লেখক: সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়
বাড়িতে এসেই শুনলাম নাটাদা এসেছিল। বলে গেছে, কাল সকালে যেন আমি তৈরি থাকি। একটা লং ড্রাইভে যাবে আমাকে নিয়ে। বড় মুশকিলে পড়ে গেছি। হাতে খুব বেশি সময় নেই। তারপর অফিসেও ধরো ছুটি পাওনা নেই। এখন কী যে করি ভেবে পাচ্ছি না।
ওহো, তোমরা ভাবছ, নাটাদার সঙ্গে যেতে হলে অনেক খরচাপাতি হবে? ভুল ভাবছ। নাটাদার সঙ্গে বেরোলে অনেক খরচাপাতি দূরের কথা, মনিব্যাগটা বাড়িতেই রেখে যাওয়া চলে। পৃথিবীতে এক ধরনের দুর্লভ লোক আছে, যারা সারা জীবন শুধু অন্যের জন্য খরচা করে চলে। নাটাদা তেমনি লোক। একবারের কথা বলি। সেবার আমরা কালিয়াগঞ্জে বাস থেমেছে বলে নেমেছি। নাটাদা গিয়ে বাসের চালককে বলল, "শোনেন, আমাদের জন্য তো অনেকটা পথ ড্রাইভ কইরা আইলেন। অহন একটু মা বসুমতীর কোলে নামেন। একটু চা খামু, আপনেও খান। আর, জানেন তো, কালিয়াগঞ্জের ছানা ভোবনবিখ্যাত। গোটা কয় রসগোল্লা খাইয়া দ্যাখেন।” সে-ভদ্রলোক তো অবাক। তিনি বললেন, “না না, সে কী!” নাটাদার হাত থেকে অত সহজে ছাড়া পাওয়া যায় না। ও ঠিক টেনে নামাল। ভদ্রলোক সেই দেবদুর্লভ রসগোল্লা খেতে-খেতে বল্লেন, “আমি পঁচিশ বছর বাস চালাচ্ছি। আমায় কেউ এভাবে আগে খেতে বলেনি।” বাসে উঠে নাটাদাকে বললাম, “এটা কী হল ?” নাটাদা বলল, "রসগোল্লা কেমন খাইলি বল?” আমি বললাম, “একদম না-জবাব।” “তবে এখন ক' দেখি, ওরে যদি সঙ্গে না লইতাম, নিশ্চিন্ত মনে খাইতে পারতিস্? সারাক্ষণ মনে হইত, ওই বুঝি বাস ছাইড়া দিল। আরে, যে বাস চালাইব, সেই যখন সঙ্গে আছে, তখন তারাইয়া তারাইয়া খাইলাম। এইসব ট্রিকস্ শিইখ্যা ল। তরও ভাল হইব।"
তবে কেন আমি নাটাদার হাত থেকে রেহাই পেতে চাইছি? কেন পাশের বাড়ি থেকে কোন্ ট্রেন কত তাড়াতাড়ি আমায় কত দূরে নিয়ে যেতে পারে ভাবছি?
সে-কথা জানতে হলে তোমাদের একটু ধৈর্য ধরে আমাদের শেষবারের লং ড্রাইভের বৃত্তান্ত ভাই শুনতেই হবে। সেবার নাটাদা আমায় বলল, “গুরু নানকের জন্মদিনে তর ছুটি আছে?” মাসটা মাঘ, তাই গুরু নানকের জন্মদিন সে সময় নয়। বুঝলাম, সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিনের কথা বলছে। হ্যাঁ, নাটাদার কথাবার্তা বুঝতে হবে তোমাকে। বেশি প্রশ্ন করা চলবে না। সেবার আমরা আগরতলা গিয়েছি। সারাদিন দু'জনে ঘুরেছি। আগরতলা দেখে নাটাদা খুব খুশি। সব নাকি একদম ময়মনসিংহের মতো। ওইখানেই ছোটবেলায় নাটাদা ছিল। “কটা জায়গায় হঠাৎ বলল, “র, র, এইখানে একটু গাড়িটারে রাখ।” চালক থামিয়ে দিল গাড়ি। নাটাদা নেমে সব খুব ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করে বলল, “জায়গাটা একেবারে ময়মনসিংহের ব্রাইম্মপল্লীর মতো।" তারপর একটা বড়রকম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, "কদ্দিন হইয়া গেল ব্রাইম্মপল্লী যাই নাই।” সেইদিন রাত্রে একটা নেমন্তন্ন গিয়ে একটা বড় কাঁঠাল খেল। বলল, “ত্রিপুরার কাঁঠালের স্বাদ একদম ময়মনসিংহের মতো। কইলকাতার কাঁঠালগুলি একদম পাইনসা।” রাত্রে প্রচণ্ড গরম। আমি কিছুতেই ঘুমোতে পারছি না। কারণ, গদির খাট দিয়েছিল শুতে। গরমে সে-বিছানায় শোয়া আর আগুনের তপ্ত আঁচে শোয়া প্রায় একই আরামের। আমি স্নানের ঘর থেকে এক বালতি জল এনে মেঝেটা ধুলাম। তারপর শুতে চলেছি, এমন সময় করুণ কণ্ঠে নাটাদা বলল,
“আমি তো বোধহয় মইরাই যামু।” আমি প্রশ্ন করলাম, “কেন, কাঁঠালগুলি পাইনসা নয় বলে পেটে লাফালাফি করছে বুঝি?” নাটাদা বলল, “ঠাট্টা করতাছস্ কর। কিন্তু সেইবার যখন তুই আমার বারণ সত্বেও চিংড়িমাছ খাইয়া কলেরা বাধাইছিলি প্রায়, আমি কিন্তু কিছু কই নাই।” আমি দেখলাম, কথাবার্তাগুলো একটু বেলাইনে চলে যাচ্ছে। তাই বললাম, “কী করব বলো।” নাটাদা বলল, “ওইখানে জিনিয়াস্ টেবলেট আছে। কয়েকটা আইনা দে।” এখন দ্যাখো, তোমরা জিনিয়াস্ ট্যাবলেটের কথা শুনলে ঘাবড়ে যেতে তো? বলো? আমি একদম সোজা জেলুসিল ট্যাবলেট নিয়ে ওকে দিলাম।
সুতরাং গুরু নানক আর নেতাজির বিবরণে একটু-আধটু ভুল হলে আমরা ধরি না। এই কিছুদিন আগে যখন মারকোসকে নিয়ে কাগজে খুব লেখালেখি হয়েছিল, তখন হঠাৎ নাটাদা আমায় এসে প্রশ্ন করল, “একটা কথা ক' দেখি, মারকোস দাড়ি কামাইল ক্যান? দাড়ি রাইখ্যা তো অরে একদম রজনীকান্তর মতো লাগত। বুঝলাম কার্ল মার্কসের সঙ্গে মারকোস গুলিয়ে ফেলেছে । 'র' শব্দটা রবীন্দ্রনাথ আর রজনীকান্ত দু'জনেরই আদ্যক্ষর। আমি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বললাম, “এরা সব আলাদা লোক।” নাটাদা তাই শুনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, “তাই ক। আমি ভাবি, এত চাপদাড়ি কামায় ক্যান্।”
যাই হোক, কবুল করলাম, নেতাজির জন্মদিনে ছুটি আছে। তারপর শনি রবির এমনিই ছুটি । আবার সোমবার দিনও ছুটি সাধারণতন্ত্র দিবস বলে। পরপর চারদিন ছুটি।
নাটাদা বলল, “তাইলে আর কথা নাই। আমরা শুকুরবারই একেরে আর্লি মরনিং-এ বাইর হইতাছি। কোথায় যামু কাইল ঠিক করুম। আমার গাড়ি লইয়া আমি ঠিক চাইরটার সময় রেডি থাকুম। তুই চইল্যা আয়।” তারপর একটু থেমে বলল, “এই দ্যাখ, আমি কী কইতাসি! তুই আসবি ক্যান, আমিই তুইল্যা নিমু তরে। তুই কিন্তু রেডি থাকিস্।”
নাটাদা এল সাড়ে চারটের সময় গাড়ি না নিয়ে। আমার বাড়ির থেকে ওর বাড়ি, হাঁটাপথে ঢিকুস্-ঢিকুস্ করে চললেও পাঁচ মিনিট। আমার মা'কে দেখে বলল, “মাসিমা, ভাবলাম যাওনের আগে আপনার হাতে চা'টা খাইয়া যাই।”
নাটাদা বসল চা খেতে।
মা ওকে যোড়শোপচারে খাওয়ালেন। রুটি, ডিমভাজা, জিবেগজা, কলা, আপেল, ঘন দুধ, মুড়ি, সব খেল। তারপর পরিতৃপ্ত স্বরে বলল, “এই পোলাপানগুলানের বড্ড তাড়াতাড়ি। এত কষ্ট কইরা আপনে সব বানাইছেন, না খাইয়া যাওনের কোনও মানে হয় ?”
শীতকালের ভোর সাড়ে তিনটের সময় উঠে ঘরঘুট্টি অন্ধকারে তৈরি হয়ে থাকবার জন্যে যে তাড়া দিয়েছিল, তার মুখ থেকে এহেন জ্ঞানগর্ভ বাণী শুনলে তোমাদের কী হয় জানি না, আমার প্রচণ্ড রাগ হয়। আমরা এমনিতেই আবার রাগীর বংশ কিনা, অন্তত ঠাকুমা তো তাই বলতেন।
খেয়েদেয়ে নাটাদা হেলতে-দুলতে চলল আমায় নিয়ে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে হঠাৎ বলল, “এই দ্যাখ, কী ভুল করলাম। মাসিমা কী সুন্দর মুখশুদ্ধি বানান, সেগুলান তর তাড়াহুড়িতে নেওয়া হইল না।”
আমি বললাম, রাক্ষসের মতো তো খেলে। মুখশুদ্ধি খাবার জায়গা পেটে আছে?”
এতে নাটাদা স্পষ্টতই ক্ষুপ্ন হল। বলল, “তর বাড়িতে খাইলাম, তাই খোঁটা দিতাছস্?”
আমি বললাম, “ছি-ছি, তাই কখনও দিতে পারি? তুমি তো খেলে মা'র কাছে। আমার কাছে আর খেলে কই। বাইরে বেরোলেও তো তুমিই খাওয়াও। আসলে তোমার শরীরের কথা ভাবছি ।"
এবার নাটাদা বিরক্ত হল। বলল, “তর মতো শরীর না আমার বুঝছিস্? আমরা খাঁটি সব জিনিস খাইছি। এখনও লোহা হজম করতে পারি।” গাড়িটা ওর বাড়ির বাইরে থাকে। ওর গাড়ি নাকি ' কেউর চুরি করনের খ্যামতা নাই'। নাটাদার দাদা বলেন, ওই গাড়ি কেউ পয়সা দিলেও নেবে না। গাড়ির কাছে এসে নাটাদা বলল, “দ্যাখ, এই শীতের সকালে গাড়ি স্টার্ট করনের একটু ঠ্যালা দেওনের প্রয়োজন হয়। তরে কইত্যাছি, শোন, কিছুতেই এক গজের বেশি ঠ্যালতে হইব না। পরে মাইপ্যা দেখিস্।”
আমাদের বাড়িতে নাটাদা যে কেন গাড়ি নিয়ে যায়নি, এতক্ষণে তা বোধগম্য হল। তা লং জার্নিতে যিনি মিনি-মাগনা পেট্রল খরচা করে আমায় নিয়ে যাচ্ছেন, তাঁর গাড়িটা একটু ঠেলব না, এতটা অকৃতজ্ঞ আমি নই। তা ঠেললাম। মেপে দেখিনি, তবে পুরো বিবেকানন্দ পার্কটা পেরিয়ে গাড়ি স্টার্ট হ'ল। নাটাদার মুখটা একটু অপরাধী-অপরাধী মনে হল। “তরে কইতাসি, এতটা ঠেলনের প্রয়োজন কিন্তু রোজ হয় না রে। আইজই হইল। কী শীত পড়ছে ক? আমাগো ল্যাপ্-কম্বল ছাইড়্যা উঠতে কত কষ্ট হয়, আর এ তো একটা যন্তর মাত্র।” তা সেই 'যন্ত্র মাত্র' চলতে শুরু করল। আমরা এস্প্ল্যানেডের কাছে আসতেই নাটাদা আমায় বলল, “এইখানে জানস্, একটা দোকানে না দারুণ জিলাপি ভাজে। খাইছস্?”
আমি বললাম, “না । তুমিও খাবে না। কারণ, একটু আগে প্রচণ্ড সাঁটিয়েছ। এখন জিলিপি কচুরি কিস্সু খাবে না।”
আহত হয়ে নাটাদা বলল, “পৃথিবীটা বড় আজব রে। তা না হইলে অমন মায়ের তুই এমন পোলা হবি ক্যান?”
এরপর আর কোনও বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটল না কিছুক্ষণ। আমরা শ্যামবাজারের মোড়ে ঘোড়ায়-চড়া নেতাজির মূর্তি পেরোলাম। নির্বিঘ্নে পেরোলাম চিড়িয়ার মোড়। বি. টি. রোডে একটা বাড়ির নাম 'গন্ধগৃহ'। সেটাও পেরোলাম। তারপরই হল মুশকিল। হঠাৎ দেখলাম গাড়িটা থেমে আসছে। নাটাদা বলল, "খাইছে। বুলটির সেফটিপিন খুইল্যা গেছে।"
বুলটি নাটাদার বোন। আমি খুব অবাক হয়ে ভাবলাম, বরানগরে এসে ও বালিগঞ্জে বুলটির সেফটিপিন খোলার কথা কীভাবে জানতে পারল? গাড়িটা থামিয়ে বনেট খুলে কীসব করল।
তারপর বলল, “লাগাইয়া দিছি।” তারপর আমাকে অবাক হতে দেখে বলল, “এক্সিলেরেটরের তারটা বদলাইতে হইব। বুলটির সেফটিপিন দিয়া অহন কাম চলতাছে।”
আমি বিম্ময়াহত হয়ে বসে রইলাম। এরপর আমরা বিবেকানন্দ সেতু পার হয়ে এসে পড়লাম দিল্লি রোডে। নাটাদা খুব খুশি৷ বলল, “গাড়িটা কীরকম বাঘের মতো চলতাছে দ্যাখছস্?”
কথাটা আমি সঙ্গে-সঙ্গেই মেনে নিলাম। যা শব্দ, তাতে বাঘ সিংহ একত্র করলেও তারা এ-শব্দ বার করতে পারবে না। বলতে-বলতেই গাড়িটা আবার থামল। এবার বনেট খুলে নাটাদা বলল, “যা ভাবছি তাই। তুই সিগারেট খাস?”
প্রশ্নটা যে কেন করা হল, তা আমি ধরতে পারলাম না। সেটা বলতেই নাটাদা খেঁকিয়ে উঠে বলল, “যা জানস্ না, তাই লইয়া কথা কইস্ না। যা জিগাইলাম, তার উত্তর দে। আমার প্রয়োজন সিগারেট-প্যাকেটের রাংতা। সেইডা আছে কিনা কও।”
আমি সিগারেট খাই না। তাই সিগারেট-প্যাকেটের রাংতাও আমার নেই। কিন্তু সতুজ্যাঠা ইউরোপে কাজে গিয়েছিল। সেখান থেকে রাংতায় মোড়া কয়েকটা চকোলেট এনেছে। দারুণ খেতে। আমি সেই চকোলেটের কয়েকটা পকেটে নিয়ে এসেছিলাম। তারই একটা ছাড়িয়ে মুখে পুরে দিলাম চকোলেটটা। বলো তোমরা, মোড়ক ছাড়া চকোলেট কি পকেটে রাখা চলে? নাটাদা বললেন, “মোড়ক ছাড়াইতেও জানস্ না। আরেকটা বাইর কর।” তারপর সেটার মোড়ক ছাড়িয়ে উনি চকোলেটটা মুখে দিলেন। তারপর রাংতা গুঁজলেন কী একটা জায়গায়। বললেন, “যাউক, নিশ্চিন্ত। কী ভাগ্যিস্ তর সঙ্গে এইগুলা আছিল। পাইলি কোথায়?”
আমি বললাম, “সতুজ্যাঠা এনেছেন"।
“বাঃ তর জ্যাঠা তো বড় ভাল রে। যখন আবার বিলাতে যাবেন, আমারে কইস্। কিছু চকোলেট আমার লাইগাও আনতে কমু।”
দুপুর নাগাদ আমরা একটা ধাবায় পৌঁছলাম। সেখানে নাটাদা খুব তৃপ্তি করে খেল। ফলে ওদের মাংস সব ফুরিয়ে গেল। ছত্রিশটা রুটি খাবার পর ওখানে বেশ একটা আলোড়ন পড়ে গেল। অনেকে ঘিরে দাঁড়াল নাটাদার খাওয়া দেখতে। ভিড় হয়েছে দেখে ট্রাক-ড্রাইভাররাও সেখানে এসে দাঁড়িয়ে গেল। আমার খুব লঙ্জা করছিল। নাটাদা নির্বিকার। সকলের সঙ্গে হেসে- হেসে কথা বলল । ওরা সবাই এসে নাটাদার গাড়ি দেখল। নাটাদা বলল, ওর গাড়ি আসল ল্যান্ড মাস্টার। এখনও কী তেজ ! ওর কাছেই শুনলাম, আমরা নাকি বেনারস যাচ্ছি। আমার তক্ষুনি বুলটির সেফটিপিন আর সতুজ্যেঠার চকোলেটের রাংতার কথা মনে পড়ল।
বেরোতে গিয়ে দেখলাম, গাড়ি আবার ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। আবার ঠেলা। এবার অবিশ্যি ওই বন্ধুভাবাপন্ন ট্রাকড্রাইভাররাই ঠেলে দিল। গাড়ি চলল। চা খাওয়া হবে কুলটিতে৷ সোমশঙ্করদা ওখানে থাকে। ভারী ভাল লোক। সোমশঙ্করবউদি রাঁধে এত ভাল যে, ওর রাগী-রাগী ভাবটায় কেউ দমে না।
আমাদের কিন্তু শেষ পর্যন্ত কুলটি যাওয়া হয়নি। ভিরিঙ্গির জঙ্গলেই রাত কাটাতে হল। জঙ্গলের মধ্যেই গাড়িটা থামিয়ে দিয়েছিল নাটাদা। নাকি একটু হাত-পা ছড়িয়ে নেবে আর জঙ্গলের সৌন্দর্য্য উপভোগ করবে। থামানো মানেই আবার গাড়ি ঠেলা। আর এবার ঠেলার সময় দেখা গেল যে, গাড়ি আর চলে না। তখন আবার বনেট খুলল নাটাদা। তারপর বলল, “দ্যাখ, এইবার কিন্তু কেস সিরিয়াস। তুই সঙ্গে কম্বল আনছস্?” বুঝলাম না। বোঝাল নাটাদাই। বলল, “বুঝতাছস না? কয়েলডা দেখতাসি ফাটসে। একটুকরা কম্বল ভিজাইয়া কয়েলের চাইর দিকে জড়াইয়া দিলেই গাড়ি আবার সোনাপারা মুখ কইরা চলতে শুরু করব।”
আমি বললাম, "আমি আস্ত কম্বল এনেছি, টুকরা কম্বল আনিনি।”
নাটাদা অধৈর্য হয়ে পড়ে বলল, “আরে গাধা, আস্ত কম্বল থিক্যাই তো এক টুকরা বাইর করন যায়।”
এবার আমি স্রেফ খেপে গেলাম। বললাম, “কম্বল টুকরো হবে না।”
নাটাদা খুব অবাক হয়ে বলল, “কী কস্ তুই? এক টুকরা কম্বল কাটলে তর কী ক্ষতিডা ক' তো? তুই কি পুরা কম্বলডা গায়ে দিস্ নাকি? অল্প একটুক কাটলে কী হইব ক' তো?”
তা কাটল একটুকরা কম্বল। তারপর জলে ভিজিয়ে নিয়ে একটা বোতলের মতো দেখতে জিনিসের গায়ে সেটা জড়ালও। আর বিশ্বাস করো, গাড়িটাও চলল।
আমি তখন মনে-মনে ঠিক করে নিয়েছি যে, কুলটিতে গিয়ে আমি আর কোথাও যাচ্ছি না, সোমবউদির সব বাক্যবাণ হজম করেও আমি কুলটিতেই থেকে যাব।
আসানসোল পেরোবার সঙ্গে-সঙ্গে গাড়িটা আবার বেগড়বাই শুরু করল।
এবার নাটাদা সত্যিই চিন্তিত হল। বলল, “এ সি পাম্পটা গ্যাছে গিয়া। তুই গাড়িতে একটু অপেক্ষা কর, আমি আসানসোল গিয়া একটু খোঁজ লই এ সি-পাম্প পাই কি না। এখন এইরকম পাম্প কেউ রাখে না।”
আমি বললাম, “ওসব চিন্তা ছাড়ো। আমি একলা এই নির্জন জায়গায় থাকতে পারব না।”
ভাগ্যক্রমে উলটো দিক থেকে একটা ট্রাক আসছিল। সেটাই দড়ি দিয়ে আসানসোলের এক গাড়ি-মেরামতের জায়গায়। সেখানকার মিস্ত্রি তো বিশ্বাস করতেই চায় না যে, আমরা এই গাড়ি করে কলকাতা থেকে এতদূর এসেছি। সে বারবার বলে, “এ-গাড়ির তো দেখি কিচ্ছুই নেই।”
শেষ পর্যন্ত সেই গাড়ি সারানো হল। দু'দিন ধরে আমরাও সারাক্ষণ সেই মিস্ত্রির সঙ্গে রইলাম। তারপর ২৬ জানুয়ারি আমরা ফিরে এলাম কলকাতায়।
আবার সেই লং জার্নি? আমি আজ রাত্রেই কন্যাকুমারিকা চলে যাচ্ছি। আর নাটাদার সঙ্গে নয়।
ছবি: দেবাশিষ দেব
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment