মৃত্যুতালিকা
লেখক: সুবোধ সরকার
জলে-ডোবা কাদার ভেতর দিয়ে অবয়বহীন প্রাণীগুলো ধীরে ধীরে মহাকাশযানটির দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের শরীরে কোনোও হাড় নেই। তুলো- ভর্তি বস্তার মতো মনে হচ্ছে।
তাদের অগ্রগতি কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। প্রথম দিকে দু’একটি প্রাণীর শরীর বিশেষ রশ্মির সাহায্যে ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু ফেটে ছড়িয়ে পড়া জেলি থেকে আবার নতুন জন্ম নিয়ে তারা সংখ্যায় ক্রমশ বেড়ে যেতে লাগল। চোখ নেই, মুখ নেই, পা নেই, হাত নেই-- প্রাণীগুলো ধীরে-ধীরে এগিয়ে আসছে। তাদের লক্ষ্য ওই মহাকাশযান।
ডঃ যোশি খুব ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। তাঁর ওপর দায়িত্ব অনেক। অনেক মানুষের জীবন নির্ভর করছে তাঁর সিদ্ধান্তের উপর। যা করতে হবে খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে। পৃথিবী থেকে এসে একমাত্র তাঁরাই পেরেছেন এই গ্রহে মহাকাশ- স্টেশন তৈরি করতে। কিন্তু তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারছেন, ধ্বংস মাত্র কয়েক.হাত দুরে অপেক্ষা করছে। গত দু’দিনের ভেতরেই ওই ভয়াবহ প্রাণীগুলো তাঁদের দুটি মহাকাশযান একেবারে নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছে। তাদের শরীর থেকে নির্গত একরকম তীব্র অ্যাসিড ধীরে ধীরে মহাকাশযানদুটিকে গলিয়ে কাদার ভেতর মিশিয়ে দিয়েছে।
কমান্ডার ডঃ যোশি তাঁর লম্বা দাড়িতে একবার হাত বেলালেন। তারপর মনে-মনে বললেন, দেখা যাক।
মিস্টার রঙ্গনাথন, যিনি এই মহাকাশ-স্টেশনের প্রধান টেকনোলজি অফিসার, এখনও আশা ছেড়ে দেননি। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে প্যাকেটের মুখটা খুলে ডঃ যোশির দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, “একটা ব্যবস্থা করা গেছে, চোখে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু বিশেষভাবে প্রস্তুত একরকম রশ্মি দিয়ে একটা দেওয়াল তুলে দেওয়া গেছে সামনের দিকটায়, কিন্তু তা দিয়ে তাদের বেশিক্ষণ আটকে রাখা যাবে না।” মিস্টার রঙ্গনাথন কথাগুলো খুব স্বাভাবিকভাবেই বলতে পারলেন। তাঁর খুব আশ্চর্য লাগছে প্রাণীগুলোর কথা ভেবে।
“আমাদের এই স্টেশন ছেড়ে যেতে হবে,”-খুব দ্রুত এই সিদ্ধান্তে এলেন ডঃ যোশি। যত দূর তাঁর চোখ যায়, দেখতে পেলেন বিশাল জলাভূমিটা একটা থকথকে জন্তুর মতো এগিয়ে আসছে।
প্রাণীগুলোকে আলাদা ভাবে চেনা যাচ্ছে না আর।
মিস্টার রঙ্গনাথন বললেন, “ছেড়ে যাব ঠিকই, কিন্তু আপনি কি প্রাথমিক সমস্যাটা জানেন, স্যার?”
“হ্যাঁ জানি”, ডঃ যোশি বললেন। তারপর সিগারেটে একটা দীর্ঘ টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে খুব বিষণ্ণ কন্ঠে যোগ করলেন, “আমাদের দলের কুড়িজনকে এখান থেকে চলে যেতে হবে এবং অপেক্ষা করতে হবে মৃত্যুর জন্য, মহাকাশযানটি সবাইকে নিয়ে যেতে পারবে না।”
“কারা-কারা যেতে পারবে তার তালিকা কি প্রস্তুত?” প্রশ্নটা এল ডঃ যোশির পেছন থেকে। তিনি ঘুরে দেখলেন,পাইলট রাও। রাও পাইলট হিসেবে অনন্য। তাঁর ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। “আমার নাম যেন একেবারে শীর্ষে থাকে”-- হাসতে হাসতেই কথাগুলো বললেন পাইলট রাও। কিন্তু বোঝা যায় সেই হাসির ভেতর লুকিয়ে রয়েছে দুটো জিনিস। তা হল -- অহংকার আর নিষ্ঠুরতা।
“দুঃখিত, পাইলট রাও, আমরা কেউই অপরিহার্য নই -- ডঃ যোশি খুব স্পষ্ট করে উচ্চারণ করলেন কথাগুলো।
“কিন্তু ভুলে যাবেন না কমাণ্ডার, এখান থেকে মহাকাশযানটিকে নিরাপদে নিয়ে যেতে আমিই সবচেয়ে সক্ষম ব্যক্তি।”
পাইলট রাওয়ের চোখ চিকচিক করে উঠল। তিনি যখন ক্রমশই উত্তেজিত হয়ে উঠছেন, তখন তাঁর পাশে এসে দাঁড়ালেন তাঁরই সহযোগী পাইলট অবন মুখার্জি। খুবই কম বয়স তাঁর, কিন্তু দক্ষতা তাঁরও আছে। তিনি রাওয়ের দুটো হাত নিজের হাতের ভেতর নিয়ে বললেন, “এটা কী হচ্ছে পাইলট রাও, আপনি কি বুঝতে পারছেন না জীবন ও মৃত্যুর ব্যাপারে আমরা এখানে সবাই সমান। আপনি শান্ত হোন।”
“ঠিক আছে, সবাইকে ডাকা হোক, কী মনে হচ্ছে, কতজন যেতে পারবে? পাইলট রাও কথাগুলো বলে খুব বিশ্রীভাবে ডান ভুরুটাকে বাঁকালেন।
সেইদিকে তাকিয়ে ডঃ যোশি বললেন, “সেরকম কিছুই ঠিক করা হয়নি, সিদ্ধান্ত যা নেবার নেব আমরাই, কিন্তু কারা কারা যেতে পারবে তার তালিকা তৈরি করে দেবে আমাদের কম্পিউটার ক, খ, গ।”
ডঃ যোশি কম্পিউটারের কি- বোর্ডের সামনে এসে বসলেন। একটি মহাকাশযান, একশো চল্লিশ জনকে বহন করতে সক্ষম। সুতরাং একশো চল্লিশটি নামের তালিকার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন ডঃ যোশি। ডঃ যোশি পেছন ফিরে তাকিয়ে বললেন, “আপনারা সমস্ত সেকশনে খবরটা পাঠিয়ে দিতে পারেন।”
সেন্ট্রাল কন্ট্রোল এরিয়াতে প্রত্যেকে অপেক্ষা করতে লাগলেন কম্পিউটার কার-কার নাম বাদ দেয় সেটা দেখার জন্য। প্রত্যেকের ভাগ্য ঠিক করে দিচ্ছে ওই ক, খ, গ। কম্পিউটার রোলার থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল নাম।
“আমার ব্যাগ গুছিয়ে নিই”-- আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথাগুলো বললেন পাইলট রাও। ব্যাগ গোছাতে চলে যাচ্ছিলেন পাইলট রাও।
হঠাৎ তাঁকে থামালেন ডঃ যোশি।
“না পাইলট রাও, এই মহাকাশযানটিকে নিরাপদে পৌঁছে দেবার জন্য কম্পিউটার নাম করেছে আপনার সহযোগী পাইলট অবন মুখার্জির। ভাগ্যবানদের তালিকায় আপনার নাম নেই।” ডঃ যোশি পাইলট রাওয়ের মুখের দিকে তাকালেন। একটু থামলেন। তারপর বললেন “ভাগ্যবান ১৪০ জনের তালিকায় আমারও নাম নেই।”
“আমার নাম নেই? যাকে আপনারাই বলেন, দি বেস্ট ফ্লায়ার! আর কতগুলো যন্ত্রাংশ দিয়ে তৈরি ওই কম্পিউটার মৃত্যু-পরোয়ানা দেবার কে? দিক, আমি মানছি না।” কথাগুলো পাইলট রাও বলার সময় দেখা গেল, তাঁর ঠোঁটের ডান দিকের কোণটা কাঁপছে।
“আমি কম্পিউটারের সিদ্ধান্তকে মাথা পেতে মেনে নিয়েছি।” বললেন ডঃ যোশি। “আপনি চিরকাল আমাদের শুনিয়ে এসেছেন আপনি কত বড় মাপের জিনিয়াস, সেটা এখন প্রমাণের সময় এসেছে পাইলট রাও। কথা শেষ করে ডঃ যোশ্মি তাঁর পকেট থেকে নিজের রুমাল বের করে রাওকে দিলেন। পাইলট রাও ঘামতে শুরু করেছেন।
“আমার খুবই খারাপ ল!গছে, পাইলট রাও, আমি খুবই বিষণ্ন বোধ করছি,” পাইলট রাওয়ের পিঠে হাত রেখে অবন মুখার্জি দুঃখ প্রকাশ করলেন। এক ঝটকায় তাঁর হাত সরিয়ে দিয়ে পাইলট রাও ধমক দিয়ে উঠলেন, “তুমি একজন সামান্য আ্যাসিসট্যান্ট, আমার পিঠে হাত রাখার যোগ্যতা এখনও তোমার আসেনি।”
“এভাবে আর আমাদের সময় নষ্ট করা যাবে না”-- জানালেন মিস্টার রঙ্গনাথন। তিনি এও জানালেন, আরও এগিয়ে এসেছে সবুজ কাদার জলাভূমি। কমান্ডার ডঃ যোশি ক্যাম্পের ভিতরে এলেন। পরিষ্কার গলায় কোনও আবেগ না রেখে তিনি মাইক্রোফোনের ছোট্ট মুখটিতে ঘোষণা করলেন হতভাগ্যদের নাম। ডঃ যোশির কণ্ঠ সমস্ত ঘরে-ঘরে পৌছে গেল। মৃত্যু-তালিকা পাঠ করার সময় যে নামটি তিনি প্রথমে পড়লেন, সেটি তাঁর নিজের।
তিনি প্রত্যেকের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে জানালেন, “যাঁরা মৃত্যু তালিকায় আছেন তাঁরা সেন্ট্রাল কমান্ডে রিপোর্ট করুন অনুগ্রহ করে, আর অন্যরা চলে যান মহাকাশযানের কাছে, জিনিসপত্র যা নেবেন তা যেন কখনওই তিন পাউণ্ডের বেশি না হয়” -- বাঁ হাতের চেটো দিয়ে কপালের ঘাম মুছে ডঃ যোশি আবার বললেন, “আমরা যাঁরা এখানে থেকে গেলাম, আপনাদের শুভ কামনা করি, আপনারাও আমাদের জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করবেন আশা করি।”
মুহূর্তের মধ্যে ছোটাছুটি লেগে গেল। দেখা গেল খুব দ্রুত এ-ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু মৃত্যু-তালিকার তেইশজনের অনেকেই বুঝতে পারলেন, যাঁরা ভাগ্যবান তাঁদের অনেকেই তাঁদের দিকে তাকাতে পারছেন না। ভাগ্যবান ও ভাগ্যহীন- এরকম দুটো দলে ভাগ হয়ে গেলেন তাঁরা, যা কিছুক্ষণ আগেও ছিল না।
করিডর দিয়ে যাবার মুখে পাইলট রাও অবন মুখার্জির সামনে এসে দাঁড়ালেন, “তোমাকে কি আমি চিরকাল আমার ছোটভাইয়ের মতো দেখে আসিনি, অবন? আমি যা জানি, তোমাকে কি সব শেখাইনি? অবন, যে করেই হোক আমি বাঁচতে চাই।”
অবন মুখার্জি খুব ভয় পেয়ে গেলেন। তাঁর পাইলটের এরকম ভেঙে-পড়া তিনি কখনও দেখেননি। তিনি বুঝতে পারলেন না কী উত্তর দেবেন। ঠিক সে সময়ই সেখানে উপস্থিত হলেন ডঃ যোশী।
“আমি শুনতে পেয়েছি পাইলট রাও, আমি আশা করব এক মুহূর্তও নষ্ট না করে আপনি পাঁচ নম্বর লেসার ব্যাটারির কাছে চলে যাবেন।”
“কমান্ডার, আপনি জানেন পৃথিবীতে আমার প্রচুর সম্পদ, আমি ফিরে গিয়ে আপনাকে ব্ল্যাঙ্ক চেক দিয়ে দেব, অনুগ্রহ করে........”
“পাইলট রাও, আপনি আমার কথা অমান্য করতে শুরু করেছেন, আপনাকে কুকুরের মতো গুলি করতে পারি, সেকথা ভুলে যাবেন না।”
ওদিকে মিস্টার রঙ্গনাথন, যাঁর নামও মৃত্যু-তালিকায় রয়েছে, সেদিকে কোনওরকম ভ্রূক্ষেপ না করে সবরকমের ঝুঁকি নিয়ে নিজের কাজ করে চলেছেন। অদ্ভুত রকমের পোশাক পরে রঙ্গনাথন তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে ছোটাছুটি করছেন। তাঁর মাথায় শুধু একটাই চিন্তা কী করে সময় বাঁচানো যায়। তিনি লেসার দেওয়ালের কাছ দিয়ে যেতে গিয়ে হঠাৎ দেখতে পেলেন কিছুটা কাদা লেগে তাঁর জুতোর মাথা গলে যাচ্ছে। বুঝতে পেরে দ্রুত সরে এলেন। সরে এসেই বুঝতে পারলেন মৃত্যু খুব কাছে এসে গেছে, আরও তাড়াতাড়ি তাঁদের কাজ করতে হবে। ওদিকে পাইলট রাও মানসিক ভারসাম্য হারাতে বসেছেন। যে করেই হোক তাঁকে বাঁচতে হবে। পাঁচ-নম্বর লেসার ডিফেন্সে না গিয়ে তিনি ধীরে-ধীরে মহাকাশযান তিন-এর কাছে চলে
এলেন। যে যাঁর প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত৷ একফাঁকে পাইলট ঢুকে পড়লেন যানটির ভেতরে। ফ্লাইট-ডেকে ঢুকতে গিয়ে দেখতে পেলেন একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। তিনি পা টিপেটিপে তার পেছনে গিয়ে বাঁ হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে ডান হাত দিয়ে তার ঘাড়ে একটা আঘাত করলেন। একটি আঘাতেই লুটিয়ে পড়ল তার অজ্ঞান শরীর। তাকে পা দিয়ে সরিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। তারপর তিনি বসে পড়লেন পাইলট সিটে। যোগাযোগরক্ষাকারী একটা সুইচে আঙুল দিয়ে তিনি কথা বললেন। তাঁর কণ্ঠ সমস্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল। “শুভ সন্ধ্যা, ডঃ যোশি, আপনি নিশ্চয়ই আমার কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছেন। শুনুন, আমি যদি না যেতে পারি, এখান থেকে জীবন নিয়ে কেউই ফিরতে পারবে না।”
“আমি শুনতে পাচ্ছি পাইলট রাও, আপনি নিজেকে সংযত করুন, এটা হয় না, হতে পারে না”--ডঃ যোশি জানালেন।
“ডঃ যোশি, যদি আমি মারা যাই, আমরা সকলে মারা যাব।” গার্গল করলে যেমন গলা হয়, তেমনই একটা গলা ভেসে এল মাইকে।
ডঃ যোশি বুঝতে পারছেন না কী করবেন। এদিকে খবর আসছে লেসার দেওয়ালের একটা অংশ কাজ করছে না। তারা ঢুকে পড়ছে। অন্যদিকে আর-একটি অংশে দেখা দিচ্ছে ত্রুটি। এদিকে ডেপুটি কমাণ্ডার জানতে চাইছেন মহাকাশযানটিকে আর ক’মিনিটের মধ্যে ছাড়তে হবে।
ডঃ যোশী হেঁটে চলে এলেন স্পেশাল ইঞ্জিনিয়ারের কাছে। তাঁর নামও রয়েছে মৃত্যু-তালিকায়। “কোনওভাবে কি আমরা ফ্লাইট- ডেকটিকে মূল অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারি না,
মিস্টার বাজপেয়ী? মানে বুঝতেই পারছেন, আমি কীজন্য বলছি।”
“সেটা যে পারা যায় না, তা নয়, কিন্তু দেখতে হবে যাতে ফ্লাইট কন্ট্রোলের কোনওরকম ক্ষতি না হয়।”
“মাপ করবেন, স্যার,” অবন মুখার্জির গলা, “আমি খুব ভাল করে চিনি পাইলট রাওকে, আমি একবার তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই।”
“তুমি আমার ছেলের মতো, দ্যাখো, কিছু করা যায় কি না, কিন্তু আপনিও চেষ্টা করে যান, যে-করেই হোক ওকে ওখান থেকে নামিয়ে আনতেই হবে।” বাক্যটির প্রথম অংশ অবনকে অসহায়ভাবে বলে বাকি অংশটি ইঞ্জিনিয়ারকে জানালেন ডঃ যোশি।
ডঃ যোশি এলেন কর্মরত রঙ্গনাথনের কাছে। তিনি একটা বাক্স খুলে যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করছেন। ডঃ যোশি খুব কাতর স্বরে বললেন, “জানি মিস্টার রঙ্গনাথন, আপনার ওপর খুব বেশি চাপ পড়ে যাচ্ছে, তবু কি লেসার-দেওয়ালকে আমরা আর-একটু শক্তিশালী করে তুলতে পারি না? আমি নিজেও ওই কাজে যোগ দিতে চাই, আমি পোশাক পরে আসছি।”
“না, ডঃ যোশি, একাজ আমাদের, আপনি একজন প্রকৃত বিজ্ঞানী, আপনার সিদ্ধান্তের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে, তা ছাড়া আপনার বয়স হয়েছে, এ-কাজটা আমাদেরই করতে দিন।”
কথাগুলো শুনে এই মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়েও ডঃ যোশির বুক ভরে গেল।
পাইলট রাওয়ের চোখের পাতা পড়ছে না। তাঁর চোখ ক্রমশই লাল হয়ে উঠছে। তিনি পাইলট-সিটে বসে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন ভিডিও স্ক্রিনের দিকে। দেখতে পাচ্ছেন কাদার ভেতর দিয়ে উঠে আসছে প্রাণীগুলো, দেখতে পাচ্ছেন রঙ্গনাথন পাঁচ-ছ’জনকে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।
হঠাৎ পাগলের মতো অট্টহাস্য করে উঠলেন পাইলট রাও। তারপর বলে উঠলেন, “আমি সবাইকে বুঝিয়ে দেব আমি কী। প্রত্যেকে বুঝতে পারবে আমি কত বড়, কত বড় একজন পাইলট, কে বলেছে আমি অপরিহার্য নই?”
“পাইলট রাও, আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?” -- অনেক দূর থেকে যেন ভেসে আসছে কথাগুলো, এরকম মনে হল রাওয়ের।
আসলে দরজার তলার থেকে ভেসে আসছে কথাগুলো। চেতনায় ফিরে এসে পাইলট রাও লাফিয়ে উঠলেন। “ও! তুমি! তোমাকে আমি চিনি না? আমার জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে চেয়েছিলে? কী ঔদ্ধত্য!”
কাঁচের ভেতর দিয়ে অবন মুখার্জি দেখলেন যে, পাইলটের হাতে পিস্তল, “ঠিক আছে। আমি ক্ষমা চাইছি পাইলট রাও, কিন্তু আমাকে ভেতরে আসতে দিন, কয়েকটা কথা তো বলা যেতে পারে, আমি আপনার ছাত্রের মতো।”
“তোমার স্থান নরকে, এখানে নয়, যাও, ডঃ যোশিকে বলে দাও, তুমি থেকে যাচ্ছ এখানে, আর আমি চললাম একে উড়িয়ে নিয়ে।”
এদিকে, ইঞ্জিনিয়ার বাজপেয়ী মহাকাশযানটির নীচে দাঁড়িয়ে কাজ করে চলেছেন। তিনি ভাবতেও পারেননি এত তাড়াতাড়ি তাঁর পক্ষে এ-কাজ সম্ভব হয়ে উঠবে। জটিল সব সুইচবোর্ড এবং তার প্যানেলের ওপর সাজানো রয়েছে। তিনি যথা সম্ভব মাথা ঠাণ্ডা রেখে দুটো কেবল্ একসঙ্গে জোড়া দেবার চেষ্টা চালাচ্ছেন। কোনওরকমে ফ্লাইট-ডেকে অবন মুখার্জি প্রবেশ করতে পারলে ঘটনা অন্য খাতে প্রবাহিত হবে।
মিস্টার রঙ্গনাথনও তাঁর সহযোগীদের নিয়ে পরিশ্রম করে চলেছেন। সবুজ জেলির স্তুপ এগিয়ে আসছে ক্রমশ!
“খুলে গেছে” চিৎকার করে উঠলেন বাজপেয়ী। ডঃ যোশি আনন্দিত মুখে ছুটে এলেন বাজপেয়ীর দিকে। ওপরে ফ্লাইট-ডেকের দরজা খুলে অবন মুখার্জি প্রবেশ করলেন৷ মুহুর্তের মধ্যে ভূতগ্রস্তের মতো চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন পাইলট রাও। তাঁর চোখ লাল, মনে হচ্ছে যেন এক্ষুনি ফেটে বেরিয়ে আসবে চোখের মণি।
অবন মুখার্জির বয়স কম। তাঁর হাত কেপে উঠল কিছুক্ষণের জন্য। কী করে এই উদ্ভ্রান্ত মানুষটার ওপর তিনি গুলি চালাবেন বুঝতে পারলেন না। কিন্তু এই দোলাচল অবস্থাই তাঁর জীবনের শেষ ভুল। উদ্ভ্রান্ত পাইলট রাওয়ের এমারজেন্সি পিস্তল থেকে এক টুকরো রশ্মি ছিটকে এল তরুণ অবনের নাকে। অবনের মৃত শরীর লুটিয়ে পড়ল। লুটিয়ে পড়ল সুইচ-বোর্ডের ওপর, যার ফলে পুনরায় কার্যক্ষমতা ফিরে পেল ফ্লাইট-ডেক।
পাগল হয়ে যাবার পূর্ব-মুহুর্তে মানুষ বোধহয় একবার ফের চেতনা ফিরে পায়। অনেকটা সেরকমই ঘটল পাইলট রাওয়ের ক্ষেত্রে। একদিকে মৃত অবনের শরীর আর অন্য দিক থেকে ছুটে আসা দশ-বারো জন, তাদের প্রত্যেকের হাতে মৃত্যুবর্ষী পিস্তল। দিশেহারা পাইলট রাও বুঝতে পারলেন তাঁর আর এ-জীবনে পৃথিবীতে ফিরে যাওয়া হল না। দ্রুত তাঁর হাতের পিস্তল নিজের নাকের কাছে স্থাপন করলেন, এবং ট্রিগার টানলেন।
ডঃ যোশি একটা সিগারেট বের করে ধরালেন। কাছেই দাঁড়িয়ে আছেন রঙ্গনাথন। মহাকাশযান-তিন উড়ে গেছে এই গ্রহ ছেড়ে। একবার ঘড়ি দেখলেন ডঃ যোশি। পাঁচ মিনিট হয়ে গেছে। খুব তাড়াহুড়ো করে কোনওরকমে অবনের শরীরটা নামিয়ে আনা গেছে। রাওয়ের মৃত শরীর ফ্লাইট-ডেকেই থেকে গেছে। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে ডঃ যোশি বললেন, “মিস্টার রঙ্গনাথন, আমাদের মধ্যে থেকে আর-একজন কিন্তু যেতে পারত, যদি পাইলট রাওয়ের শরীর নামিয়ে আনা যেত।”
রঙ্গনাথন হঠাৎ মৃদু হেসে ডঃ যোশিকে বললেন, “একবার কম্পিউটার চালিয়ে দেখবেন নাকি?”
“কেন বলুন তো?”
“না, এমনিই বলছিলাম, জাস্ট ফর ফান্, আমাদের ভেতর থেকে যে যেতে পারত, সেই ভাগ্যবানটির নাম জানতে ইচ্ছে করছে।”
ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ডঃ যোশি হেসে ফেললেন। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, “অবশ্যই দেখা যেতে পারে, চলুন।”
ওদিকে রঙ্গনাথনের নির্দেশে পুরোদমে কাজ চলেছে। যে করেই হোক প্রতিরোধ আরও শক্ত করে তুলতে হবে -- এটাই এদের বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়।
আর কিছুক্ষণ পরেই হয়তো এদের ঘাড়ের ওপর এসে পড়বে মৃত্যুর নিশ্বাস।
ডঃ যোশি ক, খ, গ,র সুইচ-বোর্ডের সামনে এসে বসলেন, সুইচে হাত রাখার সঙ্গে সঙ্গে যে নামটি স্ক্রিনে উঠে এল তা হল “পাইলট-রাও”।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment