অলাতচক্র (দ্বিতীয়াংশ)
প্রথমাংশের লিঙ্ক
লেখক: তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
॥ তিন ॥
একটানা এতক্ষণ কথা বলে আদিনাথ চক্রবর্তী একটু থামলেন। বর্ষণমুখর রাত্রির জলভেজা বাতাস ক্রমাগত দুলিয়ে চলেছে ঝুলন্ত লণ্ঠনটা, সেইসঙ্গে দেয়ালে নড়ছে ঘরে বসে থাকা মানুষদের ছায়া। আড্ডায় মাঝে মাঝে একটা সময় আসে যখন হঠাৎ সবাই একসঙ্গে চুপ হয়ে যায়। জমাট গল্পেরও একটা মহিমা আছে। সে গল্প সত্য, মিথ্যা বা অবিশ্বাস্য যাই হোক না কেন, ভাল করে বলতে পারলে শ্রোতারা মুগ্ধ হয়। আদিনাথ কথক হিসেবে প্রথম শ্রেণীর, নিতান্ত তুচ্ছ বিষয়কেও বলার গুণে মনোমুগ্ধকর করে তুলতে পারেন। আজ রাতের পরিবেশ আর তাঁর গল্প এমন খাপ খেয়ে গেল যে, আড্ডাধারীরা কেউ কোনো তর্ক তুলল না। কেবল সরসী চাটুজ্জে বললেন—আপনার ঠাকুমার মৃত্যুবিষয়ে ওই ভবিষ্যৎবাণী মিলে যাওয়াটা অবশ্য আমি খুব আশ্চর্য কিছু বলে মনে করছি না, কারণ এই কথাটা বাড়ির কেউ নিশ্চয় তাঁকে মুখ ফসকে বলে ফেলে থাকবে। ফলে আপনার ঠাকুমা মনের দিক দিয়ে পনেরোই ফাল্গুন তারিখের প্রসঙ্গে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। বয়েস অনেক হয়েছিল, কাজেই ওই বিশেষ তারিখে হয়ত মানসিক উত্তেজনা সামলাতে পারেন নি। তাঁর মনই তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিল দেহরক্ষা করতে। এমন হয়, আমি শুনেছি। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া বিষ্ণুমূর্তি ফিরে পাওয়াটা ব্যাখ্যা করা কঠিন। তাছাড়া সবকিছুর যে ব্যাখ্যা থাকতেই হবে তার কী মানে আছে। কিছু কিছু আবছা আড়াল থাক না, তাতে জীবন সরস হয়ে ওঠে।
রাম গাঙ্গুলি বললেন—সব জিনিসের ব্যাখ্যা হয়ও না। আমার আপন ভায়রাভাই তার মামাবাড়ির গ্রামে নিজের চোখে আঁতুড়ের ছেলেকে হেঁটে বেড়াতে দেখেছে, জানো? সে অত্যন্ত সাত্ত্বিক প্রকৃতির মানুষ, অকারণে মিথ্যে কথা বলবে না। সদ্যোজাত ছেলে—সবে নাড়ি কাটা হয়েছে—সে হাঁটছে আর খিলখিল করে হাসছে। আচ্ছা ভায়রাভাইয়ের কথা না হয় বাদই দাও, আমার ছোটবেলায় আমি এমন একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখেছি যা শুনলে তোমরা বিশ্বাসই করবে না—
পতিরাম মজুমদার আদিনাথের কাহিনী শেষ হলে পরিত্রাণের আশা করেছিলেন, এবং সম্প্রতি বাড়ি ফেরবার উদ্যোগ হিসেবে চাদর কাঁধে ফেলে লাঠির খোঁজ করছিলেন। আর একটা অপ্রাকৃত গল্প শুরু হতে চলেছে দেখে তিনি কাতর স্বরে বললেন—আর নয়, আজ আর নয়! এবার সবাই উঠে পড়া যাক, চল। পথ তো কম নয়, আমায় যেতে হবে সেই পশ্চিমপাড়া। তাছাড়া সরসীভায়ারও তো খাওয়াদাওয়া আছে—
সরসী চাটুজ্জে হেসে বললেন—আমার খাওয়ার এখনো ঢের দেরি। শোনাই যাক না গল্পটা। বাকিদের কী মত?
সকলে বললেন—গল্প হোক! গল্প হোক!
ওমাঃ! বলে হতাশ ভঙ্গিতে পতিরাম দেয়ালে ভর দিয়ে এলিয়ে বসলেন।
রাম গাঙ্গুলি বললেন—আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগের কথা বলছি। তখন আমার বয়েস আর কত হবে, ধর কুড়ি কী বাইশ। সে বয়েসে আমি যে কী ডানপিটে ছিলাম, যারা আমাকে এখন দেখছ তারা ধারণাও করতে পারবে না। পেটের গোলমাল আর হাঁটুর বাত আমাকে অকেজো করে দিয়েছে, নইলে আট-দশ বছর আগেও আমি নিমগাছে উঠে দাঁতন পেড়েছি। যাই হোক ঘটনাটা বলি। আমার কৈশোরের বেশ কয়েকবছর আমাকে মামাবাড়িতে কাটাতে হয়েছিল। দাদামশায় ছিলেন সংস্কৃতজ্ঞ, পণ্ডিত মানুষ। মামারাও সবাই লেখাপড়া জানা। আমার বাবা তখন জরিপ বিভাগে কাজের সূত্রে তরাইয়ের জঙ্গলে কর্মরত। বাড়ির কাছে কোনো ভাল স্কুল নেই, বাবা বছরে দু-একবার ছুটি নিয়ে বাড়ি আসেন। এমন অবস্থায় আমার পড়াশুনো হওয়া কঠিন দেখে মা আমাকে মামাবাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। দাদুর কাছে আমার লেখাপড়ার শুরু। ইংরিজি জানিনে বটে, কিন্তু ব্যাকরণ আর বেদান্তে আমি অল্পবয়েসেই কিছুটা অধিকার অর্জন করেছিলাম। যে বছর পড়া সাঙ্গ করে বাড়ি ফিরে আসি, সে বছর কালীপূজোর সময় আমার এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছিল।
মামাবাড়ির গ্রামের উত্তরে ছিল সুঁটি নদী। নদীর খাত চওড়া, কিন্তু পলি পড়ে তার স্রোত ক্ষীণ হয়ে এসেছিল। দক্ষিণ আর পশ্চিমে বিশাল এক জলাভূমি গ্রামটাকে বাইরের জগৎ থেকে পৃথক করে রেখেছে। প্রায় দ্বীপের মত এই গ্রাম থেকে বাইরে যাবার একমাত্র ভাল রাস্তা পুবদিক দিয়ে। আর একটা পথ জলার ভেতর দিয়ে অনেক ঘুরেফিরে মহকুমা শহরে যাবার পাকা সড়কে পড়েছে বটে, কিন্তু সে পথ বিশেষ কেউ ব্যবহার করে না। নানান ভৌতিক কাহিনীর গুজব চালু ছিল জলাভূমিটা সম্বন্ধে। নরম কাদা, নলখাগড়ার বন, উলুঘাসের আর হোগলার জঙ্গল—আর মাঝে মাঝে এক একটা জায়গায় একটু ঘাসজমি, তাতে একটা-দুটো বড় গাছ, এই নিয়ে সে জলাভূমির বিস্তার। আমি আর আমার প্রাণের বন্ধু তিনকড়ি—সেও ছিল আমারই মত ডানপিটে আর নির্ভীক—এই জলাভূমির মধ্যে বেড়িয়ে বেড়াতাম। সেসব দিনের কথা মনে এলে এখন বুকের মধ্যেটা কেমন করে ওঠে। মাথায় কোনো চিন্তার ভার নেই, কারো সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ নেই, মনে কেবল নির্মল আনন্দ, চোখে অল্পবয়েসের স্বপ্ন। অমন সব দিন আর আসবে না।
সে বছর কালীপূজো পড়েছিল বেশ দেরি করে, কার্তিকের মাঝখান পেরিয়ে। বাতাসে হিমের ছোঁয়া লেগেছে, বিকেলের পড়ন্ত রোদ্দুরে সোনার রঙ সন্ধে নামছে সূর্যাস্তের পরেই। এই পরিবেশে আমাদের দুই বন্ধুর জলাভূমির ভেতর ঘুরে বেড়াতে খুব ভাল লাগত। অনেকসময় দুপুরে খাওয়াদাওয়া করে বেরিয়ে পড়তাম, ফিরতাম রাতের প্রথম প্রহর পার করে। ছোট ছোট ঘাসজমিগুলোতে সরু আলের মত পথ বেয়ে গিয়ে গাছের তলায় শুয়ে বসে গল্প করতাম। সবগুলোতে যাওয়া যেত না, কোনো কোনোটায় যাবার পথ ছিল। ঠিক পথ বলা যায় না, বুড়ো আঙুলে ভর করে ডিঙি মেরে মেরে চলে যেতাম কোনোভাবে। সমস্ত জলাটা আমাদের নখদর্পণে ছিল। বিশেষ মজা হত চাঁদনি রাত্তিরে। ওই জলাজমি, নলখাগড়া আর উলুঘাসের বন, হালকা জ্যোৎস্নায় বড় বড় গাছের ছায়া—সব মিলিয়ে রূপকথার রাজ্য তৈরি করত। আর ওই বয়েস—বুঝতেই পারছ, জীবনে তা একবারই আসে। যেন মেঘের ওপর ভেসে বেড়াতাম তখন।
কালীপূজোর ঠিক আগের দিন, সেদিন ভূতচতুর্দশী, তিনকড়ি সকালের দিকে আমাকে এসে বলল—রাম, চল আজ বিকেলে জলার ভেতর বেড়াতে যাই। একেবারে সন্ধের পর একটু রাত্তির করে ফিরব। আজই রাত্তিরে অমাবস্যা লাগবে, এত অন্ধকারে কখনো ওখানে বেড়াই নি। পথঘাট তো সবই আমাদের চেনা। যাবি?
সত্যিই, পুরো জলাভূমিটা আমরা নিজেদের হাতের তালুর মত চিনতাম। সন্ধে হয়ে গেলেও অসুবিধের কোনো কারণ নেই। আমি রাজি হয়ে গেলাম।
একটু পড়ন্ত বেলায় আমরা বেরিয়ে পড়লাম। গ্রাম ছাড়িয়ে আরো মাইলখানেক হেঁটে এসে পড়লাম জলাভূমির প্রান্তে। তখন সূর্য অস্ত গিয়েছে, দিনের আলো মিলিয়ে গিয়ে নামছে আবছায়া অন্ধকার। তিনকড়িকে বললাম—হ্যাঁরে ভেতরে ঢুকবি? নাকি এইখানে বসে কিছুক্ষণ গল্প করে ফিরে যাই চল—
তিনকড়ি হেসে বলল—কেন, ভয় করছে বুঝি?
—যাঃ, ভয় কীসের? আজ অমাবস্যা পড়ছে, একেবারে অন্ধকার হয়ে যাবে কিন্তু—
—তার মানেই তো ভয় পাচ্ছিস। দূর, চল দেখি। অন্ধকারেই তো মজা। আয়—
এরপর না গিয়ে উপায় থাকে না। ঢুকলাম জলার ভেতরে। চারদিকে প্রায় মাথা ছাড়িয়ে উঠেছে হোগলার ঝোপ। বোধহয় সেইজন্যই সেখানে অন্ধকার নামছে একটু : তাড়াতাড়ি। হালকা ধোঁয়ার মত একটা অস্পষ্ট কুয়াশা ঘনাচ্ছে। হেমন্তকালের শুরু, এই সময়ে সন্ধেবেলা বাতাস বয় না, কিন্তু লম্বা ঝোপগুলোর মধ্যে বাতাস বয়ে যাওয়ার মত একটা শিঁ শিঁ আওয়াজ হচ্ছে। সেটা অবশ্য আমার মনের ভুলও হতে পারে। খুব নির্জন জায়গায় কানের ভেতর রক্ত চলাচলের শোঁ শোঁ শব্দ শোনা যায়, মনে হয় শব্দটা যেন বাইরে থেকে আসছে।
ভয় ঠিক করছিল না, কিন্তু অন্যদিন জলার ভেতরে ঘুরে বেড়াবার সময় মনে যে সহজ ফুর্তির ভাব থাকে সেটা অনুভব করছিলাম না। পরিবেশে কেমন যেন বিষন্ন ভাব, কী একটা যেন ঘটতে চলেছে, সমস্ত জায়গাটা তার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে। মনে পড়ল আজ ভূতচতুর্দশী, দুপুরে চোদ্দশাক ভাজা দিয়ে ভাত খেয়েছি। এতক্ষণে বাড়িতে দিদিমা চোদ্দ পিদিম দেবার জন্য প্রদীপ গোছাচ্ছেন, সলতে পাকাচ্ছেন। দিদিমা বলতেন—ভূতচতুর্দশীর দিন সন্ধের পর চোদ্দজন ভূত বাতাসে ভর করে পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায়, তাদের খপ্পরে পড়লে ভারি মুশকিল। এদিন অন্ধকার নামার পর আর কোথাও যাবিনে, ঘরে থাকবি। ভূতেদের নামও বলতেন—আরমুই, ছারমুই, পোড়ামুই, অন্তাই, দন্তাই, খন্তাই, বরী, ঠরী—আরো কী কী যেন, সবগুলো মনে পড়ছে না। বাড়িতে বসে এসব শুনলে হাসি পায়, এখানে গা ছমছম করে।
কিছুদূর হাঁটবার পর বাঁদিকে একটা সরু পথ ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে ঢুকেছে। দুদিকে জল-কাদা আর নরম ভসভসে জমি, মাঝখানে আট-দশ আঙুল চওড়া একটু পথ জেগে রয়েছে। জলার মধ্যে কয়েকটা ঘাসে ছাওয়া জমির টুকরো দ্বীপের মত জেগে আছে তা তো আগেই বলেছি। এই পথটা তেমন একটা দ্বীপে গিয়ে শেষ হয়েছে। আমরা সাবধানে পা ফেলে ঘাসজমিটায় গিয়ে হাজির হলাম। তখন দিনের আলো পুরোপুরি নিভে রাত্তির নেমেছে।
দ্বীপটা লম্বায় কুড়ি হাত, চওড়ায় পনেরো হাত মত হবে। মাঝখানে একটা বড় গাছ ঠেলে উঠেছে ওপরদিকে। তার মোটা গুঁড়িতে হেলান দিয়ে তিনকড়ি বসল, আমি বসলাম মুখোমুখি। অমাবস্যার রাত্তিরেও নক্ষত্রদের থেকে চুঁইয়ে আসা ক্ষীণ একটু আলোর আভাস থাকে, সে আলো অন্ধকার দূর করে না, পরিবেশকে আরো রহস্যময় করে তোলে।
তিনকড়ি বলল—আয়, নিধুবাবুর একখানা গান ধরা যাক। সেই যে গানটা—যে যাতনা যতনে, আমার মনই জানে। গাইবি? নে, শুরু কর—
আমার গাইতে ইচ্ছে করছিল না। তিনকড়ি বেশ ভাল গান জানত, সে একাই গান ধরল। হঠাৎ আমার মনে হল তিনকড়ি আসলে ভয় পেয়েছে। প্রথমে সাহস দেখিয়ে এখন সে ভয়টা স্বীকার করতে লজ্জা পাচ্ছে। গান গাওয়াটা প্রকৃতপক্ষে তার ভয় কাটানোর চেষ্টা। কিন্তু কেন ভয় পেল তিনকড়ি? পরিবেশের অস্তুত বিষণ্ণতা আর দমচাপা ভাবটা কি সে ধরতে পেরেছে?
দু-একলাইন গাইবার পর তিনকড়ি থেমে গিয়ে আমাকে বলল—গতকাল এই জলার দিকে অনেক রাত্তিরে একরকম আশ্চর্য আলো দেখতে পাওয়া গিয়েছে, জানিস?
—আলো? কী রকম আলো? এতক্ষণ বলিসনি তো—
—এমনিই বলিনি। আমাদের গ্রামের অনেকেই দেখেছে। আজ সকালে মধু মিত্তির, হারাধন মজুমদার আর বিশু খুড়ো আলোচনা করছিল পথে দাঁড়িয়ে, তাই শুনছিলাম।
—কী বলছিল? নিজেরা দেখেছে?
—মধু মিত্তির আর বিশু খুড়ো দেখেছে। নীলচে মত আলো, আকাশ থেকে গোলার মত নেমে এসে মাটির কাছে দপ করে জুলে উঠে অনেকখানি জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল। হারাধন মজুমদার বলছিল কাল রাতে এই জলায় ডাইনিদের চাতর বসেছিল—
—সে আবার কী?
—চাতর মানে আসর। দুর দূর দেশ থেকে ডাইনিরা গাছ চালিয়ে উড়ে আসে। তারপর সারারাত ধরে তাদের সভা চলে। ওই সভাকেই বলে চাতর। গাছ-চালা কাকে বলে জানিস তো? কোনো বড় গাছের ডালে বসে ডাইনিরা হুকুম করে—অমুক জায়গায় চল। আমনি সে গাছ আকাশে উড়ে সেই জায়গায় গিয়ে হাজির হয়। উড়তে উড়তে গাছ যখন মাটির কাছে নেমে এসে লেগে বসে, তখন ওইরকম দপ করে নীল আলো জ্বলে ওঠে। আমি অবশ্য এসব বিশ্বাস করি না-ওরা বলছিল, আমি শুনলাম—এই আর কী। বিশু খুড়ো আবার সন্ধের পর আফিং খায়। বুঝতেই পারছিস—
কথা বলতে বলতে হঠাৎ চুপ করে তিনকড়ি একবার ওপরদিকে তাকাল, কী একটা জিনিস যেন তার মনে পড়ে গিয়েছে। তারপর সোজা হয়ে বসে পেছন ফিরে সে গাছটায় হেলান দিয়ে দিল, তার মোটা গুঁড়িতে একবার হাত বোলালো। এবার সে ঘুরে আমার দিকে যখন তাকাল, সেই অল্প আলোতেও দেখলাম তার মুখ শুকিয়ে গিয়েছে, ভয় পেলে মানুষের যেমন হয়।
বললাম—কী রে, কী হল তোর? নিজের গল্পে নিজেই ভয় পেলি নাকি? ফিসফিস করার মত গলায় তিনকড়ি বলল—রাম, এই গাছটা কোথা থেকে এল? এটা তো আগে কখনো দেখিনি। তাছাড়া কী গাছ এটা?
এবার আমিও অবাক হয়ে গাছটার দিকে তাকালাম! সত্যিই তো, এই জমির টুকরোটায় মোটামুটি বড় গাছ বলতে একটা গাব আর একটা মাঝারি তেঁতুল গাছ বরাবর দেখে এসেছি। সে দুটো তো ওই যথাস্থানে দেখা যাচ্ছে। তাহলে বাড়তি এটা আবার কোথা থেকে এল? গাছটাই বা কী জাতের? আমরা গ্রামের ছেলে, সবরকম গাছই চিনি। বড় বড় শালগাছের মত পাতাওয়ালা এটা কোন গাছ? মাটি থেকে বিরাট মোটা গুঁড়ি সোজা আকাশের দিকে উঠেছে, বিশেষ জটিল ডালপালা নেই। অনেকটা ওপরে কিছু শাখাপ্রশাখা এদিক-ওদিক ছড়িয়েছে, তাতে থালার মত বড় বড় গোল গোল পাতা। দেখলেই মনে হয়—এ বাংলাদেশের গাছ নয়!
তিনকড়ি একইরকম ভয় পাওয়া গলায় বলল—ভেবে দেখ, দিনসাতেক আগেও এখানে বসে আমরা আড্ডা দিয়ে গিয়েছি, এই গাছটা তো দেখিনি। এখানে কেন, গ্রামের ত্রিসীমানায় এমন গাছ দেখেছিস কখনো? এ হল ভিনদেশের গাছ—
তারপর কাঁপাকাঁপা গলায় বলল—রাম, বিশু খুড়োরা ঠিকই দেখেছিল। এখানে ডাইনির চাতর হয়েছে কাল। এই গাছ তারাই উড়িয়ে এনেছে। চল, আমরা এখান থেকে চলে যাই—
কী করে যে ফিরে এলাম তা আর তোমাদের কী বলব! চেনা জায়গা, ছোটবেলা থেকে খেলা করে মানুষ হয়েছি ওই জায়গায়, কিন্তু সেদিন যেন কেবলই পথ হারিয়ে ফেলতে লাগলাম। যেদিকেই যাই, দেখি বেরুবার পথ নেই। রাস্তা আবার ঘুরে একই বিন্দুতে এসে হাজির হয়েছে। রীতিমত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, বুঝলে? অত্যন্ত আবছা তারার আলো, লম্বা ঘাসের জঙ্গল, একটু পা ফেলতে ভুল হলেই কোমর পর্যন্ত কাদায় গেঁথে যাবার সম্ভাবনা, তার সঙ্গে হেমন্তকালের অস্বচ্ছ কুয়াশার পাক খাওয়া—সব মিলিয়ে যেন একটা ভয়ের স্বপ্ন। কোনোরকমে জলাভূমির বাইরে শক্ত জমিতে এসে যখন পা দিলাম তখন আমরা দুজনেই ঘামছি।
হনহন করে হেঁটে প্রায় যখন গ্রামে পৌঁছে গিয়েছি, একবার কেন যেন তিনকড়ি পেছন ফিরে তাকাল। তারপরেই থমকে দাড়িয়ে গিয়ে আমাকে বলল—দেখ রাম, দেখ! কী কান্ড!
তাকিয়ে দেখলাম সেদিকে আকাশটা অদ্ভুত নীল রঙে ভরে গিয়েছে। তীব্র আলো নয়, মৃদু জ্যোৎস্নার মত আভা। আর তার মধ্যে দিয়ে কী একটা জিনিস যেন জলার ভেতর থেকে উঠে আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে। ভাল করে বুঝতে না বুঝতে জিনিসটা আলোর পরিধির বাইরে চলে গেল। আমরা দুজন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। আলোটাও একটু একটু করে ম্লান হয়ে শেষে মিলিয়ে গেল।
গ্রামে ঢুকে দেখলাম বেশ হই চই শুরু হয়ে গিয়েছে, অনেক মানুষ বেরিয়ে এসেছে বাইরে। কে যেন গাড়ু হাতে মাঠে যাবার সময় দক্ষিণ-পশ্চিম দিগন্তে নীল আলোটা দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে লোকজন ডাকে। একেবারে মিলিয়ে যাবার আগে অন্তত সাত আটজন মানুষ দেখেছে আলোটা। যারা পরে বেরিয়েছে, তারা এখন প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে বিবরণ শুনছে। বিশু ভটচাজ বলছেন—পরপর দুদিন। আর নিশ্চয় তোমরা অবিশ্বাস করবে না—এখন তো নিজের চোখে দেখলে? কালকেই তোমরা বলেছিলে আমি আফিঙের ঝোঁকে খেয়াল দেখেছি। আজ নিশ্চয় আর তা বলবে না? আগামীকাল কালীপূজা, রক্ষেকালীর মন্দিরে ভাল করে পূজো দাও সবাই। এসব ভাল লক্ষণ নয়—
রঘু চৌধুরী বললেন—ঠিকই। আজ হচ্ছে ভূতচতুর্দশী—ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি আজ সন্ধের পর থেকে প্রেতের দল বাতাসে মিশে ঘুরে বেড়ায়। তোমরা তো কেউ আজকাল কিছু মানো না, আধুনিক যুগ এসেছে, শহরে শুনছি তেলের বদলে গ্যাসের আলো জ্বলছে রাস্তায়। এখন বুঝে দেখ বুড়োদের কথা সত্যি না মিথ্যে—
এই গোলমালে কেউ খেয়াল করেনি আমরা বাইরে থেকে এসে গ্রামে ঢুকেছি। নইলে বকাঝকা খেয়ে মরতে হত। পরের দিন কালীপূজো, কথা রইল তিনকড়ি আর আমি বিকেল তিনটে নাগাদ রক্ষাকালীর মন্দিরের সামনে দেখা করব।
পরের দিন যথাসময়ে মন্দিরের সামনে গিয়ে দেখি তিনকড়ি আমার আগেই এসে হাজির হয়েছে। মন্দিরে আজ সারারাত ধরে পূজো হবে, তার প্রস্তুতি চলেছে পুরোদমে। তিনকড়ি আমাকে একদিকে টেনে নিয়ে গিলে বলল—রাম, চল আমরা জলার দিকটা আজ একবার ঘুরে আসি। দিনের বেলা তো কোনো ভয় নেই। কাল কী দেখতে কী দেখেছি—
—নীল আলোটা তো সত্যি। আমরা ছাড়াও গ্রামের কত লোকে দেখেছে—
একটু ভেবে তিনকড়ি বলল—তবু চল যাই। বেলা থাকতে থাকতে ফিরে আসব।
গতকাল অত ভয় পেয়েছিলাম, আজই আবার সেখানে রওনা হলাম দুজন মিলে। সেই বয়েসে সবই সম্ভব ছিল। তাছাড়া ঝকঝকে সূর্যের আলোয় অপ্রাকৃত ভয় থাকে না। জলার ভেতরে ঢুকে আজ প্রথমেই যেটা অনুভব করলাম তা হ’ল—কাল রাত্তিরের সেই দমবন্ধ-করা ভয়ের পরিবেশটা আর নেই। কেবল দিনের আলো রয়েছে বলে নয়, অমঙ্গলের প্রভাবটাই ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। বাঁদিকের সরু পথটা দিয়ে হোগলাবনে ঢুকে ঘাসজমির দ্বীপে পৌছে আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।
বড় গাছটা সেখানে নেই।
নেই মানে একেবারেই নেই। আমরা এগিয়ে গিয়ে জমি পরীক্ষা করে দেখলাম। বড় একটা গাছ উপড়ে ফেললে তো সেখানে তার চিহ্ন থাকবে, মাটিতে তার গর্ত থাকবে—কিচ্ছু নেই। দিব্যি সমান ঘাসে ছাওয়া জমি। গেল কোথায় অত বড় গাছটা? যেভাবে এসেছিল সেভাবেই কি ফিরে গিয়েছে? ওই গাছটাকেই কি কাল রাত্তিরে আমরা আকাশে উঠে যেতে দেখেছিলাম?
বললাম—তিনু, কাল আমরা আলো-আঁধারিতে ভুল দেখিনি তো? হয়ত গাছ-টাছ কিছু ছিল না, সবটাই আমাদের চোখের ভুল। হতে পারে তো, তাই না?
তিনকড়ি দৃঢ় গলায় বলল—না, হতে পারে না। কারণ আমি গাছটায় হেলান দিয়ে বসেছিলাম। জিনিসটার বাস্তব ছোঁয়া পেয়েছি। তাছাড়া—
শার্টের পকেট থেকে একটা সবুজরঙের ভাঁজকরা কী জিনিস বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল—তাছাড়া এইটে। এইটে তো আর মিথ্যে নয়, চোখের ভুল নয়—
গতকাল রাত্তিরে দেখা ভূতুড়ে গাছের একখানা পাতা।
তিনকড়ি বলল—কী ভেবে একখানা পাতা পকেটে রেখে দিয়েছিলাম। নিচেই পড়ে ছিল।
আমরা দুজনে মিলে অনেক খুঁজলাম। নাঃ, আর একটাও পাতা পড়ে নেই। সমস্ত চিহ্ন নিয়ে গাছটা মিলিয়ে গিয়েছে? কেবল তিনকড়ির রেখে দেওয়া পাতাটা ছাড়া। গ্রামে ফিরে এসে অনেককে পাতাটা দেখিয়েছিলাম, কেউ চিনতে পারেনি। বহুবছর বাদে অবশ্য জানতে পেরেছিলাম ওটা কী গাছের পাতা। কাশী গিয়েছিলাম বিশ্বনাথ দর্শন করতে। একদিন সেখান থেকে দেবী মহাকালীর পূজো দিতে গিয়ে পাহাড়ের কোলে জঙ্গলের মধ্যে ওই গাছ দেখি। যে পাণ্ডা আমাদের সঙ্গে ছিল, তাকে জিজ্ঞাসা করতে সে বলল—ওই বড় গাছটা? ওর নাম বাবু বুদ্ধ নারিকেল। বিহার আর উত্তরপ্রদেশের জঙ্গলে দেখা যায়---
বললাম—বাংলাদেশে হয় না?
—না বাবু। শুকনো পাথুরে মাটি ছাড়া বুদ্ধ নারিকেল জন্মায় না।
পরে অনেককে জিজ্ঞাসা করে জেনেছি সত্যিই ওই গাছ বাংলায় হয় না। পাণ্ডার কথা শুনে আমার মনে পড়ে গেল ফেলে আসা প্রথম যৌবনের স্মৃতি। সেই মামাবাড়ির গ্রাম, ভূতচতুর্দশীর নিকষ কালো রাত, বন্ধু তিনকড়ি। সব কোথায় মিলিয়ে গিয়েছে। মামারা কেউ আর বেঁচে নেই, তাদের ছেলেপুলেরাও একজন ছাড়া সবাই জীবিকার সন্ধানে ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন জায়গায়। আর কখনো সে গ্রামে যাইনি। তিনকড়িও এখন কোথায় আছে কে জানে। অনেকদিন তার সঙ্গে যোগাযোগ নেই।
রাম গাঙ্গুলির গল্প শেষ হতে সবাই কিছুক্ষণ চুপ, তারপর পতিরাম মজুমদার বললেন —সরসী ভায়া, এবার কিন্তু আমাকে উঠতেই হবে। কিন্তু এরপর তো আর একা যেতে পারব না, গা ছমছম করবে। তুমি বলেছিলে তোমার লোক সঙ্গে যাবে, তাই একজন কাউকে দাও। ঠাট্টা করলে কর ভাই, আমি অপারগ—
সরসী চাটুজ্জে বললেন—কেউ ঠাট্টা করছে না, লোক দিচ্ছি সঙ্গে।
আদিনাথ চক্রবর্তী বললেন—ওঠবার আগে আমার কাহিনীর শেষটা বলি—
পতিরাম বললেন—এখনো শেষটা বাকি!
—ভয় নেই, দুটো কথা মাত্র। অমর বিষ্ণুমূর্তি খুঁজে দিয়ে গিয়েছিল, ঠাকুমার মৃত্যুর পর তার ভবিষ্যৎবাণী যে সত্যি সে কথা জানান দিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার তৃতীয় ভবিষ্যৎবাণীটাও যে সত্যি, সেটা বুঝতে পেরেছিলাম অনেক পরে। সে বলেছিল আমাদের বংশে একজন অদ্ভুত চরিত্রের উদাসীন সাধকের জন্ম হবে। সংসারী হয়েও সে বৈষয়িক হবে না। কবে, কোথায় কার ঘরে তার জন্ম হবে সেটাই কেবল সে বলেনি। শুধু বলেছিল এই শিশুর জন্মের মুহুর্তে আশ্চর্য এক নীল উল্কাপাত হবে আকাশে। তা দেখলে আমরা বুঝতে পারব।
বহুদিন পরে, তখন ছোটবেলার এ কাহিনী প্রায় ভুলেই গিয়েছি, আমার তৃতীয় ছেলের জন্মের সময় আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত এক বিশাল নীল রঙের আলো ছড়ানো উল্কা ছুটে গেল। একজন দাই আঁতুড়ঘর থেকে উঠোন পেরিয়ে গরমজল আনতে যাচ্ছিল ভেতরবাড়িতে, তার চিৎকারে সকলে উঠোনে বেরিয়ে এসে দৃশ্যটা দেখলাম। সচরাচর অতক্ষণ ধরে উল্কা জ্বলতে জ্বলতে অতটা আকাশ পার হয় না। সেই আলো মিলিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমার ছেলের জন্ম। তার নাম তারানাথ। তারানাথ চক্রবর্তী।
আদিনাথের এক ছেলে ছোটবেলা থেকেই সংসারত্যাগী। মাঝে মাঝে বাড়ি আসে, আবার কোথায় চলে যায়। এটা তার জীবনের গভীর ব্যথার জায়গা। আড্ডাধারীরা সেকথা জানেন বলে চুপ করেই রইলেন। আদিনাথ বললেন—এখন তার বয়েস বাইশ কী তেইশ। কোথায় আছে কে জানে। বছরখানেক আগে একবার সাতদিনের জন্য এসেছিল, তারপর আবার নিরুদ্দেশ। ছেলে আমার খুবই ভাল, চমৎকার সংস্কৃত জানে, পণ্ডিতেরা তার সঙ্গে পেরে ওঠে না। কোথা থেকে শিখল সে এক রহস্য। স্কুল-কলেজে তো কখনো পড়েনি। দোষের মধ্যে ওই এক—বাড়িতে মন বসে না। জানি না আবার কবে তার দেখা পাব।
আডডাধারীরা তারানাথকে দেখেছেন। আট-দশ বছর আগে সে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। তার আগে অবধি এই গ্রামেই সে মানুষ হয়েছে। সমবেদনাসূচক নীরবতা পালন করা ছাড়া তাদের কিছু করবার নেই।
আদিনাথ বললেন—যাক, আমার ভাগ্য। আপনারা আশীর্বাদ করুন, যেখানেই থাকুক, সে যেন ভাল থাকে।
॥ চার ॥
এতক্ষণ এ গল্প শুনছিলাম তারানাথের মুখে।
মট লেনে তারানাথের বাড়িতে আমাদের চিরাচরিত আডডা বসেছে। আজ ছিল জন্মাষ্টমীর ছুটি। দুপুরের পরেই কিশোরী সেন আর আমি গল্পের লোভে হানা দিয়েছি তারানাথের বৈঠকখানায়। চারির বিয়ে হয়ে যাবার পর তারানাথ বোধহয় মনের দিক দিয়ে একটু অসহায় হয়ে পড়েছে। মেয়েরা বাপের যতখানি সেবা করে, ছেলেরা ততটা পারে না। মেয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবার পর তারানাথের মুখচোখে একটা ভরসা-হারা ভাব ফুটে ওঠে মাঝে মাঝে। আমরা বুঝতে পারি, কিন্তু তা নিয়ে আলোচনা করি না। কী হবে প্রৌঢ় মানুষের মনে বিষন্নতার বোঝা বাড়িয়ে?
আজ তারানাথের বাড়িতে গিয়ে কড়া নাড়তে দরজা খুলে দিল চারি। অবাক হয়ে বললাম—একি রে! কবে এসেছিস তুই? গত হপ্তাতেও তো আমরা এসে গল্প করে গিয়েছি, তোর বাবা তো বলেন নি তুই আসবি।
হাসিমুখে চারি বলল—না কাকাবাবু, আসার কথা ছিল না, গতকাল হঠাৎ এসে পড়েছি। ব্যবসার কাজে আপনাদের জামাইকে কলকাতা আসতে হ’ল, আমি ধরে পড়লাম—আমিও যাব। তাই—
বললাম—জামাই তোর কথা সব খুব মান্য করে, তাই না?
চারি সলজ্জ হেসে মুখ নিচু করল। সে চিরকালই সপ্রতিভ, কিন্তু প্ৰগলভা নয়। ছোটবেলা থেকে তাকে দেখছি, কন্যার মত স্নেহ জন্মে গিয়েছে তার ওপর। আগে আগে তার জন্য লেসের ডিজাইন, ছবিওয়ালা গল্পের বই ইত্যাদি নিয়ে আসতে হত। গতবছর ভাল ঘরে-বরে বিয়ে হয়েছে চারির। স্বামী মাঝারি ধরনের ব্যবসা করে, বিশাল ধনী নয়, কিন্তু সচ্ছল অবস্থা। ছেলেটিও ভাল, বিনয়ী এবং সচ্চরিত্র। এত ভাল পাত্রে মেয়ের বিয়ে দেবার ক্ষমতা তারানাথের ছিল না, কিন্তু চারি সুন্দরী বলে দেনাপাওনা কোনও বাধা হয়নি।
চারি বলল—আপনারা ভাল আছেন তো কাকাবাবু? আসুন, ভেতরে এসে বসুন।
একটু পরেই তারানাথ বাড়ির ভেতর থেকে বৈঠকখানায় এসে বসল। তার মুখ আজ উজ্জ্বল, গত একবছরের ম্ৰিয়মাণ ভাবটা কেটে গিয়েছে। সে বলল—এসো হে দুই মূর্তি, আজ ছুটির দিন, আমি জানতাম তোমরা আসবে। তোমাদের বউদিদি ক্ষীরের মালপোয়া করেছেন, খেয়ে যাবে—
কিশোরী বলল—চারি এসেছে, বাড়ির চেহারাই দেখছি বদলে গিয়েছে। সত্যিই, মেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে এলে মনে খুব আনন্দ হয়, তাই না?
—ঠিক। তাও এখন তো বুদ্ধি দিয়ে বুঝছ, আমার বয়েসে এলে হৃদয় দিয়ে বুঝবে। যথাসময়ে চারি চা নিয়ে এল। আজ সব একদম সময়মাফিক ঠিকঠাক চলছে। আমরা আসবার সময় মোড়ের দোকান থেকে কিনে আনা তারানাথের প্রিয় সিগারেট পাসিং-শো এর প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিলাম। এটা না হলে তারানাথের গল্পের মেজাজ আসে না। নানারকম কথা হতে হতে নিজের ছোটবেলার গল্প বলতে আরম্ভ করল তারানাথ। সাধারণত সে নিজের পুরনো জীবন সম্বন্ধে কিছু বলতে চায় না, অন্তত সাধারণ পারিবারিক তথ্যগুলো আলোচনা করে না। বেছে বেছে কেবল অদ্ভুত আর অলৌকিক অভিজ্ঞতার গল্প শোনায়। আজ হঠাৎ কিশোরী জিজ্ঞাসা করল—আপনি তন্ত্রসাধনার উৎসাহ বা প্রেরণা পেলেন কোথা থেকে? আপনার পূর্বপুরুষদের মধ্যে কি কেউ তন্ত্রসাধক ছিলেন? মানে আমি বলতে চাইছি যে, এর ধারাটা কি পরিবারে আগে থেকে ছিল?
সিগারেটের দগ্ধাবশেষ ছাইদানি হিসেবে ব্যবহৃত নারকেলের মালায় গুঁজে দিতে দিতে তারানাথ বলল—তা বলতে পার। একেবারে রক্তাম্বরধারী তান্ত্রিক কেউ না থাকলেও বাপ-ঠাকুর্দা-প্রপিতামহের ভেতর অনেকেই রীতিমত সাধকশ্রেণীর মানুষ ছিলেন। আমার আপন ছোট ঠাকুর্দা, মানে বাবার ছোটকাকা—তিনি কৈশোরেই গৃহত্যাগী হয়ে চলে গিয়েছিলেন। তাছাড়াও আমাদের পরিবারে নানাসময়ে নানান আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে, যার কোনও ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। আর কিছু কিছু তো তোমাদের বলেছি।
বললাম—আপনার ছোট ঠাকুর্দা আর কখনো সংসার জীবনে ফিরে আসেন নি?
—না। তবে একবার তার সংবাদ পাওয়া গিয়েছিল। সেও এক বলবার মত গল্প—
—বলুন না, আজকের আসর সেইটে দিয়েই শুরু হোক।
তারানাথ বলল—এ কাহিনী আমার বাবার কাছে শোনা। বাবা খুব সুন্দর করে গুছিয়ে গল্প বলতে পারতেন—এ বিষয়ে তাঁর নাম ছিল। আমাদের গায়ের সরসী চাটুজ্জের বৈঠকখানায় সন্ধেবেলা রোজ জমাট আড্ডা বসত, বাবা ছিলেন সে আড্ডার প্রধান কথক। মেজাজ ভাল থাকলে বাড়ি ফিরে সেদিন কী গল্প হল আমাদের শোনাতেন। তারপর তো আমিও অল্পবয়েসে বাড়ি থেকে উধাও হলাম। মাঝে মাঝে বাড়ি ফিরে আসি, তবে সে খুব কম। তিন-চার বছরে একবার কী দুবার। ওই ভবঘুরেমির সময়টা আমার যে কী সুন্দর কেটেছে তা আর কী বলব! কোনও পিছুটান নেই, দায়দায়িত্ব নেই, কেবল বিরাট এই পৃথিবীর পথে পথে ঘুরে বেড়ানো। বাইরে থেকে দেখলে এটা হয়ত স্বপ্নদর্শী অলসের জীবনযাত্রা বলে মনে হবে, যে বাস্তব জগতের থেকে পালিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রয়েছে। কিন্তু ব্যাপারটা অত সোজা নয়। আত্মীয়হীন, বন্ধুহীন দুনিয়ায় সম্পূর্ণ সম্বলহীন অবস্থায় ভেসে পড়তে হলে খুব সাহসের দরকার। কে খেতে দেবে ঠিক নেই, কোথায় থাকব তার কিছু ঠিক নেই, মন্দিরের চাতালে, পোড়ো বাড়ির বারান্দায় ঝড়ে-বৃষ্টিতে রাত কাটিয়েছি। কত অদ্ভুত চরিত্রের লোক দেখেছি, তাদের মধ্যে কেউ প্রকৃত সাধক, কেউ নৃশংস কাপালিক, কেউবা জুয়াচোর। কত সময়ে অসুখ করেছে, প্রবল জ্বরে পথের ধারে গাছতলায় পড়ে কষ্ট পেয়েছি, জলতেষ্টায় বুক ফেটে গিয়েছে, কিন্তু জল দেবার কেউ ছিল না। মরেও যেতে পারতাম। সেক্ষেত্রে বাড়িতে কোনও খবরও পৌঁছত না। তবু কখনো ভয় হয়নি। মৃত্যুকে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে দেখিনি, দেখেছি ঈশ্বরের তৈরি এই জগতের একটা অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে। যে পরিণতিতে ভয়ের কিছু নেই, আছে স্রষ্টার অপার করুণা।
এই পর্বেই বীরভূমের শ্মশানে মাতু পাগলীর সঙ্গে পরিচয়, বরাকর নদীর ধারে নির্জন শালবনে মধুসুন্দরী দেবীর আবির্ভাব দেখতে পাওয়া। ওঃ, সেসব কী উত্তেজনাপূর্ণ দিন গিয়েছে। মনে হয়েছিল বুঝিবা সৃষ্টির সব রহস্য জেনে ফেলব, সাধনার তীব্রতায় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নিয়মকানুন ধরা দেবে আমার চেতনায়—
কেমন অন্যমনস্ক হয়ে থেমে গেল তারানাথ। বললাম—কেন, অনেক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা তো হয়েছে—
—তা হয়েছে। যা পেয়েছি তা একজন সাধকের একটা জীবনের পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু আসলে তো কিছুই জানা হল না। এই জগতের মানে কী, কী করে এই চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্র সৃষ্টি হল, না হলেই বা কী এসে যেত, সেই ভেতরের আসল কারণগুলো সব অজানা থেকে গেল। এখন মনে হয়—
আবার থেমে গেল তারানাথ। কী ভাবতে লাগল।
জিজ্ঞাসা করলাম—কী মনে হয়?
—মনে হয় সৃষ্টির গভীরতম কারণটা ঈশ্বর মানুষের কাছ থেকে চিরদিনের জন্য আড়াল করে রেখেছেন। সে রহস্য জানতে পারলে সৃষ্টির আর কোনও সার্থকতা থাকবে না। গোলোকধাম খেলেছ তো? সেই যে কড়ি চেলে, কাগজে ছাপা ছকের ওপর গুটি এগিয়ে খেলা। জন্ম থেকে শুরু হয়ে বিদ্যালয়, কর্মক্ষেত্র, আদালত, পতিতালয়, শৌণ্ডিকালয়, মন্দির ইত্যাদির খোপে আঁকা ঘর পেরিয়ে খেলুড়েকে একটু একটু করে ওপরে উঠতে হয়। সবচেয়ে ওপরের খোপের নাম হচ্ছে গোলোকধাম। সেখানে পৌঁছলেই খেলা শেষ। তারপর ছক আর গুটি তুলে ফেলা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। আমাদের জীবনেও তাই। সবকিছু জেনে ফেললেই খেলা শেষ। সেটা ভগবান চান না। তা একদিক দিয়ে ভালই, খেলা চলছে চলুক না।
দেখলাম তারানাথ গল্প থেকে দর্শনের দিকে সরে যাচ্ছে। বললাম--তারপর যে কথা বলছিলেন, আপনার অল্পবয়েসের গল্প, সেটা বলুন—
তারানাথ বলল—একবার বাঁকুড়ার ইন্দাস অঞ্চলে ঘুরে বেড়াচ্ছি, সারাদিন হাটেমাঠে ঘুরি, রাত্রে যেখানে হোক আশ্রয় নিই। সেদিন বিকেল থেকেই আকাশে মেঘের ঘনঘটা, বেশি পথ না হেঁটে আলো থাকতে থাকতে একটা ছোট গ্রামের সীমানায় শিবমন্দিরের চাতালে আশ্রয় নিয়েছি। বেশ বড় চওড়া চাতাল, আট-দশটা থামের ওপর ছাদ রয়েছে। কাজেই ওপরটা ঢাকা, বৃষ্টি হলেও ভিজতে হবে না। গায়ে উড়ুনি, পায়ে খড়ম এক পৈতেধারী বুড়োমত লোক দেখি মন্দিরের সিঁড়ি দিয়ে নেমে কোথায় যাচ্ছে। মনে হল এখানকার পূজারী। এগিয়ে গিয়ে বললাম—আজ্ঞে, এখানে রাত্তিরটা একটু থাকা যাবে?
লোকটি একান্ত নীরস এবং অমিশুক প্রকৃতির। কিছুক্ষণ আপাদমস্তক আমাকে ভাল করে দেখে সে শুকনো গলায় বলল—থাকতে ইচ্ছে হলে থাকো, আমাকে জিজ্ঞাসা করার কী প্রয়োজন?
—না, ভাবলাম আপনিই বোধহয় এ মন্দিরের পূজারী। কাজেই আপনার অনুমতি নেওয়াটা—
—কিছু দরকার নেই। আমি এখানকার পূজারী বটে, কিন্তু নাটমন্দিরে যে কোনও যাত্রী আশ্রয় নিতে পারে। তবে এখানে অতিথিশালা নেই, খাবারদাবার দেবার ব্যবস্থাও নেই। থাকার মধ্যে ওই নাটমন্দির, থাকতে চাইলে থেকে যাও।
—আপনি কোথায় থাকেন?
বৃদ্ধ আমাকে কড়া চোখে তাকিয়ে দেখল, তারপর বলল—কেন বল তো?
—না, তাই জিজ্ঞেস করছি—
—আমি এই গ্রামেরই ভেতরে থাকি। কিন্তু আমাদের বাড়িতে স্থানাভাব, সেখানে আশ্রয় দিতে পারব না।
হেসে বললাম—আপনার আশ্রয়ে থাকার চেয়ে গাছতলায় থাকা ভাল। ভয় নেই, থাকতে চাইব না, কথাটা এমনিই জিজ্ঞেস করেছিলাম। গাছপালারা অন্তত আশ্রয়গ্রহণকারীকে কটু কথা বলে না—
বৃদ্ধ আর একবার আমার দিকে তাকিয়ে ‘হুম’ শব্দ করে গ্রামের দিকে চলে গেল।
আমার পথ হাঁটার সম্বল বলতে একটা ঝোলা। তার মধ্যে একখানা ঘটি, গায়ের চাদর, একখানা রুদ্রডামরের পুথি, কয়েকটা বাবলাডালের দাঁতনকাঠি, আর একটাকা বারো আনা পয়সা। এর বেশি কিছুর প্রয়োজনও বোধ করিনি কখনো। পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসা সেই হিন্দিভাষী সাধু শিক্ষা দিয়েছিলেন আগামীকালের জন্য কোনও সঞ্চয় না করতে। তার উপদেশ মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল। পরবর্তীকালেও যে উপার্জন বা সঞ্চয় করেছি, তা করেছি স্ত্রী-পুত্র-কন্যার মঙ্গলের জন্য, নিজের প্রয়োজনে নয়। আজ পর্যন্ত সেই অভ্যাস বজায় রেখেছি।
ক্রমেই আকাশ মেঘে অন্ধকার করে আসছে। ঝোলাসহ নাটমন্দিরের ওপর উঠে একখানা থামের গোড়ায় গুছিয়ে বসলাম। বাঁকুড়া জেলায় গিয়েছ কখনো? বড় সুন্দর জায়গা। বিশাল বিশাল লালমাটির প্রান্তর, ঝুঁটিবাঁধা বৈরাগীর মত তালগাছ জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে মাঠের মধ্যে, ধুলোওড়া গ্রামের রাস্তায় একতারা হাতে গান গাইতে গাইতে বাউল হেঁটে যাচ্ছে। জেলাটার মাটিতে শান্তি আছে। থামে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে আরাম করে বসলাম।
হঠাৎ নাটমন্দিরের চাতালে কিছুদূরে কী একটা নড়ল বলে মনে হল। সন্ধে ঘনিয়ে আসছে, পরিষ্কার কিছু দেখা যায় না। কিন্তু কোনও কিছু নড়লে আবছা আন্দাজ করা যায়। ভাল করে তাকিয়ে দেখি কেউ একজন শুয়ে রয়েছে সেখানে, শোয়া অবস্থায় পাশ ফেরায় নড়াচড়াটা চোখে পড়েছে।
হেঁকে বললাম—কে? কে ওখানে?
মনুষ্যমূর্তিটি উঠে বসে বলল—আমি।
—আমি কে? পৃথিবীতে সবাই তো আমি। যাত্রী?
লোকটি সামান্য হাসল, বলল—সংসারে সবাই যাত্রী, কোথাও না কোথাও চলেছে।
বাপ রে! এ যে গুরুমশায়ের মত কথা বলে। তবে তার কণ্ঠস্বর মৃদু, ভদ্র ও মার্জিত। পথচলতি লোকের কথা বলার ভঙ্গি সাধারণত এমন মার্জিত হয় না। একটু কৌতুহল হওয়ায় বললাম—এসো, এদিকে এসে বোসো—
লোকটি উঠে এল আমার সামনে। আলো নেই, পরিষ্কার তাকে দেখতে পেলাম না। কিন্তু মনে হ’ল তার বয়েস বছর চল্লিশ কী পঁয়তাল্লিশ হবে। এ বয়েসের কোনও লোককে ‘তুমি’ বলাটা আমার উচিত হয়নি। বললাম—কিছু মনে করবেন না, অন্ধকারে ভাল দেখতে পাইনি, ‘তুমি’ বলে ফেলেছি—
—তাতে কী হয়েছে? জগতে সকলে সকলের বন্ধু। বন্ধুকে ‘তুমি’ বলা যায়।
লোকটির পরণে খাটো ধুতি আর হাফহাতা শার্ট। সাধারণ দরিদ্র পথিক। কিন্তু তার আচরণে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যা সমীহ আদায় করে। বললাম—কোথায় যাবেন? আসছেন কোথা থেকে?
এবার বেশ মজার ব্যাপার হ’ল। পথিক মানুষটি আমাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করতে লাগল, কিন্তু তার অনুমতি পাওয়া সত্ত্বেও আমি কিছুতেই তা পারলাম না। সে বলল—কোথাও যাচ্ছি না ভাই, অনেকটা তোমারই মতন। পথে পথে ঘুরে বেড়াতে ভাল লাগে। যা পাই তাই খাই, যেখানে খুশি থেমে যাই—এই আর-কি।
আমার সেই বয়সের অভিজ্ঞতাতেই দেখেছি, কিছু লোক আছে যারা হেঁয়ালি করে কথা বলতে ভালবাসে। ভেতরে শূন্যগর্ভ বলেই বোধহয় তারা বড় বড় দুর্বোধ্য কথা বলে। প্রথমে আমি এই লোকটিকে তাদের দলে ফেলেছিলাম, কিন্তু একটু পরেই বুঝতে পারলাম তা সত্যি নয়। মানুষটার ভেতর গভীরতা আছে।
বললাম—আমারই মতন মানে? আপনি কী করে জানলেন আমি কী রকম?
—ও জানা যায়। আমি বুঝতে পারি।
বয়েস অল্প হলেও তারই মধ্যে আমি অনেক সাধক এবং অদ্ভুতকর্ম তান্ত্রিকের সঙ্গে মিশেছি। তাদের আশ্চর্য ক্রিয়াকলাপ দেখেছি। এ আর আমাকে নতুন কী ভড়ং দেখাবে?
বললাম—কী করে বোঝেন? কাকচরিত্র বা লক্ষণশাস্ত্র চর্চা করেন নাকি?
—না। বুঝি এইভাবে যে, মন আসলে একটাই—তোমার আমার যদু কিম্বা মধুর, পৃথিবীর সব প্রাণীর। মায়ার আবরণে আলাদা আলাদা দেখায়। পর্দা টাঙিয়ে দিলে ওপারে কী আছে দেখা যায় না, পর্দা সরিয়ে দিলে আবার সব স্পষ্ট দেখা যায়। মায়ার পর্দা সরিয়ে দিলে সবই এক। তখন কারও মনের কথা জানতে অসুবিধে হয় না।
বললাম-আপনি তো বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের কথা বলছেন। এ দর্শন শিক্ষা করেছেন কোথায়? খুব ভাল গুরু ছাড়া অদ্বৈতবাদের পাঠ নেওয়া যায় না। কে আপনার গুরু?
—আমার বাবা।
—ও, আপনি বুঝি শাস্ত্ৰাধ্যায়ী পণ্ডিতের সন্তান?
সে চুপ করে রইল। ভাবলাম কোনও কারণে সে হয়ত নিজের পরিবারের কথা আলোচনা করতে চায় না। এক্ষেত্রে কথা না বাড়ানোই ভদ্রতাসঙ্গত হবে।
ঠিক এইসময় ঠাণ্ডা হাওয়ার একটা ঝাপটা দিয়ে ঝড় এসে পড়ল। বর্ষাকাল হওয়া সত্ত্বেও সারাদিন প্রখর রোদ্দুর ছিল, গুমোটে প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। এখন শুকনো পাতা ধুলোবালি আর কুটোকাটা উড়িয়ে ঝোড়ো বাতাস এসে চারদিকে ঠাণ্ডা করে দিল। ঝড়ের মুখে পাক খেতে খেতে দুটো শালিক এসে নাটমন্দিরের কড়িকাঠের ফাঁকে আশ্রয় নিয়ে গুছিয়ে বসল। অথবা ওইটাই ওদের বাসা, ঝড়ের দাপটে কোনওরকম ফিরে এসেছে।
বললাম—আপনার নামটা তো জানা হ’ল না—
লোকটি চুপ করে থেকে বলল—আমার নাম অমর। অমরজীবন।
—বাড়ি কোথায়? এই জেলাতেই বুঝি?
অমরজীবন কোনও উত্তর দিল না। বুঝলাম নিজের কথা বলতে সে আদৌ আগ্রহী নয়। অন্য প্রসঙ্গে যাবার জন্য বললাম—আশ্রয় তো যাহোক পাওয়া গেল, কিন্তু খাওয়াটা বোধহয় জুটবে না—
—না না, তা কেন? ঝড়টা থামুক, খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যাবে এখন—
—তা কী করে হবে? কাছাকাছি কোনো দোকানপাট দেখছি না। গ্রামে হয়ত আছে, কিন্তু তারা কি এই ঝড়বাদলে দোকান খুলে রাখবে? মনে হয় না।
অমর বলল—রাত্তিরে কী খাও তুমি? ভাত না রুটি?
বললাম—আমি ঠিক সন্ন্যাসী না হলেও পথে ঘুরছি অনেকদিন। সবই অভ্যেস আছে।
—বেশ, বেশ। ভাল। খাবার এসে যাবে। অন্ধকারে অমরের মুখচোখ ভাল দেখতে পাচ্ছি না। লোকটা পাগল নয় তো? কোথায় খাবার?
অমর বলল—কালকেও আমি এখানে ছিলাম। স্বপ্নে দেখলাম আজ তুমি আসবে, তাই একটা দিন বেশি থেকে গেলাম। এমনিতে আমি দু-রাত্তির কোথাও থাকি না—
হ্যাঁ, নিশ্চয় পাগল। গতকাল রাত্তিরে স্বপ্ন দেখেছে আজ আমি আসব! বদ্ধ পাগল ছাড়া কী?
বললাম—আপনি জানতেন আমি এখানে আসব?
—হ্যাঁ।
—স্বপ্নে দেখেছেন?
—হ্যাঁ। স্বপ্ন দেখার প্রয়োজন হলে আমাকে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে সেখানে থাকতে হয়।
বেচারী! এমনিতে বেশ ভাল লোকটা, ভদ্র আর মিষ্টি কথাবার্তা। দোষের মধ্যে পাগল।
এরপরেই অমরজীবন হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বলল—তুমি বাড়ি চলে যাও।
আমি প্রথমে ঠিক বুঝতে পারিনি সে কী বলছে। বললাম—তার মানে? বাড়ি যাব কেন?
—কিছু না। ভবঘুরে জীবন ত্যাগ করে সংসারে ফিরে যেতে বলছি না। সে যখন সময় হবে যাবে। তোমার নিজের ভালর জন্য বলছি, কয়েকটা দিনের জন্য বাড়ি যাও—
আচ্ছা বিপদ তো! বললাম—কিন্তু কেন?
—মনে করো না আমি তোমার বন্ধু, আমি অনুরোধ করছি তাই যাচ্ছ।
তার কথাগুলো একটু কেমন কেমন। কিন্তু গলার স্বরে একটা ব্যক্তিত্বপূর্ণ দৃঢ়তা আছে। তার কথা মনোমত না হলেও অকস্মাৎ উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তখনকার মত তাকে শান্ত করার জন্য বললাম—আচ্ছা, আচ্ছা। সে দেখা যাবে এখন। বিড়ি চলে?
সে হাসল। বলল—সব চলে। আছে? দাও—
তাকে দিয়ে নিজে একটা বিড়ি নিলাম। বাতাসের দাপটে চার-পাঁচটা কাঠি নষ্ট করেও ধরাতে পারছিলাম না। অমর হাত বাড়িতে বলল—আমাকে দাও দেখি—
তারপর দেশলাইটা হাতে নিয়ে অদৃশ্য কার দিকে যেন ধমক লাগাল—আরে একটু থাম তো রে বাপু! একটা বিড়ি ধরাতে কি একটা আস্ত দেশলাই খরচ করব নাকি?
কাকতালীয় কিনা জানি না, হাওয়ার ঝাপটা সামান্য কয়েক মুহুর্তের জন্য কমে গেল। ঝড় চলতে চলতে এরকম অবশ্য হয়ই, তবু মনে রেখাপাত করল জিনিসটা। দেশলাই ফেরৎ দিয়ে অমর বলল—সবকিছুর ব্যাখ্যা চাইতে নেই। ব্যাখ্যা হয়ও না। তার চেয়ে সরল বিশ্বাস অনুযায়ী কাজ করা ভাল। আদেশ পেলে পালন করা ভাল।
—আদেশ কে পাঠায়?
বিড়িতে গোটাদুই টান দিয়ে অমর বলল—তা জানলে তো সব সমস্যাই মিটে যেত।
—আপনার কাছে আদেশ পোঁছয় কেন? আপনি কে?
উত্তরে অমর বলল—বিড়িটা ভাল। খুব নরমও না, খুব কড়াও না। বেশ মিঠেকড়া ধরনের। কোথেকে কিনেছ? খাওয়ার পরে আর একটা দিও তো—
ঝড় থেমে গিয়ে নামল বৃষ্টি। চলল বেশ কিছুক্ষণ। দিকদিগন্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেল। মন্দিরের পেছনে কোথা থেকে ব্যাঙ ডাকতে লাগল। বৃষ্টি যখন থামল, তখন পাড়াগাঁর হিসেবে বেশ রাত। দেখি পথে জমা জলে ছপ ছপ করে কে একজন হেঁটে এসে নাটমন্দিরে উঠল। সামনে ঝুঁকে অন্ধকারে ঠাহর করার চেষ্টা করে ডাকল—ঠাকুরমশাই! ও ঠাকুরমশাই—
অমর বলল—এই যে, আমি এখানে। দাও—
কাছে এলে দেখলাম লোকটির হাতে একটা বড় শালপাতার ঠোঙা। সে ঠোঙাটা অমরের হাতে দিতে দিতে বলল—আর এক মূর্তি এয়েচে দেখচি। তা হয়ে যাবে’খন দুজনের। দাঁড়াও, খাবার জল দিয়ে যাই। নতুন লোক, জল আনতে গেলে পুকুরঘাটে আছাড় খাবে।
বোধহয় পথিকদের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য মন্দিরের চাতালে রাখা একটা মাটির কলসী নিয়ে লোকটি অন্ধকারে কোথায় চলে গেল। অমর বলল—মন্দিরের পেছনেই একটা পুকুর আছে, সেখানে গেল জল আনতে। ভাল, পরিষ্কার জল—
তারপর আমার মুখের দিকে তাকিলে বলল—খাবার ব্যবস্থা হয়ে যাবে বলেছিলাম আর খাবার এসে গেল—এর ভেতর কিন্তু অলৌকিক কিছু নেই। এই লোকটির একটা ময়রার দোকান আছে গ্রামে, গতকালও আমাকে খাবার দিয়ে গিয়েছিল। অতিথিসেবা করতে ভালবাসে। পয়সা দিতে চেয়েছিলাম—নেয়নি। আজকের খাবারও দিতে বলা ছিল। যা খাবার দেয় তা আমি একা খেতে পারি না, আজও দুজনের হয়ে যাবে এখন। দেখি কী দিয়েছে—
উঠে গিয়ে যেখানে সে শুয়েছিল সেখান থেকে একটা কাপড়ের পুঁটুলি নিয়ে এল অমর। তার ভেতর থেকে একটা মোমবাতি বের করে বলল—দেখি, দেশলাইটা আর একবার দাও—
শালপাতার ঠোঙা খুলে দেখা গেল ভেতরে গোটা পনেরো বড় মাপের পুরী, আলুর তরকারী, আর অনেকখানি মোহনভোগ। দেশী ঘি দিয়ে তৈরি, দারুণ গন্ধ বেরুচ্ছে। তখনো গাঁয়ের দিকে খাবারে ভেজাল দেবার কথা কেউ ভাবতে পারত না।
জল ভরে মেটে কলসীটা নিয়ে ফিরে এল ময়রা। আমাদের পাশে নামিয়ে রেখে বলল—এই জল রইল। এ খাবারে হয়ে যাবে তো? নাকি আর কিছু এনে দেব?
খাবারের প্রাচুর্য সম্বন্ধে তাকে আশ্বস্ত করে বিদায় করা হ’ল। অমর বলল—অন্ধকারে গল্প করা যাবে, কিন্তু খাওয়া যাবে না। মোমবাতি বেশি পুড়িয়ে লাভ নেই, এসো খেয়ে নেওয়া যাক—
অমর খুব কম খায়। মাত্র চারখানি পুরী সে খেল, বাকি সবগুলো খেতে হল আমাকে। অবশ্য পথ হেঁটে আমার খিদে পেয়ে গিয়েছিল। কলসী কাত করে কানায় হাত দিয়ে জল খেলাম। তারপর মোমবাতি নিভিয়ে দিয়ে অমর বলল—এসো, এইবারে গল্প করি।
অন্ধকারের ভেতর থেকে তার কণ্ঠস্বর ভেসে আসতে লাগল। কত গল্প সে শোনাল সারারাত ধরে। তেমন কথা আমি কারও কাছে কখনও শুনিনি। সাধারণ ডাল-ভাত খাওয়া জীবনের কথা নয়, যেন অচেনা ভাষায় অচেনা সুরে অদ্ভুত গান শোনাচ্ছে কেউ। আকাশ আর নক্ষত্রের গল্প, সমুদ্রের ঢেউয়ের গল্প, আগুন-বাতাস-পাহাড়-মাটির গল্প। সে আমি তোমাদের ভাষা দিয়ে ঠিক বোঝাতে পারব না। সৃষ্টির আদিম গল্প সে, আমাদের প্রত্যেকদিনের জীবনে তার কোনও প্রতিচ্ছবি হয় না। সেই রাতের কথা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। কথা বলতে বলতেই অমরজীবন হঠাৎ বলল—তোমার ছোট ঠাকুর্দা গৃহত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন, না? উনি এখনো বেঁচে আছেন।
আশ্চর্য তো! কী করে সে কথা জানলো এই লোকটা? কিন্তু তখন আমার এত ঘুম পেয়েছে যে, যথেষ্ট অবাকও হতে পারলাম না।
তখন রাত বোধহয় তিনটে পেরিয়ে গিয়েছে, অমর বলল—না, আর কথা না। এবার তুমি ঘুমোও। বাড়ি চলে যেও কিন্তু। কালকেই। তোমার ভালর জন্যই বলছি।
আমার চোখে ঘুম জড়িয়ে এসেছে। বললাম—আপনিও চলুন না আমার সঙ্গে। যাবেন?
—না, এবার না। এবার থাক। তবে তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে আমার!
আমার কানে যেন কে নিদুলির মন্ত্র পড়ে দিয়েছে। আর তাকাতেই পারছি না। ঘুম—ঘুম। যখন ঘুম ভাঙল তখন রোদ্দুর উঠে গিয়েছে। গতকাল রাত্তিরের মেঘ-বৃষ্টির চিহ্ন নেই কোথাও, ঝকঝক করছে দিনের আলো।
পাশে অমরজীবন নেই। তার ঝোলাকুলিসহ কখন সে চলে গিয়েছে কে জানে।
কাল সন্ধেবেলা দেখা সেই পুরোহিত এসে মন্দিরের দরজা খুলে সকালের পুজোর উদ্যোগ করছে। আমার দিকে আড়ে আড়ে তাকাল কবার। জিজ্ঞাসা করলাম—আচ্ছা, এখানে যে আর একজন পরশু থেকে ছিলেন, তিনি চলে গিয়েছেন?
সে বলল—কে ছিলেন?
—একজন যাত্রী। আমার আগে থেকেই তো ছিলেন—
—দেখিনি। খেয়াল করিনি। অমন কত লোক যাচ্ছে আসছে—
লোকটি শুধু নীরস নয়—নিরুৎসুক, নিরুদ্বেগ এবং সম্পূর্ণ নিরুত্তাপ।
যাই হোক, অমরজীবন লোকটিকে আমার খুবই অদ্ভুত লেগেছিল, তার কথা অমান্য করতে মন চাইল না। সেদিনই রওনা হলাম বাড়ির দিকে। বাড়ি পৌঁছনোর পর প্রতিবারের মতই প্রথমে বাবার বকাঝকা, তারপরে মায়ের কান্নাকাটি, এবং তারও পরে আত্মীয়স্বজনের আবেগের বন্যা সহ্য করতে হ’ল। দুপুরে খেতে বসে বাবা বললেন—গত পরশুদিনই সরসী চাটুজ্জের আড্ডায় তোমার কথা হচ্ছিল। আমার যে একটা এমন বাড়িপালানো হাড়জ্বালানো ছেলে হবে সে কথা অনেক আগেই একজন বলে দিয়েছিল—
বললাম—কে? কোনও জ্যোতিষী?
—না। এমনিই একজন পথিক। আমার ছোটবেলায় একদিনের জন্য আমাদের বাড়ি আশ্রয় নিয়েছিল। তার নাম অমর, অমরজীবন। সেই গল্পই হচ্ছিল সরসী চাটুজ্জের বাড়ি—
চমকে উঠে বললাম—অমর! অমরজীবন! বাবা বললেন—হ্যাঁ। চমকে উঠলে কেন?
—না, কিছু না। গল্পটা বরং বলুন, শুনি—
খেয়ে উঠে গড়গড়ায় তামাক খেতে খেতে বাবা বলতে শুরু করলেন। নিজের বাবার কাহিনী লেখকের বর্ণনার ভঙ্গিতে বলে গেল তারানাথ। তারপর থেমে একটু দম নিয়ে বলল—এই ব্যাপারটার সবচেয়ে বিচিত্র দিক কোনটা জানো? যে লোককে চল্লিশ বছর আগে বাবা পঁয়তাল্লিশ বছরের দেখেছিলেন, তাকে এতকাল পরে আমিও সেই বয়েসে দেখলাম কী করে?
ছোট ঠাকুর্দার খবরটা বাবাকে জানাবো ভেবেছিলাম, দেখলাম অমরজীবন মারফৎ সেটা তিনি আগেই জানেন।
পরদিন বুঝলাম কেন অমরজীবন বাড়ি চলে আসতে বলেছিল। পরদিন থেকে আমার এল প্রবল জ্বর। প্রায় দেড়মাস ভুগে সেরে উঠলাম। পথে থাকলে প্রাণসংশয় হত সন্দেহ নেই।
পরের পর্ব পড়ুন..
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment