সত্যান্বেষী (প্রথমাংশ)

লেখক: শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়


সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সীর সহিত আমার প্রথম পরিচয় হইয়াছিল সন তেরশ’ একত্রিশ সালে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগুলি শেষ করিয়া সবেমাত্র বাহির হইয়াছি। পয়সার বিশেষ টানাটানি ছিল না, পিতৃদেব ব্যাঙ্কে যে টাকা রাখিয়া গিয়াছিলেন, তাহার সুদে আমার একক জীবনের খরচা কলিকাতার মেসে থাকিয়া বেশ ভদ্রভাবেই চলিয়া যাইত। তাই স্থির করিয়াছিলাম, কৌমার্য ব্রত অবলম্বন করিয়া সাহিত্যচর্চায় জীবন অতিবাহিত করিব। প্রথম যৌবনের উদ্দীপনায় মনে হইয়াছিল, একান্তভাবে বাগদেবীর আরাধনা করিয়া বঙ্গ-সাহিত্যে অচিরাৎ যুগান্তর আনিয়া ফেলিব। এই সময়টাতে বাঙালীর সন্তান অনেক ভাল স্বপ্ন দেখে,–যদিও সে-স্বপন ভাঙিতেও বেশী বিলম্ব হয় না।

কিন্তু ও কথা থাক। ব্যোমকেশের সহিত কি করিয়া পরিচয় হইল এখন তাহাই বলি।

যাঁহারা কলিকাতা শহরের সহিত ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত, তাঁহাদের মধ্যেও অনেকে হয়তো জানেন না যে এই শহরের কেন্দ্রস্থলে এমন একটি পল্লী আছে, যাহার এক দিকে দুঃস্থ ভাটিয়া-মাড়োয়ারী সম্প্রদায়ের বাস, অন্য দিকে খোলার বস্তি এবং তৃতীয় দিকে তির্যক্‌চক্ষু পীতবর্ণ চীনাদের উপনিবেশ। এই ত্রিবেণী সঙ্গমের মধ্যস্থলে যে ‘ব’-দ্বীপটি সৃষ্টি হইয়াছে, দিনের কর্ম-কোলাহলে তাহাকে দেখিয়া একবারও মনে হয় না যে ইহার কোনও অসাধারণত্ব বা অস্বাভাবিক বিশিষ্টতা আছে। কিন্তু সন্ধ্যার পরেই এই পল্লীতে এক আশ্চর্য পরিবর্তন ঘটিতে আরম্ভ করে। আটটা বাজিতে না বাজিতেই দোকানপাট সমস্ত বন্ধ হইয়া পাড়াটা একেবারে নিস্তব্ধ হইয়া যায়; কেবল দূরে দূরে দু’একটা পান বিড়ির দোকান খোলা থাকে মাত্র। সে সময় যাহারা এ অঞ্চলে চলাফেরা করিতে আরম্ভ করে, তাহারা অধিকাংশই নিঃশব্দে ছায়ামূর্তির মত সঞ্চরণ করে এবং যদি কোনও অজ্ঞ পথিক অতর্কিতে এ পথে আসিয়া পড়ে, সে-ও দ্রুতপদে যেন সন্ত্রস্তভাবে ইহার এলাকা অতিক্রম করিয়া যায়।

আমি কি করিয়া এই পাড়াতে আসিয়া এক মেসের অধিবাসী হইয়া পড়িয়াছিলাম তাহা বিশদ করিয়া লিখিতে গেলে পুঁথি বাড়িয়া যাইবে। এইটুকু বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, দিনের বেলা পাড়াটা দেখিয়া মনে কোনও প্রকার সন্দেহ হয় নাই এবং মেসের দ্বিতলে একটী বেশ বড় হাওয়াদার ঘর খুব সস্তায় পাইয়া বাক্যব্যয় না করিয়া তাহা অধিকার করিয়াছিলাম। পরে যখন জানিতে পারিলাম যে, এই পাড়ায় মাসের মধ্যে দুই তিনটা মৃতদেহ ক্ষতিবিক্ষত অবস্থায় রাস্তায় পড়িয়া থাকিতে দেখা যায় এবং নানা কারণে সপ্তাহে অন্তত একবার করিয়া পুলিস-রেড্‌ হইয়া থাকে, তখন কিন্তু বাসাটার উপর এমন মমতা জন্মিয়া গিয়াছে সে, আবার তল্পিতল্পা তুলিয়া নূতন বাসায় উঠিয়া যাইবার প্রবৃত্তি নাই। বিশেষতঃ সন্ধ্যার পর আমি নিজের লেখাপড়ার কাজেই নিমগ্ন হইয়া থাকিতাম, বাড়ির বাহির হইবার কোনও উপলক্ষ ছিল না; তাই ব্যক্তিগত ভাবে বিপদে পড়িবার আশঙ্কা কখনও হয় নাই।

আমাদের বাসার উপরতলায় সর্বসুদ্ধ পাঁচটি ঘর ছিল, প্রত্যেকটিতে একজন করিয়া ভদ্রলোক থাকিতেন। তাঁহারা সকলেই চাকরীজীবী এবং বয়স্ক; শনিবারে শনিবারে বাড়ী যাইতেন, আবার সোমবারে ফিরিয়া অফিস যাতায়াত আরম্ভ করিতেন। ইঁহারা অনেকদিন হইতে এই মেসে বাস করিতেছেন। সম্প্রতি একজন কাজ হইতে অবসর লয়া বাড়ী চলিয়া যাওয়াতে তাঁহারই শূন্য ঘরটা আমি দখল করিয়াছিলেন। সন্ধ্যার পর তাসের বা পাশার আড্ডা বসিত–সেই সময় মেসের অধিবাসীদের কণ্ঠস্বর ও উত্তেজনা কিছু উদ্রভাব ধারণ করিত। অশ্বিনীবাবু পাকা খেলোয়াড় ছিলেন,–তাঁহার স্থায়ী প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ঘনশ্যামবাবু। ঘনশ্যামবাবু হারিয়া গেলে চেঁচামেচি করিতেন। তারপর ঠিক নয়টার সময় বামন ঠাকুর আসিয়া জানাইত যে আহার প্রস্তুত; তখন আবার ইঁহারা শান্তভাবে উঠিয়া আহার সমাধা করিয়া যে যাহার ঘরে শুইয়া পড়িতেন। এইরূপ নিরুদ্বেগ শান্তিতে মেসের বৈচিত্রহীন দিনগুলি কাটিতেছিল; আমিও আসিয়া নির্বিবাদে এই প্রশান্ত জীবনযাত্রা বরণ করিয়া লইয়াছিলাম।

বাসার নীচের তলার ঘরগুলি লইয়া বাড়িওয়ালা নিজে থাকিতেন। ইনি একজন হোমিওপ্যাথ ডাক্তার–নাম অনুকুলবাবু। বেশ সরল সদালাপী লোক। বোধ হয় বিবাহ করেন নাই, কারণ, বাড়িতে স্ত্রী পরিবার কেহ ছিল না। তিনি মেসের খাওয়া-দাওয়া ও ভাড়াটেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য সম্বন্ধে তত্ত্বাবধান করিতেন। এমন পরিপাটীভাবে তিনি সমস্ত কাজ করিতেন যে, কোনও দিক্‌ দিয়া কাহারও অনুযোগ করিবার অবকাশ থাকিত না, মাসের গোড়ায় বাড়িভাড়া ও খোরাকি বাবদ পঁচিশ টাকা তাঁহার হাতে ফেলিয়া দিয়া সকল বিষয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যাইত।

পাড়ার দরিদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে ডাক্তারের বেশ পসার ছিল। সকালে ও বিকালে তাঁহার বসিবার ঘরে রোগীর ভিড় লাগিয়া থাকিত। তিনি ঘরে বসিয়া সামান্য মূল্যে ঔষধ বিতরণ করিতেন। রোগীর বাড়িতে বড় একটা যাইতেন না, গেলেও ভিজিট লইতেন না। এই জন্য পাড়া-প্রতিবাসী সকলেই তাঁহাকে অত্যন্ত খাতির ও শ্রদ্ধা করিত। আমিও অল্পকালের মধ্যে তাঁহার ভারি অনুরক্ত হইয়া পড়িয়াছিলাম। বেলা দশটার মধ্যে মেসের অন্যান্য সকলে অফিসে চলিয়া যাইত, বাসায় আমরা দুইজনে পড়িয়া থাকিতাম। স্নানাহার প্রায় একসঙ্গেই হইত, তারপর দুপুরবেলাটাও গল্প-গুজবে সংবাদপত্রের আলোচনায় কাটিয়া যাইত, ডাক্তার অত্যন্ত নিরীহ ভালমানুষ লোক হইলেও ভারি চমৎকার কথা বলিতে পারিতেন। বয়স বছর চল্লিশের ভিতরেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও উপাধিও তাঁহার ছিল না, কিন্তু ঘরে বসিয়া এত বিভিন্ন বিষয়ের জ্ঞান তিনি অর্জন করিয়াছিলেন যে, তাঁহার কথা শুনিতে শুনিতে বিস্ময় বোধ হইত। বিস্ময় প্রকাশ করিলে তিনি লজ্জিত হইয়া বলিতেন–“আর তো কোনও কাজ নেই, ঘরে বসে বসে কেবল বই পড়ি। আমার যা কিছু সংগ্রহ সব বই থেকে।”

এই বাসায় মাস দুই কাটিয়া যাইবার পর একদিন বেলা আন্দাজ দশটার সময় আমি ডাক্তারবাবুর ঘরে বসিয়া তাঁহার খবরের কাগজখানা উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিতেছিলাম। অশ্বিনীবাবু পান চিবাইতে চিবাইতে অফিস চলিয়া গেলেন; তারপর ঘনশ্যামবাবু বাহির হইলেন, দাঁতের ব্যথার জন্য এক পুরিয়া ঔষধ ডাক্তারবাবুর নিকট হইতে লইয়া তিনিও অফিস যাত্রা করিলেন। বাকি দুইজনও একে একে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। সারা দিনের জন্য বাসা খালি হইয়া গেল।

ডাক্তারবাবুর কাছে তখনও দু’একজন রোগী ছিল, তাহারা ঔষধ লইয়া একে একে বিদায় হইলে পর তিনি চশমাটা কপালে তুলিয়া দিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন–“কাগজে কিছু খবর আছে না কি?

“কাল বৈকালে আমাদের পাড়ায় খানাতল্লাসী হয়ে গেছে।”

ডাক্তার হাসিয়া বলিলেন–“সে তো নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। কোথায় হল?”

“কাছেই–ছত্রিশ নম্বরে। শেখ আবদুল গফুর বলে একটা লোকের বাড়িতে।”

ডাক্তার বলিলেন–“আরে লোকটাকে যে আমি চিনি, প্রায়ই আমার কাছে ওষুধ নিতে আসে।–কি জন্যে খানাতল্লাসী হয়েছে, কিছু লিখেছে?”

“কোকেন। এই পড়ুন না!” বলিয়া আমি ‘দৈনিক কালকেতু’ তাঁহার দিকে আগাইয়া দিলাম।

ডাক্তার চশমা-জোড়া পুনশ্চ নাসিকার উপর নামাইয়া পড়িতে লাগিলেন।–

“গতকল্য–অঞ্চলে ছত্রিশ নং–স্ট্রীটে শেখ আবদুল গফুর নামে জনৈক চর্ম-ব্যবসায়ীর বাড়িতে পুলিসের খানাতল্লাসী হইয়া গিয়াছে। কিন্তু কোনও বে-আইনী মাল পাওয়া যায় নাই। পুলিসের অনুমান, এই অঞ্চলে কোথাও একটি কোকেনের গুপ্ত আড়ত আছে, সেখান হইতে সর্বত্র কোকেন সরবরাহ হয়। এক দল চতুর অপরাধী পুলিসের চোখে ধুলি নিক্ষেপ করিয়া বহুদিন যাবৎ এই আইন-বহির্গত ব্যবসা চালাইতেছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, এই অপরাধীদের নেতা কে এবং ইহাদের গুপ্ত ভাণ্ডার কোথায়, তাহা বহু অনুসন্ধানেও নির্ণয় করা যাইতেছে না।”

ডাক্তার একটু চিন্তা করিয়া কহিলেন–“কথাটা ঠিক। আমারও সন্দেহ হয় কাছে-পিঠে কোথাও কোকেনের একটা মস্ত আড্ডা আছে। দু’একবার তার ইশারা আমি পেয়েছি,–জানেন তো নানা রকম লোক ওষুধ নিতে আমার কাছে আসে। আর যাই করুক, যে কোকেনখোর, সে ডাক্তারের কাছে কখনও আত্মগোপন করতে পারে না।–কিন্তু ঐ আবদুল গফুর লোকটাকে তো আমার কোকেনখোর বলে মনে হয় না। বরং সে যে পাকা আফিংখোর এ কথা জোর করে বলতে পারি। সে নিজেও সে কথা গোপন করে না।”

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম–“আচ্ছা, অনুকূলবাবু, এ পাড়ায় যে এত খুন হয়, তার কারণ কি?”

ডাক্তার বলিলেন–“তার তো খুব সহজ হিসাব রয়েছে। যারা গোপনে আইন ভঙ্গ করে একটা বিরাট ব্যবসা চালাচ্ছে, তাদের সর্বদাই ভয়–পাছে ধরা পড়ে। সুতরাং দৈবক্রমে যদি কেউ তাদের গুপ্তকথা জানতে পেরে যায়, তখন তাকে খুন করা ছাড়া অন্য উপায় থাকে না। ভেবে দেখুন, আমি যদি কোকেনের ব্যবসা করি আ আপনি যদি দৈবাৎ সে কথা জানতে পেরে যান, তাহলে আপনাকে বাঁচতে দেওয়ার আমার পক্ষে আর নিরাপদ হবে কি? আপনি যদি কথাটি পুলিসের কাছে ফাঁস করে দেন, তাহলে আমি তো জেনে যাবই, সঙ্গে সঙ্গে এতবড় একটা ব্যবসা ভেস্তে যাবে। লক্ষ লক্ষ টাকার মাল বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে। আমি তা হতে পারি?” বলিয়া তিনি হাসিতে লাগিলেন।

আমি বলিলাম–“আপনি অপরাধীদের মনস্তত্ত্ব বেশ অনুশীলন করেছেন দেখছি!”

“হ্যাঁ। ওদিকে আমার খুব ঝোঁক আছে!” বলিয়া আড়মোড়া ভাঙিতে ভাঙিতে তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন।

আমিও উঠি-উঠি করিতেছি, এমন সময় একটি লোক আসিয়া প্রবেশ করিল। তাহার বয়স বোধ করি তেইশ-চব্বিশ হইবে, দেখিলে শিক্ষিত ভদ্রলোক বলিয়া মনে হয়। গায়ের রঙ ফরসা, বেশ সুশ্রী সুগঠিত চেহারা,–মুখে চোখে বুদ্ধির একটা ছাপ আছে। কিন্তু বোধ হয়, সম্প্রতি কোনও কষ্টে পড়িয়াছে; কারণ, বেশভূষার কোনও যত্ন নাই, চুলগুলি অবিন্যস্ত, গায়ের কামিজটা ময়লা, এমন কি পায়ের জুতাজোড়াও কালির অভাবে রুক্ষভাব ধারণ করিয়াছে। মুখে একটা উৎকণ্ঠিত আগ্রহের ভাব। আমার দিক হইতে অনুকূল্বাবুর দিকে ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করিল–“শুনলুম এটা একটা মেস–জায়গা খালি আছে কি?”

ঈষৎ বিস্ময়ে আমরা দু’জনেই তাহার দিকে চাহিয়াছিলাম, অনুকূলবাবু মাথা নাড়িয়া বলিলেন–“না। মশায়ের কি করা হয়?”

লোকটি ক্লান্তভাবে রোগীর বেঞ্চের উপর বসিয়া পড়িয়া বলিল–“উপস্থিত চাকরির জন্য দরখাস্ত দেওয়া আর মাথা গোঁজবার একটা আস্তানা খোঁজা হয়। কিন্তু এই হতভাগা শহরে একটা মেসও কি খালি পাবার যো নেই–সব কানায় কানায় ভর্তি হয়ে আছে।”

সহানুভূতির স্বরে অনুকূলবাবু বলিলেন–“সীজনের মাঝখানে মেসে-বাসায় জায়গা পাওয়া বড় মুসকিল। মশায়ের নামটি কি?”

“অতুলচন্দ্র মিত্র। কলকাতায় এসে পর্যন্ত চাকরির সন্ধানে টো-টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছি। দেশে ঘটি-বাটি বিক্রি করে যে-ক’টা টাকা এনেছিলুম, তাও প্রায় শেষ হয়ে এল–গুটি পঁচিশ-ত্রিশ বাকী আছে। কিন্তু দু’বেলা হোটেলে খেলে সেও আর কদ্দিন বলুন? তাই একটা ভদ্রলোকের মেস খুঁজছি–বেশি দিন নয়, মাসখানেকের মধ্যেই একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাবে–এই ক’টা দিনের জন্য দু’বেলা দুটো শাকভাত আর একটু জায়গা পেলেই আর আমার কিছু দরকার নেই।”

অনুকূলবাবু বলিলেন–“বড় দুঃখিত হলাম অতুলবাবু, কিন্তু আমার এখানে সব ঘরই ভর্তি।”

অতুল একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল–“তবে আর উপায় কি বলুন–আবার বেরুই। দেখি যদি ওড়িয়াদের আড্ডায় একটু জায়গা পাই।–আর তো কিছু নয়, ভয় হয়, রাত্তিরে ঘুমুলে হয়তো টাকাগুলো চুরি করে নেবে।–এক গেলাস জল খাওয়াতে পারেন?”

ডাক্তার জল আনিতে গেলেন। লোকটির অসহায় অবস্থা দেখিয়া আমার মনে বড় দয়া হইল। একটু ইতস্তত করিয়া বলিলাম–“আমার ঘরটা বেশ বড় আছে–দু’জনে থাকলে অসুবিধা হবে না। তা–আপনার যদি আপত্তি না থাকে–”

অতুল লাফাইয়া উঠিয়া বলিল–“আপত্তি? বলে কি মশায়–স্বর্গ হাতে পাব।” তাড়াতাড়ি ট্যাঁক হইতে কতকগুলো নোট ও টাকা বাহির করিয়া বলিল–“কত দিতে হবে? টাকাটা আগাম নিয়ে নিলে ভাল হত না? আমার কাছে আবার–”

তাহার আগ্রহ দেখিয়া আমি হাসিয়া বলিলাম–“থাক্‌, টাকা পরে দেবেন অখন–তাড়াতাড়ি কিছু নেই–” ডাক্তারবাবু জল লইয়া ফিরিয়া আসিলেন, তাঁহাকে বলিলাম–“ইনি সঙ্কটে পড়েছেন তাই আপাতত আমার ঘরেই থাকুন–আমার কোনও কষ্ট হবে না।”

অতুল কৃতজ্ঞতাগদ্‌গদ স্বরে বলিল–“আমার ওপর ভারি দয়া করেছেন ইনি! কিন্তু বেশি দিন আমি কষ্ট দেব না–ইতিমধ্যে যদি অন্য কোথাও জায়গা পেয়ে যাই, তাহলে সেখানেই উঠে যাব।” বলিয়া জলপানান্তে গেলাসটা নামাইয়া রাখিল।

ডাক্তার একটু বিস্মিতভাবে আমার দিকে ফিরিয়া বলিলেন–“আপনার ঘরে? তা–বেশ। আপনার যখন অমত নেই, তখন আমি কি বলব? আপনার সুবিধাও হবে–ঘরভাড়াটা ভাগাভাগি হয়ে যাবে–”

আমি তাড়াতাড়ি বলিলাম–“সে জন্য নয়–উনি বিপদে পড়েছেন–”

ডাক্তার হাসিয়া বলিলেন–“সে তো বটেই। –তা আপনি আপনার জিনিসপত্র নিয়ে আসুন গে, অতুলবাবু। এইখানেই আপাতত থাকুন।”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। জিনিসপত্র সামান্যই–একটা বিছানা আর ক্যাম্বিসের ব্যাগ। এক হোটেলের দারোয়ানের কাছে রেখে এসেছি–এখনই নিয়ে আসছি।”

আমি বলিলাম–“হ্যাঁ–স্নানাহার এখানেই করবেন।”

“তাহলে তো ভালই হয়।”–কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে আমার পানে চাহিয়া অতুল বাহির হইয়া গেল। সে চলিয়া গেলে আমরা কিছুক্ষণ নীরব হইয়া রহিলাম। অনুকূলবাবু অন্যমনস্কভাবে কোঁচার খুঁটে চশমার কাঁচ পরিষ্কার করিতে লাগিলেন।

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম–“কি ভাবছেন ডাক্তারবাবু?”

ডাক্তার চমক ভাঙিয়া বলিলেন–“কিছু না। বিপন্নকে আশ্রয় দেওয়া উচিত, আপনি ভালই করেছেন। তবে কি জানেন–‘অজ্ঞাতকুলশীলস্য’–শাস্ত্রের একটা বচন আছে–। যাক, আশা করি, কোনও ঝঞ্ঝাট উপস্থিত হবে না।” বলিয়া তিনি উঠিয়া পড়িলেন।

অতুল মিত্র আমার ঘরে আসিয়া বাস করিতে লাগিল। অনুকূলবাবুর কাছেও একটা বাড়তি তক্তপোষ ছিল, তিনি সেখানা অতুলের ব্যবহারের জন্য উপরে পাঠাইয়া দিলেন।

অতুল দিনের বেলায় বড় একটা বাসায় থাকিত না। সকালে উঠিয়া চাকরির সন্ধানে বাহির হইয়া যাইত, বেলা দশটা এগারোটার সময় ফিরিত; আবার স্নানাহারের পর বাহির হইত। কিন্তু যতটুকু সময় সে বাসায় থাকিত, তাহারই মধ্যে বাসার সকলের সঙ্গে বেশ সম্প্রীতি জমাইয়া তুলিয়াছিল। সন্ধ্যার পর খেলার মজলিসে তাহার ডাক পড়িত। কিন্তু সে তাস-পাশা খেলিতে জানিত না, তাই কিছুক্ষণ সেখানে বসিয়া আস্তে আস্তে নীচে নামিয়া গিয়া ডাক্তারের সহিত গল্প-গুজব করিত। আমার সঙ্গেও তাহার বেশ ভাব হইয়া গিয়াছিল। দু’জনের একই বয়স, তার উপর একই ঘরে ওঠা-বসা; সুতরাং আমাদের সম্বোধন ‘আপনি’ হইতে ‘তুমি’তে নামিতে বেশি বিলম্ব হয় নাই।

অতুল আসিবার পর হপ্তাখানেক বেশ নিরুপদ্রবে কাটিয়া গেল। তারপর মেসে নানা রকম বিচিত্র ব্যাপার ঘটিতে আরম্ভ করিল।

সন্ধ্যার পর অতুল ও আমি অনুকূলবাবুর ঘরে বসিয়া গল্প করিতেছিলাম। রোগীর ভিড় কমিয়া গিয়াছিল; দু’একজন মাঝে মাঝে আসিয়া রোগের বিবরণ বলিয়া ঔষধ লইয়া যাইতেছিল, অনুকূলবাবু আমাদের সঙ্গে কথা কহিতে কহিতে ঔষধ দিতেছিলেন ও হাত-বাক্সে পয়সা তুলিয়া রাখিতেছিলেন। গতরাত্রিতে প্রায় আমাদের বাসার সম্মুখে একটা খুন হইয়া গিয়াছিল, আজ সকালে রাস্তার উপর লাস আবিষ্কৃত হইয়া একটু উত্তেজনার কারণ এই যে, লাস দেখিয়া লোকটাকে দরিদ্র শ্রেণীর ভাটিয়া বলিয়া মনে হইলেও তাহার কোমরের গেঁজের ভিতর হইতে একশ’ টাকার দশকেতা নোট পাওয়া গিয়াছিল। ডাক্তার বলিতেছিলেন–“এ কোকেন ছাড়া আর কিছু নয়। ভেবে দেখুন, টাকার লোভে যদি খুন করত, তাহলে ওর কোমরে হাজার টাকার নোট পাওয়া যেতো না–আমার মনে হয়, লোকটা কোকেনের খরিদ্দার ছিল; কোকেন কিনতে এসে কোকেন-ব্যবসায়ীরদের সম্বন্ধে কোনও মারাত্মক গুপ্তকথা জানতে পারে। হয়তো তাদের পুলিসের ভয় দেখায় blackmail করবার চেষ্টা করে। তার পরেই ব্যস,–খতম।”

অতুল হাসিয়া বলিল–“কে জানে মশায়, আমার তো ভারি ভয় করছে। আপনার এ পাড়ায় আছে কি করে? আমি যদি আগে জানতুম, তাহলে–”

ডাক্তার হাসিয়া বলিলেন–“তাহলে ওড়িয়াদের আড্ডাতেই যেতেন? আমাদের কিন্তু ভয় করে না। আমি তো দশ-বারো বছর এ পাড়ায় আছি, কিন্তু কারুর কথায় থাকি না বলে কখনও হাঙ্গামায় পড়তে হয়নি।”

অতুল ফিস্‌ফিস্‌ করিয়া বলিল–“ডাক্তারবাবু, আপনি নিশ্চয় কিছু জানেন–না?”

হঠাৎ পিছনে খুট করিয়া একটা শব্দ শুনিয়া ফিরিয়া দেখি, আমাদের মেসের অশ্বিনীবাবু দরজার ফাঁকে মুখ বাড়াইয়া আমাদের কথা শুনিতেছেন। তাঁহার মুখের অস্বাভাবিক পাণ্ডুরতা দেখিয়া আমি সবিস্ময়ে বলিলাম–“কি হয়েছে অশ্বিনীবাবু? আপনি এ সময় নীচে যে?”

অশ্বিনীবাবু থতমত খাইয়া বলিলেন–“না, কিছু না–অমনি। এক পয়সার বিড়ি কিনতে–” বলিতে বলিতে তিনি সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠিয়া গেলেন।

আমরা পরস্পর মুখ-তাকাতাকি করিলাম। পৌঢ় গম্ভীর-প্রকৃতি অশ্বিনীবাবুকে আমরা সকলেই শ্রদ্ধা করিতাম–তিনি হঠাৎ নিঃশব্দে নীচে নামিয়া আসিয়া আড়ি পাতিয়া আমাদের কথা শুনিতেছিলেন কেন?

রাত্রিতে আহারে বসিয়া জানিতে পারিলাম অশ্বিনীবাবু পূর্বেই খাওয়া-দাওয়া শেষ করিয়াছেন। আহারান্তে অভ্যাসমত একটু চুরুট শেষ করিয়া শয়নঘরে প্রবেশ করিয়া দেখি, অতুল মেঝের উপর একটা বালিশ ফেলিয়া শুইয়া আছে। একটু বিস্মিত হইলাম, কারণ, এমন কিছু গরম পড়ে নাই যে মেঝেয় শোয়া প্রয়োজন হইতে পারে। ঘর অন্ধকার ছিল, অতুলও কোনও সাড়া দিল না–তাই ভাবিলাম, সে ক্লান্ত হইয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। আমার তখনও ঘুমের কোনও আগিদ ছিল না, কিন্তু আলো জ্বালিয়া পড়িতে বা লিখিতে বসিলে হয়তো অতুলের ঘুম ভাঙিয়া যাইবে, তাই খালি পায়ে ঘরের মধ্যে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলাম। কিছুক্ষণ এইভাবে বেড়াইবার পর হঠাৎ মনে হইল, যাই অশ্বিনীবাবুকে জিজ্ঞাসা করিয়া আসি, তাঁহার কোন অসুখ-বিসুখ করিয়াছে কি না। আমার দু’খানা ঘর পরেই অশ্বিনীবাবুর ঘর; গিয়া দেখিলাম, তাঁহার দরজা খোলা, বাহির হইতে ডাক দিয়া সাড়া পাওয়া গেল না। তখন কৌতুহলী হইয়া ঘরে ঢুকিলাম; দ্বারের পাশেই সুইচ ছিল, আলো জ্বালিয়া দেখিলাম ঘরে কেহ নাই। রাস্তার ধারের জানালাটা দিয়া উঁকি মারিয়া দেখিলাম, কিন্তু রাস্তাতেও তাঁহাকে দেখিতে পাইলাম না।

তাই তো! এত রাত্রে ভদ্রলোক কোথায় গেলেন? অকস্মাৎ মনে হইল–হয়তো ডাক্তারের নিকট ঔষধ লইতে গিয়াছেন। তাড়াতাড়ি নীচে নামিয়া গেলাম। ডাক্তারের দরজা ভিতর হইতে বন্ধ। এত রাত্রে নিশ্চয় তিনি শুইয়া পড়িয়াছেন। বন্ধ দরজার সম্মুখে অনিশ্চিতভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়ে ফিরিয়া আসিতেছি, এমন সময় ঘরের ভিতর গলার শব্দ শুনিতে পাইলাম। অত্যন্ত উত্তেজিত চাপা কণ্ঠে অশ্বিনীবাবু কথা কহিতেছেন।

একবার লোভ হইল, কান পাতিয়া শুনি কি কথা। কিন্তু পরক্ষণেই সে ইচ্ছা দমন করিলাম–হয়তো অশ্বিনীবাবু কোনও রোগের কথা বলিতেছেন, আমার শোনা উচিত নয়। পা টিপিয়া টিপিয়া উপরে ফিরিয়া আসিলাম।

ঘরে আসিয়া দেখিলাম, অতুল পূর্ববৎ মেঝের উপর শুইয়া আছে, আমাকে দেখিয়া ঘাড় তুলিয়া বলিল–“কি অশ্বিনীবাবু ঘরে নেই?”

বিস্মিত হইয়া বলিলাম–“না। তুমি জেগে ছিলে?”

“হ্যাঁ। অশ্বিনীবাবু নীচে ডাক্তারের ঘরে আছেন।”

“তুমি জানলে কি করে?”

“কি করে জানলুম, যদি দেখতে চাও, এই বালিশে কান পেতে মাটিতে শোও।”

“কি হে, মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি?”

“মাথা ঠিক আছে। শুয়েই দেখ না।”

কৌতুহলের বশবর্তী হইয়া অতুলের মাথার পাশে মাথা রাখিয়া শুইলাম। কিছুক্ষণ স্থির হইয়া থাকিবার পর অস্পষ্ট কথাবার্তার শব্দ কানে আসিতে লাগিল। তারপর পরিস্কার শুনিতে পাইলাম, অনুকূলবাবু বলিতেছেন–“আপনি বড় উত্তেজিত হয়েছেন। ওটা আপনার দৃষ্টি-বিভ্রম ছাড়া আর কিছু নয়। ঘুমের ঘোরে মাঝে মাঝে অমন হয়। আমি ওষুধ দিচ্ছি, খেয়ে শুয়ে পড়ুন গিয়ে। কাল সকালে উঠে যদি আপনার ঐ বিশ্বাস থাকে, তখন যা হয় করবেন।”

উত্তরে অশ্বিনীবাবু কি বলিলেন, ধরা গেল না। চেয়ার টানার শব্দে বুঝিলাম, দু’জনে উঠিয়া পড়িলেন।

আমি ভূ-শয্যা ছাড়িয়া উঠিয়া বসিলাম, বলিলাম–“ডাক্তারের ঘরটা যে আমাদের ঘরের নীচেই, তা মনে ছিল না। কিন্তু কি ব্যাপার বল তো? অশ্বিনীবাবুর হয়েছে কি?”

অতুল হাই তুলিয়া বলিল,–“ভগবান জানেন। রাত হল, এবার বিছানায় উঠে শুয়ে পড়া যাক।”

আমি সন্দিগ্ধভাবে জিজ্ঞাসা করিলাম–“তুমি মাটিতে শুয়েছিলে কেন?”

অতুল বলল–“সমস্ত দিন ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম, মেঝেটা বেশ ঠাণ্ডা বোধ হল, তাই শুয়ে পড়লুম। ঘুমও একটু এসেছিল, এমন সময় ওঁদের কথাবার্তায় চটকা ভেঙে গেল।”

সিঁড়িতে অশ্বিনীবাবুর পায়ের শব্দ শুনিতে পাইলাম। তিনি নিজের ঘরে ঢুকিয়ে সশব্দে দরজা বন্ধ করিয়া দিলেন।

ঘড়িতে দেখিলাম, রাত্রি প্রায় এগারোটা বাজে। অতুল শুইয়া পড়িয়াছিল, মেসও একেবারে নিশুতি হইয়া গিয়াছি। আমি বিছানায় শুইয়া অশ্বিনীবাবুর কথাই ভাবিতে ভাবিতে ঘুমাইয়া পড়িলাম।

সকালে অতুলের ঠেলা খাইয়া ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিলাম। বেলা সাতটা বাজিয়াছে। অতুল বলিল–“ওহে, ওঠ ওঠ; গতিক ভাল ঠেকছে না।”

“কেন? কি হয়েছে?”

“অশ্বিনীবাবু ঘরের দরজা খুলছেন না। ডাকাডাকিতে সাড়াও পাওয়া যাচ্ছে না।”

“কি হয়েছে তাঁর?”

“তা বলা যায় না। তুমি এস”–বলিয়া সে ঘর হইতে তাড়াতাড়ি বাহির হইয়া গেল।

আমিও তাহার পশ্চাতে বাহিরে আসিয়া দেখিলাম, অশ্বিনীবাবুর দরজার সম্মুখে সকলেই উপস্থিত আছেন। উৎকণ্ঠিত জল্পনা ও দ্বার ঠেলাঠেলি চলিতেছে। নীচে হইতে অনুকূলবাবুও আসিয়াছেন। দুশ্চিন্তা ও উৎকণ্ঠা ক্রমেই বাড়িয়াই চলিল, কারণ, অশ্বিনীবাবু এত বেলা পর্যন্ত কখনও ঘুমান না। তা ছাড়া, যদি ঘুমাইয়া পড়িয়াই থাকেন, তবে এত হাঁকডাকেও জাগিতেছেন না কেন?

অতুল অনুকূলবাবুর নিকটে গিয়া বলিল–“দেখুন, দরজা ভেঙে ফেলা যাক। আমার তো ভাল বোধ হচ্ছে না।”

অনুকূলবাবু বলিলেন–“হ্যাঁ, হ্যাঁ, স আর বল্‌তে! ভদ্রলোক হয়তো মূর্ছিত হয়ে পড়ে আছেন, নইলে জবাব দিচ্ছেন না কেন? আর দেরি নয়, অতুলবাবু, দরজা ভেঙে ফেলুন।”

দেড় ইঞ্চি পুরু কাঠের দরজা, তাহার উপর ইয়েল্‌-লক্‌ লাগানো। কিন্তু অতুল এবং আরও দুই-তিনজন একসঙ্গে সজোরে ধাক্কা দিতেই বিলাতি তালা ভাঙিয়া ঝন্‌ ঝন্‌ শব্দে দরজা খুলিয়া গেল। তখন মুক্ত দ্বারপথে যে-বস্তুটি সকলের দৃষ্টিগোচর হইল তাহা দেখিয়া বিস্ময়ে ভয়ে কাহারও মুখে কথা ফুটিল না। স্তম্ভিত হইয়া সকলে দেখিলাম, ঠিক দরজার সম্মুখেই অশ্বিনীবাবু উর্দ্ধমুখ হইয়া পড়িয়া আছেন–তাঁহার গলা এক প্রান্ত হইতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত কাটা। মাথা ও ঘাড়ের নীচে পুরু হইয়া রক্ত জমিয়ে যেন একটা লাল মখমলের গালিচা বিছাইয়া দিয়াছে। আর, তাঁহার প্রক্ষিপ্ত প্রসারিত দক্ষিণ হস্তে একটা রক্ত-মাখানো খুর, তখনও যেন জিঘাংসাভরে হাসিতেছে। নিশ্চল জড়পিণ্ডবৎ আমরা কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিলাম। তারপর অতুল ও ডাক্তার একসঙ্গে ঘরে ঢুকিলেন। ডাক্তার বিহ্বলভাবে অশ্বিনীবাবুর বীভৎস মৃতদেহের প্রতি তাকাইয়া থাকিয়া কম্পিত স্বরে কহিলেন,–“কি ভয়ানক, শেষ অশ্বিনীবাবু আত্মহত্যা করলেন!”

অতুলের দৃষ্টি কিন্তু মৃতদেহের দিকে ছিল না। তাহার দুই চক্ষু তলোয়ারের ফলার মত ঘরের চারিদিকে ইতস্তত ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল। সে একবার বিছানাটা দেখিল, রাস্তার ধারের খোলা জানালা দিয়া উঁকি মারিল, তারপর ফিরিয়া শান্তকণ্ঠে বলিল–“আত্মহত্যা নয়, ডাক্তারবাবু, এ খুন, নৃশংস নরহত্যা। আমি পুলিস ডাকতে চললুম–আপনারা কেউ কোন জিনিস ছোঁবেন না।”

অনুকূলবাবু বলিলেন–“বলেন কি, অতুলবাবু–খুন! কিন্তু দরজা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল–তা ছাড়া ওটা–” বলিয়া অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া মৃতের হস্তে রক্তাক্ত ক্ষুরটা দেখাইলেন। অতুল মাথা নাড়িয়া বলিল–“তা হোক্‌, তবু এ খুন! আপনারা থাকুন–আমি এখনই পুলিস ডেকে আনছি।”–সে দ্রুতপদে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেল।

ডাক্তারবাবু কপালে হাত দিয়া সেইখানে বসিয়া পড়িলেন, বলিলেন–“উঃ, শেষে আমার বাসাতে এই ব্যাপার হল!”

পুলিশের কাছে মেসের চাকর বামুন হইতে আরম্ভ করিয়া আমাদের সকলেরই এজাহার হইল। যে যাহা জানি, বলিলাম। কিন্তু কাহারও জবানবন্দীতে এমন কিছু প্রকাশ পাইল না যাহাতে অশ্বিনীবাবুর মৃত্যুর কারণ অনুমান করা যাইতে পারে। অশ্বিনীবাবু অত্যন্ত নির্বিরোধ লোক ছিলেন, মেস ও অফিস ব্যতীত অন্য কোথাও তাঁহার বন্ধুবান্ধব কেহ ছিল বলিয়াও জানা গেল না। তিনি প্রতি শনিবারে বাড়ি যাইতেন। দশ-বারো বৎসর এইরূপ চলিয়া আসিতেছে, কখনও ব্যতিক্রম হয় নাই। কিছুদিন হইতে তিনি বহুমূত্র-রোগে ভুগিতেছিলেন; এইরূপ গোটাকয়েক সাধারণ কথাই প্রকাশ পাইল।

ডাক্তার অনুকূলবাবুও এজাহার দিলেন। তিনি যাহা বলিলেন, তাহাতে অশ্বিনীবাবুর মৃত্যু-রহস্য পরিষ্কার না হইয়া যেন আরও জটিল হইয়া উঠিল। তাঁহার জবানবন্দী সম্পূর্ণ উদ্ধৃত করিতেছি :

“গত বারো বৎসর যাবৎ অশ্বিনীবাবু আমার বাসায় ছিলেন। তাঁর বাড়ি বর্ধমান জেলায় হরিহরপুর গ্রামে। তিনি সওদাগরী অফিসে কাজ করতেন, একশ’ কুড়ি টাকা আন্দাজ মাইনে পেতেন। এত অল্প মাহিনায় পরিবার নিয়ে কলকাতায় থাকার সুবিধা হয় না, তাই তিনি একলা মেসে থাকতেন। এ মেসের প্রায় সকলেই তাই করে থাকেন।

“অশ্বিনীবাবুকে আমি যতদূর জানি, তিনি সরল-প্রকৃতির কর্তব্যনিষ্ঠ লোক ছিলেন। কখনও কারুর পাওনা ফেলে রাখতেন না, কারুর কাছে এক পয়সা ধার ছিল না। কোন বদখেয়াল কি নেশা ছিল বলেও আমার জানা নেই; মেসের অন্য সকলেই এ বিষয়ে সাক্ষী দিতে পারবেন।

“এই বারো বছরের মধ্যে তাঁর সম্বন্ধে অস্বাভাবিক বা সন্দেহজনক কিছু লক্ষ্য করিনি। তিনি গত কয়েক মাস থেকে ডায়াবিটিসে ভুগছিলেন, আমারই চিকিৎসাধীন ছিলেন। কিন্তু তাঁর মানসিক রোগের কোন লক্ষণ ইতিপূর্বে চোখে পড়েনি। কাল হঠাৎ তাঁর চাল-চলনে একটা অপ্রকৃতিস্থ ভাব প্রথম লক্ষ্য করলুম।

“কাল বেলা প্রায় পৌঁনে দশটার সময় আমি আমার ডাক্তারখানায় বসেছিলুম। হঠাৎ অশ্বিনীবাবু এসে বললেন–‘ডাক্তারবাবু, আপনার সঙ্গে আমার একটা গোপনীয় কথা আছে।’ একটু আশ্চর্য হয়ে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে দেখলুম; তাঁকে অত্যন্ত বিচলিত মনে হল। জিজ্ঞাসা করলুম–‘কি কথা?’ তিনি এদিক ওদিক চেয়ে চাপা গলায় বললেন–‘এখন নয়, আর এক সময়।’ বলেই তাড়াতাড়ি অফিসে চলে গেলেন। সন্ধ্যার পর আমি, অজিতবাবু আর অতুলবাবু আমার ঘরে বসে গল্প করছিলুম, হঠাৎ অজিতবাবু দেখতে পেলেন দরজার পাশে দাঁড়িয়ে অশ্বিনীবাবু আমাদের কথা শুনছেন। তাঁকে ডাকতেই তিনি কোন গতিকে একটা কৈফিয়ৎ দিয়ে তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। আমরা সবাই অবাক্‌ হয়ে রইলুম, ভাবলুম, কি হল অশ্বিনীবাবুর?”

“তারপর রাত্রি দশটার সময় তিনি চোরের মত চুপি চুপি আমার কাছে এসে উপস্থিত হলেন। মুখ দেখেই বুঝলুম, তাঁর মানসিক অবস্থা প্রকৃতিস্থ নয়। দরজা বন্ধ করে দিয়ে তিনি আবোল-তাবোল নানারকম বলতে লাগলেন। কখনও বলেন, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ভীষণ বিভীষিকাময় স্বপ্ন দেখেছেন, কখনও বলেন, একটা ভয়ানক গুপ্তরহস্য জানতে পেরেছেন। আমি তাকে ঠাণ্ডা করিবার চেষ্টা করলুম, কিন্তু তিনি ঝোঁকের মাথায় বলেই চললেন। শেষ আমি তাঁকে এক পুরিয়া ঘুমের ওষুধ দিয়ে বললুম–‘আজ রাত্রে শুয়ে পড়ুন গিয়ে, কাল সকালে আপনার কথা শুনব।’ তিনি ওষুধ নিয়ে উপরে উঠে গেলেন।

“সেই তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা,–তারপর আজ সকালে এই কাণ্ড! তাঁর ভাবগতিক দেখে তাঁর মানসিক প্রকৃতিস্থতা সম্বন্ধে আমার সন্দেহ হয়েছিল বটে, কিন্তু তিনি যে এই ক্ষণিক উত্তেজনার বশে আত্মঘাতী হবেন, তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি।”

অনুকূলবাবু নীরব হইলে দারোগা জিজ্ঞাসা করিলেন–“আপনি মনে করেন, এ আত্মহত্যা?”

অনুকূলবাবু বলিলেন–“তা ছাড়া আর কি হতে পারে? তবে অতুলবাবু বলছিলেন যে, এ আত্মহত্যা নয়–অন্য কিছু। এ বিষয়ে তিনি হয়তো বেশি জানেন, অতএব তিনিই বলতে পারেন।”

দারোগা অতুলের দিকে ফিরিয়া কহিলেন–“আপনিই না অতুলবাবু? এটা যে আত্মহত্যা নয়, তা মনে করবার কোনও কারণ আছে?”

“আছে। নিজের হাতে মানুষ অমন ভয়ানকভাবে নিজের গলা কাটতে পারে না। আপনি লাস দেখেছেন–ভেবে দেখুন, এ অসম্ভব।”

দারোগা কিয়ৎকাল চিন্তা করিয়া বলিলেন–“হত্যাকারী কে, আপনার কোনও সন্দেহ হয় কি?”

“না।”

“হত্যার কারণ কিছু অনুমান করতে পারেন কি?”

অতুল রাস্তার দিকের জানলাটা নির্দেশ করিয়া বলিল–“ঐ জানলাটা হত্যার কারণ।”

দারোগা সচকিত হইয়া বলিলেন–“জানলা হত্যার কারণ? আপনি বলতে যান, হত্যাকারী ঐ জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকেছিল?”

“না। হত্যাকারী দরজা দিয়েই ঘরে ঢুকেছিল।”

দারোগা মৃদু হাসিয়া বলিলেন–“আপনার বোধহয় স্মরণ নেই যে, দরজা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল।”

“স্মরণ আছে।”

দারোগা ঈষৎ পরিহাসের স্বরে বলিলেন–“তবে কি অশ্বিনীবাবু আহত হবার পর দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন?”

“না, হত্যাকারী অশ্বিনীবাবুকে হত্যা করবার পর বাইরে থেকেই দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল।”

“সে কি করে হতে পারে?”

অতুল মুখ টিপিয়া হাসিয়া বলিল–“খুব সহজে, একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারবেন।”

অনুকূলবাবু এতক্ষণ দরজাটার দিকেই তাকাইয়া ছিলেন, তিনি বলিয়া উঠিলেন–“ঠিক তো! ঠিক তো! দরজা সহজেই বাইরে থেকে বন্ধ করা যায়, এতক্ষণ আমাদের মাথাতেই ঢোকেনি। দেখেছেন না দরজায় যে ইয়েল লক্‌ লাগানো।”

দারোগা প্রবীণ লোক, তিনি গালে হাত দিয়ে ভাবিতে ভাবিতে লাগিলেন,–“সে ঠিক। কিন্তু একটা জায়গায় খট্‌কা লাগছে। অশ্বিনীবাবু যে রাত্রে দরজা খুলে শুয়েছিলেন তার কি কোন প্রমাণ আছে?”

অতুল বলিল–“না, বরঞ্চ তার উল্টো প্রমাণই আছে। আমি জানি, তিনি দরজা বন্ধ করে শুয়েছিলেন।”

আমি বললাম–“আমিও জানি। আমি তাঁকে দরজা বন্ধ করতে শুনেছি।”

দারোগা বলিলেন–“তবে? অশ্বিনীবাবু রাত্রে উঠে হত্যাকারীকে দরজা খুলে দিয়েছিলেন, এ অনুমানও তো সম্ভব বলে মনে হয় না।”

অতুল বলিল–“না। কিন্তু আপনার বোধহয় স্মরণ নেই যে, অশ্বিনীবাবু গত কয়েকমাস থেকে একটা রোগে ভুগছিলেন।”

“রোগে ভুগছিলেন? ওঃ! ঠিক বলেছেন, ঠিক বলেছেন, অতুলবাবু! ও কথাটা আমার খেয়ালই ছিল না।” দারোগা একটু মুরুব্বীয়ানাভাবে বলিলেন–“আপনি দেখছি বেশ intelligent লোক, পুলিসে ঢুকে পড়ুন না! এ পথে আপনি উন্নতি করতে পারবেন। কিন্তু এদিকে ব্যাপার ক্রমেই ঘোরালো হয়ে উঠছে। যদি সত্যিই এটা হত্যাকাণ্ড হয়, তাহলে হত্যাকারী যে ভয়ানক হুঁশিয়ার লোক, তাতে সন্দেহ নেই। কারুর উপর আপনাদের সন্দেহ হয়?” বলিয়া উপস্থিত সকলের মুখের দিকে চাহিলেন।

সকলেই নীরবে মাথা নাড়িলেন। অনুকূলবাবু বলিলেন–“দেখুন, এ পাড়ায় প্রায়ই একটা-দুটো খুন হয়; এ খবর অবশ্য আপনার কাছে নূতন নয়। পরশু দিনই আমাদের বাসার প্রায় সামনে একটা খুন হয়ে গেছে। এই সব দেখে আমার মনে হয় যে, সবগুলো হত্যাই এক সুতোয় গাঁথা,–একটার কিনারা হলেই অন্যটার কিনারা হবে। অবশ্য যদি অশ্বিনীবাবুর মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড বলে মেনে নেওয়া হয়!”

দারোগা বলিলেন–“তা হতে পারে। কিন্তু অন্য খুনের কিনারা হবার আশায় বসে থাকলে বোধহয় অনন্তকাল বসেই থাকতে হবে।”

অতুল বলিল–“দারোগাবাবু, যদি এ খুনের কিনারা করতে চান, তাহলে ঐ জানালাটার কথা ভাল করে ভেবে দেখেবেন।”

দারোগা ক্লান্তভাবে কহিলেন–“সব কথাই আমাদের ভাল করে ভেবে দেখতে হবে, অতুলবাবু। এখন আপনাদের প্রত্যেকের ঘর আমি খানাতল্লাস করতে চাই।”

তারপর উপরে নীচে সব ঘরই পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে খানাতল্লাস করা হইল, কিন্তু কোথাও এমন কিছু পাওয়া গেল না যাহার দ্বারা এই মৃত্যু-রহস্যের উপর আলোকপাত হইতে পারে। অশ্বিনীবাবুর ঘরও যথারীতি অনুসন্ধান করা হইল, কিন্তু দু’একটা অতি সাধারণ পারিবারিক চিঠিপত্র ছাড়া আর কিছুই পাওয়া গেল না। ক্ষুরের শূন্য খাপটা বিছানার পাশেই পড়িয়াছিল। তিনি নিজে ক্ষৌরকার্য করিতেন এ কথা আমরা সকলেই জানিতাম, খাপটা চিনিতেও কষ্ট হইল না। অশ্বিনীবাবুর মৃতদেহ পূর্বেই স্থানান্তরিত হইয়াছিল, অতঃপর তাঁহার দরজায় তালা লাগাইয়া সীলমোহর করিয়া দারোগা বেলা দেড়টা নাগাদ প্রস্থান করিলেন।

অশ্বিনীবাবুর বাড়িতে ‘তার’ পাঠানো হইয়াছিল, বৈকালে তাঁহার পুত্ররা ও অন্যান্য নিকট-আত্মীয়বর্গ আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহাদের বিস্মিত বিমূঢ় শোকের চিত্রের উপর যবনিকা টানিয়া দিলাম। আমরা অনাত্মীয় হইলেও অশ্বিনীবাবুর এই শোচনীয় মৃত্যুতে প্রত্যেকেই গভীরভাবে আহত হইয়াছিলাম। তা ছাড়া নিজেদের প্রাণ লইয়াও কম আশঙ্কা হয় নাই। যেখানে পাশের ঘরে এরূপ ব্যাপার ঘটিতে পারে, সেখানে আমাদের জীবনেরই বা নিশ্চয়তা কি? মলিন সশঙ্ক অবসন্নতার ভিতর দিয়া এই বিপদভারাক্রান্ত দুর্দিন কাটিয়া গেল।

রাত্রিকালে শয়নের পূর্বে ডাক্তারের ঘরে গিয়া দেখিলাম, তিনি স্তব্ধগম্ভীরমুখে বসিয়া আছেন। এই এক দিনের ঘটনায় তাঁহার শান্ত নিশ্চিহ্ন মুখের উপর কালো কালো রেখা পড়িয়া গিয়াছে। আমি তাঁহার পাশে বসিয়া বলিলাম–“বাসার সকলেই তো মেস ছেড়ে চলে যাবার জোগাড় করছেন।”

ম্লান হাসিয়া অনুকূলবাবু বলিলেন–“তাঁদের তো দোষ দেওয়া যায় না, অজিতবাবু! এ রকম ব্যাপার যেখানে ঘটে, সেখানে কে থাকতে চায় বলুন!–কিন্তু একটা কথা আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না–একে খুব বলা যেতে পারে কি করে? আর যদি খুনই হয়, তাহলে মেসের বাইরের লোকের দ্বারা তো খুন বলা যেতে পারে কি করে? আর যদি খুনই হয়, তাহলে মেসের বাইরের লোকের দ্বারা তো খুব সম্ভব হতে পারে না। প্রথমত, হত্যাকারী উপরে উঠল কি করে? সিঁড়ির দরজা রাত্রিকালে বন্ধ থাকে, এ তো আপনারা সকলে জানেন। যদি ধরে নেওয়া যায় যে, লোকটা কোনও কৌশলে উপরে উঠেছিল–কিন্তু সে অশ্বিনীবাবুর ক্ষুর দিয়ে তাঁকে খুন করল কি করে? এ কি কখনও সম্ভব? সুতরাং বাইরের লোকের দ্বারা খুন হয়নি এ কথা নিশ্চিত। তা হলে বাকি থাকেন কারা?–যাঁরা মেসে থাকেন। এঁদের মধ্যে অশ্বিনীবাবুকে খুন করতে পারে, এমন কেউ আছে কি? অবশ্য অতুলবাবু অল্পদিন হল এসেছেন–তাঁর বিষয়ে আমরা কিছু জানি না”

আমি চমকিয়া উঠিয়া বলিলাম–“অতুল–?

ডাক্তারবাবু গলা খাটো করিয়া বলিলেন–“অতুল্বাবু লোকটিকে আপনার কি রকম মনে হয়?”

আমি বলিলাম–“অতুল? না না, এ কখনও সম্ভব নয়। অতুল কি জন্য অশ্বিনীবাবুকে–”

ডাক্তার বলিলেন–“তবেই দেখুন, আপনার মুখ থেকেই প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে যে, মেসের কেউ এ কাজ করতে পারেন না। তাহলে বাকি থাকে কি?–তিনি আত্মহত্যা করেছেন, এই কথাটাই কি বাকি থেকে যাচ্ছে না?”

“কিন্তু আত্মহত্যা করবারও তো একটা কারণ থাকা চাই।”

“সে কথাও আমি ভেবে দেখেছি। আপনার মনে আছে–কিছুদিন আগে আমি বলেছিলুম যে এ পাড়ায় একটা কোকেনের গুপ্ত সম্প্রদায় আছে।–এই সম্প্রদায়ের সর্দার কে তা কেউ জানে না।”

“হ্যাঁ–মনে আছে।”

ডাক্তার ধীরে ধীরে বলিলেন–“এখন মনে করুন, অশ্বিনীবাবুই যদি এই সম্প্রদায়ের সর্দার হয়?”

আমি স্তম্ভিত হইয়া বলিলাম–“সে কি? তাও কি কখনও সম্ভব?”

ডাক্তার বলিলেন–“অজিতবাবু, পৃথিবীতে কিছুই অসম্ভব নয়। বরঞ্চ কাল রাত্রে অশ্বিনীবাবু আমাকে যে-সব কথা বলেছিলেন, তাতে এই সন্দেহই ঘনীভূত হয়–খুব সম্ভব তিনি অত্যন্ত ভয় পেয়েছিলেন। অত্যধিক ভয় পেলে মানুষ অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়তে পারে। কে বলতে পারে, হয়তো এই অপ্রকৃতিস্থতার ঝোঁকেই আত্মহত্যা করেছেন!–ভেবে দেখুন, এ অনুমান কি সঙ্গত মনে হয় না?”

এই অভিনব থেয়োরি শুনিয়া আমার মাথা একেবারে গুলাইয়া গিয়াছিল, আমি বলিলাম–“কি জানি ডাক্তারবাবু, আমি তো কিছুই ধারণা করতে পারছি না। আপনি বরং আপনার সন্দেহের কথা পুলিসকে খুলে বলুন।”

ডাক্তার উঠিয়া দাঁড়াইলেন, বলিলেন–“কাল তাই বলব। এ সমস্যার একটা মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত যেন কিছুতেই শান্তি পাচ্ছি না।”

দুই তিনটা দিন কোন রকমে কাটিয়া গেল। মনের একান্ত অশান্তির উপর সি-আই-ডি বিভাগের বিবিধ কর্মচারীর নিরন্তর যাতায়াতে ও সওয়াল-জবাবে প্রাণ অতিষ্ঠ হইয়া উঠিয়াছিল। মেসের প্রত্যেকেই পালাই পালাই করিতেছিলেন, কিন্তু আবার পালাইতে সাহস হইতেছিল না। কি জানি, তাড়াতাড়ি বাসা ছাড়িলে যদি পুলিস তাঁহাকেই সন্দেহ করিয়া বসে।

বাসারই কোন ব্যক্তির চারিধারে যে সন্দেহের জাল ধীরে ধীরে গুটাইয়া আসিতেছে, তাহার ইশারা পাইতেছিলাম। কিন্তু সে ব্যক্তি কে, তাহা অনুমান করিতে পারিতেছিলাম না। মাঝে মাঝে অজ্ঞাত আতঙ্কে বুকটা ধড়াস্‌ করিয়া উঠিতেছিল–পুলিস আমাকেই সন্দেহ করে না তো?

সেদিন সকালে অতুল ও আমি ডাক্তারের ঘরে বসিয়া সংবাদপত্র পাঠ করিতেছিলাম। একটা মাঝারি গোছের প্যাকিং কেস্‌-এ ডাক্তারের ঔষধ আসিয়াছিল, তিনি বাক্স খুলিয়া সেগুলি সযত্নে বাহির করিয়া আলমারিতে সাজাইয়া রাখিতেছিলেন। প্যাকিং কেসের উপর আমেরিকার ছাপ মারা ছিল; ডাক্তারবাবু দেশী ঔষধ ব্যবহার করিতেন না, দরকার হইলেই আমেরিকা কিম্বা জার্মানী হইতে ঔষধ আনাইয়া লইতেন। প্রায় মাসে মাসে তাঁহার এক বাক্স করিয়া ঔষধ আসিত।

অতুল খবরের কাগজের অর্দ্ধাংশটা নামাইয়া রাখিয়া বলিল,–“ডাক্তারবাবু, আপনি বিদেশ থেকে ওষুধ আনান কেন? দেশী ওষুধ কি ভাল হয় না?”

অতুল একটা বড় সুগার-অফ-মিল্কের শিশি তুলিয়া লইয়া তাহার গায়ে লেখা বিখ্যাত বিক্রেতাদের নাম দেখিয়া বলিল,–“এরিক্‌ এণ্ড হ্যাভেল্‌। এরাই বুঝি সবচেয়ে ভাল ওষুধ তৈরী করে?”

“হ্যাঁ।”

“আচ্ছা, হোমিওপ্যাথিতে সত্যি সত্যি রোগ সারে? আমার তো বিশ্বাস হয় না। এক ফোঁটা জল খেলে আবার রোগ সারবে কি?”

ডাক্তার মৃদু হাসিয়া বলিলেন,–“এত লোক যে ওষুধ নিতে আসে, তারা কি ছেলেখেলা করে?”

অতুল বলিল,–“হয়তো রোগ আপনিই সারে, তারা ভাবে ওষুধের গুণে সারল। বিশ্বাসেও অনেক সময় কাজ হয় কি না।”

ডাক্তার শুধু একটু হাসিলেন, কিছু বলিলেন না। কিয়ৎকাল পরে জিজ্ঞাসা করিলেন,–“খবরের কাগজে আমাদের বাসার কথা কিছু আসে না কি?”

“আছে” বলিয়া আমি পড়িয়া শুনাইলাম,–“হতভাগ্য অশ্বিনীকুমার চৌধুরীর হত্যার এখনও কোন কিনারা হয় নাই। পুলিসের সি-আই-ডি বিভাগ এই হত্যা রহস্যের তদন্তভার গ্রহণ করিয়াছেন। কিছু কিছু তথ্যও আবিষ্কৃত হইয়াছে। আশা করা যাইতেছে, শীঘ্রই আসামী গ্রেপ্তার হইবে।”

“ছাই হবে। ঐ আশা করা পর্যন্ত।” ডাক্তারবাবু মুখ ফিরাইয়া বলিয়া উঠিলেন,–“এ কি! দারোগাবাবু–”

দারোগা ঘরে প্রবেশ করিলেন, সঙ্গে দুইজন কনেস্টবল। ইনি আমাদের সেই পূর্ব-পরিচিত দারোগা; কোনও প্রকার ভণিতা না করিয়া একেবারে অতুলের সম্মুখে গিয়া বলিলেন,–“আপনার নামে ওয়ারেণ্ট আছে। থানায় যেতে হবে। গোলমাল করবেন না, তাতে কোন ফল হবে না। রামধনী সিং, হ্যাণ্ডকাফ লাগাও।” একজন কনেস্টবল ক্ষিপ্ত অভ্যস্ত হস্তে কড়াৎ করিয়া হাতকড়া পরাইয়া দিল।

আমরা সভয়ে উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিলাম। অতুল বলিয়া উঠিল,–“এ কি!”

দারোগা বলিলেন,–“এই দেখুন ওয়ারেণ্ট। অশ্বিনীকুমার চৌধুরীকে হত্যা করার অপরাধে অতুলচন্দ্র মিত্রকে গ্রেপ্তার করা হল। আপনারা দু’জনে একে অতুলচন্দ্র মিত্র বলে সনাক্ত করেছেন?”

নিঃশব্দে অভিভূতের মত আমরা ঘাড় নাড়িলাম।

অতুল মৃদু হাসিয়া বলিল,–“শেষ পর্যন্ত আমাকেই ধরলেন। আচ্ছা, চলুন থানায়।–অজিত, কিছু ভেবো না–আমি নির্দোষ।”

একটা ঠিকা গাড়ী ইতিমধ্যে বাড়ীর সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল, অতুলকে তাহাতে তুলিয়া পুলিস সদলবলে চলিয়া গেল।



পাংশুমুখে ডাক্তার বলিলেন,–“অতুলবাবুই তাহলে–! কি ভয়ানক! কি ভয়ানক! মানুষের মুখ দেখে কিছু বোঝবার উপায় নেই।”

শেষাংশ     পড়ুন..

No comments:

Post a Comment