ষষ্ঠ পর্ব
বেলা প্রায় এগারোটা। নিজের ঘরে বসে কাবেরী তন্ময় হয়ে একখানা ছবি দেখছিল, ওরই ছবি। সিপিয়া রঙে ক্রেয়নে আকা। সদ্য সমাপ্ত। হঠাৎ, দ্বারের কাছে প্রশ্ন হল, ভিতরে আসতে পারি? সচকিত হয়ে কাবেরী লক্ষ্য করে দ্বারপথে দাঁড়িয়ে আছেন চার-নম্বরের সুদর্শন ভদ্রলোক।
-- আসুন, আসুন। কী ব্যাপার?
-- কৌতূহলটা দমন করতে পারলাম না। ছবিটা দেখতে পারি?
-- দেখুন না! আপত্তি কিসের -- ছবিখানা বাড়িয়ে ধরে কাবেরী।
সুবীর জমিয়ে বসে একখানা চেয়ারে। সমঝদারের মত ওর ছবিখানা দেখতে থাকে -- কাছে ধরে, দূরে ধরে। দু-একবার কাবেরীর দিকেও তাকায়। তারপর বলে, ছবিটা সুন্দর, তবে অরিজিনালের মত সুন্দর নয়।
কাবেরী একটু রাঙিয়ে ওঠে। কথা ঘোরাবার জন্য বলে, আপনার পরিচয়টা কিন্তু আমি জানি না।আপনি তো আছেন ঐ চার নম্বরে?
-- হ্যাঁ। আমার নাম সুবীর রায়। আরে, আপনার সুটকেসটা তো চমৎকার!
-- ওপাশে রাখা সাদা রঙের সুটকেসটা লক্ষ্য করে সে। বলে, এগুলোকেই ভি.আই.পি. সুটকেস বলে, তাই নয়?
কাবেরী বলে, সখ করে কিনেছি। যদিও আমি ভি.আই.পি. মোটেই নই।
-- বেড়াতে এসেছেন বুঝি দার্জিলিঙে?-- প্রশ্ন করে সুবীর সিগ্রেট ধরাতে ধরাতে।
-- হ্যাঁ ছুটিতে --
-- অত সকালে কোথা থেকে এলেন?
ভ্রূ-কুঞ্চিত হল কাবেরীর। বললে, আপনি তো এলেন মধ্যরাত্রে -- আমি কখন এসেছি তা জানলেন কেমন করে?
সুবীর মামুলী গলায় বললে, সুজাতা দেবী বলছিলেন আপনি নাকি সেই কাক-ডাকা ভোরে এলেন!
কাবেরীও মামুলী-গলায় জবাব দিল, কাক-ডাকা ভোরই বটে। আমি পর্শু রাত্রে কার্শিয়াঙে হল্ট করেছিলাম। রাত ভোর হতেই এখানে চলে এসেছি।
-- কার্শিয়াঙে কোথায় ছিলেন? হোটেলে?
আবার সচকিত হয়ে ওঠে কাবেরী। বলে, কেন বলুন তো?
-- না, আমি ফেরার পথে কার্শিয়াঙে দু-দিন থাকব ভাবছি। তাই জানতে চাইছি কোন হোটেলে ছিলেন, তাদের ব্যবস্থা কেমন--
কাবেরী কৃত্রিম হাসিতে ভেঙে পড়ে। বলে, যদি কোন হোটেল ছেড়ে রাত থাকতে বোর্ডার পালিয়ে বাঁচে সেটায় থাকবার কথা ভাবছেন ফেরার পথে?
সুবীর বললে, তাহলে ধরে নিন ভুল করে সেটাতে উঠে যাতে নাকাল না হতে হয় তাই নামটা জানতে চাইছি। কার্শিয়াঙে কোন হোটেলে ছিলেন?
কাবেরী আবার প্রশ্নটা এড়িয়ে বলে, আপনি যে পুলিসের মত জেরা করছেন!
সুবীর বললে, তাহলে ধরে নিন ভুল করে সেটাতে উঠে যাতে নাকাল না হতে হয় তাই নামটা জানতে চাইছি। কার্শিয়াঙে কোন হোটেলে ছিলেন?
কাবেরী আবার প্রশ্নটা এড়িয়ে বলে, আপনি যে পুলিসের মত জেরা করছেন!
-- তাই করছি, কারণ পুলিস বিভাগেই কাজ করি আমি। ক্রিমিনাল ইন্টেলিজেন্সে এসেছি একটা খুনের তদন্তে। সেই প্রসঙ্গেই আমি জানতে চাইছি -- পয়লা অক্টোবর রাত্রে আপনি কোথায় ছিলেন? রাত দশটার পর থেকে বাকি রাত।
পকেট থেকে একটি নোটবুক বার করে বলে, এবার বলুন --
কাবেরীর মুখটা সাদা হয়ে যায়। ঠোঁট দুটো নড়ে ওঠে, কিন্তু কথা কিছু বলে না। ঠিক সেই মুহূর্তেই বিনা-নোটিসে ঘরে ঢুকে পড়লেন অজয় চাটুজ্জে।
সরাসরি কাবেরীকে বললেন, ও ক্রেয়নে ঠিক এফেক্টটা আসেনি, বুঝলে! আমি অয়েলে আর একখানা আঁকতে চাই। তোমার সময় হবে এখন?
কাবেরী তৎক্ষণাৎ সামলে নেয় নিজেকে। বলে, সময় হবে না? কী বলছেন? নিশ্চয় হবে। এখনই বসবেন? চলুন --
এতক্ষণে অজয়বাবু সুবীরকে নজর করেন; বলেন, এ্রকে তো ঠিক, মানে--
কাবেরী প্রথম সুযোগেই সুবীরের ট্রাম্প-কার্ডখানা খুলে দেখায়। বলে, উনি ক্রিমিনাল ইন্টেলিজেন্স বিভাগের একজন অফিসার, মিস্টার সুবীর রায়। এসেছেন একটা খুনের তদন্তে।
সুবীর ক্রুদ্ধ আক্রোশে কাবেরীর দিকে তাকায়।
চোখ থেকে চশমাটা খুলে কাঁচটা মুছতে মুছতে অজয়বাবু বলেন --অ!
-- বসুন অজয়বাবু। আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করার আছে আমার।
অজয় বসেন না। চশমাটা নাকে চড়িয়ে বলেন, কাঞ্চনজঙ্ঘা হোটেলের সেই দারোগার মৃত্যু সংক্রান্ত প্রশ্ন নিশ্চয়?
অজয় বসেন না। চশমাটা নাকে চড়িয়ে বলেন, কাঞ্চনজঙ্ঘা হোটেলের সেই দারোগার মৃত্যু সংক্রান্ত প্রশ্ন নিশ্চয়?
--হ্যাঁ, তাই। আপনি তো ঐ হোটেলেই ছিলেন?
-- এস কাবেরী --অজয় প্রস্থানোদ্যত।
-- আপনি আমার প্রশ্নের জবাব দেবেন না?
-- দেব! যখন কোর্টের সমন পাব, সাক্ষীর কাঠগড়ায় উঠে দাঁড়াব, তখন দেব! উঃ! হরিবল, এস কাবেরী।
কাবেরীর হাতটা ধরে অসঙ্কোচে টানতে টানতে নিয়ে চলেন অজয় চাটুজ্জে।
পিছন থেকে সুবীর বলে, কাজটা কিন্তু ভাল করলেন না। কোর্টের সমন ছাড়াও পুলিস অফিসারের প্রশ্নের জবাব দিতে হয় --
-- হয়, জানি। কিন্তু তার একটা স্থান-কাল-পাত্র আছে! পথে-ঘাটে প্রথম সাক্ষাতেই অমন মোড়লি করার কোন অধিকার পুলিসের নেই! বুঝেছেন --ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন উনি।
বেলা সওয়া এগারোটা।
বেলা সওয়া এগারোটা।
সুবীর এসে উপস্থিত হল আলি-সাহেবের ঘরে। দরজায় নক করে বললে, আসতে পারি?
আগাথা ক্রিস্টিকে বালিশের উপর উবুড় করে রেখে আলি বললে স্বচ্ছন্দে! ইন ফ্যাক্ট আপনার সঙ্গে আলাপ করতে যাব ভাবছিলাম। আমার নাম এন.আলি।
সুবীর বললে, আমার নাম সুবীর রায়। ক্রিমিনাল ইন্টেলিজেন্সে আছি। এসেছি একটা খুনের তদন্তে।
ভেবেছিল প্রতিপক্ষ হকচকিয়ে যাবে। তা কিন্তু গেল না আলি। হেসে বললে, তাস খেলেন?
-- কেন বলুন তো? ভ্রূকুঞ্চিত সুবীরের প্রশ্ন!
-- প্রথম ডীলেই রঙের টেক্কা পেড়ে লীড দিচ্ছেন তো, তাই বলছি!
-- মানে?
-- আগাথা ক্রিস্টি পড়ছিলাম কিনা --গোয়েন্দা গল্পে দেখেছি ডিটেকটিভরা সহজে আত্মপরিচয় দেয় না ওভাবে।
-- সকলের পদ্ধতি এক নয়। আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারি?
--এ বিনয়ও ডিটেকটিভ-সুলভ নয়। নিশ্চয় করতে পারেন। করুন। আমি প্রস্তুত।
-- আপনি তো এখানে এসেছেন পয়লা তারিখ রাত সওয়া নয়টায়। কোথা থেকে এলেন?
--দার্জিলিঙ থেকে।
-- দার্জিলিঙে কবে এসেছিলেন?
-- ঐ পয়লা তারিখ বেলা বারোটায়। একটা শেয়ারের ট্যাক্সিতে চেপে।
-- ঐ ট্যাক্সিতে একজন পুলিস অফিসার আর একজন ভদ্রমহিলাও এসেছিলেন?
--না। কোন পুলিস অফিসার বা মহিলা ছিলেন না আমার সঙ্গে।
-- কোন হোটেলে উঠেছিলেন আপনি?
হোটেল কুন্ডুজ। স্বনামেই উঠেছিলাম --হোটেল রেজিস্টার হাতড়ে দেখতে পারেন সত্য কিনা।
-- কিন্তু এমনও তো হ'তে পারে -- স্বনামে হোটেল কুন্ডুজ-এ ঘর বুক করে আপনি বেনামে অন্য কোনও হোটেলে উঠেছিলেন?
আলি হেসে ফেলে। বলে, যেমন ধরা যাক মহম্মদ ইব্রাহিম এই ছদ্মনামে হোটেল কাঞ্চনজঙ্ঘায়?
-- কেন নয়?
-- নয় এজন্য যে সে-ক্ষেত্রে অজয়বাবু এবং ব্যারিস্টার বাসু আমাকে তৎক্ষণাৎ চিনে ফেলতেন।ওঁরা দুজনেই ছিলেন এ কাঞ্চনজঙ্ঘয়।
-- আপনি ভুলে যাচ্ছেন --মহম্মদ ইব্রাহিম হোটেলে ছিল মাত্র কয়েক মিনিট। চেক-ইন করেই সে বেরিয়ে যায়। ফিরে আসে রাত সাতটায় এবং এক ঘণ্টার মধোই চেক-আউট করে বেরিয়ে যায়। রাত আটটায় দার্জিলিঙ থেকে রওনা হলে রাত ন'টার মধ্যে তার পক্ষে রিপোস-এ এসে পৌঁছানো সম্ভব!
আলি পাইপ ধরালো। বললে, তাইতো হিসাবে দাঁড়াচ্ছে। এক্ষেত্রে আপনি একটিমাত্র কাজ করতে পারেন। কাঞ্চনজঙ্ঘা হোটেলের রুম-সারভিসের বেয়ারা বীর বাহাদুরকে এখানে নিয়ে আসুন। সে সনাক্ত করে যাক- ইব্রাহিম বা মিস ডিক্রুজা এখানে আছে কিনা!
সুবীর বলে, বীর বাহাদুর! ও নাম আপনি জানলেন কেমন করে?
-- এখানেই কারও কাছে শুনেছি বোধহয়! হোটেল রিপোসে তো দিবারাত্র এই গল্পই হচ্ছে। আসুন--
একটি সিগ্রেট সে বাড়িয়ে ধরে সুবীরের দিকে। পাইপখোর তাহলে সৌজন্যের খাতিরেও সিগ্রেট রাখে!
মোট কথা আলি-সাহেব বিন্দুমাত্র নার্ভাস হন না।
সাড়ে এগারোটায়- সুবীর এসে হানা দিল ডক্টর সেনের ঘরে। সেখানেও বিশেষ কিছু সুবিধা হল না। কিন্তু একটা খটকা লাগে সুবীরের। ডক্টর সেনকে অফার করা সিগ্রেটের প্যাকেট থেকে মিসেস সেন অম্লানবদনে একটি সিগ্রেট নিয়ে ধরালেন। দিব্যি হুসহুস করে টানলেন এবং একবারও কাশলেন না। ডক্টর আর মিসেস সেন সুবীরকে অনেক পীড়াপীড়ি করলেন তাসের আড্ডায় যোগ দিতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজী করাতে পারলেন না। মিসেস সেন এ হোটেলের ব্যবস্থাপনার ভূয়সী নিন্দা করলেন এবং কথা প্রসঙ্গে জানালেন তাঁর এক ভাই আছেন 'ম্যারিকায়, এক ভাই পশ্চিম জার্মানিতে। উনি নাকি ডক্টর
সেনকে পই-পই করে বলছেন চাটি-বাটি গুটিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাতে_কিন্তু ঘরকুনো ডাক্তার সেন কিছুতেই রাজী হচ্ছেন না দেশ ছেড়ে যেতে।
সেনকে পই-পই করে বলছেন চাটি-বাটি গুটিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাতে_কিন্তু ঘরকুনো ডাক্তার সেন কিছুতেই রাজী হচ্ছেন না দেশ ছেড়ে যেতে।
মোট কথা সুবীর হালে পানি পেল না।
ঠিক বারোটার সময় সুবীর এসে হানা দিল বাসু-সাহেবের ঘরে।
-- এস! আর কিছু ক্লু পাওয়া গেল? -- প্রশ্ন করলেন বাসু।
--কিছু না। আপনি কিছু আন্দাজ করতে পারছেন?
-- পারছি। আন্দাজ নয়। অকাটা প্রমাণ!
ঘনিয়ে আসে সুবীর, বলেন কী স্যার? কে?
-- কে নয় সুবীর? কারা? দুজনকেই! ইব্রাহিম এন্ড মিস ডিক্রুজা।
সুবীর অবাক হয়ে যায়। দরজাটা বন্ধ করে ঘনিয়ে আসে। বলে, নৃপেনদা অবশ্য আপনার খুব প্রশংসা করছিলেন; কিন্তু আপনি যে দুজনকেই... কী ব্যাপার বলুন তো?
সুবীর অবাক হয়ে যায়। দরজাটা বন্ধ করে ঘনিয়ে আসে। বলে, নৃপেনদা অবশ্য আপনার খুব প্রশংসা করছিলেন; কিন্তু আপনি যে দুজনকেই... কী ব্যাপার বলুন তো?
বাসু-সাহেব নিবন্ত পাইপে অগ্নি সংযোগ করতে করতে বলেন, আয়াম সরি! এখনই কিছু বলতে পারছি না। আগে জাল গুটিয়ে আনি-- সবটা একসঙ্গে ভাঙব।
হতাশ হয় সুবীর। বলে, তাহলে, মানে -- আমি এখন কী করব?
--তোমার অফিসিয়াল ইনভেস্টিগেশন চালিয়ে যাও।
আজও সারদিনে বর্ষণ ক্ষান্ত হল না। ক্রমাগত বৃষ্টি হয়ে চলেছে। কার্ট রোড দিয়ে গাড়ি যাতায়াত বন্ধ। টেলিফোন তো অনেক আগেই গেছে -- এবার গেল ইলেকট্রিক। ব্যাটারি-সেট রেডিও কারও কাছে নেই। রেডিও-র শেষ সংবাদ যা পাওয়া গেল তাতে জানা গেছে যে, সমগ্র উত্তরবঙ্গ একটা ঐতিহাসিক দুর্যোগের কবলে পড়েছে। মিলিটারিকে ডাকা হয়েছে উদ্ধারের কাজে। তিস্তা ব্রীজ নিশ্চিহ্ন। আরও অনেক ব্রীজ ভেঙে গেছে। মহানন্দা, তিস্তা ফুলে ফেঁপে ডুবিয়ে দিয়েছে গ্রামের পর গ্রাম, জেলার পর জেলা।
আজও সারদিনে বর্ষণ ক্ষান্ত হল না। ক্রমাগত বৃষ্টি হয়ে চলেছে। কার্ট রোড দিয়ে গাড়ি যাতায়াত বন্ধ। টেলিফোন তো অনেক আগেই গেছে -- এবার গেল ইলেকট্রিক। ব্যাটারি-সেট রেডিও কারও কাছে নেই। রেডিও-র শেষ সংবাদ যা পাওয়া গেল তাতে জানা গেছে যে, সমগ্র উত্তরবঙ্গ একটা ঐতিহাসিক দুর্যোগের কবলে পড়েছে। মিলিটারিকে ডাকা হয়েছে উদ্ধারের কাজে। তিস্তা ব্রীজ নিশ্চিহ্ন। আরও অনেক ব্রীজ ভেঙে গেছে। মহানন্দা, তিস্তা ফুলে ফেঁপে ডুবিয়ে দিয়েছে গ্রামের পর গ্রাম, জেলার পর জেলা।
সন্ধ্যার পর কালীপদ ঘরে ঘরে মোমবাতি রেখে গেল। মিটমিটে আলোয় বাড়িটাতে একটা ভূতুড়ে ভাব এসেছে: সুবীর রায়ের পরিচয় জানতে আর
কারও বাকি নেই। সকলেই যেন কিছুটা সতর্ক, সন্দিগ্ধং একঘেয়ে বৃষ্টির মত রিপোস-এর জীবনযাত্রা বৈচিত্রাহীন হয়ে পড়েছে একেবারে।
বৈচিত্র্য দেখা দিল রাত ঠিক আটটা তেত্রিশে।
তার তিন মিনিট আগের কথা। কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে আটটায়। ড্রইংরুমের ঘড়িটা ঠিক যখন ঢং করে সময়টা ঘোষণা করল।
সুজাতা তখন ছিল রান্নাঘরে। একাই। রাতের রান্না করছিল সে একা। কালীপদ নিজের কাজে ব্যস্ত।কাঞ্চী বাড়ি চলে গেছে।
আলি-সাহেব নিজের ঘর মোমবাতির আলোয় আগাথা ক্রিস্টির 'মাউসট্র্যাপ' গল্পের শেষ ক'টা পাতায় ডুবে আছেন।
সুবীর ছিল তার নিজের ঘরের সংলগ্ন বাথরুমে। গীজারের জল এখনও কিছুটা গরম আছে। সে হট বাথ নেবার একটা চেষ্টা করছে। গরমজল আর পাওয়া যাবে না।
ডক্টর আর মিসেস সেন জোড়া মোমবাতি জ্বেলে ফিশ্ খেলছেন। মিসেস সেন সারাদিনে প্রায় সওয়া শ' টাকা হেরে বসে আছেন!
কৌশিক একটা ছাতি আর টর্চ নিয়ে উঠেছে ছাদে। মই বেয়ে জল-নিকাশী গাটারটা সাফা করতে। গাছের পাতায় জল-নিকাশী গাটারটা আটকে গেছে।
বাসু-সাহেব তাঁর ঘরের সামনে উত্তরের বারান্দায় অন্ধকারে বসেছিলেন একট ইজিচেয়ারে। শুনছিলেন -- গাছের পাতা থেকে টুপটুপ করে ঝরে পড়া বৃষ্টির শব্দ।
বাসু-সাহেব তাঁর ঘরের সামনে উত্তরের বারান্দায় অন্ধকারে বসেছিলেন একট ইজিচেয়ারে। শুনছিলেন -- গাছের পাতা থেকে টুপটুপ করে ঝরে পড়া বৃষ্টির শব্দ।
ঠিক তখনই ঢং করে ড্রইংরুমের ঘড়িতে সাড়ে আটটা বাজল।
রানী দেবী ছিলেন নিজের ঘরে। হুইলচেয়ারটা তার ঘরের উত্তরের জানলার কাছে টেনে নিয়ে আপন মনে তিনি গান ধরলেন।এমন অকালবর্ষণের সন্ধ্যায় তিনি কিন্তু কোন বর্ষা-সঙ্গীত ধরলেন না।কী জানি কেন আপন খেয়ালে শুরু করলেন অতি পরিচিত একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত:
“যদি জানতেম আমার কিসের ব্যথা তোমার জানাতেম--”
“যদি জানতেম আমার কিসের ব্যথা তোমার জানাতেম--”
ঘরে ঘরে বিচিত্র প্রতিক্রিয়া শুরু হল।
সুজাতা তার প্রেশার-কুকারের মুখটা খুলে দিল। সোঁ-সোঁ শব্দটা বন্ধ হল।
মিসেস সেন তাস ডীল করা বন্ধ করে প্রশ্ন করলেন, কে গাইছে বল তো?
বাসু-সাহেব দেশলাইটা জ্বালবার উপক্রম করছিলেন, থমকে গেলেন তিনি।
সুবীর বোধহয় গানটা শুনতে পায়নি। তার কলের শব্দ বন্ধ হল না!
অরূপ পায়চারি করছিল একতলার দক্ষিণের বারান্দায়। চট করে সে ঢুকে গেল হল-কামরায়। ডাইনিং হল-এ একটা মোমবাতি জ্বলছে। মাঝের পর্দাটা টানা। তাই ড্রইংরুমটা আলো-আঁধারি। অরূপ কিন্তু ভ্রূক্ষেপ করল না। প্রায় হাতড়াতে হাতড়াতে সে সরে এল ড্রইংরুমের উত্তর দিকের দেওয়ালের কাছে। বসল গিয়ে পিয়ানোর টুলে।
গান যখন অন্তরায় গৌছালো তখন পিয়ানোর মিঠে আওয়াজ যুক্ত হল কণ্ঠ-সঙ্গীতের সঙ্গে।সমের মাথায় একবার থামলেন রানী দেবী। কান পেতে কী শুনলেন। বুঝে নিলেন -- পিয়ানো বাজছে। চুপ করে রইলেন পুরো একটি কলি। পিয়ানো বেজে গেল শুধু। তারপর যুক্ত হল যন্ত্র-সঙ্গীতের সঙ্গে কন্ঠ-সঙ্গীত। রানীদেবী নিশ্চয় বুঝে উঠতে পারেননি কে এমন আচমকা সঙ্গত করতে বসেছে -- কিন্তু এটুকু বুঝে নিয়েছিলেন যে সঙ্গতকার একজন দক্ষ যন্ত্রশিল্পী।
“কোথায় যে হাত বাড়াই মিছে ফিরি আমি কাহার পিছে
সব কিছু মোর হারিয়েছে পাইনি তাহার দাম।”
“কোথায় যে হাত বাড়াই মিছে ফিরি আমি কাহার পিছে
সব কিছু মোর হারিয়েছে পাইনি তাহার দাম।”
কৌশিক সচকিত হয়ে ওঠে। সঙ্গীতের আকর্ষণে সে নেমে আসে মই বেয়ে। এসে নামে দোতলার বারান্দায়। সেখান থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় ওর নজরে পড়ল দক্ষিণের বারান্দার ও-প্রান্তে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে ঠিক বোঝা গেল না, মনে হল স্ত্রীলোক। কাবেরীই হবে নিশ্চয়। ঠিক তার ঘরের সামনেই? কৌশিক একটু ইতস্তত করে। তারপর অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে সে নেমে যায় একতলায়।
সঙ্গীতের আকর্ষণে সস্ত্রীক সেনও উঠে এসে দাঁড়িয়েছেন উত্তরের বারান্দায়।
গান শেষ হল। সঙ্গীতমগ্না দ্বিতীয়বার শুরু করলেন 'স্থায়ী'টা
গান শেষ হল। সঙ্গীতমগ্না দ্বিতীয়বার শুরু করলেন 'স্থায়ী'টা
"যদি জানতেম আমার কিসের ব্যথা তোমায় জানাতেম”
ড্রইংরুমে ঘড়িতে তখন ঠিক আটটা বেজে তেত্রিশ।
ড্রইংরুমে ঘড়িতে তখন ঠিক আটটা বেজে তেত্রিশ।
হঠাৎ সমস্ত বাড়ি সচকিত করে একটা ফায়ারিং-এর শব্দ হল ড্রইংরুমে!
তৎক্ষণাৎ কে যেন ফুঁ দিয়ে নিবিয়ে দিল ডাইনিং হল-এর মোমবাতিটা!
একটা চেয়ার উল্টে পড়ার শব্দ। ঐ সঙ্গে ভেঙে পড়ল একটা ফুলদানি। বিশ থেকে ত্রিশ সেকেন্ড। বাড়িশুদ্ধ সবাই এসে উপস্থিত হল ড্রইংরুমে। প্রায় একসঙ্গেই।
অরূপরতন পড়ে আছে উবুড় হয়ে। তার পাশেই একটা ভাঙা ফুলদানি আর কিছু ছড়ানো ছিটানো গ্ল্যাডিওলাই। ডক্টর সেন হুমড়ি খেয়ে পড়লেন।
কৌশিক তার হাতের টর্চটা জ্বালল। ডক্টর সেন মুখ তুলে বললেন, থ্যাংক গড। গুলিটা কাঁধে লেগেছে। ফেটাল নয় বোধহয়!
-- এতক্ষণে সুবীর এসে পৌঁছালো তার বাথরুম থেকে। তার গায়ে একটা তোয়ালের তৈরী ড্রেসিং গাউন। তার চুল বেয়ে জল ঝরছে। বললে --পাশেই দু-নম্বর ঘর। ওখানেই ওঁকে নিয়ে যাওয়া যাক।
ধরা-ধরি করে অচৈতন্য অরূপকে ওরা নিয়ে গেল বাসু-সাহেবের ঘরে।
ডক্টর সেন একেবারে অন্য মানুষ। সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। সুজাতাকে গরম জল আনতে বললেন। আর সবাইকে বললেন, প্লীজ ক্লিয়ার আউট। ঘর ফাঁকা করে দিন। স্ত্রীকে বলেন, আমার ডাক্তারী ব্যাগটা নিয়ে এস চট্ করে।
মিসেস সেন ভ্রূকুঞ্চিত করে বলেন, কী দরকার বাপু ওসব খুন-জখমের মধ্যে নাক গলাবার? তুমি চলে এস!
--শাট আপ!! --গর্জন করে উঠলেন ডক্টর সেন। তারপর কৌশিকের দিকে ফিরে বলেন, আমার ব্যাগটা প্লীজ --
হ্যাঁ। ডাক্তার সেন মুহুর্তে বদলে গেছেন।
বারান্দার ও প্রান্তে ইজিচেয়ারে গিয়ে বসেছিলেন ফের বাসু-সাহেব। সুবীর গট গট করে এগিয়ে আসে তাঁর কাছে। কঠিন স্বরে বলেন, আপনিই এজন্য দায়ী!
-- আমি! কেন? কী করে?
-- কেন তখন সব কথা খুলে বললেন না? হয় তো এ দুর্ঘটনা রোখা যেত!
বাসু-সাহেব বেদনাহত দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে রইলেন। জবাব দিলেন না।
বাসু-সাহেব বেদনাহত দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে রইলেন। জবাব দিলেন না।
দুম দুম করে পা ফেলে সুবীর চলে গেল আবার।
রানী দেবী হুইল-চেয়ারটা নিয়ে এগিয়ে এলেন। সহানুভূতির সুরে বললেন, এ দুর্ঘটনা এড়ানো যেত, তাই নয়!
হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ওঠেন বাসু-সাহেব: ইয়েস, ইটস্ মাই মিস্টেক! আমি ভেবেছিলাম -- আমিই বুঝি ওর টার্গেট! তাই প্রস্তুত হয়েই বসেছিলাম আমি। বুঝতে পারিনি ও অরূপকে --
পকেট থেকে একটা ছোট্ট কালো যন্ত্র বার করে দেখালেন স্ত্রীকে।
রানী দেবী স্তম্ভিত হ'য়ে যান।
আধ ঘণ্টা পরে বাসু-সাহেব এসে দাড়ালেন রোগীর শিয়রে। অরূপের কাঁধের উপর ব্যান্ডেজ বাঁধা। অরূপ তখনও অচৈতন্য। প্রশ্ন করলেন ডক্টর সেনকে
--কী বুঝছেন? .
-- বুলেটটা স্ক্যাপুলার খাঁজে আটকে আছে। বার করে দেওয়া দরকার --
-- হাসপাতালের অপারেশান থিয়েটার ছাড়া সম্ভব হবে?
-- অসম্ভব! থাক, আপাতত বুলেটটা থাক। শকটা কাটিয়ে উঠুন। বেঁচে যাবেন। অন্তত মেডিকেল-সায়েন্স এক্ষেত্রে যতটুকু করতে পারে তা আমি করব। নিশ্চিন্ত থাকুন!
--থ্যাংক্স!
অন্ধকারের মধ্যে এগিয়ে এল সুবীর। বললে, কিছু মনে করবেন না ডক্টর সেন। আমি কয়েকটা খোলা কথা বলব। অরূপবাবুকে কে গুলি করেছে তা আমরা জানি না। কিন্তু আমাদের মধ্যেই কেউ একজন তা করেছে --ইয়েস! এনি ওয়ান! আপনি-আমিও হতে পারি!
সো হোয়াট? -- রুখে ওঠেন ডক্টর সেন।
-- আপনি কে কী ওষুধ দিচ্ছেন, কী ইনজেকশান দিচ্ছেন সব একটা স্টেটমেন্টের আকারে লিখে যাবেন এবং মিসেস বাসুকে দেখিয়ে ওষুধ খাওয়াবেন, ইনজেকশান দেবেন --
--মিসেস্ বাসুকে! কেন? উনি কী বোঝেন ডাক্তারির?
সে জন্য নয়। একমাত্র মিসেস্ বাসুই সন্দেহের অতীত।
ডাক্তার সেন কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তাকে থামিয়ে দিয়ে বাসু-সাহেব বলেন, ইয়েস ডক্টর সেন। টেক মাই লীগাল আ্যাডভাইস। সুবীর যা বলছে তাই করুন। মেডিক্যাল সায়েন্সে যতখানি সম্ভব আপনি করুন --ক্রিমিনাল জুরিসপ্রুডেন্সে যতখানি সম্ভব আমাকে করতে দিন --
শ্রাগ করলেন ডাক্তার সেন: অ্যাজ য়ু প্লীস্!
সপ্তম পর্ব
পরদিন। চৌঠা অক্টোবর। শুক্রবার। সকাল।
সুবীরের ঘরে এসে হাজির হল আলি। পর্দার বাইরে থেকে বললে: ভিতরে আসতে পারি?
সুবীর একটু অবাক হল, বললে, নিশ্চয় আসুন মিস্টার আলি। কী ব্যাপার? আলি এসে বসল সামনের চেয়ারটায়। বললে, আপনাকে কয়েকটা কথা বলতে এলাম।
--বলুন? --ঘনিয়ে আসে সুবীর।
-- দেখুন মিস্টার রায়, আপনি কাল যখন আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তখন আমি জোভিয়াল-মুডে জবাব দিয়েছিলাম। সত্যিকথা বলতে কি আমি বিশ্বাস করিনি যে, দার্জিলিঙ-এর ঘটনা এই রিপোস-এ রিপিটেড হতে যাচ্ছে -- ভেবেছিলাম এসব আপনাদের আষাঢ়ে কল্পনা। কিন্তু এখন আর সেটা ভাবা যাচ্ছে না। দু-নন্বর ঘটনা এখানে কাল রাত্রে ঘটে গেছে। ফলে এখন সিরিয়াসলি ব্যাপারটা আপনার সঙ্গে আলোচনা করতে চাই --
-- করুন। আমি কর্ণময়!
-- প্রথম কথাই বলব যে, আমি জানি-- আমি নিজে আপনার সন্দেহের তালিকায় আছি। আই নো ইট! শুধু আমি নই, আপনি হয়তো ডক্টর সেন এমনকি বৃদ্ধ অজয়বাবুকেও সন্দেহের তালিকায় রেখেছেন; মিস্ ডিক্রুজার সন্ধানে আপনি কাবেরী দেবী অথবা মিসেস্ সেনকেও নজরে নজরে রেখেছেন --তাই নয়?
-- বলে যান --
আমার আশঙ্কা হচ্ছে আপনি -- এ কেস-এ ইনভেস্টিগেটিং অফিসার -- সমস্ত সম্ভাবনা তলিয়ে দেখছেন না, ফলে আপনার সন্দেহের তালিকা থেকে একজন বাদ যাচ্ছেন, যাঁকে ঠিকমত বাজিয়ে দেখা আপনার উচিত। আপনারা কয়েকটি ভুল পূর্বসদ্ধান্ত করেছেন!
-- আর একটু পরিষ্কার করে বলুন --
-- আপনারা ধরে নিয়েছেন --পয়লা অক্টোবর ইব্রাহিম নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশান থেকে শেয়ারের ট্যাক্সি চেপে রমেন দারোগা আর মিস্ ডিক্রুজার সঙ্গে দার্জিলিঙ-এ এসেছিল। তা তো না-ও হতে পারে? এমনও তো হতে পারে যে, রমেনবাবু আর মিস্ ডিক্রুজা নিউ জলপাইগুড়ি থেকে শেয়ারের ট্যাক্সিতে আসছিল আর ইব্রাহিম মাঝপথে ঐ ট্যাক্সিতে ওঠে, ধরুন পাঙ্খাবাড়ি,
কার্শিয়াং, সোনাদা কিম্বা এই ঘুম-এই।
-- এমনটা মনে করার হেতু?
-- আপনাদের ধারণা যে, এই ট্যাক্সিতে আসার সময়েই রমেনবাবু আর মিস্ ডিক্রুজার মধ্যে ঘনিষ্ঠতা হয় --সেটা এতদূর নিবিড় হয় যাতে হোটেলে সৌছেই রমেনবাবু ডুপ্লিকেট চাবিটা চেয়ে নেয় এবং ডিক্রুজাকে সেটা দিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে স্বতঃই ধরে নিতে হয় ট্যাক্সিতে দুজন বেশ কিছুক্ষণ নিভৃত আলাপের সুযোগ পেয়েছিল। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে একটা শেয়ারের ট্যাক্সিতে দুটি পুরুষ ও একটি মহিলা একসঙ্গে রওনা হলে এ জাতীয় ঘনিষ্ঠতা কখনো গড়ে উঠতে পারে দুজনের মধ্যে?
--সো হোয়াট?
-- তাতে এ-কথাই প্রমাণিত হয় যে, ইব্রাহিম পয়লা তারিখ সকালে এ ট্রেনে কলকাতা থেকে আসেনি। সে মাঝ-রাস্তায় ঐ ট্যাক্সিতে উঠেছিল--
সুবীর বলে, কিন্তু মুশকিল কী হচ্ছে জানেন মিস্টার আলি -- আমাদের সন্দেহের তালিকায় যে কজন আছেন, যেমন ধরুন ডক্টর সেন, অজয়বাবু এবং--
-- আপনার ইতস্তত করার কিছু নেই -- আমরা অ্যাকাডেমিক ডিস্কাশান করছি, ফলে, 'এবং মিস্টার আলি'! আমি নিজেকে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেবার শুভেচ্ছা নিয়ে আপনার কাছে আসিনি; আমি শুধু বলতে এসেছি যে, সমস্যাটার আরও একটা দিক আছে, আরও একজনকে সন্দেহের তালিকায় আপনাদের রাখা উচিত।
--আর একটু স্পেসিফিকালি বলবেন?
--বলব। আমি এখানে এসে পৌঁছাই পয়লা তারিখ রাত সওয়া ন'টায়। তখন এখানে মিসেস মিত্র একা ছিলেন। মিস্টার কৌশিক মিত্র ফিরে এলেন রাত দশটায় এবং এসেই তাঁর স্ত্রীকে কৈফিয়ৎ দিলেন যে, তিনি সমস্ত দিন ছিলেন কাঞ্চন ডেয়ারিতে, দার্জিলিঙ-এ তিনি আদৌ যাননি সারাটা দিন--
-- তাতে কী হল?
অথচ আমি নিশ্চিত জানি -- কৌশিকবাবু বেলা এগারোটার সময় ঘুম স্টেশানে একটা শেয়ারের ট্যাক্সিতে চেপে দার্জিলিঙ-এ যান। সারাটা দিন তিনি দার্জিলিঙ-এ কী করেছেন তা জানি না। কিন্তু এটুকু জানি যে, তিনি দুপুরে 'সাংগ্রিলা' নামে একটি চীনা হোটেলে লাঞ্চ করেন --একা নন, তাঁর সঙ্গে ছিলেন একটি সুন্দরী মহিলা।
-- মহিলা! কে তিনি?
-- এ কাহিনীর মিসিং লিংক। বয়স পঁচিশ-ছাবিবশ। সুন্দরী। চমৎকার ফিগার। চুল ছোট, বব নয়। চেহারায় অবাঙালিত্বের ছাপ; কিন্তু চমৎকার বাঙলা বলতে পারেন। মহিলাটি কে হতে পারেন তা মিসেস্ মিত্র আন্দাজ করতে পারছেন না, অথচ আমি স্বচক্ষে দেখেছি কৌশিকবাবু তাকে একটি “সোনার কাটা" উপহার দিচ্ছেন! আর --যদি না আমার চোখ ভুল করে থাকে, মহিলাটির ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিক্স এ রকমই 34-28-32।
সুবীরের ভ্রূকুঞ্চিত হয়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে দেখতে থাকে আলিকে। তার পর বলে, আপনি কেমন করে জানলেন?
-- আমি প্রত্যক্ষদর্শী। তিন টেবিল পিছনে আমি ঐ রেস্তোরাঁতেই খাচ্ছিলাম। একা। ফলে কৌশিকবাবু আমাকে নজর করেননি। আর তাঁর সুন্দরী সঙ্গিনী থাকায় আমি বার বার ওদিকে তাকিয়ে দেখছিলাম।
সুবীর বললে, অ্যাকাডেমিক ডিসকাশানই যখন করছি তখন বলি--এমনও তো হতে পারে যে, আপনি আদ্যন্ত বানিয়ে বলছেন। আমার দৃষ্টি বিভ্রান্ত করতে।
-- কারেক্ট! সেটাও যেমন সম্ভব তেমনি এটাও সম্ভব যে, আমি আদ্যন্ত সত্যকথা বলছি। আমি কোনভাবেই আপনার তদন্তে প্রভাবিত করতে চাই না। আমি শুধু একথা বলব যে, আমি তদন্তকারী অফিসার হলে এটার সত্যতা যাচাই করে দেখতাম। সত্য হলে কৌশিককে সন্দেহ করতাম, আর মিথ্যা হলে আলিকে আরও সন্দেহের চোখে দেখতাম।
সুবীর বললে -- থ্যাংকস, ফর দ্য টিপস্!
আরও আধঘন্টা পরের কথা। সুবীর এসে উপস্থিত হল কৌশিকের ঘরে। বললে, কৌশিকবাবু এতক্ষণ আপনাকে কিছু প্রশ্ন করা হয়নি, এখন আপনার স্টেটমেন্টটা নিতে চাই --
কৌশিক কী একটা হিসাব লিখছিল। খাতাটা বন্ধ করে বললে, বলুন?
-- ঐ পয়লা তারিখ আপনি কোথায় ছিলেন? সকাল থেকে রাত্রি দশটা পর্যন্ত?
কৌশিক চট করে জবাব দেয় না। প্রতিপ্রশ্ন করে, কেন বলুন তো?
আমি যদি বলি ঐদিন বেলা এগারটা নাগাদ আপনি ঘুম স্টেশান থেকে একটা শেয়ারের ট্যাক্সি নিয়ে দার্জিলিঙ গিয়েছিলেন, সারাদিন দার্জিলিঙ-এই ছিলেন এবং সন্ধ্যাবেলা ফিরে এসে মিসেস্ মিত্রকে মিথ্যা কথা বলেছিলেন -- আপনি কি অস্বীকার করবেন?
কৌশিক চট করে জবাব দেয় না। প্রতিপ্রশ্ন করে, কেন বলুন তো?
আমি যদি বলি ঐদিন বেলা এগারটা নাগাদ আপনি ঘুম স্টেশান থেকে একটা শেয়ারের ট্যাক্সি নিয়ে দার্জিলিঙ গিয়েছিলেন, সারাদিন দার্জিলিঙ-এই ছিলেন এবং সন্ধ্যাবেলা ফিরে এসে মিসেস্ মিত্রকে মিথ্যা কথা বলেছিলেন -- আপনি কি অস্বীকার করবেন?
এবারও সরাসরি জবাব দেয় না কৌশিক। বলে, কে বলেছে আপনাকে? সুজাতা?
-- কে আমাকে বলেছে সেটা বড় কথা নয়। আপনি আমার প্রশ্নের জবাবটা দেননি এখনও?
কৌশিক তবুও সহজ হতে পারে না। এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে, আপনার অভিযোগ সত্য!
-- আপনি দুপুরে সাংগ্রি-লাতে লাঞ্চ করেন। আপনার সঙ্গে একটি মহিলা আহার করেছিলেন -- সুন্দরী। চমৎকার ফিগার। অবাঙালী, অথচ তিনি চমৎকার বাঙলা বলতে পারেন। ট্রু?
রীতিমত চমকে ওঠে কৌশিক। বলে, আপনি কী বলতে চান? আমি...আমি রমেন দারোগাকে খুন করেছি?
আমি কিছু বলতে চাই না কৌশিকবাবু। বলবেন তো আপনি। আমি যা বলছি তা সত্য?
কৌশিক রুখে ওঠে, হ্যাঁ সত্য! সো হোয়াট?
-- সেই মহিলাটি কে?
-- আমি বলব না!
-- আপনি আমার সঙ্গে সহযোগিতা করছেন না।
-- বেশ তাই! তারপর?
সুবীর উঠে ছাড়ায়। বলে, না, তারপর আর কিছু নেই। ধন্যবাদ।
নিঃশব্দে উঠে চলে যায় সুবীর।
কৌশিকও উঠে পড়ে। তার মনে হয়--এর মূলে আছে সুজাতা। কিন্তু সুজাতা কেমন করে আন্দাজ করল সে কাঞ্চন ডেয়ারিতে যায়নি --গিয়েছিল দার্জিলিঙ? সুজাতা কেমন করে জানবে সে কোথায় কার সঙ্গে লাঞ্চ খেয়েছিল? পায়ে পায়ে ও চলে আসে কিচেন-ব্লকে। ব্যাপারটার ফয়শালা হওয়া দরকার। কেমন করে সুজাতা জানতে পারল এ কথা?
কিচেন-ব্লকে পর্দার সামনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হল ওকে। ঘরের ভিতর দুজনে নিচুস্বরে কথা বলছে। একজন সুজাতা, দ্বিতীয়জন কে? পুরুষকণ্ঠ! ভদ্রলোক তখন বলছিলেন, আপনি আমাকে ভুল বুঝেছেন সুজাতা দেবী, আমি তেমন কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে ও প্রশ্ন করিনি।
-- তাহলে আমাদের বিবাহিত জীবন নিয়ে আপনার অত কৌতুহল কেন?
-- কী আশ্চর্য! আপনি অফেন্ডেড হচ্ছেন কেন? আমি শুধু জানতে চাইছি আ্যারেঞ্জড ম্যারেজ যখন হয়নি তখন কতদিন ধরে আপনি কৌশিকবাবুকে চেনেন। এতে অফেন্স নেবার কী আছে?
-- অফেন্স নিচ্ছি প্রশ্নটার জন্য নয়, তার পিছনে যে ইঙ্গিতটা আছে সেটায়! হ্যাঁ, আপনি যা জানতে চাইছেন তা ঠিক। মিস্টার মিত্র একবার মার্ডার কেসে অ্যারেস্টেড হয়েছিলেন, ঐ রমেনবাবুই তাকে গ্রেপ্তার করেন। খবরটা কোথা থেকে সংগ্রহ করেছেন জানি না, কিন্তু সংবাদটা অসমাপ্ত-- ঐ সঙ্গে এটুকুও জেনে রাখুন, আমিও এ কেসে মার্ডার চার্জে অ্যারেস্টেড হয়েছিলাম! কিন্ত প্লীজ মিস্টার আলি, এসব আলোচনা আপনার সঙ্গে আমি করতে চাই না! আপনি এবার আসুন। আমাকে কাজ করতে দিন। আর...কিছু মনে করবেন না, এ কিচেন-ব্লকটা বোর্ডারদের জন্য নয়, এটা হোটেলের প্রাইভেট অংশ।
আমার সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন হলে কাঞ্চীকে দিয়ে খবর পাঠাবেন দয়া করে--
আমার সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন হলে কাঞ্চীকে দিয়ে খবর পাঠাবেন দয়া করে--
কৌশিক নিঃশব্দচরণে ফিরে যায় নিজের ঘরে।
আরও আট দশ ঘণ্টা কেটে গেছে তারপর। সময় যেন থমকে আছে এ অভিশপ্ত বাড়িটায় -- যেখানে নূতন জীবনের সূত্রপাত করতে সদ্যোবিবাহিত একটি দম্পতি আনন্দের আয়োজন করেছিল। না। ভুল বললাম! সময় থমকে নেই। রুদ্ধ নিঃশ্বাসে সময় বয়ে চলেছে -- ড্রইংরুমের পেন্ডুলাম-ওয়ালা ঘড়িটায় তার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শোনা যায়। আর শোনা যায় নিরবচ্ছিন্ন ধারাপাতের শব্দে। বৃষ্টি এখনও পড়ছে -- কখনও জোরে, কখনও ঝড়ো-হাওয়ার ক্ষ্যাপামিতে, কখনও বা ইলশে-গুঁড়ির নৈঃশব্দে। বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই। টেলিফোন যোগাযোগ নেই, ইলেকট্রিক কারেন্ট নেই --স্তব্ধ হয়েছে কার্ট-রোড দিয়ে গাড়ির আনাগোনাও -- কোনও মানুষজনের সাড়া শব্দ নেই। এমনকি পাখিটা পর্যন্ত ডাকছে না।
আরও আট দশ ঘণ্টা কেটে গেছে তারপর। সময় যেন থমকে আছে এ অভিশপ্ত বাড়িটায় -- যেখানে নূতন জীবনের সূত্রপাত করতে সদ্যোবিবাহিত একটি দম্পতি আনন্দের আয়োজন করেছিল। না। ভুল বললাম! সময় থমকে নেই। রুদ্ধ নিঃশ্বাসে সময় বয়ে চলেছে -- ড্রইংরুমের পেন্ডুলাম-ওয়ালা ঘড়িটায় তার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শোনা যায়। আর শোনা যায় নিরবচ্ছিন্ন ধারাপাতের শব্দে। বৃষ্টি এখনও পড়ছে -- কখনও জোরে, কখনও ঝড়ো-হাওয়ার ক্ষ্যাপামিতে, কখনও বা ইলশে-গুঁড়ির নৈঃশব্দে। বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই। টেলিফোন যোগাযোগ নেই, ইলেকট্রিক কারেন্ট নেই --স্তব্ধ হয়েছে কার্ট-রোড দিয়ে গাড়ির আনাগোনাও -- কোনও মানুষজনের সাড়া শব্দ নেই। এমনকি পাখিটা পর্যন্ত ডাকছে না।
বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের বেষ্টনীতে জাহাজ-ডুবির কজন যাত্রী আশ্রয় নিয়েছে জনমানবশূন্য একটা ছোট্ট দ্বীপে। সংখ্যায় ওরা মাত্র দশজন! চারদিকেই উত্তালতরঙ্গ সমুদ্রের লবণাক্ত বেড়াজাল --পালাবার কোন পথ নেই। ওদের মুক্তির একমাত্র উপায় হয়তো ছিল --সঙ্ঘবদ্ধতায়। বিশ্বাসে, পারস্পরিক সৌহার্দ্যে। অথচ এমনই দুর্ভাগ্য ওদের --ওরা কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ভদ্রতা বজায় রেখে একসঙ্গে হাসছে, কথা বলছে, খাচ্ছে, ঘুমোচ্ছে -- অথচ প্রত্যেকেই প্রত্যেককে সন্দেহ করছে।
ওরা জানে--ওদের মধ্যে আত্মগোপন করে আছে একজন নৃশংস খুনী --জাত ক্রিমিনাল। ওদেরই মধ্যে একজনকে খুন করবার জন্য সে অবকাশ খুঁজছে। কে কাকে? তা ওরা জানে না; কিন্তু ভুলতেও পারছে না সেই মারাত্মক তিন নম্বরের জিজ্ঞাসা চিহ্নটিকে।
কৌশিক ওর ঘরে চুপ করে বসেছিল। জানলা দিয়ে দৃষ্টি চলে গেছে ধারাস্নাত পাইন গাছগুলোর দিকে। সুজাতা ঘরেই আছে। কথাবার্তা হচ্ছে না ওদের। মন খুলে কেউ যেন কিছু বলতে পারছে না এ ক'দিন। এমনিই হয়! প্রেমের ফুল যখন ফোটে তখন কুন্দর মত সুন্দর হয়ে ফোটে; আর প্রেমের কাঁটা যখন ফোটে তখন শজারুর কাঁটার মত সর্বাঙ্গে বিঁধতে থাকে! শজারুর কাঁটা না সোনার কাঁটা? শেষে কী মনে করে সুজাতা এগিয়ে এল পিছন থেকে। আলতো করে একখানা হাত রাখল কৌশিকের কাঁধে। কৌশিক ফিরে তাকালো না। সুজাতার হাতের উপর হাতটা রাখল।
-- একটা কথা সত্যি করে বলবে?
এবারও মুখ ঘোরালো না কৌশিক। একইভাবে বসে বলে, বল?
-- তুমি পয়লা-তারিখ কাঞ্চন-ডেয়ারি যাওনি, নয়?
-- যাইনি!
-- দাজিলিঙে গিয়েছিল?
-- হুঁ।
-- সেখানে সাংগ্রি-লাতে দুপুরে লাঞ্চ করেছিলে?
-- হুঁ
-- তোমার সঙ্গে একটি মেয়ে খেয়েছিল। সে কে?
কৌশিক নিরাসক্তভাবে বললে, প্রমীলা ডালমিয়া। আমার সহপাঠী কিশোর ভালমিয়ার স্ত্রী। সাংগ্রি-লাতেই হঠাৎ দেখা হয়ে গিয়েছিল।
সুজাতা এক মুহূর্ত কী ভেবে নেয়। তারপর ওর চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে বলে, তাহলে সেদিন কেন মিছে কথা বললে আমায়?
কৌশিক ম্লান হাসে। এতক্ষণে ওর দিকে ফিরে বললে, একটা ব্যাপার তোমার কাছে গোপন করতে --
-- কী ব্যাপার?
-- তোমার জন্য একটা জিনিস কিনতে দার্জিলিঙ গিয়েছিলাম।
-- জিনিস? কী জিনিস?
অন্যমনস্কের মত পকেট থেকে একটা গহনার কেস বার করে কৌশিক টেবিলের উপর রাখে। সুজাতা সেটা খুলে দেখে না। বলে, হঠাৎ গহনা কেন?
শূন্যের দিকে তাকিয়ে কৌশিক বলে, কাল তোমাকে উপহার দেব ভেবেছিলাম। কাল পাঁচই অক্টোবর।
উদাসীনের মত সুজাতা বললে, ও হ্যাঁ। ভুলেই গেছিলাম।
হঠাৎ পর্দার বাইরে থেকে কে যেন বললে. ভিতরে আসতে পারি?
কৌশিক প্যাকেটটা আবার পকেটে ভরে নিয়ে বলে, আসুন --
ঘরে ঢোকে সুবীর। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে বলে, ব্যাড লাক! ঘুম-অঞ্চলের সমস্ত টেলিফোন বিকল। দার্জিলিঙ থানার সঙ্গে যোগাযোগ করা গেল না।
-- তাহলে?
-- না, ব্যবস্থা একটা হয়েছে। ঘুম আউটপোস্ট থেকে একজন বিশেষ সংবাদবহ পাকদন্ডী পথে আমার চিঠি নিয়ে এই বৃষ্টি মাথায় করেই দার্জিলিঙ চলে গেছে। আজ রাত্রের মধ্যেই সার্চ-ওয়ারেন্ট নিয়ে ও.সি. মিস্টার ঘোষাল হয়তো নিজেই এসে পড়বেন।
সুজাতা প্রশ্ন করে, আপনি কি কিছুই আন্দাক্ত করতে পারছেন না?
একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে সুবীর বলে, এখনও ডেফিনিট হতে পারিনি। ইব্রাহিম যদি সহদেব স্বয়ং হয় তবে মিস্টার আলি অথবা ডক্টর সেনের মধ্যে একজনকে বেছে নিতে হবে। আর ইব্রাহিম-ডিক্রুজা যদি পার্টনার-ইন-ক্রাইম হয় তাহলে ডক্টর অ্যান্ড মিসেস্ সেন অথবা আলি-কাবেরী গ্রুপকে সন্দেহ করতে হয়। অজয়বাবু একটু রগচটা প্রকৃতির-- কিন্তু তাকে সন্দেহ করার কোন কারণ দেখছি না। আচ্ছা, ভাল কথা -- বাসু-সাহেব আমাকে বলেছেন যে তিনি ইব্রাহিম আর ডিক্রুজাকে নিশ্চিতভাবে স্পট করেছেন! আপনাদের কিছু বলেছেন তিনি?
সুজাতা বলে, বাসু-সাহেব কখন কী ভাবছেন বোঝা মুশকিল; কিন্তু উনি আমার সাহায্যে একটা ছোট্ট তদন্ত করিয়েছিলেন --
--কী তদন্ত?
-- কাবেরী দেবীর ঘরের অ্যাশট্রেটা আমাকে দিয়ে আনিয়ে উনি কী-যেন পরীক্ষা করেন।
হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে পড়ে সুবীর। একটানে পর্দাটা সরিয়ে দেয়। দেখা গেল পর্দার ও পাশে ডক্টর সেন দাঁড়িয়ে ছিলেন। থতমত খেয়ে ডক্টর সেন বলেন, ইয়ে, আজ আর থার্ড কাপ চা পাওয়া যাবে না, না মিসেস্ মিত্র?
ভ্রূকুঞ্চিত করে সুজাতা বললে, চা-য়ের সন্ধানে এখানে?
ভ্রূকুঞ্চিত করে সুজাতা বললে, চা-য়ের সন্ধানে এখানে?
--না, মানে রান্নাঘরে আপনাকে দেখতে না পেয়ে --
--আসুন। --সুজাতা ডক্টর সেনকে নিয়ে নিচে নেমে গেল।
ও. সি. দার্জিলিঙের উপস্থিতি অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল অন্য একটি কারণে :
কালরাত্রেই সুবীর জানতে চেয়েছিল কার কার কাছে আগ্নেয়াস্ত্র আছে: বাসু-সাহেব তৎক্ষণাৎ স্বীকার করেছিলেন তাঁর কাছে আছে।
কালরাত্রেই সুবীর জানতে চেয়েছিল কার কার কাছে আগ্নেয়াস্ত্র আছে: বাসু-সাহেব তৎক্ষণাৎ স্বীকার করেছিলেন তাঁর কাছে আছে।
সুবীর প্রশ্ন করে, অরূপরতন যখন গুলিবিদ্ধ হয় কখন রিভলভারটা কোথায় ছিল?
-- আমার ডান হাতে। আমি রিভলভারটা, হাতে নিয়ে বসেছিলাম এ ইজিচেয়ারে। পশ্চিমমুখো--
ভ্রূকুঞ্চিত হয়েছিল সুবীরের। বলেছিল, কেন? রিভলভার হাতে বসেছিলেন কেন?
-- একটা প্রিমনিশান হয়েছিল আমার। মনে হচ্ছিল এখনই এই মুহূর্তেই একটা দুর্ঘটনা ঘটবে। আমি সহদেবের প্রতীক্ষা করছিলাম।
বাসু একে একে সকলের দিকে তাকিয়ে দেখেন --আলি, অজয়, ডাক্তার সেন, কৌশিক -- সকলেই পাথরের মূর্তি। সুবীর বললে, আপনার রিভলভারটা দেখি?
অম্লানবদনে বাসুসাহেব হস্তান্তরিত করলেন আগ্নেয়াস্ত্রটা। বললেন ওটা লোডেড। সুবীর সেটা শুঁকে দেখল। চেম্বারটা খুলে কী যেন দেখল। যন্ত্রটার নম্বর নোটবুকে টুকে নিয়ে ফেরত দিল সেটা! তারপর এদিকে ফিরে বললে, আর কার কাছে রিভলভার আছে?
কেউ জবাব দেয়নি।
কেউ জবাব দেয়নি।
--এক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে প্রত্যেকের মালপত্র আমাকে সার্চ করতে হবে।
প্রতিবাদ করেছিলেন অজয় চট্টোপাধ্যায়। বলেছিলেন, আগে থানা থেকে সার্চ ওয়ারেন্ট করিয়ে আনুন তারপর আমার বাক্স ঘাঁটবেন। তার আগে নয়।
প্রতিবাদ করেছিলেন অজয় চট্টোপাধ্যায়। বলেছিলেন, আগে থানা থেকে সার্চ ওয়ারেন্ট করিয়ে আনুন তারপর আমার বাক্স ঘাঁটবেন। তার আগে নয়।
-- কেন? আমি তো প্রত্যেকের বাক্সই সার্চ করতে চাইছি। আর কেউ তো তাতে আপত্তি করছেন না। আপনি একাই বা কেন --
--করছি। আমারও আপত্তি আছে। --বলেছিল আলি।
বাসু-সাহেব বলেছিলেন --সার্চ ওয়ারেন্ট ছাড়া তুমি হোটেল তল্লাসী করতে পার না।
গুম মেরে গিয়েছিল সুবীর। আলি হেসে বলেছিল, অর্থাৎ অবজেকশান সাসটেইন্ড।
তাই সকালে উঠেই সুবীর চলে গিয়েছিল ঘুম-আউটপোস্ট-এ। সেখানে গিয়ে জানতে পারে ঘুম অঞ্চলের সমস্ত টেলিফোন বিকল। বাধ্য হয়ে সে নাকি দার্জিলিঙে স্পেশাল মেসেঞ্জার পাঠিয়েছে।রাত্রের মধ্যেই ও.সি. দার্জিলিঙ এসে যাবেন। সার্চ ওয়ারেন্ট আসবে। আর হয়তো আসবে কাঞ্চনজঙ্ঘা হোটেলের রুম সার্ভিসের বেয়ারা বীর-বাহাদুর। যে রিপোস-এর আবাসিকদের দর্শনমাত্র বলে দিতে পারে মহম্মদ ইব্রাহিম অথবা ডিক্রুজা এখানে আছে কি না।
সন্ধ্যাবেলায় সুবীর রায়ের আহানে সকলে সমবেত হলেন ড্রইংরুমে। সুবীর নাকি সকলকে সম্বোধন করে কিছু জানতে চায়। সবাই এসে গুটিগুটি বসেছে ড্রইংরুমে।
দিনের আলো নিবে গেছে। গোটা তিনচার মোমবাতি জ্বলছে ঘরের এপ্রান্তে ও-প্রান্তে। এলোমেলো হাওয়ায় মোমবাতির শিখা কাঁপছে। সেইসঙ্গে কাঁপছে আতঙ্কতাড়িত আবাসিকদের অতিকায় ছায়া-মিছিল।
গলাটা সাফা করে নিয়ে সুধীর কললে. অপ্রিয় সত্যটা অস্বীকার করে লাভ নেই--আমাদের মধ্যেই একজন আছেন যিনি মিস্টার মহাপাত্রের দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। রমেনবাবুর মৃত্যুর সঙ্গে তাকে যুক্ত করা যায় কিনা সে কথা ঠিক এখনই বলা যাচ্ছে না; কিন্তু অরূপ মহাপাত্রকে যে লোকটা পিছন থেকে গুলিবিদ্ধ করে সে এখন বসে আছে এই ঘরেই। আমাদের মধো আত্মগোপন করে। এ যুক্তিতে আপত্তি আছে কারও?
কেউ কোন জবাব দেয় না।
সুবীর পুনরায় বলে, আপনারা এ যুক্তি মেনে নিলেন। এবার আরও স্পেসিফিক্যালি বলি : আমরা দশ-বারো জন আছি, তার মধ্যে মিসেস বাসুকে আমরা বাদ দিতে পাবি। কারণ তার আলেবাই অকাট্য। তিনি নিজের ঘরে বসে গান গাইছিলেন --সে গান আমরা সবাই শুনেছি, গুলির শব্দের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত। দ্বিতীয়ত---ওয়েল, আর যুক্তির প্রয়োজন নেই, -- মিসেস বাসু অনারেবলি অ্যাকুইটেড। এগ্রীড?
এবারও কেউ কোন সাড়া দিল না।
-- তাহলে বাকি রইলাম আমরা ন-জন। আসুন, এবার আমরা বিচার করে দেখি। এই নয়জন ঘটনার মুহূর্তে কে কোথায় ছিলেন। কারও কোনও আ্যালেবাই আছে কিনা। একে একে আপনারা বলুন --
-- নয়জন বলতে? প্রশ্ন করেন অজয়বাবু।
-- মিস্টার কৌশিক মিত্র, মিসেস মিত্র, ডক্টর অ্যান্ড মিসেস সেন, মিস্টার অজয় চ্যাটার্জি, কাবেরী দেবী, মিস্টার আলি, মিস্টার বাসু এবং কালীপদ।
--অ্যান্ড হোয়াই নট মিস্টার সুবীর রয়? -- প্রশ্নটা অজয় চাটুজ্জের।
-- আলি উৎফুল্ল হয়ে বলে. পার্টিনেন্ট কোশ্চেন। হিন্দু-দর্শনে 'দশমস্তমসি' বলে একটা কথা আছে না?
সুবীর হেসে বলে, আছে। বেশ, আমরা দশজন। আমিই বা বাদ যাই কেন অক্ষের হিসাব থেকে? তাহলে আমিই আগে কৈফিয়ৎটা দিই: আমি ছিলাম বাথরুমে। হট বাথ নিচ্ছিলাম। গান আমি শুনতে পাইনি, তবে গুলির শব্দটা শুনেছি। জামাকাপড় পরে বের হয়ে আসতে আমার মিনিট দুই দেরী হয়েছিল। আমিই বোধহয় সবার শেষে ড্রইংরুমে এসে পৌঁছাই। এবার আপনারা সবাই বলুন।কৌশিকবাবু।
-- আমি ছিলাম ছাদে। গান শুরু হতেই শুনতে পেয়েছিলাম। আমি তখন নেমে আসি।
-- ছাদে! ছাদ তো ঢালু ছাদ -- সুবীর প্রশ্ন করে।
-- না, ঠিক ছাদে নয়, মই বেয়ে উঠে আমি রেনওয়াটার পাইপটা বন্ধ হয়ে গেছে কিনা দেখছিলাম। দোতলায় নেমে এসে দেখি --দক্ষিণ বারান্দার ওপ্রান্তে একজন মহিলা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছেন জানিনা--তিনি কাবেরী দেবী অথবা মিসেস সেন। সুজাতা নয়, কারণ আমি তাকে মীট করি একতলায়, কিচেন-ব্লকের সামনে --
ওর বক্তব্যের সূত্র ধরে কাবেরী বলে ওঠে, ওখানে আমিই দাঁড়িয়েছিলাম। গান শুনছিলাম। আমি কৌশিকবাবুকে নেমে আসতে দেখেছিলাম। কৌশিকবাবুই কি না হলপ করে বলতে পরব না। কারণ আলো ছিল খুব কম। একজন পুরুষ মানুষকে বর্ষাতি গায়ে এবং টর্চ হাতে দেখেছিলাম মাত্র।
ডক্টর সেন বলেন, অর্থাৎ আপনারা দুজন দুজনের অ্যালেবাই। কেমন?
আলি বলে ওঠেন, ব্যারিস্টার-সাহেব কী বলেন? ওঁরা তো কেউ কাউকে চিনতে পারেননি। ইনি দেখেন নারী মূর্তি, উনি দেখেছেন পুরুষ মূর্তি! তাতে কী প্রমাণ হয়?
বাধা দিয়ে সুবীর বলে, সে বিশ্লেষণ থাক। আপনি তখন কোথায় ছিলেন?
-- নিজের ঘরে। একটা ডিকেটটিভ গল্প পড়ছিলাম। আগাথা ক্রিস্টির “মাউসট্র্যাপ"।
-- অর্থাৎ আপনার কোন আ্যালেবাই নেই?
-- আগাথা ক্রিস্টি আমার আলেবাই!
অজয় চট্টোপাধ্যায় চটে উঠে বলেন, এই কি আপনার রসিকতা করবার সময়?
-- কেন নয়? আমরা তো এসেছি বেড়াতে, ফূর্তি করতে, পাহাড় দেখতে, তাই নয়?
সুবীর অজয় বাবুকে প্রশ্ন করে, আপনি কোথায় ছিলেন?
--কে আমি? --সচকিত হয়ে ওঠেন অজয় চাটুজ্জে। তারপর সামলে নিয়ে বলেন, আমি ইয়ে, আহ্নিক করছিলাম।
-- আহ্নিক! মানে? প্রশ্ন করে সুবীর রায়॥
আবার চটে ওঠেন অজয়বাবু: আপনি হিন্দুর ছেলে, তাই আহিক বোঝেন না। আলি-সাহেবকে জিজ্ঞাসা করবেন, উনি বুঝিয়ে দেবেন সন্ধ্যাহ্নিক বলতে কী বোঝায়!
সুবীর এ বক্রোক্তি গলাধঃকরণ করে ভাক্তার সেনকে বলে, আপনি কী বলেন?
-- ঐ সন্ধ্যাহিক বিষয়ে?-- জানতে চান ডক্টর সেন।
ধমক দিয়ে ওঠে সুবীর, আজ্ঞে না। আপনারা দুজন তখন কোথায় ছিলেন?
-- তাস খেলছিলাম। উনি আর আমি। আমরা দুজন দুজনের অ্যালেবাই।
আলি হেসে ওঠে: অবজেকশান ইয়োর অনার! স্বামী-স্ত্রী দুজনেই সাসপেকটেড। এক্ষেত্রে কি ওঁরা পরস্পরের অ্যালেবাই হতে পারেন?
মিসেস্ সেন চীৎকার করে ওঠেন, সাস্পেক্টেড মানে? হাউ ডেয়ার য়ু--
সুবীর তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, ব্যারিস্টার-সাহেব কাউকে কিছু প্রশ্ন করবেন?
বাসু-সাহেব বলেন, হ্যাঁ করব। তোমাকেই করব। আজ রাত্রে কি নৃপেন এখানে এসে পৌঁছতে পারবে?
বাসু-সাহেব বলেন, হ্যাঁ করব। তোমাকেই করব। আজ রাত্রে কি নৃপেন এখানে এসে পৌঁছতে পারবে?
-- তাই তো আশা করছি।
-- কাঞ্চনজঙ্ঘা হোটেলের বেহারা বীর বাহাদুরও কি আসবে?
-- হ্যাঁ, আসবে। আমাদের মধ্যে ইব্রাহিম অথবা মিস্ ডিক্রুজা আছে কিনা সেটা আজ রাত্রেই জানা যাবে। --বলেই সুবীর একে একে সকলের দিকে তাকায়। এ ঘোষণায় শ্রোতৃবৃন্দের কার মুখে কী অভিব্যক্তি হচ্ছে জেনে নিতে চায়! তারপর সে আবার বলে, আপনাদের সকলের সহযোগিতার জন্য, ধন্যবাদ। এবার আমার একটি প্রস্তাব আছে। আমি একটা পরীক্ষা করতে চাই। আশা করি সকলের সহযোগিতা পাব।
--কী জাতের পরীক্ষা? জানতে চান অজয়বাবু।
জবাবে সুবীর বলে, একটা কথা তো মানবেন যে, আমাদের মধ্যে অন্তত একজন মিথ্যা কথা বলেছেন! ঘটনার মুহুর্তে তিনি বাস্তবে ছিলেন অরপবাবুর পিছনে! তিনি কে, তা আমরা জানি না -- কিন্তু জানতে চাই। তাই আমার প্রস্তাব --আজ রাত ঠিক সাড়ে আটটায় আমরা প্রত্যেকে গতকালকার পজিশানে ফিরে যাব! ড্রইংরুমের ঘড়িতে সাড়ে আটটার শব্দ হতেই রানী দেবী তার ঘরে বসে এ গানটাই গাইবেন। আমরা এইমাত্র আমাদের জবানবন্দিতে যে কথা বলেছি ঠিক তাই তাই করে যাব আটটা তেত্রিশ পর্যন্ত! ঠিক আটটা তেত্রিশে আমি ড্রইংরুমে একটা ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার করব। আপনারা গতকালকের মত সবাই ছুটে আসবেন ড্রইংরুমে।
অজয়বাবু বলেন, তাতে কোন চতুর্বর্গলাভ হবে?
-- যারা সত্য কথা বলেছে, তারা গতকালকার আচরণ অনুযায়ী আজকেও কাজ করে যেতে পারবে। কিন্তু যে মিথ্যা কথা বলেছে তার ব্যাপারটা গুলিয়ে যাবেই। সে এমন একটা কিছু করে বসবে যাতে সে ধরা পড়ে যাবে। এটা ক্রাইম ডিটেকশানের একটি সাম্প্রতিক পদ্ধতি। অনেক সময়েই এতে সুফল পাওয়া গেছে! না কি বলেন, বাসু সাহেব?
বাসু-সাহেব বলেন, হতে পারে আমি ব্যাক-ডেটেড। আমি এ পদ্ধতির কথা শুনিনি।
আলি বলে ওঠে, আমি শুনেছি মিস্টার রায়, আগাথা ক্রিস্টির 'মাউসট্র্যাপে' ঠিক ঐ ধরনের একটা পরীক্ষার কথা আছে--
অজয়বাবু বলেন, দূর মশাই। তাই কি হয় নাকি? কাল যদি আমিই গুলি করে থাকি, তাহলে আজ কি আর সারা বাড়ি দাপাদাপি করে বেড়াবো? আজ তো গ্যাঁটসে নিজের ঘরে বসে সীতারাম জপ করব!
সুবীর বলে, তাই করবেন। তাহলে তো আপনার আপত্তি নেই?
কাবেরী বলে. তবু একটা তফাৎ হবে কিন্তু মিস্টার রায়। আজ আর গানের সঙ্গে পিয়ানো বাজবে না৷
-- বাজবে! --সুবীর ওকে আশ্বস্ত করে।
-- বাজবে? কেমন করে? কে বাজাবে আজ?
-- আমি বাজাব! আমার ঘরে জলের কলটা খোলা থাকবে: কিন্ত আমি বাথরুমে থাকব না। আমি আজ অভিনয় করব অরূপরতনের চরিত্রটা অর্থাৎ গান অন্তরায় পৌছালে আমি পিয়ানো বাজাতে শুরু করব। আপনি, রানী দেবী, গত কালকের মতই এক লাইন আমাকে 'সোলো' বাজাতে দেবেন। তারপর মিউজিকে যোগ দেবেন। কেমন?
আলি বললে, আপনি পিয়ানো বাজাতে জানেন?
-- জানি।
-- অত ভাল?
-- রাত সাড়ে আটটায় এ প্রশ্নের জবাব পাবেন!
আলি বিজ্ঞের মত মাথা নেড়ে বলে, বুঝেছি, মহাভারতে আছে আত্মশ্লাঘা আত্মহত্যার নামান্তর। মিসেস সেন বলেন, আপনি কথায় কথায় মহাভারত পাড়েন কেন বলুন তো?
--মহাভারত আর রামায়ণ হচ্ছে আমার প্রিয় গ্রন্থ। আর বিভীষণ হচ্ছে আমার হীরো! মন্দোদরী বিভীষণকে নিকা করেছিল কি না ঠিক জানি না। সুজাতা দেবী বলতে পারবেন!
আলোচনা প্রসঙ্গন্তরে যাচ্ছে দেখে সুবীর বলে ওঠে, থ্যাঙ্ক ইউ অল। রাত আটটা হয়েছে। এবার তাহলে আমরা সবাই প্রস্তুত হই।
ডক্টর সেন বলেন, একটা কথা। আটটা তেত্রিশে ব্ল্যাঙ্ক-ফায়ার শুনে আমরা সবাই ছুটে আসব।তারপর?
সুবীর জবাবে বলে, তার পরেও আপনারা কালকের আচরণ করে যাবেন। আপনারা এসে দেখাবেন -- আমি ঠিক এখানে উবুড় হয়ে পড়ে আছি। অর্থাৎ আমিই যেন অরূপবাবু। আপনি, ডক্টর সেন আমাকে পরীক্ষা, করে বলবেন
--থ্যাঙ্ক গড! গুলিটা কাঁধে লেগেছে! ফেটাল নয়!
ডক্টর সেন গম্ভীর হয়ে ঘাড় নাড়লেন।
-- কিন্তু একটা কথা।--সতর্ক করে দেয় সুবীর --কোন কারণেই আজ ওই তিন মিনিটের জন্য আপনারা অন্য রকম আচরণ করবেন না। ঠিক কাল যা করেছেন, তাই করবেন। অন্যরকম আচরণ করতে বাধ্য হবে অবশ্য ক্রিমিনাল নিজে!
মিসেস সেন হঠাৎ হাততালি দিয়ে ওঠেন: গ্র্যান্ড আইডিয়া। খেলাটা জমবে! ঠিক পাটিতে যেমন হয়।
সবাই মুখ চাওয়া-টাওয়ি করে।
রাত আটটা পঁচিশ।
বাসু-সাহেব রিভলবারটা নিয়ে উত্তরের বারান্দায় চলে গেলেন। বসলেন গিয়ে ইজিচেয়ারে। অরূপ অঘোরে ঘুমাচ্ছে। রানী দেবী তার হুইল চেয়ারে বসে আছেন জানলার দিকে মুখ করে -- উৎকর্ণ হয়ে আছেন, কখন ঢং করে বেজে উঠবে হলঘরের দেওয়াল ঘড়িটা।
কৌশিক মই বেয়ে ছাদে উঠে গেল। আলি-সাহেব পড়া বইয়ের শেষ-কটা পাতা পড়তে বসেছেন। কাবেরী উৎকর্ণ হয়ে বসে আছে তার বিছানায় --কখন শুরু হয় গান। সুজাতা রান্নাঘরে। ডক্টর সেন বললেন, কাল ঠিক সাড়ে আটটার সময় তুমি ডীল করছিলে, তাসটা ধর।
অজয় চাটুজ্জে আহ্নিকে বসেছেন। অন্তত আজকের রাতে।
আটটা আঠাশ। সুবীর রায়ের বাথরুমে কলের জল পড়তে শুরু করল।
দুনম্বর ঘর।
রানী দেবী নিজের মণিবন্ধে ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলেন: আটটা উনত্রিশ।
খুট করে শব্দ হল পিছনে। রানী হুইলড চেয়ারটা ঘুরিয়ে অবাক হয়ে গেলেন। ওঁর থেকে হাত তিনেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে সুবীর রায়।
দুনম্বর ঘর।
রানী দেবী নিজের মণিবন্ধে ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলেন: আটটা উনত্রিশ।
খুট করে শব্দ হল পিছনে। রানী হুইলড চেয়ারটা ঘুরিয়ে অবাক হয়ে গেলেন। ওঁর থেকে হাত তিনেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে সুবীর রায়।
-- কী ব্যাপার; আপনি?
-- আপনাকে আর গান গাইতে হবে না মিসেস বাসু!
-- হবে না! সেকি? বাড়িশুদ্ধ সবাই যে আমার গান শুনতে --
-- আপনার গান নয়, ওঁরা উদগ্রীব হয়ে আছেন সত্যিকারের রানী দেবীর গান শুনতে।
-- মানে?
-- মানে এ সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। সহদেব হুই কে তা জানা গেছে।
-- আপনি জানেন!
-- জানি! আপনিও এখনই জানবেন --
দো-তলায় সাত নম্বর ঘর।
কাবেরী বসেছিল খাটে। শুনল শুরু হয়ে গেল:
"যদি জানতেম আমার কিসের ব্যথা তোমায় জানাতেম।”
দো-তলায় সাত নম্বর ঘর।
কাবেরী বসেছিল খাটে। শুনল শুরু হয়ে গেল:
"যদি জানতেম আমার কিসের ব্যথা তোমায় জানাতেম।”
এক লাইন গান হতেই ঢং করে সাড়ে আটটা বাজল। রানী দেবী কয়েক সেকেন্ড আগেই শুরু করেছেন তাহলে। শুরু হতেই বেজে উঠল পিয়ানো। কালকের মতই রানী দেবী চুপ করে গেলেন। এক লাইন শুধু পিয়ানো বেজে গেল। তারপর শুরু হল যৌথসঙ্গীত। কন্ঠসঙ্গীত আর যন্ত্রসঙ্গীত। কাবেরী খাট থেকে নামল, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল বারান্দায়। ঠিক কালকের মত রেলিঙে ভর দিয়ে দাঁড়াল। গান তখন পৌঁছেছে সঞ্চারীতে:
“এই বেদনার ধন সে কোথায় ভাবি জনম ধরে,
ভুবন ভরে আছে যেন, পাইনে জীবন ভরে।"
“এই বেদনার ধন সে কোথায় ভাবি জনম ধরে,
ভুবন ভরে আছে যেন, পাইনে জীবন ভরে।"
হঠাৎ সচকিত হয়ে কাবেরী লক্ষ্য করে বিদ্যুৎগতিতে মই বেয়ে নেমে আসছে কৌশিক। দ্বিতলে সে মূহুর্তের জন্যও দাঁড়ালো না, কালকের মত। যেন তাকে পিছন থেকে তাড়া করেছে উদ্যত-পিস্তল এক খুনী আসামী। প্রাণপণে সে ছুটে নেমে গেল একতলায়। কী ব্যাপার! কৌশিক তো নিয়ম মানছে না।
গতকালকার আচরণের পুনরাভিনয় তো সে করল না! চকিতে কাবেরীর মনে হল তবে কি কৌশিক --
গতকালকার আচরণের পুনরাভিনয় তো সে করল না! চকিতে কাবেরীর মনে হল তবে কি কৌশিক --
কৌশিকের দোষ নেই। বেচারি নির্দেশমত মই বেয়ে ছাদে উঠে গিয়েছিল ঠিকই! কিন্তু গান শুরু হতেই ওর কেমন যেন সব গুলিয়ে গেল। ওর মনে হল ইব্রাহিমের পরিত্যক্ত সেই 'এক: দুই: তিন' লেখা কাগজখানার কথা। ওর মনে হল -- আততায়ী কাল যে সুযোগ পেয়েছিল ঠিক সেই সুযোগ ওরা যৌথভাবে তাকে পাইয়ে দিচ্ছে! হুবহু এক পরিবেশ! খুনীটা কি এই সুযোগ নেবে না? যদি নেয়? কে তার তিন নম্বর টার্গেট ?
ভেসে আসছে অস্ফূট সঙ্গীত:
"কোথায় যে হাত বাড়াই মিছে ফিরি আমি কাহার পিছে
সব কিছু মোর বিকিয়েছে, পাইনি তাহার দাম।।”
"কোথায় যে হাত বাড়াই মিছে ফিরি আমি কাহার পিছে
সব কিছু মোর বিকিয়েছে, পাইনি তাহার দাম।।”
কৌশিকের মনে হল এই মুহূর্তেই বুঝি তার সব কিছু বিকিয়ে যেতে বসেছে! হয়তো এতক্ষণে খুনীটা কিচেন-ব্লকে ঢুকে--! সব কিছু ভুল হয়ে গেল কৌশিকের। সে বিদ্যুৎবেগে নেমে এল একতলায়!
আবার ঐ দু-নম্বর ঘর। রানী দেবী আর সুবীর রায়। মুখোমুখি। রানী রীতিমত আতঙ্কতাড়িত। বলছে, এসব কী বলছেন আপনি! আমি...আমি কী দোষ করলাম?
নেপথ্যে তখন শোনা যাচ্ছে গান এবং যন্ত্রসঙ্গীত।
সুবীর বললে, দোষ করেছেন ব্যারিস্টার পি. কে. বাসু! প্রায়শ্চিত্ত করবেন তাঁর স্ত্রী! আপনি!
পকেট থেকে একটা রিভলভার বার করল সুবীর।
রানী আর্তনাদ করতে গেলেন। স্বর ফুটল না তাঁর কন্ঠে।
কিচেন-ব্লকটা অন্ধকার। মোমবাতি নিবে গেছে ঝোড়ো হাওয়ায়। কৌশিক টর্চ জ্বেলে চারিদিক দেখল। সুজাতা কোথাও নেই। অস্ফুটে একবার ডাকল, সুজাতা!
কিচেন-ব্লকটা অন্ধকার। মোমবাতি নিবে গেছে ঝোড়ো হাওয়ায়। কৌশিক টর্চ জ্বেলে চারিদিক দেখল। সুজাতা কোথাও নেই। অস্ফুটে একবার ডাকল, সুজাতা!
কেউ সাড়া দিল না।
কৌশিক ঘুরে দাঁড়ায়। ছুটে বেরিয়ে আসে দক্ষিণের বারান্দায়।পর্দা সরিয়ে ঢুকে পড়ে ডাইনিং রুমে। সেখানেও কেউ নেই --কিন্তু ও কী! পিয়ানোর টুলে তো সুবীর রায় বসে নেই। অথচ কী আশ্চর্য! গান হচ্ছে! পিয়ানো বাজছে! যন্ত্রসঙ্গীত আর কণ্ঠসঙ্গীত যৌথভাবে ফিরে এসেছে স্থায়ীতে:
"যদি জানতেম আমার কিসের ব্যথা --"
"যদি জানতেম আমার কিসের ব্যথা --"
হঠাৎ কে যেন স্পর্শ করল ওর বাহুমূল। চমকে উঠল কৌশিক। দেখে সুজাতা। ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে সুজাতা ওর বাহুমূল ধরে আকর্ষণ করছে। কৌশিক ওকে অনুসরণ করে এগিয়ে আসে। চার-নম্বর ঘরের পর্দা সরিয়ে সুজাতা প্রবেশ করল সুবীর রায়ের ঘরে। কৌশিক তার পিছন পিছন। ঘর নীরন্ধ্র অন্ধকার --কিন্তু সেই ঘরই হচ্ছে সঙ্গীতের উৎস। টর্চ জ্বালল সুজাতা:
টেবিলের উপর একটা ব্যাটারি-সেট টেপ-রেকর্ডার চক্রাবর্তনের পথে গাইছে: “__তোমায় জানাতেম!
টেবিলের উপর একটা ব্যাটারি-সেট টেপ-রেকর্ডার চক্রাবর্তনের পথে গাইছে: “__তোমায় জানাতেম!
কে যে আমায় কাঁদায় আমি কি জানি তার নাম।।”
কৌশিক সুজাতার বাহুমূল ধরে এবার টানে। বলে, কুইক!
--কী?
-- বাসু-সাহেব অথবা রানী দেবী!
ওরা ছুটে বেরিয়ে আসতে চায়! ঠিক তখনই হল একটা ফায়ারিঙের শব্দ! ঠিক পাশের ঘর থেকে।
কৌশিক দাঁড়িয়ে পড়ে। গুলিটা যেন তারই পাঁজরে বিঁধেছে।
সুজাতা শুধু বললে, সব শেষ হয়ে গেল!
গুলির শব্দ শুনে সকলেই নেমে এসেছে। ডক্টর আর মিসেস সেন, কাবেরী, আলি আর অজয়বাবু প্রায় একই সঙ্গে প্রবেশ করলেন ডাইনিং রুম পার হয়ে ড্রইংরুমে। আলি টর্চ জ্বাললেন। আশ্চর্য! পিয়ানোর টুলে কেউ নেই। ভূতলেও নেই!
ঠিক তখনই চার-নম্বর ঘর থেকে ছুটে বের হয়ে এল কৌশিক আর সুজাতা। কৌশিক বললে, কুইক! আসুন আপনারা--
ওরা হুড়মুড়িয়ে বার হয়ে এল উত্তরের বারান্দায়। টর্চের আলো পড়ল বাসু-সাহেবের চিহ্নিত ইজিচেয়ারে। সেটা ফাঁকা। এবার ওরা সদলবলে ঢুকে পড়ে বাসু-সাহেবের ঘরে।
ভাগ্যক্রমে ঠিক তখনই লাইট কানেকশানটা ফিরে এল। আলোয় ঝলমলিয়ে উঠল "দা রিপোস"।
অরূপরতন শুয়েছিল বাসু-সাহেবের খাটে। বালিশে ভর দিয়ে মাথাটা তুলেছে সে। দু-হাতে মুখ ঢেকে রানী দেবী নিথর হয়ে বসে আছেন তাঁর চাকা দেওয়া চেয়ারে! ড্রেসিং রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন ব্যারিস্টার পি. কে. বাসু। তাঁর হাতে উদ্যত রিভলভার।
আর মেজেতে লোটাচ্ছে সুবীর রায়। রক্তে ভেসে যাচ্ছে সে।
হঠাৎ খেয়ে পড়েন ডাক্তার সেন। পরমুহূর্তেই বলেন, থ্যাঙ্ক গড! পেলভিক বোনে লেগেছে। ফেটাল নয়!
গতকালকার উক্তির সজ্ঞান অভিনয় নয়। অরিজিনাল ডায়ালগ!
সুবীরের জ্ঞান ছিল। যন্ত্রণায় সে কাতরাচ্ছে।
কৌশিক সবিস্ময়ে বাসু-সাহেবকে বলে, কী ব্যাপার?
বাসু-সাহেব গম্ভীরমুখে বলেন, আস্ক সহদেব!
-- সহদেব! মানে?
রিভলভারটা দিয়ে ভূলুন্ঠিত সুবীর রায়কে নির্দেশ করে বাসু বলেন, সহদেব হুই! আর্চ-গ্যাংস্টার, বাফেলো, 'ম্যারিকা!
শেষ পর্ব
অক্টোবরের পাঁচ তারিখ, শনিবার।
ঝলমলে রোদ উঠেছে আজ। মেঘ সরে গেছে। গাঁইতা আর কোদাল নিয়ে গ্যাংকুলিরা নেমেছে কার্ট-রোড মেরামত করতে। উৎপাটিত টেলিগ্রাফ পোল আবার মাথা তুলে খাড়া হচ্ছে। মিলিটারি জীপ নাচতে নাচতে চলতে শুরু করেছে, গর্তে ভরা কার্ট রোড দিয়ে অনেক কষ্টে অ্যাম্বুলেন্স ভ্যান এসে নিয়ে গেছে দু-জন আহত মানুষকে রিপোস থেকে হাসপাতালে।
আজ মেঘভাঙা সকালে সবাই আবার গোল হয়ে বসেছে ড্রইং বুমে। বাসু-সাহেবকে ঘিরে। পরিচিত দলের মধ্যে যোগ হয়েছে একটি নতুন মুখ, - দার্জিলিঙ থানার ও. সি. নৃপেন ঘোষাল। সে কোন টেলিফোন পেয়ে আসেনি। রাস্তায় জীপ চলতে শুরু করা মাত্র নৃপেন চলে এসেছিল ঘুমে। খবর নিতে, রিপোসের অবস্থা। নৃপেন প্রশ্ন করে, আপনি স্যার ঠিক কখন বুঝতে পারলেন?
--একেবারে প্রথম সাক্ষাৎ মুহুর্তেই!
-- প্রথম সাক্ষাতেই! চমকে উঠে কৌশিক: কেমন করে?
মারাত্মক একটা ভুল করে বসেছিল সুবীর, আই মীন সহদেব। দোশরা তারিখে রাত এগারোটায় নিজেই ফোন করে তোমাদের বলেছিল --“আমি নৃপেন ঘোষাল, ও. সি. দার্জিলিঙ বলছি।"
তারপর মধ্যরাত্রে এখানে আসবার আগে সে বাড়ির বাইরে টেলিফোনের লাইনটা ছিঁড়ে ফেলে, যাতে আমরা আর থানার সঙ্গে যোগাযোগ না করতে পারি।
কৌশিক বাধা দিয়ে বলে, সে তো বুঝলাম; কিন্তু আপনি কেমন করে বুঝলেন
ও জাল?
-- বলছি। পরদিন সকালে তার সঙ্গে আমার পরিচয় হল। প্রথম সাক্ষাতেই আমি ইব্রাহিমের সেই 'এক: দুই: তিন' লেখা কাগজটা প্রসঙ্গ তুললাম। সুবীরবেশী সহদেব তখন একটা দুঃসাহস দেখিয়ে বসে। ও চেয়েছিল আমাদের, মানে তোমাদের ভয় দেখাতে। ভয়ে নার্ভাস করে দিতে। বেড়াল যেমন খেলিয়ে নিয়ে ইঁদুরছানাকে মারে! তাই সে এ 'এক: দুই:তিন' লেখা কাগজখানা তোমাদের দেখাতে চাইল। আগে থেকেই সেটা ও নতুন করে লিখে এনেছিল। ও তাই কাগজখানা সকলকে দেখাবার লোভ সামলাতে পারল না। হয়তো ও আমাকে প্রভাবে ঠকাতে চেয়েছিল। পাছে আমি ওর আইডেন্টিটি কার্ড দেখতে চাই, তাই ওভাবে ওর অভিজ্ঞান অঙ্গুরীয় মেলে ধরেছিল আমার কাছে -- প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে, ও নৃপেনের কাছ থেকে আসছে। আর তাতেই ও ধরা পড়ে গেল।
সুজাতা বলে, কেমন করে? কাগজখানা তো আমরাও দেখেছি --
-- দেখেছ। কিন্তু তোমরা দেখেছ মাত্র একবার। আমি দেখেছি দুবার। আমার ক্রিমিনাল লইয়ারের চোখ ভুল করেনি। কাগজখানা দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম --ওই লোকটা, সহদেব! ও নৃপেনের সহকারী সুবীর রায় নয়!
কেমন করে?
কেমন করে?
-- নৃপেন যে কাগজটা দেখিয়েছিল সেখানা আর এই কাগজটা হুবহু এক। দুটোই চব্বিশ পাউন্ডের, ব্যাঙ্ক পেপার, একই কালো কালি, একই হস্তাক্ষর, একইভাবে উপর দিকে পারফোরেটেড এবং ডান কোনায় ছেঁড়া। তবু একটি অতি সূক্ষ্ম তফাৎ ছিল। প্রথমবার 'দার্জিলিঙ' শব্দটার শেষ অক্ষরটা ছিল "ঙ"; দ্বিতীয়বার "ং"। ব্যস! চূড়ান্ত ভাবে ধরা পড়ে গেল সহদেব।
সুজাতা আবার বলে, কিন্তু কেমন করে?
সুজাতা আবার বলে, কিন্তু কেমন করে?
-- বুঝলে না' “ঙ" মুছে গিয়ে "ং" এল কেমন করে? ফলে এখানা নতুন করে লেখা। কে লিখেছে? নিঃসন্দেহে যে সেটা দাখিল করছে। কিন্তু দুটি কাগজের হস্তাক্ষর এক হয় কী করে? অর্থাৎ এ লোকটাই আবার ইব্রাহিম -- যে লোকটা পয়লা তারিখ কয়েক মিনিটের জন্য ঐ মাস্টার কী দিয়ে তেইশ নম্বর ঘরে ঢুকবার সুযোগ পেয়েছিল! রানু, তোমার মনে আছে আমি তখনই বলেছিলাম সহদেবকে আমি চিনতে পেরেছি, কিন্তু প্রমাণ এমন পাক্কা নয় যাতে খুনী আসামীর কনভিকশান হতে পারে।
মিসেস সেন বলেন, ঈস্! তাই সব জেনে-শুনে আপনি ঘাপটি মেরে বসেছিলেন?
-- ইয়েস ম্যাডাম! তাই সব জেনে-শুনে আমি ঘাপটি মেরে বসেছিলাম। কিন্তু আমার ভুল কোথায় হল জান? আমি ভেবেছিলাম -- আমিই ওর সেকেন্ড টার্গেট। অরূপ নয়। ওখানেই সে আমাকে টেক্কা মেরেছে। কিন্তু তৃতীয়বার আমি আর ভুল করিনি, বুঝতে পেরেছিলাম --এবার ওর টার্গেট হচ্ছে রানু।
কাবেরী প্রশ্ন করে, কেন? মিসেস বাসু কেন?
কাবেরী প্রশ্ন করে, কেন? মিসেস বাসু কেন?
--কারণ সহদেব জানত আমি সশস্ত্র আছি। ও বুঝতে পেরেছিল, আমি ওর নাগালের বাইরে, গুলি করতে গেলে গুলি খেতে হতে পারে! তাছাড়া ও জানত রানুর মৃত্যু আমার কাছে মর্মান্তিক যন্ত্রণাদায়ক হবে, কারণ --
-- কারণ? --সুজাতা জানতে চায়।
বাসু-সাহেব রানীর দিকে ফিরে বলেন, সবার সামনে বলব?
হতচকিত হয়ে রানী বলেন, কী?
-- রানুকে আমি ভীষণ ভালবাসি!
সবাই হেসে ওঠে ওঁর ভঙ্গিতে। মিসেস বাসুও রাঙিয়ে ওঠেন। বলেন, ছাই বাস। আচ্ছা ওই লোকটা যখন আমাকে বলছিল যে, সে আমাকে খুন করতে চায় তখন পর্দার আড়ালে দাড়িয়ে তুমি কী করে চুপ করে ছিলে: তুমি পারলে
এ খুনীটার সামনে আমাকে ওভাবে বসিয়ে রাখতে?
বাসু-সাহেব মুখটা সূচালো করেন। নীরবে মাথাটা নাড়েন সম্মতিসূচকভাবে।
-- তোমার একটুও মায়া হল না?
-- কই আর হল রানু? মিস্ ডিক্রুজাকে যখন খুঁজে পাওয়া গেল না, তখন একমাত্র অস্ত্র হচ্ছে ওর নিজ মুখে কনফেশান। সেটা তোমার কাছে স্বীকার করার আগে কি আর ওকে নিরস্ত্র করতে পারি? যতই কেন না ভালবাসি তোমাকে --আমি যে ক্রিমিলাল লইয়ার!
কৌশিক জানতে চায়, আচ্ছা সহদেবের প্ল্যানটা কী ছিল?
-- এখনও বুঝতে পারনি রানী প্রথমবার যখন গানটা গায় তখন সহদেব ছিল তার নিজের ঘরে। চট করে সে গানটা টেপ রেকর্ড করতে শুরু করে। তখনও ওর তৃতীয় এমনকি দ্বিতীয় খুনের পরিকল্পনাও করা ছিল না। গানটা রেকর্ড করার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল প্রয়োজনমত আমাদের ভবিষ্যতে বিভ্রান্ত করা। মিনিটখানেক পরেই সহদেব শোনে অরূপ এসে পিয়ানো বাজাচ্ছে। মুহূর্তমধ্যে সে মনস্থির করে --বাথরুমের কলটা খুলে দেয় এবং অরূপকে গুলি করে বাথরুমে ঢুকে যায়। তারপর ধীরে-সুস্থে সে তৃতীয় খুনের পরিকল্পনা করে। ও চেয়েছিল --দ্বিতীয়বার রানীর গান টেপ-রেকর্ডে “তোমায় জানাতেম” শব্দটায় পৌঁছানোমাত্র সে রানীকে গুলি করে ছুটে বেরিয়ে যাবে ড্রইংরুমে। ও যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখান থেকে পিয়ানোর টুলটা ফুট চারেক দূরে, পাশের ঘরে। তোমরা এসে ওকে দেখতে পেতে ড্রইংরুমে পড়ে থাকতে! পরে রানীর মৃত্যুর তদন্ত যখন হত তখন ওর মোক্ষম আ্যালেবাই থাকত পিয়ানোর শব্দ। রানী যে আদৌ গায়নি আর ও বাজায়নি তা কেউ কোনদিন জানতে পারত না-- একমাত্র রানীই হতে পারত সে ঘটনার সাক্ষী, কিন্তু তৃতীয় হত্যাকাণ্ডের তদন্ত যখন হত তখন রানীর এজাহার আর নেওয়া যেত না --
নৃপেন বলে, কিন্তু ওর টেপ রেকর্ডার আর ডিসচার্জড রিভলভারটা তো আমরা তদন্তের সময় খুঁজে পেতাম। ও যে আদৌ পিয়ানো বাজাতে জানে না এটা প্রমাণ করতাম!
--না, দারোগা-সাহেব, তা পেতে না! ওর পরিকল্পনা অনুযায়ী পেতে না। সে রাত দশটার মধ্যেই 'থানায় যাচ্ছি' বলে বেরিয়ে যেত। তাকে আমরা সবাই পুলিস-অফিসার বলে মেনে নিয়েছিলাম -- ফলে আমরা তাতে আপত্তি করতাম না। সহদেব অনায়াসে হাওয়ায় মিলিয়ে যেত!
কাবেরী বলে, উফ! কী ভীষণ!
বাসু-সাহেব বলেন, তুমিই কিন্তু আমাকে সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছ কাবেরী!
-- আমি: ওমা, কেন! কী করে?
-- কার্শিয়াঙে তোমার বান্ধবী অথবা বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া করে!
কাবেরী অবাক বিস্ময়ে ওঁর দিকে তাকিয়ে থাকে। শেষে সামলে নিয়ে বলে, আপনি কেমন করে জানলেন?
কাবেরী অবাক বিস্ময়ে ওঁর দিকে তাকিয়ে থাকে। শেষে সামলে নিয়ে বলে, আপনি কেমন করে জানলেন?
-- জানি না। আন্দাজ করছি। তুমি নিজেই সুজাতাকে বলেছিলে যে, কার্শিয়াঙে তুমি আশ্রয় নিয়েছিলে 'বন্ধুস্থানীয় একজনের' কাছে। রাত থাকতেই বাসিমুখে কেউ বন্ধুস্থানীয় লোকের বাড়ি ছেড়ে ট্যাক্সি নিয়ে বের হয় না। তাই অনুমান করতে অসুবিধা হয় না --একটা রাগারাগি নিশ্চয় হয়েছিল।
অবশ্য “রাগ" শব্দটা বাঙলা না সংস্কৃতে সেটা হলপ করে বলতে পারব না। ওটা 'অভিমান'ও হতে পারে। তিনি 'বান্ধবী' না 'বন্ধু' তা'জানা না থাকায় সঠিক কনক্লুশনে আসা যাচ্ছে না --
অবশ্য “রাগ" শব্দটা বাঙলা না সংস্কৃতে সেটা হলপ করে বলতে পারব না। ওটা 'অভিমান'ও হতে পারে। তিনি 'বান্ধবী' না 'বন্ধু' তা'জানা না থাকায় সঠিক কনক্লুশনে আসা যাচ্ছে না --
কাবেরী একেবারে লাল হয়ে যায়।
বাসু সাহেব তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গটা বদলে বলেন, তাছাড়া এখানে ঘর ছেড়ে বাইরে যাবার সময় নিজের ঘরটা তালাবদ্ধ না করেও তুমি ব্যাপারটা গুলিয়ে তুলেছ। তুমি জান না -- তোমার ঘরে অ্যাশট্রের ভিতর সহদেব ক্রমাগত ফিল্টার টিপড সিগারেটের স্টাম্প ফেলে গেছে?
-- সে কী! কেন?
-- যাতে তোমাকে মিস্ ডিক্রুজা বলে আমি ভুল করি।
-- আপনি আমাকে তাই ভেবেছিলেন?
-- না ভাবিনি; অরূপ তোমাকে চার্চে দেখা একটি ক্রিশ্চিয়ান মেয়ের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলায় একটু বিভ্রান্ত হয়েছিলাম অবশ্য --কিন্তু ক্রমশঃ আমি বুঝতে পারলাম সহদেব নিজেই লুকিয়ে এ সিগারেটের স্টাম্প ফেলে আসছে। তাই সহদেবকে বুঝতে দিয়েছিলাম যে, আমি ওর ফাঁদে পা দিয়েছি। তাকে তাই
বলেছিলাম --মিস ডিক্রুজাকেও আমি সনাক্ত করেছি এই হোটেলে!
নৃপেন বলে, মিস্ ডিক্রুজা তাহলে নিরপরাধ?
-- একটা অপরাধ সে করেছে। মেয়েটা ছিল কল গার্ল। রমেনের সঙ্গে তার একটা ব্যবস্থা হয়েছিল। তাই রমেন তোমার বাড়িতে রাতে থাকতে রাজী হয়নি। পয়লা তারিখ গভীর রাত্রে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে মেয়েটা রমেনের ঘরে ঢোকে। হয়তো অনেকক্ষণ বসেও ছিল। সিগ্রেট যে খেয়েছিল তার প্রমাণই তো আছে। হয়তো তার চোখের সামনেই মদ্যপান করতে গিয়ে রমেন গুহ মারা যায়। মিস ডিক্রুজার একমাত্র অপরাধ তৎক্ষণাৎ পুলিসে খবর না দিয়ে সে রাত ভোর হতেই পালিয়ে যায়।
নৃপেন গম্ভীরভাবে বলে, গুরুতর অপরাধ!
বাসু-সাহেব বলেন, কিন্তু তার অবস্থাটাও বোঝ! বেচারি ডুপ্লিকেট চাবির সাহায্যে ঘরে ঢুকেছে--খুনের দায়ে সে নিজেই জড়িয়ে পড়ত। তাছাড়া অমন মেয়ে নিশ্চিত মদ খায় --হয়তো একচুলের জন্য সে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে -- যাকে বলে slip between the cup and lip!
অধিবেশন ভঙ্গ হলে নৃপেন বাসু-সাহেবকে জনান্তিকে বলে, আপনার সঙ্গে একটা প্রাইভেট-কথা ছিল স্যার --
বাসু-সাহেব ওকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, মনে আছে। আমি বলব!
নৃপেন অবাক হয়ে বলে, মানে! কাকে কী বলবেন?
-- বিপুলকে তোমার সাবস্টিটুটের কথা তো? বলব আমি!
-- নৃপেন যেন দাঁতের ডাক্তারের কাছে এসেছে! লোকটা কি অন্তর্যামী!
ঘণ্টাখানেক পরে।
সুজাতা কিচেনে ব্যস্ত। আজ পোলাও হবে! জবর খানার আয়োজন। কৌশিক নিঃশব্দে প্রবেশ করল পিছন থেকে । সুজাতা তখন কাজ করতে করতে গুনগুন করে তান ভাঁজছিল: মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি--
-- এতক্ষণে গান বেরিয়েছে গলায়?
চমকে ঘুরে দাঁড়ায় সুজাতা। বলে, ও তুমি! আমি ভেবেছি--বিভীষণ!
-- বিভীষণ!
সে কথার জবাব না দিয়ে সুজাতা ঘনিয়ে আসে। বলে, এই! আজ না পাঁচুই অক্টোবর?
-- হুঁ! তাই কি?
--বা রে, আমার সেই সোনার কাঁটাটা?
-- আয়াম সরি। ওটা আমার পকেটেই রয়ে গেছে, নয়?
-- কৌশিক পকেট থেকে বার করে গহনার বাক্সটা।
(শেষ)
No comments:
Post a Comment