কঙ্কাবতী (প্রথমাংশ)



লেখক: ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়

প্রথম খণ্ড

প্রথম পরিচ্ছেদ

তনু রায়

শ্রীযুক্ত রামতনু রায় মহাশয়ের বাস কুসুম-ঘাটী। রামতনু রায় বলিয়া কেহ তাঁহাকে ডাকে না, সকলে তাঁহাকে “তনু রায়” বলে। ইনি ব্রাহ্মণ, বয়স হইয়াছে। ব্রাহ্মণের যাহা কিছু কর্তব্য, তাহা ইনি যথাবিধি করিয়া থাকেন। ত্রিসন্ধ্যা করেন, শ্রাদ্ধতর্পণাদি করেন, দেবগুরুকে ভক্তি করেন, দলাদলি লইয়া আন্দোলন করেন। এখনকার লোকে ভাল করিয়া ধর্মকর্ম করে না বলিয়া রায় মহাশয়ের মনে বড় রাগ।

রায় মহাশয় নিজে বংশজ ব্রাহ্মণ। তিনি বলেন, “বিধাতা যখন আমাকে বংশজ করিয়াছেন, তখন বংশজের ধর্মটি আমাকে রক্ষা করিতে হইবে। যদি না করি, তাহা হইলে বিধাতার অপমান করা হইবে, আমার পাপ হইবে, আমাকে নরকে যাইতে হইবে। যদি বল বংশজের ধর্মটি কি? বংশজের ধর্ম এই যে কন্যাদান করিয়া পাত্রের নিকট হইতে কিঞ্চিৎ ধন গ্রহণ করিবে। বংশজ হইয়া যিনি এ কার্য না করেন, তাঁহার ধর্মলোপ হয়, তিনি একেবারেই পতিত হন।”

তনু রায় প্রকৃতই অতি উচ্চদরের বংশজ। তবে, তাঁহার বংশের বিবাহাদি সম্পর্কে কিছু কিছু পরিহাস প্রচলিত আছে। শোনা যায়, ইহার নিজের বিবাহের সময়ও কিছু গোলযোগ হইয়াছিল। “পাঁচ শত টাকা পণ দিব” বলিয়া একটি কন্যা স্থির করিলেন। পৈতৃক ভূমি বিক্রয় করিয়া সেই টাকা সংগ্রহ করিলেন। বিবাহের দিন উপস্থিত হইলে সেই টাকাগুলি লইয়া বিবাহ করিতে গেলেন। কন্যার পিতা টাকাগুলি গণিয়া ও বাজাইয়া লইলেন। বিবাহের লগ্ন উপস্থিত হইল কিন্তু তবুও তিনি কন্যা-সম্প্রদান করিতে তৎপর হইলেন না। কেন বিলম্ব করিতেছেন, কেহ বুঝিতে পারে না। অবশেষে, তিনি নিজেই খুলিয়া বলিলেন, “পাত্রের এত অধিক বয়স হইয়াছে, তাহা আমি বিবেচনা করিতে পারি নাই। এক্ষণে আর এক শত টাকা না পাইলে কন্যাদান করিতে পারি না।”

কন্যাকর্তার এই কথায় বিষম গোলযোগ উপস্থিত লইল। সেই গোলযোগে লগ্ন অতীত হইয়া গেল, রাত্রি প্রায় অবসান হইল। যখন প্রভাত হয় হয়, তখন পাঁচজনে মধ্যস্থ হইয়া এই মীমাংসা করিয়া দিলেন যে, রায় মহাশয়কে আর পঞ্চাশটি টাকা দিতে হইবে। খত লিখিয়া তনু রায় আর পঞ্চাশ টাকা ধার করিলেন ও কন্যার পিতাকে তাহা দিয়া বিবাহ-কার্য সমাধা করিলেন। বাসর-ঘরে গাহিবেন বলিয়া,তনু রায় অনেকগুলি গান শিখিয়া গিয়াছিলেন। কিন্তু সব বৃথা হইল। কারণ, বাসর হয় নাই, রাত্রি প্রভাত হইয়া গিয়াছিল। এ দুঃখ তনু রায়ের মনে চিরকাল ছিল।

এক্ষণে তনু রায়ের তিনটি কন্যা ও একটি পুত্রসন্তান। কুলধর্ম রক্ষা করিয়া দুইটি কন্যাকে তিনি সুপাত্রে অর্পণ করিয়াছিলেন। জামাতারা তনু রায়ের সম্মান রাখিয়াছিলেন। কেহ পাঁচ শত, কেহ হাজার গণিয়া দিয়াছিলেন। কাজেই সুপাত্র বলিতে হইবে।

সম্মান কিছু অধিক পাইবেন বলিয়া রায় মহাশয় কন্যা দুইটিকে বড় করিয়া বিবাহ দিয়াছিলেন। তিনি বলিতেন, অল্প বয়সে বিবাহ দিলে কন্যা যদি বিধবা হয়, তাহা হইলে সে পাপের দায়ী কে হইবে? কন্যা বড় করিয়া বিবাহ দিবে। কুলীন ও বংশজের তাহাতে কোন দোষ নাই। ইহা শাস্ত্রে লেখা আছে।

তনু রায়ের জামাতা দুইটির বয়স নিতান্ত কচি ছিল না। ছেলে মানুষ বরকে তিনি দুটি চক্ষু পাড়িয়া দেখিতে পারেন না। তাহারা একশত কি দুই শত টাকায় কাজ সারিতে চায়। তাই একটু বয়স্ক পাত্র দেখিয়া কন্যা দুইটির বিবাহ দিয়াছিলেন। এক জনের বয়স হইয়াছিল সত্তর, আর এক জনের পঁচাত্তর।

জামাতাদিগের বয়সের কথায় পাড়ার মেয়েরা কিছু বলিলে, তনু রায় সকলকে বুঝাইতেন “ওগো। তোমরা জান না, জামাইয়ের বয়স একটু পাকা হইলে মেয়ের আদর হয়।” জামাতাদিগের বয়স কিছু অধিক পাকিয়াছিল। কারণ, বিবাহের পর বৎসর ফিরিতে না ফিরিতে দুইটি কন্যাই বিধবা হয়।

তনু রায় জ্ঞানবান লোক। জামাতাদিগের শোকে একেবারে অধীর হন নাই। মনকে তিনি এই বলিয়া প্রবোধ দিয়া থাকেন, বিধাতার ভবিতব্য। কে খণ্ডাতে পারে? কত লোক যে বার বৎসরের বালকের সহিত পাঁচ বৎসরের বালিকার বিবাহ দেয়, তবে তাহাদের কন্যা বিধবা হয় কেন? যাহা কপালে থাকে, তাহাই ঘটে। বিধাতার লেখা কেহ মুছিয়া ফেলিতে পারে না!

তনু রায়ের পুত্রটি ঠিক বাপের মত। এখন তিনি আর নিতান্ত শিশু নন, পঁচিশ পার হইয়াছেন। লেখাপড়া হয় নাই, তবে পিতার মত শাস্ত্রজ্ঞান আছে। পিতা কন্যাদান করিয়া অর্থসঞ্চয় করিতেছেন, সে জন্য তিনি আনন্দিত, নিরানন্দ নন। কারণ পিতার তিনিই একমাত্র বংশধর। বিধবা কয়টা আর কে বল? তনু রায়ের স্ত্রী কিন্তু অন্য প্রকৃতির লোক। এক-একটি কন্যার বিবাহ হয়, আর পাত্রের রূপ দেখিয়া তিনি কান্নাকাটি করেন। তনু রায় তখন তাহাকে অনেক ভৎর্সনা করেন, আর বলেন, “মনে করিয়া দেখ দেখি, তোমার বাপ কি করিয়াছিলেন?” এইরূপ নানা প্রকার খোঁটা দিয়া তবে তাঁহাকে সান্ত্বনা করেন। কন্যাদিগের বিবাহ লইয়া স্ত্রীপুরুষের চিরবিবাদ। বিধবা কন্যা দুইটির মুখপানে চাহিয়া সদাই চক্ষের জলে মায়ের বুক ভাসিয়া যায়। মেয়েদের সঙ্গে মাও এক প্রকার একাদশী করেন। একাদশীর দিন কিছুই খান না, তবে স্বামীর অকল্যাণ হইবার ভয়ে, কেবল একটু একটু জল পান করেন।

প্রতিদিন পূজা করিয়া একে একে সকল দেবতাদিগের পায়ে তিনি মাথা খুঁড়েন, আর তাঁহাদের নিকট প্রার্থনা করেন যে, হে মা কালী। হে মা দুর্গা। হে ঠাকুর। যেন আমার কঙ্কাবতীর বরটি মনের মত হয়। কঙ্কাবতী তনু রায়ের ছোট কন্যা। এখনও নিতান্ত শিশু।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

খেতু

তনু রায়ের পাড়ায় একটি দুঃখিনী ব্রাহ্মণী বাস করেন। লোকে তাঁহাকে “খেতুর মা, খেতুর মা” বলিয়া ডাকে। খেতুর মা আজ দুঃখিনী বটে, কিন্তু এক সময়ে তাঁহার অবস্থা ভাল ছিল। তাঁহার স্বামী শিবচন্দ্র মুখোপাধ্যায় লেখাপড়া জানিতেন কলিকাতায় কর্ম করিতেন, দুপয়সা উপার্জন করিতেন। কিন্তু তিনি অর্থ রাখিতে জানিতেন না। পরদুঃখে তিনি নিতান্ত কাতর হইয়া পড়িতেন ও যথাসাধ্য পরের দুঃখ মোচন করিতেন। অনেক লোককে অন্ন দিতেন ও অনেকগুলি ছেলের তিনি লেখাপড়ার খরচ যোগাইতেন।, এরূপ লোকের হাতে পয়সা থাকে না।

অধিক বয়সে তাঁহার স্ত্রীর একটি পুত্র সন্তান হয়। ছেলেটির নাম ক্ষেত্র রাখেন, সেই জন্য তাঁহার স্ত্রীকে সকলেই খেতুর মা বলে।

যখন পুত্র হইল, তখন শিবচন্দ্র মনে করিলেন, এইবার আমাকে বুঝিয়া খরচ করিতে হইবে। আমার অবর্তমানে স্ত্রী পুত্র যাহাতে অন্নের জন্য লালায়িত না হয়, আমাকে সে ব্যবস্থা করিতে হইবে। মানস হইল বটে, কিন্তু কার্যে পরিণত হইল না। পৃথিবী অতি দুঃখময়। এ দুঃখ যিনি নিজ দুঃখ বলিয়া ভাবেন, চিরকাল তাঁহাকে দরিদ্র থাকিতে হয়।

খেতুর যখন চারি বৎসর বয়স, তখন হঠাৎ তাহার পিতার মৃত্যু হইল। স্ত্রী ও শিশু সন্তানটিকে একেবারে পথে দাঁড় করাইয়া গেলেন। খেতুর বাপ অনেকের উপকার করিয়াছিলেন। তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ এখন বড়লোক হইয়াছেন। কিন্তু এই বিপদের সময় কেহই একবার উঁকি মারিলেন না। কেহই একবার জিজ্ঞাসা করিলেন না যে, খেতুর মা। তোমার হবিষ্যের সংস্থান আছে কি না? এই দুঃখের সময় কেবল রামহরি মুখোপাধ্যায় ইহাদের সহায় হইলেন। রামহরি ইহাদের জ্ঞাতি, কিন্তু দুরসম্পর্ক। খেতুর বাপ তাঁহার একটি সামান্য চাকরি করিয়া দিয়াছিলেন। দেশে অভিভাবক নাই, সে জন্য কলিকাতায় তাঁহাকে পরিবার লইয়া থাকিতে হইয়াছে। যে কয়টি টাকা পান, তাহাতেই কষ্টে সৃষ্টে দিনপাত করেন। তিনি কোথায় পাইবেন? তবুও যাহা কিছু পারিলেন, বিধবাকে দিলেন ও চাঁদার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরিলেন। খেতুর বাপের খাইয়া যাহারা মানুষ, আজ তাহারা রামহরিকে কতই না ওজর আপত্তি অপমানের কথা বলিয়া দুই এক টাকা চাঁদা দিল। তাহাতেই খেতুর বাপের তিল-কাঞ্চন করিয়া শ্রাদ্ধ হইল। চাঁদার টাকা হইতে যাহা কিছু বাঁচিল, রামহরি তাহা দিয়া খেতুর মা ও খেতুকে দেশে পাঠাইয়া দিলেন। দেশে পাঠাইয়া দুঃখিনী বিধবাকে তিনি চাউলের দামটি দিতেন। অধিক আর দিতে পারিতেন না। ব্রাহ্মণী পইতা কাটিয়া কোনো মতে কুলান করিতেন। দেশে বান্ধব কেহই ছিল না। নিরঞ্জন কবিরত্ন কেবল মাত্র ইহাদের দেখিতেন শুনিতেন। বিপদে আপদে তিনিই বুক দিয়া পড়িতেন। খেতুর মার এইরূপ কষ্টে দিন কাটিতে লাগিল। ছেলেটি শান্ত সুবোধ অথচ সাহসী ও বিক্রমশীল হইতে লাগিল। তাহার রূপ-গুণে, স্নেহ-মমতায়, মা সকল দুঃখ ভুলিলেন। ছেলেটি যখন সাত বৎসরের হইল, তখন রামহরি দেশে আসিলেন।

খেতুর মাকে তিনি বলিলেন, “খেতুর এখন লেখাপড়া শিখিবার বয়স হইল, আর ইহাকে এখানে রাখা হইবে না। আমি ইহাকে কলিকাতায় লইয়া যাইতে ইচ্ছা করি। আপনার কি মত?” খেতুর মা বলিলেন, “বাপরে। তাহা কি কখনও হয়? খেতুকে ছাড়িয়া আমি কি করিয়া থাকিব? নিমিষের নিমিত্তও খেতুকে চক্ষুর আড় করিয়া আমি জীবিত থাকিতে পারিব না। না বাছা। এ প্রাণ থাকিতে আমি খেতুকে কোথাও পাঠাইতে পারিব না।”

রামহরি বলিলেন, “দেখুন, এখানে থাকিলে খেতুর লেখাপড়া হইবে না। মথুর চক্রবর্তীর অবস্থা কি ছিল জানেন তো? গাজনের শিবপূজা করিয়া অতি কষ্টে সংসার প্রতিপালন করিত। ‘গাজুনে বামুন’ বলিয়া সকলে তাহাকে ঘৃণা করিত। তাহার ছেলে আপনার বাসায় দিন কতক রাঁধুনী বামুন থাকে। অল্পবয়স্ক বালক দেখিয়া শিবকাকার দয়া হয়, তিনি তাহাকে স্কুলে দেন। এখন সে উকিল হইয়াছে। এখন সে একজন বড়লোক। পুরুষ মানুষে লেখা-পড়া না শিখিলে কি চলে?” খেতুর মা বলিলেন, “হাঁ সত্য কথা। তবে বুঝিয়া দেখ, আমার মার প্রাণ, আমি অনাথিনী সহায়হীনা বিধবা। পৃথিবীতে আমার কেহ নাই, এই এক রতি ছেলেটিকে লইয়া সংসারে আছি। খেতুকে আমি নিমেষে হারাই। খেলা করিয়া ঘরে আসিতে খেতুর একটু বিলম্ব হইলে, আমি যে কত কি কু ভাবি, তাহা আর কি বলিব?”

রামহরি বলিলেন, “খুড়ী-মা। ভয় করিবেন না। আমার নিজের ছেলের চেয়েও আমি খেতুর যত্ন করিব। শিবকাকার আমি অনেক খাইয়াছি। তাঁহার অনুগ্রহে আজ পরিবারবর্গকে এক মুঠা অন্ন দিতেছি। আজ তাঁহার ছেলে যে মূর্খ হইয়া থাকিবে, তাহা প্রাণে সহ্য হইবে না। খেতু কেমন আছে কেমন লেখাপড়া করিতেছে, সে বিষয়ে আমি সর্বদা আপনাকে পত্র লিখিব। আবার, খেতু যখন চিঠি লিখিতে শিখিবে, তখন সে নিজে আপনাকে চিঠি লিখিবে। পূজার সময়ও গ্রীষ্মের ছুটির সময় খেতুকে দেশে পাঠাইয়া দিব। বৎসরের মধ্যে দুই তিন মাস সে আপনার নিকট থাকিবে। আজ আমি এখন যাই আজ শুক্রবার। বুধবার ভাল দিন। সেইদিন খেতুকে লইয়া কলিকাতায় যাইব।”

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

নিরঞ্জন

তনু রায়ের সহিত নিরঞ্জন কবিরত্নের ভাব নাই। নিরঞ্জন তনু রায়ের প্রতিবেশী।

নিরঞ্জন বলেন, “রায় মহাশয়। কন্যার বিবাহ দিয়া টাকা লইবেন না, টাকা লইলে ঘোর পাপ হয়।”

তনু রায় তাই নিরঞ্জনকে দেখিতে পারেন না, নিরঞ্জনকে তিনি ঘৃণা করেন। যে দিন তনু রায়ের কন্যার বিবাহ হয়, নিরঞ্জন সেই দিন গ্রাম পরিত্যাগ করিয়া অপর গ্রামে গমন করেন। তিনি বলেন, “কন্যাবিক্রয় চক্ষে দেখিলে, কি সে কথা কর্ণে শুনিলেও পাপ হয়।” নিরঞ্জন অতি পণ্ডিত লোক। নানা শাস্ত্র তিনি অধ্যয়ন করিয়াছেন। বিদ্যা-শিক্ষার শেষ নাই, তাই রাত্রিদিন তিনি পুঁথি-পুস্তক লইয়া থাকেন।

লোকের কাছে আপনার বিদ্যার পরিচয় দিতে তিনি ভালবাসেন না। তাই জগৎ জুড়িয়া তাঁহার নাম হয় নাই। পূর্বে অনেকগুলি ছাত্র তাঁহার নিকট বিদ্যা-শিক্ষা করিত। দিবারাত্রি তাহাদিগকে বিদ্যা শিক্ষা দিয়া তিনি পরম পরিতোষ লাভ করিতেন। আহার পরিচ্ছদ দিয়া ছাত্রগুলিকে পুত্রের মত প্রতিপালন করিতেন। লোকের বাড়ি নিমন্ত্রণে গিয়া বিদায়ের জন্য তিনি মারামারি করিতেন না। কারণ, তাঁহার অবস্থা ভাল ছিল। পৈতৃক অনেক ব্রহ্মোত্তর ভূমি ছিল। গ্রামের জমিদার জনার্দন চৌধুরীর সহিত এই ভূমি লইয়া কিছু গোলমাল হয়। একদিন দুই প্রহরের সময় জমিদার এক জন পেয়াদা পাঠাইয়া দেন। পেয়াদা আসিয়া নিরঞ্জনকে বলে, “ঠাকুর। চৌধুরী মহাশয় তোমাকে ডাকিতেছেন, চল।”

নিরঞ্জন বলিলেন, “আমার আহার প্রস্তুত, আমি আহার করিতে যাইতেছি। আহার হইলে জমিদার মহাশয়ের নিকট যাইব। তুমি এক্ষণে যাও।”

পেয়াদা বলিল, “তাহা হইবে না, তোমাকে এই ক্ষণেই আমার সহিত যাইতে হইবে”। নিরঞ্জন বলিলেন, “বেলা দুই প্রহর অতীত হইয়া গিয়াছে, ঠাঁই হইয়াছে, ভাত প্রস্তুত। ভাত দুইটি মুখে দিয়া, চল, যাইতেছি। কারণ, আমি আহার না করিলে গৃহিণী আহার করিবেন না, ছাত্রগণেরও আহার হইবে না। সকলেই উপবাস থাকিবে।”

পেয়াদা বলিল, “তাহা হইবে না, তোমাকে এক্ষণেই যাইতে হইবে।”

নিরঞ্জন বলিলেন, “এই ক্ষণেই যাইতে হইবে, বটে? আচ্ছা, তবে চল যাই।”পেয়াদার সহিত নিরঞ্জন গিয়া জমিদারের বাটীতে উপস্থিত হইলেন। জনার্দন চৌধুরী বলিলেন, “কখন আপনাকে ডাকিতে পাঠাইয়াছি, আপনার যে আর আসিবার বার হয় না।”

নিরঞ্জন বলিলেন, “আজ্ঞা, হাঁ মহাশয়, আমার একটু বিলম্ব হইয়াছে।”

জমিদার বলিলেন, “বামুনমারীর মাঠে আপনার যে পঞ্চাশ বিঘা ব্রহ্মোত্তর ভূমি আছে, জরিপে তাহা পঞ্চান্ন বিঘা হইয়াছে। আপনার দলিলপত্র ভাল আছে, সে জন্য সবটুকু ভূমি আমি কাড়িয়া লইতে বাসনা করি না, তবে মাপে যেটুকু অধিক হইয়াছে, সেটুকু আমার প্রাপ্য।” নিরঞ্জন উত্তর করিলেন, “আজ্ঞা, হাঁ মহাশয়, দলিলপত্র আমার ভাল আছে। দেখুন দেখি, এই কাগজখানি কি না।”

জনার্দন চৌধুরী কাগজখানি হাতে লইয়া বলিলেন, “হাঁ এই কাগজখানি বটে, ইহা আমি পূর্বে দেখিয়াছি, এখন আর দেখিবার আবশ্যক নাই।”

এই কথা বলিয়া নিরঞ্জনের হাতে তিনি কাগজখানি ফিরাইয়া দিলেন। নিরঞ্জন কাগজখানি তামাক খাইবার আগুনের মালসায় ফেলিয়া দিলেন। দেখিতে দেখিতে কাগজখানি জ্বলিয়া উঠিল।

জমিদার বলিলেন, “হাঁ হাঁ, করেন কি, করেন কি?” নিরঞ্জন বলিলেন, “কেবল পাঁচ বিঘা কেন? আজ হইতে আমার সমুদয় ব্রহ্মোত্তর আপনার। যিনি জীব দিয়াছেন, নিরঞ্জনকে তিনি আহার দিবেন।”

পাছে ব্রহ্মশাপে পড়েন, সেজন্য জনার্দন চৌধুরীর ভয় হইল। তিনি বলিলেন, “দলিল গিয়াছে গিয়াছে, তাহাতে কোনও ক্ষতি নাই। আপনি ভূমি ভোগ করুন, আপনাকে আমি কিছু বলিব না।”

নিরঞ্জন উত্তর করিলেন, “না মহাশয়। জীব যিনি দিয়াছেন, আহার তিনি দিবেন। সেই দীনবন্ধুকে ধ্যান করিয়া তাঁহার প্রতি জীবন সমর্পণ করিয়া কালাতিপাত করাই ভাল। আমার ভূমি ছিল বলিয়াই তো আজ দুই প্রহরের সময় আপনার পেয়াদার নিষ্ঠুর বচন আমাকে শুনিতে হইল? সুতরাং সে ভূমিতে আর আমার কাজ নাই।” এই কথা বলিয়া নিরঞ্জন প্রস্থান করিলেন। নিরঞ্জনের সেই দিন হইতে অবস্থা মন্দ হইল। অতি কষ্টে তিনি দিনাতিপাত করিতে লাগিলেন। ছাত্রগণ একে একে তাঁহাকে ছাড়িয়া গোবর্ধন শিরোমণির চতুষ্পাঠিতে গেল।

গোবর্ধন শিরোমণি জনার্দন চৌধুরীর সভা-পন্ডিত। অনেকগুলি ছাত্রকে তিনি অন্নদান করেন। বিদ্যাদান করিবার তাঁহার অবকাশ নাই। চৌধুরী মহাশয়ের বাটিতে সকাল সন্ধ্যা উপস্থিত থাকিতে হয়, তাহা ব্যতীত অধ্যাপকের নিমন্ত্রণে সর্বদা তাঁহাকে নানা স্থানে গমনাগমন করিতে হয়। সুতরাং ছাত্রগণ আপনা-আপনি বিদ্যা শিক্ষা করে। সে জন্য কিন্তু কেহ দুঃখিত নয়। গোবর্ধন শিরোমণির উপর রাগ হয় না, অভিমানও হয় না। কারণ, তিনি অতি মধুরভাষী, বাক্যসুধা দান করিয়া সকলকেই পরিতুষ্ট করেন। বিশেষতঃ ধনবান লোক পাইলে শ্রাবণের বৃষ্টিধারায় তিনি বাক্যসুধা বর্ষণ করিতে থাকেন। তৃষিত চাতকের ন্যায় তাহারা সেই সুধা পান করেন।

একদিন জনার্দন চৌধুরীর বাটিতে আসিয়া তনু রায় শাস্ত্রবিচার করিতেছিলেন। নিরঞ্জন, গোবর্ধন প্রভৃতি সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

তনু রায় বলিলেন, “কন্যাদান করিয়া বংশজ কিঞ্চিৎ সম্মান গ্রহণ করিবে। শাস্ত্রে ইহার বিধি আছে”। নিরঞ্জন জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোন শাস্ত্রে আছে? এরূপ, শুল্ক গ্রহণ করা তো ধর্মশাস্ত্রে একেবারেই নিষিদ্ধ”।

গোবর্ধন চুপি চুপি বলিলেন, “বল না, মহাভারতে আছে।”

তনু রায় তাহা শুনিতে পাইলেন না। ভাবিয়া চিন্তিয়া বলিলেন, “দাতাকর্ণে আছে”।

এই কথা শুনিয়া নিরঞ্জন একটু হাসিলেন। নিরঞ্জনের হাসি দেখিয়া তনু রায়ের রাগ হইল।

নিরঞ্জন বলিলেন, রায় মহাশয়, “আপনি শাস্ত্র জানেন না, শাস্ত্র পড়েন নাই।” তনু রায় আর রাগ সংবরণ করিতে পারিলেন না। নিরঞ্জনের প্রতি নানা কটু কথা প্রয়োগ করিয়া অবশেষে বলিলেন, “আমি শাস্ত্র পড়ি নাই? ভাল, কিসের জন্য আমি পরের শাস্ত্র পড়িব? যদি মনে করি তো আমি নিজে কত শাস্ত্র করিতে পারি। যে নিজে শাস্ত্র করিতে পারে, সে পরের শাস্ত্র কেন পড়িবে?”

নিরঞ্জনকে এইবার পরাস্ত মানিতে হইল। তাঁহাকে স্বীকার করিতে হইল যে, যে লোক নিজে শাস্ত্র প্রণয়ন করিতে পারে, পরের শাস্ত্র তাহার পড়িবার আবশ্যক নাই।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

বিদায়

যে দিন রামহরির সহিত কথাবার্তা হইল, সেইদিন রাত্রিতে মা খেতুর গায়ে স্নেহের সহিত হাত রাখিয়া বলিলেন, “খেতু, বাবা, তোমাকে একটি কথা বলি”।

খেতু জিজ্ঞাসা করিল, “কি মা?”

মা উত্তর করিলেন, “বাছা, তোমার রামহরি দাদার সহিত তোমাকে কলিকাতায় যাইতে হইবে।” খেতু জিজ্ঞাসা করিল, “সে কোথায় মা?”

মা বলিলেন, “তোমার মনে পড়ে না? সেই যে-যেখানে গাড়ী-ঘোড়া আছে”।

খেতু বলিল, “সেইখানে? তুমি সঙ্গে যাইবে তো মা?”

মা উত্তর করিলেন, “না বাছা, আমি যাইব না, আমি এইখানেই থাকিব।”

খেতু বলিল, “তবে মা আমিও যাইব না।”

মা বলিলেন, “না গেলে বাছা চলিবে না। আমি মেয়েমানুষ, আমাকে যাইতে নাই। রামহরি দাদার সঙ্গে যাইবে, তাহাতে আর ভয় কি?”খেতু বলিল, “ভয়। ভয় মা আমি কিছুই করি না। তবে তোমার জন্য আমার মন কেমন করিবে। তাই মা বলিতেছি যে, যাইব না।”

মা বলিলেন, “খেতু সাধ করিয়া কি তোমাকে আমি কোথাও পাঠাই?। কি করি বাছা, না পাঠাইলে নয়, তাই পাঠাইতে চাই। তুমি এখন বড় হইয়াছ, এইবার তোমাকে স্কুলে পড়িতে হইবে। না পড়িলে শুনিলে মূর্খ হয়। মূর্খকে কেহ ভালবাসে না, কেহ আদর করে না। তুমি যদি স্কুলে যাও আর মন দিয়া লেখাপড়া কর, তাহা হইলে সকলেই তোমাকে ভালবাসিবে। আর খেতু, তোমার এই দুঃখিনী মার দুঃখ ঘুচিবে। এই দেখ, আমি আর সরু পইতা কাটিতে পারি না, চক্ষে দেখিতে পাই না। আর কিছু দিন পরে হয়তো মোটা পইতাও কাটিতে পারিব না। তখন বল, পয়সা কোথায় পাইব? লেখাপড়া শিখিয়া তুমি টাকা আনিতে পারিলে, আমাকে আর পইতা কাটিতে হইবে না।”খেতু বলিল, “মা, আমি যদি যাই, তুমি কাঁদিবে না?”

মা উত্তর করিলেন “না বাছা, কাঁদিব না।”

খেতু বলিল, “ওই যে মা কাঁদিতেছ।”

মা উত্তর করিলেন, “এখন কান্না পাইতেছে, ইহার পর আর কাঁদিব না”।

সেইদিন আহারাদির পর, খেতুর ছেঁড়া-খোঁড়া কাপড়গুলি মা সেলাই করিতে বসিলেন। খেতু বলিল, “মা। আমি ছেঁড়ার দুই ধার এক করিয়া ধরি, তুমি ওদিক্ হইতে সেলাই কর, তাহা হইলে শীঘ্র শীঘ্র হইবে।”

এইরূপে মাতা-পুত্রে কথা কহিতে কহিতে কাপড় সেলাই হইতে লাগিল। তাহার পর মা সেইগুলিকে, ক্ষারে কাচিয়া পরিষ্কার করিয়া লইলেন। খেতু কলিকাতায় যাইবে, তাহার আয়োজন এইরূপে হইতে লাগিল।

বৈকাল বেলা খেতু নিরঞ্জনের বাটি গেল। নিরঞ্জন ও নিরঞ্জনের স্ত্রীকে প্রণাম করিয়া পায়ের ধুলা লইয়া কলিকাতায় যাইবার কথা তাঁহাদিগকে বলিল। রামহরির নিকট নিরঞ্জন পূর্বেই সমস্ত কথা শুনিয়াছিলেন। এক্ষণে খেতুকে আশীর্বাদ করিয়া, নানারূপ উপদেশ দিয়া নিরঞ্জন বলিলেন, “খেতু, সর্বদা সত্য কথা বলিবে, মিথ্যা কখনও বলিও না। নীচতা ও নিষ্ঠুরতা পরিত্যাগ করিবে। যথাসাধ্য পরোপকার করিবে। ইহাই ধর্ম।”এইরূপে খেতু নিরঞ্জন কাকার নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিল। মঙ্গলবার রাত্রিতে মাতা-পুত্রের নিদ্রা হইল না। দুই জনে কেবল কথা কহিতে লাগিলেন, কথা আর ফুরায় না।

কতবার মা বলিলেন, “খেতু ঘুমাও, না ঘুমাইলে অসুখ করিবে।”

খেতু বলিল, “না মা, আজ রাত্রিতে ঘুম হইবে না। আর মা, কাল রাত্রিতে তো আর তোমার সঙ্গে কথা কহিতে পাইব না। কাল কতদূর চলিয়া যাইব। সে কথা যখন মা মনে করি, তখন আমার কান্না পায়।” প্রাতঃকালে রামহরি আসিলেন। খেতুর মা খেতুর কপালে দধির ফোঁটা করিয়া দিলেন, চাদরের খুঁটে বিল্বপত্র বাঁধিয়া দিলেন। নীরবে নিঃশব্দে রামহরির হাতের উপর খেতুর হাতটি দিলেন। চক্ষু ফাটিয়া জল আসিতে-ছিল, অনেক কষ্টে তাহা নিবারণ করিলেন।

অবশেষে ধীরে ধীরে কেবল এই কথাটি বলিলেন, “দু:খিনীর ধন তোমাকে দিলাম।”

রামহরি বলিলেন, “খেতু, মাকে নমষ্কার কর।”

খেতু প্রণাম করিল, রামহরি নিজেও প্রণাম করিয়া দুইজনে বিদায় হইলেন। যতক্ষণ দেখা গেল, ততক্ষণ খেতুর মা অনিমেষ নয়নে সেই পথপানে চাহিয়া রহিলেন। খেতুও মাঝে মাঝে পশ্চাৎ দিকে চাহিয়া মাকে দেখিতে লাগিল। যখন আর দেখা গেল না, তখন খেতুর মা পথের ধূলায় শুইয়া, পড়িলেন।

পথে পড়িয়া খেতুর মা কাঁদিতেছেন, এমন সময় তনু রায়ের স্ত্রী সেইখানে আসিলেন।

তাঁহার হাত ধরিয়া তুলিয়া ধীরে ধীরে তিনি বলিলেন, “দিদি, চুপ কর। চক্ষের জল ফেলিতে নাই, চক্ষের জল ফেলিলে ছেলের অমঙ্গল হয়।”খেতুর মা উত্তর করিলেন, “সব জানি বোন। কিন্তু কি করি? চক্ষের জল যে রাখিতে পারি না, আপনা-আপনি বাহির হইয়া পড়ে। আমি যে আজ পৃথিবী শূণ্য দেখিতেছি। কি করিয়া ঘরে যাই?”

তনু রায়ের স্ত্রী বলিলেন, “চল দিদি, ঘরে চল। সেইখানে বসিয়া চল খেতুর গল্প করি। আহা, খেতু কি গুণের ছেলে। দেশে এমন ছেলে নাই।” এই বলিয়া তনু রায়ের স্ত্রী খেতুর মার হাত ধরিয়া ঘরে লইয়া গেলেন। সেখানে অনেকক্ষণ ধরিয়া দুই জনে খেতুর গল্প করিলেন।

খেতু খাইয়া গিয়াছিল, তনু রায়ের স্ত্রী সেই বাসনগুলি মাজিলেন ও ঘর-দ্বার সব পরিষ্কার করিয়া দিলেন। বেলা হইলে খেতুর মা রাঁধিয়া খাইবেন, সে নিমিত্ত তরকারিগুলি কুটিয়া দিলেন, বাটনাটুকু বাটিয়া দিলেন। খেতুর মা বলিলেন, “থাক বোন থাক, আজ আর আমার খাওয়া দাওয়া। আজ আর আমি কিছু খাইব না।”

তনু রায়ের স্ত্রী বলিলেন, “না দিদি। উপবাসী কি থাকিতে আছে? খেতুর অকল্যান হইবে”।

“খেতুর অকল্যাণ হইবে” এই কথাটি বলিতেই খেতুর মা চুপ। যাহা করিলে খেতুর অকল্যাণ হয় তাহা কি তিনি করিতে পারেন?

তনু রায়ের স্ত্রী পুনরায় বলিলেন, “এই সব ঠিক করিয়া দিলাম। বেলা হইলে রান্না চড়াইয়া দিও। কাজ-কর্মসারা হইলে আমি আবার ও বেলা আসিব।” অপরাহ্ণে তনু রায়ের স্ত্রী পুনরায় আসিলেন। কোলের মেয়েটিকে সঙ্গে আনিয়াছিলেন।

খেতুর মা বলিলেন, “আহা। কি সুন্দর মেয়েটি বোন। যেমন মুখ, তেমনি চুল, তেমনি রং।”

তনু রায়ের স্ত্রী বলিলেন, “হাঁ। সকলেই বলে, তোমার গর্ভের এ কন্যাটি সুন্দর। তা দিদি। এ পোড়া পেটে কেন যে এরা আসে? মেয়ে হইলে ঘরের মানুষটি আহ্লাদে আটখানা হন। কিন্তু আমার মনে হয় যে, আঁতুড় ঘরেই মুখে নুন দিয়া মারি। গ্রীষ্মকালে একাদশীর দিন, মেয়ে দুইটির যখন মুখ শুকাইয়া যায়, যখন একটু জলের জন্য বাছাদের প্রাণ টা টা করে বল দেখি দিদি। মার প্রাণ তখন কিরূপ হয়? পোড়া নিয়ম।” খেতুর মাতে আর তনু রায়ের স্ত্রীতে নানারূপ কথাবার্তা হইতে লাগিল। খেতুর মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার এ মেয়েটি বুঝি এক বৎসরের হইল?”

তনু রায়ের স্ত্রী উত্তর করিলেন, “হাঁ এই এক বৎসর পার হইয়া দুই বৎসরে পড়িবে”।

খেতুর মা পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “মেয়েটির নাম রাখিয়াছ কি?”

তনু রায়ের স্ত্রী উত্তর করিলেন, “ইহার নাম হইয়াছে কঙ্কাবতী”।খেতুর মা বলিলেন, “কঙ্কাবতী। দিব্য নামটি তো? মেয়েটিও যেমন নরম নরম দেখিতে, নামটিও সেইরূপ নরম নরম শুনিতে।”

এইরূপ খেতুর মা-তে আর তনু রায়ের স্ত্রী-তে ক্রমে ক্রমে বড়ই সদ্ভাব হইল। অবসর পাইলে তনু রায়ের স্ত্রী খেতুর মার কাছে আসেন, আর খেতুর মাও তনু রায়ের বাটিতে যান। মাঝে মাঝে তনু রায়ের স্ত্রী কঙ্কাবতীকে খেতুর মার কাছে ছাড়িয়া যান।

মেয়েটি এখনও হাঁটিতে শিখে নাই। হামাগুড়ি দিয়া চারিদিকে বেড়ায়, কখনও বা বসিয়া খেলা করে, কখনও বা কিছু ধরিয়া দাঁড়ায়। খেতুর মা আপনার কাজ করেন ও তাহার সহিত দুটি একটি কথা কহেন। কথা কহিলে মেয়েটি ফিক্ ফিক্ করিয়া হাসে, মুখে হাসি ধরে না। মেয়েটি বড় শান্ত, কাঁদিতে একেবারে জানে না।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

বালক-বালিকা

বাড়ী যাইবার দিন নিকট হইল। এখানে খেতুর মনে, আর সেখানে মার মনে আনন্দ আর ধরে না। তসর ও গালার ব্যবসায়ীরা সকলে এখন দেশে যাইতেছিল। তাহাদের সহিত রামহরি খেতুকে পাঠাইয়া দিলেন, আর কবে কোন্ সময় দেশে পৌঁছিবে, সে সমাচার আগে থাকিতে খেতুর মাকে লিখিলেন।

দত্তদের পুকুরধারে কেন, খেতুর মা আরও অনেক দূরে গিয়া দাঁড়াইয়া ছিলেন। দূর হইতে খেতু মাকে দেখিতে পাইয়া ছুটিয়া গিয়া তাহাকে ধরিল। খেতুর মা ছেলেকে বুকে করিয়া স্বর্গসুখ লাভ করিলেন।

খেতু বলিল, “ওই যা! মা, আমি তোমাকে প্রণাম করিতে ভুলিয়া গিয়াছি।”মা উত্তর করিলেন, “থাক্, আর প্রণামে কাজ নাই। অমনি তোমাকে আশীর্বাদ করি তুমি চিরজীবী হও, তোমার সোনার দোয়াত-কলম হউক্।”

খেতু বলিল, “মা, আমি মনে করিয়াছিলাম, তুমি দত্তদের পুকুরধারে থাকিবে, এত দূরে আসিবে তাহা জানিতাম না।”

মা বলিলেন, “বাছা, যদি উপায় থাকিত, তো আমি কলিকাতা পর্যন্ত যাইতাম। খেতু, তুমি রোগা হইয়া গিয়াছ।”

খেতু উত্তর করিল, “না মা, রোগা হই নাই, পথে একটু কষ্ট হইয়াছে তাই রোগা রোগা দেখাইতেছে”। পরদিন খেতু দেখিল যে তাহাদের বাটিতে কোথা হইতে একটি ছোট মেয়ে আসিয়াছে।

খেতু জিজ্ঞাসা করিল, মা, ও মেয়েটি কাদের গো?”

মা বলিলেন, “জান না? ও যে তোমার তনু কাকার ছোট মেয়ে। ওর নাম কঙ্কাবতী।” তনু রায়ের স্ত্রী এখন সর্বদাই আমার নিকট আসেন। আমি পইতা কাটি, আর দুই জনে বসিয়া গল্প করি। মেয়েটিকে তিনি আমার কাছে মাঝে মাঝে ছাড়িয়া যান। মেয়েটি আপনার মনে খেলা করে কোনওরূপ উপদ্রব করে না। আমার কাছে থাকিতে ভালবাসে। তনু রায়ের সহিত খেতুর কোনও সম্পর্ক নাই, কেবল পাড়া-প্রতিবেশী, সুবাদে কাকা কাকা করিয়া ডাকে।

কঙ্কাবতীকে খেতু বলিল, “এস, এই দিকে এস।”

কঙ্কাবতী সেই দিকে যাইতে লাগিল। খেতু বলিল “দেখ দেখ মা, এ কেমন টল্ টল্ করিয়া চলে”।

খেতুর মা বলিলেন, ‘পা এখনও শক্ত হয় নাই।”

একটি পাতা দেখাইয়া খেতু বলিল, “এই নাও।” পাতাটি লইবার নিমিত্ত কঙ্কাবতী হাত বাড়াইল ও হাসিল।

খেতু বলিল, “মা, কেমন হাসে দেখ।”

মা উত্তর করিলেন, “হাঁ বাছা, মেয়েটি খুব হাসে, কাঁদিতে একেবারে জানে না, অতি শান্ত”।

খেতু বলিল, “মা, আগে যদি জানিতাম, তো ইহার জন্য একটি পুতুল কিনিয়া আনিতাম”।

মা বলিলেন, “এইবার যখন আসিবে, তখন আনিও।” পূজার ছুটি ফুরাইলে খেতু কলিকাতায় চলিয়া গেল। সেখানে অতি মনোযোগের সহিত লেখাপড়া করিতে লাগিল। বৎসরের মধ্যে দুইবার ছুটি হইলে সে বাটি আসে। সেই সময় মার জন্য কোনও না কোনও দ্রব্য, আর কঙ্কাবতীর জন্য পুতুলটি খেলনাটি লইয়া আসে। খেতুর মার নিকট কঙ্কাবতী সর্বদাই থাকে, কঙ্কাবতীকে তিনি বড় ভালবাসেন।

খেতুর যখন বার বৎসর বয়স, তখন সে একটি বড়মানুষের ছেলেকে পড়াইতে লাগিল। বালকের পিতা খেতুকে মাসে পাঁচ টাকা করিয়া দিতেন। প্রথম মাসের টাকা কয়টি, খেতু রামহরির হাতে দিয়া বলিল, “দাদা মহাশয়। এ মাস হইতে মার চাউলের দাম আর আপনি দিবেন না, এই টাকা মাকে দিবেন। আমি শুনিয়াছি, আপনার ধার হইয়াছে তাই যত্ন করিয়া আমি এই টাকা উপার্জন করিয়াছি।”

রামহরি বলিলেন, “খেতু, তুমি উত্তম করিয়াছ। উদ্যম, উৎসাহ, পৌরুষ মনুষ্যের নিতান্ত প্রয়োজন। এ টাকা আমি তোমার মার নিকট পাঠাইয়া দিব। তাঁহাকে লিখিব যে, তুমি নিজে এ টাকা উপার্জন করিয়াছ। আর আমি সকলকে বলিব যে, দ্বাদশ বৎসরের শিশু আমাদের খেতু, তাহার মাকে প্রতিপালন করিতেছে।” এইবার যখন খেতু বাটি আসিল, তখন মার জন্য একখানি নামাবলী, আর কঙ্কাবতীর জন্য একখানি রাঙা কাপড় আনিল। রাঙা কাপড়খানি পাইয়া কঙ্কাবতীর আর আহ্লাদ ধরে না। ছুটিয়া তাহার মাকে দেখাইতে গেল।

খেতু বলিল, “মা, কঙ্কাবতীকে লেখাপড়া শিখাইলে হয় না?”

মা বলিলেন, “কি জানি বাছা। তনু রায় এক প্রকারের লোক। কি বলিতে কি বলিয়া বসিবে।”

খেতু বলিল, “তাহাতে আর দোষ কি, মা? কলিকাতায় কত মেয়ে স্কুলে যায়।”

মা বলিলেন, “কঙ্কাবতীর মাকে এ কথা জিজ্ঞাসা করিয়া দেখিব”। সেই দিন তনু রায়ের স্ত্রী আসিলে, খেতুর মা কথায় কথায় বলিলেন, “খেতু বলিতেছে, এবার যখন বাটী আসিব, তখন কঙ্কাবতীর জন্য একখানি বই আনিব, কঙ্কাবতীকে একটু একটু পড়িতে শিখাইব। আমি বলিলাম না বাছা। তাতে আর কাজ নাই, তোমার তনু কাকা হয় তো রাগ করিবেন”।

তনু রায়ের স্ত্রী উত্তর করিলেন, “তাহাতে আবার রাগ কি? আজকাল তো ওই সব হইয়াছে। জামা গায়ে দেওয়া, লেখা পড়া করা, আজকাল তো সকল মেয়েই করে। তবে আমাদের পাড়াগাঁ, তাই এখানে ও-সব নাই।

বাটি গিয়া কঙ্কাবতীর মা স্বামীকে বলিলেন, “খেতু বাড়ী আসিয়াছে। কঙ্কাবতীর জন্য কেমন একখানি রাঙা কাপড় আনিয়াছে”।তনু রায় বলিলেন, “খেতু ছেলেটি ভাল। লেখাপড়ায় মন আছে। দুই-পয়সা আনিয়া খাইতে পারিবে। তবে বাপের মতো ডোকলা না হয়।”

স্ত্রী বলিলেন, “খেতু বলিতেছিল যে, এইবার যখন বাটি আসিব, তখন একখানি বই আনিয়া কঙ্কাবতীকে একটু একটু পড়িতে শিখাইব।”

তনু রায় বলিলেন, “আচ্ছা, খেতু যদি কঙ্কাবতীকে একটু আধটু পড়িতে শিখায়, তাহাতে আমার বিশেষ কোনও আপত্তি নাই। তনু রায়ের স্ত্রী সেই কথা খেতুর মাকে বলিলেন। খেতুর মা সেই কথা খেতুকে বলিলেন। এবার যখন খেতু বাটি আসিল, তখন কঙ্কাবতীর জন্য একখানি প্রথমভাগ বর্ণপরিচয় আনিল। লেখাপড়া শিখিব, এই কথা মনে করিয়া প্রথম প্রথম কঙ্কাবতীর খুব আহ্লাদ হইল। কিন্তু দুই চারি দিন পরেই সে জানিতে পারিল যে, লেখাপড়া শিক্ষা করা নিতান্ত আমোদের কথা নহে। কঙ্কাবতীর চক্ষে অক্ষরগুলি সব এক প্রকার দেখায়। কঙ্কাবতী এটি বলিতে সেটি বলিয়া ফেলে।

খেতুর রাগ হইল। খেতু বলিল, “কঙ্কাবতী, তোমার লেখাপড়া হইবে না। চিরকাল মূর্খ হইয়া থাকিবে।” কঙ্কাবতী অভিমানে কাঁদিয়া ফেলিল। সে বলিল, “আমি কি করিব, আমার যে মনে থাকে না।”

খেতুর মা বলিলেন, “ছেলেমানুষকে কি বকিতে আছে? মিষ্ট কথা বলিয়া শিখাইতে হয়। আইস মা, তুমি আমার কাছে আইস, তোমার আর লেখাপড়া শিখিতে হইবে না।”

খেতু বলিল, “মা, কঙ্কাবতী রাত্রি দিন মেনিকে লইয়া থাকে। তাহাতে কি আর লেখাপড়া হয়?”

মেনি কঙ্কাবতীর বিড়াল। অতি আদরের ধন মেনি। কঙ্কাবতী বলিল, “জেঠাইমা। আমি মেনিকে ক খ শিখাই, তা আমিও যেমন বোকা, মেনিও তেমনি বোকা। কেমন মেনি, না? মেনিও পড়িতে পারেনা, আমিও পড়িতে পারি না। আমিও ছেলে মানুষ, মেনিও ছেলেমানুষ। আমিও বড় হইলে পড়িতে শিখিব, মেনিও বড় হইলে পড়িতে শিখিবে। না, মেনি?”

খেতু হাসিয়া উঠিল।

যাহা হউক, ক্রমে কঙ্কাবতীর প্রথমভাগ বর্ণ-পরিচয় সায় হইল। খেতু বলিল, “আমি শীঘ্র কলিকাতায় যাইব। তাড়াতাড়ি করিয়া প্রথমভাগ খানি শেষ করিলাম, কিন্তু ভাল করিয়া হইল না। এই কয় মাসে পুস্তকখানি একবারে মুখস্থ করিয়া রাখিবে। এবার আমি দ্বিতীয়ভাগ লইয়া আসিব। পুনরায় যখন খেতু বাটি আসিল, তখন কঙ্কাবতীর দ্বিতীয়ভাগ শেষ হইল। কঙ্কাবতীকে আর পড়াইতে হইল না। কঙ্কাবতী এখন আপনা-আপনি সব পড়িতে শিখিল। খেতু কঙ্কাবতীকে একখানি পাটিগণিত দিয়াছিল। তাহা দেখিয়া কঙ্কাবতী অঙ্ক শিখিল। মাঝে মাঝে খেতু কেবল একটু আধটু বলিয়া দিত।

কঙ্কাবতী পড়িতে বড় ভালবাসিত। কলিকাতা হইতে খেতু তাহাকে নানা পুস্তক ও সংবাদপত্র পাঠাইয়া দিত। সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনগুলি পর্যন্ত কঙ্কাবতী পড়িত। রামহরির কন্যা সীতার এখন সাত বৎসর বয়স। মা একেলা থাকেন, সেইজন্য দাদাকে বলিয়া, খেতু সীতাকে মার নিকট পাঠাইয়া দিল। সীতাকে পাইয়া খেতুর মার আর আনন্দের অবধি নাই।

কঙ্কাবতীও সীতাকে খুব ভালবাসিত। বৈকাল বেলা দুইজনে গিয়া বাগানে বসিত। কঙ্কাবতী এখন খেতুর সম্মুখে বড় বাহির হয় না। খেতুকে দেখিলে কঙ্কাবতীর এখন লজ্জা করে। তবে খেতুর গল্প করিতে, খেতুর গল্প শুনিতে সে ভালবাসে। অন্য লোকের সহিত খেতুর গল্প করিতে, কিংবা অন্য লোকের মুখে খেতুর কথা শুনিতে, তাহার লজ্জা করিত। এসব কথা সীতার সহিত হইত। বৈকাল বেলা দুইজনে ফুলের বাগানে যাইত। নানা ফুলে মালা গাঁথিয়া কঙ্কাবতী সীতাকে সাজাইত। ফুল দিয়া নানারূপ গহনা গড়িত। গলায়, হাতে, মাথায়, যেখানে যাহা ধরিত, কঙ্কাবতী সীতাকে ফুলের গহনা পরাইত। তাহার পর সীতার মুখ হইতে বসিয়া বসিয়া খেতুর কথা শুনিত।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

সম্বন্ধ

তের বৎসর বয়সে খেতু ইংরেজীতে প্রথম পাসটি দিল। পাস দিয়া জলপানি পাইল। জলপানি পাইয়া মার জন্য সে একটি ঝি নিযুক্ত করিয়া দিল। মা বৃদ্ধ হইতেছেন, মার যেন কোনও কষ্ট না হয়। এটি সেটি আনিয়া, কাপড়খানি চোপড়খানি কিনিয়া রামহরির সংসারেও সে সহায়তা করিতে লাগিল।

পনর বৎসর বয়সে খেতু আর একটি পাস দিল। জলপানি বাড়িল। সতর বৎসর বয়সে আর একটি পাস দিল। জলপানি আরও বাড়িল। খেতু টাকা পাইতে লাগিল, সেই টাকা দিয়া মার দুঃখ সম্পূর্ণরূপে ঘুচাইল। মা যখন যাহা চাহেন, তৎক্ষণাৎ তাহা পান। তাহার আর কিছুমাত্র অভাব রহিল না। খেতু তিনটা পাস দিল, কন্যাভারগ্রস্ত লোকেরা রামহরির নিকট আনা-গোনা করিতে লাগিল। সকলের ইচ্ছা খেতুর সহিত কন্যার বিবাহ দেয়। কেহ বলে, “আমি এত সোনা দিব, এত টাকা দিব।” আবার কেহ বলে, “আমি এত দিব, তত দিব।” এইরূপে সকলে নিলাম ডাকাডাকি করিতে লাগিল।

রামহরি সকলকে বুঝাইয়া বলিলেন যে, যতদিন না খেতুর লেখাপড়া সমাপ্ত হয়, যতদিন না খেতু দুপয়সা উপার্জন করিতে পারে, ততদিন খেতুর বিবাহ দিবেন না। কিন্তু কন্যাভারগ্রস্ত লোকেরা সে কথা শুনিবে কেন? রামহরির নিকট তাহারা নানারূপ মিনতি করিতে লাগিল। অবশেষে রামহরি মনে করিলেন, দুর হউক। একস্থানে কথা দিয়ে রাখি। তাহা হইলে সকলে আর আমাকে এরূপ ব্যস্ত করিবে না। এই মনে করিয়া তিনি অনেকগুলি কন্যা দেখিলেন। শেষে জন্মেঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যাকে তিনি মনোনীত করিলেন। জন্মেঞ্জয়বাবু সংগতিপন্ন লোক ও সদ্বংশজাত। রামহরি কিন্তু তাহাকে সঠিক কথা দিতে পারিলেন না। খেতুর মার মত না লইয়া কি করিয়া তিনি কথা স্থির করেন?এদিকে কঙ্কাবতীর যতই বয়স হইতে লাগিল, ততই তাহার রূপ বাড়িতে লাগিল। কঙ্কাবতীর রূপে দশদিক আলো। কঙ্কাবতীর পানে চাওয়া যায় না। রংটি উজ্জ্বল ধবধবে, ভিতর হইতে যেন জ্যোতি বাহির হইতেছে। জল খাইলে যেন জল দেখা যায়। শরীরটি স্থূলও নয়, কৃশও নয়, যেন পুতুলটি, কি ছবিখানি। মুখখানি যেন বিধাতা কুঁদে কাটিয়াছেন। নাকটি টিকালো-টিকালো, চক্ষু দুটি টানা, চক্ষুর পাতা দীর্ঘ, ঘন ও ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। চক্ষু কিঞ্চিৎ নীচে করিলে পাতার উপর পাতা পড়িয়া এক অদ্ভুত শোভার আবির্ভাব হয়। এইরূপ চক্ষু দুইটির উপর যেরূপ সরু সরু, কাল কাল, ঘন ভুরুতে মানায়, কঙ্কাবতীর তাহাই ছিল। গাল দুটি নিতান্ত পূর্ণ নহে, কিন্তু হাসিলে টোল পড়ে। তখন সেই হাসিমাখা টোল খাওয়া মুখখানি দেখিলে শত্রুর মনও মুগ্ধ হয়। ঠোঁট দুটি পাতলা। পান খাইতে হয় না, আপনা-আপনি সদাই টুকটুক করে। কথা কহিবার সময় ঠোঁটের ভিতর দিয়া, সাদা দুধের মত দুই চারিটি দাঁত দেখিতে পাওয়া যায়, তখন দাঁতগুলি যেন ঝকঝক করিতে থাকে। কঙ্কাবতীর খুব চুল, ঘোর কাল। ছাড়িয়া দিলে, কোঁকড়া কোঁকড়া হইয়া পিঠের উপর গিয়া পড়ে। সম্মুখের সিঁথিটি কে যেন তুলি দিয়া ঈষৎ সাদা রেখা টানিয়া দিয়াছে। ফল কথা, কঙ্কাবতী একটি প্রকৃত সুন্দরী, পথের লোককে চাহিয়া দেখিতে হয়, বার বার দেখিয়াও আশা মিটে না। সমবয়স্কা বালিকাদিগের সহিত কঙ্কাবতী যখন দৌড়াদৌড়ি করিয়া খেলা করে, তখন যথার্থই যেন বিজলী খেলিয়া বেড়ায়। একদিন মা কঙ্কাবতীকে দেখাইয়া তনু রায়কে বলিলেন, “তোমার মেয়ের পানে একবার চাহিয়া দেখ। এ সোনার প্রতিমাকে তুমি জলাঞ্জলি দিও না। কঙ্কাবতী স্বয়ং লক্ষ্মী। এমন সুলক্ষণা মেয়ে জনমে কি কখনও দেখিয়াছ? মা যদি এই অভাগার কুটীরে আসিয়াছে তো মাকে হেনস্তা করিও না। মা যেরূপ লক্ষ্মী, সেইরূপ নারায়ণ দেখিয়া মার বিবাহ দিও। এবার আমার কথা শুনিও।”

কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া তনু রায় বলিলেন, “আচ্ছা, আমি না হয় কঙ্কাবতীর বিবাহ দিয়া টাকা না লইলাম, কিন্তু ঘর হইতে টাকা তো আর দিতে পারিব না? আজ কাল যেরূপ বাজার পড়িয়াছে, টাকা না দিলে সুপাত্র মিলে না। তাহার কি করিব?” স্ত্রী উত্তর করিলেন, “আচ্ছা, আমি যদি বিনা টাকায় সুপাত্রের সন্ধান করিয়া দিতে পারি, তুমি তাহার সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ দিবে কি না, তাহা আমাকে বল?”

তনু রায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথায়? কে?”

স্ত্রী বলিলেন, “বৃদ্ধ হইলে চক্ষুর দোষ হয়, বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ হয়। চক্ষুর উপর দেখিয়াও দেখিতে পাও না?”

তনু রায় বলিলেন, “কে বল না শুনি?”

স্ত্রী উত্তর করিলেন “কেন, খেতু?” তনু রায় বলিলেন, “তাহা কি কখনও হয়? বিষয় নাই, বন্ধু নাই, বান্ধব নাই। এরূপ পাত্রে আমি কঙ্কাবতীকে কি করিয়া দিই?―ভাল, আমি না হয় কিছু না লইলাম, মেয়েটি যাহাতে সুখে থাকে, দুখানা গহনা-গাঁটি পরিতে পায়, তাহা তো আমাকে করিতে হইবে?”

তনু রায়ের স্ত্রী উত্তর করিলেন, “খেতুর কি কখনও ভাল হইবে না? তুমি নিজেই না বল যে, খেতু ছেলেটি ভাল, খেতু দু-পয়সা আনিতে পারিবে? যদি কপালে থাকে তো খেতু হইতেই কঙ্কাবতী কত গহনা পরিবে। কিন্তু গহনা হউক আর না হউক, ছেলেটি ভাল হয়, এই আমার মনের বাসনা। খেতুর মত ছেলে পৃথিবী খুঁজিয়া কোথায় পাইবে বল দেখি? মা কঙ্কাবতী,আমার যেমন লক্ষ্মী, খেতু তেমনি দুর্লভ সুপাত্র। এক বোঁটায় দুইটি ফুল সাধ করিয়া বিধাতা যেন গড়িয়াছেন।” তনু রায় বলিলেন, “ভাল, সে কথা তখন পরে বুঝা যাইবে। এখন তাড়াতাড়ি কিছু নাই।”

আরও কিছুদিন গত হইল। কলিকাতা হইতে খেতুর মার নিকট একখানি চিঠি আসিল। সেই চিঠিখানি তিনি তনু রায়কে দিয়া পড়াইলেন। পত্রখানি রামহরি লিখিয়াছিলেন। তাহার মর্ম এইঃ

“খেতুর বিবাহের জন্য অনেক লোক আমার নিকট আসিতেছে। আমাকে তাহারা বড়ই ব্যস্ত করিয়া তুলিয়াছে। আমার ইচ্ছা যে লেখাপড়া সমাপ্ত হইলে, তাহার পর খেতুর বিবাহ দিই। কিন্তু কন্যাদায়গ্রস্ত ব্যক্তিগণ সে কথা শুনিবে কেন? তাহারা বলে, কথা স্থির হইয়া থাকুক, বিবাহ না হয় পরে হইবে। আমি অনেকগুলি কন্যা দেখিয়াছি। তাহাদিগের মধ্যে জন্মেঞ্জয়বাবুর কন্যা আমার মনোনীত হইয়াছে। কন্যাটি সুন্দরী, ধীর ও শান্ত। বংশ সৎ, কোনও দোষ নাই। মাতাপিতা, ভাই-ভগিনী বর্তমান। কন্যার পিতা সংগতিপন্ন লোক। কন্যাকে নানা অলংকার ও জামাতাকে নানা ধন দিয়া বিবাহকার্য সমাধা করিবেন। এক্ষণে আপনার কি মত জানিতে পারিলে; কন্যার পিতাকে আমি সঠিক কথা দিব।” পত্রখানি পড়িয়া তনু রায় অবাক। দুঃখী বলিয়া যে খেতুকে তিনি কন্যা দিতে অস্বীকার করেন, আজ নানা ধন দিয়া সেই খেতুকে জামাতা করিবার নিমিত্ত লোকে আরাধনা করিতেছে।

খেতুর মা রামহরিকে উত্তর লিখিলেন, “আমি স্ত্রীলোক, আমাকে আবার জিজ্ঞাসা করা কেন?” তুমি যাহা করিবে, তাহাই হইবে। তবে আমার মনে একটি বাসনা ছিল, যখন দেখিতেছি, সে বাসনা পূর্ণ হইবার নহে, তখন সে কথায় আর আবশ্যক নাই।

এই পত্র পাইয়া রামহরি খেতুকে সকল কথা বলিলেন, আর এ বিষয়ে খেতুর কি মত, তাহা জিজ্ঞাসা করিলেন। খেতু বলিল, “দাদা মহাশয়। মার মনের বাসনা কি, তাহা আমি বুঝিয়াছি। যতদিন মার সাধ পূর্ণ হইবার কিছুমাত্রও আশা থাকিবে, ততদিন কোনও স্থানে আপনি কথা দিবেন না।”

রামহরি বলিলেন, “হাঁ, তাহাই উচিত। তোমার বিবাহ বিষয়ে আমি এক্ষণে কোনও স্থানে কথা দিব না।”

খেতুর অন্য স্থানে বিবাহ হইবে, এই কথা শুনিয়া কঙ্কাবতীর মা একেবারে শরীর ঢালিয়া দিলেন। স্বামীর নিকট রাত্রি-দিন কান্নাকাটি, করিতে লাগিলেন। এদিকে তনু রায়ও কিছু চিন্তিত হইলেন। তিনি ভাবিলেন, আমি বৃদ্ধ হইয়াছি। দুইটি বিধবা গলায়, পুত্রটি মূর্খ। এখন একটি অভিভাবকের প্রয়োজন। খেতু যেরূপ বিদ্যাশিক্ষা করিতেছে, খেতু যেরূপ সুবোধ, তাহাতে পরে তাহার নিশ্চয় ভাল হইবে। আমাকে সে একেবারে এখন কিছু না দিতে পারে, না পারুক। পরে, মাসে মাসে আমি তাহার নিকট হইতে কিছু কিছু লইব।” এইরূপ ভাবিয়া চিন্তিয়া তনু রায় স্ত্রীকে বলিলেন, “তুমি যদি খেতুর সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ স্থির করিতে পার, তাহাতে আমার আপত্তি নাই। কিন্তু আমি খরচ-পত্র কিছু করিতে পারিব না।”

এইরূপ অনুমতি পাইয়া তনু রায়ের স্ত্রী তৎক্ষণাৎ খেতুর মার নিকট গেলেন, আর খেতুর মার পায়ের ধূলা লইয়া তাঁহাকে সকল কথা বলিলেন।

খেতুর মা বলিলেন, “কঙ্কাবতী আমার বউ হইবে, চিরকাল আমার এই সাধ। কিন্তু বোন, দুইদিন আগে যদি বলিতে? অন্য স্থানে কথা স্থির করিতে আমি রামহরিকে চিঠি লিখিয়াছি। রামহরি যদি কোনও স্থানে কথা দিয়া থাকে, তাহা হইলে সে কথা আর নড়িবার নয়। তাই আমার মনে বড় ভয় হইতেছে।” তনু রায়ের স্ত্রী বলিলেন, “দিদি। যখন তোমার মত আছে, তখন নিশ্চয় কঙ্কাবতীর সহিত খেতুর বিবাহ হইবে। তুমি একখানি চিঠি লিখিয়া রাখ। চিঠিখানি লোক দিয়া পাঠাইয়া দিব।”

তাহার পরদিন খেতুর মা ও কঙ্কাবতীর মা দুই জনে মিলিয়া কলিকাতায় লোক পাঠাইলেন। খেতুর মা রামহরিকে একখানি পত্র লিখিলেন।

খেতুর মা লিখিলেন : “কঙ্কাবতীর সহিত খেতুর বিবাহ হয়, এই আমার মনের বাসনা। এক্ষণে তনু রায় ও তাঁহার স্ত্রী, সেই জন্য আমার নিকট আসিয়াছেন অন্য কোনও স্থানে যদি খেতুর বিবাহের কথা স্থির না হইয়া থাকে, তাহা হইলে তোমরা কঙ্কাবতীর সহিত স্থির করিয়া তনু রায়কে পত্র লিখিবে।” এই চিঠি পাইয়া রামহরি, তাঁহার স্ত্রী ও খেতু, সকলেই আনন্দিত হইলেন।

খেতুর হাতে পত্রখানি দিয়া রামহরি বলিলেন, “তোমার মার আজ্ঞা, ইহার উপর আর কথা নাই।”

খেতু বলিল, “মার যেরূপ অনুমতি, সেইরূপ হইবে। তবে তাড়াতাড়ি কিছুই নাই। তনু কাকা তো মেয়েগুলিকে বড় করিয়া বিবাহ দেন। আর দুই তিন বৎসর তিনি অনায়াসেই রাখিতে পারিবেন। তত দিনে আমার সব পাসগুলিও হইয়া যাইবে। তত দিনে আমিও দুপয়সা আনিতে পারিব। আপনি এই মর্মে তনু কাকাকে পত্র লিখুন।” রামহরি তনু রায়কে সেইরূপ পত্র লিখিলেন। তনু রায় সে কথা স্বীকার করিলেন। বিলম্ব হইল বলিয়া তাঁহার কিছুমাত্র দুঃখ হইল না, বরং তিনি আহ্লাদিত হইলেন।

তিনি মনে করিলেন, স্ত্রীর কান্নাকাটিতে আপাততঃ এ কথা স্বীকার করিলাম, দেখি না, খেতুর চেয়ে ভাল পাত্র পাই কি না? যদি পাই―। আচ্ছা, সে কথা তখন পরে বুঝা যাইবে।

খেতুর মা নিরঞ্জনকে সকল কথা বলিয়াছিলেন। নিরঞ্জন মনে করিলেন, বৃদ্ধ হইয়া তনু রায়ের ধর্মে মতি হইতেছে। কঙ্কাবতী আজ কয়দিন বিরস-বদনে ছিল। সকলে আজ কঙ্কাবতীর হাসি-হাসি মুখ দেখিল। সেই দিন মেনিকে কোলে লইয়া বিরলে বসিয়া কত যে তাহাকে মনের কথা বলিল, তাহা আর কি বলিব। মেনি এখন আর শিশু নহে, বড় একটি বিড়াল। সুতরাং কঙ্কাবতী যে তাহাকে মনের কথা বলিবে, তাহার আর আশ্চর্য কি?

সপ্তম পরিচ্ছেদ

বিড়ম্বনা

দেখিতে দেখিতে তিন বৎসর কাটিয়া গেল। খেতুর এক্ষণে কুড়ি বৎসর বয়স। যাহা কিছু পাস ছিল, খেতু সবগুলি পাস দিল। বাহিরেরও দুই একটি পাস দিল। শীঘ্র একটি উচ্চপদ পাইবে, খেতু এরূপ আশা পাইল। রামহরি ও রামহরির স্ত্রী ভাবিলেন যে, এক্ষণে খেতুর বিবাহ দিতে হইবে। দিন স্থির করিবার নিমিত্ত তাঁহারা খেতুর মাকে পত্র লিখিলেন।

পত্রের প্রত্যুত্তরে খেতুর মা অন্যান্য কথা বলিয়া অবশেষে লিখিলেন, “তনু রায়কে বিবাহের কথা কিছু বলিতে পারি নাই। আজকাল সে বড়ই ব্যস্ত, তাহার দেখা পাওয়া ভার। জনার্দন চৌধুরীর স্ত্রী বিয়োগ হইয়াছে। মহাসমারোহে শ্রাদ্ধ হইবে, এই কার্যে তনু রায় একজন কর্তা হইয়াছে। জনার্দন চৌধুরীর স্ত্রীর ধন্য কপাল। পুত্র, পৌত্র, দৌহিত্র চারিদিকে জাজ্বল্যমান রাখিয়া অশীতিপর স্বামীর কোলে তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে। ইহার চেয়ে স্ত্রীলোকের পুণ্যবল আর কি হইতে পারে? যখন তাঁহাকে ঘাটে লইয়া যায় তখন আমি দেখিতে গিয়াছিলাম। সকলে এক মাথা সিন্দুর দিয়া দিয়াছে, আর ভাল একখানি কস্তাপেড়ে কাপড় পরাইয়া দিয়াছে। আহা। তখন কি শোভা হইয়াছিল। যাহা হউক, তনু রায়ের একটু অবসর হইলে, আমি তাহাকে বিবাহের কথা বলিব।”কিছুদিন পরে খেতুর মা, রামহরিকে আর একখানি পত্র লিখিলেন। তাহার মর্ম এইঃ

“বড় ভয়ানক কথা শুনিতেছি। তনু রায়ের কথার ঠিক নাই। তাহার দয়ামায়া নাই, তাহার ধর্মাধর্মজ্ঞান নাই। শুনিতেছি, সে না কি জনার্দন চৌধুরীর সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ দিবে। কি ভয়ানক কথা। আর জনার্দন চৌধুরীও পাগল হইয়াছে না কি? পুত্র পৌত্র দৌহিত্র চারিদিকে বর্তমান। বয়সের গাছ পাথর নাই। চলিতে ঠক্ ঠক্ করিয়া কাঁপে। ঘাটের মড়া, তাহার আবার এ কুবুদ্ধি কেন? বিষয় থাকিলে, টাকা থাকিলে, এরূপ করিতে হয় না কি? সে বড়মানুষ, জমিদার, না হয় রাজা, তা বলিয়া কি একেবারে বিবেচনাশূন্য হইতে হয়? বৃদ্ধ মনে ভাবে না যে, মৃত্যু সন্নিকট? যেরূপ তাহার অবস্থা, তাহাতে আর কয়দিন? লাঠি না ধরিয়া একটি পা চলিতে পারে না। কি ভয়ানক কথা, আর তনু রায় কি নিকষা, দুধের বাছা কঙ্কাবতীকে কি করিয়া এই অশীতিপর বৃদ্ধের হাতে সমর্পণ করিবে? কঙ্কাবতীর কপালে কি শেষে এই ছিল? কঙ্কাবতীর সেই মধুমাখা মুখখানি মনে করিলে বুক ফাটিয়া যায়। শুনিতে পাই কঙ্কাবতীর মা নাকি রাত্রি-দিন কাঁদিতেছেন। আমি ডাকিয়া পাঠাইয়াছিলাম, কিন্তু আসেন নাই। বলিয়া পাঠাইলেন যে, দিদির কাছে আর মুখ দেখাইব না, এ কালা মুখ লোকের কাছে আর বাহির করিব না। এই বিবাহের কথা শুনিয়া আমার বুক ফাটিয়া যাইতেছে। আহা! তাঁহার মার প্রাণ, কতই না তিনি কাতর হইয়া থাকিবেন!”এই চিঠিখানি পাইয়া রামহরি খেতুকে দেখাইলেন।

খেতু বলিল, ‘দাদা মহাশয়, আমি এক্ষণে দেশে যাইব।”

রামহরি বলিলেন, “জনার্দন চৌধুরী বড়লোক, তুমি সহায়হীন বালক, তুমি দেশে গিয়া কি করিবে?”

খেতু বলিল, “আমি কিছু করিতে পারিব না সত্য, তথাপি নিশ্চিন্ত থাকা উচিত নহে। কঙ্কাবতীকে এ বিপদ হইতে রক্ষা করিবার নিমিত্ত চেষ্টা করাও কর্তব্য। কৃতকার্য না হই, কি করিব? খেতু দেশে আসিল। মার নিকট ও পাড়াপ্রতিবেশীর নিকট সকল কথা শুনিল। শুনিল যে জনার্দন চৌধুরী প্রথমে কিছুতেই বিবাহ করিতে সম্মত হন নাই। কেবল তাঁহার সভাপণ্ডিত গোবর্ধন শিরোমণি তাঁহাকে অনেক বুঝাইয়া সম্মত করিয়াছেন।

বৃদ্ধ হইলে কি হয়? জনার্দন চৌধুরীর শ্রী-ছাঁদ আছে, প্রাণে শখও আছে। দুর্লভ পঞ্চমুখী রুদ্রাক্ষের মাল্য দ্বারা গলদেশ তাঁহার সর্বদাই সুশোভিত থাকে। কফের ধাতু বলিয়া শৈত্য নিবারণের জন্য চুড়াদার টুপি মস্তকে তাঁহার দিন-রাত্রি বিরাজ করে। এইরূপ বেশ-ভূষায় সুসজ্জিত হইয়া নিভৃতে বসিয়া যখন তিনি গোবর্ধন শিরোমণির সহিত বিবাহ-বিষয়ে পরামর্শ করেন, তখন তাঁহার রূপ দেখিয়া ইন্দ্র চন্দ্র বায়ু বরুণকেও লজ্জায় অধোমুখ হইতে হয়। খেতু শুনিল যে, জনার্দন চৌধুরী বিবাহ করিবার জন্য এখন একেবারে পাগল হইয়া উঠিয়াছেন। আর বিলম্ব সহে না। এই বৈশাখ মাসের ২৪এ তারিখে বিবাহ হইবে। জনার্দন চৌধুরী এক্ষণে দিন গণিতেছেন। তাঁহার পুত্র-কন্যা সকলের ইচ্ছা, যাহাতে এ বিবাহ না হয়। কিন্তু কেহ কিছু বলিতে সাহস করে না। তাঁহার বড় কন্যা একদিন মুখ ফুটিয়া মানা করিয়াছিল। সেই অবধি বড় কন্যার সহিত তাঁহার আর কথা-বার্তা নাই।

জনার্দন চৌধুরীকে কন্যা দিতে তনু রায়ও প্রথমে ইতস্ততঃ করিয়া-ছিলেন। কিন্তু যখন জনার্দন চৌধুরী বলিলেন যে, “আমার নববিবাহিতা স্ত্রীকে আমি দশ হাজার টাকার কোম্পানির কাগজ দিব, একখানি তালুক দিব, স্ত্রীর গা সোনা দিয়া মুড়িব, আর কন্যার পিতাকে দুই হাজার টাকা নগদ দিব।” তখন তনু রায় আর লোভ সংবরণ করিতে পারিলেন না। কঙ্কাবতীর মুখপানে চাহিয়া তবুও তনু রায় ইতস্ততঃ করিতেছিলেন। কিন্তু তাঁহার পুত্র টাকার কথা শুনিয়া একেবারে উন্মত্ত হইয়া পড়িল। বকিয়া ঝকিয়া পিতাকে সে সম্মত করাইল। টাকার লোভে এক্ষণে পিতাপুত্র দুইজনে উন্মত্ত হইয়াছেন।

তবুও তনু রায় স্ত্রীর নিকট নিজে এ কথা বলিতে সাহস করেন নাই। তাহার পুত্র বলিল, “তোমাকে বলিতে হইবে না, আমি গিয়া মাকে বলিতেছি।”

এই কথা বলিয়া পুত্র মার নিকট গিয়া বলিল, “মা, জনার্দন চৌধুরীর সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ হইবে। বাবা সব স্থির করিয়া আসিয়াছেন”। এ কথার উপর আর কথা নাই। মা একেবারে বসিয়া পড়িলেন। অবিরল ধারায় তাঁহার চক্ষু হইতে অশ্রু বিগলিত হইতে লাগিল। মনে করিলেন যে, হে পৃথিবী, তুমি দুই ফাঁক হও, তোমার ভিতর আমি প্রবেশ করি। মেয়ে দুইটিও অনেক কাঁদিলেন; কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না। কঙ্কাবতী নীরব। প্রাণ যাহার ধুধু করিয়া পুড়িতেছে, চক্ষে তাহার জল কোথা হইতে আসিবে?

মা ও প্রতিবেশীদিগের নিকট হইতে খেতু এই সকল কথা শুনিল।

খেতু প্রথম তনু রায়ের নিকট গেল। তনু রায়কে অনেক বুঝাইল। খেতু বলিল, “মহাশয়, এইরূপ অশীতিপর বৃদ্ধের সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ দিবেন না। আমার সহিত বিবাহ না হয় না দিবেন, কিন্তু একটি সুপাত্রের হাতে দিন। মহাশয় যদি সুপাত্রের অনুসন্ধান করিতে না পারেন, আমি করিয়া দিব।”এই কথা শুনিয়া তনু রায় ও তনু রায়ের পুত্র খেতুর উপর অতিশয় রাগান্বিত হইলেন। নানারূপ ভৎর্সনা করিয়া তাহাকে বাটি হইতে তাড়াইয়া দিলেন।

নিরঞ্জনকে সঙ্গে করিয়া খেতু তাহার পর জনার্দন চৌধুরীর নিকট গমন করিল। হাত জোড় করিয়া খেতু বিনীতভাবে জনার্দন চৌধুরীকে বিবাহ করিতে নিষেধ করিল। প্রথমতঃ জনার্দন সে কথা হাসিয়া উড়াইয়া দিলেন। তাহার পর খেতু যখন তাঁহাকে দুই একবার বৃদ্ধ বলিল, তখন রাগে তাঁহার সর্বশরীর কাঁপিতে লাগিল। তাঁহার শ্লেষ্মার ধাত রাগে এমনি তাঁহার ভয়ানক কাসি আসিয়া উপস্থিত হইল যে, সকলে বোধ করিল, দম আটকাইয়া তিনি বা মরিয়া যান। কাসিতে কাসিতে তিনি বলিলেন, “গলাধাক্কা দিয়া এ ছোঁড়াকে বাড়ী হইতে বাহির করিয়া দাও।”

অনুমতি পাইয়া পারিষদগণ খেতুর গলাধাক্কা দিতে আসিল।

খেতু জনার্দন চৌধুরীর লাঠিগাছটি তুলিয়া লইল। পারিষদবর্গকে ধীরভাবে বলিল, “তোমরা কেহ আমার গায়ে হাত দিও না। যদি আমার গায়ে হাত দাও,-তাহা হইলে এই দণ্ডে তোমাদের মুণ্ডপাত করিব।”

খেতুর তখন সেই রুদ্রমূর্তি দেখিয়া ভয়ে সকলেই আকুল হইল। গলাধাক্কা দিতে আর কেহ অগ্রসর হইল না। নিরঞ্জন উঠিয়া উভয় পক্ষকে সান্ত্বনা করিয়া খেতুকে সেখান হইতে বিদায় করিলেন।

খেতু চলিয়া গেল। তবুও জনার্দন চৌধুরীর রাগও থামে না, কাসিও থামে না। রাগে থর থর করিয়া শরীর কাঁপিতে লাগিল, খক্ খক্ করিয়া ঘন ঘন কাসি আসিতে লাগিল।

কাসিতে কাসিতে তিনি বলিলেন, “ছোঁড়ার কি আস্পর্ধা। আমাকে কি না বুড়া বলে।”

গোবর্ধন শিরোমণি বলিলেন, “না না। আপনি বৃদ্ধ কেন হইবেন? আপনাকে যে বুড়া বলে, সে নিজে বুড়া।” ষাঁড়েশ্বর নামে একটি মদ্যপ পারিষদ সেখানে উপস্থিত ছিল। সে বলিল, “হয় তো ছোকরা মদ খাইয়া আসিয়াছিল। চক্ষু দুইটা যেন জবা-ফুলের মত, দেখিতে পান নাই?”

গোবর্ধন শিরোমণি বলিলেন, “ক্ষেত্রচন্দ্র মদ খায়, কি, না খায়, তাহা আমি জানি না। তবে সে যে যবনের জল খায়, তাহা জানি। সেই যারে বলে ‘বরখ’, সাহেবেরা কলে যাহা প্রস্তুত করেন, ক্ষেত্রচন্দ্র সেই বরখ খান। গদাধর ঘোষ ইহা স্বচক্ষে দেখিয়াছে।”

জনার্দন চৌধুরী বলিলেন, “কি কি? কি বলিলে?” ষাঁড়েশ্বর বলিল, “সর্বনাশ, বরফ খায়? গোরক্ত দিয়া সাহেবেরা যাহা প্রস্তুত করেন? এবার দেখিতেছি, সকলের ধর্মটি একেবারে লোপ হইল। হায় হায়। পৃথিবীতে হিন্দুধর্ম একেবারে লোপ হইল।”

নিরঞ্জন বলিলেন, “ষাঁড়েশ্বরবাবু, একবার মনে করিয়া দেখ, খেতুর বাপ তোমার কত উপকার করিয়াছেন। খেতুর অপকার করিতে চেষ্টা করিও না।”

জনার্দন চৌধুরী বলিলেন, “ও সব বাজে কথা এখন তোমরা রাখ। গদাধর ঘোষকে ডাকিতে পাঠাও।”

গদাধর ঘোষকে ডাকিতে লোক দৌড়িল।

অষ্টম পরিচ্ছেদ

গদাধর-সংবাদ

গদাধর ঘোষ আসিয়া উপস্থিত হইল। চৌধুরী মহাশয়কে কৃতাঞ্জলিপুটে নমস্কার করিয়া অতি দূরে সে মাটিতে বসিল।

চৌধুরী মহাশয় বলিলেন, “কেমন হে গদাধর। এ কি কথা শুনিতে পাই? শিবচন্দ্রের ছেলেটা, ওই খেতা, কি খাইয়াছিল? তুমি কি দেখিয়াছিলে? কি শুনিয়াছিলে, তাহার সহিত তোমার কি কথাবার্তা হইয়াছিল? সমুদয় বল, কোনও বিষয় গোপন করিও না।”

গদাধর বলিল, “মহাশয়। আমি মূর্খ মানুষ। অত শত জানি না। যাহা হইয়াছিল, তাহা আমি বলিতেছি।”গদাধর বলিল, “আর বৎসর আমি কলিকাতায় গিয়াছিলাম। কোথায় থাকি? তাই রামহরির বাসায় গিয়াছিলাম। সন্ধ্যাবেলা বাহিরের ঘরে বসিয়া আছি, এমন সময়ে এক মিনষে হাঁড়ি মাথায় করিয়া পথ দিয়া কি শব্দ করিতে করিতে যাইতেছিল। সেই শব্দ শুনিয়া রামহরিবাবুর ছেলেটি বাড়ীর ভিতর হইতে ছুটিয়া আসিল, আর খেতুকে বলিল, “কাকা, কাকা। ‘কুলকি’ যাইতেছে, আমাকে কিনিয়া দাও। খেতু তাহাকে দুই পয়সার কিনিয়া দিল। তাহার পর খেতু আমাকে জিজ্ঞাসা করিল, গদাধর, তুমি একটা কুলকি খাইবে?” আমি বলিলাম, “না দাদাঠাকুর, আমি কুলকি খাই না”। রামহরিবাবুর ছেলে খেতুকে বলিল, “কাকা, তুমি খাইবে না?” খেতু বলিল, না, আমার পিপাসা পাইয়াছে, ইহাতে পিপাসা ভাঙে না, আমি কাঁচা বরখ খাইব। এই কথা বলিয়া খেতু বাহিরে গেল। কিছুক্ষণ পরে সাদা ধবধবে কাচের মত একটা ঢিল গামছায় বাঁধিয়া বাটি আনিল। সেই ঢিলটি ভাঙিয়া জলে দিল, পরে সেই জল খাইতে লাগিল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, দাদাঠাকুর, ও কি? খেতু বলিল, ইহার নাম ‘বরখ’। এই গ্রীষ্মকালের দিনে যখন বড় পিপাসা হয়, তখন ইহা জলে দিলে জল শীতল হয়। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, দাদাঠাকুর, সকল কাচ কি জলে দিলে জল শীতল হয়? খেতু উত্তর করিল, এ কাচ নয়, এ বরখ। জল জমিয়া প্রস্তুত হয়। ইহা জল। নদীতে যে জল দেখিতে পাও, ইহাও তাহাই, জমিয়া গিয়াছে এইমাত্র। আকাশ হইতে যে শিল পড়ে, বরখ তাহাই। সাহেবেরা বরখ কলে প্রস্তুত করে। একটু হাতে করিয়া দেখ দেখি। এই বলিয়া আমার হাতে একটুখানি দিল। হাতে রাখিতে না রাখিতে আমার হাত যেন করাত দিয়া কাটিতে লাগিল। আমি হাতে রাখিতে পারিলাম না, আমি ফেলিয়া দিলাম। তাহার পর খেতু বলিল গদাধর, একটু খাইয়া দেখ না? ইহাতে কোনও দোষ নাই। আমি বলিলাম, না দাদাঠাকুর, তোমরা ইংরেজী পড়িয়াছ, তোমাদের সব খাইতে আছে, তাহাতে কোনও দোষ হয় না। আমি ইংরেজী পড়ি নাই। সাহেবেরা যে দ্রব্য কলে প্রস্তুত করে, সে দ্রব্য খাইলে আমাদের অধর্ম হয়, আমাদের জাতি যায়।”গদাধরের মুখে সকল কথা শুনিয়া, জনার্দন চৌধুরী তখন তনু রায় প্রভৃতি গ্রামের ভদ্রলোকদিগকে ডাকিতে পাঠাইলেন। সকলে আসিয়া উপস্থিত হইলে জনার্দন চৌধুরী বলিলেন, ‘আজ আমি ঘোর সর্বনাশের কথা শুনিলাম। জাতি-কুল, ধর্ম-কর্ম সব লোপ হইতে বসিল। পিতা-পিতামহদিগকে যে এক গণ্ডুষ জল দিব, তাহারও উপায় রহিল না। ঘোর কলি উপস্থিত।”

সকলে জিজ্ঞাসা করিল, “কি হইয়াছে, মহাশয়?”জনার্দন চৌধুরী উত্তর করিলেন, “শিবচন্দ্রের পুত্র, ওই যে খেতা, কলিকাতায় রামহরির বাসায় থাকিয়া ইংরেজী পড়ে, সে বরফ খায়। বরফ সাহেবরা প্রস্তুত করে, সাহেবের জল। শিরোমণি মহাশয় বিধান দিয়াছেন যে, বরফ খাইলে সাহেবত্ব প্রাপ্ত হয়। সাহেবত্ব-প্রাপ্ত লোকের সহিত সংস্রব থাকিলে সেও সাহেব হইয়া যায়। তাই, এই খেতার সহিত সংস্রব রাখিয়া সকলেই আমরা সাহেব হইতে বসিয়াছি।”

এই কথা শুনিয়া দেশ সুদ্ধ লোক একেবারে মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িল। সর্বনাশ। বরফ খায়? যা:। এইবার ধর্মকর্ম সব গেল।

সবার চেয়ে ভাবনা হইল ষাঁড়েশ্বরের। ডাক ছাড়িয়া সে কাঁদে নাই সত্য, কিন্তু তাহার ধর্মগত প্রাণে বড়ই আঘাত লাগিয়াছিল। কত যে সে হায় হায় করিল তাহার কথা আর কি বলিব? যাহা হউক, সর্ববাদীসম্মত হইয়া খেতুকে একঘরে করা স্থির হইল।

নিরঞ্জন কেবল ওই কথায় সায় দিলেন না। নিরঞ্জন বলিলেন, “আমি থাকিতে খেতুকে কেহ একঘরে করিতে পারিবে না। আমরা না হয় দু-ঘরে হইয়া থাকিব।”

খেতু যে একঘরে হইয়াছে নিয়মিতরূপে লোককে সেইটি দেখাইবার নিমিত্ত, স্ত্রীর মাসিক শ্রাদ্ধ উপলক্ষ্যে জনার্দন চৌধুরী সপ্তগ্রাম সমাজ নিমন্ত্রণ করিলেন। চারিদিকে হৈ হৈ পড়িয়া গেল যে, কুসুমঘাটি নিবাসী শিবচন্দ্রের পুত্র ক্ষেত্র বরফ খাইয়া ক্রিস্তান হইয়াছে। সেইদিন রাত্রিতে ষাঁড়েশ্বর চারি বোতল মহুয়ার মদ আনিল। তারিফ শেখের বাড়ী হইতে চুপি চুপি মুরগি রাঁধাইয়া আনিল। পাঁচ ইয়ার জুটিয়া পরম সুখে পান-ভোজন হইল। একবার কেবল এই সুখে ব্যাঘাত হইবার উপক্রম হইয়াছিল। খাইতে খাইতে ষাঁড়েশ্বরের মনে উদয় হইল যে, তারিফ শেখ হয় তো মুরগির সহিত বরফ মিশ্রিত করিয়াছে। তাই তিনি হাত তুলিয়া লইলেন, আর বলিলেন, “আমার খাওয়া হইল না; বরফ-মিশ্রিত মুরগি খাইয়া শেষে কি জাতিটি হারাইব?” সকলে অনেক বুঝাইল যে, মুরগি বরফ দিয়া রান্না হয় নাই। তবে সে পুনরায় আহারে প্রবৃত্ত হইল। পান-ভোজনের পর নিরঞ্জনের বাটীতে সকলে গিয়া ঢিল ও গোহাড় ফেলিতে লাগিল। এইরূপ ক্রমাগত প্রতি রাত্রিতে নিরঞ্জনের বাটিতে ঢিল ও গোহাড় পড়িতে লাগিল। আর সহ্য করিতে না পারিয়া, নিরঞ্জন ও তাঁহার স্ত্রী কাঁদিতে কাঁদিতে পৈতৃক বাস্তুভূমি পরিত্যাগ করিয়া অন্য গ্রামে চলিয়া গেলেন। খেতু বলিল, “কাকা মহাশয়, আপনি চলুন। আমিও এ গ্রাম হইতে শীঘ্র উঠিয়া যাইব।”

খেতুর মার নিকট যে ঝি ছিল, সে ঝিটি ছাড়িয়া গেল। সে বলিল, মা ঠাকুরাণী, আমি আর তোমার কাছে কি করিয়া থাকি? পাঁচজনে তাহা হইলে আমার হাতে জল খাইবে না।

আরও নানা বিষয়ে খেতুর মা উৎপীড়িত হইলেন। খেতুর মা ঘাটে স্নান করিতে গেলে, পাড়ার স্ত্রীলোকেরা দুরে দুরে থাকে। পাছে খেতুর মা তাহাদিগকে ছুঁইয়া ফেলেন। একদিন কমল ভট্টাচার্যের বিধবা স্ত্রী মুখ ফুটিয়া খেতুর মাকে বলিল, “বাছা, নিজে সাবধান হইতে জানিলে, কেহ আর কিছু বলে না। বসিতে জানিলে উঠিতে হয় না। তোমার ছেলে বরখ খাইয়াছে, তোমাদের এখন জাতিটি গিয়াছে। তা বলিয়া আমাদের সকলের জাতিটি মার কেন? আমাদের ধর্ম-কর্ম নাশ কর কেন? তা, তোমার বাছা দেখিতেছি এ ঘাটটি না হইলে আর চলে না। সেদিন, মেটে কলসীটি যেই কাঁখে করিয়া উঠিয়াছি, আর তোমার গায়ের জলের ছিটা আমার গায়ে লাগিল, তিন পয়সার কলসীটি আমাকে ফেলিয়া দিতে হইল। আমাকে পুনরায় স্নান করিতে হইল। আমরা তোমার বাছা কি করিয়াছি যে তুমি আমাদের সঙ্গে এত লাগিয়াছ?”

খেতুর মা কোন উত্তর দিলেন না। কাঁদিতে কাঁদিতে বাড়ী আসিলেন। খেতু বলিল, “মা, কাঁদিও না। এখানে আর আমরা অধিক দিন থাকিব না। এ গ্রাম হইতে আমরা উঠিয়া যাইব।”খেতুর মা বলিলেন, “বাছা, অভাগীরা যাহা কিছু বলে, তাহাতে আমি দুঃখ করি না। কিন্তু তোমার মুখপানে চাহিয়া রাত্রিদিন আমার ভিতর আগুন জ্বলিতেছে। তোমার আহার নাই, নিদ্রা নাই। একদণ্ড তুমি সুস্থির নও, শরীর তোমার শীর্ণ, মুখ তোমার মলিন। খেতু, আমার মুখপানে চাহিয়া একটু সুস্থির হও বাছা।”

খেতু বলিল, “মা আর সাতদিন। আজ মাসের হইল ১৭ই তারিখ। ২৪এ তারিখে কঙ্কাবতীর বিবাহ, হইবে। সেই দিন আমরা জন্মের মত এদেশ হইতে চলিয়া যাইব।”খেতুর মা বলিলেন, “দাসেদের মেয়ের কাছে শুনিলাম যে, কঙ্কাবতীকে আর চেনা যায় না। সে রূপ নাই, সে রং নাই, সে হাসি নাই। আহা, তবুও বাছা মার দুঃখে কাতর। আপনার সকল দুঃখ ভুলিয়া বাছা আমার মার দুঃখে দুঃখী। কঙ্কাবতীর মা রাত্রি-দিন কাঁদিতেছেন, আর কঙ্কাবতী মাকে বুঝাইতেছে।”

“শুনিলাম, সেদিন কঙ্কাবতী মাকে বলিয়াছে যে, মা তুমি কাঁদিও না, আমার এই কয়খানা হাড় বেচিয়া বাবা যদি টাকা পান, তাহাতে দুঃখ কি মা? এরূপ কত হাড় শ্মশানঘাটে পড়িয়া থাকে, তাহার জন্য কেহ একটি পয়সাও দেয় না আমার এই হাড় কয়-খানার যদি এত মূল্য হয়, বাপ-ভাই সেই টাকা পাইয়া যদি সুখী হন, তাহার জন্য আর আমরা দুঃখ কেন করি মা? তবে মা, আমি বড়ই দুর্বল হইয়াছি, শরীরে আমার সুখ নাই। পাছে এই কয়দিনের মধ্যে আমি মরিয়া যাই সেই ভয় হয়। টাকা না পাইতে পাইতে মরিয়া গেলে, বাবা আমার উপর বড় রাগ করিবেন। আমি তো ছাই হইয়া যাইব, কিন্তু আমাকে তিনি যখনই মনে করিবেন, তখনই কত গালি দিবেন।” খেতুর মা পুনরায় বলিলেন, “খেতু, কঙ্কাবতীর কথা যেরূপ আমি শুনি, তাহা তোমাকে বলি না, পাছে তুমি অধৈর্য হইয়া পড়। কঙ্কাবতীর যেরূপ অবস্থা শুনিতে পাই, কঙ্কাবতী আর অধিক দিন বাঁচিবে না।”

খেতু কোনও উত্তর দিল না, আঁচলে চক্ষু মুছিতে লাগিল।

এইরূপে দিন দিন কঙ্কাবতীর পীড়া বাড়িতে লাগিল, কিছুই কমিল না। সাতদিন হইল। বিবাহের দিন উপস্থিত হইল।



সেদিন কঙ্কাবতীর গায়ের বড় জ্বালা, কঙ্কাবতীর বড়ই পিপাসা, কঙ্কাবতী একেবারে শয্যাধরা। কঙ্কাবতীর সমূহ রোগ। কঙ্কাবতীর ঘোর বিকার। কঙ্কাবতীর জ্ঞান নাই, সংজ্ঞা নাই। লোক চিনিতে পারে না, কঙ্কাবতী এখন যায় তখন যায়।

পরের পর্ব....


No comments:

Post a Comment