ভূতায়ন - অপারেশন - মাদার্যাহমপি (Bhutayan - Operation MadarjaHamapi)



লেখক: নারায়ণ সান্যাল

 

খেলাধূলা ছাড়া আরও একটা বিষয়ে অদ্ভুত পারদর্শিতা ছিল ভূতোদার। চমৎকার ম্যাজিকের খেলা দেখাতো সে। আমি ছিলুম ওর সাকরেদ। ছোটখাটো অনেক ম্যাজিক সে আমাকে শিখিয়েছিল। এখন তার অনেকগুলো ভুলে গেছি। তবু আজও যখন কোন ম্যাজিক শো'তে গিয়ে পুরানো খেলাগুলো দেখি, সব মনে পড়ে যায়। তা বলে কখনও কোন ম্যাজিশিয়ানের কায়দা সর্বসমক্ষে ধরে দিই না। ভূতোদা শিখিয়েছিল-ম্যাজিক-জগতে তা নিষেধ। ওর সাকরেদি করতে করতে যখন হাত-সাফাই বেশ কিছুটা অভ্যাস হয়েছে, তখনই একদিন ভূতোদা আমাকে ডেকে বলেছিল - ম্যাজিক-ওয়ার্ল্ডে কতকগুলো অলিখিত আইন আছে, বুঝলি নরেন! সেগুলো কখনো লঙ্ঘন করিস না।

আমি বলি, সেগুলি কি? তুমি গুরুদেব, আমাকে শিখিয়ে দাও।

এই 'গুরুদেব' ডাকটা ভূতোদার ভারি পছন্দ। অমনি খুশী হয়ে ওঠে। সাদা বাংলা ছেড়ে অমনি সংস্কৃত বুলি শুরু হয়ে যায়, বলে, হ্যাঁ, তোকে এখন একে একে সব কথা বলা দরকার। এখন তুই নিজেও একজন ছোটখাট মাদারী হয়ে উঠেছিস। যখন দেখবি কোন ম্যাজিশিয়ান খেলা দেখাচ্ছে, তখন ধ্যানী-বুদ্ধর মতো চুপচাপ বসে থাকবি। কোনো শব্দ করবি না। আর যদি দেখিস তোকেই বোকা বানাতে চায় তখন নিচু গলায় বলবি: মাদার্যাহমপি।

আমি অবাক হয়ে বলি, 'মাদার্যাহমপি'? মানে? -সন্ধি বিচ্ছেদ কর। মাদারী অহম্ যোগ অপি। অর্থাৎ কিনা আমিও একজন মাদারী। বুঝলি?

ঠিক এই কাণ্ডই একবার ঘটেছিল ভূতোদার জীবনে। আমার সামনেই। আমি ছিলুম উপস্থিত ওর অ্যাসিসটেন্টরূপে। ব্যাপারটা বলি-

 

আমাদের জেলার ম্যাজিস্ট্রেট, সেই যিনি ভূতোদাকে 'দুর্গেশ দুমরাজ' খেতাব দিয়েছিলেন-তিনি বদলি হয়ে যাচ্ছেন। অফিসার্স ক্লাব থেকে তাঁকে বিদায় ভোজে আপ্যায়ন করা হবে। ভূতোদাকে ওরা আমন্ত্রণ করল নৈশ ভোজের আসরে, আনন্দ পরিবেশন করতে। খরচ যা পড়বে তা ওরা দেবে, তাছাড়া রাত্রে শো'র পর ওখানেই ভালমন্দ খ্যাঁটের ব্যবস্থা। মুরগীর রোস্ট, চিংড়ির পোলাও, ভেটকির ফ্রাই আর আইসক্রীম। আমি তো সাকরেদ হিসেবে এক পায়ে খাড়া। ফুলপ্যান্ট একটাই ছিল। আর্জেন্ট কাচতে দিলাম। ধোপদুরস্ত না হলে কি অমন ভোজসভায় যাওয়া যায়!

সন্ধ্যাবেলায় আমরা দুটি বন্ধু সেজেগুজে হাজির হলাম অফিসার্স ক্লাবে। একটা কালো রঙের ঝোলা ঝোলা জোব্বার মতো বেঢপ পোশাক ছিল ভূতোদার। সেটাই চড়ালো গায়ে। পাখির পালক দেওয়া পাগড়ি ছিল একটা। পায়ে নাগরা। ঐ কন্দর্পকান্তি চেহারায় সে সব সাজপোশাকে যা খোলতাই বাহার হল তা আর কহতব্য নয়।

সে বছর ক্লাবের সেক্রেটারি ছিলেন এস. ডি. ও-নর্থ। তিনি সকলের কাছে ভূতোদার পরিচয় দেবার উদ্যোগ করতে মিসেস্ ডি. এম বলে ওঠেন, - উই অল নো হিম। ও ভালো খেলোয়াড়। আচ্ছা, তুমি ম্যাজিকও দেখাতে পারো?

ভূতোদা বলে, নট মাচ। থোড়া থোড়া।

শুরু হল খেলা। তাসের খেলা। এমন খোলা জায়গায় তাসের হাতসাফাই ছাড়া আর কি দেখানো সম্ভব? স্টেজ নেই, স্ক্রীন নেই, চারিদিক ঘিরে লোক বসেছে। তবু ওরই মধ্যে চমৎকার কতকগুলো খেলা সে দেখালো। মেমসাহেব খুব খুশী। ঘন ঘন হাততালি দিচ্ছেন তিনি।

শেষে ভূতোদা শুরু করল একটা নতুন খেলা। তাসগুলো মেমসাহেবের সামনে উপুড় করে মেলে ধরে বললে, যে কোন একখানা টেনে নিন। আমাকে দেখাবেন না, অন্য সকলকে দেখান।

মেমসাহেব বললেন, অন্য কউকে টানতে বল। আমি না।

ভূতোদা বলে - না না, আপনিই নিন।

মেমসাহেব ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেবের দিকে তাকিয়ে দেখলেন। দুজনের চোখে চোখে কি যেন কথা হল। শেষে মেমসাহেব নিচু গলায় বলে, আই নো এফ. সি.। সর্বনাশ। মেমসাহেব খেলাটা জানে। 'এফ. সি.' মানে হচ্ছে 'ফোর্সিং কার্ড'। খেলাটা আর কিছুই নয়, ম্যাজিশিয়ান কায়দা করে একখানা তাস দর্শকের হাতে গছিয়ে দেয়। যে তাস টানে সে বুঝতে পারে না, ভাবে বাণ্ডিল থেকে স্বেচ্ছায় যে কোন একখানাই বুঝি নিল সে। আসলে যেটা নেয় সেটা ম্যাজিশিয়ানের পরিচিত তাস-কায়দা করে গছিয়ে দেওয়া, আর কি।

ভূতোদা বলে, কই টানুন?

কী আপদ। ভূতোদা কি মেমসাহেবের ইঙ্গিত বুঝতে পারেনি। আমি তার পেটে অলক্ষ্যে এটা খোঁচা মেরে কানে কানে বলি, মেমসাহেব: বলছেন - মাদার্যাহমপি!

আমার এমন নিখুঁত সংস্কৃত মন্ত্রতেও কাজ হল না। ভূতোদা হয় কালা, নয় সংস্কৃত ভুলে গেছে। বললে, তাতে কি? আবার মেমসাহেবের সামনেই তাসের গোছা মেলে বলে, - কই, নিন?

মেমসাহেবেরও এতক্ষণে ধৈর্যচ্যুতি হয়। হাজার হোক ষাঁড়ের ভালনা খাওয়া রক্ত তো। বললে, - অলরাইট! তোমার তাস আমি বাঁ হাতে নেব না, রাইট হ্যান্ডে নেব। আন্ডারস্ট্যান্ড? দাও তাস!

বাঁ-হাতের দুটি আঙুলে একটি বিশেষ তাসকে চেপে ধরে মেমসাহের ডান হাতে টেনে নেয় একখানা। ভূতোদা একেবারে চুপসে যায়।বলে,- আচ্ছা, আর একবার।

আবার নতুন ভাবে তাসগুলো মেলে ধরে।

মেমসাহেব হেসে বলে, - একবার নয়, একশ বার। কিন্তু কায়দাটাও আমার জানা আছে। ওকে বলে ব্যাক-হ্যান্ড পুশ। আই নো দ্যাট – ওয়েল! বাঁ-হাতে প্যাকেটটির সবচেয়ে নিচের তাসখানা চেপে ধরে বলে, শ্যাল আই টেক দ্যাট। নেব এইবার?

ভূতোদার অবস্থা তখন ছেড়ে-দে-মা-কেঁদে-বাঁচি। পরপর চার পাঁচ বার চেষ্টা করে সে। চার-পাঁচ ধরনে। সাইড-থ্রাস্ট, লেফট-হ্যান্ড-ম্যানেজ, আন্ডার হ্যান্ড পুশিং।

কিন্তু নাঃ, কিছুতেই কাবু করা যায় না মেমসাহেবকে। ভদ্রমহিলা সব কয় রকম ফোর্সিং-এর সঙ্গেই পরিচিত।

শেষে তিনি বলেন, ফোর্সিং কার্ডের নয়রকম ভ্যারাইটি আছে ভূতনাথবাবু, আমি নয়টি কায়দাই জানি। সময় নষ্ট করে কি হবে, তুমি অন্য খেলা দেখাও।

সবাই হো-হো করে হেসে ওঠে। এর বড় অপমান ভূতোদা জীবনে হয়নি। একেবারে ফ্ল্যাট হয়ে যায় সে। মেমসাহেব যেন একটা গুগুলি বলে মিডল স্টাম্পটা উপড়ে নিয়েছে ওর।

তবু চালু ছেলে তো, তা সত্ত্বেও মুখে একটা সপ্রতিভ ভাব ফুটিয়ে বলে, আপনি সত্যিই যত্ন নিয়ে ম্যাজিক শিখেছেন দেখছি। কিন্তু এই মাত্র আপনি একটা ভুল কথা বললেন। ফোর্সিং কার্ড দশ রকমের হয়, নয় রকম নয়। ভুরু কুঞ্চিত হল মেমসাহেবের।

বলেন, অ্যাবসার্ড। আমি সবরকম ম্যাজিকের বই পড়ে দেখেছি। এটাই আমার হবি।

ভূতোদা একটা ঢোক গিলে বলে, হতে পারে। ইংরেজি বইতে নয় রকম ফোর্সিং কার্ডের কথা থাকাই স্বাভাবিক।কারণ, দশম নিয়মটা এক্কেবারে ভারতীয় কায়দা। আমাদের শাস্ত্রেই বলেছে। দশমস্তমসি!

মেমসাহেব বলেন, - তার মিনিং কি হল?

তম অর্থাৎ অন্ধকার, সী মানে সমুদ্র। অর্থাৎ শাস্ত্রকার বলেছেন, এই দশ নম্বরের কায়দাটা খুব গভীর।

মেমসাহেব সেসন-জজ দাশ সাহেবের দিতে ফিরে বলেন, আপনাদের শাস্ত্রে এই কথা আছে?

দাশ সাহেব পণ্ডিতমানুষ বলে পরিচিত। তিনি একটা গলা খাঁকারি দিয়ে বলেন, এই রকম কথা ভারতীয় দর্শনে আছে বটে, তবে তার এমন শাঙ্করভাষ্য আমার জানা ছিল না।

তাঁর মুখের কথা লুফে নিয়ে ভূতোদা বলে, - তবেই দেখুন, উনি পর্যন্ত এ ব্যাখ্যা জানেন না। এই দশম কায়দাটা একেবারে ভাগবত প্রক্রিয়া। জাদুকর হুডিনিও জানতেন না। গণপতি জানতেন, পি সি সোরকার জানেন, আর জানেন ---- এবার একটা ‘বাও’করে বাকিটুকু অনুক্ত রাখল সে।

ভাবখানা, আর জানেন এই শর্মা। সকলে মুখ টিপে হাসে। মেমসাহের গালে হাত দিয়ে ওর চালবাজি লক্ষ্য করছিলেন এতক্ষণ। এবার বলেন, - তুমি সেই দশম কায়দায় আমাকে ফোর্স করতে পারো?

রুমাল দিয়ে মুখটা মুছে নিয়ে ভূতোদা বলে, পারি। তবে আজ তো হবে না। এজন্য আমাকে দুদিন হঠযোগ করতে হবে।

আপনারা যে কালই চলে যাচ্ছেন, - না হলে পরশু সে ম্যাজিক আপনাকে দেখাতাম।

মেমসাহেব বলেন, - তুমি ভুল শুনেছ ভূতনাথবাবু। আমরা পরশুর পরের দিন যাব। তুমি পরশুই আমাকে সে খেলা দেখাও। হঠযোগ অর নো হঠযোগ, আমাকে যদি তুমি ফোর্স করতে পারো তাহলে আমি একশত টাকা বাজি হারব। কেমন রাজি?

ভূতোদার চোয়ালের নিচের অংশটা ঝুলে পড়ে।

কোনওক্রমে ঢোঁক গিলে বলে, রাজি তো হতেই পারি, তবে কি জানেন, আমার কেমন যেন বিবেকে বাধছে।

-কেন? তোমার বিবেকে বাধছে কেন?

-এ যেন ছেলেমানুষের হাত থেকে মোয়া কেড়ে খাওয়া! মনে করুন, আপনার সঙ্গে কেউ বাজি রাখতে চায় যে আগামীকাল সূর্য পশ্চিম দিকে উঠবে। সে বেটিং অ্যাকসেপ্ট করতে আপনার বিবেকে বাধবে না?

ভূতোদা যতই সপ্রতিভ ভাব দেখাক, মেমসাহেব কিন্তু ওর চালাকি ধরে ফেলেছেন।এবার তিনি সবাইকে সম্বোধন করে বলেন - পরশু সন্ধ্যায় আপনারা সকলে এখানে চা খেতে আসবেন। অতি অবশ্যই। আপনাদের নতুন ডি. এম.- ও কাল আসছেন। আপনারা হঠযোগী ফোর্সিং দেখে যাবেন। যে খেলা স্বয়ং হুডিনিও জানতেন না, আশা করি সে খেলা দেখতে আপনারা সকলেই খুব উৎসুক।

তারপর ভূতোদার দিকে ফিরে বলেন, ইজ্ দ্যাট্ ও কে?

ভূতোদা একটা ম্যাজিশিয়ানি 'বাও' করে বলে, - পারফেক্টলি মাদাম।

পাশের ঘরে টেবিল পেতে আমাদের দুজনকে নিরিবিলিতে খেতে দেওয়া হল। আড়ালে পেয়ে বলি, গুরুদেব! হঠযোগী ফোর্সিং আবার কী?

গুরুদেব কোন জবাব দেয় না। চোখ বুজে কড়মড় করে মুরগির ঠ্যাঙ চিবোতে থাকে। কিন্তু আমার খাওয়া তখন মাথায় উঠেছে। বলি, - ও গুরুদেব?

চোখ বুজেই ভূতোদা বলে, - আরে খেয়ে নে। চাল মারতে গিয়ে লেঙ্গি খেয়েছি।

- কী চাল মারতে গিয়েছিলে?

- আরে দূর। আমাকে কে যেন বলল, ওরা কাল সক্কাল বেলাতেই চলে যাবে। তাই --! কিন্তু তুমি যে বললে একশো টাকা ঠকিয়ে নিতে তোমার বিবেকে বাধছে।

- তা তো বলতেই হবে। না হলে মুখ রক্ষা হত কি?

- তা এখন কী করবে?

- কী আবার করব? মুর্গির রোস্ট দিয়ে পোলাও সাঁটব। কথায় বলে, 'প্রাপ্তিমাত্রেন সাঁটয়েৎ।'

কী দুর্জয় সাহস !! আমি বলি, সে তো এখন! তারপর? কাল বাদ পরশু?

এঁটো হাত দুটোই জোড় করে ভূতোদা বলে, - এখন একটু মৌজ করে খেতে দে বাবা। পরশুর কথা পরশু।

পরদিন ক্লাসে এসে বন্ধুদের সব কথা খুলে বলতে নেড়া আর ক্যাবলা তো হেসেই বাঁচে না। আচ্ছা জব্দ হয়েছে ভূতোদা।

গজেন বলে, পীরের কাছে মামদোবাজি। মেমসাহেব ভূতোদার নাকে এবার স্রেফ ঝামা ঘষে দেবে। আজ আসুক না ভূদ্দা ক্লাসে!

কিন্তু কোথায় ভূতোদা? স্কুলেই এল না সে।

তা বলে আমার তো একটা দায়িত্ব আছে! আমি হলুম গিয়ে তার সাকরেদ।

ছুটির পরে ছুটি তার বাড়ি পানে। কিন্তু বাড়িতেও ভূতোদা নেই! ওর বোন নেড়ি বললে, - দাদা কলকাতা গেছে।

গজেন বলে, - শেষ পর্যন্ত মেমসাহেব ভূদ্দাকে একেবারে দেশান্তরী করে ছাড়ল রে?

ক্যাবলা বলে, - অতঃ কিম্। এখন কী করা যায়?

নেড়া বলে, - আয় আমরা ক'জন ভূদ্দার মহাপ্রস্থানে দু-মিনিট সাইলেন্স অবসার্ভ করি।

কিন্তু না। পরদিন বিকালের লালগোলায় চেপে ঠিক ফিরে এসেছে সে। আমি বলি, - গুরুদেব। আর একটা দিন কোনক্রমে গা-ঢাকা দিয়ে কাটিয়ে দিলেই পারতে। আজ আবার মরতে এলে কেন? কলকাতা গিয়েছিলে কি জন্যে?

ভূতোদা গম্ভীর হয়ে বলে, কলকাতায় গেছিলাম ব্যাটের অর্ডার দিতে।

- ব্যাট। কী ব্যাট?

-ক্রিকেট ব্যাট। আগামী বুধবার গিয়ে ডেলিভারী নেব। ফার্স্টক্লাস একটা ব্যাট পছন্দ করে এসেছি। পঁচাত্তর টাকা দাম।
 

আমি ওর কথার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারছি না দেখে বলে, - আরে বুঝলি না, আজ রাত্রেই তো নগদ একশ টাকা পাচ্ছি।

আমি বলি, তার মানে? তুমি কি এখনও আশা করছ, ঐ মাদারীসম্রাজ্ঞী মেমসাহেবকে ফোর্সিং করতে পারবে?

উত্তরে ও বলে, - না হলে পঁচিশ টাকা অ্যাডভান্স করে আসি?

আমাদের উপস্থিত হতে কিছু দেরি হয়েছিল। তার আগেই সকলে জমায়েত হয়েছেন। আমরা আর আসব না এটাই বোধহয় এঁরা ধরে নিয়েছিলেন, কারণ আমরা ঘরে ঢুকতেই সমস্বরে সকলে বলে ওঠেন: - এই তো ওরা এসে গেছে।

লক্ষ্য করে দেখি দুটি নতুন মুখের আমদানি ঘটেছে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, এঁরা হচ্ছেন নতুন ডি. এম. আর তাঁর স্ত্রী। অল্প বয়স। বেশ স্ফূর্তিবাজ মনে হল।

ভূতোদা একটা 'বাও' করে বলে, প্রথমেই একটা নতুন খেলা দেখাচ্ছি --

বাধা দিয়ে মিসেস ডি. এম. বলেন, না, না, আজ আমাদের সময় কম। তুমি শুধু তোমার যৌগিক ফোর্সিং কার্ডের খেলাটাই দেখাও।

ভূতোদা সসম্ভ্রমে বলে, - বেশ স্যার। তাই হবে, কিন্তু এঁরা আমার কোনও খেলাই দেখেননি। অন্তত এঁদের অনারে একটা খেলা আমাকে দেখাতে দিন।

মেমসাহেব 'স্যার' সম্বোধনে বিচলিত হলেন না, - বললেন, বেশ দেখাও। কিন্তু ঐ একটা খেলাই।

ভূতোদা পকেট থেকে চকচকে একটা তাসের প্যাকেট বার করে মেমসাহেবের হাতে দিয়ে বললে, চারটে টেক্কা আমাকে বার করে দিন। মেমসাহেব তাসের প্যাকেট থেকে চারখানা টেক্কা বার করে ওর হাতে দিলেন।

ভূতোদা বাকি তাসগুলো প্যাকেটে বন্ধ করে পকেটে পুরল। তারপর সে চারখানা টেক্কা চারজনকে দিল। বললে, টেক্কাগুলো আপনারা সাবধানে রাখবেন, আমি চাইলেই ফেরত দেবেন।

চারজন অফিসার যে যার পকেটে তাসগুলো লুকিয়ে রাখলেন। মুন্সেফবাবু, সিভিল সার্জেন, আর দুজন ডেপুটি। ভূতোদা এবার আগের ডি. এম-এর দিকে ফিরে বললে, - স্যার, গচ্ছিত ধন কেউ যদি ফেরত না দিতে চায়, তাহলে আইনে তার শাস্তির ব্যবস্থা আছে নিশ্চয়ই?

ডি. এম. বলেন, - নিশ্চয় আছে। কিন্তু সে কথা কেন?

- তাহলে স্যার আমি এঁদের চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনছি। সর্বসমক্ষে এঁদের আমি চারখানা তাস রাখতে দিয়েছি, এঁরা আমাকে তা ফেরত দিচ্ছেন না।

সিভিল সার্জেন আঁতকে উঠে বলেন, - আরে-আরে তুমি তো সাঙ্ঘাতিক লোক হে, ফেরত দেব না কেন? চাইলেই দেব, এই নাও।

তাজ্জব কাণ্ড! সিভিল সার্জেন তাঁর কোটের পকেট হাতড়ালেন, মুন্সেফবাবু তাঁর পাঞ্জাবির পকেট তল্লাস করলেন, - কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা! টেক্কা চারখানা বেমালুম গায়েব। কারও পকেটে তাস নেই।

ডি. এম. হেসে বলেন, - সে সব জানি না মশাই, এ ছোকরা আপনাদের তাস রাখতে দিয়েছে, আমরা সবাই সাক্ষী। গচ্ছিত সম্পত্তি আত্মসাৎ করা কঠিন অপরাধ। তাস ফেরত দিতে না পারলে শাস্তি পেতে হবে। মুন্সেফবাবু বলেন, খুব জানি। আমার কোর্টে আজ তো এই রকমই একটা কেস চলল সারাদিন।

সিভিল সার্জেন হেসে বলেন, - কী গেরো। তা দিন শাস্তিই দিন। হারিয়ে যখন ফেলেছি তখন শাস্তিই ভোগ করি। বুড়ো বয়সে ঘানি ঘোরাই।

ভূতোদা মিটিমিটি হাসছে তখন।

ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, - আমি ডিস্ট্রিক্টের চার্জ বুঝিয়ে দিয়েছি। ফলে নূতন কালেকটারকেই অনুরোধ করছি তাস উদ্ধার করে এঁদের শাস্তির ব্যবস্থা করুন।

নবাগত ডি. এম বয়সে তরুণ। রসিক ব্যক্তি। খুব এক চোট হেসে নিয়ে বলেন, - নতুন জেলার চার্জ নিয়েই আমার চার চারজন সহকর্মীর শাস্তির ব্যবস্থা করতে আমার কেমন যেন সঙ্কোচ হচ্ছে। তাই আমি মামলা আমার স্ত্রীর আদালতে ট্রান্সফার করে দিলাম।

স্ত্রীর দিকে ফিরে বলেন, - যা শাস্তি দেবার তুমিই দাও। নতুন ম্যাজিস্ট্রেট-পত্নী এতক্ষণ মুখ টিপে হাসছিলেন বসে বসে। হঠাৎ এ অনুরোধে বিব্রত হয়ে পড়েন। গুছিয়ে নিয়ে কিছু একটা বলবার উপক্রম করতেই হাঁ হাঁ করে তেড়ে আসে ভূতোদা।

হাত দুটি জোড় করে সবিনয়ে বলে, - না স্যার, তা হবে না। ওঁর এজলাসে মামলা ট্রান্সফার করা চলবে না। বাদীর তাতে ঘোরতর আপত্তি।

নতুন ডি. এম. বিস্মিত হয়ে বলেন, - কেন? আপত্তি কিসের?

-স্যার, উনি দিব্যি ভাল মানুষটির মত বসে আছেন বটে, কিন্তু আমার কাছে খবর, - বামাল সমেত উনিই পাচার করেছেন। বিশ্বাস না করেন ওর ভ্যানিটি ব্যাগ তল্লাস করার হুকুম দিন।

কী কেলেঙ্কারি!! টেক্কা চারখানা সত্যিই পাওয়া গেল নবাগত মিসেস্ ডি. এম এর ভ্যানিটি ব্যাগের ভিতর থেকে।

ভদ্রমহিলা তো অপ্রস্তুতের একশেষ।

নতুন ডি. এম. আবার তার উপর রসিকতা করে বলেন, এ হে হে। সহকর্মীদের তঞ্চকতায় হতাশ হয়েছিলাম আমি, কিন্তু সহকর্মী দূরের কথা, স্বয়ং সহধর্মিণীই যে শেষ পর্যন্ত - -

হঠাৎ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে মাঝপথেই থেমে পড়েন উনি।

হো-হো করে হেসে ওঠে সবাই।

 

ভূতোদা এবার টেক্কা চারখানা টেবিলের উপর রেখে, আবার পকেট থেকে বাকি প্যাকেটটা বার করলে। বললে, - আর কোনও খেলা দেখতে চান?

মেমসাহেব ব্যস্ত হয়ে বলেন, - না, না, এবার তোমার সেই যৌগিক ফোর্সিং কার্ড।

প্যাকেটের তাসগুলো বার-কয়েক শাফল করে নিয়ে ভূতোদা বললে, - বেশ কথা। আমি আপনাকে চিড়িতনের গোলাম ফোর্স করব, আগেই বলে দিলাম।

ভূতোদা একটা লম্বা শ্বাস নিল। দম বন্ধ করে আধ-বোজা চোখে সে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল মেমসাহেবের দিকে। যন্ত্রচালিতের মত মেলে ধরলে উপুড় করা তাসগুলো। মেমসাহেব তো ছার, আমিই বুঝতে পারলুম কোন তাসখানা সে গুঁজে দিতে চাইছে। প্যাকেটের তলা দিয়ে সেই তাসখানা সরসর করে এগুচ্ছে আর পিছুচ্ছে। এগুচ্ছে আর পিছুচ্ছে।

মেমসাহেব হাসল। সেই চিহ্নিত তাসখানা এড়িয়ে অন্য একটা তাস সন্তর্পণে টেনে নিলেন তিনি।

আমি ভাবলুম, যাঃ, ভূতোদা বোল্ড হয়ে গেল। কিন্তু চিৎ করতেই দেখা গেল সেটা আর কিছু নয়, চিড়িতনের গোলাম।

মেমসাহেব অবাক বিস্ময়ে শুধু বললে, স্ট্রেঞ্জ!

হুস্ করে শ্বাস ছেড়ে এতক্ষণে হঠযোগী ভূতোদা চোখ মেলে তাকায়। সকলের উপর দৃষ্টি বুলিয়ে বললে, - কি হল? চিড়িতনের গোলামই তো বটে?

কেউ আর কথা বলে না। মেমসাহেবই শেষ পর্যন্ত বলেন, - আমি বাজি হেরেছি।

ভ্যানিটি-ব্যাগ খুলে একশ টাকার একখানা করকরে নোট বার করে সেটা তিনি টেবিলের উপর রাখলেন। ভূতোদা সেটা কপালে ছুঁইয়ে সযত্নে বুক পকেটে তুলে রাখল। মেমসাহেব বোধ করি নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। বলেন, খেলাটি তুমি আর একবার দেখাবে?

ভূতোদা বলে - আজ্ঞে হ্যাঁ। টানেন।

দীর্ঘশ্বাস টেনে আধবোজা নেত্রে ধ্যানস্থ ভূতোদা আবার মেলে ধরে তাসের গোছা। মেমসাহেব অনেক বুদ্ধি বিবেচনা করে অনেক বেছে বেছে করে একটা তাস টেনে নেয়।

ক্যা তাজ্জব কী বাৎ! এবারেও সেই চিড়িতনের গোলাম। মেমসাহেব বলেন, ইটস্ রিয়ালি ওয়ান্ডারফুল। এ পদ্ধতিটি হুডিনিও জানিতেন না?

ভূতোদা বললে, - ক্যামন করে জানবেন বলুন, স্যার? এটা যে পিওর ভারতীয় যৌগিক পদ্ধতি।

মেমসাহেব বললেন, - এই দশম পদ্ধতিটি তুমি আমাকে শিখিয়ে দেবে? আমি তোমাকে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেবো।

ভূতোদা বলে, - আর পারিশ্রমিক লাগবে না। আপনি তো এইমাত্র নগদ একশ টাকা দিলেন।

- আমাকে কি প্রাণায়াম অভ্যাস করতে হইবে?

-আজ্ঞে না। এই দেখুন, - খেলাটা জলবৎ তরলং।

তাসের গোছা সে টেবিলের উপর চিৎ করে বিছিয়ে দেয়। হরি বোল! মেমসাহেব তো ছাড়, দেখে আমার মতো মাদারীরও চক্ষুস্থির। প্যাকেটের বাহান্নখানা তাসই চিড়িতনের গোলাম।

ভূতোদা বলে, - খেলাটা কিছু ব্যয়সাধ্য। পাইকারি হারে তিপ্পান্ন প্যাকেট একই রকম তাস কিনতে হবে। যে প্যাকেট থেকে আপনাদের চার টেক্কার খেলা দেখালাম সেটা এ প্যাকেট নয়।

পকেট থেকে এক প্যাকেট তাস বার করে বলে, সেটা এইটা। এটুকুই হাত সাফাই। বাকিটা আগেই বলেছি-জলবৎ তরলং।

মেমসাহেব মুখে রুমাল চাপা দিয়ে বলেন, ও। ইউ নটি বয় !!

 

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এই গল্পটি শুনতে হলে নিচের লিংকে ক্লিক করুন:  👇👇

অপারেশন: মাদার্যাহমপি। নারায়ণ সান্যাল। মজার গল্প। গল্প পাঠে : অনুব্রতা Narayan Sanyal. Comedy Story

 

এই সিরিজের অন্য গল্পগুলি:

 


No comments:

Post a Comment