চোরাবালি (শেষাংশ)

 লেখক: শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রথমাংশের লিঙ্ক

আমি ঘাড় নাড়িলাম। ব্যোমকেশ তখন কুটীরের সম্মুখে কোমরে হাত দিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, বাঃ! ঘরটি কি চমৎকার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে দেখেছ? পিছনে পনের হাত দুরে চোরাবালি, সামনে বিশ হাত দূরে গভীর বন--দুধারে বাঁধ। কে এটি তৈরি করেছিল জানতে ইচ্ছে করে।

কুয়াশা কটিয়া গিয়া বেশ রৌদ্র উঠিয়ছিল। আমি বনের দিকে তাকাইয়া দেখিলাম, গাছের ছায়ার নীচে দিয়া একজন হাফ--প্যান্ট পরিহিত লোক, কাঁধে বন্দুক লইয়া দীর্ঘ পদক্ষেপে আমাদের দিকে আসিতেছে। গাছের ছায়ার বাহিরে আসিলে দেখিলাম, হিমাংশুবাবু।

হিমাংশুবাবু দূর হইতে হাঁকিয়া বলিলেন, আপনারা কোথায় ছিলেন? আমি জঙ্গলের মধ্যে খুঁজে বেড়াচ্ছি।

ব্যোমকেশ মৃদুকণ্ঠে বলিল, ‘অজিত, মনে থাকে যেন--চোরাবালি সম্বন্ধে কোনো কথা নয়।তারপর গলা চড়াইয়া বলিল, অজিতের পাল্লায় পড়ে পাখি শিকারে বেরিয়ে পড়েছিলুম। পাখিরা অবশ্য বেশ অক্ষত শরীরে আছে, কিন্তু আর্মস অ্যাক্টের বিরুদ্ধে অজিত যেরকম অভিযান আরম্ভ করেছে, শীগগির পুলিসের হাতে পড়বে।

আমি বলিলাম, ‘এবার কলকাতায় গিয়েই একটা বন্দুকের লাইসেন্স কিনিব।

হিমাংশুবাবু আমাদের মধ্যে আসিয়া দাঁড়াইলেন, বন্দুক নামাইয়া বলিলেন, তারপর, কিছু পেলেন?

কিছু না। আপনি একেবারে রাইফেল নিয়ে বেরিয়েছেন যে! বলিয়া ব্যোমকেশ তাঁহার অস্ত্রটির দিকে তাকাইল।

হিমাংশুবাবু বলিলেন, ‘হ্যাঁ--সকালে উঠেই শুনলুম জঙ্গলে নাকি বাঘের ডাক শোনা গেছে। তাই তাড়াতাড়ি রাইফেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লুম; চাকরটা বললে আপনারা এদিকে এসেছেন--একটু ভাবনা হল। কারণ, হঠাৎ যদি বাঘের মুখে পড়েন তাহলে আপনাদের পাখিমারা বন্দুক আর দশ নম্বরের ছররা কোনো কাজেই লাগবে না।

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, বাঘ এসেছে কার মুখে শুনলেন?

হিমাংশুবাবু বলিলেন, ঠিক যে এসেছেই একথা জোর করে কেউ বলতে পারছে না। আমার গয়লাটা বলছিল যে গরুগুলো সমস্ত রাত খোঁয়াড়ে ছটফট করেছে, তাই তার আন্দাজ যে হয়তো তারা বাঘের গন্ধ পেয়েছে। তা ছাড়া, দেওয়ানজী বলছিলেন। তিনি নাকি অনেক রাত্রে বাঘের ডাকের মত একটা আওয়াজ শুনতে পেয়েছেন। যা হোক, চলুন এবার ফেরা যাক। এখনো চা খাওয়া হয়নি ৷

হাতের ঘড়ি দেখিয়া ব্যোমকেশ বলিল, সাড়ে আটটা। চলুন। আচ্ছা, এই পোড়ো ঘরটা এরকম নির্জন স্থানে কে এই ঘর তৈরি করেছিল? কেনই বা করেছিল? কিছু জানেন কি?

হিমাংশুবাবু বলিলেন, জানি বৈকি। চলুন, যেতে যেতে বলছি।

তিনজনে বাড়ির দিকে অগ্রসর হইলাম। হিমাংশুবাবু চলিতে চলিতে বলিলেন, বছর চার--পাঁচ আগে--ঠিক ক'বছর হল বলতে পারছি না, তবে বাবা মারা যাবার পর--হঠাৎ একদিন আমার বাড়িতে এক বিরাট তান্ত্রিক সন্ন্যাসী এসে হাজির হলেন। ভয়ঙ্কর চেহারা, মাথায় জটার মত চুল, অজস্ৰ গোঁফদাড়ি, পাঁচ হাত লম্বা এক জোয়ান। পরনে স্রেফ একটি নেংটি, চোখদুটো লাল টকটক করছেআমার দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত রূঢ়ভাবে তুইতোকারি করে বললেন যে তিনি কিছুদিন আমার আশ্রয়ে থেকে সাধনা করতে চান।

সাধু--সন্ন্যাসীর উপর আমার বিশেষ ভক্তি নেই--ও সব বুজরুকি আমার সহ্য হয় না; বিশেষত ভেকধারীদের ঔদ্ধত্য। আর স্পর্ধা আমি বরদাস্ত করতে পারি না। আমি তৎক্ষণাৎ তাঁকে দূর করে দিচ্ছিলুম; কিন্তু দেওয়ানজী মাঝ থেকে বাধা দিলেন। তাঁর বোধহয় তান্ত্রিক ঠাকুরকে দেখেই খুব ভক্তি হয়েছিল। তিনি আমাকে অনেক করে বোঝাতে লাগলেন, প্ৰত্যবায় অভিসম্পাত প্রভৃতির ভয়ও দেখালেন। কিন্তু আমি ঐ উলঙ্গ লোকটাকে বাড়িতে থাকতে দিতে কিছুতেই রাজী হলুম না। তখন দেওয়ানজী তান্ত্রিক ঠাকুরের সঙ্গে মোকাবিলা করে ঠিক করলেন যে তিনি আমার জমিদারীর মধ্যে কোথাও কুঁড়ে বেঁধে থাকবেন।আর ভাণ্ডার থেকে তাঁর নিয়মিত সিধে দেওয়া হবে। দেওয়ানজীর আগ্রহ দেখে আমি অগত্যা রাজী হলুম।

বাবাজী তখন এই জায়গাটি পছন্দ করে কুঁড়ে বাঁধলেন। মাস ছয়েক এখানে ছিলেন। কিন্তু তার মধ্যে আমার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। তবে দেওয়ানজী প্রায়ই যাতায়াত করতেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর ভক্তি এতই বেড়ে গিয়েছিল যে শুনতে পাই তিনি বাবাজীর কাছ থেকে মন্ত্র নিয়েছিলেন। অবশ্য উনি আগেও শাক্তই ছিলেন। কিন্তু এতটা বাড়াবাড়ি ছিল না।

যা হোক, বাবাজী একদিন হঠাৎ সরে পড়লেন। সেই থেকে ও ঘরটা খালি পড়ে আছে।

গল্প শুনিতে শুনিতে বাড়ি আসিয়া পৌছিলাম। চায়ের সরঞ্জাম প্রস্তুত ছিল। বারান্দায় টেবিল পাতিয়া তাহার উপরে চা, কচুরি, পাখির মাংসের কাটলেট, ডিমের অমলেট ইত্যাদি বহুবিধ লোভনীয় আহার্য ভুবন খানসামা সাজাইয়া রাখিতেছিল। আমরা বিনা বাক্যব্যয়ে চেয়ার টানিয়া লইয়া উক্ত আহার্য বস্তুর সৎকারে প্রবৃত্ত হইলাম।

সৎকার কার্য অল্পদুর অগ্রসর হইয়াছে, এমন সময় বারান্দার সম্মুখে মোটর আসিয়া থামিল। কুমার ত্রিদিব অবতরণ করিলেন।

মোটরের পশ্চাতে আমাদের সুটকেস কয়টা বাঁধা ছিল, সেগুলা নামাইবার হুকুম দিয়া কুমার আমাদের মধ্যে আসিয়া বসিলেন; ব্যোমকেশের দিকে তাকাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কদ্দুর?

ব্যোমকেশ অনিশ্চিতভাবে মাথা নাড়িয়া বলিল, বেশি দূর নয়। তবে দুএক দিনের মধ্যেই একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাবে আশা করি। আজ একবার শহরে যাওয়া দরকার। পুলিসের কাছ থেকে কিছু খোঁজ খবর নিতে হবে।

কুমার ত্রিদিব বলিলেন, বেশ তো, চলুন আমার গাড়িতে ঘুরে আসা যাক। এখন বেরুলে বেলা বারোটার মধ্যে ফেরা যাবে ৷

ব্যোমকেশ মাথা নাড়িলআমার একটু সময় লাগবে; সন্ধের আগে ফেরা হবে না। একেবারে খাওয়া--দাওয়া করে বেরুলে বোধহয় ভাল হয় ৷

কুমার বলিলেন, সে কথাও মন্দ নয়। হিমাংশু, তুমি চল না হে, খুব খানিক হৈ হৈ করে আসা যাক। অনেকদিন শহরে যাওয়া হয়নি।

হিমাংশুবাবু কুন্ঠিতভাবে বলিলেন, না ভাই, আমার আজ আর যাওয়ার সুবিধা হবে না। একটু কাজ

ব্যোমকেশ বলিল, না, আপনার গিয়ে কাজ নেই। অজিতও থাকুক। আমরা দুজনে গেলেই যথেষ্ট হবেবলিয়া কুমারের দিকে তাকাইল। তাহার চাহনিতে বোধহয় কোনো ইশারা ছিল, কারণ কুমার বাহাদুর পুনরায় কি একটা বলিতে গিয়া থামিয়া গেলেন।

বেলা এগারোটার সময় ব্যোমকেশ কুমারের গাড়িতে বাহির হইয়া গেল। যাইবার আগে আমাকে বলিয়া গেল, চোখ দুটো বেশ ভাল করে খুলে রেখো। আমার অবর্তমানে যদি কিছু ঘটে লক্ষ্য করে।

তাহাদের গাড়ি ফটিক পার হইয়া যাইবার পর হিমাংশুবাবুর মুখ দেখিয়া বোধ হইল তিনি যেন পরিত্রাণের আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া উঠিয়াছেন। আমরা তাঁহার বাড়িতে আসিয়া অধিষ্ঠিত হওয়াতে তিনি যে সুখী হইতে পারেন নাই, এই সন্দেহ আবার আমাকে পীড়া দিতে লাগিল।

দেওয়ান কালীগতিও উপস্থিত ছিলেন। তিনি অতিশয় বুদ্ধিমান ব্যক্তি; আমাদের মুখের ভাব হইতে মনের কথা আন্দাজ করিয়াছিলেন। কিনা বলিতে পারি না, কিন্তু তিনি আমাকে ডাকিয়া লইয়া বারান্দায় চেয়ারে উপবেশন করিয়া নানা বিষয়ে সম্ভাষণ করিতে লাগিলেন। হিমাংশুবাবুও কথাবার্তায় যোগ দিলেন। ব্যোমকেশ সম্বন্ধেই আলোচনা বেশি হইল। ব্যোমকেশের কীৰ্তিকলাপ প্রচার করিতে আমি কোনদিনই পশ্চাৎপদ নই। সে যে কতবড় ডিটেকটিভ তাহা বহু উদাহরণ দিয়া বুঝাইয়া দিলাম। তাহার সাহায্য পাওয়া যে কতখানি ভাগ্যের কথা সে ইঙ্গিত করিতেও ছাড়িলাম না। শেষে বলিলাম, হরিনাথ মাস্টার যে বেঁচে নেই একথা আর কেউ এত শীগগির বার করতে পারত না।

দু'জনেই চমকিয়া উঠিলেনবেঁচে নেই।

কথাটা বলিয়া ফেলা উচিত হইল। কিনা বুঝিতে পারিলাম না; ব্যোমকেশ অবশ্য বারণ করে নাই, তবু মনে হইল, না বলিলেই বোধহয় ভাল হইত। আমি নিজেকে সম্বরণ করিয়া লইয়া রহস্যপূর্ণ শিরঃসঞ্চালন করিলাম, বলিলাম, যথাসময় সব কথা জানতে পারবেন।

অতঃপর বারোটা বাজিয়া গিয়াছে দেখিয়া আমরা উঠিয়া পড়িলাম। কালীগীতি ও হিমাংশুবাবু আমার অনিচ্ছা লক্ষ্য করিয়া আর কোনো প্রশ্ন করিলেন না। কিন্তু হরিনাথের মৃত্যুসংবাদ যে তাঁহাদের দুজনকেই বিশেষভাবে নাড়া দিয়াছে তাহা বুঝিতে কষ্ট হইল না।

দুপুরবেলাটা বোধকরি নিঃসঙ্গভাবে ঘরে বসিয়াই কাটাইতে হইত; কারণ হিমাংশুবাবু আহারের পর একটা জরুরী কাজের উল্লেখ করিয়া অন্দরমহলে প্রস্থান করিয়াছিলেন। কিন্তু বেবি আসিয়া আমাকে সঙ্গদান করিল। সে আসিয়া প্ৰথমেই ব্যোমকেশের খোঁজ খবর লইল এবং সকালবেলা মেনির সন্তান প্রসবের জন্য আসিতে পারে নাই বলিয়া যথোচিত দুঃখ জ্ঞাপন করিল। তারপর আমাকে নানাপ্রকার বিচিত্র প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়া ও নিজেদের পারিবারিক বহু গুপ্ত রহস্য প্রকাশ করিয়া গল্প জমাইয়া তুলিল।

হঠাৎ একসময় বেবি বলিল, মা আজ তিনদিন ভাত খাননি।

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, তাঁর অসুখ করেছে বুঝি?

মাথা নাড়িয়া গভীরমুখে বেবি বলিল, না, বাবার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে।

এবিষয়ে তাহাকে প্রশ্ন করিয়া আরও কিছু সংবাদ সংগ্ৰহ করা ভদ্রোচিত হইবে কিনা ভাবিতেছি। এমন সময় খোলা জানালা দিয়া দেখিলাম, একটা সবুজ রঙের সিডান বডির মোটর গ্যারাজের দিক হইতে নিঃশব্দে বাহির হইয়া যাইতেছে। আমি তাড়াতাড়ি উঠিয়া জানালার সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলাম। গাড়িখানি সাবধানে ফটক পার হইয়া শহরের দিকে মোড় লইয়া অদৃশ্য হইয়া গেল! দেখিলাম, চালক স্বয়ং হিমাংশুবাবু। গাড়ির অভ্যন্তরে কেহ আছে কিনা দেখা গেল না।

বেবি আমার পাশে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল, বলিল, আমাদের নতুন গাড়ি।

ফিরিয়া আসিয়া বসিলাম। হিমাংশুবাবু ঠিক যেন চোরের মত মোটর লইয়া বাহির হইয়া গেলেন। কোথায় গেলেন? সঙ্গে কেহ ছিল কি? তিনি গোড়া হইতেই আমাদের কাছে একটা কিছু লুকাইবার চেষ্টা করিতেছেন। আমাদের আগমন তাঁহার কোনো কাজে বাধা দিয়াছে; তাই তিনি ভিতরে ভিতরে অধীর হইয়া পড়িয়াছেন। অথচ বাহিরে কিছু করিতে পারিতেছেন না--এই ধারণা ক্ৰমেই আমার মনে দৃঢ়তর হইতে লাগিল। তবে কি তিনি হরিনাথের অন্তর্ধানের গুঢ় রহস্য কিছু জানেন? তিনি কি জানিয়া শুনিয়া কাহাকেও আড়াল করিবার চেষ্টা করিতেছেন? ভীত--দৃষ্টি রুগ্নকায় অনাদি সরকারের কথা মনে পড়িল। সে কাল প্রভুর পায়ে ধরিয়া কাঁদিতেছিল কি জন্য? ‘ও মহাপাপ করিনিকোন মহাপাপ হইতে নিজেকে ক্ষালন করিবার চেষ্টা করিতেছিল!

বেবি আজ আবার একটা নূতন খবর দিলহিমাংশুবাবু ও তাঁহার স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া চলিতেছে। ঝগড়া। এতদূর গড়াইয়াছে যে স্ত্রী তিনদিন আহার করেন নাই। কি লইয়া ঝগড়া? হরিনাথ মাস্টার কি এই কলহ--রহস্যের অন্তরালে লুকাইয়া আছে!

তুমি ছবি আঁকতে জানো? বেবির প্রশ্নে চিন্তাজাল ছিন্ন হইয়া গেল।

অন্যমনস্কভাবে বলিলাম, জানি ৷

ঝামর চুল উড়াইয়া বেবি ছুটিয়া গেল। কোথায় গেল ভাবিতেছি এমন সময় সে একটা খাতা ও পেন্সিল লইয়া ফিরিয়া আসিল। খাতা ও পেন্সিল আমার হাতে দিয়া বলিল, একটা ছবি এঁকে দাও না। খু--ব ভাল ছবি।

খাতাটি বেবির অঙ্কের খাতা। তাহার প্রথম পাতায় পাকা হাতে লেখা রহিয়াছে, শ্ৰীমতী বেবিরাণী দেবী।

জিজ্ঞাসা করিলাম, একি তোমার মাস্টারমশায়ের হাতের লেখা?

বেবি বলিল, হ্যাঁ।

খাতার পাতা উল্টাইতে উল্টাইতে আশ্চর্য হইয়া গেলাম। বেশির ভাগই উচ্চ গণিতের অঙ্ক; বেবির হাতে লেখা যোগ, বিয়োগ খুব অল্পই আছে। আবার জিজ্ঞাসা করিলাম, এসব অঙ্ক কে করেছে?

বেবি বলিল, মাস্টারমশাই। তিনি খালি আমার খাতায় অঙ্ক করতেন।

দেখিলাম, মিথ্যা নয়। খাতার অধিকাংশ পাতাই মাস্টারের কঠিন দীর্ঘ অঙ্কের অক্ষরে পূর্ণ হইয়া আছে। কি ব্যাপার কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। একটি ছোট মেয়েকে গণিতের গোড়ার কথা শিখাইতে গিয়া কলেজের শিক্ষিতব্য উচ্চ গণিতের অবতারণার সার্থকতা কি?

খাতার পাতাগুলা উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিতে দেখিতে একস্থানে দৃষ্টি পড়িলএকটা পাতার আধখানা কাগজ কে ছিঁড়িয়া লইয়াছে। একটু অভিনিবেশ সহকারে লক্ষ্য করিতে মনে হইল যেন পেন্সিল দিয়া খাতার উপর কিছু লিখিয়া পরে কাগজটা ছিঁড়িয়া লওয়া হইয়াছে। কারণ, খাতার পরের পৃষ্ঠায় পেন্সিলের চাপ--দাগ অস্পষ্টভাবে ফুটিয়া রহিয়াছে। আলোর সম্মুখে ধরিয়া নখচিহ্নের মত দাগগুলি পড়িবার চেষ্টা করিলাম। কিন্তু পড়িতে পারিলাম না।

বেবি অধীরভাবে বলিল, ও কি করছ। ছবি এঁকে দেখাও না!

ছেলেবেলায় যখন ইস্কুলে পড়িতাম তখন এই ধরনের বর্ণহীন চিহ্ন কাগজের উপর ফুটাইয়া তুলিবার কৌশল শিখিয়াছিলাম, এখন তাহা মনে পড়িয়া গেল।

বেবিকে বলিলাম, একটা ম্যাজিক দেখবে?

বেবি খুব উৎসাহিত হইয়া বলিল,”হ্যাঁ--দেখব।

তখন খাতা হইতে এক টুকরা কাগজ ছিঁড়িয়া লইয়া তাহার উপর পেন্সিলের শিষ ঘষিতে লাগিলাম; কাগজটা যখন কালো হইয়া গেল তখন তাহা সন্তৰ্পণে সেই অদৃশ্য লেখার উপর বুলাইতে লাগিলাম। ফটোগ্রাফের নেগেটিভ যেমন রাসায়নিক জলে ধৌত করিতে করিতে তাহার ভিতর হইতে ছবি পরিস্ফুট হইয়া উঠিতে থাকে, আমার মৃদু ঘর্ষণের ফলেও তেমনি কাগজের উপর ধীরে ধীরে অক্ষর ফুটিয়া উঠিতে লাগিল। সবগুলি অক্ষর ফুটিল না, কেবল পেন্সিলের চাপে সেগুলি কাগজের উপর গভীরভাবে দাগ কাটিয়াছিল সেইগুলি স্পষ্ট ইয়া উঠিল।

ওঁ হ্রীং..ক্লীং

রাত্ৰি ১১.৫.অম.পড়িবে

অসম্পূর্ণ দুবোর্ধ অক্ষরগুলার অর্থ বুঝিবার চেষ্টা করিলাম কিন্তু বিশেষ কিছু বুঝিতে পারলিাম না! ওঁ হ্রীং ক্লীং--বোধহয় কোনো মন্ত্র হইবে। কিন্তু সে যাহাই হোক, হস্তাক্ষর যে হরিনাথ মাস্টারের তাহাতে সন্দেহ রহিল না। প্রথম পৃষ্ঠার লেখার সঙ্গে মিলাইয়া দেখিলাম, অক্ষরের ছাঁদ একই প্রকারের।

বেবি ম্যাজিক দেখিয়া বিশেষ পরিতৃপ্ত হয় নাই; সে ছবি আঁকিবার জন্য পীড়াপীড়ি করিতে লাগিল। তখন তাহার খাতায় কুকুর বাঘ রাক্ষস প্রভৃতি বিবিধ জন্তুর চিত্তাকর্ষক ছবি আঁকিয়া তাহাকে খুশি করিলাম। মন্ত্র--লেখা কাগজটা আমি ছিঁড়িয়া লইয়া নিজের কাছে রাখিয়া দিলাম।

বেলা সাড়ে তিনটার সময় হিমাংশুবাবু ফিরিয়া আসিলেন। মোটর তেমনি নিঃশব্দে প্রবেশ করিয়া বাড়ির পশ্চাতে গ্যারাজের দিকে চলিয়া গেল। কিছুক্ষণ পরে হিমাংশুবাবুর গলার আওয়াজ শুনিতে পাইলাম; তিনি ভুবন বেয়ারাকে ডাকিয়া চায়ের বন্দোবস্ত করিবার হুকুম দিতেছেন।

ব্যোমকেশ যখন ফিরিল তখন সন্ধ্যা হয়--হয়। কুমার গাড়ি হইতে নামিলেন না; ব্যোমকেশকে নামাইয়া দিয়া শরীরটা তেমন ভাল ঠেকিতেছে না বলিয়া চলিয়া গেলেন।

তখন ব্যোমকেশের অনারে আর একবার চা আসিল। চা পান করিতে করিতে কথাবার্তা আরম্ভ হইল। দেওয়ানজীও আসিয়া বসিলেন। ব্যোমকেশকে জিজ্ঞাসা করিলেন, কি হল?

ব্যোমকেশ চায়ে চুমুক দিয়া বলিল, বিশেষ কিছু হল না। পুলিসের ধারণা হরিনাথ মাস্টারকে প্রজারা কেউ নিজের বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছে।

দেওয়ানজী বলিলেন, আপনার তা মনে হয় না?

ব্যোমকেশ বলিল, না। আমার ধারণা অন্যরকম ৷

আপনার ধারণা হরিনাথ বেঁচে নেই?

ব্যোমকেশ একটু বিস্মিতভাবে বলিল, আপনি কি করে বুঝলেন? , অজিত বলেছে। হ্যাঁআমার তাই ধারণা বটে। তবে আমি ভুলও করে থাকতে পারি।

কিছুক্ষণ কোনো কথা হইল না। আমি অত্যন্ত অস্বস্তি অনুভব করিতে লাগিলাম। ব্যোমকেশের মুখ দেখিয়া এমন কিছু বোধ হইল না যে সে আমার উপর চটিয়াছে; কিন্তু মুখ দেখিয়া সকল সময় তাহার মনের ভাব বোঝা যায় না। কে জানে, হয়তো কথাটা ইহাদের কাছে প্রকাশ করিয়া অন্যায় করিয়াছি, ব্যোমকেশ নির্জনে পাইলেই আমার মুণ্ড চিবাইবে।

কালীগতি হঠাৎ বলিলেন,”আমার বোধ হয় আপনি ভুলই করেছেন ব্যোমকেশবাবু। হরিনাথ সম্ভবত মরেনি।

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ কালীগতির পানে চাহিয়া রহিল, তারপর বলিল, ‘আপনি নতুন কিছু জানতে পেরেছেন?

কালীগতি ধীরে ধীরে মাথা নাড়িয়া বলিলেন, না--তাকে ঠিক জানা বলা চলে না; তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস সে ঐ বনের মধ্যে লুকিয়ে আছে।

ব্যোমকেশ চমকিত হইয়া বলিল, বনের মধ্যে? এই দারুণ শীতে?

হ্যাঁ। বনের মধ্যে কাপালিকের ঘর বলে একটা কুঁড়ে ঘর আছে--রাত্রে বাঘ ভালুকের ভয়ে সম্ভবত সেই ঘরটায় লুকিয়ে থাকে।

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, স্পষ্ট কোনো প্ৰমাণ পেয়েছেন কি?

না। তবে আমার স্থির বিশ্বাস সে ঐখানেই আছে।

ব্যোমকেশ আর কিছু বলিল না। রাত্ৰে শয়ন করিতে আসিয়া ব্যোমকেশ বলিল, চোরাবালির কথাটাও চারিদিকে রাষ্ট্র করে দিয়েছ তো?

না না--আমি শুধু কথায় কথায় বলেছিলুম। যে—?

বুঝেছি।বলিয়া সে চেয়ারে বসিয়া পড়িয়া হাসিতে লাগিল। আমি বলিলাম, তুমি তো ও কথা বলতে বারণ করনি।

তোমার মনের ভাব দেখছি। রবিবাবুর গানের নায়কের মতযদি বারণ কর। তবে গাহিব না। এবং বারণ না করিলেই তারস্বরে গাহিব। যা হোক, আজ দুপুরবেলা কি করলে বল।

দেখিলাম, ব্যোমকেশ সত্যসত্যই চটে নাই; বোধহয় ভিতরে ভিতরে তাহার ইচ্ছা ছিল যে ও কথাটা আমি প্ৰকাশ করিয়া ফেলি। অন্তত তাহার কাজের যে কোনো ব্যাঘাত হয় নাই তাহা নিঃসন্দেহে।

আমি তখন দ্বিপ্রহরে যাহা যাহা জানিতে পারিয়াছি সব বলিলাম; মন্ত্র--লেখা কাগজটাও দেখাইলাম। কাগজটা ব্যোমকেশ মন দিয়া দেখিল, কিন্তু বিশেষ ঔৎসুক্য প্রকাশ করিল না। বলিল, নুতন কিছুই নয়এসব আমার জানা কথা। এই লেখাটার দ্বিতীয় লাইন সম্পূর্ণ করলে হবে

রাত্রি ১১টা ৪৫মিঃ গতে অমাবস্যা পড়িবে। অর্থাৎ হরিনাথও পাঁজি দেখেছিল।

হিমাংশুবাবুর বহিৰ্গমনের কথা শুনিয়া ব্যোমকেশ মুচকি হাসিল, কোন মন্তব্য করিল না। আমি তখন বলিলাম, দ্যাখ ব্যোমকেশ, আমার মনে হয়। হিমাংশুবাবু আমাদের কাছে কিছু লুকোবার চেষ্টা করছেন। তুমি লক্ষ্য করেছ কি না জানি না, কিন্তু আমাদের অতিথিরূপে পেয়ে তিনি খুব খুশি হননি।

ব্যোমকেশ মৃদুভাবে আমার পিঠ চাপড়াইয়া বলিল, ঠিক ধরেছ। হিমাংশুবাবু যে কত উঁচু মেজাজের লোক তা ওঁকে দেখে ধারণা করা যায় না। সত্যি অজিত, ওঁর মতন সহৃদয় প্রকৃত ভদ্রলোক খুব কম দেখা যায়। যেমন করে হোক এ ব্যাপারে একটা রফা করতেই হবে।

আমাকে বিস্ময় প্রকাশের অবকাশ না দিয়া ব্যোমকেশ পুনশ্চ বলিল, অনাদি সরকারের রাধা নামে একটি বিধবা মেয়ে আছে শুনেছ বোধহয়। তাকে আজ দেখলুম।

আমি বোকার মত তাহার মুখের দিকে তাকাইয়া রহিলাম, সে বলিয়া চলিল, সতের--আঠার বছরের মেয়েটি--দেখতে মন্দ নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের পীড়নে আর লজ্জায় একেবারে নুয়ে পড়েছে। দেখে অজিত, যৌবনের উন্মাদনার অপরাধকে আমরা বড় কঠিন শাস্তি দিই, বিশেষত অপরাধী যদি স্ত্রীলোক হয়। প্রলোভনের বিরাট শক্তিকে হিসাবের মধ্যে নিই না, যৌবনের স্বাভাবিক অপরিণামদৰ্শিতাকেও হিসাব থেকে বাদ দিই। ফলে যে বিচার করি সেটা সুবিচার নয়। আইনেই grave and sudden provocation বলে একটা সাফাই আছে। কিন্তু সমাজ কোনো সাফাই মানে না; আগুনের মত সে নির্মম, যে হাত দেবে তার হাত পুড়বে। আমি সমাজের দোষ দিচ্ছি নাসাধারণের কল্যাণে তাকে কঠিন হতেই হয়। কিন্তু যে--লোক এই কঠিনতার ভিতর থেকে পাথর ফাটিয়ে করুণার উৎস খুলে দেয় তাকে শ্রদ্ধা না করে থাকা যায় না।

ব্যোমকেশকে কখনো সমাজতত্ত্ব সম্বন্ধে লেকচার দিতে শুনি নাই; অনাদি সরকারের কন্যাকে দেখিয়া তাহার ভাবের বন্যা উথলিয়া উঠিল কেন তাহাও বোধগম্য হইল না। আমি ফ্যালফ্যাল করিয়া কেবল তাহাকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলাম।

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ দেয়ালের দিকে তাকাইয়া রহিল, তারপর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাসমোচন করিয়া বলিল, আর একটা আশ্চর্য দেখছি, এসব ব্যাপারে মেয়েরাই মেয়েদের সবচেয়ে নিষ্ঠুর শাস্তি দেয়। কেন দেয় কে জানে ৷

অনেকক্ষণ কোনো কথা হইল না; শেষে ব্যোমকেশ উঠিয়া পায়ের মোজা টানিয়া খুলিতে খুলিতে বলিল, রাত হল, শোয়া যাক। এ ব্যাপারটা যে কিভাবে শেষ হবে কিছুই বুঝতে পারছি না। যা কিছু জ্ঞাতব্য সবই জানা হয়ে গেছেঅথচ লোকটাকে ধরবার উপায় নেই। তারপর গলা নামাইয়া বলিল, ফাঁদ পাততে হবে, বুঝেছ অজিত, ফাঁদ পাততে হবে।

আমি বলিলাম, যদি কিছু বলবে ঠিক করে থাকো তাহলে একটু স্পষ্ট করে বল। জ্ঞাতব্য কোনো কথাই আমি এখনো বুঝতে পারিনি।

কিছু বোঝোনি?

কিছু না।

আশ্চর্য! আমার মনে যা একটু সংশয় ছিল তা আজ শহরে গিয়ে ঘুচে গেছে। সমস্ত ঘটনাটি বায়স্কোপের ছবির মত চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।

অধর দংশন করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, শহরে সারাদিন কি করলে?

ব্যোমকেশ জামার বোতাম খুলিতে খুলিতে বলিল, মাত্র দুটি কাজ। ইস্টিশনে অনাদি সরকারের মেয়েকে দেখলুম--তাকে দেখবার জন্যেই সেখানে লুকিয়ে বসেছিলুম। তারপর রেজিস্ট্রি অফিসে কয়েকটি দলিলের সন্ধান করলুম।

এইতেই এত দেরি হল?

হ্যাঁ। রেজিস্ট্রি অফিসের খবর সহজে পাওয়া যায় না--অনেক তদ্বির করতে হল।

তারপর?

তারপর ফিরে এলুম।বলিয়া ব্যোমকেশ লেপের মধ্যে প্রবেশ করিল।

বুঝিলাম, কিছু বলিবে না। তখন আমিও রাগ করিয়া শুইয়া পড়িলাম, আর কোনও কথা বলিলাম না।

ক্ৰমে তন্দ্রাবেশ হইল। নিদ্রাদেবীর ছায়া--মঞ্জীর মাথার মধ্যে রুমঝুম করিয়া বাজিতে আরম্ভ করিয়াছে, এমন সময় দরজার কড়া খুট খুট করিয়া নড়িয়া উঠিল। তন্দ্ৰা ছুটিয়া গেল।

ব্যোমকেশের বোধ করি তখনো ঘুম আসে নাই, সে বিছানায় উঠিয়া বসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কে?

বাহির হইতে মৃদুকণ্ঠে আওয়াজ আসিল, ব্যোমকেশবাবু, একবার দরজা খুলুন।

ব্যোমকেশ উঠিয়া দরজা খুলিয়া দিল। সবিস্ময়ে দেখিলাম, দেওয়ান কালীগতি একটি কালো রঙের কম্বল গায়ে জড়াইয়া দাঁড়াইয়া আছেন।

কালীগতি বলিলেন, আমার সঙ্গে আসুন, একটা জিনিস দেখাতে চাই। অজিতবাবু, জেগে আছেন নাকি? আপনিও আসুন।

ব্যোমকেশ ওভারকোট গায়ে দিতে দিতে বলিল, এত রাত্ৰে! ব্যাপার কি?

কালীগতি উত্তর দিলেন না। আমিও লেপ পরিত্যাগ করিয়া একটা শাল ভাল করিয়া গায়ে জড়াইয়া লইলাম। তারপর দুইজনে কালীগতির অনুসরণ করিয়া বাহির হইলাম।

বাড়ি হইতে নিস্ক্রান্ত হইয়া আমরা বাগানের ফটকের দিকে চলিলাম। অন্ধকার রাত্রি, বহুপূর্বে চন্দ্রাস্ত হইয়াছে। ছুঁচের মত তীক্ষ্ণ অথচ মন্থর একটা বাতাস যেন অলসভাবে বস্ত্ৰাচ্ছাদনের ছিদ্র অনুসন্ধান করিয়া ফিরিতেছে। আমি ভাবিতে লাগিলাম, বৃদ্ধ এহেন রাত্রে আমাদের কোথায় লইয়া চলিল। কতদূর যাইতে হইবে! ব্যোমকেশই বা এমন নির্বিচারে প্রশ্নমাত্র না করিয়া চলিয়াছে কেন?

কিন্তু ফটক পর্যন্ত পৌঁছবার পূর্বেই বুঝিলাম, আমাদের গন্তব্যস্থান বেশিদূর নয়। কালীগতির বাড়ির সদর দরজায় একটি হ্যারিকেন লণ্ঠন ক্ষীণভাবে জ্বলিতেছিল, সেটিকে তুলিয়া লইয়া তাহার বাতি উস্কাইয়া দিয়া কালীগতি বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিলেন, বলিলেন, আসুন।

কালীগীতির বাড়িতে বোধহয় চাকর--বাকির কেহ থাকে না, কারণ বাড়িতে প্ৰবেশ করিয়া জনমানবের সাড়াশব্দ পাইলাম না। লন্ঠনের শিখা বাড়ির অংশমাত্র আলোকিত করিল, তাহাতে নিকটস্থ দরজা জানালা ও ঘরের অন্যান্য দুএকটা আসবাব ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়িল না। একপ্রস্থ সিঁড়ি ভাঙিয়া আমরা দোতলায় উঠিলাম; তারপর আর এক প্রস্থ সিঁড়ি। এই সিঁড়ির শেষ ধাপে উঠিয়া কালীগতি লণ্ঠন কমাইয়া রাখিয়া দিলেন। দেখিলাম, আলিসা--ঘেরা খোলা ছাদে উপস্থিত হইয়াছি।

এদিকে আসুন। বলিয়া কালীগতি আমাদের আলিসার ধারে লইয়া গেলেন; তারপর বাহিরের দিকে হস্ত প্রসারিত করিয়া বলিলে, কিছু দেখতে পাচ্ছেন?

উচ্চস্থান হইতে অনেক দূর পর্যন্ত দৃষ্টিগ্রাহ্য হইয়াছিল বটে। কিন্তু গাঢ় অন্ধকার দৃষ্টির পথরোধ করিয়া দিয়াছিল। তাই চারিদিকে অভেদ্য তমিস্রা ছাড়া আর কিছুই দেখা গেল না। কেবল কালীগতির অঙ্গুলি--নির্দেশ অনুসরণ করিয়া দেখিলাম বহুদূরে একটি মাত্র আলোকের বিন্দু চক্রবালশায়ী মঙ্গলগ্রহের মত আরক্তিমভাবে জ্বলিতেছে।

ব্যোমকেশ বলিল, একটা আলো জ্বলছে। কিম্বা আগুনও হতে পারে। কোথায় জ্বলছে?

কালীগতি বলিলেন, জঙ্গলের ধারে যে কুঁড়ে ঘরটা আছে তারই মধ্যে।

ও--যাতে সেই কাপালিক মহাপ্ৰভু ছিলেন। তা--তিনি কি আবার ফিরে এলেন নাকি? ব্যোমকেশের ব্যঙ্গহাসি শুনা গেল।

না--আমার বিশ্বাস এ হরিনাথ মাস্টার।

ওঃ!ব্যোমকেশ যেন চমকিয়া উঠিলআজি সন্ধ্যেবেলা আপনি বলছিলেন বটে। কিন্তু আলো জ্বেলে সে কি করছে?

বোধহয় শীত সহ্য করতে না পেরে আগুন জ্বেলেছে।

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ চুপ করিয়া ভাবিল, শেষে মৃদুস্বরে বলিল, হতেও পারে--হতেও পারে। যদি সে বেঁচে থাকে--অসম্ভব নয়।

কালীগতি বলিলেন, ব্যোমকেশবাবু, সে বেঁচে আছে --ঐ আগুনই তার প্রমাণ। মনুষ্যসমাজ থেকে যে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে সে ছাড়া এই রাত্রে ওখানে আর কে আগুন জ্বালবে?

তা বটে! ব্যোমকেশ আবার কিছুক্ষণ চিন্তামগ্ন হইয়া রহিল, তারপর বলিল, হরিনাথ মাস্টার হোক বা না হোক, লোকটাকে জানা দরকার অজিত, এখন ওখানে যেতে রাজী আছ?

আমি শিহরিয়া উঠিয়া বলিলাম, এখন? কিন্তুকালীগতি বলিলেন, সব দিক বিবেচনা করে দেখুন। এখন গেলে যদি তাকে ধরতে পারেন।

তাহলে এখনি যাওয়া উচিত। কিন্তু এই অন্ধকারে কোনো রকম শব্দ না করে কুঁড়ে ঘরের কাছে এগুতে পারবেন কি? আলো নিয়ে যাওয়া চলবে না, কারণ আলো দেখলেই সে পালাবে। আর অন্ধকারে বন--বাদাড় ভেঙে যেতে গেলেই শব্দ হবে। কি করবেন, ভাল করে ভেবে দেখুন।

তিনজনে মিলিয়া পরামর্শ করিলাম। সব দিক ভাবিয়া শেষে স্থির হইল যে আজ রাত্রে যাওয়া হইবে না; কারণ আসামী যদি একবার টের পায় তাহা হইলে আর ওঘরে আসিবে না।

ব্যোমকেশ বলিল, দেওয়ানজীর পরামর্শই ঠিক, আজ যাওয়া সমীচীন নয়। আমার মাথায় একটা মতলব এসেছে। আসামী যদি ভড়কে না যায় তাহলে কালও নিশ্চয় আসবে। কাল আমি আর অজিত আগে থাকতে গিয়ে ঐ ঘরে লুকিয়ে থাকিব--বুঝছেন? তারপর সে যেমনি আসবে

কালীগতি বলিলেন, এ প্রস্তাব মন্দ নয়। অবশ্য এর চেয়েও ভাল মতলব যদি কিছু থাকে তাও ভেবে দেখা যাবে। আজ তাহলে এই পর্যন্ত থাক।

ছাদ হইতে নামিয়া আমরা নিজেদের ঘরে ফিরিয়া আসিলাম। দেওয়ানজী আমাদের দ্বার পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দিয়া গেলেন। যাইবার সময় ব্যোমকেশের মুখের দিকে তাকাইয়া বলিলেন, ব্যোমকেশবাবু, আপনি তান্ত্রিক ধর্মে বিশ্বাস করেন না?

ব্যোমকেশ বলিল, না, ওসব বুজরুকি। আমি যত তান্ত্রিক দেখেছি, সব বেটা মাতাল আর লম্পট।

কালীগতির চোখের দৃষ্টি ক্ষণকালের জন্য কেমন যেন ঘোলাটে হইয়া গেল, তিনি মুখে একটু ক্ষীণ হাসি টানিয়া আনিয়া বলিলেন, আচ্ছা, আজ তবে শুয়ে পড়ুন। ভাল কথা, হিমাংশু বাবাজীকে আপাতত এসব কথা না বললেই বোধহয় ভাল হয় ৷

ব্যোমকেশ ঘাড় নাড়িয়া বলিল, হ্যাঁ, তাঁকে এখন কিছু বলবার দরকার নেই।

কালীগীতি প্ৰস্থান করিলেন। আমরা আবার শয়ন করিলাম। কিয়ৎকাল পরে ব্যোমকেশ বলিল, ব্ৰাহ্মণ আমার ওপর মনে মনে ভয়ঙ্কর চটেছেন ৷

আমি বলিলাম, যাবার সময় তোমার দিকে যেরকম ভাবে তাকালেন তাতে আমারও তাই মনে হল। তান্ত্রিকদের সম্বন্ধে ওসব কথা বলবার কি দরকার ছিল? উনি নিজে তান্ত্রিক--কাজেই ওঁর আঁতে ঘা লেগেছে।

ব্যোমকেশ বলিল, আমিও কায়মনোবাক্যে তাই আশা করছি।

তাহার কথা ঠিক বুঝিতে পারিলাম না। কাহারও ধর্মবিশ্বাসে আঘাত দিয়া কথা কওয়া তাহার অভ্যাস নয়, অথচ এক্ষেত্রে সে জানিয়া বুঝিয়াই আঘাত দিয়াছে। বলিলাম, তার মানে? ব্ৰাহ্মণকে মিছিমিছি চটিয়ে কোন লাভ হল নাকি?

সেটা কাল বুঝতে পারব। এখন ঘুমিয়ে পড়। বলিয়া সে পাশ ফিরিয়া শুইল। পরদিন সকাল হইতে অপরাহ্ন পর্যন্ত ব্যোমকেশ অলসভাবে কাটাইয়া দিল। হিমাংশুবাবুকে আজ বেশ প্রফুল্ল দেখিলাম--নানা কথাবার্তায় হাসি তামাসায় শিকারের গল্পে আমাদের চিত্তবিনোদন করিতে লাগিলেন। আমরা যে একটা গুরুতর রহস্যের মর্মোদঘাটনের জন্য তাঁহার অতিথি হইয়াছি তাহা যেন তিনি ভুলিয়াই গেলেন; একবারও সে প্রসঙ্গের উল্লেখ করিলেন না।

বৈকালে চা--পান সমাপ্ত করিয়া ব্যোমকেশ কালীগতিকে একান্তে লইয়া গিয়া ফিসফিস করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কালকের প্ল্যানই ঠিক আছে তো?

কালীগতি চিন্তান্বিতভাবে কিছুক্ষণ ব্যোমকেশের মুখের পানে তাকাইয়া থাকিয়া বলিলেন, আপনি কি বিবেচনা করেন?

ব্যোমকেশ বলিল, আমার বিবেচনায় যাওয়াই ঠিক, এর একটা নিষ্পত্তি হওয়া দরকারআজ রাত্রি দশটা নাগাদ চন্দ্রাস্ত হবে, তার আগেই আমি আর অজিত গিয়ে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে বসে থাকব। যদি কেউ আসে তাকে ধরব।

কালীগীতি বলিলেন, যদি না আসে?

তাহলে বুঝব আমার আগেকার অনুমানই ঠিক, হরিনাথ মাস্টার বেঁচে নেই।

আবার কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া কালীগতি বলিলেন, বেশ, কিন্তু ঘরটা এখন গিয়ে একবার দেখে এলে ভাল হত। চলুন, আপনাদের নিয়ে যাই।

ব্যোমকেশ বলিল, চলুন। ঘরটা বেলাবেলি দেখে না রাখলে আবার রাত্রে সেখানে যাবার অসুবিধা হবে।

ঘরটা যে আমরা আগে দেখিয়াছি তাহা ব্যোমকেশ ভাঙিল না। যথা সময় তিনজন বনের ধারে কুটীরে উপস্থিত হইলাম। কালীগীতি আমাদের কুটীরের ভিতরে লইয়া গেলেন। দেখিলাম, মেঝের উপর একস্তুপ ছাই পড়িয়া আছে। তা ছাড়া ঘরের আর কোনো পরিবর্তন হয় নাই।

কালীগতি পিছনের কবাট খুলিয়া বালুর দিকে লইয়া গেলেন। বালুর উপর তখন সন্ধ্যার মলিনতা নামিয়া আসিতেছে। ব্যোমকেশ দেখিয়া বলিল, বাঃ। এদিকটা তো বেশ, যেন পাঁচিল দিয়ে ঘেরা।

আমি দেখাদেখি বলিলাম, চমৎকার!

কালীগতি বলিলেন, আপনারা আজ রাত্রে এই ঘরে থাকবেন বটে। কিন্তু আমার একটু দুর্ভাবনা হচ্ছে। শুনতে পাচ্ছি, একটা বাঘ নাকি সম্প্রতি জঙ্গলে এসেছে।

আমি বলিলাম, তাতে কি, আমরা বন্দুক নিয়ে আসব।

কালীগতি মৃদু হাসিয়া মাথা নাড়িলেন, বাঘা যদি আসে, অন্ধকারে বন্দুক কোনো কাজেই লাগবে না। যা হোক, আশা করি বাঘের গুজবটা মিথ্যে--বন্দুক আনবার দরকার হবে না; তবে সাবধানের মার নেই, আপনাদের সতর্ক করে দিই। যদি রাত্ৰে বাঘের ডাক শুনতে পান, ঘরের মধ্যে থাকবেন না, এই দিকে বেরিয়ে এসে আগল লাগিয়ে দেবেন, তারপর ঐ বালির ওপর গিয়ে দাঁড়াবেন। যদি বা বাঘ ঘরে ঢোকে বালির ওপর যেতে পারবে না।

ব্যোমকেশ খুশি হইয়া বলিল, সেই ভাল--বন্দুকের হাঙ্গামায় দরকার নেই। অজিত আবার নূতন বন্দুক চালাতে শিখেছে, হয়তো বিনা কারণেই আওয়াজ করে বসবে; ফলে শিকার আর এদিকে ঘেঁষবে না।

তারপর বাড়ি ফিরিয়া আসিলাম। মনটা কুহেলিকায় আচ্ছন্ন হইয়া রহিল। সন্ধ্যার পর হিমাংশুবাবুর অস্ত্রাগারে বসিয়া গল্পগুজব হইল। এক সময় ব্যোমকেশ হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা হিমাংশুবাবু, মনে করুন কেউ যদি একটা নিরীহ নির্ভরশীল লোককে জেনেশুনে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে পাঠিয়ে দেয় তার শাস্তি কি?

হিমাংশুবাবু হাসিয়া বলিলেন, মৃত্যু। A tooth for a tooth, an eye for an eye ব্যোমকেশ আমার দিকে ফিরিলঅজিত, তুমি কি বল?

আমিও তাই বলি।

ব্যোমকেশ অনেকক্ষণ উৰ্ধৰ্বমুখে বসিয়া রহিল। তারপর উঠিয়া গিয়া দরজার বাহিরে উঁকি মারিয়া দরজা ভেজাইয়া দিয়া ফিরিয়া আসিয়া বসিল। মৃদুস্বরে বলিল, হিমাংশুবাবু, আজ রাত্রে আমরা দুজনে গিয়ে কাপালিকের কুঁড়েয় লুকিয়ে থাকব।

বিস্মিত হিমাংশুবাবু বলিলেন, সে কি! কেন? ব্যোমকেশ সংক্ষেপে কারণ ব্যক্ত করিয়া শেষে কহিল, কিন্তু আমাদের একলা যেতে সাহস হয় না। আপনাকেও যেতে হবে।

হিমাংশুবাবু সোৎসাহে বলিলেন, বেশ বেশ, নিশ্চয় যাব

ব্যোমকেশ বলিল, কিন্তু আপনি যাচ্ছেন একথা যেন আকারে ইঙ্গিতেও কেউ না জানতে পারে। তা হলেই সব ভেস্তে যাবে। শুনুন, আমরা আন্দাজ সাড়ে নটার সময় বাড়ি থেকে বেরুব; আপনি তার আধঘন্টা পরে বেরুবেন, কেউ যেন জানতে না পারে। এমন কি, আমাদের যাবার কথা। আপনি জানেন সে ইঙ্গিতও দেবেন না।

বেশ ৷

আর আপনার সবচেয়ে ভালো রাইফেলটা সঙ্গে নেবেন। আমরা শুধু হাতেই যাব।

রাত্ৰি নটার মধ্যে আহারাদি শেষ করিয়া আমরা নিজেদের ঘরে প্রবেশ করিলাম। সাজগোজ করিয়া বাহির হইতে ঠিক সাড়ে নটা বাজিল।

বাগান পার হইয়া মাঠে পদার্পণ করিয়াছি। এমন সময় চাপা কণ্ঠে কে ডাকিল, ব্যোমকেশবাবু!

পাশে তাকাইয়া দেখিলাম, একটা গাছের আড়াল হইতে বাহির হইয়া কালীগতি আসিতেছেন। তিনি বোধহয় এতক্ষণ আমাদের জন্য প্ৰতীক্ষা করিতেছিলেন, কাছে আসিয়া বলিলেন, যাচ্ছেন? বন্দুক নেননি দেখছি। বেশ--মনে রাখবেন, যদি বাঘের ডাক শুনতে পান, বালির ওপর গিয়ে দাঁড়াবেন।

হ্যাঁমনে আছে ৷

চন্দ্ৰ অস্ত যাইতে বিলম্ব নাই, এখনি বনের আড়ালে ঢাকা পড়িবে। কালীগীতির মৃদুকথিত দুর্গা দুর্গা শুনিয়া আমরা চলিতে আরম্ভ করিলাম।

কুটীরে পৌঁছিয়া ব্যোমকেশ পকেট হইতে টর্চ বাহির করিল, নিমেষের জন্য একবার জ্বালিয়া ঘরের চারিদিক দেখিয়া লইল। তারপর নিজে মাটির উপর উপবেশন করিয়া বলিল, বোসো

পারো। তবে দেশলাইয়ের আলো হাত দিয়ে আড়াল করে রেখো।

দুজনে উক্তরূপে দেশলাই জ্বালিয়া সিগারেট ধরাইয়া নীরবে টানিতে লাগিলাম।

আধঘণ্টা পরে বাহিরে একটু শব্দ হইল। ব্যোমকেশ ডাকিল, হিমাংশুবাবু আসুন।

হিমাংশুবাবু রাইফেল লইয়া আসিয়া বসিলেন। তখন তিনজনে সেই কুঁড়ে ঘরের মেঝেয় বসিয়া দীর্ঘ প্রতীক্ষা আরম্ভ করিলাম। মাঝে মাঝে মৃদুস্বরে দুএকটা কথা হইতে লাগিল। হিমাংশুবাবুর কব্জিতে বাঁধা ঘড়ির রেডিয়ম--দ্যুতি সময়ের নিঃশব্দ সঞ্চার জ্ঞাপন করিতে লাগিল।

বারোটা বাজিয়া পঁচিশ মিনিটের সময় একটা বিকট গম্ভীর শব্দ শুনিয়া তিনজনেই লাফাইয়া দাঁড়াইয়া উঠিলাম। বন্য বাঘের ক্ষুধার্ত ডাক আগে কখনো শুনি নাই--বুকের ভিতরটা পর্যন্ত কাঁপিয়া উঠিল। হিমাংশুবাবু চাপা গলায় বলিলেন, বাঘ। তাহার রাইফেলে খুঁট করিয়া শব্দ হইল, বুঝিলাম তিনি রাইফেলে টোটা ভরিলেন।

বাঘের ডাকটা বনের দিক হইতে আসিয়াছিল। হিমাংশুবাবু পা টিপিয়া টিপিয়া খোলা দরজার পাশে গিয়া দাঁড়াইলেন, তাঁহার গাঢ়তর দেহরেখা অন্ধকারের ভিতর অস্পষ্টভাবে উপলব্ধি হইল। আমরা নিস্তব্ধভাবে দাঁড়াইয়া রহিলাম।

হিমাংশুবাবু ফিসফিস করিয়া বলিলেন, কিছু দেখতে পাচ্ছি না।

শব্দভেদী--ব্যোমকেশের স্বর যেন বাতাসে মিলাইয়া গেল। হিমাংশুবাবু শুনিতে পাইলেন কি না জানি না, তিনি কুটীরের বাহিরে দুই পদ অগ্রসর হইয়া বন্দুক তুলিলেন।

এই সময় আবার সেই দীর্ঘ হিংস্র আওয়াজ যেন মাটি পর্যন্ত কাঁপাইয়া দিল। এবার শব্দ আরো কাছে আসিয়াছে, বোধহয় পঞ্চাশ গজের মধ্যে। শব্দের প্রতিধ্বনি মিলাইয়া যাইতে না। যাইতে হিমাংশুবাবুর বন্দুকের নল হইতে একটা আগুনের রেখা বাহির হইল। শব্দ হইল--কড়াৎ!

সঙ্গে সঙ্গে দূরে একটা গুরুভার পতনের শব্দ। হিমাংশুবাবু বলিয়া উঠিলেন, পড়েছে। ব্যোমকেশবাবু, টর্চ বার করুন।

টর্চ ব্যোমকেশের হাতেই ছিল, সে বোতাম টিপিয়া আলো জ্বলিল; ঘর হইতে বাহির হইয়া আগে আগে যাইতে যাইতে বলিল, আসুন।

আমরা তাহার পশ্চাতে চলিলাম। হিমাংশুবাবু বলিলেন, বেশি কাছে যাবেন না; যদি শুধু জখম হয়ে থাকে

কিন্তু বাঘ কোথায়? বনের ঠিক কিনারায় একটা কালো কম্বল--ঢাকা কি যেন পড়িয়া রহিয়াছে। নিকটে গিয়া টর্চের পরিপূর্ণ আলো তাহার উপর ফেলিতেই হিমাংশুবাবু চীৎকার করিয়া উঠিলেন, একি! এ যে দেওয়ানজী!

দেওয়ান কালীগতি কাৎ হইয়া ঘাসের উপর পড়িয়া আছেন। তাঁহার রক্তাক্ত নগ্ন বক্ষ হইতে কম্বলটা সরিয়া গিয়াছে। চক্ষু উন্মুক্ত; মুখের একটা পাশবিক বিকৃতি তাঁহার অন্তিমকালের মনোভাব ব্যক্ত করিতেছে।

ব্যোমকেশ ঝুঁকিয়া তাঁহার বুকের উপর হাত রাখিল, তারপর সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া বলিল, গতাসু। যদি প্রেতলোক বলে কোনো রাজ্য থাকে তাহলে এতক্ষণে হরিনাথ মাস্টারের সঙ্গে দেওয়ানজীর মুলাকাত হয়েছে।

তাহার মুখে বা কণ্ঠস্বরে মর্মপীড়ার কোনো আভাসই পাওয়া গেল না।

হিসাবের খাতা কয়টা হিমাংশুবাবুর দিকে ঠেলিয়া দিয়া ব্যোমকেশ বলিল, এগুলো ভাল করে পরীক্ষা করলেই বুঝতে পারবেন, এক লক্ষ টাকা দেনা কেন হয়েছে।

আমরা তিনজনে বৈঠকখানার ফরাসের উপর বসিয়াছিলাম। কালীগতির মৃত্যুর পর দুই দিন অতীত হইয়াছে। তাঁহার লোহার সিন্দুক ভাঙিয়া হিসাবের খাতা চারিটা ও আরও অনেক দলিল ব্যোমকেশ বাহির করিয়াছিল।

হিমাংশুবাবুর চক্ষু হইতে বিভীষিকার ছায়া তখনো সম্পূর্ণ তিরোহিত হয় নাই। তিনি করতলে চিবুক রাখিয়া বসিয়াছিলেন, বোমকেশের কথায় মুখ তুলিয়া বলিলেন, এখনো যেন আমি কিছু বুঝতে পারছি না--ভাবতে গেলেই সব গুলিয়ে যাচ্ছে।

ব্যোমকেশ বলিল, আপনার বর্তমান মানসিক অবস্থায় গুলিয়ে যাওয়া আশ্চর্য নয়। আমি টুকরো টুকরো প্রমাণ থেকে এই রহস্য কাহিনীর যে কাঠামো খাড়া করতে পেরেছি তা আপনাকে বলছি, শুনুন। কিন্তু তার আগে এই রেজিস্ট্রি দলিলগুলো নিন।

কি এগুলো? বলিয়া হিমাংশুবাবু দলিলগুলি হাতে লইলেন।

ব্যোমকেশ বলিল, আপনি যে--মহাজনের কাছে তমসুক লিখে টাকা ধার নিয়েছিলেন, সেই মহাজন সেই সব তমসুক রেজিস্ট্রি করে কালীগতিকে বিক্রি করে। এগুলো হচ্ছে সেই সব তমসুক আর তার বিক্রি কবালা।

কালীগতি এইসব তমসুক কিনেছিলেন?

হ্যাঁ, আপনার টাকায় কিনেছিলেন; যাকে বলে মাছের তেলে মাছ ভাজা।

হিমাংশুবাবু উদভ্ৰান্তভাবে দেয়ালের পানে তাকাইয়া রহিলেন। ব্যোমকেশ বলিল, ওগুলো এখন ছিঁড়ে ফেলতে পারেন, কারণ কালীগতি আর আপনার কাছ থেকে টাকা আদায় করতে আসবেন না। তিনি ঋণের দায়ে আপনার আস্ত জমিদারীটাই নিলাম করে নেবেন ভেবেছিলেনআরো বছর দুই এইভাবে চালাতে পারলে করতেনও তাই। কিন্তু মাঝ থেকে ঐ ন্যালাখ্যাপা অঙ্ক--পাগলা মাস্টারটা এসে সব ভণ্ডুল করে দিলে।

আমি বলিলাম, না না, ব্যোমকেশ, গোড়া থেকে বল।

ব্যোমকেশ ধীরভাবে একটা সিগারেট ধরাইয়া বলিল, গোড়া থেকেই বলছি। হিমাংশুবাবুর বাবা মারা যাবার পর কালীগতি যখন দেখলেন যে নূতন জমিদার বিষয় পরিচালনায় উদাসীন তখন তিনি ভারী সুবিধা পেলেন। হিসাবের খাতা তিনি লেখেন, তাঁর মাথার ওপর পরীক্ষা করবার কেউ নেইসুতরাং তিনি নিৰ্ভয়ে কিছু কিছু টাকা তছরূপ করতে আরম্ভ করলেন। এইভাবে কিছুদিন চলল। কিন্তু নাল্পে সুখমস্তি--ও প্রবৃত্তিটা ক্রমশ বেড়েই চলে। এদিকে জমিদারীর আয়--ব্যয়ের একটা বাঁধা হিসেব আছে, বেশি গরমিল হলেই ধরা পড়বার সম্ভাবনা। তিনি তখন এক মস্ত চাল চললেন, বড় বড় প্রজাদের সঙ্গে মোকদ্দমা বাধিয়ে দিলেন। খরচ আর বাঁধাবাঁধির মধ্যে রইল না; আদালতে ন্যায্য এবং ন্যায়--বহির্ভূত দুই রকমই খরচ আছে, সুতরাং স্বচ্ছন্দে গোঁজামিল দেওয়া চলে। কালীগীতির চুরির খুব সুবিধা হল।

প্রথমটা বোধহয় কালীগতি কেবল চুরি করবার মতলবেই ছিলেন, তার বেশি উচ্চাশা করেননি। কিন্তু হঠাৎ একদিন এক তান্ত্ৰিক এসে হাজির হল-- এবং আপনি প্রথমেই তার বিষ--নজরে পড়ে গেলেন। কালীগতি তার কাছ থেকে মন্ত্র নিলেন; সঙ্গে সঙ্গে আরো অনেক কুমন্ত্রণা গ্ৰহণ করলেন। আমার বিশ্বাস এই কাপালিকই জমিদারী আত্মসাৎ করবার পরামর্শ কালীগতিকে দেয়; কারণ হিসেবের খাতা থেকে দেখতে পাচ্ছি, সে আসবার পর থেকেই চুরির মাত্রা বেড়ে গেছে।

স্বাভাবিক লোভ ছাড়াও একটা ধমার্ন্ধতার ভাব কালীগতির মধ্যে ছিল। ধর্মান্ধতা মানুষকে কত নৃশংস করে তুলতে পারে তার দৃষ্টান্ত আমাদের দেশে বিরল নয়। কালীগতি গুরুর প্ররোচনায় অন্নদাতার সর্বনাশ করতে উদ্যত হলেন। তিনি যে কৌশলটি বার করলেন সেটি যেমন সহজ তেমনি কার্যকর। প্রথমে আপনার টাকা চুরি করে তহবিল খালি করে দিলেন, পরে খরচের টাকা নেই ওই অজুহাতে মহাজনের কাছ থেকে টাকা ধার নেওয়ালেন, এবং শেষে মহাজনের কাছ থেকে আপনারই টাকায় সেই তমসুক কিনে নিলেন। কালীগতি বিনা খরচে আপনার উত্তমৰ্ণে হয়ে দাঁড়ালেন। আপনি কিছুই জানতে পারলেন না।

এইভাবে বেশ আনন্দে দিন কাটছে, হঠাৎ একদিন কোথা থেকে হরিনাথ এসে হাজির হল। আপনি তাকে বেবির মাস্টার রাখলেন। বড় ভালুমানুষ বেচারা, দুচার দিনের মধ্যে কালীগতির ভক্ত হয়ে উঠল; কালীগতি তাকে তান্ত্রিক ধর্ম--মাহাত্ম্য শেখাতে লাগলেন। কালীমূর্তির এক পট হরিনাথ তাঁর কাছ থেকে এনে নিজের ঘরের দেওয়ালে ভক্তিভরে টাঙিয়ে রাখলে।

কিন্তু শুধু ধর্মে তার পেট ভরে না--সে অঙ্ক--পাগল। বেবিকে সে যোগ বিয়োগ শেখায়, আর নিজের মনে বেবির খাতায় বড় বড় অঙ্ক কষে। কিন্তু তবু নিজের কল্পিত অঙ্কে সে সুখ পায় না।

একদিন আলমারি খুলে সে হিসেবের খাতাগুলো দেখতে পেলে। অঙ্কের গন্ধ পেলে সে আর স্থির থাকতে পারে না--মহা আনন্দে সে খাতাগুলো পরীক্ষা করতে আরম্ভ করে দিলে। যতই হিসেবের মধ্যে ঢুকতে লাগল, ততই দেখলে হাজার হাজার টাকার গরমিল। হরিনাথ স্তম্ভিত হয়ে গেল।

কিন্তু এই আবিষ্কারের কথা সে কাকে বলবে? আপনার সঙ্গে তার বড় একটা দেখা হয় না, উপরন্তু আপনার সঙ্গে উপযাচক হয়ে দেখা করতে সে সাহস করে না। এ অবস্থায় যা সবচেয়ে স্বাভাবিক সে তাই করলে--কালীগতিকে গিয়ে হিসেব গরমিলের কথা বললে।

কালীগতি দেখলেন----সর্বনাশ। তাঁর এতদিনের ধারাবাহিক চুরি ধরা পড়ে যায়। তিনি তখনকার মত হরিনাথকে স্তোকবাক্যে বুঝিয়ে মনে মনে সঙ্কল্প করলেন যে, হরিনাথকে সরাতে হবে, এবং এই সঙ্গে ঐ খাতাগুলো। নইলে তাঁর দুস্কৃতির প্রমাণ থেকে যাবে। এতদিন যে সেগুলো কোনো ছুতোয় নষ্ট করে ফেলেননি এই অনুতাপ তাঁকে ভীষণ নিষ্ঠুর করে তুলল।

এইখানে এই কাহিনীর সবচেয়ে ভয়াবহ আর রোমাঞ্চকর ঘটনার আবির্ভাব। হরিনাথকে পৃথিবী থেকে সরাতে হবে, অথচ ছুরি ছোরা চালানো বা বিষপ্রয়োগ চলবে না। তবে উপায়?

যে চোরাবালি থেকে আপনার জমিদারীর নামকরণ হয়েছে সেই চোরাবালির সন্ধান কালীগতি জানতেন। সম্ভবত তাঁর গুরু কাপালিকের কাছ থেকেই জানতে পেরেছিলেন; কারণ চোরাবালিটা কাপালিকের কুঁড়ের ঠিক পিছনেই। আমরাও সেদিন সকালে পাখি মারতে গিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে সেই ভয়ঙ্কর চোরাবালির সন্ধান পেয়েছিলুম।

কালীগতি মাস্টারকে সরাবার এক সম্পূর্ণ নূতন উপায় উদ্ভাবন করলেন। চমৎকার উপায়। হরিনাথ মাস্টার মরবে। অথচ কেউ বুঝতেই পারবে না যে সে মরেছে। তাঁর ওপর সন্দেহের ছায়াপাত পর্যন্ত হবে না, বরঞ্চ খাতাগুলো অন্তর্ধানের বেশ একটা স্বাভাবিক কারণ পাওয়া যাবে।

গত অমাবস্যার দিন তিনি হরিনাথকে বললেন, তুমি যদি মন্ত্রসিদ্ধ হতে চাও তো আজ রাত্রে ঐ কুঁড়ে ঘরে গিয়ে মন্ত্র সাধনা কর।

হরিনাথ রাজী হল; সে বেবির খাতায় মন্ত্রটা লিখে কাগজটা ছিঁড়ে নিয়ে নিজের কাছে রাখল।

রাত্রে সবাই ঘুমুলে হরিনাথ নিজের ঘর থেকে বার হল। সে সাধনা করতে যাচ্ছে, তার জামা জুতো পরিবার দরকার নেই, এমন কি সে চশমাটাও সঙ্গে নিল নাকারণ অমাবস্যার রাত্রে চশমা থাকা না থাকা সমান।

কালীগতি তাকে কুটীর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে এলেন। আসবার সময় বলে এলেন-- যদি বাঘের ডাক শুনতে পাও ভয় পেও না, পিছনের দরজা দিয়ে বালির ওপর গিয়ে দাঁড়িও; সেখানে বাঘ যেতে পারবে না।

হরিনাথ জপে বসলোতারপর যথাসময়ে বাঘের ডাক শুনতে পেল। সে কি ভয়ঙ্কর ডাক, তা আমরাও সেদিন শুনেছি। হিমাংশুবাবুর মত পাকা শিকারীও বুঝতে পারেননি যে এ নকল ডাক। কালীগতি জন্তু--জানোয়ারের ডাক অদ্ভুত নকল করতে পারতেন। প্রথম দিন এখানে এসেই আমরা তাঁর শেয়াল ডাক শুনেছিলুম।

বাঘের ডাক শুনে অভাগা হরিনাথ ছুটে গিয়ে বালির ওপর দাঁড়াল এবং সঙ্গে সঙ্গে চোরাবালির অতল গহ্বরে তলিয়ে গেল। একটা চীৎকার হয়তো সে করেছিল। কিন্তু তাও অর্ধপথে চাপা পড়ে গেল। তার ভয়ঙ্কর মৃত্যুর কথা--ভাবলে গা শিউরে ওঠে।

একটু চুপ করিয়া ব্যোমকেশ আবার বলিতে লাগিল, কালীগতি কার্য সুসম্পন্ন করে ফিরে এসে সেই রাত্ৰেই হরিনাথের ঘর থেকে খাতা সরিয়ে ফেললেন। তার পরদিন যখন হরিনাথকে পাওয়া গেল না। তখন রটিয়ে দিলেন যে সে খাতা চুরি করে পালিয়েছে।

হরিনাথের অন্তর্ধানের কৈফিয়ৎ বেশ ভালই হয়েছিল। কিন্তু তবু কালীগতি সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। কে জানে যদি কেউ সন্দেহ করে যে, হরিনাথ শুধু খাতা নিয়ে পালাবে কেন? নিশ্চয় এর মধ্যে কোন গুঢ় তত্ত্ব আছে। তখন তিনি সিন্দুক থেকে ছ'হাজার টাকাও সরিয়ে ফেললেন। এই সময়ে আপনার চাবি হারিয়েছিল, সুতরাং সন্দেহটা সহজেই কালীগতির ঘাড় থেকে নেমে গেলসবাই ভাবলে হারানো চাবির সাহায্যে হরিনাথই টাকা চুরি করেছে। কালীগতির ডবল লাভ হল, টাকাও পেলেন, আবার হরিনাথের অপরাধও বেশ বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠল।

তারপর আমি আর অজিত এলুম। এই সময়ে বাড়িতে আর একটা ব্যাপার ঘটছিল যার সঙ্গে হরিনাথের অন্তর্ধানের কোনো সম্পর্ক নেই। ব্যাপারটা আমাদের সমাজের একটা চিরন্তন ট্র্যাজেডিবিধবার পদস্থলন, নূতন কিছু নয়। অনাদি সরকারের বিধবা মেয়ে রাধা একটি মৃত সন্তান প্রসব করে। তারা অনেক যত্ন করে কথাটা লুকিয়ে রেখেছিল, কিন্তু শেষে আপনার স্ত্রী জানতে পারেন। তিনি তৎক্ষণাৎ আপনাকে এসে বলেন যে, এসব অনাচার এ বাড়িতে চলবে না, ওদের আজই বিদেয় করে দাও--কেমন, ঠিক কি না?

শেষের দিকে হিমাংশুবাবু বিস্ফারিত নেত্ৰে ব্যোমকেশের দিকে তাকাইয়া ছিলেন, এখন একবার ঘাড় নাড়িয়া নীরবে জানালার বাহিরে চাহিয়া রহিলেন।

ব্যোমকেশ বলিতে লাগিল, কিন্তু আপনার মনে দয়া হল; আপনি ঐ অভাগী মেয়েটাকে কলঙ্কের বোঝা মাথায় চাপিয়ে তাড়িয়ে দিতে পারলেন না। এই নিয়ে আপনার স্ত্রীর সঙ্গে একটু মনোমালিন্যও হয়েছিল। যা হোক, আপনি যখন বুঝলেন যে ওরা ভ্রুণহত্যার অপরাধে অপরাধী নয়, তখন রাধাকে চুপি চুপি তার মাসীর কাছে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করলেন। পাছে আপনার আমলা বা চাকর--বাকিরদের মধ্যেও জানাজানি হয়, এই জন্যে নিজে গাড়ি চালিয়ে তাকে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে এলেন।

অনাদি সরকারের ভাগ্য ভাল যে আপনার মত মনিব পেয়েছে; অন্য কোনো মালিক এতটা করত বলে আমার মনে হয় না।

সে যাহাকে, এই ব্যাপারের সঙ্গে হরিনাথের অন্তর্ধানের ঘটনা জড়িয়ে গিয়ে সমস্তটা আমার কাছে অত্যন্ত জটিল হয়ে উঠেছিল। তারপর অতি কষ্টে জট ছাড়ালুম; রাধাকে দেখবার জন্যে স্টেশনে গিয়ে লুকিয়ে বসে রইলুম। তার চেহারা দেখেই বুঝলুম এ ব্যাপারের সঙ্গে তার কোনো সম্বন্ধ নেইতার ট্র্যাজেডি অন্য রকমতখন আর সন্দেহ রইল না যে কালীগতিই হরিনাথকে খুন করেছেন। লোকটি কতবড় নৃশংস আর বিবেকহীন তার জ্বলন্ত প্রমাণ পেলুম রেজিস্ট্রি অফিসে। কিন্তু তাঁকে ধরবার উপায় নেই; যে খাতাগুলো থেকে তাঁর চুরি--অপরাধ প্রমাণ হতে পারত সেগুলো তিনি আগেই সরিয়েছেন। হয়তো পুড়িয়ে ফেলেছেন, নয়তো হরিনাথের সঙ্গে ঐ চোরাবালিতেই ফেলে দিয়েছেন।

কালীগীতি প্রথমটা বেশ নিশ্চিন্তই ছিলেন। কিন্তু যখন অজিতের মুখে শুনলেন যে হরিনাথের মৃত্যুর কথা আমি বুঝতে পেরেছি তখন তিনি ভয় পেয়ে গেলেন। প্রথমে তিনি আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন যে হরিনাথ মরেনি, প্রমাণস্বরূপ নিজেই কুঁড়ে ঘরে আগুন জ্বেলে রেখে এসে দুপুর রাত্রে আমাদের দেখালেন। আমি তখন এমন ভাব দেখাতে লাগলুম যেন তাঁর কথা সত্যি হলেও হতে পারে। আমরা ঠিক করলুম রাত্রে গিয়ে কুঁড়ে ঘরে পাহারা দেব। তিনি রাজী হলেন বটে। কিন্তু কাউকে একথা বলতে বারণ করে দিলেন।

আমাদের মারবার ফন্দি প্ৰথমে কালীগীতির ছিল না; তাঁর প্রথম চেষ্টা ছিল আমাদের বোঝান যে হরিনাথ বেঁচে আছে। কিন্তু যখন দেখলেন যে আমরা হরিনাথের জন্যে কুঁড়ে ঘরে গিয়ে বসে থাকতে চাই, তখন তাঁর ভয় হল যে, এইবার তাঁর সব কল--কৌশল ধরা পড়ে যাবে। কারণ হরিনাথ যে কুঁড়ে ঘরে আসতেই পারে না, একথা তাঁর চেয়ে বেশি কে জানে? তখন তিনি আমাদের চোরাবালিতে পাঠাবার সঙ্কল্প করলেন। আমিও এই সুযোগই খুঁজছিলুম; আমাদের খুন করবার ইচ্ছাটা যাতে তাঁর পক্ষে সহজ হয়। সে চেষ্টারও ক্ৰটি করিনি। তান্ত্রিক এবং তন্ত্র--ধর্মকে গালাগালি দেবার আর কোনো উদ্দেশ্য ছিল না।

পরদিন বিকেলে তিনি আমাদের নিয়ে কুঁড়ে ঘর দেখাতে গেলেন। সেখানে গিয়ে কথাচ্ছলে বললেন, রাত্রে যদি আমরা বাঘের ডাক শুনতে পাই তাহলে যেন বালির ওপর গিয়ে দাঁড়াই।

এই হল সেদিন সন্ধ্যে পর্যন্ত যা ঘটেছিল তার বিবরণ। তারপর যা যা ঘটেছে সবই আপনি জানেন।

ব্যোমকেশ চুপ করিল। অনেকক্ষণ কোনো কথা হইল না। তারপর হিমাংশুবাবু বলিলেন, আমাকে সে--রাত্রে রাইফেল নিয়ে যেতে কেন বলেছিলেন ব্যোমকেশবাবু?

ব্যোমকেশ কোনো উত্তর দিল না। হিমাংশুবাবু আবার প্রশ্ন করিলেন, আপনি জানতেন আমি বাঘের ডাক শুনে শব্দভেদী গুলি ছুড়ব?

মৃদু হাসিয়া ব্যোমকেশ মাথা নাড়িল, বলিল, সে প্রশ্ন নিষ্প্রোয়জনহিমাংশুবাবু, আপনি ক্ষুব্ধ হবেন না। মৃত্যুই ছিল কালীগতির একমাত্র শাস্তি। তিনি যে ফাঁসি--কাঠে না ঝুলে বন্দুকের গুলিতে মরেছেন এটা তাঁর ভাগ্যআপনি নিমিত্ত মাত্র। মনে আছে, সেদিন রাত্রে আপনিই বলেছিলেন— a tooth for a tooth, an eye for an eye?

এই সময় বাহিরের বারান্দার সম্মুখে মোটর আসিয়া থামিল। পরক্ষণেই বাস্তসমস্তভাবে কুমার ত্ৰিদিব প্ৰবেশ করিলেন, তাঁহার হাতে একখানা খবরের কাগজ। তিনি বলিলেন, হিমাংশু, এসব কি কাণ্ড! দেওয়ান কালীগতি বন্দুকের গুলিতে মারা গেছেন? বলিয়া কাগজখানা বাড়াইয়া দিয়া বলিতে লাগিলেন, আমি কিছুই জানতাম না; ইনফ্লুয়েঞ্জায় পড়েছিলুম তাই ক'দিন আসতে পারিনি। আজ কাগজ পড়ে দেখি এই ব্যাপার। ছুটতে ছুটতে এলুম। ব্যোমকেশবাবু, কি হয়েছে বলুন দেখি।

ব্যোমকেশ উত্তর দিবার আগে কাগজখানা হাতে লইয়া পড়িতে আরম্ভ করিল। তাহাতে লেখা ছিল

চোরাবালি নামক উত্তরবঙ্গের প্রসিদ্ধ জমিদারী হইতে একটি শোচনীয় মৃত্যু--সংবাদ পাওয়া গিয়াছে। চোরাবালির জমিদার কয়েকজন বন্ধুর সহিত রাত্রিকালে নিকটবতী জঙ্গলে বাঘ শিকার করিতে গিয়াছিলেন। বাঘের ডাক শুনিতে পাইয়া জমিদার হিমাংশুবাবু বন্দুক ফায়ার করেন। কিন্তু মৃতদেহের নিকট গিয়া দেখিলেন যে বাঘের পরিবর্তে জমিদারীর পুরাতন দেওয়ান কালীগীতি ভট্টাচার্যগুলির আঘাতে মরিয়া পড়িয়া আছেন।

বৃদ্ধ দেওয়ান এই গভীর রাত্রে জঙ্গলের মধ্যে কেন গিয়াছিলেন এ রহস্য কেহ ভেদ করিতে পারিতেছে না।

জমিদার হিমাংশুবাবু দেওয়ানের মৃত্যুতে বড়ই মর্মাহত হইয়াছেন, পুলিস--তদন্ত দ্বারা বুঝিতে পারা গিয়াছে যে এই দুর্ঘটনার জন্য হিমাংশুবাবু কোন অংশে দায়ী নহেন--তিনি যথোচিত সাবধানতা অবলম্বন করিয়া গুলি ছুঁড়িয়াছিলেন।

কাগজখানা রাখিয়া দিয়া ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইল। আলস্য ভাঙ্গিয়া কুমার ত্ৰিদিবকে বলিল, চলুন, এবার আপনার রাজ্যে ফেরা যাক, এখানকার কাজ আমার শেষ হয়েছে। পথে যেতে যেতে কালীগতির শোচনীয় মৃত্যুর কাহিনী আপনাকে শোনাব।

(শেষ)


No comments:

Post a Comment