প্রথমাংশের লিঙ্ক
দ্বিতীয়াংশের লিঙ্ক
তৃতীয়াংশের লিঙ্ক
লেখক : তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
॥ আট ॥
শাঁখ আর ঘণ্টা বেজে উঠল, ঢাক তো বাজছেই। বাড়ির আর সমাগত গ্রামের মেয়েরা উলু দিচ্ছে। কামারের হাতে ঝকঝকে খাঁড়া উঠছে নামছে, এঁটেল আর বালিমাটি মিশিয়ে তৈরি বেদীর ওপরে পরপর বলি হয়ে যাচ্ছে একশো আটটা চালকুমড়ো, কলা, আখ, সুপুরি। মুখুজ্যেবাড়ির পূজো হয় দেবীপুরাণ অনুযায়ী, পশুবলি এ বাড়িতে নিষেধ। তার মধ্যে সুপুরি বলি ব্যাপারটা দেখার মত। মাটির বেদীতে রাখা ওইটুকু একটা জিনিসের ওপর অতবড় ভারি খাড়া নির্ভুলভাবে নামিয়ে আনা রীতিমত কঠিন কাজ। সুপুরি শক্ত এবং গোল জিনিস, খাড়া যথেষ্ট ধারালো এবং কামার যথেষ্ট কুশলী না হলে ফলটা ফসকে পাশে সরে যাবে। তা হলে মহা অকল্যাণ। কিন্তু বলি হয়ে যাচ্ছে নির্বিঘ্নে।
সন্ধিপূজো শেষ হল। মেয়েরা গলবস্ত্র হয়ে ঠাকুরপ্রণাম করছেন, লোকজন সব উত্তেজিত হয়ে গড়ের তোপের প্রসঙ্গ আলোচনা করছে। এতদিনের কিম্বদন্তী, কিন্তু সেভাবে কেউ শোনেনি কামানের শব্দ। গ্রামের সরল বিশ্বাসী মানুষের মনে আলোড়ন তৈরি করবার মত ঘটনা এটা। মুখুজ্যেবাড়ির দুর্গোৎসবের মাহাত্ম্য নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হল।
দেবদর্শন প্রণাম সেরে আমার কাছে এসে দাঁড়ালেন। তার চোখে জল।
—শুনলেন ঠাকুরমশাই?
—শুনলাম। আপনার নিমন্ত্রণ রেখে ভালই করেছি।
—চলুন, আমরা বৈঠকখানায় গিয়ে বসি। রঘু, আমাদের তামাক দে—আর প্রসাদ নিয়ে আয়।
উৎসব উপলক্ষে বাড়ি সাজানো হয়েছে দেখলাম। বৈঠকখানার দরজায় ঝুলছে আমপাতা আর শোলার কদমফুল। ভেতরে তক্তাপোশে গদির ওপর নতুন ধপধপে ফরাস পাতা, ধারে ধারে কটা মোটা গির্দা। আমরা গিয়ে বসার একটু পরেই রঘু দুজনকে তামাক দিয়ে গেল। পেছনে এল পুরোহিতের তন্ত্রধার, তার হাতে দুখানা কাঠের বারকোশে পূজোর প্রসাদ। দেবদর্শন বললেন—প্রসাদ খেয়ে আপাতত চালান ঠাকুরমশাই। দুপুরে খেতে কিন্তু দেরি হবে। লোকজন সব এতক্ষণ সন্ধিপূজো দেখছিল, এইবার রান্না চাপাবে—
বললাম—তা হোক, আমার কোনও তাড়া নেই।
—আমাদের কিন্তু দেবীপুরাণ মতে পুজো, এই কদিন নিরামিষ খাওয়া চলছে, সেই বোধনের দিন থেকে। একেবারে দশমীর দিন বিসর্জন সেরে এসে রাত্তিরে লুচি-মাংস খাওয়া হবে সকলে মিলে। আপনার হয়ত কষ্ট হবে—
—কিচ্ছু অসুবিধে হবে না। ভালমন্দ জিনিস খেতে খুব ভালবাসি ঠিকই, আবার নুনভাত খেতেও ভালই লাগে। স্বাদ জিনিসটা জিভে নয় মুখুজ্যেমশাই, হৃদয়ে।
দু-একজন করে গ্রামের বৃদ্ধ প্রতিবেশী বৈঠকখানায় এসে বসতে শুরু করলেন। সাধারণ মানুষেরা প্রসাদ খেয়ে সামিয়ানার নিচেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গল্পগুজব করতে লাগল। সবাই দুপুরে খেয়ে বাড়ি যাবে, সন্ধেবেলা এসে আরতি দেখবে, এবং আবার রাত্তিরের খাওয়া সেরে ফিরবে! সমস্ত গ্রামটায় উৎসবের আবহাওয়া—এবং সেটা মুখুজ্যেবাড়িকে কেন্দ্র করে।
দেবদর্শনের বাড়ির একটা সুন্দর প্রথা দেখলাম। যেমন, দুপুর আর রাত্তিরের সামুদায়িক ভোজ। সবাই মিলে সামিয়ানার নিচে সারি দিয়ে বসে একই খাবার খাওয়া হচ্ছে। জমিদার বলে দেবদর্শন আলাদা বসেন নি, বা তাকে আলাদা করে বিশেষ কোনও খাবারও দেওয়া হচ্ছে না। রান্না হয়েছে মোটা লালরঙের আউশ চালের ভাত। কী মিষ্টি তার স্বাদ! সঙ্গে কলাইয়ের ডাল, কাঁচকলা ভাজা, আলু-বেগুন-কুমড়ো-ঝিঙে-ডাঁটাশাক-গুড়িকচু দিয়ে অনবদ্য একটা ঘ্যাঁট, আমড়ার চাটনি আর পাতলা পায়েস। কোনও জমিদারবাড়ির পক্ষে নিতান্তই সামান্য আয়োজন, কিন্তু সমবেত মানুষজন সোনা হেন মুখ করে আনন্দের সঙ্গে তাই খাচ্ছে। প্রথম কারণ, জমিদারবাবুর প্রতি ভালবাসা। দ্বিতীয় কারণ, একসঙ্গে বসে খাওয়ার আনন্দ। দুটো কারণই সমান গুরুত্বপূর্ণ।
খেতে খেতে দেবদর্শন বললেন – রাত্তিরে হবে লুচি, আলু-কুমড়োর তরকারি আর পায়েস। পায়েসটা একটু জোলো লাগছে, না? কী আর করা যাবে বলুন, এতগুলো মানুষের জন্য আয়োজন। আমাদেরও তো সে দিন আর নেই। তবে হ্যাঁ, আগামীকাল দুপুরে আপনাকে একটা জিনিস খাওয়াব। সামান্য জিনিস, তবে খেতে ভারি ভাল—
বললাম— কী জিনিস?
—আমরুল পাতা, রাঙাআলু আর আম-আদা দিয়ে তৈরি চাটনি। আমাদের এই অঞ্চল ছাড়া জিনিসটার চল দেখিনি বিশেষ কোথাও—
সরল মানুষ দেবদর্শন, আনন্দে পূর্ণ মনের মানুষ। এই নিয়ে মাত্র দুবার ওঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ, তবু যেন একটা আত্মীয়তার বন্ধন অনুভব করলাম। সকলের সঙ্গে আনন্দ করে পূজোর বাকি দুটো দিন কেটে গেল। দশমীর দিন দুপুরের পর থেকে বৌ-ঝির দল ভিড় করে ঠাকুরবরণ করতে শুরু করল। দু-থাক তক্তা দিয়ে প্রতিমার সামনে উঁচু মঞ্চের মত করে দেওয়া হয়েছে, তার ওপরে দাঁড়িয়ে মেয়েরা ঠাকুরের কপালে সিঁদুর পরিয়ে দিচ্ছে, মুখে ছুঁইয়ে দিচ্ছে সন্দেশ। নিজেদের মধ্যে এ-ওর কপালে সিঁদুর লেপে দিচ্ছে, শাঁখা আর নোয়ায় মাখিয়ে দিচ্ছে। এই লোকাচারের নাম সিঁদুর খেলা’। আমাদের সমাজে মেয়েদের সমস্ত উৎসব-আনন্দই প্রায় পর্দার আড়ালে পালিত হয়। এই একটা দিন তারা অসঙ্কোচে বেরিয়ে আসে বাইরে। দেখতে ভারি ভাল লাগে তাদের স্বতোৎসারিত আনন্দের প্রকাশ। বুঝতে পারা যায় আড়ালে থাকা এই বিপুল নারীশক্তির বলেই ঠিকঠাক চলছে সমাজটা।
সারা গাঁয়ের লোক মিছিল করে প্রতিমা নিয়ে বেরোলো বিকেলবেলায়। তখন সূর্য অস্ত গিয়েছে। ছায়া গাঢ় হচ্ছে আম-জামবাগানের ফাঁকে ফাঁকে। বাতাসে হিমের ছোঁয়া, কার্তিক মাসের প্রথম দিকের স্নিগ্ধ হিম। হেমন্তকাল আসতে আর দেরি নেই।
বাঁশের ওপর পাশাপাশি তক্তা সাজিয়ে শক্ত করে বেঁধে তার ওপর ঠাকুর রেখে কাঁধে নিয়েছে বাহকেরা। হাতে তাদের মশাল, সন্ধে আর একটু গাঢ় হলেই জ্বালিয়ে দেওয়া হবে। নাচতে নাচতে আর দেবীর নামে জয়ধ্বনি দিতে দিতে পুরো দলটা এসে দাঁড়াল নদীর ঘাটে। সেখানে ভাসানের জন্য পাশাপাশি দু-খানা নৌকো বেঁধে চওড়া বেদীর মত করা হয়েছে। ঠাকুরসুদ্ধ তক্তা রাখা হল সেই নৌকোর ওপরে, সঙ্গে উঠল দশ-বারোজন বলিষ্ঠ লোক আর ছ-জন ঢাকি। ঘাট থেকে ছেড়ে ধীরগতিতে নৌকো মাঝনদীতে গিয়ে দাঁড়াল। তখন অন্ধকার নেমেছে ঘোর হয়ে, নৌকোর ওপর জ্বলে উঠেছে মশাল। হঠাৎ সবগুলো ঢাক বেজে উঠল দ্রুততালে, নদীর পারে আর নৌকোর ওপরে লোকজন চিৎকার করে উঠল—আবার এসো মা, আবার এসো। আস্তে আস্তে দু-দিকে সরে গেল দুই নৌকো, প্রতিমাবাহকের মাঝখানের বাঁধনের দড়ি কেটে দিয়েছে। সোজাসুজি দাঁড়ানো অবস্থায় জলে ডুবে গেল দেবীপ্রতিমা। পাগলের মত বাজছে ঢাক, পাগলের মত চেঁচাচ্ছে মানুষ। ধকধক করে জ্বলছে মশাল। বিসর্জন হয়ে গেল।
পুরো দলটা আবার ফিরে এল মুখুজ্যেবাড়ির পূজোপ্রাঙ্গণে। মূর্তিহীন বেদীতে মিটমিট্ করে একটা প্রদীপ জ্বলছে। অতগুলো মানুষ ফিরে এল, কিন্তু পরিবেশে কীসের যেন একটা হাহাকার। কী একটা খুব আনন্দের জিনিস যেন এই একটু আগেও ছিল, এখন আর নেই। ঢাক থেমে গিয়েছে, পুরোহিত সুধীর ভট্টাচার্য ঘটে আম্রপল্লব ডুবিয়ে সবার মাথায় শান্তিজল ছিটিয়ে দিয়ে মন্ত্রোচ্চারণ করছেন। দেবদর্শনের কাছে শুনেছি এই সুধীর ভট্টাচার্যেরই পূর্বপুরুষ হচ্ছেন দীনদয়াল ভট্টাচার্য, মুখুজ্যেবাড়ির তৎকালীন পুরোহিত, যিনি গড়ের তোপ সম্বন্ধে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন।
বারবাড়ির উঠোনে পরপর পাঁচখানা উনুনে রান্না চেপেছে। লোহার চাদর দিয়ে তৈরি বিশাল কড়াইতে মাংস কষা হচ্ছে। দেবদর্শনের কাছে শুনলাম চারমণ মাংস রান্না হচ্ছে, আর দেড়মণ ময়দার লুচি। নিবারণ ময়রাকে বায়না দেওয়া হয়েছিল, সে দু-মণ কড়াপাকের ছানার গজা বানিয়ে দিয়েছে। যারা বিসর্জনের মিছিলে গিয়েছিল তাঁরা আর ফিরে যায়নি, সামিয়ানার নিচে বসে গল্পগুজব করছে। এখন একটু একটু করে আরও মানুষ এসে জড়ো হচ্ছে। খাওয়াদাওয়া মিটলে মাঝরাত থেকে কবিগান হবে। নবদ্বীপ থেকে রাম গোস্বামীর দল এসে পৌচেছে বিকেল নাগাদ, এখন তারা এক কোণে গোল হয়ে বসে তামাক খেতে খেতে বিশ্রাম করছে। পাশে তাদের যন্ত্রপাতি রাখা আছে। উৎসাহী মানুষেরা তাদের কাছে ঘুরঘুর করছে আলাপ জমানোর জন্য, কিন্তু তারা খুবই গম্ভীর লোক, বাজে আলাপ করে নিজেদের মর্যাদা ক্ষুন্ন করতে রাজি নয়। চোখ বুজে ঝিমোনোর ভান করছে।
আর একটা পাসিং শো ধরিয়ে তারানাথ বলল—আমার গল্প একটু ধান ভানতে শিবের গীত হয়ে যাচ্ছে, না? তবু মন দিয়ে শোনো, এসব দিনকাল চলে যাচ্ছে, তোমরা আর দেখতে পাবে না। শুনে রাখো, পরে ছেলেপুলেদের গল্প বলতে পারবে। বাংলার উৎসব ক্রমেই চেহারা বদল করছে। তাছাড়া আড্ডার তো এই নিয়ম, ধরাবাঁধা পথে গল্প এগোয় না। আচ্ছা তোমরা একটু বোসো, আমি ভেতরবাড়ি থেকে আর একবার চায়ের কথা বলে আসি—
এখান থেকে হাঁক দিয়েই চায়ের ফরমাশ করে দেওয়া যায়, তারানাথ সচরাচর তাই করে থাকে। কিন্তু সে বিচক্ষণ মানুষ, আমরা তার সামনে ধূমপান করি না, তাই সে মাঝে মাঝে এটা-ওটা আছিলা করে উঠে যায়। আমরাও বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খেয়ে আসি। তারানাথ উঠে ভেতরে যেতে কিশোরী বলল—চল হে, চটপট একটু ধোঁয়া টেনে আসি—
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমরা সিগারেট ধরালাম। মট লেনের একটু ভেতরদিকে তারানাথের বাড়ি। বড় রাস্তা থেকে খুব দূরে নয়, কিন্তু রাস্তার কোলাহল এপর্যন্ত এসে পৌঁছয় না। প্রাচীন কলকাতার একটা শাস্ত, স্নিগ্ধ কোণে তারানাথ থাকে। পলস্তারা খসে যাচ্ছে নোনা-ধরা দেওয়াল, সদর দরজার কাঠ জীর্ণ হয়ে ফাঁক দেখা দিয়েছে। তবু তারানাথের গল্পের মত পুরনো দিনের চাদর মুড়ি দিয়ে বাড়িটা দাঁড়িয়ে। আধুনিক যুগ একে না ছুঁয়ে পাশ দিয়ে এড়িয়ে চলে গিয়েছে।
কিশোরী বলল—চার-পাঁচ বছর আগেও তারানাথ চক্কোত্তিকে আমরা চিনতাম না। মনে আছে, আমিই তোমাকে প্রথম নিয়ে আসি? তুমি তো বুজরুক ভেবে প্রথমে আসতেই রাজি হওনি। আর আজ? হপ্তায় অন্তত একটা দিন না এলে মন ছটফট করে।
—ঠিক বলেছ।
—আসলে কী জানো, লোকটা গল্প বলে দারুণ সুন্দর। গল্পটা সত্যি না মিথ্যে, সে প্রশ্ন মনেই আসে না। ও একটা সম্মোহনের মত ব্যাপার—
সিগারেট শেষ করে দুজনে ভেতরে এসে বসলাম। একটু পরেই তারানাথও ফিরে এল। গলাখাঁকারি দিয়ে বলল—ঠাণ্ডা মত লেগেছে, আদা দিয়ে চা করতে বললাম। সেদিন ছেলেটার একটু সর্দিজ্বর মত হয়েছিল, গলির মোড়ের ভূপেন ডাক্তার এসে জেফরল নামে কাশির সিরাপ দিয়ে গেল। অবশ্য আমার কাছ থেকে ভিজিট বা ওষুধের দাম নেয় না, ওর ছেলের কোষ্ঠী আমি করে দিয়েছিলাম। কিন্তু ওইসব রঙচঙে ডাক্তারি জল খাওয়ার চাইতে খুচখাচ অসুখে দেশী টোটকায় কাজ হয় অনেক বেশি। সর্দিকাশি হলে আমি আদা দিয়ে চা খাই, বড়জোর মুখে দু-একদানা কাবাবচিনি রাখি। তাতেই দিব্যি সেরে যায়। কাবাবচিনি চেন তো? ওই যে, ছোট্ট ল্যাজওয়ালা গোলমরিচের মত দেখতে—
চা এসে গেল। সুরুৎ করে চুমুক দিয়ে তারানাথ বলল আছে? হ্যা, গল্পটা যেন কোন পর্যন্ত বলেছিলাম?
কিশোরী বলল—মুখুজ্যেবাড়িতে চার মণ মাংস রান্না হচ্ছে—
—হ্যাঁ। তারপর রাত সাড়ে-দশটা নাগাদ সামিয়ানার নিচে সারি সারি পাত পড়ে গেল। যজ্ঞিবাড়িতে পরিবেশন করবার জন্য পাড়াগায়ে একদল দক্ষ লোক থাকে। এখানেও তেমন কিছু লোক কোমরে লাল গামছা বেঁধে কাজে নেমে পড়েছে। বড় কড়াইতে কলকল করছে ঘি, দুচলো-মুখ বাঁখারির আগায় গেঁথে তোলা হচ্ছে লুচির গোছা। গরম ঘি আর সদ্য ভাজা লুচির গন্ধে সমস্ত জায়গাটা আমোদ করেছে। এক একজন লোক যে পরিমাণ লুচি খাচ্ছে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। দেড়মণ ময়দায় শেষপর্যন্ত কুলোবে কিনা কে জানে। এখনকার তুলনায় সে ছিল অনেক সস্তাগণ্ডার বাজার, গাওয়া ঘি-তে লুচি ভেজে খাওয়াটা কোনও আহামরি ব্যাপার ছিল না। খাঁটি গাওয়া ঘিয়ের সের তখন দশ আনা কী বারো আনা, ভাবতে পারো? তবু একথা সত্যি যে, গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ ছিল গরীব। যতই সস্তা হোক, গাওয়া ঘিয়ে ভেজে লুচি খাওয়া তাদের কাছে স্বপ্ন ছিল। এসব দামী খাওয়া-দাওয়া একটু উচ্চবিত্ত পরিবারের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকত। পালেপার্বণে জমিদারবাড়িতে নেমন্তন্ন পেলে এরা কোমরের কষি ঢিলে করে খেতে বসে। খাওয়ার পর্ব চুকতে চুকতে রাত প্রায় সাড়ে-বারোটা হল। একটা থেকে আরম্ভ হল কবিগানের আসর। সামনের সারিতে একটু কোণের দিকে আমাকে নিজের পাশে বসালেন দেবদর্শন। বললেন—ঠাকুরমশাই, কালকের দিনটাও থেকে যাবেন কিন্তু—
বললাম—শুধু কাল নয়, আমি আরও তিনদিন থাকব, লক্ষ্মীপূজো দেখে তারপর ফিরব—
কী একটা প্রশ্ন করতে গিয়েও করলেন না দেবদর্শন। বললেন—খুব ভাল কথা, বেশ তো, বাঃ!
কবিগান হয় দুই বিরোধী পক্ষ নিয়ে। দুই পক্ষের তুমুল লড়াইতে আসর জমে ওঠে। রাম গোস্বামীর ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। তারা নিজেদের মধ্যেই দুটো দল করে নেয়। তারপর চলতে থাকে চাপান-উতোর। প্রথমে মনে হয় নিজেদের ভেতরে সাঁটে গাইছে, এ কি আর তেমন জমবে? কিন্তু কিছুদূর এগুনোর পর দু-পক্ষের হুঙ্কার আর তেড়ে ওঠা দেখে বোঝা যায় ভেতরে আপোস থাকুক আর নাই থাকুক, আসর এবং গান জিনিসটা তারা ভালই বোঝে। তখনকার দিনে গ্রামাঞ্চলে হাততালি দেবার রেওয়াজ ছিল না, তার বদলে মানুষ হরিধ্বনি দিত। এখন ঘন ঘন হরি হরি’ শুনে বুঝলাম আসর জমে গিয়েছে।
কিশোরী জিজ্ঞাসা করল—আচ্ছা, সে সময়ে আসরে আলো করত কী দিয়ে? বিদ্যুতের তো প্রশ্নই ওঠে না, হ্যাজাক বা ডে-লাইটও বোধহয় আসেনি। অন্ধকারে নিশ্চয় গান হত না—
তারানাথ বলল—ভাল প্রশ্ন করেছ। আলোর বিষয়টা সমস্যা ছিল ঠিকই, তবে ব্যবস্থা যা হত তা মন্দ নয়। মুখুজ্যেবাড়িতেই দেখেছি, সামিয়ানার নিচে বড় ঝাড়লণ্ঠন গোটাকতক ঝুলিয়ে দেওয়া হত। পঞ্চাশ, একশো বা দুশো কাচের পাত্রের মধ্যে বাতি জ্বালিয়ে দেওয়া হত। এমন দু-খানা ঝাড়ে যেখানে অভিনয় বা গানবাজনা হচ্ছে সেই মঞ্চ যথেষ্ট আলোকিত হত। দর্শকদের বসবার জায়গার মাথার ওপরে বড় বড় কাচের ফানুস টাঙানো থাকত, তার ভেতরে জ্বলত তেলের বাতি। পরবর্তীকালে মোমবাতি বাজারে আসায় এবং ক্রমে সুলভ হওয়ায় মোমবাতিও জ্বলত। তোমরা ভাবছ এতে আর এমন কী আলো হত, আসরের কাজ চলত কী করে? ব্যাপার কী জানো, আজকাল ইলেকট্রিক আলো দেখে দেখে তোমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছ, তুলনামূলকভাবে সেকালের এইসব আলোর আয়োজন তোমাদের কাছে তুচ্ছ বলে মনে হবে। কিন্তু তখন গ্রামের মানুষ রাত্তিরে ঘরের কাজ করত রেড়ির তেলের প্রদীপে, তাও বেশি তেল খরচ করার সামর্থ্য কারোরই ছিল না। সন্ধের পর খাওয়া সেরে সবাই শুয়ে পড়ত। সাড়ে-আটটায় গভীর রাত। উৎসবে অনুষ্ঠানে ধনীর বাড়ি নেমন্তন্ন পেয়ে সেখানে গিয়ে এই আলোর বাহার দেখেই তারা মুগ্ধ হয়ে যেত—যা তোমাদের কাছে অকিঞ্চিৎকর বলে মনে হচ্ছে। আমার বাবার কাছে শুনেছি, তার ছোটবেলায় প্রথম কেরোসিন তেলের বাতির ঔজ্জ্বল্য দেখে তিনি অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। এ তো তবু ভাল, বলা যেতে পারে রীতিমত আধুনিক যুগ। আজ থেকে আশি-পঁচাশি বছর আগে কি হত জানো? আসরের চারদিকে কলাগাছের মাথা কেটে মাটিতে পুঁতে দেওয়া হত, তার ওপরে বসানো থাকত মাটির সরা। যাত্রা বা পালাগান আরম্ভ হলে সেই সরায় ধুনোর আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হত। ধুনোর আগুন বড় সাঙঘাতিক, রাত্তিরে পথ হাঁটার জন্য ধুনোর মশালও তৈরি করার রেওয়াজ ছিল। ওই সরাগুলোতে আগুন জ্বলে উঠত দাউ দাউ করে, আলোয় আলো হয়ে যেত চারদিক।
কয়েকজন লোক বগলিতে ধুনো নিয়ে আলোর তদারক করে বেড়াত। কোথাও আগুন কমে এলে বগলি থেকে মুঠো করে ধুনো তুলে সরায় ছুড়ে দিত, আবার আগুন জ্বলে উঠত আগের তেজে।
অনেকক্ষণ একটানা কথা বলেছে তারানাথ, এবার দম নেবার জন্য থেমে সিগারেট ধরাল। মৌজ, করে কয়েকটা লম্বা টান দিয়ে বলল—তোমরা আলোর কথা তুললে, কিন্তু অত বড় আসরে দর্শক-শ্রোতারা গায়ক বা অভিনেতার গলা শুনতে পেত কী করে সে কথা জিজ্ঞাসা করলে না। আজকাল দেখছি বাজারে লাউডস্পীকার বলে যন্ত্র উঠেছে, সে যন্ত্রের সামনে মুখ রেখে কথা বললে চোঙের মধ্যে দিয়ে বিকট আওয়াজ বেরোয়। সে যুগে স্বপ্নেও এমন কাণ্ডের কথা কেউ ভাবেনি। তখন কী করত মানুষ?
বললাম—এটা তো সত্যিই তেমন করে ভাবিনি। কী করত তারা?
তারানাথ হেসে বলল—তোমরা ভাবছ তারানাথ চক্কোত্তি আবার একখানা অসম্ভব কিছু কলাকৌশলের কথা বলবে, শুনে সবার তাক লেগে যাবে। না হে, তেমন কোনও উপায় ছিল না সেকালে। কবিয়াল বা যাত্রার অভিনেতার গলার জোরে দর্শকদের সংলাপ শোনাতে হত। আমি তেমন কয়েকজনকে দেখেছি। বাপরে, কী তাদের চেহারা, কী তাদের সাগরের গর্জনের মত গলার আওয়াজ! নৃপেন সেন্নামৎ ছিল আমাদের ছোটবেলার নামকরা অভিনেতা। সে যখন রাবণের ভূমিকায় নেমে হুঙ্কার ছাড়ত, আসরে বসে থাকা মায়েদের কোলে ঘুমন্ত বাচ্চারা জেগে উঠে তারস্বরে কান্না জুড়ে দিত। বুকের কাপড় সরিয়ে মায়েরা ছেলের মুখে ইয়ে গুঁজে দিয়ে তবে তাদের শান্ত করত। শুনেছি আসরে বাচ্চারা বেশি কাঁদলে বিরক্ত শ্রোতারা তাদের কান্না থামাবার সহজ উপায়টা একযোগে চিৎকার করে মায়েদের বাতলেও দিত।
প্রায় শেষরাত্তিরে আলো ফোটবার কিছু আগে আসর ভাঙলো। দেবদর্শন আর আমি পূজোমণ্ডপ থেকে হেঁটে আসছি কাছারিবাড়ির দিকে, মাঝখানে জমিটুকু ঘন অন্ধকার, হঠাৎ দেউড়ির ওপারে দেবদর্শনের ভদ্রাসনের দিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেলাম।
সমস্ত বাড়িটাকে ঘিরে রয়েছে একটা মৃদু শান্ত নীল আলোর আভা।
থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। লক্ষণ, প্রতিলক্ষণ, দৈব, কূটপ্রসার—এসব নিদর্শন বিচার করেই আমাদের চলতে হয়। নীল আলোটা দেখে বুঝলাম এই বাড়িকে ভগবান আশীৰ্বাদ করেছেন। এখানে কিছুদিনের ভেতর খুব ভাল কিছু একটা ঘটবে।
॥ নয় ॥
আমাকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে দেবদর্শনও দাঁড়িয়ে গেলেন। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন—কী হল ঠাকুরমশাই? দাঁড়িয়ে পড়লেন যে?
বুঝলাম নীল আলোটা উনি দেখতে পাচ্ছেন না। না পাওয়ারই কথা।
বললাম—কিছু না। আজ শুক্লপক্ষের একাদশী পড়ে গিয়েছে, চাঁদের আলো সামান্য হলেও থাকা উচিত ছিল। এত অন্ধকার হল কীভাবে?
দেবদর্শন বললেন—চাঁদ আকাশে আছে ঠাকুরমশাই। পশ্চিমে হেলে পড়েছে কিনা, আমবাগানের আড়ালে বলে দেখতে পাচ্ছেন না—
—বড় অন্ধকার, তাই না?
—যা বলেছেন। নিজের বাড়িটাই দেখতে পাচ্ছি না—
এই জিনিসটা বরাবর আমাকে অবাক করেছে। স্পষ্ট, সুন্দর নীল আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে আছে মুখুজ্যেবাড়ি। কিন্তু আমি ছাড়া কেউ তা দেখতে পাচ্ছে না। আমার মানসিক শক্তি খানিকটা দেবদর্শনের মধ্যে সঞ্চারিত করে ওঁকে আলোটা দেখাতে পারতাম, কিন্তু এ ধরণের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়ার জন্য কিছুটা পূর্ব-প্রস্তুতি দরকার। নইলে উনি ভয় পেয়ে যেতেন।
বৈঠকখানায় বসে দেবদর্শন বললেন – সারারাত তো জেগে, তাছাড়া কয়েকদিন ধরে আপনার পরিশ্রমও কম যাচ্ছে না। একটু ঘুমিয়ে নেবেন নাকি?
তখন ব্রাহ্মমুহুর্ত। পূব আকাশে প্রাক্-উষার হালকা আভাস। বৈঠকখানার পাশে একটা বড় জগডুমুর গাছের ডালে ভোরের প্রথম দোয়েলপাখি ডাকতে শুরু করেছে। রাত্তিরে না ঘুমোলেও ঠিক এইসময়টায় আর কোনো জড়তা থাকে না, ঈশ্বরের আশীৰ্বাদ হয়ে মনের ভেতর পবিত্রতা জেগে ওঠে, সকালের আলো ফুটে ওঠে। বললাম—না মুখুজ্যেমশাই, এখন আর শোব না—
—বসুন তাহলে, গল্প করা যাক। আমিও শোবো না। রঘু, তামাক দিয়ে যা—
দুপুরে খাওয়ার পর দেবদর্শন বললেন—মাছ ধরার নেশা আছে?
—খুব। আমার গ্রামে আমি ছোটবেলা থেকে মেছো তারানাথ বলে বিখ্যাত। কেন বলুন তো?
—চলুন, কাল তাহলে রাণীদীঘিতে মাছ ধরা যাক। আমার শ্বশুরবাড়ির কয়েকজন আত্মীয়েরও আসার কথা আছে, সবাইকে কাল রাত্তিরে লুচি আর মাছের কালিয়া খাওয়াবো—
বললাম—রাণীদীঘি কোথায়?
—বেশীদূর নয়। ওই আমবাগানটার পেছনে। বেশ গাছপালার ছায়ায় ঢাকা সুন্দর পরিবেশ। মনের মত পরিবেশ না হলে মাছ ধরে সুখ নেই, বলুন ঠাকুরমশাই?
এই শেষের দফায় আমি দেবদর্শনকে একজন পাকা মেছুড়ে বলে চিনতে পারলাম। অনেক মাছ ধরাটা বড় কথা নয়, পরিবেশ এবং মাছ ধরার উদ্যোগটাই বড় কথা।
বললাম—ঠিক বলেছেন। দীঘিতে ভাল মাছ আছে? টোপে ঠোকরায়?
দেবদর্শন হাসলেন, বললেন—প্রচুর মাছ আছে। ও দীঘি জমিদারবাড়ির নিজস্ব সম্পত্তি, বাইরের কেউ ব্যবহার করে না। পালে-পার্বণে জাল ফেলা হয়, প্রয়োজনমত সামান্য মাছ রেখে বাকি আবার ছেড়ে দেওয়া হয়। এমন অনেক মাছ আছে যাদের ওজন বিশ-ত্রিশ সের, গায়ে শ্যাওলা গজিয়ে গিয়েছে। তবে টোপে ঠোকরাবে কিনা সে তো অনেকটা কপালের ব্যাপার—
—জাল ফেলে দরকারমত মাছ ধরে নিতে পারেন তো? ছিপে যদি না আসে?
—নাঃ, আত্মীয়দের বলেছি নিজে মাছ ধরব। এখন জাল ফেলাটা—
বুঝলাম এখন কিছু মাছ অন্তত নিজে না ধরলে শ্বশুরবাড়ির মানুষদের কাছে তার সম্মান থাকবে না। একটু ভাবনাও হল। শরৎকালের এই সময়টায় চারে মাছ আসবে কি? এটা ঠিক মাছ ধরার সময় নয়। দেবদর্শন মানুষটি বড় ভাল, নিজে মাছ ধরে আত্মীয়দের খাওয়াবেন—এই সামান্য সাধটুকু পূর্ণ না হলে মনে ভারি দুঃখ পাবেন। কী করা যায়?
বিকেলের ছায়া গাঢ় হয়ে এলে গ্রামের পথে একটু বেড়াতে বের হলাম। শরৎসন্ধ্যার একটা আলাদা স্নিগ্ধ রূপ আছে। ঝোপঝাড় থেকে কেমন সুন্দর মিষ্টি গন্ধ বের হয়, মাথার ওপর দিয়ে পাখিরা বাসার দিকে উড়ে যায়। মাঠে-প্রান্তরে হালকা কুয়াশা জমে, ঈষৎ হিমের ছোঁয়া আর বেলাশেষের আলো হঠাৎই ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে পড়িয়ে দেয়। একটা জিনিস কখনও লক্ষ্য করেছ? সন্ধ্যের সময় যত পাখি আকাশে ওড়ে তারা সব পূব থেকে পশ্চিমে যায়, উল্টোদিকে খুব একটা কাউকে যেতে দেখবে না। অর্থাৎ কোনও অজ্ঞাত কারণে পাখিরা দিনের বেলা নিজেদের বাসার পূবদিকে ঘোরাফেরা করে। কী করে তারা দিক চিনতে পারে কে জানে!
পথের বাঁকে একজায়গায় একটা বড় আকন্দগাছ প্রায় আমার মাথা ছাড়িয়ে লম্বা। বড় বড় চ্যাটালো, ফ্যাকাসে সবুজ পাতায় ভরপুর প্রাণশক্তি প্রকাশিত হয়েছে। সে গাছ থেকে বুড়ো আঙুলের মত মোটা আর কড়ে আঙুলের মত লম্বা কিছুটা ডাল ভেঙে নিয়ে কোমরে গুজে রাখলাম। যাক, কাজ অন্তত কিছু এগিয়ে রইল।
সন্ধ্যে গাঢ় হতে মুখুজ্যেবাড়ি ফিরে এলাম। দেউড়িতে বসে বাতির কাঁচ পরিষ্কার করছিল রঘু, তাকে বললাম—হাতের কাজটা শেষ করে আমাকে একটা নরুণ এনে দিতে পার?
—আজ্ঞে, নরুণ? নখ কাটবেন বুঝি? কাল সকালে নলিন পরামাণিককে পাঠিয়ে দেব?
—কারুকে পাঠাতে হবে না। তুমি একটা নরুণ আমাকে দিয়ে যাও—
কিছুক্ষণ পরে রঘু অতিথিশালার ঘরে এসে একটা চকচকে নরুণ দিয়ে গেল।
রাত্তিরে খাওয়ার পরে বসে বসে নরুণ দিয়ে আকন্দগাছের ডাল থেকে একটা ছোট্ট গণেশমূর্তি কুঁদে বের করলাম। আকন্দকাঠ নরম, তাই অসুবিধে হল না। দেখতে বেশ ভালই হল। গণেশমূর্তি বানানোর একটা সুবিধে আছে, নাদা পেট আর সামনে শুঁড় দুলিয়ে দিলেই গণেশ। খুব বড় শিল্পী হওয়ার দরকার পড়ে না। মোটামুটি আদল আনতে পারলেই জিনিসটা কী তা বোঝা যায়।
পূজো উপলক্ষ্যে কাছারি এখন বন্ধ। নায়েবমশাইকে বলেছিলাম একটা নীলের বড়ি আমাকে জোগাড় করে দিতে। উনি কাছারির দরজা খুলে লেখার কালি বানাবার একখানা বড়ি এনে দিয়েছিলেন বিকেলে। মাটির ভাড়ে কুঁজো থেকে জল ঢেলে তাতে বড়ি গুলে গাঢ় নীল কালি বানিয়ে তাতে গণেশমূর্তি ভিজিয়ে রাখলাম কিছুক্ষণ। যখন তুললাম তখন সাদা আকন্দকাঠ রঙ টেনে কটকটে নীল হয়ে গিয়েছে।
তারানাথ সিগারেট ধরাবার জন্য থামল। জিজ্ঞাসা করলাম—নীল গণেশ দিয়ে কী হয়?
—নীল গণেশ খুব শুভকারী দেবতা। সঠিক আরাধনা করতে পারলে ওকে দিয়ে করানো যায় না এমন কাজ নেই। তোমাদের আগেও নীল গণেশের কথা বলেছি, তোমাদের মনে নেই।
যাই হোক, পরদিন সকালে জলখাবার খাওয়ার পর মুখুজ্যেমশাইয়ের ডাক এল। সরঞ্জাম তৈরি, এবার মাছ ধরতে যাওয়া হবে। কাছারিবাড়ির সামনে দেখি দেবদর্শন ব্যস্ত হয়ে কর্মচারীকে কী করতে হবে বোঝাচ্ছেন। একজন ভৃত্য পাঁচ-ছ’গাছা ছিপ নিয়ে দাঁড়িয়ে, মাটিতে ছড়িয়ে রয়েছে নানামাপের কৌটো আর ভাঁড়। তা থেকে মনোমুগ্ধকর সব গন্ধ বের হচ্ছে। হঠাৎ সম্মিলিত গলার কোলাহল শুনে দেখি কয়েকজন ভদ্রলোক নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে এদিকে আসছেন। বুঝলাম এরাই দেবদর্শনের শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়, এদের সামনেই তিনি মাছ ধরে দেখাতে চান।
রাণীদীঘি সত্যিই একটা বিশাল জলাশয়। এপার থেকে ওপারে দাঁড়ানো মানুষকে ভাল চেনা যায় না। যেখানে মাছ ধরতে বসা হবে সেখানে বাড়ির মেয়েদের স্নান করার জন্য বাঁধানো ঘাট, কয়েকখানা প্রাচীন আমকাঁঠালের ছায়ায় স্নিগ্ধ হয়ে আছে। দু-চারটে কলাপাতা পেতে দেবদর্শন মাছ ধরতে বসে গেলেন। একটু উঁচুতে পৈঠার ওপর শতরঞ্জি ভাঁজ করে বসলেন অতিথিরা। সকাল-বিকেলে সামান্য হিমের ভাব থাকলেও বেলা হবার সঙ্গে সঙ্গে রোদ্দুর বেশ চড়চড় করে বেড়ে ওঠে। কিন্তু এখানে সারাদিনই ছায়া থাকবে মনে হয়।
ছুপ ছুপ শব্দ করে জলে চার ছড়াচ্ছেন দেবদর্শন, গন্ধে চারদিক মম করছে। পুরুষ্টু কেঁচো দিয়ে টোপ গাথা হল, শক্ত মুঠোয় ছিপ ধরে তীক্ষ্ণ চোখ করে বসলেন বটে, কিন্তু জমিদারমশাই আজ কতটা সফল হবেন সে বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রইল। গত কুড়ি বছর ধরে মাছ ধরে আসছি, শরতের সকালে টোপে মাছ ঠোকরাতে খুব একটা দেখিনি।
দেবদর্শন আমার দিকে তাকিয়ে বললেন—ঠাকুরমশাইও একটা ছিপ নিয়ে বসে যান না, শুধু দেখবেন কেন?
—নাঃ, আজ আপনিই ধরুন। আজ আর হাত লাগাতে ইচ্ছে করছে না।
মাছ ধরতে ইচ্ছে করছিল না এমন নয়, কিন্তু ভাগ্যবশে ওর বদলে আমার ছিপে মাছ উঠলে উনি দুঃখ পেতেন। আর সত্যিকারের মেছুড়ে মাছ ধরা দেখতেও ভালবাসে। উনি বিশেষ পীড়াপীড়ি করলেন না। আমিও দেবদর্শনের পেছনে একখানা কলাপাতা পেতে বসে পড়লাম।
যা আশঙ্কা করেছিলাম তাই ঘটতে চলল। দুপুরে খাওয়ার সময় পর্যন্ত একটা মাছও চারে এল না। একসময় ছিপ গুটিয়ে রেখে উঠে দাড়িয়ে দেবদর্শন বললেন—চলুন, খেয়ে আসা যাক। তারপর আবার বসা যাবে। ততক্ষণ চার আর একটু জমুক—
আত্মীয়ের দলটিও একটু উসখুস করছিল, তারাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে নিচু স্বরে বললাম – চিন্তা নেই। খেয়ে এসে বসুন, পাবেন—
দেবদর্শন চমকে আমার দিকে তাকালেন, মুখে কিছু বললেন না, আমি একটু হাসলাম।
প্রথম হেমন্তের বেলা চট করে পড়ে আসে। খাওয়ার পরেই আর দেরি না করে আবার রাণীদীঘির পাড়ে ফিরে আসা হল। ছিপ মুঠো করে বসে গেলেন দেবদর্শন।
আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম জমিদারমশাইয়ের সব আত্মীয়েরা এখনও এসে পৌঁছোয় নি। যারা এসেছেন তারা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছেন, এদিকে কারো তেমন মনোযোগ নেই। আমি ধুতির ভাঁজে লুকিয়ে রাখা নীল গণেশের মূর্তিটা বের করে দেবদর্শনের মাথার ওপর দিয়ে দীঘির জলে ছুঁড়ে দিয়ে বললাম—শ্বেতার্ক নির্মিতং গণনাথং পঞ্চান্তকং ওঁ অন্তরীক্ষায় স্বাহা।
দেবদর্শন চমকে উঠে ফিরে তাকালেন, তার চোখে বিমূঢ় দৃষ্টি। বললেন – কে কী ফেলল জলে? এঃ, মাছ পালিয়ে যাবে যে! এতক্ষণে হয়ত চার একটু জমে আসছিল—
—ভাবনা নেই। ও আমি একটা জিনিস ফেলেছি—
—আপনি! সে কি! কী জিনিস?
উত্তরে বললাম—ঘুরে বসুন মুখুজ্যেমশাই। বাঁদিকের ছিপের ফাতনা কাঁপছে।
বড় মাছ। দু-তিনবার কেঁপে ফাতনা একেবারে নিতলি হয়ে গেল।
হর্ষধ্বনি করে আত্মীয়ের দল উঠে দাঁড়াল। ধনুকের মত বেঁকে গিয়েছে ছিপ, মাছ ছুটেছে দীঘির উত্তর-পশ্চিম কোণ লক্ষ্য করে। কিরকির আওয়াজ করে ঘুরে যাচ্ছে হুইল। গতকাল তামাক খেতে খেতে তাঁর মাছ ধরার সরঞ্জাম দেখিয়েছিলেন দেবদর্শন। কলকাতায় লোক পাঠিয়ে অনেক খরচ করে কিনে আনা মূল্যবান বর্মী বাঁশের ছিপ, বিলিতি হুইল আর বঁড়শি—খাঁটি ইস্পাতের তৈরি। শক্ত মুগার সূতো, মথুরা থেকে আনানো ময়ূরের পাখার ফাতনা—যত বড় মাছই হোক, একবার গাঁথলে আর সহসা ছাড়া পাবার উপায় নেই।
প্রায় পৌনে একঘণ্টা খেলাবার পর হুইল গুটিয়ে ঘাটের কাছে মাছটা টেনে আনলেন দেবদর্শন। তাঁর গা বেয়ে ঘাম ঝরছে। কিন্তু মুখ উজ্জ্বল। বড় মাছ গেঁথেছে এ খবর রটে যাওয়ায় রাণীদীঘির পাড়ে ভিড় জমে গিয়েছে। অনেকক্ষণ লড়ে যদিও মাছটা নিজীব হয়ে পড়েছে, তবু জলের ভেতর ও জিনিস বাঘের মত শক্তি ধরে। রঘু এবং আরও তিনজন লোক জলে নেমে পাঁজাকোলা করে জাপটে মাছটা ওপরে তুলে এনে ঘাটের পৈঠায় শুইয়ে দিল। অস্ফুট শব্দে ভিড় ঝুঁকে পড়ল সামনে।
চোদ্দ-পনেরো সের ওজনের বিশাল লালচে রুই। একটা বাছুরের মত বড়।
সবাই নানারকম প্রশংসাসূচক কথা বলছে, কেউ ফিতে এনে মাছটা মাপার কথা বলছে। আমি তাকিয়েছিলাম দেবদর্শনের দিকে। তিনি ভারি খুশি হয়েছেন। মানুষটির মনের মধ্যে কোনো ঘোরপ্যাঁচ নেই, এইটুকু কৃতিত্বতেই ভদ্রলোক তৃপ্ত।
বললাম—এতে হবে তো? না আর একখানা ধরবেন?
দেবদর্শন বললেন—না, না, এতেই খুব হয়ে যাবে। আজ তো কেবল বাড়ির লোক আর এই এরা, সবমিলিয়ে ধরুন তিরিশজন। মুড়ো আর আঁশ-টাশ বাদ দিয়ে যদি দশ কী এগারো সের মাছও পাই, তাহলেও ভেসে যাবে। আর ধরা উচিত হবে না, কোনো কিছুর অপচয় করতে নেই।
তারপর বললেন—সুন্দর মাছটা, বলুন? এর মুড়োটা কিন্তু আজ আপনাকে খেতে হবে—
—সে কী! আমি কেন? নিয়ম জানেন না? মাছ যে ধরেছে মুড়ো তাকেই খেতে হয়?
স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে দেবদর্শন বললেন—সেইজন্যই তো মুড়োটা আপনি খাবেন। নিয়ম জানি বলেই তো এ কথা বলছি—
আমরা দুজন কয়েকমুহূর্ত পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর আমি হেসে বললাম—বেশ তো, মুড়ো খেতে হয় খাব। কিন্তু মাছটা আপনিই ধরেছেন।
সবকিছু বাদ দিয়ে মোট সাড়ে-বারোসের মাছ পাওয়া গেল। পেটভরে মাছ খেয়ে সবাই ভারি খুশি। কেবল খেতে খেতে দেবদর্শন হাসি হাসি মুখে আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন।
পরের দুটো দিন ভালই কাটল। খাই-দাই আর গ্রামের পথে পথে ঘুরে বেড়াই। সত্যি বলতে কী, এ ক’দিন আরামে থেকে থেকে আমার অভ্যেসটাই খারাপ হয়ে গেল। আর বড় জোর দুদিন, তারপর আবার বেরিয়ে পড়তে হবে পথে।
বাঁশবাগানের পাশ দিয়ে যে পথটা বেঁকে নদীর দিকে চলে গেল, সেই পথে সন্ধ্যের দিকে রোজ হাঁটতাম। দুদিন পরে পূর্ণিমা, রাঙা চাঁদটা পূব দিগন্তের একটু ওপরে ভেসে থাকে দেবতাদের দেওয়া আকাশপ্রদীপের মত। আমবাগানের ওপারে ঝোপঝাড়ের মধ্যে থেকে শেয়ালের দল একসঙ্গে ডেকে ওঠে। বর্ষা চলে যাবার পর জোনাকির ঝাঁক বিদায় নিয়েছে, তবু দেরি করে রয়ে যাওয়া দু-দশটা গাছ-গাছালির ফাঁকে ফাঁকে জ্বলে-নেভে। বাংলার পল্লী অঞ্চলের এই পরিবেশ আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, শহুরে চালচলন আর ভাবধারা ঢুকে পড়েছে গ্রামে। তোমরা যারা দেখছ তারা জানো, তোমাদের সন্তানেরা হয়ত এ জিনিস আর পাবে না।
লক্ষ্মীপূজোর দিন খুব ভোরে উঠে শিশিরভেজা ঘাসের পথে হেঁটে নদীতে স্নান করতে গেলাম। হেমন্তের সকালে অবগাহন স্নান ভারি আরামের, একটা পবিত্রতার বোধ এনে দেয়।
স্নান করে ফিরতে রঘু এসে বলল—ঠাকুরমশাই, কর্তাবাবু বৈঠকখানায় এসে বসেছেন। আপনাকে ডাকছেন। আপনি আজ ওখানেই জলখাবার খাবেন।
বৈঠকখানায় তাকিয়া হেলান দিয়ে আলবোলার নলে টান দিচ্ছেন দেবদর্শন। এই সকালেই তাঁরও স্নান হয়ে গিয়েছে। আমাকে দেখে বললেন—বসুন। ওরে রঘু, ঠাকুরমশাইকে তামাক দিয়ে যা।
তামাক এল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জলখাবার। খাঁটি ঘিয়ে ভাজা খাস্তা পরোটা, বেগুনভাজা এবং একথাবা সর—তার ওপরে মোটা করে চিনি ছড়ানো। বললাম—একি! আমার একার জন্য কেন? আপনার কই?
—আমি এখন খাব না। কোজাগরী লক্ষ্মীপূর্ণিমায় আমি সারাদিন নির্জলা উপোস করি। রাত্তিরে একেবারে পূজোর পর অঞ্জলি দিয়ে প্রসাদ নেব। আপনি সঙ্কোচ বোধ করবেন না, শুরু করুন।
তারপর তামাকের নলে গোটা দুই লম্বা টান দিয়ে বললেন—আজ আপনাকে একটা মজার জিনিস খাওয়াব—
—আপনার সঙ্গে আলাপ হবার পর থেকে কেবলই তো নানারকম খাবার খাচ্ছি। আজ আবার কী?
—আজকেরটা ঠিক খাবার বলা যায় না, বরং পানীয় বলতে পারেন—
একটু অবাক হয়ে বললাম—পানীয়। তার মানে—কিন্তু আপনি তো—ইয়ে, কী পানীয়ের কথা বলছেন?
দেবদর্শন হাসলেন, বললেন—ভয় নেই, কড়া কোনও পানীয় নয়। আপনাকে গড়গড়ির জল খাওয়াব—
—গড়গড়ির জল! সে আবার কী?
মুখ থেকে নল নামিয়ে দেবদর্শন বললেন—একমাত্র শীতকাল ছাড়া আমাদের দেশে তেমন ঠাণ্ডা খাবার জল পাওয়া যায় না। গরমকালে মাটির জালায় রাখা হলে কিছুটা ঠাণ্ডা হয় ঠিক, কিন্তু একেবারে বরফজলের মত তো আর হয় না। আমাদের এই পাড়াগাঁয়ে বরফ পাওয়াও যায় না, তাই কোনো ঘরোয়া উৎসবে অতিথিদের দাঁত শিরশির করা কনকনে জল খাওয়াবার ইচ্ছে হলে আমি গড়গড়ির জলের ব্যবস্থা করি।
—সে তো বুঝলুম, কিন্তু জিনিসটা কী?
—মোগল আমলে সম্রাটেরা এই পদ্ধতিতে জল ঠাণ্ডা করতেন। একটা বড় পেতলের হাঁড়ির মধ্যে অর্ধেক ভর্তি করে জল ঢেলে তাতে বেশ কিছুটা সোরা মিশিয়ে দেওয়া হয়। কালীপুজো আসছে, গ্রামের ছেলেপুলেরা অনেকেই আতসবাজি তৈরি করে, তাই এ সময়টায় সারের দোকানে সোরা পাওয়া যায়। একটা কাঠের ডান্ডা দিয়ে ভাল করে ঘুটে দিলে জলটা বরফের মত ঠাণ্ডা হয়ে যায়। এবার একটা জলভর্তি সরু গলা ধাতুর পাত্র ওই হাঁড়ির মধ্যে বসিয়ে দিলে আধঘণ্টার ভেতর সে জলও কনকনে ঠাণ্ডা হয়ে যায়। ভরপেট খাবার পর ঠাণ্ডা জল ভারি তৃপ্তিদায়ক, বলুন?
বলবার আর বিশেষ কী ছিল, দুপুরে আহারাদির পর গড়গড়ির জল খেয়ে হাতেনাতে ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। দেবদর্শনের সব অতিথিরাই সে জল খেয়ে অবাক।
দুপুরের পর থেকে মেয়েরা বসে গেলেন পূজোদালানের মেঝেতে চালবাটা দিয়ে আলপনা দিতে। এই জিনিসটা আমাকে চিরকাল মুগ্ধ আর বিস্মিত করে। বাঙালীর জীবনে যতই বারো মাসে তেরো পার্বণ হোক, মাসে পনেরোদিন তো আর মেয়েদের আলপনা দেবার জন্য বসতে হয় না। তাহলে নিয়মিত অভ্যাস ছাড়া তাঁরা এত সুন্দর আর নিখুঁত আলপনা দেন কী করে? পরিষ্কার মেঝেতে যেন জাদুবনে ফুটে উঠছে ছোট ছোট কুটির, তার দুপাশে কলাগাছ, সামনে সরু পথ—সে পথে লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ আঁকা। তাছাড়া ধানের গোলা, ধানের ছড়া। পাশেই বসে রয়েছে গম্ভীরমুখ প্যাঁচা। বড় বড় কানওয়ালা সে প্যাঁচারা আসল প্যাঁচার চাইতেও দেখতে অনেক ভাল।
সূর্য অস্ত গেল। পুরোপুরি অন্ধকার নামবার আগেই পূবদিগন্ত বেয়ে উঠে এল সোনালি রঙের পূর্ণিমার চাঁদ। আমাকে বৈঠকখানায় বসিয়ে রেখে দেবদর্শন স্নান করতে গিয়েছিলেন। এবার স্নান সেরে গরদের ধুতি আর চাদর পরে এসে তিনি বললেন—চলুন ঠাকুরমশাই, পূজোর সময় হয়েছে—
আমি উঠে দাড়াবার আগেই হঠাৎ বাইরে কীসের একটা হই-চই শোনা গেল। ঘরে এসে ঢুকল রঘু, নায়েবমশাই এবং আরও কয়েকজন লোক। তারা সবাই খুব উত্তেজিত, সবাই একসঙ্গে কী একটা বলতে চাইছে। দেবদর্শন অবাক হয়ে বললেন—কী হয়েছে? কী ব্যাপার?
তারা কিছু বলবার আগেই ভিড়ের পেছন থেকে এগিয়ে এল একজন মানুষ। সেও উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছে।
লোকটি ভূষণ রায়।
দেবদর্শন বললেন—একি ভূষণ! কী হয়েছে? গোলমাল কীসের?
॥ দশ ॥
ঘরের মধ্যে একটা উৎকণ্ঠিত নীরবতা। কিন্তু দেবদর্শনের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝতে পারলাম ভূষণ রায় কিছু বলার আগেই উনি উত্তরটা জেনে গিয়েছেন।
ভূষণ রায় বললেন–রাজাবাবু! আপনি বিলিতি ডার্বির সেকেন্ড প্রাইজ পেয়েছেন! আশি হাজার টাকা। এই একটু আগে টেলিগ্রামে খবর এসেছে।
বলতে বলতে ভূষণ রায় উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে বসে পড়ে দুইহাতে নিজের মাথা ধরে রইলেন। হঠাৎ দেখলে মনে হবে তিনি এক্ষুণি একটা ভয়ানক খারাপ খবর পেয়েছেন। আসলে চরম শোক আর চরম উল্লাসের প্রকাশ অনেকটা একই রকম।
বাইরে একটা সম্মিলিত গলার কোলাহল শুরু হল। এসব খবর বাতাসের মত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। যারা পূজো দেখতে আর প্রসাদ পেতে এসেছে তারা সবাই চেঁচাচ্ছে—জয় রাজাবাবু! জয় মা লক্ষ্মী! যারা দেরী করছিল তারাও খবর পেয়ে দলে দলে এসে ভিড় বাড়াচ্ছে। মানে ভূষণ রায় আসবার পথে খবরটা ছড়াতে ছড়াতে এসেছেন।
দেবদর্শন আমার হাতদুটো একবার চেপে ধরলেন। তার চোখে বিস্মিত কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি। তারপর বললেন—একটু বসুন। আমি একবার ভেতর থেকে আসছি। বাইরে গোলমাল শুনে ওঁরা হয়ত ভয় পাচ্ছেন।
একটা বাদেই বাড়ির ভেতর থেকে উলুধ্বনি আর শাঁখের আওয়াজ ভেসে এল। বুঝলাম দেবতার কাছে পারিবারিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ আরম্ভ হয়েছে।
ভূষণ রায় এখনও মাটিতেই বসে আছেন। মানুষটি এমনিতে নম্র আর নিরীহ হলেও বেশ বুদ্ধিমান। কথা বিক্রি করে যাদের খেতে হয় তাদের বোকা হলে চলে না। কিন্তু বাস্তব ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি বর্তমানে কেমন যেন থতিয়ে গিয়ে প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকিয়ে বিগলিত অর্থহীন হাসি হাসছেন। জিজ্ঞাসা করলাম—আপনার বিক্রি করা টিকিটে এর আগে কখনও প্রাইজ উঠেছে?
মাথা নেড়ে ভূষণ রায় বললেন—নাঃ। কক্ষণো না। এই প্রথম—
—ছোটখাট প্রাইজও ওঠেনি কখনও? দু-পাঁচশো কিম্বা অমনি কিছু?
—না ঠাকুরমশাই। প্রাইজের টাকার কমিশন কখনও চোখে দেখিনি, কেবল টিকিট বিক্রি করলে টাকায় ছ-পয়সা করে পাই। তাতে কি সংসার চলে? আমার ছাতা আর জামা-জুতোর তালি দেখুন, বাড়ি গিয়ে ডিগডিগে ছেলেপুলেগুলোকে দেখে আসুন—এবার পুজোয় কারও জামাকাপড় হয়নি ঠাকুরমশাই।
—এই টাকা থেকে আপনি কত পাবেন?
—কোম্পানী থেকে বেশি নয়। বেশির ভাগটাই নিয়ে নেবে কলকাতার যে আসল এজেন্ট, সে। আমাকে হাজার দুয়েক দেবে বোধহয়। কী আর করব? যা দেয় তাই অনেক। তবে রাজাবাবু মানুষ খুব ভাল, উনি কি আর কিছু দেবেন না? নিশ্চয় দেবেন—উনি আমাকে ভালবাসেন—
দেবদর্শন ভেতর থেকে ফিরে এলেন। তক্তাপোষে তাকিয়া হেলান দিয়ে বসে প্রথমেই বললেন—ভূষণ, এর থেকে পাঁচ হাজার টাকা আমি তোমাকে দেব। তোমার জন্যই তো প্রাইজটা পেলাম—
ভূষণ রায় তার দিকে তাকিয়ে বললেন—আমার জন্য নয়, এই যে এই ঠাকুরমশাইয়ের জন্য। আমার টিকিটে কিছুই পেতেন না, ইনি বেছে দিয়েছিলেন বলেই—
—সে কথা ঠিক, সে কথা ঠিক। যাক, তোমরা এখন সবাই পুজোর মণ্ডপে যাও। আমিও আসছি—
উপস্থিত লোকেরা টিকিট পছন্দ এবং বদলানোর ব্যাপারটা কিছুই জানে না। তারা একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ভূষণ রায় বললেন—চল, চল হে। পুজোর জায়গায় চল। রাজাবাবু বিশ্রাম করে আসছেন—
ভূষণ রায় গপ্পে লোক, বুঝলাম কিছুক্ষণের মধ্যেই টিকিট বদল করে দেবার ঘটনাটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। এও বুঝলাম যে, হয় কাল, নয় পরশু সকালে আমাকে এ গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে। ভূষণ রায়ের গল্প শুনলেই মানুষের স্রোত শুরু হবে—কারও সস্তান হয়ে বাঁচে না, কারও অম্লশূলের ব্যথা, কারও ভাই মামলা করেছে, কেউ বা আবার হঠযোগ শিখতে চায়। পালানো ছাড়া গতি নেই।
কিশোরী বলল—পালাবেন কেন? আপনি কি এসবের প্রতিবিধান করতে পারেন না?
একটু চুপ করে থেকে তারানাথ বলল—হয়ত পারি। বিশ্বের যাবতীয় দুঃখকষ্ট দুর করার ক্ষমতা যদি আমার থাকত তাহলে আমি অন্য সব কিছু ছেড়ে সেই কাজে লেগে পড়তাম। তা নয়। আসলে মধুসুন্দরী দেবী আর বীরভূমের শ্মশানের মাতু পাগলী আমাকে কিছু সাধারণ ক্ষমতা দিয়েছিলেন, খুব মাঝারি সিদ্ধাই গোছের জিনিস। তা দিয়ে চটজলদি ভেলকি দেখানো যায়, কিন্তু তার চেয়ে বড় মাপের কিছু হয় না। এককালে টাকা উপার্জন করার জন্য তাও করেছি। সে সময়টা তোমাদের সঙ্গে আলাপ হয়নি। আমার বাড়ির সামনে মাড়োয়ারীদের মোটরগাড়ির ভিড় লেগে থাকত। বেশি ব্যবহারে আর অপব্যবহারে সে শক্তি চলে গেল, তারপর থেকেই এই খারাপ সময় যাচ্ছে—
খারাপ সময় যে যাচ্ছে তাতে আর সন্দেহ কী? প্রথম যেদিন আমরা আলাপ করতে এসেছিলাম, সেদিন আমাদের পাওনাদার ভেবে তারানাথ প্রথমে বাইরে আসেনি। তার ছেলে এসে আমাদের কী প্রয়োজন জেনে ভেতরে গিয়ে খবর দিতে তারপর তারানাথ বেরিয়েছিল। মানুষ হিসেবে তার চরিত্র আদর্শ বা প্রশংসনীয় হয়ত নয়, কিন্তু তার ব্যক্তিত্বের একটা আশ্চর্য আকর্ষণী ক্ষমতা আছে। তার গল্প বিশ্বাস হোক বা না-ই হোক, শেষ না হওয়া পর্যন্ত উঠে আসার উপায় থাকে না।
তারানাথ আবার বলতে শুরু করল।
উজ্জ্বলমুখে বাড়ির ভেতর থেকে ফিরে এলেন দেবদর্শন! বললাম—কী, কেমন লাগছে?
মানুষটি অত্যন্ত সংযমী। যে খবর তিনি একটু আগে শুনেছেন অন্য কেউ সে সংবাদ পেলে কী যে করত তার ঠিক নেই। কিন্তু দেবদর্শন বাইরে কোনও উচ্ছাস না দেখিয়ে সবাইকে বললেন—যাও, তোমরা পুজোর জায়গায় যাও। আমি আসছি— তক্তাপোষের একপাশে বসে তাকিয়ায় কনুই রেখে হেলান দিয়ে দেবদর্শন, তারপর বললেন—ঠাকুরমশাই, টাকাটা তাহলে পাইয়েই দিলেন?
হেসে বললাম—আমি কেন? টিকিট বিক্রি করেছে ভূষণ রায়, কিনেছেন আপনি। ঘোড়া দৌড়েছে বিলেতে, খবর এসেছে ডাকবিভাগের টেলিগ্রামে—আমি কী করলাম?
দেবদর্শন মিষ্টি করে হাসলেন। তার ব্যক্তিত্বের স্বরূপটাই মিষ্টি।
—ওসব কথা থাক, আপনি কী করেছেন আমি তা জানি। কেবল কয়েকটা জিনিস ঠিক বুঝতে পারছি না—
—যেমন? কী জিনিস?
—আবছা আবছা বুঝতে পারছি অমরজীবনের ছড়ার সঙ্গে টিকিটের নম্বরের একটা কিছু যোগ আছে। নইলে ভূষণ রায়ের পছন্দ করে দেওয়া টিকিট আপনি বদলাতে বলবেন কেন? ছড়াটার মানেই বা কী?
বললাম—মুখুজ্যেমশাই, অমরজীবন ছড়ার মধ্যে যে সংকেত ব্যবহার করেছিল সেটা একটা পুরনো ধাঁধা। আমাদের ছোটবেলায় দেশে ঘরে খুব প্রচলিত ছিল। নানারকম চেহারায় এই ধাঁধা বাসরঘরে কিংবা বাড়িতে জামাই এলে তাকে ঠকানোর জন্য ফিরে ফিরে দেখা দিতো। ছোটবেলায় ধারাপাত পড়েছেন তো? ধারাপাতের প্রথম দিকে একে চন্দ্র, দুইয়ে পক্ষ’ কবিতাটা মনে পড়ছে কি? অমরজীবনের ছড়ার মূল সংকেতও ওই ধারাপাতের কবিতা।
দেবদর্শন বললেন—ঠিক বুঝতে পারছি না ঠাকুরমশাই। আর একটু খুলে বলবেন?
বললাম—কবিতাটা মনে করুন। দিকে দিকে সাগরেতে ভাই/চোখে চোখে চাঁদ খুঁজে পাই’। দিক কখানা? চারটে তো? পূব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ। তাহলে দুবার দিক’—অর্থাৎ ৪-৪, ঠিক আছে? পরের কথা সাগরেতে’। সাগর কটা? না, সপ্তসমুদ্র। তাহলে এ পর্যন্ত কী হল? দিক, দিক, সাগর—৪-৪-৭। পরের লাইনে ছড়ায় বলেছে—“চোখে চোখে চাঁদ খুঁজে পাই।’ তিনে নেত্র, অর্থাৎ পরপর দুটো তিন হবে। আর চাঁদ তো একটা। কাজেই পুরো সংখ্যাটা দাড়ালো ৪ ৪ ৭ ৩ ৩ ১। আপনি এর চারখানা আগের নম্বরের টিকিট নিচ্ছিলেন। নিলে একটুর জন্য প্রাইজটা হাতছাড়া হয়ে যেতো। আমি কেউ না, মুখুজ্যে মশাই। পুরস্কারটা আপনার ভাগ্যই পাইয়ে দিয়েছে—অমরজীবনের মাধ্যমে।
কিছুক্ষণ একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন দেবদর্শন। তারপর বললেন—অমরজীবন কে?
বললাম—আমি জানি না মুখুজ্যেমশাই। এ প্রশ্ন আপনি আগেও করেছেন, উত্তর জানা থাকলে আমারও আনন্দ হতো। কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর না জানাই থাক না। তাতে জীবন সরস থাকে, জীবনে বিশ্বাস থাকে, আনন্দ থাকে। সব জেনে ফেলতে নেই। চলুন, পুজোর সময় হলো, আপনার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে—
দেবদর্শনকে পুজোমণ্ডপে আসতে দেখে সবাই হর্ষধ্বনি করে উঠে দাঁড়াল। সেদিনকার পুজোর পরিবেশই আলাদা। অকস্মাৎ ঘটে যাওয়া কোনও অলৌকিক ঘটনা, অন্তত আমরা সঠিক ব্যাখ্যার অভাবে যাকে অলৌকিক বলে মনে করি, তা মানুষের মনে বিশ্বাস আর ভক্তির জোয়ার এনে দেয়। সেদিনও তাই হয়েছিল—
বললাম—তাতে আর অন্যায় কী? রোজকার জীবনে যা ঘটে না, তেমন অদ্ভুত কিছু চোখের সামনে ঘটতে দেখলে মানুষ তো আপ্লুত হবেই, তাই না?
একটা পাসিং শো ধরিয়ে তারানাথ বলল—সাধারণভাবে কথাটা ঠিক, কিন্তু ওই বিশ্বাস আর আবেগের প্রকৃত কোনও মূল্য নেই—
কিশোরী বলল—কেন, একথা বলছেন কেন? হয়ত আশ্চর্য বা অলৌকিক কিছু দেখে বিশ্বাস বা ভক্তির ভাব জেগে উঠেছে, কিন্তু তাতে ওই বিশ্বাস কি মিথ্যে হয়ে যাবে? এ যুক্তি আমার ঠিক বলে মনে হচ্ছে না—
তারানাথ বলল—মিথ্যে হয়ে যাবে এমন কথা বলছি না, কিন্তু সরল বিশ্বাসের মূল্য তার সারল্যেই। কিছু পাব বলে আমরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না, ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে ভাল লাগে বলেই তা করি। যদি কেউ অন্যরকম করে, তবে তা দোকানদারি। বাবার সম্পত্তি পাব, তাই বাবাকে ভালবাসি—এ কেমন কথা?
কিশোরী বলল—সে আশা কি মনের কোণে একটু থাকে না?
—থাকলে সে কেমন ভালবাসা তুমিই ভেবে দেখ। জানি, যে কোনও ভালবাসাই শেষ পর্যন্ত স্বার্থের ওপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে থাকে—মাও যে শিশুকে ভালবাসেন, তা ওই ভালবাসার পরিবর্তে বাৎসল্যের রসঘন তৃপ্তিদায়ক অনুভূতি হয় বলেই। তবু নিছক বৈষয়িক স্বার্থের চেয়ে কি তা ভাল নয়? কোন না কোন আসক্তি যদি জীবনে থাকতেই হয়, তাহলে ঈশ্বরে নিষ্কাম আসক্তি থাকুক—
আলোচনার গতি দেখে ভেতরে ভেতরে ক্রমাগত উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিলাম। কিশোরটা চিরকালের বুদ্ধিহীন কুতার্কিক, বেশ জমাট গল্পের স্রোত বয়ে চলেছে, হঠাৎ এর মধ্যে নৈয়ায়িক আচার্যের সদসৎ বিচার না আনলেই কি চলত না? এখন তর্ক জমে উঠলেই গল্প ডুবে যাবে। বললাম—সে তো ঠিকই, খুব ন্যায্য কথা। যাই হোক, অমরজীবন-রহস্য কি শেষ পর্যন্ত ভেদ হয়েছিল?
তারানাথ বলল—না। অমরজীবনের কাহিনী এখনও চলছে।
একটু বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকালাম। তারানাথ ও-প্রসঙ্গে আর কিছু বলল না বটে, কিন্তু কেমন করে যেন স্পষ্ট বুঝতে পারলাম সে কী বলতে চায়। মানবসভ্যতার ইতিহাসের সঙ্গে বোধ করি অমরজীবনের গল্পটা মিশে রয়েছে, হঠাৎ কোথাও তো তা শেষ হবার নয়।
বললাম—এ গল্পের তাহলে এখনও অনেক বাকি?
—অনেক। আজকে তো শেষ হবেই না, যতদিন বাঁচব একটু একটু করে বলে গেলেও শেষ হবে না। তা সে যাই হোক, আপাতত দেবদর্শন মুখুজ্জের অংশটুকু বলে শেষ করি। তারপর আবার আর একদিন হবে। তোমরা পানিফল তো খেয়েছ নিশ্চয়, পুকুরে পানিফলের ঝাঁক দেখেছ কখনও?
হঠাৎ হঠাৎ তারানাথ এরকম কথার গতি পরিবর্তন করে থাকে। হেসে বললাম— দেখেছি। আমারও তো গ্রামেই বাড়ি। কেন?
—পানিফলের ঝাঁক অর্ধেক পুকুর ছেয়ে থাকে, কিন্তু যে কোন একটা জায়গা ধরে টান দিলে সবটা একসঙ্গে নড়ে ওঠে। আমাদের বেঁচে থাকাও ঠিক তাই। আলাদা ঘটনা বলে কিছু হয় না। সবকিছু সবকিছুর সঙ্গে সম্পর্কিত। আমি তুমি দেবদর্শন অমরজীবন জীবন মৃত্যু হাসি কান্না—সব। তোমাদের এখনও বয়েস অল্প, পরে নিজেরাই সব বুঝবে।
ছাইদানি হিসেবে ব্যবহৃত নারকেলের মালায় সিগারেটের দগ্ধাবশিষ্টটুকু গুঁজে দিয়ে তারানাথ শুরু করল।
—পূর্ণিমার আলোয় চারদিক ভেসে যাচ্ছে। তেমন জ্যোৎস্না তোমরা শহরে কখনও দেখবে না। পাখিরা সকাল হয়ে গিয়েছে মনে করে ডাকতে আরম্ভ করে। ঈষৎ শীত-শীত ভাব পরিবেশে, অথচ পুরো ঠাণ্ডা পড়েনি। এখানে ওখানে কাশের গুচ্ছ চাঁদের আলোয় দেখাচ্ছে যেন রূপোর মেঘ। পুজোমণ্ডপে বডড ভিড়, তাছাড়া আজ দেবদর্শনের প্রাইজ পাওয়ার ব্যাপারটা সর্বত্র উত্তেজনা তৈরি করেছে। ভূষণ রায় আর আমাকে দেখলেই লোকে কথা বলবার জন্য দাঁড়িয়ে পড়ছে। তার চেয়ে ভিড় থেকে দূরে আপনমনে থাকাই ভাল।
মুখুজ্জেবাড়ির বাঁদিকে নদীতে যাবার পথের মুখে একটা পুরনো ভাঙা মন্দির। জ্যোৎস্নায় দেখাচ্ছে যেন হালকা জলরঙে আঁকা ছবি। সেদিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ মাথার ওপর দিয়ে নিঃশব্দে ডানা মেলে একটা বেশ বড় সাদা লক্ষ্মীপ্যাঁচা উড়ে গিয়ে মন্দিরের চূড়ায় বসল। মন্দিরটা মুখুজ্জে-পরিবারের পূর্বপুরুষদের প্রতিষ্ঠিত, বর্তমানে আর্থিক কারণে কিছুটা ভগ্নদশাপ্রাপ্ত হলেও একজন পুরোহিত সেখানে নিত্যপূজা করে আসেন, সন্ধেবেলা আরতি হয়। মন্দিরের প্রতিষ্ঠিতা দেবী বিশালাক্ষী। কালো পাথরের মূর্তি, ভারি প্রশান্ত মুখ। ঠিক আজকের দিনেই বংশের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর মন্দিরের ওপর লক্ষ্মীপ্যাঁচার উড়ে বসাটা একটা সুলক্ষণ।
মৃদু পায়ের আওয়াজ শুনে পাশে তাকিয়ে দেখি কখন দেবদর্শন এসে দাঁড়িয়েছেন, হাতজোড় করে প্রণাম করছেন মন্দিরের দিকে মুখ করে। তাঁর মুখ উদ্ভাসিত।
বললাম—প্রণামটা কি প্যাঁচাকে?
দেবদর্শন হেসে বললেন—না, দেবীকে। তবে ঈশ্বরের প্রকাশ সর্বজীবেই, প্যাঁচাকে প্ৰণাম করলে অন্যায় কী?
—অন্যায় আর কী! যে স্তরে উঠলে ওই উপলব্ধি হয়, সেখানে পৌঁছলে সবাই সমান। আর প্যাঁচা প্রাণীটিও বেশ সুন্দর—
দেবদর্শন কেবলমাত্র দুঁদে বৈষয়িক জমিদার নন সেকথা তো আগেই বলেছি। মানুষটার ভেতর কবিত্ব আর সৌন্দর্য মিশে গিয়ে চমৎকার একটি স্নিগ্ধ রসায়ন তৈরি করেছে। তিনি বললেন—পুজোমণ্ডপে বেজায় ভিড় জমেছে। আপনাকেও দেখতে পেলাম না। ঠিক বুঝেছি আপনি এখানে এসে দাঁড়িয়ে আছেন। তাই আমিও চলে এলাম। কী অপূর্ব জ্যোৎস্না ফুটেছে দেখছেন। এই দেখ, ইনি আবার একা চললেন কোথায়?
জমিদারবাড়ি থেকে বেরিয়ে এক ঘোমটা দেওয়া বৌ মানুষ পায়ে চলা সুঁড়ি পথটা দিয়ে বিশালাক্ষী মন্দিরের দিকে চলেছেন। বোধহয় মুখুজ্জেগিন্নী, মন্দিরে প্রণাম করে তারপর পুজোর জায়গায় যাবেন। বললাম—বৌঠান না?
দেবদর্শন বললেন—হ্যাঁ। কিন্তু একা যাচ্ছেন কেন? বাড়ির বাকি মেয়েরা কই? পেছনে সব আসছে বোধহয়—
দেবদর্শনের স্ত্রী কিন্তু মন্দিরের পৈঠায় বা চালাতে দাঁড়িয়ে প্রণাম সারলেন না, সিঁড়ি বেয়ে উঠে মন্দিরে ঢুকে গেলেন। আমরা এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে বেরুবার সময় উনি আমাদের দেখতে পাবেন, ওঁর অস্বস্তি হতে পারে সেকথা ভেবে আমি বললাম—চলুন মুখুজ্জেমশাই, নদীর দিক থেকে একটু ঘুরে আসি—
আবার বলছি, সে-সব দিনের কথা ভাবলে এখনও বুকের মধ্যেটা কেমন করে ওঠে। জ্যোৎস্না এত সাদা ধপধপে যে, নদীর ধারের সাদা বালির চরে দাঁড়িয়ে সময়টা দিনের বেলা বলে ভুল হয়। খুব হালকা বাতাসে চরে গজিয়ে ওঠা কাশগুচ্ছ দুলছে, কট্ কট্ করে ডাকছে কী একটা নিশাচর পোকা। বয়েস অল্প, পৃথিবী বিশাল, শরীর নীরোগ, প্রকৃতি সুন্দর, ঈশ্বর তার সিংহাসনে আসীন—এবং দুনিয়ার সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। তখন অমর ছিলাম, পৃথিবীতে কোনও গ্লানি ছিল না, কালো রঙ ছিল না, বুকভরা অকারণ আনন্দ ছিল, মৃত্যু ছিল আবছা জনশ্রুতি। সে বাংলাও আর নেই—আমার এই কথাকে জীবনের পেছনদিকে ফিরে তাকিয়ে প্রৌঢ়ের স্বাভাবিক হাহাকার মনে কোরো না—তখন দিনকাল সত্যিই অন্যরকম ছিল। মনের ভেতরের সেই আনন্দ মিশিয়ে শরৎরাত্রি অপরূপ হয়ে উঠত।
যুগ যুগ ধরে শারদ পূর্ণিমার রাত্রির সঙ্গে উৎসবের একটা সম্পর্ক আছে বলেই কিনা জানি না, এই রাত্তিরটার একটা মায়াময় রূপ আছে। দেবদর্শনের বড় গুণ, তিনি অকারণে কথা বলে পরিবেশের গাম্ভীর্য নষ্ট করেন না। কাশফুলে ঢাকা জ্যোৎস্নামাখা সাদা বালির চরে দুজনে বেশ কিছুক্ষণ পায়চারি করলাম, কিন্তু দেবদর্শন কথা বলে পরিবেশের মাধুর্য নষ্ট করলেন না। কিছুক্ষণ পরে আমিই বললাম—চলুন, এবার ফিরে যাই। পুজো এতক্ষণ শেষ হয়ে এলো।
ফেরবার সময় আমাদের ডানদিকে বাঁশঝাড়ের পাশে বিশালাক্ষী মন্দিরটা পড়লো, তার ওধারে মুখুজ্জেবাড়ি। আর বাঁদিকে পথ থেকে একটু ভেতরে পুজোমণ্ডপ। পুজোর জায়গায় ঢোকবার মুখে দেবদর্শন থমকে দাঁড়িয়ে নিজের বাড়ি থেকে আসার পথের দিকে তাকিয়ে একটু অবাক গলায় বললেন—এ কী! এদের আজ হল কী! বারবার কোথায় যাওয়া-আসা করছে?
তাকিয়ে দেখলাম মুখুজ্জেগিন্নী বাড়ির অন্য মেয়ে-বৌদের সঙ্গে চলেছেন পুজোমণ্ডপে। মানে তিনি বিশালাক্ষী মন্দিরে প্রণাম করে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন, এখন আবার সবাইকে নিয়ে পুজো দেখতে যাচ্ছেন।
পুজো শেষ হয়ে গেল, পুরোহিত শান্তিজল আর চরণামৃত দিলেন সবাইকে। ওদিকে কয়েকজন কর্মচারী প্রসাদ বিতরণ শুরু করেছে। ছোট ছোট চেরা কলাপাতার টুকরোয় চটকে মাখা। খিচুড়ি-ভোগ একটু বেশি রাত্তিরে শুরু হবে। বাচ্চারা সামিয়ানার নিচে ছোটাছুটি করছে, বয়স্করা নিজেদের মধ্যে গল্পগুজবে ব্যস্ত। আমরাও বৈঠকখানায় ফিরে এলাম। কোনও কারণে দেবদর্শনের ভ্রূ কুঁচকে রয়েছে, কিছু একটা ভাবছেন ভদ্রলোক।
রঘু তামাক দিয়ে গেল। তামাক টানতে টানতে এটা-সেটা গল্প করছি, কিন্তু দেবদর্শনের মুখের গম্ভীর ভাবটা যাচ্ছে না। হঠাৎ উনি বললেন—ঠাকুরমশাই, আমার স্ত্রী যখন প্রথমবার একা বিশালাক্ষী মন্দিরে প্রণাম করতে যাচ্ছিলেন, তখন তার হাতে কিছু ছিল কি?
অকস্মাৎ এই প্রশ্নে একটু অবাক হয়ে বললাম—হাতে? আমি তো ঠিক—দাঁড়ান, একখানা ডাঁটাওয়ালা পদ্ম ছিল বোধহয়, তাই না?
দেবদর্শন বললেন—আর দ্বিতীয়বার?
—যখন বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে আসছিলেন?
—হ্যাঁ।
—তখন তো হাতে পুজোর ডালা ছিল। কেন, এ প্রশ্ন করছেন কেন?
দেবদর্শন যেন কিছুটা আপনমনেই বললেন—তাহলে পদ্মটা উনি কোথায় রেখে এলেন? পরে তো হাতে ছিল না—
এই সামান্য ব্যাপারে দেবদর্শন ব্যস্ত হচ্ছেন কেন বুঝতে পারলাম না। বললাম – ডালাতেই রাখা ছিল হয়তো, পাশ থেকে দেখা যায় নি।
—তাই? তা হবে হয়ত, অন্ধকারে বুঝতে পারিনি। নইলে আর যাবে কোথায়?
মানুষের একটা না একটা বাতিক থাকেই, ভেবে মজা লাগল। দেবদর্শনের মত বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান লোক এই সামান্য একটা বিষয় নিয়ে এতক্ষণ মাথা ঘামাচ্ছেন!
নিমন্ত্রিতদের খাওয়া মিটতে মিটতে অনেক রাত্তির হয়ে গেল। এ পরিবারের নিয়ম, বাইরের কারও খাওয়া বাকি থাকতে বাড়ির কেউ খেতে বসবেন না। আমরা বৈঠকখানাতে বসেই তামাক খাচ্ছিলাম, রাত একটা কী দেড়টা নাগাদ রঘু এসে দেবদর্শনকে বলল—চলুন কর্তামশাই, খাবার জায়গা হয়েছে—
ভেতরবাড়ির বারান্দায় খেতে বসলাম দুজনে। কলাপাতায় করে খাওয়া, মুখুজ্জেবাড়ির রীতি অনুযায়ী পুজোর প্রসাদ ধাতুপাত্রে পরিবেশন করা হয় না। খিচুড়ি, পাঁচভাজা, পাঁচমিশেলি একটা ঘণ্ট—তার মধ্যে আলু কচু বেগুন থোড় পালংপাতা চালকুমড়ো সবই আছে, তারপর লুচি আর পায়েস। একটা জিনিস বরাবর দেখেছি, পুজোর ভোগ হিসেবে যে খিচুড়ি রান্না হয় তার স্বাদ অদ্ভুতভাবে আলাদা। বর্ষার দিনে গরম খিচুড়ি আর ডিমভাজা খাবার ইচ্ছে হয়েছে? বেশ তো, রেঁধে খাও। চড়ুইভাতি কিম্বা পোষলায় খিচুড়ি রান্না হয়েছে? বেশ তো, পেট ভরে খাও। রান্না নিশ্চয় ভাল হবে, কিন্তু সে অন্যরকমের ভাল, পুজোর ভোগের স্বাদ তাতে পাবে না।
কিশোরী বলল—তার কারণ আমাদের মনের ধর্মভাব। বৃষ্টির দিনে বা পৌষলায় রান্না করা হয় মনে একটা আড্ডা বা হুল্লোড়ের ভাব নিয়ে, আর পুজোর ভোগ রাঁধবার সময় মনে পবিত্র ধর্মীয় সচেতনতা জেগে থাকে—তাই পার্থক্য। নইলে একই চাল-ডাল মশলায় তৈরি খাবারে অন্যরকম স্বাদ হবে কেন?
তারানাথ বলল—তাই হবে হয়ত। যাক, গল্পটা শোন।
মাথা নিচু করে খেয়ে যাচ্ছি, বুঝতে পারছি রান্নাঘরের দরজার পাশে মুখুজ্জেগিন্নী দাঁড়িয়ে রয়েছেন। অতিথির খাওয়ার সময় গৃহকর্ত্রীর উপস্থিত থাকা বনেদি বাড়ির নিয়ম। হয়ত তিনি কথা বলবেন না, কোন ছোট মেয়ে বা কর্মচারীর মাধ্যমে কী লাগবে তা জিজ্ঞাসা করে নেবেন, কিন্তু নিজে আড়ালে দাঁড়িয়ে সমস্ত সময়টা তদারক করবেন। আমার ক্ষেত্রে অবশ্য পরিস্থিতি একটু অন্যরকম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পরপর দুবার কিছুদিনের ভেতর এসে অতিথি হওয়ায়, মুখুজ্জেগিন্নীর সহজ মাতৃত্বপূর্ণ চরিত্রের জন্য, আর লটারির প্রাইজ পাবার টিকিটটা যে আমিই বেছে দিয়েছি সে খবরটা রাষ্ট্র হয়ে পড়ায় বাড়ির সকলেই আমাকে একান্ত আপনজন বলে ভাবতে শুরু করেছে।
খেতে খেতে দেবদর্শন বললেন—বিশালাক্ষী মন্দিরে প্রণাম করে আবার ফিরে গিয়েছিলে কেন? সবাইকে নিয়ে একবারেই তো গেলে পারতে—
দরজার আড়ালে একটুখানি বিস্মিত নীরবতা। তারপর মুখুজ্জেগিন্নী একটু অবাক গলায় বললেন—বিশালাক্ষী মন্দিরে? সেখানে আমি যাইনি তো!
খাওয়া থামিয়ে মুখ তুলে তাকালেন দেবদর্শন।
—যাওনি। কী বলছ তুমি!
—ঠিকই বলছি। বাড়ির মেয়েরা মিলে যখন পুজোর জায়গায় যাচ্ছি তখন তো তোমার সঙ্গে দেখাই হল, তুমি আর ঠাকুরমশাই মিলে নদীর ধারের পথ দিয়ে ফিরছিলে। আমাদের দেখে বাঁশঝাড়ের তলায় দাঁড়িয়ে ওঁকে কী যেন বললে। তার আগে আবার কোথায় গেলাম?
—তার একটু আগে তুমি একা যাওনি বিশালাক্ষী মন্দিরে প্রণাম করতে?
—না তো! আমি, রাজুর মা, বিরাজপিসি আর ছেলেপুলেরা মিলে একবারই বেরিয়েছিলাম। কেন জিজ্ঞাসা করছ বল তো? কিছু হয়েছে নাকি?
পাত থেকে হাত তুলে ফেলেছেন দেবদর্শন।
—না, হয়নি কিছু। কিন্তু আমি যে স্পষ্ট—মানে তোমার হাতে একটা—
আমি একটু কেশে বললাম—ওটা বোধহয় ভুল দেখেছেন মুখুজ্জেমশাই।
দেবদর্শন আমার দিকে তাকিয়ে বললেন—সে কী! আপনিও তো—
আমি জোর দিয়ে বললাম—সে-সব কথা পরে হবে এখন। চাঁদের আলোয় অত ভাল করে কিছু দেখা যায় না, কাকে দেখতে কাকে দেখেছেন—
দেবদর্শন কেমন হকচকিয়ে গিয়েছেন। কিছুক্ষণ আগেই ওঁর সঙ্গে এ নিয়ে আমার কথা হয়েছে, ওঁর মত আমিও যে বউঠাকরুণকে বিশালাক্ষী মন্দিরে ঢুকতে দেখেছি তা বলেছি—কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার এই উল্টো কথা বলায় উনি খুবই বিস্মিত হয়েছেন সন্দেহ নেই।
দেবদর্শন বললেন—কিন্তু আপনিই যে—
ফের খেতে শুরু করে নিচু গলায় বললাম—খেয়ে নিন, পরে কথা হবে।
কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো বেশিরভাগ পূর্ববঙ্গেই পালিত হয়। দেবদর্শনের জমিদারি ঠিক পূর্ববঙ্গে নয়, বরং বেশ খানিকটা দূরেই বলতে হবে। কিন্তু উৎসব আর আনন্দ করার আকাঙ্ক্ষা মানুষের এত প্রবল যে তা কোন প্রথা কিংবা দেশকালের সীমা মানে না। উৎসব করার সুযোগ পেলে মানুষ সঙ্গে সঙ্গে সেটিকে আঁকড়ে ধরে। মুখুজ্জেবাড়ি ছাড়াও এই অঞ্চলে অনেক জায়গাতেই কোজাগরী লক্ষ্মীপূজো হতে দেখলাম।
এই লক্ষ্মীপূর্ণিমার রাতে ঘুমোতে নেই, সারারাত জেগে তাস-পাশা খেলে, গল্প-গুজব করে কাটিয়ে দিতে হয়। কোনও কোনও পরিবারে আবার নিজেদের মধ্যে জুয়াখেলারও রীতি আছে। মুখুজ্জে-পরিবারে জুয়াখেলাটা হয় না, কিন্তু আড্ডা দিয়ে রাত জাগা হয়। সেই উদ্দেশ্যে কয়েকজন গ্রামবৃদ্ধ দেবদর্শনের বৈঠকখানায় এসে জড়ো হয়েছেন দেখলাম। আগেই বলেছি, রঘু জমিদারের কেতাদুরস্ত কর্মচারী, সে অতিথিদের তামাক দিয়ে গেল। তাকিয়া হেলান দিয়ে তাঁরা জমিয়ে বসলেন। দেবদর্শনও বসতে যাচ্ছিলেন, আমি বললাম—চলুন না, বাইরে একটু ঘুরে আসি, কী চমৎকার চাঁদের আলো ফুটেছে। তাছাড়া দেরি করে খাওয়া হল তো—হাঁটাচলা করলে হজম হবে।
দেবদর্শন আমার কাণ্ডে অবাক হওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। কোনও দ্বিধা না করে বললেন—চলুন।
তারপর অভ্যাগতদের দিকে তাকিয়ে বললেন—আপনার বসুন, তামাক খান। আমি এই এক্ষুণি আসছি—
রাত তখন প্রায় আড়াইটে। রূপোর চাকার মত চাঁদ পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে বিশাল পাকুড়গাছের পেছনে। মৃদু হিমের ছোঁয়া বাতাসে, কী যেন কী কত কথা মনে পড়ে যায়। স্বার্থ হিংসা আর হানাহানির মধ্যেও মনে হয় আকাশ মধু, বাতাস মধু। মনে হয় মৃত্যু আর অন্ধকার সত্য, কিন্তু তার চেয়েও বড় সত্য মুক্ত জীবনের আনন্দ।
দেবদর্শন আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
বললাম—মুখুজ্জেমশাই, কেবল লটারির টাকা পাওয়া নয়, আপনার পরিবারের ইতিহাসে আজ একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে—
—কী ঘটেছে ঠাকুরমশাই?
—আসুন আমার সঙ্গে। দেখাচ্ছি—
দেবদর্শনকে নিয়ে বিশালাক্ষী মন্দিরের দিকে এগিয়ে গেলাম।
॥ এগারো ॥
দেবদর্শন উদগ্রীব হয়ে আমার সঙ্গে আসছেন, যদিও আমি নিজেই জানি না ঠিক কী দেখাতে তাঁকে নিয়ে চলেছি। তবে আমি দেখেছি কোনো অলৌকিক প্রত্যক্ষণ বিষয়ে আমার পূর্বানুভূতি সচরাচর নির্ভুল হয়।
বিশালাক্ষী মন্দির পর্যন্ত মাটির সুঁড়ি পথটায় দেখার মতো কোনো কিছু নেই, তারপর থেকেই পথ ভাগ হয়ে একটা চলে গেল নদীর দিকে। আর একটা পুজোর মণ্ডপের দিকে। এই দুই পথের সংযোগস্থলেই বিশালাক্ষী মন্দির। ভাগ হওয়ার জায়গাটা থেকে মন্দিরের দিকে এগোতেই চোখ পড়ল সারি সারি পায়ের ছাপ, সাদা রঙের কিছুতে পা ডুবিয়ে হাঁটলে যেমন হয় ঠিক তেমনি। বাড়ির মেয়েরা চালবাটা কিম্বা খড়িমাটি গুলে যেমন মা লক্ষ্মীর পা আঁকে, অনেকটা সেরকম। পার্থক্য এই—পুজোর জন্য আলপনা হিসেবে আঁকা পায়ের ছাপ জোড়া জোড়া, মানে পাশাপাশি হয়। দেখলে মনে হয় যেন কেউ কিছুক্ষণ সেখানে বিশ্রাম করার জন্য দাঁড়িয়েছিল। আর এই যা ছাপ দেখছি, এ নকল ছাপ নয়। এ হল সত্যিকারের কোনো হেঁটে যাওয়া মানুষের পা। দু’জনে নিঃশব্দে মন্দির পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে দেখলাম কেবল মন্দিরের গর্ভগৃহে ঢোকবার দরজার সামনে পায়ের ছাপ এক জোড়া। অর্থাৎ যাঁর তিনি এইখানে একমুহূর্ত দাঁড়িয়ে বিশ্রাম করেছিলেন।
সিঁড়ি বেয়ে আমরা দুজন মন্দিরের চাতালে উঠেছিলাম। শেষ জোড়া পায়ের ছাপের দিকে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমার দিকে মুখ তুললেন দেবদর্শন। তাঁর চোখে জল। বললেন—ঠাকুরমশাই, আমি যা ভাবছি তাই কি সত্যি?
—ঠিক তাই মুখুজ্জেমশাই। শুধু আপনার নয়, আমার জীবনও ধন্য।
পশ্চিমদিগন্তে হেলে পড়েছে চাঁদ। এবার রাত ফুরিয়ে আসছে। হেমন্তের শেষরাত্তিরে আকাশবাতাস আর পৃথিবী যেন কেমন এক রূপকথার দেশে পরিণত হয়। বাঁশপাতার ফাঁক দিয়ে আসা রাত্রিশেষের জ্যোৎস্না ঈষৎ শীতের ছোঁয়া আর পুজোমণ্ডপ থেকে দেবীবাড়ি ফেরা লোকজনের গলার মৃদু গুঞ্জন পরিবেশকে অবাস্তব আর অপার্থিব করে তুলেছে। এখন প্রকৃতির সাধারণ নিয়ম আর বলবৎ নয়, এখন সবকিছুই ঘটতে পারে।
মন্দিরের চাতালে দাড়িয়ে চোখ মুছছেন দেবদর্শন। বললাম—সব মানুষ ভাগ্যবান নয়, কোন কোন মানুষ ভাগ্যবান। ক্ষমতা, টাকাপয়সা এসব অনেকেরই থাকে, কিন্তু আপনার জীবনে আজ যা ঘটল তা খুব কম মানুষের ভাগেই ঘটে। যাকে আজ দেখেছেন তিনি আপনার স্ত্রী নন। তিনি—
আমি চুপ করতে দেবদর্শন বললেন—কে তিনি? বলুন ঠাকুরমশাই—
—তিনি স্বয়ং দেবী। আপনি আজ দেবীর আশীর্বাদ পেয়েছেন।
দেবদর্শন বললেন—এখান দিয়ে তিনি হেঁটে গিয়েছেন। এই তার পদচিহ্ন! আমার স্ত্রীর রূপে তিনি দেখা দিলেন কেন? তবে, তবে কি—
এর আর কী উত্তর দেব? বললাম—মায়েরা সকলেই দেবী।
মাটির পিলসুজের ওপর মাটির তৈরি ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলছে মন্দিরের ভেতর। অন্যদিন ছোটমাপের রেড়ির তেলের প্রদীপ জ্বলে, সেটিও পাশেই রাখা আছে। সন্ধ্যেবেলা নিত্যপূজার পর জ্বেলে দেওয়া হয়েছে। এখনো তা জুলছে। সেই স্নিগ্ধ আলোয় দেবীর প্রস্তরময়ী প্রতিমা যেন মুখে সত্যিকারের হাসি ফুটিয়ে রেখেছে। এবং—
এবং দেবীর মূর্তির ডানহাতে একটি ডাঁটিওয়ালা তাজা পদ্ম।
এরপরে আর কোন প্রশ্ন থাকে না। আমি এবং দেবদর্শন করজোড়ে দেবীকে প্রণাম জানালাম। দুহাতে কড়া ধরে মন্দিরের দরজা বন্ধ করে দিলেন দেবদর্শন। তারপর পেছন ফিরেই বললেন—এ কি!
পদচিহ্ন আর নেই। শুধু চাতালেই নয়, সিঁড়ির ধাপে ধাপে এবং সুঁড়িপথে শ্বেতসঙ্কেতে আঁকা সেই দেবীর পায়ের ছাপ আর কোথাও নেই। দেবী আমাকে এবং গৃহস্বামীকে জানিয়ে দিতে এসেছিলেন যে, তার আবির্ভাব ঘটেছিল।
না ঘুমিয়েই রাত শেষ হয়ে গেল। সকালে নদী থেকে স্নান করে এসে বৈঠকখানায় বসলাম। একটু পরে দেবদর্শনও ভেতরবাড়ি থেকে এসে বসলেন। তাঁরও স্নান হয়ে গিয়েছে। রঘু এসে তামাক দিয়ে গেল। দেবদর্শনের মুখেচোখে দিব্যানুভূতির উদ্ভাস, ইনি যেন আর ঠিক কালকের সেই মানুষ নন। আজ যেন তিনি অনেক বেশি সৌম্য, অনেক বেশি গভীর।
বললাম—এবার যে আমাকে যেতে হবে মুখুজ্জেমশাই। অনেকদিন হয়ে গেল, আবার পথ ডাকছে—
দেবদর্শন চমকে উঠে বললেন—সে কী! চলে যাবেন। কেন?
হেসে বললাম—পরিব্রাজকের এক জায়গায় বেশিদিন থাকতে নেই, তাতে আসক্তি জন্মায়। এই যে আপনার সঙ্গে আমার পরিচয়, বন্ধুত্ব—এই পর্যন্তই ভাল। এর চেয়ে বেশি গভীরতা হলে তা বন্ধন হয়ে পায়ে জড়িয়ে যাবে।
দেবদর্শন চুপ করে তামাক খেতে লাগলেন।
বললাম—কথাগুলো একটু নিষ্ঠুর শোনাচ্ছে, না?
দেবদর্শন কিছু বললেন না।
—রাগ করবেন না। জীবনে কিছু কিছু ব্যাপার আছে যা রূঢ় হলেও সত্য। এক জায়গায় থেকে জীবন কাটাবো এমন ইচ্ছে থাকলে তো বাড়িতেই থাকতাম, মাকে কাঁদিয়ে গৃহত্যাগ করতাম না। ভালবাসা, বন্ধুত্ব, প্রীতির সম্পর্ক—এসব খুব ভাল জিনিস, কিন্তু যে মোহ আবরণ মহত্তর সত্য থেকে আমাদের আড়াল করে রেখেছে তার থেকে মুক্তি পেতে হলে যতই কষ্ট হোক পথে বেরিয়ে পড়তে হবে। আমি আপনাদের ভালবাসায় জড়িয়ে পড়ছি। এবার যেতে হবে—
দেবদর্শন তামাক খেয়ে যেতে লাগলেন।
খোলা দরজা দিয়ে সকালের আলোয় উজ্জ্বল আমবাগান-বাঁশবাগান দেখতে পাচ্ছি। সুঁড়িপথটা দিয়ে জাল কাঁধে গান গাইতে গাইতে একজন জেলে এবং তার পরে-পরেই একজন রাখাল কয়েকটা গরু নিয়ে মাঠের দিকে গেল। আজকালকার ছেলেদের ইস্কুলের পড়ার বইতে যেমন পাড়াগাঁর বর্ণনার সঙ্গে কবিতা থাকে—‘রাখাল গরুর পাল লয়ে যায় মাঠে’—ঠিক তেমনি। আজকাল ছাত্রদের ছবি এঁকে আর কবিতা লিখে বোঝাতে হয় গ্রাম কেমন ছিল, বাঁশঝাড় কাকে বলে—না, হেসো না—সত্যিই তাই। কলকাতা শহরে মোটরগাড়ি চেপে মানুষ হয়েছে এমন বড়লোকের ছেলেপুলেরা কেউই গ্রাম দেখেনি। মজার কথা কী জানো, এদের অনেকেরই আদি বাড়ি কিন্তু গ্রামে। এক বা দুই পুরুষ আগে এদের বংশের কেউ একজন হয়তো বেশি উপার্জনের লোভে বা অন্য কোন সুবিধের জন্য গ্রাম থেকে বেরিয়ে এসেছিল শহরে বাস করতে। তার দেখাদেখি আরো অনেকে। এদের গ্রামের প্রাচীন ভদ্রাসন ভেঙে পড়ছে, কার্নিসে বট-অশ্বত্থের চারা আর উঠোনে আগাছা জন্মাচ্ছে, কবজা থেকে দরজা ভেঙে ঝুলছে—কিন্তু দরজার কড়ায় তালা এখনো আটকানো। এসব বংশের ছেলেপুলেরা এখন বড়বড় চাকরি করে, কেউ বালিগঞ্জে কেউ ভবানীপুরে বাড়ি করেছে। মজা ডোবা আর ম্যালেরিয়ায় ভরা গ্রামে তারা আর কেউ বাস করতে ফিরে যাবে না।
কিশোরী বলল—আমি কিন্তু একটি পরিবারকে জানি যারা প্রতিবছর নিয়ম করে অন্তত একবার গ্রামের বাড়ি যায়—
তারানাথ হেসে বলল—ওরকম দু’একটা উদাহরণ দিলে তো সত্য বদলাবে না। আমিও জানি কেউ কেউ আছে যারা সাধারণত দুর্গাপুজোর আগে গ্রামের বাড়িতে বছরে একবার করে ফিরে যায়, লোক লাগিয়ে আগাছা বা বনজঙ্গল পরিষ্কার করায়। সম্ভব হলে একবার হালকা চুনকাম করায়। তারপর ধূমধামে দুর্গাপুজো করে দেওয়ালির পর আবার কলকাতায় ফিরে আসে।
এবার আমি বললাম—সে তো ভালো কথাই, এতে নিন্দের কী আছে? বছরে অন্তত একবার হলেও তো তারা দেশের বাড়ির টানে ফিরে আসে।
তারানাথ বলল—জিনিসটা অত হালকাভাবে দেখো না। এরা সবাই যে জন্মভূমির টানে ফিরে যায় এমন নয়। কেউ কেউ গরিব গ্রামবাসী আর শরিকদের কাছে নিজের ঐশ্বর্য আর বৈভব দেখাতে যায়।
একটু থেমে একটা পাসিং শো ধরালো তারানাথ। মৃদুমন্দ টান দিয়ে সিগারেটের একচতুর্থাংশ শেষ কবে নারকেলের মালায়, ছাই ঝেড়ে সে বলল—আগে মানুষ অনেক বেশি ধর্মভীরু ছিল। শত দুঃখকষ্টেও ভদ্রাসন ছেড়ে যেতে চাইতো না। এখন আর ওসব আবেগকে কেউ প্রশ্রয় দেয় না। উপার্জনের লোভে কোথাকার মানুষ কোথায় চলে যাচ্ছে—কারো কোনো শেকড় নেই। সমাজ দিনে দিনে শিথিল হয়ে পড়ছে।
কিশোরী বলল—কিন্তু সামাজিক মানুষের এসব চলাচল না হলে পৃথিবীর উন্নতি হবে কী করে? সভ্যতা এগুবে কী করে? ভেবে দেখুন—
তারানাথ হাত তুলে তাকে থামিয়ে বলল—দাঁড়াও হে, ওসব যুক্তি আমি অনেক শুনেছি। যন্ত্রপাতি কলকারখানা রেলগাড়ি—এসব দরকার মানুষের উন্নতির জন্য। এখন তো শুনছি এরোপ্লেন না হলেও সভ্যতা অচল। ভবিষ্যতে আরও কত কী হবে কে জানে! আমি সে-সব দেখেও যেতে পারবো না। কিন্তু কথাটা হচ্ছে—এসবে কী মানুষের শান্তি বাড়ছে? হৃদয়ের নরম অনুভূতির যে-সমস্ত প্রকাশকে আমরা সভ্যতা বলি, তার কি কোন উন্নতি হচ্ছে? পকেটে অনেক টাকা। কিন্তু মনে শান্তি নেই, এমন অবস্থা কি কেউ চায়? এর চেয়ে কি সেই পাখিডাকা ফুলফোটা পাড়াগাঁই ভালো ছিল না? যাক, আসল গল্প ছেড়ে বড্ড বেশি তত্ত্বকথায় ঢুকে পড়েছি। গল্পটা শোন।
তারানাথ আবার শুরু করল।
আলবোলার নল মুখ থেকে সরিয়ে দেবদর্শন জিজ্ঞাসা করলেন—কবে যাবেন ঠিক করেছেন?
—দেখি, কাল তো আর হবে না, পরশু নাগাদ রওনা দেব। আজ একটু বাদে থেকেই কৃষ্ণপক্ষের প্রতিপদ পড়বে। কোথাও যাওয়ার পক্ষে এটা ভাল তিথি নয়। দ্বিতীয়া পড়তে পড়তে কাল দুপুর গড়িয়ে যাবে। বিকেলের দিকে আর কোথায় যাব? দু’মাইল হাঁটতে না হাঁটতে অন্ধকার নেমে আসবে। হেমন্তকালের ছোট দিন।
দেবদর্শন একটা আরামের নিঃশ্বাস ফেলে বললেন—যাক, কালকের দিনটা তো অন্তত আছে।
জিজ্ঞাসা করলাম—ভূষণ রায়ের কথামতো লটারির টাকাটা বোধহয় মাসখানেকের মধ্যেই হাতে পেয়ে যাবেন। টাকা দিয়ে কী করবেন কিছু ঠিক করলেন?
—এখনো পাকাপাকি ভাবে কিছু ঠিক করিনি। তবে প্রথমে তো বাড়িটা মেরামত করব। বাড়ির মায়া বড় মায়া। পিতৃপুরুষের এতবড় বাড়ি, সবটা ভালোভাবে সারাতে পারবো না। পঁচিশ-তিরিশ হাজার টাকায় যতটা হয়—একটু হালকা মেরামত আর কী—যাতে আবার দেড়-দু পুরুষ অন্তত চলে যায়। তারপর উত্তরাধিকারীদের ভাবনা থাকবে। আমার অবর্তমান ঘটলে তাঁর কোনো অসুবিধে হবে না। তিনিও গত হলে ছেলেরা সে টাকা নিয়ে যেমন বুঝবে করবে। ভূষণ রায়কে দেব পাঁচ হাজার। বাকি টাকা সম্বন্ধে এখনো কিছু ভাবিনি, আগে হাতে তো আসুক। তবে কয়েক জায়গায় আমি সাহায্য করব বলে প্রতিশ্রুত, কী করে সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করব তাই ভাবছিলাম। যারা চেয়েছে তারাও খুব অসহায়। বিশ্বাস করুন, ঠাকুরমশাই, টাকা পেয়ে এইটেই আমার সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হয়েছে। ঈশ্বর আমার মুখ রক্ষা করলেন—
—ছেলেদের কিছু দেবেন না?
—না ঠাকুরমশাই, সেভাবে কিছু দেব না। আমার সংসারে ওদের কোনো অভাব নেই, আর আমি না থাকলে সবই ওদের দুজনের। তবে দুজনকেই আমি নবদ্বীপে রেখে আচার্য স্তর পর্যন্ত ন্যায়-কাব্য-ব্যাকরণ পড়িয়েছি। শীগগিরই হয়তো ওরাই বাড়িতে টোল খুলবে। অর্থের গৌরব নিম্নমানের এবং ক্ষণস্থায়ী, আমি চাই ওদের পাণ্ডিত্যের গৌরব হোক—
পরের দিন দুপুরে খাওয়ার সময় আমাদের দুজনকে পরিবেশন করলেন স্বয়ং দেবদর্শনের স্ত্রী। সেই পরাতের মত বিশাল কাঁসার থালায় ভুরভুরে খাঁটি গাওয়া ঘিয়ের গন্ধওয়ালা পোলাও, ঘন মুগের ডাল আর বেগুন ভাজা। তার সঙ্গে চাররকমের মাছের পদ।
বললাম—করেছেন কী মুখুজ্জেমশাই! এত কি খাওয়া যায়? আতিথেয়তারও তো সীমা আছে—
দেবদর্শন বললেন–কিছু নয় ঠাকুরমশাই—আবার কবে আসবেন তার তো ঠিক নেই—বাড়ির এঁরা আপনার জন্য আজ যত্ন করে করেছেন, খেয়ে নিন—
মুখুজ্জেগিন্নীকে এর আগে ভাল করে কখনও দেখিনি। আমি স্বাভাবিক সঙ্কোচের জন্য সরাসরি কখনও তাকাইনি, তিনিও বাঁহাতের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে মাথার কাপড় একটু টেনে ধরে রাখতেন। আজ খেতে খেতে কেন যেন মুখ তুলে হঠাৎ তাঁর দিকে একবার তাকলাম। তাকিয়েই অবাক হয়ে গেলাম। পদ্মপলাশাক্ষী কথাটা সংস্কৃতে দেবীদের স্তরে প্রচলিত আছে, বাঙলার অখ্যাত এক পাড়াগাঁর পড়ন্ত জমিদারবধূর যে এমন দেবীর মত আয়ত পদ্মপলাশ লোচন হবে তা কে জানত! অতসী ফুলের মত গায়ের রং, কোঁকড়া চুল, সূর্যের গোলকের মত উজ্জ্বল সিঁদুরের টিপ, আর তার নীচে গভীর মাতৃত্বে পরিপূর্ণ ঐ দুটি টানাটানা বিশাল চোখ! হ্যাঁ, জগদ্ধাত্রীর মত রূপ বটে। তিনিও ক্ষণিকের জন্য আমার দিকে তাকিয়ে বাৎসল্যের মৃদুহাসি হাসলেন।
পরক্ষণেই আমি লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নিলাম।
একটু দেরি করে হলেও সেদিন চাঁদ উঠল ভারি চমৎকার। নদীর ধারে বেড়িয়ে বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে বিশালাক্ষী মন্দিরের খোলা দরজা দিয়ে একবার দেবীকে প্রণাম করে মুখুজ্জে বাড়িতে এলাম। বৈঠকখানায় বসে তামাক খাচ্ছেন দেবদর্শন। আমাকে দেখে বললেন—আসুন ঠাকুরমশাই, বসুন। ওরে রঘু, ঠাকুরমশাইকে তামাক দিয়ে যা—
তামাক এল। টান দিতে দিতে বললাম—আগামীকাল এই সময় কোথায় আছি কে জানে। সত্যি, মায়া পড়ে যাবার আগেই আমার চলে যাওয়া উচিত ছিল।
দেবদর্শন বললেন—যাবেন তো কাল দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে, তার এখনো একটা রাত আর একটা বেলা বাকি। এখন বলুন রাত্তিরে কী খাবেন? মাংস চলবে?
হেসে বললাম—ওকথাও এখন থাক। দুপুরে যা ঠেসে খেয়েছি, রাত্তিরে আর খেতে পারবো মনে হয় না। রান্নাও হয়েছিল চমৎকার। সবই বুঝি বউঠাকরুণের রান্না?
দেবদর্শন একটা স্মিত হাসি হেসে বললেন—হ্যাঁ, আজ প্রায় সব রান্নাই অতিথির জন্য বিশেষ করে আমার স্ত্রী রেঁধেছেন—
বললাম—সবচেয়ে ভাল হয়েছিল পোলাওটা। গাওয়া ঘি আর মশলা সব দোকানেই পাওয়া যায়, যে কেউ কিনে আনতে পারে। কিন্তু সবাই কী এমন সুন্দর পোলাও রাঁধতে পারে?
দেবদর্শনের আলবোলা টানার শব্দ হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল।
আমার দিকে তাকিয়ে তিনি অবাক হয়ে বললেন—পোলাও! কিন্তু আজ দুপুরে তো পোলাও রান্না হয়নি। কী বলছেন আপনি! আমি তো আপনার পাশেই বসে খেলাম—
—আপনি কী খেলেন?
দেবদর্শন বললেন—কেন, সাদা ভাত! চালটা অবশ্য খুবই ভাল ছিল, রামচন্দ্রপুর থেকে আনানো এক নম্বর বাসমতী—কিন্তু তা সে যত ভাল চালই হোক, পোলাও তো কোনোমতেই নয়—
—আপনি কী খেয়েছেন? সাদা ভাত?
—অবশ্যই—কারণ সাদা ভাত ছাড়া কিছু রান্নাই হয়নি।
হেসে বললাম—এবার পুজোর সময়টা ভালই কাটল মুখুজ্জেমশাই, বলুন? শুধু টাকার কথা বলছি না। লটারিতে অর্থাগম প্রতিবছরই কারো না কারো হয়। কিন্তু এবার আপনি গড়ের তোপ শুনলেন, স্বয়ং দেবীকে পায়ের ছাপ ফেলে হেঁটে যেতে দেখলেন। আর আজকের এই পোলাও-এর ব্যাপারটা—
দেবদর্শন মুখ থেকে নল সরিয়ে বললেন—আর অমরজীবনের ব্যাপারটা? তার তো কোন ব্যাখ্যা হল না। কোথা থেকে এসেছিল সে, কোথায়ই বা গেল, কীই—বা তার পরিচয়? আপনি কী কিছু আন্দাজ করতে পেরেছেন ঠাকুরমশাই?
—আন্দাজ করতে হয়তো পেরেছি, কিন্তু তার বেশি কিছু নয়।
—কী আন্দাজ করেছেন?
—ঠিক বোঝাতে পারব না মুখুজ্জেমশাই। এই সৃষ্টির রহস্য বড় বিচিত্র, সেই বৈচিত্র্যেরই একটা অংশ অমরজীবন। কেন এই পৃথিবী আকাশ-বাতাস, গ্রহ-নক্ষত্র সৃষ্টি হয়েছিল, সে কেউ কি জানে? তেমনিই অমরজীবনের পরিচয়—একটা আকস্মিক আবর্তের মত হঠাৎ সে সৃষ্টির ভেতর জেগে উঠেছে, তার কোনো কারণ নেই, কোনো ব্যাখ্যা নেই। তবে এটুকু বুঝেছি—তার অস্তিত্ব একটা বড় মাপের শুভশক্তির প্রকাশ–
দেবদর্শন বললেন—কী রকম?
বললাম—সৃষ্টির মুহুর্তেই শুভ আর অশুভ দুরকম শক্তি তৈরি হয়েছিল, এ কথার সমর্থন পৃথিবীর সব ধর্মশাস্ত্র আর দর্শনে পাবেন। যেমন আলো আর অন্ধকার, মহত্ত্ব আর নীচতা। এও প্রকৃতির একটা সঠিক আইন, আসল বস্তু না থাকলে পরিপূরক এবং বৈপরীত্যের ধারণা আসবে কী করে? শাসকের অত্যাচার, ধর্মান্ধতা, ধনীদের দম্ভ, নিষ্ঠুরতা—এসবের ভেতর দিয়ে অশুভ শক্তি নিজেকে প্রকট করে। আর উলটো দিকে শুভ আর মহৎ বিশ্বশক্তি নিজেকে স্পষ্ট করে তোলে মহাপুরুষের বাণী, দেশপ্রেমীর আত্মোৎসর্গ, বৈজ্ঞানিকের নিঃস্বার্থ কর্ম—এর মাধ্যমে।
দেবদর্শন বললেন—তার কী প্রয়োজন ছিল? এত জটিল ঝামেলায় না গিয়ে ঈশ্বর তো অবিমিশ্র ভালোও সৃষ্টি করতে পারতেন?
বললাম—এর উত্তর আমি দিতে পারবো না। তবে আমার বিশ্বাস দুনিয়ায় অকারণে কিছুই ঘটে না। কিন্তু ঈশ্বর যেহেতু আমার সঙ্গে পরামর্শ করে জগৎ সৃষ্টি করেন নি, তাই সব রহস্যের উত্তর দেওয়া আমার সাধ্যের অতীত। তবে একটা কথা বলি, যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন, ঈশ্বরে মতি স্থির রাখবেন। যে যাই বলুন, তিনি আছেনই।
পরের দিন সকালবেলা জলখাবার খাওয়ার পর বেরিয়ে পড়লাম। গ্রামের প্রান্ত অবধি এগিয়ে দিতে এলেন দেবদর্শন। আমি বারণ করেছিলাম, তিনি শুনলেন না। গ্রামের একেবারে শেষ সীমায়, একটা মহানিম গাছের তলায় দাঁড়িয়ে তাকে বললাম—আর নয়, এবার ফিরে যান। আবার দেখা হবে—
ব্যগ্রভাবে আমার হাতদুটো ধরে দেবদর্শন বললেন—দেখা হবে বলছেন?
একটু ইতস্তত করে বললাম—দেখা হবে। আর যদি কোন কারণে আমাকে খুব প্রয়োজন হয় তাহলে—
—কী তাহলে?
—তাহলে নির্জনে কোথাও দাঁড়িয়ে মধুসুন্দরী দেবীর নাম উচ্চারণ করে একান্তভাবে আমার দেখা পেতে চাইবেন। যেখানেই থাকি না কেন, আমি ঠিক জানতে পারবো।
—ব্যস, এতেই হবে? মধুসুন্দরী দেবী কে?
বললাম—এতেই হবে। মধুসুন্দরী দেবী আমার আরাধ্যা। কী করে আপনার ডাক শুনতে পাবো আমাকে জিজ্ঞাসা করবেন না, কারণ আমিও তার উত্তর জানি না। আর পেছনে না তাকিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম।
গল্প থামিয়ে তারানাথ আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল—আজ এই পর্যন্ত থাক। সামনে যেদিন আসবে সেদিন আবার কিছুটা বলা যাবে।
কিশোরী বলল—গল্প শুনতে তো খুবই ভাল লাগে। কিন্তু চট করে ফুরিয়ে যাবে না তো?
তারানাথ হেসে বলল—ফুরিয়ে যাবে কী হে! এই তো সবে পানিফলের ঝাঁকে টান দিয়েছি। পুরো ঝাঁক এক জায়গায় হতে এখনো দেরি আছে। আচ্ছা, সামনের দিন বলা যাবে বাকিটা।
পরের পর্ব পড়ুন..
No comments:
Post a Comment