাইবাবু। যেন কী বোকার মতো কথাটাই না বলেছে নেড়া। বলেন, তোমাদের ঐ মালোপাড়ার মালো-মশায়ের এঁটো অর্গান বাজাব আমি! তোবা তোবা।
 
কান-এঁটো-করা হাসি হাসেন জামাইবাবু।
 
ভূতোদাকে কানে কানে বলি, শুনছ?
 
ভূতোদা শুধু বললে, কপালে অনেক দুঃখ আছে রে।
 
আমি বলি, কার?
 
-- কার আবার? শিবুর বড়দির। ভূ-ভারত খুঁজে কী জামাই-ই এনেছেন কালিজ্যাঠা। একেবারে 'ঠুন ঠুন' পেয়ালা।
 
সবশেষে ভূতোদার প্রোগ্রাম। শুরু হল খেলা। জামাইবাবুকে ডাকতে হল না, নিজেই স্টেজে উঠে এসে তালাস করলেন ওর জামার পকেট, আস্তিন, টেবিলের তলা। তবু হারানো আংটি তাঁর পকেট থেকেই উদ্ধার করে আনলুম আমি। জামাইবাবু অপ্রস্তুত হলেন।
 
কিন্তু মনে হল, ভদ্রলোক আর কিছু শিখুন না শিখুন ম্যাজিক খানিকটা সত্যই শিখেছিলেন। দু-একটা খেলা উনি ধরে ফেললেন। ভূতোদা যে চটেছে, তার মুখ দেখে বুঝতে পারি। মুখে সে কিছু বললে না।
 
তাছাড়া চ্যাটাং চ্যাটাং কথা লেগেই আছে। সব কিছুতেই ফোড়ন কাটার স্বভাব। ভূতোদা দর্শকদের সাধারণ ভাবে প্রশ্ন করল, যে কোন একটা অসময়ের ফলের নাম করুন। আমি খাওয়াব।
 
সেটা অগ্রহায়ণ মাস। জামাইবাবু ফস্ করে বলেন, তোমার নাম শুনে একটি মাত্র ফলের কথাই মনে পড়ছে ভাই। তাই খাওয়াও। ভূতো-বোম্বাই।
 
সকলে হোহো করে হেসে ওঠে। ভূতোদা রাগ করেছে কিনা বোঝা যায় না। একটা খালি টুপী সকলকে দেখিয়ে রুমাল দিয়ে সেটা চাপা দেয়। লাঠি বুলিয়ে কিছু মন্ত্র পাঠ করে। তারপর জামাইবাবু এসে রুমালের ঢাকাটা খুলতে দেখা গেল তার মধ্যে সত্যিই একটা বোম্বাই আম। সকলেই চমৎকৃত, শুধু জামাইবাবু বলেন, এটা বোম্বাই আমই মনে হচ্ছে; কিন্তু ভূতো-বোম্বাই কিনা বুঝব কেমন করে?
 
ভূতোদা বললে, 'ভূতোর ভৌতিক বোম্বাই' ইতি মধ্যপদলোপী ভূতোবোম্বাই। সহজ সমাধান।
 
সবাই খুশী হল। ওর নাম নিয়ে বারে বারে রসিকতা করায় সে যে অফেন্স নেয়নি এতে নিশ্চিন্ত হল সকলে। জামাইবাবু বলেন, আচ্ছা এবার মজঃফরপুরী লিচু খাওয়াও দেখি।
 
ভূতোদা সে কথায় কর্ণপাত না করে স্টেজের সামনে এগিয়ে আসে। কালিচরণবাবুর দিকে ফিরে বলে-জ্যাঠামশায়, আপনি বোধহয় আপনার জামাইকে পেট ভরে খেতে দিচ্ছেন না। খেলা দেখানো শেষ হয়ে গেছে, উনি এখনও খাই খাই করছেন।
 
এবার দ্বিগুণ জোরে হেসে ওঠে সকলে। জগদানন্দবাবু বলেন, বেশ বলেছ বাবা ভূতনাথ। কালিভায়া তুমি একটি পেটুক জামাই এনেছ।
 
অমলেন্দুবাবু অপ্রস্তুতের একশেষ। ফিরে এসে বসেন নিজের আসনে, কিন্তু অত সহজে হার মানবার পাত্র নন তিনি। বলেন, যতসব ফোরটোয়েন্টির কারবার।
 
ধক্ করে জ্বলে ওঠে ভূতোদার চোখ দুটো। আমার মনে হয়, -- এই সেরেছে। পাগলা খেপল বুঝি এবার। শিশুপাল বধ হয় বুঝি এতক্ষণে! ভূতোদা বলে, -- ফোর-টোয়েন্টি মানে? কী বলতে চান আপনি?
 
-- ফোর-টোয়েন্টি মানে বোঝ না? জুয়াচুরি। তুমি হাতসাফাই করে আগেই আম রেখে দিয়েছিলে টুপির ভিতর।
 
ভূতোদা বলে, আলবাৎ। তা তো বটেই। আপনি কি ভাবছিলেন? হাঁস যেমন ডিম পাড়ে, টুপি তেমনি আম পেড়েছে? গ্যাঁড়াতলার মানুষ হয়ে আপনি এটুকু বোঝেন না?
 
আবার সবাই হেসে ওঠে উচ্চৈঃস্বরে। জামাইবাবুর রঙটা ফর্সা। মুখটা টকটকে লাল হয়ে ওঠে অপমানে। বলেন, ছোঃ। একে আবার ম্যাজিক বলে নাকি? আমি ভেবেছিলুম ভূতোর খেলা বুঝি সত্যিই ভূতের খেলা। এতো সবই শুধু ফোর-টোয়েন্টির কারবার।
 
এতক্ষণে বেশ বুঝতে পারি ভূতোদা চটেছে। চটে বেগুন হয়ে গেছে। বললে, দেখুন অমলেন্দুবাবু, লেবু বেশি কচলালে তেতো হয়ে যায়। বাপ-মা আমার নাম ভূতনাথ দিয়েছিলেন, আমি তো তাতে লজ্জার কিছু দেখি না। তা সে যাগগে মরুগগে। ভূতের খেলা দেখতে চান আপনি? ভূত দেখবেন? তাও দেখাতে পারি আমি।
 
ওর কণ্ঠস্বরে এমন একটা কিছু ছিল, যাতে সবাই নির্বাক। ভূতোদা আবার বলে, ভূত দেখে দাঁত-কপাটি লাগবে না তো?
 
জামাইবাবু বলেন, ভয়? আমার অভিধানে ও শব্দটা নেই।
 
ভূতোদা বলে, বেশ, এখন ভূতের খেলাই দেখাব তাহলে। অবশ্য যাঁদের হার্টের ব্যারাম আছে তাঁরা দয়া করে এবার ঘরে যান।
 
কেউই উঠে গেল না। সবাই বুঝতে পারে, এসব নেহাৎ রসিকতা।
 
ভূতোদা বললে, আমাকে খান ছয়েক চিনামাটির বড় প্লেট এনে দিতে হবে। ডিনার প্লেট। এ খেলা দেখানোর প্রোগ্রাম ছিল না। নেহাৎ জামাইবাবু ভূত দেখতে চাইছেন, তাই-
 
জগদানন্দবাবু বলে, তোমার ব্যবস্থা করতে কতক্ষণ লাগবে?
 
 -- দশ মিনিট। ততক্ষণ আমার অ্যাসিস্টেন্ট খেলা দেখাবে।
 
আমাকে আড়ালে টেনে নিয়ে বলে, দশটা মিনিট তুই ম্যানেজ করে দে বলিবর্দ। গ্যাঁড়াতলার জামাইবাবুকে আজ ন্যায্য ভূত দেখিয়ে ছাড়ব, -- স্রেফ কালিয়া পিরেৎ।
 
বলিবর্দ! খাঁটি সংস্কৃত গাল! তবে তো মেজাজ ঠিক আছে ভূতোদার।
 
গ্যাঁড়াতলার জামাইবাবুর সে সামনে খেলা দেখাতে সত্যিই ভয় ভয় করছিল আমার। তবু গুরুর কৃপায় ধর্মে ধর্মে দশটা মিনিট আমি ম্যানেজ করে দিলাম ঠিকই। ওদিকে ভূতোদা ততক্ষণ খান-ছয়েক চিনামাটির প্রমাণ সাইজ ডিনার প্লেট নিয়ে গ্রীনরুমের ভিতর কী সব প্রক্রিয়া করছিল। আমার খেলা দেখানো শেষ হতেই সে বেরিয়ে এল স্টেজে।
 
বললে, আমি রেডি। এখন স্টেজে ভূত নামাবো। কি। কয়েকটা শর্ত আছে।
-- কী শর্ত?
 
 -- প্রথম কথা, আমি বাতি নিভিয়ে দেব তখন কেউ টর্চ জ্বালাবেন না। দ্বিতীয় কথা, যখন কেউ ভূত দেখতে পাবেন কোন শব্দ করবেন মা।
 
জগদানন্দবাবু বলেন, ভূতকে কি শুধু দেখতেই পাওয়া যাবে? সে কি কোন কথা বলবে না?
 
ভূতোদা বলে, বলেন কি দাদু? ভূত মাত্রেই বাচাল; কথা না বলে ওরা থাকতেই পারে না। ভূত কথা বলবে, হাঁটবে, হাসবে-
 
জামাইবাবু রসিকতা করলেন, -- ভূত নাচবে না?
 
ভূতোদা তৎক্ষণাৎ বলল, -- ঘুঙুর এনে দিন, ভূতকে নাচিয়ে ছাড়ব।
 
আমি ভাবলাম, -- ভূতোদা বলে কি? এরকম খেলা তো সে আগে কখনও দেখায়নি।
 
ভূতোদা বলে, লাইট বন্ধ কর।
 
আমি সুইচ টিপে তৎক্ষণাৎ স্টেজ অন্ধকার করে দেই। ভূতোদা একটা মোমবাতি জ্বেলে রাখল টেবিলের উপর। আবছা আলোয় রঙ্গমঞ্চ রহস্যময় হয়ে ওঠে। ভূতোদা বললে, খান ছয়েক চেয়ার প্লিজ।
 
আমি নেড়া আর ক্যাবলা হাতে হাতে ছটা চেয়ার তুলে দিলাম স্টেজের উপর। ভূতোদা বলে, এখন আপনাদের মধ্যে থেকে ছয়জন খুব সাহসী লোক স্টেজের উপর উঠে আসুন।
 
সর্বসমক্ষে সাহস দেখাবার এমন মওকা ছাড়ব কেন? আমরা চার বন্ধুই উঠে এলুম স্টেজে।
 
ভূতোদা বলে, না, তোমাদের দিয়ে হবে না। শেষে জামাইবাবু বলবেন, তোমরা আমাকে সাহায্য করেছ।
 
অগত্যা আমরা আবার নেমে এলাম। জনা-ছয়েক দর্শক উঠে যান আবার স্টেজের উপর। বলা বাহুল্য অমলেন্দুবাবু এলেন সবার আগে। ভূতোদা বলে, একটা কথা। অন্ধকারের ভিতর আমাকে আপনারা দেখতে পাবেন না। আমিও আপনাদের দেখতে পাব না, কিন্তু আমার নির্দেশ আপনাদের ঠিক ঠিক মানতে হবে, কথা দিন।
 
ওঁরা সকলে স্বীকৃত হলেন। ভূতোদা তখন ফুঁ দিয়ে মোমবাতিটা নিবিয়ে দেয়। ঘন আঁধারে ঢেকে গেল সব। কেউ কাউকে আর দেখতে পাচ্ছে না। তারপর শুরু হল ভুতোদার নির্দেশ। তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। ভূতোদা বলছে, আপনারা ছয়জন ডান হাত টেবিলের উপর রাখুন। হাত মুঠো করুন। বাঁ হাত বুকের উপর রাখুন। এবার বলুন: অং বং ছুটুং।
 
এই ভাবে মিনিট তিনেক আবোলতাবোল নির্দেশ দিয়ে হঠাৎ বলে ওঠে, আলো জ্বালো।
 
আমি আলো জ্বেলে দিই। সবাই বলে, কই, ভূত কই?
 
ভূতোদা বিস্মিতভাব দেখিয়ে বলে, সে কি? ভূত দেখেননি?
 
--কই না?
 
--জামাইবাবু আপনিও দেখেন নি?
 
জামাইবাবু একগাল হেসে বলেন, অন্ধকারে দেখতে পাইনি, তবে আলোর মধ্যে দেখতে পাচ্ছি। ভূত নয়,--- ভূতো।
 
লেবু বেশি কচলালে তেতো হয় বলেছিল ভূতোদা, কিন্তু সেই তেতো লেবু কচলালে কী হয় তা আর তখন বলেনি। কিন্তু ভূতোদার নির্বিকার মুখখানা দেখে আমার মনে হল, বুঝি বজ্রাঘাত হয়। ভাল মানুষের মতো সে বলে, আচ্ছা তাহলে আবার একবার চেষ্টা করি। বাতি নেভাও।
 
আবার আমি বাতি নিবিয়ে দিই। আবার শুরু হল ভূতোদার আবোল তাবোল নির্দেশ: এই ছয়জনকে আমি ছয়খানা চিনেমাটির প্লেট দিচ্ছি। ধরুন। ধরেছেন তো ঠিক? এখন আপনারা কোলের উপর প্লেটখানি রাখুন। উপুড় করে রাখবেন কিন্তু, চিৎ করে নয়। রেখেছেন? এখন ধীরে ধীরে ঐ মন্ত্রঃপুত আধারের উপর দুটি হাতের তালু বুলাতে থাকুন আর মনে মনে বলতে থাকুন: ক্রিং ক্রিং ওসাকাচাটাম্বু-ওনা মাসি ঢং।
 
আমি তখন মনে মনে ভাবছি, --ব্যাপারটা আসলে কী? কী করতে চায় ভূতোদা? এত সহজে সে কেমন করে ভূত নামাবে স্টেজের উপর? ব্ল্যাক-আর্টের খেলা ভূতোদা মাঝে মাঝে দেখাতো। অন্ধকার ঘরের মধ্যে আবছায়া আলোয় কঙ্কালের নৃত্য। আমিই স্বয়ং সেই কঙ্কাল। কিন্তু তার ফৈজত অনেক। সেসব ব্যবস্থা তো কিছুই করা হয়নি। আমাকেও তো নেংটিসার হয়ে সারা গায়ে ভুষো কালির উপর সাদা রঙ মাখতে হয়নি। আমার মত আজ্ঞাবাহী ভূত তো ভূতোদার দ্বিতীয়টি নেই। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ভূতের আবির্ভাব হবে, আর আমিই টের পাব না? আমাকে বাদ দিয়ে যদি ভূতোদা অন্য কোন নেংটি-সার ভূতের আমদানী করে থাকে তবে দুই ভূতে ডুয়েল লড়ে যাব আমরা।
 
ওদিকে ভূতোদা তখনও এক নাগাড়ে নির্দেশ দিয়ে চলেছে: হ্যাঁ, এখন দুহাতে মুখ ঢাকুন। চোখ বন্ধ - মুঠো খোলা। ব্যস্। রগের দুপাশ টিপে ধরুন। এখন আঙুলগুলো উপর থেকে নিচের দিকে নামবে। 'হেডেক' হলে যেমন ভাবে মাথা টেপা হয়। করছেন? এখন মনে মনে ধীরে ধীরে মন্ত্রোচ্চারণ করুন: হ্রীং ধিং হিম্ব-ডিম্ব-জিম্বো-গুরুবিং-চিত্তের।
 
জামাইবাবুর আর সহ্য হল না। ক্ষেপে উঠে বলেন, দুত্তেরি। যতসব বুজরুকি। বোঝা গেছে তোমার কেরামতি। নাও আলো জ্বাল এবার।
 
ভূতোদা অন্ধকারের মধ্যেই বলে, এ কি। আপনি কথা বললেন কেন?
 
-- বেশ করেছি, বলেছি। আর ভূত দেখার শখ নেই আমার। আলো জ্বালো বরং ভূতোকেই দেখি। তোমার এই ফোর- টোয়েন্টির কারবার বন্ধ কর। আমি কথা বলেছি এই ছুতো দেখিয়ে বরং বল, --তাই ভূত এল না।
 
ভূতোদা বলে, তা কেন? আপনি শর্ত ভেঙেছেন, তাই আপনি ভূত দেখতে পাবেন না। আর সবাই তো শর্ত ভাঙেনি। তারা না হয় দেখুক। লাইট অন।
 
আমি বিজলি বাতি জ্বেলে দিলুম।
 
ভূতোদা দর্শকদের দিকে ফিরে একটা ম্যাজিশিয়ানি 'বাও' করে বললে, আপনারা ভূত দেখতে পাচ্ছেন?
 
প্রথমটা কয়েক সেকেণ্ড সকলেই হতভম্ব। তারপর হঠাৎ একটা সোরগোল পড়ে গেল। হাসতে হাসতে এ-ওর গায়ে লুটিয়ে পড়ে। একবাক্যে সবাই বলে, হ্যাঁ।
 
ভূতোদা গম্ভীরভাবে বলে, মিলিয়ে দেখে নিন। ভূত কথা কইছে, হাসছে। সবাই ভীষণ হাসছে। আর সবচেয়ে বেশি হাসছে কালিচরণবাবুর ছোট মেয়ে সীমা।
 
আসলে হয়েছে কি, -- ছয়খানি প্লেটের একখানির উল্টো পিঠে ছিল শুকনো ভূষোকালি। প্রদীপের শিখার উপর ধরা কালো কালি। অন্ধকারের মধ্যে সেই প্লেটখানাই ভূতোদা কায়দা করে চালান করেছিল অমলেন্দুবাবুকে। জামাইবাবু অন্ধকারের মধ্যে প্লেটের উপর সযত্নে হাত বুলিয়েছেন ওসাকাচাটাম্বু মন্ত্রে, --অর্থাৎ দু-হাতের তালুতে মেখেছেন ভূষোকালি। তারপর হিম্ব-ডিম্ব-জিম্বো মন্ত্রে সেই নিজের হাতের কালি মেখেছেন কপালে মুখে-গালে। ঘিয়ে রঙের গরম পাঞ্জাবি, হীরের বোতাম, চুনট করা ধুতি আর ফর্সা পাউডার-মাখা মুখে ভূষোকালির প্রলেপ।
 
সে যে কী খোলতাই বাহার তা আর কী বলব।
 
সবাই ভীষণ হাসছে। অমলেন্দুবাবুর স্ত্রী-নববধূ, শাড়ি ঝলমল করতে করতে একরকম ছুটেই পালালো।
 
সীমা তার শাড়ির আঁচল চেপে ধরে বলে, দিদি, কোথায় পালাচ্ছ?
 
ভূতোদা বলে, শুভ কাজে বাধা দিও না সীমা। জামাইবাবু ভূতের নাচ দেখতে চেয়েছিলেন, তাই দিদি বোধহয় ঘুঙুর আনতে যাচ্ছেন।
 
অমলেন্দুবাবু শালীকে ধমক দেন, কী বোকার মত হ্যা হ্যা করে হাসছে শুধু শুধু? সত্যি দেখতে পেয়েছ তুমি?
 
সীমা হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে, বলে, দেখেছি কি বলছেন জামাইবাবু? এখনও দেখছি। স্রেফ কালিয়া পিরেৎ। সীমার আর এক বোন ততক্ষণে একটা হাত-আয়না নিয়ে এসেছে। সেটা জামাইবাবুর মুখের সামনে মেলে ধরে বলে, -- সবাই যখন আশ মিটিয়ে ভূত দেখল, তখন আপনিও একটু দেখুন।
 
আয়নায় ভূত দেখেই জামাইবাবুর চক্ষুস্থির। রাগে গ্যাঁড়াতলার জামাইবাবুর তোৎলামি শুরু হয়ে গেল। ভূতোদার দিকে ফিরে বলেন, তো – তো - তোমাকে আমি -, -- ভূতোদা ফরাসী কায়দায় নিচু হয়ে তাঁকে 'বাও' করলে একটা।
 
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এই গল্পটি শুনতে হলে নিচের লিংকে ক্লিক করুন: 
 


এই সিরিজের অন্য গল্পগুলি:

ভূতায়ন - অপারেশন - মাদার্যাহমপি (Bhutayan - Operation MadarjaHamapi)



লেখক: নারায়ণ সান্যাল

 

খেলাধূলা ছাড়া আরও একটা বিষয়ে অদ্ভুত পারদর্শিতা ছিল ভূতোদার। চমৎকার ম্যাজিকের খেলা দেখাতো সে। আমি ছিলুম ওর সাকরেদ। ছোটখাটো অনেক ম্যাজিক সে আমাকে শিখিয়েছিল। এখন তার অনেকগুলো ভুলে গেছি। তবু আজও যখন কোন ম্যাজিক শো'তে গিয়ে পুরানো খেলাগুলো দেখি, সব মনে পড়ে যায়। তা বলে কখনও কোন ম্যাজিশিয়ানের কায়দা সর্বসমক্ষে ধরে দিই না। ভূতোদা শিখিয়েছিল-ম্যাজিক-জগতে তা নিষেধ। ওর সাকরেদি করতে করতে যখন হাত-সাফাই বেশ কিছুটা অভ্যাস হয়েছে, তখনই একদিন ভূতোদা আমাকে ডেকে বলেছিল - ম্যাজিক-ওয়ার্ল্ডে কতকগুলো অলিখিত আইন আছে, বুঝলি নরেন! সেগুলো কখনো লঙ্ঘন করিস না।

আমি বলি, সেগুলি কি? তুমি গুরুদেব, আমাকে শিখিয়ে দাও।

এই 'গুরুদেব' ডাকটা ভূতোদার ভারি পছন্দ। অমনি খুশী হয়ে ওঠে। সাদা বাংলা ছেড়ে অমনি সংস্কৃত বুলি শুরু হয়ে যায়, বলে, হ্যাঁ, তোকে এখন একে একে সব কথা বলা দরকার। এখন তুই নিজেও একজন ছোটখাট মাদারী হয়ে উঠেছিস। যখন দেখবি কোন ম্যাজিশিয়ান খেলা দেখাচ্ছে, তখন ধ্যানী-বুদ্ধর মতো চুপচাপ বসে থাকবি। কোনো শব্দ করবি না। আর যদি দেখিস তোকেই বোকা বানাতে চায় তখন নিচু গলায় বলবি: মাদার্যাহমপি।

আমি অবাক হয়ে বলি, 'মাদার্যাহমপি'? মানে? -সন্ধি বিচ্ছেদ কর। মাদারী অহম্ যোগ অপি। অর্থাৎ কিনা আমিও একজন মাদারী। বুঝলি?

ঠিক এই কাণ্ডই একবার ঘটেছিল ভূতোদার জীবনে। আমার সামনেই। আমি ছিলুম উপস্থিত ওর অ্যাসিসটেন্টরূপে। ব্যাপারটা বলি-

 

আমাদের জেলার ম্যাজিস্ট্রেট, সেই যিনি ভূতোদাকে 'দুর্গেশ দুমরাজ' খেতাব দিয়েছিলেন-তিনি বদলি হয়ে যাচ্ছেন। অফিসার্স ক্লাব থেকে তাঁকে বিদায় ভোজে আপ্যায়ন করা হবে। ভূতোদাকে ওরা আমন্ত্রণ করল নৈশ ভোজের আসরে, আনন্দ পরিবেশন করতে। খরচ যা পড়বে তা ওরা দেবে, তাছাড়া রাত্রে শো'র পর ওখানেই ভালমন্দ খ্যাঁটের ব্যবস্থা। মুরগীর রোস্ট, চিংড়ির পোলাও, ভেটকির ফ্রাই আর আইসক্রীম। আমি তো সাকরেদ হিসেবে এক পায়ে খাড়া। ফুলপ্যান্ট একটাই ছিল। আর্জেন্ট কাচতে দিলাম। ধোপদুরস্ত না হলে কি অমন ভোজসভায় যাওয়া যায়!

সন্ধ্যাবেলায় আমরা দুটি বন্ধু সেজেগুজে হাজির হলাম অফিসার্স ক্লাবে। একটা কালো রঙের ঝোলা ঝোলা জোব্বার মতো বেঢপ পোশাক ছিল ভূতোদার। সেটাই চড়ালো গায়ে। পাখির পালক দেওয়া পাগড়ি ছিল একটা। পায়ে নাগরা। ঐ কন্দর্পকান্তি চেহারায় সে সব সাজপোশাকে যা খোলতাই বাহার হল তা আর কহতব্য নয়।

সে বছর ক্লাবের সেক্রেটারি ছিলেন এস. ডি. ও-নর্থ। তিনি সকলের কাছে ভূতোদার পরিচয় দেবার উদ্যোগ করতে মিসেস্ ডি. এম বলে ওঠেন, - উই অল নো হিম। ও ভালো খেলোয়াড়। আচ্ছা, তুমি ম্যাজিকও দেখাতে পারো?

ভূতোদা বলে, নট মাচ। থোড়া থোড়া।

শুরু হল খেলা। তাসের খেলা। এমন খোলা জায়গায় তাসের হাতসাফাই ছাড়া আর কি দেখানো সম্ভব? স্টেজ নেই, স্ক্রীন নেই, চারিদিক ঘিরে লোক বসেছে। তবু ওরই মধ্যে চমৎকার কতকগুলো খেলা সে দেখালো। মেমসাহেব খুব খুশী। ঘন ঘন হাততালি দিচ্ছেন তিনি।

শেষে ভূতোদা শুরু করল একটা নতুন খেলা। তাসগুলো মেমসাহেবের সামনে উপুড় করে মেলে ধরে বললে, যে কোন একখানা টেনে নিন। আমাকে দেখাবেন না, অন্য সকলকে দেখান।

মেমসাহেব বললেন, অন্য কউকে টানতে বল। আমি না।

ভূতোদা বলে - না না, আপনিই নিন।

মেমসাহেব ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেবের দিকে তাকিয়ে দেখলেন। দুজনের চোখে চোখে কি যেন কথা হল। শেষে মেমসাহেব নিচু গলায় বলে, আই নো এফ. সি.। সর্বনাশ। মেমসাহেব খেলাটা জানে। 'এফ. সি.' মানে হচ্ছে 'ফোর্সিং কার্ড'। খেলাটা আর কিছুই নয়, ম্যাজিশিয়ান কায়দা করে একখানা তাস দর্শকের হাতে গছিয়ে দেয়। যে তাস টানে সে বুঝতে পারে না, ভাবে বাণ্ডিল থেকে স্বেচ্ছায় যে কোন একখানাই বুঝি নিল সে। আসলে যেটা নেয় সেটা ম্যাজিশিয়ানের পরিচিত তাস-কায়দা করে গছিয়ে দেওয়া, আর কি।

ভূতোদা বলে, কই টানুন?

কী আপদ। ভূতোদা কি মেমসাহেবের ইঙ্গিত বুঝতে পারেনি। আমি তার পেটে অলক্ষ্যে এটা খোঁচা মেরে কানে কানে বলি, মেমসাহেব: বলছেন - মাদার্যাহমপি!

আমার এমন নিখুঁত সংস্কৃত মন্ত্রতেও কাজ হল না। ভূতোদা হয় কালা, নয় সংস্কৃত ভুলে গেছে। বললে, তাতে কি? আবার মেমসাহেবের সামনেই তাসের গোছা মেলে বলে, - কই, নিন?

মেমসাহেবেরও এতক্ষণে ধৈর্যচ্যুতি হয়। হাজার হোক ষাঁড়ের ভালনা খাওয়া রক্ত তো। বললে, - অলরাইট! তোমার তাস আমি বাঁ হাতে নেব না, রাইট হ্যান্ডে নেব। আন্ডারস্ট্যান্ড? দাও তাস!

বাঁ-হাতের দুটি আঙুলে একটি বিশেষ তাসকে চেপে ধরে মেমসাহের ডান হাতে টেনে নেয় একখানা। ভূতোদা একেবারে চুপসে যায়।বলে,- আচ্ছা, আর একবার।

আবার নতুন ভাবে তাসগুলো মেলে ধরে।

মেমসাহেব হেসে বলে, - একবার নয়, একশ বার। কিন্তু কায়দাটাও আমার জানা আছে। ওকে বলে ব্যাক-হ্যান্ড পুশ। আই নো দ্যাট – ওয়েল! বাঁ-হাতে প্যাকেটটির সবচেয়ে নিচের তাসখানা চেপে ধরে বলে, শ্যাল আই টেক দ্যাট। নেব এইবার?

ভূতোদার অবস্থা তখন ছেড়ে-দে-মা-কেঁদে-বাঁচি। পরপর চার পাঁচ বার চেষ্টা করে সে। চার-পাঁচ ধরনে। সাইড-থ্রাস্ট, লেফট-হ্যান্ড-ম্যানেজ, আন্ডার হ্যান্ড পুশিং।

কিন্তু নাঃ, কিছুতেই কাবু করা যায় না মেমসাহেবকে। ভদ্রমহিলা সব কয় রকম ফোর্সিং-এর সঙ্গেই পরিচিত।

শেষে তিনি বলেন, ফোর্সিং কার্ডের নয়রকম ভ্যারাইটি আছে ভূতনাথবাবু, আমি নয়টি কায়দাই জানি। সময় নষ্ট করে কি হবে, তুমি অন্য খেলা দেখাও।

সবাই হো-হো করে হেসে ওঠে। এর বড় অপমান ভূতোদা জীবনে হয়নি। একেবারে ফ্ল্যাট হয়ে যায় সে। মেমসাহেব যেন একটা গুগুলি বলে মিডল স্টাম্পটা উপড়ে নিয়েছে ওর।

তবু চালু ছেলে তো, তা সত্ত্বেও মুখে একটা সপ্রতিভ ভাব ফুটিয়ে বলে, আপনি সত্যিই যত্ন নিয়ে ম্যাজিক শিখেছেন দেখছি। কিন্তু এই মাত্র আপনি একটা ভুল কথা বললেন। ফোর্সিং কার্ড দশ রকমের হয়, নয় রকম নয়। ভুরু কুঞ্চিত হল মেমসাহেবের।

বলেন, অ্যাবসার্ড। আমি সবরকম ম্যাজিকের বই পড়ে দেখেছি। এটাই আমার হবি।

ভূতোদা একটা ঢোক গিলে বলে, হতে পারে। ইংরেজি বইতে নয় রকম ফোর্সিং কার্ডের কথা থাকাই স্বাভাবিক।কারণ, দশম নিয়মটা এক্কেবারে ভারতীয় কায়দা। আমাদের শাস্ত্রেই বলেছে। দশমস্তমসি!

মেমসাহেব বলেন, - তার মিনিং কি হল?

তম অর্থাৎ অন্ধকার, সী মানে সমুদ্র। অর্থাৎ শাস্ত্রকার বলেছেন, এই দশ নম্বরের কায়দাটা খুব গভীর।

মেমসাহেব সেসন-জজ দাশ সাহেবের দিতে ফিরে বলেন, আপনাদের শাস্ত্রে এই কথা আছে?

দাশ সাহেব পণ্ডিতমানুষ বলে পরিচিত। তিনি একটা গলা খাঁকারি দিয়ে বলেন, এই রকম কথা ভারতীয় দর্শনে আছে বটে, তবে তার এমন শাঙ্করভাষ্য আমার জানা ছিল না।

তাঁর মুখের কথা লুফে নিয়ে ভূতোদা বলে, - তবেই দেখুন, উনি পর্যন্ত এ ব্যাখ্যা জানেন না। এই দশম কায়দাটা একেবারে ভাগবত প্রক্রিয়া। জাদুকর হুডিনিও জানতেন না। গণপতি জানতেন, পি সি সোরকার জানেন, আর জানেন ---- এবার একটা ‘বাও’করে বাকিটুকু অনুক্ত রাখল সে।

ভাবখানা, আর জানেন এই শর্মা। সকলে মুখ টিপে হাসে। মেমসাহের গালে হাত দিয়ে ওর চালবাজি লক্ষ্য করছিলেন এতক্ষণ। এবার বলেন, - তুমি সেই দশম কায়দায় আমাকে ফোর্স করতে পারো?

রুমাল দিয়ে মুখটা মুছে নিয়ে ভূতোদা বলে, পারি। তবে আজ তো হবে না। এজন্য আমাকে দুদিন হঠযোগ করতে হবে।

আপনারা যে কালই চলে যাচ্ছেন, - না হলে পরশু সে ম্যাজিক আপনাকে দেখাতাম।

মেমসাহেব বলেন, - তুমি ভুল শুনেছ ভূতনাথবাবু। আমরা পরশুর পরের দিন যাব। তুমি পরশুই আমাকে সে খেলা দেখাও। হঠযোগ অর নো হঠযোগ, আমাকে যদি তুমি ফোর্স করতে পারো তাহলে আমি একশত টাকা বাজি হারব। কেমন রাজি?

ভূতোদার চোয়ালের নিচের অংশটা ঝুলে পড়ে।

কোনওক্রমে ঢোঁক গিলে বলে, রাজি তো হতেই পারি, তবে কি জানেন, আমার কেমন যেন বিবেকে বাধছে।

-কেন? তোমার বিবেকে বাধছে কেন?

-এ যেন ছেলেমানুষের হাত থেকে মোয়া কেড়ে খাওয়া! মনে করুন, আপনার সঙ্গে কেউ বাজি রাখতে চায় যে আগামীকাল সূর্য পশ্চিম দিকে উঠবে। সে বেটিং অ্যাকসেপ্ট করতে আপনার বিবেকে বাধবে না?

ভূতোদা যতই সপ্রতিভ ভাব দেখাক, মেমসাহেব কিন্তু ওর চালাকি ধরে ফেলেছেন।এবার তিনি সবাইকে সম্বোধন করে বলেন - পরশু সন্ধ্যায় আপনারা সকলে এখানে চা খেতে আসবেন। অতি অবশ্যই। আপনাদের নতুন ডি. এম.- ও কাল আসছেন। আপনারা হঠযোগী ফোর্সিং দেখে যাবেন। যে খেলা স্বয়ং হুডিনিও জানতেন না, আশা করি সে খেলা দেখতে আপনারা সকলেই খুব উৎসুক।

তারপর ভূতোদার দিকে ফিরে বলেন, ইজ্ দ্যাট্ ও কে?

ভূতোদা একটা ম্যাজিশিয়ানি 'বাও' করে বলে, - পারফেক্টলি মাদাম।

পাশের ঘরে টেবিল পেতে আমাদের দুজনকে নিরিবিলিতে খেতে দেওয়া হল। আড়ালে পেয়ে বলি, গুরুদেব! হঠযোগী ফোর্সিং আবার কী?

গুরুদেব কোন জবাব দেয় না। চোখ বুজে কড়মড় করে মুরগির ঠ্যাঙ চিবোতে থাকে। কিন্তু আমার খাওয়া তখন মাথায় উঠেছে। বলি, - ও গুরুদেব?

চোখ বুজেই ভূতোদা বলে, - আরে খেয়ে নে। চাল মারতে গিয়ে লেঙ্গি খেয়েছি।

- কী চাল মারতে গিয়েছিলে?

- আরে দূর। আমাকে কে যেন বলল, ওরা কাল সক্কাল বেলাতেই চলে যাবে। তাই --! কিন্তু তুমি যে বললে একশো টাকা ঠকিয়ে নিতে তোমার বিবেকে বাধছে।

- তা তো বলতেই হবে। না হলে মুখ রক্ষা হত কি?

- তা এখন কী করবে?

- কী আবার করব? মুর্গির রোস্ট দিয়ে পোলাও সাঁটব। কথায় বলে, 'প্রাপ্তিমাত্রেন সাঁটয়েৎ।'

কী দুর্জয় সাহস !! আমি বলি, সে তো এখন! তারপর? কাল বাদ পরশু?

এঁটো হাত দুটোই জোড় করে ভূতোদা বলে, - এখন একটু মৌজ করে খেতে দে বাবা। পরশুর কথা পরশু।

পরদিন ক্লাসে এসে বন্ধুদের সব কথা খুলে বলতে নেড়া আর ক্যাবলা তো হেসেই বাঁচে না। আচ্ছা জব্দ হয়েছে ভূতোদা।

গজেন বলে, পীরের কাছে মামদোবাজি। মেমসাহেব ভূতোদার নাকে এবার স্রেফ ঝামা ঘষে দেবে। আজ আসুক না ভূদ্দা ক্লাসে!

কিন্তু কোথায় ভূতোদা? স্কুলেই এল না সে।

তা বলে আমার তো একটা দায়িত্ব আছে! আমি হলুম গিয়ে তার সাকরেদ।

ছুটির পরে ছুটি তার বাড়ি পানে। কিন্তু বাড়িতেও ভূতোদা নেই! ওর বোন নেড়ি বললে, - দাদা কলকাতা গেছে।

গজেন বলে, - শেষ পর্যন্ত মেমসাহেব ভূদ্দাকে একেবারে দেশান্তরী করে ছাড়ল রে?

ক্যাবলা বলে, - অতঃ কিম্। এখন কী করা যায়?

নেড়া বলে, - আয় আমরা ক'জন ভূদ্দার মহাপ্রস্থানে দু-মিনিট সাইলেন্স অবসার্ভ করি।

কিন্তু না। পরদিন বিকালের লালগোলায় চেপে ঠিক ফিরে এসেছে সে। আমি বলি, - গুরুদেব। আর একটা দিন কোনক্রমে গা-ঢাকা দিয়ে কাটিয়ে দিলেই পারতে। আজ আবার মরতে এলে কেন? কলকাতা গিয়েছিলে কি জন্যে?

ভূতোদা গম্ভীর হয়ে বলে, কলকাতায় গেছিলাম ব্যাটের অর্ডার দিতে।

- ব্যাট। কী ব্যাট?

-ক্রিকেট ব্যাট। আগামী বুধবার গিয়ে ডেলিভারী নেব। ফার্স্টক্লাস একটা ব্যাট পছন্দ করে এসেছি। পঁচাত্তর টাকা দাম।
 

আমি ওর কথার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারছি না দেখে বলে, - আরে বুঝলি না, আজ রাত্রেই তো নগদ একশ টাকা পাচ্ছি।

আমি বলি, তার মানে? তুমি কি এখনও আশা করছ, ঐ মাদারীসম্রাজ্ঞী মেমসাহেবকে ফোর্সিং করতে পারবে?

উত্তরে ও বলে, - না হলে পঁচিশ টাকা অ্যাডভান্স করে আসি?

আমাদের উপস্থিত হতে কিছু দেরি হয়েছিল। তার আগেই সকলে জমায়েত হয়েছেন। আমরা আর আসব না এটাই বোধহয় এঁরা ধরে নিয়েছিলেন, কারণ আমরা ঘরে ঢুকতেই সমস্বরে সকলে বলে ওঠেন: - এই তো ওরা এসে গেছে।

লক্ষ্য করে দেখি দুটি নতুন মুখের আমদানি ঘটেছে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, এঁরা হচ্ছেন নতুন ডি. এম. আর তাঁর স্ত্রী। অল্প বয়স। বেশ স্ফূর্তিবাজ মনে হল।

ভূতোদা একটা 'বাও' করে বলে, প্রথমেই একটা নতুন খেলা দেখাচ্ছি --

বাধা দিয়ে মিসেস ডি. এম. বলেন, না, না, আজ আমাদের সময় কম। তুমি শুধু তোমার যৌগিক ফোর্সিং কার্ডের খেলাটাই দেখাও।

ভূতোদা সসম্ভ্রমে বলে, - বেশ স্যার। তাই হবে, কিন্তু এঁরা আমার কোনও খেলাই দেখেননি। অন্তত এঁদের অনারে একটা খেলা আমাকে দেখাতে দিন।

মেমসাহেব 'স্যার' সম্বোধনে বিচলিত হলেন না, - বললেন, বেশ দেখাও। কিন্তু ঐ একটা খেলাই।

ভূতোদা পকেট থেকে চকচকে একটা তাসের প্যাকেট বার করে মেমসাহেবের হাতে দিয়ে বললে, চারটে টেক্কা আমাকে বার করে দিন। মেমসাহেব তাসের প্যাকেট থেকে চারখানা টেক্কা বার করে ওর হাতে দিলেন।

ভূতোদা বাকি তাসগুলো প্যাকেটে বন্ধ করে পকেটে পুরল। তারপর সে চারখানা টেক্কা চারজনকে দিল। বললে, টেক্কাগুলো আপনারা সাবধানে রাখবেন, আমি চাইলেই ফেরত দেবেন।

চারজন অফিসার যে যার পকেটে তাসগুলো লুকিয়ে রাখলেন। মুন্সেফবাবু, সিভিল সার্জেন, আর দুজন ডেপুটি। ভূতোদা এবার আগের ডি. এম-এর দিকে ফিরে বললে, - স্যার, গচ্ছিত ধন কেউ যদি ফেরত না দিতে চায়, তাহলে আইনে তার শাস্তির ব্যবস্থা আছে নিশ্চয়ই?

ডি. এম. বলেন, - নিশ্চয় আছে। কিন্তু সে কথা কেন?

- তাহলে স্যার আমি এঁদের চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনছি। সর্বসমক্ষে এঁদের আমি চারখানা তাস রাখতে দিয়েছি, এঁরা আমাকে তা ফেরত দিচ্ছেন না।

সিভিল সার্জেন আঁতকে উঠে বলেন, - আরে-আরে তুমি তো সাঙ্ঘাতিক লোক হে, ফেরত দেব না কেন? চাইলেই দেব, এই নাও।

তাজ্জব কাণ্ড! সিভিল সার্জেন তাঁর কোটের পকেট হাতড়ালেন, মুন্সেফবাবু তাঁর পাঞ্জাবির পকেট তল্লাস করলেন, - কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা! টেক্কা চারখানা বেমালুম গায়েব। কারও পকেটে তাস নেই।

ডি. এম. হেসে বলেন, - সে সব জানি না মশাই, এ ছোকরা আপনাদের তাস রাখতে দিয়েছে, আমরা সবাই সাক্ষী। গচ্ছিত সম্পত্তি আত্মসাৎ করা কঠিন অপরাধ। তাস ফেরত দিতে না পারলে শাস্তি পেতে হবে। মুন্সেফবাবু বলেন, খুব জানি। আমার কোর্টে আজ তো এই রকমই একটা কেস চলল সারাদিন।

সিভিল সার্জেন হেসে বলেন, - কী গেরো। তা দিন শাস্তিই দিন। হারিয়ে যখন ফেলেছি তখন শাস্তিই ভোগ করি। বুড়ো বয়সে ঘানি ঘোরাই।

ভূতোদা মিটিমিটি হাসছে তখন।

ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, - আমি ডিস্ট্রিক্টের চার্জ বুঝিয়ে দিয়েছি। ফলে নূতন কালেকটারকেই অনুরোধ করছি তাস উদ্ধার করে এঁদের শাস্তির ব্যবস্থা করুন।

নবাগত ডি. এম বয়সে তরুণ। রসিক ব্যক্তি। খুব এক চোট হেসে নিয়ে বলেন, - নতুন জেলার চার্জ নিয়েই আমার চার চারজন সহকর্মীর শাস্তির ব্যবস্থা করতে আমার কেমন যেন সঙ্কোচ হচ্ছে। তাই আমি মামলা আমার স্ত্রীর আদালতে ট্রান্সফার করে দিলাম।

স্ত্রীর দিকে ফিরে বলেন, - যা শাস্তি দেবার তুমিই দাও। নতুন ম্যাজিস্ট্রেট-পত্নী এতক্ষণ মুখ টিপে হাসছিলেন বসে বসে। হঠাৎ এ অনুরোধে বিব্রত হয়ে পড়েন। গুছিয়ে নিয়ে কিছু একটা বলবার উপক্রম করতেই হাঁ হাঁ করে তেড়ে আসে ভূতোদা।

হাত দুটি জোড় করে সবিনয়ে বলে, - না স্যার, তা হবে না। ওঁর এজলাসে মামলা ট্রান্সফার করা চলবে না। বাদীর তাতে ঘোরতর আপত্তি।

নতুন ডি. এম. বিস্মিত হয়ে বলেন, - কেন? আপত্তি কিসের?

-স্যার, উনি দিব্যি ভাল মানুষটির মত বসে আছেন বটে, কিন্তু আমার কাছে খবর, - বামাল সমেত উনিই পাচার করেছেন। বিশ্বাস না করেন ওর ভ্যানিটি ব্যাগ তল্লাস করার হুকুম দিন।

কী কেলেঙ্কারি!! টেক্কা চারখানা সত্যিই পাওয়া গেল নবাগত মিসেস্ ডি. এম এর ভ্যানিটি ব্যাগের ভিতর থেকে।

ভদ্রমহিলা তো অপ্রস্তুতের একশেষ।

নতুন ডি. এম. আবার তার উপর রসিকতা করে বলেন, এ হে হে। সহকর্মীদের তঞ্চকতায় হতাশ হয়েছিলাম আমি, কিন্তু সহকর্মী দূরের কথা, স্বয়ং সহধর্মিণীই যে শেষ পর্যন্ত - -

হঠাৎ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে মাঝপথেই থেমে পড়েন উনি।

হো-হো করে হেসে ওঠে সবাই।

 

ভূতোদা এবার টেক্কা চারখানা টেবিলের উপর রেখে, আবার পকেট থেকে বাকি প্যাকেটটা বার করলে। বললে, - আর কোনও খেলা দেখতে চান?

মেমসাহেব ব্যস্ত হয়ে বলেন, - না, না, এবার তোমার সেই যৌগিক ফোর্সিং কার্ড।

প্যাকেটের তাসগুলো বার-কয়েক শাফল করে নিয়ে ভূতোদা বললে, - বেশ কথা। আমি আপনাকে চিড়িতনের গোলাম ফোর্স করব, আগেই বলে দিলাম।

ভূতোদা একটা লম্বা শ্বাস নিল। দম বন্ধ করে আধ-বোজা চোখে সে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল মেমসাহেবের দিকে। যন্ত্রচালিতের মত মেলে ধরলে উপুড় করা তাসগুলো। মেমসাহেব তো ছার, আমিই বুঝতে পারলুম কোন তাসখানা সে গুঁজে দিতে চাইছে। প্যাকেটের তলা দিয়ে সেই তাসখানা সরসর করে এগুচ্ছে আর পিছুচ্ছে। এগুচ্ছে আর পিছুচ্ছে।

মেমসাহেব হাসল। সেই চিহ্নিত তাসখানা এড়িয়ে অন্য একটা তাস সন্তর্পণে টেনে নিলেন তিনি।

আমি ভাবলুম, যাঃ, ভূতোদা বোল্ড হয়ে গেল। কিন্তু চিৎ করতেই দেখা গেল সেটা আর কিছু নয়, চিড়িতনের গোলাম।

মেমসাহেব অবাক বিস্ময়ে শুধু বললে, স্ট্রেঞ্জ!

হুস্ করে শ্বাস ছেড়ে এতক্ষণে হঠযোগী ভূতোদা চোখ মেলে তাকায়। সকলের উপর দৃষ্টি বুলিয়ে বললে, - কি হল? চিড়িতনের গোলামই তো বটে?

কেউ আর কথা বলে না। মেমসাহেবই শেষ পর্যন্ত বলেন, - আমি বাজি হেরেছি।

ভ্যানিটি-ব্যাগ খুলে একশ টাকার একখানা করকরে নোট বার করে সেটা তিনি টেবিলের উপর রাখলেন। ভূতোদা সেটা কপালে ছুঁইয়ে সযত্নে বুক পকেটে তুলে রাখল। মেমসাহেব বোধ করি নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। বলেন, খেলাটি তুমি আর একবার দেখাবে?

ভূতোদা বলে - আজ্ঞে হ্যাঁ। টানেন।

দীর্ঘশ্বাস টেনে আধবোজা নেত্রে ধ্যানস্থ ভূতোদা আবার মেলে ধরে তাসের গোছা। মেমসাহেব অনেক বুদ্ধি বিবেচনা করে অনেক বেছে বেছে করে একটা তাস টেনে নেয়।

ক্যা তাজ্জব কী বাৎ! এবারেও সেই চিড়িতনের গোলাম। মেমসাহেব বলেন, ইটস্ রিয়ালি ওয়ান্ডারফুল। এ পদ্ধতিটি হুডিনিও জানিতেন না?

ভূতোদা বললে, - ক্যামন করে জানবেন বলুন, স্যার? এটা যে পিওর ভারতীয় যৌগিক পদ্ধতি।

মেমসাহেব বললেন, - এই দশম পদ্ধতিটি তুমি আমাকে শিখিয়ে দেবে? আমি তোমাকে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেবো।

ভূতোদা বলে, - আর পারিশ্রমিক লাগবে না। আপনি তো এইমাত্র নগদ একশ টাকা দিলেন।

- আমাকে কি প্রাণায়াম অভ্যাস করতে হইবে?

-আজ্ঞে না। এই দেখুন, - খেলাটা জলবৎ তরলং।

তাসের গোছা সে টেবিলের উপর চিৎ করে বিছিয়ে দেয়। হরি বোল! মেমসাহেব তো ছাড়, দেখে আমার মতো মাদারীরও চক্ষুস্থির। প্যাকেটের বাহান্নখানা তাসই চিড়িতনের গোলাম।

ভূতোদা বলে, - খেলাটা কিছু ব্যয়সাধ্য। পাইকারি হারে তিপ্পান্ন প্যাকেট একই রকম তাস কিনতে হবে। যে প্যাকেট থেকে আপনাদের চার টেক্কার খেলা দেখালাম সেটা এ প্যাকেট নয়।

পকেট থেকে এক প্যাকেট তাস বার করে বলে, সেটা এইটা। এটুকুই হাত সাফাই। বাকিটা আগেই বলেছি-জলবৎ তরলং।

মেমসাহেব মুখে রুমাল চাপা দিয়ে বলেন, ও। ইউ নটি বয় !!

 

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এই গল্পটি শুনতে হলে নিচের লিংকে ক্লিক করুন:  👇👇

অপারেশন: মাদার্যাহমপি। নারায়ণ সান্যাল। মজার গল্প। গল্প পাঠে : অনুব্রতা Narayan Sanyal. Comedy Story

 

এই সিরিজের অন্য গল্পগুলি: