সোনার কাঁটা (দ্বিতীয়াংশ )

সোনার কাঁটা 

লেখক: নারায়ণ সান্যাল

প্রথমাংশের লিঙ্ক

চতুর্থ পর্ব

 

দোশরা অক্টোবর, বুধবার! সন্ধ্যা।
ইতিমধ্যে রিপোস-এ এসে হাজির হয়েছেন বেশ কয়েকজন। সুজাতা চোখে অন্ধকার দেখে। কাল রাত্রি থেকে যে বৃষ্টি শুরু হয়েছে তা থামার লক্ষণ নেই। একনাগাড়ে বর্ষণ চলেছে। পাহাড়ে বৃষ্টি। কখন থামবে কেউ জানে না। রেডিওতে তো বলছে সহজে থামবে না। কালীপদ সেই যে শুয়েছে আর ওঠার নাম নেই। সারা রাত প্রবল জ্বরে ছটফট করেছে বেচারি। ওদিকে কাঞ্চী আজ সকালে আসেনি--ওদের বস্তির ঘরে হুড়হুড় করে জল ঢুকছে হয়তো। সেই সামলাতেই ওরা হিমসিম। অথচ এদিকে একে একে উপস্থিত হচ্ছেন আবাসিকেরা।
 

সবার আগে এসেছেন মিস্‌ কাবেরী দত্তগুপ্তা। সকাল ছটায়। তখনও শয্যাত্যাগ করেনি সুজাতারা। কাল রাত্রে সুজাতার ভাল ঘুম হয়নি। কৌশিক হঠাৎ কেন একঝুড়ি মিথ্যা কথা বলল তা ও কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিল না। অপরপক্ষে কৌশিকও একটু গুম মেরে গেছে। খাবার টেবিলে যে কথোপকথনটা হল সেটার কথাই ওর বার বার মনে পড়ে যাচ্ছে। ভাবছিল -- সুজাতা কেন আলি-সাহেবকে প্রথম সাক্ষাতেই বলে বসেছিল -- বাড়িতে সে একেবারে একা, চাকরটা পর্যন্ত নেই! আর আলি-সাহেব কেন অমন ইঙ্গিতপূর্ণ ভাষায় বললে, 'আমার বারে বারে মনে পড়ে যাচ্ছে এটা বর্ষণমুখর রাত্রি!' সুজাতাই বা অমন রাঙিয়ে উঠল কেন হঠাৎ? কৌশিকের ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছিল -- সে এসে পৌঁছানোর আগে সুজাতা আর আলি নির্জন বাড়িতে কী নিয়ে কথাবার্তা বলছিল। আলি যখন আসে তখন সুজাতা কি গান গাইছিল-- 'কৈসে গোঙাইবি হরি বিনে দিন-রাতিয়া!' পাশাপাশি খাটে দুজনেই জেগে শুয়েছিল অনেক রাত পর্যন্ত। কেউই কিন্ত সাড়া দেয়নি। তারপর কখন দুজনে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙল নিচের কলিংবেলটা আর্তনাদ করে ওঠায়।
 

-- এই, নিচে কে যেন কলিংবেল বাজাচ্ছে। কাঞ্চী এসেছে বোধহয় -- কৌশিক সুজাতাকে ডেকে দেয়।
 

ধড়মড়িয়ে উঠে বসে সুজাতা। কাঞ্চী তো এত সকালে আসে না। নিচে নেমে আসে। দরজা খুলেই দেখে, --, কাঞ্চী নয়, আগন্তুক একজন নতুন বোর্ডার। বছর পঁচিশ-ত্রিশ বয়সের একজন মহিলা। চিকনের একটি শাড়ির উপর গরম ওভারকোট। দেখতে ভালই -- সুন্দরীই বলা চলে। মেয়েটি বলে, আমার নাম কাবেরী দত্তগুপ্তা।
 

-- সুপ্রভাত! আসুন, আসুন! -- এত ভোরবেলা কোথা থেকে? আপনার না আজ দুপরে আসার আসার কথা?
 

-- তাই স্থির ছিল। রেলওয়ে রিজার্ভেশান পেলাম একদিন আগে। কাল এসেছি --
 

-- কাল এসেছেন? রাত্রে কোথায় ছিলেন?
 

-- কার্শিয়াঙে। ওখানে আমার একজন বন্ধুস্থানীয় লোক আছেন। তাঁর বাড়িতেই রাত্রে ছিলাম। ভোরবেলা উঠেই একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে এসেছি। যা বৃষ্টি --
 

-- আসুন, ভিতরে আসুন -- আপনার জামা-কাপড় একদম ভিজে গেছে।
কাবেরীর সঙ্গে কোন বেডিং নেই। আছে, একটা সুন্দর সাদা স্যুটকেস! কালীপদ অসুস্থ। ফলে সুজাতা আর কাবেরী দুজনে ভাগাভাগি করে সেটা টেনে নিয়ে আসে দোতলায়। কাবেীর জন্য ছিল দোতলার সাত নম্বর ঘরটা। সেটা পছন্দ হল কাবেরীর। ঘরে পৌঁছে কাবেরী বললে, আপনিই তো হোটেলের মালিক, তাই নয়?
 

-- আমি একা নই। আমরা স্বামী স্ত্রী। আজই খোলা হল হোটেলটা। পরে ভালো করে আলাপ যাবে। চা খাবেন নিশ্চয়। আমরাও এখনও খাইনি।
 

-- চা তো খাবই। একেবারে বাসিমুখে রওনা হয়েছি --
 

-- ঠিক আছে। মুখ হাত ধুয়ে নিন। গীজার আছে, গরম জল পাবেন।
দুপুরে যে ট্রেনটা শিলিগুড়ি থেকে আসে সেটা এসে উপস্থিত হল বেলা চারটেয়। বৃষ্টির জন্য। কাক-ভেজা হয়ে এসে উপস্থিত হলেন অরূপরতন মহাপাত্র। ছোটরেলের ট্রেনটা যে শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছাবে এ ভরসাই নাকি ছিল না। প্রবল বর্ষণে অনেক জায়গায় ধস নেমেছে। তবে লাইন চালু আছে এখনও। অরূপরতনের জন্য নির্দিষ্ট ছিল দোতলার নয়-নম্বর ঘরটা। কিচেন ব্লকের উপরে, সিঁড়ির পাশেই। অরূপ ঘুরে ঘুরে বাড়িটা দেখলেন। প্রশংসা করলেন -- যতটা না বাড়ির, তার চেয়ে বেশি তার রূপসজ্জার। সুজাতার রুচিকেই তারিফ করলেন বারে বারে। সারা বাড়িটা দেখিয়ে ওঁকে পৌঁছে দিচ্ছিল ওঁর সাত নম্বর ঘরে। হঠাৎ সিঁড়ির মুখে দেখা হয়ে গেল কাবেরীর সঙ্গে। সে নিচে নামছিল। সুজাতা ওঁদের পরিচয় করিয়ে দেয়, মিস্‌ কাবেরী দত্তগুপ্তা, আজই সকালে এসেছেন। আর ইনি মিঃ অরূপরতন মহাপাত্র, অ্যাডভোকেট। আমাদের পারিবারিক বন্ধু।
 

কাবেরী কোন কৌতুহল দেখাল না। মামুলী নমস্কার করল শুধু।
 

অরূপ প্রতিনমস্কার করে বললে, আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো?
 

-- আমাকে! কোথায়? --কেমন যেন চমকে ওঠে কাবেরী।
 

-- মাপ করবেন, আপনি কি ক্রিশ্চিয়ান?
 

-- ক্রিশ্চিয়ান! না তো ! এমন অদ্ভুকথা মনে হল কেন আপনার?
 

অরূপ হেসে বলে, আমারই ভুল তাহলে। আমার এক খ্রীষ্টান বন্ধুর বিয়েতে একবার চার্চে গিয়েছিলাম -- বছরখানেক আগে। সেখানে একটি মেয়েকে দেখেছিলাম --
 

-- না না, -- আমার বংশের কেউ কখনও গীর্জায় যায়নি। আপনি ভুল করছেন!
 

কাবেরী তরতরিয়ে নেমে গেল সিঁড়ি দিয়ে।
 

অরূপ একটু হকচকিয়ে যায়। সুজাতাকে বলে, ভদ্রমহিলা কি অফেন্স নিলেন?
 

 -- অফেন্স নেওয়ার মত কোন কথা তো আপনি বলেননি।
 

-- না, তা বলিনি। আমারই ভুল।
 

সুজাতার মনে পড়ে গেল অনেকদিন আগেকার কথা। সেবারও অরূপরতন একজনকে দেখে বলেছিলেন -- 'আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো?' আর সেবার কিন্তু অরূপের ভুল হয়নি।
 

বিকাল নাগাদ এসে উপস্থিত হলেন আর একজন আগন্তুক। আসার ঘণ্টাখানেক আগে দার্জিলিঙ থেকে একটা টেলিফোন করে জানতে চাইলেন সিঙ্গল সীটেড ঘর পাওয়া যাবে কিনা। কৌশিক অবস্থা বেগতিক দেখে আপত্তি করেছিল, কিন্তু সুজাতা শোনেনি। সুজাতার মতে বোর্ডার হচ্ছে ওদের ব্যবসায়ের লক্ষ্মী! উদ্বোধনের দিনেই সে কাউকে প্রত্যাখ্যান করবে না -- যতই কেন না অসুবিধা হোক।ফলে ঘণ্টাখানেক পরে একটা ট্যাক্সি নিয়ে এসে হাজির হলেন অজয় চট্টোপাধ্যায়। বৃদ্ধ সরকারী অফিসার ছিলেন। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। বিপত্নীক। ছেলে-মেয়েরা বিবাহিত এবং জীবনে প্রতিষ্ঠিত! খেয়ালী মানুষ, মেজাজ একটু তিরিক্ষে। অবসরপ্রাপ্ত জীবনে তিনি ছবি এঁকে বেড়াচ্ছেন। পাহাড়ে এসেছেন ছবি আঁকতে। দোতলার আট নম্বরে তাঁকে থাকতে দেওয়া হল।
 

বাসু-সাহেব সস্ত্রীক যখন এসে পৌঁছালেন তখন দিনের আলো মিলিয়ে গেছে।
বর্ষণক্লান্ত সন্ধ্যায় সবাই জমিয়ে বসেছেন ড্রইংরুমে। আলি-সাহেব, কাবেরী, অরূপ, অজয় চাটুজ্জে এবং কৌশিক। শুধু সুজাতা অনুপস্থিত। সে ছিল কিচেন-ব্লকে। এতগুলি প্রাণীর রান্নার জোগাড় করতে বেচারি হিমসিম খাচ্ছে। কালীপদ শয্যাশায়ী। কাঞ্চী আদৌ আসেনি। ডাইনে-বাঁয়ে তাকাবার অবসর নেই সুজাতার। কৌশিক একবার এসেছিল কোন সাহায্য করতে হবে কি না জানতে; রূঢ়ভাবে সুজাতা তাকে প্রতাখ্যান করেছে। সুজাতার মেজাজ হঠাৎ এমন বিগড়ে গেল কেন কৌশিক কিছু আন্দাজ করতে পারে না। অতএব সেও গুটিগুটি এসে বসেছে ড্রইংরুমে।
 

বাইরের দিক থেকে পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকলেন বাসু-সাহেব, ঢাকা-দেওয়া চেয়ারে সহধর্মিনীকে নিয়ে! কৌশিক সকলের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দেয়, আর ওঁদের বলে -- আর ওঁদের পরিচয় উনি আমাদের মামা আর মামীমা। মিস্টার পি.কে. বাসু, বার-আ্যট-ল আর মিসেস্‌ রানী বাসু। লেডিজ এন্ড জেন্টেলমেন! আমার একটা ঘোষণা আছে।এমন জমাট বর্ষার সন্ধ্যায় আপনাদের একটি সুখবর দিচ্ছি -- আমাদের বাসুমামুর ঝুলিতে অসংখ্য ইন্টারেস্টিং কেস-হিস্ট্রি আছে। উনি ছিলেন ক্রিমিনাল লইয়ার। ফলে উনি যদি একটা গোয়েন্দা গল্প ফাঁদেন আমরা অজান্তে ডিনার টাইমে গৌছে যাব!
আলি বলেন, ভেরি ইন্টারেস্টিং! আপনার ঝুলি ঝেড়ে অতীতদিনের কোনও একটা লোমহর্ষক কাহিনী বার করে ফেলুন বাসু-সাহেব--
 

বাসু-সাহেব একটা সোফায় সবেমাত্র গুছিয়ে বসেছেন। পাইপ আর পাউচটা বার করে লক্ষ্য করে দেখছিলেন -- টোব্যাকোটা ভিজে গেছে কি না। অন্যমনস্কের মত বলেন, উঁ? অতীতদিনের কোন লোমহর্ষক কাহিনী? নো, আয়াম সরি --
 

-- শোনাবেন না? -- হতাশ হয়ে প্রশ্ন করে কৌশিক!
 

-- নাঃ অতীতের কথা থাক! Let The Dead Past Bury Its Dead! তবে তোমাদের একেবারে নিরাশও করব না। অতি সাম্প্রতিক কালের একটা লোমহর্ষক কাহিনী তোমাদের শোনাব--
 

-- সে তো আরও ভাল কথা -- বলে ওঠে কাবেরী।
 

--উঁ? ভাল? তা ভাল-খারাপ জানি না -- আজই -- এই ধর ঘণ্টা চৌদ্দ আগে দার্জিলিঙে একটা হোটেলে একটা মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়েছে। আমি তার প্রত্যক্ষদর্শী!
 

সবাই চমকে ওঠে খবরটা শুনে।
 

কৌশিক বলে, দার্জিলিঙের হোটেল? কোন হোটেলে?
 

-- হোটেল -- দ্য কাঞ্চনজঙ্ঘা! রুম নাম্বার টোয়েন্টি থ্রি! বাই দ্য ওয়ে -- হোটেল কাঞ্চনজঙ্ঘার নাম আপনারা কেউ শুনেছেন? দৃষ্টিটা উনি বুলিয়ে নেন ওঁর সোৎসুক দর্শকবৃন্দের উপর!
 

সবাই স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। কেমন যেন অস্তোয়াস্তি বোধ করে সবাই! কেউ কোনও জবাব দেয় না। শেষ পর্যন্ত আর্টিস্ট অজয় চাটুজ্জে গলাটা সাফা করে নিয়ে বলেন, আমি চিনি। ইন ফ্যাক্ট, ওখান থেকেই আসছি আমি। আমি কাল রাত্রে ঐ হোটেলে ছিলাম, রুম নম্বর একুশে।
 

-- তাই নাকি! তা এতবড় খবরটা শোনেননি?-- প্রশ্নটা পেশ করেন আলি-সাহেব।
 

অজয়বাবু একটু নড়ে-চড়ে বসেন। বলেন, শুনব না কেন, শুনেছি। তাই তো চলে এলাম এখানে। ওখানে আর ছবি আঁকার পরিবেশ নেই। সওয়াল-জবাব শুরু হয়ে গেছে!
 

কৌশিক বলে, কী আশ্চর্য! এতক্ষণ তো আমাদের বলেননি কিছু?
 

-- কী বলব? এটা কি একটা বলার মত কথা? আমরা এখানে এসেছি পাহাড় দেখতে, বেড়াতে, স্ফূর্তি করতে। তার মধ্যে দারোগা-খুনের খবরটা জনে জনে বলে বেড়াতে হবে তার অর্থ কী?
 

-- দারোগা! যে লোকটা মারা গেছে সে কি পুলিশের দারোগা ছিল?-- প্রশ্নটা আবার পেশ করেন আলি-সাহেব।
 

বাসু-সাহেব অরূপরতনের দিকে ফিরে বলেন, রমেন গুহকে মনে আছে অরূপ?
 

-- নাট্যামোদী রমেন দারোগা? আলবৎ। কেন কী হয়েছে তার?
 

-- রমেন বদলি হয়ে এসেছিল দার্জিলিঙে। গতকাল বেলা বারটার সময় সে এসে ওঠে এ হোটেল কাঞ্চনজঙ্ঘায়। আর আজ সকাল পৌনে ছয়টায় তার মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়েছে। তার নিজের ঘরে, রুদ্ধদ্বার কক্ষে। এ কেস অব পয়েজনিং! ওর ফ্লাস্কে কেউ পটাসিয়াম সায়ানাইড ফেলে গেছে!
সকলে ঘনিয়ে আসে। বিস্তারিত জানতে চায় ঘটনাটা। যতদূর জানা ছিল বাসু-সাহেব আনূপূর্বিক বলে যেতে থাকেন। মাঝে মাঝে পাদপূরণ করছিলেন রানী দেবী। ইতিমধ্যে সুজাতাও মাঝে মাঝে এসে দাঁড়াচ্ছে। আবার ফিরে যাচ্ছে রান্নাঘরে। রমেন গুহ সুজাতার বিশেষভাবে পরিচিত। বাসু-সাহেব সব কথারই উল্লেখ করলেন। কিন্তু জানালেন না দু'টি সংবাদ। তেইশ নম্বর ঘরে আশট্রে থেকে উদ্ধার করা সিগ্রেটের টুকরার কথা, আর বাইশ-নম্বরের ওয়েস্টপেপার বাস্কেটের কাগজের কথাটা।
 

আলি-সাহেব বলে, এ মহম্মদ ইব্রাহিমের চেহারার কী বর্ণনা পেলেন?
 

সন্ধানী দৃষ্টি মেলে বাসু-সাহেব বললেন, হাইট এবং স্ট্রাকচার এই ধরুন প্রায় আপনার মত। তবে লোকটার দাড়ি ছিল এবং চোখে চশমা ছিল --
আলি হেসে বললে, ভাগ্যে আমার তা নেই! না হলে আপনারা হয়তো আমাকেই সন্দেহ করতেন। আমি তো কাল রাত্রে এসে পৌঁছেছি, ইব্রাহিম-সাহেব চেক-আউট করবার ঘণ্টা খানেক পরে।
 

-- এবং লোকটা পাইপ খেত! --পাদপূরণ করেন বাসু-সাহেব।
 

-- পাইপ খেত! সেরেছে! -- জ্বলন্ত পাইপটা নিয়ে আলি-সাহেব অভিনয় করেন যেন তিনি অত্যন্ত বিড়ম্বিত--কোথায় পাইপটা লুকোবেন ভেবে পাচ্ছেন না।
 

কাবেরী বলে, মিস্টার আলি, আপনার ভয় নেই। বাসু-সাহেব নিজেও পাইপ খান!
 

-- থ্যাঙ্কু! থ্যাঙ্কু! ভাগ্যে মনে করিয়ে দিলেন! --আলি-সাহেব পাইপ টানতে থাকেন আবার।
 

-- আর মিস্‌ ডিক্রুজা? --এবার জানতে চায় অরূপ।
 

প্রশ্নকর্তার দিকে না তাকিয়ে বাসু-সাহেব সরাসরি তাকালেন কাবেরী দত্তগুপ্তার দিকে। যেন তারই একটা দৈহিক বর্ণনা দেখে দেখে দিচ্ছেন সেইভাবে বলে গেলেন, হাইট -- মাঝারি, রঙ -- ফর্সা, বয়স কত হবে? এই ধরুন সাতাশ-আঠাশ! সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী। মাপ নাকি -- 34-28-32।
কাবেরীকে প্রথমটায় একটু নার্ভাস লাগছিল, কিন্তু শেষ বর্ণনাটায় সে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। রানীদেবীকে বলে, মামীমা, একটু সাবধানে থাকবেন! মামা যেভাবে মেয়েদের দেখা মাত্র তাদের ভাইট্যাল- স্ট্যাটিসটিক্স বুঝে ফেলছেন--
 

রানী বললেন, উনি মিস্‌ ডিক্রুজাকে দেখেননি। শোনা কথা বলছেন!
 

আলি-সাহেব রসিকতা করে, কী দাদা কানে শুনেই এই? চোখে দেখলে --
বাধা দিয়ে রানী বলে ওঠেন, উনি আর একটা কথা বলতে ভুলেছেন! মিস্‌ ডিক্রুজা ভার্মিলিয়ান রঙের লিপস্টিক ব্যবহার করে! তবে তোমার ভয় নেই কাবেরী, তুমি একাই তা করনি, সুজাতাও তাই করে। এ দেখ--
সুজাতা তখনই এসে দাঁড়িয়েছে পিছনের দরজায়।
 

চিত্রকর অজয় চাটুজ্জে এতক্ষণ কোন কথা বলেননি। আপন মনে একটা ম্যাগাজিনের পাতা উলটে যাচ্ছিলেন। তাঁর দিকে ফিরে বাসু-সাহেব এবার বলেন, আচ্ছা চাটুজ্জেমশাই, আপনি কি একুশ নম্বর ঘরটা ছেড়ে আজ বাইশ নম্বরে আসতে চেয়েছিলেন?
 

-- উঁ? -- চমকে বই থেকে মুখ তুলে অজয়বাবু বলেন, --আমাকে বলছেন?
প্রশ্নটা দ্বিতীয়বার পেশ করেন বাসু-সাহেব।
 

গুছিয়ে জবাব দেবার জন্যই প্রশ্নটা দ্বিতীয়বার শুনতে চাইলেন কি না বোঝা গেল না, চাটুজ্জে মশাই জবাবে বললেন, হ্যাঁ! চেয়েছিলাম। আমার একুশ নম্বর ঘর থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার আনডিস্টার্বড ভিয়ু পাওয়া যাচ্ছিল না, তাই--
 

-- তাহলে শেষ পর্যন্ত মহম্মদ ইব্রাহিমের ঘরটা নিলেন না যে?
 

--ঐ যে বললাম--আমি ও-ঘরে শিফট করার আগেই পুলিসে এসে ঘরটা তল্লাশী করল। ভাবলাম --'বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা'। মানে মানে সরে পড়লাম ওখান থেকে--
 

মহম্মদ ইব্রাহিম ঘরটা ছেড়ে যাবার পর আপনি ঐ ঘরটা দেখতে গিয়েছিলেন, নয়?
 

-- হ্যাঁ গিয়েছিলাম। দেখতে গিয়েছিলাম ও-ঘরের জানলা থেকে কাঞ্জনজঙ্ঘা কেমন দেখতে পাওয়া যায়। মিনিটখানেক ও-ঘরে ছিলাম আমি। কিন্তু, কেন বলুন তো?
 

-- আচ্ছা, মিস্টার চ্যাটার্জি, এমনও তো হতে পারে এ এক মিনিটের ভিতর কোন অপ্রয়োজনীয় জিনিস আপনি ঐ ঘরের ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে ফেলে দেন? যেমন ধরুন, খালি দেশলাইয়ের বাক্স, পুরানো ক্যাশমেমো অথবা দলাপাকানো একটা কাগজ--
 

হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান অজয় চাটুজ্জে। কৌশিকের দিকে ফিরে বলেন, আজ রাত হয়ে গেছে; কাল সকালেই আপনার বিলটা পাঠিয়ে দেবেন। আমি চেক-আউট করব।
 

অরূপ বলে ওঠে, কী হল মশাই? রাগ করছেন কেন?
 

-- রাগ নয়! আমার এসব বরদাস্ত হয় না --এই গোয়েন্দাগিরি আর পুলিসী প্যাঁচ! আমি একটু আনডিস্টার্বড থাকতে চাই। একানেও সওয়াল-জবাব শুরু হয়ে গেছে --
 

রীতিমত রাগ করেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান অজয়বাবু।
 

অরূপ একটু ঝুঁকে বসে। বাসু-সাহেবকে প্রশ্ন করে, কী ব্যাপার স্যার? এ ইব্রাহিমের ঘরের ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে কিছু মালঝাল পাওয়া গেছে না কি?
 

বাসু-সাহেব পাইপটায় কামড় দিয়ে বলেন, কী দরকার অরূপ, ওসবের মধ্যে আমাদের যাবার? আমরা এসেছি পাহাড় দেখতে, বেড়াতে আর স্ফূর্তি করতে! কী বলেন?
 

দর্শকদলের উপর একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নেন উনি। আলি কী একটা কথা বলতে গেল। তারপর কাবেরীর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই চুপ করে গেল হঠাৎ।
 

বাসু-সাহেব অরূপরতনকেই পুনরায় প্রশ্ন করেন, একটা কথা আমাকে বলতো অরূপ --ঐ নকুল হুইয়ের কেসটায় তুমি কি ডিফেন্স কাউন্সিলার ছিলে? কেসটার খবর আর আমি কিছু নিইনি।
 

-- না। আমি সরকার পক্ষে ছিলাম।
 

কৌশিক অবাক হয়ে বলে, সরকার পক্ষে! সে কি? মার্ডার কেসে তো পাবলিক প্রসিকিউটার থাকেন সরকার পক্ষে --
 

-- তাই থাকেন।-- বুঝিয়ে বলে অরূপ --নকুল হুইয়ের কেসটায় আমাকে সরকার পক্ষ থেকেই পি.পি.-র সহকারী হিসাবে নিযুক্ত করা হয়।
 

-- তাই নাকি? এ খবর তো বলনি আমাকে?--বাসু-সাহেব বলে ওঠেন।
বলার সুযোগ পেলাম কোথায়? আপনি তো দীর্ঘদিন না-পাত্তা।
 

-- তাহলে তুমিই হচ্ছ নকুল হুইয়ের দু-নম্বর শত্রু?
অরূপ অবাক হয়ে বলে, তার মানে? নকুল হুই তো মরে ভূত!
 

-- জানি। কিন্তু শুনেছি নকুল সুপ্রীম কোর্ট পর্যন্ত লড়েছিল। এত মামলা-লড়ার খরচ সে পেল কোথায়?
 

আলি বাধা দিয়ে বলে ওঠে --মাপ করবেন ব্যারিস্টার-সাহেব, নকুল হুই চরিত্রটা এখনও এস্ট্যাব্লিশড হয়নি। আমরা কাহিনীর ঠিক রসাস্বাদন করতে পারছি না।
 

কৌশিক এবং অরূপ ভাগাভাগি করে পূর্ব-কাহিনীর মোটামুটি একটা খসড়া পেশ করে। অরূপরতন উপসংহারে বলে, নকুল হুই লোকটাকে আমরা ঠিকমত চিনতে পারিনি। দীর্ঘদিন, ধরে সে আগরওয়াল ইন্ডাস্ট্রিজ-এ বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। অনেক টাকা সে তলে তলে সরিয়েছিল --যেকথা শেষপর্যন্ত জেনে যেতে পারেনি ময়ূরকেতন আগরওয়াল। নকুল থাকত নিতান্ত গরিবের মত --কিন্তু বেশ পুঁজি জমিয়ে ফেলেছিল সে। এমনকি ওর এক ভাইকে নাকি আমেরিকা পাঠিয়েছিল খরচ দিয়ে! ভাইটিও দাদার উপযুক্ত! মার্কিন-মুলুকে নাকি নামকরা গ্যাংস্টার হয়েছিল শেষ পর্যন্ত। সেই ভাইই ওর মামলার খরচ দেয়। শুনেছি, ফাঁসির দিন মার্কিন-মুলুক থেকে ওর সেই ভাই চলে এসেছিল ভারতবর্ষে!
 

বাসু-সাহেব নির্বাপিত পাইপটি ধরাতে ধরাতে বলেন, কী নাম নকুলের ভায়ের! সহদেব নাকি?
 

-- হ্যাঁ, আপনি কেমন করে জানলেন?
 

-- জানি না। আন্দাজ করছি। এপিক্যাল ইনফারেন্স --মানে মহাভারতের এ রকমই নির্দেশ! তা সেই সহদেব বাবাজীবনের দৈহিক বর্ণনাটা কী? --কাবেরীর দিকে ফিরে যোগ করেন, যাকে বলে ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স আর কি!
 

-- আমি জানি না। সহদেবকে আমি স্বচক্ষে কোনদিন দেখিনি, বলে অরূপ।
সুজাতা এই সময় এসে ঘোষণা করে, ডিনার রেডি!
সভা ভঙ্গ হল!


আহারাদি মিটতে যার নাম দশটা। ইতিমধ্যে, এক মুহূর্তের জন্যও বৃষ্টি থামেনি। ক্রমাগত বর্ষণ হয়ে চলেছে। খরস্রোতা উপলবন্ধুর জলধারা পাহাড়ের মাথা থেকে সর্পিল গতিতে ছুটে আসছে সমতলের সন্ধানে! বাতি এখনও জ্বলছে। যে কোনও মূহূর্তে ইলেকট্রিক অফ্‌ হয়ে যেতে পারে। সুজাতা ঘরে ঘরে মোমবাতি রেখে এসেছে। আহারাদি মিটিয়ে যে যার ঘরে চলে গেছেন। কৌশিকও শুতে যাবার উপক্রম করছে এমন সময় এসে উপস্থিত হলেন রাতের শেষ অতিথি!
 

আবার একটি ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল পোর্চে।
 

সুজাতা আর কৌশিক দরজা খুলে বেরিয়ে এল বাইরের বারান্দায়। ট্যাক্সি থেকে নেমে এলেন একজন মাঝ-বয়েসি ভদ্রলোক। গাড়ির ভিতর বসেছিলেন আর একজন সুবেশিনী সুন্দরী মহিলা।
 

ভদ্রলোক নমস্কারের ভঙ্গিতে হাতদুটি এক করে বললেন, রাতটুকুর মত তলায় একখানা করে বালিশ আর উপরে একখানা পাকা ছাদ মিলবে?...আই মীন, আমি আমাদের মাথার কথা বলছি।
 

কৌশিক প্রতিনমস্কার করে বলে, এমন দুর্যোগের রাত্রে কোন গৃহস্থ 'না' বলতে পারে?
 

এ গাড়ির ভিতর থেকে এক-গা-গহনা বলে ওঠেন, তুমি চুপ কর দিকিনি!
 

কৌশিক আঁৎকে ওঠে, আমায় বলছেন?
 

ভদ্রলোক একগাল হেসে বলেন, আজ্ঞে না, আমায়। ডায়ালগটা ছাড়তে একটু দেরী হয়েছে ওঁর...আই মীন, আপনার ডায়লগের আগে ওঁর ডায়লগ! ...ই'য়ে উনি, মানে আমার বেটার-হাফ!
 

ভদ্রমহিলা সে কথায় কর্ণপাত না করে এবার সরাসরি কৌশিককে প্রশ্ন করেন, এটা হোটেল তো?
 

কৌশিক সম্মতিসূচক গ্রীবা সঞ্চালন করে।
 

-- তবে গৃহস্থের কথা উঠছে কেন? ডবল্ বেডরুম হবে?
 

কৌশিক জবাব দেবার আগেই উপরের ধাপ থেকে সুজাতা বলে, হবে না!
 

ভদ্রমহিলা সুজাতাকে আপাদমস্তক দেখে নেন একবার। তারপর তাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে কৌশিককেই পুনরায় প্রশ্ন করেন, অন্তত দুটো আলাদা সিঙ্গল সিটেড?
 

কৌশিক যেন শ্রুতিধর। সুজাতার দিকে ফিরে বলে, অন্তত দুটো আলাদা সিঙ্গল সিটেড?
 

ভদ্রমহিলা ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন। কৌশিক নিরুপায় ভঙ্গিতে ভদ্রলোককে যেন কৈফিয়ৎ দেয়, উনি হলেন গিয়ে আবার আমার বেটার-হাফ।
 

ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলা অগত্যা সুজাতার দিকে তাকান।
 

সুজাতা একই ভাবে বললে, হবে না!
 

ভদ্রলোক শ্রাগ করলেন। সুজাতা তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললে, তবে নিচে একখানা করে বালিশ এবং উপরে একখানা পাকা ছাদ হতে পারে --
ভদ্রলোক চমকে তাকান সুজাতার দিকে।
 

সুজাতা পাদপূরণ করে, আই মীন, আমি আপনাদের মাথার কথা বলছি।
 

-- এনাফ! --সোৎসাহে ভদ্রলোক মালপত্র নামাবার উদ্দেশ্যে পিছনের কেরিয়ারটা খুলে ফেললেন। কৌশিক হাত লাগায়। সুজাতাও। এক-গা-গহনা শুধু নিজের ভ্যানিটি ব্যাগটা নিয়ে নেমে আসেন। মালপত্র টানাটানিতে তার কোন ভূমিকা ছিল না।
 

কৌশিক কাজ করতে করতেই বলে, আপাতত আসছেন কোথা থেকে?
--Scylla আর Charybdis-এর মধ্যবিন্দু থেকে --মাল নামাতে নামাতে জবাব দেন ভদ্রলোক।
 

-- আজ্ঞে? --কৌশিক ব্যাখ্যা চায়।
 

-- 'হর্নস্‌ অব দ্য ডাইলেমা' বোঝেন? তারই কেন্দ্রবিন্দু থেকে। এদিকে কার্শিয়াঙের পথে এক বিরাট খাদ, ওদিকে দার্জিলিঙের রাস্তায় এক হোঁড়ল গর্ত! মাঝখানে স্যান্ডুইচ হয়ে পড়েছিলাম। অবস্থাটা বুঝতে পারছেন?
 

-- জলের মত। মহারাজ ত্রিশঙ্কুর অবস্থা আর কি। ঘুম শহরের এই হাল হয়েছে তা আমরা এখনও টের পাইনি!
 

-- আমরা পেয়েছি। অস্থিতে অস্থিতে। দার্জিলিঙ থেকে কলকাতা যাচ্ছিলাম। বাধা পেয়ে আবার ফিরে যাচ্ছিলাম দার্জিলিঙে। দুদিকেই রোড ক্লোসড।
খানকয়েক দশ টাকার নোট বার করে দিলেন তিনি ট্যাক্সি ড্রাইভারকে, বললেন, তোড়ানি রাখ্‌ দো ভাইসাব, -- তোমার অবস্থাও তো সসেমিরা! আপাতত ঘুমের রাজ্যে কোথায় ঘুমাবে দেখ!
 

একগাল হেসে ড্রাইভার ব্যাক করল ট্যাক্সিটা।
 

দ্বিতলের ছয় নম্বর ঘরটা খুলে দিল সুজাতা। এটা সাজানো নেই, ভাড়া দেওয়ার কথা ছিল না। এক-গা-গহনা এক নজর ঘরটা দেখে নিয়ে বললেন, ও রাম! পর্দা নেই, বেডকভার নেই, ড্রেসিং টেবিল নেই -- গুদাম ঘ্বর নাকি?
কৌশিক আমতা আমতা করে বলে, আজ্ঞে না। এটা সবচেয়ে ভাল ডবল্‌ বেডরুম। আকাশ ফাঁকা হলে ঘরে বসেই কাঞ্চনজঙ্ঘার ভিয়ু পাবেন। তবে ইয়ে...এটা ভাড়া দেওয়ার কথা ছিল না। বেডিং পাঠিয়ে দিচ্ছি; কিন্তু পর্দা বা ড্রেসিং টেবিল দিতে পারব না।
 

ভদ্রমহিলা আড়চোখে একবার সুজাতাকে দেখে নিয়ে বলেন, ভাড়া বোধকরি পুরোই নেবেন?
 

ভদ্রলোক তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, আহাহা ভাড়ার কথা কাল হবে। ইয়ে, আপনাদের কিচেন বোধকরি ক্লোসড্‌ হয়ে গেছে?
 

কৌশিক সুজাতার দিকে একটা চোরা চাহনি নিক্ষেপ করে বলে, আজ্ঞে হ্যাঁ। রাত তো বড় কম হয়নি! সব ছুটি হয়ে গেছে। তবে হেড কুক বোধহয় এখনও জেগে আছে, নয়? --শেষ প্রশ্নটা সুজাতাকে।
 

সুজাতা দাঁতে দাঁত চেপে বললে, হেড-বেহারাও জেগে আছে মনে হয়।
 

-- অ! কৌশিক ঢোক গেলে!
 

ভদ্রলোক সুজাতার দিকে ফিরে বলেন, লোকে খেতে পেলে শুতে চায়....আই মীন, শুতে পেলে খেতে চায়! হবে কিছু? শুকনো বিস্কুট অবশ্য কিছু আছে আমাদের সঙ্গে।
 

সুজাতা বললে, ডবল-ডিমের অমলেট আর কফি হতে পারে।
 

--এনাফ! এনাফ! --ভদ্রলোক খুশিয়াল হয়ে ওঠেন।
 

তাঁকে আবার থামিয়ে দিয়ে গহনা-ভারাক্রান্তা বলে ওঠেন, তুমি থাম! তারপর কৌশিকের দিকে ফিরে বলেন, তাই বলে রাতের ফুল-মীল চার্জ করবেন না তো?
 

সুজাতা যাবার জন্যে পা বাড়িয়েছিল। দ্বারের কাছে ফিরে দাড়িয়ে বলে, ফুল-মীলই চার্জ করা হবে। অসুবিধা থাকে তো দরকার কি?
 

ভদ্রমহিলাও ঘুরে দাঁড়ালেন। দুই বেটার-হাফ দুজনকে দেখে নিলেন। দুই ওয়ার্স-হাফ কণ্টকিত হয়ে ওঠেন। ভদ্রমহিলা কৌশিককে প্রশ্ন করেন, হোটেলের ম্যানেজার কে?
 

-- ইয়ে, আমি! -- কবুল করে কৌশিক।
 

-- তবে সব কথায় উনি অমন চ্যাটাং চ্যাটাং করছেন কেন?
 

কৌশিক আমতা আমতা করে বলে, উনি যে আমার এমপ্লয়ার, হোটেলের মালিক!
 

ভদ্রলোক একগাল হেসে বলেন, আই ফলো!--স্ত্রীকে বলেন, এই তুমি যেমন আমার গার্জেন আর কি? --সুজাতাকে বলেন, তা ফুল-মীল চার্জই দেব। কিচেন যখন বন্ধ হয়ে গেছে তখন এক্সট্রা চার্জ দিতে হবে বই কি। আমার জন্য এক প্লেট পাঠিয়ে দিন। আর ইয়ে....ওঁর যখন এত আপত্তি, উনি না হয় বিস্কুটই খাবেন রাত্রে।
 

-- থাম তুমি! ডাকাতের হাতে যখন পড়েছি, তখন নাচার! --মহিলা ক্ষুব্ধা!
 

-- আমিও তো তাই বলছি-- যাহা বাহান্ন তাহা পঁয়ষট্টি! ও --দু' প্লেটই পাঠিয়ে দিন! আর কড়া দু-কাপ কফি!
 

-- না এক কাপ কফি, এক কাপ চা। রাতে কফি খেলে ওঁর ঘুম হয় না!
 

-- নিরুপায় ভদ্রলোক শ্রাগ করলেন শুধু।
 

সুজাতা নেমে আসে কিচেন-ব্লকে। ভদ্রলোক পকেট থেকে নামাঙ্কিত একটা আইন্ডরি-ফিনিশড কার্ড বার করে কৌশিককে দেন। বলেন, আমার নাম ডঃ এ.কে. সেন, প্রাইভেট প্রাকটিশনার। আপনার রেজিস্টারে কাল সকালে সই করে দেব কেমন?
 

কৌশিকও নেমে আসে। পায়ে পায়ে এসে হাজির হর কিচেন ব্লকে। সুজাতা গুম মেরে আছে। কাল থেকেই তার কী যেন হয়েছে। কৌশিক ইতস্তত করে। ঘুরঘুর করে--সান্ত্বনাবাচক কী বলবে ভেবে পায় না। সুজাতা বলে, ডিমটা ফাটাও!
 

-- ফর্ক দিয়ে ডিমগুলো ফাটাতে ফাটাতে কৌশিক একটা স্বগতোক্তি করে-- প্রমোশনই হল আমার! স্বাধীন ব্যবসা! বিয়ের আগে ছিলাম হুজুরাইন-এর ড্রাইভার, বিয়ের পরে হলাম হেড-বেয়ারা।
 

সুজাতা হাসল না পর্যন্ত!
 

-- ওরা ভেবেছিল কর্মব্যস্ত উদ্বোধনের দিনটার বুঝি এখানেই সমাপ্তি। ভুল ভেবেছিল। হেড-কুক অমলেট নিয়ে, আর হেড-বেয়ারা কফি ও চা নিয়ে দ্বিতলে যখন পৌঁছে দিয়ে এল, ভদ্রলোক তখন সৌজন্য দেখিয়ে বললেন, সো সরি! আপনাদের চাকর-বেয়ারা পর্যন্ত শুয়ে পড়েছে দেখছি। খুব কষ্ট দিলাম আপনাদের।
 

সুজাতা অম্লান বদনে বললে, সঙ্কুচিত হবার কী আছে? এক্সট্রা চার্জ তো সেই জন্যেই দিচ্ছেন!
 

শুভরাত্রি জানিয়ে ওরা নিজেদের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। ঠিক তখনই ঝনঝন্‌ করে বেজে উঠল টেলিফোনটা। ঘড়ির দিকে নজর গেল স্বভাবতই। রাত পৌনে এগারোটা।
 

দুজনেই নেমে আসে আবার সুজাতাই তুলে নিল টেলিফোনটা হ্যালো! রিপোস হোটেল।.. হ্যাঁ, আছেন। কোথা থেকে বলছেন?
 

শুনে নিয়ে সুজাতা কৌশিককে বলে, তোমাকে খুঁজছে। ও-সি. সদর, দার্জিলিঙ।
 

-- থানা! কেন কী হল আবার? শঙ্কিত কৌশিকের প্রশ্ন।
 

-- কী হল তা নিজের কানে শোন! -- রিসিভারটা হস্তান্তরিত করে সুজাতা পা বাড়ায়। যায় না কিন্তু। অপেক্ষা করে।
 

-- কৌশিক মিত্র বলছি। কে বলছেন?
 

--নৃপেন ঘোষাল। ও.সি. দার্জিলিঙ সদর। ব্যারিস্টার সাহেব জেগে আছেন?
 

-- না। ঘুমোচ্ছেন। কেন কী হয়েছে? ডেকে দেব?
 

-- না থাক। তাহলে আপনাকেই বলি। সব কথা টেলিফোনে বলা যাবে না। আকারে ইঙ্গিতে বলব-- বুঝে নেবেন। শুনুন: ব্যারিস্টার-সাহেবের কাছে শুনেছেন নিশ্চয় আজ সকালে দার্জিলিঙ-এর একটি হোটেলে--
 

--হ্যাঁ, জানি, কাঞ্চনজঙ্ঘায়--
 

প্রায় ধমক দিয়ে ওঠে নৃপেন ঘোষাল, প্লিজ ডোন্ট মেনশন এনি নেম!...শুনুন! আশঙ্কা করার যথেষ্ট কারণ ঘটেছে যে, সন্দেহভাজন লোকটা এখন ঘুমে আছে, রিপোস্-এর কাছাকাছি। হয়তো রিপোস্-এর ভিতরেই! দ্বিতীয়ত যে ঘটনা দার্জিলিঙে ঘটেছে অনুরূপ একটি ঘটনা হয়তো ঘুমে ঘটতে যাচ্ছে। হয়তো রিপোস্‌-এর ভিতরেই! ফলো?
 

কৌশিক অকপটে স্বীকার করে, না! আমি মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না!
 

-- পারছেন! বিশ্বাস করতে পারছেন না, তাই নয়? --না বোঝার কী আছে?
 

-- এমন সব অদ্ভুত কথা অনুমান করার হেতু?
 

-- সেকথা টেলিফোনে বলা যায় না।...শুনুন....আজ রাতেও আপনাদের ওখানে ঐ জাতীয় ঘটনা ঘটতে পারে। খুব সতর্ক থাকবেন। বুঝলেন?
 

কৌশিক বিহ্বল হয়ে বলে, একটু ধরুন। আমার স্ত্রীর সঙ্গে একটু পরামর্শ করে ফের আপনার সঙ্গে কথা বলছি।
 

টেলিফোনের মুখে হাত চাপা দিয়ে অত্যন্ত সংক্ষেপে কৌশিক সুজাতাকে ব্যাপারটা জানায়। সুজাতা ওর হাত থেকে টেলিফোনটা নিয়ে তার মাউথপীসে বলে, মিসেস্‌ মিত্র বলছি। আপনার কথা আমরা বুঝতে পেরেছি। কিন্তু বড় 'ইনসিকিওর্ড' বোধ করছি। কিছু করা যায়?
 

ওপ্রান্ত ইতস্তত করে বলে, মুশকিল কী জানেন, কার্ট-রোড ভেঙে গেছে। ঘুম আউটপোস্টে ব্যাপারটা আমি টেলিফোনে জানিয়েছি। ওরা ওয়াচ রাখবে। আপনারা ওখান থেকে পারতপক্ষে কোন টেলিফোন কল ইনিশিয়েট করবেন না।
 

মরিয়া হয়ে সুজাতা বলে, থানা থেকে কেউ এসে থাকতে পারে না, আজ রাত্রে?
 

ওখানকার লোকাল ফাঁড়িতে তেমন লোক কেউ নেই।...আচ্ছা এক কাজ করছি...আমার একজন অফিসারকে পাঠাচ্ছি। মিস্টার পি.কে. বাসু, তাকে চেনেন। এখান থেকে জীপে বাতাসিয়া লুপ পর্যন্ত যাবে, বাকি পথ হেঁটে যাবে। আপনারা জেগে থাকবেন, যাতে কলিং বেল বাজাতে না হয়।
 

-- ধন্যবাদ। কী নাম বলুন তো তাঁর?
 

-- সুবীর রায়!
 

ক্লান্ত অবসন্ন দেহে ওরা অপেক্ষা করতে থাকে। ঘড়ির কাঁটা টিক টিক করে এগিয়ে চলেছে। আর বাইরে একটানা ধারাপাত। আর কোথাও কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না! বোর্ডাররা যে-যার ঘরে ঘুমে অচেতন। শেষ বাতি নিবেছে ডাক্তার সেন-এর ঘরে। তাও আধঘণ্টা হয়ে গেল। ড্রইংরুমের ঘড়িটা সাড়ে এগারোটায় ঢং করে সাড়া দিল। সারা ঘুম ঘুমে অচেতন।
 

কৌশিক বললে, যাও তুমি শুয়ে পড়! আমি জেগে আছি।
 

সুজাতা জবাবে বলে, শুয়ে লাভ নেই! ঘুম হবে না। আর আধঘন্টার মধ্যেই এসে পড়বেন মনে হয়।ওর অনুমানই ঠিক। রাত বারোটায় সদর দরজার কাঁচের উপর একটা টর্চের আলোর সঙ্কেত হল।
 

নিঃশব্দে উঠে গেল কৌশিক। পাল্লাটা একটু খুলে প্রশ্ন করল, কে?
 

-- সুবীর রায়!
 

-- আসুন।
 

আগন্তুক ভিজা বর্ষাতিটা খুলে ফেলে। দীর্ঘ বলিষ্ঠ চেহারা। বয়স ত্রিশের কোঠায়। হাতে একটা অ্যাটাচি। ওদের উপর দৃষ্টি বুলিয়ে বললে, মিস্টার আর মিসেস্‌ মিত্র নিশ্চয়?
 

কৌশিক ঘাড় নেড়ে জানায় ওর অনুমান সত্য।
 

-- কোন্‌ ঘরে আমি থাকব দেখিয়ে দিন। কাল সকালে কথা হবে।
 

-- কিন্তু ব্যাপারটা কী?
 

-- কেন? ও.সি, বলেননি টেলিফোনে?
 

-- বলেছেন। সংক্ষেপে। টেলিফোনে তো সব কথা বলা যায় না। এমন আশঙ্কা করার কারণটা কী?
 

-- সেটা কাল সকালে বলব। আপনাদের জেগে থাকার কোন প্রয়োজন নেই। যা করার আমিই করব। কিন্তু থাকব কোন ঘরে?
 

--আসুন দেখিয়ে দিচ্ছি।
 

কৌশিক ওকে ঘরটা দেখিয়ে দিল। এক তলার চার নম্বর ঘর। সুজাতাও এল পিছন পিছন। ঘরে ঢুকেই সুবীর দরজাটা বন্ধ করে দেয়। অ্যাটাচি কেসটা খুলে একটা ম্যাপ বার করে। বলে, এটা এ বাড়ির প্ল্যান। আমরা আছি এই ঘরে। এবার বলুন -- কে কোন ঘরে আছেন?
 

কৌশিক অবাক হয়ে বলে, আমাদের হোটেলের প্ল্যান পেলেন কোথায়?
 

সুবীর বিরক্ত হয়ে বলে, অবান্তর কথা বলে রাত বাড়ানোর দরকার আছে কি?
-- কৌশিক আর প্রশ্ন করে না। উপস্থিত আবাসিকদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়, আর কে কোন ঘরে আছেন তা প্ল্যানে দেখিয়ে দিতে থাকে। সুবীর প্ল্যানের গায়ে নামগুলি লিখে নিল। তারপর বললে, গুড নাইট!



অসহিষ্ণুর মত কৌশিক বলে, একটা কথা অন্তত বলুন --দার্জিলিঙে যে ঘটনা ঘটছে তা হঠাৎ রিপোস-এ ঘটতে পারে এমন ধারণা কেন হল আপনাদের?
কাগজটা ভাঁজ করে পকেটে রাখতে রাখতে সুবীর বললে, বিশে ডাকাতের নাম শুনেছেন?
 

-- না। কে সে?
 

-- কিংবদন্তীর বিশে ডাকাত! সে নাকি ডাকাতি করতে বার আগে নোটিস দিয়ে আগেভাগেই জানিয়ে দিত। রমেনবাবুকে যে মেরেছে সে ঐ বিশে-ডাকাত-এর উত্তরসূরী! সেও অমন চিঠি লিখে জানিয়ে দিয়েছে তার সেকেন্ড টার্গেট আছে ঘুম-এ, ঘুম-এর এই রিপোস্‌ হোটেলে?
 

সুজাতা বলে, কী বলছেন আপনি! বিংশ শতাব্দীর কোন ক্রিমিনাল এমন মূর্খামি করে?
 

-- তাই তো দেখা যাচ্ছে। মূর্খামি নয়-- লোকটা ওভার-কনফিডেন্ট! ইচ্ছা করেই সে এটা করেছে! খুনীর একমাত্র উদ্দেশ্য প্রতিশোধ নেওয়া! যাকে প্রাণে বধ করবে তাকে আগে-ভাগে জানিয়ে না দিলে যেন তার তৃপ্তি হচ্ছে না। লোকটা অত্যন্ত পাকা ক্রিমিনাল। আমেরিকায় বাফেলো-অঞ্চলে গ্যাংস্টার দলে তার নাম আছে। বেঙ্গল পুলিসের এই আমাদের সে মনে করে চুনোপুঁটি!
 

-- লোকটা কে তা আপনারা জানতে পেরেছেন?
 

-- অন্তত নামটা আন্দাজ করা গেছে। তার নাম সহদেব হুই।
 

সুজাতার মুখটা ছাইয়ের মত সাদা হয়ে যায়, সহদেব হুই! নকুল হুইয়ের ভাই?
 

-- হ্যাঁ। তাই আমাদের অনুমান।
 

একটু ইতস্তত করে সুজাতা বলে, ওর সেকেন্ড টার্গেট কে জানেন?
 

সুবীর হেসে ফেলে। না। সহদেব আমাকে বলেনি। তবে নকুল হুইয়ের মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী তাদের মধ্যেই কেউ একজন হবেন। আপনারা আন্দাজ করতে পারেন?
 

কৌশিক গম্ভীর হয়ে বলে, পারি! ব্যারিস্টার পি. কে. বাসু!
 

সুবীর হেসে বললে, তাও ভাল। আপনাদের মুখ দেখে আমি কিন্তু ভেবেছিলাম বুঝি আপনাদের দুজনের কেউ।

পঞ্চম পর্ব

 

তেশরা অক্টোবর। বৃহস্পতিবার। বৃষ্টির বিরাম নেই। ক্রমাগত বর্ষণে চরাচর বিলুপ্ত। এদিকে আজ সকাল থেকে “দা রিপোস' রীতিমত হোটেলে রূপান্তরিত হয়েছে। সকালবেলা আবাসিকেরা যখন প্রাতরাশ টেবিল-এ এসে বসলেন তখন নবাগতদের সঙ্গে তাঁদের পরিচয় করিয়ে দেবার কথা মনে হল না কৌশিকের। কালীপদ খাড়া হয়েছে। জ্বর নেই তার। ভোরবেলা থেকে সুজাতার হাতে হাতে কাজ করছে। বৃষ্টি সত্বেও কাঞ্চী এসেছে ভিজতে ভিজতে। বর্ষাবিধ্বস্ত বস্তির একটি মর্মন্তুদ বর্ণনা সে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল, কিন্ত সুস্থির হয়ে শুনবার অবকাশ ছিল না সুজাতার। সে ক্রমাগত টোস্ট-পোচ-অমলেট আর হাফ-বয়েল বানিয়ে চলেছে ফরমায়েশ মত। কাঞ্চী আর কালীপদ পর্যায়ক্রমে পৌঁছে দিয়ে আসছে চা আর কফি। হোটেল জমে উঠেছে।
 

আবাসিকরা দেখলেন দু'টি নতুন মুখ। ডঃ সেন আর সুবীর রায়। মিসেস সেনকে অবশ্য দেখতে পেলেন না ওঁরা। তিনি তাঁর দ্বিতলের কামরা থেকে নামলেন না আদৌ। তাঁর ব্রেকফাস্ট কাঞ্চী পৌঁছে দিয়ে এল দ্বিতলের ছয় নম্বর ঘরে। বোধকরি এই সাতসকালে তাঁর যথোপযুক্ত প্রসাধন সারা হয়নি -- তাই তিনি এই শঙ্কুবৃত্তি অবলম্বন করলেন।
 

সকালে উঠে প্রথম সুযোগেই কৌশিক বাসু-সাহেবের সঙ্গে দেখা করে। গতকাল রাত্রে যে তিনজন নবীন অতিথির আবির্ভাব ঘটেছে তাদের সম্বন্ধে যাবতীয় সংবাদ দাখিল করে। বাসু-সাহেব শুনে বলেছিলেন, হ্যাঁ, সুবীর রায় নামটা আমার জানা।তাকে এ ঘরে নিয়ে এস, আর অরূপকেও খবর দাও -- সুজাতা বোধকরি রান্নাঘর ছেড়ে আসতে পারবে না, নয়?
 

কৌশিক বলেছিল, এখন তার পক্ষে আসা সম্ভব নয়। তা হোক, আমিই তো রইলাম। এখানে যা কিছু আলোচনা হবে তা আমি তাকে জানিয়ে দেব।
মিনিটদশেক পরে বাসু-সাহেবের ঘরে একটি গোপন বৈঠক বসল। অরূপরতন আর সুবীর রায় যোগ দিল তাতে। কৌশিক সুবীরকে পরিচয় করিয়ে দিল ওঁদের সঙ্গে। বেচারি স্থির হয়ে বসতে পারছিল না আলোচনা সভায়। তাকে বারে বারে দেখে আসতে হচ্ছিল ঘরের চারপাশ। কেউ আড়িপেতে শুনছে কি না। না, শুনছে না। ডঃ সেন তাঁর উত্তমার্ধের সঙ্গে তাস খেলছেন নিজের ঘরে; আলি-সাহেব নিজের ঘরে একটি ইংরাজি ডিটেকটিভ উপন্যাসে বুঁদ। কাবেরী আর অজয়বাবু আছে দোতলার উত্তরের বারান্দায়। কাবেরী বসে আছে একটি টুলে, উদাস ভঙ্গিতে আকাশ পানে তাকিয়ে।অজয়বাবু ক্রেয়নে তার একটি স্কেচ করছেন। দুজনে ভাব হয়ে গেছে বেশ। সুন্দরী তন্বী কাবেরী দত্তগুপ্তা এবং বৃদ্ধ চিত্রকর অজয় চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে!
 

বাসু-সাহেব বলেন, মিস্টার রায়, আপনার কথা নৃপেন ঘোষাল আমাকে বলেছিল--
 

বাধা দিয়ে সুবীর বললে, আপনি স্যার আমাকে 'তুমিই' বলবেন--
 

-- তা না হয় বলব, কিন্তু--
 

কৌশিক আবার উঠে পড়ে। বলে, আমি বরং বাইরে গিয়ে বসি --
 

তাকে বাধা দিয়ে রানী বলেন, না। তুমি থাক কৌশিক। আমিই বরং ব্যুহমুখে জয়দ্রথের ভূমিকায় থাকি। তেমন তেমন কাউকে আসতে দেখলেই আমি গান ধরব--
 

হুইল-চেয়ারে পাক দিয়ে রানী দেবী পার হয়ে গেলেন ঘর ছেড়ে বারান্দায়। ড্রইংরুমে, যেখানে পিয়ানোটা বসানো আছে তার পাশের দরজার কাছে থামলেন তিনি -- যাতে দুদিকেই নজর রাখা যায়।
 

বাসু-সাহেব বললেন, রিপোস-এর বাসিন্দারা এখন স্পষ্টত দুটি দল বিভক্ত। প্রথম দলে আছেন একজন ভালনারেবল্। তিনি যে কে তা আমরা ঠিক জানি না তবে সে দলের সভ্যসংখ্যা পাঁচ --রানী, সুজাতা, কৌশিক, অরূপ আর আমি। দ্বিতীয় দলের মধ্যে আছেন একজন সুচতুর দক্ষ ক্রিমিনাল --তার রেঞ্জ হচ্ছে আলি, কাবেরী, ডঃ অ্যান্ড মিসেস সেন এবং অজয় চট্টোপাধ্যায়!
 

--এঁরা সবাই?--অবাক হয়ে প্রশ্ন করে কৌশিক।
 

-- সবাই নয়, এ্রদের মধ্যে যে কোন একজন অথবা দু'জন। নৃপেন এবং সুবীরের ধারণা --এবং আমিও তাদের সঙ্গে একমত -- রমেন গুহের মৃত্যুর পিছনে আছে সহদেব হুই-এর হাত। প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ।ইব্রাহিম যদি স্বয়ং সহদেব হয় তবে সন্দেহ করতে হবে আলি এবং ডক্টর সেনকে। আর সহদেব যদি কোন এজেন্ট লাগিয়ে থাকে তবে অজয়বাবুকেও নেড়েচেড়ে দেখতে হবে। অপরপক্ষে মিস্‌ ডিক্রুজা যদি রমেন গুহর মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত থাকে তবে কাবেরী আর মিসেস্‌ সেনকেও সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া চলে না।
 

অরূপ প্রশ্ন করে, প্রথমে বলুন তো -- আপনারা কেন মনে করছেন রমেন গুহর মৃত্যুতেই ব্যাপারটার যবনিকাপাত ঘটেনি? রিপোস-এ আমাদের মধ্যে এ ঘটনার পুনরাভিনয় হবার কথা আশঙ্কা করা হচ্ছে কেন?
 

বাসু-সাহেব বলেন, কালকে সে কথার কিছুটা ইঙ্গিত আমি দিয়েছি। ইব্রাহিমের পরিত্যক্ত ঘরটা সার্চ করতে গিয়ে নৃপেন একখণ্ড কাগজ পায়, ঘরের ময়লা-ফেলা কাগজের ঝুঁড়ি থেকে। কাগজটা আমার কাছে নেই 

--নৃপেন নিয়ে গেছে, না হলে তোমাদের দেখাতাম--
 

বাধা দিয়ে সুবীর বলে, কাগজখানা আমার কাছে আছে--
 

--তোমার কাছে? নৃপেন দিয়েছে?
 

-- হ্যাঁ, এই দেখুন।
 

অ্যাটাচি কেস খুলে কাগজখানা সে বাসু সাহেবকে সবাই ঝুঁকে পড়ে। হাতে হাতে কাগজখানা ঘোরে। অবশেষে সেটি বাসু-সাহেবের হাতে আসে। তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কাগজটা পরীক্ষা করেন।যেন একশ-টাকার নোট জাল কি না দেখছেন। কৌশিক লক্ষ্য করে দেখল, কাগজটা দলামচা করা হয়েছিল। কোঁচকানোর দাগ আছে। তার উপরপ্রান্তে পারফোরেশনের চিহ্ন -- যেন ফুটো-ফুটো করা নোটবইয়ের একটি ছেঁড়া পাতা। একটি প্রান্ত মসৃণ আর দুটি প্রান্তে যেন তাড়াতাড়ি ছিঁড়ে নেওয়ার চিহ্ন। কাগজটায় কালো কালিতে লেখা:




 

সুবীর বললে, বেশ বোঝা যাচ্ছে - রিপোস-এ দ্বিতীয়বার হত্যা করলেও আততায়ীর প্রতিহিংসাপরায়ণতা নিবৃত্ত হবে না। সে তিন নম্বর হত্যার কথাও চিন্তা করছে।
 

কৌশিক বললে, নকুল হুইয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধের জন্য যদি এ পরিকল্পনা করা হয়ে থাকে তবে আমার মনে হয় আততায়ীর দু-নম্বর টার্গেট হচ্ছেন বাসু-সাহেব। তাই নয়?
 

অরূপ বললে, তুমি আমিও হতে পারি। সুজাতা দেবীই বা কেন বাদ যাবেন? আমরা সকলেই নকুল হুইয়ের ফাঁসির জন্য আংশিকভাবে দায়ী।
 

-- সে কথা ঠিক। কৌশিক মেনে নেয়।
 

বাসু সাহেব চোখ বুজে আপন মনে পাইপ খাচ্ছিলেন। সুবীর বলে, আপনি স্যার কিছু ভাবছেন মনে হচ্ছে।
 

বাসু-সাহেব চোখ মেলে তাকান। বিচিত্র হাসেন। বলেন- ভাবছি? হ্যাঁ, ভাবছি বৈকি। ভাবনার কি অন্ত আছে। কিন্তু আজ এই পর্যন্তই -- উঠে দাঁড়ান তিনি, বলেন -- দীর্ঘ আলোচনার কিছু নেই, এভাবে আমরা রূদ্ধদ্বার কক্ষে আলোচনা চালালে ওপক্ষ সজাগ হয়ে যাবে সো উই ডিজলভ্!
 

বেশ বোঝা গেল সকলেই এ সিদ্ধান্তে মর্মাহত। এত সংক্ষিপ্ত অধিবেশন হবে তা কেউ ভাবেনি। কিন্তু রায় দিয়ে বাসু-সাহেব উঠে পড়েছিলেন। গুটিগুটি বেরিয়ে এসে বসলেন বারান্দার একান্তে একটি ইজিচেয়ারে। কৌশিক, অরূপ আর সুবীর একে একে চলে গেল। রানী দেবী তাঁর চাকা-দেওয়া চেয়ারে পাক মেরে ঘনিয়ে এলেন বাসু-সাহেবের পাশে। ধ্যানস্থ বাসু-সাহেব বোধ করি তা টের পাননি। তিনি চমকে উঠলেন রানী দেবীর প্রশ্নে: কী হল? এরই মধ্যে কনফারেন্স শেষ?
 

--উঁ? হুঁ! অন্যমনষ্কের মত জবাব দিলেন বাসু। মাঝে মাঝে পাইপে টান দিচ্ছেন। কুন্ডলী পাকিয়ে যে ধোঁয়াটা উঠছে তারই দিকে তাকিয়ে আছেন একদৃষ্টে।
 

-- কী ভাবছ বলতো? -- আবার প্রশ্ন করেন রানী বাসু।
 

-- ঐ রমেন গুহর মৃত্যু-রহস্যের কথাই ভাবছি। আর কী ভাবব?
 

সহানুভূতির সুরে রানী বলেন, কে খুন করেছে তার কোন কূলকিনারাই করতে পারছ না, নয়?
 

বিচিত্র হাসলেন বাসু-সাহেব। অনুচ্চকণ্ঠে বললেন, সেইটেই তো ট্রাজেডি রানু। লোকটাকে আমি চিনতে পেরেছি। কে খুন করেছে, কেন করেছে, এখানেই বা কাকে খুন করতে চাইছে তা বোধহয় সব ঠিকমতই জানতে পেরেছি আমি! অথচ আমার হাত-পা বাঁধা। সব জেনেও কিছু করতে পারছি না! ট্রাজেডিটা বুঝতে পারছ?
 

বিষ্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন রানী দেবী। স্তব্ধ বিস্ময়ে তিনি তাকিয়ে থাকেন তাঁর অদ্ভুত-প্রতিভা স্বামীর দিকে! যাঁকে তিনি অত্যন্ত নিবিড়ভাবে চেনেন -- অথচ যে লোকটা তাঁর সম্পূর্ণ অপরিচিত। তারপর যেন সম্বিত ফিরে পেয়ে বলেন, খুনী কে তা তুমি জান?
 

মুখটা সুচালো করলেন বাসু-সাহেব। সম্মতি-সূচক গ্রীবা সঞ্চালন করলেন শুধু।
 

-- সে এখানে আছে ? এই রিপোস-এ?
 

একই রকম ভঙ্গি করেন উনি।
 

-- আমাকে বলতে পার না?
 

এবার দুদিকে মাথা নাড়েন উনি।
 

-- আমাকে না পার, অন্তত সুবীরকে বল, নৃপেনকে কিস্বা বিপুলকে?
 

একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল বাসু-সাহেবের। বললেন, উপায় নেই রানু। আমার হাতে যা এভিডেন্স আছে তাতে কনভিকশান হবে না। এখন কেউ আমার কথা বিশ্বাসই করবে না -- বলবে পি. কে. বাসু একটা বদ্ধ পাগল! লোকটাকে হাতে-নাতে ধরতে হবে -- তার দ্বিতীয় খুনের প্রচেষ্টার পূর্ব-মূহুর্তে।
 

-- ব্যাপারটা রিস্কি হয়ে যাবে না?
 

-- তা কিছুটা যাবে। কিন্তু উপায় কী বল? ওকে গিল্টি বলে প্রমাণ করব কী ভাবে? ওর দাড়ি, চশমা নেই -- বীর বাহাদুর আইডেন্টিফিকেশান্‌ প্যারেডে ওকে চিনতে পারবে না। তাছাড়া বীর বাহাদুর অথবা মহেন্দ্র ওকে দেখেছে মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য। একমাত্র যদি মিস ডিক্রুজাকে খুঁজে বার করতে পারি তবে হতে পারে। সে সারাদিন ইব্রাহিমকে দেখেছে। বাট হু নোস্‌ 

--ডিক্রুজা ওর পাপের সাথী হতেও পারে, আবার নাও পারে!
 

রানী দেবী ঝুঁকে পড়ে বললেন, কী ক্লু পেয়েছ তুমি?
 

-- নিজেই গোয়েন্দাগিরি করতে চাও? উঁ?
 

-- বল না?
 

-- সুবীরের হাতে এ 'এক : দুই : তিন' লেখা কাগজখানায়। প্রথমবার আমি ভাল করে ওটা পরীক্ষা করিনি। এবার তীক্ষ্ণভাবে পরীক্ষা করেছি। ওর ভিতরেই সহদেব ভুল করে রেখে গেছে তার আত্মপরিচয়! বেচারি সহদেব হুই!
 

-- তবে তাকে ধরিয়ে দিচ্ছ না' কেন?
 

-- ঐ যে বললাম -- যে সুক্ষ্ম যুক্তির বিচারে আমি ইব্রাহিমকে সনাক্ত করছি তাতে খুনী-আসামীর কনভিকশান হয় না! আমাকে জানতে হবে মিস্‌ ডিক্রুজা ওর পার্টনার-ইন-ক্রাইম ছিল কি না। একমাত্র সেই পারবে ইব্রাহিমকে সনাক্ত করতে। সহদেবকে আমি খুঁজে পেয়েছি; এখন খুঁজছি শুধু মিস্‌ ডিক্রুজাকে -- এই রিপোস হোটেলেই!
 

-- হোটেল কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে বাহাদুর আর মহেন্দ্রকে আনানো যায় না?
এ প্রশ্নের জবাব দেবার আগেই বাসু-সাহেব দেখলেন কৌশিক এগিয়ে আসছে ওঁদের দিকে।
 

-- কী ব্যপার? এমন উদভ্রান্ত দেখাচ্ছে কেন হে তোমাকে?
 

-- কেলেঙ্কারিয়াস্‌ কাণ্ড স্যার: এক নম্বর: টেলিফোন লাইনটা সকাল থেকে ডেড হয়ে গেছে। দু-নম্বর: কার্ট-রোডের সঙ্গে এ বাড়িটার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে -- প্রকাণ্ড একটা ধ্বস নেমেছে। আর তিন নম্বর--সুজাতা নোটিস দিয়েছে তার ভাঁড়ারে ডিম-মাংস-রুটি মাখন সব বাড়ন্ত!
 

বাসু-সাহেব রানী দেবীর দিকে ফিরে বলেন -- এই নাও তোমার প্রশ্নের জবাব!
 

-- কী প্রশ্ন? --জানতে চায় কৌশিক।
 

উনি দার্জিলিঙ থেকে আজ আবার দু-জনকে নিমন্ত্রণ করে আনতে চাইছিলেন। সে যাক, মন-খারাপ কর না। যেমন করে হ'ক এ ক'দিন চালিয়ে নিতে হবে আমাদের! দু-তিন দিনের মধ্যেই সভ্যজগতের সঙ্গে নিশ্চয় যোগাযোগ করা যাবে।
 

-- রেডিওর খবর -- তিস্তা ব্রিজ ভেসে গেছে। মহানন্দা, তোরশা, টাঙ্গন, পুন্ডবা, আত্রেয়ী সবাই একসঙ্গে ক্ষেপে উঠেছে। জলপাইগুড়ি, কুচবিহার, মালদা -- এক কথায় গোটা উত্তরবঙ্গে প্রচণ্ড বন্যা হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ ভেসে গেছে --এতবড় বন্যা নাকি উত্তরবঙ্গে কখনও হয়নি।

বেলা নয়টা নাগাদ বৃষ্টি মাথায় করেই কৌশিক বার হয়ে পড়ল। রেন-কোট চড়িয়ে। গাড়ি চলবে না, পায়ে হেঁটে। স্থানীয় বাজারে কিছু পাওয়া যাবে কিনা খোঁজ নিতে।
 

অজয় চাটুজ্জে কাবেরীর স্কেচটা শেষ করে এনেছেন।
 

আলিও আগাথা ক্রিস্টি শেষ করে আনল প্রায়।
 

ছয় নম্বর ঘরে মিসেস সেন ক্ষুব্ধা। তৃতীয় এক কাপ চা চেয়ে তিনি প্রত্যাখ্যাতা হয়েছেন। কিচেন-ব্লক থেকে কাঞ্চী এসে জানিয়ে গেছে এখন আর চা পাঠানো সম্ভবপর নয়। প্রাতঃরাশের সময়সীমা অতিক্রান্ত। কিচেন এখন লাঞ্চের ব্যবস্থায় ব্যস্ত।
 

বাসু-সাহেক গুটি গুটি এসে হাজির হলেন রান্নাঘরে: কী সুজাতা? আজ কী রান্না হচ্ছে?
 

-- মাংস যা আছে এবেলা হয়ে যাবে। মাংসই করছি। আলুসেদ্ধ এই নামল।
 

হঠাৎ ওর কাছে ঘনিয়ে এসে বাসু-সাহেব বলেন, একটা কাজ কর তো সুজাতা । চট করে একবার দোতলার সাত নম্বরে চলে যাও। কাবেবীর ঘরে। কাবেরী এখন ঘরে নেই--কিন্তু ওর ঘর তালাবন্ধও নেই৷ কাবেরী উত্তরের বারান্দায় বসে ছবি আঁকাচ্ছে। ওর ঘরে গিয়ে চট করে ওর আশষ্ট্রেটা নিয়ে এস তো --
 

--অ্যাশট্রে! অ্যাশট্রে কী হবে?
 

-- তুমি তো আগে এমন ছিলে না সুজাতা! 'কেন' এ প্রশ্ন তো আগে করতে না--
 

-- কিন্তু এদিকে আমার তরকারিটা--
 

ওটা আমি দেখছি --
 

ওর হাত থেকে খুন্তিটা নিয়ে বাসু-সাহেব উনানের উপর বসানো তরকারির ডেকচিটায় মনোনিবেশ করেন।
 

খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে সুজাতা -- ওঁর অনভ্যস্ত হাতে খুন্তি নাড়া দেখে।
 

-- হাসছ কেন? -- রোষকষায়িত দৃষ্টিতে বাসু-সাহেব জানতে চান।
 

হাসি থামিয়ে সুজাতা গম্ভীর হয়ে বলে, অবজেকশান ইয়োর অনার। ইটস্ ইনকম্পিটেন্ট, ইররেলিভান্ট আন্ড ইম্মেটিরিয়্যাল!
 

বাসু সাহেব হেসে ফেলেন। বলেন, অবজেকশান ওভার-রুল্ড। যাও, ওপরে যাও!
 

সুজাতা দু-মিনিটের মধ্যেই অ্যাশট্রেটা নিয়ে ফিরে এল। বাসু-সাহেব তার ভিতর থেকে গুটিতিনেক সিগারেটের স্টাম্প উদ্ধার করে বললেন, আশ্চর্য! কাল সন্ধ্যা পর্যন্ত এটা শূন্যগর্ভ ছিল! যাও, এটা রেখে দিয়ে এস আবার।
 

আরও মিনিট পনের পরে। বাসু-সাহেবের প্রস্থানের পরে আলি-সাহেব রান্নাঘরে এসে হাজির। প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে বলে, আসতে পারি? অনধিকার প্রবেশ করছি না তো?
 

সুজাতা চমকে ওঠে: আসুন, আসুন। কী ব্যাপার? একেবারে হেঁসেলে?
 

-- আপনাকে প্রথম সাক্ষাতেই বলেছিলাম মহিলাদের হেঁসেল সম্বন্ধে আমার কিছুটা পারদর্শীতা আছে।
 

-- তা বলেছিলেন। ধন্যবাদ। আমার সাহায্যের কোন দরকার হবে না।
আলি একটা টুল টেনে নিয়ে বসে পড়ে। বলে, চার নম্বরে ঐ যে লম্বামতন ভদ্রলোক এসে উঠেছেন তাঁর নামটা কী বলুন তো?
 

-- মিস্টার রায়।
 

-- কী রায়?
 

সুজাতা হেসে বললে, তাহলে রেজিস্টার দেখতে হবে। পুরো নামটা মনে নেই।
 

-- কখন এলেন উনি? .
 

-- হঠাৎ ওর বিষয়ে এত কৌতুহলী হয়ে পড়লেন কেন? --সুজাতা প্রতিপ্রশ্ন করে।
 

একটু থতমত খেয়ে আলি বলে, না না, শুধু ওঁর সন্ধন্ধে নয়, ছয় নম্বরের দম্পতির বিষয়েও আমার কৌতুহল আছে।
 

-- তা আমার কাছে কেন? ছয় নম্বরে গিয়ে আলাপ জমালেই পারেন।
আলি সে-কথার জবাব দেয় না। আলুর ডেকচিটা টেনে নেয়। তাতে ছিল সিদ্ধ করা আলু। আপনমনে সে আলুর খোসা ছাড়াতে থাকে। আড়চোখে সুজাতা একবার তাকে দেখে নিল। বোঝা গেল যে কোন কারণেই হ'ক, আলি ভাব জমাতে চায়। সুজাতার তাতে আপত্তি নেই। এবার সে নিজে থেকেই বলে ওঠ, মিস্টার আলি, এবার বলুন তো, আপনি প্রথম সাক্ষাতেই কেমন করে বুঝতে পেরেছিলেন যে বাড়িতে আমি একেবারে একা আছি? চাকরটা পর্যন্ত নেই?
 

আলি-সাহেব জবাব দিল না। আপন মনে আলুর খোসা ছাড়াতে থাকে। 

সুজাতা একটা প্লেটে কিছু ওরকারি তুলে ওর দিকে বাড়িয়ে ধরে বলে, দেখুন তো নুন-ঝাল ঠিক আছে কি না?
 

প্লেটে ফুঁ দিতে দিতে আলি বললে, একসঙ্গে এত লোকের রান্নায় আন্দাজ পাচ্ছেন না, তাই নয়? ছিল দু'জনের ছোট্ট সংসার--হয়ে গেল রাবণের গুষ্টি!
 

-- রাবণের গুষ্টি! আপনি হিন্দুদের এপিক পড়েছেন দেখছি।
 

-- তা পড়েছি। ওই রামায়ণ না মহাভারতেই আছে না আর একটা কথা--'শক্র এবং স্ত্রীর কাছে মিথ্যাভাষণে পাপ নেই।'
 

-- হঠাৎ একথা কেন?
 

তরকারিটা ইতিমধ্যে ঠাণ্ডা হয়েছে। আলি পরখ করে বললে, নুন-ঝাল ঠিক আছে।
 

তা তো আছে --কিন্তু হঠাৎ ও কথা কেন বললেন?
 

আলি হেসে বললে, দেখুন, আমি ব্যাচেলর মানুষ। দাম্পত্য জীবনের খুঁটিনাটি অত জানি না। আচ্ছা, স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের কাছে হামেশাই মিছে কথা বলে, তাই নয়?
 

--কেন ও কথা বলছেন তাই আগে বলুন?
 

-- কতদিন বিয়ে হয়েছে আপনাদের?
 

সুজাতা রাগ দেখিয়ে বললে, বলব না!
 

আলি হাসে। বলে, নেহাৎ পীড়াপীড়ি করছেন তাই বলছি -- পরশু-রাতে আপনাদের কথাবার্তা শুনে আমার মনে হয়েছিল যে, বিকালের দিকে দার্জিলিঙ যাবার একটা প্রোগ্রাম আপনাদের করা ছিল, তাই নয়? মিস্টার মিত্র বললেন যে, কাঞ্চন ডেয়ারিতে গিয়ে উনি আটকা পড়েছিলেন। কথাটা উনি সত্য বলেননি। পরশু-সকালে উনি দার্জিলিঙেই গিয়েছিলেন;
 

-- আপনি কেমন করে জানলেন?
 

-- পরশু আমি ছিলাম দার্জিলিঙে। বেলা একটার সময় একটা চাইনিজ রেস্তোরাঁয় বসে লাঞ্চ সারছিলাম। আমার থেকে তিন টেবিল দূরে মিস্টার মিত্র দুপুরে ওখানে লাঞ্চ করেন। উনি নিশ্চয় আমাকে লক্ষ্য করেননি--
 

-- দার্জিলিঙ-এ চাইনিস রেস্তোরাঁ? আছে না কি?
 

-- আছে। গ্রেনারির ঠিক উপ্টোদিকে। সাংগ্রিলা তার নামে।
 

-- ওখানে বসে সে খাচ্ছিল।
 

বিচিত্র হাসল আলি। বললে, আপনি রাগ না করেন তো আরও কিছু নিবেদন করি। উনি একা খাচ্ছিলেন না -- ওঁকে সঙ্গদান করছিলেন একজন বাঙালী ভদ্রমহিলা। বিবাহিতা, বয়স বছর ত্রিশ -- আর ভয়ে-বলব-না-নির্ভয়ে-বলব? ভদ্রমহিলা রীতিমত সুন্দরী।
 

সুজাতা আত্মসংবরণ করে কৃত্রিম হাসিতে ভেঙে পড়ে৷ বলে -- ভয়ে বলতে যাবেন কোন দুঃখে? নির্ভয়েই বলুন। আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন মিস্টার আলি, -- আমরা বিংশ শতাব্দীর শেষপাদে বাস করছি। আমার স্বামী কোনও সুন্দরী মহিলার সঙ্গে লাঞ্চ সেরেছেন শুনলে আমি মূর্ছা যাব না।
 

আলি একটা মোগলাই-কুর্নিশ ঝেড়ে বলে, বেগমসাহেবা মহানুভব। বিংশ শতাব্দীর শেষপাদের ঔদার্যটার সম্বন্ধে আমার ধারণা সীমিত) আচ্ছা ধরুন, যদি সংবাদ পান লাঞ্চান্তে আপনার কর্তা সেই সুন্দরী মহিলাটিকে একটা 'সোনার কাঁটা' উপহার দিচ্ছেন?
 

--সোনার কাঁটা? সেটা কী জাতীয় বস্তু?
 

--ও-বস্তুটা আমিও এর আগে কখনও দেখিনি। একটা অলঙ্কার। মেয়েরা খোঁপায় গোঁজে --লোহার, অ্যালুমিনিয়ামের, প্লাস্টিকের। কবরী যাতে শিথিল না হয়ে যায় তাই তার ব্যবহার -- এই যেমন আপনি এখন কাঁটা গুঁজেছেন আপনার খোঁপায়। সোনার কাঁটার মূল্য কবরীবন্ধনে নয়--
 

--কৃষ্ণা-কবরী-শোভা-বর্ধনে-- প্রশ্ন করে সুজাতা।
 

-- অথবা রক্ত-কবরী-সোহাগ-বর্ধনে!--জবাব দেয় আলি।
 

-- সংবাদটা বিচিত্র!
 

-- সন্দেশটা বিস্বাদ না হলেই হল! ভরি-তিনেক ওজনের অমন একটা সোনার কাঁটা মিস্টার মিত্রের পকেট থেকে যাত্রা শুরু করে তাঁর মিত্রাণীর খোঁপা বিদ্ধ কবলে বেদনাটা অন্যত্র অনুভূত হবার কারণ নেই। কী বলেন! আফটার-অল, আমরা বিংশ শতাব্দীর শেষপাদে বাস করছি!
 

সুজাতা এবারও হেসে বলে, মিস্টার আলি, রামায়ণ তো আপনার পড়া। নিশ্চয় জানেন --রাবণের গুষ্টি শেষ হবার পর বিভীষণ সিংহাসনে বসে -- কিন্তু কোনও হিন্দুই সত্যবাদী বিভীষণকে শ্রদ্ধা করে না -- তার পরিচয় 'ঘরভেদী বিভীষণ!'
 

আলি এ জবাবের জন্য প্রস্তুত ছিল না। সামলে নিয়ে কী একটা কথা সে বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই দ্বারপথে কে - যেন বলে ওঠে, এক্সকিউজ মি। ভিতারে আসতে পারি?
 

-- কে ডক্টর সেন! আসুন। এখানে কী মনে করে?
 

হাসি হাসি মুখে ড: সেন ঢুকে পড়েন রান্নাঘরে। অনুনয়ের ভঙ্গিতে সুজাতাকে বলেন, এক কাপ চা কি কিছুতেই হতে পারে না, মিসেস মিত্র? আমার বেটার-হাফ, মানে ….
 

স্ত্রৈণ ভদ্রলোকের অবস্থা দেখে সুজাতার করুণা হয়। আলি এগিয়ে এসে বলে, আপনার সঙ্গে আমার আলাপ হয়নি। আমার নাম এন. আলি -- আমি আছি তিন নম্বরে।
 

-- সো গ্ল্যাড টু মীট য়ু। একা আছেন, না সস্ত্রীক?
 

-- আজ্ঞে না। স্ত্রীর বালাই নেই। আমি কনফার্মড ব্যাচেলর!
 

-- শুনে সুখী হলাম। বেঁচে গেছেন মশাই!
 

আলি বলে, কেন? আপনি যে মরে আছেন তা তো মনে হচ্ছে না। 'কপোত-কপোতী যথা' উচ্চনীড়ে সকাল থেকে তো দিব্যি তাস পিটছেন!
 

-- আরে তাতেই তো হয়েছে বখেড়া। এ পর্যন্ত আমার বেটার হাফ সাড়ে বাহান্ন টাকা হেরেছেন। মেজাজ খেপচুরিয়াস! তাতেই তো চায়ের সন্ধানে এসেছি।
 

আলি অবাক হয়ে বলে, সাড়ে বাহান্ন টাকা! আপনি কি স্ত্রীর সঙ্গে স্টেকে তাস খেলছেন?
 

--আলবৎ! স্টেক ছাড়া 'ফিশ' খেলা যায় নাকি!
 

-- তাই বলে স্ত্রীর সঙ্গে?
 

-- কেন নয়? ওর রোজগার আর আমার রোজগার আলাদা। জয়েন্ট আ্যাকাউন্ট নেই। এমনকি ITO-র ফাইল নাম্বার পর্যন্ত পৃথক।
এমনও হয় না কি?
 

-- আজ্ঞে! বে-থা তো করেননি -- কী খবর রাখেন! -- অম্লানবদনে ডাক্তার-সাহেব ডেকচি থেকে একটি সিদ্ধ আলু নিয়ে মুখে পুরলেন।
 

সুজাতা হেসে বললে, ঠিক আছে ডাক্তার-সাহেব, আমি চা পাঠিয়ে দিচ্ছি। এক কাপ না দুকাপ?
 

-- বানাতেই যখন হচ্ছে তখন আর এক কাপ কেন? যাহা সাড়ে বাহান্ন তাঁহা পঁয়ষট্টি। দু-কাপই হ'ক।-- দ্বিতীয় একটি বড়-মাপের আলু তুলে নিয়ে তাতে কামড় বসান ডাক্তার সেন। বাঁ-হাতে এক চিমটে নুনও তুলে নেন।
 

সুজাতা বললে, আচ্ছা আপনি যান, আমি দু-কাপ চা পাঠিয়ে দিচ্ছি।
 

-- থ্যাঙ্কু! থ্যাঙ্কু! না, না, কষ্ট করে আর পাঠিয়ে দিতে হবে না। আমি অপেক্ষা করছি। নিজেই নিয়ে যাব।
 

সুজাতা হাসতে হাসতে বলে, ততক্ষণে বোধহয় আমার আলুসেদ্ধর ডেকচি খালি হয়ে যাবে।
 

-- আলুসেদ্ধ! ও আয়াম সরি! --এঁটো আলুটা উনি ফেরত দিতে উদ্যত হন।
 

-- এ কী করছেন! ওটা আপনার এঁটো!
 

--এঁটো! ও আয়াম সরি -- আলুটা কোথায় রাখবেন উনি ভেবে পান না।
 

-- একি! তুমি এখানে বসে আলুসেদ্ধ খাচ্ছ! -- প্রবেশ করেন মিসেস সেন।
 

-- আমি? না, মানে, ইয়ে -- হঠাৎ বাকি আলুটা মুখে পুরে দিয়ে ডাক্তার-সাহেব আলি-সাহেবের দিকে ফিরে বলতে চাইলেন -- 'আমার বেটার-হাফ'; কিন্তু মুখে গরম আলুসেদ্ধ থাকায় কথাটা বোঝা গেল না।
 

-- চলে এস উপরে! -- রীতিমত ধমকের সুরে ডাকেন মিসেস সেন।
 

-- না, মানে তোমার চা-টা--
 

-- থাক। চা আর লাগবে না।
 

সুজাতার গরম জল তৈরীই ছিল। ইতিমধ্যে সে চা ছেড়েছে 'পট'-এ। বললে, চা যে হয়ে গেছে ইতিমধ্যে।
 

রুখে ওঠেন মিসেস সেন, বলছি লাগবে না! এক ঘণ্টা আগে চা চেয়েছি, এতক্ষণে শোনাচ্ছেন -- হয়ে গেছে!
 

সুজাতা ডক্টর সেনের দিকে ফিরে বললে, না লাগে পাঠাব না। তবে আপনার অর্ডার অনুযায়ী দু'কাপ চা বানানো হয়েছে। বিল-এ দু'কাপ চায়ের দাম কিন্তু ঠিকই উঠবে ডঃ সেন!
 

-- কারেক্ট! তা তো উঠবেই। তবে এক কাজ করুন -- আমার কাপটা দিন, নিয়ে যাই। ওঁর যখন আর লাগবে না।
 

-- থাম তুমি! উঃ কী ডাকাতের রাজ্যে এসে পড়েছি! দাম দেব আর চা খাব না! ইয়ার্কি নাকি! তুমি এস -- ওরা বেয়ারা দিয়ে পাঠিয়ে দেবে।
 

ওয়ার্স হাফকে উদ্ধার করে উপরে উঠে গেলেন মিসেস সেন।
 

শেষাংশ পড়ুন...





No comments:

Post a Comment