মাছের কাঁটা
সপ্তম পর্ব
আদালতের অধিবেশন শুরু হওয়ার আগেই কৌশিকের সঙ্গে বাসু-সাহেবের দেখা হল। ওর কাছে আদ্যোপান্ত শুনে উনি তখনই গিয়ে দেখা করলেন আসামী সুপ্রিয়র সঙ্গে। বললেন, তুমি কি সখ করে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে চাও?
লোকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল।
-- এগারো তারিখ রাত্রে মোকাম্বোতে তুমি আর যদুপতি খেতে গিয়েছিলে -- তাহলে কেন বললে জীবন বিশ্বাসও তোমাদের সঙ্গে ছিল।
-- সুপ্রিয় চোখটা নিচু করে বলল, জীবনই এ পরামর্শ দিয়েছিল। বলেছিল, যদুপতি কিছুতেই সাক্ষী দিতে আসবে না। জীবন ছাড়া আর কে আমার আ্যালিবাইটা প্রতিষ্ঠিত করবে?
-- তাই বলে তোমাদের কাউন্সেলকেও তোমরা জানাবে না যে, মিথ্যে সাক্ষী দিচ্ছ?
-- আমি জানতাম আপনি এতে রাজী হবেন না!
-- হব না তো বটেই: জীবনকে নতুন করে তালিম দিতে হবে; তাছাড়া ঐ সুকুমারের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছিলে? সেটা এতক্ষণ স্বীকার করনি কেন?
সুপ্রিয় মাথা নিচু করে বসে রইল।
-- ওর ক্যাশে কত টাকা আছে তা টেলিফোনে জানতে চেয়েছিলে?
মাথা নেড়ে সায় দিল সুপ্রিয়। অস্ফুটে বলল, পরদিন ছিল গুডফ্রাইডের ছুটি। ব্যাঙ্কের ভল্ট বন্ধ সেই অজুহাতে দু’-লাখ টাকা নগদ নিতে জৈন-সাহেব রাজী হবে না আমার এই আশঙ্কা ছিল। অথচ ঐ গুডফ্রাইডের রাতের ট্রেনেই আমাদের টিকিট কাটা ছিল। তার উপর যদি জৈন-সাহেবের কাছে আগে থেকেই মোটা টাকা থেকে থাকে তাহলে ছুটির দিন তিন হয়তো মুশকিলে পড়েন। তাই আমি জানতে চেয়েছিলাম।
বাসু-সাহেব ধমকে ওঠেন, বেশ করেছিলে! কিন্তু আমাকে বলনি কেন?
সুপ্রিয় অধোবদনে বসেই রইল।
-- বোম্বাইয়ে তোমার স্ত্রীকে চিঠি লিখেছ?
নেতিবাচক শিরশ্চালন করল সুপ্রিয়।
-- তোমার স্ত্রী আজ-কালের মধ্যেই আসছে।
একেবারে শিউরে উঠল সুপ্রিয়, সর্বনাশ! তার নাম-ঠিকানা কেমন করে পেলেন আপনি?
-- সেটা পরের কথা। সর্বনাশ কেন?
-- ও ভয়ানক নার্ভাস! সে আপনি বুঝবেন না। জীবনকে একবার আমার কাছে আনতে পারবেন?
বাসু-সাহেব বললেন, অসম্ভব! তোমার উকিল ছাড়া আর কারও সঙ্গে এ অবস্থায় তোমাকে দেখা করতে দেবে না। তোমার স্ত্রী এলে, হয়তো দিতে পারে।
ঠিক এই সময়েই প্রহরী এসে জানালো -- আদালত এবার বসবে। বাসু-সাহেব ফিরে এলেন। কোর্টে গিয়ে বসলেন। প্রদ্যোৎকে বললেন, জীবনকে ডাক তো?
জীবন গরুড়পক্ষীর মত হাত দুটি জোড় করে এসে দাঁড়ায়। বাসু বলেন, তোমাকে এখনই সাক্ষী দিতে ডাকব। মোকাম্বোতে তুমি ঐ রাত্রে সুপ্রিয়র সঙ্গে খেয়েছ এ মিথ্যা কথা বলবে না, বুঝলে?
মাথা চুলকে জীবন বলে, ঐটেই আমাদের একমাত্র ভরসা স্যার! অকাট্য অ্যালিবাই!
ধমক দিয়ে ওঠেন বাসু, বেশি পণ্ডিতেমি কর না। মিথ্যে সাক্ষী তোমাকে দিতে হবে না।
-- কিন্তু স্যার আমি যে থানায় গিয়ে এজাহার দিয়ে বসে আছি।
-- সেটা অন্য জিনিস। থানায় মিথ্যে এজাহার দেওয়া, আর আদালতে হলপ নিয়ে মিথ্যে সাক্ষ্য দেওয়া সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস।
জীবনবাবু বলে, আপনি মিছে ডরাচ্ছেন স্যার। এ মাইতির বাবার ক্ষমতা হবে না -- জেরায় আমাকে কাৎ করে! আমি মোকাম্বোতে ঢুকে সব খুঁটিয়ে দেখে এসেছি কাল সন্ধ্যাবেলায়। বাসু-সাহেব আর কিছু বলবার সুযোগ পেলেন না। জাস্টিস ভাদুড়ী পুনরায় বিচারারম্ভ ঘোষণা করলেন। বাদীপক্ষের সাক্ষ্য নেওয়া শেষ হয়নি। সাক্ষ্য দিতে উঠলেন ইস্টার্ন রেলওয়ের স্টাফ -- বোম্বাই মেল-এর কন্ডাকটার-গার্ড হেমন্ত মজুমদার। মাইতি সাহেবের প্রশ্নে তিনি গুডফ্রাইডের সন্ধ্যায় বোম্বাই মেল-এ সি-নং কুপেতে যে ঘটনা ঘটেছিল তার আনুপূর্বিক বর্ণনা দিলেন। সুজাতা ফিরে এসে যা বলেছিল হুবহু তাই।
বাসু তাঁকে কোন জেরা করলেন না।
পরবর্তী সাক্ষী নেপালচন্দ্র বসু। জি.আর.পি-র ইন্সপেক্টার। তিনিও তাঁর সাক্ষ্যে ঐ ঘটনার পাদপূরণ করলেন। বাসু-সাহেব তাঁকে ক্রস এগজামিনে প্রশ্ন করলেন, মিস্টার বোস, আপনি যখন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ব্যাগটা আপনার?’ আর আসামী বলল, ‘হুঁ’, তখন সে কি ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে দেখেছিল?
-- না, দেখেনি, কিন্তু তার পূর্বমুহূর্তে যখন সুজাতা বললেন, ও ব্যাগটা আমার নয়, তখন সে ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে ছিল।
-- আপনার কি মনে হয় কি মনে হয় সেটা ‘ভেকেন্ট লুক’ -- মানে সে অন্য কথা ভাবতে ভাবতে ঐদিকে তাকিয়ে ছিল?
-- অবজেকশান! সাক্ষী কি মনে করেছিল তা আমরা শুনতে চাই না। -- মাইতির কন্ঠস্বর।
-- অবজেকশান সাসটেন্ড -- জজসাহেবেব নির্দেশ।
-- বেশ, দ্বিতীয়বার যখন আপনি প্রশ্ন করেন তখন ও অস্বীকার করেছিল? বলেছিল, ব্যাগটা ওর নয়?
-- হ্যাঁ, তাই বলেছিল।
-- তখনও তো আপনি রিভলভারটা ব্যাগ থেকে বার করে দেখাননি?
-- না।
-- তার মানে আসামী তখনও জানত না কে, ব্যাগের ভিতর কী আছে?
-- তা কেন? আপনি ধরে নিচ্ছেন কেন যে, ব্যাগটা সে নিজেই সঙ্গে করে আনেনি?
-- আপনি কি তাই ধরে নিতে চান?
-- কেন নয়?
-- ‘কেন নয়’ আমার প্রশ্নের জবাব নয়। আমার প্রশ্ন ‘আপনি কি তাই ধরে নিতে চান’, ইয়েস অর নো?
-- ইয়েস!
-- আপনি কি এখনই এটা ভাবছেন, না প্রথম থেকেই ওটা ধরে নিয়েছেন?
-- প্রথম থেকেই!
-- তাই বলুন। তার মানে ব্যাগটা যে আসামীর এই রকম একটা পূর্বসিদ্ধান্ত প্রথম থেকে ধরে নিয়ে আপনি সাক্ষী দিতে এসেছেন? যা দেখেছেন তা বলছেন না, যা আপনার প্রথম থেকে ধরে নেওয়া পূর্ব-সিদ্ধান্তের সঙ্গে মিলে যায় তাই সাক্ষী দিচ্ছেন।
-- কী আশ্চর্য! আমি কি তাই বলেছি?
আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনি ঠিক তাই বলেছেন। দ্যাটস্ অল মি লর্ড!
সরকার পক্ষের সাক্ষী এখানেই শেষ।
প্রতিবাদী পক্ষের প্রথম সাক্ষী মিসেস্ সুজাতা মিত্র।
হলপ নিয়ে সাক্ষ্য দিতে উঠল সুজাতা। বাসু-সাহেব প্রশ্নের মাধ্যমে প্রমাণ করলেন, সুজাতাই সি-চিহ্নিত ক্যুপেতে প্রথম প্রবেশ করে। বন্ধ দরজা খুলেই সে দেখতে পায় একজন স্যুটপরা ভদ্রলোককে। তার সঙ্গে সুজাতার কী কথা হয়েছিল তা নথিবদ্ধ করা হল। ভদ্রলোকের চলে যাওয়ার সময় ব্যাগ রেখে যাওয়ার কথাও সুজাতা বলল এবং বলল -- সুপ্রিয় কামরায় করেছিল, ব্যাগটা আপনার?
মাইতি জেরা করতে উঠলেন। তাঁর প্রথম প্রশ্ন, আপনি কোথায় থাকেন সুজাতা দেবী?
সুজাতা তার ঠিকানা দিল।
-- ঐ বাড়িতে এ মামলার প্রতিবাদী বারিস্টার পি.কে.বাসুও থাকেন না?
-- হ্যাঁ, থাকেন।
-- আপনি যে ডিটেকটিভ প্রতিষ্ঠানের পার্টনার তার সঙ্গে ঐ ব্যারিস্টার সাহেবের একটা পার্সেন্টেজ ব্যবস্থা আছে, না? কমিশনের ব্যবস্থা?
-- আছে!
-- অর্থাৎ এ মামলায় বাসু-সাহেব যা ফি পাবেন তার একটা অংশ আপনারও জুটবে. কেমন?
সুজাতার মুখটা লাল হয়ে ওঠে।
-- বলুন, বলুন, লজ্জা পাচ্ছেন কেন? এ মামলা বাবদ কমিশন পাবেন না?
-- পাব।
-- তার মানে এ মামলায় বাসু-সাহেব জিতুন এই আপনি চান?
-- না। আমি চাই সত্যের জয় হোক!
-- চমৎকার। আর্থিক লোকসান করেও?
-- ওঁর় কেস জেতা-হারার সঙ্গে আমাদের কমিশনের কোনও সম্পর্ক নেই। উনি ‘স্পেসিফিক জব দেন, ‘স্পেসিফায়েড ফি’ দেন। হারলেও দেন, জিতলেও দেন।
-- তাই বুঝি? আচ্ছা সুজাতা দেবী আপনি নিজে কখনও ঐ 320-ধারায় আসামী হয়েছিলেন? খুনের মামলায়?
-- না।
-- না? কিন্তু আমি যদি প্রমাণ করতে পারি --
-- উকিল হিসাবে আপনার জানা উচিত সে-ক্ষেত্রে আপনি আমার বিরুদ্ধে পার্জারির মামলা আনতে পারেন। আপনার আরও জানা উচিত আদালতের বাইরে ওকথা বললে আপনার বিরুদ্ধে আমি মানহানির মামলা আনতে পারি -- সুজাতার দৃপ্ত জবাব।
মাইতি চোখ থেকে চশমাটা খুললেন। প্রতিটি শব্দ স্পষ্ট উচ্চারণ করে বললেন, রামচন্দ্রপুরের ময়ুরকেতন আগরওয়াল হত্যা-মামলার আপনি খুনের মামলায় আসামী ছিলেন না?
-- না! আমার বিরুদ্ধে কোন চার্জ ফ্রেম করার আগেই প্রকৃত অপরাধী ধরা পড়ে। আমার বিরুদ্ধে খুনের মামলা তো ছাড়, আদৌ কোনও চার্জ ফ্রেম করা হয়নি!
-- কিন্তু আপনি গ্রেপ্তার হরেছিলেন তো?
-- বাসু-সাহেব উঠে দাড়ান, এনাফ অব ইট! অবজেকশান য়োর অনার। এ-সব প্রশ্নের সঙ্গে বর্তমান মামলার কোন সম্পর্ক নেই৷ অনেক আগেই আমি আপত্তি করতাম -- করিনি এজন্য যে, ভেবেছিলাম -- মাননীয় সহযোগীর যে-কোনও মুহুর্তে মনে পড়ে যাবে যে, সে মামলার প্রকৃত আসামীকে গ্রেপ্তার না করে তিনি ক্রমাগত রাম-শ্যাম-যদুকে কাঠগড়ায় তুলেছিলেন। উনি সাক্ষীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন -- ‘লজ্জা পাচ্ছেন কেন?’ তাই ভেবেছিলাম, সে-সব কথা মনে পড়ে গেলে উনি নিজেই লজ্জায় থেমে যাবেন। কিন্তু উনি থামছেন না মি’ লর্ড!
জাস্টিস ভাদুড়ী সংক্ষেপে শুধু বলেন, অবজেকশান সাসটেন্ড। আপনি অন্য প্রশ্ন করুন।
-- আমার আর কিছু জিজ্ঞাস্য নেই -- বসে পড়েন নিরঞ্জন মাইতি।
এরপর সাক্ষী দিতে এলেন জীবন ঝিশ্বাস।
এগারো তারিখের প্রসঙ্গ আসামাত্র সে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জানিয়ে দিল ঐ দিন সন্ধ্যায় সে, আসামী এবং তৃতীয় একজনের সঙ্গে মোকাম্বোতে নৈশ-আহার করেছে।
বাসু-সাহেবের মুখচোখ রাগে লাল হয়ে উঠল। তিনি তৎক্ষণাৎ সওয়াল বন্ধ কয়ে বললেন, ‘দ্যাটস্ অল মি লর্ড ।
মাইতি ডাইরেক্ট এভিডেন্সের সূত্রটি ভুলে নিয়ে বললেন, জীবনে কতবার মোকাম্বোতে খেয়েছেন, জীবনবাবু?
-- ঐ একবারই স্যার।
-- ঐ এগারোই তারিখে রাত্রেই, জীবনে একবার?
-- আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার।
-- তার পরে গতকাল আপনি মোকাম্বোতে যাননি? সন্ধ্যা সাতটা পাঁচে?
জীবনবাবুর চোয়ালের নিম্নাংশটা ঝুলে পড়ে।
-- বলুন, বলুন -- আমি আপনার টনসিল দেখতে চাইছি না।
কোর্টে হাস্যরোল উঠল।
ঢোক গিলে জীবন বিশ্বাস বলে, গিয়েছিলাম স্যার।
কেন গিয়েছিলেন? হোটেলের ভিতরটা দেখে আসতে? যাতে জেরায় আপনার এ অ্যালিবাইটা ফেঁসে না যায়?
সামলে নিয়েছে জীবন। বললে, আজ্ঞে না, আমি দেখতে গিয়েছিলাম যদুপতি সিঙ্ঘানিয়া ওখানে আছেন কিনা। সেই মর্মে একটা খবর পেয়েছিলাম।
-- তাই বুঝি। তাহলে মিথ্যা কথা বললেন কেন? জীবনে একবার মাত্র মোকাম্বোতে গিয়েছিলেন।
জীবন বলে, আপনি আমার মুখে নিজের ইচ্ছে মত কথা বসাবেন না সার।
ভ্রূকুঞ্চিত করে মাইতি বলেন, তার মানে! আপনি ও কথা বলেননি?
জীবন এতক্ষণে বেশ সহজ হয়েছে। বললে, আজ্ঞে না। আপনি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘জীবনে কতবার মোকাম্বোতে খেয়েছেন, জীবনবাবু?’ তাতে আমি বলেছিলাম, ‘ঐ একবারই স্যার’। কাল সন্ধ্যায় আমি মোকাম্বোতে খাইনি কিন্তু!
একটা মোক্ষম আন্ডারকাট সাক্ষী অতি সুন্দরভাবে এড়িয়ে গেল সেটা এতক্ষণে অনুধাবন করলেন নিরঞ্জন মাইতি। জীবন বিশ্বাসের পিছনে টিকটিকি লাগিয়ে এমন সুন্দর একটা সূত্র আবিষ্কার করলেন, কিন্তু লোকটা পিছলে গেল। জীবন হাসি-হাসি মুখে বললে, আমিও স্যার আপনার টনসিল দেখতে চাইছি না। বিশ্বাস না হয় পেশকারবাবুকে শুধোন!
প্রচণ্ড হাস্যরোল উঠল আদালতে।
জোরে হাতুড়িটা ঠুকলেন জাস্টিস্ ভাদুড়ী। দর্শকদের দিকে ফিরে বললেন, আপনারা যদি আদালতের কাজে বাধা দেন তাহলে আমি আদালত ফাঁকা করে দিতে বাধ্য হব।
তৎক্ষণাৎ নিস্তব্ধতা ফিরে এল কোর্ট-রুমে। সাক্ষীর দিকে ফিরে জাস্টিস্ বললেন, আপনি বাজে কথা বলবেন না একদম।
হাত দুটি জোড় করে জীবন বিশ্বাস বললে, টনসিলের কথাটা কিন্তু হুজুর আমি আগে তুলিনি।
-- স্টপ ইট! য়ু মে প্রসীড।
মাইতি পুনরায় শুরু করেন, কী খেয়েছিলেন আপনারা?
-- বিরিয়ানি পোলাও, তন্দুরি চিকেন, ফ্রায়েড প্রন, সুইট অ্যান্ড সাওয়ার। ও ভুলে গেছি স্যার-তার আগে আমি খেয়েছিলাম চিকেন সুপ আর ডিনার রোল। সব শেষে কুলফি।
সবাই তাই খেয়েছিলেন।
-- আজ্ঞে হ্যাঁ, ভাগ করে। ওঁরা দুজন সুপ খাননি।
-- ড্রিংকস্ নেননি?
মাথা চুলকে জীবন বিশ্বাস বললে, আজ্ঞে আমি খাইনি স্যার। ছাপোষা মানুষ, ওসব আমার পোষায় না। আমি সুপ খেয়েছিলাম শুধু।
-- আর ওরা দুজন?
-- ওরা এক এক পেগ চড়িয়ে ছিলেন!
বাসু-সাহেব দাঁতে দাঁতে চেপে বললেন, ঈডিয়ট!
মাইতিও স্বাভাবিকতা ফিরে পেয়েছেন। বড়শি-ছেঁড়া মাছটা আবার টোপ গিলেছে। এখন খেলিয়ে তুলতে হবে। বললেন, মাত্র এক এক পেগ?
-- আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার!
-- কী খেয়েছিলেন ওঁরা জানেন? না কি মদের নামও জানেন না আপনি?
প্রদ্যোত বাসু-সাহেবের কানে কানে বললে -- অবজেকশান দিন! মামলার সঙ্গে এসবের কী সম্পর্ক?
বাসু-সাহেব বললেন, ও আমার মক্কেল নয়! লোকটা আত্মহত্যা করছে। করুক, আমার কী?
ব্যারিস্টার রে-সাহেব অস্ফুটে বললেন, ট্রু!
-- কেন? বে-ফাঁস কী বলল ও?-- প্রশ্ন করে প্রদ্যোৎ।
ব্যারিস্টার রে অস্ফূটে বললেন, ডোঞ্চু ফলো ইয়াং ম্যান? ঘটনাটা গুডফ্রাইডের আগের সন্ধ্যা।
প্রদ্যোত হালে পানি পায় না। ওদিকে আরও কয়েকটি প্রশ্নোত্তর হয়ে গেছে মাইতি তখন জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কী করে বুঝলেন ইনি ব্ল্যাকনাইট হুইস্কি খেলেন, আর উনি জিন-উইথ-লাইম? একটু পরখ করে দেখেছিলেন নাকি?
জীবন বিশ্বাস একগাল হেসে বললে, আজ্ঞে না স্যার! আমার সামনে অর্ডার দিলেন, বিল মেটালেন, আমি জানব না?
-- তা তো বটেই। তাহলে আপনি নিঃসন্দেহ যে, আসামী সে-রাত্রে জিন-উইথ-লাইম আর মিস্টার যদুপতি সিঙ্ঘানিয়া ব্ল্যাক নাইট হুইস্কি খেয়েছিলেন?
-- আজ্ঞে হ্যাঁ।
মাইতি হেসে বলেন, এবার বলুন তো বিশ্বাস মশাই, ‘পার্জারি’ মানে কী?
-- আজ্ঞে আমি জানি না। জোলাপ নেওয়া বোধহয়।
-- কিন্তু এটা তো জানেন যে, সেটা ছিল গুডফ্রাইডের আগের সন্ধ্যা।
-- আজ্ঞে, হ্যাঁ। তা জানি বইকি।
-- সেদিন কি বার ছিল?
-- বৃহস্পতিবার।
-- ক’লকাতার কোন খানদানি দোকানে বৃহস্পতিবার মদ বিক্রি হয়?
টনসিলের প্রশ্নটা মাইতি আবার তুলতে পারতেন। তা কিন্তু তুললেন না তিনি। বললেন, আপনি আগাগোড়া মিছে কথা বলেছেন! মোকাম্বোতে আপনি ঐ দিন আদৌ যাননি এবং সেখানে এ আসামীর সঙ্গে খানা খাননি! বলুন! স্বীকার করুন!
জীবন হাত দুটি জোড় করে বললে, বিশ্বাস করুন স্যার, আমি যাইনি। কিন্তু ওঁরা দুজন গিয়েছিলেন! ঐ সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত নটা পর্যন্ত ওঁরা ওখানে ছিলেন!
-- দ্যাটস্ অল মি’ লর্ড! -- মাইতি আসন গ্রহণ করেন। তৎক্ষণাৎ একজন সাব ইন্সপেক্টার তাঁর কানে কানে কী যেন বলে। উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন মাইতি। উঠে দাঁড়িয়ে জজ-সাহেবকে একটি সাড়ম্বর ‘বাও’ করে বলেন, আদালত যদি অনুমতি করেন, তবে আমি একটি নিবেদন করতে চাই। এই মাত্র ইনভেস্টিগেটিং অফিসার আমাকে একটি চাঞ্চল্যকর সংবাদ পেশ করেছেন -- যা এই মামলায় সত্য নির্ধারণে প্রভূতভাবে সাহায্য করবে। বস্তুত গত এক সপ্তাহ ধরেই আমরা অনুসন্ধান কার্য চালাচ্ছিলাম -- চূড়ান্ত তথ্য এইমাত্র জানা গেছে। আদালত অনুমতি করলে আমি আর একজন সাক্ষীকে প্রসিকিউশনের তরফে সাক্ষ্য দিতে ডাকতে পারি।
জজ-সাহেব বলেন, আদালত এটা পছন্দ করেন না। বাদীপক্ষ সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত না হয়ে মামলায় “ডেট” নিলেন কেন? বিবাদী পক্ষের সাক্ষী নেওয়া হয়ে গেছে, এখন, ওয়েল-- আমি রুলিং দেবার আগে জানতে চাই এ বিষয়ে প্রতিবাদীর কাউন্সেল কী বলেন?
বাসু বলেন, সত্য প্রতিষ্ঠিত হ’ক এটাই আমরা চাই। আমাদের আপত্তি নেই।
মাইতির আহবানে অতঃপর সাক্ষ্য দিতে উঠে দাড়ালেন সি. বি. আই-এর ফিঙ্গার প্রিন্ট এক্সপার্ট মিস্টার এম. পান্ডে। মাইতি খুশিতে ডগমগ! প্রশ্ন করেন, মিস্টার পান্ডে, আপনি ফিঙ্গার-প্রিন্ট এক্সপার্ট হিসাবে কোথায় ট্রেনিং নিয়েছেন? কতদিনের?
-- স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে। দু’বছরের।
-- আপনাকে গত বারই এপ্রিল আসামীর একটি ফিঙ্গার-প্রিন্ট দিয়ে অনুসন্ধান করতে বলা হয়েছিল কি?
-- হয়েছিল।
-- আসামীর সেই ফিঙ্গার-প্রিন্টটি কি আপনি দয়া করে আমাদের দেখাবেন?
সাক্ষী তার ব্যাগ খুলে নম্বর দেওয়া একটি ফিঙ্গার-প্রিন্ট বার করে দিলেন। মাইতি সেটি আদালতে, নথিভুক্ত করলেন -- ‘এফ-পি-ওয়ান’ রূপে। তারপর বললেন, এবার আপনার তদন্তের ফলাফল বলুন।
সাক্ষী জবাবে বললেন যে, তিনি লালবাজার ফিঙ্গার-প্রিন্ট লাইব্রেরীতে বসে গত চার-পাঁচদিন এটা মেলাবার জন্য ক্রমাগত চেষ্টা করে যান। গত পনের তারিখে তাঁর সন্দেহ হয়, একজন দাগী আসামীর সঙ্গে ফিঙ্গারপ্রিন্টটি মিলে যাচ্ছে। দাগী আসামীর নাম লালু, ওরফে খোকন। সে বহরমপুরের একটি ডাকাতি কেসে ইতিপূর্বে ধরা পড়েছিল আরও সাতজনের সঙ্গে। তাদের ভিতর পাঁচজনের মেয়াদ হয় -- দুজন যথেষ্ট প্রমাণ অভাবে ছাড়া পায়। সেই দুজনের ভিতর একজন এ খোকন ওরফে লালু। ঘটনা ছয় মাস আগেকার। সাক্ষী ঐ দিনই বহরমপুরে চলে যান। সেখানকার থানায় রাখা হিসাব এর সঙ্গে ঐ ‘এফ-পি-ওয়ান’ ছাপটি মিলিয়ে দেখেন। দেখে নিঃসন্দেহ হন যে, বর্তমান মামলার আসামী সুপ্রিয় দাশগুপ্ত আর খোকন ওরফে লালু অভিন্ন ব্যক্তি!
মাইতি প্রশ্ন করেন, বহরমপুর থানা থেকে কী খবর পেলেন? সেই লালু ওরফে খোকন বর্তমানে কোথায়?
-- ওঁরা তা বলতে পরলেন না। আজ ছয় সাতমাস সে বহরমপুরে যায়নি।
-- তাহলে আপনি নিঃসন্দেহ যে, খোকন ওরফে লালুই হচ্ছে এ আসামী সুপ্রিয়?
-- হ্যাঁ, আমি নিঃসন্দেহ!
-- আচ্ছা, এমনও হতে পারে যে দুটো ফিঙ্গার-প্রিন্ট হুবহু মিলে গেল, অথচ পরে দেখা গেল সে দুটো বিভিন্ন লোকের ?
-- না, তা হতে পারে না!
-- এমন রেকর্ড কোথাও নেই?
-- না, নেই!
-- কিন্তু ‘আনব্রোকন রেকর্ড’ও ক্ষেত্র-বিশেষে তো ‘ব্রোকন’ হয়? --
-- সাক্ষী ভ্রূকুঞ্চিত করে কলেন, আমি আপনার প্রশ্নটা বুঝতে পারছি না?
-- পারছেন না? আচ্ছা, আমি একটা উদাহরণ দিই, -- হয়তো বুঝবেন কী বলতে চাইছি -- ধরুন আজ আমি বিশ বছর ডিফেন্স কাউন্সেল হিসাবে প্র্যাকটিস করছি এবং এই বিশ বছরের ভিতর আমার কোনও মক্কেলের কখনও ‘কনভিকশন’ হয়নি। তখন হয়তো আমি বড়াই করে বলতে পারি, এটা হচ্ছে ‘আনব্রোকন রেকর্ড! এ রেকর্ড কখনও ভাঙা যায়নি, ভাঙা যাবে না!
পাণ্ডে সাহেব কলকাতার লোক নন। প্রশ্নটার তীব্র ব্যঙ্গের মর্মোদ্ধার করতে পারলেন না। সহজভাবে বলে ওঠেন, তার সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই! সমন্ত দুনিয়া মেনে নিয়েছে দুটি মানুষের কখনও হুবহু এক রকম ফিঙ্গার-প্রিন্ট হতে পারে না।
প্রদ্যোৎ লক্ষ করে দেখে বাসু-সাহেব একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন আসামীর দিকে! যে লোকটাকে বাঁচাবার প্রতিজ্ঞা নিয়ে এসেছেন, এখন যেন তাকেই খুন করতে চান উনি! তার পরেই প্রদ্যোতের নজরে পড়ল বাসু-সাহেবের পাশের চেয়ারখানায়। সেটা ফাঁকা। বৃদ্ধ ব্যারিস্টার এ. কে. রে কখন নিঃশব্দে উঠে চলে গেছেন।
মাইতি একেবারে বিনয়ের অবতার। ঝুঁকে পড়ে বাসুকে বলেন, যু মে ক্রস-এক্সামিন হিম, ইফ য়ু প্লীজ!
বাসু উঠে দাঁড়ালেন। আদালত কর্ণময়। বার আ্যসোসিয়েশানের অনেকেই এসেছে আজ। এমন অবস্থায় বাসু-সাহেবকে কেউ কখনও দেখেনি। সবাই উদ্গ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে। বাসু-সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন, সহযোগী পাবলিক প্রসিকিউটার যে বারো তারিখ থেকে এ জাতীয় অনুসন্ধান চালাচ্ছিলেন সে খবরটা তিনি এতাবৎকাল আদালতকে জানাননি। বস্তুত তদন্ত শেষ না করে মামলায় উপস্থিত হওয়া যে তাঁর পক্ষে উচিত হয়নি একথা মহামান্য আদালত ইতিপূর্বেই বলেছেন। সে যাই হোক, আমরা এ তথ্য এইমাত্র শুনলাম। তাই প্রতিবাদী পক্ষ আদালতের কাছে কিছু সময় চাইছেন।
জাস্টিস ভাদুড়ী বলেন, আমি আপনার সঙ্গে একমত। প্রতিবাদী আগামী কাল জেরা করবেন।
নির্ধারিত সময়ের কিছু পূর্বেই আদালত বন্ধ হয়ে গেল।
বাসু-সাহেবের গরম লাগছিল। গাউনটা খুলে হাতে ঝুলিয়ে নিলেন। চকিতে তাকিয়ে দেখলেন পাশের চেয়ারখানার দিকে । সেটা ফাঁকা। ধীর পদে আদালত ছেড়ে বার হয়ে এলেন। পিছন পিছন এল সুজাতা। প্রদ্যোৎ না বলে পারল না --সুপ্রিয়র সঙ্গে একবার দেখা করবেন না স্যার?
-- নো! হি ইজ এ ডাউন-রাইট ড্যাম্ লায়ার! এক নম্বর মিথ্যাবাদী!
-- কিন্তু যদুপতি সিঙ্ঘানিয়া তাহলে কেন ওকে --
-- যদুপতি কিছু যুধিষ্ঠিরের বাচ্চা নয়! একটা ব্ল্যাকমার্কেটিয়ার! এমনও হতে পারে খোকন ওরফে লালু -- অর্থাৎ সুপ্রিয়, ওর পোষা গুণ্ডা: পাপের সাথী!
কোর্ট থেকে ফিরে এলেন ওঁরা।
অষ্টম পর্ব
বাড়িতে যখন এসে পৌঁছালেন, তখন বিকাল সাড়ে পাঁচটা। গাড়ি থেকে নেমে উনি ধীরে ধীরে ঢুকে গেলেন নিজের চেম্বারে। অন্যদিন সচরাচর প্রথমেই গিয়ে রানীর সঙ্গে দেখা করেন। দু চারটে খোশ-গল্প করতে করতেই এক কাপ কফি খান। তারপরে স্নান করেন, এবং তারপর নিজের চেম্বারে গিয়ে বসেন। পিছনে থাক দেওয়া আইনের বই, -- নিচেকার লকারে থাকে লিকারের গ্লাস। বিশু রেখে যায় বরফের কুচির প্লেট। রাত নটায় ডিনার। কিন্তু তারপর আবার শুরু হয় পড়াশুনা। আবার গিয়ে বসেন চেম্বারে -- তখন আর মদ্যপান করেন না। কচিৎ কোনদিন হয়তো একটা ড্রাই মার্টিনী নিলেন -- সেটা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। কখন শুতে যাবেন সেটা নির্ভর করে পরদিনের মামলার গুরুত্বের উপর -- অথবা হয়তো নির্ভর করে কতক্ষণে একটা চাকা দেওয়া চেয়ার এসে থামবে এ চেম্বারের দ্বারপথে। শোনা যাবে প্রশ্ন, রাত অনেক হল যে, শোবে না?
আজ তার ব্যতিক্রম হল। বাসু স্নান করলেন না, কফি খেলেন না। রানী দেবীর সঙ্গে দুটো হাল্কা-রসিকতাও করলেন না। এমনকি জামা জুতো পর্যন্ত ছাড়লেন না। ঢুকে গেলেন চেম্বারে।
মিনিট দশেক পরে ইন্টারকমটা সাড়া দিয়ে উঠল। কাচের গবলেটটা সরিয়ে রেখে বাসু সুইচ টিপে বললেন, বল, শুনছি।
-- কফি খাবে না? ভিতরে আসবে না?
-- আসব রানু -- ভিতরে আসব বই কি। একটু পরে --
-- শোন, ইতিমধ্যে একটা ব্যাপার হয়েছে। একটু আগে সুবর্ণ এসেছে --
চমকে উঠলেন বাসু। অস্বাভাবিকভাবে। হয়তো আনমনা ছিলেন. কিংবা অত্যন্ত দ্রুত মদটা খাচ্ছিলেন -- প্রায় আর্তকন্ঠে বলে ওঠেন, কে? কে এসেছে বললে?
-- ঐ সুপ্রিয়ের স্ত্রী। যাকে আসতে বলেছিলে তুমি --
-- হ্যাঁ, কিন্তু কী নাম কললে তাঁর?
বেদনাহত কন্ঠ ভেসে এল রানী দেবীর, হ্যাঁ, এ নামই; আশ্চর্য কোয়েন্সিডেন্স নয়?
দু্জনেই নীরব। প্রায় আধ মিনিট! শেষে রানী বললেন, আমি ও-ঘরে আসব?
--তাই এস। আমি ঐ মেয়েটার সামনে দাঁড়াতে...তুমি চলে এস --
নিতান্ত কাকতালীয় বাপার। বছর সাতেক আগে ম্যাসানজোর বাঁধ দেখতে গিয়ে পথ দুর্ঘটনায় বাসু সাহেবের যে মেয়েটি মারা যায় তার নাম এবং ঐ দাগী আসামী সুপ্রিয় দাশগুপ্তের স্ত্রীর নাম অভিন্ন। দুজনেই সুবর্ণ!
একটু পরে চেম্বারের দরজাটা খুলে গেল। চাকা-দেওয়া চেয়ারে এসে উপস্থিত হলেন মিসেস বাসু। বললেন, সুজাতার কাছে সব শুনলাম। আজকের মামলার খবর। -- একটু থেমে আবার বলেন, ছেলেটাকে বাঁচানো যাবে না, নয়?
অসহায়ভাবে মাথা নাড়লেন বাসুসাহেব।
দুজনেই কিছুটা নীরব। তারপর বাসু বললেন, তুমি যা ভাবছ তা নয় রানু। আমার আনব্রোকন রেকর্ড আজ ভেঙে যাচ্ছে বলে আজ ভেঙে পড়িনি আমি। আফটার অল, হোয়াটস দ্যাট আনব্রোকন রেকর্ড? মিয়ার চান্স! আমি বরাবর জিতেছি। কেন জিতেছি? আমার বাকপটুতার জন্যে? বুদ্ধির জন্যে? আইনজ্ঞানের জন্যে? না! নিতান্ত কোয়েন্সিডেন্স। ঘটনাচক্রে প্রতিটি ক্ষেত্রেই সত্য ছিল আমার পক্ষে। আমি যাদের হয়ে লড়েছি তারা প্রতিক্ষেত্রেই ছিল নির্দোষ! হ্যাঁ, একটিমাত্র ব্যতিক্রম আছে -- তোমার মনে আছে নিশ্চয়। সেই মারোয়াড়ি ছেলেটার কেস -- যে তার বাপকে খুন করেছিল! কিন্তু আমি যখন তার কেস লড়েছিলাম তখন আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করেছিলাম তার
কথায় -- যে. সে নির্দোষ! সেও বেকসুর খালাস হয়েছিল। খালাস পাবার পর আনন্দের আতিশয্যে সে এসে আমার কাছে স্বীকার করেছিল -- সে নিজেই তার বাপকে খুন করেছে!
রানী বললেন, মনে আছে আমার। তারপরে বহুদিন তুমি কোর্টে যাওনি।
-- সেবার তবু একটা সান্ত্বনা ছিল রানী -- আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করেছিলাম যে, ছেলেটা নির্দোষ! বিবেকের কাছে আমি পরিষ্কার ছিলাম। কিন্তু এবার? এবার যে আমি নিজেই বুঝতে পারছি লোকটা একটা পাকা ক্রিমিনাল।
-- সন্দেহের কোন অবকাশ নেই?
-- থাকলে এভাবে ভেঙে পড়ি আমি? আগামীকাল জীবনে প্রথম কোর্ট থেকে হেরে ফিরব -- সেজন্য আমার কোন দুঃখ নেই। অতটা আত্মকেন্দ্রিক নই আমি। কোর্ট থেকে ফেরার কথা ভাবছি না আমি। কোর্টে যাবার কথাই ভাবছি। লোকটা দোষী জেনেও কেমন করে তার পক্ষে সওয়াল করব? সেখানেই যে আমার সত্যিকারের আনব্রোকন রেকর্ড সজ্ঞানে ভাঙব আমি।
-- উপায় কী বল? এ অবস্থায় কি তুমি আইনত ওর পক্ষ ত্যাগ করতে পার?
-- পারি! আইনত পারি -- প্রফেশনাল এথিক্সে পারি না। সমস্ত বার আসোসিয়েশান একবাক্যে বলবে -- নিশ্চিত পরাজয় এড়াতে বাসু-সাহেব পালিয়ে গেল!
-- ওরা তোমার আসল বেদনার কথাটা বুঝবে না?
-- কেমন করে বুঝবে রানু? তুমি ওদের সাইকলিজিটা দেখছ নাঃ ওদের সবারই একবার না একবার লেজ কাটা গেছে। দল-ছুট এই লাঙ্গুল-যুক্ত শৃগালটিকে কেমন করে ওরা ক্ষমা করতে পারবে? আর তাছাড়া কথাটাও তো ঠিক! নিশ্চিত পরাজয় এড়াতে সবাই যদি এমনভাবে সরে দাঁড়ায় তবে মক্কেলরা কোথায় দাড়াবে?
-- মিঠুর সঙ্গে দেখা করবে না?
-- মিঠু? -- চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ান বাসু-সাহেব!
অত্যন্ত লজ্জা পেয়ে যান রানী দেবী, না. না। ওটা আমারই ভুল! ওর নাম মিঠু নয়। ওর… ওর ডাক নাম আমি জানি না! আমার... আমার… হঠাৎ কোথাও কিছু নেই মুখে আঁচল চাপা দিলেন রানী বাসু।
অনেক অনেক দিন পর এ দুটো নাম -- সুবর্ণ আর ‘মিঠু’ এ বাড়িতে উচ্চারিত হল। বাসু-সাহেব বুঝতে পারেন -- রানী অজান্তে এ নামের সাযুজ্য ধরে অজানা অচেনা মেয়েটাকে আপন করে নিয়েছে। তাই সুপ্রিয় দাসগুপ্তের স্ত্রী সুবর্ণ হঠাৎ ‘মিঠু’ও হয়ে গেছে তাঁর কাছে। বাসু উঠে এসে ওঁর পিঠে একটা হাত রাখেন। রানী ততক্ষণে সামলেছেন। স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, চল, ভিতরে যাই।
সুপ্রিয় বলেছিল তার স্ত্রী নার্ভাস প্রকৃতির। কিন্তু তেমন কিছু নার্ভাস প্রকৃতির বলে মনে হল না বাসু-সাহেবের। এমন দুঃসংবাদ আচমকা পেলে সবাই কিছুটা হতচকিত হয়ে পড়ে। তার বেশি কিছু নয়। সে নিজেই চলে এসেছে। প্লেনে নয়, ট্রেনেই! হাওড়া স্টেশন থেকে ট্যাক্সি নিয়ে একেবারে নিউ আলিপুরে। বাসু-সাহেব ওকে আপাদমস্তক ভাল করে দেখে নিলেন। ওঁদের মেয়ে সুবর্ণ মারা গেছে সাত বছর আগে। তখন তার বয়স ছিল আট-নয় -- অর্থাৎ থাকলে আজ সেই সুবর্ণের বয়স হত ষোলো। এ মেয়েটি ষোড়শী নয়। বছর বাইশ বয়স ওর। দুই সুবর্ণের আকৃতিগত পার্থক্যও যথেষ্ট। সে ছিল ফর্সা, এ শ্যামলা। সে ছিল রোগা একহারা, এ দোহারা, স্বাস্থ্যবতী। একমাত্র নাম --সাযুজ্য ছাড়া আর কোন সাদৃশ্য নেই!
না! ভুল হল! আর একটা সাদৃশ্য আছে! সেই সুবর্ণের মাথা লক্ষ্য করে যখন এক নিষ্ঠুর অলক্ষ্যচারী বজ্র নিক্ষেপ করেছিলেন তখন বাসু-সাহেব বুক পেতে দিয়েও তাকে রক্ষা করতে পারেননি। ওঁর বুদ্ধি, প্রতিপত্তি, অর্থ সব-কিছু নিষ্ফল হয়ে গিয়েছিল সেই অসহায় ছোট্ট মেয়েটার শেষ-সংগ্রামে। আজ এই সুবর্ণের অবস্থাও তাই। ওঁর বিদ্যা-বুদ্ধি-আইনজ্ঞান কোন কিছুই এ আশ্রিতা মেয়েটিকে রক্ষা করতে পারবে না!
কতদিন বিয়ে হয়েছে তোমাদের?-- প্রশ্ন করলেন বাসু।
-- দু’বছর।
-- বাচ্চা - টাচ্চা হয়নি?
মেয়েটি মুখ নিচু করল। রানী দেবী পাশ থেকে বলে ওঠেন, পেটে এসেছিল, থাকেনি।
-- বাবা-মা আছেন? বাপের বাড়ি কোথায়?
মেয়েটি মুখ তুলল না। টপ্ টপ্ করে কয়েক ফোঁটা জল ঝরে পড়ল কোলের উপর।
রানী দেবীই জবাব দিলেন এ প্রশ্নের। বললেন -- বাপের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি কোথাও ওকে নেবে না। অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ নয় -- অসবর্ণ বিয়ে। ওরা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিল!
কোথায় এ রোমান্টিক সংবাদে খুশিয়াল হয়ে উঠবেন আধুনিকমনা ব্যারিস্টার-সাহেব, তা নয় খিঁচিয়ে ওঠেন উনি, প্রেম করে বিয়ে! তা প্রেম করার আগে ওর ফিঙ্গার-প্রিন্টটা নিয়ে যাচাই করাওনি? -- চেয়ার ছেড়ে উঠে পদচারণা শুরু করেন।
বেদনাহত জলভরা দু-চোখ তুলে মেয়েটি বললে, ও খুন করেনি! আপনি বিশ্বাস করুন!
বাসু-সাহেব বাঁ হাতের তালুতে ডান আতে একটা মুষ্ট্যাঘাত করলেন শুধু।
-- ও মামলায় জড়িয়ে পড়েছে... আপনি… আপনি ওঁকে বাঁচান! -- মেয়েটি উঠে দাঁড়াতে চায়! ওঁর পায়ের উপর লুটিয়ে পড়ত -- কিংবা --
বাসু-সাহেব প্রচণ্ড ধমক দিয়ে ওঠেনঃ সিট ডাউন!
থতমত খেয়ে মেয়েটি আবার চেয়ারে বসে পড়ে।
-- আজ থেকে ছ’মাস আগে -- ধর, গত বছর অক্টোবর-নভেম্বরে-ডিসেম্বরে সুপ্রিয় বোম্বাই থেকে কলকাতা এসেছিল?
-- সুবর্ণ মনে মনে কী হিসাব করে বলল, হ্যাঁ, অফিসের কাজে। মাসখানেকের জন্য। কেন?
-- কেন সেকথা থাক! তুমি কি কোনদিন এমন আশঙ্কা করনি যে, ওর কোন ‘শেডি-পাস্ট’ থাকতে পারে?
-- ওর কোনও শেডি-পাস্ট নেই!
-- কাকে কী বলছ সুবর্ণ? মায়ের কাছে মাসীর গল্প?
রানী দেবী এবার প্রতিবাদ করে ওঠেন, তুমি কথায় কথায় ওকে অমন ধমক দেবে না কিন্তু --
বাসু-সাহেবের একবার সুবর্ণের দিকে তাকিয়ে দেখলেন। শ্রাগ করলেন। গিয়ে বসলেন তাঁর ইজিচেয়ারে। পাইপটা ধরালেন।
সুবর্ণ বললে, আমি ওর সঙ্গে দেখা করব।
-- তাতো করবেই। কাল সকালে তোমাকে নিয়ে যাব।
ঠিক তখনই বিশু এনে দিল একটা ওভার-সীজ টেলিগ্রাফ। খামটা খুলে বাসু দেখলেন তারবার্তাটা আসছে ব্যাঙ্কক থেকে। তাতে লেখাঃ
“সুপ্রিয় দাশগুপ্তকে ডিফেন্ড করুন এএএ তার সততা এবং কর্মদক্ষতা সন্দেহের অতীত এএএ যাবতীয় খরচ আমার এএএ আকাশ হচ্ছে খরচের উর্দ্ধ্বসীমা এএএ রবিবারে দমদম পৌঁছাব এএএ মোহনস্বরূপ কাপাডিয়া।”
বাসু-সাহেব টেলিগ্রাফখানা বাড়িয়ে ধরলেন সুবর্ণের দিকে। বললেন, আই নাউ বেগ য়োর পার্ডন, সুবর্ণ আমি অন্যায় কথা বলেছিলাম। তুমি প্রেমে পড়ে যে ভুল করেছ তোমার স্বামীর এমপ্লয়ার ধুরন্ধর কাোটিপতি হওয়া সত্ত্বেও সেই একই ভুল করেছেন।
নিজের ঘরে গিয়ে টেলিফোন তুলে নিলেন বাসু। পার্ক-হোটেলের নাম্বার চাইলেন। অপারেটারকে বললেন, রুম নম্বর 78 প্লীজ।
একটু পরে রিঙিং টোন শোনা গেল। ওপ্রান্ত কলল, হ্যালো, জীবন বিশ্বাস বলছি -
-- আমাকে না বলে কোর্ট ছেড়ে চলে এলেন কেন?
-- আপনি কে? বাসু-সাহেব?
-- হ্যাঁ, আমি। কোর্ট থেকে পালিয়ে এলে কেন?
-- পালিয়ে তে৷ আসিনি স্যার। কেন, কোন দরকার আছে?
-- আছে! তুমি ইচ্ছে করে তোমার বন্ধুকে ফাঁসাচ্ছো!
-- কী যে বলেন স্যার! আমি কেন ফাঁসাব? আমি তো তার জন্যে পার্জারির কেসে ফাঁসতে পর্যন্ত রাজী হয়েছিলাম?
বাসু-সাহেব একটু চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, তুমি ঘণ্টাখানেক হোটেল ছেড়ে বের হয়ো না। তোমাকে একটা জরুরী খবর দেব। বুঝলে?
-- আজ্ঞে আচ্ছা!
বাসু-সাহেব টেলিফোনটা রেখে টানা-ড্রয়ারটা খুললেন। বার করে নিলেন আত্মরক্ষার একটা অস্ত্র। সুজাতা এসে দাড়ালো দরজায়। বললে, বের হচ্ছেন নাকি আবার?
-- হ্যাঁ সুজাতা! আবার এক মিস্টিরিয়াস্ ব্যাপার। পার্ক-হোটেলে ফোন করে এইমাত্র জীবন বিশ্বাসের সঙ্গে কথা বললাম। লোকটা জীবন বিশ্বাস নয়৷ আই মাস্ট ফাইন্ড আউট -- লোকটা কে?
-- সে কী! লোকটা বলল যে, সে জীবন বিশ্বাস?
-- তাই সে বলল। গলাটা নকল করবার চেষ্টাও করছিল--কিন্তু পারেনি।
গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন উনি। একাই।
আধঘন্টা পরে পার্ক হোটেলের নিচে গাড়িটা রেখে এগিয়ে গেলেন রিসেপশান কাউন্টারের দিকে! জীবন বিশ্বাসের রুম নম্বব জেনে নিয়ে লিফট ধরে উপরে উঠলেন। চিহ্নিত দরজায় যখন বাঁ-হাতে টোকা মারলেন তখন তার ডান হাতটা ছিল পকেটে -- যে পকেটে আছে তাঁর আত্মরক্ষার অস্ত্রটা।
একটু পরেই দরজা খুলে গেল। ভিতরে দাঁড়িয়ে আছে কৌশিক।
-- তুমি! তুমিই তখন ফোন ধরেছিলে?
-- হ্যাঁ, কিন্তু আপনি যে বললেন আবার ফোন করবেন?
বাসু-সাহেব দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। হাসতে হাসতে গিয়ে বসলেন একটা চেয়ারে। বললেন, টিকটিকিগিরি ভালই করছ। কিছু একটা ভুল হয়েছিল তোমার। তুমি ভুলে গিয়েছিলে জীবন বিশ্বাসের কাছে ‘পার্জারির’ অর্থ জোলাপ নেওয়া।
এবার কৌশিকও হেসে ওঠে উচ্চকন্ঠে। বলে, আয়াম সরি!
কৌশিক তার এই অদ্ভুত আচরণের কৈফিয়ৎ দিল --
মিথ্যা-সাক্ষী ধরা পড়ার পরেই জীবন আদালত ছেড়ে বেরিয়ে আসে। কৌশিকের সন্দেহ হয় যে, সে আত্মগোপন করতে চাইছে। সে পিছন পিছন বেরিয়ে আসে। জীবন একটি ফ্লাইং ট্যাক্সি ধরে রওনা দেয়। দ্বিতীয় ট্যাক্সি পেতে প্রায় মিনিট দশেক দেরী হয়ে যায় তার। দুর্ভাগ্যক্রমে পথে একটা মিছিল পড়ে আরও দশ মিনিট দেরী হয়ে যায়। কৌশিক এসে পৌছায় পার্ক-হোটেলে। রুম বেয়ারা হরিমোহনের খোঁজ পেতে বিলম্ব হয় না। তার মাধ্যমে রিসেপশান কাউন্টারে খবর নিয়ে জানতে পারে, মিনিট পাঁচেক আগে জীবন বিশ্বা্স চেক আউট করে বেরিয়ে গেছে। ও তার রুম নাম্বারটা জেনে নেয় এবং জে.বিশ্বাস নামে তখনই ঘরটা বুক করে।
-- কেন?
-- আমি একটা চান্স নিলাম স্যার, আর অদ্ভুত ফল ফলেছে তাতে!
-- কী রকম?
কৌশিক নাকি ঘরে এসেই টেলিফোনটা তুলে নিয়েছিল। অপারেটারকে বলে, রুম নাম্বার 78 থেকে মিস্টার বিশ্বাস বলছি -- আমার কোন ট্রাংক কল এসেছে ইতিমধ্যে?
মেয়েটি বললে, না স্যার! কাল বিকালে সেই যে ট্রাংক কল এসেছিল তারপর তো আসেনি।
-- কৌশিক বলেছিল, আচ্ছা কালকে আমি যে কলটা রিসিভ করেছিলাম সেটা বর্ধমান থেকে না দুর্গাপুর থেকে? মনে আছে আপনার?
-- আপনার মনে নেই? আসানসোল থেকে। কলার-এর নাম্বারটা চান?
-- আছে আপনার কাছে? আমাকে উনি বলেছিলেন, লিখেও রেখেছি: কিন্তু কোথায় যে ফেললাম!
-- এক মিনিট। আপনি লাইনটা ছেড়ে দিন। এখুনি জানাব আপনাকে! সমস্ত ইন-কামিং আর আউট-গোয়িং ট্রাংক কল লেখা থাকে একটা রেজিস্টারে।
-- তাই নাকি? তা তো জানতাম না।
-- নাহলে এত চার্জ আপনারা দেন কেন পার্ক-হোটেলে?
কৌশিক টেলিফোনটা নামিয়ে রাখল। সে মনে মনে হাসছিল -- মেয়েটা ধরতে পারেনি যে, রুম নম্বর 78-এর বাসিন্দা গত দশ মিনিটের ভিতর বদলে গেছে! বিশ্বাস উপাধিটাই কি ওর বিশ্বাস উৎপাদন করল? মেয়েটিও তখন ও-প্রান্তে মনে মনে হাসছিল --রুম 78-এর ভদ্রলোকের কাছে হোটেলের বিজ্ঞাপনটা সে ভালই করেছে! সে জানে এ ব্যবস্থার জন; আসলে দায়ী কলকাতার পুলিশ কমিশনার ! খানদানী হোটেলেই খানদানী ষড়যন্ত্রকারীরা ওঠে! তাদের গতিবিধির উপর নজর রাখার জন্যই এই আদেশ দিয়েছে আরক্ষা বিভাগ।
এক মিনিট পরে মেয়েটি ফোন করে জানাল, কাল আপনার কলার ছিলেন আসানসোল...
-- থ্যাংকু। আপনি আর কতক্ষণ বোর্ডে আছেন?
-- কেন বলুন তো? কোন ইন্সট্রাকশান থাকলে আমার সাকসেসার়কে বলে যাব।
-- সে জন্য নয়। কারণটা না জানালে বলতে আপত্তি আছে?
-- না না, তা কেন? আমার এখনই ডিউটি শেষ হল। আবার কাল বেলা দশটায় আসব আমি। এবার বলুন, কেন জানতে চাইছিলেন।
কৌশিক অম্লান বদনে বললে, তাহলে কাল দশটার সময় আবার আপনাকে বিরক্ত করব। আপনার কন্ঠস্বরটা আমার খুব ভাল লাগছে। ডোন্ট টেক ইট আদার-ওয়াইজ -- আমার এক নিকট আত্মীয়া, আত্মীয়া ঠিক নয় বান্ধবীর সঙ্গে আপনার কন্ঠস্বরের অদ্ভুত মিল।
মেয়েটির হাসির জলতরঙ্গ ভেসে এসেছিল টেলিফোনে। বলেছিল, গুডনাইট স্যার। সুইট ড্রিম্স!
-- সেম টু য়ু। লাইন কেটে দিয়েছিল কৌশিক।
তারপর আধঘণ্টা অপেক্ষা করে সে আবার ফোনটা তুলেছিল। এবার কণ্ঠস্বর অনেক ভারী, অনেক ভরাট! কৌশিক বর্ধমান সদর থানার ও.সি.-কে একটা পি.পি.কল বুক করে। লাইটনিং কল। তৎক্ষণাৎ লাইন পায়। সে নৃপেন ঘোষালকে জানায় যে, বাসু-সাহেব যে মিস ডিক্রুজাকে খুঁজছেন সে আসানসোলের ‘অমুক’ নম্বর থেকে গতকাল ফোন করেছিল। নৃপেন ওকে বলে -- এরপর যদি মেয়েটাকে চবিবশ ঘন্টার মধ্যে পাকড়াও করতে না পারি তবে আমার নামটা পালটে রাখবেন।
কৌশিকের এতবড় কৃতিত্বেও কিন্তু বাসু-সাহেবের কোন ভাবান্তর হল না। তিনি স্থির হয়ে বসে আছেন। যেন ধ্যানস্থ। এতক্ষণ শুনছিলেন কিনা তাই বোঝা গেল না। কৌশিক বুঝতে পারে উনি গভীর চিন্তায় মগ্ন। সে কোন সাড়াশব্দ দেয় না। পুরো পাঁচ মিনিট কী চিন্তা করে হঠাৎ নড়েচড়ে বসলেন উনি। বলেন, কৌশিক, আমি কোন চান্স নেব না! মনে হচ্ছে সমাধান হয়ে গেছে। এখনও দু চারটে ছোট ছোট অসঙ্গতি রয়েছে বটে, কিন্তু মূল সমস্যাটার মীমাংসা হয়ে গেছে।
-- কী বুঝেছেন আপনি?
-- দুই আর দুইয়ে চার!
-- তার মানে?
-- তার মানে তুমি এখান থেকেই আমার এই গাড়িটা নিয়ে আসানসোল চলে যাও। এখন সন্ধ্যা সাতটা। রাত দশটা নাগাদ তুমি বর্ধমানে পৌঁছাবে। সেখানে যদি নৃপেনের দেখা পাও ভাল, না পাও প্রসীড টু আসানসোল। রাত একটা নাগাদ সেখানে পৌঁছাবে। সোজা কোতোয়ালিতে চলে যাবে। সেখানে আমার পরবর্তী নির্দেশ পাবে।
--কার কাছে?
-- ডিউটি অফিসারের কাছে। আমি বাড়ি ফিরে এ, ডি. এম্ আসানসোল, ডি. এস. পি. অথবা এস. ডি. ও. সদর যাকে কনট্যাক্ট করতে পারব তাঁকে ব্যাপারটা জানাব। মার্ডার-কেস। ওরা তোমাকে সাহায্য করবেই।
কৌশিক বলে, আর যে-সে মার্ডার নয়! লক্ষপতি এম.পি.জৈনের মার্ডার-কেস!
বাসু উঠে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ওর কাঁধে একখানা হাত রেখে বলেন, তুমি আমাকে ভুল বুঝছ কৌশিক। আমি হত্যা তদন্তের কথা বলছি না --হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে চাইছি! আজ রাত্রেই আসানসোলে দ্বিতীয় একটা মার্ডার হবার আশঙ্কা আছে!
কৌশিক স্তব্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে।
বাসু-সাহেব পকেট থেকে রিভলভারটা বার করে ওর হাতে দেন, ধর!
-- সে কী! এর লাইসেন্স যে আপনার নামে!
সে দায়িত্ব আমার, কৌশিক। কিন্ত মৃত্যুর মুখে তোমাকে তো আমি নিরস্ত্র যেতে বলতে পারি না। আমি নিজে যেতে পারছি না। কাল দশটায় আমার কেস আবার উঠবে। আশা করছি, তার আগেই ভোররাতে তোমার একটা ফোন পাব। আমার অনুমান যদি সত্যি হয় মিঠুকে এবার বাঁচাতে পারব!
কৌশিক অবাক বিস্ময়ে বলে, মিঠু কে?
ম্লান হাসলেন বাসু। নিজেকেই বললেন যেন, আই বেগ য়োর পার্ডন। মিসেস্ সুপ্রিয় দাসগুপ্ত। সে এসে উঠেছে আমার বাড়িতে।
নবম পর্ব
আলিপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে আলিপুর কোর্ট। গাড়িতে যেতে দুই খেকে তিন মিনিট লাগার কথা। কিন্তু ওঁদের লাগল আধঘণ্টা। সাড়ে ন’টায় ট্যাক্সি নিয়ে বার
হয়েছিলেন জেলখানার ফটক থেকে, আর আদালতের সামনে এসে উপস্থিত হলেন তখন ঠিক দশটা। কারণ ছিল। জেলখানা থেকে ট্যাক্সিটা নিয়ে ওঁরা চলে এসেছিলেন ন্যাশনাল লাইব্রেরীতে। গাড়িটা বাগানের ধারে রেখে ড্রাইভারের পাশে বসা বাসু-সাহেব পিছন ফিরে বলেছিলেন, একটু নেমে এস, এ গাছতলায় বসে কয়েকটা কথা বলব!
পিছনের দিক থেকে সুজাতা আর সুবর্ণ নেমে পড়েছিল।
ট্যাক্সি ড্রাইভার বলে, আমাকে ছেড়ে দিন স্যার --
-- মানিব্যাগ থেকে একটা দশ টাকার নোট বার করে ওর দিকে বাড়িয়ে ধরে বাসু বলেন, এটা তোমার মিটারের উপর। আধঘন্টা দাঁড়াতে হবে।
ট্যাক্সি ড্রাইভার বুদ্ধিমান। তৎক্ষণাৎ বুঝে নেয়, মালদার শাঁসালো প্যাসেঞ্জার জুটেছে আজ তার বরাতে। সে কৃতার্থ হয়ে বলে, ঠিক আছে স্যার।
ঘাসের উপর ওরা তিনজন বসলেন। বাসু বললেন, সুবর্ণ, বুঝতে পারছি সুপ্রিয় তোমার সঙ্গে দেখা করতে রাজি না হওয়াতে তুমি মর্মাহত হয়েছ -- কিন্তু এতে তোমার দুঃখ করার কিছু নেই, এতে তোমার আনন্দিত হওয়ার কথা।
সুজাতা অবাক হয়ে তাকায়। আসামী সুপ্রিয় দাশগুপ্ত হাজতে তার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে না-চাওয়াটা বোম্বাই থেকে ছুটে আসা তার হতভাগ্য স্ত্রীর কাছে কোন্ যুক্তিতে আনন্দের হতে পারে এটা তার মাথায় ঢোকে না। বাসু-সাহেব বলে চলেন, কাল যখন কোর্ট থেকে ফিরে এসেছিলাম, তখন আমার জয়ের সম্ভাবনা ছিল শূন্য -- কেসটা হারার আশঙ্কা ছিল হান্ড্রেড পার্সেন্ট। তারপর সন্ধ্যা সাতটার সময় কৌশিক একটা অদ্ভুত আবিষ্কার করে বসল। এক লাফে আমার জেতার সম্ভাবনাটা হয়ে গেল শতকরা পঁচিশ ভাগ! আজ দুরু দুরু বুকে তোমাকে নিয়ে আলিপুর জেলে এসেছিলাম। তুমি হয়তো শুনলে রাগ করবে, আমি মনে মনে ভগবানকে বলছিলাম -- হে ঈশ্বর! সুপ্রিয় যেন তার স্ত্রীর
সঙ্গে দেখা করতে রাজী না হয়! শেষ পর্যন্ত দয়াময় আমার প্রার্থনাতে কর্ণপাত করেছেন। আয়াম হ্যাপি টু সে -- ঠিক এই মুহূর্তে আমার জয়ের সম্ভাবনা সেভেন্টিফাইভ পার্সেন্ট!
সুবর্ণ তার অশ্রুধৌত চোখজোড়া তুলে তাকায়। কথা বলে না।
সুজাতা কিন্তু স্থির থাকতে পারে না। বলে, কী বলছেন আপনি! সুপ্রিয়বাবু আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে রাজী না হওয়ায় আপনার এ মামলা জেতার সম্ভাবনা শতকরা পঞ্চাশ ভাগ বেড়ে গেল?
-- ইফ নট মোর!
-- কেন?
-- সেটা আমি এখন বলব না। বলতে পারি না। সুবর্ণকে আমি আশা দিয়ে হতাশ করতে চাই না। কিন্তু একটা কথা বলব সুবর্ণ, মন দিয়ে শোন।
-- বলুন?
-- আদালতে মনকে খুব শক্ত করে রেখ। যত বড় মানসিক আঘাতই আসুক তৃমি ভেঙে পড়বে না। পারবে?
-- সুবর্ণের চোয়ালের হাড় শক্ত হয়ে উঠল। বললে, আমাকে পারতেই হবে।
-- ধর যদি আসামীর মৃত্যুদন্ডাজ্ঞাও হয়, ভেঙে পড়বে না?
সুবর্ণ দাঁত দিয়ে ঠোঁটটা কামড়ে নির্বাক বসে রইল।
বাসু-সাহেব বললেন, তোমাকে সাক্ষী দেবার জন্য ডাকব আমি। পাঁচ-সাতটা প্রশ্ন করব। কিন্তু জেরায় বিপক্ষের উকিল তোমাকে খুব নাকাল করতে চাইবে। তুমি খুব শক্ত হয়ে থাকবে আর জবাবে যা বলবে তাতে নির্জলা সত্য থেকে বিন্দুমাত্র বিচলিত হবে ন। পারবে? উত্তরে তোমার স্বামীর ভাল হবে কি মন্দ হবে তা বিবেচনা করবে না -- আদ্যন্ত সত্য কথা বলবে!
-- তাই বলব আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন -- কোর্টে যত বড় আঘাতই আসুক না কেন আমি অটল থাকব।
-- দ্যাটস এ গুড গার্ল। কিন্তু তারও আগে হয়তো একটা শক পাবে তুমি। কোর্টে বসার আগে, মানে তোমাকে সাক্ষী দিতে ডাকার আগে তোমার কানে কানে একটা প্রশ্ন করব আমি। তুমি আমায় কানে কানে তার সত্য জবাব দেবে। এগ্রীড?
সুজাতা বলল, এখনই সে উত্তরটা জেনে নিন না?
-- সব জিনিসেরই একটা নিজস্ব সময় আছে সুজাতা । এগ্রীড?
-- হ্যাঁ ।
-- তবে ওঠ, চল, সময় হয়ে গেছে।
আদালত -প্রাঙ্গণে ওরা প্রবেশ করলেন দশটায়। সেখানে বাসু-সাহেবের জনা দুটি বিষ্ময় ইতিপূর্বেই উপস্থিত। প্রথমত তাঁর পাশের চেয়ারে বসে আহ্ছেন বৃদ্ধ ব্যারিস্টার এ.কে. রে। প্রবেশপথেই দেখতে পেলেন বাসু-সাহেব। উনি ভেবেছিলেন, ব্যারিস্টার রে আজ আসবেন না। দ্বিতীয়ত প্রবেশপথেই দাঁড়িয়ে ছিল কৌশিক।
-- কী খবর?
-- কৌশিক ওঁকে হাত ধরে বারান্দার একান্তে নিয়ে গেল। নিজের হাতঘড়িতে সময়টা দেখল। দশটা বেছে এক। বললে, ভোড় সাড়ে চারটেয় আসানসোল থেকে রওনা হয়েছি। মিনিট দশেক আগে এ্রখানে পৌঁচেছি। শুনুন -- জীবন বিশ্বাস ফেরার, তার এক লাখ টাকা সমেত --
-- আই নো। নেক্সট?
-- মিস.ডি.সিলভার আস্তানা আমরা খুঁজে পেরেছিলাম, কিন্তু সেও ভেগেছে!
-- লেট হার গো টু হেল্। তার ভাই? বিকৃতমস্তিষ্ক ছেলেটা?
-- তাকে উদ্ধার করে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। কোর্টে বসিয়েছি, দর্শকদের গ্যালারিতে -- কিন্তু সে পাগল নয় মোটেই।
কৌশিক থেমে পড়ল। কে একজন এগিয়ে এসে বললেন, জজসাহেব এসে গেছেন।
বাসু বলেন, চলুন আমি যাচ্ছি --
কৌশিক বলে, আসল কথাটাই আমার বলা হয়নি --
আসল কথাটা আমি জানি কৌশিক! তুমি মিস্টার ডি.সিলভার কাছে যাও । বেচারি অনেক ধকল সয়েছেন এ-কদিন। ডাক্তার দেখিয়েছিলে?
একজন কোর্ট পেয়াদা ছুটতে ছুটতে এসে বললে, স্যার!
-- ঠিক আছে, চল।
দ্রুত পায়ে বাসু এসে প্রবেশ করলেন! নিজ আসনের কাছে এসে জজ-সাহেবকে বাও করে বললেন, আয়াম সরি!
জাস্টিস ভাদুড়ী বললেন, য়ু অট টু বি! আমাদের প্রতিটি মিনিট হচ্ছে পাব্লিক টাইম। এনি ওয়ে। আর উই অল রেডি নাউ?
বাদীপক্ষে নিরঞ্জন মাইতি উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, আমরা তো অনেকক্ষণ আগে থেকেই প্রস্তুত!
-- তাহলে আদালত বসছে। গতকাল মিস্টার পান্ডের ক্রস-একজামিনেশনের আগেই অধিবেশন শেষ হয়েছিল। মিস্টার পান্ডে! টেক ইয়োর স্ট্যান্ড প্লীজ।
সি.বি.আই অফিসার মঞ্চের উপর উঠে ছাড়ালেন।
জাস্টিস ভাদুড়ী বললেন, প্লিজ রিমেম্বার, য়ু আর আন্ডার ওথ ওভার-নাইট!
ফিঙ্গার-প্রিন্ট এক্সপার্ট অভিবাদন করে বলেন, আই নো মি’ লর্ড!
বাসু-সাহেবকে ইঙ্গিত করলেন বিচারক, প্লীজ প্রসীড।
এতক্ষণ নিম্নস্বরে কথা হচ্ছিল গুরু-শিষ্যে। ব্যারিস্টার রে সাহেব বলেছিলেন, সেজন্য কাল আমি উঠে চলে যাইনি বাসু। আমার শরীরটা খারাপ লাগছিল বলে চলে গিয়েছিলাম। হার-জিত নিয়েই জীবন! ইফ য়ু ক্যান টেক দ্য পাঞ্চ, কান্ট আই সোয়ালো ইট অ্যাজ ওয়েল?
জজ-সাহেব ‘প্লীজ প্রসীড’ বলার সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্যালাপ অসমাপ্ত রেখে বাসু উঠে দাঁড়ালেন। সাক্ষীকে প্রশ্ন করেন, মিস্টার পান্ডে, আপনি কাল আপনার সাক্ষ্যে বলেছেন যে, দুটি ভিন্ন লোকের ফিঙ্গার-প্রিন্ট কোন অবস্থাতেই হুবহু এক হতে পারে না। তাই না?
-- তাই বলেছি।
-- যেহেতু, ‘এফ-পি-ওয়ান’ আর বহরমপুর থানায় রক্ষিত ফিঙ্গার-প্রিন্ট দুটি হুবহু এক, তাই আপনি এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, কাপাডিয়া অ্যান্ড কাপাডিয়া কোম্পানির ম্যানেজার সুপ্রিয় দাশগুপ্ত এবং খোকন ওরফে লালু অভিন্ন ব্যক্তি? ইয়েস অর নো?
-- ইয়েস!
-- আপনার দু’বছর স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড ট্রেনিং এই সিদ্ধান্তে আপনাকে পৌছে দিয়েছে?
-- হ্যাঁ তাই!
-- কিন্তু এ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড ইতিহাসে কি এমন নজির নেই, যে হায়েস্ট অথরিটি অন দা সাবজেক্ট বলেছেন, দুটি ফিঙ্গার-প্রিন্ট হুবহু মিলে গেছে অথচ পরে প্রমাণিত হয়েছে যে দুটি বিভিন্ন লোকের ফিঙ্গার-প্রিন্ট?
-- আমি এমন কেস একটিও জানি না।
-- আপনি কি ‘চেজ এ ক্রুকেড শ্যাডো’ ফিল্মটা দেখেছেন?
-- অবজেকশান য়োর অনার। দ্য কোয়েশ্চেন ইজ ইররেলিভ্যান্ট, ইমপাটিন্যান্ট এবং বর্তমান মামলার সঙ্গে সম্পর্ক বিমুক্ত।
জাস্টিস্ ভাদুড়ী একটু নড়েচড়ে বসে বললেন, অবজেকশান সাসটেন্ড ! বাট....একটু থেমে বললেন, বিষয়টা অত্যন্ত কৌতুহলোদ্দীপক। প্রতিবাদী কাউন্সেলকে আমি রিসেস্ পিরিয়ডে এ বিষয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করতে অনুরোধ করছি। আমি ফিল্মটা দেখিনি, কিন্তু--ওয়েল, য়ু মে প্রসীড……
বাসু-সাহেব একটা বাও করে বললেন, ‘চেজ এ ক্রুকেড শ্যাডো’ ফিল্মটা, বর্তমান মামলায় অপ্রাসঙ্গিক, কিন্তু সহযোগী তাঁর ডাইরেক্ট এভিডেন্সে রামচন্দ্রপুরে আগরওয়াল হত্যার মামলার প্রসঙ্গ এনেছিলেন। সে মামলায় বর্তমান বিচারকই বিচার করেছিলেন, এবং আমার সহযোগী আইনজীবীই পাবলিক প্রসিকিউটার ছিলেন। আশা করি আপনাদের মনে আছে, সেখানেও দুটি ফিঙ্গার-প্রিন্ট পুলিশ কর্তৃপক্ষ হুবহু এক বলে সাটিফিকেট দিয়েছিলেন, কিন্তু পরে প্রমাণিত হয়েছিল সে দুটি ভিন্ন বাক্তির!
নিরঞ্জন মাইতি বলেন, সেটা ছিল অন্য ব্যাপার। তাতে ফিঙ্গার-প্রিন্ট সায়েন্সটা ভুল প্রমাণিত হয়নি!
জাস্টিস ভাদুড়ী বলেন, আমি বাদীর সঙ্গে একমত। যাই হোক. আপনি জেরা চালিয়ে যান।
বাসু-সাহেব বলেন, মিস্টার পান্ডে, আজ যদি আমি প্রমাণ করি আসামী সুপ্রিয় দাশগুপ্ত খোকন ওরফে লালু নয়, তবে কি আপনি মেনে নেবেন ফিঙ্গার-প্রিন্ট সায়েন্সটা ভুল?
-- ওটা আপনার পক্ষে প্রমাণ করা সম্পূর্ণ অসম্ভব।
-- ওটা আমার প্রশ্নের জবাব নয়। সে ইয়েস অর নো!
-- ইয়েস।
বাসু হেসে বলেন, য়ু শুড বেটার হ্যাড সে ‘নো’! তাই কিন্তু প্রমাণ করব আমি!
মাইতি উঠে দাঁড়িয়েছিলেন প্রতিবাদ জানাতে। তার আগেই বাসু বলেন, দ্যাটস্ অল মি লর্ড।
তারপর মহামান্য বিচারককে সম্বোধন করে বলেন, আদালত অনুমতি করলে আমি আমার পরবর্তী সাক্ষীকে ডাকতে পারি।
মাইতি একটা স্বগতোক্তি করেন, এর পরেও!
জাস্টিস ভাদুড়ী তাঁর দিকে কঠিন দৃষ্টিপাত করলেন; বাসুকে বলেন, ইয়েস, প্রসীড।
-- আমার পরবর্তী সাক্ষী মিসেস সুবর্ণ দাশগুপ্তা।
-- মিসেস সুবর্ণ দাশগুপ্তা হাজির?
সুবর্ণ সুজাতার পাশ থেকে উঠে দাড়ালো সাক্ষীর মঞ্চে। অচঞ্চল দীপশিখার মত।
-- আপনার নাম?
-- মিসেস সুবর্ণ দাশগুপ্তা।
-- স্বামীর নাম?
-- মিস্টার সুপ্রিয় দাশগুপ্ত।
-- আপনার স্বামী কী কাজ করেন?
-- বোম্বাইয়ের কাপাডিয়া অ্যান্ড কাপাডিয়া কোম্পানির ম্যানেজার।
-- কতদিন বিয়ে হয়েছে আপনাদের?
-- দু’বছর।
-- হিন্দু ম্যারেজ না রেজিস্ট্রি ম্যারেজ?
-- রেজিস্ট্রি ম্যারেজ।
-- আপনার স্বামী বর্তমানে কোথায় আছেন?
-- আমি জানি না।
-- অবজেকশান য়োর অনার! জানেন না মানে কী? -- লাফিয়ে ওঠেন মাইতি।
জাস্টিস ভাদুড়ী ভ্রূকুটি করেন। একবার সাক্ষী একবার বাসু-সাহেবের দিকে তাকিয়ে দেখেন। বাসুকে কিছু বলতে যান, তারপর মনস্থির করে মাইতিকেই বলেন, অবজেকশান অন হোয়াট গ্রাউন্ডস্?
--ওঁর স্বামী জলজ্যান্ত চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, আর উনি বলছেন ‘জানি না’!
জাস্টিস ভাদুড়ী বাসু-সাহেবের দিকে ফিরে বলেন, আপনি কিছু বলবেন?
-- আমি কী বলব? আমি তো শুনছি এখন। আমি সাক্ষীকে প্রশ্ন করেছি, তিনি জবাব দিয়েছেন। সহযোগী ‘অবজেকশান’ দিয়েছেন, তার কারণ দেখাচ্ছেন না। এখন কী বলতে পারি আমি?
-- য়ু আর পারফেক্টলি রাইট টেকনিকালি --জজসাহেব মাইতির দিকে ফিরে বলেন, কী আপত্তি এ প্রশ্নোত্তরে তা তো বলবেন?
-- এ তো ডাহা মিথ্যা কথা--ফুঁসে ওঠেন মাইতি!
-- সো হোয়াট! সেটা জেরায় প্রমাণ করবেন। মিথ্যা সাক্ষী দেওয়ার জন্য সাক্ষীর বিরুদ্ধে মামলা আনতে পারেন, অনেক কিছু করতে পারেন; কিন্তু বর্তমান মামলায় বাধা দিচ্ছেন কোন অধিকারে?
মাইতি অসহায়ভাবে বসে পড়েন।
বাসুর প্রশ্ন, এই কোর্ট রুমে আপনার স্বামী উপস্থিত আছেন?
সাক্ষী দর্শকমণ্ডলীর উপর দৃষ্টি বুলিয়ে বলেন, আমি জানি না। দেখতে পাচ্ছি না।
মাইতি উঠে দাঁড়ান। আবার বসে পড়েন।
বাসু তাঁর বাঁ হাতটা বাড়িয়ে বলেন, আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়ানো ঐ লোকটাকে ভালভাবে দেখুন...বলুন, ঐ লোকটাকে আপনি ইতিপূর্বে জীবনে কখনও দেখেছেন?
--না!
মুহুর্মুহু হাতুরির আঘাত সত্ত্বেও কোর্টরুমে নিস্তব্ধতা ফিরে আসতে পুরো এক মিনিট লাগল। জাস্টিস ভাদুড়ী এবার কিন্তু কাউকে ধমকালেন না।
বাসুর পরবর্তী প্রশ্ন, কাঠগড়ার ঐ লোকটা আপনার বিয়ে করা স্বামী, কাপাডিয়া আন্ড কাপাডিয়া কোম্পানির ম্যানেজার সুপ্রিয় দাশগুপ্ত, এম. এ. নয়?
-- না!
মাইতি আর আত্মসম্বরণ করতে পারেন না। লাফিয়ে ওঠেন, দিস ইস্ প্রিপস্টারাস মি’ লর্ড! এসব ওঁর অতি-নাটকীয় প্যাঁচ!
বাসু একধাপ এগিয়ে এসে উচ্চকণ্ঠে বলেন, মাননীয় আদালতের কাছে আমার একটি আর্জি আছে। যেহেতু এ পর্যন্ত বিচার আমার মক্কেল সুপ্রিয় দাশগুপ্তের অনুপস্থিতিতে সংঘটিত হয়েছে তাই আমি এ মামলার আদ্যন্ত নাকচ করবার প্রার্থনা জানাচ্ছি!
বিচারকক্ষে পুনরায় গণ্ডগোলের সুত্রপাত হতেই জাস্টিস্ ভাদুড়ী একবার জোরে হাতুড়ির আঘাত করেন। স্তব্ধতা ফিরে আসে। বিচারক বলেন, যেহেতু এখনও চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হয়নি যে, আপনার মক্কেলের অনুপস্থিতিতে এ মামলার অধিবেশন হয়েছে তাই আপনার প্রার্থনা এখনই মঞ্জুর করা যাচ্ছে না। য়ু মে প্রসীড!
-- দ্যাটস্ অল মি’ লর্ড! -- বাসু মাইতিকে বলেন, য়ু মে ক্রস-একজামিন হার।
আহত সিংহের মত লাফ দিয়ে ওঠেন মাইতি। নাটকীয়ভাবে সাক্ষীর সামনে এগিয়ে এসে বলেন, আপনি বললেন যে, এ লোকটা আপনার স্বামী নয়?
-- তাই বলছি!
-- তাহলে আপনার স্বামী কে?
-- সুপ্রিয় দাশগুপ্ত!
-- ঐ উনিই তো সুপ্রিয় দাশগুপ্ত!
-- হতে পারে ওঁরও তাই নাম, কিন্তু উনি আমার স্বামী নন!
মাইতি অসহায়ভাবে মাথা নাড়েন। বলেন, রাতারাতি কোথা থেকে আমদানি হলেন আপনি?
-- অবজেকশান য়োর অনার! সহযোগীর প্রশ্নের ভাষায় আমার আপত্তি।
-- অবজেকশান সাসটেইন্ড! আপনি সংযত ভাষায় প্রশ্ন করুন।
-- আপনার কটা বিয়ে?
-- অবজেকশান! সহযোগী আদালতের নির্দেশ মানছেন না। ওঁর ভাষা এখনও অশালীন!
জাস্টিস ভাদুড়ী মাইতিকে ধমক দেন, আপনি আপনার ভাষাকে সংযত করুন, না হলে ব্যাপারটা আমি আপনাদের বার-অ্যাসোসিয়েশানকে জানাতে বাধ্য হব!
মাইতি কিছু বলতে গেলেন। পারলেন না। মরিয়া হয়ে বললেন, আমি সময় চাইছি মি’ লর্ড। এ মেয়েছেলেটা কে, সে খবরটা --
-- অবজেকশান। ‘এই ভদ্রমহিলাকে’ বলুন!
মাইতি প্রায় তোৎলা হয়ে গেলেন।
জাস্টিস ভাদুড়ী বলেন, আপনারা দু-পক্ষ যদি রাজী থাকেন তাহলে আমি দশ মিনিটের জন্য কোর্ট স্থগিত রেখে আমার চেম্বারে আপনাদের দুজনের সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করতে চাই।আফটার অল, আমাদের উদ্দেশ্য সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করা।
বাসু বলেন, আমি রাজী, কিন্তু তার আগে আমি একটা কাজ করতে চাই। আমি জানি, এ ভদ্রমহিলার স্বামী এই আদালতে উপস্থিত আছেন। তাঁর জীবন সংশয়। তাঁকে সনাক্ত করে সর্বপ্রথম পুলিসের জিম্মায় দেওয়ার প্রয়োজন। আপনি কি ব্যাপারটা আমার হাতে ছেড়ে দেবেন?
-- ইয়েস! ডু আজ য়ু প্লীজ!
বাসু-সাহেব দর্শকমণ্ডলীর দিকে তাকিয়ে বললেন, মিস্টার সুপ্রিয় দাশগুপ্ত, ম্যানেজার, কাপাডিয়া অ্যান্ড কাপাডিয়া কোম্পানি, যদি এ আদালতে উপস্থিত থাকেন তবে দয়া করে উঠে দাঁড়ান।
দেখা গেল ভীড়ের মধো একজন একহারা ফর্সা ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়েছেন। তাঁরও বড় বড় জুলপি আছে। কিন্তু কোন মূর্খই তাকে আসামীর যমজ ভাই বলে ভুল করবে না --চেহারার সাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও।
-- আপনি এগিয়ে আসুন।
ধীর পদক্ষেপে ভদ্রলোক এগিয়ে আসেন।
আপনিই সুপ্রিয় দাশগুপ্ত --ম্যানেজার, কাপাডিয়া আ্যান্ড কাপাডিয়া কোম্পানি?--প্রশ্ন করেন বাসু।
-- হ্যাঁ!
-- সাক্ষীর মঞ্চে দাঁড়ানো ঐ সুবর্ণ দাশগুপ্ত আপনার স্ত্রী?
লোকটা মুখ তুলে তাকালো। দেখলো চোখের জলে ভেঙে যাচ্ছে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়ানো মেয়েটি। সে কিন্তু স্থির হয়ে দাড়িয়ে আছে। লোকটা বললে, হ্যাঁ, আমার স্ত্রী!
মাইতি বললেন, কিন্তু এটা আমরা মেনে নিতে রাজী নই। এরা দুজনেই জাল হতে পারে! সমস্ত ব্যাপারটাই একটা মেলোড্রামাটিক হচপচ হতে পারে।
জাস্টিস ভাদুড়ী বললেন, মিস্টার বাসু, আপনি কি কোন পথ দেখাতে পারেন যাতে প্রমাণ করা যায় -- এঁরা দুজন সত্যি কথা বলছেন, অর্থাৎ আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়ানো ঐ লোকটা সুপ্রিয় দাশগুপ্ত নয়?
-- কিছু সময় পেলে নিশ্চয় পারব. কিন্তু ঠিক এই মুহুর্তেই সেটা কেমন করে সম্ভব?
-- ভুল বললে বাসু! এই মুহুর্তেই সেটা প্রমাণ করা সম্ভব।
সকলের দৃষ্টি গেল ডিফেন্স কাউন্সেলারদের চিহ্নিত কোণাটায়। উঠে দাঁড়িয়েছেন অশীতিগর বৃদ্ধ ব্যরিস্টার এ. কে. রে। তিনি একটি বাও করে বলেন, আদালত যদি আমাকে অনুমতি দেন -- আমি পাঁচ মিনিটের ভিতর চূড়ান্তভাবে সমাধান করে দেব সমস্যাটা--
জাস্টিস ভাদুড়ী বলেন, ইয়েস! প্লীজ ডু ইট!
-- মিস্টার পান্ডে এখানে উপস্থিত! তিনি এই দু্জনের ফিঙ্গার-প্রিন্ট নিন। এখনই! তারপর ঐ নথিটা দিন। পিপলস এক্সিবিট নম্বর সেভেন; ওটা হল সাদার্ণ আভিন্যুর একটা বাড়ির বিক্রয়-কোবালা। বিক্রেতা পাওয়ার অফ এ্যাটর্নি হোল্ডার সুপ্রিয় দাশগুপ্ত। সাড়ে চার লাখ টাকার সম্পত্তি বিক্রয় করতে হলে সই ছাড়াও টিপছাপও দিতে হয়। মিস্টার পান্ডে ওটা দেখে পাঁচ মিনিটের ভিতর সনাক্তকরণ চূড়ান্তভাবে করে দিতে পারবেন ।
আধঘন্টার জন্য কোট অ্যাডজার্ন করে জজ-সাহেব তাঁর খাশ কামরায় চলে গেলেন। সেখানে ডাক পড়ল বাসু, মাইতি এবং এ.কে.রে-র। ইতিমধ্যে পান্ডে সাব তাঁর পরীক্ষাকার্য করে জানিয়েছেন, আসামী আর যেই হোক মোহনস্বরূপ কাপাডিয়ার ওকালতনামাধারী সুপ্রিয় ।দাশগুপ্ত নয়। দর্শকের আসন থেকে যে ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়েছিলেন তিনিই তাই।
জাস্টিস ভাদুড়ী বলেন, মিস্টার বাসু, আপনি যদি ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে দেন, তাহলে মামলাটায় -- অবশ্য মামলার নিষ্পত্তি তো হয়েই গেছে। আপনার মক্কেলের অনুপস্থিতিতে --
মাইতি বলেন, তা কেন? ওঁর মক্কেল তো ঐ আসামী। তার অপরাধ তো প্রমাণিত হয়েছে --
-- না হয়নি।-- বাধা দিয়ে বলেন এ. কে. রে -- মামলায় তাকে অসংখ্যবার ম্যানেজার, কাপাডিয়া অ্যান্ড কাপাডিয়া কোম্পানি বলে আপনি উল্লেখ করেছেন। সে পূনর্বিচার দাবী করতে পারে আইনত।
বাসু-সাহেব বলেন. সে সব কথা পরে। আপাততঃ এই নিন আমার দরখাস্ত! বর্তমান মামলার আসামী খোকন ওরফে লালু জামার মক্কেল নয়। স্টেট-ভার্সেস সুপ্রিয় দাশগুপ্তের মামলা ডিসমিস জানলেই আমার ছুটি।
জাস্টিস্ ভাদুড়ী বলেন, মামলা তো ডিসমিস হয়েই গেছে। শুধু আমার অ্যানাউন্স করা বাকি। কিন্তু রহস্যটা পরিষ্কার হল না বাসু-সাহেব।
বাসু হাত দুটি জোড় করে বলেন, -- আমার এক অনুগত ভক্ত আছে। সে গোয়েন্দা গল্প লেখে। কিছুদিনের মধ্যেই তার লেখা ছাপা বই বাজারে বেরুবে। আপনাকে না হয় এক কপি কমপ্লিমেন্টারি পাঠিয়ে দিতে বলব।
উঠে দাঁড়ান তিনি।
এ.কে.রে মাইতির দিকে ফিরে বললেন, আপনার নিমন্ত্রণে এসেছিলাম। আই এঞ্জয়েড ইট থরোলি। আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য ধন্যবাদ।
মাইতির মুখটা কালো হয়ে গেল। তবু কাষ্ঠ-হাসি হেসে শুধু বললেন, হেঁ হেঁ!
জাস্টিস্ ভাদুড়ী বললেন, অনেকদিন পরে আপনাকে দেখলাম রে-সাহেব! শরীর ভাল তো?
-- ভাল না থাকলে পর পর দুদিন অ্যাটেন্ড করি?
জাস্টিস্ ভাদুড়ী বলেন, বারওয়েল দ্য সেকেন্ড রিটায়ার করায় কলকাতার ‘বার’ কিন্তু কানা হয়ে রে-সাহেব।
রে বললেন, আই বেগ টু ডিফার। নূতন সূর্যের উদয় হয়েছে কলকাতার বারে -- পিয়ারী-ম্যাসন অফ দ্য ঈস্ট! অর্থাৎ সাদা বাংলায়ঃ পূর্বাঞ্চলের ‘মেরে পেয়ারী বাস্তুকার’।
শেষ পর্ব
কোর্ট-ফেরত সবাই এসে বসেছেন বাসু-সাহেবের বাড়ির সামনের লনে। বৈশাখী সন্ধ্যা, ঘরের চেয়ে বাইরেই আরামপ্রদ। তার উপর চাঁদনী রাত। গোল হয়ে বসেছেন বাসু, রানী, কৌশিক, সুজাতা. সুপ্রিয়, সুবর্ণ আর এ. কে. রে। বৃদ্ধ ব্যারিস্টার এখনও বাড়ি যাননি। ব্যাপারটা সব জেনে না গেলে নাকি তাঁর নিদ্রায় ব্যাঘাত হবে।
সুজাতা বললে, এবার বলুন বাসু-মামু। কী করে কী হল?
কৌশিক বাধা দিয়ে বলল, আমি কিন্তু ইন্টারেস্টেড জানতে, আপনি কোন পর্যায়ে কতটা বুঝতে পেরেছিলেন, কোন্ কোন্ ক্লুয়ের সাহায্যে এবং কখন বুঝলেন।
এ. কে. রে বলেন, অর্থাৎ আমাদের কাছে এটা আড্ডা! তোমার কাছে ট্রেনিং ক্লাস।
রানী বললেন, তা তো হবেই। এ. কে. রে-র পতাকা তুলে নিয়েছিলেন পি. কে. বাসু --
ভবিষ্যতে সেটাই তো বহন করবেন কে. মিত্র।
কৌশিক বললে, ভবিষ্যৎ পড়ে মরুক। আপাততঃ আমি হচ্ছি পেরি মেসনের সাকরেদ -- পল ড্রেক।কিন্তু আর দেরী নয়। শুরু করুন আপনি।
বিশু খাবারের ট্রে নিয়ে এসে পরিবেশন শুরু করল।
বাসু বললেন, শুরু আমি করব না, সুপ্রিয় বলে যাও তোমার অভিজ্ঞতা --
-- আমি সুবর্ণকে বলে এসেছিলাম, সাতদিনের জন্য কলকাতা যাচ্ছি। কেন যাচ্ছি, তা ও জানত না। মিস্টার কাপাডিয়ার নির্দেশে আমি ব্যাপারটা ওর কাছেও গোপন করি। কলকাতায় এসে পার্ক হোটেলে উঠি। আমি আর জীবনবাবু। গুডফ্রাইডের আগের দিন এগারোই বাড়িটা বিক্রি হল। যদুপতি নগদ দু-লক্ষ টাকা আমাকে হোটেলে পৌঁছে দিয়েছিল, এগারোই সকালে। সেটা হোটেলের ভল্টে রেখে আমরা রেজিস্ট্রেশান অফিসে যাই।
--হোটেলে আপনারা কত নম্বর ঘরে উঠেছিলেন?
-- 39 নম্বরে! ডবল্ বেড রুম। একসঙ্গেই ছিলাম। যাই হোক, রেজিস্ট্রেশান হয়ে গেলে জীবনবাবু যদুপতিকে বললেন, স্যার আমাদের মিষ্টিমুখ করিয়ে দেবেন না? যদুপতি ওকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গেল। তারপর ফিরে এসে আমাকে বলল, আজ রাত্রে আপনাকে ডিনারে নিমন্ত্রণ করছি। মোকাম্বোতে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়। আমি রাজী হই। আমি আর যদুপতি রাত নটা পর্যন্ত মোকাম্বোতে ছিলাম। তারপর ফিরে আসি হোটেলে। রাত দশটায় জীবন ফিরে আসে। সারাদিনের ধকলে আর কলকাতার গরমে আমার ভীষণ মাথা ধরেছিল। বেয়ারাটাকে ডেকে আমি সারিডন আনতে দিচ্ছিলাম। জীবন বললে, আনাতে হবে না, তার কাছেই আছে। সে আমাকে একটা ট্যাবলেট দেয়। আমি খেয়ে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ি। তারপরের কথা আর কিছু জানি না আমি। যখন জ্ঞান হয়, দেখি, আমি হাত-পা বাঁধা অবস্থায় কোন অজানা জায়গায় পড়ে আছি। মাঝে মাঝে একটি অচেনা স্ত্রীলোককে দেখেছি। জ্ঞান হলেই সে আমাকে একটা পানীয় খেতে দিত। প্রচণ্ড তেষ্টায় আমি সেটা ঢকঢক করে খেয়ে ফেলতাম। এখন হিসাব করে দেখছি, এভাবে সাতদিন আমি ঘুমিয়েছি। তারপর গতকাল শেষ রাত্রে কৌশিকবাবু আমাকে উদ্ধার করেন আসানসোল থেকে। এছাড়া আমি কিছুই জানি না।
বাসু-সাহেব ওর সূত্র তুলে নিয়ে বললেন, সমস্ত ব্যাপারটার মূল পরিকল্পনা হচ্ছে জীবন বিশ্বাসের। লোকটার সঙ্গে আন্ডার-ওয়ার্ল্ড-এর দু-একজনের জানাশোনা ছিল। মাসকতক আগে থেকেই সে জানতে পারে যে, মোহনস্বরূপ কাপাডিয়া এভাবে বাড়িটা বিক্রি করবেন। তখন থেকেই সে সক্রিয় হয়ে খোকন বা লালুর সঙ্গে যোগাযোগ করে। খোকন মিস্ ডি-সিলভার মাধ্যমে এই পরিকল্পনাটা ছকে। ডি. সিলভার এক ভাই রাঁচি উন্মাদাশ্রমে ছিল। সে তাকে নয় তারিখে ওখান থেকে খালাস করে এনে পার্ক-হোটেলে তোলে এবং নয়-দশ তারিখে বারে বারে তাকে গাড়ি করে নিয়ে বার হয়। ওর ভাই ছিল জড়ভরত প্রকৃতির পাগল। তাই এতে তার কোন অসুবিধা হয়নি। দশ তারিখে সে তাকে কলকাতার কোন প্রাইভেট উন্মাদাগারে ভর্তি করে দিয়ে একাই ফিরে আসে। হোটেলের সবাই জানত ভাইটি হোটেলেই আছে। এগারোই রাত্রে বড়বাজারে জৈনের গদিতে ডাকাতি করে খোকন এসে আশ্রয় নেয় ডি. সিলভার ঘরে। মধ্যরাতে সুপ্রিয় অজ্ঞান হয়ে গেলে তাকে ধরাধরি করে পাশের ঘরে আনা হয় এবং খোকন সুপ্রিয়র সীটে চলে যায়। বারো তারিখ সকালেই ডি. সিলভা একটা অ্যাম্বাসাডারে করে বর্ধমান চলে যায়। সঙ্গে যায় অজ্ঞান অবস্থায় আসল সুপ্রিয়, তার ভায়ের পরিচয়ে।
কৌশিক বলে, আমি ব্যাপারটা বুঝলাম না। সুপ্রিয়বাবু, আপনি কী জীবনবাবুকে বম্বে মেলে তিনখানা টিকিট কাটতে বলেননি।
-- আদৌ না। আমার প্লেনে ফেরার কথা ছিল। টিকিটও কাটা ছিল।
-- তাহলে?
বাসু-সাহেব বলেন, জীবন বিশ্বাসের পরিকল্পনাটা তুমি বুঝতে পারনি কৌশিক। তার প্ল্যান ছিল -- বম্বে মেলে ওরা দু’জন, জীবন আর খোকন রওনা হবে। রেলওয়ে রেকর্ড-এ থাকবে -- ক্যুপেতে ছিলেন মিস্টার অ্যান্ড মিসেস দাশগুপ্ত আর তার পাশের কম্পার্টমেন্টে যাচ্ছিলেন জীবন বিশ্বাস। গাড়ি বর্ধমানে পৌঁছালে মিস্ ডি. সিলভা তার তথাকথিত অসুস্থ ভাই, অর্থাৎ সুপ্রিয় দাশগুপ্তকে নিয়ে বিনা টিকিটে কামরায় উঠবে। সেই আসল সুপ্রিয় দাশগুপ্তকে শুইয়ে দেওয়া হবে ক্যুপের লোয়ার বার্থে। তারপর খোকন আর ডি. সিলভা বর্ধমানেই নেমে যাবে দু-লাখ টাকা সমেত। রাত ভোর হলে জীবন এ কামরায় এসে চীৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দেবে। দেখা যাবে, সুপ্রিয় বিষ খেয়ে মারা গেছে এবং তার দুটি স্যুটকেস নেই। জীবন ধরা-ছোঁওয়ার মধ্যে নেই। সে তার ম্যানেজারের নির্দেশে তিনখানা টিকিট কেটেছে। ম্যানেজার সুপ্রিয় কোথা থেকে একটা অসৎচরিত্রের মেয়েছেলে জুটিয়ে এনেছিল তা সে কেমন করে জানবে? তার সন্দেহ হয়েছিল কিনা?--হ্যাঁ! হয়েছিল। তাই ঘটনার অনেক আগে সে ক্রিমিনাল ব্যারিস্টার বাসু-সাহেবকে তার আশঙ্কার কথা জানিয়েছিল। বিশ্বাস না হয়, তাঁকে জিজ্ঞাসা করুন।
সুজাতা বলে, চমৎকার প্ল্যান!
কৌশিক বলে, দাঁড়াও, দাঁড়াও! তাহলে এ জৈন-সাহেবের রিভলভারটা ও কামরায় এল কেমন করে?
বাসু হেসে বলেন, সেটা জীবনের পরিকল্পনা অনুযায়ী নয়। খোকনের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ঐ ডি. সিলভার সঙ্গে যৌথভাবে। ওরা দু-জনে হচ্ছে বর্ন-ক্রিমিনাল। দু-লাখ টাকা তিনভাগ করার চেয়ে তারা দু-জনে সেটাকে দু-ভাগ করতে চাইল। যাকে বলে ডবল্-ক্রস। ব্যবস্থা করা হল -- ট্রেন ছাড়ার আগে ওদের দলের একজন একটা লোডেড রিভলভার খোকনকে পৌঁছে দেবে। রুদ্ধদ্বার সি-ক্যুপেতে অতি অনায়াসে খোকন জীবনকে হত্যা করত। ট্রেন বর্ধমানে পৌছালে জীবনের মৃতদেহকেও ঐ ক্যুপেতে রেখে তারা সুযোগমত বর্ধমানে বা আসানসোলে নেমে যেত। পরদিন জোড়াখুন আবিষ্কৃত হত ঐ ক্যুপেতে। কেউ জানতে পারত না -- কে খুন করে টাকাটা নিয়ে ভেগেছে!
রানী বলেন, তাহলে জৈনকে কে খুন করেছিল?
-- খুব সম্ভব খোকন নিজেই। সুকুমার বোস-এর এভিডেন্স থেকে তাই মনে হয়। আপনি কী বলেন? বাসু-সাহেব প্রশ্ন করেন এ. কে. রে-কে।
-- আই বেগ টু ডিফার!--বললেন এ. কে. রে। একহারা চেহারা, ফর্সা রঙ আর বড় বড় জুলফি ছাড়া আর কোন যুক্তি নেই।
কিন্তু বিরুদ্ধ যুক্তিও কিছু লেই।--বললেন বাসু-সাহেব।
-- আছে। প্রকাণ্ড একটা বিরুদ্ধ যুক্তি আছে। তাই যদি হত, তাহলে জৈনের রিভলভারটা এগারোই রাত্রে খোকনের কাছে থাকারই সম্ভাবনা। সে-ক্ষেত্রে ট্রেনে অন্য কেউ তাকে এ রিভলভারটা পৌঁছে দিতে আসত না। এগারোই তারিখ থেকে তার পকেটে থাকত একটা রিভলভার, যার নম্বর 759362।
সুজাতা অবাক হয়ে বললে, নম্বরটা মুখস্থ আছে এখনও!
-- বাই! কোর্টে স্বকর্ণে শুনলাম যে!
কৌশিক বললে, সে তো আমরাও শুনেছি। ভুলে মেরে দিয়েছি।
এ. কে. রে বললেন, তাহলে কোনদিন ‘পল-ড্রেক অব দ্য ঈস্ট’ হতে পারবে না তুমি! কিন্তু একটা ব্যাপার এখনও পরিষ্কার হয়নি। সুপ্রিয়বাবু -- তুমি কি এগারোই সকালে লেট-ল্যামেন্টেড মিস্টার জৈনের বাড়িতে ফোন করেছিলে?
-- না তো! ফোন করব কেন?
-- ধর, এ হুন্ডির ব্যবস্থা পাকা করতে?
-- সে কথা তো হয়েই ছিল তাঁর সঙ্গে। নেহাৎ তিনি রাজি না হলে আমি অন্য কারও দ্বারস্থ হতাম।কাপাডিয়া কোম্পানির ম্যানেজার হিসাবে আমি কলকাতার অনেক ধনী ব্যবসায়ীকে চিনি। আর কাউকে না পেলে যদুপতির কাছ থেকে হুন্ডি নিতাম।
-- যদুপতি রাজী না হলে --
অ্যাট লিস্ট দু-লাখ টাকা স্যুটকেসে নিয়ে বোম্বাই মেলে যেতাম না। হয় কোন ব্যাঙ্ক ভল্টে রাখতাম -- নেহাৎ না হয় প্লেনে নিয়ে যেতাম টাকাটা!
কৌশিক বলে, এবার আপনি বলুন স্যার, কেমন করে আন্দাজ করলেন ব্যাপারটা।
বাসু-সাহেব বুঝিয়ে বলেন, আমার প্রথম সন্দেহ জাগে জীবন ঠিক যে মুহূর্তে প্রথমবার আমার কক্ষে ঢোকে। কিন্তু সেটা আমি বুঝিয়ে বলতে পারব না। সেটা একটা অনুভূতি। আমার সন্দেহ জাগে। জীবন যে সন্দেহজনক ব্যাক্তি এ আশঙ্কা তোমাদের সকলেরই হয়েছিল। আমার খটকা লাগল মোহনস্বরূপ কাপাডিয়ার একটি টেলিগ্রামের একটি শব্দে। উনি লিখেছেন, ‘হিজ ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড এফিসিয়েন্সি ইজ বিয়ন্ড কোশ্চেন’ অর্থাৎ তার সততা আর কর্মদক্ষতা, সন্দেহের অতীত। এ ‘কর্মদক্ষতা’ শব্দটায় খটকা লাগল আমার! মোহনস্বরূপ একজন কোটিপতি -- তাঁর ম্যানেজারের ‘কর্মদক্ষতার’ বিষয়ে এতবড় সার্টিফিকেট তিনি কেন দিলেন? অমন দক্ষ ম্যানেজার বোম্বাই মেল-এ স্যুটকেসে করে পাচার করা ছাড়া আর কোন রাস্তা খুজে পেল না! দু-লাখ টাকা! দ্বিতীয়ত এতবড় কোম্পানির ম্যানেজার খুনের মামলায় জড়িয়ে পড়ল অথচ বোম্বাই থেকে কোন সাড়া-শব্দ নেই কেন? মালিক না হয় বিদেশে -- কিন্তু আর সবাই তো আছে --
-- কিন্তু ওরা দু-জন তো গোপনে সম্পত্তিটা বেচতে এসেছিল। আর কেউ হয়ত জানে না --
-- মানলাম। কিন্তু স্বাভাবিক হতো কী? এক্ষেত্রে জীবন নিজেই ট্রাঙ্ককল করে হেড অফিসে জানাতো, কোন একটা কাজে মালিকের নির্দেশে কলকাতা এসে ওরা ভীষণ বিপদে পড়েছে?
-- তা ঠিক।
-- তৃতীয়ত, খুনের মামলায় যে লোকটা ফাঁসী যেতে বসেছে সে তার উকিলের মাধ্যমে বাবা-দাদা-শত্রু-বন্ধু কাউকে খবরটা জানাবে না? সাহায্য চাইবে না? চতুর্থত, স্ত্রীর আগমন আশঙ্কায় সে অমন শিউরে উঠল কেন? আর সবচেয়ে বড় কন্ট্রাডিকশান হচ্ছে সুপ্রিয় দাশগুপ্তের চরিত্র-চিত্রণ! পান্ডে সাহেবের আঁকা ছবির সঙ্গে মোহনস্বরূপের আঁকা ছবিখানার আশমান-জমীন ফারাক! আমার মনে হল -- দুটো লোক আলাদা । সেটা নিঃসন্দেহ হলাম যখন আলিপুরের হাজতে আসামী তার স্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে অস্বীকার করল। তার আগেই অবশ্য আমার সন্দেহ হয়েছিল -- ডি. সিলভার হেপাজতেই আছে আসল সুপ্রিয়। আসামী যদি সুপ্রিয় না হয় তাহলে কখন সে সুপ্রিয়ের চরিত্রে অভিনয় শুরু করেছে? নিঃসন্দেহে এগারোই দুপুরের পরে! কারণ দলিলে নিশ্চয় আসল সুপ্রিয় সই করেছে। সেটা সন্দ্হোতীতরূপে দেখে নেবে যদুপতি। অথচ যদুপতি বলছে রাত নটা পর্যন্ত সে আসল সুপ্রিয়কে দেখেছে। যদুপতির মিথ্যাভাষণের কোন যুক্তিপূর্ণ কারণ নেই। সে আসল সুপ্রিয়কে নিশ্চিত চেনে. যেহেতু রেজিস্ট্রেশান অফিসে তাকে সনাক্ত হতে দেখেছে। তাহলে এগারোই রাত নটার পর এবং বারই বেলা দশটার আগে --
-- কেন, বারই বেলা দশটার আগে কেন? প্রশ্ন করে সুজাতা।
-- যেহেতু বারো তারিখ বেলা দশটায় কৌশিক পার্ক হোটেলে থেকে টেলিফোনে জানায় সে সুপ্রিয়কে দেখেছে, যে-সুপ্রিয়কে সে আদালতে আসামীর কাঠগড়ায় দেখেছে ফলে, এ রাত্রেই মানুষটার বদল হয়েছে। ঐ পার্ক হোটেল থেকেই। অথচ দেখা যাচ্ছে, এ বারো তারিখেই বেলা নয়টার সময় ওদের পাশের ঘর থেকে মিস ডি: সিলভা তার পাগল ভাইকে নিয়ে হোটেল ছেড়ে চলে যায়। বাই রোড -- দিল্লী রোড ধরে। বাকিটা দুইয়ে দুইয়ে চার... .
ঠিক সেই সময়েই একটা প্রকাণ্ড গাড়ি এসে থামল পোর্টিকোতে। নেমে এলেন একজন সুসজ্জিত যুবক। তাঁকে দেখে সুপ্রিয় উঠে দাঁড়ায়, হ্যালো! আপনি?
ভদ্রলোক গরুড়পক্ষীর মত হাত দুটি জোড় করে বলেন, চ্ছ্মা মাংতে এসেছি! আর ছিপিয়ে থাকার জরুরৎ না আছে৷
সুপ্রিয় বলে, আপনাদের সঙ্গে এর পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি হচ্ছেন, . , .
বাধা দিয়ে কৌশিক বলে, প্রয়োজন হবে না। ওর ভাষাতেই আমাদের মালুম হয়েছে!
ভদ্রলোক একগাল হেসে বলেন, আমিও আপনাকে পহচানতে পেরেছি সুকৌশলীদাদা!
কৌশিক বলে, আপনার গাড়ির ডায়নামো ঠিক হয়ে গেছে?
-- বিলকুল!
-- আর সেই মাছের কাঁটাটা?
-- না-পাত্তা-- তারপর হঠাৎ নাটকীয় ভঙ্গিতে কৌশিকের সামনে মাথাটা নিচু করে যোগ করেন, মাথা পাতিয়ে দিলাম সুকৌশলীদাদা! অগর চাহেন তো এক ঝাপড় মারুন! লেকিন শালা-বাহানচোৎ করবেন না!
-- বলেই পান-জর্দায় লাল আধ-হাত জিব বার করেন। দু’টি হাত কানে ছুঁইয়ে যোগ করেন, সীয়ারাম! বিলকুল নজর হোয় নাই। লেডিসরা আছেন ইখানে!
(শেষ)
No comments:
Post a Comment