কঙ্কাবতী (শেষাংশ)



লেখক: ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়

প্রথমাংশের লিঙ্ক

দ্বিতীয়াংশের লিঙ্ক

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

খর্বুর

দীর্ঘ-শুণ্ড মশা বলিলেন, “রক্তবতী, এক্ষণে মনুষ্য-শাবকটি তোমার। ইহাকে লইয়া তুমি যাহা ইচ্ছা হয় কর।”

রক্তবতী বলিলেন, “পিতা, ইনি আমার ভগিনী। ইহার সহিত আমি পচাজল পাতাইয়াছি। আমার পচাজল বিপদে পড়িয়াছে। পচাজলের পতিকে নাকেশ্বরী খাইয়াছে। কাঁদিয়া কাঁদিয়া পচাজল আমার সারা হইয়া গেল। যাহাতে আমার পচাজল আপনার পতি পায়, বাবা তুমি তাহাই কর।”

কি করিয়া কঙ্কাবতীর পতিকে নাকেশ্বরী খাইয়াছে, মশা আদ্যোপান্ত সমুদয় বিবরণ শুনিতে ইচ্ছা করিলেন। আগা-গোড়া সকল কথা কঙ্কাবতী তাঁহাকে বলিল।ভাবিয়া চিন্তিয়া মশা শেষে বলিলেন, “তুমি আমার রক্তবতীর পচাজল। সে নিমিত্ত তোমার প্রতি আমার স্নেহের উদয় হইয়াছে। তোমাকে আর আমরা কেহ খাইব না। স্নেহের সহিত তোমাকে আমরা প্রতিপালন করিব। যাহাতে তুমি তোমার পতি পাও সে জন্যও যথাসাধ্য চেষ্টা করিব। আমার তালুকে খর্বুর মহারাজ বলিয়া একটি মনুষ্য আছে। শুনিয়াছি সে নানারূপ ঔষধ, নানারূপ মন্ত্রতন্ত্র জানে। আকাশে বৃষ্টি না হইলে মন্ত্র পড়িয়া মেঘে সে ছিদ্র করিয়া দিতে পারে। শিলা-বৃষ্টি পড় পড় হইলে সে নিবারণ করিতে পারে। বৃদ্ধা স্ত্রী দেখিলেই সে বলিতে পারে, এ ডাইনী কি ডাইনী নয়। তাহাকে দেখিবামাত্র ভূতগণ পলায়ন করে। তাহার মত গুণী মনুষ্য পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় নাই। নাকেশ্বরীর হাত হইতে তোমার পতিকে সে-ই উদ্ধার করিতে পারিবে।”

কঙ্কাবতী বলিল, “তবে মহাশয়, আর বিলম্ব করিবেন না। চলুন এখনই তাঁহার নিকট যাই। মহাশয়, স্বামী-শোকে শরীর আমার প্রতিনিয়তই দগ্ধ হইতেছে, সংসার আমি শূন্য দেখিতেছি। তাঁহার প্রাণরক্ষা হইবে কেবল এই প্রত্যাশায় জীবিত আছি। তাহা না হইলে, কোন কালে এ পাপ প্রাণ বিসর্জন দিতাম।” মশা বলিলেন, “অধিক রাত্রি হইয়াছে, তুমি পরিশ্রান্ত হইয়াছ। আমার তালুক নিতান্ত নিকট নয়। তবে রও, আমার কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে ডাকিতে পাঠাই। তাহার পিঠে চড়িয়া আমরা সকলে এখনই খর্বুর মহারাজের নিকট গমন করিব।”

মশা এই বলিয়া আপনার কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে ডাকিতে পাঠাইলেন। কিছুক্ষণ বিলম্বে মশার ছোট ভাই আসিয়া উপস্থিত হইলেন। মশানীগণ তাঁহাকে ‘হাতী-ঠাকুরপো, হাতী-ঠাকুরপো’ বলিয়া অনেক সমাদর ও নানারূপ পরিহাস করিতে লাগিলেন।

রক্তবতী তাহাকে বলিলেন, “কাকা, আমি একটি মানুষের ছানা পাইয়াছি। তাহার সহিত আমি পচাজল পাতাইয়াছি। আমি পচাজলকে বড় ভালবাসি, আমার পচাজল ও আমাকে বড় ভালবাসে।”

কঙ্কাবতী আশ্চর্য হইল। মশার ছোট ভাই হাতী, প্রকাণ্ড হস্তী। বনের সকলে তাঁহাকে হাতী-ঠাকুরপো বলিয়া থাকে। রক্তবতীর পিতা হস্তীকে বলিলেন, “ভায়া, আমি বড় বিপদে পড়িয়াছি রক্তবতী একটি মানুষের মেয়ের সহিত পচাজল পাতাইয়াছে। মেয়েটির পতিকে নাকেশ্বরী খাইয়াছে। মেয়েটি পথে পথে কাঁদিয়া বেড়াইতেছে। রক্তবতীর দয়ার শরীর। রক্তবতী তার দুঃখে বড় দুঃখী। আমি তাই মনে করিয়াছি যদি কোনও মতে পারি তো তার স্বামীকে উদ্ধার করিয়া দিই। খর্বুর মহারাজের দ্বারাই এ কার্য সাধিত হইতে পারিবে। তাই আমার ইচ্ছা যে এখনই খর্বুরের নিকট যাই। কিন্তু মানুষের মেয়েটি পথ হাঁটিয়া ও কাঁদিয়া কাঁদিয়া অতিশয় শ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছে। এত পথ সে চলিতে পারিবে না। এখন ভায়া তুমি যদি কৃপা কর তবেই হয়। আমাদিগকে যদি পিঠে করিয়া লইয়া যাও তো বড় উপকার হয়।”

হাতী-ঠাকুরপো সে কথায় সম্মত হইলেন। কঙ্কাবতী মশানীদিগকে নমস্কার করিয়া তাঁহাদিগের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিল।রক্তবতীর গলা ধরিয়া কঙ্কাবতী বলিল, “ভাই পচাজল, তুমি আমার অনেক উপকার করিলে। তোমার দয়া, তোমার ভালবাসা, কখনও ভুলিতে পারিব না। যদি ভাই পতি পাই, তবে পুনরায় দেখা হইবে। তা না হইলে ভাই এ জনমের মত তোমার পচাজল এই বিদায় হইল।”

রক্তবতীর চক্ষু ছল ছল করিয়া আসিল, রক্তবতীর চক্ষু হইতে অশ্রুবিন্দু ফোঁটায় ফোঁটায় ভূতলে পতিত হইতে লাগিল।

মশা ও কঙ্কাবতী দুইজনে হাতীর পৃষ্ঠে আরোহণ করিলেন। হাতী-ঠাকুরপো মৃদুমন্দ গতিতে চলিতে লাগিলেন। যাইতে যাইতে সমস্ত রাত্রি গত হইয়া গেল। অতি প্রত্যূষে খর্বুরের বাটিতে গিয়া সকলে উপস্থিত হইলেন। তাঁহারা দেখিলেন যে, খর্বুর শয্যা হইতে উঠিয়াছেন। অতি বিষণ্ণ-বদনে আপনার দ্বারদেশে বসিয়া আছেন। একটু একটু তখনও অন্ধকার রহিয়াছে। আকাশে কৃষ্ণপক্ষীয় প্রতিপদের চন্দ্র তখনও অস্ত যান নাই। খর্বুরের বিষণ্ণ মূর্তি দেখিয়া আকাশের চাঁদ অতি প্রসন্ন মূর্তি ধারণ করিয়াছেন। চাঁদের মুখে আর হাসি ধরে না। চাঁদের হাসি দেখিয়া খর্বুরের রাগ হইতেছে। খর্বুর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিলেন যে, “এই চাঁদের একদিন আমি দণ্ড করিব। চাঁদকে যদি উচিত মত দণ্ড না দিতে পারি, তাহা হইলে খর্বুরের গুণ-জ্ঞান, তুক-তাক্, মন্ত্র-তন্ত্র, শিকড়-মাকড়, সবই বৃথা।”মশা, কঙ্কাবতী ও হস্তী গিয়া খর্বুরের দ্বারে উপস্থিত হইলেন। মশাকে দেখিয়া খর্বুর শশব্যস্ত হইয়া উঠিলেন।

হাত জোড় করিয়া খর্বুর বলিলেন, “মহাশয়, আজ প্রাত:কালে কি মনে করিয়া? প্রতিদিন তো সন্ধ্যার সময় আপনার শুভাগমন হয়। আজ দিনের বেলা কেন? ঘরে কুটুম্ব-সাক্ষাৎ আসিয়াছেন না কি? তাই কনিষ্ঠকে সঙ্গে করিয়া আনিয়াছেন যে, তাঁহার পিঠে বোঝাই দিয়া প্রচুর পরিমাণে রক্ত লইয়া যাইবেন?”

মশা উত্তর করিলেন, “না, তা নয়, সেজন্য আমি আসি নাই, কি জন্য আসিয়াছি, তাহা বলিতেছি। আপাততঃ জিজ্ঞাসা করি, তুমি বিষণ্ণ মুখে বসিয়া আছ কেন? এরূপ বিষণ্ণ-বদনে থাকা তো উচিত নয়। মনোদু:খে থাকিতে তোমাদিগকে বারবার নিষেধ করিয়াছি। মনের সুখে না থাকিলে, শরীরে রক্ত হয় না, সে রক্ত সুস্বাদু হয় না। মনের সুখে যদি তোমরা না থাকিবে, পুষ্টিকর তেজস্কর দ্রব্য-সামগ্রী যদি আহার না করিবে, তবে তোমাদের রক্তহীন দেহে বসিয়া আমাদের ফল কি? তোমরা সব যদি নিয়ত এরূপ অন্যায় কার্য করিবে, তবে আমরা পরিবারবর্গকে কি করিয়া প্রতিপালন করিব? তোমাদের মনে কি একটু ত্রাস হয় না যে, আমাদের গায়ে বসিয়া মশা-প্রভু যদি সুচারুরূপে রক্তপান করিতে না পান, তাহা হইলে তিনি, আমাদিগের উপর রাগ করিবেন?”খর্বুর বলিলেন, “প্রভু, শীর্ণ হইয়া যাইতেছি সত্য। আমার শরীরে ভালরূপ সুস্বাদু রক্ত না পাইলে মহাশয় যে রাগ করিবেন, তাহাও জানি। কিন্তু কি করিব? স্ত্রীর তাড়নায় আমার এই দশা ঘটিয়াছে।”

মশা জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন? কি হইয়াছে? তোমার স্ত্রী তোমার প্রতি কিরূপ অত্যাচার করেন?”

খর্বুর উত্তর করিলেন, “প্রভু, আমাদের স্ত্রী-পুরুষে সর্বদা বিবাদ হয়। দিনের মধ্যে দুই তিন বার মারামারি পর্যন্ত হইয়া থাকে। কিন্তু দুঃখের কথা আর মহাশয়কে কি বলিব! আমি হইলাম তিন হাত লম্বা, আমার স্ত্রী হইলেন সাত হাত লম্বা। যখন আমাদের মারামারি হয়, তখন আমার স্ত্রী নাগরা জুতা লইয়া ঠন্ ঠন্ করিয়া আমার মস্তকে প্রহার করেন। আমি ততদূর নাগাল পাই না; আমি যা মারি তা কেবল তাঁর পিঠে পড়ে। স্ত্রীর প্রহারের চোটে অবিলম্বেই আমি কাতর হইয়া পড়ি, আমার প্রহারে স্ত্রীর কিন্তু কিছুই হয় না। সুতরাং স্ত্রীর নিকটে আমি সর্বদাই হারিয়া যাই। একে মার খাইয়া, তাতে মনক্লেশে শরীর আমার শীর্ণ হইয়া যাইতেছে; দেহে আমার রক্ত নাই। সেজন্য মহাশয় রাগ করিতে পারেন, তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু আমি কি করিব? আমার অপরাধ নাই।”মশা বলিলেন, “বটে। আচ্ছা তুমি এক কর্ম কর। আজ হাতী ভায়ার পিঠে চড়িয়া তুমি স্ত্রীর সহিত মারামারি কর।”

এই বলিয়া মশা খর্বুরকে হাতীটি দিলেন। খর্বুর হাতীর পিঠে চড়িয়া বাড়ীর ভিতর গিয়া স্ত্রীর সহিত বিবাদ করিতে লাগিলেন। কথায় কথায় ক্রমে মারামারি আরম্ভ হইল। খর্বুর আজ হাতীর উপর বসিয়া মনের সুখে ঠন্ ঠন্ করিয়া স্ত্রীর মাথায় নাগরা জুতা মারিতে লাগিলেন। আজ স্ত্রী যাহা মারেন, খর্বুরের গায়ে কেবল সামান্যভাবে লাগে। যখন তুমুল যুদ্ধ বাধিয়া উঠল, মশার তখন তার আনন্দের পরিসীমা রহিল না। মশার হাত নাই যে, হাতাতালি দিবেন। নখ নাই যে, নখে নখে ঘর্ষণ করিবেন। তাই তিনি কখনও এক পা তুলিয়া নৃত্য করিতে লাগিলেন, কখনও দুই পা তুলিয়া নৃত্য করিতে লাগিলেন ও গুন গুন করিয়া ‘নারদ নারদ’ বলিতে লাগিলেন। অবিলম্বেই আজ খর্বুরের স্ত্রীকে পরাভব মানিতে হইল। খর্বুরের মন আজ আনন্দে পরিপূর্ণ হইল। খর্বুরের ধমনী ও শিরায় প্রবলবেগে আজ শোণিত সঞ্চালিত হইতে লাগিল। মশা সেই রক্ত একটু চাখিয়া দেখিলেন, দেখিয়া বলিলেন, “বাঃ। অতি সুমিষ্ট, অতি সুস্বাদু।”মশা মহাশয়কে খবুর্র শত শত ধন্যবাদ দিলেন ও কি জন্য তাঁহাদের শুভাগমন হইয়াছে, সে কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। কঙ্কাবতী ও নাকেশ্বরীর বিবরণ মশা মহাশয় আদ্যোপান্ত তাঁহাকে শুনাইলেন।

সমস্ত বিবরণ শুনিয়া খর্বুর বলিলেন, “আপনাদের কোনও চিন্তা নাই। নাকেশ্বরীর হাত হইতে আমি ইহার পতিকে উদ্ধার করিয়া দিব। ভূত, প্রেতিনী, ডাকিনী সকলেই আমাকে ভয় করে। চলুন আমাকে সেই নাকেশ্বরীর ঘরে লইয়া চলুন, দেখি সে কেমন নাকেশ্বরী!”

মশা, কঙ্কাবতী ও খর্বুর হস্তীর পৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া বনাভিমুখে যাত্রা করিলেন। প্রায় দুই প্রহরের সময় পর্বতের নিকট উপস্থিত হইলেন।

ষোড়শ পরিচ্ছেদ

খোক্কশ

নাকেশ্বরী যখন খেতুকে পাইল, তখন খেতু একেবারে মৃতপ্রায় হইয়া পড়িল। জ্ঞান-গোচর আর তাহার কিছু মাত্র রহিল না। নিঃশ্বাস দ্বারা নাকেশ্বরী যে কঙ্কাবতীকে দূরীভূত করিল, খেতু তাহার কিছুই জানে না। খেতুকে মৃতপ্রায় করিয়া নাকেশ্বরী মনে মনে ভাবিল, বহুকাল ধরিয়া অনাহারে আছি। ইষ্ট দেবতা ব্যাঘ্রের প্রসাদে আজ যদি এরূপ উপাদেয় খাদ্য মিলিল, তবে ইহাকে ভালরূপে রন্ধন করিয়া খাইতে হইবে। এমন সুখাদ্য একেলা খাইয়া তৃপ্তি হইবে না, যাই মাসীকে গিয়া নিমন্ত্রণ করিয়া আনি।

মাসী আসিতে আসিতে পাছে খাদ্য পচিয়া যায়, সেজন্য নাকেশ্বরী তখন খেতুকে একেবারে মারিয়া ফেলিল না, মৃতপ্রায় অজ্ঞান করিয়া রাখিল।নাকেশ্বরী মাসীকে নিমন্ত্রণ করিতে গেল। নাকেশ্বরীর মাসীর বাড়ী অনেক দূর, সাত সমুদ্র তের নদীর পার, সেই একঠেঙো মুল্লুকের ওধারে। সেখানে যাইতে, আবার মাসীকে লইয়া আসিতে, অনেক বিলম্ব হইল।

মাসী বুড়া মানুষ। মাসীর দাঁত নাই। খেতুর কোমল মাংস দেখিয়া মাসীর আর আহ্লাদের সীমা নাই। মাসীর মুখ দিয়া লাল পড়িতে লাগিল।

খেতুর গা টিপিয়া টিপিয়া মাসী বলিলেন, “আহা, কি নরম মাংস। বুড়া হইয়াছি, একঠেঙো মানুষের দড়িপানা শক্ত মাংস আর চিবাইতে পারি না। আজ দুঠেঙো মানুষের মাংস দাগা দাগা করিয়া কাটিয়া ভাজা হউক, আঙুলগুলির চড়চড়ি হউক, অন্যান্য মাংস অম্বল করিয়া রাঁধা থাকুক, দুই দিন আহার করা যাইবে, গন্ধ হইয়া যাইবে না।” মাসী-বোনঝিতে এইরূপ পরামর্শ হইতেছে, এমন সময় বাহিরে একটি গোল উঠল। হাতীর বৃংহণ, মশার গুঞ্জন, মানুষের কণ্ঠস্বর পর্বতের বাহির হইতে অট্টালিকার ভিতর প্রবেশ করিল।

নাকেশ্বরী ব্যস্ত হইয়া বলিল, “মাসী! সর্বনাশ হইল। মুখের গ্রাস বুঝি কাড়িয়া লয়! ছুঁড়ী বুঝি ওঝা আনিয়াছে।”

মাসী বলিলেন, “চল চল চল! দ্বারের উপর দুই জনে পা ফাঁক করিয়া দাঁড়াই।”

অট্টালিকার দ্বারের উপর নাকেশ্বরী ও নাকেশ্বরীর মাসী পদপ্রসারণ করিয়া দাঁড়াইল। পর্বতের ধারে সুড়ঙ্গের দ্বারে উপস্থিত হইয়া মশা, কঙ্কাবতী ও খর্বুর হস্তীর পৃষ্ঠ হইতে অবতরণ করিলেন। হাতী-ঠাকুরপো বাহিরে দন্ডায়মান থাকিয়া গাছের ডাল ভাঙ্গিয়া মাছি তাড়াইতে লাগিলেন। কখনও বা শুঁড়ে করিয়া ধূলারাশি লইয়া আপনার গায়ে পাউডার মাখিতে লাগিলেন। দোল খাইতে ইচ্ছা হইলে কখনও বা মনের সাধে শরীর দোলাইতে লাগিলেন।

মশা, কঙ্কাবতী ও খর্বুর সুড়ঙ্গের ভিতর প্রবেশ করিলেন। সুড়ঙ্গের পথ দিয়া অট্টালিকার ভিতর প্রবেশ করিবার সময় দ্বারে নাকেশ্বরী ও নাকেশ্বরীর মাসীর পদতল দিয়া সকলকে যাইতে হইল। ভিতরে প্রবেশ করিয়া, খেতুর নিকট সকলে গমন করিলেন। সকলে দেখিলেন যে, খেতু মৃতপ্রায় হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে। অজ্ঞান অচৈতন্য শরীরে প্রাণ আছে কি-না সন্দেহ। নিঃশ্বাস প্রশ্বাস বহিতেছে কি-না সন্দেহ। কঙ্কাবতী তাহার পদপ্রান্তে পড়িয়া পা-দুটি বুকে লইয়া নানারূপ বিলাপ করিতে লাগিল। খর্বুর খেতুকে নানা প্রকারে পরীক্ষা করিয়া দেখিতে লাগিলেন। অবশেষে খর্বুর বলিলেন, “কঙ্কাবতী তুমি কাঁদিও না। তোমার পতি এখনও জীবিত আছেন। সত্বর আরোগ্য লাভ করিবেন। আমি এক্ষণেই এ রোগের প্রতিকার করিতেছি।”

এই বলিয়া খর্বুর মন্ত্র পড়িতে লাগিলেন, খেতুর শরীরে শত শত ফুৎকার বর্ষণ করিতে লাগিলেন, নানারূপ ঔষধ প্রয়োগ করিলেন। কিন্তু কোনও ফল হইল না। সংজ্ঞাশূন্য হইয়া খেতু যেভাবে পড়িয়া ছিল, সেইভাবেই পড়িয়া রহিল। তিলমাত্রও নড়িল চড়িল না।খর্বুর বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “এ কি হইল! আমার মন্ত্র-তন্ত্র এরূপ কখনও তো বিফল হয় না। রোগী পুনর্জীবিত হউক না হউক, মন্ত্রের ফল অল্পাধিক অবশ্যই প্রকাশিত হইয়া থাকে। আজ যে আমার মন্ত্র-তন্ত্র শিকড়-মাকড় একেবারে নিরর্থক হইতেছে, ইহার কারণ কি।”

খর্বুর সাতিশয় চিন্তিত হইলেন। ভাবিয়া কারণ কিছু স্থির করিতে পারেন না। অবশেষে তিনি বলিলেন, “মশা-প্রভু। আসুন দেখি, সকলে পুনরায় বাহিরে যাই। বাহিরে গিয়া দেখি, ব্যাপারখানা কি?”

অট্টালিকা হইতে সকলে পুনর্বার বাহির হইলেন। একবার বাহিরে যাইয়া, সুড়ঙ্গের পথ দিয়া সকলে পুনরায় ফিরিয়া আসিতে লাগিলেন। অতি তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে, আশ-পাশ, অগ্র-পশ্চাৎ, ঊর্ধ্ব-নিম্ন দশ দিক সূক্ষ্মাণুসূক্ষ্মরূপে পরীক্ষা করিতে করিতে খর্বুর আসিতে লাগিলেন। অট্টালিকার নিকট আসিয়া ঊর্ধ্বদিকে চাহিয়া দেখেন যে, ভূতিনীদ্বয় পদপ্রসারণ করিয়া দ্বারের উপর দাঁড়াইয়া আছে। খর্বুর ঈষৎ হাসিলেন আর মনে করিলেন, বটে! তোমাদের চাতুরী তো কম নয়!

বার বাহির হইতে খর্বুর মন্ত্র পড়িতে লাগিলেন। মন্ত্রের প্রভাবে ভূতিনীদ্বয় পদ উত্তোলন করিয়া সেখান হইতে পলায়ন করিল। ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া খর্বুর পুনরায় ঝাড়ান কাড়ান আরম্ভ করিলেন। ক্রমে মন্ত্রবলে নাকেশ্বরী আসিয়া খেতুর শরীরে আবির্ভূত হইল। খেতু বক্তা হইলেন, অর্থাৎ কি না, খেতুর মুখ দিয়া ভূতিনী কথা কহিতে লাগিল। নানারূপ ঔষধ প্রয়োগ করিয়া, নানারূপ মন্ত্র পড়িয়া খর্বুর নাকেশ্বরীকে ছাড়িয়া যাইতে বলিলেন। নাকেশ্বরী কিছুতেই ছাড়িবে না। নাকেশ্বরী বলিল যে, “এ মনুষ্য ঘোরতর অপরাধে অপরাধী হইয়াছে, আমা-রক্ষিত সঞ্চিত ধন অপহরণ করিয়াছে। সেজন্য আমি ইহাকে কখনই ছাড়িতে পারি না, আমি ইহাকে নিশ্চয়ই ভক্ষণ করিব।”খর্বুর পুনরায় নানারূপ মন্ত্রাদি দ্বারা নাকেশ্বরীকে অশেষ যন্ত্রণা দিতে লাগিলেন। যাতনা-ভোগে নিতান্ত অসমর্থ হইয়া, অবশেষে নাকেশ্বরী খেতুকে ছাড়িয়া যাইতে সম্মত হইল। কিন্তু “যাই যাই” বলে, তবু কিন্তু যায় না। “এইবার যাই, এইবার চলিলাম” বারবার এই কথা বলে, তবু কিন্তু যায় না।

নাকেশ্বরীর শঠতা দেখিয়া খর্বুর অতিশয় বিরক্ত হইলেন। ক্রোধে তাঁহার ওষ্ঠদ্বয় কাঁপিতে লাগিল, তাঁহার চক্ষুদ্বয় রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল। খর্বুর বলিলেন, “যাবে না? বটে, আচ্ছা দেখি এইবার যাও কি না।” এই বলিয়া তিনি একটি কুষ্মাণ্ড আনয়ন করিলেন, মন্ত্রপুত করিয়া তাহার উপর সিন্দুরের ফোঁটা দিয়া কুমড়াটিকে বলিদান দিবার উদযোগ করিলেন। খর্পরে কুমড়াটি রাখিয়া খবুর্র খড়্গ উত্তোলন করিলেন। কোপ মারেন আর কি। এমন সময় নাকেশ্বরী অতি কাতর স্বরে চীৎকার করিয়া বলিল, “রক্ষা করুন, রক্ষা করুন! কোপ মারিবেন না, আমাকে কাটিয়া ফেলিবেন না। আমি এখন সত্য সত্য সকল কথা বলিতেছি।”খর্বুর জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি বলিবে বল! সত্য বল, কেন তুমি ছাড়িয়া যাইতেহ না। সত্য সত্য না বলিলে, এখনই তোমাকে কাটিয়া ফেলিব।”

নাকেশ্বরী বলিল, “আমি ছাড়িয়া গেলে কোনও ফল হইবে না। রোগী এখনই মরিয়া যাইবে। রোগীর পরমায়ুটুকু লইয়া কচুপাতে বাঁধিয়া আমি তাল গাছের মাথায় রাখিয়াছিলাম। মনে করিয়াছিলাম, মাসী আসিলে পরমায়ুটুকু বাঁটিয়া দুইজনে খাইব। তা পরমায়ুসহিত কচুপাতাটি বাতাসে তালগাছ হইতে পড়িয়া গিয়াছে। ক্ষুদ্র পিপীলিকাতে পরমায়ুটুকু খাইয়া ফেলিয়াছে। এখন আর আমি পরমায়ু কোথায় পাইব যে, রোগীকে আনিয়া দিব? সেই জন্য বলিতেছি যে, আমি ছাড়িয়া গেলেই রোগী মরিয়া যাইবে।” খর্বুর গুণিয়া গাঁথিয়া দেখিলেন যে, নাকেশ্বরী যাহা বলিতেছেন, তাহা সত্য কথা, মিথ্যা নয়। খর্বুর মনে মনে ভাবিলেন যে, এইবার প্রমাদ হইল। ইহার এখন উপায় কি করা যায়? পরমায়ু না থাকিলে পরমায়ু তো আর কেহ দিতে পারে না?

অনেক চিন্তা করিয়া, খর্বুর নাকেশ্বরীকে আদেশ করিলেন, “যে ক্ষুদ্র পিপীলিকা ইহার পরমায়ুভক্ষণ করিয়াছে, তুমি অনুসন্ধান করিয়া দেখ, সে খুদে-পিঁপড়েরা এখন কোথায়?”

নাকেশ্বরী গিয়া, তালতলায়, পাথরের ফাটলে, মাটির গর্তে, কাঠের কোটরে, সকল স্থানে সেই ক্ষুদ্র পিপীলিকাদিগের অন্বেষণ করিতে লাগিল। কোথাও আর তাহাদিগকে দেখিতে পাইল না। ডেয়ো-পিপঁড়ে, কাঠ-পিপঁড়ে, শুশশুড়ে-পিঁপড়ে, টোপ-পিঁপড়ে, যত প্রকার পিপঁড়ের সহিত সাক্ষাৎ হয়, সকলকেই নাকেশ্বরী ও নাকেশ্বরীর মাসী জিজ্ঞাসা করে, “হাঁগা! খুদে-পিঁপড়েরা কোথায় গেল, তোমরা দেখিয়াছ?” খুদে-পিঁপড়ের তত্ত্ব কেহই বলিতে পারে না। বোনঝির বিপদে মাসীও ব্যথিত হইয়া চারিদিকে অন্বেষণ করিতে লাগিল। কিন্তু শীঘ্রই বুড়ীর হাঁপ লাগিল, চলিতে চলিতে নাকেশ্বরীর মাসীর পায়ে ব্যথা হইল। তখন নাকেশ্বরীর মাসী মনে করিল, ভাল দু-ঠেঙো মানুষের মাংস খাইতে আসিয়াছিলাম বটে! এখন আমার প্রাণ নিয়ে টানাটানি! অনুসন্ধান করিতে করিতে অবশেষে কানা-পিঁপড়ের সহিত নাকেশ্বরীর সাক্ষাৎ হইল। কানা-পিঁপড়েকে খুদে-পিঁপড়ের কথা জিজ্ঞাসা করিল। কানা-পিঁপড়ে বলিল, “আমি খুদে-পিঁপড়েদের কথা জানি। তালতলায় কচুপাতা হইতে মানুষের সুমিষ্ট পরমায়ুটুকু চাটিয়া-চুটিয়া খাইয়া, হাত মুখ পুঁছিয়া, খুদে-পিঁপড়েরা গৃহে গমন করিতেছিল। এমন সময় সাহেবের পোশাক পরা একটি ব্যাঙ আসিয়া তাহাদিগকে কূপ কূপ করিয়া খাইয়া ফেলিল।”

অট্টালিকায় প্রত্যাগমন করিয়া নাকেশ্বরী এই সংবাদটি খর্বুরকে দিল। ভেকের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত খর্বুর পুনরায় নাকেশ্বরীকে পাঠাইলেন। নাকেশ্বরী মনে করিল, ভাল কথা! আমার মুখের গ্রাস কাড়িয়া লইবে, আবার সেই কাজে আমাকেই খাটাইবে। কিন্তু নাকেশ্বরী করে কি? কথা না শুনিলেই খর্বুর সেই কুমড়াটি বলিদান দিবেন। এ দিকে তিনি কুমড়াটি কাটিবেন, আর ওদিকে নাকেশ্বরীর গলাটি দুইখানা হইয়া যাইবে। বনে-বনে, পথে-পথে, পর্বতে-পর্বতে, খানায়-ডোবায়, নাকেশ্বরী ও নাকেশ্বরীর মাসী ভেকের অনুসন্ধান করিয়া ফিরিতে লাগিলেন। কোথায় কোন্ গর্তের ভিতর ব্যাঙ খাইয়া-দাইয়া বসিয়া আছেন, তাহার সন্ধান ভূতিনীরা কি করিয়া পাইবে? ব্যাঙের কোনও সন্ধান হইল না। নাকেশ্বরী ফিরিয়া আসিয়া খর্বুরকে বলিল, “আমাকে মারুন আর কাটুন, ব্যাঙের সন্ধান আমি কিছুতেই করিতে পারিলাম না।”

নাকেশ্বরীর কথা শুনিয়া খর্বুর পুনরায় ঘোর চিন্তায় নিমগ্ন হইলেন। অনেকক্ষণ চিন্তা করিয়া অবশেষে তিনি এক মুষ্টি সর্ষপ হাতে লইলেন। মন্ত্রপূত করিয়া সরিষাগুলিকে ছড়াইয়া ফেলিলেন। পড়া সরিষারা নক্ষত্র-বেগে পৃথিবীর চারিদিকে ছুটিল। দেশ-বিদেশ, গ্রাম-নগর, উপত্যকা-অধিত্যকা, সাগর-মহাসাগর, চারিদিকে খর্বুরের সরিষা-পড়া ছুটিল। পর্ণপূর্ণ, পুরাতন, পঙ্কিল পুষ্করিণীর পার্শ্বে, সুশীতল গর্তের ভিতর ব্যাঙ মহাশয় মনের সুখে নিদ্রা যাইতেছিলেন। সরিষাগণ সেইখানে গিয়া উপস্থিত হইল। সূচের সূক্ষ্ম ধারে চর্ম-মাংস ভেদ করিয়া সরিষাগণ ব্যাঙের মস্তকে চাপিয়া বসিল। ভেকের মাথা হইতে সাহেবী টুপিটি খসিয়া পড়িল। যাতনায় ব্যাঙ মহাশয় ঘোরতর চীৎকার করিতে লাগিলেন। ঠেলিয়া ঠেলিয়া সরিষারা তাঁহাকে গর্তের ভিতর হইতে বাহির করিল। ঠেলিয়া ঠেলিয়া তাঁহাকে অট্টালিকার দিকে লইয়া চলিল। ঠেলিয়া ঠেলিয়া তাহাকে সুড়ঙ্গের পথে প্রবিষ্ট করিল। অট্টালিকার সম্মুখে আসিয়া ব্যাঙ মহাশয় হস্ত দ্বারা দ্বারে আঘাত করিলেন। মশা দ্বার খুলিয়া দিলেন, ভেক মহাশয় অট্টালিকার ভিতর প্রবেশ করিয়া যেখানে কঙ্কাবতী ও খর্বুর বসিয়া ছিলেন, সেইখানে গিয়া উপস্থিত হইলেন। কঙ্কাবতী চিনিলেন যে, এ সেই ব্যাঙ। ব্যাঙ চিনিলেন যে, এ সেই কঙ্কাবতী।

ব্যাঙ বলিলেন, “ওগো ফুটফুটে মেয়েটি তোমার সহিত এত আলাপ পরিচয় করিলাম, আর তুমি আসিয়া সকলকে আমার আধুলিটির সন্ধান বলিয়া দিলে গা! ছি বাছা! তুমি এ ভাল কাজ কর নাই। ধনের গল্প গাঁট-কাটাদের কাছে কি করিতে আছে? বিশেষত ওই চেপটা গাঁট-কাটার কাছে। আমার আধুলির যাহা কিছু বাকী আছে, সকলে ভাগ করিয়া লও, লইয়া আমাকে এখন ছাড়িয়া দাও। চেপটা মহাশয়! আমি দেখিতেছি, এ সরিষাগুলি আপনার চেলা। এখন কৃপা করিয়া সরিষাগুলিকে আমার মাথাটি ছাড়িয়া দিতে বলুন, ইহাদের যন্ত্রণায় আমার প্রাণ বাহির হইতেছে।” খর্বুর বলিলেন, তোমার আধুলিতে আমাদের প্রয়োজন কি? এ বালিকাটি তোমার পরিচিতা বালিকাটি কি ঘোর বিপদে পতিত হইয়াছে, তাহাও বোধ হয় তুমি জান। ওই যে মৃতবৎ যুবাটিকে দেখিতেছ, উনিই ইহার পতি। নাকেশ্বরী দ্বারা উনি আক্রান্ত হইয়াছেন। নাকেশ্বরী ওঁর পরমায়ু লইয়া তালবৃক্ষের মস্তকে লুকাইয়া রাখিয়াছিল। বাতাসে সেই পরমায়ুটুকু তলায় পড়িয়া গিয়াছিল। ক্ষুদ্র পিপীলিকারা সেই পরমায়ু ভক্ষণ করে। তুমি সেই পিপীলিকাদিগকে ভক্ষণ করিয়াছ। এক্ষণে উদরের ভিতর হইতে সেই পিপীলিকাগুলিকে বাহির করিয়া দাও। পিপীলিকাদিগের উদর হইতে পরমায়ুটুকু বাহির করিয়া কঙ্কাবতীর পতির প্রাণরক্ষা করি। পিপীলকাগুলিকে বাহির করিয়া দিলেই সরিষাগণ তোমাকে ছাড়িয়া দিবে।”

ব্যাঙ উত্তর করিলেন, “এই বালিকাটি আমার পরিচিত বটে। যাহাতে ইহার মঙ্গল হয়, তাহা করিতে আমি প্রস্তুত আছি।”এই বলিয়া ব্যাঙ গলায় অঙ্গুলি দিয়া উদগিরণ করিতে যত্ন করিলেন, কিন্তু বমন কিছুতেই হইল না। তাহার পর গলায় পালক দিয়া বমন করিতে চেষ্টা করিলেন, তবুও বমন হইল না। অবশেষে খর্বুর তাহাকে নানাবিধ বমনকারক ঔষধ সেবন করাইতে লাগিলেন, কিন্তু ব্যাঙের বমন আর কিছুতেই হইল না!

খর্বুর ভাবিলেন, এ আবার এক নূতন বিপদ। ইহার উপায় কি করা যায়?

খর্বুর ব্যাঙের নাড়ী ধরিয়া উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন। তিনি ভাবিলেন, এইবার চাঁদকে আমি পতনে পাইয়াছি। চাঁদের কথা তাঁহার মনে পড়িল। চাঁদের ফল-শিকড় এ রোগের অব্যর্থ মহৌষধ। সেবন করাইলে এখনই ভেকের বমন হইবে। মশাকে সম্বোধন করিয়া খর্বুর কহিলেন, “মহাশয়, এ ব্যাঙের বমন হয় এরূপ ঔষধ পৃথিবীতে নাই। জগতে ইহার কেবল একমাত্র ঔষধ আছে। ওই যে আকাশে চাঁদ দেখিতে পান, ওই চাঁদের মূল-শিকড়ের ছাল এক তোলা, সাতটি মরিচ দিয়া বাটিয়া খাইলে, তবেই ব্যাঙের বমন হইবে, নতুবা আর কিছুতেই হইবে না।”

এই কথা শুনিয়া মশা বিমর্ষ হইয়া রহিলেন। কঙ্কাবতী একেবারে হতাশ হইয়া পড়িলেন। কঙ্কাবতী বলিলেন, মশা মহাশয়! খর্বুর মহারাজ! এই হতভাগিনীর জন্য আপনারা অনেক পরিশ্রম করিলেন। কিন্তু আপনারা কি করিবেন? এ হতভাগিনীর কপাল নিতান্তই পুড়িয়াছে। আকাশে গিয়া চাঁদের মূল-শিকড় কে কাটিয়া আনিতে পারে? চাঁদের ফল-শিকড়ও সংগ্রহ হইবে না, পতিও আমার প্রাণ পাইবেন না। আপনারা সকলে গৃহে প্রত্যাগমন করুন, আমার জন্য বৃথা আর ক্লেশ পাইবেন না। আপনাদিগের অনুগ্রহে আমি যে আমার পতির মৃতদেহটি পাইলাম, তাহাই যথেষ্ট। পতির পদ আশ্রয় করিয়া আমি এক্ষণে প্রাণ পরিত্যাগ করি। আপনারা সকলে গৃহে প্রত্যাগমন করুন।”মশা বলিলেন, “আমি অনেক দূর উড়িতে পারি সত্য। কিন্তু চাঁদ পর্যন্ত যে উড়িয়া যাই, এরূপ শক্তি আমার নাই। সেজন্য আমি দেখিতেছি যে, আমাদের সমুদয় পরিশ্রম বিফল হইল। আহা! রক্তবতী মা আমার পথপানে চাহিয়া আছেন। রক্তবতীকে গিয়া কি বলিব?”

খর্বুর বলিলেন, “আপনারা নিতান্ত হতাশ হইবেন না। একটি খোক্কশের বাচ্চার সন্ধান হয়? তাহা হইলে তাহার পিঠে চড়িয়া অনায়াসেই আকাশে উঠিতে পারা যায়। ধাড়ী খোক্কশ পাইলে কাজ হইবে না, ধাড়ী খোক্কশ বাগ মানিবে না, বাচ্চা খোক্কশ আবশ্যক।”ব্যাঙ বলিলেন, “একস্থানে খোক্কশের বাচ্চা হইয়াছে, তাহার সন্ধান আমি জানি। কিন্তু খোক্কশের বাচ্চা তোমরা ধরিবে কি করিয়া? ধাড়ী খোক্কশ যে তোমাদিগকে খাইয়া ফেলিবে। আচ্ছা, যেন পাকে-প্রকারে তাহাকে ধরিলে। তাহার পিঠে চড়িয়া আকাশের উপর যায় কে? প্রাণটি হাতে করিয়া আকাশে যাইতে হইবে। আকাশে একটা ভয়ানক সিপাহী আছে, আকাশের সে চৌকিদার। কর্ণে সে বধির। কানে ভাল শুনিতে পায় না বটে, কিন্তু অন্য দিকে সে বড়ই দুর্দান্ত সিপাহী। আকাশের লোক তাহার ভয়ে সব জড়সড়। আকাশের চারিদিকে সে পাহারা দিয়া বেড়ায়, তাহার হাতে পড়িলে আর রক্ষা নাই। তাই ভাবিতেছি, চাঁদের মূল-শিকড় কাটিয়া আনিতে আকাশে যায় কে?”

কঙ্কাবতী বলিল, “সেজন্য আপনাদিগের কোনও চিন্তা নাই। যদি খোক্কশের বাচ্চা পাই, তাহা হইলে তাহার পিঠে চড়িয়া আমি আকাশে যাইব। আমার আর ভয় কিসের? যদি আকাশের সিপাহীর হাতে পড়ি, সে না হয় আমাকে মারিয়া ফেলিবে, আর আমার সে কি করিতে পারে? পতি বিহনে আমি তো এ প্রাণ রাখিব না, এ তো আমার একান্ত প্রতিজ্ঞা। তবে প্রাণের ভয় আর কি জন্য করিব? এখন খোক্কশের বাচ্চা ধরাই স্থির হইল। যে পাহাড়ের ধারে, গর্তের ভিতর খোক্কশের বাচ্চা হইয়াছে, ব্যাঙ তাহার সন্ধান বলিয়া দিলেন। মশা বলিলেন, “কৌশল করিয়া খোক্কশের বাচ্চা ধরিতে হইবে।”

এইরূপ স্থির হইল যে, ব্যাঙ ও খর্বুর অট্টালিকায় খেতুকে চৌকি দিয়া বসিয়া থাকিবেন। আর মশা, কঙ্কাবতী ও হাতী-ঠাকুরপো খোক্কশের বাচ্চা ধরিতে যাইবেন।

যাত্রা করিবার সময় কঙ্কাবতী খেতুর পদধূলি লইয়া আপনার মস্তকে রাখিল।

মশা কঙ্কাবতীকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন কঙ্কাবতী, তুমি আকাশে উঠিতে পারিবে তো? তোমার তো ভয় করিবে না?”

কঙ্কাবতী বলিল, “ভয় আমার আবার কিসের? যদি আকাশে একবার উঠিতে পারি, তাহা হইলে দেখি কি করিয়া চাঁদ আপনার মূল-শিকড় রক্ষা করেন। আর দেখি, আকাশের সেই বধির সিপাহীর কত ঢাল-খাঁড়া আছে। পতিপরায়ণা সতীর পরাক্রম আজ আকাশের লোককে দেখাইব।”

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

নক্ষত্রদের বউ

খোক্কশের বাচ্চা ধরিয়া আকাশে উঠিবার কথা নাকেশ্বরী ও নাকেশ্বরীর মাসী বসিয়া বসিয়া শুনিল। তাহারা দুইজনে পরামর্শ করিতে লাগিল যে, যদি এই কাজটি নিবারণ করিতে পারা যায়, তাহা হইলে খর্বুর আর আমাদের দোষ দিতে পারিবে না, অথচ খাদ্যটিও আমাদের হাতছাড়া হইবে না।

মাসী বলিল, “বৃদ্ধ হইয়াছি। এখন পৃথিবীর অর্ধেক দ্রব্যে অরুচি। এইরূপ কোমল রসাল মাংস খাইতে এখন সাধ হয়। যদি ভাগ্যক্রমে একটি মিলিল, তাও বুঝি যায়!”

নাকেশ্বরী বলিল, “মাসী তুমি এক কর্ম কর। তোমার ঝুড়িতে বসিয়া তুমি গিয়া আকাশে উঠ। সমস্ত আকাশ তুমি একেবারে চুনকাম করিয়া দাও। ভাল করিয়া দেখিয়া শুনিয়া চুনকাম করিবে কোথাও যেন একটু ফাঁক না রহিয়া যায়। তুমি তোমার চশমা নাকে দিয়া যাও, তাহা হইলে ভাল করিয়া দেখিতে পাইবে। চুনকাম করিয়া দিলে ছুঁড়ী আর আকাশের ভিতর যাইতে পথ পাইবে না, চাঁদও দেখিতে পাইবে না, চাঁদের মূল-শিকড়ও কাটিয়া আনিতে পারিবে না।” দুইজনে এইরূপ পরামর্শ করিয়া মাসী গিয়া ঝুড়িতে বসিল। ঝুড়ি হুহু শব্দে আকাশে উঠিল। সমস্ত আকাশে নাকেশ্বরীর মাসী চুনকাম করিয়া দিল।

অট্টালিকা হইতে বাহির হইবার সময়ে মশা দেখিলেন যে সেখানে একটি ঢাক পড়িয়া রহিয়াছে। মশা সেই ঢাকটি সঙ্গে লইলেন। বাহিরে আসিয়া কঙ্কাবতী ও মশা হস্তীর পৃষ্ঠে আরোহণ করিলেন। যে বনে খোক্কশের বাচ্চা হইয়াছে, সেই বনে সকলে চলিলেন। সন্ধ্যার পর খোক্কশের গর্তের নিকট উপস্থিত হইলেন।

একবার আকাশ পানে চাহিয়া মশা বলিলেন, “কি হইল? আজ দ্বিতীয়ার রাত্রি, চাঁদ এখন উঠিলেন না কেন? মেঘ করে নাই, তবে নক্ষত্র সব কোথায় গেল? আকাশ এরূপ শুভ্রবর্ণ ধারণ করিল কেন? ধাড়ী খোক্কশ আপনার বাচ্চা চৌকি দিয়া গর্তে বসিয়া আছে। একে রাত্রি, তাতে নিবিড় অন্ধকার বন। দূর হইতে ধাড়ী খোক্কশ কঙ্কাবতীর গন্ধ পাইল।

ভয়ংকর চীৎকার করিয়া ধাড়ী খোক্কশ বলিল, “হাঁউ মাঁউ খাঁউরে, মঁনুষ্যের গঁন্ধ পাঁউরে! কে রা তোরা, এদিকে আসিস?”

মশা চীৎকার করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুই কে?”

খোক্কশ বললেন, “আমরা আবার কে? আমরা খোক্কশ!” মশা বলিলেন, “আমরা আবার কে? আমরা ঘোক্কশ!”

এই উত্তর শুনিয়া খোক্কশের ভয় হইল খোক্কশ বলিল, “বাপ রে! তবে তো তোরা কম নয়? ক খ গ ঘ, আমি খ-য়ে তোরা ঘ-য়ে, আমার চেয়ে তোরা দুই পইঠা উঁচু! আচ্ছা, কেমন তোরা ঘোক্কশ, একবার কাশ দেখি, শুনি?”

মশা তখন সেই ঢাকটি ঢং ঢং করিয়া বাজাইলেন।

সেই শব্দ শুনিয়া খোক্কশ বলিল, “ওরে বাপ রে! তোদের কাশির কি শব্দ! শুনলে ভয় হয়, কানে তালা লাগে! তোরা ঘোক্কশ বটে!” খোক্কশ কিন্তু কিছু সন্দিগ্ধ চিত্ত। এরূপ অকাট্য প্রমান পাইয়াও তবু তাহার মনে সম্পূর্ণ বিশ্বাস হইল না। তাই সে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা! তোরা কেমন ঘোক্কশ, তোদের মাথার একগাছা চুল ফেলিয়া দে দেখি?”

এই কথা বলিতে, মশা হাতীর কাছিগাছটি ফেলিয়া দিলেন। খোক্কশ তাহা হাতে করিয়া দেখিতে লাগিল। অনেক দেখিয়া শেষে বলিল, “ওরে বাপ রে! এই কি তোদের মাথার চুল! তোদের চুল যখন এত বড়, এত মোটা, তখন তোরা না জানি কত মোটা। তোদের সঙ্গে পারা ভার।”

তবুও কিন্তু খোক্কশের মনে সম্পূর্ণ বিশ্বাস হইল না। ভাবিয়া চিন্তিয়া খোক্কশ পুনরায় বলিল, “আচ্ছা তোরা যদি ঘোক্কশ, তবে তোদের মাথার একটা উকুন ফেলিয়া দে দেখি?”

মশা বলিলেন, “কঙ্কাবতী, শীঘ্র হাতীর পিঠ হইতে নামো।”তাহার পর মশা হাতীকে বলিলেন, “হাতী ভায়া! এইবার!”

এই কথা বলিয়া মশা হাতীটিকে ধরিয়া খোক্কশের গর্তে ফেলিয়া দিলেন। গর্তে পড়িয়া হাতী শুঁড় দিয়া খোক্কশের বাচ্চাটিকে ধরিলেন। খোক্কশের বাচ্চা ‘চ্যাঁ চ্যাঁ’ শব্দে ডাকিয়া স্বর্গ মর্ত্য পাতাল তোলপাড় করিয়া ফেলিল। শুঁড়বিশিষ্ট পর্বতাকার উকুন দেখিয়া, ত্রাসে খোক্কশের প্রাণ উড়িয়া গেল। খোক্কশ ভাবিল, ওদের মাথার উকুন আসিয়া তো আমার বাচ্চাটিকে ধরিল, ঘোক্কশেরা নিজে আসিয়া আমাকে না ধরে! এই মনে করিয়া খোক্কশ বাচ্চা ফেলিয়া উড়িয়া পলাইল।

মশা ও কঙ্কাবতী তখন সেই গর্তের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন। মশা বলিলেন, কঙ্কাবতী, তুমি এখন ইহার পৃষ্ঠে আরোহণ কর। খোক্কশ-শাবকের পিঠে চড়িয়া তুমি এখন আকাশে গিয়া উঠ, চাঁদের শিকড় লইয়া পুনরায় এখানে আসিবে। তোমার প্রতীক্ষায় আমরা এক্ষনে বসিয়া রহিলাম। তুমি আসিলে আমরা খোক্কশের বাচ্চাটিকে ফিরাইয়া দিব। কারণ, এখনও এ স্তন্যপান করে, অতি শিশু। ইহাকে লইয়া আমরা কি করিব? যাহা হউক তুমি এখন আকাশের দোর্দণ্ড সিপাহীটার হাত হইতে, রক্ষা পাইলে হয়। শুনিয়াছি সে অতি ভয়ংকর দোর্দণ্ড-প্রতাপান্বিত সিপাহী, সাবধানে আকাশ উঠবে।”

আকাশ পানে চাহিয়া মশা পুনরায় বলিলেন, “কঙ্কাবতী, আমার কিন্তু আশ্চর্য বোধ হইতেছে। আজ দ্বিতীয়ার রাত্রি, চাঁদ উঠিবার সময় অনেকক্ষণ উর্ত্তীণ হইয়া গিয়াছে। কিন্তু চাঁদও দেখিতে পাই না, নক্ষত্রও দেখিতে পাই না। অথচ মেঘ করে নাই। কালো মেঘে না ঢাকিয়া, সমস্ত আকাশ বরং শুভ্রবর্ণ হইয়াছে, ইহার অর্থ আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। ইহার কারণ কি? আকাশে উঠিলে হয়তো তুমি বুঝতে পারিবে। অতি সাবধানে আপনার কার্য উদ্ধার করিবে।” কঙ্কাবতী খোক্কশ-শাবকের পিঠে চড়িয়া আকাশের দিকে তাহাকে পরিচালিত করিল, দ্রুতবেগে খোক্কশ-শাবক উড়িতে লাগিল। কঙ্কাবতী অবিলম্বে আকাশের নিকট গিয়া উপস্থিত হইল।

আকাশের কাছে গিয়া কঙ্কাবতী দেখিল যে, সমুদয় আকাশ চুন-কাম করা। কঙ্কাবতী ভাবিল এ কি প্রকার কথা। আকাশের উপর এরূপ চুনকাম করিয়া কে দিল?

আকাশের উপর উঠিতে কঙ্কাবতী আর পথ পায় না। যে দিকে যায়, সেই দিকেই দেখে চুনকাম। আকাশের এক ধার হইতে অন্য ধার পর্যন্ত ঘুরিয়া বেড়াইল পথ কিছুতেই পাইল না। সব চুনকাম। কঙ্কাবতী ভাবিল, ঘোর বিপদ! আকাশের উপর এখন উঠি কি করিয়া? হতাশ হইয়া আকাশের চারি ধারে কঙ্কাবতী পথ খুঁজিতে লাগিল। অনেকক্ষণ অন্বেষণ করিয়া, সহসা এক স্থানে একটি সামান্য ছিদ্র দেখিতে পাইল। সেই ছিদ্রটি দিয়া নক্ষত্রদের বউ উঁকি মারিতেছিল। কঙ্কাবতী সেই ছিদ্রটির নিকট গেল। কঙ্কাবতীকে দেখিয়া নক্ষত্রের বউ একবার লুকাইল, পুনরায় আবার ভয়ে ভয়ে উঁকি মারিতে লাগিল।

কঙ্কাবতী বলিল, “ওগো নক্ষত্রদের বউ! তোমার কোনও ভয় নাই। আমিও মেয়েমানুষ, আমাকে দেখিয়া আবার লজ্জা কেন বাছা?”

নক্ষত্রদের বউ উত্তর করিল, “কে গা মেয়েটি তুমি? তোমার কথাগুলি বড় মিষ্ট। অনেকক্ষণ ধরিয়া দেখিতেছি, তুমি চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়াইতেছ। তাই মনে করিলাম তোমাকে জিজ্ঞাসা করি, কি তুমি খুঁজিতেছ? কিন্তু হাজার হউক, আমি বউ মানুষ, সহসা কি কাহারও সঙ্গে কথা কহিতে পারি? তাতে রাত্রি কাল। একটু আস্তে কথা কও বাছা! আমার ছেলে-পিলেরা সব শুইয়াছে, এখনই জাগিয়া উঠিবে, কাঁচা ঘুম ভাঙিলে কাঁদিয়া জ্বালাতন করিবে।” কঙ্কাবতী বলিল, “ওগো নক্ষত্রদের বউ! আমার নাম কঙ্কাবতী। আমি পতিহারা সতী, আমি বড় অভাগিনী। আকাশের ভিতর যাইবার নিমিত্ত পথ অন্বেষণ করিতেছি। তা, আজ এ কি হইয়াছে বাছা, পথ কেন পাই না? একবার আকাশের ভিতর উঠিতে পারিলে আমার পতির প্রাণ রক্ষা হয়। বাছা, তুমি যদি পথটি বলিয়া দাও তো আমার বড় উপকার হয়।”

নক্ষত্রদের বউ উত্তর করিল, “পথ আর বাছা, তুমি কি করিয়া পাইবে? এই সন্ধ্যাবেলা এক বেটী ভূতিনী-বুড়ী আসিয়া আকাশের উপর সব চুনকাম করিয়া দিয়াছে। তা যাই হউক, আমি চুপি চুপি তোমাকে আকাশের খিড়কি-দ্বারটি খুলিয়া দিই। সেই পথ দিয়া তুমি আকাশের ভিতর প্রবেশ কর।”

এই কথা বলিয়া, নক্ষত্রদের বউ চুপি চুপি আকাশের খিড়কি-দ্বারটি খুলিয়া দিল। সেই পথ দিয়া কঙ্কাবতী আকাশের উপর উঠিল।

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

দুর্দান্ত সিপাহী

আকাশের ভিতর গিয়া কঙ্কাবতী খোক্ষশ-শাবককে একটি মেঘের ডালে বাঁধিয়া দিল। তাহার পর পদব্রজে আকাশের মাঠ দিয়া চলিতে লাগিল। চারিদিকে দেখিল, নানা বর্ণের নক্ষত্র সব ফুটিয়া রহিয়াছে। নক্ষত্র ফুটিয়া আকাশকে আলো করিয়া রাখিয়াছে। অতি দূরে চাঁদ চাকার মত আকাশের উপর বসিয়া আছেন।

কঙ্কাবতী আকাশের ভিতর প্রবেশ করিলে চাঁদ সংবাদ পাইলেন যে, তাঁহার মূল-শিকড় কাটিতে মানুষ আসিতেছে। খন্তা, কুড়ুল লইয়া এক মানবী উন্মত্তার ন্যায় ছুটিয়া আসিতেছে। এই দুঃসংবাদ শুনিয়া চাঁদের মনে ত্রাস হইল। ভয়ে চাঁদ কাঁপিতে লাগিলেন। চাঁদ মনে করিলেন, “কেন যে মরিতে সুন্দর হইয়াছিলাম। তাই তো আমার প্রতি সকলের আক্রোশ! যদি সুন্দর না হইতাম, তাহা হইলে কেহ আর আমার মুল-শিকড় কাটিতে আসিত না। একে তো রাহুর জ্বালায় মরি, তাহার উপর আবার যদি মানুষের উপদ্রব হয়, তাহা হইলে আর কি করিয়া বাঁচি! যদি আমার গলা থাকিত, তো আমি গলায় দড়ি দিয়া মরিতাম। তা যে ছাই, এ পোড়া শরীর কেবল চাকার মত! গলা নাই তা আমি কি করিব? দড়ি দিই কোথা?”

নানারূপ খেদ করিয়া, অতিশয় ভীত হইয়া চাঁদ আকাশের সিপাহীকে ডাকিতে পাঠাইলেন। আকাশের সিপাহী সকল দিকে বীরপুরুষ বটে, কেবল কর্ণে কিছু হীনবল, একটু কালা। অতিশয় চীৎকার করিয়া কোনও কথা না বলিলে তিনি শুনিতে পান না। সিপাহী আসিয়া উপস্থিত হইলে অতি চীৎকার করিয়া চাঁদ তাঁহাকে সকল কথা বলিলেন। চাঁদ তাহাকে বলিলেন, “আমার মুল-শিকড় কাটিতে মানুষ আসিতেছে।”

সিপাহী ভাবিলেন যে, চাঁদ তাঁহাকে কালা মনে করিয়া এত হাঁ করিয়া কথা কহিতেছেন। সিপাহীর তাই রাগ হইল।

সিপাহী বলিলেন, “নাও! আর অত হাঁ করিতে হইবে না। শেষকালে চিড় খাইয়া, চারিদিক ফাটিয়া, দুইখানা হইয়া যাইবে।”

এইবার একটু হাঁ কম করিয়া, চাঁদ পুনরায় বলিলেন, “আমার মূল-শিকড় কাটিতে মানুষ আসিতেছে।”সিপাহী বলিলেন, “অত আর চুপি চুপি কথা কহিতে হইবে না। কোথাও ডাকাতি করিবে না কি যে অত চুপি চুপি কথা। যদি কোথাও ডাকাতি কর তো আমায় কিন্তু ভাগ দিতে হইবে।”

চাঁদ ভাবিলেন, সিপাহী-লোকের সঙ্গে কথা কওয়া দায়। কথায় কথায় রাগিয়া উঠে।

চাঁদ পুনরায় বলিলেন, “না, ডাকাতি করিবার কথা বলি নাই। আমি কোথাও ডাকাতি করিতে যাইব না। আমি বলিতেছি যে, আমার মূল-শিকড় কাটিতে মানুষ আসিতেছে।”

সিপাহী এতক্ষণে চাঁদের কথা শুনিতে পাইলেন।সিপাহী বলিলেন, “তোমার মূল-শিকড় কাটিতে মানুষ আসিতেছে? তা বেশ, কাটিয়া লইয়া যাইবে। তার আর কি?”

চাঁদ বলিলেন, “তুমি আকাশের চৌকিদার, তুমি আমাকে রক্ষা করিবে না?”

সিপাহী উত্তর করিলেন, “তোমাকে রক্ষা করিতে গিয়া যদি আমার মুল-শিকড়টি কাটা যায়? তখন?”

চাঁদ বলিলেন, “যদি তুমি এরূপ সমূহ বিপদ হইতে আমাকে রক্ষা না করিবে, তবে তুমি আকাশের মাহিনা খাও কি জন্য?”সিপাহী উত্তর করিলেন, “রেখে দাও তোমার মাহিনা! না হয় কর্ম ছাড়িয়া দিব; পৃথিবীতে গিয়া কনেস্টেবিলি করিয়া খাইব। আমা হেন প্রসিদ্ধ দুর্দান্ত সিপাহী পাইলে, সেখানে তাহারা লুফিয়া লইবে। সেখানে এমন মুল-শিকড় কাটাকাটি নাই। সেখানে দাঙ্গাহাঙ্গামা হয় বটে, তা দাঙ্গা-হাঙ্গামার সময় আমি তফাৎ তফাৎ থাকিব। দাঙ্গাহাঙ্গামা সব হইয়া গেলে দাঙ্গাবাজেরা আপনার আপনার ঘরে চলিয়া গেলে, তখন আমি রাস্তার দু-চারিজন ভাল মানুষ ধরিয়া কাছারিতে লইয়া গিয়া হাজির করিব। তবে এখন আমি যাই। কারণ, মানুষটি যদি আসিয়া পড়ে! শেষে যদি আমাকে পর্যন্ত ধরিয়া টানাটানি করে?”

এই কথা বলিয়া, দুর্দান্ত সিপাহী সেখান হইতে অতি দ্রুতপদে প্রস্থান করিলেন। নিরুপায় হইয়া, যা থাকে কপালে,- এই মনে করিয়া চাঁদ আকাশে গা ঢালিয়া দিলেন। মেঘের ডালে খোক্কশ বাঁধিয়া আকাশের মাঠ দিয়া কঙ্কাবতী অতি দ্রুতবেগে চাঁদের দিকে ধাবমান হইল।

চারিদিকে জনরব উঠিল যে, আকাশবাসী আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার সকলের মূল-শিকড় কাটিতে পৃথিবী হইতে মনুষ্য আসিয়াছে। আকাশবাসীরা সকলে আপনার আপনার ছেলেপিলে সাবধান করিয়া ঘরে খিল দিয়া বসিয়া রহিল। নক্ষত্রগণের পলাইবার জো নাই, তাই নক্ষত্রগণ বন উপবনে, ক্ষেত্র উদ্যানে, যে যেখানে ফুটিয়াছিল, সে সেইখানে বসিয়া মিট মিট করিয়া জ্বলিতে লাগিল। চাঁদের পলাইবার জো নাই, কারণ জগতে আলো না দিয়া পলাইলে জরিমানা হইবে। চাঁদ তাই বিরসমনে ম্লানবদনে ধীরে ধরে আকাশের পথে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন।

ক্রমে কঙ্কাবতী চাঁদের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল। চাঁদ ভাবিলেন, এইবার তো দেখিতেছি, আমার মুল-শিকড়টি কাটা যায়! এখন আমি-সুদ্ধ না যাই, তবেই রক্ষা। ইহারে বিশ্বাস কি? যদি বলিয়া বসে যে, বাঃ দিব্য চাঁদটি, কাপড়ে বাঁধিয়া লইয়া যাই, তাহা হইলে আমি কি করিতে পারি? কাজ নাই বাপু, আমি চক্ষু বুজিয়া, থাকি, নিঃশ্বাস বন্ধ করি, মড়ার মত কাঠ হইয়া থাকি। মানুষটা মনে করিবে যে, এ মরা চাঁদ লইয়া আমি কি করিব? আমাকে সে আর ধরিয়া লইয়া যাইবে না।

বুদ্ধিমন্ত চাঁদ এইরূপ মনে মনে পরামর্শ করিয়া চক্ষু বুজিলেন, নিঃশ্বাস বন্ধ করিয়া রহিলেন।

চাঁদকে বিবর্ণ, বিষণ্ণ, মৃত্যু-ভাবাপন্ন দেখিয়া কঙ্কাবতী ভাবিল, বাঃ চাঁদটি বা মরিয়া গেল! মূল-শিকড়টি কাটিয়া লইব, সেই ভয়ে চাঁদের বা প্রাণত্যাগ হইল! আহা, কেমন সুন্দর চাঁদটি ছিল! কেমন চমৎকার জ্যোৎস্না হইত, কেমন পূর্ণিমা হইত। সে সকল আর হইবে না চিরকাল অমাবস্যার রাত্রি থাকিবে। লোকে আমায় কত গালি দিবে।একটু ভাল করিয়া দেখিয়া কঙ্কাবতী পুনরায় মনে মনে বলিল, না, “চাঁদ মরে নাই। বোধ হয় মূর্ছা গিয়াছে। তা ভালই হইয়াছে কাটিতে কুটিতে হইলে, ডাক্তারেরা প্রথম ঔষধ শুঁকাইয়া অজ্ঞান করেন, তারপর করাত দিয়া হাত-পা কাটেন। ভালই হইয়াছে যে, চাঁদ আপনা-আপনি অজ্ঞান হইয়াছে। মূল-শিকড় কাটিতে ইহাকে আর লাগিবে না। কিন্তু শিকড়টি একেবারে দুইখণ্ড করিয়া কাটা হইবে না, তাহা হইলে চাঁদ মরিয়া যাইবে। আমার কেবল একতোলা শিকড়ের ছালের প্রয়োজনমত ততটুকু আমি কাটিয়া লই।”

এইরূপ ভাবিয়া চারিদিক ঘুরিয়া, কঙ্কাবতী অবশেষে চাঁদের মুল-শিকড়টি দেখিতে পাইল। ছুরি দিয়া উপর উপর মূল-শিকড়ের ছাল চাঁছিয়া তুলিতে লাগিল।

অল্পক্ষণের নিমিত্ত চাঁদ অতি কষ্টে যাতনা সহ্য করিলেন, তার পর আর সহিতে পারিলেন না। চাঁদ বলিলেন, উঃ! লাগে যে!”কঙ্কাবতী বলিল, “ভয় নাই। এই হইয়া গেল!”

তাড়াতাড়ি কঙ্কাবতী চাঁদের মূল-শিকড় হইতে এক তোলা পরিমাণ ছাল তুলিয়া লইল।

তখন চাঁদ জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমার শিকড় পুনরায় গজাইবে তো?”

কঙ্কাবতী উত্তর করিল, “গজাইবে বই কি! চিরকাল কি আর এমন থাকিবে। ইহার উপর একটু কাদা দিয়া দিও, মন্দ লোকের দৃষ্টি পড়িয়া বিষাইয়া উঠিবে না।”

চাঁদ জিজ্ঞাসা করিলেন, “যদি ঘা হয়?”কঙ্কাবতী উত্তর করিল, “যদি ঘা হয় তাহা হইলে ইহার উপর একটু লুচি-ভাজা ঘি দিও।”

চাঁদ জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি বুঝি মেয়ে-ডাক্তার? দাঁতের গোড়ার ঔষধ জান? আমার দাঁতের গোড়া বড় কন কন করে।”

কঙ্কাবতী উত্তর করিল “আমি মেয়ে-ডাক্তার নই। তবে এই বয়সে আমি অনেক দেখিলাম, অনেক শুনিলাম, তাই দুটো একটা ঔষধ শিখিয়া রাখিয়াছি। তোমার দাঁতের গোড়া আর ভাল হইবে না। লোকের দাঁত কি চিরকাল সমান থাকে? তুমি কত কালের চাঁদ হইলে, মনে করিয়া দেখ দেখি? কবে সেই সমুদ্রের ভিতর হইতে বাহির হইয়াছ! এখন আর ছেলে-চাঁদ হইতে সাধ করিলে চলিবে কেন?” চাঁদ বলিলেন, “ছেলে-চাঁদ হইতে চাই না। ঘরে আমার অনেকগুলি ছেলে-চাঁদ আছে। আশীর্বাদ কর তাহারা বাঁচিয়া বর্তিয়া থাকুক, তাহা হইলে এর পর দেখিতে পাইবে, আকাশে কত চাঁদ হয়। আকাশের চারিদিকে তখন চাঁদ উঠবে। এখনই আমার ছেলেমেয়েগুলি বলে, “বাবা, অমাবস্যার রাত্রিতে তুমি শ্রান্ত হইয়া পড়, সন্ধ্যাবেলা বিছানা হইতে আর উঠিতে পারনা। তা যাই না? আমরা গিয়া আকাশে উঠি না?” আমি তাদের মানা করি। আকাশের একধার হইতে অন্য ধার পর্যন্ত, পথটুকু তো আর কম নয়। তারা ছেলেমানুষ, অত পথ গড়াইতে পারিবে কেন?”

কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার ছেলেমেয়েগুলি কত বড় হইয়াছে?”চাঁদ উত্তর করিলেন, “বড় মেয়েটি একখানি কাঁসির মত হইয়াছে। কেমন চকচকে কাঁসি! তেঁতুল দিয়া মাজিলেও তোমাদের কাঁসির সেরূপ রং হয় না। মেজ ছেলেটি একখানি খত্তালের মত হইয়াছে। মাঝে আরও অনেকগুলি ছেলেমেয়ে আছে। কোলের মেয়েটি একটু কালো। তোমরা যে সেকালে পাথুরে পোকার টিপ পরিতে, সেই তত বড় হইয়াছে। কিন্তু কালো হউক, মেয়েটির শ্রী আছে। বড় হইলে, এর পর যখন আকাশে কালো চাঁদ উঠবে, তখন তোমরা বলিবে, হাঁ চটক-সুন্দরী বটে। তাহার কালো কিরণে জগতে চকচকে অন্ধকার হইবে, সমুদয় জগৎ যেন বারনিশ চামড়ায় মুড়িয়া যাইবে। তা, যাই হউক, এখন দাঁতের গোড়ার কি হইবে? কি হয়ে খাইতে পারি না। ডাঁটা চিবাইতে যে বড় লাগে। ভাল যদি কোনও ঔষধ থাকে তো আমাকে দিয়া যাও।”

কঙ্কাবতী বলিল, “চাঁদ, তুমি এক কাজ কর, আমার সঙ্গে তুমি চল। তোমার শিকড় পাইয়াছি পতি আমার এখন ভাল হইবেন। পতি আমার কলিকাতায় থাকেন। কলিকাতায় দন্তকারেরা আছে। তোমার পোকা-ধরা পচা দাঁতগুলি সাঁড়াশি দিয়া তাহারা তুলিয়া দিবে, নূতন কৃত্রিম দন্ত পরাইয়া দিবে।”এই কথা শুনিয়া চাঁদের ভয় হইল, চাঁদ বলিলেন, আমার মূল-শিকড়ে ব্যথা হইয়াছে, আমি এখন গড়াইতে পারিব না, তত দূর আমি যাইতে পারব না।”

কঙ্কাবতী বলিল, “তার ভাবনা কি? আমি তোমাকে কাপড়ে বাঁধিয়া লইয়া যাইব।”

চাঁদের প্রাণ উড়িয়া গেল। চাঁদ ভাবিলেন, “যা ভয় করিয়াছিলাম তাই। কেন মরিতে ইহার সহিত কথা কহিয়াছিলাম। চক্ষু বুজিয়া চুপ করিয়া থাকিলেই হইত।”

চাঁদ বলিলেন, “আমার দাঁতের গোড়া ভাল হইয়া গিয়াছে, আর ব্যথা নাই। সে জন্য তোমাকে আর কষ্ট করিতে হইবে না, আমি বড় ভারী, আমাকে তুমি লইয়া যাইতে পারিবে না। এখন যাও, বাড়ী যাও। বিলম্ব করিলে তোমার বাড়ীর লোকে ভাবিবে।” কঙ্কাবতী উত্তর করিল, “কি বলিলে? তুমি ভারী! বাপের বাড়ী থাকিতে তোমার চেয়ে বড় বড় বগি-থালা আমি ঘাটে লইয়া মাজিতাম। এই দেখ, তোমাকে লইয়া যাইতে পারি কি না!”

এই কথা বলিয়া কঙ্কাবতী আকাশের উপর আঁচলটি পাতিল। চাঁদটিকে ধরিয়া আঁচলে বাঁধে আর কি। এমন সময় চাঁদের স্ত্রী চাঁদের ছানা-পোনা লইয়া উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিতে কাঁদিতে আছাড়ি-পিছাড়ি খাইতে খাইতে সেইখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। চাঁদনীর কান্নায় আকাশ ফাটিয়া যাইতে লাগিল। চাঁদের ছানা-পোনার কান্নায় কঙ্কাবতীর কানে তালা লাগিল।

চাঁদনী কাঁদিতে লাগিলেন, “ওগো, আমি দুর্দান্ত সিপাহীর মুখে শুনিলাম যে, মানুষে তোমার মূল-শিকড় কাটিবে। ওগো, আমি সে পোড়ারমুখী মানুষীর কি বুকে ধান ভানিয়াছি যে, সে আমার সহিত এরূপ শত্রুতা সাধিবে! আমাকে যদি বিধবা হইতে হয়, তাহা হইলে তারও আমার মত হাত হইবে। সে বাপ-ভাইয়ের মাথা খাইবে।”চাঁদের ছানা-পোনাগুলি কঙ্কাবতীর কাপড় ধরিয়া টানিতে লাগিল, আর বলিতে লাগিল, ওগো, তোমার পায়ে পড়ি। বাবার তুমি মূল-শিকড় কাটিও না, বাবাকে ধরিয়া লইয়া যাইও না।”

চাঁদের ছোট মেয়েটি, যেটি পাথুরে পোকার টিপের মত, সেই মেয়েটি মাঝে মাঝে কাঁদে, মাঝে মাঝে রাগে, আর কঙ্কাবতীকে গালি দিয়া বলে, “অভাগী, পোড়ারমুখী, শালা।” আবার সে কঙ্কাবতীকে গায়ের চারিদিকে আচড়ায় কামড়ায় আর চিমটি কাটে। তার চিমটির জ্বালায় কঙ্কাবতী ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়িল।

কঙ্কাবতী বলিল, “ওগো, ও চাঁদনী! তোমার মেয়ে সামলাও বাছা, তোমার এ ছোট মেয়েটি চিমটি কাটিয়া আমার গায়ের ছাল-চামড়া তুলিয়া লইতেছে!” চাঁদনী উত্তর করিলেন “হাঁ, মেয়ে সামলাব বই কি? তুমি আমার সর্বনাশ করিবে, আর আমি মেয়ে সামলাব। কেন বাছা? তোমার আমি কি করিয়াছি যে, তুমি আমার সর্বনাশ করিবে? মুল-শিকড়টি কাটিয়া তুমি আমার পতির প্রাণবধ করিবে?”

কঙ্কাবতী বলিল, “না গো না। একটুখানি শিকড়ের আমার আবশ্যক ছিল, তা আমি উপর উপর চাঁছিয়া লইয়াছি। অধিক রক্তও পড়ে নাই, কিছুই হয় নাই। তুমি বরং চাঁদকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখ? তার পর তোমার স্বামী বলিলেন যে, তাঁর দাঁত নড়িতেছে। তাই মনে করিলাম যে কলিকাতায় লইয়া যাই দাঁত ভাল করিয়া পুনরায় তোমার স্বামীকে আকাশে পাঠাইয়া দিব। তাতে আর কাজ নাই বাছা, এখন তোমরা সব চুপ কর। আর তোমার এই মেয়েটিকে বল, আমায় যেন আর চিমটি না কাটে।”

এই কথা শুনিয়া চাঁদনী আশ্বস্ত হইলেন। চাঁদের ছেলে-পিলেদেরও কান্না থামিল।চাঁদনী বলিলেন, “তোমার যদি বাছা, কাজ সারা হইয়া থাকে, তবে তুমি এখন বাড়ী যাও। তোমার ভয়ে আকাশ একেবারে লণ্ডভণ্ড হইয়া গিয়াছে। আকাশবাসীরা সব ঘরে খিল দিয়া বসিয়া আছে। সবাই সশঙ্কিত।”

কঙ্কাবতী বলিল, “আমার কাজ সারা হইয়াছে সত্য, কিন্তু আমার কতকগুলি নক্ষত্র চাই। আমাদের সেখানে নক্ষত্র নাই। আহা! এখানে কেমন চারিদিকে সুন্দর সুন্দর সব নক্ষত্র ফুটিয়া রহিয়াছে! আমি মনে করিয়াছি, কতকগুলি নক্ষত্র এখান হইতে তুলিয়া লইয়া যাইব। এখান হইতে অনেক দূরে আমার খোক্কশ বাঁধা আছে। কি করিয়া নক্ষত্রগুলি তত দূর লইয়া যাই? একটি মুটে কোথায় পাই?”

চাঁদনী বলিলেন, “আর বাছা! তোমার ভয়ে ঘর হইতে আজ কি লোক বাহির হইয়াছে যে তুমি মুটে পাইবে? দোকানী -পসারী সব দোকান বন্ধ করিয়াছে, আকাশের বাজার-হাট আজ সব বন্ধ। পথে জনপ্রাণী নাই! আমিই কেবল প্রাণের দায়ে ঘর হইতে বাহির হইয়াছি।”এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে, এমন সময় কঙ্কাবতী দেখিতে পাইল যে, মেঘের পাশে লুকাইয়া কে একটি লোক উঁকিঝুঁকি মারিতেছে। কঙ্কাবতী ভাবিল, ওই লোকটিকে বলি খোক্কশের বাচ্চার কাছ পর্যন্ত নক্ষত্রগুলি দিয়া আসে। এইরূপ চিন্তা করিয়া কঙ্কাবতী তাহাকে ডাকিল। কঙ্কাবতী বলিল, “ওগো শুন। একটা কথা শুন।”

কঙ্কাবতী যেই এই কথা বলিয়াছে, আর লোকটি উর্দ্ধশ্বাসে ছুটিয়া পলাইল। কঙ্কাবতী তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ দৌড়াইল। কঙ্কাবতী বলিতে লাগিল, “ওগো, একটু দাঁড়াও, আমার একটা কথা শুন, তোমার কোনও ভয় নাই।”

আর ভয় নাই! কঙ্কাবতী যতই তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যায়, আর লোকটি ততই প্রানপণে দৌড়িতে থাকে। কঙ্কাবতী মনে করিল, লোকটি কি দৌড়িতে পারে! বাতাসের মত যেন উড়িয়া যায়। কঙ্কাবতী তাহাকে কিছুতেই ধরিতে পারিল না, কিন্তু দৈবক্রমে এক ঢিপি মেঘ তাহার পায়ে লাগিয়া সে হোঁচোট খাইয়া পড়িয়া গেল। পড়িয়াও পুনরায় উঠতে কত চেষ্টা করিল, কিন্তু উঠিতে না উঠিতে কঙ্কাবতী গিয়া তাহাকে ধরিয়া ফেলিল।

কঙ্কাবতী তাহার গায়ে হাত দিয়া দেখে যে, তাহার গায়ে হাড় নাই, মাস নাই, কিছুই নাই। দেহ তার অতি লঘু দুইটি অঙ্গুলি দ্বারা কঙ্কাবতী তাহাকে ধরিয়া তুলিল। চক্ষুর নিকট আনিয়া নিরীক্ষণ করিয়া দেখিল যে, কেবল দুই চারিটি তালপাতা দিয়া তাহার শরীর নির্মিত। তালপাতের হাত, তালপাতের পা, তালপাতের নাক-মুখ। সেই তালপাতের উপর জামাজোড়া-পরা। তাহার শরীর দেখিয়া কঙ্কাবতী অতিশয় বিস্মিত হইল।

কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কে?”লোকটি উত্তর করিল, “আমি আকাশের দুর্দান্ত সিপাহী। আবার কে? এখন ছাড়িয়া দাও বাড়ী যাই। আঙ্গুল দিয়া অমন করিয়া টিপিও, না।”

কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার শরীর তালপাতা দিয়া গড়া?”

দুর্দান্ত সিপাহী বলিলেন, “তালপাতা দিয়া গড়া হইবে না তো কি দিয়া গড়া হইবে? ইঁট পাথর চুন সুরকি দিয়া রেক্তার গাঁথুনী করিয়া আমার শরীর গড়া হইবে না কি? এত দেশ বেড়াইলে, এত কাণ্ড করিলে, আর তালপাতার সিপাহীর নাম কখনও শুননি? এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে আমাকে কে না জানে? বীর-পুরুষ দেখিলেই লোকে আমার সহিত উপমা দেয়। এখন ছাড়িয়া দাও, বাড়ী যাই। ভাল এক মূল-শিকড় কাটাকাটি হইয়াছে বটে!” কঙ্কাবতী এখন বুঝিল যে, ছেলা-বেলা যে সেই তালপাতার সিপাহীর কথা শুনিয়াছিল, তাহার বাস আকাশে, পৃথিবীতে নয়। আর সেই-ই আকাশের দুর্দান্ত সিপাহী!

কঙ্কাবতী বলিল, “দেখ দুর্দান্ত সিপাই! তোমাকে আমার একটি কাজ করিতে হইবে। তা না করিলে তোমাকে আমি কিছুতেই ছাড়িব না। এখান হইতে এক বোঝা নক্ষত্র আমি তুলিয়া লইয়া যাইব। কিছু দূর মোটটি তোমাকে লইয়া যাইতে হইবে।”

সিপাহী আর করেন কি? কাজেই সম্মত হইলেন। কঙ্কাবতীর আঁচলে আর কতটি নক্ষত্র ধরিবে? তাই কঙ্কাবতী ভাবিতে লাগিল, কি দিয়া নক্ষত্রগুলি বাঁধিয়া লই? সিপাহী বলিলেন, “অত আর ভাবনা-চিন্তা কেন? চল আমরা আকাশ-বুড়ীর কাছে যাই। কদমতলায় বসিয়া চরকা কাটিয়া সে কত কাপড় করিয়াছে। তাহার কাছ হইতে একখানি গামছা চাহিয়া লই।”

কঙ্কাবতী ও সিপাহী আকাশ-বুড়ির নিকট গিয়া একখানি গামছা চাহিল। অনেক বকিয়া-ঝকিয়া আকাশ-বুড়ী একখানি গামছা দিলেন। তখন কঙ্কাবতী আকাশের মাঠে নক্ষত্র তুলিতে লাগিল। বাছিয়া বাছিয়া, ফুটন্ত-ফুটন্ত, আধ-কুঁড়ি, আধ-ফুটন্ত নানাবর্ণের নক্ষত্র তুলিল। সেইগুলি গামছায় বাঁধিয়া মোটটি সিপাহীর মাথায় দিল।

সিপাহী ভাবিলেন, “এতকাল আকাশে চাকরি করিলাম, কিন্তু মুটেগিরি কখনও করিতে হয় নাই। ভাগ্যক্রমে আকাশের লোক সব আজ দ্বারে খিল দিয়া বসিয়া আছে। কেহ যদি আমার এ দুর্দশা দেখিত, তাহা হইলে আজ আমি মরমে মরিয়া যাইতাম।”মোটটি মাথায় করিয়া, সিপাহী আগে আগে যাইতে লাগিলেন। কঙ্কাবতী তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইতে লাগিল। কিছুক্ষণ পরে খোক্কশের বাচ্চার নিকটে আসিয়া দুইজনে উপস্থিত হইলেন। সিপাহীর মাথা হইতে নক্ষত্রের বোঝাটি লইয়া তখন কঙ্কাবতী বলিল, “এখন তুমি যাইতে পার, তোমাকে আর আমার প্রয়োজন নাই।” এই কথা বলিতে না বলিতে সিপাহী এমনি ছুট মারিলেন যে মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ্য হইয়া গেলেন। কঙ্কাবতী ভাবিল তালপাতার সিপাহী কি না! তাই এত দ্রুতবেগে ছুটিতে পারে।

মোটটি লইয়া কঙ্কাবতী খোক্কশের বাচার পিঠে চড়িল। খোক্কশের পিঠে চড়িয়া আকাশ হইতে পৃথিবীর দিকে পুনরায় অবতরণ করিতে লাগিল। আকাশ হইতে পৃথিবী একেবারে কম দূরের পথ নহে। কঙ্কাবতী খোক্কশের ছানার পিঠে বসিয়া বসিয়া কি করে? তাহার পুটুলিটি খুলিয়া কঙ্কাবতী এক ছড়া মালা গাঁথিল ―এই মালাটি খেতুর জন্য। খেতু বাঁচিয়া উঠলে নক্ষত্রের মালাটি কঙ্কাবতী খেতুর গলায় পরাইয়া দিবে। কঙ্কাবতী নামিতে নামিতে আরও দুইটি মালা গাঁথিল―একটি তাহার নিজের জন্য, আর একটি পচাজলের জন্য।

যেখানে মশা ও হাতী কঙ্কাবতীর প্রতীক্ষা করিতেছিলেন, অবিলম্বে কঙ্কাবতী সেইখানে উপস্থিত হইল। শিকড়-লাভে কৃতকার্য হইয়াছে শুনিয়া মশা ও হাতীর আনন্দের আর অবধি রহিল না। খোক্কশের বাচ্চাটিকে পুনরায় তাহার গর্তে ছাড়িয়া দিয়া, মশা ও কঙ্কাবতী হস্তীর পৃষ্ঠে আরোহণ করিলেন ও পর্বত-অভ্যন্তরস্থিত সেই অট্টালিকার দিকে যাত্রা করিলেন। অট্টালিকায় উপস্থিত হইয়া, কঙ্কাবতী চাঁদের মূল-শিকড়টুকু খর্বুরের হস্তে অর্পণ করিল। খর্বুর তাহার এক তোলা ওজন করিয়া সাতটি গোলমরিচের সহিত অতি সাবধানে শিলে বাটিলেন। ঔষধটুকু বাটা হইলে, ব্যাঙকে তাহা সেবন করাইলেন। ঔষধ সেবন করিয়া ব্যাঙের হুড় হুড় করিয়া বমন আরম্ভ হইল। পেটে যাহা কিছু ছিল, সমুদয় বাহির হইয়া পড়িল। ব্যাঙ বলিলেন, “ব্যাঙাচি-অবস্থায়, জলে কিল কিল করিতে করিতে আমি যাহা কিছু খাইয়াছিলাম, তাহা পর্যন্ত বাহির হইয়া গিয়াছে, উদরে আর আমার কিছুই নাই।”

বমনের সহিত সেই ক্ষুদ্র পিপীলিকাগুলি বাহির হইয়া পড়িল। খর্বুর অতি যত্নে তাহাদিগকে বমনের ভিতর হইতে বাছিয়া লইলেন। তাহার পর একটি পিপীলিকা লইয়া, তাহার উদর হইতে অতি সূক্ষ্ম সন্নার দ্বারা খেতুর পরমায়ুটুকু বাহির করিতে লাগিলেন। এইরূপে খুঁটিয়া খুঁটিয়া সমস্ত পিপীলিকাগুলি হইতে পরমায়ুবাহির করা হইলে খর্বুর বলিলেন, “এ কি হইল? পরমায়ু তো অধিক বাহির হইল না। এ যৎসামান্য পরমায়ুটুকু লইয়া কি হইবে? ইহাতে তো কোনও ফল হইবে না?” খর্বুর বিষণ্ণচিত্ত হইলেন, মশা হতাশ হইলেন, ব্যাঙের চক্ষু দিয়া জল পড়িতে লাগিল, কঙ্কাবতী নীরবে বসিয়া রহিল। অদৃশ্যভাবে অবস্থিত নাকেশ্বরী ও তাহার মাসী পরিতোষ লাভ করিল।

যাহা হউক, সেই যৎসামান্য পরমায়ুটুকু লইয়া খর্বুর খেতুর নাকে নাস দিয়া দিলেন। খেতু চমকিত হইয়া উঠিয়া বসিল।

খেতু বলিল, “কি অঘোর নিদ্রায় আমি অভিভূত হইয়াছিলাম! কঙ্কাবতী, তুমি আমাকে জাগাইতে পার নাই? দেখ দেখি কত বেলা হইয়া গিয়াছে?”কঙ্কাবতী বলিল, “সাধ্য থাকিলে আর জাগাইতাম না?”

খেতু তাহার পর চারিদিকে চাহিয়া দেখিল। দেখিল, কঙ্কাবতীর চক্ষু দিয়া জল পড়িতেছে। খর্বুর, মশা ও ব্যাঙ বিষণ্ণ বদনে বসিয়া আছেন।

খেতু জিজ্ঞাসা করিল, “কঙ্কাবতী, তুমি কাঁদিতেছ কেন? আর এঁরা কারা?”

কঙ্কাবতী কোনও উত্তর করিল না। খেতু একটু চিন্তা করিয়া পুনরায় বলিল, আমার সকল কথা এখন মনে পড়িতেছে। আমার মাথায় শিকড় ছিল না বলিয়া আমাকে নাকেশ্বরী খাইয়াছিল। কঙ্কাবতী, তুমি বুঝি ইহাদিগকে ডাকিয়া আনিয়া আমাকে সুস্থ করিয়াছ? তবে আর কান্না কেন? আমি তো এখন ভাল আছি। কেবল আমার মাথা অল্প অল্প ব্যথা করিতেছে। আমি আর একবার শুই। কঙ্কাবতী, তুমি আমার মাথাটি একটু টিপিয়া দাও। আমার মাথা বড় বেদনা করিতেছে। অসহ্য বেদনা করিতেছে। প্রাণ বুঝি আমার বাহির হয়! ওগো, তোমরা সকলে আমার কঙ্কাবতীকে দেখিও। আমার কঙ্কাবতীকে তাহার মার কাছে দিয়া আসিও। হা ঈশ্বর!”

খেতুর মৃত্যু হইল।

ঘাড় হেঁট করিয়া সকলে নীরবে বসিয়া রহিলেন। কাহারও মুখে বাক্য নাই। সকলের চক্ষু দিয়া জলধারা পড়িতে লাগিল। কেবল কঙ্কাবতী স্থির হইয়া রহিল। কঙ্কাবতীর শরীর অবশ হইয়া আসিল। কঙ্কাবতী মুর্চ্ছিতা হইয়া পড়িল।

ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ

পরিশেষ

বৈদ্য বলিলেন, “এই যে নিদ্রাটি দেখিতেছেন, ইহা সুনিদ্রা। বিকারের ঘোর নহে। বিকার কাটিয়া গিয়াছে। নাড়ী পরিষ্কার হইয়াছে। এক্ষণে বাড়ীতে যেন শব্দ হয় না। নিদ্রাটি যেন ভঙ্গ হয় না!”

বৈদ্য প্রস্থান করিলেন। অঘোর অচৈতন্য হইয়া রোগী নিদ্রা যাইতে লাগিল। বাড়ীতে সকলেই চুপি চুপি কথা কহিতে লাগিলেন। বাড়ীতে পিপীলিকার পদশব্দটি পর্যন্ত নাই।

মাতা কাছে বসিয়া রহিলেন। এক একবার কেবল কন্যার নাসিকার নিকট হাত রাখিয়া দেখিতে লাগিলেন, রীতিমত নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস বহিতেছে কি না। আহার নিদ্রা পরিত্যাগ করিয়া মা আজ বাইশ দিন কন্যার নিকট এইরূপে বসিয়া আছেন। প্রাণসম কন্যাকে লইয়া যমের সহিত তুমুল যুদ্ধ করিতেছেন। প্রবল বিকারের উত্তেজনায় কন্যা যখন উঠিয়া বসে, মা তখন আস্তে আস্তে পুনরায় তাহাকে শয়ন করান। বিকারের প্রলাপে কন্যা যখন চীৎকার করিয়া উঠে, মা তখন তাহাকে চুপ করিতে বলেন। সুধাময় মার বাক্য শুনিয়া বিকারের আগুনও কিছুক্ষণের নিমিত্ত নির্বাণ হয়।

কন্যা নিদ্রিত, চক্ষু মুদ্রিত করিয়া আছে। বহুদিন অনাহারে, প্রবল দুরন্ত জ্বরে, ঘোরতর বিকারে দেহ এখন তাহার শীর্ণ, মুখ এখন মলিন! তবুও তাহার মধুর রূপ দেখিলে সংসার সুন্দর বলিয়া প্রতীতি হয়। অনিমেষ নয়নে মা সেই অপূর্ব রূপরাশি অবলোকন করিতেছেন। রাত্রি প্রভাত হইল। বেলা হইল। তবুও রোগীর নিদ্রাভঙ্গ হইল না। মা কাছে বসিয়া রহিলেন। নিঃশব্দে ভগিনী আসিয়া মার কাছে বসিলেন।

রোগীর ওষ্ঠদ্বয় একবার ঈষৎ নড়িল। অপরিস্ফুট স্বরে কি বলিল। শুনিবার নিমিত্ত ভগিনী মস্তক অবনত করিলেন। শুনিতে পাইলেন না, বুঝিতে পারিলেন না।

আবার ওষ্ঠ নড়িল, রোগী আবার কি বলিল। মা এইবার সে কথা বুঝিতে পারিলেন।

মা বলিলেন, “খেতু খেতু করিয়াই বাছা আমার সারা হইল, আজ কয়দিন মুখে কেবল ওই নাম। এখন যদি চারিহাত এক করিতে পারি, তবেই মনের কালি যায়।” মার সুমধুর কন্ঠ-স্বর কন্যার কর্ণ-কুহরে প্রবেশ করিল। সম্পূর্ণরূপে জাগরিত হইয়া, ধীরে ধীরে সে চক্ষু উন্মীলন করিল। বিস্মিতবদনে চারিদিক নিরীক্ষণ করিতে লাগিল।

মা বলিলেন, “বিকার সম্পূর্ণরূপ এখনও কাটে নাই। চক্ষুতে এখনও সুদৃষ্টি হয় নাই। আজ উনিশ দিন মা আমার কাহাকেও চিনিতে পারে নাই।”

ভগিনী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কঙ্কাবতী, তুমি আমাকে চিনিতে পার?”

কঙ্কাবতী অতি মৃদুস্বরে উত্তর করিল, “পারি, তুমি বড় দিদি!”ভগিনী পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “ইনি কে বল দেখি?”

কঙ্কাবতী বলিল, “মা।”

তনু রায় ঘরের ভিতর আসিলেন। তনু রায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “কঙ্কাবতী, আজ কেমন আছ মা?”

কঙ্কাবতী বলিল, “ভাল আছি বাবা।”

তনু রায় একটু কাছে বসিলেন। স্নেহের সহিত কন্যার গায় মাথায় একটু হাত বুলাইলেন। তাহার পর বাহিরে চলিয়া গেলেন।কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিল, “মা, আমার কি অতিশয় পীড়া হইয়াছিল ?”

মা বলিলেন, “হাঁ বাছা, আজ বাইশ দিন তুমি শয্যাগত। তোমার কিছুমাত্র জ্ঞান ছিল না। এবার যে তুমি বাঁচিবে, সে আশা ছিল না।”

কঙ্কাবতী বলিল, “মা, আশ্চর্য স্বপ্ন দেখিয়াছি। স্বপ্নটি আমার মনে এরূপ গাঁথা রহিয়াছে যে, প্রকৃত ঘটনা বলিয়া আমার বিশ্বাস হইতেছে। এখন আমার মনে নানা কথা আসিতেছে। তাহার ভিতর আবার কোনটি সত্য কোনটি স্বপ্ন, তাহা আমি স্থির করিতে পারিতেছি না। তাই মা, তোমাকে গুটিকতক কথা জিজ্ঞাসা করি। আচ্ছা মা, জনার্দন চৌধুরীর স্ত্রী-বিয়োগ হইয়াছে, সে কথা সত্য?” মা বলিলেন, “সে কথা সত্য। তাই লইয়াই তো আমাদের যত বিপদ।”

কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিল, “মা, বরফ লইয়া কি দলাদলি হইয়াছিল, সে কথা কি সত্য?”

মা উত্তর করিলেন, “হাঁ বাছা, সে কথাও সত্য। সেই কথা লইয়া পাড়ার লোকে খেতুর মাকে কত অপমান করিয়াছিল।”

কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিল, “তিনি এখন কোথায় মা?” মা বলিলেন, “তিনি আসেন এই। সমস্ত দিন এইখানেই থাকেন। আমার চেয়ে তিনি তোমাকে ভালবাসেন। তাঁহার হাতে তোমাকে একবার সঁপিয়া দিতে পারিলেই এখন আমার সকল দুঃখ যায়। কর্তার মত হইয়াছে, সকলের মত হইয়াছে, এখন তুমি ভাল হইলেই হয়।”

কঙ্কাবতী বুঝিল যে, তবে খেতুর মার মৃত্যু হয় নাই, সে কথাটি স্বপ্ন।

কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিল এই দলাদলির পর আমার জ্বর হয়, না মা?”

মা বলিলেন, “এই সময় তোমার জ্বর হয়। তুমি একেবারে অজ্ঞান অচৈতন্য হইয়া পড়। তোমার ঘোরতর জ্বর-বিকার হয়। আজ বাইশ দিন।”কঙ্কাবতী বলিল, “তাহার পর মা, আমি নদীর ঘাটে গিয়া একখানি নৌকার উপর চড়ি না মা?”

মা বলিলেন, “বালাই, তুমি নৌকায় চড়িবে কেন মা? সেই অবধি তুমি শয্যাগত।”

কঙ্কাবতী বলিল, “মা, কত যে কি আশ্চর্য স্বপ্ন দেখিয়াছি, তাহা আর তোমায় কি বলিব। সে সব কথা মনে হইলে হাসিও পায়, কান্নাও পায়। স্বপ্নে দেখিলাম কি মা, যে গায়ের জ্বালায় আমি নদীর ঘাটে গিয়া জল মাখিতে লাগিলাম। তাহার পর একখানি নৌকাতে চড়িয়া নদীর মাঝখানে গেলাম। নৌকাখানি আমার ডুবিয়া গেল। মাছেরা আমাকে তাদের রানী করিল, তাহার পর কিছুদিন গোয়ালিনী মাসীর বাড়ীতে রহিলাম। সেখান হইতে শ্মশানঘাটে গেলাম। তাহার পর পুনরায় বাড়ী আসিলাম। এক বৎসর পরে আমাদের বাটীতে একটি বাঘ আসিল। সেই বাঘের সহিত আমি বনে গেলাম। তার পর ভূতিনী, ব্যাঙ, মশা, কত কি দেখিলাম। তার পর মা আকাশে উঠিলাম, কত কি করিলাম, কত কি দেখিলাম, স্বপ্নটি যেন আমার ঠিক সত্য বলিয়া বোধ হইতেছে। হাঁ মা, সে দলাদলির কি হইল?”মা উত্তর করিলেন, “সে দলাদলি সব মিটিয়া গিয়াছে। যখন তোমার সমূহ পীড়া, যখন তুমি অজ্ঞানে অভিভূত হইয়া পড়িয়া আছ, আজ আট নয় দিনের কথা আমি বলিতেছি, সেই সময় জনার্দন চৌধুরীর একটি পৌত্রের হঠাৎ মৃত্যু হইল। জনার্দন চৌধুরী সেই পৌত্রটিকে অতিশয় ভালবাসিতেন। তিনি শোকে অধীর হইয়া পড়িলেন। সেই সময় গোবর্ধন শিরোমণিরও সংকটাপন্ন পীড়া হইল। আর আমাদের বাটিতে তো তোমাকে লইয়া সমূহ বিপদ। জনার্দন চৌধুরীর সুমতি হইল। তিনি রামহরিকে আনিতে পাঠাইলেন। রামহরি সপরিবারে কলিকাতা হইতে দেশে আসিল। রামহরির সহিত জনার্দন চৌধুরী অনেকক্ষণ পরামর্শ করিলেন। তাহার পর রামহরি নিরঞ্জনকে ডাকিয়া আনিল। রামহরি, নিরঞ্জন, আমাদের কর্তাটি ও খেতু সকলে মিলিয়া জনার্দন চৌধুরীর বাটীতে গেলেন। জনার্দন চৌধুরী বলিলেন, আমি পাগল নাকি যে এই বৃদ্ধ বয়সে আমি পুনরায় বিবাহ করিতে ইচ্ছা করিয়াছিলাম। নিরঞ্জনকে আমি দেশত্যাগী করিয়াছি। খেতু বালক, তাহার প্রতি আমি ঘোরতর অত্যাচার করিয়াছি। এই কথা বলিয়া তিনি নিরঞ্জনকে অনেক অনুনয়-বিনয় করিয়া তাঁহার ভূমি ফিরিয়া দিলেন। নিরঞ্জন এখন নিজের বাটীতে বাস করিতেছেন। খেতুকে অনেক আশীর্বাদ করিয়া জনার্দন চৌধুরী সান্ত্বনা করিলেন। আমাদের কর্তাটি আর সে মানুষ নাই। এক্ষণে তাঁহার মনে স্নেহ-মায়া দয়া-ধর্ম হইয়াছে। বিপদে পড়িলে লোকের এইরূপ সুমতি হয়। তোমার দাদাও এখন আর সেরূপ নাই। মাকে যেরূপ আস্থা-ভক্তি করিতে হয়, সুপুত্রের মত তোমার দাদাও এক্ষণে আমাকে আস্থা-ভক্তি করে। তোমার পীড়ার সময় তোমার দাদা অতিশয় কাতর হইয়াছিল। তুমি ভাল হইলে খেতুর সহিত তোমার বিবাহ হইবে। এবার আর এ কথার অন্যথা হইবে না। তোমার পীড়ার সময় খেতু, খেতুর মা, রামহরি, সীতা প্রভৃতি সকলেই প্রাণপণে পরিশ্রম করিয়াছেন। এক্ষণে সকল কথা শুনিলে, এখন আর অধিক কথা শুনিয়া কাজ নাই। এখনও তুমি অতিশয় দুর্বল। পুনরায় অসুখ হইতে পারে।”কঙ্কাবতী অনেক দিন দুর্বল রহিল। ভাল হইয়া সারিতে তাহার অনেক বিলম্ব হইল। সীতা তাহার নিকট আসিয়া সর্বদা বসিত। স্বপ্ন-কথা সে সীতার নিকট সমুদয় গল্প করিল। সীতা মাকে বলিল, বউদিদি খেতুকে বলিলেন, এইরূপে কঙ্কাবতীর আশ্চর্য স্বপ্নকথা পাড়ার স্ত্রী-পুরুষ সকলেই শুনিল। স্বপ্ন-কথা আদ্যোপান্ত শুনিয়া কঙ্কাবতীর উপর সীতার বড় অভিমান হইল।

সীতা বলিল, “সমুদয় নক্ষত্রগুলি তোমরা নিজে পরিলে, আর তোমার পচাজলকে দিলে। আমার জন্য একটিও রাখিলে না। আমাকে তুমি ভালবাস না। তুমি তোমার পচাজলকে ভালবাস। আমি তোমার সহিত কথা কহিব না।”

কঙ্কাবতী সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য লাভ করিল। পূর্বের ন্যায় পুনরায় সবল হইল। পীড়া হইতে সারিয়া কঙ্কাবতী সম্মুখে একটু-আধটু বাহির হইত। একদিন খেতু কঙ্কাবতীদের বাটীতে গিয়াছিল। সেইখানে একটি মশা উড়িতেছিল। খেতু সেই মশাটিকে ধরিয়া কঙ্কাবতীকে জিজ্ঞাসা করিল, “দেখ দেখি কঙ্কাবতী। এই মশাটি তো তোমার ‘পচাজল’ নয়? সে হয়তো তোমাকে খুঁজিতে আসিয়াছে।” লজ্জায় কঙ্কাবতী গিয়া ঘরে লুকাইল। সেই অবধি আর খেতুর সম্মুখে বাহির হইত না।

কঙ্কাবতী উত্তমরূপে আরোগ্য লাভ করিলে শুভ দিনে শুভ লগ্নে খেতু ও কঙ্কাবতীর শুভ-বিবাহ-কার্য সম্পন্ন হইল। ঘোরতর দুঃখের পর এই কার্য সুসম্পন্ন হইল সে জন্য সপ্তগ্রাম সমাজের লোক সকলেই আনন্দিত হইলেন। বিশেষতঃ জনার্দন চৌধুরী পরম প্রীতিলাভ করিলেন। তাঁহার বৃদ্ধ বয়স ও কফের ধাত কিন্তু সেজন্য তিনি কিছুমাত্র উপেক্ষা করেন নাই।

বিবাহের দিন সমস্ত রাত্রি তিনি তনু রায়ের বাটীতে উপস্থিত ছিলেন। চুপি চুপি তিনি কলিকাতা হইতে প্রচুর পরিমাণে বরফ আনয়ন করিয়াছিলেন। ব্রাহ্মণ-ভোজনের সময় পরিহাসচ্ছলে সকলকে তিনি বলিলেন, “বর যে একেলা ‘বরখ’ খাইয়া প্রাণ সুশীতল করিবে তাহা হইবে না, আমরাও আমাদের শরীর যৎসামান্য স্নিগ্ধ করিব।” দেশের লোক, যাঁহারা কখনও বরফ দেখে নাই, আজ বরফ দেখিয়া সকলেই চমৎকৃত হইল। আগ্রহের সহিত সকলেই সুস্নিগ্ধ বরফ-জল পান করিল। বাড়ীতে দেখাইবার জন্য অনেকেই অল্প কাঁচা বরফ লইয়া গেল।

শূদ্রভোজনের সময় গদাধর ঘোষ তিন লোটা বরফ জল পান করিল। আর প্রায় এক সের সেই করাতের মত কর্তনশীল ‘বরখ’ দন্ত দ্বারা চিবাইয়া খাইল।



তাহার পর কি হইল? তাহার পর আমার গল্পটি ফুরাইল। ন’টে গাছটির কপালে যাহা লেখা ছিল, তাহাই ঘটিল। সেই ঘটনা লইয়া কত অভিযোগ উপস্থিত হইল।

(শেষ)


No comments:

Post a Comment