লেখক: নারায়ণ স্যান্যাল
প্রথমাংশ পড়তে ক্লিক করুন
দ্বিতীয়াংশ পড়তে ক্লিক করুন
তেরো
বাসু-সাহেবের মেজাজ খারাপ। সঙ্গত হেতুতে। প্রসিকিউশনের তরফে আদালতে আবেদন করা হয়েছিল যেন কমলেশ-হত্যা মামলার শুনানীর দিন একপক্ষকাল পিছিয়ে দেওয়া হয়। হেতু? বাদীপক্ষ এখনও নানান তদন্ত করছে-- সময় লাগবে কেসটা সাজাতে। বিচারক প্রতিবাদীপক্ষের মতামত জানতে চান। বাসু বলেন, প্রতিবাদীপক্ষ ডিফেন্সের জন্য তৈয়ার। বাদীপক্ষের আবেদন-মোতাবেক মামলার দিন শুধু পনেরো দিন কেন -- ছয় মাস- পিছিয়ে দিলেও তাঁর আপত্তি নেই – কিন্তু শর্তসাপেক্ষ: আসামিকে জামিন দিতে হবে। জীবিকায় আসামি একজন নার্স -- বিনা বিচারে হাজতে রেখে দেওয়ায় তার দৈনিক উপার্জন বন্ধ।
বিচারক প্রতিবাদীর আবেদন গ্রাহ্য করেননি। তবে বাদীপক্ষের আবেদনও পুরোপুরি মেনে নেননি।
মামলার তারিখ সাতদিন পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে মাত্র। জামিন দেওয়া হয়নি। জামিন না-মঞ্জুর হওয়ার একটা সম্ভাব্য হেতু: পুলিস-কর্তৃপক্ষ ত্রিদিবনারায়ণের বিবৃতির অংশবিশেষ সাংবাদিকদের মধ্যে বিতরণ করেছে। কাগজে ছাপা হয়েছে ত্রিদিবের অভিযোগ। একটি সদ্যোবিবাহিতা বিয়ের কনে স্বামীকে জোরালো ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অভিসারে গিয়েছিল -- এমন একটা মুখরোচক কিসসা খবরের কাগজ লুফে নিল। বিচারক সেজন্য প্রভাবত হলেন কিনা বোঝা গেল না। মোটকথা, সে জামিন পায়নি।
ওই দিন সন্ধ্যায় আদালত থেকে ফিরে আসার পরেই রানুদেবী খবর দিলেন, দু-টো কথা বলার আছে। তুমি আদালত বেরিয়ে যাবার পর কোর্ট-পেয়াদা নোটিস সার্ভ করে গেছে। তোমার মকেল ছন্দা রাওয়ের বিরুদ্ধে। বিবাহ-নাকচের আবেদন। শুনানীর দিন: শুক্রবার, বেলা সাড়ে দশটা, আলিপুর কোর্ট-এ তিন নম্বর এজলাসে। তোমার ডায়েরিতে লিখে রেখেছি।
বাসু বললেন, এটা তো প্রত্যাশিত সংবাদ। ছন্দার বিবাহটা নাকচ না হওয়া পর্যন্ত কমলেশ-হত্যা মামলা শুরু হতে পারছে না যে!
-- জানি। ত্রিদিব যতক্ষণ আইনত ছন্দার স্বামী, ততক্ষণ বাদীপক্ষ ত্রিদিবকে সাক্ষীর কাঠগড়ায় তুলতে পারবে না। সেজন্যই ওরা মামলার দিন পিছিয়ে নিচ্ছে, যাতে তার আগেই বিবাহ-বিচ্ছেদের মামলাটার ফয়সালা হয়ে যায়।
বাসুসাহেব কোটটা গা থেকে খুলতে ব্যস্ত ছিলেন। ওই অবস্থাতেই বললেন, ব্যারিস্টারের বউ হয়ে এমন একটা বে-আইনি কথা বলতে পারলে তুমি?
সুজাতা ছিল পাশেই। উপরপড়া হয়ে বলে, কেন? মামিমা কী ভুল বললেন?
বাসু কোটের আলিঙ্গনমুক্ত হয়ে বসেছেন। পাইপ-পাউচ বার করতে করতে বললেন, ওদের বিবাহ বিচ্ছেদ মঞ্জুর হয়ে গেলেও ত্রিদিব আদালতে উঠে সাক্ষী দিতে পারবে না, যদি তার ভূতপূর্ব স্ত্রী আপত্তি জানায়।
-- কেন?
-- কারণ ঘটনার রাতে ওরা স্বামী-স্ত্রী ছিল। আজ এখন বিবাহ-বিচ্ছেদ মঞ্জুর হলে ওদের অতীতকালের দাম্পত্য জীবনটা কর্পুরের মতো তো উপে যায় না।
সুজাতা জানতে চায়, তাহলে ওদের উদ্দেশ্যে কী? কমলেশ-হত্যা মামলার তারিখ পিছিয়ে ওরা এত তাড়াহুড়ো করে বিবাহ-বিচ্ছেদের মামলাটা আদালতে আনছে কেন?
-- আরে বাপু, নোটিসটা পড়ে দেখ। এটা কি ডিভোর্স পিটিশন? আদৌ নয়! এটা ‘অ্যানালমেন্টের’ মামলা। ওরা বলতে চায় যে, ছন্দা বিশ্বাস আর ত্রিদিব রায় এক বিছানায় সাত রাত শুয়েছে, এই মাত্র। ওদের বিবাহটাই অসিদ্ধ। কারণ পনেরোই জুন তারিখে যখন ছন্দা বিশ্বাস আর ত্রিদিব রাও ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের কাছে উপস্থিত হয় তখন ওদের একজন -- ছন্দা ছিল অন্যপূর্বা, বিবাহিতা। তার প্রথম পক্ষের স্বামী কমলেশ বিশ্বাস ওই তারিখে জীবিত ছিল! সুতরাং ওই ‘ছন্দা-ত্রিদিব’ শুভবিবাহ গোড়া থেকেই অসিদ্ধ – ‘নাল অ্যান্ড ভয়েড’।
-- এটা যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে ত্রিদিব তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে সাক্ষী দেতে পারবে?
-- আবার বে-আইনি কথা! ‘স্ত্রী’-র বিরুদ্ধে হচ্ছে কোথায়? বিয়েটা যদি শুরু থেকেই অসিদ্ধ প্রমাণিত হয়, তখন ত্রিদিবের চোখে ছন্দা তো একজন সাধারণ ভারতীয় নাগরিক মাত্র, যে ওর বিছানায় সাত রাত শুয়েছে -- স্ত্রী নয়। ফলে ছন্দার বিরুদ্ধে সে-সাক্ষী-দিতে পারবে না কেন? সে যাই হোক, তোমার দ্বিতীয় দুঃসংবাদটা কী? দুটো খবর দেবার আছে বলেছিলে না?
-- হ্যাঁ, দ্বিতীয়টা দুঃসংবাদ নয়। ডঃ ব্যানার্জি ফোন করেছিলেন। বলেছেন, তুমি এলেই যেন ওঁর চেম্বারে একটা ফোন কর।
-- ডঃ ব্যানার্জি! সে এখনও কলকাতায়?
-- কেন? তার কি বাইরে যাবার কথা ছিল?
-- ধরত ডাক্তারকে। লোকটা এভাবে আত্মহত্যা করতে চাইছে কেন?
একটু পরেই ডাক্তার-সাহেবকে ফোনে ধরা গেল। ব্যানার্জি-বললেন, আরে মশাই, ডাক্তার মানুষ কি রাতারাতি বেড়াতে যেতে পারে? যাব পরশু। টিকিট কেটেছি, হোটেলেও রিজার্ভেশন করেছি। দু-একটি রুগী মরতে বাকি আছে। সেগুলো সেরেই...
-- আমাকে ফোন করতে বলেছিলেন কেন?
-- আমার নার্সিং হোমের একটি পেশেন্ট আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়। দিন-চারেক আগে তার গল-ব্লাডারটি কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে। তাই শয্যাগত। না হলে তিনি নিজেই আপনার সঙ্গে গিয়ে দেখা করতেন।
-- কী নাম ভদ্রলোকের?
-- ভদ্রলোক নয়। ভদ্রমহিলা। বেহালা অঞ্চলে একটা স্কুলের হেডমিস্ট্রেস্ শকুত্তলা দত্ত।
-- অ! তা কী বিষয়ে তিনি আমার পরামর্শ চান সে কথার কিছু ইঙ্গিত দিয়েছেন?
-- আজ্ঞে হ্যাঁ। প্রথম কথা, তিনি আপনার পরামর্শের জন্য সাক্ষাৎটা চাইছেন না -- ওই কমলেশ বিশ্বাসের মার্ডার কেসের কিছু তথ্য আপনাকে জানাতে চান।
-- রিয়ালি? আমি এখনি আসছি। আধঘণ্টার ভিতর।
রানী দেবী জানতে চান, চা টা খেয়ে যাবে না?
-- টী ক্যান ওয়েট, টাইম কান্ট!
কোটটা গায়ে চাপাতে চাপাতে আবার গিয়ে উঠলেন গাড়িতে।
ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়নি। শকুন্তলা দত্তের কেবিনে তিন-চারজন দর্শনার্থী। ডাক্তার ব্যানার্জি বাসু-সাবকে নিয়ে ঘরে ঢুকতেই অন্যান্য দর্শনার্থীরা উঠে দাঁড়াল। ব্যানার্জী পরিচয় করিয়ে দিলেন। শকুন্তলা বললেন, আপনি আমার খুবই পরিচিত, যদিও আজই আপনাকে চাক্ষুষ দেখলাম।
বাসু বলেন, ভা-রি নতুন কথা বললেন! ও-কথ৷ তো আমিও বলতে পারি!
-- কোন কথা?
-- আপনি আমার খুবই পরিচিত, যদিও আজই আপনাকে চাক্ষুষ দেখলাম!
-- আমি আপনার পরিচিত?
-- আলবৎ। আপনি বড়িষা বেহালার মেয়েদের স্কুলে হেডমিস্ট্রেস্। আপনারা দুই বোন, আপনার ছোটোবোনের নাম অনসূয়া কর...
ওঁদের কেবিনে প্রবেশের পর যারা দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল তাদের মধ্যে একটি মেয়ে হঠাৎ কথার মধ্যেই নিচু হয়ে বাসু-সাহেবকে প্রণাম করল। বাসু জানতে চান, কী হল? তোমার আবার হঠাৎ ভক্তি উথলে উঠল কেন?
শকুন্তলা বলেন, ওই আমার ছোটোবোন অনু।
-- অ! আর যে ছেলেটি আপনাকে সেই তেরোই আগস্ট মানে সেই চুরাশি সালের কথা বলছি -- আপনাকে বেলেঘাটার বস্তিতে নিয়ে গেছিল।
-- আশ্চর্য! তারিখটাও মনে আছে আপনার? আমি তো ডায়েরি না দেখে...
এবার অনসূয়ার পাশে দাঁড়ানো যুবকটি নিচু হয়ে বাসু-সাহেবকে প্রণাম করে।
বাসু দু’হাত ওর দুই কাঁধে ফেলে বললেন: থাক, থাক। তা হ্যাঁ গো, বিয়েটা সেরে ফেলেছ তো? এখন তো আর কোনো বাধা নেই।
অনসূয়া মাথা নিচু করে। ছেলেটিও অপ্রস্তুত। জবাব দিলেন শকুন্তলা। বললেন, আমি বাড়ি ফিরে একটু সুস্থ হলেই সে আয়োজন করব। আপনাকে আসতে হবে কিন্তু।
-- চেষ্টা করব। ভালোমন্দ খেতে পেলে ছাড়ি না, বামুন না হলেও ! তা ডেকে পাঠিয়েছিলেন কেন?
-- কমলাক্ষর পূর্ব-ইতিহাস সম্বন্ধে কোনো সাক্ষ্যের প্রয়োজন হলে আমি রাজি আছি। প্রয়োজনে অনসূয়াও আদালতে উঠে সাক্ষী দেবে।
বাসু বলেন, কমলাক্ষ ওরফে কমলেশ ওরফে কমলেন্দু যে ধোয়া তুলসী পাতা ছিল, এমন দাবী পুলিস করেনি। ফলে আমরা সদলবলে মৃত মানুষটার চরিত্রহনন করে কোনোভাবেই লাভবান হব না। তবু তোমাদের নাম-ঠিকানাগুলো লিখে দাও।
অনসূয়া নাম-ঠিকানা লিখে দিল। অস্ফুটে বললে, আপনি যদি সময় করে সেদিন আসতে পারেন দারুণ -- দারুণ খুশি হব।
-- তাই বুঝি। কিন্তু কোন্ দিনটার কথা বলছো, বল তো? সাল তারিখ আমার ঠিক মনে থাকে না।
অনসুয়া গোলাপি হাসি হাসে!
ডাক্তার ব্যানার্জি ওঁকে নিজের কোয়ার্টার্সে নিয়ে এলেন। বললেন, কী খাবেন বলুন? চা, কফি, না ড্রিংক্স?
-- ড্রিংক্স্! তারও আয়োজনও আছে না কি? তা তোমার গার্জেনটিকে দেখছি না যে?
-- গার্জেন?
-- তোমার সেই কনফিডেনশিয়াল নার্স?
--ও, সে তো নার্সিংহোমে। কেন? দরকার আছে?
-- আছে বৈ কি। গদাধরকে তো দেখছি না, তাহলে কফিটা বানাবে কে?
ডাক্তার ব্যানার্জি নার্সটিকে ডেকে পাঠালেন। বাসু তাকে বললেন, তোমার নামটা জানি না, তুমি বলছি। তা, আমার উপর আর রাগ নেই তো, মা?
নার্সটি সলজ্জে ওকে প্রণাম করে বলল, তখন তো আপনার সঠিক পরিচয় পাইনি। আমার নাম জবা দে।
-- তিন কাপ কফি বানাও তো মা, জবা। মানে, তুমিও এককাপ খাবে, ধরে নিয়ে বলছি। আমারটা র।
জবা হেসে সম্মতি জানিয়ে কিচেনেটের দিকে চলে গেল।
ডাক্তার , ছন্দার কেসটা কেমন বুঝছেন, বলুন?
বাসু বললেন, ডাক্তার আমাকে যা অ্যাডভাইস্ করে আমি তা কিন্তু শুনে থাকি--
-- হঠাৎ এ কথা?
--- তাহলে কনভার্স থিওরেমটা ট্রু হবে না কেন? তুমিই বা ব্যারিস্টারের অ্যাডভাইস মেনে নেবে না কেন?
-- আরে মশাই, ছুটিতে যাব বললেই কি যাওয়া যায়? ...
-- যায় ডক্টর ব্যানার্জি। তোমার হাতে যে-কটা জরুরু কেস আছে তা তোমার বন্ধু বান্ধবদের মধ্যে ভাগাভাগি করে দাও। তোমার পক্ষে এখন কলকাতায় পড়ে থাকা অত্যন্ত বিপদজনক। আমি যেভাবে জানতে পেরেছি যে, সাতাশে মার্চ অষ্টআশি সালে তোমার নার্সিং-হোমে একটি ক্যানসার রুগি মারা যায় -- তোমার রেজিস্টার খাতার অনুযায়ী সে রুগির নাম...
-- বুঝেছি, বুঝেছি। সেভাবে পুলিসেও তথ্যটা আবিষ্কার করতে পারে...তাহলেই আমার সমূহ বিপদ, নয়? আচ্ছা, আপনি ও খবরটা জানলেন কী করে?
-- সে প্রশ্ন অবান্তর, ড. ব্যানার্জি! তোমাকে বরং আর একটা খবর দিয়ে রাখি, যা অত্যন্ত জরুরি...
-- কী সেটা?
-- ছন্দা পুলিসের কাছে একটা জবানবন্দি দিয়েছে। আমার নির্দেশ না মেনে। সে স্বীকার করেছে যে, শনিবার রাত একটা নাগাদ সে ওই কমলেশের বাড়িতে গেছিল। তার জবানবন্দি অনুসারে সে ওই বাড়ির সামনে যখন যায় তখন দোতলার ঘরে আলো জ্বলছিল। একটা বচসা চলছিল। হঠাৎ কাঁচের কিছু একটা ভেঙে যাওয়ার শব্দ হয়। আর তৎক্ষণাৎ আলোটা নিবে যায়। ছন্দা নাকি তখন কলবেলটা টিপে ধরে। একটু পরে ওর মনে হয় দরজা খুলে কে যেন ছুটে বেরিয়ে গেল। তখন ও ভয় পেয়ে ফিরে আসে!
-- আশ্চর্য! এ ঘটনা -- মানে প্রায় ওই রকম -- ঘটনা তো বাস্তবে ঘটেছে আমার ক্ষেত্রে।
-- আমি জানি। একটা কথা খেয়াল করে দেখ। পুলিস জানে, কমলেশ যখন খুন হয় তখন বাড়ির বাইরে কেউ একজন কলবেল বাজাচ্ছিল। এ তথাটার দু-দুটো সূত্র! পানওয়ালা বটুক এবং তার স্ত্রী। পুলিস এও জানে যে, ষে লোকটা কলবেল বাজাচ্ছিল সে বাড়ির বাইরে ছিল। ফলে সে হত্যাকারী হতে পারে না। তোমাকে যদি পুলিস ট্রেস করতে পারে, তাহলে তোমার জবানবন্দি নেবে। তখন দেখা যাবে তোমরা দু-জনেই ওই দাবিটা করছ -- তুমি ও ছন্দা! দু-জনেই নিজ নিজ স্টেটমেন্ট অনুযায়ী ঘটনার সময় ফুটপাথে কলবেল বাজাচ্ছ! এর মধ্যে একজন নিশ্চয় মিথ্যে কথা বলছে! পুলিস বিশ্বাস করবে যে, মিথ্যা কথাটা বলেছে ছন্দা। সহজবোধ্য হেতুতে। যেহেতু ছন্দা হচ্ছে অ্যাকিউজড্! এজন্য তোমার পক্ষে কলকাতায় থাকাটা…
মাঝপথেই থেমে গেলেন বাসু-সাহেব। কারণ ঠিক তখনই পর্দা সরিয়ে ঘরে প্রবেশ করল জবা।
তার হাতে একটা ট্রে-তে তিন কাপ কফি, বিস্কিট। একটা কাপে র-কফি।
কফি পরিবেশন করতে করতে জবা বললে, আপনারা নিশ্চয় এতক্ষণ আমার নিন্দে-মন্দ করছিলেন, তাই নয়?
ডাক্তার ব্যানার্জি বলেন, এ কথা কেন?
-- আমি আসা মাত্র আপনাদের আলোচনাটা বন্ধ হয়ে গেল।
বাসু কফিতে একটা চুমুক দিয়ে বললেন, নিন্দে-মন্দ নয় গো, ডাক্তার এতক্ষণ তোমার প্রশংসা করছিল। তা তোমার সামনেই তোমার প্রশংসা করলে তোমার পায়া-ভারী হয়ে যাবে, তাই ও মাঝপথে থেমে পড়েছে।
-- প্রশংসা! ফু! স্যার শুধু একটি নার্স-এরই প্রশংসা করতেন, কিন্তু সে কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে। আপনার মক্কেল!
বাসু কথাটা ঘোরাবার জন্য বলেন, তুমি কোথায় থাকো গো, জবা?
-- বেলঘরিয়ায়।
-- ডেলি-প্যাসেঞ্জারি কর?
-- উপায় কী?
-- তোমার বাড়িতে আর কে আছে?
-- মুন্না -- আমার পাঁচ বছরের বাচ্চা মেয়ে -- ননদ আর শাশুড়ি।
ওঁকে ইতস্তত করতে দেখে জবা আরও বলে, মুন্নার বাবা এখন দিল্লিতে পোস্টেড।
ঠিক ওই সময় বাইরে থেকে কে যেন কলবেল বাজালো।
জবা তার কাপটা নামিয়ে রেখে পর্দা সরিয়ে কক্ষান্তরে চলে গেল, সদর খুলতে। ঠিক বোঝা গেল না, মনে হল সদর দরজার কাছে একটা চেঁচামেচি গোলমাল। জবার কণ্ঠস্বর শোনা গেল : কী পেয়েছেন আপনারা? জোর করে ভিতরে ঢুকছেন কোন্ সাহসে?
কথাটা তার শেষ হল না। পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকল শার্ট-প্যান্ট পরা দু-জন লোক। তার পিছন-পিছন জবা। দর্শনমাত্র বাসুসাহেব চিনতে পারেন ওদের -- যাকে বলে ‘শাদা-পোশাকী পুলিশ গোয়েন্দা’। দুজনেই মুখচেনা।
তৎক্ষণাৎ আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ান বাসু। জবাকে বলেন, ওঁদের বাধা দিও না, জবা। শাদা পোশাকে আছেন বটে, তবে ওঁরা পুলিস। লালবাজার হোমিসাইড সেকশনের।
লোক দুটি বিরক্ত হয়। বোধকরি তারা এত শীঘ্র নিজেদের পরিচয় দিতে চাইছিল না। দর্শনার্থীদের ভেক ধরে কিছু জেনে নেবার ইচ্ছে ছিল ওদের।
বাসু ডাক্তারের দিকে ফিরে বললেন, ঠিক আছে ডাক্তার! ব্লাড-টেস্ট করিয়ে রিপোর্টটা নিয়ে আসব কাল-পরশুর মধ্যেই। তুমি ফি নিলে না -- আমি পীড়াপীড়ি করব না, বরং বলব ওকালতি পরামর্শের প্রয়োজন হলে অসংকোচে ফোন কর। একটা কথা এখনই বরং বলে যাই -- এই দুজন লালবাজারি ভদ্রলোকের কোনো প্রশ্নের জবাব না দেবার সাংবিধানিক অধিকার তোমার আছে...
-- ব্যস! ব্যস! ব্যস! যথেষ্ট হয়েছে। এবার আপনি আসুন বাসু-সাহেব!
দু-জন এসে দাঁড়ায় বাসু-সাহেবের দু-পাশে।
বাসু-সাহেবের চোখ দুটো ধ্বক করে একবার জ্বলে উঠল। তিনি পকেট থেকে নামাঙ্কিত একটি কার্ড বার করে টেবিলের উপর রেখে বললেন, এরা দু-জন কেন এসেছেন তা আমি জানি না। আন্দাজ করতে পারি। সম্ভবত তোমাকে লালবাজারে নিমন্ত্রণ জানাতে। আমার টেলিফোন নাম্বারটা তোমার মানিব্যাগে ভরে রাখ। প্রয়োজনে আমাকে ফোন কর।
একজন বলে ওঠে, আপনাকে উনি ফোন করবেন কেমন করে, স্যার? যে কেস-এ ওঁকে নিমন্ত্রণ জানাতে এসেছি সে কেস-এ আপনি তো আপনার ঘোড়া আগেই ধরে বসে আছেন! এক মার্ডার কেস-এ তো দু-জন নেওয়া চলে না। দু-জনের ইন্টারেস্ট ক্ল্যাশ করেতে পারে। পারে না?
বাসু ওর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ডাক্তারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আমি যদি তোমার জায়গায় থাকতাম ডাক্তার, তাহলে ওদের একটা প্রশ্নেরও জবাব দিতাম না! আচ্ছা চলি! গুড লাক টু এভরিবডি!
আলিপুর আদালতে ডিস্ট্রিক্ট আ্যান্ড সেশনস জাজ প্রণব মুখার্জি তার চেম্বার থেকে আদালতে ঢুকে নিজের আসনে বসতে গিয়ে হঠাৎ থমকে গেলেন। চশমার উপর দিয়ে আদালত-কক্ষের উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে কোর্ট-পেশকারকে প্রশ্ন করেন, কী ব্যাপার? এখন তো সেই ‘আ্যানালমেন্ট’ কেসটা হবার কথা?
পেশকার সসন্ত্রমে বলে, আজ্ঞে হ্যাঁ, হুজুর। ‘দ্যা কেস অব্ রাও ভার্সেস রাও’ অর্থাৎ ছন্দা দেবী বনাম ত্রিদিবনারায়ণ।
-- হুঁ। কিন্তু আদালতে এত লোক কেন তাহলে?
বিচারকের ডানদিকে দর্শকের আসনে বসেছিলেন পাবলিক প্রসিকিউটার নিরঞ্জন মাইতি। তিনি উঠে দাড়িয়ে বললেন, এঁদের কিছু লোক বাদী অথবা প্রতিবাদীর আত্মীয়-বন্ধু, কিছু আলিপুর আদালতের উকিল এবং কিছু সাংবাদিক। বাদী বা প্রতিবাদীর তরফে কোনো আপত্তি না থাকায় এরা কেসটা শুনতে এসেছেন। সবাই আশা করছেন, এটা একটা উল্লেখযোগ্য মামলা হিসাবে রেকর্ডেড হয়ে থাকবে। তাই সকলে উৎসাহী।
জজসাহেব জানতে চান, আপনি কি বাদীপক্ষের আ্যাটর্নি?
-- আজ্ঞে না, হুজুর। বাদীপক্ষের অ্যাটর্নি অ্যাডভোকেট গোপালচন্দ্র রায় -- এই ইনি। আমি দর্শকমাত্র। বাদী একটি হত্যা-মামলার সাক্ষী এবং প্রতিবাদী ওই মামলারই আসামি। তাই স্টেটের স্বার্থ দেখতে আমি উপস্থিত আছি।
বিচারক এবার তার টেবিলে দাখিল করা ফাইলটা তুলে নিয়ে পড়লেন, ‘দ্য কেস অব রাও ভার্সেস রাও’। বাদী শ্রীত্রিদিবনারায়ণ রাও, সান অব ত্রিবিক্রমনারায়ণ রাও অব নাসিক। তাঁর পক্ষে আছেন অ্যাডভোকেট শ্রী গোপালচন্দ্র রায়।
বাদীপক্ষের গাউনপরা একজন উকিল উঠে দাঁড়ালেন। মুখেও বললেন, ইয়েস, য়োর অনার।
প্রতিবাদী শ্রীমতী ছন্দা রাও, “নে” বিশ্বাস -- এর তরফে কাউল্সেল আছেন শ্রী পি. কে. বাসু বার-অ্যাট-ল।
প্রতিবাদীর তরফে বাসু-সাহেব হাত তুলে আত্মঘোষণা করলেন।
বিচারক জানতে চাইলেন, আপনাদের দু-জনের মধ্যে কারও দাবী নেই যে, আদালত-কক্ষে দর্শক বা প্রেসের লোক থাকবে না?
গোপালচন্দ্র একটি “বাও” করে বললেন, বাদীর তরফে নেই হুজুর। আমরা মনে করি, হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্টে কী কী প্রভিশন্স আছে, কীভাবে তার প্রয়োগ হয়, তা জনসাধারণের জানা বাঞ্ছনীয় । ঘটনাচক্রে এক্ষেত্রে বাদী একজন ধনকুবেরের একমাত্র ওয়ারিশ এবং প্রতিবাদী একটি হত্যা মামলার বিচারাধীন আসামি। তাই এ বিষয়ে সাধারণের যথেষ্ট কৌতৃহল জাগ্রত হয়েছে। আমরা তা প্রশমিত করতে চাই না।
পি. কে. বাসুর দিকে ফিরে বিচারক বললেন, আপনার কী অভিমত?
বাসু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি সহযোগীর সঙ্গে একমত। ঘটনাচক্রে বাদীর পিতা ধনকুবের শ্রীত্রিবিক্রমনারায়ণ রাও স্বয়ং পুত্র ও পুত্রবধূর বিবাহ নাকচের মামলায় উপস্থিত হয়েছেন। তার প্রাসাদ থেকে পুত্রবধূকে বিতাড়ন করতে! প্রতিবাদী আইনসঙ্গত অধিকার বলে তার শ্বশুরমশাইকে সে-অপরাধে আদালতকক্ষ থেকে বিতাড়ন করতে চান না।
ত্রিবিক্রমের কর্ণমূল রক্তাক্ত হয়ে উঠল। তিনি পাথরের মূর্তির মতো বসেই রইলেন।
বিচারক বললেন, অল রাইট। কিন্তু প্রেসের তরফে যারা এসেছেন তাদের আমি আগেভাগেই জানিয়ে রাখছি, আদালতের ভিতর তারা যেন কোনো ফটো না তোলেন।
বিচারকের নির্দেশে আদালতকক্ষের দু-পাশের দু-টি দরজা খুলে গেল। বাদী ও প্রতিবাদী প্রহরাধীন অবস্থায় আদালতে প্রবেশ করলেন। ঘটনার রাত্রিপ্রভাতে ছন্দা ঘুম ভেঙে উঠে দেখেছিল তার শয্যার বাকি আধখানা খালি। তারপর থেকে দু-জনের আর সাক্ষাৎ হয়নি। ছন্দা তাই নিজের অজান্তেই অস্ফূট একটা শব্দ উচ্চারণ করে দ্রুত পায়ে ত্রিদিবের দিকে এগিয়ে যেতে চাইল। আদালত-কক্ষে একজন মহিলা-আরক্ষা কর্মী তার গমনপথে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে তাকে রুখল।
ত্রিদিব স্ত্রীর দিকে দৃষ্টিপাত মাত্র করেনি। মাথা সোজা রেখে সে ধীরপদে এগিয়ে গেল তার জন্য নির্দিষ্ট চেয়ারটার দিকে। বোধকরি ঘটনাচক্রেই সেই চেয়ারটি খালি রাখা ছিল তার স্বনামধন্য পিতৃদেবের পাশেই।
ছন্দা শুধু হতাশ নয়, কিছুটা অপমানিত বোধ করল। ধীরপদে সে এসে বসল বাসু-সাহেবের পাশে খালি চেয়ারে।
বিচারক আদালতের নীরবতা ভঙ্গ করে ঘোষণা করলেন, বাদী এবং প্রতিবাদী দু-জনেই এতক্ষণ ছিলেন পুলিশের হেপাজতে। প্রতিবাদী একটি হত্যা মামলার জামিন প্রত্যাখ্যাত আসামি হিসাবে এবং বাদী ওই মামলার একজন গুরুত্ত্বপূর্ণ সাক্ষী হিসাবে। আদালতের সম্মুখে যে বিচার্য মামলাটি রয়েছে দেখা যাচ্ছে বাদীর সেই আবেদনপত্রটি পাবলিক প্রসিকিউটারের দফতর ঘুরে এসেছে। তাতে একটি নোটও আছে। বিচার্য মামলাটি একটি রেজিস্ট্রি করা বিবাহ ‘অ্যানাল’ বা নাকচ করা সংক্রান্ত। আবেদনপত্রে অভিযোগ করা হয়েছে যে, বিবাহকালে প্রতিবাদীর স্বামী জীবিত ছিলেন এবং সে কারণে ত্রিদিবনারায়ণ ও ছন্দাদেবীর বিবাহটা অসিদ্ধ। আমরা বর্তমানে, এই তথ্যটি শুধু যাচাই করে রায় দেব। তার বাইরে কোনো কিছু আলোচনা করা চলবে না! আমি আরও স্পষ্ট ভাষায় পূর্বে দু-পক্ষকে জানিয়ে রাখতে চাই যে, দুই পক্ষের উপস্থাপিত সাক্ষীদের জেরা করতে গিয়ে ওই হত্যা মামলা সংক্রান্ত কোনো তথ্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা আদালত অনুমোদন করবে না। আশা করি আমার বক্তব্যটা দু-পক্ষই প্রণিধান করেছেন।
ত্রিবিক্রম পাথরের মূর্তির মতো নিস্পন্দ বসে রইলেন; কিন্তু নিরঞ্জন মাইতি স্পষ্টতই খুশি হয়ে বলে বসলেন, হ্যাঁ, হুজুর!
বাসু কোনো জবাব দিলেন না। নীরবে মাথা নেড়ে সায় দিলেন।
আদালতে উপস্থিত প্রতিটি আইনজীবী বুঝতে পারলেন যে, মামলা শুরু হবার আগেই প্রতিবাদীপক্ষ হারতে শুরু করেছে। বিচারক ক্রস এগজামিনেশন করার অধিকার কেড়ে নিয়ে শুধু বাসু-সাহেবকেই বঞ্চিত করলেন : কারণ ছন্দাকে বাদীপক্ষের উকিল কোনো মারাত্মক প্রশ্ন করলে বাসু-সাহেব অনায়াসে বলতে পারেন যে, সে জবাব দেবে না; কারণ জবাব দিলে সে নিজেকেই ‘ইনক্রিমিনেট’ করবে -- হত্যা-মামলায় স্বীকৃতি হিসাবে সে জবাব গৃহীত হবার আশঙ্কা আছে। অপরপক্ষে বাদী পক্ষের উকিলের সে সুযোগ ছিল না। সেই সুযোগটুকুই বিচারকের নির্দেশে এখন লাভ করলেন গোপালবাবু।
অ্যাডভোকেট গোপালচন্দ্র রায় উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, বাদীপক্ষের প্রথম সাক্ষী : শ্রীত্রিদিবনারায়ণ রাও।
ত্রিদিব তার বাবার দিকে তাকাল। ত্রিবিক্রম ওর পিঠে একট! হাত রাখলেন। ত্রিদিব উঠে দাঁড়াল। পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে সাক্ষীর কাঠগড়ায় উঠে এল। শপথবাক্য পাঠ করার সময় তার অশান্ত চুলের গোছাটা নেমে এল বাঁ-চোখের উপর। ত্রিদিব হাত দিয়ে সেটা সরিয়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল।
-- আপনার নাম শ্রীত্রিদিবনারায়ণ রাও?
-- ইয়েস।
-- আপনি আলিপুরের বাসিন্দা? কলকাতায় থাকেন?
-- ইয়েস।
-- প্রতিবাদী ছন্দা রাওকে আপনি চেনেন?
--চিনি।
-- ওঁকে প্রথম কোথায় দেখেন?
-- বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে সানিসাইড নার্সিংহোমে। ওঁকে আমি নাইট নার্স হিসেবে নিয়োগ করেছিলাম।
--পরে, মানে নার্সিংহোম থেকে বাড়ি ফেরার পরে, ওই ছন্দাদেবীকে আপনি রেজিস্ট্রিমতে বিয়ে করেন, --একথা সত্যি?
-- সত্যি।
-- তারিখটা মনে আছে আপনার?
-- আছে। পনেরোই জুন।
-- বর্তমান বছরে? এই একানব্বই সালে?
--ইয়েস।
গোপালচন্দ্র বিচারকের দিকে ফিরে বললেন, আমার সওয়াল শেষ হয়ে গেছে হুজুর!
বাসসাহেবের দিকে ফিরে বললেন, য়োর উইটনেস্।
বাসু হাসি হাসি মুখে বললেন: নো কোশ্চেনস্।
গোপালচন্দ্র বসে পড়েছিলেন। পুনরায় উঠে দাঁড়ালেন। সবিষ্ময়ে বললেন, মানে? আপনি ক্রস করতে চান না?
বিচারক ত্রিদিবের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি নেমে আসুন।
গোপালচন্দ্র এবং ত্রিদিব দু-জনেই বিস্মিত। ওঁরা কেউই এটা প্রত্যাশা করেননি। বাসুসাহেবের জোরালো সওয়ালের জবাব কীভাবে দিতে হবে তার অনেক তালিম নিতে হয়েছিল ত্রিদিবকে, দেখা গেল, বৃথাই। দর্শকদের মধ্যেও বিস্ময়ের অনুভূতিটা সংক্রামিত হয়েছে মনে হল ! কিছুটা হতাশাও। ফিসফিস্ গুজ-গুজ শুরু হতেই বিচারক তাঁর কাঠের হাতুড়িটা ঠুকলেন।
আদালতে নিস্তব্ধতা ফিরে এল।
গোপালচন্দ্র বললেন, য়োর অনার! এবার আমি প্রতিবাদীকে সাক্ষীর মঞ্চে উঠে দাঁড়াতে অনুরোধ করব। কিন্তু তার পূর্বে আমি নিবেদন করতে চাই যে, ‘আন্ডার দ্য কোড অব সিবিল প্রসিডিওর, আমি প্রতিবাদীকে 'অ্যাডভার্স পার্টি' হিসাবে ধরে নিয়ে সওয়াল করব। এবং সেটা করব, প্রতিবাদীপক্ষের কাউন্সেল তাঁকে সাক্ষী হিসাবে কাঠগড়ায় তোলার পূর্বেই।
বিচারক বাসু সাহেবর দিকে তাকিয়ে দেখলেন।
বাসু গোপালচন্দ্রকেই প্রশ্ন করলেন, প্রতিবাদীকে জেরা করে আপনি কী তথ্য প্রতিষ্ঠা করতে চান?
গোপালচন্দ্রের ভ্রূকুটি হল। বললেন, সে-কথা আমি আগে-ভাগে জানাতে বাধ্য নই। আমার স্ট্র্যাটেজি আমি সহযোগীকে আগেই জানিয়ে দেব কেন?
বাসু বললেন, আদালত যে নির্দেশ দিয়েছেন সেই অনুসারে আমি জানতে চাইছি-- আপনি প্রতিবাদীকে জেরা করে কী তথ্য প্রতিষ্ঠা করতে চান? সেটা জানলে, আমরা হয়তো তা ‘স্টিপুলেট’ করতে পারি।
-- পারেন। আবার নাও পারেন। আমি কী প্রতিষ্ঠা করতে চাই তা আগেভাগে জেনে নিয়ে আপনি এ-কথাও বলতে পারেন যে, আপনি তা 'স্টিপুলেট' করছেন না। মেনে নিচ্ছেন না।
তখন? ‘আন্ডার দ্য কোড অব সিবিল প্রসিডিওর’ আমি আমার অধিকার সম্বন্ধে রুলিং চাইছি।
বিচারক বাসু-সাহেবের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন, প্রতিবাদীকে সাক্ষীর মঞ্চে ওঠানোতে আপনার আপত্তি আছে, কাউন্সেল?
বাসু বলেন, নো, ইয়োর অনার। আমি শুধু আদালতের সময় বাঁচাতে চাইছি। সহযোগী তাঁর অধিকারের প্রশ্ন তুলেছেন-- 'আণ্ডার দ্য. কোড অব্ সিবিল প্রসিডিওর'। আমি জানতে চাই প্রতিবাদীর কাউন্সেল হিসাবে আমার অধিকার আছে কিনা আমার মক্কেলকে নির্দেশ দেবার যে, সহযোগীর প্রতিটি প্রশ্নের জবাবে সে বলবেঃ ‘এ প্রশ্নের জবাব আমি দেব না, কারণ, তাহলে পরবর্তী হত্যা-মামলায় আমি নিজেকেই ‘ইনক্রিমিনেট' করব! এমন কী সহযোগী যদি তার নাম জিজ্ঞাসা করেন, তার হাতঘড়িতে কটা বাজে তা জানতে চান? তাহলেও? সো হোয়াট? আমিও আদালতের রুলিং চাইছি। ‘আন্ডার দ্য কোড অব সিবিল প্রসিডিওর’ আমার কি সে অধিকার নেই?
বিচারক চিন্তিতভাবে মাথা নাড়লেন।
গোপালচন্দ্র নিরুপায় ভাবে বললেন, অল রাইট! আমি বলছি, প্রতিবাদিণীকে সাক্ষীর কাঠগড়ায় তুলে কী তথ্য প্রতিষ্ঠা করতে চাইছি। এক- নম্বরঃ আপানি কি মেনে নেবেন যে, এ বছর পনেরোই জুন বিবাহের পূর্বে যখন প্রতিবাদী ছন্দা বিশ্বাস ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের খাতায় সই করেন তখন তাঁর পূর্বতন স্বামী জীবিত ছিল? সেই পূর্বতন স্বামীর নাম কমলেশ বিশ্বাস, ওরফে কমলাক্ষ কর, ওরফে কমলচন্দ্র ঘোষ? যে লোকটি এ বছর বাইশে জুন তারাতলার মা-সম্তোষী অ্যাপার্টমেন্ট-এ মধ্যরাতে হত হয়েছে?
-- হ্যাঁ, আমরা মেনে নিচ্ছি।
গোপালচন্দ্র যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। বিচারকের কপালে একটা ভ্রূকুটি-চিহ্ন ফুটে উঠল। তিনি উভয়ের দিকে একবার করে দেখে নিয়ে নীরবে রুমাল দিয়ে চশমার কাঁচটা মুছতে শুরু করলেন।
হঠাং গোপালচন্দ্র আবার বাঙ্ময় হয়ে ওঠেন।
আমি প্রতিবাদীকে আরও একটি বিষয়ে প্রশ্ন করতে চাইঃ ২ পাম অ্যাভেনু যেখানে বন্ডেল রোডে পড়েছে তারই কাছাকাছি সানি-সাইড নার্সংহোমে উনি নার্স হিসাবে চাকরি করতেন কি না?
-- হ্যাঁ, আমরা মেনে নিচ্ছি। করতেন।
-- এবং ওই নার্সিংহোমে, তিন বছর আগে সাআশে মার্চ উনিশশো অষ্টআশি সালে একজন রোগী লাং ক্যানসারে ভুগে মারা যায়, যার নাম কমলেশ বিশ্বাস -- আমি প্রাতবাদীকে জিজ্ঞাসা করতে চাই, তিনি ওই কমলেশ বিশ্বাসকে চেনেন কি না?
বাসু বললেন, আপনার পূর্ববর্তী প্রশ্নের উত্তরে আমরা ‘স্টিপুলেট করেছি যে, এ বছর পনেরোই জুন প্রতিবাদী ছন্দা বিশ্বাস যখন ত্রিদিব রাওকে বিবাহ করে তখন ছন্দার পূর্ববৎ স্বামী কমলেশ বিশ্বাস জীবিত ছিল। সেই 'স্টিপুলেশন’ মোতাবেক তিন বছর আগে অন্য কোথাও ওই একই নামের আর একজন লোক লাং ক্যানসারে মারা গিয়োছল কী না, সেটা বর্তমান মামলার পক্ষে ইমমেটেরিয়াল, ইররেলিভেণ্ট ! আই অবজেক্ট !
বিচারক রায় দিলেনঃ অবজেকশান ইজ সাসটেইণ্ড। প্রসিড্!
গোপালচন্দ্র বললেন, তাহলে আমার আর কোনো বক্তব্য নেই।
বাসু উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, প্রতিবাদী পক্ষের প্রথম সাক্ষী শ্রীমতী অনসূয়া কর।
নকিবের ব্যবস্থাপনায় নামটা ঘোষণা হল। পাশের ঘর থেকে একটি মেয়ে –বছর ত্রিশ বত্রিশ বয়স তার – সাক্ষীর মঞ্চে দাঁড়িয়ে শপথ নিল।
-- আজ্ঞে হ্যাঁ।
-- তুমি কুমারী, বিবাহিতা না বিধবা?
-- আমি বিধবা।
-- তোমার স্বামী কত তারিখে মারা গেছেন?
-- এ বছর বাইশে জুন।
-- কোথায়?
-- তারাতলায়। মা-সন্তোষী অ্যাপার্টমেন্টের মেজানাইন ঘরে।
-- তার নাম কমলেশ বিশ্বাস?
-- আমি জানতাম তার নাম কমলাক্ষ কর। খবরের কাগজে তার মৃত্যুর খবর পড়ে আমার দিদির সঙ্গে কমলেশ বিশ্বাসের ইনকোয়েস্ট-এর সময় আমি দেখতে গিয়েছিলাম। তাকে তখন চিনতে পারি। তাই আমি জানি, কমলেশ বিশ্বাস আর কমলাক্ষ কর একই ব্যক্তি।
-- তুমি নিঃসন্দেহ যে, তোমার স্বামী কমলাক্ষ কর এবং মা-সন্তোষী অ্যাপার্টমেন্টে নিহত কমলেশ বিশ্বাস একই ব্যক্তি?
-- আজ্ঞে, হ্যাঁ।
-- তুমি তাকে কি হিন্দু-মতে বিবাহ করেছিলে, না রেজিস্ট্রি ম্যারেজ?
-- রেজিস্ট্রি ম্যারেজ।
-- কত তারিখে?
-- পাঁচ সেপ্টেম্বর উনআশি সালে।
-- তুমি কি তোমার রেজিস্ট্রি-বিবাহের সার্টিফিকেটের একটি জেরক্স কপি এবং তোমাদের যুগলে তোলা ছবি নিয়ে এসেছ। এনে থাকলে আমাকে দাও।
মেয়েটি একটি সার্টিফিকেট এবং একটি ফটো বাসু-সাহেবকে দেয়।
বাসু সে-দুটি গোপালচন্দ্রকে দেখতে দিলেন। বললেন, প্রতিবাদী তরফের একজিবিট হিসাবে এ দুটি আদালত দাখিল করতে চাই।
গোপালচন্দ্র তড়াক করে উঠে দাঁড়ান। বলেন ইয়োর অনার? আমি এই সাক্ষীর জবানবন্দী আদ্যোপান্ত নাকচ করার আর্জি জানাচ্ছি। প্রশ্নোত্তরের সবটাই ‘ইনকম্পিটেন্ট, ইররেলিভেন্ট অ্যান্ড ইম্মেটিরিয়াল’ -- অপ্রাসঙ্গিক এবং প্রক্ষিপ্ত। কমলাক্ষ কর আর কমলেশ বিশ্বাস একই লোক কী না প্রমাণ হয়নি। আর হলেই বা কী? লোকটা রিবাহ-বিশারদ ছিল--এমন কথা সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। হয়তো এমন বিয়ে সে আরও পাঁচটা করেছে। তাতে কী? প্রতিবাদী তার প্রথম পক্ষের স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করতে পারতেন। তা তিনি করেননি।
বিচারক বাসু-সাহেবের দিকে ফিরে বলেন, আপনি কি কিছু বলবেন?
বাসু একটি বাও করে বলেলেন, ইয়োর অনার! ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে ‘হংস যা ভক্ষণ করে তা হংসীও খেতে পারে।’ আমার মনে হয় ওর কনভার্সটাও ট্রু! অর্থাৎ ‘হংসী যা ভক্ষণ করতে পারে, হংসও তা পারে!’ অর্থাৎ যে কারণে বিচক্ষণ সহযোগী ছন্দার সঙ্গে ত্রিদিবের বিবাহটা নাকচ করতে চাইছেন সেই হেতুটাই ওঁরই যুক্তি-মোতবেক নাকচ হয়ে যাচ্ছে। সহজ ভাষায়: কমলেশ বিশ্বাস যখন ছন্দাকে বিবাহ করে তখন কমলেশের পূর্বতন পত্নী অনসূয়া দেবী জীবিতা। সুতরাং আন্ডার দ্য স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট নং ফর্টি-থ্রি অব নাইন্টিন সিক্সটি-ফোর, আন্ডার সেকশন ফোর, ছন্দার সঙ্গে কমলেশের রেজিস্ট্রি বিবাহ অসিদ্ধ। তার ফলে, ছন্দা যখন ত্রিদিবকে বিবাহ করে তখন আইন মোতাবেক ছন্দার কোনো পূর্বতন স্বামী ছিল না। সে ছিল অবিবাহিতা। অর্থাৎ ত্রিদিব এবং ছন্দার বিবাহ সে-কারণে নাকচ করা যায় না।
নিরঞ্জন মাইতি এই সময় বলে ওঠেন, কিন্ত কমলাক্ষ কর আর কমলেশ বিশ্বাস যে একই লোক তা-তো প্রমাণ হয়নি।
বাসু বলেন, তা-প্রমাণ করার দায় বাদীপক্ষের। যতদিন তা-প্রমাণ করতে না পারছেন ততদিন ওই অজুহাতে ছন্দা ও ত্রিদিবের রেজিস্ট্রি বিবাহ নাকচ করা যায় না। অন্তত ততদিন ওরা বৈধ স্বামী-
বিচারক দু-পক্ষের উকিলকে প্রশ্ন করলেন, তাঁদের আর কারও বক্তব্য আছে কি না। দু-জনেই জানালেন, না, নেই।
এবার বিচারক স্বয়ং সাক্ষীকে প্রশ্ন করেন, তোমাকে এবার আমিই দু-একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি, মা। প্রথমে বলতো, তুমি ওই কমলেশ বিশ্বাসের ইনকোয়েস্টে কেন গেছিলে? তুমি তো কমলেশ বিশ্বাসের নামও জানতে না।
অনসূয়া বলল, না হুজুর, জানতাম। ওই ছন্দা দেবী যখন কমলেশ বিশ্বাসের সঙ্গে বেলেঘাটার বস্তিতে স্বামী-স্ত্রী হিসাবে বাস করতেন, তখন আমার দিদি সেখানে খোঁজ নিতে গেছিলেন। তিনি আমার স্বামী কমলাক্ষ করের ফটো ওই প্রতিবাদী বিশ্বাসকে দেখান এবং ছন্দা দেবী চিনতে পারেন। বুঝতে পারেন যে, আমরা দু-জন একই লোকের স্ত্রী। তাই হুজুর, আমি খবরের কাগজে কমলেশ বিশ্বাসের নাম দেখে তাকে চিনতে পারি।
-- কিন্ত স্বচক্ষে মৃতদেহ দেখতে যাবার মূল প্রেরণাটা কী?
অনসূয়া বিচারকের চোখে-চোখে রেখে অকপটে বলল, আমি জানতে গেছিলাম যে, দ্বিতীয়বার বিবাহ করার অধিকার আমার এতদিনে বর্তেছে কি না। আমার স্বামী আমার গহনা চুরি করে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছিল।
-- তুমি তাহলে নিঃসন্দেহ যে, ওই মৃত ব্যক্তি আর তোমার স্বামী একই লোক?
-- আজ্ঞে হ্যাঁ, য়োর অনার।
-- এবার তুমি মঞ্চ থেকে নেমে এস, মা। হয়তো বর্তমান মামলার পক্ষে এটা অপ্রাসঙ্গিক হচ্ছে, তবু আমি খুশি মনে তোমাকে আশীর্বাদ করছি -- তোমার এই, দ্বিতীয়বারের বিবাহ সুখের হোক।
অনুসূয়া সাক্ষীর মঞ্চের রেলিঙে মাথাটা ঠেকালো প্রণামের ভঙ্গিতে।
বিচারক কোর্ট-পেশকারের দিকে ফিরে বললেন, লিখে নাও: জাজমেন্ট! বাদীর দাবি নাকচ করা হল। কোর্ট ইজ্ অ্যাডজর্নড।
বিচারক উঠে দড়ালেন। সবাই উঠে দাঁড়ায়! বিচারক কক্ষ অ্যাগ করেন। ছন্দা হঠাৎ এগিয়ে যায় ত্রিদিবের দিকে। মহিলা-পুলিশ ওর ধরে ফেলে। ছন্দা তাকে ধমকে ওঠে, আমি পালিয়ে যাচ্ছি না। ছাড়ুন! শুনলেন না -- ওই ভদ্রলোক আমার স্বামী?
ত্রিবিক্রমনারায়ণ দৃঢ়মুষ্টিতে পুত্রের বাহুমূল ধরেছিলেন। তাকে আকর্ষণ করে বললেন, চলে এস।
ছন্দা তাকেও ধমকে উঠল: ওয়েট! আপনি কী রকম ভদ্রলোক মিস্টার রাও? এটিকেট জানেন না? পুত্র ও পুত্রবধূর মধ্যে যখন জনান্তিক আলাপ হয় তখন সেখানে শ্বশুরকে থাকতে নেই – এটা আপনাদের ‘শক্তাবৎ খানদানে’ কেউ শেখায়নি?
ত্রিবিক্রমনারায়ণ বজ্রাহত হয়ে গেলেন। একটি পাবলিক প্লেসে কোনো একজন মরমানুষ যে তাঁকে এভাবে প্রকাশ্যে অপমান করতে পারে তা ছিল তাঁর দুঃস্বপ্নের বাইরে। তবু ধুরন্ধর ব্যবসায়ী মুহূর্তে সামলে নিলেন নিজেকে। বললেন, তুমি যে এখনও খুনের মামলায় জামিন-না-পাওয়া আসামী, বউমা! এই সময় সর্বসমক্ষে স্বামী-সম্ভাষণের অধিকার থাকে না। যাও মা, হাজতে যাও!
জবাবে ছন্দা কী-যেন বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার পূর্বেই ত্রিদিব বলে উঠল, তাছাড়া শক্তাবৎ রাজবংশে কেউ কখনও দ্বিচারিণী স্ত্রীর সঙ্গে বাক্যালাপ করে না। চল, ড্যাডি!
এবার বজ্রাহত হবার পালা ছন্দার।
সে শুধু অস্ফুটে বললে: কী বললে? দ্বিচারিণী?
ত্রিদিব জবাব দিল না। এবার সেই আকর্ষণ করল তার বাবাকে। ওরা সবাই ততক্ষণে আদালত কক্ষ থেকে বারান্দায় বেরিয়ে এসেছে। আর তৎক্ষণাৎ দু-তিনটে ক্যামেরা বিদ্যুৎচমকে এই দাম্পত্য-কলহের ক্ষণিক উন্মাদনাকে শাশ্বত করে ধরে রাখল।
মহিলা-পুলিশ ছন্দার বাহুমূল ধরে এগিয়ে চলল পুলিশ-ভ্যানটার দিকে। গাড়িতে উঠতে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো ছন্দা। বলল, কই, উনি কোথায়?
-- কে?
--- আমার কাউন্সেলার? মিস্টার পি. কে. বাসু?
বাসু-সাহেব এগিয়ে এসে বললেন, এখানে কোনো কথা নয়, ছন্দা। আমি হাজতে গিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করব।
চোদ্দ
আদালত থেকে ফিরে এসে সান্ধ্য চায়ের আসরে বাসু-সাহেব তাঁর স্ত্রীকে শোনাচ্ছিলেন সেদিন কোর্টে কেসটা কী ভাবে মোড় নিল।
সুজাতা বলে, একটা কথা, মামু। আইনের প্যাঁচে আপনি ছন্দার সঙ্গে ত্রিদিবনারায়ণের বিয়েটা নাকচ হতে দিলেন না। কিন্ত ত্রিবিক্রম কি কোনদিন ওকে পুত্রবধূ বলে স্বীকার করে নেবে?
বাসু বলেন, খুব সম্ভবত, না। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা ত্রিদিবের অ্যাটিচুড: আমি কাল জেল- হাজতে যাব। ছন্দাকে দিয়ে বিবাহ-বিচ্ছেদ দরখাস্তে সই করিয়ে আনব। ছন্দা ‘হেভি ড্যামেজ আর অ্যালিমনি’ দাবী করবে। দশ লক্ষ টাকা।
-- দশ লক্ষ! কী হেতু দেখাবে?
-- নিষ্ঠুরতা। ত্রিদিব চরম বিপদের সময় স্ত্রীকে শুধু ফেলে পালিয়েই যায়নি। পুলিসের কাছে গিয়ে মিথ্যে এজাহার দিয়েছে৷ খবরের কাগজে তার স্টেটমেন্ট ছাপানো হয়েছে। তাছাড়া আজ প্রকাশ্যে আদালত প্রাঙ্গণে স্ত্রীকে দ্বিচারিণী বলে ভর্ৎসনা করেছে! সে কারণেই বিবাহ-বিচ্ছেদ এবং খেশারত।
রানু বললেন, আমার ধারণা: ত্রিবিক্রম দশ লক্ষ-টাকার চেক লিখে দিয়ে বিবাহ-বিচ্ছেদটা এক কথায় মেনে নেবেন। কারণ ছয় মাসের মধোই নিজের সমাজের কোন এক কোটিপতির মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দেবেন। দশ লাখ টাকার উপর সুদ’টুকু কষে দহেজ দাবী করবেন। আদায়ও করবেন।
বাসু বললেন, আমি রানুর সঙ্গে প্রকমত। দহেজ হিসাবে দশলাখ টাকা আদায় করতে পারুক-না-পারুক ছন্দার মতো একটি মেয়েকে তার ‘হাভেলি’তে সে কিছুতেই ঢুকতে দেবে না। ছন্দা যে কী পরিমাণ বিপদজনক তা ত্রিবিক্রম বুঝেছে। মাত্র সাতদিনে সে ত্রিদিবকে বাবার দুর্ভেদ্য দুর্গ থেকে বার করে এনেছিল।
কৌশিক বলে, কোথায়? নিজের চোখেই তো আদালতে দেখলেন, সে স্ত্রীকে ত্যাগ করে বাবার বগলের তলায় ফিরে গেল...
-- সেটাই একমাত্র সত্য নয়, কৌশিক। এ-কথা তুমি অস্বীকার করতে পার না যে, ছন্দার প্রভাবে ত্রিদিব বাবাকে না জানিয়ে একজন সাধারণ নার্সকে রেজিস্ট্রি-বিয়ে করেছিল। হয়তো জীবনে প্রথম সে এ-ভাবে বাবার বিরুদ্ধে রুখে ওঠে। বিদ্রোহী হবার হিম্মৎ হয় তার!
হঠাৎ টেলিফোনটা বেজে উঠল। রানু ধরলেন, ফোন করছেন ডক্টর ব্যানার্জি। রিসিভারটা স্ত্রীর হাত থেকে নিয়ে বাসু বললেন, কী ব্যাপার? তোমার না আজ সকালে কলকাতার বাইরে যাবার কথা? কোথায় যেন টিকিট কেটেছ, হোটেল রিজার্ভ করেছ...
-- সব ভেস্তে গেছে, স্যার! কাল লালবাজারে আমাকে ওরা পেড়ে ফেলবার নানান চেষ্টা করে।
-- থাক, থাক। তোমার টেলিফোনটা ‘বাগড’ হয়ে থাকতে পারে!
-- বুঝেছি। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে লালবাজার থেকে আমার উপর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কোন প্রয়োজনে কলকাতার বাইরে গেলে আমার ঠিকানা যেন নার্সিংহোমে রেখে যাই। এবং ঠিকানা বদলালে তা যেন আমার কনফিডেনশিয়াল নার্সকে টেলিফোনে বারে বারে জানাই। এসব বিষয়ে আপনার সঙ্গে কিছু পরামর্শ করতে চাই। মানে সামনাসামনি বসে। টেলিফোনে নয়। কখন আসব?
বাসু বললেন, এ বিষয়ে আলোচনার কিছু নেই, ডাক্তার। তোমার মতো বিখ্যাত ডাক্তারের পক্ষে তোমার গতিবিধি নার্সিংহোম-এর কনফিডেনশিয়াল নার্সের জানা থাকা আবশ্যিক। তারপর এ বিষয়ে যদি লালবাজার থেকে বিশেষ নির্দেশ এসে থাকে তবে আর আলোচনার কী আছে? তুমি কলকাতার বাইরে যাচ্ছিলে স্বাস্থ্যের কারণে। ফলে আমার সঙ্গে পরামর্শের কিছু নেই। তোমার ফিজিশিয়ানের সঙ্গে পরামর্শ কর। টেলিফোনটা নামিয়ে রাখলেন বাসু।
পরদিন দেখা করতে এল বটুক দত্ত। তারাতলার সেই পানওয়ালা। বাসু-সাহেব বললেন, তোমার আবার কী হল?
-- বিপদে না পড়লে কে আর ডাক্তার-উকিলের কাছে দরবার করতে আসে? বলুন, স্যার?
-- বল?
বটুক হাতদুটি জোড় করে গরুড়পক্ষীর ভঙ্গিতে বললে, আপনারে ট্যাকা পয়সা দিতে পারব না হুজুর, তবে হ্যাঁ, উবগারের বদলে উবগার কিছু করতে পারি।
-- আগে শুনি, তুমি কী কারণে আমার দ্বারস্থ হয়েছ, তারপর ওসব কথা হবে। সাধারণ মানুষ আইনের প্যাঁচে বিপদগ্রস্ত হলে আমি বিনা পারিশ্রমিকেও আইনের পরামর্শ দিয়ে থাকি। তুমি সঙ্কোচ কর না। তুমি আমাকে পান খাওয়াওনি বটে, তার কারণ বাঁধানো দাঁতে পান আমি চিবুতে পারি না। নাও শুরু কর--
-- আপনি তো নিজের চোখেই দেখেছেন হুজুর, আমার পরিবার বড় এক-বগ্গা। আমার শ্বশুর ভীমা কৈবর্ত-মশাই ছিলেন একজন ডাকসাইটে ‘ইয়ে’ আর কি। পাঁচ-গাঁয়ের মানুষ তেনারে একডাকে চিনত। সদু আর কিছু পাক-না-পাক বাপের সেই একরোখা জিদ্দিবাজিটা পেয়েছে।
-- ভূমিকা তো হল, এবার আসল কথাটা বল।
-- পুলিশ ইন্সপেক্টার-সাহেবকে আমরা যে জবানবন্দি সেদিন দিছিলাম, তার মধ্যে কিছু গড়বড় ছিল। মানে, আমাদের তিনজনের এজাহার তিন রকম হয়ে যাচ্ছে...
-- তৃতীয়জন আবার কোথেকে এল? সৌদামিনীর পেটের সেই বাচ্চাটা?
-- আজ্ঞে না হুজুর, সে তো মায়ের পেটে ঘুমুচ্ছে। সে শুনবে কেমন করে?
-- এমন কান্ডও হয়, বটুক। তুমি শোননি? অভিমন্যু মায়ের পেটের ভিতর থেকেই চক্রব্যুহে ঢোকার পথটা চিনে নিয়েছিল।
-- সে সব সত্য-ত্রেতা যুগে হত, স্যার। কলিযুগে হয় না। তিন নম্বর মনিষ্যি, দোতলার ডাক্তারবাবু -- ডাক্তার নবীন দত্ত-সাহেব। তারেও তো সে-রাত্রে ডেকে এনেছিলাম। তিনিও টর্চের আলোয় খোলা জানলা দিয়ে ও-বাড়ির ভিতরটা দেখেছিলেন। তাঁর টেলিফোনেই...
-- হ্যাঁ বুঝেছি। তা তোমাদের কী-বিষয়ে মত-পার্থক্যটা হচ্ছে?
-- আমাদের তিন জনের জবানবন্দিতে আর কোন ফারাক নেই। ঝামেলা বাধছে মাত্র একটা বিষয়ে। এ কলিং-বেলটা নিয়ে...
-- ‘কলিংবেলটা’ মানে?
-- ডাক্তারবাবুর মতে এ একটানা শব্দটা রেল-ইঞ্জিনের হুইসিল।
-- রেল-ইঞ্জিন তারাতলা রোডে কেমন করে আসবে?
-- আসে, হুজুর। রেল-ইঞ্জিন আসে না, তার বাঁশির শব্দ আসে। নিশুতি রাতে মাঝেরহাট ব্রিজের তলা দিয়ে যদি কোনও ইঞ্জিন একটানা হুইসিল বাজাতে-বাজাতে না থেমে চলে যায় তাহলে তার শব্দ আমাদের পাড়া থেকে শোনা যায়।
-- বুঝলাম। ডাক্তারবাবুর মতে, ঘটনার সময় -- মানে কমলেশ যখন খুন হচ্ছে -- তখন বাইরে দাড়িয়ে কেউ ‘কল বেল’ বাজাচ্ছিল না -- এ সময় মাঝের-হাট ব্রিজের তলা দিয়ে একটা এঞ্জিন হুইসিল বাজিয়ে চলে যাচ্ছিল। তা, তোমার ঘরওয়ালী কী বলছে?
-- তার মতে এ সময় পাশের বাড়িতে টেলিফোন বাজছিল -- মানে ঐ কমলবাবুর ঘরেই।
-- আর তোমার কী মনে আছে?
-- আমার স্পষ্ট মনে আছে হুজুর, ওটা কমলবাবুর বাড়ির কলিংবেলের শব্দ। প্রথম কথা, টেলিফোনের শব্দ কখনো একটানা বাজে না, থেমে-থেমে বাজে । আমার একার নয়, ডাক্তারবাবুরও স্পষ্ট মনে আছে শব্দটা ছিল একটানা। সদু -- মানে আমার পরিবার, কিছুতেই মানবে না। মেয়েটা এমনিতেই একরোখা, জেদী, পোয়াতি হয়ে যেন মাথা কিনেছেন -- জিদ্দিবাজি আরও বেড়ে গেছে।
-- সদুর কথা থাক ; কিন্তু তুমি আর ডাক্তারবাবু কেন একমত হতে পারছ না?
-- ডাক্তারবাবু একটা কথা খেয়াল করছেন না। রেল ইঞ্জিনের শব্দে বেশ কিছুটা চন্দবিন্দুর ভেজাল থাকে...
-- কী ভেজাল থাকে?
-- আজ্ঞে এ ‘চন্দরবিন্দু’ আর কি! উ-ঞ জাতীয় শব্দে যা থাকে।
-- বুঝেছি। আনুনাসিক শব্দ।
-- আজ্ঞে তাই হবে হয়তো। এ আওয়াজে চন্দরবিন্দুর কোন ভেজাল ছিল না। ওটা তাই ইঞ্জিনের হুইসেল নয়। কলিং বেল।
-- বেশ তো। তা আমার কাছে কী পরামর্শ চাইতে এসেছ?
-- ভাক্তারবাবুর কথা ছাড়ান দ্যান। আমরা মাগ্-ভাতারে যদি দু-জনে দুরকম কথা বলি, তাহলে কি আমাদের ধরে চালান দেবে না?
-- তা কেন দেবে? দু’জনের অভিজ্ঞতা দুরকম তো হতেই পারে। হলপ নিয়ে সাক্ষীর কাঠগড়ায় নিছক সত্যি কথাই তো বলতে হবে। ..
-- অ্যাই দেখুন! তাই নয়? অথচ মুখুজ্জে সাহেব বলছেন…
-- কোন মুখার্জি-সাহেব?
বটুক দুহাতে নিজের কান স্পর্শ করে জিব বার করল। বলল. মুখ-‘ফক্সে’ বলে ফেলেছি, হুজুর। পুলিশ সাহেব পই-পই করে বারণ করেছেন। শাসিয়ে রেখেছেন -- কথাটা পাঁচকান হলে আমার জিব উপড়ে নেবেন।
-- ও বুঝেছি! ইন্সপেক্টর অসীম মুখার্জি! সে বুঝি তোমাকে তালিম দিতে গেছিল। কাঠগড়ায় উঠে কী বলতে হবে। তাই নয়?
-- আজ্ঞে হ্যাঁ, হুজুর। কথাটা গোপন রাখবেন স্যার। পুলিশের কাছে একবার যে এজাহার দিয়েছি, কাঠগড়ায় ডাইরে তার একটি কথা কি বদলাতে পারি? তাইলে জেল হয়ে যাবে না?
-- না, বটুক। তা যাবে না। পুলিসের কাছে প্রথম যে জবানবন্দি দিয়েছ তার কিছুটা পরিবর্তন তুমি অনায়াসে করতে পার সাক্ষী দিতে উঠে। বলতে পার, পরে ভেবে দেখেছ আগেকার দেওয়া এজাহারটা ভুল। শপথ নিয়ে তুমি একবারই সাক্ষী দিচ্ছ আদালতে, -- প্রথমবার পুলিসের কাছে যে এজাহার দিয়েছ, তা তো শপথ নিয়ে নয়!
বটুক এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে একটু ঝুঁকে সামনের দিকে এগিয়ে এল। নিচু গলায় প্রায় ফিস্-ফিস করে বলল, তাইলে এট্টা কথা বলব, হুজুর? ভয়ে বলব না নিভ্যয়ে বলব?
-- ভনিতা করছ কেন? যা বলবে বল না। আমি কাউকে জানাতে যাব না।
-- মুখুজ্জে-সাহেব বলছেন আমারে কবুল করতে হবে যে, আমি টর্চের আলোয় দেখতে পেয়েছিলাম যে লোকটা ফুটপাতে দাঁইড়ে ‘কলিং বেল’ বাজাচ্ছিল সে পুরুষ মানুষ। মুখ দেখতে পাইনি, কিন্তু তার পরনে ছিল প্যান্-শার্ট! এ নাকি নিয্যস স্বচক্ষে দেখিচি।
বাসু পাইপে বার দুই টান দিয়ে বললেন: হুঁ! অথচ আসলে তা তুমি দেখনি?
-- আজ্ঞে না, হুজুর। আমি ও-বাগে টর্চ ফোকাসই করিনি।
-- করলে, মানে ওদিকে টর্চের আলো ফেললে, তুমি তোমার ঘরের জানলা থেকে দেখতে পেতে: কে বেলটা বাজাচ্ছে?
-- আজ্ঞে, হ্যাঁ। তা দেখা যায়। কিন্ত হককথা বলব: ও-বাগে আমি উর্চের আলো একবারো ফেলিনি। মানে আমার যদ্দুর মনে পড়ে...
-- ডাক্তারবাবুর কদ্দূর মনে পড়ে? মানে টর্চের আলো ফেলার বিষয়ে?
-- না, হুজুর। ডাক্তারবাবুকে আমি যখন ডাকতে যাই তখন তো কলিং বেল বাজানো বন্ধ হয়ে গেছে।
-- তবে যে ডাক্তারবাবু বললেন, এঞ্জিনের শব্দ?
-- সে তো উনি নিজের খাটে শুয়ে শুয়ে শুনেছেন। তখনও আমি ওঁরে ডাকিনি। উনি যখন এসে দেখেন তখন ওই যে-লোকটা কলিং বেল বাজাচ্ছিল সে চলে গেছে৷
বাসু বললেন, বুঝলাম। তা সৌদামিনী কী বলছে? ওই টর্চের আলো ফেলার বিষয়ে?
-- ওই তো আমারে এখানে পাঠাল। আপনার কাছে জেনে যেতে যে, ওর আগেকার দেওয়া জবানবন্দিটা ও বদল করতে পারে কি না। নতুন করে বলতে পারে কি না যে, ও কিছুই দেখেনি, কিছুই শোনেনি। জানলার বাগে ও প্রথমটায় যায়নি।
-- তাতে কী লাভ?
-- তাহলে আমি বলতে পারি যে, আমি একাই জানলা দিয়ে টর্চের আলো ফোকাস করে মেঝেতে একটা লোকের নিথর ঠ্যাং দেখতে পাই ; আর টর্চের আলোটা ওই সদর-দরজার বাগে ফোকাস করে দেকিচি ফুটপাথে ডাঁইড়ে কলিং বেলের বোতামের গলার টিপে ধরেছিল। তারপর আমি সদুরে ডাকি। সে জানলার বাগে সরে আসে। দেখে, শুধু ওই নিথর ঠ্যাংখানা। ততক্ষণে ফুটপাথে ডাঁইড়ে যে কলিং বেল বাজাচ্ছিল, সে ভাগলবা।
-- এ ভাবে মিথ্যে সাক্ষী দেওয়ায় লাভ?
বটুক মাথা নিচু করে দাঁত দিয়ে নখ. খুঁটতে থাকে। নীরব।
-- বুঝলাম। তাতে তোমার কিছু আর্থিক লাভ হবে। তা মিথ্যে সাক্ষীই যদি দেবে তাহলে দু-জনেই তা দিচ্ছ না কেন? তোমরা স্বামী-স্ত্রী তো একই কথা বলতে পারো --
-- কী কথা?
-- ঐ মুখার্জি-সাহেব যে কথা বলতে বলছে। যে, তোমার পরিবার যখন জানলার কাছে সরে আসে তখনই তুমি টর্চের আলোটা রাস্তার দিকে ফেলেছিলে। তোমরা দু-জনেই দেখতে পাও যে, ফুটপাথে ‘ডাঁইড়ে’ যে মানুষটা ‘কল-বেল’ বাজাচ্ছে তার পরনে শার্ট-প্যান্ট! তাহলে কি মুখার্জি সাহেব তোমাকে যত টাকা দেবে বলেছে তার ডবল-টাকা দেবে না? দু-জন সাক্ষী একই কথা বললে তো ওদের কেসটা আরও জোরদার হয়।
-- তা হয় হুজুর। ডবল না দিলেও আমারে যত ট্যাকা বকশিস্ দেবে বলেছে, তার দেড়া দেবে নিশ্চয় -- মানে ঠিক মতো দরাদরি করতে পারলে কিন্তু মুশকিল কী হয়েছে জানেন হুজুর? সদু সাহস পাচ্ছে না।
-- সে কী! এই যে বললে, সে খুব ডাকাবুকো। তার বাপ ভীমা ডাকাতের মতো?
-- না হুজুর ‘ডাকাত’ কথাটা আমি বলিনি। ব্যাপারটা কী জানেন? সদুর সব বীরত্ব শুধু আমার উপর। পুলিশকে ও ভীষণ ডরায়। এটাও ওর বাপের কাছ থেকে পাওয়া । ভীমা কৈবর্ত কি কম ঠ্যাঙানি খেয়েছে পুলিশের হাতে। সদুর আদালত অভিজ্ঞতাও আছে। বাপের কেস শুনতে গেছিল। সাক্ষীর কাঠগড়ায় উকিলবাবুরা যে কীভাবে নাকাল করে তা ও জানে। তাই ও এখন এজাহার দিতে চায় যে, সে বিশেষ কিছু দেকেনি।
-- বুঝলাম। তা মুখার্জি-সাহেব কত টাকা দেবে বলেছে?
বটুক ঘাড় চুলকে বললে, পুলিশে আবার ট্যাকা বকশিস্ দ্যায় নাকি? এট্যাকা তো ওই রাও-সাহেব দিচ্ছে।
-- রাও সাহেব ত্রিবিক্রমনারায়ণ রাও?
-- আজ্ঞে। তিনি তো আর নিজে আমার কাছে আসেননি। আন্জাদ করছি।
বাসু নীরবে কিছুক্ষণ ধূমপান করে বললেন, তা আমার কাছে ঠিক কী জানতে এসেছ, বটুক? আমার মনে হচ্ছে মন খুলে তুমি সব কথা এখনও বলতে সাহস পাচ্ছ না, তাই না?
-- আজ্ঞে, তাই! আপনি ঠিকই আন্জাদ করছেন।
-- কথাটা কী?
-- আমরা মাগ-ভাতারে চাই না ওই নার্স-মেয়েটার -- ওই আপনার মক্কেল আর কী – তার ফাঁসি হয়ে যাক।
-- ফাঁসিই যে হবে তা ধরে নিচ্ছ কেন?
-- না হয়, মেয়াদই হল। ট্যাকার জোরে ওই অবাঙালি কোটিপতি লোকটা একটা খেটে-খাওয়া বাঙালি মেয়েকে এ ভাবে হেনস্তা করবে এটা আমাদের ভালো লাগছে না!
-- মানলাম। তাহলে তোমরা কী করতে চাও?
-- ধরুন হুজুর আমি যদি বলি যে, সদরের দিকে টর্চ ফোকাস করে আমি যারে দেখতে পাই তার পরনে ছিল শাড়ি-বেলাউজ?
-- তাহলে রাও-সাহেবের ‘বকশিশ’ তোমরা পাবে না।
-- কিন্তু আপনার মক্কেল কি...
-- না বটুক, টাকার প্রতিযোগিতায় আমার মক্কেল এই রাও-সাহেবের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে না। আর শোন -- যদি পারতও তাহলেও. আমি তোমাকে দিয়ে মিথ্যে সাক্ষী দেওয়াতাম না। আমার এখন মনে হচ্ছে ইন্সপেক্টর মুখার্জিও তোমার কাছে যায়নি। তুমি সব বানিয়ে বানিয়ে বলছ। জানতে এসেছ, আমি টাকা দেব কি না। হোক, তুমি খুবই ভুল করলে বটুক। আমাকে সব কথা বলে ফেলে। তোমার গোপন-কথা আমি কাউকে বলব না বটে, কিন্তু কাঠগড়ায় ডাঁইরে তুমি বা তোমার পরিবার যদি একচুল মিছে-কথা বল, তাহলে তোমাদের আমি ছিঁড়ে খাব! মিথ্যে সাক্ষী দেবার দায়ে তোমাদের জেল খাটাব! বুঝেছ?
-- না, মানে...
-- আর একটি কথা নয়! তুমি ওঠ। তুমি আমার কাছে পরামর্শ চাইতে এসেছিলে । আমার পরামর্শ হল: কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে, ‘যাহা বলিবে সত্য বলিবে, সত্য বই মিথ্যা বলিবে না।’ ‘বলিলে’ তোমার গলায় আমি নম্বরি তকতি ঝোলাইব। ওই ধুতি খুলে ডোরা কাটা হাফপ্যান্ট পরাইব, বুঝেছ? পান-সাজা ছেড়ে মাটি কোপাতে হবে তোমাকে। নাউ জাস্ট ক্লিয়ার আউট।
লোকটা দু-হাত জোড় করে বললে, স্যার….
-- আই সে: গেট আউট!
ওঁর কষ্ঠস্বরে কৌশিক পাশের ঘর থেকে উঠে আসে। বটুকের দিকে ফিরে বলে, তুমি কে? কী চাও?
-- আজ্ঞে না, কিছু চাই না।
-- সাহেব তোমাকে চলে যেতে বলছেন, যাচ্ছ না কেন?
-- যাচ্ছি, যাচ্ছি স্যার --
বটুক পালাবার পথ খুঁজে পায় না।
পনের
বাসু-সাহেব জেল-হাজতে নিয়ে ছন্দার সঙ্গে দেখা করলেন। ওঁর মনে হল দু-দিনেই ছন্দা বেশ ভেঙে পড়েছে। তার চোখের কোলে কালি। বোধহয় রাত্রে ঘুম হয় না। বাসু-সাহেবকে দেখে বলল, মামলার দিন পড়েছে?
-- হ্যাঁ, পড়েছে। তোমাকে জানিয়েও গেছি। তোমার মনে নেই?
-- না, মনে পড়ছে না। আই অ্যাম নট ইন্টারেস্টেড!
-- তা বললে তো চলবে না, ছন্দা। তোমাকে লড়তে হবে।
-- কার বিরুদ্ধে?
-- যারা টাকার জোরে তোমার মতো অসহায় মেয়ের সর্বনাশ করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে। তুমি তো খুনটা করনি, অথচ...
-- কে বললে? না, স্যার, আমি পরে ভেবে দেখেছি, খুনটা আমিই করেছি।
-- জানি। আমার মনে আছে। তুমি বলেছিলে, কমলেশ দু-হাত বাড়িয়ে তোমার দিকে এগিয়ে আসে। তুমি তখন মেঝে থেকে একটা কিছু কুড়িয়ে নাও। ঘটনাচক্রে সেটা একটা গ্যালভানাইজড্ পাইপের টুকরো। তুমি সেটা এলোপাথাড়ি ঘোরাতে থাকো। তাতেই কমলেশ আহত হয়; তাই না?
-- হ্যাঁ, তাই।
-- কিন্তু তুমি স্বচক্ষে ওকে আহত হতে দেখনি, ঠিক তখনই আলোটা কে যেন নিবিয়ে দেয়।
-- অথবা আলোটা ফিউজ হয়ে যায়।
-- কিন্তু প্রথমবার আমাকে তা বলনি, বলেছিলে ‘সুইচ অফ’ হবার শব্দ তুমি স্বকর্ণে শুনেছ। ঘরে তৃতীয় ব্যক্তি ছিল, যে লোকটা বারে-বারে অন্ধকার ঘরে দেশলাই কাঠি জ্বালাচ্ছিল।
-- হ্যাঁ, তা জ্বালাচ্ছিল।
-- এবং তোমার মনে হল, ভারা বেয়ে সেই লোকটা নেমে গেল।
-- হয়তো সে-লোকটা নয়। কারণ আমি যখন দরজা খুলে বার হয়ে আসি তখনও সে ল্যান্ডিং এ দাঁড়িয়ে। ভারা বেয়ে যে নেমে যায়, সে অন্য একজন।
-- এবং আরও অন্য একজন বাইরে থেকে কলিং বেল বাজাচ্ছিল।
-- হ্যাঁ, তাই।
-- তার মানে কমলেশ খুন হবার সময় তুমি ছাড়া আরও দু-তিনজন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল। তাছাড়া কাগজে যে খবর বার হয়েছিল তাতে লেখা হয়: কমলেশের মাথার পিছন দিকে আঘাত লাগে। তা কেমন করে হয়! তুমি যখন এলোপাথাড় পাইপটা ঘোরাচ্ছিলে তখন সে তো তোমার দিকে ফিরে ছিল?
-- কী জানি। আমি কিছু চিন্তা করতে পারছি না।
-- একটা কথা অন্তত বল। কমলেশের সঙ্গে যখন দেখা করতে যাও -- শনিবার রাত একটা নাগাদ, তখন ওর বাড়ির কাছে, রাস্তায় তুমি কি গাড়িটা লক করে যাওনি? ঐ অত রাত্রে গাড়িটা অরক্ষিত রেখে গেছিলে!
-- হ্যাঁ তাই। নাহলে। আমি ফেরার সময় গাড়িতে ঢুকতে পারতাম না। চাবিটা তো তার আগেই ওই ঘরে পড়ে গেছিল।
-- আমি যুক্তির কথা জিজ্ঞেস করছি না ছন্দা, স্মৃতির কথা জিজ্ঞেস করছি। তোমার কি স্পষ্ট মনে আছে যে, কমলেশের ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এসে কী করে গাড়িতে উঠলে? চাবি দিয়ে দরজা খুলেছিলে কিংবা খোলনি?
-- আমার কিছু মনে পড়ছে না। তখন আমি অত্যন্ত উত্তেজিত ছিলাম।
-- ন্যাচারালি। কিন্তু চাবিটা তো ছিল তোমার ভ্যানিটি ব্যাগের ভিতর। কমলেশের ঘরে চাবিটা পড়ে গেল কী করে? ভ্যানিটি ব্যাগ তুমি ওর ঘরে ঢোকার পর খুলেছিলে?
-- আমার মনে নেই! তবে ওই ব্যাগেই ছিল ডাক্তার ব্যানার্জির রিভলভারটা। হয়তো কমলেশ যখন আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে তখন আমি ব্যাগ খুলে যন্ত্রটা বার করতে চেয়েছিলাম...
-- এ-ও তো ডিডাক্শন। চাবিটা কীভাবে তোমার ব্যাগ থেকে বার হয়ে মাটিতে পড়ে গেল তার যুক্তিনির্ভর বিশ্লেষণ। তোমার স্মৃতি কী বলে? তোমার মনে আছে কি, যে ব্যাগ খুলেছিলে?
-- না, মনে নেই।
বাসু-সাহেব এবার তার ব্রিফকেস্ খুলে একটা আবেদনপত্র বার করে ওর হাতে দিলেন। ছন্দা জানতে চায়, কী এটা?
-- ত্রিদিবনারায়ণের বিরুদ্ধে তোমার বিবাহ-বিচ্ছেদের আবেদন।
-- কিন্তু আমি তো বিবাহ-বিচ্ছেদ চাই না...
-- এর পরেও? আদালতের বারান্দায় সে সর্বসমক্ষে তোমাকে যে গালাগাল দিল, যে ব্যবহার করল..
ছন্দা ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলে, সেটা ওর অপরাধ নয় স্যার, সেটাই ওর অসুখ ! ও একটা অবসেশনে ভুগছে। ও যা কিছু করছে তা ওর বাবার নির্দেশে...
-- তা কেমন করে হবে, ছন্দা? তোমাকে একা বিছানায় ফেলে রেখে ঘটনার পরদিন শনিবার আক্ষরিক অর্থে সাত-সকালে সে যখন আমার কাছে আসে তখন তার রাবা কলকাতায় ছিলেন না। আমার নিষেধ সত্বেও সে যখন পুলিসে যায় তখন সে স্বেচ্ছায় যায়, বাবার নির্দেশে নয়...
-- স্বেচ্ছায় নয়, স্যার। ‘স্ব-ইচ্ছা’ বলে ওর কিছু নেই। ওর ইচ্ছাটাই ওরা বদলে দিয়েছে। ভালো-মন্দ, সৎ-অসৎ, ন্যায়-অন্যায়, বিচার-বুদ্ধিটা ওর মগজ ধোলাই করে ধ্বংস করে দিয়েছে।
বাসু নিজের পকেট থেকে ফাউন্টেন খাপটা খুলে ওর দিকে বাড়িয়ে ধরেন। বলেন, তুমি বারে বারে অবাধ্য হয়েছে। তোমাকে করেছিলাম যে, পুলিশের কাছে কোনও জবানবন্দি দেবে না। তুমি আমার কথা শোননি -- আত্মরক্ষার্থে তুমি কমলেশকে হত্যা করেছ – যেটা হতে পারত আমার শেষ প্রতিরোধ – তা আর দাঁড় করানো যাবে না। কারণ তুমি বলেছ যে, তুমি বাড়ির ভেতরেই যাও নি। রাস্তায় কলিংবেল বাজাচ্ছিলে। কিন্তু বাস্তবে কলবেল কে বাজাচ্ছিল জান? ডক্টর ব্যানার্জি।
-- ডক্টর ব্যানার্জি! তিনি তখন ওখানে কেন আসবেন?
-- কেন আসবেন, তা তুমি জান। যে কারণে তোমাকে বেআইনীভাবে রিভলভারটা দিয়েছিলেন! যে কারণে তোমাকে একটা ফল্স ডেথ সার্টিফিকেটও দিয়েছিলেন। তার প্রতিদানে তুমি এবার চাও তোমার বদলে তিনি এসে খুনের মামলার আসামী হয়ে দাঁড়ান?
ছন্দা অসহায়ভাবে ওঁর দিকে তাকায়।
-- হ্যাঁ, ডক্টর ব্যানার্জি সেই শুক্রবার রাত্রে কিছুতেই নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেননি। তিনি আমার কাছে স্বীকার করেছেন যে, উনি শনিবার রাত একটা নাগাদ মা সন্তোষী অ্যাপার্টমেন্টে এসেছিলেন। তিনিই কলিংবেলটা বাজিয়েছিলেন। তাঁকে লালবাজার থেকে ডেকে পাঠিয়েছিল। ডিভোর্সের মামলার দিন ত্রিদিবের অ্যাডভোকেট কী প্রশ্ন করেছিল মনে নেই?
এই সময় হাজতের ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টার মুখ বাড়িয়ে বলে, সময় হয়ে গেছে স্যার, এবার আসুন আপনি --
বাসু বলেন, আর এক মিনিট।
লোকটা! চলে যেতেই বাসু-সাহেব কলমটা ছন্দার হাতে গুঁজে দিয়ে বলেন, ডক্টর ব্যানার্জিকে তুমি এভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পার না, ছন্দা, ডু আজ আই সে! সই কর।
ছন্দা আর আপত্তি করে না। কলমটা হাত বাড়িয়ে নেয় বিবাহ-বিচ্ছেদ দরখাস্তের চিহ্নিত স্থানে গোটা-গোটা হরফে নিজের নামটা সই করে দেয়।
বাড়িতে ফিরে এসে শোনেন একটা অদ্ভুত সংবাদ:
ডাক্তার ব্যানার্জি অ্যাবডাক্টেড !
নার্সি-হোম থেকে জবা ফোন করে জানিয়েছে। গতকাল মধ্যরাত্রে নাকি জবার চোখের সামনেই একদল লোক ডক্টর ব্যানার্জিকে তুলে নিয়ে গেছে। খবরটা পেয়েই কৌশিক চলে যায় নার্সিং-হোমে। জবার সঙ্গে কথা বলে। সেখান থেকে থানায় যায়। তারপর ফিরে এসে বাসু-সাহেবের জন্য অপেক্ষা করছে।
বাসু বলেন, ‘জোর করে তুলে নিয়ে গেছে’ মানে কী?
কৌশিক যা বিবরণ দিল তা এই রকম:
গতকাল রাত আটটা নাগাদ একটা এমার্জেন্সি কেস আসে। জবা সচরাচর এ আটটা নাগাদ বাড়ি চলে যায়। শেয়ালদহ হয়ে বেলঘরিয়া। কিন্তু এমার্জেন্সি কেসটার জন্য ও আটক পড়ে যায়। এর আগেও এমন ঘটনা দু’একবার হয়েছে। ডক্টর ব্যানার্জি ব্যাচিলার, একা থাকেন, তাই তার কোয়ার্টার্সে রাত কাটায় না। হয় নার্সি-হোমে বসে বসেই রাতটা কাটিয়ে দেয়। অথবা ওর দিদির বাড়িতে চলে যায়। সেটা কাছাকাছিই। গতকাল রাত এগারোটা নাগাদ রোগীটিকে অপারেশন থিয়েটার থেকে ইন্টেন্সিভ-কেয়ার ইউনিটে অপসারণ করা হয়। তারপর রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা নাগাদ ডাক্তার ব্যানার্জি গাড়ি নিয়ে জবাকে তার দিদির বাড়িতে পৌঁছে দেবার জন্য বার হন। কিন্ত কিছুটা যেতেই নির্জন গলির মুখে আর একটা কালো রঙের অ্যাম্বাসাডার ওঁর গাড়ির পথরোধ করে দাঁড়ায়। ডক্টর ব্যানার্জি কিছু বলার আগেই সেই গাড়ি থেকে দু-তিনজন লোক নেমে আসে। ব্যানার্জি তখন নিজের গাড়ি থেকে রাস্তায় নেমে দাঁড়িয়েছেন! তিনি বলেন, এভাবে গাড়ি চালাচ্ছেন কেন? এখনি তো অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যেত!
ও-গাড়ি থেকে যারা কাছে ঘনিয়ে এসেছিল তাদের মধ্যে দুজন ডাক্তারবাবুর দুদিকে চলে যায়। তাদের একজনের হাতে রিভলভার। ডক্টর ব্যানার্জির তলপেটে মারণাস্ত্রটা ঠেকিয়ে লোকটা বলে, চিৎকার চেঁচামেচি করবেন না। এ গাড়িতে উঠে বসুন।
একজন জবার কাছে এগিয়ে আসে। তার হাতে একটা ছোরা। লোকটা বলে, দিদি, কোনও শব্দ করবেন না। জানে মারা পড়বেন । আমরা চলে গেলে একটা ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি চলে যাবেন। ডাক্তারবাবুর গাড়ি এখানেই পড়ে থাক।
জবা জবাবে কিছু বলার আগেই ঐ কালো রঙের অ্যাম্বাসাডারখানা ডাক্তারবাবুকে নিয়ে হাওয়া।
জবা নার্সিং হোমে ফিরে যায় হেঁটেই। থানায় ফোন করে। থানা থেকে এনকোয়ারিতে আসে মধ্যরাতে। জবার জবানবন্দি নেয়। ডাক্তারবাবুর গাড়ির ইগনিশন চাবি ড্যাশবোর্ড লাগানোই ছিল। ওরা গাড়িটা নিয়ে গ্যারেজজাত করে চলে যায়।
বাসু বলেন, এতবড় একটা ব্যাপার হয়ে গেল, জবা তাহলে কাল রাতে আমাকে ফোন করেনি কেন?
-- ও বললে, ততক্ষণে রাত সাড়ে বারোটা বেজে গেছে, তাই!
-- অল রাইট । আজ সকাল ছয়টা-সাতটার সময় সে ফোন করে আমাকে জানায়নি কেন?
-- ও তো বলছে, বার-কতক চেষ্টা করেছিল। কানেকশন পায়নি। যখন কানেকশন পায়, ততক্ষণে আপনি ছন্দাদেবীর সঙ্গে দেখা করতে বেরিয়ে গেছেন।
বাসু চিন্তিত মুখে বারকতক পদাচারণ করে বললেন, সবটা তদন্ত করে তোমার কী মনে হল, কৌশিক?
-- থানা অফিসারের সঙ্গে কথা বলে মনে হল, সে ব্যাপারটায় খুব কিছু গুরুত্ব দিচ্ছে না।
-- তাই বা কী করে সম্ভব? ডক্টর ব্যানার্জি একজন অত্যন্ত নামকরা চিকিৎসক, তিনি এভাবে অপহৃত হয়ে গেলেন তাতে থানা বিচলিত নয়?
-- দুটো সম্ভাবনার মধ্যে একটা আপনাকে বেছে নিতে হবে, মামু!
-- কী দুটো সম্ভাবনা?
-- এক নম্বর: পুলিশ জানে, ডাক্তার ব্যানার্জি কমলেশ-হত্যা মামলায় সাক্ষীর কাঠগড়ায় উঠে দাঁড়াতে চান না এবং আপনিও তা চান না। তাই পুলিশ মনে করছে, এটা আপনার পরিকল্পনা মোতাবেক। অর্থাৎ অ্যাবডাকশনটা আপনিই সাজিয়েছেন। দু’নম্বর: থানা জানে যে, লালবাজার থেকে এটা অর্গানাইজ করা হয়েছে, অর্থাৎ ডাক্তার ব্যানার্জিকে আপনার নাগালের বাইরে রাখা হয়েছে। মামলার দিন সকালে তথাকথিত অপহারকদল তাঁকে মুক্তি দেবে। আর তৎক্ষণাৎ পুলিশ তাঁকে সমন ধরাবে। তার মানে, আপনার বিনা তালিমে ডাক্তার ব্যানার্জি সাক্ষীর-মঞ্চে উঠে দাঁড়াতে বাধ্য হবেন।
বাসু-সাহেব নিঃশব্দে বারকতক পদচারণা করে হঠাৎ থেমে পড়েন। নিজের চেয়ারে বসে বললেন, -- তোমার দুটো যুক্তির একটাও ধোপে টেঁকে না।
-- কেন?
-- প্রথম কথা, আমি যে ‘অপারেশন-অ্যাবডাকশন’-এর পরিচালক নই তা তোমরা সবাই জান। তোমার দ্বিতীয় সম্ভাবনাটাও গ্রাহ্য নয় -- এই সামান্য কারণে পুলিস ডক্টর ব্যানার্জির মতো একজন বিখ্যাত চিকিৎসককে ‘অ্যাবডাক্ট’ করবে না।
-- তা হলে উনি অপহৃত হলেন কেন?
-- এটা ডক্টর ব্যানার্জি আর জবা মিলে অর্গানাইজ করেনি তো?
- মানে?
-- মানে, সবটাই সাজানো! ডক্টর ব্যানার্জি যখন বুঝল যে; দিন দশ-পনেরোর জন্য -- অর্থাৎ এ হত্যা মামলার শুনানী পর্যত -- সে নিরুদ্দেশ হতে পারবে না, তখন নিজেই এই অপহরণটা সাজায়নি তো?
-- সেজন্য ডাক্তার ব্যানার্জির মতো এক ছাপোষা মানুষ এমন একটা অপহরণ অর্গানাইজ করাবে?
-- আরে বাপু অপহরণটা তো জবার বর্ণনা মোতাবেক? আর কোনও সূত্রেও তো আমরা জানি না যে ডাক্তারবাবু আদৌ অপহৃত হয়েছেন!
-- তা বটে।
-- সবটাই ডক্টর ব্যানার্জির উর্বর মস্তিষ্কের পরিকল্পনা বলে মনে হচ্ছে। তোমারা জান যে, লালবাজার থেকে ডাক্তারের উপর একটা নির্দেশ জারী করা হয়েছিল। কলকাতার বাইরে গেলে সে যেন তার ঠিকানা রেখে যায়। সে তখন আমার সঙ্গে পরামর্শ করতে চেয়েছিল। আমি প্রঅ্যাখ্যান করি। হয়তো তখন ডাক্তার আর তার নার্স উদ্ভট পরিকল্পনাটা করে! সেক্ষেত্রে জবা সব কিছুই জানে। আর সে জন্যই কাল রাত্রে আমাদের অহেতুক ডিসটার্ব করেনি। আজ সকালেও তার টেলিফোন করতে এত দেরী হয়ে যায়।
সুজাতা বললে আপনি ঠিকই বলেছেন, মামু ডাক্তার ব্যানার্জি যদি সত্যিই এভাবে অপহৃত হতেন তাহলে জবা নার্সিং হোমের কোন লোককে সঙ্গে নিয়ে রাত্রেই ট্যাক্সি করে এখানে চলে আসত। বিশেষ, থানা যখন তাকে আমল দিচ্ছে না।
বাসু পাইপে তামাক ঠেশতে ঠেশতে বলেন, প্রায় সবগুলো অসঙ্গতির যুক্তিপূর্ণ বাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে, শুধু একটি বাদে --
রানু জানতে চান, কী সেটা?
-- রাত একটার সময় ছন্দা কোন্ আক্কেলে তারাতলায় তার মারুতি-সুজুকি গাড়ির কী-বোর্ডে ইগ্নিশন চাবি রেখে, গাড়িটা লক না করে কমলেশের বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়!
রানু বললেন, সে সময় ও খুব উত্তেজিত ছিল।
-- না, রানু, ছিল না। ফেরার পথে সে উত্তেজিত ছিল। ফলে সে ফেরার সময় কী করে গাড়িতে ওঠে এটা তার মনে না থাকতে পারে। কিন্তু গাড়িটা তারাতলার মতো কারখানা-এলাকায় এভাবে অত রাত্রে সে কেন অরক্ষিত রেখে গেল? গাড়ি থেকে নেমে গেলে ড্রাইভার কাঁচ উঠিয়ে গাড়ি লক করে। এটা প্রায় প্রতিবর্তী প্রেরণায়। অভ্যাসবশে। দেখলে না, ছন্দা তার জবানবন্দিতে বলল, বাড়ি ফিরে এসে যখন গাড়ি গ্যারেজ করে তখন সে স্লাইডিং ডোরটা টেনে গ্যারেজটা বন্ধ করতে চেয়েছিল । কিন্তু পারেনি। অ্যামবাসাডার গাড়িটা একটু সরে-নড়ে যাওয়ায়। তখন সে খুবই উত্তেজিত। তবু নিজের গ্যারেজের ভিতর সে গাড়ি লক্ করতে চেয়েছে। আর হপ্তাবারে...মানে সপ্তাহান্তে রাত একটার সময় তারাতলার মতো কারখানায়-ভর্তি এলাকায় সে গাড়ি লক্ না-করে গাড়ি থেকে নেবে যাবে? নাঃ। মিলছে না...
-- কিন্তু গাড়ি যদি সে লক্-করে নেমে যায়, তাহলে চাবি ছাড়া সে গাড়িতে উঠবে কী করে?
-- দ্যাটস্ দ্য মিলিয়ান-ডলার কোশ্চেন!
ষোলো
প্রাথমিক তদন্ত শেষ করে মামলাটা ট্রাইং ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে উঠতে দেরী হয় না, এবং তিনি আসামীকে দায়রায় সোপর্দ করলেন। চীফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে মামলা উঠতে বিলম্ব হ’ল না। এমনটা সচরাচর হয় না। সম্ভবত, নেপথ্যে রাজনৈতিক চাপ এর হেতু। ধনকুবের-সম্প্রদায় চার-পাঁচ বৎসর অন্তর রাজনৈতিক দলগুলিকে ভোটযুদ্ধের রসদ যোগান দেন। ফলে তাঁদের প্রভাবে এদেশে অনেক কিছুই ঘটে থাকে। এক্ষেত্রেও যখন ছন্দা-ত্রিদিবের বিবাহটা প্রথম থেকেই নাকচ করানো গেল না তখন ত্রিবিক্রম সর্বশক্তি নিয়োগ করলেন পুত্রবধূকে ফঁসিকাঠে ঝোলাতে। এছাড়া তাঁর একচ্ছত্র-সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা রক্ষিত হত না।
ত্রিদিব তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে পারবে না। উপায় নেই; কিন্তু সাংবাদিকদের হাত থেকে রক্ষা করতে ত্রিদিবকে একেবারে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখা হয়েছে। সম্ভবত কোনও পাঁচতারা হোটেলের অজ্ঞাতবাসে।
মামলার দিন আদালতে অপ্রঅ্যাশিত জনসমাগম হয়েছে। অপ্রঅ্যাশিত বলাটা অবশ্য ঠিক হবে না, কারণ ইতিমধ্যে কয়েকটি সংবাদপত্রে এ-নিয়ে বিস্তারিত ‘রিপোর্টাজ’ হয়েছে। রাজপুত ঐতিহ্যের শক্তাবত-রাজরক্তের এক ধনকুবেরের একমাত্র পুত্রকে কী-ভাবে একটি নার্সিংহোমের ভেতো-বাঙালী ‘নাইট-নার্স’ কব্জা করে ফেলল, কীভাবে তাদের রেজিস্ট্রি-বিবাহ সুসম্পন্ন হল, কী-ভাবে ছেলেটির কোটিপতি পিতা নাসিক থেকে উড়ে এসে সে বিবাহ অবৈধ প্রমাণে ‘আদ্রকোদক-সেবনান্তে’ প্রাণপাত করলেন, এবং কী-প্যাঁচে পি. কে. বাসু বার-অ্যাট-ল ধনকুবেরের সে উষ্ণ-প্রয়াসে এক বালতি বরফ-গলা জল ঢেলে দিলেন! এসব তথ্যই সংবাদপত্রের একনিষ্ঠ পাঠক-পাঠিকার দল প্রভাতী চায়ের উপাদান হিসাবে জানে! তাই তারা আরও জানতে আগ্রহী: ধনকুবের কি অতঃপর তার বধূমাতাকে – ‘উদ্বাহন’ থেকে নিরস্ত করতে ব্যর্থ হয়ে ‘উদ্বন্ধনে’ উর্ধ্বগামী করতে সক্ষম হবেন? মামলাটা যদিও স্টেট-ভার্সেস ছন্দা রাওয়ের -- সকলে ধরে নিয়েছে বাস্তবে: ধনকুবের ত্রিবিক্রমনারায়ণ রাও বনাম ব্যারিস্টার পি. কে. বাসুর।
আদালত যদি অনুমতি করেন তাহলে বাদীপক্ষ একটি সংক্ষিপ্ত প্রারম্ভিক ভাষণ দিয়ে এই মামলার সূত্রপাত করতে ইচ্ছুক। বাদীপক্ষ আশা করেন যে, তাঁরা প্রমাণ করবেন: এই মামলার আসামী শ্রীমতী ছন্দা রাও সুপরিকল্পিতভাবে তারাতলার মা-সন্তোষী অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে মধ্যরাতে তার প্রথম পক্ষের স্বামী কমলেশ বিশ্বাসকে হত্যা করেছেন। আমরা আরও আশা রাখি প্রমাণ করব যে, মাত্র সাত দিনের কোর্টশিপে ঐ আসামী শয্যাশায়ী, অসুস্থ এক ধনকুবেরের একমাত্র পুত্র তথা-ওয়ারিশকে মোহমুদ্ধ করে, তার পিতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গোপনে রেজিস্ট্রি-বিবাহ করেন। এত অল্প সময়ের কোর্টশিপে এ জাতীয় বিবাহের একটিই উদ্দেশ্য হতে পারে -- কিন্তু সেই উদ্দেশ্য সাধন করতে গিয়ে আসামী হঠাৎ এক প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন হয়ে পড়েন: তার প্রথম পক্ষের জীবিত স্বামী, কমলেশ বিশ্বাস! সদ্যোবিবাহিত রাজপুত্রের কুবেরীর্ষিত বৈভব হস্তগত করতে হলে প্রথম পক্ষের স্বামীকে অপসারণ করা নিতান্ত প্রয়োজন। আসামী মধ্যরাত্রে সেই উদ্দেশাই একাকী ড্রাইভ করে প্রথম স্বামীসাক্ষাতে গিয়েছিলেন। আমরা প্রমাণ করব: সে সময় তার হাতব্যাগে একটা রিভলভার ছিল: কিন্তু অত্যন্ত বুদ্ধিমতী মেয়েটি হত্যার হাতিয়ার হিসাবে একটা গ্যালভানাইজড পাইপ বেছে নেয় -- যাতে স্বতই মনে হতে পারে যে, এটা সুপরিকল্পিত হত্যা নয়, আত্মরক্ষার্থে হোমিসাইভ। আমরা আরও আশা রাখি প্রমাণ করব যে, আসামী একটি মিথ্যা ডেথ সার্টিফিকেটের সাহায্যে তার জীবিত স্বামীর ওয়ারিশ হিসাবে ইনশিওরেন্স পলিসি থেকে...
বাসু হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন: অবজেকশন য়োর অনার! প্রারম্ভিক ভাষণে মাননীয় সহযোগী অবান্তর প্রসঙ্গের অবতারণা করছেন। আমরা একটি হত্যা-মামলার বিচার প্রঅ্যাশায় এসেছি, আসামীর বিরুদ্ধে আর কোন অপরাধের জন্য পাবলিক প্রসিকিউটর যদি কোন অভিযোগ আনেন, তবে তা চার্জশিটে আইনের ধারা মোতাবেক উল্লেখ করা উচিত ছিল।
পি.পি. নিরঞ্জন মাইতি বলেন, আমরা আসামীর চরিত্র উদ্ঘাটনের উদ্দেশ্যে...
বিচারপতি সদানন্দ ভাদুড়ী বলেন, আপত্তি গ্রাহ্য হল। মিস্টার পি. পি. আপনি হত্যা-মামলার সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত প্রারম্ভিক ভাষণ দেবেন, এটাই আদালতের প্রত্যাশা।
-- দ্যাটস্ অল, য়োর অনার।
বিচারক চীফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট-সদানন্দ ভাদুড়ী এবার প্রতিবাদীর দিকে ফিরে বললেন, আপনারা কি কোনও প্রারম্ভিক ভাষণ দিতে চান?
বাসু বললেন, নো, য়োর অনার। বাদীপক্ষ এবার একে-একে তাঁদের সাক্ষীদের ডাকতে পারেন।
দর্শকের প্রথম সারিতে একদিকে বসে আছেন প্রস্তরমূর্তির মতো ত্রিবিক্রমনারায়ণ রাও, অন্যদিকে সুজাতা আর কৌশিক। দর্শকমন্ডলীর ভিতর ডক্টর ব্যানার্জি আর ত্রিদিবকে দেখা গেল না। জবা কিন্তু উপস্থিত।
বাদীপক্ষের প্রথম সাক্ষী পুলিশ-ইসপেক্টর অসীম মুখার্জি । মাইতি প্রশ্নোত্তরে মাধামে তার পরিচয় প্রতিষ্ঠা করলেন। ইল্পেক্টর মুখার্জি জানালো বাইশে জুন, শনিবার, রাত একটা আঠাশ মিনিটে সে রেডিও মেসেজ পায়: তারাতলায় মা-সন্তোষী অ্যাপার্টমেন্টে সম্ভবত একজন লোক খুন হয়েছে। এ সময় সে একটা পুলিশ-জীপে ডায়মন্ডহারবার রোডে টহল দিচ্ছিল। ওর জীপে রেডিও রিসিভারে খবরটা পায়, স্থানীয় পুলিশ-স্টেশন থেকে। মুখার্জি তখন মা-সন্তোষী অ্যাপার্টমেন্টে চলে যায়। পুলিশের গাড়ি দেখেই পাশের বাড়ি থেকে দুজন লোক নেমে এসে জানান যে, তারাই ফোন করে পুলিশ ডেকেছেন। তাদের একজনের নাম ডক্টর এন. দত্ত, অপরজনের নাম শ্রী বটুকনাথ মণ্ডল। ওঁরা মা-সন্তোষী অ্যাপার্টমেন্টের সদর দরজায় কলবেল বাজান। কেউ সাড়া দেয় না। তখন বটুক ইন্সপেক্টার মুখার্জিকে তার নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে যায় এবং টর্চের আলোয় পাশের বাড়িতে মেঝের উপর উপুড় হয়ে পড়ে থাকা দেহটি দেখায়। শুধু পা-টুকু দেখা যাচ্ছিল। এরপর মুখার্জির নির্দেশে একজন পুলিশ ভারা বেয়ে উপরতলায় উঠে যায়। গ্রিলহীন জানলার ফোকর দিয়ে ভেতরে গলে যায়। ভিতর থেকে ইয়েল-লক খুলে দেয়। ওঁরা সদলবলে উপরে আসেন।
ভুলুন্ঠিত কমলেশ তখনো জীবিত ছিল; কিন্তু তার জ্ঞান ছিল না। আহতের ঘরে গৃহনির্মাণ সামগ্রী গাদা করে রাখা ছিল। তার ভিতর ছিল একটি পৌনে-এক-মিটার দীর্ঘ বিশ মিলিমিটার ব্যাসের গ্যালভানাজইড লোহার পাইপ। তাতে রক্তের দাগ। যেটি আহতের অদূরেই পাওয়া যায়। মুখার্জির ধারণা হয়: এ পাইপের সাহায্যেই ভূতলশায়ী লোকটি আহত হয়েছে। সে পাইপটি সংগ্রহ করে। ডক্টর দত্ত ভুলুন্ঠিত বাক্তিকে পরীক্ষা করে দেখেন যে, সে জ্ঞানহীন বটে তবে মৃত নয়। ফলে ইন্সপেক্টর মুখার্জি একটি অ্যাম্বুলেন্স আনাবার ব্যবস্থা করে। বটুকের কাছ থেকে জানতে পারে আহত ব্যক্তির নাম কমলেশ বিশ্বাস। সে এ ঘরে একাই থাকত। তল্লাসি করতে গিয়ে ঘরের মেঝেতে -- মৃতদেহের পাশেই -- একটি চাবির রিঙ দেখতে পায়। তাতে তিনটি চাবি, একটি নবতাল তালার, আর দুটি মোটর গাড়ির ডোর-কী। মাইতি সেটিকে পিপলস্ এক্সিবিট ‘A’ হিসাবে দাখিল করলেন। ইতিমধ্যে অ্যাম্বুলেন্স আর পুলিশের গাড়ি এসে পড়ে । আহতকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরে মুখার্জি শুনেছে -- হলপ নিয়ে বলতে পারবে না -- কমলেশ ঐ হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই মারা যায়। ইতিমধ্যে পুলিশ-ফোটোগ্রাফার অনেকগুলি ফটো নিয়েছে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্ট কিন্তু কোথায়ও কোনও আঙুলের ছাপ আবিষ্কার করতে পারেনি। না -- সুমসৃণ সদ্য-লাগানো দরজার ইলেক্ট্রোপ্লেটেড হ্যাঁন্ডেলে, টেলিফোন রিসিভারে, গ্লাসটপ টেবিলে -- কোথাও কোন আঙুলের ছাপ নেই।
মাইতি বলেন: এটা আপনার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়নি?
বাসু তৎক্ষণাৎ আপত্তি জানান: জবাবটা সাক্ষীর ‘কনক্লুশন’।
মাইতি বলেন, য়োর অনার! সাক্ষী-অপরাধ-বিজ্ঞানে বিশেষ শিক্ষাপ্রাপ্ত। তাঁর যুক্তিনির্ভর সিদ্ধান্ত আদালতে গ্রাহ্য হওয়া উচিত।
বিচারক বাসু-সাহেবের আপত্তি নাকচ করে দিলেন।
ইন্সপেক্টর মুখার্জি বলে, হ্যাঁ, আমার কাছে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল। আততায়ী যদি হাতে গ্লাভস্ পরে এসে থাকে তাহলে গৃহস্বামীর আঙুলের ছাপ অন্তত পাওয়া যেত। তা গেল না কেন?
মাইতি জানতে চান: এমনটা হল কেমন করে?
বাসু এবারও আপত্তি জানালেন। বিচারক পুনরায় তা নাকচ করলেন।
মুখার্জি বলল, তার সিদ্ধান্ত: আততায়ী ঘর ছেড়ে চলে যাবার আগে একটা রুমাল দিয়ে সবকিছু মসৃণ পদার্থ মুছে দিয়ে যায়।
মাইতি বলেন, ‘রুমাল দিয়ে’ কী করে বুঝলেন?
-- না, রুমাল দিয়েই যে মোছা হয়েছে এ-কথা বলা যায় না। হয়তো শাড়ির আঁচল দিয়ে মোছা হয়েছে!
মাইতি বাসু-সাহেবের দিকে ফিরে বললেন, য়ু মে ক্রস্ হিম!
বাসু জেরা করতে উঠে প্রথমেই বললেন, মিস্টার মুখার্জি, আপনি এইমাত্র বললেন ‘রুমাল দিয়েই যে মোছা একথা বলা যায় না। হয়তো শাড়ির আঁচল দিয়ে মোছা হয়েছে।’ তাই না?
-- হ্যাঁ, তাই বলেছি আমি।
-- তার মানে আপনার বিশেষজ্ঞের সিদ্ধান্ত: যে-লোকটা সব কিছু থেকে আঙুলের ছাপ মুছে দিয়ে যায় তার পরিধানে শাড়ি ছিল। ধুতি কোনক্রমেই থাকতে পারে না, তাই কি?
-- না, তাই নয়। এজন্যই আমি ‘হয়তো’ বলেছি।
-- কিন্তু নিরপেক্ষ এক্সপার্ট হিসাবে কি আপনার বলা উচিত ছিল না: ‘হয়তো শাড়ির আঁচল অথবা কোঁচার খুঁটে’?
মাইতি আপত্তি তোলেন, সহযোগী তার মনোমত জবাব পাননি বলে ক্ষুব্ধ হতে পারেন; কিন্তু ক্ষোভের এ-জাতীয় প্রকাশ হওয়াটা অবাঞ্ছনীয়। আমি আপত্তি জানাচ্ছি, হুজুর।
বিচারক বাসু-সাহেবের দিকে ফিরে বলেন, য়োর পয়েন্ট ইজ ওয়েল টেকন্। আপনি পরবর্তী প্রশ্নে এগিয়ে যান।
বাসু বলেন, আমি শুধু দেখাতে চাইছিলাম, বর্তমান সাক্ষী আদৌ নিরপেক্ষ এক্সপার্ট নন, একটি পূর্ব-ধারণার বশবর্তী হয়ে সহযোগীর প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন।
-- আদালত আপনার যুক্তি শুনেছেন, যা সিদ্ধান্ত নেবার তা নেবেন। আপনি পরবর্তী প্রশ্নটি পেশ করুন।
বাসু টেবিলের উপর থেকে পিপলস্ একজিবিট ‘বি-এর একটি ফটো তুলে নিয়ে সাক্ষীকে দেখান। বলেন, এ ফটো আপনার উপস্থিতিতে পুলিস ফোটোগ্রাফার সে রাত্রে তুলেছিল? যখন আপনি এ ঘরে তদন্ত করছেন? তাই না?
-- হ্যাঁ, তাই।
ফটোতে টেবিলের উপর একটা টেবল-ক্লক দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। যেটাতে সময় দেখা যাচ্ছে দুটো বেজে দশ। যেহেতু আপনি বলছেন যে, আপনি ঐ ঘরে পদার্পণ করেন রাত একটা চল্লিশে তাই বিশেষজ্ঞ হিসাবে আপনি কি বলবেন যে, আপনার এ ঘরে পদার্পণের ঠিক আধঘন্টা পরে ফটোটি তোলা হয়।
-- আজ্ঞে না। তা বলব না। বলব: পঁয়ত্রিশ মিনিট পরে। কারণ ঘরে ঢুকেই আমি নিজের হাতঘড়ির...যেটা নির্ভুল ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড টাইম দিচ্ছিল -- সঙ্গে ওটা মিলিয়ে দেখি। আমি লক্ষ্য করেছিলাম: ঐ টেবিল ঘড়িটি পাঁচ-মিনিট স্লো ছিল।
-- সেই টেবল্ অ্যালার্ম-ক্লকটা কোথায়?
-- আমরা ওটা ‘সীজ’ করে নিয়ে এসেছিলাম। জমা দিয়েছিলাম। এখন কোথায় আছে, তা জানি না।
বাসু-সাহেব নিরঞ্জন মাইতির দিকে ফিরে জানতে চান, ঘড়িটা কি আদালতে উপস্থিত করা যাবে?
মাইতি বললেন, যাবে। যখন বাদীপক্ষ সেটা উপস্থিত করার সিদ্ধান্ত নেবেন, তখন যাবে। এখন নয়।
বাসু-সাহেব নিরুপায়ের ভঙ্গিতে শ্রাগ করলেন। পুনরায় সাক্ষীর দিকে ফিরে প্রশ্ন করেন, ঐ টেবল ঘড়িতে সময়ের কাঁটা দুটো ফটো-তোলার মুহূর্তে দুটো বেজে দশ মিনিট দেখাচ্ছিল, কিন্তু ওর অ্যালার্ম-কাঁটা কী সময় নির্দেশ করছিল তা ম্যাগ্নিফাইং গ্লাসের সাহায্যে ফটো দেখে বলবেন কি?
-- ফটো দেখার দরকার হবে না। আমার মনে আছে: ঠিক একটা ।
বাসু-সাহেব পি. পি.-র দিকে ফিরে বললেন, ঘড়িটা কি এখন আদালতে আনা যেতে পারে?
মাইতি দৃঢ়স্বরে বললেন, না। বাদীপক্ষ ঐ ঘড়ির প্রসঙ্গে কোন প্রশ্নই করেননি। ফলে, এখন ওটা অবান্তর ।
বাসু বিচারকের দিকে ফিরে বললেন, য়োর অনার! বাদীপক্ষ ঐ ফটোটা তাদের একজিবিট হিসাবে দাখিল করেছেন। ফটোতে একটি টেবল-ক্লক আছে, এটা প্রত্যক্ষ সত্য। বাদীপক্ষের সাক্ষী এ ঘড়ি সম্বন্ধে দু-একটি তথ্য দাখিল করেছেন যা আদালতে নথীবদ্ধ হয়েছে। সাক্ষী এ কথাও স্বীকার করছেন যে, তাঁর ‘সীজার লিস্টে’ এ ঘড়িটি আছে। অর্থাৎ সেটি বাদীপক্ষের হেপাজতে রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রতিবাদী পক্ষের আর্জি: সেটি আদালতে দাখিল করা হোক, যাতে আমরা বর্তমান সাক্ষীকে ও বিষয়ে আরও কিছু জেরা করতে পারি।
বিচারক সম্মত হলেন না। তাঁর মতে বাদীপক্ষ ঘড়িটিকে তাঁদের এভিডেন্সের মধ্যে এখনো আনেননি! যখন আনবেন, তখন প্রয়োজনে বর্তমান সাক্ষীকে আবার কাঠগড়ায় তুলে প্রতিবাদী জেরা করতে পারবেন।
বাসু বললেন, ঠিক আছে। সেক্ষেত্রে বর্তমানে এই সাক্ষীকে জেরায় আর কোন প্রশ্ন করছি না। ওঁরা পরবর্তী সাক্ষীকে ডাকতে পারেন।
পরবর্তী সাক্ষী অটোপ্সি সার্জন ডাক্তার অতুলকৃষ্ণ সান্যাল। জিজ্ঞাসিত হয়ে তিনি তাঁর বিশেষজ্ঞের মতামত দিলেন: কমলেশের মৃত্যু হয়েছে, রাত বারোটা থেকে দুটোর মধ্যে। মৃত্যুর হেতু কোন একটি ডাণ্ডা জাতীয় কঠিন বস্তু দিয়ে কেউ কমলেশের মাথার পিছন দিকে আঘাত করেছিল, তাতে তার ‘সেরিবেলাম’ আহত হয়। সে জ্ঞান হারায়।
মাইতি সুচতুরভাবে প্রশ্ন করেন, আপনি বলতে চান আততায়ী পিছন থেকে কমলেশের মাথায় আঘাত করেছিল?
-- সে-কথা আমি আদৌ বলিনি। আমি বলেছি, তার মাথার পিছন দিকে অবস্থিত ‘সেরিবেলাম’ আহত হয়েছিল -- আততায়ী যে আক্রান্ত ব্যক্তির পিছনে ছিল এ-কথা আমি বলিনি!
-- কিন্তু তা কী করে সম্ভব? সামনে দাঁড়িয়ে আততায়ী কী করে একজনের মাথার পিছন দিকে আঘাত করবে?
-- হ্যাঁ, সেটাও সম্ভব। সেটাই ঘটেছে, একথা আমি বলছি না অবশ্য। বলছি, সেটাও অসম্ভব নয়...
-- কী ভাবে? একটু বুঝিয়ে বলুন?
-- কমলেশের দেহে দুটো আঘাত-চিহ্ন ছিল। একটি মাথার পিছন দিকে -- সেটি ওর মৃত্যুর কারণ; দ্বিতীয়টি ওর বাম ভ্রূর উপর। এমন হতে পারে যে, ওরা দুজন সামনা-সামনি ছিল। আততায়ী প্রথমে কমলেশের বাম ভ্রূতে আঘাত করে। তাতে কমলেশ ওর সামনে উবুড় হয়ে পড়ে যায়। তখন আততায়ী ওর মাথার পিছন দিকে অনায়াসে দ্বিতীয়বার আঘাত করতে.পারে। আই রিপীট...এমনটা ঘটেছিল তা আমি বলছি না, এমনটা ঘটতে পারে, তাই বলছি…
-- দ্যাটস্ অল য়োর অনার।
বাসু জেরা করতে উঠে বললেন, ডক্টর সান্যাল, আমি আপনাকে একটা বিকল্প ঘটনা-পরম্পরা শোনাচ্ছি। ধরা যাক: যে প্রথম বাড়িটা মারে -- কমলেশের বাম ভ্রূতে -- সে আত্মরক্ষা করতে চাইছিল। হয়তো সে স্ত্রীলোক, অথবা দুর্বল, তাই নিজেকে রক্ষা করতে সে এলোপাথাড়ি ডাণ্ডা ঘোরাচ্ছিল। কমলেশ বাঁ-চোখে আঘাত পেয়ে পড়ে যায়। আত্মরক্ষাকামেচ্ছু তখন লোহার পাইপটা ফেলে পালিয়ে যায়। কমলেশ মিনিটখানেক পরে সামলে নিয়ে উঠে বসতে চায়। আর তখন ঘরে উপস্থিত কোনও তৃতীয় ব্যক্তি এ পাইপটা তুলে নিয়ে কমলেশের মাথার পিছনে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করে! এমনটা যে ঘটেছিল সে দাবী কেউ করছে না, কিন্তু এ জাতীয় ঘটনা-পরম্পরায় কি কমলেশের মৃত্যু হতে পারে? এক্সপার্ট হিসাবে আপনার কী অভিমত?
-- নিশ্চয় পারে।
- থ্যাঙ্কু ডক্টর! আমার আর কিছু জিজ্ঞাস্য নেই।
নিরঞ্জন মাইতি তখন একের পর এক সাক্ষীকে কাঠগড়ায় তুলে ঘটনাপরম্পরা প্রতিষ্ঠিত করতে থাকেন। পাশের বাড়ির একজন ভদ্রলোক মধ্যরাত্রে ছন্দাকে তার মারুতি-সুজুকি গাড়ি চালিয়ে আলিপুরের বাড়ি থেকে রওনা হতে দেখেছে। রাত তখন বারোটা পঁয়ত্রিশ। সে ওদের অবাঙালী প্রতিবেশী। ত্রিদিবকে দীর্ঘদিন ধরে চেনে। ত্রিদিব যে সম্প্রতি একটি নার্সকে বিবাহ করেছে, তা ও খবর রাখে। তার নাকি ‘ইনসমনিয়া’ আছে। রাত্রে ঘুম হয় না। ঘটনার রাত্রে সে বস্তুত জেগেই ছিল। তাই জানে, ঠিক একঘন্টা পরে -- রাত একটা পঁয়ত্রিশে ছন্দা মারুতি-সুজুকি গাড়িটা চালিয়ে ফিরে আসে।
বাসু লোকটাকে আদৌ জেরা না করায় কৌশিক বিস্মিত হল। নিম্নস্বরে বলল, লোকটাকে জেরা করলেন না, মামু?
- পন্ডশ্রম! ওকে তোতাপাখির মতো সব কিছু শেখানো হয়েছে। ত্রিবিক্রমনারায়ণের আমদানী করা পেশাদার মিথ্যে সাক্ষী! ওকে জেরায় কজ্জা করা যাবে না।
তারপর সাক্ষী দিতে এলেন আরও একজন অবাঙালী: যশপাল মাথুর। তাঁর একটি পেট্রোল পাম্প আছে। ডায়মন্ডহারবার রোডে। তিনি তাঁর সাক্ষ্যে জানালেন যে, ঘটনার দিন, রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ তিনি ক্যাশ মেলাচ্ছিলেন, এমন সময় একটা মারুতি-সুজুকি চালিয়ে একজন ভদ্রমহিলা ওঁর পেট্রোল-পাম্পের শেডের ভিতর ঢুকলেন। সচরাচর এসব উনি নজর করে দেখেন না; কিন্তু একটা বিশেষ কারণে উনি বিস্মিত বোধ করেন। গাড়ি চালিয়ে যিনি প্রবেশ করলেন তিনি যুবতী -- বাঙালী মহিলা, এবং গাড়িতে আর কেউ নেই। এ জন্যই ঘড়ির দিকে তাঁর নজর পড়ে। রাত তখনো বারোটা বেজে তেতাল্লিশ! অত গভীর রাত্রে এ বয়সের একটি বাঙালী মহিলা একা ডায়মন্ডহারবার রোডে গাড়ি চালাচ্ছেন দেখেই উনি কৌতুহলী হয়ে পড়েন। সব কিছু খুঁটিয়ে দেখেন। -
মাইতি প্রশ্ন করেন, সে ভদ্রমহিলা কি এখন আদালতকক্ষে আছেন?
-- আজ্ঞে হ্যাঁ। ঐ তো আসামীর কাঠগড়ায় চেয়ারে বসে আছেন।
-- তিনি কি পেট্রোল কিনতে এসেছিলেন?
লীডিং কোশ্চেন! হোক, বাসু আপত্তি করলেন না।
মাথুর বললেন, আজ্ঞে না। তাঁর গাড়িতে পিছনের ডানদিকের চাকাটায় একদম হাওয়া ছিল না। উনি হাওয়া নিতে এসেছিলেন।
-- আপনি ওঁর গাড়ির চাকায় হাওয়া ভরে দিলেন?
-- আজ্ঞে না। আমি নয়। রামবিলাস। আমার কর্মচারী।
মাথুর বর্ণনা করলেন: রামবিলাস প্রথমে জ্যাক দিয়ে গাড়ির পিছনদিকটা তুলল। চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া চাকাটা বার করে নিল। ‘ডিক্’ থেকে স্পেয়ার চাকাটা ‘লাগ’ খুলে বার করে এনে লাগালো। জ্যাক সরিয়ে নিতেই দেখা গেল -- এ টায়ারটাও জখম। দ্রুত হাওয়া বের হয়ে যাচ্ছে। নজর হল, তাতে একটা পেরেক বিঁধে আছে। তাই আবার, জ্যাক লাগাতে হল। স্পেয়ার-টায়ার থেকে জখম-টিউবটা বার করে একটা নতুন টিউব দিতে-হল। রামবিলাস জানতে চাইল, জখম টিউবটা উনি মেরামত করাতে চান কিনা। তার জবাবে মহিলা বলেন, অনেক রাত হয়ে গেছে। টিউবটা এখানেই থাক। পরদিন মেরামত করা টিউবটা উনি সংগ্রহ করে নিয়ে যাবেন। এই সময়ে মাথুর বেরিয়ে এসে বলেন, ‘আপনার গাড়িতে আর স্পেয়ার টায়ার থাকল না কিন্তু ম্যাডাম। আবার যদি পাঞ্চার হয়...’ জবাবে উনি বলেন, উনি বেশি দূরে যাবেন না। তারাতলা যাচ্ছেন। এক কিলোমিটারও হবে না। রামবিলাস একটা রসিদ ধরিয়ে দেয় টিউবটা রাখার জন্য। ভদ্রমহিলা যখন চলে যান কখন রাত ঠিক একটা।
কাঁটায়-কাঁটায়!
সতের
বাসু জেরা করতে উঠে বললেন, মিস্টার মাথুর, আপনি ইতিপূর্বে বলেছেন, আসামী যখন আপনার পেট্রোল-পাম্প স্টেশনে ঢোকেন তখন রাত বারোটা বেজে
তেতাল্লিশ। তাই না?
-- আজ্ঞে হ্যাঁ, তাই।
-- আপনার হাতঘড়ি মোতাবেক, না ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড টাইম?
-- আমার ঘরে তিনটে ঘড়ি ছিল, স্যার। একটা ইলেকট্রিকাল দেওয়াল ঘড়ি, একটা টেবিল ক্লক, একটা রিস্ট-ওয়াচ। তিনটেতেই একই সময় দেয়। সে রাত্রেও দিচ্ছিল। ইন্ডিয়ান স্ট্যন্ডার্ড টাইম।
-- এবং ঐ ভদ্রমহিলা যখন আপনার দোকান থেকে বার হয়ে যান তখন রাত একটা?
-- আজ্ঞে হ্যাঁ।
-- কাঁটায়-কাঁটায় একটা?
--- পাঁচ-দশ সেকেন্ড কম-বেশি হতে পারে।
-- এই সময়কালের মধ্যে, বারোটা তেতাল্লিশ থেকে রাত একটা -- এই সতের মিনিটকাল আসামী আপনার চোখের সামনে ছিলেন?
-- আজ্ঞে হ্যাঁ।
-- মুহুর্তের জন্যেও আপনার দৃষ্টিপথের বাইরে যাননি?
-- আজ্ঞে না।
-- আপনি ওঁকে চিনতে ভুল করছেন না তো?
-- তা কেন করব? না, নিশ্চয় করছি না।
-- ওঁর মারুতি-সুজুকি গাড়ির নাম্বারটা আপনি জানেন?
-- জানি! মানে, মনে নেই, লেখা আছে আমার দোকানে। কারণ টিউবটা উনি জমা রেখে যান। সচরাচর এক্ষেত্রে গাড়ির নম্বর আমরা লিখে রাখি।
-- দ্যাটস্ অল য়োর অনার।
পরবর্তী সাক্ষী ডাক্তার নবীন দত্ত। মাইতি-সাহেবের প্রশ্নোত্তরে তিনি বর্ণনা করে গেলেন: কীভাবে মধ্যরাত্রে বটুক ওঁকে টেনে তোলে, উনি এসে তার ঘরের ভিতর দিয়ে টর্চের আলোয় কমলেশের পা-খানা দেখতে পান। ইঅ্যাদি, প্রভৃতি। ইতিপূর্বে জবানবন্দিতে তিনি যা বলেছেন এবার হলফ নিয়ে তা আবার বলে গেলেন।
মাইতি প্রশ্ন করেন, বটুক মন্ডল যখন আপনাকে ডাকতে আসে তার কিছু আগে কি পাশের বাড়িতে টেলিফোন বাজার শব্দ আপনি শুনতে পেয়েছিলেন?
-- হ্যাঁ, পেয়েছিলাম। আমি জেগেছিলাম বিছানায়।
-- বটুক মণ্ডল যখন আপনাকে ডাকতে আসে রাত তখন কটা?
-- আমি ঘড়ি দেখিনি! আন্দাজ দেড়টা।
-- তার কতক্ষণ আগে পাশের বাড়িতে টেলিফোন বাজে?
-- আন্দাজ দশ-পনের মিনিট হবে।
-- টেলিফোন বাজার পর এবং বটুকবাবু আপনাকে ডাকতে আসার মাঝখানে যে দশ-পনের মিনিট সময় পার হয়ে যায় তার মধ্যে আপনি আর কোন শব্দ শুনেছিলেন কি?
-- হ্যাঁ, একটানা একটা মেকানিকাল যান্ত্রিক শব্দ।
-- সেটা কিসের?
-- তা বলতে পারব না। আমার ধারণা হয়েছিল যে, মাঝেরহাট ব্রীজের তলা দিয়ে কোনও ইঞ্জিন না-থেমে হুইসিল বাজাতে বাজাতে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু পরে জেনেছি, রাত একটা থেকে দেড়টার মধ্যে এরকম কোন ইঞ্জিন মাঝেরহাট ব্রীজের তলা দিয়ে যায়নি। তাই আমার ধারণা: ডায়মন্ডহারবার রোডে বা তারাতলা রোডে কোনও মোটরকার-এর হর্নে শর্ট-সার্কিট হয়ে একটানা শব্দ হয়েছিল। অথবা দূর দিয়ে একটা দমকল যাচ্ছিল।
-- এ একটানা শব্দটা কতক্ষণ হয়েছিল?
-- এক থেকে দেড় মিনিট।
-- ওটা টেলিফোনের আওয়াজ নয়?
-- নিশ্চয় না। টেলিফোনের শব্দ অমন একটানা হয় না।
-- পাশের বাড়ির ডোরবেল নয়?
-- খুব সম্ভবত নয়। ডোর-বেল বাজালে কেউ সচরাচর ওভাবে পুরো এক মিনিট পুশ-বাটন ধরে থাকে না। বিশেষ রাত একটার সময়। একবার বাজায়, একবার থামে।
-- সচরাচর করে না। কিন্তু যদি ‘পুশবটন’ চেপে ধরে থাকে, তাহলে তো শব্দটা এ রকমই হবে?
-- হতে পারে। কিন্তু হলফ নিয়ে আমি বলতে পারব না। ওটা ‘ডোরবেল’-এর শব্দ।
-- তা তো কেউ বলাতে চাইছে না। হতে পারে কি না সেই সম্ভাবনার কথাই তো জানতে চাইছি।
-- তা পারে।
বাসু জেরায় প্রশ্ন করলেন, ওটা যে ইঞ্জিনের শব্দ নয়, এটা সাক্ষী কেমন করে জানলেন। ডক্টর দত্ত জানালেন, তিনি স্বয়ং মাঝেরহাট স্টেশনে গিয়ে অ্যাসিস্টেন্ট স্টেশন মাস্টরকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলেন। খুনের মামলায় ওঁকে সাক্ষী দিতে হবে শুনে এ. এস. এম. খাতা খুলে ওঁকে দেখিয়ে দেন ঘটনার রাত্রে এ সময় কোনও এঞ্জিন -- কী আপ, কী ডাউন -- মাঝেরহাট স্টেশন দিয়ে যায়নি।
পরবর্তী সাক্ষী বটুক মণ্ডল! পি. পি. র প্রশ্নের উত্তরে সে যা দেখেছে তা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করে গেল: তার প্রথমবারের জবানবন্দির সঙ্গে বর্তমান এজাহারে বস্তুত কোন প্রভেদ হল না। মাইতি ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, বটুকের ঘর থেকে টর্চ ফেললে মা-সন্তোষী অ্যাপার্টমেন্টের সদর দরজাটা দেখতে পাওয়া যায় কি না।
-- আজ্ঞে, তা যায়।
-- তাহলে কে কলিং-বেল বাজাচ্ছে দেখবার জন্য তুমি সেদিকে টর্চের আলো ফেলনি?
বটুক ঢোক গিলল। তার গলকন্ঠটা বার কতক ওঠা-নামা করল! আড়চোখে সে বাসু-সাহেবের দিকে তাকিয়ে দেখল। বাসু-সাহেব তখন সামনের দিকে ঝুঁকে এসেছেন। জ্বলন্ত এক-জোড়া চোখে তাকিয়ে আছেন বটুকের দিকে। ঝটুক আমতা-আমতা করল...
-- কী হল? জবাব দাও? তুমি ওদিকে টর্চের আলো ফেলেছিলে কি?
-- না। ও-বাগে ফোকাস করিনি। হল তো?
-- তোমার কৌতূহল হল না? জানতে, যে -- কে এতরাত্রে ‘কলবেল’ বাজাচ্ছে পাশের বাড়িতে?
-- না হয়নি। তাছাড়া পাশের বাড়িতে কেউ ‘কলবেল’ বাজাচ্ছিল তা তো আমি বলিনি।
-- পুলিশের কাছে প্রথম যে এজাহার দিয়েছিলে...
-- সে সব কথা ছাড়ান দ্যান, হুজুর। এই কাঠগড়ায় ডাঁইরে আমি ও-কথা বলিনি। এ কলিংবেলের কথা...
-- তুমি বলনি যে, যে সময় ঝগড়া-মারামারি হচ্ছিল তখন একটানা একটা কলিংবেলের শব্দ হচ্ছিল?
-- আজ্ঞে না! একটানা ‘একটা শব্দ হচ্ছিল’ বলিচি! তবে সেটা কলিংবেলের কি না, জানি না। রেল-ইঞ্জিনের হতে পারে। মটোর-গাড়ির হর্ন অমন পাগলামি করে মাঝে-মধ্যে -- তাও হতে পারে। আর, হ্যাঁ, দমকলের পাগলাঘন্টিও হতে পারে...
-- তুমি শুনলে না, ডক্টর নবীন দত্ত বললেন যে, উনি মাঝেরহাট স্টেশনে গিয়ে এ. এস. এম-এর কাছে জেনে এসেছেন, সে সময় মাঝেরহাট ব্রীজের তলা দিয়ে কোন এঞ্জিন যাচ্ছিল না। শোননি?
বটুক রুখে ওঠে, আজ্ঞে হ্যাঁ, শুনিচি! কিন্তু তার সত্যি-মিথ্যে আমি জানি না, হুজুর। এ শোনা কথার ভিত্তিতে আমি হলপ নিয়ে কিছু বললে ঐ উনি জেরায় আমাকে ছিঁড়ে খাবেন!
বাসুসাহেবকে সে দেখায়।
মাইতি বলেন, দ্যাটস্ অল, য়োর অনার।
বাসু এবার উঠলেন জেরা করতে! প্রথমেই প্রশ্ন করলেন, বটুকবাবু, তোমার পানের দোকানে তাকের উপর একটা জ্যাজ কোম্পানির অ্যালার্ম-ক্লক আছে, তাই না? মা-কালীর পটখানার ঠিক ডান-বাগে?
মাইতি আপত্তি জানালেন: অবান্তর প্রশ্ন, এই অজুহাতে ।
বাসু আদালতকে আশ্বস্ত করলেন যে, প্রশ্নের প্রাসঙ্গিকতা তিনি অচিরেই প্রতিষ্ঠা করবেন। ফলে বিচারক সাক্ষীকে অনুমতি দিলেন প্রশ্নের জবাবটা দিতে বটুক বলল, কোন কোম্পানির ঘড়ি তা বলতে পারব না, হুজুর, তবে হ্যাঁ, একটা ঘণ্টা-ঘড়ি আছে। বাবার আমল থেকে! ঐ আমার পানের দোকানে। ঠিকই বলেছেন, মা-কালীর পটের ডান বাগে।
-- সেটা তুমি মাঝে-মধ্যে দম দিয়ে বাজাও নিশ্চয়?
-- আজ্ঞে হ্যাঁ, তা বাজাই বইকি! ভোর রেতে কোথাও যাবার দরকার হলে।
-- ওটার শব্দ কেমন? টেলিফোনের মতো থেমে থেমে --ক্রিরিং-ত্রিং --ক্রিরিং-ক্রিং নাকি দমকলের ঘণ্টার মতো একটানা ঠঙাঠঙ-ঠঙাঠঙ-ঠঙাঠঙ?
বটুক জবাব দিল না, কী যেন ভাবছে সে।
-- কী হল? জবাব দাও। কী ভাবছ?
-- আজ্ঞে এ-কথাই ভাবছি। রেতের বেলা কি তাহ’লে দোকান ঘরে আমার ঘড়িটাই বাজছিল?
-- তুমি কি ওটাতে অ্যালার্ম দম দিয়েছিলে? এ দিন রাত একটার?
-- আজ্ঞে না।
-- তাহলে তোমার ঘড়ি বাজবে কী করে?
বটুক জবাব দিল না।
-- এবার তুমি এই ফটোটা দেখ তো। কমলেশের টেবিলে যে অ্যালার্ম-ক্লকটা দেখা যাচ্ছে, এটা কি তোমার পানের দোকানের ঘড়িটার মতো?
সাক্ষী ছবিটা দেখে নিয়ে নিজে থেকেই আত্মজিজ্ঞাসা করল, সে-রাতে কি তাইলে ঘড়িটাই একটানা বেজে চলেছিল? তাই শুনিচি?
বাসু বিচারকের দিকে ফিরে বললেন, প্রতিবাদীপক্ষ থেকে পুনরায় দাবী করা হচ্ছে, য়োর অনার! কমলেশের ঘর থেকে অপসারিত ঘড়িটি আদালতে উপস্থাপিত করা হক। বর্তমান সাক্ষী প্রসিকিউশন-তরফের। সে সন্দেহ প্রকাশ করেছে যে, এই ঘড়ির শব্দই ঘটনার রাত্রে শুনে থাকবে। এ-ক্ষেত্রে বাদীপক্ষ ঘড়িটি আদালতে নিয়ে আসুন। তাদের তরফে সাক্ষীকে সে ঘড়ির অ্যালার্মটা শুনিয়ে দিন। প্রতিবাদী পক্ষ জানতে ইচ্ছুক এ অ্যালার্ম ঘড়ির শব্দ শোনার পর সাক্ষীর স্মৃতি কী বলে।
বিচারক মাইতির দিকে ফিরে বলেন, আপনার নিশ্চয় আর কোন আপত্তি নেই?
মাইতি তড়াক করে উঠে দাঁড়ান: কী বলছেন ধর্মাবতার? প্রচণ্ড আপত্তি আছে। ঘড়িটা আমরা এখনি আদালতে আনতে চাই না। এভাবে বাসু-সাহেব প্যাঁচে ফেলে আমাদের বাধ্য করতে পারেন না...
বিচারক তাঁর কাঠের হাতুড়িটা টেবিলে ঠুকলেন। দৃঢ়স্বরে বললেন, মিস্টার পি.পি! আপনি বসুন! আপনার ভাষা অনুমোদনযোগ্য নয়। প্রতিবাদী পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছে বাদীপক্ষের ‘সীজ’-করা একটা বিশেষ দ্রব্য আদালতে উপস্থাপিত করা হোক। এ দাবী ইতিপূর্বেই ডিফেন্স-কাউন্সেল দু-দুবার পেশ করেছিলেন এবং আমি তখন তা নাকচ করে দিই। বর্তমানে বাদীপক্ষের সাক্ষী স্বতপ্রবৃত্ত হয়ে বলছেন যে, হয়তো তিনি ঐ পুলিশের সীজ করা ঘড়ির আওয়াজটাই শুনেছেন! এক্ষেত্রে বর্তমানে আদালত মনে করছেন যে, প্রতিবাদীর দাবী যুক্তিসঙ্গত! সুতরাং এখন আমি জানতে চাইছি: মৃত কমলেশের ঘর থেকে অধিকৃত ঐ অ্যালার্ম-ক্লকটি কোথায় আছে?
মাইতি জবাব দিলেন না। অবাধ্য ছাত্রের মতো গৌঁজ হয়ে বসে রইলেন।
ভাদুড়ী পুনরায় বলেন, মিস্টার পি.পি.! আমি আপনাকেই জিজ্ঞাসা করছি! কমলেশের ঘর থেকে ‘সীজ’ করা ঘড়িটি কোথায়?
এবার মাইতি বললেন, পেশকারবাবুর কাছে জমা আছে।
বিচারকের আদেশে পেশকারবাবু অ্যালার্ম-ক্লকটি এনে জজ-সাহেবের টেবিলের উপর রাখলেন। বাসু-সাহেব সেটা নেড়েচেড়ে দেখলেন। মাইতি সাহেবকে প্রশ্ন করেন, এইটাই সেই আইডেন্টিকাল অ্যালার্ম ক্লক ?
মাইতি বললেন, ওর গায়ে লেবেলেই তো সে কথা লেখা আছে।
বিচারক কী একটা কথা বলতে গিয়েও বললেন না। ঘড়ির গায়ে লেবেল আঁটা কাগজটা পড়ে দেখে বললেন, হ্যাঁ এটাই সেই ঘড়ি। বাইশে জুন রাত্রে মা-সন্তোষী অ্যাপার্টমেন্ট থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে।
ঘড়িটি বিচারক বাসু-সাহেবের হাতে দিলেন। বাসু বলেন, ধরে নিচ্ছি যে, আপনি আমাকে এটা ব্যবহারের অনুমতি দিচ্ছেন। দম দিতে বা বাজাতে?
বিচারক পাবলিক প্রসিকিউটারের দিকে দৃকপাত করে দেখলেন। কিন্তু মাইতি তখনো স্বাভাবিক হতে পারেননি।
বিচারক বললেন, আদালতের নির্দেশেই বাদীপক্ষ তাদের ‘সীজ’-করা ঘড়িটি আদালতে উপস্থাপিত করেছেন। আপনি প্রতিবাদীর পক্ষ থেকে এটি বাজিয়ে প্রসিকিউশনের সাক্ষীকে শোনাতে চাইছেন।
আমি আপত্তির কোন কারণ দেখছি না। পি. পি.-র যদি আপত্তির কারণ থাকে তবে তাকে তা এখনি জানাতে হবে।
মাইতি তার চেয়ারে প্রস্তরমূর্তির মতো নিশ্চল বসে রইলেন।
বাসু হাত বাড়িয়ে ঘড়িটি নিলেন। সেটি বটুকের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, বটুকবাবু, তুমি লক্ষ্য করে দেখ, অ্যালার্ম-কাঁটাটা একটার ঘরে আছে। তাই না?
-- আজ্ঞে হ্যাঁ, তাই আছে বটে। ঠিক একটার ঘরে।
-- আরও লক্ষ্য করে দেখ বটুকবাবু, ‘অ্যালার্ম-দম’ শেষ হয়ে গেছে। মানে বর্তমানে অ্যালার্ম-দম দেওয়া নেই।
মাইতি এতক্ষণে বলে ওঠেন, বিস্ময়কর তথ্য! শুধু অ্যালার্ম কেন? ঘড়িটাও তো দম না পেয়ে বন্ধ হয়ে গেছে পুলিশের গুদামঘরে।
বিচারক বলেন, অবান্তর মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
বাসু-সাহেবকে বলেন, আপনি কি অ্যালার্ম ঘড়িটা বাজিয়ে শোনাতে চান?
-- ইয়েস, য়োর অনার। আমি প্রথমে ফুরিয়ে যাওয়া অ্যালার্ম দমটা দেব। তারপর মিনিটের কাঁটাখানা ধীরে-ধীরে ঘোরাতে থাকব, কারণ আমি দেখতে চাই শেষ বার অ্যালার্মটা কটার সময় বেজে শেষ হয়েছিল। অর্থাৎ ঠিক কটার সময় মিনিটের কাঁটাটা পৌঁছলে অ্যালার্ম বাজতে শুরু করে। আর তখনই আমি সাক্ষীর মতামতটা শুনতে চাই। ঘটনার রাত্রে নিজের ঘর থেকে সে এই ঘড়ির অ্যালার্ম-এর আওয়াজটাই শুনেছিল কি না।
বিচারক বললেন, আপনি তা করতে পারেন। মিস্টার পি.পি., আপনি এখানে এগিয়ে এসে কাছাকাছি দাঁড়াতে পারেন। বাদীর পক্ষ থেকে সবকিছু তদারক করতে পারেন।
মাইতি দৃঢ়স্বরে বললেন, পি. কে. বাসু-সাহেবের এ-জাতের হাত-সাফাই আমার অনেক দেখা আছে। আদালত যখন অনুমতি দিয়েছেন তখ্খন তিনি আবার ভানুমতীর খেল দেখান। আমার তা দেখবার উৎসাহ নেই।
চীফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বললেন, মিস্টার পি.পি.! আপনি অবহিত আছেন কি না জানি না, আপনার আচার এবং কথাবার্তা কিন্তু আদালত-অবমাননার সীমান্তের কাছাকাছি এসে গেছে। আপনাকে আমি ‘অ্যাডমনিশ্’ করছি! ফর দ্য লাস্ট টাইম!
হঠাৎ এদিকে ফিরে বাসুকে বলেন, ইয়েস কাউন্সেল, আপনি যে পরীক্ষাটা করতে চান এবার শুরু করুন।
পি. কে. বাসু এগিয়ে এলেন। এখন তিনিই আদালতকক্ষের মধ্যমণি। অহেতুক -- সম্ভবত নাটকীয় ভাবটা ফুটিয়ে তুলতে, অথবা মাইতির ঈর্ষা অগ্মিতে সমিধনিক্ষেপমানসে -- বিচারককে একটি ম্যাজিশিয়ানি ‘বাও’ করলেন। তারপর ঘড়িতে ‘অ্যালার্ম দম দিলেন। ধীরে ধীরে মিনিটের কাঁটাটা ঘোরাতে শুরু করলেন। কীটা যখন বারোটা আটান্ন মিনিটে পৌঁছালো তখনই ঝনন্ করে বেজে উঠল ঘড়িটা।
যেন অপ্রত্যাশিত একটা সাফল্যলাভ করেছেন! বাসু-সাহেব টেবিল-ঘড়িটা ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেবের বেঞ্চে রেখে নিজের চেয়ারে ফিরে এসে বসলেন। মিনিটখানেক বেজে ঘড়িটা থামল।
বাসু উঠে দাঁড়ালেন। সাক্ষীকে বললেন, বটুকবাবু, এবার বল, তুমি যে একটানা শব্দটা শুনেছিলে তা কি রেল-ইঞ্জিনের হইসিল? নাকি মটোর গাড়ির শর্ট-সার্কিট হয়ে যাওয়া হর্ন, অথবা দমকলের একটানা ঠনাঠন, কিংবা...কথাটা তাঁর শেষ হল না। ঝটুক বলে উঠল: ঐ ঘড়িটা!
-- কী ঐ ঘড়িটা?
-- ঐ ঘড়ির ‘ঠনাঠন’-শব্দটা আমি শুনেচি হুজুর!
-- তুমি নিঃসন্দেহ?
-- আজ্ঞে হ্যাঁ, নিয্যস, নিঃসন্দেহ।
-- তুমি হলপ নিয়ে এ-কথা বলছ কিন্তু!
-- জানি হুজুর। মিছে কথা বললে আপনি আমারে ডোরাকাটা হাফপ্যান্ট পরাবেন, গলায় তক্তি ঝোলাবেন, পানসাজা ছেড়ে আমারে মাটি কোপাতে হবে! সব, স-ব কথা -- মনে আছে হুজুর। আমি নিয্যস এ ঘড়িটার ঠনাঠন-ঠনাঠন শুনেছিলাম! সেদিন রেতের বেলা!
-- তোমার মনে কোনও সন্দেহ নেই?
-- তিলমাত্র নয়।
-- তাহলে এ ঠনাঠনটা তুমি শুনেছিলে রাত ঠিক একটা বেজে তিন-এ?
-- আজ্ঞে না। একটা বাজতে দুইয়ে। বারোটা আটান্ন-মিনিটে!
-- সে তো ঐ অ্যালার্ম-ঘড়ির টাইমে। কিন্ত শুনলে না, ইন্সপেক্টর মুখার্জি সাহেব এক্সপার্ট ওপিনিয়ান দিয়ে গেলেন ঐ অ্যালার্ম-ঘড়িটা পাঁচ মিনিট স্লো ছিল? তার মানে অ্যালার্মটা বেজেছিল একটা বেজে তিন-এ?
-- ও হ্যাঁ। তা বটে। ঘড়িটা পাঁচমিনিট শোলো ছিল।
বাসু-সাহেব বিচারকের দিকে ফিরে বলেন, দ্যাটস্ অল য়োর অনার।
বিচারক নিরঞ্জন মাইতির দিকে ফিরে বলেন: এনি রিডাইরেক্ট?
মাইতি মাথা নেড়ে অস্বীকার করেন।
বাসু বিচারককে বলেন, ইতিপূর্বে ডক্টর নবীন দত্তকে ঐ অ্যালার্ম ক্লক সম্বন্ধে কোনও প্রশ্ন করা যায়নি, কারণ তখনো সেটা আদালতে উপস্থিত করা হয়নি। আমি আর একবার বাদীপক্ষের ঐ সাক্ষীকে কাঠগড়ায় তোলার জন্য আর্জি জানাচ্ছি।
বিচারক বললেন, বর্তমান অবস্থায় এটা অনুমোদনযোগ্য।
ডক্টর দত্ত পুনরায় কাঠগড়ায় উঠে দড়ালেন। বাসু জানতে চান, আপনি কি অ্যালার্ম-ঘড়ির শব্দটা শুনেছেন?
-- হ্যাঁ, শুনেছি।
আপনার কি মনে হয় ঘটনার রাত্রে আপনি যে একটানা শব্দটা শুনেছেন তা এ ঘড়ির অ্যালার্ম?
-- খুব সম্ভবত তাই। ‘নিশ্চিত তাই’ বলতে পারছি না।
-- আপনি পেশায় চিকিৎসক। মনস্তত্ব নিয়ে পড়াশুনা করেছেন। তাই জানতে চাইছি: কোন ঘুমম্ত ব্যক্তির নাগালের মধ্যে যদি মাঝ রাতে অ্যালার্ম ক্লক বেজে ওঠে তাহলে সে কি প্রতিবর্তী প্রেরণায় ঘুম ভেঙেই ঘড়িটা বন্ধ করে দেয় না?
মাইতি আপত্তি করেন: আর্গুমেনটেটিভ। কনক্লুশন।
বিচারক আপত্তি নাকচ করেন। সাক্ষী একজন বিশেষজ্ঞ। এ-জাতীয় প্রশ্নের সুচিন্তিত জবাব দেবার শিক্ষা তাঁর আছে। সাইকলজি ওঁর অধীতবিদ্যা।
-- ওয়েল, ডক্টর দত্ত। আনসার দ্যাট কোশ্চেন।
-- হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন। ঘুম ভেঙে উঠেই প্রতিবর্তী-প্রেরণায় সে হাত বাড়িয়ে অ্যালার্মটা বন্ধ করে দেয়। বিশেষ মধ্যরাত্রে।
-- বর্তমান ক্ষেত্রে যদি প্রমাণিত হয় যে, আপনি ও বটুকবাবু এ অ্যালার্ম ক্লকের শব্দটাই শুনেছেন, তাহলে কী কারণে কমলেশ সেটা বন্ধ করে দেননি? আপনার কী অনুমান?
-- অবজেকশন য়োর অনার! এ প্রশ্নটা শারীরবিদ্যা সংক্রান্ত নয়, সাক্ষীর অধীত-বিদ্যার অন্তর্গত নয়। বিশেষজ্ঞ হিসাবে তার অনুমাননির্ভর জবাব উনি দিতে পারেন না। এ ক্রিমিনোলোজির প্রশ্ন, শারীরবিদ্যার নয়।
-- অবজেকশন সাসটেইন্ড!
বাসু একগাল হেসে বললেন, এবার তাহলে প্রসিকিউশন ইন্সপেক্টর মুখার্জিকে আর একবার কাঠগড়ায় তুলুন। সহযোগী তো তাকে ইতিপূর্বেই ক্রিমিনোলজির এক্সপার্ট হিসাবে দাবী করছেন। আমরা তার কাছেই এ প্রশ্নটার জবাব শুনি বরং। একটা বেজে তিন-মিনিটে কমলেশ কেন অ্যালার্মটা বন্ধ করতে পারেনি! কেন ঘড়িটা দম শেষ হওয়া পর্যন্ত একটানা বেজে গেল।
ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেব ঘড়ি দেখে বললেন, রিসেস-এর সময় হয়ে গেছে। নেক্সট সেসনে ইন্সপেক্টর মুখার্জির ক্রস শুরু হবে। আপাতত আদালত মুলতুবি থাকছে; কোর্ট ইজ অ্যাডজর্নড!
আঠার
রাত্রে ডাইনিং-টেবিলে ওঁরা ‘চারজন’ খেতে বসেছিলেন। আহার পর্ব শেষ হয়েছে। এখন খোশগল্প চলেছে। রানু আদালতে যান না। যেতে পারেন না। অথচ তাঁর কৌতূহল অনন্ত। বাকি তিনজনের কাছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব কিছু শোনেন।
কৌশিক বলল, মামু প্রায় জাল গুটিয়ে এনেছেন। বাদীপক্ষের দু’দুজন সাক্ষী স্বীকার করেছে যে, তারা রাত একটা বেজে তিন মিনিটে কমলেশের ঘরে অ্যালার্ম-ক্লকটা বাজতে শুনছে। কমলেশ সেটা হাত বাড়িয়ে থামিয়ে দেয়নি। তার মানে, তার আগেই সে আহত হয়ে অজ্ঞান অবস্থায় ভূতলশায়ী !
রানু জানতে চান, তাতেই বা কী সুবিধা হল?
-- তাতে প্রমাণ হল: রাত একটা বেজে তিন মিনিটের আগে কমলেশের মাথায় আঘাতটা লেগেছিল। অথচ পেট্রোল-পাম্পের ম্যানেজার মাথুরের জবানবন্দী অনুসারে ছন্দা রাত একটা পর্যন্ত ওঁর দোকানে ছিল। মাত্র তিন মিনিটের ভিতর ছন্দার পক্ষে এক কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করে, গাড়ি পার্ক করে, দ্বিতলে উঠে কমলেশের সঙ্গে ঝগড়া শেষ করে তাকে হত্যা করা অসম্ভব। ফলে হত্যাকারী ছন্দা ছাড়া আর কেউ!
বাসু বললেন, অত তাড়াহুড়া কর না, কৌশিক। এখনো নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়নি যে, ডোরবেল কেউ বাজায়নি। ডাক্তার ব্যানার্জি ধরা পড়লেই তাকে স্বীকার করতে হবে যে, ডোরবেলটা সেই বাজিয়েছিল। ওদিকে ছন্দা এজাহার দিয়ে বসে আছে যে সে নিজে এ ঘরে ঢোকেনি। কলিংবেলটা বাজিয়েছিল সে নিজেই...
-- তা বটে।
বাসু বলেন, সুজাতা, হোটেল তাজ-বেঙ্গলে একটা ফোন কর তো? মিস্টার ত্রিবিক্রম রাও অব নাসিককে তার ঘরে পাও কি না দেখ। রুম সেভেন হান্ড্রেড অ্যান্ড ফিফ্টিন।
অচিরেই যোগাযোগ হল। রাশভারী গলায় ত্রিবিক্রম ইংরেজিতে জানতে চাইলেন, কে কথা বলছেন?
সুজাতা বললে, প্লীজ হোল্ড অন, স্যার! মিস্টার পি.কে. বাসু, বার অ্যাট-ল, আপনার সঙ্গে কথা বলবেন।
-- অল রাইট!
বাসু টেলিফোনটা নিয়ে বললেন, গুড-ইভনিং মিস্টার রাও।
-- হ্যাঁ, শুভ-সন্ধ্যা। বলুন? কীভাবে আপনার খিদমৎ করতে পারি?
-- আপনি আদালতে ছিলেন লক্ষ্য করেছি। কখন উঠে গেলেন টের পাইনি।
-- এটা তো ভূমিকা। মূল বক্তব্য? সেটায় সরাসরি এলে দুজনেরই সময় সংক্ষেপ হয়।
-- অল রাইট! শুনুন। আমার মক্কেল আদালতে বিবাহ-বিচ্ছেদের আবেদন পেশ করতে ইচ্ছুক।
-- করুক না! এতো ভাল কথা। তবে সে-কথা আমাকে কেন?
-- তার স্বামী বর্তমানে কোথায় আছে তা আমরা জানি না, তাই নোটিসটা সার্ভ করা যাচ্ছে না।
-- ভা -- রি দুঃখের কথা। আমি এ বিষয়ে আপনাকে বা আপনার মক্কেলকে সাহায্য করতে পারি এ-কথা কেন ধরে নিলেন?
-- এই কারণে যে, আমার বিশ্বাস: আপনি আপনার পুত্রের বর্তমান ঠিকানা জানেন, এবং বিবাহ-বিচ্ছেদটা চাইছেন। আমার ধারণাটা ভুল হলে আমি মক্কেলের তরফে কলকাতা-দিল্লি-বোম্বাইয়ের সব খানদানি খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেব। সেটাও ‘লীগ্যালি ভ্যালিড নোটিস্’। পরের ঘরের কেচ্ছা খবরের কাগজে বিস্তারিত ছাপতে আমার প্রচুর খরচ পড়বে – তবে ‘অ্যালিমনি’র ভিতর সে খরচও না হয় ধরে দেওয়া যাবে, কিন্তু আপনার খানদান যেভাবে খানখান হয়ে যাবে তা আর জোড়া লাগবে না, রাও-সাহেব।
-- কী পরিমাণ ‘অ্যালিমনি’ চেয়েছে আপনার মক্কেল?
-- সে-কথা তো আপনার কপর্দকহীন পুত্রের সঙ্গে। আপনি তো লীগ্যালি থার্ড-পার্টি। তাই নয়?
-- অল রাইট! কাল সকাল দশটায় এই হোটেলে, এই ঘরে যেন আদালতের লোক নোটিসটা সার্ভ করে যায়। আপনার মকেলের স্বামী তখন এখানে থাকবে।
-- থ্যাঙ্কু অ্যান্ড গুড নাইট!
হত্যা-মামলার দিন পড়েছে পনের দিন পরে। কিন্তু বিবাহ-বিচ্ছেদের মামলার দিন আগামী সপ্তাহেই। ছন্দা জামিন পায়নি। এদিকে ডক্টর ব্যানার্জি এখনো নিরুদ্দেশ। জবা হয় সত্য কথা বলছে, অথবা অত্যন্ত দৃঢ় চরিত্রের মেয়ে। সে স্বীকার করেনি -- এমনকি জনান্তিকেও, বাসু-সাহেবের কাছে যে, এ ‘অপারেশন অ্যাবডাকশনটা’ বাস্তবে অলীক -- ডাক্তার-নার্সের যৌথ পরিকল্পনা।
বিবাহ-বিচ্ছেদের নোটিস্টা ত্রিদিবকে সার্ভ করা গেছে। নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট সময়ে সে উপস্থিত ছিল। স্বাক্ষর করে নোটিসটা সে গ্রহণ করেছে। দেখা গেল, বাপ-বেটা দু’ জনাই এটা চাইছেন। বাপ তো বটেই -- ঐ ‘নি-খানদানী’ নার্স-মেয়েটি, যে অন্যপূর্বা, যে বাড়ি-থেকে পালিয়ে একজনের সঙ্গে - বস্তিতে বাস করেছে, ফলস্ ডেথ-সার্টিফিকেটের জোরে ইনসিওরেন্স-এর টাকা আদায় করেছে এবং সম্ভবত প্রথম স্বামীকে হত্যা করেছে -- তাকে তাঁর হাভেলীতে কোন মতেই প্রবেশ করতে দিতে পারেন না। অপরপক্ষে বর্তমান অবস্থায় বিবাহ-বিচ্ছেদটা মঞ্জুর হয়ে গেলে, ছন্দার ফাঁসিই হোক অথবা যাবজ্জীবন – তাঁর শক্তাবৎ খানদান অক্ষত থাকবে। এজন্য তিনি এক কথায় দশ লক্ষ টাকা খরচ করতে প্রস্তুত।
দুটো অসুবিধা ছিল। এক নম্বর: ত্রিদিব বেঁকে বসতে পারত। ত্রিবিক্রম ভাগ্যবান। তা হল না। যেকোন কারণেই হোক, ত্রিদিব ‘প্রডিগাল সান’-এর চরিত্রটা অভিনয় করতে আগ্রহী। ছন্দার মোহমুক্ত হয়ে সে বাপের কক্ষপুটে ফিরে যেতে চায়। দ্বিতীয় আপত্তি: বাসু-সাহেব যে-কারণে বিবাহ-বিচ্ছেদটা চাইছেন -- ‘নিষ্ঠুরতা’। ওটা মেনে নেওয়া চলে না। সংগ্রামসিংহের আমল থেকে কোন শক্তাবৎ রাজপুরুষ ধর্মপত্নীর প্রতি নিষ্ঠুর হয়নি।
সুতরাং ত্রিবিক্রম বোম্বাই থেকে উড়িয়ে আনলেন একজন ব্যারিস্টারকে -- এল. জি. নটরাজন, বার-অ্যাট-ল। ত্রিবিক্রম জানতেন, ওঁরা দুজন -- নটরাজন এবং বাসু -- একই বছরে ব্যারিস্টার হয়েছিলেন, চষ্লিশ বছর আগে। একই বছরে একই চেম্বার থেকে।
নটরাজনকে উনি বললেন, আপনি বাসু-সাহেবের সঙ্গে দরাদরি করুন। উনি আপনার ক্লাসফ্রেন্ড। পারলে, আপনিই পারবেন।
নটরাজন জানতে চান, আপনি ম্যাক্সিমাম কত অ্যালিমনি দেবেন?
ত্রিবিক্রম মাথা নেড়ে বলেন, আপনি আমার প্রস্তাবটা কিছুই বুঝতে পারেননি! টাকার প্রশ্ন আদৌ উঠছে না। দশ লক্ষ পুরোই দেব। প্রয়োজনে ওটা বেড়ে পনের হলেও ক্ষতি নেই ; কিন্তু এ কারণটা দেখানো চলবে না: নিষ্ঠুরতা! হেতুটা হোক দুজনের মতের মিল হচ্চে না -- জীবনদর্শনে ফারাক!
-- এই গ্রাউন্ডে কি বিবাহবিচ্ছেদ মঞ্জুর হবে?
-- হবে। সে দায়িত্ব আমার। তবে পি. কে. বাসু বাগড়া দিলে হবে না।
-- আচ্ছা, দেখি আমি কী করতে পারি!
নটরাজন টেলিফোন করলেন বাসুকে। বাসু উচ্ছসিত। দুই বন্ধুতে অনেক-অনেকদিন পর সাক্ষাৎ হল। প্রায় ত্রিশ বছর। বাসু এককথায় রাজি। ত্রিদিব যদি ‘অপোজিশন’ না দেয়, তাহলে বিচারককে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলা যাবে। সত্যিই তো। দুজনের জীবনদর্শনে আসমান-জমিন ফারাক! মিউচুয়াল ডিভোর্স হলেও হতে পারে।
বাসু নটরাজনকে ডিনারে নিমন্ত্রণ করলেন। নটরাজন বললেন, ভালয় ভালয় বিবাহ-বিচ্ছেদটা মিটে গেলে নিশ্চয় ডিনারে আসব। এখন ওটা দৃষ্টিকটু দেখাবে।
বাসু জানতে চান, ছন্দা রাওয়ের মামলায় তোমার কোনও ভূমিকা নেই?
-- তুমি ভুল করছ, বাসু। মামলার আসামী আগামী সপ্তাহ থেকে আর ছন্দা ‘রাও’ থাকবে না। বিশ্বাস কর, ওটা ‘বিশ্বাস’ হয়ে যাবে!
নটরাজন জানতে চান, শুনেছি তুমি কোন মক্কেলের কেস নাও না যতক্ষণ না তুমি নিজে বিশ্বাস কর যে, সে নির্দোষ। কথাটা সত্যি?
-- এ বদনাম বোম্বাইয়েও রটেছে?
-- তার মানে অভিযোগটা তুমি মেনে নিচ্ছ। এবং তার মানে তোমার বিশ্বাস: ঐ কমলেশ বিশ্বাসকে ছন্দা হত্যা করেনি।
-- একটি মাত্র যুক্তি। ‘কে’ হত্যা করেছে, ‘কেন’ হত্যা করেছে, ‘কী করে’ হত্যা করেছে তা আমি জানি। প্রমাণ করতে পারছিলাম না।
-- ‘পারছিলাম না’! মানে অতীতকাল। এখন পার?
-- এখন পারি। যদি তুমি আমাকে সাহায্য কর।
-- আমি? আমি কী ভাবে সাহায্য করব?
-- পরামর্শ দিয়ে। বাধা না দিয়ে।
-- আমার ‘প্রফেশনাল এথিক্সে’ না আটকালে আমি নিশ্চয় সাহায্য করব। বল, কী করতে হবে?
-- পরশু, শুক্রবার, আমি তোমার মকেলের একটা ‘ডিপজিশন’ নিতে চাই। এই বিবাহ-বিচ্ছেদ মামলার বিষয়েই। তার ভিতর থেকেই অপরাধী চিহ্নিত হবে। তুমি জান কি জান-না আমার জানা নেই, ত্রিদিব প্রথমে আমার কাছেই এসেছিল, তার স্ত্রীর তরফে আমাকে ‘রিটেইন’ করতে।
-- হ্যাঁ, আমি শুনেছি সে-কথা।
-- তখন সে আমাকে কতকগুলো ‘ক্লু’ দিয়ে যায়। যার সাহায্যে আমি কেসটার সমাধানে পৌঁছেছি, আসল হত্যাকারীকে চিহ্নিত করেছি। কিন্ত দুর্ভাগ্যবশত প্রকৃত অপরাধীকে চিহ্নিত করলেও আমি অকাট্য প্রমাণগুলি সংগ্রহ করতে পারিনি। সে সুযোগলাভের আগেই পুলিস ত্রিদিবকে আমার নাগালের বাইরে নিয়ে যায়। আর তার দেখা পাইনি।
-- অল রাইট। কোথায় তুমি ডিপজিশনটা নিতে চাও?
-- তুমি কোথায় উঠেছ?
-- ঐ তাজ বেঙ্গলেই। পাঁচশ-একুশ নম্বর ঘরে।
-- তাহলে এ ঘরেই হতে পারে। পরশু, শুক্রবার, বেলা দুটোয়। একটি শর্ত -- ঘরে আমরা মাত্র চারজন থাকব: তুমি, আমি, ত্রিদিব আর স্টেনোগ্রাফার।
-- আল রাইট। কিন্ত ত্রিবিক্রম কেন থাকবেন না?
-- ত্রিদিব ওর দাম্পত্যজীবনের জটিলতা সম্বন্ধে এমন কিছু বলেছিল যেকথা ত্রিবিক্রমের না শোনাই মঙ্গল। এটিকেটে বাধে। তুমি তাঁকে বুঝিয়ে বল।
-- বলব।
শুক্রবার, রাত আটটা। বাসু-সাহেব তাঁর চেম্বারে বসে কি যেন করছিলেন। ইন্টারকমটা বেজে উঠল। তুলে নিয়ে বললেন, বল রানু?
-- উনি এসে গেছেন।
-- ঠিক আছে। তাঁকে পাঠিয়ে দাও।
একটু পরেই ঘরের ফ্লাশ-পাল্লাটা খুলে গেল। নিখুঁত থ্রিপিস্ স্যুটধারী ত্রিবিক্রমনারায়ণ রাও প্রবেশ করলেন ঘরে। সামনে দিকে একটু ঝুঁকে পড়ে বললেন, গুড ইভনিং! ব্যারিস্টার সাহেব।
-- ওয়েলকাম, স্যার। বসুন ঐ ডিভানটায় ; কিন্ত আপনি একা যে? আমি তো নটরাজনকেও প্রত্যাশা করছিলাম।
-- না। তিনি বোম্বাই ফিরে গেছেন, ইভনিং ফ্লাইটে।
-- সে কী! বিবাহ-বিচ্ছেদের মামলার ফয়শালা না হতেই?
ত্রিবিক্রম ইতিমধ্যে আসন গ্রহণ করেছেন। বললেন, মিস্টার নটরাজন তো যাবার আগে বলে গেলেন আপনি আর আপনার মক্কেল রাজি হয়েছেন হেতুটা পরিবর্তন করতে, অর্থাৎ ‘নিষ্ঠুরতা’-র পরিবর্তে ‘ম্যাল্অ্যাডজাস্টমেন্ট’ -- বাকিটা তো জাস্ট ফর্মালিটি।
বাসু তার ড্রয়ার খুলে একটা সিগার-এর বাক্স বার করে এগিয়ে দিলেন: চলবে?
-- নো, থ্যাংকস্। আই স্টিক টু মাই ওন ব্রান্ড।
বাসু পাইপ ধরালেন। ত্রিবিক্রমও ধরালেন নিজের ব্র্যান্ডের সিগার।
বাসু বলেন, বিবাহ-বিচ্ছেদের সঙ্গে এ ক্ষেত্রে আরও একটা জিনিস যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকবে সে-কথা নটরাজন আপনাকে কিছু বলে যায়নি?
-- বলে গেছেন। অ্যালিমনি। তার অ্যামাউন্টটা অবশ্য বলে যাননি। সেটা আমাকে সেটল্ করতে পরামর্শ দিয়ে গেছেন। জোকিংলি বললেন -- ‘ওটা নেহাৎই দরাদরি। আপনি ব্যবসায়ী মানুষ, ওটা নিজেই ম্যানেজ করে নেবেন।’ তো বলুন স্যার, আপনার মক্কেল কী পরিমাণ ড্যামেজ চাইছেন?
-- ‘ড্যামেজ’ কেন বলছেন? ‘ড্যামেজ’ ক্লেম করে এমপ্লয়ী। নিগৃহীত প্রতিবেশী । অন্যায়ভাবে আহত ব্যক্তি। এটা তো শুধু ‘ড্যামেজ’ নয়। মানি সেটেলমেন্ট। স্বামী-স্ত্রীর যৌথ সম্পত্তির বিভাজন।
-- সেক্ষেত্রে আপনার মক্কেলকে তো খালি হাতে ফিরে যেতে হবে মিস্টার বাসু। আপনি তো ভালভাবেই জানেন যে, আপনার মকেলের স্বামী কপর্দকশুণ্য। আপনার ভাষায়: ওয়াইফকে খাওয়া-পরার যোগান দিতে আপনার মকেলের হাজবেন্ড তার বাপের কাছে হাত পাতে। আর আমি লোকটা তো থার্ড পার্টি! কী বলেন?
-- কারেক্ট! ভেরি কারেক্ট ! ওর স্বামীর যদি নিজস্ব বলতে কিছু না থাকে তাহলে অ্যালিমনির প্রশ্নই ওঠে না। বাই দ্য ওয়ে, নটরাজন কি আপনাকে জানিয়ে গেছে, আজ দুপুরে তার মক্কেল – আই মীন, আমার মক্কেলের স্বামী -- কী জাতের ডিপজিশন দিয়েছে?
-- না। নটরাজন বললেন, প্রথমত আমি তার মক্কেল নই, থার্ড পার্টি। দ্বিতীয়ত, আমার পুত্র ও পুত্রবধূর মলোমালিন্যের হেতু নির্ধারণে আপনারা দুই ব্যারিস্টার মিলে ত্রিদিবের যে জবানবন্দি নিয়েছেন তার ‘ডিটেইলস্’ জানা আমার পক্ষে অশোভন, এটিকেটে বারণ।
-- নটরাজন ঠিক কথাই বলেছে। তার মক্কেলের গোপন কথা সে কাউকে জানাতে পারে না, এমনকি মক্কেলের বাবাকেও নয়। কিন্তু আমি পারি। কারণ ত্রিদিব আমার মক্কেল নয়। ইন ফ্যাক্ট, আমি আপনাকে তা জানাব বলেই এই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছি।
ত্রিবিক্রম সহাস্যে বলেন, সরি স্যার! আপনি জানাতে রাজি হলেই তো চলবে না। আমি জানতে রাজি কিনা সেটাও বিচার্য! ইন ফ্যাক্ট আয়াম নট ইন্টারেস্টেড।
বাসু শ্রাগ করলেন: ইটস্ য়োর প্রিভিলেজ! না শুনতে চাইলে আমিই বা কেন জোর করে তা শোনাব? তবে আমার অবস্থাটা হয়েছে সেই ‘প্রভার্বিয়াল ভবম-হাজাম’-এর মতো! একজনকে না শোনানো পর্যন্ত আমার ফাঁপা-পেট স্বাভাবিক হবে না। আপনি শুনতে না চাইলে আমাকে কাল একটি প্রেস-কনফারেন্স ডেকে সব খবরের কাগজকে এই মুখরোচক কিসসাটি শোনাতে হবে!
ত্রিবিক্রমের ভ্রূকুঞ্চন হল।
-- ‘মুখরোচক কিসসা’ মানে?
-- বলতেই তো চাই, কিন্ত আপনি যে আবার নন-ইন্টারেস্টেড!
ত্রিবিক্রম পাঁচ-সেকেন্ড কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, লেটসবি সিরিয়াস, ব্যারিস্টার-সাহেব। আপনি কী কারণে আমাকে জোর করে ওদের দাম্পত্যজীবনের কথা শোনাতে চাইছেন?
বাসু গম্ভীর হয়ে বললেন, প্রথম কথা: আপনার পুত্র ও পুত্রবধূর যৌন-জীবনের কথা এর মধ্যে আদৌ নেই। দ্বিতীয় কথা, ওদের দাম্পত্য জীবনের জটিলতার যে আলোচনা হয়েছে তা শ্বশুর হিসাবে আপনার শোনার মধ্যে কোনও অশোভনতা নেই। তৃতীয় কথা, এই ‘ডিপজিশন-’এর কথাটা জানাতে না পারলে, আমি আমার মক্কেলের তরফে টাকাটা আদায় করতে পারব না।
--- টাকা! কোন টাকা? কিসের টাকা?
-- ‘ঘুষ’ নয়, ন্যায্য পাওনা -- তাকে ড্যামেজ, অ্যালিমনি, মানি-সেটলমেন্ট আপনি যে নামে ইচ্ছা অভিহিত করুন।
-- আপনি এখনো আশা করেন, আমি আপনাকে অথবা আপনার মক্কেলকে একটা নয়া পয়সাও দেব?
-- ইয়েস্ স্যার! আমি তো ইতিপূর্বেই আপনাকে বলেছিলাম, এ কেস হারলে সান্ত্বনা থাকবে যে, বিনা পারিশ্রমিকে এক নিষ্ঠুর ধনকুবেরের বিরুদ্ধে তার অসহায়া পুত্রবধূর পক্ষ নিয়ে লড়েছি ; আর এ কেস জিতলে আপনি এ চেয়ারে বসে আমার দাবীমতো টাকাটা মিটিয়ে দেবেন! আমার ফী, আর আমার মক্কেলের খেশারত!
ত্রিবিক্রম হাসলেন। বললেন, তর্কের খাতিরে ধরা যাক, আমি আপনার মক্কেলকে ‘হাফ-আ-মিলিয়ান’ দিলাম -- কিন্তু সেটা নিয়ে সে কী করবে? ফাঁসি না হলেও ওর দীর্ঘমেয়াদী কারাদণ্ড হবেই।
-- আপনি তাই আশা করেন?
-- করি। কারণ আপনার এবং মিস্টার মাইতির ধারণাটা ভুল। ত্রিদিব এবং আপনার মক্কেলের বিবাহ ‘নাল্-অ্যান্ড-ভয়েড’ না হওয়া সত্ত্বে আদালতে উঠে সাক্ষী দিতে পারবে!
-- এভিডেন্স অ্যাক্ট-এর সেকশান 122-তে যে প্রভিশন্স আছে তৎসত্ত্বেও?
-- ইয়েস স্যার! তা সত্ত্বেও। আইন বলছে, স্বামী বা স্ত্রী তার ‘স্পাউস’-এর বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে পারবে “regarding any act made by one party or the other during their valid married life.”
বাসু-সাহেব স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলেন তার প্রতিপক্ষের দিকে। তারপর জানতে চাইলেন, এ-কথা কে বলেছে আপনাকে? নটরাজন?
-- ইয়েস্ স্যার!
হাসলেন বাসু। বলেন, নটরাজন ইজ এ জুয়েল অব এ সলিসিটার। রেফারেলটা আপনাকে দিয়ে যায়নি? ‘রাম ভরোসে ভার্সেস স্টেট’?
ভ্রূকুঞ্চন হল ত্রিবিক্রমের। বললেন, সেটা কী?
-- ডায়েরি লিখে নিন বরং ‘রামভরোসে ভার্সেস স্টেট – A.I.R 1954. S.C. 704’। সুপ্রীম কোর্ট-এর ডিভিশন বেঞ্চ বলেছেন ‘The protection under Sec 122 applies only to communications between the partners and not to the facts’ তার মানে: ত্রিদিব আদালতে বলতে পারবে না এমন কোন গোপন কথা, যা বিশ্বাস করে ছন্দা তার স্বামীকে বলেছিল, যদি আদৌ কিছু বলে থাকে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তো৷ সব কিছুই ‘facts’ -- ত্রিদিবের হট-চকলেটে স্লিপিং ট্যাবলেট মেশানো, রাত্রে ‘গৃহত্যাগ’ করা, ইত্যাদি, প্রভৃতি সব কিছুই প্রত্যক্ষ জ্ঞানে। শোনা কথা নয়। তাই নয়?
ত্রিবিক্রম কী বলবেন ভেবে পেলেন না।
বাসুই পুনরায় বলেন, শে পর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত হল রাও-সাহেব? আপনার পুত্রের ‘ডিপজিশনটা’ আপনাকে শোনাব, না প্রেস-কনফারেন্স ডেকে?
‘ত্রিবিক্রম মনস্থির করলেন, অল রাইট। আমাকেই শোনান।
ইন্টারকমের মাউথপীসটা তূলে নিয়ে বাসু বললেন, রানু, তুমি ঐ ডিপজিশনের টাইপ করা কাগজগুলো নিয়ে কাইন্ডলি এ-ঘরে আসবে?
একটু পরেই ইনভ্যালিড-চেয়ারে পাক মেরে রানু এঘরে এলেন। বাসু তাকে বললেন, আজ আফটারনুনে মিস্টার ত্রিদিবনারায়ণ রাও যে ডিপজিশন দিয়েছেন তা ওঁকে পড়ে শোনাও। প্রশ্ন এবং উত্তর।
রানু চশমাজোড়া নাকে চড়ালেন। টাইপ করা কাগজগুলো তুলে নিয়ে ধীরে ধীরে পড়তে শুরু করেন --
প্রশ্ন: আপনার নাম শ্রীত্রিদিবনারায়ণ রাও?
উত্তর: ইয়েস, স্যার।
প্রশ্ন: আপনার স্ত্রীর নাম শ্রীমতী ছন্দা রাও?
উত্তর: ইয়েস!
প্রশ্ন: আপনি কি জানেন যে, আপনার স্ত্রী আপনার বিরুদ্ধে বিবাহ-বিচ্ছেদের আবেদন করেছেন, যার শুনানী হবে আগামী সোমবার?
উত্তর: হ্যাঁ, শুনেছি সে-কথা।
প্র্রশ্ন: এবং জানেন যে, আপনার স্ত্রীর অভিযোগের মূল বক্তব্য হচ্ছে স্বামী হিসাবে আপনার নিষ্ঠুরতা?
উত্তর: ‘নিষ্ঠুরতা!’ কই সে-কথা তো কেউ বলেনি?
প্রশ্ন: ‘বলার’ কী আছে? ‘ডিভোর্স পিটিশনটা’ তো আপনিই সই করে নিয়েছিলেন। পড়ে দেখেননি?
উত্তর: না, ড্যাডি বললেন, ও তোমাকে দেখতে হবে না। বলে, তিনি কাগজখানা কেড়ে নিলেন। নিষ্ঠুরতা? ছন্দা বলেছে: আমি নিষ্ঠুর?
রানু দেবী টাইপ করা পাতা -ওল্টাবার অবকাশে তাকিয়ে দেখলেন বাণিজ্য-চুম্বকটির দিকে। তিনি প্রস্তরমূর্তির মতো নির্বাক-নিস্পন্দ বসে আছেন ডিভান-এ। যেন একটা ঐতিহাসিক নাটকের ডায়ালগ শুনছেন। রানু আবার শুরু করেন --
প্রশ্ন: হ্যাঁ, আপনার বিরুদ্ধে আপনার স্ত্রীর অভিযোগ: নিষ্ঠুরতার। আপনি পড়ে দেখেননি, তাই জানেন না -- আপনার নিষ্ঠুরতার অনেকগুলি উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। যেমন ধরুন, ‘কমলেশ হত্যা’-কেস-এ আপনি পুলিসের কাছে গিয়ে মিথ্যা অভিযোগ দিয়েছেন...
উত্তর: কিন্তু মিথ্যা অভিযোগ তো আমি করিনি। সত্যি কথাই বলেছি।
প্রশ্ন: এ কথা জেনেও যে, সেজন্য আপনার স্ত্রীর ফাঁসি হয়ে যেতে পারে?
উত্তর: তার আমরা কী করতে পারি? সে তার কৃতকর্মের ফলভোগ করবে। কোন শক্তাবৎ রাজপুত স্ত্রীকে বাঁচাতে মিথ্যার আশ্রয় নিতে পারে না। আমাদের হাজার বছরের ইতিহাস তাই বলে।
প্রশ্ন: তার মানে, আপনি এখনো এ মত পোষণ করেন? এ হত্যা মামলার আসামী ছন্দা রাও দোষী?
উত্তর: নিশ্চয় করি।
প্রশ্ন: কোন্ যুক্তিতে? কেন আপনার মতে ছন্দা রাও হত্যাকারী?
উত্তর: অসংখ্য যুক্তিতে। ও আমাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে ফেলতে চেয়েছিল। আমি ঘুমিয়ে পড়েছি ভেবে সে মধ্যরাত্রে তার প্রথম স্বামীর কাছে যায়। তাকে হত্যা করে! না-হলে সে আমার স্ত্রী থাকতে পারে না। আমার ড্যাডির কোটি-কোটি টাকার সম্পত্তির ওয়ারিশ হতে পারে না। তাই সে কমলেশকে খুন করে নিঃশব্দে পালিয়ে আসে। জামা-কাপড় পাল্টে গুটিগুটি আমার পাশে খাটে উঠে শুয়ে পড়ে। এসব মিথ্যা কথা?
প্রশ্ন: মিস্টার রাও, আমি প্রশ্ন করব। আপনি শুধু জবাব দেবেন। ‘ডিপজিশন’-এ সেটাই কানুন।
উত্তর: আর কী জানতে চান?
প্রশ্ন: আপনি পরদিন সকালে যখন আমার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ করতে আসেন তখন আমি জানতে চেয়েছিলাম, ‘তুমি কি আমার বাড়ি চিনতে?’ জবাবে আপনি বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, চিনতাম’। তখন আমি জানতে চেয়েছিলাম, ‘কী ভাবে?’ তার জবাবে আপনি কী বলেছিলেন তা আপনার মনে আছে?
উত্তর: না নেই। কী বলেছিলাম? তাছাড়া আপনি এখন আমাকে ‘আপনি’ বলে কথা বলছেন কেন? আগে তো ‘তুমি’ই বলতেন?
প্রশ্ন: বেশ, আবার না হয় ‘তুমি’ই বলছি। আমার ও প্রশ্নের জবাবে তুমি বলেছিলে ‘সরি, স্যার! ঠিক বলতে পারব না। স্বীকারই করি -- আমি ডক্টর ব্যানার্জির নার্সিং-হোমে ভর্তি হয়েছিলাম মানসিক রোগী হিসাবে। সব সময় সব কথা আমি মনে করতে পারি না।’
উত্তর: হ্যাঁ, মনে পড়েছে বটে। আজ্ঞে হ্যাঁ, এ কথাই আমি বলেছিলাম বটে।
প্রশ্ন: এখন কি মনে পড়েছে? কীভাবে ঘটনার পরদিন সাত সকালে ঠিকানা জানা না-থাকা সত্ত্বেও তুমি আমার বাড়িতে গাড়ি ড্রাইভ করে চলে আসতে পেরেছিলে?
উত্তর: না, মনে পড়ছে না।
প্রশ্ন: আমি তোমাকে একটু সাহায্য করি, কেমন? দেখ, মনে পড়ে কিনা। তার আগে দু-একটা কথা বলি। প্রথম কথা: তোমার ড্যাডি চাইছেন যে, এই বিবাহবিচ্ছেদটা যত শীঘ্র সম্ভব অনুমোদিত হয়ে যাক। তুমিও তাই চাইছ, শুনেছি। কিন্ত তোমার স্বনামধন্য পিতৃদেব ইচ্ছাপ্রকাশ করেছেন যে, বিবাহবিচ্ছেদের হেতুটা যেন ‘নিষ্ঠুরতা’ না হয়। হেতুটা যেন ‘সমঝোতার অভাব’ বলে খাতাপত্রে লেখা থাকে। তাহলে তোমাদের শক্তাবৎ খানদান অক্ষত থাকবে। সেজন্যই এই ‘ডিপজিশন’ নেওয়া হচ্ছে। তোমার স্বার্থ দেখবার জন্য তোমার ড্যাডি এই ব্যারিস্টার নটরাজনকে নিয়োগ করছেন। তুমি যদি এখন আমার কাছে সব সত্যি কথা স্বীকার কর -- তোমার নিজের ক্ষতি না করে -- তাহলে আমি চেষ্টা করব যাতে হেতুটা ‘নিষ্ঠুরতা’-র পরিবর্তে ‘দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য’ হিসাবে লিপিবদ্ধ করা হয়। আমি কী বলছি তুমি বুঝতে পারছ?
উত্তর: না-বোঝার কী আছে? বুঝছি।
প্রশ্ন: এবার বলি: তুমি সেই সাত-সকালে আমার বাড়ি চিনে আসতে পেরেছিলে এই কারণে যে, তার পূর্বদিন শুক্রবার তোমার স্ত্রী যখন আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে তখন তুমি তাকে অনুসরণ করে এসেছিলে। তুমি নিজের গাড়িতে আসনি -- যাতে ছন্দা গাড়ির নম্বর দেখে চিনতে না পারে, বুঝে ফেলতে পারে। তাই এসেছিলে একটা ভাড়া করা জীপ চেপে। তোমার চোখে ছিল সানগ্লাস, মুখে ফলস্ দাড়ি, ঝোলায় একটা বাইনোকুলার...তাই নয়?
উত্তর: আপনি কেমন করে জানলেন?
প্রশ্ন: আমি জানি। জানি যে, তোমার মূল উদ্দেশ্য ছিল তদন্ত করে দেখা: তোমার স্ত্রী দ্বিচারিণী কিনা। কারণ হাজার-বছর ধরে কোনও শক্তাবৎ রাঠোর রাজপুত্র কখনো কোনও দ্বিচারিণীকে সহ্য করেনি। স্বহস্তে সেই অসতীর শিরশ্ছেদ করেছে। তাই নয়?
উত্তর: হ্যাঁ, তাই। আপনি ঠিকই বলছেন!
বাসু: এবং ঐ একই উদ্দেশ্যে তুমি তোমার সদ্য-পরিণীতা ধর্মপত্নীর হাত-বটুয়া হাৎড়ে…..
ত্রিদিব: কোন্ উদ্দেশ্যের কথা বলছেন, স্যার?
বাসু: তোমার তো একটাই উদ্দেশ্য ছিল, ত্রিদিব। সাচ্চা রাঠোর রাজপুতের যা লক্ষ্য: স্ত্রী দ্বিচারিণী কি না সমঝে নেওয়া… সেই উদ্দেশ্যেই তুমি তোমার সহধর্মিনী হাতব্যাগ হাতড়ে কমলেশ বিশ্বাসের টেলিগ্রামখানা দেখতে পেয়েছিলে। আন্দাজ করেছিলে: সে হচ্ছে ছন্দার প্রথমপক্ষের স্বামী।
ত্রিদিব: কিন্তু আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি যে, ওদের ডিভোর্স হয়ে যায়নি। ওরা এখনো স্বামী- স্ত্রী। বিশ্বাস করুন, স্যার!
বাসু: তা তুমি কেমন করে আন্দাজ করবে, ব্রিদিব? এক স্বামী জীবিত থাকতে কেউ দ্বিতীয়বার বিবাহ করে?
ত্রিদিব: আপনিই বলুন, স্যার!
বাসু: আর সেই জন্যেই যখন সেই শনিবার রাত বারোটা পঁয়ত্রিশে ছন্দা তার মারুতি-সুজুকি গাড়িটা নিয়ে রওনা হয়, তখন তুমি তাকে অনুসরণ করেছিলে। তোমার অ্যাম্বাসাডারে...তাই নয়?
ত্রিদিব: আজ্ঞে না, আমি তো৷ তখন ডক্টর ব্যানার্জির বাড়িতে ফোন করেছিলাম।
বাসু: আমার মনে আছে। গদাধর টেলিফোনে জানালো যে, ডাক্তারবাবুও গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছেন। তাতেই তো তোমার সন্দেহ হল যে, ওরা দুজনে যুক্তি করে কমলেশকে হত্যা করতে গেছে।
ত্রিদিব: না হলে ছন্দার ব্যাগে রিভলভার আসবে কোথেকে? আপনিই বলুন।
বাসু: কারেক্ট। তুমি অবশ্য জানতে না যে, রিভলভারটা ডক্টর ব্যানার্জির!
ত্রিদিব: না স্যার, জানতাম। আগের দিনই টেলিফোনে ওদের কথাবার্তা আমি আড়ি পেতে শুনেছিলাম। তাতেই তো আমি জানতাম: খুনটা ডক্টর ব্যানার্জিই করেছে -- সেই হচ্ছে ছন্দার আসল লাভার -- কমলেশ বিশ্বাস নয়! আমি সেদিনই আপনাকে বলিনি যে, খুনটা করেছে ঐ ব্যানার্জিই -- আর সে পরস্ত্রীর পেটিকোটের আড়ালে মুখ লুকাতে চাইছে? আমি জানতাম, ছন্দা খুনটা করেনি, করতে পারে না -- চাবিটা ঐ ঘরের মেজেতে ফেলে এসে সে মিথ্যা খুনের দায়ে জড়িয়ে পড়েছে...
বাসু: আই রিমেম্বার! এ-কথা তুমি সে-দিনই বলেছিলে! আর সে জন্যই গদাধর যখন বলল যে,
ডক্টর ব্যানার্জি বাড়িতে নেই ঠিক তখনই তুমি স্থির করলে: স্ত্রীকে ফলো করা দরকার!
ত্রিদিব: না স্যার, ঠিক তখনই নয়। তার অনেক আগেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, ছন্দা যদি আমাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে রাত্রে কোথাও অভিসারে যেতে চায়, তাহলে তাকে ফলো করব।
বাসু: আমি তো তা জানিই।
ত্রিদিব: আপনিও তাই আন্দাজ করেছিলেন? কেমন করে?
বাসু: না হলে ছন্দার মারুতি-সুজুকি গাড়ির পিছন দিকের ডান চাকায় অমন চোরা-লীক হবে কেমন করে? আমি জানতাম -- ওটা তুমিই করেছিলে। যাতে ছন্দা তড়িঘড়ি রওনা হলেও তোমার ফলো করতে অসুবিধা না হয়।
ত্রিদিব: এটা কী করে বলছেন, স্যার? টায়ার-পাঞ্চার তো অ্যাক্সিডেন্টালিও হতে পারে?
বাসু: পারে। যে-চাকা পথের ঘর্ষণে নিত্য ক্ষয়িত হচ্ছে তা পাঞ্চার হতেই পারে। কিন্তু যে-চাকা জমি থেকে দুই-ফুট উঁচুতে ডিকি-এর বর্মে নিরাপদে সুরক্ষিত, তাতে অ্যাক্সিডেন্টালি একটা পেরেক ফুটতে পারে না! পারে?
ত্রিদিব: মানে?
বাসু: আরে বাপু, ‘মানে’টা তুমিও জানো, আমিও জানি। ঐ স্পেয়ার টায়ারে একটা পেরেক ঢুকিয়ে চোরা ‘লীক’ তৈরী করতে পার একমাত্র তুমিই। কারণ ছন্দা ছাড়া ঐ গাড়ির চাবি শুধুমাত্র তোমার কাছেই ছিল। ছন্দা তো আর নিজের গাড়ির স্পেয়ার-টায়ারে পেরেক পুঁতে রাখবে না! ফলে ওটা তোমার কীর্তি! তুমি এমন ব্যবস্থা করেছিলে যে, ছন্দা মাঝরাতে হঠাৎ কোথাও অভিসারে গেলে অন্ততপক্ষে দশ-পনের মিনিট সময় তোমাকে দিতে বাধ্য হবে। দু-দুবার ‘লীক’ সারাতে। তবে হ্যাঁ, এর মধ্যে দোষের কিছু নেই। তোমার মূল উদ্দেশ্য ছিল মহৎ। সাচ্চা রাঠোর শক্তাবৎ রাজপুতের মতো। শুধু সমঝে নেওয়া: স্ত্রী দ্বিচারিণী কিনা!
ত্রিদিব: আপনিই বলুন, স্যার। আর কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে আমার?
বাসু: কারেক্ট! শ্রেফ রাজপুত শ্যিভালরি!...তুমি যে টেলিফোন করার পর নিজের অ্যাম্বাসাডার বার করে ওকে ‘ফলো’ করেছিলে এটা বুঝতে আমার কোন অসুবিধা হয়নি।
ত্রিদিব: কী করে বুঝলেন?
বাসু: যুক্তিনির্ভর সিদ্ধান্ত: দেখ! ছন্দা বলেছে -- গাড়িটা বার করে তারাতলামুখো যাবার আগে সে গ্যারেজের স্লাইডিং ডোরটা টেনে তালাবন্ধ করে দিয়ে গেছিল। তুমিও বলেছিলে জানলা দিয়ে দেখতে পাও ডবল্-পাল্লা স্লাইডিং ডোরটা সে টেনে বন্ধ করে। নবতাল তালা লাগায়। তুমি বলেছিলে, ফিরে এসে ছন্দা তোমাদের ট্রিপলিকেট চাবি দিয়ে নবতাল-তালাটা খোলে, স্লাইডিং-ডোরটা সরায়। তাই নয়?
ত্রিদিব: হ্যাঁ, তাই। কারণ, ওর নিজের চাবির সেট তো তখন তারাতলায় পড়ে আছে।
বাসু: তাই যদি হয়, তাহলে শুতে যাবার আগে, গ্যারেজের পাল্লা সে টেনে বন্ধ করেনি কেন?
ত্রিদিব: আপনিই বলুন?
বাসু: একমাত্র যুক্তি: ইতিমধ্যে অ্যাম্বাসাডার গাড়িটা কেউ বার করেছিল এবং ছন্দা ফিরে আসার আগে দ্বিতীয়বার ঢুকিয়েছিল। তবে তাড়াহুড়ায় অ্যাম্বাসাডার-গাড়িটা যথেষ্ট ভিতরে ঢুকিয়ে ‘পার্ক’ করেনি। সে জন্যই এ গাড়ির বাম্পারে স্লাইডিং-ডোরটা আটকে যাচ্ছিল। ছন্দা তাই স্লাইডিং ডোরটা বন্ধ করতে পারেনি। নবতাল-তালা লাগানোর প্রশ্নই ওঠেনি।
ত্রিদিব: কে?...কে? অ্যাম্বাসাডার গাড়িটা বার করবে? ঢোকাবে?
বাসু: একমাত্র তুমিই তা পারতে। তুমিই তা করেছিলে। যেহেতু সাচ্চা শক্তাবতের মতো তুমি জানতে চেয়েছিলে তোমার স্ত্রী দ্বিচারিণী কিনা। কী? ঠিক বলছি তো?
ত্রিদিব: হ্যাঁ, ঠিকই বলছেন! আমি স্বচক্ষে দেখেছি, ছন্দা ঐ গ্যলভানাইজড পাইপটা ঘুরিয়ে কমলেশের মাথায় মারল। বিশ্বাস করতে পারেন? আমি সে-কথা পুলিশকে বলিনি। কাউকে বলিনি। কিন্তু নিজের চোখে আমি তা দেখেছি।
বাসু: আমি তো তা জানিই!
ত্রিদিব: তাও জানেন আপনি! অসম্ভব! কী জানেন?
বাসু: বলছি। শোন! মিলিয়ে নাও! ছন্দা রওনা হবার পর তুমি ডাক্তার ব্যানার্জিকে একটা ফোন কর। কারণ তুমি জানতে তোমার হাতে যথেষ্ট সময় আছে। ছন্দাকে দু-দুবার চাকা বদলাতে হবে। দু-দুবার টিউবে হাওয়া ভরাতে হবে। ডাক্তার ব্যানার্জিও তার বাড়িতে নেই শুনে তুমি ধরে নিয়েছিলে ওরা দুজনে মিলে তারাতলায় গেছে। তাই তুমি সোজা তারাতলার মা-সন্তোষী অ্যাপার্টমেন্টে চলে যাও। ছন্দা চাকায় হাওয়া ভরে সেখানে পৌঁছানোর অনেক আগেই তুমি পৌঁছাও। পুলিসটা পরে যে-ভাবে ঢুকেছিল সেইভাবে মেজানাইন –উচ্চতায় উঠে জানলার ফোকর বেবে ভিতরে ঢুকে লুকিয়ে বসে থাক। একটু পরে কমলেশের টেলিফোনটা বাজে । কমলেশ জেগেই ছিল। টেলিফোনে কথা বলে...
ত্রিদিব: কী-কথা বলুন তো?
বাসু: ফোন করেছিল ওর এক পাওনাদার। ও তাকে জানায় ছন্দা রাও ওকে পরদিনই দু-হাজার টাকা দেবে। তা থেকে কমলেশ তার ধার কিছুটা শোধ করবে।
ত্রিদিব: আজ্ঞে না! ভুল হল আপনার: ধার নয়। ওর আর এক প্রাক্তন শ্যালক ফোন করেছিল। কমলেশ যে-টাকা চুরি করেছে তাই উশুল করতে চাইছিল।
বাসু: তাহলে তাই হবে। মোটকথা একটু পরে ছন্দা এসে কলবেল বাজায়। কমলেশ নিচে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। ওরা দুজনে উপরে উঠে আসে। দু’জনে কথা কাটাকাটি থেকে ঝগড়া করছিল। তুমি আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনছিলে। কমলেশ বিশ্বাস ‘দু-হাজার টাকা’ চাইছিল, আর ছন্দা বলছিল অত টাকা ওর কাছে নেই! কমলেশ তা বিশ্বাস করে না, সে-একটা অশ্লীল গালাগাল দিয়ে ওর হাত চেপে ধরে।
ত্রিদিব: কারেক্ট! তখন আমার মাথায় রক্ত চড়ে যায়। আপনি তো জানেনই, আমার ধমনীতে শক্তাবৎ রাঠোর রাজপুতের রক্ত।
বাসু: তাহলে তুমি ঝাঁপিয়ে পড়ে কমলেশের চোয়ালে একটা ঘুসি মারলে না কেন? ‘টিসম্’ করে! অমিতাভ বচ্চনের মতো?
ত্রিদিব: মারতামই তো! কিন্তু ওদের দু-জনের হেপাজতেই আছে রিভলভার -- আমি নিরস্ত্র! আমি দেখলাম, ওরা দুজনে মারামারি করছে! ছন্দা এক ধাক্কা মেরে তার হাতটা ছাড়িয়ে নিল। সেই ধাক্কাতে একটা কাঁচের গ্লাস ঝনঝনিয়ে ভেঙে পড়ল। এই সময় কমলেশ কী করল জানেন?
বাসু: জানি। দু-হাত বাড়িয়ে ছন্দার গলা টিপে ধরতে গেল!
ত্রিদিব: কারেক্ট! তখনই ছন্দা একটা জলের পাইপ তুলে নিয়ে এলোপাথাড়ি ঘোরাতে থাকে। পাইপটা দ্রাম করে গিয়ে লাগে কমলেশের মাথায়। ও পড়ে যায়। ঠিক তখনি আমি হাত বাড়িয়ে সুইচটা অফ্ করে দিই।
বাসু: আই নো! কিন্তু কমলেশের আঘাতটা মারাত্মক ছিল না। পাঁচ সেকেন্ড বাদেই সে উঠে বসতে চাইল!
ত্রিদিব: একজ্যাক্টলি! রাস্তার আলো পড়েছিল এখানে। আমি স্পষ্ট দেখলাম -- ও হিপ-পকেটে হাত চালিয়ে দিয়েছে। তার মানেটা বুঝেছেন, স্যার?
বাসু: জলের মতো পরিষ্কার! ওর হিপ্-পকেটে ছিল রিভলভারটা! তাই তো? তাহলে তুমি যা করেছিলে তা সমর্থনযোগ্য। ওটা তো আত্মরক্ষার্থে! না হলে কমলেশই গুলি করে মারত। তাই না?
ত্রিদিব: বলুন স্যার! আমার অন্যায়! কী হল? আমি ছন্দার ফেলে যাওয়া জলের পাইপটা নিয়ে ঐ শয়তানটার মাথার পিছন দিকে অ্যাইসা এক বাড়ি ঝাড়লাম যে, ওর ভবলীলা খতম!
বাসু: বুঝলাম। তারপর তুমি ছন্দাকে নাম ধরে ডাকলে না কেন?
ত্রিদিব: আমার ধারণা ছিল ছন্দার জন্য ডক্টর ব্যানার্জি নিচে অপেক্ষা করছে। সেটা সত্যি কিনা তাই দেখতে চাইলাম। নিচে হঠাৎ ‘কলবেল’ বেজে ওঠায় আমার সন্দেহ বেড়ে যায়। তারপর আমার হঠাৎ আতঙ্ক হয় -- যে লোকটা ‘কলবেল’ বাজাচ্ছে সে যদি পুলিশ হয়! তাই আমি তৎক্ষণাৎ ভারা বেয়ে নিচে এলাম। দেখলাম, একটা লোক আমার আগে আগে ভারা বেয়ে নিচে নামছে। সে দৌড়ে গিয়ে একটা মটোর-সাইকেলে উঠে পালিয়ে যায়।
বাসু: তুমিও গাড়িতে উঠে বাড়ি ফিরে এসেছিলে, কেমন? কিন্তু তোমার হাতে সময় ছিল কম। তাই তাড়াহুড়া করে গাড়িটা পার্ক করে স্লাইডিং ডোর টেনে দেবার সময় পাওনি। তালা লাগাবার প্রশ্নই ওঠে না।
ত্রিদিব: কারণ আমি জানতাম দু-তিন মিনিটের মধ্যেই ছন্দা এসে পৌঁছাবে। তাড়াহুড়ায় অ্যামসাডার গাড়িটা আমি ঠিক মতো পার্ক করতে পারিনি। তাই ছন্দা স্লাইডিং-ডোরটা বন্ধ করতে বন্ধ করতে পারেনি।
বাসু: তুমি সব কথাই বলেছ ত্রিদিব, কিন্তু একটা কথা এখনো বলনি!
ত্রিদিব: কী কথা?
বাস: পরদিন সকালে, যখন ছন্দা অঘোরে ঘুমোচ্ছে, আর তুমি আমার কাছে আসবে বলে মনস্থির করলে তখন তুমি পকেট হাৎড়ে দেখতে পেলে -- তোমার চাবির থোকাটা নেই! আগের দিন রাত্রে কমলেশের ফ্ল্যাটে যখন পকেট থেকে দেশলাই বার করছিলে তখন অসাবধানে তোমার চাবির থোকাটা পড়ে গেছে! যেহেতু তারাতলায় পৌঁছে কমলেশের ফ্ল্যাটে যাওয়ার আগে তুমি গাড়ি ‘লক’ করে যাওনি আর ইগ্নিশন-কী ড্যাশ বোর্ডে লাগানো ছিল, যেহেতু ছন্দাকে অনুসরণ করার সময় তুমি নবতাল-তালাটা লাগিয়ে যাওনি তাই বাড়ি ফিরে তোমার কোনও অসুবিধা হয়নি। তাই না? তার মানে তুমিই ড্রয়ার থেকে ট্রিপ্লিকেট চাবিটা সংগ্রহ করেছিলে পরদিন সকালে। আর ছন্দার ব্যাগ খুলে তার চাবিটাও নিজের পকেটে ভরে নাও। অর্থাৎ খবরের কাগজে যে ফটো বার হয়েছে তা তোমার চাবির সেট -- ছন্দার নয়। কী? ঠিক বলছি?
ত্রিদিব: আশ্চর্য্য! আপনি কেমন করে টের পেলেন?
বাসু-সাহেব হাতটা তুলে রানুকে থামতে বললেন, দ্যাটস্ অল! আর পড়ার দরকার নেই। তুমি বিশ্রাম নাও গে যাও।
রানু কাগজগুলো নিয়ে তাঁর ইনভ্যালিড-চেয়ারের চাকায় পাক মেরে গৃহাভ্যন্তরে চলে গেলেন। তবে নিতান্ত মেয়েলী কৌতূহলে রাঠোর রাজপুতটির দিকে একবার চকিত দৃষ্টিপাত করতে ভুল হল না।
ফোলানো বেলুনটিতে কে যেন নির্মমভাবে সূঁচ ফুটিয়েছে! উনি শ্রেফ চুপসে গেছেন!
রানু চলে যাবার পর স্বয়ংক্রিয়-পাল্লাটা বন্ধ হতেই ত্রিবিক্রমনারায়ণ ঝুঁকে পড়ে বললেন, আপনি কি এই ডিপজিশনের কপি পুলিশকে দেবেন?
জবাবে বাসু বললেন, ফর য়োর ইনরমেশন মিস্টার রাও, আপনার পুত্রবধূর জামিনের অর্ডার বেরিয়ে গেছে। প্রসিকিউশনের নিজেদের সাক্ষীরাই তাকে ‘অ্যালেবাই’ দিয়েছে। সম্ভবত পুলিস এ-কেস চালাবে না। হত্যামুহূর্তে আসামী অকুস্থলে ছিল না, এটা প্রমাণিত হয়েছে!
ত্রিবিক্রম পুনরায় বলেন, তা নয়, আমি জিজ্ঞেস করছি, এই ‘ডিপজিশনে’র কপি কি আপনি পুলিশ-কমিশনারকে পাঠিয়ে দিচ্ছেন?
বাসু বলেন, আপনার পুত্র পুত্রবধূ দু-জনেই ‘মিউচুয়াল এগ্রি’ করেছে। বিবাহবিচ্ছেদটা হয়ে যাবে। অবশ্য অ্যালিমনির খেশারতটা আপনি দিতে রাজি হলে।
ত্রিবিক্রম স্পষ্টতই বিরক্ত হলেন: দ্যাটস্ নট দ্য পয়েন্ট, কাউন্সেলার! আমি জানতে চাইছি, এই ডিপজিশনের কপি কি পুলিশে পাঠানো হবে?
-- কে পাঠাবে? আমরা ছয়জন জানি, কমলেশকে কে হত্যা করেছে। ত্রিদিব নিজে জানে, কিন্তু সে পাঠাবে না। কারণ সে হত্যাকারী। নটরাজন আর স্টেনোগ্রাফার ‘প্রফেশনাল এথিক্সে’ পুলিসে জানাতে পারে না। বাকি রইলাম আমরা তিনজন: আপনি, আমি আর আমার সেক্রেটারি! কে পাঠাবে?
ত্রিবিক্রম দাঁতে-দাঁত দিয়ে বললেন, আপনি?
-- না। আমি পাঠাব না। কেন জানেন? আমি চাই না যে, টাকার জোরে আপনি আইনকে ফাঁকি দিতে সক্ষম হন। এ জন্য শাস্তি যা দেবার তা আমি নিজেই দেব।
-- আপনি নিজেই শাস্তি দেবেন? ত্রিদিবকে?
-- নিজেই দেব। ত্রিদিবকে নয়। তার বাবাকে। প্রকৃত অপরাধীকে। কমলেশ যখন পকেট থেকে রিভলভার বার করেছে, তখন তার মাথায় বাড়ি মারাকে খুন তো বলাই চলে না। সেটা আত্মরক্ষা করা। সাচ্চা মরদ হলে সে পুলিসে গিয়ে অকপটে আদ্যন্ত সত্য কথা বলত। নিঃসন্দেহে সে নির্দোষী হিসাবে মুক্তি পেত। কিন্ত ত্রিদিব সে-পথে যায়নি। তার পরিবর্তে সে তার স্ত্রীর -- যে স্ত্রী দ্বিচারিণী নয়, যে দু হাজার টাকা ব্ল্যাকমেলারকে দিতে রাজি হল না -- তাকে ফাঁসিয়ে দিল। ফাঁসির দড়িতে ঝোলাতে চাইল! তার ভ্যানিটিব্যাগ থেকে চাবির গোছা চুরি করে পুলিসের কাছে মিথ্যা এজাহার দিয়ে এল। এই হিমালয়ান্তিক অপরাধের জন্য দায়ী কে? একমাত্র ত্রিদিবের বাবা। যে ওকে মেরুদণ্ডহীন ক্রিমিকীটের মতো না-মানুষ করে গড়ে তুলেছে। অপরাধীকে তাই কঠিন শাস্তি দেব আমি।
-- কী শাস্তি?
-- অর্থদণ্ডই! তবে আইন-সম্মতভাবে। ঘুষ নয়।
ত্রিবিক্রম পকেট থেকে চেক বই বার করে, কলমের খাপটা খুলে বলেন, বলুন?
-- দু’টো চেক লিখবেন। একটা আমাকে। অ্যাকাউন্ট-পেয়ী। আপনার পুত্রবধূর পক্ষে মামলা- লড়ার জন্য ‘ফীজ’: পঞ্চাশ হাজার, ইনক্লুডিং কস্ট। দ্বিতীয়টা আপনার বধূমাতাকে -- হোয়াইট মানি - আলিমানি-কাম-প্রপার্টি সেটলমেন্ট: সাতাত্তর লক্ষ টাকা।
ত্রিবিক্রম একটু চমকিত হয়ে বললেন, বেগ্ য়োর পার্ডন? লক্ষ? ‘হাজার’ নয়?
-- না ‘মিলিয়ান’ নয়, লক্ষই। আপনিই না সেদিন--বললেন, আপনার হাত দিয়ে দিনে লাখ-লাখ নয়, কোটি-কোটি টাকা হাত ফিরি হয়?
ত্রিবিক্রম জবাব দিলেন না। দু-খানি চেক লিখে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আগে বলিনি, তাহলে আমাকে ভুল বুঝতেন। এখন বলছি, আই প্লীড: গিল্টি! ছেলেটাকে আমি ঠিক মতো মানুষ করতে পারিনি।
বাসুও উঠে দাঁড়ালেন। করমর্দনের জন্য হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, শুভ-প্রচেষ্টা যে-কোন বয়সেই শুরু করা যেতে পারে। উইশ্ য়ু বেস্ট অব লাক্। ছেলেকে এবার মানুষ করে তুলুন!
ত্রিবিক্রম ওঁর প্রসারিত হাতটা ধরেই ছেড়ে দিলেন। বললেন, থ্যাংস্ কাউন্সেলার, ফর দিস্ কাউন্সেল!
উনিশ
পরদিন সকাল।
ওরা চারজনে ব্রেকফাস্টে বসেছেন। আজ প্রাতরাশে কিছু রকমফের হয়েছে -- কড়াইশুঁটির কচুরি। বোধকরি বাসু-সাহেবের সাফল্যের কারণে। সুজাতা কচুরিগুলো বেলে দিয়ে এসেছে। বিশু একটার পর একটা কড়াইয়ে ছাড়ছে, আর গরম-গরম পাতে নামিয়ে দিচ্ছে। রানু হিসাব রাখছেন জনান্তিকে -- ব্যারিস্টার সাহেবের পাতে ক-খানা নামল। তাঁর কোলেস্টরল বুঝি বিপদসীমা ছুঁই-ছুঁই। তাই বেশি ভাজা খাওয়া মানা, অর্থাৎ ভাজা বেশি খাওয়া মানা।
কৌশিক বলল, একটা জিনিস কিন্তু আমার কাছে পরিষ্কার হয়নি, মামু। ত্রিদিবের আগে-আগে যে ছায়ামূর্তি ভারা বেয়ে নেমে গিয়েছিল সে কে?
বাসু, পাতের স্ফীতোদর খাদ্যবস্তুটার উদরে ফর্ক সহযোগে একটা ছিদ্র করে, ফুঁ দেওয়ায় ব্যস্ত ছিলেন। বললেন, শিবানী সোমের কমিশন এজেন্ট।
-- রানু একটু বিস্মিত হয়ে পড়েন: শিবানী সোম? সে কে?
-- তোমরা এখনো চেন না। আমি চিনি।
- তাহলে আমাদের চিনিয়ে দাও।
-- দিতে পারি। যদি তুমি আর একখানা কচুরি স্যাংশন কর! বিনা কমিশনে ‘কমিশন-এজেন্টে’র তথ্য পেশ করা চলবে না।
রানু হেসে ফেলেন। বলেন, পাতে যেটা রয়েছে সেটা নিয়ে ক-খানা হল?
-- তিনখানা।
সুজাতা টপ্ করে ওঁর পাতে আর একটা কচুরি নামিয়ে দিয়ে বলে, তিন শত্তুর করতে নেই। নিন, হল তো? এবার বলুন -- শিবানী সোম কে? তার পাত্তা কোথায় পেলেন?
-- তথ্যটা সরবরাহ করেছে বটুক। সে দু নৌকোয় পা দিয়ে ডুবতে চেয়েছিল। কিন্তু দোহাত্তা লোটা তার বরাতে নেই। শিবানী সোমের এজেন্ট কেটে পড়ায় সে শুধু আমাকেই সংবাদ সরবরাহ করে পকেট ভারী করছিল। একেবারে শেষ পর্যায়ে।
কৌশিক বলে, বুঝেছি। কমলেশ খুন হওয়ার আগেই পানের দোকানে যে মোটর সাইকেলের মালিকের সঙ্গে আপনার পরিচয় হয়। যে-ছোকরা সাহস করে আপনার চেম্বারে আসতেই রাজি হয়নি।
বাসু কচুরিতে একটা কামড় দিয়ে বলেন, হ্যাঁ. সেই ছোকরাই শহরতলির মস্তান। শিবানী সোমও বিবাহ-বিশারদ কমলের এক ধর্মপত্নী। তার কিছু গহনা হাতিয়ে কমল নিরুদ্দেশ হয়েছিল। ওই কমিশন-এজেন্ট ছোকরাও ঘটনার রাত্রে সেখানে উপস্থিত ছিল। সম্ভবত সে এসেছিল ত্রিদিবেরও আগে। আমার মনে হয়, সে যখন ভারা বেয়ে উঠছে তখনই ত্রিদিব এসে তার গাড়িটা রাস্তার ধারে রাখে। তাতেই ও আত্মগোপন করে লুকিয়ে বসে থাকে। সমস্ত ঘটনার হয়তো সে নীরব দর্শক -- আড়ালে লুকিয়ে থেকে। চোখের সামনে কমলকে খুন হতে দেখে সে ভারা বেয়ে নেমে যায়। তার মোটর-সাইকেলের শব্দ অনেকেই শুনেছে।
-- তাহলে ফিঙ্গার-প্রিন্টগুলো মুছে দিয়ে গেল কে?
-- ‘নেতি-নেতি’ করতে করতে যে লোকটি অকুস্থলে সর্বশেষ উপস্থিত ছিল -- যার ধমনীতে শক্তাবৎ রাজরক্ত! আপাতদৃষ্টিতে তাকে ন্যালা-ক্যাবলা মনে হলেও শয়তানি বুদ্ধি তার কম নয়! হয়তো প্রচুর ডিটেক্টিভ গল্প ওর পড়া আছে। তাই যখন দেখল সব শুনশা -- ডোরবেল বাজানোও বন্ধ হয়ে গেছে তখন ত্রিদিবই সব কিছু মসৃণ বস্তু তার রুমাল দিয়ে মুছে দিয়ে যায়। এমনও হতে পারে যে, রুমাল বার করবার সময়েই তার গাড়ির চাবিটা পড়ে যায়।
সুজাতা জানতে চায়, কিন্তু ঐ চাবির থোকাটা -- মানে, যেটার ফটো খবরের কাগজে ছাপা হয় -- সেটা যে ছন্দার নয়, ত্রিদিবের, তা বুঝলেন কেমন করে?
বাসু বললেন, সেটাই হওয়ার সম্ভাবনা । ছন্দার মতো সুস্থ মস্তিষ্কের মেয়ে তারাতলার মতো এলাকায় রাত একটার সময় গাড়ি ‘আনলক’ করে নেমে যাবে এটা বিশ্বাস করা শক্ত। যদি যায়ই, তাহলে সে ফেরার পথে গাড়ি স্টার্ট করবে কেমন করে? কারণ আমাদের হাইপথেসিস্ -- ত্রিদিবের প্রথম দিনের বক্তব্য অনুযায়ী -- ছন্দা নিজের সেট চাবিটা খুঁজে পায়নি বলেই থার্ড চাবিটা নিয়ে গিয়েছিল! সেটা যদি কমলেশের ঘরে খোয়া গিয়ে থাকে তাহলে ছন্দা ফেরার পথে গাড়ি স্টার্ট করতে পারে না! কিন্তু ত্রিদিবের মতো মানসিক রোগগ্রস্ত রোগির পক্ষে তা সম্ভব। সে গাড়ি আনলক অবস্থায় ড্যাশ-বোর্ডে চাবি রেখে চলে যেতে পারে। অথবা তার নিজস্ব চাবির থোকাটা হয়তো তার নিজের কোটের পকেটেই ছিল, যা সে খুঁজে পায় ফেরার পথে গাড়িতে ওঠার আগে পকেট তল্লাসী করতে করতে।
হঠাৎ কলবেলটা বেজে ওঠে। বিশু গিয়ে দরজা খুলে দেখল। আগন্তুক বাধা মানল না। সরাসরি চলে এল ভিতর বাড়িতে -- ডাইনিং হলে। রানু সবার আগে দেখতে পেলেন। খুশিমনে ডেকে ওঠেন, এস, এস ছন্দা! ছাড়া পেয়ে গেছ তাহলে? বস ওই চেয়ারটায়।
ছন্দা এগিয়ে এল। নত হয়ে প্রণাম করল বাসুকে আর রানুকে। বলল, হাজত থেকে সোজা চলে এসেছি। আর যাবই বা কোথায়? আলিপুরের বাড়িতে তো প্রবেশ নিষেধ। শুভ্রাদির বাড়িতে যেতে পারতাম, কিন্তু সেখানে যেতেও কেমন যেন সঙ্কোচ হল।
বাসু বললেন, এখানে চলে এসে বুদ্ধিমতীর মতো কাজ করেছ। তবে ইচ্ছা করলে যে কোনও পাঁচতারা হোটেলে ভি. আই. পি. সুইটেও তুমি উঠতে পারতে।
ছন্দা ম্লান হাসে। বলে, ধনকুবেরের প্রাক্তন পুত্রবধূকে নিয়ে লেগ-পুলিং করছেন, স্যার?
রানু হাত বাড়িয়ে কর্তাকে বাধা দিলেন। ছন্দাকে বলেন, তুমি বাথরুমে গিয়ে মুখে-হাতে জল দিয়ে এখানে এসে বস দিকিন। সকাল থেকে এক কাপ চাও কপালে জোটেনি মনে হচ্ছে!
সুজাতা ওকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল।
একটু পরে মুখ মুছতে-মুছতে ছন্দা ফিরে এসে বসল একটা চেয়ারে।
বিশু ওর সামনে নামিয়ে রাখল গরম কচুরির প্লেট।
আহারান্তে বাসু বললেন, রানু বাধা দেওয়ায় তখন তোমার প্রশ্নটার জবাব দিতে পারিনি ছন্দা। এখন বলি: না! রসিকতা আমি করিনি। ধনকুবেরের প্রাক্তন পুত্রবধূ-হিসাবে তুমি আজ সত্তর লক্ষ টাকার মালিক! পাঁচ তারা হোটেলের বিলাসবহুল কক্ষ তোমার কাছে স্বপ্নরাজ্য নয়।
সুজাতা সংশোধন করে দেয়, সত্তর নয় মামু, সাতান্তর লক্ষ।
-- না সুজাতা। পাঁচ লাখ টাকার চেক ছন্দা দেবে কমলাক্ষ করের বিধবা অনসূয়া করকে, আর দু-লাখ কমলাপতি সোমের বিধবা শিবানী সোমকে। ওরা দু-জনেও কম ভোগেনি। ওদের কথা মনে ছিল বলেই আমি সত্তরের বদলে অঙ্কটা-সাতাত্তর লাখ করেছি।
ছন্দা বোকার মতো একবার এদিকে একবার ওদিকে তাকিয়ে দেখে। শেষ বলেই ফেলে, এ সব কী আবোল-তাবোল বকছেন আপনারা?
বাসু নিঃশব্দে উঠে গেলেন পাশের ঘরে। তখনই ফিরে এসে চেকটা বাড়িয়ে ধরলেন ছন্দার দিকে। টাকার অঙ্কটার দিকে নজর পড়ায় বজ্রাহত হয়ে গেল যেন। প্রশ্ন করবার ক্ষমতাও ছন্দার আর অবশিষ্ট ছিল না।
বাসু বললেন, ত্রিবিক্রম রাও আমার ফি মিটিয়ে দিয়েছেন। এটা তোমার ‘নেট’। তবে ওই সাত- লাখ তোমার খরচ হবে! বুঝলে না? এটা তোমার বিবাহ-বিচ্ছেদের খেশারত। তোমার প্রাক্তন স্বামী দিচ্ছে: ‘অ্যালিমনি কাম-মানি-সেটেলমেন্ট।’
ছন্দা ধীরে-ধীরে চেকটা টেবিলে নামিয়ে রাখল। মুখটা থমথমে হয়ে গেল তার। বললে, ত্রিবিক্রম রাও-এর দেওয়া ঘুষ আমি নেব, এটা আপনি ধরে নিলেন কেন?
-- ঘুষ! সার্টেনলি নট! সবটাই লিগাল-মানি। কালো টাকার নয়। ত্রিবিক্রম ঘুষ দেবে আর আমি তাই হাত পেতে নেব? কি বলছ ছন্দা? এ তার অর্থদন্ড। ঠিক আছে। চেকটা এখানেই থাক। তুমি এই কাগজগুলো নিয়ে ওঘরে যাও। পড়। তারপর ফিরে এসে তোমার সিদ্ধান্ত জানিও…
ছন্দা জানতে চায়, কীসের কাগজ এগুলো?
-- তোমাদের বিবাহ-বিচ্ছেদের মামলার ব্যাপারে ত্রিদিব কী ডিপজিশন দিয়েছে তা পড়ে দেখ। তারপর কী করতে চাও, বল।
প্রায় আধঘণ্টা পরে ছন্দা ফিরে এল। বলল, আশ্চর্য! আমি তো স্বপ্নেও এমন কথা ভাবতে পারিনি। ডাক্তার ব্যানার্জি তাহলে ঠিকই বলেছিলেন, মাতৃত্ব কামনার তির্যক পরিতৃপ্তির সন্ধানে আমি অন্ধ হয়ে গেছিলাম। ওকে শোধরানো অসম্ভব। জেনে-বুঝে সে আমাকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দিচ্ছিল! আমার চাবির গোছাটা চুরি করে...
এই সময় বেজে উঠল টেলিফোনটা। এ কাজ চিরকাল রানুর। উনি আগ বাড়িয়ে যন্ত্রটা তুলে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ, আপনি ঠিকই খবর পেয়েছেন। ছন্দা ছাড়া পেয়ে গেছে।...না, জামিন নয়, মুক্তি। পুলিশ আর মামলা চালাতেই চায় না...আপনি কোথা থেকে বলছেন ?...কী?...ক্যালাঙ্গুটে ! সেটা আবার কোথায়?...না, না, নিতান্ত ঘটনাচক্রে সে এখানেই বসে আছে!..এই তো আমার সামনে !...আচ্ছা দিচ্ছি তাকে….
টেলিফোনটা বাড়িয়ে ধরে ছন্দাকে বলেন, ডাক্তার ব্যানার্জি! গোয়া থেকে এস. টি. ডি. করছেন...নাও, কথা বল...না, বরং এক কাজ কর। আমার রিসেপশনে চলে যাও। এক্সটেনশনে জনান্তিকে কথা বলতে পারবে। যাও।
ছন্দা সলজ্জে ও-ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। চেকটা তুলে নিয়ে।
রানু সুজাতার দিকে ফিরে বলেন, বল তো সু, ‘শেষের কবিতা’র শেষ কবিতার মোদ্দা কথাটা কী? -
সুজাতা অবাক হয়ে বলে, আমি জানি না। হঠাৎ এ কথা-কেন?
বাসু বললেন, ‘পরশুরামে’র মতে : উৎকন্ঠ আমার লাগি কেহ যদি প্রতীক্ষিয়া থাকে, সেই ধন্য করিবে আমাকে!”
শেষ
No comments:
Post a Comment