মাছের কাঁটা (দ্বিতীয়াংশ)

মাছের কাঁটা

চতুর্থ পর্ব

শনিবার তের তারিখ সন্ধ্যায় জীবন বিশ্বাস এসে হাজির হল বাসু-সাহেবের চেম্বারে। একদিনেই লোকটা যেন অর্ধেক হয়ে গেছে। ভেঙে পড়ল সে একেবারে, হুজুর এবার বাঁচান আমাদের!

-- কী হল আবার? আপনার না গতকাল বোম্বাই চলে যাবার কথা?

-- তাই তো কথা ছিল স্যার। ট্রেন ছাড়ার আগে নেমে পড়তে হল আমাকে। সে এক কেলেঙ্কারি কান্ড। বলি শুনুনঃ

জীবন বিশ্বাস বিস্তারিত বর্ণনা দিলেন ঘটনাটার। হোটেল থেকে যথাসময়ে ওঁরা স্টেশানে এসেছিলেন। কথা ছিল, মিস্টার দাসগুপ্ত ক্যুপেতে একা থাকবেন ট্রেন ছাড়ার সময়; এবং ট্রেন চলতে শুরু করলে পাশের কামরা থেকে জীবনবাবু এসে ওটাতে রাত্রে শোবেন। কিন্তু ঝামেলা বাধালেন এক ভদ্রমহিলা। জীবন তাকে চেনেন না, তিনি নাকি আগেভাগেই এ ক্যুপের একটা সীট দখল করে বসেছিলেন। বললেন, তাঁর নাম মিসেস্‌ অঞ্জলি দাসগুপ্তা। সবচেয়ে তাজ্জব ব্যাপার সেই ভদ্রমহিলা ওদের টিকিটের নম্বর দুটোও কী করে জানি সংগ্রহ করেছিলেন।

বাসু-সাহেব বাধা দিয়ে বলেন, সে আর শক্ত কী? ফার্স্ট-ক্লাস রিজার্ভেশান চার্টেই তো নামের পাশে টিকিট নম্বর লেখা থাকে।

-- তবে তাই হবে স্যার; কিন্তু ভদ্রমহিলা ব্যাগে করে একটা লোডেড রিভলভার নিয়ে এসেছিলেন --

আনুপূর্বিক ঘটনার একটা বর্ণনা দাখিল করলেন জীবনবাবু। শোনা গেল, সুপ্রিয় দাসগুপ্ত জামিন পায়নি। তার বিরুদ্ধে পুলিস নাকি হত্যার অভিযোগ আনছে।

-- মার্ডার কেস? খুন হল কে আবার? কখন?

জীবনবাবু তখন বিস্তারিত জানালেন সেই পূর্ব ইতিহাস। তিনি থানা থেকে মোটামুটি জেনে এসেছেন। এগারই তারিখ, বৃহস্পতিবার রাত পৌনে আটটার সময় বড় বাজারে নিজের গদিতে খুন হয়েছেন একজন ধনী ব্যবসায়ী -- এম. পি. জৈন। আটটায় দোকান বন্ধ হয়। ওঁরা ঝাঁপ ফেলার উদ্যোগ করছেন এমন সময় তিন-চারজন মুখোশধারী লোক হঠাৎ ঢুকে পড়ে দোকানে। তাদের একজনের হাতে ছিল রিভলভার আর সকলের ছোরা। গেটে ছিল দারোয়ান। সে বাধা দেবার চেষ্টা করায় প্রথমেই গুলিবিদ্ধ হয়ে উল্টে পড়ে। ডাকাতেরা দোকানে ঢুকে পড়ে ক্যাশিয়ারের কাছে চাবি চায়। ক্যাশিয়ার ইতস্তত করে। তখন একজন ডাকাত তার কপালে রিভলভার উদ্যত করে ধরে। বাধ্য হয়ে ক্যাশিয়ার

চাবির থোকাটা বার করে দেয়।

মালিক এম. পি. জৈনের একটা নিজস্ব রিভলতার ছিল তার ড্রয়ারে। ডাকাতগুলো আয়রন সেফ খুলে নোট বার করতে ব্যস্ত আছে দেখে তিনি চট করে টানা ড্রয়ারটা খুলে রিভলভার বার করে ফায়ার করেন। কেউই তাতে গুলিবিদ্ধ হয় না! অপর পক্ষে ডাকাতদের একজন তখন মিস্টার জৈনকে প্রচণ্ড ধাক্কা মারে। জৈন উল্টে পড়ে যান। তাঁর হাত থেকে রিভলভারটা ছিটকে পড়ে৷ তখন আর একজন ডাকাত সেই রিভলভারটা কুড়িয়ে নিয়ে তাই দিয়েই জৈনকে গুলি করে। তিন-চার মিনিটের ব্যাপার।ওরা বোমা ছুড়তে ছুঁড়তে একটা কালো অ্যাম্বাসাডার চেপে উধাও হয়ে যায়। তখন লোকজন ছুটে আসে। দেখা যায় এম. পি. জৈন মৃত। দারোয়ানটার আঘাত মারাত্মক নয়। ডাকাতেরা নগদে প্রায় ষাট হাজার টাকা নিয়ে যায়, এবং মৃত এম. পি. জৈনের রিভলভারটাও নিয়ে যায়!

এখন নম্বর মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে গতকাল বোম্বাই মেলের ফার্স্ট-ক্লাস কামরায় ঐ BOAC মার্কা ব্যাগের ভিতর যে রিভলভারটা পাওয়া গেছে সেটা জৈনসাহেবের রিভলভার।

সুপ্রিয়র বিরুদ্ধে তাই চার্জ হচ্ছে, ডাকাতি আর খুনের।

বাসু-সাহেব সমস্ত শুনে বললেন, কেসটা খারাপ। কাল রাত্রে ঐ পুলিস ইন্সপেক্টর যখন জিজ্ঞাসা, করেছিল --’ব্যাগটা আপনার’? তখন সুপ্রিয় কেন বলেছিল, ‘হুঁ’?

-- ও অন্যমনস্ক হয়ে বলেছিল স্যার। বুঝতে পারেনি কোন্‌ ব্যাগটার কথা হচ্ছে।

-- আপনাকে ও তাই বলল?

-- তার দেখা পেলাম কোথায় স্যার? হাজতে আমাকে যেতেই দিল না। বললে, একমাত্র ওর উকিল ছাড়া আর কারও সঙ্গে ওকে দেখা করতে দেবে না। এখন আপনি যদি ওর কেসটা হাতে নেন স্যার!

একটু ভেবে নিয়ে বাসু-সাহেব বললেন, নেব, কিন্তু এবার আর মৌফৎসে নয়।

-- নিশ্চয় নয় স্যার, নিশ্চয় নয় -- বলুন এবার কত দিতে হবে?

-- আমার মোট ফি হবে দশহাজার টাকা, তার অগ্রিম পাঁচ হাজার এখনই দিতে হবে!

-- দ-শ-হা-জা-র টাকা! কী বলছেন স্যার?

গম্ভীর হয়ে বাসু বললেন, জীবনবাবু, ফি নিয়ে দরাদরি আমি করি না। কোন বাধ্যবাধকতা নেই। ক্রিমিনাল লইয়ার অনেকে আছেন এ-শহরে। অনেক কমেও হয়তো অনেকে রাজী হয়ে যাবেন। চেষ্টা করে দেখুন।

-- না স্যার। আমিও বাজার যাচাই করতে যাব না। বেশ, দশ হাজারই দেব। টাকা তো আমার নয়, কোম্পানির! তবে স্যার আপনাকে আর একটা কাজও করে দিতে হবে! মামলায় যেন এ ব্ল্যাক-মানির প্রসঙ্গটা না ওঠে!

-- সেটা অসম্ভব। এক লাখটাকা দশ টাকার নোটে ওর ব্যাগে কেন এল একথা উঠবেই। ভাল কথা বাকি এক লাখ কি আপনার কাছে ছিল?

-- হ্যাঁ স্যার। সেটা আবার ঐ হোটেলের ভল্টেই রেখেছি।

-- পার্ক-হোটেলেই উঠেছেন ফের?

-- আজ্ঞে হ্যাঁ। অত টাকা নিয়ে আর কোথায় উঠব? এবার রুম নম্বর 78।

-- আর একটা কথা। ঠিক খুনের সময়, অর্থাৎ এগারো তারিখ রাত পৌনে আটটায় আপনি ‘আর মিস্টার দাসগুপ্ত কে কোথায় ছিলেন?

-- দুজনেই মোকাম্বো রেস্তোঁরাতে খাচ্ছিলাম স্যার!

-- মোকাম্বো! কেন পার্ক-হোটেলের খানা কি পছন্দ হচ্ছিল না?

-- কী যে বলেন স্যার? আমি ছাপোষা গরিব মানুষ --ওসব খাবার কি চোখে দেখেছি কখনও? এগারো তারিখ রাতে আমাদের নিমন্ত্রণ করে মোকাম্বোতে খাইয়েছিলেন ঐ রঘুপতি সিঙ্ঘানিয়া সাহেবের বড় ছেলে যদুপতিজী।

-- ওঁরা কে?

-- আজ্ঞে বড়কর্তার বাড়িটা রঘুপতিজী তাঁর বড় ছেলের নামে কিনলেন। ঐ এগারো তারিখের দুপুরেই রেজিস্ট্রি হল কিনা, তা আমি বললাম যদুপতিজী, অতবড় সম্পত্তি কিনলেন, আমাদের মিষ্টিমুখ করাবেন না? উনি তৎক্ষণাৎ আমাদের মোকাম্বোতে নিমন্ত্রণ করলেন। আমরা সন্ধ্যা সাতটায় ঐ রেস্তোঁরাতে যাই এবং রাত সাড়ে নয়টায় বার হয়ে আসি। আমরা তিনজনেই খেয়েছিলাম।

-- তিনজন বলতে আপনি, সুপ্রিয় এবং ঐ যদুপতি সিঙ্ঘানিয়া?

-- আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার!

-- তাহলে কেসটা অনেক সরল। যদুপতি সিঙ্ঘানিয়া একজন নামকরা ধনী নিশ্চয় --

-- নিশ্চয়, নিশ্চয় --বিশ পঞ্চাশ হাজার টাকা ইনকাম ট্যাক্স দেন!

-- তাঁর সাক্ষীটা জোরালো হবে। ঠিক আছে, আমি এ-কেস নেব। রিটেনারটা দিয়ে যান।

-- রিটেনার কী স্যার?

-- অগ্রিম পাঁচ হাজার টাকা।

ক্যাশিয়ার জীবনবাবু তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালেন। মাজার কষি আলগা করে একটা কোমরবন্ধ বার করে আনেন। পাঁচ থাক নোটের বান্ডিল নামিয়ে রাখেন টেবিলে। বাসু-সাহেব টেলিকমে রানী দেবীকে ডাকলেন। অল্প পরেই হুইল্‌-চেয়ারে মিসেস্‌ বাসু এসে উপস্থিত হলেন ওর ঘরে। বাসু বললেন, এঁকে একটা পাঁচ হাজার টাকার রসিদ লিখে দাও। রসিদটা হবে মিস্টার সুপ্রিয় দাসগুপ্ত, ম্যানেজার, কাপাডিয়া আ্যান্ড কাপাডিয়া কোম্পানির নামে।

জীবন বিশ্বাস চমকে উঠে বললে, কেন স্যার? টাকা দিচ্ছি আমি, রসিদ কেন ম্যানেজারের নামে হবে?

-- কারণ সুপ্রির দাসগুপ্তই আমার ক্লায়েন্ট ৷ আপনি নন।

জীবন বিশ্বাস ভ্রূকুঞ্চিত করে চুপ করে বসে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর বললেন, তার মানে কি এটাই ধরে নেব স্যার, যে আপনি ইঙ্গিত করতে চাইছেন আপনার ক্লায়েন্টের স্বার্থে আপনি আমারও বিরুদ্ধাচরণ করতে পারেন?

-- না! ইঙ্গিত করছি না। স্পষ্টাক্ষরে সে-কথা জানাচ্ছি! টাকা আপনি টেবিলে রেখেছেন। আমি তা নিইনি এখনও । এ শর্তেই আমি কাজটা হাতে নেব।

জীবন বিশ্বাস গোঁজ হয়ে বসে রইলেন কয়েক সেকেন্ড! তারপর বললেন। ঠিক আছে, রাখলেও আপনি, মারলেও আপনি --

রানী দেবী বললেন, আসুন আপনি। রসিদটা নিয়ে যাবেন।



পরদিন রবিবার। সকালবেলা প্রাতরাশের টেবিলে বমেছিলেন বাসু-সাহেব,সুজাতা আর রানী দেবী। কৌশিক অনুপস্থিত। সুজাতাই এখন রান্নাঘরের হেপাজতে। হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন রানী দেবী। তার চেয়েও বড় কথা নিঃসঙ্গতাটার হাত থেকে রেহাই পেয়েছেন। অনেক অনেকদিন পর়ে বাড়িটা কলমুখর হয়ে উঠেছে।

সুজাতা প্রশ্ন করে, আপনার ক্লায়েন্ট কী বলল শেষ পর্যন্ত?

বাসু-সাহেব শনিবার বিকালেই হাজতে গিয়ে দেখা করেছিলেন সুপ্রিয়র সঙ্গে। জামিন দেওয়া হয়নি তাকে। কথাবার্তা বলে বাসু-সাহেবের মনে হয়েছে খুনের মামলায় সে বেচারি বেমক্কা জড়িয়ে পড়েছে। সুপ্রিয় দাসগুপ্ত বোম্বাইয়ের একটা নামকরা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার। বিবাহিত। জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত। তাছাড়া সে কলকাতার সমাজের খবর বড় একটা রাখে না। প্রবাসী বাঙালী! তার পক্ষে সাতদিনের জন্য কলকাতায় এসে ডাকাতির দলে ভীড়ে পড়া একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। যে ব্যাগটার মধ্যে রিভলভারটা পাওয়া গেছে ওটা সুপ্রিয় সঙ্গে করে আনেনি। সুজাতা নিজেই তার সাক্ষী। সুজাতা ডিফেন্স-এর তরফে সাক্ষী দিলে সুপ্রিয়র ঐ অন্যমনস্কভাবে ‘হুঁ’ বলার অপরাধটা গুরুত্ব পাবে না।

তাছাড়া সুপ্রিয়র অকাট্য আলিবাই আছে। দু-দুজন সাক্ষীর সঙ্গে সে মোকাম্বোতে নৈশ-আহার করছিল ঠিক যে-সময়ে বড়বাজারে খুনটা সংঘটিত হয়। দু-জন সাক্ষীর একজন অবশ্য ওরই অধীনস্থ কর্মচারী -- কিন্তু দ্বিতীয়জন বিশিষ্ট নাগরিক।

রানী দেবী বলেন, তাহলে কাল থেকে এত কী ভাবছ তুমি?

-- ভাবছি? হ্যাঁ ভাবছি অন্যদিক থেকে। দুটো কথা আমি ভাবছি। প্রথম, ঐ মিস ডিক্রুজার ব্যাপারটা । মিস ডিক্রুজা নামটা তোমার মনে আছে সুজাতা?

-- আছে। দার্জিলিঙ-এর খুনের কেসটার প্রসঙ্গে এক মিস্‌ ডিক্রুজাকে আমরা খুঁজছিলাম; কিন্তু কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

-- কারেক্ট। কিন্তু এটুকু বোঝা গিয়েছিল মেয়েটা নষ্ট-স্বভাবের।

রানী দেবী বলেন, কিন্তু মিস্‌ ডিক্রুজা নামে কলকাতায় কি একটিই মেয়ে আছে?

-- না নেই। কিন্তু এ নামটা আমাকে কেমন যেন হন্ট করছে।

-- আর আপনার দ্বিতীয় চিন্তার কারণ?

-- মাইতি হঠাৎ এত উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন কেন?

মিসেস বাসু বলেন, মাইতিটা কে?

বাসু-সাহেব বুঝিয়ে বলেন, নিরঞ্জন মাইতি হচ্ছেন পাবলিক প্রসিকিউটার। অর্থাৎ কোর্টে যখন কেস উঠবে তখন নিরঞ্জন মাইতি ওঁর বিরুদ্ধে সওয়াল করবেন, সরকার পক্ষে। মাইতি নাকি গতকাল বার-আ্যাসোসিয়েশানের আড্ডায় বলেছেন, বাসু-সাহেব কেন যে এই বুড়ো বয়সে তাঁর নিজের রেকর্ডটা ভাঙতে এলেন! বেচারি!

সুজাতা বলে, নিজের রেকর্ডটা ভাঙতে মানে?

বাসু জবাব দিলেন না। জোড়া পোচের প্লেটটা টেনে নিলেন।

রানী বললেন, উনি আজ পর্যন্ত কোনও কেসে হারেননি। মানে, মার্ডার কেসে!

শ্রাগ করে ব্যারিস্টার বাসু বলেন, এ ফ্যাক্ট কান্ট বি ডিনায়েড! হ্যাঁ, ঘটনাচক্রে কোনও মার্ডার কেসেই আমি কখনও হারিনি সুজাতা। তাই আমি শুধু ভাবছি, মাইতি ও কথা বলল কেন? সে নিশ্চয়ই এমন কিছু প্রমাণ পেয়েছে, এমন সাক্ষীর খোঁজ পেয়েছে যাতে কোর্টে আমাকে হঠাৎ চমকে দেবে! সেটা যে কী, তা আমি এখনও বুঝে উঠতে পারছি না। বাট হি মাস্ট বি হ্যাভিং সামথি আপ হিজ স্লিভ!

মিসেস বাসু প্রসঙ্গান্তরে যাবার জন্য বললেন, কৌশিককে কোথায় পাঠালে?

-- রাঁচি।

-- রাঁচিতে কেন?

বাসু-সাহেব দাখিল করেন তার যুক্তি। পার্ক-হোটেলের আটত্রিশ নম্বর ঘরের ঐ ভদ্রমহিলা আসলে কে, সেটা তাঁকে জানতে হবে। এ মেয়েটার সম্বন্ধে দু্জনে দু-রকম কথা৷ কেন বলছে?

-- ‘দুজনে দু-রকম কথা’ মানে?

-- জীবন বিশ্বাস বলছে পাশের কামরায় ডি-সিলভাকে সে দেখেছে এবং এ মেয়েটির সঙ্গে সে সুপ্রিয়কে কথা বলতেও দেখেছে। অথচ সুপ্রিয় সরাসরি অস্বীকার করছে। পাশের ঘরের এ মেয়েটির অস্তিত্বই না কি সে জানে না।

-- কেসটা করে কোর্টে উঠবে?

চার্জ ফ্রেম করা হয়ে গেছে। প্রাথমিক শুনানিও। কেস উঠবে বৃহস্পতিবার।

-- এত তাড়াতাড়ি আপনি তৈরি হতে পায়কেন?

-- তৈরি আমাকে হতেই হবে সুজাতা। আমার মক্কেল জামিন পায়নি!



সোমবার সকালে বাসু-সাহেবের জুনিয়ার প্রদ্যোৎ নাথ এনে জানালো -- জীবন বিশ্বাসকে সমন করা হয়েছে স্যার; কিন্তু তার আগেই ওকে থানা থেকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে সে একটা এজাহার দিয়ে এসেছে --

-- তাই নাকি? তা এজাহারে কী কলেছে সে?

-- আমাদের কাছে যা বলেছে সেই সব কথাই। তবে ব্ল্যাক-মানির কথা স্বীকার করেনি!

-- আ্যালিবাই-এর কথা?

-- তা বলেছে। জীবনযাধু বললেন, থানা অফিসার ঐ মোকাম্বোর ব্যাপারে খুব বিস্তারিত প্রশ্ন করেছে। কখন ওঁরা আসেন, কখন যান -- মায় কে কোন্‌ আইটেম খেয়েছেন তাও।

-- সব কথাই সে সত্যি বলেছে তো?

-- তাইতো বললেন আমাকে।

-- আর যদুপতি সিঙ্ঘানিয়া? তাকে সমন ধরানো হয়েছে তো?

-- না স্যার? তিনি বাড়ি ছেড়ে একেবারে নিরুদ্দেশ।

-- নিরুদ্দেশ! মানে? কেউ জানে না তিনি কোথায়?

-- আজ্ঞে না। আমার মনে হয় পাছে আদালতে এ দু-লাখ টাকা ব্ল্যাক-মানির প্রসঙ্গটা উঠে পড়ে, তাই তিনি গা-ঢাকা দিয়েছেন।

বাসু সাহেব বলেন, তবে তো কেসটা আবার কাঁচিয়ে গেল?

-- রাত্রের ট্রেনে কৌশিক ফিরে এল। রাঁচি থেকে সে জেনে এসেছে -- মিস্টার ডি.সিলভাকে সত্যই আট তারিখে ওখানকার মানসিক হাসপাতাল থেকে মুক্ত করা হয়। তাকে নিয়ে যায় তারই দিদি মিস ডি-সিলভা। হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ মেয়েটির যা বর্ণনা দিয়েছেন, পার্ক-হোটেলের বেয়ারা হরিমোহনও তাই দিয়েছে। সুতরাং ওখানে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।

-- কিন্তু তাহলে সুপ্রিয় কেন তার অস্তিত্বটাই অস্বীকার করছে?

সন্ধ্যাবেলা গাড়িটা বার করে বাসু-সাহেব কৌশিককে নিয়ে চলে গেলেন চৌরঙ্গী অঞ্চলে প্রথমে মোকাম্বো। সেখানে কিছুই সুবিধা হল না। না ওদের ম্যানেজার, না কোনও বেয়ারা -- কেউই ধনকুবের যদুপতি সিঙ্ঘানিয়াকে চেনে না। সেটাই স্বাভাবিক। এমন কত লক্ষপতি আছে কলকাতা শহরে যারা নিত্য মোকাম্বোতে এসে সান্ধ্য আসর জমায় -- খাদ্যে আর পানীয়ে।

দ্বিতীয়ত পার্ক-হোটেলে। এখানে হরিমোহন বরং কিছু খবর দিতে পারল। হ্যা, আটত্রিশ নম্বরের সেই মেম-সাহেবকে তার মনে আছে; তার পাগল ভাইকেও। না, সে চেঁচামেটি কিছু করত না। কেমন যেন জড়বুদ্ধি, ধন্ধধরা মানুষ। সবসময় গোঁজ হয়ে বসে থাকত একটা চেয়ারে। মেমসাহেব তাকে নিয়ে দিবারাত্র একটা গাড়িতে করে ঘুরত! তার চিকিৎসা-ব্যবস্থার জন্যই হবে হয়তো। কবে তারা চলে যায়?-- বারো তারিখ সকালে। ঠিক কখন তা সে জানে না। তখন সে ওখানে ছিল না। দারোয়ান বলতে পারে।

দারোয়ানকেও প্রশ্ন করা হল। তারও মনে আছে ওদের প্রস্থান পর্বটা। সে ঐ মেমসাহেব বা সাহেবকে আগে দেখেনি। তবে মনে আছে এটা যে, সাহেবটাকে প্রায় ধরাধরি করে এনে গাড়িতে তোলা হয়েছিল। তখন দারোয়ান ভেবেছিল সাহেবটা মাতোয়ারা। পরে শুনেছে -- না, সে পাগল।

-- আর কিছু মনে পড়ছে না তোমার?

-- নগদ পাঁচ টাকা বকশিশ পেয়েছে দারোয়ান। অনেক চিন্তা করে কলল, আরও একটা কথা মনে পড়ছে স্যার। ঠিক রওনা হবার আগে ড্রাইভার মেমসাহেবকে বলেছিল, জি. টি. রোড খারাপ আছে! আমরা দিল্লী রোড হয়ে যাই বরং।

--ট্যাক্সি না প্রাইভেট গাড়ি?

-- না, সাব, প্রাইভেট গাড়ি।

বাসু-সাহেব মানি ব্যাগ খুলে আরও পাঁচটা টাকা ওর হাতে দিয়ে বললেন, থ্যাঙ্ক য়ু।

গাড়িতে স্টার্ট দিলেন উনি। কৌশিক বললে, ব্যাপার কি? আপনি যে আজ দাতাকর্ণ।

বাসু রোষ-কষায়িত নেত্রে একবার তাকালেন কৌশিকের দিকে। কোন কথা বললেন না। বাড়িতে ফিরে এসেও নয়। সোজা ঢুকে গেলেন নিজের ঘরে। ঘণ্টাখানেক চুপচাপ বসে বাইরে গেলেন। তারপর বেরিয়ে এসে বললেন, সুজাতা, দুটো ট্রাঙ্ককল বুক কর। একটা বোম্বাই। লাইটনিং কল। নম্বর এই নাও। পি. পি. মিস্টার সি. বরুয়া। দ্বিতীয়টা বর্ধমানের সদর থানার ও. সি! ওটাও পি. পি. এবং লাইটনিং। নাম নৃপেন ঘোষাল। নম্বরটা 183 ডায়াল করে জেনে নাও।

সুজাতা ওর থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে কোন প্রশ্ন করল না। এগিয়ে গেল টেলিফোনটার দিকে। দুটি লাইনই পাওয়া গেল অল্পকালের মধো। প্রথমে এল বর্ধমান।

রিসিভারটা তুলে বাসু-সাহেব বললেন, কে নৃপেন? আমি পি. কে. বাসু। চিনতে পারছ?...হ্যাঁ, একটা উপকার করতে হবে। খোঁজ নিয়ে জানাও তো, যে, শুক্রবার বারো তারিখে বর্ধমানে সাম মিস্টার ডি.সিলভা এবং মিস্‌ ডি. সিলভা কোথায় উঠেছেন।...না, না একটু শোন ডিটেলসটা। মিস্টার সিলভার বয়স পঁচিশ ছাবিবশ, লম্বা একহারা।বিকৃতমস্তিষ্ক … ইয়েস, ম্যাড! তার দিদি তাকে একটা কালো অ্যাম্বাসাডারে নিয়ে যায় বারো তারিখ, বেলা আটটায়। তার মানে এগারোটা নাগাদ ওরা বর্ধমানে পৌঁচেছে। চেক অল্‌ দা হোটেলস, রেস্ট হাউসেস্‌, অ্যান্ড য়ু নো বেটার হোয়ার। ভাড়া বাড়িতেও উঠতে পারে। কালো রঙের অ্যাম্বাসাডারটাকে স্পট করার চেষ্টা কর বরং।...কী? না: বর্ধমান ছেড়ে যায়নি। গেলেও কাছে-পিঠে কোনখানে আছে।...ইয়েস! খবর গেলেই আমাকে জানাবে। থ্যাঙ্কু!

নৃপেন ঘোষাল একটি বদলি সংক্রান্ত ব্যাপারে বাসু-সাহেবের কাছে প্রভূতভাবে উপকৃত। বেচারিকে দু নৌকায় পা দিয়ে চলতে হয় -- সরকারী চাকরি আর ডিফেন্স কাউন্সিলার প্রতাপশালী ব্যারিস্টার পি. কে. বাসু।

দ্বিতীয় ফোনটা ধরলেন বাসু-সাহেবের বোম্বাই-প্রবাসী এক বন্ধু -- চন্দ্রকান্ত বরুয়া। তাঁকে বললেন, একটু কষ্ট দিচ্ছি। বোম্বাইয়ের কাপাডিয়া অ্যান্ড কাপাডিয়া কোম্পানিতে খোঁজ নিয়ে তাদের ম্যানেজার সুপ্রিয় দাসগুপ্তের স্ত্রীর সঙ্গে গিয়ে দেখা কর। বেচারি বোধহয় এখনও জানে না, তার স্বামী কলকাতায় এসে একটা বিশ্রী মামলায় জড়িয়ে পড়েছে ...কী? না, মার্ডার চার্জ! তোমাকেই বলাম ব্যাপারটার গুরুত্ব বোঝাতে। তুমি মেয়েটিকে মার্ডার-চার্জের কথা বল না। আমার নাম করে বল, তার সাক্ষী খুব জরুরী দরকার। সে যেন নেকস্ট অ্যাভেইলেবল্‌ প্লেনে ক’লকাতা চলে আসে। প্যাসেজ-মানি তার কাছে যদি না থাকে, তুমি আমার হয়ে দিয়ে দেবে! মেয়েটি যদি পারে তবে এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে যেন সোজা আমার বাড়িতে চলে আসে। যদি পার, তবে ওকে প্লেনে তুলে দিয়ে আমাকে ফোন কর। ...ইয়েস্‌ ইয়েস্‌... অল এক্সপেনসেস আর মাইন্‌! চিয়ারিও!

পঞ্চম পর্ব

বৃ্স্পতিবার সকাল। প্রতিবাদী সুপ্রিয় দাসগুপ্তের আজ প্রাথমিক হিয়ারিং হবে। বাসু-সাহেব আর সুজাতা তৈরি হয়ে নিলেন। সুজাতা প্রতিবাদী পক্ষের সমন পেয়েছে। প্রদ্যোৎ নাথ সরাসরি কোর্টে যাবে। ওঁরা রওনা হতে যাবেন এমন সময় বেজে উঠল টেলিফোনটা । বাসু-সাহেব ধরলেন।

ফোন করেছেন প্রবীণ ব্যারিস্টার এ. কে. রে.। একন বয়স আশির কোঠায়। ত্রিশ বছর হল তিনি প্র্যাকটিস্‌ ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁর আমলে রে-সাহেব ছিলেন কলকাতার সবচেয়ে নামকরা! ক্রিমিনাল ব্যারিস্টার। ব্যারিস্টার মহলে তাঁকে বলা হত ‘বারওয়েল দ্য সেকেন্ড’। বারওয়েল ছিলেন কলকাতা বারের বিখ্যাত শেষ ইংরাজ ব্যারিস্টার। পি. কে. বাসু প্রথম যৌবনে এঁর কাছেই জুনিয়ার হিসাবে কাজ শিখেছেন, ব্যারিস্টারী পড়তে যাবার আগে। রে-সাহেব ওঁকে শুভেচ্ছা জানালেন, বললেন, অনেক অনেকদিন পর আজ কোর্টে বের হচ্ছ, তাই শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।

বাসু বললেন, শুভেচ্ছা কেন স্যার? বলুন আশীর্বাদ !

-- বেশ আশীর্বাদই। কিন্তু একটা কথা, বাসু। গতকাল নিরঞ্জন মাইতি হঠাৎ আমার কাছে এসেছিল। আমাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করে গেল আজ কোর্টে উপস্থিত থাকতে। আমি তো আজ বিশ ত্রিশ বছর কোটে যাইনি। হঠাৎ এ নিমন্ত্রণটা হল কেন বল তো?

-- জানি না। আন্দাজ করতে পারি। সে কি বলল?

-- বলল, অনেকদিন পর আপনার শিষ্য আজ সওয়াল করছে, আপনি আসবেন স্যার। আমি নিমন্ত্রণ করতে এসেছি! ওর মুখ-চোখ দেখে আমার মনে হল, মানে...

-- আপনার দৃষ্টি ভুল না স্যার। আপনি ঠিকই ভেবেছেন -- মাইতি বার অ্যাসোসিয়েশনেই বলে এসেছে এই কেস-এ সে আমার রেকর্ড ভাঙবে! অর্থাৎ অ্যাকিউসড-এর কনভিকশান হবে!

-- কেসটা কী? তিনশ দুই? .

-- ইয়েস স্যার!

-- কী বুঝছ? কেসটা কী খারাপ?

-- ফিফটি ফিফটি! কিন্তু আমার আশঙ্কা হচ্ছে মাইতি এমন কিছু এভিডেন্স পেয়েছে যার কোন হদিসই আমি এখনও পাইনি-- হি হ্যাজ্‌ সামথিঙ আপ হিজ্‌ স্লিভ! কোর্ট-এর ভিতর ড্রামাটিক্যালি সেটা সে পেশ করতে চায় -- তাতেই আপনাদের সকলকে নিমন্ত্রণ করছে!

-- আমারও তাই মনে হল। এনি ওয়ে -- যদি প্রয়োজন মনে কর তাহলে কোর্ট থেকে ফেরার পথে আমার সঙ্গে কনসাল্ট কর। তারপর একটু ইতস্তত করে বললেন, য়ু ক্যান ওয়েল আপ্রিশিয়েট, বাসু -- আই জাস্ট কান্ট অ্যাফোর্ড টু সি মাই হিদারটু আনডিফিটেড কোলীগ --

-- কোলীগ নয় স্যার, শিষ্য বলুন!

-- ওয়েল মাই বয়। শিষ্যই। ...যাক তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। বেস্ট অফ লাক!

প্রবীণ গুরুর আশীর্বাদ নিয়ে বাসু-সাহেব যখন কোর্টে এসে উপস্থিত হলেন তখন কোর্ট বসেছে। আদালতে তিল ধারণের স্থান নেই। ব্যারিস্টার পি.কে.বাসু নতুন করে প্র্যাকটিস্‌ শুরু করছেন এ খবর আইনজীবী মহলে ছড়িয়ে পড়েছে। বার অ্যাসোসিয়েশান ভেঙে পড়েছে। দর্শকদের আসন অনেক আগেই পূর্ণ হয়ে গেছে। অনেকে দেওয়াল ঘেঁষে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু প্রেসের লোকও এসেছে। কোর্ট থেকে তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যেন আদালত চলা কালে কোন ফটো না তোলা হয়।

বিচক্ষণ বিচারক জাস্টিস্‌ সদানন্দ ভাদুড়ী নিজের আসনে এসে বসলেন। জুরির মাধ্যমে আজকাল আর বিচার হয় না। জুরি নেই। একটু নিচের ধাপে বসে আছে দুজন কোর্ট পেশকার। প্রথা-মাফিক বাদী ও প্রতিবাদী প্রস্তুত আছেন কিনা জেনে নিয়ে বিচারক বিচার আরম্ভ ঘোষণা করলেন। পাবলিক প্রসিকিউটর বিশালায়তন প্রবীণ আইনজীবী নিরঞ্জন মাইতির দিকে তাকিয়ে বলেন, প্রারম্ভিক ভাষণ?

মাইতি খুশিতে ডগমগ। উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন করে বললেন, আদালত যদি অনুমতি দেন, আমি একটি সংক্ষিপ্ত প্রারম্ভিক ভাষণ দিতে ইচ্ছুক। আমরা আশা রাখি যে, আমরা প্রমাণ করব -- আসামী সুপ্রিয় দাশগুপ্ত গত এগারোই এপ্রিল, বৃহস্পতিবার, রাত প্রায় পৌনে আটটার সময় বড়বাজারে মিস্টার এম. পি. জৈনের গদীতে আরও তিনটি সঙ্গীর সঙ্গে অনধিকার প্রবেশ করে। আমরা প্রমাণ করব যে, সে ভয় দেখিয়ে ঐ দোকানের ক্যাশিয়ার সুকুমার বসুর কাছ থেকে ষাট হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয় এবং মিস্টার এম. পি. জৈনের নিজের রিভলভারটি তাঁর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে তাকে গুলিবিদ্ধ করে হত্যা করে। আমরা আশা রাখি, আসামী সুপ্রিয় দাশগুপ্তের বিরুদ্ধে অনধিকার প্রবেশ, ডাকাতি,

আনলাইসেন্সড্‌ রিভলভার রাখা ও হত্যার অপরাধ প্রমাণিত হবে। এবং আমরা আশা রাখি, মহামান্য আদালত এ ক্ষেত্রে আসামীর প্রতি চরমদণ্ড বিধান করবেন!

এই কথা বলে নিরঞ্জন মাইতি আসন গ্রহণ করলেন। উকিল মহলে একটা গুঞ্জন উঠল। পি. পি. নিরঞ্জন মাইতিও শুরুতেই একটি রেকর্ড করলেন: এত সংক্ষিপ্ত প্রারম্ভিক ভাষণ নাকি তিনি জীবনে দেননি।

জজ-সাহেবও বোধকরি এটা আশা করেননি। মাইতি শেষ করার পরেও তিনি আশা করেছিলেন, মাইতি বুঝি আবার উঠে কিছু বলবেন। মাইতি সত্যই উঠলেন আবার। হেসে বললেন, দ্যাটস্ অল মি’ লর্ড!

জাস্টিস ভাদুড়ী এবার প্রতিবাদী আইনজীবীদের দিকে ফিরলেন। পাশাপাশি বসে আছেন ব্যারিস্টার পি. কে. বাসু এবং তার সহকারী প্রদ্যোৎ নাথ। জাস্টিস্‌ ভাদুড়ী বললেন, এবার আপনারা প্রারম্ভিক ভাষণ দিতে পারেন।

বাসু-সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। কিছু একটা বলতে গেলেন। হঠাৎ তাঁর দৃষ্টি পড়ল আদালতের প্রবেশ-দ্বারের দিকে। চমকে উঠলেন উনি। সংক্ষেপে বিচারককে বললেন, দ্যাটস্‌ অল মি’ লর্ড! আমি কোন প্রারম্ভিক ভাষণ দেব না!

বিচারকের দিকে একটি বাও করে বাসু-সাহেব তাঁর আসন ছেড়ে এগিয়ে গেলেন দ্বারের দিকে। শুভ্রকেশ অতি বৃদ্ধ এ.কে.রে লাঠি ঠুকঠুক করতে করতে এগিয়ে আসছিলেন। তাঁর হাতটা ধরলেন। হাসলেন রে সাহেব। বাসু ওঁকে নিয়ে এসে বসালেন নিজ আসনের পাশে। বৃদ্ধ এ.কে.রে স্থির থাকতে পারেননি। এসে উপস্থিত হয়েছেন আদালতে। কোর্টে একটা গুঞ্জন উঠল। জুনিয়র উকিল যাঁরা এ. কে. রে-র নাম শুনেছে, কিন্তু চোখে দেখেনি, তারা দাঁড়িয়ে উঠে তাঁকে দেখতে চায়। জাস্টিস ভাদুড়ী তাঁর হাতুড়িটা ঠুকলেন। এ. কে. রে বিচারককে একটা বাও করে আসন গ্রহণ করলেন।

বিচারক ভাদুড়ীও হাত নেড়ে প্রত্যাভিবাদন করলেন হেসে।

জজ-সাহেব মাইতিকে বললেন, আপনি প্রথম সাক্ষীকে ডাকতে পারেন।

প্রথম সাক্ষীঃ ডাঃ রামকুমার অধিকারী।

রামকুমার যথারীতি শপথ নিয়ে সাক্ষীর মঞ্চ থেকে তাঁর নাম, পরিচয়, পেশা ইত্যাদি জানালেন মাইতি মশায়ের প্রশ্নের উত্তরে! স্বীকার করলেন, তার ডিস্পেনসারি এ জৈন-সাহেবের গদীর কাছেই। ঘটনার দিন রাত আটটা বেজে তিন মিনিটে একজন লোক ছুটে এসে বলে জৈন-সাহেব গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। শুনেই তিনি দেখতে যান। ওঁর ডাক্তারখানা থেকে যেতে ওঁর আন্দাজ দু’মিনিট লাগে। সুতরাং আটটা পাঁচ মিনিটে তিনি প্রথমে জৈন-সাহেব এবং পরে দারোয়ানকে পরীক্ষা করেন। জৈন মারা গেছেন, আর দারোয়ানের বাঁ-কাঁধে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। দ্বিতীয়জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা করে তিনি জানতে চান যে, পুলিসে খবর দেওয়া হয়েছে কি না। ভীড়ের মধ্যে একজন, কে তা তিনি বলতে পারবেন না -- জানায় যে থানা এবং অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করা হয়েছে। মিনিট দশেকের ভিতরেই অ্যাম্বুলেন্স এসে যায়, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পুলিসও।

মাইতি প্রশ্ন করেন, মিস্টার জৈন কখন মারা গেছেন বলে আপনার বিশ্বাস?

-- এ্রগার তারিখ রাত আটটা পাঁচ মিনিটের আগে।

-- না না,কত আগে? রাত আটটা পাঁচ মিনিটে তাকে যখন মৃত অবস্থায় দেখেছেন তখন, -- ও-জবাব আমি চাইছি না।

দেখা গেল রামকুমার অত্যন্ত সতর্ক সাক্ষী । জবাবে বললেন, কত আগে তা অটোপ্সি সার্জেন বলতে পারেন৷ আমি মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করিনি।

মাইতি বিরক্ত হয়ে বলেন, কী আশ্চর্য! আপনার পাশের দোকানে ডাকাতি হল, চেঁচামেচি হল, গুলির আওয়াজ হল --

-- গুলির আওয়াজ স্বকর্ণে শুনেছি, একথা আমি বলিনি।

--তা শোনেননি, কিন্তু হৈচৈ চেঁচামেচি তো শুনেছেন?

-- শুনেছি। কিন্তু সেই জ্ঞানের ভিত্তিতে যদি বিশেষজ্ঞ হিসাবে আমি বলি যে, মৃত্যু রাত পৌনে আটটার পরে হয়েছে তবে ঐ উনি কোর্টের মধ্যে আমার প্যান্টলুন খুলে নেবেন! ওঁকে আমি চিনি --

সাক্ষী ডিফেন্স-কাউন্সিলার পি. কে. বাসুকে ইঙ্গিত করেন। বাসু-সাহেব তখন একদৃষ্টে একটা নথি পড়ছিলেন। চোখ তুলে দেখলেন না। কোর্টে একটা মৃদু হাস্যরোল উঠতেই জাস্টিস্‌ ভাদুড়ী হাতুড়ি পিটলেন। বিচারক সাক্ষীকে বললেন, আপনি অবান্তর কথা বলবেন না। প্রশ্নের যা রেঞ্জ উত্তর তার মধ্যেই সীমিত রাখুন।

মাইতি বললেন, দ্যাটস্‌ অল মি’ লর্ড।

বাসু উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, নো৷ ক্রস্‌ এক্সামিনেশান।

এবার সাক্ষীর মঞ্চে উঠে দাঁড়ালেন সরকারপক্ষের দ্বিতীয় সাক্ষী অটোপ্সি সার্জেন ডাঃ অতুলকৃষ্ণ স্যান্যাল। তিনিও তাঁর পরিচয় ইত্যাদি দিয়ে স্বীকার করলেন, মৃত মিস্টার জৈনের মৃতদেহ তিনি ব্যবচ্ছেদ করেছিলেন। সীসার গোলকটি মৃতের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পাঁজরের মাঝামাঝি অংশ দিয়ে হৃদপিণ্ডে প্রবেশ করে, ঠিক যেখানে ‘সুপিরিয়র ভেনা কাভা’ এবং দক্ষিণ দিকস্থ ‘পালমোনারি আর্টারি’ এসে পড়েছে হৃদপিণ্ডের দক্ষিণ আর্টিয়ামে। ফলে দক্ষিণ আর্টিয়াম বিদ্ধ হয়, তারপর ঐ সুপিরিয়র ভেনা কাভাকে ফুটো করে এবং দক্ষিণ পালমোনারি আর্টারিদ্বয়ের উপর দিকের ধমনীটি বিচ্ছিন্ন করে সীসার গোলকটি পিঠের দিকে চলে যায়। শিরদাঁড়ার একাদশতম থোরাসিক ভাটিব্রাতে আহত হয়ে সেটা হৃদপিন্ড অঞ্চলেই আটকে থাকে। যেহেতু ‘সুপিরিয়ার ভেনা কাভা’ এবং হৃদপিন্ডের আর্টিয়াম মানবদেহে অতি আবশ্যিক প্রত্যঙ্গ -- যাকে বলে ভাইটাল-অর্গান, তাই কয়েক মিনিটের ভিতরেই গুলিবিদ্ধ জৈনের মৃত্যু হয়েছিল বলে তাঁর বিশ্বাস।

মাইতি প্রশ্ন করেন, আপনি যা বললেন তা থেকে বোঝা যাচ্ছে গুলিটা জমির সমান্তরালে যায়নি, ক্রমশঃ উঁচু থেকে নিচু দিকে গিয়েছে। তাই নয়?

-- আজ্ঞে হ্যাঁ।

-- বুকের যেখান দিয়ে ঢুকেছে এবং পিঠের যেখানে আটকেছে এতে গুলিটা কতখানি নেমেছে?

-- পাঁচ সেন্টিমিটার অর্থাৎ প্রায় দু-ইঞ্চি।

এ থেকে কি আপনার ধারণা যে-লোকটা গুলি করেছে, সে মৃত ব্যক্তির চেয়ে উচ্চতায় বেশি?

-- আজ্ঞে হ্যাঁ।

-- আপনার উত্তরের সাধারণ-বোধ্য বৈজ্ঞানিক একটা ব্যাখ্যা দিন --

ডাক্তার সান্যাল মনে হয় এ প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত হয়েই এসেছিলেন। আদালতের অনুমতি নিয়ে তিনি মানব-কঙ্কালের একটি বড় চার্ট পিছনের দেওয়ালে টাঙিয়ে দেবার ব্যবস্থা করলেন। লম্বা একটা লাঠি দিয়ে দেখালেন ঠিক কোন্‌ স্থানে গুলিটা বুকে প্রবেশ করেছে এবং কোন্‌ অস্থিতে আটকে ছিল। উনি বললেন, মানুষে সচরাচর গুলি করে নিজের বুকের সমতলে রিভলভারটা ধরে। ফলে যদি আহত ব্যক্তির ঠিক বুকেই যদি গুলিবিদ্ধ হয় এবং দেখা যায় সেটা ক্রমশঃ নিচের দিকে নেমেছে তবে আন্দাজ করতে পারা যায় হত্যাকারীর উচ্চতা আহতের চেয়ে বেশী ছিল।

-- মিস্টার জৈন-এর উচ্চতা কত ছিল?

-- ঠিক পাঁচ ফুট!

-- আপনার হিসাবমত আততায়ীর উচ্চতা কত হবে?

-- তা ঠিক করে বলা শক্ত। তবে আন্দাজে বলা যায়, সাড়ে পাঁচ ফুটের উপরে তো বটেই।

-- আমার জেরা এখানেই শেষ -- বসে পড়েন মাইতি।

ব্যারিস্টার বাসু জেরা করতে উঠে দাঁড়ালেন। প্রথমেই প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা ডক্টর সানিয়াল -- ঐ যে বললেন, আপনার মতে আততায়ীর উচ্চতা আহত জৈন-এর চেয়ে বেশী ছিল -- এটা আপনার আন্দাজ, বিশ্বাস না স্থির সিদ্ধান্ত?

-- না, স্থির সিদ্ধান্ত নয়, আবার আন্দাজও নয় -- ওটা আমার যুক্তি-নির্ভর অনুমান!

-- আই সী। যুক্তি-নির্ভর অনুমান! কী যুক্তি?

-- তাই তো আমি বোঝালাম এতক্ষণ।

-- আমি বুঝিনি।

-- সেটা আমার দুর্ভাগ্য! আমি চেষ্টার ত্রুটি করিনি।

-- তা বললে তো চলবে না ডঃ সানিয়াল। আপনি মানবদেহ সম্বন্ধে একজন বিশেষজ্ঞ; কিন্তু আমি শারীর-বিদ্যার কিছুই জানি না। আমাদের বোধগম্য ভাষায় আপনাকে বুঝিয়ে দিতে হবে বইকি। আচ্ছা, আমি একে একে প্রশ্ন করি। আমাকে বুঝিয়ে দিন। -- ধরুন গুলি করার মুহূর্তে যদি আততায়ী বা আহতের মধ্যে একজন বসে থাকত অথবা কুঁজো হয়ে দাঁড়াত তাহলে আপনার যুক্তিনির্ভর অনুমানটা টেকে না, কেমন?

-- না, টেকে না।

-- আততায়ী যদি তার নিজের বুকের সমতলে রিভলভারটা না ধরে তাহলেও ও-যুক্তি টেঁকে না? কারেক্ট?

-- ইয়েস!

-- আপনি জানেন যে, আয়রন সেফটায় পৌঁছতে গেলে দুটি ধাপ উঠতে হয়। সেক্ষেত্রে আততায়ী যদি সেই সিঁড়ির উপর থেকে গুলি ছুঁড়ে থাকে তবে বামন হওয়া সত্ত্বে্‌ও গুলি ঐ ভাবে মৃতের দেহে ঢুকতে পারত। অ্যাম আই কারেক্ট!

একটু ইতস্তত করে সাক্ষী বলেন, কারেক্ট!

--তা সত্ত্বেও আপনি মনে করেন আপনার ঐ সিদ্ধান্ত যুক্তি-নির্ভর অনুমান?

-- ও-গুলো তো একসেপশনাল কেসা

-- একসেপশনাল! আপনি তো বিজ্ঞান-শিক্ষিত! পারমু্টেশন কম্বিনেশান অঙ্ক নিশ্চয় কষেছেন! দুজন লোক আছে। একজন আততায়ী একজন আহত; তাদের চারটি অবস্থা হতে শোয়া, বসা, দাঁড়ানো এবং কুঁজো হয়ে দাঁড়ানো। এক্ষেত্রে দুজনের সমান হয়ে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা কত পার্সেন্ট?

মাইতি উঠে দাঁড়ান, অবজেকশান য়োর অনার! সাক্ষী একজন শারীর-বিদ্যা বিশারদ। অঙ্কশাস্ত্রে নন! এ প্রশ্ন অবৈধ!

বাসু-সাহেব বলে ওঠেন, এ প্রশ্নের জবাব দিতে হলে অঙ্কে র‍্যাংলার হবার দরকার নেই৷ ইন্টারমিডিয়টে অঙ্ক না থাকলে ডাক্তারী কলেজে ভর্তি হওয়া যেত না। যে প্রশ্ন আমি করেছি, উনি যখন পাশ করেছেন তখন তা আই. এস সি.-তে কষানো হত। এই রুডিমেন্টাল অঙ্ক উনি ভুলে গিয়ে না থাকলে ওর বলা উচিত, মাত্র 6.25 পার্সেন্ট!

জাস্টিস ভাদুড়ী বলেন, অবজেকশান ওভাররুলড!

সাক্ষী রুমাল দিয়ে মুখটা মুছে বললেন, খাতা পেন্সিল ছাড়া ওটা আমি কষে বার করতে পারব না। তবে মনে হয় শতকরা দশ পার্সেন্টের কম!

-- যে পার্সেন্টেজটা এখন বলছেন, সেটা আপনার আন্দাজ, স্থির সিদ্ধান্ত না যুক্তি-নির্ভর অনুমান?

-- আন্দাজ!

-- ঠিক আছে ! অঙ্কশান্ত্র থাক। ডাক্তারী প্রশ্নেরই জবাব দিন। থোরাসিক অথবা ডর্সাল ভার্টিব্রার সংখ্যা বারোটা -- অ্যাম আই কারেক্ট?

-- ইয়েস।

-- একাদশতম থোরাসিক ভার্টিব্রার অবস্থান প্রায় নাভিকুণ্ডের সম-উচ্চতায়? অ্যাম আই কারেক্ট? -- আমি তখন একাদশতম থোরাসিক ভার্টিব্রার কথা বলিনি, স্পাইনাল কলমের একাদশতম অস্থির --

বাধা দিয়ে বাসু বলেন, আনসার মি! একাদশতম থোরাসিক ভার্টিব্রার অবস্থান প্রায় নাভিকুণ্ডের উচ্চতায়? ইয়েস আর নো?

-- কী আশ্চর্য! আমি তখন --

-- আই আস্ক ফর দ্য থার্ড টাইম--একাদশতম থোরাসিক ভাটিব্রার -- প্রশ্নটা শেষ করতে দেন না সাক্ষী। তার আগেই বলেন, ইয়েস।

-- আহতের বুকে যেখানে গুলি লেগেছে সেখান থেকে তার একাদশতম থোরাসিক অস্থির অবস্থিতি -- সোজা হয়ে দাঁড়ালে -- অন্তত এক ফুট নিচে! ঠিক কথা?

-- কিন্তু আমি তা --

-- বড় বাজে কথা বলছেন আপনি! বলুন --’হ্যাঁ’, না ‘না’!

-- ইয়েস!

-- আপনার যুক্তি-নির্ভর থিয়োরী অনুযায়ী -- অর্থাৎ এ 6.25 পার্সেন্ট সম্ভাবনা যদি কোনক্রমে কার্যকরী হয়, আই মীন দুজনেই যদি খাড়া হয়ে দাঁড়ায় এবং আততায়ী তার বুকের লেভেল থেকে গুলি করে, সে ক্ষেত্রে আততায়ীর উচ্চতা দশ থেকে বারো ফুট হওয়া উচিত? বলুন -- ‘হ্যাঁ’, না ‘না’?

মরিয়া হয়ে সাক্ষী বলেন, আপনি শুধু শুধু ব্যাপারটা গুলিয়ে দিচ্ছেন! আমি একাদশ থোরাসিক ভার্টিব্রার কথা আদৌ বলিনি --

বাসু-সাহেব হাত তুলে সাক্ষীকে থামতে বলেন, জজসাহেবকে বলেন, মহামান্য আদালতকে অনুরোধ করছি, সাক্ষীর জবানবন্দি ঐ অংশ তাঁকে পড়ে শোনানো হোক -- ঐ যেখানে উনি সীসার গোলকটা শব-ব্যবচ্ছেদের সময় পেয়েছেন। -- বাসু-সাহেব বসে পড়েন, রুমাল দিয়ে চশমায় কাঁচটা মোছেন।

বিচারকের অনুমতি অনুসারে কোর্ট পেশকার পড়ে শোনায়, “ফলে দক্ষিণ আর্টিয়াম বিদ্ধ হয় তারপর ঐ সুপিরিয়ার ভেনা কাভাকে ফুটো করে এবং দক্ষিণ পালমোনারি আর্টারিদ্বয়ের উপর দিকের ধমনীটি বিচ্ছিন্ন করে সীসার গোলকটি পিঠের দিকে চলে যায়। শিরদাঁড়ার একাদশতম থোরাসিক ভার্টিব্রাতে আহত হয়ে সেটা হৃদপিন্ড অঞ্চলেই আটকে থাকে।”

জবানবন্দি পাঠ শেষ হতেই তড়াক করে উঠে দাঁড়ান বাসু-সাহেব -- নাউ আনসার মি! আপনার যুক্তি-নির্ভর অনুমান মতো আততায়ীর উচ্চতা দশ থেকে বারো ফুট হওয়া উচিত?

মাইতি আপত্তি জানান, বলেন, সাক্ষী ইতিপূর্বে একাদশ থোরাসিক ভার্টিব্রার কথা মোটেই বলতে চাননি! শিরদাঁড়ার একাদশতম অস্থির কথা বলতে চেয়েছেন। শিরদাঁড়ার উপর দিকের প্রথম সাতটি অস্থি থোরাসিক নয়।

বাসু-সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে বিচারককে বলেন, মাননীয় সহযোগী যদি নিজেকেই বিশেষজ্ঞ হিসাবে দাবী করেন তবে তাঁকেই জেরা করার অনুমতি চাইছি -- on voir dire!

কোর্টে একটা হাস্যরোল ওঠে।

জাস্টিস ভাদুড়ী গম্ভীর হয়ে বলেন, আদালত এসব ব্যঙ্গোক্তি পছন্দ করেন না। কিনতু এক্ষেত্রে ডিফেন্স কাউন্সেলের সঙ্গে আমি একমত। সাক্ষী কী বলতে চান তার ব্যাখ্যা আমরা বাদীপক্ষের উকিলের কাছে শুনতে চাই না, বিশেষজ্ঞ হিসাবে তিনি কী বলেছেন তা আমরা শুনেছি। মিস্টার ডিফেন্স কাউন্সেলার, য়ু মে প্রসীড --

-- আমার আর কিছু জিজ্ঞাস্য নেই। আমি মাননীয় আদালতকে এই সিদ্ধান্তেই আসতে বলব যে সাক্ষী শুধু অঙ্কশাস্ত্র নয়, ডাক্তারী শাস্ত্র বিষয়েও বিশেষজ্ঞ হিসাবে দাবী করতে পারেন না। স্পাইনাল কর্ডের একাদশতম অস্থিকে যিনি অষ্টাদশতম অস্থি বলতে পারেন তাঁর পক্ষে ফার্স্ট এম. বি. পাশ করাও অসম্ভব!

জাস্টিস ভাদুড়ী কঠিনস্বরে বলেন, আদালত কোন্‌ সিদ্ধান্তে আসবেন সেটা আদালতের বিচার্য।

-- আই এগ্রি, মি’ লর্ড! কিন্তু একথাও আমি আদালতকে ভেবে দেখতে বলব যে, বিশেষজ্ঞ হিসাবে সাক্ষী যে বলেছেন আততায়ীয় উচ্চতা পাঁচ ফুটের চেয়ে বেশি তার কোন যুক্তি নেই।

জাস্টিস ভাদুড়ী একটু বিরক্ত হয়েই বলেন, মিস্টার পি. পি.। আপনার পরবর্তী সাক্ষীকে ডাকুন।

পরবর্তী সাক্ষী ব্যালাস্টিক এক্সপার্ট জীতেন বসাক। তিনি তার সাক্ষ্যে এই সত্যই প্রতিষ্ঠিত করলেন যে, এম. পি. জৈনের মৃত্যু হয়েছে যে গুলিতে সেটা .38 বোর রিভলভারের। জৈনের নিজের রিভলভারটি ছিল ঐ বোরের স্যাক্সবি কোম্পানির, তার নম্বর 759362 এবং আসামীর নামে রিজার্ভ করা ক্যুপে থেকে যে রিভলভারটি আবিষ্কৃত হয়েছে সেটারও ঐ বোর এবং ঐ নম্বর অর্থাৎ সেটা জৈনের রিভলভার। রিভলভারটি পিপলস্ একজিবিট হিসাবে চিহ্নিত হল।

বাসু-সাহেব তাকে কোনও প্রশ্ন করলেন না।

প্রদ্যোত নাথ জনান্তিতে তাঁকে বলে, ব্যালাসটিক এক্সপার্টকে ক্রস করবেন না?

বাসু নিম্নস্বরে বললেন, পন্ডশ্রম! লোকটা আদ্যন্ত সত্য কথা বলছে!

পাশে বসেছিলেন এ. কে. রে। তিনি শুধু বললেন, কারেক্ট।

চতুর্থ সাক্ষী জৈনের ক্যাশিয়ার সুকুমার বসু। মাইতির প্রশ্নে সে নিজের নাম, ধাম, পরিচয় দিয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যারাত্রের ঘটনার একটি নিখুঁত বিবরণ দিল। বলল, তিনজন ডাকাতেরই মুখে রুমাল বাঁধা ছিল। তাদের চোখ দেখা যাচ্ছিল। মাইতি প্রশ্ন করেন, যে লোকটা গুলি করেছিল তাকে আপনি দেখেছেন?

-- নিশ্চয়ই! আমার চোখের সামনেই তো সে গুলি করল।

-- তার আকৃতির একটা বর্ণনা দিন।

সাক্ষী আসামীর দিকে তাকিয়ে বললে, উচ্চতা পাঁচফুটি দশ ইঞ্চি হবে; একহারা ফর্সা --

-- ওদিকে কি দেখছেন? যিনি প্রশ্ন করছেন তাঁর দিকে তাকান -- বাধা দেন বাসু-সাহেব!

সাক্ষী থতমত খেয়ে যায়। আসামীর দিকে আর তাকায় না। বলে, বয়স পঁচিশ ছাবিবশ, বড় বড় জুলফি ছিল, চোখে কালো চশমা --

মাইতি ওকে ভরসা দিয়ে বলেন, আমার দিকে কেন? ওদিকেই তাকিয়ে দেখুন। আপনার কি মনে হয়, আততায়ীর চেহারার সঙ্গে আসামীর চেহারার সাদৃশ্য আছে?

-- আছে।

-- কী সাদৃশ্য?

-- দুজনের উচ্চতা এক, বয়স এক, দুজনেই ফর্সা এবং দুজনেরই বড় বড় জুলফি আছে।

-- আপনার কি অনুমান আসামীই সেই আততায়ী?

-- অবজেকশান য়োর অনার! সাক্ষী তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথাই বলতে পারেন। তাঁর অনুমান কোন এভিডেন্স নয়।

মাইতি হেসে বলেন, আচ্ছা আমি প্রশ্নটা অন্যভাবে করছি -- আপনি আততায়ীকে প্রত্যক্ষ করেছেন, আসামীকেও প্রত্যক্ষ করছেন। এখন বলুন, দুজনের আকৃতি কি একই রকম?

-- আজ্ঞে হ্যাঁ!

-- সব চেয়ে বেশী সাদৃশ্য কোথায় লক্ষ্য করছেন?

-- ঐ বড় বড় জুলফি।

-- য়ু মে ক্রস এক্সামিন। বাসুকে অনুমতি দিয়ে আসন গ্রহণ করেন মাইতি।

বাসু প্রথমেই জিজ্ঞাসা করেন। সুকুমারবাবু, আপনার নিজের ‘হাইট’ কত?

প্রথম প্রশ্নেই আপত্তি জানালেন পি. পি.। এ প্রশ্ন নাকি অবৈধ। সাক্ষীর উচ্চতার সঙ্গে মামলার কোন সম্পর্ক নাকি নেই। বাসু জজ-সাহেবকে বললেন, য়োর অনার, সাক্ষীকে দিয়ে বলাতে চাইছি যে, তার নিজের উচ্চতাও ঐ পাঁচ-ফুট দশ ইঞ্চির কাছে, তিনিও একহারা, হোয়াইটেক্স মাখলে তিনিও আসামীর মত ফর্সা হয়ে যাবেন এবং তাঁর নিজেরও বড় বড় জুলফি আছে! অর্থাৎ আসামীর মঞ্চে যদি আসামীর পরিবর্তে একটি প্রমাণ সাইজ আয়না থাকত তাহলেও তাঁর জবাব এক রকমই হত! যাই হোক, সহযোগী যখন আপত্তি করছেন তখন আমি না হয় অন্য প্রশ্ন করছি। বলুন,

সুকুমারবাবু -- আপনি এখনই বলেছেন আসামীকে আততায়ীরূপে চিহ্নিত করবার সবচেয়ে বড় যুক্তি হচ্ছে তার বড় বড় জুলফি। তাই নয়?

-- হ্যাঁ, তাই বলেছি।

-- আপনি কেন অতবড় জুলফি রেখেছেন?

-- অবজেকশান য়োর অনার! ইররেলিভ্যান্ট....

বিচারক বললেন, অবজেকশান সাসটেনড।

বাসু হেসে বলেন, বড় বড় জুলফি রাখা আজকের দিনে একটা ফ্যাসান, তাই নয়?

-- আজ্ঞে হ্যাঁ, তাই তো দেখতে পাই।

-- তাহলে শিকারী বিড়ালকে যেমন গোঁফ দেখে চেনা যায়, মানুষ শিকারীকে তেমনি জুলফি দেখে চেনা যায়, না?

মাইতি আজ পান থেকে চুন খসতে দেবেন না। তড়াক করে উঠে দাঁড়ান আবার। আপত্তি জানিয়ে বলেন, সাক্ষী একথা বলেননি যে, গোঁফ দেখে কিছু চেনা যায়।

বাসু গম্ভীর হয়ে বলেন, না, গোঁফ দেখে চেনার কথা সাক্ষী সুকুমার বোস বলেননি, বলেছিলেন সুকুমার রায়।

মাইতি অবাক হয়ে বলেন, মানে! সুকুমার রায়! তিনি কে?

বাসু গাম্ভীর্য বজায় রেখেই বলেন, না, সুকুমার রায় নিজেও কথা বলেননি। বলেছিলেন তাঁর হেড অফিসের বড়বাবু। বড়বাবুর বদলে ক্যাশিয়ার বরং বলেছেনঃ ‘জুলফির আমি, জুলফির তুমি--তাই নিয়ে যায় চেনা’!

আদালতে হাস্যরোল ওঠে।

জাস্টিস ভাদুড়ী তাঁর হাতুড়ি পিটিয়ে গণ্ডগোল থামালেন। বাসুকে বললেন, আই অ্যাডভাইস দ্য কাউন্সেল নট টু বি ফ্রিভলাস!

বাসু একটি বাও করে বললেন, পার্ডন মি’ লর্ড! আমার মনে আছে, এটা তিনশ দুই ধারার মামলা। কিন্তু বর্তমান সাক্ষী তার সাক্ষ্যকে ক্রমশ ঐ ফ্রিভলিটির পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছেন, -- আমি নাচার। মাননীয় আদালত সমবেত ভদ্রমন্ডলীর দিকে তাকিয়ে প্রণিধান করবেন, এ বয়সের শতকরা চল্লিশজনের বড় বড় জুলপি আছে।

জাস্টিস ভাদুড়ী শুধু বললেন, য়ু বেটার প্রসীড উইথ য়োর ক্রস একজামিনেশনস্‌।

বাসু পুনরায় সাক্ষীকে জেরা শুরু করেনঃ আসামী যখন হাজতে ছিল তখন পুলিস আপনাকে সেখানে নিয়ে গিয়ে দূর থেকে ঐ আসামীকে চিনিয়ে দিয়েছিল। তাই নয়?

-- না তো!

-- আপনি বলতে চান আপনাকে পুলিস আগেভাগে ঐ আসামীকে দেখিয়ে দেয়নি? চিনিয়ে দেয়নি?

-- আজ্ঞে না, কখনও না!

-- কেন বাজে কথা বলছেন? আপনি কি বলতে চান আজ এই আদালতে এসে ঐ কাঠগড়ার লোকটাকে জীবনে প্রথম দেখলেন?

-- নিশ্চয়ই!

-- তাই বলুন। তার মানে দঁড়াচ্ছে গত এগারো তারিখ রাত আটটা নাগাদ ঐ আসামীকে আপনি দেখেননি -- যেহেতু আজই তাকে জীবনে প্রথম দেখলেন। তাই না!

-- না, মানে, আমি সেকথা বলিনি!

-- বলেছেন! আপনি যা বলেছেন তা সঙ্গে সঙ্গে লেখা হয়ে যাচ্ছে। শুনতে চান?

-- না, না, আমি যা বলেছি তার মানে হচ্ছে --

-- মানে হচ্ছে ‘কনক্লুশান’। সেটা আদালত করবেন। আপনি নন।

একটি ‘বাও’ করে বাসু বলেন, থ্যাঙ্কয়ু মি’ লর্ড। আমার আর কিছু জিজ্ঞাসা নেই।

তড়াক করে লাফিয়ে ওঠেন মাইতি। বলেন, পরবর্তী সাক্ষীকে ডাকার আগে আমি বর্তমান সাক্ষীকে রি-ডাইরেক্ট-এক্সামিনেশানে কিছু প্রশ্ন করতে চাই।

-- করুন।

মাইতি বললেন, সুকুমারবাবু, আপনি এইমাত্র বলেন যে, আসামীকে সুপ্রিয় দাশগুপ্তরূপে আজই জীবনে প্রথম দেখলেন --

-- অবজেকশান য়োর অনার! সাক্ষী সে কথা আদৌ বলেননি।

-- বাট হি মেন্ট, ইট! -- ঘুরে দাঁড়ান মাইতি।

জজ-সাহেব নিরাসক্ত কন্ঠে বলেন, আপনার সহযোগী ও-প্রসঙ্গে শেষ কথা বলে দিয়েছেন। সাক্ষী কী বলেছেন আদালত তা শুনেছেন, তার কী অর্থ আদালত তা বুঝে নেবেন। আপনি সরাসরি প্রশ্ন করুন। সাক্ষীর মুখে নিজ অভিপ্রায়মতো শব্দ বসাবেন না।

মাইতির মুখচোখ লাল হয়ে উঠল। সামলে নিয়ে বললেন, সুকুমারবাবু, আপনি কি আসামী সুপ্রিয় দাশগুপ্তের সঙ্গে কখনও টেলিফোনে কথাবার্তা বলেছেন? বলে থাকলে কবে?

-- বলেছি। ঘটনার দিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার, এ বছরের এগারোই এপ্রিল।

-- কখন?

-- বিকাল পাঁচটায়।

-- কী কথা হয়েছিল?

-- উনি টেলিফোনে আমার মালিকের খোঁজ করলেন -- তিনি গদীতে নেই শুনে উনি নিজের নাম আর পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন --

-- জাস্ট এ মিনিট। নিজ নাম আর পরিচয় বলতে?

-- উনি বললেন, উনি সুপ্রিয় দাশগুপ্ত, বোম্বাইয়ের কাপাডিয়া অ্যান্ড কাপাডিয়া কোম্পানির ম্যানেজার। আরও বললেন, মালিক ফিরে এলে আমি যেন তাঁকে জানাই যে, সুপ্রিয়বাবু ফোন করেছিলেন, তিনি পরদিন বেলা এগারোটার সময় হুন্ডিটা নিতে আসবেন।

-- আই সী! হুন্ডিটা! আর কিছু প্রশ্ন করেননি তিনি?

-- আজ্ঞে হ্যাঁ, করেছিলেন। আমি ক্যাশিয়ার বলে পরিচয় দেবার পর উনি জানতে চান, আমার ক্যাশে তখন কত টাকা আছে!

মাইতি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, বলেন কী! আপনার ক্যাশে কত টাকা আছে তা উনি কেন জানতে চাইছেন তা আপনি জিজ্ঞাসা করেননি?

-- করেছিলাম। তাতে উনি বলেন, পরদিন গুডফ্রাইডের ছুটি; ব্যাঙ্ক ভল্ট বন্ধ। তাই জানতে চাইছেন।

-- তার মানে কী?

-- মানে আমি জানি না।

-- দ্যাটসহ অল মি’ লর্ড।--আসন গ্রহণ করেন মাইতি।

বাসু-সাহেব তখন সাক্ষীকে রি-ক্রস-এক্সামিনেশান শুরু করলেনঃ আচ্ছা সুকুমারবাবু, টেলিফোনে যে আপনি আসামীর সঙ্গেই কথা বলেছিলেন সেটা কেমন করে বুঝলেন?

-- উনিই তো তাঁর নাম, ধাম টেলিফোনে বললেন!

-- সে তো টেলিফোনে যে কেউ বলতে পারে। পারে না?

-- পারে।

-- আপনি বলেছেন, আসামীকে আপনি জীবনে কখনও আজকের আগে দেখেননি, কণ্ঠস্বরও শোনেননি নিশ্চয়? শুনেছেন?

-- আজ্ঞে না।

-- তার মানে যে-কেউ আসামীর নাম পরিচয় নিয়ে ও কথা বলতে পারত?

-- তা পারত!

-- তাহলে কেন হলপ নিয়ে বললেন -- আসামী সুপ্রিয় দাশগুপ্তের সঙ্গে আপনি টেলিফোনে কথা বলেছেন?

-- স্যার, আমি ভেবেছিলাম--

-- ভেবেছিলেন! আই সী! -- বসে পড়েন বাসু।

আদালত বেলা আড়াইটা পর্যন্ত বন্ধ রইল। মধ্যাহ্ন বিরতি।

ষষ্ঠ পর্ব

কৌশিক আদালতে যায়নি। বাড়িতেই ছিল। বেলা বারোটা নাগাদ একটা টেলিফোন এল বাসু-সাহেবের অফিসে। ব্যারিস্টার সাহেব অনুপস্থিত শুনে লোকটা সুকৌশলীর কৌশিক মিত্রের সাথে কথা বলতে চাইল। কৌশিকের সঙ্গে তার নিম্নোক্ত কথোপকথন হল --

-- আপনি কি সুকৌশলীর মিস্টার কৌশিক মিত্র আছেন?

কৌশিক ওর খাজা বাংলা শুনে বললে, আছি। আপনি কে?

-- আমার নাম আছে যদুপতি সিঙ্ঘানিয়া। নামটা পহচানতে পারেন?

-- পারি। আপনি গত এগারো তারিখে কাপাডিয়া আ্যান্ড কাপাডিয়া কোম্পানির একটা বাড়ি সাড়ে ছয় লাখ টাকায় কিনেছেন।

-- দু-দুটো টেকনিক্যাল গলতি হইয়ে গেল, সুকৌশলী দাদা। সাড়ে ছয় না আছে, সাড়ে চার লাখ, ঔর বাড়ির মালিক কাপাডিয়া কোম্পানি না আছে। মালিকের খাস সম্পত্তি ছিল। আর শুনেন -- যো মামলাটা বাসু-সাহেব হাতে নিয়েছেন, আই মীন সুপরিও দাশগুপ্তের মামলা --এটার বিষয়ে কুছ্ জরুরী টিপস্‌ আমি বাসু-সাহেবকে দিতে চাই। তা বাসু-সাহেব তো দফতরে না-আছেন না? তাই আপনাকে বাৎলিয়ে দিচ্ছি। অগর জবুরৎ হোয় তো ফিন লিখিয়ে নিন --

কিন্তু আপনিই যে মিস্টার যদুপতি সিঙ্ঘানিয়া তা আমি বুঝব কী করে? আপনি বাড়ি থেকে বলছেন তো! লাইন কেটে দিয়ে অপেক্ষা করুন। আমি এখনই আপনার বাড়িতে ফোন করছি --

টেলিফোনে খুকখুক করে হাসির শব্দ ভেসে এল। লোকটা বললে, সুকৌশলী দাদা। আমি ভি কুছুকুছু সুকৌশলী আছি। আমি একটা পাবলিক বুথ থিকে টেলিফোন করছি. ঘর থিকে নয়। লেকিন আমি আপনার বাৎ মানিয়ে নিলাম -- আমি যে, জেনুইন যদুপতি আছি, সিটা প্রমাণ করার ‘ওনাস’ আমার আছে। একটা কোড-নাম্বার বাতলাচ্ছি, লিখে নিন --795630। . ..লিখেছেন? আমার সঙ্গে বাতচিতের পিছে আপনি হামার বাড়িতে হামার ‘ফাদার’কে ফোন করবেন। তিনি এ কোড-নম্বরটা বাৎলিয়ে দেবেন। ব্যস! আমার আইডেন্টিটি ইস্টাবলিশ হইয়ে যাবে। সমঝলেন?

কৌশিক অবাক হয়ে বলে, এমন কাণ্ড করার অর্থ?

লোকটা হেসে ধললে, আগর বাসু-সাহেব হলে এ বাৎ পুছতেন না। সমঝিয়ে নিতেন। মালুম হল না?...এ মামলার ফয়সালা যবতক না হচ্ছে তবতক্ আমি শালা ছিপিয়ে থাকব। আমার পাত্তা মিলে গেলেই বাসু-সাহেব আমাকে ‘নেওতা’ করে বসবেন --

-- নেওতা! মানে নিমন্ত্রণ! কিসের?

-- কোর্টের ‘সমন’, সুকৌশলী দাদা! ব্যস! খতম! শালার আদালতে উঠলেই আমাকে কবুল খেতে হবে কি আমি দো-লাখ রূপেয়া ব্ল্যাক-মানি সুপারিও বাবুকে দিয়েছি! কবুল খেলে ইনকাম ট্যাক্সে ফাঁসব!...হর্নস অব এ ডাইনামো সমঝেন?

-- হর্নস্‌ অব এ ভায়নামো!

-- জী হাঁ! ডাইনামো ভি চার্জ নিচ্ছে না. ব্যাটারি ভি ডিসচার্জড! আমার এ হাল! তাই ছিপিয়ে বসে আছি!

ইংরাজি জ্ঞান যেমনই হ’ক লোকটা যে খলিফা এটা বোঝা গেল। কৌশিক বললে, তাহলে নিজে থেকে টেলিফোন করছেন কেন?

-- সিটা কেমন করে আপনাকে সমঝাই সুকৌশলীদাদা? আমার গলায় যে মছলির কাঁটা বিঁধিয়ে গেল। হর্নস্‌ অব এ ডাইনামো -- শালার কাঁটা না নামছে না উগড়াচ্ছে!

-- মাছের কাঁটা; সেটা আবার কী?

আপনি বাংগালি আছেন, ফির ‘মাছের কাঁটা’ বুঝেন না?...আপনার ক্লায়েন্ট শালা সাচ্চা মাল আছে। এমন ইমানদার বুড়বক আমি জিন্দগিভর দু’টি দেখি নাই; শালা যদি খালাস পায় ঔর কাপাডিয়া কোম্পানি যদি ওকে বরখাস্ত করে তবে এ শালা ইমানদার বুড়বককে আমি দেড়া মাইন দিয়ে আমার ম্যানেজার বানিয়ে দিব!

কৌশিক হেসে ফেলে, এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না কি মিস্টার...?

লোকটা গম্ভীরস্বরে বললে, জী নেহি! তাহলে সেই কোথাই শুনাইঃ মোহনস্বরূপ কাপাডিয়া তাঁর ম্যানেজারকে সিরফ স্পেশাল পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দেননি -- দরটা ফাইনাল করবার এক্তিয়ারও দিয়েছিলেন। মোহনস্বরূপজী লেনদেনটা খুব গোপন রাখতে চেয়েছিলেন -- আমি জানি, চার লাখ টাকাতে তিনি ক্লোজ ডাউন করতেন। লেকিন তা হতে পারেনি এ শালা ইমানদার বুড়বকটার জন্য। সে কলকাতা বাজারে যাচাই করে সমঝে নিয়েছিল কি হোয়াইট মানিতে সাত লাখ দর উঠবে। আমি তখন এ ম্যানেজারকে সিধা অফার দিয়েছিলাম কি সে যদি ভাও কমিয়ে দেয় তবে টুয়েন্টি ফাইভ পার্সেন্ট কমিশন দিব। লোকটা এত বড় বুড়বক্‌ যে, রাজী হল না! আমি দাদা নাকতক্‌ কালোটাকায় ডুবে আছি,

লেকিন এসব বুড়বকের জন্য আজও আমি মাথার টুপি খুলি। সমঝলেন?

-- বলে যান। আমি শুনছি --

-- আদালতে দাঁড়িয়ে আমি এজাহার দিতে সেকব না; লেকিন ঐ জান-কবুল বুড়বকটাকে বাঁচাবার জন্য আমি তৈয়ার; কাপাডিয়া কোম্পানি যদি মামলা খরচ না দেয় তবে আমি এ মামলা চালাতে প্রস্তুত --

-- কালো টাকায়?

-- সে বাৎ পুছিয়ে কেন লজ্জা দিচ্ছেন দাদা! বাসু-সাহেবকে আমার নাম বাতাবেন।

-- কিন্তু বাসু-সাহের আপনার পাত্তা পাবেন কেমন করে?

-- ঐ তো মুশকিল আছে দাদা। তো ঠিক হ্যায়, আমি ফিন রাত আট বাজে ফোন করব।

-- তার আগে আমার কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দিন তো? প্রথম কথা, গত বৃহস্পতিবার, আই মীন এগারোই এপ্রিল রাত্রে আপনারা তিনজনে মোকাম্বোতে খেয়েছিলেন?

-- তিনজন না আছে দাদা, দু’জন। আমি আর ঐ সুপারিও দাশগুপ্তা। রাত সাড়ে সাত বাজে মোকাম্বোতে ঘুষেছিলাম, সাড়ে নও বাজে নিকলে আসি। জৈনসাব যখন বড়বাজারে ফৌত হল তখন সুপারিও শালা আমার সামনে বসে মুরগির টেংরি চুষছে! আপন গড!

-- সেখানে ঐ ক্যাশিয়ার জীবন বিশ্বাস ছিল না?

-- সুকৌশলীদাদা --

-- আমার নাম সুকৌশলী নয়, কৌশিক --

-- একই বাৎ আছে দাদা। লেকিন এটা তো মানবেন কি ঐ গন্দাকামিজ পিনহেবালা বিশ্ওয়াসবাবুকে, নিয়ে আমি মোকাম্বোতে ঘুষবো না? সে পান খেতে চেয়েছিল, তাকে পান-শ’ রূপেয়ার পান খাইয়েছি। ‘পান খাওয়া’ সমঝেন?

কৌশিক বলে, আর একটা কথা বলুন তো? ওরা ঐ বাড়তি দু’লাখ টাকা কী ভাবে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেছিল?

-- কালোটাকার লেন-দেন কী ভাবে হয় আপনি জানেন না সুকৌশলীদাদা? হুন্ডি! হুন্ডির চোরা গলিতে। আমি খোদ ইন্তাজাম করে দিয়েছিলাম। জৈনসাব এর হুন্ডি দিত। লেকিন তার আগেই লোকটা ফৌত হইয়ে গেল। ইমানদার বেওকুফটা রোডে সিট-ডাউন হইয়ে গেল!

-- কৌশিক ধমক দিয়ে ওঠে, বার বার লোকটাকে ইমানদার বেওকুফ বলছেন, সেই ইমানদার লোকটাকে ফাঁসির দড়ি থেকে বাঁচানোর জন্যে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াবার সাহস আপনার নেই?

-- দাদা! দো-লাখ রূপিয়ার ঝামেলা আছে। আমি বিলকুল গড্ডায় গিরে যাব --

-- তবে ফোন করছেন কেন?

-- ওহি তো বাতাচ্ছি! হর্ন অব এ ডাইনামো! ইদিকে আই.টি.ও. উদিকে মছলির কাঁটা

-- কৌশিক উত্তেজিত হয়ে বলে, আপনি কী মশাই? আপনি....আপনি একটা --

কথাটা তার শেষ হয় না। যদুপতি বলে ওঠে, সুকৌশলীদাদা! এখন আপনি আমাকে শালা-বাহানচোৎ শুরু করবেন। আমি লাইন কাটিয়ে দিলাম...

সত্যই সে টেলিফোনের লাইনটা কেটে দিল।

স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল কৌশিক। যদুপতি সিঙ্ঘানিয়ার চরিত্রটাকে বুঝবার চেষ্টা করল। লোকটা নিজেই স্বীকার করছে তার নাক পর্যন্ত ডুবে আছে কালো টাকায়।তাহলে ‘মাছের কাঁটা’ বলতে সে কী বোঝাতে চায়? কোথায় বাধছে তার এ কাঁটাটা? বিবেক? বিবেক বলে এ জাতীয় লোকের সত্যই কিছু থাকে না কি?

একটু পরে সে টেলিফোন ডাইরেক্টারি হাতড়ে ফোন করল যদুপতির বাবা রঘুপতি সিঙ্ঘানিয়াকে। বাপ ছেলের মত বাংলা বলতে পারেন না। কৌশিক যেইমাত্র বলল যে, সে ব্যারিস্টার বাসুর বাড়ি থেকে ফোন করছে, ভদ্রলোক তৎক্ষণাৎ বললেন, তব ঠাহরিয়ে!

মিনিটখানেক টেলিফোনে আর মনুষ্যকন্ঠ শোনা গেল না। ক্ষীণ সুরে বিবিধ-ভারতীর হিন্দী প্রোগ্রামের গানের সঙ্গে একটা অ্যালেসেশিয়ানের গর্জন ভেসে এল শুধু। তারপর শুনলঃ অব শুনিয়ে! ম্যায় রঘুপতি সিঙ্ঘানিয়া বোলতা হুঁ। মুঝকো কহনে কা মতলব ইয়ে হ্যায় কি সেবুন-নাইন-ফাইভ-সিকস্‌-থিরি উর ইয়ে ক্যা হ্যায়? জিরো হোগা সায়েদ্‌! রাম রাম....

লাইন কেটে দিলেন রঘুপতি।

কিন্তু কৌশিক ছাড়বার পাত্র নয়। পুনরায় ফোন করল সে। এবার বৃদ্ধ সিঙ্ঘানিয়া সিংহমূর্তি ধরলেন। অনর্গল মাতৃভাষায় যে ঝড় বইয়ে দিলেন তার নিগলিতার্থঃ তিনি এ ব্যাপারে বিন্দুবিসর্গ জানেন না। তাঁর পুত্রের নির্দেশ আছে, ব্যারিস্টার বাসুর ফোন এলে এ অদ্ভূত নাম্বারটা তাকে শুধু শুনিয়ে দিতে হবে। কেন, কী বৃত্তান্ত তিনি কিছুই জানেন না। এ সঙ্গে আরও বললেন -- এসব হচ্ছে এ ‘জিরো-জিরো-সেবুন’ মার্কা পিকচারের কুফল! তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র বর্তমানে জেমস্‌ বন্ডের ভূমিকায় না-পাত্তা হয়ে গেছেন। ফলে তাঁর মন-মেজাজ খারাপ। নিজেকেই গদিতে বসতে হচ্ছে! তাঁকে যেন এ নিয়ে আর বিরক্ত করা না হয়। পুনরায় রাম-নামের দ্বিত্বপ্রয়োগান্তে তিনি দূরভাষণে ক্ষান্ত হলেন।

কৌশিক ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল। বেলা বারোটা। এখনই বার হলে মধ্যাহ্ন-অবকাশের মধ্যে বাসু-সাহেবকে খবরগুলো জানানো খায়। সে তৎক্ষণাৎ একটা ট্যাক্সি নিয়ে আদালতের দিকে রওনা দেয়।

শেষাংশ পড়ুন..

No comments:

Post a Comment