লেখক: শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
পূর্বখন্ড পড়ার জন্য ক্লিক করুন
উত্তরখন্ড (প্রথমাংশ) পড়ার জন্য ক্লিক করুন
৭
দুর্গে ফিরিয়া কিছুক্ষণ সিঁড়ি ওঠা-নামার ক্লান্তি দূর করিলাম। ব্যোমকেশ সিগারেট ধরাইয়া বলিল, রামকিশোরবাবু দলিল রেজিস্ট্রি করতে গেলেন। যদি হয়ে যায়, তাহলে ওদের বাড়িতে একটা নাড়াচাড়া তোলাপাড়া হবে; বংশী আর মুরলীধর হয়তো শহরে গিয়ে বাড়ি-ভাড়া করে থাকতে চাইবে। তার আগেই এ ব্যাপারের একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাওয়া দরকার।
প্রশ্ন করিলাম, ব্যোমকেশ, কিছু বুঝছ? আমি তো যতই দেখছি, ততই জট পাকিয়ে যাচ্ছে।
ব্যোমকেশ বলিল, একটা আবছায়া চলচ্চিত্রের ছবি মনের পর্দায় ফুটে উঠছে। ছবিটা ছোট নয়; অনেক মানুষ অনেক ঘটনা অনেক সংঘাত জড়িয়ে তার রূপ। একশ বছর আগে এই নাটকের অভিনয় শুরু হয়েছিল, এখনও শেষ হয়নি। —ভাল কথা, কাল রাত্রের আলগা পাথরটার কথা মনে ছিল না। চল, দেখি গিয়ে তার তলায় গর্ত আছে কি না।
চল।
পাথরটার উপর অল্প-অল্প চুন সুরকি জমাট হইয়া আছে, আশেপাশের পাথরগুলির মত মসৃণ নয়। ব্যোমকেশ দেখিয়া বলিল, মনে হচ্ছে পাথরটাকে তুলে আবার উল্টো করে বসানো হয়েছে। এসো, তুলে দেখা যাক।
আমরা আঙুল দিয়া তুলিবার চেষ্টা করিলাম, কিন্তু পাথর উঠিল না। তখন সীতারামকে ডাকা হইল। সীতারাম করিতর্কমা লোক, সে একটা খুন্তি আনিয়া চাড়া দিয়া পাথর তুলিয়া ফেলিল।
পাথরের নীচে গর্ত টর্ত কিছু নাই, ভরাট চুন সুরকি। ব্যোমকেশ পাথরের উল্টা পিঠ পরীক্ষা করিয়া বলিল, ওহে, এই দ্যাখো, উর্দু-ফারসী লেখা রয়েছে!
দেখিলাম পাথরের উপর কয়েক পংক্তি বিজাতীয় লিপি খোদাই করা রহিয়াছে। খোদাই খুব গভীর নয়, উপরন্তু লেখার উপর ধূলাবালি জমিয়া প্রায় অলক্ষণীয় হইয়া পড়িয়াছে। ব্যোমকেশ হঠাৎ বলিল, আমার মনে হচ্ছে—। দাঁড়াও, ঈশানবাবুর খাতাটা নিয়ে আসি।
ঈশানবাবুর খাতা ব্যোমকেশ নিজের কাছে রাখিয়াছিল। সে তাহা আনিয়া যে-পাতায় ফারসী লেখা ছিল, তাহার সহিত পাথরের উৎকীর্ণ লেখাটা মিলাইয়া দেখিতে লাগিল। আমিও দেখিলাম। অর্থবোধ হইল না বটে, কিন্তু দুটি লেখার টান যে একই রকম তাহা সহজেই চোখে পড়ে।
ব্যোমকেশ বলিল, হয়েছে। এবার চল।
পাথরটি আবার যথাস্থানে সন্নিবেশিত করিয়া আমরা ঘরে আসিয়া বসিলাম। ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ব্যাপার বুঝলে?
তুমি পরিষ্কার করে বল।
একশ বছর আগের কথা স্মরণ কর। সিপাহীরা আসছে শুনে রাজারাম তাঁর পরিবারবর্গকে সরিয়ে দিলেন, দুর্গে রইলেন কেবল তিনি আর জয়রাম। তারপর বাপবেটায় সমস্ত ধনরত্ন লুকিয়ে ফেললেন।
কিন্তু সোনাদানা লুকিয়ে রাখার পর রাজারামের ভয় হল, সিপাহীদের হাতে তাঁরা যদি মারা পড়েন, তাহলে তাঁদের স্ত্রী-পরিবার সম্পত্তি উদ্ধার করবে কি করে? তিনি পাথরের উপর সঙ্কেত-লিপি লিখলেন; এমন ভাষায় লিখলেন যা সকলের আয়ত্ত নয়। তারপর ধুলোকাদা দিয়ে লেখাটা অস্পষ্ট করে দিলেন, যাতে সহজে সিপাহীদের নজরে না পড়ে।
সিপাহীরা এসে কিছুই খুঁজে পেল না। রাগে তারা বাপবেটাকে হত্যা করে চলে গেল। তারপর রাজারামের পরিবারবর্গ যখন ফিরে এল, তারাও খুঁজে পেল না। রাজারাম কোথায় তাঁর ধনরত্ন লুকিয়ে রেখে গেছেন। পাথরের পাটিতে খোদাই করা ফারসী সঙ্কেত-লিপি কারুর চোখে পড়ল না।
বলিলাম, তাহলে তোমার বিশ্বাস, রাজারামের ধনরত্ন এখনও দুৰ্গে লুকোনো আছে।
তাই মনে হয়। তবে সিপাহীরা যদি রাজারাম আর জয়রামকে যন্ত্রণা দিয়ে গুপ্তস্থানের সন্ধান বার করে নিয়ে থাকে তাহলে কিছুই নেই।
তারপর বল।
তারপর একশ বছর পরে এলেন অধ্যাপক ঈশান মজুমদার। ইতিহাসের পণ্ডিত ফারসী-জানা লোক; তার ওপর বন্ধু রামবিনোদের কাছে দুর্গের ইতিবৃত্ত শুনেছিলেন। তিনি সন্ধান করতে আরম্ভ করলেন; প্রকাশ্যে নয়, গোপনে। তাঁর এই গুপ্ত অনুসন্ধান কতদূর এগিয়েছিল জানি না, কিন্তু একটা জিনিস তিনি পেয়েছিলেন-ঐ পাথরে খোদাই করা সঙ্কেত-লিপি। তিনি সযত্নে তার নকল খাতায় টুকে রেখেছিলেন, আর পাথরটাকে উল্টে বসিয়েছিলেন, যাতে আর কেউ না দেখতে পায়। তারপর-তারপর যে কী হল সেইটেই আমাদের আবিষ্কার করতে হবে।
ব্যোমকেশ খাটের উপর চিৎ হইয়া শুইয়া উর্ধ্বে চাহিয়া রহিল। আমিও আপন মনে এলোমেলো চিস্তা করিতে লাগিলাম। পাণ্ডেজি এবেলা বোধহয় আসিলেন না। ...কলিকাতায় সত্যবতীর খবর কি? ব্যোমকেশ হঠাৎ তুলসীর সহিত এমন সস্নেহে কথা বলিল কেন? মেয়েটার চৌদ্দ বছর বয়স, দেখিলে মনে হয় দশ বছরেরটি...
দ্বারের কাছে ছায়া পড়িল। ঘাড় ফিরাইয়া দেখি, তুলসী আর গদাধর। তুলসীর চোখে শঙ্কা ও আগ্রহ, বোধহয় একা আসিতে সাহস করে নাই, তাই গদাধরকে সঙ্গে আনিয়াছে। গদাধরের কিন্তু লেশমাত্র শঙ্কা-সঙ্কোচ নাই; তাহার হাতে লাট্টু, মুখে কান-এঁটো-করা হাসি। আমাকে দেখিয়া হাস্য সহকারে বলিল, হে হে জামাইবাবুর সঙ্গে তুলসীর বিয়ে হবে-হে হে হে—
তুলসী বিদ্যুদ্বেগে ফিরিয়া তাহার গালে একটি চড় বসাইয়া দিল। গদাধর ক্ষণেক গাল ফুলাইয়া দাঁড়াইয়া রহিল, তারপর গভীরমুখে লাট্টুতে লেত্তি পাকাইতে পাকাইতে প্ৰস্থান করিল। বুঝিলাম ছোট বোনের হাতে চড়-চাপড় খাইতে সে অভ্যস্ত।
তুলসীকে ব্যোমকেশ আদর করিয়া ঘরের মধ্যে আহ্বান করিল, তুলসী কিন্তু আসিতে চায় না, দ্বারের খুঁটি ধরিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। ব্যোমকেশ তখন তাহাকে হাত ধরিয়া আনিয়া খাটের উপর বসাইয়া দিল।
তবু তুলসীর ভয় ভাঙে না, ব্যাধশঙ্কিত হরিণীর মত তার ভাবভঙ্গী। ব্যোমকেশ নরম সুরে সমবয়স্কের মত তাহার সহিত গল্প করিতে আরম্ভ করিল। দুটা হাসি তামাসার কথা, মেয়েদের খেলাধুলা পুতুলের বিয়ে প্রভৃতি মজার কাহিনী,—শুনিতে শুনিতে তুলসীর ভয় ভাঙিল। প্রথমে দু একবার হুঁ না, তারপর সহজভাবে কথা বলিতে আরম্ভ করিল।
মিনিট পনরোর মধ্যে তুলসীর সঙ্গে আমাদের সহজ বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপিত হইল। দেখিলাম তাহার মন সরল, বুদ্ধি সতেজ; কেবল তাহার স্নায়ু সুস্থ নয়; সামান্য কারণে স্নায়বিক প্রতিক্রিয়া সহজতর মাত্রা ছাড়াইয়া যায়। ব্যোমকেশ তাহার চরিত্র ঠিক ধরিয়াছিল। তাই সস্নেহ ব্যবহারে তাহাকে আকর্ষণ করিয়া লইয়াছে।
তুলসীর সহিত আমাদের যে সকল কথা হইল, তাহা আগাগোড়া পুনরাবৃত্তি করিবার প্রয়োজন নাই, তাহাদের পরিবার সম্বন্ধে এমন অনেক কথা জানা গেল যাহা পূর্বেই লিপিবদ্ধ হইয়াছে। বাকিগুলি লিপিবদ্ধ করিতেছি।
ব্যোমকেশ বলিল, এখানে এসে যিনি ছিলেন, তোমার বাবার বন্ধু ঈশানবাবু, তাঁর সঙ্গে তোমার ভাব হয়েছিল?
তুলসী বলিল, হ্যাঁ। তিনি আমাকে কত গল্প বলতেন। রাত্তিরে তাঁর ঘুম হত না; আমি অনেক বার দুপুর রাত্তিরে এসে তাঁর কাছে গল্প শুনেছি।
তাই নাকি! তিনি যে-রাত্তিরে মারা যান সে-রাত্তিরে তুমি কোথায় ছিলে?
সে-রাত্তিরে আমাকে ঘরে বন্ধ করে রেখেছিল।
ঘরে বন্ধ করে রেখেছিল! সে কি!
হ্যাঁ। আমি যখন-তখন যেখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াই কিনা, তাই ওরা সুবিধে পেলেই আমাকে বন্ধ করে রাখে।
ওরা কারা?
সবাই। বাবা বড়দা মেজদা জামাইবাবু—
সে-রাত্তিরে কে তোমাকে ঘরে বন্ধ করে রেখেছিল?
বাবা।
হুঁ। আর কাল রাত্ৰে বুঝি মেজদা তোমাকে ঘরে বন্ধ করে রেখেছিল?
হ্যাঁ। তুমি কি করে জানলে?
আমি সব জানতে পারি। আচ্ছা, আর একটা কথা বল দেখি। তোমার বড়দার বিয়ে হয়েছিল, বৌদিদিকে মনে আছে?
কেন থাকবে না? বৌদিদি খুব সুন্দর ছিল। দিদি তাকে ভারি হিংসে করত।
তাই নাকি! তা তোমার বৌদিদি আত্মহত্যা করল কেন?
তা জানি না। সে-রাত্তিরে দিদি আমাকে ঘরে বন্ধ করে রেখেছিল।
ও—
ব্যোমকেশ আমার সহিত একটা দৃষ্টি বিনিময় করিল। কিছুক্ষণ অন্য কথার পর ব্যোমকেশ বলিল, আচ্ছা তুলসী, বল দেখি বাড়ির মধ্যে তুমি কাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসো?
তুলসী নিঃসঙ্কোচে অলজ্জিত মুখে বলিল, মাস্টার মশাইকে। উনিও আমাকে খুব ভালবাসেন।
আর মণিলালকে তুমি ভালবাসো না?
তুলসীর চোখ দুটা যেন দপ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল—না। ও কেন মাস্টার মশাইকে হিংসে করে! ও কেন মাস্টার মশাইয়ের নামে বাবার কাছে লাগায়? ও যদি আমাকে বিয়ে করে আমি ওকে পাহাড় থেকে ঠেলে ফেলে দেব? বলিয়া তুলসী ছুটিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
আমরা দুই বন্ধু পরস্পর মুখের পানে চাহিয়া রহিলাম। শেষে ব্যোমকেশ একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল, বেচারি।
আধা ঘন্টা পরে স্নানের জন্য উঠি-উঠি করিতেছি, রমাপতি আসিয়া দ্বারে উকি মারিল, কুন্ঠিত স্বরে বলিল, তুলসী এদিকে এসেছিল না কি?
ব্যোমকেশ বলিল, হ্যাঁ, এই খানিকক্ষণ হল চলে গেছে। এস-বোসো।
রমাপতি সঙ্কুচিতভাবে আসিয়া বসিল।
ব্যোমকেশ বলিল, রমাপতি, প্রথম যেদিন আমরা এখানে আসি, তুমি বলেছিলে এবার ঈশানবাবুর মৃত্যু-সমস্যার সমাধান হবে। অর্থাৎ, তুমি মনে কর ঈশানবাবুর মৃত্যুর একটা সমস্যা আছে। কেমন?
রমাপতি চুপ করিয়া রহিল। ব্যোমকেশ বলিল, ধরে নেওয়া যাক ঈশানবাবুর মৃত্যুটা রহস্যময়, কেউ তাকে খুন করেছে। এখন আমি তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব, তুমি তার সোজাসুজি উত্তর দাও। সঙ্কোচ কোরো না। মনে কর তুমি আদালতে হলফ নিয়ে সাক্ষী দিচ্ছ।
রমাপতি ক্ষীণ স্বরে বলিল,বলুন।
ব্যোমকেশ বলিল, বাড়ির সকলকেই তুমি ভাল করে চেনো। বল দেখি, ওদের মধ্যে এমন কে মানুষ আছে যে খুন করতে পারে?
রমাপতি সভয়ে কিয়ৎকাল নীরব থাকিয়া কম্পিত কণ্ঠে বলিল, আমার বলা উচিত নয়, আমি ওঁদের আশ্রিত। কিন্তু অবস্থায় পড়লে বোধহয় সবাই মানুষ খুন করতে পারেন।
সবাই? রামকিশোরবাবু?
হ্যাঁ।
বংশীধর?
হ্যাঁ।
মুরলীধর?
হ্যাঁ। ওঁদের প্রকৃতি বড় উগ্র।
নায়েব চাঁদমোহন?
বোধহয় না। তবে কর্তার হুকুম পেলে লোক লাগিয়ে খুন করাতে পারেন।
মণিলাল?
রমাপতির মুখ অন্ধকার হইল, সে দাঁতে দাঁত চাপিয়া বলিল, নিজের হাতে মানুষ খুন করবার সাহস ওঁর নেই। উনি কেবল চুকলি খেয়ে মানুষের অনিষ্ট করতে পারেন।
আর তুমি? তুমি মানুষ খুন করতে পার না?
আমি—
আচ্ছ, যাক। —তুমি টর্চ চুরি করেছিলে?
রমাপতি তিক্তমুখে বলিল, আমার বদনাম হয়েছে জানি। কে বদনাম দিয়েছে তাও জানি। কিন্তু আপনিই বলুন, যদি চুরিই করতে হয়, একটা সামান্য টর্চ চুরি করব।
অর্থাৎ চুরি করনি। —যাক, মণিলালের সঙ্গে তুলসীর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে তুমি জানো?
রমাপতির মুখ কঠিন হইয়া উঠিল। কিন্তু সে সংযতভাবে বলিল, জানি। কর্তার তাই ইচ্ছে।
আর কারুর ইচ্ছে নয়?
না।
তোমারও ইচ্ছে নয়?
রমাপতি উঠিয়া দাঁড়াইল,—আমি একটা গলগ্ৰহ, আমার ইচ্ছে-অনিচ্ছেয় কী আসে যায়। কিন্তু এ বিয়ে যদি হয়, একটা বিশ্ৰী কাণ্ড হবে। বলিয়া আমাদের অনুমতির অপেক্ষা না করিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ দ্বারের দিকে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, ছোকরার সাহস আছে!
৮
বৈকালে সীতারাম চা লইয়া আসিলে ব্যোমকেশ তাহাকে বলিল, সীতারাম, তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। বছর দুই আগে একদল বেদে এসে এখানে তাঁবু ফেলে ছিল। তোমাকে বুলাকিলালের কাছে খবর নিতে হবে, বাড়ির কে কে বেদের তাঁবুতে যাতায়াত করত—এ বিষয়ে যত খবর পাও যোগাড় করবে।
সীতারাম বলিল, জী হুজুর। বুলাকিলাল এখন বাবুদের নিয়ে শহরে গেছে, ফিরে এলে খোঁজ নেব।
সীতারাম প্রস্থান করিলে বলিলাম, বেদে সম্বন্ধে কৌতুহল কেন?
ব্যোমকেশ বলিল, বিষ! সাপের বিষ কোত্থেকে এল খোঁজ নিতে হবে না?
এই সময় পাণ্ডেজি উপস্থিত হইলেন। তাঁহার কাঁধ হইতে চামড়ার ফিতায় বাইনাকুলার বুলিতেছে। ব্যোমকেশ বলিল, একি; দূরবীন কি হবে?
পাণ্ডেজি বলিলেন, আনিলাম। আপনার জন্যে, যদি কাজে লাগে। —সকলে আসতে পারিনি, কাজে আটকে পড়েছিলাম। তাই এবেলা সকাল-সকাল বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় আসতে আসতে দেখি রামকিশোরবাবুও শহর থেকে ফিরছেন। তাঁদের ইঞ্জিন বিগড়েছে, বুলাকিলাল হুইল ধরে বসে আছে, রামকিশোরবাবু গাড়ির মধ্যে বসে আছেন, আর জামাই মণিলাল গাড়ি ঠেলছে।
তারপর?
দড়ি দিয়ে বেঁধে গাড়ি টেনে নিয়ে এলাম।
ওঁদের আদালতের কাজকর্ম চুকে গেল?
না, একটু বাকি আছে, কাল আবার যাবেন। —তারপর, নতুন খবর কিছু আছে নাকি?
অনেক নতুন খবর আছে।
খবর শুনিতে শুনিতে পাণ্ডেজি উত্তেজিত হইয়া উঠিলেন। বিবৃতি শেষ হইলে বলিলেন, আর সন্দেহ নেই। ঈশানবাবু তোষাখানা খুঁজে বার করেছিলেন, তাই তাঁকে কেউ খুন করেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কে খুন করতে পারে?
ব্যোমকেশ বলিল, রামকিশোরবাবু থেকে সন্নিসি ঠাকুর পর্যন্ত সবাই খুন করতে পারে। কিন্তু এটাই একমাত্র প্রশ্ন নয়। আরও প্রশ্ন আছে।
যেমন?
যেমন, বিষ এল কোত্থেকে। সাপের বিষ তো যেখানে সেখানে পাওয়া যায় না। তারপর ধরুন, সাপের বিষ শরীরে ঢোকাবার জন্যে এমন একটা যন্ত্র চাই যেটা ঠিক সাপের দাঁতের মত দাগ রেখে যায়।
হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ—
ইনজেকশনের ছুঁচের দাগ খুব ছোট হয়, দু’চার মিনিটের মধ্যেই মিলিয়ে যায়। আপনি ঈশানবাবুর পায়ে দাগ দেখেছেন, ইনজেকশানের দাগ বলে মনে হয় কি?
উহুঁ। তাছাড়া, দুটো দাগ পাশাপাশি—
ওটা কিছু নয়। যেখানে রুগী অজ্ঞান হয়ে পড়েছে সেখানে পাশাপাশি দু’বার ছুঁচ ফোটানো শক্ত কি?
তা বটে। —আর কি প্রশ্ন?
আর, ঈশানবাবু যদি গুপ্ত তোষাখানা খুঁজে বার করে থাকেন তবে সে তোষাখানা কোথায়?
এই দুর্গের মধ্যেই নিশ্চয় আছে।
শুধু দুর্গের মধ্যেই নয়, এই বাড়ির মধ্যেই আছে। মুরলীধর যে সাপের ভয় দেখিয়ে আমাদের তাড়াবার চেষ্টা করছে, তার কারণ কি?
পাণ্ডেজি তীক্ষ্ণ চক্ষে চাহিলেন, মুরলীধর?
ব্যোমকেশ বলিল, তার অন্য উদ্দেশ্য থাকতে পারে। মোট কথা, ঈশানবাবু আসবার আগে তোষাখানার সন্ধান কেউ জানত না। তারপর ঈশানবাবু ছাড়া আর একজন জানতে পেরেছে এবং ঈশানবাবুকে খুন করেছে। তবে আমার বিশ্বাস, মাল সরাতে পারেনি।
কি করে বুঝলেন?
দেখুন, আমরা দুর্গে আছি, এটা কারুর পছন্দ নয়। এর অর্থ কি?
বুঝেছি। তাহলে আগে তোষাখানা খুঁজে বার করা দরকার। কোথায় তোষাখানা থাকতে পারে; আপনি কিছু ভেবে দেখেছেন কি?
ব্যোমকেশ একটু হাসিল, বলিল, কাল থেকে একটা সন্দেহ আমার মনের মধ্যে ঘুরছে—
আমি বলিলাম, গজাল।
এই সময় সীতারাম চায়ের পাত্রগুলি সরাইয়া লইতে আসিল। ব্যোমকেশ তাহার দিকে চাহিয়া বলিল, বুলাকিলাল ফিরে এসেছে।
সীতারাম মাথা ঝুঁকাইয়া পাত্রগুলি লইয়া চলিয়া গেল। পাণ্ডে জিজ্ঞাসা করিলেন, ওকে কোথাও পাঠালেন নাকি?
হ্যাঁ, বুলাকিলালের কাছে কিছু দরকার আছে।
যাক। এবার আপনার সন্দেহের কথা বলুন।
ব্যোমকেশ বলিল, ঐ গজালগুলো। কেবল সন্দেহ হচ্ছে ওদের প্রকাশ্য প্রয়োজনটাই একমাত্র প্রয়োজন নয়, যাকে বলে ধোঁকার টাটি, ওরা হচ্ছে তাই।
পাণ্ডে গজালগুলিকে নিরীক্ষণ করিতে করিতে বলিলেন, হুঁ। তা কি করা যেতে পারে।
আমার ইচ্ছে ওদের একটু নেড়েচেড়ে দেখা। আপনি এসেছেন, আপনার সামনেই যা কিছু করা ভাল। যদি তোষাখানা বেরোয়, আমরা তিনজনে জানিব, আর কাউকে আপাতত জানতে দেওয়া হবে না। —অজিত, দরজা বন্ধ কর।
দরজা বন্ধ করিলে ঘর অন্ধকার হইল। তখন লণ্ঠন জ্বালিয়া এবং টর্চের আলো ফেলিয়া আমরা অনুসন্ধান আরম্ভ করিলাম। সর্বসুদ্ধ পনরোটি গজাল। আমরা প্রত্যেকটি টানিয়া ঠেলিয়া উঁচু দিকে আকর্ষণ করিয়া দেখিতে লাগিলাম। গজালগুলি মরিচা-ধরা কিন্তু বজ্রের মত দৃঢ়, একচুলও নড়িল না।
হঠাৎ পাণ্ডে বলিয়া উঠিলেন, এই যে! নড়ছে-একটু একটু নড়ছে—! আমরা ছুটিয়া তাঁহার পাশে গিয়া দাঁড়াইলাম। দরজার সামনে যে দেয়াল, তাহার মাঝখানে একটা গজাল। পাণ্ডে গজাল ধরিয়া ভিতর দিকে ঠেলা দিতেছেন; নড়িতেছে কিনা আমরা বুঝিতে পারিলাম না। পাণ্ডে বলিলেন, আমার একার কর্ম নয়। ব্যোমকেশবাবু, আপনিও ঠেলুন।
ব্যোমকেশ হাঁটু গাড়িয়া দুই হাতে পাথরে ঠেলা দিতে শুরু করিল। চতুষ্কোণ পাথর ধীরে ধীরে পিছন দিকে সরিতে লাগিল। তাহার নীচে অন্ধকার গর্ত দেখা গেল।
আমি টর্চের আলো ফেলিলাম। গর্তটি লম্বা-চওড়ায় দুই হাত, ভিতরে একপ্রস্থ সরু সিঁড়ি নামিয়া গিয়াছে।
পাণ্ডে মহা উত্তেজিতভাবে কপালের ঘাম মুছিয়া বলিলেন, শাবাশ! পাওয়া গেছে তোষাখানা। —ব্যোমকেশবাবু, আপনি আবিষ্কর্তা, আপনি আগে ঢুকুন।
টর্চ লইয়া ব্যোমকেশ আগে নামিল, তারপর পাণ্ডেজি, সর্বশেষে লণ্ঠন লইয়া আমি।
ঘরটি উপরের ঘরের মতই প্রশস্ত। একটি দেওয়ালের গা ঘেষিয়া সারি সারি মাটির কুণ্ডা। কুণ্ডার মুখ ছোট ছোট হাঁড়ি, হাঁড়ির মুখ সরা দিয়া ঢাকা। ঘরের অন্য কোণে একটি বড় উনান, তাহার সহিত একটি হাপরের নল সংযুক্ত রহিয়াছে। হাপরের চামড়া অবশ্য শুকাইয়া ঝরিয়া গিয়াছে, কিন্তু কাঠামো দেখিয়া হাপর বলিয়া চেনা যায়। ঘরে আর কিছু নাই।
আমাদের ঘন ঘন নিশ্বাস পড়িতেছিল, পেট মোটা কুণ্ডাগুলিতে না জানি কোন রাজার সম্পত্তি রহিয়াছে। কিন্তু আগে ঘরের অন্যান্য স্থান দেখা দরকার। এদিক-ওদিক আলো ফেলিতে এককোণে একটা চকচকে জিনিস চোখে পড়িল। ছুটিয়া কাছে গিয়া দেখি-একটি ছোট বৈদ্যুতিক টর্চ। তুলিয়া লইয়া জ্বালাইবার চেষ্টা করিলাম, কিন্তু টর্চ জ্বালাই ছিল, জ্বলিয়া জ্বলিয়া সেল ফুরাইয়া নিভিয়া গিয়াছে।
ব্যোমকেশ বলিল, ঈশানবাবু যে এ ঘরের সন্ধান পেয়েছিলেন, তার অকাট্য প্রমাণ।
তখন আমরা হাঁড়িগুলি খুলিয়া দেখিলাম। সব হাঁড়িই শূন্য, কেবল একটা হাঁড়ির তলায় নুনের মত খানিকটা গুঁড়া পড়িয়া আছে। ব্যোমকেশ একখামচা তুলিয়া লইয়া পরীক্ষা করিল, তারপর রুমালে বাঁধিয়া পকেটে রাখিল। বলিল, নুন হতে পারে, চুন হতে পারে, অন্য কিছুও হতে পারে।
অতঃপর কুণ্ডাগুলি একে একে পরীক্ষা করা হইল। কিন্তু হায় সাত রাজার ধন মিলিল না। সব কুণ্ডা খালি, কোথাও একটা কপর্দক পর্যন্ত নাই।
আমরা ফ্যাল ফ্যাল চক্ষে পরস্পরের পানে চাহিলাম। তারপর ঘরটিতে আঁতিপাঁতি করা হইল, কিন্তু কিছু মিলিল না।
উপরে ফিরিয়া আসিয়া প্ৰথমে গুপ্তদ্বার টানিয়া বন্ধ করা হইল। তারপর ঘরের দরজা খুলিলাম। বাহিরে অন্ধকার হইয়া গিয়াছে; সীতারাম দ্বারের বাহিরে ঘোরাঘুরি করিতেছে। ব্যোমকেশ ক্লান্তস্বরে বলিল, সীতারাম, আর একদফা চা তৈরি কর।
চেয়ার লইয়া তিনজনে বাহিরে বসিলাম। পাণ্ডে দমিয়া গিয়াছিলেন, বলিলেন, কি হল বলুন দেখি? মাল গেল কোথায়?
ব্যোমকেশ বলিল, তিনটে সম্ভাবনা রয়েছে। এক, সিপাহীরা সব লুটে নিয়ে গিয়েছে। দুই, ঈশানবাবুকে যে খুন করেছে, সে সেই রাত্রেই মাল সরিয়েছে। তিন, রাজারাম অন্য কোথাও মাল লুকিয়েছেন।
কোন সম্ভাবনাটা আপনার বেশি মনে লাগে?
ব্যোমকেশ হাত নাড়িয়া ‘বলাকা’ কবিতার শেষ পংক্তি আবৃত্তি করিল, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে।
চা পান করিতে করিতে ব্যোমকেশ সীতারামকে জিজ্ঞাসা করিল, বুলাকিলালের দেখা পেলে?
সীতারাম বলিল, জী। গাড়ির ইঞ্জিন মেরামত করছিল, দু-চারটে কথা হল।
কি বললে সে?
হুজুর, বুলাকিলাল একটা আস্ত বুদ্ধু। সন্ধ্যে হলেই ভাঙ খেয়ে বেদম ঘুমোয়, রাত্তিরের কোনও খবরই রাখে না। তবে দিনের বেলা বাড়ির সকলেই বেদের তাঁবুতে যাতায়াত করত। এমনকি, বুলাকিলালও দু-চারবার গিয়েছিল।
বুলাকিলাল গিয়েছিল কেন?
হাত দেখাতে। বেদেনীরা নাকি ভাল হাত দেখতে জানে, ভূত-ভবিষ্যৎ সব বলে দিতে পারে। বুলাকিলালকে বলেছে ও শীগগির লাট সাহেবের মোটর ড্রাইভার হবে।
বাড়ির আর কে কে যেতো?
মালিক, মালিকের দুই বড় ছেলে, জামাইবাবু, নায়েববাবু, সবাই যেতো। আর ছোট ছেলেমেয়ে দুটো সর্বদাই ওখানে ঘোরাঘুরি করত।
হুঁ, আর কিছু? ‘আর কিছু নয় হুজুর।
রাত্রি হইতেছে দেখিয়া পাণ্ডেজি উঠিলেন। ব্যোমকেশ তাঁহাকে রুমালে বাঁধা পুঁটুলি দিয়া বলিল, এটার কেমিক্যাল অ্যানালিসিস করিয়ে দেখবেন। আমরা এ পর্যন্ত যতটুকু খবর সংগ্ৰহ করেছি। তাতে নিরাশ হবার কিছু নেই। অন্তত ঈশানবাবুকে যে হত্যা করা হয়েছে, এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ, বাকি খবর ক্রমে পাওয়া যাবে।
পাণ্ডেজি রুমালের পুঁটুলি পকেটে রাখিতে গিয়া বলিলেন, আরে, ডাকে আপনার একটা চিঠি এসেছিল, সেটা এতক্ষণ দিতেই ভুলে গেছি। এই নিন। —আচ্ছা, কাল আবার আসব।
পাণ্ডেজিকে সিঁড়ি পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দিয়া ফিরিয়া আসিয়া বসিলাম। ব্যোমকেশ চিঠি খুলিয়া পড়িল, জিজ্ঞাসা করিলাম, সত্যবতীর চিঠি নাকি?
না, সুকুমারের চিঠি।
কি খবর?
নতুন খবর কিছু নেই। তবে সব ভাল।
৯
রাত্রিটা নিরুপদ্রবে কাটিয়া গেল।
পরদিন সকালে ব্যোমকেশ ঈশানবাবুর খাতা লইয়া বসিল। কখনও খাতাটা পড়িতেছে, কখনও উর্ধ্বপানে চোখ তুলিয়া নিঃশব্দে ঠোঁট নাড়িতেছে, কথাবার্তা বলিতেছে না।
বাইনাকুলার কাল পাণ্ডেজি রাখিয়া গিয়াছিলেন, সেটা লইয়া নাড়াচাড়া করিতে করিতে বলিলাম, কিসের গবেষণা হচ্ছে?
ব্যোমকেশ সংক্ষেপে বলিল, মোহনলাল।
মোহনলালের নামে আজ, কেন জানি না, বহুদিন পূর্বে পঠিত পলাশীর যুদ্ধ মনে পড়িয়া গেল। বলিলাম, আবার আবার সেই কামান গর্জন, কাঁপাইয়া গঙ্গাজল—
ব্যোমকেশ ভর্ৎসনা-ভরা চক্ষু তুলিয়া আমার পানে চাহিল। আমি বলিলাম, দাঁড়ারে দাঁড়ারে ফিরে দাঁড়ারে যবন, গৰ্জিল মোহনলাল নিকট শমন।
ব্যোমকেশের চোখের ভর্ৎসনা ক্রমে হিংস্র ভাব ধারণ করিতেছে দেখিয়া আমি ঘর ছাড়িয়া চলিয়া আসিলাম। কেহ যদি বীররসাত্মক কাব্য সহ্য করিতে না পারে, তাহার উপর জুলুম করা উচিত নয়।
বাহিরে স্বর্ণোজ্জ্বল হৈমন্ত প্রভাত। দূরবীনটা হাতেই ছিল, আমি সেটা লইয়া প্রাকারে উঠিলাম। চারিদিকের দৃশ্য অতি মনোরম। দূরের পর্বতচূড়া কাছে আসিয়াছে, বনানীর মাথার উপর আলোর ঢেউ খেলিতেছে। ঘুরিয়া ঘুরিয়া দেখিতে দেখিতে রামকিশোরবাবুর বাড়ির সম্মুখে আসিয়া পৌঁছিলাম। বাড়ির খুঁটিনাটি সমস্ত দেখিতে পাইতেছি। রামকিশোর শহরে যাইবার জন্য বাহির হইলেন, সঙ্গে দুই পুত্র এবং জামাই। তাঁহারা সিঁড়ি দিয়া নামিয়া গেলেন; কিছুক্ষণ পরে মোটর চলিয়া গেল। ...বাড়িতে রহিল মাস্টার রমাপতি, গদাধর আর তুলসী।
ঘরে ফিরিয়া দেখিলাম ব্যোমকেশ তখনও জলপানরত মুরগীর মতো একবার কোলের দিকে ঝুঁকিয়া খাতা পড়িতেছে, আবার উঁচু দিকে মুখ তুলিয়া আপন মনে বিজ বিজ করিতেছে। বলিলাম, ওহে, রামকিশোরবাবুরা শহরে চলে গেলেন।
ব্যোমকেশ আমার কথায় কৰ্ণপাত না করিয়া মুরগীর মত জল পান করিতে লাগিল। তারপর হঠাৎ বলিল, মোহনলাল মস্ত বীর ছিল—না?
সেই রকম তো শুনতে পাই।
ব্যোমকেশ আর কথা কহিল না। তাহার ভাবগতিক দেখিয়া মনে হইল, সে আজ খাতা ছাড়িয়া উঠিবে না। সকালবেলাটা নিষ্ক্রিয়ভাবে কাটিয়া যাইবে ভাবিয়া বলিলাম, চল না, সাধু-দৰ্শন করা যাক। তিনি হয়তো হাত গুনতে জানেন।
অন্যমনস্কভাবে চোখ তুলিয়া ব্যোমকেশ বলিল, এখন নয়, ওবেলা দেখা যাবে।
দুপুরবেলা শয্যায় শুইয়া তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় খানিকটা সময় কাটিয়া গেল। রামকিশোরবাবু ঠিক বলিয়ছিলেন; এই নির্জনে দুদিন বাস করিলে প্ৰাণ পালাই-পালাই করে।
পৌনে তিনটা পর্যন্ত বিছানায় এপাশি-ওপাশ করিয়া আর পারা গেল না, উঠিয়া পড়িলাম। দেখি, ব্যোমকেশ ঘরে নাই। বাহিরে আসিয়া দেখিলাম, সে প্রাকারের উপর উঠিয়া পায়চারি করিতেছে। রৌদ্র তেমন কড়া নয় বটে, কিন্তু এ সময় প্রাকারের উপর বায়ু সেবনের অর্থ হৃদয়ঙ্গম হইল না। তবু হয়তো নূতন কিছু আবিষ্কার করিয়াছে ভাবিয়া আমিও সেই দিকে, চলিলাম।
আমাকে দেখিয়া সে যেন নিজের মনের ভিতর হইতে উঠিয়া আসিল, যন্ত্রবৎ বলিল, একটা তুরপুন চাই।
তুরপুন! দেখিলাম, তাহার চোখে অধীর বিভ্রান্ত দৃষ্টি। এ-দৃষ্টি আমার অপরিচিত নয়, সে কিছু পাইয়াছে। বলিলাম, কি পেলে?
ব্যোমকেশ এবার সম্পূর্ণ সচেতন হইয়া আমাকে দেখিতে পাইল, ঈষৎ লজ্জিতভাবে বলিল, না না, কিছু না। তুমি দিব্যি ঘুমুচ্ছিলে, ভাবলাম এখানে এসে দূরবীনের সাহায্যে নিসর্গ-শোভা নিরীক্ষণ করি। তা দেখবার কিছু নেই। —এই নাও, তুমি দ্যাখো।
প্রাকারের আলিসার উপর দুরবীনটা রাখা ছিল, সেটা আমাকে ধরাইয়া দিয়া ব্যোমকেশ নামিয়া গেল। আমি একটু অবাক হইলাম। ব্যোমকেশের আজ এ কী ভাব!
চারিদিকে দৃষ্টি ফিরাইলাম। আতপ্ত বাতাসে বহিঃপ্রকৃতি ঝিম ঝিম করিতেছে। দূরবীন চোখে দিলাম; দূরবীন এদিক-ওদিক ঘুরিয়া রামকিশোরবাবুর বাড়ির উপর স্থির হইল।
দূরবীন দিয়া দেখার সহিত আড়ি পাতার একটা সাদৃশ্য আছে; এ যেন চোখ দিয়া আড়ি পাতা। রামকিশোরবাবুর বাড়িটা দূরবীনের ভিতর দিয়া আমার দশ হাতের মধ্যে আসিয়া গিয়াছে; বাড়ির সবই আমি দেখিতে পাইতেছি, অথচ আমাকে কেহ দেখিতে পাইতেছে না।
বাড়ির সদরে কেহ নাই, কিন্তু দরজা খোলা। দূরবীন উপরে উঠিল। হাঁটু পর্যন্ত আলিসা-ঘেরা ছাদ, সিঁড়ি পিছন দিকে। রমাপতি আলিসার উপর গালে হাত দিয়া বসিয়া আছে, তাহার পাশের ভাগ দেখিতে পাইতেছি। ছাদে আর কেহ নাই; রমাপতি কপাল কুঁচকাইয়া কি যেন ভাবিতেছে।
রমাপতি চমকিয়া মুখ তুলিল। সিঁড়ি দিয়া তুলসী উঠিয়া আসিল, তাহার মুখেচোখে গোপনতার উত্তেজনা। লঘু দ্রুতপদে রমাপতির কাছে আসিয়া সে আঁচলের ভিতর হইতে ডান হাত বাহির করিয়া দেখাইল। হাতে কি একটা রহিয়াছে, কালো রঙের পেন্সিল কিম্বা ফাউন্টেন পেন।
দূরবীনের ভিতর দিয়া দেখিতেছি, কিন্তু কিছু শুনিতে পাইতেছি না; যেন সে-কালের নির্বাক চলচ্চিত্র। রমাপতি উত্তেজিত হইয়া কি বলিতেছে, হাত নাড়িতেছে। তুলসী তাহার গলা জড়াইয়া অনুনয় করিতেছে, কালো জিনিসটা তাহার হাতে ধরাইয়া দিবার চেষ্টা করিতেছে।
এই সময় রঙ্গমঞ্চে আরও কয়েকটি অভিনেতার আবির্ভাব হইল। রামকিশোরবাবু সিঁড়ি দিয়া উঠিয়া আসিলেন, তাঁহার পিছনে বংশীধর ও মুরলীধর; সর্বশেষে মণিলাল।
সকলেই ক্রুদ্ধ; রমাপতি দাঁড়াইয়া উঠিয়া কাঠ হইয়া রহিল। বংশীধর বিকৃত মুখভঙ্গী করিয়া তুলসীকে তাড়না করিল এবং কালো জিনিসটা তাহার হাত হইতে কড়িয়া লইল। তুলসী কিছুক্ষণ সতেজ তর্ক করিল, তারপর কাঁদো-কাঁদো মুখে নামিয়া গেল। তখন রমাপতিকে ঘিরিয়া বাকি কয়জন তর্জন-গর্জন করিতে লাগিলেন, কেবল মণিলাল কটমটে চক্ষে চাহিয়া অধরোষ্ঠ সম্বদ্ধ করিয়া রাখিল।
বংশীধর সহসা রমাপতির গালে একটা চড় মারিল। রামকিশোর বাধা দিলেন, তারপর আদেশের ভঙ্গীতে সিঁড়ির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিলেন। সকলে সিঁড়ি দিয়া নামিয়া গেল।
এই বিচিত্র দৃশ্যের অর্থ কি, সংলাপের অভাবে তাহা নির্ধারণ করা অসম্ভব। আমি আরও দশ মিনিট অপেক্ষা করিলাম, কিন্তু নাটকীয় ব্যাপার আর কিছু দেখিতে পাইলাম না; যাহা কিছু ঘটিল। বাড়ির মধ্যে আমার চক্ষুর অন্তরালে ঘটিল।
নামিয়া আসিয়া ব্যোমকেশকে বলিলাম। সে গভীর মনোযোগের সহিত শুনিয়া বলিল, রামকিশোরবাবুরা তাহলে সদর থেকে ফিরে এসেছেন। —তুলসীর হাতে জিনিসটা চিনতে পারলে না?
মনে হল ফাউন্টেন পেন।
দেখা যাক, হয়তো শীগগিরই খবর পাওয়া যাবে। রমাপতি আসতে পারে।
রমাপতি আসিল না, আসিল তুলসী। ঝড়ের আগে শুষ্ক পাতার মত সে যেন উড়িতে উড়িতে আসিয়া আমাদের ঘরের চৌকাঠে আটকাইয়া গেল। তাহার মূর্তি পাগলিনীর মত, দুই চক্ষু রাঙা টকটক করিতেছে। সে খাটের উপর ব্যোমকেশকে উপবিষ্ট দেখিয়া ছুটিয়া আসিয়া তাহার কোলের উপর আছড়াইয়া পড়িল, চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল, আমার মাস্টার মশাইকে তাড়িয়ে দিয়েছে।
তাড়িয়ে দিয়েছে?
তুলসীর কান্না থামানো সহজ হইল না। যা হোক, ব্যোমকেশের সস্নেহ সান্ত্বনায় কান্না ক্রমে ফোঁপানিতে নামিল, তখন প্রকৃত তথ্য জানা গেল।
জামাইবাবুর দুইটি ফাউন্টেন পেন আছে; একটি তাঁহার নিজের, অন্যটি তিনি বিবাহের সময় যৌতুক পাইয়াছিলেন. জামাইবাবু দুইটি কলম লইয়া কি করিবেন? তাই আজ তুলসী জামাইবাবুর অনুপস্থিতিতে তাঁহার দেরাজ হইতে কলম লইয়া মাস্টার মশাইকে দিতে গিয়াছিল-মাস্টার মশায়ের একটিও কলম নাই-মাস্টার মশাই কিন্তু লইতে চান নাই, রাগ করিয়া কলম যথাস্থানে রাখিয়া আসিতে হুকুম দিয়াছিলেন, এমন সময় বাড়ির সকলে আসিয়া উপস্থিত হইল এবং মাস্টার মশাইকে চোর বলিয়া ধরিল...তুলসী এত বলিল মাস্টার মশাই চুরি করেন নাই কিন্তু কেহ শুনিল না। শেষ পর্যন্ত মারধর করিয়া মাস্টার মশাইকে বাড়ি হইতে তাড়াইয়া দিয়াছে।
আমি দূরবীনের ভিতর দিয়া যে দৃশ্য দেখিয়াছিলাম তাহার সহিত তুলসীর কাহিনীর কোথাও গরমিল নাই। আমরা দুইজনে মিলিয়া তুলসীকে প্ৰবোধ দিতে লাগিলাম, মাস্টার আবার ফিরিয়া আসিবে, কোনও ভাবনা নাই; প্রয়োজন হইলে আমরা গিয়া তুলসীর বাবাকে বলিব।
দ্বারের কাছে গলা খাঁকারির শব্দ শুনিয়া চকিতে ফিরিয়া দেখি, জামাই মণিলাল দাঁড়াইয়া আছে। তুলসী তাঁহাকে দেখিয়া তীরের মত তাহার পাশ কাটাইয়া অদৃশ্য হইল।
ব্যোমকেশ বলিল, আসুন মণিবাবু।
মণিলাল ঘরে প্রবেশ করিয়া বলিল, কর্তা পাঠিয়েছিলেন তুলসীর খোঁজ নেবার জন্যে। ও ভারি দুরন্ত, আপনাদের বেশি বিরক্ত করে না তো?
ব্যোমকেশ বলিল, মোটেই বিরক্ত করে না। ওর মাস্টারকে নাকি তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তাই বলতে এসেছিল।
মণিলাল একটু অপ্ৰস্তুত হইয়া পড়িল, বলিল, হ্যাঁ, রমাপতিকে কর্তা বিদেয় করে দিলেন। আমরা কেউ বাড়িতে ছিলাম না, পরচাবি দিয়ে আমার দেরাজ খুলে একটা কলম চুরি করেছিল। দামী কলম—
ব্যোমকেশ হাত বাড়াইয়া বলিল, যে কলামটা আপনার বুক পকেটে রয়েছে ঐটে কি?
হ্যাঁ।
মণিলাল কলম ব্যোমকেশের হাতে দিল।
পার্কারের কলম, দামী জিনিস। ব্যোমকেশ কলম ভালবাসে, সে তাহার মাথার ক্যাপ খুলিয়া দেখিল, পিছন খুলিয়া কালি ভরিবার যন্ত্র দেখিল; তারপর কলম ফিরাইয়া দিয়া বলিল, ভাল কলম। চুরি করতে হলে এই রকম কলমই চুরি করা উচিত। বাড়িতে আর কার ফাউন্টেন পেন আছে?
মণিলাল বলিল, আর কারুর নেই। বাড়িতে পড়ালেখার বিশেষ রেওয়াজ নেই। কেবল কর্তা দোয়াত কলমে লেখেন।
হুঁ। তুলসী বলছে ও নিজেই আপনার দেরাজ থেকে কলম বার করেছিল—
মণিলাল দুঃখিতভাবে বলিল, তুলসী মিথ্যে কথা বলছে। রমাপতির ও দোষ বরাবরই আছে। এই সেদিন একটা ইলেকট্রিক টর্চ—
আমি বলিতে গেলাম, ইলেকট্রিক টর্চ তো—
কিন্তু আমি কথা শেষ করিবার পূর্বে ব্যোমকেশ বলিয়া উঠিল, ইলেকট্রিক টর্চ একটা তুচ্ছ জিনিস। রমাপতি হাজার হোক বুদ্ধিমান লোক, সে কি একটা টর্চ চুরি করে নিজের ভবিষ্যৎ নষ্ট করবে?
মণিলাল কিছুক্ষণ ব্যোমকেশের পানে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, আপনার কথায় আমার ধোঁকা লাগছে, কি জানি যদি সে টর্চ না চুরি করে থাকে। কিন্তু আজ আমার কলমটা—। তবে কি তুলসী সত্যিই—
আমি জোর দিয়া বলিলাম, হ্যাঁ, তুলসী সত্যি কথা বলেছে। আমি—
ব্যোমকেশ আবার মুখে থাবা দিয়া বলিল, মণিলালবাবু, আপনাদের পারিবারিক ব্যাপারে আমাদের মাথা গলানো উচিত নয়। আমরা দুদিনের জন্যে বেড়াতে এসেছি, কি দরকার আমাদের ওসব কথায়! আপনারা যা ভাল বুঝেছেন করেছেন।
তাহলেও-কারুর নামে মিথ্যে বদনাম দেওয়া ভাল নয়—? বলিতে বলিতে মণিলাল দ্বারের দিকে পা বাড়াইল।
ব্যোমকেশ বলিল, আজ। আপনাদের সদরের কাজ হয়ে গেল?
হ্যাঁ, সকাল সকাল কাজ হয়ে গেল। কেবল দস্তখৎ করা বাকি ছিল।
যাক, এখন তাহলে নিশ্চিন্ত।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
মণিলাল প্ৰস্থান করিলে ব্যোমকেশ দরজায় উঁকি মারিয়া আসিয়া বলিল, আর একটু হলেই দিয়েছিলে সব ফাঁসিয়ে।
সে কি! কী ফাঁসিয়ে দিয়েছিলাম!
প্ৰথমে তুমি বলতে যাচ্ছিলে যে হারানো টর্চ পাওয়া গেছে।
হ্যাঁ।
তারপর বলতে যাচ্ছিলে যে দূরবীন দিয়ে ছাদের দৃশ্য দেখেছি!
হ্যাঁ, তাতে কী ক্ষতি হত?
মণিলালকে কোনও কথা বলা মানেই বাড়ির সকলকে বলা। গর্দভচমাবৃত যে সিংহটিকে আমরা খুঁজছি সে জানতে পারত যে আমরা তোষাখানার সন্ধান পেয়েছি এবং দূরবীন দিয়ে ওদের ওপর অষ্টপ্রহর নজর রেখেছি। শিকার ভড়কে যেত না?
এ কথাটা ভাবিয়া দেখি নাই।
এই সময় সীতারাম চা লইয়া আসিল। কিছুক্ষণ পরে পাণ্ডেজি আসিলেন। তিনি আমাদের জন্য অনেক তাজা খাদ্যদ্রব্য আনিয়াছেন। সীতারাম সেগুলা মোটর হইতে আনিতে গেল। আমরা চা পান করিতে করিতে সংবাদের আদান-প্ৰদান করিলাম।
আমাদের সংবাদ শুনিয়া পাণ্ডেজি বলিলেন, জাল থেকে মাছ বেরিয়ে যাচ্ছে। আজ রমাপতি গিয়েছে, কাল বংশীধর আর মুরলীধর যাবে। তাড়াতাড়ি জাল গুটিয়ে ফেলা দরকার। —হ্যাঁ, বংশীধর কলেজ হোস্টেলে যে কুকীর্তি করেছিল তার খবর পাওয়া গেছে।
কি কুকীর্তি করেছিল?
একটি ছেলের সঙ্গে ওর ঝগড়া হয়, তারপর মিটমাট হয়ে যায়। বংশীধর কিন্তু মনে মনে রাগ পুষে রেখেছিল; দোলের দিন সিদ্ধির সঙ্গে ছেলেটাকে ধুতরোর বিচি খাইয়ে দিয়েছিল। ছেলেটা মরেই যেত, অতি কষ্টে বেঁচে গেল।
ব্যোমকেশ একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, হুঁ। তাহলে বিষ প্রয়োগের অভ্যাস বংশীধরের আছে।
তা আছে। শুধু গোঁয়ার নয়, রাগ পুষে রাখে।
পাঁচটা বাজিল। ব্যোমকেশ বলিল, চলুন, আজ সন্ন্যাসী ঠাকুরের সঙ্গে একটু আলাপ করে আসা যাক।
১০
দেউড়ি পর্যন্ত নামিবার পর দেখিলাম বাড়ির দিকের সিঁড়ি দিয়া বংশীধর গটগট করিয়া নামিয়া আসিতেছে। আমাদের দেখিতে পাইয়া তাহার সতেজ গতিভঙ্গী কেমন যেন এলোমেলো হইয়া গেল; কিন্তু সে থামিল না, যেন শহরের রাস্তা ধরিবে এমনিভাবে আমাদের পিছনে রাখিয়া আগাইয়া গেল।
ব্যোমকেশ চুপি চুপি বলিল, বংশীধর সাধুবাবার কাছে যাচ্ছিল, আমাদের দেখে ভড়কে গিয়ে অন্য পথ ধরেছে।
বংশীধর তখনও বেশি দূর যায় নাই, পাণ্ডেজি হাঁক দিলেন, বংশীধর বাবু।
বংশীধর ফিরিয়া ভ্রু নত করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। আমরা কাছে গেলাম, পাণ্ডেজি কৌতুকের সুরে বলিলেন, কোথায় চলেছেন হনহনিয়ে?
বংশীধর রুক্ষ সংক্ষিপ্ত জবাব দিল, বেড়াতে যাচ্ছি।
পাণ্ডেজি হাসিয়া বলিলেন, এই তো শহর বেড়িয়ে এলেন। আরও বেড়াবেন?
বংশীধরের রগের শিরা উঁচু হইয়া উঠিল, সে উদ্ধতস্বরে বলিল, হ্যাঁ, বেড়াবো। আপনি পুলিস হতে পারেন, কিন্তু আমার বেড়ানো রুকতে পারেন না।
পাণ্ডেজিরও মুখ কঠিন হইল। তিনি কড়া সুরে বলিলেন, হ্যাঁ, পারি। কলেজ হোস্টেলে আপনি একজনকে বিষ খাইয়েছিলেন, সে মামলার এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। ফৌজদারি মামলার তামাদি হয় না। আপনাকে গ্রেপ্তার করতে পারি।
ভয়ে বংশীধরের মুখ নীল হইয়া গেল। উগ্রতা এত দ্রুত আতঙ্কে পরিবর্তিত হইতে পারে চোখে না দেখিলে বিশ্বাস হয় না। সে জালবদ্ধ পশুর ন্যায় ক্ষিপ্ৰচক্ষে এদিক ওদিক চাহিল, তারপরে যে পথে আসিয়াছিল সেই সিঁড়ি দিয়া পলকের মধ্যে বাড়ির দিকে অদৃশ্য হইয়া গেল।
পাণ্ডেজি মৃদুকণ্ঠে হাসিলেন।
বংশীধরের বিক্রম বোঝা গেছে। —চলুন।
সাধুবাবার নিকট উপস্থিত হইলাম। চারিদিকের ঝাঁকড়া গাছ স্থানটিকে প্রায় অন্ধকার করিয়া তুলিয়াছে। জ্বলন্ত ধুনির সম্মুখে বাবাজী বসিয়া আছেন। আমাদের দেখিয়া নীরব অথচ ইঙ্গিতপূর্ণ হাস্যে তাঁহার মুখ ভরিয়া উঠিল, তিনি হাতের ইশারায় আমাদের বসিতে বলিলেন।
পাণ্ডেজি তাঁহার সহিত কথা আরম্ভ করিলেন। বলা বাহুল্য, হিন্দীতেই কথাবার্তা হইল। পাণ্ডেজির গায়ে পুলিসের খাকি কামিজ ছিল, সাধুবাবা তাঁহার সহিত সমধিক আগ্রহে কথা বলিতে লাগিলেন।
কিছুক্ষণ সাধারণভাবে কথা হইল। সন্ন্যাস জীবনের মাহাত্ম্য এবং গাৰ্হস্থ্য জীবনের পঙ্কিলতা সম্বন্ধে আমরা সকলেই একমত হইলাম। হৃষ্ট বাবাজী বুলি হইতে গাঁজা বাহির করিয়া সাজিবার উপক্ৰম করিলেন।
পাণ্ডেজি জিজ্ঞাসা করিলেন, এখানে গাঁজা কোথায় পান। বাবা?
বাবাজী উর্ধ্বে কটাক্ষপাত করিয়া বলিলেন, পরমাৎমা মিলিয়ে দেন বেটা।
চিমটা দিয়া ধুনি হইতে একখণ্ড অঙ্গার তুলিয়া বাবাজী কলিকার মাথায় রাখিলেন। এই সময়ে তাঁহার চিমটাটি ভাল করিয়া লক্ষ্য করিলাম। সাধুরা যে নিৰ্ভয়ে বনে-বাদাড়ে বাস করেন তাহা নিতান্ত নিরস্ত্রভাবে নয়। চিমটা ভালভাবে ব্যবহার করিতে জানিলে ইহার দ্বারা বোধ করি বাঘ মারা যায়। আবার তাহার সূচাগ্রতীক্ষ্ণ প্রান্ত দুটির সাহায্যে ক্ষুদ্র অঙ্গারখণ্ডও যে তুলিয়া লওয়া যায় তাহা তো স্বচক্ষেই দেখিলাম। সাধুরা এই একটি মাত্র লৌহাস্ত্ৰ দিয়া নানা কাৰ্য সাধন করিয়া থাকেন।
যা হোক, বাবাজী গাঁজার কলিকায় দম দিলেন। তাঁহার গ্ৰীবা এবং রাগের শিরা-উপশিরা ফুলিয়া উঠিল। দীর্ঘ একমিনিটব্যাপী দম দিয়া বাবাজী নিঃশেষিত কলিকাটি উপুড় করিয়া দিলেন।
তারপর ধোঁয়া ছাড়িবার পালা। এ কার্যটি বাবাজী প্ৰায় তিন মিনিট ধরিয়া করিলেন; দাড়ি-গোঁফের ভিতর হইতে মন্দ মন্দ ধূম বাহির হইয়া বাতাসকে সুরভিত করিয়া তুলিল।
বাবাজী বলিলেন, বম! বম শঙ্কর!
এই সময় পায়ের শব্দে পিছন ফিরিয়া দেখিলাম, একটি লোক আসিতেছে। লোকটি আমাদের দেখিতে পাইয়া থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল। তখন চিনিলাম, রামকিশোরবাবু! তিনি আমাদের চিনিতে পারিয়া স্থলিত স্বরে বলিলেন, ও-আপনারা—?
ব্যোমকেশ বলিল, আসুন।
রামকিশোর ঈষৎ নিরাশ কষ্ঠে বলিলেন, না, আপনারা সাধুজীর সঙ্গে কথা বলছেন বলুন। আমি কেবল দর্শন করতে এসেছিলাম। জোড়হস্তে সাধুকে প্ৰণাম করিয়া তিনি প্ৰস্থান করিলেন।
সাধুর দিকে ফিরিয়া দেখিলাম তাঁহার মুখে সেই বিচিত্ৰ হাসি। হাসিটিকে বিশ্লেষণ করিলে কতখানি আধ্যাত্মিকতা এবং কতখানি নষ্টামি পাওয়া যায় তাহা বলা শক্ত। সম্ভবত সমান সমান।
এইবার ব্যোমকেশ বলিল, সাধুবাবা, আপনি তো অনেকদিন এখানে আছেন। সেদিন একটি লোক এখানে সর্পাঘাতে মারা গেছে, জানেন কি?
সাধু বলিলেন, জানতা হ্যায়। হম ক্যা নাহি জনতা!
ব্যোমকেশ বলিল, আচ্ছা, সে রাত্রে কেউ দুর্গে গিয়েছিল কি না। আপনি দেখেছিলেন?
হ্যাঁ, দেখা।
বাবাজীর মুখে আবার সেই আধ্যাত্মিক নষ্টামিভরা হাসি দেখা গেল। ব্যোমকেশ সাগ্রহে আবার তাঁহাকে প্রশ্ন করিতে যাইতেছিল, আবার পিছন দিকে পায়ের শব্দ হইল। আমরা ঘাড় ফিরাইলাম, বাবাজীও প্রখর চক্ষে সেই দিকে চাহিলেন। কিন্তু আগন্তুক কেহ আসিল না; হয়তো আমাদের উপস্থিতি জানিতে পারিয়া দূর হইতেই ফিরিয়া গেল।
ব্যোমকেশ আবার বাবাজীকে প্রশ্ন করিতে উদ্যত হইলে তিনি ঠোঁটের উপর আঙুল রাখিয়া পরিষ্কার বাঙলায় বলিলেন, এখন নয়। রাত বারোটার সময় এস, তখন বলব।
আমি অবাক হইয়া চাহিলাম। ব্যোমকেশ কিন্তু চট করিয়া উঠিয়া পড়িল, বলিল, আচ্ছা বাবা, তাই আসিব। ওঠ অজিত।
বৃক্ষ-বাটিকার বাহিরে আসিয়া দেখিলাম রাত্রি হইয়া গিয়াছে। বোমকেশ ও পাণ্ডেজি চারিদিকে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি প্রেরণ করিলেন, কিন্তু সন্দেহভাজন কাহাকেও দেখা গেল না।
পাণ্ডেজি বলিলেন, “আমি আজ এখান থেকেই ফিরি। রাত বারোটা পর্যন্ত থাকতে পারলে হত। কিন্তু উপায় নেই। কাল সকালেই আসব।
পাণ্ডেজি চলিয়া গেলেন। দুর্গে ফিরিতে ফিরিতে প্রশ্ন করিলাম, সাধুবাবা বাঙালী?
ব্যোমকেশ বলিল, সাক্ষাৎ বাঙালী।
দুৰ্গে ফিরিয়া ঘড়ি দেখিলাম, সাতটা বাজিয়াছে। মুক্ত আকাশের তলে চেয়ার পাতিয়া বসিলাম।
সাধুবাবা নিশ্চয় কিছু জানে। কী জানে? সে রাত্রে ঈশানবাবুর হত্যাকারীকে দুর্গে প্রবেশ করিতে দেখিয়ছিল? বৃক্ষ-বাটিকা হইতে দুর্গে উঠিবার সিঁড়ি দেখা যায় না; বিশেষত অন্ধকার রাত্রে। তবে কি সাধুবাবা গভীর রাত্রে সিঁড়ির আশেপাশে ঘুরিয়া বেড়ায়?...তাহার চিমটা কিন্তু সামান্য অস্ত্র নয়-ঐ চিমটার আগায় বিষ মাখাইয়া যদি—
ব্যোমকেশকে জিজ্ঞাসা করিলাম; সে কেবল গলার মধ্যে চাপা কাশির মত শব্দ করিল।
রাত্রি দশটার মধ্যে আহার সমাধা করিয়া আমরা আবার বাহিরে গিয়া বসিলাম। এখনও দুঘন্টা জাগিয়া থাকিতে হইবে। সীতারাম আহার সম্পন্ন করিয়া আড়ালে গেল; বোধ করি দু একটা বিড়ি টানবে। লণ্ঠনটা ঘরের কোণে কমানো আছে।
ঘড়ির কাঁটা এগারোটার দিকে চলিয়াছে। মনের উত্তেজনা সত্ত্বেও ক্রমাগত হাই উঠিতেছে—
ব্যোমকেশবাবু!
চাপা গলার শব্দে চমকিয়া জড়তা কাটিয়া গেল। দেখিলাম, অদূরে ছায়ার মত একটি মূর্তি দাঁড়াইয়া আছে। ব্যোমকেশ উঠিয়া বলিল, রমাপতি! এস।
রমাপতিকে লইয়া আমরা ঘরের মধ্যে গেলাম। ব্যোমকেশ আলো বাড়াইয়া দিয়া তাহার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিল, “এবেলা কিছু খাওয়া হয়নি দেখছি। —সীতারাম!
সীতারাম পাঁচ মিনিটের মধ্যে কয়েকটা ডিম ভাজিয়া আনিয়া রমাপতির সম্মুখে রাখিল। রমাপতি দ্বিরুক্তি না করিয়া খাইতে আরম্ভ করিল। তাহার মুখ শুষ্ক, চোখ বসিয়া গিয়াছে; গায়ের হাফ-শার্ট স্থানে স্থানে ছিঁড়িয়া গিয়াছে, পায়ে জুতা নাই। খাইতে খাইতে বলিল, সব শুনেছেন তাহলে? কার কাছে শুনলেন?
তুলসীর কাছে। এতক্ষণ কোথায় ছিলে?
জঙ্গলে। তারপর দুর্গের পিছনে।
বেশি মারধর করেছে নাকি?
রমাপতি পিঠের কামিজ তুলিয়া দেখাইল, দাগড়া দাগড়া লাল দাগ ফুটিয়া আছে। ব্যোমকেশের মুখ শক্ত হইয়া উঠিল।
বংশীধর?
রমাপতি ঘাড় নাড়িল।
শহরে চলে গেলে না কেন?
রমাপতি উত্তর দিল না, নীরবে খাইতে লাগিল।
এখানে থেকে আর তোমার লাভ কি?
রমাপতি অস্ফুট স্বরে বলিল, তুলসী—
তুলসীকে তুমি ভালবাসো?
রমাপতি একটু চুপ করিয়া রহিল, তারপর আস্তে আস্তে বলিল, ওকে সবাই যন্ত্রণা দেয়, ঘরে বন্ধ করে রাখে, কেউ ভালবাসে না। আমি না থাকলে ও মরে যাবে।
আহার শেষ হইলে ব্যোমকেশ তাহাকে নিজের বিছানা দেখাইয়া বলিল, শোও।
রমাপতি ক্লান্ত নিশ্বাস ফেলিয়া শয়ন করিল। ব্যোমকেশ দীর্ঘকাল তাহার পানে চাহিয়া থাকিয়া হঠাৎ প্রশ্ন করিতে আরম্ভ করিল, রমাপতি, ঈশানবাবুকে কে খুন করেছে তুমি জানো?
না, কে খুন করেছে জানি না। তবে খুন করেছে।
হরিপ্রিয়াকে কে খুন করেছিল জানো?
না, দিদি বলবার চেষ্টা করেছিল—কিন্তু বলতে পারেনি।
বংশীধরের বৌ কোন পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়েছিল জানো?
একটু চুপ করিয়া থাকিয়া রমাপতি-বলিল, জানি না, কিন্তু সন্দেহ হয়েছিল। দিদি তাকে দেখতে পারত না, দিদির মনটা বড় কুচুটে ছিল। বোধ হয় মুখোশ পরে তাকে ভূতের ভয় দেখিয়েছিল—
মুখোশ?
দিদির একটা জাপানী মুখোশ ছিল। ঐ ঘটনার পরদিন মুখোশটা জঙ্গলের কিনারায় কুড়িয়ে পেলাম; বোধ হয়। হাওয়ায় উড়ে গিয়ে পড়েছিল। আমি সেটা এনে দিদিকে দেখলাম, দিদি আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেললে।
বংশীধর মুখোশের কথা জানে?
আমি কিছু বলিনি।
সাধুবাবাকে নিশ্চয় দেখেছি। কি মনে হয়?
আমার ভক্তি হয় না। কিন্তু কর্তা খুব মান্য করেন। বাড়ি থেকে সিধে যায়।
ঈশানবাবু কোনদিন সাধুবাবা সম্বন্ধে তোমাকে কিছু বলেছিলেন
না। দর্শন করতেও যাননি। উনি সাধু-সন্ন্যাসীর ওপর চটা ছিলেন।
ব্যোমকেশ ঘড়ি দেখিয়া বলিল, বারোটা বাজে। রমাপতি, তুমি ঘুমোও আমরা একটু বেরুচ্ছি।
চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া রমাপতি বলিল, কোথায়?
বেশি দূর নয়, শীগগিরই ফিরব। এস অজিত।
বড় টৰ্চটা লইয়া আমরা বাহির হইলাম।
রামকিশোরবাবুর বাড়ি নিষ্প্রদীপ। দেউড়ির পাশ দিয়া যাইতে যাইতে শুনিলাম বুলাকিলাল সগর্জনে নাক ডাকাইতেছে।
বৃক্ষ-বাটিকায় গাঢ় অন্ধকার, কেবল ভস্মাচ্ছাদিত ধুনি হইতে নিরুদ্ধ প্ৰভা বাহির হইতেছে। সাধুবাবা ধুনির পাশে শুইয়া আছেন; শয়নের ভঙ্গীটা ঠিক স্বাভাবিক নয়।
ব্যোমকেশ তাঁহার মুখের উপর তীব্র আলো ফেলিল, বাবাজী। কিন্তু জাগিলেন না। ব্যোমকেশ তখন তাঁহার গায়ে হাত দিয়া নাড়া দিল এবং সশব্দে নিশ্বাস টানিয়া বলিল, অ্যাঁ!
টর্চের আলো বাবাজীর সবাঙ্গ লেহন করিয়া পায়ের উপর স্থির হইল। দেখা গেল গোড়ালির উপরিভাগে সাপের দাঁতের দুটি দাগ।
১১
ব্যোমকেশ বলিল, যাক, এতদিনে রামবিনোদ সত্যি সত্যি দেহরক্ষা করলেন।
রামবিনোদ!
তুমি যে আকাশ থেকে পড়লে। বুঝতে পারনি? ধন্য তুমি।
ধুনিতে ইন্ধন নিক্ষেপ করিয়া বহ্নিমান করিয়া তোলা হইয়াছে। বাবাজীর শব তাহার পাশে শক্ত হইয়া পড়িয়া আছে। আমরা দুইজনে কিছুদূরে মুখোমুখি উপু হইয়া বসিয়া সিগারেট টানিতেছি।
ব্যোমকেশ বলিল, মনে আছে, প্রথম রামকিশোরবাবুকে দেখে চেনা-চেনা মনে হয়েছিল? আসলে তার কিছুক্ষণ আগে বাবাজীকে দেখেছিলাম। দুই ভায়ের চেহারায় সাদৃশ্য আছে; তখন ধরতে পারিনি। দ্বিতীয়বার রামকিশোরকে দেখে বুঝলাম।
কিন্তু রামবিনোদ যে প্লেগে মারা গিয়েছিল?
রামবিনোদের প্লেগ হয়েছিল, কিন্তু সে মরবার আগেই বাকি সকলে তাকে চড়ায় ফেলে পালিয়েছিল। চাঁদমোহনের কথা থেকে আমি তা বুঝতে পেরেছিলাম। তারপর রামবিনোদ বেঁচে গেল। এ যেন কতকটা ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মামলার মত।
এতদিন কোথায় ছিল?
তা জানি না। বোধ হয় প্রথমটা বৈরাগ্য এসেছিল, সাধু-সন্ন্যাসীর দলে মিশে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তারপর হঠাৎ রামকিশোরের সন্ধান পেয়ে এখানে এসে হাজির হয়েছিল। কিন্তু ওকথা যাক, এখন মড়া আগলাবার ব্যবস্থা করা দরকার। অজিত, আমি এখানে আছি, তুমি টর্চ নিয়ে যাও, সীতারামকে ডেকে নিয়ে এস। আর যদি পারো, বুলাকিলালের ঘুম ভাঙিয়ে তাকেও ডেকে আনো। ওরা দু’জনে মড়া পাহারা দিক।
বলিলাম, তুমি একলা এখানে থাকবে? সেটি হচ্ছে না। থাকতে হয় দু’জনে থাকিব, যেতে হয় দু’জনে যাব।
ভয় হচ্ছে আমাকেও সাপে ছোবলাবে! এ তেমন সাপ নয় হে, জাগা মানুষকে ছোবলায় না। যা হোক, বলছি। যখন, চল দুজনেই যাই।
দেউড়িতে আসিয়া ব্যোমকেশ বলিল, দাঁড়াও, বুলাকিলালকে জাগানো যাক।
অনেক ঠেলাঠেলির পর বুলাকিলালের ঘুম ভাঙিল। তাহাকে বাবাজীর মৃত্যুসংবাদ দিয়া ব্যোমকেশ বলিল, আজ সাধুবাবা ভাঙ খেয়েছিলেন?
জী, এক ঘটি খেয়েছিলেন।
আর কে কে ভাঙি খেয়েছিল?
আর বাড়ি থেকে চাকর এসে এক ঘটি নিয়ে গিয়েছিল।
বেশ, এখন যাও, বাবাজীকে পাহারা দাও গিয়ে। আমি সীতারামকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
বুলাকিলাল ঝিমাইতে ঝিমাইতে চলিয়া গেল। মনে হইল, ঘুম ভাঙিলেও তাহার নেশার ঘোর কাটে নাই।
দুর্গে ফিরিয়া দেখিলাম সীতারাম জাগিয়া বসিয়া আছে। খবর শুনিয়া সে কেবল একবার চক্ষু বিস্ফারিত করিল, তারপর নিঃশব্দে নামিয়া গেল।
ঘরের মধ্যে রমাপতি ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। তাহাকে জাগাইলাম না, বাহিরে আসিয়া বসিলাম। রাত্রি সাড়ে বারোটা।
ব্যোমকেশ বলিল, আজ আর ঘুমানো চলবে না। অন্তত একজনকে জেগে থাকতে হবে। অজিত, তুমি না হয় ঘণ্টা দুই ঘুমিয়ে নাও, তারপর তোমাকে তুলে দিয়ে আমি ঘুমবো।
উঠিতে মন সরিতেছিল না, মস্তিষ্ক উত্তেজিত হইয়াছিল। প্রশ্ন করিলাম, ব্যোমকেশ, বাবাজীকে মারলে কে?
ঈশানবাবুকে যে মেরেছে সে।
সে কে?
তুমিই বল না। আন্দাজ করতে পারো না?
এই কথাটাই মাথায় ঘুরিতেছিল। আস্তে আস্তে বলিলাম, বাবাজী যদি রামবিনোদ হন তাহলে কে তাঁকে মারতে পারে? এক আছেন রামকিশোরবাবু—
তিনি ভাইকে খুন করবেন?
তিনি মুমূর্ষু ভাইকে ফেলে পালিয়েছিলেন। সেই ভাই ফিরে এসেছে, হয়তো সম্পত্তির বখরা দাবি করেছে—
বেশ, ধরা যাক রামকিশোর ভাইকে খুন করেছেন। কিন্তু ঈশানবাবুকে খুন করলেন কেন?
ঈশানবাবু রামবিনোদের প্রাণের বন্ধু ছিলেন, সন্ন্যাসীকে দেখে চিনতে পেরেছিলেন। হয়তো রামকিশোরকে শাসিয়েছিলেন, ভালয় ভালয় সম্পত্তির ভাগ না দিলে সব ফাঁস করে দেবেন। সন্ন্যাসীকে রামবিনোদ বলে সনাক্ত করতে পারে দুজন-চাঁদমোহন আর ঈশানবাবু। চাঁদমোহন মালিকের মুঠোর মধ্যে, ঈশানবাবুকে সরাতে পারলে সব গোল মিটে যায়—
ব্যোমকেশ হঠাৎ আমার পিঠে চাপড় মারিয়া বলিল, অজিত! ব্যাপার কি হে? তুমি যে ধারাবাহিক যুক্তিসঙ্গত কথা বলতে আরম্ভ করেছ! তবে কি এতদিনে সত্যিই বোধোদয় হল! কিন্তু আর নয়, শুয়ে পড় গিয়। ঠিক তিনটের সময় তোমাকে তুলে দেব।
আমি গমনোদ্যত হইলে সে খাটো গলায় কতকটা নিজ মনেই বলিল, রমাপতি ঘুমোচ্ছে—না মটকা মেরে পড়ে আছে?—যাক, ক্ষতি নেই, আমি জেগে আছি।
বেলা আটটা আন্দাজ পাণ্ডেজি আসিলেন। বাবাজীর মৃত্যুসংবাদ নীচেই পাইয়াছিলেন, বাকি খবরও পাইলেন। ব্যোমকেশ বলিল, আপনি লাস নিয়ে ফিরে যান। আবার আসবেন কিন্তু— আর শুনুন—
ব্যোমকেশ তাঁহাকে একটু দূরে লইয়া গিয়া মৃদুস্বরে কিছুক্ষণ কথা বলিল। পাণ্ডেজি বলিলেন, বেশ, আমি দশটার মধ্যেই ফিরব। রমাপতিকে ঘর থেকে বেরুতে দেবেন না।
তিনি চলিয়া গেলেন।
সাড়ে ন’টার সময় আমি আর ব্যোমকেশ রামকিশোরবাবুর বাড়িতে গেলাম। বৈঠকখানায় তক্তপোশের উপর রামকিশোর বসিয়া ছিলেন, পাশে মণিলাল। বংশীধর ও মুরলীধর তক্তপোশের সামনে পায়চারি করিতেছিল, আমাদের দেখিয়া নিমেষের মধ্যে কোথায় অন্তর্হিত হইল। বোধ হয় পারিবারিক মন্ত্রণা-সভা বসিয়াছিল, আমাদের আবির্ভাবে ছত্ৰভঙ্গ হইয়া গেল।
রামকিশোরের গাল বসিয়া গিয়াছে, চক্ষু কোটরগত। কিন্তু তিনি বাহিরে অবিচলিত আছেন। ক্ষীণ হাসিয়া বলিলেন, আসুন-বসুন।
তক্তপোশের ধারে চেয়ার টানিয়া বসিলাম। রামকিশোর একবার গলা ঝাড়া দিয়া স্বাভাবিক কণ্ঠে বলিলেন, সন্ন্যাসী ঠাকুরকেও সাপে কামড়েছে। ক্ৰমে দেখছি এখানে বাস করা অসম্ভব হয়ে উঠল। বংশী আর মুরলী দু’একদিনের মধ্যে চলে যাচ্ছে, আমরা বাকী ক’জন এখানেই থাকব ভেবেছিলাম। কিন্তু সাপের উৎপাত যদি এভাবে বাড়তেই থাকে—
ব্যোমকেশ বলিল, শীতকালে সাপের উৎপাত-আশ্চর্য!
রামকিশোর বলিলেন, তার ওপর বাড়িতে কাল রাত্রে আর এক উৎপাত। এ বাড়িতে আজ পর্যন্ত চোর ঢোকেনি—
মণিলাল বলিল, এ মামুলি চোর নয়।
ব্যোমকেশ বলিল, কি হয়েছিল?
রামকিশোর বলিলেন, আমার শরীর খারাপ হয়ে অবধি মণিলাল রাত্রে আমার ঘরে শোয়। কাল রাত্রে আন্দাজ বারোটার সময়—। মণিলাল, তুমিই বল। আমার যখন ঘুম ভাঙল চোর তখন পালিয়েছে।
মণিলাল বলিল, আমার খুব সজাগ ঘুম। কাল গভীর রাত্রে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল, মনে হল দরজার বাইরে পায়ের শব্দ। এ বাড়ির নিয়ম রাত্রে কেউ দোরে খিল দিয়ে শোয় না, এমন কি সদর দরজাও ভেজানো থাকে। আমার মনে হল আমাদের ঘরের দোর কেউ সন্তপর্ণে ঠেলে খোলবার চেষ্টা করছে। আমার খাট দরজা থেকে দূরে; আমি নিঃশব্দে উঠলাম, পা টিপে টিপে দোরের কাছে গোলাম। ঘরে আলো থাকে না, অন্ধকারে দেখলাম দোরের কপাট আস্তে আস্তে খুলে যাচ্ছে। এই সময় আমি একটা বোকামি করে ফেললাম। আর একটু অপেক্ষা করলেই চোর ঘরে ঢুকতো, তখন তাকে ধরতে পারতাম। তা না করে আমি দরজা টেনে খুলতে গেলাম। চোর সতর্ক ছিল, সে দুড় দুড় করে পালাল।
রামকিশোর বলিলেন, এই সময় আমার ঘুম ভেঙে গেল।
ব্যোমকেশ বলিল, যাকে চোর মনে করছেন সে তুলসী নয় তো? তুলসীর শুনেছি। রাত্রে ঘুরে বেড়ানোর অভ্যোস আছে।
রামকিশোরের মুখের ভাব কড়া হইল, তিনি বলিলেন, না, তুলসী নয়। তাকে আমি কাল রাত্রে ঘরে বন্ধ করে রেখেছিলাম।
ব্যোমকেশ মণিলালকে জিজ্ঞাসা করিল, চোরকে আপনি চিনতে পারেননি?
না। কিন্তু—
আপনার বিশ্বাস চেনা লোক?
হ্যাঁ।
রামকিশোর বলিলেন, লুকোছাপার দরকার নেই। আপনারা তো জানেন রমাপতিকে কাল আমি তাড়িয়ে দিয়েছি। মণিলালের বিশ্বাস সেই কোন মতলবে এসেছিল।
ব্যোমকেশ বলিল, ঠিক ক’টার সময় এই ব্যাপার ঘটেছিল বলতে পারেন। কি?
রামকিশোর বলিলেন, ঠিক পৌনে বারোটার সময়। আমার বালিশের তলায় ঘড়ি থাকে, আমি দেখেছি।
ব্যোমকেশ আমার পানে সঙ্কেতপূর্ণ দৃষ্টিপাত করিল, আমি মুখ টিপিয়া রহিলাম। রমাপতি যে পৌনে বারোটার সময় ব্যোমকেশের খাটে শুইয়া ছিল তাহা বলিলাম না।
রামকিশোর বিষণ্ণ গভীর স্বরে বলিলেন, আজ সকালে আর একটা কথা জানা গেল। রমাপতি তার জিনিসপত্র নিয়ে যায়নি, তার ঘরেই পড়ে ছিল। আজ সকালে ঘর তল্লাস করালাম। তার টিনের ভাঙা তোরঙ্গ থেকে এই জিনিসটা পাওয়া গেল। পকেট হইতে একটি সোনার কাঁটা বাহির করিয়া তিনি ব্যোমকেশের হাতে দিলেন।
মেয়ের যে-ধরনের লোহার দুভাঁজ কাঁটা দিয়া চুল বাঁধেন সেই ধরনের সোনার কাঁটা। আকারে একটু বড় ও স্থুল, দুই প্রান্ত ছুঁচের মত তীক্ষ্ণ। সেটিকে নাড়িয়া চাড়িয়া ব্যোমকেশ সপ্রশ্নচক্ষে রামকিশোরের পানে চাহিল; তিনি বলিলেন, আমার বড় মেয়ে হরিপ্রিয়ার চুলের কাঁটা। তার মৃত্যুর পর হারিয়ে গিয়েছিল।
কাঁটা ফেরৎ দিয়া ব্যোমকেশ পূর্ণদৃষ্টিতে রামকিশোরের পানে চাহিয়া বলিল, রামকিশোরবাবু, এবার সোজাসুজি বোঝাপড়ার সময় হয়েছে।
রামকিশোর যেন হতবুদ্ধি হইয়া গেলেন, বোঝাপড়া!
হ্যাঁ। আপনার দাদা রামবিনোদবাবুর মৃত্যুর জন্য দায়ী কে সেটা পরিষ্কার হওয়া দরকার।
রামকিশোরের মুখ ফ্যাকাসে হইয়া গেল। তিনি কথা বলিবার জন্য মুখ খুলিলেন, কিন্তু মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না। তারপর অতিকষ্টে নিজেকে আয়ত্ত করিতে করিতে অর্ধরুদ্ধ স্বরে বলিলেন, আমার দাদা—! কার কথা বলছেন আপনি?
ব্যোমকেশ বলিল, কার কথা বলছি তা আপনি জানেন। মিথ্যে অভিনয় করে লাভ নেই। সর্পাঘাত যে সত্যিকার সর্পাঘাত নয় তাও আমরা জানি। আপনার দাদাকে কাল রাত্রে খুন করা হয়েছে।
মণিলাল বলিয়া উঠিল, খুন করা হয়েছে!
হ্যাঁ। আপনি জানেন কি, সন্ন্যাসীঠাকুর হচ্ছেন আপনার শ্বশুরের দাদা, রামবিনোদ সিংহ।
রামকিশোর এতক্ষণে অনেকটা সামলাইয়াছেন, তিনি তীব্ৰস্বরে বলিলেন, মিথ্যে কথা! আমার দাদা অনেকদিন আগে প্লেগে মারা গেছেন। এসব রোমান্টিক গল্প কোথা থেকে তৈরি করে আনলেন? সন্ন্যাসী আমার দাদা প্ৰমাণ করতে পারেন। সাক্ষী আছে?
ব্যোমকেশ বলিল, একজন সাক্ষী ছিলেন ঈশানবাবু, তাঁকেও খুন করা হয়েছে।
রামকিশোর এবার ক্ৰোধে ফাটিয়া পড়িলেন, উর্ধ্বস্বরে বলিলেন, মিথ্যে কথা! মিথ্যে! এসব পুলিসের কারসাজি। যান আপনারা আমার বাড়ি থেকে, এই দণ্ডে দুর্গ থেকে বেরিয়ে যান। আমার এলাকায় পুলিসের গুপ্তচরের জায়গা নেই।
এই সময় বাহিরে জানালায় মুরলীধরের ভয়ার্ত মুখ দেখা গেল—বাবা! পুলিস বাড়ি ঘেরাও করেছে। বলিয়াই সে অপসৃত হইল।
চমকিয়া দ্বারের দিকে ফিরিয়া দেখি পায়ের বুট হইতে মাথার হেলমেট পর্যন্ত পুলিস পোষাক-পরা পাণ্ডেজি ঘরে প্রবেশ করিতেছেন, তাঁহার পিছনে ব্যাগ হাতে ডাঃ ঘটক!
পাণ্ডে বলিলেন, তল্লাসী পরোয়ানা আছে, আপনার বাড়ি খানাতল্লাস করব। ওয়ারেন্ট দেখতে চান?
রামকিশোর ভীত পাংশুমুখে চাহিয়া রহিলেন, তারপর ভাঙা গলায় বলিলেন, এর মানে?
পাণ্ডে বলিলেন, আপনার এলাকায় দুটো খুন হয়েছে। পুলিসের বিশ্বাস অপরাধী এবং অপরাধের প্রমাণ এই বাড়িতেই আছে। আমরা সার্চ করে দেখতে চাই।
রামকিশোর আরও কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া, বেশ, যা ইচ্ছে করুন—বলিয়া তাকিয়ার উপর এলাইয়া পড়িলেন।
ডাক্তার!
ডাক্তার ঘটক প্রস্তুত ছিল, দুই মিনিটের মধ্যে রামকিশোরকে ইনজেকশন দিল। তারপর নাড়ি টিপিয়া বলিল, ভয় নেই।
ইতিমধ্যে আমি জানালা দিয়া উঁকি মারিয়া দেখিলাম, বাহিরে পুলিস গিসগিস করিতেছে; সিঁড়ির মুখে অনেকগুলা কনস্টেবল দাঁড়াইয়া যাতায়াতের পথ বন্ধ করিয়া দিয়াছে।
ইন্সপেক্টর দুবে ঘরে আসিয়া স্যালুট করিয়া দাঁড়াইল, সকলে নিজের নিজের ঘরে আছে, বেরুতে মানা করে দিয়েছি।
পাণ্ডে বলিলেন, বেশ। দুজন বে-সরকারী সাক্ষী চাই। অজিতবাবু, ব্যোমকেশবাবু, আপনার সাক্ষী থাকুন। পুলিস কোনও বে-আইনী কাজ করে কি না আপনারা লক্ষ্য রাখবেন।
মণিলাল এতক্ষণ আমাদের কাছে দাঁড়াইয়া ছিল, বলিল, আমিও কি নিজের ঘরে গিয়ে থাকব?
পাণ্ডে তাহার দিকে ফিরিয়া বলিলেন, মণিলালবাবু! না চলুন, আপনার ঘরটাই আগে দেখা যাক।
আসুন।
পাণ্ডে, দুবে, ব্যোমকেশ ও আমি মণিলালের অনুসরণ করিয়া তাহার ঘরে প্রবেশ করিলাম। ঘরটি বেশ বড়, একপাশে খাট, তাছাড়া আলমারি দেরাজ প্রভৃতি আসবাব আছে।
মণিলাল বলিল, কি দেখবেন দেখুন।
ব্যোমকেশ বলিল, বেশি কিছু দেখবার নেই। আপনার দুটো ফাউন্টেন পেন আছে, সেই দুটো দেখলেই চলবে।
মণিলালের মুখ হইতে ক্ষণকালের জন্য যেন একটা মুখোশ সরিয়া গেল। সেই যে ব্যোমকেশ বলিয়াছিল, গর্দভচমাবৃত সিংহ, মনে হইল সেই হিংস্ৰ শ্বাপদটা নিরীহ চর্মাবরণ ছাড়িয়া বাহির হইল; একটা ভয়ঙ্কর মুখ পালকের জন্য দেখিতে পাইলাম। তারপর মণিলাল গিয়া দেরাজ খুলিল; দেরাজ হইতে পার্কারের কলমটি বাহির করিয়া দ্রুতহস্তে তাহার দুদিকের ঢাকনি খুলিয়া ফেলিল; কলমটাকে ছোরার মত মুঠিতে ধরিয়া ব্যোমকেশের পানে চোখ তুলিল। সে-চক্ষে যে কী ভীষণ হিংসা ও ক্ৰোধ ছিল তাহা বৰ্ণনা করা যায় না। মণিলাল শ্বদন্ত নিষ্ক্রান্ত করিয়া বলিল, এই যে কলম। নেবে? এস, নেবে এস।
আমরা জড়মূর্তির মত দাঁড়াইয়া রহিলাম। পাণ্ডে কোমর হইতে রিভলবার বাহির করিলেন। মণিলাল হায়েনার মত হাসিল। তারপর নিজের বামহাতের কব্জির উপর কলমের নিব বিঁধিয়া অঙ্গুষ্ঠ দ্বারা কালিভরা পিচকারিটা টিপিয়া ধরিল।
ব্যোমকেশ রামকিশোরবাবুকে বলিল, দুধ কলা খাইয়ে কালসাপ পুষেছিলেন। ভাগ্যে পুলিসের এই গুপ্তচরটা ছিল তাই বেঁচে গেলেন। কিন্তু এবার আমরা চললাম, আপনার আতিথ্যে আর আমাদের রুচি নেই। কেবল সাপের বিষের শিশিটা নিয়ে যাচ্ছি।
রামকিশোর বিহ্বল ব্যাকুল চক্ষে চারিদিকে চাহিতে লাগিলেন। ব্যোমকেশ দ্বার পর্যন্ত গিয়া ফিরিয়া দাঁড়াইল, বলিল, আর একটা কথা বলে যাই। আপনার পূর্বপুরুষেরা অনেক সোনা লুকিয়ে রেখে গিয়েছিলেন। সে সোনা কোথায় আছে আমি জানি। কিন্তু যে-জিনিস আমার নয় তা আমি ছুঁতেও চাই না। আপনার পৈতৃক সম্পত্তি আপনি ভোগ করুন। —চলুন পাণ্ডেজি। এস অজিত।
অপরাহ্নে পাণ্ডেজির বাসায় আরাম-কেদারায় অর্ধশয়ান হইয়া ব্যোমকেশ গল্প বলিতেছিল। শ্রোতা ছিলাম আমি, পাণ্ডেজি এবং রমাপতি।
খুব সংক্ষেপে বলছি। যদি কিছু বাদ পড়ে যায়, প্রশ্ন কোরো।
পাণ্ডে বলিলেন, একটা কথা আগে বলে নিই। সেই যে সাদা গুঁড়ো পরীক্ষা করতে দিয়েছিলেন, কেমিস্টের রিপোর্ট এসেছে। এই দেখুন।
রিপোর্ট পড়িয়া ব্যোমকেশ ভ্রুকুঞ্চিত করিল— Sodium Tetra Borate—Borax, মানে সোহাগা কোন কাজে লাগে? এক তো জানি, সোনায় সোহাগা। আর কোনও কাজে লাগে নাকি?
পাণ্ডে বলিল, ঠিক জানি না। সেকালে হয়তো ওষুধ-বিষুধ তৈরির কাজে লাগত।
রিপোর্ট ফিরাইয়া দিয়া ব্যোমকেশ বলিল, যাক। এবার শোনো। মণিলাল বাইরে বেশ ভাল মানুষটি ছিল, কিন্তু তার স্বভাব রাক্ষসের মত; যেমন নিষ্ঠুর তেমনি লোভী। বিয়ের পর সে মনে মনে ঠিক করল শ্বশুরের গোটা সম্পত্তিটাই গ্ৰাস করবে। শালাদের কাছ থেকে সে সদাব্যবহার পায়নি, স্ত্রীকেও ভালবাসেনি। কেবল শ্বশুরকে নরম ব্যবহারে বশ করেছিল।
মণিলালের প্রথম সুযোগ হল যখন একদল বেদে এসে ওখানে তাঁবু ফেলল। সে গোপনে তাদের কাছ থেকে সাপের বিষ সংগ্ৰহ করল।
স্ত্রীকে সে প্রথমেই কেন খুন করল। আপাতদৃষ্টিতে তা ধরা যায় না। হয়তো দুর্বল মুহুর্তে স্ত্রীর কাছে নিজের মতলব ব্যক্ত করে ফেলেছিল, কিম্বা হয়তো হরিপ্রিয়াই কলমে সাপের বিষ ভরার প্রক্রিয়া দেখে ফেলেছিল। মোট কথা, প্রথমেই হরিপ্রিয়াকে সরানো দরকার হয়েছিল। কিন্তু তাতে একটা মস্ত অসুবিধে, শ্বশুরের সঙ্গে সম্পর্কই ঘুচে যায়। মণিলাল কিন্তু শ্বশুরকে এমন বশ করেছিল যে তার বিশ্বাস ছিল রামকিশোর তার সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দেবেন না। তুলসীর দিকে তার নজর ছিল।
যা হোক, হরিপ্রিয়ার মৃত্যুর পর কোনও গণ্ডগোল হল না, তুলসীর সঙ্গে কথা পাকা হয়ে রইল। মণিলাল ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগল, সম্পর্কটা একবার পাকা হয়ে গেলেই শালাগুলিকে একে একে সরাবে। দু’বছর কেটে গেল, তুলসী প্রায় বিয়ের যোগ্য হয়ে এসেছে, এমন সময় এলেন ঈশানবাবু; তার কিছুদিন পরে এসে জুটলেন সাধুবাবা। এঁদের দু’জনের মধ্যে অবশ্য কোনও সংযোগ ছিল না; দুজনে শেষ পর্যন্ত জানতে পারেননি যে বন্ধুর এত কাছে আছেন।
রামকিশোরবাবু ভাইকে মৃত্যুর মুখে ফেলে পালিয়েছেন এ গ্লানি তাঁর মনে ছিল। সন্ন্যাসীকে চিনতে পেরে তাঁর হৃদয়যন্ত্র খারাপ হয়ে গেল, যায়-যায় অবস্থা। একটু সামলে উঠে তিনি ভাইকে বললেন, যা হবার হয়েছে, কিন্তু এখন সত্যি প্রকাশ হলে আমার বড় কলঙ্ক হবে। তুমি কোনও তীৰ্থস্থানে গিয়ে মঠ তৈরি করে থাকো, যত খরচ লাগে আমি দেব। রামবিনোদ কিন্তু ভাইকে বাগে পেয়েছেন, তিনি নড়লেন না; গাছতলায় বসে ভাইকে অভিসম্পাত দিতে লাগলেন।
এটা আমার অনুমান। কিন্তু রামকিশোর যদি কখনও সত্যি কথা বলেন, দেখবে অনুমান মিথ্যে নয়। মণিলাল কিন্তু শ্বশুরের অসুখে বড় মুশকিলে পড়ে গেল; শ্বশুর যদি হঠাৎ পটল তোলে তার সব প্ল্যান ভেস্তে যাবে, শালারা তদণ্ডেই তাকে তাড়িয়ে দেবে। সে শ্বশুরকে মন্ত্রণা দিতে লাগল, বড় দুই ছেলেকে পৃথক করে দিতে। তাতে মণিলালের লাভ, রামকিশোর যদি হার্টফেল করে মরেও যান, নাবালকদের অভিভাবকরূপে অর্ধেক সম্পত্তি তার কিব্জায় আসবে।
তারপর তুলসীকে সে বিয়ে করবে, আর গদাধর সর্পাঘাতে মরবে।
মণিলালকে রামকিশোর অগাধ বিশ্বাস করতেন, তাছাড়া তাঁর নিজেরই ভয় ছিল তাঁর মৃত্যুর পর বড় দুই ছেলে নাবালক ভাইবোনকে বঞ্চিত করবে। তিনি রাজী হলেন; উকিলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলতে লাগিল।
ওদিকে দুর্গে আর একটি ঘটনা ঘটছিল; ঈশানবাবু গুপ্তধনের সন্ধানে লেগেছিলেন। প্রথমে তিনি পাটিতে খোদাই করা ফারসী লেখাটা পেলেন। লেখাটা তিনি সযত্নে খাতায় টুকে রাখলেন এবং অনুসন্ধান চালাতে লাগলেন। তারপর নিজের শোবার ঘরে গজাল নাড়তে নাড়তে দেখলেন, একটা পাথর আলগা। বুঝতে বাকি রইল না যে ঐ পাথরের তলায় দুর্গের তোষাখানা আছে।
কিন্তু পাথরটা জগদ্দল ভারী; ঈশানবাবু রুগ্ন বৃদ্ধ। পাথর সরিয়ে তোষাখানায় ঢুকবেন কি করে ঈশানবাবুর মনে পাপ ছিল, অভাবে তাঁর স্বভাব নষ্ট হয়েছিল। তিনি রামকিশোরকে খবর দিলেন না, একজন সহকারী খুঁজতে লাগলেন।
দুজন পূৰ্ণবয়স্ক লোক তাঁর কাছে নিত্য যাতায়াত করত, রমাপতি আর মণিলাল। ঈশানবাবু মণিলালকে বেছে নিলেন। কারণ মণিলাল ষণ্ডা বেশি। আর সে শালাদের ওপর খুশি নয় তাও ঈশানবাবু বুঝেছিলেন।
বোধ হয় আধাআধি বখরা ঠিক হয়েছিল। মণিলাল কিন্তু মনে মনে ঠিক করলে সবটাই সে নেবে, শ্বশুরের জিনিস পরের হাতে যাবে কেন? নির্দিষ্ট রাত্রে দুজনে পাথর সরিয়ে তোষাখানায় নামলেন।
হাঁড়িকলসীগুলো তল্লাস করবার আগেই ঈশানবাবু মেঝের ওপর একটা মোহর কুড়িয়ে পেলেন। মণিলালের ধারণা হল হাঁড়িকলসীতে মোহর ভরা আছে। সে আর দেরি করল না, হাতের টর্চ দিয়ে ঈশানবাবুর ঘাড়ে মোরল এক ঘা। ঈশানবাবু অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। তারপর তাঁর পায়ে কলমের খোঁচা দেওয়া শক্ত হল না।
কিন্তু খুনীর মনে সর্বদাই একটা ত্বরা জেগে থাকে। মণিলাল ঈশানবাবুর দেহ ওপরে নিয়ে এল। এই সময় আমার মনে হয়, বাইরে থেকে কোনও ব্যাঘাত এসেছিল। মুরলীধর ঈশানবাবুকে তাড়াবার জন্যে ভয় দেখাচ্ছিলই, হয়তো সেই সময় ইঁট-পাটকেল ফেলেছিল। মণিলাল ভয় পেয়ে গুপ্তদ্বার বন্ধ করে দিল। হাঁড়িগুলো দেখা হল না; টৰ্চটাও তোষাখানায় রয়ে গেল।
তোষাখানায় যে সোনাদানা কিছু নেই একথা বোধ হয় মণিলাল শেষ পর্যন্ত জানতে পারেনি। ঈশানবাবুর মৃত্যুর হাঙ্গামা জুড়োতে না জুড়োতে আমরা গিয়ে বসলাম; সে আর খোঁজ নিতে পারল না। কিন্তু তার ধৈর্যের অভাব ছিল না; সে অপেক্ষা করতে লাগল, আর শ্বশুরকে ভজাতে লাগল দুৰ্গটা যাতে তুলসীর ভাগে পড়ে।
আমরা স্রেফ হওয়া বদলাতে যাইনি, এ সন্দেহ তার মনে গোড়া থেকেই ধোঁয়াচ্ছিল, কিন্তু কিছু করবার ছিল না। তারপর কাল বিকেল থেকে এমন কয়েকটা ঘটনা ঘটল যে মণিলাল ভয় পেয়ে গেল। তুলসী তার কলম চুরি করে রমাপতিকে দিতে গেল। কলমে তখন বিষ ছিল কিনা বলা যায় না, কিন্তু কলম সম্বন্ধে তার দুর্বলতা স্বাভাবিক। রমাপতিকে সে দেখতে পারত। না-ভাবী পত্নীর প্রেমাষ্পদকে কেই বা দেখতে পারে? এই ছুতো করে সে রমাপতিকে তাড়ালো। যা হোক, এ পর্যন্ত বিশেষ ক্ষতি হয়নি, কিন্তু সন্ধ্যেবেলা আর এক ব্যাপার ঘটল। আমরা যখন সাধুবাবার কাছে বসে তাঁর লম্বা লম্বা কথা শুনছি, ‘হ্যম ক্যা নাহি জনতা’ ইত্যাদি—সেই সময় মণিলাল বাবাজীর কাছে আসছিল; দূর থেকে তাঁর আস্ফালন শুনে ভাবল, বাবাজী নিশ্চয় তাকে ঈশানবাবুর মৃত্যুর রাত্রে দুর্গে যেতে দেখেছিলেন, সেই কথা তিনি দুপুর রাত্রে আমাদের কাছে ফাঁস করে দেবেন।
মণিলাল দেখল, সর্বনাশ! তার খুনের সাক্ষী আছে। বাবাজী যে ঈশানবাবুর মৃত্যু সম্বন্ধে কিছুই জানেন না, তা সে ভাবতে পারল না; ঠিক করল রাত বারোটার আগেই বাবাজীকে সাবাড় করবে।
আমরা চলে আসার পর বাবাজী এক ঘটি সিদ্ধি চড়ালেন। তারপর বোধ হয়। মণিলাল গিয়ে আর এক ঘটি খাইয়ে এল। বাবাজী নিৰ্ভয়ে খেলেন, কারণ মণিলালের ওপর তাঁর সন্দেহ নেই। তারপর তিনি নেশায় বুঁদ হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন; এবং যথাসময়ে মণিলাল এসে তাঁকে মহাসুষুপ্তির দেশে পাঠিয়ে দিলে৷
আমি বলিলাম, আচ্ছা, সন্ন্যাসী ঠাকুর যদি কিছু জানতেন না, তবে আমাদের রাত দুপুরে ডেকেছিলেন কেন?
ব্যোমকেশ বলিল, ডেকেছিলেন তাঁর নিজের কাহিনী শোনাবার জন্যে, নিজের আসল পরিচয় দেবার জন্যে।
আর একটা কথা। কাল রাত্রে যে রামকিশোরবাবুর ঘরে চোর ঢুকেছিল সে চোরটা কে?
কাল্পনিক চোর। মণিলাল সাধুবাবাকে খুন করে ফিরে আসবার সময় ঘরে ঢুকতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছিল, তাতে রামকিশোরবাবুর ঘুম ভেঙে যায়। তাই চোরের আবির্ভাব। রামকিশোরবাবু আফিম খান, আফিম-খোরের ঘুম সহজে ভাঙে না, তাই মণিলাল নিশ্চিন্ত ছিল; কিন্তু ঘুম যখন ভাঙল তখন মণিলাল চট করে একটা গল্প বানিয়ে ফেলল। তাতে রমাপতির ওপর একটা নতুন সন্দেহ জাগানো হল, নিজের ওপর থেকে সন্দেহ সরানো হল। রমাপতির তোরঙ্গতে হরিপ্রিয়ার সোনার কাঁটা লুকিয়ে রেখেও ঐ একই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হল। যা শত্রু পরে পরে। যদি কোনও বিষয়ে কারুর ওপর সন্দেহ হয় রমাপতির ওপর সন্দেহ হবে।
ব্যোমকেশ সিগারেট ধরাইল। প্রশ্ন করিলাম, মণিলাল যে আসামী এটা বুঝলে কখন?
ব্যোমকেশ ধোঁয়া ছাড়িয়া বলিল, অস্ত্রটা কী তাই প্রথমে ধরতে পারছিলাম না। তুলসী প্রথম যখন ফাউন্টেন পেনের উল্লেখ করল, তখন সন্দেহ হল। তারপর মণিলাল যখন ফাউন্টেন পেন আমার হাতে দিলে তখন এক মুহুর্তে সব পরিষ্কার হয়ে গেল। মণিলাল নিজেই বললে বাড়িতে আর কারুর ফাউন্টেন পেন নেই। কেমন সহজ অস্ত্ৰ দেখ? সর্বদা পকেটে বাহার দিয়ে বেড়াও, কেউ সন্দেহ করবে না।
কিছুক্ষণ নীরবে কাটিবার পর পাণ্ডেজি বলিলেন, গুপ্তধনের রহস্যটা কিন্তু এখনও চাপাই আছে।
ব্যোমকেশ মুচকি হাসিল।
বাড়ির সদরে একটা মোটর আসিয়া থামিল এবং হর্ন বাজাইল। জানালা দিয়া দেখিলাম, মোটর হইতে নামিলেন রামকিশোরবাবু ও ডাক্তার ঘটক।
ঘরে প্রবেশ করিয়া রামকিশোর জোড়হস্তে বলিলেন, আমাকে আপনারা ক্ষমা করুন। বুদ্ধির দোষে আমি সব ভুল বুঝেছিলাম। রমাপতি, তোকেই আমি সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছি। বাবা তুই আমার সঙ্গে ফিরে চল।
রমাপতি সলজ্জে তাঁহাকে প্ৰণাম করিল।
১২
রামকিশোরবাবুকে খাতির করিয়া বসানো হইল। পাণ্ডেজি বোধ করি চায়ের হুকুম দিবার জন্য বাহিরে গেলেন।
ডাক্তার ঘটক হাসিয়া বলিল, আমার রুগীর পক্ষে বেশি উত্তেজনা কিন্তু ভাল নয়। উনি জোর করলেন বলেই সঙ্গে নিয়ে এসেছি, নইলে ওঁর উচিত বিছানায় শুয়ে থাকা।
রামকিশোর গাঢ়স্বরে বলিলেন, আর উত্তেজনা! আজি সকাল থেকে আমার ওপর দিয়ে যা গেছে তাতেও যখন বেঁচে আছি তখন আর ভয় নেই ডাক্তার।
ব্যোমকেশ বলিল, সত্যিই আর ভয় নেই। একে তো সব বিপদ কেটে গেছে, তার ওপর ডাক্তার পেয়েছেন। ডাক্তার ঘটক যে কত ভাল ডাক্তার তা আমি জানি কিনা। কিন্তু একটা কথা বলুন। সন্ন্যাসীকে দাদা বলতে কি আপনি এখনও রাজী নন?
রামকিশোর লজ্জায় নতমুখ হইলেন।
ব্যোমকেশবাবু, নিজের লজ্জাতে নিজেই মরে আছি, আপনি আর লজ্জা দেবেন না। দাদাকে হাতে পায়ে ধরেছিলাম, দাদা সংসারী হতে রাজী হননি। বলেছিলাম, আমি হরিদ্বারে মন্দির করে দিচ্ছি। সেখানে সেবায়েৎ হয়ে রাজার হালে থাকুন। দাদা শুনলেন না। শুনলে হয়তো অপঘাত মৃত্যু হত না। তিনি নিশ্বাস ফেলিলেন।
পাণ্ডেজি ফিরিয়া আসিলেন, তাঁহার হাতে আমাদের পূর্বদৃষ্ট মোহরটি। সেটি রামকিশোরকে দিয়া বলিলেন, আপনার জিনিস আপনি রাখুন।
রামকিশোর সাগ্রহে মোহরটি লইয়া দেখিলেন, কপালে ঠেকাইয়া বলিলেন, আমার পিতৃপুরুষের সম্পত্তি। তাঁরা সবই রেখে গিয়েছিলেন, আমাদের কপালের দোষ এতদিন পাইনি। ব্যোমকেশবাবু, সত্যিই কি সন্ধান পেয়েছেন?
পেয়েছি বলেই আমার বিশ্বাস। তবে চোখে দেখিনি।
তাহলে—তাহলে—! রামকিশোরবাবু ঢোক গিলিলেন।
ব্যোমকেশ মৃদু হাসিল।
আপনার এলাকার মধ্যেই আছে। খুঁজে নিন না।
খোঁজবার কি ত্রুটি করেছি, ব্যোমকেশবাবু? কেল্লা কিনে অবধি তার আগাপাশতলা তন্ন তন্ন করেছি। পাইনি; হতাশ হয়ে ভেবেছি সিপাহীরা লুটেপুটে নিয়ে গেছে। আপনি যদি জানেন, বলুন। আমি আপনাকে বঞ্চিত করব না, আপনিও বখরা পাবেন। এঁদের সালিশ মানছি, পাণ্ডেজি আর ডাক্তার ঘটক যা ন্যায্য বিবেচনা করবেন তাই দেব। আপনি আমার অশেষ উপকার করেছেন, যদি অর্ধেক বখরাও চান—
ব্যোমকেশ নীরস স্বরে বলিল, বখরা চাই না। কিন্তু দুটো শর্ত আছে।
শর্ত! কী শর্ত?
প্রথম শর্ত, রমাপতির সঙ্গে তুলসীর বিয়ে দিতে হবে। দ্বিতীয় শর্ত, বিয়ের যৌতুক হিসেবে আপনার দুর্গ রমাপতিকে লেখাপড়া করে দিতে হবে।
ব্যোমকেশ যে ভিতরে ভিতরে ঘটকালি করিতেছে তাহা সন্দেহ করি নাই। সকলে উচ্চকিত হইয়া উঠিলাম। রমাপতি লজ্জিত মুখে সরিয়া গেল।
রামকিশোর কয়েক মিনিট হেঁট মুখে চিন্তা করিয়া মুখ তুলিলেন। বলিলেন, তাই হবে। রমাপতিকে আমার অপছন্দ নয়। ওকে চিনি, ও ভাল ছেলে। অন্য কোথাও বিয়ে দিলে আবার হয়তো একটা ভূত-বাঁদর জুটবে। তার দরকার নেই।
আর দুর্গ?
দুর্গ লেখাপড়া করে দেব। আপনি চান পৈতৃক সোনাদানা তুলসী আর রমাপতি পাবে, এই তো? বেশ তাই হবে।
কথার নড়াচড় হবে না?
রামকিশোর একটু কড়া সুরে বলিলেন, আমি রাজা জানকীরামের সন্তান। কথার নড়াচড় কখনও করিনি।
বেশ। আজ তো সন্ধ্যে হয়ে গেছে। কাল সকালে আমরা যাব।
পরদিন প্ৰভাতে আমরা আবার দুর্গে উপস্থিত হইলাম। আমরা চারজন-আমি, ব্যোমকেশ, পাণ্ডেজি ও সীতারাম। অন্য পক্ষ হইতে কেবল রামকিশোর ও রমাপতি। বুলাকিলালকে হুকুম দেওয়া হইয়াছিল দুর্গে যেন আর কেহ না আসে। সে দেউড়িতে পাহারা দিতেছিল।
ব্যোমকেশ বলিল, আপনারা অনেক বছর ধরে খুঁজে খুঁজে যা পাননি ঈশানবাবু দুহপ্তায় তা খুঁজে বার করেছিলেন। তার কারণ তিনি প্রত্নতত্ত্ববিৎ ছিলেন, কোথায় খুঁজতে হয় জানতেন। প্ৰথমে তিনি পেলেন একটা শিলালিপি, তাতে লেখা ছিল, যদি আমি বা জয়রাম বাঁচিয়া না থাকি আমাদের তামাম ধনসম্পত্তি সোনাদানা মোহনলালের জিম্মায় গচ্ছিত রহিল। এ লিপি রাজারামের লেখা। কিন্তু মোহনলাল কে? ঈশানবাবু বুঝতে পারলেন না। বুঝতে পারলে মনে হয় কোন গন্ডগোলই হত না, তিনি চুরি করবার বৃথা চেষ্টা না করে সরাসরির রামকিশোরকে খবর দিতেন।
তারপর ঈশানবাবু পেলেন গুপ্ত তোষাখানার সন্ধান; ভাবলেন সব সোনাদানা সেইখানেই আছে। আমরা জানি তোষাখানায় একটি গড়িয়ে পড়া মোহর ছাড়া আর কিছুই ছিল না; বাকি সব কিছু রাজারাম সরিয়ে ফেলেছিলেন। এইখানে বলে রাখি, সিপাহীরা তোষাখানা খুঁজে পায়নি; পেলে হাঁড়িকলসীগুলো আস্ত থাকত না।
সে যাক। প্রশ্ন হচ্ছে, মোহনলাল কে, যার জিম্মায় রাজারাম তামাম ধনসম্পত্তি গচ্ছিত রেখে গিয়েছিলেন? একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যায় মোহনলাল মানুষ হতে পারে না। দুর্গে সে সময় রাজারাম আর জয়রাম ছাড়া আর কেউ ছিল না; রাজারাম সকলকে বিদেয় করে দিয়েছিলেন। তবে কার জিম্মায় সোনাদানা গচ্ছিত রাখলেন? মোহনলাল কেমন জীব?
আমিও প্রথমটা কিছু ধরতে পারছিলাম না। তারপর অজিত হঠাৎ একদিন পলাশীর যুদ্ধ আবৃত্তি করল—আবার আবার সেই কামান গর্জন-গৰ্জিল মোহনলাল...। কামান—মোহনলাল। সেকালে বড় বড় বীরের নামে কামানের নামকরণ হত। বিদ্যুতের মত মাথায় খেলে গেল মোহনলাল কে! কার জিম্মায় সোনাদানা আছে। ঐ যে মোহনলাল। ব্যোমকেশ অঙ্গুলি দিয়া ভূমিশয়ান কামানটি দেখাইল।
আমরা সকলেই উত্তেজিত হইয়াছিলাম; রামকিশোর অস্থির হইয়া বলিলেন, অ্যাঁ! তাহলে কামানের নীচে সোনা পোঁতা আছে।
কামানের নীচে নয়। সেকালে সকলেই মাটিতে সোনা পুতে রাখত; রাজারাম অমন কাঁচা কাজ করেননি। তিনি কামানের নলের মধ্যে সোনা ঢেলে দিয়ে কামানের মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ঐ যে দেখছেন কামানের মুখ থেকে শুকনো ঘাসের গোছা গলা বাড়িয়ে আছে, একশো বছর আগে সিপাহীরাও অমনি শুকনো ঘাস দেখেছিল; তারা ভাবতেও পারেনি যে ভাঙা অকর্মণ্য কামানের পেটের মধ্যে সোনা জমাট হয়ে আছে।
রামকিশোর অধীর কণ্ঠে বলিলেন, তবে আর দেরি কেন? আসুন, মাটি খুঁড়ে মোহর বের করা যাক।
ব্যোমকেশ বলিল, মোহর? মোহর কোথায়? মোহর আর নেই। রামকিশোরবাবু। রাজারাম এমন বুদ্ধি খেলিয়েছিলেন যে সিপাহীরা সন্ধান পেলেও সোনা তুলে নিয়ে যেতে পারত না।
মানে-মনে-কিছু বুঝতে পারছি না।
ব্যোমকেশ বলিল, পাণ্ডেজি, তোষাখানায় একটা উনান আর হাপর দেখেছিলেন মনে আছে? সোহাগাও একটা হাঁড়িতে ছিল। বুঝতে পারলেন? রাজারাম তাঁর সমস্ত মোহর গলিয়ে ঐ কামানের মুখে ঢেলে দিয়েছিলেন। ওর ভেতরে আছে জমাট সোনার একটা থাম।
তাহলে--তাহলে-
ওর মুখ থেকে মাটি খুঁড়ে সোনা দেখতে পাবেন হয়তো। কিন্তু বার করতে পারবেন না।
তবে উপায়?
উপায় পরে করবেন। কলকাতা থেকে অকসি-অ্যাসিটিলিন আনিয়ে কামান কাটতে হবে; তিন ইঞ্চি পুরু লোহা ছেনি বাটালি দিয়ে কাটা যাবে না। আপাতত মাটি খুঁড়ে দেখা যেতে পারে আমার অনুমান সত্যি কি না-সীতারাম!
সীতারামের হাতে লোহার তুরপুন প্রভৃতি যন্ত্রপাতি ছিল। আদেশ পাইয়া সে ঘোড়সওয়ারের মত কামানের পিঠে চড়িয়া বসিল। আমরা নীচে কামানের মুখের কাছে সমবেত হইলাম। সীতারাম মহা উৎসাহে মাটি খুঁড়িতে লাগিল।
প্রায় এক ফুট কাটিবার পর সীতারাম বলিল, হুজুর, আর কাটা যাচ্ছে না। শক্ত লাগছে!
পাণ্ডেজি বলিলেন, লাগাও তুরপুন!
সীতারাম তখন কামানের মুখের মধ্যে তুরপুন ঢুকাইয়া পাক দিতে আরম্ভ করিল। দু’চারবার ঘুরাইবার পর চাকলা চাকলা সোনার ফালি ছিটকাইয়া বাহিরে আসিয়া পড়িতে লাগিল। আমরা সকলে উত্তেজনায় দিশাহারা হইয়া কেবল অর্থহীন চীৎকার করিতে লাগিলাম।
ব্যোমকেশ হাত তুলিয়া বলিল, ব্যস, সীতারাম, এবার বন্ধ কর। আমার অনুমান যে মিথ্যা নয়। তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। রামকিশোরবাবু, দুর্গের মুখে মজবুত দরজা বসান, পাহারা বসান; যতদিন না সব সোনা বেরোয় ততদিন আপনারা সপরিবারে এসে এখানে বাস করুন। এত সোনা আলগা ফেলে রাখবেন না।
সেদিন বাসায় ফিরিতে বেলা একটা বাজিয়া গেল। ফিরিয়া আসিয়া শুনিলাম ব্যোমকেশের নামে ‘তার’ আসিয়াছে। আমাদের মুখ শুকাইয়া গেল। হঠাৎ ‘তা’র কেন? কাহার ‘তার’?--সত্যবতী ভাল আছে তো!
তারের খাম ছিঁড়িতে ব্যোমকেশের হাত একটু কাঁপিয়া গেল। আমি অদূরে দাঁড়াইয়া অপলকচক্ষে তাহার পানে চাহিয়া রহিলাম।
‘তার’ পড়িতে পড়িতে তাহার মুখখানা কেমন এক রকম হইয়া গেল; তারপর সে মুখ তুলিল। গলা ঝাড়া দিয়া বলিল, ওদিকেও সোনা।
সোনা!
হ্যাঁ ছেলে হয়েছে।
ছয় মাস পরে বৈশাখের গোড়ার দিকে কলকাতা শহরে গরম পড়ি-পড়ি করিতেছিল। একদিন সকালবেলা আমি এবং ব্যোমকেশ ভাগাভাগি করিয়া খবরের কাগজ পড়িতেছি, সত্যবতী একবাটি দুধ ও ছেলে লইয়া মেঝেয় বসিয়াছে, দুধ খাওয়ানো উপলক্ষে মাতাপুত্ৰে মল্লযুদ্ধ চলিতেছিল, এমন সময় সদর দরজায় খটখট শব্দ হইল। সত্যবতী ছেলে লইয়া পলাইবার উপক্ৰম করিল। আমি দ্বার খুলিয়া দেখি রমাপতি ও তুলসী। রমাপতির হাতে একটি চৌকশ বাক্স, গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবি, মুখে সলাজ হাসি।
তুলসীকে দেখিয়া আর চেনা যায় না। এই কয় মাসে সে রীতিমত একটা যুবতী হইয়া উঠিয়াছে। অগ্রহায়ণ মাসে তাহাদের বিবাহ উপলক্ষে আমরা নিমন্ত্রিত হইয়াছিলাম, কিন্তু যাইতে পারি নাই। ছয় মাস পরে তাহদের দেখিলাম।
তুলসী ঘরে আসিয়াই একেবারে ঝড় বহাইয়া দিল। সত্যবতীর সহিত পরিচয় করাইয়া দিবার সঙ্গে সঙ্গে সে তাহার কোল থেকে খোকাকে তুলিয়া লইয়া তাহাকে চুম্বন করিতে করিতে ঘরময় ছুটাছুটি করিল; তারপর তাহাকে রমাপতির কোলে ফেলিয়া দিয়া সত্যবতীর আঁচল ধরিয়া টানিতে টানিতে পাশের ঘরে লইয়া গেল। তাহাদের কলকাকলি ও হাসিয়া শব্দ পদ ভেদ করিয়া আমাদের কানে আসিতে লাগিল।
তুলসীর চরিত্ৰ যেন পাথরের তলায় চাপা ছিল, এখন মুক্তি পাইয়াছে। নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ। ঘর ঠাণ্ডা হইলে ব্যোমকেশ রমাপতিকে জিজ্ঞাসা করিল, বাক্স কিসের? গ্রামোফোন নাকি?
না। আমরা আপনার জন্যে একটা জিনিস তৈরি করিয়ে এনেছি,-বলিয়া রমাপতি বাক্স খুলিয়া যে জিনিসটি বাহির করিল। আমরা তাহার পানে মুগ্ধনেত্ৰে চাহিয়া রহিলাম। আগাগোড়া সোনায় গড়া দুর্গের একটি মডেল। ওজন প্রায় দুই সের, অপূর্ব কারুকার্য। আসল দুর্গের সহিত কোথাও এক তিল তফাত নাই; এমন কি কামানটি পর্যন্ত যথাস্থানে রহিয়াছে।
আমরা চমৎকৃত স্বরে বলিলাম, বাঃ!
তারপর খাওয়া-দাওয়া গল্পগাছা রঙ্গতামাসায় বেলা কাটিয়া গেল। রামকিশোরবাবুদের খবর জানা গেল, কর্তার শরীর ভালই যাইতেছে, বংশীধর নিজের জমিদারীতে বাড়ি তৈয়ারি করিয়াছে; মুরলীধর শহরে বাড়ি কিনিয়া বাস করিতেছে; গদাধর তুলসী ও রমাপতিকে লইয়া কর্তা শৈলগৃহেই আছেন; চাঁদমোহন আবার জমিদারী দেখাশুনা করিতেছেন। দুর্গটিকে সম্পূর্ণরূপে সংস্কার করানো হইতেছে। তুলসী ও রমাপতি সেখানে বাস করিবে।
অপরাহ্ণে তাহারা বিদায় লইল। বিদায়কালে ব্যোমকেশ বলিল, তুলসী, তোমার মাস্টার কেমন?
মাস্টারের দিকে কপট-কুটিল কটাক্ষপাত করিয়া তুলসী বলিল, বিচ্ছিরি।
ব্যোমকেশ বলিল, হুঁ। একদিন আমার কোলে বসে মাস্টারের জন্যে কেঁদেছিলে মনে আছে?
এবার তুলসীর লজ্জা হইল। মুখে আঁচল চাপা দিয়া সে বলিল, ধেৎ!
শেষ
No comments:
Post a Comment