কঙ্কাবতী (দ্বিতীয়াংশ)



লেখক: ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়




প্রথমাংশের লিঙ্ক

দ্বিতীয় খণ্ড

প্রথম পরিচ্ছেদ

নৌকা

বড় পিপাসা, বড় গায়ের জ্বালা। কঙ্কাবতী মনে করিল, যাই, নদীর ঘাটে যাই, সেই খানে বসিয়া এক পেট জল খাই, আর গায়ে জল মাখি, তাহা হইলে শান্তি পাইব।”

নদীর ঘাটে বসিয়া কঙ্কাবতী জল মাখিতেছে, এমন সময় কে বলিল, “কে ও, কঙ্কাবতী?” কঙ্কাবতী চারিদিকে চাহিয়া দেখিল, কাহাকেও দেখিতে পাইল না। কেহ কোথাও নাই। কে এ কথা বলিতেছে, কঙ্কাবতী তাহা স্থির করিতে পারিল না। নদীর জলে দূরে কেবল একটি কাতলা মাছ ভাসিতেছে আর ডুবিতেছে, তাহাই দেখিতে পাইল।

পুনরায় কে জিজ্ঞাসা করিল, “কে ও, কঙ্কাবতী?”

কঙ্কাবতী এইবার উত্তর করিলেন, “হাঁ গো আমি কঙ্কাবতী।”

পুনরায় কে জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার কি বড় গায়ের জ্বালা, তোমার কি বড় পিপাসা?” কঙ্কাবতী উত্তর করিল, “হাঁ গো, আমার বড় গায়ের জ্বালা, আমার বড় পিপাসা।”

কে আবার বলিল, “তবে তুমি এক কাজ কর না কেন? নদীর মাঝখানে চল না কেন? নদীর ভিতর অতি সুশীতল ঘর আছে, সেখানে গেলে তোমার পিপাসার শান্তি হইবে, তোমার শরীর জুড়াইবে।”

কঙ্কাবতী উত্তর করিল, “নদীর মাঝখান যে অনেক দুর! সেখানে আমি কি করিয়া যাইব?”

সে বলিল, “কেন? ওই যে জেলেদের নৌকা রহিয়াছে, ও নৌকার উপর বসিয়া কেন এস না।” জেলেদের একখানি নৌকার উপর গিয়া কঙ্কাবতী বসিল। এমন সময় বাটীতে কঙ্কাবতীর অনুসন্ধান হইল। “কঙ্কাবতী কোথায় গেল, কঙ্কাবতী কোথায় গেল?”―এই বলিয়া একটা গোল পড়িল। কে বলিল, “ওগো! তোমাদের কঙ্কাবতী ওই ঘাটের দিকে গিয়াছে।”

কঙ্কাবতীর বাড়ীর সকলে মনে করিল যে, জনার্দন চৌধুরীর সহিত বিবাহ হইবার ভয়ে কঙ্কাবতী পলায়ন করিতেছে। তাই কঙ্কাবতীকে ডাকিয়া আনিবার জন্য প্রথমে বড় ভগ্নী ঘাটের দিকে দৌড়িল। ঘাটে আসিয়া দেখে, কঙ্কাবতী একখানি নৌকায় চড়িয়া নদীর মাঝখানে যাইতেছে।

কঙ্কাবতীর ভগিনী বলিলঃ

“কঙ্কাবতী বোন আমার, ঘরে ফিরে এস না? / বড় দিদি হই আমি, ভাল কি আর বাস না?

তিন ভগ্নী আছি দিদি, দুইটি বিধবা তার / কঙ্কাবতী তুমি ছোট, বড় আদরের মার।”

নৌকায় বসিয়া বসিয়া কঙ্কাবতী উত্তর করিলঃ

“শুনিয়াছি আছে নাকি জলের ভিতর / শান্তিময় সুখময় সুশীতল ঘর।

সেই খানে যাই দিদি পূজি তোমার পা / এই কঙ্কাবতীর নৌকাখানি হুথু যা।”

এই কথা বলিতেই কঙ্কাবতীর নৌকাখানি আরও গভীর জলে ভাসিয়া গেল। তখন ভাই আসিয়া কঙ্কাবতীকে বলিলঃ

“কঙ্কাবতী ঘরে এস, কুলেতে দিও না কালি / রেগেছেন বাবা বড়, দিবেন কতই গালি।

বালিকা অবুঝ তুমি, কি জান সংসার-কথা? / ঘরে ফিরে এস, দিও না বাপের মনে ব্যথা।

কঙ্কাবতী উত্তর করিলঃ

“কি বলিছ দাদা তুমি বুঝিতে না পারি / জ্বলিছে আগুন দেহে নিবাইতে নারি।

যাও দাদা ঘরে যাও হও তুমি রাজা / এই কঙ্কাবতীর নৌকাখানি হুথু যা।”

এই কথা বলিতেই কঙ্কাবতীর নৌকাখানি আরও দূরে জলে ভাসিয়া গেল। তখন কঙ্কাবতীর মা আসিয়া বলিলেনঃ

“কঙ্কাবতী লক্ষ্মী আমার ঘরে ফিরে এস না? / কাঁদিতেছে মায়ের প্রাণ, বিলম্ব আর ক’রো না।

ভাত হ’ল কড় কড় ব্যঞ্জন হইল বাসি / কঙ্কাবতী মা আমার সাত দিন উপবাসী।

কঙ্কাবতী উত্তর করিলঃ

“বড়ই পিপাসা মাতা না পারি সহিতে / তুষের আগুন সদা জ্বলিছে দেহেতে;

এই আগুন নিবাইতে যাইতেছি মা / কঙ্কাবতীর নৌকাখানি এই হুথু যা।”

এই বলিতে কঙ্কাবতীর নৌকাখানি আরও দূরে জলে ভাসিয়া গেল।

তখন বাবা আসিয়া বলিলেনঃ

“কঙ্কাবতী ঘরে এস, হইবে তোমার বিয়া / কত যে হতেছে ঘটা দেখ তুমি ঘরে গিয়া।

গহনা পরিবে কত আর সাটিনের জামা / কত যে পাইবে টাকা নাহিক তাহার সীমা।”

কঙ্কাবতী উত্তর করিলঃ

টাকাকড়ি কাজ নাই বসন-ভূষণ / আগুনে পুড়িছে পিতা শরীর এখন।

দারুণ যাতনা পিতা আর ত সহে না / এই কঙ্কাবতীর নৌকাখানি ডুবে―যা।”

এই বলিতেই কঙ্কাবতীর নৌকাখানি নদীর জলে টুপ করিয়া ড়ুবিয়া গেল।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

জলে

নৌকার সহিত কঙ্কাবতীও ডুবিয়া গেল। কঙ্কাবতী জলের ভিতর ক্রমেই ডুবিতে লাগিল। ক্রমেই নীচে যাইতে লাগিল। যাইতে যাইতে অনেক দূর চলিয়া গেল। তখন নদীর যত মাছ সব একত্র হইল। নদীর ভিতর মহা-কোলাহল পড়িয়া গেল যে, কঙ্কাবতী আসিতেছে। রুই বলে, “কঙ্কাবতী আসিতেছে।” পুঁটী বলে “কঙ্কাবতী আসিতেছে।” সবাই বলে, “কঙ্কাবতী আসিতেছে।” পথ পানে এক দৃষ্টে চাহিয়া জলচর জীব-জন্তু সব যেখানে দাঁড়াইয়াছিল, ক্রমে কঙ্কাবতী আসিয়া সেইখানে উপস্থিত হইল। সকলেই কঙ্কাবতীর আদর করিল। সকলেই বলিল, “এস এস, কঙ্কাবতী এস।”

মাছেদের ছেলে-মেয়েরা বলিল, “আমরা কঙ্কাবতীর সঙ্গে খেলা করিব। বৃদ্ধা কাতলা মাছ তাহাদিগকে ধমক দিয়া বলিল, “কঙ্কাবতীর এ খেলা করিবার সময় নয়। বাছার বড় গায়ের জ্বালা দেখিয়া আমি কঙ্কাবতীকে ঘাট হইতে ডাকিয়া আনিলাম। আহা, কত পথ আসিতে হইয়াছে। বাছার আমার মুখ শুকাইয়া গিয়াছে! এস মা, তুমি আমার কাছে এস। একটু বিশ্রাম কর, তারপর তোমার একটা ব্যবস্থা করা যাইবে।”

কঙ্কাবতী আস্তে আস্তে কাতলা মাছের নিকট গিয়া বসিল।

এদিকে কঙ্কাবতী বিশ্রাম করিতে লাগিল, ওদিকে জলচর জীবজন্তুগণ মহাসমারোহে একটি সভা করিল। তপস্বী মাছের দাড়ি আছে দেখিয়া সকলে তাহাকে সভাপতিরূপে বরণ করিলেন। কঙ্কাবতীকে লইয়া কি করা যায় সভায় এই কথা লইয়া বাদানুবাদ হইতে লাগিল।অনেক বক্তৃতার পর, চতুর বাটা মাছ প্রস্তাব করিল, “এস ভাই, কঙ্কাবতীকে আমরা আমাদের রানী করি।”

এই কথাটি সকলের মনোনীত হইল। চারিদিকে জয়ধ্বনি উঠিল।

মাছেদের আর আনন্দের পরিসীমা নাই। সকলেই বলাবলি করিতে লাগিল যে, ভাই! কঙ্কাবতী আমাদের রানী হইলে আর আমাদের কোনও ভাবনা থাকে না। বঁড়শী দিয়া আমাদিগকে কেহ গাঁথিলে হাত দিয়া কঙ্কাবতী সুতাটি ছিঁড়িয়া দিবেন। জেলেরা জাল ফেলিলে ছুরি দিয়া কঙ্কাবতী জালটি কাটিয়া দিবেন। কঙ্কাবতী রানী হইলে আর আমাদের কোনও ভয় থাকিবে না। এস, এখন সকলে কঙ্কাবতীর কাছে যাই, আর কঙ্কাবতীকে গিয়া বলি যে, কঙ্কাবতী, তোমাকে আমাদের রানী হইতে হইবে।তাহার পর মাছেরা কঙ্কাবতীর কাছে গেল, আর সকলে বলিল, “কঙ্কাবতী! তোমাকে আমাদের রানী হইতে হইবে।”

কঙ্কাবতী বলিল, “এখন আমি তোমাদের রানী হইতে পারিব না। আমার শরীরে সুখ নাই, আমার মনেও বড় অসুখ। তাই এখন আমি তোমাদের রানী হইতে পারিব না।”

তখন কাতলানী বলিল, “তোমরা রাজপোশাক প্রস্তুত করিয়াছ? রাজপোশাক না পাইলে কঙ্কাবতী তোমাদের রানী হইবে কেন?”এই কথা শুনিয়া মাছেরা সব বলিল, “ও হো বুঝেছি বুঝেছি। রাজ-পোশাক না পাইলে কঙ্কাবতী রানী হইবে না। রাঙা কাপড় চাই, মেমের মত পোশাক চাই, তবে কঙ্কাবতী রানী হইবে।”

কঙ্কাবতী উত্তর করিল, “না গো না! রাঙা কাপড়ের জন্য নয়। সাজিবার গুজিবার সাধ আমার নাই। একেলা বসিয়া কেবল কাঁদি, এখন আমার এই সাধ।”

মাছেরা সে কথা শুনিল না। বিষম কোলাহল উপস্থিত করিল। তাহাদের কোলাহলে অস্থির হইয়া সে জিজ্ঞাসা করিল, “ভাল। না হয় আমি তোমাদের রানী হইলাম। এখন আমাকে করিতে হইবে কি?” মাছেরা উত্তর করিল, “করিতে হইবে কি? কেন? দরজীর বাড়ী যাইতে হইবে, গায়ের মাপ দিতে হইবে, পোশাক পরিতে হহবে।”

সকলে তখন কাঁকড়াকে বলিল, “কাঁকড়া মহাশয়! আপনি জলেও চলিতে পারেন, স্থলেও চলিতে পারেন, আপনি বুদ্ধিমান লোক। চক্ষু দুইটি যখন আপনি পিট পিট করেন, বুদ্ধির আভা তখন তাহার ভিতর চিক চিক করিতে থাকে। কঙ্কাবতীকে সঙ্গে লইয়া আপনি দরজীর বাড়ী গমন করুন। ঠিক করিয়া কঙ্কাবতীর গায়ের মাপটি দিবেন, দামী কাপড়ের জামা করিতে বলিবেন। কচ্ছপের পিঠে বোঝাই দিয়া টাকা মোহর লইয়া যান। যত টাকা লাগে, তত টাকা দিয়া কঙ্কাবতীর ভাল কাপড় করাইয়া দিবেন।” কাঁকড়া মহাশয় উত্তর করিলেন, “অবশ্যই আমি যাইব। কঙ্কাবতীর ভাল কাপড় হয়, ইহাতে কার না আহ্লাদ? আমাদের রানীকে ভাল না সাজাইলে গুজাইলে, আমাদের অখ্যাতি। তোমরা কচ্ছপের পিঠে টাকা মোহর বোঝাই দাও, আমি ততক্ষণ ঘর হইতে পোশাকী কাপড় পরিয়া আসি আর মাথার মাঝে সিঁথি কাটিয়া আমার চুলগুলি বেশ ভাল করিয়া ফিরাইয়া আসি।”

কচ্ছপের পিঠে টাকা মোহর বোঝাই দেওয়া হইল। ততক্ষণ কাঁকড়া মহাশয় ভাল কাপড় পরিয়া, মাথা আঁচড়াইয়া, ফিট-ফাট হইয়া আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

রাজ-বেশ

কঙ্কাবতী করে কি? সকলের অনুরোধে তাহাদের সঙ্গে চলিল। কাঁকড়া মহাশয় আগে, কঙ্কাবতী মাঝখানে, কচ্ছপ পশ্চাতে, এইরূপে তিনজনে যাইতে লাগিলেন।

প্রথম অনেক দূর জলপথে গেলেন, তাহার পর অনেক দূর স্থলপথে গেলেন। পাহাড়, পর্বত, বন, জঙ্গল অতিক্রম করিয়া অবশেষে বুড়া দরজীর বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন। বুড়া দরজী চশমা নাকে দিয়া কাঁচি হাতে করিয়া কাপড় কাটিতেছিলেন। দূর পাহাড় পানে চাহিয়া দেখিতে পাইলেন যে, তিনজন কাহারা আসিতেছে। মনে মনে ভাবিলেন, ও কাহারা আসে? নিকটে আসিলে চিনিতে পারিলেন।

তখন বুড়া দরজী বলিলেন, “কে ও কাঁকড়া ভায়া?”

কাঁকড়া মহাশয় উত্তর করিলেন, “হাঁ দাদা, কেমন, ভাল আছ তো?”

দরজী বলিলেন, “আর ভাই, আমাদের আর ভাল থাকা না থাকা। এখন গেলেই হয়। তোমরা শৌখিন পুরুষ, তোমাদের কথা স্বতন্ত্র। এখন কি মনে করিয়া আসিয়াছ বল দেখি?”কাঁকড়া উত্তর করিলেন, “এই কঙ্কাবতীকে আমরা আমাদের রানী করিয়াছি। কঙ্কাবতীর জন্য ভাল জামা চাই, তাই তোমার নিকট আসিয়াছি।”

দরজী বলিলেন, “বটে, তা আমার নিকট উত্তম উত্তম জামা আছে। ভাল পাটনাই খেরোর জামা আছে। টক্-টকে লাল খেরো, রং উঠিতে জানে না। ছিঁড়িতে জানে না, আগা-গোড়া আমি বখেয়া দিয়া সেলাই করিয়াছি। তোমাদের রানী কঙ্কাবতী যদি শিমুল তুলা হয় তো পরাও অতি উত্তম দেখাইবে। দামের জন্য আটক খাইবে না। এখন টিপিয়া দেখ দেখি, কঙ্কাবতী শিমুল তূলা কি-না?” দাঁড়া দিয়া কাঁকড়া মহাশয় কঙ্কাবতীর গা টিপিয়া টিপিয়া দেখিলেন। তাহার পর দরজীর পানে চাহিয়া বলিলেন, “কই, না, সেরূপ নরম তো নয়।”

কঙ্কাবতী বলিল, “খেরোর খোল পরাইয়া তোমরা আমাকে বালিশ করিবে না কি? এই সকলে মিলিয়া আমাকে রানী করিলে, তবে আবার বালিশ করিবার পরামর্শ করিতেছ কেন?”

দরজী উত্তর করিলেন, “ইশ, মেয়ের যে আম্বা ভারী, বালিশ হবে না তো কি তাকিয়া হইতে চাও না কি?”

দরজীর এই নিষ্ঠুর বচনে কঙ্কাবতীর মনে বড় দু:খ হইল, কঙ্কাবতী কাঁদিতে লাগিলেন। কাঁকড়া মহাশয় বলিলেন, “তুমি ছেলেমানুষ, আমাদের কথায় কথা কও কেন বল দেখি? যা তোমার পক্ষে ভাল তাই আমরা করিতেছি, চুপ করিয়া দেখ! চুপ কর, কাঁদিতে নাই।”

এইরূপ সান্ত্বনা বাক্য বলিয়া কাঁকড়া মহাশয় আপনার বড় দাঁড়া দিয়া কঙ্কাবতীর মুখ মুছাইয়া দিলেন। তাহাতে কঙ্কাবতীর মুখ ছড়িয়া গেল।

বুড়া দরজী বলিলেন, “তাই তো, তবে এর গায়ের জামা আমার কাছে নাই। এর জামা আমি কাটিতেও জানি না, সেলাই করিতেও জানি না।” কাঁকড়া মহাশয় জিজ্ঞাসা করিলেন, “তবে এখন উপায়? ভাল জামা কোথায় পাই?”

বুড়া দরজী বলিলেন, “তুমি এক কাজ কর। তুমি খলিফা সাহেবের কাছে যাও। খলিফা সাহেব ভাল কারিকর, খলিফা সাহেবের মত কারিকর এ পৃথিবীতে নাই, তাহার কাছে নানাবিধ কাপড় আছে, সে কাপড় পরিলে খাঁদারও নাক হয়।

এই কথায় কাঁকড়া মহাশয়ের রাগ হইল। তিনি বলিলেন, “তুমি কি আমাকে ঠাট্টা করিতেছ না কি? তোমার না হয় নাকটি একটু বড় আমার না হয় নাকটি ছোট, তা বলিয়া এত আবার ঠাট্টা কিসের?” বুড়া দরজী উত্তর করিলেন, “না না, তা কি কখনও হয়। তোমাকে আমি ঠাট্টা করিতে পারি? কেন, তোমার নাকটি মন্দ কি? কেবল দেখিতে পাওয়া যায় না―এই যা দুঃখের বিষয়।”

বুড়া দরজীর এইরূপ প্রিয় বচনে কাঁকড়া মহাশয়ের রাগ পড়িল। সন্তোষ লাভ করিয়া তিনি উত্তর করিলেন “তা বটে আমার নাকটি ভাল, তবে দোষের মধ্যে এই যে দেখিতে পাওয়া যায় না। কোথায় আছে আমি নিজেই খুঁজিয়া পাই না। যদি দেখিতে পাওয়া যাইত, তাহা হইলে আমার নাক দেখিয়া সকলেই প্রশংসা করিত, সকলেই বলিত, আহা, কাঁকড়ার কি নাক, যেন বাঁশীর মত!” কঙ্কাবতী ভাবিল, ব্যাপারখানা কি? আমি দেখিতেছি সব পাগলের হাতে পড়িয়াছি। এ কাঁকড়াটা তো বদ্ধ পাগল। এরে পাগলা গারদে রাখা উচিত। মুখ ফুটিয়া কিন্তু কঙ্কাবতী কিছু বলিল না।

সকলে পুনরায় সেখান হইতে চলিলেন। আগে কাঁকড়া মহাশয়, তারপর কঙ্কাবতী, শেষে কচ্ছপ। এইরূপে তিনজনে যাইতে লাগিলেন। যাইতে যাইতে অনেক দূরে গিয়া অবশেষে খলিফা সাহেবের ঘরে উপস্থিত হইলেন। খলিফা তখন অন্দরমহলে ছিলেন।

কাঁকড়া মহাশয় বাহির হইতে ডাকিলেন, খলিফা সাহেব, ও খলিফা সাহেব!”ভিতর হইতে খলিফা উত্তর দিলেন, “কে হে, কে ডাকাডাকি করে?”

কাঁকড়া মহাশয় উত্তর করিলেন, “আমি কাঁকড়াচন্দ্র। একবার বাহিরে আসুন, বিশেষ কাজ আছে।

খলিফা বাহিরে আসিলেন। কাঁকড়াচন্দ্রকে দেখিয়া অতি সমাদরে তাহাকে অভ্যর্থনা করিলেন।

খলিফা বলিলেন, “আসুন আসুন, কাঁকড়াবাবু আসুন। আর এই যে কচ্ছপবাবুকেও দেখিতেছি। কচ্ছপবাবু, আপনি ওই টুলটিতে বসুন আর কাঁকড়াবাবু আপনি ওই চেয়ারখানি নিন্। এ মেয়েটিকে বসিতে দিই কোথায়? দিব্য মেয়েটি। কাঁকড়াবাবু, এ কন্যাটি কি আপনার ― ?”কাঁকড়াচন্দ্র উত্তর করিলেন, “না, এ কন্যাটি আমার নয়, আমি বিবাহ করি নাই। ওঁর জন্যই এখানে আসিয়াছি। ওঁকে আমরা আমাদের রানী করিয়াছি। এক্ষণে রাজ-পরিচ্ছদের প্রয়োজন। তাই আপনার নিকট আসিয়াছি। এঁর জন্য অতি উত্তম রাজ-পরিচ্ছদ প্রস্তুত করিয়া দিতে হইবে।

খলিফা উত্তর করিলেন, “রাজ-পরিচ্ছদ প্রস্তুত করিতে পারি। আমার কাছে রেশম আছে, পশম আছে, সাটিন আছে, মায় বেনারসী কিংখাপ পর্যন্ত আছে। কিন্তু রাজ-পোশাক তো আর অমনি হয় না? তাতে হীরা বসাইতে হইবে, মতি বসাইতে হইবে, জরি-লেস প্রভৃতি ভাল ভাল দ্রব্য লাগাইতে হইবে। অনেক টাকা খরচ হইবে। টাকা দিতে পারিবেন তো?” কাঁকড়াচন্দ্র হাসিয়া বলিলেন, আমাদের টাকার অভাব কি? যত নৌকা-জাহাজ ডুবি হয়, তাহাতে যে টাকা থাকে, সে সব কোথায় যায়? সে সকল আমাদের প্রাপ্য। এক্ষণে আপনার কত টাকা চাই, তা বলুন?”

খলিফা উত্তর করিলেন, “যদি দুই তোড়া টাকা দিতে পারেন, তাহা হইলে উত্তম রাজ-পোশাক প্রস্তুত করিয়া দিতে পারি।”

কাঁকড়া তৎক্ষণাৎ কচ্ছপের পিঠ হইতে লইয়া দুই তোড়া মোহর খলিফার সম্মুখে ফেলিয়া দিলেন। খলিফা অনেক রাজার পোশাক, অনেক বাবুর পোশাক, অনেক বরের পোশাক প্রস্তুত করিয়াছিলেন। কিন্তু একেবারে দুই তোড়া মোহর কেহ কখনও তাঁহাকে দেয় নাই। মোহর দেখিয়া কঙ্কাবতী ব্যাকুল হইয়া বলিল, “ও গো, তোমরা এ টাকাগুলি আমাকে দাও। আমি বাড়ী লইয়া যাই। আমার বাবা বড় টাকা ভালবাসেন, এত টাকা পাইলে বাবা কত আহ্লাদ করিবেন। এই ময়লা কাপড় পরিয়াই আমি না হয় তোমাদের রানী হইব, ভাল কাপড়ে আমার কাজ নাই। তোমাদের পায়ে পড়ি, এই টাকাগুলি আমাকে দাও, আমি বাবাকে গিয়া দিই।

কাঁকড়া কঙ্কাবতীকে বকিয়া উঠিলেন। কাঁকড়া বলিলেন, “তুমি বড় অবাধ্য মেয়ে দেখিতেছি। একবার তোমাকে মানা করিয়াছি যে, তুমি ছেলেমানুষ, আমাদের কথায় কথা কহিও না। চুপ করিয়া দেখ, আমরা কি করি।” কি করিবে? কঙ্কাবতী চুপ করিয়া রহিল। মোহর পাইয়া খলিফার আর আনন্দের পরিসীমা রহিল না। তিনি বলিলেন, “টাকাগুলি বাড়ীর ভিতর রাখিয়া আসি, আর ভাল ভাল কাপড় বাহির করিয়া আনি। এক্ষণে তোমাদের রানীর রাজবস্ত্র করিয়া দিব।

দুই তোড়া মোহর লইয়া খলিফা বাটীর ভিতর চলিয়া গেলেন। আহ্লাদে পুলকিত হইয়া দন্তপাটি বাহির করিয়া একগাল হাসির সহিত সেই মোহর স্ত্রীকে দেখাইতে লাগিলেন।

স্ত্রী অবাক, কি আশ্চর্য! আজ সকাল বেলা আমরা কাহার মুখ দেখিয়া উঠিয়াছিলাম? খলিফানী এইরূপ ভাবিতে লাগিলেন। অবশেষে প্রকাশ্যে খলিফানী বলিলেন, “এবার কিন্তু আমাকে ডায়মণ্ডকাটা তাবিজ গড়াইয়া দিতে হইবে।”তাহার পর খলিফা কঙ্কাবতীকে বাটীর ভিতর লইয়া গেলেন। স্ত্রীকে বলিলেন, “ইনি রানী। এঁর নাম কঙ্কাবতী। এঁর জন্য রাজপরিচ্ছদ প্রস্তুত করিতে হইবে। অতি সাবধানে তুমি ইহার গায়ের মাপ লও।”

খলিফানী কঙ্কাবতীর গায়ের মাপ লইলেন। অনেক লোক নিযুক্ত করিয়া অতি সত্বর খলিফা রাজবস্ত্র প্রস্তুত করিয়া ফেলিলেন। খলিফানী যত্নে সেই পোশাক কঙ্কাবতীকে পরাইয়া দিলেন। রাজ-পরিচ্ছদ পরিধান করিয়া কঙ্কাবতীর রূপ ফাটিয়া পড়িতে লাগিল।

খলিফানী বলিলেন, “আহা! মরি, কি রূপ!”খলিফা বলিলেন, “মরি কি রূপ!”

সকলেই বলিলেন, “মরি কি রূপ!”

রাজ-পরিচ্ছদ পরা হইলে কাঁকড়া ও কচ্ছপ কঙ্কাবতীকে লইয়া পুনরায় গৃহাভিমুখে চলিলেন। অনেক স্থল অনেক জল অতিক্রম করিয়া তিনজনে পুনরায় নদীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করিলেন। সেখানে উপস্থিত হইলে কঙ্কাবতীর মনোহর রূপ মনোহর পরিচ্ছদ দেখিয়া সকলেই চমৎকৃত হইল। সকলেই ধন্য ধন্য করিতে লাগিল। সকলেই বলিল, “আমাদের পরম সৌভাগ্য যে, আমরা কঙ্কাবতী হেন রানী পাইলাম।”এক্ষণে একটি মহা ভাবনার বিষয় উপস্থিত হইল। জলচর জীবগণের এখন এই ভাবনা হইল যে, রানী থাকেন কোথায়? যে সে রানী নয়, কঙ্কাবতী রানী। যেরূপ জগৎসুশোভিনী মনোমোহিনী কঙ্কাবতী রানী, সেইরূপ সুসজ্জিত অলংকৃত মনোমোহিত অট্টালিকা চাই। অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া অবশেষে সকলে স্থির করিলেন যে, রানী কঙ্কাবতীর নিমিত্ত মোতিমহলই উপযুক্ত স্থান। যাহাকে মতি বলে তাহাকেই মুক্তা বলে। মুক্তার যথায় উৎপত্তি, মুক্তার যথায় স্থিতি, সেই স্থানকে মোতিমহল বলে। রুই প্রভৃতি মৎস্যগণ জোড়হাত করিয়া কঙ্কাবতীকে বলিলেন, “রানী-অধিরানী-মহারানী, মোতিমহল আপনার বাসের উপযুক্ত স্থান, আপনি ওই মোতিমহলে গিয়া বাস করুন।”

এইরূপে সসম্ভ্রমে সম্ভাষণ করিয়া মাছেরা কঙ্কাবতীকে একটি ঝিনুক দেখাইয়া দিল। ঝিনুকের ভিতর মুক্তা হয় বলিয়া ঝিনুকের নাম মোতিমহল। কঙ্কাবতী সেই ঝিনুকের ভিতর প্রবেশ করিল। ঝিনুকের ভিতর বাস করিয়া কঙ্কাবতী মাছেদের রানীগিরি করিতে লাগিল।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

গোয়ালিণী

এইরূপে কিছুদিন যায়। এখন একদিন এক গোয়ালিনী নদীতে স্নান করিতে আসিয়াছিল। স্নান করিতে করিতে তাহার পায়ে সেই ঝিনুকটি ঠেকিল। ডুব দিয়া সে সেই ঝিনুকটি তুলিল। দেখিল যে চমৎকার ঝিনুক। ঝিনুকটি সে বাড়ী লইয়া গেল। আর আপনার চালের বাতায় গুঁজিয়া রাখিল।

বাহিরের দ্বারে কুলুপ দিয়া গোয়ালিনী প্রতিদিন লোকের বাড়ী দুধ দিতে যায়। কঙ্কাবতী সেই সময় ঝিনুকের ভিতর হইতে বাহির হয়। প্রথম দিন ঝিনুকের ভিতর হইতে বাহির হইয়া যেমন সে মাটিতে পা দিল, আর তাহার রাজবেশ গিয়া একেবারে পূর্ববৎ বেশ হইল। কঙ্কাবতী তাহা দেখিয়া বড়ই আশ্চর্য হইল। প্রতিদিন ঝিনুকের ভিতর হইতে বাহির হইয়া কঙ্কাবতী গোয়ালিনীর সমুদয় কাজ-কর্ম সারিয়া রাখেন। ঘর-দ্বার পরিষ্কার করেন, বাসন-কোসন মাজেন, ভাত ব্যঞ্জন রাঁধেন, আপনি খান আর গোয়ালিনীর জন্য ভাত বাড়িয়া রাখেন। বাড়ী আসিয়া সেইসব দেখিয়া গোয়ালিনী বড়ই আশ্চর্য হয়। গোয়ালিনী মনে করে, “এমন করিয়া সমুদয় কাজকর্ম কে করে? দ্বারে যেরূপ চাবি দিয়া যাই, সেইরূপ চাবি দেওয়াই থাকে। বাহির হইতে বাড়ীর ভিতর কেহ আসে নাই। তবে এসব কাজকর্ম করে কে?”

ভাবিয়া চিন্তিয়া গোয়ালিনী কিছুই স্থির করিতে পারে না। এইরূপ প্রতিদিন হইতে লাগিল।

অবশেষে গোয়ালিনী ভাবিল, আমাকে ধরিতে হইবে। প্রতিদিন যে আমার কাজকর্ম সারিয়া রাখে তারে ধরিতে হইবে। এইরূপ মনে মনে স্থির করিয়া, গোয়ালিনী তার পরদিন সকাল সকাল বাটী ফিরিয়া আসিল। নিঃশব্দে, অতি ধীরে ধীরে দ্বারটি খুলিয়া দেখে যে, বাটীর ভিতর এক পরমাসুন্দরী বালিকা বসিয়া বাসন মাজিতেছে।

গোয়ালিনীকে দেখিয়া তাড়াতাড়ি কঙ্কাবতী যেই ঝিনুকের ভিতর লুকাইতে গেল, আর সে গিয়া তৎক্ষণাৎ তাহাকে ধরিয়া ফেলিল। ধরিয়া দেখে না কঙ্কাবতী।

আশ্চর্য হইয়া গোয়ালিনী জিজ্ঞাসা করিল, “কঙ্কাবতী,তুমি এখানে? তুমি এখানে কি করিয়া আসিলে? তুমি না নদীর জলে ডুবিয়া গিয়াছিলে” কঙ্কাবতী উত্তর করিল, “হাঁ মাসী, আমি কঙ্কাবতী। আমি নদীর জলে ডুবিয়া গিয়াছিলাম। নদীতে আমি ওই ঝিনুকটির ভিতর ছিলাম। ঝিনুকটি আনিয়া তুমি চালের বাতায় রাখিয়াছ। তাই মাসী, আমি তোমার বাড়ী আসিয়াছি।”

গোয়ালিনী এখন সকল কথা বুঝিল। আশ্চর্য হইবার আর কোনও কারণ রহিল না।

কঙ্কাবতী পুনরায় বলিল “মাসী, আমি যে এখানে আছি, সে কথা এখন তুমি আমার বাড়ীতে বলিও না। শুধু হাতে বাড়ী গেলে বাবা হয় তো বকিবেন। জলের ভিতর আমি অনেক টাকা দেখিয়াছি। তাহারা দরজীকে দিল, কিন্তু আমাকে দিল না। আমি কত কাঁদিলাম কাটিলাম, তবুও তাহারা আমাকে দিল না। দেখি, যদি তাহারা আমাকে কিছু দেয়, তাহা হইলে বাবাকে দিব, বাবা তাহা হইলে বকিবেন না, দাদা গালি দিবেন না।গোয়ালিনী বলিল, “বাছা রে আমার, জনার্দন চৌধুরীকে এই সোনার বাছা বেচিতে চায়! পোড়ারমুখো বাপ! রও, এইবার দেখা হইলে হয়, গালি দিয়া ভুত ছাড়াইব।”

কঙ্কাবতী উত্তর করিল, “না মাসী, বাবাকে গালি দিও না, জান তো মাসী? বাবা দুঃখী মানুষ, ঘরে অনেকগুলি পুষ্যি। আমাকে না বেচিলে বাবা সংসার প্রতিপালন কি করিয়া করিবেন?”

এইরূপ কথাবার্তার পর স্থির হইল যে, কঙ্কাবতী এখন কিছুদিন গোয়ালিনীর ঘরে থাকিবে।কঙ্কাবতী বলিল, “মাসী, প্রতিদিন তুমি পাড়ায় যাও। গ্রামে যে দিন যে ঘটনা হয়, আমাকে আসিয়া বলিও।”

গোয়ালিনীর ঘরে কঙ্কাবতী বাস করিতে লাগিল। গ্রামে যে দিন যেখানে যাহা হয়, গোয়ালিনী আসিয়া তাহাকে বলে।

একদিন গোয়ালিনী আসিয়া বলিল, “আহা। খেতুর মার বড় অসুখ! খেতুর মা এবার বাঁচেন কি না।”

অতি কাতরভাবে, কাঁদ-কাঁদ হইয়া, কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিল, “কি হইয়াছে, মাসী? তাঁহার কি হইয়াছে?”গোয়ালিনী উত্তর করিল, “শুনিলাম, তাঁহার জ্বর-বিকার হইয়াছে। খেতু বৈদ্য ডাকিতে গিয়াছে, কিন্তু বৈদ্য আসে নাই। বৈদ্য বলিয়াছেন, তোমার বাটীতে চিকিৎসা করিতে গিয়া শেষে জাতিটি হারাইব না কি?”

কঙ্কাবতী বলিল, “মাসী, তিনি আমাকে বড় ভালবাসেন। আমার আপনার মা যেরূপ, তিনিও আমার সেইরূপ। তাঁহার অসময়ে আমি কিছু করিতে পারিলাম না, সেজন্য বড় দুঃখ মনে রহিল।”

এই বলিয়া কঙ্কাবতী কাঁদিতে লাগিল।

তাহার পরদিন অতি প্রত্যুষে কঙ্কাবতী বলিল, “মাসী, আজ একটু সকাল সকাল তুমি পাড়ায় যাও। শীঘ্র ফিরিয়া আসিয়া আমাকে বল, তিনি কেমন আছেন।” গোয়ালিনী সকাল সকাল পাড়ায় গেল, সকাল সকাল ফিরিয়া আসিয়া কঙ্কাবতীকে বলিল, “আহা! বড় দুঃখের কথা। খেতুর মা নাই। খেতুর মা মারা গিয়াছেন। মাকে ঘাটে লইয়া যাইবার নিমিত্ত খেতু দ্বারে দ্বারে ঘুরিতেছে, কিন্তু কেহই আসিতেছে না। সকলেই বলিতেছে, তুমি ‘বরখ’ খাইয়াছ। তোমার জাতি গিয়াছে। তোমার মাকে ঘাটে লইয়া গেলে আমাদের জাতি যাইবে। ষাঁড়েশ্বর চক্রবর্তী, গোবর্ধন শিরোমণি, আর, কঙ্কাবতী, তোমার বাপ―এই তিনজনে সকলকে মানা করিয়া বেড়াইতেছেন, যেন কেহ না যায়।”

এই সংবাদ শুনিয়া কঙ্কাবতী একেবারে শুইয়া পড়িল। অবিশ্রান্ত কাঁদিতে লাগিল। গোয়ালিনী তাহাকে কত বুঝাইল। গোয়ালিনী কত বলিল, “কঙ্কাবতী, চুপ কর। কঙ্কাবতী, উঠ, খাও।” কঙ্কাবতী উঠল না, সে দিন রাঁধিল না। মাটিতে পড়িয়া কেবল কাঁদিতে লাগিল।সন্ধ্যাবেলা কঙ্কাবতী বলিল, “মাসী, তুমি আর একবার পাড়ায় যাও। দেখ গিয়া সেখানে কি হইতেছে। শীঘ্র আসিয়া আমাকে বল।”

গোয়ালিনী পুনরায় পাড়ায় গেল। একটু রাত্রি হইল, তবুও গোয়ালিনী ফিরিল না। একপ্রহর রাত্রি হইল, তবুও গোয়ালিনী ফিরিল না। মাটিতে শুইয়া পথপানে চাহিয়া কঙ্কাবতী কেবল কাঁদিতে লাগিল।

এক প্রহর রাত্রির পর গোয়ালিনী ফিরিয়া আসিল। গোয়ালিনী বলিল, কঙ্কাবতী, বড়ই দুঃখের কথা শুনিয়া আসিলাম। খেতুর মাকে লইয়া যাবার নিমিত্ত কেহই আসে নাই। খেতু করে কি? সন্ধ্যা হইলে কাঠ নিজে মাথায় করিয়া প্রথম ঘাটে রাখিয়া আসিল। আহা! একেবারে অতগুলি কাঠ লইয়া যাইতে পারবে কেন? তিনবার কাঠ লইয়া তাকে ঘাটে যাইতে হইয়াছে। সে এখন মাকে ঘাটে লইয়া যাইতেছে। একেলা নিজে কোলে করিয়া মাকে লইয়া যাইতেছে। মরিলে লোক ভারী হয়। তাতে শ্মশান ঘাট তো আর কম দূর নয়। খানিক দূর লইয়া যায়, তারপর আর পারে না। মাকে মাটিতে শয়ন করায়, একটু বিশ্রাম করিয়া পুনরায় লইয়া যায়। এইরূপ করিয়া সে এখন মাকে ঘাটে লইয়া যাইতেছে। অন্ধকার রাত্রি। একটু দূরে দূরে থাকিয়া আমি এই সব দেখিয়া আসলাম।এই কথা শুনিয়া কিয়ৎক্ষণের নিমিত্ত কঙ্কাবতী বসিয়া ভাবিতে লাগল, তাহার পর ধীরে ধীরে উঠিল, ধীরে ধীরে গিয়া বাটীর দ্বারটি খুলিল, বাটীর বাহিরে গিয়া উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াইল।

গোয়ালিনী বলিল, “কঙ্কাবতী, কোথায় যাও? কঙ্কাবতী, কোথায় যাও?”

আর, কোথায় যাও! আজ আর কঙ্কাবতী রানী-অধিরানী-মহারানী নয়, আজ কঙ্কাবতী পাগলিনী। মনোহর রাজবেশে আজ কঙ্কাবতী সুসজ্জিতা নয়, আজ কঙ্কাবতী গোয়ালিনীর একখানি সামান্য মলিন বসন পরিহিতা। কঙ্কাবতীর মুখ আজ উজ্জ্বল প্রভাসম্পন্ন নয়, আজ কঙ্কাবতীর মুখ ঘন-ঘটায় আচ্ছাদিত। বাটীর বাহির হইয়া, মলিন বেশে আলুলায়িত কেশে, পাগলিনী সেই শ্মশানের দিকে ছুটিল।

“কঙ্কাবতী শুন, কঙ্কাবতী শুন।” এই কথা বলিতে বলিতে কিয়দ্দুর গোয়ালিনী তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমানা হইল। কিন্তু কঙ্কাবতী তাহার কথায় কর্ণপাত করিল না, একবার ফিরিয়াও দেখিল না।

রাহুগ্রস্ত পূর্ণশশী অবিলম্বেই নিশার তমোরাশিতে মিশিয়া গেল। গোয়ালিনী আর তাহাকে দেখিতে পাইল না। কাঁদিতে কাঁদিতে গোয়ালিনী বাড়ী ফিরিয়া আসিল।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

শ্মশান

দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হইয়া পাগলিনী এখন শ্মশানের দিকে দৌড়াইল। কিছু দূর গিয়া দেখিতে পাইল, পথে খেতু মাতাকে রাখিয়াছে মার মস্তকটি আপনার কোলে লইয়াছে, মার কাছে বসিয়া মার মুখ দেখিতেছে আর কাঁদিতেছে। অবিরলধারায় অশ্রুবারি তাহার নয়নদ্বয় হইতে বিগলিত হইতেছে।

কঙ্কাবতী নিঃশব্দে তাহার নিকটে গিয়া দাঁড়াইল। অন্ধকার রাত্রি, সেইজন্য খেতু তাহাকে দেখিতে পাইল না। মার মুখপানে চাহিয়া খেতু বলিল, “মা। তুমিও চলিলে? যখন কঙ্কাবতী গেল, তখন মনে করিয়াছিলাম এ ছার জীবন আর রাখিব না। কেবল মা, তোমার মুখপানে চাহিয়া বাঁচিয়া ছিলাম। এখন মা তুমিও গেলে? তবে আর আমার এ প্রাণে কাজ কি? কিসের জন্য, কার জন্য আর বাঁচিয়া থাকিব? এ সংসারে থাকা কিছু নয়। এখানে বড় পাপ, বড় দুঃখ। বেশ করিয়াছ, কঙ্কাবতী এখান হইতে গিয়াছ। বেশ করিলে মা যে, এ পাপ সংসার হইতে তুমিও চলিলে। চল মা, যেখানে কঙ্কাবতী, যেখানে তুমি, সেইখানে আমিও শীঘ্র যাইব।

কঙ্কাবতী আসিয়া অধোমুখে খেতুর সম্মুখে দাঁড়াইল। খেতু চমকিত হইল, অন্ধকারে চিনিতে পারিল না।

কঙ্কাবতী মার পায়ের নিকট গিয়া বসিল। মার পা দুখানি আপনার কোলের উপর তুলিয়া লইল। সেই পায়ের উপর আপনার মাথা রাখিয়া নীরবে কাঁদিতে লাগিল।

ঘোরতর বিস্মিত হইয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া খেতু তাহার মুখপানে চাহিয়া রহিল। অবশেষে খেতু বলিল, “কঙ্কাবতী, জ্ঞান হইয়া পর্যন্ত এ পৃথিবীতে কখনও কাহারও অনিষ্ট চিন্তা করি নাই, সর্বদা সকলের ইষ্টচিন্তাই করিয়াছি। জানিয়া শুনিয়া কখনও মিথ্যা কথা বলি নাই প্রবঞ্চনা কখনও করি নাই, কোনও রূপ দুষ্কর্ম কখনও করি নাই। তবে কি মহাপাপের জন্য আজ আমার এ ভীষণ দণ্ড, আজ এ ঘোর নরক! বিনা দোষে কত দুঃখ পাইয়াছি, সহিয়াছি। গ্রামের লোকে বিধিমত উৎপীড়ন করিল, তাহাও সহিলাম। প্রাণের পুতলি তুমি কঙ্কাবতী জলে ডুবিয়া মরিলে, তাহাও সহিলাম। প্রাণের অধিক মা আমার আজ মরিলেন, তাহাও সহিলাম। কিন্তু এই সংকট সময়ে তুমি যে আমার শত্রুতা সাধিবে, স্বপ্নেও তাহা কখনও ভাবি নাই! মাতার মৃতদেহ একেলা আমি আর বহিতে পারিতেছি না। মাতার পীড়ার জন্য আজ তিন দিন আমার আহার নাই, নিদ্রা নাই। আজ তিন দিন এক বিন্দু জল পর্যন্ত আমি খাই নাই। শরীরে আমার শক্তি নাই শরীর আমার অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছে। আর একটি পা-ও আমি মাকে লইয়া যাইতে পারিতেছি না। কি করি, ভাবিয়া আকুল হইয়াছি। এমন সময়ে কি না, তুমি কঙ্কাবতী, ভূত হইয়া আমাকে ভয় দেখাইতে আসিলে! দুঃখের এইবার আমার চারি পো হইল! এ দুঃখ আমি আর সহিতে পারি না।”কাঁদ কাঁদ স্বরে অধোমুখ কঙ্কাবতী উত্তর করিল “আমি ভূত হই নাই, আমি মরি নাই, আমি জীবিত আছি!”

আশ্চর্য হইয়া খেতু জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি জীবিত আছ? জলে ডুবিয়া গেলে, তোমায় আমরা কত অনুসন্ধান করিলাম। তোমাকে খুঁজিয়া পাইলাম না। মনে করিলাম, আমিও মরি। মরিবার নিমিত্ত জলে ঝাঁপ দিলাম। সাঁতার জানিয়াও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইয়া জলের ভিতর রহিলাম, কিছুতেই উঠিলাম না। তাহার পর জ্ঞানশূন্য হইয়া পড়িলাম। অজ্ঞান অবস্থায় জেলেরা আমাকে তুলিল, তাহারা আমাকে বাঁচাইল। জ্ঞান হইয়া দেখিলাম, মা আমার কাঁদিতেছেন! মার মুখপানে চাহিয়া প্রাণ ধরিয়া রহিলাম। কঙ্কাবতী! তুমি কি করিয়া বাঁচিলে?”কঙ্কাবতী উত্তর করিল, “সে অনেক কথা। সকল কথা পরে বলিব। আমি গোয়ালিনী মাসীর বাটীতে ছিলাম। এই ঘোর বিপদের কথা সেইখানে শুনিলাম। আমি থাকিতে পারিলাম না, তাই ছুটিয়া আসিলাম। এক্ষণে চল, মাতাকে ঘাটে লইয়া যাই। তুমি একদিক ধর, আমি একদিক ধরি।”

এইপ্রকারে কঙ্কাবতী ও খেতু মাকে ঘাটে লইয়া গেল। সেখানে গিয়া দুইজনে চিতা সাজাইল। মাকে উত্তমরূপে স্নান করাইল। নূতন কাপড় পরাইল। তাহার পর চিতার উপর তুলিল। চিতার উপর তুলিয়া দুইজনে মায়ের পা ধরিয়া অনেকক্ষণ কাঁদিল। অবশেষে চিতা প্রদক্ষিণ, করিয়া খেতু অগ্নিকার্য করিল। চিতা ধু ধু করিয়া জ্বলিতে লাগিল।

কঙ্কাবতী ও খেতু নিকটে বসিয়া মাঝে মাঝে কাঁদে, মাঝে মাঝে খেদ করে, আর মাঝে মাঝে অন্যান্য কথাবার্তা কয়। কি করিয়া জল হইতে রক্ষা পাইয়াছে, কঙ্কাবতী সেই সমুদয় কথা খেতুকে বলিল। খেতু মনে করিল, নানা দুঃখে কঙ্কাবতীর চিত্ত বিকৃত হইয়াছে। দুঃখের উপর দুঃখ, এ আবার এক নূতন দুঃখ তাহার মনে উপস্থিত হইল। মনের কথা খেতু কিন্তু কিছু প্রকাশ করিল না।

মার সৎকার হইয়া গেলে দুইজনে নদীতে স্নান করিল।

তাহার পর খেতু বলিল, “কঙ্কাবতী চল তোমাকে বাড়ীতে রাখিয়া আসি।” কঙ্কাবতী উত্তর করিল, “পুনরায় আমি কি করিয়া বাড়ী যাই? বাবা আমাকে তিরস্কার করিবেন, দাদা আমাকে গালি দিবেন। আমি জলের ভিতর গিয়া মাছেদের কাছে থাকি। না হয়, গোয়ালিনী মাসীর ঘরে যাই।”

খেতু বলিল, “কঙ্কাবতী, সে কাজ করিতে নাই। তোমাকে বাড়ী যাইতে হইবে। যতই কেন দুঃখ পাও না, ঘরে থাকিয়া সহ্য করিতে হইবে। মনোযোগ করিয়া আমার কথা শুন। আর এখন বালিকার মত কথা কহিলে চলিবে না। তুমি বাড়ী চল, তোমাকে বাড়ীতে রাখিয়া আসি। বাটীর বাহিরে তুমি পা রাখিয়াছ বলিয়া জনার্দন চৌধুরী আর তোমাকে বিবাহ করিবেন না। সত্বর অন্য পাত্র সংঘটন হওয়াও সম্ভব নয়। তোমার পিতা ভ্রাতা যাহা কিছু তোমার লাঞ্ছনা করেন, এক বৎসর কাল পর্যন্ত সহ্য করিয়া থাক। শুনিয়াছি পশ্চিম অঞ্চলে অধিক বেতনে কর্ম পাওয়া যায়। আমি এক্ষণে পশ্চিমে চলিলাম। কাশীতে মাতার শ্রাদ্ধাদি ক্রিয়া সমাধা করিয়া কর্মের অনুসন্ধান করিব। এক বৎসরের মধ্যে যাহা কিছু অর্থ সংগ্রহ করিতে পারি, তাহা আনিয়া তোমার পিতাকে দিব। আমি নিশ্চয় বলিতেছি, তখন তোমার পিতা আহ্লাদের সহিত আমার প্রার্থনা পরিপূর্ণ করিবেন। কেবল এক বৎসর, কঙ্কাবতী, দেখিতে দেখিতে যাইবে। দুঃখে হউক, সুখে হউক, ঘরে থাকিয়া, কোনও রূপে এই এক বৎসর কাল অতিবাহিত কর।”তখন কঙ্কাবতী বলিল, “তুমি আমাকে যেরূপ আজ্ঞা করিবে, আমি সেইরূপ করিব।”

দুই জনে ধীরে ধীরে গ্রামাভিমুখে চলিল। রাত্রি সম্পূর্ণ প্রভাত হয় নাই, এমন সময় দুইজনে তনু রায়ের দ্বারে গিয়া উপস্থিত হইল।

খেতু বলিল, “কঙ্কাবতী, তবে এখন আমি যাই। সাবধানে থাকিবে।”

যাই যাই করিয়াও খেতু যাইতে পারে না। যাইতে খেতুর পা সরে না। দুইজনের চক্ষুর জলে তনু রায়ের দ্বার ভিজিয়া গেল।একবার সাহসে ভর করিয়া খেতু কিছুদূর গেল কিন্তু পুনরায় ফিরিয়া আসিল, আর বলিল, “কঙ্কাবতী একটি কথা তোমাকে ভাল করিয়া বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি। কথাটি এই যে, অতি সাবধানে থাকিও।”

আবার কিছুক্ষণ ধরিয়া দুইজনে কথা কহিতে লাগিল। ক্রমে প্রভাত হইল, চারিদিকে লোকের সাড়া-শব্দ হইতে লাগিল।

তখন খেতু বলিল, “কঙ্কাবতী, এইবার আমি নিশ্চয় যাই। অতি সাবধানে থাকিবে। কাঁদিও কাটিও না। যদি বাঁচিয়া থাকি তো এক বৎসর পরে নিশ্চয় আমি আসিব। তখন আমাদের সকল দুঃখ ঘুচিবে। তোমার মাকে সকল কথা বলিও, অন্য কাহাকেও কিছু বলিবার আবশ্যক নাই।”

খেতু এইবার চলিয়া গেল। যতদূর দেখা গেল, ততদূর কঙ্কাবতী সেই দিক পানে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল। তাহার পর, চক্ষুর জলে সে পৃথিবী অন্ধকারময় দেখিতে লাগিল। জ্ঞানশূন্য হইয়া ভূতলে পতিত হওয়ার ভয়ে, দ্বারের পাশে প্রাচীরে সে ঠেস দিয়া দাঁড়াইল। খেতু ফিরিয়া দেখিল যে, চিত্রপুত্তলিকার ন্যায় কঙ্কাবতী দাঁড়াইয়া আছে। তাহার পর আর দেখিতে পাইল না।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

বাঘ

খেতু চলিয়া গেলে, দ্বারের পাশে প্রাচীরে ঠেস দিয়া, অনেকক্ষণ ধরিয়া কঙ্কাবতী কাঁদতে লাগল। অনেকক্ষণ পর্যন্ত দ্বার ঠেলিতে তাহার সাহস হইল না। অবশেষে সাহসে বুক বাঁধিয়া আস্তে আস্তে সে দ্বার ঠেলিতে লাগিল।

শয্যা হইতে উঠিয়া, বাটীর ভিতর বসিয়া, তনু রায় তামাক খাইতে-ছিলেন। কে দ্বার ঠেলিতেছে দেখিবার নিমিত্ত তিনি দ্বার খুলিলেন। দেখিলেন, কঙ্কাবতী।

কঙ্কাবতীকে দেখিয়া তিনি বলিলেন, “এ কি? কঙ্কাবতী যে, তুমি মর নাই? তাই বলি, তোমার কি আর মৃত্যু আছে! এতদিন কোথায় ছিলে? আজ কোথা হইতে আসিলে? এতদিন যেখানে ছিলে পুনরায় সেইখানে যাও। আমার ঘরে তোমার আর স্থান হইবে না। কঙ্কাবতী বাটীর ভিতর প্রবেশ করিল না। সেই মলিন আর্দ্রবস্ত্র পরিহিতা থাকিয়া দ্বারের পাশে দাঁড়াইয়া কেবল কাঁদিতে লাগিল। পিতার কথায় কোনও উত্তর করিল না।

পিতার তর্জন-গর্জনের শব্দ পাইয়া, পুত্রও সত্বর সেইখানে আসিয়া উপস্থিত হইল।

ভাই বলিল, “এই যে, কালামুখ লইয়া ফের এখানে আসিয়াছেন, যাবেন আর কোন্ চুলোয়। কিন্তু তাহা হইবে না, এ বাড়ী হইতে তোমার অন্ন উঠিয়াছে। এখন আর মনে করিও না যে, জনার্দন চৌধুরী তোমাকে বিবাহ করিবে। বাবা, পাড়ার লোক জানিতে না জানিতে কুলাঙ্গারীকে দূর করিয়া দাও।”বচসা শুনিয়া কঙ্কাবতীর দুই ভগিনী বাহিরে আসিল। অবশেষে মাও আসিলেন। মা দেখিলেন, দুঃখিনী কঙ্কাবতী দীন দরিদ্র মলিন বেশে দ্বারের পাশে দাঁড়াইয়া কাঁদিতেছে। স্বামী ও পুত্র বিধিমতে ভর্ৎসনা করিয়া তাড়াইয়া দিতেছেন।

কঙ্কাবতীর মা কাহাকেও কিছু বলিলেন না। স্বামী কি পুত্র কাহারও পানে একবার চাহিলেন না। কঙ্কাবতীর বক্ষঃস্থল একবার আপনার বক্ষঃস্থলে রাখিয়া গদগদ মৃদুভাষে বলিলেন, “এস, আমার মা এস, দুঃখিনী মাকে ভুলিয়া এতদিন কোথায় ছিলে মা?”

মার বুকে মাথা রাখিয়া কঙ্কাবতীর প্রাণ জুড়াইল। অন্তরে অন্তরে যে খরতর অগ্নি তাহাকে দহন করিতেছিল, সে অগ্নি এখন অনেকটা নির্বাণ হইল। তাহার পর, মা কঙ্কাবতীর হাত ধরিলেন। অপর হাত দিয়া আর একটি মেয়ের হাত ধরিলেন। স্বামী ও পুত্রকে তখন সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “তোমরা কঙ্কাবতীকে দূর করিয়া দিবে? কঙ্কাবতীকে ঘরে স্থান দিবে না? বটে, এ দুধের বাছা কি হেন দুষ্কর্ম করিয়াছে যে, মা বাপের কাছে ইহার স্থান হইবে না? মান-সম্ভ্রম, পুণ্য ধর্ম লইয়া তোমরা এখানে সুখে স্বচ্ছন্দে থাক। আমরা চারিজন হতভাগিনী এখান হইতে বিদায় হই। এস মা, আমরা সকলে এখান হইতে যাই। দ্বারে দ্বারে আমরা মুষ্টিভিক্ষা করিয়া খাইব, তবু এই মুনি-ঋষিদের অন্ন আর খাইব না।”

তিন কন্যা ও মাতা, সত্য সত্যই বাটী হইতে প্রস্থান করিবার উপক্রম করিলেন। তখন তনু রায়ের মনে ভয় হইল। তনু রায় বলিলেন, “গৃহিণী, কর কি? তুমিও যে পাগল হইলে দেখিতেছি। এখন এ মেয়ে লইয়া আমি করি কি? এ মেয়ের কি আর বিবাহ হইবে? সেইজন্য বলি ওর যেখানে দুই চক্ষু যায় সেইখানে ও যাক, ওর কথায় আর আমাদের থাকিয়া কাজ নাই।”

তনু রায়ের স্ত্রী বলিলেন, “কঙ্কাবতীর বিবাহ হইবে না? আচ্ছা, সে ভাবনা তোমার ভাবিয়া কাজ নাই। সে ভাবনা আমি ভাবিব। কিন্তু তোমার তো প্রকৃত সে চিন্তা নয়! তোমার চিন্তা যে, জনার্দন চৌধুরীর টাকাগুলি হাত-ছাড়া হইল। যাহা হউক, তোমার গলগ্রহ হইয়া আর আমরা থাকিব না। যেখানে আমাদের দুই চক্ষু যায়, আমরা চারিজনে সেইখানে যাইব। মেয়ে তিনটির হাত ধরিয়া দ্বারে দ্বারে আমি ভিক্ষা করিব।” স্ত্রীর এইরূপ উগ্র মূর্তি দেখিয়া তনু রায় ভাবিলেন, ঘোর বিপদ! নানারূপ মিষ্ট বচন বলিয়া স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিতে লাগিলেন। স্ত্রীর অনেকটা রাগ পড়িয়া আসিলে শেষে তনু রায় বলিলেন, “দেখ। পাগলের মত কথা বলিও না। যাও বাড়ীর ভিতর যাও। যাও মা কঙ্কাবতী, বাড়ীর, ভিতর যাও।”

মা, কঙ্কাবতী ও ভগিনী দুইটি বাড়ীর ভিতর চলিয়া গেলেন। কঙ্কাবতী পুনরায় বাপ-মার নিকট রইল। বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া যাহা যাহা ঘটিয়াছিল, আদ্যোপান্ত সমুদয় কথা কঙ্কাবতী মাকে বলিল কঙ্কাবতী নিজে, কি কঙ্কাবতীর মা, এ সমুদয় কথা অন্য কাহাকেও কিছু বলিলেন না। কঙ্কাবতীকে তনু রায় সর্বদাই ভর্ৎসনা করেন, সর্বদাই গঞ্জনা দেন। কঙ্কাবতী সে কথায় কোনও উত্তর করে না, অধোবদনে চুপ করিয়া শুনে।

তনু রায় বলেন, “এমন রাজা-হেন পাত্রের সহিত তোমার বিবাহ স্থির করিলাম। তোমার কপালে সুখ নাই, তা আমি কি করিব? জনার্দন চৌধুরীকে কত বুঝাইয়া বলিলাম, কিন্তু তিনি আর বিবাহ করিবেন না। এখন এ কন্যা লইয়া আমি করি কি? পঞ্চাশ টাকা দিয়াও কেহ এখন ইহাকে বিবাহ করিতে চায় না।”

স্ত্রী-পুরুষে মাঝে মাঝে এই কথা লইয়া বিবাদ হয়। স্ত্রী বলেন, “কঙ্কাবতীর বিবাহের জন্য তোমাকে চিন্তা করিতে হইবে না। এক বৎসর কাল চুপ করিয়া থাক। কঙ্কাবতীর বিবাহ আমি নিজে দিব। যদি আমার কথা না শুন, যদি অধিক বাড়াবাড়ি কর, তাহা হইলে মেয়ে তিনটির হাত ধরিয়া তোমার বাটী হইতে চলিয়া যাইব।”তনু রায় বৃদ্ধ হইয়াছেন। স্ত্রীকে এখন তিনি ভয় করেন, এখন স্ত্রীকে যাহা-ইচ্ছা তাহাই বলিতে বড় সাহস করেন না।

এইরূপে দেখিতে দেখিতে এক বৎসর কাটিয়া গেল। খেতুর দেখা নাই, খেতুর কোনও সংবাদ নাই। কঙ্কাবতীর মুখ মলিন হইতে মলিনতর হইতে লাগিল, কঙ্কাবতীর মার মনে ঘোর চিন্তার উদয় হইল। কঙ্কাবতীর বিবাহ বিষয়ে স্বামী কোনও কথা বলিলে এখন আর তিনি পূর্বের ন্যায় দম্ভের সহিত উত্তর করিতে সাহস করেন না। বৎসর শেষ হইয়া যতই দিন গত হইতে লাগিল, তনু রায়ের তিরস্কার ততই বাড়িতে লাগিল। কঙ্কাবতীর মা অপ্রতিভ হইয়া থাকেন, বিশেষ কোনও উত্তর দিতে পারেন না।

এক দিন সন্ধ্যার পর তনু রায় বলিলেন, “এত বড় মেয়ে হইল, এখন এ মেয়ে লইয়া আমি করি কি? সুপাত্র ছাড়িয়া কুপাত্র মিলাও দুর্ঘট হইল।”কঙ্কাবতীর মা উত্তর করিলেন, “আজ এক বৎসর অপেক্ষা করিলে, আর অল্পদিন অপেক্ষা কর। সুপাত্র শীঘ্রই মিলিবে।”

তনু রায় বলিলেন, “এক বৎসর ধরিয়া তুমি এই কথা বলিতেছ। কোথা হইতে তোমার সুপাত্র আসিবে, তাহা বুঝিতে পারি না। তোমার কথা শুনিয়া আমি এই বিপদে পড়িলাম। সে দিন যদি কুলাঙ্গারীকে দূর করিয়া দিতাম, তাহা হইলে আজ আমাকে এ বিপদে পড়িতে হইত না। এখন দেখিতেছি, সেকালের রাজারা যাহা করিতেন আমাকেও তাহাই করিতে হইবে। ব্রাহ্মণ না হয়, চণ্ডালের সহিত কন্যার বিবাহ দিতে হইবে। মনুষ্য না হয়, জীব জন্তুর সহিত কন্যার বিবাহ দিতে হইবে। রাগে আমার সর্ব শরীর জ্বলিয়া যাইতেছে। আমি সত্য বলিতেছি, যদি এই মুহূর্তে বনের বাঘ আসিয়া কঙ্কাবতীকে বিবাহ করিতে চায় তো আমি তাহার সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ দিই। যদি এই মুহুর্তে, বাঘ আসিয়া বলে, রায় মহাশয়, দ্বার খুলিয়া দিন তো আমি তৎক্ষণাৎ দ্বার খুলিয়া দিই।”এই কথা বলিতে না বলিতে বাহিরে ভীষণ গর্জনের শব্দ হইল। গর্জন করিয়া কে বলিল, “রায় মহাশয়, তবে কি দ্বার খুলিয়া দিবেন?”

সেই শব্দ শুনিয়া তনু রায় ভয় পাইলেন, কিসে এরূপ গর্জন করিতেছে, কিছুই বুঝিতে পারিলেন না। দেখিবার নিমিত্ত আস্তে আস্তে দ্বার খুলিলেন। দ্বার খুলিয়া দেখেন না, সর্বনাশ! এক প্রকাণ্ড ব্যাঘ্র বাহিরে দণ্ডায়মান!

ব্যাঘ্র বলিলেন, “রায় মহাশয়! এই মাত্র আপনি সত্য করিলেন যে, ব্যাঘ্র আসিয়া যদি কঙ্কাবতীকে বিবাহ করিতে চায়, তাহা হইলে ব্যাঘ্রের সহিত আপনি কঙ্কাবতীর বিবাহ দিবেন। তাই আমি আসিয়াছি এক্ষণে আমার সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ দিন, না দিলে এই মুহূর্তে আপনাকে খাইয়া ফেলিব।” তনু রায় ভীত হইয়াছিলেন সত্য, ভয়ে এক প্রকার হতজ্ঞান হইয়াছিলেন সত্য, কিন্তু তবুও আপনার ব্যবসায়টি বিস্মরণ হইতে পারেন নাই।

তনু রায় বলিলেন, “যখন কথা দিয়াছি তখন অবশ্যই তোমার সহিত আমি কঙ্কাবতীর বিবাহ দিব। আমার কথার নড় চড় নাই। মুখ হইতে একবার কথা বাহির করিলে সে কথা আর আমি কখনও অন্যথা করি না। তবে আমার নিয়ম তো জানেন? আমার কুল-ধর্ম রক্ষা করিয়া যদি আপনি বিবাহ করিতে পারেন তো করুন, তাহাতে আমার কিছুমাত্র আপত্তি নাই।”

ব্যাঘ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, “কত হইলে আপনার কুল-ধর্ম রক্ষা হয়?”তনু রায় বলিলেন, “আমি সদ্বংশজাত ব্রাহ্মণ। সন্ধ্যা-আহ্নিক না করিয়া জল খাই না। এরূপ ব্রাহ্মণের জামাতা হওয়া পরম সৌভাগ্যের কথা। আমার জামাতা হইতে যদি মহাশয়ের অভিলাষ থাকে, তাহা হইলে তোমাকে আমার সম্মান রক্ষা করিতে হইবে। কিঞ্চিৎ অর্থব্যয় করিতে হইবে।”

ব্যাঘ্র উত্তর করিলেন, “তা বিলক্ষণ জানি। এখন কত টাকা পাইলে মেয়ে বেচিবেন তাহা বলুন।”

তনু রায় বলিলেন, “এ গ্রামের জমিদার মান্যবর শ্রীযুক্ত জনার্দন চৌধুরী মহাশয়ের সহিত আমার কন্যার সম্বন্ধ হইয়াছিল। দৈব ঘটনাবশতঃ কার্য সমাধা হয় নাই। চৌধুরী মহাশয় নগদ দুই সহস্র টাকা দিতে স্বীকার করিয়াছিলেন। তিনি মনুষ্য, ব্রাহ্মণ, স্বজাতি। আপনি তাহার কিছুই নন। সুতরাং আপনাকে কিছু অধিক দিতে হইবে।”ব্যাঘ্র বলিলেন, “বাটীর ভিতর চলুন। আপনাকে আমি এত টাকা দিব যে আপনি কখনও চক্ষে দেখেন নাই, জীবনে স্বপনে কখনও ভাবেন নাই।”

এই কথা বলিয়া তর্জন গর্জন করিতে করিতে ব্যাঘ্র বাটীর ভিতর প্রবেশ করিলেন। তনু রায়ের মনে তখন বড় ভয় হইল। তনু রায় ভাবিলেন, এইবার বুঝি সপরিবারে খাইয়া ফেলে। নিরুপায় হইয়া তিনিও, ব্যাঘ্রের পশ্চাৎ পশ্চাৎ বাটীর ভিতর গেলেন।

বাহিরে ব্যাঘ্রের গর্জন শুনিয়া এতক্ষণ কঙ্কাবতী, কঙ্কাবতীর মাতা ও ভগিনীগণ ভয়ে মৃতপ্রায় হইয়াছিলেন। তনু রায়ের পুত্র তখন ঘরে ছিল না, বেড়াইতে গিয়াছিল। যেখানে কঙ্কাবতী প্রভৃতি বসিয়াছিল, ব্যাঘ্র গিয়া সেইখানে উপস্থিত হইলেন। সেইখানে সকলের সম্মুখে তিনি একটি বৃহৎ টাকার তোড়া ফেলিয়া দিলেন।

ব্যাঘ্র বলিলেন, “খুলিয়া দেখুন, ইহার ভিতর কি আছে।”

তনু রায় তোড়াটি খুলিলেন; দেখিলেন, তাহার ভিতর কেবল মোহর! হাতে করিয়া, চশমা নাকে দিয়া, আলোর কাছে লইয়া, উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন ষে, মেকি মোহর নয়, প্রকৃত স্বর্ণমুদ্রা। সকলেই আশ্চর্য হইলেন যে, এত টাকা বাঘ কোথা হইতে আনিল? তনু রায়ের মনে আনন্দ আর ধরে না। তনু রায় ভাবিলেন, “এত দিন পরে এইবার আমি মনের মত জামাই পাইলাম।”

প্রদীপের কাছে লইয়া তনু রায় মোহরগুলি গণিতে বসিলেন।

এই অবসরে, ব্যাঘ্র ধীরে ধীরে কঙ্কাবতী ও কঙ্কাবতীর মাতার নিকট গিয়া বলিলেন, “কোনও ভয় নাই।”

কঙ্কাবতী ও কঙ্কাবতীর মাতা চমকিত হইলেন। কাহার সে কণ্ঠস্বর; তাহা তাঁহারা সেই মুহূর্তেই বুঝিতে পারিলেন। সেই কণ্ঠস্বর শুনিয়া তাঁহাদের প্রাণে সাহস হইল। কেবল সাহস কেন? তাঁহাদের মনে অনির্বচনীয় আনন্দের উদয় হইল। কঙ্কাবতীর মাতা মৃদুভাবে বলিলেন, “হে ঠাকুর! যেন তাহাই হয়।”ব্যাঘ্র এই কথা বলিয়া, পুনরায় তনু রায়ের নিকটে থাবা পাতিয়া বসিলেন। তোড়ার ভিতর হইতে তনু রায় তিন সহস্র স্বর্ণ-মুদ্রা গণিয়া পাইলেন।

ব্যাঘ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, “তবে এখন?” তনু রায় উত্তর করিলেন, “এখন আর কি? যখন কথা দিয়াছি তখন এই রাত্রিতেই তোমার সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ দিব। সে জন্য কোনও চিন্তা করিও না। আর মনে করিও না যে ব্যাঘ্র বলিয়া তোমার প্রতি আমার কিছুমাত্র অভক্তি হইয়াছে। না না আমি সে প্রকৃতির লোক নই। কাহারে কিরূপ মান-সম্ভ্রম করিতে হয় তাহা আমি ভালরূপ বুঝি। জনার্দন চৌধুরী দূরে থাকুক, যদি জনার্দন চৌধুরীর বাবা আসিয়া আজ আমার পায়ে ধরে, তবুও তোমাকে ফেলিয়া তাঁহার সহিত আমি কঙ্কাবতীর বিবাহ দিব না।”তাহার পর তনু রায় স্ত্রীকে বলিলেন, “তুমি আমার কথার উপর কথা কহিও না; তাহা হইলে অনর্থ ঘটিবে। আমি নিশ্চয় ইহাকে কন্যা সম্প্রদান করিব। ইহার মত সুপাত্র আর পৃথিবীতে পাইব না। এ বিষয়ে আমি কাহারও কথা শুনিব না। যদি তোমরা কান্নাকাটি কর তাহা হইলে এই ব্যাঘ্রকে বলিয়া দিব, এ এখনই তোমাদিগকে খাইয়া ফেলিবে।”

তনু রায়ের স্ত্রী উত্তর করিলেন, “তোমার যাহা ইচ্ছা, তাহাই কর। আমি কোনও কথায় থাকিব না।”

যাঁহার টাকা আছে তাঁহার কিসের ভাবনা? সেই দণ্ডেই তনু রায় পুত্রকে ডাকিতে পাঠাইলেন। সেই দন্ডেই প্রতিবাসী প্রতিবাসিনিগণ আসিয়া উপস্থিত হইল। সেই দণ্ডেই নাপিত পুরোহিত আসিল। সেই দণ্ডেই বিবাহের সমস্ত আয়োজন হইল। সেই রাত্রিতেই ব্যাঘ্রের সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ কার্য সমাধা হইল। প্রকাণ্ড বনের বাঘকে জামাই করিয়া কার না মনে আনন্দ হয়? আজ তনু রায়ের মনে তাই আনন্দ ধরে না।

প্রতিবাসীদিগকে তিনি বলিলেন, “আমার জামাইকে লইয়া তোমরা আমোদ-আহ্লাদ করিবে। আমার জামাই যেন মনে কোনও রূপ দুঃখ না করে।”

জামাইকে তনু রায় বলিলেন, “বাবাজি! বাসর-ঘরে গান গাহিতে হইবে। গান শিখিয়া আসিয়াছ তো? এখানে কেবল হালুম-হালুম করিলে চলিবে না। শালী-শালাজ তাহা হইলে কান মলিয়া দিবে। বাঘ বলিয়া তাহারা ছাড়িয়া কথা কহিবে না।”বর না চোর! ব্যাঘ্র ঘাড় হেঁট করিয়া রহিলেন। বাসর ঘরে গান গাহিয়াছিলেন কি না, সে কথা শালী-শালাজ ঠানদিদিরা বলিতে পারেন। আমরা কি করিয়া জানিব?

প্রভাত হইবার পূর্বে ব্যাঘ্র তনু রায়কে বলিলেন, “মহাশয়, রাত্রি থাকিতে থাকিতে জনসমাজ পরিত্যাগ করিয়া বনে আমাকে পুনরাগমন করিতে হইবে। অতএব আপনার কন্যাকে সুসজ্জিতা করিয়া আমার সহিত পাঠাইয়া দিন। আর বিলম্ব করিবেন না।”

প্রতিবাসিনিগণ কঙ্কাবতীর চুল বাঁধিয়া দিলেন। কঙ্কাবতীর মাতা কঙ্কাবতীর ভাল কাপড়গুলি বাছিয়া বাছিয়া বাহির করিলেন। তাহা দেখিয়া তনু রায় রাগে আরক্ত-নয়নে স্ত্রীকে বলিলেন, “তোমার মত নির্বোধ আর এ পৃথিবীতে নাই। যাহার ঘরে এরূপ লক্ষ্মী-ছাড়া স্ত্রী তাহার কি কখনও ভাল হয়? বাঘের কিসের অভাব? কাপড়ের দোকানে গিয়া হালুম করিয়া পড়িবে, দোকানী দোকান ফেলিয়া পলাইবে, আর বাঘ কাপড়ের গাঁঠরি লইয়া চলিয়া যাইবে। স্বর্ণকারের দোকানে গিয়া বাঘ হালুম করিয়া পড়িবে, প্রাণের দায়ে স্বর্ণকার পলাইবে, আর বাঘ গহনাগুলি লইয়া চলিয়া যাইবে। দেখিয়া শুনিয়া যখন এরূপ সুপাত্রের হাতে কন্যা দিলাম, তখন আবার কঙ্কাবতীর সঙ্গে ভাল কাপড়-চোপড় দেওয়া কেন? তাই বলি তোমার মত বোকা আর এ ভূ-ভারতে নাই।”তনু রায় লক্ষ্মীমন্ত পুরুষ, বৃথা অপব্যয় একেবারে দেখিতে পারেন না। যখন তাঁহার মাতার ঈশ্বর-প্রাপ্তি হয়, তখন মাতা বিছানায় শুইয়া ছিলেন। নাভিশ্বাস উপস্থিত হইলে, মাকে তিনি কেবল মাত্র একখানি ছেঁড়া মাদুরে শয়ন করাইলেন। নিতান্ত পুরাতন নয় এরূপ একখানি বস্ত্র তখন তাঁহার মাতা পরিয়াছিলেন। কণ্ঠ-শ্বাস উপস্থিত হইলে সেই বস্ত্রখানি তনু রায় খুলিয়া লইলেন। আর একখানি জীর্ণ ছিন্ন গলিত নেকড়া পরাইয়া দিলেন। এইরূপ টানা হেঁচড়া করিতে ব্যস্ত থাকায় মৃত্যুসময়ে তিনি মাতার মুখে এক বিন্দু জল দিতে অবসর পান নাই; কাপড় ছাড়াইয়া ভক্তিভাবে যখন পুনরায় মাকে শয়ন করাইলেন তখন দেখিলেন যে মার অনেকক্ষণ হইয়া গিয়াছে।

স্বামীর তিরস্কারে তনু রায়ের স্ত্রী দুই একখানি ছেঁড়া-খোঁড়া নেকড়া-চোকড়া লইয়া একটি পুঁটুলি বাঁধিলেন। সেইটি কঙ্কাবতীর হাতে দিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে, ঠাকুরদেবতাদের ডাকিতে ডাকিতে, কন্যাকে বিদায় দিলেন।

সপ্তম পরিচ্ছেদ

বনে

পুঁটুলি হাতে করিয়া, কঙ্কাবতী ব্যাঘ্রের নিকট আসিয়া অধোবদনে দাঁড়াইল। ব্যাঘ্র মধুরভাষে বলিলেন, “কঙ্কাবতী, তুমি বালিকা। পথ চলিতে পারিবে না। তুমি আমার পৃষ্ঠে আরোহণ কর, আমি তোমাকে লইয়া যাই। তাহাতে আমার কিছুমাত্র ক্লেশ হইবে না।”

কঙ্কাবতী গাছ-কোমর বাঁধিয়া বাঘের পিঠের উপর চড়িয়া বসিল। ব্যাঘ্র বলিলেন, “কঙ্কাবতী, আমার পিঠের লোম তুমি দৃঢ়রূপে ধর। দেখিও, যেন পড়িয়া যাইও না।”

কঙ্কাবতী তাহাই করিল। ব্যাঘ্র বনাভিমুখে দ্রুতবেগে ছুটিলেন। বিজন অরণ্যের মাঝখানে উপস্থিত হইয়া ব্যাঘ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, “কঙ্কাবতী, তোমার কি ভয় করিতেছে?”

কঙ্কাবতী উত্তর করিল, “তোমার সহিত যাইব, তাতে আবার আমার ভয় কি?”

কঙ্কাবতী এ কথা বলিল বটে, কিন্তু একেবারেই যে তাহার ভয় হয় নাই, তাহা নহে। বাঘের পিঠে সে আর কখনও চড়ে নাই, এই প্রথম। সুতরাং ভয় হইবার কথা।

ব্যাঘ্র বলিলেন, “কঙ্কাবতী, কেন আমি বাঘ হইয়াছি, সে কথা তোমাকে পরে বলিব। এ দশা হইতে শীঘ্রই আমি মুক্ত হইব, সেজন্য তোমার কোনও চিন্তা নাই। এখন কোনও কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করিও না।”এইরূপ কথা কহিতে কহিতে দুইজনে যাইতে লাগিলেন। অবশেষে বৃহৎ এক অত্যুচ্চ পর্বতের নিকট গিয়া দুইজনে উপস্থিত হইলেন।

ব্যাঘ্র বলিলেন, “কঙ্কাবতী! কিছুক্ষণের নিমিত্ত তুমি চক্ষু বুজিয়া থাক। যতক্ষণ না আমি বলি, ততক্ষণ চক্ষু চাহিও না।”

কঙ্কাবতী চক্ষু বুজিল। ব্যাঘ্র দ্রুতবেগে যাইতে লাগিলেন। অল্পক্ষণ পরে খলখল করিয়া বিকট হাসির শব্দ কঙ্কাবতীর কর্ণকুহরে প্রবেশ করিল।

কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিল, “কি বিকট, কি ভয়ানক হাসি! ওরূপ করিয়া কে হাসিল?”ব্যাঘ্র উত্তর করিলেন, “সে কথা সব তোমাকে পরে বলিব। এখন শুনিয়া কাজ নাই। এখন তুমি চক্ষু উন্মীলন কর, আর কোনও ভয় নাই।”

কঙ্কাবতী চক্ষু চাহিয়া দেখিল যে, এক মনোহর অট্টালিকায় আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। শ্বেতপ্রস্তরে নির্মিত বহুমূল্য মণি-মুক্তায় অলংকৃত, অতি সুরম্য অট্টালিকা। ঘরগুলি সুন্দর,পরিষ্কৃত,নানা ধনে পরিপূরিত, নানা সাজে সুসজ্জিত। রজত, কাঞ্চন, হীরা, মাণিক, মুকুতা চারিদিকে রাশি রাশি স্তূপাকারে রহিয়াছে দেখিয়া কঙ্কাবতী মনে মনে অদ্ভুত মানিলেন। অট্টালিকাটি কিন্তু পর্বতের অভ্যন্তরে স্থিত। বাহির হইতে দেখা যায় না। পর্বত গাত্রে সামান্য একটি নিবিড় অন্ধকারময় সুড়ঙ্গ দ্বারা কেবল ভিতরে প্রবেশ করিতে পারা যায়। পর্বতের শিখরদেশ হইতে অট্টালিকার ভিতর আলোক প্রবেশ করে। কিন্তু আলোক আসিবার পথও এরূপ কৌশলভাবে নিবেশিত ও লুক্কায়িত আছে যে, সে পথ দিয়া ভূচর খেচর কেহ অট্টালিকার ভিতর প্রবেশ করিতে পারে না। অট্টালিকার ভিতর হইতে কেহ বাহিরে যাইতেও পারে না; অট্টালিকার ভিতর বসন,ভূষণ, খাট পালঙ্ক প্রভৃতি কোনও দ্রব্যের অভাব নাই। নাই কেবল আহারীয় সামগ্রী। অট্টালিকার ভিতর উপস্থিত হইয়া ব্যাঘ্র বলিলেন, “কঙ্কাবতী এখন তুমি আমার পৃষ্ঠ হইতে অবতরণ কর। একটুখানি এইখানে বসিয়া থাক, আমি আসিতেছি। কিন্তু সাবধান! এখানকার কোনও দ্রব্যে হাত দিও না, কোনও দ্রব্য লইও না। যাহা আমি হাতে করিয়া দিব, তাহাই তুমি লইবে,আপনা আপনি কোনও দ্রব্য স্পর্শ করিবে না?”

এইরূপ সতর্ক করিয়া ব্যাঘ্র সে স্থান হইতে চলিয়া গেলেন।

কিছুক্ষণ পরে খেতু আসিয়া কঙ্কাবতীর সম্মুখে দাঁড়াইল। খেতু জিজ্ঞাসা, “কঙ্কাবতী, আমাকে চিনিতে পার?”

কঙ্কাবতী ঘাড় হেঁট করিয়া রহিল। খেতু পুনরায় বলিল, “কঙ্কাবতী, এই বনের মাঝখানে আসিয়া তোমার কি ভয় করিতেছে?”

কঙ্কাবতী মৃদুস্বরে উত্তর করিল, “না, আমার ভয় করে নাই। তোমাকে দেখিয়া আমার ঘোমটা দেওয়া উচিত, লজ্জা করা উচিত। তাহা আমি পারিতেছি না। তাই আমি ভাবিতেছি। তুমি কি মনে করিবে!”

খেতু বলিল, “না কঙ্কাবতী, আমাকে দেখিয়া তোমার ঘোমটা দিতে হইবে না, লজ্জা করিতে হইবে না। আমি কিছু মনে করিব না, তাহার জন্য তোমার ভাবনা নাই। আর এখানে কেবল তুমি আর আমি, অন্য কেহ নাই, তাতে লজ্জা করিলে চলিবে কেন? তাও বটে, আবার এখানে আমরা সম্পূর্ণ নিরাপদ নই। বিপদের আশঙ্কা বিলক্ষণ আছে।”কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিল, “কি বিপদ?”

খেতু বলিল, “এখন সে কথা শুনিয়া তোমার কাজ নাই। তাহা হইলে ভয় পাইবে। এখন সে কথা তুমি আমাকে জিজ্ঞাসা করিও না। তবে, এখন তোমাকে এইমাত্র বলিতে পারি যে, যদি তুমি এখানকার দ্রব্যসামগ্রী স্পর্শ না কর তাহা হইলে কোনও ভয় নাই, কোনও বিপদ হইবার সম্ভাবনা নাই। যেটি আমি হাতে তুলিয়া দিব সেইটি লইবে; নিজ হাতে কোনও দ্রব্য লইবে না। একবৎসর কাল আমাদিগকে এইখানে থাকিতে হইবে। তাহার পর এ সমুদয় ধনসম্পত্তি আমাদের হইবে। এই সমুদয় ধন লইয়া তখন আমরা দেশে যাইব। আচ্ছা কঙ্কাবতী, যখন আমি তোমাকে বিবাহ করি, তখন তুমি আমাকে চিনিতে পারিয়াছিলে?” কঙ্কাবতী উত্তর করিল, “তা আর পারি নি? এক বৎসর কাল তোমার জন্য পথপানে চাহিয়াছিলাম। যখন এক বৎসর গত হইয়া গেল, তখনও তুমি আসিলে না। তখন মা আর আমি হতাশ হইয়া পড়িলাম। মা যে কত কাঁদিতেন, আমি যে কত কাঁদিতাম, তাহা আর তোমাকে কি বলিব? কাল রাত্রিতে বাবা যখন বলিলেন যে, বাঘের সহিত আমি কঙ্কাবতীর বিবাহ দিব, আর সেই কথায় তুমি যখন বাহির হইতে বলিলে, তবে কি মহাশয় দ্বার খুলিয়া দিবেন? সেই গর্জনের ভিতর হইতেও একটু যেন বুঝিলাম যে, সে কাহার কন্ঠস্বর! তার পর আবার ঘরের ভিতর আসিয়া, যখন তুমি চুপি চুপি মার কানে ও আমার কানে বলিলে, কোনও ভয় নাই, তখন তো নিশ্চয়ই বুঝিলাম যে তুমি বাঘ নও।”

খেতু বলিল, “অনেক দুঃখ গিয়াচে। কঙ্কাবতী, তুমিও অনেক দুঃখ পাইয়াছ, আমিও অনেক দুঃখ পাইয়াছি আর এক বৎসর কাল দুঃখ সহিয়া এইখানে থাকিতে হইবে। তাহার পর ঈশ্বর যদি কৃপা করেন তো আমাদের সুখের দিন আসিবে। দেখিতে দেখিতে এক বৎসর কাল কাটিয়া যাইবে। তখন এই সমুদয় ঐশ্বর্য আমাদের হইবে। আহা! মা নাই,এত ধন লইয়া যে কি করিব! তাই ভাবি, মা যদি বাঁচিয়া থাকিতেন, তাহা হইলে পৃথিবীতে যাহা কিছু পুণ্যকর্ম আছে সমস্ত আমি মাকে করাইতাম। যাহা হউক পৃথিবীতে অনেক দীন-দুঃখী আছে। কঙ্কাবতী, এখন কেবল তুমি আর আমি যতদূর পারি, দুই জনে জগতের দুঃখমোচন করিয়া জীবন অতিবাহিত করিব।”কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিল, “মাতার সৎকার কার্য সমাপ্ত করিয়া আমাকে বাটীতে রাখিয়া তাহার পর তুমি কোথায় গেলে, কি করিলে? ফিরিয়া আসিতে তোমার এক বৎসরের অধিক হইল কেন? তুমি ব্যাঘ্রের আকার ধরিলে কেন? সে সব কথা তুমি আমাকে এখন বলিবে না?”

খেতু বলিল, “না কঙ্কাবতী, এখন নয়। এক বৎসর গত হইয়া যাক, তাহার পর সব কথা তোমাকে বলিব।”

কঙ্কাবতী আর কোনও কথা জিজ্ঞাসা করিল না।

কঙ্কাবতী ও খেতু পর্বত-অভ্যন্তরে সেই অট্টালিকায় বাস করিতে লাগিল। অট্টালিকার কোনও দ্রব্য কঙ্কাবতী স্পর্শ করে না! কেবল খেতু যাহা হাতে করিয়া দেয়, তাহাই গ্রহণ করে। অট্টালিকার ভিতর সমুদয় দ্রব্য ছিল, কেবল খাদ্য-সামগ্রী ছিল না। প্রতিদিন বাহিরে গিয়া খেতু বনের ফল-মূল লইয়া আসে, তাহাই দুইজনে আহার করিয়া কালযাপন করে। বাহিরে যাইতে হইলে, খেতু ব্যাঘ্ররূপ ধারণ করে। বাঘ না হইয়া খেতু বাহিরে কখনও যায় না। আবার অট্টালিকার ভিতর আসিয়া খেতু পুনরায় মনুষ্য হয়। কেন সে বাঘের রূপ না ধরিয়া বাহিরে যায় না, কঙ্কাবতী তাহা বুঝিতে পারে না, খেতু মানা করিয়াছে, সেজন্য জিজ্ঞাসা করিবারও জো নাই। এইরূপে দশমাস কাটিয়া গেল।

একদিন কঙ্কাবতী বলিল, “অনেকদিন মাকে দেখি নাই। মাকে দেখিতে বড় ইচ্ছা হয়। মাও আমাদের কোনও সংবাদ পান নাই। মাও হয়তো চিন্তিত আছেন। আমরা কোথায় গেলাম, কি করিলাম, মা, তাহার কিছুই জানেন না।”খেতু উত্তর করিল, “অল্প দিনের মধ্যে পুনরায় দেশে যাইব, সেজন্য আর তাঁহাদিগকে কোনও সংবাদ দিই নাই। আর লোকালয়ে যাইতে হইলেই আমাকে বাঘ হইয়া যাইতে হইবে, সেজন্য আর যাইতে বড় ইচ্ছাও হয় না। কি জানি কখন কি বিপদ ঘটে, বলিতে তো পারা যায় না। যাহা হউক, মাকে দেখিতে যখন তোমার সাধ হইয়াছে, তখন কাল তোমার এসাধ পূর্ণ করিব। কালসন্ধ্যার সময় মার নিকট তোমাকে আমি লইয়া যাইব। কঙ্কাবতী, বৎসর পূর্ণ হইতে আর কেবল দুই মাস আছে। যদি তোমার ইচ্ছা হয়, তাহা হইলে এই দুই মাস তুমি না হয় বাপের বাড়ী থাকিও।”

কঙ্কাবতী বলিল, “না, তা আমি থাকিতে চাই না। তুমি এই বনের ভিতর নানা বিপদের মধ্যে একেলা থাকিবে, আর আমি বাপের বাড়ী থাকিব, তা কি কখনও হয়? মার জন্য মন উতলা হইয়াছে, কেবল একবার খালি মাকে দেখিতে চাই। দেখা-শুনা করিয়া আবার তখন ফিরিয়া আসিব।”

অষ্টম পরিচ্ছেদ

শ্বশুরালয়

তাহার পরদিন সন্ধ্যাবেলা, খেতু ব্যাঘ্রের রূপ ধরিয়া কঙ্কাবতীকে তাহার পিঠে চড়িতে বলিল। অট্টালিকা হইতে অনেকগুলি টাকাকড়ি লইয়া কঙ্কাবতীকে দিল, আর বলিল যে, “এই টাকাগুলি লইয়া তোমার মাতা, পিতা, ভাই ও ভগিনীদিগকে দিবে।”

অট্টালিকা হইতে বাহির হইয়া দুইজনে অন্ধকারময় সুড়ঙ্গের পথে চলিল। সুড়ঙ্গ হইতে বাহির হইবার সময় খেতু বলিল, “কঙ্কাবতী, চক্ষু মুদ্রিত কর। যতক্ষণ না বলি, ততক্ষণ চক্ষু চাহিও না।”কঙ্কাবতী চক্ষু বুজিল। পুনরায় সেই বিকট হাসি শুনিতে পাইল। সেই ভয়াবহ হাসি শুনিয়া আতঙ্কে তাহার শরীর শিহরিয়া উঠিল।

সুড়ঙ্গের বাহিরে আসিয়া বনের ভিতর প্রবেশ করিয়া, খেতু কঙ্কাবতীকে চক্ষু চাহিতে বলিল। ব্যাঘ্র দ্রুতবেগে গ্রামের দিকে ছুটিল। প্রায় এক প্রহর রাত্রির সময় ঝি-জামাতা তনু রায়ের বাটীতে উপস্থিত হইল।

কঙ্কাবতীকে পাইয়া কঙ্কাবতীর মা যেন স্বর্গ হাত বাড়াইয়া পাইলেন। কঙ্কাবতীর ভগিনীগণও কঙ্কাবতীকে দেখিয়া পরম সুখী হইলেন। অনেক টাকা মোহর দিয়া ব্যাঘ্র তনু রায়কে নমস্কার করিলেন। শ্যালককেও তিনি অনেক টাকাকড়ি দিলেন। ব্যাঘ্রের আদর রাখিতে আর স্থান হয় না। মা পঞ্চোপচারে কঙ্কাবতীকে আহারাদি করাইলেন। তনু রায়ের ভাবনা হইল, “জামাতাকে কি আহার করিতে দিই?”

অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া মনে মনে বিচার করিয়া তনু রায় বলিলেন, “বাবাজী, এত পথ আসিয়াছ ক্ষুধা অবশ্যই পাইয়াছে। কিন্তু আমাদের ঘরে কেবল ভাত-ব্যঞ্জন আছে, আর কিছুই নাই। ভাত-ব্যঞ্জন কিছু তোমার খাদ্য নয়। তাই ভাবিতেছি, তোমাকে খাইতে দিই কি? তা তুমি। এক কর্ম কর। আমার গোয়ালে একটি বৃদ্ধা গাভী আছে। সময়ে সে দুগ্ধবতী গাভী ছিল। এখন তাহার বৎস হয় না, এখন আর সে দুধ দেয় না। বৃথা কেবল বসিয়া খাইতেছে। তুমি সেই গাভীটিকে আহার কর। তাহা হইলে তোমার উদর পূর্ণ হইবে। আমারও জামাতাকে আদর করা হইবে। আর মিছামিছি আমাকে খড় যোগাইতে হইবে না।” ব্যাঘ্র বলিলেন, “না মহাশয়, আজ দিনের বেলায় আমি উত্তমরূপে আহার করিয়াছি। এখন আমার আর ক্ষুধা নাই, গাভীটি এখন আমি আহার করিতে পারিব না।”

তনু রায় বলিলেন, “আচ্ছা যদি তুমি গাভীটি না খাও, তাহা হইলে না হয় আর একটি কাজ কর। তুমি নিরঞ্জন কবিরত্নকে খাও। তাহার সহিত আমার চিরবিবাদ। সে শাস্ত্র জানে না, তবু আমার সহিত তর্ক করে। তাহাকে আমি দুটি চক্ষু পাড়িয়া দেখিতে পারি না। সে এ গ্রাম হইতে এখন উঠিয়া গিয়াছে। এখান হইতে ছয় ক্রোশ দূরে মামার বাড়ীতে গিয়া আছে। আমি তোমায় সব সন্ধান বলিয়া দিতেছি। তুমি স্বচ্ছন্দে গিয়া তাহাকে খাইয়া আইস।”

ব্যাঘ্র উত্তর করিলেন, “না মহাশয়, আজ রাত্রিতে আমার কিছুমাত্র ক্ষুধা নাই। আজ রাত্রিতে আমি নিরঞ্জন কবিরত্নকে খাইতে পারিব না।”তনু রায় পুনর্বার বলিলেন, “আচ্ছা! তত দূর যদি না যাইতে পার তবে এই গ্রামেই তোমার আমি খাবার ঠিক করিয়া দিতেছি। এই গ্রামে এক গোয়ালিনী আছে। মাগী বড় দুষ্ট। দু-বেলা আসিয়া আমার সঙ্গে ঝগড়া করে। তোমাকে কন্যা দিয়াছি বলিয়া মাগী আমাকে যাহা নয় তাই বলে। মাগী আমাকে বলে, অল্পায়ু, বুড়া, ডেকরা। টাকা নিয়ে কি না বাঘকে মেয়ে বেচে খেলি! তুমি আমার জামাতা, ইহার একটা প্রতিকার তোমাকে করিতে হইবে। তুমি তার ঘাড়টি ভাঙিয়া রক্ত খাও। তার রক্ত ভাল, খাইয়া তৃপ্তিলাভ করিবে।”

ব্যাঘ্র বলিলেন, “না মহাশয়, আজ আমি কিছু খাইতে পারিব না, আজ ক্ষুধা নাই।”

তনু রায় ভাবিলেন, জামাতারা কিছু লজ্জাশীল হন। বারবার খাও খাও বলিতে হয়, তবে কিছু খান। খাইতে বসিয়া এটি খাও ওটি খাও, আর একটু খাও, এইরূপে পাঁচজনে বার বার না বলিলে জামাতারা পেট ভরিয়া আহার করেন না। পাতে সব ফেলিয়া উঠিয়া যান। এদিকে জঠরানল দাউ দাউ করিয়া জ্বলিতে থাকে। ওদিকে মুখে বলেন, আর ক্ষুধা নাই, আর খাইতে পারি না। জামাতাদিগের রীতি এই। এইরূপ চিন্তা করিয়া, তনু রায় আবার বলিলেন, “শ্বশুরবাড়ী আসিয়া কিছু না খাওয়া কি ভাল? লোকে আমার নিন্দা করিবে। পাড়ার লোকগুলির কথা তোমাকে আর কি পরিচয় দিব? পাড়ার মেয়েপুরুষগুলি এক একটি সব অবতার। তামাসা দেখিতে খুব প্রস্তুত। পরের ভাল একটু দেখিতে পারেন না। তুমি আমার জামাতা হইয়াছ, যাহা হউক, তোমার দু-পয়সা সংগতি আছে, এই হিংসায় সকলে ফাটিয়া মরিতেছে। এখনই কাল সকালে বলিবেন যে, তনু রায়ের জামাতা আসিয়াছিল, তনু রায় জামাতার কিছুমাত্র আদর করে নাই, এক ফোঁটা জল পর্যন্ত খাইতে দেয় নাই। সেইজন্য কিছু খাইতে তোমাকে বারবার অনুরোধ করিতেছি। চল, গোয়ালিনীর ঘর তোমাকে দেখাইয়া দিই। সে দুধ-ঘি খায়। মাংস তাহার কোমল। তাহার মাংস তোমার মুখে ভাল লাগিবে। খাইয়া তৃপ্তি লাভ করিবে। মন্দ দ্রব্য কি তোমাকে খাইতে বলিতে পারি?”

ব্যাঘ্র উত্তর করিলেন, “এবার মহাশয় আমাকে ক্ষমা করুন। এইবার যখন আসিব তখন দেখা যাইবে।”তনু রায় মনে মনে ক্ষুণ্ণ হইলেন। জামাতা আদরের সামগ্রী। প্রাণ ভরিয়া আদর করিতে না পারিলে শ্বশুর-শাশুড়ীর মনে ক্লেশ হয়। তিনি তিনটি সুখাদ্যের কথা বলিলেন, জামাতা কিন্তু একটিও খাইলেন না। তাহাতে ক্ষুণ্ণ হইবার কথা।

তনু রায় বলিলেন, “শ্বশুরবাড়ীতে এরূপ খাইয়া দাইয়া আসিতে নাই। শ্বশুর-শাশুড়ীর মন তাহাতে বুঝিবে কেন? জামাতা কিছু না খাইলে শ্বশুর-শাশুড়ীর মনে দুঃ:খ হয়। এই আজ তুমি কিছু খাইলে না, সেজন্য তোমার শাশুড়ীঠাকুরাণী আমাকে কত বকিবেন। তিনি বলিবেন, তুমি জামাতাকে ভাল করিয়া বল নাই, তাই জামাতা আহার করিলেন না। এবার যখন আসিবে, তখন আহারাদি করিয়া আসিও না। এইখানে আসিয়া আহার করিবে। তোমার জন্য এই তিনটি, খাদ্যসামগ্রী আমি ঠিক করিয়া রাখিলাম। এবার আসিয়া একবারেই তিনটিকে খাইতে হইবে। যদি না খাও তাহা হইলে বনে যাইতে দিব না, তোমার চাদর ও ছাতি লুকাইয়া রাখিব। না না, ও কথা নয়, তোমার যে আবার ছাতি কি চাদর নাই। যদি না খাও, তাহা, হইলে তোমার উপর আমি রাগ করিব।” কঙ্কাবতী সমস্ত, রাত্রি মা ও ভগিনীদের সহিত কথাবার্তা কহিতে লাগিল। ব্যাঘ্র প্রকৃত কে তাহা মাতাকে বলিল। আর দুই মাস পরে তাহারা যে বিপুল ঐশ্বর্য্য লইয়া দেশে আসিবে, তাহাও মাতাকে বলিল।

তনু রায় একবার কঙ্কাবতীকে ডাকিয়া চুপি চুপি বলিলেন, “কঙ্কাবতী, বোধ হইতেছে যে, জামাতা আমার প্রকৃত ব্যাঘ্র নন। বনের শিকড় মাথায় দিয়া মানুষে যে সেই বাঘ হয়, ইনি বোধ হয় তাই; আমি ইহাকে নানারূপ সুখাদ্য খাইতে বলিলাম, আমার গোয়ালের বুড়ো গরুটিকে খাইতে বলিলাম, নিরঞ্জনকে খাইতে বলিলাম, গোয়ালিনীকে খাইতে বলিলাম, কিন্তু ইনি ইহার একটিকেও খাইলেন না। যথার্থ বাঘ হইলে কি এসব লোভ সামলাইতে পারিতেন? তাই আমার বোধ হইতেছে, ইনি প্রকৃত বাঘ নন। তুমি দেখিও দেখি? ইহার মাথায় কোনও রূপ শিকড় আছে কিনা? যদি শিকড় পাও, তাহা হইলে সেই শিকড়টি দগ্ধ করিয়া ফেলিবে। যদি লোকে মন্দ করিয়া থাকে তো শিকড়টি পোড়াইলে ভাল হইয়া যাইবে। যে কারণেই কেন বাঘ হইয়া থাকুক না, শিকড়টি দগ্ধ করিয়া ফেলিলেই সব ভাল হইয়া যাইবে। তখন পুনরায় মানুষ হইয়া ইনি লোকালয়ে আসিবেন।” পিতার এই উপদেশ পাইয়া কঙ্কাবতী যখন পুনরায় মার নিকট আসিল, তখন মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “উনি তোমাকে চুপি চুপি কি বলিলেন?”

পিতা যেরূপ উপদেশ দিলেন, কঙ্কাবতী সেই সমস্ত কথা মার নিকট ব্যক্ত করিল।

মা সেই কথা শুনিয়া বলিলেন “কঙ্কাবতী, তুমি এ কাজ কখনও করিবে না। করিলে নিশ্চয় মন্দ হইবে। খেতু অতি ধীর ও সুবুদ্ধি। খেতু যাহা করিতেছে, তাহা ভালর জন্যই করিতেছে। খেতুর আজ্ঞা তুমি কোনও মতেই অমান্য করিও না। সাবধান কঙ্কাবতী, আমি যাহা বলিলাম,তাহা মনে যেন থাকে!”

রাত্রি অবসান-প্রায় হইলে খেতু ও কঙ্কাবতী পুনরায় বনে চলিল। পর্বতের নিকট আসিয়া খেতু পূর্বের মত কঙ্কাবতীকে চক্ষু বুজিতে বলিল। সুড়ঙ্গ-দ্বারে পূর্বের মত কঙ্কাবতী সেই বিকট হাসি শুনিল। অট্টালিকায় উপস্থিত হইয়া পূর্বের মত তাহারা দিনযাপন করিতে লাগিল।

নবম পরিচ্ছেদ

শিকড়

আর একমাস গত হইয়া গেল।

খেতু বলিল, “কঙ্কাবতী, কেবল আর এক মাস রহিল। এই এক মাস পরে আমরা স্বাধীন হইব। আর এক মাস গত হইয়া গেলে, আমাদিগকে আর বনবাসী হইয়া থাকিতে হইবে না। এই বিপুল বৈভব লইয়া আমরা তখন দেশে যাইব।”

এক একটি দিন যায়, আর খেতু বলে, “কঙ্কাবতী, আর উনত্রিশ দিন রহিল। কঙ্কাবতী, আর আটাইশ দিন রহিল। কঙ্কাবতী, আর সাতাইশ দিন রহিল।” এইরূপে কুড়িদিন গত হইয়া গেল। কেবল আর দশ দিন রহিল। দশ দিন পরে কঙ্কাবতীকে লইয়া দেশে যাইবে, সেজন্য খেতুর মনে অসীম আনন্দের উদয় হইল। খেতুর মুখে সদাই হাসি!

খেতু বলিল, “কঙ্কাবতী, তুমি এক কর্ম কর। কয়লা দ্বারা এই প্রাচীরের গায়ে দশটি দাগ দিয়া রাখ। প্রতিদিন প্রাতঃকালে উঠিয়া একটি করিয়া দাগ পুঁছিয়া ফেলিব, তাহা হইলে সম্মুখে সর্বদাই প্রত্যক্ষ দেখিব, ক-দিন আর বাকী রহিল।”

কঙ্কাবতী ভাবিল যে, দেশে যাইবার নিমিত্ত স্বামীর মন বড়ই আকুল হইয়াছে। প্রাচীরে তো দশটি দাগ দিলাম, যেমন এক একটি দিন যাইবে, তেমনি এক একটি দাগ তো মুছিয়া ফেলিলাম; তা তো সব হইবে। কিন্তু এক দিনেই কি দশটি দিন মুছিয়া ফেলিতে পারি না? এক দিনেই কি স্বামীর উদ্ধার করিতে পারি না? বাবা যা বলিয়া দিয়াছেন, তাই করিয়া দেখিলে তো হয়। আজ কি কাল যদি দেশে যাইতে পান, তাহা হইলে আমার স্বামীর মনে কতই না আনন্দ হইবে! এই দুই মাসের মধ্যে, পিতার কথা তাহার অনেক বার স্মরণ হইয়াছিল। মন্দ লোকে তাহার স্বামীকে গুণ করিয়াছে এই চিন্তা তাহার মনে বারবার উদয় হইয়াছিল। তবে মা বারণ করিয়া দিয়াছিলেন, সে জন্য এত দিন সে কোনও রূপ প্রতিকারের চেষ্টা করে নাই। এক্ষণে দেশে যাইবার নিমিত্ত স্বামীর ঘোরতর ব্যগ্রতা দেখিয়া কঙ্কাবতীর মন নিতান্ত অস্থির হইয়া পড়িল।

কঙ্কাবতী ভাবিল, বাবা পুরুষ মানুষ। পাহাড়-পর্বত বন-জঙ্গল, বাঘ-ভল্লুক, শিকড়-মাকড়, তন্ত্র-মন্ত্র, এ সকলের কথা বাবা যত জানেন, মা তত কি করিয়া জানিবেন? মা মেয়েমানুষ, ঘরের বাহিরে যান না। মা কি করিয়া জানিবেন যে, লোকে শিকড় দিয়া মন্দ করিলে তাহার কি উপায় করিতে হয়? শিকড়টি দগ্ধ করিয়া ফেলিলেই সকল বিপদ কাটিয়া যায়, বাবা এই কথা বলিয়াছেন। এখনও দশ দিন আছে, স্বামী আমার দিন গণিতেছেন। যদি কাল তিনি বাড়ী যাইতে পান তাহা হইলে তাঁর কত না আনন্দ হইবে! এইরূপ কঙ্কাবতী সমস্ত দিন ভাবিতে লাগিল। একবার মনে ভাবে,―কি জানি, পাছে ভাল করিতে গিয়া মন্দ হয়। কাজ নাই, এ দশটা দিন চক্ষু-কর্ণ বুজিয়া চুপ করিয়া থাকি। বাবা যাহা করিতে বলিয়াছেন, মা তাহা বারণ করিয়াছেন।

আবার ভাবে, দুষ্টেরা আমার স্বামীর মন্দ করিয়াছে। দুষ্টদিগের দুরভিসন্ধি হইতে স্বামীকে আমি মুক্ত করিব। আমি যদি স্বামীকে মুক্ত করিতে পারি, তাহা হইলে তিনি কত না আমার উপর পরিতুষ্ট হইবেন।

ভাবিতে ভাবিতে সমস্ত দিন চলিয়া গেল। কি করিবে, কঙ্কাবতী কিছু স্থির করিতে পারিল না। রাত্রিতে কঙ্কাবতী এই চিন্তা করিতে লাগিল। তিলকসুন্দরী ও ভুশকুমড়োর গল্প মনে পড়িল। রাজপুত্র তিলকসুন্দরীর রূপে মুগ্ধ হইয়াছিলেন। তিলকসুন্দরীকে বিবাহ করিবার নিমিত্ত তাঁহার মন হইয়াছিল। তিলকসুন্দরীর সৎ-মা তাঁহার মাথায় একটি শিকড় দিয়া দিলেন। শিকড়ের গুণে তিলকসুন্দরী পক্ষী হইয়া গেল। উড়িয়া গিয়া গাছের ডালে বসিল। সৎ-মা কৌশল করিয়া আপনার কন্যা ভুশকুমড়োর সহিত রাজপুত্রের বিবাহ দিলেন। ভুশকুমড়োকে রাজপুত্র আদর করিতে লাগিলেন। তাহা দেখিয়া তিলকসুন্দরী গাছের ডাল হইতে বলিল, “ভুশকুমড়ো কোলে। তিলকসুন্দরী ডালে!” রাজপুত্র মনে করিলেন,―পাখীটি কি বলে? রাজপুত্র সেই পাখীটিকে ডাকিলেন। পাখীটি আসিয়া রাজপুত্রের হাতে বসিল। সুন্দর পাখীটি দেখিয়া, রাজপুত্র তাহার মাথায় হাত বুলাইতে লাগিলেন। হাত বুলাইতে বুলাইতে মাথার শিকড়টি পড়িয়া গেল। পাখী তখন পুনরায় তিলকসুন্দরী হইল। রাজপুত্র তখন সৎ-মার দুষ্টাভিসন্ধি বুঝিতে পারিলেন। সৎ-মার কন্যা ভুশকুমড়োকে হেঁটে কাঁটা, উপরে কাঁটা দিয়া পুঁতিয়া ফেলিলেন। তিলকসুন্দরীকে লইয়া সুখে ঘরকন্না করিতে লাগিলেন। কঙ্কাবতীর সেই তিলকসুন্দরীর কথা এখন মনে হইল। আরব্য উপন্যাসে এই ভাবের যে গল্প আছে, তাহাও তাহার মনে পড়িল। সে ভাবিল,―দুষ্টগণ শিকড়ের দ্বারা এইরূপে লোকের মন্দ করে। আচ্ছা যাই দেখি, আমার স্বামীর মাথায় কোনও রূপ শিকড় আছে কি না।

এই মনে করিয়া সে অন্য ঘরে গিয়া বাতি জ্বালিল। বাতিটি হাতে করিয়া শয্যার পাশে দাঁড়াইয়া খেতুর মাথায় শিকড়ের অনুসন্ধান করিতে লাগিল। খেতু ঘোর নিদ্রায় অভিভূত। খেতু ইহার কিছুই জানে না।

সর্বনাশ! অনুসন্ধান করিতে করিতে কঙ্কাবতী খেতুর মাথায় একটি শিকড় দেখিতে পাইল।―বাবা যা বলিয়াছিলেন, তাই! দুষ্টলোকদিগের একবার দুরভিসন্ধি দেখ। ভাগ্যক্রমে আজ আমি মাথাটি অনুসন্ধান করিয়া দেখিলাম; তাহা না হইলে কি হইত? কঙ্কাবতী শিকড়টি খেতুর মাথা হইতে খুলিয়া লইতে চেষ্টা করিল। কিন্তু শিকড়টি মাথার চুলের সহিত দৃঢ়রূপে আবদ্ধ ছিল, খুলিয়া লইতে পারিল না। পাছে খেতু জাগিয়া উঠে, এই ভয়ে আর অধিক বল প্রয়োগ করিল না। পুনরায় অপর ঘরে গিয়া, সেস্থান হইতে কাঁচি লইয়া আসিল। চুলের সহিত শিকড়টি খেতুর মাথা হইতে কাটিয়া লইল। শিকড়টি তৎক্ষণাৎ বাতির অগ্নিতে দগ্ধ করিয়া ফেলিল।

শিকড় পুড়িয়া ঘরের ভিতর অতি ভয়ানক তীব্র দুর্গন্ধ বাহির হইল। সেই গন্ধে কঙ্কাবতীর শ্বাস রোধ হইবার উপক্রম হইল। ভয়ে কঙ্কাবতী বিহ্বল হইয়া পড়িল। কঙ্কাবতীর সর্বশরীর কাঁপিতে লাগিল।

চমকিয়া খেতু জাগরিত হইল। মাথায় হাত দিয়া দেখিল যে, শিকড় নাই। বিহ্বলা, কম্পিত-কলেবরা, জ্ঞানহীনা কঙ্কাবতীকে সম্মুখে দণ্ডায়মানা, দেখিল। অচেতন হইয়া কঙ্কাবতী ভূতলশায়ী হয় আর কি, এমন সময় খেতু উঠিয়া তাহাকে ধরিল। বাতিটি তাহার হাত হইতে লইয়া আস্তে আস্তে বসাইল। কঙ্কাবতীর মুখে জল দিয়া কঙ্কাবতীকে সুস্থ করিবার নিমিত্ত চেষ্টা করিতে লাগিল। সুস্থ হইয়া কঙ্কাবতী বলিল, “আমি যে ঘোর কু-কর্ম করিয়াছি, তাহা আমি এখন বুঝিতে পারিতেছি। আমাকে তুমি মাপ কর!”

এই বলিয়া, কঙ্কাবতী অধোবদনে বসিয়া কাঁদিতে লাগিল।

খেতু বলিল, “কঙ্কাবতী, ইহাতে তোমার কোনও দোষ নাই। প্রথম তো অদৃষ্টের দোষ। তাহা না হইলে এত দিন গিয়া আজ এ দুর্ঘটনা ঘটিবে কেন? তাহার পর আমার দোষ। আমি যদি আদ্যোপান্ত সকল কথা তোমাকে প্রকাশ করিয়া বলিতাম, যদি তোমার নিকট কিছু গোপন না করিতাম, তাহা হইলে এ কাজ তুমি কখনই করিতে না, আজ এ দুর্ঘটনা ঘটিত না। শিকড়টি বাতির আগুনে পোড়াইয়া ফেলিয়াছ?”কঙ্কাবতী ঘাড় নাড়িয়া বলিল, “হাঁ, শিকড়টি দগ্ধ করিয়া ফেলিয়াছি।”

খেতু বলিল, “তবে এখন তোমাকে বুকে সাহস বাঁধিতে হইবে। স্ত্রীলোক, বালিকার মত এখন আর কাঁদিলে চলিবে না। এই জনশূন্য অরণ্যের মধ্যে তুমি একাকিনী। তোমার জন্যই প্রাণ আমার নিতান্ত আকুল হইয়াছে। কঙ্কাবতী, প্রকৃত যাহারা পুরুষ হয়, মরিতে তাহারা ভয় করে না। অনাথিনী স্ত্রী প্রভৃতি পোষ্যদিগের জন্যই তাহারা কাতর হয়।

ব্যস্ত হইয়া কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিল, “কেন? কি? আমাদের কি বিপদ হইবে? কি বিপদের আশঙ্কা তুমি করিতেছ?”

খেতু উত্তর করিল, “কঙ্কাবতী, যদি গোপন করিবার সময় থাকত, তাহা হইলে আমি গোপন করিতাম। কিন্তু গোপন করিবার আর সময় নাই। তোমাকে একাকিনী এ স্থান হইতে বাটী ফিরিয়া যাইতে হইবে। সুড়ঙ্গের ভিতর হইতে বাহির হইয়া ঠিক উত্তর মুখে যাইবে। প্রাতঃকাল হইলে সূর্য উদয় হইবে, সূর্যকে দক্ষিণদিকে রাখিয়া চলিলেই তুমি গ্রামে গিয়া পৌঁছিবে।”কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিল, “আর তুমি?”

খেতু বলিল, “আমাকে এইখানেই থাকিতে হইবে। আমি এ স্থানের দ্রব্য ছুঁইয়াছি, এখান হইতে আমি টাকাকড়ি লইয়াছি, সুতরাং এখান হইতে আমি আর যাইতে পারিব না। আমাকে এইখানেই থাকিতে হইবে। সেইজন্য এখানকার কোনও দ্রব্য স্পর্শ করিতে তোমাকে মানা করিয়াছিলাম। এক্ষণে তুমি আর বিলম্ব করিও না। অট্টালিকা হইতে বাহির হইয়া সুড়ঙ্গপথে গমন করিবে। পর্বতের ভিতর হইতে বাহির হইয়া কোনও গাছতলায় রাত্রিটি যাপন করিবে। যখন প্রাতঃকাল হইবে, সূর্য উদয় হইবে, তখন কোন্ দিক উত্তর, অনায়াসেই জানিতে পারিবে। উত্তর-মুখে গেলেই গ্রামে গিয়া উপস্থিত হইবে। কঙ্কাবতী, আর বিলম্ব করিও না।”

কঙ্কাবতী বলিল, “এ স্থান হইতে আমি যাইব? তোমাকে এইখানে রাখিয়া আমি এখান হইতে যাইব? এমন কথা তুমি কি করিয়া বলিলে? আমি ঘোরতর কুকর্ম করিয়াছি সত্য। আমি অপরাধিনী সত্য। আমি হতভাগিনী। কিন্তু তাই বলিয়া কি আমাকে দূর করিতে হয়? আমি বালিকা, আমি অজ্ঞান, আমি জানি না, না জানিয়া এ কাজ করিয়াছি। ভাল ভাবিয়া মন্দ করিয়াছি। আমার কি আর ক্ষমা নাই?” খেতু উত্তর করিল, “কঙ্কাবতী, তোমার উপর আমি রাগ করি নাই। রাগ করিয়া তোমাকে বলি নাই যে, তুমি এখান হইতে যাও। বড় বিপদের কথা, বড় নিদারুণ কথা, কি করিয়া তোমাকে বলি? এখান হইতে তোমাকে যাইতে হইবে। কঙ্কাবতী, নিশ্চয় তোমাকে এখান হইতে যাইতে হইবে, আর এখনই যাইতে হইবে। বিলম্ব করিলে চলিবে না। এখন তুমি পিতার বাটীতে গিয়া থাক, লোকজন সঙ্গে করিয়া দশ দিন পরে পুনর্বার এই বনের ভিতর আসিও। এই অট্টালিকার ভিতর যাহা কিছু ধনসম্পত্তি আছে, তাহা লইয়া যাইও। দশদিন পরে লইলে কোনও ভয় নাই, তখন তোমাকে কেহ কিছু বলিবে না। এই ধন-সম্পত্তি চারিভাগ করিবে। একভাগ তোমার পিতাকে দিবে, একভাগ রামহরি দাদা মহাশয়কে দিবে, একভাগ নিরঞ্জন কাকাকে দিবে, আর একভাগ তুমি লইবে। ব্রতনিয়ম ধর্মকর্ম দানধ্যান করিয়া জীবন যাপন করিবে। মনুষ্য-জীবন কয় দিন? কঙ্কাবতী, দেখিতে দেখিতে কাটিয়া যাইবে। তাহার পর এখন আমি যেখানে যাইতেছি, সেইখানে তুমি যাইবে। দুইজনে পুনরায় সাক্ষাৎ হইবে।” কঙ্কাবতী বলিল, “তোমার কথা শুনিয়া আমার বুক ফাটিয়া যাইতেছে, প্রাণে বড় ভয় হইতেছে। হায়, আমি কি করিলাম। কি বিপদের কথা! কি নিদারুণ কথা! এখন কোথায় তুমি যাইবে? আমাকে ভাল করিয়া সকল কথা বল।”

খেতু বলিল, “তবে শুন। এই অট্টালিকার ভিতর যা ধন দেখিতেছ, ইহার প্রহরিণীস্বরূপ নাকেশ্বরী নামধারিণী এক ভয়ঙ্করী ভূতিনী আছে। সুড়ঙ্গের দ্বারে সর্বদা সে বসিয়া থাকে। সেই যে খল খল বিকট হাসি তুমি শুনিয়াছিলে, সে হাসি এই নাকেশ্বরীর। যে কেহ তাহার এই ধন, স্পর্শ করিবে মুহূর্তের মধ্যে সে তাহাকে খাইয়া ফেলিবে। আমি এই ধন লইয়াছি। কিন্তু যে শিকড়টি তুমি দগ্ধ করিয়া ফেলিয়াছ, সেই শিকড়ের দ্বারা এতদিন আমি রক্ষিত হইতেছিলাম। তা না হইলে এতদিন কোনকালে নাকেশ্বরী আমাকে খাইয়া ফেলিত। শিকড় নাই, এ কথা নাকেশ্বরী এখনও বোধ হয় জানিতে পারে নাই। কিন্তু শীঘ্রই সে জানিতে পারিবে। জানিতে পারিলেই সে এখানে আসিয়া আমাকে মারিয়া ফেলিবে। নাকেশ্বরীর হাত হইতে নিস্তার পাইবার কোনও উপায় নাই। এক তো এখান হইতে বাহিরে যাইবার অন্য উপায় নাই। তা থাকিলেও কোনও লাভ নাই। বনে যাই কি জলে যাই, গ্রামে যাই কি নগরে যাই, যেখানে যাইব, নাকেশ্বরী সেইখানে গিয়া আমাকে মারিয়া ফেলিবে। এই কথা শুনিয়া, কঙ্কাবতী খেতুর পা-দুটি ধরিয়া সেইখানে শুইয়া পড়িল।

খেতু বলিল, “কঙ্কাবতী, কাঁদিও না। কাঁদিলে আর কি হইবে? যাহা অদৃষ্টে ছিল, তাহা ঘটিল। সকলই তাঁহার ইচ্ছা। উঠ, যাও। আস্তে আস্তে সুড়ঙ্গ দিয়া বাহিরে যাও। এখনই নাকেশ্বরী এখানে আসিয়া পড়িবে। তাহাকে দেখিলে তুমি ভয় পাইবে। যাও, বাড়ী যাও। মার কাছে গেলে, তবু তোমার প্রাণ অনেকটা সুস্থ হইবে।”

কঙ্কাবতী উঠিয়া বসিল। আরক্ত-নয়নে আরক্ত-বদনে কঙ্কাবতী উঠিয়া বসিল। কঙ্কাবতীর মৃদু মনোমুগ্ধকারিণী সেই রূপ-মাধুরী উগ্রভাবাপন্ন হইয়া এখন অন্য প্রকার এক সৌন্দর্যের আবির্ভাব হইল। কঙ্কাবতী বলিল, “আমি তোমাকে এইখানে ছাড়িয়া যাই? তোমাকে এইখানে ছাড়িয়া নাকেশ্বরীর ভয়ে প্রাণ লইয়া আমি পলাইব? তা যদি করি, তো ধিক্ আমার প্রাণে, ধিক্ আমার বাঁচনে। শত ধিক আমার প্রাণে, শত ধিক্ আমার বাঁচনে। তোমার কঙ্কাবতী অল্পবুদ্ধি বালিকা বটে, সেইজন্য সে তোমার আজ্ঞা অবজ্ঞা করিয়াছে। তাই বলিয়া কঙ্কাবতী নরকের কীট নয়। নাকেশ্বরীর হাত হইতে তোমাকে উদ্ধার করিতে পারি ভাল, না পারি, তোমারও যে গতি, আমারও সেই গতি। যদি তোমার মৃত্যু তো আমারও মুত্যু। কঙ্কাবতী মরিতে ভয় করে না। তোমাকে ছাড়িয়া কঙ্কাবতী এ পৃথিবীতে থাকিতেও চায় না। কঙ্কাবতীর এই প্রতিজ্ঞা। কঙ্কাবতী নিশ্চয় নিজের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করিবে।”

খেতু কঙ্কাবতীর মুখপানে চাহিয়া দেখিল। কঙ্কাবতীর মুখ দেখিয়া বুঝতে পারিল যে, তাঁর প্রতিজ্ঞা অটল, অচল। কঙ্কাবতীর চক্ষে আর জল নাই, কঙ্কাবতীর মুখে ভয়ের চিহ্নমাত্র নাই। খেতু ভাবিল, কঙ্কাবতীকে আর যাইতে অনুরোধ করা বৃথা।

দশম পরিচ্ছেদ

চুরি

খেতু বলিল, “কঙ্কাবতী, যদি নিতান্ত তুমি এখান হইতে পলাইবে না, তবে তোমাকে সকল কথা বলি, শুন। তুমি বালিকা, তাতে জন-শূন্য এই বিজন অরণ্যের মধ্যে আমাদের বাস। ঘরের দ্বারে ভয়ঙ্করী নাকেশ্বরী। পাছে তুমি ভয় পাও, তাই এতদিন সকল কথা তোমাকে বলি নাই। এখন বলি, শুন। কিন্তু কথা আমার শেষ হইলে হয়। শিকড় পোড়ার গন্ধ পাইলেই বোধ হয় নাকেশ্বরী জানিতে পারিবে যে, আমার কাছে আর শিকড় নাই। তখনই সে ভিতরে আসিয়া আমার প্রাণবধ করিবে। আমার কথা শেষ হইতে না হইতে পাছে আসিয়া পড়ে সেই ভয়। “মাতার অন্ত্যেষ্টি-ক্রিয়া সমাপ্ত করিয়া আমি কাশী অভিমুখে যাত্রা করিলাম। কলিকাতা না গিয়া কি জন্য পশ্চিমাঞ্চলে যাত্রা করিলাম, সে কথা তোমাকে পূর্বেই বলিয়াছি। কাশীতে উপস্থিত হইয়া মাতার শ্রাদ্ধাদি ক্রিয়া সমাপ্ত করিলাম। তাহার পর কাজ-কর্মের অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম। সৌভাগ্যক্রমে অবিলম্বেই একটি উত্তম কাজ পাইলাম। অতিশয় পরিশ্রম করিতে হইত সত্য, কিন্তু বেতন অধিক ছিল। এক বৎসরের মধ্যে অনেকগুলি টাকা সঞ্চয় করিতে পারিব, এরূপ আশা হইল। কেবল মাত্র শরীরে প্রাণ রাখিতে যাহা কিছু আবশ্যক, সেইরূপ যৎসামান্য ব্যয় করিয়া অবশিষ্ট টাকা আমি তোমার বাপের জন্য রাখিতে লাগিলাম। কঙ্কাবতী, বলিতে গেলে জল খাইয়া আমি জীবনধারণ করিতে লাগিলাম। সমস্ত দিন পরিশ্রম করিয়া এক এক দিন সন্ধ্যাবেলা এরূপ ক্ষুধা পাইত যে, ক্ষুধায় দাঁড়াইতে পারিতাম না, মাথা ঘুরিয়া পড়িয়া যাইবার উপক্রম হইত। কিন্তু রাত্রিতে আর কিছু খাইতাম না। জলখাবার নয় কেবল খালি জল, তাই পান করিয়া উদর পূর্ণ করিতাম। তাহাতে শরীর অনেকটা সুস্থ হইত। কিছুক্ষণের নিমিত্ত ক্ষুধার জ্বালাও নিবৃত্ত হইত। তাহার পর শয়ন করিলে নিদ্রায় অভিভূত হইয়া পড়িতাম, ক্ষুধার জ্বালা আর জানিতে পারিতাম না। জল আনিবার জন্য কাহাকেও একটি পয়সা দিতাম না। একটি বড় লোটা কিনিয়াছিলাম। সন্ধ্যার পর যখন আমাকে কেহ চিনিতে পারিবে না, সেই সময়ে আপনি গিয়া গঙ্গার ঘাট হইতে জল আনিতাম। কাশীতে গঙ্গার ঘাট বড় উচ্চ। জল আনিতে গিয়া একদিন অন্ধকার রাত্রিতে আমি পড়িয়া গিয়াছিলাম। হাতে ও পায়ে অতিশয় আঘাত লাগিয়াছিল। কোনও মতে উঠিয়া সেই ঘাটের একটি সোপানে বসিলাম। কঙ্কাবতী, সেইখানে বসিয়া কত যে কাঁদিলাম, তাহা আর তোমাকে কি বলিব। মনে মনে বলিলাম যে, হে ঈশ্বর! আমি কি পাপ করিয়াছি যে, তাহার জন্য আমার এ ঘোর শাস্তি! তারপর আরও কত কি যে ভাবিলাম, তাহা আর তোমাকে কি বলিব, কঙ্কাবতী? আস্তে আস্তে পুনরায় জল লইয়া বাটী প্রত্যাগমন করিলাম। এইরূপ এক বৎসর গত হইল। এই সময়ের মধ্যে প্রায় দুই সহস্র টাকা সঞ্চয় করিয়াছিলাম। মনে করিলাম, এই টাকা পাইলে তোমার পিতা পরিতোষ লাভ করিবেন। তোমাকে আমি পাইব। টাকাগুলি লইয়া দেশাভিমুখে যাত্রা করিলাম। সমুদয় নগদ টাকা ছিল, নোট লই নাই। কারণ নোটের প্রতি আমাদের গ্রামের লোকের আস্থা নাই। একটি ব্যাগের ভিতর টাকাগুলি লইয়া রেলগাড়ীতে চড়িলাম। ব্যাগটি নিজের কাছে অতি যত্নে অতি সাবধানে রাখিলাম। পাছে কেহ চুরি করে, পাছে কেহ লয়, এই ভয়ে একবারও গাড়ী হইতে নামি নাই। যখন সন্ধ্যা হইল তখন বড় একটি স্টেশনে আসিয়া গাড়ী থামিল। সেখানে অনেকক্ষণ গাড়ী দাঁড়াইবে। আমার বড় ক্ষুধা পাইয়াছিল। তবুও জলখাবার কিনিবার জন্য গাড়ী হইতে আমি নামিলাম না। যে গাড়ীতে আমি বসিয়াছিলাম, সে গাড়ীতে আর একটি অপরিচিত লোক ছিল, অন্য আর কেহ ছিল না। সে লোকটি নিজের জন্য জলখাবার আনিতে গেল। যাইবার সময় সে আমাকে জিজ্ঞাসা করিল,―মহাশয়, আপনার যদি কিছু প্রয়োজন থাকে তো বলুন, আমি আনিয়া দিই। আমি উত্তর করিলাম, যদি তুমি আনিয়া দাও, তাহা হইলে আমি উপকৃত হইব। এই বলিয়া, জল-খাবার কিনিবার নিমিত্ত তাহাকে আমি পয়সা দিলাম। সে আমাকে জল-খাবার আনিয়া দিল। আমি তাহা খাইলাম। অল্পক্ষণ পরে আমার মাথা ঘুরিতে লাগিল। মনে করিলাম, গাড়ীর উত্তাপে এইরূপ হইয়াছে। একটু শুইলাম। শুইতে না শুইতে ঘোর নিদ্রায় অভিভূত হইয়া পড়িলাম। চৈতন্য কিছুমাত্র রহিল না। প্রাতঃকাল হইলে অল্পে অল্পে জ্ঞানের উদয় হইল। কিন্তু মাথা বড় ব্যথা করিতে লাগিল, মাথা যেন তুলিতে পারি না। যাহা হউক জ্ঞান ফিরিয়া দেখি যে, “শিয়রে আমার ব্যাগ নাই। চারিদিকে চাহিয়া দেখি যে, গাড়ীতে সে লোকটা নাই। আমার মাথায় যেন বজ্রাঘাত হইল।”অনেকক্ষণ পরে কঙ্কাবতীর চক্ষুতে জল আসিল, কঙ্কাবতী কাঁদিতে লাগিল।

খেতু বলিল, “কান পাতিয়া শুন দেখি, নাকেশ্বরীর কোনও সাড়া-শব্দ পাও কি না?”

কঙ্কাবতী একটু কান পাতিয়া শুনিল, তাহার পর বলিল, “না, কোনও রূপ সাড়া-শব্দ নাই।”

খেতু পুনরায় বলিল, “তবে শুন, তাহার পর কি হইল। নাকেশ্বরী না আসিতে আসিতে সকল কথা বলিয়া লই।”“যখন বুঝিলাম ষে, আমার টাকাগুলি চুরি গিয়াছে, তখন মনে করিলাম আজ আমার সকল আশা নির্মূল হইল। যে লোকটি আমার সঙ্গে গাড়ীতে ছিল, সে চোর। জল-খাবারের সহিত সে কোনও প্রকার মাদক দ্রব্য মিশাইয়া দিয়াছিল। সেই জল-খাবার খাইয়া যখন আমি অজ্ঞান হইয়া পড়ি, তখন সে আমার টাকাগুলি লইয়া পলাইয়াছে। কখন কোন্ স্টেশনে নামিয়া গিয়াছে, তাহা আমি কি করিয়া জানিব? সুতরাং চোর ধরা পড়িবার কিছুমাত্র সম্ভাবনা নাই। তবু রেলের কর্মচারীদিগকে সকল কথা জানাইলাম। আমাকে সঙ্গে লইয়া সমস্ত গাড়ী তাঁহারা অনুসন্ধান করিলেন।

“কোনও গাড়ীতে সে লোকটিকে দেখিতে পাইলাম না। তখন আমি পৃথিবী শূণ্য দেখিতে লাগিলাম। কি করিব আর কঙ্কাবতী? আমি চুপ করিয়া রহিলাম। ভাবিতে লাগিলাম, এখন করি কি? যাই কোথায়? কলিকাতা যাই, কি কাশী ফিরিয়া যাই, কি দেশে যাই। তারপর মনে পড়িল যে, রানীগঞ্জের টিকিটখানি আর গুটি-কতক পয়সা ভিন্ন হাতে আর কিছুই নাই।“কলিকাতা কি কাশী না গিয়া বাড়ী যাইব, স্থির করিয়া রানীগঞ্জে নামিলাম। রানীগঞ্জ হইতে আমাদের গ্রামে আসিতে দুইটি পথ আছে। একটি রাজপথ, যাহা দিয়া অনেক লোক গতি-বিধি করে, দ্বিতীয়টি বনপথ, যাহাতে বাঘ-ভালুকের ভয় আছে, সেজন্য সে পথ দিয়া লোকে বড় যাতায়াত করে না। বনপথটি কিন্তু নিকট। সে পথটি দিয়া আসিলে পাঁচ দিনে আমাদের গ্রামে উপস্থিত হইতে পারা যায়, রাজপথ দিয়া গেলে ছয়দিন লাগে। রানীগঞ্জে যখন নামিলাম, তখন আমার হাতে কেবল চারিটি পয়সা ছিল। শীঘ্র গ্রামে পৌঁছিব, সে নিমিত্ত আমি বনপথটি অবলম্বন করিলাম। প্রথম দিনেই পয়সা কয়টি খরচ হইয়া গেল। পাহাড়-পর্বত, বন-উপবন, নদী-নির্ঝর অতিক্রম করিয়া চলিতে লাগিলাম। বনের ফলমূল যাহা কিছু পাই, তাহাই খাই। রাত্রিতে যে দিন গ্রাম পাই সে দিন কাহারও দ্বারে পড়িয়া থাকি। যে দিন গ্রাম না পাই সে দিন গাছতলায় শুইয়া থাকি। মনে করিলাম, আমাকে বাঘ-ভালুকে কিছু বলিবে না, তাহার জন্য কোনও চিন্তা নাই। আমাকে যদি বাঘ-ভালুকে খাইবে, তবে পৃথিবীতে এমন হতভাগা আর কে আছে যে, এ দুঃখ সব ভোগ করিবে? এইরূপে চারিদিন কাটিয়া গেল। আমাদের গ্রাম হইতে যে উচ্চ পর্বতটি দেখিতে পাওয়া যায়, সন্ধ্যাবেলা আমি সেই পর্বতের নিম্নদেশে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। সেই পর্বতটি এই, যাহার ভিতর এক্ষণে আমরা রহিয়াছি। এখান হইতে আমাদের গ্রাম প্রায় একদিনের পথ। কয় দিন অনাহারে ক্রমেই দুর্বল হইয়া পড়িয়াছিলাম। মনে করিলাম কাল প্রাতঃকালে আরও অধিক দুর্বল হইয়া পড়িব, তাহার চেয়ে সমস্ত রাত্রি চলি, সকাল বেলা গ্রামে গিয়া পৌঁছিব। এইরূপ ভাবিয়া সে রাত্রিতে আর বিশ্রাম না করিয়া ক্রমাগত চলিতে লাগিলাম। রাত্রি এক প্রহরের পর চন্দ্র অস্ত গেল। ঘোরতর অন্ধকারে বন আচ্ছন্ন হইল, আমি পথ হারাইলাম। নিবিড় বনের মধ্যে গিয়া পড়িলাম, কোনও দিকে আর পথ পাই না। এমন সময় সম্মুখে একটি মন্দির দেখিতে পাইলাম। মন্দিরটি দেখিয়া আমার মৃতপ্রায় দেহে পুনরায় প্রাণের সঞ্চার হইল। ভাবিলাম অবশ্য এই স্থানে লোক আছে। আর কিছু পাই না পাই, এখন একটু জল পাইলে প্রাণরক্ষা হয়। এই ভাবিয়া তৃষিত চাতকের ন্যায় ব্যগ্রতার সহিত মন্দিরের দিকে গেলাম। হা অদৃষ্ট! গিয়া দেখিলাম মন্দিরে দেব নাই, দেবী নাই, জনমানব নাই! মন্দিরটি অতি প্রাচীন, ভগ্ন; ভিতর ও বাহির বন্য বৃক্ষলতায় আচ্ছাদিত। বহুকাল হইতে জনমানবের সেখানে পদার্পণ হয় নাই। হা ভগবান! তোমার মনে আরও কত কি আছে! এই বলিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া সেইখানে আমি শুইয়া পড়িলাম।”

একাদশ পরিচ্ছেদ

ভূত কোম্পানি

খেতু বলিতেছে, “রাত্রি প্রায় দুই প্রহর হইয়াছে, অতিশয় শ্রান্তি বশতঃ আমার একটু নিদ্রার আবেশ হইয়া আসিতেছে, এমন সময় মন্দিরের সোপানে কি ঠক্ ঠক্ করিয়া শব্দ হইতে লাগিল। চাহিদা দেখি ভীষণাকার শ্বেতবর্ণ এক মড়ার মাথা। একটি পৈঠা হইতে অন্য পৈঠার উপর লাফাইয়া লাফাইয়া উঠিতেছে। কঙ্কাবতী, ভয় আমার শরীরে কখনও নাই, তবুও এই মড়ার মাথার কাণ্ড দেখিয়া আমার শরীর কেমন একটু রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল। আমি উঠিয়া বসিলাম। মড়ার মাথাটি লাফাইয়া লাফাইয়া সমস্ত পৈঠাগুলি উঠিল, তারপর ভাটার মত গড়াইতে গড়াইতে আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল। আমার নিকট আসিয়া একটি লাফ মারিল, লাফ মারিয়া আমার ঠিক মুখের সম্মুখে শূন্যেতে স্থির হইয়া কিছুক্ষণের নিমিত্ত আমার দিকে চাহিয়া রহিল। সেইখানে থাকিয়া আকর্ণ হাঁ করিয়া দন্ত-পাঁতি বাহির করিল।“এইরূপ বিকটাকার হাঁ করিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিল, বাবু, তুমি না কি ভূত মান না?”

“আমি উত্তর করিলাম, রক্ষা করুন মহাশয়, আপনারা পর্যন্ত আর আমার সহিত লাগিবেন না। নানা কষ্টে, নানা দুঃখে আমি বড়ই উৎপীড়িত হইয়াছি। যান ঘরে যান। আমাকে আর জ্বালাতন করিবেন না।”

“আমার কথায় মুণ্ডটির আরও ক্রোধ হইল। চীৎকার করিয়া সে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল, বাবু, তুমি নাকি ভূত মান না? ইংরেজী পড়িয়া তুমি নাকি ভূত মান না?

“আমি বলিলাম, ইংরেজী-পড়া বাবুরা ভূত মানেন না বলিয়া কি আপনার রাগ হইয়াছে? লোকে ভূত না মানিলে কি আপনাদের অপমান বোধ হয়?” “মড়ার মুণ্ড উত্তর করিল, রাগ হইবে না তো কি, সর্বশরীর শীতল হইবে? ভুত না মানিলে, ভূতদিগের অপমান হয় না তো কি আর মর্যাদা বাড়ে? কেন লোকে বলিবে যে, পৃথিবীতে ভূত নাই? ইংরেজী-পড়া বাবুদের আমরা কি করিয়াছি যে, তাহারা আমাদিগকে পৃথিবী হইতে একেবারে উড়াইয়া দিবে? দেবতাদিগকে তোমরা উড়াইয়া দিয়াছ, এখন এই উপদেবতা কয়টাকে শেষ করিতে পারিলেই হয়। বটে!

“দুঃখের সময়ও হাসি পায়, দেবতাদিগকে না মানিলে, না পূজা দিলে, দেবতাদিগের রাগ হয়, দেবতারা মুখ হাঁড়ি করিয়া বসিয়া থাকেন, একথা পূর্বে জানিতাম; কিন্তু লোকে ভূত না মানিলে, ভূতের রাগ হয়, ভূতের অপমান হয় এ কথা কখনও শুনি নাই। আমার তাই হাসি পাইল। “আমি বলিলাম, হাঁ মহাশয়, ইংরেজী-পড়া বাবুদের এটি অন্যায় বটে!

“আমার কথায় মড়ার মাথা কিছু সন্তুষ্ট হইল, অনেকটা তাহার রাগ পড়িল। মুণ্ড বলিল, তুমি ছোকরা দেখিতেছি ভাল। ইংরেজী-পড়া বাবুদের মত ত্রিপণ্ড নাস্তিক নও! তোমার মাথায় টিকি আছে?”

“আমি বলিলাম, না মহাশয়, আমার মাথায় টিকি নাই।”

“মুণ্ড বলিল, এইবার ঘরে গিয়া টিকি রাখিও। আর শুন, ইংরেজী-পড়া বাবুদের আমরা সহজে ছাড়িব না। যাহাতে পুনরায় ভূতের উপর তাহাদিগের বিশ্বাস জন্মে, আমরা সে সমুদয় আয়োজন করিয়াছি। আমরা তাহাদিগকে ভজাইব। যেখানে সেখানে গিয়া বক্তৃতা করিব পুস্তক ছাপাইব, সংবাদপত্র বাহির করিব। এই সকল কার্যের নিমিত্ত আমরা একটি কোম্পানি খুলিয়াছি। কোম্পানির নাম রাখিয়াছি, ―স্কল স্কেলিটন অ্যান্ড কোং।”

“কঙ্কাবতী, তোমার বোধ হয় মনে থাকিতে পারে যে, ‘স্কল’ মানে মনুষ্যের মাথার খুলি, ‘স্কেলিটন’ মানে কঙ্কাল, অর্থাৎ অস্থি-নির্মিত মনুষ্য শরীরের কাঠামো। মুণ্ড যাহা বলিল, তাহার অর্থ এই যে, ইংরেজী-পড়া লোকেরা যাহাতে ভূতের অস্তিত্ব স্বীকার করেন, তাঁহাদের মনে যাহাতে ভূতের উপর বিশ্বাস হয়, ভূতের প্রতি ভক্তি হয়, এইরূপ শিক্ষা দিবার নিমিত্ত খুলি, কঙ্কাল প্রভৃতি ভূতগণ দলবদ্ধ হইয়াছেন।”“স্কল অর্থাৎ সেই মড়ার মাথাটি আমাকে পুনরায় বলিলেন, আমরা কোম্পানী খুলিয়াছি। কোম্পানির নাম রাখিয়াছি, ‘স্কল স্কেলিটন অ্যাণ্ড কোং।’ ইংরেজী নাম রাখিয়াছি কেন, তাহা জান? তাহা হইলে পসার বাড়িবে, মান হইবে, লোকের মনে বিশ্বাস জন্মিবে। যদি নাম রাখিতাম, ‘খুলি কঙ্কাল কোম্পানি’ তাহা হইলে কেহই আমাদিগকে বিশ্বাস করিত না। সকলে মনে করিত ইহারা জুয়াচোর। দেখিতে পাও না যে যখন মুখোপাধ্যায়, বন্দ্যোপাধ্যায় ও চট্টোপাধ্যায় জুতা কি শরাব কি হ্যাম বা শূকরের মাংসের দোকান করেন, তখন সে দোকানের নাম দেন, লংম্যান অ্যাণ্ড কোং, অথবা গুডম্যান অ্যাণ্ড কোং। দেখিয়া শুনিয়া শতসহস্র বার ঠকিয়া দেশী লোককে আর কেহ বিশ্বাস করে না। বরং ইংদ্রুজ পিংদ্রুজ দোকানীর কথা লোকে বিশ্বাস করে। তবু দেশী দোকানীর কথা লোকে বিশ্বাস করে না। আবার দেখ বেদের কথা বল, শাস্ত্রের কথা বল, বিলাতী সাহেবেরা যদি ভাল বলেন, তবেই বেদ পুরাণ ভাল হয়। দেশী পন্ডিতদের কথা কেহ গ্রাহ্যও করে না। এই সকল ভাবিয়া চিন্তিয়া আমাদের কোম্পানির নাম দিয়াছি, ‘স্কল স্কেলিটন অ্যাণ্ড কোং’। ‘স্কেলিটন’ ভায়া ওইখানে দাঁড়াইয়া আছেন। এস তো স্কেলিটন ভায়া, একটু এদিকে এস তো! “হাড় ঝম ঝম্ করিতে করিতে স্কেলিটন আমার নিকটে আসিলেন। সর্বশরীরের অস্থিকে স্কেলিটন বলে, কিন্তু এক্ষণে আমার সম্মুখে যিনি আসিয়া উপস্থিত হইলেন, তিনি দেখিলাম মুন্ডহীন স্কেলিটন।

“তখন স্কল আমাকে পুনরায় বলিলেন, কেমন, ভূতের উপর এখন তোমার সম্পূর্ণরূপ বিশ্বাস হইয়াছে তো?”

“আমি উত্তর করিলাম, পূর্ব হইতেই আমার বিশ্বাস আছে। কারণ, ভূতের ষড়যন্ত্রেই আমি এত দিন ধরিয়া ক্লেশ ভোগ করিতেছি; কিন্তু সে অন্য প্রকার ভূত। এখন হইতে আপনাদিগের মত ভূতকে মানিয়া লইলাম। প্রত্যক্ষ চক্ষের উপর দেখিয়া আর কি করিয়া না মানি? তার জন্য আর আপনারা কোনও চিন্তা করিবেন না। যান এক্ষণে ঘরে যান। রাত্রি অধিক হইয়াছে। আপনাদিগের ঘরের লোক ভাবিবে। আর আমাকে একটু নিদ্রা যাইতে হইবে। কারণ, কাল প্রাতঃকালে আবার আমাকে পথ চলিতে হইবে। “স্কল তখন স্কেলিটনকে বলিলেন, দেখিলে স্কেলিটন ভায়া! কোম্পানি খুলিলে কত উপকার হয়। ইংরেজী পড়িয়া এই বাবুটির মতি-গতি একেবারে বিকৃত হইয়া গিয়াছিল। দু-কথাতেই পুনরায় ইহাকে স্বধর্মে আনয়ন করিলাম। এক্ষণে চল অন্যান্য বিকৃতমতি বাবুদিগকে অন্বেষণ করি। ভূতবর্গের প্রতি যাহাতে তাঁহাদের শ্রদ্ধা-ভক্তি হয়, চল সেইরূপ উপায় করি।”

“স্কেলিটন হাড় ঝম্ ঝম্ করিলেন। আমি একটু কান পাতিয়া শুনিলাম যে সে কেবল হাড় ঝমঝম নয়। তাঁহার মুণ্ড নাই, সুতরাং মুখ দিয়া কথা কহিবার তাঁহার উপায় নাই। সে জন্য গায়ের হাড় নাড়িয়া হাড় ঝমঝম্ করিয়া তিনি কথা-বার্তা কহিয়া থাকেন। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, সে কথা আমি অনায়াসে বুঝিতে পারিলাম।” “স্কেলিটন বলিলেন, যদি ইনি ভূতভক্ত হইলেন তবে ইঁহাকে পুরস্কার দেওয়া উচিত। লোককে ভক্ত করিতে হইলে অর্থ দান একটি তাহার প্রধান উপায়। অর্থ পাইলে লোকে অতি ধর্মমান্, অতি ভক্তিমান্ মহাপুরুষ হয়। অতত্রব তুমি ইঁহাকে ধন দান কর। যখন দেশে গিয়া ইনি গল্প করিবেন তখন শত শত লোক অর্থলোভে ভুতভক্ত হইবে।”

“আমি বলিলাম―সম্প্রতি আমার অর্থের নিতান্ত প্রয়োজন আছে বটে, কিন্তু আমি অর্থলোভী নই। ধন দিয়া আমাকে ভূতভক্ত করিতে হইবে না। আপনাদের অর্থ আমি লইব না।”

“এই কথা শুনিয়া স্কল আরও প্রসন্ন মূর্তি ধারণ করিলেন। তিনি বলিলেন, এস, আমাদের সঙ্গে এস। আমাদের সঞ্চিত ধন তোমাকে দিলে ধনের সফলতা হইবে, ধন সুপাত্রে অর্পিত হইবে, সে ধন দ্বারা মঙ্গল সাধিত হইবে, সেই জন্য তোমাকে আমাদের সঞ্চিত ধন দিব। জীবিত থাকিতে আমরা ধনের সদ্ব্যবহার করি নাই। এক্ষণে তোমা কর্তৃক সে ধনের সদ্ব্যবহার হইলে আমাদের উপকার হইবে। “স্কেলিটনও আমাকে সেইরূপ অনেক অনুরোধ করিলেন। দুই ভূতের অনুরোধে আমি তাঁহাদিগের সাঙ্গ চলিলাম। স্কেলিটন হাঁটিয়া চলিলেন, আর স্কল স্থানবিশেষে লাফাইয়া বা গড়াইয়া যাইতে লাগিলেন। অল্পক্ষণ পরে এই পর্বতের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলাম। পর্বতের একস্থানে আসিয়া, স্কল বলিলেন, এইখানকার বন আমাদিগকে একটু পরিষ্কার করিতে হইবে। আজ সহস্র বৎসর ধরিয়া এখানে জনমানব পদার্পণ করে নাই,। আমরা তিনজনে অনেকক্ষণ ধরিয়া সেই বন পরিষ্কার করিতে লাগিলাম। পরিষ্কৃত হইলে পর্বতগাত্রে গাঁথুনির ঈষৎ একটু রেখা বাহির হইয়া পড়িল। স্কল, স্কেলিটন ও আমি অতিকষ্টে সেই গাঁথুনির পাথরগুলি ক্রমে খুলিয়া ফেলিলাম। গাঁথুনি খুলিতেই আমাদের এই অট্টালিকার সুড়ঙ্গ-পথটি বাহির হইয়া পড়িল। সুড়ঙ্গ-দ্বারে ভয়ঙ্করী নাকেশ্বরীকে দেখিলাম। নাকেশ্বরী খল খল করিয়া হাসিল, কিন্তু যেই স্কল চক্ষুকোটর বিস্তৃত করিয়া তাহার দিকে কোপ-কটাক্ষ করিলেন, আর সে চুপ করিল। সুড়ঙ্গের পথ দিয়া আমরা এই অট্টালিকার ভিতর প্রবেশ করিলাম। এই বিপুল ধনরাশি দেখিয়া আমি চমৎকৃত হইলাম। “স্কল বলিলেন, সহস্র বৎসর পূর্বে এই অঞ্চলের আমরা রাজা ছিলাম। জীবিত থাকিতে ধর্ম-কর্ম কিছুই করি নাই, কেবল যুদ্ধ ও ধনসঞ্চয় করিয়া জীবন অতিবাহিত করিয়াছিলাম। আমাদের সন্তান-সন্ততি ছিল না। সেজন্য কিন্তু আমরা দুঃখিত ছিলাম না, বরং আনন্দিত ছিলাম। যেহেতু সন্তান-সন্ততি দ্বারা ধনের ব্যয় হইবার সম্ভাবনা। টাকা গণিয়া, নাড়িয়া চাড়িয়া, আমরা স্বর্গ-সুখ উপভোগ করিতাম। আমাদের অবর্তমানে পাছে কেহ এই ধন লয়, সেজন্য আমরা ইহার উপর ‘যক্’ দিলাম, অর্থাৎ ইহার উপর এক ভূতিনীকে প্রহরিণী-স্বরূপ নিযুক্ত করিলাম। যথাবিধি যাগ-যজ্ঞাদি ক্রিয়া করিয়া নবমবর্ষীয়া সুলক্ষণা একটি বালিকাকে উৎসর্গ করিয়া, তাহাকে বলিয়া দিলাম যে এক সহস্র বৎসর পর্যন্ত তুমি এই ধনের প্রহরিণী স্বরূপ নিযুক্ত থাকিবে। এক সহস্র বৎসরের মধ্যে যদি কেহ এই ধনের এক কণামাত্রও লয়, তাহা হইলে তৎক্ষণাৎ তুমি তাহার প্রাণবধ করিবে। এক সহস্র বৎসর পরে তুমি যেখানে ইচ্ছা সেইখানে যাইও, তখন যাহার অদৃষ্টে থাকিবে, সে এই ধনের অধিকারী হইবে। বালিকাকে এইরূপ আদেশ করিয়া, অট্টালিকার ভিতর একটি প্রদীপ জ্বালিয়া, আমরা সুড়ঙ্গের দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিলাম। প্রদীপটি যেই নির্বাণ হইল, আর বালিকার মৃত্যু হইল; মরিয়া সে ভীষণাকৃতি অতি-দীর্ঘ-নাসিকা-ধারিণী ভূতিনী হইল। ভূতসমাজে সে জন্য সে নাকেশ্বরী নামে পরিচিত। দ্বারে যে এই প্রহরিণীস্বরূপ রহিয়াছে, সে সেই বিকৃত-আকৃতি ভূতিনী, যাহার বিকট হাসি তুমি এই মাত্র শুনিলে। “কিছুদিন পরে যুদ্ধে আমরা হত হই। শক্রর তরবারির আঘাতে দেহ হইতে মুণ্ড বিচ্ছিন্ন হইয়া যায়। জীবিত থাকিতে ছিলাম একজন মনুষ্য; মরিয়া হইলাম দুইজন ভূত। মুণ্ডটি হইলাম আমি স্কল, আর ধড়টি হইলেন ইনি স্কেলিটন ভায়া। ৯৯৯ বৎসর পূর্বে আমরা এই ধনের উপর যক্ দিয়াছি। আর এক বৎসর গত হইলেই সহস্র বৎসর পূর্ণ হয়। তখন নাকেশ্বরী এ ধন ছাড়িয়া দিবে। গত পৌষ মাসে নাকেশ্বরীর সহিত ঘ্যাঁঘোঁ নামক ভূতের শুভবিবাহ হইয়াছে। নাকেশ্বরী আপনার শ্বশুরালয়ে চলিয়া যাইবে। তখন এ ধন লইলে আর তোমার কোনও বিপদ ঘটিবে না। কিন্তু এই এক বৎসরের ভিতর কোনও মতে এ ধনের কণামাত্র স্পর্শ করিবে না, করিলেই অবিলম্বে নাকেশ্বরী তোমাকে খাইয়া ফেলিবে, অবিলম্বে তোমার মৃত্যু ঘটিবে। এই ধনসম্পত্তির প্রকৃত স্বামী আমরা দুইজন। এই ধন আমরা তোমাকে প্রদান করিলাম। কিন্তু সাবধান, এই এক বৎসরের ভিতর এ ধন স্পর্শ করিবে না।“আমি উত্তর করিলাম, মহাশয় আপনাদের কৃপায় আমি অতিশয় অনুগৃহীত হইলাম। যদি আমাকে এ সম্পত্তি দিলেন, তবে এরূপ কোনও একটা উপায় করুন, যাহাতে এ ধন হইতে এখন আমি কিছু লইতে পারি। সম্প্রতি আমার অর্থের নিতান্ত প্রয়োজন। এখন যদি পাই তবে আমার। বিশেষ উপকার হয়, এমন কি আমার প্রাণ রক্ষা হয়। এখন না পাইলে, এক বৎসর পরে জীবিত থাকি কিনা তাহাই সন্দেহ।

“এই কথা শুনিয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া স্কল ও স্কেলিটন পরামর্শ করিতে লাগিলেন। তাঁহারা কি বলাবলি করিলেন আমি তাহা বুঝিতে পারিলাম না।”

“স্কল বলিলেন এস আমাদের সঙ্গে পুনরায় বাহিরে এস। সকলে পুনরায় গেলাম, বনের ভিতর পুনরায় আমরা ভ্রমণ করিতে লাগিলাম। স্কল বন খুঁজিতে লাগিলেন। অবশেষে সামান্য একটি ওষধির গাছ দেখাইয়া তিনি আমাকে বলিলেন, এই গাছটির তুমি মূল উত্তোলন কর। আমি সেই গাছটির শিকড় তুলিলাম। স্কলের আদেশে অপর একটি গাছের আঠা দিয়া শিকড়টি আমার চুলের সহিত জুড়িয়া দিলাম। তাহার পর সকলে পুনরায় আবার এই অট্টালিকায় ফিরিয়া আসিলাম।“এইখানে উপস্থিত হইয়া স্কল বলিলেন, যে সকল কথা তোমাকে আমি এখন বলি, অতি মনোযোগের সহিত শুন। আপাততঃ যথা প্রয়োজন টাকা লইয়া তুমি তোমার কার্য সমাধা করিবে। যে শিকড় তোমাকে আমরা দিলাম, তাহার গুণ এই যে, ইহা মাথায় থাকিলে যতক্ষণ তুমি অট্টালিকার ভিতর থাকিবে ততক্ষণ নাকেশ্বরী তোমার প্রাণ বধ করিতে পারিবে না। অট্টালিকার বাহিরে শিকড় তোমাকে রক্ষা করিতে পারিবে না। শিকড়ের কিন্তু আর একটি গুণ এই যে, ইহা মাথায় থাকিলে যে জন্তুর আকার ধরিতে ইচ্ছা করিবে তৎক্ষণাৎ সেই জন্তু হইতে পারিবে। ব্যাঘ্র হইতেছেন নাকেশ্বরীর ইষ্ট দেবতা। সেজন্য যখন তুমি অট্টালিকার বাহিরে যাইবে তখন ব্যাঘ্ররূপ ধরিয়া যাইবে। তাহা হইলে নাকেশ্বরী তোমাকে কিছু বলিতে পারিবে না। তাহার পর অট্টালিকার ভিতর প্রত্যাগমন করিয়া, ইচ্ছা করিলেই মনুষ্যের মূর্তি ধরিতে পারিবে। অতএব দুইটি কথা স্মরণ রাখিও, কোনও মতেই ভুলিবে না। প্রথম এ এক বৎসর শিকড়টি যেন কিছুতেই তোমার মাথা হইতে না যায়, গেলেই মৃত্যু। তুমি যেখানে থাক না কেন সেইখানেই মৃত্যু। দ্বিতীয় ব্যাঘ্ররূপ না ধরিয়া বাহিরে যাইবে না, এক মুহুর্তকালের নিমিত্তও নিজরূপে বাহিরে থাকিবে না, থাকিলেই মৃত্যু, সেই দণ্ডেই মৃত্যু। এক বৎসর পরে শিকড়টি দগ্ধ করিয়া সমুদয় ধনসম্পত্তি লইয়া দেশে চলিয়া যাইবে। এ এক বৎসরের ভিতর যদি তুমি ধন না লইতে তাহা হইলে এ সব কিছুই করিতে হইত না। কারণ নাকেশ্বরী-রক্ষিত ধন না লইলে নাকেশ্বরী কাহাকেও কিছু বলে না, বলিতেও পারে না। যাহা হউক, এক বৎসর পরে ধন ছাড়িয়া নাকেশ্বরী আপনার শ্বশুরালয়ে চলিয়া যাইবে। ঘ্যাঁঘোঁ ভুতের সহিত যখন তাহার বিবাহের কথা হয়, তখন লোকে কত না ভাঙচি দিয়াছিল! “আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ভাঙচি কেন দিয়াছিল, মহাশয়?

“স্কল বলিলেন, তুমি জান না, তাই পাগলের মত কথা জিজ্ঞাসা কর। বিবাহে ভাঙচি দিলে যেমন আমোদটি হয়, এমন আমোদ আর কিছুতে হয় না। তুমি একটি পাত্র কি পাত্রী স্থির করিয়া বন্ধুবান্ধব আত্মীয়-স্বজনের মত জিজ্ঞাসা কর। তাঁরা বলিবেন, দিবে দাও, কিন্তু-। ওই যে কিন্তু কথাটি, উহার ভিতর এক জাহাজ মানে থাকে। যাহা হউক, যাহা বলি আর যাহা কই ঘ্যাঁঘোঁর বিবাহে অতি চমৎকার ভাঙচি দিয়াছিল। প্রশংসা করিতে হয়।

“আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ভাঙচি আবার চমৎকার কি মহাশয়?“ স্কল উত্তর করিলেন, সাত কাণ্ড ―সেই যাহা আমাদের নাম করিতে নাই―তাহা পড়িয়া থাকিবে। কিন্তু ভূতের কাণ্ড তুমি কিছুই জান না। কি হইয়াছিল বলিতেছি শুন। ঘ্যাঁঘোঁর সহিত বিবাহের কথা উপস্থিত হইলে নাকেশ্বরীর মাসী পাত্র দেখিতে একটি ভূত পাঠাইয়া দিলেন। ঘ্যাঁঘোঁর বাটীতে সেই ভূত উপস্থিত হইলে ঘ্যাঁঘোঁ তাঁহার বিশেষ সমাদর করিলেন। আহারাদি প্রস্তুত হইলে তিনি নিকটস্থ একটি বিলের জলে স্নান করিতে গেলেন। সেইখানে প্রতিবেশী ভূতগণও পরামর্শ করিয়া স্নান করিতে গেলেন। তাঁহাদের মধ্যে এক জন আগন্তুক ভূতকে জিজ্ঞাসা করিলেন, মহাশয়ের নিবাস? আগন্তুক ভূত উত্তর করিলেন, আমার নিবাস একঠেঙো মুল্লুকের ও-ধারে, বউ-ভুলুনি নামক আঁব গাছে। ঘ্যাঁঘোঁর প্রতিবেশী ভূত পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, এখানে কি মনে করিয়া আগমন হইয়াছে? আগন্তুক ভূত উত্তর করিলেন, আমি ঘ্যাঁঘোঁকে দেখিতে আসিয়াছি। প্রতিবেশী ভূতগণ তখন জিজ্ঞাসা করিলেন, মহাশয়, তবে কি বৈদ্য? আগন্তুক ভূত বলিলেন, কেন? বৈদ্য কেন হইব? ঘ্যাঁঘোঁর কি কোনও পীড়া-শীড়া আছে না-কি? প্রতিবেশী ভূতগণ একটু যেন অপ্রতিভ হইয়া উত্তর করিলেন, না না। এমন কিছু নয়! তবে একটু একটু খুক খুক করিয়া কাশি আছে। তাহার সহিত অল্প অল্প আলকাতরার ছিট থাকে, আর বৈকাল বেলা যৎসামান্য ঘুষ-ঘুষে জ্বর হয়। তা সে কিছু নয়, গরমে হইয়াছে। নাইতে খাইতে ভাল হইয়া যাইবে। এই কথা শুনিয়া আগন্তুক ভূতের তো চক্ষু স্থির। আর তিনি ঘ্যাঁঘোঁর কাছে ফিরিয়া গেলেন না। সেই বিল হইতে একবারে একঠেঙো মুল্লুকের ও-ধারে গিয়া উপস্থিত হইলেন। নাকেশ্বরীর মাসীকে সকল কথা বলিলেন। সম্বন্ধ ভাঙিয়া গেল। নাকেশ্বরী একটি সুন্দরী ভূতিনী। তাহার রূপে ঘ্যাঁঘোঁ একেবারে মুগ্ধ হইয়াছিল। কত দিন ধরিয়া পাগলের মত সে গাছে গাছে কাঁদিয়া বেড়াইয়াছিল। তারপর মৌনব্রত অবলম্বন করিয়া অন্ধকূপের ভিতর বসিয়া ছিল। যাহা হউক, অবশেষে বিবাহ যে হইয়া গিয়াছে তাহাই সুখের কথা।“ আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, শ্লেশ্মার সহিত আলকাতরা কি?

“স্কল বলিলেন, তোমাদের যেরূপ রক্ত, আমাদের সেইরূপ আলকাতরা। কাশ-রোগে আমাদের বক্ষঃস্থল হইতে আলকাতরা বাহির হয়।

“আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, যদি আমাদের মত ভূতদিগের রোগ হয় তাহা হইলে ভূতেরাও তো মরিয়া যায়? আচ্ছা মানুষ মরিয়া তো ভূত হয়, ভূত মরিয়া কি হয়?

“স্কল উত্তর করিলেন, কেন? ভূত মরিয়া মারবেল হয়। সেই যে ছোট ছোট গোল গোল ভাঁটার মত মারবেল, যাহা লইয়া ছেলেরা সব খেলা করে।“আমি বলিলাম, মারবেল হয়! পৃথিবীতে এত বস্তু থাকিতে মারবেল হয় কেন?

“স্কল আমার এই কথায় কিছু রাগত হইয়া বলিলেন, ভুল হইয়াছে। তোমার সহিত পরামর্শ করিয়া তাহার পর আমাদের মরা উচিত। এখন হইতে না হয় তাই করা যাইবে।

“আমি বলিলাম, মহাশয়, আমার অপরাধ ক্ষমা করুন। আমি জানি না তাই জিজ্ঞাসা করিতেছি। যদি অনুমতি করেন তো আর একটি কথা জিজ্ঞাসা করি, ভূত মরিয়া যদি মারবেল হয়, তাহা হইলে মারবেল লইয়া খেলা করা তো বড় বিপদের কথা?

“স্কল উত্তর করিলেন, মরা ভূত লইয়া খেলা করিতে আবার দোষ কি? হাঁ, জিয়ন্ত ভূত হইত, তাহা হইলে তাহার সহিত খেলা করা বিপদের কথা বটে।“ স্কল পুনরায় বলিলেন, তোমার সহিত আর আমাদের মিছামিছি বকিবার সময় নাই। আমরা কোম্পানি খুলিয়াছি, এখন গিয়া কোম্পানির কাজ করি। আমরা স্কল, ‘স্কেলিটন অ্যাণ্ড কোম্পানি’। আমরা কম ভূত নই। যে সব কথা বলিয়া দিয়াছি সাবধানে মনে করিয়া রাখিবে। তাহা না হইলে বিপদে পড়িবে। এখন আমরা চলিলাম। আর তোমার সহিত আমাদের সাক্ষাৎ হইবে না।

“এই বলিয়া স্কল ও স্কেলিটন সেখান হইতে প্রস্থান করিলেন। অট্টালিকার ভিতর আমি একেলা বসিয়া রহিলাম। তাহার পর কি করিলাম তাহা তুমি জান, বলিবার আর আবশ্যক নাই। কঙ্কাবতী, কথা এই। এখন সকল কথা তোমাকে বলিলাম।”

কঙ্কাবতী বলিল, “তবে আমিও যাই, গিয়া নাকেশ্বরীর টাকা লই, তাহা হইলে আমাদের দুই জনকে সে এক সঙ্গে মারিয়া ফেলিবে। পতিপরায়ণা সতীর ইহার চেয়ে আর সৌভাগ্য কি?” এই কথা বলিয়া কঙ্কাবতী উঠিবার উপক্রম করিতেছে, এমন সময়ে এক অতি ভয়াবহ চীৎকারে সে স্থান পরিপূরিত হইল। অট্টালিকা কাঁপিতে লাগিল। দ্বার গবাক্ষ পরস্পরে আঘাতিত হইয়া ঝনঝন্ করিয়া শব্দ হইতে লাগিল। অট্টালিকা ঘোর অন্ধকারে আচ্ছাদিত হইল। প্রজ্বলিত বাতিটি নির্বাণ হইল না বটে, কিন্তু অন্ধকারে আবৃত হইয়া গেল।

খেতু বলিল, “কঙ্কাবতী, ওই নাকেশ্বরী আসিতেছে।”

কঙ্কাবতী এতক্ষণ শয্যার ধারে বসিয়াছিল। এখন তাড়াতাড়ি উঠিয়া দ্বারটি উত্তমরূপে বন্ধ করিয়া দিল, আর দ্বারের উপর সমুদয় শরীরের বলের সহিত ঠেস দিয়া দাঁড়াইল। নাকেশ্বরীকে সে ভিতরে আসিতে দিবে না। অতি দুর্গন্ধে, নিবিড় অন্ধকারে, ঘন ঘন ঘোর গভীর শব্দে ঘর পরিপূরিত হইল।

ক্রমে শব্দ থামিল, অন্ধকার দূর হইল, বাতির আলোকে পুনরায় ঘর আলোকিত হইল।

তখন কঙ্কাবতী দেখিতে পাইল যে মৃতপ্রায় অচেতন হইয়া চক্ষু মুদ্রিত করিয়া খেতু বিছানায় পড়িয়া আছে। ভীমরূপা নাকেশ্বরী পার্শ্বে দণ্ডায়মানা। কঙ্কাবতী দৌড়িয়া গিয়া নাকেশ্বরীর পায়ে পড়িল।

কঙ্কাবতী বলিল, “ওগো! তুমি আমার স্বামী-কে মারিও না। ওগো আমি বড় দুঃখিনী, আমি কাঙালিনী কঙ্কাবতী। কত দুঃখ পাইয়া আমি এই প্রাণসম পতিকে পাইয়াছি। পৃথিবীতে এই পতি ভিন্ন আর আমার কেহ নাই। ওগো, আমার স্বামীকে না মারিয়া তুমি আমার প্রাণবধ কর। তোমার পায়ে পড়ি, তুমি আমার স্বামীকে মারিও না। আমরা তোমার এ ধন চাহি না, কিছু চাহি না। আমার পতিকে তুমি দাও, আমার পতিকে লইয়া আমি ঘরে যাই। নাকেশ্বরীর পা ধরিয়া কঙ্কাবতী এইরূপে কাঁদিতে লাগিল, নানা মতে কাকুতি মিনতি করিতে লাগিল। নাকেশ্বরীর মনে কিন্তু কিছুমাত্র দয়া হইল না। নাকেশ্বরী সে কথায় কর্ণপাতও করিল না। কঙ্কাবতী যত কাঁদেন আর নাকেশ্বরী বাম হস্ত উত্তোলন করিয়া কেবল বলে, “দুর! দুর!”

কঙ্কাবতী বলিল, “ওগো, আমার স্বামীকে ছাড়িয়া আমি এখান হইতে দূর হইব না। আমার স্বামীকে দাও, আমি এখান হইতে এখনই দূর হইতেছি। স্বামী, স্বামী, উঠ। চল আমরা এখান হইতে যাই। স্বামী, উঠ।

কঙ্কাবতী যত কাঁদে, যত বলে, হাত উত্তোলন করিয়া নাকেশ্বরী তত বলে, “দূর! দূর!”কঙ্কাবতী উঠিয়া দাঁড়াইল। চক্ষু মুছিল। তাহার পর আরক্ত নয়নে দর্পের সহিত নাকেশ্বরীকে বলিল, “আমার স্বামীকে দিবে না? আমাকেও খাইবে না? কেবল ‘দূর! দূর’! মুখে অন্য কথা নাই! বটে! তা নাকেশ্বরী হও, আর যাই হও, আজ তোমার একদিন, কি আমারই একদিন!”

এই কথা বলিয়া পাগলিনী উন্মাদিনীর ন্যায় কঙ্কাবতী নাকেশ্বরীকে ধরিতে গেল। কোনও উত্তর না করিয়া নাকেশ্বরী কেবলমাত্র একটি নিঃশ্বাস পরিত্যাগ করিল। সেই নিঃশ্বাসের প্রবল বেগে কঙ্কাবতী একেবারে দ্বারের নিকট গিয়া পড়িল।

কঙ্কাবতী পুনরায় উঠল, পুনরায় উঠিয়া নাকেশ্বরীকে ধরিতে দৌড়িল। নাকেশ্বরী আর একটি নিঃশ্বাস ত্যাগ করিল, আর কঙ্কাবতী একেবারে অট্টালিকার বাহিরে গিয়া পড়িল। তখন কঙ্কাবতী আস্তে-ব্যস্তে পুনরায় উঠিয়া নাকেশ্বরীকে বলিল, “ওগো! তোমাকে আমি আর ধরিতে যাইব না, তোমাকে আমি মারিব না। আমি আমার স্বামীকে আর ফিরিয়া চাই না। এখন কেবল এই চাই যে, স্বামী হইতে তুমি আমাকে পৃথক করিও না। স্বামীর পদযুগল ধরিয়া আমাকে মরিতে দাও। যদি মারিবে তো আমাদের দুইজনকেই একসঙ্গে মার, যদি খাইবে তো আমাদের দুইজনকেই একসঙ্গে খাও। আর তোমার কাছে আমি কিছু চাই না। তোমার নিকট এখন কেবল এই প্রার্থনাটি করি। ইহা হইতে তুমি আমাকে বঞ্চিত করিও না।”

এই বলিয়া কঙ্কাবতী পুনরায় ঘরের দিকে দৌড়িল। কোনও কথা না বলিয়া নাকেশ্বরী আর একটি নিঃশ্বাস ছাড়িল আর কঙ্কাবতী একেবারে পর্বতের বাহিরে বনের মাঝখানে গিয়া পড়িল।

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

ব্যাঙ-সাহেব

বনের মাঝে কঙ্কাবতী একেবারে নির্জীব হইয়া পড়িল। বার বার উঠিয়া পড়িয়া শরীর তাহার ক্ষতবিক্ষত হইয়া গিয়াছিল। শরীরের নানা স্থান হইতে শোণিত-ধারা বহিতেছিল। কঙ্কাবতীর এখন আর উঠিবার শক্তি নাই। উঠিয়াই বা কি করিবে? স্বামীর নিকট যাইতে গেলেই নাকেশ্বরী আবার তাহাকে নিঃশ্বাসের দ্বারা দুরীকৃত করিবে। বনের মাঝে পড়িয়া কঙ্কাবতী অবিরাম কাঁদিতে লাগিল। স্বামীর পদপ্রান্তে পড়িয়া সে যে প্রাণ পরিত্যাগ করিতে পাইল না, এখন কেবল এই দুঃখ তাঁহার মনে অত্যন্ত প্রবল হইল। কাঁদিয়া কাঁদিয়া শরীর তাহার অবসন্ন হইয়া পড়িল। তখন সে মনে মনে স্থির করিল, “আচ্ছা, তাই ভাল, স্বামী ভিতরে থাকুন, আমি এই বাহিরে পড়িয়া থাকি। তাঁহার পদ-যুগল ধ্যান করিতে করিতে এই বাহিরেই আমি প্রাণ পরিত্যাগ করিব। করুণাময় জগদীশ্বর আমার প্রতি কৃপা করিবেন। মরিয়া আমি তাঁহাকে পাইব।”এইরূপ চিন্তা করিয়া কঙ্কাবতী স্বামীর পা দুইটি মনে মনে প্রত্যক্ষ দেখিতে লাগিল, উজ্জ্বল শুভ্রবর্ণ অল্প-আয়তন, চম্পককলিসদৃশ-অঙ্গুলি-বিশিষ্ট সেই পা দুইখানি মনে মনে ধ্যান করিতে লাগিল।

একাবিষ্ট চিত্তে এইরূপ ধ্যান করিতেছে এমন সময় কঙ্কাবতীর মনে একটি নূতন ভাবের উদয় হইল। সে ভাবিল, “ভাল। ভূতিনী, প্রেতিনী ডাকিনীতে মনুষ্যের মন্দ করিলে তাহার তো উপায় আছে। পৃথিবীতে অনেক গুণী মনুষ্য আছেন, তাঁহারা মন্ত্র জানেন, তাঁহারা তো ইহার চিকিৎসা করিতে পারেন। কেন বা আমার স্বামীকে তাঁহারা রক্ষা করিতে না পারিবেন? আর যদি একান্তই আমার স্বামীর প্রাণরক্ষা না হয়, তাঁহার মৃতদেহ তো আমি পাইব। তাই লইয়া পড়িয়া মরিতে পারিলেও আমি কথঞ্চিৎ শান্তিলাভ করিব। যাহা হউক আমি আমার স্বামীকে নাকেশ্বরীর হাত হইতে রক্ষা করিতে যত্ন করিব নিশ্চিন্ত হইয়া থাকিব না। হই না কেন স্ত্রীলোক? আমি কি মানুষ নই? পতির হিতকামনায়, আমি সমুদয় জগৎকে তৃণ জ্ঞান করি, কাহাকেও আমি ভয় করি না।”মনে মনে এইরূপ কল্পনা করিয়া কঙ্কাবতী চক্ষু মুছিল, উঠিয়া বসিল। এখন লোকালয়ে যাইতে হইবে, এই উদ্দেশ্যে উঠিয়া দাঁড়াইল।

কিন্তু লোকালয় কোন্ দিকে তাহা তো সে জানে না। উত্তরমুখে যাইতে খেতু বলিয়াছিল, কিন্তু উত্তর কোন্ দিক? বিস্তীর্ণ তমোময় সেই বনকান্তারে দিক্ নির্ণয় করা তো সহজ কথা নহে। রাত্রি এখনও প্রভাত হয় নাই সূর্য এখনও উদয় হন নাই। তবে কোনদিক উত্তর কোন্ দিক দক্ষিণ, কিরূপে সে জানিবে?

তাই সে ভাবিল যে দিকে হয় যাই। একটা না একটা গ্রামে গিয়া উপস্থিত হইব। লোকালয়ে গিয়া সুচিকিৎসকের অনুসন্ধান করিব। কালবিলম্ব করা উচিত নয়। কালবিলম্ব করিলে আমার আশা হয় তো ফলবতী হইবে না।বন-জঙ্গল, গিরি-গুহা অতিক্রম করিয়া উন্মাদিনীর ন্যায় কঙ্কাবতী চলিল। কতটা পথ গেল, কত দূর চলিয়া গেল, কিন্তু গ্রাম দেখিতে পাইল না। রাত্রি প্রভাত হইল, সূর্য উদয় হইলেন, দিন বাড়িতে লাগিল, তবুও জন-মানবের সহিত তাহার সাক্ষাৎ হইল না।

কি করি, কোনদিকে যাই, কাহাকে জিজ্ঞাসা করি, কঙ্কাবতী এইরূপ চিন্তা করিতেছে, এমন সময় সম্মুখে একটি ব্যাঙ দেখিতে পাইল। ব্যাঙের অপূর্ব মূর্তি। সেই অপূর্ব মূর্তি দেখিয়া কঙ্কাবতী বিস্মিত হইলেন। ব্যাঙের মাথায় হ্যাট, গায়ে কোট, কোমরে পেন্টুলেন, ব্যাঙ সাহেবের পোশাক পরিয়াছেন। ব্যাঙকে আর চেনা যায় না। রঙটি কেবল ব্যাঙের মত আছে, সাবাং মাখিয়াও রঙটি সাহেবের মত হয় নাই। আর পায়ে জুতা নাই। জুতা এখনও কেনা হয় নাই। ইহার পর তখন কিনিয়া পরিবেন। আপাতত: সাহেবের সাজ সাজিয়া দুই পকেটে দুই হাত রাখিয়া সদর্পে ব্যাঙ চলিয়া যাইতেছেন। এই অপূর্ব মূর্তি দেখিয়া এই ঘোর দুঃখের সময়ও কঙ্কাবতীর একটু হাসি দেখা দিল। কঙ্কাবতী মনে করিল, ইহাকে আমি পথ জিজ্ঞাসা করি।

কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিল, “ব্যাঙ মহাশয়, গ্রাম কোনদিকে? কোনদিক দিয়া গেলে লোকালয়ে পৌঁছিব?”

ব্যাঙ উত্তর করিলেন, “হিট মিট ফ্যাট।”

কঙ্কাবতী বলিল, “ব্যাঙ মহাশয়, আপনি কি বলিলেন তাহা আমি বুঝিতে পারিলাম না। ভাল করিয়া বলুন। আমি জিজ্ঞাসা করিতেছি, কোনদিক দিয়া গেলে গ্রামে গিয়া উপস্থিত হতে পারা যায়?” ব্যাঙ বলিলেন, “হিশ, ফিশ, ড্যাম।”

কঙ্কাবতী বলিল, “ব্যাঙ মহাশয়, আমি দেখিতেছি, আপনি ইংরেজী কথা কহিতেছেন। আমি ইংরেজী পড়ি নাই। আপনি কি বলিতেছেন, তাহা আমি বুঝতে পারিতেছি না। অনুগ্রহ করিয়া যদি বাঙ্গালা করিয়া বলেন, তাহা হইলে আমি বুঝতে পারি।”

ব্যাঙ এদিক ওদিক চাহিয়া দেখিলেন। দেখিলেন যে কেহ কোথাও নাই। কারণ লোকে যদি শুনে যে তিনি বাঙ্গালা কথা কহিয়াছেন, তাহা হইলে তাঁহার জাতি যাইবে। সকলে তাঁহাকে ‘নেটিভ’ মনে করিবে। যখন দেখিলেন কেহ কোথাও নাই, তখন বাঙ্গালা কথা বলিতে তাঁহার সাহস হইল। কঙ্কাবতীর দিকে কোপদৃষ্টিতে চাহিয়া অতিশয় ক্রুদ্ধভাবে ব্যাঙ বলিলেন, “কোথাকার ছুঁড়ী রে তুই! আ গেল যা! দেখিতেছিস, আমি সাহেব। তবু বলে ব্যাঙ মশাই, ব্যাঙ মশাই! কেন? সাহেব বলিতে তোর কি হয়?

কঙ্কাবতী বলিল, “ব্যাঙ সাহেব! আমার অপরাধ হইয়াছে, আমাকে ক্ষমা করুন। এক্ষণে গ্রামে যাইব কোন দিক দিয়া অনুগ্রহ করিয়া আমাকে বলিয়া দিন।”

এই কথা শুনিয়া ব্যাঙ আরও জ্বলিয়া উঠিলেন, আরও ক্রোধাবিষ্ট হইয়া বলিলেন, “ম’লো যা! এ হতভাগা ছুঁড়ীর রকম দেখ! মানা করিলেও শুনে না। কথা গ্রাহ্য হয় না। কেবল বলিবে ব্যাঙ ব্যাঙ, ব্যাঙ! কেন? আমার নাম ধরিয়া ডাকিতে কি মুখে ব্যথা হয় না কি? আমার নাম মিস্টার গামিশ।”কঙ্কাবতী বলিল, “মহাশয়, আমার অপরাধ হইয়াছে। না জানিয়া অপরাধ করিয়াছি, আমাকে ক্ষমা করুন। এক্ষণে মিস্টার গামিশ, আমি লোকালয়ে যাইব কোন দিক দিয়া তাহা আমাকে বলিয়া দিন। আমার নাম কঙ্কাবতী। বড় বিপদে আমি পড়িয়াছি। প্রাণের পতিকে আমি হারাইয়াছি। পতির চিকিৎসার নিমিত্ত আমি গ্রাম অনুসন্ধান করিতেছি। রতি মাত্র বিলম্ব আর করিতে পারি না। এই হতভাগিনীর প্রতি দয়া করিয়া বলিয়া দিন কোন দিক দিয়া আমি গ্রামে যাই।”

কঙ্কাবতী তাঁহাকে সাহেব বলিল, কঙ্কাবতী তাঁহাকে মিস্টার গামিশ বলিয়া ডাকিল। সে জন্য ব্যাঙের শরীর শীতল হইল, রাগ একেবারে পড়িয়া গেল।

কঙ্কাবতীর প্রতি হৃষ্ট হইয়া ব্যাঙ জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমি সাহেব হইয়াছি কেন তা জান?”কঙ্কাবতী উত্তর করিল, “আজ্ঞা না, তা আমি জানি না। মহাশয়, গ্রামে কোন দিক্ দিয়া যাইতে হয়? গ্রাম এখান হইতে কত দূর?”

ব্যাঙ বলিলেন, “দেখ লঙ্কাবতী, তোমার নাম লঙ্কাবতী বলিলে বুঝি? দেখ লঙ্কাবতী, একদিন আমি এই বনের ভিতর বসিয়া ছিলাম। হাতী সেই পথ দিয়া আসিতেছিল। আমি মনে করিলাম, আমার মান মর্যাদা রাখিয়া আমাকে ভয় করিয়া হাতী অবশ্যই পাশ দিয়া যাইবে। একবার আস্পর্ধার কথা শুন দুষ্ট হাতী পাশ দিয়া না গিয়া আমাকে ডিঙাইয়া গেল। রাগে আমার সর্ব শরীর কাঁপিতে লাগিল। রাগ হইলে আমার আর জ্ঞান থাকে না। আমার ভয়ে তাই সবাই সদাই সশঙ্কিত। আমি ভাবিলাম হাতীকে একবার উত্তমরূপে শিক্ষা দিতে হইবে। তাই আমি হাতীকে বললাম―

‘উট-কপালী চিরুন-দাঁতী বড় যে ডিঙুলি মোরে?’ কেমন বেশ ভাল বলি নাই, লঙ্কাবতী?”

কঙ্কাবতী বলিল, “আমার নাম কঙ্কাবতী। লঙ্কাবতী নয়। আপনি উত্তম বলিয়াছেন। গ্রামে যাইবার পথ আপনি বলিয়া দিলেন না? তবে আমি যাই, আর আমি এখানে অপেক্ষা করিতে পারি না।”

ব্যাঙ বলিলেন, “শুন না, অত তাড়াতাড়ি কর কেন? দুষ্ট হাতীর একবার কথা শুন। আমি রাগিয়াছি দেখিয়া তাহার প্রাণে ভয় হইল না। হাতীটা উত্তর করিলঃ

‘থাক থাক থাক থ্যাবড়া নাকী, ধর্মে রেখেছে তোরে।’ হাঁ কঙ্কাবতী, আমার কি থ্যাবড়া নাক?”

কঙ্কাবতী ভাবিল যে এই নাক লইয়া কাঁকড়ার অভিমান হইয়াছিল, আবার দেখিতেছি এই ভেকটিরও সেই অভিমান।

কঙ্কাবতী বলিল, “না না, কে বলে আপনার থ্যাবড়া নাক? আপনার চমৎকার নাক! মহাশয়, এই দিক্ দিয়া কি গ্রামে যাইতে হয়?”

কিছুক্ষণের নিমিত্ত ব্যাঙ একটু চিন্তায় মগ্ন হইলেন। কঙ্কাবতী মনে করিল, ভাবিয়া চিন্তিয়া ইনি আমাকে পথ বলিয়া দিবেন। কখন পথ বলিয়া দেন সেই প্রতীক্ষায় একাগ্রচিত্তে কঙ্কাবতী ব্যাঙের মুখপানে চাহিয়া রহিল। স্থির-গম্ভীর ভাবে অনেকক্ষণ চিন্তা করিয়া অবশেষে ব্যাঙ বলিলেন, “তবে বোধ হয় কথার মিল করিবার নিমিত্ত হাতী আমাকে থ্যাবড়ানাকী বলিয়াছে। কারণ, এই দেখ না! আমার কথায় আর হাতীর কথায় মিল হয়ঃ

উট-কপালী চিরুন-দাঁতী বড় যে ডিঙুলি মোরে।

থাক থাক থাক থ্যাবড়া-নাকী ধর্মে রেখেছে তোরে।।

কঙ্কাবতী, কবিতাটি খবরের কাগজে ছাপাইলে হয় না? কিন্তু ইহাতে আমার নিন্দা আছে, থ্যাবড়া নাকের কথা আছে। তাই খবরের কাগজে ছাপাইব না। শুনলে তো এখন হাতীর আস্পর্ধার কথা? তাই আমি ভাবিলাম সাহেব না হইলে লোকে মান্য করে না। সেই জন্য এই সাহেবের পোশাক পরিয়াছি। কেমন? আমাকে ঠিক সাহেবের মত দেখাইতেছে তো? এখন হইতে আমাকে সকলে সেলাম করিবে। সকলে ভয় করিবে। যখন রেলগাড়ির তৃতীয় শ্রেণীতে গিয়া চড়িব, তখন সে গাড়িতে অন্য লোক উঠিবে না। টুপি মাথায় দিয়া আমি দ্বারের নিকট গিয়া দাঁড়াইব। সকলে উঁকি মারিয়া দেখিবে, আর ফিরিয়া যাইবে। আর বলিবে, ও গাড়িতে সাহেব রহিয়াছে। কেমন কঙ্কাবতী, এ পরামর্শ ভাল নয়?”কঙ্কাবতী বলিল, “উত্তম পরামর্শ, এক্ষণে অনুগ্রহ করিয়া পথ বলিয়া দিন। আর যদি না দেন তো বলুন আমি চলিয়া যাই।”

কানে হাত দিয়া ব্যাঙ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি বলিলে?”

কঙ্কাবতী বলিল, “আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, কোন্ পথ দিয়া গ্রামে যাইব? গ্রাম এখান হইতে কত দূর, কতক্ষণে সেখানে গিয়া পৌঁছিব?”

ব্যাঙ বলিলেন, আমার একটা হিসাব করিয়া দাও। পথ দেখাইয়া দিব কি আমি এখন ঘোর বিপদে পড়িয়াছি। আমার একটি আধুলি ছিল; একজনকে তাহা আমি ধার দিয়াছি। তাহার সহিত নিয়ম হইয়াছে যে, যাহা বাকী থাকিব প্রতিদিন সে তাহার অর্ধেক দিয়া সে ঋণ পরিশোধ করিবে। প্রথম দিন সে আমাকে চারি আনা দিবে, দ্বিতীয় দিন দুই আনা দিবে, তৃতীয় দিন এক আনা, চতুর্থ দিন দুই পয়সা, পঞ্চম দিন সে এক পয়সা দিবে। এক পয়সায় হয় পাঁচ গণ্ডা, অর্থাৎ কুড়ি কড়া। ষষ্ঠ দিনে সে আমাকে দশ কড়া দিবে। তার পরদিন সে আমাকে পাঁচ কড়া দিবে। তার পরদিন আড়াই কড়া, তার পরদিন স-কড়া, তার পরদিন তার অর্ধেক, পরদিন তার অর্ধেক, পরদিন তার অর্ধেক ―”অতি চমৎকার সুমিষ্ট কান্না-সুরে ব্যাঙ এইবার গলা ছাড়িয়া কাঁদিতে লাগিলেন, “ওগো মাগো! এ যে আর কখনও শোধ হবে না গো! আমার আধুলিটি যে আর কখন পুরাপুরি হবে না গো! ওগো আমি কোথায় যাব গো! জুয়াচোরের হাতে পড়িয়া আমার যে সর্বস্ব গেল গো! ওগো আমার যে ওই আধুলিটি বই পৃথিবীতে আর কিছু নাই গো! ওগো তা লইয়া মানুষে যে ঠাট্টা করে গো। ব্যাঙের আধুলি, ব্যাঙের আধুলি বলিয়া মানুষে যে হিংসায় ফাটিয়া মরে গো! ওগো মাগো! আমার কি হল গো!”

ব্যাঙ পুনরায় আধ-কান্না সুরে ফুঁপিয়া ফুঁপিয়া বলিলেন, “ওগো! আমি যে মনে করিয়াছিলাম, দুই দণ্ড বসিয়া তোমার সঙ্গে গল্পগাছা করিব গো! ওগো তাহা যে আর হইল না গো! ওগো আমার যে শোকসিন্ধু উথলিয়া উঠিল গো! ওগো, তুমি ওই দিক্ দিয়া যাও গো। তাহা হইলে লোকালয়ে পৌঁছিতে পারিবে গো। ওগো, সে যে অনেক দূর গো! ওগো, আজ সেখানে যাইতে পারিবে না গো! ওগো, তোমরা যে আমাদের মত লাফাইতে পার না গো! ওগো, তোমরা যে গুটি-গুটি চলিয়া যাও গো! ওগো, তোমাদের চলন দেখিয়া, আমার যে হাসি পায় গো! ওগো, তোমার চলন দেখিয়া, আমার যে কান্না পায় না গো! ওগো, তুমি যে লোক ভাল গো! ওগো, লেখাপড়া শিখিয়া তুমি মদ্দা মেয়েমানুষ হওনি গো! ওগো, আমার যে আধুলিটি এইবার জন্মের মত গেল গো! ওগো, আমার কি হইল গো! ওগো মাগো!”

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

পচাজল

কঙ্কাবতী ভাবিল, একে আপনার দুঃখে মরি, তাহার উপর এ আবার এক জ্বালা। যাহা হউক ব্যাঙের কান্না একটু থামিয়াছে। এইবার আমি যাই।

ব্যাঙ যেরূপ বলিয়া দিলেন, কঙ্কাবতী সেই পথ দিয়া চলিল। চলিতে চলিতে সন্ধ্যা হইয়া গেল, তবুও বন পার হইতে পারিল না। যখন সন্ধ্যা হইয়া গেল, তখন সে অতিশয় শ্রান্ত হইয়া পড়িল। আর চলিতে পারিল না। বনের মাঝখানে একখানি পাথরের উপর বসিয়া কাঁদিতে লাগিল।

পাথরের উপর বসিয়া কঙ্কাবতী কাঁদিতেছে, এমন সময় মৃদু মধুর তানে গুনগুন করিয়া কে তাহার কানে বলিল, “তোমরা কারা গা? তুমি কাদের মেয়ে গা?” কঙ্কাবতী এদিক ওদিক চারিদিকে চাহিয়া দেখিল। অবশেষে দেখিতে পাইল যে একটি ক্ষুদ্র মশা তাহার কানে এই কথা বলিতেছে। মশাটিকে ভাল করিয়া নিরীক্ষণ করিয়া দেখিল যে সেটি নিতান্ত বালিকা-মশা। কঙ্কাবতী উত্তর করিল, “আমি মানুষের মেয়ে গো, আমার নাম কঙ্কাবতী।”

মশা-বালিকা বলিল, “মানুষের মেয়ে। আমাদের খাবার? বাবা যাদের রক্ত নিয়ে আসেন? খাই বটে, কিন্তু মানুষ কখনও দেখি নাই।”

আমরা ভদ্র-মশা কি না? তাই আমরা ওসব কথা জানি না। আমি কখনও মানুষ দেখি নাই। কিরূপ গাছে মানুষ হয়, তাহাও আমি জানি না। কই? দেখি দেখি। মানুষ আবার কিরূপ হয়?”এই বলিয়া মশা-বালিকা, কঙ্কাবতীর চারিদিকে উড়িয়া উড়িয়া দেখিতে লাগিল।

ভাল করিয়া দেখিয়া শেষে মশা-বালিকা জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি ধাড়ী মানুষ নও, বাচ্চা মানুষ, না?”

কঙ্কাবতী উত্তর করিল, “নিতান্ত ছেলেমানুষ নই, তবে এখনও লোকে আমাকে বালিকা বলে।”

মশা-বালিকা পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার নাম কি বলিলে?”

কঙ্কাবতী উত্তর করিল, “আমার নাম কঙ্কাবতী।”মশা-বালিকা বলিল, “ভাল হইয়াছে। আমার নাম রক্তবতী। ছেলেবেলা রক্ত খাইয়া পেটটি আমার টুপটুপে হইয়া থাকিত, বাবা তাই আমার নাম রাখিয়াছেন রক্তবতী। আমাদের দুই জনের নামে নামে বেশ মিল হইয়াছে, রক্তবতী আর কঙ্কাবতী। এস ভাই আমরা দুইজনে কিছু একটা পাতাই।”

কঙ্কাবতী বলিল, “আমি এখন বড় শোক পাইয়াছি, এখন ঘোর মনোদুঃখে আছি। আমি এখন পতিহারা সতী। তুমি বালিকা সে সব কথা বুঝিতে পারিবে না। কিছু পাতাইয়া আহ্লাদ-আমোদ করি এখন আমার সে সময় নয়।”

রক্তবতী বলিল, “তুমি পতিহারা সতী। তার জন্য আর ভাবনা কি? বাবা বাড়ী আসুন, বাবাকে আমি বলিব। বাবা তোমার কত পতি আনিয়া দিবেন। এখন এস ভাই। কিছু একটা পাতাই। কি পাতাই বল দেখি? আমি পচা-জল বড় ভালবাসি। যেখানে পচা-জল থাকে, মনের সুখে আমি সেইখানে উড়িয়া বেড়াই, পচা-জলের ধারে উড়িয়া উড়িয়া আমি কত খেলা করি। তোমার সহিত আমি ‘পচাজল’ পাতাইব। তুমি আমার পচাজল আমি তোমার পচাজল। কেমন মনের মতন হইয়াছে তো? কঙ্কাবতী ভাবিল, ইহাদের সহিত তর্ক করা বৃথা। বুড়ো মিনসে ব্যাঙ তারেই বড় বুঝাইয়া পারিলাম তা এ তো একটা সামান্য বালিকা-মশা। ইহার এখনও জ্ঞান হয় নাই। ইহাদের যাহা ইচ্ছা হয় করুক। আর আমি কোনও কথা কহিব না।

কঙ্কাবতী দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া বলিল, “আচ্ছা তাহাই ভাল। আমি তোমার পচাজল, তুমি আমার পচাজল। হা জগদীশ্বর, হে হৃদয়দেবতা, তুমি কোথায়, আর আমি কোথায়। সেখানে তোমার কি দশা, আর এখানে আমার কি দশা!”

এই কথা বলিয়া কঙ্কাবতী বার বার নি:শ্বাস ফেলিতে লাগিল, আর কাঁদিতে লাগিল।

পচাজলের দুঃখ দেখিয়া মশা-বালিকাটিরও দুঃখ হইল। মশা-বালিকাটি বুঝিতে পারে না যে, তার পচাজল এত কাঁদে কেন? গুন্ গুন্ করিয়া কঙ্কাবতীর চারিদিকে সে উড়িয়া দেখিতে লাগিল। রক্তবতী বলিল, “পচাজল, তোমার ভাই আর দুটি পা কোথায় গেল? উপরের দুটি পা আছে, নীচের দুটি পা আছে, মাঝের দুটি পা কোথায় গেল? ভাঙিয়া গিয়াছে বুঝি? ওঃ! সেইজন্য তুমি কাঁদিতেছ? তার আবার কান্না কি পচাজল? খেলা করিতে করিতে আমারও একটি পা ভাঙিয়া গিয়াছিল। এই দেখ, সে পা-টি পুনরায় গজাইতেছে। তোমারও পা সেইরূপ গজাইবে, চুপ কর, কাঁদিও না!”

কঙ্কাবতী বলিল, “আমার পা ভাঙিয়া যায় নাই। তোমাদের মত আমাদের পা নয়। আমাদের পা এইরূপ। পায়ের জন্য কাঁদি নাই।”

মশা-বালিকা পুনরায় গুনগুন করিয়া উড়িতে লাগিল। চারিদিকে ঘুরিয়া কঙ্কাবতীর শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সমুদয় নিরীক্ষণ করিয়া দেখিতে লাগিল। অবশেষে কঙ্কাবতীর নাকের কাছে গিয়া বলিল, “একি ভাই পচাজল! সর্বনাশ। তোমার নাক কোথায় গেল? তোমার নাকটি কে কাটিয়া নিল? আহা! তোমার নাক নাই তো খাবে কি দিয়া?”

মশা-বালিকা কি বলিতেছে, কঙ্কাবতী তাহা প্রথমে বুঝিতে পারিল না। পরে বুঝিল যে, সে শুঁড়ের কথা বলিতেছে। কঙ্কাবতী মনে করিল যে, “এ মশা-বালিকাটি নিতান্ত শিশু, এখনও ইহার কিছুমাত্র জ্ঞান হয় নাই।”

কঙ্কাবতী উত্তর করিল, “আমাদের নাক এইরূপ। তোমাদের নাক যেরূপ দীর্ঘ, আমাদের নাক সেরূপ লম্বা নয়। আমরা নাক দিয়া খাই না, আমরা মুখ দিয়া খাই।”

রক্তবতী বলিল, “আহা! তবে পচাজল, তোমার কি দূরদৃষ্ট যে আমার মত তোমার নাক নয়। এই বড় নাকে আমাকে কেমন দেখায় দেখ দেখি। জলের উপর গিয়া আমি আমার মুখখানি দেখি, আর মনে মনে কত আহ্লাদ করি। মা বলেন যে, বড় হইলে আমার রক্তবতী একটি সাক্ষাৎ সুন্দরী হইবে। তা ভাই পচাজল, তোমাকেও আমি সুন্দরী করিব। বাবা বাড়ী আসিলে বাবাকে বলিব, তিনি তোমার নাকটি টানিয়া বড় করিয়া দিবেন। তখন তোমাকে বেশ দেখাইবে।” কঙ্কাবতী ভাবিল, “আবার সেই নাকের কথা। নাক নাক করিয়া ইহারা সব সারা হইয়া গেল। কাঁকড়া নাকের কথা বলিয়াছিল, ব্যাঙ বলিয়াছিল। এই মশা-বালিকাও সেই কথা বলিতেছে। তার পর সেই, নাকেশ্বরীর নাক। উঃ! কি ভয়ানক!

কঙ্কাবতী আরও ভাবিতে লাগিল, “এই ঘোর দুঃখের সময় আমি বড় বিপদেই পড়িলাম। কোথায় তাড়াতাড়ি গ্রামে গিয়া চিকিৎসক আনিয়া স্বামীর প্রাণরক্ষা করিব; না ওখানে ব্যাঙ, এখানে মশা, সকলে মিলিয়া আমাকে বিষম জ্বালাতনে ফেলিল। ব্যাঙের হাত এড়াইতে না এড়াইতে মশার হাতে পড়িলাম। মশার একরতি মেয়েটি তো এই রঙ্গ করিতেছেন, আবার ইঁহার বাপ বাড়ী আসিয়া যে কি রঙ্গ করিবেন, তা তো বলিতে পারি না।” রক্তবতী বলিল, “ওই যে পাতাটি দেখিতেছ পচাজল, যার কোণটি কুঁকড়ে রহিয়াছে? উহার ভিতর আমাদের ঘর। আমার মা’রা উহার ভিতরে আছেন। আমার তিন মা। বাবা চরিতে গিয়াছেন, বাবা এখনই কত খাবার আনিবেন। যাই, মাদের বলিয়া আসি যে আমার ‘পচাজল’ আসিয়াছে।”

এই বলিয়া রক্তবতী ঘরের দিকে উড়িয়া গেল। অল্পক্ষণ পরে রক্তবতী পুনরায় ফিরিয়া আসিয়া বলিল, “পচাজল, মা তোমাকে ডাকিতেছেন, উঠ। আমার মা’র সঙ্গে দেখা করিবে।”

কঙ্কাবতী করে কি। ধীরে ধীরে উঠিল। মশাদের ঘর সেই কোঁকড়ানো পাতাটির কাছে গেল।একটি নবীনা মশানী কুঞ্চিত পত্রকোণ হইতে ঈষৎ মুখ বাড়াইয়া বলিলেন, “হাঁ গো বাছা। তুমি আমার রক্তবতীর সহিত পচাজল পাতাইয়াছ? তা বেশ করিয়াছ। রক্তবতী আমাদের বড় আদরের মেয়ে। কর্তার এত বিষয়-বৈভব, তা আমার এই রক্তবতীই।তাঁর একমাত্র সন্তান। তা হাঁ গা বাছা, রক্তবতী কি তোমার পতির কথা বলিতেছিল? কি হইয়াছে?”

কঙ্কাবতী কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, “ওগো আমি বড় দুঃখিনী। আমি বড় শোক পাইয়াছি। পৃথিবী আমি অন্ধকার দেখিতেছি। যদি আমার পতিকে আমি না পাই তবে এ ছার প্রাণ আমি কিছুতেই রাখিব না। আমার পতিকে নাকেশ্বরী খাইয়াছে। পতিকে বাঁচাইবার নিমিত্ত আমি লোকালয়ে যাইতেছি। সেখান হইতে ভাল চিকিৎসক আনিব, আমার স্বামীকে দেখাইব। তাই আমি বিলম্ব করিতে পারি না। পুনরায় আমি এই রাত্রিতেই পথ চলিব। কিন্তু আমি পথ জানি না, অন্ধকারে আমি পথ দেখিতে পাইব না। তোমরা আমাকে যদি একটু পথ দেখাইয়া দাও, তাহা হইলে আমার বড় উপকার হয়।”মশানী বলিলেন, “ছেলেমানুষ, বালিকা তুমি, তোমার কোনও জ্ঞান নাই। একে আমরা স্ত্রীলোক, যে-সে মশার স্ত্রী নই, গণ্য-মান্য সম্ভ্রান্ত মশার স্ত্রী। তাতে আমরা পর্দানশীন, কুলের কুলবধূ। আমাদিগের কি ঘরের বাহিরে যাইতে আছে, বাছা? না, আমরা পথঘাট জানি? তুমি কাঁদিও না। কর্তা বাড়ী আসুন, কর্তাকে আমি ভাল করিয়া বলিব। তুমি এখন আমাদের কুটুম্ব। রক্তবতীর পচাজল। যাহা ভাল হয় তোমার জন্য কর্তা অবশ্যই করিবেন। তুমি একটু অপেক্ষা কর।”

কঙ্কাবতীর সহিত যিনি এতক্ষণ কথা কহিতেছিলেন, তিনি রক্তবতীর মা। মশার ছোট-রানী। এইবার মশার বড়-রানী পাশ দিয়া একটু মুখ বাড়াইলেন।

বড়-মশানী বলিলেন, “ওটা একটা মানুষের ছানা বুঝি? আমি ওরে পুষিব। আমার ছেলেপিলে নাই। অনেক দিন ধরিয়া আমার মনে সাধ আছে যে, জীবজ্জন্তু কিছু একটা পুষি। তা ভাল হইয়াছে, ওই মানুষের ছানাটা এখানে আসিয়াছে। ওটাকে আমি পুষিব। কিছু বড় হইয়া গিয়াছে সত্য, তা যাহাই হউক এখনও পোষ মানিবার সময় আছে। মানুষে শুনিয়াছি মেষ, ছাগল, পায়রা এই সব খায়। আবার সাধ করিয়া তাদের পোষে। এই মানুষের ছানাটাকে পুষিলে ইহার উপর আমার মায়া পড়িবে। ইহাকে খাইতে তখন আর আমার ইচ্ছা হইবে না।” মেজ-মশানী আর এক পাশ দিয়া উঁকি মারিয়া বলিলেন “দিদি, তোমার এক কথা। মানুষের ছানাটাকে যদি পুষিবে তো যাতে কাজে লাগে, এরূপ করিয়া পুষিয়া রাখা মানুষে যেরূপ দুধের জন্য গরু পোষে সেইরূপ করিয়া ইহাকে ঘরে পুষিয়া রাখা কর্তা কতদুর হইতে রক্ত লইয়া আসেন। আনিতে আনিতে রক্ত বাসী হইয়া যায়। মানুষ একটি ঘরে পোষা থাকিলে যখন ইচ্ছা হইবে তখন টাটকা রক্ত খাইতে পাইব।”

রক্তবতীর মা বলিলেন, “তোমাদের সব এক কথা। সবটাতেই তোমাদের প্রয়োজন। ছেলেমানুষ রক্তবতী মানুষের ছানাটিকে পথে কুড়াইয়া পাইয়াছে। পুষিতে কি খাইতে সে তোমাদিগকে দিবে কেন? ছেলের হাতের জিনিসটি তোমরা কাড়িয়া লইতে চাও তোমাদের কিরূপ বিবেচনা বল দেখি? আসুন, আজ কর্তা আসুন, তাঁহাকে সকল কথা বলিব। এ সংসারে আর আমি থাকিতে চাই না। আমাকে তিনি বাপের বাড়ী পাঠাইয়া দিন। আমার বাপ ভাই বাঁচিয়া থাকুক। আমার ভাবনা কিসের? আমি ছন্নছাড়া আঁটকুড়োদের মেয়ে নই। আমার চারিদিকে সব জাজ্জ্বল্যমান।”বড়-মশানী বলিলেন, “আঃ মর, ছুঁড়ির কথা শোন! বাপ-ভাইয়ের গরবে ওঁর মাটিতে পা পড়েনা। বাপ-ভাইয়ের মাথা খাও।”

এইরূপে তিন সপত্নীতে ধুন্ধুমার ঝগড়া বাধিয়া গেল। কঙ্কাবতী অবাক। কঙ্কাবতী মনে করিল, ভাল কথা, জীব-জন্তুর মত ইহারা আমাকে পুষিতে চায়।

তিন সতীনে ঝগড়া ক্রমে একটু থামিল। কখন মশা ঘরে আসিবেন, সেই প্রতীক্ষায় কঙ্কাবতী সেইখানে বসিয়া রহিল। অনেক বিলম্ব হইতে লাগিল, তবু মশা ফিরিলেন না।

কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিল, “হাঁ গা তোমাদের কর্তার এত বিলম্ব হইতেছে কেন?”ছোট-রানী বলিলেন, “বাঁশ কাটছেন, ভার বাঁধছেন, রক্ত নিয়ে আসছেন পারা।”

অর্থাৎ কিনা, কর্তা হয়তো আজ অনেক রক্ত পাইয়াছেন। একেলা বহিয়া আনিতে পারিতেছেন না। তাই বাঁশ কাটিয়া ভার বাঁধিয়া মুটে করিয়া রক্ত আনিতেছেন। বিলম্ব সেইজন্য হইতেছে।

কঙ্কাবতী আরও কিছুক্ষণ বসিয়া রহিল, তবুও মশা ঘরে ফিরিলেন না।

কঙ্কাবতী পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল, “তোমাদের কর্তা কখন আসিবেন গা? বড় যে বিলম্ব হইতেছে।”

এবার মধ্যম-মশানী উত্তর দিলেন, “তুষের ধোঁ, কুলোর বাতাস, কোণ নিয়েছেন পারা।”অর্থাৎ কিনা, চরিবার নিমিত্ত কর্তা হয়তো কোনও লোকের ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়াছেন। সে লোক তুষের অগ্নি করিয়া তাহার উপর সূর্পের বাতাস দিয়া, ঘর ধূমে পরিপূর্ণ করিয়াছে। কর্তা গিয়া ঘরের এক কোণে লুক্কায়িত হইয়াছেন, বাহির হইতে পারিতেছেন না। সেইজন্য বিলম্ব হইতেছে। একটু ধূম কমিলে বাহির হইয়া আসিবেন।

কঙ্কাবতী আবার অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। তাহার পর পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল, “কই গা, তিনি তো এখনও এলেন না। আর কত বিলম্ব হইবে?”

এইবার বড়-মশানী উত্তর করিলেন, “কটাস্ কামড়, চটাস চাপড় মরে গিয়াছেন পারা।”অর্থাৎ কিনা, কর্তা হয়তো কোনও লোকের গায়ে বসিয়াছিলেন। গায়ে বসিয়া যেমন কটাস্ করিয়া কামড় মারিয়াছেন, আর অমনি সে লোকটি একটি চটাস করিয়া চাপড় মারিয়াছে। সেই চাপড়ে কর্তা হয়তো মরিয়া গিয়াছেন।

কর্তা মরিয়া গিয়াছেন, এইরূপ অকল্যাণের কথা শুনিয়া ছোট-রানী ফোঁস করিয়া উঠিলেন। তিনি বলিলেন, “তোমার যত বড় মুখ না, তত বড় কথা। আসুন কর্তা, তাঁরে বলিব যে, তুমি মরিয়া গেলে তোমার বড় রানীর হাড়ে বাতাস লাগে।” তোমার মুখে চুন-কালি দিয়া তোমার মাথা মুড়াইয়া তোমার মাথায় ঘোল ঢালিয়া তোমাকে এখনই বিদায় করিবেন।”

চতুর্দশ পরিচ্ছেদ

মশা প্রভু

তিন সতীনে পুনরায় ঘোরতর বিবাদ বাধিল। রক্তবতী চীৎকার করিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। মশার ঘরে কোলাহলের রোল উঠিল। এমন সময় মশা বাড়ী আসিলেন। ঘরে কলহ-কচকচির কোলাহল শুনিয়া মশার সর্বশরীর জ্বলিয়া গেল।

মশা বলিলেন, “এ যন্ত্রণা আর আমার সহ্য হয় না। তোমাদের ঝগড়ার জ্বালায় আমাদের ঘরের কাছে গাছের ডালে কাক-চিল বসিতে পারে না। যেখানে এরূপ বিবাদ হয় সেখানে লক্ষ্মী থাকেন না। তালুকে মনুষ্যদিগের শরীরে শোণিত শুষ্ক হইয়া যায়। ইচ্ছা হয় যে গলায় দড়ি দিয়া মরি, কি বিষ খাইয়া মরি। আত্মহত্যা করিয়া আমাকে মরিতে হইবে। এই সেদিন ধর্মে ধর্মে আমার প্রাণটি রক্ষা হইয়াছে। আমি একজন আফিমখোরের গায়ে বসিয়াছিলাম। তাহার রক্ত কি তিক্ত, এক শুঁড় রক্ত সব ফেলিয়া দিলাম। বার বার কুলকুচা করিয়া তবে প্রাণ রক্ষা হইল। মনে করিলাম অপঘাত মৃত্যুতে মরিব। তাই এত কাণ্ড করিয়া প্রাণ বাঁচাইলাম। কিন্তু তোমাদের জ্বালায় এত জ্বালাতন হইয়াছি যে বাঁচিতে আর আমার তিলমাত্র সাধ নাই।”এইরূপে মশা স্ত্রীগণকে অনেক ভর্ৎসনা করিতে লাগিলেন। অবশেষে তাহার রাগ পড়িলে তিনি একটু সুস্থির হইলে রক্তবতী গিয়া তাঁহার কোলে বসিলেন।

রক্তবতী বলিলেন, “বাবা, আমার পচাজল আসিয়াছে।”

মশা জিজ্ঞাসা করিলেন, “সে আবার কে? পচাজল আবার কি?”রক্তবতীর মা উত্তর করিলেন, “ওগো একটি মানুষের কন্যা। সন্ধ্যা হইতে এখানে বসিয়া আছে। রক্তবতী তাহার সহিত পচাজল পাতাইয়াছে। আহা, বালিকা এখানে আসিয়া পর্যন্ত কেবল কাঁদিতেছে। বলে, আমি পতিহারা সতী। পতিকে নাকেশ্বরী খাইয়াছে। আমি লোকালয়ে যাইব, সেখান হইতে বৈদ্য আনিয়া আমার পতিকে ভাল করিব। আমি তাকে বলিলাম, বাছা একটু অপেক্ষা কর। কর্তাটি বাড়ী আসুন, তাঁহার সহিত পরামর্শ করিয়া তোমার একটা উপায় করা যাইবে। তুমি যখন রক্তবতীর পচাজল হইয়াছ, তখন তোমার দুঃখ মোচন করিতে আমরা যথাসাধ্য যত্ন করিব।―রক্তবতীর পচাজল হইবে, রক্তবতী পচাজলকে লইয়া সাধ আহ্লাদ করিবে, তোমার আর দুইটি রানীর প্রাণে সহিবে কেন? তাঁদের আবার ওই মানুষের ছানাটিকে পুষিতে সাধ হইল। সেই কথা লইয়া আমাকে তারা যা-না-তাই বলিল। তা আমার আর এখানে থাকিয়া আবশ্যক নাই। তুমি আমাকে বাপের বাড়ী পাঠাইয়া দাও। দিয়া দুই রানী লইয়া সুখে স্বচ্ছন্দে ঘর-কন্না কর। আমি তোমার কন্টক হইয়াছি। আমি এখান হইতে যাই।”মশা জিজ্ঞাসা করিলেন, “সে মানুষের কন্যাটি কোথায়?”

রক্তবতীর মা বলিলেন, “ওই বাহিরে বসিয়া আছে।”

রক্তবতী বলিলেন, “বাবা, তুমি আমার সঙ্গে এস। আমার পচাজল কোথায় আমি এখনই দেখাইয়া দিব।”

মশা ও রক্তবতী দুই জনে উড়িলেন। বিষণ্ণ বদনে অশ্রুপূরিত নয়নে যেখানে কঙ্কাবতী বসিয়াছিল, গুনগুন করিয়া দুই জনে সেইখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।রক্তবতী বলিলেন, “পচাজল, এই দেখ বাবা আসিয়াছেন।”

কঙ্কাবতী সসম্ভ্রমে গাত্রোত্থান করিয়া মশাকে নমস্কার করিল। কঙ্কাবতীকে ভাল করিয়া দেখিতে পাইবেন বলিয়া মশা গিয়া একটি ঘাসের ডগার উপর বসিলেন। তাহার পাশে আর একটি ঘাসের ডগার উপর রক্তবতী বসিলেন। মশার সম্মুখে হাত জোড় করিয়া কঙ্কাবতী দণ্ডায়মান রহিল।

অতি বিনীতভাবে কঙ্কাবতী বলিল, “মহাশয়, বিপন্না অনাথা বালিকা আমি। জনশূন্য এই গহন কাননে আমি একাকিনী। আমি পতিহারা সতী। আমি দুঃখিনী কঙ্কাবতী। প্রাণসম পতি আমার ভূতিনীর হস্তগত হইয়াছেন। আমার পতিকে উদ্ধার করিয়া দিন। আমি আপনার শরণ লইলাম।”মশা জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কাহার সম্পত্তি?”

কঙ্কাবতী উত্তর করিল “মহাশয়, পূর্বে আমি পিতার সম্পত্তি ছিলাম। বাল্যকালে মনুষ্য-বালিকারা পিতার সম্পত্তি থাকে। এক্ষণে আমি আমার পতির সম্পত্তি।”

মশা বলিলেন, “উঁহু, সে কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি না। তুমি কোন্ মশার সম্পত্তি?”

কঙ্কাবতী উত্তর করিল, কোন মশার সম্পত্তি। সে কথা তো আমি কিছুই জানি না। কই আমি তো কোনও মশার সম্পত্তি নই।”

মশা বলিলেন, রক্তবতী, তোমার পচাজল দেখিতেছি পাগলিনী, উন্মত্তা। ইহার কোনও জ্ঞান নাই। সঠিক সত্য সত্য কথার উত্তর না পাইলে তোমার পচাজলের কি করিয়া আমি উপকার করি?”

রক্তবতী বলিলেন, “ভাই পচাজল, বাবা যে কথা জিজ্ঞাসা করেন, সত্য সত্য তাহার উত্তর দাও।”মশা বলিলেন, “শুন মনুষ্য-শাবক, এই ভারতে যত নর-নারী দেখিতে পাও ইহারা সকলেই মশাদিগের সম্পত্তি। যে মশা মহাশয় তোমার অধিকারী তাঁহার নিকট হইতে বোধ হয় তুমি পলাইয়া আসিয়াছ। সেই ভয়ে তুমি আমার নিকট সত্য কথা বলিতেছ না, আমার নিকট কথা গোপন করিতেছ। তোমার ভয় নাই, তুমি সত্য সত্য আমার কথার উত্তর দাও। আমি জিজ্ঞাসা করিতেছি, তুমি কোন্ মশার সম্পত্তি? কোন্ মশা তোমার গায়ে উপবিষ্ট হইয়া রক্তপান করেন? তাঁহার নাম কি? তাঁহার নিবাস কোথায়? তাঁহার কয় স্ত্রী? কয় পুত্র? কয় কন্যা? পৌত্র দৌহিত্র আছে কি না? তাঁহার জ্ঞাতি-বন্ধুদিগের তোমার উপর কোনও অধিকার আছে কিনা? তাঁহারা তোমাকে এজমালিতে রাখিয়াছেন, কি তোমার হস্তপদাদি বন্টন করিয়া লইয়াছেন? যদি তুমি বন্টিত হইয়া থাক, তাহা হইলে সে বিভাগের দলিল কোথায়? মধ্যস্থ দ্বারা তুমি বন্টিত হইয়াছ, কি আদালত হইতে আমিন আসিয়া তোমাকে বিভাগ করিয়া দিয়াছে? এই সব কথার তুমি আমাকে সঠিক উত্তর দাও। কারণ, আমি তোমাকে কিনিয়া লইবার বাসনা করি। আমার তালুকে অনেক মানুষ আছে। মানুষের অভাব নাই। আমার সম্পত্তি নরনারীগণের দেহে যা রক্ত আছে তাহাই খায় কে? তবে তুমি রক্তবতীর সহিত পচাজল পাতাইয়াছ, সেইজন্য তোমাকে আমি একেবারে কিনিয়া লইতে বাসনা করি। তাহা যদি না করি তাহা হইলে তোমার অধিকারী মশাগণ আমার নামে আদালতে অভিযোগ উপস্থিত করিতে পারেন। তোমাকে এখান হইতে তাঁহারা পুনরায় লইয়া যাইতে পারেন! আমার রক্তবতী তাহা হইলে কাঁদিবে। এখন বল তোমার মশা-প্রভুর নাম কি।”কঙ্কাবতী উত্তর করিলেন, “মহাশয়, আমি আপনাকে সত্য বলিতেছি। আমার মশা-প্রভুর নাম আমি জানি না। মনুষ্যেরা যে মশাদিগের সম্পত্তি তাহাও আমি এত দিন জানিতাম না। মশাদিগের মধ্যে যে মনুষ্যেরা বিতরিত, বিক্রীত ও বন্টিত হইয়া থাকে তাহাও আমি জানিতাম না। মশাদিগের যে আবার নাম থাকে তাহাও আমি জানি না। তা আমি কি করিয়া বলি যে, আমি কোন মশার সম্পত্তি?”

ক্রোধে মশা প্রজ্জ্বলিত হইয়া উঠিলেন। রাগে তাঁহার নয়ন আরক্ত হইয়া উঠিল। মশা বলিলেন, “না, তুমি কিছুই জান না! তুমি কচি খুকীটি! গায়ে কখনও মশা বসিতে দেখ নাই! সে মশাগুলিকে তুমি চেন না! তাহাদের তুমি নাম জান না! তুমি ন্যাকা! পতিহারা সতী হইয়া কেবল পথে পথে কাঁদিতে জান!” মশার এইরূপ তাড়নায় কঙ্কাবতী কাঁদিতে লাগিল। কঙ্কাবতীর পানে চাহিয়া রক্তবতী চক্ষু টিপিলেন। সে চক্ষু-টিপুনির অর্থ এই যে, পচাজল, তুমি কাঁদিও না। বাবা বড় রাগী মশা। একে রাগিয়াছেন, তাতে তুমি কাঁদিলে আরও রাগিয়া যাইবেন। চুপ কর। বাবার রাগ এখনই যাইবে।

রক্তবতী যাহা বলিলেন, তাহাই হইল। কঙ্কাবতীর কান্না দেখিয়া মশা আরও রাগিয়া উঠিলেন। মশা বলিলেন, “এ কোথাকার প্যানপেনে মেয়েটা। ভ্যানোর ভ্যানোর করিয়া কাঁদে দেখ।”

রক্তবতী বলিলেন, “আমার পচাজল মানুষের ছানা বই তো নয়। মানুষদের বুদ্ধি সুদ্ধি নাই, তা সকল মশাই জানে। নির্বোধ মশাকে সকলে মানুষ বলিয়া গালি দেয়। সকলে বলে, ‘অমুক মশা তো মশা নয়, ওটা একটা মানুষ। তা আমাদের মত পচাজলের বোধ-শোধ কেমন করিয়া হইবে? আমার পচাজলকে বাবা তুমি আর বকিও না।” মশা ভাবিলেন, সত্য কথা। মানুষের ছানাটাকে আর কোনও কথা জিজ্ঞাসা করা বৃথা। আমাকে নিজেই সকল সন্ধান লইতে হইবে।

মশা জিজ্ঞাসা করিলেন, “বলি হাঁগো মেয়ে, এখন তোমার বাড়ী কোন্ গ্রামে বল দেখি? তাহা বলিতে পারিবে তো?”

কঙ্কাবতী উত্তর করিল যে, তাহাদের গ্রামের নাম কুসুমঘাটী। মশা তৎক্ষণাৎ আপন অনুচরদিগকে কুসুমঘাটী পাঠাইলেন ও কঙ্কাবতীর প্রভুগণকে ডাকিয়া আনিতে আদেশ করিলেন। দূতগণ, কুসুমঘাটীতে উপস্থিত হইয়া অনেক সন্ধানের পর জানিতে পারিলেন যে, কঙ্কাবতীর অধিকারী তিনটি মশা। তাঁহাদের নাম গজগণ্ড, বৃহৎমুণ্ড ও বিকৃততুন্ড। রক্তবতীর পিতার নাম দীর্ঘশুন্ড। দূতগণ শুনিলেন যে কঙ্কাবতীর অধিকারিগণের বাস আকাশমুখ নামক শালবৃক্ষ। সেইখানে গিয়া কঙ্কাবতীর অধিকারিগণকে সকল কথা তাঁহারা বলিলেন। তাঁহারা দূতগণের সহিত আসিয়া অবিলম্বে দীর্ঘশুণ্ডের নিকট উপস্থিত হইলেন। অনেক বাদানুবাদ, অনেক দর কষা-কষির পর তিন ছটাক নররক্ত দিয়া কঙ্কাবতীকে দীর্ঘশুণ্ড কিনিয়া লইলেন। কঙ্কাবতীকে ক্রয় করিয়া তিনি কন্যাকে বলিলেন, “রক্তবতী এই নাও, তোমার পচাজল নাও। এই মানুষের ছানাটি এখন আমাদের নিজস্ব। ইহা এখন আমাদের সম্পত্তি।”

পরের পর্ব...


No comments:

Post a Comment