লেখক : শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
১
ব্যোমকেশের শরীর সারাইবার জন্য সাঁওতাল পরগণার যে শহরে হাওয়া বদলাইতে গিয়াছিলাম, বছর না ঘুরিতেই যে আবার সেখানে যাইতে হইবে, তাহা ভাবি নাই। এবার কিন্তু স্বাস্থ্যের অন্বেষণে নয়, পুরন্দর পাণ্ডে মহাশয় যে নূতন শিকারের সন্ধান দিয়াছিলেন তাঁহারই অন্বেষণে ব্যোমকেশ ও আমি বাহির হইয়াছিলাম।
প্ৰথমবার যখন এ শহরে যাই, তখন এখানকার অনেকগুলি বাঙালীর সহিত পরিচয় হইয়াছিল, কিন্তু শহরের বাহিরেও যে একটি ধনী বাঙালী পরিবার বাস করেন, তাহা কেহ বলে নাই। এই পরিবারটিকে লইয়া এই বিচিত্ৰ কাহিনী। সুতরাং তাহার কথাই সর্বাগ্রে বলিব। সব কথা অবশ্য একসঙ্গে জানিতে পারি নাই, ছাড়া-ছাড়া ভাবে কয়েকজনের মুখে শুনিলাম। পাঠকের সুবিধার জন্য আরম্ভেই সেগুলিকে ধারাবাহিকভাবে সাজাইয়া দিলাম।
শহরের দক্ষিণ দিকে অর্থাৎ জংশন হইতে বিপরীত মুখে প্রায় ছয় মাইল পর্যন্ত একটি রাস্তা গিয়াছে। রাস্তাটি বহু পুরাতন; বাদশাহী আমলের। বড় বড় চৌকশ পাথর দিয়া আচ্ছাদিত; পাথরের ফাঁকে ফাঁকে ঘাস ও আগাছা জন্মিয়াছে, কিন্তু তবু রাস্তার উপর দিয়া মোটর চালানো যায়। দুই পাশের শিলাকৰ্কশ বন্ধুরতাকে দ্বিধা ভিন্ন করিয়া পথ এখনও নিজের কঠিন অস্তিত্ব বজায় রাখিয়াছে।
এই পথের সর্পিল গতি যেখানে গিয়া শেষ হইয়াছে সেখানে পাশাপাশি দুটি ক্ষুদ্র গিরিচূড়া। কালিদাসের বর্ণনা মনে পড়ে ‘মধ্যে শ্যামঃ স্তন ইব। ভুবঃ।” বেশি উঁচু নয়, কিন্তু দুটি চূড়ার মাঝখানে খাঁজ পড়িয়াছে। উপমা কালিদাসস্য বাদ দিলেও দৃশ্যটি লোভনীয়।
চূড়া দুটি নিরাভরণ নয়। একটির মাথায় প্রাচীন কালের এক দুর্গের ভগ্নাবশেষ; অন্যটির শীর্ষে আধুনিক কালের চুনকাম করা বাড়ি। বাড়ি এবং দুর্গের মালিক শ্রীরামকিশোর সিংহ সপরিবারে এই স্থানে বাস করেন।
এইখানে প্রাচীন দুর্গ ও তাহার আধুনিক মালিকের কিছু পরিচয় আবশ্যক। নবাব আলিবর্দীর আমলে জানকীরাম নামক জনৈক দক্ষিণ রাঢ়ী কায়স্থ নবাবের বিশেষ প্রিয়পাত্ৰ হইয়া উঠিয়াছিলেন। ইনি রাজা জানকীরাম খেতাব পাইয়া কিছুকাল সুবা বিহার শাসন করিয়াছিলেন এবং প্রভূত ধনসম্পত্তি অর্জন করিয়াছিলেন। কিন্তু দেশে তখন ক্রান্তিকাল আরম্ভ হইয়াছে; ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মোগল বাদশাহী ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে; দুর্দম মারাঠা বর্গী বারম্বার বাঙলা বিহারে হানা দিয়া চারিদিক ছারখার করিয়া দিতেছে; ইংরেজ বণিক বাণিজ্যের খোলস ছাড়িয়া রাজদণ্ডের দিকে হাত বাড়াইতেছে। দেশজোড়া অশান্তি; রাজা প্ৰজা ধনী দরিদ্র কাহারও চিত্তে সুখ নাই। রাজা জানকীরাম কুশাগ্ৰবুদ্ধি লোক ছিলেন; তিনি এই দুৰ্গম গিরি-সঙ্কটের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র দুৰ্গ তৈয়ার করাইয়া তাঁহার বিপুল ধনসম্পত্তি এবং পরিবারবর্গকে এইখানে রাখিলেন।
তারপর রাষ্ট্রবিপ্লবের প্রবল প্লাবনে অনেক কিছুই ভাসিয়া গেল। কিন্তু জানকীরামের এই নিভৃত দুর্গ নিরাপদে রহিল। তাঁহার বংশধরগণ পুরুষানুক্রমে এখানে বাস করিতে লাগিল।
পলাশীর যুদ্ধের পর আরও একশত বছর কাটিয়া গেল।
কোম্পানীর শাসনে দেশ অনেকটা ঠাণ্ডা হইয়াছে। জানকীরামের দুর্গে তাঁহার অধস্তন চতুর্থ ও পঞ্চম পুরুষ বিদ্যমান-রাজারাম ও তৎপুত্র জয়রাম। রাজারাম বয়স্থ ব্যক্তি, পুত্র জয়রাম যুবক। পিতৃপুরুষের সঞ্চিত অর্থ ও পারিপার্শ্বিক জমিদারীর আয় হইতে স্বচ্ছন্দে সংসারযাত্রা চলিতেছে। সঞ্চিত অর্থ এই কয় পুরুষে হ্রাসপ্রাপ্ত না হইয়া আরও বাড়িয়াছে। জানকীরামের বংশধরদের স্বভাব ছিল টাকা হাতে আসিলেই তাহা স্বর্ণে রূপান্তরিত করিয়া রাখা; এইভাবে রাশি রাশি মোহর আসরফি তৈজস সঞ্চিত হইয়া ছিল! কাহারও কোনও প্রকার বদখেয়াল ছিল না। এই জঙ্গলের মধ্যে বিলাস-ব্যসনের অবকাশ কোথায়?
হঠাৎ দেশে আগুন জ্বলিয়া উঠিল। সিপাহী বিদ্রোহের আগুন কেবল নগরগুলির মধ্যেই আবদ্ধ রহিল না। দাবানলের মত বনে জঙ্গলেও প্রসারিত হইল।
রাজারাম সংসারের কর্তা, তিনি উদ্বিগ্ন হইলেন। চারিদিকে লুঠতরাজ; কোথাও ইংরেজ দলের সিপাহীরা লুঠ করিতেছে, কোথাও বিদ্রোহী সিপাহীরা লুঠ করিতেছে। রাজারাম খবর পাইলেন একদল সিপাহী এইদিকে আসিতেছে। তিনি সম্পত্তি রক্ষার জন্য প্ৰস্তুত হইলেন।
কিন্তু সম্পত্তি রক্ষা করিবেন কী উপায়ে? শতবর্ষের পুরাতন দুর্গটি সুশিক্ষিত আগ্নেয়াস্ত্ৰধারী শত্রুর আক্রমণ রোধ করিতে সমর্থ নয়। দুর্গের জীৰ্ণ তোরণদ্বার একটি গোলার আঘাতেই উড়িয়া যাইবে। দুর্গে একটি বড় কামান আছে বটে, কিন্তু দীর্ঘকাল অব্যবহারের ফলে উহা মরিচা পড়িয়া অকৰ্মণ্য হইয়াছে, উহার গোড়ার দিকের লৌহকপাট এমন জাম হইয়া গিয়াছে যে খোলা যায় না। তাছাড়া যে-কয়টি গাদা বন্দুক আছে, তাহার দ্বারা জঙ্গলে হরিণ শিকার বা চোর তাড়ানো চলিতে পারে, লুণ্ঠন-লোলুপ সিপাহীর দলকে ঠেকাইয়া রাখা একেবারেই অসম্ভব।
রাজারাম উপযুক্ত পুত্রের সহিত পরামর্শ করিয়া পরিবারস্থ নারী ও শিশুদের স্থানান্তরিত করিবার ব্যবস্থা করিলেন। দুর্গ হইতে কয়েক ক্রোশ দূরে ঘন জঙ্গলের মধ্যে একটি সাঁওতাল পল্লী ছিল, স্ত্রী পুত্র-বধূ ও দুই তিনটি নাতি-নাতিনীকে সেইখানে পাঠাইয়া দিলেন। দুর্গের সমস্ত ভৃত্য ও কর্মচারী সেই সঙ্গে গেল; কেবল পুত্ৰ জয়রাম সহ রাজারাম দুর্গে রহিলেন। বিদায়কালে রাজারাম গৃহিণীর অঞ্চলে কয়েকটি মোহর বাঁধিয়া দিলেন। বেশি মোহর দিতে সাহস হইল না, কি জানি বেশি সোনার লোভে পরিচরেরাই যদি বেইমানি করে। তারপর তাহারা প্ৰস্থান করিলে পিতাপুত্র মিলিয়া সঞ্চিত সোনা লুকাইতে প্রবৃত্ত হইলেন।
তিন দিন পরে ফিরিঙ্গী নায়কের অধীনে একদল সিপাহী আসিয়া উপস্থিত হইল। রাজারামের বোধ হয় ইচ্ছা ছিল, সোনা দানা লুকাইয়া রাখিয়া নিজেও পুত্রকে লইয়া দুর্গ হইতে অন্তর্হিত হইবেন; কিন্তু তাঁহারা পলাইতে পারিলেন না। সিপাহীরা অতর্কিতে উপস্থিত হইয়া নির্বিবাদে দুর্গে প্রবেশ করিল।
তারপর দুর্গের মধ্যে কি হইল কেহ জানে না। দুই দিন পরে সিপাহীরা চলিয়া গেল। রাজারাম জয়রামকে কিন্তু ইহলোকে আর কেহ দেখিল না। শূন্য দুর্গ পড়িয়া রহিল।
ক্ৰমে দেশ শান্ত হইল। কয়েক মাস পরে রাজারামের পরিবার ও অনুচরগণ ফিরিয়া আসিয়া দেখিল দুর্গের পাথরগুলি ছাড়া আর কিছুই নাই; তুলিয়া লইয়া যাইবার মত যাহা কিছু ছিল সিপাহীরা লইয়া গিয়াছে। দুর্গের স্থানে স্থানে, এমন কি ঘরের মেঝেয় সিপাহীরা পাথর তুলিয়া গর্ত খুঁড়িয়াছে; বোধকরি ভূ-প্রোথিত ধনরত্নের সন্ধান করিয়াছে। কিছু পাইয়াছে কিনা অনুমান করা যায় না, কারণ রাজারাম কোথায় ধনরত্ন লুকাইয়া রাখিয়াছিলেন তাহা কেবল তিনি এবং জয়রাম জানিতেন। হয়তো সিপাহীরা সব কিছুই লুটিয়া লইয়া গিয়াছে; হয়তো কিছুই পায় নাই, তাই পিতাপুত্রকে হত্যা করিয়া চলিয়া গিয়াছে।
অসহায়া দুইটি নারী কয়েকটি শিশুকে লইয়া কিছুকাল দুর্গে রহিল, কিন্তু যে দুর্গ একদিন গৃহ ছিল তাহা এখন শ্মশান হইয়া উঠিয়াছে। ক্ৰমে ভৃত্য ও কর্মচারীরা একে একে খসিয়া পড়িতে লাগিল; কারণ সংসারযাত্রা নির্বাহের জন্য শুধু গৃহই যথেষ্ট নয়, অন্নবস্ত্রেরও প্রয়োজন। অবশেষে একদিন দুইটি বিধবা শিশুগুলির হাত ধরিয়া দুৰ্গ হইতে বাহির হইয়া পড়িল। তাহারা কোথায় গিয়া আশ্রয় পাইল তাহার কোনও ইতিহাস নাই। সম্ভবত বাংলা দেশে কোনও দূর আত্মীয়ের ঘরে আশ্রয় পাইল। পরিত্যক্ত দুর্গ শৃগালের বাসভূমি হইল।
অতঃপর প্রায় ষাট বছর এই বংশের ইতিহাস অন্ধকারে আচ্ছন্ন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে বংশের দুইটি যুবক আবার মাথা তুলিলেন। রামবিনোদ ও রামকিশোর সিংহ দুই ভাই। দারিদ্র্যের মধ্যে তাঁহারা মানুষ হইয়াছিলেন, কিন্তু বংশের ঐতিহ্য ভোলেন নাই। দুই ভাই ব্যবসা আরম্ভ করিলেন, এতদিন পরে কমলা আবার তাঁহাদের প্রতি মুখ তুলিয়া চাহিলেন। প্রথমে ঘৃতের, পরে লোহার কারবার করিয়া তাঁহারা লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করিলেন।
বড় ভাই রামবিনোদ। কিন্তু বেশিদিন বাঁচিলেন না। যৌবন কালেই হঠাৎ রহস্যময়ভাবে তাঁহার মৃত্যু হইল। রামকিশোর একাই ব্যবসা চালাইলেন এবং আরও অর্থ অর্জন করিলেন।
দিন কাটিতে লাগিল। রামকিশোর বিবাহ করিলেন, তাঁহার পুত্রকন্যা জন্মিল। তারপর বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের শেষে রামকিশোর প্রাচীন কালের পৈতৃক সম্পত্তি পুনরায় ক্রয় করিয়া দুর্গের পাশের দ্বিতীয় চূড়ায় নূতন গৃহ নির্মাণ করাইলেন, আশেপাশে বহু জমিদারী কিনিলেন এবং সপরিবারে শৈল-গৃহে বাস করিতে লাগিলেন। দুর্গটিকেও পূর্ব গৌরবের স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ অল্প-বিস্তর মেরামত করানো হইল; কিন্তু তাহা আগের মতই অব্যবহৃত পড়িয়া রহিল।
২
পাথরের পাটি বসানো সাবেক পথটি গিরিচূড়ার পদমূলে আসিয়া শেষ হয় নাই কিছুদূর চড়াই উঠিয়াছে। যেখানে চড়াই আরম্ভ হইয়াছে, সেখানে পাথরের ধারে একটি বৃহৎ কৃপ। কুপের সরসতায় পুষ্ট হইয়া কয়েকটি বড় বড় গাছ তাহার চারিপাশে ব্যুহরচনা করিয়াছে।
এখান হইতে রাস্তা প্রায় পঞ্চাশ গজ চড়াই উঠিয়া দেউড়ির সম্মুখে শেষ হইয়াছে। তারপর পাথর-বাঁধানো সিঁড়ি সর্পজিহ্বার মত দুই ভাগ হইয়া দুই দিকে গিয়াছে; একটি গিয়াছে দুর্গের তোরণদ্বার পর্যন্ত, অন্যটি রামকিশোরের বাসভবনে উপনীত হইয়াছে।
দেউড়িতে মোটর রাখিবার একটি লম্বা ঘর এবং চালকের বাসের জন্য ছোট ছোট দুটি কুঠুরি। এখানে রামকিশোরের সাবেক মোটর ও তাহার সাবেক চালক বুলাকিলাল থাকে।
এখান হইতে সিঁড়ির যে ধাপগুলি রামকিশোরের বাড়ির দিকে উঠিয়াছে, সেগুলি একেবারে খাড়া ওঠে নাই, একটু ঘুরিয়া পাহাড়ের অঙ্গ বেড়িয়া উঠিয়াছে। চওড়া সিঁড়িগুলি বাড়ির সদর পর্যন্ত পৌঁছিয়াছে।
পাহাড়ের মাথার উপর জমি চৌরস করিয়া তাহার মাঝখানে বৃহৎ বাড়ি। বাড়ি ঘিরিয়া ফল-ফুলের বাগান, বাগান ঘিরিয়া ফণি-মনসার বেড়া। এখানে দাঁড়াইলে পাশেই শত হস্ত দূরে সর্বোচ্চ শিখরে ধূম্ৰবৰ্ণ দুর্গ দেখা যায়, উত্তরদিকে ছয় মাইল দূরে শহরটি অস্পষ্টভাবে চোখে পড়ে। দক্ষিণে চড়াইয়ের মূলদেশ হইতে জঙ্গল আরম্ভ হইয়াছে; যতদূর দৃষ্টি যায় নিবিড় তরুশ্রেণী। এ জঙ্গলটিও রামকিশোরের সম্পত্তি। শাল সেগুন আবলুস কাঠ হইতে বিস্তর আয় হয়।
রামকিশোর যখন প্রথম এই গৃহে অধিষ্ঠিত হইলেন, তখন তাঁহার বয়স চল্লিশের নীচেই; শরীরও বেশ মজবুত এবং নীরোগ। তথাপি অর্থপার্জনের জন্য দৌড়াদৌড়ির আর প্রয়োজন নাই বলিয়াই বোধ করি তিনি স্বেচ্ছায় এই অজ্ঞাতবাস বরণ করিয়া লইলেন। তাঁহার সঙ্গে আসিলেন তাঁহার স্ত্রী, দুইটি পুত্র, একটি কন্যা, বহু চাকর-বাকর এবং প্রবীণ নায়েব চাঁদমোহন দত্ত।
ক্রমে রামকিশোরের আর একটি পুত্র ও কন্যা জন্মিল। তারপর তাঁহার স্ত্রী গত হইলেন। পাঁচটি পুত্ৰ-কন্যার লালন-পালনের ভার রামকিশোরের উপর পড়িল।
পুত্ৰ-কন্যারা বড় হইয়া উঠিতে লাগিল। রামকিশোর কিন্তু পারিবারিক জীবনে সুখী হইতে পারিলেন না। বড় হইয়া ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পুত্ৰ-কন্যাগুলির স্বভাব প্রকটিত হইয়া উঠিতে লাগিল। এই বন্য স্থানে সকল সংসৰ্গ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া থাকার ফলে হয়তো তাহদের চরিত্র বিকৃত হইয়াছিল। বড় ছেলে বংশীধর দুর্দান্ত ক্রোধী, রাগ হইলে তাহার আর কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। সে স্থানীয় স্কুলে ম্যাট্রিক পাশ করিয়া বহরমপুর কলেজে পড়িতে গেল। কিন্তু কয়েক মাস পরেই সেখানে কি একটা অতি গৰ্হিত দুষ্কর্ম করার ফলে তাহাকে কলেজ ছাড়িতে হইল। কলেজের কর্তৃপক্ষ তাহার দুষ্কৃতির স্বরূপ প্রকাশ করিলেন না; কলেজের একজন অধ্যাপক ছিলেন রামকিশোরের বাল্যবন্ধু, তিনি ব্যাপারটাকে চাপা দিলেন। এমন কি রামকিশোরও প্রকৃত ব্যাপার জানিতে পারিলেন না। তিনি জানিতে পারিলে হয়তো অনর্থ ঘটিত।
বংশীধর আবার বাড়িতে আসিয়া বসিল। বাপকে বলিল, সে আর লেখাপড়া করিবে না, এখন হইতে জমিদারী দেখাশুনা করিবে। রামকিশোর বিরক্ত হইয়া বকাবকি করিলেন, কিন্তু ছেলের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করিলেন না। বংশীধর জমিদারী তত্ত্বাবধান করিতে লাগিল। নায়েব চাঁদমোহন দত্ত হাতে ধরিয়া তাহাকে কাজ শিখাইলেন।
যথাসময়ে রামকিশোর বংশীধরের বিবাহ দিলেন। কিন্তু বিবাহের কয়েক মাস পরেই বধূর অপঘাত মৃত্যু হইল। বংশীধর গৃহে ছিল না, জমিদারী পরিদর্শনে গিয়াছিল। একদিন সকালে বধূকে গৃহে পাওয়া গেল না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর দুই চূড়ার মধ্যবর্তী খাঁজের মধ্যে তাহার মৃতদেহ পাওয়া গেল! বধূ বোধ করি রাত্রে কোনও কারণে নিজের ঘর হইতে বাহির হইয়া খাদের কিনারায় গিয়াছিল, তারপর পা ফস্কাইয়া নীচে পড়িয়াছে। মৃত্যু রহস্যজনক। বংশীধর ফিরিয়া আসিয়া বধূর মৃত্যুর সংবাদে একেবারে ফাটিয়া পড়িল; উন্মত্ত ক্রোধে ভাই বোন কাহাকেও সে দোষারোপ করিতে বিরত হইল না। ইহার পর হইতে তাহার ভীষণ প্রকৃতি যেন ভীষণতর হইয়া উঠিল।
রামকিশোরের দ্বিতীয় পুত্র মুরলীধর; বংশীধরের চেয়ে বছর দেড়েকের ছোট। গিরগিটির মত রোগা হাড়-বাহির করা চেহারা, ধূর্তামিভরা ছুচালো মুখ; চোখ এমন সাংঘাতিক ট্যারা যে, কখন কোন দিকে তাকাইয়া আছে বুঝিতে পারা যায় না। তার উপর মেরুদণ্ডের ন্যুব্জতা শীর্ণ দেহটাকে ধনুকের মত বাঁকাইয়া দিয়াছে। মুরলীধর জন্মাবধি বিকলাঙ্গ। তাহার চরিত্রও বংশীধরের বিপরীত; সে রাগী নয়, মিটমিটে শয়তান। কিশোর বয়সে দুই ভায়ে একবার ঝগড়া হইয়াছিল, বংশী মুরলীর গালে একটি চড় মারিয়াছিল। মুরলীর গায়ে জোর নাই। সে তখন চড় হজম করিয়াছিল; কিন্তু কয়েকদিন পরে বংশী হঠাৎ এমন ভেদবমি আরম্ভ করিল যে যায়—যায় অবস্থা। এ ব্যাপারে মুরলীর যে কোনও হাত আছে তাহা ধরা গেল না; কিন্তু তদবধি বংশী আর কোনও দিন তাহার গায়ে হাত তুলিতে সাহস করে নাই। তর্জন গর্জন করিয়াই ক্ষান্ত হইয়াছে।
মুরলীধর লেখাপড়া শেখে নাই, তার উপর ওই চেহারা; বাপ তাহার বিবাহ দিলেন না। সে আপন মনে থাকে এবং দিবারাত্ৰ পান-সুপারি চিবায়। তাহার একটি খাস চাকর আছে, নাম গণপৎ। গণপৎ মুরলীধরেরই সমবয়স্ক; বেঁটে নিরেট চেহারা, গোল মুখ, চক্ষু দুটিও গোল, ভ্রুযুগল অর্ধচন্দ্ৰাকৃতি। তাহার মুখ দেখিয়া মনে হয় সে সর্বদাই শিশুসুলভ বিস্ময়ে আবিষ্ট হইয়া আছে। অথচ তাহার মত দুষ্ট খুব কম দেখা যায়। এমন দুষ্কর্ম নাই যাহা গণপতের অসাধ্য; নারীহরণ হইতে গৃহদাহ পর্যন্ত, প্রভুর আদেশ পাইলে সে সব কিছুই করিতে পারে। প্রভু-ভৃত্যের অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ। শোনা যায়, ইহারা দুইজনে মিলিয়া অনেক দুষ্কৃতি করিয়াছে, কিন্তু কখনও ধরা পড়ে নাই।
রামকিশোরের তৃতীয় সন্তানটি কন্যা, নাম হরিপ্রিয়া। সে মুরলীধর অপেক্ষা বছর চারেকের ছোট; দেখিতে শুনিতে ভালই, কোনও শারীরিক বিকলতা নাই। কিন্তু তাহার চোখের দৃষ্টি যেন বিষমাখানো। মনও ঈর্ষার বিষে ভরা। হরিপ্রিয়া নিজের ভাই-বোনদের দুচক্ষে দেখিতে পারিত না। সকলের ছিদ্রান্বেষণ, পান হইতে চুন খসিলে তীব্ৰ অসন্তোষ এবং তদুপযোগী বচন-বিন্যাস, এই ছিল হরিপ্রিয়ার স্বভাব। বংশীধরের বিবাহের পর যখন নববধূ ঘরে আসিল, তখন হরিপ্রিয়ার ঈর্ষার জ্বালা দ্বিগুণ বাড়িয়া গেল। বধূটি ভালোমানুষ ও ভীরু স্বভাব; হরিপ্রিয়া পদে পদে তাহার খুঁত ধরিয়া তাহাকে অপদস্থ করিয়া বাক্যবাণে জর্জর করিয়া তুলিল।
তারপর অকস্মাৎ বধূর মৃত্যু হইল। এই দুর্যোগ কাটিয়া যাইবার কয়েক মাস পরে রামকিশোর কন্যার বিবাহ দিলেন। শ্বশুর-ঘর করিতে পরিবে না বুঝিয়া তিনি দেখিয়া শুনিয়া একটি গরীব ছেলের সঙ্গে তাহার বিবাহ দিলেন। ছেলেটির নাম মণিলাল; লেখাপড়ায় ভাল, বি. এস-সি. পাস করিয়াছে; স্বাস্থ্যবান, শান্ত প্রকৃতি, বিবাহের পর মণিলাল শ্বশুর গৃহে আসিয়া অধিষ্ঠিত হইল।
হরিপ্রিয়া ও মণিলালের দাম্পত্য জীবন সুখের হইল কিনা বাহির হইতে বোঝা গেল না। মণিলাল একেই চাপা প্রকৃতির যুবক, তার উপর দরিদ্র ঘরজামাই; অ-সুখের কারণ ঘটিলেও সে নীরব রহিল। হরিপ্রিয়াও নিজের স্বামীকে অন্যের কাছে লঘু করিল না। বরং তাহার ভ্রাতারা মণিলালকে লইয়া ঠাট্টা-তামাসা করিলে সে ফোঁস করিয়া উঠিত।
একটি বিষয়ে নবদম্পতির মধ্যে প্রকাশ্য ঐক্য ছিল। মণিলাল বিবাহের পর শ্বশুরের বিশেষ অনুরক্ত হইয়া পড়িয়াছিল। শ্যালকদের সহিত তাহার সম্পর্ক ছিল সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত, কাহারও প্রতি অনুরাগ বিরাগ ছিল না; কিন্তু শ্বশুরের প্রতি যে তাহার অসীম শ্রদ্ধা-ভক্তি আছে তাহা তাহার প্রতি বাক্যে ও আচরণে প্রকাশ পাইত। হরিপ্রিয়াও পিতাকে ভালবাসিত; পিতাকে ছাড়া আর কাহাকেও বোধ হয় সে অন্তরের সহিত ভালবাসিত না। ভালবাসিবার শক্তি হরিপ্রিয়ার খুব বেশি ছিল না।
হরিপ্রিয়ার পর দুটি ভাই বোন; কিশোর বয়স্ক গদাধর এবং সর্বকনিষ্ঠা তুলসী। গদাধর একটু হাবলা গোছের, বয়সের অনুযায়ী বুদ্ধি পরিণত হয় নাই। কাছ কোঁচার ঠিক থাকে না, অকারণে হি হি করিয়া হাসে। লেখাপড়ায় তাহারও মন নাই; গুলতি লইয়া বনে পাখি শিকার করিয়া বেড়ানো তাহার একমাত্র কাজ।
এই কাজে ছোট বোন তুলসী তাহার নিত্য সঙ্গিনী। তুলসীর বুদ্ধি কিন্তু গদাধরের মত নয়, বরং বয়সের অনুপাতে একটু বেশি। ছিপছিপে শরীর, সুশ্ৰী পাতলা মুখ, অত্যন্ত চঞ্চল প্রকৃতি। দুপুরবেলা জঙ্গলের মধ্যে পাখির বাসা বা খরগোশের গর্ত খুঁজিয়া বেড়ানো এবং সকল বিষয়ে গদাধরের অভিভাবকতা করা তাহার কাজ। বাড়িতে কে কোথায় কি করিতেছে কিছুই তুলসীর চক্ষু এড়ায় না। সে কখন কোথায় থাকে তাহাও নির্ণয় করা কাহারও সাধ্য নয়। তবু সব ভাইবোনের মধ্যে তুলসীকেই বোধ হয় অপেক্ষাকৃত সহজ ও প্রকৃতিস্থ বলা চলে।
রামকিশোরের সংসারে পুত্রকন্যা ছাড়া আর একটি পোষ্য ছিল যাহার পরিচয় আবশ্যক। ছেলেটির নাম রমাপতি। দুঃস্থ স্বজাতি দেখিয়া রামকিশোর তাহাকে আশ্রয় দিয়াছিলেন। রমাপতি ম্যাট্রিক পাস; সে গদাধর ও তুলসীকে পড়াইবে এই উদ্দেশ্যেই রামকিশোর তাহাকে গৃহে রাখিয়াছিলেন। রমাপতির চেষ্টার ক্রটি ছিল না, কিন্তু ছাত্রছাত্রীর সহিত মাস্টারের সাক্ষাৎকার বড় একটা ঘটিয়া উঠিত না। রমাপতি মুখচোরা ও লাজুক স্বভাবের ছেলে, ছাত্রছাত্রী তাহাকে অগ্রাহ্য করিত; বাড়ির অন্য সকলে তাহার অকিঞ্চিৎকর অস্তিত্ব লক্ষ্যই করিত না। এমনিভাবে দু’বেলা দুমুঠি অন্ন ও আশ্রয়ের জন্য রমাপতি বাড়ির এক কোণে পড়িয়া থাকিত।
নায়েব চাঁদমোহন দত্তের উল্লেখ পূর্বেই হইয়াছে। তিনি রামকিশোর অপেক্ষা পাঁচ-ছয় বছরের বড়; রামকিশোরের কর্ম-জীবনের আরম্ভ হইতে তাঁহার সঙ্গে আছেন। বংশীধর জমিদারী পরিচালনার ভার নিজ হস্তে গ্রহণ করিবার পর তাঁহার একপ্রকার ছুটি হইয়াছিল। কিন্তু তিনি কাজকর্মের দিকে সতর্কদৃষ্টি রাখিতেন; আয় ব্যয় হিসাব নিকাশ সমস্তই তাঁহার অনুমোদনের অপেক্ষা রাখিত। লোকটি অতিশয় হুঁশিয়ার ও বিষয়জ্ঞ; দীর্ঘকাল একত্ৰ থাকিয়া বাড়ির একজন হইয়া গিয়াছিলেন।
রামকিশোর পারিবারিক জীবনে সুখী হইতে পারেন নাই সত্য, কিন্তু স্নেহের বশে এবং বয়োধর্মে মানুষের সহনশীলতা বৃদ্ধি পায়। যৌবনকালে তাঁহার প্রকৃতি দুৰ্জয় ও অসহিষ্ণু ছিল, এখন অনেকটা নরম হইয়াছে। পূর্বে পুরুষকারকেই চূড়ান্ত বলিয়া মানিতেন, এখন অদৃষ্টকে একেবারে অস্বীকার করেন না। ধর্মকর্মের প্রতি অধিক আসক্তি না থাকিলেও ঠাকুরদেবতার প্রতি অশ্রদ্ধা প্ৰদৰ্শন করেন না। তাঁহার স্ত্রী ছিলেন গোঁড়া বৈষ্ণব বংশের মেয়ে, হয়তো তাঁহার প্রভাব রামকিশোরের জীবনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয় নাই। অন্তত পুত্রকন্যাদের নামকরণের মধ্যে সে প্রভাবের ছাপ রহিয়া গিয়াছে।
তবু, কদাচিৎ কোনও কারণে ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটিলে তাঁহার প্রচণ্ড অন্তঃপ্রকৃতি বাহির হইয়া আসিত, কলসীর মধ্যে আবদ্ধ দৈত্যের মত কঠিন হিংস্ৰ ক্ৰোধ প্রকাশ হইয়া উঠিত। তখন তাঁহার সম্মুখে কেহ দাঁড়াইতে পারিত না, এমন কি বংশীধর পর্যন্ত ভয়ে পিছাইয়া যাইত। তাঁহার ক্ৰোধ কিন্তু বেশিক্ষণ স্থায়ী হইত না, দপ করিয়া জ্বলিয়া আবার দপ করিয়া নিভিয়া যাইত।
৩
হরিপ্রিয়ার বিবাহের আট-নয় মাস পরে শীতের শেষে একদল বেদে-বেদেনী আসিয়া কুয়ার সন্নিকটে আস্তানা গাড়িল। তাঁহাদের সঙ্গে একপাল গাধা কুকুর মুরগী সাপ প্রভৃতি জন্তুজানোয়ার। তাহারা রাত্রে ধুনি জ্বালিয়া মদ্যপান করিয়া মেয়ে-মদ্দ নাচগান হুল্লোড় করে, দিনের বেলা জঙ্গলে কাঠ কাটে, ফাঁদ পাতিয়া বনমোরগ খরগোশ ধরে, কূপের জল যথেচ্ছা ব্যবহার করে। বেদে জাতির নীতিজ্ঞান কোনও কালেই খুব প্রখর নয়।
রামকিশোর প্রথমটা কিছু বলেন না, কিন্তু ক্ৰমে উত্যক্ত হইয়া উঠিলেন। সবচেয়ে আশঙ্কার কথা, গদাধর ও তুলসী আহার নিদ্ৰা ত্যাগ করিয়া বেদের তাঁবুগুলির আশেপাশে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল, অনেক শাসন করিয়াও তাঁহাদের বিনিদ্র কৌতুহল দমন করা গেল না। বাড়ির বয়স্থ লোকেরা অবশ্য প্রকাশ্যে বেদে-পল্লীকে পরিহার করিয়া চলিল; কিন্তু রাত্রির অন্ধকারে বাড়ির চাকর-বাকর এবং মালিকদের মধ্যে কেহ কেহ যে সেখানে পদার্পণ করিত তাহা অনুমান করা যাইতে পারে। বেদেনী যুবতীদের রূপ যত না থাক মোহিনী শক্তি আছে।
হপ্তাখানেক এইভাবে কাটিবার পর একদিন কয়েকজন বেদে-বেদেনী একেবারে রামকিশোরের সদরে আসিয়া উপস্থিত হইল এবং শিলাজিৎ, কস্তুরী মৃগের নাভি, সাপের বিষ, গন্ধকমিশ্র সাবান প্রভৃতির পসরা খুলিয়া বসিল। বংশীধর উপস্থিত ছিল, সে মার-মার করিয়া তাহাদের তাড়াইয়া দিল। রামকিশোর হুকুম দিলেন, আজই যেন তাহারা এলাকা ছাড়িয়া চলিয়া যায়।
বেদেরা এই আদেশ পালন করিলা বটে, কিন্তু পুরাপুরি নয়। সন্ধ্যার সময় তাহারা ডেরাডাণ্ডা তুলিয়া দুই তিন শত গজ দূরে জঙ্গলের কিনারায় গিয়া আবার আস্তানা গাড়িল। পরদিন সকালে বংশীধর তাহা দেখিয়া একেবারে অগ্নিশর্মা হইয়া উঠিল। বন্দুক লইয়া সে তাঁবুতে উপস্থিত হইল, সঙ্গে কয়েকজন চাকর। বংশীধরের হুকুম পাইয়া চাকরেরা বেদেদের পিটাইতে আরম্ভ করিল, বংশীধর বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজ করিল। এবার বেদেরা সত্যই এলাকা ছাড়িয়া পলায়ন করিল।
আপদ দূর হইল বটে, কিন্তু নায়েব চাঁদমোহন মাথা নাড়িয়া বলিলেন, কাজটা বোধহয় ভাল হল না। ব্যাটারা ভারি শয়তান, হয়তো অনিষ্ট করবার চেষ্টা করবে।
বংশীধর উদ্ধতভাবে বলিল, কি অনিষ্ট করতে পারে ওরা?
চাঁদমোহন বলিলেন, তা কি বলা যায়। হয়তো কুয়োয় বিষ ফেলে দিয়ে যাবে, নয়তো জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে দেবে--
কিছুদিন সকলে সতর্ক রহিলেন, কিন্তু কোনও বিপদাপদ ঘটিল না। বেদেরা কোনও প্রকার অনিষ্ট করিবার চেষ্টা করে নাই, কিম্বা করিলেও তাহা ফলপ্রসূ হয় নাই।
মাসখানেক পরে রামকিশোর পরিবারবর্গকে লইয়া জঙ্গলের মধ্যে বনভোজনে গেলেন। ইহা তাঁহার একটি বাৎসরিক অনুষ্ঠান। বনের মধ্যে চাঁদোয়া টাঙানো হয়; ভৃত্যেরা কাঠ কাটিয়া রন্ধন করে; ছেলেরা বন্দুক লইয়া জঙ্গলের মধ্যে পশুপক্ষীর সন্ধানে ঘুরিয়া বেড়ায়। কর্তা চাঁদোয়ার তলে বসিয়া চাঁদমোহনের সঙ্গে দুচার বাজি দাবা খেলেন। তারপর অপরাহ্নে সকলে গৃহে ফিরিয়া আসেন।
সকালবেলা দলবল লইয়া রামকিশোর উদ্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হইলেন। ঘন শালবনের মধ্যে একটি স্থান পরিষ্কৃত হইয়াছে; মাটির উপর শতরঞ্চি পাতা, মাথার উপর চন্দ্ৰাতপ। পাচক উনান জ্বালিতেছে, চাকর-বাকর রান্নার উদ্যোগ করিতেছে। মোটর চালক বুলাকিলাল একরাশ সিদ্ধির পাতা লইয়া হামানদিস্তায় কুটিতে বসিয়াছে, বৈকালে ভাঙের সরবৎ হইবে। আকাশে স্বর্ণাভ রৌদ্র, শালবনের ছায়ায় স্নিগ্ধ হইয়া বাতাস মৃদুমন্দ প্রবাহিত হইতেছে। কোথাও কোনও দুর্লক্ষণের চিহ্নমাত্র নাই।
দুই বৃদ্ধ চন্দ্ৰাতপতলে বসিয়া দাবার ছক পাতিলেন; আর সকলে বনের মধ্যে এদিক ওদিক অদৃশ্য হইয়া গেল। বংশীধর বন্দুক কাঁধে ফেলিয়া এক দিকে গেল, মুরলীধর নিত্যসঙ্গী গণপৎকে লইয়া অন্য দিকে শিকার সন্ধানে গেল। দু’জনেই ভাল বন্দুক চালাইতে পারে। গদাধর ও তুলসী একসঙ্গে বাহির হইল; মাস্টার রমাপতি দূরে দূরে থাকিয়া তাহাদের অনুসরণ করিল। কারণ ঘন জঙ্গলের মধ্যে বালকবালিকাদের পথ হারানো অসম্ভব নয়। রামকিশোর বলিয়া দিয়াছিলেন, ওদের চোখে চোখে রেখো।
জামাই মণিলাল একখানা বই লইয়া আস্তানা হইতে কিছু দূরে একটা গাছের আড়ালে গিয়া বসিল। রামকিশোর তাহাকে তন্ত্র সম্বন্ধে একটি ইংরেজি বই দিয়াছিলেন, তাহাই সে মনোযোগের সহিত দাগ দিয়া পড়িতেছিল। তাহার শিকারের শখ নাই।
বাকি রহিল কেবল হরিপ্রিয়া। সে কিছুক্ষণ রান্নার আয়োজনের আশেপাশে ঘুরিয়া বেড়াইল, একবার স্বামীর গাছতলার দিকে গেল, তারপর একাকিনী বনের মধ্যে প্ৰবেশ করিল। আজ একদিনের জন্য সকলে স্বাধীন হইয়াছে; একই বাড়িতে এতগুলো লোক একসঙ্গে থাকিয়া যেন পরষ্পরের সান্নিধ্যে হাঁপাইয়া উঠিয়াছিল, তাই বনের মধ্যে ছাড়া পাইয়া একটু নিঃসঙ্গতা উপভোগ করিয়া লইতেছে।
বেলা বাড়িতে লাগিল। দুই বৃদ্ধ খেলায় মগ্ন হইয়া গিয়াছেন, জঙ্গলের অভ্যন্তর হইতে থাকিয়া থাকিয়া বন্দুকের আওয়াজ ভাসিয়া আসিতেছে, রন্ধনের সুগন্ধ বাতাস আমোদিত করিয়া তুলিয়াছে। গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে গিরিচূড়ার চুনকাম করা বাড়ি এবং ভাঙা দুর্গ দেখা যাইতাছে। বেশি দূর নয়, বড় জোর আধ মাইল। ভাঙা দুর্গের ছায়া মাঝের খাদ লঙ্ঘন করিয়া সাদা বাড়ির উপর পড়িয়াছে।
হঠাৎ একটা তীব্র একটানা চীৎকার অলস বনমর্মরকে ছিন্নভিন্ন করিয়া দিল। দাবা খেলোয়াড় দুইজন চমকিয়া চোখ তুলিলেন। গাছের তলায় মণিলাল বই ফেলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। দেখা গেল, তুলসী শালবনের আলোছায়ার ভিতর দিয়া উর্দ্ধশ্বাসে ছুটিয়া আসিতেছে এবং তারস্বরে চীৎকার করিতেছে।
তুলসী চাঁদোয়া পর্যন্ত পৌঁছবার পূর্বেই মণিলাল তাহাকে ধরিয়া ফেলিল, তাহার কাঁধে একটা প্রবল ঝাঁকানি দিয়া বলিল, এই তুলসী! কি হয়েছে! চেঁচাচ্ছিস কেন?
তুলসী পাগলের মত ঘোলাটে চোখ তুলিয়া ক্ষণেক চাহিয়া রহিল, তারপর আগের মতই চীৎকার করিয়া বলিল, দিদি! গাছতলায় পড়ে আছে-বোধহয় মরে গেছে! শীগগির এসো-বাবা, জেঠামশাই, শীগগির এসো।
তুলসী যেদিক হইতে আসিয়াছিল। আবার সেই দিকে ছুটিয়া চলিল; মণিলালও তাহার সঙ্গে সঙ্গে ছুটিল। দুই বৃদ্ধ আলুথালুভাবে তাঁহাদের অনুসরণ করিলেন।
প্রায়-দুইশত গজ দূরে ঘন গাছের ঝোপ; তুলসী ঝোপের কাছে আসিয়া একটা গাছের নীচে অঙ্গুলি নির্দেশ করিল। হরিপ্রিয়া বাসন্তী রঙের শাড়ি পরিয়া আসিয়াছিল, দেখা গেল সে ছায়াঘন গাছের তলায় পড়িয়া আছে, আর কে একটা লোক তাহার শরীরের উপর ঝুঁকিয়া নিরীক্ষণ করিতেছে।
পদশব্দ শুনিয়া রমাপতি উঠিয়া দাঁড়াইল। তাহার মুখ ভয়ে শীর্ণ, সে স্থলিত স্বরে বলিল, সাপ! সাপে কামড়েছে।
মণিলাল তাহাকে ঠেলিয়া দূরে সরাইয়া দিল, তারপর দুই বাহু দ্বারা হরিপ্রিয়াকে তুলিয়া লইল। হরিপ্রিয়ার তখন জ্ঞান নাই। বাঁ পায়ের গোড়ালির উপর সাপের দাঁতের দাগ; পাশাপাশি দুটি রক্তবর্ণ চিহ্ন।
৪
হরিপ্রিয়া বাঁচিল না, বাড়িতে লইয়া যাইতে যাইতে পথেই তাহার মৃত্যু হইল।
জঙ্গলে ইতিপূর্বে কেহ বিষধর সাপ দেখে নাই। এবারও সাপ চোখে দেখা গেল না বটে, কিন্তু সাপের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ রহিল না; এবং ইহা যে বেদেদের কাজ, তাহারাই প্ৰতিহিংসা চরিতার্থ করিবার উদ্দেশ্যে জঙ্গলে সাপ কিম্বা সাপের ডিম ছাড়িয়া দিয়া গিয়াছে, তাহাও একপ্রকার স্বতঃসিদ্ধ হইয়া পড়িল। কিন্তু বেদের দল তখন বহুদূরে চলিয়া গিয়াছে, তাহাদের সন্ধান পাওয়া গেল না।
হরিপ্রিয়ার মৃত্যুর পর কিছুদিন রামকিশোরের বাড়ির উপর অভিশাপের মত একটা থমথমে ছায়া চাপিয়া রহিল। রামকিশোর তাঁহার সকল সন্তানদের মধ্যে হরিপ্রিয়াকেই বোধহয় সবচেয়ে বেশি ভালবাসিতেন; তিনি দারুণ আঘাত পাইলেন। মণিলাল অতিশয় সম্বৃতচরিত্র যুবক, কিন্তু সেও এই আকস্মিক বিপর্যয়ে কেমন যেন উদভ্ৰান্ত দিশহারা হইয়া গেল। অপ্রত্যাশিত ভূমিকম্পে তাহার নবগঠিত জীবনের ভিত্তি একেবারে ধ্বংসিয়া গিয়াছিল।
আর একজন এই অনৰ্থপাতে গুরুতরভাবে অভিভূত হইয়াছিল, সে তুলসী। তুলসী যে তাহার দিদিকে খুব বেশি ভালবাসিত তা নয়, বরং দুই বোনের মধ্যে খিটিমিটি লাগিয়াই থাকিত। হরিপ্রিয়া সুযোগ পাইলেই তুলসীকে শাসন করিত, ঘরে বন্ধ করিয়া রাখিত। তবু, হরিপ্রিয়ার মৃত্যু চোখের সামনে দেখিয়া তুলসী কেমন যেন বুদ্ধিভ্রষ্ট হইয়া পড়িয়াছিল। সেদিন বনের মধ্যে বেড়াইতে বেড়াইতে সে অদূরে গাছতলায় হলুদবৰ্ণ শাড়ি দেখিয়া সেই দিকে গিয়াছিল; তারপর দিদিকে ঐভাবে পড়িয়া থাকিতে দেখিয়া ভীতভাবে ডাকাডাকি করিয়াছিল। হরিপ্রিয়া কেবল একবার চোখ মেলিয়া চাহিয়াছিল, কথা বলিবার চেষ্টা করিয়াছিল।
সেই হইতে তুলসীর ধন্দ লাগিয়া গিয়াছিল। ভূতগ্ৰস্তের মত শঙ্কিত চক্ষু মেলিয়া সে বাড়িময় ঘুরিয়া বেড়াইত; কেহ কিছু জিজ্ঞাসা করিলে ফ্যাল ফ্যাল করিয়া চাহিয়া থাকিত। তাহার অপরিণত স্নায়ুমণ্ডলীর উপর যে কঠিন আঘাত লাগিয়াছিল তাহাতে সন্দেহ নাই।
বংশীধর এবং মুরলীধরও ধাক্কা পাইয়াছিল। কিন্তু এতটা নয়। বংশীধর গুম হইয়া গিয়াছিল; মনে মনে সে হয়তো হরিপ্রিয়ার মৃত্যুর জন্য নিজেকে দোষী করিতেছিল; বেদেদের উপর অতটা জুলুম না করিলে বোধ হয় এ ব্যাপার ঘটিত না। মুরলীধরের বাহ্য চালচলনে কোনও পরিবর্তন দেখা যায় নাই বটে। কিন্তু সেও কচ্ছপের মত নিজেকে নিজের মধ্যে গুটাইয়া লইয়াছিল। দুই ভ্ৰাতার মধ্যে কেবল একটি বিষয়ে ঐক্য হইয়াছিল, দুইজনেই মণিলালকে বিষচক্ষে দেখিতে আরম্ভ করিয়াছিল। যেন হরিপ্রিয়ার মৃত্যুর জন্য মণিলালই দায়ী।
হরিপ্রিয়ার মৃত্যুর একমাস পরে মণিলাল রামকিশোরের কাছে গিয়া বিদায় চাহিল। এ সংসারের সহিত তাহার সম্পর্ক ঘুচিয়া গিয়াছে, এই কথার উল্লেখ করিয়া সে সজল চক্ষে বলিল, আপনার স্নেহ কখনও ভুলব না। কিন্তু এ পরিবারে আর তো আমার স্থান নেই।
রামকিশোরের চক্ষুও সজল হইল। তিনি বলিলেন, কোন স্থান নেই? যে গেছে সে তো গেছেই, আবার তোমাকেও হারাবো? তা হবে না। তুমি থাকো। যদি ভগবান করেন আবার হয়তো সম্পর্ক হবে।
বংশীধর ও মুরলীধর উপস্থিত ছিল। বংশীধর মুখ কালো করিয়া উঠিয়া গেল; মুরলীধরের ঠোঁটে অসন্তোষ বাঁকা হইয়া উঠিল। ইঙ্গিতটা কাহারও বুঝিতে বাকি রহিল না।
মণিলাল রহিয়া গেল। পূর্বাপেক্ষাও নিস্পৃহ এবং নির্লিপ্তভাবে ভূতপূর্ব শ্বশ্রূগৃহে বাস করিতে লাগিল।
অতঃপর বছর দুই নিরুপদ্রবে কাটিয়া গিয়াছে। রামকিশোরের সংসার আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়া আসিয়াছে। কেবল তুলসী পূর্বের মত ঠিক প্রকৃতিস্থ হইল না। তাহার মনে এমন গুরুতর ধাক্কা লাগিয়াছিল, যাহার ফলে তাহার দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধি নিরুদ্ধ হইয়া গিয়াছিল। দশ বছর বয়সে তাহার দেহ-মন যেরূপ অপরিণত ছিল, তের বছরে পা দিয়াও তেমনি অপরিণত আছে। মোট কথা, যৌবনোদগমের স্বাভাবিক বয়সে উপনীত হইয়াও সে বালিকাই রহিয়া গিয়াছে।
উপরন্তু তাহার মনে আর একটি পরিবর্তন ঘটিয়াছে। যে-মাস্টারের প্রতি পূর্বে তাহার অবহেলার অন্ত ছিল না, অহেতুকভাবে সে সেই মাস্টারের অনুরক্ত হইয়া পড়িয়াছে। ইহাতে মাস্টার রমাপতি যতটা আনন্দিত হইয়াছে, তাহার অধিক সঙ্কোচ ও অশান্তি অনুভব করিতেছে। কারণ অবহেলায় যাহারা অভ্যস্ত, একটু সমাদর পাইলে তাহারা বিব্রত হইয়া ওঠে।
যাহোক, রামকিশোরের সংসার-যন্ত্র আবার সচল হইয়াছে এমন সময় বাড়িতে একজন অতিথি আসিলেন। ইনি রামকিশোরের যৌবনকালের বন্ধু। আসলে রামকিশোরের দাদা রামবিনোদের সহিত তাঁহার গাঢ় বন্ধুত্ব ছিল। রামবিনোদের অকালমৃত্যুর পর রামকিশোরের সহিত তাঁহার সখ্য-বন্ধন শিথিল হইয়াছিল বটে, কিন্তু প্রীতির সূত্র একেবারে ছিন্ন হয় নাই। ইনি কলেজের অধ্যাপক ছিলেন, সম্প্রতি অবসর লইয়াছেন। নাম ঈশানচন্দ্র মজুমদার। কয়েক বছর আগে বংশীধর যখন কলেজে দুষ্কৃতি করার ফলে বিতাড়িত হইতেছিল, তখন ইনিই তাহাকে রক্ষা করিয়াছিলেন।
অধ্যাপক ঈশানচন্দ্রের চেহারা তপঃকৃশ সন্ন্যাসীর ন্যায় শুষ্কশীর্ণ, প্রকৃতি ঈষৎ তিক্তর সাক্ত। অবসর গ্রহণ করিবার পর তাঁহার স্বাস্থ্য ভাঙ্গিয়াছিল, অর্থেরও বোধকরি অনটন ঘটিয়াছিল। তিনি পূর্ব ঘনিষ্ঠতা স্মরণ করিয়া রামকিশোরকে পত্র লিখিলেন; তোমাদের অনেকদিন দেখি নাই, কবে আছি কবে নাই, ওখানকার জলহাওয়া নাকি ভাল, ইত্যাদি। রামকিশোর উত্তরে অধ্যাপক মহাশয়কে সাদর আমন্ত্রণ জানাইয়া পত্র লিখিলেন, এখানকার স্বাস্থ্য খুবই ভাল, তুমি এস, দু’এক মাস থাকিলেই শরীর সারিয়া যাইবে।
যথাসময়ে ঈশানচন্দ্ৰ আসিলেন এবং বাড়িতে অধিষ্ঠিত হইলেন। বংশীধর কিছু জানিত না, সে খাস-আবাদী ধান কাটাইতে গিয়াছিল; বাড়ি ফিরিয়া ঈশানচন্দ্রের সঙ্গে তাহার মুখোমুখি দেখা হইয়া গেল। বংশীধর ভূত দেখার মত চমকিয়া উঠিল; তাহার মুখ সাদা হইয়া গিয়া আবার ধীরে ধীরে লাল হইয়া উঠিল। সে ঈশানচন্দ্রের কাছে আসিয়া চাপা গলায় বলিল, আপনি এখানে?
ঈশানচন্দ্ৰ কিছুক্ষণ একদৃষ্টি প্রাক্তন শিষ্যের পানে চাহিয়া থাকিয়া শুষ্কম্বরে বলিলেন, এসেছি। তোমার আপত্তি আছে নাকি?
বংশীধর তাঁহার হাত ধরিয়া টানিয়া বলিল, শুনে যান। একটা কথা আছে।
আড়ালে গিয়া গুরুশিষ্যের মধ্যে কি কথা হইল, তাহা কেহ জানিল না। কিন্তু বাক্যবিনিময় যে আনন্দদায়ক হয় নাই তাহা প্ৰমাণ হইল যখন ঈশানচন্দ্র রামকিশোরকে গিয়া বলিলেন যে, তিনি আজই চলিয়া যাইতে চান। রামকিশোর তাঁহার অনেক সাধ্যসাধনা করিলেন; শেষ পর্যন্ত রফা হইল অধ্যাপক মহাশয় দুর্গে গিয়া থাকিবেন। দুর্গের দু’একটি ঘর বাসোপযোগী আছে; অধ্যাপক মহাশয়ের নির্জনবাসে আপত্তি নাই। তাঁহার খাদ্য দুর্গে পৌঁছাইয়া দেওয়া হইবে।
সেদিন সন্ধ্যায় ঈশানচন্দ্ৰকে দুর্গে প্রতিষ্ঠিত করিয়া রামকিশোর ফিরিয়া আসিলেন এবং বংশীধরকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। পিতাপুত্রে সওয়াল জবাব চলিল। হঠাৎ রামকিশোর খড়ের আগুনের মত জ্বলিয়া উঠিলেন এবং উগ্ৰকণ্ঠে পুত্ৰকে ভৎসনা করিলেন। বংশীধর কিন্তু চেঁচামেচি করিল না, আরক্ত চক্ষে নিস্ফল ক্ৰোধ ভরিয়া তিরস্কার শুনিল।
যাহাকে, ঈশানচন্দ্ৰ দুর্গে বাস করিতে লাগিলেন। রাত্রে তিনি একাকী থাকেন। কিন্তু দিনের বেলা বংশীধর ও মুরলীধর ছাড়া বাড়ির আর সকলেই দুর্গে যাতায়াত করে। মুরলীধর অধ্যাপক মহাশয়ের উপর মর্মান্তিক চটিয়াছিল, কারণ তিনি দুর্গ অধিকার করিয়া তাহার গোপন কেলিকুঞ্জটি কাড়িয়া লইয়াছিলেন।
অতঃপর একপক্ষ নির্ঝঞ্ঝাটে কাটিয়া গেল। একদিন সন্ধ্যার সময় রামকিশোর ঈশানচন্দ্রের সহিত দেখা করিতে যাইতেছিলেন, দেউড়ি পর্যন্ত নামিয়া দুর্গের সিঁড়ি ধরিবেন, দেখিতে পাইলেন কুয়ার কাছে তরুগুচ্ছের ভিতর হইতে ধূঁয়া বাহির হইতেছে। কৌতুহলী হইয়া তিনি সেইদিকে গেলেন। দেখিলেন, বৃক্ষতলে এক সাধু ধুনি জ্বালিয়া বসিয়া আছেন।
সাধুর অঙ্গ বিভূতিভূষিত, মাথায় জটা, মুখে কাঁচা-পাকা দাড়ি-গোঁফ। রামকিশোর এবং সাধুবাবা অনেকক্ষণ স্থির নেত্রে পরস্পর নিরীক্ষণ করিলেন। তারপর সাধুবাবার কণ্ঠ হইতে খল খল হাস্য নিৰ্গত হইল।
রামকিশোরের দুর্গে যাওয়া হইল না। তিনি ফিরিয়া আসিয়া শয্যায় শয়ন করিলেন। কিছুক্ষণ পরে তাঁহার তাড়স দিয়া জ্বর আসিল। জ্বরের ঘোরে তিনি উচ্চকণ্ঠে প্ৰলাপ বকিতে লাগিলেন।
ডাক্তার আসিল। প্ৰলাপ বন্ধ হইল, জ্বরও ছাড়িল। রামকিশোর ক্রমে সুস্থ হইলেন। কিন্তু দেখা গেল তাঁহার হৃদযন্ত্র গুরুতরভাবে জখম ইয়াছে। পূর্বে তাঁহার হৃদযন্ত্র বেশ মজবুত ছিল। আরও একপক্ষ কাটিল। ঈশানচন্দ্র পূর্ববৎ দুর্গে রহিলেন। সাধুবাবাকে বৃক্ষমূল হইতে কেহ তাড়াইবার চেষ্টা করিল না। ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখিলে ডরায়, বেদেদের লইয়া যে ব্যাপার ঘটিয়া গিয়াছে তাহার পুনরাভিনয় বাঞ্ছনীয় নয়।
পরবর্তী অংশ
No comments:
Post a Comment