অপারেশন অরিন্দম (প্রথমাংশ)

লেখক: বাণী বসু

এক

অক্টোবরের প্রথম শনি-রবিবার ওরা কাটিয়েছিল জিতের লোকাল গার্জেন মুকতার আলিসাহেবের বাড়ি, অর্থাৎ হোটেলে। ‘ওরা’ মানে সুনৃত বোস, পৃথ্বীশ রঙ্গচারী এবং অবশ্যই জিত রায়চৌধুরী। আলিসাহেবের একমাত্র মেয়ে শাহিনদি এসেছে। শাহিন-জামাইবাবুও খুব দিলদরিয়া লোক। সবাই মিলে লাল টিব্বায় দারুণ মজাদার পিকনিক করেছে শনিবার। বাস্কেটে দারুণ দারুণ জিভে-জল-আসা খাবার দিয়ে দিয়েছিলেন আলি-কাকিমা৷ খেতে খেতে দূর আকাশের বুকে সারি-সারি পাখি দেখা গেল। রঙ্গচারী তো মলয়ালাম না কন্নড় ভাষায় একখানা দু-পাতার কবিতাই লিখে ফেলল। রবিবার কেম্পটিতে স্নান করতে গিয়েছিল ওরা। এ-বছরের মতো শেষবার। কেম্পটিই এ চত্বরে একমাত্র প্রপাত যার জলে উলটে-পালটে মনের সুখে স্নান করা যায়। ক’দিন পরেই পুজোর ভিড় শুরু হয়ে যাবে। তখন স্থানীয় লোকেদের দমবন্ধ হয়ে আসবে এ-সব জায়গায়। মোটামুটি নির্জন থাকতে-থাকতেই তাই ওরা এবারের মতো মুসৌরি উপভোগ করে নিচ্ছিল। কারণ পুজোর পর মাস দেড়েকের মধ্যেই পরীক্ষা, তারপরেই শীতের ছুটি।

সোমবার অ্যাসেমব্লির সময় ফাদার ঘোষণা করলেন, সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত, অদ্ভুত সংবাদটা। ওরা কেউ বিন্দুমাত্র টের পায়নি। সুনৃত, পৃথ্বীশ, জিত কেউ না। অথচ, অরিন্দমের ঘর ওদের ঘর থেকে কতটুকুই বা! সরু দালানের এপার-ওপার। নাইন্থ ফর্মে উঠবার পর থেকেই ওদের এক-একটা আলাদা ঘর দেওয়া হয়েছে। ঘর নয় ঠিক কিউবিকল। ওরা বলে কিউব। একটা বড় হলকে কাঠের পার্টিশন দিয়ে ভাগ-ভাগ করা। প্রতিটি কিউবে একটা করে জানলা, তাকালেই দেখা যায় নীল পাহাড়, আর কালচে দেওদার আকাশের বুকে হেলান দিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। প্রথম যখন পাঁচ-ছ বছরের পুঁচকে পুঁচকে বীজকলাই ছিল তখন শুত বাঙ্কে। একজনের ওপর একজন। তারপর হল ডর্ম। সেই ডর্ম চলেছে একাদিক্রমে ছ’বছর। এখন প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ঘর। বৌদ্ধ শ্রমণদের খুপরি-খুপরি সেলের মতো। খালি পাথরের তোশক- বালিশের জায়গায় রিল্যাকসন। নইলে পৃথ্বীশদের বাবা-মা’রা রাগ করবেন। তাঁরা অতটা কৃচ্ছসাধনে বিশ্বাস করেন না। ফাদার চান এইবার ছেলেরা আড্ডা কমাক। পড়াশোনায় মন বসাক। একা-একা থাকতে এবং ভাবতে শিখুক। নাইনে ওঠার পর প্রথম প্রার্থনা-সভার শেষে, তাদের আলাদা করে নিয়ে ফাদার বলেছিলেন সে-কথা। - বয়েজ, এতদিন সমবয়সী, বড় এবং ছোটদের সঙ্গে মিলে-মিশে কীভাবে থাকতে হয় শিখেছ, টিম-স্পিরিট যাকে বলে,আশা করি তোমরা তা আয়ত্ত করতে পেরে গেছ। কিন্তু শুধু নিজেকে নিয়ে থাকবার শিক্ষাও একটা মস্ত জরুরি শিক্ষা। আশা করি, একাকিত্বকে কীভাবে কাজে লাগাতে হয় তোমরা তা এবার শিখে নেবে।

রুটিনমাফিক প্রেয়ার হল। সোমবারের জন্য নির্দিষ্ট হিম্‌ ‘প্রেইজ দাই লর্ড ইন হাই হেভ্‌ন, প্রেইজ হিম্‌ প্রেইজ হিম...’ হঠাৎই যেন খুব অস্বস্তিকর ভাবে থেমে গেল সব। খুব গম্ভীরভাবে, প্রায় শোকসংবাদ ঘোষণা করার ভঙ্গিতে ফাদার জোনাথন বললেন, - কাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না অরিন্দম চোপরাকে। আসলে রাত থেকে না দুপুর থেকে, তা-ও তাঁর সঠিক.জানা নেই। লাঞ্চের সময় সে রিপোর্ট করেছিল, কিন্তু তারপর থেকে তার গতিবিধির খবর কেউ জানে না। এ-স্কুলের ইতিহাসে এরকম ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি। নাইনথ্‌ ফর্ম থেকেই এখানে ছেলেদের খানিকটা স্বাধীনতা দেওয়া হয়। ঘুরে ফিরে বেড়াবার, ইচ্ছেমতো রাতের খাবার একা-একা খেয়ে নেবার স্বাধীনতা। পরীক্ষার পড়া করতে করতে রাত হয়ে যায়। সাড়ে-সাতটায় খেয়ে আটটা সাড়ে-আটটায় ঘুমিয়ে পড়া সম্ভব নয়। বিকেলের খেলাধুলোতেও তাদের এখন থেকে অতটা বাধ্যবাধকতা থাকে না।

গত সাতাশ বছরের ইতিহাসে ছেলেদের এইভাবে স্বাধীনতা দিয়ে ফাদার জোনাথন ঠকেননি কোনওদিন। সোমবার সকালে রোল-কলের সময় অরিন্দমের অনুপস্থিতি ধরা পড়ে। ওর কিউবে গিয়ে দেখা যায়, বিছানা নিভাঁজ। অতঃপর ওর নিজের ফর্মের ছেলেদের কাছে খোঁজাখুঁজি। কেউ কিচ্ছু জানে না। অস্বাভাবিক নয়। নিজের ফর্মের ছেলেদের সঙ্গে অরিন্দম কমই মিশত। ওদের মতে অরিন্দম হামবাগ, কিছুটা খ্যাপাও। আর অরিন্দমের মতে ওরা ছেলেমানুষ।

লাঞ্চ-ব্রেকের সময় ফাদারের ঘরে তিন মূর্তির ডাক পড়ল। এটা ওরা অনেক আগে থেকেই আশঙ্কা করেছিল। চোপরা ওদের থেকে এক ক্লাস উঁচুতে পড়লেও ওদের সঙ্গেই তার ঘনিষ্ঠতা সবচেয়ে বেশি, বরাবর। একমাত্র ওরাই জানে চোপরা খ্যাপা তো নয়ই, উন্নাসিকও না। আসলে ছেলেটা ভাবুক, নিলস বোরের মতো, আইনস্টাইনের মতো ভাবুক। ওই বয়সের ছেলেদের তুলনায় ও অনেক বেশি পরিণত। ওর ভাবনা-চিন্তা, আগ্রহের বিষয়বস্তুগুলো সম্পূর্ণ অন্য জাতের। তাই চোপরা অনেকদিন ধরেই ওদের অবিসংবাদিত নেতা, যদিও ওরা কেউ হিরো-ওয়ারশিপে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করে না।

ফাদার এমনিতে খুব শান্ত, সমাহিত। চট করে রাগেন না। মুষড়ে পড়েন না। কিন্তু আজ ওরা ঘরে ঢুকেই লক্ষ্য করল, তাঁর ফরসা, লালচে মুখে যেন কালির ছোপ পড়েছে। কপালে অনেকগুলো ভাঁজ। ধবধবে সাদা। ওদের বসতে বলে ওদের এবং নিজের লাঞ্চ তাঁর ঘরেই আনাবার নির্দেশ দিলেন তিনি হোস্টেলের কুক ভাণ্ডারীকে।

- রাঙ্গাচারী, রয়চাউড্রি, বোসো, প্রত্যেকের দিকে আলাদা করে তাকিয়ে বললেন, - তোমরা এ-বিষয়ে কে কী জানো কিছু গোপন না করে আমাকে বলবে। তোমাদের কোনও শাস্তির আশঙ্কা নেই। আশা করি বয়েজ, আমার অবস্থাটা তোমরা বুঝতে পারছ। পুলিশকে জানানো হয়েছে, তারা যথাসাধ্য করছে, কিন্তু মিঃ চোপড়াকে আমি কী কৈফিয়ত দেব?

ওরা মাথা নিচু করল। সারা ভারতের শিল্পপতি, ফরেন সার্ভিসের ডিপ্লোম্যাট, বড়-বড় সরকারি চাকুরে, কাজের খাতিরে যাঁদের যখন-তখন পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত ছুটে বেড়াতে হয়, তাঁদের ছেলেরাই পড়ে গ্রিন হিল কনজারভেটরিতে। ভ্রাম্যমাণ বাবা-মায়েদের সম্পূর্ণ চিন্তামুক্ত রাখাই স্কুলের মুখ্য উদ্দেশ্য। কীভাবে আজ থেকে সাতাশ বছর আগে স্কটিশ প্রেজবিটারিয়ান চার্চের সদস্য ফাদার জোনাথন, উত্তর প্রদেশের বিজনেস ম্যাগনেট হরকিষন চোপরার সাহায্যে একটা সামান্য পাশ্চাত্য সঙ্গীত শিক্ষার স্কুলকে একটা বিরাট প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিলেন, হরকিষন চোপরাজি এ-স্কুলের জন্য কত লক্ষ টাকার ডোনেশন জোগাড় করেছিলেন, নিজেও কত লক্ষ টাকা ব্যক্তিগতভাবে খয়রাতি করেছিলেন, সে সবকথা ফাদার জোনাথনের মুখে ওরা বেশ কয়েকবারই শুনেছে। দুঃখের বিষয়, এই চোপরাজির একমাত্র ছেলে, অর্থাৎ অরিন্দমের বাবা এবং মা প্লেন অ্যাকসিডেন্টে মারা যান। তখন থেকেই অরিন্দম ফাদার জোনাথনের কাছেই একরকম মানুষ। বিজনেস দেখেন অরিন্দমের জ্ঞাতিকাকা জগজিৎ চোপরা। ঠাকুর্দা কয়েক বছর আগে মারা যাওয়ার পরে অরিন্দমের অভিভাবক এখন কাকা এবং এই ফাদার জোনাথন। কাজই ফাদারের দুশ্চিন্তা হবে বইকি। কিন্তু সত্যিই অরিন্দমের এই অন্তর্ধানের মাথামুণ্ডু ওরা কিছুই জানে না।

জিত সাহস করে বলল, - ইদানীং ওর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ কমে আসছিল ফাদার। ও আজকাল একলা থাকতে ভালবাসত। আমরা ভাবতাম, সিলেকশন এসে গেছে, তাই।

ফাদার বললেন, - শেষ ওকে কে কী ভাবে দেখেছিলে?

অনেক চিন্তা করে পৃথ্বীশ বলল, - শুক্রবার রাতে আমাদের ল্যাব থেকে ওকে বেরিয়ে যেতে দেখেছি। এত অন্যমনস্ক ছিল যে, আমার সঙ্গে কোনও কথাই বলেনি।

- রাত তখন কটা?

সাতটা হবে হয়ত। এগজ্যাক্ট টাইম বলতে পারছি না।

সুনৃত বলল, - ইয়েস, মনে পড়েছে। আমরা হোস্টেলে ফিরছিলুম। আমি আর জিত। ও ‘হুইস্পারিং উইন্ডো’র সামনে রাইট অ্যাক্রস দা রোড বসে বসে একটা বাজনার তালে তাল দিচ্ছিল। রেস্তোরাঁটা থেকেই ভেসে আসছিল বাজনাটা৷ এটাও শুক্রবার রাতেই।

- তারপর আমরা শনিবার ভোরবেলা আলিকাকার ওখানে চলে গেলাম। আপনি তো জানেন ফাদার।

আরও কিছুক্ষণ জেরা করে বিমর্ষমুখে ওদের ছেড়ে দিলেন ফাদার। ডিটেকটিভগিরি করতে হবে এ-কথা তো কোনওদিন ভাবেননি, শুধু স্কুল চালাতেই শিখেছেন তিনি। বললেন, -খোঁজাখুজির ব্যাপারে তোমরা যদি কোনওভাবে সাহায্য করতে পারো, দি স্কুল অথরিটি উইল বি গ্রেটফুল টু ইউ। তোমাদের চলাফেরার পূর্ণ স্বাধীনতা আমি দিচ্ছি। আশা করি, মিস্ইউজ করবে না। নিজেরা অসাবধান হবে না কোনওমতেই।

তিনজনকে তিনটে লিখিত পার্মিশন উনি খসখস করে লিখে দিলেন সঙ্গে-সঙ্গে।



দুই

- আচ্ছা ঝামেলা পাকালে তো চোপরাটা! সুনৃত বলল।

জিতের ঘরে জড়ো হয়েছে সকলে।

- এরকম একটা কিছু যে হতে যাচ্ছে, আমি কিন্তু তা আগেই আঁচ করেছিলাম, পৃথ্বীশ বলল।

- তুই তো সব সময়েই আগে থেকে সব কিছু আঁচ করতে পারিস।

- উঁহু, ঠাট্টা নয়। ইদানীং ও প্রায়ই বলত, - আয়্যাম গোয়িং টু বাঙ্ক। পরীক্ষাগুলো তরে গেলেই চোপরা অ্যান্ড চোপরার ডিরেকটরগিরি কপালে নাচছে আমার। ডিসগাস্টিং! তো, আমি বলতাম, - সে কী রে! প্রিন্সের গদি তৈয়ার, আর এমন বোকা প্রিন্স যে বসতেই চাইছে না। বিজনেসও কিন্তু খুব ইন্টারেস্টিং জিনিস! ও বলত, - তুই বোস্‌ গে না যা। ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। বনবাদাড় ঢুঁড়ে জ্যান্ত বাঁদর আর গোরস্থান খুঁড়ে মরা হাড় চালান দিবি, সেই সঙ্গে কুনো ব্যাঙের ঠ্যাং আর আরশোলার মগজ।

জিত বলল, - রাইট। এইখানেই ওর আসল আপত্তি। ও সায়েন্টিস্ট হতে চায়। পুরোপুরি গবেষণায় নিয়োগ করতে চায় ওর সমস্ত টাকা। এদিকে ওর চাচা সেই বিদ্ঘুটে এক্সপোর্টের লোভ ছাড়বেন না। বাংলার গ্রাম থেকে সঙ-বার্ড ধরে ধরেও নাকি চালান দেন। লক্ষ-লক্ষ মার্কিন ডলার কামান।

- তা নিজে যা খুশি করুন না। অরিটাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে টানাটানি করেন কেন? সুনৃত বলল।

- জানিস না? অরির আঠারো বছর বয়স হলেই ওর প্রাইভেট লিমিটেড কম্পানি নিয়ে ও যা-খুশি করতে পারে। কারও গার্জেনি তখন খাটবে না। ঠাকুর্দা’র উইলের শর্ত এমনি কড়া যে, জগজিৎ চোপরার আর দাঁত ফোটাবার সাধ্য থাকবে না। কিন্তু ভদ্রলোক অরিকে ভালও তো বাসেন খুব। যখনই আসেন খুব শান্তভাবে বোঝাবার চেষ্টা করেন। অরি যা চায় দিতে কার্পণ্য করেন না। নিজের ছেলে নেই তো!

পৃথ্বীশ বলল, - অরির যে ধরনের ব্রেন, সেটাকে বিজ্ঞানের কাজে না লাগিয়ে ফরেন এক্সচেঞ্জ কামানোর কাজে জুতে দেবার চেষ্টা করাটা কী ধরনের ভালবাসা আমি বুঝি না ভাই। গত সেশনে পলিউশন সম্পর্কে বলতে গিয়ে ও কীভাবে ন্যাচারাল সায়েন্স থেকে সাইকোলজিতে চলে গেল, খেয়াল করেছিলি?

জিত বলল, - অবশ্যই করেছিলুম। আই. এস. সি-র গিধ্ধড়গুলো ওকে হাততালি দিয়ে বসিয়ে দেবার চেষ্টা করলে মিঃ রডরিগস্ উলটো-পালটা বকে ওকে বাঁচালেন বটে, আমার কিন্তু ধারণা, শেষ করতে দিলে ওর স্পিচটা দুর্দান্ত হত। সামথিং লুমিনাসলি অরিজিন্যাল। আরেকটা জিনিস জানবি, এমন কোনও বিজ্ঞানী নেই যাঁর যুগান্তকারী আবিষ্কার নিয়ে তাঁর নিজের প্রোফেশনের লোকেরা পর্যন্ত হাসাহাসি করতে ছাড়েনি। পাস্তুর-পাউসেটের কথা মনে কর। চিন্তা কর; ইরেন কুরি-জোলিও কুরি যখন তাঁদের একটা পেপারে নিউক্লিয়ার ফিশনের কথা বলেছিলেন, অটো হানের মতো বিজ্ঞানী পর্যন্ত সেটাকে আমল দেননি।

রঙ্গচারী বলল, - যদ্দুর মনে আছে, ও বলছিল, জৈব-অজৈব যৌগের ব্যালান্স নষ্ট হয়ে যাওয়া আবহাওয়া-দূষণ নিয়ে আমরা এত চিন্তিত। কিন্তু মানুষের ইভল থটস্ আরও সূক্ষ্ম উপায়ে এবং আরও ভয়াবহভাবে পৃথিবীর আবহ দূষিত করে চলেছে। এর ফলে জন্মাবে অপূর্ণ শিশু, যে-কোনও মানুষ যে-কোনও মুহূর্তে জঘন্য ক্রাইম করে বসবে, খাদ্যের ফুড-ভ্যালু কমে যাবে।

সুনৃত বলল, - বুঝলাম। কিন্তু প্রমাণ কই?

জিত বলল, - প্রমাণের কথাতে ও আসছিল ভাই। বলছিল, এ জিনিস প্রমাণ করে দেখাতে গেলে অন্তত এক বছর সময় চাই, ওর স্যাম্পলগুলো দীর্ঘদিন ধরে ওয়াচ করতে হবে। অন্যান্য ফ্যাক্টর এলিমিনেট করতে হবে। ব্যয়সাধ্য এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাছাড়াও জিনিসটা হয়তো জাস্ট একটা হাঞ্চ, এখনও আইডিয়ার স্তরে আছে।

তিনজনেই খুব চিন্তিত হয়ে অনেকক্ষণ বসে রইল। মুসৌরির উত্তুঙ্গ আকাশে সূর্য তখনও অস্ত যায়নি। আকাশের নীল আর পাহাড়ের গাঢ় সবুজ শেষবেলার গোলাপি আলোর সঙ্গে মিশে কেমন একটা গভীর বেগুনি রঙ ধরছে। জিত হঠাৎ বলল, - জানিস, অরি একবার আমায় বলেছিল, যে-কোনও মানুষ ভর্তি জায়গাতে গেলেই ও নাকি কতকগুলো ভাইব্রেশন টের পায়। ভাল-মন্দ নানারকম। সবাই বলবে গাঁজাখুরি। আমি কিন্তু বলতে পারি না। আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে। গত বছর সামারে অরির কাকা এসে আমার কিউবে বসে ছিলেন অনেকক্ষণ। আমি জানতামও না। রাত্তিরে কিছুতেই ঘুমোতে পারি না, কী প্রচণ্ড অস্বস্তি। যেন চারদিক থেকে কিছু আমাকে ধাক্কা মারছে। পরদিন ভাণ্ডারীর কাছে শুনলুম, অরি ছিল না, আমার কিউবটা খোলা ছিল বলে ওখানেই নাকি ওরা বসিয়েছিল চাচাজিকে। এটাকে কী বলবি, বল্‌?



তিন

ম্যালের সমান্তরাল গ্র্যানাইটের তৈরি এই কালচে পাথুরে খাঁজটার নাম ক্যামেল্স ব্যাক। শোনা যায়, হিমালয় নাকি বহু লক্ষ বছর আগে টেথিস নামে বিশাল এক সাগরে নিমজ্জিত ছিল। ক্রমাগত পার্শ্বচাপের ফলে সমুদ্রগর্ভে সঞ্চিত পাললিক শিলাস্তর ভাঁজ খেয়ে খেয়ে ওপরে উঠে আসতে থাকে। এইসব অযুত, লক্ষ, নিযুত, কোটি, কোটি, কোটি, ভাঁজের মধ্যে ছোট্ট একটা ভাঁজ ক্যামেল্স ব্যাক। ঠিক যেন মরুঝড়ের আশঙ্কায় হাঁটু মুড়ে বালিতে মুখ গুঁজেছে একটা অতিকায় উট। কুঁজসুদ্ধ পিঠটা খালি জেগে। খুব ভোরে একটা মস্ত কালো ঘোড়ার সওয়ার এক ব্যক্তি এই ক্যামেল্স ব্যাক থেকে বাইনোকুলার ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে চতুর্দিক দেখছিল। সওয়ারের নাম তিস্তা মুখার্জি। নাম শুনলে-অনেকেই চোখ কপালে তুলবে। হ্যাঁ, সেই তিস্তা মুখার্জিই। রাইফেল শ্যুটিং, ফ্লাইং, সাঁতার, এই তিনটি বিষয়ে দক্ষতা দেখাবার জন্যে যে এই আঠারো বছর বয়সেই ভারতবিখ্যাত।

তিস্তার কালো ঘোড়া দুলকি চালে চলতে লাগল। দুই বন্ধুর সঙ্গে মাত্র গত পরশু তিস্তা ছুটি কাটাতে এসেছে মুসৌরি। উঠেছে লাইব্রেরি বাজারের কাছে একটি ভারী ছিমছাম হোটেলে। হোটেল মালিক মুকতার আলি গুজরাটি মুসলমান। ছুটিতে তাঁর মেয়ে শাহিন, জামাই আনোয়ার এবং পুঁচকে নাতি মুফদ্দর ওরফে মুফিও এসেছে। ভারী আদর-যত্ন করেন এরা সবাই, ঠিক বাড়ির মতো। ক’দিনেই শাহিন, আনোয়ার আর বেগম আলির সঙ্গে ওদের দারুণ জমে গেছে। গতকাল, অর্থাৎ সোমবার বিকেল থেকে এই মুড়কির মতো একফোঁটা মুফিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সবারই প্রথমে মনে হয়েছিল চঞ্চল বাচ্চা, টলতে টলতে হয়তো বাইরে চলে গেছে।

ওয়েসাইড হোটেলের দোতলার বারান্দা আর রাস্তা একই লেভেলে। এখানে সর্বত্রই এরকম। রাস্তায় বেরিয়ে ও হয়তো গড়ানো পথে সামলাতে পারেনি নিজেকে, খাদে-টাদে পড়ে যেতে পারে। দু’বছরের তো বাচ্চা। হোটেলের কাছাকাছি খাদগুলো আঁতিপাঁতি খুঁজেছে তিস্তা। এখন ওরা তিন বন্ধু তিন দিকে খোঁজাখুজি করছে। স্প্রিং রোড ধরে মিউনিসিপ্যাল গার্ডেনের দিকে চলে গেছে দুর্বাদি, ল্যান্ডর বাজারের দিকে গেছে র‍্যাচেল। মাঝামাঝি জায়গাটার ভার নিয়েছে ও। খাদের তলাগুলো রোদ উঠলে ভাল করে দেখতে হবে। যদি গড়াতে গড়াতে গিয়ে ঝোপেঝাড়ে আটকে গিয়ে থাকে, কাটা-ছেঁড়া ছাড়া মারাত্মক ক্ষতি হয়তো কিছু হবে না। কারণ, এইসব খাদ খুব ধীরে ধীরে ঢালু হয়েছে।

সবুজ ঘাসের জাজিমে আপাদমস্তক ছাওয়া, থেকে থেকেই গাছপালা, ঝোপঝাড়। অত্যন্ত পরিষ্কার। সর্বদাই দেখা যাবে স্থানীয় পাহাড়িরা পিঠে লম্বা ঝুড়ি বেঁধে কাঠিকুটি পাতাটাতা কুড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তার ওপর তুলতুলে বেড়ালছানার মতো এত্তটুকুনি তো শরীর!

বিভিন্ন জায়গা থেকে দেখে-দেখে ওরা নিশ্চিন্ত হতে চাইছে, ছেলেটা কোথাও আটকে নেই। র‍্যাচেলের অবশ্য গোড়া থেকেই ধারণা, এটা ছেলেধরার কাজ। মুকতার আলিসাহেব কিন্তু বারেবারেই বলছেন, গাড়োয়ালিরা অত্যন্ত সরল এবং সৎ। একটা বাচ্চাকে এভাবে ধরে কার কী লাভ? মুফির মা বেচারি শাহিন কেঁদে-কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। আনোয়ারভাই যাকে বলে বড়লোকের নাদুস ছেলে, সে ভ্যাবলা মেরে রয়েছে। মুসৌরি-পুলিশের ওপর ওদের তিন বন্ধুর কোনও আস্থা নেই। দূর্বাদিই বলেছে, - দেখেছিস কীরকম বোকা-বোকা চেহারা। সুতরাং কাউকে কিছু না বলে ওরা নিজেদের কাজ আরম্ভ করে দিয়েছে। ও দূর্বাদি আর র‍্যাচেল। র‍্যাচেল বলছে র‍্যানসমের চিঠি এল বলে।

অনেক খুঁজে-খুজে হয়রান হয়ে অবশেষে তিস্তা ওয়েসাইড হোটেলের পথ ধরল। ওর ব্রোঞ্জ রঙের কপালে ভাঁজ। বাদামি চোখের মণিতে দুশ্চিন্তা, রাগ। কোন্‌ প্রাণে কোন্‌ দুশমন ওইটুকু বাচ্চাকে ধরে? মুফির হারিয়ে যাওয়ার জন্য ওরা নিজেরাও কিছুটা দায়ী। শাহিন প্রায় সমবয়সী কিছু মেয়ে পেয়ে খুব আড্ডায় জমে গিয়েছিল। ওর শ্বশুরবাড়ি খুব রক্ষণশীল তো! ও এদিকে কলকাতায় প্র্যাটে পড়েছে, র‍্যাচেলেরও স্কুল ওটা। তিস্তারা সেদিন ওর কাছ থেকে একটা স্পেশাল মাংস রান্না শিখছিল। হাড়-হাড় দেখে মাংস দিয়ে কাঠকয়লার আঁচে করতে হবে। নো পেঁয়াজ। শুধু রসুন। দারুণ হয় নাকি খেতে। বদলে দূর্বাদিও ওদের পূর্ববঙ্গের মোচার পাতুরি, নারকোল-চিঁড়ে ইত্যাদি হাঁকছিল। মাঝখান থেকে মা দিদিমার অমনোযোগে ঘটে গেল ব্যাপারটা।

ম্যাল রোড যেখানে গান্ধী চৌকের সঙ্গে মিশেছে, সেখানে একটা বিশ্রাম করবার গোলঘর আছে। তিস্তা দেখল দুটো বাদামি ঘোড়া নিয়ে বসে আছে ওদের ঘোড়াওয়ালা দত্তরাম। অর্থ দূর্বাদি আর র‍্যাচেলও ফিরে এসেছে। কী হল, কে জানে!

হোটেলের মুখের কাছেই দূর্বাদির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তিস্তা বলল, - কিছু পেলে?

- নাঃ! কিন্তু একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার ঘটেছে। ক্লুও বলতে পারিস। চল্‌ দেখবি।

ব্যাস, এইটুকু বলেই দূর্বা মুখে কুলুপ এঁটে দিল। তিস্তা ওর এ-স্বভাব ভাল করেই জানে বলে চাপাচাপি করল না। হোটেলে ওদের ঘরের সামনে চমৎকার ঢাকা বারান্দা। বাইরে খাদ। স্টিলের ফিতের মতো পাক খেতে খেতে নেমে গেছে দেরাদুন-মুসৌরি রোড।

পাহাড়ের গায়ে-গায়ে থোকা-থোকা গ্রাম তিস্তা দেখল র‍্যাচেল সোনালি চুলে একটা টপ-নট বেঁধে ব্রেকফাস্ট পরিবেশন করছে। টেবিলে-বসা তিনটি অচেনা ছেলে। তিনজনেরই পরনে সাদা শর্টস। সাদা স্পোর্টস গেঞ্জি, গেঞ্জির বুকে কী যেন মনোগ্রাম করা।

আলিসাহেব বললেন, - এসো তিস্তা, এদের কথাই তোমাদের বলছিলুম। পৃথ্বীশ রঙ্গচারী, জিত রায়চৌধুরী, সুনৃত বোস, এরা তিনজন আর ফোর্থ অরিন্দম চোপরা মিলে আমার বেসমেন্টে ওই ল্যাবরেটরিটা বানিয়েছে। ফিফটিন টু সিক্সটিন এদের বয়স। অরিন্দম বোধহয় শ্লাইটলি ওল্ডার। ধারণা করতে পারবে না, কী ম্যাচিওর চোখা ছেলে সব!

তিস্তা বলল, - ভেরি ইন্টাররেস্টিং! তোমরা তো সকলেই গ্রিনহিলের ছাত্র শুনলাম। হোস্টেলে থাকো। কীভাবে এটা ম্যানেজ করলে?

জিত রায়চৌধুরী বলল, - কিভাবে আর? আলিকাকাকে আমি ছোটবেলা থেকে চিনি। আমাদের ফ্যামিলি-ফ্রেণ্ড উনি, আমার লোকাল গার্জেনও। ওঁকে খুব ধরে পড়াতে উনি ওই পোর্শনটা আমাদের ছেড়ে দিলেন। ফিনানস্ করেছে অলমোস্ট পুরোপুরি চোপরা। কিন্তু তিস্তাদি, দা স্যাড থিং ইজ চোপরা সিম্স্‌ টু বি মিসিং সিন্স সানডে।

দূর্বা বলল, - এইটাই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার, তোকে বলছিলাম। এই চোপরা ছেলেটি চোপরা আ্যাণ্ড চোপরা ইন্টারন্যাশানালের একমাত্র উত্তরাধিকারী। বাবা, কাকা, মা তিনজনেরই বিপুল সম্পত্তির ওয়ারিশ। আর আমাদের মুফিয়ার ঠাকুরদা গান্ধীনগরের কটন্‌ কিং। এবার দু’য়ে দু’য়ে চার করো। র‍্যাচেল ইজ আফটার অল রাইট।

পৃথ্বীশ রঙ্গচারী শুধু একবার মৃদুস্বরে বলল, - চোপরা কিন্তু সহজে কিডন্যাপড হবার পাত্র নয়।

র‍্যাচেল, দূর্বা ওর কথা পাত্তার মধ্যেই আনল না।

কিন্ত প্রত্যাশিত মুক্তিপণের চিঠি পরবর্তী তিনদিনের মধ্যেও এল না।



চার

ম্যাল রোড জুড়ে ভুটিয়ারা আজ তাদের মরসুমি মালপত্তর নিয়ে বসেছে। রঙ-বেরঙের গরম পোশাক আর পাথরের মালার ঝকমকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। টুরিস্ট সমাগম আরম্ভ হয়েছে, জমজমাট মুসৌরি। এটা-ওটা দর করছিল তিন বন্ধু। তিস্তা কিনবে উইন্ড চিটার, র‍্যাচেল রঙিন পাথর, দূর্বা খুঁজছে ভাল দেখে একটা সাদা কার্ডিগান। ওর কালো রঙে নাকি সাদাই সবচেয়ে খোলতাই হয়, নয়তো খুনখারাপি-লাল। তিস্তা নিচু গলায় বলল, - দূর্বাদি, এটা মনে হচ্ছে মুসৌরির বাঙালি সিজন। কত রঙ-বেরঙের বাঙালি ছেলে-মেয়ে নিয়ে হাওয়া বদলাতে এসেছে দ্যাখো! এই ফুটফুটে ছেলে-মেয়েগুলোর দু-চারটে যদি হাওয়া হয়ে যায়!

- অলুক্ষুনে কথা বলিসনি দূর্বা বিরক্ত হয়ে বলল। তা সত্ত্বেও তিস্তা ছোট্ট বাচ্চাসমেত একটি দম্পতির কাছাকাছি জিনিস পরখ করার ছলে এগিয়ে গিয়ে বলল, - বাচ্চা সামলে রাখবেন। মুসৌরিতে এ-সিজনে ছেলেধরার উপদ্রব শুরু হয়েছে।

ভদ্রলোক চমকে উঠলেন, ভদ্রমহিলা ভয়ের চোটে বছর-তিনেকের ফুটফুটে মেয়েটাকে কোলে তুলে নিলেন। বললেন, - সর্বনাশ, কলকাতাতেও ছেলেধরা, কানপুরেও ছেলেধরা, আবার বলছেনএখানেও! আমরা তবে যাই কোথায় বলুন তো?

ভদ্রলোক বললেন, - আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো? ভীষণ চেনা-চেনা মনে হচ্ছে!

তিস্তা বলল, - আপনিও কলকাতার লোক, আমিও কলকাতার লোক। দেখে থাকবেন বাসে-ট্রামে।

ভদ্রলোক অন্যমনস্কভাবে বললেন, - কানপুরে আমার মাসির নাতিকে এখনও পাওয়া যায়নি। শহর তোলপাড় করে ফেলেছে পুলিশ। আর কলকাতায় তো নিত্য এই খবর হয়েছে। তবে বেশির ভাগই যাচ্ছে ধনী লোকের ছেলেরা। সিন্ধি, পার্শি। মোটা-মোটা টাকা হাঁকতে হবে তো!

ভদ্রমহিলা বললেন, - আপনার ছবি আমি কাগজে দেখেছি মনে হচ্ছে!

তিস্তা সংক্ষেপে - সাবধানে থাকুন, বলে সরে এল। দূর্বা ওকে ধমক লাগাল, - খামোখা বেচারিদের বেড়ানোটা নষ্ট করলি তো!

- সাবধানের মার নেই। স্বীকার করবে তো দূর্বাদি?

- মারেরও কিন্তু সাবধান নেই। যতক্ষণ না কিছু ঘটছে আমাদের কী করার আছে বল?

পাহাড়ের ওপর থাক-কাটা সিঁড়ি বেয়ে ক্যামেল্‌স ব্যাকে চড়ল ওরা। অন্ধকার হয়ে এসেছে। জিন্সের ওপর গরম পুলোভার, উলের টুপি চাপিয়েছে ওরা। র‍্যাচেল মাথায় একটা পাতলা উলের শাল জড়িয়েছে। রাস্তা অনেকটা। এবড়ো-খেবড়ো। কুলরি-বাজার ওদের গন্তব্য। কিছু সওদা করবে ঠিক আছে। কিন্তু যেভাবে রাত হয়ে যাচ্ছে তাতে করে দোকানবাজার খোলা থাকলে হয়। র‍্যাচেল প্রথম দিকটা বেশ খুশমেজাজে ছিল। খোলা গলায় গাইছিল, - ডোন্ট স্টপ টিল ইউ গেট এনাফ। হঠাৎ চুপ করে গিয়ে বলল, - এত রাস্তা থাকতে এইরকম একটা গড-ফরসেকন রাস্তায় উঠলে কেন দূর্বাদি এই সন্ধেবেলায়?

তিস্তা জবাব দিল, - যে-কোনও শহরের নাইনটি পার্সেন্ট ক্রাইম এইরকম গড-ফরসেকন অঞ্চলে হয় র‍্যাচেল।

অন্ধকারের মধ্যে র‍্যাচেল মিডফোর্ড একটু শিউরে উঠল। এদের তিনজনের মধ্যে ওই সবচেয়ে ভিতু। আর্মচেয়ারে শুয়ে-শুয়ে ক্রাইম-নভেলের পাতা ওলটাতে-ওলটাতে মাইক্রফট্ হোমসের কায়দায় একটার পর একটা থিয়োরি দিয়ে যেতে পারে অনায়াসেই। কিন্তু কিছু কাজ করতে গেলে যে তাগদ আর নার্ভ চাই তা ওর নেই। কোয়ালিটির সামনে ওরা যখন পৌঁছল তখন বেশকিছু দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেলেও সিজন বলেই কয়েকটা দোকানের ঝাঁপ খোলা। একচিলতে একটা ঘড়ির দোকানে ওরা ঢুকল। র‍্যাচেল চুপিচুপি জিজ্ঞেস করল, - এত জিনিস থাকতে ঘড়ি কেন হঠাৎ?

দূর্বা উত্তর দিল, - তিনজনে যদি তিনটে বিদেশী ঘড়ি এই কাউন্টার থেকে ফাঁকতালে পেয়ে যাই, মন্দ কী?

ও ভাঙল না, সকালে ওরা তন্নতন্ন কর কুলরিবাজার ঘেঁটে গেছে। এই দোকানটার ব্যাপারস্যাপার খুব সন্দেহজনক মনে হয়েছিল। প্রথমত, কাউন্টারে একজন শিখ যুবক এবং একটি বয়স্ক চিনা। দ্বিতীয়ত, তিন ঘণ্টার মধ্যে দোকানে কোনও কেনাবেচা হয়নি। কিছু লোক শুধু দোকানটার মধ্যে এসেছে আর গেছে, হয় শিখ নয় চিনা। বড় অদ্ভুত যোগাযোগ! এই লোকগুলি কাউন্টারে মাথা নামিয়ে গভীর শলাপরামর্শ করেছে বলে ওদের ধারণা। একবারও শো-কেস থেকে একটাও ঘড়ি বার হয়নি। তৃতীয়ত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, ছোট্ট একপাটি পিচ-রঙ এর মোজার মতো কিছু একটা তিস্তা এই দোকানের সিঁড়ির পাশে পড়ে থাকতে দেখেছে সকালে। যে মুহূর্তে ও জিনিসটা সংগ্রহ করবার জন্য দোকানটার দিকে পা বাড়িয়েছিল, ঠিক তখনই বিপুলকায় এক চিনা মহিলা বিশাল একটা পাতার ঝাঁটা দিয়ে দোকানের ধাপ এবং নীচের যাবতীয় জিনিস ঝেঁটিয়ে নিয়ে চলে যায়। পিচ-রঙের একটা পুরো উলের স্যুট পরেই মুফি উধাও হয়। জিনিসটা বিদেশী, খুব পাতলা অথচ গরম। অনেকবার ওরা জিনিসটার প্রশংসা করেছিল বলেই ভাল করে মনে আছে। র‍্যাচেলকে ওরা এত কথা ভেঙে বলেনি। বিপদের সময় ওর উপস্থিতবুদ্ধি ভালই খোলে, কিন্তু বিপদের কথা আগে থেকে চিন্তা করতে দিলেই সর্বনাশ।

দোকানে ঢুকে ওরা খুব আড়ম্বরের সঙ্গে ঘড়ি দেখা শুরু করল। সান-ট্রেক নামে সুন্দর একটা ঘড়ি শিখটি দমাস করে মেঝেতে আছড়ে ফেলে বলল, - দেখিয়ে মেমসাব, গিরলে ভি টুটে না, বালটিভর পানিতে ছেড়ে ভি রাখুন, খারাব হোবে না, বহুত আচ্ছা চিজ আছে।

- টিসো পাওয়া যাবে না? কিন্বা ওমেগা? দূর্বা বলল।

- ওসব চিজ এখানে মিলবে না, স্মাগলড্ চিজের কারবার নেই হমাদের, দূর্বার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে শিখটি বলল। এই সময়ে দূর্বা পায়ে কেড্‌সের ঠোক্কর খেল, তিনজনেরই কান খাড়া। খুব দূর থেকে একটা শিশুর কান্নার আওয়াজ আসছে না! তিস্তা হঠাৎ দুম্‌ করে বলল, - টয়লেট আছে আপনাদের দোকানে?

- জরুর। শিখটি বলল।

চিনেম্যান মাথা নেড়ে বলল, - নো প্রবলেম মিস, ইউ গো থ্লু দিস দোল, অ্যান্দ্‌ তার্ন রাইত্‌। মাই ওয়াইফ উইল তেল ইউ। তিস্তা এত তাড়াতাড়ি চিনে লোকটির খুলে-ধরা সবুজ দরজার ভেতর দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল যে, বাকি দু’জন হতভম্ব।

অন্ধকার প্যাসেজটা। ডান দিকে ঘুরতে সামান্য আলো পেল তিস্তা। একটা অপ্রশস্ত চাতাল। একটি অসম্ভব মোটা চিনে মহিলা সেখানে টুলের ওপর বসে আগুনে পাত্র বসিয়ে চিনে গন্ধওলা কী একটা খাদ্যবস্তু নাড়াচাড়া করছে। তিস্তার অনুরোধে একটা দরজা দেখিয়ে দিল। ভাঙাচোরা হলেও টয়লেটটা পরিষ্কার। দরজাটা নড়বড় করছে। তিস্তা ঢুকেই হুড়কো লাগিয়ে দিল। উলটো দিকের দেওয়ালে উঁচুতে একটা স্কাইলাইট। কমোডের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে স্কাইলাইট দিয়ে বাইরে তাকাল তিস্তা। প্যাসেজটায় বোধহয় জিরো পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে। উলটো দিকে দুটো ঘর, একটা বাইরে থেকে ছিটকিনি দেওয়া। পাশেরটায় ওর দিকে পেছন ফিরে দুই সুবেশ ভদ্রলোক মাথা নামিয়ে নিচু গলায় কথা বলছেন। খুব স্পষ্টভাবে এবার ভেসে এল শিশুকণ্ঠের কান্না। তিস্তার মনে হল, বাচ্চাটা বলছে - মাম্মি-ই-ই। দুই ভদ্রলোকের একজন উঠে এসে খুব ব্যস্ত হয়ে এদিকে তাকিয়ে কী যেন বললেন। মোটা চিনে মহিলা সঙ্গে-সঙ্গে গিয়ে দাঁড়াল বন্ধ দরজাটার সামনে। প্রচণ্ড কৌতূহলে তিস্তা স্কাইলাইট দিয়ে মাথাটা প্রায় গলিয়ে দিয়েছে এমন সময় ঘাড়ের ওপর প্রচণ্ড ভারী, ভোঁতা একটা কিছুর ধাক্কা লাগল। ও আর কিচ্ছু জানে না।



পাঁচ

নিত্যকার মতো ওরা দৌড়তে বেরিয়েছে। পৃথ্বীশ, জিত আর সুনৃত। এখন কিছুদিন খেলাধুলো বন্ধ আছে। সকালবেলায় এই ব্যায়ামটুকু না করলে শরীর ঠিক থাকবে না, গেমস্-টিচার বারবার বলেছেন। কুয়াশায় চারদিক ঢাকা। সূর্য এখনও সে-কুয়াশা ভেদ করতে পারেনি। হুইসপারিং উইন্ডোর সামনে এসে পাথরের একটা চাঁইয়ের ওপর বসল তিনজনে। সুনৃত বলল, - এইখানটায় বসে ও বাজনার তালে তাল দিচ্ছিল।

জিত বলল, - খুব খোশমেজাজে। যেন নিজের আনন্দে নিজেই বিভোর হয়ে আছে। আমাদের খেয়ালই করল না। সুরটা কী বল তো? ওয়েস্টার্ন মিউজিক, কিন্তু কী? খুব মন-মাতানো এইটুকু মনে আছে।

সুনৃত বলল, - উঁহু। ঠকে গেছিস। মোটেই ওয়েস্টার্ন মিউজিক নয়। তবে সুরটা পাশ্চাত্ত্য ঘেঁষা। রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো’। ডি-সুজা মাঝেমধ্যেই রবীন্দ্রসঙ্গীত অর্কেস্ট্রায় তোলে। ম্যান্ডোলিন আর বঙ্গো দুটো যা বাজছিল না, সিম্পলি ওয়াণ্ডারফুল!

পৃথ্বীশ বলল, - তার একটু আগেই আমি ওকে আনমনা ভাবে ল্যাবরেটরি থেকে বেরোতে দেখেছি।

- নিশ্চয়ই ল্যাবে ও যা করছিল তার সঙ্গে এই ফুর্তির যোগ আছে। ‘দোলে মন দোলে অকারণ পুলকে, জিত বলল।

- সুতরাং ক্লুর জন্য আমাদের ল্যাবেই যাওয়া উচিত।

দৌড়তে-দৌড়তে ওরা তিববতি রেস্তোরাঁ শিগাৎসির সামনে থমকে গেল। রাস্তার তলায় রেস্তোঁরাটা। খোলা পোর্টিকোয় সিনিয়র চোপরা অর্থাৎ অরিন্দমের কাকা খুব মন দিয়ে কিছু-একটা পড়ছেন। ক’দিন পরেই পুজো। এ-সময়টা ওদের চার-পাঁচদিন ছুটি থাকে। এত কম সময়ের জন্যে কেউই বাড়ি যায় না। কারও-কারও বাড়ির লোক কটা দিন এসে ছেলেকে সঙ্গে করে কোনও হোটেলে কাটিয়ে যান। চোপরা সাধারণত আসেন না। অরিন্দম স্কুল-বোর্ডিংয়েই ফাদার জোনাথনের হেফাজতে থাকে। এই সময়ে ওঁকে এখানে দেখে তিন বন্ধু মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। দ্রুত উলটো দিকের পাকদণ্ডী বেয়ে নীচে নেমে গেল তিনজনে। খানিকটা উর্ধ্বশ্বাসে নামবার পর সুনৃত বলল, - সর্বনাশের মাথায় পা। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই কি সন্ধে হতে হবে? সাতজন্মে উনি পুজোয় আসেন না, আর ঠিক এবারেই ওঁর আসা চাই!

জিত বলল, - ফাদার জোনাথন না হার্ট ফেল করেন। বেচারি বুড়ো মানুষ। পুলিশ তো শত খোঁজাখুঁজিতেও কিছু করতে পারছে না। রঙ্গচারি বলল, - অরিন্দম মতো রিসোর্সফুল ছেলে যদি নিজেকে লুকিয়ে রাখবে মনে করে তো কার সাধ্য বলো এই মুসৌরি টাউনে তাকে খুঁজে বার করে। দ্যাখো, হয়তো টেহরি গাড়োয়ালের কোনও পাহাড়ি গ্রামে গিয়ে বসে আছে।

সুনৃত ক্ষোভের সঙ্গে বলল, - কিন্তু আমাদের সঙ্গেও তো যোগাযোগ রাখবে। আমরা তো ওকে বিট্রে করতে যাচ্ছি না। যাই বলিস, অরি কিন্তু কাজটা ঠিক করেনি।

এই সময় দু’জন ষণ্ডামার্কা লামা ওদের পাশ দিয়ে হনহন করে নেমে গেল। খানিকটা দূরে চলে যাওয়ার পরে জিত বলল, - এই লামা দু’জন সারাক্ষণ আমাদের পেছন-পেছন এসেছে। এখন মনে হচ্ছে ইচ্ছে করেই। কী ব্যাপার বল্‌ তো? এত ফোরস্টার থ্রি-স্টার হোটেল থাকতে শিগাৎসিতে আঙ্কল চোপরা! এদিকে লামারা আমাদের ওপর গুপ্তচরগিরি করছে। অরিন্দম ওঁর হাত থেকে পিছলে যাচ্ছে টের পেয়ে নিজেই নিজের ভাইপোকে কিডন্যাপ করেননি তো ভদ্রলোক?

ল্যাবে যখন ওরা এসে পৌঁছল তখন রোদ উঠে গেছে। তালা খুলে ঢুকতে যাবে, আলিকাকা উসকোখুসকো চুলে এসে বললেন, - সর্বনাশ হয়েছে জিত। ওই তিনটি বোর্ডার -তিস্তা, র‍্যাচেল আর দূর্বা কাল ফেরেনি।

- বলেন কী! আপনি কখন জানতে পারলেন?

- রাত্তিরে জানতে পারিনি। এটা আমার দিক থেকে মস্ত একটা গাফিলতি বলতে পারো। অভিভাবকহীন তিনটি মেয়ে। আমার নজর রাখা উচিত ছিল৷ কিন্তু এখন ট্যুরিস্ট সিজন আরম্ভ হয়ে গেছে। তা ছাড়াও মনটা আমার একদম ভাল নেই।

- কী হয়েছিল, খুলে বলুন তো! সুনৃত বলল।

- ওরা রোজই বিকেলে বেরিয়ে যায়। রাতের খাওয়া বাইরে থেকে সেরে আসে। আটটা সাড়ে-আটটার মধ্যে এসে ঢুকে পড়ে রোজ।

কোনও-কোনও দিন লিভিং-রুমে আমাদের সঙ্গে বসে টিভি দ্যাখে বা শাহিনের সঙ্গে আড্ডা মারে। ক’দিন তো শাহিন শয্যা নিয়েছে। তবে আমার ধারণা ওই ডাকাবুকো মেয়ে তিনটি মুফির খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছে। এবং যারা মুফিকে ধরেছে তাদের হাতেই ওদের কিছু-একটা অনিষ্ট ঘটেছে। বাই দি ওয়ে, দিল্লিতে পুলিশ একটা বাচ্চাকে ট্রেস করতে পেরেছে। আনোয়ার চলে গেছে তাকে আইডেনটিফাই করতে।

জিত বলল, - মহা মুশকিল হল তো! পৃথ্বীশ তুই কি এখনও মনে করছিস অরিন্দম লুকিয়ে আছে? আমার তো মনে হচ্ছে বিরাট একটা গ্যাং এর পেছনে কাজ করছে। মুফির মতো বাচ্চাকে লোপাট করা এক জিনিস, আর তিনটে জলজ্যান্ত মেয়েকে উধাও করা আর-এক জিনিস৷ আমাদের কিন্তু এত নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকা উচিত হচ্ছে না।

আলিসাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, - কী বলতে চাইছ জিত? পুলিশ যা করার করছে। তোমরা তিনমূর্তি এর মধ্যে নাক গলিয়ে আর নতুন ফ্যাসাদ বাঁধিও না। মেয়ে তিনটি তো আমাকে একেবারে শাসিয়ে গেছে। তোমাদের এই নিউ জেনারেশনকে কিছু বলাও মুশকিল।

উনি দুমদুম করে চলে গেলেন।

সুনৃত বলল, - আলিকা হেভি আপসেট।

জিত বলল, - বন্ধুগণ, আমরা সাবধান থাকব ঠিকই, কিন্তু গার্জেনদের নিষেধ-বাক্য মেনে নিষ্ক্রিয় থাকবার দিন কি আমাদের চলে যায়নি? আমার মতে আমাদের অ্যাকশন এবার আরম্ভ হোক। রাজি?

বাকি দু’জন একসঙ্গে বলল, - রাজি।

ক’দিন ল্যাবে ঢোকা হয়নি। পাতলা ধুলোর একটা আস্তরণ পড়েছে সবকিছুর ওপর। তিন বন্ধু মিলে যত্ন করে ঝাড়পোঁছ করতে লাগল। বিকার, টেস্ট-টিউব সুদ্ধু স্ট্যাণ্ড, উলফ্‌ বটল, ফ্লাস্ক, নানারকম কেমিক্যালের শিশিগুলো, ব্যারোমিটার, হাজার জিনিস জড়ো করেছে, সবাই মিলে। হঠাৎ রঙ্গচারী বলল, - এই রিটর্টটার পেছনে এটা কী রে জিত, ট্রানজিস্টর রেডিও?

রঙ্গচারী যে জিনিস তুলে ধরল সেটা একটা ছোট বলের মতো। আপাদমস্তক নানা রঙের ছোট-ছোট বোতাম। সবাই হাতে করে দেখতে লাগল জিনিসটা। হাতে করেই চমকে উঠল সবাই। শোলার মতো হালকা, এবং গোল ও মসৃণ হলেও গড়ায় না! যেখানে রাখো আঠা-লাগানো বস্তুর মতো আটকিয়ে থাকে। বোতামগুলো বেরিয়ে নেই। গোলাকার তলাটার ওপর কতকগুলো নানা রঙের টিপের মতো দেখাচ্ছে সেগুলোকে। সুনৃত হাতে নিয়ে একটু ইতস্তত করে সবুজ বোতামটা টিপল। কিছুই হল না। তারপর সাহস করে ওরা সবাই এলোপাথাড়ি কয়েকটা বোতাম টিপে গেল। কিছুই ঘটল না।

জিত বলল, - চল্‌ এটা হোস্টেলে নিয়ে যাই। এটা যাই হোক, নিশ্চয় অরিন্দমের বানানো।

এমন সময় রঙ্গচারী দারুণ চমকে চেঁচিয়ে উঠল, - দ্যাখ, দ্যাখ জিত, আমি অন্যমনস্ক হয়ে এটা পকেটে ঢোকাতে গিয়েছিলাম, জিনিসটা কী সুন্দর স্কুইজ করে আমার পকেটের মাপে ছোট, চ্যাপটা হয়ে গেছে।

তিনজনেই অবাক। শেষ দিকে অরিন্দমের হাবভাব দেখে ওরা ক’দিন ল্যাবটা ওকেই পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছিল। অরিন্দম অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করত। একটা পুরো পোর্টেবল টিভিসেট, ছোট্ট একটা একশো ওয়াটের ইনভার্টার, ক্যালকুলেটর ইত্যাদি অনেক জিনিস ও ল্যাবে বসেই তৈরি করেছে। ইলেকট্রনিক্সের যন্ত্রপাতি তৈরিতে ওর দক্ষতা ছিল রীতিমত বিস্ময়কর। এই অদ্ভুত বস্তুটা কি সত্যিই ওর তৈরি? কী ধাতু এটা? ধাতু এত হালকা! নিশ্চয়ই পলিথিন জাতীয় কিছু। কিন্তু পলিথিনের এরকম স্থিতিস্থাপকরা আছে বলে তো জানা ছিল না।

ল্যাবে তালা ঝুলিয়ে তিনজন রোদের মধ্যে বেরিয়ে পড়ল। হাঁটতে লাগল স্কুলের দিকে। আজ শনিবার স্কুল ছুটি। অনায়াসেই ওদের শখের বিজ্ঞানীগিরির সাধ মেটাতে পারত ল্যাবে বসে, কিন্তু মন লাগছে না। প্রথম কথা মুফি এবং তিস্তারা, এতদিন কেটে গেল শাহিনদির বাচ্চাটাকে পুলিশ তো বার করতে পারলই না, উপরন্তু এই তিনটি মেয়ে। হয়তো ওরা কেথাও গিয়ে আটকে গেছে, হয়তো ফিরবে। আশা করা যাক, কিন্তু ব্যাপারটা অস্বাভাবিক। দ্বিতীয়ত, অরিন্দমের জন্য এবার সত্যি-সত্যি দুশ্চিন্তা হচ্ছে। এতদিন ধরে ও স্রেফ লুকিয়ে বসে থাকবে, ওদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করবে না এটা অবিশ্বাস্য। তৃতীয়ত, এই অদ্ভুত বস্তু।

কিউবেই ওরা ব্রেকফাস্ট আনিয়ে নিল। আজ শনিবারের স্পেশাল। ছোলা-বাটোরা। বড়-বড় গ্লাসে চকোলেট দুধ। এটা ওরা গলাধঃকরণ করেছে দেখে তবে ভান্ডারী যাবে। ফাদারের সেইরকমই নির্দেশ। তিনি নাকি দু-তিন দিন ওদের ঘরের পেছনের বাগানে কিছু ঝোপঝাড় দুধে অভিষিক্ত থাকতে দেখেছেন। খেতে-খেতে পকেটের মধ্যে জিনিসটাকে নাড়াচাড়া করছিল পৃথ্বীশ রঙ্গচারী। এটা কি রাবার? কিন্তু রাবারের রঙ এরকম স্ফটিক-স্ফটিক? তা ছাড়া হার্ড-রাবার তো স্থিতিস্থাপক হবার কথা নয়! পকেটে ঢুকে জিনিসটা কীরকম আপাদমস্তক ছোট্ট আর চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। কোথাও কোনও খোঁচ বা ভাঁজ পড়েনি। খুবই আশ্চর্য! এটা কী বস্তু? ওর পনেরো বছরের সায়েন্স ও প্রযুক্তিবিদ্যার মধ্যে নেই এ-জিনিসটার ব্যাখ্যা। রঙ্গচারী অন্যমনস্ক হয়ে জিনিসটা পকেটের মধ্যেই টেপাটেপি করছিল, হঠাৎ একটা কাণ্ড ঘটল। কী টিপেছে ও জানে না, ওর পকেটের মধ্যে থেকে অরিন্দমের গলার স্বর ভেসে আসতে লাগল, - আমি একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পাস করছি। পৃথ্বীশ, তোরা যদি জানতে পারতিস আমি কী করতে পেরেছি।

পকেট থেকে তাড়াতাড়ি করে বস্তুটা বার করতে গিয়েছিল ও। সুইচ অফ হয়ে যাওয়ার জন্যে বোধহয় কথা বন্ধ হয়ে গেল। আর টেপাটেপি করতে জিত বারণ করল। যদি খারাপ হয়ে যায়। এটা কি টেপ-রেকর্ডার? অরিন্দম নিজের কিছু-কিছু কথা টেপ করে ধরে রেখেছে? যাই হোক, সূত্র তো একটা পাওয়া গেল! অরিন্দম একটা নতুন কিছু করতে পেরেছে, যেটা অরিন্দমের নিজের কাছেই বিস্ময়কর। কে জানে, এই নতুন আবিষ্কার-সংক্রান্ত কাজেই ও কোথাও উধাও হয়েছে কি না, কিংবা এটার কথা জানতে পেরে কোনও দু্ষ্কৃতিকারী ওকে গায়েব করেছে কি না। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, আবিষ্কৃত বস্তুটা কি এমনি অবহেলায় ল্যাবে পড়ে থাকত? বস্তুটাতে হাত বুলোতে-বুলোতে রঙ্গচারী বলল, - আওয়ার লিটল ট্রানজিস্টার। সুনৃত ফোড়ন কাটল, - ঈশ্বর জানেন ট্রানডিজাস্টারও হতে পারে। রেজিস্ট্যান্স ট্রান্সফার না করে ডিজাস্টার ট্রান্সফার করবে হয়তো।

শেষাংশ...










No comments:

Post a Comment