এক বেকুফ সুলতানের কথা

লেখক: বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়

নামটা ‘বেকুফ’ না হলেই খাসা হত বা এ-ধরণের কোনও নাম। তা হয়নি। কানা ছেলের নাম যেমন পদ্মলোচন হয়ে যায়, বেকুফ শাহজাদার বেলাতেও ঠিক সেই রকম ওলটপালট হয়ে গেল। তৈমুরের তিন নম্বর ছেলেটি বেকুফ নাহয়ে পাকেচক্রে হয়ে গেল ‘মিরন শা’। নাম বদলের ফলটা অবশ্য হাতে হাতে পাওয়া গেল না। টের পাওয়া গেল অনেক পরে। টের পেলেন বাপজান তৈমুরও। কিন্তু সেও অনেক পরে। ঠেকানোর সাধ্য তখন আয়ত্বের বাইরে।

পড়ুয়াদের কাছে অচেনা নন তৈমুর। মুঘলদের মধ্যে ইনিই পয়লা প্রবাদপুরুষ। জন্মসূত্রে ইনি ‘তাতার’। তার মানে হল তুর্কি। পাহাড়ি দেশের মানুষ হলেন তৈমুর। খোটান-বাদাকশান-কাশগড়-সমরখন্দ ঘিরে যে পাহাড়ি জনপদ, সেই দেশে ছিল তাঁর বাস। তাতার ছাড়াও ছিল অনেক উপজাতি। ওদের ভিতর মুখ্য হল, উজবেক আর মোঙ্গল। পাহাড়ি বকরির মত এরা টিঁকে ছিল একে অপরকে ঢুঁ মেরে খুনসুটি করে। হিমেল বাতাসের সঙ্গে লড়াই করে এরা টিকে ছিল বছরের পর বছর। কোনও গোল ছিল না।

গোল বাধাল তৈমুর এসে । খোঁড়া তৈমুর।

তৈমুরের বাবা ছিলেন ‘মির্জা’। পাহাড়ি রাজ্যের রাজা। ছড়ানো-ছিটনো খানকয়েক পাহাড়ি গাঁ নিয়ে ছিল ওর রাজত্ব। বৈভবের ভেতর ছিল কয়েকশো ভেড়া, কিছু উট, আর বেশ কিছু টগবগে ঘোড়া। তৈমুর ছিলেন ছেলেবেলা থেকেই ডাকাবুকো। ওঁর মানসিক আদর্শ ছিল ‘চেঙ্গিস’। চেঙ্গিসের সঙ্গে একটি ক্ষীণ আত্মীয়তাও ছিল। তবে তা ছিল একশো বছরের পুরনো। একেবারে নিরুত্তাপ। তবু তৈমুরের কাছে ওই চেঙ্গিস নামটুকু ছিল ভীষণ উত্তেজক। নাম শোনার সঙ্গে-সঙ্গে শিরশিরিয়ে উঠত গা। অশরীরী ভর করত শরীরে। ইচ্ছে করত খুনের দরিয়ায় গোসল করতে।

বাবা মারা গেলেন চব্বিশ বছর বয়সের সময়। সঙ্গে-সঙ্গে তৈমুর হলেন মির্জা। বাবার সামান্য পুঁজিটুকু নিয়ে এবার শুরু হল তাঁর নিজস্ব খেলা। দুঃসাহসিক ক্রিয়াকর্ম। এই দুঃসাহস অবশ্য ওঁকে একে-একে এনে দিল বহু অভাবিত সাফল্য। ন’ বছরের ভিতর হয়ে গেলেন সমরখন্দের আমির। সেখান থেকে অচিরেই দায়িত্ব পেলেন চুঘতাই তুর্কিদের হয়ে রাজত্ব বিস্তারের। এই রাজ্যবিস্তারের খেলাতেই তৈমুর হয়ে উঠলেন তাঁর নিজের আদর্শের আদলে গড়া প্রকৃত তৈমুর। ভয়ঙ্কর রকমের কঠোর, নির্মম আর নিষ্ঠুর। এ্রঁর তরোয়ালের এক-এক কোপে লুটিয়ে পড়ল এক-একটি প্রতিবেশী দেশ। লুটিয়ে পড়ল পারস্য-তুরস্ক, আজারবাইজান -আফগানিস্থান। পশ্চিম আর মধ্য এশিয়ার ছোট-ছোট রাজ্যগুলি পাকা ফলের মতো টুপটুপ করে খসে পড়ল ওর হাতে। তৈমুরের দাপটে তখন সবাই তটস্থ। ভীত। তৈমুর তাঁর এই দাপট জাহির করতে একদা গিয়ে হাজির হলেন রুশদেশে। মস্কো নগরের দরজায় গিয়ে লাঠি ঠুকে এলেন।

তৈমুরের প্রিয় একটি খেলা ছিল মানুষের ছিন্ন মুণ্ড জড়ো করে পাহাড় বানানো। এরকম পাহাড় তিনি অনেক জায়গাতেই তৈরি করেছিলেন, তবে তা সব থেকে চটকদারি হয়েছিল আমাদের ভারতে তাঁর প্রবেশের পর, হিন্দুস্থান অভিযানে তিনি চরম পৈশাচিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। দিল্লিতে এসে তিনি ছিলেন দিন-পনেরো। ওই পনেরো দিন শহর দিল্লি পরিণত হয়েছিল বিরাট এক কসাইখানায়। পথে আসবার সময় তিনি লুঠতরাজ করেছিলেন অবাধে। ছোট ছেলে আর মেয়েদের তিনি বেঁধে নিয়ে গিয়েছিলেন ক্রীতদাস করার জন্য। বন্দী করেছিলেন তিনি এক লাখ মানুষকে। পরে হঠাৎ খেয়ালে ওই এক লাখ লোককে ছিন্ন-শির করে তাদের মাথা দিয়ে বানিয়েছিলেন একটি পিরামিড আর ওদের খুন জমিয়ে তৈরি করেছিলেন একটি লাল দরিয়া। নগর দিল্লিতে এ খেলার কোনও কমতি হয়নি। আকাশের পাখিরা পর্যন্ত তৈমুরের পৈশাচিকতায় হয়ে পড়েছিল সন্ত্রস্ত, আতঙ্কিত। তৈমুর চলে যাওয়ার পরেও দিল্লির আকাশ দু'মাস ছিল পাখিহীন। ভুলেও তারা উড়তে আসত না দিল্লির আকাশে। শহরের বাড়ি ঘরদোর পড়ে ছিল খাঁ-খাঁ নির্জনতায়। ইতিহাসে এ-ধরনের নৃশংসতার তুলনা মেলা ভার।

এইভাবে পৈশাচিক খুনের ভিতর দিয়ে তৈমুর তাঁর সাম্রাজ্যটিকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে করে তুলেছিলেন বিরাট। রুশ দেশের ভোল্গা নদীর কোণ থেকে পুবে হিন্দুস্থানের কিনারা পর্যন্ত ছিল এঁর রাজত্ব। চেঙ্গিসের মতনই বড়, ওইরকম বিশাল জনপদ।

এদিকে তাঁর নিজের সাম্রাজ্যের মতনই তৈমুর বড়সড় করে বানিয়ে নিয়েছিলেন নিজের পরিজনের সংখ্য্যা। ছেলেপুলে নাতি-নাতনি একসঙ্গে সব ধরলে তাদের সংখ্যা অনেক। এদের সকলকেই তাঁর রাজ্যের নানান কাজে দিয়েছিলেন লাগিয়ে। বেকুফ মিরন শা’কে ধরলে ওঁর চার ছেলের খবর আমরা পেতে পারি। ওই চারজনকেই তিনি দায়িত্ব দিয়েছিলেন আঞ্চলিক শাসনকর্তার। বড় জাহাঙ্গিরকে রেখেছিলেন তিনি রাজধানী সমরখন্দে। নিজের কাছে। মেজ উমর শেখের ওপর চাপানো ছিল ফরগনার শাসনভার। তৃতীয় সন্তান মিরন একটু বোকা ছিল বলে ওকে দিয়েছিলেন একটু বেশি রাজত্ব। সে রাজত্ব হল সিরিয়া-ইরাক এবং আজারবাইজান। আজারবাইজানের নীচে শহর তাব্রিজে বেশ জাঁক করে আরামে ছিলেন বেকুফ শাহাজাদা। চতুর্থ ও কনিষ্ঠ পুত্র সন্তান শাহারুখ ছিল বেশ চালাক-চতুর। তৈমুর একে পাঠিয়েছিলেন হিরাট আর খোরাসাহার শাসক করে। এ ছাড়া পৌত্রদেরও নানান দায়িত্বপূর্ণ কাজে লাগিয়ে রেখে মির্জা তৈমুর বেশ নিশ্চিন্ত হয়েই বসে থাকতেন সমরখন্দে। পৌত্রদের ভিতর নিরবক্সের ওপর তাঁর ছিল বিশেষ ধরনের পক্ষপাতিত্ব। অনেক অভিযানে সে পিতামহের সঙ্গে ছিল এবং হিন্দুস্থান-আফগান সীমান্ত সে শাসন করত অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে।

তৈমুর যে খুব কড়া লোক ছিলেন, তা তাঁর অত্যাচারের বহর দেখেই টের পাওয়া যায়। এ ছাড়া আর-একটি জায়গায় টের পাওয়া যেত তৈমুরের কড়া মনোভাবের। সে-জায়গাটি হল, তাঁর সৈন্যবাহিনী। সেকালে দীর্ঘ তরবারি, বর্শা-বল্লম আর তীর-ধনুকের লড়াইটাই ছিল প্রধান। কামান-বন্দুকের চলন তখনও হয়নি। দূর থেকে শত্রু খতম করার কৃট কৌশল ছিল তীরন্দাজিতে ৷ তৈমুর তাই তাঁর সৈন্যবাহিনীতে বেশি কদর করতেন তীরন্দাজদের। যুদ্ধ থাক আর না-থাক, নিত্য অনুশীলনের ব্যাপারে তীরন্দাজদের ওপর কড়া নজর দেওয়া হত। দক্ষতা আর নৈপুণ্যের স্বীকৃতিতে তাদের হামেশাই মিলত ইনাম-বকশিশ।

আর একটি বিষয়ে কড়া নজর ছিল তৈমুরের। তা হল সেনানিবাসের ঘোড়ার ওপর। ঘোড়াকেই তিনি মনে করতেন লড়াইয়ের পয়লা হাতিয়ার। দেশ-দেশান্তর থেকে তিনি ঘোড়া সংগ্রহ করতেন চড়া দামে। তারপর সেই ঘোড়াকে শিক্ষিত করা হত লড়াইয়ের উপযোগী করে। ওই ঘোড়ায় চড়ে হাজার হাজার সিপাই নিয়ে তিনি যখন ঝড়ের বেগে ঝাঁপিয়ে পড়তেন এক-একটি দেশের ওপর, সেসব দেশের সৈন্যরা রুখে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, উর্দি পরার মতো অবকাশও পেত না। আর এই ম্যাজিকটা সম্ভব হত, কেবল ঘোড়ার জন্য। সুতরাং তৈমুরকে ঘোড়ার ওপর কড়া নজর রাখতে হত তাঁর নিজের প্রয়োজনে। সেনানিবাসের সঙ্গে-সঙ্গে থাকত বড়-বড় আস্তাবল। পরিচর্যার জন্য থাকত সহিস। তবু মাঝে-মাঝে অঘটন ঘটে যেত। ব্যবস্থা শিথিল হলে ঘোড়ায়-ঘোড়ায় লেগে যেত লড়াই। এক ঘোড়া লাফিয়ে উঠত আর-এক ঘোড়ার ঘাড়ে। এইভাবে নিজেদের ভেতর মারামারি করে আহত হত অনেক ঘোড়া। কারও ভাঙত সামনের ঠ্যাং, কারও পিছনের। এই অকেজো ঘোড়াগুলি পরে লড়াইয়ের প্রয়োজনে একদম ব্যবহার করা যেত না। সুতরাং বরবাদ বলেই তাদের ধরে নেওয়া হত। বাড়ত খরচের বহর। সুলতানি তোশাখানা এসব খরচ মেটাতে হিমশিম খেত। এইসব দেখেশুনে তৈমুর একদা রীতিমত কঠিন হলেন। প্রাদেশিক শাসকদের ওপর দায়িত্ব দিলেন অশ্ব-রক্ষার। আর হুকুমনামা জারি করে জানিয়ে দিলেন যে, আস্তাবলের ঘোড়ার লড়াইয়ে যদি সামরিক ঘোড়ার জখম-টখম দেখা যায়, তা হলে অশ্ব-রক্ষক সরাসরি অভিযুক্ত করা হবে। আর ওই অপরাধের জন্য বরাদ্দ থাকবে একটা মাত্র শাস্তি। সে শাস্তি শিরচ্ছেদ। মাদ্রাজের এক প্রান্ত থেকে আর-এক প্রান্ত পর্যন্ত এ হুকুমনামা জারি করা হল। সতর্ক করে দেওয়া হল সেনাপতিদের। শাসকদের। জানিয়ে দেওয়া হল, হাকিম নড়তে পারে, হুকুম নড়বে না।

তবু আশ্চর্য হলেন কেউ-কেউ। সঙ্গে-সঙ্গে বহাল হল হুকুমনামা। আইন-মোতাবেক দোষী ব্যক্তির মাথা উড়ে গেল। তৈমুর যে কত কঠিন, তা আবার জানিয়ে দেওয়া হল। এইভাবে দেখতে দেখতে গড়িয়ে গেল সময়। কিছু মাস। এবং কয়েকটি বছরও।

ইতিমধ্যে তৈমুরের পরিবারে এসেছে দু-দুটি মৃত্যু। এ-মৃত্যু একেবারে বর্শার মতন এসে বিঁধল তৈমুরের পাঁজরায়। প্রথম মৃত্যুটি হল, তার বড় ছেলে জাহাঙ্গিরের। দ্বিতীয়টি হল মেজ ছেলে উমর শেখের। আরও দু-একটি ছোটখাটো মৃত্যু যে আসেনি তা নয়। কিন্তু তারা এমনভাবে পাঁজরা ভেদ করতে পারেনি লৌহমানব তৈমুরের।একটু একটু করে বয়সটা যে বেড়ে চলেছে, তা এখন তৈমুর টের পেতে থাকেন। দু’ছেলেকে হারিয়ে তাই তিনি বাকি দু'ছেলেকে দ্বিগুণ স্নেহে ভালবাসতে থাকেন। শীতের দেশে থেকেও যা তিনি কখনও বোঝেননি, সেটা এখন বোঝেন। বুঝতে পারেন, শীতটা বড় তীব্র। হাড়ে-হাড়ে কাঁপন লাগে মাঝে-মাঝে। কানের পাশ দিয়ে বাতাস বয়ে যায় শিরশির করে। দেখতে-দেখতে তৈমুর পৌঁছলেন. উনসত্তরে।

আর ঠিক এই সময়েই অঘটন ঘটিয়ে বসল বেকুফ শাহজাদা। আজারবাইজানের নীচে শহর তাব্রিজে বসেই ঘটালেন অঘটন। তাঁর অধীনস্থ অশ্বশালায় ঘটে গেল মহাপ্রলয়। ঘোড়াদের সংঘর্ষে জখম হল অনেকগুলি ঘোড়া। তৈমুরের হুকুমনামা-মোতাবেক খতিয়ে দেখা হল অপরাধী কে ! বিচারে অপরাধী হিসেবে যে চিহ্নিত হল, সে আর কেউই নয়, শাহজাদা মিরন। বেকুফ শাহাজাদা। সুতরাং শাহাজাদাকে দণ্ডিত করাই সাব্যস্ত হল। দন্ডাজ্ঞার কাগজটুকু সই করানোর জন্য সুলতানি দূত ছুটল তৈমুরের কাছে। তৈমুর তখন ছিলেন কাবুলে। কাবুলে বসেই শাহজাদা মিরনের অপকর্মের খবরটা পেলেন তৈমুর। দুটি ছেলের শোকে আগে থেকেই বাঁঝরা হয়ে আছে তাঁর পাঁজরা। এখন তৃতীয় সন্তানের মরণের পরোয়ানা তাঁকে সই করতে হবে ভাবতেই গা হিম হয়ে গেল। লৌহমানবের বুকের খাঁচায় একটা পাখির ঠোঁট অবিরাম চলল খুঁচিয়ে। এই হানাদারকে ঠিক চিনতে পারলেন না তৈমুর। পাখির ঠোকরানোটা তীব্র হতে থাকল। পেলেন যে, তাঁর পরোয়ানা এসে গেছে। অত বড় দুর্ধর্ষ যোদ্ধা, দুর্জয় সাহস, বিপুল বৈভব আর অতখানি দাপট, এক নিমেষে গেলেন চুপসে। দুম করে মারা গেলেন তৈমুর।

ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে যা হয়, পরের ঘটনাগুলি ঠিক সেইভাবে ঘটে যেতে থাকল। যে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন তৈমুর, কয়েক মাসের ভিতর তা ভেঙে পড়ল তাসের ঘরের মতন। যে যেখানে শাসনকর্তা হিসাবে বহাল ছিলেন, তিনি সেখানে রাজা বনে গেলেন। যে ছেলেটির জন্য প্রাণ-বিয়োগ হল, সেই মিরন শা'ও রাতারাতি রাজায় পরিণত হলেন। সিরিয়া-ইরাক আজারবাইজানকে ঘিরে গড়ে উঠল তাঁর রাজ্য। ওর দরবারি নাম চালু হয়ে গেল সুলতান মিরণ শা।

তাব্রিজে রাজধানী করে তিনি পত্তন করলেন মিরনশাহি রাজবংশের। বেকুফ লোকেরা যে নিজেদের বুদ্ধি এবং শক্তি সম্পর্কে কখনও সচেতন থাকে না,.তা আর-একবার প্রমাণিত হল মিরন শার কাজকর্মে। মিরনের ধারণা ছিল যে, সে নিজে তৈমুরের মতো দুর্ধর্ষ এক যোদ্ধা। একটু সচেষ্ট হলেই সে পারবে বাবার মতন বড় একটি বিশাল সাম্রাজ্য পত্তন করতে। পারবে বড়-বড় রাজাদের পরাজিত করতে।-সুতরাং সে প্রতিবেশী রাজাদের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হল।

তৈমুরের মৃত্যুর সঙ্গে-সঙ্গে এদিকে পরিবেশগত পরিবর্তন দেখা গেল। আশেপাশে যেসব ছোটখাটো পাহাড়ি উপজাতি ছিল, তারা একটু-একটু করে উঠে দাঁড়াল মাথাচাড়া দিয়ে। নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করল। মিরন শা’র রাজ্যের পাশেই ছিল তুর্কমান উপজাতিদের ছোট্ট একটি রাজ্য। ওরা ছিল উজবেক। ওদের রাজধানী ছিল কাশগড়। উজবেক সর্দারের নাম ছিল ইউসুফ। সর্দার ইউসুফের বিরুদ্ধেই প্রথম যুদ্ধ ঘোষণা করল সুলতান মিরন। তৈমুরের মতোই সে লাফিয়ে পড়ল শত্রুর ঘাড়ের ওপর। তবে লড়াইটা ঠিক তৈমুরের মতন হল না। তাই জয়ের পরবির্তে এল, পরাজয়। ইউসুফ সর্দারের হাতে নাকানিচোবানি খেয়ে বেচারি মিরনকে মেনে নিতে হল হার। উপজাতিদের হাতে বন্দী হয়ে গেল সুলতান মিরন।

তবে সদারি ইউসুফ ছিলেন খুব দয়ালু। আর রাজ্যবিস্তারের মনোভাব তাঁর একটুও ছিল না। কাশগড়ের বাইরে আসতে তাঁর মন সরল না। তাই হাতে পেয়েও মিরনের রাজত্ব তিনি দখল করলেন না। বন্দী সুলতানকেও ছেড়ে দিলেন, সঙ্গে রাজত্ব। রাজধানী তাব্রিজে ফিরে এল সুলতান মিরন। কয়েকদিন এই বেকুফ রাজা বসে রইল মন খারাপ করে। তবে খুব বেশি দিন না। পরাজয়ের অপমান বেমালুম ভুলে গেল সে একদিন। আর সঙ্গে-সঙ্গে তৈমুরের ভূতটা আবার চেপে বসল ঘাড়ে। তৈমুরকে নিয়ে নানা ধরনের গালগল্প সে শুনে এসেছে ছেলেবেলা থেকে। একদিন এক বুড়ো তার দরবারে এসে শুনিয়ে গেল সেই ধরনের এক গল্প। আর বলতে কী, তারপর থেকেই সে উঠল চাঙ্গা হয়ে। দরবার সেদিন ফাঁকা, যুদ্ধে হারের পর কমে গেছে দরবারি চাকচিক্য। সুলতান মিরন শা বসে আছেন গালে হাত দিয়ে। সর্বদা বিমর্ষ। সে দৃশ্য দেখতে ভাল লাগে না আমিরদের। সুতরাং অনেকেই থাকেন অনুপস্থিত। সুলতানের মেজাজ ভাল নেই বলে প্রজারাও ভিড় করে না তাদের অভাব-অভিযোগ নিয়ে। এর ওপর আগের দিন থেকে নেমেছে জোর বৃষ্টি। খুব জোর। জাঁকিয়ে বসেছে শীত। পথ হয়ে গেছে জনবিরল। সুতরাং দরবারও যে ফাঁকা হবে, তাতে আর বিস্ময় কী।

ফাঁকা দরবারেই ঢুকল এসে এক ফকির। নাটকীয়ভাবে। তৈমুরের জমানা চলে গেছে জানি। কিন্তু সেই বড় মির্জার ছেলে হয়ে সুলতান মিরন শা কি গালে হাত দিয়ে কেয়ামতের ভাবনা ভাবছেন ? নাকি তাঁর শরীরটাই বিলকুল বে-শরিফ ? ফকিরের এই অদ্ভুত কথায় চমকে উঠেছিল সুলতান মিরন। তারপর মনের সব দুঃখ উজাড় করে দিয়ে শা মিরন পরামর্শ চেয়েছিল ফকিরের কাছ থেকে। চেয়েছিল অলৌকিক আশীর্বাদ। মিরনের অবস্থা দেখে হাহা করে হেসে উঠেছিল ফকির। তারপর ধীরেসুস্থে একটা পুরনো কিংবদন্তি শুনিয়েছিল শাহাজাদাকে, যে-কিংবদন্তির নায়ক ছিলেন মির্জা তৈমুর।

তৈমুর তখন ছেলেমানুষ। পাহাড়ি-বকরির মতন তখন সে লাফালাফি করে বেড়ায় এক পাহাড় থেকে আর-এক পাহাড়ে। তবে ছেলেবেলা থেকেই সে খুনসুটে ৷ গায়ে পড়ে মারামারি করে। আর খুব জেদি। স্বপ্ন দেখে সুলতান হবার। ঘোড়া ছুটিয়ে সে দেশ-দেশান্তরে পাড়ি দেবার খোয়াব দেখে। খোয়াব দেখে রাজ্য জয়ের। অনেক রাজ্য জয় করে সে মনে-মনে তৈরি করে বিশাল সাম্রাজ্যের, আর নিজেকে ওই বিশাল সাম্রাজ্যের মাথায় বসিয়ে মনে মনে অনেক আঁক কষে। শৈশবের অমনি এক স্বপ্ন দেখা দিনে হঠাৎ এক দরবেশের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল তৈমুরের। দরবেশটি বেশ ভাল। অন্তত সেইরকম মনে হয়েছিল তৈমুরের। মাথায় একরাশ জটা। গায়ে রংদার আলখাল্লা। মুখে কাঁচা-পাকা ইসলামি দাড়ি। হাতে বাঁকা লাঠি। আর নানা কাপড়ের তালি লাগানো এক ঝোলা। তৈমুরকে দেখে দরবেশ হাসি-হাসি মুখে বলেছিল, “কী বাবজান, তুমি কি সুলতান হতে চাও ? চাও চেঙ্গিসের মতো রাজত্ব?”

ওইরকমভাবে মনের কথা টেনে কেউ যে কখনও বলতে পারে, তা ছোট্ট তৈমুর স্বপ্নেও ভাবেনি। তাই সে অনেক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে-ছিল দরবেশের মুখের দিকে। তার মুখ দিয়ে কোনও কথা সরেনি। --“কী বাপজান? সুলতান হবে না?” আবার হাসি-হাসি মুখে বলেছিল দরবেশ। -- হ্যাঁ, আমি খুব বড় সুলতান হতে চাই।”

“বাঃ, বেশ বেশ”-- খুব খুশি হয়েছিল দরবেশ, “তা হলে তো তোমাকে এক কাজ করতে হবে বাপু !”

“কী কাজ?”

“তোমাদের বাড়ি থেকে আমাকে এনে দিতে হবে একমুঠো চাল। আর-একটি দিনার।”

দরবেশের কথা ফুরোতে-না-ফুরোতে দৌড়ে বাড়ি চলে গিয়েছিল তৈমুর। এনে দিয়েছিল একমুঠো চাল, আর একটি দিনার। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে বলেছিল, “দরবেশ, তোমার কথা রাখলুম। তা আমি সুলতান হতে পারব তো ?”

“পারবে” -- দরবেশ আবার একগাল হাসল। একটু থেমে বলল, তা তুমি একাই সুলতানি নিতে চাও, না তোমার ছেলেরাও বংশ-পরম্পরায় সুলতান হোক, চাও ?”

“আমার বংশধররাও সুলতানিতে থাকুক, এটাই আমি চাই।“

“বাঃ, বাঃ বেশ সুন্দর কথা”--বলে উঠল দরবেশ, “তবে তার জন্য তোমাকে যে আমার এই হাতের ছড়ি ঘা খেতে হবে। পারবে তো ছড়ির ঘা খেতে ?”

“পারব।”

তৈমুরের সম্মতি পেয়ে দরবেশ তার গা থেকে একটি কালো চাদর খুলে জড়িয়ে দিল তৈমুরের গায়ে। তারপর তাকে পথের ওপর শুইয়ে দিয়ে আরম্ভ করল ছড়ি দিয়ে পেটানো। ছড়ির এক-একটি আঘাতে কুঁকড়ে ওঠে তৈমুর। বোধ করে অসহ্য যন্ত্রণা। তবু তা সে মেনে নেয়। থাকে নীরব। এইভাবে এগারোটা মার খাওয়ার পর আর সে থাকতে পারল না। উঠে পড়ল।

দরবেশ এবার তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিল। বলল, “ঠিক আছে, বাপজান। তুমি যতবার এই ছড়ির ঘা হজম করেছ তত পুরুষ তোমার বাদশাহি থাকবে। এ দরবেশের কথা মিথ্যা হবে না।”দরবেশ চলে গেল। বাড়ি ফিরল তৈমুর। তবে সে দরবেশকে তৈমুর আর জীবনে দেখেনি। অনেক চেষ্টা করেও খুঁজে পায়নি তাকে। দরবেশের কথা জীবনে মিলে. গিয়েছিল অক্ষরে অক্ষরে।

শীত জাঁকিয়ে বসেছে। দরবার প্রায় ফাঁকা।

ফকিরের গমগমে গলায় তৈমুরের এ-কাহিনী শুনতে শুনতে সুলতান মিরন শা রোমাঞ্চিত হন বারবার। উজবেক সদা ইউসুফের কাছে হেরে যাওয়ার জ্বালাটা হঠাৎ যেন কমে গেল। ভেতর থেকে উৎসারিত হতে থাকল প্রবল উদ্দীপনা, উৎসাহ। ফকির বলেছিল, “জমানা বদল হতে পারে, কিন্তু জেনে রাখবেন—আপনাদের সুলতানিটা টিকে থাকবে এগারো পুরুষ ধরে। এখানে কেউ চোট দিতে পারবে না। ঝাঁহাপনা, চাঙ্গা হয়ে উঠুন। কোনও ভয় নেই। মিরনশাহি বংশে কেউ চোট লাগাতে সক্ষম নয়।

ফকির চলে গেল। সুলতান মিরন শা'ও সঙ্গে-সঙ্গে উঠল চাঙ্গা হয়ে। পরের বছরই আবার সৈন্যবাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল পাহাড়ি সর্দার ইউসুফের ওপর। এবারও হার হল মিরন শা’র। এবার সে হল বন্দী। বাঁধা পড়ল বেচারির রাজত্ব। তবে ইউসুফ এবারেও তাকে ছেড়ে দিল দয়া করে। ফিরিয়ে দিল তার রাজত্ব। এবং অপমানিত মিরন শা এবারও যথারীতি ফিরে এল রাজধানী তাব্রিজে।

সর্দার ইউসুফের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া শেষমেশ মিরন শা’র বাৎসরিক একটি ক্রিয়াকর্মে দাঁড়িয়ে গেল।

তৈমুরের ছেলে হিসেবে এ-অভিযান যেন তাকে করতেই হবে। আর প্রতিবারই হেরে গিয়ে সে বন্দী হয়ে যায়। সর্দার ইউসুফ সকৌতুকে প্রতিবারই তাকে পিঠ চাপড়ে ছেড়ে দিয়ে বলেন, “বাছা, আরও একটু বল সঞ্চয় করে সামনের বার এসো। তোমার সিপাইদের ভাল করে তালিম. দিও। জোগাড় করো ভাল-ভাল বলশালী সৈনিক। কেমন? আসছে বছর আবার দেখা হবে।" মিরন শা চলে আসে নীরবে। নতুন উদ্যমে সে তৈরি হয় পরের বছরের জন্য। এবং মনে-মনে সঙ্কল্প করে ইউসুফের ওই রসিকতার সে একদিন বদলা নেবে। তৈমুরের ছেলে হিসেবে কোনওদিনই সে ওই পাহাড়ি মানুষটাকে ক্ষমা করতে পারবে না।

আটবারের বার সত্যি সত্যিই সুলতান মিরণের কপালে শিকে ছিঁড়ল। অসতর্ক এক মুহূর্তে উজবেক সর্দারকে সে বন্দী করে ফেলল। বন্দী ইউসুফকে তারপর সোজা সে নিয়ে এল নিজের রাজধানীতে। ইচ্ছে ছিল কাশগড়ে গিয়ে সে একটু তৈমুরি তাণ্ডব দেখায়। মানুষের মাথা কেটে তৈরি করে পাহাড় বা পিরামিড। কিংবা ধরে নিয়ে আসে হাজার-হাজার ক্রীতদাস। দু'হাত ভরে নিয়ে আসে লুষ্ঠিত জিনিস। কাশগড়ের পাহাড়ি-সিপাইরা ছিল বড়ই দুর্ধর্ষ, তাই কোনও ইচ্ছেই সে পারল না পূর্ণ করতে। তবে ফাঁকতালে ইউসুফকে ধরে নিয়ে আসার জন্য বারবার সে নিজের কৃতিত্বকে বাহবা দিল।

এদিকে সর্দার ইউসুফ ভাবলেন যে, মিরন তাঁকে আটক করলেও, ধরে রাখবে না বেশি দিন। বছরের পর বছর যাকে তিনি ক্ষমা দেখিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন, এবার সে নিশ্চয়ই পুরনো দিনের কথা স্মরণ করে তার কৃতজ্ঞতা জানাবে। ছেড়ে দেবে তাঁকে। কিন্তু বাস্তবে যে ঘটনা ঘটল, তা ঠিক বিপরীত। ছেড়ে দেওয়া তো দূরের কথা, মিরন হয়ে পড়ল প্রতিহিংসাপরায়ণ। দরবারে হাজির করে সে বিচার করল ইউসুফের। বিচারের শেষে তার চোখ দুটি উপড়ে ফেলা হল। তাকে চিরতরে অন্ধ করে দেওয়া হল।

কয়েক মাস পরে নতুন অভিযানের জন্য আবার সাজ-সাজ রব পড়ল তাব্রিজ নগরে।

মিরন শা নিজে হাঁকডাক করে তার তদারকি করতে থাকল। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দেখতে থাকল সিপাইদের কুচকাওয়াজ। আর বেশি করে সে নজর দিল তীরন্দাজদের ওপর। কেননা, তৈমুর কদর করতেন এই তীরন্দাজদের। এদের দক্ষতা দেখে করতেন পুরস্কৃত। বিলোতেন ইনাম-বকশিশ। সুতরাং সুলতান মিরনও চাইলেন অনুরূপভাবে তাদের তৈরি করতে।

তখন শেষ-শরৎ। পাহাড়ি বাতাসে হিমের ছোঁয়া। আকাশ ঘন নীল। সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ছে পাহাড়ের সাদা চুড়োয়। সুলতান মিরন শা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল তীরন্দাজদের অনুশীলন। সুলতান মিরনের পাশে বসে ছিল পারিষদবর্গ। ছিল আমির মনসবদারেরা। তীরন্দাজ -বাহিনীর সেনাপতি এসে সুলতানকে জানিয়ে বলল, “সুলতান যদি অনুমতি করেন, তা হলে তীরন্দাজির সেরা বিদ্যেটা আমরা আজ শিখে ফেলতে পারি।”

“শিখতে বাধা কোথায়? আর এজন্য অনুমতিই বা লাগবে কেন?”

“হুজুর, এ বিদ্যেটা বড় কঠিন। অন্ধকারে শব্দ শুনে তীর ছোঁড়া। আমাদের লোকেরা কেউ জানে না এ-বিদ্যে। বাইরে থেকে আনতে হবে গুনিন। যদি সুলতান অনুমতি করেন, তবেই গুনিনকে হাজির করা যায়।”

“গুনিন আছে ? কোথায় সে গুনিন?” কৌতুহলী হল মিরন শা।

মাথা চুলকে সেনাপতি বলল, “আজ্ঞে, সে গুনিন আছে কয়েদখানায়। কাশগড়ের সর্দার ইউসুফ।”

“ইউসুফ জানে এ-বিদ্যে ?”

“আজ্ঞে, সে জানে এ-বিদ্যে। সে যদি তালিম দেয়, তা হলে এ বিদ্যে আমরা শিখে ফেলব। তবে সে রাজি হবে কিনা সন্দেহ।হুজুরের হুকুম, না হলে তাকে জোর করা যাবে না। তাই বলছিলাম কি….”

“জোর করতেই হবে। রাজি হবে না মানে?” হুঙ্কার ছাড়ল মিরন শা। “তৈমুরের ছেলে হয়ে তাকে আজও যে বাঁচিয়ে রেখেছি, সে তার বাপের পূন্যি ! রাজি না হলে পিঠের ছাল ছাড়িয়ে নেওয়া হবে”। পারিষদেরাও সঙ্গে-সঙ্গে গর্জন করে উঠল, “যাও, ধরে নিয়ে এসো তাকে। ওর আজ উচিত শিক্ষা হবে।”

কয়েদখানায় জরুরি তলব গেল। গেল সুলতানি হুকুমনামা। ওই গোপনবিদ্যা শত্রুদের শেখানো যাবে না বলে প্রথমে বেঁকে বসলেন সর্দার ইউসুফ। তবে বারবার ভয় দেখানোর পরে নিমরাজি হলেন সর্দার। তবে রইল একটি শর্ত। তীর ছোঁড়বার সময় নির্দেশ জারি করতে হবে স্বয়ং সুলতানকে। কেননা, কাশগড়ের উজবেক সর্দার সুলতান ছাড়া আর কারও নির্দেশ গ্রহণে প্রস্তুত নন।

যাই. হোক, সর্দারের শর্তের কথা জানানো হল মিরন শা'কে। মিরন হেসে উঠল হাহা করে। বলল, “বলেছিলাম, ওই সর্দার ব্যাটাকে রাজি হতেই হবে। তা বেশ, আমিই জারি করব নির্দেশ। তোমরা ওই ফাঁকে শিখে ফেলো বিদ্যেটা।”

সঙ্গে-সঙ্গে ওই সেনানিবাসের ভেতর পড়ে গেল হুড়োহুড়ি। ছোট্ট করে একটা দরবারি আয়োজন হয়ে গেল। সুলতানের জন্য আলাদা জায়গার ব্যবস্থা হল। ওখান থেকে তিনি নির্দেশ দেবেন। আর বিপরীত দিকে প্রস্তুত করা হল একটি নিশানা। সুলতানের নির্দেশ ঘোষিত হলেই ওই নিশানায়। বেজে উঠবে একটি ঘণ্টা। ওই ঘণ্টার শব্দে লক্ষ্যভেদ করবেন সর্দার ইউসুফ।

ইউসুফকে সুলতানি সৈন্যরা এনে হাজির করে দিল কয়েদখানা থেকে। কয়েকমাস কয়েদ বাসের পর ওই উজবেক সর্দারের চেহারার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সেই পাহাড়ি সতেজ ভাবটা আর নেই। চোখ দুটো উপড়ে ফেলার পর মুখটি কেমন যেন কুৎসিত হয়ে গেছে। চুল-দাড়ি হঠাৎ পেকে গেছে। দেখলে মনে হয় তিনি বেশ বুড়ো হয়ে গেছেন। কপালে পড়েছে বলিরেখা।

তীরন্দাজ বাহিনীর সেনাপতি পরিস্থিতিটা বুঝিয়ে দিলেন। বুঝিয়ে দিলেন সুলতান কেমনভাবে নির্দেশ জারি করবেন এবং ওই নির্দেশ জারির সঙ্গে-সঙ্গে কেমনভাবে নিশানায় বেজে উঠবে ঘণ্টা। আর ঘন্টা বাজার সঙ্গে-সঙ্গে তিনি দেখাবেন তাঁর তীরের খেলা।

একটি ভারী ধনুক এবং বেশ কয়েকটি তীর তুলে দেওয়া হল ইউসুফ সর্দারের হাতে। নাড়াচাড়া করে সর্দার বিশেষ একটি তীরকে নিলেন বাছাই করে। তারপর ধনুকে শর যোজনা করে দাঁড়িয়ে রইলেন নির্দেশের অপেক্ষায়। সুলতানি তীরন্দাজরা তাঁর দিকে তাকিয়ে রইল উৎসুক দৃষ্টিতে ৷ সুলতানের পারিষদ এবং আমিররাও অপেক্ষা করে রইলেন অধীর আগ্রহে। মুহূর্তে গোটা পরিবেশটা হয়ে গেল নিস্তব্ধ। খুব দূরে কয়েকটি পাখির কিচিরমিচির ছাড়া আর কিছুই কানে আসে না।

পাথরের একটি মূর্তির মতো ধনুকধারী সর্দার দাঁড়িয়ে। আর ওর ডানপাশে কিছু দূরে দাঁড়িয়ে সুলতান মিরন শা।

সেই নিস্তব্ধতাকে ভেঙে ভারী গমগমে গলায় নির্দেশ জারি করল তৈমুরের তৃতীয় সন্তান। ঠিক তৈমুরের ভঙ্গিতে। সঙ্গে-সঙ্গে নিশানায় বেজে উঠল ঘণ্টা। সকলের চোখের দৃষ্টি নিশানার দিকে। ওরা বিস্মিত হলেন, কই নিশানায় গিয়েও তীর পৌঁছল না। কিন্তু এদিকে ঘাড় ফেরাতেই যে দৃশ্য চোখে পড়ল, তা রোমহর্ষক। ইউসুফ সর্দারের তীর সোজা গিয়ে বিদ্ধ করেছে সুলতান মিরন শা’কে। তাঁর পাঁজর করে দিয়েছে এ-ফোঁড় ও-ফোঁড়। রক্তাপ্লুত মিরন মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছে দুঃসহ যন্ত্রণায়। আর দূরে দাঁড়িয়ে পাগলের মতন হাহা করে হাসছেন পাহাড়ি সর্দার।

সাত-সাতবার যে লোকটি ক্ষমা করেছেন মিরনের ছেলেমানুষি, এবারে সে আর তাকে ক্ষমা করল না। বেকুফ মিরন শা তার বোকামির জন্যই বরণ করল মৃত্যু। তার এক বোকামির জন্য খতম হয়েছিলেন বাপজান দুর্ধর্ষ তৈমুর। শেষ বোকামিতে বেচারা নিজের প্রাণটা দিয়ে গেল। ইতিহাস এ-জাতীয় ঘটনা বিরল। তবে ইতিহাস বেকুফ লোকটিকে স্মরণ করে একটি কারণে। এ মানুষটির বংশেই পরে জন্ম হয় বাবরের। অর্থাৎ, মিরনশাহি বংশই হল ভারতের মুঘল বংশ।

(শেষ)

No comments:

Post a Comment