তারানাথ তান্ত্রিকের গল্প (কালভৈরব)
সেদিন বিকেলে তারানাথের বাড়ি গিয়ে দেখি সে বাইরের ঘরে তক্তাপোশের ওপর বসে তামাক খাচ্ছে। চোখমুখ উদাস। মাঝে মাঝে তারানাথের এ ধরনের ভাব পরিবর্তন দেখেছি, দু-চারদিন থাকে, তারপর আবার ঠিক হয়ে যায়। বললাম--কি, মন খারাপ নাকি?
আমি যে ঘরে ঢুকেছি তা বোধ হয় তারানাথ লক্ষ্যই করেনি, একটু চমকে উঠে বলল--ও, তুমি! এস, বোস ওইখানটায়। না মনখারাপ নয়, অনেকদিন আগেকার কথা ভাবছিলাম-- ছোটবেলার কথা। পুরনো দিনের কথা মনে এলে একটু মন খারাপ তো হয়ই, না? কিশোরী এল না যে?
-- আসবে। তাকে সকালে বলে রেখেছি, অফিসের পরে সোজা এখানে চলে আসবে।
নাম করতে করতেই কিশোরী এসে পড়ল। -- কি, গল্প শুরু হয়ে গিয়েছে নাকি?
তারানাথ বলল--না, বোসো। তোমার কথাই হচ্ছিল। আজ গল্প বলার মেজাজ নেই, আর একদিন হবে’খন। চা খাবে?
বাড়ির ভেতরে গিয়ে চায়ের কথা বলে এসে তারানাথ আবার তক্তাপোশে বসে হুঁকো টানতে লাগল। আমি আর কিশোরী জানি “গল্প হবে না” কথাটার বিশেষ কোন গুরুত্ব নেই। অপেক্ষা করলে একটা ভাল গল্প বেরিয়ে আসতেও পারে।
-- দুত্তোরি! এটা আবার গেল নিবে! বোস তোমরা, চারিকে বলে আসি এক ছিলিম সেজে দিতে --
কিশোরী পকেট থেকে নতুন পাসিং শো-এর প্যাকেট বের করে। মাসের প্রথম, এ সময়টা আমরা একটু নবাবী করেই থাকি। তক্তাপোশে রেখে বলল-- বসুন ঠাকুরমশাই, বারবার উঠতে হবে না, সিগারেট খান--
তারানাথ উজ্জ্বলমুখে একটা সিগারেট বের করে ধরাতে ধরাতে বলল-- সে বরং ভাল। হুঁকো-কল্কে আমাদের দেশে আর চলবে না, বুঝলে? কত ফৈজৎ, তামাক-টিকের যোগাড় রাখ, ঠিকরে লাগাও-- ছিলিম সাজ, একঘণ্টা ধরে ফুঁ দাও-- নাঃ, সিগারেটই ভাল--
চোখ বুঁজে সিগারেটে টান দিতে দিতে একটু পরে তারানাথ বলল--তবে কি জানো? তামাকের মৌজ সিগারেটে নেই। এই যে সোঁদা সোঁদা গন্ধ, কড়া স্বাদ, গুডুক গুড়ুক শব্দ—সব মিলিয়ে একটা দারুণ আমেজ। তারপরে ধরো, ঠিকরে গুঁজছি, তামাক আর টিকে সাজাচ্ছি, মনোযোগ দিয়ে ফুঁ দিচ্ছি, আর মনের ভেতর “এই হয়ে গেল--এক্ষুনি আমি তামাক খাব”--
এই ভাব। সেটাও একরকমের মেজাজ, ওই অপেক্ষাটা। আর সিগারেট কি, না-- এই ধরালাম, দু’দশটা টান দিয়ে ফেলে দিলাম-- চুকে গেল। তা মানুষের হাতে সময় কমে আসছে, করবে কি? এই সিগারেটই বাজার দখল করবে দেখ--
কিশোরী বলল- পুরনো দিনের কথা ভাবছিলেন বললেন না? আপনার ছোটবেলার ঘটনাই বলুন না, শোনা যাক।
ছাইদানি হিসেবে ব্যবহৃত নারকোলের মালায় সিগারেটের দগ্ধাবশেষ গুঁজে দিয়ে তারানাথ বলল-- সে তো আর একটা টানা গল্প নয়, কত বছর ধরে টুকিটাকি কত কিছু ঘটেছে, আমার কাছে সে-সবের গভীর মূল্য আছে-- কিন্ত তোমাদের ভাল লাগবে কেন?
আমি জিজ্ঞাসা করলাম-- আচ্ছা, তন্ত্রসাধনার দিকে প্রথম আপনার ঝোঁক আসে কি করে?
-- সে তো তোমাদের বলেছি, গ্রামের বাঁধানো গাছতলায় সেই সাধু, তারপর বীরভূমের শ্মশানের সেই মাতঙ্গিনী-- সে আবার ডামরতন্ত্রে সিদ্ধ ছিল, কিংবা বরাকর নদীর ধারের সাধুজী, যার ‘পঞ্চমুন্ডি’ আসনে বসে মধুসুন্দরী দেবীকে দেখতে পাই। এদেরই প্রভাবে এ পথে আসি-- এ গল্প তো তোমরা শুনেছ।
বললাম-- কিন্তু তারও আগে? একেবারে ছোটবেলায় কবে বুঝলেন যে আপনার জীবনটা ঠিক অন্য সবার মত হবে না?
তারানাথ দুই আঙুলে ভ্রূ-র মাঝখানটা টিপে ধরে রইল কিছুক্ষণ, তারপর মুখ তুলে আস্তে আস্তে বলল-- জন্মের সময় থেকেই বোধ হয় ঈশ্বর আমার জীবনের গতিপথ নির্ণয় করে দিয়েছিলেন। আমি যখন ভূমিষ্ঠ হই সেই মুহূর্তে আকাশ দিয়ে একটা বিরাট উল্কা ছুটে গিয়েছিল। মা আঁতুড়ঘরে, গ্রামের বৌ ঝি-রা তাকে ঘিরে বসে রয়েছে, বাবা পায়চারী করছেন দক্ষিণের বারান্দায়। গরমজল নেবার জন্য সিন্ধুবালা দাই আঁতুড়ঘর থেকে উঠোন পেরিয়ে রান্নাবাড়ির দিকে আসছিল। সে-ই হঠাৎ আকাশে আশ্চর্য আলো দেখতে পেয়ে চিৎকার করে ওঠে। তার ডাকে বাড়ির সবাই উঠোনে এসে জড়ো হল। অদ্ভুত নীল আলোয় চারিদিক উদ্ভাসিত করে একটা নীল আগুনের গোলক পুবদিক থেকে পশ্চিম দিগন্তের দিকে চলে যাচ্ছে।
সাধারণত উল্কা জ্বলে উঠেই চকিতে মিলিয়ে যায়, লোকজন ডেকে এনে দেখবার অবকাশ পাওয়া যায় না। এই নীল আলো কিন্তু অনেক-- অনেক ওপর দিয়ে বেশ সময় নিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে, ধূমকেতুর মত একটা অস্পষ্ট স্বতঃপ্রভ ধোঁয়ার পথরেখা ফেলে যাচ্ছে পেছনে।
পশ্চিমদিগন্তে নীল উল্কা মিলিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমি ভূমিষ্ঠ হই।
এ গল্প পরে বড় হয়ে সবার মুখে শুনেছি। সে বয়েসটা একটা অদ্ভুত বয়েস, বুঝলে? রেড়ির তেলের প্রদীপ, ছোট ছোট ফোঁড় দেওয়া পদ্মকাঁথা, আরামদায়ক রোদ-ঝিঁঝিঁ করা নির্জন দুপুর, উঠোনের চাটাইতে শুকোতে দেওয়া টোপাকুলের ভরপুর গন্ধ, রান্তিরে জ্যোৎস্নায় চকচক্ করা নারকোল গাছের পাতা-- সে সময়ে সবই সম্ভব ছিল। সমবয়েসীদের সঙ্গে বনতো না, তাদের খেলাধুলো কথাবার্তা কেমন অর্থহীন আর হাস্যকর বলে মনে হত। একা একা বেড়াতাম মাঠে-বনে, গ্রামের বাইরে যাবার পথে চৌধুরীদের বাঁশবাগানে। একটা জিনিস খুব অনুভব করতাম, এখনো ভাবলে মন উদাস হয়ে যায়। ধরো, খাওয়া-দাওয়া সেরে বাড়ির সকলে দুপুরের ঘুম দিচ্ছে, আমি বেরিয়ে চলে গিয়েছি সাঁতরাদীঘির পারে। চুপ করে বসে আছি।
ঝিরঝিরে বাতাসে দীঘির জলে ডুরে ডুরে ঢেউ উঠেছে। লিচু আর জামরুল গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো এসে মাটিতে রোদ আর ছায়ার আলপনা তৈরি করছে—আমগাছের গুঁড়ি বেয়ে উঠছে একসারি কাঠপিঁপড়ে। এইসব নির্জন মুহূর্তে, আমি তোমাদের সত্যি বলছি, স্পষ্ট শুনতে পেতাম গাছপালা, মাটি, দীঘির জল আমার সঙ্গে কথা বলছে। ঠিক কোন ভাষা দিয়ে নয়, সে ভাষা ওদের নেই। এ অনেকটা গানের সুরের মত-- কিংবা তাও ঠিক নয়, এমন একটা কিছু -- যা মন দিয়ে বোঝা যায় কিন্তু মুখ দিয়ে বলা যায় না। পরে সাধনা করতে গিয়ে দেখেছি উচ্চকোটির তন্ত্রসাধকেরাও স্বীকার করেছেন যে, আমরা যাদের নির্জীব পদার্থ ভাবি তাদেরও প্রাণ আছে চেতনা আছে। এখন ভাবলে বিস্মিত হই, তখন কিন্তু ব্যাপারটাকে খুবই স্বাভাবিকভাবে নিয়েছিলাম। ভাবতাম, সবাই বুঝি আমার মতই ওদের কথা শুনতে পায়।
একদিন দুপুরে খেলা করতে করতে চলে গিয়েছি গ্রামের বাইরের মাঠে। কেউ কোথাও নেই, শূন্য মাঠের ওপর রোদ্দুর ঝাঁ ঝাঁ করছে। গ্রামের ঠিক প্রান্তে একটা বিরাট চটকাগাছ। সেই চটকাগাছের নিচে একজন লোক বসে আছে। কুচকুচে কালো রঙ খালি গা। হাতে একটা পাঁচনবাড়ি। সম্ভবত সে শুয়োর চরায়, কারণ এদিক ওদিকে কয়েকটা শুয়োর চরে বেড়াচ্ছে দেখলাম।
দৃশ্যটা অতি সাধারণ। গ্রামের অনেক গরিব মানুষেরা শুয়োর চরিয়ে দিনাতিপাত করে, তাদের এইরকমই দেখতে এবং তারা ক্লান্ত হয়ে পড়লে গাছতলায় বসে বিশ্রামও করে। কাজেই অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। কিন্তু কেন যেন লোকটাকে ভাল করে দেখবার জন্য আমি পায়ে পায়ে তার দিকে এগিয়ে গেলাম।
আমি কাছে যেতেই লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। কি তার চোখের প্রখরতা। ভাল করে তাকান যায় না। যেন ঝকঝক্ করে জ্বলছে। আঁটোসাটো দৃঢ় শরীরের মধ্যে সে যেন নিজেকে আটকে রাখতে পারছে না, প্রাণশক্তি উপচে পড়ছে শরীর ছাড়িয়ে। আমার দিকে তাকিয়ে সে বলল-- এস, তোমার জন্যই বসে আছি।
অবাক হয়ে বললাম-- আমার জন্য?
-- হ্যাঁ। তোমার সঙ্গে কথা বলবার জন্যই আজ আমাকে পাঠান হয়েছে। বোস।
-- কে পাঠিয়েছে?
-- সে বললে এখন তুমি বুঝবে না, বড় হলে নিজেই জানতে পারবে। এদিকে এসো তো, কাছে এসো--
আমার ঠিক ভয় করছিল না, বরং কেমন যেন রহস্যময় আনন্দের অনুভূতি হচ্ছিল। লোকটার কাছে এগিয়ে যেতে সে আমার কপালে হাত দিয়ে কি যেন দেখতে লাগল, তারপর খুশি হয়ে বলল-- ঠিক আছে, বোস ওই শেকড়টার ওপরে।
বসলাম। দু-একটা দুষ্টু শুয়োর দল ছেড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, নিজেদের মধ্যে মারামারির উদ্যোগ করছিল। লোকটা পাঁচনবাড়ি তুলে বিচিত্র এক হুঙ্কার দিল--অ্যাও! সাবধান, আমি জেগে আছি! ঠিক হয়ে চল--
শুয়োরগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মত ঠেলাঠেলি বন্ধ করে একজায়গায় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম তার হাতের পাঁচনবাড়িটা কোন গাছের ডাল বা কঞ্চি দিয়ে তৈরি নয়-- কিসের যেন সরু হাড় সেটা!
বললাম-- কোথায় থাক তুমি? এ গাঁয়ে তো দেখিনি তোমাকে।
সে বলল-- এ গাঁয়ে থাকি না, তাই দেখনি।
-- তাহলে?
লোকটা তার প্রখর দৃষ্টিতে একবার চারদিকে তাকাল। সূর্যের আলো সরাসরি তার মুখে এসে পড়েছে, আকাশে উড়তে উড়তে একটা চিল ডাকছে কর্কশ, তীক্ষ্ণস্বরে। সেই রৌদ্রালোকিত আকাশ, দিগন্ত আর পৃথিবীর দিকে লোকটা দু-হাত ছড়িয়ে দিয়ে বলল--এই সবকিছুর মধ্যে আমার থাকার জায়গা। অল্প জায়গায় আমাকে ধরে না যে!
আমি তার কথা ঠিকঠাক বুঝতে পারলাম না। একজন লোক একটা বাড়িতে থাকবে এটাই নিয়ম। সব জায়গায় সে থাকে কি করে? বললাম-- তুমি শুয়োর চরাও?
লোকটা চমকে বলল--কই, না তো!
-- এগুলো তোমার শুয়োর নয়?
সে একবার স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শুয়োরগুলোর দিকে দেখল, তারপর বলল--কিন্ত এরা তো কেউ শুয়োর নয়--,
আমার তখন দৃঢ় ধারণা হয়েছে লোকটা বদ্ধ পাগল। হ্যাঁ ঠিক তাই। সেজন্যেই এর কথাবার্তা কেমন কেমন, চাউনি অমন অদ্ভুত। আর তাছাড়া পরিষ্কার দেখছি অতগুলো শুয়োর দাঁড়িয়ে রয়েছে, তবু মানতে হবে ওরা শুয়োর নয়? ওগুলো কি তবে শেয়াল?
লোকটা বলল-- তুমি ছোটো তো, তোমাকে এখন বোঝান অসুবিধে হবে। এগুলো সত্যিই শুয়োর নয়। এগুলো হচ্ছে-- কি বলি-- আমাদের ভেতরে যে দোষগুলো থাকে, যাদের জন্য আমরা খারাপ কাজ করি, খারাপ কথা ভাবি--এরা হচ্ছে সেইসব দোষের বাইরের চেহারা। সাধারণ মানুষকে এরা চরিয়ে বেড়ায়, কিন্তু আমি এদের চরাবার বিদ্যা শিখেছি। দুটো শুয়োর আবার মারামারির উদ্যোগ করছিল, লোকটা সরু হাড়ের লাঠি তুলে গর্জন করে উঠতেই তারা চুপ করে গেল।
লোকটা এবার যেন একটু ব্যস্ত হয়ে বলল-- নাঃ, কথায় কথায় অনেক দেরি হয়ে গেল। আমার ফিরে যাবার সময় হয়েছে। যে জন্য আসা সেটা তাড়াতাড়ি সেরে নিই। এদিকে এগিয়ে এসো তো খোকা, কোন ভয় নেই, এসো। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম-- কেন?
সে বলল-- আমি তোমাকে একটু মনখারাপ দিয়ে যাব।
আমার দুই কাঁধ ধরে নিজের দিকে টেনে নিয়ে লোকটা অস্বাভাবিক জোরে, প্রায় চিৎকার করে বলে উঠল-- আমার চোখের দিকে তাকাও!
আমি তার চোখের দিকে তাকালাম।
হঠাৎই মানুষটার চোখ যেন দুটো জানালা হয়ে গিয়েছে। ভেতরে কতদূর অবধি দেখতে পাচ্ছি। ওখানে যেন আর একটা জগত, এ রকমই রোদ্দুর ঝাঁ ঝাঁ করছে দিগন্ত অবধি বিছিয়ে থাকা মাঠে। সবুজ বন, নীল পাহাড় থেকে ঝুরঝুর করে ঝরনা নেমে আসছে-- মেঘে আর কুয়াশায় ঢাকা ওই পাহাড়ে কবে যেন আমি থাকতাম। সুতোর কাটিম উলটোদিকে ঘুরে যাওয়ার মত বিস্মৃতির আড়াল থেকে কত পুরনো, মহাকালের স্তরে স্তরে সঞ্চিত ভুলে যাওয়া কথা মনে পড়ে যেতে লাগল। ক্রমে আমার সমস্ত চেতনা ওই দুই চোখের জানালার ভেতর দিয়ে আশ্চর্য জগৎটার মধ্যে গিয়ে দাঁড়াল আমাদের গ্রামের সীমানায় চটকাগাছটা, চিলের তীক্ষ্ণ ডাক, সামনে পড়ে থাকা কইখালির বিশাল মাঠ-- সব কোথায় মিলিয়ে গেল। এখন আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সে জগতে ছায়াবাড়ির মত কত ছবি মেলে যাচ্ছে চোখের সামনে দিয়ে। কোথায় যেন এক উন্নতশীর্ষ মন্দির, শেষবেলার আলোয় তার চূড়ার সোনার পদ্ম ঝলসে উঠছে। কাদের হাসিমুখ-- এরা আমাকে খুব ভালবাসত, কিন্তু এখন মিলিয়ে গিয়েছে দূর অতীতে। কানে ভেসে আসছে সমস্বরে উচ্চারিত মন্ত্রধ্বনির মত একটানা উদার-গম্ভীর সংগীতময় শব্দপ্রবাহ। সব ছবি মিলিয়ে গিয়ে চোখের ওপর ভেসে উঠছে সৃষ্টিপূর্ব আদিম অন্ধকারের মত কালো মহাশূন্য-- থেকে থেকে সেই পরম কিছু না-র মধ্যে চমকে উঠছে তীব্র জ্যোতির উদ্ভাস, সৃষ্টি হচ্ছে নক্ষত্রের, নীহারিকার, অনন্ত শূন্যের থেকে বস্তুপুঞ্জের। আমার চেতনা চলে যেতে লাগল, আর কিছুক্ষণ এখানে থাকলেই আমি সম্পূর্ণ জ্ঞান হারাব। ঠিক তখনই অনুভব করলাম চিরচেনা পৃথিবীর বিপুল আকর্ষণে আমি ফিরে আসছি আমাদের গ্রামের প্রান্তের রোদে পোড়া মাঠে। লোকটার চোখের জানালা দিয়ে বেরিয়ে আসবার সময় শেষবারের মত তাকিয়ে দেখলাম সেই নিকষ কালো অনন্তস্পর্শী মহাশূন্যের বুক চিরে চলে যাচ্ছে একটা নীল উল্কা চটকাগাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে আমি মুহ্যমানের মত বসে রইলাম, মাঠের ওপর দিয়ে তার শুয়োর তাড়িয়ে নিয়ে লোকটা কোথায় যেন চলে গেল। সে কোথায় যাচ্ছে, কি করে আবার দেখা হবে কিছুই জিজ্ঞাসা করা হল না।
কিন্তু কি মনখারাপই সে আমাকে দিয়ে গেল!
এরপর আমার আর কিছু ভাল লাগত না। একা তো ছিলামই, আরও একা হয়ে গেলাম। সবসময় মনে হত কি একটা কাজ যেন ফেলে রেখেছি, কোথায় যেন আমাকে চলে যেতে হবে।
প্রথম যৌবনে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ি, সে কথা তোমাদের বলেছি। বীরভূমের শ্মশানে মাতু পাগলী আমাকে সম্মোহিত করে নানা দৃশ্য দেখিয়েছিল। আমি যেন নদীর জলে নেমে গাছের শেকড়ে আটকে থাকা মৃতদেহ তুলে এনে পূজার উপকরণ সংগ্রহ করে শবসাধনায় বসলাম। সারারাত কত আতঙ্কজনক দৃশ্য দেখলাম, কত উপদ্রব ঘটল। পরে সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখি ধূসর সন্ধ্যায় নির্জন শ্মশানে দাঁড়িয়ে আমি মাতু পাগলীর সামনে-- মাত্র দশমিনিট সময় কেটেছে।
এ তো গেল ভেল্কি, কিন্তু সদ্গুরুর সাহায্যে আমি প্রকৃতই একবার শবসাধনা করেছিলাম। মুর্শিদাবাদ জেলার এক অজ পাড়াগাঁয়ের শ্মশানে তখন আস্তানা গেড়েছি-- সঙ্গে গুরু রয়েছেন।
জ্যৈষ্ঠের শেষে আশেপাশের গ্রামগুলোতে কলেরার মহামারী শুরু হল। সারাদিন ধরে দূর দূরান্ত থেকে মৃতদেহ দাহ করতে আনছে লোকে। পরে এমন অবস্থা দাঁড়াল, দাহ করার কাঠ জোটে না। মুখে আগুন ছুঁইয়ে দেহ ফেলে শ্মশানবন্ধুরা পালায়। তারই ভেতর থেকে লক্ষণযুক্ত একটি মৃতদেহ একদিন তুলে নিয়ে এলাম। শ্মশানের পূর্বপ্রান্তে একটু জঙ্গলমত জায়গা, সেখানে বিরাট একটা ঝাঁকড়া ছাতিমগাছ রয়েছে। তারই তলায় গুরু পূজার আয়োজন করলেন। রাত্তিরে দাহ করার জন্য দলবল এলেও এদিকে তারা ঘেঁসবে না।
আমি ভেবেছিলাম শুরুই বোধহয় শবাসনে বসবেন। কিন্ত প্রাথমিক প্রকরণের শেষে গুরু যখন আমাকে পদ্মবীজের মালা ধারণ করতে বললেন, তখন অবাক হয়ে বললাম--আমি কেন?
-- তুমিই তো আসনে বসবে?
-- আমি! আমি কি পারব?
-- নিশ্চয় পারবে, আমি তোমাকে আমার শক্তির অংশ দান করব। তাছাড়া এ আমার কাছে নতুন নয়, একুশ বছর আগে আমি এতে সিদ্ধিলাভ করেছি। আজকের ক্রিয়ায় তোমারই অধিকার।
ঘোর অমাবস্যার মধ্যরাত্রি। গুরু আমাকে আসনে বসিয়ে দিয়ে “সকালে আসব” বলে চলে গেলেন। শব সাধনার সময় সামনে অন্য সাধকের উপস্থিত থাকতে নেই।
সাষ্টাঙ্গ প্রণামের ভঙ্গিতে উপুড় করে শোয়ানো মৃতদেহের পিঠের ওপর বজ্রাসনে বসে বীজমন্ত্র জপ আরম্ত করলাম। মনে কোন ভয় নেই। বহুদিন হল তান্ত্রিক সাধুসঙ্গ করছি, অনেক অস্বাভাবিক আর অলৌকিক ঘটনা চোখের সামনে ঘটতে দেখেছি। আমি জানি নিখুঁতভাবে দেহশুদ্ধি করে আসনে বসলে কোন বিপদ সাধককে স্পর্শ করে না।
ঘণ্টাখানেক একমনে জপ চালাবার পরে অনুভব করলাম নিচে মৃতদেহটা যেন নড়ে উঠছে, তাতে প্রাণের স্পন্দন জেগেছে। পোড়া মাছ গুঁজে দিলাম শবের মুখে, নরকপাল থেকে একটু একটু করে কারণ ঢেলে দিতে লাগলাম। শব আবার শান্ত হয়ে এল। আরও তিনবার এমন হল সে রাত্তিরে। সাধনায় বিঘ্ন সৃষ্টি করবার জন্য হাঁকিনীরা কত বীভৎস রূপ ধারণ করে এল-- একসময় তো তাকিয়ে দেখলাম আমার আসনের চারদিকে চলস্ত গলিত মৃতদেহের দল করতালি দিয়ে নৃত্য করছে। যে কোন সাধারণ মানুষের হৃৎপিন্ড থামিয়ে দেবার পক্ষে এ দৃশ্য যথেষ্ট। সে মুহূর্তে বুক যে একটু কেঁপে ওঠেনি তা বলব না। প্রাণপণে মনকে একাগ্র করে বীজমন্ত্র জপ করতে লাগলাম, ধীরে ধীরে মিলিয়ে এল প্রেতের দল। অনেকের মধ্যেই ভুল ধারণা আছে যে, একরাত শবসাধনা করলেই বুঝি সিদ্ধিলাভ হয়। বিশেষ বিশেষ তিথিতে কয়েকবার আসনে বসলে তবেই সিদ্ধি আসে। এতে অনেকবছরও লেগে যেতে পারে। ধরো, তিথি সুপ্রশস্ত, পূজার সব আয়োজনই করা হয়েছে, কিন্তু শেষপর্যন্ত শব পাওয়া গেল না। সব পণ্ড। আমারও তাই হয়েছিল। নানা কারণে ওই একবার ছাড়া আর শবসাধনা করতে পারিনি। গুরুর কাছ থেকে যখন বিদায় নিয়ে আসি তখন তিনি সাবধান করে বলেছিলেন-- শোনো, সময়মত সাধনা সম্পূর্ণ কোরো। তোমাকে তো সবই শিখিয়ে দিয়েছি, আমি না থাকলেও অসুবিধে হবে না। নইলে কিন্তু বিপদ--
-- আজ্ঞে, কি রকম বিপদ?
-- ভয়ঙ্কর বিপদ। মৃত্যুর পরে আত্মা সঙ্গে সঙ্গে উর্ধ্বগতি পায় না। বেশ কিছুক্ষণ নিজের প্রাণহীন দেহটার কাছে ঘোরাফেরা করে। যার দেহ নিয়ে শবসাধনা করা হয়, তার আত্মা দেখতে পায় দেহের সৎকার হয়নি-- বরং সেটা সাধক নিজের কাজে লাগিয়েছে। তাতে মৃতের আত্মা নিশ্চয় খুশি হয় না। সে প্রতিশোধ গ্রহণের সুযোগ খোঁজে। সাধনা সম্পূর্ণ করলে সাধক অমিত শক্তিলাভ করে, ফলে তার আর ভয় থাকে না। নাইলে বুঝতেই পারছ কি বিপদ হতে পারে! সাবধানে থেকো, জানো তো, প্রবাদ আছে--সাপুড়ের মরণ সাপের হাতে। তোমার ভাগ্য আমি গণনা করে দেখেছি, তুমি একটানা সাধনা করতে পারবে না, আবার তোমাকে ফিরে যেতে হবে গৃহাশ্রমে। আবার বেরুবে-- এবং ফিরে যাবে। এইভাবেই চলবে। শবসাধনা গৃহে বসে করবার জিনিস নয়। কাজেই একেবারে অসম্ভব হয়ে পড়ার আগে কর্ম সম্পূর্ণ করে রেখো।
তারপর আমার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে গুরু বললেন--কিন্তু-- তোমার কপালে একটা আশ্চর্য যোগাযোগের চিহ্ন রয়েছে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। খুব বড় একজন মহাপুরুষ, কিংবা মহাসাধক তোমাকে কৃপা করবেন। দেখি হাতটা--
ডান হাত বাড়িয়ে দিলাম। উনি হাতটা ধরলেন, কিন্তু দেখলেন না, তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। বললাম-- কি ধরনের মহাপুরুষ?
-- এমন কোন উচ্চমার্গের মুক্ত আত্মা যার নাম মুখে উচ্চারণ করার যোগ্যতা আমার নেই। সবরকম সাধনা ও সিদ্ধির উর্দ্ধে চলে গিয়েছেন এমন কেউ। ইতি তোমাকে অনেক বিপদ থেকে রক্ষা করবেন।
আমি ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম-- কবে এঁর দেখা পাব?
শান্তকণ্ঠে গুরু বললেন-- এর দেখা তুমি পেয়েছ।
-- সে কি! কবে?
-- তা জানি না। তবে মহাগুরুর সান্নিধ্য পেলে দেহে ও মনে যে যে লক্ষণ ফুটে ওঠে, তা তোমার রয়েছে।
-- আমি দেখা পেলাম আর আমিই জানতে পারলাম না?
গুরু বললেন-- তেমন তো হতেই পারে। এসব সাধকদের কোন ভেকও নেই, ভড়ংও নেই। নিতান্ত সাধারণ মানুষের মত বেড়ান, দেখলেও হয়ত চিনতে পারবে না। হঠাৎ আমার ছোটবেলায় দেখা সেই অদ্ভুত মানুষটিকে মনে পড়ে গেল। রোদ ঝিমঝিম করা কইখালির মাঠ, সেই শুয়োরের দল, আমার হারানো শৈশব। তিনিই কি আমার জীবনের অজানা মহাপুরুষ?
তরাই অঞ্চলে কোথায় তন্ত্রসাধকদের এক গোপন মিলনসভা হবে খবর গেয়ে গুরু সেখানে রওনা হয়ে গেলেন, আমি আর সঙ্গে গেলাম না। এবার কিছুদিন একা থাকব ঠিক করলাম। পথে পথে ঘুরি, বেশির ভাগই শ্মশানে-মশানে রাত কাটাই, কচিৎ কখনও কোন গৃহস্থবাড়িতে আশ্রয় নিই। একদিন এক রেল স্টেশনের প্লাটফর্মে বসে আছি, আমার ট্রেন আসতে ঘণ্টাখানেক দেরি। সেটা জংশন স্টেশন, লুপ লাইনে যেতে হলে ওখান থেকে গাড়ি বদল করতে হয়।
প্রচণ্ড বৃষ্টি নেমেছে সকাল থেকে, আকাশ কালো হয়ে রয়েছে মেঘে। ঝুপঝুপ করে বৃষ্টির আর যেন বিরাম নেই। দু’পয়সার বিড়ি কিনব বলে স্টেশনের দোকানটার দিকে এগুচ্ছি, হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন ডাকল--আরে, তারানাথ না?
থমকে দাঁড়ালাম। এমন জায়গায় আমার নাম ধরে কে ডাকে? এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখি ওজন করার লোহার কলের পাশে কয়েকটা চটের বস্তার আড়ালে বেঞ্চির ওপর বসে আছে আমাদের গ্রামের ভূপতি শিকদারের ছেলে রমাপতি। ছোটবেলায় এই রমাপতিই বোধ হয় গ্রামে আমার একমাত্র বন্ধু ছিল। কতদিন ওদের বাগান থেকে দুপুরে কাচা পেঁপে ছিঁড়ে এনে নুন দিয়ে খেয়েছি। গ্রামের পুরনো বন্ধুকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে গেলাম, রমাপতিও উঠে এসে আমার হাত ধরে বলল-- উঃ, কতদিন পরে দেখা! এখানে কি করছিস রে? তোর গেরুয়া কই?
হেসে বললাম-- আমি কি সন্ন্যাসী হয়েছি নাকি, যে গেরুয়া পরে ঘুরব?
-- সন্ন্যাসী হোস্ নি? তবে যে সবাই বলে তুই সাধু হয়ে চলে গিয়েছিস?
-- সংস্কৃতে সাধু মানে ভাল লোক, সেটা হবার চেষ্টা করছি বটে-- তবে ভেকধারী সন্ন্যাসী হইনি। তুই এখানে কেন?
-- আমার শ্বশুরবাড়ি এখান থেকে ট্রেনে বদল করে যেতে হয়। বৌ সেখানে আছে, আনতে যাচ্ছি। আয় ওই দোকানটায় চা খাবি?
পুরনো বন্ধুর অকৃত্রিম আগ্রহে রমাপতি আমার হাত ধরে টেনে চায়ের দোকানে গিয়ে চা আর কেকের অর্ডার দিল। পকেট থেকে নতুন মেপোল সিগারেটের প্যাকেট বের করে আমাকে একটা দিয়ে বলল-- ধরা। তারপর তুই কোথায় যাচ্ছিস বললি না তো?
-- বিশেষ কোথাও না। বাড়ি ছাড়ার পরে এইরকমই ঘুরে ঘুরে বেড়াই, একজায়গায় থাকি না বেশিদিন--
-- কেন বল দিকি? এতে লাভ কি?
-- তা তো তোকে বোঝাতে পারব না ভাই! যারা বাড়িতে থাকে, তাদের দেখে আমার মনে হয়, এতে তাদের লাভ কি? কাজেই এর ‘ঠিক কোন উত্তর হয় না।’
রমাপতি চুপ করে রইল! তার মুখ দেখে বুঝলাম আমার উত্তরটা তার বিশেষ পছন্দ হয়নি, সে বুঝতেও পারেনি। গৃহত্যাগ করে বিদেশে গিয়ে অর্থ উপার্জন করলে বোঝা যায়, বাড়ি থেকে পালিয়ে সাধুসন্ন্যাসী হলে তারও যাহোক একটা মানে হয়-- কারণ তেমনটা বহু ঘটতে দেখা গিয়েছে। কিন্তু সে-সব কিছু নয় খামোকা একজন মানুষ বাড়ির আরাম ছেড়ে পথে পথে বেড়িয়ে বেড়ায়-- এর কারণ সে ধরতে পারছে না।
চা খেতে খেতে রমাপতি বলল-- তুই তো বেশ অনেকদিন বাড়ি ছেড়েছিস, তাই না?
-- হ্যাঁ।
-- যেতে বাধা আছে কোনও?
-- না, বাধা আর কি? আমি তো আর গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হইনি--তোকে বললাম না? যখন ইচ্ছে করবে চলে যাব।
চায়ের কাপ দোকানীকে ফেরত দিয়ে রমাপতি একটু ইতস্তত করে বললল-- তারানাথ, তোর বোধহয় এখন একবার বাড়ি যাওয়া উচিত--
তার গলায় কেমন একটা সুর ছিল, ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম-- কেন বল তো? হঠাৎ বাড়ি যাব কেন?
-- কাকীমার খুব অসুখ। অবস্থা তেমন একটা-- মানে, কখন কি হয় বলা যায় না। তুই একবার যা--
বিশ্বে মাতৃশক্তি একটা খুব বড় শক্তি। আমার পথে পথে বেড়ানো যাযাবর জীবন, সাধুসঙ্গে আগ্রহ, সিদ্ধিলাভের আকাঙ্খা-- সব কোথায় উড়ে গেল। মনে হল, যাঁর নাড়ি ছিড়ে ভূমিষ্ঠ হয়েছি, যার কোলে খেলা করে বড় হয়েছি-- আমার সেই চিরপরিচিত সদাহাস্যমুখী মা অসুস্থ! তিনি হয়ত আমাকে দেখতে চান-- আমি এখুনি বাড়ি যাব।
-- কি ভয়ানক বৃষ্টি। থামবার নাম নেই। তারই মধ্যে ভিজতে ভিজতে পরের দিন দুপুর নাগাদ বাড়ি পৌঁছলাম। মানুষের মনের সঙ্গে শরীরের একটা ঘনিষ্ঠ যোগ আছে। মায়ের রোগশয্যার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে আমাকে দেখে তাঁর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বিছানায় বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করলাম-- এখন কেমন আছ মা?
উত্তরে মা শীর্ণ হাত দিয়ে আমার চিবুক ছুঁয়ে বললেন-- ভয় নেই খোকা, তুই এসে পড়েছিস-- এ যাত্রা আমি আর মরব না।
সত্যই পরের দিন থেকে মায়ের অবস্থা ভালোর দিকে যেতে লাগল। আমি ফেরায় বাড়ির লোকও খুশি। খাই দাই আর চন্ডীমণ্ডপে বসে বৃষ্টি দেখি। চার-পাঁচদিন ধরে নাগাড়ে বর্ষা চলেছে। গ্রামের সব পথে একহাঁটু কাদা, খালবিল আর মাঠ একাকার হয়ে গিয়েছে জলে! আমাদের পুরনো কৃষাণ বনমালী ভিজতে ভিজতে বলল-- দাদাবাবু, এমন কাণ্ড জন্মে দেখিনি! সারা গাঁ থৈ থৈ করছে, পাঁচু হালদারের বাঁশবাগানে একহাঁটু জল! তার চে আশ্চর্য কইখালির মাঠে মাছ খেলছে দেখে এলাম শিং-মাগুর, পোনার চারা, কই-- শয়ে শয়ে মাছ!
কৈশোরে মাছ ধরবার খুব নেশা ছিল। শুধু বঁড়শি দিয়ে নয়, পোলো, হাত-জাল আর কোঁচ দিয়েও বহু মাছ ধরেছি। মাছ খাব বলে মাছ ধরা নয়, আসলে এর তোড়জোড় আর মজাটাই বড় কথা। বনমালীর বর্ণনা শুনে হঠাৎ পুরনো নেশাটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। এমন ঘনঘোর বর্ষা দিনরাত্রির ব্যাঙ ডাকছে খালেবিলে-- এই তো মাছ ধরার উপযুক্ত সময়। বনমালীকে ডেকে বললাম-- বনমালীদা, তোমার কাছে একটা পোলো হবে?
-- পোলো? মাছ ধরবে নাকি?
-- হ্যাঁ। অনেকদিন অভ্যেস নেই অবিশ্যি, দেখি তবু--
-- আছে বোধহয় একটা। ওবেলা এনে দেব এখন।
বিকেলে বনমালী পোলো এনে দিল। পোলো জানো তোমরা? বেত বা কঞ্চির চটা দিয়ে তৈরি একটা গোল খাঁচামত জিনিস, ফুটতিনেক উঁচু। ওপরদিকে সরু মুখ, সেখান দিয়ে হাত গলিয়ে মাছ বের করতে হয়। তলার দিকের ঘের বড়। মাছ দেখতে পেলেই ঝপ্ করে পোলো দিয়ে চেপে ধরলে আর পালাতে পারে না। ছিপ না নিয়ে পোলো নেবার কারণ হল—আমি রাত্তিরে মাছ ধরব স্থির করে ফেলেছি। আলো নিয়ে মাছ ধরা ভারি মজার। বিশেষ করে সে সময়ে বিরক্ত করার কেউ থাকে না, পাশে দাঁড়িয়ে পরামর্শ দেয় না, কটা মাছ পেয়েছি জিজ্ঞাসা করে না। রাত্তিরেই ভাল।
পোলো দিয়ে মাছ ধরতে হলে পুকুর বা বিলে সম্ভব নয়, অগভীর জলাশয় প্রয়োজন। সন্ধ্যের একটু আগে গিয়ে কইখালির মাঠের অবস্থা দেখে এলাম। সমস্ত মাঠটায় পায়ের গোছ ডুবে যায় এমন জল। মাঝে মাঝে সামান্য উঁচু জমি এখানে-ওখানে দ্বীপের মত জেগে আছে। একেবারে আদর্শ জায়গা।
খাওয়া-দাওয়া সেরে রাত এগারোটা নাগাদ লন্ঠন আর পোলো নিয়ে বেরুলাম। বনমালী সঙ্গে আসতে চেয়েছিল, আমি রাজি হইনি। ওই যে বললাম, মাছ ধরার পরিবেশটাই আসল। সঙ্গে লোক থাকলে বকবক করবে, নানান্ কথা বলবে-- নাঃ, সে সুবিধে হবে না।
কিন্তু বনমালীকে সঙ্গে নিলেই ভাল করতাম। তখনও জানিনা কি ঘটতে চলেছে সেদিন রাত্তিরে।
সন্ধ্যে থেকে বৃষ্টিটা একটু ধরেছে, আজ পাঁচদিন পর এই প্রথম একটু ক্ষান্তি। কিন্তু সমস্ত আকাশ কালো মেঘে ঢেকে রয়েছে, বিদুৎ চমকাচ্ছে একটু বাদে বাদেই। যে কোন সময়ে আবার ঝেঁপে জল আসতে পারে। খুড়তুতো ভাইয়ের কাছ থেকে তার বাঁশের হাতলওয়ালা ছাতাখানা চেয়ে এনেছি, সেটা বগলে রয়েছে। ভাঁজ করা ছাতার ভেতরে আছে মুগার সুতো দিয়ে বোনা জালের থলে। মাছ পেলে তাতে রাখা হবে। আয়োজন সব ঠিক, এবার দেখা যাক কি রকম কি হয়। ভোর রাত অবধি চেষ্টা তো চালিয়ে যাব।
মাঠে পা দিয়েই বুঝলাম বনমালী মিথ্যে খবর দেয়নি। খালবিল ভেসে গিয়ে প্রচুর মাছ চলে এসেছে কইখালির মাঠে। কিন্তু মাছ থাকা আর মাছ ধরা এক ব্যাপার নয়। তুমি পোলো হাতে এগিয়ে গিয়ে ঝুপ্ করে চেপে ধরবে বলে মাছ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবে তা তো হয় না। জলের জীব-- বহু কৌশল করে তবে এদের ধরতে হয়। কৌশল আমার অজানা নেই, ছোটবেলা থেকে মাছ ধরে আসছি। যেমন ধর, শোল বা ল্যাটা মাছ লন্ঠন উঁচু করে ধরে নাড়ালে আলোয় আকৃষ্ট হয়ে কাছে আসে। কইমাছ আবার আলো টালো কিছুই খেয়াল করে না, ঝাঁক বেঁধে একদিকে চলেছে তো চলেছেই। এদের ধরা সোজা। শিং আর মাগুর খুব চালাক মাছ, মানুষ বা অন্য কিছুর সাড়া পেলেই আর সে তল্লাটে থাকে না, শোঁ শোঁ করে পালায়-- এরা ছোটেও খুব জোরে, জলের মধ্যে দৌড়ে নাগাল পাওয়া যায় না। কিন্তু মজা হচ্ছে, শিং মাগুর ছোটে একদম সোজা, কোনদিকে গেল খেয়াল করলে একটু পরে পেছন পেছন সেখানে গিয়ে হাজির হওয়া যায়। সচরাচর এরা তাড়া খেয়ে আলের ধারে বা গাছের শেকড়ের কাছে গিয়ে আশ্রয় নেয়, খোলা জায়গায় থাকে না। অমন জায়গায় পোলো বসানো মুশকিল। তখন পা দিয়ে জলে শব্দ করতে হয়, ভয় পেয়ে মাছ আবার দৌড় দেবার উদ্যোগ করলেই তাড়াতাড়ি পোলো বসিয়ে দিতে হয়। যাক্ গে, কথায় কথায় অন্য প্রসঙ্গে চলে এসেছি, আসল কথাটা বলি।
রাত দেড়টার মধ্যে অনেক মাছ ধরে ফেললাম। মুগার সুতো দিয়ে তৈরি ব্যাগ এত ভারী হয়ে উঠেছে যে, শক্ত সরু সুতো হাতে কেটে বসে যাচ্ছে। এদিকে আবার মেঘ ডাকতে শুরু করেছে, গা শিরশির করা বাদলার হাওয়া দিচ্ছে বৃষ্টি ফের এল বলে। এবার ‘বাড়ি’ চলে যাওয়াই ভাল।
অনেকক্ষণ থেকেই মনের ভেতরে কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল, কি অস্বস্তি সেটা আমি ঠিক বলে বোঝাতে পারব না। কোন অমঙ্গল আসবার আগে থেকে আমি টের পাই, এ কথা আগেই বলেছি। এতক্ষণ মনের একেবারে তলায় কোণের দিকে কোথাও একটা বিপদের পূর্বাভাস খচ্ খচ্ করছিল, মাছ ধরার আনন্দ আর উত্তেজনায় খেয়াল করিনি। এবারে পরিপূর্ণ সম্বিত ফিরে পেয়ে চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম ঘনবর্ষার মধ্যরাতে গ্রামের বাইরে নির্জন জলভরা মাঠে একা দাঁড়িয়ে আছি। একটা শেয়াল পর্যন্ত এই দুর্যোগে আশ্রয় ছেড়ে বাইরে বের হয়নি। তেমন কিছু ঘটলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলেও সাহায্যের জন্য কেউ এগিয়ে আসবে না। নাঃ, বনমালীকে সঙ্গে আনাই উচিত ছিল। এই জলকাদা ভেঙে বাড়ি পৌঁছতেও অন্তত আধঘণ্টা সময় লাগবে। তার মধ্যে আবার বৃষ্টি এসে গেলেই তো হয়েছে।
ভাবতে ভাবতেই ঝিরঝির করে বৃষ্টি নামল। তাড়াতাড়ি ছাতা খুলতে যাচ্ছি, কেমন করে যেন হাত ফস্কে লন্ঠনটা জলে পড়ে নিভে গেল।
চারদিকে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার।
কিছুক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আলো থাকলে বুকে বেশ সাহস থাকে। তাছাড়া আমাদের তন্ত্রশান্ত্রে বলে আগুন হচ্ছে পবিত্রকারী শুভশক্তি, কোন অশিব উপস্থিতি আগুনের সান্নিধ্যে আসতে পারে না। এইজন্য সাধকদের আসনে সবসময় ধুনি জ্বালিয়ে রাখা নিয়ম। কিন্ত দাঁড়িয়ে থেকে তো লাভ নেই, বরং আন্দাজে আন্দাজে চলতে শুরু করাই ভাল। মাছ ধরতে ধরতে মাঠের একেবারে অপর প্রান্তে চলে গিয়েছিলাম। এবার মাঠ পার হয়ে সেই চটকাগাছটার পাশ দিয়ে গ্রামের পথে ঢুকতে হবে। মাথায় ছাতি ধরে মাছভর্তি থলে আর নেভা লন্ঠন হাতে চটকাগাছটা আন্দাজ করে হাঁটতে শুরু করলাম।
হঠাৎ দিকদিগন্ত উদ্ভাসিত করে একবার বিদ্যুৎ চমকাল।
বিদ্যুতের উজ্জ্বল আলোয় স্পষ্ট দেখলাম উল্টোদিক থেকে একজন মানুষ আমার দিকে এগিয়ে আসছে। বিদ্যুতের আলো একমুহূর্তের বেশি ছিল না, কিন্তু আলো নিভে যাবার পরেও মনে মনে চিন্তা করে কোথায় কি দেখেছি, কতটা দেখেছি বোঝা যায়। যে লোকটা আমার দিকে এগিয়ে আসছে তার হাঁটার ভঙ্গিতে কোন জড়তা নেই, অন্ধকারেও যেন সে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। তার গা খালি, কালো রঙ পরনে একটা নেংটিমত কাপড়ের ফালি। কিন্ত সবচেয়ে বড় কথা ও লোকটাকে আমি চিনি! খুব পরিচিত সে, এই-- কিছুদিনের ভেতরেই কোথায় যেন দেখেছি। কোথায়? কোথায়?
অকস্মাৎ আমি বুঝতে পারলাম, এবং সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করলাম আমি ভয়ানক বিপদগ্রস্ত। জীবিত অবস্থায় এ মাঠ থেকে বেরুতে পারব কিনা তার নিশ্চয়তা নেই। কারণ-- যে মানুষটির মৃতদেহের ওপর বসে ছ-মাস অগে আমি সাধনা করে এসেছি তার শব এগিয়ে আসছে আমার দিকে, বৃষ্টিধারার মধ্যে দিয়ে।
গুরুর কথাই ফলে গেল। সময়মত সাধনা শেষ করতে পারিনি, এবার সেই শৈথিল্যের মূল্য বুঝে নিতে আসছে ওই মূর্তি!
যতদূর সম্ভব শব্দ করা থেকে বাঁচিয়ে সাবধানে জলে পা ফেলে ডানদিকে সরে যেতে লাগলাম-- একটু ঘুরপথে হলেও যদি ওই জীবন্ত বিভীষিকার হাত এড়িয়ে গ্রামের পথে পা দিতে পারি। একবার বাড়ি পৌছতে পারলে আর ভয় নেই। সেখানে প্রতিষ্ঠিত গৃহদেবতা আছেন, সেখানে এই শরীরী আতঙ্ক প্রবেশ করতে পারবে না।
অনেকখানি সরে এসেছি এমন সময় আবার চমকে উঠল বিদ্যুৎ। চকিত মুহূর্তের মধ্যেই দেখতে পেলাম চলন্ত অপচ্ছায়াও তার গতিপথ বদলে সোজা আমার দিকে আসছে।
আমারই ভুল। অন্ধকারে ওই ভয়ঙ্করের দৃষ্টি বাধা পায় না। এভাবে ওকে ফাঁকি দেবার চেষ্টা বৃথা। আদিম জড়বিশ্বের বুদ্ধিহীন, চেতনাহীন অন্ধশক্তির দ্বারা চালিত হয়ে একটা বিকৃত মানবদেহ অমোঘগতিতে আমার নিকটবর্তী হচ্ছে। কোনোক্রমে বাড়ি ফিরতে পারলে কয়েকটা গূঢ় প্রক্রিয়ার দ্বারা একে আমি ঠেকাতে পারি, কিন্তু এই মাঠে দাঁড়িয়ে তা সম্ভব নয়।
প্রাণপণে দৌড়তে লাগলাম। পারব কি গ্রামের পথে পৌঁছতে? সে পথে একটু এগিয়ে হাঁক দিলে গ্রামের শেষে কোনো বাড়ি থেকে হয়ত শুনতে পাওয়া যাবে।
হঠাৎ অন্ধকারে উঁচুমত একটা কিসের সঙ্গে হোঁচট খেয়ে ঠিকরে পড়লাম জলে। প্রথমেই বলেছি মাঠের মধ্যে কয়েক জায়গায় উঁচু ডাঙা দ্বীপের মত জেগে ছিল, তারই একটাতে ঠোকর লেগে পড়েছি বুঝতে পারলাম। একটা মাটির ঢেলা বা ইটের টুকরোতে ডান হাঁটু পড়েছিল, দারুণ যন্ত্রণায় মাথার ভেতর অবধি ঝন্ঝন্ করে উঠল। হাঁটু আর সোজা করতে পারছি না।
বেশ কিছুক্ষণ আর উঠতে পারব না বুঝতে পারলাম। এতক্ষণ নিজের পায়ের শব্দে টের পাইনি, এবার শুনতে পেলাম ছপ্ ছপ্ করে জলের ওপর দিয়ে ভারী পায়ের আওয়াজ ক্রমেই এগিয়ে আসছে কাছে। এল, এল, ওই এল!
অতিরিক্ত ভয়ে, আতঙ্কে আর আসন্ন ভয়াবহ মৃত্যুর উপলব্ধিতে অকস্মাৎ আমার মন থেকে সবরকম অনুভূতি লুপ্ত হয়ে গেল। হাঁটু চেপে ধরে চিৎ হয়ে শুয়ে আছি, মুখের ওপর ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে, কানে ভেসে আসছে দূরাগত মেঘগর্জন--কিন্ত হাঁটুতে প্রবল যন্ত্রণা ছাড়া পৃথিবীর আর সব বাস্তবতা আমার কাছে অর্থহীন হয়ে গিয়েছে।
এমন সময় আমার চারদিকে জলের ওপর অনেকগুলো পায়ের শব্দ জেগে উঠল। অগুন্তি পা দ্রুত জলে পড়ছে, কারা যেন ছুটে যাচ্ছে এদিকে সেদিকে। আশ্চর্য! কাদের পায়ের শব্দ এ?
এখানে আসতে হলে তো জল পেরিয়ে জানান দিয়ে আসতে হবে, কিন্তু এই পদশব্দ যেন অকস্মাৎ জলের বুকেই জন্ম নিল। শূন্য থেকে জেগে উঠল হঠাৎ।
তড়বড় করে একদল ঘোড়া যেন ছুটে যাচ্ছে সামনে- পেছনে। কি ঘটছে কিছুই বুঝতে পারছি না। বিদ্যুতও চমকাচ্ছে না বেশ কিছুক্ষণ। এবং তারপরেই আমার চারদিকে একপাল শুয়োরের ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ শুনতে পেলাম!
এই দুর্যোগে কইখালির মাঠে শুয়োর কোথা থেকে এল? তাও একটা দুটো নয়, পায়ের আওয়াজে বুঝতে পারছি পনেরো কুড়িটা প্রাণী অন্তত ছুটোছুটি করছে।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমার মনে পড়ে গেল শৈশবে দেখা সেই অদ্ভুত মানুষটিকে, সরু হাড়ের দণ্ড দিয়ে যিনি শূকররূপী হিংস্র প্রবৃত্তিগুলিকে শাসন করেন। তবে কি তিনিই? আমার খুব কাছে এসে কে দাঁড়িয়েছে। তাকে আমি দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু সে আমাকে দেখতে পাচ্ছে। আমার মনে আর ভয় নেই, পরিবেশ থেকে মুছে গিয়েছে অমঙ্গলের অনুভূতি। বরং কার অদৃশ্য উপস্থিতিজনিত পবিত্রতা অনুভব করছি সমস্ত অস্তিত্বে।
কে যেন ভালবেসে হাত রাখল-- না, আমার হাতে নয়, শরীরের কোথাও নয়-- সে হাত রেখেছে আমার বুকের ঠিক মধ্যেটায়।
তারপরই বুঝলাম মাঠে আমি একা, সে উপস্থিতি আসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে আমাকে রক্ষা করে ফিরে গিয়েছে স্বস্থানে। এতক্ষণ বাদে এবার বিদ্যুৎ চমকাল, আকাশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে চিরে যাওয়া আলোয় ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম কোথাও আর কেউ নেই। সে অপচ্ছায়াও নয়--আমার ত্রাণকর্তাও নয়।
রাত বোধহয় আড়াইটে। বৃষ্টি ঝরছে তো ঝরছেই।
কোনোরকমে বাড়ি ফিরে এসে শুয়ে পড়লাম। পরদিন সকালে মেঘ কেটে সূর্য উঠল পাঁচ-ছ’দিন বাদে। ঝকঝকে রোদ্দুরে ভেসে যাওয়া পৃথিবীর রূপ দেখে আমার নিজেরই সন্দেহ হতে লাগল--সত্যিই কি কাল রাত্তিরে কিছু ঘটেছিল? বাড়ির কাউকে কিছু জানালাম না। অনর্থক তাদের চিন্তা বাড়িয়ে লাভ কি?
মা সুস্থ হয়ে ওঠার মাসখানেক পরে আবার বাড়ি ছাড়লাম। একটানা গৃহবাস ঈশ্বর আমার কপালে লেখেন নি। ঘুরতে ঘুরতে এক সন্ধ্যায় খামারবেড়িয়া নামে এক গ্রামে গিয়ে পড়লাম।
দেখি গ্রামের একধারে ঝুরিনামা বটগাছের নিচে একজন জটাধারী সাধু ধুনি জালিয়ে বসে আছেন। ভাবলাম ভালই হল, আজ রাত্তিরটা অস্তত এঁর সঙ্গে কাটানো যাবে। গুটি গুটি ধুনির এপারে গিয়ে বসলাম। প্রত্যেক গ্রামেই কিছু লোক থাকে যারা সাধু-সন্ন্যাসী দেখলে ওষুধ-বিষুধ আর মাদুলির জন্য ভিড় করে। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। জনাকয়েক লোক করুণমুখে তাদের দুঃখ দুর্দশার কথা সাধুকে জানাচ্ছে। ক্রমে তারা বিদায় নিয়ে চলে গেলে সাধুবাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন--তারপর? তোমার কি চাই?
সবিনয়ে জানালাম, আমার কিছু চাই না।
-- তবে আর কি, যাও, বাড়ি যাও--
দু’এক কথায় বুঝিয়ে দিলাম আমার বাড়ি এখানে নয়, আমি পথে পথে বেড়িয়ে বেড়াচ্ছি, আপাতত রাতটা এখানে কাটাতে চাই।
সাধু আর কোনো ব্যক্তিগত প্রশ্ন করলেন না, বললেন-- থাকো!
একটু পরে নিজের ঝুলি থেকে একটা পাকা কলা আর একটা পেয়ারা বের করে আমাকে দিয়ে বললেন-- খাও, আর কিছু আমার কাছে নেই।
-- আপনি খাবেন না?
-- আমি রাত্তিরে কিছু খাই না।
দু’একটা কথা বলতে বলতে আলাপ জমে উঠল। দেখলাম সাধুজী স্বল্পভাষী হলেও বদমেজাজী নন। একসময় আমাকে বললেন- এখানে ধুনি জ্বেলে আজ ভুল কাজ করেছি, বুঝলে?
দু-একদিন থাকব ভেবেছিলাম, কিন্তু কাল চলে যেতে হবে।
-- আজ্ঞে, কেন?
ওপরদিকে আঙুল তুলে সাধুজী বললেন-- এই গাছে অনেক পাখির বাসা রয়েছে, ধুনির গরম হল্কা আর ধোঁয়ায় তারা আজ কেউ বাসায় ফিরতে পারেনি। ওই দেখ, ওদিকে একটা গাছের ভালে বসে কিচমিচ্ করছে। কাউকে গৃহহীন করা মহাপাপ। ইতর প্রাণীদেরও আত্মা আছে, তাদের মনে দুঃখ দিলে সাধনার ফল ক্ষয় হয়ে যায়--
বললাম-- যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?
-- কি?
-- আপনি কোন্ মার্গের সাধক?
-- কেন বল তো?
-- আপনার কথা শুনে আমার খুব ভাল লাগছে। আমি অনেক সাধুসঙ্গ করেছি, বেশির ভাগ সাধকেরা অন্তরে মহৎ হলেও বড় কটুভাষী, অপরের দুঃখ সম্বন্ধে উদাসীন। আপনার মত কথা বলতে শুনিনি কাউকে।
সাধু মৃদু হেসে বললেন-- কোনো মার্গেরই নয়। আমার দীক্ষাই হয়নি।
অবাক হয়ে বললাম-- সে কি! তাহলে?
-- তাহলে আর কি? ভগবানের স্বরূপ জানতে ইচ্ছে করে, তাই ঘুরে বেড়াই, তাঁর সৃষ্টির বিচিত্র রূপের মধ্যে তাঁকে বুঝতে চেষ্টা করি। ভগবানকে ডাকব, তার আবার মার্গ কি? দীক্ষা কি?
সাধুজীর ওপর শ্রদ্ধা হল। আবছা অনুভব করতে পারলাম--অনেক বড় সাধক ইনি। সারারাত ধরে কত গল্প করলেন, ধর্মের বিভিন্ন দিক সম্বন্ধে গভীর জ্ঞানের পরিচয় দিলেন। সঙ্কীর্ণতা নেই এতটুকু। সব মতের প্রতিই সমান শ্রদ্ধা।
তাঁকে প্রশ্ন করলাম-- আপনি যে ভগবানকে ডাকেন, তার কোন্ রূপ কল্পনা করেন ধ্যানের সময়?
-- কোনো রূপই নয়। মনকে কেন্দ্রীভূত করতে পারলে ঈশ্বরের রূপকল্পনার প্রয়োজন হয় না। দু-রকম শক্তি মহাবিশ্বে ক্রিয়াশীল। শুভশক্তি, আর ঈশ্বরবিরোধী অশুভশক্তি। বিশ্বের সৃষ্টির সময়েই এই দুই শক্তির জন্ম। ঈশ্বরবিরোধী শক্তির ক্ষমতা কিন্তু কম নয়, বৌদ্ধধর্মে একেই “মার” হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। কালভৈরবের মাধ্যমে জগদীশ্বর এর দমন করেন। সর্বদা এই দুই শক্তির লড়াই চলেছে। তোমার চারদিকে তার প্রকাশ তো দেখতেই পাচ্ছ-- বললাম-- কালভৈরব কে?
-- তিনি শুভশক্তির প্রয়োগকর্তা। দক্ষিণকালিকাতন্ত্রে তাঁর রূপ কল্পনা করা হয়েছে এইভাবে-- মহাবলশালী পুরুষ, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, নগ্নগাত্র, রিপুতাড়ন তাঁর প্রধান কর্ম। শূকরের ছদ্মবেশে কাম-ক্রোধ-হিংসা ইত্যাদি রিপুগণ তাঁর বশবত্তী হয়ে সর্বদা তাঁর সঙ্গে ঘোরে। নিজের বুকের পাঁজরের একখানা হাড় দিয়ে তিনি তাদের শাসন করেন।
আমি তখন উত্তেজনায় সটান খাড়া হয়ে বসেছি। এ বর্ণনা তো কইখালির মাঠে শৈশবে দেখা সেই মানুষটির সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। বললাম--তারপর?
-- আর কি? কালভৈরবই অনিবার্য ধ্বংসের হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করছেন। ঈশ্বরের সাক্ষাৎ শিষ্য তিনি। আমি সেই ভগবানেরই আরাধনা করি।
আমার গলা তখন আবেগে বুঁজে এসেছে। স্বয়ং কালভৈরব সেদিন রাত্তিরে আমাকে স্বয়ং এসে রক্ষা করেছেন। শৈশবে তাঁর অপার করুণার স্পর্শ দিয়েছেন। একটু চুপ করে থেকে তারানাথ বলল-- কিন্তু সে তুলনায় জীবনে কিছুই করতে পারলাম না। কতগুলো তুচ্ছ সিদ্ধাই পেয়েছিলাম, কিছু টাকাকড়ি-- বড় কিছুই হল না। এ জন্ম এমনই গেল। দেখি, যদি পরজন্ম বলে কিছু থাকে-- অন্তত এবারের ভুলগুলো আর করব না--
তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল--আজকের গল্প এইখানেই শেষ। কিন্তু ভয় পেয়ো না, বলবার মত গল্প আমার ঝুলিতে আরো অনেক রয়েছে! সময়মতো বলা যাবে। আজ থামি তাহলে, কেমন?
শেষ
তারানাথ তান্ত্রিকের গল্প (বিশুঠাকুর)
(এই লেখকের অন্য লেখা পড়তে লেখকের নামের উপর ক্লিক করুন)
পুজোর পর অফিস খুলেছে। দশ-বারোদিন কুঁড়েমি করার পর কাজে আর মন বসে না, সকালে উঠে জোর করে অফিসের জন্য তৈরি হতে হয়। এতদিনেও বেশ পোক্ত চাকরিজীবী হতে পারলাম না। আমার বিশ্বাস মানুষের জীবনটা প্রধানত অবকাশ-যাপনের জন্যই, তবে অবসর সময়ে একটা চাকরি করলে ক্ষতি নেই। কিন্তু বর্তমান পৃথিবীর দাবী এত বেশি যে, চাকরিই প্রধান হয়ে উঠেছে, অবকাশটা গৌণ। অথচ মানবসভ্যতার শ্রেষ্ঠ অবদান যা--যেমন সাহিত্য, শিল্প, ভাষ্কর্য সবই তো অবকাশের ফসল। একমাত্র বার্নে পেটেন্ট অফিসে কাজ করতে করতে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদের আবিষ্কার ছাড়া চাকরি করে কে কবে অমর হয়েছে?
ছুটির পর বাড়ি ফিরে চা খেতে খেতে এইসব উচ্চমার্গের চিন্তা করছিলাম। ক্রমে যখন ধারণা হয়ে এসেছে যে, চাকরি না করলে আমিও জগতে অমর কীর্তি রেখে যেতে পারতাম, (ক্লাশ সেভেনে যখন পড়ি, আমার লেখা কবিতা পড়ে থার্ড পণ্ডিত মশাই যে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন সেটা তো আর মিথ্যে নয়! কেউ কেউ যে রবি ঠাকুরের কবিতার সঙ্গে মিল দেখতে পেয়েছিল, সেটা কেবল 'নিন্দুকগুলা খাইতে পায়না বলিয়াই'--) সেই সময়ে বাইরে থেকে কিশোরীর হাঁক শোনা গেল। বেরিয়ে বললাম-- ব্যাপার কি?
-- এই যে, ফিরেছ দেখছি। আজ আর তাসের আড্ডায় যেতে ইচ্ছে করছে না। চল, তারানাথকে বিজয়ার প্রণাম করে আসি--,
শার্টটা গায়ে চাপিয়ে কিশোরীর সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। তারানাথ রাবড়ি খেতে ভালবাসে, কিন্তু সম্প্রতি তার যা আর্থিক অবস্থা তাতে রাবড়ি খাওয়া চলে না। কিশোরী আর আমি পকেট হাতড়ে যা বের করলাম, তা দিয়ে তালতলার চেনা হিন্দুস্থানীর দোকান থেকে সেরখানেক রাবড়ি কিনে নেওয়া গেল।
আমাদের দেখে তারানাথের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বলল-- বৌ আর ছেলেপিলেরা ছাড়া এই তোমরাই যা বিজয়া করতে এলে এবার! এত যে জানাশোনা লোক ছিল, তারা গেল কোথায় বল দেখি?
রাবড়ি পেয়ে তারানাথ খুব খুশি, -- ওঃ এ তো প্রায় সেরখানেক হবেই! অনেকদিন পর পেট ভরে রাবড়ি খাব। বোসো তোমরা, চা বলে আসি--
চা এল, সঙ্গে নারকেল নাড়ু আর বাড়িতে ভাজা কুচো নিম্কি। খাওয়ার পর কিশোরীর পকেট থেকে অবশ্যম্ভাবী পাসিং শো-এর প্যাকেটটি বেরুল। সিগারেট ধরিয়ে তারানাথ চোখ বুঁজে মৌজ করে টান দিচ্ছে, কিশোরী বলল-- আজ বছরকার দিনটা, একটা গল্প না শুনেই ফিরে যাব?
তারানাথ চোখ মেলে হেসে বলল-- তোমরা দুটিতে যখন এসেছ, গল্প না শুনে ফিরবে না জানি। কি রকম গল্প চাই?
-- আজ আমাদের কোনো বায়না নেই। আপনি যা বলবেন--
কিছুক্ষণ তারানাথ চুপ। বোধহয় মনে মনে গল্পটাকে গুছিয়ে নেবার কাজ চলছে। সিগারেটে শেষ টান দিয়ে অ্যাশট্রে হিসেবে ব্যবহৃত একটা নারকেলের মালায় গুঁজে তারানাথ বলতে শুরু করল-- বীরভূমের একটা রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বসে আছি। লুপ লাইনের অখ্যাত, গেঁয়ো স্টেশন। সাহেবগঞ্জ লোকাল ধরে হাওড়া আসব, তা সে ট্রেন শুনলাম দেড়ঘণ্টা লেট। কোথাও একটা খাবারের দোকানও নেই যে এককাপ চা খাব। একটা বিড়ি ধরিয়ে পায়চারী করছি, দেখি প্র্যাটফর্মের একেবারে শেষ প্রান্তে একটা ইঁটের পাঁজার ওপর একজন বিশাল চেহারার লোক চুপ করে বসে আছে। পোশাক খুবই সাধারণ, খাটো ধুতির ওপর একটা ফতুয়া গোছের জামা, পায়ে বহু পুরনো একজোড়া চটি। মাথায় অযত্নলালিত ঝাঁকড়া চুল। কিন্তু লোকটার ঋজু বসবার ভঙ্গিতে আর চোখের দৃষ্টিতে এক আশ্চর্য ব্যক্তিত্বের ছাপ রয়েছে, বার বার তাকিয়ে দেখতে হয়।
আমাকে অনেকক্ষণ একা কাটাতে হবে, কাজেই আলাপ জমাবার উদ্দেশ্যে ইঁটের পাঁজার একপাশে বসে পড়ে জিজ্ঞাসা করলাম-- সাহেবগঞ্জ লোকাল ধরবেন বুঝি?
আমার দিকে না তাকিয়েই লোকটা বলল-- হ্যাঁ।
-- সে ট্রেন তো শুনলাম দেড়ঘণ্টা দেরিতে আসছে।
-- হ্যাঁ।
দু'বার এরকম একাক্ষরী উত্তর দেবার পর লোকটি এবার আমার দিকে তাকাল। বেশ বুদ্ধিদীপ্ত চোখে আমার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলল-- গুরুর দর্শনলাভ ঘটেছে?
হেসে বললাম-- কি করে বুঝলেন?
লোকটিও সামান্য হেসে বলল-- হাত গুনতে হয় না, তোমার গেরুয়া আর রুদ্রাক্ষের মালা দেখেই বলা যায় তুমি কোন্ পথের পথিক।
-- আর গুরুর ব্যাপারটা?
-- গুরুর কৃপা না পেলে চোখে জ্যোতি ফোটে না। তোমার চোখে সেই জ্যোতি রয়েছে। 'তুমি' বলছি বলে রাগ করছ না তো? তুমি আমার চেয়ে অনেক ছোট--,
সবিনয়ে বললাম-- না না, আমাকে 'তুমি'-ই বলবেন।
-- আমার বয়েস কত মনে হয়?
ভাল করে তাকিয়ে দেখে বললাম-- বছর পঞ্চাশেক হবে, না কি?
-- আমার এই বাহাত্তর চলছে, সামনের চৈত্রে তিয়াত্তর হবে।
অবাক হয়ে বললাম-- বলেন কি। যাঃ, তা কি করে হতে পারে? আপনার তো একটা চুলও পাকেনি দেখছি--
-- পাকবেও না। যেদিন যাবার হবে এইভাবেই চলে যাব।
আমি উঠে তাঁর পায়ের ধুলো নিয়ে বললাম-- আপনি নিশ্চয় সিদ্ধপুরুষ, অনেক ভাগ্যে আপনার দেখা পেলাম। আমাকে আশীর্বাদ করুন।
লোকটি সজ্জন, আমি পায়ে হাত দিতে সঙ্কুচিত হয়ে বললেন-- আরে আরে! পায়ে হাত দিচ্ছ কেন? আমি সিদ্ধপুরুষ টুরুষ কিছু নইরে ভাই, নিয়মিত প্রাণায়াম করি-- তাতেই শরীরটা তৈরি হয়ে গিয়েছে আর কি। জরার আক্রমণ কিছুদিন ঠেকিয়ে রাখতে পারব।
ইঁটের পাজার ওপর লোকটির পাশে জমিয়ে বসলাম। একটু একটু করে আলাপও হয়ে গেল। তার নাম বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য, লোকে বিশুঠাকুর বলে ডাকে! এককালে মুর্শিদাবাদের কোন্ গ্রামে বাড়ি ছিল, এখন কিছু নেই। এইরকম ঘুরে ঘুরে বেড়ান, কোথাও কোনো বটতলায় বা মন্দিরে আশ্রয় নেন। সাধুসন্তের প্রতি গ্রামের মানুষের আকর্ষণ চিরকালের-- তারা দেখতে এসে কলা মুলো যা দেয় তাতেই একটা পেট চলে যায়।
জিজ্ঞাসা করলাম-- এখন যাচ্ছেন কোথায়?
উনি একটু চুপ করে থেকে বললেন-- বেশিদূর নয়, এই কয়েকটা ইস্টিশন পরেই আমার এক গুরুভাইয়ের বাড়ি। একসঙ্গে দীক্ষা নিয়ে দুজনে কিছুদিন সাধনা করেছিলাম। পরে সে অবশ্য বিয়েথাওয়া করে সংসারী হয়-- ধানের ব্যবসা করে কিছু টাকাও করেছিল, সেটাই তার কাল হল শেষ অবধি--
নড়ে বসে বললাম-- কি রকম?
বিশুঠাকুর বললেন-- আমার সেই বন্ধু, রামরাম ঘোষাল, দিন দশবারো আগে খুন হয়েছে।
-- সেকি! খুন! কেন?
-- রামরামের কিছু টাকাপয়সা হয়েছিল এ খবর অনেকেই জানত। নিজের বসতবাড়ি থেকে একটু দূরে বাঁশঝাড়ের পেছনে রামরাম একখানা ঘর তুলেছিল, সেখানে রাত্তিরে গিয়ে সাধনভজন করবার চেষ্টা করত। গৃহী হয়েও এ অভ্যেসটা ছাড়তে পারেনি। এই ঘরেরই মাটির মেঝেতে টাকা পুঁতে রেখেছিল রামরাম। তাকে মেরে মাটি খুঁড়ে সবকিছু নিয়ে চলে গিয়েছে।
-- কে করল এ কাজ?
বিশুঠাকুর বললেন-- জানি না। তবে যে করেছে তাকে শাস্তি পেতেই হবে। যে কাঠায় মাপ, সে কাঠায় শোধ, বুঝলে?
ঠাকুরের গলার স্বরে একটু অবাক হলাম। এ শুধু প্রিয় বন্ধুর অক্ষম হাহাকার নয়, এ কথার পেছনে দৃঢ় প্রত্যয় লুকিয়ে রয়েছে। কিন্তু অজ্ঞাত হত্যাকারীর বিরুদ্ধে বিশুঠাকুর কিইবা করতে পারেন তা বুঝলাম না।
-- তুমি কোথায় চলেছ?
হেসে বললাম-- কোথাও না। মানে, কোনো ঠিক নেই আর কি। বাড়িতে ভাল লাগে না, তাই ঘুরে ঘুরে বেড়াই, আর সাধুসন্ন্যাসীর দেখা পেলে তাঁদের সঙ্গলাভের চেষ্টা করি। এই যেমন এখন ইচ্ছে করছে আপনার সঙ্গে থাকি--
বিশুঠাকুর এই প্রথম হাসলেন, বললেন-- আমার সঙ্গে থাকতে চাও? বেশ, চল-- আমার কোনো আপত্তি নেই। খাওয়াদাওয়া কিন্তু আমার যা জুটবে তোমারও তাই, আবার নাও জুটতে পারে, চলবে তো?
-- আমার অভ্যেস আছে।
আমার সংক্ষিপ্ত উত্তরে বিশুঠাকুর একবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, তারপর বললেন-- চল তাহলে।
গ্রামে পৌঁছনো গেল। বিশুঠাকুর আগে দু-একবার এ গ্রামে এসেছেন। তিনি হনহন করে হেঁটে গ্রামের একেবারে শেষপ্রান্তে একটা বড় আটচালা বাড়ির সামনে দাঁড়ালেন। মাঝখানে উঠোন ঘিরে গায়ে গায়ে লাগা অনেকগুলো ঘর, উঠোনে তুলসীমঞ্চ। ঘরে ঘরে আলো জ্বালার উদ্যোগ চলছে, কয়েকটি শিশুর কলরব শোনা যাচ্ছে। কিন্তু সবমিলিয়ে বাড়ির পরিবেশে একটা শোকের বিষণ্ণতা পরিব্যপ্ত হয়ে আছে। বিশুঠাকুর আমার হাত ধরে উঠোনে এসে দাঁড়ালেন।
গৃহস্বামী এগিয়ে এসে অতিথিকে আপ্যায়ন না করলে অতিথির পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকাটা বড় অস্বস্তিকর হয়ে পড়ে। এ বাড়ির কর্তা এখন কে জানি না, কাজেই আমরা চুপ করে দাঁড়িয়েই রইলাম।
মিনিটদশেক পরে উঠোনের ওধারের একটা ঘর থেকে প্রদীপ হাতে এক বিষণ্ণমূর্তি মহিলা বেরিয়ে তুলসীতলায় আসতে গিয়ে আমাদের দেখে থমকে দাঁড়িয়ে বললেন-- কে? কে ওখানে?
বিশুঠাকুর দু-পা এগিয়ে গিয়ে বললেন-- বৌমা, আমি বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য। চিনতে পারছ? রামরাম থাকতে আমি এসেছি কয়েকবার--
মহিলাটি একমুহূর্ত নীরব থাকবার পর চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। তাঁর কান্নার শব্দে চারদিকের ঘর থেকে এতক্ষণে অনেকে বেরিয়ে এল। বেশ কিছুক্ষণ একটা মিশ্র কোলাহল চলবার পর আমরা দাওয়ায় বসবার আসন গেলাম।
একঘন্টা পর।
বিশুঠাকুর এসেছেন শুনে গ্রামের অনেকে জড়ো হয়েছে রামরাম ঘোষালের বাড়ি। তালপাতার চাটাইতে বিশুঠাকুর বেশ ঋজু হয়ে বসে আছেন। রামরামের ছোটভাই শিবরাম চোখে জল নিয়ে হাতজোড় করে ধরা গলায় বলছে-- ঠাকুরমশাই, কে একাজ করেছে জানি না-- কিন্তু যেই করুক, সে ভুল করেছে। দাদা আমার শিবতুল্য মানুষ ছিলেন, ব্যবসা করতেন বটে, কিন্তু টাকাকড়ির ওপর কোন লোভ ছিল না। কত লোকের পাওনা ছেড়ে দিয়েছেন, কত লোকের কন্যাদায় উদ্ধার করেছেন। এ অঞ্চলের সবাই জানত বিপদে পড়ে রামঠাকুরের কাছে গেলে খালিহাতে ফিরতে হবে না। এত পয়সা উপার্জন করতেন, কিন্তু নিজে পরতেন একটা খাটো ধুতি, সারাদিনের শেষে খেতেন একমুঠো আতপচাল সেদ্ধ। আমার বিশ্বাস, হত্যাকারী চাইলে দাদা টাকাপয়সা সবই বের করে দিতেন, খুন করবার দরকার হত না। সবই ভাগ্য--
বিশুঠাকুর জিজ্ঞাসা করলেন--পুলিশ কি বলছে?
শিবরাম উত্তর দেবার আগেই ভিড়ের মধ্য থেকে একজন কে বলে উঠল-- পুলিশ বরাবর যা বলে। খুনের পরদিন সকালে খবর দেওয়া হয়েছে, পুলিশ এসেছে বিকেলে। কি ঝামেলা ভাবুন তো! আবার দারোগা বলে দিয়েছিল-- পুলিশ পৌঁছনোর আগে যেন মৃতদেহ সৎকার না করা হয়। সেই দেহ নিয়ে পরদিন রাত বারোটা অবধি সবাই বসে। এদিকে পুলিশের কি হম্বিতম্বি-- গ্রামসুদ্ধু লোককে ফাঁসি দেয় আর কি! তারপর পুলিশও চলে গেল, সবকিছু মিটে গেল। খুনি আর ধরা পড়েছে!
বিশুঠাকুর বিষণ্ণতা মাখানো গলায় বললেন--ঠিকই। পুলিশের অপদার্থতা আর কারও জানতে বাকি নেই, খুনীকে তারা ধরতে পারবে বলে আমারও বিশ্বাস হয় না। আহা, রামরাম এমন বেঘোরে মারা যাবে স্বপ্নেও ভাবিনি। নাঃ, এ খুনের কিনারা কিছু হবে না--
আমি একটু অবাক হয়ে বিশুঠাকুরের মুখের দিকে তাকালাম। এই আজই কয়েকঘণ্টা আগে উনি জোর দিয়ে বলেছেন খুনীরা শাস্তি পাবেই, আবার এখন বলছেন হত্যার কিনারা হবে না-- ব্যাপার কি? কিন্তু বিশুঠাকুর সত্যিই যেন কেমন হতাশ আর হালছাড়া ভঙ্গিতে বসে রয়েছেন, মুখে শোকের ছায়া। আসলে বন্ধুর মৃত্যুতে বুড়োমানুষ হয়ত রেগে গিয়ে ওসব কথা তখন বলেছিলেন, সত্যিই তো-- কি করে আর এখন ধরা যাবে হত্যাকারীকে?
একজন দীর্ঘদেহ শ্যামবর্ণ লোক ভিড়ের থেকে একটু আলাদা হয়ে দাওয়ার একপ্রান্তে বসে সবার কথা শুনছিল। গ্রাম্য মানুষদের থেকে তার ব্যক্তিত্বকে কিছুটা আলাদা করে বোঝা যায়। অন্য সবাই বেশির ভাগই খালি গায়ে এসেছে, কেবল এ লোকটির গায়ে হাফহাতা নীল শার্ট। এসব শহুরে ধাঁচ লোকটা পেল কোথায় তা ভাবছি, এমন সময় লোকটা বলে উঠল-- খুনের কিনারা হবে না বলছেন? ভাবলেও খারাপ লাগে, রামজ্যাঠার মত লোক--খুনীর শাস্তি না হলে তাঁর আত্মা শাস্তি পাবে না। কিছুই কি করার নেই?
সে কথার উত্তর না দিয়ে বিশুঠাকুর লোকটির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন-- তুমি কে?
লোকটি যেন একটু থতমত খেয়ে বলল-- আজ্ঞে, আমি হরিপদ!
-- রামরামের ভাইপো?
-- আজ্ঞে না, ওঁকে ছোটবেলা থেকেই জ্যাঠামশাই বলে ডাকি। উনি আমার বাবার বন্ধু ছিলেন।
-- গতবার এসে তো তোমাকে দেখেছি বলে মনে হয় না।
হরিপদ বলল-- ঠিকই। আমি মাঝে প্রায় পনেরো বছর গ্রামে ছিলাম না। বাইরে চাকরি করতাম, সম্প্রতি ফিরে গ্রামে বসেছি।
-- চাকরি ছাড়লে কেন?
বিশুঠাকুরের জেরায় লোকটি স্পষ্টত বেশ অস্বস্তি বোধ করছে। সে বলল-- শরীরটা ভাল যাচ্ছে না, চাকরির ধকল পোষাল না। শরীর একটু ভাল বোধ করলে হয়ত আবার চলে যাব--
বিশুঠাকুর তাকে আর কোন প্রশ্ন করলেন না। উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে একটু মাতব্বরমত শ্রীদাম ঘোষ বলল-- ঠাকুর যখন এসেছেন, এঁদের বাড়িতে একটু স্বস্ত্যয়ন করে দিয়ে যান। অপঘাতটা হল তো-- বাড়ি ঠাণ্ডা হবে'খন।
-- সে হবে। কর্তব্য করব বলেই তো এসেছি--
আবার ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম। ভারি অদ্ভুত মানুষ তো! সেই দৃঢ় প্রত্যয়ের সুর ফিরে এসেছে গলায়। কর্তব্য! কি কর্তব্যের কথা উনি বলছেন?
কিন্ত আমাকে বেশি ভাবতে না দিয়ে বিশুঠাকুর হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে বললেন-- চল দেখি তোমরা, রামরামের সেই চালাঘর কোনদিকে? একটু দেখে আসি জায়গাটা--
গ্রামে যেমন হয়, পুরো ভিড়টা আমাদের সঙ্গে চলল। বাড়ির পেছনের ঘন বনজঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটা ছোট্ট সুঁড়িপথ চলে গিয়েছে। সেটা ধরে বেশ কিছুটা যাওয়ার পর মৃত রামরাম ঘোষালের সাধনপীঠে এসে উপস্থিত হলাম। সামান্য খানিকটা জায়গা পরিষ্কার করে মজবুত চালাঘর তোলা হয়েছে, মাটির সিঁড়ি বেয়ে উঠে প্রথমে সরু দাওয়া, তারপর ঘর। দরজা খোলা - হা হা করছে। এখানে কয়েকদিন আগেও একজন রীতিমত জীবন্ত মানুষ বসে ঈশ্বরের আরাধনা করত। এখনও তার রক্তের দাগ মাটির মেঝেতে লেগে রয়েছে। এসব ভাবতে গিয়ে মনটা উদাস হয়ে গেল। হাসিমুখে যে লোকটা দুপুরে ভাত খেয়েছে, ভোরে সূর্যপ্রণাম করেছে, ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছে-- সে জানত না পরের দিন সকালে এই পৃথিবীটা তার কাছে অনেক
দূরের হয়ে যাবে। এইটুকু তো মানুষের জীবন, নিতান্ত অনিশ্চিত--এরই মধ্যে কত ঈর্ষা ও বিদ্বেষ, পার্থিব ভোগ্যবস্তু অধিকার করে রাখার প্রাণপণ প্রচেষ্টা! কি সার্থকতা এর?
বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য আর আমি দাওয়া পেরিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকলাম। শ্রীদামের হাতে লন্ঠন ছিল, সেও আমাদের সঙ্গে ঢুকল ঘরে-- তার পেছনে শিবরাম। বাকিরা ভিড় করে দাঁড়াল দরজার কাছে। গ্রামে এমনিতে জীবন নিস্তরঙ্গ--কাজেই সামান্য কিছু ঘটলেও খবর রটে বিদ্যুতের গতিতে। ঘোষালবাড়িতে দুজন সাধু এসেছে--এ বার্তা রটে যেতেই অর্ধেক গ্রাম রামরামের চালাঘরের সামনে এসে জমল।
ঘরের এককোণে কাঠের ছোট জলচৌকির ওপর লাল বনাত দিয়ে ঢাকা ঠাকুরের আসন। সেখানে সিঁদুর মাখানো একটি পাথরের কালীমূর্তি রয়েছে। দেয়ালে দশমহাবিদ্যার ছাপা ছবি বাঁধানো, বাজারে যেমন কিনতে পাওয়া যায়। এছাড়া সমস্ত ঘরে আর কিছুই নেই, আসবাবপত্রও না।
ঘরের মেঝেতে এখানে-সেখানে মাটি খুঁড়ে ডাঁই করা রয়েছে। হত্যাকারী বেশ মাথাঠাণ্ডা লোক বলতে হবে। একজনকে খুন করে তার মৃতদেহের পাশে বসে মাটি খুঁড়ে লুকোনো টাকা বের করতে হলে স্নায়ুর ওপর রীতিমত কর্তৃত্ব থাকা প্রয়োজন। একবারে যে খুঁজে পায়নি তা বোঝাই যাচ্ছে, কারণ মেঝের বিভিন্ন অংশ খোঁড়া হয়েছে। ঠাকুরের আসনের সামনে মাটির মেঝেতে কালো ছোপ লেগে, রক্ত শুকিয়ে কালো দেখাচ্ছে। অর্থাৎ গভীর রাত্তিরে রামরাম ঘোষাল যখন দরজার দিকে পেছন ফিরে সাধনায় রত ছিলেন, তখন আততায়ী পেছন থেকে তাঁকে আঘাত করে।
মাটিতে লেগে থাকা রক্তের দাগের দিকে তাকিয়ে বিশুঠাকুরের চোখ জলে ভরে এল। ধরা গলায় তিনি বললেন-- রামরাম, তুই আমাদের চেয়ে অনেক বড় ছিলি। আমি তো সংসার ছেড়ে বিবাগী হয়ে বেড়াই। আর তুই গৃহী হয়েও সাধনা ছাড়িস্ নি-- অনেক মহৎ ছিলি তুই--
তারপর কেমন একটা দৃষ্টিতে ঘরের অন্ধকার একটা কোণের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস্ করে বললেন-- আমি এসে গিয়েছি। কাজ সেরে ফিরব। তুই ভাবিস্ না-
এমন দৃঢ়তার সঙ্গে বিশুঠাকুর কথাগুলো বললেন যেন ঘরের ওই শূন্য অন্ধকার কোণে তিনি এক অশরীরী উপস্থিতিকে প্রত্যক্ষ করছেন। আমার সমস্ত শরীরে কাঁটা দিল। শ্রীদাম আর শিবরামও দেখি কেমনভাবে তার দিকে তাকাচ্ছে, পাগল ভাবছে কিনা কে জানে।
বিশুঠাকুর বললেন-- চল তারানাথ, বাইরে যাই।
ঘর থেকে বেরিয়ে আমরা দাওয়ায় বসলাম। গ্রামবাসীরা চারদিকে ঘিরে রইল। আমি শ্রীদামকে বললাম-- ঘোষালমশায়ের সাহস ছিল বলতে হবে। এমন নির্জন জায়গায়, জঙ্গলের মধ্যে রাত্তিরে একা থাকতেন। সাধারণ লোক হলে পারত না।
-- আজ্ঞে হ্যাঁ। তবে সাধক মানুষ তো, কিছুকে পরোয়া করতেন না।
শিবরাম বলল-- দাদার সঙ্গে কেতু থাকত, দাদার আদরের কুকুর। কিন্ত দাদার মৃত্যুর পর থেকে তাকেও কোথাও দেখা যাচ্ছে না। কোথায় যে গেল কুকুরটা।
হঠাৎ দেখলাম বিশুঠাকুর ঋজু হয়ে বসেছেন, চোখে বুদ্ধি মেশানো খরদৃষ্টি। বললেন-- কেতু কি দেশি কুকুর?
-- আজ্ঞে! বিলিতি কুকুর আর এই গ্রামে আমরা কোথা থেকে পাচ্ছি বলুন? তবে দেশি কুকুর বলে তাকে কেউ অবহেলা করতে সাহস পেত না। এই বিশাল চেহারা কেতুর, সিংহের মত থাবা। ভারী গলায় তার গর্জন শুনলে অচেনা লোকের নাড়ী ছেড়ে যেত। বাড়ির কাছে কারো আসার উপায় ছিল না-- বাঘের মত কুকুর ঠাকুরমশাই! দাদার পেছন পেছন ঘুরত সারাদিন, দাদা রাত্তিরে এইখানে এলে কেতুর দরজার কাছে চুপটি করে বসে থাকত।
-- ওহ্। তাকে আর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না বলছ?
-- না ঠাকুরমশাই। দাদা মারা যেতে কোথাও চলে গিয়েছে হয়ত। জন্তু জানোয়াররা সব বুঝতে পারে।
বিশুঠাকুর যেন বিষয়টা ঝেড়ে ফেলার মত করে শিবরামকে বললেন-- তা হবে হয়ত। যাক্ গে সে কথা, আমরা কিন্তু আজ রাত্তিরটা এখানেই থাকব, বুঝলে?
শিবরাম অবাক হয়ে বলল-- এখানে কি করে থাকবেন? পাড়া থেকে এতটা দূরে, বনের মধ্যে--
-- আমাদের কোন অসুবিধে হবে না। শুধু কিছুটা দুধ দিয়ে যেয়ো, আর একবোঝা শুকনো কাঠ, ধুনি জ্বালাব।
শিবরাম বলল-- আমি গিয়েই কাঠ আর দুধ পাঠিয়ে দিচ্ছি। যদি বলেন, চাল-ডাল আর নতুন হাঁড়িও দিচ্ছি, বরং দু'টো ভাত ফুটিয়ে নিয়ে--
বিশুঠাকুর দৃঢ়গলায় বললেন-- প্রয়োজন হবে না। আমি রাত্তিরে দুধ ছাড়া কিছু খাই না।
-- ঠিক আছে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তবে ঠাকুরমশাই আজ আমার বাড়িতে থাকলেই ভাল করতেন--
-- আমার এরকম বাইরে থেকেই অভ্যেস, কারো বাড়িতে থাকলে ঘুমোতে পারব না। তাছাড়া ভয় কি? এখান থেকে চেঁচিয়ে ডাকলে তো তুমি শুনতে পাবে, তাই না?
-- আজ্ঞে হ্যাঁ।
-- তবে ঠিক আছে। কাল আমরা চলে যাব, একটা রাত এখানেই কেটে যাবে। যার সঙ্গে এত বন্ধুত্ব-- যাকে দিয়ে সম্পর্ক-- সেই যখন রইল না--
তারপর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বিশুঠাকুর বললেন-- নাঃ, আর মায়া বাড়াব না-
ঠাকুরের গলাটা যেন বড়ই অভিনয়-অভিনয় ঠেকল। এত দীর্ঘশ্বাস ফেলে হা-হুতাশ করবার লোক ইনি নন। কি ব্যাপার বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলাম।
বিশুঠাকুর আবার বললেন-- সত্যি, মানুষের কি কপাল! টাকা পয়সা তো মেঝে খুঁড়ে নিয়ে গেলই, গ্রামের কালীমন্দিরটাও আর হল না--
ভিড়ের মধ্যে সামান্য গুঞ্জন চলছিল, হঠাৎ তা থেমে গেল। সবাই নতুন কথা শুনে বিশুঠাকুরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
শ্রীদাম ঘোষ বলল-- আজ্ঞে, ঐ কালীমন্দিরের কথাটা কি বললেন, ঠিক বুঝলাম না তো?
-- কেন তোমরা জান না? রামরাম ঠিক করেছিল গ্রামে বিরাট কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করবে। স্বপ্নে আদেশ পেয়েছিল দেবীর কাছ থেকে। এজন্য কিছু সোনা কিনে জমিয়ে রেখেছিল বেচারা। সে-সবও হত্যাকারী নিয়ে গেল!
শিবরাম অবাক হয়ে বলল-- দাদা সোনা কিনে জমিয়ে রেখেছিল। বলেন কি ঠাকুরমশাই? কই, আমরা তো কিছু জানতাম না--
-- জানবে কি করে? গোপনে করছিল কাজটা। মন্দির প্রতিষ্ঠা হলে দেখতেই পেতে। গতবার যখন আসি, আমাকে একমুঠো পাকা সোনার গিনি দেখিয়ে ছিল। এ ক'বছরে না জানি আরও কত গিনি জমেছিল। সবই পরের ভোগে চলে গেল। মন্দিরটা হলে তোমাদেরই থাকত। মেঝে খোঁড়ার কথা শুনেই বুঝেছি হত্যাকারী আর কিছু রেখে যায়নি—
ভীড়টা আস্তে আস্তে পাতলা হয়ে এল। এত বড় খবরটা বাড়ি গিয়ে সবাইকে জানাতে হবে তো!
শিবরামও শেষপর্যন্ত আমাদের প্রণাম করে উঠে পড়ল। -- লন্ঠনটা রইল ঠাককুরমশাই, তেল ভরা আছে।
হঠাৎ পেছন থেকে বিশুঠাকুর তাকে ডাকলেন-- শিবরাম, শোনো।
-- আজ্ঞে?
-- দুধটা তুমি নিজে দিয়ে যেয়ো, কারো হাত দিয়ে পাঠিয়ো না-- আর--
শিবরাম বিনীত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
-- রামরামের কুকুর কেতুর গায়ের রঙ কি ছিল বলতে পার? লাল?
একটু বিস্মিত হয়ে শিবরাম বলল-- আজ্ঞে না, কালো, মিশমিশে কালো। কেন বলুন তো?
-- নাঃ, এমনি মনে হল তাই জিজ্ঞাসা করলাম। আচ্ছা, তুমি যাও এখন!
শিবরাম চলে যেতেই চারদিকে নৈশ স্তব্ধতা যেন প্রকট হয়ে উঠল। ঝিঁঝি ডাকছে জঙ্গলে, বাঁশবনে অদ্ভুত শব্দ করে বাঁশ দুলছে। মাথার ওপরে কেবল একটুখানি খোলা আকাশ দেখা যায়। অজস্র নক্ষত্র ফুটেছে কালো রাত্রির পটে। আবহাওয়া বেশ সুন্দর, তেমনি গরমও নেই, আবার ঠাণ্ডাও নয়।
বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্যের গলা শুনতে পেলাম রাত্রির নির্জনতার মধ্যে বেজে উঠেছে, আস্তে আস্তে স্পষ্ট, উচ্চারণে বলছেন--অহন্যহনি ভূতানি গচ্ছন্তিহ যমালয়ম্, শেষাঃ স্থাবরমিচ্ছন্তি কিমাশ্চর্যমতঃপরম্!
বললাম-- মহাভারত?
-- হ্যাঁ। বকরপী ধর্মের সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের সংলাপ। প্রত্যেক দিনই পৃথিবীতে শতশত মানুষ মরছে, কেউ পার্থিব সম্পদ বোঁচকা বেঁধে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারছে না। তবু যারা বেঁচে আছে তারা ভাবছে তারা বুঝি চিরকালই বেঁচে থাকবে।
-- কিন্তু সবাই এই সার কথা বুঝে সন্যাসী হয়ে গেলে জগৎসংসার কি করে চলবে ঠাকুরমশাই?
-- সবাই সন্ন্যাসী হবে কেন? গৃহী কি সৎ হতে পারে না? অনাসক্ত হতে পারে না? কিসের সম্পত্তি আর ঐশ্বর্য আর ক্ষমতা নিয়ে অহঙ্কার? জান তো, মা কুরু ধনজনযৌবনগর্বং, নিমেষে হরতি কালং সর্বং? যদি সম্পদ সংগ্রহ করতে হয়, তাহলে অপরের জন্য করো--মহাকাল সব এক নিমেষে হরণ করতে পারে।
বললাম-- যেমন ঘোষালমশাই গ্রামের লোকদের ভাল হবে বলে মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য সোনা জমিয়েছিলেন?
বিশুঠাকুর একমুহূর্ত আমার দিকে রহস্যময় চোখে তাকিয়ে রইলেন, তাঁর ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসির রেখা। তারপর চোখ সরিয়ে নিয়ে হাল্কা গলায় বললেন-- রামরাম কোনোদিনই মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য দেবীর আদেশ পায়নি, তার কোন সোনাও জমানো ছিল না।
বিস্মিত হয়ে বললাম-- তার মানে? আপনি যে সবাইকে বললেন নিজের চোখে একমুঠো গিনি দেখে গিয়েছেন--
-- মিথ্যে কথা বলেছি।
-- সে কি! কেন?
-- যে সোনা আমার কল্পনায় ছাড়া কোথাও ছিল না, কাজেই হত্যাকারী নিশ্চয় তা পায়নি। যা নেই তা আর পাবে কি করে? কিন্তু আমার এই কথাটা এখুনি গ্রামের মধ্যে প্রচার হয়ে যাবে।
হত্যাকারী গ্রামের লোক, রামরামের পরিচিত লোক-- নইলে প্রথমত সে রামরামের লুকোনো টাকার কথা জানতে পারত না, দ্বিতীয়ত তাকে দেখেই খুনের রাত্রে কুকুরটা চেঁচাত এবং আক্রমণ করত। সম্ভবত একটু আগে এখানে যে ভিড় জমেছিল, তার মধ্যে সে দাঁড়িয়েছিল। এখন এই সোনার কথা শুনে সে মনে করবে এটা এখনও এ ঘরের মেঝেতেই কোথাও মাটির তলায় পোঁতা রয়েছে। সোনার লোভ বড় লোভ। আমার বিশ্বাস, এ ভুল শুধরে নিতে সে আবার এখানে আসবে।
শুনে বিশেষ ভরসা হল না। বাঁশবনের ধারে এই চালাঘরে আমরা দু-টি প্রাণী। রাত্তিরে যদি রামরামের হত্যাকারী আবার আসে তাহলে আমি অন্তত খুব আনন্দ পাব না।
বললাম-- কবে আসবে?
বিশুঠাকুর হেসে বললেন-- ভয় নেই, আজ আসবে না। সে বোকা নয়, সে জানে তার হাতে অঢেল সময় রয়েছে। আমরা কাল চলে গেলে সে যে কোনোদিন এসে ধীরেসুস্থে কাজ শেষ করে যাবার কথা ভাববে। একজন অসতর্ক মানুষকে খুন করা সোজা, কিন্তু ধুনী জালিয়ে জেগে থাকা দু'জন মানুষকে আক্রমণ করা সহজ নয়-- আর খামোকা করবেই বা কেন, যখন পরে নিরুপদ্রবে কাজটা সারা যেতে পারে?
একটু ভেবে বললাম-- কিন্তু আমরা তো কাল চলে যাচ্ছি, তাহলে এ ফাঁদ পেতে লাভ কি? খুনি এলেই বা তাকে ধরবে কে? আর ধরলেই বা কি প্রমাণ হবে? রাত্তিরে এই চালাঘরের কাছে ঘুরঘুর করছিল, কাজেই সে রামরাম ঘোষালকে মেরেছে-- এমন যুক্তি কি আদালত শুনবে?
বিশুঠাকুর যথার্থ বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন-- আদালত? এর মধ্যে আদালত আসছে কোথা থেকে?
-- তাহলে?
-- পরে বলব। তুমি তো আমার সঙ্গে আছ, দেখতে পাবে।
চুপ করে বসে আছি, সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। বিশুঠাকুর আপনমনে গুনগুন করে একটা শ্যামাসঙ্গীত গাইছেন।
শিবরাম দুধ নিয়ে এল।
-- ভয় করছে না তো ঠাকুরমশাই?
-- নাঃ। মায়ের নামগান করছি। ভয় কি?
-- দরকার হলে চেঁচিয়ে ডাকবেন কিন্তু, কেমন?
-- নিশ্চয়। তুমি চিন্তা কোরো না।
শিবরাম চলে গেলে ঠাকুরমশাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-- শিবরামকে নিজে এসে দুধ দিয়ে যেতে বলেছিলাম কেন জানো?
-- কেন?
আমরা আসায় এ গ্রামের একজন নিশ্চয় স্বস্তি বোধ করছে না। সে কে, তা তো আমরা জানি না। তাই সাবধানে থাকাই ভাল। সামনে আক্রমণ না করলেও খাবারে বিষ মিশিয়ে দিতে বাধা কোথায়? দুধটা শিবরামের নিজের গরুর, নিশ্চিন্তে খেতে পারো--
-- খাব?
-- খাও। শিবরাম তার দাদাকে খুন করেনি।
-- কি করে বুঝলেন?
-- আমি বুঝতে পারি।
নিজের পোঁটলা থেকে একটা পেতলের ঘটি বের করে তাতে অর্ধেক দুধ ঢেলে নিয়ে মাটির ভাঁড়টা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন-- ধরো।
ঘটিতে একটা চুমুক দিয়ে বিশুঠাকুর বললেন-- যে অন্যায় করে, মনে তার সবসময়ই ভয় থাকে-- এই বুঝি ধরা পড়লাম! সবার দিকেই সে সন্দেহের চোখে তাকায়। তাই এই সাবধানতাটুকু নিতে হল। শুধু দুধ খেতে কষ্ট হচ্ছে, না?
লজ্জা পেয়ে বললাম-- না না--,
-- আমারই ভুল। তুমি ছোকরা লোক, তোমার খিদে পেতেই পারে। কি খেতে ভালবাস তুমি?
হেসে বললাম-- আমার এখন কিছু না হলেও চলবে। তবে একটু আগে মনে পড়ছিল ছোটবেলায় গ্রামের বিরিঞ্চি ময়রার দোকানের মাখা সন্দেশের কথা। মা দুধ আর মাখা সন্দেশ খেতে দিতেন মাঝেমাঝে, কোথায় গেল সে ছোটবেলা?
-- মাখা সন্দেশ? মানে কাঁচাগোল্লা? ভাল মজা তো, আজই বিকেলে তোমার সঙ্গে দেখা হবার একটু আগে খানিকটা মাখা সন্দেশ কিনেছিলাম রাত্তিরে আর কিছু না জুটলে খাব বলে। আর তুমিও কিনা পৃথিবীতে এত জিনিস থাকতে মাখা সন্দেশ খেতে চাইলে। দাঁড়াও--
বিশুঠাকুর পোঁটলার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একটা শালপাতার ঠোঙা বের করে আমার হাতে দিলেন।
ঠোঙার ভেতরে অনেকখানি কাঁচাগোল্লা।
ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে বললাম--এটা আপনি বিকেলে কিনেছেন? আমার সঙ্গে দেখা হবার আগে?
-- হ্যাঁ। কেন?
-- এ সন্দেশ তো এখনো গরম রয়েছে।
একটু থতমত খেয়ে বিশুঠাকুর বললেন-- বোঁচকার ভেতর ছিল তো, তাই গরম রয়ে গিয়েছে আর কি?
আপত্তি করে বললাম-- তাই কখনও হতে পারে?
-- হতে পারে নিশ্চয়, নইলে, হল কি করে? নাও, আর কথা না বাড়িয়ে খেয়ে ফেল দেখি। তারপর তুমি ঘুমোও, আমি জেগে থাকব।
শুয়ে শুয়ে অনেক রাত্তির অবধি দেখলাম বাঁশবনের মাথা দুলছে তারাভরা আকাশের পটভূমিকায়। ঘুম আসার আগে একবার জিজ্ঞাসা করলাম-- আচ্ছা, কেতুর কি হল বলুন দেখি?
গম্ভীর গলায় বিশুঠাকুর উত্তর দিলেন-- কেতুকে হত্যাকারী মেরে ফেলেছে, সম্ভবত বিষ মেশানো খাবার দিয়ে। চেনা লোক বলে কেতু চেঁচামেচি করেনি, হাত থেকে খাবারও নিয়েছে। কিন্তু রামরামকে আঘাত করতে দেখলেই সে, আক্রমণ করত। কাজেই তাকে আগে সরানো একান্ত দরকার ছিল।
-- দেহটা কোথায় গেল তাহলে?
-- খুব সম্ভব শেয়ালে নিয়ে গিয়েছে। এসব অঞ্চলে সাবধানে দরজা দিয়ে না শুলে অনেকসময় ছোট শিশুকেও বিছানা থেকে শিয়ালে টেনে নিয়ে যায়।
আবার শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি, ঘুম আসে না। হঠাৎ আর একটা প্রশ্ন মাথায় আসতে জিজ্ঞাসা করলাম-- আচ্ছা, আপনি কেতুর গায়ের রঙের কথা জিজ্ঞাসা করলেন কেন? এটা আমি কিন্তু বুঝতে পারিনি--
চটে গিয়ে বিশুঠাকুর বললেন-- বেশ করেছি জিজ্ঞেস করেছি, কেবল প্রশ্ন করে! ঘুমোও না কেন বাপু-- কোন্ ব্যাপারটাই বা এ অবধি বুঝতে পেরেছ?
ঠাকুরকে আর না ঘাঁটিয়ে বিনাবাক্যব্যয়ে পাশ ফিরে শুয়ে অচিরাৎ ঘুমিয়ে পড়লাম। সারারাত স্বপ্ন দেখলাম কেতু ল্যাজ নাড়তে নাড়তে বিশুঠাকুরের হাত থেকে মাখা সন্দেশ খাচ্ছে।
পরের দিন সকালে আমরা শিবরামের কাছে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। সে আমাদের কয়েকটা দিন তার বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণের জন্য বিস্তর অনুরোধ করেছিল, কিন্তু বিশুঠাকুর রাজি হলেন না। তাঁর নাকি কি কাজে আজই সিউড়ি রওনা হতে হবে, থাকার কোন উপায়ই নেই। পরে বরঞ্চ কখনও-- ইত্যাদি।
শিবরাম, শ্রীদাম ঘোষ ইত্যাদি অনেকেই গ্রামের সীমানা পর্যন্ত আমাদের এগিয়ে দিয়ে গেল।
স্টেশনের কাছে একটা নির্জন জায়গায় এসে বিশুঠাকুর দাঁড়িয়ে পড়লেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-- তারানাথ, এখন আমি যা বলছি খুব মনোযোগ দিয়ে শোন। আমরা সিউড়ি যাচ্ছি না, আমরা আজ এখানেই থাকব-- আজকের দিনটা। তারপর রাত্তিরে আবার গ্রামে ফিরে যাব।
অবাক হয়ে বললাম-- তার মানে?
-- মানে এই, আমরা চলে গিয়েছি মনে করে রামরামের খুনী আজ রাত্তিরেই আমাদের পেতে আসা ফাঁদে পা দেবে। অত সোনা মাটির তলায় পড়ে আছে জেনে সে শান্তিতে ঘুমোতে পারবে না। মানুষের চরিত্র যতদূর বুঝেছি তাতে আমার দৃঢ়বিশ্বাস আর দেরি না করে আজ রাতেই সে আসবে। তাকে ধরতে গেলে ওই চালাঘরের পাশে জঙ্গলে আমাদের লুকিয়ে বসে থাকতে হবে।
-- কিন্তু এ কাজ কি আমাদের দু-জনের দ্বারা সম্ভব? খুনীর হাতে তো অস্ত্রও থাকতে পারে। তাছাড়া আগে যা বলেছিলাম, কাউকে ধরলেও সেই যে খুন করেছে তা প্রমাণ করা যাবে না। ধরবার সময় দু-একজন সাক্ষীও থাকা ভাল--
-- সব ব্যবস্থা হয়েছে। আমরা রওনা হবার আগে বাড়ির মেয়েরা প্রণাম করতে চায় বলে শিবরাম আমাকে অন্দরমহলে নিয়ে গেল না? তখনই শিবরামকে আমি সমস্ত কথা খুলে বলেছি। শিবরাম, তার দুই জোয়ান ছেলে আর বাড়ির কয়েকজন কৃষাণ আজ রাত্তিরে না ঘুমিয়ে তৈরি হয়ে বসে থাকবে। আমাদের ডাক শুনলেই তারা দৌড়ে চালাঘরে এসে হাজির হবে। আপাতত দিনের বেলাটা আমরা ইস্টিশনে কোথাও ঘাপটি মেরে কাটিয়ে দিই এস--
-- এ রকম একটা খুনোখুনির ব্যাপারে আমার জড়িয়ে পড়তে ইচ্ছে করছিল না, আবার ঘটনার শেষটা দেখার জন্য নিদারুণ কৌতূহলও ছিল। ফলে থেকেই গেলাম। ভাল সিদ্ধান্তই নিয়েছিলাম, কারণ এর ফলে জীবনের এক অন্যতম আশ্চর্য অভিজ্ঞতা আমার লাভ হয়েছিল।
প্ল্যাটফর্মের শেষপ্রান্তে কয়েক বস্তা পাটের পেছনে বসে আমাদের দিনটা কেটে গেল। সন্ধ্যা নামতে বিশুঠাকুর উঠে গিয়ে স্টেশনের বাইরের মুদিখানা থেকে কিছু চিঁড়ে আর গুড় কিনে এনে আমাকে দিলেন।-- নাও, তোমার আর রামরামের বাড়ি হয়ে যাবার কোন দরকার নেই, গ্রামের লোকে দেখে ফেলবে। একেবারে সোজা ওই চালাঘরের পুবদিকে আশশেওড়ার ঝোপের পেছনে বসে থেকো। ভয় নেই, আমি সময়মত পৌঁছে যাব--
-- সে কি! আপনি আমার সঙ্গে যাবেন না?
-- না। দু'জনে একসঙ্গে গেলেই লোকের নজরে পড়বার সম্ভাবনা। তুমিও সোজাপথে গ্রামে ঢুকো না, গ্রাম ছাড়িয়ে চলে গিয়ে পেছনের আমবাগান দিয়ে চালাঘরের কাছে চলে যেয়ো।
তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন-- আরে! তুমি ভয় পাচ্ছ নাকি? শোন, বিশ্বেশ্বর ভটচায যাকে বলেছে ভয় নেই, তার সত্যিই কোন ভয় নেই। যাও--
-- লোকটার যাদুকরী ব্যক্তিত্ব আছে। আমি একলা যেতে রাজি হয়ে গেলাম।
অন্ধকারে অচেনা পথে ছ'মাইল হাঁটতে সময় লাগে। রামরাম ঘোষালের চালাঘরের পুবদিকে আশশেওড়ার ঘন ঝোপের পেছনে যখন গুছিয়ে বসলাম তখন বেশ রাত হয়েছে, অন্তত পল্লীগ্রামে একেই রাত বলে। দূরে কোথাও সংকীর্তন হচ্ছিল, ক্রমে তাও বন্ধ হয়ে গেল। বাঁশঝাড়ে মাটির ওপর পড়ে থাকা শুকনো বাঁশপাতার ওপর দিয়ে মাঝে মাঝে খসখস্ করে কী যেন যাতায়াত করছে-- তাছাড়া আর কোথাও কোন শব্দ নেই। চুপ করে বসে আছি।
কিন্তু কিচ্ছু না করেই বা কতক্ষণ বসে থাকা যায়? রাত কত হল কে জানে? বিশুঠাকুরই বা আসছেন না কেন? আমাকে এরকম বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে তাঁর কি এত দেরি করা উচিত হচ্ছে? মশাও কামড়াচ্ছে বেশ। কিন্তু পাছে শব্দ হয় সেই ভয়ে চাপড় দিয়ে মশা মারতে পারছি না, হাত নেড়ে নেড়ে তাড়াচ্ছি। নিজের ওপর বেশ রাগও হচ্ছে। জীবনে অনেক কিছু করেছি বটে, কিন্তু কখনও একজন অচেনা হত্যাকারীকে ধরব বলে রাত্তিরবেলা সাপখোপের ভয় উপেক্ষা করে মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে ঝোপের আড়ালে বসে থাকিনি।
এভাবে বহুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর আমার সত্যিই খুব ভয় করতে লাগল। ব্যাপার কি? স্টেশন থেকে ছ-মাইল পথ হেঁটে আসতে যতক্ষণই লাগুক, তাতে এত দেরি হতে পারে না। বিশুঠাকুরের কি হল? আমার কাছে ঘড়ি না থাকলেও আন্দাজ করতে পারছি রাত অনেক হয়েছে। একা এইভাবে বসে থাকা বিপজ্জনকও বটে। উঠে শিবরামের বাড়ির দিকে চলে যাব কি? কিন্তু ধরা যাক আমিও উঠলাম, আর ওদিক থেকে রামরাম ঘোষালের হত্যাকারী এসে হাজির হল-- সেটাই বা কি এমন সুখকর ব্যাপার হবে? তার চেয়ে বরং চুপ করে এভাবে বসে থাকাই ভাল। যদি বিশুঠাকুর না আসেন, অথচ রামরামের হত্যাকারী এসে উপস্থিত হয়, তাহলে সে সমস্তটা ঘরের মেঝে থেকে উঠোন অবধি খুঁড়ে ফেললেও আমি চেঁচাব না।
তখনও জানি না আমার জীবনের এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতার মুহূর্ত কত কাছে এসে গিয়েছে।
নাকের ফুটোয় একটা মশা ঢুকে পড়ায় হাঁচি এসেছিল, প্রাণপণে হাত মুঠো করে, চোয়াল শক্ত করে সজোরে হেঁচে ফেলবার ইচ্ছে দমন করবার চেষ্টা করছি-- এমন সময় আমি যেকানে বসে আছি তার উল্টো দিক দিয়ে, অর্থাৎ বাঁশবাগানের পাশের জঙ্গল ঠেলে সন্তর্পণে কার আসবার আওয়াজ পেলাম।
হাঁচি আপনিই বন্ধ হয়ে গেল।
বিশুঠাকুর এলেন কি?
কিন্তু তিনি এলে আমি যে পথে এসেছি সেই পথে মাঠের মধ্যে দিয়ে ঘুরে আসবেন, নয়তো শিবরামের বাড়ির থেকে সুঁড়িপথটা ধরে আসবেন-- কিন্তু ও রাস্তায় নয়। ওটা তো গ্রামের ভেতর থেকে আসবার রাস্তা।
রামরাম ঘোষালের চালাঘরটা অন্ধকারের স্তূপের মত দাঁড়িয়ে রয়েছে। জঙ্গল ভেদ করে তার পাশে ফুটে উঠল একটা ছায়ামূর্তি, বেশ লম্বামত, হাতে সম্ভবত একখানা শাবল। লোকটা সন্দিগ্ধভাবে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। আমি যেভাবে যেখানে বসে আছি, তাতে আমাকে দেখতে পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু প্রচণ্ড ঝুঁকির কাজে প্রবৃত হলে মানুষের স্নায়ু একধরনের বিশেষ সংবেদনশীলতা লাভ করে। তাই দিয়ে লোকটা হয়ত অনুভব করেছে আজ রাতে এ জায়গা তার পক্ষে নিরাপদ নয়।
ততক্ষণে আমি লোকটাকে চিনে ফেলেছি।
হরিপদ!
কি নৃশংসতা মানুষ টাকার লোভে করতে পারে! বাবার বন্ধুকে হত্যা করতে তার হাত কাঁপেনি, আবার আজ এসেছে সোনার লোভে।
হরিপদর মনোবল বোধহয় ভেঙে পড়ল। ইতস্তত করে সে ফিরে যাওয়ার উদ্যোগ করছে। আমার চুপ করে দেখে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। এমন সময় আমার বাঁদিকে খুব কাছে ঝোপের মধ্যে একটা আওয়াজ শুনে চমকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম, বুকের মধ্যে বিস্ময়ে আর আতঙ্কে ঢেউ খেলে উঠল। কখন যেন আমার ঠিক গা ঘেঁষে এসে দাঁড়িয়েছে একটা বাঘের মত মিশমিশে কালো কুকুর। তার প্রগাঢ় নিঃশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। একদৃষ্টে সে ঝোপের ফাঁক দিয়ে হরিপদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
হরিপদও বোধহয় কিছু শুনতে পেয়েছিল। সে ফিরে দাঁড়িয়েছে, তার সমস্ত শরীর শক্ত, শাবলটা শক্ত করে ধরে আছে।
একটা গম্ভীর গর্জন করে কুকুরটা লাফিয়ে গিয়ে হরিপদর সামনে খোলা উঠোনে পড়ল। একবার সেদিকে তাকিয়েই মহাতঙ্কে তীব্র আর্তনাদ করে উঠল হরিপদ। আমি এমন রক্তজমানো ভয়ের আর্তনাদ আর কখনো শুনিনি। সঙ্গে সঙ্গে হরিপদ হাতের শাবলটা সজোরে ছুঁড়ে দিল কুকুরটার দিকে। ভারী লোহার শাবল ডানপায়ের থাবায় এসে লাগতেই কুকুরটা আর একবার তীব্র গর্জন করে হরিপদর ওপর লাফিয়ে পড়ল।
সুঁড়িপথের দিকে কাদের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, বেশ অনেক মানুষের কণ্ঠ। এতক্ষণে কি এলেন বিশুঠাকুর?
আমি ততক্ষণে উত্তেজনায় আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি, কেন যেন বুঝতে পেরে গিয়েছি হরিপদকে আর ভয় করবার কোন কারণ নেই।
শিবরামের গলা শোনা যাচ্ছে-- ভয় নেই ঠাকুরমশাই, এই যে আমরা সবাই এসে পড়েছি!
এদিকে উঠোনে মাটিতে পড়ে দু-হাত দিয়ে আত্মরক্ষার ব্যর্থ চেষ্টা করছে হরিপদ, কি এক অপার্থিব আতঙ্ক দেখে যেন তার নিজের পেশীর ওপর সব কর্তৃত্ব চলে গিয়েছে। তার বুকের ওপর শরীরের উর্ধ্বাংশ চাপিয়ে দিয়ে গলায় দাঁত বসাবার সুযোগ খুঁজছে কুকুরটা, ডান থাবা দিয়ে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে, সেদিকে তার কোন ভ্রূক্ষেপ নেই।
আমার পাশে লোকজন নিয়ে পৌঁছে গিয়েছে শিবরাম, গ্রামের আরও লোকজন ছুটে আসছে, তাদেরও গলার শব্দ শুনতে পাচ্ছি।
কুকুরটার দিকে একবার তাকিয়েই শিবরাম চিৎকার করে উঠল-- কেতু! তুই কোথা থেকে এলি?
কেতু তখন হরিপদর টুঁটি কামড়ে ধরেছে, হরিপদর দু-হাত অবশ হয়ে এলিয়ে পড়েছে দু-দিকে। কেবল পা-দুটো পর্যায়ক্রমে মৃত্যুবিক্ষেপে সামনে পেছনে নড়ে অদৃশ্য কি একটা বস্তু যেন ঠেলে দেবার চেষ্টা করছে।
শ্রীদাম ঘোষ সহ গ্রামের আরও অনেকে এসে পড়ে বিস্তারিত চোখে উঠোনের ভয়াবহ দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে আছে।
শিবরাম বলল--কিন্তু লোকটা কে? হরিপদ না?
বললাম--হ্যাঁ।
এতক্ষণে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে শিবরামের কৃষাণেরা লাঠি উঁচিয়ে তাড়া করে গেল। কেতু সরে গিয়ে মুখ তুলে তাকাল একবার। তার কষ বেয়ে গড়াচ্ছে তাজা রক্ত। তারপরই একলাফে কেতু পাশের ঝোপে পড়ে মিলিয়ে গেল। শোনা গেল-- শুকনো বাঁশপাতার ওপর তার পায়ের শব্দ দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। কৃষাণেরা যখন ধরাধরি করে হরিপদর দেহ রামরাম ঘোষালের চালাঘরের দাওয়ায় এনে রাখল, তখন সে দেহে আর প্রাণ নেই।
শিবরাম বলল-- শেষে হরিপদ এই কাজ করল। দাদা ওকে নিজের ছেলের মতন ভালবাসতেন।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম-- ঠাকুরমশাই কোথায়?
-- তিনি তো আপনার সঙ্গে ছিলেন, আপনার সঙ্গেই থাকবার কথা। আপনি জানেন না?
বিশুঠাকুর আর এলেনই না। পরের দিন সকালে আমিও স্টেশনের দিকে বেরিয়ে পড়লাম! আর থেকে কি হবে? পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে-- এবার তাদের কাজ তারা করবে। কোন মামলাও বোধহয় হবে না এ নিয়ে। অন্তত ত্রিশজন গ্রামাবাসী ঘটনাটা নিজের চোখে দেখেছে-- পাগলা কুকুরের আক্রমণে জনৈক গ্রামবাসীর করুণ মৃত্যু। মামলা আর কি হবে?
কিন্তু কেতু এল কোথা থেকে?
উত্তরটা পেলাম বিশুঠাকুরের সঙ্গে দেখা হবার পর। তিনি পরম প্রশান্তমুখে প্ল্যাটফর্মের চায়ের দোকানে বসে গরম চা খাচ্ছিলেন-- আমাকে দেখে বললেন--এই যে তারানাথ এসো। চা খাবে? আমার আর কালকে যাওয়া হল না, বুঝলে? তুমি চলে যাবার পর-- বললে বিশ্বাস করবে না-- ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। একঘুমে একদম রাত কাবার। জেগে দেখি ভোর হয়ে এসেছে। ভাবলাম আর এতটা পথ হেঁটে কি হবে? তুমি নিশ্চয় এসে পড়বে সকালে। তা কি হল বল রাত্তিরে? খামোকা জাগতে হোল তো?
নিতান্ত গা জ্বালা করা সত্ত্বেও সমস্ত ঘটনাটা তাঁকে বললাম। তাঁর বিশেষ কোনো ভাব পরিবর্তন হল বলে মনে হল না। চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে পেয়ালা নামিয়ে রাখতে রাখতে বললেন-- যাঃ! শেষ অবধি হরিপদর এই কাজ! ব্যাটা একেবারে নরাধম, ঠিক শাস্তি হয়েছে।
-- আপনি বলেছিলেন কেতু মারা গেছে।
-- ভুল বলেছিলাম। বেঁচে আছে তো দেখাই যাচ্ছে। যাক্ গে, ট্রেনের প্রথম ঘণ্টা পড়ছে-- টিকিট কাটো গে যাও।
একটু চুপ করে থেকে বললাম-- আমি আপনার সঙ্গে আর যাব না--
-- কোথায় যাবে তবে?
-- কোলকাতার দিকে যাব। কাজ আছে।
বিশুঠাকুর হেসে বললেন-- বেশ, তাই যেয়ো। আমাকে ট্রেনে তুলে দাও অন্তত। তোমার গাড়ির তো দেরি আছে।
গাড়িতে তুলতে গিয়ে খেয়াল করলাম বিশুঠাকুর খোঁড়াচ্ছেন, ডানপায়ের পাতায় ন্যাকড়ার পটি বাঁধা।
আমার বুকের ভেতরটা হিম হয়ে এল, বললাম-- একি! আপনার পায়ে কি হয়েছে? কাল বিকেলেও তো দেখিনি--
বিশুঠাকুর বললেন-- ও কিছু নয়, প্ল্যাটফর্মের বেড়া পার হতে গিয়ে কাঁটা-তারে লেগে কেটে গিয়েছে।
আমি একদৃষ্টে বিশুঠাকুরের ডানপায়ের পট্টির দিকে তাকিয়ে আছি। হরিপদর সেই আর্তনাদ, শাবল ছুঁড়ে মারা-- কেতুর ডানপায়ে রক্তের ধারা! তবে কি--
ট্রেন ছেড়ে দিল। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বিশুঠাকুর হাসি হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। সেই শেষ, আর কখনও তাকে দেখিনি।
সমাপ্ত
তারানাথ তান্ত্রিকের গল্প (ইচ্ছাশক্তি)
লেখক: তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
(এই লেখকের অন্য লেখা পড়ার জন্য লেখকের নামের উপর ক্লিক করুন)
সেদিন সকাল থেকেই টিপটিপ্ বৃষ্টি হচ্ছে। জামাকাপড়, রুমাল -- এমন কি মনের ভেতরটা অবধি ভিজে স্যাঁতসেঁতে হয়ে রয়েছে। অন্যদিন অফিস ছুটির পর বলাইবাবু কিম্বা হরি মিত্তিরের সঙ্গে মোড়ের দোকানে চা খেতে খেতে রাজনীতি, জিনিসপত্রের অগ্নিমূল্য অথবা বাঙালী কি ছিল আর কি হয়েছে -- এসব বিষয়ে গভীর আলোচনা করে আনন্দ পেয়ে থাকি। কিন্তু আজ আর সে-সব ইচ্ছে করল না। অফিস থেকে বেরিয়ে তারানাথের বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলাম।
পৌঁছে দেখি কিশোরী সেন আমার আগেই এসে বসে আছে। আমাকে দেখে বলল -- এই যে! এসো হে -- তোমারই জন্য বসে আছি -- হেসে বললাম -- কি করে জানলে আমি আসব?
ওর জন্য কি আর মন্ত্রতন্ত্র জানতে হয়? আজ এমন বাদলা করেছে -- যাকে বলে আড্ডার মেজাজ, না এসে যাবে কোথায়?
তারানাথের জন্য এক প্যাকেট পাসিং শো কিনে এনেছিলাম, তাকে দিয়ে বললাম -- আজ একটা ভাল গল্প হবে নাকি?
তারানাথ হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নিল বটে, কিন্তু তার মুখে বিশেষ প্রফুল্পতা দেখলাম না। বিরসমুখে সে বলল- নাঃ, তোমাদের কাছে গল্প বলতে ইচ্ছে করে না, তোমরা আমার গল্প অবিশ্বাস করো—
কিশোরী বলল -- কই, সব গল্প তো অবিশ্বাস করি না! নেহাত যেগুলো একেবারেই বিশ্বাস করবার মত নয়, সেগুলো বাদে।
তারানাথ চটে উঠতে যাচ্ছিল, আমি কথার মোড় ঘোরাবার জন্য বললাম -- কিশোরীর কথা ছেড়ে দিন। আসল কথা হচ্ছে, আপনার গল্প যদি সত্যি হয় তাহলে আমরা বিশ্বাস করলেই বা কি আর না করলেই বা কি? সত্য কারো মতামত নির্ভর নয়।
তারানাথ কিঞ্চিৎ শান্ত হয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল -- এই যে বিশ্বাসের কথা বললে না? বিশ্বাসে সত্যিই অনেক কিছু ঘটায়, সাধারণ বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা করা যায় না --
কিশোরীর ঘাড়ে আজ দুর্গ্রহ ভর করেছিল, সে বলল -- তার মানে আপনি বলতে চাইছেন কেউ যদি বিশ্বাস করে সে কোনোদিন মরবে না, তাহলে বিশ্বাসের জোরে সে সত্যি সত্যিই অমর হয়ে যাবে?
যাবেই তো। তবে তোমার মত ফিচেল লোক পারবে না। হিমালয়ে যে-সব প্রাচীন যোগীরা শত শত বছর বেঁচে আছেন, তারা কি করে এত দীর্ঘকাল জীবিত আছেন বলে মনে কর? কেবলমাত্র ইচ্ছাশক্তির জোরে। মানুষের বিশ্বাস ইচ্ছাশক্তিরই একটা প্রকাশ --
এমন সময় বাইরে আবার ঝমঝম্ করে বৃষ্টি নামল। আলো কমে গিয়ে অন্ধকারমত হয়ে এল ঘরের ভেতরে। বৃষ্টির বহর দেখে মনে হল সহসা থামবার নয়। অবশ্য তাড়াতাড়ি মেসে ফিরেই বা কি লাভ? কিন্তু এখানে বসে থাকতে হলে গল্প চাই। বললাম -- বিশ্বাসের শক্তি সম্বন্ধ একটা ভাল গল্প হোক তবে --
তারানাথ বলল -- আমার কাছে কোনো গল্প নেই, সব সত্যি ঘটনা।
কিশোরী আবার কি বলতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম -- এখন অন্তত ঘণ্টাদুই 'আমরা আপনার অতিথি, বেরোবার উপায় নেই। আমাদের প্রার্থনা -- একটি গল্প -- মানে সত্যি ঘটনা। সৎ গৃহস্বামী মাত্রেই অতিথির প্রার্থনা পূরণ করে থাকে। আপনারও করা উচিত।
তারানাথ একটু হাসল। চোখ বুজে কিছুক্ষণ ভেবে বোধ হয় মনে মনে গল্পটা গুছিয়ে নিল, তারপর বলতে শুরু করল -- বছর কুড়ি আগেকার কথা। এক শিষ্যবাড়ি থেকে স্বস্ত্যয়ন করে ফিরছি, ট্রেন বদলাবার জন্য বসে আছি রানাঘাট স্টেশনে। ট্রেনের তখনো প্রায় ঘণ্টাখানেক দেরি। কি করা যায়, একটা বেঞ্চিতে বসে আপন মনে সিগারেট খেয়ে সময় কাটাতে লাগলাম। দক্ষিণা এবং পুজো বাবদ পাওয়া জিনিসপত্র পোঁটলা করে পায়ের কাছে রাখা। এমন সময় একজন মধ্যবয়সী লোক এসে আমার কাছে দাঁড়িয়ে বলল -- একটু আগুনটা দেবেন তো ভাই --
বিশেষ খেয়াল না করেই পকেট থেকে দেশলাই বের করে তার হাতে দিলাম। প্রথম কাঠিটা নষ্ট করে দ্বিতীয় কাঠি দিয়ে লোকটা বিড়ি ধরিয়ে আমাকে দেশলাই ফেরত দিল। তখনও আমি তার দিকে তাকাইনি। দেশলাই পকেটে পুরে কি জানি কেন হঠাৎ লোকটার দিকে একবার চাইলাম। সে তখন পেছন ফিরে প্ল্যাটফর্মের অন্যদিকে চলে যাচ্ছে।
তাকিয়েই চমকে উঠলাম।
তোমরা তো জানো আমার কতগুলো বিশেষ ক্ষমতা আছে -- যা দিয়ে আমি মানুষের আশু বিপদ বা ভাগ্য পরিবর্তনের কথা টের পাই। পেছন থেকে তাকিয়ে আমি লোকটার শরীর ঘিরে একটা কালো ছায়া দেখতে পেলাম। যেন একটা কালো মসলিনের ঘেরাটোপের মধ্যে থেকে লোকটা চলাফেরা করছে। বুঝলাম মানুষটা ভয়ানক বিপদগ্রস্ত। পায়ের কাছ থেকে পোঁটলাটা হাতে নিয়ে আমি দ্রুতপায়ে তার পেছনে এগিয়ে গেলাম।
প্ল্যাটফর্মের একটা অপেক্ষাকৃত নির্জন জায়গায় দাঁড়িয়ে লোকটি অন্যমনস্কভাবে লাইনের ওপারে তাকিয়ে ছিল। আস্তে করে ডাকলাম -- শুনছেন ভাই?
ভদ্রলোক ভয়ানক চমকে উঠে আমার দিকে তাকালেন। দেখলাম বছর চল্লিশ বয়সের একজন মানুষ, উদ্বেগে ও চিন্তায় মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। গালে পাঁচ-ছ'দিনের না কামানো খোঁচা খোঁচা দাড়ি। শার্টের একটা বোতাম ভুল ঘরে লাগানো। ভদ্রলোক বিস্মিত গলায় বললেন -- আমাকে কিছু বলছেন কি?
একটু বিপদে পড়লাম। কেন ডেকেছি তা ভদ্রলোককে কি ভাবে বলা যায়? একজনকে তো আর হঠাৎ বলা যায় না -- ও মশাই, আপনার খুব বিপদ, কারণ আপনার চারদিকে একটা কালো ছায়া দেখা যাচ্ছে!
সময় নেবার জন্য বললাম -- আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা ছিল, একটু এদিকে আসবেন?
-- কিন্তু আপনাকে তো ঠিক, মানে --
-- না, আপনি আমাকে চেনেন না। আসুন, ওই চায়ের দোকানটায় এক ভাঁড় চা খেতে খেতে গুছিয়ে বলছি। আমি যা বলতে চাই এক কথায় বলা সম্ভব না --
যে কোন কারণেই হোক, এই সময়ে চায়ের স্টলে বিশেষ ভিড় ছিল না। ভদ্রলোককে একটা বেঞ্চিতে বসিয়ে দু'কাপ চায়ের অর্ডার দিলাম।
ভদ্রলোক উসখুস্ করছিলেন, বললেন -- কই, কি বলবেন বলছিলেন -- কি ব্যাপার বলুন তো?
কোন ভূমিকা না করেই বললাম -- আমি একটু-আধটু জ্যোতিষ ইত্যাদি চর্চা করি। আপনি যখন আমার কাছে দেশলাই চাইলেন, আমার হঠাৎ কেন যেন মনে হল আপনার খুব বিপদ। সত্যি কি তাই? আমাকে খুলে বললে আমি হয়ত আপনার কাজে লাগতে পারি --
আমার বিশেষ ক্ষমতার কথাটা আর বললাম না। প্রথমেই সে কথা বললে আমাকে হয় পাগল নয়তো ঠগ মনে করবে।
ভদ্রলোক একটু সন্দিগ্ধ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। এবার ভাল করে দেখে বুঝলাম মানুষটা বেশ বুদ্ধিমান, কিন্তু সাম্প্রতিক দুঃসময় এবং উদ্বেগ তার মুখের স্বাভাবিক ঔজ্জ্বল্যের ওপর ছায়া ফেলেছে। আজকাল সময় খারাপ, নানারকম ধান্দাবাজ লোক চারদিকে ঘুরছে -- এমন অবস্থায় আমাকে হঠাৎ বিশ্বাস করতে না পারাই সম্ভব। কিন্তু মনের যে জোর থাকলে লোকে কোন কিছুকে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করতে পারে, বর্তমানে সে মনের জোর তার নেই। অসহায় ভাবে ভদ্রলোক আমার দিকে চেয়ে বসে রইলেন।
হেসে বললাম -- ভয় নেই, আমি ঠগ-জোচ্চার নই। আমার একটা, মানে একটা বিশেষ ধরনের ক্ষমতা আছে, তা দিয়ে আমি অনেক কিছু আগে থেকে বুঝতে পারি। আমার গুরুর আদেশ ছিল কারো বিপদ বুঝতে পারলে এগিয়ে গিয়ে সাহায্য করা, তাই আপনাকে দেখে -- ,
ভদ্রলোক সামান্য কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন -- কি ধরনের বিশেষ ক্ষমতা?
বললাম -- এই যেমন ধরুন -- আপনাকে দেখে বুঝতে পারছি আপনার জন্ম চৈত্র মাসে, সাত থেকে দশ তারিখের মধ্যে। আপনার নামের আদ্যক্ষর “ক”। গত তিন-চারদিনের মধ্যে আপনি বেশ বড় রকমের একটা অগ্নিভয় থেকে রক্ষা পেয়েছেন। আর --
ভদ্রলোকের চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠেছিল, বললেন -- আর কি?
-- বলব?
দুর্বল স্বরে ভদ্রলোক বললেন -- বলুন।
-- গত বছর আপনার কর্মস্থলে আপনাকে নিয়ে যে গোলমাল হয়েছিল তাতে বিচারে আপনি রেহাই পেয়ে গেলেও দোষটা কিন্তু আপনারই ছিল, তাই না?
ভদ্রলোক মাথা নিচু করে শুনছিলেন। মুখ তুললে দেখলাম তার চোখে জল। আস্তে আস্তে বললেন -- -আজ্ঞে হ্যাঁ, দোষ আমারই ছিল! কেউ জানে না সেকথা, আমার স্ত্রীও না।
কিন্তু বিশ্বাস করুন, নিতান্ত বাধ্য হয়েই --
বললাম -- তিন হাজার টাকা। ঠিক তো?
ভদ্রলোক একবার কেঁপে উঠলেন। -- আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনি সবই জানতে পেরেছেন দেখছি। আপনার ক্ষমতায় আর আমি অবিশ্বাস করছি না। স্ত্রীর অসুখে বাধ্য হয়ে তাকে বাঁচাবার জন্য টাকাটা নিতে হয়েছিল। ভেবেছিলাম কেউ টের পাবার আগেই দেশের জমিজমা বিক্রি করে আবার পূরিয়ে দেব। কিন্তু তার আগেই অডিট্ বসল, ঘাটতি ধরা পড়ে গেল। আমি বহু পুরনো বিশ্বস্ত কর্মচারী, আমাকে কেউ সন্দেহ করল না। অন্য কারো ঘাড়ে দোষ পড়লে হয়ত আমি এগিয়ে গিয়ে অপরাধ স্বীকার করতাম। কিন্তু তাও হল না -- যথেষ্ট প্রমাণের অভাবে টাকাটা বাজে খরচের খাতে লিখে রাখা হল।
তারপর ভদ্রলোক আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন -- ওঃ, আপনার কাছে সব স্বীকার করে যেন বাঁচলাম! এতদিন মনে পাপবোধ পুষে রাখা -- উঃ, সে যে কি কষ্ট --
ধুতির খুঁটে মুখ মুছে আবার বললেন -- হ্যাঁ, গত পরশুদিন আগুনের হাত থেকে বেঁচেছি বটে। আমার স্ত্রী পুত্র বর্তমানে দেশের বাড়িতে রয়েছে -- যেখানে আমি এখন যাচ্ছি। নিজে রান্না করে খাওয়ার অভ্যেস নেই কোনকালে। হোটেলে খেলে আমার শরীর খারাপ হয়, তাই যা হোক ভাতে-ভাত দুটো-কটা ফুটিয়ে নেব বলে স্টোভ জ্বেলে চাল বের করতে পেছন ফিরেছি, আর মশাই ধুতিতে লেগে গিয়েছে আগুন! কি ভাগ্য, সেই সময় আমার এক বন্ধু এসে হাজির আড্ডা দিতে। সে বিছানার মোটা চাদর চেপে ধরে আগুন নেভায়। তাও দেখুন না, কতখানি পুড়ে গিয়েছে --
ডান পায়ের থেকে কাপড় সরিয়ে নিতেই দেখলাম পায়ের গুলি থেকে উরুর পেছন অবধি ভেজা নেকড়ার ফেটি বাঁধা। বললেন -- নারকেল তেলের পট্টি বেঁধে রেখেছি।
চায়ের দোকানের ছেলেটা এসে শূন্য কাপ দুটো নিয়ে গেল। তাকে বললাম আর দু-কাপ চা দিতে। সিগারেটের প্যাকেট বের করে নিজে ধরালাম, ভদ্রলোককেও দিলাম।
সিগারেটে গোটা কয়েক লম্বা টান দিয়ে তিনি বললেন -- আমার নাম কালীপ্রসাদ মিত্র। খুলনার বিখ্যাত মিত্রদের কথা হয়ত শুনে থাকবেন, আমরা তাদেরই বংশধর। অবশ্য পঞ্চাশ-যাট বছর হল খুলনার সঙ্গে আমাদের আর কোনো যোগাযোগ নেই। ঠাকুরদা কর্ম উপলক্ষ্যে এদিকে চলে আসেন -- -সেই থেকেই আর কখনো দেশে ফিরে যাওয়া হয়নি।
আবার চা এল। গরম চায়ে চুমুক দিয়ে কালীপ্রসাদ বললেন- নদীয়া জেলার উত্তর প্রান্তে কিছু ভূসম্পত্তি কিনে ঠাকুরদা বসবাস শুরু করেন। ব্যবসা করতেন কোলকাতায়, মাঝে মাঝে গ্রামে এসে থাকতেন। তিনি ছাড়া বাড়ির লোকজন গ্রামেই থাকত। বন্দরে যে-সব জাহাজ এসে ভেড়ে, তাতে কাঁচা আনাজ যোগান দেবার ব্যবসা করতেন ঠাকুরদা। বিলক্ষণ দু'পয়সা করেছিলেন। কিন্ত বহু প্রতিদ্বন্দী জোটায় তাঁর জীবদ্দশাতেই সে ব্যবসা নষ্ট হয়ে যায়। চেনাশুনো কাকে যেন ধরে বাবাকে এক সাহেবী ফার্মে চাকরিতে ঢুকিয়ে দেন। বাবা অবসর গ্রহণ করার পর সেই চাকরি আমি পেয়েছি।
কতদিন বাবা রিটায়ার করেছেন?
তা বছর কুড়ি তো বটেই। বাবার বয়েস এখন প্রায় আশি, কিন্ত বেশ ভাল স্বাস্থ্য -- অসুখবিসুখ কিছুই নেই। কেবল চোখে একটু কম দেখেন।
বললাম -- যা হোক, যা বলছিলেন বলে যান --
চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে পেয়ালাটা নামিয়ে রেখে কালীপ্রসাদ বলতে শুরু করলেন -- জ্ঞাতিদের শক্রতায় ঠাকুরদাকে খুলনা ছেড়ে আসতে হয়েছিল। আসবার সময় দেশের সম্পত্তির বিশেষ কিছুই আনতে পারেননি। নগদ টাকা সামান্য যা ছিল তাই দিয়েই কোলকাতায় ব্যবসা শুরু করেন। কেবল প্রাণের চেয়েও প্রিয় একটি জিনিস বয়ে নিয়ে আসেন --
বললাম -- কি জিনিস?
-- একটি অষ্টধাতুর তৈরী কালীমুর্তি। আমাদের গৃহদেবী। চার-পাঁচ পুরুষ ধরে এই মূর্তি আমাদের পরিবারে পুজো পেয়ে আসছে। ঠাকুরদার বাবা -- আমার প্রপিতামহ -- তিনি ছিলেন তন্ত্রসাধক। আজীবন সাধনা করে তন্ত্রের বিভিন্ন শাখায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন বলে শোনা যায়। তাঁর জীবনের শেষদিকে একবার গ্রহনক্ষত্রের কি এক বিচিত্র সংস্থান এবং অমাবস্যা একসঙ্গে পড়ে। তেমন যোগ নাকি একশো বছরেও একটা আসে না। সেই বিশেষ অমাবস্যার রাত্তিরে আমার প্রপিতামহ সারারাত জেগে তন্ত্রের এক গূঢ় প্রক্রিয়া সাধন করেন। শেষরাত্রে হোমকুণ্ডে পূর্ণাহুতি দিয়ে একটা গোল লোহার কৌটোয় পুজোর উপচার থেকে কি একটা জিনিস পুরে কৌটোটা প্রপিতামহীর হাতে দিয়ে বলেন -- এই নাও, রাখো। এ যা করে দিয়ে গেলাম আমাদের বংশে আর হঠাৎ কারো কোন বিপদ হবে না।
সত্যিই তারপর থেকে আজ পর্যন্ত এই কৌটোটা আমাদের সব আপদে-বিপদে রক্ষা করে এসেছে। কারো অসুখ-বিসুখ হলে এই মা-কালীর কৌটো তার মাথায় বুকে ঠেকিয়ে দিলে সে ভাল হয়ে ওঠে। ডাক্তার জবাব দিয়ে গিয়েছে এমন মরণাপন্ন রোগীকেও মা-কালীর কৌটোর প্রভাবে সেরে যেতে দেখেছি। সেও না হয় কাকতালীয়, কিন্তু কে একবার কৌটোর মহিমা নিয়ে উপহাস করায় বাবা সাপুড়েদের সদ্য ধরা বিষাক্ত গোখরো সাপের সামনে কৌটোটা ধরেন। ছোটবেলার ঘটনা হলেও আমার পরিষ্কার মনে আছে -- সাপটা সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করে গুটিয়ে এতটুকু হয়ে পড়ে রইল। জোঁকের মুখে নুন পড়লে যেমন হয়।
বললাম -- -এটা কিন্তু দ্রব্যগুণ হতে পারে।
কালীপ্রসাদ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন -- ঠিক। দ্রব্যগুণে সাপ বশীভূত হয়, কিন্তু লোহার কৌটো ফুটো করে দ্রব্যগুণ বের হবে কি করে বলতে পারেন?
যথার্থ কথা। বললাম -- বলে যান।
যাই হোক, বিগত তিনপুরুষ ধরে আমাদের পরিবারের ভালমন্দর ব্যাপারে আমরা মা-কালীর কৌটোর ওপর নির্ভর করে থাকি। তবু তো আমি আধুনিক লোক, বাস করি আধুনিক কোলকাতায়, আমার বিশ্বাস হয়ত অতটা দৃঢ় নয়। কিন্তু বাবা প্রাচীন মানুষ -- ডাক্তার-উকিলের চেয়ে এই কৌটোর ওপর তাঁর নির্ভরতা বেশি।
মাস চারেক আগে কোলকাতার বাসায় আমার বড় ছেলের খুব অসুখ হয়। ছেলে মরণাপন্ন হয়ে পড়ে। সেই সময়েই আবার আমার অফিসে অডিট বসেছে, টাকাটার বিষয় নিয়ে হই-চই, হচ্ছে -- ভেতরে বাইরে আমি তখন খুব বিপন্ন। টাকার ব্যাপার বাবা জানতেন না, কিন্তু নাতির অসুখের খবর পেয়ে আমার এক খুড়তুতো ভাইয়ের হাত দিয়ে মা-কালীর কৌটো কোলকাতায় আমার কাছে পাঠিয়ে দেন। কৌটোর মহিমাতেই কিনা জানি না, আমার ছেলেটি সেরে ওঠে -- অফিসের গোলমালও মিটে যায়।
একটু থেমে কালীপরসাদ বললেন -- কিছু মনে করবেন না, আমাকে আর একটা সিগারেট দেবেন?
সিগারেট ধরিয়ে ঘন ঘন টান দিয়ে প্রায় অর্ধেক করে আনবার পর কালীপ্রসাদ আবার বলতে শুরু করলেন -- এতদিন মা-কালীর কৌটো কোলকাতায় আমার কাছেই ছিল। হঠাৎ দিন দুয়েক আগে বাবার এক জরুরি চিঠি পেলাম। সে এক অদ্ভুত চিঠি। ছেলে-বৌকে ক'দিন আগেই বাবার দেখাশুনা করবার জন্য দেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম -- এখন চিঠি পেয়ে আমিও চলেছি। কৌটোটাও নিয়ে যাচ্ছি সঙ্গে।
বললাম -- চিঠিটা অদ্ভুত বলছেন কেন? কি আছে চিঠিতে?
উত্তরে কালীপ্রসাদ কাধের ঝোলা থেকে একটা খাম বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন -- নিজেই পড়ে দেখুন।
বয়স্ক মানুষের ঈষৎ কম্পিত হস্তাক্ষরে লেখা চিঠি --
স্নেহের কালীপ্রসাদ,
আশা করি মঙ্গলময়ের কৃপায় কুশলেই আছ। এক বিচিত্র ঘটনার সম্মুখীন হইয়া তোমাকে এই পত্র দিতেছি। আজ কয়েকদিন হইল আমাদের বাটিতে নানা অলৌকিক এবং ভৌতিক উপদ্রব আরম্ত হইয়াছে। ইহার কারণ বা কি ভাবে নিরসন হইবে কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। যাহা হউক, পত্র পাওয়া মাত্র তুমি ছুটি লইয়া দেশে আসিবে। গত চার-পাঁচ মাস যাবৎ মা-কালীর কৌটা তোমার কলিকাতায় বাসায় রহিয়াছে, আসিবার সময় উহা সঙ্গে আনিতে ভুলিবে না। সম্ভবত উহা না থাকাতেই এই উপদ্রব। এই পত্রকে তার মনে করিয়া অবিলম্বে রওনা হইবে।
আশীর্বাদ লইয়ো। ইতি --
আঃ
চণ্ডিকাপ্রসাদ মিত্র
পড়া শেষ করে চিঠিটা কালীপ্রসাদকে ফেরত দিলাম। ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন -- কি বুঝলেন?
-- হ্যাঁ, রহস্যময় চিঠি বটে।
-- কি অলৌকিক ব্যাপার কিছু আন্দাজ করতে পারেন?
বললাম -- তা কি বলা যায়? সে তো কত কিছুই হতে পারে। আগে কখনো আপনাদের বাড়িতে এরকম কিছু হয়েছে?
কালীপ্রসাদ বললেন -- কক্ষনো না।
বেলা পড়ে আসছে। আমার ট্রেন আসবার সময় হল। কালীপ্রসাদ দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে কি যেন ভাবছেন। যাক্, আমার আর কি করবার আছে? পোঁটলাটা হাতে নিয়ে বেঞ্চি থেকে উঠে দাঁড়ালাম। বললাম -- আসি তাহলে। সাবধানে থাকবেন --
কালীপ্রসাদ কেমন যেন হতাশ আর ভীত গলায় বললেন -- কিন্তু আমার কি হবে? জানেন, আমার বড্ড ভয় করছে।
-- বিপদে ঈশ্বরকে স্মরণ করবেন। একমাত্র তিনিই সমস্ত ভয় থেকে মানুষকে মুক্ত করতে পারেন।
কালীপ্রসাদের মুখ দেখে মনে হল না যে আমার উপদেশে তিনি কিছুমাত্র ভরসা পেয়েছেন। অবশ্য সেজন্য তাকে দোষ দেওয়া যায় না। ঈশ্বর অদৃশ্য, আড়ম্বর করে তার পুজো দেওয়া যায়। কিন্তু জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে তার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করা একটা উচ্চস্তরের সাধনা। সে সাধনায় কালীপ্রসাদ এখনো সিদ্ধিলাভ করেননি। কিন্তু আমি আর কি করবো? বিদায়সূচক সামান্য হেসে পেছন ফিরে হাঁটতে শুরু করলাম।
কয়েক পা হেঁটে আসতে-না-আসতেই কালীপ্রসাদ দৌড়ে এলেন।
-- শুনছেন? একটু দাঁড়ান --
দাঁড়ালাম। কালীপ্রসাদ আমার কাছে পৌঁছে বললেন -- আর একটা কাজ করা যেতে পারে।
-- কি?
-- আপনি কি তাতে রাজি হবেন?
বললাম -- বলেই ফেলুন না। আমারও তো ট্রেন আসবার সময় হল --
গুরুত্বপূর্ণ কথা শুরু করার ভঙ্গিতে কেশে গলা পরিষ্কার করে কালীপ্রসাদ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন -- আপনি আমার সঙ্গে আমাদের দেশের বাড়ি চলুন।
প্রস্তাবটা নিতান্ত আকস্মিক। অবাক হয়ে বললাম -- আমি? আপনার বাড়িতে?
-- হ্যাঁ। আপনি অলৌকিক শক্তির অধিকারী। আপনি গেলে আমাদের অমঙ্গল কেটে যাবে। আপত্তি করবেন না -- দয়া করে আমার সঙ্গে চলুন। বলুন, যাবেন?
লোকটা সত্যিই ভয় পেয়েছে। পাওয়াই স্বাভাবিক। একটু চিন্তা করলাম -- বাড়িতে এমন কিছু বলে আসিনি যে তাড়াতাড়ি ফিরবো। আরো পাঁচ-সাত দিন দেরি হলে ক্ষতি নেই। দেখাই যাক্ না এর সঙ্গে গিয়ে।
বললাম -- আচ্ছা চলুন -- যাব।
কালীপ্রসাদের চোখের দৃষ্টি কৃতজ্ঞতায় ভারী হয়ে এল। আমার হাত দুটো ধরে তিনি বললেন -- বাঁচলাম। সত্যি বিশ্বাস করিনি আপনি যেতে রাজি হবেন --
একটা ছোট্ট গ্রাম্য স্টেশনে নেমে পাক্কা তিন মাইল হেঁটে কালীপ্রসাদের বাড়ি। গ্রামে যখন ঢুকলাম, তখন রাত্রি প্রায় আটটা। পল্লীগ্রামের তুলনায় শেষ রাত। কৃষ্ণপক্ষের সুমুখ অন্ধকার রাত্তির, পঞ্চমীর রাঙা চাঁদ পুবদিগন্তের নিচে থেকে চালতে গাছের পেছন দিয়ে এক অলৌকিক গোলকের মত উঠে আসছে। গ্রামের প্রায় শেষের দিকে আম-জাম গাছে ঘেরা নির্জন বাড়ি, পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। সদর দরজায় শেকল নাড়তে একটু বাদে দরজার ফাক দিয়ে লন্ঠনের আলো দেখা গেল। কিন্তু কারো সাড়াশব্দ নেই, যেন ভেতরে যে দাঁড়িয়ে, সে সাহস করে দরজা খুলতে পারছে না।
কালীপ্রসাদ হেঁকে বললেন -- অভিরাম নাকি? দরজা খোল্ --
-- কে, বাবু?
ব্যস্ত হয়ে যে লোকটি দরজা খুলে দিল তার বয়েস ষাট ছাড়িয়েছে। মাথায় কাঁচাপাকা চুল, পরনে খাটো ধুতি, খালি গা। তার সরল মুখে বিশ্বস্ততার ছাপ! কালীপ্রসাদ বললেন -- ঠাকুরমশাই, এ হচ্ছে অভিরাম। পুরনো লোক, আমাকে কোলে করেছে ছোটবেলায়। দরজা খুলছিলি না কেন রে?
অভিরামের সরল মুখে ভয়ের স্পষ্ট চিহ্ন ফুটে উঠল। সে বলল -- বাবু বাড়িতে যা কাণ্ড।
দরজা হঠাৎ খুলতে সাহস হয় না --
-- কেন, কি হচ্ছে বাড়িতে?
এর উত্তর অভিরামের দিতে হল না। আমাদের পেছনে আমবাগানে অন্ধকারের মধ্যে গাছের পাতার সরসর শব্দ উঠল, যেন গাছের একটা ভাল ধরে কেউ খুব জোরে ঝাঁকাচ্ছে। আমরা দুজন অবাক হয়ে সেদিকে ফিরে তাকাতেই অভিরাম বলল -- ওই আবার শুরু হল, দেখছেন তো? নানান উপদ্রব সত্যিই, কিসে নাড়াচ্ছে অত মোটা ডালটাকে? মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তাহলে?
সাঁই করে কি একটা জিনিস গাছের ওপর থেকে আমাদের দিকে ছুটে এল। সহজাত সংস্কারের বশে কালীপ্রসাদ কোমর থেকে শরীর সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে ফেলেছিলেন, জিনিসটা ঠক্ করে পাঁচিলে লেগে মাটিতে পড়ে গেল। নইলে এই আঘাতেই কালীপ্রসাদের গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটত।
লন্ঠনের ম্লান ঘোলাটে আলোয় দেখলাম মাটিতে পড়ে আছে একটা সের দশেক ওজনের পাথরের টুকরো।
বললাম -- -আপনারা দুজনে ভেতরে চলে যান। বাড়িতে টর্চ আছে?
-- আজ্ঞে না। কেন?
-- আমি একবার ওই গাছটার কাছে যাব। দাও হে অভিরাম, তোমার লন্ঠনটাই দাও --
কালীপ্রসাদ বিচলিত হয়ে বললেন -- না না, একা যাবেন না! দেখলেন তো --
-- আমার কিছু হবে না। আপনি ভিতরে যান।
আমি জানতাম মধুসুন্দরী দেবীর কৃপায় কোনো নিম্নশ্রেণীর প্রেত আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। পাথরটা কালীপ্রসাদকে লক্ষ্য করেই নিক্ষিপ্ত হয়েছিল, আমাকে নয়। লন্ঠন হাতে বাগানের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালাম।
চারদিক নিষুত, কোথাও গাছের একটি পাতা অবধি নড়ছে না। মনে হল সামনের মোটা গুঁড়িওয়ালা আমগাছটার ওপর থেকেই পাথরটা ছুটে গিয়েছিল। লন্ঠনটা তুলে ধরে ওপরদিকে দেখবার চেষ্টা করলাম -- কিছু দেখা গেল না।
কিন্তু আমার মনের মধ্যে একটা আশ্চর্য অনুভূতি হল।
মনের একেবারে গভীরে হঠাৎ যেন কে একটা কল বিগড়ে দিল। আমার হাত-পা অবশ হয়ে আসছে, সজ্ঞান চৈতন্য নিভে আসতে চাইছে তেলহীন প্রদীপের মত। আর আমি যেন এক পা-ও হাঁটতে পারব না। সমস্ত দেহে-মনে কি অস্বস্তি। সে ভাষায় বোঝানো যাবে না।
নিজের ক্ষমতার ওপর অগাধ বিশ্বাস নিয়ে একা এখানে এসেছিলাম। এবার আমার অকস্মাৎ ভয় করতে লাগল। মৃত্যুভয় নয়, যে কোন কারণেই হোক সে ভয় আমার কোনোদিনই নেই। কোন অজানা শক্তির মুখোমুখি হতে গেলে যে ভয় হয় -- সেই রকম।
বিশ্রী একটা গন্ধে ভরে গিয়েছে চারদিক। প্রতি নিঃশ্বাসে গন্ধটা একেবারে ফুসফুসের ভেতর অবধি চলে গিয়ে যেন শরীরকে অপবিত্র করে দিচ্ছে। মনকে স্থির করে আমি মধুসুন্দরী দেবীর ধ্যানমন্ত্র আবৃত্তি করতে লাগলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পরিবেশ থেকে দুর্গন্ধ দূর হয়ে গেল, মনের বল ফিরে পেলাম।
দরজা খোলাই ছিল, ভেতরে ঢুকে দেখি উঠোনের ওপারে বারান্দায় বাড়ির সবাই জড়ো হয়ে শঙ্কিত চোখে তাকিয়ে আছে। আমি ঢুকতেই কালীপ্রসাদ বললেন -- এই যে ঠাকুরমশাই। ওঃ, আমরা যা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম --
কালীপ্রসাদের কাঁধে হাতের ভর রেখে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন, আন্দাজে বুঝলাম তিনিই চণ্ডিকাপ্রসাদ। ফর্সা মানুষ, দীর্ঘদেহী -- দেখে বোঝা যায় এককালে খুবই সুপুরুষ ছিলেন।
অগোছালো ধরনের ধুতি পরা!
বারান্দায় উঠে লন্ঠনটা নামিয়ে রাখলাম। চন্ডিকাপ্রসাদ এগিয়ে এসে বললেন -- কালী আমাকে এতক্ষণ আপনার কথা বলছিল। আপনি যে কষ্ট করে এসেছেন --
বললাম -- ও কথা বলবেন না, আপনি আমার বাবার বয়েসী চণ্ডিকাপ্রসাদ আমার হাত দুটো ধরে বললেন -- তাতে কি? আপনি বর্ণশ্রেষ্ঠ, সাধক মানুষ৷ আপনি এসেছেন, এবার আমার বাড়ির অমঙ্গল কেটে যাবে। কঠিন রোগীর বাড়ি বিলেতফেরত ভাক্তার গেলে বাড়ির লোকে যেমন বলে।
-- আমার যা সাধ্য আমি করব মিত্রমশায়। নইলে আমি আসতাম না।
-- আমাদের বাড়িতে কেন এমন হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছেন ঠাকুরমশাই?
-- কিছু কিছু বুঝতে পেরেছি বইকি।
পিতা পুত্র দুজনেই বলে উঠলেন -- কি? কি বুঝেছেন?
-- এখন না। আগে আপনাদের কথা শুনে নিই। তারপর বলব।
চণ্ডিকাপ্রসাদ ব্যস্ত হয়ে বললেন- হ্যাঁ, হ্যাঁ -- চলুন, হাত-মুখ ধুয়ে বসে সব শুনবেন।
-- ওরে -- ও অভিরাম, ঠাকুরমশাইকে জল দে --
দক্ষিণ দিকে বড় বড় জানালাওয়ালা একটা ঘরে আমার থাকবার ব্যবস্থা হয়েছিল। একটু সুস্থ হয়ে সেখানে বসে চন্ডিকাপ্রসাদের বিবরণ শুনলাম। চণ্ডিকাপ্রসাদ বললেন -- আমার জীবনে কখনো এমন অভিজ্ঞতা হয়নি ঠাকুর মশাই। দিন পনেরো-কুড়ি আগে এক রাত্তিরে শুরু। খেতে বসেছি সবে, রাত দশটা কি সাড়ে দশটা হবে -- হঠাৎ বাইরে শোঁ শোঁ আওয়াজ করে একটা ঘূর্ণি হাওয়া মত উঠল। আমরা অবাক। ঝড়বৃষ্টির সময় নয়, আকাশে মেঘ নেই -- এমন বাতাস উঠল কোত্থেকে? সেই বাতাসের দাপটেই রাজ্যের ধুলোবালি এসে আমার ভাতে পড়ল। মনটা যেন কেমন হয়ে গেল। আমরা সেকেলে মানুষ, লক্ষণ-অলক্ষণ মানি -- আর না খেয়ে উঠে পড়লাম। সারারাত ভাল ঘুম হল না। বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে রাত শেষ হয়ে গেল। সকালে উঠে গাড়ু হাতে বাগানে যাচ্ছি, দেখি সদর দরজার কাছে দুটো মরা পাখি পড়ে আছে। প্রথমে ভাবলাম গতরাত্রিতে যে বাতাস উঠেছিল, তারই ঝাপটায় বোধ হয় মারা পড়েছে ভাল করে লক্ষ্য করে দেখি তা নয় -- কে যেন পাখি দুটোর ঘাড় মুচড়ে ঘুরিয়ে দিয়েছে। ঝড়ে তেমন হতে পারে না। বাড়ির সবাই দেখলে ভয় পাবে বলে হাতে করে মরা পাখি দুটোকে ঝুলিয়ে নিয়ে গিয়ে দূরে ফেলে দিলাম।
একটু দম নিয়ে চন্ডিকাপ্রসাদ বললেন -- এই শুরু হল। মাঝেমাঝেই উল্টো-পাল্টা বাতাস দেয়, বাড়ির জিনিসপত্র হুড়মুড় করে পড়ে যায়, অদ্ভুত গোঙানির শব্দ শোনা যায় বাড়ির চারপাশে । এসব কিন্তু আমার বাড়ি এবং চারদিকের কিছুটা জায়গায় ঘটে। পরে গ্রামের মধ্যে জিজ্ঞেস করে দেখেছি, তারা ঝড়-বাতাস কিছুই টের পায়নি। কেন এমন হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনি কি বলেন ঠাকুরমশাই?
চন্ডিকাপ্রসাদের দিকে তাকিয়ে বললাম -- আপনার বাড়িতে কোনো প্রেতের উপদ্রব হচ্ছে না। অন্তত যে অর্থে আমরা “প্রেত” কথাটা ব্যবহার করি -- সে অর্থে নয়।
ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন -- তাহলে?
-- ব্যাপারটা আপনাকে বোঝানো একটু কঠিন হবে। আমাদের এই মানুষের জগতের মতই আরো বহু জীবলোক আমাদের চারদিকে সর্বদাই বর্তমান। তারা ঠিক ভূত বা প্রেত নয় -- তারাও এক ধরনের জীব। হয়ত মানুষের চেয়ে অন্য রকম। তাদের মন, চিন্তা, আচার-ব্যবহার সবই মানুষের থেকে আলাদা। আমাদের বিচারে হয়ত অমানুষিক সে জগতের সমস্ত পদাথই আমাদের কাছে অদৃশ্য ও অস্পর্শযোগ্য। বস্তুত একই স্থান অধিকার করেও এই দুই জগৎ একে অপরের কাছে অস্তিত্বহীন। কিন্ত মাঝে মাঝে প্রকৃতির কোনো আশ্চর্য খেয়ালে এই ছায়াজগৎ আমাদের জগৎকে স্পর্শ করে। এখানে ঠিক তাই হয়েছে। আমরা কোনোভাবে তাদের দুনিয়াতে ঢুকে পড়েছি। সেটা তাদের পছন্দ না হলে তাদের দোষ দেওয়া যায় না। যা ঘটতে দেখছেন, তা হচ্ছে আমাদের জাগতিক বস্তুর ওপর তাদের মানসিক শক্তির ক্রিয়া। হয়ত তারা ভাবছে এইভাবে ভয় দেখিয়ে তাদের জগৎ থেকে তারা আমাদের দূর করতে পারবে। বাড়িতে বেড়াল-কুকুর ঢুকলে আমরা যেমন ঠেঙিয়ে তাড়াই আর কি! পার্থক্য এই যে, এক্ষেত্রে এসবে কোনো কাজ হবে না। পরিবেশে আর একটা বড় রকমের ঝাঁকুনি লাগলে দুটো জগৎ আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তার আগে নয়।
আমি থামতে চণ্ডিকাপ্রসাদ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। তারপর বললেন -- এসব আপনি জানলেন কি করে?
খুলে বললে বিস্তর কথা বলতে হয়। ইচ্ছে করছিল না। সংক্ষেপে বললাম -- আমি জানতে পারি।
-- ওই ঝাঁকুনি না কি বললেন, সেটা কি করে দেওয়া যায়?
-- সেটা আপনা আপনিই হয়ে যেতে পারে, যেমন করে শুরু হয়েছিল। স্ত্বত্যয়ন বা স্থানশুদ্ধি গোছের একটা হোমও করতে পারি। কিন্তু আপনাকে সত্য কথাই বলে রাখা ভাল, এই ধরনের উপদ্রবের কথা আমি গুরুদেবের কাছে শুনেছি মাত্র -- নিজে দেখছি এই প্রথম। এ বিষয়ে আমার বিশেষ কোনো অভিজ্ঞতা নেই। আমার হোমে কতদূর কাজ হবে জানি না।
চণ্ডিকাপ্রসাদ কি ভাবলেন, তারপর বললেন -- তা হোক, আপনি হোমের আয়োজন করুন। আর একটা কথা, যদি কিছু মনে না করেন --
-- না, বলুন আপনি --
একটু ইতস্তত করে চণ্ডিকাপ্রসাদ বললেন -- আপনার ওপরেই যদিও সব কিছু ছেড়ে দিচ্ছি, তবু আমার নিজস্ব বিশ্বাসের জন্য যদি কিছু ক্রিয়াকলাপ করি তাহলে আপত্তি হবে না তো?
হেসে বললাম -- না, আমার কি আপত্তি? করুন আপনার যা ইচ্ছে --
চণ্ডিকাপ্রসাদ ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন -- কালী, কৌটোটা এনেছিস তো?
-- হ্যাঁ, বাবা। এনে দেব?
-- নিয়ে আয়।
কালীপ্রসাদ উঠে পাশের ঘর থেকে মা কালীর কৌটো এনে বাবার হাতে দিলেন। সেটা নিয়ে চণ্ডিকাপ্রসাদ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন -- এটার কথা শুনেছেন বোধ হয়?
বললাম- হ্যাঁ, কালীবাবু আসতে আসতে আমাকে বলেছেন।
-- তাহলে তো আপনি সবই জানেন। এই কৌটোর ওপর আমাদের সবার -- মনে একটা গভীর বিশ্বাস আছে আর কি। তবে বিশ্বাসটা অযৌক্তিক নয়, পরীক্ষিত সত্য। গ্রামে বসন্তের মড়ক লেগে হাহাকার পড়ে গিয়েছিল। এই কৌটো হাতে মা কালীর নাম করতে করতে বাড়ির চারদিক ঘুরে গণ্ডি কেটে দিয়েছিলাম। আর্দ্ধেক গ্রাম সাফ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু আমাদের বাড়িতে অসুখ ঢোকেনি। আজও তাই করবো ভাবছি, কৌটো নিয়ে বাড়ির চারধারে গণ্ডি কেটে দেব। আসবেন আমার সঙ্গে? কালী, তুইও আয় -- ,
বৃদ্ধকে একা ছাড়তে ইচ্ছে করল না। বললাম -- চলুন, যাবো।
বাইরে যাবার জন্য সবে উঠে দাঁড়িয়েছি, হঠাৎ বাড়ির ভেতরে হুড়মুড় করে বিকট শব্দ হল -- ধাতব কিছু পড়ে যাওয়ার আওয়াজ।
চণ্ডিকাপ্রসাদ বললেন -- ওই শুরু হল আবার! চলুন দেখি।
ভেতরের বারান্দা থেকে আওয়াজ এসেছিল, সেখানে গিয়ে দেখলাম বাড়ির মেয়ে আর বাচ্চারা বারান্দার অপর প্রান্তে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দশ-বারোখানা ইঁট দিয়ে বেদীমত করে তার ওপরে একটা লোহার ড্রাম দাঁড় করানো ছিল -- চাল রাখবার জন্য। সেটা উল্টে পড়ে চাল ছড়িয়ে পড়েছে চতুর্দিকে। আমরা যখন পৌঁছলাম, তখনও ড্রামটা গড়াচ্ছে। আমাদের পায়ের কাছে এসে থেমে গেল।
আমার নাকে ভেসে এল সেই বিশ্রী গন্ধটা, বাইরের বাগানে যেটা পেয়েছিলাম।
চণ্ডিকাপ্রসাদ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, তাকে বললাম -- -যা করবার করে ফেলুন, আর রাত করবেন না।
সদর দরজা দিয়ে আমরা বাইরে এলাম। সঙ্গে কালীপ্রসাদ আর লষ্টন নিয়ে অভিরাম। চাঁদ ঢাকা পড়েছে গাছের পাতার আড়ালে। মাটিতে ম্লান জ্যোৎস্না আর ছায়ার খেলা। ঝোপেঝাড়ে জোনাকি জ্বলছে। বাতাস নেই কোনো দিকে, কেমন একটা থমথমে আবহাওয়া। কালীপ্রসাদের হাতে একটা মোটা লাঠি, যদিও বুঝতে পারলাম না অতিপ্রাকৃত কোন বিপদ হলে লাঠি দিয়ে কি করে ঠেকানো সম্ভব।
চণ্ডিকাপ্রসাদের হাতে মা-কালীর কৌটো, মুখে বিড়বিড় করে কি মন্ত্র পড়তে পড়তে চলেছেন। ক্রমে আমরা বাড়ির পেছনদিকে এসে হাজির হলাম। এদিকটায় জঙ্গল খুব বেশি, আসশেওড়া আর কুঁচকাটার ঝোপে ভর্তি। সাবধানে কাপড় বাঁচিয়ে চলেছি, আর কয়েক পা হাঁটলেই আমরা একটা বাঁক ফিরে বাড়ির পুব দিকের সীমানায় পৌছব, সেখানে ঝোপঝাড় অপেক্ষাকৃত কম। এমন সময় আমার মনের ভেতর সেই পরিচিত বিপদের ঘণ্টাটা বেজে উঠল -- বুঝতে পারলাম এক্ষুনি একটা কিছু ঘটবে।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ডানদিকের একটা ঘন ঝোপের মধ্যে খড়খড় করে কি নড়ল, আমরা সবাই থমকে দাঁড়িয়ে সেদিকে তাকালাম। কালীপ্রসাদ দুই হাতে লাঠি বাগিয়ে ধরেছেন। অভিরাম লণ্ঠন মাটিতে নামিয়ে রেখে নিঃশব্দে তাঁর হাত থেকে লাঠিটা নিল।
পরমুহূর্তেই ঝোপের মধ্যে থেকে কালো মত বেশ বড়সড় কুকুরের আকারের কি একটা জীব বেরিয়ে এসে ক্রুদ্ধ গর্জন করে চণ্ডিকাপ্রসাদের দিকে ছুটে গেল। কালীপ্রসাদ ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন। আমি বলে উঠলাম -- সামলে!
জন্তুটা চণ্ডিকাপ্রসাদের পায়ে দাঁত বসিয়ে দিতে গেল, অস্ফুট আর্তনাদ করে সরে গেলেন তিনি -- প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অভিরাম সবলে লাঠি দিয়ে আঘাত করল প্রাণীটার মাথায়। শূন্য মাটির হাঁড়ি ফেটে যাবার মত ফটাস্ করে শব্দ হল। নিঃশব্দে জন্তুটা কাত হয়ে পড়ে গেল একপাশে। বলতে এত সময় লাগলেও ঘটতে লেগেছিল কয়েক মুহূর্ত মাত্র।
কালীপ্রসাদ লণ্ঠন নিয়ে ঝুঁকে পড়ে বললেন -- এঃ! এ তো শেয়াল। মরে গেছে।
মরা জ্যোৎস্না আর ম্লান আলো মিলিয়ে কেমন একটা আলো-আঁধারি মত হয়েছে। তবু ভাল করে তাকিয়ে মনে হল শেয়ালই বটে।
অভিরাম বলল- অদ্ভুত ব্যাপার বাবু! শেয়ালে কখনো তাড়া করে কামড়াতে আসে শুনিনি!
কালীপ্রসাদ বললেন -- ঠিক কথা। শেয়াল ভীতু জন্তু, মানুষ দেখলে পালিয়ে যায়। এটা তাড়া করে এল কেন?
চণ্ডিকাপ্রসাদ বোধ হয় নিজেকে সান্ত্বনা দেবার জন্য বললেন -- পাগলা শেয়াল হবে। নইলে কি আর -- যা হোক চল্ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা উচিত নয়।
এদিনের গৃহ প্রদক্ষিণের একটা ফল কিন্তু হাতে হাতে দেখতে পেলাম। সে রাত্তির থেকে বাড়ির ভেতরের উপদ্রব বন্ধ হয়ে গেল। সারারাত সজাগ হয়ে শুয়ে রইলাম, কাশির শব্দ শুনে টের পাচ্ছিলাম চন্ডিকাপ্রসাদও জেগে। কিন্ত সে রাতে আর কোনো উপদ্রব হল না।
পরের দিন সমস্ত ব্যাপারটা অদ্ভুতভাবে মিটে গেল। যে কথা বলবার জন্য এ গল্পের অবতারণা। আমাকে আর যজ্ঞ করতে হয়নি। এ ঘটনায় আমার ভূমিকা ছিল শুধুই দ্রষ্টার।
মরা শেয়ালটার পা ধরে টেনে অভিরাম দূরে আমবাগানের ওপাশে একটা পতিত জমিতে ফেলে দিয়ে এসেছিল। রাত্তিরেও কোন উপদ্রব হয়নি। সকালে উঠে দেখলাম বেশ প্রসন্ন সূর্যের আলোয় চারদিক ভরে আছে। চণ্ডিকাপ্রসাদের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলাপ করে দিনটা কেটে গেল। ভদ্রলোক সেকেলে মানুষ হলেও হিন্দু শাস্ত্রের বিভিন্ন দিক নিয়ে বেশ পড়াশুনো করেছেন।
দুপুরে সুন্দর দিবানিদ্রা দিয়ে যখন উঠলাম, তখন বিকেলের রোদ মিলিয়ে গিয়ে ছায়া গাঢ় হয়ে এসেছে। বাইরের তক্তাপোশে বসে চণ্ডিকাপ্রসাদ হুঁকোয় টান দিচ্ছিলেন, সেখানে গিয়ে বসলাম। গাড়ু হাতে কালীপ্রসাদ উঠোন পেরিয়ে বাড়ির বাইরে বাগানের দিকে চলে গেলেন।
চণ্ডিকাপ্রসাদ ডেকে বললেন -- কালী, চট্ করে সেরে আয়। একসঙ্গে বসে ঠাকুরমশায়ের যজ্ঞের ফর্দটা করে ফেলা দরকার --
এই আসছি -- বলে কালীপ্রসাদ বেরিয়ে গেলেন।
সকালের আলোচনার খেই ধরে চণ্ডিকাপ্রসাদ বললেন- হ্যাঁ, সকালে যে কথা হচ্ছিল নিষ্ঠা এবং সদ্গুরুর প্রয়োজন আছে ঠিকই, কিন্তু মন্ত্রোচ্চারণের যথার্থতার ওপরেই অনুষ্ঠানের সাফল্য নির্ভর করে। মন্ত্রের প্রত্যেক অক্ষরের একজন অধিষ্ঠাত্রী দেবী আছেন, সঠিক উচ্চারণ না হলে তারা কূপিত হন।
বাড়ির ভেতর থেকে গরম ভাজা পরোটা আর আলুভাজা এল। খেতে খেতে গল্প চলল। যখন সন্ধ্যে উতরে অন্ধকার বেশ ঘন হয়ে উঠেছে, সে সময় অভিরাম এসে জিজ্ঞাসা
করল -- কর্তামশাই, ছোটবাবু কোথায়? মাঠাকরুণ ডাকছেন—
চন্ডিকাপ্রসাদ বললেন -- কে, কালী তো -- তাই তো, কালী ফেরেনি? সে কি!
হঠাৎ আমারও খেয়াল হল, কালীপ্রসাদ বহক্ষণ হল বাগানে গিয়েছেন বটে। ছোট-বড় কোনো প্রাকৃতিক আহ্বানে সাড়া দিতেই এতক্ষণ লাগতে পারে না।
দু'এক মুহূর্তের ভেতর ব্যাপারটা সম্যক উপলব্ধি করে আমরা লাফিয়ে উঠলাম! চণ্ডিকাপ্রসাদ কেমন অবরুদ্ধ গলায় বললেন -- অভিরাম, আলো আর লাঠি নিয়ে আয়, তাড়াতাড়ি --
বাড়ি থেকে বেরুচ্ছি, চণ্ডিকাপ্রসাদ বললেন- ঐ যাঃ, দাঁড়ান -- এক্ষুনি আসছি।
তিনি আবার বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেলেন। মিনিটখানেক বাদে বেরিয়ে এলে বুঝলাম আমার আন্দাজ ঠিকই ছিল -- তাঁর হাতে মা-কালীর কৌটো। এইটে আনতেই তিনি ফিরে গিয়েছিলেন।
আমবাগানে পা দিয়েই বুঝতে পারলাম এ বাড়ির ওপর থেকে দুর্ভাগ্যের কালো ছায়া একেবারে মিলিয়ে যায়নি। সমস্ত পরিবেশে ছেয়ে আছে একটা বিকট গন্ধ, গতকাল এসে যেটা পেয়েছিলাম। বিকেলবেলা মনের মধ্যে যে প্রসন্নতা জেগে উঠেছিল, তা কোথায় বিলীন হয়ে গেল।
লন্ঠন হাতে অভিরাম আগে আগে চলেছে, সে ডাকছে -- ছোটবাবু গো -- ও --
চণ্ডিকাপ্রসাদ ডাকছেন -- কালী-ই-ই --
আমার বুক গুরগুর করছে। আজ সন্ধ্যেটা ভাল নয় -- ভাল নয়।
একটা ঝোপের পেছনে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা কালীপ্রসাদকে অভিরামই আগে দেখতে পেল! “ছোটবাবু!" বলে চিৎকার করে উঠে সে ছুটে গিয়ে কালীপ্রসাদের দেহের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে কেঁদে উঠল।
পরমুহূর্তেই আমরাও পৌঁছে গেলাম। আমি শক্ত করে চণ্ডিকাপ্রসাদের হাত ধরে রেখেছি, বুঝতে পারছি তাঁর সমস্ত শরীর ঠকঠক্ করে কাঁপছে। এ অবস্থায় সেটাই স্বাভাবিক। তাঁর হাত ছেড়ে দিয়ে বললাম -- দাঁড়ান একটু, এত বিচলিত হবেন না--
নিচু হয়ে কালীপ্রসাদের নাড়ি দেখলাম, বুকে হাত দিয়ে স্পন্দন বোঝার চেষ্টা করলাম। নাড়ি ঠিক আছে, তবে মৃদু। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললাম -- ভয় নেই, ইনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছেন। অভিরাম, চল -- ধরাধরি করে এঁকে বাড়ি নিয়ে যাই।
আমরা অজ্ঞান কালীপ্রসাদের দেহ তোলবার জন্য নিচু হয়েছি, হঠাৎ ঠিক গতকালের মত ঝোপের মধ্যে খস্ খস্ শব্দ হল। কি যেন আমাদের দিকে আসছে। কিন্তু তার গতি কালকের চেয়ে ধীর।
আমাদের ভয়চকিত দৃষ্টির সামনে ঝোপ ঠেলে বেরিয়ে এল একটা শেয়াল!
গতকাল যে শেয়ালটাকে অভিরাম মেরেছিল!
প্রাণীটার মাথা দু'ফাঁক হয়ে আছে, ঘিলু বেরিয়ে গড়াচ্ছে ডান চোখের ওপর দিয়ে অন্য চোখে মৃত, নিষ্প্রাণ দৃষ্টি। প্রকট দংস্ট্রার ফাঁক দিয়ে জিভের আধখানা বেরিয়ে রয়েছে। সে এক অনৈসর্গিক, বীভৎস দৃশ্য!
ধীর, কিন্তু অমোঘ গতিতে শেয়ালটা আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। কোনোদিকে কোনো শব্দ নেই, গাছের পাতায় বাতাসের সামান্যতম মর্মর নেই -- সমস্ত জগৎটাই অন্ধকারের চাদরে ঢাকা পড়ে আড়াল হয়ে গিয়েছে চেতনার থেকে। থাকবার মধ্যে কেবল সামনে ওই সচল মৃতদেহটা।
হঠাৎ অনুভব করলাম আমার পাশে চণ্ডিকাপ্রসাদের নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে উঠেছে। তাকিয়ে দেখলাম তাঁর বার্ধক্যে স্তিমিত চোখে কি এক আগুনে জ্বলছে। মুখের ভঙ্গিতে ভয় নেই, আছে প্রবল ক্রোধ। ত্বরিতে মা কালীর কৌটো হাতে নিয়ে সামনে ঝুঁকে পড়ে কৌটোটা বাড়িয়ে ধরে বললেন -- থাম্!
সচল মৃতদেহ স্থাণু হয়ে গেল।
আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কৌটোসুদ্ধ হাত মাথার ওপর তুলে চিৎকার করে চণ্ডিকাপ্রসাদ বললেন -- মা কালীর নামে বলছি, আমার বাড়ির সব বিপদ দূর হয়ে যাক্। যদি সদ্ধর্ম নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে থাকি, যদি সৎ কায়স্থের সম্তান হই, যদি জীবনে কোনো পুণ্যসঞ্চয় করে থাকি -- তার সবটুকুর জোরে আদেশ করছি, যে অপদেবতারা আমার বাড়িতে ভর করেছে তারা এই মুহূর্তে দূর হয়ে যাক্। আমার হাতে পবিত্র নির্মাল্যের এই কৌটো রয়েছে। দেখি তাদের কত শক্তি, সাধ্য থাকে আমার ক্ষতি করো --
মাথার ওপরে কৌটো তুলে ধরে তিনি বিভিন্ন দিকে ঘোরাতে লাগলেন।
শেয়ালের মৃতদেহটা আস্তে আস্তে আবার কাত হয়ে পড়ে গেল। এবারে সেটা সত্যিই মরেছে।
তার সঙ্গে সঙ্গে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল।
এতক্ষণ বন ছিল, নিষ্পন্দ, নীরব। হঠাৎ কোথা থেকে ছুটে এল ঝড়ের মত বাতাস। সারা বাগান, ঝোপঝাড় মথিত করে কিছুক্ষণ সে বাতাস বইল। অভিরাম বলে উঠল -- দেখুন ঠাকুরমশায়, দেখুন!
তার নির্দেশিত দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেখানে গাছপালা একটু কম, পাতার ফাঁক দিয়ে রাত্রির আকাশ দেখা যায়। চাঁদ উঠতে আজ দেরি আছে, কিন্তু অস্পষ্ট তারার আলোয় অন্ধকার অনেকটা তরল। বাতাসের ঘূর্ণির সঙ্গে পাক খেয়ে একটা জমাট অন্ধকারের স্তম্ভ আকাশে অনেকখানি ঠেলে উঠেছে। অন্ধকারের উপাদানে তৈরি অমানুষী এক আকৃতি -- পরিচিত কিছুর সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। সমস্ত পরিবেশ থেকে, চণ্ডিকাপ্রসাদের বাড়ির ওপর থেকে, আমবাগান থেকে বাতাসের সঙ্গে উঠে যাচ্ছে গুঁড়ো গুঁড়ো অন্ধকার। কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকারের কালো পিন্ডটা অনেক ওপরে উঠে গিয়ে আবছা হয়ে মিলিয়ে গেল।
তারপরেই বনের বাইরে থেকে ভেসে এল একঝলক বাতাস। বুক ভরে নিঃশ্বাস নেবার মত সহজ, স্বাভাবিক, মুক্ত বাতাস। কিটকিট্ করে নিশাচর কীটপতঙ্গেরা ডাকতে শুরু করল। আমরা কেউ কথা না বললেও বুঝতে পারলাম অমঙ্গলের ছায়াটা একেবারে সরে গিয়েছে। কালীপ্রসাদকেও বয়ে নিয়ে যাবার প্রয়োজন হল না, এর কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর জ্ঞান ফিরে এল। বাগান থেকে ফেরবার মুখে শেয়ালটা এসে ওর সামনে দাঁড়িয়েছিল। ভদ্রলোক স্নায়ুর ওপর এত চাপ সহা করতে পারেননি।
ফেরবার সময় চণ্ডিকাপ্রসাদ বললেন -- দেখলেন আমার মা কালীর কৌটোর গুণ? সব ব্যাটাকে তাড়িয়ে দিলাম --
বললাম -- তা বটে।
তারানাথ থামল। কিশোরী বলল -- কিন্তু এ তো মন্ত্রশক্তি বা দ্রব্যগুণের গল্প। এতে বিশ্বাসের শ্রেষ্ঠত্ব কি প্রমাণিত হয়?
তারানাথ বলল -- হয়। পরের দিন নির্জনে বসে কালীপ্রসাদের সঙ্গে গল্প করছিলাম। কালীপ্রসাদ বললেন -- বাবা বিশ্বাসের জোরে আমাদের আপদ দূর করে দিলেন।
বললাম -- কেন, মা কালীর কৌটোর গুণও আছে বলতে হবে --
ম্লান হেসে কালীপ্রসাদ বললেন -- দাঁড়ান, একটা জিনিস দেখাই আপনাকে।
একটু পরে হাতে করে মা কালীর কৌটোটা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন ভদ্রলোক এবং আমার বিস্মিত দৃষ্টির সামনে ঢাকনাটা খুলে ফেললেন।
বাধা দিয়ে বলে উঠলাম -- ও কি করছেন? মন্ত্রঃপূত নির্মাল্য খুলতে নেই, ওতে গুণ নষ্ট হয়ে যায়।
কিছু না বলে কালীপ্রসাদ বিছানার ওপরে কৌটোটা উপুড় করে ধরলেন। ভিতরে যা ছিল চাদরের ওপর ছড়িয়ে পড়ল।
ভেতর থেকে বেরুল কতকগুলো গোল গোল করে পাকানো খবরের কাগজের গুলি। আর কিচ্ছু নেই।
অবাক হয়ে বললাম -- এ কি! নির্মাল্য কই?
কালীপ্রসাদ বললেন -- নেই।
-- তার মানে?
কালীপ্রসাদ মাথা নিচু করে বললেন -- মানে আসল কৌটো অনেক দিন আগে হারিয়ে গিয়েছে। এটা নকল। ছেলের অসুখের সময় কোলকাতায় নিয়ে যাবার পথেই কোথাও পড়ে যায়। বাবা শুনলে অনর্থ করবেন এই ভয়ে শিশি বোতলওয়ালার কাছ থেকে দু'পয়সা দিয়ে এই কৌটোটা কিনি। বাবা আজকাল চোখে কম দেখেন, তাঁকে ঠকানো সহজ। কাজেই বুঝতে পারছেন, যা হয়েছে তা বাবার বিশ্বাসের জোরেই হয়েছে --
আর কেউ জানে এ কথা?
-- শুধু আপনার বৌমা, আমার স্ত্রী। অন্য কেউ না। বাবার বয়েস হয়েছে, আর ক'দিন বা বাঁচবেন? খামোকা কেন তাঁকে দুঃখ দিই?
তারানাথ থামল। ঘরের মধ্যে স্তব্ধতা। বাইরেও বৃষ্টি ধরে এসেছে। একটা নিঃশ্বাস ফেলে কিশোরী বলল -- গল্পটা বেশ। গল্প বানানোয় আপনার একটা স্বাভাবিক দক্ষতা আছে। সিগারেট ধরাতে গিয়ে তারানাথ জ্বলন্ত চোখে কিশোরীর দিকে তাকাল।
আমি ব্যাকুল হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে কিশোরীর হাত ধরে টানলাম -- ওঠো হে, আবার বৃষ্টি এলে বাড়ি ফেরা মুশকিল হয়ে পড়বে।
সমাপ্ত