কৌতুহলী কনের কাঁটা (প্রথমাংশ)

লেখক: নারায়ণ স্যান্যাল

এক

ইন্টারকমে ভেসে এল রানী দেবীর কন্ঠস্বর, তোমার সঙ্গে একজন দেখা করতে চাইছে।

বাসু-সাহেব একটি এফিডেবিটের ড্রাফট সংশোধন করছিলেন। ইন্টারকমেই জানতে চান, ‘চাইছে’ বললে যখন, তখন নিশ্চয় অল্পবয়সী। ছেলে না মেয়ে?

-- দ্বিতীয়টা।

-- বিবাহিতা না কুমারী?

-- চাবিটা তো তোমার বাঁ-দিকের ড্রয়ারে আছে।

-- চাবি! কিসের চাবি?

-- আচ্ছা, আসছি আমি।

একটু পরেই হুইল-চেয়ারে পাক মেরে রানী এ ঘরে চলে আসেন। মানে, ব্যারিস্টার পি. কে. বাসুর খাশ-কামরায়। উনি ইনভ্যালিড-চেয়ারেই সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ান। কারণ তিনিই ব্যারিস্টার-সাহেবের রিসেপশনিস্ট তথা জীবনসঙ্গিনী।

রানী দরজা খুলে এ ঘরে এলেন। অটোমেটিক ডোর-ক্লোজারের অমোঘ আকর্ষণে একপাল্লার ফ্লাশ-পাল্লা নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে গেল। বাসু জানতে চান, চাবির কথা কী বলছিলে? চাবি তো হারায়নি কিছু?

রানী মুখে আঁচল চাপা দেন। হাসির দমক একটু কমলে বলেন, একে ব্যারিস্টার, তায় গোয়েন্দা!

চাবির রহস্যটা ধরতে পারলে না? সাক্ষাৎপ্রার্থিনী আমার সামনেই বসে আছে। তার নাকের ডগায় বসে কোন আক্কেলে বলি,শুধু বিবাহিতা নয়,সদ্য বিয়ের জল

পাওয়া কনে! অষ্টমঙ্গলা পার হয়েছে কি হয়নি।

বাসু-সাহেব পকেট থেকে পাইপ-পাউচ বার করতে করতে বলেন,কীভাবে এ সিদ্ধান্তে এলে?

-- ওটা বোঝা যায়, বোঝানো যায় না।

-- তবু?

-- রাতে ভালো ঘুম হয়নি, মুখটা ফুলো ফুলো --বাঁ হাতের অনামিকায় যে আংটি পরেছে সেটায় অভ্যস্ত হয়নি, বারে বারে ডান হাতের আঙুল দিয়ে পাকাচ্ছে। সিঁথিতে সিঁদুর পরার ঢংটা দেখেও বোঝা যায়, অভ্যস্ত হাতের কাজ নয়।

তাছাড়া ও পুরুষমানুষ বুঝুক না বুঝুক, আমরা দেখলেই বুঝতে পারি।

-- কী নাম?

-- শিখা দত্ত।

-- কী চায়?

-- সে কথা শুধু তোমাকেই বলতে চায়। কী-সব লিগ্যাল অ্যাডভাইস।

-- ঠিক আছে। পাঠিয়ে দাও। কৌশিক আর সুজাতা কোথায়?

-- ওরা দু’জনেই বেরিয়েছে। আচ্ছা, মেয়েটিকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

তে-চাকা গাড়িতে পাক মেরে রানী চলে গেলেন পাশের ঘরে। যেটাকে গৌরবে বলা হয় রিসেপশান কাউন্টার। শুধু বাসু-সাহেবের নয়, ও পাশের উইং-এ “সুকৌশলী”-র রিসেপশান অফিসও ওইটাই।

একটু পরে দরজায় কেউ নক করল।

-- ইয়েস। কাম ইন, প্লিজ।

ভিতরে এল মেয়েটি। সপ্রতিভভাবে নমস্কার করল। বছর পঁচিশ-ছাবিবশ। আহা-মরি সুন্দরী কিছু নয়, তবে স্বাস্থ্যবতী, যৌবনের চটক আছে। দীর্ঘাঙ্গী। দেহসৌষ্ঠবও ভালো। লালচে রঙের একটা মুর্শিদাবাদি পরেছে, ম্যাচ-করা ব্লাউজ। খুব সম্তব রানী দেবীর অনুমান নির্ভুল : সদ্যোবিবাহিতা। কিন্ত ওর চোখে কুমারী মেয়ের ভীরু সরলতা। হাত তুলে নমস্কার করল বটে, চোখ তুলে তাকাতে পারল না।

-- বোস ওই সোফাটায়। বল শিখা, কী তোমার সমস্যা?

বসল। কিন্তু এখনও চোখের দিকে তাকাতে পারছে না। আঁচলের প্রান্তটা আঙুলে জড়াতে জড়াতে বললে, আজ্ঞে না, সমস্যাটা আমার নয়, আমার বন্ধুর, মানে বান্ধবীর --

-- আই সী! কী সমস্যা তোমার বন্ধুর, মানে বান্ধবীর?

-- আমার বান্ধবীর স্বামী নিরুদ্দেশ হয়ে গেছিল। অনেকদিন আগে। শুনেছি, “লিগ্যাল ডেথ” বলে একটা কথা আছে -- মানে, যখন ওই রকম নিরুদ্দিষ্ট মানুষকে আইনত মৃত বলে ধরা হয় -- সেটা কত বছর?

বাসু-সাহেব সেপ্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলেন, বয়স কত?

-- কার? আমার বান্ধবীর ?

-- না। তোমার?

শিখা একটু নড়ে চড়ে বসল। হ্যান্ডব্যাগটা এতক্ষণ রাখা ছিল ওর কোলের ওপর। এবার সেটাকে সোফার পাশে নামিয়ে রাখল। তারপর বলল, সাতাশ।

তুমি যে বিবাহিতা তা তো দেখতেই পাচ্ছি, আমার সেক্রেটারির অনুমান : তুমি সদ্যোবিবাহিতা। কতদিন বিয়ে হয়েছে তোমার?

এতক্ষণে মেয়েটি চোখে চোখে তাকায়। বলে, প্লিজ স্যার, আমার প্রসঙ্গ থাক। আমার নাম, বয়স, ইত্যাদি সব কিছুই ফালতু কথা। আমি আগেই আপনাকে বলেছি যে, আমার এ সাক্ষাৎকার আমার এক বান্ধবীর তরফে। সে নিজে আসতে পারছে না বলেই আমাকে পাঠিয়েছে।

বাসু বললেন, রানু -- মানে আমার সেক্রেটারি -- বাই দ্য ওয়ে, উনি আমার বেটার-হাফও বটেন -- এসব বিষয়ে সচরাচর ভুল করে না। ও বলছিল, তোমাদের অষ্টমঙ্গলা হয়েছে-কি-হয়নি।

-- তোমরা হানিমুনে যাওনি কোথাও? মধুচন্দ্রিমায়?

মেয়েটি দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে দেড়-মুহূর্ত নীরবে নিজেকে সংযত করল। তারপর একেবারে নিরুত্তাপকণ্ঠে বলতে থাকে, আমার বান্ধবীর স্বামী হরিদ্বার থেকে বদ্রিনারায়ণ যাচ্ছিল। অনেকদিন আগে। যাত্রীবাহী বাসটা খাদে পড়ে যায়। পুলিশ রিপোর্টে জানা যায় যে, পেট্রল ট্যাঙ্কে আগুন ধরে বহু লোক জীবন্ত দগ্ধ হয়। বহু যাত্রীর দেহ শনাক্ত করা যায়নি। কিন্তু যাত্রীর তালিকায় -- মানে অফিসে যে টিকিট বিক্রি হয়েছিল তার কাউন্টার ফয়েলে -- আমার বান্ধবীর স্বামীর নাম ছিল। তারপর আর তাকে কেউ দেখেনি....

-- কতদিন আগে?

-- বছরসাতেক।

-- এই সাত বছরের মধ্যে নিরুদিষ্ট ব্যক্তির জীবিত থাকার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি? কেউ কখনও তাকে দেখেনি, বা তার চিঠি পায়নি?

-- হ্যাঁ, তাই।

-- তোমার বিয়ে হয়েছে কবে?

-- প্লিজ, স্যার -- আমাকে রেহাই দিন! আপনাকে বারে বারে একই কথা শোনাতে আমারই বিরক্ত লাগছে, আপনারও নিশ্চয় তাই। আবার বলি, আমি এসেছি আমার বান্ধবীর তরফে।

আমার মনে হচ্ছে নিরুদ্দিষ্ট ব্যক্তির কিছু জীবনবীমা করা ছিল, আর তার স্ত্রী ইনসিওরেন্স কোম্পানি থেকে টাকাটা আদায় করতে পারছে না, যেহেতু সে “ডেথ সার্টিফিকেট” দেখাতে পারছে না। তাই কি?

-- আজ্ঞে, হ্যাঁ তাই। সেটাও একটা সমস্যা।

-- একটা সমস্যা! তাহলে মূল সমস্যাটা কী?

-- আমার বান্ধবী জানতে চায়, সাত বছর যখন অতিক্রান্ত তখন সে কি আইনত বিধবা নয়? সে কি আবার বিয়ে করতে পারে? আইনত?

-- ঠিক কতদিন আগে বাস দুর্ঘটনা ঘটেছিল?

-- সাত বছরের চেয়ে দু-তিন মাস বেশি। অবশ্য সে যখন...

মাঝপথেই মেয়েটি থেমে যায়। বাসু-সাহেব ওর অসমাপ্ত বাক্যের শব্দদুটি পুনরুচ্চারণ করেন একটা জিজ্ঞাসা চিহ্নের লেজুড় জুড়ে দিয়ে, ‘অবশ্য সে যখন...?”

-- সে যখন এই নতুন ছেলেটির সঙ্গে পরিচিত হয়...মানে, যাকে সে এখন বিবাহ করতে চাইছে...অর্থাৎ সে যদি আইনত বিধবা হয়...

বাসু নীরবে পাইপে কয়েকটা টান দিয়ে বললেন, তোমার বান্ধবীর আর কোনও কিছু জিজ্ঞাস্য নেই?

-- আছে...মানে, সে একটা আইনের লবজ-এর প্রকৃত অর্থটা জানতে চায়...আমাকে জেনে যেতে বলেছে...অবশ্য নিছক কৌতৃহল...

-- “আইনের লব্জ”? কী কথাটা?

-- corpus delicti...কথাটার মানে কী?

বাসু-সাহেব সোজা হয়ে বসলেন। কুঞ্চিত ভ্রুভঙ্গে প্রশ্ন করলেন, তোমার বান্ধবী হঠাৎ ওই ল্যাটিন শব্দটার অর্থ জানতে কৌতৃহলী হলেন কেন?

-- না, মানে..আসলে সে জানতে চেয়েছে...এটা কি আইনের নির্দেশ যে, হত্যাপরাধে কাউকে অপরাধী হিসাবে চিহ্নিত করতে হলে মৃত ব্যক্তির মৃতদেহের অস্তিত্বটা প্রসিকিউশনকে প্রমাণ করতে হবে?

-- সেটাই বা তোমার বান্ধবী জানতে চাইছেন কেন?

-- একটা গোয়েন্দা গল্পে তাই লেখা হয়েছে। কথাটা কি ঠিক?

বাসু মুখ থেকে পাইপটা সরিয়ে গম্তীরভাবে বললেন, বুঝলাম। তার মানে এটাই দাঁড়াচ্ছে যে, তোমার বান্ধবী চাইছেন তার মৃত স্বামীর: দেহের অস্তিত্বটা প্রমাণিত হোক, যাতে এক নম্বর : তিনি ইনসিওর করা টাকাটা আদায় করতে পারেন, দু-নম্বর : সদ্যোপরিচিত পাণিপ্রার্থীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারেন, এবং, একই সঙ্গে, তোমার বান্ধবী চাইছেন, যেন তাঁর নিরুদ্দিষ্ট স্বামীর মৃতদেহের অস্তিত্বটা পুলিসে না প্রমাণ করতে পারে, কারণ সেক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধ স্বামীহত্যার মামলা দায়ের করা যেতে পারে। মোদ্দা ব্যাপারটা তো এই?

মেয়েটি যেন ইলেকট্রিক শক খেয়েছে। সোজা হয়ে উঠে বসে বলে, এসব কী বলছেন আপনি ?....বাঃ! ‘‘corpus delicti” কথাটার মানে তো সে জানতে চেয়েছে আ্যাকাডেমিক্যালি, মানে একটা গোয়েন্দা গল্পে...

বাসু একটা হাত তুলে ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিলেন। বললেন, একটা কথা বুঝিয়ে বলো তো?

-- তোমার বান্ধবী কি আমার স্ত্রীর মতো হুইল-চেয়ারব্যবহার করেন? তিনি কি প্রতিবন্ধী?

-- না, তা হতে যাবে কেন?

-- তাহলে তাকে বল, আমার সেক্রেটারির সঙ্গে টেলিফোনে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে নিজেই চলে আসতে। দেখ শিখা, ‘‘corpus delicti” শব্দের অর্থ তোমার বান্ধবী না জানলেও তার ক্ষতি নেই; কিন্ত প্রতিটি মানুষের জানা উচিত যে, ডাক্তারের কাছে রোগের উপসর্গ আর সলিসিটারের কাছে সত্য ঘটনা গোপন করতে নেই। তার সমস্যার কথা তিনিই যেন স্বয়ং এসে আমাকে সরাসরি জানান।

মেয়েটি রুখে ওঠে, কিন্তু কেন? আমি তার প্রতিনিধি, তার তরফে আমি জানতে এসেছি-- সেই আমাকে পাঠিয়েছে। এক্ষেত্রে...

-- ক্ল্যায়েন্টের নামধাম না জেনে আমি কখনও কাউকে লিগ্যাল আ্যাডভাইস দিই না। তোমার বান্ধবী ইনভ্যালিড নন একথা তুমি বলেছ। আশা করি তিনি পর্দানসিনও নন। তাকে স্বয়ং আসতে বল, কেমন?

মেয়েটি কী একটা কথা বলতে গেল। বলল না। হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। তার মুখচোখ লাল হয়ে উঠেছে। অপমান, অভিমান, না উত্তেজনায় বোঝা গেল না। কোনো কথা না বলে গটগট্‌ করে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। বাসু-সাহেবের মুখের হাসিটা মিলিয়ে যায়নি। তিনি প্রতিমুহূর্তেই আশা করছিলেন, মেয়েটির সুবুদ্ধি হবে, সে থমকে দাঁড়াবে। ফিরে আসবে। তা সে এল না। একবার পিছন ফিরে তাকালো না পর্যন্ত। মাথা খাড়া রেখেই সে ঘর ছেড়ে বার হয়ে গেল।

বাসু-সাহেবের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। বিষন্নভাবে তিনি আপন মনেই মাথা নাড়লেন। দু-হাতের কনুই গ্লাসটপ টেবিলে রেখে দু-হাতে মুখটা ঢাকলেন।

-- কী হল? এত তাড়াতাড়ি শিখা চলে গেল যে?

চোখ তুলে দেখলেন, নিঃশব্দে কখন রানী প্রবেশ করেছেন ঘরে।

-- ও কিছুতেই স্বীকার করল না, সমস্যাটা ওর নিজের। ভেবেছিলাম, ও ভেঙে পড়বে, মন খুলে সব কথা বলবে। আমি ওর বাবার বয়সী, কিংবা তার চেয়েও বড়ো। কিন্ত মেয়েটা আমার কাছে মন খুলে সব কথা বলল না। ভারি জেদী মেয়ে। আত্মসম্মান জ্ঞানটা প্রখর।

-- ও যে বিয়ের কনে এখনও, অন্তত সেটুকু স্বীকার করেছে?

-- ও মা! কেন করবে? সমস্যাটা যে ওর ‘বান্ধবী’র। ওর কথা যতবার তুলতে গেলাম ততবারই বাধা ;দিল। ওর নাম যে “শিখা দত্ত” নয় এটা নিশ্চিত। নাম ভাঁড়িয়ে ও এসেছিল, কিছু আইনের ব্যাখ্যা জেনে যেতে। ভেবেছিল সেটুকু হাতিয়ার দখলে পেলে ও নিজেই ওর প্রথম পক্ষের স্বামীর সঙ্গে লড়তে পারবে! কিন্ত ওভাবে কোনও ক্লায়েন্টকে আমি অন্ধকারে টিল ছুঁড়তে দিতে পারি না-- মেয়েটা সে’কথা বুঝল না!

-- ওর প্রথম পক্ষের স্বামী? ও বলেছে?

ও বলবে কেন? সেটা তো এখন সূর্যোদয়ের মতো স্বয়ংপ্রকাশ! সাত বছর আগে ওর প্রথম পক্ষের স্বামী একটা বাস-আ্যাকসিডেন্টে মারা যায় -- অন্তত এটাই ছিল ওর ধারণা! সেই বিশ্বাসে ও বোধকরি ভালোবেসে সম্প্রতি বিয়ে করেছে -- সাত বছরের বৈধব্য জীবন অতিক্রম করে। আর তারপরেই ও জানতে পেরেছে ওর প্রথম পক্ষের স্বামী জীবিত!

-- তাহলে? এ সব কথা সে বলেনি?

-- কিছুই বলেনি। এ সবই আমার অনুমান। ও তো শুধু ওর বান্ধবীর কথা শোনাতে এসেছিল।

ব্যাকুলকণ্ঠে রানী জানতে চান, তুমি যা অনুমান করছ তার ফলে কী হবে?

- তা কেমন করে জানব রানু। প্রথম কথা, সাত বছর ওর স্বামী আত্মগোপন করে রইল কেন? অ্যামনেশিয়া? মানে স্মৃতিভ্রংশ? নাকি, সে প্রতীক্ষায় ছিল কতদিনে মেয়েটি আবার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয় -- কারণ তারপর থেকেই যে তার ব্ল্যাকমেলিঙের খেলা শুরু করতে পারবে।

-- কিসের ব্ল্যাকমেলিং?

-- বাঃ! প্রথম স্বামী জীবিত আছে এটা প্রমাণিত হলেই তো তার দ্বিতীয় বিবাহ অসিদ্ধ! ভালোবেসে যদি বিয়ে করে থাকে তাহলে বাকি জীবন তাকে গহনা বেচে বেচে প্রথম পক্ষের স্বামীকে টাকা জুগিয়ে যেতে হবে!

-- কী সর্বনাশ! তাহলে তোমার ক্লায়েন্ট...

-- কে আমার ক্লায়েন্ট? ওই একগুঁয়ে জেদী মেয়েটা? যার নাম পর্যন্ত আমি জানি না? যে আমাকে বিশ্বাস করে মন খুলে তার সমস্যার কথা বলতে পারল না? বাপের বয়সী...

বাধা দিয়ে রানী বলে ওঠেন, “শিখা দত্ত” ওর নাম হোক না হোক, সে তোমার ক্লায়েন্ট তো বটেই। ওই নামেই তো রসিদটা কেটেছি আমি!

এবার বাসুসাহেবের ইলেকট্রিক শক খাবার পালা।

ধীরে ধীরে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি : কী? কী বললে? রসিদ? রিসিট? তুমি কি ওর কাছ থেকে কিছু রিটেইনার নিয়েছ? টাকা নিয়েছ?

-- হ্যাঁ। মেয়েটি নিজে থেকেই একটা একশো টাকার নোট আমার টেবিলে রেখে দিয়ে বললে,এটা রাখুন। আমার রিটেইনার! আমি ওঁর কাছ থেকে কিছু লিগ্যাল অ্যাডভাইস নিতে এসেছি!

-- মাই গড! দেন...দেন শী ইজ মাই ক্লয়েন্ট! অগ্রিম টাকা দিয়ে সে আমার কাছে পরামর্শ চাইতে এসেছিল। আর আমি তাকে নিয়ে শুধু ব্যঙ্গ করেছি, তার আত্মাভিমানে আঘাত করে...ছি! ছি! ছি!

অশান্তভাবে ঘরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত একবার পদচারণা করেই থমকে থেমে পড়েন। বলেন, -- ওকে খুঁজে বার করতেই হবে। ও প্রচণ্ড বিপদে পড়েছে। ওকে রক্ষা করা আমার ধর্ম...

প্রৌঢ় মানুষটি প্রায় ছুটে বেরিয়ে যেতে চাইলেন ঘর ছেড়ে। প্রায় ধাক্কা লাগার মত অবস্থা। সেদিক থেকে ঘরে ঢুকছিল কৌশিক। বললে, কী ব্যাপার? কাকে খুঁজছেন?

-- একটি মেয়ে। রানী-কালারের মুর্শিদাবাদি শাড়ি -- আ্যারাউন্ড পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি -- বয়স সাতাশ--

-- হ্যাঁ, সে চলে গেছে। আমি যখন গেট খুলে ঢুকছি, তখনই। একটা ফোর-ডোর মারুতি-সুজুকি চালিয়ে। মেয়েটি অবশ্য জানে না যে, একজন অ্যামেচারিশ গোয়েন্দা তাকে ফলো করছে...

-- তুমি কি করে জানলে?

-- গোয়েন্দাটা ছিল ওই মিষ্টির দোকানের কাছে। একটা জিপে। আপনার ক্লায়েন্ট মারুতিতে স্টার্ট দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেও জিপটা চালু করে। মেয়েটির পিছন পিছন সেও চলে গেল- প্রায় বিশ মিটার দূরত্ব বজায় রেখে।

-- এটা একটা কোয়িন্সিডেন্সও তো হতে পারে।

-- না পারে না। মেয়েটিকে দেখার আগে-- ইন ফ্যাক্ট, সে আপনার চেম্বার থেকে বের হবার আগেই ওই জিপের ড্রাইভারটিকে আমার নজরে পড়ে। তখন আমি বাড়ি থেকে প্রায় ত্রিশ মিটার দূরে। লোকটার হাতে একটা বাইনোকুলার ছিল। দৃষ্টি আপনার ঘরের দিকে। মেয়েটি আপনার ঘর ছেড়ে বার হওয়া মাত্র সে বাইনোটা ঝোলা ব্যাগে ভরে নেয়।

-- সে লোকটা কি জানে যে, তুমি তাকে লক্ষ্য করেছ?

-- জানি না, কিন্তু এটুকু তার বিশ্বাস আছে যে, ভবিষ্যতে তাকে আমি শনাক্ত করতে পারব না। কারণ ওর ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, গোঁফ, টুপি, গগল সব কিছুই টিপিক্যাল আ্যামেচারিশ গোয়েন্দার ছদ্মবেশ!

কৌশিককে সঙ্গে নিয়ে বাসু-সাহেব ফিরে এলেন তার চেম্বারে।

নজরে পড়ে, রানী তার চাকা-দেওয়া চেয়ারে বসেই মেঝে থেকে কী একটা জিনিস তুলবার চেষ্টা করছেন। পারছেন না।

কী করছ তুমি?

রানী সোজা হয়ে বসলেন। বললেন, তোমার ক্লায়েন্ট একটা ব্যাগ ভুলে ফেলে গেছে। এতক্ষণে নজরে পড়ে। যে ভিজিটার্স-সোফায় মেয়েটি বসেছিল তার পাশে পড়ে আছে একটা লেডিজ-ব্যাগ। কৌশিক সেটা সাবধানে তুলে আনে। বাসু-সাহেবের হাতে দেয়। বাসু নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলেন একটা প্যাড আর ডট পেন রানীর দিকে বাড়িয়ে ধরে বললেন, লেখ --

-- কী লিখব?

-- ইনভেন্ট্রি। লেডিজ হাতব্যাগে কী কী পাওয়া গেল তার তালিকা।

সাবধানে ব্যাগ থেকে একটি একটি করে গচ্ছিত সম্পদগুলি তাঁর গ্লাসটপ টেবিলে সাজিয়ে রাখতে রাখতে ঘোষণা করতে থাকেন : একটা লেসবসানো লেডিজ রুমাল, একটা পার্স -- তাতে নোট আর খুচরোয় মিলিয়ে দুশো বাহাত্তর টাকা আশি পয়সা, লিপস্টিক একটা, কম্প্যাক্ট একটা। একটা ওষুধের শিশি -- ভিতরে সাদা রঙের ট্যাবলেট। ওষুধের নাম ‘ইপ্রাল’। একটা বড় হাতলওয়ালা চিরুনি, টেলিগ্রামের খাম একটা। টেলিগ্রামের প্রাপক সি রায়, একুশের-এক বেণীমাধব সরকার লেন। টেলিগ্রামের বক্তব্য : ‘শুক্রবার সন্ধ্যা ছয়টা হচ্ছে সময়ের শেষসীমা -- কমলেশ’.. হঠাৎ মুখ তুলে বলেন, আজ কী বার?

-- আজই তো শুক্রবার।-কৌশিক জবাবে জানায়।

বাসু আবার ব্যাগের ভিতর হাত চালিয়ে দেন। তোয়ালে জড়ানো ভারী কী একটা ব্যাগের তলা থেকে উদ্ধার করে আনেন। সাবধানে তোয়ালের পাক খুলে বলে ওঠেন : দ্যাখো কাণ্ড! তাঁর হাতে একটি ঝকঝকে ছোট্ট রিভলভার!

রানী আঁৎকে ওঠেন: কী সর্বনাশ!

বাসু নির্বিকার। বলে চলেন, লিখে নাও -- পয়েন্ট থ্রি টু ক্যালিবারের কোল্ট অটোমেটিক। নাম্বার : থ্রি-সেভেন-ফাইভ-নাইন-সিক্স-টু-ওয়ান। ম্যাগাজিন চেম্বারে ছয়টা স্টিল-জ্যাকেট বুলেট। ব্যারেল সাফা। বারুদের গন্ধ নেই। ছ’টা বুলেটই তাজা।

প্রতিটি বস্তু নিজেই রুমাল দিয়ে সাফ করে অর্থাৎ আঙুলের ছাপ মুছে নিয়ে আবার ভরে রাখলেন। শুধু টেলিগ্রামখানা ভরে নিলেন নিজের পকেটে।

রানী বলেন, -- রিভলভার নিয়ে ঘুরছে কেন?

বাসু বলেন, -- খুনি বলে যখন আশঙ্কা করা যাচ্ছে না, তখন আত্মরক্ষার্থে নিশ্চয়।

কৌশিক বলে ওঠে, কলকাতা শহরে কেউ আত্মরক্ষার্থে রিভলভার নিয়ে ঘোরাফেরা করে না। বাসু বলেন, তাহলে বোধহয় টিফিন বক্স নিতে গিয়ে ভুল করে রিভলভারটা ব্যাগে ভরেছিল।

রানী ধমক দেন, রসিকতা থাক। রিভলভার নিয়ে ঘোরাফেরা করার হেতু নিশ্চয় আছে। মেয়েটি জানে, তার সামনে প্রচণ্ড বিপদ আসতে পারে!

বাসু প্রসঙ্গটা অন্যদিকে মোড় ঘোরালেন, রানু, দেখতো মেয়েটি রেজিস্টারে নিজের কী ঠিকানা লিখেছে?।

ব্যারিস্টার-সাহেবের সঙ্গে যারা দেখা করতে আসে – অর্থাৎ ক্লায়েন্ট হিসাবে -- তাদের একটা রেজিস্টারে নাম-ধাম স্বহস্তে লিখতে হয়। স্বাক্ষরও করতে হয়।

সেই রেজিস্টার দেখে রানী বললেন, নামধাম ও যা লিখেছে তা হল : “শিখা দত্ত, একশ বত্রিশ নসিরাম পতিতুণ্ড সেকেন্ড বাই লেন”।

বাসু কৌশিকের দিকে ফিরে জানতে চান, চেন?

-- শিখা দত্তকে?

-- আরে না রে বাপু। কলকাতা শহরে নসিরাম পতিতুণ্ডের নামে কোনও রাস্তা? কৌশিক নেতিবাচক মাথা নেড়েই থামে না। বইয়ের র্যা ক থেকে কলকাতা শহরের পথনির্দেশিকা দেখে নিয়ে বলে, -- সেকেন্ড বাই লেন দুরঅন্তর! ও নামে কোনও রাস্তাই নেই!

-- অলরাইট! আমি একটু বেরুচ্ছি! একফোঁটা একটা মেয়ে এভাবে তেজ দেখিয়ে বেরিয়ে যাবে! ওকে খুঁজে বার করতেই হবে।

রানী বলেন, পৌনে তিনশো টাকার মায়ায় না হলেও ওই রিভলভারটার জন্য ওকে ফিরে আসতেই হবে।

বাসু-সাহেব পিঞ্জরাবদ্ধ শার্দূলের মতো ঘরময় পায়চারি করছিলেন। রানীর কথায় থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন। বলেন, আসবে না! লিখে দিতে পারি। ভারি জেদী মেয়ে। ও জানে,আমার চেম্বারে ওর রিভলভারটা থাকাও যা, ব্যাঙ্ক ভল্টে থাকাও তাই। কিন্ত হতভাগিটা নিরস্ত্র হয়ে গেল যে----

কৌশিক প্রশ্ন করে, আপনি কোথায় যাবেন খোঁজ নিতে?

-- সেকথা তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। তুমি, বরং লালবাজারে চলে যাও আমার গাড়িটা নিয়ে।

রবিকে ধরো, রবি বোস, পুলিস ইন্সপেক্টর! আমাকে খুব শ্রদ্ধা করে। তার মাধ্যমে দেখ, ওই রিভলভারটার লাইসেন্সি কে! ভালো কথা, গাড়ি দুটোর নম্বর নোট করে নিয়েছিলে?

-- জিপের নম্বরটা টুকেছি; কিন্তু মারুতির নম্বরটা...

-- টোকনি! কারণ সেটাই যে আমার বিশেষ প্রয়োজন!

কী আশ্চর্য! আপনি খামোকা রাগ করছেন। দু-দুটো গাড়ি হুস-হুস করে বেরিয়ে গেল নাকের ডগা দিয়ে। ন্যাচারালি আমি শুধু পিছনের গাড়ির নম্বরটা টুকে নেবার সুযোগ পেয়েছি...আর তাছাড়া আমি কেমন করে জানব যে, আপনি আপনার ক্লায়েন্টের নাম-ধাম জানেন না?

বাসু-সাহেব ওর দিকে একটা অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে হনহন করে বেরিয়ে গেলেন।



দুই

বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল একটা ট্যাক্সি। পাড়ারই। বাসু এগিয়ে এসে বললেন, কী যেন নাম তোমার?

-- রসিদ আলি, স্যার।

-- ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। রসিদ! তা তুমি বেণীমাধব সরকার লেন চেন?

-- জী হাঁ, নজদিগই। কেতনা নম্বর?

-- একুশের-এক। বাড়িটার থেকে কিছু দূরে ট্যাক্সিটা থামিও। অপেক্ষা করতে হবে। আমি ওদের জানাতে চাই না যে ট্যাক্সি করে এসেছি। বুঝলে? নাও এট ধরো, এটা তোমার মিটারের

উপর।

প্রয়োজন ছিল না। পাড়ার ট্যাক্সি। বাসু-সাহেবকে ট্যাক্সি-ড্রাইভার ভালো করেই চেনে। সে কোনও উচ্চবাচ্য করল না। নোটখানা নিয়ে কপালে ঠেকিয়ে পকেটে রাখল!

মিটারে দশ টাকাও ওঠেনি -- ঘ্যাঁচ করে কার্ব-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গেল ট্যাক্সিটা। ড্রাইভার বললে, বাঁয়ে তরফ বিশ নম্বর কোঠি, সা’ব!

বাসু নেমে গেলেন। একুশ নম্বর একটা গম ভাঙানোর কল। তার পাশেই একটা একতলা পুরনো বাড়ি। নম্বর-প্লেট বসানো : একুশের-এক। কল-বেল-এর বালাই নেই। অগত্যা সদর দরজার কড়া ধরে জোরে-জোরে নাড়লেন বারকয়েক।

দরজা খুলে মুখ বাড়ালেন একটি মহিলা।

বছর চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ। সাদা থান নয় -- তবু বিধবা বলেই মনে হল ওঁর। অম্লানবদনে বাসু-সাহেব হাঁকাড় পাড়েন : টেলিগ্রাম! সি. রায়। এ বাড়িই?

ভদ্রমহিলা ঝুঁকে পড়ে দেখলেন খামের উপর লেখা নাম-ঠিকানা।

বললেন, হ্যাঁ, দাও।

এখানে একটা সই দিন আগে। -- পকেট থেকে নোটবই আর ডটপেন বার করে মহিলার দিকে বাড়িয়ে ধরেন।

এতক্ষণে মহিলাটি ভালো করে টেলিগ্রাফ-পিয়নের দিকে তাকিয়ে দেখেন। বলেন, আপনাকে তো আগে কখনও দেখিনি টেলিগ্রাম নিয়ে আসতে?

একটু আগে মহিলা ওঁর দিকে না তাকিয়েই ‘তুমি’ সন্বোধন করেছিলেন। অভ্যাসবশত। “টেলিগ্রাম” হাঁক শুনে, প্রতিবর্তী প্রেরণায় যখন উনি একটু ঘাবড়ে গেলেন মনে হল। স্যুটেড-বুটেড টেলিগ্রাম-পিয়ন ইতিপূর্বে দেখেননি বলে।

বাসুর চটজলদি জবাব? আমি পোস্টমাস্টার। এদিকেই আসছিলাম, তাই, নিন, সই করুন। এমন পোষ্টমাস্টার মশাইও বোধ করি ওঁর দেখা নেই যিনি ডাক পিয়নের কাজ স্কন্ধে তুলে নেন এদিকেই আসার সুবাদে। কিন্তু টেলিগ্রামটা নিতে হলে খাতায় সই করতে হয় -- স্যুটেড ভদ্রলোক অন্যায় কিছু দাবি করেননি। ফলে ভদ্রমহিলা ওঁর হাত থেকে পকেট বুকটা নিয়ে সই দিলেন: “সি.রায়”?

বাসু কুঞ্চিত ভ্রভঙ্গে বললেন, আপনিই সি.রায়?

-- না, তবে ওর টেলিগ্রাম আমিই বরাবর নিয়ে থাকি।

-- ও! তাহলে আপনি ওই “সি. রায়” কথাটার উপর লিখে দিন “ফর আ্যান্ড অন বিহাফ অফ”, আর নিচে আপনার সই দিন।

-- আগে তো কখনও তা করিনি।

-- টেলিগ্রাফ পিয়নগুলো সব অকর্মার ধাড়ি। কেবল কাজে ফাঁকি দেয়। সেটাই পোস্টাল ডিপার্টমেন্টের নিয়ম।

ভদ্রমহিলা যুক্তির সারবত্তা অনুধাবন করেন। নোটবইটা নিয়ে নির্দেশ মতো লিখে ফেরত দিলেন। বাসু দেখলেন লেখা আছে “সি. রায়’-এর তরফে শুভ্রা চৌধুরি। এবার মহিলা টেলিগ্রামখানা গ্রহণ করতে হাতটা বাড়িয়ে দেন।

বাসু তার আগেই নোটবুক আর টেলিগ্রামখানা নিজের পকেটে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এবার বললেন, আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা ছিল শুভ্রা দেবী। ঘরে চলুন। রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে এসব কথা আলোচনা করা ঠিক নয়।

গটগট করে গলিপথটা অতিক্রম করে তিনি সামনের বৈঠকখানায় ঢুকে একখানা চেয়ার দখল করে জমিয়ে বসলেন। যেন গৃহকর্তা, অম্লানবদনে বলেন, আসুন, ভিতরে এসে ওইখানে বসুন। আমি আপনার কাছ থেকে “সি. রায়”-এর বিষয়ে কিছু তথা জানতে এসেছি।

ভদ্রমহিলা ওঁর পিছন পিছন ঘরে ঢুকেছেন বটে, তবে বসেননি। তার বিস্ময়ের ঘোরটা কাটেনি।

বলেন, আপনি..আপনি আসলে কে?

বাসু-সাহেব হিপ পকেট থেকে টেলিগ্রামখানা আবার বার করলেন। সেটা শুভ্রা দেবীর নাকের ডগায় মেলে ধরে বলেন, লুক হিয়ার, শুভ্রা দেবী, এটা একটা পুরনো টেলিগ্রাম। গতকাল সকালে এটা এই ঠিকানাতেই বিলি করা হয়। কেউ একজন ‘সি. রায়’-এর নাম দিয়ে সেটা গ্রহণ করেছে। এখন মিসেস রায় অভিযোগ করছেন -- তাঁর নাম ভাঁড়িয়ে কেউ তার টেলিগ্রাম হাতিয়ে নিচ্ছে। সেজন্যই এন্‌কোয়ারিতে এসেছি আমি। টেলিগ্রাম পিয়নের কাজ ভাগ করে নিতে নয়।...এখন বলুন, কাল সকালে কি আপনি এই টেলিগ্রামখানা ‘সি. রায়’-এর তরফে নেননি?

-- নিয়েছিলাম! তারই অনুরোধে -- আর তাকেই দিয়েছিলাম।

-- কিন্তু টেলিগ্রাম পিয়নের খাতায় আপনি তো নিজের নাম লেখেননি। তাছাড়া আপনি তাকে টেলিগ্রামখানা দিলে তিনি আপনার নামে কমপ্লেন করবেন কেন?

-- ছন্দা তা করতেই পারে না!

-- তাহলে আমার পকেটে এ টেলিগ্রামখানা কী করে এল, বলুন?

তাই তো ভাবছি আমি!

-- ভাবাভাবির দরকার নেই, আপনি মিসেস ছন্দা রায়কে ডাকুন।

-- সে এখানে থাকে না।

-- কোথায় থাকে? তার ঠিকানা কী?

-- আমি জানি না।

এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? ছন্দা কোথায় থাকে তা আপনি জানেন না, অথচ তার সই জাল করে তার টেলিগ্রাম আপনি হাতিয়ে নিচ্ছেন?

-- সই জাল করে হাতিয়ে নিচ্ছি?

-- নয়? এর আগে কি আপনি পোস্টাল-পিয়নের খাতায় লিখেছিলেন “ফর অ্যান্ড অন বিহাফ অব ছন্দা রায়”? নিজের নামটাও তো সই করেননি। আমি সব কাগজপত্র দেখে নিয়ে তারপর এনকোয়ারিতে এসেছি। ‘আ-য়াম’ সরি। আপনি তৈরী হয়ে নিন। আমার সাথে একবার আপনাকে থানায় যেতে হবে।

-- থানায়! বাঃ! কেন? কী আমার অপরাধ?

-- বাঃ! অপরাধ নয়? আপনি মিসেস ছন্দা রায়ের সই জাল করেছেন। সে এখানে থাকে না, তবু আপনি তার টেলিগ্রাম রিসিভ করেছেন।

কিন্তু আমার কী দোষ? সে তো ছন্দারই অনুরোধে। ও বললে, ও একজনকে এ বাড়ির ঠিকানা দিয়েছে। তার চিঠিপত্র এলে বা টেলিগ্রাম এলে আমি যেন রেখে দিই। ও সময় মতো এসে নিয়ে যাবে।

-- এই টেলিগ্রামখানা আপনি কাল কখন পেয়েছেন? আর কখন মিসেস রায়কে হস্তাস্তরিত করেছিলেন?

-- গতকাল সকাল নটা নাগাদ ওটা পাই! আমি হাসপাতালে যাই এগারোটা নাগাদ। তার আগেই ছন্দা ফোন করে জানতে চায়, তার কোনও চিঠিপত্র এসেছে কিনা। আমি বলি, একখানা টেলিগ্রাম এসেছে। সে হাসপাতালে এসে দুপুরবেলা আমার সঙ্গে দেখা করে আর ওটা নিয়ে নেয়।

-- কোন্‌ হাসপাতালে?

-- শরৎ বোস রোডের শ্রীরামকৃষ্ণ মিশন সেবাশ্রম হাসপাতালে।

-- আপনি নার্স?

-- হ্যাঁ।

-- ট্রেইনড নার্স?

-- হ্যাঁ, দু’জনেই পাস করা নার্স।

-- ছন্দা তার নিজের ঠিকানায় টেলিগ্রাম নেয় না কেন?

-- তার….মানে, কিছু অসুবিধা আছে!

-- ‘অসুবিধা’ মানে তো তার স্বামী ? এরই মধ্যে স্বামীর কাছ থেকে লুকোবার মতো ব্যাপার ঘটেছে?

-- “এরই মধ্যে” মানে?

-- কেন, তা আপনি জানেন না -- ওদের বিয়ে হয়েছে এই সেদিন?

-- আপনি কেমন করে জানলেন?

-- ছন্দা দেবী নিজেই এসেছিলেন পোস্ট অফিসে। কমপ্লেন করতে। দেখেই মনে হল ও এখনও সদ্য বিয়ের কনে। কদ্দিন বিয়ে হয়েছে ওর?

-- দিন দশেক।

ওর স্বামীর নাম কী?

-- আমি জানি না।

ঠিক আছে, ঠিক আছে। ছন্দা রায় কোথায় থাকে তা আপনি জানেন না, তার স্বামীর নাম কী তা জানেন না, অথচ তার সই জাল করতে জানেন। তা আমার অত কথায় কী দরকার? যা বলার থানায় গিয়ে বলবেন। মিসেস রায় কমপ্লেন করেছেন বলেই...

-- ছন্দা আমার নামে কমপ্লেন করতেই পারে না।

-- পারে না? তাহলে আমি কেন এসেছি?

-- সেটাই তো তখন থেকে ভাবছি আমি। আমার মনে হয় আপনি পোস্ট অফিস থেকে আদৌ আসেননি। কায়দা করে ছন্দার সম্বন্ধে কিছু খোঁজ-খবর নিতে এসেছেন। তাই নয়?

-- আপনি ঠিকই ধরেছেন, শুভ্রা দেবী। আমি ডাক-বিভাগের কেউ নই। আমি ছন্দার একজন শুভানুধ্যায়ী, কিন্তু ছন্দা নিজেই সে কথা জানে না। আমি জানতে পেরেছি, ছন্দার একটা ভীষণ বিপদ ঘনিয়ে আসছে কিন্তু সেকথা ওকে জানাতে পারছি নাট ওর বর্তমান ঠিকানাটা জানি না বলে। আপনি আমাকে সাহায্য করবেন।

জবাবে ভদ্রমহিলা যা বললেন তা একেবারে ভিন্ন খাতে।

-- আপনাকে আমার ভীষণ চেনা-চেনা লাগছে। আপনার ছবি আমি কোথাও দেখেছি। আপনি কি টি. ভি. সিরিয়ালে অভিনয় করেন?

-- না! সম্ভবত আপনি খবরের কাগজে আমার ছবি দেখেছেন।

-- হঠাৎ শুভ্রা বলে ওঠেন, এতক্ষণে চিনতে পেরেছি! আপনি ব্যারিস্টার পি. কে. বাসু?

-- ঠিকই চিনেছেন। এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছেন যে, আমি ছন্দার শুভাকাঙ্ক্ষী। সব কথা খুলে বলুন এবার।

-- বলব। সব কথাই বলব। কিন্তু তার আগে বলুন কী খাবেন? চা, না কফি?

-- কী আশ্চর্য! আমি ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে এসেছি। আমার নানান জরুরি কাজও আছে। সংক্ষেপে বলুন, ছন্দা রায় সম্বন্ধে আপনি কতটুকু কী জানেন? কেমন করে তার সন্ধান পেতে পারি?

শুভ্রা দেবী আর কোনও সংকোচ করলেন না। সব কথাই খুলে বলেন: না, ছন্দা রায়ের ঠিকানা উনি সত্যিই জানেন না। এমনকি তার স্বামীর নামটাও ওর অজানা। না, বিয়েতে শুভ্রা দেবীর আমন্ত্রণ ছিল না। সম্ভবত রেজিস্ট্রি-বিয়ে হয়েছে, কলকাতাতেই। অথচ ছন্দা আর শুভ্রা দু’জন দু’জনকে দীর্ঘদিন ধরে চেনেন। এই বাড়িতে শুভ্রার সঙ্গে বিয়ের আগে ছন্দা বিশ্বাস -- হ্যাঁ, বিয়ের আগে কুমারী অবস্থায় ওর পদবি ছিল বিশ্বাস -- চার-পাঁচ বছর বাস করে গেছে। দু’জনেই পাস করা নার্স, যদিও বয়সে ছন্দা দশ-বারো বছরের ছোটো। অবশ্য দু’জনের কর্মস্থল ছিল ভিন্ন। ছন্দা কাজ করত একটা প্রাইভেট নার্সিং হোমে, বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছাকাছি। সব কিছুই সে গোপন করতে চাইত। তার অতীত ইতিহাসে এমন কিছু আছে যাতে সে নিজের কথা কিছুই বলতে চাইত না। এমন কী, সে যে ঠিক কোন্‌ নার্সিং হোমে চাকরি করত -- চার পাঁচ বছর একই ছাদের তলায় বাস করেও -- শুভ্রা তা জানতে পারেননি। হঠাৎই সে একদিন এসে জানায় যে, সে একজনকে বিয়ে করতে যাচ্ছে। কাকে, কী বৃত্তান্ত কিছুই স্বীকার করেনি। তীব্র অভিমানে শুভ্রাও বিস্তারিত জানতে চাননি। প্রায় মাসখানেক আগে ওর জিনিসপত্র নিয়ে ছন্দা এ বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। দিন-সাতেক আগে আবার হঠাৎ এসে জানায় যে সে ইতিমধ্যে জনৈক মিস্টার রায়কে বিবাহ করেছে। আরও জানায় যে, তার কিছু চিঠি অথবা টেলিগ্রাম এই ঠিকানায় আসবে। শুভ্রা যেন তা সংগ্রহ কয়ে রাখেন। সময় মতো ছন্দা তা নিয়ে যাবে। এরপর প্রত্যেকদিন সকালেই ছন্দা একবার করে ফোনে জেনে নিত তার কোনও চিঠিপত্র এসেছে কিনা। গতকালও সে ফোন করেছিল।

বাসু বললেন, আবার যদি সে ফোন করে তাহলে তাকে বলবেন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে! আজ সকালেই সে এসেছিল আমার চেম্বারে। আর যাবার সময় ভুল করে একটা হ্যান্ডব্যাগ ফেলে গেছে।

ওই ব্যাগের ভিতর অত্যন্ত দামি কিছু আছে...

-- অত্যন্ত দামি কিছু? কী তা?

-- সেটা আমি আপনাকে জানাতে পারছি না, শুভ্রা দেবী প্রফেশনাল এথিক্‌সে বাধছে। তবে ছন্দা নিশ্চয় এতক্ষণে সেটা টের পেয়েছে। হয়তো সে মনে করতে পারছে না -- ব্যাগটা ঠিক কোথায় খুইয়েছে। আপনি বললেই ওর মনে পড়ে যাবে। ও বুঝতে পারবে অথবা...

-- অথবা?

-- অথবা হয়তো ওর মনে পড়েছে সব কথা। কিন্ত দুরন্ত অভিমানী মেয়েটা জেদ করে ফিরে আসছে না। কারণ সে জানে, আমার হেফাজতে ও জিনিস নিরাপদেই আছে।

শুভ্রা বললেন, তাও হতে পারে। ছন্দা অত্যন্ত অভিমানী।--

-- আপনি ওকে বলবেন তো?

-- নিশ্চয় বলব। তবে একটা শর্ত আছে;

-- শর্ত! কী শর্ত?

-- আপনার ব্লাড শুগার আছে?

-- গুড গড! না! কিন্ত সে কথা কেন?

-- তাহলে আপনি একটু বসুন। পাঁচ মিনিট। আমি সামনের দোকান থেকে দুটো কড়াপাক সন্দেশ নিয়ে আসি। খুব ভালো বানায়। আপনি একটা কিছু মুখে না দিলে আমার...

-- অল রাইট! যান, নিয়ে আসুন।

-- শুভ্রা ড্রয়ার খুলে একটা নোট নিয়ে চটিটা পায়ে গলিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

বাসু তৎক্ষণাৎ টেলিফোনটা তুলে নিয়ে ওর বাড়িতে ডায়াল করলেন। ধরলেন রানী দেবী : কী খবর?

-- সুজাতা ফিরেছে?

-- না।

-- সুজাতা ফিরে এলেই বলবে বালিগঞ্জ ফাঁড়ি অঞ্চলে চলে যেতে। কাছে-পিঠে প্রতিটি নার্সিং হোমে গিয়ে সে যেন খোঁজ নেয় : নার্স ছন্দা বিশ্বাস সেখানে কাজ করে কি না। ইন ফ্যাক্ট -- ছন্দা রায় মাসখানেক আগে “বিশ্বাস” পদবিতে ওই অঞ্চলের কোনও নার্সিং হোমে কাজ করত, এখন করে না। তবে প্রশ্নটা ওইভাবে পেশ করাই শোভন। যদি কেউ বলে, আগে এখানে কাজ করত, এখন করে না, তখন তার বর্তমান ঠিকানা সংগ্রহের নানান চেষ্টা যেন করে। বুঝলে?

-- বুঝলাম। কিন্তু নার্স ছন্দা রায়টি কে?

-- যার হাত থেকে একখানা একশো টাকার নোট হাতিয়ে তুমি আমাকে দ’য়ে মজিয়েছ!

-- আমিঃ না তুমি নিজে ওকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে...

-- সারেন্ডার! সারেন্ডার! হ্যাঁ, সব দোষ আমার। আরও নোট করে নাও -- আমি ফোন করছি-একুশের-এক বেণীমাধব সরকার লেন থেকে। এই নম্বরটা হচ্ছে ৪৬-৫৩২২। মিনিট দশেক পরে এখানে রিং কর। যিনি ধরবেন তর নাম শুভ্রা চৌধুরি। তাকে বলবে-- তুমি যা হয় একটা নাম বলে নিজের পরিচয় দিও -- শুভ্রা দেবীকে বলবে, তুমি কমলেশের বান্ধবী ছন্দা রায়ের জন্য একটা জরুরি খবর দিতে চাও। ছন্দা যেন তোমাকে ফোন করে। তোমার নাম্বারটা শুভ্রাকে দিয়ো।

-- তারপর ছন্দা যখন ফোন করবে?

-- তখন তাকে নিজের সত্য পরিচয় দিয়ে বলবে সে যেন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। জানিয়ো, নিজের ব্যবহারের জন্য আমি দুঃখিত।

-- বুঝলাম। আর কিছু?

-- রিভলভারের লাইসেন্সির পাত্তা পাওয়া গেছে?

-- এখনও না। কৌশিক কোনও ফোন করেনি এখনও।

-- আপাতত এই পর্যন্ত। জানলা দিয়ে দেখছি এক জোড়া কড়াপাকের সন্দেশ এগিয়ে আসছে।

-- একজোড়া কড়াপাকের সন্দেশ! তার মানে?

বাসু নিঃশব্দে ধারকযন্ত্রে টেলিফোনটা নামিয়ে রাখলেন পরমৃহুর্তেই সন্দেশের প্যাকেট হাতে শুভ্রা ফিরে এলেন।

ট্যাক্সিতে উঠে বললেন, এবার চল রাজা রামমোহন রায় সরণীতে। শেয়ালদা ফ্লাইওভার হয়ে। ভিড় কম হবে।



আমহার্স্ট স্ট্রিট আর হ্যারিসন রোডের জংশনে নেমে ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিলেন। ওঁর গন্তব্যস্থল থেকে বেশ কিছুটা দূরে। কারণ ছিল। এবার উনি যে কাজটা করতে চলেছেন সেটা বে-আইনি! এমন ক্রিয়াকাণ্ডে উনি অভ্যস্ত। ওর মতে ‘এন্ড জাস্টিফাইজ দ্য মীনস’ -- অর্থাৎ মূল লক্ষ্যটা যদি “সত্য-শিব-সুন্দর’মুখী হয়, তাহলে প্রতিটি, পন্থাই নীতিধর্মের অনুসারে। প্রতিপক্ষদল -- অর্থাৎ সমাজবিরোধীরা -- কোমরের নিচে ক্রমাগত আঘাত হানবে আর শান্তিকামী ব্যক্তিরা যে-কোনওভাবেওদের মোকাবিলা করতে পারবে, না’-- ওটা কোনও যুক্তি নয়। তাই উনি ট্যাক্সি-চালককে জানাতে চান না ওর গন্তব্যস্থলটা।

ছোট্ট একটা প্রেসের সামনে এসে দাঁড়ালেন। সামনে বসে একজন কম্পজিটার টেবিল-ল্যাম্পের আলোয় কাজ করছিলেন। চোখের উপর চশমা তুলে বললেন, কাকে খুঁজছেন স্যার?

-- গোরা আছে? গৌরাঙ্গ জানা?

আজ না। গোরা কন্টাই গেছে। মানে, দেশের বাড়িতে। ছাপাখানার কাজ করাতে চান কিছু?

-- তা তো চাই, কিন্তু গোরা না হলে তো তা হবে না!

-- কেন স্যার? গোরাকে বাদ দিয়েই তো ছাপাখানা দিব্যি চলছে।

বাসু জবাব দিলেন না। হঠাৎ ভিতর থেকে এক বৃদ্ধ হন্তদন্ত হয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। খেটো ধুতি, গলায় কন্ঠী, ফতুয়া গায়ে, চোখে নিকেলের চশমা। হাত জোড় করে বলেন, স্যার! আপনি?

-- আমাকে আপনি চেনেন?

-- বিলক্ষণ! আপনাকে চিনব না? আপনি না থাকলে সেবার যে গোরার মেয়াদ হয়ে যেত। আমি গোরা, মানে গৌরাঙ্গের বাপ, প্রভুচরণ জানা, আজ্ঞে। আসুন, ভিতরে আসুন--

নিজের চেয়ারটা কোঁচার খুঁট দিয়ে মুছে নিয়ে বসতে বললেন। বাসু-সাহেবের নজর হল, অনেকগুলি কৌতুহলী চোখ ওঁদের লক্ষ্য করছে। বললেন, জানামশাই, কিছু গোপন কথা ছিল। কোথায় বসে হতে পারে?

প্রভুচরণের কোনও ভাববৈকল্য হল না। যেন নিত্য ত্রিশদিন তিনি এমন গোপন কথা শুনে থাকেন।বলেন, তাহলে, স্যার, ওপরে চলুন। দোতলায় আমার বাসা!

কাঠের নড়বড়ে সিঁড়ি বেয়ে দু’জনে দ্বিতলে উঠে আসেন। নিন্নমধ্যবিত্তের অভাবের সংসার। একজন অবগুন্ঠনবতী -- বোধকরি গৌরাঙ্গের গর্ভধারিণী -- একটি বেতের মোড়া পেতে দিয়ে গেলেন। প্রভুচরণ ভিতর থেকে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে বলেন, এবার বলুন। গৌরাঙ্গ দেশে গেছে। তাতে আটকাবে না। কী কাজ, বলুন?

বাসু মোড়ায় বসে একটু ভূমিকা করতে গেলেন, জানামশাই, সেবার গোরা যেমন বিনা অপরাধে জেল খাটতে যাচ্ছিল এবার তেমনি এক নিরপরাধীকে বাঁচাতে আমি একটু বেআইনি...

প্রভুচরণ দু’হাত দু’কানে চাপা দিয়ে বলে ওঠেন, আপনি দেবতুল্য মনিষ্যি। আমারে কোনও কৈফিয়ৎ দিতে যাবেন না। কী করতে হবে -- শুধু সেইটুকু বলুন।

-- আমাকে খানকতক -- ধরুন পাঁচখানা -- ভিজিটিং কার্ড বানিয়ে দিতে হবে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে।

-- এ আর কী এমন শক্ত কাজ। গোরা নেই তো নেতাই আছে -- ওই গোরারই ছোটো ভাই। প্রেসের সব কাজই জানে। কম্পোজ করে নিজেই ছাপিয়ে আনবে। আপনি শুধু কী লিখতে হবে বলেন। বাসু তার পকেট নোটবুক থেকে একটা পৃষ্ঠা ছিঁড়ে নিয়ে ইংরেজি হরফে লিখে দিলেন :

Charu Chandra Roy. B.Sc.

Real Estate Agent & Govt.

Authorised Agent of N.S.C

C.T.D., Unit Trust, R.D.

21/4 Benimadhab Naskar Lane

Calcutta 700026

প্রভুচরণ বললেন -- ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করতে হবে স্যার।

-- তাহলে আমি একটু ঘুরে আসি।

-- আজ্ঞে না, ইঞ্জিরি হরফ, প্রুফটা আপনাকেই দেখে দিতে হবে। আমি বরং আপনার জন্য কিছু চা-মিষ্টির যোগাড় দেখি--

আগেই বলেছি, উদ্দেশ্য সৎ হলে মিথ্যা বলতে ওঁর বাধে না। আপাতত ওঁর উদ্দেশ্য নিজের উদর এবং অপরের আত্মাভিমানকে বাঁচানো। অম্লানবদনে বললেন, না, জানামশাই, একটু অ্যাসিডিটি মতো হয়েছে -- ওই অম্বল আর কী। বরং দেখুন, কাছে-পিছে ঠাণ্ডা ‘লিমকা’ পাওয়া যায় কিনা, অথবা ডাব।

-- ডাবই পাওয়া গেল। ঘণ্টাখানেক পরে ওই সদ্যমুদ্রিত ভিজিটিং-কার্ডগুলি নিয়ে বাসু-সাহেব রওনা দিলেন।



বাসু-সাহেবের কর্মপদ্ধতি ছকবাঁধা।

পরবর্তী দৃশ্য মধ্য কলকাতার একটি বড়ো ডাক ও তার ঘর।

কমলেশ নামধারী এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি দু’দিন আগে এই ডাকঘর থেকে একটি তারবার্তা পাঠিয়েছিল জনৈক সি. রায়কে : ‘শুক্রবার সন্ধ্যা ছয়টা হচ্ছে সময়ের শেষ সীমা’।

আজই সেই শুক্রবার। নির্দিষ্ট সময়ের শেষ সীমান্তে উপনীত হতে আরও ঘণ্টাছয়েক বাকি। উনি নিজে এই মর্মান্তিক বার্তাটা জেনেছেন ঘণ্টাতিনেক আগে। এই তিন ঘণ্টার মধ্যে জানতে পেরেছেন “সি. রায়” হচ্ছে ছন্দা রায়। একটি আতঙ্কতাড়িতা সদ্যো-বিবাহিতা। বোধকরি যৌবনের শ্রেষ্ঠ দিনগুলি -- দীর্ঘ সাত বছর -- সে ছিল বিধবা। এখন সে তার মনের মানুষ খুঁজে পেয়েছে। আর সেই শুভ মুহূর্তেই অজ্ঞাতবাস থেকে এসে উপস্থিত হয়েছে ওই কমলেশ। তার পুরো নামটা জানেন না -- কিন্তু আন্দাজ করেছেন, ওই ভিরু কপোতীর দৃষ্টিভঙ্গিতে সে এক হিংস্র শ্যেনপক্ষী!

হয়তো-- হ্যাঁ, এমনও হতে পারে -- সাত-সাতটি বছর সে স্বেচ্ছায় অজ্ঞাতবাসে ছিল : কখন তার পত্নী নতুন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়! তখনই শুরু হবে তার খেলা : ব্ল্যাকমেলিং!

প্রথম স্বামী জীবিত থাকাকালে -- তার সঙ্গে ডিভোর্স না হলে -- দ্বিতীয় বিবাহ অসিদ্ধ। অর্থাৎ ওই অজ্ঞাত পরিচয় ‘কমলেশ’ যে মুহূর্তে জনবহুল ট্রাম রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে হাকাড় পাড়বে ‘অয়ম অহম্‌ ভো’ -- তৎক্ষণাৎ ওই সদ্যোবিবাহিতার সাতমহলা স্বপ্নের প্রাসাদ হাড়গোড় ভেঙে হুড়মুড়িয়ে উল্টে পড়বে। এই হচ্ছে আইনের অনিবার্য নির্দেশ! সেই দুর্দৈব ঠেকাবার শুভ উদ্দেশ্য নিয়ে বাড়ি থেকে বার হয়েছেন অভুক্ত প্রৌঢ় মানুষটি। প্রথামতো যাঁর কাজ আদালত চৌহদ্দি থেকে ল’ লাইব্রেরির ভিতর সীমিত হবার কথা।

ডাকঘরে ঢুকেই নজরে পড়ল এনকোয়ারির পাশেই খাম-পোস্টকার্ড আর ডাকটিকিট বিক্রি হচ্ছে। সেদিকটায় চাপ ভিড়। বাসু সেদিকে গেলেন না। এক ফাঁকামতো কাউন্টারে গিয়ে কর্মরত করণিককে বললেন, শুনছেন? কিছু এন. এস. সি. কিনব। কার কাছে যাব?

মন্ত্রের মত কাজ হল তাতে। ইউনিট ট্রাস্টের নানান সুবিধাজনক স্কিমের চাপে লোকে আজকাল আর ন্যাশনাল সেভিংস সার্টিফিকেট কিনতে উৎসাহী নয়। অথচ এগুলি বিক্রয় করতে নানান কারণে পোস্টাল কর্মচারীরা উৎসাহী। ছেলেটি বললে, গলিপথে একটা দরজা আছে-- ওইদিকে। তাই দিয়ে ভিতরে চলে আসুন। ওই কোণায় যে টাকমাথা ভদ্রলোক বসে আছেন, ওঁর সঙ্গে কথা বলুন। ওঁর নাম : অরিন্দমচন্দ্র ঘোষাল।

গলিপথে খিড়কি-দরজা দিয়ে বাসু ওই বৃদ্ধের কাছে উপস্থিত হয়ে দেখলেন ভিতরের গলিপথে ছেলেটি ইতিপূর্বেই ঘোষাল-মশাইকে তার উদ্দেশ্যের কথাটা জানিয়ে দিয়েছে। একটি টুলও কোথা থেকে যোগাড় করে এনেছে।

অনুরুদ্ধ হয়ে বাসু টুলে বসলেন। অরিন্দম প্রশ্ন করেন, এন. এস. সি. কিনবেন? কত হাজার?

বাসু সেকথার জবাব না দিয়ে বললেন, আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো, ঘোষালমশাই?

আপনি কি কখনও প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তেন?

হা হা করে হেসে ওঠেন অরিন্দম। বলেন, আরে না মশাই! কলেজে আর পড়ার সুযোগ পেলাম কোথায়? বাবামশাই ছিলেন পোস্ট-মাস্টার। ম্যাট্রিকটা পাশ করার পর একটা টুলে বসিয়ে দিয়েছিলেন! সে আমলে সেসব সুবিধে ছিল। তেত্রিশ বছরে ঘষতে ঘষতে এতদূরে এসে পৌঁছেছি। ডিসেম্বরে রিটায়ার করব।

কিন্তু আপনাকে এত চেনা চেনা লাগছে কেন? আপনারও তাই লাগছে না কি?

অরিন্দম বাসু-সাহেবকে আর একবার ভালো করে দেখে নিয়ে বললেন, আজ্ঞে না। তবে আমার চেহারাটা টিপিক্যাল কেরানির। আপনি হয়তো অন্য কোনও করণিকের সঙ্গে আমাকে গুলিয়ে ফেলেছেন।

ইতিমধ্যে ও পাশের আর একটি মহিলা করণিক একটা ফাইল এগিয়ে দিয়ে বললে, ঘোষালদা, এইখানে একটা সই দিন।

নির্দেশিত স্থানে স্বাক্ষর দিয়ে অরিন্দম আবার বাসু-সাহেবের দিকে মন দিলেন, খগেন বলছিল,

আপনি নাকি কিছু এন. এস. সি. কিনতে এসেছেন।

খগেন তার সিটে ফিরে গেছে। বাসু ইতিমধ্যে গোটা পোস্ট-অফিসটা দেখে নিয়েছেন। না, কেউ ওঁর দিকে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে নেই। পি. কে. বাসু-হিসাবে কেউ তাকে চিহ্নিত করেনি। তাই হাসতে হাসতে বললেন, না ঘোষালমশাই। আমি জাতে ময়রা। সন্দেশ খাই না।

-- ময়রা? সন্দেশ খান না? মানে? কিন্তু খগেন যে বলল...

বাসু-সাহেব সদ্যলব্ধ ভিজিটিং-কার্ড একখানা নামিয়ে রাখলেন ঘোষাল মশায়ের টেবিলে। উনি সেটা পড়তে যখন ব্যস্ত তখন বাসু বলতে থাকেন, আমার কাজ কারবার ছিল এতদিন দক্ষিণ কলকাতায়। কিন্তু আমার ছেলে অফিস থেকে এ পাড়ায় কোয়ার্টার্স পেয়েছে। তাই বেণীমাধব নস্কর লেন ছেড়ে সামনের মাসে এ-পাড়ায় উঠে আসছি। তা সিজনে পাঁচ-সাত লাখ টাকার বিজনেস্ও পাই। আপনি তো জানেনই যে, কোন পোস্টঅফিসে এন. এস. সি. জমা পড়ল তা নিয়ে ক্লায়েন্টের কোনও পক্ষপাতিত্ব থাকে না -- কিন্তু এজেন্টদের থাকে।

বলে, ইঙ্গিতপূর্ণভাবে বাম চক্ষুটি নিমীলিত করলেন।

ঘোষাল অনুচ্চকণ্ঠে বলে ওঠেন, ও-পাড়ায় যেসব ফেসিলিটি পেতেন, এখানেও তাই-তাই পাবেন। মাসে পাঁচ-সাত লাখ?

-- না, মাসে বলিনি। সিজন টাইমে মাসে আট লাখও হয়েছে ইয়ার বিফোর লাস্ট। যাহোক, এ পাড়ায় এসে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব!... ও ভালো কথা, আর একটি কাজ আছে ঘোষাল-মশাই। আমার একটা উপকার করতে হবে।

-- অত সংকোচ করছেন কেন? বলুন বলুন?

-- আমার এক মক্কেল-- কমলেশবাবু-- কলকাতায় একটা অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে চায়। ও দর দিচ্ছে সাড়ে সাত, আর মালিক হাঁকছে আট লাখ...

অরিন্দম বাধা দিয়ে বলে ওঠেন, আদার ব্যাপারিকে ওইসব জাহাজের গপ্পো কেন শোনাচ্ছেন চারুবাবু?

বাসু পকেট থেকে একটা টেলিগ্রাম বার করে বললেন, দিন-তিনেক আগে কমলেশবাবু এই ডাকঘর থেকেই আমাকে টেলিগ্রাম করেছিলেন। আজ সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে শেষ দর জানাবার কথা। কিন্তু ওঁর ঠিকানা লেখা ভিজিটিং কার্ডখানা আমি হারিয়ে ফেলেছি। এই টেলিগ্রামের মাথায় যেসব সাঙ্কেতিক নম্বর-টম্বর লেখা আছে তা থেকে কি জানা যায়, কমলেশবাবুর ঠিকানাটা?

-- নিশ্চয় যায়। টেলিগ্রামের ফর্মে প্রেরক নাম-ঠিকানা লিখে দেয়। স্বাক্ষরও করে। এ তো মাত্র তিনদিন আগেকার। এখনি দেখে বলে দিচ্ছি। বি-কা-শ! একটু শোনো তো ইদিকে।

বিকাশ, অর্থাৎ টেলিগ্রাফ-প্রেরক করণিক এগিয়ে আসে।

অনতিবিলম্বেই শ্যেনপক্ষীর নীড়ের সন্ধান পাওয়া গেল ; কমলেশ ঘোষ, মা সম্তোষী অ্যাপার্টমেন্টস, ১৩ বি, তারাতলা রোড।

বাসু বলেন,অ্যাপার্টমেন্টস মানে তো মস্ত বাড়ি। অথচ নম্বর-টম্বর তো কিছু নেই।

-- তাই তো দেখছি।

বাসু জানতে চান, আর্জেন্ট টেলিগ্রামে জবাব পাঠালে আজ সন্ধ্যা ছয়টার আগে সেটা তারাতলা পৌঁছাবে?

বিকাশের চট জলদি জবাব, অসম্তব। পরশুর আগে নয়। গোটা পঞ্চাশ আর্জেন্ট টেলিগ্রাম জমা হয়ে আছে।

বিকাশকে বিদায় করে ঘোষালমশাই নিম্নকন্ঠে বাসু-সাহেবকে বলেন, সাত-আট লাখ টাকার বিজনেস! আপনার কমিশন কোন্‌ না দশ-বিশ হাজার টাকা হবে? আপনি মশাই একশ-টি মুদ্রা খরচ করতে পারবেন? তাহলে একঘণ্টার মধ্যে টেলিগ্রাফ তারাতলায় বিলি হয়ে যাবে।

-- কী ভাবে?

-- আমাদের টেলিগ্রাফ-পিয়ন যদুনাথ ট্যাক্সি করে যাবে, বাসে করে ফিরবে। টেলিফোনে তারাতলা পোস্ট অফিসে আমি জানিয়ে দিচ্ছি ট্যাক্সি আর বাসভাড়া বাবদ বিশ টাকা, বাকি সত্তর নানান লোককে খুশি করতে--সোজা হিসাব।

বাসু এককথায় রাজি। টেলিগ্রাফে লিখে দিলেন : ইম্পর্টেন্ট ডেভেলপমেন্ট নেসেসিটেটস ইনডেফিনিট পোস্টপোনমেন্ট এএএ কলিং ইন পার্সন টু এক্সপ্লেন [অনিবার্য ঘটনাচক্রে অনির্দিষ্টকালের জন্য ব্যাপারটা মুলতুবি রাখতে বাধ্য হচ্ছি। সাক্ষাতে সব কথা বুঝিয়ে বলব] -- সি. রায়।



তিন



ডাকঘর থেকে বাইরে এসে ওঁর মনে হল দু-দুটো অসঙ্গতি রয়ে গেল। এক নম্বর-- যেটা উনি বলেই ফেলেছিলেন ঘোষাল মশাইকে -- ‘অ্যাপার্টমেন্টস’ কথাটার মানে অনেকগুলি ফ্ল্যাট। সেক্ষেত্রে ‘দুই-এর তিন’ বা “তিনের পাঁচ” ইত্যাদি একটা নম্বর ঠিকানায় থাকার কথা, যাতে বোঝা যায় ‘কয়’তলায় এবং কত নম্বর চিহ্নিত দরজা। কমলেশ সেটা উল্লেখ করেনি। কেন? সে কি পুরো ঠিকানাটা জানাতে চায় না? সেক্ষেত্রে গোটা ঠিকানাটাই তো তার উর্বর মস্তিষ্কপ্রসুত হতে পারে--যেমন হয়েছিল কল্পিত শিখা দত্তের লেখা ‘নসীরাম পতিতুণ্ড সেকেন্ড বাই লেন।’ দ্বিতীয় প্রশ্ন, তারাতলা রোড-এর বাসিন্দা বেহুদ্দো এতদূর এসে মধ্য কলকাতার একটি পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফ অফিস থেকে টেলিগ্রাফটা করবে কেন? অবশ্য তার অনেক অজ্ঞাত কারণ থাকতে পারে। হয়তো ওর কর্মস্থল এ-পাড়ায়। যাই হোক, ওঁকে একবার তারাতলা অঞ্চলে গিয়ে অনুসন্ধান করে দেখতে হবে। হয়তো ‘বুনো-হাঁসের’ পিছনে এ দৌড়াদৌড়ি অহেতুক। কিন্তু উপায় নেই -- শিখা দত্ত’ ওর নাম না হওয়া সত্ত্বেও যে মেয়েটি ওঁকে দ-য়ে মজিয়েছে সে ওঁর ক্লায়েন্ট।

সামনেই একটা বড় ওষুধের দোকান। বাসু-সাহেব ঢুকে পড়লেন। মধ্য-দিনে তেমন ভিড় নেই। কাউন্টারের বিপরীত থেকে একজন অল্পবয়সী ডিসপেন্সিং কর্মচারী প্রশ্ন করে, বলুন স্যার?

বাসু জানতে চান, ইপ্রাল আছে।

লোকটা নেতিবাচক মাথা নাড়ল।

-- ওষুধটা কোথায় পাব বলতে পারেন?

-- আমি ওর নামই শুনিনি।

বাসু জানতে চান, আপনাদের এখানে কোনও ডাক্তারবাবু. বসেন?

-- বসেন। সকালে আর সন্ধ্যায়। এখন নেই।

হতাশ হয়ে উনি পিছন ফিরছিলেন। কে যেন ওঁর ও-পাশ থেকে বললে, “ইপ্রাল” কলকাতার বাজারে পাবেন না। পেটেন্টেড ওষুধ। প্রেসক্রিপশনটা সঙ্গে আছে?

বাসু ঘুরে দাঁড়ালেন। বছর পঁয়তাল্লিশের একজন প্রৌঢ়। সাফারি সুট পরনে। জানতে চান, আপনি নিশ্চয় ডাক্তার। বলতে পারেন, ‘ইপ্রাল’ কী জাতের ওষুধ? মানে কোন অসুখে...

-- ওটা বিষ নয়!

--“বিষ নয়”! এটা বিষ, তা তো আমি বলিনি।

ডাক্তারবাবু হাসতে হাসতে বললেন, আজ্ঞে না স্যার, আপনি বলেননি, আপনার বলার কথাও নয়, ব্যারিস্টার-সাহেব! ওটা তো বলবে পাবলিক প্রসিকিউটার? যখন আমি হতভাগার পেট চিরে বলব,অত্যধিক পরিমাণে কেউ একে ‘ইপ্রাল’ খাইয়েছে-- সেটাই মৃত্যুর কারণ।”

বাসু এতক্ষণে হেসে ফেলেন। বলেন, এইবার আপনাকে চিনেছি। আপনি অটোন্সি-সার্জেন ডাক্তার অতুলকৃষ্ণ সান্যাল।

-- আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্ত এ ক্ষেত্রে কেসটা কী, স্যার?

-- না, মরেনি কেউ। পুলিস একজনের মেডিসিন-ক্যাবিনেট সার্চ করে যেসব ওষুধ পেয়েছে তার মধ্যে ছিল এক শিশি “ইপ্রাল”। শাদা শাদা ছোটো ছোটো ট্যাবলেট। ওটা কীসের ওষুধ তা জানা থাকা ভালো। তাই, জিজ্ঞাসা করছিলাম।

-- ‘ইপ্রাল’ একটা ‘হিপনটিক’--এক রকমের “ঘুম-পাড়ানিয়া”। বিদেশী ওষুধ। এখানে পাওয়া যায় না। আমরা তার বদলে ‘কাম্পোজ’ আ্যাট্রিভান, বা অন্য জাতের ওষুধ প্রেসক্রাইব করি। ইপ্রালের বৈশিষ্ট্য এই যে, ঘুমটা খুব গাঢ় হয়। কিন্তু পরদিন ঘুম ভাঙার পর কোনও ‘আফটার-এফেক্ট’ থাকে না। মাতালের যেমন খোঁয়াড় ভাঙতে বিলম্ব হয়, ইপ্রালে তা হয় না। ঘুম ভাঙলেই খুব ঝরঝরে লাগে। মার্কিন মুলুকে ড্রাগ-অ্যাডিক্টদের চিকিৎসায় এর ব্যাপক ব্যবহার।

-- যদি কাউকে ‘ইপ্রাল’ এর ওভারডোজ খাওয়ানো হয়?

-- ঘুম পাড়ানিয়ার ওভারডোজ-এর মতো কাণ্ড ঘটবে। তার ঘুম ভাঙবে না, আর আমার ঘুম ছুটে যাবে--

-- আপনার?

-- নয়? আমি তো অটোন্সি-সার্জেন। মরাকাটা ঘরে আমাকেই তো পেট চিরে বলতে হবে : ইটস এ কেস অব ওভারডোজ অব স্লিপিং ট্যাবলেটস।

-- থ্যাঙ্কু ডক্টর!

-- য়ু আর ওয়েলকাম। ধন্যবাদ তো আমিই দেব। পুলিশের পক্ষে সাক্ষী দিতে উঠে বরাবর আপনার ধমক খেয়েছি। আজ প্রশ্নোত্তরের সময় আপনি কিন্ত একবারও ধমকাননি স্যার!

বাসু-সাহেব হা হা করে হেসে ওঠেন।

ডক্টর সান্যাল নমস্কার করে বিদায় হলেন।

বাসু-সাহেব এবার দোকানের মালিকের দিকে ফিরে বলেন, -- একটা ফোন করতে পারি?

-- শ্যিওর! করুন, স্যার।

বোধকরি ওঁদের কথোপকথন কিছুটা শুনেছেন তিনি। টেলিফোনটা দোকানের একান্তে। নিম্নকন্ঠে কথোপকথন করলে দোকানের আর কেউ শুনতে পাবে না। ঘড়িটা দেখলেন একবার ; বারোটা কুড়ি।তার মানে শুভ্রা দেবীর বাড়ি থেকে ফোন করার পর দু’ দুটি ঘণ্টা কেটে গেছে। ইতিমধ্যে কৌশিক কোনও সূত্র আবিষ্কার করতে পেরেছে কি না জানা দরকার।

দু’বার রিডিং টোন হতেই রানী লাইনে এলেন : হ্যালো?

-- কৌশিক কি কোনও পাত্তা পেল? ওই লাইসেন্সটার ব্যাপারে?

-- কোন লাইসেন্স?

-- আরে বাপু, আমিই বলছি। লাইসেন্স নাম্বার ; থ্রি-সেভেন-ফাইভ নাইন-সিক্স-টু-ওয়ান!

ওঁকে কোনও ডায়েরি বা-পকেট-বুক দেখতে হল না --নম্বরগুলো পরপর ওর মস্তিষ্কে গ্রে সেল এঁর খাজে খাজে সাজানো। কিন্তু রানীদেবী চটজলদি তার খাতা দেখে মিলিয়ে নিয়েছেন। বলেন, হ্যাঁ পেয়েছে। লাইসেন্স হোল্ডারের নাম ডক্টর পি. সি. ব্যানার্জি -- প্রতুলচন্দ্র -- এম. আর. সি. পি.। পাম আ্যাভিন্যু যেখানে বন্ডেল রোডে পড়েছে তার কাছাকাছি একটা নার্সিং হোম। অনেক ডাক্তার বসেন। উনিই মালিক। নাম—‘সানিসাইড নার্সিং হোম’।

-- এত কথা লাইসেন্সে লেখা থাকে?

-- না, থাকে না। কিন্তু কৌশিক টেলিফোনে যখন জানায় যে, ওই যন্ত্রটার লাইসেন্সি ডাক্তার পি.সি. ব্যানার্জি, তখন সুজাতা এখানে ছিল। ঠিকানাটা নিয়ে ও তৎক্ষণাৎ একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে যায়। তার ফোনও পেয়েছি। ডক্টর ব্যানার্জিকে সে ধরতে পারেনি ; কিন্তু একথা জানতে পেরেছে ওই নার্সিং হোমেই মাসখানেক আগে ছন্দা বিশ্বাস চাকরি করত। বর্তমানে সে ছন্দা রায়। তার স্বামীর নামটা জানা যায়নি। তবে এটুকু জানা গেছে যে সে অত্যন্ত বড়লোকের একমাত্র পুত্র-- মানে, রিয়েল মালটি-মিলিয়নেয়র ধনকুবের! ওদের ঠিকানাটা জানা যায়নি, তবে জাতীয় গ্রন্থাগারের পিছনে আলিপুর রোডে অথবা...

-- অলরাইট! অলরাইট! তোমরা কাজ অনেকটা এগিয়ে রেখেছ দেখছি। সুজাতা বা কৌশিকের ভেতর কেউ কি ফিরে এসেছে?

-- দু’জনেই এখন এখানে।

-- দু’জনকেই বেরিয়ে পড়তে বল। জাতীয় গ্রন্থাগারকে কেন্দ্র হিসাবে ধরে নিয়ে ম্যাপের উপর এক মাইল ব্যাসার্ধের বৃত্ত টানলে কলকাতা শহরের যতটা ভূভাগ বৃত্তের ভিতর আসবে তার মধ্যে প্রত্যেকটি ম্যারেজ-রেজিস্ট্রার অফিসে গিয়ে খোঁজ নিতে বল; ‘সাম মিস্টার রায়ের সঙ্গে মিস ছন্দা বিশ্বাসের বিবাহ রেজিস্ট্রি করা আছে কি না এক মাসের ভিতর’।

-- ঠিক আছে, পাঠাচ্ছি। এবার আমাদেরও কিছু জিজ্ঞাস্য আছে। পেশ করব?

-- কর। প্রশ্নকর্তা কে? তুমি? না সুকৌশলী দম্পতি?

-- দু তরফই। কৌশিক জানতে চায়; শিখা দত্ত যে একশ টাকা রিটেইনার দিয়ে গিয়েছিল তার ডবল খরচ তো ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। অজ্ঞাতনামা ক্লায়েন্টের পিছনে আরও খরচ করা কি যুক্তিযুক্ত হবে?

-- ‘অজ্ঞাতনামা’ কেন হবে? ষাট বালাই ! শিখা দত্তের নামে রসিদ কাটা হলেও আমার ক্লায়েন্টের নাম তো ছন্দা রায়, ‘নে’ বিশ্বাস!

-- আচ্ছা বাপ? ‘অজ্ঞাতনামা’ না হলেও ‘অজ্ঞাতবাসিনী’ তো বটে?

-- দ্যাট ডিপেন্ডস অন দ্য ফোর্থ ডাইমেনশনঃ টাইম। আর ঘন্টা-দুয়েকের মধ্যেই ওর আবাসের দৈর্ঘ্য প্রস্থ উচ্চতা সমেত অবস্থানও জানা যাবে! ও নিয়ে কৌশিককে চিন্তা করতে বারণ কর। দ্বিতীয়টা কি তোমার?

-- হ্যাঁ।

-- ফায়ার!

-- পৌনে একটা তো বাজে। তুমি লাঞ্চ খেতে আসবে না?

-- না রানু। আজ আমার উপবাস।

-- উপবাস! কেন? কিসের?

-- আমি একটা প্রায়শ্চিত্ত করছি! আমি আমার আতঙ্কতাড়িতা ক্লায়েন্টকে দোর থেকে ফিরিয়ে দিয়োছ! লেট নি অ্যাটোন ফর ইট। তুমি খেয়ে নাও।… কী হল? জবাব দিলে না যে? লাইনে আছ তো?

-- আছি! একই লাইনে আমি! তোমার পিছু পিছু। উপবাস বা প্রায়শ্চিত্ত তুমি একা করবে কেন? পাপ তো আমিও করেছি। তোমাকে আমার বলা উচিত ছিল: মেয়েটি তোমার সঙ্গে দেখা করার আগেই একটা ‘রিটেইনার’ দিয়েছে-- সে তোমার ক্লায়েন্ট!

-- অল রাইট! অ্যাজ য়ু প্লিজ। সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসছি। আশা করি একসঙ্গে ‘ইফতারি’ করা যাবে।

-- ‘ইফতারি’, মানে?

-- এক পাতে আহার গ্রহণ করা, সমবেতভাবে, ‘রোজা’ ভাঙা।

লাইন কেটে দিলেন বাসু-সাহেব! দোকানের মালিককে টেলিফোনের দাম মিটিয়ে দিতে গেলেন। সে কিছুতেই নিল না। বললে, ডাক্তার সান্যাল আপনাকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করেছেন। আপনি কে, তা আমি জানি না, কিন্তু ডক্টর সান্যালের কাছে যখন নিই না, তখন আপনার কাছেও নিতে পারি না।

-- অল রাইট! আমাকে তাহলে এক শিশি ম্যাগনাম সাইজ হরলিক্স দিতে বলুন।



তেরো নম্বর একটি দ্বিতল বাড়ি। তেরোর-এ বোধহয় একটা ফাঁকা প্লট। তারপরই একটা অর্ধসমাপ্ত প্রকাণ্ড বাড়ির কঙ্কাল। চারতলা পর্যন্ত কলমের ছড় বাঁধা হয়েছে। ঢালাই হয়েছে দুটি মাত্র ফ্লোর। একতলায় উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। কংক্রিট মীক্সিং মেশিন, লোহালক্কর, ঢালাই-এর কড়াই ছড়ানো। জনমানব-শূন্য এলাকাটা। চারদিকে বাঁশের ভারা বাঁধা। মনে হল এটাই শেষ হলে ‘মা সন্তোষী অ্যাপার্টমেন্টস’-এর রূপ নেবে। সেই মর্মে একটা সাইন বোর্ড আছে। নির্মাণকারী এবং আর্কিটেক্ট-এর পরিচয় দিয়ে বিজ্ঞপ্তিও জানানো হয়েছে।

বিপরীত দিকে একটা পান-বিড়ির দোকান। বাসু-সাহেব সেখানে গিয়ে বললেন, হ্যাঁগো, এ-বাড়িতে কেউ থাকে না?

লোকটার গালে পান ঠাসা। কোনোক্রমে বলে, আজ্ঞে না ! হাইকোর্টের অর্ডারে কাজ বন্ধ আছে। আজ প্রায় ছ’মাস।

-- দারোয়ান টারোয়ান নেই?

-- ছিল। এখন নেই। শুধু ওই দোতলায় এক বাবু একা একা থাকে।

-- কী নাম সেই বাবুর? জান?

-- ঘোষবাবু!

-- কমলেশ ঘোষ কি?

-- পুরো নাম জানি না, বাবু। ওই গেটের পাশে কলিংবেল আছে৷ বাজান না? বাবু থাকলে বেরিয়ে আসবে।

বাসুসাহেব নির্দেশমত কলবেলটা বাজালেন। বারকতক-ক্রিরিং ক্রিরিং করার পর দ্বিতলের খোলা বারান্দায় একটি মূর্তির আবির্ভাব ঘটল। টি-শার্ট গায়ে, লুঙ্গি পরা। বছর চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ। ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করল, কাকে চাই?

বাসু উর্দ্ধমুখে বললেন, কমলেশ ঘোষকে।

-- কোথা থেকে আসা হচ্ছে?

-- তার আগে অনুগ্রহ করে বলুন, কমলেশ ঘোষ কি আছেন?

-- তার আগে অনুগ্রহ করে বলুন, কোথা থেকে আসা হচ্ছে?

-- ছন্দা রায়ের কাছ থেকে।

লোকটা একটু থমকে গেল। বললে, আপনি তার কে হন?

-- এখান থেকেই চিৎকার করে নিজের এবং ছন্দা রায়ের বংশ পরিচয় বলতে থাকব?

-- ও আচ্ছা দাঁড়ান। নিচে গিয়ে দোর খুলে দিচ্ছি।

দ্বিতলবাসীর মুন্ড অপসৃত হল। একটু পরে নিচে নেমে এসে দরজা খুলে দিল। কিন্তু দু হাতে দরজা আগলে বললে, এবার বলুন?

-- রাস্তায় দাঁড়িয়েই?

-- ক্ষতি কী?

-- ক্ষতি আমার নয় কমলেশবাবু, ক্ষতি আপনার। আপনি ওর সঙ্গে আজ সন্ধ্যায় যে অ্যাপয়েন্টমেন্টটা করেছেন সেটার বিষয়েই আলোচনা। রাস্তায় দাঁড়িয়ে সে কথা বলা যায় না। আপনি ইন্টারেস্টেড না হলে আমি বরং এখান থেকেই ফিরে যাই। আফটার অল, আম আমার ‘ফি’ ঠিকই পাব। আর্থিক লোকসানটা শুধু আপনারই।

লোকটা একদৃষ্টে বাসু-সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইল কয়েকটা মুহূর্ত। তারপর বললে, আপনার নামটা জানতে পারি?

-- অনায়াসে। আপনি স্বীকার না করলেও আমি যখন আপনার নাম জানি, তখন আপনিই বা আমার নাম জানবেন না কেন? আমার নাম প্রসন্নকুমার বাসু।

--আপনি ব্যারিস্টার?

-- তা বলতে পারেন।

-- অ! আচ্ছা আসুন আপনি।

দুজনে ভিতরে ঢুকলেন। ইয়েল-লক দরজা আপনি বন্ধ হয়ে গেল। সামনেই সিঁড়ি। ঢালাই হয়েছে, রেলিং নেই। ফিনিশিং হয়নি! ডগ-লেগেড স্টেয়ার। মোড় ঘুরে দ্বিতলে পৌঁছলেন। দ্বিতলে খাড়া খাড়া স্তম্ভ, যেন আগ্রা দূর্গের দেওয়ানি আম। শুধু একটা বড়ো হল-কামরার চারদিকে দেওয়াল তোলা। এক কোনায় শুধু সেই ঘরের বাইরের দিকের জানলায় গ্রিল বসানো। ঘরে চৌকি, বিছানা পাতা। টেবিল-চেয়ার কিছু। টেবিলে টেলিফোন, কিছু নকশা ছড়ানো। এক পাশে নানান গৃহ-নির্মাণের সরঞ্জাম স্তুপাকার করে রাখা। স্যানিটারি পাইপ, কমোড, ওয়াশ-বেসিন। গ্যালভানাইজড জলের পাইপ। আরও কীসব সরঞ্জাম বড়ো বড়ো ক্রেটে বাক্সবন্দী করা। বাসুর দিকে একটি চেয়ার বাড়িয়ে দিয়ে লোকটা তাঁর মুখোমুখি বসল। বাসু জানতে চাইলেন হাইকোর্টের অর্ডারে নাকি এ বাড়ির নির্মাণ-কাজ বন্ধ আছে?

-- হ্যাঁ, মাস-দুয়েক। কর্পোরেশনের মতে বেআইনি কাজ হয়েছে।

-- আপনি কি কেয়ার-টেকার, মিস্টার ঘোষ?

-- সর্ট অফ! এন্টারপ্রেনার আমার বন্ধু। আমি এখানে থাকায় তাকে দারোয়ান রাখতে হয় না। আমিই দেখভাল করি।

-- যদি দলবেঁধে ডাকাত আসে?

কমলেশ টেবিলের টানা-ড্রয়ার খুলে একটা কালোমতো যন্ত্র বার করে দেখাল। বললে, আপনি যে বিষয়ে আলোচনা করতে এসেছেন সে কথাই বলুন। ছন্দা রায়ের কী প্রস্তাবের কথা বলতে চান?

-- আমি তো বলতে আসিনি কমলেশবাবু, শুনতে এসেছি।

-- এই যে বললেন, ছন্দা রায়ের কাছ থেকে এসেছেন?

-- সে তো বটেই। ওই পরিচয় না দিলে আপনি দোর-গোড়া থেকেই আমায় বিদায় দিতেন, তাই নয়? কিন্তু আমি তো বলিনি যে, তার কাছ থেকে কোনও প্রস্তাব নিয়ে এসেছি।

-- অ! তার মানে আপনার কিছু বলার নেই?

-- সেটাও ঠিক নয়। আমার কিছু বলার আছে। এক নম্বর কথা, ছন্দা রায় মেয়েটি খুব ভালো।

তার জীবনে কোনও অশান্তি বা বিড়ম্বনা আসে, এটা আমি চাই না।

-- আমিই কী সেটা চাইছি? আমি তার শক্রপক্ষ নই।

-- বটেই তো! আইনত আপনিই যখন ছন্দা রায়ের স্বামী! “

লোকটা স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বললে, বুঝেছি। কাজটা ছন্দা ভালো করেনি। আপনাকে সব কথা বলে ফেলা...

-- ফর ইওর ইনফরমেশান, ছন্দা রায় আদৌ বলেনি যে, ‘কমলেশ ঘোষ’ তার প্রথম পক্ষের স্বামী।

-- তাহলে কে বলেছে সে কথা?

-- আপনি। এইমাত্র! ছন্দা আমার কাছে এসেছিল তার বান্ধবীর জন্য কিছু লিগাল আ্যাডভাইস নিতে। সে একবারও বলেনি যে, তার প্রথম পক্ষের স্বামী সাত বছর নিরুদ্দেশ ছিল। ওটা আমার আন্দাজ। আপনি এইমাত্র সেটা কনফার্ম করলেন।

লোকটা জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ওঁর দিকে তাকিয়ে থাকল পুরো একটা মিনিট! তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বললে, ছন্দা যদি আপনার মাধ্যমে কোনও প্রস্তাব না পাঠিয়ে থাকে তাহলে আপনি অনুগ্রহ করে যেতে পারেন।

বাসু জবাব দেবার আগেই কলিং-বেলটা বেজে উঠল। একবার দু’বার।

-- কমলেশ জানতে চায়, আপনি কি একা এসেছেন? না গাড়িতে আর কেউ আছে?

-- আমি একাই এসেছি। ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়েছি।

-- তাহলে কলিং-বেল বাজাচ্ছে কে?

-- আপনার কোনও সাক্ষাৎপ্রার্থী। আমি কেমন করে জানব?

কমলেশ টানা-ড্রয়ার থেকে রিভলভারটা হিপ-পকেটে ভরে নিল। বলল, আপনাকে একটু কষ্ট দেব,মিস্টার বাসু। আপনাকে এখানে একা ছেড়ে রেখে আমি যেতে পারব না। আপনিও আসুন আমার সঙ্গে।

-- অল রাইট। চলুন।

বাসুকে অগ্রবর্তী করে কমলেশ নিচে নেমে এল। দ্বার খুলে দিল। বাইরে একজন ডাক-পিয়ন।

বললে: টেলিগ্রাম! কমলেশ ঘোষ? আছেন?

-- আমারই নাম। দাও।

টেলিগ্রাম-পিয়ন খাতায় সই নিয়ে টেলিগ্রামটা হস্তাস্তরিত করে চলে গেল। কমলেশ খামটা ছিঁড়ে টেলিগ্রামটা পড়ল। মুখ তুলে বলল, ছন্দারই টেলিগ্রাম। কিন্তু সে তো আপনার আসার সম্ভাবনার কথা কিছু লেখেনি।

-- ন্যাচারালি। সে জানে না যে, আমি এখানে আসছি। ইন ফ্যাক্ট, সে আপনার নাম বা ঠিকানা কোনওটাই আমাকে জানায়নি।

-- তাহলে আপনি কেন এসেছেন আমার কাছে ? শুধু জানাতে যে, ছন্দা একটা লক্ষ্মী মেয়ে, অথবা তার বান্ধবীর স্বামী নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে?

-- না, মিস্টার ঘোষ। আমি এসেছি ছন্দার বর্তমান ঠিকানার সন্ধানে। তার সঙ্গে যোগাযোগ করাটা জরুরি দরকার ; কিন্তু সে কোথায় থাকে তা আমি জানি না।

-- এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? ছন্দা আপনার ক্লায়েন্ট, অথচ আপনি তার ঠিকানা জানেন না ?

বাসু জবাব দেবার আগেই দ্বিতলে টেলিফোনটা বেজে উঠল। কমলেশ বলল, আপনার বক্তব্য বলা নিশ্চয় শেষ হয়ে গেছে। এবার আসুন আপনি।

-- না, মিস্টার ঘোষ। আমার আরও কিছুটা বলার আছে। কিছুটা শোনারও আছে। আপনি বরং টেলিফোনের ঝামেলাটা প্রথমে মিটিয়ে নিন।

-- অল রাইট। তাহলে আপনি আমার সামনে সামনে চলুন।

-- কোন প্রয়োজন নেই, কমলেশবাবু। আপনি সার্চ রুরে দেখে নিতে পারেন আমি নিরস্ত্র। আপনার চেয়ে বয়সে আমি না-হোক পঁচিশ বছরের বড়ো। আপনার হাতে রিভলভার। অত ভয় পাচ্ছেন কেন?

-- ভয় আমি পাইনি।

-- পেয়েছেন। অন্য কারণে। গিল্টি কনশিয়েন্স। যা হোক। চলুন -- উপরে চলুন। আচ্ছা আমিই না হয় আগে আগে যাচ্ছি।

দু’জনে সিঁড়ি দিয়ে দ্বিতলে উঠে আসেন।

টেলিফোনটা তখনও একনাগাড়ে বেজে চলেছে : ক্রিরিং...ক্রিরিং...



চার

বাসু-সাহেব তার চেয়ারে যতক্ষণ না স্থির হয়ে বসলেন ততক্ষণ কমলেশ টেলিফোনটাকে বাজতে দিল। তারপর তুলে নিল যন্ত্রটা। নিজে বসল না। যন্ত্রটার কথা-মুখে -- না, ‘হ্যালো’ ও বলল না, নিজের নামও ঘোষণা করল না -- নিজের টেলিফোন নম্বরটা ঘোষণা করল শুধু।

ওর স্থিরদৃষ্টি বাসু-সাহেবের দিকে নজর হল, তিনি চোখ দুটি বন্ধ করেছেন। আন্দাজ করতে পারল না হেতুটা -- বাসু-সাহেব তখন তাঁর মস্তিষ্কের একটি ফোকরে পর্যায়ক্রমে ছয়টি গাণিতিক সংখ্যা গুছিয়ে রাখতে ব্যস্ত।

ওপক্ষের কথা শুনে নিয়ে কমলেশ বললে, এ-কথা তো টেলিগ্রামেই বলেছ তুমি, তাহলে কখন আসছ।...কী ? ন্যাকা সাজবার চেষ্টা কোরো না, তুমি ছাড়া কে এই টেলিগ্রামখানা পাঠাবে? ....ঠিক আছে, পরে কথা হবে...না, না, বললাম তো এখন আমি ব্যস্ত আছি। আমার ঘরে ভিজিটার আছে...কী?...সেটা তো তুমি জানই....আয়াম সরি.....

বাসু-সাহেব মাঝপথেই উঠে দাঁড়ান। বলেন, লাইনটা ছেড়ো না। ওর সঙ্গে আমার কথা আছে...

কমলেশ গর্জে ওঠে : সিট ডাউন!

নিঃশব্দে টেলিফোনটা রিসিভারে বসিয়ে দেয়।

বাসু-সাহেব ধীরে ধীরে বসে পড়েন নিজের চেয়ারে।

কমলেশ বলে, বলুন, আর কী বলতে চান।

-- ছন্দাই ফোন করছিল তো?

-- অবান্তর কথা বলবেন না, মিস্টার বাসু। আর আমার প্রাইভেট লাইফে অহেতুক নাক গলাতেও আসবেন না। আপনার যদি কিছু বলার থাকে বলে ফেলুন ; না থাকে বিদায় হন--

-- আমার অনেক কিছুই জানবার আছে, মিস্টার ঘোষ।

-- তাহলে শুরু করুন। আমাদের দুজনেরই সময়ের দাম আছে।

-- এক নম্বর প্রশ্ন : আপনার উপাধি ‘ঘোষ’ অথচ আইনত যিনি আপনার স্ত্রী তার উপাধি “রায়” -- ইতিপূর্বে ছিল ‘বিশ্বাস’। এটা কেমন করে হল?

-- সেটা আপনার ক্লায়েন্টের কাছ থেকে জেনে নেবেন। আর কিছু?

-- গত সাত বছর আপনি আপনার স্ত্রীর সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করেননি কেন? তাকে নতুন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবার সুযোগ দিতে?

-- লুক হিয়ার, মিস্টার বাসু! আমি কিছু কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নেই যে, আপনি ক্রমাগত প্রশ্ন করে যাবেন, আর আমি জবাব দিয়ে যাব। এটা আপনি আশা করেন কোন, আক্কেলে? আমার একটিমাত্র কথা বলার আছে : আমি বেআইনি কাজ কিছু করছি না। ইন্ডিয়ান পিনাল কোডের কোনও ধারাই আমি লঙ্ঘন করতে চাইছি না। ফলে আপনার কিছু করণীয় নেই। আপনি ফুটুন!

--‘ফুটুন’?

-- মানে, মানে-মানে কেটে পড়ুন।

-- আই সী! আপনার ওই শব্দপ্রয়োগে—‘ফুটুন’ কথাটিতে আমার বাকি যেটুকু জানাবার ছিল,তা জানা হয়ে গেছে। ‘ফোটো’ কথাটা যে সম্মানার্থের-আপনাদের ক্লাসের মানুষরা ‘ফুটুন’ বলে থাকেন, তা আমার ঠিক জানা ছিল না। .

উঠে দাঁড়ান উনি। দ্বারের দিকে দু-একপদ গিয়ে ফিরে দাঁড়ান। বলেন, ছন্দা তোমার ঠিকানা আমাকে জানায়নি কমলেশ, আমি নিজেই তা খুঁজে বার করেছি। আর....ও হ্যাঁ, ও টেলিগ্রামটাও ছন্দা রায় তোমাকে পাঠায়নি ওটাও আমিই পাঠিয়েছি...

-- কোন্ টেলিগ্রাম?

-- ওই যেটা আমার উপস্থিতিতে তুমি ডেলিভারি নিলে -- ইম্পট্যার্ন্ট ডেভেলপমেন্ট নেসেসিটেটস ইনডেফিনিট পোস্টপোনমেন্ট” এটসেটরা এটসেটরা...

কমলেশ বুকপকেট থেকে টেলিগ্রামখানা বার করে পড়ে দেখল। ওর চোখ দুটো বড়ো বড়ো হয়ে গেল। বললে, ইজ দ্যাট সো? তা আপনিই বা আমাকে অমন একখানা টেলিগ্রাম পাঠালেন কেন? সি. রায়ের নাম ভাঁড়িয়ে?

বাসু বললেন, জবাবে আমিও তো ওই কথা বলতে পারি, কমলেশ! ওই যেটা তুমি এখন আমাকে শোনালে? পারি না?

-- কী কথা?

“লুক হিয়ার, মিস্টার ঘোষ! আমি কিছু কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নেই যে, আপনি ক্রমাগত প্রশ্ন করে যাবেন আর আমি জবাব দিয়ে যাব!”

কমলেশ হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়েই থাকে।

বাসু বলেন, হয় আমরা পরস্পরের কাছে প্রশ্ন পেশ করব এবং জবাব শুনব, অথবা তুমি তাতে রাজি না থাকলে, আমি আপাতত “ফুটব” এবং পরে এমন ব্যবস্থা করব, যাতে তুমি ফুটন্ত ডেকচিতে “ফুটবে”!

কমলেশ শান্ত স্বরে বললে, বসুন। অলরাইট! আমরা একের পর একজন প্রশ্ন করব এবং অপরপক্ষের জবাব শুনব। একবার আমি, একবার আপনি। পর্যায়ক্রমে। আপাতত বলুন, আমার শেষ প্রশ্নটার কী জবাব?

-- তোমার শেষ প্রশ্নটা ছিল, সি. রায়ের নাম ভাঁড়িয়ে? আমার জবাব হচ্ছে ; সি. রায় আমার ক্লায়েন্ট! সলিসিটার ক্ল্যায়েন্টের তরফে চিঠি লিখলে বা টেলিগ্রাম করলে আইনত তাকে নাম তাড়ানো বলে না।

-- সে কথা আমি বলতে চাইনি, আমার প্রশ্ন...

-- আই নো, আই নো! কিন্তু শেষ প্রশ্নটা তোমার ওই রকমই ছিল। আমি তার জবাব দিয়েছি।

তোমার সার্ভিস নেট-এ আটকে গেছে। এবার আমার সার্ভিস করার কথা। তুমি রিটার্ন দেবে। তাই না? শর্ত হয়েছে দুপক্ষই পর পর প্রশ্ন করব। সুতরাং এবার বলো, কেন তুমি সাত বছর আত্মগোপন করে প্রতীক্ষা করেছিলে?

-- আমি...আমি আত্মগোপন করেছিলাম না মোটেই। বাস-অ্যাকসিডেন্ট-এ আমার স্মৃতিভ্রংশ হয়ে যায়, -- ওই যাকে বলে অ্যামনেশিয়া -- হঠাৎ আমার পূর্বস্মৃতি ফিরে এসেছে!

বাসু হাসলেন। বললেন, সুন্দর জবাবটা দিয়েছ, কমলেশ। তোমার একটিই ভুল হয়েছে-- কর্তৃবাচক পদটির দ্বিত্বপ্রয়োগ! বুঝলে না? কৈফিয়ৎটা তোমার সড়গড় হয়নি। তোমার বলা উচিত ছিল, ‘আমি আত্মগোপন করে ছিলাম না মোটেই।’

-- তাই তো বলেছি আমি!

-- না, তা বলোনি। বলেছ : ‘আমি….আমি আত্মগোপন করেছিলাম না মোটেই।’ প্রথম ‘আমি’র পর যে সামান্য বিরতি দিয়ে দ্বিতীয়বার “আমি” টাই প্রশ্নকর্তাকে বুঝিয়ে দিল : এটা মিথ্যা অজুহাত। সে যা হোক, এবার তোমার প্রশ্ন করার পালা। সার্ভ করো।

-- আপনার ক্লায়েন্ট...

-- সরি, ফর ইন্টারাপ্টিং য়ু। এই পর্যায়ে আমার পক্ষে জানিয়ে রাখা শোভন যে, আমার ক্লায়েন্ট ‘ছন্দা’ নয়, তার স্বামী মিঃ রায়। ইয়েস, বলো কী জানতে চাইছ?

-- আপনি তো এতক্ষণ বলেননি যে, “ছন্দা” নয়, ‘ত্রিদিবনারায়ণ’ই আপনার ক্লায়েন্ট! কেন?

-- তার হেতু তুমি তো এতক্ষণ আমার সঙ্গে সহযোগিতা করতে স্বীকৃত হচ্ছিলে না। দোর থেকেই আমাকে ‘ফোটাতে’ চাইছিলে। এখন শর্ত হয়েছে দুজনেই প্রশ্ন করব এবং উত্তর শুনব, তাই।

-- সেক্ষেত্রে আমার প্রশ্ন--

-- সরি, কমলেশ! এবারও তোমার সার্ভিস নেটে আটকে গেছে! ডাবল্ ফল্ট্। তোমার প্রশ্ন তুমি পেশ করেছ এবং আমি তার জবাব দিয়েছি। এবার আমার প্রশ্ন করার পালা: তুমি কি জান যে, ত্রিদিবনারায়ণ রায়ও জানতে পেরেছে যে, তার স্ত্রীর প্রথমপক্ষের স্বামী জীবিত এবং সে ব্ল্যাকমেলিং-এর ধান্দায় আছে?

কমলেশ স্থির দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর প্রায় আত্মগতভাবে বললে,ইম্পসিবল।

-- কোনটা ইম্পসিবল? ত্রিদিবনারায়ণ জানে না ছন্দার প্রথম স্বামী জীবিত থাকার তথ্যটা? না কি ব্ল্যাকমেলিং করবার কথাটা?

-- কে ব্ল্যাকমেলিং করতে চাইছে? সে প্রশ্ন তো এখনও ওঠেনি?

-- না, ত্রিদিবের বিশ্বাস তার স্ত্রীকে ব্ল্যাকমেলিং করতে চাইছে একজন তৃতীয়পক্ষ -- একজন প্রফেশনাল ব্ল্যাকমেলার-- যে, ঘটনাচক্রে জানতে পেরেছে ধনকুবের ত্রিদিবনারায়ণের স্ত্রী অন্যপূর্বা!

কমলেশের বোধকরি গুলিয়ে গেল খেলার আইনটা। এক-একবার সার্ভ করার কথা। কে কাকে প্রশ্ন করছে আর কে কাকে জবাব দিচ্ছে তার হিসাবটার কথা তার মনে রইল না।

কমলেশ বললে, তৃতীয়পক্ষ! তা হতেই পারে না। তৃতীয়পক্ষ কোথা থেকে আসবে? আর ত্রিদিব এমন গবেট...

-- না, কমলেশ! তুমি ত্রিদিবকে যতটা গবেট ভাবছ, ততটা সে নয়!

-- কেন? তার ‘অতিবুদ্ধির’ কী পরিচয় পেয়েছেন আপনি?

-- তা পেয়েছি বইকি কিছুটা। তার সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়নি যে, সে আলালের ঘরের দুলাল।

-- তাহলে বলব, মানুষ চেনার ক্ষমতা আপনার আদৌ নেই!

-- কিন্তু এ কথা তো ঠিক -- একটু আত্মশ্লাঘা হয়ে যাচ্ছে -- ত্রিদিব খুঁজে খুঁজে জব্বর উকিলকেই কেসটা দিয়েছে। একটা ফেরেব্বাজ টাউটের পাল্লায় পড়ে রক্তচোষা বাদুড়ের খপ্পড়ে পড়েনি--

কমলেশ বাধা দিয়ে বললে, তার কারণ অন্য কিছুও হতে---

ওকে বাধা দিয়ে বাসু বলে ওঠেন, তা অবশ্য হতে পারে, মানে তুমি যা বলছ...

-- আমি আবার কী বললাম?

-- অর্থাৎ ত্রিদিব আমাকে নিজে নির্বাচন করেনি। সে ব্যক্তিগতভাবে আমার সঙ্গে দেখা করেছিল বটে। কিন্তু আমাকে নির্বাচন করেছেন তার স্বনামধন্য পিতৃদেব!

-- আমি মোটেই সে কথা বলিনি। ত্রিবিক্রমনারায়ণ কিছুই জানেন না এখনও।

-- তুমি বলতে চাও যে, ত্রিদিব যে একটি হাসপাতালের নার্সকে বেমক্কা বিয়ে করে বসে আছে সে খবরটাও ধনকুবের ত্রিবিক্রমনারায়ণ রায় জানেন না?

হঠাৎ কী খেয়াল হয় কমলেশের। সে আচমকা উঠে দাঁড়ায়! বলে, আপনি ক্রমাগত আমার পেট থেকে কথা বের করে নিচ্ছেন। অথচ নিজে থেকে কিছুই বলছেন না।

-- আমি ও তো তোমাকে বলছি, কমলেশ। বলছি, সাবধান হও!

-- সাবধান হব! কেন? কী করেছি আমি?

-- সেটা তুমিও জান, আমিও জানি। সেটা আলোচনা না করা দুপক্ষেরই মঙ্গল। তোমার সঙ্গে আমার যেমন কোনও দোস্তি নেই, তেমনি কোনও শক্রতাও নেই। আমি শুধু আমার ক্লায়েন্টের মঙ্গলাকাঙক্ষী। আর সেটা যদি ‘বিনা’ রক্তপাতে হয়...

-- “বিনা রক্তপাতে” মানে?

-- তুমি তো গবেট নও, কমলেশ! ত্রিবিক্রমনারায়ণ তার পারিবারিক সুনাম রক্ষার জন্যে কতদূর যেতে পারেন....

-- আপনি কি আমাকে ভয় দেখাতে এসেছেন?

-- আমার স্বার্থ?

-- আপনার ব্যক্তিগত নয়, কিন্তু আপনার ক্লায়েন্টের স্বার্থ জড়িত আছে বইকি।

-- তার মানে ধনকুবের ত্রিবিক্রমনারায়ণের পারিবারিক সুনাম নষ্ট করতে তুমি বদ্ধপরিকর?

-- তেমন কথা আমি আদৌ বলিনি!

-- বলনি। ইঙ্গিত করেছ, যদি তোমার স্ত্রী টাকাটা না মিটিয়ে দেয়।

দুর্ভাগ্য! নিতান্ত দুর্ভাগ্য! এই মুহূর্তে আবার বেজে উঠল টেলিফোনটা।

কথার মারপ্যাচে সাক্ষীকে পেড়ে ফেলাই ওঁর পেশা ও নেশা। সেই কায়দাতে শুভ্রার কাছ থেকে আদায় করেছিলেন ওর ক্লায়েন্টের নাম। এখানেও সেই একই কায়দায় কমলেশের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছেন তাঁর ক্লায়েন্টের স্বামী ও শ্বশুরের নাম। কথাবার্তা আর একটু চালাতে পারলে ছন্দা রায়ের ঠিকানা অথবা টেলিফোন নাম্বারটা ঠিক সংগ্রহ করা যেত। অথচ ওই ব্রাহ্মমুহূর্তেই ক্রিরিং-ক্রিরিং করে বেজে উঠল টেলিফোনটা। যেন সম্মোহনের একটা ঘোর থেকে জেগে উঠল কমলেশ। যন্ত্রটা তুলে নিয়ে এবার আর নাম্বার বলল না, বলল--

কমল বলছি..বলো ?...না, ওয়েট! একটু লাইনটা ধরো...

যন্ত্র নামিয়ে রাখল টেবিলে। বাসুসাহেবের দিকে ফিরে শান্ত স্বরে বললে, প্লিজ মিস্টার বাসু! এবার আসুন আপনি।

-- ছন্দাই আবার ফোন করছে?

-- গর্জে উঠল কমলেশ, দ্যাটস্ নান্ অব ইয়োর বিজনেস! প্লিজ গেট আউট!

বাসু উঠে দাঁড়ালেন। শাস্তস্বরে বললেন, তুমি অহেতুক রাগারাগি করছ কেন কমলেশ? আমি তো তোমার শক্রপক্ষ নই!

কমলেশ হিপপকেট থেকে তার আত্মরক্ষার অস্ত্রটা বার করে বলল, লুক হিয়ার মিস্টার বাসু। আমি আপনার ক্লায়েন্টের মতো আলালের ঘরের দুলালও নই, গবেটও নই! ফ্র্যাঙ্কি-পাইলের মাঙ্কিটার দুম-দুম শব্দ শুনতে পাচ্ছেন?

-- শেষ প্রশ্নটা আপাত-অপ্রাসঙ্গিক, কিন্তু তার মর্মগ্রহণে অসুবিধা, হল না বাসু-সাহেবের। অদুরেই কোনও বাড়িতে পাইল-বনিয়াদ্ বানানোর জন্য সাত-সেকেন্ড পর পর একটা ‘দুম্” শব্দ হচ্ছে। সেটার কথাই বলছে। কমলেশ সেই অপ্রাসঙ্গিক কথাটা অর্থবহ করে তুলল তার পরবর্তী কথায় : ঠিক ওই শব্দটার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ফায়ার করলে ত্রিসীমানায় কেউ বুঝতে পারবে না,বসু সাহেব তাঁর মানবলীলা এই অসমাপ্ত প্রাসাদের ভিতর সংবরণ করলেন। আর বিলিভ ইট অর নট---এ বাড়ির পিছনে প্লিন্থ ভরাট করানোর জন্য বিরাট বড়ো বড়ো গর্ত খোঁড়া আছে। লাশ পাচার করতে আমার কোনও অসুবিধা হবে না।

বাসু বলে ওঠেন, এসব কী বলছ, কমলেশ?

মারণযন্ত্রটা উঁচু করে জবাবে ও বলল, আমি তিন গুণব, তার মধ্যে আপনি যদি সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু না করেন...আই মিন, না ‘ফোটেন....’

-- অলরাইট, অলরাইট! ওটা নামিয়ে রাখো ওটা লোডেড...

পায়ে-পায়ে উনি সিঁড়ির দিকে এগিয়ে চলেছেন। কমল দেখা গেল অত্যন্ত সাবধানী। বাসু-সাহেবের পিছনে পিছনে সে নিজেও নেমে এল নিচে। দরজা খুলে বৃদ্ধকে আক্ষরিক অর্থে পথে নামিয়ে ইয়েল-লক দরজা বন্ধ করে দিল। বাসু ঘড়ি দেখলেন। অনেক বেলা হয়ে গেছে! রাস্তা দিয়ে কিছু প্রাইভেট-কার যাতায়াত করছে বটে, খালি ট্যাক্সির কোনও চিহ্নমাত্র নেই। কী করবেন স্থির করতে গিয়ে প্রতিবর্তী প্রেরণায় ডান হাতটা চলে গেল পকেটে, পাইপ-পাউচ-এর সন্ধানে। দুর্ভাগ্য সবদিকেই। অনেকক্ষণ খচর-খচর করেও লাইটারটা জ্বালাতে পারলেন না। সম্ভবত জ্বালানি ফুরিয়েছে। রি-ফিল করতে হবে। আপাতত সমাধান: একটি দেশলাই খরিদ করা। নজর গেল গলি রাস্তার ওপারে--যে পান-বিড়ির দোকানে সংবাদ নিয়েছিলেন প্রথমে। লোকটার গালে এখনও পান-ঠাসা। দোকানের সামনে একটি মাত্র খদ্দের। মটোর সাইকেলে বসে কী যেন বলছে। লোকটার মাথায় হেলমেট, চোখে সানগ্লাস-- চেনা মুশকিল। বাসু গুটিগুটি সেদিকপানে এগিয়ে গেলেন।

পানওয়ালা তখন বলছে, আজ্ঞে না বাবু, আপনি ভুল ঠিকানায় এসেছেন। এই গলিতে আমি হাফ-প্যান্ট-পরে মার্বেল খেলেছি, এ পাড়ার সবাইকে চিনি। ‘দত্ত-মজুমদার’ নামে কেউ এ গলিতে থাকেন না।

বাসু এসে দাঁড়ালেন। মোটর-বাইকের আরোহীর বয়স সাতাশ-আঠাশ। নিম্নাঙ্গে জীনস, উর্ধ্বাঙ্গে উইন্ড-চিটার। অত্যন্ত বলিষ্ঠগঠন যুবাপুরুষ। বাসু-সাহেবকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে তাকেই প্রশ্ন করে, আপনি কি এপাড়ায় থাকেন, দাদু?

বাসু বললেন, না দাদু, থাকি না। তবে অনেক অনেক দত্ত-মজুমদারকে চিনি। কেউ এ পাড়ার, কেউ বে-পাড়ার। বাই এনি চান্স, তুমি কি কমলেশ দত্ত-মজুমদারকে খুঁজছ?

লোকটা পকেট থেকে একটি সুদৃশ্য সিগ্রেট-কেস বার করে ঠোঁটে একটা সিগ্রেট চেপে ধরে লাইটার জ্বালিয়ে সেটাকে ধরাল। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললে, কমলেশ নয়, কমলচন্দ্র দত্ত মজুমদার...

-- বাসু হাত বাড়িয়ে ওর কাছ থেকে লাইটারটা চেয়ে নিয়ে নিজের পাইপটা ধরিয়ে বললেন, সরি। তাহলে সে অন্য কমল। আমি বলছিলাম কুলীন-কমলের কথা।

ছেলেটি উৎসাহ দেখাল, কী কমল? ‘কুলীন’ কমল মানে?

-- কুলীনরা সেকালে অনেক অনেক বিয়ে করত শোননি? আমি যে কমল-এর কথা বলছি সে ছিল তেমনি বিবাহ-বিশারদ কমল। কমলচন্দ্র নয়, কমলেশ...

ছেলেটা তার বাহনকে স্ট্যান্ডের উপর দাঁড় করায়। ঘনিয়ে এসে বলে, আপনি যার কথা বলছেন, আমিও বোধহয় তার কথাই বলছি...

-- বয়স বছর পঁয়তাল্লিশ, রোগা, মুখে বসন্তের দাগ?

-- এগজ্যাক্টলি। কোথায় থাকে জানেন?

-- জানি। এ পাড়ায় নয়।

-- পানওয়ালা ওপরপড়া হয়ে বলে ওঠে, দেখলেন? এ পাড়ার নাড়ি-নক্ষত্র আমার নখদর্পণে।

ছেলেটি বলে, তবে কোথায়?

বাসু বললেন, এসো, ওই দোকানে গিয়ে একটু চা পান করা যাক। তোমার মটোর-সাইকেলটা এখানেই থাক।...কী বল!

শেষ প্রশ্নটা পান-বিড়ি-ওয়ালাকে। সে স্বীকৃত হল।

চায়ের দোকানে দূরতমপ্রান্তে দুজনে গিয়ে বসলেন। এই পড়ন্ত বেলায় আর কোনও খদ্দের ছিল না। দোকানদারও ঝিমোচ্ছিল। ঢ়ুলু ঢ়ুলু চোখে জানতে চায় কী দেব, স্যার?

-- দু-কাপ চা।

-- ঠিক আছে বসুন। একটু দিতে দেরী হবে কিন্তু। আঁচটা নেমে গেছে।

বাসু বললেন, ‘উঁচু করো। আমাদের তাড়া নেই’।

ছেলেটি বসল দেয়াল-ঘেঁষে। রাস্তার দিকে মুখ করে, যাতে বাহনটাকে নজরে রাখা যায়।

বসু জানতে চান, কমলকে খুঁজছ কেন? আগে সেটাই বল?

-- সে অনেক কথা, দাদু! বর্তমান ঠিকানাটা জানেন?

জানি। তোমাকে জানাতে রাজি আছি। কিন্তু তার আগে আমার কয়েকটি কৌতুহল মেটাতে হবে। প্রথম প্রশ্ন : তুমি যাকে খুঁজছ সেই কমল যাকে ফাঁসিয়েছে সে মেয়েটি তোমার কে?

ছেলেটি একটু অবাক হল। বলল, আপনি যে গণৎকার ঠাকুরের মতো ভেল্কি শুরু করলেন, দাদু! কেমন করে জানলেন যে, আমি যে কমলকে খুঁজছি সে একটি মহিলাকে ফাঁসিয়েছে?

বাসু বললেন, দেখ ভাই। আমি খোলা কথার মানুষ। এভাবে উলটো-পালটা প্রশ্নোত্তর করলে আমার চলবে না। তুমি যদি, আমার সাহায্য চাও তাহলে আমাকে সাহায্যও করতে হবে। তুমি না চাও কথোপকথন বন্ধ করে আমরা দু-জনেই যে যার বাড়ি পানে হাঁটা ধরতে পারি। আর যদি আমার মাধ্যমে কমলের বর্তমান ঠিকানাটা জানতে চাও...

ছেলেটি বাধা দিয়ে বলে, বুঝেছি, বুঝেছি। বলুন, কী জানতে চান?

বাসু পকেট থেকে তার নামাঙ্কিত একটি কার্ড ওর সামনে টেবিলে রেখে বলেন, প্রথম প্রশ্ন, তোমার নাম ও ঠিকানা।

ছেলেটা ওঁর কার্ডখানার দিকে তাকিয়েও দেখল না। ফেরত দেবার জন্য বাড়িয়ে ধরে বললে, মাপ করবেন, দাদু, আমি তে-তাস খেলার আসরে প্রথমে তিন ডীল ব্রাইন্ড খেলি।

বাসু নির্বিবাদে ওঁর নিজের নামাঙ্কিত কার্ডখানি তুলে নিয়ে বললেন, তাহলে ওই প্রশ্নটার জবাব দাও, যে মেয়েটিকে কমল ফাঁসিয়েছে সে তোমার কে?

-- আমার ক্লায়েন্ট।

-- যেহেতু এটা সেকেন্ড ডিল তাই বোধহয় আমার প্রশ্নটা করা সমীচীন হবে না – মেয়েটি তোমার ক্লায়েন্ট হল কোন সুবাদে -- ডাক্তারি, ওকালতি, ঘটকালি...

-- আজ্ঞে না, ওর একটাও নয়। আমি কমিশন নিয়ে কার্যোদ্ধার করি। আমার ক্লায়েন্টের বিশ হাজার টাকা মেরে দিয়ে ওই হারামজাদা গা-ঢাকা দিয়েছে। টাকাটা উদ্ধার করতে পারলে আমি কমিশন পাব টোয়েন্টি-ফাইভ পার্সেন্ট অর্থাৎ পাঁচ হাজার নেট!

-- নেট? অর্থাৎ তোমার খরচ-খরচা ছাড়া?

-- আজ্ঞে হ্যাঁ! এক্সপেলসেস্ পৃথক। কিন্তু এত বিস্তারিত জানতে চাইছেন কেন?

-- একই হেতুতে। আমিও ওই বিবাহ-বিশারদ কমলকে খুঁজছি একই কারণে। তাই ভাবছি, তোমাকে কমিশনে কাজটার দায়িত্ব দেওয়া যায় কি না?

-- কেন যাবে না! আমার রেট বাঁধা। টোয়েন্টি-ফাইভ। আপনার আত্মীয়ার কত খোয়া গেছে? কত দিন আগে?

-- আমার মনে হচ্ছে থার্ড ডিল খেলা হয়ে গেছে। এখন তোমার নাম পরিচয়টা...

-- আজ্ঞে না। আপনি যে পুলিশের লোক নন, তার প্রমাণ এখনও আমি পাইনি।

-- আমার ভিজিটিং কার্ড তো তুমি দেখতেই চাইলে না।

-- ভিজিটিং কার্ড-এ কিছু প্রমাণ হয় নাকি? সঙ্গে আপনার ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে? কিংবা পাসপোর্ট?

একটি বাচ্চা ছেলে দু-কাপ চা নামিয়ে রাখল। তার হাতে, টাকার নোট গুঁজে দিয়ে বাসু উঠে পড়লেন। তার ভিজিটিং কার্ডখানা এই অজ্ঞাতনামা যুবকের দিকে ঠেলে দিয়ে বললেন, হিম্মতে যদি কুলায় তাহলে ওই ঠিকানায় কাল সকালে ঠিক আটটার সময় আমার সঙ্গে দেখা কর। আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স আর পাসপোর্ট দুটোই দেখাব। তবে হ্যাঁ...তোমার আইডেন্টিফিকেশনের সন্দেহাতীত প্রমাণটা নিয়ে যেও, ব্রাদার।

ছেলেটি বাধা দেয়, শুনুন, স্যার! আচ্ছা সব কথা বলছি...

বাসু রাজি হলেন না। বললেন, সরি; য়ু হ্যাভ মিসড য়োর বাস্। কাল সকাল আটটায়। আমার চেম্বারে।

ছেলেটি উবুড়-করা কার্ডটা এবার চিত করে দেখল। কোন উচ্চবাচ্য করল না। রাস্তা পার হয়ে মটোর বাইকে সওয়ার হল। পাড়া কাঁপিয়ে নিঃশব্দে চলে গেল পুবমুখো।

বাসুও রাস্তা পার হলেন। লক্ষ্য হল পানওয়ালা দুলে দুলে বিড়ি বানিয়ে চলেছে বটে কিন্তু ওঁদেরকে মাঝে মাঝে চোখ তুলে নজর করছে। বসু ওর কাছে ঘনিয়ে এসে বললেন, একটা দেশলাই দেখি। লোকটা “নিক্কথায়” একটা টেক্কামার্কা চতুষ্কোণ ওঁর দিকে বাড়িয়ে ধরল। বাসুও হিপ-পকেট থেকে ভারি ওয়ালেটটা বার করে তার গর্ভ থেকে বার করে আনলেন একটা বিশ টাকার নোট। এবার লোকটা পানের পিক্ ফেলতে বাধ্য হল। একটু ধমকের সুরে বললে, দেশলাই কিনে কি বিশ টাকার নোট ভাঙানো যায়, বাবু?

-- না, যায় না!

-- তাহলে? খুচরো দিন?

-- না! গোটা নোটখানাই তোমার। ভাঙানি দিতে হবে না তোমাকে।

লোকটার গালে ঠাসা পান। তবু মুখটা হাঁ হয়ে গেল।

বাসু পাদপূরণ করলেন, তুমি এ পাড়ায় হাফপ্যান্ট পরে ড্যাংগুলি খেলেছ। সবাইকে চেন। তোমাকে বেশ চালাক-চতুরও মনে হচ্ছে আমার। তাই তোমার কাছে আমি কিছু সাহায্য চাইব। ও বিশ টাকা থাক। ভালো সার্ভিস দিলে আরও পাবে।

পানওয়ালা সামলে নিয়েছে। কিন্তু নোটখানা নেয়নি। সেটা ওর সামনে মার্বেল স্ল্যাবে পাতা-পানের পাশে পড়েই আছে। বললে, তার আগে একটা কথা বলুন, স্যার, আপনি পুলিশের লোক, না পার্টির? পার্টি হলে কোন পার্টি!

বাসু নিক্কথায় নোটখানা তুলে নিলেন। পরিবর্তে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট সেখানে রেখে বললেন, তোমাকে আমি আন্ডার-এস্টিমেট করেছিলাম। তুমি বুদ্ধিমান। এই ধর আমার কার্ড! আমি ব্যারিস্টার! ওই দোতলায় যে লোকটি থাকে--যাকে তুমি ঘোষবাবু নামে চেন-- ওরই সন্ধানে আমি এসেছিলাম--’

-- সে তো দেখতেই পেলাম, পাকা চল্লিশ মিনিট আপনি ছিলেন ওর দোতলার ঘরে।

-- তা ছিলাম। তা তোমার নামটি কী বাপু? তুমি কোথায় থাক?

-- আজ্ঞে, আমার নাম বটুক। বটুকনাথ মণ্ডল। থাকি এই বাড়িতেই। দিনে দোকান দেখি। রাতে থাকি এর উপরের ঘরখানায়। দেড়তলার কামরায়।

-- একা?

-- আজ্ঞে না, আমার পরিবারও থাকে, মানে ইস্ত্রি। মাত্র দুজন।

-- ওই ঘোষবাবু এ পাড়ায় কদ্দিন এসেছে?

-- কমলেশ ঘোষ?

-- কমলেশ? ওর নাম কমলেশ তা তুমি জানতে।

-- আজ্ঞে আজ সকালেও জানতাম না, কিন্তু এখন জানি। আপনি তো কমলেশ ঘোষকেই খুঁজছিলেন।

-- তা খুঁজছিলাম। তা উনি কতদিন এ বাড়িতে এসেছেন?

-- ধরুন হপ্তাখানেক। মথুরাবাবু গাড়ি করে ওকে পৌঁছে দিয়ে গেছলেন।

-- মথুরাবাবুটি কে?

-- যিনি এই বাড়িটা বানাচ্ছিলেন। ঠিকাদার। লক্ষপতি মানুষ।

-- ঠিক আছে বটুক! আজ আমি যাই। পরে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করব। ওই কমলেশের বাড়িতে কে কখন আসছে, নজর রেখো। গাড়ি বা ট্যাকসিতে এলে গাড়ির নম্বর টুকে রেখো। আর কমল নিজে যদি বাড়ির বাইরে যায়, তাহলে কখন গেল, কখন ফিরল লিখে রেখো, কেমন?

-- একটা কথা বলেন, স্যারঃ লোকটা কি মস্তান পার্টির? মানে রাজনৈতিক দাদাদের পোষা গুণ্ডা? পুলিশের সঙ্গে আঁতাত রেখে.....’

-- না, বটুক, সে ভয় নেই! তবে হ্যাঁ, লোকটা আঁধারের কারবারি।

-- তাহলে স্যার, আমি ছা-পোষা মানুষ...

-- ছা’ আবার এল কোথা থেকে? এই যে বললে, দোতলার ঘরে তোমরা মাত্র দু’জন থাক? তুমি আর তোমার স্ত্রী?

-- একটু রেখে- ঢেকে বলেছিলম আর কী। দুই নয়, সওয়া দুই! আমার স্ত্রী-- মানে-আর মাস ছয়েক--

-- বুঝেছি। না, লোকটার সঙ্গে সংঘর্ষে যেয়ো না। দূর থেকে নজর রেখো শুধু। তোমার স্ত্রীর পিছনে খরচও তো করতে হচ্ছে। উপরি কিছু রোজগারে আপত্তি কী?

-- তা তো বটেই স্যার!



পাঁচ



বাড়িতে এসে যখন পৌছালেন তখন সাড়ে তিনটে। রানু কী একটা বই পড়ছিলেন। বারান্দায় বসে। ট্যাক্সিটা এসে দাঁড়াতেই সুজাতা এগিয়ে এল। বাসু ভাড়া মিটিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে সুজাতাকে বললেন, ওর স্বামী আর শ্বশুরের নাম জানা গেছে।

-- হ্যাঁ, ত্রিদিব আর ত্রিবিক্রম নারায়ণ! কিন্তু সে সব কথা পরে। মামিমা এখনও মুখে কুটোটি কাটেননি। আপনি মুখ-হাত ধুয়ে ডাইনিং হলে চলে আসুন। বড্ড বেলা হয়ে গেল আজ।

রানু বললেন, কৌশিককেও ডাক সুজাতা। সে বোধহয় না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে।

বাসু বিব্রত: তার মানে তোমরা কেউ লাঞ্চ করোনি?

রানুর জবাবটা ধমকের মতো শোনাল: তাই কি কেউ পারে?

তিনজনে একসঙ্গে আহারে বসলেন। কারণ কৌশিক না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েনি আদৌ। সুজাতা ইতিমধ্যে ম্যারেজ রেজিস্টার--যাঁর অফিসে ওরা বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল--তাঁর পাত্তাটা পেয়েছে শুনে কৌশিক আবার গাড়ি নিয়ে বার হয়ে গেছে। ত্রিদিব আর ত্রিবিক্রমের বিস্তারিত সংবাদ সংগ্রহ মানসে। বাসু-সাহেবের প্রশ্নে সুজাতা জানাল, ওরা ম্যারেজ-রেজিস্টারের খোঁজ বার করতে পেরেছে। হ্যাঁ ছন্দার শ্বশুর একজন ধনকুবের। বোম্বাই আর নাসিকের মাঝামাঝি তাঁর বিশাল ফ্যাক্টরি৷ এতদিন একচ্ছত্র মালিক ছিলেন, ইদানীং সেটি লিমিটেড কোম্পানি; কিন্তু ত্রিবিক্রমনারায়ণ রায় শেয়ারের বৃকোদরভাগ দখল করে ম্যানেজি ডাইরেক্টর হয়ে বসে আছেন। ত্রিদিবনারায়ণ তাঁর একমাত্র পুত্র। বরাবর কলকাতায় থেকে পড়াশুনা করেছে। একেবারে ভেতো বাঙালি হয়ে গেছে। যদিও ত্রিবিক্রমনারায়ণ বাস্তবে ‘রায়’ নন, 'রাও’। ওরা জাতে রাজপুত। শক্তাবৎ না চন্দ্রাবৎ, কী যেন একটা রাজবংশের রক্ত ওঁদের ধমনীতে। রক্ত থাক না থাক, অভিমানটা আছে। পুত্র পিতাকে গোপন করে বেমক্কা একটা রেজিস্ট্রি বিয়ে করে বসেছে।

শেষপাতে ডিশে যখন পুডিং পরিবেশন করছে, তখন বেজে উঠল টেলিফোন। সুজাতার হাতের কাছেই যন্ত্রটা। তুলে নিয়ে আত্মঘোষণা করল। তারপরেই বলল, কী নাম বললেন? সুভদ্রা সেন? এই নাম্বারে...? না-না, নাম্বার ঠিকই আছে....

রানু দেবী চিৎকার করে বললেন, ফোনটা আমার। আমাকে দাও !

সুজাতা রীতিমতো বিস্মিত। তবে বিস্ময়ের অনুভূতিটা এ বাড়িতে সকলেই অনায়াসে ভোঁতা করে নিতে জানে। সুজাতা রিসিভারটা রানুর দিকে বাড়িয়ে ধরল। তিনি হাত দিয়েই খাচ্ছিলেন-- কাঁটা চামচ দিয়ে নয়-- বাঁ হাতে যন্ত্রটা ধরে তার ‘কথামুখে’ বললেন, সুভদ্রা সেন বলছি; কে? ছন্দা রায়?

ও-প্রান্ত থেকে ভেসে এল প্রত্যুত্তর, হ্যাঁ। আপনি শুভ্রাকে ফোন করে জানিয়েছিলেন আমি যেন রিং-ব্যাক করি। তাই নয়?

-- হ্যাঁ তাই। তোমাকে কিছু বলার আছে, ছন্দা....

-- তার আগে বলুন, আপানি কেমন করে জানলেন ওই নাম্বারে শুভ্রা চৌধুরী আমার বন্ধু?

-- বলব। তারও আগে বলি, কমলেশ ঘোষ আমার বন্ধু নয় আদৌ। শুভ্রা ওটা ভুল বলেছে তোমাকে। সে নিশ্চয় বলেছে যে, আমি কমলেশের বান্ধবী এবং তোমাকে কমলেশের তরফে কিছু জানাতে চাই, বলেনি?

ছন্দা ওর এই বাহুল্য প্রশ্নের কোনও জবাব দেবার চেষ্টাই করল না। সরাসরি বললে, তাহলে আপনি কে? আমাকে কী বলতে চান?

আমার নাম সুভদ্রা নয়, আমার নাম রানু বাসু। আমি মিস্টার পি. কে. বাসুর বাড়ি থেকে বলাছ। তুমি আজই সকালে আমাদের বাড়িতে এসেছিলে, নিউ আলিপুরে, শিখা দত্তের পরিচয়ে...

-- গুড গড। আপনি কেমন করে........?

-- শোন, তুমি এখানে একটা ব্যাগ ফেলে গেছ। সেটা টের পেয়েছ নিশ্চয়। তাতে অনেক দামি জিনিস আছে...

-- জানি, জানি, কিন্তু শুভ্রাদির নাম্বারটা...

-- তোমাকে আরও জানাই, মিস্টার পি. কে. বাসু তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান। আমার পাশেই তিনি বসে আছেন। তুমি কি তার সঙ্গে কথা বলবে?

-- আর কোনও অলটারনেটিভ্ রেখেছেন আপনারা? দিন!

বাসু ওঁর হাত থেকে টেলিফোন-যন্ত্রটা নিয়ে তার কথামুখে বললেন, অনেক ভুগিয়েছ ছন্দা, এবার এসে মুখোমুখি বসে সব কথা বলবে?

-- তার আগে একটা কথা বলুন, আপনি কি ওকে একটা টেলিগ্রাম করেছেন?

-- “ওকে” মানে? তোমার বান্ধবীর স্বামী নিরুদ্দিষ্ট কমলেশ ঘোষকে? হ্যাঁ, করেছি।

-- আপনি ওর নাম-ঠিকানা জানলেন কীভাবে?

ঠিক যেভাবে তোমার এবং তোমার স্বামী ত্রিদিবনারায়ণ রাওয়ের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করেছি। কিন্ত সে-সব কথা টেলিফোনে আলোচনা করতে চাই না। তুমি কি একবার আসতে পার?

-- না! আপনি ইতিমধ্যেই সর্বনাশ যা করার তা করেছেন! আর না!

-- তাহলে আমিই তোমাদের আলিপুরের বাড়িতে….

-- সর্বনাশ! না, না, সে চেষ্টাও করবেন না।

-- তাহলে? একটা কিছু তো করতে হবেই। উই মাস্ট সিট আ্যা্ক্রস দ্য টেবিল সামহোয়ার!

-- অল রাইট। আমিই আসছি। আধঘণ্টার মধ্যে।

এসো। তবে তোমার মারুতি গাড়িতে নয়। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটা ফ্লাইং ট্যাক্সি ধরে।

-- কেন বলুন তো?

-- তুমি কি এখনও টের পাওনি যে, তোমাকে একজন “ফলো” করছে?

-- না তো? কে? কেন? আমার পিছু নেওয়ার কী উদ্দেশ্য?

-- সেটা তো তুমিই আমাকে বলবে, ছন্দা।

আধঘণ্টার মধ্যে এল মেয়েটি।

ওঁর একান্ত কক্ষে বসলেন দু-জনে?

ছন্দা মুখ খোলার আগেই উনি একনিশ্বাসে বললেন, আয়াম সরি, ছন্দা। আমি জানতাম না, তুমি আমার সঙ্গে দেখা করতে আসার আগেই রানুকে একটা রিটেইনার দিয়ে এসেছিলে!

ছন্দা অবাক হয়ে বলে, তাতে কী হল?

-- তাতে এই হল যে, রানু ‘রিটেইনার’ গ্রহণের মুহূর্ত থেকে তুমি আমার ক্লায়েন্ট। তুমি জান না, এথিক্যাল কারণে ক্লায়েন্টের জন্যে আমি জান-কবুল। তাই সারা দিনে তোমার নাম, স্বামীর নাম, শ্বশুরের নাম, মায়, তোমার প্রথম স্বামীর নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে ফেলেছি।

-- আপনি জানেন না, এইভাবে আপনি আমার কী সর্বনাশ করে বসে আছেন!

-- না, তা নয়। সে যাই হোক, তুমি কমলেশের সঙ্গে সন্ধ্যা পাঁচটার আ্যাপয়েন্টমেন্টটা রাখতে পারলে না কেন?

-- কারণ আমি এখনও কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি।

-- কমলেশ কেন দেখা করতে বলেছে? সে কী চায়?

-- এখনও বোঝেননি? টাকা।

-- কত?

-- কাল সকালে ব্যাঙ্ক খোলার আগে দুই হাজার। এ সপ্তাহের ভিতর দশ হাজার।

-- অত টাকা তোমার আছে?

-- না নেই। ধার করতে পারি।

-- কেন? তুমি তো বড়োলোকের বউ। তোমার স্বামী তো কোটি কোটি টাকার ওয়ারিশান।

-- সেকথা আপনি কেমন করে জানলেন?

-- সে-কথা মুলতুবি থাক না, ছন্দা। আমি কি ভুল বলেছি?

-- না, ভুল নয়। তবে স্বামী বর্তমানে কপর্দকহীন। তাছাড়া তার টাকা আমি নেব কেমন করে, কেন নেব?

-- ঠিক কথা। ত্রিদিব কি জানে কমলেশের কথা?

-- না!

দু-জনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ। নীরবতা ভেঙে ছন্দাই প্রশ্ন করে, এত কথা আপনি কী করে জানলেন বলবেন না?

-- সে অনেক কথা। সে-সব তোমার না জানলেও চলবে। বরং আমি যা জানতে চাই তা জানাও। ডাক্তার পি. সি. ব্যানার্জি কে?

ছন্দা একটু সময় নিল জবাবটা দিতে। গুছিয়ে নিয়ে বললে, আমার এক্স-এমপ্লয়ার। তার নাসিংহোমে আমি নার্স হিসাবে চাকরি করতাম, মানে এই বিয়ের আগে।

-- ত্রিদিব কি তার কথা জানে?

-- হ্যাঁ, ডাক্তার ব্যানার্জিকে সে চেনে বইকি। তার নার্সিং হোমেই তো ও ভর্তি হয়েছিল। সেখানেই ওর সঙ্গে আমার আলাপ। আমি তার নাইট নার্স ছিলাম।

একটু চুপচাপ। তারপর ছন্দা জানতে চায়, আপনি তো সব কথাই জানতে পেরেছেন। এখন একটা কথা আমাকে বুঝিয়ে বলবেন?

-- কী কথা?

-- একটা মানুষ যদি সাতটা বছর নিরুদ্দেশ হয়ে থাকে, তাহলে আইনের চোখে সে কি মৃত নয়? সাত-সাতটা বছর স্বামী তাকে দেখভাল করেনি, মুখের অন্ন, পরিধেয় বস্ত্র জোগায়নি, সে যে বেঁচে আছে, শুধু আড়ালে লুকিয়ে আছে তা পর্যন্ত জানায়নি। আর সাত-সাতটা বছর জীবনযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যদি সেই তথাকথিত ‘বিধবা’ নতুন কারে সংসার পাততে চায় তাহলে আইন তাকে সে অধিকার দেবে না?

-- দেবে। সাত বছর ধরে কেউ যদি নিরুদ্দেশ থাকে তবে আইনের চোখে সে তথাকথিত মৃত। বিধবা পত্নী --বলা উচিৎ তার পরিত্যক্তা পত্নী, যদি নতুন করে কাউকে বিয়ে করে তবে সে বিবাহ সিদ্ধ।

ছন্দার মুখটা ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। প্রথম সূর্যের আলোয় কাঞ্চনজঙ্ঘার চুড়োটা যেমন ধীরে ধীরে ঝলমল করে ফুটে ওঠে। একটা দমবন্ধকরা শ্বাস -- হয়তো কয়েক মাস ধরে এই দীর্ঘশ্বাসটা তার বুকে আটকে ছিল -- ত্যাগ করে বলল, এই কথাটাই আজ সকালে আমি জানতে এসেছিলাম। আপনি আমাকে বাঁচালেন।

বাসু-সাহেবের মুখটা বেদনার্ত হয়ে ওঠে। তিনি ধীরে ধীর নেতিবাচক ভঙ্গিতে দু-দিকে মাথা নাড়ছিলেন।

ছন্দা জানতে চায়, কী ‘না’?

-- আই আ্যাম সরি, ছন্দা। সাত বছর নিরুদ্দিষ্টের পত্নী দ্বিতীয়বার বিবাহ করতে পারে এবং সে বিবাহ আইনত সিদ্ধ একটা বিশেষ শর্তসাপেক্ষে। প্রোভাইডেড্ ওই নিরুদ্দিষ্ট প্রথম স্বামী সশরীরে কোনদিন ফিরে না আসে। যে মুহূর্তে সে রঙ্গমঞ্চে পুনঃপ্রবেশ করবে, সেই মুহূর্তেই ওই দ্বিতীয় বিবাহ অসিদ্ধ: ‘নাল্ আ্যান্ড ভয়েড!’

ব্যাখ্যাটা দিতে ওঁর দু-মিনিটও লাগেনি, কিন্তু মনে হল পুরো দিনটাই কেটে গেছে। সূর্য নেমে গেল অস্তাচলে -- কাঞ্চনজঙঘার তুষারশুভ্রশিখরের রক্তিমাভা ঢাকা পড়ে গেল কালো আবরণে। ঘনিয়ে এল অন্ধকার।

ছন্দা ওঁর দিকে দু-চোখ মেলে তাকাল। তার ডাগর দুটি চোখ জলে ভরে এল। সে সংকোচ করল না, আঁচল দিয়ে চোখ দুটি মুছল না। ওর দু-গাল দিয়ে অশ্রুর দুটি ধারা নেমে এল। অস্ফুটে বলল,বেচারি।

-- বেচারি? কার কথা বলছ?

-- ত্রিদিব। আমার স্বামী।

বাসু ওর পিঠে একখানি হাত রাখলেন। বললেন, ওর সব কথা আমাকে বুঝিয়ে বল, ছন্দা? কেন সে ‘বেচারি’? কমলেশ অর্থমূল্যে তোমাকে ডিভোর্স দিতে পারে। তাহলে ত্রিদিবের সঙ্গে তোমার বিবাহটা......

-- তা হবার নয়, স্যার! ত্রিবিক্রমনারায়ণ যদি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেন যে, আমি আইনত তাঁর পুত্রবধূ নই...

-- তাই বা কেন? তাঁকে অস্বীকার করে ত্রিদিব তো তোমাকে রেজিস্ট্রি বিয়ে করেছে...

-- তাই তো বলছি, ‘বেচারি ত্রিদিব’! আপনি ওর সব কথা জানেন না।

-- বল, সব কথা আমাকে বুঝিয়ে বল।

-- বললেও আপনি বুঝবেন না। কেউ কোনও দিনই ওকে বুঝবে না। আর সেটাই ওর ট্র্যাজেডি! ওর বাড়ির কেউ, এমনকি ওর বাবাও ওর সমস্যাটা বুঝতে পারেননি, বুঝতে পারবেন না।

-- কিন্তু ওর মা?

-- শৈশবেই ও মাতৃহারা, বিমাতার কাছে মানুষ।

-- কিন্তু ওর সমস্যাটা কী? ওর চরিত্রের কোন্ জটিলতাটা কেউ বুঝতে পারবে না বলতে চাও? যা, একমাত্র তুমিই বুঝেছ?

-- না, স্যার! তেমন দাবি আমি করিনি? আমিও বুঝিনি, তবে বোঝবার চেষ্টা করেছি। আমিই প্রথম। বোধকরি তার আগে সাইকিয়াট্রিস্ট।

-- কী সেটা?

-- ও একটা অবসেশনে ভূগছে। একা নয়, সবাই। গোটা রাও পরিবার। ওর বাবা ত্রিবিক্রমনারায়ণ তো বটেই। ওদের ধমনীতে নাকি বইছে রাজরক্ত। ওরা রানা প্রতাপের বংশধর, সংগ্রাম সিংহের অধঃস্তন পুরুষ। ওদের ধমনীতে সেই রাজরক্ত। যে রক্ত বইতো ফ্রম রাজসিংহ ব্যাক টু--হেভেন নোজ---কোন্ এক ‘গায়েব-গায়েবী’।

-- বেশ তো তাই না হয় বইছে। তাতে কী?

-- আপনাকে কেমন করে বোঝাব? তাই এরা যখন হাঁটে তখন ওদের ঠ্যাঙজোড়া এই ধুলিময় ধরণীর স্পর্শ পায় না, তার বিঘৎখানেক উপর দিয়ে ওরা চলে -- হোভারক্রাফ্ট-এর মতো!

-- হোভারক্রাফট? শব্দ প্রয়োগটা তোমার, না তোমার স্বামীর?

-- আমারই। আমার তাই মনে হয়েছে। ওরা সবাই অতীত আঁকড়ে জীবনযাপন করে, বর্তমান ওদের কাছে ছায়া-ছায়া। তাতে আর কার কী ক্ষতি হয়েছে জানি না, ত্রিদিব হয়ে গেছে যন্ত্রমানব। ওর বাবা ওকে পঁচিশ বছর ধরে ‘স্পুন-ফিডিং’ করিয়েছেন -- চামচেটা অবশ্য সোনার!

-- ও কি তোমার চেয়ে বয়সে ছোটো?

-- হ্যাঁ, সেটাও একটা হেতু, আমাকে পুত্রবধূ বলে মেনে না নেবার। তবে সেটা পরোক্ষ হেতু। মূল কারণ আমার ধমনীতে কোন নীল রক্ত বইছে না।

-- বিয়ের পরে তোমার শ্বশুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি?

-- আগেও নয়, পরেও নয়। তাঁকে আমি চোখে দেখিনি। ও তাঁকে না জানিয়েই আমাকে রেজিস্ট্রি বিয়ে করেছে। টেলিগ্রাম করে বাবাকে জানিয়েছিল। তিনি টেলিগ্রামে আশীর্বাদ পাঠিয়েছিলেন। ব্যাস!

-- ওর সঙ্গে তোমার কোথায় প্রথম আলাপ?

-- বললাম যে -- হাসপাতালের কেবিনে, নার্স হিসাবে। ও যে মানসিক ভাবে প্রতিবন্ধী এটা ও আজকাল বুঝতে শিখেছে। জীবনযুদ্ধে পরাজয়টা ভুলতে কিছু ইয়ারদোস্ত যে পথটা বাতলায় ও সে পথেই এগিয়ে চলছিল। এভাবেই ও ড্রাগ-আ্যাডিক্ট হয়ে পড়ে। তারপর নার্সিংহোমে ভর্তি হয়। ডক্টর ব্যানার্জির পেশেন্ট হিসাবে। সেখানেই আমার সঙ্গে ওর আলাপ... আমার কাছে ও সব কথা স্বীকার করেছিল, বলেছিল যে, তার বাড়ির লোকেরা যদি জানতে পারে যে, সে ড্রাগ অ্যাডিক্ট, তাহলে আত্মহত্যা করা ছাড়া ওর বাঁচবার কোনও পথ থাকবে না।

-- আত্মহত্যা করে বাঁচা?

-- হ্যাঁ! ওরা যে রানা প্রতাপের বংশধর। ওদের বংশে পদ্মিনী নারীরা জহর ব্রত পালন করে দিব্যজীবন লাভ করত -- আপনি শোনেননি?

-- বুঝলাম। তোমার প্রথম বিয়ের কথা বল। ওই কমলেশের কথা!

ছন্দার ঠোঁট দুটো নড়ে উঠল। কোনওরকমে বলল, সে জীবনের কথাটা আমি ভুলে থাকতেই চাই, স্যার।

-- কেন? যা ফ্যাক্ট, যা সত্য, তাকে ভুলে থাকলেই কি তার জের মেটে? কেন ভুলে থাকতে চাও সে জীবনটাকে?

-- ছেলেমানুষ ছিলাম তখন। ছেলেমানুষের মতো নিরবুদ্ধিত্তার পরিচয় দিয়েছি। কড়ায়-গণ্ডায় তার মাসুলও দিয়ে এসেছি অবশ্য।

-- তবে আর কী? ছেলেবয়সে মানুষে পাকা মাথার পরিচয় দেয় না। দ্যাটস ন্যাচারাল। তুমিও দিয়েছ। সো হোয়াট? বেশ তো, সে জীবনটার স্মৃতি যদি তোমার বর্তমান জীবনকে বিড়ম্বিত করে, তবে তাকে সাময়িক ভাবে জাগ্রত মনের আড়ালে সরিয়ে রাখ, আমার আপত্তি নেই। কিন্তু প্রয়োজনে যেন সেই জীবনের প্রতিটি ঘটনা মনে করতে পার, সেটাও দেখতে হবে। কারণ ওগুলো ফ্যাক্ট! আজ সেই রকম একটি লগ্ন এসেছে। আমার জানা দরকার -- আই মাস্ট নো -- কবে, কোথায় তুমি কমলেশের সাক্ষাৎ পেয়েছিলে কী কারণে তাকে বিয়ে করেছিলে? কেমন ছিল তোমাদের দাম্পত্যজীবন, এটসেটরা, এটসেটরা!

ছন্দা নতনেত্রে কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল। ওঁর টেবিলে একটা কাঁচের রঙিন কাগজচাপা নিয়ে কিছুক্ষণ অহেতুক নাড়াচাড়া করল। তারপর মনস্থির করে বল, হ্যাঁ, বলব, আপনার জানা থাকা দরকার, অ্যাজ মাই আ্যাটর্নি! কী জানেন? চরম উত্তেজনায় মুহূর্তের সুযোগ পেলে আমি ওই লোকটাকে খুন করে ফেলতে পারি! কিন্তু বিশ্বাস করুন, স্যার, তেমন কোনও পূর্ব-পরিকল্পনা আমার মাথায় নেই! ওই দুর্ঘটনা যদি আদৌ ঘটে, তবে দ্যাট উড বি জ্যস্ট আ কালপেবল হোমিসাইড, নট আ ডেলিবারেট মার্ডার! খুন করার পূর্বসিদ্ধান্ত মোতাবেক নয়, ওর উস্কানিতে উত্তেজিত হয়ে, প্রচণ্ড রাগে..অথবা ঘৃণায়...

মাঝপথেই ও থেমে যায়। অসমাপ্ত বাক্যটা শেষ করে না। বাসুসাহেব ধৈর্য ধরে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলেন। ছন্দা আত্মস্থ হয়ে নিশ্চুপ বসেই রইল। পড়ন্তবেলার রোদ পশ্চিমের জানলা দিয়ে মেঝেতে গ্রিল-এর একটা সিলুয়েট-আলপনা এঁকেছে -- সেইদিকে তাকিয়ে ও দীর্ঘসময় ধ্যানমগ্ন হয়ে রইল। তারপর যেন সেই ভাবের ঘোর থেকে বাস্তবে ফিরে এল। হাসল। বলল, না! তেমন দুর্ঘটনা ঘটবে না, কিছুতেই ঘটবে না। আমার ঘরে, জানেন, এককালে ভারি ইঁদুরের উপদ্রব ছিল। আমি ইঁদুর-কল পেতে ওদের ধরে, দূরের মাঠে ছেড়ে দিয়ে আসতাম। মাঠে লক্ষ্য করে দেখতাম, কাকগুলো ঘুর-ঘুর করত খাঁচায় ইঁদুর দেখে। তাই আমি ঘন ঝোপ-ঝাড়ের আড়ালে ইঁদুর-কলের ঢাকনাটা খুলে দিতাম....

বাসু বললেন, তাহলে তোমার হাত-ব্যাগে লোডেড রিভলভার থাকে কেন?

আবার আত্মস্থ হয়ে যায়, হাসে। বলে, সে কথা থাক।

-- থাকবে কেন? সব কথাই তো খুলে বলতে রাজি হয়েছে?

-- না স্যার! সব কথা নয় আমার জীবনের এ জটিলতার দিকটা আপনাকে জানাতে পারব না-- সরি। রাওয়ের কথা বলব, বিশ্বাসের কথা বলব, কিন্তু.....

-- বিশ্বাস! ‘বিশ্বাস’ কে?

-- আমার প্রথম পক্ষের স্বামী -- কমলেন্দু বিশ্বাস!

-- আই সী! বল?

পরবর্তী অংশ.....


No comments:

Post a Comment