অর্থমনর্থম (শেষাংশ)



লেখক: শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রথমাংশের লিঙ্ক

দুপুরবেলাটা ব্যোমকেশ আরাম-কেদারায় চোখ ‍বুজিয়া শুইয়া কাটাইয়া দিল; মনে হইল, সে যেন প্রতীক্ষা করিতেছে। তিনটা বাজিতেই পুঁটিরাম চা দিয়া গেল, নিঃশব্দে পান করিয়া ব্যোমকেশ পূর্ববৎ পড়িয়া রহিল।

সাড়ে চারটা বাজিবার পর পাশের ঘরে টেলিফোন বাজিয়া উঠিল। ব্যোমকেশ দ্রুত উঠিয়া গিয়া ফোন ধরিল, ‘কে আপনি?… ও ইনস্পেক্টরবাবু, কি খবর? …সুকুমারবাবুর ঘর সার্চ হয়েছে! বেশ বেশ, বিধুবাবু তাহলে শেষ পর্যন্ত…তাঁর ঘরে কি পাওয়া গেল?…অ্যাঁ, সুকুমারবাবুকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। তারপর—কিছু পাওয়া গেল? ক্লোরোফর্মের শিশি—আলমারিতে বইয়ের পেছনে ছিল—আর? উইল! আর একখানা টাইপ—করা উইল? বলেন কি? কোন্ তারিখের?…যে রাত্রে করালীবাবু মারা যান, সেইদিন তৈরি—হুঁ। কোথায় ছিল? বাক্সের তলায়! এ উইলে ওয়ারিস কে?…ফণীবাবু!

‘হ্যাঁ—ঠিক বলেছেন, পর্যায়ক্রমে এবার তারই পালা ছিল বটে। …সুকুমারবাবুর বোনকে কি গ্রেপ্তার করা হয়েছে? …না…ও বুঝেছি…ঘরে আর কিছু পাওয়া যায়নি? এই ধরুন—একটা লাল পেন্সিল? পাননি? আশ্চর্য! সেলাইয়ের কোনও উপকরণ পাননি? তাই তো! বিধুবাবু আছেন?… মতিলালকে খালাস করতে গেছেন…তবু ভাল, বিধুবাবুর সুমতি হয়েছে। সুকুমারবাবুর ঘর ছাড়া আর কোন্ কোন্ ঘর সার্চ হয়েছে? আর হয়নি! কি বললেন, বিধুবাবু দরকার মনে করেননি! বিধুবাবু তো কিছুই দরকার মনে করেন না। আমার আজ যাবার দরকার আছে কি? নুতন উইলখানা দেখতুম…ও নিয়ে গেছেন…আচ্ছা—কাল সকালেই হবে। লাল পেন্সিল আর ঐ সেলাইয়ের উপকরণটা যতক্ষণ না পাওয়া যাচ্ছে—ততক্ষণ—কি বলছেন? সুকুমারের বিরুদ্ধে overwhelming প্রমাণ পাওয়া গেছে? তা বলতে পারেন—কিন্তু ডাক্তারের রিপোর্ট পাওয়া গেছে? মৃত্যুর সময় সম্বন্ধে কি লিখেছেন? আহারের তিন ঘন্টা পরে…তার মানে আন্দাজ রাত বারোটা…আচ্ছা,কাল সকালে নিশ্চয় যাব।’

ফোন রাখিয়া ব্যোমকেশ ফিরিয়া আসিয়া বসিল। তাহার চিন্তা-কুঞ্চিত ভ্রু ও মূখ দেখিয়া মনে হইল, সে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হইতে পারে নাই। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘সুকুমারই তাহলে? তুমি তো গোড়া থেকেই সন্দেহ করেছিলে—না?’

কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘এ ব্যাপারে যত কিছু প্রমাণ, সবই সুকুমারের দিকে নির্দেশ করছে। দেখ, করালীবাবুর মৃত্যুর ধরনটা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, এ ডাক্তারের কাজ। যারা ডাক্তারি কিছু জানে না, তারা ওভাবে খুন করতে পারে না। যে ছুঁচটা ব্যবহার করা হয়েছে, তাও তার বোনের সেলায়ের বাক্স থেকে চুরি করা, এমন কি, সুতোটা পর্যন্ত এক। সুকুমার বারোটার সময় বাড়ি ফিরল—ঠিক সেই সময় করালীবাবুও মারা গেলেন। সুকুমারের ঘর সার্চ করে বেরিয়েছে ক্লোরোফর্মের শিশি, আর একটা টাইপ-করা উইল—করালীবাবুর শেষ উইল, যাতে তিনি সুকুমারকে বঞ্চিত করে ফণীকে সর্বস্ব দিয়ে গেছেন। সুকুমার নিজের মুখেই স্বীকার করেছে যে, সেদিন সন্ধ্যাবেলা করালীবাবুর সঙ্গে তার ঝগড়া হয়েছিল—সুতরাং তিনি যে আবার উইল বদলাবেন, তা সে বেশ বুঝতে পেরেছিল। খুন করার মোটিভ্ পর্যন্ত পরিষ্কার পাওয়া যাচ্ছে।’

‘তাহলে সুকুমারই যে আসামী, তাতে আর সন্দেহ নেই?’

‘সন্দেহের অবকাশ কোথায়?’ কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘আচ্ছা, সুকুমারকে দেখে তোমার কি রকম মনে হল? খুব নির্বোধ বলে মনে হল কি?’

আমি বলিলাম,‘না। বরঞ্চ বেশ বুদ্ধি আছে বলেই মনে হল।’

ব্যোমকেশ ভাবিতে ভাবিতে বলিল, ‘সেইখানেই ধোঁকা লাগছে। বুদ্ধিমান বোকার মত কাজ করে কেন?’বলিয়াই ব্যোমকেশ সচকিতভাবে সোজা হইয়া বসিল। দ্বারের কাছে অস্পষ্ট পদধ্বনি আমিও শুনিতে পাইয়াছিলাম, ব্যোমকেশ গলা চড়াইয়া ডাকিল, ‘কে? ভিতরে আসুন।’

কিছুক্ষণ কোন সাড়া পাওয়া গেল না, তারপর আস্তে আস্তে দ্বার খুলিয়া গেল। তখন ঘোর বিস্ময়ে দেখিলাম, সম্মুখে দাঁড়াইয়া আছে—সত্যবতী!

সত্যবতী ঘরে প্রবেশ করিয়া দ্বার ভেজাইয়া দিল; কিছুকাল শক্ত হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল, তারপর হঠাৎ ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিয়া রুদ্ধস্বরে বলিল, ‘ব্যোমকেশবাবু, আমার দাদাকে বাঁচান।’

অপ্রত্যাশিত আবির্ভাবে আমি একেবারে ভ্যাবাচাকা খাইয়া গিয়াছিলাম। ব্যোমকেশ কিন্তু তড়াক করিয়া সত্যবতীর সম্মুখে দাঁড়াইল। সত্যবতীর মাথাটা ঘুরিয়া গিয়াছিল, সে অন্ধভাবে একটা হাত বাড়াইয়া দিতেই ব্যোমকেশ হাত ধরিয়া তাহাকে একখানা চেয়ারে আনিয়া বসাইয়া দিল। আমাকে ইঙ্গিত করিতেই পাখাটা চালাইয়া দিলাম।

প্রথম মিনিট দুই-তিন সত্যবতী চোখে আঁচল দিয়া খুব খানিকটা কাঁদিল, আমার নির্বাক লজ্জিত মুখে অন্য দিকে চোখ ফিরাইয়া রহিলাম। আমাদের বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনেও এমন ব্যাপার পূর্বে কখনও ঘটে নাই।

সত্যবতীকে পূর্বে আমি একবারই দেখিয়াছিলাম; সাধারণ শিক্ষিত বাঙ্গালী মেয়ে হইতে সে যে আকারে-প্রকারে একটুও পৃথক, তাহা মনে হয় নাই। সুতরাং ঘোর বিপদের সময় সমস্ত শঙ্কাসঙ্কোচ লঙ্ঘন করিয়া সে যে আমাদের কাছে উপস্থিত হইতে পারে, ইহা যেমন অচিন্ত্যনীয়, তেমনই বিস্ময়কর। বিপদ উপস্থিত হইলে অধিকাংশ বাঙালীর মেয়েই জড়বস্তু হইয়া পড়ে। তাই এই কৃশাঙ্গী কালো মেয়েটি আমার চক্ষে যেন সহসা একটা অপূর্ব অসামান্যতা লইয়া দেখা দিল। তাহার পায়ের মলিন জরির নাগরা হইতে রুক্ষ অযত্নসম্বৃত চুল পর্যন্ত যেন অনন্যসাধারণ বিশিষ্টতায় ভরপুর হইয়া উঠিল।

ভাল করিয়া চোখ মুছিয়া সে যখন মুখ তুলিয়া আবার বলিল, ‘ব্যোমকেশবাবু, আমার দাদাকে আপনি বাঁচান,’ তখন দেখিলাম, সে প্রাণপণে আত্মসম্বরণ করিয়াছে বটে, কিন্তু তাহার গলার স্বর তখনও কাঁপিতেছে।

ব্যোমকেশ আস্তে আস্তে বলিল,‘আপনার দাদা অ্যারেস্ট হয়েছেন, আমি শুনেছি—কিন্তু—’

সত্যবতী ব্যাকুলভাবে বলিয়া উঠিল, ‘দাদা নির্দোষ, তিনি কিছু জানেন না—বিনা অপরাধে তাঁকে—’ বলিতে বলিতে আবার সে কাঁদিয়া ফেলিল।

ব্যোমকেশ ভিতরে ভিতরে বিচলিত হইয়াছে বুঝিলাম, কিন্তু সে শান্তভাবেই বলিল, ‘কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে যে সব প্রমাণ পাওয়া গেছে—’

সত্যবতী বলিল, ‘সে সব মিথ্যে প্রমাণ। দাদা কখনও টাকার লোভে কাউকে খুন করতে পারেন না। আপনি জানেন না—তাঁর মতন লোক; ব্যোমকেশবাবু, আমার মেসোমশায়ের টাকা চাই না, আপনি শুধু দাদাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করুন, আমার আপনার পায়ে কেনা হয়ে থাকব।’ তাহার দুই চোখ দিয়া ধারার মত অশ্রু ঝরিয়া পড়িতে লাগিল, কিন্তু সে আর তাহা মুছিবার চেষ্টা করিল না—বোধ করি, জানিতেই পারিল না। ব্যোমকেশ এবার যখন কথা কহিল, তখন তাহার কণ্ঠস্বরে একটা অশ্রুতপূর্ব গাঢ়তা লক্ষ্য করিলাম, সে বলিল, ‘আপানার দাদা যদি সত্যই নির্দোষ হন, আমি প্রাণপণে তাঁকে বাঁচাবার চেষ্টা করব—কিন্তু—’

‘দাদা নির্দোষ, আপনি বিশ্বাস করছেন না? আমি আপনার পা ছুঁয়ে বলছি, দাদা এ কাজ করতে পারেন না—একটা মাছিকে মারাও তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়—’ বলিতে বলিতে সে হঠাৎ নতজানু হইয়া ব্যোমকেশের পায়ের উপর হাত রাখিল।

‘ও কি করছেন? উঠে বসুন—উঠে বসুন?’ বলিয়া ব্যোমকেশ নিজেই চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া পা সরাইয়া লইল।

‘আপনি আগে বলুন, দাদাকে ছেড়ে দেবেন?’

ব্যোমকেশ দুই হাত ধরিয়া সত্যবতীকে জোর করিয়া তুলিয়া চেয়ারে বসাইয়া দিল, তারপর তাহার সম্মুখে বসিয়া দৃঢ় স্বরে বলিল,‘আপনি ভুল করছেন—সুকুমারবাবুকে ছেড়ে দেবার মালিক আমি নই—পুলিস। তবে আমি চেষ্টা করতে পারি। কিন্ত চেষ্টা করতে হলে সব কথা আমার জানা দরকার। বুঝেছেন না, আমার কাছ থেকে যতক্ষণ আপনি কথা গোপন করবেন, ততক্ষণ কোন সাহায্যই আমি করতে পারব না।’

চক্ষু নত করিয়া সত্যবতী বলিল, ‘আমি তো কোনও কথা গোপন করিনি।’

‘করছেন। আপনি সেই রাত্রেই করালীবাবুর ঘরে গিয়ে তাঁর মৃত্যুর কথা জানতে পেরেছিলেন, কিন্তু আমাকে বলেননি।’

ত্রাস-বিস্ফারিত নেত্রে সত্যবতী ব্যোমকেশের মুখের পানে তাকাইল, তারপর বুকে মুখ গুঁজিয়া নীরব হইয়া রহিল।

ব্যোমকেশ নরম সুরে বলিল, ‘এখন সব কথা বলবেন কি?’

কাতর চোখ দুটি তুলিয়া সত্যবতী বলিল, ‘কিন্তু সে কথা আমি কি করে বলব? তাতে দাদার ওপরেই সব দোষ গিয়ে পড়বে।’

অনুনয়ের কণ্ঠে ব্যোমকেশ বলিল, ‘দেখুন,আপনার দাদা যদি নির্দোষ হন, তাহলে সত্যি কথা বললে তাঁর কোনও অনিষ্ট হবে না, আপনি নির্ভয়ে সমস্ত খুলে বলুন, কোনো কথা গোপন করবেন না।’

সত্যবতী অনেকক্ষণ মুখ নীচু করিয়া ভাবিল, শেষে ভগ্ন স্বরে বলিল,‘আচ্ছা, বলছি। আমার যে আর উপায় নেই—’উদগত অশ্রু আঁচল দিয়া মুছিয়া নিজেকে ঈষৎ শান্ত করিয়া সে ধীরে ধীরে বলিতে আরম্ভ করিল—

‘সেদিন সন্ধ্যেবেলা মেসোমশায়ের সঙ্গে দাদার একটু বচসা হয়েছিল। মেসোমশাই দাদাকে সব সম্পত্তি উইল করে দিয়েছিলেন, তাই নিয়ে মতিদা’র সঙ্গে দুপুরবেলা তুমুল ঝগড়া হয়ে গিয়েছিল। কলেজ থেকে ফিরে তাই শুনে দাদা মেসোমশাইকে বলতে গিয়েছিলেন যে, তিনি সব সম্পত্তি চান না, সম্পত্তি যেন সকলকে সমান ভাগ করে দেওয়া হয়। মেসোমশাই কোনও রকম তর্ক সইতে পারতেন না, তিনি রেগে উঠে বললেন, ‘আমার কথার ওপর কথা! বেরোও এখান থেকে—তোমাকে এক পয়সা দেব না।’

‘মেসোমশাই যে এ কথায় রাগ করবেন, তা দাদা বুঝতে পারেননি; তিনি সে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ফণীদা’র ঘরে গিয়ে বসলেন। ফণীদা খোঁড়া মানুষ, বাইরে বেরুতে পারেন না—তাই দাদা রোজ সন্ধ্যেবেলা তাঁর কাছে বসে খানিকক্ষণ গল্প করতেন। ফণীদা’কে আপনারা বোধহয় দেখেছেন? তিনি ইস্কুল-কলেজে পড়েননি বটে, কিন্তু বেশ ভাল লেখাপড়া জানেন।

তাঁর আলমারির বই দেখে বুঝতে পারবেন—কত রকম বিষয়ে তাঁর দখল আছে। অনেক সময় আমি তাঁর কাছে পড়া বলে নিয়েছি।

‘মেসোমশায়ের সঙ্গে বচসা হওয়াতে দাদার মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল,তিনি রাত্রি আন্দাজ আটটার সময় আমাকে বললেন, ‘সত্য, আমি বায়স্কোপ দেখতে যাচ্ছি, সাড়ে এগারটার সময় ফিরব—সদর দরজা খুলে রাখিস।’ এই বলে খাওয়া-দাওয়া সেরে তিনি চুপি চুপি বেরিয়ে গেলেন।

‘আমাদের বামুনঠাকুর রাত্রির খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়ে যাবার পর বাইরে গিয়ে অনেক রাত্রি পর্যন্ত নিজের দেশের লোকের আড্ডায় গল্পগুজব করে, আমি জানতুম—তাই দাদাকে দোর খুলে দেবার জন্যে আমি আর জেগে রইলুম না। রাত্রি দশটার পর হাঁড়ি-হেঁসেল উঠে গেলে আমিও গিয়ে শুয়ে পড়লুম।

‘ঘুমিয়ে পড়েছিলুম—হঠাৎ এক সময় ঘুম ভেঙ্গে গেল। মনে হল, যেন দাদার ঘরে একটা শব্দ শুনতে পেলুম। মেঝের ওপর একটা ভারী জিনিস—টেবিল কি বাক্স সরালে যে রকম শব্দ হয়, সেই রকম শব্দ। ভাবলুম দাদা বায়স্কোপ দেখে ফিরে এলেন।

‘আবার ঘুমবার চেষ্টা করলুম; কিন্তু কি জানি ঘুম এল না—চোখ চেয়েই শুয়ে রইলুম। দাদার ঘরে থেকে আর কোনও সাড়া পেলুম না; মনে করলুম তিনি শুয়ে পড়েছেন।

‘এইভাবে মিনিট পনের কেটে যাবার পর—বারান্দায় একটা খুব মৃদু শব্দ শুনতে পেলুম, যেন কে পা টিপে টিপে যাচ্ছে। ভারী আশ্চর্য মনে হল; দাদা তো অনেকক্ষণ শুয়ে পড়েছেন, তবে কে বারান্দায় দিয়ে যাচ্ছে? আমি আস্তে আস্তে উঠলুম; দরজা একটু ফাঁক করে দেখলুম—দাদা নিঃশব্দে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। চাঁদের আলো বারান্দায় পড়েছিল, দাদাকে স্পষ্ট দেখতে পেলুম।’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘একটা কথা; আপনার দাদার পায়ে জুতা ছিল?’

‘হ্যাঁ।’

‘তাঁর হাতে কিছু ছিল?’

‘না।’

‘কিছু না? একটা কাগজ কিম্বা শিশি?’

‘কিছু না।’

‘তখন ক’টা বেজেছিল; দেখেছিলেন কি?’

সত্যবতী বলিল, ‘দেখবার দরকার হয়নি, তখন শহরের সব ঘড়িতেই বারোটা বাজছিল।’

ব্যোমকেশের দৃষ্টি চাপা উত্তেজনায় প্রখর হইয়া উঠিল। সে বলিল, ‘তারপর বলে যান।’

সত্যবতী বলিতে লাগিল,‘প্রথমটা আমি ‍কিছু বুঝতে পারলুম না। দাদা পনের মিনিট আগে ফিরে এসেছেন—তাঁর ঘরে আওয়াজ শুনে জানতে পেরেছি—তবে আবার তিনি কোথায় গিয়েছিলেন? হঠ্যাৎ মনে হলো হয়তো মেসোমশায়ের শরীর খারাপ হয়েছে, তাঁর ঘরেই গিয়েছিলেন। মেসোমশাই কখনও কখনও রাত্রিবেলা বাতের বেদনায় কষ্ট পেতেন—ঘুম হত না। তখন তাঁকে ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়াতে হত। আমি চুপি চুপি ঘর থেকে বেরিয়ে মেসোমশাইয়ের ঘরের দিকে গেলুম।

‘তাঁর ঘরের দোর রাত্রে বরাবরই খোলা থাকে—আমি ঘরে ঢুকলুম। ঘর অন্ধকার—কিন্তু সেই অন্ধকারের মধ্যেও কি রকম একটা গন্ধ নাকে এল। গন্ধটা যে ঠিক কি রকম তা আমি আপনাকে বোঝাতে পারব না—তীব্র নয়, অথচ—’

‘মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ?’

‘হ্যাঁ—ঠিক বলেছেন, মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ।’

‘হুঁ—ক্লোরোফর্ম। তারপর!’

‘দোরের পাশেই সুইচ। আলো জ্বেলে দেখলুম, মেসোমশাই খাটে শুয়ে আছেন—ঠিক যেন ঘুমাচ্ছেন। তাঁর শোবার ভঙ্গী দেখে একবারও মনে হয় না যে তিনি—, কিন্তু তবু কি জানি কেন আমার বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করতে লাগল। সেই গন্ধটা যেন একটা ভিজে ন্যাকড়ার মতন আমার নিঃশ্বাস বন্ধ করবার উপক্রম করলে।

‘কিছুক্ষণ আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইলুম। মনকে বোঝাবার চেষ্টা করলুম যে, ওটা ওষুধের গন্ধ, মেসোমশাই ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন।

‘পা কাঁপছিল, তবু সন্তর্পণে তাঁর খাটের পাশে দাঁড়ালুম। ঝুঁকে দেখলুম—তাঁর নিশ্বাস পড়ছে না। তখন আমার বুকের মধ্যে যে কি হচ্ছে, তা আমি বোঝাতে পারব না—মনে হচ্ছে এইবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাব। বোধহয় মাথাটা ঘুরেও উঠেছিল; নিজেকে সামলাবার জন্যে আমি মেসোমশায়ের বালিশের ওপর হাত রাখলুম। হাতটা ঠিক তাঁর ঘাড়ের পাশেই পড়েছিল—একটা কাঁটার মত কি জিনিস হাতে ফুটল। দেখলুম,একটা ছুঁচ তাঁর ঘাড়ে আমূল বেঁধানো—ছুঁচে তখনও সুতো পরানো রয়েছে।

‘আমি আর সেখানে থাকতে পারলুম না। কিন্তু কি করে যে আলো নিবিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এলুম, তাও জানি না। যখন ভাল করে চেতনা ফিরে এল, তখন নিজের বিছানায় বসে ঠক্ ঠক্ করে কাঁপছি আর কাঁদছি।

‘তারপর তো সবই আপনি জানেন। দাদাকে আমি সন্দেহ করিনি, আমি জানি, দাদা এ কাজ করতে পারেন না, তবু একথা যে কাউকে বলা চলবে না, তাও বুঝতে দেরি হল না। পরদিন সকালবেলা কোনোরকমে চা তৈরি করে নিয়ে মেসোমশায়ের ঘরে গেলুম—’

সত্যবতীর স্বর ক্ষীণ হইয়া মিলাইয়া গেল। তাহার মুখের অস্বাভাবিক পাণ্ডুরতা, চোখের আতঙ্কিত দৃষ্টি হইতে বুঝিতে পারিলাম, কি অসীম সংশয় ও যন্ত্রণার ভিতর দিয়া সেই ভয়ঙ্কর রাত্রিটা তাহার কাটিয়াছিল। ব্যোমকেশের মুখের দিকে চাহিয়া দেখিলাম, তাহার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করিয়া জ্বলিতেছে। সে হঠাৎ বলিয়া উঠিল, ‘আপনার মত অসাধারণ মেয়ে আমি দেখিনি। অন্য কেউ হলে চেঁচামেচি করে মূর্ছা—হিস্টিরিয়ার ঠেলায় বাড়ি মাথায় করত—আপনি—’

সত্যবতী ভাঙ্গা গলায় বলিল,‘শুধু দাদার জন্যে—’

ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ‘আপনি এখন তাহলে বাড়ি ফিরে যান। কাল সকালে আমি আপনাদের ওখানে যাব।’

সত্যবতীও উঠিয়া দাঁড়াইল, শঙ্কিত কণ্ঠে বলিল, ‘কিন্তু আপনি তো কিছু বললেন না?’

ব্যোমকেশ কহিল, ‘বলবার কিছু নেই। আপনাকে আশা দিয়ে শেষে যদি কিছু না করতে পারি? এর মধ্যে বিধুবাবু নামক একটি আস্ত—ইয়ে আছেন কিনা, তাই একটু ভয়। যা হোক, এইটুকু বলতে পারি যে, আপনি যে সব কথা বললেন, তা যদি প্রথমেই বলতেন, তাহলে হয়তো কোনও গোলমাল হত না।’

অশ্রুপূর্ণ চোখে সত্যবতী বলিল, ‘আমি যা বললুম তাতে দাদার কোনও অনিষ্ট হবে না? সত্যি বলছেন? ব্যোমকেশবাবু, আমার আর কেউ নেই—’ তাহার স্বর কান্নায় বুজিয়া গেল।

ব্যোমকেশ তাড়াতাড়ি গিয়া সদর দরজাটা খুলিয়া দাঁড়াইল, একটু হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল, ‘আপনি আর দেরি করবেন না—রাত হয়ে গেছে। আমাদের এটা ব্যাচেলর এস্টাবলিশমেন্ট—বুঝলেন না—’

সত্যবতী একটু ব্যস্তভাবে বাহির হইয়া যাইবার উপক্রম করিল। সে চৌকাঠ পার হইয়াছে, এমন সময় ব্যোমকেশ মৃদুস্বরে তাহাকে কি বলিল শুনিতে পাইলাম না। সত্যবতী চমকিয়া ফিরিয়া চাহিল। ক্ষণকালের জন্যে তাহার কৃতজ্ঞতা-নিষিক্ত মিনতিপূর্ণ চোখ দুটি আমি দেখিতে পাইলাম—তারপর সে নিঃশব্দে ছোট্ট একটি নমস্কার করিয়া দ্রুতপদে সিঁড়ি দিয়া নামিয়া গেল।

দরজা ভেজাইয়া দিয়া ব্যোমকেশ ফিরিয়া আসিয়া বসিল, ঘড়ি দেখিয়া বলিল,‘সাতটা বেজে গেছে।’ তারপর মনে মনে কি হিসাব করিয়া চেয়ারে হেলান দিয়া বলিল, ‘এখনও ঢের সময় আছে।’

আমি সাগ্রহে তাহাকে চাপিয়া ধরিলাম, ‘ব্যোমকেশ, কি বুঝলে? আমি তো এমন কিছু—কিন্তু তোমার ভাব দেখে বোধ হয়, যেন তুমি ভেতরের কথা বুঝতে পেরেছ।’

ব্যোমকেশ মাথা নাড়িল—‘এখনও সব বুঝিনি।’

আমি বলিলাম, ‘যাই বল, সুকুমারের বিরুদ্ধে প্রমাণ যতই গুরুতর হোক, আমার দৃঢ় বিশ্বাস সে খুন করেনি।’

ব্যোমকেশ হাসিল—‘তবে কে করেছে?’

‘তা জানি না—কিন্তু সুকুমার নয়।’

ব্যোমকেশ আর কিছু বলিল না, সিগারেট ধরাইয়া নীরবে টানিতে লাগিল। বুঝিলাম, এখন কিছু বলিবে না। আমিও বসিয়া এই ব্যাপারে অদ্ভুত জটিলতার কথা ভাবিতে লাগিলাম।

অনেক্ষণ পরে ব্যোমকেশ একটা প্রশ্ন করিল, ‘সত্যবতীকে সুন্দরী বলা বোধ হয় চলে না—না?’

আমি চমকিয়া উঠিয়া বলিলাম, ‘কেন বল দেখি?’

‘না, অমনি জিজ্ঞাসা করছি। সাধারণে বোধহয় কালোই বলবে।’

বর্তমান সমস্যার সঙ্গে সত্যবতীর চেহারার কি সম্বন্ধ আছে, বুঝিলাম না; কিন্তু ব্যোমকেশের মন কোন্ দুর্গম পথে চলিয়াছে, তাহা অনুমান করা অসম্ভব। আমি বিবেচনা করিয়া বলিলাম, ‘হ্যাঁ, লোকে তাকে কালোই বলবে, কিন্তু কুৎসিত বোধহয় বলতে পারবে না।’

ব্যোমকেশ একটু হাসিয়া উঠিয়া পড়িল, বলিল, ‘অর্থাৎ তুমি বলতে চাও—‘কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ।’—কেমন?—ভাল কথা, অজিত, তোমার বয়স কত হল বল দেখি?’

সবিস্ময়ে বলিলাম, ‘আমার বয়স—’

‘হ্যাঁ—কত বছর ক’মাস ক’দিন, ঠিক হিসেব করে বল।’

কে জানে—হয়তো আমার বয়সের হিসাবের মধ্যেই করালীবাবুর মৃত্যু-রহস্যটা চাপা পড়িয়া আছে। ব্যোমকেশের অসাধ্য কার্য নাই; আমি মনে মনে গণনা করিয়া বলিলাম, ‘আমার বয়স হল ঊনত্রিশ বছর পাঁচ মাস এগারো দিন।–কেন?’

ব্যোমকেশ একটা ভারী স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ‘যাক তুমি আমার চেয়ে তিন মাসের বড়। বাঁচা গেল। কথাটা কিন্তু মনে রেখো।’

‘মানে?’

‘মানে কিছুই নেই। কিন্তু ও কথা থাক। এই ব্যাপার নিয়ে ভেবে ভেবে মাথা গরম হয়ে উঠেছে। চল, আজ নাইট-শো’তে বায়স্কোপ দেখে আসি।’

ব্যোমকেশ কখনও বায়স্কোপে যায় না, বায়স্কোপ থিয়েটার সে ভালই বাসে না। তাই বিস্ময়ের অবধি রহিল না। বলিলাম, ‘তোমার আজ হল কি বল দেখি? একেবারে খেপচুরিয়াস্ মেরে গেলে না কি?’

ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল, ‘অসম্ভব নয়। আমি লগনচাঁদা ছেলে—ভট্টাচায্যিমশাই কুষ্ঠি তৈয়ার করেই বলেছিলেন, এ ছেলে ঘোর উন্মাদ হবে। কিন্তু আর দেরি নয়। চল, খেয়েদেয়ে বেরিয়ে পড়া যাক। ‘চিত্রা’য় ক’দিন থেকে একটা ভাল ফিল্ম দেখাচ্ছে।’

আহারাদি করিয়া বায়স্কোপে উপস্থিত হইলাম। রাত্রি সাড়ে নয়টার চিত্র-প্রদর্শন আরম্ভ হইল। ছবিটা কিছু দীর্ঘ—শেষ হইতে প্রায় পৌনে বারোটা বাজিল।

অনেক দূর যাইতে হইবে—বাসও দু’একখানা ছিল; আমি একটাতে উঠিবার উপক্রম করিতেছি, ব্যোমকেশ বলিল, ‘না না হেঁটেই চল না খানিকদূর।’ বলিয়া হনহন করিয়া চলিতে আরাম্ভ করিল।

কর্ণওয়ালিস স্ট্রীট ছাড়িয়া সে যখন পাশের একটা সরু রাস্তা ধরিল, তখন বুঝিলাম সে করালীবাবুর বাড়ির দিকে চলিয়াছে। এত রাত্রে সেখানে কি প্রয়োজন, তাহা হৃদয়জম হইল না। যাহা হউক, বিনা আপত্তিতে তাহার সঙ্গে চলিলাম।

স্বাভাবিক অপেক্ষা কিছু বেশি দ্রুতপদেই আমরা চলিতেছিলাম, তবু করালীবাবুর বাড়ি পৌঁছিতে অনেকটা সময় লাগিল। করালীবাবুর দরজার পাশেই একটা গ্যাস-পোস্ট ছিল, তাহার নীচে দাঁড়াইয়া ব্যোমকেশ হাতের আস্তিন সরাইয়া ঘড়ি দেখিল। কিন্তু ঘড়ি দেখিবার প্রয়োজন ছিল না, ঠিক এই সময় অনেকগুলো ঘড়ি চারিদিক হইতে মধ্যরাত্রি ঘোষণা করিয়া দিল।

ব্যোমকেশ উৎফুল্লভাবে আমার পিঠে একটা চাপড় মারিয়া বলিল, ‘হয়েছে। চল, এবার একটা ট্যাক্সি ধরা যাক।’



পরদিন বেলা সাড়ে আটটার সময় আমরা করালীবাবুর বাড়িতে উপস্থিত হইলাম। কয়েকজন পুলিস-কর্মচারী ও বিধুবাবু হাজির ছিলেন। ব্যোমকেশকে দেখিয়া বিধুবাবু একটু অপ্রস্তুত হইলেন, কিন্তু সে ভাব গোপন করিয়া গম্ভীর স্বরে বলিলেন, ‘ব্যোমকেশবাবু, আপনি শুনেছেন বোধহয় যে, সুকুমারকে অ্যারেস্ট করেছি। সে-ই আসল আসামী, তা আমি গোড়া থেকেই বুঝেছিলাম—আমি শুধু তাকে ল্যাজে খেলাচ্ছিলুম।’

‘বলেন কি?’ ব্যোমকেশ মহা বিস্ময়ের ভান করিয়া এমনভাবে বিধুবাবুর পশ্চাদ্দিকে দৃষ্টিপাত করিতে লাগিল, যেন খেলাবার যন্ত্রটা সত্য সত্যই সেখানে বিদ্যমান আছে। ইনস্পেক্টর,সাব-ইনস্পেক্টর হাসি চাপিবার চেষ্টায় উৎকট গাম্ভীর্য অবলম্বন করিয়া অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া লইল।

বিধুবাবু একটু সন্দিগ্ধভাবে বলিলেন, ‘আপনি আজ কি মনে করে?’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘কিছু না। শুনলুম, আর একটা নুতন উইল বেরিয়েছে—তাই সেটা দেখতে এলুম।’

উইল ব্যোমকেশকে দেখাইবেন কি না, তাহা কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বিধুবাবু অনিচ্ছাভরে ফাইল হইতে একটা কাগজ বাহির করিয়া দিলেন। বলিলেন, ‘দেখবেন, ছিঁড়ে ফেলবেন না যেন। এই উইলটাই হচ্ছে সুকুমারের বিরুদ্ধে সেরা প্রমাণ। করালীবাবুকে খুন করবার পর এটা সুকুমার চুরি করে নিজের ঘরে এনে লুকিয়ে রেখেছিল—কোথায় রেখেছিল জানেন? তার ঘরে যে তিনটে ট্রাঙ্ক উপরো-উপরি করে রাখা আছে, তারই নীচের ট্রাঙ্কটার তলায়।’

ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল, ‘বাঃ, সবই যে মিলে যাচ্ছে দেখছি! কিন্তু একটা কথা বলুন তো, সুকুমার উইলখানা ছিঁড়ে ফেললে না কেন?’

বিধুবাবু নাকের মধ্যে একপ্রকার শব্দ করিয়া বলিলেন, ‘হুঁ, সে বুদ্ধি থাকলে তো। ভেবেছিল, আমরা তার ঘর সার্চই করব না।’

‘সুকুমার কিছু বললে?’

‘কি আর বলবে! সবাই যা বলে থাকে, যেন ভারি আশ্চর্য হয়ে গেছে, এমনি ভাব দেখিয়ে বললে, ‘আমি কিছু জানি না।’

ব্যোমকেশ উইলখানা উল্টাইয়া দেখিয়া, সমুচিত শ্রদ্ধার সহিত তাহার ভাঁজ খুলিয়া পড়িতে আরম্ভ করিল। আমিও গলা বাড়াইয়া দেখিলাম, সাদা এক-তা ফুলস্ক্যাপ্ কাগজের উপর ছাপার অক্ষরে লেখা রহিয়াছে—

‘অদ্য ইংরাজী ১৯৩৩ খৃষ্টাব্দের ২২শে সেপ্টেম্বর তারিখে, আমি সজ্ঞানে সুস্থ শরীরে এই উইল করিতেছি যে, আমার মৃত্যুর পর আমার সমস্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি ও নগদ টাকা আমার কনিষ্ঠ ভাগিনেয় শ্রীমান ফণীভূষণ পাইবে। পূর্বে যে সকল উইল করিয়াছিলাম, তাহা অত্র দ্বারা নাকচ করা হইল। স্বাক্ষর—শ্রীকরালীচরণ বসু।’

উইল পড়িয়া ব্যোমকেশ লাফাইয়া উঠিল, দেখিলাম, তাহার মুখ উত্তেজনায় লাল হইয়া উঠিয়াছে। সে বলিল, ‘বিধুবাবু, এ কি আশ্চর্য ব্যাপার! উইল যে—’ বলিয়া কাগজখানা বিধুবাবুর সম্মুখে পাতিয়া ধরিল।

বিধুবাবু বিস্মিতভাবে সেটা আগাগোড়া পড়িয়া বলিলেন, ‘কি হয়েছে? আমি তো কিছু—’

‘দেখছেন না?’ বলিয়া স্বাক্ষরের নীচেটা আঙুল দিয়া দেখাইল।

তখন বিধুবাবু চক্ষু গোলাকৃতি করিয়া বলিলেন, ‘ওঃ, সাক্ষী—’

‘চুপ!’ ব্যোমকেশ ঠোঁটে আঙুল দিয়া ঘরের ভেজানো দরজার দিকে তাকাইল। কিছুক্ষণ উৎকর্ণভাবে শুনিয়া পা টিপিয়া টিপিয়া গিয়া হঠাৎ কবাট খুলিয়া ফেলিল।

মাখনলাল দরজায় কান পাতিয়া শুনিতেছিল, সবেগে পালইবার চেষ্টা করিল। ব্যোমকেশ তাহাকে কামিজের গলা ধরিয়া ঘরের মধ্যে টানিয়া আনিল; জোর করিয়া একটা চেয়ারে বসাইয়া দিয়া বলিল, ‘ইনস্পেক্টরবাবু, একে ধরে রাখুন—ছাড়বেন না। আর, কথা কইতে দেবেন না।’

মাখন ভয়ে আধমরা হইয়া গিয়াছিল, বলিল, ‘আমি—’

‘চুপ! বিধুবাবু একটা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে আনিয়ে নিন। আসামীর নাম দেবার দরকার নেই—নামটা পরে ভর্তি করে নিলেই হবে।’ বিধুবাবুর কানের কাছে মুখ লইয়া গিয়া খাটো গলায় বলিল, ‘ততক্ষণ এই লোকটাকে ল্যাজে খেলান—আমরা আসছি।’

বিধুবাবু বুদ্ধিভ্রষ্টের মত বলিলেন, ‘কিন্তু আমি কিছুই—’

‘পরে হবে। ইতিমধ্যে আপনি ওয়ারেন্টখানা আনিয়ে রাখুন। এস অজিত।’

দ্রুতপদে ব্যোমকেশ উপরে উঠিয়া গিয়া ফণীর কবাটে টোকা মারিল। ফণী আসিয়া দরজা খুলিয়া সম্মুখে ব্যোমকেশকে দেখিয়া ঈষৎ বিস্ময়ের সহিত বলিল, ‘ব্যোমকেশবাবু!’

আমরা ঘরে প্রবেশ করিলাম। ব্যোমকেশের ব্যস্তসমস্ত ভাব আর ছিল না, সে সহাস্যমুখে বলিল, ‘আপনি শুনে সুখী হবেন, করালীবাবুর প্রকৃত হত্যাকারী কে—তা আমরা জানতে পেরেছি।’

ফণী একটু মলিন হাসিয়া বলিল, ‘হ্যাঁ—সুকুমারদা গ্রেপ্তার হয়েছেন জানি। কিন্তু এখনও যেন বিশ্বাস করতে পারছি না।’

‘বিশ্বাস না হবারই তো কথা। তাঁর ঘর থেকে আর একটা উইল বেরিয়েছে।–সে উইলের ওয়ারিস আপনি!’

ফণী বলিল, ‘তাও শুনেছি। কথাটা শুনে অবধি আমার মনটা যেন তেতো হয়ে গেছে। তুচ্ছ টাকার জন্যে মামার অপঘাতে প্রাণে গেল।’ একটা নিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, ‘অর্থমনর্থম্! তিনি আমায় সব সম্পত্তি দিয়ে গেছেন, এতেও আমি খুশি হতে পারছি না ব্যোমকেশবাবু। নাই দিতেন টাকা—তবু তো তিনি বেঁচে থাকতেন।’

ব্যোমকেশ বইয়ের শেলফটার সম্মুখে দাঁড়াইয়া বইগুলা দেখিতে দেখিতে অন্যমনস্কভাবে বলিল, ‘তা তো বটেই। পুত্রাদপি ধনভাজাং ভীতিঃ—শঙ্করাচার্য তো আর মিথ্যে বলেননি! এটা কি বই? ফিজিওলজি! সুকুমারবাবুর বই দেখছি।’ বইখানা বাহির করিয়া ব্যোমকেশ নামপত্রটা দেখিল।

ফণী একটু হাসিয়া বলিল, ‘হ্যাঁ—সুকুমারদা মাঝে মাঝে আমাকে তাঁর ডাক্তারি বই পড়তে দিতেন। কি আশ্চার্য দেখুন। এ বাড়িতে আমি সুকুমারদাকেই সবচেয়ে আপনার লোক মনে করতুম—এমন কি, দাদাদের চেয়েও—অথচ তিনিই—’

ব্যোমকেশ আরও কতকগুলি বই খুলিয়া দেখিয়া বিস্মিতভাবে বলিল, ‘আপনি তো দেখছি একজন পাকা গ্রন্থকীটি! সব বই দাগ দিয়া পড়েছেন।’

ফণী বলিল, ‘হ্যাঁ। পড়া ছাড়া আর তো কোনও অ্যামুজমেন্ট নেই—সঙ্গীও নেই। এক সুকুমারদা রোজ সন্ধ্যাবেলা খানিকক্ষণ আমার কাছে এসে বসতেন। আচ্ছা, ব্যোমকেশবাবু, সত্যই কি সুকুমারদা এ কাজ করেছেন? কোন সন্দেহ নেই?’

ব্যোমকেশ চেয়ারে আসিয়া বসিল, বলিল, ‘অপরাধীর বিরুদ্ধে যে সব প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাতে সন্দেহের বিশেষ স্থান নেই। বসুন—আপনাকে সব কথা বলছি।’

ফণী বিছানায় উপবেশন করিল, আমি তাহার পাশে বসিলাম। ব্যোমকেশ বলিল, ‘দেখুন, হত্যা দু’রকম হয়—এক, রাগের মাথায় হত্যা, যাকে crime of passion বলে; আর এক, সঙ্কল্প করে হত্যা। রাগের মাথায় যে—লোক খুন করে, তাকে ধরা কঠিন নয়—অধিকাংশ সময় সে নিজেই ধরা দেয়। কিন্তু যে লোক ভেবে-চিন্তে নিজেকে যথাসম্ভব সন্দেহমুক্ত করে খুন করে, তাকে ধরাই কঠিন হয়ে পড়ে। তখন কে আসামী, তার নাম আমরা জানতে পারি না, পাঁচজন লোকের ওপর সন্দেহ হয়। এ রকম ক্ষেত্রে আমরা কোন্ পথে চলব? তখন আমাদের একমাত্র পথ হচ্ছে—হত্যার প্রণালী থেকে হত্যাকারীর প্রকৃতি বোঝবার চেষ্টা করা।

‘বর্তমান ক্ষেত্রে আমরা একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখতে পাচ্ছি—হত্যাকারী লোকটা একাধারে বোকা এবং চতুর। সে অত্যন্ত বুদ্ধিমানের মত খুন করেছে অথচ নির্বোধের মত খুনের যা-কিছু প্রমাণ নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে রেখে দিয়েছে। বলুন দেখি, সত্যবতী ছুঁচ দিয়ে খুন করবার কি দরকার ছিল? বাজারে কি ছুঁচ পাওয়া না? আর উইলখানা যত্ন করে লুকিয়ে রাখবার কোনও আবশ্যকতা ছিল কি? ছিঁড়ে ফেললেই তো সব ন্যাটা চুকে যেত। এ থেকে কি মনে হয়?’

ফণী হাতের উপর চিবুক রাখিয়া শুনিতেছিল, বলিল, ‘কি মনে হয়?’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘যে ব্যক্তি বুদ্ধিমান, সে বোকামির ভান করতে পারে। সুতরাং পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, আসামী যে হোক সে বুদ্ধিমান।

‘কিন্তু বুদ্ধিমান লোকও ভুল করে,বোকা সাজবার চেষ্টাও সব সময় সফল হয় না। এ ক্ষেত্রেও আসামী কয়েকটা ছোট ছোট ভুল করেছিল বলে আমি তাকে ধরতে পেরেছি।’

ফণী মৃদু স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, ‘কি ভুল সে করেছিল?’

‘বলছি।’ ব্যোমকেশ পকেট হাঁটকাইয়া একটা সাদা কাগজ বাহির করিল—‘কিন্তু তার আগে এ বাড়ির একটা নক্সা তৈরি করে দেখাতে চাই। একটা পেন্সিল আছে কি? যে কোনও পেন্সিল হলেই চলবে।’

ফণীর বিছানায় বালিশের পাশে একটা বই রাখা ছিল, তাহার ভিতর হইতে সে একটা লাল পেন্সিল বাহির করিয়া দিল।

পেন্সিলটা লইয়া ব্যোমকেশ ভাল করিয়া দেখিল, তারপর মৃদু হাস্যে সেটা পকেটে রাখিয়া দিয়া বলিল, ‘থাক, প্ল্যান্ আঁকবার দরকার নেই—মুখেই বলছি। অপরাধী ‍প্রধানত তিনটি ভুল করেছিল। প্রথমে—সে গ্রে’র অ্যানাটমির এক জায়গায় লাল পেন্সিল দিয়ে দাগ দিয়েছিল; দ্বিতীয়—সে বাক্স টানবার সময় একটু শব্দ করে ফেলেছিল; আর তৃতীয়—সে আইন ভাল জানত না।’

ফণীর মুখ হইতে সমস্ত রক্ত নামিয়া গিয়া মুখখানা একেবারে মড়ার মত হইয়া গিয়াছিল, সে অতি কষ্টে উচ্চারণ করিল,‘আইন জানত না?’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘না, আর সেই জন্যেই তার অতবড় অপরাধটা ব্যর্থ হয়ে গেল।’

শুঙ্ক অধর লেহন করিয়া ফণী বলিল, ‘আপনি কি বলছেন, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।’

ব্যোমকেশ ধীরে ধীরে বলিল, ‘সুকুমারবাবুর ঘর থেকে যে উইলটা বেরিয়েছে—উইল হিসেবে সেটা মূল্যহীন। তাতে সাক্ষীর দস্তখত নেই।’

মনে হইল, ফণী এবার মূর্ছিত হইয়া পড়িয়া যাইবে। অনেকক্ষণ কেহ কোনও কথা বলিল না; দৃষ্টিহীন শুষ্ক চক্ষু মেলিয়া ফণী মাটির দিকে তাকাইয়া রহিল। তারপর দুই হাতে মাথার চুল মুঠি করিয়া ধরিয়া অর্ধব্যক্ত স্বরে বলিল, ‘সব বৃথা—সব মিছে—’ ব্যোমকেশবাবু, আমাকে একটু সময় দিন, আমি বড় অসুস্থ বোধ করছি।’

ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া ঘাড় নাড়িল, ‘আধ ঘণ্টা সময় আপনাকে দিলুম—তৈরি হয়ে নিন।’ দ্বার পর্যন্ত গিয়া ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ‘থিম্বলটা অবশ্য’ ফেলে দিয়েছেন; সেটা সুকুমারের ঘরে রেখে আসেননি কেন বোঝা যাচ্ছে না। তাড়াতাড়িতে আঙুল থেকে খুলতে ভুলে গিয়েছিলেন—না? তাই হবে। কিন্তু ক্লোরোফর্ম কার হাত দিয়ে আনালেন? মাখন?’

ফণী বিছানায় শুইয়া পড়িয়া বলিল, ‘আধ ঘণ্টা পরে আসবেন—’

দ্বার ভেজাইয়া দিয়া আমরা নীচে নামিয়া আসিয়া বসিলাম। মাখন তখনও ইনস্পেক্টর ও সাব-ইনস্পেক্টরের মধ্যবর্তী হইয়া দারুভুত জগন্নাথের মত বসিয়াছিল, ব্যোমকেশ ভীষণ ভ্রুকুটি করিয়া তাহাকে প্রশ্ন করিল, ‘তুমি কবে ফণীকে ক্লোরোফর্ম এনে দিয়েছ?’

মাখন চমকাইয়া উঠিয়া বলিল, ‘আমি কিছু জানি না—’

‘সত্যি কথা বল, নইলে ওয়ারেন্টে তোমার নামই লেখা হবে।’

মাখন কাঁদিয়া ফেলিয়া বলিল, ‘দোহাই আপনাদের, আমি এ সবের মধ্যে নেই। ফণী বলেছিল রাত্রে তার ঘুম হয় না, একফোঁটা করে ক্লোরোফর্ম খেলে ঘুম হবে—তাই—’

‘বুঝেছি। একে এবার ছেড়ে দিতে পারেন, বিধুবাবু।’

মুক্তি পাইয়া মাখন একেবারে বাড়ি ছাড়িয়া দৌড় মারিল। ব্যোমকেশ বলিল, ‘ওয়ারেন্ট এসেছে?’

বিধুবাবু বলিলেন, ‘না, এই এল বলে। কিন্তু কার জন্যে ওয়ারেন্ট?’

‘করালীবাবুকে যে খুন করেছে তার জন্য।’

বিধুবাবু অতিশয় অপ্রসন্নভাবে মাথা নাড়িয়া বলিলেন, ‘ব্যোমকেশবাবু, এটা পরিহাসের সময় নয়। কমিশনার সাহেব আপনাকে একটু স্নেহ করেন বলে আপনি আমার ওপর হুকুম চালাচ্ছেন, তাও আমি সহ্য করেছি। কিন্তু তামাশা সহ্য করব না।’

‘তামাশা নয়—এ একেবারে নিরেট সত্যি কথা। শুনুন তবে—’ বলিয়া ব্যোমকেশ সংক্ষেপে সমস্ত কথা বিধুবাবুকে বলিল। বিধুবাবু কিছুক্ষণ বিস্ময়বিহুল হইয়া রহিলেন, তারপর ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বলিলেন, ‘তাই যদি হয়, তবে তাকে একলা ফেলে এলেন কি বলে? যদি পালায়?’

‘পালাবে না; সে নিজের অপরাধ স্বীকার করবে। আর সেইটেই আমাদের একমাত্র ভরসা; কারণ, তার অপরাধ আদালতে প্রমাণ করা বিশেষ কঠিন হবে। জুরীদের আপনি জানেন তো—তারা ‘নট্ গিল্টি’ বলেই আছে।’

‘তা তো জানি—কিন্তু—’ বিধুবাবুর আবার বসিয়া পড়িলেন।

ঠিক আধ ঘণ্টা পরে আমরা ফণীর ঘরে এলাম। বিধুবাবু সর্বপ্রথম দরজা খুলিয়া গটগট্ করিয়া ঘরে ঢুকিয়াই থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িলেন।

ফণী বিছানায় শুইয়া আছে, বিছানার পাশে তাহার ডান হাতটা ঝুলিতেছে; আর ঠিক তাহার নীচে মেঝের উপর পুরু হইয়া রক্ত জমিয়াছে। কব্জির কাটা ধমনী হইতে তখনও ফোঁটা ফোঁটা গাঢ় রক্ত ঝরিয়া পড়িতেছে।

কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘এতটা আমি প্রত্যাশা করিনি। কিন্তু এ ছাড়া তার উপায়ই বা ছিল কি?’

ফণীর বুকের উপর একখানা চিঠি রাখা ছিল; সেটা তুলিয়া লইয়া ব্যোমকেশ পাঠ করিল। চিঠেতে এই কয়টি কথা লেখা—

‘ব্যোমকেশবাবু,

চলিলাম। আমি খোঁড়া অকর্মণ্য, এখানে আমার অন্ন জুটিবে না—দেখি ওখানে জোটে কি না। আমি জানি, মোকদ্দমা করিয়া আপনারা আমার ফাঁসি দিতে পারিতেন না। কিন্তু আমার বাঁচিয়া কোনও লাভ নাই; যখন টাকাই পাইলাম না,তখন কিসের সুখে বাঁচিব?

মামাকে খুন করিয়াছি সেজন্য আমার ক্ষোভ নাই; তিনি আমাকে ভালবাসিতেন না, খোঁড়া বলিয়া বিদ্রুপ করিতেন। তবে সুকুমারদার কাছে ক্ষমা চাহিতেছি। কিন্তু তিনি ছাড়া দোষ চাপাইবার লোক আর কেহ ছিল না।

তা ছাড়া, তিনি ফাঁসি গেলে আর একটা সুবিধা হইত। কিন্তু যে কথা নিজের বিকলাঙ্গতার লজ্জায় জীবনে কাহাকেও বলিতে পারি নাই আজ আর তাহা প্রকাশ করিব না।

ক্লোরোফর্ম কোথা হইতে পাইয়াছি তাহা বলিব না; যে আনিয়া দিয়াছিল সে আমার অভিসন্ধি জানিত না। তবে পরে হয়তো সন্দেহ করিয়াছিল।

আপনি আশ্চর্য লোক, থিম্বলের কথাটাও ভুলেন নাই। সেটা সত্যই আঙুল হইতে খুলিতে ভুলিয়া গিয়াছিলাম; ঘরে ফিরিয়া আসিয়া চোখে পড়িল। সেটা এই ঘরেই আছে—খুঁজিয়া লইবেন। সেদিন রাত্রিতে সত্যবতীর ঘর হইতে থিম্বল আর ছুঁচ চুরি করিয়াছিলাম—সে তখন রান্নাঘরে ছিল।

আপনি ছাড়া আমাকে বোধহয় আর কেহ ধরিতে পারিত না কিন্তু তবু আপনাকে বিদ্বেষ করিতে পারতেছি না।

বিদায়।

ইতি—

বহুদূরের যাত্রী

ফণীভূষণ কর

চিঠিখানি বিধুবাবুর হাতে দিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘এখন সুকুমারবাবুকে ছেড়ে দেবার বোধহয় আর কোনও বাধা নেই। তাঁর ভগিনীকেও জানানো দরকার। তিনি বোধহয় নিজের ঘরেই আছেন।–চল অজিত।’



সপ্তাহখানেক পরে আমরা দুইজনে আমাদের বসিবার ঘরে অধিষ্ঠিত ছিলাম। বৈকালবেলা নীরবে চা—পান চলিতেছিল।

গত কয়দিন অপরাহ্ণে ব্যোমকেশ নিয়মিত বাহিরে যাইতেছিল। কোথায় যায়, আমাকে বলে নাই, আমিও জিজ্ঞাসা করি নাই। তাহার কাছে মাঝে মাঝে এমন দু’একটা গোপনীয় কেস আসিত যাহার কথা আমার কাছেও প্রকাশ করিবার তাহার অধিকার ছিল না।

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘আজও বেরুবে না কি?’

ঘড়ি দেখিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘হুঁ।’

একটু সঙ্কুচিতভাবে প্রশ্ন করিলাম, ‘নুতন কেস হাতে এসেছে, না?’

‘কেস? হ্যাঁ—কিন্তু কেসটা বড় গোপনীয়।’

আমি আর ও বিষয়ে কোনও প্রশ্ন করিলাম না, বলিলাম, ‘সুকুমারের ব্যাপার সব চুকে গেছে?’

‘হ্যাঁ—প্রোবেটের দরখাস্ত করেছে।’

আমি বলিলাম, ‘আচ্ছা ব্যোমকেশ, ঠিক কিভাবে ফণী খুন করলে, আমাকে বুঝিয়ে বলতো; এখনও ভাল করে জট ছাড়াতে পারছি না।’

চায়ের শূণ্য পেয়ালাটা নামাইয়া রাখিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘আচ্ছা শোন, পর পর ঘটনাগুলো যেমন ঘটেছিল, বলে যাচ্ছি—

‘সেদিন দুপুরবেলা করালীবাবুর সঙ্গে মতিলালের ঝগড়া হল। সন্ধ্যেবেলা সুকুমার এসে তাই শুনে করালীবাবুকে বোঝাতে গেল। সেখান থেকে গালাগালি খেয়ে বেরিয়ে ফণীর ঘরে প্রায় সাড়ে সাতটা পর্যন্ত কাটালে; তারপর খেয়েদেয়ে বায়স্কোপ দেখতে গেল। এ পর্যন্ত কোনও গোলমাল নেই।’

‘না।’

‘রাত্রি আটটার থেকে নয়টার মধ্যে—অর্থাৎ সত্যবতী যে সময় রান্নাঘরে ছিল, সেই সময় ফণী তার ঘর থেকে থিম্বল আর ছুঁচ চুরি করলে। সে বুঝতে পেরেছিল, করালীবাবুর আবার উইল বদলাবেন এবং এবার সে সম্পত্তি পাবে। সে ঠিক করলে, বুড়োকে আর মত বদলাবার ফুরসৎ দেবে না। বুড়োকে ফণী বিষচক্ষে দেখত; বিকলাঙ্গ লোকের একটা অদ্ভুত মানসিক দুর্বলতা প্রায়ই দেখা যায়—তারা নিজেদের দৈহিক বিকৃতি সম্বন্ধে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ সইতে পারে না। ফণী বোধহয় অনেকদিন থেকেই করালীবাবুকে খুন করবার মতলব আঁটছিল। ‘বামুনঠাকুর এজেহার থেকে জানা যায়, রাত্রি আন্দাজ সাড়ে এগারোটার সময় মতিলাল বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। গাঁজাখোরদের সময়ের ধারণা থাকে না, তাই বামুনঠাকুর একটু সময়ের গোলমাল করে ফেলেছিল। গাঁজাখোরদের সময়ের ধারণা থাকে না, তাই বামুনঠাকুর একটু সময়ের গোলমাল করে ফেলেছিল। আমি হিসাব করে দেখেছি , মতিলাল বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল ঠিক এগারোটা বেজে পঁচিশ মিনিটে। তার ও-দোষ বরাবরই ছিল—রাত্রে বাড়ি থাকত না।

‘সে বেরিয়ে যাবার পর ফণীও নিজের ঘর থেকে বেরুল। মতিলালের ঘর করালীবাবুর শোবার ঘরের ঠিক নীচেই, পাছে পায়ের শব্দ হয়, তাই ফণী এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল। ঘুমন্ত করালীবাবুকে ক্লোরোফর্ম করতে মিনিট পাঁচেক সময় লাগল; তারপর সে তাঁর ঘাড়ে অপটু হস্তে ছুঁচ ফোটালে। তিনবার ফোটবার পর তবে ছুঁচ যথাস্থানে পৌছল। সুকুমারের মতন ডাক্তারি ছাত্র যদি একাজ করত, তাহলে তিনবার ফোটাবার দরকার হত না।

‘করালীবাবুকে শেষ করে ফণী পাশের ঘরের দেরাজ থেকে তাঁর শেষ উইল বার করলে—দেখলে, উইল তার নামেই বটে।

‘এখানে একটু সন্দেহের অবকাশ আছে। এমনও হতে পারে যে, ফণী করালীবাবুকে ক্লোরোফর্ম করে পাশের ঘরে গিয়ে উইলটা পড়লে; যখন দেখলে উইল তারই নামে, তখন ফিরে এসে করালীবাবুকে খুন করলে। সে যাই হোক, এই ব্যাপারে তার দশ-বারো মিনিট সময় লাগল।

‘এখন কথা হচ্ছে, উইলখানা নিয়ে সে কি করবে? যথাস্থানে রেখে দিলেও পারত, কিন্তু তাতে সুকুমারকে ভাল করে ফাঁসানো যায় না। অথচ নিজেকে বাঁচাতে হলে একজনকে ফাঁসানো চাই—ই।

উইল আর ক্লোরোফর্মের শিশি সে সুকুমারের ঘরে লুকিয়ে রেখে এল। জানত, এত বড় কাণ্ডের পর সব ঘর খানাতল্লাস হবেই—তখন উইলও বেরুবে। এক ঢিলে দুই পাখি মরবে—সুকুমার তখন ফিরতে পারে না; সে ফিরছে—যখন ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারোটা বাজছে—

‘আর কিছু বোঝাবার দরকার আছে কি?’

‘উইলে সাক্ষীর দস্তখত না থাকার কারণ কি?’

ব্যোমকেশ ভাবিতে ভাবিতে বলিল, ‘আমার মনে হয়, খাওয়া-দাওয়ার পর করালীবাবু উইলটা লিখেছিলেন, তাই আর রাত্রে কিছু করেননি। সম্ভবত তাঁর ইচ্ছে ছিল, পরদিন সকালে চাকর-বামুনকে দিয়ে সহি দস্তখত করিয়ে নেবেন।’

নীরবে ধুমপান করিয়া কিছুক্ষণ কাটিয়া গেল, তারপর জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘সত্যবতীর সঙ্গে তারপর আর দেখা হয়েছিল? সে কি বললে? খুব ধন্যবাদ দিলে তো?’

বিমর্ষভাবে মাথা নাড়িয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘না। শুধু গলায় আঁচল দিয়ে পেন্নাম করলে।’

‘চমৎকার মেয়ে কিন্তু—না?’

ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইল,তর্জনী তুলিয়া বলিল, ‘তুমি আমার চেয়ে বয়সে বড়, সে কথাটা মনে আছে তো?’

‘হ্যাঁ—কেন?’

উত্তর না দিয়া ব্যোমকেশ পাশের ঘরে প্রবেশ করিল। মিনিট পাঁচেক পরে বিশেষ সাজ-সজ্জা করিয়া বাহির হইয়া আসিল। আমি বলিলাম, ‘তোমার গোপনীয় মক্কেল তো ভারী শৌখিন লোক দেখছি, সিল্কের পাঞ্জাবি পরা ডিটেকটিভ না হলে মন ওঠে না।’

এসেন্স-মাখানো রুমালে মুখ মুছিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘হুঁ। সত্য অণ্বেষণ তো আর চাট্টিখানি কথা নয়, অনেক তোড়জোড় দরকার।’

আমি বললাম, ‘সত্য অণ্বেষণ তো অনেকদিন থেকেই করছ, এত সাজ-সজ্জা তো কখনো দেখিনি।’

ব্যোমকেশ একটু গম্ভীর হইয়া বলিল, ‘সত্য অণ্বেষণ আমি অল্পদিন থেকেই আরম্ভ করেছি।’

‘তার মানে?’

‘তার মানে অতি গভীর। চললুম।’ মুচকি হাসিয়া ব্যোমকেশ দ্বারের দিকে অগ্রসর হইল।

‘সত্য—ওঃ।’ আমি লাফাইয়া গিয়া তাহার কাঁধ চাপিয়া ধরিলাম—‘সত্যবতী! এ ক’দিন ধরে ঐ মহা সত্যটি অণ্বেষণ করা হচ্ছে বুঝি? অ্যাঁ—ব্যোমকেশ! শেষে তোমার এই দশা। কবি তাহলে ঠিক বলেছেন—প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে।’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘খবরদার। তুমি আমার চেয়ে বয়সে বড়, অর্থাৎ সম্পর্কে তার ভাশুর। ঠাট্টা-ইয়ার্কি চলবে না। এবার থেকে আমিও তোমায় দাদা বলে ডাকব।’

জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘আমাকে এত ভয় কেন?’

সে বলিল, ‘লেখক জাতটাকেই আমি ঘোর সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখি।’

দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলাম, ‘বেশ, দাদাই হলুম তাহলে।’ ব্যোমকেশের মস্তকে হস্তার্পণ করিয়া বলিলাম, ‘যাও ভাই, চারটে বাজে, এবার জয়যাত্রায় বেরিয়ে পড়। আশীর্বাদ করি, সত্যের প্রতি যেন তোমার অবিচলিত ভক্তি থাকে।’

ব্যোমকেশ বাহির হইয়া গেল।

(শেষ)


No comments:

Post a Comment