লেখক: শিবশঙ্কর মিত্র
বেশ কিছুদিন আগের কথা। তখনও সুন্দরবনে ব্যাঘ্রপ্রকল্প চালু হয়নি। মানে, তখনও বাঘ মারার আইনত অধিকার ছিল, তবে অনুমতি নিতে হত, এই যা।
আর পুলিশ-কর্তাদের বনকর আপিস থেকে সে-অনুমতি পেতে তো কোনও বেগ পাবার কথা নয়। পেতেও হয়নি। জেলার পুলিশসাহেব ও বাসন্তী থানার দারোগাবাবু দু'খানা লঞ্চ নিয়ে দিব্যি চলেছেন সুন্দরবনের গভীরে। দু'জনের দু'খানা লঞ্চ হলেও পুলিশসাহেবের লঞ্চেই ডেকের ফাঁকা জায়গায় সকালের মিষ্টি রোদে আড্ডা জমিয়েছেন দু'জনে। দু'খানা লঞ্চ প্রায় পাশাপাশি চলেছে ঘুটঘুট করে। শিকার? না, ওঁদের জানা আছে এভাবে সুন্দরবনে শিকার হয় না। এমন নিরাপদে বসে সুন্দরবনে বাঘ-শিকার তো দূরের কথা, বাঘের দেখাও মিলবে না। তবে অনেক দূর থেকে হরিণের পালে কপাল-ঠুকে গুলি করলেও করা যেতে পারে। যেতে পারে বটে, কিন্তু চঞ্চল হরিণ আহত হয়েও কিছুটা বনের ভিতর যাবেই যাবে। বনের কিনারায় সেই আহত শিকার অনুসরণ করলে আচমকা আক্রান্ত হওয়া মোটেই বিচিত্র নয়। এমন ঘটনা হামেশাই ঘটে সুন্দরবনে। বাঘ এই সময় হরিণের মাংসের লোভ ছেড়ে মানুষের মাংসের জন্য দুর্দান্ত হয়ে ওঠে। যে-কোনও ঝুঁকি নেয় মানুষকে ঘায়েল করার জন্য।
ওদের লঞ্চ দুটি ছোট্ট খাল দুগ্যোদোয়ানি ছেড়ে গোমর নদীতে পড়ে তারপর কত নদী-নালা ডিঙিয়ে দক্ষিণে এগোল, তার হিসেব নেই। পিরখালি, আঁধারমানিক, খোলাখালি, চর গাজি, অবশেষে বড়গাজি খাল পেরিয়ে ন’বাকি দোয়ানিতে পড়েছে। দোয়ানি মানে, এই সব খাল বা নদী সাধারণত পুব-পশ্চিম টানা হয়ে দুটো উত্তর-দক্ষিণ টানা বড় নদী যোগ করে দেয়। ফলে দোয়ানির দু'মুখ দিয়েই একই সময়ে ঢোকে, তেমনই দু'মুখ দিয়েই ভাটির স্রোতও হড়হড় করে সমুদ্রগামী হয়ে বেরিয়ে যায়। এর ফলে নৌকো বা লঞ্চকে দোয়ানির দু'মুখে দু'রকম স্রোতের টানে পড়তে হয়। এতে অবশ্য যন্ত্রযানের ভাবনার বিশেষ কিছু ছিল না, অর্ধেক পথ স্রোতের টানে তাড়াতাড়ি যায়, কিন্তু বাকি অর্ধেক পথ স্রোত ঠেলে কষ্ট করে আস্তে আস্তে এগোতে হয়, এই যা। কিন্তু ডিঙি নৌকোকে বেশ অসুবিধায় পড়তে হয়।
পুলিশের কর্তাদের লঞ্চের গতি নিয়ে বিব্রত হওয়ার বিশেষ কারণ ছিল না। ওরা যাবেন ব্যাঘ্রসঙ্কুল চামটা বনের কাছাকাছি। ভাটি অঞ্চলে বিশাল গোসাবা নদী থেকে উঠে ন'বাকি দোয়ানি এঁকে-বেঁকে পুবে সমুদ্রগামী ঝিলা নদীতে পড়েছে। এই ঝিলা নদীর বেশ কিছুটা ভাটিতে বাঁ দিকে চামটা বন। এই সব এলাকায় প্লাবনের জল বনের অভ্যন্তর পর্যস্ত ছড়িয়ে পড়ে। কাজেই আশপাশের বনাঞ্চলে জীবজন্তুর ব্যবহারও ভিন্ন প্রকৃতির।
লঞ্চ দু'খানি এখন ন'বাকি দোয়ানির মধ্যভাগে। কতার্বাবুরা ডেকের উপর বসে সুন্দরবনের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করছেন আর নানারকম গল্পগুজব করছেন। ওরা সুন্দরবনের অভিজ্ঞ লোক হিসেবে সঙ্গে একজন বাউলে এনেছেন। বাউলে আবার তার এক অনুগত লোককে নিয়ে এসেছে সঙ্গে করে। তার নাম চিত্ত মের্ধা। এরাও মাঝে-মাঝে কতার্দের সঙ্গে টিপ্পনী কেটে চলেছে। হঠাৎ চিত্ত মের্ধা চিৎকার করে বলে ওঠে, “ওই, ওই যে, কুমির ভেসেছে ! ওই !” বলেই আঙুল দিয়ে দেখাবার চেষ্টা করে। মের্ধার চিৎকারের ধাক্কায় সবাই দ্রুত যে যার বন্দুক হাতড়াবার চেষ্টা করে। বাউলে একনজর দেখেই বলে, “না কর্তা এটা বোধহয় কুমির নয়।”
দু'জন কর্তাই প্রায় একসঙ্গে জোরে বলে ওঠেন, “কুমির নয় তো কী! কী হতে পারে?” বাউলে শান্তভাবেই উত্তর দেয়, “না বাবু, কুমির কি কখনও নদী পারাপার করার চেষ্টা করে! ও যে সোজা পার হতে চলেছে। কুমির কি অতখানি লম্বা হয়ে ভাসে ? কুমির লেজ কখনও ভাসায় না। পিঠের শিরদাঁড়া, চোখ আর উঁচু নাকটাই ভাসিয়ে রাখে। লেজ ওরা জলের তলায় রাখে। সাঁতরে এগোবার সময় হালের কাজ করে ওদের লেজ। অত লম্বাপানা হয়ে কুমির ভাসে না। কুমির নয় বাবু, অন্য কিছু”।
আরও উৎকঠিত হয়ে দারোগাবাবু বলেন, “তবে ওটা কী ? জলে আর কোন্ অমন লম্বা জন্তু আছে?” “কর্তা সাবধান ! আমরা বেকায়দায় পড়তে পারি। ওটা আর কিছু নয়, সুন্দরবনের সাঙ্ঘাতিক বিষধর সাপ। নিশ্চয়ই কোনও আইরাজ, নিশ্চয়ই... হয় ওকে আগে পার হয়ে যেতে দিন, না হয় আমাদের লঞ্চখানা আগেই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাক। ওর পারাপারের পথ আগলে ধরবেন না। চটপট যা হয় একটা কিছু করুন|” পুলিশসাহেব সারেঙকে আদেশ দিলেন, “জলদি স্পিড বাড়াও। খুব তাড়াতাড়ি সোজা বেরিয়ে যাও।” যথা আদেশ, সারেঙ লঞ্চে স্পিড দিলেন। কিন্তু স্পিড তেমন উঠছে না। ন'বাকির মাঝামাঝি অঞ্চল যে! কোনও স্রোতের বিশেষ টান নেই।
এদিকে আইরাজ এসে পড়েছে। বেগতিক দেখে বড়কর্তা চিৎকার করে ওঠেন, “লঞ্চ ঘুরিয়ে দাও, ঘোরাও !” একথা আবার একজন সারেঙকে তো বললে হবে না। দুটি লঞ্চই প্রায় পাশাপাশি চলেছে। তাই চিৎকার আর ইঙ্গিতে আদেশ দিলেন। দুই কর্তাই এখন লঞ্চের খুপরির ছাদে। বিপদ ছিল, স্পিড থামিয়ে হঠাৎ পাশাপাশি লঞ্চের গতিপথ কূল-বরাবর করতে গেলেই ঠোকাঠুকি হয়ে যেতে পারে। তবে সারেঙদের দক্ষতায় সেটা ঘটেনি বটে, কিন্তু এই সব করতে গিয়ে লঞ্চ দু'খানার পেছনটা আইরাজের লাইনে এসে পড়েছে। আইরাজ কোনও কিছুই ভ্রূক্ষেপ করে না, ঠিক সোজাসুজি নদী পার হবেই সে। ঝিরঝিরে হাওয়ায় নদীতে তখন তিরতিরে ঢেউ। আইরাজ সেই ঢেউয়ের মধ্যে মাথা উঁচু করে এগিয়ে আসছে। দেড় বিঘত ফণাকে পেখমের মতো বিছিয়ে ধরার চেষ্টা করছে। যেন সামনে পেলেই ছোবল মারবে। লঞ্চ বাঁ দিকে মোড় নিয়েছে, জলের তলার চাকাও তাদের স্তব্ধ। স্তব্ধ হলেও লঞ্চ দুটি গতিবেগের ঝোঁকে তীরের দিকে ছুটে চলেছে।
আইরাজও লঞ্চের পেছনে শাঁ শাঁ করে এগিয়ে আসছে। লঞ্চ দুটো বোধহয় ওর শত্রু। এদের ওপর তার ভয়ঙ্কর দাঁতের ছোবল মেরে মৃত্যু-বিষ ঢালতে চায়। এবার খলবল করে লেজ নাড়াচ্ছে। কোনওমতে উঁচু হয়ে ফণা শূন্যে তোলার চেষ্টা। কিন্তু জলের উপর তেমন করে শক্ত হয়ে উঁচিয়ে ফণা তুলতে পারছে না। আরোহীরা কেউ ডেকে, কেউ বা খুপরির ছাদে। এমন নিরাপদ আশ্রয়ে থেকেও কেউ নিশ্চিন্ত নন। জলের উপর আইরাজের কিলবিলে গতি আর আক্রোশ দেখে সকলের বেশ ভয়-ভয় করছে।
বাউলের মনে হঠাৎই আশঙ্কা জাগে লঞ্চের দু'পাশের নারকোল দড়ির গোছাগুলি নিয়ে। আইরাজ এগুলির সন্ধান পেলে নিশ্চিত বেয়ে উপরে উঠে আসবে। মাঝিমাল্লা যাকেই হাতের কাছে পেল তাকেই চিৎকার করে বলল, “শিগগির যা, কাতার গোছাগুলি টেনে উপরে – তোল। যা,যা, এক্ষুনি যা। কোনও কাছি জালির উপর দিয়ে যেন ঝুলে না থাকে। যা, এক্ষুনি যা।” হঠাৎ আইরাজকে আর দেখতে পাওয়া গেল না। আইরাজ অদৃশ্য। লঞ্চের মুখটা কূলের পলি-কাদায় আটকে যাবার উপক্রম দেখে সারেঙ আগেই লঞ্চের চাকা উলটোদিকে চালিয়ে দিয়েছে। পেছন-গিয়ারে চাকা বেগে চলেছে। তবুও লঞ্চ কুলের দিকে এগিয়ে চলে। এবার পুরোদমে পেছন-গিয়ার। লঞ্চের চাকা নদীর জল তীরে ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছে। আইরাজ ডুব দিয়েই বুঝি আতঙ্কের শিহরন এনে দিল গোটা লঞ্চে। একে তো বাউলে নারকোল-দড়ির গোছার কথা তুলে লঞ্চের সবাইকে দুর্ভাবনায় ফেলে দিয়েছে। তার উপর আইরাজ অদৃশ্য হয়ে আতঙ্ক চরমে তুলে দিল। মায় পুলিশ-কর্তা পর্যন্ত এবার চঞ্চল হয়ে উঠেছেন। দারোগাবাবুকে জিজ্ঞেসা করেন, “তোমার রাইফেলটা লোড করা আছে তো ?” খোঁজ নিলেন অবশ্য রাইফেল লোড আছে কি না, কিন্তু তাতেও ভরসা নেই বুঝে খুপরির ছাদে রাখা লগিগুলি হাতড়াতে থাকেন? আর ঝুঁকি মেরে দড়ির গোছাগুলি দেখবার চেষ্টা করেন। কাণ্ড দেখে বাউলে বলে, “না, বাবু. লগি দিয়ে খোঁচাখুঁচি করবেন না। ওতে হিতে বিপরীত হবে, আইরাজ আরও খেপে যাবে !”
জলের আথালি-পাথালি তোড়ের মধ্যে কোথায় গেল আইরাজ ? দেখতে-দেখতে পুরোদমে চালু চাকার ছুঁড়ে মারা জলের তোড়ের সঙ্গে তীরের ওপর ঝপাত করে পড়েছে কুন্ডলী পাকিয়ে। না, পরক্ষণেই টানটান হয়ে সামান্য জলে কূল-বরাবর এগিয়ে যায়। বাউলে আর দেরি করতে চায় না। হাতের বন্দুকে ছররা-টোটা ভরাই আছে। তাক করে ছুঁড়ে মারে। খুবই কাছে তো, লক্ষ্যভ্রষ্ট হবার কথা নয়। হয়ও না। আইরাজের শরীর থেকে রক্ত ফিনকি দিয়ে উঠল। আর কী আক্রোশ তখন আইরাজের ! শত্রুকে সামনে না পেয়ে চরের উপরই বিস্ফারিত ফণা তুলে ছোবল মারতে থাকে। মাজা-ভাঙা ক্লান্ত আইরাজকে কূল ঘেঁষে সামান্য জলে খলবল করে কোনওমতে আবার চলতে দেখে বাউলে মের্ধাকে ধমক দিয়ে বলল, “লগি দিয়ে চরে ঝাঁপিয়ে পড়, যা।” বলেই একহাতে বন্দুক নিয়ে অন্য হাতে চরের ওপর লগির ঠেকো দিয়ে লাফিয়ে পড়ে বাউলে। বাঘ-শিকারের মতো নিঃশব্দে এগোবার দরকার নেই। চরে পড়েই চিৎকার করে উঠে, “চিত্ত, বন্দুক নিয়ে নদী-বরাবর বনের কিনারা দিয়ে চল্। আমার দিকে তাকাবি না, শুধু দেখবি বনের দিকে। বড়মিঞা আবার আমাকে তাক না করে ! এমন সুযোগের সন্ধানে বড়মিঞা থাকেই, বুঝলি তো চিত্ত?” থপথপ্ করে দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকে। হাতের লগিখানা উদ্যতভাবে ধরাই আছে। বেশ কিছুটা এগিয়েও গেছে। এমন সময় হঠাৎ থমকে পড়ে সে, সামনেই আইরাজ। কেন জানি, এতক্ষণ পলির প্রলেপ দেওয়া চরে আইরাজ ওঠবার চেষ্টা করেনি। এবার আইরাজ চরে উঠবে নিশ্চয়ই। মাথা নিচু করেই বনের চত্বরের দিকে চর বেয়ে আস্তে আস্তে উঠতে থাকে। বাউলে মুখে আর কথা বলে না। শুধু আঙুলে তুড়ি মেরে মের্ধাকে ইশারা করে, আর এগোবি না, দাঁড়া ওখানে।
আইরাজ বনে উঠতে গিয়েও যেন থমকে যায়। বনের মুখে এখানে কূল-বরাবর একটা দীর্ঘ হেঁতালগাছের ঝাড়। জোয়ারের জল এসে এসে এই লম্বা ঝাড়ের তলদেশের মাটি ধুয়ে নিয়ে গেছে। ঝাড় ঝুঁকে পড়েছে চরের দিকে। বেশ দেখা যায়, হেঁতাল গাছের অজস্র ঘন বিন্যস্ত শিকড় জলে ধুয়ে যাওয়া ফাঁকা জায়গায় ঝুলে আছে। হঠাৎ আইরাজ সেই ঝুলন্ত শিকড়ের মধ্যে মাথাটা ঢুকিয়ে দিল। আহত আইরাজ হয়তো ছুটে আশ্রয় খুঁজছে। সঙ্গে সঙ্গে বাউলে ছুটে গিয়ে ফলক-কাটা লগির গোড়াটা দিয়ে রক্তঝরা মাজাটা সজোরে কাদার মধ্যে চেপে ধরল। অন্য সব কথা ভুলে বাউলের এখন লক্ষ আইরাজের দীর্ঘ লেজ। এই লজের আওতায় একবার পড়লে বাউলেকে জড়িয়ে চেপে হাড়গোড় গুঁড়ো করে দেবে। শত্রুর সঙ্গে লড়বার এ এক মহা অস্ত্র।
না, বাউলে প্রথমে দেখেই বুঝে নিয়েছে, সে-ভয়ের বোধহয় কারণ নেই। গুলির আঘাতে মাজা-ভাঙা লেজের আর তত ক্ষমতা নেই। কিন্ত হলে কী হবে, তবুও লেজ দিয়ে সে শত্রুকে খুঁজছে এদিক-ওদিক। লেজের পাশ থেকে নিজের দেহকে একটু সরিয়ে নিয়েই বাউলে চিৎকার করে উঠল, “মের্ধা শিগগির আয়, ছুটে আয়।” আর্তনাদ শুনেই মের্ধা হেঁতাল-ঝাড়টাড় ভেঙে লাফিয়ে পড়ল চরে। হাতের বন্দুক কাদায় পড়তে দেয়নি। বাউলে বলে ওঠে, “গুলি কর্, তুরন্ত চোট কর্! ছররা! ওই শিকড়-ঝাঁকের মধ্যে। নিরিখ করতে হবে না! শিগগির গুলি কর্! আন্দাজেই কর!” হাতের লগিতে চাপ রাখতে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে আদেশ দেয় সে। মের্ধা আদেশের সঙ্গে-সঙ্গেই একটা চোট করে, আরেকটার জন্য তৈরি। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি। এতক্ষণ লগির চাপের নীচে মৃত্যু-যন্ত্রণায় ক্ষীণভাবে নড়াচড়া করছিল। এখন শান্ত, নেতিয়ে পড়েছে। লেজের ডগাটা একটু-আধটু নড়াচড়া করতে থাকে। লগির চাপটা একবার শিথিল করে বাউলে বুঝে নেয় সত্যি-সত্যি নিস্তেজ হয়েছে কি না। নিশ্চিন্ত হয়েই মেধাকে বলে, আস্তে আস্তেই বলে, “যা এবার লঞ্চ থেকে দড়ি নিয়ে আয়।” বড়শি গিঁট মাজায় বেঁধে চর দিয়ে টেনে নিয়ে যেতে হবে। বাউলের সাবধানের শেষ নেই। এক ভয়ঙ্কর বিষধর আইরাজ নিয়ে কারবার করছে। মের্ধাকে দড়ি ধরে টেনে হেঁতাল গাছের তলা থেকে বের করে আনতে আদেশ দিল। আর নিজে বন্দুক নিয়ে তাক করে রইল ওর ফণার দিকে।
শেষপর্যন্ত আইরাজকে সবাই মিলে টেনে লঞ্চের ডেকে তুলল। কতার্বাবু তো ইঞ্চি মেপে আর ওজন করে দেখলেন, সাড়ে পনেরো ফিট লম্বা আর ওজনে প্রায় এক মণ। বাউলে বলল, “বাবু জানেন, আইরাজ সুন্দরবনে নরকমের আছে। এর নাম হল ধনীরাজ। দেখছেন তো কালচে রঙ। আর সাপেদের মধ্যে আইরাজেরই দাঁত খুব বড়, যেখানে ছোবল মারে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। আইরাজের মধ্যে দুধরাজ আর ভীমরাজও আছে। দুধরাজ দেখতে সাদা ধবধবে। কত বড় ফণা দেখেছেন। মাথায় এই দ্যাখেন বড় চক্র-চিহ্ন! দেখতে কী সুন্দর বলুন তো ! আর কী শক্তিধর, বাপ্ রে!”
বর্ণনার ঝোঁকে পুলিশসাহেবের দিকে তাকিয়ে বলে, “আচ্ছা কতসাহেব, শুনছি আপনারা কিছু দিনের মধ্যে সুন্দরবনে ব্যাঘ্র-প্রকল্প চালু করবেন। কিন্ত আপনারা কি সুন্দরবনে আইরাজ-প্রকল্প করতে পারেন না ? এদের ফণা দেখলে ভিরমি খেতে হয় বটে, কিন্তু দেখতে কী সুন্দর ! বাঘের মতো এরাও তো বনের রক্ষক, তাই না?” পুলিশ-কর্তা মৃদু হেসে বললেন, “তা তো হল! কিন্তু তুমি তো নিজেই আইরাজকে মারলে, তা আবার প্রকল্প করে ওদের বাঁচাতে বলছ।” বাউলে এবার মাথা নিচু করে বলল, “বাবু সাপটাকে আপনারা আগেই লঞ্চের চাকায় আধমরা করে ফেলেছেন। আমরা সাপকে কখনও আঘাত করি না, ওরাও আমাদের আমল না দিয়ে চলে যায়। সুন্দরবনের চালু নিয়ম, আঘাত করে কোনও সাপকে কোনওদিন ছেড়ে দিতে নেই, তাকে শেষ করে তবে বাঁচোয়া। নইলে এরা শোধ নেয়। আহত সাপ একদিন-না-একদিন শোধ নেবেই নেবে। শত্রুকে এরা চিনে রাখে।” তারপর আইরাজের গায়ে হাত ঠেকিয়ে আর নিজের কপালে হাত তুলে নমস্কার করে বাউলে দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বলল, “তা বাবু, আমরা সুন্দরবনের মানুষেরা সাপের আইন বড্ড মেনে চলি। আমাদের যে এদের সঙ্গেই বাস করতে হয় কি না।”
(শেষ)
No comments:
Post a Comment