প্রথমাংশ পড়তে ক্লিক করুন
লেখক: বাণী বসু
ছয়
লেখক: বাণী বসু
ছয়
জ্ঞান হতে তিস্তা অনুভব করল বেশ নরম একটা স্প্রিংয়ের খাটে ও শুয়ে রয়েছে। তবে জায়গাটা সম্পূর্ণ অন্ধকার। মাথার পেছনে একটা সাঙ্ঘাতিক দপদপানি। নির্ঘাত স্যান্ডব্যাগ৷ তবে ওরা ওকে খুব শাস্তি দেয়নি দেখা যাচ্ছে। অবাঞ্ছিত কৌতুহল প্রকাশের জন্য এর চেয়ে বেশি শাস্তি ওর পাওনা ছিল। বেশ নরম-গরম খাটে শুইয়ে রেখেছে। কিন্তু বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে ওর ভুল ভাঙল। খাটটার সঙ্গে ও আগাগোড়া পিছমোড়া করে বাঁধা। খুব সম্ভব শক্ত নাইলনের দড়ি দিয়ে। মাথাটা ও ঘোরাতে পারল না প্রথম চেষ্টায়। তিস্তা বোঝবার চেষ্টা করল ও সেই ঘড়ির দোকানের পেছন দিকের কোনও ঘরেই আছে কি না। বুঝতে পারল না।
শেকল-তোলা ঘরটার মধ্যে কী ছিল তা জানা নেই। মুফি ছিল নির্ঘাত। পাশের ঘরটার আসবাবপত্র ছিল অন্যরকম। অন্ধকার চোখে সয়ে গেলে অনেক কষ্টে ঘাড় সামান্য কাত করে ও দেখল, ওর ডান দিকের খাটে দূর্বাদি, বাঁ দিকের খাটে র্যাচেল। সর্বনাশ, এরা কী করে এল! কোথায় ও ভাবছিল দূর্বাদি এতক্ষণে মুসৌরি থানা তছনছ করে ফেলছে ওর জন্যে! দু’জনে একই ভাবে বাঁধা। ঘুমোচ্ছে। দূর্বাদির আবার ফুররর ফুররর করে নাক ডাকছে। আশ্চর্য! ওদের কি ঘুমের ওষুধ খাইয়েছে? নিশ্চয়ই!
চাপা গলায় তিস্তা ডাকল, - র্যাচেল, র্যাচেল! দূর্বাদি। কোনও সাড়া নেই। মড়ার মতো ঘুমোচ্ছে দু’জনে। কিন্তু এইভাবে আওয়াজ করায় একটা বিতিকিচ্ছিরি ফল হল। ঘরের একটা অন্ধকার কোণ থেকে আপাদমস্তক বোরখায় ঢাকা একটা ভয়াবহ নারীমূর্তি উঠে দাঁড়াল। নিঃশব্দে তিস্তার বাঁ দিকে এসে দাঁড়াল। মুখে কোনও কথা নেই, তারপর দুটো কর্কশ হাত বেরিয়ে এসে তিস্তার বাঁ বাহুতে একটা ছুঁচ ফুটিয়ে দিল। খুব আনাড়ি হাত। তিস্তার ভীষণ লাগল। মুখ দিয়ে শুধু উঃ বলে একটা আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই করতে পারল না। অসহায়ের মতো ইঞ্জেকশনটা নিল এই কথা ভাবতে ভাবতে যে, রহস্য-গল্পের গোয়েন্দাদের অলৌকিক ক্ষমতার শতাংশের একাংশও ওর নেই। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই ওর চেতনা সম্পূর্ণ লোপ পেয়ে গেল।
সাত
রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর জিত ওর ডেস্ক থেকে গোলকটা বার করল। এটা ওরা পালা করে-করে এক-একজনের কাছে রাখবে স্থির করেছে। আজ জিতের পালা। রঙ্গচারীর পকেট থেকে ছাড়া পেয়েই জিনিসটা আবার আন্দাজ বারো মিলিমিটার ব্যাসের একটা গোলকে পরিণত হয়েছে। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে পরীক্ষা করতে করতে জিতের হঠাৎ খেয়াল হল, একটা কালো বোতাম অন্য বোতামগুলোর থেকে একটু দূরে রয়েছে। সেটা টেপার সঙ্গে-সঙ্গে টেলিফোনের ডায়াল-টোনের মতো একটা মৃদু আওয়াজ হতে লাগল যন্ত্রতে। কালোর পরেই একটা সোনালি বোতাম। সেটাও টিপল জিত। সঙ্গে-সঙ্গে একটা অদ্ভুত কাণ্ড হল। গোলকের ভেতরটা কীরকম একটা নরম আলোয় ভরে গেল। তার মধ্যে খুব আবছাভাবে অরিন্দমের মুখ ভেসে উঠল। কীরকম অদ্ভুত অরিন্দম। চুলগুলো ছোট-ছোট, চোখ দুটো অস্বাভাবিক জ্বলজ্বল করছে। কপালের মাঝখানে একটা গভীর ভাঁজের মতো কাটা দাগ। জিত সঙ্গে সঙ্গে একটা ছোটখাটো বৈদ্যুতিক শকের মতো কিছু অনুভব করল। গোলকের অরিন্দম বলল, - জিত, প্লিজ, আমার যন্তর-মন্তরটা দিয়ে দে।
জিত বলল, - এটা তোর? তুই করেছিস?
অরিন্দম হাসল, - করেছিও বলতে পারিস, করিনিও বলতে পারিস।
- রহস্য রাখ। এটা তো আশ্চর্য যন্ত্র। কী কাজ এটার?
- বুঝতে পারছিস না? ওটা থট্ ট্রান্সমিটার। তোর সঙ্গে আমার চিন্তার যোগাযোগ ঘটিয়ে দিয়েছে যন্ত্রটা৷
- কীভাবে এটা করলি, অরি?
- পরে বলব। এখন ওটা দিয়ে দে।
- কীভাবে দেব? কোথা থেকে তুই কথা বলছিস?
- দ্রেবুং লামাসারি থেকে। লাসা।
- কী বললি?
- যা বললুম, তা বললুম। সে যাই হোক, সেখানে তো তুই আসতে পারছিস না। কালো বোতামের পেছনে একটা সাদা বোতাম আছে সেটা টেপ। যন্ত্রটাই তোকে ঠিক জায়গায় নিয়ে যাবে। শোন্। কালো বোতামটা টিপলে তবে যন্ত্র চালু হয়, সোনালি বোতামটা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার উপায়। আচ্ছা এবার যাই ভাই, সি ইউ।
অরিন্দমের মুখটা স্ফটিকের আলোর বৃত্তে হারিয়ে গেল৷ জিত প্রথমটা হতভম্ব হয়ে রইল। তারপর অরিন্দমের কথামতো সাদা বোতামটা টিপল। কিছুক্ষণ পরে ও অনুভব করল কিছু যেন একটা ওকে চুম্বকের মতো টানছে। স্থির থাকতে দিচ্ছে না। ও সন্তর্পণে করিডরে বেরিয়ে এল। করিউরের আলো রাতের মতো নিবে গেছে। সুনৃত, পৃথ্বীশকে ডাকবে নাকি? ডাকা উচিত। ওরা তিনজনে মিলে অরির খোঁজ করবে। মুফির অনুসন্ধান করবে। তিস্তাদিদের সাহায্য করবে, এই স্থির হয়েছিল। ওর একা যাওয়া মানে স্বার্থপরতা। পৃথ্বীশের কিউবের দিকে যাচ্ছে, কিন্ত চুম্বকের মতো সেই টানটা ওকে ডাইনিং-হলের দিকে টানতে লাগল। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই সেদিকে এগিয়ে গেল ও। আস্তে করে দরজার খিল খুলল। ভেজিয়ে দিয়ে কিচেন-গার্ডেন থেকে একটা ভারী পাথর নিয়ে এসে দরজার গায়ে ঠেসে দিল। নইলে সারা রাত দরজাটা হা-হা করবে। ঠাঁই ঠাঁই আওয়াজ করবে।
ঠাণ্ডা তারা-জ্বলা রাত। আকাশ থেকে হিম ঝরছে, জিত স্লিপিং সুটের ওপর শুধু ওর স্কুলের ব্রেজারটা চাপিয়ে নিয়েছে। মাথা খালি। ওর ঢেউ-খেলানো নরম চুল ভেদ করে ঠাণ্ডাটা কাঁচের মতো বিঁধছে। অদৃশ্য একটা চুম্বক ওকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আশ্চর্য! ওই তো তিব্বতি রেস্তোরাঁ শিগাৎসি। উলটো দিকের পাকদণ্ডী দিয়েই তো ওরা সেদিন নেমেছিল! হুড়হুড় করে নেমে যাচ্ছে জিত! যেন নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই। দূরে দেখা যাচ্ছে একটা কাঠের বাড়ি। তিন-কোনা মাথাটা। তিব্বতি ভাষায় কিছু লেখা দরজার মাথায়। কাঠের দরজা সামান্য ঠেলতেই খুলে গেল। লম্বা প্যাসেজ। জিত এগিয়ে চলেছে। কোথাও কেউ নেই। একটা চৌকোনো উঠোন। তার তিনদিকে ঘর, একদিকে একটা খোলা গুহামুখের মতো, তার দু’দিকে দুটো বু্দ্ধমূর্তি। ধর্মচক্রমুদ্রায় বসে আছেন। মঙ্গোলীয়-মুখ বুদ্ধ। ঘরের ভেতর সম্পূর্ণ অন্ধকার। শুধু এক কোণে একটা বাতি জ্বলছে। প্রথমে ঢুকে কিছু দেখতে পায়নি জিত। তারপর বাতির আলোয় দেখতে পেল একটা লম্বা কাঠের পাটাতন। তার ওপর একজন লামা শুয়ে।
কাছে এগিয়ে জিত বিষ্ময়ে স্থাণু হয়ে গেল। পাটাতনের ওপর শায়িত লামা আর কেউ নয়। তারই প্রিয় বন্ধু অরিন্দম চোপরা। যেন ঘুমোচ্ছে। দু’হাত দু’দিকে বুকের সঙ্গে লেগে রয়েছে। পরনে লামার লাল পোশাক। চুল ছোট-ছোট করে ছাঁটা। দুই ভুরুর মাঝে কপালে একটা গভীর কাটা দাগ, যেমন যন্তর-মন্তরে দেখেছিল। কিন্তু অরিন্দমের বুকে কোনও ওঠা-পড়া নেই। যেন ওর নিশ্বাস পড়ছে না। প্রচণ্ড উদ্বেগে জিত তক্ষুনি হাঁটু গেড়ে বসল। অরিন্দমের একটা হাত তুলে নিতে গেল। হঠাৎ গুরুগম্ভীর একটা কণ্ঠস্বরে গুহার নিস্তব্ধতা ভেঙে খানখান হয়ে গেল। - ওকে ছুঁয়ো না। সর্বনাশ হয়ে যাবে তোমার বন্ধুর। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কেউ বলল। শিউরে দাঁড়িয়ে পড়ল জিত।
পিছন দিকে একটা নিচু দরজা দিয়ে একটা ঘরের একাংশ দেখা যাচ্ছে। মেঝেতে পদ্মাসনে বসা একজন লামা। তিনি বেরিয়ে আসতে-আসতে কোনও অদৃশ্য ব্যক্তিকে লক্ষ করে বললেন, - চোমো, তোমাকে বহুবার বলেছি এখান থেকে নড়বে না। আরেকটু হলেই কী সর্বনাশ হত বলো তো! জিতের দিকে চেয়ে বললেন, - তুমি এখানে এলে কী করে? আগুন নিয়ে খেলা করছ ? অরিন্দম চোপরার এই বডির কথা কাউকে বলবে না। বললে ওরই বিপদ হবে।
জিতের আর সহ্য হল না, বলল, - লজ্জা করে না আপনাদের? ওকে আপনারা মেরেছেন, তারপর নিজেদের স্বার্থ-সিদ্ধির জন্য বডিটাকে এইভাবে প্রিজার্ভ করে রেখেছেন। তান্ত্রিক-টান্ত্রিক জাতীয় লোকেরা শবসাধনা করে শুনেছি। আমি আপনাদের নামে পুলিশে রিপোর্ট করব গিয়ে।
জিত লক্ষ করেনি ওর দু’পাশে দুই ষণ্ডামার্কা লামা কখন এসে দাঁড়িয়েছে। প্রধান লামার চোখের নির্দেশে মুহূর্তে একজন জিতের ঘাড়ের নীচের একটা জায়গা টিপে দিল: জিত দেখল ও আর নড়তে পারছে না, সমস্ত শরীর অসাড়। আস্তে-আস্তে ওকে বসিয়ে দিল লামারা। দ্বিতীয়জন এইবার ওর দুই ভুরুর মাঝখানে একটা জায়গা দু’আঙলে টিপে ধরল। প্রথমে জিত লাল-নীল নানা রঙের খেলা দেখতে লাগল চোখের সামনে। তারপর আস্তে-আস্তে কীরকম একটা চিনচিনে অনুভূতি তার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে লাগল।
চিনচিনে ভাবটা কমে গেলে জিত একটা বড় অদ্ভুত জিনিস দেখতে পেল। ও দেখল, ঘরের আসবাবগুলো সব ছায়া-ছায়া। ওর সামনে অরিন্দমের শায়িত দেহ। ঠিক তেমনি নিস্পন্দ নিথর হয়ে শুয়ে আছে। কিন্তু কী আশ্চর্য! তার ওপর যেন হাওয়ায় ভাসছে আরেকটা অরিন্দম। দুই অরিন্দমের মাঝখানে একটা সূক্ষ্ম রূপোলি সুতো। ভাসমান অরিন্দম আস্তে-আস্তে গুম্ফার ছাদে গিয়ে ঠেকল। হাত নেড়ে একটা বিদায়ের ভঙ্গি করল। তারপর ছাদের কাঠের সিলিং ভেদ করে জিতের দৃষ্টির বাইরে চলে গেল।
লামা দু’জন ততক্ষণে তার ঘাড়ের নীচে এবং ভুরুর মাঝখানের জায়গা দুটো ডলতে আরম্ভ করেছে। প্রধান লামা বললেন, - শুধু তোমাকে আশ্বস্ত করবার জন্য অরিন্দমকে সুদূর লাসা থেকে আনাতে হল। সুক্ষ্ম শরীরে ও সেখানে অনেক কিছু শিখছে। স্থূল শরীরটার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছে ওই রুপোলি সুতো। ওর শরীরটা নাড়াচাড়া করলে সুতো ছিঁড়ে যেতে পারে। ও আর শরীরে ফিরে আসতে পারবে না। এ-কথা কাউকে বোলো না। বহু যুগ পরে আমাদের গুপ্তবিদ্যা দিয়ে যাবার উপযুক্ত পাত্র পেয়েছি। বাধা দিও না। পৃথিবীর মঙ্গল হবে।
জিতকে একটা কাঠের পাটাতনে শুইয়ে দেওয়া হল। লামা গম্ভীর গলায় বললেন, - পো-চা-কে-শো। আরেকজন লামা বাটিতে করে কী একটা তরল বস্তু সামনে রাখলেন। স্বহস্তে চামচ করে বস্তুটা জিতকে খাইয়ে দিতে-দিতে প্রধান লামা বললেন, - এই মাখন-চা খেয়ে নাও। শরীরে বল ফিরে পাবে।
জিনিসটা খেতে খুব বিশ্রী হলেও খাবার পর জিত সত্যিই একটু সুস্থ বোধ করল। সেই অসাড় ভাবটা একদম কেটে যাচ্ছে। তিনজন মিলে ওকে সাবধানে তুলে ধরে গুম্ফার বাইরে বার করে দিলেন। তখনই জিতের খেয়াল হল যন্তর-মন্তরটাকোথায়? সেটার টানেই তো এখানে আসা। সেটা এখানে দিয়ে গেলেই তো অরিন্দম পেয়ে যাবে। ও-ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, - আমি অরিন্দমের একটা জিনিস দিতে এখানে এসেছিলাম। ওই আমায় আসতে বলেছিল।
লামারা তিনজনেই ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। প্রধান লামা বললেন, - কী জিনিস? জিত বর্ণনা-দিল জিনিসটার। ওঁরা তিনজন ঢুকে গিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজলেন জিনিসটা। একটু পরে ফিরে এসে বললেন, - কোনও জিনিসই তাঁরা গুম্ফার ভেতরে দেখতে পাননি। পেলে অরিন্দমকে নিশ্চয় দিয়ে দেবেন। জিত রাতের অন্ধকারে হোস্টেলের পথ ধরল।
আট
পৃথ্বীশ আর সুনৃত ঘুম থেকে উঠে ব্রেকফাস্ট খেয়ে নিয়েছে। স্নান টান সেরে খুব ঝরঝরে লাগছে শরীরটা। সনৃত বলল, - জিত কিন্তু ঘরে নেই। নিশ্চয়ই আমাদের আগেই উঠে বেরিয়ে গেছে। চল্, ল্যাবে যাই। কতকাল কাজকর্ম করি না।
এই সময়ে ক্লাস-টেন-এর গুরবচন সিং ও চাওলা বলে দুটি ছেলে এসে বলল, - ফাদার ওদের ডেকে পাঠিয়েছেন। আজ ফাদার জোনাথনের ঘরে দু’জন পুলিশ অফিসার এসেছেন। ফাদার ওদের দেখিয়ে বললেন, - এই যে, এদের কথাই বলছিলাম মিঃ খান্না। পৃথ্বীশ, এরা দেরাদুন থেকে আসছেন, তারপর বললেন, - জিত কই?
পৃথ্বীশ বলল, - জিত বোধহয় আমাদের আগেই উঠেছে, জগিংয়ে বেরিয়ে গেছে।
একটি অফিসার বাঁকা হাসি হেসে বললেন, - শুনলাম তোমরা নাকি মিসিং চোপরার অন্তরঙ্গ বন্ধু। অথচ সে হারিয়ে যাওয়ায় তোমাদের মনে কোনও উদ্বেগ আছে বলে তো মনে হচ্ছে না? য়ু আর অভিয়াসলি ফলোয়িং ইয়োর ডেইলি রুটিন?
সুনৃত বলল, - মনের উদ্বেগের জন্যে আমাদের ডেইলি রুটিনে বাধা পড়ে না, স্যার।
পৃথ্বীশ বলল, - দুটোকে ডিটাচ করার শিক্ষা স্কুলই আমাদের দিয়েছে।
সুনৃত হেসে বলল, - তা ছাড়া আপনাদের মতো এফিসিয়েন্ট পুলিশ অফিসার থাকতে অরিন্দমের কোনও বিপদের আশঙ্কা আমরা করি না। মাত্রই তো সাতদিন হল হারিয়েছে আমাদের বন্ধু। বছর-খানেকের মধ্যে খুঁজে বার করতে পারবেন আশা করি!
ফাদার হাত তুলে বললেন, - ব্যস, ব্যস, যথেষ্ট হয়েছে বয়েজ।
অফিসারটি চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, - যদি বলি তোমাদের বন্ধুটি কোথায় কী উদ্দেশ্যে গা-ঢাকা দিয়েছে তোমরা খুব ভাল করে জানো? যদি বলি তোমরা তাকে এখনও সাহায্য করে চলেছ?
সুনৃত বলল, - বেশ তো! য়ু আর ফ্রি টু ফলো আস। পেছনে টিকটিকি লাগান।
- জানো, তোমরা যা করেছ তার জন্য কী ধরনের শাস্তি হতে পারে? গলা প্রচণ্ড চড়ছিল লোকটির।
ফাদার অস্বস্তি বোধ করছিলেন। তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠানে নিজের ছাত্রদের তিরস্কার করার দায়িত্ব আর কেউ নিক, স্বভাবতই এটা তাঁর পছন্দ। নরম সুরে বললেন, - ওরা সে ধরনের ছেলে নয় মিঃ খান্না, অরিন্দমের ব্যক্তিগত জীবন, অভ্যাস, পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কে কিছু বলতে পারবে বলেই ওদের এখানে ডাকিয়েছি।
- আপনি জানেন না ফাদার, খান্না নামের অফিসারটি চোখ লাল করে গর্জন করে উঠল, - এই রকম অকালপক্ক দায়িত্বজ্ঞানহীন ছেলেদের জন্য আমাদের দেশে জুভেনাইল ক্রাইম কী রেটে বেড়ে যাচ্ছে। স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল তো দূরের কথা, এদের বাপ-কাকা পর্যন্ত জানে না এদের উর্বর মস্তিষ্কে কখন কী ক্রাইমের প্ল্যান খেলছে। আপনি জানেন না মোটামুটি এই একই সময়ে এই মুসৌরি শহরে একটি বাচ্চা এবং একটি তরুণী মেয়েও কিডন্যাপড হয়েছে। এই ছেলে ক’টিকে আমরা ক’দিন ধরেই শ্যাডো করছি। উই আর অলমোস্ট শিওর যে, এরা চোপরার হোয়্যারআ্যাবাউটস্ জানে।
শেষের দিকে দুই বন্ধুর কান খাড়া হয়ে উঠেছিল। বাচ্চাটা তো মুফি। কিন্তু একটি তরুণী মেয়েও অন্তর্ধান করেছে, এটা জানত না। সুনৃত পৃথ্বীশের দিকে চাইল না। পৃথ্বীশ নিশ্চই এখন বোকার মতো ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ওদের সেই চোখ চাওয়া-চাওয়ির কী ব্যাখ্যা দেবে এই অভব্য অফিসারটি, ভগবান জানেন!
আরও কিছুক্ষণ জেরা চলল। মনে হল, ফাদার ভেতরে-ভেতরে খুব বিরক্ত হয়েছেন। তিনি বললেন, - আচ্ছা মিঃ খান্না, আপাতত ছেলে দুটিকে আমি যেতে দিচ্ছি, আবার নতুন কোনও দরকার হলেই ওরা আপনার কাছে হাজির হবে।
বাইরে এসে পৃথ্বীশ বলল, - তরুণীটি আবার কে রে?
সুনৃত বলল, আমি তো তিনজন তরুণীর কথা জানি। দূর্বাদিরা তিনজন রাতে ফেরেনি আলিকাকা বলছিলেন না? এই অফিসারটি যেমন অপদার্থ, তেমন অসভ্য। তার ওপর মিস্ইনফর্মড। আবার আমাদের ভয় দেখাতে এসেছে। চল্ তো ওয়েসাইডে যাই।
পৃথ্বীশ বলল, - ফাদারের কাছে যখন ডাক পড়ল আমি কিন্তু ভেবেছিলাম আঙ্কল চোপরা।
- এটা তো ভাল মনে করিয়েছিস বন্ধু। সুনৃত বলল, - চোপরার ‘চোপ রও’ কিন্তু এখনও আরম্ভ হয়নি। কেন বল তো?
ওয়েসাইড হোটেলে এসে ওরা দেখল ভীষণ কাণ্ড। পুলিশে পুলিশ। আলিকাকা জবানবন্দি ইত্যাদি নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। শাহিনের কাছেই শুনল ওরা ব্যাপারটা। আজ ভোরে আলিকাকা বাইরের দরজা খুলতেই নাকি দুম করে দুটো লাশের মতো কী যেন পড়ে যায়। আলিকাকা ভয় পেয়ে তাঁর ভৃত্য বিরখাবাহাদুরকে ডাকেন। দু’জনে দেখেন মানুষ দুটি তিস্তা আর দূর্বা। পরশুদিন যে পোশাকে বেরিয়েছিল এখনও পরনে সেই ব্লু জিন্স, সেই রঙিন কার্ডিগান। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত চেহারা। তাদের ধরাধরি করে এনে শুইয়ে দেওয়া হয়। সারা শরীরে আবার আ্যাল্কোহলের গন্ধ। যারা কুকীর্তিটি করেছে তারা বোধহয় প্রমাণ করতে চায়, মেয়ে দুটি মাতাল-টাতাল হয়ে বাড়ি ফেরেনি। স্পষ্ট কোনও ঘুমের ওষুধ ইনজেক্ট করা হয়েছে ওদের শরীরে। ঘণ্টাখানেক আগে ঘুম ভেঙেছে, কড়া কালো কফি খাওয়ানো হয়েছে বড়-বড় মগে। এখনও ঘোর পুরোপুরি কাটেনি। র্যাচেল ওদের সঙ্গে নেই।
পৃথ্বীশ বলল, - তরুণীটি কে এবার বুঝলি তো সুনৃত?
সুনৃত বলল, - হুঁ।
এখানে আপাতত থাকার কোনও মানে হয় না। পুলিশে ঘিরে রেখেছে দূর্বাদি আর তিস্তাদিকে। অথচ কৌতূহলও প্রচণ্ড। শাহিনদি কেঁদে-কেঁদে মুখখানাকে বোলতার চাকের মতো ফুলিয়ে ফেলেছে।
মনটা ওদের ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। ওরা বেরিয়ে যাচ্ছে, চৌকাঠ পেরোতেই মিঃ খান্নার মুখোমুখি। বাঁকা হাসি হেসে বললেন, - এই যে, খুনি অকুস্থলেই ফিরে এসেছে। বাঃ বাঃ!
বাইরে এসে রাগে ফেটে পড়ল পৃথ্বীশ, - কী মনে করেছে লোকটা? খুনি? অকুস্থল? আমরা কাকে খুন করলুম?
সুনৃত বলল, - চেপে যাও বন্ধু। লোকটা যে-কোনও কারণেই হোক আমাদের প্রচন্ড অপছন্দ করছে এবং ইচ্ছে করে রাগিয়ে দিচ্ছে।
তিস্তার মতো শক্ত মেয়ে একেবারে হাউহাউ করে কাঁদছিল। তাদের জ্ঞান ফিরেছে। নিজেদের ফিরে আসার বৃত্তান্ত অন্যের মুখে শুনেছে। কিভাবে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনে ও দোকানের ভেতরে যায় এবং ধরা পড়ে। তিস্তা ভেতরে যাবার পর নাকি চিনেম্যানটি দূর্বা ও র্যাচেলকে চা দিয়ে আপ্যায়িত করে, - চাইনিজ গ্রিন তি মিস, দিস ইজ দি বেস্ত তি উই ক্যান গেত হিয়াল। ওরা ভাবে সময়টা কাটাতে হলে বোধহয় চা খাওয়াই ভাল। শিখ এবং চিনেটিও নিজেদের জন্যে চা আনায়। দূর্বা আবার কায়দা করে শিখের সঙ্গে নিজের কাপ বদলাবদলি করে নিয়েছিল। তা সত্ত্বেও চা খাওয়ার কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই ওদের হাত-পা ঝিমঝিম করতে থাকে। বড়-বড় হাই ওঠে। কখন ঘুমিয়ে পড়েছে ওরা নিজেরাই জানে না। ঘুম ভাল করে ভেঙেছে আজ। কিন্তু তিস্তার চোখের জল আর বাধা মানছিল না। র্যাচেল মিডফোর্ড তার কতদিনের বন্ধু। কলকাতার ওয়াই-ডবলু-সি-এ-তে টেবিলটেনিস খেলতে গিয়ে আলাপ। খুব বুদ্ধি মেয়েটার। তিস্তার মতো লড়িয়ে না হলেও এই বুদ্ধির জন্য ওকে তারিফ করে তিস্তা। ও কী করে র্যাচেলের মা’র কাছে মুখ দেখাবে?
কী ভয়ানক এই দুর্বৃত্তরা! মুফির মতো শিশুকে নিয়েছে, র্যাচেলকে নিল। কী উদ্দেশ্য ওদের? ওদের তিনজনকেই বন্দী করে রাখতে পারত। যা হবার একসঙ্গে হত। বেচারি র্যাচেল। ভিতুর একশেষ। ভয়েই তো ও মরে যাবে।
দূর্বা অনেকক্ষণ ধরে তিস্তার কান্না শুনছিল। বলল, - তুই তো জানিস তিস্তা, সব সমস্যারই একটা-না-একটা সমাধান আছে। পুলিশ ঘড়ি দোকান রেইড করতে গেছে, র্যাচেলকে আমরা নিশ্চয়ই ফিরে পাব, বিপদের সময়ে এরকম অধৈর্য হয়ে পড়লে চলে?
নয়
ওয়েসাইড হোটেলের দরজায় যখন দূর্বাদের ঘুমন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়, তখন র্যাচেল মুখ শুকনো করে একটা অন্ধকার ঘরের কড়িকাঠের দিকে চেয়েছিল। দিন কি রাত বোঝার উপায় নেই। ঘরের মধ্যে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। হাতের রেডিয়াম-ডায়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখল পাঁচটা দশ। যদি বিকেল হয় তা হলে সার্কাস অ্যাভিনিউয়ের খুদে একতলা ফ্ল্যাটটা থেকে ওর ভাই ভ্যাল টেনিস র্যাকেট হাতে করে বেরিয়ে যাচ্ছে। মা ঘরে তালা দিয়ে জলি-আন্টির বাড়ি টিভি দেখতে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। ছেলে মেয়েকে নিয়ে বেচারির শখের অন্ত নেই। মায়ের ধারণা ছেলে অন্তত একটা দ্বিতীয় কৃষ্ণান তো হবেই! মেয়েও হবে নাম-করা গাইয়ে। ডরিস ডে’র মতো ভরাট মিষ্টি গলাখানা। অন্যান্য অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান মায়ের মতো আই সি এস ই পাশ করা মাত্রই মেয়েকে স্টেনো-টাইপিস্ট করে তোলার চেষ্টা করেননি তিনি। র্যাচেল কলেজে পড়ছে। পিয়ানো শিখছে। গান গাইছে। ভবিষ্যৎ ডরিস ডে’র কী করুণ অবস্থা।
ওদিকের ঘরটাতে কারা যেন কথা বলছে! ঘরটাতে কি পার্টিশন? প্রথম দিকে শুধু গলার আওয়াজ পাচ্ছিল র্যাচেল। তারপর একজনের গলা বোধহয় তকাতর্কির জন্যে একটু চড়ল। অন্য গলাটাও। র্যাচেল শুনতে পেল স্পষ্ট, - ওইটুকু শরীরে আর কতটুকু মাল ধরবে? ধাড়িটাকে তো ওইজন্যেই রেখে দিলুম।
- কিন্তু সুইডিশগুলো তো বেগার-চিলড্রেন চাইছে। তুমি তো জানো বাচ্চাটাকে দেখে ওরা বিশ্বাস করবে না সেটা। ওজন নেবে, নানারকম ডাক্তারি পরীক্ষা করাবে। ম্যালনিউট্রিশনের সিমটম না হলে আমাদের ভোগাবে কিন্তু সেবারের মতো।
- হুঁ, সাহেবি ন্যাকামির কথা বাদ দাও তো। জীবনে কখনও থার্ড ওয়ার্ডে পা দেয়নি। ইন্ডিয়ার বেগার-চিলড্রেন কী জিনিস তা জানে?
ব্লন্ড না হলে পছন্দ হয় না। কালো চুল দেখলেই খুঁত-খুঁত করবে, দেখে-দেখে সিন্ধি-পার্শিদের বাচ্চাগুলো ধরতে হয় তা ছাড়া এতদিনেও কি যথেষ্ট ম্যালনিউট্রিশন হয়নি?
- তা অবশ্য। চি-চি করছে বাচ্চাটা। আর কাঁদতেও পারছে না। জাস্ট প্রাণধারণের মতো ক্যালোরিটুকু দিয়ে যাচ্ছি। তা হলে কলকাতা আর কানপুরের লটটার সঙ্গে মিক্স করে ওকে..
- হ্যাঁ, আর ধাড়িটার ইনসাইডে মাল যাবে। ডাঃ মালহোত্রাকে ইমিডিয়েটলি কেবল করো। দেরি করে লাভ নেই।
র্যাচেল শক্ত কাঠ হয়ে রইল। বাচ্চাটা কে? মুফি? তাকে সুইডেনে পাঠাবে? নিঃসন্তান দম্পতির কাছে ভিখিরি-বাচ্চা বলে বিক্রি করতে? আর ধাড়িটা কে? ও নিজে? ওর ইনসাইডে মাল যাবে? র্যাচেলের মনে হল, ভয়ে ও এক্ষুনি অজ্ঞান হয়ে যাবে। উঃ। তিস্তা কোথায়? দূর্বাদি? দূর্বাদি? ঘরে অন্ধকার একটু-একটু করে পাতলা হচ্ছে। র্যাচেল দেখল অনেক উঁচুতে একটা তারের জাল দেওয়া জানলা। এইবার ওই জানলাপথে একটু-একটু করে সকালের আলো আসছে। আসবাবপত্রহীন, সিমেন্টের মেঝে-অলা একটা ন্যাড়া ঘরে সে একটা তক্তাপোশের ওপর শুয়ে আছে। হাত এবং পা-জোড়া করে বাঁধা। খুব দুর্বল লাগছে। নড়তেই বাঁ দিকের বাহুটা টনটন করে উঠল। ইনজেকশনের ব্যথা। ওরা তা হলে ওকে একটার-পর-একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখছে?
র্যাচেল দাঁত দিয়ে হাতের বাঁধন কাটতে চেষ্টা করল। হঠাৎ বাইরে তালা খোলার শব্দে নিশ্চুপ অনড় হয়ে গেল। বাইরের দরজা সামান্য খুলে বোরখা-পরা একজন কেউ ঢুকল। হাতে একটা প্লেট আর গ্লাস। তক্তাপোশের একদিকে জিনিসগুলো নামিয়ে রাখল মহিলাটি। র্যাচেল তখনও কাঠ হয়ে পড়ে আছে। চোখ বোজা, নিশ্বাস প্রায় বন্ধ। বোরখাধারিণী ওকে নাড়াল খানিকটা। তারপর আপনমনে বলল, - ঘুম ভাঙেনি এখনও দেখছি। ভালই হল। ডাঃ মালহোত্রা আসা পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকলে ভালই হয়।
র্যাচেল হতভম্ব, কারণ, কণ্ঠস্বর পুরুষের। জিনিসগুলো র্যাচেলের পাশে নামিয়ে রেখে বোরখাধারী পুরুষটি বেরিয়ে গেল। বাইরে তালা লাগানোর আওয়াজ হল আবার। র্যাচেল ভাবল, গোয়েন্দা-গল্পের নায়িকা হলে সে এতক্ষণে হাত-পায়ের বাঁধন খুলে ঘুমের ভান করে পড়ে আছে। লোকটা নিচু হওয়া মাত্র জোড়া-পায়ের আঘাতে তাকে ধরাশায়ী করে খোলা দরজা দিয়ে পালাচ্ছে। হরিণের মতো ছুট লাগাচ্ছে যতক্ষণ না থানায় পৌঁছয়।
এই সময়ে পাশের ঘরে আবার গুনগুন শুরু হল। - অর্গানগুলোর আ্যাপ্রক্সিমেট ওজন জানা চাই।
- সেইমতো মাল।
এইসব কথা মাঝে-মধ্যে শুনতে পেয়ে প্রচণ্ড ভয়ে চোখ বুজল র্যাচেল।
দশ
বাইরের দিকে উদাস চোখে তাকিয়ে নিজের কিউবে বসে ছিল জিত। বাইরে কিছু বাঁদর-বাঁদরি বাচ্চা নিয়ে খেলা করছে। দিনের আলো এখন নিবে আসছে। আজ সারাদিন ও ঘর থেকে বার হয়নি। চুপচাপ একা-একা কাটিয়েছে। বন্ধুরা ওর রাত্রির অভিজ্ঞতার কিচ্ছু জানে না। সেজন্য কেমন একটা অপরাধবোধ ওর মনের মধ্যে জন্ম নিয়েছে। এই গোপনীয়তার ভার ওকে একলাই বহন করতে হবে। লামা বলেছেন, গোপন না করলে অরিন্দমের সমূহ বিপদ। এখন ও, যা দেখেছে, শুনেছে, ওর বিশ্বাস হতে চাইছে না সেটা। দুটো অরিন্দম! একটা মৃতের মতো শুয়ে, আর-একটা কাঠের সিলিং ভেদ করে অনায়াসে চলে গেল? কী অদ্ভুত! বোঝাই যাচ্ছে, অরিন্দম যেখানে গেছে স্বেচ্ছায় গেছে। যা করছে স্বেচ্ছায় করছে। কিন্তু মুফিরা? পৃথ্বীশদের কাছে শুনেছে দূর্বাদি ও তিস্তাদি ফিরেছে। যে কারণেই হোক দুর্বৃত্তরা ওদের ফিরিয়ে দিয়ে গেছে। দূর্বাদি ওস্তাদ অ্যাথলিট। তিস্তা মুখার্জির নাম একডাকে সবাই চেনে৷ কাগজে ছবি দেখে। এখানে ওকে দেখামাত্র চিনে ফেলেছিল ও। কিন্তু র্যাচেল মিডফোর্ড নামের ওই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়েটি ফেরেনি। এইসব ব্যাপারের সঙ্গে অরিন্দমের অন্তর্ধানের কোনও যোগ আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। যত দূর মনে হয়, বড় লামা ওর ওপর খুব অসন্তুষ্ট নন, বেশ কিছু অলৌকিক ক্ষমতাও ধরেন, ওকে এই বিপদটার কথা বলে ওর সাহায্য নেওয়া যায় না! তবে কাজটা করতে হবে সম্পূর্ণ একা। সে শপথ নিয়েছে, গুপ্ত-কথা ফাঁস করবে না।
অন্ধকার গাঢ় হওয়ামাত্র জিত বেরিয়ে পড়ল। পৃথ্বীশরা গেছে ওয়েসাইডে। ও শরীর খারাপের অজুহাতে এড়িয়ে গিয়েছিল। বন্ধুদের বাদ দিয়ে এভাবে কিছু করতে ওর বিবেকে বাধছে। কিন্তু কী আর করা যাবে? পাকদন্ডী দিয়ে নামতে লাগল জিত। দ্রুত। একটা বুনো এপ্রিকট গাছ ওর দিকচিহ্ন। এইখানটায় দাঁড়িয়ে তিব্বতি গুম্ফায় যাবার দিক ঠিক করতে হবে ওকে। কারণ, তিনটে পায়ে-চলা পথ নীচের দিকে নেমে গেছে। হঠাৎ ওর পায়ে কী একটা শক্তমতো ঠেকল। জিত নিচু হয়ে দেখল, আশ্চর্য! অরিন্দমের যন্তর-মন্তর। নিজের হাতে এটা ও গত রাতে গুম্ফায় নিয়ে যায়। সম্ভবত যখন ওরা জুডো না কিসের প্যাঁচে ওকে চলচ্ছক্তিরহিত করে দেয়, তখনই জিনিসটা হাত থেকে পড়ে যায়। অথচ কোনও শব্দ শুনতে পেয়েছে বলে ও মনে করতে পারল না। কারও পায়ে লাগেনি। জিনিসটা কি আপন খেয়ালেই গড়াতে-গড়াতে চড়াই ভেঙে এইখানে চলে এসেছে?
মাধ্যাকর্ষণের শক্তিকে কি উপেক্ষা করতে পারে অরিন্দমের যন্ত্রটা? ভিজে ঘাস থেকে সন্তর্পণে তুলে নিল ও যন্ত্রটাকে। রুমালে মুছল, যদিও মোছার কিছু ছিল না। কেননা একফোঁটা জল বা ধুলোও যন্ত্রের গায়ে লেগে নেই। কালো বোতাম টিপল জিত। করকর্-করকর্ করে ডায়ালটোনের মতো শব্দটা হতে লাগল। সোনালি বোতাম টিপল। কিছু হল না। খারাপ হয়ে গেল নাকি যন্তর-মন্তর? কেমন যেন মরিয়া হয়ে লাল বোতাম টিপল ও। সঙ্গে সঙ্গে একটা অদ্ভুত কাণ্ড হল। গোধূলির মতো একটা আলো জ্বলল ভেতরে। সে যেন পৃথিবীর গোধূলি নয়, অদ্ভুত, অপার্থিব একটা আলো, কোনও আকৃতি দেখা গেল না। খালি স্পষ্ট সুরে জিত শুনতে পেল, - হাই, হোয়াটস্ রং ?
জিত বলল, - এভরিথিং।
- এক্সপ্লেন।
জিত খুব উত্তেজিত স্বরে জানাল, মুফি আর র্যাচেলের হারিয়ে যাওয়ার কথা। এবার যন্ত্র বলল, - ওয়েট। একটু পরেই আবার বলল, - দে আর আ্যাট দেরাদুন। সুন উইল বি প্যাকড অফ্ টু ডেলহি। র্যাচেল উইল বি কিল্ড্ বাই টুমরো আফটারনুন ইফ নো স্টেপস আর টেক্ন্। ডেঞ্জার। গ্রেভ ডেঞ্জার। রিপোর্টিং টু অরিন্দম। টেক দি আর্লিয়েস্ট বাস টু দেরাদুন। উইল বি ইনস্ট্রাকটেড।
জিত যন্তর-মন্তর পকেটে পুরে দৌড়ল। ম্যাল রোডের ওপরে উঠে রিকশ নিল এটা। - জলদি চলো লাইব্রেরি বাজার বাসস্ট্যাণ্ড। তখুনি ছাড়ছিল দেরাদুনের শেষ বাস। একরকম লাফিয়ে উঠল জিত।
এগারো
পুলিশ যখন ‘রোজা’ নামের ঘড়ির দোকানটা রেইড করতে যায় তখন পৃথ্বীশ আর সুনৃত উপস্থিত ছিল তিস্তাদের বিশেষ অনুরোধে। কিন্তু ওদের নির্দেশমতো কোনও দোকান তো দূরস্থান, ওই আকৃতির কোনও দোকানই ওখানে পাওয়া গেল না। তিস্তা বলেছিল, বাঁ দিকে একটা ধাবা ছিল, তড়কা রুটি বিক্রি হয়, ডাইনে ডাইং-ক্লিনিং। মাঝখানে সরু একচিলতে দোকান। নির্দিষ্ট স্থানে পুলিশ গিয়ে দেখে, একটা মস্ত সাইনবোর্ড টাঙানো, রেডিমেড কাপড়ের দোকানের। কাউন্টার, ফার্নিচার, প্যানেল ইত্যাদি বসানো হচ্ছে, পালিশ হচ্ছে। ছুতোরদের মারফত মালিকের পাত্তা পাওয়া গেল আড়াই ঘণ্টা পরে।
এই জায়গাটা নাকি পাঁচ বছরের জন্য লিজ দেওয়া ছিল একজন শিখকে। কর্তার সিং তার নাম। তিনদিন আগে লিজ শেষ হয়ে যাওয়ায় মালিক তার জায়গাটা ফেরত পেয়েছে, এবং দোকান বসাচ্ছে। কর্তার সিং-এর ঠিকানা, হোশিয়ারপুর, পঞ্জাব।
দূর্বা ও তিস্তাকে তৎক্ষণাৎ পুলিশ-জিপে চাপিয়ে আনানো হল। তারা হতভম্ব। একটা দোকানকে দোকানই যে টুকরো-টুকরো হয়ে লোপাট হয়ে যেতে পারে, এটা তাদের কারও ধারণার মধ্যেই ছিল না। সবাই মিলে দোকানের পেছনে গিয়ে গাদাগুচ্ছের কাঠের পার্টিশন ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায়নি। তখনকার মতো মুসৌরি পুলিশ থানায় ফিরে গেল। কর্তার সিংয়ের খোঁজে হোশিয়ারপুরে জরুরি পুলিশ-ফোন যাচ্ছে। ওয়েসাইড হোটেলে তখন শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
বারো
অন্ধকার ক্রমেই ঘন হয়ে উঠছে। কোণের ঘরে শাহিনকে ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িবে রাখা হয়েছে। আনোয়ার ফিরেছে দিল্লি থেকে। বাচ্চাটা মুফি নয়। দিল্লিরই কোনও পঞ্জাবি-তনয়, খেলতে-খেলতে হারিয়ে গিয়েছিল। বেগম আলি শয্যা নিয়েছেন। মুকতার আলিসাহেব ঢাকা-বারান্দায় নিজস্ব চেয়ারটি পেতে চুপ। তাঁর সামনে টেবিলের ওপর বোর্ডারদের বিল-সংক্রন্ত স্তূপীকৃত কাগজ তিনি ওখানেই বসেন, ওখানেই ঘুমোন।
রাত আন্দাজ দশটা তিস্তা ও দূর্বাকে জোর করে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। তিস্তার ঘুম আসছে না। যদিও দূর্বার নাক ডাকছে। যে-কোনও বিপদের সময়ে মাথা ঠাণ্ডা রাখার প্রশংসনীয় ক্ষমতা আছে দূর্বার। কী করে যে এই পরিস্থিতিতে ওর নাক ডাকে! হঠাৎ ঘরের মধ্যে একটা তীব্র ধূপ-ধূপ গন্ধ পেয়ে তিস্তা উঠে বসল। বেড-সুইচটা টিপতেই অবাক হয়ে দেখল, ওর শয্যার পাশে একজন তরুণ লামা দাঁড়িয়ে৷ চুল ছোট-ছোট করে ছাঁটা, পরনে লামাদের লাল পোশাক। দুই ভুরুর মাঝখানে একটা খাঁজের মতো লম্বাটে দাগ।
- আপনি তিস্তা মুখার্জি? রাইফেল-শুটিংয়ে ফার্স্ট প্রাইজ পাচ্ছেন ক বছর ধরে?
- হ্যাঁ।
- সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র কিছু আছে?
- দুটো রিভলভার আছে।
- আপনার সঙ্গিনী রিভলভার ব্যবহার করতে পারেন নিশ্চয়ই?
- ওঁকে জাগিয়ে দিয়ে আমার সঙ্গে তাড়াতাড়ি আসুন মুফদ্দর ও র্যাচেল মিডফোর্ডকে যদি বাঁচাতে চান।
দূর্বার ততক্ষণে ঘুম ভেঙে গেছে। সে উঠে চিৎকার করতে যাচ্ছিল। লামাটি বলল, - আমার নাম অরিন্দম চোপরা! আমি খুব খারাপ ভাইব্রেশন টের পাচ্ছি। সমস্ত মুসৌরি শহর দুক্কৃতিকারীতে ভরে গেছে। তাদের নেতা সবচেয়ে বড় শয়তান, সেও এখন এখানেই। ভাগ্য ভাল থাকলে তাকেও আমরা ধরতে পারব। পাঁচ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে নিন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমন্ত ওয়েসাইড-এর দরজা থেকে একটা ল্যান্ডরোভার ছুটে চলল। গ্রিন হিল কনজারভেটরির সামনে এসে থামল গাড়িটা। দ্রুতপায়ে নেমে গেল অরিন্দম। পৃথ্বীশ আর সুনৃত তখন ঘুমে অচেতন। জানলায় উপর্যুপরি টোকার শব্দে ঘুম ভাঙল ওদের। - আমার সুটকেস থেকে জিনস্ শার্ট আর একটা পুলোভার নিয়ে ডাইনিংহলের দরজাট! খুলে দে শিগগিরই। প্রশ্ন করিস না, বলল অরিন্দম।
একটু পরেই তিন বন্ধু ডাইনিংহলের দরজা খুলে বাইরের হিম-ঝরা অন্ধকারে বেরিয়ে পড়ল। - দেরাদুনের লাস্ট বাস কোনও একটা টোল-স্টেশনে ব্রেকডাউন হয়েছে। তাতে আটকে পড়ে আছে জিত। ওকে তুলতে হবে।
সুনৃত বলল, - বলিস কী। জিত দেরাদুনের বাসে?
অরিন্দম বলল, - রাগ করিস না সুনৃত, আমার যন্তর-মন্তরের নির্দেশে ও ছুটেছে দেরাদুনের দিকে। লক্ষ্য একই। মুফদ্দর ও র্যাচেলকে বাঁচানো৷ তোদের সঙ্গে যোগাযোগ করার ওর সময় ছিল না। তোদের নিয়ে যাবার ভার পড়েছে আমার ওপর।
তৃতীয় স্টেশনেই জিতকে ধরতে পারল ওরা। জিতকে দেখাবার জন্যই গাড়ি থেকে নেমে আলোর দিকে এগিয়ে গিয়েছিল ওরা। জিত গাড়ি দেখেই ছুটতে-ছুটতে আসতে থাকে, - আমাকে একটু দেরাদুনে নামিয়ে দেবেন? না গেলেই নয়.., বলতে-বলতেই বিপুল বিস্ময়ে ও বন্ধুদের দিকে চাইল। স্টিয়ারিংয়ে অরিন্দমকে দেখে ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে ছোট ছেলের মতো কাঁধে মাথা রাখল জিত। বলল, - তুই সত্যি-সত্যি বেঁচে আছিস অরি?
- নয় তো কী? যন্তর-মস্তরটা পেয়ে গেছিস তো আবার?
- হ্যাঁ, কিন্তু কি করে জানি না।
লামারা ওটা আমায় নিতে দিলেন না রে, বললেন, - আমরা তোমায় জীবন্ত যন্তর-মন্তর বানাচ্ছি, যন্ত্র নিয়ে তুমি কী করবে? তোমার বন্ধুর দরকার হবে। ওকে দিয়ে দাও। ও যেখানে পাবে সেখানেই রেখে আসছি যন্ত্রটা।
তিস্তারা কিছুই বুঝছিল না। অবাক হয়ে শুধু শুনছিল। জিত পকেট থেকে যন্তর-মন্তরটা বার করে তিস্তার হাতে দিল। যেতে-যেতে যথাসম্ভব ব্যাখ্যা করে জিনিসটা বুঝিয়ে দিচ্ছিল অরিন্দম, - তোরা তো জানিস কিছুদিন ধরেই বিষাক্ত চিন্তার ওয়েভ দ্বারা পরিবেশ-দূষণ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিলুম আমি। তোরা যেটা জানতিস না সেটা হল আমার কতকগুলো একস্ট্রা-সেন্সরি পার্সেপশনের ক্ষমতা ছিল। কোনও লোকের সংস্পর্শে এলে আমি কতকগুলো সূক্ষ্ম কম্পন টের পেতাম। আমার মন বুঝে নিত সেগুলো ভাল কি মন্দ। অর্থাৎ লোকটার চিন্তার তরঙ্গ-আমাকে আঘাত করত। এর থেকেই আমার মাথায় আসে শব্দের যেমন তরঙ্গ আছে, চিন্তারও তেমন তরঙ্গ আছে। ই.ই.জি যন্ত্রে জানিস তো অস্বাভাবিক ব্রেন-ওয়েভ ধরা পড়ে! এ-ও কতকটা তাই। তবে আরও অনেক সূ্ক্ষ্ম। আমার ধারণা হয়, চিন্তা-তরঙ্গ সাধারণ শ্রবণগ্রাহ্য শব্দ-তরঙ্গের থেকেও অনেক অনেক কম হার্টজের কোনও শব্দ-তরঙ্গ। চিন্তা-তরঙ্গ ধরবার একটা যন্ত্র তৈরি করা ক্রমশ আমার ধ্যানজ্ঞান হয়ে ওঠে। দিল্লির মার্কেট থেকে, তা ছাড়াও নিউ ইয়র্ক থেকে কাকাকে দিয়ে সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম ইনটিগ্রেটেড কিট ইত্যাদির বহু কল-কব্জা আনাই। ছোট্ট-খাট্টো একটা থট-ট্রান্সমিটার তৈরি করাই আমার উদ্দেশ্য ছিল। এক একটা চ্যানেল ধরতে পারলে এক-এক ধরনের চিন্তা-তরঙ্গ আমার আয়ত্তে আসবে এই আর কি!
- একদিন সফলও হলাম। নিজের চিন্তা নিজের কানে শুনতে পেলাম। তারপর একদিন বড় অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল। আরও নানারকম আনআইডেনটিফায়েড থট-ওয়েভ ধরতে-ধরতে হঠাৎ একদিন কী ধরলাম জানি না। যন্ত্রটা আমার চোখের সামনে বদলে যেতে লাগল। বাইরের পলিথিন কেসটা একরকম অদ্ভুত রকমের হয়ে যেতে লাগল। ভেতর থেকে একটা আলোর সঙ্গে-সঙ্গে একটা জলদ্গম্ভীর আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল, - হোয়াটস রং ম্যান, হোয়াটস রং? অ্যানাদার ওয়র ইন হুইচ ইউ প্রোপোজ টু কিল ওয়ান অ্যানাদার? স্পিকিং ফ্রম জিবুস স্পিকিং..।
- আমি তো অবাক। শুধু বলতে পারলাম, চারদিকে ইভ্ল ভাইব্রেশন টের পাচ্ছি। কিছু বুঝতে পারছি না, বড় বিপদ।
- স্বরটা বলল, - ঠিক আছে,যত শীঘ্র সম্ভব হেল্প পাঠাচ্ছি। তারপর কখন সুইচ টিপে জিনিসটা আমি বন্ধ করে দিয়েছি নিজেই জানি না। তাই বলছিলাম এটা আমার তৈরি বলতে পারিস, আবার না-ও বলতে পারিস। আসলে আরম্ভ করে ছিলুম আমি, তারপর কীভাবে ওই অজানা গ্রহ জিবুসের কোনও থট-ওয়েভ ধরে ফেলে যন্ত্রটা! তারই প্রভাবে ওটা পালটে গিয়ে নিজেই নিজেকে তৈরি করে নিয়েছে। এটা ঘটে একটা শুক্রবার।
জিত বলল, - লামাদের সঙ্গে তোর যোগাযোগ হল কী করে?
- থট-ওয়েভ ধরতে ধরতেই লামা মিঙ্গির সেনচেনের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়। উনি লাসার দ্রেবুং মঠের অধ্যক্ষ। ওঁর নির্দেশ অনুযায়ী এখানকার লামারা আমাকে সূক্ষ্ম শরীর ধারণ করতে শিখিয়ে দেন। সূক্ষ্ম শরীরে দ্রেবুং মঠে গিয়ে আমি অনেক কিছু শিখেছি যা বোধহয় এবার কাজে লাগাতে পারব।
জিত বলল, - দ্বিতীয়বার যন্তর-মস্তর পেয়ে যখন তোর সঙ্গে যোগাযোগ করবার চেষ্টা করলাম, তখন পেলাম না কেন?
- নিশ্চয়ই তখন হিপনোটিক ট্রান্স বা সম্মোহক নিদ্রায় ছিলাম। ওইভাবেই অল্পসময়ে অনেক জিনিস শেখায় ওরা তিববতে।
তেরো
দেরাদুনে পৌছে যন্তর-মন্তর এবং অরিন্দম একই দিকে নির্দেশ দিতে লাগল। রাজপুত রোডের মধ্যিখানে হোটেলটা। কাউন্টারে বসে ছিল এক বৃদ্ধ শিখ। বিনা বাক্যব্যয়ে ওরা তার হতভম্ব দৃষ্টির সামনে দিয়ে দোতলায় উঠে গেল। উঠেই ডান দিকে একটা তালা দেওয়া ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল ওরা। অরিন্দম বলল, দূর্বাদি, তুমি পাশের ঘরটা দ্যাখো। খুব সম্ভব দু’ঘরে দু’জন আছে।
এই সময় হোটেলের মালিক ও একটি জোয়ান লোক ছুটে এল। অরিন্দম ইঙ্গিত করতেই জিত আর পৃথ্বীশ লোকটির দু’পাশে গিয়ে দাঁড়াল। চিতাবাঘের মতো লাফিয়ে উঠে অরিন্দম তার ঘাড়ের নীচে একটা জায়গা টিপে দিল। তৎক্ষণাৎ সে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল। অরিন্দম ধরে না ফেললে দুম্ করেই পড়ে যেত, মাথায় লাগত ভীষণ। অরিন্দম বলল, - এর নাম ‘অ্যানেস্থেটিক হোল্ড’, এইভাবে তিব্বতে সার্জারি করে ওরা।
রিভলভার তাক করে হোটেল-মালিককে বলল তিস্তা, - কর্তার সিং, যতই পাকা দাড়ি, পাকা মোচ আর সাদা পাগড়ি লাগাও, তোমায় আমি চিনে ফেলেছি। দরজা দুটো খুলে দাও, নইলে খুলি উড়িয়ে দেব।
কর্তার সিং কাঁপতে-কাঁপতে পকেট থেকে চাবির গোছা বার করে পরপর দরজা দুটো খুলে দিল এবং পরক্ষণেই একটা হুইসল মুখে পুরে তীব্র ফুঁ দিল। প্রথম ঘরটার মধ্য থেকে অর্ধমৃত মুফিকে ততক্ষণে বুকে তুলে নিয়েছে দূর্বা। দ্বিতীয় ঘরটা থেকে হাত-পা বাঁধা র্যাচেলকে মুক্ত করে পাঁজাকোলা করে নেমে যাচ্ছে তিস্তা। সাত-আটজন পুলিশ কনস্টেবল এসে ঘিরে ধরল চার বন্ধুকে।
কর্তার সিং বলল, - এই ছেলেগুলো মাঝরাত্তিরে আমার হোটেলে হামলা করছে। বোর্ডারদের ওপর বিস্তর উপদ্রব করছে খামোখা।
পৃথ্বীশ বলল, - বেশ তো, চলুন না। আমাদের যা বলবার আছে একেবারে আপনাদের ডি. আই. জি. মিঃ খান্নার কাছেই সব বলব।
জিতের হাতে যন্তর-মন্তর তখনও ফিসফিস করে চলেছে, -ডেঞ্জার, ডেঞ্জার।
অরিন্দমকে হঠাৎ কেমন চুপচাপ হয়ে যেতে দেখল জিত। ওর মতো উঠে পড়ল কালো ভ্যানে। পুলিশ-ভ্যান যতক্ষণ ওদের থানায় নিয়ে যাচ্ছে ততক্ষণে দেরাদুন-মুসৌরি রোড ধরে তীব্রবেগে ছুটে চলেছে তিস্তাদের ল্যান্ডরোভার। স্টিয়ারিংয়ে তিস্তা। পাশে মুফিকে কোলে নিয়ে দূর্বা, পেছনের সিটে শুয়ে আছে র্যাচেল। কিছুক্ষণ পরই যে আর-একটা ল্যান্ডতরোভার ওদের পিছু নিল, সেটা লক্ষ্য করে তিস্তা গাড়ির স্পিড সাঙ্ঘাতিক বাড়িয়ে দিল।
নিজের ঘরে তিনখানা টেলিফোন আর অজস্র ফাইলে পরিবৃত হয়ে বসে ছিলেন মিস্টার খান্না। ওদের চারজনকে দেখে বললেন, - আমার অনুমান ঠিকই মিলেছে তা হলে। এবার শ্রীঘরে বাস করবে চলো চার ওস্তাদ। পয়লা ক্রাইম, অভিভাবকদের ধোঁকা দিয়ে হোস্টেল থেকে একজনের পলায়ন। বাকি তিনজনের কুপরামর্শে এবং সাহায্যে, দুসরা ক্রাইম, মাঝরাত্তিরে ভদ্রলোকের হোটেলে হামলা করা। বাকি ক্রাইমগুলো আস্তে-আস্তে সাক্ষ্য-প্রমাণ সহযোগে যথাসময়ে কোর্টে হাজির করা হবে।
ওদের কোনও কথা, কোনও কৈফিয়তই শোনা হল না।
চোদ্দ
মুসৌরির ওয়েসাইড হোটেলে মাঝরাত্তিরে আনন্দ-মজলিস বসেছে। ছোট্ট মুফিয়া তার শাহিন মায়ের কোলে ঘুমোচ্ছে দুধ খেয়ে। শাহিন এক মুহূর্তের জন্যও তাকে কাছছাড়া করতে চাইছে না। ডাক্তারের পরামর্শে ওকে দু’ঘণ্টা অন্তর অল্প-অল্প করে দুধ, ফলের রস ইত্যাদি খাইয়ে যেতে হবে। র্যাচেল একটা ডিভানে আধশোয়া হয়ে রয়েছে। তাকে দুধের সঙ্গে ব্র্যাণ্ডি খেতে দেওয়া হয়েছে আপাতত। চিকেন স্যুপ এবং চিপসের অর্ডার গেছে। এমন অবস্থা তার যে, কঠিন খাদ্যবস্তু খুব ধীরে-ধীরে সইয়ে-সইয়ে না খাওয়ালে বমি করে ফেলবে। গায়ের রঙ ফ্যাকাশে। ওজন এত কমে গেছে যে, তিস্তা বলেছে, ওকে পাঁজাকোলা করে বয়ে আনতে একটি বারো তের বছরের মেয়েকে বয়ে আনার চেয়ে বেশি কষ্ট ওর হয় নি।
ফাদার জোনাথন ও জগজিৎ চোপরা এসে ঘরে ঢুকলেন। উঠে দাঁড়িয়ে তাঁদের অভ্যর্থনা করলেন আলিসাহেব। অরিন্দম এবং অন্যান্যদের ফিরে পাওয়া গেছে এই মর্মে তাঁদের সংবাদ পাঠিয়েছিলেন তিনি। ঘটনাচক্রে হোস্টেলের গেস্টরুমে তখন অবস্থান করছিলেন জগজিৎ চোপরা। ঘটনার জটিলতার কথা তাঁকে কিছু বলা হয়নি। তিনি শুধু জানেন অরিন্দম ক’দিনের জন্য কাউকে কিছু না বলে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল।
হঠাৎ ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকলেন মিস্টার খান্না। চকিতে সবাইকার দিকে চোখ বুলিয়ে নিলেন। তারপর হাত দুটো ঘষতে লাগলেন খুব আত্মপ্রসাদের সঙ্গে।
- বসুন খান্নাসাহেব, বেগম আলি বললেন।
- আমার হেড কোয়ার্টারে খবর গিয়েছিল, সঙ্গে-সঙ্গে ছুটে এসেছি।
মিঃ খান্না সোৎসাহে বললেন, যেন নিরুদ্দিষ্টদের উদ্ধার-করার কৃতিত্বটা ওঁরই।
- তবে এই দুটি মেয়ের অসমসাহসের জন্যেই শেষ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া গেল মিঃ আলি, আপনার নাতি আর এই বোর্ডারটিকে। স্বীকার করতেই হবে। আমার জাল আমি গুটিয়ে আনছিলাম ঠিকই।
কিন্তু কম্ম ফতে করেছে মেয়ে দুটি, স্বীকার করতেই হবে। খান্না শেষ পর্যন্ত উদারভাবে বললেন, - মিঃ আলির এগিয়ে দেওয়া কফির পাত্রটা নিতে-নিতে।
র্যাচেল বলল, - ঠিকই, মিঃ খান্না। আপনি কতদূর এগিয়েছিলেন জানি না। ওরা কিন্তু ঠিক করেছিল মুফিকে কোনও নিঃসন্তান সুইডিশ দম্পতির কাছে অনাথ ভিখিরির বাচ্চা বলে বেচে দেবে। সত্যি-সত্যি ভিখিরি-বাচ্চা ধরলে বাচ্চাগুলোরও সদগতি হত, ওদেরও কোনও অসুবিধে হত না। কিন্তু সুইডিশগুলোর কোনও বাস্তব জ্ঞান নেই। ওদের ব্রুনেট অর্থাৎ কালো চুল, কালো চোখ ভারী অপছন্দ, তাই অনেক খুঁজে-খুঁজে ওদের সোনালি বা তামাটে-চুল বাচ্চা ধরতে হত। এরকম শিশু ওরা বহু জোগাড় করেছে ভারতের নানা শহর থেকে। মুফির মতো সোনালি-চুল নীল-চোখ বাচ্চাদের জন্য ওরা বহু ডলার মূল্য পায়। কিন্তু একটা মুশকিল আছে। সুইডিশরা তো চুরি করা বাচ্চা চায় না। চায় সত্যি সত্যি অনাথ বাচ্চাদের, যারা ভাল করে খেতে পায় না। ম্যালনিউট্রিশনে ভুগছে। তাই ওরা এই আট দশদিন মুফিকে শ্রেফ গ্লুকোজ ওয়াটার খাইয়ে রেখেছে।
- জানেন খান্নাসাব, জানেন আলিকাকা, আমার বেলায় ওদের ব্যবস্থা ছিল সামান্য অন্যরকম। আমি তো আর বাচ্চা নই যে, কোনও নিঃসন্তান বিদেশী দম্পতি আমায় দত্তক নেবে! তাই ওরা ঠিক করেছিল ওদের ব্যবসার আর-একটা শাখায় আমায় কাজে লাগাবে। আমার পেট-টেট চিরে পাকস্থলী, ইনটেসটিন, লিভার ইত্যাদি সব বার করে নিয়ে সে-জায়গায় ঠেসে দেবে নিরেট সোনা, কিংবা কোকেন, কোনটা আমি জানি না অবশ্য। নাটকটা হল মার্কিন হিপি মেয়ে ইন্ডিয়া বেড়াতে এসেছিল, সাপ, বাঘ আর বিষাক্ত জলের দেশে বেচারি মারা গেছে স্বাভাবিক ভাবে। তাই তার মৃতদেহ তার বাবা-মা’র কাছে আমেরিকায় ফেরত পাঠানো হচ্ছে, এই আর কি! কী চমৎকার মঞ্চসজ্জা, সিচুয়েশন তৈরির কায়দা বলুন তো?
- দূর্বাদির নিকষ কালো রঙ, তিস্তার বাঙালি চেহারা আর বিখ্যাত মুখের জন্য ওদের দিয়ে এটা সম্ভব ছিল না, তাই-ই আমাকে বেছে নিলেন, না মিঃ খান্না? সোনালি চুল দুলিয়ে, ফ্যাকাশে ঠোঁটে ঈষৎ হেসে বলল র্যাচেল। তার গলায় বিন্দুমাত্র উত্তেজনা নেই।
মিস্টার খান্না অন্যমনস্ক হয়ে বললেন, - ঠিক ঠিক। পরক্ষণেই প্রচণ্ড উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়ে দারুণ রেগে চিৎকার করে উঠলেন, - কী, কী বললে তুমি মিস মিডফোর্ড?
- ঠিকই বলেছি খান্নাসাব। জ্ঞান হয়ে থেকে আমাদের কটেজ পিয়ানোর একানব্বইখানা চাবির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় কিনা আমার। কান পুরোপুরি তৈরি। পার্টিশনের ওধার থেকেই হোক আর বোরখার আড়াল থেকেই হোক আপনার হেঁড়ে গলা কোন্ সুরে বলে বুঝতে আমার ভুল হয় না। আমার কান কখনও ভুল সাক্ষ্য দেবে না। আমাদের গাড়িটা আপনি শত চেষ্টাতেও ধরে ফেলতে পারলেন না!
তিস্তা বিদ্যুদ্বেগে উঠে দাঁড়িয়েছে। হাতে রিভলভার। বলল, - পেছন থেকে দূর্বা মিত্র আপনাকে কভার করছে খান্নাসাহেব, পালাবার চেষ্টা করবেন না। আমাদের চারটি বালক-বন্ধুকে কোথায় রেখে এলেন? এই মুহূর্তে টেলিফোনে তাদের নিরাপত্তা এবং অবিলম্বে এখানে পৌঁছনোর ব্যবস্থা না করলে আপনার সমূহ বিপদ।
আপনার মতো ঘৃণ্য, নৃশংস, জানোয়ারের ঠ্যাং চিরকালের মতো খোঁড়া করে দিলে সরকার নিশ্চয়ই খুশি হয়ে আমাদের যুগল পদ্মশ্রী উপাধি দেবে।
সামনে তিস্তা পেছনে দূর্বা ঠেলতে ঠেলতে টেলিফোনের কাছে নিয়ে গেল খান্নাকে। দেরাদুন থানায় সংক্ষিপ্ত নির্দেশ দেওয়ার পরে কাঁপতে-কাঁপতে চেয়ারে এসে বসল খান্না। তারপর ঝাড়া দু-ঘণ্টা প্রতীক্ষা। মধ্যে শুধু একবার হতভম্ব ফাদার জোনাথন জিজ্ঞেস করলেন, - অরিন্দমকে কি সত্যিই পাওয়া গেছে?
জগজিৎ চোপরা বললেন, - এই বাচ্চাটি আর এই মেয়েটির সঙ্গে অরিকেও কি এরা কিড্ন্যাপ করেছিল? অ্যায়াম গেটিং কনফিউজড।
কেউ ওঁদের কথার কোনও জবাব দিল না। র্যাচেল অবিচলিতভাবে একটা বিরাট বক্তৃতা দিয়ে এখন নেতিয়ে পড়েছে। তাকে চামচ করে চিকেন স্যুপ খাইয়ে দিচ্ছেন বেগম আলি। তিস্তার নির্দেশে আলিসাহেব ফোন করলেন দিল্লির স্বরাষ্ট্র দফতরে। সেখানকার ফার্স্ট সেক্রেটারি তিস্তার বাবার বন্ধু।
নীচে গাড়ির শব্দ। তারপরই ঘরে ঢুকল চার বন্ধু। সুনৃত ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এসে বলল, - মাই গড্, য়ু আর সেফ দেন। র্যাচেল, হোপ য়ু আর ওকে!
ওরা লক্ষ করেনি জিত তখনও চৌকাঠে। অরিন্দম ঘরে ঢোকেইনি। জগজিৎজি ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, - অরি কই? অরি? তুমি নাকি কাউকে না বলে কোথায় চলে গিয়েছিলে? দেখলে তো, দুর্বত্তদের হাতে পড়ে তোমার কী হয়রানিটাই হল?
ওরা সবাই দেখল অরিন্দম হঠাৎ পিছিয়ে যাচ্ছে। মুখে গভীর যন্ত্রণার ছাপ। জিত পাশে গিয়ে দাঁড়াল। অরিন্দম বলল, - জিত, মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। একটার পর একটা তরঙ্গ আসছে। সামলাতে পারছি না। প্লিজ, আমায় তোরা ছেড়ে দে। টলতে টলতে পিছু হঠতে শুরু করল অরিন্দম। তারপরই মুখ ফিরিয়ে দে ছুট। এত দ্রুত ঘটে গেল ব্যাপারটা যে বাধা দেওয়া তো দূরের কথা, কেউ কোনও কথা পর্যন্ত বলতে পারল না। জিত ওর পেছন-পেছন দৌড়ল। ওর পিছনে দৌড়লেন পৃথ্বীশ, সুনৃত, চোপরা, ফাদার জোনাথন।
অনেক পেছনে পড়ে আছে লাইব্রেরি বাজার। নির্জন রাস্তা। দু’পাশে শুধু দেওদার। রাতের অন্ধকার মেখে সব নিশ্চুপ।
অনেকটা গিয়ে অরিন্দম দাঁড়িয়ে পড়ল। ফিসফিস করে বলল, - দূরে ওই ডান দিকে তাকিয়ে দ্যাখ জিত। ওরা বলেছিল ওরা আসবে। কথা রেখেছে, ওরা এসেছে।
জিত দেখল, অনেক দূরে একটা কাচের প্লেটের মতো সাদা আলোর উপবৃত্ত অন্ধকারে ঝকঝক করছে।
অরিন্দম বলল, - আমার তো একস্ট্রা সেনসরি পার্সেপশন, তার ওপর লামারা সার্জারি করে দুই ভুরুর মাঝখানে তৃতীয় একটা চোখ খুলে দিলেন। সিক্সথ্ সেন্স্ও বলতে পারিস। দুষ্ট চিন্তা-তরঙ্গ আগে শুধু অনুভব করতে পারতুম, এখন আর সহ্যই করতে পারছি না। আমাকে চলে যেতে হবে জিত, নইলে এই আমার শেষ।
ততক্ষণে বাকিরা আরও কাছে এগিয়ে এসেছেন। - ওই দ্যাখ, বিষণ্ণ গলায় অরিন্দম বলল আবার, - আঙ্কল চোপরা, বানর আর ব্যাঙের সঙ্গে-সঙ্গে আজকাল লোকের কোলের ছেলেও চুরি করে চালান দিতে শুরু করেছেন। জ্যান্ত-মানুষের শরীরের কল-কব্জা বার করে তার মধ্যে সোনা বা নার্কোটিকস্ পুরে বিদেশে পাঠাবার অভিনব ফন্দি বার করেছেন। এই মানুষটি আমার কাকা, আমার একমাত্র আপনজন। অরিন্দম দু’হাতে নিজের চুলের মুঠি আঁকড়ে ধরল।
দূর থেকে মৃদু বাঁশির মতো একটা আওয়াজ ভেসে এল। অরিন্দম, বলল, - ওরা জিবুস নামে বহু আলোকবর্ষ দূরের কোনও গ্রহ থেকে আমায় নিতে এসেছেন। আঙ্কল চোপরার ব্যাপারে তোরা যা হয় করিস। আসি জিত। তোর কাছে যন্তর-মন্তরটা রইল। কোনও না কোনও সময়ে.....।
গোল চাকার মতো আলোটার সামনে জিত দেখল, তিনটি অস্বাভাবিক দীর্ঘ কায়া। আলোর বিপরীতে দাঁড়াবার ফলেও তাঁদের দেহের কোনও অংশ কিন্তু কালো দেখাচ্ছে না। পুরোপুরি জমাট আলো দিয়ে গড়া যেন। অরিন্দম চিৎকার করে উঠল, - আমার কাছ থেকে সরে দাঁড়া জিত।
বলতে না বলতেই টর্নেডোর মতো একটা প্রচণ্ড আশ্চর্য হাওয়ার চোঙা অরিন্দমকে প্রায় শূন্যপথে যেন শুষে নিয়ে চলে গেল। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই নিবে গেল আলোর চাকতি। অদৃশ্য হয়ে গেল আলোর মানুষ এবং অরিন্দম৷ আকাশের অনেক জ্যোতিষ্কের মধ্য দিয়ে শুধু ছুটে চলল আরও একটি জ্যোতিষ্ক; জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের আকাশচিত্রে যার ঠিকানা নেই। ছুটে চলল কোন্ দূর উদ্দেশে কে জানে!
মুসৌরির পথের ওপর তখন কতকগুলি বিমূঢ় মানুষকে ঘিরে শেষ রাতের হালকা অন্ধকার।
(শেষ)
শেকল-তোলা ঘরটার মধ্যে কী ছিল তা জানা নেই। মুফি ছিল নির্ঘাত। পাশের ঘরটার আসবাবপত্র ছিল অন্যরকম। অন্ধকার চোখে সয়ে গেলে অনেক কষ্টে ঘাড় সামান্য কাত করে ও দেখল, ওর ডান দিকের খাটে দূর্বাদি, বাঁ দিকের খাটে র্যাচেল। সর্বনাশ, এরা কী করে এল! কোথায় ও ভাবছিল দূর্বাদি এতক্ষণে মুসৌরি থানা তছনছ করে ফেলছে ওর জন্যে! দু’জনে একই ভাবে বাঁধা। ঘুমোচ্ছে। দূর্বাদির আবার ফুররর ফুররর করে নাক ডাকছে। আশ্চর্য! ওদের কি ঘুমের ওষুধ খাইয়েছে? নিশ্চয়ই!
চাপা গলায় তিস্তা ডাকল, - র্যাচেল, র্যাচেল! দূর্বাদি। কোনও সাড়া নেই। মড়ার মতো ঘুমোচ্ছে দু’জনে। কিন্তু এইভাবে আওয়াজ করায় একটা বিতিকিচ্ছিরি ফল হল। ঘরের একটা অন্ধকার কোণ থেকে আপাদমস্তক বোরখায় ঢাকা একটা ভয়াবহ নারীমূর্তি উঠে দাঁড়াল। নিঃশব্দে তিস্তার বাঁ দিকে এসে দাঁড়াল। মুখে কোনও কথা নেই, তারপর দুটো কর্কশ হাত বেরিয়ে এসে তিস্তার বাঁ বাহুতে একটা ছুঁচ ফুটিয়ে দিল। খুব আনাড়ি হাত। তিস্তার ভীষণ লাগল। মুখ দিয়ে শুধু উঃ বলে একটা আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই করতে পারল না। অসহায়ের মতো ইঞ্জেকশনটা নিল এই কথা ভাবতে ভাবতে যে, রহস্য-গল্পের গোয়েন্দাদের অলৌকিক ক্ষমতার শতাংশের একাংশও ওর নেই। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই ওর চেতনা সম্পূর্ণ লোপ পেয়ে গেল।
সাত
রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর জিত ওর ডেস্ক থেকে গোলকটা বার করল। এটা ওরা পালা করে-করে এক-একজনের কাছে রাখবে স্থির করেছে। আজ জিতের পালা। রঙ্গচারীর পকেট থেকে ছাড়া পেয়েই জিনিসটা আবার আন্দাজ বারো মিলিমিটার ব্যাসের একটা গোলকে পরিণত হয়েছে। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে পরীক্ষা করতে করতে জিতের হঠাৎ খেয়াল হল, একটা কালো বোতাম অন্য বোতামগুলোর থেকে একটু দূরে রয়েছে। সেটা টেপার সঙ্গে-সঙ্গে টেলিফোনের ডায়াল-টোনের মতো একটা মৃদু আওয়াজ হতে লাগল যন্ত্রতে। কালোর পরেই একটা সোনালি বোতাম। সেটাও টিপল জিত। সঙ্গে-সঙ্গে একটা অদ্ভুত কাণ্ড হল। গোলকের ভেতরটা কীরকম একটা নরম আলোয় ভরে গেল। তার মধ্যে খুব আবছাভাবে অরিন্দমের মুখ ভেসে উঠল। কীরকম অদ্ভুত অরিন্দম। চুলগুলো ছোট-ছোট, চোখ দুটো অস্বাভাবিক জ্বলজ্বল করছে। কপালের মাঝখানে একটা গভীর ভাঁজের মতো কাটা দাগ। জিত সঙ্গে সঙ্গে একটা ছোটখাটো বৈদ্যুতিক শকের মতো কিছু অনুভব করল। গোলকের অরিন্দম বলল, - জিত, প্লিজ, আমার যন্তর-মন্তরটা দিয়ে দে।
জিত বলল, - এটা তোর? তুই করেছিস?
অরিন্দম হাসল, - করেছিও বলতে পারিস, করিনিও বলতে পারিস।
- রহস্য রাখ। এটা তো আশ্চর্য যন্ত্র। কী কাজ এটার?
- বুঝতে পারছিস না? ওটা থট্ ট্রান্সমিটার। তোর সঙ্গে আমার চিন্তার যোগাযোগ ঘটিয়ে দিয়েছে যন্ত্রটা৷
- কীভাবে এটা করলি, অরি?
- পরে বলব। এখন ওটা দিয়ে দে।
- কীভাবে দেব? কোথা থেকে তুই কথা বলছিস?
- দ্রেবুং লামাসারি থেকে। লাসা।
- কী বললি?
- যা বললুম, তা বললুম। সে যাই হোক, সেখানে তো তুই আসতে পারছিস না। কালো বোতামের পেছনে একটা সাদা বোতাম আছে সেটা টেপ। যন্ত্রটাই তোকে ঠিক জায়গায় নিয়ে যাবে। শোন্। কালো বোতামটা টিপলে তবে যন্ত্র চালু হয়, সোনালি বোতামটা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার উপায়। আচ্ছা এবার যাই ভাই, সি ইউ।
অরিন্দমের মুখটা স্ফটিকের আলোর বৃত্তে হারিয়ে গেল৷ জিত প্রথমটা হতভম্ব হয়ে রইল। তারপর অরিন্দমের কথামতো সাদা বোতামটা টিপল। কিছুক্ষণ পরে ও অনুভব করল কিছু যেন একটা ওকে চুম্বকের মতো টানছে। স্থির থাকতে দিচ্ছে না। ও সন্তর্পণে করিডরে বেরিয়ে এল। করিউরের আলো রাতের মতো নিবে গেছে। সুনৃত, পৃথ্বীশকে ডাকবে নাকি? ডাকা উচিত। ওরা তিনজনে মিলে অরির খোঁজ করবে। মুফির অনুসন্ধান করবে। তিস্তাদিদের সাহায্য করবে, এই স্থির হয়েছিল। ওর একা যাওয়া মানে স্বার্থপরতা। পৃথ্বীশের কিউবের দিকে যাচ্ছে, কিন্ত চুম্বকের মতো সেই টানটা ওকে ডাইনিং-হলের দিকে টানতে লাগল। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই সেদিকে এগিয়ে গেল ও। আস্তে করে দরজার খিল খুলল। ভেজিয়ে দিয়ে কিচেন-গার্ডেন থেকে একটা ভারী পাথর নিয়ে এসে দরজার গায়ে ঠেসে দিল। নইলে সারা রাত দরজাটা হা-হা করবে। ঠাঁই ঠাঁই আওয়াজ করবে।
ঠাণ্ডা তারা-জ্বলা রাত। আকাশ থেকে হিম ঝরছে, জিত স্লিপিং সুটের ওপর শুধু ওর স্কুলের ব্রেজারটা চাপিয়ে নিয়েছে। মাথা খালি। ওর ঢেউ-খেলানো নরম চুল ভেদ করে ঠাণ্ডাটা কাঁচের মতো বিঁধছে। অদৃশ্য একটা চুম্বক ওকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আশ্চর্য! ওই তো তিব্বতি রেস্তোরাঁ শিগাৎসি। উলটো দিকের পাকদণ্ডী দিয়েই তো ওরা সেদিন নেমেছিল! হুড়হুড় করে নেমে যাচ্ছে জিত! যেন নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই। দূরে দেখা যাচ্ছে একটা কাঠের বাড়ি। তিন-কোনা মাথাটা। তিব্বতি ভাষায় কিছু লেখা দরজার মাথায়। কাঠের দরজা সামান্য ঠেলতেই খুলে গেল। লম্বা প্যাসেজ। জিত এগিয়ে চলেছে। কোথাও কেউ নেই। একটা চৌকোনো উঠোন। তার তিনদিকে ঘর, একদিকে একটা খোলা গুহামুখের মতো, তার দু’দিকে দুটো বু্দ্ধমূর্তি। ধর্মচক্রমুদ্রায় বসে আছেন। মঙ্গোলীয়-মুখ বুদ্ধ। ঘরের ভেতর সম্পূর্ণ অন্ধকার। শুধু এক কোণে একটা বাতি জ্বলছে। প্রথমে ঢুকে কিছু দেখতে পায়নি জিত। তারপর বাতির আলোয় দেখতে পেল একটা লম্বা কাঠের পাটাতন। তার ওপর একজন লামা শুয়ে।
কাছে এগিয়ে জিত বিষ্ময়ে স্থাণু হয়ে গেল। পাটাতনের ওপর শায়িত লামা আর কেউ নয়। তারই প্রিয় বন্ধু অরিন্দম চোপরা। যেন ঘুমোচ্ছে। দু’হাত দু’দিকে বুকের সঙ্গে লেগে রয়েছে। পরনে লামার লাল পোশাক। চুল ছোট-ছোট করে ছাঁটা। দুই ভুরুর মাঝে কপালে একটা গভীর কাটা দাগ, যেমন যন্তর-মন্তরে দেখেছিল। কিন্তু অরিন্দমের বুকে কোনও ওঠা-পড়া নেই। যেন ওর নিশ্বাস পড়ছে না। প্রচণ্ড উদ্বেগে জিত তক্ষুনি হাঁটু গেড়ে বসল। অরিন্দমের একটা হাত তুলে নিতে গেল। হঠাৎ গুরুগম্ভীর একটা কণ্ঠস্বরে গুহার নিস্তব্ধতা ভেঙে খানখান হয়ে গেল। - ওকে ছুঁয়ো না। সর্বনাশ হয়ে যাবে তোমার বন্ধুর। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কেউ বলল। শিউরে দাঁড়িয়ে পড়ল জিত।
পিছন দিকে একটা নিচু দরজা দিয়ে একটা ঘরের একাংশ দেখা যাচ্ছে। মেঝেতে পদ্মাসনে বসা একজন লামা। তিনি বেরিয়ে আসতে-আসতে কোনও অদৃশ্য ব্যক্তিকে লক্ষ করে বললেন, - চোমো, তোমাকে বহুবার বলেছি এখান থেকে নড়বে না। আরেকটু হলেই কী সর্বনাশ হত বলো তো! জিতের দিকে চেয়ে বললেন, - তুমি এখানে এলে কী করে? আগুন নিয়ে খেলা করছ ? অরিন্দম চোপরার এই বডির কথা কাউকে বলবে না। বললে ওরই বিপদ হবে।
জিতের আর সহ্য হল না, বলল, - লজ্জা করে না আপনাদের? ওকে আপনারা মেরেছেন, তারপর নিজেদের স্বার্থ-সিদ্ধির জন্য বডিটাকে এইভাবে প্রিজার্ভ করে রেখেছেন। তান্ত্রিক-টান্ত্রিক জাতীয় লোকেরা শবসাধনা করে শুনেছি। আমি আপনাদের নামে পুলিশে রিপোর্ট করব গিয়ে।
জিত লক্ষ করেনি ওর দু’পাশে দুই ষণ্ডামার্কা লামা কখন এসে দাঁড়িয়েছে। প্রধান লামার চোখের নির্দেশে মুহূর্তে একজন জিতের ঘাড়ের নীচের একটা জায়গা টিপে দিল: জিত দেখল ও আর নড়তে পারছে না, সমস্ত শরীর অসাড়। আস্তে-আস্তে ওকে বসিয়ে দিল লামারা। দ্বিতীয়জন এইবার ওর দুই ভুরুর মাঝখানে একটা জায়গা দু’আঙলে টিপে ধরল। প্রথমে জিত লাল-নীল নানা রঙের খেলা দেখতে লাগল চোখের সামনে। তারপর আস্তে-আস্তে কীরকম একটা চিনচিনে অনুভূতি তার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে লাগল।
চিনচিনে ভাবটা কমে গেলে জিত একটা বড় অদ্ভুত জিনিস দেখতে পেল। ও দেখল, ঘরের আসবাবগুলো সব ছায়া-ছায়া। ওর সামনে অরিন্দমের শায়িত দেহ। ঠিক তেমনি নিস্পন্দ নিথর হয়ে শুয়ে আছে। কিন্তু কী আশ্চর্য! তার ওপর যেন হাওয়ায় ভাসছে আরেকটা অরিন্দম। দুই অরিন্দমের মাঝখানে একটা সূক্ষ্ম রূপোলি সুতো। ভাসমান অরিন্দম আস্তে-আস্তে গুম্ফার ছাদে গিয়ে ঠেকল। হাত নেড়ে একটা বিদায়ের ভঙ্গি করল। তারপর ছাদের কাঠের সিলিং ভেদ করে জিতের দৃষ্টির বাইরে চলে গেল।
লামা দু’জন ততক্ষণে তার ঘাড়ের নীচে এবং ভুরুর মাঝখানের জায়গা দুটো ডলতে আরম্ভ করেছে। প্রধান লামা বললেন, - শুধু তোমাকে আশ্বস্ত করবার জন্য অরিন্দমকে সুদূর লাসা থেকে আনাতে হল। সুক্ষ্ম শরীরে ও সেখানে অনেক কিছু শিখছে। স্থূল শরীরটার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছে ওই রুপোলি সুতো। ওর শরীরটা নাড়াচাড়া করলে সুতো ছিঁড়ে যেতে পারে। ও আর শরীরে ফিরে আসতে পারবে না। এ-কথা কাউকে বোলো না। বহু যুগ পরে আমাদের গুপ্তবিদ্যা দিয়ে যাবার উপযুক্ত পাত্র পেয়েছি। বাধা দিও না। পৃথিবীর মঙ্গল হবে।
জিতকে একটা কাঠের পাটাতনে শুইয়ে দেওয়া হল। লামা গম্ভীর গলায় বললেন, - পো-চা-কে-শো। আরেকজন লামা বাটিতে করে কী একটা তরল বস্তু সামনে রাখলেন। স্বহস্তে চামচ করে বস্তুটা জিতকে খাইয়ে দিতে-দিতে প্রধান লামা বললেন, - এই মাখন-চা খেয়ে নাও। শরীরে বল ফিরে পাবে।
জিনিসটা খেতে খুব বিশ্রী হলেও খাবার পর জিত সত্যিই একটু সুস্থ বোধ করল। সেই অসাড় ভাবটা একদম কেটে যাচ্ছে। তিনজন মিলে ওকে সাবধানে তুলে ধরে গুম্ফার বাইরে বার করে দিলেন। তখনই জিতের খেয়াল হল যন্তর-মন্তরটাকোথায়? সেটার টানেই তো এখানে আসা। সেটা এখানে দিয়ে গেলেই তো অরিন্দম পেয়ে যাবে। ও-ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, - আমি অরিন্দমের একটা জিনিস দিতে এখানে এসেছিলাম। ওই আমায় আসতে বলেছিল।
লামারা তিনজনেই ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। প্রধান লামা বললেন, - কী জিনিস? জিত বর্ণনা-দিল জিনিসটার। ওঁরা তিনজন ঢুকে গিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজলেন জিনিসটা। একটু পরে ফিরে এসে বললেন, - কোনও জিনিসই তাঁরা গুম্ফার ভেতরে দেখতে পাননি। পেলে অরিন্দমকে নিশ্চয় দিয়ে দেবেন। জিত রাতের অন্ধকারে হোস্টেলের পথ ধরল।
আট
পৃথ্বীশ আর সুনৃত ঘুম থেকে উঠে ব্রেকফাস্ট খেয়ে নিয়েছে। স্নান টান সেরে খুব ঝরঝরে লাগছে শরীরটা। সনৃত বলল, - জিত কিন্তু ঘরে নেই। নিশ্চয়ই আমাদের আগেই উঠে বেরিয়ে গেছে। চল্, ল্যাবে যাই। কতকাল কাজকর্ম করি না।
এই সময়ে ক্লাস-টেন-এর গুরবচন সিং ও চাওলা বলে দুটি ছেলে এসে বলল, - ফাদার ওদের ডেকে পাঠিয়েছেন। আজ ফাদার জোনাথনের ঘরে দু’জন পুলিশ অফিসার এসেছেন। ফাদার ওদের দেখিয়ে বললেন, - এই যে, এদের কথাই বলছিলাম মিঃ খান্না। পৃথ্বীশ, এরা দেরাদুন থেকে আসছেন, তারপর বললেন, - জিত কই?
পৃথ্বীশ বলল, - জিত বোধহয় আমাদের আগেই উঠেছে, জগিংয়ে বেরিয়ে গেছে।
একটি অফিসার বাঁকা হাসি হেসে বললেন, - শুনলাম তোমরা নাকি মিসিং চোপরার অন্তরঙ্গ বন্ধু। অথচ সে হারিয়ে যাওয়ায় তোমাদের মনে কোনও উদ্বেগ আছে বলে তো মনে হচ্ছে না? য়ু আর অভিয়াসলি ফলোয়িং ইয়োর ডেইলি রুটিন?
সুনৃত বলল, - মনের উদ্বেগের জন্যে আমাদের ডেইলি রুটিনে বাধা পড়ে না, স্যার।
পৃথ্বীশ বলল, - দুটোকে ডিটাচ করার শিক্ষা স্কুলই আমাদের দিয়েছে।
সুনৃত হেসে বলল, - তা ছাড়া আপনাদের মতো এফিসিয়েন্ট পুলিশ অফিসার থাকতে অরিন্দমের কোনও বিপদের আশঙ্কা আমরা করি না। মাত্রই তো সাতদিন হল হারিয়েছে আমাদের বন্ধু। বছর-খানেকের মধ্যে খুঁজে বার করতে পারবেন আশা করি!
ফাদার হাত তুলে বললেন, - ব্যস, ব্যস, যথেষ্ট হয়েছে বয়েজ।
অফিসারটি চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, - যদি বলি তোমাদের বন্ধুটি কোথায় কী উদ্দেশ্যে গা-ঢাকা দিয়েছে তোমরা খুব ভাল করে জানো? যদি বলি তোমরা তাকে এখনও সাহায্য করে চলেছ?
সুনৃত বলল, - বেশ তো! য়ু আর ফ্রি টু ফলো আস। পেছনে টিকটিকি লাগান।
- জানো, তোমরা যা করেছ তার জন্য কী ধরনের শাস্তি হতে পারে? গলা প্রচণ্ড চড়ছিল লোকটির।
ফাদার অস্বস্তি বোধ করছিলেন। তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠানে নিজের ছাত্রদের তিরস্কার করার দায়িত্ব আর কেউ নিক, স্বভাবতই এটা তাঁর পছন্দ। নরম সুরে বললেন, - ওরা সে ধরনের ছেলে নয় মিঃ খান্না, অরিন্দমের ব্যক্তিগত জীবন, অভ্যাস, পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কে কিছু বলতে পারবে বলেই ওদের এখানে ডাকিয়েছি।
- আপনি জানেন না ফাদার, খান্না নামের অফিসারটি চোখ লাল করে গর্জন করে উঠল, - এই রকম অকালপক্ক দায়িত্বজ্ঞানহীন ছেলেদের জন্য আমাদের দেশে জুভেনাইল ক্রাইম কী রেটে বেড়ে যাচ্ছে। স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল তো দূরের কথা, এদের বাপ-কাকা পর্যন্ত জানে না এদের উর্বর মস্তিষ্কে কখন কী ক্রাইমের প্ল্যান খেলছে। আপনি জানেন না মোটামুটি এই একই সময়ে এই মুসৌরি শহরে একটি বাচ্চা এবং একটি তরুণী মেয়েও কিডন্যাপড হয়েছে। এই ছেলে ক’টিকে আমরা ক’দিন ধরেই শ্যাডো করছি। উই আর অলমোস্ট শিওর যে, এরা চোপরার হোয়্যারআ্যাবাউটস্ জানে।
শেষের দিকে দুই বন্ধুর কান খাড়া হয়ে উঠেছিল। বাচ্চাটা তো মুফি। কিন্তু একটি তরুণী মেয়েও অন্তর্ধান করেছে, এটা জানত না। সুনৃত পৃথ্বীশের দিকে চাইল না। পৃথ্বীশ নিশ্চই এখন বোকার মতো ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ওদের সেই চোখ চাওয়া-চাওয়ির কী ব্যাখ্যা দেবে এই অভব্য অফিসারটি, ভগবান জানেন!
আরও কিছুক্ষণ জেরা চলল। মনে হল, ফাদার ভেতরে-ভেতরে খুব বিরক্ত হয়েছেন। তিনি বললেন, - আচ্ছা মিঃ খান্না, আপাতত ছেলে দুটিকে আমি যেতে দিচ্ছি, আবার নতুন কোনও দরকার হলেই ওরা আপনার কাছে হাজির হবে।
বাইরে এসে পৃথ্বীশ বলল, - তরুণীটি আবার কে রে?
সুনৃত বলল, আমি তো তিনজন তরুণীর কথা জানি। দূর্বাদিরা তিনজন রাতে ফেরেনি আলিকাকা বলছিলেন না? এই অফিসারটি যেমন অপদার্থ, তেমন অসভ্য। তার ওপর মিস্ইনফর্মড। আবার আমাদের ভয় দেখাতে এসেছে। চল্ তো ওয়েসাইডে যাই।
পৃথ্বীশ বলল, - ফাদারের কাছে যখন ডাক পড়ল আমি কিন্তু ভেবেছিলাম আঙ্কল চোপরা।
- এটা তো ভাল মনে করিয়েছিস বন্ধু। সুনৃত বলল, - চোপরার ‘চোপ রও’ কিন্তু এখনও আরম্ভ হয়নি। কেন বল তো?
ওয়েসাইড হোটেলে এসে ওরা দেখল ভীষণ কাণ্ড। পুলিশে পুলিশ। আলিকাকা জবানবন্দি ইত্যাদি নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। শাহিনের কাছেই শুনল ওরা ব্যাপারটা। আজ ভোরে আলিকাকা বাইরের দরজা খুলতেই নাকি দুম করে দুটো লাশের মতো কী যেন পড়ে যায়। আলিকাকা ভয় পেয়ে তাঁর ভৃত্য বিরখাবাহাদুরকে ডাকেন। দু’জনে দেখেন মানুষ দুটি তিস্তা আর দূর্বা। পরশুদিন যে পোশাকে বেরিয়েছিল এখনও পরনে সেই ব্লু জিন্স, সেই রঙিন কার্ডিগান। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত চেহারা। তাদের ধরাধরি করে এনে শুইয়ে দেওয়া হয়। সারা শরীরে আবার আ্যাল্কোহলের গন্ধ। যারা কুকীর্তিটি করেছে তারা বোধহয় প্রমাণ করতে চায়, মেয়ে দুটি মাতাল-টাতাল হয়ে বাড়ি ফেরেনি। স্পষ্ট কোনও ঘুমের ওষুধ ইনজেক্ট করা হয়েছে ওদের শরীরে। ঘণ্টাখানেক আগে ঘুম ভেঙেছে, কড়া কালো কফি খাওয়ানো হয়েছে বড়-বড় মগে। এখনও ঘোর পুরোপুরি কাটেনি। র্যাচেল ওদের সঙ্গে নেই।
পৃথ্বীশ বলল, - তরুণীটি কে এবার বুঝলি তো সুনৃত?
সুনৃত বলল, - হুঁ।
এখানে আপাতত থাকার কোনও মানে হয় না। পুলিশে ঘিরে রেখেছে দূর্বাদি আর তিস্তাদিকে। অথচ কৌতূহলও প্রচণ্ড। শাহিনদি কেঁদে-কেঁদে মুখখানাকে বোলতার চাকের মতো ফুলিয়ে ফেলেছে।
মনটা ওদের ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। ওরা বেরিয়ে যাচ্ছে, চৌকাঠ পেরোতেই মিঃ খান্নার মুখোমুখি। বাঁকা হাসি হেসে বললেন, - এই যে, খুনি অকুস্থলেই ফিরে এসেছে। বাঃ বাঃ!
বাইরে এসে রাগে ফেটে পড়ল পৃথ্বীশ, - কী মনে করেছে লোকটা? খুনি? অকুস্থল? আমরা কাকে খুন করলুম?
সুনৃত বলল, - চেপে যাও বন্ধু। লোকটা যে-কোনও কারণেই হোক আমাদের প্রচন্ড অপছন্দ করছে এবং ইচ্ছে করে রাগিয়ে দিচ্ছে।
তিস্তার মতো শক্ত মেয়ে একেবারে হাউহাউ করে কাঁদছিল। তাদের জ্ঞান ফিরেছে। নিজেদের ফিরে আসার বৃত্তান্ত অন্যের মুখে শুনেছে। কিভাবে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনে ও দোকানের ভেতরে যায় এবং ধরা পড়ে। তিস্তা ভেতরে যাবার পর নাকি চিনেম্যানটি দূর্বা ও র্যাচেলকে চা দিয়ে আপ্যায়িত করে, - চাইনিজ গ্রিন তি মিস, দিস ইজ দি বেস্ত তি উই ক্যান গেত হিয়াল। ওরা ভাবে সময়টা কাটাতে হলে বোধহয় চা খাওয়াই ভাল। শিখ এবং চিনেটিও নিজেদের জন্যে চা আনায়। দূর্বা আবার কায়দা করে শিখের সঙ্গে নিজের কাপ বদলাবদলি করে নিয়েছিল। তা সত্ত্বেও চা খাওয়ার কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই ওদের হাত-পা ঝিমঝিম করতে থাকে। বড়-বড় হাই ওঠে। কখন ঘুমিয়ে পড়েছে ওরা নিজেরাই জানে না। ঘুম ভাল করে ভেঙেছে আজ। কিন্তু তিস্তার চোখের জল আর বাধা মানছিল না। র্যাচেল মিডফোর্ড তার কতদিনের বন্ধু। কলকাতার ওয়াই-ডবলু-সি-এ-তে টেবিলটেনিস খেলতে গিয়ে আলাপ। খুব বুদ্ধি মেয়েটার। তিস্তার মতো লড়িয়ে না হলেও এই বুদ্ধির জন্য ওকে তারিফ করে তিস্তা। ও কী করে র্যাচেলের মা’র কাছে মুখ দেখাবে?
কী ভয়ানক এই দুর্বৃত্তরা! মুফির মতো শিশুকে নিয়েছে, র্যাচেলকে নিল। কী উদ্দেশ্য ওদের? ওদের তিনজনকেই বন্দী করে রাখতে পারত। যা হবার একসঙ্গে হত। বেচারি র্যাচেল। ভিতুর একশেষ। ভয়েই তো ও মরে যাবে।
দূর্বা অনেকক্ষণ ধরে তিস্তার কান্না শুনছিল। বলল, - তুই তো জানিস তিস্তা, সব সমস্যারই একটা-না-একটা সমাধান আছে। পুলিশ ঘড়ি দোকান রেইড করতে গেছে, র্যাচেলকে আমরা নিশ্চয়ই ফিরে পাব, বিপদের সময়ে এরকম অধৈর্য হয়ে পড়লে চলে?
নয়
ওয়েসাইড হোটেলের দরজায় যখন দূর্বাদের ঘুমন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়, তখন র্যাচেল মুখ শুকনো করে একটা অন্ধকার ঘরের কড়িকাঠের দিকে চেয়েছিল। দিন কি রাত বোঝার উপায় নেই। ঘরের মধ্যে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। হাতের রেডিয়াম-ডায়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখল পাঁচটা দশ। যদি বিকেল হয় তা হলে সার্কাস অ্যাভিনিউয়ের খুদে একতলা ফ্ল্যাটটা থেকে ওর ভাই ভ্যাল টেনিস র্যাকেট হাতে করে বেরিয়ে যাচ্ছে। মা ঘরে তালা দিয়ে জলি-আন্টির বাড়ি টিভি দেখতে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। ছেলে মেয়েকে নিয়ে বেচারির শখের অন্ত নেই। মায়ের ধারণা ছেলে অন্তত একটা দ্বিতীয় কৃষ্ণান তো হবেই! মেয়েও হবে নাম-করা গাইয়ে। ডরিস ডে’র মতো ভরাট মিষ্টি গলাখানা। অন্যান্য অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান মায়ের মতো আই সি এস ই পাশ করা মাত্রই মেয়েকে স্টেনো-টাইপিস্ট করে তোলার চেষ্টা করেননি তিনি। র্যাচেল কলেজে পড়ছে। পিয়ানো শিখছে। গান গাইছে। ভবিষ্যৎ ডরিস ডে’র কী করুণ অবস্থা।
ওদিকের ঘরটাতে কারা যেন কথা বলছে! ঘরটাতে কি পার্টিশন? প্রথম দিকে শুধু গলার আওয়াজ পাচ্ছিল র্যাচেল। তারপর একজনের গলা বোধহয় তকাতর্কির জন্যে একটু চড়ল। অন্য গলাটাও। র্যাচেল শুনতে পেল স্পষ্ট, - ওইটুকু শরীরে আর কতটুকু মাল ধরবে? ধাড়িটাকে তো ওইজন্যেই রেখে দিলুম।
- কিন্তু সুইডিশগুলো তো বেগার-চিলড্রেন চাইছে। তুমি তো জানো বাচ্চাটাকে দেখে ওরা বিশ্বাস করবে না সেটা। ওজন নেবে, নানারকম ডাক্তারি পরীক্ষা করাবে। ম্যালনিউট্রিশনের সিমটম না হলে আমাদের ভোগাবে কিন্তু সেবারের মতো।
- হুঁ, সাহেবি ন্যাকামির কথা বাদ দাও তো। জীবনে কখনও থার্ড ওয়ার্ডে পা দেয়নি। ইন্ডিয়ার বেগার-চিলড্রেন কী জিনিস তা জানে?
ব্লন্ড না হলে পছন্দ হয় না। কালো চুল দেখলেই খুঁত-খুঁত করবে, দেখে-দেখে সিন্ধি-পার্শিদের বাচ্চাগুলো ধরতে হয় তা ছাড়া এতদিনেও কি যথেষ্ট ম্যালনিউট্রিশন হয়নি?
- তা অবশ্য। চি-চি করছে বাচ্চাটা। আর কাঁদতেও পারছে না। জাস্ট প্রাণধারণের মতো ক্যালোরিটুকু দিয়ে যাচ্ছি। তা হলে কলকাতা আর কানপুরের লটটার সঙ্গে মিক্স করে ওকে..
- হ্যাঁ, আর ধাড়িটার ইনসাইডে মাল যাবে। ডাঃ মালহোত্রাকে ইমিডিয়েটলি কেবল করো। দেরি করে লাভ নেই।
র্যাচেল শক্ত কাঠ হয়ে রইল। বাচ্চাটা কে? মুফি? তাকে সুইডেনে পাঠাবে? নিঃসন্তান দম্পতির কাছে ভিখিরি-বাচ্চা বলে বিক্রি করতে? আর ধাড়িটা কে? ও নিজে? ওর ইনসাইডে মাল যাবে? র্যাচেলের মনে হল, ভয়ে ও এক্ষুনি অজ্ঞান হয়ে যাবে। উঃ। তিস্তা কোথায়? দূর্বাদি? দূর্বাদি? ঘরে অন্ধকার একটু-একটু করে পাতলা হচ্ছে। র্যাচেল দেখল অনেক উঁচুতে একটা তারের জাল দেওয়া জানলা। এইবার ওই জানলাপথে একটু-একটু করে সকালের আলো আসছে। আসবাবপত্রহীন, সিমেন্টের মেঝে-অলা একটা ন্যাড়া ঘরে সে একটা তক্তাপোশের ওপর শুয়ে আছে। হাত এবং পা-জোড়া করে বাঁধা। খুব দুর্বল লাগছে। নড়তেই বাঁ দিকের বাহুটা টনটন করে উঠল। ইনজেকশনের ব্যথা। ওরা তা হলে ওকে একটার-পর-একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখছে?
র্যাচেল দাঁত দিয়ে হাতের বাঁধন কাটতে চেষ্টা করল। হঠাৎ বাইরে তালা খোলার শব্দে নিশ্চুপ অনড় হয়ে গেল। বাইরের দরজা সামান্য খুলে বোরখা-পরা একজন কেউ ঢুকল। হাতে একটা প্লেট আর গ্লাস। তক্তাপোশের একদিকে জিনিসগুলো নামিয়ে রাখল মহিলাটি। র্যাচেল তখনও কাঠ হয়ে পড়ে আছে। চোখ বোজা, নিশ্বাস প্রায় বন্ধ। বোরখাধারিণী ওকে নাড়াল খানিকটা। তারপর আপনমনে বলল, - ঘুম ভাঙেনি এখনও দেখছি। ভালই হল। ডাঃ মালহোত্রা আসা পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকলে ভালই হয়।
র্যাচেল হতভম্ব, কারণ, কণ্ঠস্বর পুরুষের। জিনিসগুলো র্যাচেলের পাশে নামিয়ে রেখে বোরখাধারী পুরুষটি বেরিয়ে গেল। বাইরে তালা লাগানোর আওয়াজ হল আবার। র্যাচেল ভাবল, গোয়েন্দা-গল্পের নায়িকা হলে সে এতক্ষণে হাত-পায়ের বাঁধন খুলে ঘুমের ভান করে পড়ে আছে। লোকটা নিচু হওয়া মাত্র জোড়া-পায়ের আঘাতে তাকে ধরাশায়ী করে খোলা দরজা দিয়ে পালাচ্ছে। হরিণের মতো ছুট লাগাচ্ছে যতক্ষণ না থানায় পৌঁছয়।
এই সময়ে পাশের ঘরে আবার গুনগুন শুরু হল। - অর্গানগুলোর আ্যাপ্রক্সিমেট ওজন জানা চাই।
- সেইমতো মাল।
এইসব কথা মাঝে-মধ্যে শুনতে পেয়ে প্রচণ্ড ভয়ে চোখ বুজল র্যাচেল।
দশ
বাইরের দিকে উদাস চোখে তাকিয়ে নিজের কিউবে বসে ছিল জিত। বাইরে কিছু বাঁদর-বাঁদরি বাচ্চা নিয়ে খেলা করছে। দিনের আলো এখন নিবে আসছে। আজ সারাদিন ও ঘর থেকে বার হয়নি। চুপচাপ একা-একা কাটিয়েছে। বন্ধুরা ওর রাত্রির অভিজ্ঞতার কিচ্ছু জানে না। সেজন্য কেমন একটা অপরাধবোধ ওর মনের মধ্যে জন্ম নিয়েছে। এই গোপনীয়তার ভার ওকে একলাই বহন করতে হবে। লামা বলেছেন, গোপন না করলে অরিন্দমের সমূহ বিপদ। এখন ও, যা দেখেছে, শুনেছে, ওর বিশ্বাস হতে চাইছে না সেটা। দুটো অরিন্দম! একটা মৃতের মতো শুয়ে, আর-একটা কাঠের সিলিং ভেদ করে অনায়াসে চলে গেল? কী অদ্ভুত! বোঝাই যাচ্ছে, অরিন্দম যেখানে গেছে স্বেচ্ছায় গেছে। যা করছে স্বেচ্ছায় করছে। কিন্তু মুফিরা? পৃথ্বীশদের কাছে শুনেছে দূর্বাদি ও তিস্তাদি ফিরেছে। যে কারণেই হোক দুর্বৃত্তরা ওদের ফিরিয়ে দিয়ে গেছে। দূর্বাদি ওস্তাদ অ্যাথলিট। তিস্তা মুখার্জির নাম একডাকে সবাই চেনে৷ কাগজে ছবি দেখে। এখানে ওকে দেখামাত্র চিনে ফেলেছিল ও। কিন্তু র্যাচেল মিডফোর্ড নামের ওই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়েটি ফেরেনি। এইসব ব্যাপারের সঙ্গে অরিন্দমের অন্তর্ধানের কোনও যোগ আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। যত দূর মনে হয়, বড় লামা ওর ওপর খুব অসন্তুষ্ট নন, বেশ কিছু অলৌকিক ক্ষমতাও ধরেন, ওকে এই বিপদটার কথা বলে ওর সাহায্য নেওয়া যায় না! তবে কাজটা করতে হবে সম্পূর্ণ একা। সে শপথ নিয়েছে, গুপ্ত-কথা ফাঁস করবে না।
অন্ধকার গাঢ় হওয়ামাত্র জিত বেরিয়ে পড়ল। পৃথ্বীশরা গেছে ওয়েসাইডে। ও শরীর খারাপের অজুহাতে এড়িয়ে গিয়েছিল। বন্ধুদের বাদ দিয়ে এভাবে কিছু করতে ওর বিবেকে বাধছে। কিন্তু কী আর করা যাবে? পাকদন্ডী দিয়ে নামতে লাগল জিত। দ্রুত। একটা বুনো এপ্রিকট গাছ ওর দিকচিহ্ন। এইখানটায় দাঁড়িয়ে তিব্বতি গুম্ফায় যাবার দিক ঠিক করতে হবে ওকে। কারণ, তিনটে পায়ে-চলা পথ নীচের দিকে নেমে গেছে। হঠাৎ ওর পায়ে কী একটা শক্তমতো ঠেকল। জিত নিচু হয়ে দেখল, আশ্চর্য! অরিন্দমের যন্তর-মন্তর। নিজের হাতে এটা ও গত রাতে গুম্ফায় নিয়ে যায়। সম্ভবত যখন ওরা জুডো না কিসের প্যাঁচে ওকে চলচ্ছক্তিরহিত করে দেয়, তখনই জিনিসটা হাত থেকে পড়ে যায়। অথচ কোনও শব্দ শুনতে পেয়েছে বলে ও মনে করতে পারল না। কারও পায়ে লাগেনি। জিনিসটা কি আপন খেয়ালেই গড়াতে-গড়াতে চড়াই ভেঙে এইখানে চলে এসেছে?
মাধ্যাকর্ষণের শক্তিকে কি উপেক্ষা করতে পারে অরিন্দমের যন্ত্রটা? ভিজে ঘাস থেকে সন্তর্পণে তুলে নিল ও যন্ত্রটাকে। রুমালে মুছল, যদিও মোছার কিছু ছিল না। কেননা একফোঁটা জল বা ধুলোও যন্ত্রের গায়ে লেগে নেই। কালো বোতাম টিপল জিত। করকর্-করকর্ করে ডায়ালটোনের মতো শব্দটা হতে লাগল। সোনালি বোতাম টিপল। কিছু হল না। খারাপ হয়ে গেল নাকি যন্তর-মন্তর? কেমন যেন মরিয়া হয়ে লাল বোতাম টিপল ও। সঙ্গে সঙ্গে একটা অদ্ভুত কাণ্ড হল। গোধূলির মতো একটা আলো জ্বলল ভেতরে। সে যেন পৃথিবীর গোধূলি নয়, অদ্ভুত, অপার্থিব একটা আলো, কোনও আকৃতি দেখা গেল না। খালি স্পষ্ট সুরে জিত শুনতে পেল, - হাই, হোয়াটস্ রং ?
জিত বলল, - এভরিথিং।
- এক্সপ্লেন।
জিত খুব উত্তেজিত স্বরে জানাল, মুফি আর র্যাচেলের হারিয়ে যাওয়ার কথা। এবার যন্ত্র বলল, - ওয়েট। একটু পরেই আবার বলল, - দে আর আ্যাট দেরাদুন। সুন উইল বি প্যাকড অফ্ টু ডেলহি। র্যাচেল উইল বি কিল্ড্ বাই টুমরো আফটারনুন ইফ নো স্টেপস আর টেক্ন্। ডেঞ্জার। গ্রেভ ডেঞ্জার। রিপোর্টিং টু অরিন্দম। টেক দি আর্লিয়েস্ট বাস টু দেরাদুন। উইল বি ইনস্ট্রাকটেড।
জিত যন্তর-মন্তর পকেটে পুরে দৌড়ল। ম্যাল রোডের ওপরে উঠে রিকশ নিল এটা। - জলদি চলো লাইব্রেরি বাজার বাসস্ট্যাণ্ড। তখুনি ছাড়ছিল দেরাদুনের শেষ বাস। একরকম লাফিয়ে উঠল জিত।
এগারো
পুলিশ যখন ‘রোজা’ নামের ঘড়ির দোকানটা রেইড করতে যায় তখন পৃথ্বীশ আর সুনৃত উপস্থিত ছিল তিস্তাদের বিশেষ অনুরোধে। কিন্তু ওদের নির্দেশমতো কোনও দোকান তো দূরস্থান, ওই আকৃতির কোনও দোকানই ওখানে পাওয়া গেল না। তিস্তা বলেছিল, বাঁ দিকে একটা ধাবা ছিল, তড়কা রুটি বিক্রি হয়, ডাইনে ডাইং-ক্লিনিং। মাঝখানে সরু একচিলতে দোকান। নির্দিষ্ট স্থানে পুলিশ গিয়ে দেখে, একটা মস্ত সাইনবোর্ড টাঙানো, রেডিমেড কাপড়ের দোকানের। কাউন্টার, ফার্নিচার, প্যানেল ইত্যাদি বসানো হচ্ছে, পালিশ হচ্ছে। ছুতোরদের মারফত মালিকের পাত্তা পাওয়া গেল আড়াই ঘণ্টা পরে।
এই জায়গাটা নাকি পাঁচ বছরের জন্য লিজ দেওয়া ছিল একজন শিখকে। কর্তার সিং তার নাম। তিনদিন আগে লিজ শেষ হয়ে যাওয়ায় মালিক তার জায়গাটা ফেরত পেয়েছে, এবং দোকান বসাচ্ছে। কর্তার সিং-এর ঠিকানা, হোশিয়ারপুর, পঞ্জাব।
দূর্বা ও তিস্তাকে তৎক্ষণাৎ পুলিশ-জিপে চাপিয়ে আনানো হল। তারা হতভম্ব। একটা দোকানকে দোকানই যে টুকরো-টুকরো হয়ে লোপাট হয়ে যেতে পারে, এটা তাদের কারও ধারণার মধ্যেই ছিল না। সবাই মিলে দোকানের পেছনে গিয়ে গাদাগুচ্ছের কাঠের পার্টিশন ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায়নি। তখনকার মতো মুসৌরি পুলিশ থানায় ফিরে গেল। কর্তার সিংয়ের খোঁজে হোশিয়ারপুরে জরুরি পুলিশ-ফোন যাচ্ছে। ওয়েসাইড হোটেলে তখন শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
বারো
অন্ধকার ক্রমেই ঘন হয়ে উঠছে। কোণের ঘরে শাহিনকে ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িবে রাখা হয়েছে। আনোয়ার ফিরেছে দিল্লি থেকে। বাচ্চাটা মুফি নয়। দিল্লিরই কোনও পঞ্জাবি-তনয়, খেলতে-খেলতে হারিয়ে গিয়েছিল। বেগম আলি শয্যা নিয়েছেন। মুকতার আলিসাহেব ঢাকা-বারান্দায় নিজস্ব চেয়ারটি পেতে চুপ। তাঁর সামনে টেবিলের ওপর বোর্ডারদের বিল-সংক্রন্ত স্তূপীকৃত কাগজ তিনি ওখানেই বসেন, ওখানেই ঘুমোন।
রাত আন্দাজ দশটা তিস্তা ও দূর্বাকে জোর করে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। তিস্তার ঘুম আসছে না। যদিও দূর্বার নাক ডাকছে। যে-কোনও বিপদের সময়ে মাথা ঠাণ্ডা রাখার প্রশংসনীয় ক্ষমতা আছে দূর্বার। কী করে যে এই পরিস্থিতিতে ওর নাক ডাকে! হঠাৎ ঘরের মধ্যে একটা তীব্র ধূপ-ধূপ গন্ধ পেয়ে তিস্তা উঠে বসল। বেড-সুইচটা টিপতেই অবাক হয়ে দেখল, ওর শয্যার পাশে একজন তরুণ লামা দাঁড়িয়ে৷ চুল ছোট-ছোট করে ছাঁটা, পরনে লামাদের লাল পোশাক। দুই ভুরুর মাঝখানে একটা খাঁজের মতো লম্বাটে দাগ।
- আপনি তিস্তা মুখার্জি? রাইফেল-শুটিংয়ে ফার্স্ট প্রাইজ পাচ্ছেন ক বছর ধরে?
- হ্যাঁ।
- সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র কিছু আছে?
- দুটো রিভলভার আছে।
- আপনার সঙ্গিনী রিভলভার ব্যবহার করতে পারেন নিশ্চয়ই?
- ওঁকে জাগিয়ে দিয়ে আমার সঙ্গে তাড়াতাড়ি আসুন মুফদ্দর ও র্যাচেল মিডফোর্ডকে যদি বাঁচাতে চান।
দূর্বার ততক্ষণে ঘুম ভেঙে গেছে। সে উঠে চিৎকার করতে যাচ্ছিল। লামাটি বলল, - আমার নাম অরিন্দম চোপরা! আমি খুব খারাপ ভাইব্রেশন টের পাচ্ছি। সমস্ত মুসৌরি শহর দুক্কৃতিকারীতে ভরে গেছে। তাদের নেতা সবচেয়ে বড় শয়তান, সেও এখন এখানেই। ভাগ্য ভাল থাকলে তাকেও আমরা ধরতে পারব। পাঁচ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে নিন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমন্ত ওয়েসাইড-এর দরজা থেকে একটা ল্যান্ডরোভার ছুটে চলল। গ্রিন হিল কনজারভেটরির সামনে এসে থামল গাড়িটা। দ্রুতপায়ে নেমে গেল অরিন্দম। পৃথ্বীশ আর সুনৃত তখন ঘুমে অচেতন। জানলায় উপর্যুপরি টোকার শব্দে ঘুম ভাঙল ওদের। - আমার সুটকেস থেকে জিনস্ শার্ট আর একটা পুলোভার নিয়ে ডাইনিংহলের দরজাট! খুলে দে শিগগিরই। প্রশ্ন করিস না, বলল অরিন্দম।
একটু পরেই তিন বন্ধু ডাইনিংহলের দরজা খুলে বাইরের হিম-ঝরা অন্ধকারে বেরিয়ে পড়ল। - দেরাদুনের লাস্ট বাস কোনও একটা টোল-স্টেশনে ব্রেকডাউন হয়েছে। তাতে আটকে পড়ে আছে জিত। ওকে তুলতে হবে।
সুনৃত বলল, - বলিস কী। জিত দেরাদুনের বাসে?
অরিন্দম বলল, - রাগ করিস না সুনৃত, আমার যন্তর-মন্তরের নির্দেশে ও ছুটেছে দেরাদুনের দিকে। লক্ষ্য একই। মুফদ্দর ও র্যাচেলকে বাঁচানো৷ তোদের সঙ্গে যোগাযোগ করার ওর সময় ছিল না। তোদের নিয়ে যাবার ভার পড়েছে আমার ওপর।
তৃতীয় স্টেশনেই জিতকে ধরতে পারল ওরা। জিতকে দেখাবার জন্যই গাড়ি থেকে নেমে আলোর দিকে এগিয়ে গিয়েছিল ওরা। জিত গাড়ি দেখেই ছুটতে-ছুটতে আসতে থাকে, - আমাকে একটু দেরাদুনে নামিয়ে দেবেন? না গেলেই নয়.., বলতে-বলতেই বিপুল বিস্ময়ে ও বন্ধুদের দিকে চাইল। স্টিয়ারিংয়ে অরিন্দমকে দেখে ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে ছোট ছেলের মতো কাঁধে মাথা রাখল জিত। বলল, - তুই সত্যি-সত্যি বেঁচে আছিস অরি?
- নয় তো কী? যন্তর-মস্তরটা পেয়ে গেছিস তো আবার?
- হ্যাঁ, কিন্তু কি করে জানি না।
লামারা ওটা আমায় নিতে দিলেন না রে, বললেন, - আমরা তোমায় জীবন্ত যন্তর-মন্তর বানাচ্ছি, যন্ত্র নিয়ে তুমি কী করবে? তোমার বন্ধুর দরকার হবে। ওকে দিয়ে দাও। ও যেখানে পাবে সেখানেই রেখে আসছি যন্ত্রটা।
তিস্তারা কিছুই বুঝছিল না। অবাক হয়ে শুধু শুনছিল। জিত পকেট থেকে যন্তর-মন্তরটা বার করে তিস্তার হাতে দিল। যেতে-যেতে যথাসম্ভব ব্যাখ্যা করে জিনিসটা বুঝিয়ে দিচ্ছিল অরিন্দম, - তোরা তো জানিস কিছুদিন ধরেই বিষাক্ত চিন্তার ওয়েভ দ্বারা পরিবেশ-দূষণ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিলুম আমি। তোরা যেটা জানতিস না সেটা হল আমার কতকগুলো একস্ট্রা-সেন্সরি পার্সেপশনের ক্ষমতা ছিল। কোনও লোকের সংস্পর্শে এলে আমি কতকগুলো সূক্ষ্ম কম্পন টের পেতাম। আমার মন বুঝে নিত সেগুলো ভাল কি মন্দ। অর্থাৎ লোকটার চিন্তার তরঙ্গ-আমাকে আঘাত করত। এর থেকেই আমার মাথায় আসে শব্দের যেমন তরঙ্গ আছে, চিন্তারও তেমন তরঙ্গ আছে। ই.ই.জি যন্ত্রে জানিস তো অস্বাভাবিক ব্রেন-ওয়েভ ধরা পড়ে! এ-ও কতকটা তাই। তবে আরও অনেক সূ্ক্ষ্ম। আমার ধারণা হয়, চিন্তা-তরঙ্গ সাধারণ শ্রবণগ্রাহ্য শব্দ-তরঙ্গের থেকেও অনেক অনেক কম হার্টজের কোনও শব্দ-তরঙ্গ। চিন্তা-তরঙ্গ ধরবার একটা যন্ত্র তৈরি করা ক্রমশ আমার ধ্যানজ্ঞান হয়ে ওঠে। দিল্লির মার্কেট থেকে, তা ছাড়াও নিউ ইয়র্ক থেকে কাকাকে দিয়ে সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম ইনটিগ্রেটেড কিট ইত্যাদির বহু কল-কব্জা আনাই। ছোট্ট-খাট্টো একটা থট-ট্রান্সমিটার তৈরি করাই আমার উদ্দেশ্য ছিল। এক একটা চ্যানেল ধরতে পারলে এক-এক ধরনের চিন্তা-তরঙ্গ আমার আয়ত্তে আসবে এই আর কি!
- একদিন সফলও হলাম। নিজের চিন্তা নিজের কানে শুনতে পেলাম। তারপর একদিন বড় অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল। আরও নানারকম আনআইডেনটিফায়েড থট-ওয়েভ ধরতে-ধরতে হঠাৎ একদিন কী ধরলাম জানি না। যন্ত্রটা আমার চোখের সামনে বদলে যেতে লাগল। বাইরের পলিথিন কেসটা একরকম অদ্ভুত রকমের হয়ে যেতে লাগল। ভেতর থেকে একটা আলোর সঙ্গে-সঙ্গে একটা জলদ্গম্ভীর আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল, - হোয়াটস রং ম্যান, হোয়াটস রং? অ্যানাদার ওয়র ইন হুইচ ইউ প্রোপোজ টু কিল ওয়ান অ্যানাদার? স্পিকিং ফ্রম জিবুস স্পিকিং..।
- আমি তো অবাক। শুধু বলতে পারলাম, চারদিকে ইভ্ল ভাইব্রেশন টের পাচ্ছি। কিছু বুঝতে পারছি না, বড় বিপদ।
- স্বরটা বলল, - ঠিক আছে,যত শীঘ্র সম্ভব হেল্প পাঠাচ্ছি। তারপর কখন সুইচ টিপে জিনিসটা আমি বন্ধ করে দিয়েছি নিজেই জানি না। তাই বলছিলাম এটা আমার তৈরি বলতে পারিস, আবার না-ও বলতে পারিস। আসলে আরম্ভ করে ছিলুম আমি, তারপর কীভাবে ওই অজানা গ্রহ জিবুসের কোনও থট-ওয়েভ ধরে ফেলে যন্ত্রটা! তারই প্রভাবে ওটা পালটে গিয়ে নিজেই নিজেকে তৈরি করে নিয়েছে। এটা ঘটে একটা শুক্রবার।
জিত বলল, - লামাদের সঙ্গে তোর যোগাযোগ হল কী করে?
- থট-ওয়েভ ধরতে ধরতেই লামা মিঙ্গির সেনচেনের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়। উনি লাসার দ্রেবুং মঠের অধ্যক্ষ। ওঁর নির্দেশ অনুযায়ী এখানকার লামারা আমাকে সূক্ষ্ম শরীর ধারণ করতে শিখিয়ে দেন। সূক্ষ্ম শরীরে দ্রেবুং মঠে গিয়ে আমি অনেক কিছু শিখেছি যা বোধহয় এবার কাজে লাগাতে পারব।
জিত বলল, - দ্বিতীয়বার যন্তর-মস্তর পেয়ে যখন তোর সঙ্গে যোগাযোগ করবার চেষ্টা করলাম, তখন পেলাম না কেন?
- নিশ্চয়ই তখন হিপনোটিক ট্রান্স বা সম্মোহক নিদ্রায় ছিলাম। ওইভাবেই অল্পসময়ে অনেক জিনিস শেখায় ওরা তিববতে।
তেরো
দেরাদুনে পৌছে যন্তর-মন্তর এবং অরিন্দম একই দিকে নির্দেশ দিতে লাগল। রাজপুত রোডের মধ্যিখানে হোটেলটা। কাউন্টারে বসে ছিল এক বৃদ্ধ শিখ। বিনা বাক্যব্যয়ে ওরা তার হতভম্ব দৃষ্টির সামনে দিয়ে দোতলায় উঠে গেল। উঠেই ডান দিকে একটা তালা দেওয়া ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল ওরা। অরিন্দম বলল, দূর্বাদি, তুমি পাশের ঘরটা দ্যাখো। খুব সম্ভব দু’ঘরে দু’জন আছে।
এই সময় হোটেলের মালিক ও একটি জোয়ান লোক ছুটে এল। অরিন্দম ইঙ্গিত করতেই জিত আর পৃথ্বীশ লোকটির দু’পাশে গিয়ে দাঁড়াল। চিতাবাঘের মতো লাফিয়ে উঠে অরিন্দম তার ঘাড়ের নীচে একটা জায়গা টিপে দিল। তৎক্ষণাৎ সে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল। অরিন্দম ধরে না ফেললে দুম্ করেই পড়ে যেত, মাথায় লাগত ভীষণ। অরিন্দম বলল, - এর নাম ‘অ্যানেস্থেটিক হোল্ড’, এইভাবে তিব্বতে সার্জারি করে ওরা।
রিভলভার তাক করে হোটেল-মালিককে বলল তিস্তা, - কর্তার সিং, যতই পাকা দাড়ি, পাকা মোচ আর সাদা পাগড়ি লাগাও, তোমায় আমি চিনে ফেলেছি। দরজা দুটো খুলে দাও, নইলে খুলি উড়িয়ে দেব।
কর্তার সিং কাঁপতে-কাঁপতে পকেট থেকে চাবির গোছা বার করে পরপর দরজা দুটো খুলে দিল এবং পরক্ষণেই একটা হুইসল মুখে পুরে তীব্র ফুঁ দিল। প্রথম ঘরটার মধ্য থেকে অর্ধমৃত মুফিকে ততক্ষণে বুকে তুলে নিয়েছে দূর্বা। দ্বিতীয় ঘরটা থেকে হাত-পা বাঁধা র্যাচেলকে মুক্ত করে পাঁজাকোলা করে নেমে যাচ্ছে তিস্তা। সাত-আটজন পুলিশ কনস্টেবল এসে ঘিরে ধরল চার বন্ধুকে।
কর্তার সিং বলল, - এই ছেলেগুলো মাঝরাত্তিরে আমার হোটেলে হামলা করছে। বোর্ডারদের ওপর বিস্তর উপদ্রব করছে খামোখা।
পৃথ্বীশ বলল, - বেশ তো, চলুন না। আমাদের যা বলবার আছে একেবারে আপনাদের ডি. আই. জি. মিঃ খান্নার কাছেই সব বলব।
জিতের হাতে যন্তর-মন্তর তখনও ফিসফিস করে চলেছে, -ডেঞ্জার, ডেঞ্জার।
অরিন্দমকে হঠাৎ কেমন চুপচাপ হয়ে যেতে দেখল জিত। ওর মতো উঠে পড়ল কালো ভ্যানে। পুলিশ-ভ্যান যতক্ষণ ওদের থানায় নিয়ে যাচ্ছে ততক্ষণে দেরাদুন-মুসৌরি রোড ধরে তীব্রবেগে ছুটে চলেছে তিস্তাদের ল্যান্ডরোভার। স্টিয়ারিংয়ে তিস্তা। পাশে মুফিকে কোলে নিয়ে দূর্বা, পেছনের সিটে শুয়ে আছে র্যাচেল। কিছুক্ষণ পরই যে আর-একটা ল্যান্ডতরোভার ওদের পিছু নিল, সেটা লক্ষ্য করে তিস্তা গাড়ির স্পিড সাঙ্ঘাতিক বাড়িয়ে দিল।
নিজের ঘরে তিনখানা টেলিফোন আর অজস্র ফাইলে পরিবৃত হয়ে বসে ছিলেন মিস্টার খান্না। ওদের চারজনকে দেখে বললেন, - আমার অনুমান ঠিকই মিলেছে তা হলে। এবার শ্রীঘরে বাস করবে চলো চার ওস্তাদ। পয়লা ক্রাইম, অভিভাবকদের ধোঁকা দিয়ে হোস্টেল থেকে একজনের পলায়ন। বাকি তিনজনের কুপরামর্শে এবং সাহায্যে, দুসরা ক্রাইম, মাঝরাত্তিরে ভদ্রলোকের হোটেলে হামলা করা। বাকি ক্রাইমগুলো আস্তে-আস্তে সাক্ষ্য-প্রমাণ সহযোগে যথাসময়ে কোর্টে হাজির করা হবে।
ওদের কোনও কথা, কোনও কৈফিয়তই শোনা হল না।
চোদ্দ
মুসৌরির ওয়েসাইড হোটেলে মাঝরাত্তিরে আনন্দ-মজলিস বসেছে। ছোট্ট মুফিয়া তার শাহিন মায়ের কোলে ঘুমোচ্ছে দুধ খেয়ে। শাহিন এক মুহূর্তের জন্যও তাকে কাছছাড়া করতে চাইছে না। ডাক্তারের পরামর্শে ওকে দু’ঘণ্টা অন্তর অল্প-অল্প করে দুধ, ফলের রস ইত্যাদি খাইয়ে যেতে হবে। র্যাচেল একটা ডিভানে আধশোয়া হয়ে রয়েছে। তাকে দুধের সঙ্গে ব্র্যাণ্ডি খেতে দেওয়া হয়েছে আপাতত। চিকেন স্যুপ এবং চিপসের অর্ডার গেছে। এমন অবস্থা তার যে, কঠিন খাদ্যবস্তু খুব ধীরে-ধীরে সইয়ে-সইয়ে না খাওয়ালে বমি করে ফেলবে। গায়ের রঙ ফ্যাকাশে। ওজন এত কমে গেছে যে, তিস্তা বলেছে, ওকে পাঁজাকোলা করে বয়ে আনতে একটি বারো তের বছরের মেয়েকে বয়ে আনার চেয়ে বেশি কষ্ট ওর হয় নি।
ফাদার জোনাথন ও জগজিৎ চোপরা এসে ঘরে ঢুকলেন। উঠে দাঁড়িয়ে তাঁদের অভ্যর্থনা করলেন আলিসাহেব। অরিন্দম এবং অন্যান্যদের ফিরে পাওয়া গেছে এই মর্মে তাঁদের সংবাদ পাঠিয়েছিলেন তিনি। ঘটনাচক্রে হোস্টেলের গেস্টরুমে তখন অবস্থান করছিলেন জগজিৎ চোপরা। ঘটনার জটিলতার কথা তাঁকে কিছু বলা হয়নি। তিনি শুধু জানেন অরিন্দম ক’দিনের জন্য কাউকে কিছু না বলে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল।
হঠাৎ ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকলেন মিস্টার খান্না। চকিতে সবাইকার দিকে চোখ বুলিয়ে নিলেন। তারপর হাত দুটো ঘষতে লাগলেন খুব আত্মপ্রসাদের সঙ্গে।
- বসুন খান্নাসাহেব, বেগম আলি বললেন।
- আমার হেড কোয়ার্টারে খবর গিয়েছিল, সঙ্গে-সঙ্গে ছুটে এসেছি।
মিঃ খান্না সোৎসাহে বললেন, যেন নিরুদ্দিষ্টদের উদ্ধার-করার কৃতিত্বটা ওঁরই।
- তবে এই দুটি মেয়ের অসমসাহসের জন্যেই শেষ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া গেল মিঃ আলি, আপনার নাতি আর এই বোর্ডারটিকে। স্বীকার করতেই হবে। আমার জাল আমি গুটিয়ে আনছিলাম ঠিকই।
কিন্তু কম্ম ফতে করেছে মেয়ে দুটি, স্বীকার করতেই হবে। খান্না শেষ পর্যন্ত উদারভাবে বললেন, - মিঃ আলির এগিয়ে দেওয়া কফির পাত্রটা নিতে-নিতে।
র্যাচেল বলল, - ঠিকই, মিঃ খান্না। আপনি কতদূর এগিয়েছিলেন জানি না। ওরা কিন্তু ঠিক করেছিল মুফিকে কোনও নিঃসন্তান সুইডিশ দম্পতির কাছে অনাথ ভিখিরির বাচ্চা বলে বেচে দেবে। সত্যি-সত্যি ভিখিরি-বাচ্চা ধরলে বাচ্চাগুলোরও সদগতি হত, ওদেরও কোনও অসুবিধে হত না। কিন্তু সুইডিশগুলোর কোনও বাস্তব জ্ঞান নেই। ওদের ব্রুনেট অর্থাৎ কালো চুল, কালো চোখ ভারী অপছন্দ, তাই অনেক খুঁজে-খুঁজে ওদের সোনালি বা তামাটে-চুল বাচ্চা ধরতে হত। এরকম শিশু ওরা বহু জোগাড় করেছে ভারতের নানা শহর থেকে। মুফির মতো সোনালি-চুল নীল-চোখ বাচ্চাদের জন্য ওরা বহু ডলার মূল্য পায়। কিন্তু একটা মুশকিল আছে। সুইডিশরা তো চুরি করা বাচ্চা চায় না। চায় সত্যি সত্যি অনাথ বাচ্চাদের, যারা ভাল করে খেতে পায় না। ম্যালনিউট্রিশনে ভুগছে। তাই ওরা এই আট দশদিন মুফিকে শ্রেফ গ্লুকোজ ওয়াটার খাইয়ে রেখেছে।
- জানেন খান্নাসাব, জানেন আলিকাকা, আমার বেলায় ওদের ব্যবস্থা ছিল সামান্য অন্যরকম। আমি তো আর বাচ্চা নই যে, কোনও নিঃসন্তান বিদেশী দম্পতি আমায় দত্তক নেবে! তাই ওরা ঠিক করেছিল ওদের ব্যবসার আর-একটা শাখায় আমায় কাজে লাগাবে। আমার পেট-টেট চিরে পাকস্থলী, ইনটেসটিন, লিভার ইত্যাদি সব বার করে নিয়ে সে-জায়গায় ঠেসে দেবে নিরেট সোনা, কিংবা কোকেন, কোনটা আমি জানি না অবশ্য। নাটকটা হল মার্কিন হিপি মেয়ে ইন্ডিয়া বেড়াতে এসেছিল, সাপ, বাঘ আর বিষাক্ত জলের দেশে বেচারি মারা গেছে স্বাভাবিক ভাবে। তাই তার মৃতদেহ তার বাবা-মা’র কাছে আমেরিকায় ফেরত পাঠানো হচ্ছে, এই আর কি! কী চমৎকার মঞ্চসজ্জা, সিচুয়েশন তৈরির কায়দা বলুন তো?
- দূর্বাদির নিকষ কালো রঙ, তিস্তার বাঙালি চেহারা আর বিখ্যাত মুখের জন্য ওদের দিয়ে এটা সম্ভব ছিল না, তাই-ই আমাকে বেছে নিলেন, না মিঃ খান্না? সোনালি চুল দুলিয়ে, ফ্যাকাশে ঠোঁটে ঈষৎ হেসে বলল র্যাচেল। তার গলায় বিন্দুমাত্র উত্তেজনা নেই।
মিস্টার খান্না অন্যমনস্ক হয়ে বললেন, - ঠিক ঠিক। পরক্ষণেই প্রচণ্ড উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়ে দারুণ রেগে চিৎকার করে উঠলেন, - কী, কী বললে তুমি মিস মিডফোর্ড?
- ঠিকই বলেছি খান্নাসাব। জ্ঞান হয়ে থেকে আমাদের কটেজ পিয়ানোর একানব্বইখানা চাবির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় কিনা আমার। কান পুরোপুরি তৈরি। পার্টিশনের ওধার থেকেই হোক আর বোরখার আড়াল থেকেই হোক আপনার হেঁড়ে গলা কোন্ সুরে বলে বুঝতে আমার ভুল হয় না। আমার কান কখনও ভুল সাক্ষ্য দেবে না। আমাদের গাড়িটা আপনি শত চেষ্টাতেও ধরে ফেলতে পারলেন না!
তিস্তা বিদ্যুদ্বেগে উঠে দাঁড়িয়েছে। হাতে রিভলভার। বলল, - পেছন থেকে দূর্বা মিত্র আপনাকে কভার করছে খান্নাসাহেব, পালাবার চেষ্টা করবেন না। আমাদের চারটি বালক-বন্ধুকে কোথায় রেখে এলেন? এই মুহূর্তে টেলিফোনে তাদের নিরাপত্তা এবং অবিলম্বে এখানে পৌঁছনোর ব্যবস্থা না করলে আপনার সমূহ বিপদ।
আপনার মতো ঘৃণ্য, নৃশংস, জানোয়ারের ঠ্যাং চিরকালের মতো খোঁড়া করে দিলে সরকার নিশ্চয়ই খুশি হয়ে আমাদের যুগল পদ্মশ্রী উপাধি দেবে।
সামনে তিস্তা পেছনে দূর্বা ঠেলতে ঠেলতে টেলিফোনের কাছে নিয়ে গেল খান্নাকে। দেরাদুন থানায় সংক্ষিপ্ত নির্দেশ দেওয়ার পরে কাঁপতে-কাঁপতে চেয়ারে এসে বসল খান্না। তারপর ঝাড়া দু-ঘণ্টা প্রতীক্ষা। মধ্যে শুধু একবার হতভম্ব ফাদার জোনাথন জিজ্ঞেস করলেন, - অরিন্দমকে কি সত্যিই পাওয়া গেছে?
জগজিৎ চোপরা বললেন, - এই বাচ্চাটি আর এই মেয়েটির সঙ্গে অরিকেও কি এরা কিড্ন্যাপ করেছিল? অ্যায়াম গেটিং কনফিউজড।
কেউ ওঁদের কথার কোনও জবাব দিল না। র্যাচেল অবিচলিতভাবে একটা বিরাট বক্তৃতা দিয়ে এখন নেতিয়ে পড়েছে। তাকে চামচ করে চিকেন স্যুপ খাইয়ে দিচ্ছেন বেগম আলি। তিস্তার নির্দেশে আলিসাহেব ফোন করলেন দিল্লির স্বরাষ্ট্র দফতরে। সেখানকার ফার্স্ট সেক্রেটারি তিস্তার বাবার বন্ধু।
নীচে গাড়ির শব্দ। তারপরই ঘরে ঢুকল চার বন্ধু। সুনৃত ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এসে বলল, - মাই গড্, য়ু আর সেফ দেন। র্যাচেল, হোপ য়ু আর ওকে!
ওরা লক্ষ করেনি জিত তখনও চৌকাঠে। অরিন্দম ঘরে ঢোকেইনি। জগজিৎজি ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, - অরি কই? অরি? তুমি নাকি কাউকে না বলে কোথায় চলে গিয়েছিলে? দেখলে তো, দুর্বত্তদের হাতে পড়ে তোমার কী হয়রানিটাই হল?
ওরা সবাই দেখল অরিন্দম হঠাৎ পিছিয়ে যাচ্ছে। মুখে গভীর যন্ত্রণার ছাপ। জিত পাশে গিয়ে দাঁড়াল। অরিন্দম বলল, - জিত, মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। একটার পর একটা তরঙ্গ আসছে। সামলাতে পারছি না। প্লিজ, আমায় তোরা ছেড়ে দে। টলতে টলতে পিছু হঠতে শুরু করল অরিন্দম। তারপরই মুখ ফিরিয়ে দে ছুট। এত দ্রুত ঘটে গেল ব্যাপারটা যে বাধা দেওয়া তো দূরের কথা, কেউ কোনও কথা পর্যন্ত বলতে পারল না। জিত ওর পেছন-পেছন দৌড়ল। ওর পিছনে দৌড়লেন পৃথ্বীশ, সুনৃত, চোপরা, ফাদার জোনাথন।
অনেক পেছনে পড়ে আছে লাইব্রেরি বাজার। নির্জন রাস্তা। দু’পাশে শুধু দেওদার। রাতের অন্ধকার মেখে সব নিশ্চুপ।
অনেকটা গিয়ে অরিন্দম দাঁড়িয়ে পড়ল। ফিসফিস করে বলল, - দূরে ওই ডান দিকে তাকিয়ে দ্যাখ জিত। ওরা বলেছিল ওরা আসবে। কথা রেখেছে, ওরা এসেছে।
জিত দেখল, অনেক দূরে একটা কাচের প্লেটের মতো সাদা আলোর উপবৃত্ত অন্ধকারে ঝকঝক করছে।
অরিন্দম বলল, - আমার তো একস্ট্রা সেনসরি পার্সেপশন, তার ওপর লামারা সার্জারি করে দুই ভুরুর মাঝখানে তৃতীয় একটা চোখ খুলে দিলেন। সিক্সথ্ সেন্স্ও বলতে পারিস। দুষ্ট চিন্তা-তরঙ্গ আগে শুধু অনুভব করতে পারতুম, এখন আর সহ্যই করতে পারছি না। আমাকে চলে যেতে হবে জিত, নইলে এই আমার শেষ।
ততক্ষণে বাকিরা আরও কাছে এগিয়ে এসেছেন। - ওই দ্যাখ, বিষণ্ণ গলায় অরিন্দম বলল আবার, - আঙ্কল চোপরা, বানর আর ব্যাঙের সঙ্গে-সঙ্গে আজকাল লোকের কোলের ছেলেও চুরি করে চালান দিতে শুরু করেছেন। জ্যান্ত-মানুষের শরীরের কল-কব্জা বার করে তার মধ্যে সোনা বা নার্কোটিকস্ পুরে বিদেশে পাঠাবার অভিনব ফন্দি বার করেছেন। এই মানুষটি আমার কাকা, আমার একমাত্র আপনজন। অরিন্দম দু’হাতে নিজের চুলের মুঠি আঁকড়ে ধরল।
দূর থেকে মৃদু বাঁশির মতো একটা আওয়াজ ভেসে এল। অরিন্দম, বলল, - ওরা জিবুস নামে বহু আলোকবর্ষ দূরের কোনও গ্রহ থেকে আমায় নিতে এসেছেন। আঙ্কল চোপরার ব্যাপারে তোরা যা হয় করিস। আসি জিত। তোর কাছে যন্তর-মন্তরটা রইল। কোনও না কোনও সময়ে.....।
গোল চাকার মতো আলোটার সামনে জিত দেখল, তিনটি অস্বাভাবিক দীর্ঘ কায়া। আলোর বিপরীতে দাঁড়াবার ফলেও তাঁদের দেহের কোনও অংশ কিন্তু কালো দেখাচ্ছে না। পুরোপুরি জমাট আলো দিয়ে গড়া যেন। অরিন্দম চিৎকার করে উঠল, - আমার কাছ থেকে সরে দাঁড়া জিত।
বলতে না বলতেই টর্নেডোর মতো একটা প্রচণ্ড আশ্চর্য হাওয়ার চোঙা অরিন্দমকে প্রায় শূন্যপথে যেন শুষে নিয়ে চলে গেল। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই নিবে গেল আলোর চাকতি। অদৃশ্য হয়ে গেল আলোর মানুষ এবং অরিন্দম৷ আকাশের অনেক জ্যোতিষ্কের মধ্য দিয়ে শুধু ছুটে চলল আরও একটি জ্যোতিষ্ক; জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের আকাশচিত্রে যার ঠিকানা নেই। ছুটে চলল কোন্ দূর উদ্দেশে কে জানে!
মুসৌরির পথের ওপর তখন কতকগুলি বিমূঢ় মানুষকে ঘিরে শেষ রাতের হালকা অন্ধকার।
(শেষ)
No comments:
Post a Comment