মাছের কাঁটা (প্রথমাংশ)

লেখক: নারায়ণ স্যান্যাল

মাছের কাঁটা


প্রথম পর্ব


“মৈত্রেয়ী তখন একমুহূর্তে বলে উঠলেন, “যেনাহং নামৃতা স্যাম কিমহং তেন কুর্য্যাম্‌” যার দ্বারা আমি অমৃতা হব না, তা নিয়ে আমি কী করব।... উপনিষদে সমস্ত পুরুষ ঋষিদের জ্ঞানগম্ভীর বাণীর মধ্যে একটিমাত্র স্ত্রী-কন্ঠের এই একটিমাত্র ব্যাকুল বাক্য ধ্বনিত হয়ে উঠেছে এবং সে ধ্বনি বিলীন হয়ে যায়নি -- সেই ধ্বনি তাঁদের মেঘমন্দ্র শান্ত স্বরের মাঝখানে অপূর্ব একটি অশ্রুপূর্ণ মাধুর্য জাগ্রত করে রেখেছে। মানুষের মধ্যে যে পুরুষ আছে উপনিষদে নানা দিকে নানা ভাবে আমরা তারই সাক্ষাৎ পেয়েছিলুম, এমন সময়ে হঠাৎ এক প্রাণে দেখা গেল মানুষের মধ্যে যে নারী রয়েছেন তিনিও সৌন্দর্য বিকীর্ণ করে…..”


হঠাৎ রবীন্দ্র রচনাবলীটা বন্ধ করে বাসু সাহেব তাঁর একক শ্রোতার দিকে তাকিয়ে দেখেন। দেখেন, রানী দেবী তাঁর হুইল-চেয়ারে ক্লান্ত হয়ে বসে আছেন। চোখ দুটি বোজা।

--ঘুম পাচ্ছে? প্রশ্ন করলেন বাসু-সাহেব।

চমকে উঠে রানী দেবী বললেন, না, শুনছি, পড় তুমি --

-- ভাল লাগছ না, নয়?

ম্লান হাসলেন রানী দেবী। মাথাটা নেড়ে সত্যি কথা স্থীকার করলেন।

-- তবে থাক! এস কিছু গান শোনা যাক। বল, কী বাজাব?

উঠে গেলেন রেডিওগ্রামের দিকে।

-- গান থাক। তুমি এখানে এসে বস তো। কয়েকটা কথা বলার ছিল।

সন্দিগ্ধ চোখে বাসু-সাহেব তাকিয়ে দেখলেন একবার স্ত্রীর দিকে। এসে বসলেন তাঁর পরিত্যক্ত চেয়ারেঃ বল?

-- দেখ, আমাদের যা গেছে তা আর কোনদিন ফিরবে না। আমি না হয় পঙ্গু হয়ে পড়েছি, তুমি তো হওনি! তুমি কেন এভাবে জীবনটাকে বরবাদ করছ?

বাসু-সাহেব নিরুত্তর স্তব্ধতায় বসে থাকেন। পাইপটা পর্যন্ত জ্বালেন না। একটা দম নিয়ে মিসেস বাসু বলেন, তুমি আবার প্র্যাকটিস শুরু কর।

হঠাৎ কৃত্রিম হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন পি.কে.বাসু। পাইপটা ধরাতে ধরাতে বলেন, এই কথা! আমি ভাবছি, না জানি কোন সিরিয়াস্‌ প্রসঙ্গ তুলবে তুমি।

মিসেস বাসু জবাব দিলেন না। বাসু মুখ তুলে তাঁর দিকে চাইলেন, বললেন, কী হল আবার?

-- আমি সিরিয়াসলিই কথাটা আলোচনা করতে চেয়েছিলাম! তোমার যদি আপত্তি থাকে, তবে থাক -- হুইল-চেয়ারের চাকাটায় পাক মারতে যান। বাসু হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলেন তাঁকে। বলেন, কী বলছ রানু! তা কি হয়?

-- কেন হবে না? মাইথনে সেদিন মিঠুর সঙ্গে যদি তার মা-ও মারা যেত তাহলে তুমি এমন করতে পারতে? এমন সংসার-ত্যাগী সন্ন্যাসী মত..,না, না, আমাকে বলতে দাও, প্লীজ,আমি সেন্টিমেন্টাল কথা বলব না, প্র্যাকটিকাল কথাই বলব।

বাসু পাইপটা কামড়ে ধরে বলেন, বেশ বল।

-- আমি কী বলব? এবার তো তোমার বলার কথা। কেন প্র্যাকটিস্‌ ছেড়ে দেবে তুমি?

-- কী হবে প্র্যাকটিস্‌ করে, রানু? টাকা আমাদের যা আছে, দুজনের দুটো জীবন কেটে যাবে। নাম-ডাক? ও নিয়ে কোন মোহ আমার নেই। তা-ছাড়া এই অবস্থায় তোমাকে একলা বাড়িতে ফেলে রেখে আমি কোর্ট-কাছারি করতে পারি?

-- না,টাকার জন্যে নয়। নাম-ডাকও নয়--কিন্তু তোমার শিরদাঁড়াটা যে ভাঙেনি এটা আমাকে বুঝে নিতে দাও!... তুমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছে, পঙ্গু হয়ে যাচ্ছ। তোমার কি বিশ্বাস চোখের উপর এটা প্রতিনিয়ত দেখেও আমি মনে শান্তি পেতে পারি?

এবার আর রসিকতা করলেন না বাসু-সাহেব। বললেন, কথাটা যখন তুললে রানু, তখন খোলাখুলিই বলি। কথাটা আমিও ভেবেছি। তুমি ঠিকই বলেছ। আমাদের সামনে দীর্ঘ জীবন পড়ে রয়েছে। ‘নেগেশান’ দিয়ে অত বড় ফাঁকটা ভরিয়ে দেওয়া যায় না। আমাদের বাঁচতে হবে। এভাবে নয় -- বই পড়ে, গান শুনে, দাবা খেলে -- মানে জীবনকে অস্বীকার করে নয়। কাজের মাধ্যমেই আমরা অতীতকে ভুলতে পারব --”আমরা” মানে আমি আর তুমি! কিন্তু সে জীবন-সঙ্গীতে ঐকতান চাই। রেজনেন্স হওয়া চাই। তুমি গাইবে, আমি শুনব, আমি বাজাব, তুমি শুনবে --তা নয়! পারবে?

-- তুমি আমাকে শিখিয়ে দাও! তুমি তো জান আমার কতটুকু শক্তি।

--জানি! কিন্ত তোমার মনে কতখানি জোর তাও আমি জানি! বেশ সেই পথেই চিন্তা করি। দু-চারদিন পরে তোমাকে জানাব। কিছু একটা পথ খুঁজে বার করতেই হবে।

-- নিশ্চয়ই খুঁজে পাব আমরা।



ব্যারিস্টার পি.কে.বাসুকে যাঁরা চেনেন না তাঁদের জন্য কিছু পূর্বকথন দরকার। এখন ওঁর বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। এককালে দুর্ধর্ষ প্র্যাকটিস ছিল ওঁর। কলকাতার বারে সবচেয়ে নামকরা ক্রিমিনাল লইয়ার। কোর্ট, বার আ্যসোসিয়েশান, ক্লাব, টেনিস এই নিয়ে ছিল তাঁর জীবন। সহধর্মিণী রানী বাসুও স্বনামধন্যা। গানের আসরে শৌখীন গাইয়ে হিসাবে তাঁর ছোটাছুটিরও অন্ত ছিল না। রেডিওতে রবীন্দ্রসঙ্গীত মাসে পাঁচ-সাতখানা তাকে গাইতেই হত। অ্যাপয়েন্টমেন্টে ঠাসা থাকত কর্তা-গিন্নির দিনপঞ্জিকা।

তারপর একদিন। একটি খন্ডুমুহূর্তে একেবারে বদলে গেল সব। মাইথনে বেড়াতে গিয়েছিলেন ওরা। কর্তা-গিন্নি আর ওঁদের দশ বছরের একমাত্র মেয়ে সুবর্ণ বা মিঠু। পথ দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই মিঠু শেষ হয়ে গেল। বাসু-সাহেব বেঁচে ফিরে এলেন প্রায় অক্ষত, আর তিন মাস পরে যখন মিসেস বাসু হাসপাতাল থেকে বের হয়ে এলেন তখন জানা গেল, তাঁর মেরুদণ্ডের একটি অস্থি কোনরকমে জোড়াতালি দিয়ে রাখা হয়েছে। তিনি আর কোনোদিন সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াতে পারবেন না। সন্তানের জননী হতে পারবেন না।

প্র্যাকটিস্‌ ছেড়ে দিয়েছিলেন বাসু-সাহেব। স্ত্রীকে সাহচর্য দেওয়াই হল এর পর থেকে তাঁর দৈনন্দিন কাজ। অদ্ভূত আমুদে লোক--প্রথম পরিচয়ে কেউ বুঝতেই পারত না -- ওঁর জীবনের অন্তরালে লুকিয়ে আছে এতবড় একটা ট্র্যাজেডি। পঙ্গু স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন এখানে-ওখানে। রানী দেবীকেও হঠাৎ দেখলে বোঝা যায় না তিনি উত্থানশক্তি-রহিত -- কিন্তু তাঁর মুখখানা বিষাদ মাখানো।

ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও না কি ধান ভানে। এই ধুরন্ধর প্রতিভাশালী ক্রিমিনাল লইয়ারটিও নাকি তেমনি বেড়াতে গিয়েও তাঁর পেশাগত কাজে জড়িয়ে পড়েছিলেন দু-একবার। আগরওয়াল ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক ময়ূরকেতন আগরওয়ালের মৃত্যু-রহস্যের কথা হয়তো কেউ কেউ শুনে থাকবেন। সেখানে ঐ খুনের মামলায় সুজাতা চট্টোপাধ্যায় আর কৌশিক মিত্র নামে দুজন জড়িয়ে পড়েছিল। বাসু-সাহেব তাঁর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির সাহায্যে এ দুজনকেই সে মামলা থেকে উদ্ধার করে আনেন। এসব খবর একদিন খবরের কাগজে ফলাও করে বার হয়েছিল তা হয়তো আপনাদের নজরে পড়েছে। তারপরেও আরেকটি খুনের কিনারা তিনি করেছিলেন দার্জিলিঙের এক হোটেলে। হোটেলটার নাম ‘দ্য রিপোজ’ --সদ্য খোলা হয়েছিল। বস্তুত এ হোটেল খোলার উদ্বোধনের দিনেই অপ্রীতিকর ঘটনাটি ঘটে। হোটেলের মালিক ঐ সুজাতাই -- সুজাতা চট্টোপাধ্যায় নয়, সুজাতা মিত্র; ইতিমধ্যে কৌশিক মিত্রকে সে বিয়ে করেছে। সুজাতার বাবা নাকি কী একটা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করেন। সেসব এক ইঞ্জিনিয়ারিং খটমট ব্যাপার! আমার ঠিক মনে নেই; মোটকথা উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সেই আবিষ্কারের পেটেন্টটা বেচে সুজাতা লাখ-দেড়েক টাকা পায়। সেই টাকাতেই হোটেল-বিজনেস্‌ শুরু করেছিল ওরা স্বামী-স্ত্রী। বাসু-সাহেব আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে হোটেলের উদ্বোধনের দিন ওখানে যান। হোটেলে থাকতেই এ খুনের কিনারা করেন! শুনেছি, সেই ঘটনাটার উপর ভিত্তি করে একটি গল্পের বইও লেখা হয়েছে -- তার নাম “সোনার কাঁটা”।

যাক্ ওসব অবান্তর কথা। যে কথা বলছিলাম স্বামী-স্ত্রীর এ কথোপকথনের পর থেকেই বাসু-সাহেব ভাবছিলেন কী করে নতুনভাবে বাঁচার ব্যবস্থা করা যায়। উত্থানশক্তিরহিত স্ত্রীকে জড়িয়ে কেমন করে কর্মব্যস্ত হয়ে পড়া যায়। ঠিক এমনই সময়ে ওঁদের বাড়িতে এসে দেখা করল কৌশিক আর সুজাতা। বাসু-সাহেবের নিউ আলিপুরের বাড়িতে। বাসু-সাহেব ওদের আপ্যায়ন করে বসালেন। সুজাতা আর কৌশিক দুজনেই ওঁর অত্যন্ত স্নেহভাজন। খুশিয়াল হয়ে ওঠেন প্রৌঢ় ভদ্রলোক। বলেন, খুব খুশি হয়েছি তোমরা দেখা করতে আসায়। কবে এসেছ দার্জিলিঙ থেকে? হোটেল কেমন চলছে?

সে কথার জবাব না দিয়ে সুজাতা বলে, রানু-মামীমা কোথায়?

বাসু-সাহেব আসলে বিপুল ঘোষ, আই.এ.এস.-এর মামাশ্বশুর। সেই সূত্রে সকলে তাকে “মামু” বলে ডাকত। বিপুল ঘোষ ছিলেন ডি. এম.। যে জেলা-সদরে কৌশিক আর সুজাতার সঙ্গে তার আলাপ সেখানকার অফিসার্স ক্লাবে বাসু-সাহেব হয়ে পড়েছিলেন সার্বজনীন মামু। সেই সুবাদেই কৌশিক-সুজাতা ওঁকে “বাসুমামা” বলে ডাকে।

বাসু-সাহেব বলেন, আছে ভিতরে। খবর পাঠাচ্ছি, কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাধ পাইনি। হোটেল রিপোজ কেমন চলছে? এবার গ্রীষ্মকালে ওখানে গিয়ে কিছুদিন কাটিয়ে আসব ভাবছি। এবার কিন্তু গেস্ট হিসাবে নয়, রেগুলার বোর্ডার হিসাবে।



কৌশিক বললে, আমরা দুঃখিত বাসুমামু। আমাদের হোটেলে আপনার ঠাঁই হবে না। অন্য কোনও হোটেল বুক করুন।

হো হো করে হেসে ওঠেন পি.কে.বাসু। বলেন, ওরে বাবা। এত রাগ! পয়সা দিরে থাফব বলায়? একেবারে -- ‘ঠাঁই হবে না?’

কৌশিক বললে, আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। শুধু সেজন্য নয়। হোটেলটা আমরা বিক্রি করে দিয়েছি।

-- বিক্রি করে দিয়েছ! সেকি গো? কেন?

-- চলছিল না। পুজোর সময় কিছুদিন, আর গরমের সময় কয়েক সপ্তাহ --ব্যস্‌! বাকি সাত-আট মাস তীর্থের কাকের মত হাপিত্যেস করে বসে থাকা। সবচেয়ে হরিবল্ শীতকালের কটা মাস। দেড় বছর চালালাম -- এস্টাব্লিশমেন্ট খরচই ওঠে না। তাই সুযোগমত একটা অফার পাওয়া মাত্র লক-স্টক-ব্যারেল বেচে দিলাম!

-- বেশ করেছ! তুমি হলে পাশ করা এঞ্জিনীয়ার। হোটেল-বিজনেস কি তোমার পোষায়? তা নতুন বিজনেস ধরেছ?

-- ধরিনি কিছু। সব বেচে-বুচে ঝাড়া-হাত-পা হয়ে কলকাতায় চলে এসেছি!

-- উঠেছ কোথায়?

-- হোটেলে। একটা বাসা খুঁজছি। আর একটা বিজনেস। লাখ-দেড়েক টাকা ক্যাপিটাল আছে। তাই সুজাতা বললে, চল, বাসুমামার কাছ থেকে একটু লীগ্যাল আ্যাডভাইস্‌ নিয়ে আসি।

বাসু-সাহেব সুজ্জাতার দিকে ফিরে বলেন, তোমাদের বাসুমামা চেম্বার অফ কমার্স-এর কেউ নন সুজাতা । এখানে আমি কী পরামর্শ দেব? খুন-জখম রাহাজানি যদি কখনও করে ফেল তখন বাসুমামার কাছে এস। পরামর্শ দেব।

সুজাতা মাথা নেড়ে বললে, উঁহু! খুন-জখম রাহাজানি যদি কখনও করে বসি তবে আর যার কাছেই যাই, আপনার কাছে আসব না। ভরাডুবি হবে তাহলে!

--কেন, কেন? এভাবে আমার বদনাম করার মানে?

-- বদনাম নয়, বাসুমামু -- আপনিই বলেছিলেন একদিন যে, যখন প্র্যাক্টিস্‌ করতেন তখন সত্যিকারের অপরাধীর কেস নাকি আপনি নিতেন না!

-- কারেক্ট।

কৌশিক অবাক হয়ে বলে, নিতেন না! কেন?

চুরুটটা ধরাতে ধরাতে বাসু-সাহেব বলেন, ওটাই ছিল আমার প্রফেশনাল এথিক্স। যার এজাহার শুনে বুঝতাম সে নিরপরাধ, তার কেসই আমি নিতাম। যাকে মনে হত সত্যিকারের অপরাধী তাকে বলতাম-- হয় “গিলটি প্লীড” করে সাজা নাও, নয় অন্য কোনও উকিলের কাছে যাও।

কৌশিক বলে, সেরেছে! সব উকিল যদি তাই বলে তবে অপরাধীগুলো ডিফেন্স পাবে কোথায়?

-- পাবে না।

কিন্তু পিনাল কোড তো বলছে যে, অপরাহীরও ডিফেন্স পাবার অধিকার আছে। যে অপরাধীর আর্থিক সঙ্গতি নেই তাকে তো সরকারী খরচে ডিফেন্স পাইয়ে দেওয়া হয়।

-- তুমি ভুল করছ কৌশিক। পিনাল কোড একথা বলছে না ঘে, অপরাধীর ডিফেন্স পাওয়ার অধিকার আছে, বলছে অভিযুক্তের আছে, আসামীর জাছে। ‘অভিযুক্ত আসামী’ আর ‘অপরাধী’ শব্দ দুটোর অর্থ পৃথক। কিন্তু এসব আইনের কচকটি বন্ধ কর। দাঁড়াও, তোমাদের রানু মামীমাকে আগে খবরটা দিই।

বাসু-সাহেব টেবিলের তলায় একটা ইলেকট্রিক বেল টিপলেন। এসে হাজির হল একটি বছর দশ-বারোর চটপটে ছোকরা।

-- এই বিশে! এদের চিনিস?

-- বিশু কৌশিক আর সুজাতাকে এক নজর দেখে নিয়ে বললে, হুঁ। সিনেমা করেন।

সুজাতা হেসে ওঠে। বাসু-সাহেব বলেন, দূর গরু! না, এঁরা সিনেমা করেন না। তুই ভিতরে গিয়ে তোর মা-কে বলে আয়, দার্জিলিঙ থেকে সুজাতা আর কৌশিক এসেছে।

সায় দিয়ে বিশু ভিতর দিকে চলে যাচ্ছিল। বাসু-সাহেব তাকে ফিরে ডাকেন- এই বিশে, দাঁড়া! কী বলবি?

-- বলব কি, যে দার্জিলিঙ থেকে সুজাতা আর কৌশিক এসেছে।

-- তাই বলবি! বেটাচ্ছেলে! কী শেখাচ্ছি এতদিন ধরে?

-- তাই তো বললেন আপনে!

-- আমি বললাম বলে তুইও বলবি? না! তুই গিয়ে বলবি দার্জিলিঙ থেকে সুজাতা দেবী আর কৌশিকবাবু এসেছেন। বুঝেছিস?

-- আজ্ঞে আচ্ছা -- এক ছুটে চলে যায় ভিতরে।

কৌশিক প্রশ্ন করে, নিউ রিক্রুট?

-- সদ্য আমদানি। তবে ইন্টেলিজেন্ট খুব --

সুজাতা বলে, তাহলে আপনি ও বিষয়ে কোনও পরামর্শ দেকেন না? ঐ আমাদের নতুন ব্যবসা কী জাতীয় হবে সেই প্রসঙ্গে?

-- কে বলেছে দেব না? ক্রিমিনাল লইয়ার হিসাবে আমার বলার কিছু নেই, কিন্তু তোমাদের মামু-হিসাবে পরামর্শ দিতে দোষ কী? বল, কিসের বিজনেস করতে চাও তোমরা? কৌশিক তো শিবপুরের বি. ই.। ঠিকাদারী পোষাবে?

কৌশিক মাথা নেড়ে বললে, না! আমরা যৌথভাবে আপনার দ্বারস্থ হয়েছি। এমন একটা পথের নির্দেশ দিন যাতে আমরা দুজনেই ব্যবসায়ে খাটতে পারি। ঠিকাদারী ব্যবসায়ে প্রায় হান্ডেড পার্সেন্ট কাজই টেকনিক্যাল -- তাছাড়া ও ঠিকাদারী আমার পোষাবেও না?

বাসু-সাহেব বিচিত্র হেসে বললেন, তবে কী পোষাবে? গোয়েন্দাগিরি?

একটু বক্রোক্তি ছিল কথাটার ভিতর। কৌশিক, সাময়িক ভাবে, ঘটনাচক্রেই বলতে পারি, সুজাতার বাড়ি গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়েছিল। এই সূত্রেই সুজাতার সঙ্গে তার পরিচয়, প্রণয় ও পরে পরিণয়। কৌশিক কিন্তু রসিকতার ধার দিয়েও গেল না। বললে, কথাটা আপনি মন্দ বলেননি। বক্সীমশায়ের তিরোধানের পর কলকাতা শহরে নামকরা প্রাইভেট গোয়েন্দা আর কেউ নেই। ফিল্ড আছে, কম্পিটিটার কেউ নেই।

সুজাতা ভ্রুকুঞ্চিত করে বলে, বক্সী মশাই মানে?

-- ব্যোমকেশ বক্সী! নাম শোননি?

-- ও! ব্যোমকেশ বক্সী! তুমি কি তার শুন্য আসনে বসতে চাও নাকি?

কৌশিক উদ্দেশ্যে যুক্তকর কপালে ছোঁয়ালো। বললে, আমি তো পাগল নই। ব্যোমকেশ বক্সী ছিলেন দুর্লভ প্রতিভা। তাঁর মত গোয়েন্দা আর হবে না; কিন্তু তাঁর তিরোধানের পর কেউ তার পদাঙ্ক অনুসরণ করবে না, এটাই বা কি কথা?

কিন্তু আমার সেখানে ভূমিকা কী? -- জানতে চায় সুজাতা।

--যুগ পাল্টে গেছে সুজাতা। ব্যোমকেশবাবু যে-যুগের মানুষ তখনও “উইমেন্স্‌ লিব্‌” কথাটার জন্ম হয়নি। এখন যদি আমি এ জাতের একটা প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলে বসি তাহলে তুমি-আমি সমান পার্টনার হিসাবে কাজ করতে পারি। বাসুমামু কী বলেন?

-- তোমাদের ব্যাপার তোমরা বলবে, আমি কী বলব?

-- সুজাতা ছদ্ম-অভিমান করে বললে, বা রে! গাছে তুলে দিয়ে, মই কেড়ে নিচ্ছেন?

-- মোটেই নয়! তোমরা যদি চাও -- তলা থেকে ঐ মইটা আমিই ধরে থাকতে রাজী আছি!

সুজাতা আর কৌশিক পরস্পরের দিকে তাকায়। বলে, কী রকম?

বাসু-সাহেব গম্ভীর হয়ে বলেন, জোকস্‌ আ্যাপার্ট, কয়েকটা কথা তোমাদের বলে নিতে চাই। রানু এসে পড়ার আগে। রানু কিছুদিন থেকে খোঁচাচ্ছে আমি যেন আবার প্র্যাক্টিস্‌ শুরু করি। আমি রাজী হইনি --ওর কথা ভেবেই। তোমরা যদি সিরিয়াসলি এই প্রস্তাবটা গ্রহণযোগ্য বিবেচনা কর তাহলে আমার প্রস্তাবটা হচ্ছে এই রকমঃ আমার বাড়িটা দোতলা। ইংরাজি U অক্ষরের মত। একতলায় দুটো উইং। পুবদিকের উইং-এ হবে আমার ল-অফিস আর লাইব্রেরী। মাঝখানের অংশটা আমাদের রেসিডেন্স। পশ্চিমদিকের উইংটা হবে তোমাদের প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সির অফিস। একতলা

কমপ্লিট। এবার এস দোতলায়। উপর তলায় তিনখানি ঘর। তোমাদের ফ্ল্যাট। গোটা বাড়িটা হচ্ছে আমাদের দুজনের রেসিডেন্স কাম-অফিস। তোমাদের কাছে যারা কেস নিয়ে আসবে তাদের লীগ্যাল আ্যাডভাইস নিতে হবে। তাদের তোমরা পাঠিয়ে দেবে ইস্টার্ন উইং-এ, আমার অফিসে । আবার আমার কাছে যারা ফৌজদারী মামলায় পরামর্শ করতে আসবে তাদের হামেশাই দরকার হবে একজন প্রাইভেট গোয়েন্দার সাহাযা--আমার টেকনিকের জন্য। ঐ জুনিয়ার ব্রীফ সাজিয়ে দেবে আর কোর্টে দাঁড়িয়ে কথার মারপ্যাচে লীগাল রেফারেন্স দিয়ে কর্তব্য শেষ করার পাত্র আমি নই। ফলে আমরা হতে পারব পরস্পরের পরিপূরক।

কৌশিক বলে ওঠে, গ্র্যান্ড আইডিয়া।

সুজাতা বলে, কিন্তু একটা শর্ত আছে। আপনি এখনই বলছিলেন, এবাব গ্রীষ্মকালে আপনি হোটেল রিপোজে যাবার কথা চিন্তা করছিলেন --আমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে নয়, রেগুলার বোর্ডার হিসাবে। আমরা যদি এ বাড়ির দোতলায় থাকি তবে ভাড়া দিয়ে থাকব।

বাসু-সাহেব বলেন, রাজী আছি। তবে শর্ত একটা কেন হবে? অনেকগুলি শর্ত হবে।

-- যেমন?

-- ধর -- আমি তোমাদের কেস্‌ দিলে তোমরা কমিশন চার্জ দেবে। তোমরা আমাকে কেস পাঠালে আমি কমিশন দেব। এসব তো গেল বিজনেসের ডিটেলস। দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে --হেঁসেল হবে একটা। সুজাতা তার ইনচার্জ। তৃতীয়ত দুটি অফিসের জন্য একটিমাত্র রিসেপশান কাউন্টার -- এই সেন্ট্রাল ব্লক-এ দুটি প্রতিষ্ঠানের কম্বাইন্ড রিসেপশনিস্ট একজনই হবেন -- তিনি তোমাদের রানু-মামীমা! -- ঐ যে নাম করতে করতেই এসে গেছেন উনি।

সুজাতা উঠে আসে তাকে প্রণাম করতে। রানী বলেন, থাক, থাক।

কৌশিক বলে, থাক নয়, মামীমা-- আজকে প্রণাম করতে দিতেই হবে। আপনার পায়ের ধুলোর বিশেষ প্রয়োজন আমাদের নতুন বিজনেস-এর উদ্বোধন দিনে।

-- আবার উদ্বোধন! কিসের বিজনেস্‌ তোমাদের?

-- শুধু আমাদের নয়, আপনাদেরও। আপনি আর মামুও আমাদের পার্টনার।

রানী দেবী আকাশ থেকে পড়েন। বাসু তখন মিটিমিটি হাসছেন।

সুজাতাই পরিকল্পনাটা সাড়ম্বরে পেশ করে। রানী উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন। বলেন, এ খুব ভাল হবে। এই নির্বান্ধব পুরীতে তাহলে কথা বলার লোক পাব এবার থেকে! এস সুজাতা, তোমাকে হেঁসেলের চার্জ বুঝিয়ে দিই!

সুজাতা বলে, সে কি মামীমা, শুভস্য শীঘ্রম্‌ মানে এই মুহূর্ত থেকেই নয়! আমরা আজকালের মধ্যেই চলে আসব: একটা কাজ কিন্তু এখনও বাকি আছে। আমাদের প্রাইভেট ডিটেকটিভ ফার্মটার একটা নামকরণ করতে হবে। মামীমা, আপনিই নাম দিন।

রানী দেবী আঁৎকে ওঠার ভঙ্গি করেন। বলেন, ওরে বাবা! ও আমার কর্ম নয়। তোমরা বরং তোমার মামাকে ধর।

বেশ আপনিই নাম দিন -- সুজাতা ঘুরে বসে বাসু-সাহেবের মুখোমুখি।

বাসু পাইপটা ধরাচ্ছিলেন। বলেন --উঁ? নাম দিতে হবে? বেশ দিচ্ছি। তোমাদের প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সির নাম হবে -- ‘সুকৌশলী’!

সুজাতা এবং কৌশিক দুজনেই লাফিয়ে ওঠে -- গ্র্যান্ড নাম!

-- উঁহু-হু! তোমরা নামের ব্যুৎপত্তিগত অর্থটা না বুঝেই লাফাচ্ছ মনে হচ্ছে!

-- ব্যুৎপত্তিগত অর্থ! মানে?

-- লেডিজ-ফার্স্ট আইনে প্রথমেই সুজাতার ‘সু’, তার পিছনে পিছনে যথারীতি অনুগামী কৌশিকের ‘কৌ’। বাকি ‘শলী’টা হচ্ছে ‘খলু পাদপুরণে’! সমস্ত কথাটার একটা ব্যঞ্জনা দিতে!

দ্বিতীয় পর্ব


মাসখানেক পরের কথা।

এই একমাসে নিউ আলিপুরের ও-ব্লকের বাড়িটার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এতদিন অধিকাংশ ঘরই তালাবন্ধ হয়ে পড়েছিল। মিসেস বাসুর গতিবিধি শুধুমাত্র একতলাতেই সীমিত। দোতলাটা ভাড়া দেবার কথা হয়েছে মাঝে মাঝে --কিন্তু অজানা উটকো লোক এসে ঝামেলা না বাধায় মাথার উপর বসে --এ জন্যই এতদিন দোতলাটা ভাড়া দেওয়া হয়নি। অর্থের প্রয়োজন তো আর ওঁদের নেই। প্রথম জীবনে মাসে দশ-বিশ হাজার টাকা পর্যন্ত রোজগার করেছেন বাসু-সাহেব।

বাড়ির পুবদিকের অংশে দুখানি ঘর। পিছনের ঘরটা হচ্ছে লাইব্রেরী, সামনেটা দুটি অংশে বিভক্ত। সামনের দিকটা ল-অফিস -- ভিতরে বাসু-সাহেবের চেম্বার। একজন সদ্য পাশ উকিল, প্রদ্যোত নাথ, জুনিয়ার হিসাবে কাজ শিখতে এসেছে। এছাড়া আর দ্বিতীয় কর্মী নেই। বাসু-সাহেব বলেন, অনেকদিন পর শুরু করেছি তো -- প্রথমেই কতগুলো লোককে চাকরি দেব না। প্র্যাক্টিস্‌ যেমন যেমন জমবে, অফিসে লোকও বাড়াব।

পশ্চিমদিকের অংশটাতেও দুখানি ঘর। ‘সুকৌশলী’ও কোনও বাড়তি লোক নেয়নি। সুজাতা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া একটা পোর্টেবল্‌ টাইপরাইটারে ধীরে ধীরে টাইপ করে। কৌশিক প্রথম মাসে একটাও বিজনেস্‌ পায়নি। কীভাবে বিজ্ঞাপন দেবে তাই শুধু ভাবছে। বাসু-সাহেব একটা কেস্‌ পাঠিয়েছিলেন --ডিভোর্স কেস! মেয়েটির অভিযোগ তার স্বামী অসৎচরিত্র। তাই কৌশিককে কদিন তার পিছনে ছোটাছুটি করতে হচ্ছে খারাপ পাড়ায়।

তারপর একদিন। শুক্রবার বারই এপ্রিল। বাসু-সাহেব নিজের ঘরে বসে একটা আইনের বই পড়ছিলেন। হঠাৎ ইন্টারকমটা বেজে উঠল। সুইচটা টিপে বাসু-সাহেব বলেন, কী ব্যাপার, ব্রেকফাস্ট রেডি ?

-- না। তোমার সাঙ্গে একজন দেখা করতে চাইছেন। মিস্টার জীবন কুমার বিশ্বাস। প্রয়োজন বলছেন, আইনঘটিত পরামর্শ। পাঠিয়ে দেব?

বইটা সরিয়ে রেখে বাসু-সাহেব বললেন. দাও।

সকাল সাড়ে আটটা। অফিস আজ ছুটি, গুড ফ্রাইডে। প্রদ্যোত আসবে না আজ। কাছারী বন্ধ। একটু পরে বিশু পথ দেখিয়ে একজন ভদ্রলোককে নিয়ে এল। ভদ্রলোক খোলা-দরজার সামনে একটু দাঁড়িয়ে পড়লেন -- দেখলেন, ব্যারিস্টার বাসু সামনের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। ভদ্রলোক কাশলেন। বাসু-সাহেব এবার ওঁর দিকে ফিরে বললেন, আসুন। বসুন ঐ সোফাটায়।

আগন্তুক ভদ্রলোক জানতেন না বাসু-সাহেবের টেকনিক। মানব-চরিত্র সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল পি.কে.বাসু জানেন উকিলের সাক্ষাৎমাত্র লোকে একটা আবরণ টেনে দেয় তার মনের উপর। ঠিক যে মুহূর্তে সে উকিলের দিকে চোখে-চোখ তুলে তাকায় তখনই সেই পর্দাটা সে টেনে দেয় -- ঠিক তার আগের মুহূর্তটাতেই সে সব চেয়ে দুর্বল -- যখন সে ছদ্মবেশ ধারণ করতে চাইছে। তাই বাসু-সাহেবের চেম্বারে ওঁর সামনেই অন্ধকারে টাঙানো আছে একটা আয়না, আর প্রবেশ পথের উপর ফেলা আছে একটা জোরালো আলো। আগন্তুক ধ্যানস্থ ব্যারিস্টার সাহেবকে দেখে স্বপ্নেও ভাবতে পারে না --তিনি সামনের দিকে তাকিয়ে আয়নার ভিতর দিয়ে ওকেই লক্ষ্য করছিলেন। ঘরে ঢুকে পরে হয়তো সে এটা

লক্ষ্য করে -- কিন্তু ততক্ষণে প্রথম প্রবেশ-মুহূর্তটি অতিক্রান্ত।

-- বলুন, কী ভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?

আগন্তুক ধুতি-পাঞ্জাবি পরা -- বেশবাসে আভিজাত্য নেই কিছু। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। চোখে চশমা, ঝোলা গোঁফ, হাতে একটি ফোলিও ব্যাগ।

-- ব্যাগটা পাশে রেখে জীবনবাবু বসলেন সোফাটায়। হাত দুটো জোড় করে নমস্কার করলেন। বললেন, তার আগে স্যার, একটা কথা জানতে চাই। আপনাকে কত ফি দিতে হবে? আমি মধ্যবিত্ত ছাপোষা মানুষ, বিপদে পড়ে এসেছি। আপনার নাম আমি অনেক শুনেছি; কিছু আপনাকে উপযুক্ত মর্যাদা দেবার আর্থিক ক্ষমতা আমার নেই।

-- কী করেন আপনি?

-- আমি স্যার বোম্বাই-এর কাপাডিয়া আ্যান্ড কাপাডিয়া কোম্পানির ক্যাশিয়ার। কুল্লে চারশ পঁচাত্তর টাকা মাইনে পাই, আর ফ্রি কোয়ার্টার্স। ব্যবসায়ের কাজেই কলকাতায় এসেছি -- মানে মালিকের নির্দেশে। আমি আজ দশ বছর কলকাতা ছাড়া -- পথ-ঘাটও ভাল চিনি ন!। এখানে এসেই বিপদে পড়ে গেছি। আত্মীয় বন্ধু কেউ নেই যে পরামর্শ করি। আপনার নাম জানা ছিল! টেলিফোন গাইড খুঁজে ঠিকানা দেখে চলে এসেছি।

-- তাহলে আগে এ্রকটা টেলিফোন করলেই পারতেন?

-- টেলিফোনে ও সব কথা বলতে চাই না স্যার।

-- কী আশ্চর্য! টেলিফোনে তো শুধু আপয়েন্টমেন্ট করতেন। যাক সে কথা, আপনার বিপদটা কী জাতীয়?

-- স্যার, আপনার ফি-এর কথাটা --

ফি-এর অঙ্কটা নির্ভর করবে আপনার কেস-এর উপর। তবে কেসটা শোনার জন্য আমি কিছু চার্জ করব না। আপনি বিস্তারিত বলে যান। ফি-এর কথা অত ভাববেন না, প্রয়োজন হলে আপনাকে পরামর্শও দেব, ফি চার্জ করব না।-- বলুন --

-- আপনি আমাকে বাঁচালেন স্যার। তাহলে খুলেই বলি সব কথা।

জীবন বিশ্বাস মাড়োয়ারী সওদাগরী অফিসের ক্যাশিয়ার। কাপাডিয়া আ্যন্ড কাপাডিয়া একটি কোটিপতি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। মালিকের নির্দেশে জীবনবাবু কলকাতায় এসেছেন দিন-সাতেক আগে। একা নয়, সঙ্গে আছেন ম্যানেজার সুপ্রিয় দাশগুপ্ত। ম্যানেজারের নতুন চাকরি, এম.এ. পাশ। চাকরি নতুন হলেও বডকর্তার প্রিয় পাত্র। ওঁরা এসে উঠেছেন পার্ক স্ট্রীটের পার্ক হোটেলে --

বাসু-সাহেব ওকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ঐ সুপ্রিয় কত টাকা মাইনে পায়?

-- কাটাকুটি করে পে-প্যাকেট পায় এগারো শো টাকার, লোন নেওয়া আছে বলে বেশ কিছু কাটা যায়!

-- বুঝলাম। পার্ক হোটেলে দৈনিক কত খরচ পড়ছে আপনাদের ?

-- জীবনবাবু রুমাল দিয়ে মুখটা মুছে নিয়ে বললেন, আপনি ঠিকই ধরেছেন স্যার। খুলেই বলি। আমরা ঠিক কোম্পানির কাজে আসিনি -- এসেছি আমাদের বড়কর্তা মোহনস্বরূপ কাপাডিয়ার ব্যক্তিগত কাজে -- যাবতীয় খরচ তাঁরই। বড়কর্তার সাদার্ন আ্যাভিন্যুতে একটা বাড়ি আছে। সেটা বিক্রির ব্যাপারে। বিক্রি হল সাড়ে ছয় লাখ টাকায়। রেজেস্ট্রি ডীডে কিন্তু লেখা হল সাড়ে চার। দুই লাখ হচ্ছে কালো টাকা। এটা আমরা নগদ নিয়েছি। টাকাটা ব্যাঙ্কে রাখা চলবে না. ব্যাঙ্ক ড্রাফট্‌ করানো চলবে না। বড়কর্তার নির্দেশ আছে ওটা নগদে বড়বাজারে একজনের কাছে জমা দিয়ে হুন্ডি করিয়ে নিয়ে যেতে হবে। নগদ দু’লাখ টাকা হয়তো দু-একদিন হোটেলে লুকিয়ে রাখতে হতে পারে। তাই বড়কর্তা আমাদের দুজনকে কোন খানদানী বড় হোটেলেই উঠতে বলেছিলেন। দিন চার-পাঁচের তো ব্যাপার --

-- বুঝলাম। তারপর? লেনদেন হয়ে গেছে?

--হ্যাঁ সার, কিন্তু মুশকিল হয়েছে কি, সুপ্রিয়বাবুর মতি-গতি সন্দেহজনক লাগছে আমার কাছে। উনি টাকাটা নগদেই বোম্বাই নিয়ে যেতে চাইছেন। কারণ, বলছেন, যাঁর কাছ থেকে হুণ্ডি করানোর কথা তিনি এখন কলকাতায় নেই --

-- এ কথাটা সত্যি? আপনি খোঁজ নিয়ে দেখেছেন?

-- হ্যাঁ স্যার। সত্যি।

-- তাহলে আপনার বড়কর্তার সঙ্গে ট্রাংক লাইনে কথাবার্তা বলে নির্দেশ নিন না।

-- ওখানেই তো হয়েছে মুশকিল স্যার। বড়কর্তা বোম্বাইয়ে নেই --এমনকি ভারতবর্ষে নেই। উনি এখন আছেন ব্যাঙ্ককে। আর সবচেয়ে ঝামেলা হয়েছে এই যে, বড়কর্তা এই সম্পত্তিটা বেচে দিচ্ছেন গোপনে --মানে তাঁর পরিবারের লোকেরাও জানে না। ওঁর স্ত্রী পর্যন্ত না।

-- স্ত্রী পর্যন্ত না? আপনি সেটা কেমন করে জানলেন?

-- হাসলেন জীবনবাবু। বললেন, ও আপনি শুনতে চাইবেন না স্যার -- মেয়েছেলে-ঘটিত ব্যাপার। টাকাটা উনি ওঁর রক্ষিতাকে দিচ্ছেন। মানে ওড়াচ্ছেন!

-- বেশ তো, তার টাকা তিনি ওড়াচ্ছেন -- তাতে আপনার আমার কী?

-- না, তা তো বটেই। আমার আশঙ্কা হচ্ছে এ দু’লাখ টাকা নগদে নিয়ে যাবার সময় যদি ভালমন্দ কিছু হয়ে যায়, তবে আমি ফেঁসে যাব না তো?

বাসু-সাহেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, দায়িত্বটা আপনার বড়কর্তা কার উপর দিয়েছেন?

-- ম্যানেজারের উপর সার। আমি তো ক্যাশিয়ার মাত্র। পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি দেওয়া আছে ম্যানেজারকে। দলিলে, রসিদে সইও করেছেন তিনি -- আমি শুধু সঙ্গে আছি। উনিই আমার উপরওয়ালা--

-- তবে আর কী? আপনার ভয়টা কী?

জীবনবাবু ইতস্তত করে বললেন, এর মধ্যে স্যার আরও একটা ব্যাপার হয়েছে। ম্যানেজার-সাহেব আমাকে ট্রেনের টিকিট কাটতে পাঠিয়েছিলেন। বোন্বে মেলে একটা ফাস্ট ক্লাস ক্যুপেতে দুখানা টিকিট আমি কেটে এনেছি -- কিন্তু টিকিটটা কাটা হয়েছে মিস্টার অ্যান্ড মিসেস দাসগুপ্তের নামে।

-- তাতে কী? মিসেস দাসগুপ্তাও এ ট্রেনে যাচ্ছেন বুঝি? আর আপনার টিকিট হয়েছে কি পাশের কামরায়?

-- আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু মজা হচ্ছে এই যে, মিসেস দাসগুপ্তা বর্তমানে বোম্বাইতে আছেন।

-- তার মানে? আপনি আপনার ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসা করেননি এমন করার অর্থটা কী?

-- করেছিলাম। উনি বললেন, মিস্টার অ্যান্ড মিসেস্‌ না বললে ক্যুপে পাওয়া যাবে না। তাই উনি তিনখানা টিকিট কাটতে বলেছেন। ট্রেন ছাড়ার সময় আমি বসবো পাশের কামরায়। ক্যুপের একটা সীট ফাঁকা থাকবে। তারপর আমি চলে আসব ক্যুপেতে।

বাসু-সাহেব জবাব দিলেন না। কী যেন ভাবছেন তিনি। জীবনবাবু বলেন, ইতিএধ্যে আরও এক ব্যাপার হয়েছে স্যার। আমাদের হোটেলে পাশের ঘরেই একজন মহিলা এসে উঠেছেন। তিনি ম্যানেজারের সঙ্গে মাঝে মাঝে গুজগুজ ফুসফুস করছেন। তিনি যে কে, তা আমি জানি না। প্রথমে ভেবেছিলাম তিনি বুঝি বাঙালী। কিন্তু ম্যানেজার-সাহেব বললেন, ওঁর নাম মিস্‌ ডিক্রুজা এবং জানালেন তিনিও নাকি ঐ একই ট্রেনে বোম্বাই যাচ্ছেন।

-- ইন্টারেস্টিং কেস! এ একই ক্যুপেতে ?

-- হঠাৎ লজ্জা পেলেন জীবনবাবু। মুখটা নীচু করে বললেন, সেটা আমি জিজ্ঞাসা করিনি সার। হাজার হোক উনি আমার ওপরওয়ালা। কিন্তু সমস্ত বাপারটাই আমার কাছে কেন যেন রহস্যময় মনে হচ্ছে। এক নম্বর -- কেন উনি এভাবে অতগুলো নগদ টাকা ট্রেনে করে নিয়ে যাচ্ছেন? দু নম্বর --কেন আমাকে পাশের ঘরে পাচার করলেন, তিন নম্বর--এ অচেনা মেয়েটা যদি সত্যই ওঁর সঙ্গে এক ক্যূপেতে--সঙ্কোচে মাঝখানেই থেমে গেলেন জীবনবাবু।

-- বুঝলাম। তা আপনি কী করতে চান?

-- সেই পরামর্শই তো করতে এসেছি আপনার সঙ্গে।

-- কবে আপনাদের রওনা হওয়ার কথা?

-- আজ সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার বম্বে মেল-এ।

-- টাকাটা বর্তমানে কোথায় আছে? হোটেলে আপনাদের ঘরে?

-- হোটেলেই, তবে আমাদের ঘরে নয়। হোটেলের সেফ-ডিপজিট ভল্টে।

-- টাকাটা কি একশ’ টাকার নোটে?

-- আজ্ঞে না। দশ টাকার নোটে। স্যুটকেস বোঝাই!

-- ঠিক আছে। আপনি এক কাজ করুন --আমাকে যা যা বললেন তা একটা বিবৃতির আকারে লিখে ফেলুন! সেটা আমাকে দিয়ে যান। যাতে প্রমাণ হবে কোনও দুর্ঘটনা ঘটার পর আপনি বানিয়ে কিছু বলছেন না৷

জীবনবাবু গোঁজ হয়ে বসে কী ভাবতে থাকেন।

-- কী ভাবছেন বলুন তো?

-- ভাবছিলাম কি স্যার, আপনি যা বলছেন তা খুবই ভাল --কিন্তু একটা মুশকিল আছে। ধরুন যদি ভালমন্দ কিছু হয়েই যায় তখন আপনি হবেন আমার পক্ষের উকিল। সে ক্ষেত্রে তো আপনি নিজেই সাক্ষী দিতে পারবেন না। তার চেয়ে এক কাজ করি না কেন? আমি এখন হোটেলে ফিরে যাই। সব কথা একটা বিবৃত্তির আকারে লিখে ফেলি। তারপর পোস্ট-অফিস থেকে রেজিস্ট্রি ডাকে আপনাকে পাঠাই। সীল মোহর করে। আমি ভাল করে দেখে দেব যাতে পোস্ট-অফিসে তারিখের ছাপটা খামের উপর পড়ে। সে ক্ষেত্রে আপনি সীলটা ভাঙবেন না। চিঠিটাও পড়বেন না। ভালমন্দ কিছু ঘটলে সীল-মোহর করা খামটাই আপনি প্রমাণ হিসাবে দাখিল করবেন!

বাসু-সাহেব বুঝতে পারেন এই ক্যাশিয়ার একটি ধুরন্ধর ব্যক্তি। বললেন, কিন্তু পোস্ট-অফিস তো আজ বন্ধ। গুড-ফ্রাইডের ছুটি।

-- জি.পি.ও, তে রেজিস্ট্রেশন খোলা। সে আপনাকে ভাবতে হবে না।

-- ঠিক আছে। তাই করুন।

-- আপনি আমাকে বাঁচালেন স্যার।

বাসু-সাহেব তাঁর ডায়েরিতে ওঁদের নাম. ধাম, পার্ক হোটেলের রুম নম্বর, রেলওয়ে টিকিট তিনটের নম্বর এবং বোম্বাইয়ের ঠিকানা লিখে নিলেন। জীবনবাবু প্রশ্ন করেন, আপনাকে কী দেব স্যার?

-- কিছু দিতে হবে না আপনাকে। এবার আসুন আপনি।

জীবনবাবু যেন এই জবাবই আশা করছিলেন। নমস্কার করে তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে গেলেন তিনি! জীবনবাবু ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া মাত্র বাসু-সাহেব ইন্টারকমে সকলকে ডেকে পাঠালেন তার ঘরে। পূর্বাংশ, পশ্চিমাংশ এবং মধ্যমাংশের রিসেপশান কাউন্টারের মধ্যে ইন্টারকম ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। পাঁচ মিনিটের ভিতরেই বাসু-সাহেবের ঘরে এসে বসলেন মিসেস বাসু, কৌশিক আর সুজাতা। বাসু-সাহেব বললেন, তোমাদের পরামর্শ চাইছি, বল আমার কী করা উচিত? ওয়ান ইজটু টোয়েন্টি রেশিওতে একটা বাজি ধরার সুযোগ এসেছে আমার সামনে। পাঁচশ’ টাকা ঢালতে হবে -- পেলে পাব দশহাজার, না পেলে পাঁচশ’ টাকাই বরবাদ হবে! এখন তোমরা বল, আমার কী করা উচিত?

কৌশিক বললে, ওয়ান ইজ-টু টোয়েন্টি! নিশ্চয় বাজি ধরবেন!

সুজাতা বলে, আগে বলুন জেতার চান্স কত পার্সেন্ট?

রানী বললেন, করছ ওকালতি, এর মধ্যে বাজি ধরাধরির কী আছে?

বাসু-সাহেব নিরুপায়ভাবে শ্রাগ্‌ করলেন শুধু।

ওদের পীড়াপীড়িতে খুলে বলতে হল সব কথা। শেষে বললেন, আমার অভিজ্ঞতা বলছে -- ব্যাপারটা ঘোরালো! ঈশান কোণে যে ছোট্ট কালো স্পটটা দেখা যাচ্ছে ওটা কালবৈশাখী হবার সম্ভাবনা যথেষ্ট। খুন, তহবিল তছরুপ, রাহাজানি, ডাকাতি যা হোক কিছু একটা হবে। কেসটা তাহলে অনিবার্যভাবে আসবে আমার কাছে। দু-লাখ টাকা ইনভলভড হলে পাঁচ পার্সেন্ট হিসাবে আমার কমিশন হবে দশ হাজার টাকা। কিন্তু এখনই আমাকে সেই আশায় শ’পাঁচেক টাকা ইনভেস্ট করতে হয়।

আমার প্রশ্নঃ করব?

কৌশিক আবার বললে, আলবৎ!

সুজাতা বলে, এটা গাছে-কাঠাল-গোঁফে-তেল হচ্ছে না কি?

বাসু-সাহেব বলেন, আর রানু? তোমার মত?

রানী বলেন, আমার মতে সুজাতা একটু বেশী আশাবাদী। গাছে কাঁঠাল নজরে পড়ছে না আমার! বরং বলতে পার ট্যাঁকে-বিচি, গোঁফে তেল!”

-- সেটা আবার কী?

-- তুমি কাঁঠালের বিচি পকেটে নিয়ে ঘুরছ। পুঁতলেই গাছ হবে, গাছ হলেই কাঁঠাল, পাকলেই পেড়ে খেতে হবে --তাই গোঁফে তেল দিতে শুরু করেছ!

হো-হো করে হেসে ওঠে সবাই। মায় বাসু-সাহেব পর্যন্ত।

শেষ পর্যন্ত কিন্তু বাসু-সাহেবকে রোখা গেল না। ওঁর দৃঢ় বিশ্বাস, হয় জীবনবাবু, না হয় এ সুপ্রিয়-ডিক্রুজা টাকাটা হাতাবার তালে আছে। এখন থেকে ব্যবস্থা করলে এ দুর্ঘটনা এড়ানো চলতে পারে। কৌশিককে উনি বললেন, তুমি এখনই একটা স্যুটকেস্‌ নিয়ে পার্ক হোটেলে চলে যাও। ওরা আছে রুম নম্বর 39-এ। তার কাছাকাছি একটা ঘর একদিনের জন্য ভাড়া নিও। ঘরটা নেওয়ার আগে দেখে নিও ওখান থেকে রুম 39 নজরে আসে কি না। তারপর সারাদিন এ ক্যাশিয়ার-ম্যানেজারের উপর নজর রাখ। কে কখন বেরিয়ে যাচ্ছে, ঢুকছে, কোনও বাইরের ভিজিটার্স আসছে কি না, কোথায় লাঞ্চ করছে ইত্যাদি।

কৌশিক বলে, আর কিছু?

হ্যাঁ। এছাড়া তুমি বম্বে মেলে-এ একখানা ফার্ট ক্লাস টিকিট কাট। রিজার্ভেশান যদি না পাও তাহলেও টিকিট কাটবে। সুপ্রিয় যে কথা জীবন বিশ্বাসকে বলেছে তা যদি সত্য হয় তাহলে একটা বার্থ শেষ মুহূর্তে খালি পাবেই। যদি নাও পাও তবে কন্ডাকটার গার্ড-এর সঙ্গে ম্যানেজ করে নিও। শেষ পর্যন্ত দরকার হলে প্যাসেজে বসেই যেতে হবে। মোটকথা এ বগিতে তোমাকে বোম্বাই যেতে হবে।

-- বুঝলাম। বোম্বাই গেলাম। তারপর?

ঐ ম্যানেজার আর ক্যাশিয়ার নিরাপদে তাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেলেই তোমার ছুটি। ফিরে আসবে। কিন্তু তার আগে সহযাত্রী হিসাবে ওদের দু-জনের সঙ্গেই যতটা পার আলাপ জমাবে।

-- আর কিছু নির্দেশ?

-- আছে। প্রথম কথা, পার্ক হোটেলে যখন উঠবে তখন তোমার ছদ্মবেশ থাকবে। ট্রেনে স্বাভাবিক চেহারায়। যাতে ওরা দুজন বুঝতে না পারে যে, ওদের ট্রেনের সহযাত্রী ভদ্রলোক এ পার্ক-হোটেলেরই বোর্ডার ছিল। দ্বিতীয় কথা, ট্রেন ছাড়ার আগে তুমি সুজাতার সঙ্গে কথা বলবে না।

-- সুজাতা! সুজাতাকে কোথায় পাব?

বাসু-সাহেব এবার সুজাতার, দিকে ফিরে বলেন, তুমি সুজাতা, সন্ধ্যা সাড়ে ছটার সময় একটা ট্যাক্সি নিয়ে হাওড়া স্টেশানে চলে যাবে। সঙ্গে নেবে শুধু একটা লেডিজ হাত-ব্যাগ। স্টেশানে পৌঁছে একটা প্ল্যাটফর্ম টিকিট কাটবে। বম্বে মেল নয় নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে রাত সাড়ে সাতটার সময় ছাড়ে। কিন্তু সেটাকে বেদবাক্য বলে ধরে নিও না। কানখাড়া করে শুনে নিও ঘোষক বলছে কি নাঃ কৃপা কর্‌ শুনিয়ে থ্রী-আপ বোম্বাই মেল নও নম্বরকে বদলে --

সুজাতা বাধা দিয়ে বলে. আপনি কি আমাকে বাচ্চা খুকিটি পেয়েছেন?

-- না। সব সম্ভাবনাই ভেবে দেখছি আমি। মোটকথা ফার্স্ট ক্লাস রিজার্ভেশান চার্টে দেখবে 3542 এবং 3545 টিকিটধারী মিস্টার আ্যান্ড মিসেস্‌ দাসপুপ্তের ক্যুপে কোন্‌ বগীতে আছে। ঐ ক্যুপেতে গিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকবে। কী হচ্ছে না হচ্ছে দেখবে।

-- আর কন্ডাকটার গার্ড যখন আমার রিজার্ভেশান টিকিট দেখতে চাইবে?

-- তখন বলবে, তুমি মিসেস দাসগুপ্তা। তোমার কর্তা টিকিট আর মালপত্র নিয়ে পিছনের ট্যাক্সিতে আসছেন। ট্রেন ছাড়া পর্যন্ত ঐ অজুহাতে কামরায় বসে থাকবে। তারপর বাধ্য হয়ে নেবে পড়ে কর্তাকে খুঁজবার অভিনয় করবে। এনি কোশ্চেন?

-- ধরুন যদি এ সুপ্রিয় দাসগুপ্ত একটি মহিলাকে নিয়ে এসে কণ্ডাকটার গার্ডকে তাদের রিজ্ঞার্ভেশান দেখায়?

-- তা তো দেখাবেই। তবু তুমি সীট ছাড়বে না। ঝগড়া-চেঁচামেচি করবে -- যাতে ভীড় জমে যায়! -- অমন করে আমার দিকে তাকাচ্ছে কেন সুজাতা? এ জাতীয় কাজ তো তোমরা হামেশাই অহেতুক করে থাক, আজ প্রয়োজনে পারবে না?

-- কী করে থাকি?

-- অবুঝের মত অহেতুক চেঁচামেচি! আবদেরে ন্যাকা-ন্যাকা গলায় বলা --”আগে আমার মিস্টার আসুন, না হলে আমি সীট ছাড়ব না।”

সুজাতা হেসে ফেলে। বলে, আপনার উদ্দেশ্যটা কী বলুন তো?

-- ভীড় জমানো। যাতে আশপাশের কামরার প্যাসেঞ্জার কৌতুহলী হয়ে ব্যাপারটা দেখতে আসে। অন্তত কন্ডাকটার গার্ড যাতে এ তথাকথিত মিসেস্‌ দাসগুপ্তাকে অনেকক্ষণ ধরে দেখে | সে ক্ষেত্রে প্রয়োজন হলে ভবিষ্যতে ঐ কন্ডাকটার গার্ড বা অন্য কোন সহযাত্রী সহজেই মেয়েটিকে সনাক্ত করতে পারবে।

রানী বলেন, আর আমার কাজ? কড়ায় তেল বসিয়ে দেব?

-- তেল?

-- ভ্যারেন্ডা ভাজতে?

-- না! তুমি হচ্ছ আমাদের কন্ট্রোলরুম। কৌশিক প্রতি দু’তিন ঘণ্টা অন্তর রিপোর্ট দেবে। তুমি সেই রিপোর্ট সময়-চিহ্ন দিয়ে নোট করে যাবে। আমাদের তিনজনকে গাইড করবে ওর রিপোর্ট অনুযায়ী।

তৃতীয় পর্ব


রানী দেবীর সমস্ত দিনটাই কর্মব্যস্ত গেল। কৌশিক পর পর চার পাঁচবার ফোন করেছে। বেলা দশটায় প্রথমবার -- পার্ক হোটেল থেকে। খবরঃ ও একচল্লিশ নম্বর ঘরে উঠেছে। ওখান থেকে উনচল্লিশ নম্বর ঘর নজর রাখা যাচ্ছে। সেটাতে দুজন বোর্ডার আছেন। ডবল-বেড বুম। হোটেল রেজিস্টারে দেখেছে তাদের নাম জীবনকুমার বিশ্বাস আর সুপ্রিয় দাশগুপ্ত। স্থায়ী ঠিকানা --কাপাডিয়া অ্যান্ড কাপাডিয়া কোম্পানি, বোম্বাই। জীবনবাবু মধ্যবয়সী। দোহারা চেহারা, গোঁফ আছে। তিনি ঘর ছেড়ে দু-তিনবার বের হয়েছেন। সুপ্রিয় একবার মাত্র বার হয়েছিল। বারান্দায় বেরিয়ে এসেই আবার ঘরে ঢুকে যায়। সে যে ঘরে আছে তার আরও প্রমাণ আছে। কারণ জীবনবাবু যতবারই বার হচ্ছেন ঘরে তালা দিয়ে যাচ্ছেন না। ফিরে এসে নক করছেন। ভিতর থেকে কেউ দরজা খুলে দিচ্ছে।

রানী দেবী রিপোর্টটা বিশুর হাতে পাঠিয়ে দিলেন বাসু-সাহেবকে। বাসু সেটা পড়ে তৎক্ষণাৎ ফোন করলেন পার্ক হোটেলের একচল্লিশ নম্বর ঘরে -- দশটা বারোয়।

কৌশিক ফোন ধরতেই বললেন, তোমার রিপোর্ট পেয়েছি। শোন, এবার জীবন ঘর ছেড়ে বার হলেই তুমি উনচল্লিশে ফোন কর। সাড়া দিলেই বলবে, তুমি জীবন বিশ্বাসকে খুঁজছ। ন্যাচারালি লোকটা বলবে, তিনি ঘরে নেই। সঙ্গে সঙ্গে তুমি প্রশ্ন করবে, আপনি কি সুপ্রিয়বাবু? সে উত্তর দেওয়ামাত্র লাইন কেটে দেবে। রিপোর্ট ব্যাক রেজাল্ট।।

-- কৌশিক দ্বিতীয়বার ফোন করল দশটা কুড়িতে। বলল, জীবন সওয়া দশটায় ঘর ছেড়ে বার হতেই ও ফোন করে। উনচল্লিশ নম্বরে কেউ সেটা ধরে। কৌশিক প্রশ্ন করে, ‘জীবনবাবু আছেন? লোকটা জবাবে প্রতিপ্রশ্ন করে, ‘আপনি কে?’ কৌশিক বলে, ‘আপনি কি সুপ্রিয়বাবু?’ লোকটা যেন পিন-আটকে-যাওয়া-রেকর্ড -- বলে, ‘আপনি কে?’ সব শুনে বাসু-সাহেব বলেন, ঠিক আছে। জীবন ঘরে ফিরলেই আমাকে ফোনে জানিও।

এগারোটার সময় কৌশিক জানালো সুপ্রিয় দাসগুপ্তকে এখনও দেখা ষায়নি; এবং জীবন বিশ্বাস ঘরে ফিরেছে। বাসু তখন নিজেই ফোন করলেন ঐ উনচল্লিশ নম্বর ঘরে। ফোন ধরল সুপ্রিয়। বাসু বললেন, ‘জীবনবাবু আছেন’

লোকটা বলল, আপনি কে?

-- বাসু বললেন, আমি যেই হই না যাই, তাতে আপনার কী? জীবনবাবু যদি থাকেন ডেকে দিন, না থাকেন -- বলুন, নেই।

একটু নীরবতার পর বাসু শুনলেন, হ্যালো, জীবনকৃষ্ণ বিশ্বাস বলছি।

-- আমি পি.কে.বাসু। ফোন ধরেছিল কে বলুন তো? দু-দুবার --

জীবন ওঁকে শেষ করতে দিল না। বললে, বুঝতেই তো পারছেন। বলুন, কেন ফোন করছিলেন?

-- রেজিস্ট্রি করে দিয়েছেন?

-- হ্যাঁ, এই মাত্র।

-- দু-লাখ টাকা ব্ল্যাক মানির কথাটাও লিখেছেন নাকি?

-- না। শুধু লিখেছি অনেক টাকা নগদে নিয়ে যাচ্ছি।

-- ঠিক আছে। লাইন কেটে দিলেন বাসু।

এরপর কৌশিকের ফোন এল বিকেল চারটেয়। সে টিকিট পেয়েছে, ঘটনাচক্রে রিজার্ভেশানও। সুপ্রিয় আর একবারও ঘর ছেড়ে বার হয়নি। এমনকি লাঞ্চ খেতেও নয়। বোধহয় লোকটা অসুস্থ। না হলে অন্তত দ্বিপ্রাহরিক আহার করতে একবার বার হত। অথচ সে যে ঘরে আছে এটা নিঃসন্দেহ। এছাড়া আর একটা খবরও পাওয়া গেছে। আটত্রিশ নম্বর ঘরে দিন তিনেক আগে একজন ভদ্রমহিলা তার অসুস্থ ভাইকে নিয়ে নাকি উঠেছিলেন। হোটেল রেজিস্টার অনুযায়ী তাঁদের নাম মিস্টার এবং মিস্‌ ডিসিলভা -- ভাই বোন। ভাইটি নাকি বিকৃতমস্তিষ্ক। ইন্টারেস্টিং কেস। রাঁচি থেকে ভাইকে নিয়ে উনি এ হোটেলে উঠেছিলেন। আজ সকাল ছয়টায় চলে গেছেন। পাগল ভাইকে নিয়ে এই কদিন একটা গাড়িতে বারেবারেই বার হতেন চিকিৎসা করানোর ব্যাপারে । ভাইটা কেমন যেন জড়দ্গব, ধন্ধ-ধরা। চেঁচামেচি গণ্ডগোল করত না। দিবারাত্র পড়ে পড়ে ঘুমাতো। খবরটা ওকে দিয়েছে রুম সার্ভিসের বেয়ারা হরিমোহন। সে পাগলটাকে দেখেছে। দু-একবার তাকে ধরে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছেও দিয়ে এসেছে। লোকটা ঘুমোতে ঘুমোতেই হাঁটত। চোখ খুলে বড় একটা তাকাতোই না। এত খবর ও জানাচ্ছে এজন্য যে, মিসিং-লিঙ্ক মিস্‌ ডিক্রুজার সঙ্গে ঐ ডি-সিলভার কোন সম্পর্ক থাকতে পারে।

সন্ধ্যা ছয়টার সময় সে ফোন করে জানালো -- পাশের ঘরের দুই-বাসিন্দা রওনা হলেন। সঙ্গে দুটো বেডিং, চারটে সুটকেস। দুটো স্যুটকেস হোটেলের সেফ ডিপজিট লকার থেকে এইমাত্র ডেলিভারি নেওয়া হুল। সুপ্রিয়কে ও এক নজর মাত্র দেখেছে। লোকটা ঘর থেকে বেশ তাড়াহুড়ো করেই হঠাৎ বেরিয়ে এল। কৌশিকও ঘর ছেড়ে বের হয়ে এসেছিল। কিন্তু ভাল করে তাকে সনাক্ত করার আগেই লোকটা গিয়ে বসল ট্যাক্সিতে। তবু এক নজরে সে তাকে যা দেখেছে দরকার হলে সনাক্ত করতে পারবে। লম্বা একহারা, রঙ ফর্সা। গোঁফ-দাড়ি কামানো, বড় বড় জুলফি। কৌশিক টেলিফোনে জানালো যে, সে-ও রওনা হচ্ছে। হাওড়া স্টেশনের ফার্স্ট ক্লাস ওয়েটিংরুমে গিয়ে সে ছদ্মবেশ পালটাবে।

সুজাতাও হাতব্যাগ নিয়ে রওনা হয়ে গেল সন্ধ্যা ছটা নাগাদ।



যথেষ্ট সময় থাকতে সুজাতা স্টেশানে পৌঁচেছে। থ্রি-আপ বোম্বাই-মেল নয় নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকেই ছাড়ছে। প্ল্যাটফর্ম টিকিট কিনে স্টেশনে ঢুকে সে রিজার্ভেশান চার্টটা দেখল। 7852 বগীতে সি-চিহিত ক্যুপে-কামরায় মিস্টার এবং মিসেস দাসগুপ্তার আসন সংরক্ষিত। সুজাতা গটগটিয়ে যেই, কামরায় উঠতে যাবে, কন্ডাকটার গার্ড রুখলঃ আপনার টিকিটটা প্লীজ?

অত্যন্ত সপ্রতিভ-ভঙ্গিতে ও বললে, আমার নাম মিসেস অঞ্জলি দাসগুপ্তা। টিকেট আমার স্বামীর কাছে আছে, উনি পিছনে আসছেন। আমাদের টিকিট নম্বর হচ্ছে 3542 এবং 3543। দেখুন তো সি-কম্পার্টমেন্ট কি?

কন্ডাকটার-গার্ড তাঁর হাতের চার্ট দেখে বললেন, হ্যাঁ, সি-কম্পার্টমেন্ট। যান বসুন।

সুজাতা উঠল বগীতে। সি-কম্পার্টমেন্টে ছোট ক্যুপে । দরজা বন্ধ ছিল। টেনে খুলতেই দেখে ভিতরে বসে আছেন এক ভদ্রলোক। একা। বছর চল্লিশ বয়স, স্যুট-পরা। ওকে দেখেই বললেন, মিসেস দাসগুপ্তা নিশ্চয়?

হ্যাঁ কিন্তু আপনাকে তো ঠিক --

-- না, আমিও আপনাকে চিনি না। ক্যুপেটা মিস্টার আ্যান্ড মিসেস দাসগুপ্তের নামে রিজার্ভ করা তো --

-- ও! তা আপনার কোন্‌ কম্পার্টমেন্ট?

-- এখনও জানি না। আপনি ততক্ষণ আমার ব্যাগটা দেখুন, আমি কন্ডাকটার গার্ডকে জিজ্ঞাসা করে আসি। -- ব্যাগটা রেখেই নেমে গেলেন ভদ্রলোক। ব্যাগটা হচ্ছে BOAC-এর এয়ার ব্যাগ। সেটা রাখা ছিল জানলার ধারে। জানলার কাঁচটা বন্ধ। সুজাতা ব্যাগটা সরিয়ে দিল বেঞ্চির মাঝ বরাবর। জানলার ধারে গিয়ে বসল। কাঁচটা তুলে দিল। ঘড়িতে দেখল সাতটা পনের হয়েছে।

ঠিক তখনই কুলির মাথায় মাল চাপিয়ে এক ভদ্রলোক এসে হাজির। বছর ত্রিশেক বয়স। সুন্দর একহারা চেহারা। গোঁফ-দাড়ি কামানো। লম্বা জুলফি। নিঃসন্দেহে সুপ্রিয় দাসগুপ্ত। সুজাতাকে এক নজর দেখে নিয়ে বললেন, এ ব্যাগটা আপনার?

সুজাতা বললেন, না। ঐ ভদ্রলোক রেখে গেছেন।--হাত বাড়িয়ে প্লাটফর্মে দাঁড়ানো স্যুটপরা ভদ্রলোককে সে দেখিয়ে দেয়। ভদ্রলোক এক প্যাকেট সিগ্রেট কিনছিলেন। আগন্তুক মুখ বাড়িয়ে ভদ্রলোককে একনজর দেখে নিলেন। তারপর সুজাতার দিকে ফিরে বললেন, আপনার রিজার্ভেশান কোথায়?

-- এই ক্যুপেতেই। আপনার?

ভদ্রলোক ইতিমধ্যে বাঙ্কটা পেতে ফেলেছেন। কুলি তার উপর বেডিংটা রাখছে। তার হাত থেকে মালপত্র নিয়ে ঘরটা সাজাতে সাজাতে ভদ্রলোক বললেন, আপনি ভুল করছেন। কণ্ডাকটার গার্ডকে টিকিটটা দেখান, উনি আপনার কামরা দেখিয়ে দেবেন।

-- উনিই আমার টিকিট দেখে বললেন, এই ক্যুপে।

কুলি পয়সা চাইল। ভদ্রলোক সেকথা কান তুললেন না। সুজাতকে বলেন, কই দেখি আপনার টিকিট?

-- আপনাকে টিকিট দেখাতে যাব কোন্‌ দুঃখে?

এই সময় দ্বারপথে এসে দাঁড়ালেন একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক। সুজাতার বুঝতে অসুবিধা হল না, -- উনি জীবন বিশ্বাস! ঝোলা গোঁফেই তার পরিচয়। প্রৌঢ় ভদ্রলোক বললেন, কী হল স্যার?

-- কন্ডাকটার গার্ডকে ডাকুন তো। এ ভদ্রমহিলা অহেতুক ঝামেলা করছেন।

জীবনবাবুও বৃত্তান্তটা শুনে সুজাতাকে বোঝাতে চাইলেন সে ভুল করছে। সুজাতা কোন পাত্তাই দিল না। অগত্যা ওরা ডেকে নিয়ে এলেন কন্ডাকটার গার্ডকে।

-- কী হল আবার আপনাদের?-- দ্বারপথে এসে ছড়ায় কন্ডাকটার গার্ড।

সুপ্রিয় বললে, এ ভদ্রমহিলার কোন্‌ ঘরে রিজার্ভেশান আছে দেখে দিন তো?

-- কই দিন তো আপনার টিকিট? --কন্ডাকটার গার্ড হাত বাড়ায়।

বললাম না তখন, আমি মিসেস দাসগুপ্তা? টিকিট আমার স্বামীর কাছে আছে। আমাদের টিকিট নম্বর 3542 এবং 3543।

কন্ডাকটার গার্ড আবার তার চার্ট মেলাতে থাকে। সুপ্রিয় বাধা দিয়ে বলে, ওটা দেখতে হবে না। এই দেখুন, টিকিট নম্বর 3542 এবং 3543।

কন্ডাকটার গার্ড ফ্যালফ্যাল করে দুজনের দিকে তাকায়।

--এঁকে নামিয়ে দিন! --কঠিন কঠে সুপ্রিয় বলে।

-- আপনি কাইন্ডলি নেমে আসুন -- কন্ডাকটার গার্ড সুজাতাকে অনুরোধ করে?

-- ইয়ার্কি নাকি! আগে আমার স্বামী আসুন, তার আগে আমি নামব না।

-- কী আশ্চর্য! আপনার কাছে টিকিট নেই --

-- কে বলল টিকিট নেই? টিকিট আমার স্বামীর কাছে আছে। উনি আসুন আগে--

-- আমিও তো তাই বলছি, তিনি যতক্ষণ না আসেন --

-- বাধা দিয়ে সুজাতা বলে, বেশ তো, ওঁকে জিজ্ঞাসা করুন না, মিসেস দাসগুপ্তা কোথায়? এ গুঁপো ভদ্রলোক কি মিসেস দাসগুপ্তা? ওঁর স্ত্রী কোথায়?

জীবনবাবু সুট করে সরে পড়েন।

কন্ডাকটার গার্ড-এর মনে হল সশরীরে ভদ্রলোকের স্ত্রীকে হাজির করতে পারলে হয়তো সমস্যার সুরাহা হবে। সুপ্রিয়কে বলে, ইয়েস, আপনার স্ত্রী কই?

-- উনি এখনই আসবেন। টয়লেটে গেছেন।

সুজাতাও গম্ভীর হয়ে বলে, আমার কর্তাও এখনই আসবেন। টয়লেটে গেছেন।

ভীড়ের মধ্যে একজন যাত্রী কন্ডাকটার গার্ডকে বলে, সাতটা পঁচিশ হয়ে গেছে স্যার! জি.আর.পি.-কে ডাকুন। না হলে ট্রেন ছাড়তে দেরী হয়ে যাবে।

সুজাতা মুখ তুলে দেখল বক্তা আর কেউ নয়, কৌশিক মিত্র। ইতিমধ্যে বেশ ভীড় জমে গেছে। একজন পুলিস অফিসার মুখ বাড়িয়ে বলেন, এনি ট্রাবল্?

ইন্সপেক্টরের আবির্ভাবমাত্র অবস্থাটা পালটে গেল৷ প্রথমেই তিনি ভিড়টা হটিয়ে দিলেন -- প্লীজ ক্লিয়ার আউট! ট্রেন এখনই ছাড়বে। যে-যার সীটে গিয়ে বসুন।

তারপর ঘরে ঢুকে তিনি কন্ডাকটার গার্ডের কাছে ব্যাপারটা সংক্ষেপে শুনে সুজাতার বিরুদ্ধেই রায় দিলেন। বললেন, আপনি নেবে আসুন। বোনাফাইড টিকেট-হোল্ডারকে সীট ছেড়ে দিন।

সুজাতা বোঝে আর দেরী করা ঠিক নয়। উঠে দাঁড়ায় সে। লেডিজ হাতব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে নেয়। পুলিস অফিসার BOAC মার্কা ব্যাগের পেটটা চেপে ধরে নেমে আসেন। সুজাতা বলে, ও ব্যাগটা আমার নয়।

-- আই সী! আপনার?-- পুলিস অফিসার প্রশ্ন করে সুপ্রিয়কে।

-- হুঁ! গম্ভীরভাবে সুপ্রিয় বলে, অন্য দিকে তাকিয়ে।

পুলিস অফিসার ব্যাগটা নামিয়ে রাখতে গিয়ে কী ভেবে থেমে পড়েন। বলেন, কী আছে ব্যাগটায়? খুলুন তো?

সুপ্রিয় রুখে ওঠে, কেন বলুন তো?

ইন্সপেক্টার মুখ তুলে একবার তাকায় তার দিকে। তারপর কারও অনুমতির অপেক্ষা না করে খোলা ব্যাগের জিপটা টেনে ফেলে। হাত ঢুকিয়ে কী যেন স্পর্শ করে। পুনরায় বলে, ব্যাগটা আপনার?

সুপ্রিয় খিঁচিয়ে ওঠে, বলছি তো, না! কেন, কী হয়েছে?

ইন্সপেক্টর কন্ডাকটার গার্ড বলে, কুইক! গার্ডকে বলুন, গাড়ি যেন না ছাড়ে। সামথিং ফিশি! আমার নাম করে বলুন।

সুপ্রিয়র মুখটা সাদা হয়ে যায়। কৌশিক এবং ঝোলা গোঁফ না-পাত্তা। সুজাতা তখনও কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কন্ডাকটার গার্ড ছুটে বেরিয়ে গেল। ইন্সপেক্টর সুজাতা এবং সুপ্রিয় দুজনের দিকে পর্যায়ক্রমে তাকিয়ে বললে, এই ব্যাগটা কার? আইদার অফ য়ু! বলুন কার?

সুজাতা বললে, আমার নয়। আমি জানি না কার।

সুপ্রিয় বললে, আমি যখন ঘরে ঢুকি তখন ব্যাগটা এখানেই ছিল। উনি তখন ঘরে একা ছিলেন। ফলে ব্যাগটা ওঁর!

ইন্সপেক্টর ধমক দিয়ে ওঠেন। তাহলে তখন কেন বললেন ব্যাগটা আপনার?

-- আমি সে কথা বলিনি।--সুপ্রিয় জবাবে জানায়।

-- বলেছেন! উনি যখন বললেন ব্যাগটা ওঁর নয়। তখন আমি জিজ্ঞাসা করলাম ‘আপনার?’ আপনি বললেন ‘হুঁ।’ বলেননি?

-- আমি তখন অন্যদিকে তাকিয়েছিলাম। দেখিনি, আপনি কোন্‌ ব্যাগটার কথা জিজ্ঞাসা করছেন। কেন, কী হয়েছে?

ইন্সপেক্টর ওদের দু’জনকে ভালভাবে দেখে নিল একবার। সুজাতাকে বললে, আপনার নাম অঞ্জলি দাসগুপ্তা? ঠিকানা?

সুজাতা অম্লানবদনে বললে, না, আমার নাম সুজাতা মিত্র।

-- সুজাতা মিত্র! গুড গড! তাহলে এতক্ষণ মিথ্যা কথা বলেছিলেন কেন?

-- আমি বলব না!

-- আই মে হ্যাভ টু অ্যারেস্ট য়ু! -- হাত বাড়িয়ে ইন্সপেক্টর দরজাটা বন্ধ করে দেয়। বলে, এ ব্যাগের ভিতর কী আছে জানেন?

হাত ঢুকিয়ে সে বার করে একটা লোডেড রিভলভার!

-- কেন এতক্ষণ নিজেকে অঞ্জলি দাসগুপ্তা বলে চালাচ্ছিলেন? বলুন? জবাব দিন?

সুজাতা একটুও ঘাবড়ায় না। তার লেডিজ হ্যান্ড-ব্যাগের জিপটা খুলে ফেলে। একটা ছোট্ট আইডেন্টিটি কার্ড বার করে ইন্সপেক্টরের হাতে দিয়ে বলে, আই রিপ্রেজেন্ট “সুকৌশলী”! আমার ক্লায়েন্টের স্বার্থে মিথ্যা কথা বলছিলাম। আমি জানতাম, এই কামরায় আজ একটা বিশ্রী কাণ্ড হতে যাচ্ছে।

ইন্সপেক্টর স্তম্ভিত হয়ে যায়। আইডেন্টিটি কার্ডটা পরীক্ষা করে বলে, “সুকৌশলী!” এমন প্রাইভেট ডিটেকটিভ ফার্ম কলকাতা শহরে আছে বলে আমি জানতামই না!

-- লালবাজারের সীলটা নিশ্চয় চিনবেন?

কার্ডটা পকেটে রেখে ইন্সপেক্টর সুপ্রিয়র দিকে ফেরে। বলে, আপনার নাম মিস্টার সুপ্রিয় দাসগুপ্ত তা প্রমাণ করতে পারেন?

-- নিশ্চয়ই স্যুটকেসে আমার লেটার-হেড প্যাড আছে। ভিজিটিং কার্ড আছে।

-- স্যুটকেসটা খুলুন!

-- তার কি কোন প্রয়োজন আছে? অলরেডি পাঁচমিনিট লেট হয়ে গেছে ট্রেনটা ছাড়তে!

--আই সে ওপন ইয়োর স্যুটকেস।

সুপ্রিয় রুমাল দিয়ে মুখটা মুছল। তারপর বেঞ্চির নিচ থেকে টেনে বার করল স্যুটকেসটা। চাবি দিয়ে স্যুটকেসের ডালাটা খুলল। ওর হাত রীতিমত কাঁপছে। অতি সন্তর্পণে সে জামা-কাপড়ের নিচে হাত চালিয়ে লেটার-হেড প্যাডটা খুঁজতে থাকে। সু্টকেসের উপর চাপা দেওয়া ছিল একটা নতুন তোয়ালে। হঠাৎ ক্ষিপ্র হাতে ইন্সপেক্টর তুলে ফেলল সেই তোয়ালেটা।

তার নিচে থাক দেওয়া দশটাকার নোট ! এক সুটকেস বোঝাই!

-- মাই গড! কত টাকা আছে ওখানে?

একটা ঢোক গিলে সুপ্রিয় বললে, এক লাখ টাকা।

-- সব দশ টাকায়?

-- হুঁ।

-- বাক্সটা বন্ধ করুন!

আদেশ পালন করে সুপ্রিয়।

ইন্সপেক্টর সুজাতার দিকে ফিরে বলেন, আপনি জানতেন, উনি একলাখ টাকা নগদে এবং দশটাকার নোটে নিয়ে যাচ্ছেন?

-- না! আমার ইনফর্মেশান ছিল উনি দু-লাখ টাকা নগদে এবং দশটাকার নোটে নিয়ে যাচ্ছেন! আই সী। --ইন্সপেক্টার ঘুরে দাড়ায় সুপ্রিয়র মুখোমুখি, এ টাকা কোন্‌ ব্যাঙ্ক থেকে তুলেছেন?

-- ব্যাঙ্ক থেকে তুলিনি।

--ব্ল্যাক-মানি?

সুপ্রিয় মাথা নাড়ে -- নেতিবাচক।

-- মিস্টার দাসগুপ্ত, আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে বলছেন যে, নগদ এক লাখ টাকা আপনি দশটাকার নোটে নিয়ে যাচ্ছেন --উইথ এ লোডেড রিভলভার --

-- ওটা আমার নয়।

-- আয়াম সরি! য়ু আর আন্ডার আ্যরেস্ট! নেমে আসুন আপনি!

আবার রুখে ওঠে সুপ্রিয়, আপনি-- আপনি এভাবে আমাকে গ্রেপ্তার করতে পারেন না! আমি বোনাফাইড প্যাসেঞ্জার! আমি হিউজ কম্পেন্সেশন ক্লেম করব।

-- করবেন! তার আগে আপনাকে প্রমাণ করতে হবে ওটা ব্ল্যাক-মানি নয়। নেমে আসুন আপনি! না হলে কিন্তু আমি আপনাকে হ্যান্ডকাফ দিয়ে মাজায় দড়ি বেঁধে প্ল্যাটফর্ম দিয়ে নিয়ে যাব!

কাঁপতে কাঁপতে নেমে এল সুপ্রিয়। পাশের কেবিন থেকে জীবন বিশ্বাস। সুজাতা মুখ তুলে দেখল, কৌশিকও নেমে পড়েছে ট্রেন থেকে। অগত্যা সেও নামল।

দশ মিনিট দেরীতে অনুমতি পেয়ে গুড্‌ফ্রাইডের সন্ধ্যায় রওনা হল বোম্বাই মেল। তার চার-চারটে ফার্ষ্ট ক্লাস বার্থ খালি!

দ্বিতীয়াংশ পড়ুন...

No comments:

Post a Comment