সোনার কাঁটা (প্রথমাংশ)


লেখক পরিচিতি:
নাম: নারায়ণ স্যান্যাল

জন্ম: ২৬ এপ্রিল ১৯২৪, কলকাতা
মৃত্যু: ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০০৫

আদি নিবাস কৃষ্ণনগর, নদীয়া জেলা। লেখকের নিজের ভাষায় উনি ছিলেন 'কৃষ্ণকলি'। ১৯৪৮ সালে শিবপুরের বি. ই কলেজ থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন। ১৯৮২ তে সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। স্বভাবে ছিলেন একান্তচারী। তাঁর নিজের ভাষায়, শিল্প-সাহিত্য-ভাস্কর্য-বিজ্ঞান-শিশু-কিশোর ও গোয়েন্দা গল্পের পৃথিবীতে তিনি ছিলেন 'পল্লবগ্রাহী'। তিনি ক্রমাগত বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে গিয়ে তাঁর অমূল্য সৃষ্টি করেছেন।


ক্রিররং-ক্রিং...ক্রিররং-ক্রিং!

কোনও মানে হয়? দার্জিলিঙ-এর শীত। সকাল ছটা বেজে দশ। ছুটির দিন --দোশরা অক্টোবর, 1968। গান্ধীজীর জন্মদিবস। সব সরকারী কর্মচারী আজ বেলা আটটা পর্যন্ত ঘুমোবে - শুধু ওরই নিস্তার নেই! এই সাত-সকালে টেলিফোনটা চিল্লাতে শুরু করেছে।

ক্রিররং-ক্রিং...ক্রিররং-ক্রিং!

লেপটা গা থেকে সরিয়ে খাটের উপর উঠে বসে নৃপেন ঘোষাল- দার্জিলিঙ সদর-থানার দারোগা। দেখে, পাশের খাটে লেপের ফাঁক থেকে সুমিতাও একটা চোখ মেলে তাকাচ্ছে। ঘোড়া দেখলেই মানুষে খোড়া হয়। নৃপেন আবার সটান শুয়ে পড়ে বলে - দেখতো?

সুমিতা লেপটা টেনে দেয় মাথার উপর। স্বগতোক্তি করে একটা, দেখতে হবে না, রং নাম্বার!

অগত্যা আবার উঠে বসতে হয়। সুমিতা লেপের মায়া ত্যাগ করবে না। রং নাম্বার ধরে নিয়ে নিশ্চিত হতে পারলে তো বাঁচা যেত। ডি-সি-র ফোন হতে পারে, পুলিস সুপারের হতে পারে- কে জানে, ট্রাঙ্ক-কল কিনা! হাড়-কাঁপানো শীত অগ্রাহ্য করে উঠে পড়ে নৃপেন। হাত বাড়িয়ে হুক থেকে গরম ড্রেসিং-গাউনটা নামায়। গায়ে চড়াতে চড়াতে চটিটা পায়ে গলাতে থাকে।

সুমিতা মুখটা বার করে বলে, বেচারী!...কেন ঝামেলা করছ। শুয়ে থাক! ও আপনিই থেমে যাবে। কোথায় কোন সিঁধেল চুরি হয়েছে -

সিঁধেল চুরিই হোক, আর বউ-চুরিই হোক- আরও বারো ঘন্টা এ নরক যন্ত্রণা আমাকেই ভোগ করতে হবে -

ড্রেসিং গাউনের ফিতেটা বাঁধতে বাঁধতে ঘর ছেড়ে ‘হল’ কামরায় পৌছানোর আগেই টেলিফোনটা দাঁত কিড়মিড় করা বন্ধ করল।

যা বাব্বা! ঠাণ্ডা মেরে গেলি? - মাঝপথেই দাড়িয়ে পড়ে নৃপেন।

অনেকক্ষণ বাজছিল অবশ্য। হয়তো ও পক্ষের মানুষটা ভেবেছে – যাক্ গে; মরুগগে -এখন আর ও-লোকটা কী ভেবেছে তা নিয়ে নৃপেনের কী মাথাব্যথা? লোকটা যখন টেলিফোন নামিয়ে রেখেছে তখন নৃপেনের দায়িত্ব খতম। ঘরে ফিরে আসে সে। ড্রেসিং গাউনটা খুলে আবার হ্যাঙারে টাঙিয়ে রাখে। হঠাৎ ওর দৃষ্টি চলে যায় কাঁচের জানলা দিয়ে উত্তর দিকে। অপূর্ব দৃশ্য! নির্মেঘ আকাশে কাঞ্চনজঙ্ঘার মাথায় মাথায় লেগেছে আবীরের স্পর্শ। উদয়-ভানুর প্রথম জয়টীকা। এ দৃশ্য দেখতে এতক্ষণে নিশ্চয় ভিড় জমেছে টাইগার হিলের মাথায় -- দূর দূরান্তর থেকে এসেছে যাত্রীদল, নৃপেনের কিন্তু কোন ভাবান্তর হল না। স্ত্রীকে ডেকে জানালো না পর্যন্ত খবরটা। একটা হাই তুলল সে। জানলার পর্দাটা টেনে দিয়ে উঠে বসল খাটে। লেপটা নিল আবার। 

 

নৃপেন ঘোষাল আজ একাদিক্রমে চার বছর আছে এই দার্জিলিঙে। সে হাড়ে হাড়ে জানে রোজ সকালে ভিখারী কাঞ্চনজঙ্ঘা মাথার এ দগদগে ঘা ব্যান্ডেজ-খোলা কুষ্ঠ রুগীর মত সব্বাইকে দেখায়!

দার্জিলিঙ ওদের কাছে পচে গেছে। ঝাঁকার তলায় চেপটে যাওয়া টমেটোর মত লাল এ কাঞ্চনঙ্ঘার রঙের খেলায় আর ওদের কোন আকর্ষণ নেই। দু’ বছর ধরে ক্রমাগত বদলির জন্য তদ্বির আর দরবার করে এসেছে। এতদিনে মা কালী মুখ তুলে চেয়েছেন। বদলির অর্ডার এসেছে; মায় ওর সাবস্টিট্যুট পর্যন্ত এসে হাজির। এই হতভাগা দার্জিলিঙে আজই ওর শেষদিন। আর মাত্র বারো ঘণ্টা -- হ্যাঁ, ম্যাকসিমাম্‌ বারো ঘণ্টা এ নরক যন্ত্রণা ওকে ভোগ করতে হবে। ফোরনুনেই রমেন গুহ ওর কাছ থেকে চার্জ বুঝে নেবে! আঃ! বাঁচা গেল। বদলি হয়েছে খাস কলকাতায় – একেবারে লালবাজারে। বলা যায় একরকম প্রমোশনই। নৃপেন লেপের নিচে অবলুপ্ত হয়ে যায়।

সুমিতা বিজ্ঞতা প্রকাশ করে, দেখলে তো? বললাম রঙ-নাম্বার!

-- কোথায় আর দেখলাম? লোকটা তো বিরক্ত হয়ে ছেড়েই দিল।

-- গরজ থাকলে ছাড়তো না। আর একবার ঘুমোবার চেষ্টা কর দিকিন। কাল রাত দুটো পর্যন্ত যা দাপাদাপি করেছ!

তা করেছে। মালপত্র প্যাকিং হয়ে পড়ে আছে ঘর জুড়ে। ঘরে, হল-কামরায়, করিডরে। নানান আকারের প্যাকিং কেস আর ক্রেট। চার-বছরের সংসার, গুছিয়ে তোলা কি সহজ কথা? আজই ও-বেলায় নৃপেনরা নামবে। নামবে মানে কলকাতা-মুখো রওনা দেবে। মালপত্র যাবে ট্রাকে! হরি সিং-এর ট্রাক ঠিক এগারোটার সময় এসে দাঁড়াবে। ওরা যাবে জীপে। শিলিগুড়ি পর্যন্ত। তারপর ট্রেনে। রিজার্ভেশন করানোই আছে।

ওর সাক্সেসার রমেন গুহ এসে পৌছেছে গত কাল। রমেন ছেলে ভাল, নৃপেন একথা স্বীকার করবে। টেলিগ্রাফিক ট্রান্সফার অর্ডার পেয়ে তৎক্ষণাৎ রওনা দিয়েছে। বস্তুত মাসের শেষদিনে। আর কেউ হলে অন্তত একটা দিন অপেক্ষা করত। মাসমাহিনাটা নগদে হাতে নিয়ে চেয়ার ছাড়ত। রমেন তা করেনি। বেচারি লাস্ট পে সার্টিফিকেট কবে পাবে কে জানে? হীরের টুকরো ছেলে! কাল দুপুরেই এসে পৌঁছেছিল দার্জিলিঙে। হোটেলে মালপত্র নামিয়ে এসে দেখা করেছিল নৃপেনের সঙ্গে। নৃপেন বলেছিল, আবার হোটেলে উঠতে গেলে কেন রমেন? এ ফ্ল্যাটে তো তিনখানা ঘর। অসুবিধা কিছুই হবে না। তুমি হোটেল ছেড়ে এখানে চলে এস।

রমেন গুহ রাজী হয়নি। জবাবে বলেছিল, কেন ঝামেলা বাড়াচ্ছ ভাই? তুমি বাঁধাছাদায় ব্যস্ত থাকবে, মিসেস ঘোষালও তাঁর বড়ি-আচারের বয়াম নিয়ে বিব্রত থাকবেন -এর মধ্যে উটকো গেস্ট --

বাধা দিয়ে সুমিতা বলেছিল, আমাদের কিছুমাত্র অসুবিধা হবে না। আমরা যদি ভাতে-ভাত খাই, আপনাকেও তাই খাওয়াব।

আমি তা খাব কেন? -- জবাবে হেসে ও বলেছিল, রীতিমত বিরিয়ানি পোলাও আর মুরগির রোস্ট চাই আমার। কলকাতায় বদলি হচ্ছেন! ইয়ার্কি নাকি?

এক গাল হেসে সুমিতা বলেছিল, বেশ তাই খাওয়াব। হোটেলের ঘরটা ছেড়ে দিয়ে আসুন আপনি!

রমেন মাথা নেড়ে আপত্তি জানিয়েছিল; আমারও বদলির চাকরি মিসেস ঘোষাল। শেষ দিনটা কীভাবে কাটে তা কি আমি জানি না? আপনার হাতে পোলাও-মাংস নিশ্চিত খাব, তবে এখানে নয়! আপনারা কলকাতায় গিয়ে গুছিয়ে বসুন; আমি যখন সরকারী কাজে কলক্যতায় ট্যুরে যাব, তখন ডবল ডি.এ. ক্লেম করব আর আপনার হাতের রান্না খাব। বুঝলেন?

নৃপেন জিজ্ঞাসা করেছিল, কোথায় উঠেছ তুমি? কোন হোটেলে?

-- হোটেল কাঞ্চনজঙ্ঘা। ম্যাল-এর ওপাশে। চেন?

-- খুব চিনি। দার্জিলিঙ আমার নখদর্পণে। ওর ম্যানেজার তো একজন সিন্ধি ভদ্রলোক, নয়? কী যেন নাম?

-- ম্যানেজারকে দেখিনি, তবে কাউন্টারে যে ছোকরা বসেছিল সে বাঙালী। মালপত্র নামিয়ে রেখেই আমি তোমার এখানে চলে এসেছি --

সুমিতা আবার বলে, বেশ হোটেলে রাত কাটাতে চান কাটান, রাত্রে কিন্তু আমার এখানেই খেতে হবে।

-- কেন ঝুট-ঝামেলা পাকাচ্ছেন শখ করে?

-- ঝামেলা নয় মোটেই। শুনুন, আজ আমি রাঁধব না। বাসন-পত্রও সব প্যাক হয়ে গেছে। হোটেলে খাবার অর্ডার দেব! আপনার মুখ ফসকে যখন কথাটা বেরিয়ে গেছে তখন আজই আপনাকে খাওয়াব -- ঐ বিরিয়ানি পোলাও আর মুরগির রোস্ট! আজই! এখানেই --

রমেন তবু বলে, কিন্তু আমার শর্তটা ছিল অন্যরকম। হোটেলের রান্না নয়, আপনার শ্রীহস্তপক্ক --

বাধা দিয়ে সুমিতা বলে ওঠে, না শর্ত মোটেই তা ছিল না। শর্ত ছিল --আপনি যখন কলকাতায় গিয়ে ডবল ডি.এ ক্লেম করবেন তখন আমার হাতের রান্না খাবেন। তাই নয়?

রমেন হেসে ফেলেছিল; ঠিক কথা! আমারই ভুল!

-- ক্রিররং-ক্রিং--ক্রিররং-ক্রিং!

আবার উৎপাত! এ তো মহা বখেড়া হল দেখা যাচ্ছে নৃপেন কাতরভাবে সুমিতার দিকে তাকায়।সুমিতা উঠে বসে এবার। চীৎকার করে বলে--না, নৃপেনকে নয়, টেলিফোনকে--মশাই শুনছেন! ঘণ্টাছয়েক পরে ফোন করবেন! ও.সি-সাহেব এখন ব্যস্ত আছেন, তখন থাকবেন না!

যন্ত্রটা এ উপদেশে কান দিল না। একগুঁয়েমি চালিয়ে চলে, ক্রিররং-ক্রিং!

-- দুত্তোর নিকুচি করেছে! উঠে পড়ে সুমিতা! দুম দুম করে পা ফেলে চলে আসে হল-কামরায়। টেলিফোনটা তুলে নিয়ে বলে, বলুন?...হ্যাঁ, আছেন। না, ঘুমোচ্ছেন না। আপনি কোথা থেকে বলছেন?

নৃপেন কর্ণময়।

-- কাঞ্চনজঙ্ঘা হোটেল থেকে? মিস্টার গুহ বলছেন?...না? কী!...সে কি!!

এবার খাট থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়ে নৃপেন। ড্রেসিং গাউনটা গায়ে জড়াবার কথা আর মনেই থাকে না। সুমিতার কন্ঠস্বরে এমন একটা কিছু ছিল যাতে নৃপেন দৌড়ে এসে বলে, কী হয়েছে সুমিতা?

সুমিতা জবাব দেয় না। সে যেন পাথর হয়ে গেছে! শীতেই কিনা বোঝা গেল না, সে রীতিমত কাঁপছে। দ্রুতহাতে নৃপেন রিসিভারটা কেড়ে নেয়, বলে, ও.সি সদর বলছি। কে আপনি?...ইয়েস! কী? কী বলছেন মশাই! অসম্ভব!!

সুমিতা ইতিমধ্যে বসে পড়েছে সামনের চেয়ারখানায়।

দীর্ঘ সময় নৃপেন আর কিছু বলে না টেলিফোনে, শুধু শুনে যায়। তারপর বলে, কোনকিছু ছোঁবেন না। ঘরটা তালাবন্ধ করে রাখুন। আমি পনের মিনিটের ভিতর আসছি।

রিসিভারটা নামিয়ে রেখে সে ঘুরে দাঁড়ায়। সুমিতার মুখোমুখি। বলে, শুনলে?

সুমিতা জবাব দেয় না। মাথাটা নাড়ে শুধু।

-- কী হতে পারে বলত? হার্টফেল? থ্রম্বোসিস?

-- আমি....আমি এখনও বিশ্বাসই করে উঠতে পারছি না। কাল রাত্রেও ভদ্রলোক কত হাসি-মশকরা করে গেলেন। ওঁর এঁটো প্লেটটা পর্যন্ত এখনও--

নৃপেনের দৃষ্টি চলে যায় ডাইনিং টেবিলে। তিনটি ভুক্তাবশিষ্ট প্লেট। রমেন গুহর প্লেটে পাশাপাশি দু’খানা ঠ্যাঙ! রাত পৌনে দশটা নাগাদ রমেন হোটেলে ফিরে যায়। আর আজ সকাল ছ'টা দশে সে লোকটা বেঁচে নেই? ইম্পসিবল্‌!



দ্বিতীয় পর্ব



সকাল সাড়ে সাতটা। হোটেল কাঞ্চনজঙ্ঘা ম্যানেজারের ঘরে জমিয়ে বসেছিল নৃপেন। এখন আর ঘুম-ঘুম-চোখ স্লিপিং-স্যুট পরা নৃপেনবাবু নয়, ধরা-চূড়া-সাঁটা দার্জিলিঙ সদর থানার জাঁদরেল ওসি। সমস্ত হোটেলটা সে ইতিমধ্যে মোটামুটি ঘুরে দেখেছে। তন্নতর করে তল্লাশী করেছে দোতলার তেইশ নন্বর কামরাটা। রমেন গুহর মৃতদেহ এখনও অপসারিত হয়নি৷ ওর মৃত্যুশীতল পা দুটো দেখে নৃপেনের মনে পড়ে গেল একটু আগে দেখা একটা ডিনার প্লেটে পাশাপাশি শোয়ানো ভুক্তাবশিষ্ট মুরগির ঠ্যাঙ-জোড়া। পুলিস ফটোগ্রাফার এসে ফটো নিয়ে গেছে। দেহটা ময়না-তদস্তের জনা পাঠানো হয়নি এখনও। ইতিমধ্যে টেলেক্স চলে গেছে কলকাতায়, লালবাজার কন্ট্রোলরুমে। হয়তো রমেন গুহর পরিবারেও এতক্ষণে দুঃসংবাদটা পৌছে গেছে। যতক্ষণ না কেউ এসে পৌঁছাচ্ছে ততক্ষণ দেহটা ঠাণ্ডা ঘরে রাখতে হবে।


কেসটা আত্মহত্যাই – থ্রম্বোসিস-টম্বোসিস্‌ নয়--যদিও এখনও কিছু নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবু বড়কর্তার হুকুম ছাড়া দেহটা দাহ করাও চলবে না। সুবীর হেড-কোয়াটার্সে থাকলে ভাল হত। ছোকরার মাথাটা এসব বিষয়ে বেশ খেলে। দুর্ভাগ্যবশত সুবীর রায় দিন-তিনেক আগে একটা তদন্তে কার্শিয়াঙে গেছে। সুবীর ওর অধীনে পোস্টেড বটে, তবে ক্রিমিনাল-ইনভেস্টিগেশন বিষয়ে সে বিশেষ ট্রেনিং নিয়েছে। তুখোড় ছোকরা! এসব বিষয়ে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে টেক্কা দিতে পারে।
 

হার্টফেল যে নয়, কেসটা যে আত্মহত্যাই তা অনুমান করার যথেষ্ট কারণ আছে। মৃত রমেন গুহ আধশোয়া হয়ে পড়ে আছে তার খাটে; আর তার ডান হাতে ধরা আছে একটা কাঁচের গ্লাস। আশ্চর্য! গ্লাসটা কাত হয়ে যায়নি -- বস্তুত নৃপেন যখন ওকে পরীক্ষা করে তখনও মৃতদেহের ডান হাতে বজ্রমুষ্টিতে ধরা ছিল ঐ গ্লাসটা-- ঐ যে ‘রিগর মর্টিস’ না কী যেন বলে! নৃপেনের দৃঢ় বিশ্বাস গ্লাসের তরল পানীয়ে কোন তীব্র বিষ মিশিয়ে রমেন পান করেছে। বিষটা এতই তীব্র যে, তৎক্ষণাৎ ওর মৃত্যু হয়েছে! কিন্তু হঠাৎ এভাবে আত্মহত্যা কেন করল রমেন? কই গতকাল রাত্রেও তো সে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিল। যে লোক মধ্যরাত্রে বিষপানে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে সে কি সন্ধ্যারাত্রে ওভাবে হাসি-মশকরা করতে পারে? কিন্তু হত্যাই বা হবে কীকরে? রমেনের ঘর ছিল তালাবন্ধ! হোটেলে সে সবেমাত্র এসেছে। তার হাতের ঘড়ি, পকেটের পার্স পর্যন্ত খোয়া যায়নি। এখানে কেউ তাকে চেনে না, জানে না। কে, কোন উদ্দেশ্যে তাকে খুন করবে? তাছাড়া তালাবন্ধ ঘরে সে ঢুকবেই বা কী করে?
 

-- স্যার!
 

-- উঁ? সম্বিত ফিরে পায় নৃপেন দারোগা।
 

হাত দুটি গরুড় পক্ষীর মত জোড় করে ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে হোটেলের ম্যানেজার। বিনীতভাবে বলে, মুর্দাকে এবার হটাবার হুকুম দিয়া যায় সাব্‌। পূজা মরশুম। হমার সব বোর্ডার ভাগিয়ে যাবে!
 

একটা বজ্রদৃষ্টি নিক্ষেপ করে নৃপেন বলে, মুর্দা! ও লোকটা কে জান? বেঁচে থাকলে ও আজ বসত আমার চেয়ারে! ও একজন দারোগা!
 

ম্যানেজার যোগীন্দর কাপাডিয়া একটি তিনদুর্গ-আঁকা সবুজ টিন বাড়িয়ে ধরে! তার গর্ভে সাদা সিগারেট। যোগীন্দর গলাটা সাফা করে, মুর্দার যে জাত নেই এমন একটা দার্শনিক উক্তি করবে কিনা বুঝে উঠতে পারে না।
 

পাশ থেকে ওর অফিস-ক্লার্ক মহেন্দ্র বলে, সে আমরা জানতাম সার! দেখুন দেখি, কী কাণ্ড হয়ে গেল?
 

নৃপেন তিনদুর্গ আঁকা টিন থেকে একটি সিগারেট নিয়ে ধরায়। একমুখ ধোয়া ছেড়ে বলে- এখন বল দিকিন-- কে ওকে প্রথম ঐ অবস্থায় আবিষ্কার করে?
 

-- রুম-বেহারা সার। বীর বাহাদূর। বেড-টি দিতে গিয়ে --
 

বাধা দিয়ে নৃপেন বলে উঠে, নো সেকেন্ড-হ্যান্ড স্টোরি প্লীজ! রুম-বেহারাকো বোলাও!
 

শুধু রুম-সার্ভিসের বেহারার নয়, ডাক পড়ল অনেকেরই। ক্রমে ক্রমে এল তারা__এজাহার দিতে। কুক, হেডকুক, গেট-কীপার, কাউন্টার ক্লার্ক ইতাদি। টুকরো টুকরো জবানবন্দি থেকে সংগৃহীত হল সম্পূর্ণ কাহিনীটা। হোটেল-রেজিস্টার অনুযায়ী রমেন গুহ এসে পৌছায় পয়লা তারিখ বেলা বারোটায়।
দোতলার তেইশ নম্বরে আশ্রয় নেয়। সাড়ে বারোটায় সে মালপত্র রেখে বেরিয়ে যায়। ফিরে আসে রাত দশটায়। কোনও “মীল” নেয়নি সে। এমনকি এককাপ চা পর্যস্ত খায়নি। তার মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়েছে পরদিন সকাল ছটায়।
 

কাউন্টার ক্লার্ক মহেন্দ্রর জবানবন্দি অনুসারে কাল দুপুরে একটি ট্যাক্সি চেপে রমেন গুহ আসে। শেয়ারের ট্যাক্সি। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে এসেছে। ট্যাক্সিতে তিনজন লোক ছিল। তিনজনেই কাঞ্চনজঙ্ঘা হোটেলে ওঠে। দ্বিতলের পাশাপাশি তিনখানা সিংগল-সীটেড রুম ভাড়া নেয়। অথচ ওরা তিনজন পৃথক যাত্রী। ওরা পরস্পরকে চিনত না।
 

বাধা দিয়ে নৃপেন প্রশ্ন করেছিল, তুমি কেমন করে জানলে ওরা পরস্পরকে চিনত না?
 

-- স্বচক্ষে দেখলাম স্যার! ট্যাক্সি থেকে মালপত্র নামিয়ে ট্যাক্সিড্রাইভার এসে দাড়াল। ওঁরা তিনজনে ট্যাক্সি-ভাড়ার এক-তৃতীয়াংশ দিলেন। তারপর আমার হোটেল-রেজিস্টারে পর পর নাম লেখালেন। ঠিকানা সব আলাদা। একজন হিন্দু, একজন মুসলমান, একজন খ্রীষ্টান।
 

-- ঠিক আছে। এবার বল -- রমেন গুহর সহযাত্রী দু'জন কত নম্বরে আছেন?
মহেন্দ্র মাথা চুলকে বলে. সেইখানেই তো ঝামেলা হয়েছে স্যার। দু'জনেই ইতিমধ্যে চেক-আউট করে বেরিয়ে গেছেন।
 

-- বল কী! কাল বেলা বারোটায় চেক-ইন করে আজ সকাল সাতটাতেই চেক-আউট?
 

-- দু'জনেই নয় স্যার! মিস্টার মহম্মদ ইব্রাহিম চেক-আউট করেছেন কাল রাত সাড়ে আটটায় আর মিস্‌ ডিক্রুজা আজ ভোর পাঁচটায়!
 

-- মিস ডিক্রুজা! মেমসাহেব?
 

-- না সার। দিশি মেমসাহেব। দেখলে বাঙালী বলেই মনে হয়।
 

-- ভোর পাঁচটায়! অত ভোরে?
 

-- হ্যাঁ, স্যার। টাইগার-হিলে সানরাইজ দেখতে গেলেন যে। বললেন আজই নামবেন। মালপত্র নিয়েই চেক-আউট করে বেরিয়ে গেলেন।
 

সন্দেহজনক! অত্যন্ত সন্দেহজনক! রমেন গুহ মারা গেছে রাত দশটার পরে। তেইশ নম্বর ঘরে। আর ঠিক তার পাশের ঘরের বাসিন্দা কাকডাকা ভোরে হোটেল ছেড়ে দিল: পরবর্তী ঠিকানা না রেখে? অবশ্য মহম্মদ ইব্রাহিমকে সন্দেহ করার কিছু নেই। সে চেক-আউট করেছে রাত সাড়ে আটটায় -- রমেন তখনও নৃপেনের বাড়িতে। বহাল তবিয়তে। মহম্মদ ইব্রাহিম আর মিস্‌ ডিক্রুজার স্থায়ী ঠিকানা দুটো নৃপেন লিখে নিল তার নোট বইতে। খোদায় মালুম সেগুলো আদৌ সত্য কিনা? কাউন্টার-ক্লার্ক ছোকরাটি বেশ চলতা-পুর্জা! অনেক খবর দিতে পারল সে এ দু’জনের সম্বন্ধে। ছোকরা লক্ষ্য করেছে অনেক কিছুই। মিস্‌ ডিক্রুজার বয়স সাতাশ-আটাশ, যদিও সাজে-সজ্জায় সে নিজেকে বাইশ-তেইশ বলতে চায়। সুন্দরী। চমৎকার ফিগার। বিজ্ঞের মত বললে -- ভাইট্যাল স্টাটিসটিক্স হবে, এই ধরুন 34-28-32। চুল ছোট, বব্‌ নয়। রঙ মাজা, ফর্সা ঘেঁষা। খুব ভাল বাঙলা বলতে পারে – নাম না বললে বাঙালী বলে ভুল হতে পারে। সিগারেট খায়। ‘প্রফেশান’-এর ঘরে লেখা আছে ‘হাসিফ’। মিস্‌ কীকরে গৃহকর্ত্রী হয় তা জানে না মহেন্দ্র। তবে সে তাতে আপত্তি করেনি। তার সঙ্গে আছে একটা ভি.আই.পি.-মার্কা সাদা সুটকেস। অপর পক্ষে মহম্মদ ইব্রাহিমের বয়স ত্রিশের উপর, চল্লিশের নিচে। দীর্ঘকায়, বলিষ্ঠ গঠন। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি ও গোঁফ আছে, চোখে চশমা। পাইপ খান! প্রফেশান – তাঁর স্বীকৃতিমতো -- বিজনেস।
 

হেড-কুক সবিনয়ে নিবেদন করল খাবারে কোনক্রমেই কোন বিষাক্ত পদার্থ মিশে যেতে পারে না। তার যুক্তি প্রাঞ্জল, তাহলে তো হুজুর হোটেল শুদ্ধ লোক আজ মরে ভূত হয়ে থাকত।
 

নৃপেন ধমক দেয়, বাজে কথা ব’ল না। কে বলেছে খাবারে বিষ ছিল? রমেন তোমার কিচেনের খাবার খায়নি। কিন্তু ওর ঘরে থার্মোফ্লাস্কে জল রয়েছে দেখলাম। গরম জল তুমি সাপ্লাই করেছিলে?
 

হেডকুক সভয়ে নিবেদন করে, বোর্ডারের ঘরে থার্মোফ্লাস্কে জল থাকলে তা আমার কিচেন থেকেই সাপ্লাই হয়েছে নিশ্চয়ই। কিন্ত জল তো আমি স্রেফ কল থেকে নিয়ে গরম করেছি স্যার!
 

-- জানি! নর্দমা থেকে নাওনি! কিন্তু জলটা ওর ঘরে কে রেখে এসেছিল?
 

-- তার জিম্মাদারী আমার নয় হুজুর। রুম সার্ভিস বেহারার কাজ ওটা।
 

-- হুঁ! কী নাম সেই রুম-সার্ভিসের বেহারার?
 

-- বীর বাহাদুর, স্যার!
 

-- বীর বাহাদুর কার নাম?
 

কেউ সাড়া দেয় না।
 

নৃপেন প্রচণ্ড ধমক লাগায়; আধঘন্টা থেকে ডাকছি, বীর বাহাদুর আসছে না কেন? এরা ভেবেছে কি, দারোগা খুন করে পার পাবে! সব কটার মাজায় দড়ি বেঁধে চালান দেব আমি!
 

একটা রীতিমত শোরগোল পড়ে যায়। দু’তিনজন ছোটে বীর বাহাদুরের খোজে। যোগীন্দর কাপাডিয়া কী করবে ভেবে না পেয়ে আবার থ্রী-কাসলস্-এর টিনটা বাড়িয়ে ধরে। নৃপেন আবার একটা সিগারেট নিয়ে ধরায়।
 

তিনচার জনে ইতিমধ্যে পাকড়াও করে নিয়ে এসেছে বীর বাহাদুরকে। 

বেচারির পিতৃদত্ত নামের শেষ চিহ্নটুকু পর্যন্ত অবলুপ্ত। বীরত্ব এবং বাহাদুরি। নবমীর পাঁঠার মত কাঁপতে কাঁপতে এসে দাড়ালো দারোগা সাহেবের সামনে!
 

-- তোমার নাম বীর বাহাদুর?
 

-- জী হুজুর!
 

-- তোম বীর হ্যায় ইয়া বাহাদুর হ্যায়? বেঁটে লোকটা কী জবাব দেবে ভেবে পায় না।
 

অনেক জেরার পরে লোকটা হলফ্‌ খেয়ে বললে, সে থার্মোফ্লাস্কে বিষ-টিষ কিছু মেশায়নি। তার বিশ বছরের নোকরি! এমনটি এর আগে কখনও হয়েছে?
তুমি ফ্লাস্কটা নিয়ে কিচেন থেকে সোজা ঐ তেইশ নম্বর ঘরে গিয়েছিলে, না কি ফাস্কটা আর কারও হাতে ধরতে দিয়ে বিড়ি-টিড়ি খেয়েছিলে?
 

-- জী নেহি সাব! ম্যায় বিড়ি নেহি পীতা!
 

-- হেত্তেরি! যা জিজ্ঞাসা করছি তার জবাব দাও। সিধে তেইশ নম্বরমে গয়া থা ক্যা?
 

জী সাব!
 

-- ঠিক আছে! এবার আজ সকালের কথা বল। কখন তুমি প্রথম জানতে পারলে?
 

বীর বাহাদুর যে বর্ণনা দিল তা সংক্ষেপে এই:
হোটেলের আইন অনুসারে রাত সাড়ে দশটার পর রুম-সার্ভিস বন্ধ হয়ে যায়। ভোর সাড়ে চারটের আগে আর রুম-সার্ভিস পাওয়া যায় না। টাইগার-হিলে যাবার বায়নাক্কা থাকায় প্রায় প্রতিদিনই কিছু-কিছু বোর্ডারকে ভোর সাড়ে চারটে বেড-টি দিতে হয়। তাই শেষরাত্রে অন্ধকার থাকতেই কিচেনটি কর্মব্যস্ত হয়ে পড়ে।
 

বাধা দিয়ে নৃপেন প্রশ্ন করে, রুম নাম্বার চব্বিশে বেড-টির অর্ডার ছিল আজ?
 

-- জী নেহী! চব্বিশ মে হী বহ্ মেমসাব। উসনে বেড-টি নেহী লি-থি।
 

নৃপেন মহেন্দ্রর দিকে ফিরে বললে, তবে যে তখন তুমি বললে -- মিস ডিসুজা আজ সকালে টাইগার-হিলে গেছে?
 

মহেন্দ্র আমতা আমতা করে বললে, ইয়ে, টাইগার-হিলে যেতে হলে চা যে খেয়ে যেতে হবে, এমন কোন আইন নেই স্যার!
 

-- আমি জানি। বাজে কথা বল না! -- ধমক দেয় নৃপেন দারোগা। তারপর বীর বাহাদুরের দিকে ফিরে বলে, তেইশ নম্বরে বেড-টির অর্ডার ছিল?
 

-- জী সাব। পৌনে ছে বাজে!
 

ব্যাপারটা বিস্তারিত করে বুঝিয়ে দেয় বীর বাহাদুর। তেইশ নম্বরে ছিলেন এক দারোগা-সাহেব। মানে যিনি মারা গেছেন। তিনি পৌনে ছ’টায় চা চেয়েছিলেন। বীর বাহাদুর ঠিক সময়ে চায়ের ট্রে নিয়ে ওঁর দরজার সামনে এসে নক করে। কেউ সাড়া দেয় না। অনেকক্ষণ ধরে ডাকাডাকি করে। তবু কেউ সাড়া দেয় না। এ সময় ওদিককার খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে এক সাহেব পাইপ খাচ্ছিলেন। তিনি বাহাদুরকে বলে ওঠেন, ‘কেন হোটেলশুদ্ধ লোকের সুখনিদ্রায় বাধা দিচ্ছ বাবা? তোমার এ কুম্ভকর্ণ সাহেবের ঘুম যখন ভাঙবে তিনি নিজেই চা চাইবেন।' তখন বাহাদুর সেই পাইপ-মুখো সাহেবকে বলেছিল, ‘এমন কান্ডটা ঘটলে ম্যানেজার রাগ করবেন স্যার। উনি ভাববেন, আমি মিছে কথা বলছি -- সময়মত বেড-টি দিতে আসিনি আমি।‘ তখন সেই পাইপমুখো সাহেব বললেন, “তুমি আমাক সাক্ষী পেলে বাবা। আমি দরকার হলে আদালতে হলফ নিয়ে বলব--তোমার চেষ্টার ত্রুটি ছিল না।
 

নৃপেন প্রশ্ন করে, উনি অত ভোরে এ ঠাণ্ডার মধ্যে দাঁড়িয়ে কী করছিলেন?
 

-- বহ নেহি জানতা সাব!
 

মহেন্দ্র উপর পরা হয়ে বলে, ঐ বারান্দা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার সান-রাইজ দেখা যায় স্যার। উনি বোধহয় --
 

-- তুমি চুপ কর! --ধমক দিয়ে ওঠে নৃপেন। তারপর বাহাদুরের দিকে ফিরে বলে, তারপর? বলে যাও --
 

বীর বাহাদুর তার জবানবন্দি শুরু করে। ঠিক এ সময়েই নাকি সেই তেইশ নম্বর ঘরের ভিতর একটা অ্যালার্ম ক্লক বেজে ওঠে। পুরো এক মিনিট সেটা বাজে। তাতেও ঘরের ভিতর কোন সাড়া শব্দ জাগে না৷ পাইপমুখো সাহেব এবার কৌতুহলী হয়ে নিজেই এগিয়ে আসেন। চাবির ফুটোয় চোখ লাগিয়ে বলে ওঠেন, আশ্চর্য! ঘরে আলো জ্বলছে! এরপর উনি একটা দেশলাই জ্বেলে দরজার উপর কার্ড আটকানো খোপটা দেখে বলে ওঠেন, ‘রমেন গুহ! পুলিশের লোক নাকি?’ বীর বাহাদুর জবাবে বলেছিল, ‘জী সাব’! পাইপমুখো তখন বলেন, ‘তবে তো আমার চেনা লোক মনে হচ্ছে। তুমি এক কাজ করতো হে! কাউন্টারে গিয়ে এ ঘরের ডুপ্লিকেট চাবিটা নিয়ে এস’। বীর বাহাদুর অগত্যা ট্রেটা নামিয়ে রেখে একতলায় কাউন্টারে ফিরে যায়। কাউন্টার- ক্লার্ক মহেন্দ্র বাহাদুরকে একটা ‘মাস্টার-কী’ দেয়। সেটা নিয়ে বাহাদুর
 

-- দাঁড়াও! দাঁড়াও --এখানেই বীর বাহাদুরের জবানবন্দি থামিয়ে নৃপেন মহেন্দ্রের দিকে ফিরে প্রশ্ন করে – ‘মাস্টার কী’ বস্তুটা কী?
 

-- প্রতি ঘরের ‘ডুপ্লিকেট কি’ ছাড়াও আমার কাছে দুটো মাস্টার কী আছে। তার একটা চাবি দিয়ে এক তলার সব ঘর খোলা যায়! দ্বিতীয়টা দিয়ে দোতলার সব ঘর খোলা যায়।
 

-- আই সী। তা তুমি বাহাদুরকে এ তেইশ নম্বর ঘরের ডুপ্লিকেট চাবিটা না দিয়ে ফস্‌ করে ‘মাস্টার-কী’ দিয়ে বসলে কেন?
 

-- তেইশ নম্বর ঘরের দুটো চাবিই ঐ গুহ-সাহেব আমার কাছ থেকে নিয়ে রেখেছিলেন।
 

-- দুটো চাবিই তোমরা বোর্ডারকে দাও?
 

-- না স্যার। তবে আমি জানতাম ঐ গুহ-সাহেব আপনার জায়গায় বদলি হয়ে আসছেন) তাই—
 

-- বুঝেছি! --নৃপেন এবার বাহাদুরের দিকে ফিরে বললে. প্রসিড!
বুঝতে অসুবিধা হল ন৷ বাহাদুরের। সে তার জবানবন্দির সূত্র তুলে নেয়।
মাস্টার-কী দিয়ে দরজা খুলে ওরা দু’জনে ঘরে ঢোকে -- বাহাদুর আর সেই পাইপ-মুখো সাহেব! দেখে, টেবিল ল্যাম্পটা জ্বলছে। টেবিলের উপর মুখ-বন্ধ-করা একটা জলের ফ্লাস্ক, একটা হুইস্কির বোতল, এক প্যাকেট ক্যাপস্টান সিগারেট. একটা দেশলাই একটা অ্যাশট্রে আর একটা অ্যালার্ম ক্লক। রমেনের হাতে দৃঢ়মুষ্টিতে ধরা আছে একটা কাঁচের গ্লাস --তাতে ঈষৎ পীতাভ কিছু তরল পানীয়। সম্ভবত গরমজলে মেশানো হুইস্কি ছিল ঘণ্টাকতক আগে -- তখন বরফ-ঠাগ্ডা। বীর বাহাদুর কোনক্রমে চায়ের ট্রেটা নামিয়ে রাখে। পাইপ-মুখো সাহেব রমেনকে পরীক্ষা করেন। নাড়ি দেখেন, কানের নিচে চোয়ালের তলায় কী একটা পরীক্ষা করেন। তারপর বাহাদুরের দিকে ফিরে বলেন, “মারা গেছে। তোমার ম্যানেজারকে খবর দাও”। বাহাদুর হুড়মুড়িয়ে নেমে আসে নিচে।
 

-- সে কী! ঐ পাইপ-মুখো সাহেবকে এ ঘরে একা রেখে?
 

-- জী হুজুর। ইয়ে তো বাতায়া বহ্। কহা কি ম্যানেজারকো সেলাম দো!
 

-- সেলাম দেওয়াচ্ছি! -- নৃপেন ঘুরে দাঁড়ায় যোগীন্দরের মুখোমুখি। বলে, কী মশাই, তবে যে বললেন মৃতদেহ আবিষ্কারের পরে ও ঘরে কেউ ঢোকেনি? ওটা তালাবন্ধ পড়ে আছে!
 

যোগীন্দর আমতা আমতা করে। মহেন্দ্র বলে, ইয়ে -- বাহাদুর নিচে এসে খবর দেওয়া মাত্র আমি ঐ ঘরে উঠে যাই। মিনিট তিন-চারের বেশি ঐ বোর্ডার-ভদ্রলোক ও ঘরে একা ছিলেন না!
 

-- থাম তুমি? হুঁ:! তিন-চার মিনিট! চার মিনিট কি কম সময়? ওর ভিতর অনেক কিছু করে ফেলা যায়, বুঝেছ? সব ক’টার মাজায় দড়ি বাঁধব আমি।
যোগীন্দর সিগারেটের টিনটা বাড়িয়ে ধরবে কি না ভেবে পায় না। নৃপেনের আগের সিগারেটটা তখনও শেষ হয়নি।
 

-- ঐ পাইপ মুখো কি হোটেলে আছেন, নাকি তাকেও চেক-আউট করিয়ে দিয়েছ?
 

মহেন্দ্র হাত কচলে বলে, না স্যার, উনি আছেন। একতলায় একটা ডবল-বেড রুম নিয়ে আছেন। সস্ত্রীক।
 

-- দেখবে, ইতিমধ্যে তিনি না কেটে পড়েন। তাঁকে খবর দাও -- আমি দশ মিনিটের মধো তাঁর কাছে যাচ্ছি। তাঁর এজাহারটা নিতে হবে--
যোগীন্দরের ইঙ্গিতে একজন তখনই চলে গেল পাইপ-মুখোকে রুখতে।
 

-- তারপর? উপরে এসে কি দেখলে? না তুমি নয় – বাহাদুর বল। পাঁচ মিনিট পরে যখন তুমি উপরে এলে তখন কি দেখলে? পাইপ-মুখো কী করছিলেন তখন?
 

-- তামাম কামরামে তালাশ করতা থা!
 

-- বাঃ বাঃ বাঃ! চমৎকার! – নৃপেন দারোগা দগ্ধাবশেষ সিগারেটটা ছুঁডে ফেলে দিয়ে যোগীন্দরের দিকে ফেরে। বলে, কী মশাই? আপনি অম্লানবদনে বললেন ঘরটা বরাবর তালাবন্ধ আছে! কেউ কিছু টাচ করেনি, ট্যাম্পার করেনি?
 

যোগীন্দর তৎক্ষণাৎ সিগারেটের টিনটা বাড়িয়ে ধরে।
 

-- দূর মশাই! সিগারেট নিয়ে কী করব? যা জিজ্ঞাসা করছি তার জবাব দিন!
যোগীন্দর হাত দুটি জোড় করে বললে, স্যার! বাসু-সাহেবকে আমি বিশ বরিষ ধরে জানি। নাম করা ব্যারিস্টার। উনি কোন কিছু ট্যাম্পার করতেই পারেন না।
 

-- বাসু-সাহেব! কে বাসু-সাহেব?
 

-- যাকে বীর বাহাদুর পাইপ-মুখো সাহেব বলছে। ওঁর নাম পি. কে. বাসু আছে। উনি বহুবার আমার হোটেলে উঠেছেন। একদম শরীফ আদমি! এককালে ক্রিমিনাল ল-ইয়ার হিসাবে লাখ লাখ টাকা খিঁচেছেন। এখন প্র্যাকটিস ছেড়ে দিয়েছেন।
 

-- লাখ লাখ টাকা খেঁচার সঙ্গে গোয়েন্দাগিরির কোন সম্পর্ক নেই, বুঝেছেন? যাক তার সাথে তো এখনই কথা বলব। তারপর কী হল বলুন?
 

জবাব দিল মহেন্দ্র --তারপর আর কী? আমরা ঘরটা তালাবন্ধ করে নেমে এলাম। আপনাকে ফোন করলাম। ঠিক ছটা বেজে দশে।
 

ইতিমধ্যে একজন বেহারা এসে দাঁড়ায়। তার হাতে একটা খালি ব্রান্ডির শিশি। নৃপেন সেটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসা করে, খুব ভাল করে ধুয়েছিস তো?
 

-- হ্যাঁ স্যার! খুব ভাল করে বার বার ধুয়েছি।
 

-- ঠিক আছে। এবার আর একবার ঐ তেইশ নম্বর ঘরে যেতে হবে। চলুন।
তেইশ নম্বর ঘরে এসে নৃপেন স্বহস্তে ঐ কাঁচের গ্লাস থেকে তরল পদার্থটা শিশিতে ভরে নিল। তারপর ঘরে তালা দিয়ে বেরিয়ে এল। নেমে এল নিচে। সকলকে বিদায় দিয়ে একাই চলে এল নির্দেশমত একতলায় এক নম্বর ঘরে। সব ঘরেই ইয়েল-লক, ছিটকিনি নেই। অর্থাৎ দরজা ঠেলে বন্ধ করলে চাবিছাড়া দরজা খোলা যায় না। এক-নম্বর ঘরের দরজা খোলাই ছিল। ভারী পর্দা ঝুলছে। নৃপেন খোলা দরজায় ‘নক’ করল। ভিতর থেকে আহ্বান এল, ইয়েস! কাম ইন প্লিজ্!
 

পর্দা সরিয়ে নৃপেন প্রবেশ করল ঘরে।
 

ডবল-বেড বড় ঘর! একজন ভদ্রমহিলা বসেছিলেন একটা চাকা-ওয়ালা চেয়ারে। তার হাতে একজোড়া উলের কাঁটা। উলের সোয়েটার বুনছিলেন। তাঁর মুখোমুখি একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক ড্রেসিংগাউন পরে বসেছিলেন ইজি-চেয়ারে। বোধকরি কী একখানা বই পড়ে শোনাচ্ছিলেন স্ত্রীকে বইটা মুড়ে এদিকে ফিরে বললেন, বসুন। মিস্টার ঘোষাল আই প্রিসিউম? ও.সি. সদর?
 

-- হ্যাঁ। আপনাকে বিরক্ত করতে হচ্ছে বলে দুঃখিত।
 

নট দ্য লীস্ট, নট দ্য লীস্ট! বলুন, কী ভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি। বাই দ্য ওয়ে, আপনার হাতে ওটা কী? ব্র্যান্ডি?
 

-- না! মৃতের হাতের গ্লাসে যে তরল পদার্থটা ছিল সেটা নিয়ে যাচ্ছি। কেমিক্যাল অ্যানালিসিস করাতে হবে।
 

-- ও! তা করান। তবে কী পাবেন তা আগেই বলে দিতে পারি। অ্যালকোহল, অ্যাকোয়া আর কে. সি. এন!
 

“কে সিয়েন” মানে?
 

‘পটাসিয়াম সায়ানাইড’।
 

প্রৌঢ় ভদ্রলোকের এই বিদো জাহির করবার প্রচেষ্টা দেখে নৃপেন মনে মনে হাসে কিন্তু ভদ্রলোকের চেহারায় এমন একটা আভিজাত্য আছে যে. সে প্রকাশ্যে হেসে উঠতে পারল না। বললে. আপনি ব্যারিস্টার মানুষ! নিশ্চয় বুঝবেন, অমন আপ্তবাক্যে কোনও কোর্টে কখনও কনভিকশন্‌ হয় না। এটা এভিডেন্স হিসাবে তখনই গ্রাহ্য হবে যখন কোন রাসায়নিক বিশেষজ্ঞ তাঁর ল্যাবরেটারিতে পরীক্ষা করে একটা রিপোর্ট দেবেন।
 

-- কারেক্ট! কোয়াইট কারেক্ট! এ-ক্ষেত্রে অবশ্য বিশেষজ্ঞের রিপোর্ট সত্বেও ওটা এভিডেন্স হিসাবে গ্রাহ্য হবে না!
 

হাসি-হাসি মুখে বাসু-সাহেব তাকিয়ে থাকেন নৃপেন দারোগার দিকে। অর্থাৎ এবার আপনি জানতে চান-- কেন গ্রাহ্য হবে না? তা কিন্তু জানতে চাইল না নৃপেন। সে মনে মনে রীতিমত চটে উঠেছে এ ভদ্রলোকের অহেতুক মোড়লিতে। ওকে নীরব থাকতে দেখে বাসু-সাহেব নিজেই বলে ওঠেন – কেন গ্রাহ্য হবে না জানেন?
 

এতক্ষণে রুখে ওঠে নুপেন, না, জানি না। জানতে চাইও না!
 

বাসু-সাহেব কিন্তু রাগ করেন না। হেসেই বলেন -- গ্র্যাটিস লীগ্যাল অ্যাডভাইস আমি দিই না; কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে না হয় ব্যাতিক্রমই করলুম! আপনার উচিত ছিল যে-সব সাক্ষীর সামনে এ তরল পানীয়টা সংগ্রহ করেছেন তাদের উপস্থিতিতেই ওটা সীলমোহর করা! ডিফেন্স কাউন্সিলারগুলো ভারি পাজি হয় বুঝেছেন--তারা কিছুতেই মানতে চাইবে না বিশেষজ্ঞের রিপোর্টে যে লিকুইডটার পরিচয় লেখা আছে সেটাই ঐ মৃত ব্যক্তির হাতে পাওয়া গেছে! বলবে, সীল যখন করা নেই তখন অ্যাকিউসডকে ফাঁদে ফেলতে আপনি নিজেই ওতে কিছুটা পটাসিয়াম সায়ানাইড মিশিয়ে দিয়েছেন। ইন ফ্যাক্ট আপনি ইচ্ছে করলে এখনও তা মেশাতে পারেন। তাই নয়?
কর্ণমূল পর্যন্ত আরক্ত হয়ে ওঠে নৃপেনের!
 

-- যাক ও কথা। আমার কাছে কী জানতে চান বলুন?
 

অপমানটা গলাধঃকরণ করে নূপেন আরও মরিয়া হায়ে ওঠে। বলে, আপনিই মৃতদেহটা প্রথম আবিষ্কার করেন?
 

-- নট একজ্যাক্টলি! আমরা দুজন। আমি আর বীর বাহাদুর।
 

-- এবং তার পরেই আপনি বীর বাহাদুরকে নিচে যেতে বলেন?
 

-- অ্যাফার্মেটিভ!
 

-- আপনি কতক্ষণ এ ঘরে একা ছিলেন?
 

-- পাঁচ থেকে সাত মিনিট।
 

-- ঐ পাঁচ-সাত মিনিট ধরে আপনি ঘরটা তন্ন তন্ন করে সার্চ করেছেন?
 

-- পাঁচ-সাত মিনিটে একটা ঘর তন্ন তন্ন করে সার্চ করা যায় না। মোটামুটি তল্লাশী করেছিলাম।
 

-- কাজটা ভাল করেননি।
 

মিসেস বাসু তার হইল চেয়ারটা চালিয়ে পিছনের বারান্দার দিকে চলে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ থেমে পড়েন একথায়। বাসু-সাহেব হাসি-হাসি মুখেই বলেন, য়ু থিংক সো?
 

রূঢ়তর কণ্ঠে নৃপেন বলে, হ্যাঁ, তাই মনে করি আমি। আপনি হয়তো কিছু ফিঙ্গার প্রিন্ট নষ্ট করে ফেলেছেন, তল্লাশী করতে গিয়ে।
 

-- করিনি। আমার হাতে গ্লাভস পরা ছিল। তা ছাড়া এ-সব কেস কীভাবে হান্ডেল করতে হয় আমার জানা আছে!
 

এবার আর আত্মসংবরণ করতে পারে না নৃপেন। রীতিমত ধমকের সুরে বলে, না! আপনি অন্যায় করেছেন! আপনি ক্রিমিনাল লইয়ার, ডিটেকটিভ নন! তবু লইয়ার হিসাবে আপনার জানা থাকা উচিত যে, পুলিস এসে পৌঁছানোর আগে কোন কিছু পরীক্ষা করার অধিকার আপনার নেই!
 

মিসেস বাসু শঙ্কাভরা দু’চোখ মেলে বাসু-সাহেবের দিকে তাকালেন। তার স্বামীকে তিনি ভালমতই চিনতেন। বাসু-সাহেবের সঙ্গে তার চোখাচোখি হল। বোধ করি সেজন্যই কোনও বিস্ফোরণ হল না। বাসু-সাহেব শান্তভাবে শুধু বললেন, লুক হিয়ার মিস্টার ও.সি. হেড-কোয়ার্টার্স! আমার অধিকার সম্বন্ধে আমি সম্পূর্ণ সচেতন। হিয়ার্স মাই কার্ড! আপনি যা ভাল বোঝেন করতে পারেন!
 

নৃপেন হাত বাড়িয়ে কার্ডটা গ্রহণ করে না। চেয়ার ছেড়ে সে উঠে দাঁড়ায়।
 

বাসু-সাহেব বলেন, আগেই বলেছি গ্র্যাটিস্‌ লীগাল অ্যাডভাইস দেওয়া আমার স্বভাব নয়। এ ক্ষেত্রে তবু দিতে বাধ্য হচ্ছি এজন্য যে, রমেন গুহ ছিল আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন!
 

-- রমেন গুহ আপনার পরিচিত?- প্রশ্ন করে নৃপেন।
 

বাসু-সাহেব সে প্রশ্নের জবাব না নিয়ে বলেন, এটা যে আত্মহত্যা নয়, বরং একটা ফার্স্ট ডিগ্রি ডেলিবারেট মার্ডার তার অকাট্য এভিডেন্স আমি পেয়েছি। যেহেতু কেসটা রমেন গুহর, তাই কতকগুলো ক্লু আপনাকে দিতে চাই। আপনি কি দয়া করে বসবেন?
 

নৃপেন বসে না। একগুঁয়ে ছেলের মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলে, কী ক্লু?
 

বাসু-সাহেব পাইপটা ধরালেন। বললেন, মাথা ঠাণ্ডা করে ব্যাপারটা শুনলেই কিন্তু আপনি ভাল করতেন। তাতে আপনার নেহাৎ আপত্তি থাকলে আমি বিপুলকেই সব কথা জানাব। আফটার অল, এটা রমেন গুহর কেস!
 

-- বিপুল! বিপুল কে?
 

-- ডি.সি. দার্জিলিঙ। বিপুল ঘোষ, আই.এ.এস.। তার স্ত্রী মণির মামা হই আমি।
 

নৃপেন বসে পড়ে। পথে নয়, চেয়ারে। বলে, বলুন, কী বলবেন?
 

-- আপনি তদন্ত করে কী বুঝেছেন? এটা আত্মহত্যার কেস?
 

-- না! রমেনের আত্মহত্যার কোন কারণ খুঁজে পাইনি আমি। গতকাল রাত্রি প্রায় দশটা পর্যন্ত সে আমার বাড়িতেই ছিল। দিব্যি স্বাভাবিক মানুষ। আমাদের সঙ্গেই রাত্রে খেয়েছে, হাসি-গল্প করেছে -- হোটেলে ফিরে এসে সে তার স্ত্রীকে যে চিঠি লিখেছে তাতেও কোন ইঙ্গিত নেই!
 

-- সুতরাং...?
 

কিন্তু ওকে এখানে কে হত্যা করতে চাইবে? ওর হাতঘড়ি, মানিব্যাগ পর্যন্ত খোয়া যায়নি!

-- রমেন গুহ দারোগা ছিল। যেখান থেকে ও বদলি হয়ে এসেছে সেখানকার কোর্টে এমন দশ-বিশটা কেসে হয়তো তাকে সাক্ষী দিতে যেতে হত। অন্তত একডজন আসামী খুশি হবে লোকটা বেমকা মারা গেলে, নয়? তাদের মধ্যে অন্তত আধডজন পাকা ক্রিমিনাল!
 

খুনী-ডাকাত-ওয়াগনব্রেকার ব্ল্যাকমার্কেটিয়ার! তাদের মধ্যে কেউ--
 

-- কিন্তু তাদের মধ্যে কেউ ওর রুদ্ধদ্বার ঘরে মদের পাত্রে বিষ মিশিয়ে দেবার সুযোগ পাবে কেমন করে? রমেন কাল বেলা বারোটায় হোটেলে ঢুকেছে, সাড়ে বারোটায় ঘরে তালা মেরে বেরিয়ে গেছে। ফিরেছে রাত দশটায়! এর মধ্যে তার ঘরে কেউ ঢোকেনি।
 

-- য়ু থিংক সো?
 

-- নিশ্চয়! আপনি হয় তো জানেন না, ও তার ঘরের দুটো চাবিই চেয়ে নিয়েছিল।
 

-- জানি। কিন্তু কেন? দুটো চাবি নিয়ে সে কী করবে? সে তো একা মানুষ!
নৃপেন একটু ইতস্তত করে। তারপর বলে, আমি জানি না।
 

-- আই সী! জানেন না!
 

আবার রুখে ওঠে নৃপেন, কেন, আপনি জানেন?
 

-- জানি। কিন্তু ও কথা থাক। তার আগে বলুন তো --বীর বাহাদুর ঠিক ক’টার সময় গরম জল ভর্তি ফ্রাঙ্কটা ওর ঘরে রেখে আসে?
 

নৃপেন আবার অস্বোয়াস্তি বোধ করে। বলে, আমি জানি না।
 

-- আই সী! জানেন না! সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায়। আমি জিজ্ঞাসা করে জেনে নিয়েছিলাম। রমেন যখন সাড়ে বারোটার সময় বেরিয়ে যায় তখনই বলে যায়, তার ঘরে যেন এক ফ্লাস্ক গরম জল রেখে দেওয়া হয়। ফ্লাস্কটা তার নিজের। এখন বলুন তো, দুটো চাবিই যখন রমেনের কাছে তখন বীর বাহাদুর কেমন করে ও-ঘরে ঢুকল?
 

এ সমস্যা অনায়াসে সমাধান করে নৃপেন। বলে, জানি। এ মাস্টার-কী দিয়ে।
 

-- ও! জানেন! তাহলে আপনার এ আগেকার স্টেটমেন্টটা তো ঠিক নয়। এ যে বললেন—বেলা সাড়ে বারোটা থেকে রাত দশটার মধ্যে ও-ঘরে কেউ ঢোকেনি!
 

নৃপেন অসহিষ্ণুর মত বলে ওঠে, কী আশ্চর্য! বীর বাহাদুর কেন বিষ মেশাবে? সে এ হোটেলে বিশ বছর চাকরি করছে-- তার কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে?
 

-- কারেক্ট! কিন্তু বীর বাহাদুর তার মাস্টার-কী দিয়ে যখন ঘরটা খুলেছিল তখন আর কেউ কি এ ঘরে ঢুকেছিল তার সঙ্গে?
 

নৃপেন বিহ্বল হয়ে পড়ে। এ-জাতীয় অনুসন্ধান সে করেনি।
 

বাসু সাহেব নিজে থেকেই বলেন, ঢোকেনি। আমি বীর বাহাদুরকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিয়েছি। সে তালা খুলে একাই ঘরে ঢোকে; ফ্লাস্কটা নামিয়ে রেখে বেরিয়ে আসে। ঘরটা আবার তালাবন্ধ করে। পুরো এক মিনিটও সে ছিল না এ ঘরে! সুতরাং আর কেউ কোন সুযোগই পায়নি।
 

-- তার মানে আপনি বলতে চান, বীর বাহাদুরই একমাত্র সন্দেহজনক ব্যক্তি?
 

-- আমি মোটেই তা বলছি না। কারণ আমার কাছে এভিডেন্স আছে__বীর বাহাদুর ছাড়াও অন্তত দু’জন এ ঘরে ঢুকবার সুযোগ পেয়েছিল, গতকাল বেলা বারোটার পরে এবং আজ সকাল ছ’টার আগে!
 

ভ্রূ কুঞ্চিত হয় নৃপেনের। বলে, কী বলছেন! দু’জন এ ঘরে ঢুকেছিল?
 

-- ডিড আই সে দ্যাট? আমি বলেছি ঢুকবার সুযোগ পেয়েছিল।
 

-- অর্থাৎ তারা যে ঢুকেছিল তার প্রমাণ নেই?
 

-- আছে! একজন যে ঢুকেছিল তার একটা প্রমাণ আছে। দ্বিতীয়জনও খুব সম্ভবত ঢুকেছিল। কনক্লুসিভ প্রুফ নেই, কিন্তু অত্যন্ত জোরালো যুক্তি আছে।
নৃপেন বুঝতে পারে এ ভদ্রলোক সহজ মানুষ নন। উনি অনেক কিছু জেনে ফেলেছেন, বুঝে ফেলেছেন। চোখ তুলে দেখে মিসেস্‌ বাসু কখন অলক্ষ্যে চলে গেছেন ঘর ছেড়ে, পিছনের বারান্দায়। সাগ্রহে সে বলে, বলুন স্যার, কী প্রমাণ পেয়েছেন! বাই দা ওয়ে, রমেন গুহকে আপনি কেমন করে চিনলেন?
--আপনার দ্বিতীয় প্রশ্নটা আপাতত মুলতুবি থাক। প্রথম প্রশ্নটার জবাব দিই। একটা অনুমান, একটা প্রমাণ। অনুমানের কথাটাই আগে বলি। মহেন্দ্র আমার কাছে স্বীকার করেছে যে গতকাল রাত সাতটা নাগাদ বাইশ-নম্বর ঘরের বোর্ডার মহম্মদ ইব্রাহিম এসে তাকে বলে যে, তার ঘরের চাবিটা ঘরের ভেতর থাকা অবস্থায় সে ভুল করে ইয়েল-লক-ওয়ালা দরজাটা বন্ধ করে ফেলেছে। মহেন্দ্র তখন ওকে মাস্টার-কীটা দেয়। ইব্রাহিম মিনিট পাঁচেক পরে ফিরে এসে চাবিটা ফেরত দেয়। ফলো?
 

-- ইয়েস!
 

-- এনি কোশ্চেন?
 

-- কোশ্চেন! না কোশ্চেন কিসের?
 

তাহলে আমিই প্রশ্ন করি! মহেন্দ্র মাস্টার-কীটা কেন দিল? কেন নয় এ বাইশ-নম্বর ঘরের ডুপ্লিকেট চাবিটা?
 

নৃপেন বলে, ওতো একই কথা।
 

-- আজ্ঞে না দারোগা-সাহেব! মোটেই এক কথা নয়! মহেন্দ্র আমার কাছে স্বীকার করেছে চেক-ইন করবার সময় রমেন যখন তার ঘরের ডুপ্লিকেট চাবিটা চেয়ে নেয়, তখন ইব্রাহিমও তার ঘরের ডুপ্লিকেট চাবিটা চেয়ে নেয়। একজনকে সেটা দিয়ে দ্বিতীয়জনের ক্ষেত্রে মহেন্দ্র সেটা প্রত্যাখ্যান করতে পারেনি।
 

-- সো হোয়াটঃ তাতে হ’লটা কী? ডুপ্লিকেট চাবিতেও বাইশ-নম্বর খোলা যায়, মাস্টার-কীতেও খোলা যায়! ও তো একই ব্যাপার!
 

-- না! ডুপ্লিকেট চাবিতে শুধু বাইশ-নম্বর ঘরের দরজা খোলা যায়, আর মাস্টার-কী’তে দোতলার সব কটা ঘর খোলা যায়! ইব্রাহিম এ পাঁচ মিনিটের ভিতর তেইশ-নম্বর ঘরে ঢুকে থাকতে পারে। তার আধঘণ্টা আগে কিন্তু বীর বাহাদুর ফ্রাস্কটা রেখে গেছে। ফ্লাস্কটা খুলে তার ভিতর একটা ক্রিস্টাল ফেলে বেরিয়ে আসতে বিশ থেকে ত্রিশ সেকেন্ড লাগার কথা।
 

নৃপেন জবাব দিতে পারে না। অনেকক্ষণ পরে বলে, আশ্চর্য্য! মহেন্দ্র তো এসব কথা আমাকে বলেনি।
 

-- আপনি প্রশ্ন করেননি, তাই বলেনি। সে এখনও জানে না ব্যাপারটার ইমপ্লিকেশন। আপনার মতো সেও বিশ্বাস করে ডুপ্লিকেট চাবি আর মাস্টার-কী একই কথা। দুটোতেই বাইশ নম্বর ঘর খোলা যায়।
 

একটা ঢোক গিলে নৃপেন বলে, আর আপনার দ্বিতীয় অনুমানটা, স্যার?
 

-- দ্বিতীয়টা অনুমান নয়, আগেই বলেছি --সেটা এভিডেন্স! অকাট্য প্রমাণ! আসুন--
 

নৃপেনকে নিয়ে বাসু সাহেব দ্বিতলে উঠে আসেন। তালা খুলে দু’জনে ঐ তেইশ নম্বর ঘরে ঢুকে পড়েন। রমেন গুহ একইভাবে পড়ে আছে। বাসু-সাহেব পকেট থেকে একটা লোহার সোন্না বার করলেন। এগিয়ে এলেন টেবিলটার কাছে। অতি সাবধানে সোন্না দিয়ে অ্যাশট্রের গর্ভ থেকে উদ্ধার করলেন একটি দগ্ধাবশিষ্ট ফিলটার টিপ্ড সিগারেটের স্টাম্প। আগুনের উপর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে যেমনভাবে শিককাবাব ভাজা হয় তেমনি ভাবে সোন্নাটা টেবিল-ল্যাম্পের আলোয় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখান। নৃপেন বিস্ফারিত নেত্রে দেখতে থাকে। কী দেখছে তা সেই জানে।
 

-- দেখলেন?- প্রশ্ন করলেন বাসু-সাহেব।
 

নৃপেন আমতা আমতা করে বললে, হুঁ!
 

-- কী দেখলেন?
 

এবার নৃপেন বিরক্ত হয়ে বলে, কী আবার দেখব সিগারেটের স্টাম্প! আশট্রের ভিতর আবার কী থাকবে?
 

মাথা নাড়েন বাসু-সাহেব। বলেন, থাকে দারোগা-সাহেব, থাকে! চোখ থাকলে দেখবেন অ্যাশট্রের খোপে সিগারেটের স্টাম্পের মধো লুকিয়ে বসে আছে একটি অভিসারিকা! তার নয়নে মদির কটাক্ষ, সর্বাঙ্গে উদগ্র যৌবন, বিম্বোষ্ঠে লিপস্টিক - বোধকরি ম্যক্সফ্যাকটার-ভার্মিলিয়ান!
 

নৃপেনের সন্দেহ জাগে। প্রৌঢ় ভদ্রলোকের কি মাথায় দু-একটা স্ক্রু আলগা! নাকি এই সাত-সকালেই মদ্যপান করেছেন? কিন্তু এতক্ষণ তো ওঁকে প্রতিভাবান গোয়েন্দার মতো মনে হচ্ছিল।
 

বাসু-সাহেব নৃপেনের দিকে চোখ তুলে চাইলেন। ওর বিহ্বল অবস্থাটা বুঝে নেবার চেষ্টা করলেন।আবার মাথা নাড়লেন। তারপর বললেন, একটা কথা খোলাখুলি বলব দারোগা-সাহেব?
 

-- বলুন স্যার!
 

-- আপনার কম্মো নয়!
 

মিসেস ডি.সি.-র মামা! কী বলতে পারে নৃপেন? একজন সিনিয়ার আই.এ.এস. যাঁকে মামা ডাকেন তাঁর অধিকার আছে এ কথা বলার। সংবিধানের কত নম্বর ধারায় ওটা বলা আছে নৃপেন তা ঠিক জানে না, কিন্তু এটুকু মনে আছে -- কম্পিটিটিভ পরীক্ষা দেবার সময় আব্রিভিয়েশান মুখস্থ করেছিল: IAS শব্দের বিস্তারিতরূপ In Anticipation of Sword অর্থাৎ এমন একটি শাসকগোষ্ঠী যাঁদের তরোয়ালের প্রয়োজন নেই -- যাঁরা হাতে-মাথা-কাটেন! বিপুল ঘোষ সেই আই.এ.এস.-গোষ্ঠীর একজন সিনিয়র অফিসার -- দুদিন পরে হয়তো ডিভিশনাল কমিশনার হবেন। এ ভদ্রলোক হচ্ছেন তাঁর বেটার-হাফের মামা!
 

নৃপেন ঢোক গেলে!
 

বাসু-সাহেব ওর পিঠে একখানা হাত রেখে বলেন, দুঃখ করবেন না মিস্টার ঘোষাল। লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।ক্রিমিনোলজি ইজ এ সায়েন্স! দারোগা মানেই ডিটেকটিভ নয়! আপনাদের আই.জি.-ও এ ভুল করতে পারেন, যদি না তিনি ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশনে বিশেষ ট্রেনিং নিয়ে থাকেন। আমার পরামর্শ শুনুন --এ বিষয়ে অভিজ্ঞ কোন লোক জানা আছে আপনার? থাকলে তাকেই পাঠান। কেসটা ঘোরালো! এসব কথা তো আর আমি বিপুলকে জানাতে যাচ্ছি না!
 

নৃপেন মনস্থির করে। একেবারে আত্মসমর্পণ। বলে, অমন লোক আমার কাছেই আছে স্যার। আমার সেকেন্ড অফিসার সুবীর রায়। আজই তার কার্শিয়াং থেকে ফিরে আসার কথা। তাকেই পাঠিয়ে দেব আপনার কাছে--
 

-- না, না আমার কাছে নয়। আমি শীঘ্রই এ হোটেল ছেড়ে চলে যাব।
 

-- কেন স্যার? আর দু-একটা দিন--
 

-- উপায় নেই ঘোষাল। আমি আজই চলে যাব অন্য একটা হোটেলে। ঘুম-এর কাছে। 'দ্য রিপোস'-এ। পরশু তার উদ্বোধন। আমাদের সস্ত্রীক নিমন্ত্রণ আছে ওখানে।
 

উনি যে 'আপনি' ছেড়ে 'তুমি' ধরেছেন এতে খুশিই হল নৃপেন। বললে, কিন্তু ঐ 'ম্যাক্সফ্যাকটার ভামিলিয়ান' না কী যেন বললেন, ওটা কী? সিগারেটের স্টাম্পে কী দেখতে পেলেন আপনি?
 

-- প্রমাণ! এভিডেন্স! গতকাল রাত্রে এ ঘরে একজন অভিসারিকা প্রবেশ করেছিলেন। দেখছ না? টেবিল-এর উপর পড়ে রয়েছে রমেনের সিগারেটের প্যাকেট। ক্যাপস্টান! এটা ফিলটারটিপ্ড স্টাম্প! রমেন যখন ঘরটা ভাড়া নেয় তখন এ অ্যাশট্রেটা নিশ্চয় শূন্যগর্ভ ছিল। সে ক্যাপস্ট্যান খেয়েছে। তাহলে অ্যাশট্রেতে ফিলটার টিপড সিগারেটের স্টাম্প আসে কেমন করে? তাছাড়া এই লাল স্পটটা? ওটা লিপস্টিকের চিহ্ন। ফরেনসিক এক্সপার্ট করোবরেট করবে -- তুমি দেখে নিও। আর এই সূত্রেই বোঝা যাচ্ছে কেন রমেন গুহ দুটো চাবিই চেয়ে নেয়, কেন সে কিছুতেই রাজী হয়নি তোমার বাড়িতে রাত্রিবাস
করতে!
 

নৃপেনের এখনও একবাঁও মেলে না।
 

-- বুঝলে না? রমেন কিছু ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি ছিল না। মিস্‌ ডিক্রুজা ছিল কলগার্ল। রমেনের সঙ্গে তার ভালই আলাপ হয়েছিল ট্যাক্সিতে আসার পথে। ডুপ্লিকেট চাবিটা রমেন দিয়ে রেখেছিল এ মিস্‌ ডিক্রুজাকে। বিশ্বাস না হয় মহেন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করে দেখ -- মিস্‌ ডিক্রুজা কাল সন্ধ্যাবেলায় যে লিপস্টিক ব্যবহার করেছিলেন সেটা ভার্মিলিয়ান রেড!
 

নৃপেন বলে, এখানে আমার আর কিছু করণীয় আছে স্যার?
 

--আছে।দুটো কাজ। প্রথমত তেইশ নম্বর ঘরে যে ফ্লাস্ক আছে ওটাও এভিডেন্স হিসাবে নিয়ে যাও। তবে এবার আর ভুল কর না! সাক্ষী রেখে ওটা সীল করিয়ে নিও। আমার অনুমান এ জলেও পটাসিয়াম সায়ানাইভ পাওয়া যাবে। দু-নম্বর কাজ -- তেইশ-নম্বর ঘরের দু-পাশের দু'টি ঘর সার্চ করা। বাইশ নম্বরে ছিল ইব্রাহিম আর চবিবশে মিস ডিক্রুজা। দুজনেই সন্দেহভাজন।
 

নৃপেন বলে, ইব্রাহিম তো রাত সাড়ে আটটার সময় চেক-আউট করে বেরিয়ে যায়। তখন তো রমেন গুহ জীবিত।
 

--  আহ! তুমি বড় জ্বালাও! বললাম না তোমাকে? রাত সাড়ে আটটায় সে হোটেল ত্যাগ করে বটে, কিন্তু রাত সাতটায় সে মাস্টার-কী নিয়ে দোতলায় উঠে গিয়েছিল। সে সময় ফ্লাস্কটা রাখা ছিল রমেনের টেবিলে।
 

--আয়াম সরি! ঠিক কথা! আচ্ছা, এ দুটো ঘরই সার্চ করছি আমি; কিন্তু আপনিও সঙ্গে থাকলে ভাল হত না?
 

-- না! আমরা দার্জিলিঙে এসেছি বেড়াতে। আমার স্ত্রী অনেকক্ষণ একা বসে আছেন নিচের ঘরে। তাঁর কাছেই আমি ফিরে যাব এখন। তুমি বরং যাবার আগে আমাকে জানিয়ে যেও এ দুটো ঘরে উল্লেখযোগ্য কিছু পেলে কি না।
বাসু-সাহেব নেমে এলেন একতলায়! নিজের ঘরে ফিরে এসে দেখলেন ওর স্ত্রী রানী দেবী চুপ করে বসে আছেন চাকা-দেওয়া চেয়ারে। কোলের উপর পড়ে আছে কণ্টকবিদীর্ণ অসমাপ্ত উলের সোয়েটারখানা। উলের গুলিটা পোষমানা বেড়ালছানার মত হাত পা গুটিয়ে বসে আছে ওঁর পায়ের কাছে। বিষাদের মূর্তি যেন!
 

-- অনেকক্ষণ একা একা বসে আছো? নয়?
 

রানী দেবীর চমক ভাঙে। ম্লান হেসে বলেন, দারোগাবাবা বিদায় হল?
 

-- আপাতত। আবার আসবেন যাবার আগে।
 

-- আমরা কখন রিপোস এ যাচ্ছি?
 

--হয় আজ বিকালে, নয় কাল সকালে।
 

-- তুমি বরং আগে একবার হোটেলটা দেখে এস। একেবারে দোর পর্যন্ত ট্যাক্সি যদি না যায়-- বাক্যটা উনি শেষ করেন না। প্রয়োজন ছিল না। ওঁরা দুজনেই জানেন মিসেস বাসু চলৎশক্তিহীনা। একটা মারাত্মক আকসিডেন্টে রানী দেবীর শিরদাঁড়া ভেঙে গেছে। উনি খাড়া হয়ে উঠে দাঁড়াতে পারেন না। বস্তত এ দুর্ঘটনার পর থেকেই বাসু-সাহেবের জীবন অন্য খাতে বইছে। প্র্যাকটিস ছেড়ে দিয়েছেন। এখন ওঁর একমাত্র কাজ পঙ্গু স্ত্রীকে সঙ্গদান করা। সন্তান একটিমাত্রই হয়েছিল ওঁদের। ঐ দুর্ঘটনায় মারা যায়।
 

বাসু-সাহেব হেসে বলেন, খবর নিয়েছি। গাড়ি যাবার রাস্তা আছে। না থাকলেও বাধা ছিল না। তোমাকে কোলপাঁজা করে নিয়ে যাবার ক্ষমতা আমার আজও আছে। বিশ্বাস না হয় তো বল এখনই পরখ করে দেখাই।
এত দুঃখেও হেসে ফেলেন রানী দেবী।
 

প্রায় মিনিট পনের পরে ফিরে এল নৃপেন। যথারীতি দরজায় নক করে ঘরে ঢুকল। বললে, মিস ডিক্রুজার ঘরে কিছুই পাওয়া গেল না স্যার; কিন্তু মহম্মদ ইব্রাহিমের ঘরে একটা জিনিস উদ্ধার করেছি। মাথামুণ্ড কিছুই বুঝতে পারছি না। একটু দেখুন তো স্যার--
 

একটা কাগজের দলা। সেটা হাতের মুঠোয় নিয়ে বাসু-সাহেব বলেন, কোথায় পেলে এটা?
 

--বাইশ নম্বর ঘরে, ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে।
 

-- কাল রাত্রে ইব্রাহিম ঘরটা ছেড়ে যাবার পর ও-ঘরে নতুন বোর্ডার আসেনি?
 

-- না। তবে শুনলাম এখনই আসবে। একুশ নম্বর ঘরের বোর্ডার নাকি এ ঘরে শিফট করছেন!
 

চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন বাসু-সাহেব। কাগজটা ওঁর মুঠিতে ধরাই থাকে। বলেন, কে ঐ একুশ নম্বরের বোর্ডার?
 

-- নামটা জিজ্ঞাসা করিনি। তবে শুনলাম তিনি আর্টিস্ট। একুশ নম্বর ঘরের জানলা থেকে নাকি কাঞ্চনজঙ্ঘা ভাল দেখা যায় না, গাছের আড়াল পড়ে। তাই উনি বাইশ নম্বরে সরে আসতে চান। একটু আগে ঘরটা দেখে পছন্দ করে গেছেন। এখনই শিফট করবেন।
 

-- বুঝলাম। ধীরে ধীরে কোঁকড়ানো কাগজের দলাটা খুলে ফেলেন। কাগজটা মেলে ধরেন টেবিলের উপর! হঠাৎ চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন বাসুসাহেব। চোখ দু'টি বুঁজে যায়। রানী দেবী ছিলেন পিছনে! কৌতুহল দমন করতে পারেন না। ঝুঁকে পড়েন কাগজটার উপর। তাতে কালো কালিতে লেখা ছিল


তৃতীয় পর্ব


পয়লা অক্টোবর, মঙ্গলবার, 1968।
দার্জিলিঙ-এর আগের স্টেশন, ঘুম। পৃথিবীর সর্বোচ্চ রেলস্টেশন। দার্জিলিঙ স্টেশনের থেকেও চেয়েও তার উচ্চতা বেশি ॥ ঘুমের অদূরে এ খেলাঘরের রেললাইনটা জিলাপির প্যাঁচের মত বার দুই পাক খেয়েছে -- তার নাম বাতাসিয়া ডবল-লূপ। তারই পাশ দিয়ে একটা পাকা সড়ক উঠে গেছে উপর দিকে -- ও পথে যেতে পার ক্যাভেনটার্স অথবা কাঞ্চন ডেয়ারিতে কিম্বা 'টাইগার হিল'-এ। এই সড়কের উপরেই প্রকাণ্ড হাতা-ওয়ালা একটা বাড়ি।এককালে ছিল কোন চা-বাগানের ইউরোপীয় মালিকের আবাসস্থল। বর্তমানে এটাই 'দ্য রিপোস' হোটেল। না, কথাটা ঠিক হল না -- আজ নয়, আগামীকাল থেকে সেটা হবে রিপোস হোটেল।আগামীকাল দোশরা তার উদ্বোধন।
মালিক সুজাতা মিত্র। সুজাতা বিবাহিতা -- স্বামী কৌশিক মিত্র। শিবপুর এঞ্জিনিয়ারিং কলেজের বি-ই। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। সুজাতার বাবা ডঃ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন এঞ্জিনিয়ার। তিনি কী কি একটা আবিষ্কার করেছিলেন বলে শোনা যায়। সেই আবিষ্কারের পেটেন্টটা স্বনামে নেবার আগেই সন্দেহজনকভাবে আকষ্মিক মৃত্যু হয়েছিল ভদ্রলোকের। আবিষ্কারের সেই রিসার্চ-পেপারগুলো নিয়ে সুজাতা রীতিমত বিপদের ভিতর জড়িয়ে পড়ে। এমনকি শেষ পর্যন্ত এক খুনের মামলায়। রিসার্চের
 

কাগজগুলো হাত করতে চেয়েছিলেন একজন কুখ্যাত ধনকুবের --ময়ূরকেতন আগরওয়াল। তিনিই ঘটনাচক্রে খুন হন। কৌশিক এবং সুজাতা বিশ্রিভাবে জড়িয়ে পড়ে সেই খুনের মামলায়। বস্তুত ব্যারিস্টার পি. কে. বাসু এবং অ্যাডভোকেট অরূপরতনের যৌথ চেষ্টায় ওরা দুজনেই মুক্তি পায়। এর মধ্যে বাসু-সাহেবের ভূমিকাটাই ছিল মূখ্য। যাই হোক শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হল আগরওয়ালের হত্যাকারীর নাম -- নকুল হুই। সে ছিল আগরওয়ালেরই অধীনস্থ কর্মচারী এবং নানান পাপ-কারবারের সাথী। সে-সব অতীতের ইতিহাস। 'নাগচম্পা' উপন্যাস যাঁরা পড়েছেন অথবা 'যদি জানতেম' ছায়াছবিতে উত্তম-সৌমিত্রের যৌথ অভিনয় যাঁরা দেখেছেন তাঁদের কাছে এসব কথা অজানা নয়।
 

মোট কথা ইতিমধ্যে সুজাতার সঙ্গে কৌশিকের বিয়ে হয়েছে বছরখানেক আগে। এখনও ঠিক এক বছর হয়নি। আগামী পাঁচই অক্টোবর, শনিবারে ওদের প্রথম বিবাহ-বার্ষিকী। বিয়ের পরে কৌশিক ডঃ চ্যাটার্জির এ আবিষ্কারটা নিয়ে হাতে-কলমে কাজ করতে চায়; কিন্তু সুজাতা রাজী হতে পারেনি। এ সর্বনাশা আবিষ্কারটা তার কাছে কেমন যেন অভিশপ্ত মনে হয়েছিল। তিন-তিনজন লোকের মৃত্যু এ আবিষ্কারটার সঙ্গে জড়িত। প্রথমত ডঃ চট্টোপাধ্যায়ের রহস্যজনক মৃত্যু, দ্বিতীয়ত গুলিবিদ্ধ হয়ে
ময়ূরকেতন আগরওয়ালের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড এবং তৃতীয়ত হত্যাকারী নকুল হুই-এর ফাঁসি। হ্যাঁ, আগরওয়ালের হত্যাকারী নকুল হুইকে শেষ পর্যন্ত ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হয়। নকুল চেষ্টার ক্রটি করেনি -- সুপ্রীম কোর্ট পর্যন্ত লড়েছিল--কিন্তু লোয়ার কোর্টের বিচার তিলমাত্র নড়েনি। অর্থলোভে সুপরিকল্পিতভাবে নকুল যে হত্যাকাণ্ডটা করেছিল তার জন্য বিচারক চরমতম দণ্ডই বহাল রেখেছিলেন।
 

তাই কেমন একটা অবসাদ এসেছিল সুজাতার। এ রিসার্চের কাগজগুলো থেকে সে মুক্তি চেয়েছিল। নিজের কুমারী জীবনের এ অভিশাপকে বিবাহিত-জীবনে টেনে আনতে চায়নি। কৌশিক এঞ্জিনিয়ার। এসব ভাবালুতার প্রশ্রয় সে প্রথমটা দিতে চায়নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেও মেনে নিয়েছিল। ফলে নগদ দেড় লক্ষ টাকায় এ পেটেন্টটা ওরা বিক্রয় করে দিয়েছিল বিশিষ্ট ব্যবসায়ী জীমূতবাহন মহাপাত্রের কাছে। জীমৃতবাহন হচ্ছেন অরূপরতনের পিতৃদেব। হয়তো অরূপের প্রতি কৃতজ্ঞতাও এ সিদ্ধান্তের পিছনে কাজ করে থাকবে।
সুজাতা তার সদ্যোবিবাহিত স্বামীকে বলেছিল, এ নগদ দেড়লাখ টাকা নিয়ে এবার তুমি ঠিকাদারী ব্যবসা শুরু কর।
 

কৌশিক হেসে বলেছিল, তুমি যেমন এ রিসার্চ পেপারগুলো থেকে মুক্তি চাইছিলে সুজাতা, আমিও তেমনি আমার বি.ই. ডিগ্রিটা থেকে মুক্তি চাইছি আজ। আমি ভুলে যেতে চাই যে, আমি একজন সিভিল এঞ্জিনিয়ার!
সুজাতা অবাক হয়ে বলেছিল, ও আবার কী কথা? কেন?
 

-- ভারতবর্ষে এঞ্জিনিয়ারের প্রয়োজন নেই। এদেশে এঞ্জিনিয়ার, বৈজ্ঞানিক, ডাক্তার অথবা কারিগরী কাজ-জানা মানুষের আর কোন দরকার নেই! এদেশের প্রয়োজন এখন শুধু রাজনীতিবিদ ব্যারিস্টার আর আই.এ.এস. অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের!
 

-- হঠাৎ তোমার এই অদ্ভুত সিদ্ধান্ত?
 

-- দেখতে পাচ্ছ না দেশের হাল? ডাক্তার-এঞ্জিনিয়ার-বৈজ্ঞানিকেরা এ দেশে অন্ন সংস্থানের ব্যাবস্থা করতে পারছেন না। দলে দলে দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে যাচ্ছেন। ইহুদি হওয়ার অপরাধে নাৎসী জার্মানী যেমন আইনস্টাইনকে দেশত্যাগী করেছিল, বৈজ্ঞানিক হওয়ার অপরাধে আজ তেমনি প্রফেসর খোরানাকে ভারতবর্ষ দেশছাড়া করেছে!
 

সুজাতা হেসে বলে, -- এ তোমার-রাগের কথা। খোরানা নোবেল প্রাইজ পাবার পর তাকে পদ্মবিভূষণ খেতাব দেওয়া হয়েছে!
 

হো-হো করে হেসে উঠেছিল কৌশিক। বলেছিল, ভাগ্যে প্রফেসর খোরানা শিশির ভাদুড়ী কিংবা উৎপল দত্তের পদাঙ্ক অনুসরণ করেনি!
 

-- তুমি কী বলতে চাইছ বলত?
 

--আমি বলতে চাইছি ম্যাট্রিকে আমি তিনটে লেটার পেয়েছিলাম, স্টার পেয়েছিলাম, বি.ই-তে ফাষ্ট ক্লাস পেয়েছিলাম! আমাদের স্কুল-ব্যাচের প্রত্যেকটি ভাল ছেলে ডাক্তার-এঞ্জিনিয়ার অথবা বৈজ্ঞানিক হতে চেয়েছে। যারা এ সব কলেজে ঢুকতে পারেনি সেই সব ঝড়তি-পড়তি মালই গেছে জেনারেল লাইনে। তাদের একটা ভগ্নাংশ আজ আই.এ.এস আর একটা ভগ্নাংশ আজ এম.এল.এ.!
 

সুজাতা তর্ক করেছিল। বলেছিল -- তা তুমিও আই.এ.এস পরীক্ষা দিলে পারতে? তুমিও ইলেকশানে দাঁড়াতে পারতে!
 

কৌশিক বিচিত্র হেসে বলেছিল, তুমিও যে মন্ত্রীদের মত কথা বলছ সুজাতা! ছয় বছরের পাঠক্রম শেষ করে আই.এ.এস. পরীক্ষা না দিলে আমার ঠাঁই হবে না এ পোড়া ভারতবর্ষে? কিন্তু মুরারী মুখার্জির মত একজন সার্জেন, বি.সি. গাঙ্গুলির মত একজন এঞ্জিনিয়ার অথবা খোরানার মত একজন বৈজ্ঞানিক যতদিন ফিনান্স কমিশনার, অথবা চীফ সেক্রেটারী হতে না চাইছেন--
 

অসহিষ্ণু হয়ে সুজাতা বলে উঠেছিল, মোদ্দা কথাটা কী? তুমি কী করতে চাও? এ দেড় লাখ টাকা ফিক্সড ডিপোজিটে রেখে তার সুদের টাকায় আমরা গায়ে ফুঁ দিয়ে ঘুরে বেড়াব? না! ব্যবসাই করতে চাই আমি --
 

--আমিও তো তাই বলছি। ব্যাবসাই যদি করতে হয় তবে যে জিনিসটা জানো, বোঝ, তার ব্যাবসাই করা উচিত। আমি তো তোমাকে চাকরি করতে বলছি না; আমি বলছি ঠিকাদারী করতে--
 

--কোথায়? পি.ডাব্লু.ডি, ইরিগেশান অথবা কোনও পাবলিক আন্ডারটেকিং-এ তো? সর্বত্রই তো ও দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রদল শীর্ষস্থান দখল করে বসে আছেন। তাঁদের তৈলাক্ত করতে না পারলে --
 

--তবে কিসের ব্যবসা করবে তুমি?
 

--কোন স্বাধীন ব্যবসা। যাতে কাউকে তোসামোদ করতে হবে না। আর সেটা এমন একটা ব্যবসা হবে যেখানে তুমি-আমি দুজনেই খাটব; ইকোয়াল পার্টনার!
 

--যেমন?
 

-- ধর, আমরা একটা হোটেল খুলতে পারি। তুমি কিচেন-এর ইনচার্জ। কী রঙের পর্দা হবে, কী জাতের বেড-কভার হবে সব তোমার হেপাজতে। আর আমি রাখব হিসাব, ম্যানেজমেন্ট! সারাদিন দুজনে কাছাকাছি থেকে কাজ করব। সকালবেলা দুটো নাকেমুখে গুঁজে ঠিকাদারী করতে বেরিয়ে যাব, আর রাত দশটায় ক্লান্ত শরীরে ফিরে আসব, তার চেয়ে এটা ভাল নয়?
কথাটা মনে ধরেছিল সুজাতার।
 

তারই ফলশ্রুতি 'দ্য রিপোস'!
 

জমি-বাড়ি-ফার্নিচার, ফ্রিজ, কিচেন-গ্যাজেট এবং একটা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি কিনতেই খরচ হয়ে গেল লাখখানেক টাকা। বাকি টাকা ব্যাঙ্কে রেখে ওরা দুজনে খুলে বসেছে হোটেল বিজনেস। বাড়িটা দোতলা। চারটে ডবল্‌-বেড বড় ঘর এবং দুটি সিংগল্-বেড। এ-ছাড়া একতলায় বেশ বড় একটা ড্রইংকাম-ডাইনিং রুম। কিচেন-ব্লক, প্যান্ট্রি স্টোর ইত্যাদি। রীতিমত বিলাতী কায়দায় প্ল্যানিং। প্রতিটি বেডরুমের সঙ্গেই সংলগ্ন স্নানাগার। কৌশিক নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বাড়িটার মেরামতি করিয়েছে। গরম-জলের গীজার বসিয়েছে। সুজাতা ম্যাচকরা পর্দা, বেড-কভার ইত্যাদি কিনেছে। আয়োজন সম্পূর্ণ, আগামীকাল 'দ্য রিপোস'-এর উদ্বোধন। গোটাছয়েক বিজ্ঞাপন মাত্র ছাড়া হয়েছে। দুজন সে বিজ্ঞাপনে সাড়া দিয়েছেন। আশা করা যায় পূজা মরশুমে ঘর খালি পড়ে থাকবে না। দার্জিলিঙ-এর হৈ- চৈ এড়িয়ে নিরিবিলিতে ছুটির ক'টা দিন কাটিয়ে যেতে ইচ্ছুক যাত্রী নিশ্চয় জুটবে! যে দুজন বিজ্ঞাপনে সাড়া দিয়েছেন তাদের একজন পুরুষ একজন স্ত্রীলোক। দুজনেই কলকাতাবাসী। মিস্টার নিজামুদ্দিন আলি এবং মিস্‌ কাবেরী দত্তগুপ্তা। দুজনেই জানিয়েছেন বুধবার, দোশরা, দুপুরে ছোট রেলে ঘুম স্টেশনে এসে গৌছাবেন। কৌশিক লিখেছিল স্টেশনেই ওঁদের রিসিভ করা হবে। উদ্বোধনের দিন, প্রথম বোর্ডার --তাই এই খাতির।
 

উদ্বোধনের আগের দিল। মঙ্গলবার। পয়লা। সকাল থেকেই কালীপদ আর কাঞ্চীকে নিয়ে সুজাতা শেষ বারের মত ঝাড়াপোঁছায় লেগেছে। কালীপদ মেদিনীপুরী -- সমতলবাসী। চাকরির লোভে এসেছে এতদূর। রিপোস-এর একমাত্র বেয়ারা। আর কাঞ্চী হচ্ছে স্থানীয় নেপালী মেয়ে! সামনের গ্রামটায় থাকে।


দুজন বোর্ডার অ্যাডভান্স পাঠিয়েছেন। এছাড়াও আরও তিনজন আসছেন আমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে। ব্যারিস্টার পি.কে. বাসু সস্ত্রীক এবং অ্যাডভোকেট অরূপরতন। অরূপের জন্য দোতলার নয় নম্বর ঘরটা ঠিক করা আছে. আর বাসু-সাহেবের জন্য একতলার দু-নম্বর ঘরটা। মিসেস বাসুর পক্ষে একতলা ছাড়া উপায় নেই! আলি-সাহেবের জন্য তিন নম্বর আর কাবেরীর জনা দোতলার সাত নম্বর ঘরটা মনে মনে স্থির করে রেখেছে সুজাতা। এখন ওঁদের পছন্দ হলে হয়।


বেলা দশটা নাগাদ কৌশিক গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে গেল কাঞ্চন-ডেয়ারির দিকে। ওখান থেকে মাইলপাঁচেক। গাড়ি যাবার রাস্তা আছে। কাঞ্চন-ডেয়ারির মালিক মিস্টার সেন ওদের পরিচিত। মিস্টার সেনের ভাইপো অজিত সেন কৌশিকের সহপাঠী। আপাতত ডজন দুই-তিন ডিম, কিছু হ্যাম. সফটমীট আর মাখন নিয়ে আসবে। আলি সাহেব হ্যাম খাবেন কি না জানা নেই। তাই দু-রকম মাংসের ব্যবস্থাই থাকল। ফ্রি আছে, নষ্ট হয়ে যাবার ভয় নেই। সুজাতা বলে দিয়েছে কাঞ্চন ডেয়ারির সঙ্গে যেন একটা অন-অ্যাকাউন্ট ব্যবস্থা করে আসে। একদিন অন্তর কতটা কী মাল লাগবে তার ফিরিস্তিও লিখে দিয়েছে। আজ বিকালে সুজাতার একবার দার্জিলিঙে যাবার ইচ্ছে। কৌশিককে তাই বলে রেখেছে সকাল করে ফিরতে! কিছু টুকিটাকি বাজার এখনও বাকি আছে।
 

বাসু-সাহেব কাল দার্জিলিঙ থেকে ফোন করেছিলেন। সুজাতা অনুযোগ করেছিল -- আবার দার্জিলিঙ গেলেন কেন? সরাসরি এখানে এসে উঠলেই পারতেন?
 

বাসু-সাহেব সকৌতুকে বলেছিলেন, নেমন্তন্নর গন্ধ পেয়ে আমি দিগবিদিগ জ্ঞানশূন্য হয়ে যে আগেই এসে পৌঁছেছি।
 

-- তাতে কী? আপনি তো ঘরের লোক! রানু মামিমাও এসেছেন তো?

--নিশ্চয়ই। তোমার 'দ্য রিপোস' পযন্ত ট্যাক্সি যাবে তো?
 

--আসবে। আপনি এখনই চলে আসুন।
 

-- না সুজাতা, কাল আসছি। লাঞ্চ আওয়ার্সের পরে। ভাল কথা, রমেন গুহকে মনে আছে? আমাদের নাট্যমোদী রমেন দারোগা?
 

-- খুব মনে আছে। কেন বলুন তো?
 

-- বিপুলের কাছে শুনলাম রমেন দার্জিলিঙে বদলি হয়েছে। কাল পরশুর মধ্যে আসছে।
 

-- তবে তাঁকেও নিমন্ত্রণ করবেন আমার হয়ে। আমি থানায় ফোন করে খবর নেব। মিস্টার ঘোষ আর মিসেস ঘোষ কিছুক্ষণের জন আসবেন বলেছেন।
 

--জানি। বিপুল বোধহয় শেষ পর্যন্ত তোমার নিমন্ত্রণ রাখতে পারবে না। শুনছি গভর্নর-সাহেব স্বয়ং দার্জিলিঙ আসছেন।ফলে ডি.সি. সাহেবের স্যোশাল-অ্যাপয়েন্টমেন্ট সব ক্যানসেল হয়ে যেতে পারে।
 

কালীপদ এসে দাঁড়ায়। জানতে চায়, বড় ফুলদানিটা কোথায় থাকবে?
 

সুজাতা স্মৃতিচারণ থেকে বর্তমানে ফিরে আসে। ওর হাত থেকে চিনামাটির যুলদানিটা নিয়ে আঁচল দিয়ে মোছে। বলে, একতলায় ড্রইংরুমে, পিয়ানোটার উপর। কাল সকালে মনে করে ওতে ফুল দিবি। বুঝলি?
 

-- আজ্ঞে, আচ্ছা।
 

ঘড়ির দিকে নজর পড়ে। বেলা প্রায় দুটো। এতক্ষণে কৌশিকের ফিরে আসা উচিত ছিল! রান্নাবান্না সেই কখন হয়ে গেছে। সব ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। সুজাতা আর অপেক্ষা করল না। কালীপদ আর কাঞ্চীকে খাইয়ে ছেড়ে দিল। কালীপদর ওবেলায় ছুটি। কোথায় বুঝি পাহাড়িদের রামলীলা হবে, তাই শুনতে যাবে। তা যাক। সুজাতাও তো ওবেলায় দার্জিলিঙ যাবে। থাকবে না। হঠাৎ ঝন ঝন করে বেজে উঠল টেলিফোনটা। কৌশিকই ফোন করছে।
 

সুজাতা প্রশ্ন করে, কী ব্যাপার? এত দেরী হচ্ছে যে?
 

-- আরে বল না। গাড়িটা ট্রাবল দিচ্ছে। মেরামত করাচ্ছি। ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে যাবে।
 

--তার মানে ওবেলা দার্জিলিঙ যাওয়ার প্রোগ্রাম ক্যানসেল?
 

--উপায় কী বল! তুমি খাওয়া-দাওয়া মিটিয়ে নাও বরং।
 

--তা তো বঝলাম। কিন্তু তুমি কোথা থেকে কথা বলছ? দুপুরে খাবে কোথায়?
 

-- কাঞ্চন ডেয়ারি থেকে। সেন-সাহেবের অতিথি হয়েছি। বুঝলে? আমার জনা অপেক্ষা কর না! 

 অগত্যা উপায় কী সুজাতা একাই খেয়ে নিল। ক্রমে বেলা পড়ে এল। বিকালের দিকে কোথা থেকে আকাশে এসে জুটল দার্জিলিঙের কিছু খেয়ালী মেঘ। নামল বৃষ্টি। সন্ধ্যার আগেই ঘনিয়ে এল অন্ধকার। কৌশিকের ফোনটা আসার আগেই কালীপদকে ছুটি দিয়ে বসে আছে। আগে জানলে কালীপদকে ছাড়ত না। কাঞ্চী রাত্রে থাকে না। নির্বান্ধব পুরীতে চুপচাপ বসে রইল সুজাতা। জানলা দিয়ে দেখতে থাকে কার্ট-রোড দিয়ে গাড়ির মিছিল চলেছে--উপর থেকে নিচে আর নিচ থেকে উপরে। বাতাসিয়া ডবল লুপ দিয়ে একটা মালগাড়ি পাক খেতে খেতে নেমে গেল।
 

ঘনিয়ে এল সন্ধ্যা। অন্যদিন হলে দার্জিলিঙ-এর আলোর রোশনাই দেখ যেত। পাহাড়ের এখানে-ওখানে জ্বলজ্বলে চোখ মেলে রাতচরা বাতিগুলো তাকিয়ে থাকে। নিত্য দীপাবলীর রূপ-সজ্জা। আজ আকাশ আছে কালো করে। ঝিরঝির করে সমানে বৃষ্টি পড়ছে। আঞ্চলিক পাহাড়ে বৃষ্টি। হয়তো দার্জিলিঙ খটখটে, হয়তো কার্শিয়াঙ রৌদ্রোজ্জ্বল -- বৃষ্টি নেমেছে শুধু ঘুমের দেশে। এলোমেলো হাওয়ার খ্যাপামি। সুজাতা সব দরজা-জানলা বন্ধ করে দিয়ে এসে বসে। এমন রাতে আলো ফিউজ হয়ে যাওয়া বিচিত্র নয়। সে কথা মনে হতেই বুকের মধো ছ্যাঁৎ করে ওঠে সুজাতার। এই নির্বান্ধব পুরীতে যদি অন্ধকারে তাকে একা বসে থাকতে হয়! তাড়াতাড়ি উঠে মোমবাতি আর দেশলাইটা খুঁজে নিয়ে হাতের কাছে রাখে। টর্টটাও। 

কালীপদটার যেমন বুদ্ধি। ঝড় জলে রামলীলার আসর নিশ্চয় ভেঙে গেছে। হতভাগাটা বাড়ি ফিরে এলেই পারে। কিন্তু ওরই বা দোষ কী? হয়তো আশ্রয় নিয়েছে কারও গাড়ি-বারান্দার তলায়। বৃষ্টিটা একটু না ধরলে সে বেচারি আসেই বা কী করে! পাহাড়ে বৃষ্টি, থাকবে না বেশিক্ষণ! দার্জিলিঙের বৃষ্টি এ অজাযুদ্ধ-ঋষিশ্রাদ্ধের সগোত্র। আসতেও যেমন যেতেও তেমন। কিন্তু কই, আজ তো তা হচ্ছে না। আবার নজর পড়ল দেওয়াল ঘড়িটার দিকে। প্রতি আধঘন্টা অন্তর সে সাড়া দেয়। জানিয়ে দিল রাত সাতটা। হঠাৎ বেজে উঠল আবার ফোনটা। গিয়ে ধরল সুজাতা; হ্যালো?

--রিপোস?--হ্যাঁ বলুন।
 

--আমি 'হিমালয়ান মোটর রিপেয়ারিং শপ' থেকে বলছি। আপনাদের গাড়ি মেরামত হয়ে গেছে। লোক দিয়ে পৌঁছে দেব না কি মিস্টার মিত্র দার্জিলিঙ থেকে ফেরার পথে নিয়ে যাবেন?
 

--দাজিলিঙ থেকে! উনি দার্জিলিঙ গেছেন কে বলল?
 

--বাঃ! দার্জিলিঙেই তো যাচ্ছিলেন উনি। গাড়ি থেমে যেতে একটা শেয়ারের ট্যাক্সি ধরে চলে গেলেন।
 

-- ও! তা কী বলে গেছেন উনি?
 

-- বলেছেন তো উনি নিজেই নিয়ে যাবেন, তা রাত আটটার সময় আমার দোকান বন্ধ হয়ে যাবে --
 

--আমার মনে হয় আটটার আগেই উনি ফিরবেন। নেহাৎ না ফেরেন দোকান বন্ধ করার সময় পৌঁছে দিয়ে যাবেন।
 

লাইনটা কেটে দিয়ে সুজাতা ভাবতে বসে-- ব্যাপার কী? কৌশিক যদি একটা শেয়ারের টাক্সি নিয়ে দার্জিলিঙ গিয়ে থাকে তাহলে দুপুরে সে টেলিফোন করে মিছে কথা বলল কেন? আর দার্জিলিঙ গেলে সে নিশ্চয় সুজাতাকেও নিয়ে যেত। সেই রকমই তো কথা ছিল। কিন্ত ব্যাপারটা কী হতে পারে? 'হিমালয়ান মোটর রিপেয়ারিং শপটা আবার ও-দিকে -- মানে দার্জিলিঙ যাওয়ার পথেই পড়বে, কাঞ্চন ডেয়ারির দিকে নয়। তাহলে? কিন্তু কৌশিক তো স্পষ্ট বলল সে কাঞ্চন ডেয়ারি থেকে ফোন করছে, মিস্টার সেনের বাড়িতে দুপুরে খাবে! এমন অদ্ভুত আচরণ তো কৌশিক কখনও করেনি এর আগে।
 

সুজাতা শেষ পর্যন্ত আর কৌতূহল দমন করতে পারে না। কৌশিক ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করার মত মনের অবস্থা তার ছিল না। উঠে গিয়ে টেলিফোনটা তুলে নিল। কাঞ্চন ডেয়ারির মালিক মিস্টার সেনকে ফোন করল। ফোন ধরলেন সেনসাহেব নিজেই। সুজাতা সরাসরি প্রশ্ন করল আজ তাঁর সঙ্গে কৌশিকের দেখা হয়েছে কি না। সেন-সাহেব জানালেন --হয়েছে, দার্জিলিঙে। তাঁর অফিসে। কৌশিক ডিম-মাখন-মাংস ইত্যাদি খরিদ করেছে তাঁর দার্জিলিঙ-এর দোকান থেকে। সপ্তাহে দু'দিন সাপ্লাই দিতেও তিনি চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন কৌশিকের সঙ্গে। তারপর সেনসাহেবই প্রতিপ্রশ্ন কবেন, মিষ্টার মিত্র
কি এখনও ফিরে আসেননি?
 

-- না। তাই তো খোঁজ নিচ্ছি। দার্জিলিঙে বৃষ্টি হয়েছে নাকি?

-- আদৌ না। আমি তো এইমাত্র ফিরছি সেখান থেকে।
 

সুজাতা স্থির করল কৌশিক ফিরলে প্রথমেই সে সরাসরি জানতে চাইবে কেন এমন অযথা মিথ্যা কথা বলল সে! আরও এক ঘণ্টা কাটল। রাত সওয়া নয়টা। না কৌশিক, না কালীপদ।
 

শেষ পর্যন্ত পোর্চে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াবার শব্দ হল! সুজাতা উঠে গেল সদর খুলে দিতে। এতক্ষণে আসা হল বাবুর! বেশ মানুষ যা হোক। হঠাৎ নজর হল -- না, ওদের গাড়িটা নয়। একটা ট্যাক্সি। গাড়ি থেকে একটা সুটকেস আর একটা হাতব্যাগ নিয়ে একজন অচেনা ভদ্রলোক নেমে এলেন। ভদ্রলোক সুটের উপব বর্ষাতি চাপিয়েছেন। বৃষ্টি তখনও হচ্ছে। টর্চ জ্বেলে 'দা রিপোস'-এর সাইনবোর্ডটা দেখলেন। ভাড়া মিটিয়ে দিলেন। ট্যাক্সিটা ব্যাক করল। ভদ্রলোক কলিং বেলটা টিপে ধরলেন।
 

সুজাতার ভীষণ রাগ হচ্ছিল কৌশিকের উপর। কোনও মানে হয়। রাত সওয়া ন'টা। কী করবে সে এখন? লোকটা অচেনা -- এই নির্বান্ধব পুরীতে সে একা স্ত্রীলোক। ট্যাক্সিটাও চলে গেল!
 

দ্বিতীয়বার আর্তনাদ করে উঠল কলিং বেলটা।
 

উপায় নেই। দরজা খুলতেই হবে। তবে অনেক ঝড়-কাপটা এই বয়সেই সয়েছে সুজাতা। ভয়ডর এমনিতেই তার কম। অকুতোভয়ে সে দরজা খুলে মুখ বাড়ায়। ওকে দেখে একটু হকচকিয়ে যান ভদ্রলোক। বলেন, মাপ করবেন, এটা রিপোস হোটেল তো?
 

-- হ্যাঁ। কাকে খুঁজছেন?
 

-- ব্যক্তিকে খুঁজছি না. খুঁজছি বস্তু।
 

-- বস্তু?
 

-- আশ্রয়। আমার নাম এন. আলি--আমার রিজার্ভেশান আছে এখানে।
 

--ও আপনি! মিস্টার আলি! আসুন, আসুন --আপনার না আগামীকাল আসার কথা?
 

--কথা তাই ছিল। একদিন আগেই এসে পড়েছি বিশেষ কারণে। অসুবিধা হবে না আশা করি?
 

--অসুবিধা হবে। আমাদের নয়, আপনার! কিন্তু সেকথা এখন চিন্তা করে লাভ নেই। এই বর্ষণমুখর রাত্রে আপনি আরাম খুঁজছেন না, খুঁজছেন আশ্রয়।
 

আলি-সাহেব পাপোশে জুতোটা ঘষে ড্রইংরুমে প্রবেশ করেন। হেসে বলেন, বর্ষণমুখর রাত্রি! কথাটা কাব্যগন্ধী!
 

সুজাতা কথা ঘোরানোর জন্য বলে, ভিজে গেছেন নাকি?
 

--বিশেষ নয়। ভাল কথা, আমার নামে যে ঘরটা বুক করা আছে, সেটা কি আজ এই 'বর্ষণমুখর' রাত্রে ফাঁকা আছে?
 

সুজাতা একটু অস্বোয়াস্তি বোধ করে। ঘুরিয়ে বলে, না-থাকলেও শোবার একটা ঘর পাবেন।
 

--মানে হোটেল আপনার 'উপচীয়মান'! পূজা মরশুম। তাই নয়?
 

সুজাতা সত্যিকথাটা স্বীকার করবে কি না বুঝে উঠতে পারে না।
 

ভদ্রলোক ভিজে বর্ষাতিটা খুলে হ্যাট র‍্যাকে টাঙিয়ে রাখেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে বলেন, বেয়ারাদের কাউকে দেখছিনা যে?
 

-- আসবে এখনই। কোথা থেকে আসছেন এত রাত্রে?
 

-- দার্জিলিঙ থেকে। আজই সকালে পৌঁছেছিলাম সেখানে।
 

-- তাহলে এই রাত করে বার হলেন যে? 'রিপোস' তো আপনি চিনতেনও না।
 

-- দার্জিলিঙ ওভার-বুকড। কোনও হোটেলে ঠাঁই নেই। ভাবলাম আপনারা একটা-না-একটা ব্যবস্থা নিশ্চয় করবেন। আচ্ছা, মিস্টার মিত্র কোথায়? আমার চিঠির জবাব দিয়েছিলেন তো সাম মিস্টার মিত্র।
 

-- আমি তা আগেই বুঝেছি। মিস্টার কৌশিক মিত্র কোথায়?
 

আলি ইতস্তত করে। আশা করেছিল কোন বেয়ারা এসে ওর ব্যাগটা নেবে।
সুজাতা বলে, স্যুটকেসটা এখানেই থাক। রুম সার্ভিসের বেহারা পৌঁছে দেবে। আপনি শুধু হাত ব্যাগটা নিয়ে আসুন--
 

-- প্রয়োজন হবে না। নিজের ব্যাগ আমি নিজেই বয়ে নিয়ে যেতে অভ্যস্ত। ও-দেশে -স্টেশনে-এয়ারপোর্টে এমন কুলির ব্যবস্থা নেই। নিজের মাল নিজেকেই বইতে হয়।
 

-- আপনি বুঝি সদ্য বিদেশ থেকে ফিরেছেন? চলতে চলতে সুজাতা প্রশ্ন করে!
 

আলি সে কথা এড়িয়ে বলে, আমি কিন্তু এখন এক কাপ চা খাব মিসেস মিত্র। বিকালে চা জোটেনি।
 

এতক্ষণে মনে পড়ে গেল সুজাতার। বৈকালিক চা পান তার নিজেরও হয়নি।
ড্রইংরুম পার হয়ে পর্দা সরিয়ে ডাইনিং রুম। তার ও দিকে বাড়ির পশ্চিম-কোনার তিন নম্বর ঘরটিতে পৌঁছালো ওরা। সুজাতাই আগে ঢুকল ঘরে, আলোর সুইচটা জ্বেলে দিতে। বললে ওয়াশ-আপ করতে চান তো গীজারটা চালু করে দিন। মিনিট দশেকের মধোই গরম জল পাবেন। আমি চা-টা দেবার ব্যবস্থা করি। মিস্টার মিত্রকেও খবরটা দিই। সরুন--
 

আলি ঘরে ঢোকেনি। দাঁড়িয়ে ছিল দরজার মুখে। বস্তুত দরজা আগলে। হঠাৎ হাসি হাসি মুখে লোকটা বলল, একটা প্রশ্ন করব মিসেস মিত্র?
 

একটু সচকিত হয়ে ওঠে সুজাতা। লোকটা অমন দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছে কেন? তবু সাহস দেখিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, বলুন?
 

--এমন 'বর্ষণমুখর রাত্রে' এই নির্বান্ধব বাড়িতে একেবারে একা থাকতে আপনার ভয় করে না?
 

হাত-পা হিম হয়ে গেল সুজাতার। মনে হল ওর পিঠের দিকে, ব্লাউজের ভিতর কী-যেন একটা সরীসৃপ কিলবিল করে নেমে গেল।
 

কার্ট-রোড দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে। তাদের হেডলাইট বাঁকের মুখে জমাট বাঁধা অন্ধকার-স্তূপে আলোর কাঁটা বুলিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। অন্ধকার তাতে একটুও কমছে না। গাড়ি বাঁক নিলেই আঁধারে অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে দু'পাশের আদিম অরণ্য। তা হোক, তবু ঐ গাড়িগুলো মানব সভ্যতার প্রতিনিধি। ওর ভিতর আছে মানুষজন। সুজাতা একা নয়। কিন্তু কার্ট-রোড যে ওখান থেকে তিন-চারশ ফুট!
 

নিতান্ত কাকতালীয় ঘটনাচক্র। ঠিক এই মুহূর্তেই ড্রইংরুমে বেজে উঠল টেলিফোন। তার যান্ত্রিক কর্কশ শব্দটা জলতরঙ্গের মত মিঠে মনে হল সুজাতার কাছে। না, সে একা নয়। তাকে ঘিরে আছে এই পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের শুভেচ্ছা! ও তাদের সব্বাইকে এই মুহূর্তে দেখতে পাচ্ছে না বটে, কিন্তু ঐ তো ওদেরই মধ্যে একজন যান্ত্রিক দূরভাষণে ওর কুশল জানতে চাইছে। দুর্জয় সাহসে বুক বেঁধে সুজাতা বললে আগেকার শব্দটাই, সরুন!
দরজা থেকে সরে দাঁড়াল আলি। সুজাতা ডাইনিংরুম পার হয়ে চলে এল ড্রইংরুমে। পিয়ানোটার পাশেই টেলিফোন স্ট্যান্ড। ড্রইং আর ডাইনিং রুম-এর মাঝখানে প্রকাণ্ড একটা পর্দা। বর্তমানে সরানো! তাই তিন-নন্বর ঘরের প্রবেশ পথে দাঁড়িয়েই দেখতে পাচ্ছিল আলি -- শাড়ির আঁচল সামলিয়ে সুজাতা টেলিফোনটা তুলে নিয়ে সাড়া দিল। রিপোস!
 

দার্জিলিঙ থেকে মণি-বৌদি ফোন করছেন। ডি.সি. মিস্টার বিপুল ঘোষ, আই.এ.এস্‌.-এর স্ত্রী। জানালেন, --সুজাতার নিমন্ত্রণ রাখতে আসা সম্ভবপর হচ্ছে না তাঁদের পক্ষে। গভর্নর দার্জিলিঙে আসছেন। ফলে ডি.সি. ব্যস্ত থাকবেন। তাছাড়া রেডিওতে নাকি. খবর দিয়েছে সমস্ত উত্তরবঙ্গে আগামী দু'তিনদিন প্রবল বর্ষণ হতে পারে।
 

সুজাতা অপ্রয়োজনে দীর্ঘায়ত করল তার দূরভাষণ। নানান খেজুরে গল্প জুড়ে সময় কাটালো। লক্ষ্য করে আড়চোখে দেখল -- আলি পায়ে পায়ে এগিয়ে এসেছে অনেকটা। সে এখন ড্রইং-ডাইনিং রুম-এর সঙ্গমস্থলে। মুখ-হাত ধুতে ঘরে যায়নি। বরং পাইপটা জ্বেলেছে।
 

ঠিক এই সময়ই ফিরে এল কালীপদ। কাক ভেজা হয়ে। তাকে দেখে ধড়ে প্রাণ এল সুজাতার। টেলিফোনটা নামিয়ে রেখে বললে, জামাকাপড় ছেড়ে ফেল। চায়ের জল বসা।
 

একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল আলি-সাহেবের। নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াতেই সুজাতা বলে ওঠে, মাপ করবেন, তখন কী যেন একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিলেন আপনি? টেলিফোনটা বেজে ওঠায় জবাব দেওয়া হয়নি।
 

আলি হেসে বললে, প্রশ্নটা এতক্ষণে তামাদি হয়ে গেছে!
 

-- ভুলে গেছেন?
 

-- যাব না? ও.সি., ডি.সি., গভর্নর!...তারপর কি আর কিছু মনে থাকে?
 

-- নিজের ঘরের দিকে ফিরে গেল আলি।
 

রাত দশটায় ফিরে এল কৌশিক। বৃষ্টিতে ভিজে। গাড়ির কেরিয়ারে খাদ্য-সামগ্রী নিয়ে। অভিমান-ক্ষুব্ধা সুজাতাও কোনও কৌতুহল দেখালো না। জানতে চাইল না কেন এত রাত হল। কৌশিক নিজে থেকেই সাতকাহন করে কৈফিয়ৎ দিতে থাকে। বেশ বোঝা গেল -- "হিমালয়ান মোটর রিপেয়ারি শপ"-এর লোকটা কৌশিককে জানায়নি যে, ইতিমধ্যে সে রিপোস-এ ফোন করেছিল।
 

রাত্রে খাবার টেবিলে কৌশিকের সঙ্গে পরিচয় হল আলি-সাহেবের। তিনজনে একসঙ্গেই খেতে বসেছিল। ডিনার টেবিলে। সেলফ-হেলপ পরিবেশন ব্যবস্থা; কৌশিক আলি-সাহেবকে বললে, আপনার নিশ্চয় খুব অসুবিধা হয়েছে। আমরা এখনও ঠিকমত প্রস্তুত নই, বুঝেছেন? আগামীকাল থেকে হোটেল চালু হবার কথা।
 

আলিসাহেব আলুভাজার প্লেটটা নিজের দিকে টেনে নিতে নিতে বলেন, বুঝেছি। তাই বুঝি গাড়ি নিয়ে শেষবারের মত বাজার করতে দার্জিলিঙে গিয়েছিলেন?
 

-- না, না, দার্জিলিঙে তো নয়। আমি গিয়েছিলাম কাঞ্চন ডেয়ারিতে। এদিকে....
 

-- ও, তাই বুঝি! আমি প্রথমটায় ভেবেছিলাম -- আপনি বুঝি দোতলার অফিসঘরে বসে কাজ করছেন। মিসেস মিত্রই আমার ভুলটা ভেঙে দিলেন। বললেন -- না, উনি বাড়িতে একেবারে একা আছেন। চাকরটা পর্যন্ত নেই! আর আপনি নাকি বাজার করতে দার্জিলিঙে গেছেন।
 

-- দার্জিলিঙ! তুমি তাই বলেছ?-- কৌশিক প্রশ্ন করে সুজাতাকে।
 

সুজাতা সে প্রশ্নের জবাব দেয় না। আলিসাহেবকে বলে, আজ কিন্ত সংক্ষিপ্ত মেনু! এই তিনটেই আইটেম -- আলুভাজা, ডিমভাজা আর খিচুড়ি।
 

আলি হেসে বলে, আজ আকাশের যা অবস্থা তাতে অন্যরকম আয়োজন হলে আপনাকে বেরসিকা ভাবতাম মিসেস মিত্র।
 

কৌশিক বললে, সত্যি --কী বিশ্রী বৃষ্টি শুরু হল!
 

আলি বিচিত্র হেসে বললে, বিশ্রী! সেটা আপনার দৃষ্টিভঙ্গির দোষ। বিরহকাতরা কোন বিরহিণী হয়তো এমন রাতেই গান ধরেন 'কৈসে গোঙাইবি হরি বিনে দিন-রাতিয়া!' কী বলেন মিসেস মিত্র?
 

সুজাতা মুখ টিপে বলে, আপনাকে কাব্য রোগে ধরেছে মনে হচ্ছে!
 

-- ধরবে না? আমার কাছে রাতটা যে মোটেই বিশ্রী নয় -- আমার বারে বারে মনে পড়ে যাচ্ছে এটা 'বর্ষণমুখর রাত্রি'!
 

কৌশিক সন্দিগ্ধভাবে দু'জনের দিকে তাকায়। তার হঠাৎ মনে হয় -- সুজাতা লজ্জা পেল। কেন? যেন কথা ঘোরাতেই সুজাতা বললে, মুশকিল হয়েছে কি আমার হেড কুক-এর প্রবল জ্বর হয়েছে?
 

-- কার? কালীপদর? -- কৌশিক জানতে চায়।
 

সুজাতা বলে, হ্যাঁ। বৃষ্টিতে ভিজে।
 

আলি বলে, তবে তো খুব মুশকিল হল আপনার। কাল সকালেই সব বোর্ডাররা আসবেন তো?
 

-- সকালে না হয় সারাদিনে তো আসবেই।
 

-- তাহলে লোকজন আসার আগে আপনাকে জনান্তিকে একটা খবর দিয়ে রাখি মিসেস মিত্র। আমি ব্যাচেলার -- নিজের রান্না নিজে করি। পিকনিকে গেলে বরাবর আমকে রাঁধতে হয়েছে। প্রয়োজনবোধে আপনার হেড কুকের আ্যাকটিনি করতে পারি। ভাটপাড়া অথবা নবদ্বীপ থেকে কোনও পন্ডিতমশাই নিশ্চয় আপনার বোর্ডার হতে আসছেন না?
 

কৌশিক তাড়াতাড়ি বলে, না না তার প্রয়োজন হবে না। আমিই তো আছি!
 

-- এখন আছেন। কাল সকালেই হয়তো আবার দার্জিলিঙ ছুটবেন...আই মিন কাঞ্চন ডেয়ারিতে।
 

কৌশিক বিষম খেল।
 

দ্বিতীয়াংশ পড়ুন...



No comments:

Post a Comment