ভূতায়ন - অপারেশন: ভূতের নৃত্য (Bhutayan - Operation Bhuter Nritya)

 
তখন বয়স ছিল কম, তাই বুঝতাম না। ভূতোদাকে দেখতে মোটেই ভাল ছিল না। তালগাছের মত ঢ্যাঙা, বড়ির মত নাক, চুলগুলো খোঁচা খোঁচা। পড়াশুনাতে সে ছিল স্বয়ং বৃহস্পতি। তবু সবাই তাকে ভালবাসতো। মাস্টারমশাইরা সকলেই ওকে স্নেহ করতেন। আমরা ভাবতুম তার কারণ ও খেলাধুলায় চৌখস ছিল বলে। এখন বুঝতে পারি, --- সে জন্য নয়। তাকে সবাই ভালবাসত তার কারণ ঐ কুৎসিত-দর্শন মানুষটার হৃদয় ছিল বড়। ভূতোদা ছিল,-- যাকে বলে আউট-অ্যান্ড-আউট স্পোর্টসম্যান। খেলতে বসে কেউ যদি বলে, - তুমি জুয়াচুরি করেছ, অমনি সে খেপে উঠত। ওর মতে সবচেয়ে বড় গালাগালি হচ্ছে "চারশ বিশ" অর্থাৎ ফোর-টোয়েন্টি।
 
একবার ওকে চারশ-বিশ বলায় কি কাণ্ড ঘটেছিল এবার তাই বলব! আগেই বলেছি, --আমি ছিলুম ওর ম্যাজিকের সাকরেদ।
 
শহরের সবচেয়ে নামকরা উকিল কালিচরণবাবু। তিনি উকিলপাড়ায় মস্ত তিনতলা বাড়ি হাঁকিয়েছেন। তাঁরই বড় মেয়ে উমার বিয়েতে ডাক পড়ল ভূতোদার। ঠিক বিয়ের মধ্যে নয়, ---- অষ্টমঙ্গলাতে বর-বউ ফিরে এলে হল এই আনন্দ অনুষ্ঠান। কালিচরণবাবু শহরের অনেককেই নিমন্ত্রণ করেছিলেন। ওনার চকমেলানো উঠানে, বড় ছেলে শিবু ব্যবস্থা করেছিল একটা ভ্যারাইটি এন্টারটেনমেন্টের। কিছু নাচ-গান-বাজনা আর সবশেষে ভূতোদার ম্যাজিক। কালিচরণবাবু ভূতোদাকেও বলেছিলেন তার বন্ধু-বান্ধব কয়েকজনকে বলতে। ভূতোদা নেড়া, ক্যাবলা, গোবিন্দকে আসতে বলেছিল। আমি তো সাকরেদ হিসাবে আসবই।
 
চকমেলানো উঠোনের এক প্রান্তে আমরা কয়জনে মিলে চৌকি জোড়া দিয়ে দিয়ে একটা স্টেজ বানালাম। তারপর টানা দিয়ে স্ক্রীন করা হল। একপাশে পর্দা দিয়ে বানালাম গ্রীনরুম। ম্যাজিক দেখাতে গেলে অনেক প্রস্তুতির প্রয়োজন। সেই নেপথ্য কাজটা গোপনে করতে হয়। কিন্তু বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েদের কৌতূহল ঐ ঘেরাটোপ ঘরখানার দিকে। ওখানে আমরা আগেভাগে কী-সব লুকিয়ে রাখছি তাই দেখা চাই ওদের।
 
ভূতোদা আর আমি বারেবারে বললাম: এ রকম করলে আমরা খেলা দেখাতে পারব না। আমরা তেড়ে উঠলেই ওরা কেটে পড়ে আবার কখন গুটিগুটি ঘনিয়ে আসে। উঁকি মারে পর্দার এপাশে। শেষ পর্যন্ত ভূতোদার নির্দেশমতো আমি কালিবাবুকেই গিয়ে বললাম, -- জ্যাঠামশাই, ওরা যদি এই রকম করে, তাহলে কিন্তু আমরা খেলা দেখাতে পারব না। কালিবাবু এসে কড়া ধমক লাগালেন বাচ্চাদের। বললেন, ফের যদি কেউ ওখানে উঁকি মারতে যাও তাহলে আমি তাকে সন্ধ্যাবেলা ঘরে তালাবন্ধ করে রেখে দেব, -- ম্যাজিক দেখতে দেব না।
 
এতক্ষণে কাজ হল। ওরা সবাই মুখ কাঁচুমাচু করে পালালো। কিন্তু নতুন জামাইয়ের তাতেও হুঁশ হল না। তিনি তা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে ফিরে এসে উঁকি মারতে থাকেন। ভূতোদা দু-একবার রুখে উঠল। উনি হে-হে করে হেসে ওঠেন। যেন নির্লজ্জের মত হেসে উঠতে পারলেই সাত খুন মাপ।
 
আমি বলি, বল ভূদ্দা, আবার গিয়ে বলি কালিজ্যাঠাকে?
 
ভূতোদা বলে, তাতে কোন লাভ নেই রে, বলিবর্দ। নতুন জামাই তো আর বাচ্চা ছেলে নয়, যে তাকে তালাবন্ধ করে রাখবার ভয় দেখানো চলে।
 
নতুন জামাইয়ের নাম অমলেন্দু। চৌখস ছেলে। চোখে মুখে কথা। কলকাতার মানুষ, তাই মফঃস্বলের ছেলেদের দিকে তাকাবার ভঙ্গিটা এমন, এরোপ্লেনের যাত্রী যেমন তাকায় নিচের দিকে। শিবুর জামাইবাবু বলে আমি একটু আলাপ করতে গিয়েছিলাম প্রথমটায়। কিন্তু ওঁর চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শুনে নিজেকে গুটিয়ে নিলাম। কলকাতার কোন অঞ্চলে থাকেন প্রশ্ন করায় বললেন, গ্যাঁড়াতলায়।
 
বললাম, সেটা আবার কোথায়?
 
-- গাঁয়ের মানুষ তোমাকে আমি কেমন করে বোঝাব বাওয়া?
 
ম্যাজিকের কথায় আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলেন, এই সব গাঁইয়া ম্যাজিকও বসে বসে দেখতে হবে? বলে স্বয়ং পি. সি. সোরকারের ম্যাজিকই আমি চটপট ধরে দিই --
 
তারপর বেশ জমিয়ে শ্যালীবাহন সম্রাটের মতো আষাঢ়ে গল্প ফেঁদে বসেন। কবে নাকি উনি নিউ এম্পায়ারে একেবারে হৈ-হৈ-কাণ্ড রৈ-রৈ-ব্যাপার করে তুলেছিলেন। ম্যাজিশিয়ান যে ম্যাজিক দেখায় অমলেন্দুবাবু পটাপট তা ধরে ফেলেন। শেষ পর্যন্ত ওদের ম্যানেজার এসে অমলেন্দুবাবুর একেবারে হাতে পায়ে ধরতে থাকে। বলে, মশাই, গোটা সিজনের জন্য আপনাকে একটা বক্সের পাস দিয়ে দিচ্ছি, -- এভাবে হাটের মাঝে হাঁড়ি ভাঙবেন না। কালিবাবুর ছোট মেয়ে সীমা ন্যাকা ন্যাকা গলায় বলে, কেমন করে আপনি বুঝতে পারলেন, -- নতুনদা?
 
-- পিওর কমন সেন্স। তাছাড়া আমিও ছেলেবেলায় ম্যাজিক শিখেছিলাম।
 
ভূতোদা আর থাকতে পারে না। পর্দা সরিয়ে বাইরে এসে বলে, তাহলে আমি বলব, আপনি অন্যায় করেছিলেন। কোন ম্যাজিশিয়ান কখনও অপরের খেলায় বাধা দিতে আসে না। ম্যাজিশিয়ানদের এটাই এটিকেট। এটাই এথিক্স!
 
অমলেন্দুবাবু খ্যাঁক খ্যাঁক করে খানিক হেসে নিয়ে বলেন, বুঝেছি ভাই, বুঝেছি। আচ্ছা বেশ, তোমার ম্যাজিক না হয় হাতেনাতে ধরে দেব না।
 
ভূতোদা বলে, না দেওয়াই উচিত, -- যদি আপনি ম্যাজিশিয়ান হন। আর যদি পিওর কমনসেন্স দিয়ে ধরতে পারেন তাহলে ধরবেন।
 
শিবু ভূতোদার পক্ষে নিয়ে বলে, ভূতোদা দুর্দান্ত ম্যাজিক জানে নতুনদা, ওর সঙ্গে চালাকি চলবে না।

জামাইবাবু আবার হেসে ওঠেন, ভূতোদা? ওর নাম কি ভূতো? বাপস্। তাহলে তো সামলে কথা বলতে হবে। শেষকালে ভূত না লেলিয়ে দেয়।
 
ভূতোদা বলে, আজ্ঞে হ্যাঁ, ওটা আমার পিতৃদত্ত নাম। স্বোপার্জিত নয় আপনার 'নতুনদা' নামের মতো।
 
-- কেন নতুনদা নামটা খুব নতুন লাগছে বুঝি।
 
ভূতোদা বলে, আজ্ঞে না। আমাদের ইন্দ্রনাথেরও একজন নতুনদা ছিল, অনেকটা আপনারই মতো। তবে সে গ্যাঁড়াতলার লোক নয়, দর্জিপাড়ার।
 
অমলেন্দুবাবুর বোধকরি রসগ্রহণ হয় না। একথাতেও না হলে হে-হে করে হাসতেন না।
 
ভূতোদা সরে আসে পর্দার এপারে।
 
আমি বলি, লোকটা অসভ্য।
 
ভূতোদা বলে, শুধু অসভ্য নয়, মূর্খও। শরৎবাবুর শ্রীকান্তখানাও পড়েনি।
 
পর্দার ওপাশের কথাবার্তা সবই কানে আসছে। একজন বলে, তা সে নাম যাই হোক না কেন, চৌখস ছেলে। ফুটবল-ক্রিকেট-হকি তিনটে খেলাতেই সিদ্ধহস্ত।
 
অমলেন্দুবাবু বলেন, তিন তিনটে খেলায় বয়েল্ড-হ্যান্ড। তবে তো বনগ্রামের স্বয়ং শিবাসম্রাট।
 
আমি বলি, যাই দু চার কথা শুনিয়ে দিয়ে আসি।
 
ভুতোদা বলে, যাগ গে, মরুগ গে।
 
সন্ধ্যা হতেই লোকজন সব আসতে থাকে সেজেগুজে। জামাইবাবুও সাজটা পালটে এলেন। চুনট করা ভূঁয়ে - লোটানো ধুতি। ঘিয়ে রঙের গরম পাঞ্জাবি, হীরের আংটি আর সোনার ঘড়ি। ছাঁচি-কুমড়োর মতো পাউডারের প্রলেপ সারা মুখে ঘাড়ে। ভুরভুরে সেন্টের গন্ধ। শহরের গণ্যমান্য লোকদের সঙ্গে কালিচরণবাবু জামাইয়ের পরিচয় করিয়ে দেন, আর গ্যাঁড়াতলার জামাইবাবু ধুতির কোঁচাসমেত হাতটি তুলে নমস্কার করে।
 
প্রোগ্রাম শুরু হল। নেড়ার বোন রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইল; পাড়ার একটি মেয়ে বাজালো সেতার।
 
আমি বসেছিলুম জামাইবাবুর ঠিক পিছনেই, বন্ধুদের নিয়ে। ভদ্রলোকের যেন কিছুই পছন্দ হয় না। এর চেয়ে ওঁর ছোট বোন নাকি ভাল গায়, এক বান্ধবী ভাল বাজায়।
 
ন্যাড়া আমায় কানে কানে বলে, এক নম্বর চালবাজ!
 
মালোপাড়ার নবীন জোয়ারদার ভাল মাউথ অর্গান বাজায়। তারও একটা আইটেম ছিল। ভারি সুন্দর বাজালো নবাদা-'দূর দেশী সেই রাখাল ছেলে'।
 
শুনে গ্যাঁড়াতলার জামাইবার বললেন, ছোকরার দম নেই, স্কেল ঠিক থাকে না।
 
নেড়া আর নিজেকে সামলাতে পারে না। বলে, আপনি গানের স্কেল বোঝেন?
 
ঘাড় ঘুরিয়ে জামাইবাবু নেড়াকে এক নজর দেখে নেন। সিল্কের একখানা সুগন্ধী রুমাল বার করে ঘাড়টা মুছে নিয়ে বলেন-ইউনিভার্সিটি ইনস্টিট্যুটে আমার মাউথ অর্গান শুনে স্যার রবার্ট ক্রফোর্ড আমার অটোগ্রাফ নিয়ে গিয়েছিলেন।
 
গোবিন্দটা গবেট। বলে, রবার্ট ক্রফোর্ড কে?
 
-- তোমরা চিনবে না। নিউ অর্লিয়েন্সের টেলিভিশান প্রডিউসর। আমাকে বলেছিলেন, কেন পড়ে আছ কলকাতায়। চলে এস 'ম্যারিকায়। টেলিভিশানে রেগুলার প্রোগ্রাম তোমার বাঁধা।
 
-- তা গেলেই পারতেন?
 
-- যাব। নেক্সট সামারে।
 
নেড়া ছাড়বার পাত্র নয়; বলে, তা আমরা তো আর 'ম্যারিকা যাব না। আপনার টেলিভিশান প্রোগ্রামও শুনতে পাব না। আমাদের একটু শুনিয়ে দিন না আজ।
 
-- সরি। আমি তো মাউথ অর্গানটা আনিনি।
-- কেন ঐ নবাদার অর্গানেই বাজান!
 
খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে ওঠেন জামাইবাবু। যেন কী বোকার মতো কথাটাই না বলেছে নেড়া। বলেন, তোমাদের ঐ মালোপাড়ার মালো-মশায়ের এঁটো অর্গান বাজাব আমি! তোবা তোবা।
 
কান-এঁটো-করা হাসি হাসেন জামাইবাবু।
 
ভূতোদাকে কানে কানে বলি, শুনছ?
 
ভূতোদা শুধু বললে, কপালে অনেক দুঃখ আছে রে।
 
আমি বলি, কার?
 
-- কার আবার? শিবুর বড়দির। ভূ-ভারত খুঁজে কী জামাই-ই এনেছেন কালিজ্যাঠা। একেবারে 'ঠুন ঠুন' পেয়ালা।
 
সবশেষে ভূতোদার প্রোগ্রাম। শুরু হল খেলা। জামাইবাবুকে ডাকতে হল না, নিজেই স্টেজে উঠে এসে তালাস করলেন ওর জামার পকেট, আস্তিন, টেবিলের তলা। তবু হারানো আংটি তাঁর পকেট থেকেই উদ্ধার করে আনলুম আমি। জামাইবাবু অপ্রস্তুত হলেন।
 
কিন্তু মনে হল, ভদ্রলোক আর কিছু শিখুন না শিখুন ম্যাজিক খানিকটা সত্যই শিখেছিলেন। দু-একটা খেলা উনি ধরে ফেললেন। ভূতোদা যে চটেছে, তার মুখ দেখে বুঝতে পারি। মুখে সে কিছু বললে না।
 
তাছাড়া চ্যাটাং চ্যাটাং কথা লেগেই আছে। সব কিছুতেই ফোড়ন কাটার স্বভাব। ভূতোদা দর্শকদের সাধারণ ভাবে প্রশ্ন করল, যে কোন একটা অসময়ের ফলের নাম করুন। আমি খাওয়াব।
 
সেটা অগ্রহায়ণ মাস। জামাইবাবু ফস্ করে বলেন, তোমার নাম শুনে একটি মাত্র ফলের কথাই মনে পড়ছে ভাই। তাই খাওয়াও। ভূতো-বোম্বাই।
 
সকলে হোহো করে হেসে ওঠে। ভূতোদা রাগ করেছে কিনা বোঝা যায় না। একটা খালি টুপী সকলকে দেখিয়ে রুমাল দিয়ে সেটা চাপা দেয়। লাঠি বুলিয়ে কিছু মন্ত্র পাঠ করে। তারপর জামাইবাবু এসে রুমালের ঢাকাটা খুলতে দেখা গেল তার মধ্যে সত্যিই একটা বোম্বাই আম। সকলেই চমৎকৃত, শুধু জামাইবাবু বলেন, এটা বোম্বাই আমই মনে হচ্ছে; কিন্তু ভূতো-বোম্বাই কিনা বুঝব কেমন করে?
 
ভূতোদা বললে, 'ভূতোর ভৌতিক বোম্বাই' ইতি মধ্যপদলোপী ভূতোবোম্বাই। সহজ সমাধান।
 
সবাই খুশী হল। ওর নাম নিয়ে বারে বারে রসিকতা করায় সে যে অফেন্স নেয়নি এতে নিশ্চিন্ত হল সকলে। জামাইবাবু বলেন, আচ্ছা এবার মজঃফরপুরী লিচু খাওয়াও দেখি।
 
ভূতোদা সে কথায় কর্ণপাত না করে স্টেজের সামনে এগিয়ে আসে। কালিচরণবাবুর দিকে ফিরে বলে-জ্যাঠামশায়, আপনি বোধহয় আপনার জামাইকে পেট ভরে খেতে দিচ্ছেন না। খেলা দেখানো শেষ হয়ে গেছে, উনি এখনও খাই খাই করছেন।
 
এবার দ্বিগুণ জোরে হেসে ওঠে সকলে। জগদানন্দবাবু বলেন, বেশ বলেছ বাবা ভূতনাথ। কালিভায়া তুমি একটি পেটুক জামাই এনেছ।
 
অমলেন্দুবাবু অপ্রস্তুতের একশেষ। ফিরে এসে বসেন নিজের আসনে, কিন্তু অত সহজে হার মানবার পাত্র নন তিনি। বলেন, যতসব ফোরটোয়েন্টির কারবার।
 
ধক্ করে জ্বলে ওঠে ভূতোদার চোখ দুটো। আমার মনে হয়, -- এই সেরেছে। পাগলা খেপল বুঝি এবার। শিশুপাল বধ হয় বুঝি এতক্ষণে! ভূতোদা বলে, -- ফোর-টোয়েন্টি মানে? কী বলতে চান আপনি?
 
-- ফোর-টোয়েন্টি মানে বোঝ না? জুয়াচুরি। তুমি হাতসাফাই করে আগেই আম রেখে দিয়েছিলে টুপির ভিতর।
 
ভূতোদা বলে, আলবাৎ। তা তো বটেই। আপনি কি ভাবছিলেন? হাঁস যেমন ডিম পাড়ে, টুপি তেমনি আম পেড়েছে? গ্যাঁড়াতলার মানুষ হয়ে আপনি এটুকু বোঝেন না?
 
আবার সবাই হেসে ওঠে উচ্চৈঃস্বরে। জামাইবাবুর রঙটা ফর্সা। মুখটা টকটকে লাল হয়ে ওঠে অপমানে। বলেন, ছোঃ। একে আবার ম্যাজিক বলে নাকি? আমি ভেবেছিলুম ভূতোর খেলা বুঝি সত্যিই ভূতের খেলা। এতো সবই শুধু ফোর-টোয়েন্টির কারবার।
 
এতক্ষণে বেশ বুঝতে পারি ভূতোদা চটেছে। চটে বেগুন হয়ে গেছে। বললে, দেখুন অমলেন্দুবাবু, লেবু বেশি কচলালে তেতো হয়ে যায়। বাপ-মা আমার নাম ভূতনাথ দিয়েছিলেন, আমি তো তাতে লজ্জার কিছু দেখি না। তা সে যাগগে মরুগগে। ভূতের খেলা দেখতে চান আপনি? ভূত দেখবেন? তাও দেখাতে পারি আমি।
 
ওর কণ্ঠস্বরে এমন একটা কিছু ছিল, যাতে সবাই নির্বাক। ভূতোদা আবার বলে, ভূত দেখে দাঁত-কপাটি লাগবে না তো?
 
জামাইবাবু বলেন, ভয়? আমার অভিধানে ও শব্দটা নেই।
 
ভূতোদা বলে, বেশ, এখন ভূতের খেলাই দেখাব তাহলে। অবশ্য যাঁদের হার্টের ব্যারাম আছে তাঁরা দয়া করে এবার ঘরে যান।
 
কেউই উঠে গেল না। সবাই বুঝতে পারে, এসব নেহাৎ রসিকতা।
 
ভূতোদা বললে, আমাকে খান ছয়েক চিনামাটির বড় প্লেট এনে দিতে হবে। ডিনার প্লেট। এ খেলা দেখানোর প্রোগ্রাম ছিল না। নেহাৎ জামাইবাবু ভূত দেখতে চাইছেন, তাই-
 
জগদানন্দবাবু বলে, তোমার ব্যবস্থা করতে কতক্ষণ লাগবে?
 
 -- দশ মিনিট। ততক্ষণ আমার অ্যাসিস্টেন্ট খেলা দেখাবে।
 
আমাকে আড়ালে টেনে নিয়ে বলে, দশটা মিনিট তুই ম্যানেজ করে দে বলিবর্দ। গ্যাঁড়াতলার জামাইবাবুকে আজ ন্যায্য ভূত দেখিয়ে ছাড়ব, -- স্রেফ কালিয়া পিরেৎ।
 
বলিবর্দ! খাঁটি সংস্কৃত গাল! তবে তো মেজাজ ঠিক আছে ভূতোদার।
 
গ্যাঁড়াতলার জামাইবাবুর সে সামনে খেলা দেখাতে সত্যিই ভয় ভয় করছিল আমার। তবু গুরুর কৃপায় ধর্মে ধর্মে দশটা মিনিট আমি ম্যানেজ করে দিলাম ঠিকই। ওদিকে ভূতোদা ততক্ষণ খান-ছয়েক চিনামাটির প্রমাণ সাইজ ডিনার প্লেট নিয়ে গ্রীনরুমের ভিতর কী সব প্রক্রিয়া করছিল। আমার খেলা দেখানো শেষ হতেই সে বেরিয়ে এল স্টেজে।
 
বললে, আমি রেডি। এখন স্টেজে ভূত নামাবো। কি। কয়েকটা শর্ত আছে।
-- কী শর্ত?
 
 -- প্রথম কথা, আমি বাতি নিভিয়ে দেব তখন কেউ টর্চ জ্বালাবেন না। দ্বিতীয় কথা, যখন কেউ ভূত দেখতে পাবেন কোন শব্দ করবেন মা।
 
জগদানন্দবাবু বলেন, ভূতকে কি শুধু দেখতেই পাওয়া যাবে? সে কি কোন কথা বলবে না?
 
ভূতোদা বলে, বলেন কি দাদু? ভূত মাত্রেই বাচাল; কথা না বলে ওরা থাকতেই পারে না। ভূত কথা বলবে, হাঁটবে, হাসবে-
 
জামাইবাবু রসিকতা করলেন, -- ভূত নাচবে না?
 
ভূতোদা তৎক্ষণাৎ বলল, -- ঘুঙুর এনে দিন, ভূতকে নাচিয়ে ছাড়ব।
 
আমি ভাবলাম, -- ভূতোদা বলে কি? এরকম খেলা তো সে আগে কখনও দেখায়নি।
 
ভূতোদা বলে, লাইট বন্ধ কর।
 
আমি সুইচ টিপে তৎক্ষণাৎ স্টেজ অন্ধকার করে দেই। ভূতোদা একটা মোমবাতি জ্বেলে রাখল টেবিলের উপর। আবছা আলোয় রঙ্গমঞ্চ রহস্যময় হয়ে ওঠে। ভূতোদা বললে, খান ছয়েক চেয়ার প্লিজ।
 
আমি নেড়া আর ক্যাবলা হাতে হাতে ছটা চেয়ার তুলে দিলাম স্টেজের উপর। ভূতোদা বলে, এখন আপনাদের মধ্যে থেকে ছয়জন খুব সাহসী লোক স্টেজের উপর উঠে আসুন।
 
সর্বসমক্ষে সাহস দেখাবার এমন মওকা ছাড়ব কেন? আমরা চার বন্ধুই উঠে এলুম স্টেজে।
 
ভূতোদা বলে, না, তোমাদের দিয়ে হবে না। শেষে জামাইবাবু বলবেন, তোমরা আমাকে সাহায্য করেছ।
 
অগত্যা আমরা আবার নেমে এলাম। জনা-ছয়েক দর্শক উঠে যান আবার স্টেজের উপর। বলা বাহুল্য অমলেন্দুবাবু এলেন সবার আগে। ভূতোদা বলে, একটা কথা। অন্ধকারের ভিতর আমাকে আপনারা দেখতে পাবেন না। আমিও আপনাদের দেখতে পাব না, কিন্তু আমার নির্দেশ আপনাদের ঠিক ঠিক মানতে হবে, কথা দিন।
 
ওঁরা সকলে স্বীকৃত হলেন। ভূতোদা তখন ফুঁ দিয়ে মোমবাতিটা নিবিয়ে দেয়। ঘন আঁধারে ঢেকে গেল সব। কেউ কাউকে আর দেখতে পাচ্ছে না। তারপর শুরু হল ভুতোদার নির্দেশ। তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। ভূতোদা বলছে, আপনারা ছয়জন ডান হাত টেবিলের উপর রাখুন। হাত মুঠো করুন। বাঁ হাত বুকের উপর রাখুন। এবার বলুন: অং বং ছুটুং।
 
এই ভাবে মিনিট তিনেক আবোলতাবোল নির্দেশ দিয়ে হঠাৎ বলে ওঠে, আলো জ্বালো।
 
আমি আলো জ্বেলে দিই। সবাই বলে, কই, ভূত কই?
 
ভূতোদা বিস্মিতভাব দেখিয়ে বলে, সে কি? ভূত দেখেননি?
 
--কই না?
 
--জামাইবাবু আপনিও দেখেন নি?
 
জামাইবাবু একগাল হেসে বলেন, অন্ধকারে দেখতে পাইনি, তবে আলোর মধ্যে দেখতে পাচ্ছি। ভূত নয়,--- ভূতো।
 
লেবু বেশি কচলালে তেতো হয় বলেছিল ভূতোদা, কিন্তু সেই তেতো লেবু কচলালে কী হয় তা আর তখন বলেনি। কিন্তু ভূতোদার নির্বিকার মুখখানা দেখে আমার মনে হল, বুঝি বজ্রাঘাত হয়। ভাল মানুষের মতো সে বলে, আচ্ছা তাহলে আবার একবার চেষ্টা করি। বাতি নেভাও।
 
আবার আমি বাতি নিবিয়ে দিই। আবার শুরু হল ভূতোদার আবোল তাবোল নির্দেশ: এই ছয়জনকে আমি ছয়খানা চিনেমাটির প্লেট দিচ্ছি। ধরুন। ধরেছেন তো ঠিক? এখন আপনারা কোলের উপর প্লেটখানি রাখুন। উপুড় করে রাখবেন কিন্তু, চিৎ করে নয়। রেখেছেন? এখন ধীরে ধীরে ঐ মন্ত্রঃপুত আধারের উপর দুটি হাতের তালু বুলাতে থাকুন আর মনে মনে বলতে থাকুন: ক্রিং ক্রিং ওসাকাচাটাম্বু-ওনা মাসি ঢং।
 
আমি তখন মনে মনে ভাবছি, --ব্যাপারটা আসলে কী? কী করতে চায় ভূতোদা? এত সহজে সে কেমন করে ভূত নামাবে স্টেজের উপর? ব্ল্যাক-আর্টের খেলা ভূতোদা মাঝে মাঝে দেখাতো। অন্ধকার ঘরের মধ্যে আবছায়া আলোয় কঙ্কালের নৃত্য। আমিই স্বয়ং সেই কঙ্কাল। কিন্তু তার ফৈজত অনেক। সেসব ব্যবস্থা তো কিছুই করা হয়নি। আমাকেও তো নেংটিসার হয়ে সারা গায়ে ভুষো কালির উপর সাদা রঙ মাখতে হয়নি। আমার মত আজ্ঞাবাহী ভূত তো ভূতোদার দ্বিতীয়টি নেই। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ভূতের আবির্ভাব হবে, আর আমিই টের পাব না? আমাকে বাদ দিয়ে যদি ভূতোদা অন্য কোন নেংটি-সার ভূতের আমদানী করে থাকে তবে দুই ভূতে ডুয়েল লড়ে যাব আমরা।
 
ওদিকে ভূতোদা তখনও এক নাগাড়ে নির্দেশ দিয়ে চলেছে: হ্যাঁ, এখন দুহাতে মুখ ঢাকুন। চোখ বন্ধ - মুঠো খোলা। ব্যস্। রগের দুপাশ টিপে ধরুন। এখন আঙুলগুলো উপর থেকে নিচের দিকে নামবে। 'হেডেক' হলে যেমন ভাবে মাথা টেপা হয়। করছেন? এখন মনে মনে ধীরে ধীরে মন্ত্রোচ্চারণ করুন: হ্রীং ধিং হিম্ব-ডিম্ব-জিম্বো-গুরুবিং-চিত্তের।
 
জামাইবাবুর আর সহ্য হল না। ক্ষেপে উঠে বলেন, দুত্তেরি। যতসব বুজরুকি। বোঝা গেছে তোমার কেরামতি। নাও আলো জ্বাল এবার।
 
ভূতোদা অন্ধকারের মধ্যেই বলে, এ কি। আপনি কথা বললেন কেন?
 
-- বেশ করেছি, বলেছি। আর ভূত দেখার শখ নেই আমার। আলো জ্বালো বরং ভূতোকেই দেখি। তোমার এই ফোর- টোয়েন্টির কারবার বন্ধ কর। আমি কথা বলেছি এই ছুতো দেখিয়ে বরং বল, --তাই ভূত এল না।
 
ভূতোদা বলে, তা কেন? আপনি শর্ত ভেঙেছেন, তাই আপনি ভূত দেখতে পাবেন না। আর সবাই তো শর্ত ভাঙেনি। তারা না হয় দেখুক। লাইট অন।
 
আমি বিজলি বাতি জ্বেলে দিলুম।
 
ভূতোদা দর্শকদের দিকে ফিরে একটা ম্যাজিশিয়ানি 'বাও' করে বললে, আপনারা ভূত দেখতে পাচ্ছেন?
 
প্রথমটা কয়েক সেকেণ্ড সকলেই হতভম্ব। তারপর হঠাৎ একটা সোরগোল পড়ে গেল। হাসতে হাসতে এ-ওর গায়ে লুটিয়ে পড়ে। একবাক্যে সবাই বলে, হ্যাঁ।
 
ভূতোদা গম্ভীরভাবে বলে, মিলিয়ে দেখে নিন। ভূত কথা কইছে, হাসছে। সবাই ভীষণ হাসছে। আর সবচেয়ে বেশি হাসছে কালিচরণবাবুর ছোট মেয়ে সীমা।
 
আসলে হয়েছে কি, -- ছয়খানি প্লেটের একখানির উল্টো পিঠে ছিল শুকনো ভূষোকালি। প্রদীপের শিখার উপর ধরা কালো কালি। অন্ধকারের মধ্যে সেই প্লেটখানাই ভূতোদা কায়দা করে চালান করেছিল অমলেন্দুবাবুকে। জামাইবাবু অন্ধকারের মধ্যে প্লেটের উপর সযত্নে হাত বুলিয়েছেন ওসাকাচাটাম্বু মন্ত্রে, --অর্থাৎ দু-হাতের তালুতে মেখেছেন ভূষোকালি। তারপর হিম্ব-ডিম্ব-জিম্বো মন্ত্রে সেই নিজের হাতের কালি মেখেছেন কপালে মুখে-গালে। ঘিয়ে রঙের গরম পাঞ্জাবি, হীরের বোতাম, চুনট করা ধুতি আর ফর্সা পাউডার-মাখা মুখে ভূষোকালির প্রলেপ।
 
সে যে কী খোলতাই বাহার তা আর কী বলব।
 
সবাই ভীষণ হাসছে। অমলেন্দুবাবুর স্ত্রী-নববধূ, শাড়ি ঝলমল করতে করতে একরকম ছুটেই পালালো।
 
সীমা তার শাড়ির আঁচল চেপে ধরে বলে, দিদি, কোথায় পালাচ্ছ?
 
ভূতোদা বলে, শুভ কাজে বাধা দিও না সীমা। জামাইবাবু ভূতের নাচ দেখতে চেয়েছিলেন, তাই দিদি বোধহয় ঘুঙুর আনতে যাচ্ছেন।
 
অমলেন্দুবাবু শালীকে ধমক দেন, কী বোকার মত হ্যা হ্যা করে হাসছে শুধু শুধু? সত্যি দেখতে পেয়েছ তুমি?
 
সীমা হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে, বলে, দেখেছি কি বলছেন জামাইবাবু? এখনও দেখছি। স্রেফ কালিয়া পিরেৎ। সীমার আর এক বোন ততক্ষণে একটা হাত-আয়না নিয়ে এসেছে। সেটা জামাইবাবুর মুখের সামনে মেলে ধরে বলে, -- সবাই যখন আশ মিটিয়ে ভূত দেখল, তখন আপনিও একটু দেখুন।
 
আয়নায় ভূত দেখেই জামাইবাবুর চক্ষুস্থির। রাগে গ্যাঁড়াতলার জামাইবাবুর তোৎলামি শুরু হয়ে গেল। ভূতোদার দিকে ফিরে বলেন, তো – তো - তোমাকে আমি -, -- ভূতোদা ফরাসী কায়দায় নিচু হয়ে তাঁকে 'বাও' করলে একটা।
 
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এই গল্পটি শুনতে হলে নিচের লিংকে ক্লিক করুন: 
 


এই সিরিজের অন্য গল্পগুলি:

No comments:

Post a Comment