কৌতুহলী কনের কাঁটা (দ্বিতীয়াংশ)

লেখক: নারায়ণ স্যান্যাল

প্রথমাংশ পড়তে ক্লিক করুন

ছয়

শৈশবেই বাবা মাকে হারিয়েছে ছন্দা সেন, হ্যাঁ কুমারী জীবনে সে ছিল সেন। কাকিমার কাছে মানুষ। তাও নিজের কাকিমা নয়, সম্পর্কে কাকির বাড়ী থেকে লেখাপড়া করতে থাকে। সাবালিকা হওয়ার পর বাবার ইন্সিওরেন্স এর টাকাটা কাকার কাছ থেকে পায়। কাকা বিচক্ষন মানুষ। টাকাটা ওকে নগদে দেন না। ওর নামে ফিক্স ডিপোজিট কিনে নিজের কাছেই রাখেন, যাতে ওর বিয়ের সময় কাজে লাগে। ওর বয়স যখন উনিশ তখন কমলেন্দুর সাথে আলাপ। বেচারি দুনিয়াদারির কিছুই বুঝত না। কমলেন্দু ওর চেয়ে পনেরো বছরের বড়ো। কিন্তু চৌত্রিশ বছর বয়সেও তার ছিল দুনির্বার আকর্ষণী ক্ষমতা। একাধিক মেয়ে তার প্রেমে পড়েছিল। তার ভিতর ছিল ওর খুড়তুতো দিদি, রমা। কাকা-কাকি সেটা টের পেয়ে গেলেন। পাত্র হিসাবে তারা কমলেন্দুকে আদৌ পছন্দ করেননি। ফলে কমলেন্দুর আনাগোনা বন্ধ হয়ে গেল।

রমার সঙ্গে প্রেম করলেও ছন্দাকে সে উপেক্ষা করেনি। আড়ালে –আবডালে দুজনের দেখা হত। সত্যি সত্যি ভালোবেসে না দিদির উপর টেক্কা দিতে--এসব কিছুই না জেনে। চেনাঘাটের নোঙর তুলে অচেনা গাঙে নৌকাকে ঠেলে দিল দুঃসাহসী কুমারি মেয়েটি। সঙ্গে শুধুমাত্র একটা সুটকেস। তাতে ওর পোশাক-আশাক, মায়ের ফটো অ্যালবাম, আর বাল্যের কিছু স্মৃতি। প্রথমেই ওরা এল কালীঘাটে। কমলেন্দু ওর সিঁথিত সিঁদুর দিল, হাতে পরিয়ে দিল নোয়া শাঁখা। এসে উঠল বেলেঘাটার একটা বস্তিতে। বারো ঘর এক উঠান। এক কামরার সংসার, পিঠামূলি ছ্যাঁচা-বাশেঁর দেওয়াল-গঙ্গার পলিমাটি দিয়ে নিকানো। ঝাঁপের জানালা-দরজা। গোবরজলে নিকানো মেঝে। ছন্দার কিন্তু খারাপ লাগেনি। এ ঘরখানা ওর, ওর নিজের—না, ওদের দুজনের।

প্রায় সাত মাস ছিল টালির ঘরে। লক্ষীর পট পেতেছিল। বৃহস্পতিবারে পাঁচালি পড়ত। একা একাই। কমলেন্দু বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায় কাক-ডাকা ভোরে, ফেরে রাত করে। হপ্তাবারে মদ্যপান করে। কিন্তু ওপাশের ঘরের নেতাই –এর মতো হপ্তাবারে বউ ঠ্যাঙানোর বদভ্যাস নেই, ছন্দা আপ্রান চেষ্টা করেছিল অভ্যাসটা ছাড়াবার। পারেনি। ওর ফুলশয্যা হয়নি—মানে, ফুলে-ঢাকা-শয্যায় কুমারী জীবনের শেষ রাত্রি থেকে সীমন্তিনীর সৌভাগ্যের উওরণ। কে পাতবে ফুলশয্যা? তা বলে যৌবরাজ্য উপনীত হওয়াটা কি থেমে থাকবে? তা যদি বল,তাহলে ছন্দার বিয়ে দুবার। ওই কমলেন্দুর সঙ্গেই। হ্যাঁ,শুধু কালীঘাটের বিয়েতে মন ওঠেনি। একদিন আবার ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিসে গিয়ে সই দিয়ে বিয়ে করতে হল।

ছন্দা বলেছিল ,কী দরকার?

কমলেন্দু শোনেনি, বলেছিল, এটা তোমার নিরাপত্তার জন্যে। কেউ না ভবিষ্যতে বলতে পারে -- তুমি আমার বিয়ে করা বউ নও!

কমলের চটকলের দু-জন মজুর বিয়েতে সাক্ষী দিতে এল। তাদের কমলেন্দু প্রকাশ্যে -- মানে ছন্দার উপস্থিতিতে --মিষ্টি খাইয়েছিল, আড়ালে বেগুনি-ফুলুরি চাঁটযোগে কালীমার্কা বোতলের অমৃত।

বিয়ের পরের মাসেই দু-জনে একটি জীবনবীমা করে। ওই যে দুই বন্ধু ওদের রেজিস্ট্রি বিয়েতে সাক্ষী ছিল তাদেরই একজনের আগ্রহে। সে ছিল ইন্সিওরেন্স এজেন্ট। কমল প্রথমটায় কিছুতেই রাজি হয়নি, ছন্দার পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত স্বীকৃত হয়। পলিসিটা হল ‘জয়েন্ট’ নামে অর্থাৎ স্বামী স্ত্রীর যৌথ জীবনবীমা। দুজনেই দু-জনের নমিনি। যে কোনও একজনের মৃত্যু হলে অপর জন টাকাটা পাবে। বিপত্নীক হলে পাবে কমল, বিধবা হলে ছন্দা! পাক্কা দশ হাজার টাকা।

সাত মাসের দাম্পত্য জীবনে সে লজ্জায় কাকা-কাকি বা খুড়তুতো ভাই-বোনদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। রমাদিকে টেক্কা দিয়ে সে যে খুব কিছু জিতেছে তাও তখন মনে হতো না। রমাদির বিয়ে হয়ে গেল সুপাত্রের সঙ্গে। গাড়ি-বাড়ি-টেলিফোন না থাক, পাকা ভাড়াটে বাড়ি, ভদ্র পরিবেশ, বাড়িতে টিভি! সরকারি কেরানি! পরম্পরায় খবর পেল। বিয়েতে এক-গা গহনাও পেয়েছে রমা। আর ছন্দার হয়েছে উলটো দশা।

কমলের পরামর্শে চার গাছা চুরি, গলার মালা আর কানের দুলটা খুলে রাখতে হয়েছে। সুটকেসে তালাবন্ধ করে। এগুলো ছন্দার মায়ের। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। গৃহত্যাগের রাত্রে গায়েই ছিল। কিন্তু এই বেলেঘাটার বস্তিতে সোনার গহনা পরে ঘোরাফেরা করার রেওয়াজ নেই। ছিনতাই পার্টির দৌরাত্মে। কমল অবশ্য ওকে কাঁচের চুরি, নকলি সোনার দুল আর মঙ্গলসূত্র কিনে দিয়েছিল। এ পরিবেশে সেটাই স্বাভাবিক। সোনার গহনা সব রাখা ছিল সুটকেসে।

ঈশ্বর রক্ষা করেছেন -- শুধু ঈশ্বর একাই নন কমলও। সে এক-এক পাতা কী যেন ট্যাবলেট নিয়ে আসত। দৈনিক একটা করে খেতে হতো তার ফলে ওদের এক-কামরার খুপরিতে অবাঞ্ছিত তৃতীয় মানবশিশুর আবির্ভাব ঘটেনি।

তারপর একদিন ঘটল এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা।

ভর দুপুরবেলা। কে যেন ওর ঘরে টোকা দিল। এখানে এমন ব্যাপার প্রায়ই ঘটে। সোমত্ত মেয়েরা তাই হুট করে দরজার হুড়কো খোলে না। আগে জানলা দিয়ে দেখে নেয়, আগন্তক পরিচিত মানুষ কি না -- আবার শুধু পরিচিত হলেই চলবে না। চেনা-জানা লোকও এই নিঝুম ভরদুপুরে—যখন মরদেরা যে-যার ধান্দায় বস্তিছাড়া--তখন সোমত্ত-মেয়ের দোর খোলা পেলে দ্যাখ-না-দ্যাখ কাঁচাখেগো রাক্ষস হয়ে ওঠে। ছন্দা নজর করে দেখল -- না, ভয়ের কিছু নয়। বাড়িউলি মাসি।

এই বারোঘর-এক-উঠানের মালকিন। কর্তা-মশাই ‘গঙ্গা’ পেয়েছেন। এই বিধবাই ওদের অভিভাবিকা। ছন্দা দোর খুলে দিয়ে বললে, কী মাসি? এই ভরদুপুরে?

-- একটা প্রেয়জনে তোর কাছে এলুম, বৌমা। তোর ভাতারের কোনও ফটক আছে তোর কাছে?

-- ফটক? মানে, ফটো? না তো! কেন গো মাসি?

-- ওমা আমি কনে যাব! কালীঘাটে বে-করে সবাই যে জোড়ে ফটক তোলে। তোরা তুলিস নি?

ছন্দার মনে হল কথাটা ঠিক। ওদের একটা যুগলে ফটো তোলানো উচিত ছিল। আশ্চর্য! কমলেন্দুর কোনও ফটো যে ওর কাছে নেই, এই অভাববোধটার সন্বন্ধেও সে সচেতন নয়। কেন হবে? গোটা মানুষটা যার মুঠোয় বন্দি, সে কেন দৌড়াবে তার ছায়ার পিছনে? কিন্তু ওর ফটোর সন্ধান কেন করছে বাড়িউলি-মাসি? প্রশ্ন করে সেই মর্মে।

প্রৌঢ়া আর এক খিলি পান তার টোবলা গালে ঠেসে দিয়ে বললে, সে আর এক বেত্তান্ত। তোর শুনে কাজ নেই! যা, ঘরে গে খিল দে...

ছন্দার নজর হল, একটু দূরে একজন মাঝবয়সী মহিলা বাঁশের খুঁটিটা ধরে ওকেই দেখছেন, একদৃষ্টে। বছর চল্লিশ বয়স হবে তাঁর। সধবা না বিধবা ঠাওর হচ্ছে না, মাথায় সিঁদুর নেই, চোখে চশমা। চেহারার একটা আভিজাত্য আছে, যা এই বস্তিতে অপ্রত্যাশিত।

ছন্দা প্রশ্নটা না করে পারে না: উনি কে, মাসি?

মাসি পিছন ফিরে দেখল। বাঁশের খুঁটি ধরে যে মহিলাটি দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি এক-পা এগিয়ে এলেন। মাসি তাঁকে ধমক দেয়, আপনি আবার এখানে এসে জুটলে কেন গো বাছা? বললুম তো, আমি শুধিয়ে এসে তোমারে বলব নে। তা তর্ সইল না?

মহিলাটি ততক্ষণে ওর দোরগোড়ায় মাসিকে তিনি পাত্তাই দিলেন না। ছন্দাকে বললেন, আপনার সঙ্গে কয়েকটা গোপন কথা ছিল!

-- আমার সঙ্গে? কী কথা?

শেষ প্রশ্নটা উপেক্ষা করে উনি শুধু বললেন, হ্যা, আপনারই সঙ্গে। আপনার এবং আমার স্বার্থে। ভিতরে আসব?

ছন্দা স্তম্ভিত হয়ে যায়। সাত মাসে তার দুনিয়াদারীর অভিজ্ঞতা অনেক বেড়েছে। এই বস্তিতে নানান ঘটনা ঘটতে দেখে। অচেনা-অজানা কোনও মানুষকে, সে পুরুষ স্ত্রী যাই হোক, হঠাৎ ঘরের ভিতর ঢুকতে দিতে নেই। কমল ওকে একথা পাখিপড়া করে শিখিয়েছে। কিন্তু এই সম্ভ্রান্ত ভদ্রমহিলাটিকে সে প্রত্যাখ্যান করে কীভাবে?

ছন্দা জানতে চাইল, আপনি কি একাই এসেছেন?

--- না, আমার একজন পুরুষ ‘এসকর্ট’ সঙ্গে এসেছেন। তবে এটা মেয়েলি ঘরোয়া ব্যাপার তো, তাই বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছেন। আপনারই নাম ছন্দা বিশ্বাস তো?

-- হ্যাঁ! কিন্ত আপনি কোথা থেকে আসছেন?

-- বলব ভাই, সব কথাই খুলে বলব। কিন্তু জনান্তিকে, প্রাইভেটলি।

ছন্দা মনস্থির করে। বাড়িউলি মাসির দিকে ফিরে বলে, ঠিক আছে মাসি। তুমি এস এখন। শুনি, এ ভদ্রমহিলা আমাকে কী বলতে চান। তবে, একটু সজাগ থেকো। ডাকলে যেন সাড়া পাই।

মাসির বামগণ্ড স্ফীত ছিলই। পান ঠাশা। আঁচলের খুট খুলে জর্দার কৌটাটি বার করল। আপনমনে বললে: গুপন কতা। ভদ্দর মইলা। বেলেঘাটার বক্তিতে।

তারপর জর্দার টিপটা রক্তরাঙা মুখ-গহরে নিক্ষেপ করে একটি ‘শোলক’ শুনিয়ে দিল, ‘দেকচি কত দেকব আর। চিকার গলায় চন্দ্রহার’।

বোঝা গেল, চার দশক বেলেঘাটা বস্তিতে বাস করে কলকাত্তাইয়া লবজে রপ্ত হলেও হেইপার- বাঙলার বাল্যস্মৃতি একবারে মুছে যায়নি মাসির।

মহিলাটি ভিতরে এলেন। ছন্দা একটা মাদুর বিছিয়ে দিয়ে বলল, বসুন।

মহিলাটি সাবধানী। দরজার হুড়কোটা টেনে দিয়ে বসলেন। বললেন, তোমাকে “তুমিই” বলছি ভাই, কিছু মনে কর না। প্রথমে এক গ্লাস জল খাওয়াও।

ছন্দা বললে, তাই তো বলবেন, বয়সে আপনি কত বড়ো।

বেচারির ঘরে বাতাসা ছাড়া আর কিছু ছিল না। দু-খানা বাতাসা পেতলের রেকাবিতে সাজিয়ে জল দিল। উনি নিঃসঙ্কোচে বাতাসা মুখে দিয়ে ঢকঢক করে জলটা খেলেন। মুখটা মুছে নিয়ে বললেন, তোমার স্বামীর ছবি দেখতে চাওয়ায় তুমি খুব অবাক হয়ে গেছ, তাই না, ছন্দা?

ছন্দা বলল, তাই তো হবার কথা। কেন দেখতে চাইছেন?

-- না, ছন্দা। আমি তোমার সংসার ভাঙতে আসিনি। আমি তোমার কোনও ক্ষতি করব না। কিন্তু তুমি সত্য কথা বললে আমার অপরিসীম উপকার হবে। তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে?

ছন্দা বুদ্ধিমতী। বললে, তার আগে আপনার পরিচয় দিন। আপনি কে? হঠাৎ এমন ভরদুপুরে একজনের ঘরে চড়াও হয়ে তার স্বামীর ফটো দেখতে চাইছেনই বা কেন?

-- সঙ্গত প্রশ্ন। বেশ আমি সব কথা খুলে বলছি। সব শুনে তুমি আমাকে বল, নিজের ক্ষতি না করে আমাকে সাহায্য করতে রাজি আছ কি না।

-- বলুন।

ভদ্রমহিলার নাম শকুন্তলা দত্ত। বি. এ, বি. টি। বরিশা-বেহালায় নিস্তারিণী সেকেন্ডারি গার্লস স্কুলের অঙ্কের মাস্টারনি। অ্যাসিসটেন্ট হেডমিসট্রেস। ওই স্কুলের কাছেই একটা দু-কামরার ভাড়াবাড়িতে থাকেন। মাত্র দুটি প্রাণী। উনি আর ওঁর ছোটো বোন, অনসুয়া -- বিবাহিতা। কিন্তু স্বামীত্যক্তা। বয়সে ওঁর চেয়ে যোলো বছরের ছোটো ; নিজেরই বোন। বাবা-মা মারা যাবার সময় উনি নিজে ছিলেন বি. এ. ক্লাসের ছাত্রী। অনসূয়া স্কুলে পড়ত। প্রায় মেয়ের মতো অনুকে মানুষ করেছেন। কিন্তু ওঁর মতের বিরুদ্ধে পালিয়ে গিয়ে এক অজ্ঞাতকুলশীলকে বিয়ে করে বসল অনু। দু বছর বিবাহিত জীবনের পর আবার কাঁদতে কাঁদতে একদিন ফিরে এলো দিদির কাছে। ওর স্বামী ওর সর্বস্ব হাতিয়ে নিয়ে -- নগদ টাকাকড়ি গহনা সব কিছু নিয়ে -- ওকে ফেলে পালিয়ে গেছে। সে আজ বহু বছর আগেকার কথা। মেয়ের মতো এতদিন মানুষ করেছেন ওকে। ফেলতে পারলেন না। আবার লেখাপড়া শেখাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু অনু উৎসাহ পেল না। ইতিমধ্যে একটি ছেলে ওর প্রেমে পড়েছে—ওই যে ছেলেটিকে সঙ্গে নিয়ে উনি আজ এসেছেন বড়িশা-বেহালা থেকে এই বেলেঘাটার বস্তিতে। কিন্তু প্রথম বিবাহটার বিচ্ছেদ না হলে ওরা বিয়ে করতেও পারে না। আইনে বলে সাত-সাতটা বছর নাকি অপেক্ষা করতে হয়। অর্থাৎ ওদের আরও দুটি বছর অপেক্ষা করতে হবে। এমন সময় খবর পেলেন -- অনুর পলাতক স্বামী বেলেঘাটার বস্তিতে একটি নিয়ে থাকে। সংবাদদাতা নাকি স্বচক্ষে দেখেছে। অনসূয়ার স্বামী কমলাক্ষ করকে সে দেখেছে; আবার বেলেঘাটা বস্তিতে ছন্দার স্বামীকেও দেখেছে। দু-জন নাকি হুবহু একরকম দেখতে। অঙ্কের দিদিমণি জানেন দুটো বাহু সমান হলেই দুটি ত্রিভুজ অভিন্ন হয় না। তাদের অন্তর্নিহিত কোণটাও সমান হওয়া দরকার। তাই যাচাই করতে এসেছেন ছন্দার গৃহকোণে। না, ছন্দার সংসার ভাঙতে নয়, কোনও ক্ষতি করতে নয় -- যদি দেখা যায় যে, ছন্দার স্বামী আর অনসূয়ার স্বামী একই ব্যক্তি – অভিন্ন – তাহলে তাকে বাধ্য করতে হবে অনসূয়াকে ডিভোর্স দিতে। ব্যস্। আর কিছুই না। টাকা বা গহনা চুরির দায়ে ওকে দায়ী করতে চান না শকুন্তলা দেবী। তিনি শুধু ভিক্ষা করছেন তার কন্যাপ্রতিম ভগ্নির মুক্তি।

শুনতে শুনতে ছন্দা পাথর হয়ে গেল। কোনওক্রমে বলল, কিন্তু দিদি, ওঁর কোনও ফটো তো আমার কাছে নেই।

-- না থাক। আমার কাছে আছে আমার ভগ্নিপতির ছবি। তুমি দেখে বল একে চেন?

ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে উনি একটি ফটো মেলে ধরলেন ছন্দার দৃষ্টির সম্মুখে।

ছন্দা কোনও জবাব দিল না। প্রয়োজনও ছিল না। তার মুখের দিকে একনজর দেখে নিয়ে শকুন্তলা বললেন, তোকে বার বার বলছি, ছন্দা, আমি তোর কোনও ক্ষতি করতে চাই না। ‘দিদি’ বলে ডেকেছিস, আমি আশীর্বাদ করছি, তুই তোর স্বামী নিয়ে সুখে সংসার কর। কিন্তু আমার বোনটাকেও মুক্তি দে! শোন! কমল ফিরে এলে আমার কথা বলবি না। সে যেন টের না পায়। আজ শুক্রবার। কাল বাদে পরশু কাকডাকা ভোরে আমি আসব। আমার একটি ছাত্রীর স্বামী ক্যালকাটা পুলিসের ইন্সপেক্টার। তাকে সঙ্গে নিয়ে আসব। য়ুনিফর্ম পরিয়ে। ডিভোর্স পিটিশানও নিয়ে আসব। হাতে-নাতে ধরতে পারলে ওর আর পালাবার পথ থাকবে না। তুই ওকে কিছুই বলবি না, বুঝেছিস? যাতে তোকে না সন্দেহ করে। তাহলে আক্রোশটা তোর উপর গিয়ে পড়বে। আজ আমি চলি। কেমন?

ছন্দা কোনও কথাই বলতে পারেনি। টেরও পায়নি কখন সেই ভদ্রমহিলা চলে গেছেন। ও বিকালে মেলা শুকনো কাপড় জামা গুছিয়ে তুলল না, চুল বাঁধল না, গা ধুলো না, রান্না করল না, উদাস দৃষ্টি মেলে শুধু বসেই রইল।

চমক ভাঙল কমলেন্দুর ডাকে: কী ব্যাপার? এমন খোলা দোরের সামনে ঠ্যাঙ মেলে উদাসনেত্রে বসে আছ? কার কথা ভাবছ? আমার? না কি...

ছন্দা সামলে নেয়। গায়ে মাথায় কাপড় তোলে। বলে, কটা বাজে?

-- সাড়ে সাত। চায়ের জল বসিয়ে দাও একটু। মাসি বলছিল দুপুরে তোমার সঙ্গে কে নাকি দেখা করতে এসেছিল। কে গো?

ছন্দা চটজলদি জবাব দিল, উনি একজন সমাজকর্মী। নারী সমিতির তরফে একটা, নৈশ স্কুল খুলতে চান। নিরক্ষরতা দূরীকরণের কাজে।

-- কী নাম? কোন মহিলা সমিতি?

-- দাঁড়াও দেখাচ্ছি। লিফলেট রেখে গেছেন...ওঁদের লিটারেচার...

অনেক খুঁজেও সেসব কাজপত্র পাওয়া গেল না। তবে বোধহয় কাগজগুলো ভুল করে নিয়েই গেছেন! কিন্তু সেই কাগজগুলো খুঁজতে খুঁজতে ভদ্রমহিলার কল্পিত নাম, তাদের মহিলা সমিতির নাম ইত্যাদি মনে মনে ছকে ফেলেছে ছন্দা। কিন্ত সেসব দিকে কমল প্রশ্ন করল না। বলল, বাড়িউলি মাসি বলছিল, সে নাকি আমার ফটো আছে কি না জিজ্ঞাসা করছিল। কেন? আমার ফটো তার কী দরকার?

এবারও চটজলদি জবাব দিল: হ্যাঁ, তোমার নাম শুনে বললেন ওঁর এক ছোটো ভাইয়ের বন্ধুরও ওই নাম। তাই দেখতে চাইছিলেন, তুমিই ওর ভাইয়ের সেই বন্ধু কি না।

-- অ! তা তুমি দেখালে আমার ফটো?

-- তোমার ফটো আমার কাছে আছে নাকি?

-- নেই বুঝি? ঠিক আছে, চায়ের জল বসাও!

পরদিন ভোরবেলা ঘুম ভাঙার পর ছন্দা দেখল পাশের বিছানাটা খালি। ওর স্যুটকেসটাও স্বস্থানে নেই। সারা দিন সারা রাত কমলেন্দুর পাত্তা নেই অবশ্য তার পরদিন রবিবার ভোরবেলা বোঝা গেল ব্যাপারটা। পুলিশ সার্জেন্ট যখন জানতে ‘আপনার চুড়ি, মালা আর দুল মিলিয়ে ক-ভরি হবে? চার-পাঁচ?

-- তা হবে।

-- তা হলে তিনি আর ফিরে আসবেন না কোনওদিন।

ডবল-বেড চৌকি আর মীট-সেফটা কয় মাস বাকি-ভাড়ার বাবদে মিটিয়ে প্রায় এক কাপড়ে ফিরে এল কাকা-কাকিমার কাছে। দোর খুলে দিয়ে কাকা যেন ভূত দেখলেন। কিন্তু আগেই বলেছি, তিনি বিচক্ষণ মানুষ। চেঁচামেচি, হইচই কিছুই করলেন না। ছন্দার প্রণাম সারা হলে বললেন, আয়, ভিতরে আয়। না, না, বৈঠকখানায় নয় ; আমার শোবার ঘরে।

অর্গলবদ্ধ গৃহে ভ্রাতুষ্পুত্রীকে যা বললেন তা ন্যায্য কথাই।

-- আমার দু-দুটি মেয়ের বিয়ে দেওয়া এখনও বাকি আছে, ছন্দা। এই সাত মাস তুই কোথায় ছিলি, কী করেছিস্ কিছুই জানি না -- জানতে চাইও না। তুই সাবালিকা -- একটাই জীবন তোর, যেভাবে সে জীবন কাটাতে চাস্, কাটাবি ; কিন্তু আমার জীবনের পথে কোনও বাধার সৃষ্টি না করে, তাই না?

ছন্দা উঠে দাঁড়িয়েছিল। বলেছিল, তুমি ঠিক কথাই বলেছ, কাকু। আমার অন্যায় হয়েছে কিছু চিন্তাভাবনা না করে হঠাৎ এভাবে তোমার কাছে চলে আসা...

-- বস্! মনে হচ্ছে দারুণ একটা বিপদে পড়েছিস। তাই কি?

-- হ্যাঁ, তাই!

-- আমাকে সব কথা খুলে বল দেখি। যদি সঙ্কোচ হয় তো বল্ তোর কাকিকে ডাকি। সে এখনও জানে না তুই এসেছিস।

ছন্দা বলেছিল, না কাকা, তোমাকে সবকিছু খুলে বলতে আমার কোনও সঙ্কোচ হবে না। যাবার আগে কাকিমাকেও প্রণাম করে যাব। শোন:

বিগত সাত মাসের অভিজ্ঞতা অকপটে বিবৃত করেছিল তারপর।

কাকা সব শুনে বলেছিলেন, তুই কি এটুকু বুঝতে পারছিস, ছন্দা, যে ওই শকুন্তলা দেবী হুট করে না এসে পড়লে দু-চার মাসের মধ্যেই তুই খুন হয়ে যেতে বসেছিলি?

ছন্দা চমকে উঠে বলে, মানে? ও আমাকে খুন করত?

-- সেটাই তো ছিল ওর পরিকল্পনা। তাই কালীঘাটের বিয়ের ভরসায় না থেকে রেজিস্ট্রি বিয়ে করেছে....

-- বুঝলাম না।

-- দশ-হাজার টাকার জয়েন্ট ইন্সিওরেন্স করেছিলি, মনে নেই! দুর্ঘটনাটা কীভাবে ঘটবে এটুকুই স্থির করা বাকি ছিল। এর মধ্যে আচমকা শকুন্তলা দেবী এসে পড়ায় ও ওই ক-ভরি গহনা হাতিয়ে পালিয়ে গেছে।

ছন্দা প্রতিবাদ করতে পারেনি। বুঝতে পারে, গহনা খুইয়ে সে জীবন পেয়েছে।

কাকা বললেন, কী করবি ঠিক করেছিস?

-- কী বলব? আমি তো পথের ভিখারী!

-- কে বল্লে? দাদার পলিসিঁটা ম্যাচিওর করার পর তোর নামে ফিক্সড-ডিপজিট করেছিলাম মনে নেই। সুদে-আসলে এখন তা প্রায় পনেরো হাজার টাকা। সে টাকা তো তোর। আমার কাছে গচ্ছিত আছে -- নিয়ে যা, নতুন করে বাঁচবার চেষ্টা কর!

ছন্দা একটু ভেবে নিয়ে বলেছিল, না কাকু টাকাটা আমি নেব না!

-- কেন রে? এ তো তোরই টাকা...

-- সেজন্যে নয়। বিচার করে দেখ, তোমার বাড়িতে আমার থাকা চলে না। সমাজে তোমার মাথা হেঁট হবে -- রেবা-রেখার বিয়ে দেওয়া মুশকিল হয়ে পড়বে। ফলে আমাকে পথে নামতেই হবে। তুমি তো জানোই কাকু -- নিজের দেহটাকে বাঁচাতেই আমার জান নিকলে যাবে -- তারপর ওই বোঝার উপর এই শাকের আঁটি আমার সইবে না।

-- তাহলে তুই কি করতে চাস?

ছন্দা একেবারে আচমকা একটা প্রস্তাব দিল। সে কোনও নার্সিং ট্রেনিং স্কুলে ভর্তি হবে। কোনও ওয়ার্কিং গার্লস হস্টেলে অর্থাৎ ভদ্র নিরাপদ পরিবেশে থাকবে। ওর থাকা-খাওয়া-ট্রেনিং-এর যাবতীয় খরচা যোগাবেন কাকু, ওই পনেরো হাজার টাকা থেকে। মাস মাস কিছু হাত খরচাও নেবে। ট্রাম বাস-ভাড়া, জামা-কাপড় ইত্যাদি বাবদ।

কাকা ওর মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেছিলেন। কাকিমাও চোখের জলে ভেসে ওকে বিদায় দিতে বাধ্য হলেন। রেবা-রেখার সঙ্গে ও দেখাই করেনি। ,

পাশ করে বের হবার আগেই শুভ্রার সঙ্গে ওর আলাপ হয়। পাশ করার পর তার রুমমেট হয়ে পড়ে। শুভ্রা তার অতীত জীবনের বিষয়ে কিছুই জানতে পারেনি। ও কাজ করত ডাক্তার ব্যানার্জির নার্সিংহোমে। কী বিচিত্র ঘটনাচক্র! সেখানে একদিন এক মানসিক রোগীর নার্সিং করতে করতে সব কিছু গুলিয়ে গেল ওর। কোটিপতি বিজনেসম্যানের একমাত্র পুত্র যখন ওর হাত দুটি ধরে বলেছিল, সে ওকে জীবনসঙ্গিনী করতে চায় -- বাবাকে না জানিয়ে রেজিস্ট্রি মতে -- তখন ছন্দার সে কথা বিশ্বাসই হয়নি! অথচ সেই সুখের স্বপ্তমস্বর্গে অনায়াসে পৌঁছে গেল সে।

আর ঠিক তখনই ফিরে এল ওর জীবনের শনিগ্রহ্: কমল।

নামটা সে বারে বারে বদলেছে, নতুন মেয়ের সঙ্গে প্রেম করার আগে; কিন্তু বদলায়নি ডাক নামটা। এমনভাবে, যাতে আচমকা কেউ পিছন থেকে ওকে নাম ধরে ডাকলে কারও সন্দেহ হবে না: কমলেন্দু, কমলাক্ষ, কমলেশ -- সবারই ডাক নাম কমল! যেমন বলা যায়: হলাহল, জহর গরল, কালকূট যেটাই সেবন কর ; ফল হবে এক: বিষক্রিয়া! মৃত্যু!

সাত

পরদিন। শনিবার বাইশে জুন, সূর্যোদয়ের পূর্বেই প্রতিদিনের মতো বাসু-সাহেব প্রাতঃভ্রমণে গিয়েছিলেন। সচরাচর উনি মর্ণিং-ওয়াক সেরে ফিরে এলে সবাই জমায়েত হয় প্রাতরাশের টেবিলে। আজও ফিরে এসে দেখলেন বাড়িশুদ্ধ ডাইনিং টেবিলে উপস্থিত। কিন্তু কেউই মুখ তুলে তাকাল না। সবাই হুমড়ি খেয়ে ইংরেজি- বাংলা খবরের কাগজগুলো ভাগাভাগি করে পড়ছে। বাসু বলেন, কী ব্যাপার? কাগজে জব্বর খবর কিছু ছাপা হয়েছে মনে হচ্ছে?

রানু মুখ তুলে তাকালেন। বলেন, হ্যাঁ, কাল মাঝ রাতে কমল খুন হয়ে গেছে!

-- কে? কমল? মানে...

-- হ্যাঁ তাই। ছন্দার প্রথম পক্ষের স্বামী।

বাসু ধীরে ধীরে বসে পড়েন একখানা চেয়ারে। অস্ফুটে বলেন, এমন একটা আশঙ্কা অবশ্য ছিলই...কিন্ত এত তাড়াতাড়িই যে...

অন্যমনস্কভাবে হাতটা পকেটে চলে যায় পাইপ-পাউচের সন্ধানে।

সচরাচর প্রাতরাশান্তে কফির কাপে চুমুক দেবার আগে উনি পাইপ ধরান না। আজ তার ব্যতিক্রম হল।

ভিতরের দরজা দিয়ে বিশে উঁকি মারল। রানু আর সুজাতার মাঝে দেওয়ালে টাঙানি একটা ছবির দিকে তাকিয়ে ছুঁড়ে দিল তার প্রশ্নটা: টেবিল লাগাব? টোস্ট হয়ে গেছে।

সুজাতা বলল, একটু পরে।

-- না, একটু পরে কেন? লাগা! – বললেন বাসু। সুজাতার দিকে ফিরে বললেন, কমলেশ, কমলাক্ষ, কমলেন্দু--নাম যাই হোক, হতভাগাটা তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে গেছে। আর তার অভাবে দুনিয়ায় কেউ এখন কাঁদছে বলেও মনে হচ্ছে না। অহেতুক গরম টোস্ট ঠাণ্ডা করব কেন? দাও কাগজটা দাও--

প্রথম পাতায় নিচের দিকে খবরটা ফলাও করে লেখা হয়েছে: “রাতের অতিথির ডান্ডায় সমাজবিরোধী ঠান্ডা”।

“তারাতলার অসমাপ্ত প্রাসাদ মা-সন্তোষী অ্যাপার্টমেন্ট-এর মেজানাইন ফ্লোরে গতকাল মধ্য রাতে এক নৃশংস নাটক সংঘটিত হয়ে যায়, যার ফলে প্রকান্ড প্রাসাদের একমাত্র বাসিন্দা কমলেশ বিশ্বাস নিজ গৃহে খুন হয়েছেন। কর্পোরেশন আপত্তি করায় আদালতের আদেশে এই বহুতল-বিশিষ্ট প্রাসাদটি দীর্ঘদিন অসমাপ্ত হয়ে পড়ে ছিল। কমলেশবাবু ছিলেন সেই নির্জন প্রাসাদ-কঙ্লালের রক্ষক। তাঁর মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়েছে তারই ঘরে। পুলিশ মৃতদেহ শনাক্ত করেছে। কমলেশ একজন বিবাহ-বিশারদ সমাজবিরোধী। বস্তুত সে চার্লি চ্যাপলিনের বিখ্যাত চলচ্চিত্র মঁসিয়ে ভার্দুর প্রেরণায় তার জীবিকা বেছে নিয়েছিল কি না বলা কঠিন; তবে তার উপার্জনের কাঠামোটা ছিল প্রায় একই রকম। কমলেশ বিভিন্ন নামে, বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন পরিচয়ে একাধিক বিবাহ করেছে। কখনো কুমারী, কখনো বিধবা, কিন্তু তারা একেবারে নিঃস্ব নয়। দু-একটি বধূহত্যার দায়ে গ্রেপ্তার হয়েছে। কিন্তু প্রমাণাভাবে মুক্তিও পেয়েছে। দু-চারটি ক্ষেত্রে নবপরিণীতা বধূর অলঙ্কার ও নগদ অর্থ আত্মসাৎ করে উধাও হয়েছে। ফলে প্রত্যাশিত ভাবেই কমলেশবাবুর শত্রু সংখ্যা যথেষ্ট। পুলিশের অনুমান তাদেরই ভিতর কেউ এসে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে গেছে”।

“রাত প্রায় একটা সাতাশ মিনিট স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে একটি টেলিফোন আসে। থানা থেকে রেডিও মেসেজে ভ্রাম্যমাণ একটি পুলিস-পেট্র-কারকে তৎক্ষণাৎ জানানো হয়। অকুস্থলে উপনীত হতে পুলিশ আন্দাজ সাত মিনিট সময় নেয়। সদর দরজা বন্ধ ছিল, যদিও নিহতের মেজানাইন-ফ্রোরের দরজা ছিল খোলা। ভুলুন্ঠিত কমলেশ তখন জীবিত, কিন্তু জ্ঞানহীন। আহতের ঘরে গাদা করে রাখা ছিল গৃহ-নির্মাণের নানান সাজ সরঞ্জাম। তার ভিতর একটি পৌনে এক মিটার দীর্ঘ গ্যালভানাইজড লোহার বিশ মি. মি. ব্যাসের পাইপ পড়ে ছিল আহত ব্যক্তির পাশেই। তাতে রক্তের দাগ। পুলিশ প্রায় নিঃসন্দেহ -- সেটাই অস্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত। আততারী আচমকা সেটাই তুলে নিয়ে গৃহস্বামীর মাথায় সজোরে বসিয়ে দিয়েছিল”।

“ অত্যন্ত আশ্চর্যের কথা, নিহত ব্যক্তির হিপ-পকেটে ছিল একটি লোডেড রিভলভার। যে কোনো কারণেই হোক কমলেশ সেটা পকেট থেকে বার করার সুযোগ পায়নি। অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালে নিয়ে যাবার পথে কমলেশ মারা যায়। [এরপর পাঁচের পাতায়]।”

বাসু পাতা উলটে পঞ্চম পৃষ্ঠায় উপনীত হলেন। সেখানে নিজস্ব সংবাদদাতার সরেজমিন-তদস্তের কিছু তথ্য। মধ্যরাত্রে পুলিশের উপস্থিতিতে সংবাদদাতা অকুস্থলে উপনীত হয়ে কয়েকটি বিচিত্র সংবাদ সংগ্রহ করেন! প্রথম কথা, পুলিশকে টেলিফোনটা করেছিলেন প্রতিবেশী বটুকনাথ মণ্ডল। মা-সন্তোষী আ্যাপার্টমেন্টের পাশেই, বিশ ফুট গলি-পথের ওপ্রান্তে একটি দ্বিতল বাড়ির মেজানাইন-ফ্লোরে সস্ত্রী বাস করেন বটুকনাথ। তিনি পুলিশকে জানিয়েছেন যে, মাঝ রাত্রে টেলিফোন বাজার শব্দে ওঁর ঘুম ভেঙে যায়। দেখেন, তার স্ত্রীর নিদ্রাভঙ্গ হয়েছে পূর্বেই। ওঁরা বুঝতে পারেন, টেলিফোন বাজছে ঠিক পাশের বাড়ির মেজানাইন-ফ্লোরে। অর্থাৎ ওঁদের শয়নকক্ষ থেকে সাত-আট মিটার তফাতে। ভ্যাপসা গরম ছিল। দু-বাড়ির রুজু-রুজু জানলা খোলাই ছিল। ওঁদের জানলায়-পর্দা আছে, সামনের বাড়িতে পর্দার বালাই নেই।ওঁরা দেখতে পেলেন প্রতিবেশী কমলেশ-বাবু রিসিভার থেকে টেলিফোনটা উঠিয়ে কথাবার্তা শুরু করলেন। তখন রাত কত তা ওরা বলতে পারেন না। কথাবার্তা শোনা যাচ্ছিল না, তবে দু জনের মনে হয় কমলেশ টেলিফোনে বলেছিলেন, ‘বলছি তো, টাকাটা আমি এক সপ্তাহের মধ্যে মিটিয়ে দেব! ...কী? চন্দ্রা কাল সকালেই দু-হাজার দেবে...’ এই কথাগুলি বটুকের স্ত্রীও শুনেছেন, তবে তাঁর বিশ্বাস কমলেশ চন্দ্রা কথা বলেননি, বলেছিলেন “সন্ধ্যা”! সে যাই হোক, তারপর ওঁরা দু-জনেই আবার ঘুমোবার চেষ্টা করেন এবং ঘুমিয়েও পড়েন। কতক্ষণ ঝিমিয়েছেন বা ঘুমিয়েছেন তা বলতে পারবেন না, তবে হঠাৎ তন্দ্রা ভাবটা ছুটে যায় কিছু উচ্চকন্ঠস্বরে। এবারও মনে হল শব্দটা আসছে প্রতিবেশী কমলেশবাবুর ঘর থেকে।

এই পর্যায়ে ওরা শুনতে পান, পাশের বাড়ির মেজানাইন ঘরে কিছু কথা কাটাকাটি হচ্ছে। তার একটি পূরুষকন্ঠ, অনাটি স্ত্রীলোকের। দু-জনেই জোর গলায় কথা বলছিলেন; কিন্তু কী কথোপকথন হচ্ছিল তা বোঝা যাচ্ছিল না; কারণ ঠিক একই সময়ে ওই কমলেশেরই কলবেলটা একটানা বেজে চলেছিল। অর্থাৎ সদরের বাইরে দাঁড়িয়ে কেউ কল-বেল-এর পুশ-বাটন টিপে ধরেছিল। সেটা একটানা বেজেই চলছিল। ওঁরা জানতেন ও বাড়িতে ওই ঘরে কমলেশ একাই থাকেন। ফলে মধ্য রাত্রে সে-ঘরে নারীকন্ঠ শুনে প্রতিবেশী হিসাবে কৌতুহলী হয়ে পড়েন বটুকনাথ। বিছানা থেকে উঠে জানলা পৌঁছবার আগেই মনে হল ও-ঘরে কী একটা শব্দ হল। কেউ আহত হয়ে অথবা ধাক্কা খেয়ে ধরাশায়ী হল। বটুকনাথ দ্রুত পদক্ষেপে জানলার কাছে সরে যান; কিন্তু উনি দৃকপাত করার পূর্বেই ও ঘরের বাতিটা নিবে যায়। লোডশেডিং নয়, কারণ তখনো কল-বেলটা একটানা বেজে চলেছে। ইতিমধ্যে বটুকবাবুর স্ত্রীও এসে ঘোর অন্ধকারে জানলার ধারে দাড়িয়েছেন। আন্দাজ মিনিটখানেক পরে কলবেল বাজানো বন্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ যে লোকটা ভিতরে আসতে চাইছিল সে ওই প্রয়াসে ক্ষান্ত দেয়। তারও মিনিটতিনেক পরে দূরে বড়ো রাস্তায় একটা গাড়ির স্টার্ট নেবার শব্দ হয়। অবশ্য মিসেস্ মণ্ডলের ধারণা ওটা মোটরগাড়ি নয়, মোটরসাইকেল। তারপর সব শুন্শান্।

বটুক মিনিট-পাঁচেক অপেক্ষা করেন। কিন্তু পাশের বাড়িতে কোনো সাড়াশব্দ জাগে না। বাতিও জ্বলে না। উনি কমলেশবাবুর নাম ধরে বার কতক ডাকাডাকি করেন। কেউ সাড়া দেয় না। বটুকনাথের একটি বড়ো পাঁচসেল এভারেডি উর্চ আছে। এবার তিনি সেটার সাহায্যে পাশের বাড়ির গবাক্ষপথে আলোকপাত করেন। জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল মেঝেতে কোনো মানুষ পড়ে আছে। পুরুষমানুষ। তার একটা অনড় পা শুধু দেখা যাচ্ছিল। এবার উনি ঘড়ি দেখেন। রাত তখন ঠিক একটা পঁচিশ। বটুকনাথ তাঁর প্রতিবেশী ডাক্তার নবীন দত্তকে ঘুম থেকে টেনে তোলেন। ডাক্তার দত্ত দ্বিতলে বাস করেন। তার বাড়িতে টেলিফোন আছে। ডাক্তার দত্ত নিচের মেজানাইন ঘরে এসে টর্চের আলোয় ভূশয্যালীন ব্যক্তির অনড় একটি পা দেখে মনে করেন ঘটনাটা পুলিশে জানানো উচিত। ওঁরা থানায় ফোন করেন।

অচিরেই পুলিশ অকুস্থলে পৌছোয়। ইন্সপেক্টার মুখার্জির ঘড়িতে তখন একটা বিয়াল্লিশ। সামনের দরজাটিতে গোদরেজের ‘ইয়েল-লক’ লাগানো। অর্থাৎ আততায়ী পালাবার সময় দরজার পাল্লাটা টেনে বন্ধ করে দিয়ে গেছে। তা আর বাইরে থেকে চাবি ছাড়া খোলা যাবে না।

পুলিশ বহুক্ষণ ‘কলবেল’ বাজায়। ভিতরে কোনো সাড়াশব্দ শোনা যায় না। তখন একজন পুলিশ এসে সদর দরজা খুলে দেয়। টর্চের সাহায্যে ওরা সিঁড়ি দিয়ে দেড়-তলার মেজানাইন-ঘরে উপনীত হন। সুইচটা খুঁজে পেয়ে বাতি জেলে দেন। দেখেন, কমলেশ অজ্ঞান অবস্থায় মেজেতে পড়ে আছে। ডাক্তার দত্ত তাকে পরীক্ষা করে বলেন যে, বেঁচে আছে। আহতের ঘরে টেলিফোন ছিল। রুমাল জড়ানো-হাতে পুলিশ-সাজেন্ট অসীম মুখার্জি তখন টেলিফোনটা তুলে নেয়, একটা অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করতে। কিন্তু হাসপাতালে পৌঁছনোর পূর্বেই কমলেশ মারা যায়। তার পরে তল্লাসির সময় পুলিশ মেজেতে একটা ছোটো চামড়ার কেস-এ চাবির রিং আবিদ্ধার করে। তাতে তিন-তিনটি চাবি। পুলিশের ধারণা আততায়ী মহিলা, বড়ো ঘরের মহিলা। কারণ চাবির রিঙে আছে তিনটি চাবি। একটা নবতাল তালার। বাকি দুটি মোটরগাড়ির ‘ডোর-কী’। মেক ও মডেল দেখে পুলিশের ধারণা একটি চাবি ‘মারুতি- সুজুকি’র অপরটি ‘আ্যস্বাসাডার’-এর। তাহলে নবতাল তালাটি সম্ভবত গ্যারেজের। নিহত কমলেশ বিশ্বাসের কোনো গাড়ি নেই। ফলে পুলিস ধারণা, মধ্য রাত্রের অতিথিই অসাবধানে ওই চাবির গোছা ফেলে গেছে। এখানে তিনটি চাবির-ফটো দেওয়া হল। দুটি দামি গাড়ির চাবি যাঁর রিং-কেস-এ থাকে (যে রিং-কেস-এ দামি ফরাসি সুগন্ধের সুবাস) তাকে খুঁজে বার করা হয়তো কঠিন হবে না। পুলিশ সাঁড়াশি অভিযান চালাচ্ছে। এক দিকে নিহত বিবাহ-বিশারদের পরিত্যক্ত পাত্রীদের পরিচয় ; অপরদিকে ‘মোটর-ভেহিকলস্-এ এমন দম্পতির সন্ধান, যারা ওই দুই মেক এর গাড়ির মালিক-মাল্কিন...

প্রাতরাশ শেষ হতে-না-হতেই বাইরের বারান্দায় ‘কল-বেল’ বেজে উঠল। বাসু ঘড়ি দেখলেন। সকাল সাতটা। সচরাচর উনি চেম্বারে এসে বসেন বেলা আটটায়। কম্বাইন্ড-হ্যান্ড বিশ্বনাথ বাইরের দরজা খুলে দেখে এল। ফিরে এসে নিঃশব্দে একটি আইভরি-ফিনিশড্ দামি ভিজিটিং কার্ড টেবিলে নামিয়ে রাখল: ত্রিদিবনারায়ণ রায়।

রানু প্রশ্ন করেন, কী? দেখা করবে? নাকি, ঘন্টাখানেক পরে ঘুরে আসতে বলব?

-- না, আজ বরং একঘন্টা আগেই দপ্তর খোলা যাক। তুমি আগে যাও। রেজিস্টারে নাম-ঠিকানা, টেলিফোন নাম্বার আর ওর স্বাক্ষর...

বাধা দিয়ে রানু বলেন, আমার কাজ আর নতুন করে আমাকে শেখাতে হবে না। এস তুমি একটু পরে বাসু গিয়ে বসলেন নিজের ঘরে, রানুদেবী বাইরের রিসেপশন কাউন্টার পাক মেরে এসে উপস্থিত হলেন তার হুইল-চেয়ারে।

বাসু নিম্নকন্ঠে জানতে চাইলেন, ছন্দার দু-নম্বর তো?

-- হ্যাঁ। খুবই উত্তেজিত মনে হচ্ছে।

-- হঠাৎ ‘পর্বতোবহ্নিমান কেন? ‘ধুমাৎ’? এক নম্বর খুন হয়েছে বলে? ও কী জানে?

-- কী জানি! ঘরময় পায়চারী করছে, আর একটার পর একটা ইন্ডিয়া কিং ধরাচ্ছে। দু-টান দিয়েই অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিচ্ছে। বেশিক্ষণ ওভাবে চালালে আমার কার্পেট পুড়িয়ে ফেলবে!

-- কী চায় তা কিছু বলেছে?

-- না। তোমার সাক্ষাৎ চায় শুধু। ব্যাপারটা নাকি ‘জীবন-মৃত্যু’ নিয়ে।

-- ঠিক আছে। ডেকে দাও। দাঁড়াও...এবারও রিটেইনার নাওনি তো?

রানু হাসলেন। বললেন, আবার? তোমাকে না জিজ্ঞেস করে?

রানু বাইরের দিকে দরজাটা খুলে দ্বারপথে ও-কক্ষে কাকে যেন সম্বোধন করে বললেন, আসুন মিস্টার রাও, মিস্টার বাসু আপনার সঙ্গে দেখা করবেন।

একটি সুসজ্জিত এবং সুদর্শন যুবক প্রবেশ করল চেম্বারে। সুদর্শন, কিন্তু পৌরুষ বা ব্যক্তিত্বের কোনো ব্যঞ্জনা নেই তার দেহাকৃতিতে। উজ্জ্বল গৌর বর্ণ, মাঝারি উচ্চতা, কৃশকায়। কথা যখন বলতে শুরু করল তখন মনে হল আপার-প্রেপ্ এর কোনো ছাত্র ‘মিস’কে পড়া মুখস্ত হয়েছে কি না প্রমাণ দিচ্ছে।

আমার নাম শ্রীত্রিদিবনারায়ণ রাও। আমরা শক্তাবৎ। আমার পিতৃদেব হচ্ছেন স্বনামধন্য ধনকুবের শ্রীত্রিবিক্রমনারায়ণ রাও অফ নাসিক। আপনি তার নাম শুনে থাকবেন।

বাসু মাথা নেড়ে সায় দিলেন।

-- আপনি আজ সকালে কাগজ দেখেছেন, স্যার? আই মিন সংবাদপত্র?

-- মোটামুটি। এ কথা কেন?

ত্রিদিব বসেছিল ডান পায়ের উপর বাঁ পা-টা তুলে। এবার বদলাল। বাম-চরণের উপর উঠল দক্ষিণ ঠ্যাঙ। নড়াচড়ায় তার কপালের সামনের দিকে এ চুল চোখের উপর এসে পড়ল। ত্রিদিব বাঁ-হাতে অশান্ত চুলের গোছা কপালের উপর দিয়ে ঠেলে দিয়ে বললে: খুনের খবরটা দেখেছেন? তারাতলায়? ‘মা সন্তোষ আ্যাপার্টমেন্ট’-এ?

বাসু যেন একটু চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, হ্যাঁ, প্রথম পাতায় নিচের দিকে ওই রকম কী নিউজ আছে বটে। ডিটেইল্সে পড়িনি। কিন্তু সে-কথাই বা কেন?

হঠাৎ ত্রিদিব ঘনিয়ে এল ওঁর দিকে। ফিসফিস করে বলল, ওই খুনের মামলায় আমার ‘ওয়াইফ’ এর জড়িয়ে পড়ার সম্তাবনা! আই মিন, অচিরেই ওই খুনের দায়ে সে গ্রেপ্তার হতে চলেছে।

বাসুও ওর দিকে ঝুঁকে পড়ে জানতে চান, আপনার স্ত্রীই কি খুনটা করেছেন?

-- না! নিশ্চয় না! সে এ কাজ করতেই পারে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সে বিশ্রীভাবে কেসটায় জড়িয়ে পড়েছে! কিছুটা নির্বুদ্ধিতা, কিছুটা অসাবধানতা, বাকিটা ওর চরিত্রদোষে। আমি অস্বীকার করব না -- মানে, ও হয়তো জানে খুনটা আসলে কে করেছে। আমার অবশ্য ধারণা সে নিশ্চিত জানে। আই মিন, তার চোখের সামনেই খুনটা হয়েছে। আর দুর্ভাগ্যবশত আমার ওয়াইফ জেনে শুনে হত্যাকারীকে আড়াল করতে চাইছে। লোকটাও অদ্ভুত। কাপুরুষের অধম। একজন অবলা মহিলার আঁচলের তলায় লুকিয়ে ওকেই বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। দেখুন স্যার, আপনি না বাঁচালে...

বাধা দিয়ে বাসু বলে ওঠেন, দাঁড়াও, দাঁড়াও। খুনটা হয়েছে রাত দেড়টা নাগাদ। তখন কি তোমার স্ত্রী বাড়িতে ছিল না?

-- না! ছিল না!

-- তুমি কেমন করে জানলে?

-- সে এক দীর্ঘ কাহিনী। আমাকে তাহলে প্রথম থেকে বলতে হয়।

-- বল না! তাই বল। প্রথম থেকেই। না হলে আমি বুঝব কী করে?

আবার আরাম করে গুছিয়ে বসল। দক্ষিণ ও বাম ঠ্যাঙ তাদের অবস্থান বদলালো। চোখের উপর ঝুলে-পড়া চুলের গোছা অশান্ত হাতে সরিয়ে দিয়ে বলল, আমার নাম ত্রিদিবনারায়ণ রাও। আমার বাবা হচ্ছেন নাসিকের ধনকুবের শ্রীত্রিবিক্রমনারায়ণ রাও। আমরা...

-- জানি, শক্তাবৎ। এ কথা তুমি আগেই বলেছ। তারপরের কথাটা কী?

-- আমি কলকাতাতেই পড়াশুনা করেছি। আলিপুরে আমাদের একটা ছোট্ট ফ্ল্যাট আছে। জাস্ট একটা গ্যারেজ আর একটু দূরে এক কামরার একটা রেসিডেন্সিয়াল য়ুনিট। ওখানে ভবিষ্যতে একটা মালটিস্টোরিড অ্যাপার্টমেন্ট হাউস হবে। আপাতত ওই এক কামরার ঘরে থেকেই আমি কলকাতায় ল’ পড়ছিলাম। গত বছর পাশ করেছি। বছরখানেক আমি যুরোপ-আমেরিকা ঘুরতে গেছিলাম। মাস-তিনেক আগে ফিরে আসি। তারপর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ি। বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে একটি নার্সিং হোমে ভর্তি হই। আমার বাবা তখন বিদেশে। আমেরিকায়। ওই নার্সিং হোমে যে নাইট-নার্স ছিল তার নাম ছন্দা বিশ্বাস।

এই পর্যন্ত বলে ত্রিদিব মৌন হল। তাকিয়ে রইল ঘূর্ণ্যমান সিলিং ফ্যানটার দিকে।

বাসু বলেন, শুনলাম। তারপর?

-- আমি ছন্দা বিশ্বাসকে বিয়ে করে ফেললাম!

আবার থামল সে। যেন, একটা জঘন্য অপরাধের স্বীকারোক্তি করেছে! এখন তাই একটু দম নিচ্ছে।

বাসু বললেন, ও!

যেন, নার্সিং হোমে রুগীরা সচরাচর নাইট-নার্সকে বিয়ে করে যুগলে বাড়ি ফেরে। এটাই প্রথা!

ত্রিদিব সোজা হয়ে উঠে বসে। বলে, আপনি ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পারছেন না, স্যার। আমরা ‘রাও’, মানে চিতোরের শক্তাবৎ রাও! আমি আমার স্বনামধন্য পিতা শ্রীত্রিবিক্রমনারায়ণ রাওয়ের একমাত্র পুত্র -- আর আমি কিনা খানদানের কথা ভুলে গিয়ে বশমর্যাদার কোনো তোয়াক্কা না রেখে, বেমক্কা বিয়ে করে বসলাম একজন নার্সকে! আমার স্বনামধন্য পিতৃদেব এটাকে কী ভাবে নেবেন...

-- তা নিয়ে তোমার কেন মাথাব্যথা? দেখু ত্রিদিব, জীবনটা তোমার। জীবনসঙ্গিনীও তুমি নিজে নির্বাচন করেছ.....

-- আপনাকে আমি কেমন করে বোঝাই? বাবামশাই আমেরিকা থেকে ফিরে এসে দেখলেন আমার টেলিগ্রাম তার অপেক্ষায় রাখা আছে। আমি বিবাহিত। আমি একটি সামান্য নার্সকে বিবাহ করেছি। যে মেয়েটি অন্যপূর্বা এবং বয়সে আমার চেয়ে বড়ো।

-- ‘অন্যপূর্বা’ মানে?

-- ছন্দা বিশ্বাস বিধবা!

-- তাতে কী হল? বিদ্যাসাগর মশায়ের আমল থেকে বিধবা-বিবাহ তো সিদ্ধ।

-- আপনাকে আমি কেমন করে বোঝাই?

--ও প্রসঙ্গ থাক। তুমি কী একটা খুনের কথা বলতে চাইছিলে না?

-- হ্যাঁ খুন। এই দেখুন...

-- কোটের পকেট থেকে সে একটি দৈনিক পত্রিকার কর্তিত অংশ বার করে আনল। ভাঁজ খুলে সেটি পেতে দিল ওর গ্লাস-টপ টেবিলে। কাগজটার মাঝখানে একটা চাবির আলোকচিত্র--বস্তুত তিন- তিনটি চাবি।

ত্রিদিব তার হিপ-পকেট থেকে একটা চামড়ার “কী-কন্টেনার” বার করে টেবিলে রাখল! তাতে তিন-তিনটি চাবি। বললে, মিলিয়ে নিন, স্যার?

কাগজে অবশ্য ‘রিডিউসড্-স্কেলে’ ছাপা হয়েছে, তবু শনাক্ত করতে কোনো অসুবিধা হল না। বাসু-বললেন, এটা কেমন করে হল? আমার ধারণা এ চাবির গোছাটা তো আছে পুলিসের হেপাজতে!

ত্রিদিব মাথা নাড়ল। বলল, আজ্ঞে না! এ থোকাটা আমার। পুলিশের কাছে যেট! আছে সেটা আমার ওয়াইফ-এর। যেটা সে কাল রাত্রে অকুস্থলে অসাবধানে ফেলে এসেছে। যখন ওই লোকটা খুন হয়—তা সে যেই করুক!

-- তোমার স্ত্রী যে সে সময় অকুস্থলে ছিল তা তুমি কেমন করে জানলে?

ত্রিদিব কপাল থেকে চুলের গোছাটা সরিয়ে বলল, তাহলে আপনাকে গল্পটা গোড়া থেকে বলতে হয়।

বাসু বিরক্ত হয়ে বললেন, না! গোড়ার দিকটা আমার জানা। তোমার নাম, তোমার বাবার এবং স্ত্রীর নাম এবং তোমরা শক্তাবৎ। এখন শুধু বল তুমি কেমন করে জানলে যে, তোমার স্ত্রী কাল গভীর রাত্রে তারাতলায় ছিল?

ত্রিদিব চাবির থোকাটা তুলে নিয়ে বলল, এই চাবিটা মারুতির ফ্রন্ট-ডোর কী, যেটা আমার ওয়াইফ চালায়, এটা আমার আ্যাম্বাসাডারের। আর এই নবতালটা হচ্ছে গ্যারেজের চাবি। ডবল গ্যারেজ।

ইগনিশন কী সচরাচর গাড়িতেই লাগানো থাকে। পাশাপাশি দুটি গাড়ি থাকে। সামনে স্লাইডিংডোর। একই তালায় দুটো গাড়ি লক করা থাকে। তাই সুবিধার জন্য আমরা তিন সেট চাবি বানিয়েছি। একটা থাকে আমার কাছে। একটা ছন্দার কাছে, তৃতীয়টা আমাদের ড্রয়ারে। আমি আপনার কাছে আসার আগে দেখে এসেছি, ড্রয়ারের চাবি স্বস্থানে আছে। আমার চাবি তো আমার পকেটে! দেয়ারফোর, পুলিশ যেটা খুঁজে পেয়েছে সেটা আমার ওয়াইফের চাবির থোকা।

-- আই সি। তা তুমি যে এখানে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসছ সে কথা কি তোমার স্ত্রীকে জানিয়ে এসেছ?

-- না।

-- কেন?

-- সে অনেক কথা! শি ট্রায়েড টু ড্রাগ মি!

-- সে কী করতে চেয়েছিল? টি

-- কাল রাত দশটা নাগাদ আমাকে জোরালো ঘুমের ওষুধ খাইয়ে রাতে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে চেয়েছিল!

-- কেন?

-- না হলে তার নৈশ-অভিসারে ব্যাঘাত হত যে!

-- নৈশ-অভিসার! তার মানে?

-- সে কথাই তো বলতে চাইছি।

-- তাহলে বল। সবটা গুছিয়ে নিয়ে বল?

ত্রিদিবের সে ক্ষমতা নেই। তার কথাবার্তা আর চিন্তার ঠিক পারম্পর্য নেই। অনেক খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বাসু-সাহেব তার কাছে থেকে যে ঘটনাপরম্পরা আবিষ্কার করলেন তা এই রকম:

গতকাল রাত্রি দশটা নাগাদ ওরা টি. ভি. বন্ধ করে দ্বৈতশয্যায় শয়ন করতে যায়। ছন্দা এই সময় ত্রিদিবের কাছে জানতে চায়, শোবার আগে সে একটু হট চকলেট খাবে কি-না। ত্রিদিব রাজি হয়। সে প্রায়ই শয়নের পূর্বে গরম চকলেট পান করে। এক-কামরার ফ্ল্যাট। সংলগ্ন বাথরুম এবং এক প্রান্তে কিচেনেট। ত্রিদিব শোবার ঘরে, প্যান্ট বদলে পা-জামা পরছিল, আর ছন্দা সংলগ্ন কিচেনেটে গরম চকলেট বানাচ্ছিল। ছন্দা ছিল ত্রিদিবের দৃষ্টিসীমার বাইরে, কিন্তু দরজাটা এমনভাবে আধখোলা অবস্থায় ছিল যে, দ্বারের সংলগ্ন আয়নায় অন্ধকার শয়নকক্ষ থেকে আলোকিত কিচেনেটে ছন্দাকে দেখা যাচ্ছিল।

ত্রিদিব লক্ষ্য করে, ছন্দা তার ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে একটা ছোট্ট শিশি বার করে। শিশিটা পরিচিত। ওতে থাকে একটা ঘুমের ওষুধ: ‘ইপ্রাল’! হাসপাতালে থাকতে প্রতি রাত্রে ওই ওষুধ খেতে হত। এখন খায় না! ত্রিদিব অবাক হয়ে দেখল, ছন্দা বেশ কয়েকটা ট্যাবলেট ওর চকলেটে মিশিয়ে দিল! তারপর এ ঘরে এসে ত্রিদিবের হাতে গ্লাসটা ধরিয়ে দিল।

-- তারপর? তুমি ওকে জিজ্ঞাসা করলে না কেন সে তোমাকে না জানিয়ে তোমার চকলেটে ঘুমের ওষুধ মেশালো! অথবা কটা ট্যাবলেট সে মিশিয়েছে?

-- আজ্ঞে না, আমি জিনিসটা খতিয়ে দেখতে চাইছিলাম।

-- তাহলে ঠিক কী করলে তুমি?

ত্রিদিব চকলেটটা হাতে নিয়ে বাথরুমের দিকে চলে যায়। ভাবখানা সে ইউরিনাল ব্যবহার করতে যাচ্ছে। দরজাটা বন্ধ করে সে চকলেটটা কমোডে ঢেলে দিয়ে ফ্লাশ টেনে দেয়। তারপর গরম জলের ট্যাপটা খুলে গ্লাসে গরম জল ভরে নেয়। এ ঘরে চলে আসে। ধীরে ধীরে সিপ্ করে গরম জলটা এমনভাবে পান করতে থাকে যাতে মনে হয় সে গরম চকলেটই খাচ্ছে।

-- তারপর?

-- তারপর আমি নিজেই গ্লাসটা বেসিনে ধুয়ে আনলাম, যাতে ও দেখতে না পায় তলানিটা কী জাতের। একটু পরে ওকে বললাম, আমার দারুণ ঘুম পাচ্ছে। ও একটা বই পড়ছিল। বলল, তাহলে শুয়ে পড়। আমি শুয়ে পড়লাম। আর আধ ঘণ্টার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ার ভান করলাম। তার একটু পরে ছন্দাও শুয়ে পড়ল। কিন্তু ঘুমোলো না। রাত সওয়া বারোটায় ও নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল।

অন্ধকারেই সে নাইটি পাল্টে শাড়ি পড়ল। সাজ-পোশাক বদলালো। তারপর নিঃশব্দে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।

-- দরজা খোলাই পড়ে রইল?

-- আজ্ঞে না। আমাদের দরজায় ‘ইয়েল-লক’ লাগানো। ছন্দা যাবার সময়ে অতি সাবধানে দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিল, যাতে শব্দ না হয়।

-- তারপর কী হল?

ত্রিদিব আবার উল্টোপালটা ভাবে ঘটনা পরম্পরার বর্ণনা দিতে থাকে। পর্যায়ক্রমে সাজালে সেটা এই রকম দাঁড়ায়:

বিছানায় শুয়ে শুয়েই ত্রিদিব শুনতে পায় গ্যারেজের স্লাইডিং দরজাটা খোলা হল। মধ্যরাত্রে ওটা নিঃশব্দে খোলা যায় না। পাশাপাশি সমান্তরাল লোহার চ্যানেলে দুটি লোহার পাল্লা। গ্যারেজটায় দুটি গাড়িই পাশাপাশি থাকে। সচরাচর আ্যাম্বাসাডারটা-ডাইনে, মারুতি বাঁয়ে। ফলে, ছন্দা নবতাল প্যাডলক খুলে খুব ধীরে ধীরে -- যাতে শব্দ কম হয় বাঁ-দিকের পাল্লাটা ডানদিকে নিয়ে আসে। ওই সময় ত্রিদিব বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। জানলার কাছে সরে এসে পর্দা সরিয়ে দেখতে থাকে। দেখে, ওর স্ত্রী মারুতি গাড়িখানা বার করে আনল। আবার মারুতির দিকের লোহার পাল্লাটা ঠেলে ঠেলে স্ব-স্থানে টেনে আনল। তারপর স্টার্ট দিল গাড়িতে। কম্পাউন্ডের গেট খুলে বাইরে গেল। গেট বন্ধ করে রাস্তায় নামল। বাঁকের মুখে মিলিয়ে গেল। রাত তখন বারোটা পঁয়ত্রিশ...

এই পর্যায়ে বাসু-সাহেব বাধা দিয়ে বললেন, একটা কথা। তোমার স্ত্রী কি রওনা হবার আগে গ্যারেজের ‘নবতাল’- প্যাডলকটা বন্ধ করে দেয়নি?

ত্রিদিব বলল, নিশ্চয় দিয়েছিল।

-- তুমি অতদূর থেকে সেই ব্যাপারটা দেখতে পেলে?

-- আজ্ঞে না, স্বচক্ষে দেখিনি। এটা আমার আন্দাজ। দারোয়ানজি ছুটিতে ছিল তো? গ্যারেজটা লক্ না-করে গেলে অ্যামবাসাডার গাড়িটা অরক্ষিত হয়ে থাকত। তাই আন্দাজ করছি...আর তা ছাড়া আমরা দু-জনেই সব সময় গাড়ি নিয়ে বার হলেই গ্যারেজ-দরজা তালা বন্ধ করে যাই...ছন্দাও নিশ্চয় তা করেছিল...

বাসু বলেন, সে-ক্ষেত্রে ফিরে এসে সে গ্যারেজ খুলল কী করে? তোমার ধারণায় তো চাবিটা তার আগেই খোয়া গেছে তারাতলায়?

-- তার কারণ ট্রিপলিকেট চাবিটাও ওর কাছে ছিল!

-- ট্রিপলিকেট চাবি! মানে?

-- আপনাকে আগেই বলেছি, স্যার, আমাদের তিন-সেট চাবি আছে। একটা থাকে আমার কাছে, একটা আমার ওয়াইফের কাছে, তৃতীয় সেটটা থাকে ওর ড্রেসিং টেবিলের টানা-ড্রয়ারে। ছন্দা রওনা দেবার সঙ্গে সঙ্গে আমি তৈরি হয়ে নিই। ওকে ‘ফলো’ করব বলে। পাজামা ছেড়ে প্যান্ট পরি, আর হাওয়াই শার্ট কিন্তু আমার চাবির থোকাটা খুঁজে পাই না। সচরাচর যেখানে থাকে সেখানে নেই। খুঁজতে খুঁজতে মিনিটতিনেক দেরি হয়ে যায়। তখন মরিয়া হয়ে আমি টানা ড্রয়ার খুলে ট্রিপলিকেট চাবিটা নেবার চেষ্টা করি। কিন্তু ড্রয়ার খুলে দেখি নির্দিষ্ট স্থানে চাবির থোকাটা নেই...

বাসু জানাতে চান, তার মানে?

-- তার মানে ছন্দারও হয়েছিল ঠিক আমার অবস্থা। আামাকে নিথর হয়ে ঘুমাতে দেখে সে নিঃশব্দে উঠে পড়ে। অন্ধকারেই নাইটি ছেড়ে শাড়ি পরে ; কিন্তু তার চাবির থোকাটা খুঁজে পায় না। বাধ্য হয়ে নিশ্চয় সে ওই ড্রয়ারের তৃতীয় চাবির থোকাটাই নিয়ে যায়। আসলে ওর নিজের চাবি-সেটটা ছিল ওর লেডিজ ব্যাগেই। যেটা সে তারাতলায় ফেলে এসেছে; কিন্তু তাতে বাড়ি ফিরতে তার অসুবিধা হয়নি।

-- তারপর? বলে যাও...

ত্রিদিব আবার বলতে থাকে।

ড্রয়ারের থার্ড-সেট চাবিটা না পেলেও মিনিট পাঁচেক পরে সে তার নিজের থোকাটা খুঁজে পায়। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। স্ত্রীকে ফলো করা আর সম্ভবপর নয়। তবে ত্রিদিব আন্দাজে বুঝতে পেরেছিল তার স্ত্রী কোথায় নৈশ-অভিসারে গেছে। অর্থাৎ কোন্ ভাগ্যবান তার সদ্যপরিণীতা সহধর্মিণীর প্রাকবিবাহযুগের প্রণয়ী। ও সেখানেই ফোন করে...

আবার বাধা দিয়ে বাসু বলেন, সে লোকটা কে?

-- যে কমলেশকে খুনটা করেছে, এখন দোষটা আমার ওয়াইফের ঘাড়ে চাপাতে চাইছে...

বাসু বিরক্ত হয়ে বললেন, আঃ! সে লোকটার পরিচয় কী? কি তার পিতৃদত্ত নাম?

ত্রিদিব মুখটা নিচু করল। রুমাল বার করে মুখটা মুছল। তারপর বলল, ডক্টর প্রতুল চন্দ্র ব্যানার্জি, এম. আর. সি. পি.!

-- ডক্টর ব্যানার্জি? তোমার স্ত্রীর প্রাকবিবাহযুগের প্রণয়ী?

শুধু প্রাকবিবাহ নয় স্যার, আমার অনুমান বিবাহোত্তর জীবনেও!

-- তুমি বলতে চাও তোমার স্ত্রী ডক্টর ব্যানার্জির বাড়িতে গেছিল?

ত্রিদিব গম্ভীরভাবে বলল, হ্যা এবং না।

-- তার মানে?

-- ছন্দা ওই ডাক্তার বাঁড়ুজ্জের কাছেই গেছিল। তবে তাঁর বাড়িতে নয়!

-- তুমি কেমন করে জানলে?

-- তাহলে আপনাকে সবটা গুছিয়ে বলতে হয়।

বাসু এবার আর বিরক্ত হলেন না। বুঝতে পারছেন, এটাই ওর কথা বলার ধরন। বললেন, তাই বল?

-- ওকে ফলো করা যখন অসম্ভব হয়ে গেল তখন আমি ডাক্তার ব্যানার্জির বাড়িতে একটা ফোন করি। রাত তখন পৌনে একটা।

-- বাড়িতে না নার্সিং হোমে?

-- আজ্ঞে না। বাড়িতে। ওঁর নার্সিং হোম-এরই তিন-তলায়। উনি ব্যাচিলার। একটি ওড়িয়া কম্বাইন্ড হ্যান্ডকে নিয়ে ওই নার্সিং-হোমেরই তিন-তলায় দু-কামরার ফ্ল্যাটে থাকেন।

-- ঠিক আছে। তারপর?

-- বেশ অনেকক্ষণ রিঙিং টোনের পর টেলিফোনটা তুলল ওঁর কম্বাইন্ড হ্যান্ড। জানাল যে, ডাক্তারবাবু বাড়ি নেই। তাকে আমি বলেছিলাম, একটা জরুরী কেসে ডাক্তারবাবুকে খুঁজছি। তাকে কি নার্সিংহোমের নাম্বারে পাওয়া খাবে? লোকটা জানাল -- না। ডাক্তারবাবু গাড়ি নিয়ে কোথায় যেন বেরিয়ে গেছেন!

-- তুমি কি তোমার নাম জানিয়েছিলে?

-- না! আমি গোটা ব্যাপারটা বুঝবার চেষ্টা করছিলাম, আড়াল থেকে।

-- অল রাইট: আড়ালে থেকে তুমি গোটা ব্যাপারের কী বুঝলে শেষ পর্যন্ত?

-- সবটা বুঝিনি। যেটুকু বুঝেছি তা এই: আমার ওয়াইফ আমাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ডাক্তার ব্যানার্জির কাছে যায়। তারপর দু-জনে একসঙ্গে যায় তারাতলায়। খুন ঐ ব্যানার্জিই করেছে আর ছন্দা বোকামি করে তার চাবিটা ফেলে এসে ভীষণ বিপদে পড়ে গেছে।

বাসু বললেন, একটা কথা বুঝিয়ে বল তো! তুমি সরাসরি তোমার স্ত্রীকে এসব প্রশ্ন করছ না কেন? কেন সে তোমাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়েছিল? কেন মধ্যরাত্রে তোমাকে না-জানিয়ে শয্যাত্যাগ করে গাড়ি নিয়ে বার হয়েছিল এবং কীভাবে খবরের কাগজে তার চাবির ফটোটা ছাপা হয়েছে?

ত্রিদিব সোজা হয়ে বসল। কপালের চুলটা সরিয়ে দিয়ে গম্ভীরভাবে বলল, তা আমি জানতে চাইতে পারি না!

-- কিন্তু কেন?

-- যেহেতু আমার ধমনীতে বইছে শক্তাবৎ রাজরক্ত। আমরা এভাবে কারও ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারি না।

বাসু বিরক্ত হয়ে বলেন, লুক হিয়ার, ইয়াং ম্যান! তুমি অহেতুক, ঈর্ষান্বিত হয়ে এসব আজগুবি কথা ভাবছ। রাত দেড়টার সময় ডাক্তার ব্যানার্জি বাড়িতে না-থাকায় এটা মোটেই প্রমাণিত হয় না যে, তোমার স্ত্রীর সঙ্গে তার কোথাও রাঁদেভু ছিল। তোমার স্ত্রী যদি অভিসারে যেতে চায় তাহলে ডাক্তার ব্যানার্জির ফ্ল্যাটেই যেতে পারত। আসলে ব্যানার্জি হয়তো কোনও রুগি দেখতে গেছিলেন। আবার তোমার স্ত্রীর চাবির থোকা ওই বাড়িতে আবিষ্কৃত হওয়ার অর্থ ও এ নয় যে, খুনের সময়ে সে সেখানে ছিল। হয়তো কমলেশকে সে চিনত, দিনের বেলা তোমার স্ত্রী তার সঙ্গে দেখা করতে গেছিল।

-- ফর য়োর ইনফরমেশন, স্যার, কমলেশ আমার ওয়াইফের প্রথম পক্ষের স্বামী।

-- আই সী! আর একটা কথা বুঝিয়ে বল তো! তুমি তখন দারোয়ানের ছুটি নেবার কথা বললে। ওই দারোয়ান কতদিন ও বাড়িতে চারি করছে আর কবে থেকে ছুটিতে আছে?

-- মহাদেব প্রসাদ আমার পিতাজির একজন বিশ্বস্ত কর্মী। আমি যখন কলকাতার কলেজে পড়তে আসি তখন সে নাসিক থেকে চলে আসে। সেঠিক দারোয়ান নয়, অল্প বয়সে বস্তুত সে আমার লোকাল গার্জেনও ছিল। আমার রান্নাবান্নাও সে করে দিত। আমি বিয়ে করার পর সে ছুটি নিয়ে দেশে চলে যায়--

-- ছুটি সে চেয়েছিল, না তুমিই তাকে তাড়ালে? নাকি তোমার স্ত্রী...

-- ইন ফ্যাক্ট, পিতাজি আমেরিকা থেকে ফিরে আসার পরেই তাকে তলব করেন। ও নাসিকে যায়। সেখান থেকে দেশে চলে যায়।

-- তার মানে কাল গভীর রাত্রে তোমার স্ত্রী যে গাড়ি নিয়ে বাইরে গেছিল এ কথা তুমি ছাড়া আর কেউ জানে না -- তাই তো?

-- সম্ভবত তাই। অন্তত আমি এখনও কাউকে বলিনি।

-- সেক্ষেত্রে তোমার প্রথম কাজ হচ্ছে: তোমাদের গ্যারেজের ওই ‘নবতাল’ তালার পরিবর্তে অন্য একটি বড়ো তালা ওখানে ঝোলানো। তাহলে হয়তো পুলিশের নজর তোমাদের দিকে আদৌ পড়বে না।

-- একথা কেন বলছেন?

-- সেটাই স্বাভাবিক। পুলিস মোটর-ভেহিকলস-এ গিয়ে খবর নেবে একই পরিবারভূক্ত কয়টি ক্ষেত্রে ডবল-লাইসেন্স আছে -- একটি মারুতি এবং একটি আ্যামবাসাডার। কলকাতা শহরে এমন পাঁচ- দশটা কেস তারা হয়তো পাবে -- কিন্ত প্রত্যেকটি সম্ভ্রান্ত পরিবার। দু-দুটো গাড়ি বড়োলোক ছাড়া কেউ পোষে না। ফলে পুলিস গোয়েন্দা নিয়োগ করবে। যে সব পরিবারের নামে জোড়া লাইসেন্স আছে সেখানে গিয়ে খবর নেবে কার গ্যারেজে ‘নবতাল’ তালা আছে। তারপর যে নবতাল-তালার চাবিটা পুলিসের হেপাজতে আছে...

ত্রিদিব বাধা বলল, আপনি কি আমাকে এভিডেন্স ট্যাম্পার করতে পরামর্শ দিচ্ছেন?

বাসু ওর চোখের দিকে পুরো দশ-সেকেন্ড নির্বাক তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, তুমি কি চাও পুলিস খুঁজতে খুঁজতে ওই ‘নবতাল’ তালাটা আবিষ্কার করুক? সাত দিনের ভিতর?

ত্রিদিব দৃঢ়স্বরে বলল, সাত দিন কেন? আজই পুলিশ তা জানবে।

-- মানে?

-- কারণ আপনার এখান থেকে আমি সরাসরি পুলিস-স্টেশনে যাব। আমি যা দেখেছি, যা জানি, যা স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে কর্তৃপক্ষকে জানানো উচিত তা অপকটে এজাহারে জানাব।

বাসু চমকে ওঠেন: গুড গড! কেন? কেন এ কাজ করবে তুমি?

-- যেহেতু এটাই আমার শিক্ষা। এটাই আমার খানদান। আমার ধমনীতে বইছে শক্তাবৎ রাজপুত রাজরক্ত।

বাসু অসহায়ভাবে মাথা নাড়েন। বলেন, কিন্তু তোমার স্ত্রী তো খুনী নাও হতে পারে?

-- অফ কোর্স শি ইজ ইনোসেন্ট। খুন সে করেনি। করেছে ডাক্তার ব্যানার্জী। এখন সে পরস্ত্রীর পেটিকোটের আড়ালে লুকাতে চাইছে। আপনি কেন এই সহজ ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না স্যার। রাত বারোটা পঁয়তাল্লিশে ডাক্তার ব্যানার্জি বাড়িতে অনুপস্থিত। ছন্দা তার নৈশ অভিসারে বার হল তার ঠিক দশ মিনিট আগে, বারোটা পঁয়ত্রিশে। রাত একটা কুড়িতে তারাতলায় খুন হল কমলেশ। আর তারাতলা থেকে গাড়িতে মাঝ রাত্রে আসতে যে পনেরো মিনিট লাগে, সেই সময়ের ব্যবধানে ছন্দা ফিরে এল কাঁটায় কাঁটায় একটা পঁয়ত্রিশে। হিসাবটা তো জলের মতো পরিষ্কার। খুনটা করেছে ব্যানার্জি, কিন্তু ছন্দার উপস্থিতিতে। আর এখন চাবিটা ফেলে আসায় সব দোষ চাপছে আমার ওয়াইফের ঘাড়ে। ওকে বাঁচাতেই হবে, স্যার...

বাসু বললেন, তোমার স্ত্রী যে ঠিক একটা পঁয়ত্রিশে ফিরে এসেছে তা তুমি জানলে কী করে?

-- ঘড়ি দেখে! আমি জেগেই গাড়ির শব্দ পেয়ে জানলার ধারে এগিয়ে এলাম। দেখলাম স্বচক্ষে। ছন্দা তালা খুলল। পাল্লাটা ঠেলে দিয়ে গাড়ি গ্যারেজ করল। তারপর এগিয়ে এল বাড়ির দিকে। আমি তৎক্ষণাৎ বিছানায় শুয়ে পড়লাম...

-- জাস্ট এ মিনিট! ছন্দা গাড়ি গ্যারেজ করার পর আবার পাল্লাটা ঠেলে বন্ধ করল না? “নবতাল” তালাটা লাগাল না?

ত্রিদিব একটু চিন্তা করে বলল, না! যদ্দুর মনে পড়ছে--না!

-- কেন?

-- কারণ আজ সকালে যখন আমি নিঃশব্দে বেরিয়ে আসি, তখন গ্যারেজের পাল্লাটা খোলাই ছিল।

-- তা নয়। আমি জানতে চাইছি, ছন্দা কী কারণে গ্যারেজ বন্ধ করে তালা লাগাল না?

-- গ্যারেজটা মাপে একটু ছোটো। আ্যামবাসাডারটার সই-সই। কখনও কখনও রাস্তায় ভারি ট্রাক গেলে গ্যারেজটা কাঁপে। তখন আ্যমবাসাডার গাড়িটা একটু সড়ে-নড়ে যায়। সেক্ষেত্রে পাল্লাটা বন্ধ হয় না। তখন আ্যামবাসাডারটাকে সামনের দিকে একটু এগিয়ে নিতে হয়। ছন্দা সে রিস্ক নেয়নি। কারণ আমবাসাডারটা স্টার্ট নেবার সময় বেশ শব্দ হয়। ওর আশংকা হয়েছিল হয়তো আমার ঘুম ভেঙে যাবে।

-- আজ সকালে তুমি যখন আমার কাছে চলে আস তখন তোমার স্ত্রী কী করছিল?

-- অঘোরে ঘুমোচ্ছিল।

-- ও জানে না, তুমি উঠে চলে এসেছ?

-- নাঃ!

-- আশ্চর্য! কেন? ওকে না জানিয়ে এভাবে চলে এলে কেন?

-- কেন নয়? আমার ওয়াইফ যদি আমাকে না জানিয়ে মধ্যরাত্রে শয্যাত্যাগ করতে পারে, তাহলে সূর্যোদয়ের পর...

-- তা বটে। তা এত সকালে কোথায় যাচ্ছিলে তুমি?

-- তা বলতে পারব না। তবে ওর সঙ্গে এক বিছানায় শুয়ে থাকতেও পারছিলাম না। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়েই দেখি কাগজওলা বারান্দায় ছুঁড়ে কাগজ ফেলে গেছে। সেঁটা খুলে পড়তেই দেখি প্রথম পাতায় বার হয়েছে কমলেশ বিশ্বাস খুন হয়েছে। আমি জানতাম, ছন্দার প্রথম পক্ষের স্বামীর নাম “কমলেশ বিশ্বাস” ; কিন্তু আমার ধারণা ছিল সে মৃত। কাগজের পঞ্চম পৃষ্ঠাটা খুলেই বুঝতে পারলাম, বাস্তবে কী ঘটেছে। ব্যানার্জি আর ছন্দা কাল রাত্রে কমলেশকে খুন করতে গেছিল। নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে ড্রয়ারটা টেনে দেখি তাতে এক সেট চাবি রয়েছে; দ্বিতীয় সেট আমার পকেটে। ফলে বুঝতে অসুবিধা হল না, কাগজে যে ছবিটা ছেপেছে তা ছন্দার চাবির গোছা। তখনই গ্যারেজ থেকে গাড়িটা বার করে আপনার কাছে চলে এলাম...

-- তুমি আমার বাড়ি চিনতে?

ত্রিদিব একটু ভেবে নিয়ে বলল, হ্যাঁ চিনতাম।

-- কীভাবে?

আবার একটু ভেবে নিয়ে বলল, সরি স্যার! ঠিক বলতে পারবনা। স্বীকারই করি -- আমি ডাঃ ব্যানার্জির নার্সিং হোমে ভর্তি হয়েছিলাম মানসিক রোগী হিসাবে। সব কথা আমি সব সময় মনে করতে পারি না।

-- অল রাইট! তুমি আমার কাছে কেন এসেছিলে? ঠিক কী চাও?

-- আমার ওয়াইফকে বাঁচাতে। আমার খানদানকে বাঁচাতে!

-- তা যদি বাঁচাতে চাও ত্রিদিব নিজে থেকে কিছুতেই পুলিসে যেতে পার না!

-- দ্যাটস্ ইম্পসিবল্, স্যার রাজপুত! শক্তাবৎ!

--আই সি! কিন্তু তুমি যে আমায় নিয়োগ করতে চাও তাতে আমার জানা দরকার আমার ক্লায়েন্ট কে? তুমি না তোমার স্ত্রী?

-- অফ কোর্স আমার ওয়াইফ! আর যদি সম্ভবপর হয় তাহলে এই খুনের মামলায় যেন আমাদের খানদানটা জড়িয়ে না পড়ে। আমার বাবার নামটা...

-- তোমার বাবার নামটা তো তুমি নিজেই জড়াচ্ছো। পুলিসে গিয়ে এজাহার দিতে গেলে প্রথম পংক্তিতেই তো তোমার বাবার নামটা বলতে হবে।

ত্রিদিব গুম মেরে বসে থাকল।

-- দ্বিতীয়ত, তোমার বাবাকে আমার দরকার ‘ফি’টা মেটানোর জন্য। আমার এটাই তো পেশা...

--আই নো, আই নো, কিন্ত সে প্রয়োজনে আমার পিতৃদেবের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা বৃথা। তিনি আমার ওয়াইফকে বাঁচানোর জন্য একটা পয়সাও খরচ করবেন না!

-- কেন? সে তাঁর পুত্রবধূ! ‘খানদান’-এর ঐতিহ্যটা বাচাতে হলে তীর পক্ষে পুত্রবধূকে রক্ষা করাই তো স্বাভাবিক।

-- আজ্ঞে না। তাহলে আপনাকে ব্যাপারটা গোড়া থেকে বুঝিয়ে বলতে হয়।

-- থাক্ ত্রিদিব। আবার গোড়া থেকে শুরু করতে হবে না। শুধু একটা কথা বল: তোমার বাবার সুনাম, তোমাদের ‘খানদান’ ইত্যাদির খাতিরে তুমি কি পুলিস-স্টেশনে যাবার ইচ্ছাটা আপাতত মুলতুবি রাখবে? আর ‘নবতাল’ তালাটা বদলে দেবে?

ত্রিদিব উঠে দঁড়াল। বলল, সরি স্যার। আপনি আমাকে ঠিক চিনতে পারেননি। এভিডেন্স নষ্ট করা অথবা সত্য গোপন করা সাত শতাব্দী ধরে কোনো শক্তাবৎ রাজপুত করেনি। আমিও করতে পারব না।

মাথা খাড়া রেখেই গটগট করে বেরিয়ে গেল সে। শুধু দরজার কাছে একবার থমকে দাঁড়াল। পিছন ফিরে বলল, আপনার বিলটা আমাকে পাঠিয়ে দেবেন, স্যার। দরকার হয় ঘড়ি-আংটি বেচে আমি আপনার ফি-টা মেটাব। আর তাছাড়া জানেন নিশ্চয় -- আমাদের উত্তরাধিকার সূত্রটা বাঙালীদের মতো দায়ভাগের নয়। মিতাক্ষরা সূত্রে।

বাসু বললেন, মনে আছে। তুমি বলেছিলে যে, তুমি ল-পাশ।

আট

শক্তাবৎ রাজপুতের নাটকীয় প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়ে তিনজনে -- সস্ত্রীক কৌশিক আর রানু।

রানুই তাদের যৌথ জিজ্ঞাসাটা বাঙ্ময় করে তুললেন: কেন এসেছিল? ওই শক্তাবৎ রাজপুত্র?

-- আমাকে কিছু আইনের পরামর্শ দিতে!

-- তোমাকে! আইনের পরামর্শ! কী সেটা?

-- শক্তাবৎ রাজপুতদের ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার সূত্রটা মিতাক্ষরা আইনে, ভেতো-বাঙালিদের মতো “দায়ভাগ” সূত্রে নয়।

ওঁরা তিনজনে মুখ চাওয়া-চাওয়া করেন।

বাসু বলেন, ওসব আইনের সুক্ষাতিকূক্ষ্ম সূত্র তোমরা বুঝবে না। রানু, দেখ তো ত্রিদিব নাম-ঠিকানার সঙ্গে ওর টেলিফোন নাম্বারটা রোখে গেছে কি-না। থাকলে ইমিডিয়েটলি ফোন কর। ছন্দা বাড়িতে আছে। বোধহয় এখনো ঘুমাচ্ছে। তাকে আমার দরকার।

বেলা তখন আটটা। তবু ছন্দা ঘুমাচ্ছিল। শেষ রাতে কড়া ঘুমের ওষুধ খাবার ফলে। বেশ কিছুক্ষণ রিঙিং-টোনের পর ঘুম-জড়ানো কণ্ঠে সাড়া দিল সে। বাসু বললেন, ছন্দা? এখনো ঘুম ছোটেনি? শোন! যা বলছি মন দিয়ে শোন!

-- আপনি কি, স্যার, বাসু-সাহেব বলছেন?

-- তাই বলছি! কাল রাত্রে কী ঘটেছে তা তুমি জান! আমিও জানি!

ও প্রান্তে ছন্দা একটা চাপা আর্তনাদ করে উঠল। বোঝা গেল, এতক্ষণ সে ছিল আধোঘুমের ঘোরে। গত রাত্রের বিভীষিকাটা ওর স্মৃতিপথে ছিল না। এতক্ষণে সে পুরোপুরি জেগে উঠল, সচেতন হল। লক্ষ্য করে দেখল, পাশের বিছানাটা খালি। কণ্ঠস্বরে সংযম এনে বলল, আমি...আমি বুঝতে পারছি না, আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন? কাল রাত্রে...মানে, কী এমন ঘটেছে?

-- লুক হিয়ার, ছন্দা। তোমার ওসব পুরনো প্যাঁচ শিকেয় তুলে রাখ। তোমাকে যা বলছি তা বিনা প্রশ্নে অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। কেন তা করতে বলছি, সে-কথা যখন দেখা হবে তখন বুঝিয়ে বলব। এখন নয়! ফলো?

-- বলুন?

মিনিট পনেরোর ভিতর মিসেস্ সুজাতা মিত্র অফ “সুকৌশলী” তোমার কাছে যাবে। এই পনেরো মিনিটের ভিতর একটা ওভার-নাইট ব্যাগে তোমার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ভরে তৈরি হয়ে থেকো, যাতে সুজাতা পৌঁছানো মাত্র, তার আইডেন্টিটি প্রমাণ করা মাত্র, তুমি ওর সাথে রওনা হতে পার। দু’চার দিনের জন্য তোমাকে হয়তো অন্যত্র যেতে হবে। তোমার স্বামীর জন্যে...সে এখন ঘরে নেই তা আমি জানি -- কোনো নোট রেখে যাবার প্রয়োজন নেই...

ছনদা প্রতিপ্রশ্ন না করে পারে না, ও কোথায়?

-- পাঁচ মিনিট আগেও আমার চেম্বারে ছিল। এখন নেই। প্লিজ! কোনো প্রশ্ন টেলিফোনে কর না। ঠিক যা যা বলছি তাই করো, সুজাতা তোমাকে সব বুঝিয়ে দেবে।

ছন্দা আরও কিছু বলতে চাইছিল, পারল না, -- কারণ বাসু-সাহেব লাইন কেটে দিয়ে সুজাতার দিকে ফিরলেন, শোনো সুজাতা! ত্রিদিব থানায় গিয়ে এজাহার দেওয়ামাত্র তার ফ্ল্যাটে রেইড হবে। হয়তো মিনিট কুড়ি-পঁচিশ সময় আছে। তোমাকে কী কী করতে হবে তা তুমি নিজেই স্থির করে নিও। আমি কিছু ইনস্ট্রাকশন দেব না, দিতে পারি না। আমি শুধু আমার সমস্যাটার কথা তোমাকে বলছি। প্রথম কথা: ছন্দা আমার ক্লায়েন্ট, তার পার্মানেন্ট আ্যাড্রেস আমি জানব, এটাই স্বাভাবিক: কিন্তু দু- তিন দিনের জন্য সে যদি কোথাও বেড়াতে যায় -- আমাকে না জানিয়ে -- তাহলে তার ঠিকানা আমার জানার কথা নয়। পুলিসে জানতে চাইলে আমি নাচার। তবে আমি আশা করি -- যেহেতু ছন্দা বুদ্ধিমতী -- তাই কোনো হোটেলে গিয়ে উঠলে স্বনামেই রেজিস্টার খাতায় সই করবে। কারণ অন্যথায় মনে হতে পারে যে, আইনের হাত থেকে সে পালাতে চাইছে। সে দোষী, অন্তত জ্ঞানপাপী! সে তা নয়! তোমার কী মনে হয়?

সুজাতা কোনো জবাব দিল না। রানুর দিকে ফিরে বলল, মামিমা আমি একটু বেরুচ্ছি। রাতে না ফিরতে পারলে চিন্তা করবেন না।

কৌশিক মানিব্যাগ খুলে এক বান্ডিল নোট ওর দিকে বাড়িয়ে ধরল। সুজাতা সেটা ভ্যানিটি ব্যাগে ভরে নিয়ে রওনা হয়ে গেল।

বাসুও উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, কৌশিক তুমি দেখ রবির কাছ থেকে পুলিস-ইনভেস্টিগেশনের আর কিছু ডিটেইলস পাওয়া যায় কি না। তাছাড়া পত্রিকা -অফিসের ওই নিজস্ব সংবাদদাতার তোলা ফটোর কপিগুলো পাওয়া যায় কি না। চিফ নিউ্জ-এ্ডিটর আমাকে খুবই খাতির করে।

কৌশিক জানতে চায়, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?

-- একবার তারাতলা ঘুরে আসি ঘটনাটা যেখানে ঘটেছে।

রানু জানতে চান, দুপুরে বাড়িতে কে-কে লাঞ্চ করছ?

বাসু বলেন, সুজাতা বাদে আমরা তিনজনই।

তারাতলার অসমাপ্ত সন্তোষী-মা অ্যাপার্টমেন্টের সামনে টুলে বসে দুই সেপাই আপনমনে হাততালি দিচ্ছে। গাড়িটা কাছাকাছি এসে পড়ার পর বোঝা গেল, ওদের করধ্বনি কারও সাফল্যজনিত হেতুতে নয় -- তারা দুজন মৌজ করে খেনি বানাচ্ছে বাসু-সাহেবকে গাড়িটা পার্ক করে নেমে আসতে দেখে তারা চঞ্চল হল না। টুলে বসে বসেই প্রশ্ন করল, ক্যা চাহিয়ে সাব?

-- এ বাড়ির দেড়তলায় যিনি থাকতেন -- কমলেশ বিশ্বাস...

-- তিনি গুজর গিয়েসেন, মানে-কি ফৌত হইয়েসেন। আখবরে দেখেন নাই?

-- হ্যাঁ! খবরের কাগজে দেখেই তো খোঁজ নিতে এসেছি।

-- অখন কী তালাশ নিবেন? মুর্দা তো লাশকাটা ঘরে চালান হইয়ে গেল।

-- সেটা আন্দাজ করেছি। আমি কি একবার ওর ঘরটা দেখে আসতে পারি, সেপাইজী? তোমাদের সঙ্গে -- মানে, কালও আমি এসেছিলাম কমলেশের কাছে, একটা জিনিস ভুলে ফেলে গেছি...

-- কুঞ্চি? এক রিংমে তিনঠো চাবিকা বাৎ বোলতে ক্যা?

-- না, না, চাবি নয়। একটা নোটবই, মানে ডায়েরি।

-- মাফ কিজিয়ে সাব। বিনা-পারমিট ভিতর-যানা মানা হৈ!

অগত্যা বাসু-সাহেব এপাশে ফিরলেন। বটুকনাথ দুলে দুলে বিড়ি বাঁধছে, কিন্ত নজর ছিল এদিকেই। বাসু-সাহেবের গাড়ি এ গলিতে ঢোকার পর থেকেই। বাসু ওর দোকানের দিকে এগিয়ে গেলেন। বটুক বিনা বাক্যব্যয়ে তার উপস্থিত খদ্দেরকে পান দিল, নোট নিয়ে রেজগি দিল। তারপর দোকানটা ফাঁকা হতেই টিনের কৌটা খুলে একটা বিশ টাকার নোট বার করে বাড়িয়ে ধরল বাস-সাহেবের দিকে। বললে, একটা দেশলাইয়ের দাম মিটিয়ে দেবেন স্যার, নিন ধরুন!

-- তার মানে?

-- কাল রাতভোর ধকল গেছে! কী কুক্ষণে থানায় টেলিফোন করার দুর্মতি যে হল! জবানবন্দি দিতে দিতে জান নিকলে গেছে। একবার পুলিশ, একবার খবরের কাগজ...

-- সে তো বুঝলাম। টেলিফোনটা করে তুমি নাগরিকের কর্তব্য পালন করেছ, বটুক। তা ভালো কাজ করলেই নাকাল হতে হয়। এটাই হচ্ছে দুনিয়ার নিয়ম, কিন্তু ওই নোটটা আমাকে ফেরত দিচ্ছ কেন?

-- দারোগাবাবু যাবার আগে হুকুম দে’ গেলেন, আমাদের যা বললে তা যদি বাইরের কোনও মনিষ্যিকে বল তাইলে সোজা হাজতে ঢুকিয়ে দোব। ইদিকে আপনার কাছ থেকে আগাম নে বসি আছি, উদিকে আমি ছা-পোষা মনিষ্যি।

বাসু পাইপটা ধরাতে ধরাতে বললেন, যদিও তুমি ঠিক ছা’-পোষা মানুষ এখনো হওনি, তবে মাস-ছয়েকের ভিতরেই তা হতে চলেছ। আমি তোমার সমস্যাটা বুঝতে পারছি, বটুক। ঠিক আছে, তোমার কাছে কিছু জানতে চাইব না। তবে আমারও মুশকিল কী জান? যাকে যা দিই তা আর ফেরত নিই না। ওটা তোমার কাছেই থাক! আচ্ছা চলি...

বাসু পিছন ফিরলেন। বটুক নোটটা হাতে নিয়ে বিহ্বল হয়ে বসে রইল। আবার এদিকে ফিরে বাসু সাহেব বললেন, তুমি শুধু একটা কথা স্মরণ রেখ, বটুক-- টাকাটা দিয়েছিলাম ঘটনা ঘটে যাবার অনেক আগে। পুলিসের সাক্ষী ভাঙাতে ঘুষ দিইনি আমি। তাই না? তোমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেয়ে খুশি মনে দেশলাই কিনে ভাঙানিটা করত নিইনি। ঠিক বলছি তো, বটুক?

এতক্ষণ নজর হয়নি--দোকানের পিছন দিকে জড়োসড়ো হয়ে বসেছিল একজন। সে হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। একপা এগিয়ে এসে বটুকের হাত থেকে বিশ টাকার নোটখানা ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে বাসু-সাহেবের দিকে ফিরল। মাথার টেনে দিয়ে ফিস্ ফিস্ করে বলে, আমার নাম সদু-সৌদামিনী, আজ্ঞে। আমারে শাসায়ে যায়নি। গেলেও আমি কান দিতাম না। এই ভিতুর ডিম মুখে কুলুপ আঁইটে র চায় তো রাখুক। ভীমা কৈবর্তের মাইয়া কারুরে ডরায় না। কী জিগাইবেন জিগান! পঞ্চাশ ট্যাহা বশকিস্ দেবার মতো হিম্মৎ কইলকাত্তা শহরে আছে কয়জন ভদ্দরলোকের? শহরের সব বীরপুরুষই তো প্যাটের তলায় ন্যাজ স্যাদায়ে...

শেষ দিকের বাক্যটা সে তার মরদের দিকে ফিরে বলছিল। হঠাৎ বটুক যেন সংবিৎ ফিরে পেল। কঠিন স্বরে তার ধর্মপত্রীকে প্রথমেই একটা ধমক দিল, তুই ঘর যা কেনে! সাহেবরে আমিই সব বুলব অনে? হল তো?

সৌদামিনী হাসল। বিজয়িনীর হাসি। মরদের আদেশটা সে নিকথায় মেনে নিল। তবে অন্ধকারে পিছন দিকে মিলিয়ে যাবার আগে বাসু-সাহেবের দিকে হেসে যুক্তকরে প্রণাম জানাতে ভুল না। আর বলা বাহুল্য: যাবার আগে তার বিজয়িনী ট্রফিটা -- যেটা এতক্ষণ ধরাই ছিল তার দু’আঙুলে -- আঁচলের খুঁটে বেঁধে নিতেও ভুল হল না।

বাসু বাধা দিয়ে বললেন, না বটুক! তোমাকে বিপদে ফেলব না আমি। দারোগাবাবুর আদেশ না মানলে তোমাদের মত দোকানদারের কী হাল হয় তা আমার জানা। আমার বিশ্বাস তুমি যা দেখেছ যা বুঝেছ তা সবই বলেছ পুলিসকে এবং খবরের কাগজকে। তুমি শুধু বল, তুমি কি এমন কোনো তথ্য পুলিসে বা খবরের কাগজের বাবুকে জানিয়েছ যা সংবাদপত্রে ছাপা হয়নি।

-- আজ্ঞে না, স্যার। তবে দু-একটা কথা আমি ওদের আদৌ বলিনি।

-- কী কথা তা আমি জানতে চাইছি না; কিন্তু কেন বলনি?

-- দেখুন, স্যার -- পুলিসের উপর আমার একটুও বিশ্বাস নেই। ওরা আসে শুধু মানুষজনেরে হয়রান করতে, আর টাকা খেতে। বেশ বুঝতে পারছি -- ওই বিশ্বাসবাবু ছিল একটি হাড়-হারামজাদা মনিষ্যি! অনেক অনেক মেয়েরে সে ফাঁসায়েছে। তাদেরই বাপ-ভাইয়ের কেউ একজন হয়তো ওরে খুন করে গেছে! আপনি বলবেন, আইন নিজের হাতে নেওয়ার হক কারও নেই! ভালো কথা, কিন্তু আইন ওই কমলেশকে কি আ্যাদ্দিন অপকর্ম থেকে ঠেকাতে পারিছিল? আমি যদি হক কথাটা বলি, তাহলে বেহদ্দো আমার কয়েকজন খদ্দেরের পিছনে লাগবে ওরা। তাতে আমার লাভ তো অস্টরম্ভা, লোকশানই ষোলোকলা।

বাসু বললেন, বুঝলাম! এবার বল, কথাটা কী? কী দেখেছ তুমি, যা পুলিসকে বা কাগজের লোককে জানাওনি।

বটুক চারিদিকে একবার দেখে নিতে নিম্নকণ্ঠে বলে, টর্চের আলোয় মেজেয় লুটিয়ে পড়া মানুষডার একটা ঠ্যাঙ দেখে আমি সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে যাই ডাক্তারবাবুরে ডাকতে। তা সেই দেড়তলা থেকে দোতলায় উঠবার সময় সিঁড়ির জানলা দিয়ে আমি দেখতে পাই গলি দিয়ে পর পর দু-খানা গাড়ি হুস্ হুস্ করে বার হয়ে গেল। আমাদের বাড়িতে সিঁড়ি ঘরের বাইরের দিকে কাচের টানা জানলা আছে -- তা দিয়ে গলি তো বটেই, তারাতলা রোডটাও দেখা যায়। আমি দেখলাম, গলি দিয়ে যে দু-খানা গাড়ি বার হয়ে গেল, তার একটা মোটরসাইকেল, একটা মারুতি ভ্যান। আর ঠিক তার পরেই -- বলা যায় লগে লগেই গলির মুখে-দাঁড়ানো একটা গাড়ি স্টার্ট নিল। সে বাইরের দিকে মুখ করেই ছিল। কী গাড়ি কইতে পারব না।

-- গাড়ির ভিতরে যারা ছিল তাদের দেখতে পাওনি?

-- আজ্ঞে না। পেলেও ঘোর আঁধারে চেনা যেত না।তবে...

--কী তবে?

-- বলাটা উচিত হবে কিনা ভাই ভাবছি;

-- আমি তো পুলিস নই, খবরের কাগজেরও কেউ নই।

-- তাইলে আপনারই বা এত উতাধাই কেন, তা আমারে আগে বোঝান।

এই ‘উতাধাই’ শব্দ-প্রয়োগেই রাসু-সাহেব বটুকচন্দ্রের জাতি নির্ণয় করে ফেলেন। এ গলিতে সে হাফ-প্যান্ট পরে মার্বেল খেলে থাকতে পারে। কিন্তু সে অথবা তার পিতৃদেব এককালে নির্ঘাৎ ওপার-বাঙলা থেকে এ-দেশে এসেছেন। এপার বাঙলায় কেউ ‘কৌতুহল’ শব্দের সমার্থ হিসাবে ‘উতাধাই’ বলবে না। মায় ‘সমার্থশব্দকোষ’ লেখক অশোক মুখুজ্জে পর্যন্ত না। বাসু বলেন, শোন বটুক। আমার এক মক্কেল এই বিবাহ-বিশারদ কমলেশের পরিত্যক্ত স্ত্রী! তার গহনাগাঁটি নিয়ে লোকটা সটকেছিল। আমার আশঙ্কা পুলিস সেই নিরপরাধিনীর ঘাড়ে হত্যার অপরাধটা চাপাতে চাইবে। তাই তাকে বাঁচাবার জন্য আমি অগ্রিম সন্ধান নিয়ে চলেছি।

-- তাহলে আমি আপনার লগে আছি। সব রকম সাহায্য করতে রাজি। আমি আন্দাজ করেছি, কে খুন করেছে। সে আপনার মক্কেল নয়। সে পুরুষ মানুষ।

-- তুমি তাকে চেন?

-- স্যার, সে-কথা জিগাবেন না। আপনার মতো সেও আমারে কিছু আগাম দে’ গেছে। সন্ধে রাতে মোটর সাইকেলে চেপে -- তারে তো আপনি চেনেনই -- সেই বাবু আবার আমার কাছে এয়েছিল। আন্দাজ তখন সাতটা। তখনো কমলেশবাবু ফেরেনি। তার কথা আপনারে কেমন করে বলি, বলুন? আমি তো তারও নিমক খায়ে বসি আছি।

-- বুঝেছি বটুক! আর কিছু বলতে হবে না তোমাকে।



তারাতলা থেকে ডায়মন্ড হারবার রোডে পৌঁছে বাসু-সাহেব গাড়ি পার্ক করলেন। একটা পাবলিক টেলিফোন বুথ থেকে বাড়িতে ফোন করলেন। ধরলেন রানু। বাসু জানতে চাইলেন, সুজাতা কি তোমাকে ফোন করে কিছু জানিয়েছে? নিউ আলিপুরের লেটেস্ট নিউজ কী?

রানু জবাবে বললেন, আজ্ঞে না, মিস্টার বাসু কাজে বেরিয়েছেন, অ্যারাউন্ড একটা নাগাদ লাঞ্চে আসবেন।

বাসু ধমক দিয়ে ওঠেন, কাকে কী বলছ গো? আমি তোমার কর্তাই বলছি। সুজাতা কি কোনো...

কথাটা শেষ হয় না, তার আগেই রানু বলে ওঠেন, বেশ তো কাল সকালে আসুন। আমি ওঁর আ্যাপয়েন্টমেন্ট প্যাডে লিখে রাখছি।

এবার মালুম হল। বাসু বলেন, তোমার সামনে কেউ বসে আছে? তাই কি আবোল-তাবোল বকছ?

-- একজ্যাক্টলি!

-- পুলিস ইন্সপেক্টর? আমার সন্ধানে এসে ঠায় বসে আছে?

-- আজ্ঞে হ্যাঁ। ঠিকই বলেছেন!

-- বুঝেছি। এবার এমনভাবে প্রশ্ন করছি যাতে তোমার উত্তর ‘হ্যাঁ বা-না’র মধ্যে রাখতে পার। সুজাতা কি সফলকাম হয়েছে?

-- হ্যাঁ।

-- ওরা দুজনে কোথায় গিয়ে উঠেছে তা তুমি জান না, কেমন?

-- ঠিক তাই।

-- তোমার সামনে যে লোকটা বসে আছে সে কি হোমিসসাইড-স্কোয়াডের সতীশ বর্মন?

-- একজ্যাক্টলি।

-- আর তাকে তুমি বলেছ আমি একটার সময় লাঞ্চ খেতে আসব?

-- হ্যাঁ, তাই।

-- আল রাইট, আমি আধঘন্টার মধ্যেই আসছি!



বর্মণ অসহিষ্ণু হয়ে বলে ওঠে, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য, বাসু-সাহেব? আপনার মকেলের স্বামী বলছেন, সকাল সাড়ে ছয়টার সময় তাঁর স্ত্রী ঘুমের ওষুধ খেয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছিলেন, আর বেলা আটটা বেয়াল্লিশে তিনি কর্পূরের মত উপে গেলেন? স্বামীর জন্য একটা নোট পর্যন্ত না রেখে?

বাসু বললেন, আমি তো আপনাকে কিছু বিশ্বাস করতে বলিনি। সব তথ্য তো আপনিই সরবরাহ করছেন।

-- এগুলো ফ্যাক্ট। টেক ইট ফ্রম মি!

-- নিলাম। কিন্তু আমার কাছে কী জানতে চাইছেন?

-- আপনার মকেল এখন কোথায়?

-- আমি জানি না।

-- একথা আপনি আগেও বলেছেন। কিন্তু সেটা কি বিশ্বাসযোগ্য? অফটার অল, সে হল আপনার মক্কেল!

-- তার স্বামী কোথায়?

-- আমাদের হেপাজতে।

-- সে জানে না তার স্ত্রী কোথায় আফটার অল, সে হল মেয়েটির স্বামী!

-- তার মানে আপনি বলবেন না?

-- আজ্ঞে না। তার মানে, আমি জানি না। জানলে বলতাম। পুলিসের সঙ্গে আমি সব সময়েই সহযোগিতা করে চলি।

বর্মন উঠে দাঁড়ায়। উকিলী-কায়দায় একটা ‘বাও’ করে বলে, সে কথাটা আমি অস্থিতে-অস্থিতে জানি, য়োর অনার!

রাত আটটা নাগাদ ফিরে এল সুজাতা। ভগ্নদূতের মতো। বললে, মামিমা, রাতে খাব আর থাকব।

বাসু বলেন, কী ব্যাপার? তুমি না বলে গেলে রাতে ফিরবে না।

-- তাই বলেছিলাম। কিন্তু আপনি বোধহয় সান্ধ্য-এডিশন খবরের কাগজটা দেখেননি? তাই নয়?

-- না দেখিনি। কিছু খবর বের হয়েছে?

-- তা হয়েছে। কীর্তিটা আপনার মকেলের শিভালরাস্ শক্তাবৎ মরদের। তার উদ্যোগে আজ একটি কাগজের সান্ধ্য-এডিশনে ছন্দার একটি ছবি ছাপা হয়েছে। পুলিস ছবিটা ছেপে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে, এই মেয়েটিকে তারাতলা-হত্যা বাবদে পুলিসে খুঁজছে। আমরা সেটা জানতাম না; কিন্তু যে হোটেলে ডবল-বেড রুম বুক করে আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম সেই হোটেলের ম্যানেজার কাগজটা দেখে। ছন্দা স্বনামে ঘর নিয়েছিল। ফলে ম্যানেজার তাকে সহজেই শনাক্ত করে। থানায় ফোন করে। রাত সাতটা নাগাদ পুলিসভ্যান এসে পৌঁছায়। বডি-ওয়ারেন্ট দেখায়। ওকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যায়। বাধ্য হয়ে আমি চেক-আউট করে চলে আসি।

বাসু বললেন, বুঝলাম। সারাটা দিনে তুমি তাকে কতটা জানতে দিয়েছ আর কতটা জেনেছ?

-- আমাকে সে কিছুই বলেনি। ইন ফ্যাক্ট, বলতে চেয়েছিল, আমিই শুনতে রাজি হইনি।

তাকে বলেছিলাম, আমাকে তুমি কিছু বোলো না। কারণ পুলিসে আমাকে ‘সামন’ করলে আদালতে সব কথা আমাকে স্বীকার করতে হবে। আমাকে যা বলবে তা প্রিভিলেজড-কম্যুনিকেশন নয়।

-- ভেরি কারেক্ট। কিন্তু তুমি তাকে কতটা জানিয়েছ?

সুজাতা বলে, আমি শুধু বলেছি যে, ত্রিদিবনারায়গ আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। আর কিছু বলিনি। ...ও হ্যাঁ, আর তাকে বলেছিলাম, যদি পুলিসে তাকে গ্রেপ্তার করে তাহলে সে যেন কোন অবস্থাতেই কোন জবানবন্দি না তাকে যে-কোন প্রশ্ন করলেই যেন সে বলে “আমার অ্যাটর্নির অনুপস্থিতিতে আমি কিছুই বলব না।

-- গুড গ্যের্ল!

নয়

পরদিন রবিবার। হেবিয়াস কর্পাস করা যাবে না। আদালত বন্ধ। কিন্তু বাসু- সাহেবকে নিষ্কর্মা বসে থাকতে হল না। বেলা সাড়ে-দশটা নাগাদ বর্মন টেলিফোন করে জানাল যে, বাসু সাহেবের মক্কেল তাঁর উপস্থিতি ছাড়া কোনো কথারই জবাব দিচ্ছে না। উনি কি আসতে পারবেন হেড-কোয়ার্টার্সে?

বাসু এলেন। বললেন, আমার মক্কেল জবানবন্দি দেবে কিন্তু তার পূর্বে আমি তার সঙ্গে নির্জনে সাক্ষাৎ করতে চাই।

সে ব্যবস্থাই হল। ছন্দাকে নিয়ে আসা হল ওর কাছে, বিশেষ সাক্ষাৎ কক্ষে। লেডি-মেট্রন অদূরে বসে রইল। শ্রুতিসীমার বাইরে, কিন্তু দৃষ্টিসীমার নয়।

বাসু বললেন, আয়াম সরি ছন্দা! তুমি প্রথম থেকেই আমাকে না জানিয়ে একের পর এক ভ্রান্ত পদক্ষেপ করছিলে। তবে তুমি এটা খুব বুদ্ধিমতীর মতো কাজ করেছ -- মানে এই স্ট্যান্ডটা নিয়ে যে, তোমার আ্যাটর্নির অনুপস্থিতি তুমি কোনো এজাহার দেবে না।

-- সুজাতাদি আমাকে সে-কথা বলেছিল। একটা কথা বলুন তো: পুলিসে আমাকে সন্দেহ করল কী করে?

-- তোমার কর্তা থানায় গিয়ে এজাহার দিয়েছিল বলে!

ছন্দা একটু অবাক হল। বললে, তা কেমন করে হবে? সে তো কিছুই জানে না। সে তো তখন ঘুমাচ্ছিল?

-- না, ছন্দা! তুমি ওর গরম চকলেটে ‘ইপ্রাল’ ট্যাবলেট মিশিয়েছিলে এটা সে জানতে পেরেছিল। সে ওটা কমোডে ঢেলে দেয়। আদৌ পান করেনি। ঘুমের ভান করে পড়েছিল। তুমি কখন গাড়ি নিয়ে আলিপুর থেকে রওনা হয়েছ আর কখন ফিরে এসেছ, তা সে জানে।

ছন্দা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। কথাটা হজম করতে পারছিল না সে। তারপর কোনক্রমে বললে, ও জেগে ছিল? ঘুমায়নি? ও জানে যে, রাত্রে আমি গাড়ি নিয়ে...

কথাটা ওকে শেষ করতে দেন না বাসু। বলেন, এখন আমাকে সংক্ষেপে বল দিকি -- কেন কাল মধ্য রাত্রে তারাতলায় গিয়েছিলে?

-- কমলেন্দু আমাকে বাধ্য করেছিল। সন্ধ্যার অ্যাপয়েন্টমেন্টটা ক্যানসেল করে টেলিফোনে রাত একটায় ওর সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করি। আমার আশা ছিল, ত্রিদিবকে ঘুম পাড়িয়ে আমি একা ওর কাছে যেতে পারব।

-- তোমার বয়সী একটি মেয়ের পক্ষে একা ড্রাইভ করে অত রাত্রে ওখানে যাওয়া কি দুঃসাহসিকতা নয়? তোমার ভয় হল না?

-- ভয়ের কী আছে? আমার সঙ্গে লোডেড রিভলভার ছিল। আপনি তো নিজেই সেটা আমাকে ফেরৎ দিয়েছিলেন। কোনো মস্তান বাঁদরামো করতে এলে তার খুলি উড়িয়ে দিতাম!

বাসু ম্লান হেসে বললেন, তোমার ধমনীতেও কি শক্তাবৎ রক্ত বইছে, ছন্দা? কী দরকার ছিল এতটা ঝুঁকি নেবার?

-- সে আপনাকে বোঝাতে পারব না। আমি..আমি একটা অপরাধ করেছিলাম। কমলেশ তা জানত! খবরটা সে পুলিসে জানালে আমার নির্ঘাত জেল হয়ে যেত! কী জানেন? আমি জানি যে, আমি অন্যায় করেছি, সেজন্য জেল খাটতেও আমি প্রস্তুত, কিন্তু ত্রিদিবের কথা ভেবে আমি প্রায়শ্চিত্তটা করতে পারছিলাম না। ওর বাবা ত্রিবিক্রমের ধারণাও: তার পুত্র নিচু ঘরে বিয়ে করেছে, আমার ‘খানদান’ নেই -- তা আমার নেই বটে, তেমনি আমি কিন্তু ‘বর্নক্রিমিনাল’ও নই। আমার জেল হলে ওর বাবা ওকে বলতেন ‘দেখলে তো?’..সেটাই আমার সহ্য হচ্ছিল না। তাই আমার হাত-পা বাঁধা পড়েছিল। আমার উপায় ছিল না। কমলেশের হুকুম মতো রাত একটার সময়েই আমাকে তারাতলার মতো এলাকায় যেতে হয়েছিল, প্রচণ্ড বিপদ মাথায় করে।

-- তুমি কি ওকে কিছু টাকা দিতে গেছিলে?

-- আদৌ না! টাকা কোথায় যে, দেব? আমি শুধু কিছু সময় চাইতে গেছিলাম। হতভাগাটা কিছুতেই রাজি হল না।...আপনি জানেন, আমার ধারণা ছিল, সে বাস দুর্ঘটনায় মারা গেছে। আসলে হয়তো সে এ কয়বছর জেল খাটছিল -- ঠিক জানি না -- মোট কথা তার কোনো খবরই পাইনি বহু বছর ধরে।

কাল রাত্রে কী ঘটেছিল তাই বল। কোনো কথা বাদ দিও না, কোনো কথা গোপন কর না। যদি তুমি স্বহত্তে খুন করে থাক তাহলে অকপটে তা স্বীকার কর!

ছন্দা মেদিনীনিবদ্ধ দৃষ্টিতে পাঁচ সেকেন্ড নিথর হয়ে বসে রইল। তারপর ওর চোখে-চোখে তাকিয়ে বলল, আই কনফেস্, স্যার! হ্যাঁ, আমিই ওকে খুন করেছি...নিজের হাতে...

বাসুও মিনিটখানেক স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন। তারপর বলেন, কিন্তু সেদিন তো তুমি আমাকে বলেছিলে ছন্দা, যে, ইঁদুর কলে-পড়া ইঁদুরদেরও তুমি মারতে পারতে না – দূরে গিয়ে ছেড়ে দিতে। বলনি?

-- বলেছিলাম। সেদিন সত্যি কথাই বলেছিলাম, স্যার। কমলেশকে আমি ইচ্ছা করে খুন করিনি।

-- ঠিক কী ঘটেছিল বল দিকিন।

ওর সঙ্গে আমার কথা কাটাকাটি থেকে ঝগড়া হচ্ছিল। ও বিশ্বাস করছিল ন! যে, সত্যিই দু- হাজার টাকাও আমার কাছে নেই। হঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে ও একটা অশ্লীল গালাগাল দিয়ে আমার হাত চেপে ধরে। আমি ওকে ধাক্কা মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিই। কী-একটা জিনিস -- কাচের গ্লাসই হবে বোধহয় -- হাতের ধাক্কা লেগে ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল। ও দু-হাত বাড়িয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসে। যেন দু-হাতে আমার গলা টিপে ধরবে। আমি নিচু হয়ে হাতের কাছে যা পেলাম তাই কুড়িয়ে নিলাম। তখন বুঝতে পারিনি, এখন খবরের কাগজ পড়ে বুঝছি যে, সেটা একটা গ্যালভানাইজড কলের জলের শর্টপীস। হাত-দেড়েক লম্বা। আমি সেটা এলোপাতাড়ি ঘুরিয়ে ওকে দূরে হটাতে চাইলাম। ঠিক তখনই ও মরিয়া হয়ে এগিয়ে আসে। পাইপটা ওর মাথায় লাগে। ও পড়ে যায়।

-- তখনি তুমি ছুটে পালিয়ে গেলে?

-- না। ঠিক তখনি কে-যেন সুইচটা অফ্ করে দিল!

-- সুইচটা ‘অফ’ করে দিল? কে? ঘরে তো মাত্র তোমরা দুজন? আর কমলেশ তো তখন মাটিতে পড়ে?

-- না! ঘরে তৃতীয় আর এক ব্যক্তিও ছিল। সে যে কে বা কখন এসেছে, তা জানি না। কিন্তু সে-ই হঠাৎ সুইচটা অফ করে দেয়।

-- ঠিক কখন? আই মিন, কমলেশ মাথায় আঘাত পাওয়ার আগে, না পরে?

-- আগেও না, পরেও নয়। ঠিক একই সময়ে। কোনো ঘটনা আাগুপিছু ঘটে থাকলে তা স্প্লিট-সেকেন্ডের ব্যাপার!

-- তাহলে এমনও হাতে পারে যে, তোমার আঘাতে কমলেশ ভূতলশায়ী হয় নি। তোমার ঘূর্ণ্যমান ডাণ্ডাটা অন্য কিছুতে আঘাত করে থাকতে পারে? ওই তৃতীয় লোকটাই..

-- আপনি যদি সেই কথা আমাকে বলতে বলেন, তবে আমি অবশ্য তাই বলব; কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমিই তার মাথায় ডান্ডার বাড়ি মেরেছিলাম। ওই তৃতীয় ব্যক্তি নয়। ,

-- কোনো তৃতীয় বাতি তো ঘরে নাও থাকতে পারে ছন্দা। হয়তো ঘটনাচক্রে ঠিক তখনই বাল্ব ফিউজ হয়ে যায়।

-- না। তা যায়নি। এক নম্বর কথা: “সুইচ অফ” হবার শব্দ আমি স্বকর্ণে শুনেছি। রাত তখন নিস্তব্ধ। দ্বিতীয়ত ঘর অন্ধকার হয়ে যাবার পর আমি দরজার আড়ালে সরে যাই। কমলেশ তখন নিথর হয়ে পড়ে আছে। সেই সময়ে ঘরে পর পর চার-পাঁচ বার কেউ একটা দেশলাই জ্বালাবার চেষ্টা করে। পারে না। দেশলাইটা বোধহয় ভিজে ছিল। যে ভ্বালছিল সে দেশলাইয়ের দিকে তাকিয়েছিল, কিন্তু ক্ষণিক আলোর ঝলকানিতে আমি পালাবার পথটা দেখে নিয়েছিলাম। নিঃশব্দে আমি সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলাম। ঠিক তখনই কলবেলটা একটানা বেজে উঠল।

-- কলবেল? কার কলবেল?

-- কমলেশেরই ডোরবেল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেউ কলবেল, বাজাচ্ছিল।

-- ওই রাত দেড়টার সময়?

-হ্যাঁ। লোকটা ভিতরে আসতে চাইছিল। ফলে, আমি অন্ধকারে সিঁড়ির মাঝমাঝি থম্কে দাঁড়িয়ে পড়ি। আমার মনে হয় যে-লোকটা আমার পিছনে দেশলাই জ্বালানোর চেষ্টা করছিল সেও থমকে থেমে পড়েছে, ল্যান্ডিঙের উপর একটু পরে আমার নজর হয় -- বাড়ির পিছনের ভারা বেয়ে কে একজন নেমে যাচ্ছে! তার একটু পরেই রাস্তায় একটা মোটরবাইক স্টার্ট নেবার শব্দ হয়। তৎক্ষণাৎ ডোরবেল বাজানো বন্ধ হয়। আমি তখন বাকি কটা ধাপ নেমে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসি। আশ্চর্য তখনও আমার মনে হচ্ছিল আমার পিছনে মেজানাইন-ল্যান্ডিঙে কেউ দীঁড়িয়ে আছে। লোকটা আর একবার দেশলাই জ্বালাবার চেষ্টা করে। এবং এবার সফল হয়। ঠিক তখনি আমি সদর দরজা পার হই। আমি প্রায় দৌড়ে এসে গাড়িতে উঠি। স্টার্ট দিই...

-- জ্যস্ট এ মিনিট। আলোটা নিবে যাবার কত পরে তুমি গাড়িতে স্টার্ট দাও? হোয়াটস্ য়োর বেস্ট গেস্? পাঁচ-দশ সেকেন্ড, না তিন-চার মিনিট?

-- মিনিট দুই-তিন হবে।

-- কে ডোরবেল বাজাচ্ছিল, কে দেশলাই জ্বালাবার চেষ্টা করছিল বা ভারা বেয়ে নেমে যায়, তা তুমি জান না? আন্দাজও করতে পার না?

-- আজ্ঞে না।

- ওরা তিনজন ভিন্ন-ভিন্ন লোক? নাকি একই লোককে...

-- তা আমি জানি না। তবে ভারা বেয়ে যে নেমে যায় সে লোকটা দেশলাই জালছিল না। কারণ সে ভারা বেয়ে নেমে যাবার পরেও লোকটা ল্যান্ডিঙে দাঁড়িয়েছিল।

-- তোমার চাবির থোকাটা কখন পড়ে যায়? খবরের কাগজে যে ছবিটা ছেপেছে...

-- আমি জানি না। সম্ভবত ধস্তাধস্তির সময়!

-- তাহলে তুমি গাড়ির দরজা খুললে কী করে?

-- আমি এত উত্তেজিত ছিলাম যে, কমলেশের বাড়ির সামনে গাড়িটা পার্ক করে আদৌ লক করিনি। দরজাটা খোলা রেখেই নেমে গেছিলাম।

-- তাহলে ফিরে এসে গ্যারেজের তালাটা খুললে কী করে?

-- ওটাও আমি বন্ধ করে যাইনি।

-- তোমার স্পষ্ট মনে আছে?

ছন্দা একটু ভেবে নিয়ে বলল, না। মনে নেই। তবে ছাড়া অন্য সমাধান নেই বলেই আমি ধরে নিচ্ছি যে, গ্যারেজের তালাটা আমি বন্ধ করে খাইনি।

-- একটু বুঝিয়ে বল।

-- দেখুন, আমরা দুজনে একই ডবল্ গ্যারেজ ব্যবহার করি। যে-কেউ গাড়ি বার করলেই শ্লাইডিং ডোরটা টেনে তালা বন্ধ করে দিই। এটা অনেকটা অভ্যাসবশত -- প্রতিবর্তী প্রেরণায়। আমার স্পষ্ট মনে আছে যে, স্লাইডিং ডোরটা আমি টেনে বন্ধ করেছিলাম; কিন্ত নবতাল-তালাটা নিশ্চয়ই লাগাইনি! কারণ সে-ক্ষেত্রে ফিরে এসে আমি গাড়ি গ্যারেজ করতে পারতাম না। কারণ তার আগেই তারাতলায় আমার চাবিটা খোয়া গেছে।

-- কেন? তোমার কাছে ট্রিপ্লিকেট-চাবিটা কি ছিল না?

-- ট্রিপ্লিকেট চাবি? মানে যেটা আমাদের ড্রেসিং-টেবিলের ড্রয়ারে থাকে? আপনি তার কথা জানলেন কেমন করে?

-- তোমার কর্তাই বলেছিল।

-- না। সেটা যেখানে ছিল সেখানেই ছিল। কাল সারা দিনে-রাতে তাতে আমি হাত দিইনি।

-- তুমি নিঃসন্দেহ? অন্যমনস্কভাবে রাত্রে ড্রয়ার খুলে সেই তৃতীয় চাবির থোকাটা নিয়ে যাওনি?

-- নিশ্চয় না! একথা কেন?

-- অলরাইট। ফিরে এসে গাড়ি গ্যারেজ করার পর -- তখন তো রাত পৌনে দুটো। তুমি গ্যারেজে নবতাল ভালাটা লাগাবার চেষ্টা করনি কেনঃ

-- সে প্রশ্নই ওঠেনি। কারণ ফিরে এসে আমি শ্লাইডিং পাল্লাটা টেনে বন্ধ করতে পারিনি।

- সেটাই বা কেন?

-- কখনো কখনো আ্যান্বাসাডার গাড়িটা একটু সরে নড়ে গেলে দরজাটা বন্ধ হতে চায় না। তখন হয় আ্যাম্বাসাডারটাকে স্টার্ট দিয়ে সামনের দিকে দু-এক ইঞ্চি এগিয়ে নিতে হয়, নাহলে একজন বাম্পারটা ঠেলে ধরে অন্যজন দরজাটা বন্ধ করে। একা হাতে ওটা করা যায় না। তাই ফিরে এসে নবতাল তালা লাগানোর প্রশ্নই ওঠেনি। আর সেজন্যই রাতে আমি টের পাইনি যে, আমার চাবিটা খোয়া গেছে। তাছড়া মানসিকতাবে আমি এতই উত্তেজিত ছিলাম যে, গাড়ি দুটোর নিরাপতার কথা আমার মনেই ছিল না।

-- তারপর কী হল?

-- আমি ঘরে ফিরে এসে দেখলাম ও নিথর হয়ে ঘুমাচ্ছে। আমি নিঃশব্দে শাড়ি পালটে নাইট- গাউন পরে নিলাম। রিভলভারটা অন্ধকারে লুকিয়ে ফেললাম। ভীষণ নার্ভাস লাগছিল। কমলেশ বেঁচে আছে কি না আমি জানতাম না ; আমি স্বপ্নেও ভাবিনি যে, সে ওই সামান্য আঘাতে মারা যাবে! তবু আমি খুবই উত্তেজিত ছিলাম।তাই স্ট্রং ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়ি। ঘুম ভাঙল বেলা আটটায়, আপনি টেলিফোন করায়।

-- তুমি যা বললে তা আদ্যন্ত সত্য? কোনো কিছু গোপন করনি?

-- না! কিন্ত ফিরে এসে আমি গ্যারেজের দরজাটা যে বন্ধ না করেই শুতে গেছি, একথা আপনি কী করে জানলেন?

-- তোমার স্বামী বলেছে। সে আক্ষরিক-অর্থে সাত-সকালে আমার বাড়িতে এসেছিল।

-- কেন? আচ্ছা এ-কথা কি সত্যি যে, পুলিসে সে নিজে থেকে গেছিল?

-- হ্যাঁ, সত্যি! ও নিজের ধারণা অনুযায়ী স্থির করেছিল যে যা জানে তা পুলিসকে জানানো কর্তব্য!

-- সেজন্য আপনি ওকে দোষ দিতে পারেন না। সেটাই ওর শিক্ষা! ইন ফ্যাক্ট, সেটাই ওর মানসিক অসুখ! আচ্ছা, ও কি আর কারও কথা আপনাকে বলেছে?

-- বলেছে। ওর ধারণা খুন করেছে অন্য একজন, যাকে তুমি বাঁচাতে চাইছ--

-- সে কে?

-- ডক্টর প্রতুল ব্যানার্জি।

ছন্দা একটু চমকে উঠল। আমতা আমতা করে বললে, ও তার সম্বন্ধে কী জানে?

-- তা আমি কেমন করে জানব তুমি বরং আমাকে বল, কাল রাত্রে ডক্টর ব্যানার্জি কি তারাতলায় ছিলেন -- ওই গভীর রাত্রে!

-- গুড হেভেন্স! নিশ্চয় নয়!

-- তুমি নিঃসন্দেহ?

-- নিশ্চয়ই।

মেট্রন দূর থেকে বলে ওঠে, এক্সকিউজ মি, স্যার। সময় শেষ হয়ে গেছে।

বাসু বলেন, অল রাইট, আর এক মিনিট!

ছন্দার দিকে ফিরে বলেন, কাল রাত্রে তুমি হাতে গ্লাভস্ পরে যাওনি নিশ্চয়?

-- আজ্ঞে না। হাতে পরার গ্লাভস্ আমার কাছে আদৌ নেই। হাসপাতালে ও. টি. তে-গেলে পরি। নার্সিং-হোমের গ্লাভস্। একথা কেন?

বাসু বলেন, সংক্ষেপে এবার বল, তুমি কী এমন অপরাধ করেছিলে যেজন্য তোমার জেল হতে পারত...নাউ লুক হিয়ার...আমি তোমার অ্যাটর্নি! আমাকে বললে তা প্রিভিলেজড কম্যুনিকেশন! তাতে তোমার কোনো ক্ষতি হতে পারে না। কিন্তু আমার জানা দরকার, কমলেশ তোমাকে কী নিয়ে ভয় দেখাচ্ছিল?

ছন্দা দৃঢ়স্বরে মাথা নেড়ে বললে, সরি স্যার! বিশেষ কারণে সে-কথা আপনাকে আমি জানাতে পারি না।

তুমি কি বলতে চাও যে, সে গোপন কথাটা! তোমার একার নয়?

-- আপনার সঙ্গে কথা চালানোই বিপদ।...ওই দেখুন মেট্রন এগিয়ে আসছে। আমার যা বলার ছিল, বলেছি।

-- অলরাইট! এবার শেষ কথাটা বলি। আমার অনুপস্থিতিতে পুলিসের কাছে কোনও জবানবন্দি দেবে না। মনে থাকবে?

-- থাকবে!

দশ

পুরো দু-দুটি দিন বাসু-সাহেব ঘর ছেড়ে বার হলেন না। ক্রমাগত পাইপ টেনে গেলেন। মূল হেতু: ওঁর মক্কেল জামিন পায়নি। ওঁর মতে জামিন দেওয়া-না-দেওয়ার দায়িত্ব আইন যাঁর স্কন্ধে ন্যস্ত করেছিল তিনি অভিযুক্তের প্রতি অহেতুক নিষ্করুণ হয়েছেন। ছন্দা কিছু মস্তান পার্টির গুণ্ডা নয়, পেশাদার সমাজবিরোধী নয়, এমনকি ব্ল্যাকমানির ধনকুবের নয় যে, জামিন পেলে সে পুলিস-কেসকে প্রভাবিত করতে পারে। নিহত ব্যক্তি স্বীকৃত সমাজবিরোধী, তার হিপ্-পকেটে রিভলভার ছিল! ছন্দারও যে তা ছিল, তা কেউ এখনো জানে না। ফলে আপাতদৃষ্টিতে এটা কিছুতেই ধরে নেওয়া যায় না যে, ওই বয়সের একটি মেয়ে রাত একটার সময় অতখানি ড্রাইভ করে একা কারও বাড়িতে হানা দেবে –খুন করার পূর্ব-পরিকল্পনা নিয়ে। খুনের অস্ত্রটাও তো সে সঙ্গে করে নিয়ে যায়নি। বেশ বোঝা যায় ঘটনার দ্রুত আবর্তনে সে হঠাৎ পাইপটা হাতে তুলে নিয়েছিল -- নিঃসন্দেহে আত্মরক্ষার্থে! ফলে পুলিশের যা বক্তব্য -- এটা “হত্যা” বা “মার্ডার”, তা ধোপে টেঁকে না। বড়ো জোর বলা যায়, আত্মরক্ষার্থে অনিচ্ছাকৃত দুর্ঘটনা: ‘কাল্পেবল হোমিসাইড’। তাহলে জামিন কেন দিলেন না বিচারক?

তার একাধিক হেতু হতে পারে!

প্রথম কথা: বিচারক বিশ্বাস করেছেন আসামির স্বামীর জবানবন্দি। হয়তো তাঁর মনে পড়ে গিয়েছিল নিজের বিবাহের প্রথম সপ্তাহের কথা! একটি সদ্যোবিবাহিতা বিয়ের কনে -- যার অষ্টমঙ্গলা পার হয়নি -- সে তার বরকে কড়া ঘুমের ওষুধ খাইয়ে মধ্যরাত্রে অভিসারে -- অভিসার নাই হোক -- মধ্যরাত্রে ‘গৃহত্যাগ’ করবে এটাই যে অচিন্ত্যনীয়। দ্বিতীয় কথা: এটাও বিচারক বিশ্বাস করেছেন -- স্বেচ্ছায়, অনিচ্ছায় বা আত্মরক্ষার্থে যাই হোক, মেয়েটির আঘাতে কমলেশ ভূতলশায়ী হয়। এক্ষেত্রে অজ্ঞান অবস্থায় তাকে ফেলে পালিয়ে আসাটাও সমর্থনযোগ্য নয়। ছন্দা ওই ঘরেরই টেলিফোন ব্যবহার করে থানায়, হাসপাতালে বা কোনও আ্যাম্বুলেন্স য়ুনিটে ফোন করে জানাতে পারত যে, ওই ঠিকানায় একজন অচৈতন্য মানুষ মাটিতে পড়ে আছে। তারপর আ্যাম্বুলেন্স এসে পড়ার আগে যদি সে পালিয়েও যেত তাহলে হয়তো তাকে ক্ষমা করা যেত!

অন্তত জামিন দেওয়া।

অথবা হয়তো এসব কোনো হেতুই বিচারককে বিচলিত করেনি। ইদানিং সচরাচর যা হয়ে থাকে -- তাই ঘটেছে। অর্থাৎ অত্যন্ত প্রভাবশালী কোনো ব্যক্তি -- রাজনৈতিক ক্ষমতাদর্পে হোক অথবা অর্থকৌলীন্যের কল্যাণেই হোক -- নেপথ্য থেকে কলকাঠি নেড়েছেন। সংবাদপত্রে বাসুসাহেব দেখেছেন, ইন্ডিয়ান চেম্বার অফ কমার্সের কলকাতা শাখা-অফিসে কী একটি সেমিনারে নাসিকের ধনকুবের ব্যবসায়ী ত্রিবিক্রমনারায়ণ রাও এ সপ্তাহে একটি বক্তৃতা দিয়েছেন। সংক্ষেপে, আসামির পূজ্যপাদ শ্বশুর-মহাশয় এখন কলকাতায় বর্তমান।

ইতিমধো ‘সুকৌশল’ গোয়েন্দা সংস্থা -- অর্থাৎ সুজাতা আর কৌশিক -- যে সব তথ্য সরবরাহ করে চলেছে তাতে সমস্যার সমাধান তো “দূর অস্ত” সেটা ক্রমশই জটিলতর হয়ে উঠছে।

এক নম্বর তথ্য: মৃত কমলেশের ঘরে পুলিস কোনো লেটেস্ট ফিঙ্গারপ্রিন্ট আবিষ্কার করতে পারেনি। সদ্য-লাগানো চকচকে ডোর-হ্যান্ডেলে নয়, টেলিফোনে নয়, গ্লাসটপ টেবিলে নয়। কেন? কোথাও কোনো আঙুলের ছাপ কেন নেই? যদি ধরে নেওয়া যায় যে, আততায়ী হাতে গ্লাভস্ পরে এসেছিল তাহলে তার আঙুলের ছাপ পাওয়া যাবে না। সেটাই প্রত্যাশিত কিন্তু গৃহস্বামীর আঙুলের ছাপ পাওয়া গেলনা কেন? বাসু-সাহেব নিজেও তো ঘটনার দিন ওই বাড়ির হ্যান্ডেলে হাত দিয়েছিলেন, তাঁর আঙুলের ছাপই বা মুছে গেল কী করে? সম্ভাব্য উত্তর একটাই: অপরাধটা যে করেছে সে গৃহত্যাগের আগে প্রতিটি আঙুলের ছাপ রুমাল দিয়ে মুছে দিয়ে গেছে। অর্থাৎ আতঙ্কতাড়িতা পলায়নপরা কোনো যুবতী নয়, প্রফেশনাল খুনির স্থিরমস্তিষ্কের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। পুলিস এ তথ্যটা মেনে নিয়েছে, কিন্তু কিছু সংশোধিত আকারে: ফিঙ্গারপ্রিন্ট মোছা হয়েছে রুমাল দিয়ে নয়, আঁচল দিয়ে।

দ্বিতীয় কথা: বটুক এবং তার স্ত্রী দু’জনেই শুনেছে ওই ঘরে যখন ঝগড়া মারামারি হচ্ছিল -- ঝনঝন্ করে কাচের বাসনপত্র ভাঙছিল -- তখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেউ একজন কলবেল বাজাচ্ছিল। বাসু-সাহেবের সিদ্ধান্ত: সেই লোকটা ওই ঘরে আদৌ আসেনি। ফলে সে খুনি হতেই পারে না। কারণ কমলেশ যখন ভূতলশালী হয় তারপরও সে ডোরবেল বাজিয়ে চলেছিল। পুলিস বোধকরি তা মানে না। পুলিস মানতে রাজি নয় যে, ছন্দা একা এসেছিল। অত গভীর রাত্রে ওই বয়সের একটি মেয়ে কলকাতার রাস্তায় একা ড্রাইভ করে না -- বিশেষ তারাতলার নির্জন ফ্যাক্টরি-অঞ্চলে। সেই তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতিটাই দুর্ঘটনাকে -- পুলিসের মতে – ‘ডেলিবারেট মার্ডার’-এর দিকে ঠেলে দিচ্ছে!

আরও একটা ব্যাপার ঘটেছে। ঘটনার পরদিন থেকে ত্রিদিব নিরুদ্দেশ! বস্তুত থানায় এজাহার দেয়ার পর সে আর তার আলিপুরের বাড়িতে ফিরে যায়নি, কোথায় গেছে? কেউ জানে না। পুলিস বাদে। না হলে টি.ভি.তে নিরুদ্দেশ-তালিকায় ধনকুবেরের একমাত্র পুত্রের ছবি দেখা যেত। পুলিসের ব্যবস্থাপনায় সে লোকচক্ষুর অন্তরালে কোনও পাঁচতারা হোটেলে তোফা আরামে আছে। ব্যবস্থাপনা পুলিসের, কিন্ত খরচ সম্ভবত তার পিতৃদেবের।

কিন্তু কেন? ত্রিদিবকে লুকিয়ে ফেলার কী কারণ -- জানতে চাইলেন রানু।

ওরা তিনজনে বসেছিলেন লিভিং-রুমে। কৌশিক আজ তিনদিন বেপাত্তা -- কোথায়-কোথায় ঘুরছে কমলেশের পূর্বজীবনের ইতিহাস সংগ্রহ মানসে। বাসু জবাবে বললেন, বুঝলে না? যাতে কারও প্রভাবে পড়ে ত্রিদিবনারায়ণ তার জবানবন্দি প্রত্যাহার করে না নেয়। যাতে কেউ তাকে কোনো প্রশ্ন না করতে পারে। বিশেষ করে খবরের কাগজের লোক।

সুজাতা জানতে চায়, আচ্ছা মামু, একটা জিনিস আমাকে বুঝিয়ে বলুন তো। আমি শুনেছি, ভারতীয় আইনে স্বামী তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অথবা স্ত্রী তার স্বামীর বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ্য দিতে পারে না -- মানে ক্রিমিনাল কেস-এ! এটা সত্যি?

-- হ্যাঁ সত্যি। তবে ‘স্পাউস’ অনুমতি দিলে, পারে।

-- তাহলে এক্ষেত্রে ছন্দা যদি অনুমতি না দেয় তাহলে ত্রিদিব তো সাক্ষ্য দিতে পারবে না? ছন্দা যে তার স্বামীর চকলেটে ঘুমের ওষুধ মিশিয়েছিল, সে যে রাত সাড়ে বারোটায় গাড়ি নিয়ে আলিপুর থেকে রওনা হয়েছিল এসব তো ত্রিদিবের স্টেটমেন্টের উপর প্রতিষ্ঠিত?

বাসু বললেন, জবাবে তিনটে কথা বলব। প্রথম কথা: ছন্দা যে মুহূর্তে বলবে যে, স্ত্রী হিসাবে যে দাবি করছে ত্রিদিব যা দেখেছে, যা জানে তা আদালতে বলতে পারবে না, সেই মুহূর্তেই বিচারক ধরে নেবেন যে, তাহলে মেয়েটি ধোওয়া তুলসীপত্র নয়। অর্থাৎ তার স্বামী প্রথম এজাহারে যা বলেছিল -- যা আদালতে পেশ করা গেল না -- যার ক্রস-এগজামিন হল না -- তার ভিতর অনেকটাই সত্য আছে। দ্বিতীয় কথা: পুলিস অসংখ্য সাক্ষী খাড়া করবে -- যারা ত্রিদিবের না-বলা কথাটা প্রতিষ্ঠিত করবে। কেউ বলবে যে, রাত বারোটা পঁয়ত্রিশে সে ছন্দাকে ড্রাইভ করে তার আলিপুরের বাড়ি থেকে বার হতে দেখেছে। ত্রিদিবের কোনো বন্ধু হয়তো বলবে, ত্রিদিবনারায়ণ তাকে বলেছিল যে, ত্রিদিবের স্ত্রী তার স্বামীকে ওভারডোজের ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ‘হত্যা’ করতে চেয়েছিল, তাই বাড়ি ছেড়ে হোটেলে আশ্রয় নিয়েছে।

সুজাতা বাধা দিয়ে বললে, কিন্ত আসামির অনুপস্থিতিতে ত্রিদিব আর তার বন্ধুর কথোপথন “হেয়ার-সে” হয়ে যাবে না?

-- যাবে। আমি ‘অবজেকশান’ দেব। বিচারক হয়তো তা “সাসটেইন”ও করবেন ; কিন্তু সেই বিধিবহির্ভূত এভিডেন্স বিচারককে বিচলিত করবে। আর সবচেয়ে বড়ো কথা: পুলিস এমন ব্যবস্থা করবে যাতে ছন্দার ওই সাংবিধানিক অধিকারটা কার্যকর করা না যায়। অর্থাৎ ছন্দাকে এমন প্যাঁচে ফেলা হবে যাতে সে ত্রিদিবের সাক্ষ্যদানে আদৌ আপত্তি করতে পারবে না।

-- সেটা কীভাবে হতে পারে? -- জানতে চান রানু।

-- মামলাটা আদালতে ওঠার আগেই ওরা একটা পৃথক ‘আ্যাকশন’ নেবে! আদালতে আবেদন করবে, যাতে ছন্দা এবং ত্রিদিবনারায়ণের রেজিস্ট্রি বিবাহটা ‘বাতিল’ বলে ঘোষিত হয়।

-- ডিভোর্স পিটিশান?

-- না গো। ডিভোর্স আদৌ নয়। আদালত ওদের বিবাহ-বিচ্ছেদ অনুমোদন করলেও ত্রিদিবনারায়ণ তার ভূতপূর্বা-স্ত্রীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে পারবে না -- কারণ ঘটনা ঘটেছিল সেই 22.6.91 তারিখে ওরা ছিল বৈধ স্বামী-স্ত্রী! আমি বলছি, ওপক্ষ চেষ্টা করবে ওদের বিবাহটা সমূলে অবৈধ প্রমাণ করতে। অর্থাৎ প্রমাণ করা: ওরা দুজনে -- ওই ত্রিদিব আর ছন্দা কোনোদিনই স্বামী স্ত্রী ছিল না। এক বিছানায় শুয়েছে এই পর্যন্ত! সে-ক্ষেত্রে ত্রিদিব সাক্ষ্য দিতে পারবে।

সুজাতা প্রতিবাদ করে, কিন্তু তা ওরা কীভাবে করবে? ত্রিদিব আর ছন্দা রীতিমত রেজিস্ট্রি বিবাহ করেছে। সে বিয়ে নাকচ করা অতই সহজ।

-- হ্যাঁ সহজ!

-- একথা কেন বলছেন?

-- দ্য স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট নম্বর ফর্টি থ্রি অব নাইনটিন-ফিফটি ফোর-এর আন্ডার সেকশন ফোর-এ বলা হয়েছে: রেজিস্ট্রি-বিবাহ তখনই সিদ্ধ যখন ‘নাইদার পার্টি হ্যাজ এ স্পাউস্ লিভিং’! অর্থাৎ রেজিস্ট্রি বিবাহকালে যদি মেয়েটির কোনো পূর্বতন স্বামী অথবা ছেলেটির পূর্বতন স্ত্রী জীবিত থাকে, তাহলে সেই রেজিস্ট্রি-বিবাহ ভ্রমক্রমে লিপিবদ্ধ হলেও তা শুরু থেকেই অবৈধ। ওরা সহজেই প্রমাণ করবে যে, 15.6.91 যখন ছন্দা বিশ্বাস ত্রিদিবনারায়ণকে রেজিস্ট্রিতে বিবাহ করে তখন ছন্দার পূর্বতন স্বামী কমলেশ বিশ্বাস জীবিত ছিল! ফলে শুরু থেকে ছন্দ ত্রিদিবের বিবাহ ‘নাল আ্যান্ড ভয়েড’! এককথায়, ‘অসিদ্ধ’!

এই সময়েই ডোরবেল বেজে ওঠে। বিশু গিয়ে সদর দরজা খুলে দিল। এল কৌশিক। হাতে সুটকেস, চেহারা ভগ্নদূতের।

বাসু বলেন, কী ব্যাপার? কাউকে কিছু না বলে কোথায় চলে গেছিলে?

কৌশিক একটা চেয়ার টেনে বসে। বলে, তা কেন? সুজাতাকে তো বলে গেছি, দুর্গাপুর যাচ্ছি। আমি তো শক্তাবৎ রাজপুত নই যে, ধর্মপত্নীকে না জানিয়ে পালিয়ে যাব?

-- তা সেখানে কেন? কিছু খবর পেলে?

-- পেয়েছি, মামু। মারাত্মক খবর। অবিশ্বাস্য!

-- ফায়ার!

-- ছন্দা দেবীর প্রথম পক্ষের স্বামী কমলেশ বিশ্বাস ওরফে কমলাক্ষ, ওরফে কমলেন্দু গত শনিবার রাত্রে তারাতলায় আদৌ খুন হয়নি!

রানু আঁতকে ওঠেন: মানে?

বাসু বলেন, মানে, কৌশিক বোধহয় বলতে চাইছে “কমলেশ মরিয়াও প্রমাণ করিতে পারিল না যে, সে জীবিত ছিল”। তাই কি?

-- আজ্ঞে না। শনিবার যে মারা গেছে সে কমলেশের যমজ ভাই হতে পারে, কমলেশের ছদ্মবেশী হতে পারে, ছন্দা-কমলেশের যৌথ ধাপ্পাবাজি হাতে পারে...

সুজাতা বলে, যৌথ ধাপ্পাবাজি মানে?

-- ওই খুন হয়ে যাওয়া লোকটা যে কমলেশ বিশ্বাস তা আমরা কী করে মেনে নিয়েছি? একমাত্র ছন্দার স্টেটমেন্ট অনুযায়ী নয় কি?

বাসু প্রতিবাদে বলেন, না! কাগজে লিখেছে পুলিস তাকে সনাক্ত করেছে বিবাহ-বিশারদ সমাজবিরোধী ‘কমল’ নামে। কমলেশ, কমলাক্ষ, কমলেন্দু নানান নামে সে কুমারী মেয়েদের ফাঁসিয়ে বিয়ে করত। একথা কাগজে যখন ছাপা হয় তখনো ছন্দা গ্রেপ্তার হয়নি। ফলে তোমার সংগৃহীত তথ্যটা দাঁড়াচ্ছে না। নাকচ হয়ে যাচ্ছে!

কৌশিক রুখে ওঠে, অল রাইট, মামু! এবার আমি যে তথ্য সংগ্রহ করে এনেছি সেটাকে নাকচ করুন।

-- বলো।

সুকৌশলীর উপর নির্দেশ ছিল ‘কমল’ নামধারী বিবাহ-বিশারদের আদ্যোপান্ত ইতিহাসটা সংগ্রহ করা। কৌশিক ধাপে ধাপে তাই করছিল। ছন্দা তার এজাহারে বলেছিল, কমলেশের সঙ্গে গৃহত্যাগ করে ওরা প্রথমে কালীঘাটে গিয়ে বিয়ে করে, কিন্তু বেলেঘাটায় ঘর নেওয়ার পর দ্বিতীয়বার রেজিস্ট্রি মতে বিয়ে করে। তারিখটা ছন্দাই জানিয়েছিল: সাতই ডিসেম্বর 1983। কৌশিক তাই বেলেঘাটা অঞ্চলে একের পর একটি করে বিবাহ-রেজিস্ট্রশন অফিসে খোঁজ নিতে থাকে। পঞ্চম কি ষষ্ঠ প্রচেষ্টা সাফল্যমণ্ডিত হয়। রেজিস্ট্রারের অনুমতি নিয়ে যথাযথ ফি জমা দিয়ে একটা জেরক্স কপি সংগ্রহ করে। তাতে কমলের পিতার নাম এবং জন্মতারিখ পাওয়া যায় -- সত্য হোক, মিথ্যা হোক --তা কমলেশের স্বীকৃতি মোতাবেক। ওই বিবাহ-চুক্তিপত্রে দুজন সাক্ষীর নাম-ঠিকানা ছিল। একজন বাঙালি, বিমল কর, একজন অবাঙালি। বাঙালি সাক্ষীর ঠিকানায় গিয়ে শোনা যায় সে এখন ওখানে থাকে না। কোথায় থাকে তা কেউ জানে না। অবাঙালি সাক্ষীর ঠিকানা ছিল দুর্গাপুরের ‘জি-টাইপ’ কোয়ার্টার্সের। কৌশিক খুঁজে খুঁজে লোকটির দেখা পায়। তার বাড়িতেই।

মহেশপ্রসাদ তিওয়ারি দুর্গাপুরের একজন নামকরা লেবার লিডার। সে কিন্তু কিছুতেই স্মরণ করতে পারল না কোনো ছন্দা বা কমলেশ বিশ্বাসকে। কৌশিক তখন বিবাহের চুক্তিপত্রের জেরক্স কপিটা দেখায়। মহেশপ্রসাদ স্বীকার করে, জি হ্যাঁ! সিগ্নেচর তো হমারই আছে! লেকিন হমার তো কুছু য়াদ হচ্ছে না।

কৌশিক জানতে চায়, বিমল করকেও কি আপনি চিনতেন...

-- নেহী নেহী। বিমলবাবু সিটু য়ুনিয়নে ছিলেন। তাকে পহছান্তে পারছি। লেকিন তিনি তো গুজর গিয়েসেন!

কৌশিক পুনরায় জানতে চায়, আপনাদের দু জনের মধ্যে একজন, আই মিন, ওই বিয়ের দু-জন সাক্ষীর মধ্যে একজন কোনো ইন্সিওরেন্স কোম্পানির এজেন্ট ছিলেন। কে? আপনি না বিমলবাবু?

-- হামি। কেঁও?

-- ছন্দা দেবী আমাকে বলেছেন যে, সেই এজেন্টের অনুরোধে ওঁরা স্বামী স্ত্রী একটি যৌথ ইন্সিওরেন্স করেন, দশ হাজার টাকার!

-- হাঁ -- আভি য়্যাদ হল। ঠহরিয়ে বাবু-সাব। আরাম কিজিয়ে। মায়নে ঢুঁড়কে দেখুঁ!

তেওয়ারিজী ইন্সিওরেন্স কোম্পানির এজেন্ট হিসাবে যাঁদের জীবনবীমা করিয়েছেন তাদের নাম-ধাম-ইন্সিওরেন্স নাম্বার ইত্যাদি একটি মোটা খেরো খাতায় পর পর লিখে রেখেছেন। বার্ষিক যা কমিশন পান তার হিসাব মিলানোর জন্যই শুধু নয়, ইনকাম ট্যাক্স অফিসারকে সন্তুষ্ট করার জন্য। সেই খেরো-খাতা দেখে তেওয়ারিজী জানালেন, হ্যাঁ ছন্দা আর ওর সদ্য পরিচিত অর্থাৎ বিমলের বন্ধু কমলেশ বিশ্বাস একটি যৌথ পলিসি করেছিল বটে, জেনারেল ইন্সিওরেন্স কোম্পানিতে। দশ হাজার টাকার। একুশে ডিসেম্বর, তিরাশি সালে। কিন্তু সে পলিসি এখন আর চালু নেই। তা থেকে তেওয়ারিজীর কোনো অর্থাগম বর্তমানে হয় না। তার কারণ 27.3.88 তারিখে কমলেশ বিশ্বাস মারা গেছেন এবং তাঁর স্ত্রী নমিনি হিসাবে দশ হাজার টাকা লাভ করেছেন।

কৌশিক যথারীতি আকাশ থেকে পড়ে। তবে সে কোনো বিস্ময় প্রকাশ করে না। ইন্সিওরেন্স কোম্পানির কলকাতা-অফিসের ঠিকানা আর পলিসি নাম্বারটা টুকে নিয়ে কলকাতায় ফিরে আসে। হাওড়া স্টেশন থেকে সে সরাসরি ওই ইন্সিওরেন্স কোম্পানির অফিসে যায়। এ-ঘর-ওঘর এ-সাহেব ও-সাহেব করতে করতে একসময়ে তথ্যটার হদিশ পায়। হ্যাঁ, বিমা কোম্পানি যথারীতি অনুসন্ধান চালিয়ে সন্তষ্ট হয়ে নমিনিকে টাকাটা মিটিয়ে দিয়েছে। কমলেশ বিশ্বাসের মৃত্যুর অবিসংবাদিত প্রমাণগুলিও ওই পলিসি-পেমেন্ট ফাইলে গাঁথা আছে। ‘সুকৌশলী’-র লিখিত আবেদন-মোতাবেক ইন্সিওর কোম্পানির এক বড়ো-সাহেব সেই প্রমাণের জেরক্স কপি ইস্যু করার অনুমতি দিলেন।

কৌশিক এবার তার বাসু-মামুর সামনে একে-একে দাখিল করল তার কাগজপত্র: কমলেশ বিশ্বাসের ডেথ সার্টিফিকেট, নার্সিং হোমের বিল-ভাউচার, ক্রিমেটোরিয়ামের বিল। সবই 27.3.1988 তারিখের। বললে, এবার বলুন মামু, কমলেশ বিশ্বাসের কয়বার মৃত্যু বিশ্বাসযোগ্য?

বাসু জবাব দিলেন না। সহধর্মিণীকে বললেন, সানি-সাইড নার্সিংহোমে একবার টেলিফোনে দেখ তো, ডাক্তার প্রতুল ব্যানার্জিকে পাওয়া যায় কি না?

টেলিফোন ধরল রিসেপশনিস্ট। গেল, ইয়েস! ডক্টর ব্যানার্জি আছেন ও.টি. তে। জানতে চাইল কে ফোন ফোন করছেন।

বসু বললেন, একটা মেসেজ কাইন্ডলি লিখে নেবেন?

-- আজ রাত নয়টার সময় আমি ডঃ ব্যানার্জির সঙ্গে দেখা করতে যাব। আমার নাম পি.কে. বাসু, আ্যাটর্নি।

মেয়েটি সবিনয়ে বললে, সরি, স্যার। রাত নয়টার সময় উনি নার্সিং হোমে থাকেন না। বাড়িতে থাকেন।

-- অল রাইট! বাড়িতেই যাব। সেটা তো ওই নার্সিং হোমের উপরতলায়, তাই নয়?

-- আজ্ঞে, হ্যাঁ। বাট সরি স্যার, সন্ধ্যায় ওঁর আর কোনো আ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে কি না তা তো আমি জানি না...

-- কে জানে?

-- ডঃ ব্যানার্জি হিমসেলফ্। কিন্তু তিনি এখন অপারেশন থিয়েটারে...

-- আই নো! তাহলে মেসেজটাতে আরও লিখে রাখুন -- অন্য কোনো সান্ধ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকলে ডঃ বানার্জি যেন তা ক্যানসেল করে আমার জন্য অপেক্ষা করেন -- অ্যাট নাইন পি এম শার্প!

মেয়েটির বোধকরি ধৈর্যচ্যুতি ঘটল, বলল, আয়াম সরি এগেন, স্যার! ডক্টর ব্যানার্জি – আমি যতদূর জানি -- কারও হুকুমে চলেন না।

বাসু বললেন, আপনি তো রিসেপশনিস্ট, দূত মাত্র: আপনি এত ঘনঘন “সরি” হচ্ছেন কেন? যে, মেসেজটা দিলাম সেটা ডক্টর ব্যানার্জির হাতে ধরিয়ে দেবেন। উনি অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে আসার পর এবং এক-কাপ স্টিমুলেন্ট পান করার পর। ফলো?

মেয়েটি জবাব দেবার আগেই টেলিফোনটা নামিয়ে রাখলেন।

এগারো

ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড টাইমে রাত আটটা আটান্ন মিনিটে বাসু সাহেব নার্সিংহোমের উপরতলায় ডক্টর ব্যানার্জির ডোর-বেলটা টিপে ধরলেন। পাঁচ-সেকেন্ডের ভিতর সেটা খুলে গেল। উজ্জ্বল গৃহাভ্যন্তরে একটি নার্স -- বছর ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বয়স হবে তার -- দরজা খুলে দ্বারপথে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলেন: ইয়েস?

-- ডক্টর পি. ব্যানার্জি আছেন?

-- আছেন। কে এসেছেন জানাব?

বাসু-সাহেব নিঃশব্দে মেয়েটির হাতে একটি ভিজিটিং কার্ড বাড়িয়ে ধরেন। দেখে নিয়ে মেয়েটি বললে, আই সি! আপনিই আজ সকালে টেলিফোন করেছিলেন, তাই নয়?

-- হ্যাঁ, আপনার সঙ্গেই কথা হয়েছিল বুঝি?

-- তাই হয়েছিল। আমিই সেই দূতী! তা আমি আপনার মেসেজটা ওঁকে পৌঁছে দিয়েছি: বাট, আয়াম সরি এগেন, উনি অন্য কাজে ব্যস্ত আছেন, আজ দেখা হবে না।

-- বাড়িতে আর কে আছেন? মিসেস ব্যানার্জি?

-- না, উনি ব্যাচিলার।

-- তাহলে আমার ওই কার্ডখানা ওঁকে দেখান। আর ওঁকে বলুন যে, আমি এসেছি ওঁর পয়েন্ট থ্রি টু বোর কোল্ট অটোমেটিকটার বিষয়ে আলোচনা করতে, যার নম্বর থ্রি-সেভেন-ফাইভ-নাইন-সিক্স-টু-ওয়ান...ফলো?

মেয়টি রীতিমতো ঘাবড়ে যায়। বিশেষ করে সাত-সাতটা সংখ্যায়।

বাসু-সাহেব বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে+ অতগুলো সংখ্যা তোমার পর পর মনে থাকবে না মা, তুমি শুধু বল ডাক্তারবাবুর রিভলভারটার বিষয়ে। আর বল, আমি এখানে ত্রিশ সেকেন্ড অপেক্ষা করব, তারপর দরজা খুলে ওঘরে যাব। ফলো?

নাসটি এবার নিঃশব্দে পিছন ফিরল। ভিতরের দিকের দরজাটা খুলে অন্দরমহলে ঢুকে গেল। দরজাটা সযত্নে বন্ধ করে দিয়ে। বাসু দাঁড়িয়েই রইলেন মণিবন্ধের ঘড়িটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে। ত্রিশ সেকেন্ড অতিক্রান্ত হতেই তিনি ভিতরের দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। সৌজন্যমূলক মৃদু করাঘাত করে দরজাটা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলেন। সেটি ডাক্তারবাবুর বেড-কাম-সিটিং রুম। সিঙ্গল-বেড বিছানাটা ঘরের ওপ্রান্তে। এখানে টেবিলে টেলিফোন, কাগজপত্র। ডাক্তারবাবু বসেছিলেন তাঁর চেয়ারে। নার্সটি পাশে দাঁড়িয়ে।

দু’জনেই মুখ তুলে এমন আতঙ্কতাড়িত দৃষ্টিতে আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে দেখলেন যেন ম্যাকবেথের ডিনার-পার্টিতে অনিমন্ত্রিত ব্যাঙ্কোর ভূত বেমক্কা ঢুকে পড়েছে! যেন এখনি ডক্টর ব্যানার্জি আর্তনাদ করে উঠবেন: “দাউ কানট্ সে দ্যাট আই ডিড ইট!”

বাসু তার পিছনে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে গম্ভীরভাবে বলেন, সময়ের দাম আপনার-আমার দু- জনেরই আছে। তাই সৌজন্যমূলক খেজুরে আলাপ বাদ দিয়ে সরাসরি প্রসঙ্গটার অবতারণা করতে চাই। তাছাড়া ভেবে দেখুন, ডক্টর বানার্জি -- আপনাকে ত্রিশ-সেকেন্ডের চেয়ে বেশি সময় দিলেই আপনি একগাদা আজগুবি অবাস্তব কৈফিয়ৎ ভেবে-ভেবে বার করতেন। তাতে আবার দুজনেরই সময় নষ্ট হত -- কারণ আমাকে প্রমাণ করতে হত কৈফিয়তগুলি অবাস্তব এবং আজগুবি, ধোপে টেঁকে না! শ্যাল আই স্টার্ট?

ডক্টর ব্যানার্জি চেয়ার চেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বলিষ্ঠ গঠন যুবাপুরুষ। যুবা ঠিক নয়, স্বাস্থ্যবান হলেও বোঝা যায়, মেঘে-মেঘে কিছুটা বেলা হয়েছে। কানের পাশে বড়ো বড়ো জুলপিতে সাদা-আখরে সেই বার্তার ঘোষণা।

বজ্রনির্ঘোষে ডক্টর ব্যানার্জি বললেন, হু ডু য়ু থিংক য়ু আর? আপনি কে মশাই? কী চান? এভাবে আমার বাড়িতে চড়াও হয়েছেন কেন? এই মুহূর্তে যদি আপনি আমার ঘর ছেড়ে চলে না যান, তাহলে আমি পুলিস ডাকতে বাধ্য হব। আমিও আপনাকে ত্রিশ সেকেন্ড সময় দিচ্ছি, অনধিকার প্রবেশের মামলা থেকে- বাঁচতে!

একটা হাত উনি বাড়িয়ে দিলেন টেলিফোনটার দিকে!

বাসু দু’পা ফাঁক করে রোডস্-দ্বীপের কলোসাস-মূর্তির মতো নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে রইলেন কয়েকটা মুহূর্ত -- তারপর বললেন, আপনি তিনটি প্রশ্ন করেছেন। ত্রিশ সেকেন্ড সময়ও দয়া করে দিয়েছেন। তা আমার জবাবটা কি ওই ভদ্রমহিলার উপস্থিতিতেই দেব?

-- ও আমার কনফিডেনশিয়াল নার্স! বলুন?

-- টেলিফোনে পুলিস-স্টেশনকে ধরতে পারলে থানাকে ওই সঙ্গে জানিয়ে দেবেন যে, ছন্দা বিশ্বাসের হাতব্যাগে ঘটনার রাত্রে একটা পয়েন্ট থ্রি-টু রিভলভার ছিল, যে-কথা পুলিস এখনো জানে না আর সে রিভলভারের কেরিয়ার লাইসেন্স ছন্দার ছিল না। এবং যার লাইসেন্সি...

ডক্টর ব্যানার্জি স্থিরদৃষ্টিতে ওর দিকে পাঁচ সেকেন্ড তাকিয়ে রইলেন। তারপর পাশ ফিরে নার্সটিকে বললেন, তুমি বাইরের ঘরে গিয়ে অপেক্ষা কর জবা। সি দ্যাট উই আর নট ডিস্টার্বড।

নার্সটি ভীত-চকিত দৃষ্টিপাত করে ধীরে ধীরে বাইরের ঘরে চলে গেল। তার সেই বিচিত্রদৃষ্টির মনস্তাত্বিক-বিশ্লেষণ করলে শতকরা কত ভাগ ঘৃণা, কত ভাগ নির্যাস বার হবে সেটা অনুমান করা কঠিন।

ডক্টর ব্যানার্জির প্রশ্ন: এবার বলুন আপনি কে?

-- ছন্দা বিশ্বাসের আ্যাটর্নি।

স্পষ্টতই একটা স্বস্তির নিশ্বাস পড়ল গৃহস্বামীর। বললেন, ছন্দা আপনাকে পাঠিয়েছে?

-- না।

-- ছন্দা এখন কোথায়?

-- আপনি জানেন না? হাজতে! খুনের অপরাধে।

-- না, জানতাম না। আমার ধারণা হয়েছিল সে জামিন পেয়েছে। যাই হোক, আপনি আমার কাছে কেন এসেছেন? ওই রিভলভারটা ছন্দা তো ব্যবহার করেনি।

-- রিভলভারটা গৌণ। আমি জানতে এসেছি অন্য একটা তথ্য! একটা ডেথ-সার্টিফিকেটের বৈধতার বিষয়ে...

ডাক্তার ব্যানার্জির মুখটা শাদা হয়ে গেল। ধীরে ধীরে চেয়ারে বসে পড়লেন তিনি। বললেন, বলুন! কার ডেথ-সার্টিফিকেট?

-- সাম মিস্টার কমলেশ বিশ্বাস! লোকটা আপনার নার্সিং হোমে মারা যায়। ম্যালিগন্যান্ট টাইপ লাং ক্যান্সারে। সাতাশে মার্চ, উনিশ-শ অষ্টআশি সালে...

ব্যানার্জি তার বিশুষ্ক অধরের উপর জিবটা বুলিয়ে নিয়ে কোনোক্রমে বললেন, অষ্টাশি সাল! সে তো তিন বছর আগেকার কথা! কী নাম বললেন? বিশ্বাস? কমলেশ বিশ্বাস? আপনি কাল আসুন...আমি রেজিস্ট্রি খাতা খুঁজে...

বাসু ঝুঁকে আসেন একটু: নাউ, লুক-হিয়ার, ডক্টর ব্যানর্জি। সওয়াল-জবাব করাই আমার পেশা! সাক্ষীকে পাঁকাল মাছ হতে দেওয়া আমার স্বভাববিরুদ্ধ। ছন্দা বিশ্বাসের সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ট বন্ধুত্বের কথা আমি জানি -- না হলে ওকে নিজের রিভলভারটা ওভাবে ধার দিতেন না। রেজিস্ট্রি খাতা দেখার দরকার নেই -- আমি মুখে মুখে বলে যাচ্ছি, শুনুন। বাইশে মার্চ আপনার নার্সিং-হোমে একটি মরণাপন্ন ক্যান্সার রোগী ভর্তি হয়। পাঁচদিন পরে সে মারা যায়। আপনি তার ডেথ-সার্টিফিকেট দেন। মনে পড়েছে?

ব্যানার্জি বলেন, দেখুন...কী বলব...খাতাপত্র কিছু না দেখে...

বাসু পকেট থেকে একখণ্ড কাগজ বার করে ওঁর টেবিলে মেলে ধরেন। বলেন, দেখুন! এটা আপনার স্বাক্ষর? এই ডেথ-সার্টিফিকেটে? এবার আমাকে বুঝিয়ে বলুন কীভাবে আপনার হসপিটাল-রেজিস্টারে এই রোগীর যাবতীয় তথ্য ছন্দার নিরুদ্দিষ্ট স্বামীর সঙ্গে হুবহু মিলে গেল? নাম, বয়স, বাবার নাম, পার্মানেন্ট আড্রেস এটসেটরা, এটসেটরা...

পুনরায় ডক্টর ব্যানার্জি স্তব্ধ হয়ে গেলেন। মিনিটখানেক কী ভেবে নিয়ে বললেন, আপনাকে একটা কথা বলব, বিশ্বাস করবেন?

-- কী কথা?

-- ছন্দাকে আমি ভালোবাসি...

-- এ আর কী নতুন কথা? আমিও তাকে ভীষণ ভালোবাসি। বিশ্বাস না হয় তার সঙ্গে দেখা হলে জিজ্ঞেস করে জেনে নেবেন। সে আমাকে মাত্র একশ টাকার রিটেইনার দিয়েছে, আর আমি ইতিমধ্যে তার পিছনে কয়েক হাজার টাকা খরচ করে বসে আছি।

-- আমি সে অর্থে ভালোবাসার কথা বলিনি। আমি কেন একাজ করেছি তা আপনি বুঝবেন না। কারণ বুঝলে, এভাবে আমাকে ব্যঙ্গ করতেন না। আমি সত্যিই তাকে আমার প্রাণের চেয়ে ভালোবাসি।

-- কিন্তু ফলস্ ডেথ-সার্টিফিকেটটা সই করলেন কেন?

-- না হলে ছন্দা কিছুতেই প্রমাণ করতে পারত না যে, বাস-অ্যাকসিডেন্টে তার স্বামী মারা গেছে। ইন্সিওরেন্সের সেই ন্যায্য টাকাটা সে কোনদিন আদায় করতে পারত না। ও নিজেকে মনে করত বিধবা ; কিন্তু আইনের চোখে সেটা প্রমাণ করা যাচ্ছিল না। এই সময় আমার মাথায় একটা আইডিয়া আসে। এক ভদ্রলোক তাঁর মেসের এক রুমমেটকে আমার নার্সিং-হোমে ভর্তি করাতে চাইলেন। লোকটার তিনকুলে কেউ নেই! কলকাতার এসে থেকে কী একটা কোম্পানীতে ভেন্ডারের কাজ করত। নার্সিং-হোমে ভর্তি হবার মতো সঙ্গতি তার নেই। কোনো হাসপাতালেও ফ্রি-বেড পাচ্ছিল না। কারণ সব হাসপাতালই বলেছে কেসটা অ্যাকিউট ক্যান্সারের। চিকিৎসার বাইরে। অথচ মেস-ম্যানেজার ওই মরণাপন্ন রোগীকে মেসেও রাখতে রাজি নয়। আমি ওর রুমমেটকে বললাম, আমি রুগিকে একটা ফ্রি-বেড দিতে পারি যদি সে আমার নির্দেশ মতো নাম ধাম লেখায়। রোগীর তখন বাকশক্তি লুপ্ত হয়েছে। তার রুমমেট নিকট আত্মীয়ের মিথ্যা পরিচয়ে রোগীর নাম-ধাম, বয়স ইত্যাদি খাতায় লিখিয়ে দিয়ে যায়। বিশ্বাস করুন মিস্টার বাসু, চিকিৎসার কোনো ত্রুটি আমরা কেউ করিনি। কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যেই রোগীটি মারা গেল। আমি ডেথ-সার্টিফিকেট লিখে দিলাম। হিন্দু সৎকার-সমিতির গাড়ি আনিয়ে দিলাম। ওর রুমমেট রুগিটিকে ভর্তি করিয়ে দিয়ে সেই যে কেটে পড়ল আর এ দিকে ভেড়েনি। হয়তো তার ভয় ছিল মিথ্যা নাম-ধাম লেখানোর জন্য। যাই হোক, আমি, আমার দুই স্ট্রেচার-বেয়ারা, আর ছন্দা সৎকার সমিতির গাড়িতে করে হতভাগ্যকে ক্যাওড়াতলা ক্রিমেটোরিয়ামে পুড়িয়ে দিয়ে এলাম। বিশ্বাস করুন মিস্টার বাসু, শ্মশানে ছন্দা হাউ-হাউ করে কাঁদছিল। আমাকে বললে, মনে হচ্ছে আমি দ্বিতীয়বার বিধবা হলাম।

-- তারপর ছন্দা দশ হাজার টাকা আদায় করল?

-- তা করল। আমার ওই ডেথ-সার্টিফিকেটের বলে!

-- আপনি কতদিন ধরে ওকে চেনেন?

-- ও পাস করার পর থেকে- প্রায় ছয় বছর। এখানে কাজ করতে আসে যখন, তখন ওর সিঁথিতে সিঁদুর ছিল। এখানে কাজ করতে করতেই খবর পায় বাস-দুর্ঘটনায় ওর নিরুদ্দিষ্ট স্বামী মারা গেছে। তারপর এখানেই কাজ করতে থাকে নার্স হিসাবে।

-- ও বিধবা হবার পর আপনি কি ওকে বিবাহ করতে চেয়েছিলেন?

ডাক্তার ব্যানার্জির মুখচোখ লাল হয়ে ওঠে। মুখ তুলে বলেন, এসব প্রশ্নের কি কোনো প্রয়োজন আছে?

-- আছে। বলুন?

-- হ্যাঁ, চেয়েছিলাম। সে রাজি হয়নি।

-- কেন সে আপনাকে ভালোবাসতে পারল না, তা আন্দাজ করতে পারেন?

-- কে বললে সে আমাকে ভালোবাসতে পারেনি? আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল সম্পূর্ণ অন্য কারণে। ও স্থির করেছিল আবার বিয়ে করবে না। পুরুষমানুষকে আর সে বিশ্বাস করতে রাজি ছিল না -- অন্তত স্বামী হিসেবে নয়!

-- তারপর হঠাৎ একদিন সে ধনকুবেরের একমাত্র পুত্রটিকে রাতারাতি বিয়ে করে বসল!

-- আদালত আর অপরাধ জগতের বাইরে আপনি যে কিছুই বোঝেন না, সে-কথা আপনার এই মন্তব্যে বোঝা যায়!

-- কোনটা ভুল বলেছি? ত্রিদিবনারায়ণ ধনকুবেরের একমাত্র সন্তান নয়? নাকি মাত্র এক সপ্তাহের কোর্টশিপে ওদের বিয়েটা হয়নি।

-- কথাটা তা নয়। প্রতিটি নারীর আদিম প্রেরণা: মাতৃত্ব! এটা জীববিজ্ঞানসম্মত, বিবর্তনবাদ সম্মত। তার যে মোহিনীরূপ, পুরুষকে ভালোবাসা, পুরুষকে কাছে পেতে চাওয়া, তারও মূল প্রেরণা ওই ‘সারভাইভাল অব দ্য স্পেসিস্’। কমলেশের বিশ্বাসঘাতকতায় ওর মনের একটা দিক থেঁতলে গেছিল। কিন্তু তার মাতৃত্বকামনাটাকে কমলেশ মাড়িয়ে যেতে পারেনি। ত্রিদিবের মধ্যে ছন্দা সেই অনুভূতিটা চরিতার্থ করতে চেয়েছিল। ত্রিদিব ওকে আঁকড়ে ধরেছিল। ভেবেছিল সে নিজে ছন্দার প্রেমে পড়েছে -- আসলে সে শুধু বাঁচতে চেয়েছিল। যেন ডুবন্ত মানুষের কাছে ছন্দা একটা ভেসে যাওয়া কাঠ! আর ছন্দা চেয়েছিল তার অপূর্ণ মাতৃত্ব কামনাকে চরিতার্থ করতে! আমি মনস্তত্ব নিয়ে পড়াশুনা করেছি। তাই বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্ত ছন্দাকে বুঝিয়ে দিতে পারিনি। সে মনে করেছিল, আমি ত্রিদিবকে ঈর্ষা করছি অহেতুক।

-- তারপর কি আপনার সঙ্গে ছন্দার মনান্তর হয়?

-- মোটেই নয়। আমরা দু-জনে দুজনের বন্ধু। ছন্দার রেজিস্ট্রি বিয়েতে আমিই একমাত্র কনের তরফের বন্ধু হিসাবে উপস্থিত ছিলাম।

-- তারপর হঠাৎ কমলেশের আবির্ভাব ঘটল?

-- হ্যাঁ। হঠাৎ আকাশ ফুঁড়ে সে এসে উপস্থিত। বোধকরি ইনশিওর কোম্পানিতে খোঁজ নিয়ে সে জানতে পেরেছিল ছন্দা কীভাবে টাকাটা আদায় করেছে।

-- আপনাকে ব্ল্যাক-মেইল করার চেষ্টা করেনি?

-- না! ডেথ-সার্টিফিকেট কে দিয়েছে, তা ও জানতে পারেনি। ও আমাকে চিনত না। ও শুধু ছন্দার টাকা চেয়েছিল।

-- কত টাকা?

-- তৎক্ষণাৎ দু-হাজার আর এক মাসের মধ্যে দশ হাজার।

-- ছন্দার কাছে অত টাকা ছিল না?

-- না, ছিল না। আমি ধার দিতে চেয়েছিলাম। সে রাজি হয়নি। বলেছিল, এভাবে ব্ল্যাকমেলারকে রোখা যায় না। কমলেশ ওকে চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিয়েছিল।

-- সেজন্যই ওকে রিভলভারটা দিয়েছিলেন?

-- ঠিক সেজনাই নয়। ও যাতে আত্মরক্ষার্থে ব্যবহার করতে পারে তাই ওটা ছন্দাকে রাখতে দিয়েছিলাম।

-- আপনি তাহলে জানতেন যে, শনিবার রাত একটার সময় ছন্দা ওই কমলেশের সঙ্গে দেখা করতে যাবে? তারাতলায়?

-- হ্যাঁ, জানতাম। ছন্দা আমাকে বলেছিল।

-- সেই জন্যেই আপনি রাতে তারাতলায় যান? .

-- আমি? তারাতলায়? শনিবার রাতে? নিশ্চয় নয়!

-- শনিবার রাত একটার সময় আপনি কোথায় ছিলেন?

-- ন্যাচারালি বাড়িতে। এ সিঙ্গল-বেড খাটে অঘোর ঘুমে অচেতন।

-- আপনার কোনো সাক্ষী বা প্রমাণ আছে?

-- এর আবার কী প্রমাণ থাকবে?

-- আপনার বাড়িতে একজন ওড়িয়া চাকর আছে। আপনার কম্বাইন্ড হ্যান্ড। সে কোথায়?

-- আপনি কী করে জানলেন?

-- তাকে ডাকুন। আমি জানতে চাই শনিবার রাত দেড়টার সময় টেলিফোন ধরে কেন সে মিথ্যা কথা বলেছিল?

-- গদাধর? কী বলেছে গদাধর?

-- ডাক্তারবাবু গাড়ি নিয়ে কোথায় বেরিয়ে গেছেন! কেন? আপনি ফিরে আসার পর সে আপনাকে বলেনি যে, একটা টেলিফোন কল এসেছিল রাত বারোটা তেতাল্লিশে?

-- গুড গড! আপনি...আপনি ঘটনার আগে কেমন করে আমাকে ফোনে...

-- আপনি যখন সাক্ষী দিতে উঠবেন তখন পুলিসের কাউন্সেল ওই প্রশ্নটা করবে। আপনি কোথায় রোগী দেখতে গেছিলেন, শনিবার রাত বারোটা তেতাল্লিশে?

-- আমি...আমি কেন সাক্ষী দিতে যাব?

-- যেহেতু আপনি সমন পাবেন। শুনুন ডক্টর ব্যানার্জি, আপনাকে বিপদে ফেলা আমার উদ্দেশ্য নয়। ছন্দা আমার ক্লায়েন্ট; ন্যাচারালি ছন্দার বন্ধুদের উপকারই আমি করব। পরিবর্তে তাদের সহযোগিতাও প্রত্যাশা করি আমি। আপনি আদ্যন্ত সত্য কথা খুলে বলবেন? ওই শনিবার রাত্রির ঘটনাটা?

একমূহুর্ত চিন্তা করে রাজি হয়ে গেলেন ডাক্তারবাবু। বলে গেলেন তার অভিজ্ঞতার কথা --

হ্যাঁ, উনি জানতেন যে, ছন্দা একটার সময় কমলেশের বাড়িতে যাবে বলে কথা দিয়েছে। ছন্দার ইচ্ছে ছিল কমলেশকে বুঝিয়ে বলবে যে, তার অনেক কীর্তি-কাহিনীর কথা ছন্দাও জানে। একটা মুখোমুখি ফয়শলা করতে চেয়েছিল সে। ডাক্তারবাবু ওকে আত্মরক্ষার অস্ত্র হিসাবে আগ্নেয়াস্ত্রটা দিয়েছিলেন বটে, কিন্ত ছন্দা ওঁকে বলেছিল যে, জীবনে সে পিস্তল ছোঁড়েনি। প্রয়োজনে সময় মতো সেটা ব্যবহার করতে পারবে কি না তার নিজেরই সন্দেহ আছে। রাত বারোটা নাগাদ উনি উঠে পড়েন। গাড়িটা গ্যারেজ থেকে বার করে চলে আসেন তারাতলায়। কমলেশের বাড়িটা উনি চিনতেন। প্রায় একশ গজ দূরে গাড়িটা পার্ক করে উনি হেঁটে চলে-আসেন। তখন কমলেশের ঘরে আলো জ্বলছিল। রাস্তার ধারে ছন্দার মারুতি গাড়িটাকে পার্ক করা অবস্থায় দেখতে পান। কিছু দূরে একটা মোটর সাইকেলও দাঁড় করানো ছিল। বাড়ির কাছাকাছি এসে ওঁর মনে হল দেড়তলার মেজানাইনে একটা বচসা হচ্ছে। তারপরেই কাঁচের কিছু একটা ভেঙে যাবার শব্দ আর সঙ্গে সঙ্গে বাতিটা নিবে গেল। ডক্টর ব্যানার্জি তখন ডোরবেলটা টিপে ধরেন।

কেউ সাড়া দেয় না। হঠাৎ রাস্তায় একটা বম্ এক্সপ্লোশান হল যেন। উনি ছুটে পালিয়ে গেলেন কিছু দূরে। সেখান থেকে পিছন ফিরে দেখেন -- না, শব্দটা মোটর-বাইক স্টার্ট হবার। উনি দাঁড়িয়ে পাড়েন। বোধহয় মিনিটখানেক পরে কমলেশের সদর দরজা খুলে যায়। ছন্দা ছুটে বেরিয়ে আসে। গাড়িতে উঠে বসে। স্টার্ট দেয়। ছন্দা পালিয়ে আসতে পেরেছে দেখে উনি নিশ্চিন্ত হন। উনিও নিজের গাড়িতে উঠে স্টার্ট দেন। পিছনে কী ঘটল তা আর দেখেননি।

-- আপনি আর কোনো লোককে দেখেননি?

-- কোথায়?

-- ধরুন, ওই বাড়ির কাছে-পিঠে বা বাঁশের ভারা বেয়ে নামতে?

-- না।

-- আর কোনো গাড়ি কি পার্ক করা ছিল। রাস্তার ধারে?

-- তা হয়তো ছিল। আমি নজর করিনি।

-- বাসু-সাহেব দশ সেকেন্ড চিন্তা করে বললেন, এবার আমি আপনাকে একটা খুব গোপন কথা বলতে চাই। যদি আপনি কথা দেন যে, কথাটা পাঁচ কান করবেন না!

-- কী কথা?

-- আমি বলতে চাইছিলুম যে, আপনাকে খুব সুস্থ বোধ হচ্ছে না।

-- এই আপনার গোপন কথা? আমার যা মানসিক অবস্থা তাতে আমাকে কেমন দেখানোর কথা? খুব সুস্থ? হেইল অ্যান্ড হার্টি?

-- তা নয়, মানে এই রকম শারীরিক, এমন মানসিক অবস্থায় সাক্ষীর কাঠগড়ায় উঠে...

-- সাক্ষী! আমি কেন সাক্ষী দিতে যাব? ছন্দার পক্ষে? আপনি ‘সমন’ করবেন?

-- না, আমি করব না। আপনার সাক্ষ্য তো ছন্দার ক্ষতিই করবে শুধু। আমার মনে হয় ছন্দার বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবার জন্য আপনার ডাক পড়বে, পুলিসের তরফ থেকে! পুলিস যখনই আবিষ্কার করবে যে, ছন্দা ওই ইনশিওরেন্স-এর টাকাটা তার স্বামীর জীবিতকালে নিয়েছে তখনই আপনাকে তলব করবে। প্রমাণ করতে যে, মেয়েটি পাকা ক্রিমিনাল, -- আগেও তঞ্চকতা করেছে! আপনাকেও এ মামলায় তারা জড়াতে চাইবে -- ফলস ডেথ সার্টিফিকেট দেবার জন্য!

ডাক্তারবাবু অসহায় ভঙ্গিতে বাসুর দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন।

-- তাই তো বলছিলাম, আপনাকে খুবই অসুস্থ লাগছে! আপনার কোনো পেশেন্ট যদি এমন অবস্থায় পড়ে তখন আপনি তাকে কী পরামর্শ দেন? একজন স্পেশালিস্টকে দিয়ে দেখাতে। তাই নয়? আমার কথায় কিছু করে বসবেন না। তবে স্পেশালিস্টের কাছে আপনি জানতে চাইতে পারেন এ অবস্থায় বায়ু পরিবর্তনে কোনো উপকার হতে পারে কি না। আই মিন...

-- কী বলছেন আপনি! ছন্দার এই বিপদ, আর আমি তাকে ফেলে এখন বেড়াতে যাব?

-- তা যদি বলেন ডক্টর ব্যানার্জি, তা হলে বলি -- আপনার কলকাতায় উপস্থিতিটাই ছন্দার সর্বনাশের কারণ হতে পারে। অবশ্য আমি শুধু স্বাস্থ্যের কারণে আপনাকে রাতারাতি চেঞ্জে যেতে বলছি, তার সঙ্গে ছন্দার কোনো সম্পর্ক নেই। সেটা শুধু আপনার স্বাস্থ্যের কারণে। অবশ্য আমি তো ডাক্তার নই। আপনি কোনো স্পেশালিস্টের পরামর্শ মতো যদি...

হঠাৎ দাঁড়িয়ে ওঠেন ডক্টর ব্যানার্জি বাসু-সাহেবের দুটো হাত চেপে ধরে বলে ওঠেন, থ্যাঙ্কস কাউন্সেলার! কথাটা অনেক আগেই আমার বোঝা উচিত ছিল! কাল সকালেই...

-- আপনার অবসর বিনোদন কালের ঠিকানাটা...

-- না, না, নিশ্চিন্ত থাকুন। জবাকেও তা জানিয়ে যাব না। এ মামলা না মেটা পর্যন্ত..অল রাইট, অল রাইট! এসব কথা আলোচনা করাও মূর্খতা। আই নো!

বঁ ভয়েজ! -- বাসুও উঠে দাঁড়ান!

-- যেন ডাক্তারবাবু এখনই রওনা দিচ্ছেন।

বারো

পরদিন সকালবেলা ব্রেকফাস্ট টেবিলে কৌশিক বললে, একটা দুঃসংবাদ আছে, মামু। বলেন তো সবিনয়ে নিবেদন করি।

বাসু-সাহেব পট থেকে কাপে কফি ঢালতে ঢালতে বলেন, এমন কোনো সুপ্রভাতের কথা তো স্মরণ করতে পারছি না কৌশিক, যেদিন প্রাতরাশ টেবিলে দিনটা বিষিয়ে দেবার সুব্যবস্থা তুমি করনি। বল! আমি কর্ণময়। ইদানীং নীলকন্ঠও হয়ে গেছি! সব জাতের হলাহলই হজম করতে পারছি।

কৌশিক বললে, আপনার মক্কেল আপনার পরামর্শে কান দেয়নি, ফাস্ট ক্লাস ম্যাজিস্ট্রেটকে লিখিত জবানবন্দি দিয়ে বসেছে।

-- আরক্ষা-বিভাগের এই সুরক্ষিত গোপন তথ্য তুমি কেমন করে সংগ্রহ করলে?

-- সুকৌশলী আবার কী করে জানবে? সুকৌশলে! পুলিশ বিভাগের একাংশ অর্থমূল্যে খবর বিক্রি করে থাকে। আপনি শোনেননি?

-- বুঝলাম। জবানবন্দিতে ছন্দা কী বলেছে?

-- বলেছে, কমলেশ তাকে ব্ল্যাকমেলিঙের চেষ্টা করছিল। বস্তুত কমলেশ এতদিন আত্মগোপন করে বসেছিল, অপেক্ষা করছিল কত দিনে ছন্দা দ্বিতীয় বার বিয়ে করে। ত্রিবিক্রমনারায়ণের একমাত্র পুত্রকে সে বিয়ে করেছে এই খবর পেয়েই কমল সবিক্রমে আত্মঘোষণা করতে উদ্যোগী হয়েছিল। বার-কয়েক ছন্দা নাকি টেলিফোনে কমলেশের সঙ্গে কথা বলে। ছন্দা ওকে উলটে ধমক দেয় যে, যে- মুহূর্তে সে আত্মঘোষণা করবে সেই মুহূর্তেই নানান ব্যক্তি তাকে আক্রমণ করবে -- যাদের কন্যা বা ভগ্নীকে ফাঁসিয়ে এতদিন সে আত্মগোপন করে ছিল। এ আশঙ্কা কমলেশের নিজেরও ছিল। তাই সে একটা মাঝামাঝি রফা করতে চেয়েছিল। ছন্দা রাজি হয় যে, শনিবার রাত একটায় সে তারাতলায় তার প্রথম স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাবে। বস্তুত ত্রিদিব ঘুমিয়ে পড়ার পর সে গ্যারেজ থেকে গাড়ি বার করে তারাতলায় চলে আসে। গাড়িটা পার্ক কাছে এগিয়ে গিয়ে সে লক্ষ্য করে যে, কমলেশের ঘরে আলো জ্বলছে। ভিতর থেকে একটা বচসার শব্দ ভেসে আসছে। ছন্দা ওই সময় কলবেলটা বাজায়। কিন্তু কেউ সাড়া দেয় না। এই সময় ঝনঝন্ করে কাচের কিছু বাসনপত্র ভেঙে যাবার শব্দ হয় আর তৎক্ষণাৎ বাতিটা নিবে যায়। ঠিক তার পরেই ছন্দার নজরে পড়ে দেড়তলার ঘর থেকে কেউ বাঁশের ভারা বেয়ে নেমে আসছে। লোকটার পরনে শার্ট-প্যান্ট, মাথায় লোহার হেলমেট। ছন্দা আত্মগোপন করে। একটু পরেই সে শুনতে পায় একটা মোটর সাইকেলের চলে যাবার শব্দ। ছন্দা এরপর নিজের গাড়িতে উঠে বাড়ি ফিরে আসে। -- এই হচ্ছে তার জবানবন্দির চুম্বকসার।

-- কমলেশের বাড়ির কাছাকাছি অন্য কোনো পরিচিত গাড়িকে সে কি পার্ক করা অবস্থায় দেখেছে? সে-সব কথা কিছু বলেছে?

-- না।

-- তারপর বোধকরি পুলিশ-অফিসার ওর নাকের ডগায় একটা চাবির-রিং দুলিয়ে প্রশ্ন করেছিল: এটা তাহলে কী করে ঘরের ভিতর পাওয়া গেল?

-- আজ্ঞে হ্যাঁ, তা করেছিল। ছন্দা তার জবাবে বলেছে যে, সে বিকালের দিকে তারাতলায় একবার এসেছিল। কমলেশের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে ; কিন্তু বেশিক্ষণ বসতে পারেনি। চাবিটা হয়তো তখনই ওর ভ্যানিটি-ব্যাগ থেকে পড়ে যায়।

বাসু ম্লান হেসে বললেন, কেউ নিজের পায়ে নিজেই কুড়ুল চালায়, কেউ কুডুলটা খাড়া করে পেতে তাতে পদাঘাত করে! ফল একই!

রানু জানতে চান, এ কথা কেন বলছ?

-- হতভাগীকে পইপই করে বলে এলাম যে, পুলিস তোমাকে নানান জাতের রাঙামূলো দেখাবে।

লোভে পড়ে কোনোটা গিলতে যেও না। আমার অনুপস্থিতিতে কোনো স্টেটমেন্ট দিও না। তা শুনল না মেয়েটা। প্রথম থেকেই দেখছি -- বড্ড একবগ্গা! নিজে যা ভালো, বোঝে তাই করবে।

কৌশিক সায় দেয়, ঠিক তাই। পুলিশ নানা সার্কামস্ট্যান্সিয়াল এভিডেন্স থেকে প্রমাণ করবে যে, শনিবার বিকাল থেকে রাত একটা পর্যন্ত ছন্দার কাছে চাবির থোকাটা ছিল। এরমধ্যে হয়তো দু-একবার গ্যারেজের তালা বন্ধ করেছে ত্রিদিব। ছন্দা তা খুলেছে। হয়তো কোনো পেট্রোল পাম্পের বয় আদালতে উঠে সাক্ষী দেবে ওই মেমসাহেব রাত আটটার সময় তাদের দোকান থেকে পেট্রোল খরিদ করেছেন -- চাবির থোকাটা ওই ছোকরার হাতে দিয়েছেন পেট্রোল ট্যাঙ্ক খুলতে। সেই পেট্রোল পাম্পের মালিক ভাউচারের কাউন্টার ফয়েলে হয়তো ওই মারুতি গাড়ির নম্বরটা এসট্যাব্লিশ করবে।

বাসু বলেন, এসব অনেক অনেক সাক্ষীর সম্ভাবনা তো আছেই। তা ছাড়াও কিছু প্রত্যক্ষ বিপদের সম্ভাবনা আছে। বাস্তবে কে যে কলবেলটা বাজিয়েছে তা আমরা জানি না, কিন্তু ঘটনাস্থলে ওই সময়ে আরও দু-জন বা তিনজন ব্যক্তির উপস্থিতির কথা অনুমান করা যাচ্ছে। যে লোকটা ভারা বেয়ে নেমেছিল, যে-লোকটা দেশলাই জ্বালাচ্ছিল, যে-লোকটা মোটর বাইকে করে পালায় এবং – নিজ স্বীকৃতি মতে -- ডক্টর ব্যানার্জি। পুলিস যদি কোনোক্রমে ব্যানার্জির সন্ধান পায় এবং তাঁকে কাঠগড়ায় তোলে তাহলে তিনিই দাবি করবেন যে, কল-বেলটা তাঁরই আঙুলের ছোঁয়ায় বেজেছিল...

সুজাতা বলে, ছন্দা ওই জবানবন্দি দিয়েছে জেনেও--

বাসু বলেন, প্রথম কথা তিনি যদি সত্যিই কলবেল বাজিয়ে থাকেন তাহলে হলফ নিয়ে তিনি মিথ্যা সাক্ষী দিতে পারেন না, এমন কি ছন্দাকে বাঁচানোর জন্যও নয়। দ্বিতীয় কথা: পুলিস যদি ওই ফলস্ ডেথ-সার্টিফিকেটের অস্তিত্ব টের পায় তাহলে ডাক্তারবাবু নিতান্ত বেকায়দায় সাক্ষীর মঞ্চে উঠে দাঁড়াবেন। পুলিস যে-ভাবে চাইবে সেভাবেই তাঁকে সাক্ষী দিতে হবে।

কৌশিক বলে, তাছাড়া ওই মোটর-বাইকেরআরোহী -- সম্ভবত যে ভারা বেয়ে নেমে এসেছিল --তাকেও যদি পুলিশ পাকড়াও করে তাহলে সেও ওই সুযোগটা চাইতে পারে। কারণ বোঝা যাচ্ছে, কলবেলটা যে বাজিয়েছে সে ভিতরে ঢোকেনি!



বাসু-সাহেবের চেম্বারে দিনের প্রথম সাক্ষাংপ্রার্থী একজন স্বনামধন্য বিশিষ্ট ব্যক্তি। রানু তাঁর আগমনবার্তা ইন্টারকমে জানালেন না। সাক্ষাতপ্রার্থীকে রিসেপশন-কাউন্টারে বসিয়ে নিজেই চাকা লাগানো চেয়ারে পাক খেয়ে এঘরে চলে এলেন। বাসু কী একটা নোট দেখছিলেন। চোখ তুলে তাকিয়ে বলেন, কী ব্যাপার? কেউ দেখা করতে চায়?

-- তা চায়। ভি. আই. পি. ভিজিটার। স্বয়ং শ্বশুরমহাশয়!

-- মানে? কার শ্বশুর?

-- কার আবার? তোমার মক্কেলের!

-- আই সি! স্বনামধন্য বাণিজ্যচুম্বক ত্রিবিক্রমনারায়ণ। ঠিক আছে। পাঠিয়ে দাও। তাকে আমার দরকার। এই বিপুল খরচের ব্যয়ভার মেটানোর জন্যে...

-- তুমি কি আশা করছ পুত্রবধূর মামলায় উনি খরচ করবেন?

-- তা তো করতেই হবে। ‘খানদান’ বলে কথা! শক্তাবৎ রাজপুত রাও পরিবারের বধূমাতা হত্যার অপরাধে কাঠগড়ায় দাঁড়াবেন অথচ তার শ্বশুরমশাই খরচ করবেন না? এ কি হয়?

-- আমি বাজি ধরতে পারি, তুমি ওর কাছ থেকে একটা পয়সাও আদায় করতে পারবে না।

-- আমি তোমার বাজিটা অ্যাকসেপ্ট করতে পারছি না রানু, সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। তুমি জিতলে অথবা হারলে টাকাটা আমাকে মিটিয়ে দিতে হবে -- যেহেতু আমাদের জয়েন্ট-অ্যাকাউন্ট। মহান অতিথিকে আর বেশিক্ষণ বসিয়ে রেখ না। পাঠিয়ে দাও।

রানু দুই ঘরের দরজাটা খুলে নেপথ্যের দিকে তাকিয়ে বললেন, আসুন রাও-সাহেব। মিস্টার বাসু আপনার প্রতীক্ষা করছেন।

রাও ত্রিবিক্রমনারায়ণ ঘরে প্রবেশ করেলন। ‘বাও’ করলেন, মৃদু হাসলেন, কিন্তু করমর্দনের জন্য হাতটা বাড়িয়ে দিলেন না।

বাসু দাঁড়িয়ে পড়েছেন। হাত বাড়িয়ে একটি চেয়ারকে নির্দেশ করলেন। উভয়েই উপবেশন করলেন। নিঃশব্দে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন মিসেস বাসু। দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল।

ত্রিবিক্রম বললেন, আপনি নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন কেন এই আন্-আ্যাপয়েন্টেড সাক্ষাৎকার?

বাসু সহাস্যে বলেন, আমি বস্তুত প্রতিদিনই আপনাকে প্রত্যাশা করছি! কাগজে যখন দেখলাম, আপনি ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্সে বক্তৃতা দিতে কলকাতায় এসেছেন।

-- সেটা গৌণ কারণ, ব্যারিস্টার-সাহেব। আমাকে নাসিক থেকে উড়ে আসতে হয়েছে আমার ‘খানদান’-এর খাতিরে।

-- বুঝেছি। আপনার পুত্র ত্রিদিবের সঙ্গে কি আপনার দেখা হয়েছে? কলকাতায় আসার পরে? শুনেছি, সে সেই রবিবার সকাল থেকে আর আলিপুরের ঠিকানায় থাকে না?

ত্রিবিক্রম হাসলেন। বলেন, ব্যারিস্টার-সাহেব, আমার মনে হয় আমি যে উদ্দেশ্যে এসেছি, যে প্রস্তাবটা পেশ করতে চাই, তা প্রথমে দাখিল করি। তারপর আপনি আপনার সওয়াল শুরু করবেন...

-- ঠিক আছে। বলুন, কী আপনার প্রস্তাব?

-- দেখুন বাসু-সাহেব, আমি খোলা কথার মানুষ। শুনেছি, আপনিও তাই। আমি পেশাগতভাবে একজন ‘ফিনানশিয়ার’। টাকা খাটাই। দৈনিক লাখ লাখ নয়, কোটি টাকা হাত ফিরি হয়। সবই যে আমার টাকা তা নয়, তবে আমার হাত দিয়ে যায়। এর ফলে বেশ কিছু সুদক্ষ আইনজীবীকে আমি মাস-মাহিনায় রাখতে বাধ্য হয়েছি। তবে তারা সবাই করপোরেট - বা কমার্শিয়াল-ল-এর বিশেষজ্ঞ। সবাই দেওয়ানি আদালতের। আপনিই আমার কর্মজীবনে, প্রথম ক্রিমিনাল ল-ইয়ার, যার সঙ্গে আমাকে কারবার করতে হচ্ছে।..আমি জানি, দেওয়ানি আদালাতের ওই সব গয়ংগচ্ছ আইন বিশারদের মতো গদাই-লস্করি চাল আপনাদের পোষায় না। আপনাদের অত্যন্ত দ্রুত অথচ নির্ভুল বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত নিতে হয় -- কারণ ভুল হলে আপনার মকেল গাঁটগচ্চা দিয়েই নিষ্কৃতি পাবে না; তাকে জেল খাটতে হবে বা ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হবে...

বাধা দিয়ে বাসু বলেন, আপনি কিন্তু কাজের কথায় এখনও আসেননি। ভূমিকাটা সংক্ষেপ করলে দুপক্ষেরই সুবিধা।

-- ধন্যবাদ। আমার পুত্র আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে প্রথম সুযোগেই। সে তার সহধর্মিণীকে বাঁচাতে চায় -- খুবই স্বাভাবিক প্রেরণা। কিন্তু যেহেতু তার ধমনীতে শক্তাবৎ-রাজবংশের রক্ত বইছে, যেহেতু সে রাঠোর রাজপুত, তাই সে মিথ্যার সঙ্গে আপোস করতে অসম্মত। স্ত্রীর প্রতি অনুরাগ বা সহানুভূতি তাকে কিছুতেই সত্য থেকে বিচলিত করবে না। এই তার খানদান!

বাসু পাইপে আগুন দিতে দিতে বলেন, আপনি কিন্তু ভূমিকা পর্যায়েই আটকে আছেন এখনও। আমাকে নতুন কোনো তথ্য সরবরাহ করতে পারেননি।

-- আমি আমার বক্তব্যের বনিয়াদটা বানাচ্ছিলাম।

-- সেটা নিতান্ত নিস্প্রয়োজন। আপনার পুত্র তার নিদ্রাগতা ধর্মপত্নীকে ত্যাগ করে স্ত্রীর অজ্ঞাতসারে আমার সঙ্গে এবং থানা অফিসারের সঙ্গে দেখা করে ইতিপূবেই “ফাউনেন্ডশনটা” বানিয়ে ফেলেছে। আপনি সরাসরি সুপার-স্ট্রাকচারের বক্তব্যে আসতে পারেন।

-- ঠিক আছে। বক্তব্যটা এই: আমার পুত্র আপনাকে নিয়োগ করেছিল তার স্ত্রীর তরফে। সে কোনে ‘রিটেইনার’ দিয়ে যায়নি। আমি জানি, অগ্রিম না পাওয়া সত্ত্বেও আপনি ত্রিদিবের স্ত্রীর জন্য অনেক ছোটাছুটি করছেন, অনেক খরচও ইতিমধ্যে করে বসে আছেন। আমি এও জানি যে, আপনি প্রত্যাশা করছেন যে, আপনার ‘ফি্’ টা আমি মিটিয়ে দেব। আপনি জানেন যে, আমার পুত্রের নিজস্ব বলতে কিছুই নেই। তার সব খরচপত্র আমিই বহন করি।...আমি ত্রিদিবের নির্বাচন ক্ষমতাকে নিশ্চয় তারিফ করব। তার স্ত্রী যে জটিল মামলায় জড়িয়ে পড়েছে তা থেকে তাকে মুক্ত করবার ক্ষমতা যদি কলকাতার কোনো আইনজীবীর থাকে তবে তিনি হচ্ছেন পি. কে. বাসু, বার-আ্যাট-ল! তাই এই পর্যায়েই আমার মনে হল, আপনাকে জানিয়ে রাখা উচিত যে, আমি আপনার যাবতীয় বিল মেটাব কিন্তু একটি শর্তসাপেক্ষে --

-- বলুন? আমার এখন শুধু শুনে যাওয়ার কথা।

-- বলছি। কিন্তু মুশকিল কী জানেন? মন খুলে আপনাকে সব কথা যে বলা যায় না!

-- কেন?

-- কারণ ইতিপূর্বেই পাবলিক প্রসিকিউটার আ্যাডভোকেট নিরঞ্জন মাইতি মশায়ের সঙ্গে এই কেসটা নিয়ে কিছু আলাপচারি হয়েছে। তিনি আমাকে কথাপ্রসঙ্গে জানিয়েছেন: মামলাটা কোন্ পথে পরিচালনা করার পরিকল্পনা আছে তার। সেটা তিনি আমাকে বিশ্বাস করে বলেছেন। তা নিয়ে আমি আপনার সঙ্গে আলোচনা করতে পারি না। তাতে বিশ্বাসভঙ্গ করা হবে।

-- বটেই তো! সুতরাং?

-- কিন্তু আপনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান বলে বিখ্যাত। আপনি যদি নিজে থেকেই সেটা অনুমান করে আমাকে জানান, তাহলে আমি বিশ্বাসভঙ্গ না করেই ব্যাপারটা আলোচনা করতে পারি!

বাসু-সাহেবের দশটা আঙুল দশ সেকেন্ড গ্লাসটপ টেবিলে টরে-টক্কা বাজালো। তারপর তিনি বললেন, আপনি বোধহয় বলতে চান যে, যতদিন আপনার পুত্র এবং ছন্দার সম্পর্কটা স্বামী-স্ত্রী, ততদিন মাইতি মশাই ত্রিদিবকে সাক্ষীর মঞ্চে তুলতে পারবেন না! ফলে মাইতিমশায়ের প্রথম স্ট্যাটেজি হবে ওই বিবাহটা অ্যানাল করা অর্থাৎ বিবাহ-মুহূর্ত থেকে অসিদ্ধ প্রমাণ করা। তাই তো?

-- ধন্যবাদ। আমি জানতাম, আপনি সঠিক অনুমান করতে পারবেন এবং এটাও আপনি অনুমান করতে সক্ষম যে, আমি ওই বিবাহটাকে অসিদ্ধ-প্রমাণ করার বিষয়ে কী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করি। তাই না?

-- আপনার ধারণায় পুত্র অবাঞ্ছিত বিবাহবন্ধনে নিজেকে আবদ্ধ করেছে। তাই কি?

-- নিশ্চয়! সে এমন একটি স্ত্রীলোককে বিবাহ করেছে যে অন্যপূর্বা, যে বয়সে বড়ো, যার ‘খানদান’ নেই এবং শুধুমাত্র আমার পুত্রের বৈভবের কথা চিন্তা করেই তাকে বিবাহ করছে।

-- সে কী? আপনি তো এইমাত্র বললেন যে, আপনার একমাত্র পুত্র কপর্দকহীন! স্ত্রীকে ভাত-কাপড়ের জোগান দেবার প্রয়োজনে তাকে বাপের কাছে হাত পাততে হয়।

ত্রিবিক্রম আগুনঝরা চোখে বাসু-সাহেবের দিকে সেকেন্ড-পাঁচেক নির্বাক তাকিয়ে রইলেন। তারপর শান্তকন্ঠে বললেন, আপনার মক্কেল জানে, তার স্বামী আমার সমস্ত সম্পত্তির একমাত্র ওয়ারিশ।

বাসু-সাহেব আ্যাশট্রেতে ছাইটা ঝেড়ে ফেলে বললেন, লুক হিয়ার, মিস্টার রাও! আপনি অহেতুক কুন্ঠা করছেন। আপনার প্রস্তাবটা আমিই বাতলে দিচ্ছি। দেখুন মেলে কি না। যে মেয়েটি খুনের মামলায় ফেঁসেছে তার যাবতীয় ব্যয়ভার আপনি মেটাতে স্বীকৃত একটি শর্তসাপেক্ষে শর্তটা হল এই যে, আমি ‘ম্যারেজ-আ্যানালমেন্ট’ কেসটাতে কোনো ডিফেন্স দেব না। নির্বিবাদে ছন্দার সঙ্গে ত্রিদিবের বিবাহটা আইনত অসিদ্ধ হয়ে যাবার পর আমি মেয়েটিকে খুনের দায় থেকে বাঁচাব। অর্থাৎ বিবাহটা নাকচ হতে দিলেই আপনি আমার ফিজ মেটাবেন, আর আসামি যদি আপনার পুত্রবধূ হিসাবে মামলা লড়ে তাহলে আপনি একটি কানাকড়িও ঠেকাবেন না। মোদ্দা কথাটা তো এই?

ত্রিবিক্রম একটু নড়েচড়ে বসলেন। অস্বস্তিটা ঝেড়ে ফেলে অবশেষে বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন, তবে বড়ো চাঁচাছোলা ভাষায়।

-- কিন্তু মূল বক্তব্যে কোনো ভুল নেই। তাই নয়?

-- হ্যাঁ, তাই। অবশ্য আমার সঙ্গে সহযোগিতা করলে-আপনার ন্যায্য বিলই শুধু মেটাব না, তার বাসু বাধা দিয়ে বলেন, ‘বিল’-এর উপর ‘টিপ্স্’ দেওয়া হবে। এই কথা কি বলতে চান?

-- ছিঃ। আমি ‘সম্মানমূল্যের’ কথা বলছি। ‘অনারেরিয়াম’....

-- বুঝেছি, বুঝেছি। বিহারে ওকে বলে ‘এথি’ রাখা, ঢাকা-বাংলায় ‘পান খেতে দেওয়া’, বফর্স কেস-এর ব্যাপারে বিজনেস্ ওয়ার্ডে ‘কমিশন’ আর হর্ষদ মেহতা বা আপনার মতো ধনকুবেরদের ভাষায় ‘অনারেরিয়াম’! প্রাকৃতজনের খেলো কথায়: ‘ঘুষ!’ তাই তো?

ত্রিবিক্রম প্রতিবাদ করেন, এবার আপনার জবাবটা এককথায় শুনে যাই?

বাসু বলেন, তা কেমন করে হবে রাও-সাহেব প্রস্তাবটা পেশ করার আগে আপনি দীর্ঘ ধানাই-পানাই-ভূমিকার ফাউন্ডেশন গেড়েছেন, এখন এককথায় আমার জবাবটা শুনতে চাইলে আমিই বা রাজি হব কেন? আমার জবাবেরও একটা ভূমিকা চাই তো?

-- ঠিক আছে। বলুন?

-- প্রথম কথা: ত্রিদিবনারায়ণ রাও একটি মেরুদণ্ডহীন ইনভার্টিব্রেট! এ কথা আপনিও জানেন, আমিও জানি। কিন্তু এ দুর্ঘটনার জন্য সে বেচারি কতটা দায়ী, আর কতটা আপনি, সে-কথা আমি জানি, কিন্তু আপনি জানেন না...

ত্রিবিক্রম চাপা গর্জন করে ওঠেন, আপনি এভাবে আমাকে বাগে পেয়ে অপমান করছেন?

বাসু-সাহেব বলেন, অপমান। না তো! আপনি প্রস্তাবটা পেশ করার অবকাশে ধরে নিতে পারলেন যে, আমি সজ্ঞানে আমার মকেলের সর্বনাশ করব, আমি একজন অযোগ্য ঘুষখোর আ্যাটর্নি। আর আমি তার জবাব দেবার সময় ‘আর্গু’ করতে পারব না, আপনি সজ্ঞানে আপনার সন্তানের সর্বনাশ করেছেন, আপনি একজন অযোগ্য অপরিণামদর্শী পিতা?

পুরো আধ মিনিট ত্রিবিক্রমের বাক্যস্ফূর্তি হল না। তারপর দাঁতে দাঁত দিয়ে বললেন, আপনি আমার প্রস্তাবটা গ্রহণ করেছেন, না -- না?

-- প্লিজ মিস্টার রাও! আমাকে বলতে দিন।

-- কী বলবেন? বলুন?

-- আপনার আশঙ্কা হয়েছে যে. ছন্দা যদি আপনার পুত্রবধূ হয়ে টিকে থাকে তাহলে আপনার একচ্ছত্র সাম্রাজ্যে একটা বিপ্লব ঘটে যেতে পারে। ছন্দা হয়তো ভালোবাসার জোরে স্বামীর মেরুদণ্ডের ‘কাটিলেজ’ হয়ে যাওয়া অস্থিগুলোকে কঠিন করে তুলবে। তাই আপনি তাকে সরাতে বদ্ধপরিকর। তাই না?

-- আপনি কিন্ত এখনও আমার প্রস্তাবের প্রত্যুত্তরটা দেননি।

-- দিইনি? এবার তাহলে তাই দিচ্ছি: আমি ছন্দা রাওয়ের ডিফেন্স কেসটা নিয়েছি। সে আমার মক্কেল। তার স্বার্থের কথা সবার আগে দেখব আমি। আপনার পুত্রের মুখটা বন্ধ রাখতে পারলেই আমার মক্কেলের মস্ত সুবিধা। ফলে বিবাহ-নাকচের মামলা আমাকে লড়তেই হাবে --জান-কবুল হাড্ডাহাড্ডি লড়াই।

-- কিন্ত আইনজ্ঞ হিসাবে আপনি তো বুঝতে পারছেন যে, সে চেষ্টা বৃথা। অ্যাডভোকেট মাইতি বলেছেন, এটা জাস্ট ‘ওপেন অ্যান্ড শাট কেস’ -- দশ-মিনিটের ভিতর বিবাহটা নাকচ হয়ে যাবে, যেহেতু ছন্দা যখন আমার পুত্রকে রেজিস্ট্রি বিবাহ করে তখনও কমলেশ জীবিত। ছন্দা সেই মুহূর্তে বিবাহিতা।

বাসু বললেন, মামলায় হার-জিত থাকেই। আমি মাইতির সঙ্গে একমত: মামলার রায় হয়তো দশ মিনিটেই দেওয়া যাবে: কিন্তু ‘প্রফেশনাল এথিক্স’ বলে তো একটা কথা আছে। বিবাহ নাকচের মামলাটা আমাকে লড়তেই হবে।

-- আপনার মক্ষেল যদি আপনার ফিজ না মেটাতে পারে, তবুও?

-- মামলা জিতলে সে নিশ্চয় আমার প্রাপ্য মিটিয়ে দেবে। কারণ তখন তার স্বামী হয়ে যাবে কোটিপতির ওয়ারিশ। আর তার যদি সাময়িকভাবে সে ক্ষমতা না থাকে তাহলে খানদানের খাতিরে তার স্বনামধন্য শ্বশুরমশাই নিশ্চয় পূত্রবধূকে ঝণমুক্ত করে দেবেন।

-- সেই হিসাবটাতেই প্রচণ্ড ভুল হচ্ছে আপনার।

-- হতে পারে। আপনি বাণিজ্যচুন্বক। ‘ফাটকা’ নিশ্চয় খেলেন, অন্তত ফাটকা খেলা কাকে বলে তা জানেন। আমি একটা ফাটকা খেলছি। হারলেও এটুকু সান্ত্বনা থাকবে যে, একজন নিষ্ঠুর কোটিপতি শ্বশুরের বিরুদ্ধে এক অসহায় নিঃস্ব পুত্রবধূর হয়ে লড়েছি। বিনা পারিশ্রমিকে। আর জিতলে? সেক্ষেত্রে আপনি এই ঘরে ওই চেয়ারে বসে আমাকে আমার ন্যায্য পারিশ্রমিকটুকু মিটিয়ে দেবেন। বিনা ‘টিপ্স্’ এ।

ত্রিবিক্রমনারায়ণ চেয়ারে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। একটা বিচিত্র ব্যঙ্গহাস্য ফুটে উঠল তাঁর ওষ্ঠাধরে। বললেন, এরপর আর কথা চলে না। আমরা দুজনেই দুজনকে চিনেছি। ঠিক আছে। খেলুন ফাটকা! প্রাণ ভরে। নমস্কার।

শেষাংশ পড়তে ক্লিক করুন


No comments:

Post a Comment