ভেংকা

লেখক: আন্তন চেকভ

ভাবানুবাদ: দেবীদাস আচার্য

মস্কো শহরে ছোট্ট একটা জুতো তৈরির কারখানা রয়েছে আলেখিনের। বেশ কজন ছেলে-ছোকরাও কাজ করে। ন’বছরের ভেংকা, মানে ভেংকা জুখভও এই মাসতিনেক হল আছে সেখানে। অন্যদিন এতক্ষণে শুয়ে পড়ে ভেংকা। কিন্তু সেদিন তা করল না। পরদিন খ্রিস্টমাস। ভেংকা বসে বসে অপেক্ষা করতে লাগল। আলেখিন-তার স্ত্রী আর অন্যসব কর্মচারীরা গির্জায় চলে যেতেই চঞ্চল হয়ে উঠল সে। তাক থেকে কালির দোয়াত আর নিবে মরচে ধরে যাওয়া কলমটা পেড়ে নিল। জামার পকেট থেকে শত ভাঁজ করা একটা কাগজ বের করে মেলে ধরল সামনের টেবিলটার ওপর। হাত দিয়ে ঘষে ঘষে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া কাগজটাকে সমান করার চেষ্টা করল কিছুটা। তারপর হাঁটু গেড়ে টেবিলটার সামনে বসে একেবারে ঘাড় গুঁজে লেখার জন্য তৈরি হল।

প্রথম অক্ষরটা লেখার আগেই দরজা আর জানলার দিকে সচকিতে তাকাল বারকয়। তাকের অন্ধকার কোণটাতে একটা মূর্তি বসান। তার দুপাশে মিস্ত্রীদের একগাদা যন্ত্রপাতি রাখা। ভেংকা সেদিকে স্হির তাকিয়ে- থাকে কিছুক্ষণ। হঠাৎ-নিজের অজান্তে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়তেই নড়েচড়ে বসে লিখতে শুরু করে।

“প্রিয় দাদু,

তোমাকে একটা চিঠি লিখছি। আমার তো বাবা নেই। মাও নেই। আমার যা কিছু সব তুমিই। খ্রিস্টমাসের ভালবাসা জেনো। প্রার্থনা করি ভগবান যেন তোমাকে করুণা করেন”।

চিঠি থেকে মুখ তুলে জানলার দিকে আর একবার তাকাল ভেংকা। মোমের শিখার ছায়াটা নাচছে জানলার কাঁচে। সেদিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে ভেংকার চোখের ওপর দাদুর ছায়া ছায়া একটা মূর্তি ভেসে ওঠে।

ভেংকার দাদু কনস্টানটাইন মাকারিখ। জিভারেভ নামে এক ধনীর বাড়িতে নাইটগার্ডের কাজ করে। বয়স-ষাটের কোঠায়। বেঁটে খাটো রোগারোগা চেহারা।তবে এখনও বেশ চটপটে আর প্রাণচঞ্চল। হাল্কা হাসি মুখে। চোখদুটো সারাক্ষণ মদের ঘোর লাগা। দিনের বেলায় সাধারণত ঘুমিয়ে থাকে পেছনদিকের রান্নাঘরটাতে। কিংবা হাসি মস্করা করে কাজের লোকেদের সঙ্গে। রাত্তির হলে চামড়ার কোটটা গায়ে চাপিয়ে হাতে একটা ডান্ডা নিয়ে ঠকঠক করতে সারা চত্বরটা ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। আর কোটটা গায়ে চড়ালেই তার ওই বেজীর মত শরীরটা দেখে কাসতাংকা আর এল নামের কুকুরদুটো সসম্ভ্রমে চলতে থাকে পেছন পেছন।

ঠিক এক্ষুনি হয়ত দাদু এসে দাঁড়াল গেটের কাছটাতে। চার্চের জানলা দিয়ে যে জোরাল আলো এসে পড়েছে চত্বরটা চোখ সেদিকে একবার দেখে নিল। তারপরই পা-পেঁচিয়ে দাঁড়িয়ে চাকরবাকরদের সঙ্গে মস্করায় লেগে গেল। ডাণ্ডাটা ঝুলছে কোমরের বেল্ট থেকে। নিজের মনেই একটা ফিচেল হাসি হেসে কোটের পকেট থেকে নস্যির ডিবেটা বের করে রাঁধুনীর দিকে এগিয়ে ধরে বলল, চলবে নাকি এক টিপ?

মেয়ে মানুষটিও দিব্যি পুরো এক টিপ নস্যি নাকে টেনে নিয়ে হাঁচতে থাকল ঘনঘন। সঙ্গে সঙ্গে হেসে গড়িয়ে পড়ল দাদু, হাঃ হা, হাঃ হাঃ, ঠাণ্ডায় বন্ধ নাকের পক্ষে ভাল না?

হাসির দমকেই কুকুর দুটোর নাকেও নস্যি ভরে দেওয়া হল। কাসতাংকা হাঁচতে হাঁচতে বিরক্ত হয়ে হাঁটা দিল। এলের হাঁচতে ভালই লাগছে বোধ হয়। তাই লেজ নাড়ছে তৃপ্তিতে।

শান্ত প্রকৃতি। নিথর, নিস্তব্ধ। অন্ধকার রাত ঢেকে রেখেছে চারদিক। গ্রামের ভেতর সারিসারি বাড়িগুলো নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে। তাদের ছাদের ওপর সাদা বরফের চাদর পড়ে গেছে অনেকক্ষণ। চিমনিগুলো থেকে ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে। প্রায় বরফ-ঢাকা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাছগুলো।

তাদের মাথার ওপর অজস্র তারা ছড়িয়ে আছে নিকষ কালো আকাশের গায়ে। ছায়াপথটাও কত স্পষ্ট। খ্রিস্টমাসের জন্য যেন সদ্য বানানো হল............

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেংকা! অন্যমনস্ক হাতেই কালির দোয়াতে ডুবিয়ে নিল নিবটা। লিখতে শুরু করে আবার!

“কালকের দিনটা তো একরকম লুকিয়েই কাটিয়েছি। কত্তা আমার চুলের মুঠি ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল উঠোনে। তারপর ঘোড়ার জিনের লম্বা বেল্টটা দিয়েই সপাসপ....। আমার দোষ কী? ওদের বাচ্চাটাকে শুইয়ে রেখে তার পিঠ চাপড়াতে চাপড়াতে ঘুম এসে গিয়েছিল আমার।

এই তো গত সপ্তাহেই একদিন গিন্নিমার সামনে বসে হেরিং মাছ কাটতে হচ্ছিল আমাকে। দোষের মধ্যে লেজের দিকটা কেটে ফেলেছি আগে। তা গিন্নি প্রায় ছুটে এসে মাছটা তুলে নিয়ে মুড়োটা ঘসে দিল আমার মুখে।

আর কারখানায় কাজ শেখে যে ছোকরাগুলো – আমি যেন তাদের হাসির খোরাক। এতেই ইতি হলে তাও বুঝতাম। কত্তার বাগান থেকে শসা চুরি করতে আমায় বাধ্য করে তারা। আর ধরা পড়লে আমার কপালে যা জোটে তা আর না-ই বললাম।

খাবার জোটে না বরাতে। সকালে রুটি মেলে। দুপুরে তাও না - মাড় খানিকটা। সেই রাত্তিরে গিয়ে আবার রুটি। চা না সবজির সুপ না - ওসবই গেলে তারা বসে বসে।

এত সবের পরেও যদি একটু ঘুমোতে পারতাম! যাতায়াতের পথেই শুতে হয় আমাকে। ওদের বাচ্চাটা কেঁদে উঠলেই, উঠে গিয়ে তার পিঠ চাপড়ে ঘুম পাড়াতে হয় আবার। আর সত্যি বলতে কি সারারাতে কতবার যে কেঁদে কেঁদে ওঠে বাচ্চাটা! দুচোখের পাতা এক করতে পারি না।

ঈশ্বরের দোহাই, দাদু, এখান থেকে নিয়ে চল আমাকে। গ্রামে আমাদের বাড়িতে নিয়ে চল। এখানে আর এক দণ্ডও সহ্য করতে পারছি না। ভগবানের কাছে তোমার জন্য অনেক প্রার্থনা করব আমি। দয়া করে নিয়ে চল আমায়। নইলে মারা যাব..............

ভেংকার ঠোঁটদুটো কেঁপে ওঠে। কালো মুঠি দিয়ে চোখ কচলাতে গিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না বেরিয়ে আসে।

-- তোমার জন্য নস্যি গুঁড়িয়ে রাখব --আবার লেখে সে। -- তোমার জন্য প্রার্থনা করব। যদি অবাধ্য হই কখনও, যা ইচ্ছে সাজা দিও - কিচ্ছুটি বলব না। কোন কাজ না থাকলে নায়েবমশাইকে বলব, যদি তাঁর জুতো সাফ করতে দেন আমায়। নইলে ফেদিয়ার বদলে আমিই না হয় ভেড়ার পাল চরাতে যাব। লক্ষ্মীটি দাদু, আর পারছি না। এরা আমাকে মেরেই ফেলবে।

কতবার ভেবেছি পালিয়ে যাব এখান থেকে। পায়ে হেঁটেই। কিন্তু আমার তো জুতো নেই। বরফের রাস্তায় জুতো ছাড়া চলতে বড় কষ্ট হয়।

যখন বড় হব, তোমার দেখাশুনো করব আমি। আঘাত দেব না কখনও। তুমি মারা গেলে তোমার আত্মার শান্তি কামনা করব, যেমনটি করি মায়ের জন্য।

মস্কো শহর তুমি তো জান। সারি সারি বাড়ি, কত গাড়ি ঘোড়া। রাস্তার কুকুরগুলোকে ভয় লাগে না। খ্রিস্টমাসের দিনে সব ছেলেরাই দলবেঁধে চার্চে যায় না গান গাইতে। একবার তাদের সবাইকে দেখেছিলাম বড়শির কাঁটা বিক্রি করতে। যে কোন মাছ ধরার ভাল কাঁটা তুমি পেয়ে যাবে ওদের কাছে। একটা দোকানে দেখলাম কত বন্দুক। আমার মালিকের যেমন আছে, ঠিক তেমনটি। কম করে একশ রুবল দাম হবে একেকটার। আর কসাইয়ের দোকানে বনমোরগ বা খরগোস কাটতে দেখি। জিজ্ঞেস করলেও বলে না কোত্থেকে শিকার করেছে ওগুলো।

বাড়িতে যখন খ্রিস্টমাস ট্রি আসবে তুমি একটা কিছু সরিয়ে রেখো আমার জন্য। মিস ওলগাকে বোলো ওটা ভেংকার জন্য।........

বুক ঠেলে আবার শ্বাস বেরিয়ে আসে। জানলার দিকে তাকায় ভেংকা। মনে পড়ে, দাদুর হাত ধরে সে খ্রিস্টমাস ট্রি আনতে চলেছে। আঃ, কী দিন ছিল সেসব। বনের পথে চলতে চলতে একসময় একটা ফার গাছের তলায় দাঁড়াত তারা। পকেট থেকে পাইপ বের করে ধরিয়ে নিত দাদু। বড় একটিপ নস্যির টান দিত নাকে। মুচকি হেসে দেখত পাশে দাঁড়িয়ে ছোট্ট ভেংকা হি হি করছে শীতে। হঠাৎ একটা খরগোস তীরবেগে ছটে যেত সামনে দিয়ে। চেঁচিয়ে উঠত দাদু, এই, ধর ধর ধর। যা পালাল।

অনেক কষ্টে খ্রিস্টমাস টি বাড়িতে পৌঁছলে তাকে সাজান শুরু হত। মিস ওলগাই সব থেকে ব্যস্ত সে কাজে। মিস ওলগাকে খুব ভাল লাগে ভেংকার | তখন তার মাও বেঁচে ছিল। কাজ করত ওই বাড়িতেই। মিস গুলগা কত কিছুই না দিত তাকে। মিষ্টি, কেক আরও কত কি। তাকে পড়তে শেখাত বসে বসে, পড়া, লেখা, গোনা......। তার কাছে একটু একটু করে নাচও শিখেছিল ভেংকা। মাটাও মারা গেল আর অনাথ ভেংকার জায়গা হল পেছন দিকের ওই রান্নাঘরটাতে। দাদুর সঙ্গেই। তারপর মস্কো.......তারপর..........

এই জুতোর কারখানায়...

-- লক্ষী দাদু আমার, আবার শুরু করে ভেংকা -- আমাকে নিয়ে যাও এখান থেকে। খ্রিস্টমাসে এই শুধু আমার প্রার্থনা। এই অনাথ বালককে একটু দয়া কর, দয়া কর। এরা কেউ একটুও দয়া দেখায় না কখনও। খাবার জোটে না কপালে। শুধু মার জোটে। আমি কাঁদতে থাকি সবসময়। জুতোর ফর্মা দিয়ে মালিক একদিন মারল এমন যে আমি আছাড় খেয়ে পড়লাম মাটিতে। মনে হল আর কখনও বুঝি উঠে দাঁড়াতে পারব না। কুকুরের চেয়েও শোচনীয় জীবন আমার।

কোচওয়ানকে আমার ভালবাসা জানিও। আর হ্যাঁ, আমার বাজনাটা যেন দিয়ে দিও না কাউকে। আমার বড় সখের জিনিস ওটা। তুমি আমার আদর নিও আর শিগগির এসো আমায় নিয়ে যেতে। এসো দাদু......!

ইতি

তোমার নাতি

ইভান জুখভ

সন্তর্পণে কাগজটা চার ভাঁজ করে একটা খামে ঢুকিয়ে নিল ভেংকা। এক কোপেক দিয়ে খামটা কিনে রেখেছিল আগের দিনই। এক মুহূর্ত চুপ করে কি যেন ভাবল বসে। তারপর নিবটা আর একবার কালিতে ডুবিয়ে নিয়ে লিখল “আমার দাদু৷ লিখে ঠিক সন্তুষ্ট হল না। মাথা চুলকোতে চুলকোতে আবার কী ভাবল বোধ হয়। লিখল:

“আমাদের গ্রামের কনস্টান্টাইন মাকারিখ”

এতক্ষণে চোখে মুখে একটা তৃপ্তির ঝিলিক দেখা গেল ভেংকার। চিঠি লেখাটা যে এত নির্বিঘ্নে হয়ে যাবে ভাবতেই পারেনি। মাথায় টুপির নিচে লুকিয়ে নিল চিঠিটা। তারপর একছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। খেয়ালই করল নাযে ওই ঠাণ্ডায় ফিনফিনে একটা জামা শুধু গায়ে। বাইরে যেতে গেলে কোটটা গায়ে চাপানো দরকার।

চিঠিপত্রের ব্যাপারে আগের দিনই একটু খোঁজখবর নিয়েছিল সে কসাইয়ের দোকানের লোকগুলোর কাছে। তারাই বলছিল ডাকবাক্সে ফেলে দিতে হয় চিঠি। তারপর তিনটে ঘোড়ায় টানা গাড়িতে করে কোচওয়ানরা সে চিঠি নিয়ে যায় দূরে দূরে -- যার যেখানে যাওয়া দরকার। এসব জেনেই না চিঠি লেখার ভরসা পেয়েছিল ভেংকা।

ছুটতে ছুটতে এক্কেবারে ডাকবাক্সের সামনে এসে দাঁড়াল সে। চোখের মণি তার ওই চিঠিটা ফেলে দিল তার ভেতরে।

মনটা হাল্কা হয়ে গেল খুব। যেন কারও ওপর রাগ নেই আর, কোনও দুঃখ নেই। আশার দোলায় দোলায় ঘণ্টাখানেক বাদে গভীর ঘুম এসে জড়িয়ে ধরল তাকে...... ঘুমের মাঝে ভেসে এল এক আলোর স্বপ্ন। সে আগুনের সামনে বসে পা দোলাতে দোলাতে দাদু তার চিঠিটাই পড়ে শোনাচ্ছে চাকরবাকরদের..... পোষা কুকুর এলটাও যেন কী এক সুখের গন্ধ পেয়ে লেজ নেড়ে নেড়ে ঘুরছে সামনেটায়।

ভাবানুবাদ: দেবীদাস আচার্য

No comments:

Post a Comment