৭
সকালে ব্যোমকেশকে রাত্রির ঘটনা বলিলাম। সে চুপ করিয়া শুনিল, কোনও মন্তব্য করিল না।
একজন কনস্টেবল একটা চিঠি দিয়া গেল। ডি.এস.পি, পাণ্ডের চিঠি, আগের দিন সন্ধ্যা ছ’টার তারিখ। চিঠিতে মাত্র কয়েক ছত্র লেখা ছিল
প্রিয় ব্যোমকেশবাবু,
ডেপুটি সাহেবের আলমারি খুলিয়া দেখা গেল কিছু চুরি যায় নাই। আপনি বলিয়াছিলেন পরীকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে, কিন্তু পরী এখনও নিরুদ্দেশ। চোরের ও কোন সন্ধান পাওয়া যায় নাই। আপনি জানিতে চাহিয়াছিলেন। তাই লিখিলাম। ইতি— পুরন্দর পাণ্ডে
ব্যোমকেশ চিঠিখানা পকেটে রাখিয়া বলিল, পাণ্ডে লোকটি সত্যিকার সজ্জন ৷
এই সময় যিনি সবেগে আসিয়া উপস্থিত হইলেন তিনি ফটোগ্রাফার নকুলেশ সরকার। মহীধর বাবুর পার্টির পর রাস্তায় নকুলেশবাবুর সহিত দু’একবার দেখা হইয়াছিল। তিনি অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে বলিলেন, এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম খবরটা দিয়ে যাই। শোনেননি নিশ্চয়ই? ফাল্গুনী পাল-সেই যে ছবি আঁকত—সে মহীধরবাবুর বাগানে কুয়োয় ডুবে মরেছে।
কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হইয়া রহিলাম। তারপর ব্যোমকেশ বলিল, কখন এ ব্যাপার হল?
নকুলেশ বলিলেন, বোধ হয় কাল রাত্তিরে, ঠিক জানি না। মাতাল দাঁতাল লোক, অন্ধকারে তাল সামলাতে পারেনি, পড়েছে কুয়োয়। আজ সকালে আমি মহীধরবাবুর খবর নিতে গিয়েছিলাম, দেখি মালীরা কুয়ো থেকে লাস তুলছে।
আমরা নীরবে পরস্পর পরস্পরের মুখের পানে চাহিলাম। কাল রাত্রে মহীধরবাবুর বাগানে বহু বিচিত্র ব্যাপার ঘটিয়াছে।
আচ্ছা, আজ তাহলে উঠি; আমাকে আবার ক্যামেরা নিয়ে ফিরে যেতে হবে—। বলিয়া নকুলেশবাবু উঠিবার উপক্ৰম করিলেন।
বসুন বসুন, চা খেয়ে যান ৷
নকুলেশ চায়ের আমন্ত্রণ উপেক্ষা করিতে পারিলেন না, বসিলেন। অচিরাৎ চা আসিয়া পড়িল। দু’চার কথার পর ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল, সেই গ্রুপ-ফটোর নেগেটিভখানা খুঁজেছিলেন কি?
কোন নেগেটিভ? ও-হ্যাঁ, অনেক খুঁজেছি মশাই, পাওয়া গেল না। —আমার লোকসানের বরাত; থাকলে আরও পাঁচখানা বিক্রি হত।
আচ্ছা, সেই ফটোতে কে কে ছিল বলুন দেখি?
কে কে ছিল? পিকনিকে গিয়েছিলাম ধরুন—আমি, মহীধরবাবু, তাঁর মেয়ে রজনী, ডাক্তার ঘটক, সন্ত্রীক প্রোফেসর সোম, সপরিবারে ডেপুটি উষানাথবাবু আর ব্যাঙ্কের ম্যানেজার অমরেশ রাহা। সকলেই ফটোতে ছিলেন। ফটোখানা ভারি উৎরে গিয়েছিল-গ্রুপ-ফটো অত ভাল খুব একটা হয় না। আচ্ছা, চলি তাহলে। আর একদিন আসিব।
নকুলেশবাবু প্ৰস্থান করিলেন। দুজনে কিছুক্ষণ বসিয়া রহিলাম। ফাল্গুনীর কথা ভাবিয়া মনটা ভারী হইয়া উঠিল। সে নেশাখোর লক্ষ্মীছাড়া ছিল, কিন্তু ভগবান তাহাকে প্রতিভা দিয়াছিলেন।
এমনভাবে অপঘাত মৃত্যুই যদি তাহার নিয়তি, তবে তাহাকে প্রতিভা দিবার কি প্রয়োজন ছিল?
ব্যোমকেশ একটা নিশ্বাস ফেলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল; বলিল, এ সম্ভাবনা আমার মনেই আসেনি। চল, বেরুনো যাক।
কোথায় যাবে?
ব্যাঙ্কে যাব। কিছু টাকা বের করতে হবে।
এখানে আসিয়া স্থানীয় ব্যাঙ্কে কিছু টাকা জমা রাখা হইয়াছিল, সংসার-খরচের প্রয়োজন অনুসারে বাহির করা হইত।
আমরা সদর বারান্দায় বাহির হইয়াছি, দেখিলাম অধ্যাপক সোম ড্রেসিং-গাউন পরিহিত অবস্থায় নামিয়া আসিতেছেন। তাঁহার মুখে উদ্বিগ্ন গাম্ভীর্য। ব্যোমকেশ সম্ভাষণ করিল, কি খবর?
সোম বলিলেন, খবর ভাল নয়। স্ত্রীর অসুখ খুব বেড়েছে। বোধহয় নিউমোনিয়া। জ্বর বেড়েছে; মাঝে মাঝে ভুল বকছেন মনে হল।
আশ্চর্য নয়। কাল রাত্রে সর্দির উপর ঠাণ্ডা লাগিয়াছে। কিন্তু সোম বোধ হয় তাহা জানেন না। ব্যোমকেশ বলিল, ডাক্তার ঘটককে খবর দিয়েছেন?
ডাক্তার ঘটকের নামে সোমের মুখ অন্ধকার হইল। তিনি বলিলেন, ঘটককে ডাকব না। আমি অন্য ডাক্তার ডাকতে পাঠিয়েছি।
ব্যোমকেশ তীক্ষ্ণ চক্ষে তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিয়া বলিল, কোন? ডাক্তার ঘটকের ওপর কি আপনার বিশ্বাস নেই? আমি যখন প্রথম এসেছিলাম তখন কিন্তু আপনি ঘটককেই সুপারিশ করেছিলেন।
সোম ওষ্ঠাধর দৃঢ়বদ্ধ করিয়া নীরব রহিলেন।
ব্যোমকেশ তখন বলিল, সে যাক! এই মাত্র খবর পেলাম ফাল্গুনী পাল কাল রাত্রে মহীধরবাবুর কুয়োয় ডুবে মারা গেছে।
সোম বিশেষ ঔৎসুক্য প্রকাশ করিলেন না, বলিলেন, তাই নাকি। হয়তো আত্মহত্যা করেছে। আর্টিস্টরা একটু অব্যবস্থিতচিত্ত হয়—
ব্যোমকেশ বন্দুকের গুলির মত প্রশ্ন করিল, প্রোফেসর সোম, কাল রাত্রি এগারোটার সময় আপনি কোথায় ছিলেন?
সোম চমকিয়া উঠিলেন, তাঁহার মুখ পাংশু হইয়া গেল। তিনি স্বলিতস্বরে বলিলেন, আমি-আমি! কে বললে আমি কোথাও গিয়েছিলাম? আমি তো—
হাত তুলিয়া ব্যোমকেশ বলিল, মিছে কথা বলে লাভ নেই। প্রোফেসর সোম, আপনার স্ত্রীর যে আজ বাড়াবাড়ি হয়েছে তার জন্যে আপনি দায়ী। তিনি কাল আপনার পেছনে পেছনে রাস্তায় বেরিয়েছিলেন। এই রোগে যদি তাঁর মৃত্যু হয়—
ভয়-বিস্ফারিত চক্ষে চাহিয়া সোম বলিলেন, আমার স্ত্রী-ব্যোমকেশবাবু, বিশ্বাস করুন, আমি জানি না—
ব্যোমকেশ তর্জনী তুলিয়া ভয়ঙ্কর গম্ভীর স্বরে বলিল, কিন্তু আমরা জানি। আমি আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী, তাই সতর্ক করে দিচ্ছি। আপনি সাবধানে থাকবেন। এস অজিত।
সোম স্তম্ভের মত দাঁড়াইয়া রহিলেন, আমরা বাহির হইয়া পড়িলাম। রাস্তায় কিছু দূর গিয়া ব্যোমকেশ বলিল, সোমকে খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছি। তারপর ঘড়ি দেখিয়া বলিল, ব্যাঙ্ক খুলতে এখনও দেরি আছে। চল, ঘটকের ডিসপেন্সারিতে একবার ঢুঁ মেরে যাই।
বাজারের দিকে ডাক্তারের ঔষধালয়। আমরা ডাক্তারের ঘরে প্রবেশ করিতে যাইব, শুনিলাম সে একজনকে বলিতেছে, দেখুন, আপনার ছেলের টাইফয়েড হয়েছে; লম্বা কেস, সারাতে সময় লাগবে! আমি এখন লম্বা কেস হাতে নিতে পারব না। আপনি বরং শ্ৰীধরবাবুর কাছে যান—তিনি প্ৰবীণ ডাক্তার—
আমরা প্রবেশ করিলাম, অন্য লোকটি চলিয়া গেল। ডাক্তার সানন্দে আমাদের অভ্যর্থনা করিল। বলিল, আসুন আসুন। রোগী যখন সশরীরে ডাক্তারের বাড়িতে আসে তখন বুঝতে হবে রোগ সেরেছে। মহীধরবাবু সেদিন আমাকে ঘোড়ার ডাক্তার বলেছিলেন। এখন আপনিই বলুন, আমি মানুষের ডাক্তার কিংবা আপনি ঘোড়া!—বলিয়া উচ্চকণ্ঠে হাসিল। ডাক্তারের মন আজ ভারি প্রফুল্ল; চোখে আনন্দের জ্যোতি।
ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল, আপনি মানুষের ডাক্তার এই কথা স্বীকার করে নেওয়াই আমার পক্ষে সম্মানজনক। মহীধরবাবু কেমন আছেন?
ডাক্তার বলিল, অনেকটা ভাল। প্ৰায় সেরে উঠেছেন।
ব্যোমকেশ বলিল, ফাল্গুনী পাল মারা গেছে শুনেছেন কি?
ডাক্তার চকিত হইয়া বলিল, সেই চিত্রকর। কি হয়েছিল তার?
কাল রাত্রে জলে ডুবে মারা গেছে।—ব্যোমকেশ যতটুকু জানিত সংক্ষেপে বলিল। ডাক্তার কিছুক্ষণ বিমনা হইয়া রহিল, তারপর বলিল, আমার যাওয়া উচিত। মহীধরবাবুর দুর্বল শরীর—। যাই, একবার চট করে ঘুরে আসি। ডাক্তার উঠিয়া দাঁড়াইল।
ব্যোমকেশ সহসা জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কলকাতা যাচ্ছেন কবে?
ডাক্তারের মুখের ভাব সহসা পরিবর্তিত হইল; সে কিছুক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে ব্যোমকেশের চোখের মধ্যে চাহিয়া বলিল, আমি কলকাতা যাচ্ছি কে বললে আপনাকে?
ব্যোমকেশ কেবল মৃদু হাসিল। ডাক্তার তখন বলিল, হ্যাঁ, শীগগিরই একবার যাবার ইচ্ছে আছে। আচ্ছা, চললাম। যদি সময় পাই ওবেলা আপনাদের বাড়িতে যাব ৷
ডাক্তার ক্ষুদ্র মোটরে চড়িয়া চলিয়া গেল। আমরা ব্যাঙ্কের দিকে চলিলাম। পথে জিজ্ঞাসা করিলাম, ডাক্তার কলকাতা যাচ্ছে জানলে কি করে? তুমি কি আজকাল অন্তর্যামী হয়েছ নাকি?
ব্যোমকেশ বলিল, না। কিন্তু একজন ডাক্তার যখন বলে লম্বা কেস হাতে নেব না, অন্য ডাক্তারের কাছে যাও, তখন আন্দাজ করা যেতে পারে যে সে বাইরে যাবে৷
কিন্তু কলকাতায়ই যাবে তার নিশ্চয়তা কি?
ওটা ডাক্তারের প্রফুল্লতা থেকে অনুমান করলাম।
৮
ডাক্তারের ঔষধালয় হইতে অনতিদূরে ব্যাঙ্ক। আমরা গিয়া দেখিলাম ব্যাঙ্কের দ্বার খুলিয়াছে। দ্বারের দুই পাশে বন্দুক-কিরিচধারী দুইজন সান্ত্রী পাহারা দিতেছে।
বড় একটি ঘর দুই ভাগে বিভক্ত, মাঝে কাঠ ও কাচের অনুচ্চ বেড়া। বেড়ার গায়ে সারি সারি জানালা। এই জানালা দিয়া জনসাধারণের সঙ্গে ব্যাঙ্কের কর্মচারীদের লেন-দেন হইয়া থাকে।
ব্যোমকেশ একটি জানালার বাহিরে দাঁড়াইয়া চেক লিখিতেছে, দেখিলাম বেড়ার ভিতর দিকে ম্যানেজার অমরেশ রাহা দাঁড়াইয়া একজন কেরানীর সঙ্গে কথা কহিতেছেন। অমরেশবাবুও আমাদের দেখিতে পাইয়াছিলেন, তিনি স্মিতমুখে বাহিরে আসিলেন। বলিলেন, নমস্কার। ভাগ্যে আপনাদের দেখে ফেললাম নইলে তো টাকা নিয়েই চলে যেতেন।
অমরেশবাবুকে চায়ের পার্টির পর আর দেখি নাই। তিনি সেজন্য লজ্জিত; ফ্রেঞ্চ-কাট দাড়িতে হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিলেন, রোজই মনে করি আপনাদের বাড়িতে যাব, কিন্তু একটা না একটা কাজ পড়ে যায়। ব্যাঙ্কের চাকরি মানে অষ্টপ্রহরের গোলামি।
ব্যোমকেশ বলিল, এমন গোলামিতে সুখ আছে। হরদম টাকা নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন।
অমরেশবাবু করুণ মুখভঙ্গী করিয়া বলিলেন, সুখ আর কৈ ব্যোমকেশবাবু। চিনির বলদ চিনির বোঝা বয়ে মরে, কিন্তু দিনের শেষে খায় সেই ঘাস জল ৷
ব্যোমকেশ চেকের বদলে টাকা পকেটস্থ করিলে অমরেশবাবু বলিলেন, চলুন, আজ যখন পেয়েছি আপনাকে সহজে ছাড়ব না। আমার আপিস-ঘরে বসে খানিক গল্প-সল্প করা যাক। আপনার প্রতিভার যে পরিচয় অজিতবাবুর লেখা থেকে পাওয়া যায়, তাতে আপনাকে পেলে আর ছাড়তে ইচ্ছে করে না। আমাদের দেশে প্রতিভাবান মানুষের বড়ই অভাব।
ভদ্রলোক শুধু যে ব্যোমকেশের প্রতি শ্রদ্ধাশীল তাঁহাই নয়, সাহিত্য-রসিকও বটে। সেদিন তাঁহার সহিত অধিক আলাপ করি নাই বলিয়া অনুতপ্ত হইলাম।
তিনি আমাদের ভিতরে লইয়া গেলেন। তাঁহার একটি নিজস্ব আপিস-ঘর আছে, তাহার দ্বার পর্যন্ত গিয়া তিনি বলিলেন, না, এখানে নয়। চলুন, ওপরে যাই। এখানে গণ্ডগোল, কাজের হুড়োহুড়ি। ওপরে বেশ নিরিবিলি হবে।
আপিস-ঘরের দরজা খোলা ছিল; ভিতরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া দেখিলাম, মামুলি টেবিল চেয়ার খাতাপত্র, কয়েকটা বড় বড় লোহার সিন্দুক ছাড়া আর কিছু নাই।
কাছেই সিঁড়ি। উপরে উঠিতে উঠিতে ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ওপরতলাটা বুঝি আপনার কোয়ার্টার?
হাঁ। ব্যাঙ্কেরও সুবিধে।
স্ত্রী-পুত্র পরিবার সব এখানেই থাকেন?
স্ত্রী-পুত্র পরিবার আমার নেই ব্যোমকেশবাবু। ভগবান সুমতি দিয়েছিলেন, বিয়ে করিনি। একলা-মানুষ, তাই ভদ্রভাবে চলে যায়। বিয়ে করলে হাঁড়ির হাল হত।
উপরতলাটি একজন লোকের পক্ষে বেশ সুপরিসর। তিন চারটি ঘর, সামনে উন্মুক্ত ছাদ। অমরেশবাবু আমাদের বসিবার ঘরে লইয়া গিয়া বসাইলেন। অনাড়ম্বর পরিচ্ছন্ন ঘর; দেওয়ালে ছবি নাই, মেঝেয় গালিচা নাই। এক পাশে একটি জাজিম-ঢাকা চৌকি, দুই-তিনটি আরাম-কেদারা, একটি বইয়ের আলমারি। নিতান্তই মামুলি ব্যাপার, কিন্তু বেশ তৃপ্তিদায়ক। গৃহস্বামী যে গোছালো স্বভাবের লোক তাহা বোঝা যায়।
বসুন, চা তৈরি করতে বলি। বলিয়া তিনি প্রস্থান করিলেন।
বইয়ের আলমারিটা আমাকে আকর্ষণ করিতেছিল, উঠিয়া গিয়া বইগুলি দেখিলাম। অধিকাংশ বই গল্প উপন্যাস, চলন্তিকা আছে, সঞ্চয়িতা আছে। আমার রচিত ব্যোমকেশের উপন্যাসগুলিও আছে দেখিয়া পুলকিত হইলাম।
ব্যোমকেশও আসিয়া জুটিল। সে একখানা বই টানিয়া লইয়া পাতা খুলিল; দেখিলাম বইখানা বাংলা ভাষায় নয়, ভারতবর্ষেরই অন্য কোনও প্রদেশের লিপি। অনেকটা হিন্দীর মতন, কিন্তু ঠিক হিন্দী নয়।
এই সময় অমরেশবাবু ফিরিয়া আসিলেন। ব্যোমকেশ বলিল, আপনি গুজরাটী ভাষাও জানেন।
অমরেশবাবু মুখে চটকার শব্দ করিয়া বলিলেন, জানি আর কৈ? একসময় শেখবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ও আমার দ্বারা হল না। বাঙালীর ছেলে মাতৃভাষা শিখতেই গলদঘর্ম হয়, তার ওপর ইংরিজি আছে। উপরন্তু যদি একটা তৃতীয় ভাষা শিখতে হয় তাহলে আর বাঙালীর শক্তিতে কুলোয় না। অথচ শিখতে পারলে আমার উপকার হত। ব্যাঙ্কের কাজে গুজরাটী ভাষা জানা থাকলে অনেক সুবিধা হয়।
আমরা আবার আসিয়া বসিলাম। দুই-চারিটি একথা সেকথার পর ব্যোমকেশ বলিল, ফাল্গুনী পাল মারা গেছে শুনেছেন বোধ হয়?
অমরেশবাবু চেয়ার হইরে প্রায় লাফাইয়া উঠিলেন, অ্যাঁ। ফাল্গুনী পাল মারা গেছে! কবে— কোথায়-কি করে মারা গেল?
ব্যোমকেশ ফান্ধুনীর মৃত্যু-বিবরণ বলিল। শুনিয়া অমরেশবাবু দুঃখিতভাবে মাথা নাড়িয়া বলিলেন, আহা বেচারা! বড় দুঃখে পড়েছিল। কাল আমার কাছে এসেছিল।
এবার আমাদের বিস্মিত হইবার পালা। ব্যোমকেশ বলিয়া উঠিল, কাল এসেছিল? কখন?
অমরেশবাবু বলিলেন, সকালবেলা। কাল রবিবার ছিল, ব্যাঙ্ক বন্ধ; সবে চায়ের পেয়ালাটি নিয়ে বসেছি, ফাল্গুনী এসে হাজির, আমার ছবি এঁকেছে তাই দেখাতে এসেছিল—
ও—
চাকর তিন পেয়ালা চা দিয়া গেল। তকমা-আঁটা চাকর, বুঝিলাম ব্যাঙ্কের পিওন; অবসরকালে বাড়ির কাজও করে। ভাবগতিক দেখিয়া মনে হইল অমরেশবাবু টাকা-পয়সার ব্যাপারে বিলক্ষণ হিসাবী।
ব্যোমকেশ চায়ের পেয়ালায় চামচ ঘুরাইতে ঘুরাইতে বলিল, ছবিখানা কিনলেন নাকি?
অমরেশবাবু বিমর্ষ মুখভঙ্গী করিয়া বলিলেন, কিনতে হল। পাঁচ টাকা দিতে গেলাম কিছুতেই নিলে না, দশ টাকা আদায় করে ছাড়ল। এমন জানলে—
ব্যোমকেশ চায়ে একটা চুমুক দিয়া বলিল, মৃত চিত্রকরের শেষ ছবি দেখবার ইচ্ছে হচ্ছে।
দেখুন না। ভালই এঁকেছে বোধ হয়। আমি অবশ্য ছবির কিছু বুঝি না— বইয়ের আলমারির নীচের দেরাজ হইতে একখণ্ড পুরু চতুষ্কোণ কাগজ আনিয়া তিনি আমাদের সম্মুখে ধরিলেন।
ফাল্গুনী ভাল ছবি আঁকিয়াছে; অমরেশবাবুর বিশেষত্বহীন চেহারা উজ্জ্বল হইয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে। ব্যোমকেশ চিত্রবিদ্যার একজন জহুরী, সে ভ্রুকুঞ্চিত করিয়া ছবিটি দেখিতে লাগিল।
অমরেশবাবু আগে বেশ প্রফুল্লমুখে কথাবার্তা বলিতেছিলেন, কিন্তু ফাল্গুনীর মৃত্যু-সংবাদ শুনিবার পর কেমন যেন মুষড়াইয়া পড়িয়াছেন। প্রায় নীরবেই চা-পান শেষ হইল। পেয়ালা রাখিয়া অমরেশবাবু স্তিমিত স্বরে বলিলেন, ফাল্গুনীর কথায় মনে পড়ল, সেদিন চায়ের পার্টিতে শুনেছিলাম পিকনিকের ফটোখানা চুরি গেছে। মনে আছে? তার কোনও হদিস পাওয়া গেল কিনা কে জানে।
ব্যোমকেশ মগ্ন হইয়া ছবি দেখিতেছিল, উত্তর দিল না। আমিও কিছু বলা উচিত। কিনা বুঝিতে না পারিয়া বোকার মত অমরেশবাবুর পানে চাহিয়া রহিলাম। অমরেশবাবু তখন নিজেই বলিলেন, সামান্য ব্যাপার, তাই ও নিয়ে বোধ হয়। কেউ মাথা ঘামায়নি ৷
ব্যোমকেশ ছবি নামাইয়া রাখিয়া একটা নিশ্বাস ফেলিল, চমৎকার ছবি। লোকটা যদি বেঁচে থাকত, আমিও ওকে দিয়ে ছবি আঁকিয়ে নিতাম। অমরেশবাবু, ছবিখানা যত্ন করে রাখবেন। আজ ফাল্গুনী পালের নাম কেউ জানে না, কিন্তু একদিন আসবে যেদিন ওর আঁকা ছবি সোনার দরে বিক্রি হবে।
অমরেশবাবু একটু প্ৰফুল্ল হইয়া বলিলেন, তাই নাকি! তাহলে দশটা টাকা জলে পড়েনি? ছবিটা বাঁধিয়ে দেওয়ালে টাঙানো চলবে?
নিশ্চয়।
অতঃপর আমরা গাত্ৰোত্থান করিলাম। অমরেশবাবু বলিলেন, আবার দেখা হবে। বছর শেষ হতে চলল, আমাকে আবার নববর্ষের ছুটিতে কলকাতায় গিয়ে হেড আপিসের কর্তাদের সঙ্গে দেখা করে আসতে হবে। এবার নববর্ষে দুদিন ছুটি।
দুদিন ছুটি কেন?
এবার একত্ৰিশে ডিসেম্বর রবিবার পড়েছে। শনিবার যদি অর্ধেক দিন ধরেন, তাহলে আড়াই দিন ছুটি পাওয়া যাবে। আপনারা এখনও কিছুদিন আছেন তো?
২রা জানুয়ারি পর্যন্ত আছি বোধ হয়।
আচ্ছা, নমস্কার।
আমরা বাহির হইলাম। ব্যাঙ্কের ভিতর দিয়া নামিতে হইল না, বাড়ির পিছন দিকে একটা খিড়কি-সিঁড়ি ছিল, সেই পথে নামিয়া রাস্তায় আসিলাম। বাজারের মধ্য দিয়া যাইতে যাইতে হঠাৎ মনে পড়িয়া গেল সিগারেট ফুরাইয়াছে। বলিলাম, এস, এক টিন সিগারেট কিনতে হবে।
ব্যোমকেশ অন্যমনস্ক ছিল, চমকিয়া উঠিল। বলিল, আরো তাই তো! আমাকেও একটা জিনিস কিনতে হবে।
একটা বড় মনিহারীর দোকানে ঢুকিলাম। আমি একদিকে সিগারেট কিনিতে গেলাম, ব্যোমকেশ অন্যদিকে গেল। আমি সিগারেট কিনিতে কিনিতে আড়চোখে দেখিলাম ব্যোমকেশ একটা দামী এসেন্সের শিশি কিনিয়া পকেটে পুরিল।
মনে মনে হাসিলাম। ইহারা কেন যে ঝগড়া করে, কেনই বা ভাব করে কিছু বুঝি না। দাম্পত্য-জীবন আমার কাছে একটা হাস্যকর প্রহেলিকা।
সেদিন দুপুরবেলা আহারাদির পর একটু বিশ্রাম করিবার জন্য বিছানায় লম্বা হইয়াছিলাম, ঘুম ভাঙিয়া দেখি বেলা সাড়ে তিনটা।
ব্যোমকেশের ঘর হইতে মৃদু জল্পনার শব্দ আসিতেছিল; উঁকি মারিয়া দেখিলাম ব্যোমকেশ চেয়ারে বসিয়াছে এবং সত্যবতী তাহার পিছনে দাঁড়াইয়া দুই হাতে তাহার গলা জড়াইয়া কানে কানে কি সব বলিতেছে। দুজনের মুখেই হাসি।
সরিয়া আসিয়া উচ্চকণ্ঠে বলিলাম, ওহে কপোত-কপোতী, তোমাদের কুজন-গুঞ্জন শেষ হতে যদি দেরি থাকে তাহলে না হয় আমিই চায়ের ব্যবস্থা করি।
সত্যবতী সলজ্জভাবে মুখের খানিকটা আচলের আড়াল দিয়া বাহির হইয়া আসিল এবং রান্নাঘরের দিকে চলিয়া গেল। খানিক পরে ব্যোমকেশ জ্বলন্ত সিগারেট হইতে ধোঁয়া ছাড়িতে ছাড়িতে বাহির হইল। অবাক হইয়া বলিলাম, ব্যাপার কি! ইঞ্জিনের মত ধোঁয়া ছাড়ছ যে ৷
ব্যোমকেশ একগাল হাসিয়া বলিল, পারমিশন পেয়ে গেছি। আজ থেকে যত ইচ্ছে।
বুঝিলাম দাম্পত্য-জীবনে কেবল প্ৰেম থাকিলেই চলে না, কূটবুদ্ধিরও প্রয়োজন।
৯
চা পান করিয়া উপরতলায় রোগিণীর সংবাদ সইতে গেলাম। সামাজিক কর্তব্য পালন না অধ্যাপক সোমের মুখ চিন্তাক্রান্ত। মালতী দেবীর অবস্থা খুবই খারাপ, তবে একেবারে হাল ছাড়িয়া দিবার মত নয়। দুটা ফুসফুসই আক্রান্ত হইয়াছে, অক্সিজেন দেওয়া হইতেছে। জ্বর খুব বেশি, রোগিণী মাঝে মাঝে ভুল বকিতেছেন। একজন নার্সকে সেবার জন্য নিয়োগ করা হইয়াছে।
স্বখাত সলিল। সহানুভূতি জানাইয়া ফিরিয়া আসিলাম।
নীচে নামিয়া আসিবার কিছুক্ষণ পরে ডাক্তার ঘটক আসিল।
এবেলা ডাক্তারের ভাবভঙ্গী অন্য প্রকার। একটু সতর্ক, একটু সন্দিগ্ধ, একটু অন্তঃপ্রবিষ্ট। ব্যোমকেশের পানে মাঝে মাঝে এমনভাবে তাকাইতেছে যেন ব্যোমকেশ সম্বন্ধে তাহার মনে কোনও সংশয় উপস্থিত হইয়াছে।
কথাবার্তা সাধারণভাবেই হইল। ডাক্তার সকালে মহীধর বাবুর বাড়িতে গিয়া ফাল্গুনীর লাস দেখিয়াছিল, সেই কথা বলিল। ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, কি দেখলেন? মৃত্যুর কারণ জানা গেল?
ডাক্তার একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, অটপ্সি না হওয়া পর্যন্ত জোর করে কিছু বলা যায় না।
ব্যোমকেশ বলিল, তবু আপনি ডাক্তার, আপনি কি কিছুই বুঝতে পারলেন না?
ইতস্তত করিয়া ডাক্তার বলিল, না।
ব্যোমকেশ তখন বলিল, ও কথা যাক। মহীধরবাবু কেমন আছেন? কাল বিকেলে আমরা তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম; কিন্তু ডাকাডাকি করেও কারুর সাড়া পাওয়া গেল না, তাই ফিরে এলাম।
ডাক্তার সতর্কভাবে প্রশ্ন করিল, ক’টার সময় গিয়েছিলেন?
আন্দাজ পাঁচটার সময় ৷
ডাক্তার একটু ভাবিয়া বলিল, কি জানি। আমিও বিকেলবেলা গিয়েছিলাম, কিন্তু পাঁচটার আগে ফিরে এসেছিলাম। মহীধর বাবু ভালই আছেন। তবে আজকে বাড়িতে এই ব্যাপার হল—একটা শক পেয়েছেন।
ব্যোমকেশ বলিল, আর রজনী দেবী! তিনি কেমন আছেন?
ডাক্তারের মুখের উপর দিয়া একটা রক্তাভা খেলিয়া গেল। কিন্তু সে ধীরে ধীরে বলিল, রজনী দেবী ভালই আছেন। তাঁর অসুখ করেছে এমন কথা তো শুনিনি। আচ্ছা, আজ উঠি।
ডাক্তার উঠিল। আমরাও উঠিলাম। দ্বার পর্যন্ত আসিয়া ব্যোমকেশ বলিল, আপনার কলকাতা যাওয়া তাহলে স্থির?
ডাক্তার ফিরিয়া দাঁড়াইল, তাহার চোখ দুটা সহসা জ্বলিয়া উঠিল। সে দাঁতে দাঁত চাপিয়া বলিল, ব্যোমকেশবাবু, আপনি এখানে শরীর সারাতে এসেছেন, গোয়েন্দাগিরি করতে নয়। যা আপনার এলাকার বাইরে তা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। বলিয়া গট গট করিয়া বাহির হইয়া গেল।
আমরা ফিরিয়া আসিয়া বসিলাম। ব্যোমকেশ সিগারেট ধরাইতে ধরাইতে বলিল, ডাক্তার ঘটক এমনিতে খুব ভালোমানুষ, কিন্তু ল্যাজে পা পড়লে একেবারে কেউটে সাপ।
বাইরে মোটর-বাইকের ফট ফট শব্দ আসিয়া থামিল। ব্যোমকেশ লাফাইয়া উঠিয়া বলিল, আরো পাণ্ডে সাহেব এসেছেন। ভালই হল।
পাণ্ডে প্রবেশ করিলেন। ক্লান্ত হাসিয়া বলিলেন, ব্যোমকেশবাবু, আপনার কথা ফলে গেল। পরী উদ্ধার করেছি।
ব্যোমকেশ তাঁহাকে চেয়ার দিয়া বলিল, বসুন। কোথা থেকে পরী উদ্ধার করলেন?
মহীধরবাবুর কুয়ো থেকে। ফাল্গুনীর লাস বেরুবার পর কুয়োয় ডুবুরি নামিয়েছিলাম। উষানাথবাবুর পরী বেরিয়েছে।
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ চক্ষু কুঞ্চিত করিয়া থাকিয়া বলিল, আর কিছু?
আর কিছু না।
পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট পেয়েছেন?
পেয়েছি। ফাল্গুনী জলে ডুবে মরেনি, মৃত্যুর পর তাকে জলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।
হুঁ। অথাৎ কাল রাত্রে তাকে কেউ খুন করেছে। তারপর মৃতদেহটা কুয়োয় ফেলে দিয়েছে। আত্মহত্যা নয়।
তাই তো মনে হচ্ছে। কিন্তু ফাল্গুনীর মতন একটা অপদার্থ লোককে খুন করে কার কি লাভ?
লাভ নিশ্চয় আছে, নইলে খুন করবে কেন? অপদার্থ লোক যদি কোনও সাংঘাতিক গুপ্তকথা জানতে পারে তাহলে তার বেঁচে থাকা কারুর কারুর পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। ফাল্গুনী অপদাৰ্থ ছিল বটে, কিন্তু নির্বোধ ছিল না।
পাণ্ডে বিরস মুখে বলিলেন, তা বটে। কিন্তু ভাবছি, পরীটা কুয়োর মধ্যে এল কি করে? তবে কি ফাল্গুনীই পরী চুরি করেছিল? খুনীর সঙ্গে ফাল্গুনীর কি পরী নিয়ে মারামারি কাড়াকাড়ি হয়েছিল? তারপর খুনী ফাল্গুনীকে ঠেলে কুয়োয় ফেলে দিয়েছে?—কিন্তু পরীটা তো এমন কিছু দামী জিনিস নয়।
ব্যোমকেশ বলিল, ভাল কথা, ফাল্গুনীর গায়ে কি কোনও আঘাত-চিহ্ন পাওয়া গেছে?
না। কিন্তু তার পেটে অনেকখানি আফিম পাওয়া গেছে। মদের সঙ্গে আফিম মেশান ছিল।
ব্যোমকেশ বলিল, বুঝেছি। দেখুন, কি করে ফাল্গুনীর মৃত্যু হল সেটা বড় কথা নয়, কেন মৃত্যু হল সেইটেই আসল কথা।
পাণ্ডে উৎসুক চক্ষে চাহিয়া বলিলেন, এ বিষয়ে আপনি কি কিছু বুঝেছেন ব্যোমকেশবাবু?
ব্যোমকেশ মৃদু হাসিয়া বলিল, বোধ হয় কিছু কিছু বুঝেছি। আপনাকে আমার অনেক কথা বলবার আছে। কিন্তু আপনার শোনবার সময় হবে কি?
পাণ্ডে ব্যোমকেশের হাত ধরিয়া দ্বারের দিকে টানিয়া লইয়া চলিলেন। বলিলেন, সময় হবে। কিনা দেখাচ্ছি। চলুন আমার বাড়িতে, একেবারে রাত্রির খাওয়া-দাওয়া সেরে ফিরবেন।
পাণ্ডে ব্যোমকেশকে লইয়া চলিয়া গেলেন। আমি আর সত্যবতী রাত্রি সাড়ে নয়টা পর্যন্ত তাস লইয়া গোলামচোর খেলিলাম। ব্যোমকেশ ফিরিলে জিজ্ঞাসা করিলাম, কি হল এতক্ষণ ধরে?
ব্যোমকেশ স্বর্গীয় হাস্য করিয়া বলিল, আঃ, মুর্গিটা যা রেঁধেছিল?
ধমক দিয়া বলিলাম, কথা চাপা দিও না। পাঁচ ঘণ্টা ধরে কি কথা হল?
ব্যোমকেশ জিভ কাটিল, পুলিসের গুপ্তকথা কি বলতে আছে? তবে এমন কোনও কথা হয়নি যা তুমি জান না।
হত্যাকারী কে?
পাঁচকড়ি দে। বলিয়া বোমকেশ সুট করিয়া শয়নকক্ষে ঢুকিয়া পড়িল।
১০
বড়দিন আসিয়া চলিয়া গিয়াছে; নববর্ষ সমাগতপ্ৰায়। এখানে বড়দিন ও নববর্ষের উৎসবে বিশেষ হৈ চৈ হয় না, সাহেব-মেমেরা হুইস্কি খাইয়া একটু নাচানাচি করে এই পর্যন্ত।
এ কয়দিনে নূতন কোনও পরিস্থিতির উদ্ভব হয় নাই। মালতী দেবীর রোগ ভালর দিকেই আসিতেছিল; কিন্তু তিনি একটু সংবিৎ পাইয়া দেখিলেন ঘরে যুবতী নার্স রহিয়াছে। আমনি তাঁহার ষষ্ঠ রিপু প্রবল হইয়া উঠিল, তিনি গালাগালি দিয়া নার্সকে তাড়াইয়া দিলেন। ফলে অবস্থা আবার যায়—যায় হইয়া উঠিয়াছে, অধ্যাপক সোম একা হিমসিম খাইতেছেন।
শনিবার ৩০শে ডিসেম্বর সকালবেলা ব্যোমকেশ বলিল, চল, আজ একটু রোঁদে বেরুনো যাক।
রিকশা চড়িয়া বাহির হইলাম।
প্ৰথমে উপস্থিত হইলাম নকুলেশবাবুর ফটোগ্রাফির দোকানে। নীচে দোকান, উপরতলায় নকুলেশবাবুর বাসস্থান। তিনি উপরে ছিলেন, আমাদের দেখিয়া যেন একটু বিব্রত হইয়া পড়িলেন। মনে হইল তিনি বাঁধাছাদা করিতেছিলেন; কাষ্ঠ হাসিয়া বলিলেন, আসুন।-ছবি তোলাবেন নাকি?
ব্যোমকেশ বলিল, এখন নয়। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম আপনার দোকানটা দেখে যাই ৷
নকুলেশবাবু বলিলেন, বেশ বেশ। আমি কিন্তু ভাল ছবি তুলি। এখানকার কেষ্ট-বিষ্টু সকলেই আমাকে দিয়ে ছবি তুলিয়েছেন। এই দেখুন না।
ঘরের দেয়ালে অনেকগুলি ছবি টাঙানো রহিয়াছে; তন্মধ্যে চেনা লোক মহীধরবাবু এবং অধ্যাপক সোম। ব্যোমকেশ দেখিয়া বুলিল, বাঃ, বেশ ছবি। আপনি দেখছি। একজন সত্যিকারের শিল্পী।
নকুলেশবাবু খুশি হইয়া বলিলেন, হেঁ হেঁ। ওরে লালু, পাশের দোকান থেকে দু পেয়ালা চা নিয়ে আয়।
চায়ের দরকার নেই, আমরা খেয়ে-দেয়ে বেরিয়েছি। আপনি কোথাও যাবেন মনে হচ্ছে।
নকুলেশবাবু বলিলেন, হ্যাঁ, দু দিনের জন্য একবার কলকাতা যাব। বৌ-ছেলে কলকাতায় আছে তাদের আনতে যাচ্ছি।
আচ্ছা, আপনি গোছগাছ করুন।
রিকশাতে চড়িয়া ব্যোমকেশ বলিল, স্টেশনে চল।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ব্যাপার কি? সবাই জোট বেঁধে কলকাতা যাচ্ছে!
ব্যোমকেশ বলিল, এই সময় কলকাতার একটা নিদারুণ আকর্ষণ আছে।
রেলওয়ে স্টেশনে উপস্থিত হইলাম। ব্রাঞ্চ লাইনের প্রান্তীয় স্টেশন, বেশি বড় নয়। এখান হইতে বড় জংশন প্রায় পঁচিশ মাইল দূরে, সেখানে নামিয়া মেন লাইনের গাড়ি ধরিতে হয়। রেল ছাড়া জংশনে যাইবার মোটর-রাস্তাও আছে; সাহেব সুবা এবং যাহাদের মোটর আছে তাহারা সেই পথে যায়।
ব্যোমকেশ কিন্তু স্টেশনে নামিল না, রিকশাওয়ালাকে ইশারা করিতেই সে গাড়ি ঘুরাইয়া বাহিরে লইয়া চলিল। জিজ্ঞাসা করিলাম, কি হল, নামলে না?
ব্যোমকেশ বলিল, তুমি বোধ হয় লক্ষ্য করনি, টিকিট-ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ডাক্তার ঘটক টিকিট কিনছিলেন।
তাই নাকি? আমি ব্যোমকেশকে আরও কয়েকটা প্রশ্ন করিলাম, কিন্তু সে যেন শুনিতে পায় নাই এমনি ভান করিয়া উত্তর দিল না।
বাজারের ভিতর দিয়া যাইতে যাইতে বড় মনিহারীর দোকানটার সামনে একটা মোটর দাঁড়াইয়া আছে দেখিলাম। ব্যোমকেশ রিকশা থামাইয়া নামিল, আমিও নামিলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, আবার কি মতলব? আরও এসেন্স চাই নাকি?
সে হাসিয়া বলিল, আরে না না—
তবে কি কেশতৈল? তরল আলতা?
এসই না।
দোকানে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম ডেপুটি উষানাথবাবু রহিয়াছেন। তিনি একটা চামড়ার সুটকেস কিনিতেছেন। আমার মুখ দিয়া আপনিই বাহির হইয়া গেল, আপনিও কি কলকাতা যাচ্ছেন নাকি?
উষানাথবাবু চমকিত হইয়া বলিলেন, আমি! নাঃ, আমি ট্রেজারি অফিসার, আমার কি স্টেশন ছাড়বার জো আছে? কে বললে আমি কলকাতা যাচ্ছি? তাঁহার স্বর কড়া হইয়া উঠিল।
ব্যোমকেশ সান্ত্বনার সুরে বলিল, কেউ বলেনি। আপনি সুটকেস কিনছেন দেখে অজিত ভেবেছিল—। যাক, আপনার পরী পেয়েছেন তো?
হ্যাঁ, পেয়েছি।
উষানাথবাবু অসন্তুষ্টভাবে মুখ ফিরাইয়া লইয়া দোকানদারের সহিত কথা কহিতে লাগিলেন।
আমরা ফিরিয়া গিয়া রিকশাতে চড়িলাম। বলিলাম, কি হল? হুজুর হঠাৎ চটলেন কেন?
ব্যোমকেশ বলিল, কি জানি। ওঁর হয়তো মনে মনে কলকাতা যাবার ইচ্ছে, কিন্তু কৰ্তব্যের দায়ে স্টেশন ছাড়তে পারছেন না, তাই মেজাজ গরম। কিংবা—
রিকশাওয়ালা জিজ্ঞাসা করিল, আভি কিধর যানা হ্যায়?
ব্যোমকেশ বলিল, ডি.এস.পি. পাণ্ডে সাহেব।
পাণ্ডে সাহেবের বাড়িতেই আপিস। তিনি আমাদের স্বাগত করিলেন। ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল, সব ঠিক?
পাণ্ডে বলিলেন, সব ঠিক।
ট্রেন কখন?
রাত্রি সাড়ে দশটায়। সওয়া এগারটায় জংশন পৌঁছবে।
কলকাতার ট্রেন কখন?
পৌনে বারটায় ৷
আর পশ্চিমের মেল?
এগারটা পঁয়ত্ৰিশ।
ব্যোমকেশ বলিল, বেশ। তাহলে ওবেলা আন্দাজ পাঁচটার সময় আমি মহীধর বাবুর বাড়িতে যাব। আপনি সাড়ে পাঁচটার সময় যাবেন। মহীধরবাবু যদি আমার অনুরোধ না রাখেন, পুলিসের অনুরোধ নিশ্চয় অগ্রাহ্য করতে পারবেন না।
গম্ভীর হাসিয়া পাণ্ডে বলিলেন, আমারও তাই বিশ্বাস।
ইহাদের টেলিগ্ৰাফে কথাবার্তা হৃদয়ঙ্গম হইল না। কিন্তু প্রশ্ন করিয়া লাভ নাই; জানি প্রশ্ন করিলেই ব্যোমকেশ জিভ কাটিয়া বলিবে-পুলিসের গুপ্তকথা।
পাণ্ডের আপিস হইতে ব্যাঙ্কে গেলাম। কিছু টাকা বাহির করিবার ছিল।
ব্যাঙ্কে খুব ভিড়; আগামী দুই দিন বন্ধ থাকিবে। তবু ক্ষণেকের জন্য অমরেশবাবুর সঙ্গে দেখা হইল। তিনি বলিলেন, এই বেলা যা দরকার টাকা বার করে নিন। কাল পরশু ব্যাঙ্ক বন্ধ থাকবে।
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, আপনি ফিরছেন কবে?
পরশু রাত্রেই ফিরব।
কাজের সময়, একজন কেরানী তাঁহাকে ডাকিয়া লইয়া গেল। আমরা টাকা বাহির করিয়া ফিরিতেছি, দেখিলাম ডাক্তার ঘটক ব্যাঙ্কে প্ৰবেশ করিল। সে আমাদের দেখিতে পাইয়াছিল, কিন্তু যেন দেখিতে পায় নাই এমনিভাবে গিয়া একটা জানালার সম্মুখে দাঁড়াইল।
ব্যোমকেশ আমার দিকে চাহিয়া সহাস্য চক্ষুদ্বয় ঈষৎ কুঞ্চিত করিল। তারপর রিকশাতে চড়িয়া বসিয়া বলিল, ঘর চলো।
১১
অপরাহ্ন পাঁচটায় সময় আমি আর ব্যোমকেশ মহীধর বাবুর বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম। তিনি বসিবার ঘরে ছিলেন। দেখিলাম তাঁহার চেহারা খারাপ হইয়া গিয়াছে। মুখের ফুটি-ফাটা হাসিটি ম্ৰিয়মাণ, চালতার মতন গাল দুইটি বুলিয়া পড়িয়াছে।
বলিলেন, আসুন আসুন। অনেক দিন বাঁচবেন ব্যোমকেশবাবু, এইমাত্র আপনার কথা ভাবছিলাম। শরীর বেশ সেরে উঠেছে দেখছি। বাঃ, বেশ বেশ ৷
ব্যোমকেশ বলিল, কিন্তু আপনার শরীর তো ভাল দেখছি না।
মহীধরবাবু বলিলেন, হয়েছিল একটু শরীর খারাপ—এখন ভালই। কিন্তু একটা বড় ভাবনার কারণ হয়েছে ব্যোমকেশবাবু।
কি হয়েছে?
রজনী কাল রাত্রে কলকাতা চলে গেছে ৷
সে কি! একলা গেছেন? আপনাকে না বলে?
না না, সে সব কিছু নয়। বাড়ির পুরোনো চাকর রামদীনকে তার সঙ্গে দিয়েছি।
তবে ভাবনাটা কিসের?
মহীধরবাবুর মনে ছল চাতুরী নাই। সোজাসুজি বলিতে আরম্ভ করিলেন, শুনুন, বলি তাহলে। কলকাতায় রজনীর এক মাসী থাকেন, তিনিই ওকে মানুষ করেছেন। কাল বিকেলে ওর মেসোর এক ‘তার’ এল। তিনি রজনীকে ডেকে পাঠিয়েছেন—মাসীর ভারি অসুখ।
রজনীকে রাত্তিরের গাড়িতে পাঠিয়ে দিলাম। ও এমন প্রায়ই যাতায়াত করে, পাঁচ ছ ঘণ্টার রাস্তা বৈ তো নয়। রজনী আজ সকালে কলকাতায় পৌঁছে গেছে, তার পেয়েছি।
এ পর্যন্ত কোনও গোলমাল নেই। তারপর শুনুন। আজ সকালে দুখানা চিঠি পেলাম; তার মধ্যে একখানা রজনীর মাসীর হাতের লেখা—কালকের তারিখ। তিনি নিতান্ত মামুলি চিঠি লিখেছেন, অসুখ-বিসুখের কোনও কথাই নেই।
মহীধরবাবু শঙ্কিত চক্ষে ব্যোমকেশের পানে চাহিলেন। ব্যোমকেশ বলিল, এমনও তো হতে পারে চিঠি লেখবার পর তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
মহীধরবাবু বলিলেন, তা একেবারে অসম্ভব নয়। কিন্তু অন্য চিঠিখানার কথা এখনও বলিনি। বেনামী চিঠি। এই পড়ে দেখুন।
তিনি একটি খাম ব্যোমকেশকে দিলেন। খামের উপর ডাকঘরের ছাপ দেখিয়া বোঝা যায় এই শহরেই ডাকে দেওয়া হইয়াছে। ব্যোমকেশ চিঠি বাহির করিয়া পড়িল। সাদা এক তক্তা কাগজের উপর মাত্র কয়েকটি কথা লেখা ছিল--
আপনার চোখের আড়ালে একজন ভদ্রবেশী দুষ্ট লোক আপনার কন্যার সহিত অবৈধ প্ৰণয়ে লিপ্ত হইয়াছে। ইহারা যদি ইলোপ করে, কেলেঙ্কারির একশেষ হইবে। সাবধান! ডাক্তার ঘটককে বিশ্বাস করিবেন না।
ব্যোমকেশ চিঠি পড়িয়া ফেরত দিল। মহীধরবাবু কম্পিত স্বরে বলিলেন, কে লিখেছে জানি না। কি এ যদি সত্যি হয়—
ব্যোমকেশ শাস্তভাবে বলিল, ডাক্তার ঘটককে আপনি জানেন। সে এমন কাজ করবে বলে আপনার মনে হয়?
মহীধরবাবু ইতস্তত করিয়া বলিলেন, ডাক্তারকে তো ভাল ছেলে বলেই জানি; যখন তখন আসে আমার বাড়িতে। তবে পরচিত্ত অন্ধকার। আচ্ছা, সে কি আছে এখানে?
ব্যোমকেশ বলিল, আছে। আজ সকালেই তাকে দেখেছি।
মহীধরবাবু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, আছে? যাক, তাহলে বোধ হয় কেউ মিথ্যে বেনামী চিঠি দিয়েছে।
ব্যোমকেশ বলিল, ডাক্তার কিন্তু আজ রাত্রে কলকাতা যাচ্ছে।
মহীধর বাবু আবার ব্যাকুল হইয়া বলিলেন, অ্যাঁ-যাচ্ছে!! তবে—?
ব্যোমকেশ দৃঢ়স্বরে বলিল, মহীধরবাবু, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, কোনও কেলেঙ্কারি হবে না। আপনি মিথ্যে ভয় করছেন ৷
মহীধর বাবু ব্যোমকেশের হাত ধরিয়া বলিলেন, সত্যি বলছেন? কিন্তু আপনি কি করে জানলেন-আপনি তো—
ব্যোমকেশ বলিল, আমি এমন অনেক কথা জানি যা আপনি জানেন না। আমাকে বিশ্বাস করুন, আমি আপনাকে মিথ্যে আশ্বাস দিচ্ছি না। রজনী দেবী দুদিন পরেই ফিরে আসবেন। তিনি এমন কোনও কাজ করবেন না যাতে আপনার মাথা হেঁট হয়।
মহীধরবাবু গদগদ স্বরে বলিলেন, ব্যস, তা হলেই হল। ধন্যবাদ ব্যোমকেশবাবু। আপনার কথায় যে কত দূর নিশ্চিন্ত হলাম তা বলতে পারি না। বুড়ো হয়েছি—ভগবান একবার দাগা দিয়েছেন।—তাই একটুতেই ভয় হয় ৷
ব্যোমকেশ বলিল, ওকথা ভুলে যান। আমি এসেছি আপনার কাছে একটা অনুরোধ নিয়ে ৷
মহীধর বাবু ব্যস্ত হইয়া বলিলেন, বলুন বলুন।
আপনার মোটরখানা আজ রাত্রে একবার দিতে হবে। জংশনে যাব। একটু জরুরী কাজ আছে।
এ আর বেশি কথা কি? কখন চাই বলুন?
রাত্ৰি নটার সময় ৷
বেশ, ঠিক ন’টার সময় আমার গাড়ি আপনার বাড়ির সামনে হাজির থাকবে। আর কিছু?
আর কিছু না।
এই সময় পাণ্ডে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সকলে মিলিয়া চা ও প্রচুর জলখাবার ধ্বংস করিয়া বাড়ি ফিরিলাম।
ঠিক নাটার সময় মহীধরবাবুর আট সিলিন্ডার গাড়ি আমাদের বাড়ির সামনে আসিয়া থামিল। আমি, ব্যোমকেশ ও পাণ্ডে সাহেব তাহাতে চাপিয়া বসিলাম। গাড়ি ছাড়িয়া দিল। একটি কালো রঙের পুলিস ভ্যান আগে হইতেই দাঁড়াইয়াছিল, সেটি আমাদের পিছু লইল।
শহরের সীমানা অতিক্রম করিয়া আমাদের মোটর জংশনের দীর্ঘ গৃহহীন পথ ধরিল। দুই পাশে কেবল বড় বড় গাছ; আমাদের গাড়ি তাহার ভিতর আলোর সুড়ঙ্গ রচনা করিয়া ছুটিয়া চলিয়াছে।
পথে বেশি কথা হইল না। তিনজনে পাশাপাশি বসিয়া একটার পর একটা সিগারেট টানিয়া চলিয়াছি। একবার ব্যোমকেশ বলিল, আপনার আসামী ফাস্ট ক্লাসের টিকিট কিনবে।
হাঁ। আমারও তাই মনে হয়। যে ক্লাসেই উঠুক, ইন্সপেক্টর দুবে পাশের কামরায় থাকবে।
পুলিস মহলে আসল কথা কে কে জানে?
আমি আর দুবে। পাছে আগে থাকতে বেশি হৈ চৈ হয় তাই চুপিসাড়ে মহীধরবাবুর গাড়ি নিতে হল। পিছনের ভ্যানে যারা আছে তারাও জানে না কি জন্যে কোথায় যাচ্ছি। পুলিসের থানা থেকে যত কথা বেরোয় এত আর কোথাও থেকে নয়। ঘুষখোর পুলিস তো আছেই। তা ছাড়া পুলিসের পেটে কথা থাকে না।
পুরন্দর পাণ্ডে নির্মলচরিত্র পুরুষ, তাই স্বজাতি সম্বন্ধেও তিনি সত্যবাদী।
দশটার সময় জংশনে পৌঁছিলাম। লাল সবুজ অসংখ্য আকাশ-প্রদীপে স্টেশন ঝলমল করিতেছে।
পুলিসের ভ্যানে দুইজন সাব-ইন্সপেক্টর ও কয়েকটি কনস্টেবল ছিল। পাণ্ডে তাহাদের স্টেশনের ভিতরে বাহিরে নানা স্থানে সন্নিবিষ্ট করিলেন; তারপর স্টেশন-মাস্টারের সঙ্গে দেখা করিলেন। বলিলেন, আমার একটা লগ আসবার কথা আছে। এলেই খবর দেবেন। আমরা ওয়েটিং রুমে আছি।
আমরা তিনজনে ফাস্ট ক্লাস ওয়েটিং রুমে গিয়া বসিলাম। পাণ্ডে ঘন ঘন হাতঘড়ি দেখিতে লাগিলেন।
ঠিক সাড়ে দশটার সময় স্টেশন-মাস্টার খবর দিলেন, লগ এসেছে। সব ভাল। ফার্স্ট ক্লাস।
এখনও পঁয়তাল্লিশ মিনিট।
কিন্তু পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় যত দীর্ঘই হোক, প্রাকৃতিক নিয়মে শেষ হইতে বাধ্য। গাড়ি আসার ঘণ্টা বাজিল। আমরা প্ল্যাটফর্মে গিয়া দাঁড়াইলাম। আমাদের সকলের গায়ে ওভারকোট এবং মাথায় পশমের টুপি, সুতরাং সহসা দেখিয়া কেহ যে চিনিয়া ফেলিবে সে সম্ভাবনা নাই।
তারপর বহু প্ৰতীক্ষিত গাড়ি আসিয়া দাঁড়াইল।
পাণ্ডে সাহেব নাটকের রঙ্গমঞ্চ ভালই নির্বাচন করিয়াছিলেন। আয়োজনেরও কিছু ত্রুটি রাখেন নাই; কিন্তু তবু নাটক জমিতে পাইল না, পটোত্তোলনেরর সঙ্গে সঙ্গে যবনিকা পড়িয়া গেল।
গাড়ির প্রথম শ্রেণীর কামরা যেখানে থামে আমরা সেইখানে দাঁড়াইয়াছিলাম। ঠিক আমাদের সামনে প্রথম শ্রেণীর কামরা দেখা গেল। জানালাগুলির কাঠের কবাট বন্ধ, তাই অভ্যন্তরভাগ দেখা গেল না। অল্পকাল-মধ্যে দরজা খুলিয়া গেল। একজন কুলি ছুটিয়া গিয়া ভিতরে প্রবেশ করিল এবং দুইটি বড় বড় চামড়ার সুটকেস নামাইয়া রাখিল।
কামরায় একটি মাত্র যাত্রী ছিলেন, তিনি এবার বাহির হইয়া আসিলেন। কোটপ্যান্ট-পরা অপরিচিত ভদ্রলোক, গোঁফ-দাড়ি কামানো, চোখে ফিকা নীল চশমা। তিনি সুটকেস দুটি কুলির মাথায় তুলিবার ব্যবস্থা করিতেছেন, পাণ্ডে এবং ব্যোমকেশ তাঁহার দুই পাশে গিয়া দাঁড়াইল। ব্যোমকেশ একটু দুঃখিত স্বরে বলিল, অমরেশবাবু, আপনার যাওয়া হল না। ফিরে যেতে হবে।
অমরেশবাবু! ব্যাঙ্কের ম্যানেজার অমরেশ রাহা! গোঁফ-দাড়ি কামানো মুখ দেখিয়া একেবারে চিনিতে পারি নাই।
অমরেশ রাহা একবার দক্ষিণে একবার বামে ঘাড় ফিরাইলেন, তারপর ক্ষিপ্ৰহস্তে পকেট হইতে পিস্তল বাহির করিয়া নিজের কপালে ঠেকাইয়া ঘোড়া টানিলেন। চড়াৎ করিয়া শব্দ হইল।
মুহুর্তমধ্যে অমরেশ রাহার ভূপতিত দেহ ঘিরিয়া লোক জমিয়া গেল। পাণ্ডে হুইসল বাজাইলেন; সঙ্গে সঙ্গে পুলিসের বহু লোক আসিয়া স্থানটা ঘিরিয়া ফেলিল। পাণ্ডে কড়া সুরে বলিলেন, ইন্সপেক্টর দুবে, সুটকেস দুটো আপনার জিম্মায়।
একজন লোক ভিড় ঠেলিয়া প্রবেশ করিল। চিনিলাম, ডাক্তার ঘটক। সে বলিল, কি হয়েছে? এ কে?
পাণ্ডে বলিলেন, অমরেশ রাহা। দেখুন তো বেঁচে আছে কি না।
ডাক্তার ঘটক নত হইয়া দেহ পরীক্ষা করিল, তারপর উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, মারা গেছে।
ভিড়ের ভিতর হইতে দন্তবাদ্যসহযোগে একটা বিস্ময়-কুতুহলী স্বর শোনা গেল, অমরেশ রাহা মারা গেছে।—অ্যাঁ! কি হয়েছিল? তার দাড়ি কোথায়—অ্যাঁ—
ফটোগ্রাফার নকুলেশ সরকার।
ডাক্তার ঘটক ও নকুলেশবাবুকে লক্ষ্য করিয়া ব্যোমকেশ বলিল, আপনাদের গাড়িও এসে পড়েছে। এখন বলবার সময় নেই, ফিরে এসে শুনবেন।
১২
ব্যোমকেশ বলিল, একটা সাংঘাতিক ভুল করেছিলুম। অমরেশ রাহা ব্যাঙ্কের ম্যানেজার, তার যে পিস্তলের লাইসেন্স থাকতে পারে একথা মনেই আসেনি।
সত্যবতী বলিল, না, গোড়া থেকে বল।
২রা জানুয়ারি। কলিকাতায় ফিরিয়া চলিয়াছি। ডি.এস.পি. পাণ্ডে, মহীধর বাবু ও রজনী স্টেশনে আসিয়া আমাদের গাড়িতে তুলিয়া দিয়া গিয়াছেন। এতক্ষণে আমরা নিশ্চিন্ত মনে একত্র হইতে পারিয়াছি।
ব্যোমকেশ বলিল, দুটো জিনিস জট পাকিয়ে গিয়েছিল—এক, ছবি চুরি; দ্বিতীয়, ডাক্তার আর রজনীর গুপ্ত প্ৰণয়। ওদের প্রণয় গুপ্ত হলেও তাতে নিন্দের কিছু ছিল না। ওরা কলকাতায় গিয়ে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করেছে। সম্ভবত রজনীর মাসী আর মেসো জানেন, আর কেউ জানে না; মহীধর বাবুও না। তিনি যতদিন বেঁচে থাকবেন, ততদিন কেউ জানবে না। মহীধর বাবু সেকেলে লোক নয়, তবু বিধবা-বিবাহ সম্বন্ধে সাবেক সংস্কার ত্যাগ করতে পারেননি। তাই ওরা লুকিয়ে বিয়ে করে সব দিক রক্ষা করেছে।
জিজ্ঞাসা করিলাম, খবরটা কি ডাক্তারের কাছে পেলে?
ব্যোমকেশ বলিল, উহু। ডাক্তারকে ঘাঁটাইনি, ও যে রকম রুখে ছিল, কিছু বলতে গেলেই কামড়ে দিত। আমি রজনীকে আড়ালে বলেছিলাম, সব জানি। সে জিজ্ঞেস করেছিল, ব্যোমকেশীবাবু, আমরা কি অন্যায় করেছি? আমি বলেছিলাম-না। তোমরা যে বিদ্রোহের ঝোঁকে মহীধর বাবুকে দুঃখ দাওনি, এতেই তোমাদের গৌরব। উগ্ৰ বিদ্রোহে বেশি কাজ হয় না, কেবল বিরুদ্ধ শক্তিকে জাগিয়ে তোলা হয়। বিদ্রোহের সঙ্গে সহিষ্ণুতা চাই। তোমরা সুখী হবে।
সত্যবতী বলিল, তারপর বল।
ব্যোমকেশ বলিতে আরম্ভ করিল, ছবি চুরির ব্যাপারটাকে যদি হাল্কা ভাবে নাও তাহলে তার অনেক রকম ব্যাখ্যা হতে পারে। কিন্তু যদি গুরুতর ব্যাপার মনে কর, তাহলে তার একটিমাত্ৰ ব্যাখ্যা হয়-ঐ গ্রুপের মধ্যে এমন একজন আছে যে নিজের চেহারা লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে চায়।
কিন্তু কি উদ্দেশ্যে?—একটা উদ্দেশ্য এই হতে পারে যে ঐ দলে একজন দাগী আসামী আছে যে নিজের ছবির প্রচার চায় না। প্রস্তাবটা কিন্তু টেকসই নয়। ঐ গ্রুপে যারা আছে তারা কেউ লুকিয়ে বেড়ায় না, তাদের সকলেই চেনে। সুতরাং ছবি চুরি করার কোনও মানে হয় না।
দাগী আসামীর সম্ভাবনা ত্যাগ করতে হচ্ছে। কিন্তু যদি ঐ দলে এমন কেউ থাকে যে ভবিষ্যতে দাগী আসামী হবার জন্যে প্ৰস্তুত হচ্ছে, অর্থাৎ একটা গুরুতর অপরাধ করে কেটে পড়বার চেষ্টায় আছে, তাহলে সে নিজের ছবি লোপাট করবার চেষ্টা করবে। অজিত, তুমি তো লেখক, শুধু ভাষার দ্বারা একটা লোকের এমন হুবহু বৰ্ণনা দিতে পার যাতে তাকে দেখলেই চেনা যায়?—পারবে না; বিশেষত তার চেহারা যদি মামুলি হয় তাহলে একেবারেই পারবে না। কিন্তু একটা ফটোগ্রাফ মুহূর্তমধ্যে তার চেহারাখানা আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরতে পারে। তাই দাগী আসামীদের ফটো পুলিসের ফাইলে রাখা থাকে।
তাহলে পাওয়া গেল, ঐ দলের একটা লোক গুরুতর অপরাধ করে ডুব মারবার ফন্দি আটছে। এখন প্রশ্ন এই-সংকল্পিত অপরাধটা কি এবং লোকটা কে?
গ্রুপের লোকগুলিকে একে একে ধরা যাক। —মহীধরবাবু ডুব মারবেন না; তাঁর বিপুল সম্পত্তি আছে, চেহারাখানাও ডুব মারবার অনুকুল নয়। ডাক্তার ঘটক রজনীকে নিয়ে উধাও হতে পারে। কিন্তু রজনী সাবালিকা, তাকে নিয়ে পালানো আইন-ঘটিত অপরাধ নয়। তবে ছবি চুরি করতে যাবে কেন? অধ্যাপক সোমকেও বাদ দিতে পার। সোম যদি শিকল কেটে ওড়বার সঙ্কল্প করতেন তা হলেও স্রেফ ঐ ছবিটা চুরি করার কোনও মানে হত না। সোমের আরও ছবি আছে; নকুলেশবাবুর ঘরে তাঁর ফটো টাঙানো আছে আমরা দেখেছি। তারপর ধর নকুলেশবাবু; তিনি পিকনিকের দলে ছিলেন। তিনি মহীধরবাবুর কাছে মোটা টাকা ধার করেছিলেন, সুতরাং তাঁর পক্ষে গা-ঢাকা দেওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তিনি ফটো তুলেছিলেন, ফটোতে তাঁর চেহারা ছিল না। অতএব তাঁর পক্ষে ফটো চুরি করতে যাওয়া বোকামি।
বাকি রয়ে গেলেন ডেপুটি উষানাথবাবু এবং ব্যাঙ্ক-ম্যানেজার অমরেশ রাহা। একজন সরকারী মালখানার মালিক, অন্যজন ব্যাঙ্কের কর্তা। দেখা যাচ্ছে, ফেরার হয়ে যদি কারুর লাভ থাকে তো এঁদের দুজনের। দুজনের হাতেই বিস্তর পরের টাকা; দুজনেই চিনির বলদ।
প্রথমে উষানাথবাবুকে ধর। তাঁর স্ত্রী-পুত্ৰ আছে; চেহারাখানাও এমন যে ফটো না থাকলেও তাঁকে সনাক্ত করা চলে। তিনি চোখে কালো চশমা পরেন, চশমা খুললে দেখা যায়। তাঁর একটা চোখ কানা। বেশিদিন পুলিসের সন্ধানী চক্ষু এড়িয়ে থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া, তাঁর চরিত্রও এমন একটা দুঃসাহসিক কাজ করার প্রতিকূল।
বাকি রইলেন অমরেশ রাহা। এটা অবশ্য নেতি প্ৰমাণ। কিন্তু তারপর তাঁকে ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখবে তিনি ছাড়া আর কেউ হতে পারেন না। তাঁর চেহারা নিতান্ত সাধারণ, তাঁর মত লক্ষ লক্ষ বৈশিষ্ট্যহীন লোক পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তিনি মুখে ফ্রেঞ্চকার্ট দাড়ি রেখেছেন। এ রকম দাড়ি রাখার সুবিধে, দাড়ি কামিয়ে ফেললেই চেহারা বদলে যায়, তখন চেনা লোক আর চিনতে পারে না। নকল দাড়ি পরার চেয়ে তাই আসল দাড়ি কামিয়ে ফেলা ছদ্মবেশ হিসেবে ঢের বেশি নিরাপদ এবং নির্ভরযোগ্য।
অমরেশবাবু অবিবাহিত ছিলেন। তিনি মাইনে ভালই পেতেন, তবু তাঁর মনে দারিদ্র্যের ক্ষোভ ছিল; টাকার প্রতি দুৰ্দম আকাঙক্ষা জন্মেছিল। আমার মনে হয় তিনি অনেকদিন ধরে এই কু-মতলব আটছিলেন। তাঁর আলমারিতে গুজরাটী বই দেখেছিলে মনে আছে? তিনি চেষ্টা করে গুজরাটী ভাষা শিখেছিলেন; হয়তো সংকল্প ছিল টাকা নিয়ে বোম্বাই অঞ্চলে গিয়ে বসবেন। বাঙালীদের সঙ্গে গুজরাটীদের চেহারার একটা ধাতুগত ঐক্য আছে, ভাষাটাও রপ্ত থাকলে কেউ তাঁকে সন্দেহ করতে পারবে না।
সবদিক ভেবে আঁটঘাট বেঁধে তিনি তৈরি হয়েছিলেন। তারপর যখন সঙ্কল্পকে কাজে পরিণত করবার সময় হল তখন হঠাৎ কতকগুলো অপ্রত্যাশিত বাধা উপস্থিত হল। পিকনিকের দলে গিয়ে তাঁকে ছবি তোলাতে হল। তিনি অনিচ্ছাভরে ছবি তুলিয়েছিলেন সন্দেহ নেই, কিন্তু না তোলাতে লোকের মনে সন্দেহ জাগতে পারে। ভাবলেন, ছবি চুরি করে সামলে নেবেন।
যা হোক, তিনি মহীধর বাবুর বাড়ি থেকে ছবি চুরি করলেন। পরদিন চায়ের পার্টিতে আমরা উপস্থিত ছিলাম; সেখানে যে সব আলোচনা হল তাতে অমরেশবাবু বুঝলেন তিনি একটা ভুল করেছেন। স্রেফ ছবিখানা চুরি করা ঠিক হয়নি। তাই পরের বার যখন তিনি ঊষানাথবাবুর বাড়িতে চুরি করতে গেলেন তখন আর কিছু না পেয়ে পরী চুরি করে আনলেন। আলমারিতে চাবি ঢুকিয়ে এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করলেন যাতে মনে হয় ছবি চুরি করাটা চোরের মূল উদ্দেশ্য নয়। অধ্যাপক সোমের ছবিটা চুরি করার দরকার হয়নি। আমার বিশ্বাস তিনি কোনও উপায়ে জানতে পেরেছিলেন যে, মালতী দেবী ছবিটা আগেই ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছেন। কিংবা এমনও হতে পারে যে, তিনি ছবি চুরি করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু ছবি তার আগেই নষ্ট করা হয়েছিল। হয়তো তিনি ছেঁড়া ছবির টুকরোগুলো পেয়েছিলেন।
আমার আবির্ভাবে অমরেশবাবু শঙ্কিত হননি। তাঁর মূল অপরাধ তখনও ভবিষ্যতের গর্ভে; তিনি টাকা নিয়ে উধাও হবার পর সবাই জানতে পারবে, তখন আমি জানলেও ক্ষতি নেই। কিন্তু ফাল্গুনী পালের প্রেতমূর্তি যখন এসে দাঁড়াল, তখন অমরেশবাবু মাথায় হাত দিয়ে বসলেন। তাঁর সমস্ত প্ল্যান ভেস্তে যাবার উপক্রম হল। ফাল্গুনী থাকতে ফটো চুরি করে কি লাভ? সে স্মৃতি থেকে ছবি এঁকে ফটোর অভাব পূরণ করে দেবে।
কিন্তু পরকীয়া-প্রীতির মত বেআইনী কাজ করার একটা তীব্ৰ উত্তেজনা আছে। অমরেশবাবু তার স্বাদ পেয়েছিলেন। তিনি এতদূর এগিয়ে আর পৌঁছুতে পারছিলেন না। তাই ফাল্গুনী যেদিন তাঁর ছবি এঁকে দেখাতে এল সেদিন তিনি ঠিক করলেন ফাল্গুনীর বেঁচে থাকা চলবে না। সেই রাত্রে তিনি মদের বোতলে বেশ খানিকটা আফিম মিশিয়ে নিয়ে ফাল্গুনীর কুঁড়ে ঘরে গেলেন। ফাল্গুনীকে নেশার জিনিস খাওয়ানো শক্ত হল না। তারপর সে যখন অজ্ঞান হয়ে পড়ল তখন তাকে তুলে কুয়োয় ফেলে দিলেন। আগের রাত্রে চুরি-করা পরীটা তিনি সঙ্গে এনেছিলেন, সেটাও কুয়োর মধ্যে গেল; যাতে পুলিস ফাল্গুনীকেই চোর বলে মনে করে। এই ব্যাপার ঘটেছিল সম্ভবত রাত্রি এগারোটার পর, যখন বাগানের অন্য কোণে আর একটি মন্ত্রণা-সভা শেষ হয়ে গেছে।
পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট থেকে মনে হয় ফান্ধুনী জলে পড়বার আগেই মরে গিয়েছিল। কিন্তু অমরেশবাবুর বোধ হয় ইচ্ছে ছিল সে বেঁচে থাকতে থাকতেই তাকে জলে ফেলে দেন, যাতে প্রমাণ হয় সে নেশার ঝোঁক অপঘাতে জলে ডুবে মরেছে।
যা হোক, অমরেশবাবু নিষ্কণ্টক হলেন। যে ছবিটা তিনি আমাদের দেখিয়েছিলেন, রওনা দেবার আগে সেটা পুড়িয়ে ফেললেই নিশ্চিন্ত, আর তাঁকে সনাক্ত করবার কোনও চিহ্ন থাকবে না।
আমি যখন নিঃসংশয়ে বুঝতে পারলাম। এ অমরেশবাবুর কাজ, তখন পাণ্ডে সাহেবকে সব কথা বললাম। ভারি বুদ্ধিমান লোক, চট করে ব্যাপার বুঝে নিলেন। সেই থেকে এক মিনিটের জন্যেও অমরেশবাবু পুলিসের চোখের আড়াল হতে পারেননি।
ব্যোমকেশ সিগারেট ধরাইল।
আমি বলিলাম, আচ্ছা, অমরেশ রাহা যে ঠিক ঐ দিনই পালাবে, এটা বুঝলে কি করে? অন্য যে কোনও দিন পালাতে পারত।
ব্যোমকেশ বলিল, একটা কোনও ছুটির আগে পালানোর সুবিধে আছে, দুদিন সময় পাওয়া যায়। দুদিন পরে ব্যাঙ্ক খুললে যখন চুরি ধরা পড়বে, চোর তখন অনেক দূরে। অবশ্য বড়দিনের ছুটিতেও পালাতে পারত; কিন্তু তার দিক থেকে নববর্ষের ছুটিতেই পালানোর দরকার ছিল। অমরেশ রাহা যে-ব্যাঙ্কের ম্যানেজার ছিল সেটা কলকাতার একটা বড় ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চ অফিস। প্রত্যেক মাসের শেষে এখানে হেড আপিস থেকে মোটা টাকা আসত; কারণ পরের মাসের আরম্ভেই ব্যাঙ্কের টাকায় টান পড়বে। সাধারণ লোক ছাড়াও এখানে কয়েকটা খনি আছে, তাতে অনেক কর্মী কাজ করে, মাসের পয়লা তাদের মাইনে দিতে হয়। এবার সেই মোটা টাকাটা ব্যাঙ্কে এসেছিল বড়দিনের ছুটির পর। বড়দিনের ছুটির আগে পালালে অমরেশ রাহা বেশি টাকা নিয়ে যেতে পারত না। তার দুটি সুটকেশ থেকে এক লাখ আশি হাজার টাকার নোট পাওয়া গেছে।
ব্যোমকেশ লম্বা হইয়া শুইল, বলিল, আর কোনও প্রশ্ন আছে?
দাড়ি কামালো কখন? ট্রেনে?
হ্যাঁ। সেইজন্যেই ফাস্ট ক্লাসের টিকিট কিনেছিল। ফাস্ট ক্লাসে সহযাত্রীর সম্ভাবনা কম ৷
সত্যবতী বলিল, মহীধর বাবুকে বেনামী চিঠি কে দিয়েছিল?
ব্যোমকেশ বলিল, প্রোফেসর সোম। কিন্তু বেচারার প্রতি অবিচার কোরো না। লোকটি শিক্ষিত এবং সজ্জন, এক ভয়ঙ্করী স্ত্রীলোকের হাতে পড়ে তাঁর জীবনটা নষ্ট হতে বসেছে। সোম সংসারের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে রজনীর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু সেদিকেও কিছু হল না, ডাক্তার ঘটকের প্রবল প্ৰতিদ্বন্দ্বিতায় তিনি হেরে গেলেন। তাই ঈর্ষার জ্বালায়—। ঈর্ষার মতন এমন নীচ প্রবৃত্তি আর নেই। কাম ক্ৰোধ লোভ-ষড়রিপুর মধ্যে সবচেয়ে অধম হচ্ছে মাৎসর্য। একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, মালতী দেবীর অসুখের খুবই বাড়াবাড়ি যাচ্ছে। কারুর মৃত্যু-কামনা করতে নেই, কিন্তু মালতী দেবী যদি সিঁথেয় সিঁদুর নিয়ে এই বেলা স্বর্গারোহণ করেন তাহলে অন্তত আমি অসুখী হব না।
আমিও মনে মনে সায় দিলাম।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment