চোরাবালি (প্রথমাংশ)
লেখক: শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
কুমার ত্ৰিদিবের বারম্বার সনির্বন্ধ নিমন্ত্রণ আর উপেক্ষা করিতে না পারিয়া একদিন পৌষের শীত--সুতীক্ষ্ণ প্ৰভাতে ব্যোমকেশ ও আমি তাঁহার জমিদারীতে গিয়া উপস্থিত হইয়াছিলাম। ইচ্ছা ছিল দিন সাত--আট সেখানে নির্ঝঞ্ঝাটে কাটাইয়া, ফাঁকা জায়গার বিশুদ্ধ হাওয়ায় শরীর চাঙ্গা করিয়া লইয়া আবার কলিকাতায় ফিরিব।
আদর যত্নের অবধি ছিল না। প্রথম দিনটা ঘণ্টায় ঘণ্টায় অপর্যাপ্ত আহার করিয়া ও কুমার ত্ৰিদিবের সঙ্গে গল্প করিয়াই কাটিয়া গেল। গল্পের মধ্যে অবশ্য খুড়া মহাশয় স্যর দিগিন্দ্ৰই বেশি স্থান জুড়িয়া রহিলেন।
রাত্রে আহারাদির পর শয়নঘরের দরজা পর্যন্ত আমাদের পৌছাইয়া দিয়া কুমার ত্ৰিদিব বলিলেন, কাল ভোরেই শিকারে বেরুনো যাবে। সব বন্দোবস্ত করে রেখেছি।
ব্যোমকেশ সোৎসাহে জিজ্ঞাসা করিল, এদিকে শিকার পাওয়া যায় নাকি?
ত্রিদিব বলিলেন, যায়। তবে বাঘ--টাঘ নয়। আমার জমিদারীর সীমানায় একটা বড় জঙ্গল আছে, তাতে হরিণ, শুয়োর, খরগোশ পাওয়া যায়; ময়ূর, বনমুরগীও আছে। জঙ্গলটা চোরাবালির জমিদার হিমাংশু রায়ের সম্পত্তি। হিমাংশু আমার বন্ধু; আজ সকালে আমি তাকে চিঠি লিখে শিকার করবার অনুমতি আনিয়ে নিয়েছি। কোনো আপত্তি নেই তো?
আমরা দুজনে একসঙ্গে বলিয়া উঠিলাম, আপত্তি!
ব্যোমকেশ যোগ করিয়া দিল, তবে বাঘ নেই এই যা দুঃখের কথা।
ত্রিদিব বলিলেন, একেবারে যে নেই তা বলতে পারব না; প্রতি বছরই এই সময় দু একটা বাঘ ছিটকে এসে পড়ে—তবে বাঘের ভরসা করবেন না। আর বাঘ এলেও হিমাংশু আমাদের মারতে দেবে না, নিজেই ব্যাগ করবে।
কুমার হাসিতে লাগিলেন—জমিদারী দেখবার ফুরসৎ পায় না, তার এমনি শিকারের নেশা। দিন রাত হয় বন্দুকের ঘরে, নয় তো জঙ্গলে। যাকে বলে শিকার--পাগল। টিপও অসাধারণ--মাটিতে দাঁড়িয়ে বাঘ মারে।
ব্যোমকেশ কৌতুহলী হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কি নাম বললেন জমিদারীর----চোরাবালি? অদ্ভুত নাম তো।
হ্যাঁ, শুনেছি, ওখানে নাকি কোথায় খানিকটা চোরাবালি আছে, কিন্তু কোথায় আছে, কেউ জানে না। সেই থেকে চোরাবালি নামের উৎপত্তি। হাতের ঘড়ির দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলেন, ‘আর দেরি নয়, শুয়ে পড়ুন। নইলে সকালে উঠতে কষ্ট হবে।’ বলিয়া একটা হাই তুলিয়া প্ৰস্থান করিলেন।
একই ঘরে পাশাপাশি খাটে আমাদের শয়নের ব্যবস্থা হইয়াছিল। শরীর বেশ একটি আরামদায়ক ক্লান্তিতে ভরিয়া উঠিতেছিল; সানন্দে বিছানায় লেপের মধ্যে প্রবেশ করিলাম।
ঘুমাইয়া পড়িতেও বেশি দেরি হইল না। ঘুমাইয়া স্বপ্ন দেখিলাম--চোরাবালিতে ডুবিয়া যাইতেছি; ব্যোমকেশ দূরে দাঁড়াইয়া হাসিতেছে। ক্ৰমে ক্রমে গলা পর্যন্ত ডুবিয়া গেল; যতই বাহির হইবার জন্য হাঁকপাক করিতেছি, ততই নিম্নাভিমুখে নামিয়া যাইতেছি। শেষে নাক পর্যন্ত বালিতে তলাইয়া গেল। নিমেষের জন্য ভয়াবহ মৃত্যু--যন্ত্রণার স্বাদ পাইলাম। তারপর ঘুম ভাঙিয়া গেল।
দেখিলাম, লেপটা কখন অসাবধানে নাকের উপর পড়িয়াছে। অনেকক্ষণ ঘর্মাক্ত কলেবরে বিছানায় বসিয়া রহিলাম, তারপর ঠাণ্ডা হইয়া আবার শয়ন করিলাম। চিন্তার সংসৰ্গ ঘুমের মধ্যেও কিরূপ বিচিত্ৰভাবে সঞ্চারিত হয় তাহা দেখিয়া হাসি পাইল।
ভোর হইতে না হইতে শিকারে বাহির হইবার হুড়াহুড়ি পড়িয়া গেল। কোনওমতে হাফ--প্যান্ট ও গরম হোস চড়াইয়া লইয়া, কেক সহযোগে ফুটন্ত চা গলাধঃকরণ করিয়া মোটরে চড়িলাম। মোটরে তিনটা শট--গান, অজস্র কার্তুজ ও এক বেতের বাক্স--ভরা আহাৰ্য দ্রব্য আগে হইতেই রাখা হইয়াছিল। কুমার ত্রিদিব ও আমরা দুইজন পিছনের সীটে ঠাসাঠাসি হইয়া বসিতেই গাড়ি ছাড়িয়া দিল। কুয়াশায় ঢাকা অস্পষ্ট শীতল উষালোকের ভিতর দিয়া হু হু করিয়া ছুটিয়া চলিলাম।
কুমার ওভারকেটের কলারের ভিতর হইতে অস্ফুটম্বরে বলিলেন, সুর্যোদয়ের আগে না পৌঁছলে ময়ুর বনমোরগ পাওয়া শক্ত হবে। এই সময় তারা গাছের ডগায় বসে থাকে--চমৎকার টার্গেট।
ক্ৰমে দিনের আলো ফুটিয়া উঠিতে লাগিল। পথের দু’ধারে সমতল ধানের ক্ষেত; কোথাও পাকা ধান শোয়াইয়া দেওয়া হইয়াছে, কোথাও সোনালী ধান মাথা তুলিয়া দাঁড়াইয়া আছে। দূরে আকাশের পটমূলে পুরু কালির দাগের মত বনানী দেখা গেল; আমাদের রাস্তা তাহার একটা কোণ স্পর্শ করিয়া চলিয়া গিয়াছে। কুমার অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিলেন যে ঐ বনেই শিকার করিতে চলিয়াছি।
মিনিট কুড়ি পরে আমাদের মোটর জঙ্গলের কিনারায় আসিয়া থামিল। আমরা পকেটে কার্তুজ ভরিয়া লইয়া বন্দুক ঘাড়ে মহা উৎসাহে বনের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িলাম। কুমার ত্রিদিব একদিকে গেলেন। আমি আর ব্যোমকেশ একসঙ্গে আর একদিকে চলিলাম। বন্দুক চালনায় আমার এই প্রথম হাতেখড়ি, তাই একলা যাইতে সাহস হইল না। ছাড়াছাড়ি হইবার পূর্বে স্থির হইল যে বেলা নটার সময় বনের পূর্ব সীমান্তে ফাঁকা জায়গায় তিনজনে আবার পুনর্মিলিত হইব। সেইখানেই প্রাতরাশের ব্যবস্থা থাকিবে।
প্ৰকাণ্ড বনের মধ্যে বড় বড় গাছ--শাল, মহুয়া, সেগুন, শিমুল, দেওদার--মাথার উপর যেন চাঁদোয়া টানিয়া দিয়াছে; তাহার মধ্যে অজস্র শিকার। নীচে হরিণ, খরগোশ--উপরে হরিয়াল, বনমোরগ, ময়ুর। প্রথম বন্দুক ধরিবার উত্তেজনাপূর্ণ আনন্দ--আওয়াজ করার সঙ্গে সঙ্গে বৃক্ষচুড়া হইতে মৃত পাখির পতন--শব্দ, ছররার আঘাতে উড্ডীয়মান কুক্কুটের আকাশে ডিগবাজী খাইয়া পঞ্চত্ব প্রাপ্তি--একটা এপিক লিখিয়া ফেলিতে ইচ্ছা করিতেছে। কালিদাস সত্যই লিখিয়াছেন, বিধ্যান্তি লক্ষ্যে চলে—সঞ্চরমান লক্ষ্যকে বিদ্ধ করা—এরূপ বিনোদ আর কোথায়? কিন্তু যাক—পাখি শিকারের বহুল বর্ণনা করিয়া প্রবীণ বাঘ--শিকারীদের কাছে আর হাস্যাস্পদ হইব না।
আমাদের থলি ক্ৰমে ভরিয়া উঠিতে লাগিল। বেলাও অলক্ষিতে বাড়িয়া চলিয়াছিল। আমি একবার এক কার্তুজে--দশ নম্বর--সাতটা হরিয়াল মারিয়া আত্মশ্লাঘার সপ্তমস্বর্গে চড়িয়া গিয়াছিলাম—দৃঢ় বিশ্বাস জন্মিয়াছিল আমার মত অব্যৰ্থ সন্ধান সেকালে অৰ্জ্জুনেরও ছিল না। ব্যোমকেশ দুইবার মাত্র বন্দুক চালাইয়া—একবার একটা খরগোশ ও দ্বিতীয়বার একটা ময়ুর মারিয়াই--থামিয়া গিয়াছিল। তাহার চক্ষু বৃহত্তর শিকারের অনুসন্ধান করিয়া ফিরিতেছিল। বনে হরিণ আছে; তা ছাড়া বাঘ না থাক, ভালুকের আশা সে সম্পূর্ণ ত্যাগ করিতে পারে নাই। তাই কুঞ্জ মহুয়া গাছে তখনও ফল পাকে নাই শুধু তাহার ভালুক--লুব্ধ মনসেই দিকেই সতর্ক হইয়া ছিল।
কিন্তু বেলা যতই বাড়িতে লাগিল, জঙ্গলের বাতাসের গুণে পেটের মধ্যে অগ্নিদেব ততই প্রখর হইয়া উঠিতে লাগিলেন। আমরা তখন জঙ্গলের পূর্বসীমা লক্ষ্য করিয়া চলিতে আরম্ভ করিলাম।
কুমার ত্ৰিদিবের বন্দুকের আওয়াজ দূর হইতে বরাবরই শুনিতে পাইতেছিলাম, এখন দেখিলাম তিনিও পূর্বদিকে মোড় লইয়াছেন।
বনভূমির ঘন সন্নিবিষ্ট গাছ ক্রমে পাতলা হইয়া আসিতে লাগিল। অবশেষে আমরা রৌদ্রোজ্জ্বল খোলা জায়গায় নীল আকাশের তলায় আসিয়া দাঁড়াইলাম। সম্মুখেই বালুকার একটা বিস্তীর্ণ বলয়--প্ৰায় সিকি মাইল চওড়া; দৈর্ঘ্যে কতখানি তাহা আন্দাজ করা গেল না--বনের কোল ঘেঁষিয়া অর্ধচন্দ্রাকারে পড়িয়া আছে। বালুর উপর সূর্যকিরণ পড়িয়া চক্ চক্ করিতেছে; শীতের প্রভাতে দেখিতে খুব চমৎকার লাগিল।
এই বালু--বলয় জঙ্গলকে পূর্বদিকে আর অগ্রসর হইতে দেয় নাই। কোনও সুদূর অতীতে হয়তো ইহা একটি স্রোতস্বিনী ছিল, তারপর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে--হয়তো ভূমিকম্পে--খাত উঁচু হইয়া জল শুকাইয়া গিয়া শুষ্ক বালুপ্ৰান্তরে পরিণত হইয়াছে।
আমরা বালুর কিনারায় বসিয়া সিগারেট ধরাইলাম।
অল্পকাল পরেই কুমার ত্রিদিব আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বলিলেন, দিব্যি ক্ষিদে পেয়েছে—না? ঐ যে দুর্যোধন পৌঁছে গেছে—চলুন।
এতক্ষণ লক্ষ্য করি নাই, কুমার ত্ৰিদিবের ওড়িয়া বাবুর্চি মোটর হইতে বাস্কেট নামাইয়া ইতিমধ্যে হাজির হইয়াছিল। অনতিদূরে একটা গাছের তলায় ঘাসের উপর সাদা তোয়ালে বিছাইয়া খাদ্যদ্রব্য সাজাইয়া রাখিতে ছিল। তাহাকে দেখিয়া কুলায় প্রত্যাশী সন্ধ্যার পাখির মত আমরা সেই দিকে ধাবিত হইলাম।
আহার করিতে করিতে, কে কি পাইয়াছে তাহার হিসাব হইল। দেখা গেল, আমার এক কার্তুজে সাতটা হরিয়াল সত্ত্বেও, কুমার বাহাদুরই জিতিয়া আছেন।
আকণ্ঠ আহার ও অনুপান হিসাবে থার্মোফ্লাস্ক হইতে গরম চা নিঃশেষ করিয়া আবার সিগারেট ধরানো গেল। কুমার ত্রিদিব গাছের গুঁড়িতে ঠেসান দিয়া বসিলেন, সিগারেটে সুদীর্ঘ টান দিয়া অর্ধনিমীলিত চক্ষে কহিলেন, ‘এই যে বালুবন্ধ দেখছেন এ থেকেই জমিদারীর নাম হয়েছে চোরাবালি। এদিকটা সব হিমাংশুর। ’ বলিয়া পূর্বদিক নির্দেশ করিয়া হাত নাড়িলেন।
ব্যোমকেশ বলিল, আমিও তাই আন্দাজ করেছিলুম। এই বালির ফালিটা লম্বায় কতখানি? সমস্ত বনটাকেই ঘিরে আছে নাকি?
কুমার বলিলেন, না। মাইল তিনেক লম্বা হবে--তারপর আমার মাঠ আরম্ভ হয়েছে। এরই মধ্যে কোথায় এক জায়গায় খানিকটা চোরাবালি আছে—ঠিক কোনখানটায় আছে কেউ জানে না, কিন্তু ভয়ে কোনো মানুষ বালির উপর দিয়ে হাঁটে না; এমন কি গরু বাছুর শেয়াল কুকুর পর্যন্ত একে এড়িয়ে চলে৷
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, বালিতে কোথাও জল নেই বোধহয়?
কুমার অনিশ্চিতভাবে মাথা নাড়িলেন, ‘বলতে পারি না। শুনেছি ঐদিকে খানিকটা জায়গায় জল আছে, তাও সব সময় পাওয়া যায় না।’ বলিয়া দক্ষিণ দিকে যেখানে বালুর রেখা বাঁকিয়া বনের আড়ালে অদৃশ্য হইয়াছে সেই দিকে আঙুল দেখাইলেন।
এই সময় হঠাৎ অতি নিকটে বনের মধ্যে বন্দুকের আওয়াজ শুনিয়া আমরা চমকিয়া উঠিয়া বসিলাম। আমরা তিনজনেই এখানে রহিয়াছি, তবে কে আওয়াজ করিল----বিস্মিতভাবে পরস্পরের মুখের দিকে চাহিয়া এই কথা ভাবিতেছি, এমন সময় একজন বন্দুকধারী লোক একটা মৃত খরগোশ কান ধরিয়া ঝুলাইতে ঝুলাইতে জঙ্গল হইতে বাহির হইয়া আসিল। তাহার পরিধানে যোধপুরী ব্রীচেস, মাথায় বয়--স্কাউটের মত খাকি টুপি, চামড়ার কোমরবন্ধে সারি সারি কর্তুজ আঁটা রহিয়াছে।
কুমার ত্রিদিব উচ্চহাস্য করিয়া বলিলেন, আরো হিমাংশু, এস এস।
খরগোশ মাটিতে ফেলিয়া হিমাংশুবাবু আমাদের মধ্যে আসিয়া বসিলেন; বলিলেন, ‘অভ্যর্থনা আমারই করা উচিত এবং করছিও। বিশেষত এঁদের।’ কুমার আমাদের পরিচয় করাইয়া দিলেন, তারপর হাসিয়া হিমাংশুবাবুকে বলিলেন, তুমি বুঝি আর লোভ সামলাতে পারলে না? কিম্বা ভয় হল, পাছে তোমার সব বাঘ আমরা ব্যাগ করে ফেলি?
হিমাংশুবাবু বলিলেন, আরে বল কেন? মহা ফ্যাসাদে পড়া গেছে। আজই আমার ত্রিপুরায় যাবার কথা ছিল, সেখান থেকে শিকারের নেমন্তন্ন পেয়েছি। কিন্তু যাওয়া হল না, দেওয়ানজী আটকে দিলেন। বাবার আমলের লোক, একটু ছুতো পেলেই জুলুম জবরদস্তি করেন, কিছু বলতেও পারি না। তাই রাগ করে আজ সকালবেলা বন্দুক নিয়ে বেরিয়ে পড়লুম। দুত্তোর! কিছু না হোকদুটো বনপায়রাও তো মারা যাবে।
কুমার বলিলেন, হায় হায়--কোথায় বাঘ ভাল্লুক আর কোথায় বনপায়রা! দুঃখ হবার কথা বটে--কিন্তু যাওয়া হল না কেন?
হিমাংশুবাবু ইতিমধ্যে খাবার বাক্সটা নিজের দিকে টানিয়া লইয়া তাহার ভিতর অনুসন্ধান করিতেছিলেন, প্ৰফুল্লমুখে কয়েকটা ডিমসিদ্ধ ও কাটলেট বাহির করিয়া চর্বণ করিতে আরম্ভ করিলেন। আমি এই অবসরে তাঁহার চেহারাখানা ভাল করিয়া দেখিয়া লইলাম। বয়স আমাদেরই সমান হইবে; বেশ মজবুত পেশীপুষ্ট দেহ। মুখে একজোড়া উগ্র জার্মান গোঁফ মুখখানাকে অনাবশ্যক রকম হিংস্ৰ করিয়া তুলিয়াছে। চোখের দৃষ্টিতে পুরাতন বাঘ--শিকারীর নিষ্ঠুর সতর্কতা সর্বদাই উঁকি ঝুঁকি মারিতেছে। এক নজর দেখিলে মনে হয় লোকটা ভীষণ দুর্দান্ত। কিন্তু তবু বর্তমানে তাঁহাকে পরম পরিতৃপ্তির সহিত অৰ্ধমুদিত নেত্ৰে কাটলেট চিবাইতে দেখিয়া আমার মনে হইল, চেহারাটাই তাঁহার সত্যকার পরিচয় নহে; বস্তুত লোকটি অত্যন্ত সাদাসিধা অনাড়ম্বর--মনের মধ্যে কোনো মারপ্যাঁচ নাই। সাংসারিক বিষয়ে হয়তো একটু অন্যমনস্ক; নিদ্রায় জাগরণে নিরন্তর বাঘ ভালুকের কথা চিন্তা করিয়া বোধ করি বুদ্ধিটাও সাংসারিক ব্যাপারের অনুপযোগী হইয়া পড়িয়াছে।
কাটলেট ও ডিম্ব সমাপনান্তে চায়ের ফ্লাস্কে চুমুক দিয়া হিমাংশুবাবু বলিলেন, ‘কি বললে? যাওয়া হল না কেন? নেহাত বাজে কারণ; কিন্তু দেওয়ানজী ভয়ানক ভাবিত হয়ে পড়েছেন, পুলিসকেও খবর দেওয়া হয়েছে। কাজেই অনির্দিষ্ট কালের জন্য আমাকে এখানে ঘাঁটি আগলে বসে থাকতে হবে।’ তাঁহার কণ্ঠস্বরে বিরক্তি ও অসহিষ্ণুতা স্পষ্ট হইয়া উঠিল।
হয়েছে কি?
হয়েছে আমার মাথা। জান তো, বাবা মারা যাবার পর থেকে গত পাঁচ বছর ধরে প্রজাদের সঙ্গে অনবরত মামলা মোকদ্দমা চলছে। আদায় তসিলও ভাল হচ্ছে না। এই নিয়ে অষ্টপ্রহর অশান্তি লেগে আছে,--উকিল মোক্তার পরামর্শ, সে সব তো তুমি জানোই। যা হোক, আমমোক্তারনামা দিয়ে এক রকম নিশ্চিন্দি হওয়া গিছল, এমন সময় আবার এক নূতন ফ্যাচাং—। মাস--কয়েক আগে বেবির জন্য একটা মাস্টার রেখেছিলুম, সে হঠাৎ পরশু দিন থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে; যাবার সময় নাকি খানকয়েক পুরনো হিসেবের খাতা নিয়ে গেছে। তাই নিয়ে একেবারে তুলকালাম কাণ্ড। থানা পুলিস হৈ হৈ রৈ রৈ বেধে গেছে। দেওয়ানজীর বিশ্বাস, এটা আমার মামলাবাজ প্রজাদের একটা মারাত্মক প্যাঁচ ৷
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, লোকটা এখনো ধরা পড়েনি?
বিমৰ্ষভাবে ঘাড় নাড়িয়া হিমাংশুবাবু বলিলেন, না। এবং যতক্ষণ না ধরা পড়ছে-- হঠাৎ থামিয়া গিয়া কিছুক্ষণ বিস্ফারিত নেত্ৰে ব্যোমকেশের দিকে চাহিয়া থাকিয়া বলিয়া উঠিলেন, আরে! এটা এতক্ষণ আমার মাথাতেই ঢোকেনি। আপনি তো একজন বিখ্যাত ডিটেকটিভ, চোর--ডাকাতের সাক্ষাৎ যম! (ব্যোমকেশ মৃদুস্বরে বলিল, সত্যান্বেষী) তাহলে মশায়, দয়া করে যদি দু’একদিনের মধ্যে লোকটাকে খুঁজে বার করে দিতে পারেন—তাহলে আমার ত্রিপুরার শিকারটা ফস্কায় না। কাল--পরশুর মধ্যে গিয়ে পড়তে পারলে—
আমরা সকলে হাসিয়া উঠিলাম। কুমার ত্রিদিব বলিলেন, চোরের মন পুঁই আদাড়ে। তুমি বুঝি কেবল শিকারের কথাই ভাবছ?
ব্যোমকেশ বলিল, আমাকে কিছু করতে হবে না, পুলিসই খুঁজে বার করবে অখন। এসব জায়গা থেকে একেবারে লোপাট হয়ে যাওয়া সম্ভব নয়; কলকাতা হলেও বা কথা ছিল ৷
হিমাংশুবাবু মাথা নাড়িয়া বলিলেন, পুলিসের কর্ম নয়। এই তিন দিনে সমস্ত দেশটা তারা তোলপাড় করে ফেলেছে, কাছাকাছি যত রেলওয়ে স্টেশন আছে সব জায়গায় পাহারা বসিয়েছে। কিন্তু এখনো তো কিছু করতে পারলে না। দোহাই ব্যোমকেশবাবু, আপনি কেসটা হাতে নিন; সামান্য ব্যাপার, আপনার দুঘণ্টাও সময় লাগবে না।
ব্যোমকেশ তাঁহার আগ্রহের আতিশয্য দেখিয়া মৃদুহাস্যে বলিল, আচ্ছা, ঘটনাটা আগাগোড়া বলুন তো শুনি।
হিমাংশুবাবু সাক্ষাতে হাত উল্টাইয়া বলিলেন, আমি কি সব জানি ছাই! তার সঙ্গে বোধহয় সাকুল্যে পাঁচ দিনও দেখা হয়নি। যা হোক, যতটুকু জানি বলছি শুনুন। কিছুদিন আগে--বোধহয় মাস দুই হবে--একদিন সকালবেলা একটা ন্যালাখ্যাপা গোছের ছোকরা আমার কাছে এসে হাজির হল। তাকে আগে কখনো দেখিনি, এ অঞ্চলের লোক বলে বোধ হল না। তার গায়ে একটা ছেঁড়া কামিজ, পায়ে ছেঁড়া চটিজুতা--রোগা বেঁটে দুৰ্ভিক্ষপীড়িত চেহারা; কিন্তু কথাবার্তা শুনে মনে হয় শিক্ষিত। বললে, চাকরির অভাবে খেতে পাচ্ছে না, যা হোক একটা চাকরি দিতে হবে। জিজ্ঞাসা করলুম, কি কাজ করতে পারে?পকেট থেকে বিএসসি’র ডিগ্রি বার করে দেখিয়ে বললে, যে কাজ দেবেন। তাই করব। ছোকরার অবস্থা দেখে আমার একটু দয়া হল, কিন্তু কি কাজ দেব? সেরেস্তায় তো একটা জায়গাও খালি নেই। ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল, আমার মেয়ে বেবির জন্যে একজন মাস্টার রাখবার কথা গিন্নি কয়েকদিন আগে বলেছিলেন, বেবি এই সাতে পড়েছে, সুতরাং তাঁর পড়াশুনোর দিকে এবার একটু বিশেষভাবে দৃষ্টি দেওয়া দরকার।
তাকে মাস্টার বাহাল করলুম, কারণ, অবস্থা যাই হোক, ছোকরা শিক্ষিত ভদ্রসন্তান। বাড়িতেই বাইরের একটা ঘরে তার থাকবার ব্যবস্থা করে দিলুম। ছোকরা কৃতজ্ঞতায় একেবারে কেঁদে ফেললে। তখন কে ভেবেছিল যে--; নাম? নাম যতদূর মনে পড়ছে, হরিনাথ চৌধুরী----কায়স্থ।
যা হোক, সে বাড়িতেই রইল। কিন্তু আমার সঙ্গে বড় একটা দেখা--সাক্ষাৎ হত না। বেবিকে দুবেলা পড়াচ্ছে, এই পর্যন্তই জানতুম। হঠাৎ সেদিন শুনলুম, ছোকরা কাউকে না বলে কবে উধাও হয়েছে। উধাও হয়েছে, হয়েছে--আমার কোনো আপত্তি ছিল না, কিন্তু মাঝ থেকে কতকগুলো বাজে পুরনো হিসেবের খাতা নিয়ে গিয়েই আমার সর্বনাশ করে গেল। এখন তাকে খুঁজে বার না করা পর্যন্ত আমার নিস্তার নেই।
হিমাংশুবাবু নীরব হইলেন। ব্যোমকেশ ঘাসের উপর লম্বা হইয়া শুইয়া শুনিতেছিল, কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ছোকরা খেত কোথায়?
হিমাংশুবাবু বলিলেন,”আমার বাড়িতেই খেত। আদর যত্নের ত্রুটি ছিল না, বেবির মাস্টার বলে গিন্নি তাকে নিজে—
এই সময় পিছনে একটা গাছের মাথায় ফট ফট শব্দ শুনিয়া আমরা মাথা তুলিয়া দেখিলাম, একটা প্ৰকাণ্ড বনমোরগ নানা বর্ণের পুচ্ছ ঝুলাইয়া এক গাছ হইতে অন্য গাছে উড়িয়া যাইতেছে। গাছ দুটার মধ্যে ব্যবধান ত্ৰিশ হাতের বেশি হইবে না। কিন্তু নিমিষের মধ্যে বন্দুকের ব্রীচ খুলিয়া টোটা ভরিয়া হিমাংশুবাবু ফায়ার করিলেন। পাখিটা অন্য গাছ পর্যন্ত পৌঁছতে পারিল না, মধ্য পথেই ধপ করিয়া মাটিতে পড়িল।
আমি সবিস্ময়ে বলিয়া উঠিলাম, কি অদ্ভুত টিপ।
ব্যোমকেশ সপ্ৰশংস নেত্ৰে চাহিয়া বলিল, সত্যিই অসাধারণ ৷
কুমার ত্রিদিব বলিলেন, ও আর কি দেখলেন? ওর চেয়েও ঢের বেশি আশ্চর্য বিদ্যে ওর পেটে আছে!--হিমাংশু, তোমার সেই শব্দভেদী প্যাঁচটা একবার দেখাও না।
আরো না না, এখন ওসব থাক। চল—আর একবার জঙ্গলে ঢোকা যাক—
সে হচ্ছে না--ওটা দেখাতেই হবে। নাও--চোখে রুমাল বাঁধো।
হিমাংশুবাবু হাসিয়া বলিলেন, কি ছেলেমানুষী দেখুন দেখি। ও একটা বাজে ট্রীক, আপনারা কতবার দেখেছেন—
আমরাও কৌতুহলী হইয়া উঠিয়াছিলাম, বলিলাম, তা হোক, আপনাকে দেখাতে হবে।
তখন হিমাংশুবাবু বলিলেন, ‘আচ্ছা--দেখাচ্ছি। কিছুই নয়, চোখ বেঁধে কেবল শব্দ শুনে লক্ষ্যভেদ করা। বন্দুকে একটা বুলেট ভরিয়া বলিলেন, ব্যোমকেশবাবু, আপনিই রুমাল দিয়ে চোখ বেঁধে দিন--কিন্তু দেখবেন কান দুটো যেন খোলা থাকে।
ব্যোমকেশ রুমাল দিয়া বেশ শক্ত করিয়া তাঁহার চোখ বাঁধিয়া দিল। তখন কুমার ত্রিদিব একটা চায়ের পেয়ালা লইয়া তাহার হাতলে খানিকটা সূতা বাঁধলেন। তারপর পা টিপিয়া টিপিয়া গিয়া--যাহাতে হিমাংশুবাবু বুঝিতে না পারেন তিনি কোনদিকে গিয়াছেন--প্ৰায় পাঁচশ হাত দূরে একটা গাছের ডালে পেয়ালাটা ঝুলাইয়া দিলেন।
ব্যোমকেশ বলিল, হিমাংশুবাবু, এবার শুনুন।
কুমার ত্রিদিব চামচ দিয়া পেয়ালাটায় আঘাত করিলেন, ঠুং করিয়া শব্দ হইল। হিমাংশুবাবু বন্দুক কোলে লইয়া যেদিক হইতে শব্দ আসিল সেই দিকে ঘুরিয়া বসিলেন। বন্দুকটা একবার তুলিলেন, তারপর বলিলেন, আর একবার বাজাও।
কুমার ত্রিদিব আর একবার শব্দ করিয়া ক্ষিপ্ৰপদে সরিয়া আসিলেন। শব্দের রেশ সম্পূর্ণ মিলাইয়া যাইবার পূর্বেই বন্দুকের আওয়াজ হইল; দেখিলাম পেয়ালাটা চুৰ্ণ হইয়া উড়িয়া গিয়াছে, কেবল তাহার ডাঁটিটা ডাল হইতে ঝুলিতেছে।
মুগ্ধ হইয়া গেলাম। পেশাদার বাজীকরের সাজানো নাট্যমঞ্চে এরকম খেলা দেখা যায় বটে কিন্তু তাহার মধ্যে অনেক রকম জুয়াচুরি আছে। এ একেবারে নির্জলা খাঁটি জিনিস।
হিমাংশুবাবু চোখের রুমাল খুলিয়া ফেলিয়া বলিলেন, হয়েছে?
আমাদের মুক্তকণ্ঠ প্ৰশংসা শুনিয়া তিনি একটু লজ্জিত হইয়া পড়িলেন। ঘড়ির দিকে তাকাইয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন, বলিলেন, ও কথা থাক, আপনাদের সুখ্যাতি আর বেশিক্ষণ শুনলে আমার গণ্ডদেশ ক্রমে বিলিতি বেগুনের মত লাল হয়ে উঠবে। এখন উঠুন। চলুন, ইতর প্ৰাণীদের বিরুদ্ধে আর একবার অভিযানে বেরুনো যাক।
বেলা দেড়টার সময়, শিকার--শ্রান্ত চারিজন মোটরের কাছে ফিরিয়া আসিলাম। হরিনাথ মাস্টারের খাতা চুরির কাহিনী চাপা পড়িয়া গিয়াছিল। হিমাংশুবাবুরও কি জানি কেন, ব্যোমকেশের সাহায্য লইবার আর বিশেষ আগ্রহ ছিল না। বোধহয় এরূপ তুচ্ছ ব্যাপারে সদ্য পরিচিত একজন লোককে খাটাইয়া লইতে তিনি কুষ্ঠিত হইতেছিলেন; হয়তো তিনি ভাবিতেছিলেন যে পুলিসই শীঘ্র এই ব্যাপারে একটা সমাধান করিয়া ফেলিবে। সে যাহাই হোক, ব্যোমকেশই প্রসঙ্গটা পুনরুত্থাপন করিল, বলিল, আপনার হরিনাথ মাস্টারের গল্পটা ভাল করে শোনা হল না।
হিমাংশুবাবু মোটরের ফুট--বোর্ডে পা তুলিয়া দিয়া বলিলেন, আমি যা জানি সবই প্রায় বলেছি, আর বিশেষ কিছু জানিবার আছে বলে মনে হয় না।
ব্যোমকেশ আর কিছু বলিল না। কুমার ত্রিদিব বলিলেন, চল হিমাংশু, তোমাকে মোটরে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যাই। তুমি বোধ হয় হেঁটেই এসেছি।
হিমাংশুবাবু বলিলেন, ‘হ্যাঁ। তবে রাস্তা দিয়ে ঘুর পড়ে বলে ওদিক দিয়ে মাঠে মাঠে এসেছি। ওদিক দিয়ে মাইলখানেক পড়ে। ’ বলিয়া দক্ষিণ দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিলেন।
কুমার ত্রিদিব বলিলেন, ‘রাস্তা দিয়ে অন্তত মাইল দুই। চল, তোমাকে পৌঁছে দিই।’ তারপর হাসিয়া বলিলেন, আর যদি নেমন্তন্ন কর তাহলে না হয় দুপুরের স্নানাহারটা তোমার বাড়িতেই সারা যাবে। কি বলেন। আপনারা?
আমাদের কোনো আপত্তিই ছিল না, আমোদ করিতে আসিয়াছি, গৃহস্বামী যেখানে লইয়া যাইবেন সেখানে যাইতেই রাজী ছিলাম। আমরা ঘাড় নাড়িয়া সম্মতি জানাইলাম। হিমাংশুবাবু বলিয়া উঠিলেন, নিশ্চয় নিশ্চয়--সে। আর বলতে। তোমরা তো আজ আমারই অতিথি—এতক্ষণ এ প্রস্তাব না করাই আমার অন্যায় হয়েছে। যা হোক, উঠে পড়ুন গাড়িতে, আর দেরি নয়; খাওয়া দাওয়া করেতবু একটু বিশ্রাম করতে পারেন। তারপর একেবারে বৈকালিক চা সেরে বাড়ি ফিরলেই হবে।
ব্যোমকেশ বলিল, এবং পারিযদি, ইতিমধ্যে আপনার পলাতক মাস্টারের একটা ঠিকানা করা যাবে।
‘হ্যাঁ, সেও একটা কথা বটে। আমার দেওয়ান হয়তো তার সম্বন্ধে আরো অনেক কথা বলতে পারবেন।বলিয়া তিনি নিজে অগ্রবর্তী হইয়া গাড়িতে উঠিলেন।
হিমাংশুবাবু খুবই সমাদর সহকারে আমাদের আহ্বান করিলেন বটে কিন্তু তবু আমার একটা ক্ষীণ সন্দেহ জাগিতে লাগিল যে তিনি মন খুলিয়া খুশি হইতে পারেন নাই।
দশ মিনিট পরে আমাদের সগাড়ি তাঁহার প্রকাণ্ড উদ্যানের লোহার ফটক পার হইয়া প্রাসাদের সম্মুখে দাঁড়াইল। গাড়ির শব্দে একটি প্রৌঢ় গোছের ব্যক্তি ভিতর হইতে বারান্দায় আসিয়া দাঁড়াইলেন; তারপর হিমাংশুবাবুকে গাড়ি হইতে নামিতে দেখিয়া তিনি খড়ম পায়ে তাড়াতাড়ি নামিয়া আসিয়া বিচলিত স্বরে বলিয়া উঠিলেন, বাবা হিমাংশু, যা ভেবেছিলুম তাই। হরিনাথ মাস্টার শুধু খাতাই চুরি করেনি, সঙ্গে সঙ্গে তহবিল থেকে ছ হাজার টাকাও গেছে।
বেলা তিনটা বাজিয়া গিয়াছিল। শীতের অপরাহ্ন, ইহারই মধ্যে দিবালোকের উজ্জ্বলতা ম্লান করিয়া আনিয়াছিল।
এবার ভট্টাচার্যি মশায়ের মুখে ব্যাপারটা শোনা যাক। --বলিয়া ব্যোমকেশ মোটা তাকিয়ার উপর কনুই ভর দিয়া বসিল।
গুরু ভোজনের পর বৈঠকখানায় গদির উপর বিস্তৃত ফরাসের শয্যায় এক একটা তাকিয়া আশ্রয় করিয়া আমরা চারিজনে গড়াইতেছিলাম। হিমাংশুবাবুর কন্যা বেবি ব্যোমকেশের কোলের কাছে বসিয়া নিবিষ্ট মনে একটা পুতুলকে কাপড় পরাইতেছিল; এই দুই ঘণ্টায় তাহাদের মধ্যে ভীষণ বন্ধুত্ব জন্মিয়া গিয়াছিল। দেওয়ান কালীগতি ভট্টাচার্য মহাশয় একটু তফাতে ফরাসের উপর মেরুদণ্ড সিধা করিয়া পদ্মাসনে বসিয়াছিলেন--যেন একটু সুবিধা পাইলেই ধ্যানস্থ হইয়া পড়িবেন।
বস্তুত তাঁহাকে দেখিলে জপতপ ধ্যানধারণার কথাই বেশি করিয়া মনে হয়। আমি তো প্রথম দর্শনে তাঁহাকে জমিদার বাড়ির পুরোহিত বলিয়া ভুল করিয়াছিলাম। শীর্ণ গৌরবর্ণ দেহ, মুণ্ডিত মুখ, গলায় বড় বড় রুদ্রাক্ষের মালা, কপালে আধুলির মত একটি সিঁন্দুরের টিকা। মুখে তপঃকৃশ শান্তির ভাব। বৈষয়িকতার কোনো চিহ্নই সেখানে বিদ্যমান নাই। অথচ এক শিকার--পাগল সংসার--উদাসী জমিদারের বৃহৎ সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা যে এই লোকটির তীক্ষ্ণ সতর্কতার উপর নির্ভর করিতেছে তাহাতে সন্দেহ নাই। মান্য অতিথির সংবর্ধনা হইতে আরম্ভ করিয়া জমিদারীর সামান্য খুঁটিনাটি পর্যন্ত ইহারি কটাক্ষ ইঙ্গিতে সুনিয়ন্ত্রিত হইতেছে।
ব্যোমকেশের কথায় তিনি নড়িয়া চড়িয়া বসিলেন। ক্ষণকাল মুদিত চক্ষে নীরবে থাকিয়া ধীরে ধীরে বলিলেন, হরিনাথ লোকটা আপাতদৃষ্টিতে এতই সাধারণ আর অকিঞ্চিৎকর যে তার সম্বন্ধে বলতে গিয়ে মনে হয় বলবার কিছুই নেই। ন্যালা--ক্যাবলা গোছের একটা ছোঁড়া--অথচ তার পেটে যে এতখানি শয়তানী লুকোনো ছিল তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। আমি মানুষ চিনতে বড় ভুল করি না, এক নজর দেখেই কে কেমন লোক বুঝতে পারি। কিন্তু সে--ছোঁড়া আমার চোখেও ধুলো দিয়েছে। একবারও সন্দেহ করিনি যে এটা তার ছদ্মবেশ, তার মনে কোনো কু--অভিপ্ৰায় আছে।
প্রথম যেদিন এল সেদিন তার জামাকাপড়ের দুরবস্থা দেখে আমি ভাণ্ডার থেকে দু’জোড়া কাপড় দুটো গেঞ্জি দুটো জামা আর দু’খানা কম্বল বার করে দিলুম। একখানা ঘর হিমাংশু বাবাজী তাকে আগেই দিয়েছিলেন—ঘরটাতে পুরনো খাতাপত্র থাকত, তা ছাড়া বিশেষ কোনো কাজে লাগত না; সেই ঘরে তক্তপোশ ঢুকিয়ে তার শোবার ব্যবস্থা করে দেওয়া হল। ঠিক হল, বেবি দু’বেলা ঐ ঘরেই পড়বে। তার খাওয়া--দাওয়া সম্বন্ধে আমি স্থির করেছিলুম, অনাদি সরকারের কিম্বা কোনো আমলার বাড়িতে গিয়ে খেয়ে আসবে। আমলারা সবাই কাছেপিঠেই থাকে। কিন্তু আমাদের মা--লক্ষ্মী সে প্রস্তাবে মত দিলেন না। তিনি অন্দর থেকে বলে পাঠালেন যে বেবির মাস্টার বাড়িতেই খাওয়া--দাওয়া করবে। সেই ব্যবস্থাই ধাৰ্য হল।
তারপর সে বেবিকে নিয়মিত পড়াতে লাগল। আমি দুদিন তার পড়ানো লক্ষ্য করলুম--দেখলুম ভালই পড়াচ্ছে। তারপর আর তার দিকে মন দেবার সুযোগ পাইনি। মাঝে মাঝে আমার কাছে এসে বসত--ধর্ম সম্বন্ধে দু’চার কথা শুনতে চাইত। এমনিভাবে দু’মাস কেটে গেল।
গত শনিবার আমি সন্ধ্যের পরই বাড়ি চলে যাই। আমি যে--বাড়িতে থাকি দেখেছেন বোধ হয়-- ফটকে ঢুকতে ডান দিকে যে হলদে বাড়িখানা পড়ে সেইটে। কয়েক মাস হল আমি আমার স্ত্রীকে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছি। —একলাই থাকি। স্বপাক খাই--আমার কোনো কষ্ট হয় না। শনিবার রাত্রে আমার পুরশ্চরণ করবার কথা ছিল—তাই সকাল সকাল গিয়ে উদ্যোগ আয়োজন করে পুজোয় বসলুম! উঠতে অনেক রাত হয়ে গেল।
পরদিন সকালে এসে শুনলুম মাস্টারকে পাওয়া যাচ্ছে না। ক্রমে বেলা বারোটা বেজে গেল তখনো মাস্টারের দেখা নেই। আমার সন্দেহ হল, তার ঘরে গিয়ে দেখলুম রাত্রে সে বিছানায় শোয়নি। তখন, যে আলমারিতে জমিদারীর পুরনো হিসেবের খাতা থাকে সেটা খুলে দেখলুম--গত চার বছরের হিসেবের খাতা নেই।
গত চার বছর থেকে অনেক বড় বড় প্রজাদের সঙ্গে মামলা মোকদ্দমা চলছে; সন্দেহ হল এ তাদেরই কারসাজি। জমিদারীর হিসেবের খাতা শত্রুপক্ষের হাতে পড়লে তাদের অনেক সুবিধা হয়; বুঝলুম, হরিনাথ তাদেরই গুপ্তচর, মাস্টার সেজে জমিদারীর জরুরী দলিল চুরি করবার জন্যে এসে ঢুকেছিল।
পুলিসে খবর পাঠলুম। কিন্তু তখনো জানি না যে সিন্দুক থেকে ছ হাজার টাকাও লোপাট হয়েছে।
এ পর্যন্ত বলিয়া দেওয়ানজী থামিলেন, তারপর ঈষৎ কুন্ঠিতভাবে বলিলেন, নানা কারণে কিছুদিন থেকে তহবিলে টাকার কিছু টানাটানি পড়েছে। সম্প্রতি মোকদ্দমার খরচ ইত্যাদি বাবদ কিছু টাকার দরকার হয়েছিল, তাই মহাজনের কাছ থেকে ছ হাজার টাকা হাওলাত নিয়ে সিন্দুকে রাখা হয়েছিল। টাকাটা পুঁটলি বাঁধা অবস্থায় সিন্দুকের এক কোণে রাখা ছিল। ইতিমধ্যে অনেকবার সিন্দুক খুলেছি। কিন্তু পুঁটলি খুলে দেখবার কথা একবারও মনে হয়নি। আজ সদর থেকে উকিল টাকা চেয়ে পাঠিয়েছেন। পুঁটলি খুলে টাকা বার করতে গেলুম; দেখি, নোটের তাড়ার বদলে কতকগুলো পুরনো খবরের কাগজ রয়েছে।
দেওয়ান নীরব হইলেন।
শুনিতে শুনিতে ব্যোমকেশ আবার চিৎ হইয়া শুইয়া পড়িয়াছিল, কড়িকাঠে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিয়া বলিল, তাহলে সিন্দুকের তালা ঠিকই আছে? চাবি কার কাছে থাকে?
দেওয়ান বলিলেন, সিন্দুকের দুটো চাবি; একটা আমার কাছে থাকে, আর একটা হিমাংশু বাবাজীর কাছে। আমার চাবি ঠিকই আছে, কিন্তু হিমাংশু বাবাজীর চাবিটা শুনছি। ক’দিন থেকে পাওয়া যাচ্ছে না।
হিমাংশুবাবু শুষ্কমুখে বলিলেন, আমারই দোষ। চাবি আমার কোনোকালে ঠিক থাকে না, কোথায় রাখি ভুলে যাই। এবারেও কয়েকদিন থেকে চাবিটা খুঁজে পাচ্ছিলুম না, কিন্তু সেজন্যে বিশেষ উদ্বিগ্ন হইনি--ভেবেছিলুম কোথাও না কোথাও আছেই—
হুঁ—--ব্যোমকেশ উঠিয়া বসিল, হাসিয়া বেবিকে নিজের কোলের উপর বসাইয়া বলিল, মা--লক্ষ্মীর মাস্টারটি জুটেছিল ভাল। কিন্তু তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই আশ্চর্য। ভাল করে খোঁজ করা হচ্ছে তো?
দেওয়ান কালীগতি বলিলেন, যতদূর সাধ্য ভাল করেই খোঁজ করানো হচ্ছে। পুলিস তো আছেই, তার ওপর আমিও লোক লাগিয়েছি। কিন্তু কোনো সংবাদই পাওয়া যাচ্ছে না।
বেবি পুতুল রাখিয়া ব্যোমকেশের গলা জড়াইয়া ধরিল, জিজ্ঞাসা করিল, আমার মাস্টারমশাই কবে ফিরে আসবেন?
ব্যোমকেশ মাথা নাড়িয়া বলিল, জানি না। বোধ হয়। আর আসবেন না।
বেবির চোখ ছলছল করিয়া উঠিল; তাহা দেখিয়া ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা কলি, ‘তুমি মাস্টারমশাইকে খুব ভালবাস—না?
বেবি ঘাড় নীড়িল—হ্যাঁ--খুব ভালবাসি। তিনি আমাকে কত অঙ্ক শেখাতেন। —আচ্ছা, বল তো, সাত--নাম কত হয়?
ব্যোমকেশ বলিল, ক’ত? চৌষট্টি?
বেবি বলিল, দ্যুৎ! তুমি কিছু জান না। সাত--নাম তেষট্টি! আচ্ছা, তুমি মা কালীর স্তব জানো?
ব্যোমকেশ হতাশভাবে বলিল, না। মা কালীর স্তবও কি তোমার মাস্টারমশায় শিখিয়েছিলেন নাকি?”
হ্যাঁ--শুনবে? বলিয়া বেবি সুর করিয়া আরম্ভ করিল—
নমস্তে কালিকা দেবী করল বদনী—
কালীগতি ইষদহাস্যে তাহাকে বাধা দিয়া বলিলেন, বেবি, তোমার কালীস্তব আমরা পরে শুনিব, এখন তুমি বাগানে খেলা কর গে যাও।
বেবি একটু ক্ষুন্নভাবে পুতুল লইয়া প্ৰস্থান করিল। কালীগতি আস্তে আস্তে বলিলেন, লোকটা মাস্টার হিসেবে মন্দ ছিল না--বেশ যত্ন করে পড়াত—অথচ—
ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইল, বলিল, চলুন, মাস্টারের ঘরটা একবার দেখে আসা যাক।
বাড়ির সম্মুখস্থ লম্বা বারান্দার একপ্রান্তে একটি প্রকোষ্ঠ; দ্বারে তালা লাগানো ছিল, দেওয়ানজী কষি হইতে চাবির গুচ্ছ বাহির করিয়া তালা খুলিয়া দিলেন। আমরা ঘরে প্রবেশ করিলাম।
ঘরটি আয়তনে ছোট। গোটা--দুই কাঠের কবাটযুক্ত আলমারি; টেবিল চেয়ার তক্তপোশেই এমনভাবে ভরিয়া উঠিয়াছে যে মনে হয় পা বাড়াইবার স্থান নাই। দ্বারের বিপরীত দিকে একটা ছোট জানালা ছিল, সেটা খুলিয়া দিয়া ব্যোমকেশ ঘরের চারিদিকে একবার চোখ ফিরাইল। তক্তপোশের উপর বিছানাটা অবিন্যস্তভাবে পাট করা রহিয়াছে; টেবিলের উপর সূক্ষ্ম একপুরু ধূলার প্রলেপ পড়িয়াছে; ঘরের অন্ধকার একটা কোণে দড়ি টাঙাইয়া কাপড়--রাখিবার ব্যবস্থা। একটা আলমারির কবাট ঈষৎ উন্মুক্ত। দেওয়ালে লন্বিত একখানি কালীঘাটের পটের কালীমূর্তি হরিনাথ মাস্টারের কালীপ্রীতির পরিচয় দিতেছে।
ব্যোমকেশ তক্তপোশের নীচে উঁকি মারিয়া একজোড়া জুতা টানিয়া বাহির করিল, বলিল, তাই তো জুতোজোড়া যে একেবারে নূতন দেখছি। ও—আপনারাই কিনে দিয়েছিলেন বুঝি?
কালীগীতি বলিলেন, হ্যাঁ।
‘আশ্চর্য! আশ্চর্য!’ জুতা রাখিয়া দিয়া ব্যোমকেশ দড়ির আলনাটার দিকে গেল। আলনায় কয়েকটা কাচা আকাচা কাপড় জামা বুলিতেছিল, সেগুলিকে তুলিয়া তুলিয়া দেখিল, তারপর আবার বলিল, ভারি আশ্চর্য!
হিমাংশুবাবু কৌতুহলী হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কি হয়েছে?
জবাব দিবার জন্য মুখ ফিরাইয়া ব্যোমকেশ থামিয়া গেল, তাহার দৃষ্টি ঘরের বিপরীত কোণে একটা কুলুঙ্গির উপর গিয়া পড়িল। সে দ্রুতপদে গিয়া কুলুঙ্গির ভিতর হইতে কি একটা তুলিয়া লইয়া জানালার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল, সবিস্ময়ে বলিল, মাস্টার কি চশমা পরত?
কালীগতি বলিলেন,”ওটা বলতে ভুল হয়ে গেছে--পরত বটে। চশমা কি ফেলে গেছে। নাকি?
চশমার কাচের ভিতর দিয়া একবার দৃষ্টি প্রেরণ করিয়া সহাস্যে সেটা আমার হাতে দিয়া ব্যোমকেশ বলিল, হ্যাঁ--আশ্চর্য নয়?
কালীগীতি ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া কিয়ৎকাল চিন্তা করিয়া বলিলেন, আশ্চর্য বটে। কারণ যার চোখ খারাপ তার পক্ষে চশমা ফেলে যাওয়া অস্বাভাবিক। এর কি কারণ হতে পারে আপনার মনে হয়?
ব্যোমকেশ বলিল,”অনেক রকম কারণ থাকতে পারে। হয়তো তার সত্যি চোখ খারাপ ছিল না, আপনাদের ঠকাবার জন্যে চশমা পরত ৷
ইত্যবসরে আমি আর কুমার ত্রিদিব চশমাটা পরীক্ষা করিতেছিলাম। স্টীল ফ্রেমের নড়বড়ে বাহুযুক্ত চশমা, কাচ পুরু। কাচের ভিতর দিয়া দেখিবার চেষ্টা করিলাম। কিন্তু ধোঁয়া ছাড়া কিছুই দেখিতে পাইলাম না।
কুমার ত্রিদিব বলিলেন, ব্যোমকেশবাবু, আপনার অনুমান বোধহয় ঠিক নয়। চশমাটা অনেকদিনের ব্যবহারে পুরনো হয়ে গেছে আর কাঁচের শক্তিও খুব বেশি।
ব্যোমকেশ বলিল, আমার ভুলও হতে পারে। তবে, মাস্টার আর কারুর পুরনো চশমা নিয়ে এসেছিল এটাও তো সম্ভব। যা হোক, এবার আলমারিটা দেখা যাক ৷
খোলা আলমারিটার কবাট উদঘাটিত করিয়া দেখা গেল, তাহার মধ্যে থাকে থাকে খেরো--বাঁধানো স্থুলকায় হিসাবের খাতা সাজানো রহিয়াছে—বোধহয় সবসুদ্ধ পঞ্চাশ--ষাটখানা। ব্যোমকেশ উপরের একটা খাতা নামাইয়া দুহাতে ওজন করিয়া বলিল, বেশ ভারী আছে, সের চারেকের কম হবে না। প্রত্যেক খাতায় বুঝি এক বছরের হিসেব আছে?
কালীগতি বলিলেন, হ্যাঁ।
ব্যোমকেশ খাতার গোড়ার পাতা উল্টাইয়া দেখিল, পাঁচ বছর আগেকার খাতা, ইহার পর হইতে শেষ চার বছরের খাতা চুরি গিয়াছে। আরো কয়েকখানা খাতা বাহির করিয়া ব্যোমকেশ হিসাব রাখিবার প্রণালী মোটামুটি চোখ বুলাইয়া দেখিল। প্রত্যেকটি খাতা দুই অংশে বিভক্ত--অর্থাৎ একাধারে জাবদা ও পাকা খাতা। এক অংশে দৈনন্দিন খুচরা আয়--ব্যয়ের হিসাব লিখিত হইয়াছে—অন্য অংশে মোট দৈনিক খরচ তুলিয়া দেওয়া হইয়াছে। সাধারণত জমিদারী খাতা এরূপভাবে লিখিত হয় না, কিন্তু এরূপ লেখার সুবিধা এই যে অল্প পরিশ্রমে জাবদা ও পাকা খাতা মিলাইয়া দেখা যায়।
গোড়া হইতে ব্যোমকেশ ব্যাপারটাকে খুব হাল্কাভাবে লইয়াছিল। অতি সাধারণ গতানুগতিক চুরি ছাড়া ইহার মধ্যে আর কোনও বৈশিষ্ট্য আছে তাহা বোধহয় সে মনে করে নাই। কিন্তু ঘর পরীক্ষা শেষ করিয়া যখন সে বাহিরে আসিল তখন দেখিলাম তাহার চোখের দৃষ্টি প্রখর হইয়া উঠিয়াছে। ও দৃষ্টি আমি চিনি। কোথাও সে একটা গুরুতর কিছুর ইঙ্গিত পাইয়াছে; হয়তো যত তুচ্ছ মনে করা গিয়াছিল ব্যাপার তত তুচ্ছ নয়। আমিও মনে মনে একটু উত্তেজিত হইয়া উঠিলাম।
ঘরের বাহিরে আসিয়া ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ ভ্রু কুঞ্চিত করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল, তারপর হিমাংশুবাবুর দিকে ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আমি এ ব্যাপারে তদন্ত করি আপনি চান?
মুহুর্তকালের জন্য হিমাংশুবাবু যেন একটু দ্বিধা করিলেন, তারপর বলিলেন, হ্যাঁ--চাই বই কি। এতগুলো টাকা, তার একটা কিনারা হওয়া তো দরকার।
ব্যোমকেশ বলিল, তাহলে আমাদের দু’জনকে এখানে থাকতে হয়।
হিমাংশুবাবু বলিল, নিশ্চয় নিশ্চয়। সে আর বেশি কথা কি—
ব্যোমকেশ কুমার ত্ৰিদিবের দিকে ফিরিয়া বলিল, কিন্তু কুমার বাহাদুর যদি অনুমতি দেন তবেই আমরা থাকতে পারি। আমরা ওঁর অতিথি।
কুমার ত্রিদিব লজ্জায় পড়িলেন। আমাদের ছাড়িবার ইচ্ছা তাঁহার ছিল না। কিন্তু ব্যোমকেশের ইচ্ছাটাও তিনি বুঝিতে পারিতেছিলেন। ব্যোমকেশ হিমাংশুবাবুর কাজ করিয়া কিছু উপার্জন করিতে চায় এরূপ সন্দেহও হয়তো তাঁহার মনে জাগিয়া থাকিবে। তাই তিনি কুন্ঠিতভাবে বলিলেন, বেশ তো, আপনারা থাকলে যদি হিমাংশুর উপকার হয়—
ব্যোমকেশ মাথা নাড়িয়া বলিল, তা বলতে পারি না। হয়তো কিছুই করে উঠতে পারবো না। হিমাংশুবাবু, আপনার যদি এ বিষয়ে আগ্রহ না থাকে তো বলুন--চক্ষুলজ্জা করবেন না। আমরা কুমার ত্ৰিদিবের বাড়িতে বেড়াতে এসেছি, বিষয়চিন্তাও কলকাতায় ফেলে এসেছি। তাই, আপনি যদি আমাদের সাহায্য দরকার না মনে করেন, তাহলে আমি বরঞ্চ খুশিই হব।
ব্যোমকেশ কুমার বাহাদুরের ভিত্তিহীন সন্দেহটার আভাস পাইয়াছে বুঝিতে পারিয়া তিনি আরো লজ্জিত হইয়া উঠিলেন, তাড়াতাড়ি বলিলেন, না না ব্যোমকেশবাবু, আপনারা থাকুন। যতদিন দরকার থাকুন। আপনারা থাকলে নিশ্চয় এ ব্যাপারে কিনারা করতে পারবেন। আমি রোজ এসে আপনাদের খবর নিয়ে যাব ৷
হিমাংশুবাবু ঘাড় নাড়িয়া সমর্থন করিলেন। আমাদের থাকাই স্থির হইয়া গেল। অতঃপর চায়ের ডাক পড়িল; আমরা বৈঠকখানায় ফিরিয়া গেলাম। প্ৰায় নীরবেই চা--পান সমাপ্ত হইল। কুমার ত্রিদিব ঘড়ির দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলেন, সাড়ে চারটে বাজে। হিমাংশু, ‘আমি তাহলে আজ চলি। কাল আবার কোনও সময় আসব।’ বলিয়া উঠিয়া পড়িলেন।
কম্পাউন্ডের বাহিরে মোটর অপেক্ষা করিতেছিল। আমি এবং ব্যোমকেশ কুমারের সঙ্গে ফটক পর্যন্ত গেলাম। কুমার বাহাদুর নিজের জমিদারীতে আমাদের জন্য অনেক আমোদ--প্রমোদের ব্যবস্থা করিয়া রাখিয়াছিলেন--পুকুরে মাছ ধরা, খালে নৌ বিহার প্রভৃতি বহুবিধ ব্যসনের আয়োজন হইয়াছিল। সে সব ব্যর্থ হইয়া যাওয়ায় তিনি একটু ক্ষুব্ধ হইয়াছিলেন। মোটরের কাছে পৌঁছিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, এ কাজটায় আপনার কতদিন লাগবে?
ব্যোমকেশ বলিল, কিছুই এখনো বলতে পারছি না—আপনি আমাকে ঘোর অকৃতজ্ঞ মনে করছেন, মনে করাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখানকার ব্যাপারটা অত্যন্ত গুরুতর—আমোদ--আহ্লাদের অছিলায় একে উপেক্ষা করলে অন্যায় হবে।
কুমার বাহাদুর সচকিত হইয়া বলিলেন, তাই নাকি! কিন্তু আমার তো অতটা মনে হল না। অবশ্য অনেকগুলো টাকা গেছে—
টাকা যাওয়াটা নেহাৎ অকিঞ্চিৎকর ৷
তবে?
ব্যোমকেশ একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, আমার বিশ্বাস হরিনাথ মাস্টার বেঁচে নেই।
আমরা দুজনেই চমকিয়া উঠিলাম।
কুমার বলিলেন, সে কি?
ব্যোমকেশ বলিল, তাই মনে হচ্ছে। আশা করি একথা শোনবার পর আমাকে সহজে ক্ষমা করতে পারবেন ৷
কুমার উদ্বিগ্নমুখে বলিলেন, না না, ক্ষমার কোনো কথাই উঠছে না। আপনাকে ছেড়ে দেওয়া আমার কর্তব্য। একটা লোক যদি খুন হয়ে থাকে—
ব্যোমকেশ বলিল, খুনই হয়েছে এমন কথা আমি বলছি না। তবে সে বেঁচে নেই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস। যা হোক, ও আলোচনা আরও প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত মুলতুবি থাক। আপনি কাল আসছেনতো?তাহলে আমাদের সুটকেসগুলোও সঙ্গে করে আনবেন। আচ্ছা—আজ বেরিয়ে পড়ুন--পৌঁছুতে অন্ধকার হয়ে যাবে।
কুমারের মোটর বাহির হইয়া যাইবার পর আমরা বাড়ির দিকে ফিরিলাম। ফটক হইতে বাড়ির সদর প্রায় একশত গজ দূরে, মধ্যের বিস্তৃত ব্যবধান নানা জাতীয় ছোট বড় গাছপালায় পূর্ণ। মাঝে মাঝে লোহার বেঞ্চি পাতিয়া বিশ্রামের স্থান করা আছে।
দেওয়ানের ক্ষুদ্র দ্বিতল বাড়ি দক্ষিণে রাখিয়া আমরা বাগানে প্রবেশ করিলাম। শীতকালের দীর্ঘ গোধূলি তখন নামিয়া আসিতেছে। অবসন্ন দিবার শেষ রক্তিম আভা পশ্চিমে জঙ্গলের মাথায় অলক্ষ্যে সঙ্কুচিত হইয়া আসিতেছে।
ব্যোমকেশ চিন্তিত নতমুখে পকেটে হাত পুরিয়া ধীরে ধীরে চলিয়াছিল; চিন্তার ধারা তাহার কোন সর্পিল পথে চলিয়াছে বুঝিবার উপায় ছিল না। হরিনাথ মাস্টারের ঘরে সে এমন কি পাইয়াছে যাহা হইতে তাহার মৃত্যু অনুমান করা যাইতে পারে--এই কথা ভাবিতে ভাবিতে আমিও একটু অন্যমনস্ক হইয়া পড়িলাম। নিঃঝুম পাড়াগাঁয়ের নিস্তরঙ্গ জীবনযাত্রার মাঝখানে এতবড় একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়াছে, অন্তর হইতে যেন গ্ৰহণ করিতে পারিতেছিলাম না। কিন্তু তবু কিছুই বলা যায় না— গুঢ়নক্র হ্রদের উপরিভাগ বেশ প্রসন্নই দেখায়। ব্যোমকেশের সঙ্গে অনেক রহস্যময় ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট থাকিয়া একটু বুঝিয়েছিলাম যে, মুখ দেখিয়া মানুষ চেনা যেমন কঠিন, কেবলমাত্র বহিরাবয়ব দেখিয়া কোনো ঘটনার গুরুত্ব নির্ণয় করাও তেমনি দুঃসাধ্য।
একটা ইউক্যালিপ্টাস গাছের তলায় দাঁড়াইয়া ব্যোমকেশ সিগারেট ধরাইল, তারপর উর্ধ্বমুখে চাহিয়া কতকটা আত্মগতভাবেই বলিল, জুতো পরে না যাবার একটা কারণ থাকতে পারে, জুতো পরে হাঁটলে শব্দ হয়। যে লোক দুপুর রাত্রে চুপি চুপি করে পালাচ্ছে তার পক্ষে খালি পায়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু সে জামা পরবে না কেন? চশমাটাও ফেলে যাবে কেন?
আমি বলিলাম, চশমা সম্বন্ধে তুমি বলতে পার, কিন্তু জামা পরেনি একথা জানলে কি করে?
ব্যোমকেশ বলিল, গুণে দেখলুম সবগুলো জামা রয়েছে। কাজেই প্রমাণ হল যে জামা পরে যায়নি।
আমি বলিলাম, তার কতগুলো জামা ছিল তার হিসাব তুমি পেলে কোত্থেকে?
ব্যোমকেশ বলিল, দেওয়ানজীর কাছ থেকে। তুমি বোধহয় লক্ষ্য করনি, ভাণ্ডার থেকে মাস্টারকে দুটো গেঞ্জি আর দুটো জামা দেওয়া হয়েছিল। তা ছাড়া সে নিজে একটা ছেঁড়া কামিজ পরে এসেছিল। সেগুলো সব আলনায় টাঙানো রয়েছে।
আমি একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলাম, তাহলে তুমি অনুমান কর যে—
ব্যোমকেশ পশ্চিম আকাশের ক্ষীণ শশিকলার দিকে তাকাইয়া ছিল, হঠাৎ সেইদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিয়া উঠিল, ওহে, দেখেছ? সবে মাত্ৰ শুক্লপক্ষ পড়েছে। সে রাত্রে কি তিথি ছিল বলতে পারো?
তিথি নক্ষত্রের সঙ্গে কোনো দিনই সম্পর্ক নাই, নীরবে মাথা নাড়িলাম। ব্যোমকেশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাঁদকে পর্যবেক্ষণ করিয়া বলিল, বোধহয়--অমাবস্যা ছিল। না, ‘চল পাঁজি দেখা যাক ৷’ তাহার কণ্ঠস্বরে একটা নূতন উত্তেজনার আভাস পাইলাম।
চাঁদের দিকে চাহিয়া কবি এবং নবপ্রণয়ীরা উত্তেজিত হইয়া উঠে জানিতাম; কিন্তু ব্যোমকেশের মধ্যে কবিত্ব বা প্রেমের বাষ্পটুকু পর্যন্ত না থাকা সত্ত্বেও সে চাঁদ দেখিয়া এমন উতলা হইয়া উঠিল কেন বুঝিলাম না। যা হোক, তাহার ব্যবহার অধিকাংশ সময়েই বুঝিতে পারি না--ওটা অভ্যাস হইয়া গিয়াছে। তাই সে যখন ফিরিয়া বাড়ির অভিমুখে চলিল, তখন আমিও নিঃশব্দে তাহার সহগামী হইলাম।
আমরা বাগানের যে অশংটায় আসিয়া পৌঁছিয়ছিলাম, সেখান হইতে বাড়ির ব্যবধান পঞ্চাশ গজের বেশি হইবে না। সিধা যাইলে মাঝে কয়েকটা বড় বড় ঝাউয়ের ঝোপ উৰ্ত্তীর্ণ হইয়া যাইতে হয়। ঝাউয়ের ঝোপগুলা বাগানের কিয়দংশ ঘিরিয়া যেন পৃথক করিয়া রাখিয়াছে।
ঘাসের উপর দিয়া নিঃশব্দপদে আমরা প্ৰায় ঝাউ ঝোপের কাছে পৌঁছিয়াছি, এমন সময় ভিতর হইতে একটা চাপা কান্নার আওয়াজ পাইয়া আমাদের গতি আপনা হইতেই রুদ্ধ হইয়া গেল। ব্যোমকেশের দিকে চাহিয়া দেখিলাম, সে ঠোঁটের উপর আঙুল রাখিয়া আমাকে নীরব থাকিবার সঙ্কেত জানাইতেছে।
কান্নার ভিতর হইতে একটা ভাঙা গলার আওয়াজ শুনিতে পাইলাম— বাবু, এই অনাদি সরকার আপনাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে—পুরনো চাকর বলে আমাকে দয়া করুন। মা--ঠাকরুণ ভুল বুঝেছেন। আমার মেয়ে অপরাধী—কিন্তু আপনার পা ছুঁয়ে বলছি, ও মহাপাপ আমরা করিনি।
কিছুক্ষণ আর কোনো শব্দ নাই, তারপর হিমাংশুবাবুর কড়া কঠিন স্বর শুনা গেল—ঠিক বলছ? তোমরা মারোনি?
ধর্ম জানেন হুজুর। আপনি মালিক--দেবতা, আপনার কাছে যদি মিথ্যে কথা বলি। তবে যেন আমার মাথায় বজ্ৰাঘাত হয় ৷
আবার কিছুক্ষণ কোনও সাড়াশব্দ নাই, তারপর হিমাংশুবাবু বলিলেন, কিন্তু রাধাকে আর এখানে রাখা চলবে না। কালই তাকে অন্যত্র পাঠাবার ব্যবস্থা কর। একথা যদি জানাজানি হয়। তখন আমি আর দয়া করতে পারব না— এমনিতেই বাড়িতে অশান্তির শেষ নেই।
অনাদি ব্যগ্ৰকণ্ঠে বলিল, আজ্ঞে হজুর, কালই তাকে আমি কাশী পাঠিয়ে দেব; সেখানে তার এক মাসী থাকে—
বেশ--যদি খরচ চালাতে না পারো—
ব্যোমকেশ আমার হাত ধরিয়া টানিয়া লইল। পা টিপিয়া টিপিয়া আমরা সরিয়া গেলাম।
মিনিট পনেরো পরে অন্য দিক দিয়া ঘুরিয়া বাড়ির সম্মুখে উপস্থিত হইলাম। বারান্দার উপরে দাঁড়াইয়া কালীগতিবাবু একজন নিম্নতন কর্মচারীর সহিত কথা বলিতেছিলেন, বেবি তাঁহার হাত ধরিয়া আব্দারের সুরে কি একটা উপরোধ করিতেছিল—তাহার কথার খানিকটা শুনিতে পাইলাম, ‘একবারটি ডাকো না—’
কালীগতি একটু বিব্রত হইয়া বলিলেন, আঃ পাগলি--এখন নয়।
বেবি অনুনয় করিয়া বলিল, না দেওয়ানদাদু, একবারটি ডাকো, ঐ ওঁরা শুনবেন। বলিয়া আমাদের নির্দেশ করিয়া দেখাইল।
কালীগতি আমাদের দেখিয়া অগ্রসর হইয়া আসিলেন, যে আমলাটি দাঁড়াইয়া ছিল তাহাকে চলিয়া যাইতে ইঙ্গিত করিয়া, প্রশান্ত হাস্যে জিজ্ঞাসা করিলেন, বাগানে বেড়াচ্ছিলেন বুঝি?
ব্যোমকেশ বলিল, হ্যাঁ--বেবি কি বলছে? কাকে ডাকতে হবে?
কালীগতি মুখের একটা ভঙ্গী করিয়া বলিলেন, ওর যত পাগলামি। এখন শেয়াল--ডাক ডাকতে হবে।
আমি সবিস্ময়ে বলিলাম, সে কি রকম?
কালীগতি বেবির দিকে ফিরিয়া বলিলেন, এখন কাজের সময়, এখন বিরক্ত করতে নেই। যাও—মা’র কাছে গিয়ে একটু পড়তে বসো গে।
বেবি কিন্তু ছাড়িবার পাত্রী নয়, সে তাঁহার আঙুল মুঠি করিয়া ধরিয়া বলিতে লাগিল, না দাদু, একবারটি—
অগত্যা কালীগতি চুপি চুপি তাহার কানের কাছে মুখ লইয়া গিয়া বলিলেন, তুমি যখন ঘুমুতে যাবে তখন শোনাব--কেমন? এখন যাও লক্ষ্মী দিদি আমার।
বেশি খুশি হইয়া বলিল, নিশ্চয় কিন্তু! তা না হলে আমি ঘুমুব না।
আচ্ছা বেশ।
বেবি প্ৰস্থান করিলে কালীগতি বলিলেন, এইমাত্র থানা থেকে খবর নিয়ে লোক ফিরে এল--মাস্টারের কোনো সন্ধানই পাওয়া যায়নি।
‘ও।’ ব্যোমকেশ একটু থামিয়া জিজ্ঞাসা করিল, অনাদি বলে কোনো কর্মচারী আছে কি?
আছে। অনাদি জমিদার বাড়ির সরকার।’ বলিয়া কালীগতি উৎসুক নেত্ৰে তাহার পানে চাহিলেন।
ব্যোমকেশ যেন একটু চিন্তা করিয়া বলিল, তাকে দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না। সে কি আমলাদের পাড়াতেই থাকে?
কালীগীতি বলিলেন, না। সে বহুকালের পুরনো চাকর। বাড়ির পিছন দিকে আস্তাবলের লাগাও কতকগুলো ঘর আছে, সেই ঘরগুলো নিয়ে সে থাকে ৷
একলা থাকে?
না, তার এক বিধবা মেয়ে আর স্ত্রী আছে। মেয়েটি কদিন থেকে অসুখে ভুগছে; অনাদিকে বললুম কবিরাজ ডাকো, তা সে রাজী নয়। বললে, আপনি সেরে যাবে। —কেন বলুন দেখি?
না--কিছু নয়। কাছে পিঠে কারা থাকে তাই জানতে চাই। অন্যান্য আমলারা বুঝি হাতার বাইরে থাকে?
হ্যাঁ, তাদের জন্যে একটু দূরে বাসা তৈরি করিয়া দেওয়া হয়েছে—সবসুদ্ধ সাত--আট ঘর আমলা আছে। শহর থেকে যাতায়াত করলে সুবিধা হয় না, তাই কর্তার আমলেই তাদের জন্যে একটা পাড়া বসানো হয়েছিল ৷
শহর এখান থেকে কতদূর?
মাইল পাঁচেক হবে। সামনের রাস্তাটা সিধা পুব দিকে শহরে গিয়েছে।
এই সময় হিমাংশুবাবু বাড়ির ভিতর হইতে আসিয়া সহাস্যমুখে বলিলেন, আসুন ব্যোমকেশবাবু, আমার অস্ত্রাগার আপনাদের দেখাই।
আমরা সাগ্রহে তাঁহার অনুসরণ করিলাম। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছিল, দেওয়ান আহ্নিক করিবার সময় উপস্থিত বলিয়া খড়ম পায়ে অন্য দিকে প্রস্থান করিলেন।
হিমাংশুবাবু একটি মাঝারি আয়তনের ঘরে আমাদের লইয়া গেলেন। ঘরের মধ্যস্থলে টেবিলের উপর উজ্জ্বল আলো জ্বলিতেছিল। দেখিলাম, মেঝেয় বাঘ ভালুক ও হরিণের চামড়া বিছানো রহিয়াছে; দেওয়ালের ধারে ধারে কয়েকটি আলমারি সাজানো। হিমাংশুবাবু একে একে আলমারিগুলি খুলিয়া দেখাইলেন, নানাবিধ বন্দুক পিস্তল ও রাইফেলে আলমারিগুলি ঠাসা। এই হিংস্ৰ অস্ত্রগুলির প্রতি লোকটির অদ্ভুত স্নেহ দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া গেলাম। প্রত্যেকটির গুণাগুণ--কোনটির দ্বারা কবে কোন জন্তু বধ করিয়াছেন, কাহার পাল্লা কতখানি, কোন রাইফেলের গুলি বামদিকে ঈষৎ প্রক্ষিপ্ত হয়--এ সমস্ত তাঁহার নখদর্পণে। এই অস্ত্রগুলি তিনি প্ৰাণান্তেও কাহাকেও ছুঁইতে দেন না; পরিষ্কার করা, তেল মাখানো সবই নিজে করেন।
অস্ত্ৰ দেখা শেষ হইলে আমরা সেই ঘরেই বসিয়া গল্পগুজব আরম্ভ করিলাম। নানা বিষয়ের কথাবার্তা হইল। বিভিন্ন পারিপার্শ্বিকের মধ্যে একই মানুষকে এত বিভিন্ন রূপে দেখা যায় যে তাহার চরিত্র সম্বন্ধে একটা অভ্রান্ত ধারণা করিয়া লওয়া কঠিন হইয়া পড়ে। কিন্তু কচিৎ স্বভাবছদ্মবেশী মানুষের মন অত্যন্ত অন্তরঙ্গভাবে আত্মপরিচয় দিয়া ফেলে। এই ঘরে বসিয়া আয়াসহীন অনাড়ম্বর আলোচনার ভিতর দিয়া হিমাংশুবাবুর চিত্তটিও যেন স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া ধরা দিল। লোকটি যে অতিশয় সরল চিত্ত--মনটিও তাঁহার বন্দুকের গুলির মত একান্ত সিধা পথে চলে, এ বিষয়ে অন্তত আমার মনে কোনো সন্দেহ রহিল না।
আমাদের সঞ্চরমান আলোচনা নানা পথ ঘুরিয়া কখন অজ্ঞাতসারে বিষয় সম্পত্তি পরিচালনা, দেশের জমিদারের অবস্থা ইত্যাদি প্রসঙ্গের মধ্যে গিয়া পড়িয়াছিল। হিমাংশুবাবু এই সূত্রে নিজের সম্বন্ধে অনেক কথা বলিলেন। প্রজাদের সঙ্গে গত কয়েক বৎসর ধরিয়া নিয়ত সঙঘর্ষে তাঁহার মন তিক্ত হইয়া উঠিয়াছিল। জমিদারীর আয় প্ৰায় বন্ধ হইয়া গিয়াছে অথচ মামলা মোকদ্দমায় খরচের অন্ত নাই; ফলে, এই কয় বছরে ঋণের মাত্রা প্ৰায় লক্ষের কোঠায় ঠেকিয়াছে। নিজের বিষয় সম্পত্তির সম্বন্ধে এই সব গুহ্য কথা তিনি অকপটে প্রকাশ করিলেন। দেখিলাম, জমিদারী সংক্রান্ত অশান্তি তাহাকে বিষয় সম্পত্তির প্রতি আরো বিতৃষ্ণ করিয়া তুলিয়াছে। বিপদের গুরুত্ব অনভিজ্ঞতাবশত ঠিক বুঝিতে পারিতেছেন না, তাই মাঝে মাঝে অনির্দিষ্ট আতঙ্কে মন শঙ্কিত হইয়া উঠে; তখন সেই শঙ্কাকে তাড়াইবার জন্য প্রিয় ব্যসন শিকারের প্রতি আরো আগ্রহে ঝুঁকিয়া পড়েন। তাঁহার মনের অবস্থা বর্তমানে এইরূপ।
কথায়বার্তায় রাত্রি সাড়ে আটটা বাজিয়া গেল। অতঃপর অন্দর হইতে আহারের ডাক আসিল। এই সময় অনাদি সরকারকে দেখিলাম; সে আমাদের ডাকিতে আসিয়াছিল। লোকটির বয়স বছর পঞ্চাশ হইবে; অত্যন্ত শীর্ণ কোলকুঁজা চেহারা। গালের মাংস চুপসিয়া অভ্যন্তরের কোন অতল গহ্বরে অদৃশ্য হইয়া গিয়াছে, ঝাঁকড়া গোঁফ ওষ্ঠাধর লঙ্ঘন করিয়া চিবুকের কাছে আসিয়া পড়িয়ছে। চোখে একটা অস্বচ্ছন্দ উৎকণ্ঠিত দৃষ্টি--যেন কোনও দারুণ দুস্কৃতি করিয়া ধরা পড়িবার ভয়ে সর্বদা সশঙ্ক হইয়া আছে।
ব্যোমকেশ তাহাকে একবার তীক্ষ্মদৃষ্টিতে আপাদমস্তক দেখিয়া লইল। তারপর আমরা তিনজনে তাহাকে অনুসরণ করিয়া অন্দর মহলে প্রবেশ করিলাম।
আহারাদির পর একজন ভৃত্য আমাদের পথ দেখাইয়া শয়নকক্ষে লইয়া গেল। ভূত্যটির নাম ভুবন--সেই হিমাংশুবাবুর খাস বেয়ারা। শয়নকক্ষে ইজিচেয়ারে বসিয়া আমরা সিগারেট ধরাইলাম; ভুবন মশারি ফেলিয়া, জলের কুঁজা হাতের কাছে রাখিয়া, ঘরের এটা ওটা ঝাড়িয়া ঝাড়ন স্কন্ধে প্রস্থান করিতেছিল, ব্যোমকেশ তাহাকে ডাকিয়া বলিল, তুমি তো হরিনাথ মাস্টারকে ছমাস ধরে দেখেছ, সে কি সব সময় চশমা পরে থাকত?
আমরা যে চুরির তদন্ত করিতে আসিয়াছি তাহা ভুবন বোধকরি জানিত, তাই কথা কহিবার সুযোগ পাইয়া সে উৎসুকভাবে বলিল, আজ্ঞে হ্যাঁ, চব্বিশ ঘণ্টাই তো চশমা পরে থাকতেন। একদিন চশমা না পরে স্নান করতে যাচ্ছিলেন, হোঁচটি খেয়ে পড়ে গেলেন। বিনা চশমায় তিনি এক--পা চলতে পারতেন না বাবু।
ব্যোমকেশ বলিল, হুঁ। আচ্ছা, তার জুতো ক’জোড়া ছিল বলতে পার?
ভুবন হাসিয়া বলিল, জুতো আবার ক’জোড়া থাকবে বাবু, এক জোড়া। তাও সরকার থেকে কিনিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যে--জোড়া পরে তিনি এসেছিলেন সে তো এমন ছেঁড়া যে কুকুরেও খায় না। আমরা সেই দিনই জুতো টান মেরে আস্তাকুড়ে ফেলে দিয়েছিলুম।
বটে! আচ্ছা, মাস্টারের ঘরের দেয়ালে যে একটি মা কালীর ছবি টাঙানো রয়েছে সেটা কি মাস্টার সঙ্গে করে এনেছিল?
আজ্ঞে না হুজুর, মাস্টারবাবু একটি খড়কে কাঠিও সঙ্গে করে আনেননি। ও ছবি দেওয়ানজীর কাছ থেকে মাস্টারবাবু একদিন এনে নিজের ঘরে টাঙিয়েছিলেন।
‘বুঝেছি।’ ব্যোমকেশ একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, আচ্ছা, তুমি এখন যেতে পার।
ভুবন জিজ্ঞাসা করিল, আর কিছু চাই না হুজুর?
না। ভাল কথা, একটা কাজ করতে পার? বাড়িতে পাঁজি আছে নিশ্চয়, একবার আনতে পার?
ভুবন বোধকরি মনে মনে একটু বিস্মিত হইল। কিন্তু সে জমিদার বাড়ির লেফাফাদুরস্ত চাকর, সে ভাবে প্রকাশ না করিয়া বলিল, এখনি কি চাই হুজুর?
এখনি হলে ভাল হয়।
যে আজ্ঞে--এনে দিচ্ছি।
ভুবন বাহির হইয়া গেল। আমরা নীরবে ধূমপান করিতে লাগিলাম। পাঁচ মিনিট কাটিয়া গেল।
তারপর, হঠাৎ অতি সন্নিকটে একটানা বিকট একটা আর্তনাদ শুনিয়া আমরা ধড়মড় করিয়া সোজা হইয়া বসিলাম। কিন্তু তখনি বুঝিলাম, অনৈসৰ্গিক কিছু নয়--শেয়াল ডাকিতেছে। পাঁচ--ছয়টা শৃগাল একত্র হইয়া নিকটেরই কোনো স্থান হইতে সম্মিলিত উর্ধ্বস্বরে যাম ঘোষণা করিতেছে। এত নিকট হইতে শব্দটা আসিল বলিয়া হঠাৎ চমকিয়া উঠিয়াছিলাম।
এই সময় ভুবন পাঁজি হাতে ফিরিয়া আসিল। আমি বলিয়া উঠিলাম, ও কি হে! বাড়ির এত কাছে শেয়াল ডাকছে?
শেয়ালের ডাক তখন থামিয়াছে, ভুবন হাসি চাপিয়া বলিল, আসল শেয়াল নয় হুজুর। বেবিদিদি আজ সন্ধ্যে থেকে বায়না ধরেছিলেন দেওয়ান ঠাকুরের কাছে শেয়াল ডাক শুনবেন। তাই তিনিই ডাকছেন।
আমি বলিলাম, হ্যাঁ হ্যাঁ, আজ সন্ধ্যেবেলা বেবি বলছিল বটে। কিন্তু আশ্চর্য ক্ষমতা তো দেওয়ানজীর! একেবারে অবিকল শেয়ালের ডাক, কিছু বোঝবার জো নেই!
ভুবন বলিল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ হুজুর। দেওয়ান ঠাকুর চমৎকার জন্তু--জানোয়ারের ডাক ডাকতে পারেন।’ বলিয়া পাঁজি ব্যোমকেশের পাশে টেবিলের উপর রাখিল।
ব্যোমকেশের দিকে চাহিয়া দেখিলাম, সে যেন হঠাৎ পাথরের মূর্তিতে পরিণত হইয়া গিয়াছে; চোখের দৃষ্টি স্থির, সবার্ঙ্গের পেশী টান হইয়া শক্ত হইয়া আছে। আমি সবিস্ময়ে বলিয়া উঠিলাম, কি হে?
ব্যোমকেশের চমক ভাঙিল। চোখের সম্মুখ দিয়া হাতটা একবার চালাইয়া বলিল, কিছু না। —এই যে পাঁজি এনেছ? বেশ, তুমি এখন যেতে পারো।
ভুবন প্ৰস্থান করিল। ব্যোমকেশ পাঁজিটা তুলিয়া লইয়া তাহার পাতা উল্টাইতে লাগিল। খানিক পরে একটা পাতায় আসিয়া তাহার দৃষ্টি রুদ্ধ হইল। সেই পাতাটা পড়িয়া সে পাঁজি আমার দিকে অগ্রসর করিয়া দিয়া বলিল, এই দেখ।
মনে হইল, তাহার গলার স্বর উত্তেজনায় ঈষৎ কাঁপিয়া গেল।
পাঁজির নির্দিষ্ট পাতাটা পড়িলাম। দেখিলাম, যে--রাত্রে মাস্টার নিরুদ্দেশ হইয়া যায় সে--রাত্রিটা ছিল অমাবস্যা।
পরদিন সকাল সাতটার সময় গাত্ৰোত্থান করিয়া, প্ৰাতঃকৃত্য সমাপনান্তে বাহিরে আসিয়া দেখিলাম—তখনো সমস্ত বাড়িটা সুপ্ত। একজন ভৃত্য বারান্দা ঝাঁট দিতেছিল, তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানা গেল যে শীতকালে বেলা আটটা সাড়ে আটটার পূর্বে কেহ শয্যা ত্যাগ করে না। ইহাই এ বাড়ির রেওয়াজ।
এই দেড় ঘণ্টা সময় কি করিয়া কাটানো যায়? আকাশে একটু কুয়াশার আভাস ছিল; সূর্যের আলো ভাল করিয়া ফুটে নাই। আমার মন উসখুস করিয়া উঠিল, বলিলাম, চল ব্যোমকেশ, এখন তো তোমার কোনো কাজ হবে না; জঙ্গলে গিয়ে দু’চারটে পাখি মারা যাক। তারপর এদের ঘুম ভাঙতে ভাঙতে ফিরে আসা যাবে।
প্রথম বন্দুক চালাইতে শিখিয়া আগ্রহের মাত্রা কিছু বেশি হইয়াছিল, মনে হইতেছিল যাহা পাই তাহারই দিকে লক্ষ্য করিয়া বন্দুক ছুঁড়িয়া দিই। বিশেষত কাল বন্দুক দুটা কুমার বাহাদুর এখানেই রাখিয়া গিয়াছিলেন, টোটাও কোটের পকেটে কয়েকটা অবশিষ্ট ছিল।
ব্যোমকেশ ক্ষণেক চিন্তা করিয়া বলিল, চল।
বন্দুক কাঁধে করিয়া বাহির হইলাম। যে চাকরটা ঝাঁট দিতেছিল তাহাকে প্রশ্ন করায় সে জঙ্গলের যাইবার রাস্তা দেখাইয়া দিল; বলিল, এই পথে সিধা। যাইলে বালির পাশ দিয়া জঙ্গলে প্রবেশ করিতে পারিব। আমরা সবুজ ঘাসে ভরা চারণভূমির উপর দিয়া চলিলাম।
কুয়াশার জন্য ঘাসে শিশির পড়ে নাই, জুতা ভিজিল না। চলিতে চলিতে দেখিলাম, সম্মুখে এক মাইল দূরে বনের গাছগুলি গাঢ় বর্ণে আঁকা রহিয়াছে, তাহার কোলের কাছে বালু--বেলা অর্ধচন্দ্রাকারে পড়িয়া আছে—দূর হইতে অস্পষ্ট আলোকে দেখিয়া মনে হয় যেন একটা লম্বা খাল জঙ্গলের পাদমূল বেষ্ট করিয়া পড়িয়া আছে। আমরা যেদিকে চলিয়াছিলাম সেইদিকে উহার দক্ষিণ প্রান্তটা ক্রমশ সঙ্কুচিত হইয়া একটা অনুচ্চ পাড়ের কাছে আসিয়া শেষ হইয়া গিয়াছে;অতঃপর দক্ষিণ দিকে আর বালি নাই।
মিনিট পনেরো হাঁটবার পর পূর্বোক্ত পাড়ের কাছে আসিয়া পৌছিলাম; দেখিলাম পাড় একটা নয়—দুইটা। কোনো কালে হয়তো বালুর দক্ষিণ দিকে জলরোধ করিবার জন্য একটা উঁচু মাটির বাঁধ দেওয়া হইয়াছিল--বর্তমানে সেটা দ্বিধা ভিন্ন হইয়া গিয়াছে। মাঝখানে আন্দাজ পনেরো হাত চওড়া একটা প্ৰণালী একদিকের সবুজ ঘাসে ভরা মাঠের সহিত অপর দিকের বালুর চড়ার সংযোগ স্থাপন করিয়াছে।
আমরা নিকটতর ঢিবিটার উপর উঠিলাম। সম্মুখে নীচের দিকে চাহিয়া দেখিলাম গঙ্গা--যমুনা সঙ্গমের মত একটা ক্ষীণ রেখা ঘাসের সীমানা নির্দেশ করিয়া দিতেছে--তাহার পরেই অনিশ্চিত ভয়সঙ্কুল বালুর এলাকা আরম্ভ হইয়াছে। ইহার মধ্যে ঠিক কোনখানটায় সেই ভয়ানক চোরাবালি কে বলিতে পারে?
বাঁধের উপর উঠিয়া যে বস্তুটি প্রথমে চোখে পড়িয়াছিল তাহার কথা এখনো বলি নাই। সেটি একটি অতি জীর্ণ কুঁড়ে ঘর। বাঁধের ভাঙ্গনের দক্ষিণ মুখটি আগুলিয়া এই কুটীর পড়ি পড়ি হইয়া কোনো মতে দাঁড়াইয়া আছে—উচ্চতা এত কম যে পাড়ের আড়াল হইতে তাহার মটকা দেখা যায় না। ছিটা বেড়ার দেওয়াল, মাটি লেপিয়া জলবৃষ্টি নিবারণের চেষ্টা হইয়াছিল; এখন প্রায় সর্বত্র মাটি খসিয়া গিয়া জীর্ণ উই--ধরা হাড়--পাঁজর বাহির হইয়া পড়িয়াছে। উপরের দু’চালা খড়ের চালটিও প্রায় উলঙ্গ--খড় পচিয়া ঝরিয়া পড়িয়াছে, কোথায়ও বা গলিত অবস্থায় বুলিতেছে। বোধকরি চার--পাঁচ বছরের মধ্যে ইহাতে কেহ বাস করে নাই।
বনের ধারে লোকালয় হইতে বহু দূরে এইরূপ নিঃসঙ্গ একটি কুটীর দেখিয়া আমাদের ভারি বিস্ময় বোধ হইল। ব্যোমকেশ বলিল, তই তো! চল, ঘরটা দেখা যাক।
আমরা ফিরিয়া বাঁধ হইতে নামিবার উপক্ৰম করিতেছি। এমন সময় আকাশে শাঁই শাঁই শব্দ শুনিয়া চোখ তুলিয়া দেখি একঝাঁক বন--পায়রা মাথার উপর দিয়া উড়িয়া যাইতেছে। ব্যোমকেশ ক্ষিপ্ৰহস্তে বন্দুকে টোটা ভরিয়া ফায়ার করিল। আমার একটু দেরি হইয়া গেল, যখন বন্দুক তুলিলাম তখন পায়রার ঝাঁক পাল্লার বাহিরে চলিয়া গিয়াছে।
ব্যোমকেশের আওয়াজে একটা পায়রা নিম্নে বালুর উপর পড়িয়ছিল। সেটাকে উদ্ধার করিবার জন্য সম্মুখ দিয়া নামিতে গিয়া দেখিলাম সে--পথে নামা নিরাপদ নয়--পথ এত বেশি ঢালু যে পা হড়কাইয়া পড়িয়া যাইবার সম্ভাবনা। ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল, এত তাড়াতাড়ি কিসের হে! মরা পাখি তো আর উড়ে পালাবে না। চল, ঐ দিক দিয়ে ঘুরে যাওয়া যাক--কুঁড়ে ঘরটাও দেখা হবে ৷
তখন যে পথে উঠিয়ছিলাম। সেই পথে নামিয়া বাঁধের ভাঙ্গনের মুখে উপস্থিত হইলাম। কুটীরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, তাহাতে সম্মুখে ও পশ্চাতে দুইটি দ্বার আছে, যেটা দিয়া প্রবেশ করিলাম তাহার কবাট নাই, কিন্তু যেটা বালুর দিকে সেটাতে এখনো একটা বাখারির আগাল লাগিয়া আছে।
ঘরের মধ্যে মনুষ্যের ব্যবহারের উপযোগী কিছুই নাই। মেঝে বোধহয় পূর্বে গোময়লিপ্ত ছিল, এখন তাহার উপর ঘাস গজাইয়াছে--পচা খড় চাল হইতে পড়িয়া স্থানটাকে আকীর্ণ করিয়া রাখিয়াছে। ঘরটি চওড়ায় ছয় হাতের বেশি হইবে না। কিন্তু দৈর্ঘ্যে দুই বাঁধের মধ্যবর্তী স্থানটা সমস্ত জুড়িয়া আছে। এদিক হইতে বালুর দিকে যাইতে হইলে ঘরের ভিতর দিয়া যাইতে হয়; অন্য পথ নাই।
ব্যোমকেশ ঘরের অপরিষ্কার মেঝে ভাল করিয়া পর্যবেক্ষণ করিয়া বলিল, সম্প্রতি এ ঘরে কোনো মানুষ এসেছে। এখানে খড়গুলো চেপে গেছে। দেখেছ? ঐ কোণে কিছু একটা টেনে সরিয়েছে। এ ঘরে মানুষের যাতায়াত আছে।
মানুষের যাতায়াত থাকা কিছু বিচিত্র নয়। রাখাল বালকেরা এদিকে গরু চরাইতে আসে, হয়তো এই ঘরের মধ্যে খেলা করিয়া তাহারা দ্বিপ্রহর যাপন করে। তা হবে বলিয়া আমি অন্য দ্বারের আগল খুলিয়া বালির দিকে বাহির হইলাম। মনটা পাখির দিকেই পড়িয়া ছিল।
কিন্তু পাখি কোথায়? পাখিটা সম্মুখেই পড়িয়াছিল, লক্ষ্য করিয়াছিলাম; অথচ কোথাও তাহার চিহ্নমাত্র বিদ্যমান নাই। আমি আশ্চর্য হইয়া ব্যোমকেশকে ডাকিয়া বলিলাম, ওহে, তোমার পাখি কৈ? সত্যিই কি মরা পাখি উড়ে গেল নাকি?
ব্যোমকেশ বাহির হইয়া আসিল। সেও চারিদিকে চক্ষু ফিরাইল, কিন্তু পাখির একটা পালকও কোথাও দেখা গেল না। ব্যোমকেশ আস্তে আস্তে বলিল, তাই তো।
একটু এগিয়ে দেখা যাক, হয়তো আশেপাশে কোথাও আছে। বলিয়া আমি বালুর উপর পদার্পণ করিতে যাইব ব্যোমকেশের একটা হাত বিদ্যুদ্বেগে আসিয়া আমার কোটের কলার চাপিয়া ধরিল।
থামো—
কি হল? আমি অবাক হইয়া তাহার মুখের পানে তাকাইলাম।
বালির ওপর পা বাড়িও না।
সদ্য--ছোঁড়া কার্তুজের শূন্য খোলটা বোমকেশ পকেটেই রাখিয়াছিল, এখন সেটা বাহির করিল। সম্মুখদিকে প্রায় বিশ হাত দূরে বালুর উপর ছুঁড়িয়া দিয়া বলিল, ভাল করে লক্ষ্য কর। চাপা উত্তেজনায় তাহার স্বর প্রায় রুদ্ধ হইয়া গিয়াছিল।
লাল রঙের খোলটা পরিষ্কার দেখা যাইতেছিল, সেইদিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকাইয়া রহিলাম। দেখিতে দেখিতে আমার মাথার চুল খাড়া হইয়া উঠিল। কি সর্বনাশ!
কার্তুজ খোলের ভারী দিকটা নামিয়া গিয়া সেটা খাড়া হইয়া দাঁড়াইয়া উঠিল, তারপর নিঃশব্দে বালুর মধ্যে অদৃশ্য হইয়া গেল।
এই চোরাবালি! এবং ইহাতেই আমি গবেটের মত এখনি পদার্পণ করিতে যাইতেছিলাম। ব্যোমকেশ বাধা না দিলে আজ আমার কি হইত ভাবিয়া শরীরের রক্ত ঠাণ্ডা হইয়া গেল।
ব্যোমকেশের চোখদুটো উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করিয়া জ্বলিতেছিল, তাহার ওষ্ঠাধর বিভক্ত হইয়া দাঁতগুলা ক্ষণকালের জন্য দেখা গেল। সে বলিল, দেখলে! উঃ, কি ভয়ানক! কি ভয়ানক!
আমি কম্পিতস্বরে বলিলাম, ব্যোমকেশ, তুমি আজ আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ।
আমার কথা যেন শুনিতেই পায় নাই এমনিভাবে সে কেবল অস্ফুটস্বরে বলিতে লাগিল, কি ভয়ানক! কি ভয়ানক! দেখিলাম, তাহার মুখের রং ফ্যাকাসে হইয়া গেলেও চোখের দৃষ্টি ও চোয়ালের হাড় কঠিন হইয়া উঠিয়াছে।
অতঃপর ব্যোমকেশ কুটীরের চাল হইতে কয়েক টুকরা বাখারি ভাঙিয়া আনিল, একটি একটি করিয়া সেগুলি বালুর উপর নিক্ষেপ করিতে লাগিল। দেখা গেল, ঘাসের সীমানার প্রায় দশ হাত দূর হইতে চোরাবালি আরম্ভ হইয়াছে। কোথায় গিয়া শেষ হইয়াছে তাহা জানা গেল না, কারণ যতদূর পর্যন্ত বাখারি ফেলা হইল সব বাখারিই ডুবিয়া গেল। পুরাতন বাঁধের অর্ধচন্দ্ৰাকৃতি বাহুবেষ্টন এই চোরাবালিকেই ঘিরিয়া রাখিয়াছে। অতীত যুগের কোনো সদাশয় জমিদার হয়তো প্রজাদের জীবন রক্ষার্থেই এই বাঁধ করাইয়াছিলেন, তারপর কালক্রমে বাঁধও ভাঙিয়া গিয়াছে, তাহার উদ্দেশ্যও লোকে ভুলিয়া গিয়াছে।
চোরাবালির পরিধি নির্ণয় যথাসম্ভব শেষ করিয়া আমরা আবার কুটীরের ভিতর দিয়া বাহিরে আসিলাম। ব্যোমকেশ বলিল, অজিত, আমরা চোরাবালির সন্ধান পেয়েছি, একথা যেন ঘূণাক্ষরে কেউ জানতে না পারে। বুঝলে?
শেষাংশ পড়ুন....
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment