প্রথমাংশের লিঙ্ক
দ্বিতীয়াংশের লিঙ্ক
তৃতীয়াংশের লিঙ্ক
চতুর্থাংশের লিঙ্ক
পঞ্চমাংশের লিঙ্ক
লেখক : তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
॥ ষোলো ॥
আবার ফিরে আসি গল্পে।
মধ্যাহ্নসূর্য তখন অনেকখানি পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। বনের মধ্যে আর কিছুক্ষণ বাদেই ছায়া-ছায়া ধূসরতা নামতে শুরু করবে। সিমডেগাতে খেয়াল করে দেখেছি, পাহাড়ি অঞ্চলে সন্ধ্যা নামে ঝুপ করে, হঠাৎ। সমতল বাংলায় যেমন হয়, তেমন কোনো পূর্বপ্রস্তুতি নেই। আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি পাথরটার দিকে, অতবড় জগদ্দল পাথর, যার ওজন অন্ততঃ একশো মণ, সেটা কি দু-চারজন মানুষ ঠেলে এতখানি সরাতে পারে? তাছাড়া জলধর পণ্ডা তো বলেই দিয়েছে এদিকে আজ কুলিরা কাজ করতে আসেনি। কী হচ্ছে এসব?
গাছটারই বা কী হল? মেজকর্তা, সার্ভেয়ার সাহেব বা অসিতবাবু হয়ত আমার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করতেন না, ভাবতেন একটা বিশাল গাছ তো আর বাতাসে মিলিয়ে যেতে পারে না, নিশ্চয় আমি ভুল দেখেছি বা জায়গা ভুল করছি।
যদি না পাথরটার সরে যাওয়া তারা নিজের চোখে দেখতেন!
হঠাৎ আমার নজরে পড়ল একটা জিনিস। যেখানে গাছটা দেখেছিলাম সেখানে সেটা আর নেই, কিন্তু মাটিতে পড়ে আছে কয়েকটা বড় বড় গোল গোল পাতা। এরকম কোনো গাছের পাতা আমি কখনো দেখিনি। অদৃশ্য হয়ে যাওয়া গাছটায় এই পাতাই ছিল বটে। কিন্তু সে কথা বললে কি মেজকর্তারা বিশ্বাস করবেন?
কী একটা কথা যেন এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে। এইরকম একটা ঘটনার কথা আমি কোথায় যেন শুনেছি। কোথায়? কোনো কিছু আবছা মনে পড়ছে, পুরোটা স্পষ্ট হচ্ছে না, এ বড় যন্ত্রণার ব্যাপার। জুতোর ভেতর একটু বেরিয়ে থাকা পেরেকের মত। কেবলই খচ্ খচ্ করে।
সকলে ফিরে এলাম তাঁবুতে। কারোই মন ভাল নেই। একটা ব্যাখ্যার অতীত আশঙ্কার ছায়া পরিবেশে সংক্রামিত হয়ে গিয়েছে। বিকেলের আবছায়া এবার সত্যিই গাঢ় হয়ে নামার উদ্যোগ করছে। তাঁবুর সামনে টেবিল পেতে আমরা বসলাম। জলধর গেল কুলিদের সঙ্গে কথা বলতে। ডহরু ভারি দক্ষ কর্মচারী, চারদিকে যাই ঘটে যাক, সে নিজের কর্তব্য ভোলে না। তাকে কিছু বলার আগেই সে কাঠের ট্রেতে সকলের জন্য এনামেলের মগ ভর্তি চা নিয়ে এল।
চায়ে চুমুক দিয়ে মেজকর্তা বললেন—এটা বিংশ শতাব্দী। অপদেবতা-অভিশাপ-মাম্বো-জাম্বো আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। কিন্তু এখানে কিছু একটা যে ঘটছে সেকথা ঠিক। হয়ত এর যুক্তিসিদ্ধ ব্যাখ্যা আছে, যেটা আমরা ধরতে পারছি না। অন্য সব ব্যাপার ছেড়ে দিলেও অতবড় পাথরটার স্থান পরিবর্তন কীভাবে ব্যাখ্যা করব জানি না।
অসিতবাবু বললেন—পাখিরা আর ডাকছে না।
মেজকর্তা প্রথমে ভাল ধরতে পারলেন না। বললেন —অ্যাঁ?
—বলছি আজ দুপুর থেকে পাখির ডাক আর শোনা যাচ্ছে না। খেয়াল করেছেন? মেজকর্তার কপালে চিন্তার রেখা পড়ল। এতক্ষণ ভদ্রলোক জিনিসটা ঠিকঠাক উপলব্ধি করতে পারেন নি, এবার পরিবেশের অস্বাভাবিক স্তব্ধতা মোটা চাদরের মত সবার চেতনার ওপর বিছিয়ে নেমে এল।
অসিতবাবু বোধহয় পাখি সম্বন্ধে পড়াশুনো করেন। তিনি বললেন—ব্যাপারটা খুব হালকাভাবে নেবেন না। বিহার-উড়িষ্যা-মধ্যপ্রদেশের এই সীমান্ত অঞ্চলে কম করে একশো বত্রিশ রকমের পাখি আছে। জঙ্গলে তাদের চিৎকারে কান পাতা যায় না। ভোরবেলা আর সন্ধের সময় এরা নিজের নিজের বাসায় ফিরে প্রাণভরে ডাকে। তাকে বলে ডন কোরাস আর ইভনিং কোরাস। এই তো সন্ধে নেমে আসছে, কই, কোনো পাখি ডাকছে না কেন?
নির্মল কাঞ্জিলাল বললেন—তাই তো! এটা তো ঠিক খেয়াল করিনি। সেইজন্যেই চারিদিকটা যেন কেমন কেমন লাগছে। শুধু পাখি কেন, পোকামাকড়ের ডাকও তো শোনা যাচ্ছে না। এটা কিন্তু সত্যিই অস্বাভাবিক। জঙ্গল কেন, শহরেও সন্ধেবেলা পোকা ডাকে—
আস্তে আস্তে অন্ধকার নেমে এল। দিনের বেলা উজ্জ্বল সূর্যালোকে এই অরণ্য তার সৌন্দর্য নিয়ে ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির মত উদ্ভাসিত হয়ে থাকে। এখন নিকষ আলোকহীনতায় সেই অরণ্যই ছোটবেলায় বর্ষার রাত্তিরে মায়ের কোলে শুয়ে শোনা রাক্ষসপুরীর বাগানের বর্ণনার মত দেখাচ্ছে।
ডহরু লোহার একটা উজ্জ্বল পেট্রল বাতি জ্বেলে আমাদের টেবিলের ওপর বসিয়ে দিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে একটা আলোকবৃত্তের বাইরে অন্ধকার পিছিয়ে গেল বটে, কিন্তু অন্য এক বিপদ দেখা দিল। একেবারে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার বরং তবু সহ্য করা যায়, তীব্র আলোর মধ্যে বসে একটু দূরের রহস্যময় অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকা বড় অস্বস্তিকর। এ বোধহয় মানুষের গভীরতম অবচেতনে লুকিয়ে থাকা অজানার প্রতি ভয়। আলোয় দেখতে পাওয়া একটুখানি পরিচিত নিরাপত্তা, তার বাইরে কী লুকিয়ে আছে কে জানে! অন্ধকারে ভয় কিছু নেই, অন্ধকার যা ঢেকে রাখে সেইটেতেই আসল ভয়।
মেজকর্তা সিগারেট ধরালেন। আমাদেরও দিলেন একটা করে। আগেই বলেছি বাইরে কাজ করতে এসে আমরা সবাই পদমর্যাদা ভুলে স্বাভাবিকভাবে মিশছি, নইলে যাকে টিমওয়ার্ক বলে (এই নতুন শব্দটা সম্প্রতি মেজকর্তার কাছেই শিখেছি) তা করা সম্ভব নয়। চুপচাপ বসে আমরা সিগারেট টানতে লাগলাম।
একটু বাদে জলধর ফিরে এসে সামনে দাঁড়াল। মেজকর্তা বললেন—কী হে? মুখ অত গম্ভীর কেন? কী হয়েছে?
—কর্তা, কুলিদের নিয়ে বিপদ হবে মনে হচ্ছে। ওরা ভয় পেয়েছে।
—সে তো আগেই বলেছ, আমিও আন্দাজ করেছি। কী বলছে ওরা?
—হজুর, এসব লোক অনপড়, মূর্খ। ভূত-প্রেত-দৈত্য-দানবে বিশ্বাস করে। এই অঞ্চলের লোকেদের মধ্যে পাসাং মারা বলে এক অপদেবতার গল্প চালু আছে। সে নাকি বড় খারাপ দেবতা, অসুখ-বিসুখ মৃত্যু আর অমঙ্গল নিয়ে তার কারবার। এসব পাহাড়-জঙ্গল তার অধিকারের মধ্যে। সে না চাইলে এখানে আমরা কাজ করতে পারব না। রাগ হলে পাসাং মারা বাতাসে গান ভাসিয়ে জানান দেয়। সেই গান আজ এখানে শোনা গিয়েছে। এরপর নাকি পাহাড়ে পাহাড়ে কথা হবে। পাহাড় ক্রমশ পরস্পরের কাছে সরে এসে তাঁবুসুদ্ধ আমাদের পিষে মেরে ফেলবে। কর্তা, ওদের দিয়ে কাজ করানো মুশকিল হবে। ওরা ফিরে যেতে চাইছে।
—এতক্ষণ ধরে কি এই কথাই হচ্ছিল ওদের সঙ্গে?
—ওরা সবাই তো কথা বলে না। ওদের হয়ে সর্দার কথা বলছিল। মানুষগুলো সরল কর্তা, একবার ভয় পেলে বোঝানো কঠিন। তেমন তেমন বুঝলে আমি ওদের নিয়ে লরি করে চলে যাচ্ছি কাল, আবার নতুন লোকজন নিয়ে ফেরবার চেষ্টা করব। তার আগে আর একবার বোঝাবার চেষ্টা করে দেখি—
মেজকর্তা উদ্বিগ্ন মুখে বললেন—চেষ্টা করে দেখি মানে কী? এতবড় প্রজেক্টের সার্ভে হচ্ছে, যার ওপর কোম্পানীর ব্যবসা নির্ভর করছে—চেষ্টা করব মানে কী? এরা যদি সত্যিই শেষ পর্যন্ত কাজ করতে রাজি না হয় তাহলে নতুন কুলির দল ধরে আনতেই হবে। নইলে চলবে কী করে?
জলধর পণ্ডা বলল—হুজুর, এদের মধ্যে একতার ভাব খুব বেশি, একজন যদি কোন কাজ করতে নারাজ হয়, বাকি সবাই সেই একই বুলি ধরবে। একদিন দুদিনের মধ্যে গ্রামে গ্রামে খবর চলে যাবে। তেমন তেমন অবস্থা হলে কুলি পাওয়া খুব কঠিন হয়ে পড়বে। দেখি, যদি সামান্য কিছু বাড়তি মজুরির কথা বলে এদের রাজি করানো যায়।
দুই আঙুলে টুসকি দিয়ে মেজকর্তা সিগারেটের টুকরোটা দূরে পাঠিয়ে বললেন— জলধর, একটা সত্যি কথা বলবে?
—কী আইজ্ঞা?
—তুমি নিজে এইসব ভূত আর অপদেবতা বিশ্বাস করো?
জলধর একমুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল—দিনের বেলা করি না হুজুর। কিন্তু রাত্তিরে করি—
মেজকর্তা হাসলেন। বললেন—আচ্ছা, ঠিক আছে। যাও—
জলধর আবার কুলিদের কাছে ফিরে গেল। নির্মল কাঞ্জিলাল বললেন—কুলিরা নারাজ হলে খুব বিপদ হবে। জলধর একটা কথা ঠিকই বলেছে, একটা দল অরাজি হলে অন্যদলকে বোঝানো মুশকিল হয়ে পড়বে। কী করবেন মেজকর্তা?
মেজকর্তা বললেন—দেখা যাক, উই উইল ক্রস দি ব্রিজ হোয়েন উই কাম টু ইট। আগেই দুশ্চিন্তা করে লাভ নেই।
ডহরুও আদিবাসী, কিন্তু সে আশ্চর্যজনকভাবে নির্বিকার এবং ভাবলেশহীন। জাতভাইদের ভয় এবং উত্তেজনা তাকে স্পর্শ করেছে কিনা বোঝা যায় না। নিঃশব্দে সে নিজের কাজ করে চলেছে। রাত্তিরে খাওয়ার সময় দেখি শালপাতার থালায় ঘি-মাখানো মোটা মোটা হাতে গড়া রুটি, ঘন অড়হরের ডাল, আলু-কুমড়োর তরকারি আর আচার সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে ডহরু। খাওয়া-দাওয়া সেরে তাঁবুতে ঢুকে বিছানা আশ্রয় করলাম। ঘুম আসবার আগে অবধি দেখলাম অসিতবাবু আধশোয়া হয়ে ডায়েরি লিখছেন।
অনেক রাত্তিরে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। কত রাত্তির বুঝতে পারলাম না। বালিশের তলায় হাতঘড়িটা আছে বটে, কিন্তু এই ঘন অন্ধকারে তা দেখে কত রাত বোঝা যাবে না।
অন্ধকারের মধ্যেই চোখ মেলে অনেকক্ষণ বিছানায় শুয়ে রইলুম। কিছুতেই আর ঘুম এলো না। ওপাশে অসিতবাবু গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তার মৃদু নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে।
মনের ভেতর কেমন একটা অস্বস্তি। তাঁবুর বাইরে কী যেন একটা ঘটছে। অরণ্যে কোনো নিশাচর পাখি বা কীটপতঙ্গের ডাক নেই, পত্রমর্মর নেই। একবার কি বাইরে গিয়ে দাঁড়াবো? দেখব মধ্যরাত্রে অরণ্য কেমন আছে?
অসিতবাবুকে না জাগিয়ে নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে উঠে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। নাঃ, সবই তো ঠিক আছে। আসলে পাসাং মারার গল্প শুনে ভেতরে ভেতরে ভয় পেয়েছি। সেজন্যই ঘুম আসছে না।
শুক্লপক্ষের রাত বটে, কিন্তু আকাশে সম্ভবত হালকা মেঘ ছেয়ে আছে। অতি আবছা একটা আলোর আভাস বাদ দিলে চারদিক ছায়ায় ডুবে আছে।
তাঁবুর ভেতরে ঢুকতে যাবো, হঠাৎ কী মনে হওয়াতে আবার একবার চারদিকে তাকালাম। কোথায় যেন খুব অস্পষ্ট একটা শব্দ হচ্ছে না? ঠিক শব্দ বলা যায় না হয়ত, বরং বাতাসে ভেসে ওঠা শ্রবণসীমার প্রান্তে অবস্থিত একটা স্পন্দন বলা যেতে পারে। যেন শুকনো শালপাতা খসে পড়ছে মাটিতে। কে যেন কার কানে কানে ফিসফিস করে কী বলছে।
তারপরেই চোখ বড় বড় করে ভাল করে তাকালাম। এ কী! দিনের বেলায় দেখা দূরের পাহাড়গুলো যেন অনেকটা কাছে এগিয়ে এসেছে না? কিন্তু তাও কি হতে পারে? আলো-আঁধারিতে আমার চোখে ধাঁধা লেগেছে হয়ত। কিন্তু না, আলো যতই কম হোক, চোখ কি এতবড় ভুল করবে?
হঠাৎ মনে পড়ল জলধর পণ্ডার কথা। কুলিদের সর্দার তাকে বলেছিল এরপর পাহাড়ে পাহাড়ে কথা হবে, পাহাড়েরা চারদিক থেকে ঘিরে ধরে আমাদের পিষে মারবে। পাহাড়েরাই কি তাহলে ফিসফিস শব্দে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে? আমাদের ঘুমের অবসরে একটু একটু করে এগিয়ে এসেছে কাছে? কী কথা বলছে পাহাড়ের দল? নিজেদের অধিকারে মানুষের অবাঞ্ছিত অনুপ্রবেশ তারা যে পছন্দ করেনি সেই কথা জানাচ্ছে পরস্পরকে? বিকেলে যখন কুলি সর্দারের কথা শুনেছিলাম তখন বিশ্বাস করিনি। কিন্তু এখন—
অবাক হয়ে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয় না, তাঁবুর ভেতরে ফিরে এসে বিছানায় শুলাম। পাশে রাখা হাতব্যাগটায় টর্চ ছিল, এবার সেটা বের করে জ্বালিয়ে ঘড়ি দেখলাম। রাত আড়াইটে। অসিতবাবু পূর্ববৎ নিদ্রাচ্ছন্ন। আমিও মন থেকে দুশ্চিন্তা দূর করে ঘুমোবার চেষ্টা করলাম। যা হবার সে কাল সকালে উঠে দেখা যাবে। খামোকা রাত জেগে শরীর খারাপ করে লাভ কী?
আগেই বলেছি, উদ্বেগ আর অশান্তির চাপ কমানোর জন্য মনের একটা নিজস্ব ব্যবস্থা আছে। বয়লারের চাপের সমতা বজার রাখার ভালভের মত, চাপ নিতান্ত অসহ্য হলে মন খানিকটা আশঙ্কা অদ্ভুতভাবে ভুলে যায়, উপেক্ষা করে। আমারও একটু বাদেই ঘুম পেতে লাগল। ঘুমিয়ে পড়বার ঠিক আগের তন্দ্রাবেশঘন মুহুর্তে মনে পড়ল ওই গোল গোল পাতাগুলোর কথা আমি কোথায় শুনেছি। উনিশশো পনেরো সালের এক বর্ষামুখর রাত, হুগলী জেলার রামজয়পুর গ্রামে সরসী চাটুজ্জ্যের বাড়ির বৈঠকখানায় আষাঢ়ে গল্প জমে উঠেছে। রাম গাঙ্গুলি বলছেন তার মামাবাড়ির গ্রামে ঘটা এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতার কাহিনী। সেই গ্রামের প্রান্তে নির্জন জলাভূমির ভেতর দেখা বিশাল বনস্পতি, বড় বড় গোল তার পাতা। আগের দিন ওইখানে ছিল না গাছটা, পরের দিন গিয়েও দেখতে পাননি রাম গাঙ্গুলি। কেবল ওই একদিন। আকাশে দেখা গিয়েছিল অদ্ভুত আলো। গল্পটা শুনে এসে তারানাথের বাবা আদিনাথ চক্রবর্তী বলেছিলেন তারানাথকে। কী যেন নাম বলেছিলেন গাছটার? হ্যাঁ, বুদ্ধ নারিকেল। কত—কতদিন আগের কথা। উনিশশো পনেরো সালে রাম গাঙ্গুলি বলেছিলেন, এটা চল্লিশ বছর আগের ঘটনা, মানে সেদিন থেকে প্রায় সত্তর বছর কেটে গিয়েছে। ডাইনিদের চাতর বসেছিল জলার ভেতরের সেই ডাঙায়। ডাইনিরা উড়িয়ে নিয়ে এসেছিল সেই গাছ। অন্তত রাম গাঙ্গুলির তেমন বিশ্বাস ছিল। আজ আবার সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়া ভাল কথা নয়।
দূরে বোধহয় কোথাও মেঘ ডাকল। ঝড়বাদল হবে নাকি? আকাশে তো মেঘ দেখে এলাম। রাত্তিরেই বৃষ্টি নামলে মুশকিল হবে, কারণ লরিতে ফোল্ডিং খাট থাকলেও আজ আমরা আর সেগুলো নামাই নি, মোটা ত্রিপল মাটিতে পেতে তার ওপর বিছানা করেছি। সামান্য ঢালুর ওপর তাঁবু, বৃষ্টি নামলে পাহাড়ের ওপর থেকে জল বন্যার মত নেমে এসে সব ভাসিয়ে দেবে।
এইসব ভাবতে ভাবতে ঘুম এসে গেল। পুরোপুরি ঘুমোনোর আগে আর একবার শুনলাম মেঘের ডাক। দূরশ্ৰুত দামামার মত।
পরদিন সকালে উঠে দেখি সত্যিই আকাশ মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। তবে তক্ষুনি বৃষ্টি নামবে বলে মনে হল না। আর পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে দেখি দূরে দূরে যেখানে ছিল তারা সব সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। সকালের আলো ফুটে ওঠায় রাত্তিরের বুকচাপা ভাবটাও কেটে গিয়েছে।
খোলা জায়গায় পাতা টেবিলে গিয়ে আমরা সকলে বসলাম। পাঁচমিনিটের মধ্যে ডহরু চা বানিয়ে এনে সামনে রাখল। কিন্তু লক্ষ্য করলাম মেজকর্তা, অসিতবাবু বা নির্মল কাঞ্জিলাল কারোই মন তেমন ভাল নেই। অন্যদিন সকালে চা খেতে খেতে একটু গল্পগুজব বা হালকা আড্ডা হয়, আজ যেন সবাই মুখ ভারি করে বসে আছে। কী হল এদের?
চায়ের মগ খালি করে টেবিলে নামিয়ে রেখে বললাম—কী ব্যাপার বলুন তো অসিতবাবু? আপনাদের মুখ এত গম্ভীর কেন?
অসিত বিশ্বাস আমার দিকে মুখ তুলে তাকালেন, তারপর একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন—আচ্ছা, বুদ্ধ নারিকেল কাকে বলে?
আমি চমকে উঠলাম, দেখলাম নির্মল কাঞ্জিলালও চমকে উঠলেন। মেজকর্তা না বুঝতে পারার দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।
বললাম—কেন, একথা জিজ্ঞাসা করছেন কেন? এ নাম কোথায় পেলেন আপনি?
অসিতবাবু বললেন—কাল অনেক রাত্তিরে একটা আশ্চর্য স্বপ্ন দেখলাম। যেন একলা একলা দুপুরবেলা আপনার দেখানো ওই জায়গাটায় গিয়েছি—এবং কী অদ্ভুত। সেখানে সত্যিই বিরাট একটা গাছ দাঁড়িয়ে রয়েছে। আকাশছোঁয়া উঁচু, বড় আর গোল পাতা সে গাছের। নিচে একখানা বিশাল পাথর। স্বপ্নেই আপনার কথা ভাবলাম, আপনি তো বলেছিলেন এই গাছটার কথা। দু-তিনটে পাতাও পড়ে আছে নিচে। ঠিক যেমনটি দুপুরে দেখেছি। মনে মনে ভাবছি—কী গাছ এটা? স্বপ্নের মধ্যেই কে যেন বলল—এর নাম বুদ্ধ নারিকেল। সবকিছু এমন স্পষ্ট দেখলাম যে, মনে হচ্ছিল আমি যেন জেগে জেগে বাস্তবে ব্যাপারটা দেখছি। বুদ্ধ নারিকেল বলে সত্যিই কোনো গাছ হয় নাকি? স্বপ্নটা যে এমনিতে খুব ভয়ের কিছু তা নয়। কিন্তু সকালে ঘুম ভাঙার পর থেকে অকারণেই মনটা খারাপ হয়ে রয়েছে। কেন দেখলাম এমন স্বপ্ন কে জানে!
বললাম—মনের কোন গহন ক্রিয়ায় ওই স্বপ্ন দেখেছেন তা বলতে পারব না, কিন্তু বুদ্ধ নারিকেল বলে গাছ সত্যিই আছে। আমি দেখিনি কখনো, তবে বর্ণনা শুনেছি। কীভাবে কোথায় শুনেছি তা বলব এখন। খারাপ লাগছে এই ভেবে যে, বুদ্ধি করে দু-একটা পাতা নিয়ে রেখে দিলে পড়ে রাঁচি কলেজের কোনো বট্যানির প্রফেসারকে দেখিয়ে নিশ্চিত হওয়া যেত—
অযাচিতভাবে একটা বুদ্ধির কাজ করে ফেললে মানুষের মুখে যেমন একটা গৌরবের উজ্জ্বলতা ফুটে ওঠে, তেমনি মুখ করে অসিতবাবু বললেন—আমি রেখেছি।
—বলেন কী ৷ বাঃ, তাহলে তো দু-একদিনের ভেতর ব্যাপারটা যাচাই করে নেওয়া যায়—
অসিতবাবু বললেন—পাতাগুলো আমার ব্যাগে রেখে দিয়েছি। দাঁড়ান, দেখাই—
তিনি উঠে তাঁবুর দিকে চলে গেলেন।
মেজকর্তা আর সার্ভেয়ার নির্মলবাবুর চোখমুখ এখনো গম্ভীর। ওঁদেরও কিছু বলবার আছে নাকি? ব্যাপার যেমন দেখছি তাতে কিছুই অসম্ভব নয়।
অসিতবাবু ফিরে এলেন। তার মুখে আত্যন্তিক বিস্ময়ের ছাপ।
বললাম—কী হল? পাতাগুলো কই?
তিনি বললেন—তন্নতন্ন করে খুঁজলাম, কিন্তু পাতাগুলো ব্যাগে নেই!
॥ সতেরো ॥
সেই মেঘে ঢাকা বিষন্ন আলোর মেদুর সকালে আমরা অবাক হয়ে পরস্পরের মুখের দিকে তাকাতে লাগলাম। গতকাল থেকে নানাভাবে বেড়ে-ওঠা অস্বস্তিটাকে আমরা স্বাভাবিক ব্যাখ্যা দিয়ে ঝেড়ে ফেলতে চাইছিলাম, কিন্তু তা আর হবার নয়। এখানে যে অদ্ভুত আর অনৈসর্গিক কিছু ঘটছে সেটা আর অস্বীকার করা যাবে না। তবু বোধ করি নিজেকে প্রবোধ দেবার জন্যই একটু ইতস্তত করে অসিতবাবুকে বললাম—আপনার হয়ত ভুল হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত পাতাগুলো ব্যাগে ভরেন নি, কোথাও পড়ে-টড়ে গিয়েছে—
অসিতবাবু ম্লান হেসে বললেন—আমার ভুল হয়নি, পরিষ্কার মনে আছে পাতাগুলো আমি ব্যাগে ভরেছি। বড় সাইজের থালার মত গোল পাতা, এমনিতে ধরাতে পারছিলাম না বলে ভাঁজ করে ঢোকাতে হয়েছিল। আমি ভুল করছি না—
আমি নির্মলবাবুর দিকে তাকিয়ে বললাম—আপনার মুখও কেমন যেন থমথমে, কিছু হয়েছে নাকি? তখন একবার যেন চমকে উঠলেন—
নির্মলবাবু বললেন—আমি এসব আধিদৈবিক ব্যাপার নিয়ে কখনো মাথা ঘামাই নি, বিজ্ঞান দিয়ে যা ব্যাখ্যা করা যায় না তাতে আমার কোনো বিশ্বাসও নেই। কিন্তু এখন ঘটনা যেমন দাঁড়াচ্ছে—
মেজকর্তা বললেন—কী রকম দাঁড়াচ্ছে? কী হয়েছে আপনার?
—আমিও কাল রাত্তিরে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখেছি, ওই ওঁদের মতই স্বপ্ন। আবছা, একই স্বপ্ন তিনজন মানুষ একই রাত্তিরে কখনো দেখতে পারে কি? আমি তো অন্তত শুনিনি—
—কী দেখেছেন আপনি? কী স্বপ্ন?
—দেখলাম তাঁবু থেকে বেরিয়ে ছায়া-ছায়া অন্ধকারে ঘুরে বেড়াচ্ছি বনের মধ্যে। সময়টা বোধহয় রাত্তির, আকাশে কেমন একটা চাপা আলো। সেই বিষণ্ণ মনখারাপ করে দেওয়া আলোয় পৃথিবীকে অন্যরকম লাগছে। বুকের ভেতরে ভয়ের পাথর চেপে বসতে চাইছে স্বপ্নেই। ঘুরতে ঘুরতে জঙ্গলের মধ্যে সেই জায়গাটায় হাজির হলাম যেখানে বড় পাথরটা পড়েছিল। দেখলাম মাটিতে হড়কে যাবার দাগটা আর নেই, পাথরটা আবার পুরনো জায়গায় ফিরে এসেছে। তার পাশে একটা বিশাল বড় গাছ, গোল গোল থালার মত পাতা সেই গাছে। স্বপ্নেই ভাবলাম—ওঃ, তাহলে তো সত্যিই এখানে একটা বড় গাছ আছে! কিন্তু এমন গাছ তো আগে কখনো দেখিনি? কী গাছ এটা? সঙ্গে সঙ্গে যেন কোথা থেকে কে বলল—‘এর নাম বুদ্ধ নারিকেল। স্বপ্নেই চারদিকে তাকালাম, কই কেউ নেই তো! কে তাহলে বলল কথাটা? এই সময়েই চমকে জেগে উঠলাম। রাত তখন আড়াইটে কী তিনটে হবে। আর ঘুম এল না। মনের ভেতর কী ভীষণ অস্বস্তি। এত স্পষ্ট স্বপ্নও হয়? তাছাড়া অমন অদ্ভুত গাছের নামই বা কী করে স্বপ্নে পেলাম? নিজের অভিজ্ঞতার বাইরে কিছু তো আর স্বপ্নে পাওয়া সম্ভব নয়। এখন অসিতবাবুকেও একই নাম বলতে শুনে চমকে উঠেছিলাম। তাছাড়া——
মেজকর্তা তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে নির্মলবাবুর দিকে তাকিয়েছিলেন, বোধহয় যাচাই করে নিচ্ছিলেন তার স্বপ্নকাহিনী। রাত্তিরে দেখা স্বপ্নের কথা পরের দিন সবটা ঠিকঠাক মনে থাকে না, বলতে গেলে কিছুটা বানানো হয়ে পড়ে। কিন্তু সার্ভেয়ার সাহেব দ্বিধাহীনভাবে একটুও না থেমে গড়গড় করে বলে যাচ্ছিলেন। বোঝাই যাচ্ছিল তিনি যা দেখেছেন তাই বলছেন, তৈরি করছেন না কিছু।
মেজকর্তা বললেন—তাছাড়া কী?
নির্মলবাবু একবার ঢোক গিললেন। যে কথা সত্য, কিন্তু শোনায় অসম্ভব, সে কথা বলবার সময় মানুষের যেমন বিপন্ন মুখভাব হয়, তেমনি মুখ করে তিনি বললেন—আর দেখলাম কী, রাত্তিরের অন্ধকারে সুযোগ পেয়ে চারদিকের পাহাড়গুলো যেন অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে, বেড়ার মত ঘিরে ধরেছে আমাদের তাঁবুগুলোকে। আর বাতাসে কেমন যেন একটা অদ্ভুত ফিসফিস শব্দ হচ্ছে, কেউ যেন কাউকে নিচু গলায় গোপনীয় কিছু বলছে। স্বপ্নেই চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম, কোথাও কেউ নেই তো। ঘুমের ভেতরেই একটা দমবন্ধ করা ভয়ের ঢেউ এসে ধাক্কা দিচ্ছিল মনে। আজ সকালে উঠে প্রথমেই তাঁবুর বাইরে এসে পাহাড়ের দিকে তাকালাম। কই, পাহাড় তো সব তাদের জায়গাতেই আছে! স্বপ্নে যে কী ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম!
নির্মল কাঞ্জিলাল গতকাল কি জলধর পণ্ডার কথা শুনেছিলেন? এখানেই তো ছিলেন বসে। সচেতনভাবে খেয়াল না করলেও বাতাসে ফিসফাস আর পাহাড় এগিয়ে আসার কথা নিশ্চয় কানে গিয়েছিল। সেটাই ঘুমের মধ্যে অবচেতন মনে প্রভাব বিস্তার করে স্বপ্ন দেখিয়েছে।
কিন্তু তাতে একটা জিনিসের ব্যাখ্যা হয় না। বুদ্ধ নারিকেল কথাটা উনি পেলেন কোথা থেকে? কোথায় সেই ষাট-সত্তর বছর আগে রাম গাঙ্গুলির মামাবাড়ির গ্রামের ঘটনা, আর কোথায় বিহার-উড়িষ্যার প্রান্তবর্তী এই নির্জন অরণ্যভূমি। আমারই তো নামটা মনে পড়েছে অনেক পরে—ওঁদের দুজনের এ নাম জানার কোনো সম্ভাবনাই নেই।
জলধর পণ্ডা এসে কাছে দাঁড়াল। তার মুখচোখ গম্ভীর।
মেজকর্তা বললেন—কী খবর জলধর? ওদের সঙ্গে কথা হল?
—হইল কর্তা। কিন্তু খবর খারাপ, ওরা কাজ করতে চাইছে না।
মেজকর্তা টেবিলের ওপর থেকে সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে একটা বের করে ধরালেন। ধোঁয়া ছেড়ে সিগারেটের জ্বলন্ত ডগার দিকে চিন্তিতভাবে তাকিয়ে বললেন—জলধর, তুমি কী বলছ তুমি বুঝতে পারছ?
জলধরের ওই হাস্যোদ্রেককারী চেহারা আর বিচিত্র অ-কারান্ত উচ্চারণের পেছনে একটি বুদ্ধিমান এবং সপ্রতিভ ব্যক্তিত্ব বাস করে। তার এই রূপটা আমরা আগে কখনো দেখিনি। এবার দেখলাম এবং অবাক হলাম।
জলধর দৃঢ়গলায় বলল—আমি বুঝতে পারছি কর্তা। কাজ বন্ধ হয়ে গেলে কোম্পানির বহু টাকা লোকসান হয়ে যাবে, আমাদের সকলের কৈফিয়ৎ দিতে দিতে প্রাণ যাবে। কোম্পানির বড়বাবুরা এসব কথা বিশ্বাস করবে না। সব বুঝি বাবু, কিন্তু এরা একবার যখন বেঁকে বসেছে, আর এদের রাজি করানো যাবে না। এদের বিশ্বাস এই অঞ্চলে পাসাং মারা ক্ষেপেছে, এখানে আর থাকলে পাসাংমারার ভয়ানক অভিশাপ কাজ শেষ করে ফেরবার সময় পেছন পেছন যাবে, সমস্ত গ্রাম উজাড় করে দেবে। আমি অনেক বুঝিয়েছি, কোনো লাভ হয়নি।
—এখন তাহলে কী করবে?
—আমি এখনই কুলিদের নিয়ে ফিরে যাচ্ছি সিমডেগায়, লরিটা নিয়ে যাচ্ছি। যাবার পথে সাম পাহাড়টোলিতে ওদের নামিয়ে দিয়ে যাব। দেখি অন্য কোনো জায়গা থেকে লোক জোগাড় করতে পারি কিনা।
মেজকর্তা বললেন—সে কী। তাহলে আমরা কী করব?
—আপনারা এখানেই থাকুন। জিপটা রইল, যদি দরকার হয় এদিক-ওদিক যাতায়াত করতে পারবেন। ডহরু আপনাদের রান্নাবান্না করে দেবে। রসদ তো পনেরো দিনের মত রয়েছে, সে বিষয়ে চিন্তা নেই।
—তুমি কবে ফিরবে?
—আমার অন্তত দুদিন লাগবে। লোক জোগাড় করা সহজ কাজ নয়। এবার কোলেবীরা বা সীসার কাছে কোনো গ্রাম থেকে লোক নেব। ওদিকে বেশির ভাগই ক্রিশচান হয়েছে, রবিবারে যীশু ভজে। ওদের মধ্যে এসব ভূত-প্রেত আর অপদেবতায় বিশ্বাসটা কম। তবুও ঠিক করে বলা কঠিন—
—এখনই যাবে?
—এখনই যাব। নইলে এরা আমার পরোয়া না করে গাইতি-শাবল নিয়ে সারি বেঁধে নিজেদের গ্রামের পথে হাঁটতে শুরু করে দেবে। সেটা ভাল হবে না কর্তা। ভবিষ্যতে কখনো যদি বা আবার এদের ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনা থাকে, এখন ভদ্রতা আর সাহায্য না করলে তা আর হবে না।
মেজকর্তা একটু ভেবে বললেন—যাও তাহলে, আর কোনো উপায় যখন নেই। চেষ্টা কোরো তাড়াতাড়ি ফিরতে।
জলধর পণ্ডা করিৎকর্মা লোক। কর্মসূচী একবার স্থির হয়ে যাবার পর সে আধঘণ্টার ভেতর সবকিছু গুছিয়ে চল্লিশ মিনিটের মাথায় রওনা হয়ে গেল। দেড়-দু মিনিটের মধ্যে লরির ইঞ্জিনের শব্দ মিলিয়ে এল পাহাড়িপথের বাঁকে। এখন অন্তত দুদিন অপেক্ষা ছাড়া আমাদের কিছু করবার নেই।
একাকীত্ব জিনিসটা বড় খারাপ। আদিবাসী কুলিরা আমার সমাজের লোক নয়, আমার শিক্ষিত শহুরে মানসিকতার সঙ্গে তাদের কোনো দিক দিয়ে মিলও নেই। তবু তারা চলে যাওয়ার পর আমাদের কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা ঠেকতে লাগল। মানুষের সঙ্গ এতই মধুর।
এবং স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, কেমন যেন ভয়-ভয়ও করতে লাগল। কলকাতা শহরে বিদ্যুতের আলো আর গাড়িঘোড়ার ভিড়ে যা হেসে উড়িয়ে দেবার মত ব্যাপার, এখানে লোকালয় থেকে বহুদূরে নিবিড় বনের মধ্যে তা ভয়ের মুখোশ পরে সামনে এসে দাঁড়ায়।
অসিতবাবু পকেট থেকে নোটবুক বের করে তাতে কী যেন লিখছেন। মানুষটি বেশ আত্মস্থ, কবিপ্রকৃতির। চারদিকে লেখার উপাদান হিসেবে পরে ব্যবহার করা যেতে পারে এমন কিছু দেখতে পেলেই সঙ্গে সঙ্গে তা নোট করে রাখেন। রাত্রিবেলায় পাকা ডায়েরিতে সেসব গুছিয়ে লেখেন।
আমার বাঁদিকে একটা পিয়াশাল গাছ, তার গোড়ায় মেটে আলুর না কিসের যেন লতা। সেদিকে অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে আছি, হঠাৎ লতাটা যেন খুব হালকা হাওয়ায় একবার কেঁপে উঠল। কী ব্যাপার, এতক্ষণ তো বেশ গুমোট করে আছে আকাশে মেঘ থাকায়, বাতাস এলো কোথা থেকে? চারদিকে তাকালাম, না! বনভূমি একেবারে স্তব্ধনিশ্চল। তবে এই শান্তভাব ঝড়জলের পূর্বলক্ষণ, হয়ত বাতাস উঠবে এখনই।
ঠিক এইসময়েই লিখতে লিখতে অসিতবাবু বলে উঠলেন –এঃ!
মেজকর্তা বললেন—কী হলে আপনার?
খোলা নোটবইটা দেখিয়ে অসিতবাবু বললেন—দেখুন না কাণ্ড, বৃষ্টি আসছে বোধহয়। একফোঁটা জল এসে পড়ল লেখার ওপরে—
তিনি পকেটবুকটা আমাদের দিকে এগিয়ে দিলেন। এক জায়গায় লেখার ওপর বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে দু-তিনটে অক্ষর ধেবড়ে গিয়েছে। অসিতবাবু আর ঝুঁকি না নিয়ে উঠে গিয়ে লেখার সরঞ্জাম তাঁবুতে রেখে এলেন। ভালই করলেন। কারণ এর পরেই বেশ মোটা মোটা বিন্দুতে বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। ঝমঝম বর্ষণ নয়, বিরক্তিকর ছাগলতাড়ানি বৃষ্টি। আমাদের থাকার তাঁবুগুলোর পাশে একটা বড় তাঁবু খাটানো হয়েছে, সেটাকে আমরা বলি ওয়ার্কিং টেন্ট। মেজকর্তা উঠে পড়ে বললেন—চলুন, কাজের তাঁবুতে গিয়ে বসি। এখানে আর থাকা যাবে না। চেয়ারগুলো হাতে হাতে নিয়ে নিন—
চারদিকে তাকিয়ে দেখি মেঘের স্তর যেন আকাশ ছেড়ে নেমে এসেছে মাটির কাছে, সেজন্য ঘন ছায়ায় ঢেকেছে বনভূমি। বড় রকমের প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগে পৃথিবীকে এমনি দেখায়, এটাও কি তবে তেমন কিছুরই পূর্বাভাস?
বৃষ্টিটা তখুনি ঝেঁপে এলো না, মেঘও থমকে রইল আকাশে। কিন্তু বাতাস একটু একটু করে বাড়তে লাগল, নিচু ঝোপ আর লতাপাতা লুটোপুটি করতে লাগল মাঝেমাঝেই। আর সেই হাওয়া বয়ে যাবার শব্দের মধ্যে কীসের যেন একটা ফিসফিস আওয়াজ।
ওস্তাদ লোক বটে ডহরু। আগেই বলেছি চারদিকে কী হচ্ছে না হচ্ছে সে বিষয়ে তার কোনও তাপ-উত্তাপ নেই, সে একজন নিবিষ্টমনা রন্ধনশিল্পী। আমরা তাঁবুর ভেতরে গিয়ে বসবার কিছুক্ষণের মধ্যেই ডহরু এসে জিজ্ঞাসা করল, আমরা চা খাব কিনা। মেজকর্তা বললেন—তা খাওয়া যেতে পারে। কী নির্মলবাবু, হবে নাকি একটু?
স্যাতসেতে মনকে চাঙ্গা করতে চায়ের মত জিনিস আর নেই। এই বিষন্ন, মেঘান্ধকার পরিবেশে সকলেরই মন কেমন যেন ভারি হয়ে উঠেছে। সার্ভেয়ার সাহেব বললেন—তা মন্দ কি? হয়ে যাক—
দশমিনিটের মধ্যে এনামেলের মগে চা চলে এল। মেজকর্তা চা নিয়ে বললেন—ডহরু, টিপটিপ বৃষ্টি তো শুরু হয়ে গেল, তুমি রান্না করবে কীভাবে? উনুন নিভে যাবে না? মনে হচ্ছে বৃষ্টি আরো বাড়বে—
—চিন্তা নেই বাবু, রান্নার জায়গায় ছোট একটা ত্রিপল খাটিয়ে নিয়েছি মাথার ওপর। যদি ঝড়জল আরো বাড়ে তাহলে সব সরঞ্জাম নিয়ে আমার তাঁবুতে ঢুকে যাব, যে তাঁবুতে আমি আর জলধরদা থাকি। এখন দু-দিন জলধরদা থাকবে না, অনেক জায়গা খালি পাব—
—তাঁবুতে আগুন ধরে যাবে না?
—না বাবু। ভেতরে তো উনুন জ্বালব না, স্টোভেই হয়ে যাবে। বাবু, বিশুয়া কোথায়? এদিকে এসেছে নাকি? তার জন্যও চা বানিয়েছি যে!
বিশুয়া আমাদের জিপের ড্রাইভার। বছর পঁচিশ-ছাব্বিশ বয়েসের সপ্রতিভ ছেলে। মেজকর্তা বললেন—যাবে আর কোথায়? ওদিকেই কোথাও আছে আর কী। বাথরুম করতে গিয়েছে হয়ত। দেখ একটু, আসবে এখন—
পরিবেশ সম্পূর্ণ স্বাভাবিক না হলে মানুষের মন আশঙ্কায় টানটান হয়ে থাকে। আমরা সকলে নির্বিকার মুখে চা খেতে লাগলাম বটে, কিন্তু প্রত্যেকেই বুঝতে পারছিলাম প্রত্যেকে ভাবছে—বিশুয়া গেল কোথায়?
দশমিনিট পরে শূন্য মগ নামিয়ে রেখে নির্মলবাবু বললেন–বিশুয়া ফিরে এল কিনা দেখা দরকার। যদিও এ জঙ্গলে বোধহয় তেমন হিংস্র প্রাণী কিছু নেই, তবু আমরা এই কয়েকজন মাত্র লোক রয়েছি, খুব সাবধানে থাকা প্রয়োজন। ডহরুও কিছু জানালো না তো!
অসিতবাবু বললেন—চলুন তো দেখি কী ব্যাপার!
বাইরে এসে দেখি সেই মনখারাপ করে দেওয়া মেঘচাপা আলো আরো গাঢ় হয়েছে।
এখন বেলা কতই বা হবে, বারোটা কী সাড়ে বারোটা, তাতেই যেন সন্ধে নেমে এসেছে। ওদিকে নিজের তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে ডহরু কেমন অবাক হয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে।
মেজকর্তা বললেন—কী ডহরু, বিশুয়া ফিরল?
—না বাবু। চিন্তার কথা হল দেখছি, কোথায় যাবে বিশুয়া? যদি মাঠ করতেও গিয়ে থাকে, তাতেও তো এত সময় লাগতে পারে না—
এরপর আমরা বিশুয়ার নাম ধরে চেঁচিয়ে ডাকতে ডাকতে জঙ্গলের মধ্যে অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করলাম। কোথাও পাওয়া গেল না তাকে। শেষে ডহরুই বলল—আচ্ছা বাবু, বিশুয়া ওদের দলের সঙ্গে লরিতে করে সিমডেগা চলে যায়নি তো? হয়ত ভেবেছে একা বসে থেকে কী করব, যাই ঘুরে আসি–
মেজকর্তা আর নির্মলবাবু এ কথা সমর্থন করলেন না। জলধর আমাদের জন্য জিপটা রেখে যাচ্ছে বলেছিল, এবং সে খুব দক্ষ ও চৌকস কর্মচারী। ভুল করে জিপের ড্রাইভারকে নিয়ে চলে যাবে বলে মনে হয় না। তবে হ্যাঁ, কিছু ভুল-বোঝাবুঝি হয়ে থাকতে পারে। শেষমূহুর্তে কোনও দরকারেও হয়ত বিশুয়াকে সঙ্গে নেওয়া প্রয়োজন হয়েছে, জলধর ভেবেছে বিশুয়া আমাদের জানিয়েছে, আবার বিশুয়া মনে করেছে জলধর নিশ্চয় আমাদের বলে রেখেছে। এছাড়া তো লোকটার অন্তর্ধানের আর কোনো ব্যাখ্যা হয় না। যাই হোক, আপাতত উদ্বেগ মনেই চেপে রেখে অপেক্ষা করা ছাড়া কোনও উপায় নেই।
দুপুর গড়িয়ে যাওয়ার পর ডহরুকে তার রান্নার জিনিসপত্র নিয়ে সত্যি-সত্যিই তাঁবুতে ঢুকে পড়তে হল। হাওয়ার দাপটে মাথার ওপর থেকে ত্রিপল উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। খোলা উনুনের আগুন জ্বালিয়ে রাখা যাচ্ছে না। পাঁচজনের রান্না অবশ্য তাঁবুর ভেতরেই স্টোভে করে নেওয়া যাবে।
দুৰ্যোগ আর দুঃসময়ের দুটো রূপ আছে। একটা রূপ আমাদের সন্ত্রস্ত করে, অন্যটা একধরণের বিচিত্র আনন্দের জন্ম দেয়। মানুষ যতই বলুক, সে শুধুমাত্র শান্তির পূজারী নয়। তাহলে আদিম যুগ থেকে মানবসভ্যতা একটুও অগ্রসর হত না। আরামে গাছের ছায়ায় শুয়ে গান গেয়ে দিন কাটানোর সুযোগ ছেড়ে মানুষ চিরকাল বেরিয়ে পড়েছে অজানার হাতছানিতে। প্রায়ান্ধকার বনের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমারও গা-ছমছম করা অনুভূতি আর আনন্দ একসঙ্গে হল।
খাওয়া সেরে মেজকর্তা আর সার্ভেয়ার সাহেব কাজের কী আলোচনা করতে ওয়ার্কিং টেন্টে ঢুকলেন। আমি আর অসিতবাবু সিগারেট ধরিয়ে বনের ভেতর পায়চারি করতে লাগলাম। বৃষ্টি এখন পড়ছে না, কিন্তু থেকে থেকে শোঁ শোঁ করে বাতাস জেগে উঠছে। পরক্ষণেই আবার নেমে আসছে আশ্চর্য স্তব্ধতা। আবহাওয়ায় যেন একটু ঠাণ্ডারও ছোঁয়া।
একবার বাতাস একটু থামতেই অসিতবাবু হঠাৎ বললেন —কে যেন বনের মধ্যে দিয়ে এদিকে আসছে, পায়ের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন?
বাতাস তখন থেমে আছে। সত্যিই শুনতে পেলাম ঝরা পাতার ওপর কার যেন ধীর পদবিক্ষেপ। কে আসছে? কে?
॥ আঠারো ॥
শুকনো পাতার ওপর মচমচ শব্দ ক্রমেই কাছে এগিয়ে আসছে। সূর্যালোকিত দিনে, চারদিকে মানুষের গলার শব্দ আর পাখির ডাকের মধ্যে এই পায়ের আওয়াজ বেশ কাব্যিক বলে মনে হয়, কিন্তু লোকালয় থেকে দূরে এমন মেঘচাপা আলো আর শোঁ শোঁ হাওয়া বওয়া দুর্যোগের দিনে বুকের ভেতর নাম-না-জানা ভয়ের জন্ম দেয়।
আমাদের উৎকণ্ঠিত আশঙ্কাকে মিথ্যা প্রমাণিত করে জঙ্গলের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল বিশুয়া—আমাদের জিপের ড্রাইভার।
অসিতবাবু অবাক হয়ে বলেলেন—আরে, এ তো বিশুয়া! তুমি ছিলে কোথায়?
আমি বললাম—কী ব্যাপার বিশুয়া? কোথায় গিয়েছিলে?
বিশুয়ার চোখমুখে কেমন একটা হতচকিত ভাব। সে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বটে, কিন্তু পুরোপুরি যেন এখানে নেই। গভীর ঘুম থেকে হঠাৎ কাউকে ডেকে তুললে যেমন হয়।
অসিতবাবু আবার জিজ্ঞেস করলেন—কোথায় ছিলে এতক্ষণ? হাতের তালু দিয়ে মুখটা একবার মুছে নিয়ে বিশুয়া বলল—ওদিকে ওই বনের মধ্যে একটু গিয়েছিলাম, ইয়ে—ছোট বাইরে করতে। কেন বাবু, কী হয়েছে?
বললাম—এত সময় লাগল? প্রায় তিন কী চার ঘণ্টা। বেড়াচ্ছিলে নাকি?
বিশুয়ার মুখে অকৃত্রিম বিস্ময় এবং না-বোঝার ভাব ফুটে উঠল। একবার আকাশের দিকে এবং চারধারে তাকিয়ে সে বোধহয় আন্দাজ করবার চেষ্টা করল এখন কতটা বেলা, কিন্তু মেঘলা দিনে সময় বোঝা খুব কঠিন। সে বলল—আমি তো বেশিক্ষণ যাইনি বাবু, এই–পাঁচ কী সাত মিনিট। বেড়ানোর সময় আর পেলাম কোথায়?
অসিতবাবু বললেন—ঠিক আছে। যাও, তুমি খেয়ে নাও গিয়ে। পরে কথা হবে—
বিশুয়া অবাক হয়ে বলল—সে কী, এর মধ্যে রান্নাও হয়ে গিয়েছে! এই তো সবে সকাল।
আমি কথা বলতে যাচ্ছিলাম, অসিতবাবু আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন——হ্যাঁ, আজকে একটু তাড়াতাড়ি রান্না হয়ে গিয়েছে। যাও তুমি—
বিশুয়া চলে যেতে আমরা পরস্পরের মুখের দিকে তাকলাম। অসিতবাবু বললেন—কী বলতে যাচ্ছিলেন আপনি? তখন থামালাম বলে কিছু মনে করবেন না—
বললাম—বিশুয়ার জীবনে কোনো আশ্চর্য উপায়ে চারঘণ্টা সময় উপে গিয়েছে। ও ভাবছে এখনো বুঝি সকাল। এ আবার কী ব্যাপার?
—জানি না। কিন্তু ওর ভুল এখনই ধরিয়ে দেবার দরকার নেই। ঘাবড়ে যাবে। দুতিনদিন এই নির্জনে আমরা ক-জন মাত্র আছি, এর মধ্যে বিশুয়ার কিছু হলে খুব মুশকিল।
কিন্তু বিশুয়া অত সহজে বুঝলো না। সে সরল বটে, কিন্তু বোকা নয়। ডহরুর কাছে ঘড়ি নেই, বিশুয়া আমাদের কাছে বারবার এসে জিজ্ঞাসা করতে লাগল, এখন কটা বাজে। মেজকর্তা আর নির্মল কাঞ্জিলাল ব্যাপারটা শুনেছেন। যেহেতু তারাই কর্তা, আমরা শেষপর্যন্ত বিশুয়াকে তাদের কাছে পাঠিয়ে দিলাম। মেজকর্তা বললেন—কী বিশুয়া, তোমার নাকি কী অসুবিধে হচ্ছে, কী ব্যাপার!
বিশুয়াকে দেখলে মনে হয় তার যেন ঘোর লেগে রয়েছে। চোখ-ভাসা-ভাসা, মুখ ঈষৎ হাঁ। প্রশ্নের উত্তরে সে বলল—কর্তা, এখন বেলা কটা হল?
—কেন, সে খোঁজে তোমার কী দরকার?
—বলুন না কর্তা। আমাকে খেতে দেওয়া হল, অথচ এত বেলা তো হবার কথা নয়—
মেজকর্তা একটুখানি ভাবলেন, বুঝলাম তিনি মনে মনে স্থির করছেন কতখানি সত্যকথা বিশুয়া একবারে নিতে পারবে। তারপর বললেন—তা বেশ বেলা হয়েছে, দুটো কী আড়াইটে তো হবেই—
বিশুয়া যেন কেমন হয়ে গেল, বলল—তা কী করে হবে কর্তা? এই তো সবে ওদিককার বনে ঢুকেছিলাম, জলধরদা চলে যাবার পরে পরেই। তখন সকাল নটা। এরমধ্যেই বেলা দুটো হয়ে গেল!
—কী করে জানলে জলধর যখন গেল তখন বেলা নটা?
বিশুয়া বলল—আমি আর কী করে জানব বাবু? আপনারাই তো বলাবলি করছিলেন।
মেজকর্তা হেসে বললেন–আসলে কী হয়েছে জানো বিশুয়া, তুমি বনের মধ্যে কোথাও বসে বিশ্রাম করতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলে। তাইতে বেলা হওয়া বুঝতে পারোনি—
বিশুয়া বুদ্ধিমান না হোক, বোকা নয়। সে বলল—তাই বলছেন কর্তা? তা হবে হয়ত। কিন্তু তাহলে তো আমার খুব খিদে পেত, তাই না? খিদে পায়নি কিন্তু—
বাচ্চা ছেলেকে সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে মেজকর্তা বললেন—এক একদিন অমন হয়, কিছুতেই আর খাওয়ার ইচ্ছে হয় না। এই তো, আমারই পরশু হয়েছিল।
ভাল কর্মচারীর লক্ষণ যদি প্রশ্নহীন আজ্ঞাবহতা হয় তাহলে বিশুয়া একজন গুণী কর্মচারী। মুখের ওপর কোনো কথা না বলে সে চলে গেল বটে, কিন্তু তার ভাবভঙ্গি দেখে বুঝতে পারলাম তার মনে ধাঁধা রয়েই গেল।
বেলা এগুবার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার ক্রমেই চারদিক থেকে আরও ঘনিয়ে আসতে লাগল। বৃষ্টি কখনও টিপটিপ করে পড়ছে। কখনও বা ঝরঝর করে বেশ এক পশলা বর্ষণ হয়ে যাচ্ছে। বিকেলের চা আমরা কাজের তাঁবুর ভেতরে বসেই খেলাম। ছোটবেলায় ইস্কুলে পড়বার সময়ে আদিম পৃথিবীর ইতিহাস’ নামে একখানি বই পড়েছিলাম। পাঠ্যতালিকার বাইরেও ভালো সাহিত্য আর সাধারণ জ্ঞানের বই বাবা ডাকমারফৎ আনিয়ে আমাকে উপহার দিতেন। তাতে পড়েছিলাম সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে, যখন কৃষিকাজ, সভ্যতা বা বিজ্ঞান কিছুই ছিল না, তখন আদিম মানুষেরা দুর্যোগের দিনে গুহার মধ্যে একজায়গায় জড়াজড়ি করে বসে বাইরে প্রাকৃতিক শক্তির মাতামাতি দেখতো। আমাদের সেই পূর্বপুরুষদের কাছ থেকেই আমরা রক্তের গভীরে অন্ধকারের প্রতি ভয় ও বিস্ময়ের ভার বহন করে চলেছি। অসময়ে অন্ধকার হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের মনের মধ্যে সেই আদিম, যুক্তিহীন ভয় ফিরে এল। মুখে হয়তো কেউই কিছু বললাম না, কিন্তু সকলেই বুঝতে পারলাম ভেতরে আমরা ভালো নেই।
সেই রাত্তিরে বড় অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলাম। সেই দুদিন দুরাত্তিরের কথা ভাবলে এখনো গা শিউরে ওঠে, মনে হয়—যা দেখেছিলাম তা সব সত্যি তো?
বিকেলে চা খাওয়ার সময়েই মেজকর্তা আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন—জলধর না ফেরা পর্যন্ত আপাতত কাজকর্ম বন্ধ রইল বলেই মনে হচ্ছে। এই আবহাওয়ায় ঘুরে ফিরে কাজের প্ল্যান তৈরী করারও উপায় নেই।
নির্মলবাবু বললেন—আজ আর কিছুই করা সম্ভব ছিল না। এই বৃষ্টিতে থিওডোলাইটই খাড়া করা যেত না। তবে কাল যদি মেঘ কেটে যায় তবে সাইট সার্ভে একটু এগিয়ে রাখবো। শিখিয়ে দিলে বিশুয়া বা ডহরু আয়না চমকাবার কাজ চালিয়ে দিতে পারবে। দেখা যাক কী হয়—
তাঁবুর দরজা দিয়ে বাইরের জলে ভেজা ঝোপঝাড় আর গাছেদের কালো কালো গুঁড়ি দেখতে পাচ্ছি। জলকণা তাঁবুর ভেতরে ঢুকছে। সেই হাওয়ার দাপটেই তাঁবুর দরজার ভেজা ক্যানভাসের পর্দাটা পতপত শব্দ করছে। সেদিকে তাকিয়ে যেন কিছু আত্মগত ভাবেই অসিত বিশ্বাস বললেন—এমন জলে ভেজা বাদলার দিনে ছোটবেলার একটা পুরনো ঘটনা মনে পড়ে গেল। আপনাদের শোনাতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সে-সব সেকেলে গেঁয়ো গল্প—যাকে বলে ওলড ওয়াইভস টেল—তা কি আপনাদের ভাল লাগবে? থাক বরং—
মেজকর্তা চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন। এতক্ষণ তিনি নিতান্ত ঝিমিয়ে ছিলেন, এবার গল্পের সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় তার চোখে উৎসাহের জ্যোতি ফিরে এসেছে। অসিতবাবুর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন—গেঁয়ো গল্প আবার কী? অমন কিছু হয় না। গল্প দু রকম হতে পারে—ভাল আর খারাপ। আপনার গল্প ভাল হলেই হল।
অসিতবাবু বললেন—এসব গল্পের বোধহয় ঠিক ভাল বা খারাপ হয় না। ছোটবেলার কথা মনে পড়লে মনটা একটু কেমন যেন হয়ে পড়ে, আনন্দও হয়, বিষণ্ণও লাগে। আনন্দটা বেশি হয়। কাজেই আমার তো ভাল লাগবেই। কিন্তু আপনাদের—যাক্, ঘটনাটা বলি।
আমি মেদিনীপুরের মানুষ। দেশের বাড়ি হচ্ছে পানিপারুল গ্রামে, সেখানেই আমাদের বহুপুরুষের বাস। বাবা কাজ করতেন মহিষাদল রাজ এস্টেটে। আমার জন্মও মহিষাদলেই। আবছা আবছা সেখানকার কথা মনে পড়ে। বিশেষ করে তালগাছের সারি দিয়ে ঘেরা একটা জলে ভরা দীঘির ছবি চোখে ভাসে, তার পাড়ে আমি খেলা করতাম। বেশি বড় দীঘি নয়, কিন্তু তার চারদিকের লতাপাতা আর নির্জনতা জায়গাটিকে কেমন নিভৃত স্বপ্নময় করে তুলেছে। ছবিটা মনে পড়লেই আবার একবার মহিষাদল বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আর কি হবে?
আমার যখন দশ বছর বয়েস, সে সময় বাবা মহিষাদলের কাজ ছেড়ে পানিপারুল ফিরে আসেন। বাবা খুব স্বাধীনচেতা মানুষ ছিলেন, হয়ত নিয়োগকর্তার আচরণ তার ভাল লাগেনি। এর পরে আর কখনো উনি পরের চাকরি করেন নি, বাড়িতে থেকেই নিজেদের যা জমিজমা ছিল তার চাষের কাজ দেখতেন আর সকাল-বিকেল গ্রামের ছেলেমেয়েদের দলবেঁধে বারান্দায় বসিয়ে পড়াশুনো দেখিয়ে দিতেন। এর জন্য কারো কাছে টাকাপয়সা কিছু নিতেন না। গ্রামের লোকেরা তাকে মাস্টারমশাই বলে ডাকত।
আমাদের শৈশবে প্রায় সব পরিবারই ছিল একান্নবর্তী। বাড়ির কোনো ছেলে বড় হয়ে বৌ-ছেলেপিলে নিয়ে আলাদা থাকবে, এমন স্বার্থপরতার কথা কেউ সেকালে ভাবতেই পারত না। জ্যাঠামশাই, বাবা আর দুই কাকা ছাড়া আমাদের পরিবারে ছিলেন জ্যাঠাইমা, মা, দুই কাকিমা আর জ্যাঠতুতো-খুড়তুতো ভাইবোনেরা। চাষের কাজ দেখবার জনাদুই কৃষাণও বাইরের দালানে ঘুমোতো। আর ছিল বাড়ির পুরনো কাজের লোকেরা। তারা অবশ্য বহুদিন থেকে থেকে বাড়ির লোকের মতই হয়ে গিয়েছিল। এদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্কা ছিল অমিয়বালা, সে দেখেছি জ্যাঠামশাইকেও রীতিমত ধমকধামক করত। তাকে নাকি সে ছোট দেখেছে। জ্যাঠামশাইও মাথা নিচু করে তা মেনে নিতেন। এমনই চমৎকার ছিল সে সমাজ।
আমার যখন বছর বারো বয়েস তখন আমার জ্যাঠতুতো দিদি সিন্ধুলতার বিয়ে ঠিক হল। পাত্রের বাড়ি শোলপাট্টায়, নামকরা পরিবারের ছেলে, দানধ্যানের বিষয়ে সমাজে খ্যাতি আছে। পাত্রের বাবা উদারপন্থী মানুষ, এ বিয়েতে কিছু গ্রহণ করবেন না। তিনি নাকি বলেছেন—বাড়িতে আমার মা আসছেন, মাকে একখানা লালপেড়ে শাড়ি আর দুমুঠো ডালভাত দেবার ক্ষমতা এ পরিবারের আছে। খামোকা জিনিসপত্র চাইতে গেলে লোকে যে বিষ্টু মাইতি ছেলে বিক্রি করল’ বলে খ্যাপাবে—তখন কী হবে?
কথাটার পেছনে শুধুই সারল্য বা উদারতা নয়, কিছুটা প্রচ্ছন্ন ধনগৰ্বও ছিল। কিন্তু বিষ্টু মাইতি মানুষ এমনিতে খুব ভাল, তাছাড়া এটুকু সামান্য গৌরব করার অধিকার মানুষকে ছেড়ে দিতেই হয়। আর এ কথা তো ঠিক যে, নেহাৎ আমার দিদি খুব সুন্দরী ছিলেন বলে এখানে বিয়ে ঠিক হয়েছে, নইলে আমাদের মত অতি সাধারণ ঘর থেকে মাইতি মশায় মেয়ে নিতেন কিনা সন্দেহ।
দেশেঘরে যেমন হয়, দল বেঁধে পাড়ার মেয়ে-বৌয়েরা দিদিকে এসে দেখে যেতে লাগলেন। নেমন্তন্ন করে আইবুড়ো ভাত খাওয়াবার ধুম পড়ে গেল। ভালমন্দ খেয়ে দিদি আর পারে না। এমন সময় একদিন এলেন গ্রামের কুঞ্জকামিনী দেবী—সকলের কুঞ্জমাসি। গ্রামের একেবারে প্রান্তে শ্বশুরের ভিটেয় বাস করেন, নিঃসন্তান বালবিধবা। সবাই তাঁর মিষ্টি আর অমায়িক ব্যবহারের জন্য তাকে ভালবাসত। কুঞ্জপিসিমা বাড়িতে ঢুকে উঠোন থেকে জ্যাঠামশাইয়ের নাম ধরে জোরে ডাক দিলেন—কই গোলোক কোথায় গেলে? শুনলাম নাকি মেয়ের বিয়ে দিচ্ছ? তা আমরাও নেমন্তন্ন পাব তো, না কি?
ডাক শুনে মা আর জ্যাঠাইমা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বারান্দায় মাদুর পেতে কুঞ্জপিসিকে বসতে দিলেন। পুজো সেরে জ্যাঠামশাই এলেন, বললেন—আসুন দিদি, আজ বিকেলেই তো আপনার কাছে যাব ভেবে রেখেছি। একটু দেরি হয়ে গেল—
কুঞ্জকামিনী বললেন—ওসব জানা আছে। আসলে আমাকে নেমন্তন্নর লিস্টি থেকে বাদ দেবার ইচ্ছে, আমি কি বুঝি না? তা কুঞ্জ কায়েত্নীকে অত সহজে বাদ দেওয়া যাবে না ভাই, সে কথাটা বলতে নিজে চলে এলুম।
জ্যাঠামশাই হাতজোড় করে বললেন—ও কী কথা দিদি, সত্যিসত্যিই আজ বিকেলে আমি যেতাম। আপনাকে বাদ দিয়ে এ গ্রামের কোনো শুভ উৎসব সম্ভব নাকি!
দিদিকে ভেতরবাড়ি থেকে এনে প্রণাম করানো হল। কুঞ্জকামিনী দিদির চিবুক ছুঁয়ে চুমু খেয়ে বললেন—তোমার ভাল নাম তো সিন্ধুলতা, না খুকি?
মাথা নেড়ে দিদি জানাল—হ্যাঁ।
কুঞ্জপিসি বললেন—যাও মা, ভেতরে যাও। এই তো আর কদিন বাকি, এখন খুব সাবধানে থাকবে। বাড়ির বাইরে একদম বেরুবে না। বিয়ের আগে খুব সাবধানে থাকতে হয় জান তো? যাও—
দিদি ভেতরে গেলে কুঞ্জপিসি জ্যাঠামশাইকে ডেকে কাছে বসিয়ে বললেন—গোলোক, তোমার সঙ্গে একটু জরুরি কথা আছে। বস্তুতঃ সেই কথা বলতেই আসা। নইলে আজকে তুমি নেমন্তন্ন করতে যাবে সে তো আমি জানতামই—
জ্যাঠামশাই কুঞ্জপিসির দিকে একমুহূর্ত স্থির চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন—নেমন্তন্ন করতে যাবো, সেটা যে জানতেন তাতে আমার সন্দেহ নেই, কিন্তু আজই যে যাবো তা কী করে জানলেন?
কুঞ্জকামিনী সামান্য হাসলেন, বললেন—আমি জানতে পারি।
কুঞ্জকামিনীর বিচিত্র চরিত্র সম্বন্ধে আমাদের গ্রামের লোকেদের মধ্যে নানারকম মত প্রচালিত ছিল। কুঞ্জপিসি নিখুঁতভাবে মানুষের আসন্ন বিপর্যয়ের কথা বলে দিতে পারতেন, অনেকে বলে তিনি নাকি পশুপাখির ডাক শুনেও অনেক কিছু বুঝতে পারতেন—এবং সবক্ষেত্রেই দুর্বিপাক থেকে মুক্তি পাওয়ার একটা উপায়ও বলে দিতেন। এই কারণেই তাকে সকলে শ্রদ্ধা করতো, মানতো। অমঙ্গলের থার্মোমিটার বলে মনে করার চেয়ে সবাই তাকে স্নেহময়ী পরিত্রাণকর্ত্রী হিসেবে ভালবাসতো। গ্রামের বয়স্ক মানুষেরা বলতেন কুঞ্জপিসীর ছোটবেলায় হিমালয় থেকে একজন সাধু এসে পিসির বাপের বাড়ির গ্রামে কয়েকদিন বাসা বেঁধেছিলেন। কুঞ্জপিসীকে কোলে নিয়ে তার বাবা গিয়েছিলেন সাধুকে প্রণাম করতে। পিসিকে দেখে সাধু অবাক হয়ে বলেছিলেন—এ তো খুব উচ্চদশার মেয়ে তোমার ঘরে জন্ম নিয়েছে। একটা কথা বলি, মনখারাপ কোরো না। তোমার এ মেয়ের বিয়ে হবে বটে, কিন্তু সংসারধর্ম এর কপালে লেখা নেই। তার বদলে এক সুন্দর, দিব্য জীবন তোমার মেয়ে লাভ করবে। কিছু ক্ষমতা এ নিয়েই জন্মেছে, কিছু ক্ষমতা আমি দিয়ে যাচ্ছি। বহু মানুষের উপকার করতে পারবে তোমার এই মেয়ে।
আর ঠিক এই কারণেই কুঞ্জকামিনী আমাদের গ্রামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। কারো কোনো দুঃসময়ে তিনি খবর না দিলেও এসে দাঁড়াতেন, একটা অদ্ভুত কিছু ভবিষ্যৎবাণী করতেন, এবং তা অবধারিতভাবে ফলে যেত। সিদ্ধবাক হিসেবে কুঞ্জপিসির একটা খ্যাতি রটে গিয়েছিল। মাধব খুড়ো জব্বলপুর যাবার জন্য বাক্সবিছানা গুছিয়ে বের হচ্ছিলেন, গরুর গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাতে মালপত্র তুলে তিনি দরজায় তালা লাগাচ্ছেন, এমন সময় কুঞ্জকামিনী বামুনপাড়া যাবার পথে থমকে দাঁড়ালেন। বললেন—কী ব্যাপার মাধব? কোথাও যাচ্ছ বলে মনে হচ্ছে-
মাধব খুড়ো তালাতে চাবি ঘুরিয়ে একবার টেনে দেখে ফিরে দাঁড়ালেন। বললেন—হ্যাঁ দিদি। জব্বলপুরে বড়ছেলেটা কাজ করে, বহুদিন থেকে তার কাছে যাব যাব ভাবছি। যাওয়া আর হয়ে ওঠে না। তা এবার একটু সুযোগ পেয়ে বেরিয়ে পড়েছি। এমন সময়ে এলেন দিদি, একটু বসতেও বলতে পারলাম না, বড় খারাপ লাগছে—
কুঞ্জকামিনী একবার আকাশের দিকে তাকালেন, চোখ বুজে কী ভাবলেন, তারপর বললেন—না মাধব, তোমার এখানে একটু বসেই যাই। দরজা খোলো—
মাধব খুড়ো অস্বস্তিতে পড়লেন। এ কেমন কথা বলছেন কুঞ্জকামিনী? এক্ষুণি না রওনা হলে বারো মাইল দূরের শহরে গিয়ে বাস ধরতে পারবেন না, আর বাস না পেলে জংশনে গিয়ে মেল ট্রেন পাবেন না। এদিকে কুঞ্জকামিনীর কথাও অমান্য করা যায় না। অসাধারণ ব্যক্তিত্ব তাঁর, যা বলেন তা খেটে যায় বলেও নামডাক আছে। মাধব খুড়ো বিব্রত হয়ে বললেন—আমার বাড়িতে বসবেন এ তো আমার সৌভাগ্য। কিন্তু দিদি, অপরাধ নেবেন না, এখনই না বেরুলে যে আমি ট্রেন পাবো না—
হিমশীতল গলায় কুঞ্জকামিনী বললেন—তোমাকে ট্রেন পেতে হবে না। তোমার যাওয়া বাতিল। কেন খামোকা বকাচ্ছ মাধব? দরজা খুলে দাও, বসি—
এবার মাধব খুড়ো ভয় পেয়ে গেলেন। কুঞ্জকামিনীর চোখে কী এক অনিৰ্দেশ্য রহস্যের ছায়া। এ মানুষের কথা অমান্য করা যায় না। তিনি আবার দরজা খুলে বাড়ির ভেতরে ঢুকলেন, তালপাতার চাটাই এনে বসতে দিলেন কুঞ্জকামিনীকে। বললেন—কী ব্যাপার, দিদি।
—কীসের কী ব্যাপার?
—আমাকে যেতে বারণ করলেন কেন?
কুঞ্জকামিনী একটু রাগত স্বরে বললেন—বেশ করেছি বারণ করেছি। গুরুজন মানুষের কথা না হয় শুনলেই। অত কৈফিয়ৎ চাইছ কী জন্যে? আর যদি একান্তই যেতে ইচ্ছে করে তাহলে বেরিয়ে পড়, গাড়ি তো দাঁড়িয়েই আছে—
গাড়োয়ান নিবারণ ঘরামি এসে উঠোনে দাঁড়িয়ে বলল—খুড়োমশাই, বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু, এর পরে হলে আর বাস ধরাতে পারব না—
মাধব খুড়ো একটু ইতস্তত করলেন, একবার কুঞ্জকামিনীর দিকে তাকালেন, তারপর বললেন—ইয়ে, নিবারণ, আজ আর আমার যাওয়া হবে না। তুমি বরং মালপত্রগুলো গাড়ি থেকে নামিয়ে দাওয়ায় এনে রাখ —
নিবারণ অবাক হয়ে বলল—যাবেন না বাবু?
—না নিবারণ, একটু অসুবিধে ঘটেছে। তুমি মালগুলো নিয়ে এস–
মাধব খুড়ো শেষপর্যন্ত আর সত্যিই যাচ্ছেন না দেখে কুঞ্জকামিনী একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন—ভাল করলে মাধব, নইলে তোমার ক্ষতি হত। বাধা আছে। উঠি তাহলে। পরশু বা তরশু তোমার সঙ্গে দেখা হবে—
—পরশু বা তরশু? কেন বলুন তো? দেখা করতে বলছেন আমাকে?
—আমি কিছুই বলছি না, তুমি আপনিই যাবে—
মাধব খুড়ো আর কথা বাড়াতে সাহস করলেন না। কুঞ্জকামিনী যেতে গিয়ে উঠোনের মাঝখানে থেমে পেছন ফিরে বললেন—সাতষট্টি হত, কিন্তু এখন ছেষট্টি হবে।
এই শেষের কথাটা মাল এনে নামিয়ে রাখবার সময় নিবারণ ঘরামিও শুনে ফেলেছিল, সে-ই পরে ব্যাপারটা সবাইকে বলে। নইলে কেবল মাধব খুড়োর কথা লোকে বিশ্বাস করতে সময় নিত। মাধব খুড়োর যাত্রা স্থগিত হবার তিনদিন পর গ্রামের একমাত্র মণিহারী দোকানের মালিক সুদর্শন আদক উত্তেজিত অবস্থায় কালীতলার পাশার আড্ডায় এসে হাজির হল। অনেকখানি পথ হনহন করে হেঁটে আসায় সে হাঁপাচ্ছে। বিধু নন্দ বললেন—কী হল সুদর্শন? কী হয়েছে?
সে কথার উত্তর না দিয়ে সুদৰ্শন জিজ্ঞাসা করল—আচ্ছা, মাধব খুড়ো কি গ্রামে রয়েছে? তার তো ছেলের কাছে যাবার কথা, গিয়েছে কি?
তার কথায় রহস্যের গন্ধ পেয়ে গ্রামবৃদ্ধেরা পাশা ছেড়ে তাকে ঘিরে ধরল। বিধু নন্দ বললেন—কেন, তুমি জানো না?
সুদৰ্শনের মুখ শুকিয়ে গেল। সে বলল—আমি কিছুই জানি না, দোকানের জন্য মাল কিনতে কলকাতায় গিয়েছিলাম, পাঁচদিন পর এই বাড়ি ফিরছি। মাল আসছে পেছনে পার্সেলে। মাধব খুড়ো কেমন আছেন? তার তো ছেলের কাজের জায়গায় যাবার কথা ছিল জব্বলপুরে, গিয়েছে নাকি?
ধীরেন দলুই বললেন—সে এক মজার ব্যাপার হয়েছে বাপু না, তার যাওয়া হয়নি। কুঞ্জদিদি তাকে আটকে দিয়েছেন।
—কুঞ্জদিদি? কীভাবে?
—বেরুবে বলে মাধব খুড়ো গাড়ি ডেকে তাতে মালপত্র তুলে দরজায় তালাও লাগিয়ে ফেলেছিল। সে সময় কুঞ্জদিদি বুঝি যাচ্ছিলেন সামনে দিয়ে। তিনি মাধব খুড়োকে যেতে বারণ করেন। জানো তো, কুঞ্জদিদির কথা গাঁয়ে কেউ অমান্য করতে সাহস পায় না। মাধব খুড়োও যাওয়া বন্ধ করেছে। কেন বল তো?
উত্তরে বগলের তলা থেকে একটা খবরের কাগজ বের করে মেলে ধরল সুদর্শন আদক।
সকলে ঝুঁকে পড়ল কাগজখানার ওপর।
পরের পর্ব পড়ুন....
No comments:
Post a Comment