চিত্রচোর (প্রথমাংশ)



লেখক: শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়



কাচের পেয়ালায় ডালিমের রস লইয়া সত্যবতী ব্যোমকেশের চেয়ারের পাশে আসিয়া দাঁড়াইল। বলিল নাও, এটুকু খেয়ে ফেল।

ঘড়ির দিকে তাকাইয়া দেখিলাম বেলা ঠিক চারিটা। সত্যবতীর সময়ের নড়চড় হয় না। ব্যোমকেশ আরাম-কেদারায় বসিয়া বই পড়িতেছিল, কিছুক্ষণ বিরাগপূর্ণ চক্ষে পেয়ালার পানে চাহিয়া রহিল, তারপর বলিল, রোজ রোজ ডালিমের রস খাব কেন?

সত্যবতী বলিল, ডাক্তারের হুকুম।

ব্যোমকেশ ভ্রুকুটিকুটিল মুখভঙ্গী করিয়া বলিল, ডাক্তারের নিকুচি করেছে। ও খেতে আমার ভাল লাগে না। কি হবে খেয়ে?

সত্যবতী বলিল, গায়ে রক্ত হবে। লক্ষ্মীটি, খেয়ে ফেল।

ব্যোমকেশ চকিতে একবার সত্যবতীর মুখের পানে দৃষ্টিপাত করিল, প্রশ্ন করিল, আজ রাত্তিরে কি খেতে দেবে?

সত্যবতী বলিল, মুর্গীর সুরুয়া আর টোস্ট।

ব্যোমকেশের ভ্রুকুটি গভীর হইল, হুঁ, সুরুয়া। —আর মুর্গীটা খাবে কে?

সত্যবতী মুখ টিপিয়া বলিল, ঠাকুরপো।

আমি তাড়াতাড়ি বলিলাম, শুধু ঠাকুরপো নয়, তোমার অর্ধাঙ্গিনীও ভাগ পাবেন।

ব্যোমকেশ আমার পানে একবার চোখ পাকাইয়া তাকাইল, তারপর বিকৃত মুখে ডালিমের রসটুকু খাইয়া ফেলিল।

কয়েকদিন হইল ব্যোমকেশকে লইয়া সাঁওতাল পরগণার একটি শহরে হাওয়া বদলাইতে আসিয়াছি। কলিকাতায় ব্যোমকেশ হঠাৎ কঠিন রোগে আক্রান্ত হইয়া শয্যাশায়ী হইয়াছিল; দুই মাস যমে-মানুষে টানাটানির পর তাহাকে বাঁচাইয়া তুলিয়াছি। রোগীর সেবা করিয়া সত্যবতী কাঠির মত রোগা হইয়া গিয়াছিল, আমার অবস্থাও কাহিল হইয়াছিল। তাই ডাক্তারের পরামর্শে পৌষের গোড়ার দিকে সাঁওতাল পরগণার প্রাণপ্ৰদ জলহাওয়ার সন্ধানে বাহির হইয়া পড়িয়ছিলাম। এখানে আসিয়া ফলও মন্ত্রের মত হইয়াছে। আমার ও সত্যবতীর শরীর তো চাঙ্গা হইয়া উঠিয়াছেই, ব্যোমকেশের শরীরেও দ্রুত রক্তসঞ্চার হইতেছে এবং অসম্ভব রকম ক্ষুধাবৃদ্ধি হইয়াছে। দীর্ঘ রোগভোগের পর তাহার স্বভাব অবুঝ বালকের ন্যায় হইয়া গিয়াছে; সে দিবারাত্ৰ খাই-খাই করিতেছে। আমরা দুজনে অতি কষ্টে তাহাকে সামলাইয়া রাখিয়াছি।

এখানে আসিয়া অবধি মাত্র দুইজন ভদ্রলোকের সহিত পরিচয় হইয়াছে। এক, অধ্যাপক আদিনাথ সোম; তাঁহার বাড়ির নীচের তলাটা আমরা ভাড়া লইয়াছি। দ্বিতীয়, এখানকার স্থানীয় ডাক্তার অশ্বিনী ঘটক। রোগী সঙ্গে লইয়া আসিয়াছি, তাই সর্বাগ্রে ডাক্তারের সহিত পরিচয় করিয়া রাখা প্রয়োজন মনে হইয়াছে।

শহরে আরও অনেকগুলি বাঙালী আছেন। কিন্তু কাহারও সহিত এখনও আলাপের সুযোগ হয় নাই। এ কয়দিন বাড়ির বাহির হইতে পারি নাই, নূতন স্থানে আসিয়া গোছগাছ করিয়া বসিতেই দিন কাটিয়া গিয়াছে। আজ প্রথম সুযোগ হইয়াছে; শহরের একটি গণ্যমান্য বাঙালীর বাড়িতে চা-পানের নিমন্ত্রণ আছে। আমরা যদিও এখানে আসিয়া নিজেদের জাহির করিতে চাহি নাই, তবু কাঁঠালী চাঁপার সুগন্ধের মত ব্যোমকেশের আগমন-বার্তা শহরে রাষ্ট্র হইয়া গিয়াছে এবং তাহার ফলে চায়ের নিমন্ত্রণ আসিয়াছে।

ব্যোমকেশকে এত শীঘ্ৰ চায়ের পার্টিতে লইয়া যাইবার ইচ্ছা আমাদের ছিল না; কিন্তু দীর্ঘকাল ঘরে বন্ধ থাকিয়া সে অতিষ্ঠ হইয়া উঠিয়াছে; ডাক্তারও ছাড়পত্ৰ দিয়াছেন। সুতরাং যাওয়াই স্থির হইয়াছে।

আরাম-কেদারায় বসিয়া বই পড়িতে পড়িতে ব্যোমকেশ উসখুস করিতেছিল এবং বারবার ঘড়ির পানে তাকাইতেছিল। আমি জানালার কাছে দাঁড়াইয়া অলসভাবে সিগারেট টানিতেছিলাম; সাঁওতাল পরগণার মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া লইয়াছিল। এখানে শুষ্কতার সহিত শ্যামলতার, প্রাচুর্যের সহিত রিক্ততার নিবিড় মিলন ঘটিয়াছে; মানুষের সংস্পর্শ এখানকার কঙ্করময় মাটিকে গলিত পঙ্কিল করিয়া তুলিতে পারে নাই।

ব্যোমকেশ হঠাৎ প্রশ্ন করিল, রিকশা কখন আসতে বলেছ?

বলিলাম, সাড়ে চারটে।

ব্যোমকেশ আর একবার ঘড়ির পানে তাকাইয়া পুস্তকের দিকে চোখ নামাইল। বুঝিলাম ঘড়ি কাঁটার মন্থর আবর্তন তাহাকে অধীর করিয়া তুলিয়াছে। হাসিয়া বললাম, রাই ধৈর্য রহু ধৈৰ্যং—।

ব্যোমকেশ খিঁচাইয়া উঠিল, লজ্জা করে না! আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে সিগারেট খাচ্ছ।

অর্ধদগ্ধ সিগারেট জানালার বাহিরে ফেলিয়া দিলাম। ব্যোমকেশ এখনও সিগারেট খাইবার অনুমতি পায় নাই; সত্যবতী কঠিন দিব্য দিয়াছে।—তাহার অনুমতি না পাইয়া সিগারেট খাইলে মাথা খাইবে, মরা মুখ দেখিবে। আমিও ব্যোমকেশের সম্মুখে সিগারেট খাইতাম না; প্রতিজ্ঞাবদ্ধ নেশাখোরকে লোভ দেখানোর মত পাপ আর নাই। কিন্তু মাঝে মাঝে ভুল হইয়া যাইত।



ঠিক সাড়ে চারিটায় সময় বাড়ির সদরে দুটি সাইকেল-রিকশা আসিয়া দাঁড়াইল। আমরা প্ৰস্তুত ছিলাম; সত্যবতীও ইতিমধ্যে সাজপোশাক করিয়া লইয়াছিল। আমরা বাহির হইলাম।

আমাদের বাড়ির একতলার সহিত দোতলার কোনও যোগ ছিল না, সদরের খোলা বারান্দার ওপাশ হইতে উপরের সিঁড়ি উঠিয়া গিয়াছিল। বাড়ির সম্মুখে খানিকটা মুক্ত স্থান, তারপর ফটক। বাড়ি হইতে বাহির হইয়া দেখিলাম আমাদের গৃহস্বামী অধ্যাপক সোম বিরক্ত গম্ভীর মুখে ফটকের কাছে দাঁড়াইয়া আছেন।

অধ্যাপক সোমের বয়স বোধ করি চল্লিশের কাছাকাছি, কিন্তু তাঁহাকে দেখিয়া ত্ৰিশের বেশি বয়স মনে হয় না; তাঁহার আচার-ব্যবহারেও প্রৌঢ়ত্বের ছাপ নাই। সব কাজেই চটপটে উৎসাহশীল। কিন্তু তাঁহার জীবনে একটি কাঁটা ছিল, সেটি তাঁর স্ত্রী! দাম্পত্য জীবনে তিনি সুখী হইতে পারেন নাই।

প্রোফেসর সোম বাহিরে যাইবার উপযোগী সাজগোজ করিয়া দাঁড়াইয়া আছেন, আমাদের দেখিয়া করুণ হাসিলেন। তিনি চায়ের নিমন্ত্রণে যাইবেন জানিতাম, তাই জিজ্ঞাসা করিলাম, দাঁড়িয়ে যে! যাবেন না?

প্রোফেসর সোম একবার নিজের বাড়ির দ্বিতলের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিলেন, যাব। কিন্তু গিন্নীর এখনও প্রসাধন শেষ হয়নি। আপনারা এগোন।

আমরা রিকশাতে চড়িয়া বসিলাম। ব্যোমকেশ ও সত্যবতী একটাতে বসিল, অন্যটাতে আমি একা। ঘণ্টি বাজাইয়া মনুষ্য-চালিত ত্রিচক্র-যান ছাড়িয়া দিল। ব্যোমকেশের মুখে হাসি ফুটিল। সত্যবতী সযত্নে তাহার গায়ে শাল জড়াইয়া দিল। অতর্কিতে ঠাণ্ডা লাগিয়া না যায়।

কাঁকর-ঢাকা উঁচু-নীচু রাস্তা দিয়া দুই দিক দেখিতে দেখিতে চলিয়াছি। রাস্তার দু’ধারে ঘরবাড়ির ভিড় নাই, এখানে একটা ওখানে একটা। শহরটি যেন হাত-পা ছড়াইয়া অসমতল পাহাড়তলির উপর অঙ্গ এলাইয়া দিয়াছে, গাদাগাদি ঠেসাঠেসি নাই। আয়তনে বিস্তৃত হইলেও নগরের জনসংখ্যা খুব বেশি নয়। কিন্তু সমৃদ্ধি আছে। আশেপাশে কয়েকটি অভ্রের খনি এখানকার সমৃদ্ধির প্রধান সূত্র। আদালত আছে, ব্যাঙ্ক আছে। এখানকার অধিবাসীদের মধ্যে যাঁরা গণ্যমান্য তাঁরা প্ৰায় সকলেই বাঙালী।

যিনি আমাদের নিমন্ত্ৰণ করিয়াছেন তাঁহার নাম মহীধর চৌধুরী। অধ্যাপক সোমের কাছে শুনিয়াছি ভদ্রলোক প্রচুর বিত্তশালী; বয়সে প্রবীণ হইলেও সর্বদাই নানাপ্রকার হুজুগ লইয়া আছেন; অর্থব্যয়ে মুক্তহস্ত। তাঁহার প্রযোজনায় চড়ুইভাতি, শিকার, খেলাধূলা লাগিয়াই আছে।

মিনিট দশ পনেরোর মধ্যে তাঁহার বাসভবনের সম্মুখে উপস্থিত হইলাম। প্রায় দশ বিঘা জমি পাথরের পাঁচিল দিয়া ঘেরা, হঠাৎ দুর্গ বলিয়া ভ্রম হয়। ভিতরে রকমারি গাছপালা, মরসুমী ফুলের কেয়ারি, উঁচু-নীচু পাথুরে জমির উপর কোথাও লাল-মাছের বাঁধানো সরোবর, কোথাও নিভৃত বেতসকুঞ্জ, কোথাও বা কৃত্রিম ক্রীড়াশৈল। সাজানো বাগান দেখিয়া সহসা বনানীর বিভ্রম উপস্থিত হয়। মহীধরবাবু যে ধনবান তাহা তাঁহার বাগান দেখিয়া বুঝিতে কষ্ট হয় না।

নিমন্ত্রিতদের বসিবার স্থান হইয়াছে, শীতের বৈকালী রৌদ্র স্থানটিকে আতপ্ত করিয়া রাখিয়াছে। সুন্দর দোতলা বাড়িটি যেন এই দৃশ্যের পশ্চাৎপট রচনা করিয়াছে। আমরা উপস্থিত হইলে মহীধরবাবু সাদরে আমাদের অভ্যর্থনা করিলেন। ভদ্রলোকের দেহায়তন বিপুল, গৌরবর্ণ দেহ, মাথায় সাদা চুল ছোট করিয়া ছাঁটা, দাড়ি-গোঁফ কামানো গাল দুটি চালতার মত, মুখে ফুটিফাটা হাসি। দেখিলেই মনে হয় অমায়িক ও সরল প্রকৃতি লোক।

কুড়ি-একুশ, সুশ্ৰী গৌরাঙ্গী হাস্যমুখী; ভাসা-ভাসা চোখ দুটিতে বুদ্ধি ও কৌতুকের খেলা। মহীধরবাবু বিপত্নীক, এই মেয়েটি তাঁহার জীবনের একমাত্র সম্বল এবং উত্তরাধিকারিণী।

রজনী মুহুর্তমধ্যে সত্যবতীর সহিত ভাব করিয়া ফেলিল এবং তাহাকে লইয়া দূরের একটা সোফাতে বসাইয়া গল্প জুড়িয়া দিল। আমরাও বসিলাম। অতিথিরা এখনও সকলে আসিয়া উপস্থিত হন নাই, কেবল ডাক্তার অশ্বিনী ঘটক ও আর একটি ভদ্রলোক আসিয়াছেন। ডাক্তার ঘটক আমাদের পরিচিত, পূর্বেই বলিয়াছি; অন্য ভদ্রলোকটির সহিত আলাপ হইল। এর নাম নকুলেশ সরকার; শহরের একজন মধ্যম শ্রেণীর ব্যবসাদার, তা ছাড়া ফটোগ্রাফির দোকান আছে। ফটোগ্রাফি করেন শখের জন্য, উপরন্তু এই সূত্রে কিছু-কিঞ্চিৎ উপার্জন হয়। শহরে অন্য ফটোগ্রাফার নাই।

সাধারণভাবে কথাবার্তা হইতে লাগিল। মহীধরবাবু এক সময় ডাক্তার ঘটককে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, ওহে ঘোটক, তুমি অ্যাদ্দিনেও ব্যোমকেশবাবুকে চাঙ্গা করে তুলতে পারলে না! তুমি দেখছি নামেও ঘোটক কাজেও ঘোটক— একেবারে ঘোড়ার ডাক্তার! বলিয়া নিজের রসিকতায় হা-হা করিয়া হাসিতে লাগিলেন।

নকুলেশবাবু ফোড়ন দিয়া বলিলেন, ঘোড়ার ডাক্তার না হয়ে উপায় আছে? একে অশ্বিনী তায় ঘোটক।

ডাক্তার ইহাদের চেয়ে বয়সে অনেক ছোট, সে একটু হাসিয়া রসিকতা হজম করিল। ডাক্তারকে লইয়া অনেকেই রঙ্গ-রসিকতা করে দেখিলাম, কিন্তু তাহার চিকিৎসা-বিদ্যা সম্বন্ধে সকলেই শ্রদ্ধাশীল। শহরে আরও কয়েকজন প্রবীণ চিকিৎসক আছেন, কিন্তু এই তরুণ সৎস্বভাব ডাক্তারটি মাত্র তিন বৎসরের মধ্যে বেশ পসার জমাইয়া তুলিয়াছে।

ক্রমে অন্যান্য অতিথিরা আসিতে আরম্ভ করিলেন। প্রথমে আসিলেন সস্ত্রীক সপুত্র উষানাথ ঘোষ। ইনি একজন ডেপুটি, এখানকার সরকারী মালখানার ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী। লম্বা-চওড়া চেহারা, খসখসে কালো রঙ, চোখে কালো কাচের চশমা। বয়স আন্দাজ পঁয়ত্ৰিশ, গভীরভাবে থামিয়া থামিয়া কথা বলেন, গভীরভাবে হাসেন। তাঁহার স্ত্রীর চেহারা রুগ্ন, মুখে উৎকণ্ঠার ভাব, থাকিয়া থাকিয়া স্বামীর মুখের পানে উদ্বিগ্ন চক্ষে দৃষ্টিপাত করেন। ছেলেটি বছর পাঁচেকের; তাহাকে দেখিয়াও মনে হয় যেন সর্বদা শঙ্কিত সঙ্কুচিত হইয়া আছে। উষানাথবাবু সম্ভবত নিজের পরিবারবর্গকে কঠিন শাসনে রাখেন, তাঁহার সম্মুখে কেহ মাথা তুলিয়া কথা বলিতে পারে না।

মহীধরবাবু আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়া দিলে তিনি গম্ভীর মুখে গলার মধ্যে দুই চারিটি শব্দ উচ্চারণ করিলেন; বোধ হয় তাহা লৌকিক সম্ভাষণ, কিন্তু আমরা কিছু শুনিতে পাইলাম না। তাঁহার চক্ষু দুইটি কালো কাঁচের অন্তরালে অদৃশ্য হইয়া রহিল। একটু অস্বস্তি বোধ করিতে লাগিলাম। যাহার চোখ দেখিতে পাইতেছি না এমন লোকের সঙ্গে কথা কহিয়া সুখ নাই।

তারপর আসিলেন পুলিসের ডি.এস.পি, পুরুন্দর পাণ্ডে। ইনি বাঙালী নন, কিন্তু পরিষ্কার বাংলা বলেন; বাঙালীর সহিত মেলামেশা করিতেও ভালবাসেন। লোকটি সুপুরুষ, পুলিসের সাজ-পোশাকে দিব্য মানাইয়াছে। ব্যোমকেশের হাত ধরিয়া মৃদুহাস্যে বলিলেন, আপনি এসেছেন, কিন্তু এমনি আমাদের দুর্ভাগ্য একটি জটিল রহস্য দিয়ে যে আপনাকে সংবর্ধনা করব তার উপায় নেই। আমাদের এলাকায় রহস্য জিনিসটার একান্ত অভাব। সব খোলাখুলি। চুরি-বাটপাড়ি যে হয় না তা নয়, কিন্তু তাতে বুদ্ধি খেলাবার অবকাশ নেই।

ব্যোমকেশও হাসিয়া বলিল, সেটা আমার পক্ষে ভালই। জটিল রহস্য এবং আরও অনেক লোভনীয় বস্তু থেকে আমি উপস্থিত বঞ্চিত। ডাক্তারের বারণ৷

এই সময় আর একজন অতিথি দেখা দিলেন। ইনি স্থানীয় ব্যাঙ্কের ম্যানেজার অমরেশ রাহা। কৃশ ব্যক্তিত্বহীন চেহারা, তাই বোধ করি মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি রাখিয়া চেহারায় একটু বৈশিষ্ট্য দিবার চেষ্টা করিয়াছেন। বয়স যৌবন ও প্রৌঢ়ত্বের মাঝামাঝি একটা অনির্দিষ্ট স্থানে।

মহীধরবাবু বলিলেন, অমরেশবাবু, আপনি ব্যোমকেশবাবুকে দেখবার জন্যে ব্যস্ত হয়েছিলেন—এই নিন।

অমরেশবাবু নমস্কার করিয়া সহাস্যে বলিলেন, কীর্তিমান পুরুষকে দেখবার ইচ্ছা কার না হয়? আপনারাও কম ব্যস্ত হননি, শুধু আমাকে দোষ দিলে চলবে কেন?

মহীধরবাবু বলিলেন, কিন্তু আজ আসতে বড় দেরি করেছেন। সকলেই এসে গেছেন, কেবল প্রোফেসর সোম বাকি। তা তাঁর না হয় একটা অজুহাত আছে। মেয়েদের সাজসজ্জা করতে একটু দেরি হয়। আপনার সে অজুহাতও নেই। ব্যাঙ্ক তো সাড়ে তিনটের সময় বন্ধ হয়ে গেছে।

অমরেশ রাহা বলিলেন, তাড়াতাড়ি আসব ভেবেছিলাম। কিন্তু বড়দিন এসে পড়ল, এখন কাজের চাপ একটু বেশি। বছর ফুরিয়ে আসছে। নূতন বছর পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তো আপনারা ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলতে আরম্ভ করবেন। তার ব্যবস্থা করে রাখতে হবে তো।

ইতিমধ্যে কয়েকজন ভৃত্য বাড়ির ভিতর হইতে বড় বড় ট্রেতে করিয়া নানাবিধ খাদ্য-পানীয় আনিয়া টেবিলগুলির উপর রাখিতেছিল; চা, কেক, সন্দেশ, পাঁপরভাজা, ডালমুট ইত্যাদি। রজনী উঠিয়া গিয়া খাবারের প্লেটগুলি পরিবেশন করিতে লাগিল। কেহ কেহ নিজেই গিয়া প্লেট তুলিয়া লইয়া আহার আরম্ভ করিলেন। সঙ্গে সঙ্গে হাসি গল্প আলাপ-আলোচনা চলিল।

রজনী মিষ্টান্নের একটি প্লেট লইয়া ব্যোমকেশের সম্মুখে দাঁড়াইল, হাসিমুখে বলিল, ব্যোমকেশবাবু, একটু জলযোগ।

ব্যোমকেশ আড়চোখে একবার সত্যবতীর দিকে তাকাইল, দেখিল সত্যবতী দূর হইতে একদৃষ্টি তাহার পানে চাহিয়া আছে। ব্যোমকেশ ঘাড় চুলকাইয়া বলিল, আমাকে মাপ করতে হবে। এসব আমার চলবে না।

মহীধরবাবু ঘুরিয়া ফিরিয়া খাওয়া তদারক করিতেছিলেন, বলিলেন, সে কি কথা! একেবারেই চলবে না? একটু কিছু—? ওহে, ডাক্তার, তোমার রোগীর কি কিছুই খাবার হুকুম নেই?

ডাক্তার টেবিলের নিকট দাঁড়াইয়া এক মুঠি ডালমুট মুখে ফেলিয়া চিবাইতেছিল, বলিল, না খেলেই ভাল।

ব্যোমকেশ ক্লিষ্ট হাসিয়া বলিল, শুনলেন তো! আমাকে শুধু এক পেয়ালা চা দিন। ভাববেন না, আবার আমরা আসব; আজকের আসাটা মুখবন্ধ মাত্র।

মহীধরবাবু খুশি হইয়া বলিলেন, আমার বাড়িতে রোজ সন্ধ্যাবেলা কেউ না কেউ পায়ের ধুলো দেন। আপনারাও যদি মাঝে মাঝে আসেন সান্ধ্য-বৈঠক জমবে ভাল।

এতক্ষণে অধ্যাপক সোম সস্ত্রীক আসিয়া পৌঁছিলেন। সোমের একটু লজ্জা-লজ্জা ভাব। বস্তুত লজ্জা না হওয়াই আশ্চর্য। সোম-পত্নী মালতী দেবীর বর্ণনা আমরা এখনও দিই নাই, কিন্তু আর না দিলে নয়। বয়সে তিনি স্বামীর প্রায় সমকক্ষ; কালো মোটা শরীর, থলথলে গড়ন, ভাঁটার মত চক্ষু সর্বদাই গর্বিতভাবে ঘুরিতেছে; মুখশ্ৰী দেখিয়া কেহ মুগ্ধ হইবে সে সম্ভাবনা নাই। উপরন্তু তিনি সাজ-পোশাক করিয়া থাকিতে ভালবাসেন। আজ যেরূপ সর্বালঙ্কার ভূষিতা হইয়া চায়ের জলসায় আসিয়াছেন তাহাতে ইন্দ্রপুরীর অন্সরাদেরও চমক লগিবার কথা। পরিধানে ডগডগে লাল মাদ্রাজী সিল্কের শাড়ি, তার উপর সর্বাঙ্গে হীরা-জহরতের গহনা। তাঁহার পাশে সোমের কুন্ঠিত ম্রিয়মাণ মূর্তি দেখিয়া আমাদেরই লজ্জা করিতে লাগিল।

রজনী তাড়াতাড়ি গিয়া তাঁহাদের অভ্যর্থনা করিল, কিন্তু মালতী দেবীর মুখে হাসি ফুটিল না। তিনি বক্ৰচক্ষে রজনীর মুখ হইতে স্বামীর মুখ পর্যন্ত দৃষ্টির একটি কশাঘাত করিয়া চেয়ারে গিয়া বসিলেন।

খাওয়া এবং গল্প চলিতে লাগিল। ব্যোমকেশ মুখে শহীদের ন্যায় ভাবব্যঞ্জনা ফুটাইয়া চুমুক দিয়া দিয়া চা খাইতেছ; আমি নকুলেশবাবুর সহিত আলাপ করিতে করিতে পানাহার করিতেছি; উষানাথবাবু গভীরমুখে পুরন্দর পাণ্ডের কথা শুনিতে শুনিতে ঘাড় নাড়িতেছেন; তাঁহার ছেলেটি লুব্ধভাবে খাবারের টেবিলের দিকে অগ্রসর হইয়া শঙ্কিত-মুখে আবার ফিরিয়া আসিতেছে; তাহার মা খাবারের একটি প্লেট হাতে ধরিয়া পর্যায়ক্রমে ছেলে ও স্বামীর দিকে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিপাত করিতেছেন।

এই সময় বাক্যালাপের মিলিত কলস্বরের মধ্যে মহীধর বাবুর ঈষদুচ্চ কণ্ঠ শোনা গেল, মিস্টার পাণ্ডে খানিক আগে বলছিলেন যে আমাদের এলাকায় জটিল রহস্যের একান্ত অভাব। একথা কতদূর সত্য আপনারাই বিচার করুন। কাল রাত্রে আমার বাড়িতে চোর ঢুকেছিল।

স্বরগুঞ্জন নীরব হইল; সকলের দৃষ্টি গিয়া পড়িল মহীধরবাবুর উপর। তিনি হাস্যবিকশিত মুখে দাঁড়াইয়া আছেন, যেন সংবাদটা ভারি কৌতুকপ্রদ।

অমরেশবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, কিছু চুরি গেছে নাকি?

মহীধরবাবু বলিলেন, সেইটেই জটিল রহস্য। ড্রয়িংরুমের দেয়াল থেকে একটা বাঁধানো ফটোগ্রাফ চুরি গেছে। রাত্রে কিছু জানতে পারিনি, সকালবেলা দেখলাম ছবি নেই— আর একটা জানালা খোলা রয়েছে ৷

পুরন্দর পাণ্ডে তাঁহার পাশে আসিয়া দাঁড়াইলেন, বলিলেন, ছবি! কোন ছবি?

একটা গ্রুপ-ফটোগ্রাফ। মাসখানেক আগে আমরা পিকনিকে গিয়েছিলাম, সেই সময় নকুলেশবাবু তুলেছিলেন।

পাণ্ডে বলিলেন, হুঁ। আর কিছু চুরি করেনি? ঘরে দামী জিনিস কিছু ছিল?

মহীধরবাবু বলিলেন, কয়েকটা রূপোর ফুলদানী ছিল; তা ছাড়া পাশের ঘরে অনেক রূপোর বাসন ছিল। চোর এসব কিছু না নিয়ে স্রেফ একটি ফটো নিয়ে পালাল। বলুন দেখি জটিল রহস্য কি না?

পাণ্ডে তাচ্ছিল্যভরে হাসিয়া বলিলেন, জটিল রহস্য মনে করতে চান মনে করতে পারেন। আমার তো মনে হয় কোন জংলী সাঁওতাল জানালা খোলা পেয়ে ঢুকেছিল, তারপর ছবির সোনালী ফ্রেমের লোভে ছবিটা নিয়ে গেছে।

মহীধর বাবু বোমকেশের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, ব্যোমকেশবাবু, আপনার কি মনে হয়?

ব্যোমকেশ এতক্ষণ ইহাদের সওয়াল জবাব শুনিতেছিল বটে, কিন্তু তাহার চক্ষু অলসভাবে চারিদিকে ঘুরিতেছিল, সে এখন একটু সচেতন হইয়া বলিল, মিস্টার পাণ্ডে ঠিকই ধরেছেন মনে হয়৷ নকুলেশবাবু, আপনি ছবি তুলেছিলেন?

নকুলেশবাবু বলিলেন, হ্যাঁ। ছবিখানা ভাল হয়েছিল। তিন কপি ছেপেছিলাম। তার মধ্যে এক কপি মহীধরবাবু নিয়েছিলেন—

উষানাথবাবু গলা ঝাড়া দিয়া বলিলেন, আমিও একখানা কিনেছিলাম।

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, আপনার ছবিখানা আছে তো?

উষানাথবাবু বলিলেন, কি জানি। অ্যালবামে রেখেছিলাম, তারপর আর দেখিনি। আছে নিশ্চয়।

আর তৃতীয় ছবিটি কে নিয়েছিলেন নকুলেশবাবু?

প্রোফেসর সোম।

আমরা সকলে সোমের পানে তাকাইলাম। তিনি এতক্ষণ নির্জীবভাবে স্ত্রীর পাশে বসিয়াছিলেন, নিজের নাম উচ্চারিত হইতে শুনিয়া চমকিয়া উঠিলেন; তাঁহার মুখ ধীরে ধীরে লাল হইয়া উঠিতে লাগিল। সোম-গৃহিণীর কিন্তু কোন প্রকার ভাবান্তর দেখা গেল না; তিনি কষ্টিপাথরের যক্ষিণী মূর্তির ন্যায় অটল হইয়া বসিয়া রহিলেন।

ব্যোমকেশ বলিল, আপনার ছবিটা নিশ্চয় আছে!

সোম উত্তপ্তমুখে বলিলেন, অ্যাঁ-তা-বোধ হয়-ঠিক বলতে পারি না—

তাঁহার ভাব দেখিয়া একটু বিস্মিত হইলাম। এমন কিছু গুরুতর বিষয় নয়, তিনি এমন অসম্বৃত হইয়া পড়িলেন কেন?

তাঁহাকে সঙ্কটাবস্থা হইতে উদ্ধার করিলেন অমরেশবাবু, হাসিয়া বলিলেন, তা গিয়ে থাকে যাক গে, আর একখানা নেবেন৷ নকুলেশবাবু, আমারও কিন্তু একখানা চাই। আমিও গ্রুপে ছিলাম।

নকুলেশবাবু মাথা চুলকাইয়া বলিলেন, ও ছবিটা আর পাওয়া যাবে না। নেগেটিভও খুঁজে পাচ্ছি না।

সে কি! কোথায় গেল নেগেটিভ?

দেখিলাম, ব্যোমকেশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নকুলেশবাবুর পানে চাহিয়া আছে। তিনি বলিলেন, আমার স্টুডিওতে অন্যান্য নেগেটিভের সঙ্গে ছিল। আমি দিন দুয়েকের জন্যে কলকাতা গিয়েছিলাম, স্টুডিও বন্ধ ছিল; ফিরে এসে আর সেটা খুঁজে পাচ্ছি না।

পাণ্ডে বলিলেন, ভাল করে খুঁজে দেখবেন। নিশ্চয়ই কোথাও আছে, যাবে কোথায়।

এ প্রসঙ্গ লইয়া আর কোনও কথা হইল না। এদিকে সন্ধ্যার ছায়া ধীরে ধীরে ঘনাইয়া, আসিতেছিল। আমরা গাত্ৰোত্থানের উদ্যোগ করিলাম, কারণ সূৰ্য্যস্তের পর ব্যোমকেশকে বাহিরে রাখা নিরাপদ নয়।

এই সময় দেখিলাম একটি প্ৰেতাকৃতি লোক কখন আসিয়া মহীধরবাবুর পাশে দাঁড়াইয়াছে এবং নিম্নস্বরে তাঁহার সহিত কথা কহিতেছে। লোকটি যে নিমন্ত্রিত অতিথি নয় তাহা তাহার বেশবাস দেখিয়াই অনুমান করা যায়। দীর্ঘ কঙ্কালসার দেহে আধ-ময়লা ধুতি ও সুতির কামিজ, চক্ষু এবং গণ্ডস্থল কোটরপ্রবিষ্ট, যেন মূর্তিমান দুর্ভিক্ষ। তবু লোকটি যে ভদ্রশ্রেণীর তাহা বোঝা যায়।

মহীধরবাবু আমার অনতিদূরে উপবিষ্ট ছিলেন, তাই তাঁহাদের কথাবার্তা কানে আসিল। মহীধর বাবু একটু অপ্রসন্ন স্বরে বলিলেন, আবার কি চাই বাপু? এই তো পরশু তোমাকে টাকা দিয়েছি।

লোকটি ব্যগ্র-বিহ্বল স্বরে বলিল, আজ্ঞে, আমি টাকা চাই না। আপনার একটা ছবি এঁকেছি, তাই দেখাতে এনেছিলাম।

আমার ছবি।

লোকটির হাতে এক তা পাকানো কাগজ ছিল, সে তাহা বুলিয়া মহীশ্বরবাবুর চোখের সামনে ধরিল।

মহীধরবাবু সবিস্ময়ে ছবির পানে চাহিয়া রহিলেন। আমারও কৌতুহল হইয়াছিল, উঠিয়া গিয়া মহীধরবাবুর চেয়ারের পিছনে দাঁড়াইলাম।

ছবি দেখিয়া অবাক হইয়া গেলাম। সাদা কাগজের উপর ক্রেয়নের আঁকা ছবি, মহীধরবাবুর বুক পর্যন্ত প্রতিকৃতি; পাকা হাতের নিঃসংশয় কয়েকটি রেখায় মহীধরবাবুর অবিকল চেহারা ফুটিয়া উঠিয়াছে।

আমার দেখাদেখি রজনীও আসিয়া পিতার পিছনে দাঁড়াইল এবং ছবি দেখিয়া সহৰ্ষে বলিয়া উঠিল, বাঃ। কি সুন্দর ছবি !

তখন আরও কয়েকজন আসিয়া জুটিলেন। ছবিখানা হাতে হাতে ঘুরিতে লাগিল এবং: সকলের মুখেই প্রশংসা গুঞ্জরিত হইয়া উঠিল। দুর্ভিক্ষপীড়িত চিত্রকর অদূরে দাঁড়াইয়া গদগদ মুখে দুই হাত ঘষিতে লাগিল।

মহীধরবাবু তাহাকে বলিলেন, তুমি তো খাসা ছবি আঁকতে পার। তোমার নাম কি?

চিত্রকর বলিল, আজ্ঞে, আমার নাম ফাল্গুনী পাল।

মহীধরবাবু পকেট হইতে একটি দশ টাকার নোট বাহির করিয়া প্ৰসন্ন স্বরে বলিলেন, বেশ বেশ। ছবিখানি আমি নিলাম। এই নাও তোমার পুরস্কার।

ফাল্গুনী পাল কাঁকড়ার মত হাত বাড়াইয়া তৎক্ষণাৎ নোট পকেটস্থ করিল। পুরন্দর পাণ্ডে ললাট কুঞ্চিত করিয়া ছবিখানা দেখিতেছিলেন, হঠাৎ মুখ তুলিয়া ফাল্গুনীকে প্রশ্ন করিলেন, তুমি ওঁর ছবি আঁকলে কি করে? ফটো থেকে?

ফাল্গুনী বলিল, আজ্ঞে, না। ওঁকে পরশুদিন একবার দেখেছিলাম—তাই—

একবার দেখেছিলে তাতেই ছবি এঁকে ফেললে?

ফাল্গুনী আমতা-আমতা করিয়া বলিল, আজ্ঞে, আমি পারি। আপনি যদি হুকুম দেন। আপনার ছবি এঁকে দেব।

পাণ্ডে ক্ষণেক নীরব থাকিয়া বলিলেন, আচ্ছা, বেশ। তুমি যদি আমার ছবি এঁকে আনতে পার, আমিও তোমাকে দশ টাকা বিকশিস দেব।

ফাল্গুনী পাল সবিনয়ে সকলকে নমস্কার করিয়া চলিয়া গেল। পাণ্ডে ব্যোমকেশের দিকে চাহিয়া বলিলেন, দেখা যাক। আমি ওঁদের পিকনিক গ্রুপে ছিলাম না।

ব্যোমকেশ অনুমোদনসূচক ঘাড় নাড়িল। অতঃপর সভা ভঙ্গ হইল। মহীধরবাবুর মোটর আমাদের বাড়ি পৌঁছাইয়া দিল। সোম-দম্পতিও আমাদের সঙ্গে ফিরিলেন।




রাত্ৰি আন্দাজ আটটার সময় আমরা তিনজন বসিবার ঘরে দোরতাড়া বন্ধ করিয়া বসিয়াছিলাম। নৈশ আহারের এখনও বিলম্ব আছে, ব্যোমকেশ আরাম-কেন্দারায় বসিয়া বলবর্ধক ডাক্তারি মদ্য চুমুক দিয়া পান কিরেতেছে; সত্যবতী তাহার পাশে একটা চেয়ারে র‌্যাপার মুড়ি দিয়া বসিয়াছে। আমি সম্মুখে বসিয়া মাঝে মাঝে পকেট হইতে সিগারেটের ডিবা বাহির করিতেছি, আবার রাখিয়া দিতেছি। ব্যোমকেশের গঞ্জনা খাইবার আর ইচ্ছা নাই। চায়ের জলসার আলোচনাই হইতেছে।

আমি বলিলাম, আমরা শিল্প-সাহিত্যের কত আদর করি ফাল্গুনী পাল তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। লোকটা সত্যিকার গুণী, অথচ পেটের দায়ে ভিক্ষে করে বেড়াচ্ছে।

ব্যোমকেশ একটু অন্যমনস্ক ছিল, বলিল, পেটের দায়ে ভিক্ষে করছে তুমি জানলে কি করে? বলিলাম, ওর চেহারা আর কাপড়-চোপড় দেখে পেটের অবস্থা আন্দাজ করা শক্ত নয়।

ব্যোমকেশ একটু হাসিল, শক্ত নয় বলেই তুমি ভুল আন্দাজ করেছ। তুমি সাহিত্যিক, শিল্পীর প্রতি তোমার সহানুভুতি স্বাভাবিক। কিন্তু ফাল্গুনী পালের শারীরিক দুৰ্গতির কারণ অন্নাভাব নয়। আসলে খাদ্যের চেয়ে পানীয়ের প্রতি তার টান বেশি।

অর্থাৎ মাতাল? তুমি কি করে বুঝলে?

প্রথমত, তার ঠোঁট দেখে। মাতালের ঠোঁট যদি লক্ষ্য কর, দেখবে বৈশিষ্ট্য আছে; একটু ভিজে ভিজে, একটু শিথিল-ঠিক বোঝাতে পারব না, কিন্তু দেখলে বুঝতে পারি। দ্বিতীয়ত, ফাল্গুনী যদি ক্ষুধার্ত হত তাহলে খাদ্যদ্রব্যগুলোর প্রতি লোলুপ দৃষ্টিপাত করত, টেবিলের উপর তখনও প্রচুর খাবার ছিল। কিন্তু ফাল্গুনী সেদিকে একবার ফিরেও তাকাল না। তৃতীয়ত, আমার পাশ দিয়ে যখন চলে গেল তখন তার গায়ে মদের গন্ধ পেলাম। খুব স্পষ্ট নয়, তবু মদের গন্ধ। বলিয়া ব্যোমকেশ নিজের বলবর্ধক ঔষধটি তুলিয়া লইয়া এক চুমুক পান করিল।

সত্যবতী বলিল, যাক গে, মাতালের কথা শুনতে ভাল লাগে না। কিন্তু ছবি চুরির এ কি ব্যাপার গা? আমি তো কিছু বুঝতেই পারলাম না। মিছিমিছি। ছবি চুরি করবে কেন?

ব্যোমকেশ কতকটা আপন মনেই বলিল, হয়তো পাণ্ডেসাহেব ঠিকই ধরেছেন। কিন্তু—। যদি তা না হয় তাহলে ভাববার কথা। ...পিকনিকে গ্রুপ ছবি তোলা হয়েছিল। আজ চায়ের পার্টিতে যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা সকলেই পিকনিকে ছিলেন—পাণ্ডে ছাড়া। ...ছবির তিনটি কপি ছাপা হয়েছিল; তার মধ্যে একটা চুরি গেছে, বাকি দুটো আছে কিনা জানা যায়নি-নেগেটিভটাও পাওয়া যাচ্ছে না? একটু চুপ করিয়া থাকিয়া হঠাৎ ছাদের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিল, ইনি ছবির কথায় এমন ঘাবড়ে গেলেন কেন বোঝা গেল না।

কিছুক্ষণ নীরবে কাটিবার পর আমি বলিলাম, কেউ যদি একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে ছবিটা সরিয়ে থাকে। তবে সে উদ্দেশ্যটা কি হতে পারে?

ব্যোমকেশ বলিল, উদ্দেশ্য কি একটা অজিত? কে কোন মতলবে ফিরছে তা কি এত সহজে ধরা যায়? গহনা কর্মণো গতিঃ। সেদিন একটা মার্কিন পত্রিকায় দেখেছিলাম, ওদের চিড়িয়াখানাতে এক বানর-দম্পতি আছে। পুরুষ বাঁদরটা এমনি হিংসুটে, কোনও পুরুষ-দর্শক খাঁচার কাছে এলেই বৌকে টেনে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখে।

সত্যবতী খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল, বলিল, তোমার যত সব আষাঢ়ে গল্প। বাঁদরের কখনও এত বুদ্ধি হয়?

ব্যোমকেশ বলিল, এটা বুদ্ধি নয়, হৃদয়াবেগ; সরল ভাষায় যৌন ঈর্ষা। মানুষের মধ্যেও যে ও-বস্তুটি আছে। আশা করি তা অস্বীকার করবে না। পুরুষের মধ্যে তো আছেই, মেয়েদের মধ্যে আরও বেশি আছে। আমি যদি মহীধরবাবুর মেয়ে রজনীর সঙ্গে বেশি মাখামাখি করি তোমার ভাল লাগবে না।

সত্যবতী র‌্যাপারের একটা প্রান্ত ঠোঁটের উপর ধরিয়া নত চক্ষে চুপ করিয়া রহিল। আমি বলিলাম, কিন্তু এই ঈর্ষার সঙ্গে ছবি চুরির সম্বন্ধটা কি?

যেখানে স্ত্রী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা আছে সেখানেই এ ধরনের ঈর্ষা থাকতে পারে। বলিয়া ব্যোমকেশ উর্দ্ধমুখে ছাদের পানে চাহিয়া রহিল।

বলিলাম, মোটিভ খুব জোরালো মনে হচ্ছে না। কিন্তু এ ছাড়া অন্য কোনও উদ্দেশ্য থাকতে পারে না কি?

পারে। চিত্রকর ফাল্গুনী পাল চুরি করে থাকতে পারে। একটা মানুষকে একবার মাত্র দেখে সে ছবি আঁকতে পারে, তার এই দাবি সম্ভবত মিথ্যে। ফটো দেখে ছবি সহজেই আঁকা যায়। ফাল্গুনী সকলের চোখে চমক লাগিয়ে দিয়ে বেশি টাকা রোজগার করবার চেষ্টা করছে কিনা কে জানে!

হুঁ। আর কিছু?

ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল, ফটোগ্রাফার নকুলেশবাবু স্বয়ং ছবি চুরি করে থাকতে পারেন।

নকুলেশবাবুর স্বাৰ্থ কি?

তাঁর ছবি আরও বিক্রি হবে এই স্বাৰ্থ৷ বলিয়া ব্যোমকেশ মুচকি মুচকি হাসিতে লাগিল।

এটা সম্ভব বলে তোমার মনে হয়?

ব্যবসাদারের পক্ষে অসম্ভব কিছুই নয়। আমেরিকায় ফসলের দাম বাড়াবার জন্য ফসল পুড়িয়ে দেয়।

আচ্ছা। আর কেউ?

ঐ দলের মধ্যে হয়তো এমন কেউ আছে যে নিশ্চিহ্নভাবে নিজের অস্তিত্ব মুছে ফেলতে চায়—

মানে—দাগী আসামী?

এই সময় ঘরের বন্ধ দ্বারে মৃদু টোকা পড়িল। আমি গিয়া দ্বার খুলিয়া দিলাম। অধ্যাপক সোম গরম ড্রেসিং-গাউন পরিয়া দাঁড়াইয়া আছেন। তাঁহাকে স্বাগত করিলাম। আমরা আসা অবধি তিনি প্রায় প্রত্যহ এই সময় একবার নামিয়া আসেন। কিছুক্ষণ গল্পগুজব হয়; তারপর আহারের সময় হইলে তিনি চলিয়া যান। তাঁহার গৃহিণী দিনের বেলা দু একবার আসিয়াছেন বটে, কিন্তু সত্যবতীর সঙ্গে বিশেষ ঘনিষ্ঠতা করিবার আগ্রহ তাঁহার দেখা যায় নাই। সত্যবতীও মহিলাটির প্রতি গভীর আকর্ষণ অনুভব করে নাই।

সোম আসিয়া বসিলেন। তাঁহাকে একটি সিগারেট দিয়া নিজে একটা ধরাইলাম। ব্যোমকেশের সাক্ষাতে ধূমপান করিবার এই একটা সুযোগ; সে খিঁচাইতে পরিবে না।

সোম জিজ্ঞাসা করিলেন, আজ পার্টি কেমন লাগল?

ব্যোমকেশ বলিল, বেশ লাগল। সকলেই বেশ কৰ্ষিতচিত্ত ভদ্রলোক বলে মনে হল।

সোম সিগারেটে একটা টান দিয়া বলিলেন, বাইরে থেকে সাধারণত তাই মনে হয়। কিন্তু সেকথা আপনার চেয়ে বেশি কে জানে? মিসেস বক্সী, আজ যাঁদের সঙ্গে আলাপ হল তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে কাকে ভাল লাগল বলুন।

সত্যবতী নিঃসংশয়ে বলিল, রজনীকে। ভারি সুন্দর স্বভাব, আমার বড় ভাল লেগেছে।

সোমের মুখে একটু অরুণাভা ফুটিয়া উঠিল। সত্যবতী সেদিকে লক্ষ্য না করিয়া বলিয়া চলিল, যেমন মিষ্টি চেহারা তেমনি মিষ্টি কথা; আর ভারি বুদ্ধিমতী। —আচ্ছা, মহীধরবাবু এখনও মেয়ের বিয়ে কোন দিচ্ছেন না? ওঁর তো টাকার অভাব নেই।

দ্বারের নিকট হইতে একটি তীব্ৰ তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর শুনিয়া আমরা চমকিয়া উঠিলাম—

বিধবা! বিধবা! বিধবাকে কোন হিন্দুর ছেলে বিয়ে করবে? মালতী দেবী কখন দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন জানিতে পারি নাই। সংবাদটি যেমন অপ্রত্যাশিত, সংবাদ-দাত্রীর আবির্ভাবও তেমনি বিস্ময়কর। হতভম্ব হইয়া তাকাইয়া রহিলাম। মালতী দেবী ঈষতিক্ত নয়নে আমাদের একে একে নিরীক্ষণ করিয়া আবার বলিলেন, বিশ্বাস হচ্ছে না? উনি জানেন, ওঁকে জিজ্ঞেস করুন। এখানে সবাই জানে। অতি বড় বেহায়া না হলে বিধবা মেয়ে আইবুড়ো সেজে বেড়ায় না। কিন্তু দু’কান কাটার কি লজ্জা আছে? অত যে ছলা-কলা ওসব পুরুষ ধরবার ফাঁদ।

মালতী দেবী যেমন আচম্বিতে আসিয়াছিলেন তেমনি অকস্মাৎ চলিয়া গেলেন। সিঁড়িতে তাঁর দুম দুম পায়ের শব্দ শোনা গেল।

আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অভিভূত হইয়াছিলেন অধ্যাপক সোম। তিনি লজ্জায় মাথা তুলিতে পারিতেছিলেন না। কিছুক্ষণ নীরবে কাটিয়া গেল। শেষে তিনি বিড়ম্বিত মুখ তুলিয়া দীনকণ্ঠে বলিলেন, আমাকে আপনারা মাপ করুন। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় কোথাও পালিয়ে যাই— তাঁর স্বর বুজিয়া গেল।

ব্যোমকেশ শান্তস্বরে প্রশ্ন করিল, রাজনী সত্যিই বিধবা?

সোম ধীরে ধীরে বলিলেন, হ্যাঁ। চৌদ্দ বছর বয়সে বিধবা হয়। মহীধর বাবু বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কৃতী ছাত্রের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। বিয়ের দু’দিন পরে প্লেনে চড়ে সে বিলেত যাত্ৰা করে; মহীধরবাবুই জামাইকে বিলেত পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সে বিলেত পর্যন্ত পৌঁছল না; পথেই বিমান দুর্ঘটনা হয়ে মারা গেল। রজনীকে কুমারী বলা চলে।

কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ। আমি সোমকে আর একটি সিগারেট দিলাম এবং দেশলাই জ্বালাইয়া ধরিলাম। সিগারেট ধরাইয়া সোম বলিলেন, আপনারা আমার পারিবারিক পরিস্থিতি বুঝতে পেরেছেন। আমার জীবনের ইতিহাসও অনেকটা মহীধরবাবুর জামাইয়ের মত। গরীবের ছেলে ছিলাম এবং ভাল ছাত্র ছিলাম। বিয়ে করে শ্বশুরের টাকায় বিলেত যাই। কিন্তু উপসংহারটা সম্পূর্ণ অন্য রকমের হল। আমি বিদ্যালাভ করে ফিরে এলাম এবং কলেজের অধ্যাপক হলাম। কিন্তু বেশিদিন টিকতে পারলাম না। কাজ ছেড়ে দিয়ে আজ সাত বছর এখানে বাস করছি। অন্ন-বস্ত্রের অভাব নেই; আমার স্ত্রীর অনেক টাকা।

কথাগুলিতে অন্তরের তিক্ততা ফুটিয়া উঠিল। আমি একটু ইতস্তত করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, কাজ ছেড়ে দিলেন কেন?

সোম উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, লজ্জায়। স্ত্রী-স্বাধীনতার যুগে স্ত্রীকে ঘরে বন্ধ করে রাখা যায় না—অথচ—। মাঝে মাঝে ভাবি, বিমান দুর্ঘটনাটা যদি রজনীর স্বামীর না হয়ে আমার হত সব দিক দিয়েই সুরাহা হত।

সোম দ্বারের দিকে অগ্রসর হইলেন। ব্যোমকেশ পিছন হইতে বলিল, প্রোফেসর সোম, যদি কিছু মনে না করেন একটা প্রশ্ন করি। যে গ্রুপ ছবিটা কিনেছিলেন সেটা কোথায়?

সোম ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, সেটা আমার স্ত্রী কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছেন। তাতে আমি আর রজনী পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিলাম।

সোম ধীরপদে প্ৰস্থান করিলেন। রাত্রে আহারে বসিয়া বেশি কথাবার্তা হইল না। হঠাৎ এক সময় সত্যবতী বলিয়া উঠিল, যে যাই বলুক, রজনী ভারি ভাল মেয়ে। কম বয়সে বিধবা হয়েছে, বাপ যদি সাজিয়ে গুজিয়ে রাখতে চান তাতে দোষ কি?

ব্যোমকেশ একবার সত্যবতীর পানে তাকাইল, তারপর নির্লিপ্ত স্বরে বলিল, আজ পার্টিতে একটা সামান্য ঘটনা লক্ষ্য করলাম, তোমাদের বোধ হয় চোখে পড়েনি। মহীধর বাবু তখন ছবি চুরির গল্প আরম্ভ করেছেন, সকলের দৃষ্টি তাঁর দিকে। দেখলাম ডাক্তার ঘটক একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল, রজনী চুপি চুপি তার কাছে গিয়ে তার পকেটে একটা চিঠির মতন ভাঁজ-করা কাগজ ফেলে দিলে। দু’জনের মধ্যে একটা চকিত চাউনি খেলে গেল। তারপর রজনী সেখান থেকে সরে এল। আমার বোধ হয় আমি ছাড়া এ দৃশ্য আর কেউ লক্ষ্য করেনি। মালতী দেবীও না।



দিন পাঁচ ছয় কাটিয়া গিয়াছে।

ব্যোমকেশের শরীর এই কয়দিনে আরও সারিয়াছে। তাহার আহার্যের বরাদ্দ বৃদ্ধি পাইয়াছে; সত্যবতী তাহাকে দিনে দুইটা সিগারেট খাইবার অনুমতি দিয়াছে। আমি নিত্য গুরুভোজনের ফলে দিন দিন খোদার খাসী হইয়া উঠিতেছি, সত্যবতীর গায়েও গত্তি লাগিয়াছে। এখন আমরা প্রত্যহ বৈকালে ব্যোমকেশকে লইয়া রাস্তায় রাস্তায় পদচারণ করি, কারণ হওয়া বদলের ইহা একটা অপরিহার্য অঙ্গ। সকলেই খুশি।

একদিন আমরা পথ-ভ্ৰমণে বাহির হইয়াছি, অধ্যাপক সোম আসিয়া আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন, বলিলেন, চলুন, আজ আমিও আপনাদের সহযাত্রী।

সত্যবতী একটু উৎকণ্ঠিত হইয়া বলিল, মিসেস সোম কি—?

সোম প্ৰফুল্ল স্বরে বলিলেন, তাঁর সর্দি হয়েছে। শুয়ে আছেন।

সোম মিশুক লোক, কেবল স্ত্রী সঙ্গে থাকিলে একটু নির্জীব হইয়া পড়েন। আমরা নানা কথার আলোচনা করিতে করিতে পথে পথে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলাম।

ছবি চুরির প্রসঙ্গ আপনা হইতেই উঠিয়া পড়িল। ব্যোমকেশ বলিল, আচ্ছা বলুন দেখি, ঐ ছবিখানা কাগজে বা পত্রিকায় ছাপানোর কোনও প্ৰস্তাব হয়েছিল কি?

সোম চকিতে একবার ব্যোমকেশের পানে চাহিলেন, তারপর ভ্রু কুঞ্চিত করিয়া ভাবিতে ভাবিতে বলিলেন, কৈ, আমি তো কিছু জানি না। তবে নকুলেশবাবু মাঝে কলকাতা গিয়েছিলেন বটে। কিন্তু আমাদের না জানিয়ে তিনি ছবি ছাপতে দেবেন কি? মনে হয় না। বিশেষত ডেপুটি উষানাথবাবু জানতে পারলে ভারি অসন্তুষ্ট হবেন।

উষানাথবাবু অসন্তুষ্ট হবেন কেন?

উনি একটু অদ্ভুত গোছের লোক। বাইরে বেশ গ্ৰাম্ভারি, কিন্তু ভিতরে ভিতরে ভীরু প্রকৃতি।

বিশেষত ইংরেজ মনিবকে যমের মত ভয় করেন। সাহেবরা বোধ হয় চান না যে একজন হাকিম সাধারণ লোকের সঙ্গে ফটো তোলাবে, তাই উষানাথবাবুর ফটো তোলাতে ঘোর আপত্তি। মনে আছে, পিকনিকের সময় তিনি প্রথমটা ফটোর দলে থাকতে চাননি, অনেক বলে-কয়ে রাজী করাতে হয়েছিল। এ ছবি যদি কাগজে ছাপা হয় নকুলেশবাবুর কপালে দুঃখ আছে।

ব্যোমকেশের মুখ দেখিয়া বুঝিলাম সে মনে মনে উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছে। সে জিজ্ঞাসা করিল, উষানাথবাবু কি সব সময়েই কালো চশমা পরে থাকেন?

সোম বলিলেন, “হ্যাঁ। উনি বছর দেড়েক হল এখানে বদলি হয়ে এসেছেন, তার মধ্যে আমি ওঁকে কখনও বিনা চশমায় দেখিনি। হয়তো চোখের কোনও দুর্বলতা আছে; আলো সহ্য করতে পারেন না।

ব্যোমকেশ উষানাথবাবু সম্বন্ধে আর কোনও প্রশ্ন করিল না। হঠাৎ বলিল, ফটোগ্রাফার নকুলেশ সরকার লোকটি কেমন?

সোম বলিল, চতুর ব্যবসাদার, ঘটে বুদ্ধি আছে। মহীধরবাবুকে খোসামোদ করে চলেন, শুনেছি। তাঁর কাছে টাকা ধার নিয়েছেন।

তাই নাকি! কত টাকা?

তা ঠিক জানি না। তবে মোটা টাকা।

এই সময় সামনে ফট্‌ফট্‌ শব্দ শুনিয়া দেখিলাম একটি মোটর-বাইক আসিতেছে। আরও কাছে আসিলে চেনা গেল, আরোহী ডি.এস.পি. পুরন্দর পাণ্ডে। তিনিও আমাদের চিনিয়াছিলেন, মোটর-বাইক থামাইয়া সহাস্যমুখে অভিবাদন করিলেন। কুশল প্রশ্ন আদান-প্রদানের পর ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ফাল্গুনী পাল আপনার ছবি এঁকেছে?

পাণ্ডে চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া বলিলেন, তাজ্জব ব্যাপার মশাই, পর দিনই ছবি নিয়ে হাজির। একেবারে হুবহু ছবি এঁকেছে। অথচ আমার ফটো তার হাতে যাবার কোনই সম্ভাবনা নেই। সত্যি গুণী লোক; দশ টাকা খসাতে হল।

ব্যোমকেশ সহস্যে বলিল, কোথায় থাকে সে?

পাণ্ডে বলিলেন, আর বলবেন না। অতবড় গুণী। কিন্তু একেবারে হতভাগা। পাঁড় নেশাখোর—মদ গাঁজা গুলি কোকেন কিছুই বাদ যায় না। মাসখানেক এখানে এসেছে। এখানে এসে যেখানে সেখানে পড়ে থাকত, কোনও দিন কারুর বারান্দায়, কোনও দিন কারুর খড়ের গাদায় রাত কাটাত। মহীধরবাবু দয়া করে নিজের বাগানে থাকতে দিয়েছেন। ওঁর বাগানের কোণে একটা মেটে ঘর আছে, দুদিন থেকে সেখানেই আছে।

হতভাগ্য এবং চরিত্রহীন শিল্পীর যে-দশা হয় ফাল্গুনীরও তাঁহাই হইয়াছে। তবু কিছুদিনের জন্যও সে একটা আশ্রয় পাইয়াছে জানিয়া মনটা আশ্বস্ত হইল।

পাণ্ডে আবার গাড়িতে স্টার্ট দিবার উপক্ৰম করিলে সোম বলিলেন, আপনি এদিকে চলেছেন। কোথায়?

পাণ্ডে বলিলেন, মহীধরবাবুর বাড়ির দিকেই যাচ্ছি। নকুলেশবাবুর মুখে শুনলাম তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাই বাড়ি যাবার পথে তাঁর খবর নিয়ে যাব।

কি অসুখ?

সামান্য সর্দিকাশি। কিন্তু ওঁর হাঁপানির ধাত৷ ৷

সোম বলিলেন, তাই তো, আমারও দেখতে যাওয়া উচিত। মহীধর বাবু আমাকে বড়ই স্নেহ করেন।

পাণ্ডে বলিলেন, বেশ তো, আমার গাড়ির পিছনের সীটে উঠে বসুন না, একসঙ্গেই যাওয়া যাক। ফেরবার সময় আপনাকে নামিয়ে দিয়ে যাব।

তাহলে তো ভালই হয়। বলিয়া সোম মোটর-বাইকের পিছনে গদি-আঁটা আসনটিতে বসিয়া পাণ্ডের কোমর জড়াইয়া লইলেন।

ব্যোমকেশ বলিল, আচ্ছা, মহীধর বাবুকে বলে দেবেন। আমরা কাল বিকেলে যাব ৷

আচ্ছা! নমস্কার।

মোটর-বাইক দুইজন আরোহী লইয়া চলিয়া গেল। আমরাও বাড়ির দিকে ফিরিলাম। লক্ষ্য করিলাম ব্যোমকেশ আপন মনে মুখ টিপিয়া টিপিয়া হাসিতেছে।

বাড়ি ফিরিয়া চা পান করিতে বসিলাম। ব্যোমকেশ একটু অন্যমনস্ক হইয়া রহিল। দরজা খোলা ছিল; সিঁড়ির উপর ভারী পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। ব্যোমকেশ চকিত হইয়া খাটো গলায় বলিল, অধ্যাপক সোম কোথায় গেছেন এ প্রশ্নের যদি জবাব দেবার দরকার হয়, বলো তিনি মিস্টার পাণ্ডের বাড়িতে গেছেন।

কথাটা ভাল করিয়া হৃদয়ঙ্গম করিবার পূর্বেই প্রশ্নের উত্তর দিবার প্রয়োজন উপস্থিত হইল। মালতী দেবী দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইলেন। সর্দিতে তাঁহার মুখখানা আরও ভারী হইয়া উঠিয়াছে, চক্ষু রক্তাভ; তিনি ঘরের চারিদিকে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি প্রেরণ করিলেন। সত্যবতী উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, আসুন মিসেস সোম।

মালতী দেবী ধরা-ধরা গলায় বলিলেন, না, আমার শরীর ভাল নয়। উনি আপনাদের সঙ্গে বেরিয়েছিলেন, কোথায় গেলেন?

ব্যোমকেশ দ্বারের কাছে আসিয়া সহজ সুরে বলিল, রাস্তায় পাণ্ডে সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তিনি প্রোফেসর সোমকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন।

মালতী দেবী বিস্ময়ভরে বলিলেন, পুলিসের পাণ্ডে? ওঁর সঙ্গে তাঁর কি দরকার?

ব্যোমকেশ সরলভাবে বলিল, তা তো কিছু শুনলাম না। পাণ্ডে বললেন, চলুন আমার বাড়িতে চা খাবেন। হয়তো কোনও কাজের কথা আছে ৷

মালতী দেবী আমাদের তিনজনের মুখ ভাল করিয়া দেখিলেন, একটা গুরুভার নিশ্বাস ফেলিলেন, তারপর আর কোনও কথা না বলিয়া উপরে চলিয়া গেলেন। আমরা ফিরিয়া আসিয়া বসিলাম।

ব্যোমকেশ আমাদের পানে চাহিয়া একটু লজ্জিতভাবে হাসিল, বলিল, ডাহা মিথ্যে কথা বলতে হল। কিন্তু উপায় কি? বাড়িতে দাম্পত্য-দাঙ্গা হওয়াটা কি ভাল?

সত্যবতী বাঁকা সুরে বলিল, তোমাদের সহানুভূতি কেবল পুরুষের দিকে। মিসেস সোম যে সন্দেহ করেন। সে নেহাত মিছে নয়।

স্বামীর ভালবাসা না পেলে তোমরা হিংসেয় চৌচির হয়ে যাও, কিন্তু স্বামীর ভালবাসা কি করে রাখতে হয় তা জানি না। —যাক, অজিত, তোমাকে একটা কাজ করতে হবে ভাই; বাইরের বারান্দায় পাহারা দিতে হবে। সোম ফিরলেই তাঁকে চেতিয়ে দেওয়া দরকার, নৈলে মিথ্যে কথা যদি ধরা পড়ে যায় তাহলে সোম তো যাবেই, সেই সঙ্গে আমাদেরও অশেষ দুৰ্গতি হবে।

আমার কোনই আপত্তি ছিল না। বাহিরের বারান্দায় একটা চেয়ার পড়িয়া থাকিত, তাহাতে বসিয়া মনের সুখে সিগারেট টানিতে লাগিলাম। বাহিরে একটু ঠাণ্ডা বেশি, কিন্তু আলোয়ান গায়ে থাকিলে কষ্ট হয় না।

সোম ফিরিলেন প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে। পাণ্ডের মোটর ফট ফট শব্দে ফটকের বাহিরে দাঁড়াইল, সোমকে নামাইয়া দিয়া চলিয়া গেল। তিনি বারান্দায় উঠিলে আমি বলিলাম, শুনে যান। কথা আছে৷

বসিবার ঘরে ব্যোমকেশ একলা ছিল। সোমের মুখ দেখিলাম গম্ভীর ও কঠিন। ব্যোমকেশ বলিল, মহীধরবাবু কেমন আছেন?

সোম সংক্ষেপে বলিলেন, ভালই।

ওখানে আর কেউ ছিল নাকি?

শুধু ডাক্তার ঘটক।

ব্যোমকেশ তখন মালতী-সংবাদ সোমকে শুনাইল। সোমের গম্ভীর মুখে একটু হাসি ফুটিল। তিনি বলিলেন, ধন্যবাদ।



পরদিন প্ৰভাতে প্ৰাতরাশের সময় লক্ষ্য করিলাম দাম্পত্য কলহ কেবল বাড়ির উপরতলায় আবদ্ধ নাই, নীচের তলায় নামিয়া আসিয়াছে। সত্যবতীর মুখ ভারী, ব্যোমকেশের অধরে বঙ্কিম কঠিনতা। দাম্পত্য কলহ বোধ করি সর্দিকাশির মতই ছোঁয়াচে রোগ।

কি করিয়া দাম্পত্য কলহের উৎপত্তি হয়, কেমন করিয়া তাহার নিবৃত্তি হয়, এসব গুঢ় রহস্য কিছু জানি না। কিন্তু জিনিসটা নূতন নয়, ইতিপূর্বে দেখিয়াছি। ঋষি-শ্ৰাদ্ধের ন্যায় মহা ধুমধামের সহিত আরম্ভ হইয়া অচিরাৎ প্রভাতের মেঘ-ডম্বরবৎ শূন্যে মিলাইয়া যাইবে তাহাতে সন্দেহ নাই।

আহার শেষ হইলে ব্যোমকেশ বলিল, অজিত, চল আজ সকালবেলা একটু বেরুনো যাক ৷

বলিলাম, বেশ, চল। সত্যবতী তৈরি হয়ে নিক।

সত্যবতী বিরসমুখে বলিল, আমার বাড়িতে কাজ আছে। সকাল বিকাল টোটো করে বেড়ালে চলে না।

ব্যোমকেশ উঠিয়া শালটা গায়ে জড়াইতে জড়াইতে বলিল, আমরা দুজনে যাব এই প্রস্তাবই আমি করেছিলাম। চল, মিছে বাড়িতে বসে থেকে লাভ নেই।

সত্যবতী ব্যোমকেশের পায়ের দিকে একটা কটাক্ষপাত করিয়া তীক্ষ্ণ স্বরে বলিল, যার রোগা শরীর তার মোজা পায়ে দিয়ে বাইরে যাওয়া উচিত। বলিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

আমি হাসি চাপিতে না পারিয়া বারান্দায় গিয়া দাঁড়াইলাম। কয়েক মিনিট পরে ব্যোমকেশ বাহির হইয়া আসিল। তাহার ললাটে গভীর ভ্রুকুটি, কিন্তু পায়ে মোজা।

রাস্তায় বাহির হইলাম। ব্যোমকেশের যে কোনও বিশেষ গন্তব্য স্থান আছে তাহা বুঝিতে পারি নাই! ভাবিয়ছিলাম হাওয়া বদলকারীর স্বাভাবিক পরিব্রাজনস্পৃহা তাহাকে চাপিয়া ধরিয়াছে। কিন্তু কিছু দূর যাইবার পর একটা খালি রিকশা দেখিয়া সে তাহাতে উঠিয়া বসিল। আমিও উঠিলাম। ব্যোমকেশ বলিল, ডেপুটি উষানাথবাবুকে মোকাম চলো। রিকশা চলিতে আরম্ভ করিলে আমি বলিলাম, হঠাৎ উষানাথবাবু? ব্যোমকেশ বলিল, আজ রবিবার, তিনি বাড়ি থাকবেন। তাঁকে দুএকটা কথা জিজ্ঞেস করবার আছে।

আধ মাইল পথ চলিবার পর আমি বলিলাম, ব্যোমকেশ, তুমি ছবি চুরির ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছো মনে হচ্ছে। সত্যিই কি ওতে গুরুতর কিছু আছে?

সে বলিল, সেইটেই আবিষ্কারের চেষ্টা করছি।

আরও আধ মাইল পথ উত্তীর্ণ হইয়া উষানাথবাবুর বাড়িতে পৌঁছান গেল। হাকিম পাড়ায় বাড়ি, পাঁচিল দিয়া ঘেরা। ফটকের কাছে রিকশাওয়ালাকে অপেক্ষা করিতে বলিয়া আমরা ভিতরে প্রবেশ করিলাম।

প্রথমেই চমক লাগিল, বাড়ির সদরে কয়েকজন পুলিসের লোক দাঁড়াইয়া আছে। তারপর দেখিলাম ডি.এস.পি, পুরন্দর পাণ্ডের মোটর-বাইক রহিয়াছে।

উষানাথ ও পাণ্ডে সদর বারান্দায় ছিলেন। আমাদের দেখিয়া পাণ্ডে সবিস্ময়ে বলিলেন, একি, আপনারা!

ব্যোমকেশ বলিল, আজ রবিবার, তাই বেড়াতে এসেছিলাম।

উষানাথ হিমশীতল হাসিয়া বলিলেন, আসুন। কাল রাত্রে বাড়িতে চুরি হয়ে গেছে।

তাই নাকি? কি চুরি গেছে?

পাণ্ডে বলিলেন, সেটা এখনও জানা যায়নি। রাত্রে এঁরা দোতলায় শোন, নীচে কেউ থাকে না। ঘর বন্ধ থাকে। কাল রাত্রে আপিস-ঘরে চোর ঢুকে আলমারি খোলবার চেষ্টা করেছিল। একটা পার-চাবি তালায় ঢুকিয়েছিল, কিন্তু সেটা বের করতে পারেনি।

বটে। আলমারিতে কি ছিল?

উষানাথবাবু বলিলেন, সরকারী দলিলপত্র ছিল, আর আমার স্ত্রীর গয়নার বাক্স ছিল। স্টিলের আলমারি। লোহার সিন্দুক বলতে পারেন।

উষানাথবাবুর চোখে কালো চশমা, চোখ দেখা যাইতেছে না। কিন্তু তৎসত্ত্বেও তাঁহার মুখ দেখিয়া মনে হয়, তিনি ভয় পাইয়াছেন। ব্যোমকেশ বলিল, তাহলে চোর কিছু নিয়ে যেতে পারেনি?

পাণ্ডে বলিলেন, সেটা আলমারি না খোলা পর্যন্ত বোঝা যাচ্ছে না। একটা চাবিওয়ালা ডাকতে পাঠিয়েছি।

হুঁ। চোর ঘরে ঢুকল কি করে?

কাঁচের জানালার একটা কাঁচ ভেঙে হাত ঢুকিয়ে ছিটিকিনি খুলেছে। আসুন না দেখবেন।

উষানাথবাবুর আপিস-ঘরে প্রবেশ করিলাম। মাঝারি আয়তনের ঘর, একটা টেবিল, কয়েকটা চেয়ার, স্টিলের আলমারি, দেওয়ালে ভারত-সম্রাটের ছবি— এছাড়া আর কিছু নাই। ব্যোমকেশ কাঁচ-ভাঙা জানালা পরীক্ষা করিল; আলমারির চাবি ঘুরাইবার চেষ্টা করিল, কিন্তু চাবি ঘুরিল না। এই চাবিটা ছাড়া চোর নিজের আগমনের আর কোনও নিদর্শন রাখিয়া যায় নাই। আপিস-ঘরের পাশেই ড্রয়িং-রুম, মাঝে দরজা। আমরা সেখানে গিয়া বসিলাম। আলমারিটা খোলা না হওয়া, পর্যন্ত কিছু চুরি গিয়াছে কিনা জানা যাইবে না। উষানাথবাবু চায়ের প্রস্তাব করিলেন, আমরা মাথা নাড়িয়া প্ৰত্যাখ্যান করিলাম।

ড্রয়িং-রুমটি মামুলিভাবে সাজানো গোছানো। এখানেও দেওয়ালে ভারত-সম্রাটের ছবি। এক কোণে একটি রেডিও যন্ত্র। চেয়ারগুলির পাশে ছোট ছোট নীচু টেবিল; তাঁহাদের কোনটার উপর পিতলের ফুলদানী, কোনটার উপর ছবির অ্যালবাম; দামী জিনিস কিছু নাই।

ব্যোমকেশ বলিল, চোর বোধ হয় এ ঘরে ঢোকেনি ৷

উষানাথবাবু বলিলেন, এ ঘরে চুরি করবার মত কিছু নেই। বলিয়াই তিনি লাফাইয়া উঠিলেন। চোখের কালো চশমা ক্ষণেকের জন্য তুলিয়া কোণের রেডিও-যন্ত্রটার দিকে চাহিয়া রহিলেন, তারপর চশমা নামাইয়া বলিয়া উঠিলেন, আমার পরী! পরী কোথায় গেল!

আমরা সমস্বরে বলিলাম, পরী!

উষানাথবাবু রেডিওর কাছে গিয়া এদিক-ওদিক দেখিতে দেখিতে বলিলেন, একটা রূপোলী গিলটি-করা ছোট্ট পরী—ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের স্ত্রী আমাকে উপহার দিয়েছিলেন— সেটা রেডিওর ওপর রাখা থাকত। নিশ্চয় চোরে নিয়ে গেছে। আমরাও উঠিয়া গিয়া দেখিলাম। রেডিও যন্ত্রের উপর আধুলির মত একটা স্থান সম্পূর্ণ শূন্য। পরী ঐ স্থানে অবস্থান করিতেন সন্দেহ নাই।

ব্যোমকেশ বলিল, চোর হয়তো নেয়নি। আপনার ছেলে খেলা করবার জন্যে নিয়ে থাকতে পারে। একবার খোঁজ করে দেখুন না।

উষানাথবাবু ভ্রু-কুঞ্চন করিয়া বলিলেন, খোকা সভ্য ছেলে, সে কখনও কোনও জিনিসে হাত দেয় না। যা হোক, আমি খোঁজ নিচ্ছি।

তিনি উপরে উঠিয়া গেলেন। ব্যোমকেশ পাণ্ডেকে জিজ্ঞাসা করিল, কাউকে সন্দেহ করেন নাকি?

পাণ্ডে বলিলেন, সন্দেহ-না, সে রকম কিছু নয়। তবে একটা আরদালি বলছে, কাল রাত্রি আন্দাজ সাড়ে সাতটার সময় একটা পাগলাটে গোছের লোক ডেপুটিবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। ডেপুটিবাবু দেখা করেননি, আরদালি বাইরে থেকেই তাকে হাঁকিয়ে দিয়েছে। আরদালি লোকটার যে-রকম বর্ণনা দিলে তাতে তো মনে হয়—

ফাল্গুনী পাল?

হ্যাঁ। একজন সাব-ইন্সপেক্টরকে খোঁজ নিতে পাঠিয়েছি।

ঊষানাথবাবু উপর হইতে নামিয়া আসিয়া জানাইলেন তাঁহার স্ত্রী-পুত্র পরীর কোনও খবরই রাখেন না। নিশ্চয় চোর আর কিছু না পাইয়া রৌপ্যভ্রমে পরীকে লইয়া গিয়াছে।

ব্যোমকেশ ভ্রু কুঁচকাইয়া বসিয়া ছিল, মুখ তুলিয়া বলিল, ভাল কথা, সেই ছবিটা আছে কিনা দেখেছিলেন কি?

কোন ছবি?

সেই যে একটা গ্রুপ-ফটোর কথা মহীধরবাবুর বাড়িতে হয়েছিল?

ও-না, দেখা হয়নি। ঐ যে আপনার পাশে অ্যালবাম রয়েছে, দেখুন না ওতেই আছে।

ব্যোমকেশ অ্যালবাম লইয়া পাতা উল্টাইয়া দেখিতে লাগিল। তাহাতে উষানাথবাবুর পিতা মাতা, ভাই ভগিনী, স্ত্রী পুত্ৰ সকলের ছবি আছে, এমন কি মহীধরবাবু ও রজনীর ছবিও আছে, কেবল উদ্দিষ্ট গ্রুপ-ফটোখানি নাই!

ব্যোমকেশ বলিল, কৈ, দেখছি না তো?

নেই। উষানাথবাবু উঠিয়া আসিয়া নিজে অ্যালবাম দেখিলেন, কিন্তু ফটো পাওয়া গেল না। তিনি তখন বলিলেন, কি জানি কোথায় গেল। কিন্তু এটা এমন কিছু দামী জিনিস নয়। আলমারি থেকে যদি দলিলপত্র কিংবা গয়নার বাক্স চুরি গিয়া থাকে—

ব্যোমকেশ গাত্ৰোখান করিয়া বলিল, আপনি চিন্তা করবেন না, চোর কিছুই চুরি করতে পারেনি। গয়নার বাক্স নিরাপদে আছে, এমন কি, আপনার পরীও একটু খুঁজলেই পাওয়া যাবে। আজ তাহলে আমরা উঠি। মিস্টার পাণ্ডে, চোরের যদি সন্ধান পান আমাকে বঞ্চিত করবেন না।

পাণ্ডে হাসিয়া ঘাড় নাড়িলেন। আমরা বাহিরে আসিলাম; উষানাথবাবুও সঙ্গে সঙ্গে আসিলেন। ব্যোমকেশ উষানাথবাবুকে ইশারা করিয়া বারান্দার এক কোণে লইয়া গিয়া চুপিচুপি কিছুক্ষণ কথা বলিল। তারপর ফিরিয়া আসিয়া বলিল, চল।

রিকশাওয়ালা অপেক্ষা করিতেছিল, আমরা ফিরিয়া চলিলাম। ব্যোমকেশ চিন্তামগ্ন হইয়া রহিল, তারপর এক সময় বলিল, অজিত, উষানাথবাবু এক সময় চোখের চশমা তুলেছিলেন, তখন কিছু লক্ষ্য করেছিলে?

কৈ না। কি লক্ষ্য করব?

উষানাথবাবুর বাঁ চোখটা পাথরের ৷

তাই নাকি? কালো চশমার এই অর্থ?

হাঁ। বছর তিনেক আগে ওঁর চোখের ভেতরে ফোঁড়া হয়, অস্ত্ৰ করে চোখটা বাদ দিতে হয়েছিল। ওঁর সর্বদা ভয় সাহেবরা জানতে পারলেই ওঁর চাকরি যাবে।

আচ্ছা ভীতু লোক তো! এই কথাই বুঝি আড়ালে গিয়ে হচ্ছিল?

হাঁ।

এই তথ্যের গুরুত্ব কতখানি তাহা নির্ণয় করিতে পারিলাম না। উষানাথবাবু যদি কানাই হন তাহাতে পৃথিবীর কি ক্ষতিবৃদ্ধি?

রিকশা ক্ৰমে বাড়ির নিকটবর্তী হইতে লাগিল। ব্যোমকেশ বলিল, অজিত, যাবার সময় তুমি প্রশ্ন করেছিলে, ছবি চুরির ব্যাপার গুরুতর কি না। সে প্রশ্নের উত্তর এখন দেওয়া যেতে পারে। ব্যাপার গুরুতর।

সত্যি? কি করে বুঝলে?

ব্যোমকেশ উত্তর দিল না, একটু মুচকি হাসিল।



অপরাহ্ণে আমরা মহীধরবাবুর বাড়িতে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইলাম। সত্যবতী বলিল, ঠাকুরপো, টর্চ নিয়ে যেও। ফিরতে রাত করবে নিশ্চয়।

আমি টর্চ পকেটে লইয়া বলিলাম, তুমি এবেলাও তাহলে বেরুচ্ছ না?

সত্যবতী বলিল, না। ওপরতলায় একটা মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে, কথা কইবার লোক নেই। তার কাছে দুদণ্ড বসে দুটো কথা কইলেও তার মনটা ভাল থাকবে।

বলিলাম, মালতী দেবীর প্রতি তোমার সহানুভুতি যে ক্রমে বেড়েই যাচ্ছে।

কেন বাড়বে না? নিশ্চয় বাড়বে।

আর রজনীর প্রতি সহানুভূতি বোধ করি সেই অনুপাতে কমে যাচ্ছে?

মোটেই না, একটুও কমেনি। রজনীর দোষ কি? যত নষ্টের গোড়া এই পুরুষ জাতটা।

তর্জন করিয়া বলিলাম, দেখ, জাত তুলে কথা বললে ভাল হবে না বলছি।

সত্যবতী নাক সিঁটকাইয়া রান্নাঘরের দিকে প্ৰস্থান করিল। মহীধর বাবুর বাড়িতে যখন পৌঁছিলাম তখন সূর্য্যাস্ত হয় নাই বটে, কিন্তু বাগানের মধ্যে ঘোর-ঘোর হইয়া আসিয়াছে। খোলা ফটকে লোক নাই। রাত্রেও বোধ হয়। ফটক খোলা থাকে, কিংবা গরু ছাগলের গতিরোধ করিবার জন্য আগড় লাগানো থাকে। মানুষের যাতায়াতে বাধা নাই।

বাড়ির সদর দরজা খোলা; কিন্তু বাড়িতে কেহ আছে বলিয়া মনে হইল না। দুই-তিন বার হ্রেষা-ধ্বনিবৎ গলা খাঁকারি দিবার পর একটি বৃদ্ধগোছের চাকর বাহির হইয়া আসিল। বলিল, কর্তাবাবু ওপরে শুয়ে আছেন। দিদিমণি বাগানে বেড়াচ্ছেন। আপনারা বসুন, আমি ডেকে আনছি।

ব্যোমকেশ বলিল, দরকার নেই - আমরাই দেখছি।

বাগানে নামিয়া ব্যোমকেশ বাগানের একটা কোণ লক্ষ্য করিয়া চলিল। গাছপালা ঝোপঝাড়ে বেশিদূর পর্যন্ত দেখা যায় না, কিন্তু ঘাসে ঢাকা সঙ্কীর্ণ পথগুলি মাকড়সার জালের মত চারিদিকে বিস্তৃত হইয়া গিয়াছে। বুঝিলাম ব্যোমকেশ ফাল্গুনী পালের আস্তানার সন্ধানে চলিয়াছে।

বাগানের কোণে আসিয়া পৌঁছিলাম। একটা মাটির ঘর, মাথায় টালির ছাউনি; সম্ভবত মালীদের যন্ত্রপাতি রাখিবার স্থান। পাশেই একটা প্ৰকাণ্ড ইদারা।

ঘরের দ্বার খোলা রহিয়াছে, কিন্তু ভিতরে অন্ধকার। আমি টর্চের আলো ভিতরে ফেলিলাম। অন্ধকারে খড়ের বিছানার উপর কেহ শুইয়াছিল, আলো পড়িতেই উঠিয়া বাহিরে আসিল। দেখিলাম ফাল্গুনী পাল।

আজ ফাল্গুনীর মন ভাল নয়, কণ্ঠস্বরে ঔদাসীন্য-ভরা অভিমান। আমাদের দেখিয়া বলিল, আপনারাও কি পুলিসের লোক, আমার ঘর খানাতল্লাস করতে এসেছেন? আসুন-দেখুন, প্রাণ ভরে খানাতল্লাস করুন। কিছু পাবেন না। আমি গরীব বটে, কিন্তু চোর নই ৷

ব্যোমকেশ বলিল, আমরা খানাতল্লাস করতে আসিনি। আপনাকে শুধু একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই। কাল রাত্রে আপনি উষানাথবাবুর বাড়িতে কেন গিয়েছিলেন?

ফাল্গুনী তিক্তস্বরে বলিল, তাঁর একটা ছবি এঁকেছিলাম, তাই দেখাতে গিয়েছিলাম। দারোয়ান দেখা করতে দিলে না, তাড়িয়ে দিলে। বেশ কথা, ভাল কথা। কিন্তু সেজন্য পুলিস লেলিয়ে দেবার কি দরকার?

ব্যোমকেশ বলিল, ভারি অন্যায়। আমি পুলিসকে বলে দেব, তারা আপনাকে আর বিরক্ত করবে না।

ধন্যবাদ বলিয়া ফাল্গুনী আবার কোটরে প্রবেশ করিল। আমরা ফিরিয়া আসিলাম। দিনের আলো প্ৰায় নিঃশেষ হইয়া আসিয়াছে। আমরা বাগানে ইতস্তত ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলাম, কিন্তু রজনীকে দেখিতে পাইলাম না।

বাগানের অন্য প্রান্তে বড় বড় পাথরের চাঙড় দিয়া একটা উচ্চ ক্রীড়াশৈল রচিত হইয়াছিল। তাহাকে ঘিরিয়া সবুজ শ্যাওলার বন্ধনী। ক্রীড়াশৈলটি আকারে চারকোণা, দেখিতে অনেকটা পিরামিডের মত। আমরা তাহার পাশ দিয়া যাইতে যাইতে থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িলাম। পিরামিডের অপর পার হইতে আবেগোদ্ধত কণ্ঠস্বর কানে আসিল, ছবি ছবি ছবি। কি হবে ছবি! চাই না ছবি।

আস্তে! কেউ শুনতে পাবে।

কণ্ঠস্বর দুইটি পরিচিত; প্রথমটি ডাক্তার ঘটকের, দ্বিতীয়টি রজনীর। ডাক্তার ঘটককে আমরা শান্ত সংযতবাক মানুষ বলিয়াই জানি; তাহার কণ্ঠ হইতে যে এমন আর্ত উগ্রতা বাহির হইতে পারে তাহা কল্পনা করাও দুষ্কর। রজনীর কণ্ঠস্বরেও একটা শীৎকার আছে, কিন্তু তাহা অস্বাভাবিক নয়।

ডাক্তার ঘটক আবার যখন কথা কহিল তখন তাহার স্বর অপেক্ষাকৃত হ্রস্ব হইয়াছে বটে, কিন্তু আবেগের উন্মাদনা কিছুমাত্র কমে নাই। সে বলিল, আমি তোমাকে চাই-তোমাকে। দুধের বদলে জল খেয়ে মানুষ বাঁচতে পারে না।

রজনী বলিল, আর আমি! আমি কি চাই না? কিন্তু উপায় যে নেই।

ডাক্তার বলিল, উপায় আছে, তোমাকে বলছি।

রজনী বলিল, কিন্তু বাবা—

ডাক্তার বলিল, তুমি নাবালিকা নাও। তোমার বাবা তোমাকে আটকাতে পারেন না।

রজনী বলিল, তা জানি। কিন্তু। —শোন লক্ষ্মীটি শোন, বাবার শরীর খারাপ যাচ্ছে, তিনি সেরে উঠুন।—তারপর

ডাক্তার বলিল, না। আজই আমি জানতে চাই তুমি রাজী আছ কি না।

একটু নীরবতা। তারপর রজনী বলিল, আচ্ছা, আজই বলব, কিন্তু এখন নয়। আমাকে একটু সময় দাও। আজ রাত্রি সাড়ে দশটার সময় তুমি এস, আমি এখানে থাকবো; তখন কথা হবে। এখন হয়তো বাড়িতে কেউ এসেছে, আমাকে না দেখলে—

ব্যোমকেশ নিঃশব্দে আমার হাত ধরিয়া টানিয়া লইল।

দুজনে পা টিপিয়া ফিরিয়া আসিতেছি, হঠাৎ চোখে পড়িল পিরামিডের অন্য পাশ হইতে আর একটা লোক আমাদেরই মত সন্তৰ্পণে দূরে চলিয়া যাইতেছে। একবার মনে হইল বুঝি ডাক্তার ঘটক; কিন্তু ভাল করিয়া চিনিবার আগেই লোকটি অন্ধকারে অদৃশ্য হইয়া গেল।

পিরামিড হইতে অনেকখানি ঘুরিয়া দূরে আসিয়া ব্যোমকেশ বলিল, চল, বাড়ি ফেরা যাক। আজ আর দেখা করে কাজে নেই

রাস্তায় বাহির হইলাম। অন্ধকার হইয়া গিয়াছে, আকাশে চন্দ্ৰ নাই, পথের পাশে কেরোসিনের আলোগুলি দূরে দূরে মিটমিট করিয়া জ্বলিতেছে। আমি মাঝে মাঝে টর্চ জ্বালিয়া পথ নির্ণয় করিতে করিতে চলিলাম।

ব্যোমকেশ চিন্তায় মগ্ন হইয়া আছে। বিদ্রোহোম্মুখ যুবক-যুবতীর নিয়তি কোন কুটিল পথে চলিয়াছে-বোধ করি তাহাই নির্ধারণের চেষ্টা করিতেছে। আমি তাহার ধ্যানভঙ্গ করিলাম না। বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছিয়া ব্যোমকেশ হঠাৎ প্রশ্ন করিল, অন্য লোকটিকে চিনতে পারলে?

বলিলাম, না। কে তিনি?

ব্যোমকেশ বলিল, তিনি হচ্ছেন আমাদের গৃহস্বামী অধ্যাপক আদিনাথ সোম।

তাই নাকি! ব্যোমকেশ, ব্যাপারটা আমার পক্ষে কিছু জটিল হয়ে উঠেছে। ছবি চুরি, পরী চুরি, নেশাখোর চিত্রকর, কানা হাকিম, অবৈধ প্রণয়, অধ্যাপকের আড়িপাতা—কিছু বুঝতে পারছি না।

না পারবারই কথা। রবীন্দ্রনাথের গান মনে আছে—জড়িয়ে গেছে সরু মোটা দুটো তারে, জীবন-বীণা ঠিক সুরে তাই বাজে না রে?—আমিও সরু-মোটা তারের জট ছাড়াতে পারছি না।

আচ্ছা, এই যে ডাক্তার আর রজনীর ব্যাপার, এতে আমাদের কিছু করা উচিত নয় কি?

ব্যোমকেশ দৃঢ়স্বরে বলিল, কিছু নয়। আমরা ক্রিকেট খেলার দর্শক, হাততালি দিতে পারি, দুয়ো দিতে পারি, কিন্তু খেলার মাঠে নেমে খেলায় বাগড়া দেওয়া আমাদের পক্ষে ঘোর বেয়াদপি ৷

বাড়ি ফিরিয়া দেখিলাম সত্যবতী একাকিনী পশমের গেঞ্জি বুনিতেছে। বলিলাম, তোমার রুগীর খবর কি?

সত্যবতী উত্তর দিল না, সেলাইয়ের উপর ঝুঁকিয়া দ্রুত কাঁটা চালাইতে লাগিল। জিজ্ঞাসা করিলাম, কি, মুখে কথা নেই যে! মালতী দেবীকে দেখতে গিয়েছিলে তো?

গিয়েছিলাম—সত্যবতী মুখ তুলিল না, কিন্তু তাহার মুখ ধীরে ধীরে লাল হইয়া উঠতে ব্যোমকেশ অদূরে দাঁড়াইয়া লক্ষ্য করিতেছিল, হঠাৎ হো হো করিয়া হাসিয়া নিজের শয়নকক্ষে প্রবেশ করিল। সত্যবতী সূচীবিদ্ধবৎ চমকিয়া উঠিল, শয়নকক্ষের দ্বারের দিকে একটা ক্রুদ্ধ কটাক্ষপাত করিল, তারপর আবার সম্মুখে ঝুঁকিয়া দ্রুত কাঁটা চালাইতে লাগিল।

আমি তাহার পাশে বসিয়া বলিলাম, কি ব্যাপার খুলে বল দেখি।

কিছু না। চা খাবে তো? জল চড়াতে বলে এসেছি। দেখি- বলিয়া সে উঠিবার উপক্রম করিল।

আমি বাধা দিয়া বলিলাম, আহা, কি হয়েছে আগে বল না! চা পরে হবে।

আমার যাওয়াই ভুল হয়েছিল। এমন পচা নোংরা মন-আমাকে বলে কিনা-কিন্তু সে আমি বলতে পারব না। যার অমন মন তার মুখে নুড়ো জ্বেলে দিতে হয়।

শয়নকক্ষ হইতে আর এক ধমক হাসির আওয়াজ আসিল। সত্যবতী চলিয়া গেল। ব্যাপার বুঝিতে বাকি রহিল না। রাগে আমার মুখও উত্তপ্ত হইয়া উঠিল। সন্দিগ্ধমনা স্ত্রীলোকের সন্দেহ পাত্ৰপাত্রী বিচার করে না জানি, কিন্তু সত্যবতীকে যে স্ত্রীলোক এরূপ পঙ্কিল দোষারোপ করিতে পারে, তাকে গুলি করিয়া মারা উচিত। বোমকেশ হাসুক, আমার গা রি রি করিয়া জ্বলিতে লাগিল।

রাত্ৰে শয়ন করিতে গিয়া ঘুম আসিল না; সারাদিনের নানা ঘটনায় মাথা গরম হইয়া উঠিয়াছে। ঘড়িতে দেখিলাম দশটা; ডিসেম্বর মাসে রাত্রি দশটা এখানে গভীর রাত্রি। ব্যোমকেশ ও সত্যবতী অনেকক্ষণ শুইয়া পড়িয়াছে।

বিছানায় শুইয়া ঘুম না আসিলে আমার সিগারেটের পিপাসা জাগিয়া ওঠে, সুতরাং শয্যাত্যাগ করিয়া উঠিতে হইল। গায়ে আলোয়ান দিয়া সিগারেট ধরাইলাম। কিন্তু বদ্ধ ঘরে ধূমপান করিলে ঘরের বাতাস ধোঁয়ায় দূষিত হইয়া উঠিবে; আমি একটা জানলা ঈষৎ খুলিয়া তাহার সামনে দাঁড়াইয়া সিগারেট টানিতে লাগিলাম।

জানালাটা সদরের দিকে। সামনে ফটক, তাহার পরপারে রাস্তা, রাস্তার ধারে মিউনিসিপ্যালিটির আলোকস্তম্ভ; আলোকস্তম্ভ না বলিয়া ধূমস্তম্ভ বলিলেই ভাল হয়। প্ৰদীপের তৈল শেষ হইয়া আসিতেছে।

মিনিট দুই তিন জানালার কাছে দাঁড়াইয়া আছি, বাহিরে একটা অস্পষ্ট খস খস শব্দে চকিত হইয়া উঠিলাম। কে যেন বারান্দা হইতে নামিতেছে। জানালার ফাঁক দিয়া দেখিলাম একটি ছায়ামূর্তি ফটক পার হইয়া বাহিরে চলিয়া গেল। আলোকস্তম্ভের পাশ দিয়া যাইবার সময় তাহাকে চিনিতে পারিলাম-কালো কোট-প্যান্ট-পরা অধ্যাপক সোম।

বিদ্যুৎ চমকের মত বুঝিতে পারিলাম। এত রাত্রে তিনি কোথায় যাইতেছেন। আজ রাত্রি সাড়ে দশটার সময় মহীধরবাবুর বাগানে ডাক্তার ঘটক এবং রজনীর মিলিত হইবার কথা; সঙ্কেত-স্থলে সোম অনাহুত উপস্থিত থাকিবেন। কিন্তু কেন? কি তাঁহার অভিপ্ৰায়?

বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া মনে মনে এই কথা ভাবিতেছি, সহসা অধিক বিস্ময়ের কারণ ঘটিল। আবার খস খস শব্দ শুনিতে পাইলাম। এবার বাহির হইয়া আসিলেন মালতী দেবী। তাঁহাকে চিনিতে কষ্ট হইল না। একটা চাপা কাশির শব্দ; তারপর সোম যে পথে গিয়াছিলেন তিনিও সেই পথে অদৃশ্য হইয়া গেলেন।

পরিস্থিতি স্পষ্টই বোঝা গেল। স্বামী অভিসারে যাইতেছেন, আর স্ত্রী অসুস্থ শরীর লইয়া এই শীতজর্জর রাত্রে তাঁহার পশ্চাদ্ধাবন করিয়াছেন। বোধ হয় স্বামীকে হাতে হাতে ধরিতে চান। উঃ, কি দুৰ্বহ ইহাদের জীবন! প্রেমহীন স্বামী এবং বিশ্বাসহীন পত্নীর দাম্পত্য জীবন কি ভয়ঙ্কর। এর চেয়ে ডাইভোর্স ভাল।

বর্তমান ক্ষেত্রে আমার কিছু করা উচিত কিনা ভাবিতে লাগিলাম। ব্যোমকেশকে জাগাইয়া সংবাদটা দিব? না, কাজ নাই, সে ঘুমাইতেছে ঘুমাক। বরং আমার ঘুম যেরূপ চটিয়া গিয়াছে, দু’ ঘণ্টার মধ্যে আসিবে বলিয়া মনে হয় না। সুতরাং আমি জানালার কাছে বসিয়া পাহারা দিব। দেখা যাক কোথাকার জল কোথায় গড়ায়।

আবার সিগারেট ধরাইলাম। পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট। দীপস্তম্ভের আলো ধোঁয়ায় দম বন্ধ হইয়া মরিয়া গেল। একটি মূর্তি ফটক দিয়া প্রবেশ করিল। নক্ষত্রের আলোয় মালতী দেবীর ভারী মোটা চেহারা চিনিতে পারিলাম। তিনি পদশব্দ গোপনের চেষ্টা করিলেন না। তাঁহার কণ্ঠ হইতে একটা অবরুদ্ধ আওয়াজ বাহির হইল, তাহা চাপা কাশি কিংবা চাপা কান্না বুঝিতে পারিলাম না। তিনি উপরে চলিয়া গেলেন।

এত শীঘ্ৰ শ্ৰীমতী ফিরিয়া আসিলেন, কিন্তু শ্ৰীমানের দেখা নাই। অনুমান করিলাম শ্ৰীমতী বেশি দূর স্বামীকে অনুসরণ করিতে পারেন নাই, অন্ধকারে হারাইয়া ফেলিয়াছেন। তারপর এদিক ওদিক নিস্ফল অন্বেষণ করিয়া গৃহে ফিরিয়াছেন।

সোম ফিরিলেন সাড়ে এগারটার সময়। বাদুড়ের মত নিঃশব্দ সঞ্চারে বাড়ির মধ্যে মিলাইয়া গেলেন।

শেষাংশ.......

No comments:

Post a Comment