লেখক: শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
পূর্বখন্ড (পড়ার জন্য ক্লিক করুন)
১
একদিন কার্তিক মাসের সকালবেলা ব্যোমকেশ ও আমি আমাদের হ্যারিসন রোডের বাসায় ডিম্ব সহযোগে চা-পান শেষ করিয়া খবরের কাগজ লইয়া বসিয়াছিলাম। সত্যবতী বাড়ির ভিতর গৃহকর্মে নিযুক্ত ছিল। পুঁটিরাম বাজারে গিয়াছিল।
ব্যোমকেশের বিবাহের পর আমি অন্য বাসা লইবার প্রস্তাব করিয়াছিলাম; কারণ নবদম্পতির জীবন নির্বিঘ্ন করা বন্ধুর কাজ। কিন্তু ব্যোমকেশ ও সত্যবতী আমাকে যাইতে দেয় নাই। সেই অবধি এই চার বছর আমরা একসঙ্গে বাস করিতেছি। ব্যোমকেশকে পাইয়া আমার ভ্রাতার অভাব দূর হইয়াছিল; সত্যবতীকে পাইয়াছি একাধারে ভগিনী ও ভ্রাতৃবধূরূপে। উপরন্তু সম্প্রতি ভ্রাতুষ্পুত্র লাভের সম্ভাবনা আসন্ন হইয়াছে। আশাতীত সুখ ও শান্তির মধ্যে জীবনের দিনগুলা কাটিয়া যাইতেছে।
ভাগ করিয়া খবরের কাগজ পাঠ চলিতেছিল। সামনের পাতা আমি লইয়াছিলাম, ব্যোমকেশ লইয়াছিল ভিতরের পাতা। সংবাদপত্রের সদরে মোটা অক্ষরে যেসব খবর ছাপা হয়, তাহার প্রতি ব্যোমকেশের আসক্তি নাই, সদরের চেয়ে অলিগলিতেই তাহার মনের যাতায়াত বেশি।
হঠাৎ কাগজ হইতে মুখ তুলিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ঈশানচন্দ্র মজুমদারের নাম জানো?
চিন্তা করিয়া বলিলাম, নামটা চেনা-চেনা মনে হচ্ছে। কে তিনি?
ব্যোমকেশ বলিল, ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন। বহরমপুরে আমি কিছুদিন তাঁর ছাত্র ছিলাম। ভদ্রলোক মারা গেছেন।
বলিলাম, তা তুমি যখন তাঁর ছাত্র, তখন তাঁর মরবার বয়স হয়েছিল বলতে হবে।
তা হয়তো হয়েছিল। কিন্তু তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। সর্পাঘাতে মারা গেছেন।
ও।
গতবছর আমরা যেখানে স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করতে গিয়েছিলাম, তিনি এবছর সেখানে গিয়েছিলেন। সেখানেই মৃত্যু হয়েছে।
সাঁওতাল পরগণার সেই পাহাড়-ঘেরা শহরটি! সেখানে কয় হপ্তা বড় আনন্দে ছিলাম, যাহাদের স্মৃতি ঝাপসা হইয়া আসিতেছিল, তাহাদের কথা মনে পড়িয়া গেল। মহীধর বাবু, পুরুন্দর পাণ্ডে, ডাক্তার ঘটক, রজনী—
বহিদ্বারের কড়া নড়িয়া উঠিল। দ্বার খুলিয়া দেখিলাম, ডাকপিওন। একখানা খামের চিঠি, ব্যোমকেশের নামে। আমাদের চিঠিপত্র বড় একটা আসে না। ব্যোমকেশকে চিঠি দিয়া উৎসুকভাবে তাহার পানে চাহিয়া রহিলাম।
চিঠি পড়িয়া সে সহাস্যে মুখ তুলিল, বলিল, কার চিঠি বল দেখি?
বলিলাম, তা কি করে জানিব? আমার তো রেডিও-চক্ষু নেই।
ডি. এস. পি, পুরন্দর পাণ্ডের চিঠি।
সবিস্ময়ে বলিলাম, বল কি! এইমাত্র যে তাঁর কথা ভাবছিলাম।
ব্যোমকেশ ঘাড় নাড়িয়া বলিল, আমিও।. শুধু তাই নয়, অধ্যাপক মজুমদারের প্রসঙ্গও আছে।
আশ্চর্য!
ব্যোমকেশ বলিল, এরকম আশ্চর্য ব্যাপার মাঝে মাঝে ঘটে। অনেকদিন যার কথা ভাবিনি তাকে হঠাৎ মনে পড়ে গেল, তারপর সে সশরীরে এসে হাজির হল। পণ্ডিতেরা বলেন, ‘কোইনসিডেন্স’-সমাপতন। কিন্তু এর রহস্য আরও গভীর। কোথাও একটা যোগসূত্র আছে, আমরা দেখতে পাই না—?
সে যাক। পাণ্ডে লিখেছেন কি?
পড়ে দ্যাখো।
চিঠি পড়িলাম। পাণ্ডে যাহা লিখিয়াছেন তাহার সারমর্ম এই—
সম্প্রতি এখানে একটি রহস্যময় ব্যাপার ঘটিয়াছে। শহর হইতে কিছু দূরে পাহাড়ের উপর এক সমৃদ্ধ পরিবার বাস করেন; গৃহস্বামীর এক বৃদ্ধ বন্ধু ঈশান মজুমদার বায়ু পরিবর্তনের জন্য আসিয়াছিলেন। তিনি হঠাৎ মারা গিয়াছেন। মৃত্যুর কারণ সর্পাঘাত বলিয়াই প্রকাশ, কিন্তু এ বিষয়ে শব-ব্যবচ্ছেদক ডাক্তার এবং পুলিসের মনে সন্দেহ হইয়াছে। ... ব্যোমকেশবাবু রহস্য ভালবাসেন; তার উপর এখন শীতকাল, এখানকার জলবায়ু অতি মনোরম। তিনি যদি সবান্ধবে আসিয়া কিছু দিনের জন্য দীনের গরীবখানায় আতিথ্য গ্রহণ করেন, তাহা হইলে রথ-দেখা কলা-বেচা দুই-ই হইবে।
চিঠি পড়া শেষ হইলে ব্যোমকেশ বলিল, কি বল?
বলিলাম, মন্দ কি। এখানে তোমার কাজকর্মও তো কিছু দেখছি না। কিন্তু সত্যবতী—
ব্যোমকেশ বলিল, ওকে এ অবস্থায় কোথাও নিয়ে যাওয়া চলে না—
তা বটে। কিন্তু ও যদি যেতে চায়? কিম্বা যদি তোমাকে না ছাড়তে চায়? এ সময় মেয়েদের মন বড় অবুঝ হয়ে পড়ে, কখন কি চায় বোঝা যায় না- ভিতর দিকে পায়ের শব্দ শুনিয়া থামিয়া গেলাম।
সত্যবতী প্রবেশ করিল। অবস্থাবেশে তাহার মুখখানি শুকাইয়া গিয়াছে, দেহাকৃতি ডিম-ভরা কৈ মাছের মত। সে আসিয়া একটা চেয়ারে থপ করিয়া বসিয়া পড়িল। আমরা নীরব রহিলাম। সত্যবতী তখন ক্লান্তিভরে বলিল, আমাকে দাদার কাছে পাঠিয়ে দাও। এখানে আর ভাল লাগছে না।
ব্যোমকেশের সহিত আমার চোখে চোখে বাত বিনিময় হইয়া গেল। সে বলিল, ভাল লাগছে না! ভাল লাগছে না কেন?
সত্যবতী উত্তাপহীন স্বরে বলিল, তোমাদের আর সহ্য হচ্ছে না। দেখছি আর রাগ হচ্ছে।
ইহা নিশ্চয় এই সময়ের একটা লক্ষণ, নচেৎ আমাদের দেখিয়া রাগ হইবার কোনও কারণ নাই। ব্যোমকেশ একটা ব্যথিত নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, যাও তাহলে, আটকাব না। অজিত তোমাকে সুকুমারের ওখানে পৌঁছে দিয়ে আসুক। —আর আমরাও না হয় এই ফাঁকে কোথাও ঘুরে আসি।
টেলিগ্রাম পাইয়া পুরুন্দর পাণ্ডে মহাশয় স্টেশনে উপস্থিত ছিলেন, আমাদের নামাইয়া লইলেন। তাঁহার বাসায় পৌঁছিয়া অপর্যাপ্ত খাদ্যদ্রব্য নিঃশেষ করিতে করিতে পরিচিত ব্যক্তিদের খোঁজখবর লইলাম। সকলেই পূর্ববৎ আছেন। কেবল মালতী দেবী আর ইহলোকে নাই; প্রোফেসর সোম বাড়ি বিক্রি করিয়া চলিয়া গিয়াছেন।
অতঃপর কাজের কথা আরম্ভ হইল। পুরন্দর পাণ্ডে অধ্যাপক ঈশানচন্দ্র মজুমদারের মৃত্যুর হাল বয়ান করিলেন। সেই সঙ্গে রামকিশোরের পারিবারিক সংস্থাও অনেকখানি জানা গেল।
অধ্যাপক মজুমদারের মৃত্যুর বিবরণ এইরূপ —তিনি মাসখানেক দুর্গে অবস্থান করিতেছিলেন, শরীর বেশ সারিয়াছিল। কয়েকদিন আগে তিনি রাত্রির আহার সম্পন্ন করিয়া অভ্যাসমত দুর্গের প্রাঙ্গণে পায়চারি করিলেন; সে সময় মাস্টার রমাপতি তাঁহার সঙ্গে ছিল। আন্দাজ সাড়ে নয়টার সময় রমাপতি বাড়িতে ফিরিয়া গেল; অধ্যাপক মহাশয় একাকী রহিলেন। তারপর রাত্রিকালে দুৰ্গে কি ঘটিল কেহ জানে না। পরদিন প্ৰাতঃকালেই রমাপতি আবার দুর্গে গেল। গিয়া দেখিল, অধ্যাপক মহাশয় তাঁহার শয়নঘরের দ্বারের কাছে মরিয়া পড়িয়া আছেন। তাঁহার পায়ের গোড়ালিতে সর্পাঘাতের চিহ্ন, মাথার পিছন দিকে ঘাড়ের কাছে একটা কালশিরার দাগ এবং ডান হাতের মুঠির মধ্যে একটি বাদশাহী আমলের চকচকে মোহর।
সর্পাঘাতের চিহ্ন প্ৰথমে কাহারও চোখে পড়ে নাই। রামকিশোর সন্দেহ করিলেন, রাত্রে কোনও দুৰ্বত্ত আসিয়া ঈশানবাবুকে মারিয়া গিয়াছে; মস্তকের আঘাত-চিহ্ন এই অনুমান সমর্থন করিল। তিনি পুলিসে খবর পাঠাইলেন।
কিন্তু পুলিস আসিয়া পৌছবার পূর্বেই সর্পদংশনের দাগ আবিষ্কৃত হইল। তখন আর উপায় নাই। পুলিস আসিয়া শব-ব্যবচ্ছেদের জন্য লাস চালান দিল।
শব-ব্যবচ্ছেদের ফলে মৃতের রক্তে সাপের বিষ পাওয়া গিয়াছে, গোখুরা সাপের বিষ। সুতরাং সর্পাঘাতই যে মৃত্যুর কারণ তাঁহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু তবু পুরন্দর পাণ্ডে নিঃসংশয় হইতে পারেন নাই। তাঁহার বিশ্বাস ইহার মধ্যে একটা কারচুপি আছে।
সব শুনিয়া ব্যোমকেশ বলিল, সাপের বিষে মৃত্যু হয়েছে একথা যখন অস্বীকার করা যায় না, তখন সন্দেহ কিসের?
পাণ্ডে বলিলেন, সন্দেহের অনেকগুলো ছোট কারণ আছে। কোনোটাই স্বতন্ত্রভাবে খুব জোরালো নয় বটে, কিন্তু সবগুলো মিলিয়ে একটা কিছু পাওয়া যায়। প্রথমত দেখুন, ঈশানবাবু মারা গেছেন সর্পাঘাতে। তবে তাঁর মাথায় চোট লাগল কি করে?
ব্যোমকেশ বলিল, এমন হতে পারে, সাপে কামড়াবার পর তিনি ভয় পেয়ে পড়ে যান, মাথায় চোট লেগে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তারপর অজ্ঞান অবস্থাতেই তাঁর মৃত্যু হয়। সম্ভব নয় কি?
অসম্ভব নয়। কিন্তু আরও কথা আছে। সাপ এল কোত্থেকে? আমি তন্নতন্ন করে খোঁজ করিয়েছি, কোথাও বিষাক্ত সাপের চিহ্ন মাত্র পাওয়া যায়নি।
কিন্তু আপনি যে বললেন, দু’বছর আগে রামকিশোরবাবুর মেয়েও সর্পাঘাতে মারা গিয়েছিল।
তাকে সাপে কামড়েছিল জঙ্গলে। সেখানে সাপ থাকতেও পারে। কিন্তু দুর্গে সাপ উঠল কি করে? পাহাড়ের গা বেয়ে ওঠা অসম্ভব। সিঁড়ি বেয়ে উঠতেও পারে, কিন্তু ওঠবার কোনও কারণ নেই। দুর্গে ইঁদুর, ব্যাং কিছু নেই, তবে কিসের লোভে সাপ সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠবে?
তাহলে—
তবে যদি কেউ সাপ নিয়ে গিয়ে দুর্গে ছেড়ে দিয়ে থাকে, তাহলে হতে পারে।
ব্যোমকেশ চিন্তা করিতে করিতে বলিল, হুঁ, আর কিছু?
পাণ্ডে বলিলেন, আর, ভেবে দেখুন, অধ্যাপক মহাশয়ের মুঠির মধ্যে একটি স্বর্ণমুদ্রা ছিল। সেটি এল কোত্থেকে?
হয়তো তাঁর নিজের জিনিস।
অধ্যাপক মহাশয়ের আর্থিক অবস্থার যে পরিচয় সংগ্রহ করেছি, তাতে তিনি মোহর হাতে নিয়ে সর্বদা ঘুরে বেড়াতেন বলে মনে হয় না।
তবে-কি অনুমান করেন?
কিছুই অনুমান করতে পারছি না; তাতেই তো সন্দেহ আরও বেড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এটা মামুলি সর্পাঘাত নয়, এর মধ্যে রহস্য আছে।
কিয়ৎকাল নীরব থাকিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ঈশানবাবুর আত্মীয় পরিজন কেউ নেই?
পাণ্ডে বলিলেন, এক বিবাহিতা মেয়ে আছে। জামাই নেপালে ডাক্তারি করে। খবর পেলাম, মেয়ে-জামাইয়ের সঙ্গে অধ্যাপক মহাশয়ের সদ্ভাব ছিল না।
ব্যোমকেশ নীরবে বসিয়া ভাবিতে লাগিল। পাঁচ মিনিট কাটিবার পর পাণ্ডে আবার কহিলেন, যেসব কথা শুনলেন সেগুলোকে ঠিক প্রমাণ বলা চলে না তা মানি, কিন্তু অবহেলা করাও যায় না। তা ছাড়া, আর একটা কথা আছে। রামকিশোরবাবুর বংশটা ভাল নয়।
ব্যোমকেশ চকিত হইয়া বলিল, সে কি রকম?
পাণ্ডে বলিলেন, বংশের একটা মানুষও সহজ নয়, স্বাভাবিক নয়। রামকিশোরবাবুকে আপাতদৃষ্টিতে ভালোমানুষ বলে মনে হয়, কিন্তু সেটা পোষ-মানা বাঘের নিরীহতা; সহজাত নয়, মেকি। তাঁর অতীত জীবনে বোধ হয় কোনও গুপ্তরহস্য আছে, নইলে যৌবন পার না হতেই তিনি এই জঙ্গলে অজ্ঞাতবাস শুরু করলেন কেন তা বোঝা যায় না। তারপর, বড় ছেলে বংশীধর একটি আস্ত কাঠগোঁয়ার; সে যেভাবে জমিদারী শাসন করে, তাতে মনে হয় সে চেঙ্গিস খাঁর ভায়রাভাই। শুনেছি জমিদারীতে দু’একটা খুন-জখমও করেছে, কিন্তু সাক্ষী-সাবুদ নেই—
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, বয়স কত বংশীধরের? বিয়ে হয়েছে?
বয়স ছাব্বিশ-সাতাশ। বিয়ে হয়েছিল, কিন্তু দু’মাস যেতে না যেতেই বৌয়ের অপঘাত মৃত্যু হয়। দেখা যাচ্ছে, এ বংশে মাঝে মাঝে অপঘাত মৃত্যু লেগেই আছে।
এরও কি সর্পাঘাত?
না। দুপুর রাত্রে ওপর থেকে খাদে লাফিয়ে পড়েছিল কিম্বা কেউ ঠেলে ফেলে দিয়েছিল।
চমৎকার বংশটি তো! তারপর বলুন।
মেজ ছেলে মুরলীধর আর একটি গুণধর। ট্যারা এবং কুঁজো; বাপ বিয়ে দেননি। বাপকে লুকিয়ে লোচ্চামি করে। একটা মজা দেখেছি, দুই ছেলেই বাপকে যমের মতন ভয় করে। বাপ যদি গো-বেচারি ভালমানুষ হতেন, তাহলে ছেলেরা তাঁকে অত বেশি ভয় করত না।
হুঁ-তারপর?
মুরলীধরের পরে এক মেয়ে ছিল, হরিপ্রিয়া। সে সর্পাঘাতে মারা গেছে। তার চরিত্র সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানি না। তবে জামাইটি সহজ মানুষ।
জামাই!
পাণ্ডে জামাই মণিলালের কথা বলিলেন। তারপর গদাধর ও তুলসীর পরিচয় দিয়া বিবরণ শেষ করিলেন, গদাধরটা ন্যালা-ক্যাবলা; তার যেটুকু বুদ্ধি সেটুকু দুষ্টু-বুদ্ধি। আর তুলসী-তুলসী মেয়েটা যে কী তা আমি বুঝে উঠতে পারিনি। নির্বোধ নয়, ন্যাকাবোকা নয়, ইঁচড়ে পাকাও নয়; তবু যেন কেমন একরকম।
ব্যোমকেশ ধীরে-সুস্থে একটি সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করিয়া বলিল, আপনি যেভাবে চরিত্রগুলিকে সমীক্ষণ করেছেন, তাতে মনে হয় আপনার বিশ্বাস এদের মধ্যে কেউ পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে ঈশানবাবুর মৃত্যুর জন্য দায়ী।
পাণ্ডে একটু হাসিয়া বলিলেন, আমার সন্দেহ তাই, কিন্তু সন্দেহটা এখনও বিশ্বাসের পর্যায়ে পৌঁছয়নি। বৃদ্ধ অধ্যাপককে মেরে কার কি ইষ্টসিদ্ধি হল সেটা বুঝতে পারছি না। যা হোক, আপনার মন্তব্য এখন মুলতুবি থাক। আজ বিকেলবেলা দুর্গে যাওয়া যাবে; সেখানে সরেজমিন তজবিজ করে আপনার যা মনে হয় বলবেন।
পাণ্ডে অফিসের কাজ দেখিতে চলিয়া গেলেন। ব্যোমকেশ আমাকে জিজ্ঞাসা করিল, কি মনে হল?
বলিলাম, সবই যেন ধোঁয়া-ধোঁয়া।
ব্যোমকেশ বলিল, ধোঁয়া যখন দেখা যাচ্ছে, তখন আগুন আছে। শাস্ত্ৰে বলে, পর্বতে বহ্নিমান ধূমাৎ।
২
বৈকালে পুলিসের মোটর চড়িয়া তিনজনে বাহির হইলাম। ছয় মাইল পাথুরে পথ অতিক্রম করিতে আধা ঘন্টা লাগিল।
কুয়ার নিকট অবধি পৌঁছিয়া দেখা গেল সেখানে আর একটি মোটর দাঁড়াইয়া আছে। আমরাও এখানে গাড়ি হইতে নামিলাম; পাণ্ডে বলিলেন, ডাক্তার ঘটকের গাড়ি। আবার কারুর অসুখ নাকি?
প্রশ্ন করিয়া জানা গেল, আমাদের পরিচিত ডাক্তার অশ্বিনী ঘটক এ বাড়ির গৃহ-চিকিৎসক। বাড়ির দিকে অগ্রসর হইতেছি, দৃষ্টি পড়িল কুয়ার ওপারে তরুগুচ্ছ হইতে মৃদুমন্দ ধোঁয়া বাহির হইতেছে।
ব্যোমকেশ বলিল, ওটা কি? ওখানে ধোঁয়া কিসের?
পাণ্ডে বলিলেন, একটা সাধু ওখানে আড্ডা গেড়েছে।
সাধু! এই জঙ্গলের মধ্যে সাধু! এখানে তো ভিক্ষা পাবার কোনও আশা নেই।
তা নেই। কিন্তু রামকিশোরবাবুর বাড়ি থেকে বোধ হয় বাবাজীর সিধে আসে।
ও। কতদিন আছেন এখানে বাবাজী?
ঠিক জানি না। তবে অধ্যাপক মহাশয়ের মৃত্যুর আগে থেকেই আছেন।
তাই নাকি? চলুন, একবার সাধু দর্শন করা যাক।
একটি গাছের তলায় ধূনি জ্বলিয়া কৌপীনধারী বাবাজী বসিয়া আছেন। আমরা কাছে গিয়া দাঁড়াইলে তিনি জবারক্ত চক্ষু মেলিয়া চাহিলেন, কিছুক্ষণ অপলকনেত্রে আমাদের পানে চাহিয়া রহিলেন। তারপর শ্মশ্রুসমাকুল মুখে একটি বিচিত্র নীরব হাসি ফুটিয়া উঠিল। তিনি আবার চক্ষু মুদিত করিলেন।
কিছুক্ষণ অনিশ্চিতভাবে দাঁড়াইয়া থাকিয়া চলিয়া আসিলাম। পথেঘাটে যেসব ভিক্ষাজীবী সাধু-সন্ন্যাসী দেখা যায় ইনি ঠিক সেই জাতীয় নন। কোথায় যেন একটা তফাৎ আছে। কিন্তু তাহা আধ্যাত্মিক আভিজাত্য কিনা বুঝিতে পারিলাম না।
পাণ্ডে বলিলেন, এবার কোথায় যাবেন? আগে রামকিশোরবাবুর সঙ্গে দেখা করবেন, না। দুর্গ দেখবেন?
ব্যোমকেশ বলিল, দুৰ্গটাই আগে দেখা যাক।
দেউড়ির পাশ দিয়া দুর্গের সিঁড়ি ধরিব, মোটর চালক বুলাকিলাল তাহার কোটর হইতে বাহিরে আসিয়া ডি. এস. পি. সাহেবকে সেলাম করিয়া দাঁড়াইল। পাণ্ডে বলিলেন, বুলাকিলাল, ডাক্তার এসেছে কেন? কারুর কি অসুখ?
বুলাকিলাল বলিল, না। হুজুর, ডাক্তার সাহেব এসেছে, উকিল সাহেবও এসেছেন। কি জানি কি গুফত-গু হচ্ছে।
উকিল? হিমাংশুবাবু?
জী হুজুর। একসঙ্গে এসেছেন। এত্তালা দেব?
থাক, আমরা নিজেরাই যাব।
বুলাকিলাল তখন হাত জোড় করিয়া বলিল, হুজুর, ঠাণ্ডাই তৈরি করছি। যদি হুকুম হয়—
ঠাণ্ডাই-ভাঙ? বেশ তো, তুমি তৈরি কর, আমরা দুর্গ দেখে এখনই ফিরে আসছি।
জী সরকার।
বুড়ো বুলাকিলাল খাসা ভাঙ তৈরি করে। ঐ নিয়েই আছে।
পঁচাত্তরটি সিঁড়ি ভাঙ্গিয়া দুৰ্গতোরণে উপনীত হইলাম। তোরণের কবাট নাই, বহু পূর্বেই অন্তৰ্হিত হইয়াছে। কিন্তু পাথরের খিলান এখনও অটুট আছে। গতাগতির বাধা নাই।
তোরণপথে প্রবেশ করিয়া সর্বাগ্রে যে বস্তুটি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। তাহা একটি কামান। প্রথম দেখিয়া মনে হয় তাল গাছের একটা গুঁড়ি মুখ উঁচু করিয়া মাটিতে পড়িয়া আছে। দুই শতাব্দীর রৌদ্রবৃষ্টি অনাবৃত কামানের দশ হাত দীর্ঘ দেহটিকে মরিচা ধরাইয়া শল্কাবৃত করিয়া তুলিয়াছে। প্রায় নিরেট লৌহস্তম্ভটি জগদ্দল ভারি, বহুকাল কেহ তাহাকে নড়াচাড়া করে নাই। তাহার ভিতরের গোলা ছুঁড়িবার ছিদ্রটি বেশি ফাঁদালো নয়, কোনও ক্রমে একটি ছোবড়া-ছাড়ানো নারিকেল তাহাতে প্রবেশ করিতে পারে। তাহাও বর্তমানে ধূলামাটিকে ভরাট হইয়া গিয়াছে; মুখের দিকটায় একগুচ্ছ সজীব ঘাস মাথা বাহির করিয়া আছে। অতীতের সাক্ষী ক্ষয়িষ্ণু দুর্গটির তোরণমুখে ভূপতিত কামানটিকে দেখিয়া কেমন যেন মায়া হয়; মনে হয় যৌবনে সে বলদৃপ্ত যোদ্ধা ছিল, জরার বশে ধরাশায়ী হইয়া সে উর্ধ্বমুখে মৃত্যুর দিন শুনিতেছে।
কামান ছাড়া অতীতকালের অস্থাবর বস্তু দুৰ্গমধ্যে আর কিছু নাই। প্রাকার-ঘেরা দুৰ্গভূমি আয়তনে দুই বিঘার বেশি নয়; সমস্তটাই পাথরের পাটি দিয়া বাঁধানো। চক্রাকার প্রাকারের গায়ে ছোট ছোট কুঠুরি; বোধ হয় পূর্বকালে এগুলিতে দুৰ্গরক্ষক সিপাহীরা থাকিত। এগুলির অবস্থা ভগ্নপ্রায়; কোথাও পাথর ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে, কোথাও দ্বারের সম্মুখে কাঁটাগাছ জন্মিয়াছে। এই চক্রের মাঝখানে নাভির ন্যায় দুর্গের প্রধান ভবন। নাভি ও নেমির মধ্যে বিস্তৃত প্রাঙ্গণের অবকাশ।
গৃহটি চতুষ্কোণ এবং বাহির হইতে দেখিলে মজবুত বলিয়া মনে হয়। পাঁচ ছয়টি ছোট বড় ঘর লইয়া গৃহ; মামুলিভাবে মেরামত করা সত্ত্বেও সব ঘরগুলি বাসের উপযোগী নয়। কোনও ঘরের দেয়ালে ফাটল ধরিয়াছে, কোনও ঘরের ছাদ ফুটো হইয়া আকাশ দেখা যায়। কেবল পিছন দিকের একটি ছোট ঘর ভাল অবস্থায় আছে। যদিও চুন সুরকি খসিয়া স্থুল পাথরের গাঁথুনি প্রকট হইয়া পড়িয়াছে। তবু ঘরটিকে বাসোপযোগী করিবার জন্য তাহার প্রবেশ-পথে নূতন চৌকাঠ ও কবাট লাগানো হইয়াছে।
আমরা অন্যান্য ঘরগুলি দেখিয়া এই ঘরের সম্মুখে উপস্থিত হইলাম। পাণ্ডে চৌকাঠের দিকে আঙ্গুল দেখাইয়া বলিলেন, অধ্যাপক মহাশয়ের লাস ঐখানে পড়ে ছিল।
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ সেইদিকে তাকাইয়া থাকিয়া বলিল, সাপে কামড়বার পর তিনি যদি চৌকাঠে মাথা ঠুকে পড়ে গিয়ে থাকেন, তাহলে মাথায় চোট লাগা অসম্ভব নয়।
পাণ্ডে বলিলেন, না, অসম্ভব নয়। কিন্তু সারা বাড়িটা আপনি দেখেছেন; ভাঙ্গা বটে, কিন্তু কোথাও এমন আবর্জনা নেই যেখানে সাপ লুকিয়ে থাকতে পারে। অধ্যাপক মহাশয় বাস করতে আসার সময় এখানে ভাল করে কার্বলিক অ্যাসিডের জল ছড়ানো হয়েছিল, তারপরও তিনি বেঁচে থাকাকালে বার দুই ছড়ানো হয়েছে—
অধ্যাপক মহাশয় আসবার আগে এখানে কেউ বাস করত না?
পাণ্ডে মুখ টিপিয়া বলিলেন, কেউ কবুল করে না। কিন্তু মুরলীধর—
হুঁ-বুঝেছি। বলিয়া ব্যোমকেশ ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল।
ঘরটি লম্বায় চওড়ায় আন্দাজ চৌদ্দ ফুট। মেঝে শান বাঁধানো। একপাশে একটি তক্তপোশ এবং একটি আরাম-কেদারা ছাড়া ঘরে অন্য কোনও আসবাব নাই। অধ্যাপক মহাশয়ের ব্যবহারের জন্য যে-সকল তৈজস ছিল তাহা স্থানান্তরিত হইয়াছে।
এই ঘরে একটি বিশেষত্ব লক্ষ্য করিলাম যাহা অন্য কোনও ঘরে নাই। তিনটি দেয়ালে মেঝে হইতে প্ৰায় এক হাত উর্ধ্বে সারি সারি লোহার গজাল ঠোকা রহিয়াছে, গজালগুলি দেয়াল হইতে দেড় হাত বাহির হইয়া আছে। সেগুলি আগে বোধ হয় শাবলের মত স্থুল ছিল, এখন মরিচা ধরিয়া যেরূপ ভঙ্গুর আকৃতি ধারণ করিয়াছে তাহাতে মনে হয় সেগুলি জানকীরামের সমসাময়িক।
ব্যোমকেশ বলিল, দেয়ালে গোঁজ। কেন?
পাণ্ডে বলিলেন, এ ঘরটা বোধহয় সেকালে দুর্গের দপ্তর কিম্বা খাজনাখানা ছিল। গোঁজের ওপর তক্তা পেতে দিলে বেশ তাক হয়, তাকের ওপর নানান জিনিসপত্র, বই খাতা, এমন কি টাকার সিন্দুক রাখা চলত। এখনও বিহারের অনেক সাবেক বাড়িতে এইরকম গোঁজ দেখা যায়৷।
ব্যোমকেশ ঘরের মেঝে ও দেয়ালের উপর চোখ বুলাইয়া দেখিতে লাগিল। এক সময় বলিল, অধ্যাপক মহাশয় নিশ্চয় বাক্স-বিছানা এনেছিলেন। সেগুলো কোথায়?
সেগুলো আমাদের অর্থাৎ পুলিসের জিম্মায় আছে।
বাক্সর মধ্যে কি আছে দেখেছেন?
গোটাকয়েক জামা কাপড় আর খান-তিন-চার বই খাতা। একটা ন্যাকড়ায় বাঁধা তিনটে দশ টাকার নোট আর কিছু খুচরো টাকা পয়সা ছিল।
আর তাঁর মুঠির মধ্যে যে মোহর পাওয়া গিয়েছিল সেটা?
সেটাও আমাদের জিম্মায় আছে। এ মামলার একটা নিষ্পত্তি হলে সব জিনিস তাঁর ওয়ারিসকে ফেরত দিতে হবে।
ব্যোমকেশ আরও কিছুক্ষণ ঘর পরীক্ষা করিল, কিন্তু উল্লেখযোগ্য কিছু পাওয়া গেল না। তখন সে নিশ্বাস ছাড়িয়া বলিল, চলুন। এখানকার দেখা শেষ হয়েছে।
দুর্গ প্রাঙ্গণে আসিয়া আমরা তোরণের দিকে অগ্রসর হইয়াছি, একটি ছোকরা তোরণ দিয়া প্রবেশ করিল। মাস্টার রমাপতিকে এই প্রথম দেখিলাম। ছিপছিপে গড়ন, ময়লা রঙ, চোখেমুখে বুদ্ধির ছাপ; কিন্তু সঙ্কুচিত ভাব। বয়স উনিশ-কুড়ি। তাহাকে দেখিয়া পাণ্ডে বলিলেন, কি মাস্টার, কি খবর?
রমাপতি একটু অপ্রতিভ হাসিয়া বলিল, বাড়িতে ডাক্তারবাবু আর উকিলবাবু এসেছেন। তাঁদের নিয়ে কর্তার ঘরে কি সব কাজের কথা হচ্ছে। বড়রা সবাই সেখানে আছেন। কিন্তু গদাই আর তুলসীকে দেখতে পেলাম না, তাই ভাবলাম হয়তো তারা এখানে এসেছে।
না, তাদের তো এখানে দেখিনি।
পাণ্ডে আমাদের সহিত রমাপতির পরিচয় করাইয়া দিলেন, এঁরা আমার বন্ধু, এখানে বেড়াতে এসেছেন।
রমাপতি একদৃষ্টি ব্যোমকেশের পানে চাহিয়া থাকিয়া সংহত স্বরে বলিল, আপনি কি-সত্যান্বেষী ব্যোমকেশবাবু?
ব্যোমকেশ হাসিয়া উঠিল, হুঁ! কিন্তু চিনলেন কি করে; আমার ছবি তো কোথাও বেরোয়নি।
রমাপতি সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিল, স্থলিত স্বরে বলিল, আমি-না, ছবি দেখিনি-কিন্তু দেখে মনে হল-আপনার বই পড়েছি।--কদিন ধরে মনে হচ্ছিল-আপনি যদি আসতেন তাহলে নিশ্চয় এই ব্যাপারের মীমাংসা হত- সে থতমত খাইয়া চুপ করিল।
ব্যোমকেশ সদয় হাসিয়া বলিল, আসুন, আপনার সঙ্গে খানিক গল্প করা যাক।
নিকটেই কামান পড়িয়াছিল, ব্যোমকেশ রুমাল দিয়া ধূলা ঝাড়িয়া তাহার উপর বসিল, পাশের স্থান নির্দেশ করিয়া বলিল, ‘বসুন।’ রমাপতি সসঙ্কোচে তাহার পাশে বসিল।
ব্যোমকেশ বলিল, আপনি বললেন আমি এলে এ ব্যাপারের মীমাংসা হবে। ঈশানবাবু তো সাপের কামড়ে মারা গেছেন। এর মীমাংসা কী হবে?
রমাপতি উত্তর দিল না, শঙ্কিত নতমুখে অঙ্গুষ্ঠ দিয়া অঙ্গুষ্ঠের নখ খুঁটিতে লাগিল। ব্যোমকেশ তাহার আপাদমস্তক তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে দেখিয়া লইয়া সহজ স্বরে বলিল, যাক ও কথা। ঈশানবাবু যে-রাত্রে মারা যান সে-রাত্ৰে প্ৰায় সাড়ে ন’টা পর্যন্ত আপনি তাঁর সঙ্গে ছিলেন। কি কথা হচ্ছিল?
রমাপতি এবার সতর্কভাবে উত্তর দিল, বলিল, উনি আমাকে স্নেহ করতেন। আমি ওঁর কাছে এলে আমার সঙ্গে নানারকম গল্প করতেন। সে-রাত্রে—
সে-রাত্রে কোন গল্প বলছিলেন?
এই দুর্গের ইতিহাস বলছিলেন।
দুর্গের ইতিহাস! তাই নাকি! কি ইতিহাস শুনলেন বলুন তো, আমরাও শুনি।
আমি আর পাণ্ডে গিয়া কামানের উপর বসিলাম। রমাপতি যে গল্প শুনিয়াছিল। তাহা বলিল। রাজা জানকীরাম হইতে আরম্ভ করিয়া সিপাহী বিদ্রোহের সময় রাজারাম ও জয়রাম পর্যন্ত কাহিনী বলিয়া গেল।
শুনিয়া ব্যোমকেশ বলিল, হুঁ, সত্যি ইতিহাস বলেই মনে হয়। কিন্তু এ ইতিহাস তো পাঠ্যপুস্তকে পাওয়া যায় না। ঈশানবাবু জানলেন কি করে?
রমাপতি বলিল, উনি সব জানতেন। কর্তার এক ভাই ছিলেন, কম বয়সে মারা যান, তাঁর নাম ছিল রামবিনোদ সিংহ, অধ্যাপক মশায় তাঁর প্রাণের বন্ধু ছিলেন। তাঁর মুখে উনি এসব কথা শুনেছিলেন; রামবিনোদবাবুর মৃত্যু পর্যন্ত বংশের সব ইতিহাস এর জানা ছিল। একটা খাতায় সব লিখে রেখেছিলেন।
খাতায় লিখে রেখেছিলেন? কোথায় খাতা? এখন খাতা কোথায় তা জানি না। কিন্তু আমি দেখেছি। বোধহয় ওঁর তেরঙ্গের মধ্যে আছে।
ব্যোমকেশ পাণ্ডের পানে তাকাইল। পাণ্ডে ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, পেন্সিলে লেখা একটা খাতা আছে, কিন্তু তাতে কি লেখা আছে তা জানি না। বাংলায় লেখা।
দেখতে হবে; যা হোক ব্যোমকেশ রমাপতির দিকে ফিরিয়া বলিল, আপনার কাছে অনেক খবর পাওয়া গেল। —আচ্ছা, পরদিন সকালে সবার আগে আপনি আবার দুর্গে এসেছিলেন কেন, বলুন তো?
রমাপতি বলিল, উনি আমাকে ডেকেছিলেন। বলেছিলেন, আজ এই পর্যন্ত থাক, কাল ভোরবেলা এসো, বাকি গল্পটা বলব!
বাকি গল্পটা মানে—?
তা কিছু খুলে বলেননি। তবে আমার মনে হয়েছিল যে সিপাহী যুদ্ধের পর থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত এ বংশের ইতিহাস আমাকে শোনাবেন।
কিন্তু কেন? আপনাকে এ ইতিহাস শোনাবার কোনও উদ্দেশ্য ছিল কি?
তা জানি না; তাঁর যখন যা মনে আসত আমাকে বলতেন, আমারও ভাল লাগত। তাই শুনতাম। মোগল-পাঠান আমলের অনেক গল্প বলতেন। একদিন বলেছিলেন, যে-বংশে একবার ভ্রাতৃহত্যার বিষ প্রবেশ করেছে সে-বংশের আর রক্ষা নেই; যতবড় বংশই হোক তার ধ্বংস অনিবাৰ্য। এই হচ্ছে ইতিহাসের সাক্ষ্য।
আমরা পরস্পর মুখের পানে চাহিলাম। পাণ্ডের ললাট ভ্রুকুটি-বন্ধুর হইয়া উঠিল। ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, সন্ধ্যে হয়ে আসছে। চলুন, এবার ওদিকে যাওয়া যাক।
খাদের ওপারে বাড়ির আড়ালে সূর্য তখন ঢাকা পড়িয়াছে।
৩
দেউড়ি পর্যন্ত নামিয়া আসিয়া দেখিলাম, বুলাকিলাল দুইটি বৃহৎ পাত্রে ভাঙের সরবৎ লইয়া ঢালাঢালি করিতেছে; গদাধর এবং তুলসী পরম আগ্রহভরে দাঁড়াইয়া প্রক্রিয়া দেখিতেছে।
আমাদের আগমনে গদাধর বিরাট হাঁ করিয়া তাকাইয়া রহিল; তুলসী সংশয়-সঙ্কুল চক্ষু আমাদের উপর স্থাপন করিয়া কোণাচে ভাবে সরিয়া গিয়া মাস্টার রমাপতির হাত চাপিয়া ধরিল। রমাপতি তিরস্কারের সুরে বলিল, কোথায় ছিলে তোমরা? আমি চারিদিকে তোমাদের খুঁজে বেড়াচ্ছি।
তুলসী জবাব দিল না, অপলক দৃষ্টিতে আমাদের পানে চাহিয়া রহিল। গদাধরের গলা হইতে একটি ঘড়ঘড় হাসির শব্দ বাহির হইল। সে বলিল, সাধুবাবা গাঁজা খাচ্ছিল তাই দেখছিলাম।
রমাপতি ধমক দিয়া বলিল, সাধুর কাছে যেতে তোমাদের মানা করা হয়নি?
গদাধর বলিল, কাছে তো যাইনি, দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম।
আচ্ছা, হয়েছে —এবার বাড়ি চল।
রমাপতি তাহাদের লইয়া বাড়ির দিকে চলিল। শুনিতে পাইলাম, কয়েক ধাপ উঠিবার পর তুলসী ব্যগ্ৰকণ্ঠে বলিতেছে, মাস্টারমশাই, ওরা সব কারা?
বুলাকিলাল গেলাস ভরিয়া আমাদের হাতে দিল। দধি গোলমরিচ শসার বীচি এবং আরও বহুবিধ বকাল সহযোগে প্ৰস্তুত উৎকৃষ্ট ভাঙের সরবৎ; এমন সরবৎ ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ছাড়া আর কোথাও প্রস্তুত হয় না। পাণ্ডে তারিফ করিয়া বলিলেন, বাঃ, চমৎকার হয়েছে। কিন্তু বুলাকিলাল, তুমি এত ভাঙ তৈরি করেছ কার জন্যে? আমরা আসব তা তো জানতে না।
বুলাকিলাল বলিল, হুজুর, আমি আছি, সাধুবাবাও এক ঘটি চড়ান—
সাধুবাবার দেখছি কিছুতেই অরুচি নেই। আর—
আর-গণপৎ এক ঘটি নিয়ে যায়৷।
গণপৎ—মুরলীধরের খাস চাকর? নিজের জন্যে নিয়ে যায়, না মালিকের জন্যে?
তা জানি না হুজুর।
আচ্ছা বুলাকিলাল, তুমি তো এ বাড়ির পুরোনো চাকর, বাড়িতে কে কোন নেশা করে বলতে পারো?
বুলাকিলাল একটু চুপ করিয়া বলিল, বড়কর্তা সন্ধের পর আফিম খান। আর কারুর কথা জানি না ধর্মাবতার।
বোঝা গেল, জানিলেও বুলাকিলাল বলিবে না। আমরা সরবৎ শেষ করিয়া, আর এক প্রস্থ তারিফ করিয়া বাড়ির সিঁড়ি ধরিলাম।
এদিকেও সিঁড়ির সংখ্যা সত্তর-আশি। উপরে উঠিয়া দেখা গেল, সূর্য অস্ত গিয়াছে, কিন্তু এখনও বেশ আলো আছে। বাড়ির সদরে রমাপতি উপস্থিত ছিল, সে বলিল, কর্তার সঙ্গে দেখা করবেন? আসুন।
রমাপতি আমাদের যে ঘরটিতে লইয়া গেল সেটি বাড়ির বৈঠকখানা।
টেবিল চেয়ার ছাড়াও আর একটি ফরাস-ঢাকা বড় তক্তপোশ আছে। তক্তপোশের মধ্যস্থলে রামকিশোরবাবু আসীন; তাঁহার এক পাশে নায়েব চাঁদমোহন, অপর পাশে জামাই মণিলাল। দুই ছেলে বংশীধর ও মুরলীধর তক্তপোশের দুই কোণে বসিয়াছে। ডাক্তার ঘটক এবং উকিল হিমাংশুবাবু তক্তপোশের কিনারায় চেয়ার টানিয়া উপবিষ্ট আছেন। পশ্চিম দিকের খোলা জানালা দিয়া ঘরে আলো আসিতেছে; তবু ঘরের ভিতরটা ঘোর ঘোর হইয়া আসিয়াছে।
ঘরে প্রবেশ করিতে করিতে শুনিতে পাইলাম, মুরলীধর পেঁচালো সুরে বলিতেছে, যার ধন তার ধন নয়, নেপোয় মারে দৈ! মণিলালকে দুর্গ দেওয়া হবে কেন? আমি কি ভেসে এসেছি? দুৰ্গ আমি নেব।
বংশীধর অমনি বলিয়া উঠিল, তুমি নেবে কেন? আমার দাবি আগে, দুৰ্গ আমি নেব। আমি ওটা মেরামত করিয়ে ওখানে বাস করব।
রামকিশোর বারুদের মত ফাটিয়া পড়িলেন, খবরদার! আমার মুখের ওপর যে কথা বলবে জুতিয়ে তার মুখ ছিঁড়ে দেব। আমার সম্পত্তি আমি যাকে ইচ্ছে দিয়ে যাব। মণিলালকে আমি সর্বস্ব দিয়ে যাব, তোমাদের তাতে কি! বেয়াদব কোথাকার।
মণিলাল শান্তস্বরে বলিল, আমি তো কিছুই চাইনি—।
মুরলীধর মুখের একটা ভঙ্গী করিয়া বলিল, না কিছুই চাওনি, কিন্তু ভেতরে ভেতরে বাবাকে বশ করেছ। মিট্মিটে ডান—
রামকিশোর আবার ফাটিয়া পড়িবার উপক্ৰম করিতেছিলেন, ডাক্তার ঘটক হাত তুলিয়া বলিল, রামকিশোরবাবু, আপনি বড় বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন, আপনার শরীরের পক্ষে ওটা ভাল নয়। আজ বরং কথাবার্তা বন্ধ থাক, আর একদিন হবে।
রামকিশোরবাবু ঈষৎ সংযত হইয়া বলিলেন, না ডাক্তার, এ ব্যাপার টাঙিয়ে রাখা চলবে না। আজ আছি কাল নেই, আমি সব হাঙ্গামা চুকিয়ে রাখতে চাই। হিমাংশুবাবু, আমি আমার সম্পত্তির কি রকম ব্যবস্থা করতে চাই আপনি শুনেছেন; আর বেশি আলোচনার দরকার নেই। আপনি দলিলপত্র তৈরি করতে আরম্ভ করে দিন। যত শীগগির দলিল রেজিস্ট্রি হয়ে যায় ততই ভাল।
বেশ, তাই হবে। আজ তাহলে ওঠা যাক।
হিমাংশুবাবু গাত্ৰোত্থান করিলেন। এতক্ষণে সকলের নজর পড়িল যে আমরা তিনজন ন যযৌ ন তস্থৌ ভাবে দ্বারের নিকটে দাঁড়াইয়া আছি। রামকিশোর ভ্রু তুলিয়া বলিলেন, কে?
পাণ্ডে আগাইয়া গিয়া বলিলেন, আমি। আমার দুটি কলকাতার বন্ধু বেড়াতে এসেছেন, তাঁদের দুর্গ দেখাতে এনেছিলাম। বলিয়া বোমকেশের ও আমার নামোল্লেখ করিলেন।
রামকিশোর সমোদর সহকারে বলিলেন, আসুন, আসুন। বসতে আজ্ঞা হোক। কিন্তু তিনি ব্যোমকেশের নাম পূর্বে শুনিয়াছেন বলিয়া মনে হইল না।
বংশীধর ও মুরলীধর উঠিয়া গেল। ডাক্তার ঘটক আমাদের দেখিয়া একটু বিস্মিত ও অপ্ৰতিভ হইল, তারপর হাত তুলিয়া নমস্কার করিল। ডাক্তারের সঙ্গে দু’একটা কথা হইবার পর সে উকিল হিমাংশুবাবুকে লইয়া প্ৰস্থান করিল। ঘরের মধ্যে রহিয়া গেলাম আমরা তিনজন এবং ও-পক্ষে রামকিশোরবাবু, নায়েব চাঁদমোহন এবং জামাই মণিলাল।
রামকিশোর হাকিলেন, ওরে কে আছিস, আলো দিয়ে যা, চা তৈরি কর।
চাঁদমোহন বলিলেন, আমি দেখছি— তিনি উঠিয়া গেলেন। চাঁদমোহনের চেহারা কালো এবং চিমশে কিন্তু চোখের দৃষ্টিতে ধূৰ্ততা ভরা। তিনি যাইবার সময় ব্যোমকেশের প্রতি একটি দীর্ঘ-গভীর অপাঙ্গদৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া গেলেন।
দুই চারিটি সৌজন্যমূলক বাক্যালাপ হইল। বাহিরের লোকের সহিত রামকিশোরের ব্যবহার বেশ মিষ্ট ও অমায়িক। তারপর ব্যোমকেশ বলিল, শুনলাম ঈশানবাবু এখানে এসে সর্পাঘাতে মারা গেছেন। আমি তাঁকে চিনতাম, একসময় তাঁর ছাত্র ছিলাম।
তাই নাকি! রামকিশোর চকিত চক্ষে ব্যোমকেশের পানে চাহিলেন, আমার বড় ছেলেও—। কি বলে, ঈশান আমার প্রাণের বন্ধু ছিল, ছেলেবেলার বন্ধু। সে আমার বাড়িতে এসে অপঘাতে মারা গেল, এ লজ্জা আমি জীবনে ভুলব না। তাঁহার কথার ভাবে মনে হইল, সর্পাঘাতে মৃত্যু সম্বন্ধে যে সন্দেহ আছে তাহা তিনি জানেন না।
ব্যোমকেশ সহানুভূতি দেখাইয়া বলিল, বড়ই দুঃখের বিষয়। তিনি আপনার দাদারও বন্ধু ছিলেন?
রামকিশোর ক্ষণেক নীরব থাকিয়া যেন একটু বেশি ঝোঁক দিয়া বলিলেন, হ্যাঁ। কিন্তু দাদা প্ৰায় ত্ৰিশ বছর হল মারা গেছেন।
ও-তাহলে বর্তমানে আপনার সঙ্গেই তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল। —আচ্ছা, তিনি এবার এখানে আসার আগে এ বাড়ির কে কে তাঁকে চিনতেন? আপনি চিনতেন। আর—?
আর আমার নায়েব চাঁদমোহন চিনতেন।
আপনার ড্রাইভার তো পুরোনো লোক, সে চিনত না?
হ্যাঁ, বুলাকিলাল চিনত।
আর, আপনার বড় ছেলেও বোধহয় তাঁর ছাত্র ছিলেন?
গলাটা পরিষ্কার করিয়া রামকিশোর বলিলেন, হ্যাঁ।
এই বাক্যালাপ যখন চলিতেছিল তখন জামাই মণিলালকে লক্ষ্য করিলাম। ভোজনরত মানুষের পাতের কাছে বসিয়া পোষা বিড়াল যেমন একবার পাতের দিকে একবার মুখের দিকে পৰ্যায়ক্রমে চক্ষু সঞ্চালন করে, মণিলাল তেমনি কথা বলার পর্যায়ক্রমে ব্যোমকেশ ও রামকিশোরের দিকে দৃষ্টি ফিরাইতেছে। তাহার মুখের ভাব আধা-অন্ধকারে ভাল ধরা গেল না, কিন্তু সে যে একাগ্রমনে বাক্যালাপ শুনিতেছে তাহাতে সন্দেহ নাই।
ব্যোমকেশ বলিল, ঈশানবাবুর মুঠিতে একটি মোহর পাওয়া গিয়েছিল। সেটি কোথা থেকে এল বলতে পারেন?
রামকিশোর মাথা নাড়িয়া বলিলেন, না। ভারি আশ্চর্য ব্যাপার। ঈশানের আর্থিক অবস্থা তেমন ভাল ছিল না। অন্তত মোহর নিয়ে বেড়াবার মত ছিল না।
দুর্গে কোথাও কুড়িয়ে পাওয়া সম্ভব নয় কি?
রামকিশোর বিবেচনা করিয়া বলিলেন, সম্ভব। কারণ আমার পূর্বপুরুষদের অনেক সোনা-দানা ঐ দুর্গে সঞ্চিত ছিল। সিপাহীরা যখন লুঠ করতে আসে তখন এক-আধটা মোহর এদিকে ওদিকে ছিটকে পড়া বিচিত্র নয়। তা যদি হয় তাহলে ও মোহর আমার সম্পত্তি।
ব্যোমকেশ বলিল, আপনার সম্পত্তি হলে ঈশানবাবু মোহরটি আপনাকে ফেরত দিতেন না কি? আমি যতদূর জানি, পরের সম্পত্তি আত্মসাৎ করবার লোক তিনি ছিলেন না।
তা ঠিক। কিন্তু অভাবে মানুষের স্বভাব নষ্ট হয়। তা ছাড়া, মোহরটা কুড়িয়ে পাবার সময়েই হয়তো তাকে সাপে কামড়েছিল। বেচারা সময় পায়নি।
এই সময় একজন ভৃত্য কেরোসিনের ল্যাম্প আনিয়া টেবিলের উপর রাখিল, অন্য একজন ভৃত্য চা এবং জলখাবারের ট্ৰে লইয়া আমাদের সম্মুখে ধরল। আমরা সবিনয়ে জলখাবার প্রত্যাখ্যান করিয়া চায়ের পেয়ালা তুলিয়া লইলাম।
চায়ে চুমুক দিয়া ব্যোমকেশ বলিল, এখানে বিদ্যুৎ বাতির ব্যবস্থা নেই। ঈশানবাবুও নিশ্চয় রাত্রে কেরোসিনের লণ্ঠন ব্যাবহার করতেন?
রামকিশোর বলিলেন, হ্যাঁ। তবে মৃত্যুর হপ্তাখানেক আগে সে একবার আমার কাছ থেকে একটা ইলেকট্রিক টর্চ চেয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তার মৃত্যুর পর আর সব জিনিসই পাওয়া গেল কেবল ঐ টৰ্চটা পাওয়া যায়নি।
তাই নাকি! কোথায় গেল টৰ্চটা?
এতক্ষণে মণিলাল কথা কহিল, গভীর মুখে বলিল, আমার বিশ্বাস ঐ ঘটনার পরদিন সকালবেলা গোলমালে কেউ টৰ্চটা সরিয়েছে।
পাণ্ডে প্রশ্ন করিলেন, কে সরাতে পারে? কারুর ওপর সন্দেহ হয়?
মণিলাল উত্তর দিবার জন্য মুখ খুলিয়াছিল, রামকিশোর মাঝখানে বলিয়া উঠিলেন, না না, মণি, ও তোমার ভুল ধারণা। রমাপতি নেয়নি, নিলে স্বীকার করত।
মণিলাল আর কথা কহিল না, ঠোঁট চাপিয়া বসিয়া রহিল। বুঝিলাম, টর্চ হারানোর প্রসঙ্গ পূর্বে আলোচিত হইয়াছে এবং মণিলালের সন্দেহ মাস্টার রমাপতির উপর। একটা ক্ষুদ্র পরিবারিক মতান্তর ও অস্বাচ্ছন্দ্যের ইঙ্গিত পাওয়া গেল।
অতঃপর চা শেষ করিয়া আমরা উঠিলাম। ব্যোমকেশ বলিল, এই সূত্রে আপনার সঙ্গে পরিচয়ের সৌভাগ্য হল। বড় সুন্দর জায়গায় বাড়ি করেছেন। এখানে একবার এলে আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না।
রামকিশোর আনন্দিত হইয়া বলিলেন, বেশ তো, দুদিন না হয় থেকে যান না। দুদিন পরে কিন্তু প্ৰাণ পালাই-পালাই করবে। আমাদের অভ্যোস হয়ে গেছে তাই থাকতে পারি।
ব্যোমকেশ বলিল, আপনার নিমন্ত্রণ মনে রাখব। কিন্তু যদি আসি, ঐ দুর্গে থাকতে দিতে হবে। ক্ষুধিত পাষাণের মত আপনার দুর্গটা আমাকে চেপে ধরেছে।
রামকিশোর বিরসমুখে বলিলেন, দুর্গে আর কাউকে থাকতে দিতে সাহস হয় না। যা হোক, যদি সত্যিই আসেন তখন দেখা যাবে।
দ্বারের দিকে অগ্রসর হইয়াছি, কালো পর্দার আড়ালে জ্বলজ্বলে দুটো চোখ দেখিয়া চমকিয়া উঠিলাম। তুলসী এতক্ষণ পর্দার কাছে দাঁড়াইয়া আমাদের কথা শুনিতেছিল, এখন সরীসৃপের মত সরিয়া গেল।
রাত্রে আহারাদির পর পাণ্ডেজির বাসার খোলা ছাদে তিনটি আরাম-কেদারায় আমরা তিনজনে অঙ্গ এলাইয়া দিয়াছিলাম। অন্ধকারে ধূমপান চলিতেছিল। এখানে কার্তিক মাসের এই সময়টি বড় মধুর; দিনে একটু মোলায়েম গরম, রাত্রে মোলায়েম ঠাণ্ডা।
পাণ্ডে বলিলেন, এবার বলুন কি মনে হল।
ব্যোমকেশ সিগারেটে দু তিনটা টান দিয়া বলিল, আপনি ঠিক ধরেছেন, গলদ আছে। কিন্তু ওখানে গিয়ে যতক্ষণ না চেপে বসা যাচ্ছে ততক্ষণ গলদ ধরা যাবে না।
আপনি তো আজ তার গৌরচন্দ্ৰিকা করে এসেছেন। কিন্তু নিতান্তই কি দরকার—?
দরকার। এতদূর থেকে সুবিধা হবে না। ওদের সঙ্গে ভাল করে মিশতে হবে তবে ওদের পেটের কথা জানা যাবে। আজ লক্ষ্য করলাম, কেউ মন খুলে কথা কইছে না, সকলেই কিছু-না-কিছু চেপে যাচ্ছে।
হুঁ। তাহলে আপনার বিশ্বাস হয়েছে যে ঈশানবাবুর মৃত্যুটা স্বাভাবিক সর্পাঘাতে মৃত্যু নয়?
অতটা বলবার এখনও সময় হয়নি। এইটুকু বলতে পারি, আপাতদৃষ্টিতে যা দেখা যাচ্ছে তা সত্যি নয়, ভেতরে একটা গুঢ় এবং চমকপ্রদ রহস্য রয়েছে। মোহর কোথা থেকে এল? টৰ্চটা কোথায় গেল? রমাপতি যে-গল্প শোনালে তা কি সত্যি? সবাই দুৰ্গটা চায় কেন? মণিলালকে কর্তা ছাড়া কেউ দেখতে পারে না কেন?
আমি বলিলাম, মণিলালও রমাপতিকে দেখতে পারে না।
ব্যোমকেশ বলিল, ওটা স্বাভাবিক। ওরা দু’জনেই রামকিশোরবাবুর আশ্রিত। রমাপতিও বোধহয় মণিলালকে দেখতে পারে না। বাড়ির কেউ কাউকে দেখতে পারে না। সেটা আমাদের পক্ষে সুবিধে। দগ্ধাবশিষ্ট সিগারেট ফেলিয়া দিয়া সে বলিল, আচ্ছা পাণ্ডেজি, বংশীধর কতদূর লেখাপড়া করেছে জানেন?
পাণ্ডে বলিলেন, ম্যাট্রিক পাশ করেছে জানি। তারপর বহরমপুরে পড়তে গিয়েছিল, কিন্তু মাস কয়েক পরেই পড়াশুনা বন্ধ করে ঘরে ফিরে আসে।
গোলমাল ঠেকছে। বহরমপুরে ঈশানবাবুর সঙ্গে বংশীধরের জানা-শোনা হয়েছিল—তারপর বংশীধর হঠাৎ লেখাপড়া ছেড়ে দিলে কেন?
পাণ্ডে বলিলেন, খোঁজ নিতে পারি। বেশি দিনের কথা নয়, যদি গোলমাল থাকে কলেজের সেরেস্তায় হদিস পাওয়া যাবে।
খবর নেবেন তো। —আর মুরলীধরের বিদ্যে কতদূর?
ওটা আকাট মুখখু।
হুঁ, বংশটাই চাষাড়ে হয়ে গেছে। তবে রামকিশোরবাবুর ব্যবহারে একটা সাবেক ভদ্রতা আছে।
কিন্তু বাল্যবন্ধুর মৃত্যুতে খুব বেশি শোক পেয়েছেন বলে মনে হল না; বরং মোহরটি বাগাবার মতলব!
ব্যোমকেশ হাসিয়া উঠিল, এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভুরি ভুরি। —কাল সকালে ঈশানবাবুর জিনিসপত্রগুলো পরীক্ষা করতে হবে, খাতাটা পড়তে হবে। তাতে হয়তো কিছু পাওয়া যেতে পারে।
তারপর?
তারপর দুর্গে গিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসব। আপনি ব্যবস্থা করুন।
ভাল। কিন্তু একটা কথা ওদের দেওয়া খাবার খাওয়া চলবে না। কি জানি কার মনে কি আছে—
হাঁ, ঠিক বলেছেন। আপনার ইকমিক কুকার আছে?
আছে।
ব্যস, তাহলেই চলবে।
কিছুক্ষণ নীরবে কাটিল। ব্যোমকেশ আর একটা সিগারেট ধরাইয়া বলিল, অজিত, রামকিশোরবাবুকে দেখে কিছু মনে হল?
কি মনে হবে?
আজ তাঁকে দেখেই মনে হল, আগে কোথায় দেখেছি। তোমার মনে হল না?
কৈ না!
আমার কিন্তু এক নজর দেখেই মনে হল চেনা লোক। কিন্তু কবে কোথায় দেখেছি মনে করতে পারছি না।
পাণ্ডে একটা হাই চাপিয়া বলিলেন, রামকিশোরবাবুকে আপনার দেখার সম্ভাবনা কম; গত পাঁচ বছরের মধ্যে তিনি লোকালয়ে পা বাড়িয়েছেন। কিনা সন্দেহ। আপনি হয়তো ওই ধরনের চেহারা অন্য কোথাও দেখে থাকবেন।
একটু চুপ করিয়া থাকিয়া ব্যোমকেশ বলিল, তাই হবে বোধ হয়।
৪
পরদিন প্রাতরাশের সময় পাণ্ডে বলিলেন, দুর্গে গিয়ে থাকার সঙ্কল্প ঠিক আছে?
ব্যোমকেশ বলিল, হ্যাঁ, আপনি ব্যবস্থা করুন। বড় জোর দু-তিন দিন থাকব, বেশি নয়।
পাণ্ডে বলিলেন, আমার কিন্তু মন চাইছে না, কি জানি যদি সত্যিই সাপ থাকে।
ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল, থাকলেও আমাদের কিছু করতে পারবে না। আমরা সাপের রোজা।
বেশ, আমি তাহলে রামকিশোরবাবুর সঙ্গে দেখা করে সব ঠিকঠাক করে আসি। —আচ্ছা, দুর্গের বদলে যদি রামকিশোরবাবুর বাড়িতে থাকেন তাতে ক্ষতি কি?
অত ঘেঁষাঘেঁষি সুবিধা হবে না, পরিপ্রেক্ষিত পাব না। দুৰ্গই ভাল।
ভাল। আমি অফিসে বলে যাচ্ছি, আমার মুনশী আতাউল্লাকে খবর দিলে সে ঈশানবাবুর জিনিসপত্র আপনাদের দেখাবে। গুদাম ঘরের চাবি তার কাছে।
পাণ্ডেজি মোটর-বাইকে চড়িয়া প্ৰস্থান করিলেন। ঘড়িতে মাত্ৰ নটা বাজিয়াছে, পাণ্ডেজির অফিস তাঁহার বাড়িতেই; সুতরাং ঈশানবাবুর মালপত্র পরীক্ষার তাড়া নাই। আমরা সিগারেট ধরাইয়া সংবাদপত্রের পাতা উল্টাইয়া গড়িমসি করিতেছি, এমন সময় একটি ছোট মোটর আসিয়া দ্বারে দাঁড়াইল। ব্যোমকেশ জানালা দিয়া দেখিয়া বলিল, ডাক্তার ঘটক। ভালই হল।
ডাক্তার ঘটকের একটু অনুতপ্ত ভাব। আমরা যে তাহার গুপ্তকথা ফাঁস করিয়া দিই নাই এবং ভবিষ্যতে দিব না। তাহা সে বুঝিয়াছে। বলিল, কাল আপনাদের সঙ্গে ভাল করে কথা বলবার সুযোগ পেলাম না, তাই—
ব্যোমকেশ পরম সমাদরের সহিত তাহাকে বসাইয়া বলিল, আপনি না এলে আমরাই যেতম। কেমন আছেন বলুন। পুরোনো বন্ধুরা সব কেমন? মহীধরবাবু?
ডাক্তার বলিল, সবাই ভাল আছেন।
ব্যোমকেশ চক্ষু মিটমিট করিয়া মৃদুহাস্যে বলিল, আর রজনী দেবী?
ডাক্তারের কান দুটি রক্তাভ হইল, তারপর সে হাসিয়া ফেলিল। বলিল, ভাল আছে রজনী। আপনারা এসেছেন শুনে জানতে চাইল মিসেস বক্সী এসেছেন কি না।
‘সত্যবতী এবার আসেনি। সে—’ ব্যোমকেশ আমার পানে তাকাইল।
আমি সত্যবতীর অবস্থা জানাইয়া বলিলাম, সত্যবতী আমাদের কলকাতা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আমরাও প্রতিজ্ঞা করেছি, একটা সুখবর না পাওয়া পর্যন্ত ওমুখে হব না।
ডাক্তার হাসিয়া ব্যোমকেশকে অভিনন্দন জানাইল, কিন্তু তাহার মুখে হাসি ভাল ফুটিল না। ক্ষুধিত ব্যক্তি অন্যকে আহার করিতে দেখিলে হাসিতে পারে, কিন্তু সে হাসি আনন্দের নয়।
ব্যোমকেশ তাহার মুখের ভাব দেখিয়া মনের ভাব বুঝিল, পিঠ চাপড়াইয়া বলিল, বন্ধু, মনে ক্ষোভ রাখবেন না। আপনি যা পেয়েছেন তা কম লোকের ভাগেই জোটে। একসঙ্গে দাম্পত্য-জীবনের মাধুর্য আর পরকীয়াপ্রীতির তীক্ষ্ণ স্বাদ উপভোগ করে নিচ্ছেন।
আমি যোগ করিয়া দিলাম, ভেবে দেখুন, শেলী বলেছেন, হে পবন, শীত যদি আসে বসন্ত রহে কি কভু দূরে। ফুলের মরসুম শেষ হোক, ফল আপনি আসবে।
এবার ডাক্তারের মুখে সত্যকার হাসি ফুটিল। আরও কিছুক্ষণ হাসি-তামাসার পর ব্যোমকেশ বলিল, ডাক্তার ঘটক, কাল রামকিশোরবাবুর বাড়িতে বিষয়-ঘটিত আলোচনা খানিকটা শুনেছিলাম, বাকিটা শোনবার কৌতুহল আছে। যদি বাধা না থাকে আপনি বলুন।
ডাক্তার বলিল, বাধা কি? রামকিশোরবাবু তো লুকিয়ে কিছু করছেন না। মাসখানেক আগে ওঁর স্বাস্থ্য হঠাৎ ভেঙ্গে পড়ে; হৃদযন্ত্রের অবস্থা খুবই খারাপ হয়েছিল। এখন অনেকটা সামলেছেন; কিন্তু ওঁর ভয় হয়েছে হঠাৎ যদি মারা যান তাহলে বড় ছেলেরা মামলা-মোকদ্দমায় সম্পত্তি নষ্ট করবে। হয়তো নাবালক ছেলেমেয়েদের বঞ্চিত করবার চেষ্টা করবে। তাই বেঁচে থাকতে থাকতেই উনি সম্পত্তি ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দিতে চান। সম্পত্তি সমান চার ভাগ হবে; দুভাগ বড় দুই ছেলে পাবে, বাকি দুভাগ রামকিশোরের অধিকারে থাকবে। তারপর ওঁর মৃত্যু হলে গদাই আর তুলসী ওয়ারিসান সূত্রে ওঁর সম্পত্তি পাবে, বড় দুই ছেলে আর কিছু পাবে না।
ব্যোমকেশ চিন্তা করিতে করিতে বলিল, বুঝেছি। দুর্গ নিয়ে কি ঝগড়া হচ্ছিল?
দুৰ্গটা রামকিশোরবাবু নিজের দখলে রেখেছেন। অথচ দুই ছেলেরই লোভ দুর্গের ওপর।
মণিলালকে দুর্গ দেবার কথা উঠল কেন?
ব্যাপার হচ্ছে এই—রামকিশোরবাবু স্থির করেছেন তুলসীর সঙ্গে মণিলালের বিয়ে দেবেন। মণিলাল ওঁর বড় মেয়েকে বিয়ে করেছিল, সে-মেয়ে মারা গেছে, জানেন বোধ হয়। কাল কথায় কথায় রামকিশোরবাবু বলেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর বসতবাড়িটা পাবে গদাই, আর মণিলাল পাবে দুর্গ। মণিলাল মানেই তুলসী, মণিলালকে আলাদা কিছু দেওয়া হচ্ছে না। তাইতেই বংশী আর মুরলী ঝগড়া শুরু করে দিলে৷।
হুঁ। কিন্তু তুলসীর বিয়ের তো এখনও দেরি আছে। ওর কতই বা বয়স হবে।
আধুনিক মতে বিয়ের বয়স না হলেও নেহাৎ ছোট নয়, বছর তোর-চোদ্দ হবে। রামকিশোরবাবু বোধহয় শীগগিরই ওদের বিয়ে দেবেন। যদি হঠাৎ মারা যান, নাবালক ছেলেমেয়েদের একজন নির্ভরযোগ্য অভিভাবক চাই তো! বড় দুই ছেলের ওপর ওঁর কিছুমাত্র আস্থা নেই।
যেটুকু দেখেছি তাতে আস্থা থাকার কথা নয়। মণিলাল মানুষটি কেমন?
মাথা-ঠাণ্ডা লোক। রামকিশোরবাবু তাই ওর ওপরেই ভরসা রাখেন বেশি। তবে যেভাবে শ্বশুরবাড়ি কামড়ে পড়ে আছে তাতে মনে হয় চক্ষুলজ্জা কম।
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ শূন্যে চাহিয়া থাকিয়া হঠাৎ বলিল, ডাক্তার ঘটক, আপনি রুগী সম্বন্ধে একটু সাবধান থাকবেন।
ডাক্তার চকিত হইয়া বলিল, রুগী! কোন রুগী?
রামকিশোরবাবু। তাঁর হৃদযন্ত্র যদি দলিল রেজিস্ট্রি হবার আগেই হঠাৎ থেমে যায় তাহলে কারুর সুবিধা হতে পারে।
ডাক্তার চোখ বড় বড় করিয়া চাহিয়া রহিল।
বেলা দশটা নাগাদ ডাক্তার বিদায় লইলে আমরা মুনশী আতাউল্লাকে খবর পাঠাইলাম।
আতাউল্লা লোকটি অতিশয় কেতাদুরস্ত প্রৌঢ় মুসলমান, বোধহয় খানদানী ব্যক্তি। কৃশ দেহে ছিটের আচকান, দাড়িতে মেহেদির রঙ, চোখে সুর্মা, মুখে পান; তাহার চোস্ত জবানের সঙ্গে মুখ হইতে স্ফুলিঙ্গের ন্যায় পানের কুচি ছিটকাইয়া পড়িত। লোকটি সজ্জন।
আমাদের অভিপ্রায় জানিতে পারিয়া মুনশী আতাউল্লা দুইজন আরদালির সাহায্যে ঈশানবাবুর বিছানা ও তোরঙ্গ আনিয়া আমাদের খিদমতে পেশ করিলেন। বিছানাটা নামমাত্র। রঙ-ওঠা সতরঞ্চিতে জড়ানো জীৰ্ণ বাঁদিপোতার তোষক ও তেলচিটে বালিশ। তবু ব্যোমকেশ উহা ভাল করিয়া পরীক্ষা করিল। তোষকটি ঝাড়িয়া এবং বালিশটি টিপিয়া টুপিয়া দেখিল, কিন্তু তাঁহাদের মধ্যে গুপ্ত ধাতব পদার্থের অস্তিত্ব ধরা পড়িল না।
বিছানা স্থানাস্তরিত করিবার হুকুম দিয়া ব্যোমকেশ বলিল, মুন্শিজি, একটা মোহর ছিল সেটা দেখতে পাওয়া যাবে কি?
বেশক, জনাব। আপনার যদি মরজি হয় তাই আমি মোহর সঙ্গে এনেছি।
আতাউল্লা আচকানের পকেট হইতে একটি কাঠের কৌটা বাহির করিলেন। কৌটার গায়ে নানাপ্রকার সাঙ্কেতিক অক্ষর ও চিহ্ন অঙ্কিত রহিয়াছে। ভিতরে তুলার মোড়কের মধ্যে মোহর।
পাকা সোনার মোহর; আকারে আয়তনে বর্তমান কালের চাঁদির টাকার মত। ব্যোমকেশ উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিয়া বলিল, এতে উর্দুতে কি লেখা রয়েছে পড়তে পারেন?
আতাউল্লা ঈষৎ আহত-কণ্ঠে বলিলেন, উর্দু নয় জনাব, ফারসী। আসরফিতে উর্দু লেখার রেওয়াজ ছিল না। যদি ফরমাস করেন পড়ে দিতে পারি, ফারসী আমার খাস জবান।
ব্যোমকেশ অপ্ৰস্তুত হইয়া বলিল, তাই নাকি! তাহলে পড়ে বলুন দেখি কবেকার মোহর।
আতাউল্লা চশমা আঁটিয়া মোহরের লেখা পড়িলেন, বলিলেন, তারিখ নেই। লেখা আছে। এই মোহর নবাব আলিবর্দি খাঁর আমলে ছাপা হয়েছিল।
ব্যোমকেশ বলিল, তাহলে জানকীরামের কালের মোহর, পরের নয়। —আচ্ছ মুনশীজি, আপনাকে বহুত বহুত ধন্যবাদ, আপনি অফিসে যান, যদি আবার দরকার হয় আপনাকে খবর পাঠাব।
‘মেহেরবানি’ বলিয়া আতাউল্লা প্ৰস্থান করিলেন।
ব্যোমকেশ তখন অধ্যাপক মহাশয়ের তোরঙ্গটি টানিয়া লইয়া বসিল। চটা-ওঠা টিনের তোরঙ্গটির মধ্যে কিন্তু এমন কিছুই পাওয়া গেল না যাহা তাঁহার মৃত্যুর কারণ-নির্দেশে সাহায্য করিতে পারে। বস্ত্ৰাদি নিত্যব্যবহার্য জিনিসগুলি দেখিলে মনে হয় অধ্যাপক মহাশয় অল্পবিত্ত ছিলেন কিম্বা অতিশয় মিতব্যয়ী ছিলেন। দুইখানি পুরাতন মলাট-ছেঁড়া বই; একটি শ্যামশাস্ত্রী সম্পাদিত কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্ৰ, অন্যটি শয়র-ই-মুতীক্ষরিনের ইংরেজি অনুবাদ। ইতিহাসের গণ্ডীর মধ্যে অধ্যাপক মহাশয়ের জ্ঞানের পরিধি কতখানি বিস্তৃত ছিল, এই বই দুখানি হইতে তাহার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
বই দুখানির সঙ্গে একখানি চামড়া-বাঁধানো প্রাচীন খাতা। খাতাখানি বোধ হয় ত্রিশ বছরের পুরাতন; মলাটা ঢলঢলে হইয়া গিয়াছে, বিবৰ্ণ পাতাগুলিও খসিয়া আসিতেছে। এই খাতায় অত্যন্ত অগোছালোভাবে, কোথাও পেন্সিল দিয়া দু’চার পাতা, কোথাও কালি দিয়া দু’চার ছত্র লেখা রহিয়াছে। হস্তাক্ষর সুছাঁদ নয়, কিন্তু একই হাতের লেখা। যাহাদের লেখাপড়া লইয়া কাজ করিতে হয় তাহারা এইরূপ একখানি সর্বাংবহা খাতা হাতের কাছে রাখে; যখন যাহা ইচ্ছা ইহাতে টুকিয়া রাখা যায়।
খাতাখানি সযত্নে লইয়া আমরা টেবিলে বসিলাম! ব্যোমকেশ একটি একটি করিয়া পাতা উল্টাইতে লাগিল।
প্রথম দুই-তিনটি পাতা খালি। তারপর একটি পাতায় লেখা আছে ইতিহাসের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা যদি মানুষের ভাষায় কথা বলিতে পারিতেন তবে তিনি মহরমের বাজনার ছন্দে বলিতেন
ধনানর্জয়ধ্বম! ধনানর্জয়ধ্বম!
ব্যোমকেশ ভ্রু তুলিয়া বলিল, মহরমের বাজনার মত শোনাচ্ছে বটে, কিন্তু মানে কি?
বলিলাম, মনে হচ্ছে, ধন উপার্জন করহ, ধন উপার্জন করহ। তোমার ঈশানবাবু দেখছি সিনিক ছিলেন।
ব্যোমকেশ লেখাটাকে আরও কিছুক্ষণ দেখিয়া পাতা উল্টাইল। পরপৃষ্ঠায় কেবল কয়েকটি তারিখ নোট করা হইয়াছে। ঐতিহাসিক তারিখ; কবে হিজরি অব্দ আরম্ভ হইয়াছিল, শশাঙ্ক দেবের মৃত্যুর তারিখ কি, এইসব। বোধ হয় ছাত্রদের ইতিহাস পড়াইবার জন্য নোট করিয়াছিলেন। এমনি আরও কয়েক পৃষ্ঠায় তারিখ লেখা আছে, সেগুলির উল্লেখ করিবার প্ৰয়োজন নাই।
ইহার পর আরও কয়েক পাতা শূন্য। তারপর সহসা এক দীর্ঘ রচনা শুরু হইয়াছে। তাহার আরম্ভটা এইরূপ—
রামবিনোদের কাছে তাহার বংশের ইতিহাস শুনিলাম। সিপাহী-যুদ্ধের সময় লুঠেরাগণ বোধ হয় সঞ্চিত ধনরত্ন লইয়া যাইতে পারে নাই; অন্তত রামবিনোদের তাঁহাই বিশ্বাস। সে দুর্গ দেখিয়া আসিয়াছে। তাহার উচ্চাশা, যদি কোনও দিন ধনী হয় তখন ঐ দুর্গ কিনিয়া তথায় গিয়া বাস করিবে।
অতঃপর জানকীরাম হইতে আরম্ভ করিয়া রাজারাম জয়রাম পর্যন্ত রমাপতির মুখে যেমন শুনিয়াছিলাম ঠিক তেমনি লেখা আছে, একচুল এদিক ওদিক নাই। পাঠ শেষ হইলে আমি বলিলাম, যাক, একটা বিষয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল, রমাপতি মিথ্যে গল্প বলেনি।
ব্যোমকেশ বলিল, গল্পটা রমাপতি ঠিকই বলেছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু গল্পটা ঈশানবাবুর মৃত্যুর রাত্রে শুনেছিল তার প্রমাণ কি? দুদিন আগেও শুনে থাকতে পারে।
তা—বটে। তাহলে—?
তাহলে কিছু না। আমি বলতে চাই যে, ও সম্ভাবনাটাকেও বাদ দেওয়া যায় না। অৰ্থাৎ রমাপতি সে-রাত্রে এই গল্পই শুনেছিল এবং পরদিন ভোরবেলা গল্পের বাকিটা শোনবার জন্যে ঈশানবাবুর কাছে গিয়েছিল তার কোনও প্রমাণ নেই।
আবার কিছুক্ষণ পাতা উল্টাইবার পর এমন একটি পৃষ্ঠায় আসিয়া পৌছিলাম, যেখানে তীব্র কাতরোক্তির মত কয়েকটি শব্দ লেখা রহিয়াছে —
রামবিনোদ বাঁচিয়া নাই। আমার একমাত্র অকৃত্রিম বন্ধু চলিয়া গিয়াছে। সে কি ভয়ঙ্কর মৃত্যু! দুঃস্বপ্নের মত সে-দৃশ্য আমার চোখে লাগিয়া আছে।
ব্যোমকেশ লেখাটার উপর কিছুক্ষণ দৃষ্টি স্থাপিত রাখিয়া বলিল, ভয়ঙ্কর মৃত্যু। স্বাভাবিক মৃত্যু বলে মনে হয় না। খোঁজ করা দরকার। আমার মুখে জিজ্ঞাসার চিহ্ন দেখিয়া মৃদুকণ্ঠে আবৃত্তি করিল, যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ ভাই, পাইলে পাইতে পার লুকানো রতন।
খাতার সামনের দিকের লেখা এইখানেই শেষ। মনে হয় রামবিনোদের মৃত্যুর পর খাতাটি দীর্ঘকাল অব্যবহৃত পড়িয়া ছিল, হয়তো হারাইয়া গিয়াছিল। তারপর আবার যখন লেখা আরম্ভ হইয়াছে, তখন খাতার উল্টা পিঠ হইতে।
প্রথম লেখাটি কালি-কলমের লেখা; পীতবর্ণ কাগজে কালি চুপসিয়া গিয়াছে। পাতার মাথার দিকে লেখা হইয়াছে—
রামকিশোরের বড় ছেলে বংশীধর কলেজে পড়িতে আসিয়াছে।
অনেকদিন পরে উহাদের সঙ্গে আবার সংযোগ ঘটিল। সেই রামবিনোদের মৃত্যুর পর আর খোঁজ লই নাই। পাতার নীচের দিকে লেখা আছে-বংশীধর এক মারাত্মক কেলেঙ্কারি করিয়াছে। তাহাকে বাঁচাইবার চেষ্টা করিতেছি। হাজার হোক রামবিনোদের ভ্রাতুষ্পুত্ৰ।
ব্যোমকেশ বলিল, বংশীধরের কেলেঙ্কারির হদিস বোধ হয় দু’চার দিনের মধ্যেই পাওয়া যাবে। কিন্তু এ কি?
দেখা গেল বাকি পাতাগুলিতে যে লেখা আছে তাহার সবগুলিই লাল-নীল পেন্সিলে লেখা। ব্যোমকেশ পাতাগুলি কয়েকবার ওলট-পালট করিয়া বলিল, “অজিত, তোরঙ্গের তলায় দেখ তো লাল-নীল পেন্সিল আছে কি না।
বেশি খুঁজতে হইল না, একটি দুমুখো লাল-নীল পেন্সিল পাওয়া গেল।
ব্যোমকেশ বলিল, যাক, বোঝা গেল। এর পর যা কিছু লেখা আছে ঈশানবাবু দুর্গে আসার পর লিখেছেন। এগুলি তাঁর জীবনের শেষ অধ্যায়।
প্ৰথম লেখাটি এইরূপ:
দুৰ্গে গুপ্তকক্ষ দেখিতে পাইলাম না। ভারি আশ্চর্য! দুর্গের সোনাদানা কোথায় রক্ষিত হইত? প্ৰকাশ্য কক্ষে রক্ষিত হইত বিশ্বাস হয় না। নিশ্চয় কোথাও গুপ্তকক্ষ আছে। কিন্তু কোথায়? সিপাহীরা গুপ্তকক্ষের সন্ধান পাইয়া থাকিলে গুপ্তকক্ষ আর গুপ্ত থাকিত না, তাহার দ্বারা ভাঙ্গিয়া রাখিয়া যাইত, তখন উহা সকলেরই দৃষ্টিগোচর হইত। তবেই গুপ্তকক্ষের সন্ধান সিপাহীরা পায় নাই।
ব্যোমকেশ বলিল, অধ্যাপক মহাশয়ের যুক্তিটা খুব বিচারসহ নয়। সিপাহীরা চলে যাবার পর রাজারামের পরিবারবর্গ ফিরে এসেছিল। তারা হয়তো ভাঙা তোষাখানা মেরামত করিয়েছিল, তাই এখন ধরা যাচ্ছে না।
পাতা উল্টাইয়া ব্যোমকেশ পড়িল—
কেহ আমাকে ভয় দেখাইয়া দুৰ্গ হইতে তাড়াইবার চেষ্টা করিতেছে। বংশীধর? আমি কিন্তু সহজে দুর্গ ছাড়িব না! ধনানর্জয়ধ্বম! ধনানর্জয়ধ্বম!
জিজ্ঞাসা করিলাম, আবার মহরমের বাজনা কেন?
ব্যোমকেশ বলিল, মোহরের গন্ধ পেয়ে বোধ হয় তাঁর স্নায়ুমণ্ডলী উত্তেজিত হয়েছিল।
অতঃপর কয়েক পৃষ্ঠা পরে খাতার শেষ লেখা। আমরা অবাক হইয়া চাহিয়া রহিলাম। বাংলা ভাষায় লেখা নয়, উর্দু কিংবা ফারসীতে লেখা তিনটি পংক্তি। তাহার নীচে বাংলা অক্ষরে কেবল দুইটি শব্দ-মোহনলাল কে?
ব্যোমকেশ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, সত্যিই তো, মোহনলাল কে? এ প্রশ্নের সদুত্তর দেওয়া আমাদের কর্ম নয়। ডাকো মুনশী আতাউল্লাকে।
আতাউল্লা আসিয়া লিপির পাঠোদ্ধার করলেন। বলিলেন, জনাব, মৃত ব্যক্তি ভাল ফরাসী জানতেন মনে হচ্ছে। তবে একটু সেকেলে ধরনের। তিনি লিখেছেন, যদি আমি বা জয়রাম বাঁচিয়া না থাকি আমাদের তামাম ধনসম্পত্তি সোনাদানা মোহনলালের জিম্মায় গচ্ছিত রহিল।
মোহনলালের জিম্মায়—!
জী জনাব, তাই লেখা আছে।
হুঁ। আচ্ছা, মুনশীজি, আপনি এবার জিনিসপত্র সব নিয়ে যান। কেবল এই খাতাটা আমার কাছে রইল।
দু’জনে সিগারেট ধরাইয়া আরাম-কেদারার কোলে অঙ্গ ছড়াইয়া দিলাম। নীরবে একটা সিগারেট শেষ করিয়া তাহারই চিতাগ্নি হইতে দ্বিতীয় সিগারেট ধরাইয়া বলিলাম, খাতা পড়ে কি মনে হচ্ছে?
ব্যোমকেশ কেদারায় দুই হাতলে তবলা বাজাইতে বলিল, মনে হচ্ছে, ধনানর্জয়ধ্বম। ধনানর্জয়ধ্বম।
ঠাট্টা নয়, কি বুঝলে বল না।
পরিষ্কারভাবে কিছুই বুঝিনি এখনও। তবে ঈশানবাবুকে যদি সত্যিই কেউ হত্যা করে থাকে তাহলে হত্যার মোটিভ দেখতে পাচ্ছি।
কি মোটিভ?
সেই চিরন্তন মোটিভ-টাকা।
আচ্ছা, ফারসী ভাষায় ঐ কথাগুলো লিখে রাখার তাৎপৰ্য কি?
ওটা উনি নিজে লেখেননি। অর্থাৎ হস্তাক্ষর ওঁর, কিন্তু রচনা ওঁর নয়, রাজারামের। উনি লেখাটি দুর্গে কোথাও পেয়েছিলেন, তারপর খাতায় টুকে রেখেছিলেন।
তারপর?
তারপর মারা গেলেন।
৫
পাণ্ডেজি ফিরিলেন বেলা বারোটার পর। হেলমেট খুলিয়া ফেলিয়া কপালের ঘাম মুছিয়া বলিলেন, কাজ হল বটে কিন্তু বুড়ো গোড়ায় গোলমাল করেছিল।
ব্যোমকেশ বলিল, গোলমাল কিসের?
পাণ্ডে বলিলেন, বেলা হয়ে গেছে, খেতে বসে সব বলব। আপনি কিছু পেলেন?
খেতে বসে বলব।
আহারে বসিয়া ব্যোমকেশ বলিল, আপনি আগে বলুন। কাল তো রামকিশোরবাবু নিমরাজী ছিলেন, আজ হঠাৎ বেঁকে বসলেন কেন?
পাণ্ডে বলিলেন, কাল আমরা চলে আসবার পর কেউ ওঁকে বলেছে যে আপনি একজন বিখ্যাত ডিটেকটিভ। তাতেই উনি ঘাবড়ে গেছেন।
এতে ঘাবড়াবার কি আছে? ওঁর মনে যদি পাপ না থাকে—
সেই কথাই শেষ পর্যন্ত আমাকে বলতে হল। বললাম, হলই বা ব্যোমকেশবাবু ডিটেকটিভ, আপনার ভয়টা কিসের? আপনি কি কিছু লুকোবার চেষ্টা করেছেন? তখন বুড়ো তাড়াতাড়ি রাজী হয়ে গেল।
আমি বললাম, রামকিশোরবাবু তাহলে সত্যিই কিছু লুকোবার চেষ্টা করেছেন।
পাণ্ডে বলিলেন, আমার তাই সন্দেহ হল। কিন্তু ঈশানবাবুর মৃত্যুঘটিত কোনো কথা নয়। অন্য কিছু। যা হোক, আমি ঠিক করে এসেছি, আজই ওরা দুৰ্গটাকে আপনাদের বাসের উপযোগী করে রাখবে। আপনারা ইচ্ছে করলে আজ বিকেলে যেতে পারেন। কিম্বা কাল সকালে যেতে পারেন।
আজি বিকেলেই যাব।
তাই হবে। কিন্তু আমি আর একটা ব্যবস্থা করেছি। আমার খাস আরদালি সীতারাম আপনাদের সঙ্গে থাকবে।
না না, কি দরকার?
দরকার আছে। সীতারাম লাল পাগড়ি পরে যাবে না, সাধারণ চাকর সেজে যাবে। লোকটা খুব হুঁশিয়ার; তাছাড়া, ওর একটা মস্ত বিদ্যে আছে, ও সাপের রোজা। ও সঙ্গে থাকলে অনেক সুবিধে হবে। ভেবে দেখুন, আপনাদের জল তোলা কাপড় কাচা বাসন মাজার জন্যেও একজন লোক দরকার। ওদের লোক না নেওয়াই ভাল।
ব্যোমকেশ সম্মত হইল। পাণ্ডে তখন বলিলেন, এবার আপনার হাল বয়ান করুন।
ব্যোমকেশ সবিস্তারে ঈশানবাবুর খাতার রহস্য উদঘাটিত করিল। শুনিয়া পাণ্ডে বলিলেন, হুঁ, মোহনলাল লোকটা কে ছিল আমারও জানতে ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু একশো বছর পরে আর তার ঠিকানা বার করা সম্ভব হবে না। এদিকে হালের খবর ঈশানবাবু লিখছেন, তাঁকে কেউ ভয় দেখিয়ে দুর্গ থেকে তাড়াবার চেষ্টা করছে। তাঁর সন্দেহ বংশীধরের ওপর। কিন্তু সত্যি কথাটা কি? ভয়ই বা দেখালো কী ভাবে?
ব্যোমকেশ মাথা নাড়িয়া বলিল, এ সব প্রশ্নের উত্তর এখন পাওয়া যাবে না। দেখা যাক, দুর্গে গিয়ে যদি দুর্গের রহস্য ভেদ করা যায়।
অপরাহ্ণে পুলিস ভ্যানে চড়িয়া শৈল-দুর্গে উপস্থিত হইলাম। আমরা তিনজন এবং সীতারাম। পাণ্ডেজি আমাদের ঘর-বসতি করিয়া দিয়া ফিরিয়া যাইবেন, সীতারাম থাকিবে। সীতারামের বয়স পঁয়ত্ৰিশ, লিকলিকে লম্বা গড়ন, তামাটে ফর্সা রঙ, শিকারী বিড়ালের মত গোঁফ। তাহার চেহারার মাহাত্ম্য এই যে, সে ভাল কাপড়চোপড় পরিলে তাহাকে ভদ্রলোক বলিয়া মনে হয়, আবার নেংটি পরিয়া থাকিলে বাসন-মাজা ভৃত্য মনে করিতে তিলমাত্র দ্বিধা হয় না। উপস্থিত তাহার পরিধানে হাঁটু পর্যন্ত কাপড় কাঁধে গামছা। অর্থাৎ, মোটা কাজের চাকর।
আমাদের সঙ্গে লটবহর কম ছিল না, বিছানা বাক্স, চাল ডাল আনাজ প্রভৃতি রসদ, ইকমিক কুকার এবং আরও কত কি। সীতারাম এবং বুলাকিলাল মালপত্র দুর্গে ঢোলাই করিতে আরম্ভ করিল। পাণ্ডে বলিলেন, চলুন, গৃহস্বামীর সঙ্গে দেখা করে আসবেন।
গৃহস্বামী বাড়ির সদর বারান্দায় উপবিষ্ট ছিলেন, সঙ্গে জামাই মণিলাল, আমাদের সম্ভাষণ জানাইলেন; আমরা খাবার ব্যবস্থা নিজেরাই করিয়াছি বলিয়া অনুযোগ করিলেন; শহুরে মানুষ পাহাড়ে জঙ্গলে মন বসাইতে পারিব না বলিয়া রসিকতা করিলেন। কিন্তু তাঁহার চক্ষু সতর্ক ও সাবধান হইয়া রহিল।
মিষ্টালাপের সময় লক্ষ্য করিলাম, বাড়ির অন্যান্য অধিবাসীরা আমাদের শুভাগমনে বেশ চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে। বংশীধর এবং মুরলীধর চিলের মত চক্রাকারে আমাদের চারিদিকে পরিভ্রমণ করিতেছে, কিন্তু কাছে আসিতেছে না। রমাপতি একবার বাড়ির ভিতর হইতে গলা বাড়াইয়া আমাদের দেখিয়া নিঃশব্দে সরিয়া গেল। নায়েব চাঁদমোহন বারান্দার অন্য প্রান্তে থেলো হুঁকোয় তামাক টানিতে টানিতে বক্র দৃষ্টিশলাকায় আমাদের বিদ্ধ করিতেছেন। তুলসী একটা জুঁই ঝাড়ের আড়াল হইতে কৌতুহলী কাঠবিড়ালীর মত আমাদের নিরীক্ষণ করিয়া ছুটিয়া চলিয়া গেল; কিছুক্ষণ পরে দেখিলাম একটা থামের আড়াল হইতে সে উঁকি মারিতেছে।
ব্যোমকেশ যে একজন খ্যাতনামা গোয়েন্দা এবং কোনও গভীর অভিসন্ধি লইয়া দুর্গে বাস করিতে আসিয়াছে তাহা ইহারা জানিতে পারিয়াছে এবং তদনুযায়ী উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছে। কেবল গদাধরের জড়বুদ্ধি বোধ হয় এতবড় ধাক্কাতেও সক্রিয় হইয়া ওঠে নাই; তাহাকে দেখিলাম না।
আমরা গাত্ৰোত্থান করিলে রামকিশোরবাবু বলিলেন, শুধু থাকার জন্যেই এসেছেন মনে করবেন না যেন। আপনারা আমার অতিথি, যখন যা দরকার হবে খবর পাঠাবেন।
নিশ্চয়, নিশ্চয়। আমরা গমনোদ্যত হইলাম। গৃহস্বামী ইশারা করিলেন, মণিলাল আমাদের সঙ্গে চলিল; উদ্দেশ্য দুর্গ পর্যন্ত আমাদের আগাইয়া দিয়া আসিবে।
সিঁড়ি দিয়া নামা ওঠার সময় মণিলালের সঙ্গে দুই-চারিটা কথা হইল। ব্যোমকেশ বলিল, আমি যে ডিটেকটিভ একথা রামকিশোরবাবু জানলেন কি করে?
মণিলাল বলিল, আমি বলেছিলাম। আপনার নাম আমার জানা ছিল; এর লেখা বই পড়েছি। শুনে কর্তা খুব উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন। তারপর আপনারা দুর্গে এসে থাকতে চান শুনে ঘাবড়ে গেলেন।
কেন?
এই সেদিন একটা দুর্ঘটনা হয়ে গেল—
তাই আপনাদের ভয় আমাদেরও সাপে খাবে। ভালো কথা, আপনার স্ত্রীও না। সর্পাঘাতে মারা গিয়েছিলেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
এ অঞ্চলে দেখছি খুব সাপ আছে।
আছে নিশ্চয়। কিন্তু আমি কখনও চোখে দেখিনি।
দেউড়ি পর্যন্ত নামিয়া আমরা দুর্গের সিঁড়ি ধরিলাম। হঠাৎ মণিলাল জিজ্ঞাসা করিল, কিছু মনে করবেন না, আপনারা পুলিসের লোক, তাই জানতে কৌতুহল হচ্ছে—ঈশানবাবু ঠিক সাপের কামড়েই মারা গিয়েছিলেন তো?
ব্যোমকেশ ও পাণ্ডের মধ্যে একটা চকিত দৃষ্টি বিনিময় হইল। ব্যোমকেশ বলিল, কেন বলুন দেখি? এ বিষয়ে সন্দেহ আছে নাকি?
মণিলাল ইতস্তত করিয়া বলিল, না—তবে-কিছুই তো বলা যায় না—
পাণ্ডে বলিলেন, সাপ ছাড়া আর কি হতে পারে?
মণিলাল বলিল, সেটা আমিও বুঝতে পারছি না। ঈশানবাবুর পায়ে সাপের দাঁতের দাগ আমি নিজের চোখে দেখেছি। ঠিক যেমন আমার স্ত্রীর পায়ে ছিল। মণিলাল একটা নিশ্বাস ফেলিল।
দুর্গের তোরণে আসিয়া পৌছিলাম। মণিলাল বলিল, এবার আমি ফিরে যাব। কর্তার শরীর ভাল নয়, তাঁকে বেশিক্ষণ একলা রাখতে সাহস হয় না। কাল সকালেই আবার আসব।
মণিলাল নমস্কার করিয়া নামিয়া গেল। সূর্য অস্ত গিয়াছিল। রামকিশোরবাবুর বাড়ির মাথার উপর শুক্লা দ্বিতীয়ার কৃশাঙ্গী চন্দ্ৰকলা মুচকি হাসিয়া বাড়ির আড়ালে লুকাইয়া পড়িল। আমরাও তোরণ দিয়া দুর্গের অঙ্গনে প্রবেশ করিলাম। ব্যোমকেশ বলিল, আজ সকালে ডাক্তার ঘটককে তার রুগী সম্বন্ধে সাবধান করে দিয়েছিলাম; এখন দেখছি তার কোনও দরকার ছিল না। সম্পত্তি হস্তান্তরের দলিল রেজিস্ট্রি না হওয়া পর্যন্ত জামাই মণিলাল যক্ষের মত শ্বশুরকে আগলে থাকবে।
পাণ্ডে একটু হাসিলেন, হ্যাঁ—ঈশানবাবুর মৃত্যু সম্বন্ধে এদের খটকা লেগেছে দেখছি। কিন্তু এখন কিছু বলা হবে না।
না।
আমরা প্রাঙ্গণ অতিক্রম করিয়া বাড়ির দিকে চলিলাম। পাণ্ডেজির হাতে একটি মুষলাকৃতি লম্বা টর্চ ছিল; সেটির বৈদ্যুতিক আলো যেমন দূরপ্রসারী, প্রয়োজন হইলে সেটিকে মারাত্মক প্রহরণস্বরূপেও ব্যবহার করা চলে। পাণ্ডে টর্চ জ্বালিয়া তাহার আলো সম্মুখে নিক্ষেপ করিলেন, বলিলেন, এটা আপনাদের কাছে রেখে যাব, দরকার হতে পারে। চলুন, দেখি আপনাদের থাকার কি ব্যবস্থা হয়েছে।
দেখা গেল সেই গজাল-কন্টকিত ঘরটিতেই থাকার বন্দোবস্ত হইয়াছে। দুইটি লোহার খাট, টেবিল চেয়ার প্রভৃতি আসবাব দেওয়ালের নিরাভরণ দৈন্য অনেকটা চাপা দিয়াছে। সীতারাম ইতিমধ্যে লণ্ঠন জ্বালিয়াছে, বিছানা পাতিয়াছে, ইকমিক্ কুকারে রান্না চড়াইয়াছে এবং স্টোভ জ্বলিয়া চায়ের জল গরম করিতেছে। তাহার কর্মতৎপরতা দেখিয়া চমৎকৃত হইলাম।
অচিরাৎ ধূমায়মান চা আসিয়া উপস্থিত হইল। চায়ে চুমুক দিয়া পাণ্ডে বলিলেন, সীতারাম, কেমন দেখলে?
সীতারাম বলিল, কিল্লা ঘুরে ফিরে দেখে নিয়েছি হুজুর। এখানে সাপ নেই।
নিঃসংশয় উক্তি। পাণ্ডে নিশ্বাস ছাড়িয়া বলিলেন, যাক, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।
আর কিছু?
আর, সিঁড়ি ছাড়া কিল্লায় ঢোকবার অন্য রাস্তা নেই। দেয়ালের বাইরে খাড়া পাহাড়।
ব্যোমকেশ পাণ্ডের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, এর মানে বুঝতে পারছেন?
কি?
যদি কোনও আততায়ী দুৰ্গে ঢুকতে চায় তাকে সিঁড়ি দিয়ে আসতে হবে। অর্থাৎ, দেউড়ির পাশ দিয়ে আসতে হবে। বুলাকিলাল তাকে দেখে ফেলতে পারে।
হুঁ, ঠিক বলেছেন। বুলাকিলালকে জেরা করতে হবে। কিন্তু আজ দেরি হয়ে গেছে, আজ আর নয়। —সীতারাম, তোমাকে বেশি বলবার দরকার নেই। এদের দেখাশুনা করবে, আর চোখ কান খুলে রাখবে।
জী হুজুর।
পাণ্ডেজি উঠিলেন।
কাল কোনও সময়ে আসব। আপনারা সাবধানে থাকবেন।
পাণ্ডেজিকে দুৰ্গতোরণ পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দিলাম। বোমকেশ টর্চ জ্বলিয়া সিঁড়ির উপর আলো ফেলিল, পাণ্ডেজি নামিয়া গেলেন। কিছুকাল পরে নীচে হইতে শব্দ পাইলাম পুলিস ভ্যান চলিয়া গেল। ওদিকে রামকিশোরবাবুর বাড়িতে তখন মিটমিটি আলো জ্বলিয়াছে।
আমরা আবার প্রাঙ্গণে আসিয়া দাঁড়াইলাম। আকাশে তারা ফুটিয়াছে, জঙ্গলের দিক হইতে মিষ্ট বাতাস দিতেছে। সীতারাম যেন আমাদের মনের অকথিত অভিলাষ জানিতে পারিয়া দুটি চেয়ার আনিয়া অঙ্গনে রাখিয়াছে। আমরা তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলিয়া উপবেশন করিলাম।
এই নক্ষত্রবিদ্ধ অন্ধকারে বসিয়া আমার মন নানা বিচিত্র কল্পনায় পূর্ণ হইয়া উঠিল। আমরা যেন রূপকথার রাজ্যে উপস্থিত হইয়াছি। সেই যে রাজপুত্র কোটালপুত্র কি জানি কিসের সন্ধানে বাহির হইয়া ঘুমন্ত রাজকুমারীর মায়াপুরীতে উপনীত হইয়াছিল, আমাদের অবস্থা যেন সেইরূপ। অবশ্য ঘুমন্ত রাজকুমারী নাই, কিন্তু সাপের মাথায় মণি আছে কিনা কে বলিতে পারে? কোন অদৃশ্য রাক্ষস-রাক্ষসীরা তাহাকে পাহারা দিতেছে তাহাই বা কে জানে? শুক্তির অভ্যন্তরে মুক্তার ন্যায় কোন অপরূপ রহস্য এই প্রাচীন দুর্গের অস্থিপঞ্জরতলে লুক্কায়িত আছে?
ব্যোমকেশ ফস করিয়া দেশলাই জ্বলিয়া আমার রোমান্টিক স্বপ্নজাল ভাঙিয়া দিল। সিগারেট ধরাইয়া বলিল,ঈশানবাবু ঠিক ধরেছিলেন, দুর্গে নিশ্চয় কোথাও গুপ্ত তোষাখানা আছে।
বলিলাম, কিন্তু কোথায়? এতবড় দুর্গের মাটি খুঁড়ে তার সন্ধান বার করা কি সহজ?
সহজ নয়। কিন্তু আমার বিশ্বাস ঈশানবাবু সন্ধান পেয়েছিলেন; তাঁর মুঠির মধ্যে মোহরের আর কোনও মানে হয় না।
কথাটা মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করিয়া শেষে বলিলাম, তা যদি হয় তাহলে বুঝতে হবে সেখানে আরও অনেক মোহর আছে।
সম্ভব। এবং তার চেয়েও বড় কথা, ঈশানবাবু যখন খুঁজে বার করতে পেরেছেন তখন আমরাও পারব।
ব্যোমকেশ উঠিয়া অন্ধকারে পায়চারি করিতে লাগিল। কিছুক্ষণ পায়চারি করিবার পর সে হঠাৎ ‘উ’ বলিয়া পড়িয়া যাইতে যাইতে কোনক্রমে সামলাইয়া লইল। আমি লাফাইয়া উঠিলাম—কি হল!
কিছু নয়, সামান্য হোঁচট খেয়েছি। টৰ্চটা তাহার হাতেই ছিল, সে তাহা জ্বালিয়া মাটিতে আলো ফেলিল।
দিনের আলোতে যাহা চোখে পড়ে নাই, এখন তাহা সহজে চোখে পড়িল। একটা চৌকশ পাথর সম্প্রতি কেহ খুঁড়িয়া তুলিয়াছিল, আবার অপটু হস্তে যথাস্থনে বসাইয়া দিবার চেষ্টা করিয়াছে। পাথরটা সমানভাবে বসে নাই, একদিকের কোনা একটু উঁচু হইয়া আছে। ব্যোমকেশ অন্ধকারে ওই উঁচু কানায় পা লাগিয়া হোঁচট খাইয়াছিল।
আলগা পাথরটা দেখিয়া উত্তেজিত হইয়া উঠিলাম,—ব্যোমকেশ! পাথরের তলায় তোষাখানার গর্ত নেই তো?
ব্যোমকেশ মাথা নাড়িল, উহু, পাথরটা বড় জোর চৌদ্দ ইঞ্চি চৌকশ। ওর তলায় যদি গর্ত থাকেও, তা দিয়ে মানুষ ঢুকতে পারবে না।
তবু—
না হে, যা ভাবিছ তা নয়। খোলা উঠোনে তোষাখানার গুপ্তদ্বার হতে পারে না। যা হোক, কাল সকালে পাথর তুলিয়ে দেখতে হবে।
ব্যোমকেশ টর্চ ঘুরাইয়া চারিদিকে আলো ফেলিল, কিন্তু অন্য কোথাও পাথরের পাটি নড়াচাড়া হইয়াছে বলিয়া মনে হইল না। অদূরে কামানটা পড়িয়া আছে, তাহার নীচে অনেক ধূলামাটি জমিয়া কামানকে মেঝের সঙ্গে জাম করিয়া দিয়াছে; সেখানেও আলগা মাটি বা পাথর চোখে পড়িল না।
এই সময় সীতারাম আসিয়া জানাইল, আহার প্রস্তুত। হাতের ঘড়িতে দেখিলাম পৌনে দশটা। কখন যে নিঃসাড়ে সময় কাটিয়া গিয়াছে জানিতে পারি নাই।
ঘরে গিয়া আহারে বসিলাম। ইকমিক্ কুকারে রাঁধা খিচুড়ি এবং মাংস যে এমন অমৃততুল্য হইতে পারে তাহা জানা ছিল না। তার উপর সীতারাম অমলেট ভাজিয়াছে। গুরুভোজন হইয়া গেল।
আমাদের ভোজন শেষ হইলে সীতারাম বারান্দায় নিজের আহার সারিয়া লইল। দ্বারের কাছে আসিয়া বলিল, হুজুর, যদি হুকুম হয়, একটু এদিক ওদিক ঘুরে আসি।
ব্যোমকেশ বলিল, বেশ তো। তুমি শোবে কোথায়?
সীতারাম বলিল, সেজন্যে ভাববেন না হুজুর। আমি দোরের বাইরে বিছানা পেতে শুয়ে থাকিব।
সীতারাম চলিয়া গেল। আমরা আলো কমাইয়া দিয়া বিছানায় লম্বা হইলাম। দ্বার খোলাই রহিল; কারণ ঘরে জানালা নাই, দ্বার বন্ধ করিলে দম বন্ধ হইবার সম্ভাবনা।
শুইয়া শুইয়া বোধহয় তন্দ্ৰা আসিয়া গিয়াছিল, ব্যোমকেশের গলার আওয়াজে সচেতন হইয়া উঠিলাম, দ্যাখো, ঐ গজালগুলো আমার ভাল ঠেকছে না।
গজাল! কোন গজাল?
দেয়ালে এত গজাল কেন? পাণ্ডেজি একটা কৈফিয়ত দিলেন বটে, কিন্তু সন্দেহ হচ্ছে।
এত রাত্রে গজালকে সন্দেহ করার কোনও মানে হয় না। ঘড়িতে দেখিলাম। এগারোটা বাজিয়া গিয়াছে। সীতারাম এখনও এদিক ওদিক দেখিয়া ফিরিয়া আসে নাই।
আজি ঘুমাও, কাল গজালের কথা ভেব। বলিয়া আমি পাশ ফিরিয়া শুইলাম।
গভীর ঘুমাইয়া পড়িয়ছিলাম। হঠাৎ মাথার শিয়রে বোমা ফাটার মত শব্দে ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিলাম। মুহুর্তের জন্য কোথায় আছি ঠাহর করিতে পারিলাম না।
স্থানকালের জ্ঞান ফিরিয়া আসিলে দেকিলাম ব্যোমকেশ দ্বারের বাহিরে টর্চের আলো ফেলিয়াছে, সেখানে কতকগুলো ভাঙা হাঁড়ি কলসীর মত খোলামকুচি পড়িয়া আছে। তারপর ব্যোমকেশ জ্বলন্ত টর্চ হাতে লইয়া তীরবেগে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। অজিত, এসো—
আমিও আলুথালুভাবে উঠিয়া তাহার অনুসরণ করিলাম; সে কাহারও পশ্চাদ্ধাবন করিতেছে কিম্বা বিপদের ক্ষেত্ৰ হইতে পলায়ন করিতেছে তাহা বুঝিতে পারিলাম না। তাহার হাতের আলোটা যেদিকে যাইতেছে, আমিও সেইদিকে ছুটিলাম।
তোরণের মুখে পৌঁছিয়া ব্যোমকেশ সিঁড়ির উপর আলো ফেলিল। আমি তাহার কাছে পৌঁছিয়া দেখিলাম, সিঁড়ি দিয়া একটা লোক ছুটিতে ছুটিতে উপরে আসিতেছে। কাছে আসিলে চিনিলাম-সীতারাম।
সীতারাম বলিল, জী হুজুর, আমি ওপরে আসছিলাম, হঠাৎ একটা লোকের সঙ্গে টক্কর লেগে গেল। আমি তাকে ধরবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু লোকটা হাত ছাড়িয়ে পালাল।
তাকে চিনতে পারলে?
জী না, অন্ধকারে তার মুখ দেখতে পাইনি। কিন্তু টক্কর লাগবার সময় তার মুখ দিয়ে একটা বুরা জবান বেরিয়ে গিয়েছিল, তা শুনে মনে হল লোকটা ছোট জাতের হিন্দুস্থানী। —কিন্তু কী হয়েছে হুজুর?
তা এখনও ঠিক জানি না। দেখবে এস।
ফিরিয়া গেলাম। ঘরের সম্মুখে ভাঙা হাঁড়ির টুকরোগুলা পড়িয়া ছিল, ব্যোমকেশ বলিল, ঐ দ্যাখে। আমি জেগেছিলাম, বাইরে খুব হালকা পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলাম। ভাবলাম, তুমি বুঝি ফিরে এলে। তারপরই দুম করে শব্দ—
সীতারাম ভাঙা সরার মত একটা টুকরো তুলিয়া আঘ্রাণ গ্রহণ করিল। বলিল, হুজুর, চট্ করে খাটের উপর উঠে বসুন।
কেন? কি ব্যাপার?
সাপ। কেউ সরা-ঢাকা হাঁড়িতে সাপ এনে এইখানে হাঁড়ি আছড়ে ভেঙ্গেছে। আমাকে টর্চ দিন, আমি খুঁজে দেখছি। সাপ কাছেই কোথাও আছে।
আমরা বিলম্ব না করিয়া খাটের উপর উঠিয়া বসিলাম, কারণ অন্ধকার রাত্রে সাপের সঙ্গে বীরত্ব চলে না। সীতারাম টর্চ লইয়া বাহিরে খুঁজিয়া দেখিতে লাগিল।
লন্ঠনটা উস্কাইয়া দিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ঈশানবাবুকে কিসের ভয় দেখিয়ে তাড়াবার চেষ্টা হয়েছিল এখন বুঝতে পারছি।
কিন্তু লোকটা কে?
তা এখন বলা শক্ত। বুলাকিলাল হতে পারে, গণপৎ হতে পারে, এমন কি সন্নিসি ঠাকুরও হতে পারেন।
এই সময় সীতারামের আকস্মিক অট্টহাস্য শুনিতে পাইলাম। সীতারাম গলা চড়াইয়া ডাকিল, হুজুর, এদিকে দেখবেন আসুন। কোনও ভয় নেই।
সন্তপর্ণে নামিয়া সীতারামের কাছে গেলাম। বাড়ির একটা কোণ আশ্রয় করিয়া বাদামী রঙের সাপ কুণ্ডলী পাকিয়া কিলবিল করিতেছে। সাপটা আহত, তাই পলাইতে পারিতেছে না, তীব্র আলোর তলায় তাল পাকাইতেছে।
সীতারাম হাসিয়া বলিল, ঢামনা সাপ, হুজুর, বিষ নেই। মনে হচ্ছে কেউ আমাদের সঙ্গে দিললাগি করছে।
ব্যোমকেশ বলিল, দিললাগিই বটে। কিন্তু এখন সাপটাকে নিয়ে কি করা যাবে?
আমি ব্যবস্থা করছি। সীতারাম খাবার ঢাকা দিবার ছিদ্রযুক্ত পিতলের ঢাকনি আনিয়া সাপটাকে চাপা দিল, বলিল, আজ এমনি থাক, কাল দেখা যাবে।
আমরা ঘরে ফিরিয়া আসিলাম। সীতারাম দ্বারের সম্মুখে নিজের বিছানা পাতিতে প্রবৃত্ত হইল। রাত্রি ঠিক দ্বিপ্রহর।
ব্যোমকেশ বলিল, সীতারাম, তুমি এত রাত্রি পর্যন্ত কোথায় ছিলে, কি করছিলে, এবার বল দেখি।
সীতারাম বলিল, হুজুর, এখান থেকে নেমে দেউড়িতে গেলাম। গিয়ে দেখি, বুলাকিলাল ভাঙ খেয়ে নিজের কুঠুরির মধ্যে ঘুমুচ্ছে। তার কাছ থেকে কিছু খবর বার করবার ইচ্ছে ছিল, সন্ধ্যেবেলা তার সঙ্গে দোস্তি করে রেখেছিলাম। ঠেলাঠুলি দিলাম। কিন্তু বুলাকিলাল জাগল না। কি করি, ভাবলাম, যাই সাধুবাবার দর্শন করে আসি।
সাধুবাবা জেগে ছিলেন, আমাকে দেখে খুশি হলেন। আমাকে অনেক সওয়াল করলেন; আপনারা কে, কি জন্যে এসেছেন, এইসব জানতে চাইলেন। আমি বললাম, আপনারা হাওয়া বদল করতে এসেছেন।
ব্যোমকেশ বলিল, বেশ বেশ। আর কি কথা হল?
সীতারাম বলিল, অনেক আজে-বাজে কথা হল হুজুর। আমি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একেবারে প্রোফেসার সাহেবের মৃত্যুর কথা তুললাম, তাতে সাধুবাবা ভীষণ চটে উঠলেন। দেখলাম বাড়ির মালিক আর নায়েববাবুর ওপর ভারি রাগ। বার বার বলতে লাগলেন, ওদের সর্বনাশ হবে, ওদের সর্বনাশ হবে।
তাই নাকি! ভারি অকৃতজ্ঞ সাধু দেখছি। তারপর?
তারপর সাধুবাবা এক ছিলিম গাঁজা চড়ালেন। আমাকে প্রসাদ দিলেন।
তুমি গাঁজা খেলে?
জী হুজুর। সাধুবাবার প্রসাদ তো ফেলে দেওয়া যায় না।
তা বটে। তারপর?
তারপর সাধুবাবা কম্বল বিছিয়ে শুয়ে পড়লেন। আমিও চলে এলাম। ফেরবার সময় সিঁড়িতে ঐ লোকটার সঙ্গে ধাক্কা লাগিল।
ব্যোমকেশ বলিল, আচ্ছা, একটা কথা বল তো সীতারাম। তুমি যখন ফিরে আসছিলে তখন বুলাকিলালকে দেখেছিলে?
সীতারাম বলিল, না। হুজুর, চোখে দেখিনি। কিন্তু দেউড়ির পাশ দিয়ে আসবার সময় কুঠুরি থেকে তার নাকডাকার ঘড়ঘড় আওয়াজ শুনেছিলাম।
ব্যোমকেশ বলিল, যাক, তাহলে দেখা যাচ্ছে, সাপের হাঁড়ি নিয়ে যিনি এসেছিলেন তিনি আর যেই হোন, বুলাকিলাল কিম্বা সাধুবাবা নন। আশা করি, তিনি আজ আর দ্বিতীয়বার এদিকে আসবেন না-এবার ঘুমিয়ে পড়।
৬
সকালে উঠিয়া দেখা গেল ঢাকনি-চাপা সাপটা রাত্রে মরিয়া গিয়াছে; বোধহয় হাঁড়ি ভাঙার সময় গুরুতর আঘাত পাইয়াছিল। সীতারাম সেটাকে লাঠির ডগায় তুলিয়া দুর্গপ্রাকারের বাহিরে ফেলিয়া দিল। আমরাও প্রাকারে উঠিয়া একটা চক্ৰ দিলাম। দেখা গেল, প্রাকার একেবারে অটুট নয় বটে কিন্তু তোরণদ্বার ছাড়া দুর্গে প্রবেশ করিবার অন্য কোনও চোরাপথ নাই। প্রাকারের নীচেই অগাধ গভীরতা।
বেলা আন্দাজ আটটার সময় সীতারামকে দুর্গে রাখিয়া ব্যোমকেশ ও আমি রামকিশোরবাবুর বাড়িতে গেলাম। রমাপতি সদর বারান্দায় আমাদের অভ্যর্থনা করিল। —আসুন। কর্তা এখনি বেরুচ্ছেন, শহরে যাবেন।
তাই নাকি! আমরা ইতস্তত করিতেছি এমন সময় রামকিশোরবাবু বাহির হইয়া আসিলেন। পরনে গরদের পাঞ্জাবি, গলায় কোঁচানো চাদর; আমাদের দেখিয়া বলিলেন ‘এই যে!—নতুন জায়গা কেমন লাগছে? রাত্রে বেশ আরামে ছিলেন? কোনও রকম অসুবিধে হয়নি?
ব্যোমকেশ বলিল, কোন অসুবিধে হয়নি, ভারি আরামে রাত কেটেছে। আপনি বেরুচ্ছেন?
হ্যাঁ, একবার উকিলের বাড়ি যাব, কিছু দলিলপত্তর রেজিস্ট্রি করাতে হবে। তা—আপনারা এসেছেন, আমি না হয় একটু দেরি করেই যাব—
ব্যোমকেশ বলিল, না না, আপনি কাজে বেরুচ্ছেন বেরিয়ে পড়ুন। আমরা এমনি বেড়াতে এসেছি, কোনও দরকার নেই।
তা-আচ্ছা। রমাপতি, এঁদের চা-টা দাও। আমাদের ফিরতে বিকেল হবে।
রামকিশোর বাহির হইয়া পড়িলেন; জামাই মণিলাল এক বস্তা কাগজপত্ৰ লইয়া সঙ্গে গেল। আমাদের পাশ দিয়া যাইবার সময় মণিলাল সহাস্যমুখে নমস্কার করিল।
ব্যোমকেশ রমাপতিকে বলিল, চায়ের দরকার নেই, আমরা চা খেয়ে বেরিয়েছি। আজই বুঝি সম্পত্তি বাঁটোয়ারার দলিল রেজিষ্ট্রি হবে?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
যাক, একটা দুর্ভাবনা মিটল। —আচ্ছা, বলুন দেখি—
রমাপতি হাতজোড় করিয়া বলিল, আমাকে ‘আপনি’ বলবেন না, ‘তুমি’ বলুন।
ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল, বেশ, তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে, কিন্তু সে পরে হবে। এখন বল দেখি গণপৎ কোথায়?
রমাপতি একটু বিস্মিত হইয়া বলিল, গণপৎ-মুরলীদার চাকর? বাড়িতেই আছে নিশ্চয়। আজ সকালে তাকে দেখিনি। ডেকে আনব?
এই সময় মুরলীধর বারান্দায় আসিয়া আমাদের দেখিয়া থতমত খাইয়া দাঁড়াইল। তাহার ট্যারা চোখ আরও ট্যারা হইয়া গেল।
ব্যোমকেশ বলিল, আপনিই মুরলীধরবাবু? নমস্কার। আপনার চাকর গণপৎকে একবার ডেকে দেবেন? তার সঙ্গে একটু দরকার আছে।
মুরলীধরের মুখ ভয় ও বিদ্রোহের মিশ্রণে অপরূপ ভাবে ধারণ করিল। সে চেরা গলায় বলিল, গণপতের সঙ্গে কি দরকার?
তাকে দু একটা কথা জিজ্ঞেস করব।
সে নেই। তাকে ছুটি দিয়েছি। সে বাড়ি গেছে।
তাই নাকি! কবে ছুটি দিয়েছেন?
কাল—কাল দুপুরে। মুরলীধর আর প্রশ্নোত্তরের অপেক্ষা না করিয়া দ্রুত বাড়ির মধ্যে ঢুকিয়া পড়িল।
আমরা পরস্পর মুখের পানে চাহিলাম। রমাপতির মুখে একটা ত্ৰস্ত উত্তেজনার ভাব দেখা গেল। সে ব্যোমকেশের কাছে সরিয়া আসিয়া খাটো গলায় বলিল, কাল দুপুরে—! কিন্তু কাল সন্ধ্যের পরও আমি গণপৎকে বাড়িতে দেখেছি—
ঘাড় নাড়িয়া ব্যোমকেশ বলিল, খুব সম্ভব। কারণ, রাত বারোটা পর্যন্ত গণপৎ বাড়ি যায়নি। কিন্তু সে যাক। নায়েব চাঁদমোহনবাবু বাড়িতে আছেন নিশ্চয়। আমরা তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই।
রমাপতি বলিল, তিনি নিজের ঘরে আছেন—
বেশ, সেখানেই আমাদের নিয়ে চল।
বাড়ির এক কোণে চাঁদমোহনের ঘর। আমরা দ্বারের কাছে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, তিনি দেয়ালের দিকে মুখ করিয়া বসিয়া সারি সারি কলিকায় তামাক সাজিয়া রাখিতেছেন। বোধ করি সারাদিনের কাজ সকালেই সারিয়া লইতেছেন। বোমকেশ হাত নাড়িয়া রমাপতিকে বিদায় করিল। আমরা ঘরে প্রবেশ করিলাম, ব্যোমকেশ দরজা ভেজাইয়া দিল।
আমাদের অতর্কিত আবির্ভাবে চাঁদমোহন ত্ৰস্তভাবে উঠিয়া দাঁড়াইলেন, তাঁহার চতুর চোখে চকিত ভয়ের ছায়া পড়িল। তিনি বলিয়া উঠিলেন, কে? —ও-আপনারা—!
ব্যোমকেশ তক্তপোশের কোণে বসিয়া বলিল, চাঁদমোহনবাবু, আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই। তাহার কণ্ঠস্বর খুব মোলায়েম শুনাইল না।
ত্রাসের প্রথম ধাক্কা সামলাইয়া লইয়া চাঁদমোহন গামছায় হাত মুছিতে মুছিতে বলিলেন, কি কথা?
অনেক দিনের পুরোনো কথা। রামবিনোদের মৃত্যু হয় কি করে?
চাঁদমোহনের মুখ শীর্ণ হইয়া গেল, তিনি ক্ষণেক নীরব থাকিয়া অৰ্ধস্ফুট স্বরে বলিলেন, আমি কিছু বলতে পারি না—আমি এ বাড়ির নায়েব—
ব্যোমকেশ গভীর স্বরে বলিল, ‘চাঁদমোহনবাবু, আপনি আমার নাম জানেন; আমার কাছে কোনও কথা লুকোবার চেষ্টা করলে তার ফল ভাল হয় না। রামবিনোদের মৃত্যুর সময় আপনি উপস্থিত ছিলেন তার প্রমাণ আছে। কি করে তাঁর মৃত্যু হল সব কথা খুলে বলুন।
একপাশে আসিয়া বসিলেন, শুষ্কস্বরে বলিলেন, আপনি যখন জোর করছেন তখন না বলে আমার উপায় নেই। আমি যতটুকু জানি বলছি।
ভিজা গামছায় মুখ মুছিয়া তিনি বলিতে আরম্ভ করিলেন—
১৯১১ সালের শীতকালে আমরা মুঙ্গেরে ছিলাম। রামবিনোদ আর রামকিশোরের তখন ঘিয়ের ব্যবসা ছিল, কলকাতায় ঘি চালান দিত। মস্ত ঘিয়ের আড়ৎ ছিল। আমি ছিলাম কর্মচারী, আড়তে বসতাম। ওরা দুই ভাই যাওয়া আসা করত।
হঠাৎ একদিন মুঙ্গেরে প্লেগ দেখা দিল। মানুষ মরে উড়কুড় উঠে যেতে লাগল, যারা বেঁচে রইল। তারা ঘর-দের ফেলে পালাতে লাগল। শহর শূন্য হয়ে গেল। রামবিনোদ আর রামকিশোর তখন মুঙ্গেরে, তারা বড় মুশকিলে পড়ল। আড়তে ষাট-সত্তর হাজার টাকার মাল রয়েছে, ফেলে পালানো যায় না; হয়তো সব চোরে নিয়ে যাবে। আমরা তিনজনে পরামর্শ করে স্থির করলাম, গঙ্গার বুকে নৌকো ভাড়া করে থাকিব, আর পালা করে রোজ একজন এসে আড়ৎ তদারক করে যাব। তারপর কপালে যা আছে তাই হবে। একটা সুবিধে ছিল, আড়ৎ গঙ্গা থেকে বেশি দূরে নয়।
রামবিনোদের এক ছেলেবেলার বন্ধু মুঙ্গেরে স্কুল মাস্টারি করত—ঈশান মজুমদার। ঈশান সেদিন সর্পাঘাতে মারা গেছে। সেও নৌকোয় এসে জুটল। মাঝি মাল্লা নেই, শুধু আমরা চারজন-নৌকোটা বেশ বড় ছিল; নৌকোতেই রান্নাবান্না, নৌকোতেই থাকা।
গঙ্গার মাঝখানে চড়া পড়েছিল, কখনও সেখানে গিয়ে রাত কাটাতাম। শহরের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল কেবল দিনে একবার গিয়ে আড়ৎ দেখে আসা।
এইভাবে দশ বারো দিন কেটে গেল। তারপর একদিন রামবিনোদকে প্লেগে ধরল। শহরে গিয়েছিল জ্বর নিয়ে ফিরে এল। আমরা চড়ায় গিয়ে নৌকো লাগালাম, রামবিনোদকে চড়ায় নামালাম। একে তো প্লেগের কোনও চিকিৎসা নেই, তার ওপর মাঝ-গঙ্গায় কোথায় ওষুধ, কোথায় ডাক্তার। রামবিনোদ পরের দিনই মারা গেল।
ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল, তারপর আপনারা কি করলেন?
চাঁদমোহন বলিলেন, আর থাকতে সাহস হল না। আড়তের মায়া ত্যাগ করে নৌকো ভাসিয়ে ভাগলপুরে পালিয়ে এলাম।
রামবিনোদের দেহ সৎকার করেছিলেন?
চাঁদমোহন গামছায় মুখ মুছিয়া বলিলেন, দাহ করবার উপকরণ ছিল না; দেহ গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
চল, এবার ফেরা যাক। এখানকার কাজ আপাতত শেষ হয়েছে।
সিঁড়ির দিকে যাইতে যাইতে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, কি মনে হল? চাঁদমোহন সত্যি কথা বলেছে?
একটু মিথ্যে বলেছে। কিন্তু তাতে ক্ষতি নেই।
সিঁড়ি দিয়ে নামিতে যাইব, দেখিলাম তুলসী অদূরে একটি গাছের ছায়ায় খেলাগর পাতিয়াছে। একাকিনী খেলায় এমন মগ্ন হইয়া গিয়াছে যে আমাদের লক্ষ্যই করিল না। ব্যোমকেশ কাছে গিয়া দাঁড়াইতে সে বিস্ফারিত চক্ষু তুলিয়া চাহিল। ব্যোমকেশ একটু সস্নেহ হাসিয়া বলিল, তোমার নাম তুলসী, না? কি মিষ্টি তোমার মুখখানি।
তুলসী তেমনি অপলক চক্ষে চাহিয়া রহিল। ব্যোমকেশ বলিল, আমরা দুর্গে আছি, তুমি আসনা কেন? এসো— অনেক গল্প বলব।
তুলসী তেমনি তাকাইয়া রহিল, উত্তর দিল না। আমরা চলিয়া আসিলাম।
পরবর্তী অংশ
No comments:
Post a Comment