প্রথমাংশের লিঙ্ক
শেষাংশ
আমার মুখে কথা বাহির হইল না। অতুল হত্যাকারী! এই কয় দিন তাহার সহিত একত্র বাস করিয়া তাহার প্রতি আমার মনে একটা প্রীতিপূর্ণ সৌহার্দ্যর সূত্রপাত হইয়াছিল। তাহার স্বভাবটি এত মধুর যে, আমার হৃদয় এই অল্পকালমধ্যেই সে জয় করিয়া লইয়াছিল। সেই অতুল খুনী! কল্পনার অতীত বিস্ময়ে ক্ষোভে মর্মপীড়ায় আমি যেন দিগভ্রান্ত হইয়া গেলাম।
ডাক্তারবাবু বলিলেন,–“এই জন্যেই অজ্ঞাত-কুলশীল লোককে আশ্রয় দেওয়া শাস্ত্রে বারণ। কিন্তু তখন কে ভেবেছিল যে লোকটা এতবড় একটা–”
আমার কিছুই ভাল লাগিতেছিল না, উঠিয়া গিয়া নিজের ঘরে দ্বার বন্ধ করিয়া শুইয়া পড়িলাম। স্নানাহার করিবারও প্রবৃত্তি হইল না। ঘরের ওপাশে অতুলের জিনিসপত্র ছড়ানো রহিয়াছে–সেই দিকে চাহিয়া আমার চক্ষে জল আসিয়া পড়িল। অতুলকে যে কতখানি ভালবাসিয়াছি, তাহা বুঝিতে পারিলাম।
অতুল যাইবার সময় বলিয়া গিয়াছে,–সে নির্দোষ। তবে কি পুলিস ভুল করিল! আমি বিছানায় উঠিয়া বসিলাম। যে রাত্রে অশ্বিনীবাবু হত হন, সে রাত্রির সমস্ত কথা স্মরণ করিবার চেষ্টা করিলাম। অতুল মেঝেয় বালিশের উপর কান পাতিয়া ডাক্তারের সহিত অশ্বিনীবাবুর কথাবার্তা শুনিতেছিল। কেন শুনিতেছিল? কি উদ্দেশ্যে? তারপর রাত্রি এগারোটার সময় আমি ঘুমাইয়া পড়িলাম–একেবারে সকালে ঘুম ভাঙিল। ইতিমধ্যে অতুল যদি–
কিন্তু অতুল গোড়া হইতেই বলিতেছে, এ খুন–আত্মহত্যা নয়। যে স্বয়ং হত্যাকারী, সে কি এমন কথা বলিয়া নিজের গলায় ফাঁসী পরাইবার চেষ্টা করিবে? কিম্বা, এমনও তো হইতে পারে যে, নিজের উপর হইতে সন্দেহ ঝাড়িয়া ফেলিবার উদ্দেশ্যেই অতুল এ কথা বলিতেছে, যাহাতে পুলিস ভাবে যে, অতুল যখন এত জোর দিয়া বলিতেছে, এ হত্যা, তখন সে কখনই হত্যাকারী নহে।
এইরূপ নানা চিন্তায় উদ্ভ্রান্ত উৎপীড়িত মন লইয়া আমি বিছানায় পড়িয়া ছটফট করিতে লাগিলাম, কখনও উঠিয়া ঘরে পায়চারি করিতে লাগিলাম। এমনই করিয়া দ্বিপ্রহর অতীত হইয়া গেল।
বেলা তিনটা বাজিল। হঠাৎ মনে হইল, কোনও উকীলের কাছে গিয়া পরামর্শ লইয়া আসি। এরূপ অবস্থায় পড়িলে কি করা উচিত কিছুই জানা ছিল না, উকীলও কাহাকেও চিনি না। যাহা হউক, একটা উকীল খুঁজিয়া বাহির করা দুষ্কর হইবে না বুঝিয়া একটা জামা গলাইয়া লইয়া তাড়াতাড়ি বাহির হইবার উপক্রম করিতেছি, এমন সময় দরজায় ধাক্কা পড়িল। দ্বার খুলিয়া দেখি–সম্মুখেই অতুল!
“অ্যাঁ–অতুল!” বলিয়া আমি আনন্দে তাহাকে প্রায় জড়াইয়া ধরিলাম। সে দোষী কি নির্দোষ, এ আন্দোলন মন হইতে একেবারে মুছিয়া গেল।
রুক্ষ মাথা, শুষ্ক মুখ, অতুল হাসিয়া বলিল,–“হ্যাঁ ভাই, আমি। বড্ড ভুগিয়েছে! অনেক কষ্টে একজন জামীন পাওয়া গেল–তাই ছাড়া পেলুম, নইলে আজ হাজত বাস করতে হত। তুমি চলেছ কোথায়?”
একটু অপ্রতিভভাবে বলিলেন,–“উকীলের বাড়ী।”
অতুল সস্নেহে আমার একটা হাত চাপিয়া দিয়া বলিল,–“আমার জন্যে? তার আর দরকার নেই ভাই। আপাতত কিছু দিনের জন্য ছাড়ান্ পাওয়া গেছে।”
আমি দ্বিধা ঠেলিয়া বলিবার চেষ্টা করিলাম,–“অতুল,–তুমি–তুমি–”
“আমি কি? অশ্বিনীবাবুকে খুন করেছি কিনা?” অতুল মৃদুকণ্ঠে হাসিল–“সে আলোচনা পরে হবে। এখন কিছু খাওয়া দরকার। মাথাটা ধরেছে দেখছি। যা হোক, স্নান করলেই সেরে যাবে বোধ হয়।”
ডাক্তারবাবু প্রবেশ করিলেন। তাঁহাকে দেখিয়া অতুল বলিল,–“অনুকূলবাবু, ঘষা দোয়ানীর মত আবার আমি ফিরে এলুম। ইংরেজীতে একটা কথা আছে না–bad penny, আমার অবস্থাও প্রায় সেই রকম,–পুলিসেও নিলে না, ফিরিয়ে দিলে।”
ডাক্তার একটু গম্ভীরভাবে বলিলেন,–“অতুলবাবু, আপনি ফিরে এসেছেন, খুব সুখের বিষয়। আশা করি, পুলিস আপনাকে নির্দোষ বুঝেই ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু আমার এখানে আর–আপনার–‘ বুঝতেই তো পারছেন, পাঁচজনকে নিয়ে মেস। এমনিতেই সকলে পালাই পালাই করছেন, তার উপর যদি আবার–আপনি কিছু মনে করবেন না, আপনার প্রতি আমার কোনও বিদ্বেষ নেই–কিন্তু–”
অতুল বলিল,–“না না, সে কি কথা! আমি এখন দাগী আসামী, আমাকে আশ্রয় দিয়ে আপনারা বিপদে পড়বেন কেন? বলা তো যায় না, পুলিস হয়তো শেষে আপনাকেও এডিং অ্যাবেটিং চার্জে ফেলবে।–তা, আজই কি চলে যেতে বলেন?”
ডাক্তার একটু চুপ করিয়া থাকিয়া অনিচ্ছাভরে বলিলেন,–“না, আজ রাতটা থাকুল; কিন্তু কাল সকালেই–”
অতুল বলিল,–“নিশ্চয়। কাল আর আপনাদের বিব্রত করব না। যেখানে হোক একটা আস্তানা খুঁজে নেব,–শেষ পর্যন্ত ওড়িয়া হোটেল তো আছেই।” বলিয়া হাসিল।
ডাক্তার তখন থানায় কি হইল জিজ্ঞাসা করিলেন। অতুল ভাসাভাসা জবাব দিয়া স্নান করিতে চলিয়া গেল। ডাক্তার আমাকে বলিলেন,–“অতুলবাবু মনে মনে ক্ষুণ্ণ হলেন বুঝতে পারছি–কিন্তু উপায় কি বলুন? একে তো মেসের বদনাম হয়ে গেছে–তার উপর যদি পুলিসের প্রেপ্তারী আসামী রাখি,–সেটা কি নিরাপদ হবে, আপনিই বলুন!”
বাস্তবিক এটুকু সাবধানতা ও স্বার্থপরতার জন্য কাহাকেও দোষ দেওয়া যায় না। আমি বিরসভাবে ঘাড় নাড়িলাম, বলিলাম–“তা–আপনার মেস, আপনি যা ভাল বুঝবেন করবেন।”
আমি গামছা কাঁধে ফেলিয়া স্নানঘরের উদ্দেশ্যে প্রস্থান করিলাম; ডাক্তার লজ্জিত বিমর্ষমুখে বসিয়া রহিলেন।
স্নানাহার শেষ করিয়া ঘরে ফিরিতেছি, এমন সময় ঘনশ্যামবাবু অফিস হইতে ফিরিলেন। সম্মুখে অতুলকে দেখিয়া তিনি যেন ভূত দেখার মত চমকিয়া উঠিলেন, পাংশমুখে বলিলেন,–“অতুলবাবু আপনি–আপনি–?”
অতুল মৃদু হাসিয়া বলিল,–“আমিই বটে ঘনশ্যামবাবু। আপনার কি বিশ্বাস হচ্ছে না?”
ঘনশ্যামবাবু বলিলেন,–“কিন্তু আপনাকে তো পুলিশে–” এই পর্যন্ত বলিয়া একটা ঢোক গিলিয়া তিনি নিজের ঘরে ঢুকিয়া পড়িলেন।
অতুলের চক্ষু কৌতুকে নাচিয়া উঠিল, সে মৃদু কণ্ঠে বলিল,–“বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিসে ছুঁলে বোধ হয় আটান্ন। ঘনশ্যামবাবু আমায় দেখে বিশেষ ভয় পেয়েছেন দেখছি।”
সেদিন সন্ধ্যাবেলা অতুল বলিল,–“ওহে দেখ তো, দরজার তালাটা লাগছে না।”
দেখলাম, বিলাতী তালায় কি গোলমাল হইয়াছে। গৃহস্বামীকে খবর দিলাম, তিনি আসিয়া দেখিয়া বলিলেন,–“বিলাতী তালায় ঐ মুস্কিল; ভাল আছেন তো বেশ আছেন, খারাপ হলে একেবারে এঞ্জিনীয়ার ডাকতে হয়। এর চেয়ে আমাদের দেশী হুড়কো ভালো। যা হোক, কালই মেরামত করিয়ে দেব।” বলিয়া তিনি নামিয়া গেলেন। রাত্রে শয়নের পূর্বে অতুল বলিল,–“অজিত, মাথা ধরাটা ক্রমেই বাড়ছে–কি করি বল তো?”
আমি বলিলাম,–“ডাক্তারের কাছ থেকে এক পুরিয়া ওষুধ নিয়ে খাওনা।”
অতুল বলিল,–“হোমিওপ্যাথি ওষুধ? তাতে সারবে?–আচ্ছা চল, দেখা যাক্–হুমো পাখীর জোর।”
আমি বলিলাম,–“চল, আমার শরীরটাও ভাল ঠেকছে না।”
ডাক্তার তখন দ্বার বন্ধ করিবার উপক্রম করিতেছিলেন, আমাদের দেখিয়া জিজ্ঞাসুভাবে মুখের দিকে চাহিলেন। অতুল বলিল,–“আপনার ওষুধের গুণ পরীক্ষা করতে এলুম। বড্ড মাথা ধরেছে-কিছু ব্যবস্থা করতে পারেন?”
ডাক্তার খুশী হইয়া বলিলেন,–“বিলক্ষণ! পারি বৈ কি! পিত্তি পড়ে মাথা ধরেছে–বসুন, এখনি ওষুধ দিচ্ছি।” বলিয়া আলমারি হইতে নূতন ঔষুধ পুরিয়া করিয়া আনিয়া দিলেন,–“যান, খেয়ে শুয়ে পড়ুন গিয়ে–কাল সকালে আর কিছু থাকবে না।–অজিতবাবু, আপনার চেহারাটাও ভাল ঠেকছে না–উত্তেজনার পর অবসাদ বোধ হচ্ছে–না? শরীর ঢিস-ঢিস্ করছে? বুঝেছি, আপনিও এক দাগ নিন–শরীর বেশ ঝরঝরে হয়ে যাবে।”
ঔষধ লইয়া বাহির হইতেছি, অতুল বলিল,–“ডাক্তারবাবু, ব্যোমকেশ বক্সী বলে কাউকে চেনেন?”
ডাক্তার ঈষৎ চমকিত হইয়া বলিলেন,–“না, কে তিনি?”
অতুল বলিল,–“জানি না। আজ থানায় তার নাম শুনলুম। তিনি না কি এই হত্যার তদন্ত করছেন।”
ডাক্তার মাথা নাড়িয়া বলিলেন,–“না আমি তাঁকে চিনি না।”
উপরে নিজেদের ঘরে ফিরিয়া আসিয়া আমি বলিলাম,–“অতুল, এবার সব কথা আমায় বল।”
“কি বল্ব?”
“তুমি আমার কাছে কিছু লুকোচ্ছ। কিন্তু সে হবে না, সব কথা খুলে বলতে হবে।”
অতুল একটু চুপ করিয়া রহিল, তারপর দ্বারের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল,–“আচ্ছা, বলছি। এস, আমার বিছানায় বস। তোমার কাছে যে আর লুকিয়ে রাখা চলবে না, তা বুঝেছিলুম।”
আমি তাহার বিছানায় গিয়া বসিলাম, সে-ও দরজা ভেজাইয়া দিয়া আমার পাশে বসিল। ঔষধের পুরিয়াটা তখনও আমার হাতেই ছিল, ভাবছিলাম সেটা খাইয়া নিশ্চিন্তমনে গল্প শুনিব। মোড়ক খুলিয়া ঔষধ মুখে দিতে যাইতেছি, অতুল আমার হাতটা ধরিয়া বলিল,–“এখন থাক, আমার গল্পটা শুনে নিয়ে তারপর খেয়ো।”
সুইচ তুলিয়া আলো নিভাইয়া দিয়া অতুল আমার কানের কাছে মুখ আনিয়া ফিস্ফিস্ করিয়া তাহার গল্প বলিতে লাগিল, আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনিয়া চলিলাম। বিস্ময়ে আতঙ্কে মাঝে মাঝে গায়ে কাঁটা দিয়া উঠিতে লাগিল।
পনের মিনিট পরে সংক্ষেপে গল্প সমাপ্ত করিয়া অতুল বলিল,–“আজ এই পর্যন্ত থাক, কাল সব খুলে বল্ব।” রেডিয়ম অঙ্কিত ঘড়ির দিকে চাহিয়া বলিল,–“এখনও সময় আছে। রাত্রি দু’টোর আগে কিছু ঘটবে না, তুমি বরঞ্চ ইতিমধ্যে একটু ঘুমিয়ে নাও, ঠিক সময়ে আমি তোমাকে তুলে দেব।”
রাত্রি তখন বোধ করি দেড়টা হইবে। অন্ধকারে চোখ মেলিয়া বিছানায় শুইয়াছিলাম। শ্রবণেন্দ্রিয় এত তীক্ষ্ণ হইয়া উঠিয়াছিলে যে, নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসের সঙ্গে বিছানার উপর দেহের উত্থান-পতনের শব্দ স্পষ্ট শুনিতে পারিতেছিলাম। অতুল যে জিনিসটা দিয়াছিল, সেটি দৃঢ়মুষ্টিতে ডান হাতে ধরিয়াছিলাম।
হঠাৎ অন্ধকারে কোনো শব্দ শুনিলাম না কিন্তু অতুল আমাকে স্পর্শ করিয়া গেল। ইশারাটা আগে হইতেই স্থির করা ছিল, আমি ঘুমন্ত ব্যক্তির মত জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলিতে লাগিলাম। বুঝিলাম, সময় উপস্থিত হইয়াছে।
তারপর কখন দরজা খুলিল, জানিতে পারিলাম না; সহসা অতুলের বিছানার উপর ধপ্ করিয়া একটা শব্দ হইল এবং সঙ্গে সঙ্গে আলো জ্বলিয়া উঠিল। লোহার ডাণ্ডা হস্তে আমি তড়াক্ করিয়া বিছানা হইতে লাফাইয়া উঠিলাম।
দেখিলাম, একহাতে রিভলবার, অন্য হাতে আলোর সুইচ ধরিয়া অতুল এবং তাহারই শয্যার পাশে হাঁটু গাড়িয়ে বসিয়া, মরণাহত বাঘ যেমন করিয়া শিকারীর দিকে ফিরিয়া তাকায়, তেমনি বিস্ফোরিত নেত্রে চাহিয়া–ডাক্তার অনুকূলবাবু!
অতুল বলিল,–“বড়ই দুঃখের বিষয় ডাক্তারবাবু, আপনার মত পাকা লোক শেষকালে পাশবালিশ খুন করলে!–ব্যাস্! নড়বেন না! ছুরি ফেলে দিন। হ্যাঁ, নড়ছেন কি গুলি করেছি। অজিত, রাস্তার দিকের জানলাটা খুলে দাও তো–বাইরেই পুলিস আছে।–খবরদার–”
ডাক্তার বিদ্যুদ্বেগে উঠিয়া দরজা দিয়া পালাইবার চেষ্টা করিল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে অতুলের বজ্রমুষ্টি তাহার চোয়ালে হাতুড়ির মত লাগিয়া তাহাকে ধরাশায়ী করিল।
মাটিতে উঠিয়া বসিয়া ডাক্তার বলিল,–“বেশ, হার মানলুম। কিন্তু আমার অপরাধ কি শুনি!”
“অপরাধ কি একটা, ডাক্তার, যে মুখে মুখে বলব। তার প্রকাণ্ড ফিরিস্তি পুলিস অফিসে তৈরী হয়েছে–ক্রমে প্রকাশ পাবে। আপাতত–”
চার পাঁচজন কনেস্টবল সঙ্গে করিয়া দারোগা ও ইন্সপেক্টর প্রবেশ করিল।
অতুল বলিল,–“আপাতত, ব্যোমকেশ বক্সী সত্যান্বেষীকে আপনি খুন করবার চেষ্টা করেছেন, এই অপরাধে পুলিসে সোপর্দ করছি। ইন্সপেক্টরবাবু, ইনিই আসামী।”
ইন্সপেক্টর নিঃশব্দে ডাক্তারের হাতে হাতকড়া লাগাইলেন। ডাক্তার বিষাক্ত দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিল,–“এ ষড়যন্ত্র! পুলিস আর ঐ ব্যোমকেশ বক্সী মিলে আমাকে মিথ্যে মোকদ্দমায় ফাঁসিয়েছে। কিন্তু আমিও দেখে নেব। দেশে আইন আদালত আছে,–আমারও টাকার অভাব নেই।”
ব্যোমকেশ বলিল,–“তা তো নেই-ই। এত কোকেন বিক্রীর টাকা যাবে কোথায়!”
বিকৃত মুখে ডাক্তার বলিল,–“আমি কোকেন বিক্রী করি তার কোনও প্রমাণ আছে?”
“আছে বৈ কি ডাক্তার! তোমার সুগার-অফ-মিল্কের শিশিতেই তার প্রমাণ আছে।”
জোঁকের মুখে নুন পড়িলে যেমন হয়, ডাক্তার মুহূর্তমধ্যে তেমনই কুঁকড়াইয়া গেল। তাহার মুখ দিয়া আর কথা বাহির হইল না, শুধু নির্নিমেষ চক্ষু দু’টা ব্যোমকেশের উপর শক্তিহীন ক্রোধে অগ্নিবৃষ্টি করিতে লাগিল।
আমার মনে হইল, এ যেন আমার সেই সাদাসিধা নির্বিরোধ অনুকূলবাবু নহে, একটা দুর্দান্ত নরঘাতক গুণ্ডা ভদ্রতার খোসল ছাড়িয়া বাহির হইয়া আসিল। ইহারই সহিত এতদিন পরম বন্ধুভাবে কাল কাটাইয়াছি ভাবিয়া শিহরিয়া উঠিলাম।
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল,–“কি ওষুধ আমাদের দু’জনকে দিয়েছিলে ঠিক বল দেখি ডাক্তার? মর্ফিয়ার গুঁড়ো–না? বল্বে না? বেশ, বোলো না,–কেমিক্যাল পরীক্ষায় ধরা পড়োবেই।” একটা চুরুট ধরাইয়া বিছানায় আরাম করিয়া বসিয়া বলিল,–“দারোগাবাবু, এবার আমার এত্তালা লিখুন।”
ফার্স্ট ইনফরমেশন রিপোর্ট লিপিবদ্ধ হইলে পর ডাক্তারের ঘর খানাতল্লাস করিয়া দু’টি বড় বড় বোতলে কোকেন বাহির হইল। ডাক্তার সেই যে চুপ করিয়াছিল, আর বাঙ্নিষ্পত্তি করে নাই। অতঃপর তাহাকে বমাল সমেত থানায় রওনা করিয়া দিতে ভোর হইয়া গেল। তাহাদের চালান করিয়া দিয়া ব্যোমকেশ বলিল,–“এখানে তো সব লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে। চল আমার বাসায়–সেখানে গিয়া চা খাওয়া যাবে।”
হ্যারিসন রোডের একটা বাড়ির তেতলায় উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, দ্বারের পাশে পিতলের ফলকে লেখা আছে
**********************************************
শ্রীব্যোমকেশ বক্সী
সত্যান্বেষী
**********************************************
ব্যোমকেশ বলিল,–“স্বাগতম! মহাশয় দীনের কুটীরে পদার্পণ করুন।”
জিজ্ঞাসা করিলাম,–“সত্যান্বেষীটা কি?”
“ওটা আমার পরিচয়। ডিটেক্টিভ কথাটা শুনতে ভাল নয়, গোয়েন্দা শব্দটা আরও খারাপ। তাই নিজের খেতাব দিয়েছি–সত্যান্বেষী। ঠিক হয়নি?”
সমস্ত তেতলাটা ব্যোমকেশের–গুটি চার-পাঁচ ঘর আছে; বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। জিজ্ঞাসা করিলাম,–“একলাই থাক বুঝি?”
“হ্যাঁ। সঙ্গী কেবল ভৃত্য পুঁটিরাম।”
আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলাম,–“দিব্যি বাসাটি। কত দিন এখানে আছ?”
“প্রায় বছরখানেক,–মাঝে কেবল কয়েক দিনের জন্যে তোমাদের বাসায় স্থান পরিবর্তন করেছিলুম।”
ভৃত্য পুঁটিরাম তাড়াতাড়ি স্টোভ্ জ্বালিয়া চা তৈয়ার করিয়া আনিল। গরম পেয়ালায় চুমুক দিয়া ব্যোমকেশ বলিল,–“আঃ! তোমাদের মেসে ছদ্মবেশে ক’দিন মন্দ কাটল না। ডাক্তার কিন্তু শেষের দিকে ধরে ফেলেছিল।–দোষ অবশ্য আমারই!”
“কি রকম?”
“পুলিসের কাছে জানলার কথাটা বলেই ধরা পড়ে গেলুম–বুঝতে পারছ না? ঐ জানলা দিয়েই অশ্বিনীবাবু–”
“না না, গোড়া থেকে বল।”
চায়ে আর এক চুমুক দিয়া ব্যোমকেশ বলিল,–“আচ্ছা, তাই বলছি। কতক তো কাল রাত্রেই শুনেছ–বাকিটা শোন। তোমাদের পাড়ায় যে মাসের পর মাস ক্রমাগত খুন হয়ে চলছিল, তা দেখে পুলিসের কর্তৃপক্ষ বেশ বিব্রত হয়ে উঠেছিলেন। এক দিকে বেঙ্গল গভর্নমেণ্ট, অন্যদিকে খবরের কাগজওয়ালারা পুলিসকে ভিতরে-বাইরে খোঁচা দিয়ে দিয়ে আরও অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। এই রকম যখন অবস্থা, তখন আমি গিয়ে পুলিসের বড় সাহেবের সঙ্গে দেখা করলুম, বললুম–‘আমি একজন বে-সরকারী ডিটেক্টিভ, আমার বিশ্বাস আমি এই সব খুনের কিনারা করতে পারব।’ অনেক কথাবার্তার পর কমিশনার সাহেব আমাকে অনুমতি দিলেন; শর্ত হল, তিনি আর আমি ছাড়া এ কথা আর কেউ জানবে না।
“তারপর তোমাদের বাসায় গিয়ে জুটলুম। কোনও অনুসন্ধান চালাতে গেলে অকুস্থানের কাছেই base of operations থাকা দরকার, তাই তোমাদের মেসটা বেছে নিয়েছিলুম। তখন কে জান্ত যেম বিপক্ষ দলেরও base of operations ঐ একই জায়গায়!
“ডাক্তারকে গোড়া থেকেই বড্ড বেশী ভালমানুষ বলে মনে হয়ছিল এবং কোকেনের ব্যবসা চালাতে গেলে হোমিওপ্যাথ ডাক্তার সেজে বসা যে খুব সুবিধাজনক, সে-কথাও মনের মধ্যে উঁকি-ঝুঁকি মারছিল। কিন্তু ডাক্তারই যে নাটের গুরু, এ সন্দেহ তখনও হয়নি।
“ডাক্তারকে প্রথম সন্দেহ হল অশ্বিনীকুমার মারা যাবার আগের দিন। মনে আছে বোধহয়, সেদিন রাস্তার উপর একজন ভাটিয়ার লাস পাওয়া গিয়েছিল। ডাক্তার যখন শুনলে যে, তার ট্যাঁকের গেঁজে থেকে এক হাজার টাকার নোট বেরিয়েছে, তখন তার মুখে মুহূর্তে জন্য এমন একটা ব্যর্থ লোভের ছবি ফুটে উঠল যে, তা দেখেই আমার সমস্ত সন্দেহ ডাক্তারের ওপর গিয়ে পড়ল।
“তারপর সন্ধ্যাবেলায় অশ্বিনীবাবুর আড়ি পেতে কথা শোনার ঘটনা। আসলে অশ্বিনীবাবু আমাদের কথা শুনতে আসেননি, তিনি এসেছিলেন ডাক্তারের সঙ্গে কথা কইতে। কিন্তু আমরা রয়েছি দেখে তাড়াতাড়ি যা হয় একটা কৈফিয়ৎ দিয়ে চলে গেলেন।
“অশ্বিনীবাবুর ব্যবহারে আমার মনে আবার ধোঁকা লাগল, মনে হল হয়তো তিনিই আসল আসামী। রাত্রিতে মেঝেয় কান পেতে যা শুনলুম, তাতেও ব্যাপারটা স্পষ্ট হল না। শুধু এইটুকু বুঝলুম যে, তিনি ভয়ঙ্কর একটা কিছু দেখেছেন। তারপর সে-রাত্রে যখন তিনি খুন হলেন, তখন আর কোনও কথাই বুঝতে বাকি রইল না। ডাক্তার যখন সেই ভাটিয়াটাকেই রাস্তার ওপর খুন করে, দৈবক্রমে অশ্বিনীবাবু নিজের জানলা থেকে সে দৃশ্য দেখে ফেলেছিলেন। আর সেই কথাই তিনি গোপনে ডাক্তারকে বলতে গিয়েছিলেন।
“এখন ব্যাপারটা বেশ বুঝতে পারছ? ডাক্তার কোকেনের ব্যবসা করত, কিন্তু কাউকে জানতে দিত না যে, সে এই কাজের সর্দার! যদি কেউ দৈবাৎ জানতে পেরে যেত, তাকে তৎক্ষণাৎ খুন করত। এইভাবে সে এতদিন নিজেকে বাঁচিয়ে এসেছে।
“ঐ ভাটিয়াটা সম্ভবতঃ ডাক্তারের দালাল ছিল, হয়তো তারই মারফত বাজারে কোকেন সরবরাহ হত। এটা আমার অনুমান, ঠিক না হতেও পারে। সে-দিন রাত্রে সে ডাক্তারের কাছে এসেছিল, কোনও কারণে তাদের মধ্যে মনোমালিন্য হয়। হয়তো লোকটা ডাক্তারকে blackmail করবার চেষ্টা করে–পুলিসের ভয় দেখায়। তার পরেই–যেই সে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, অমনই ডাক্তারও পিছন পিছন গিয়ে তাকে শেষ করে দেয়।
“অশ্বিনীবাবু নিজের জানলা থেকে এই দৃশ্য দেখতে পেলেন এবং ঘোর নির্বুদ্ধিতার বশে সে-কথা ডাক্তারকেই বলতে গেলেন।
“তাঁর কি উদ্দেশ্য ছিল, জানি না। তিনি ডাক্তারের কাছে উপকৃত ছিলেন, তাই হয়তো তাকে সাবধান করে দিতে চেয়েছিলেন। ফল হল কিন্তু ঠিক তার উল্টো। ডাক্তারের চোখে তাঁর আর বেঁচে থাকবার অধিকার রইল না। সেই রাত্রেই কোনও সময় যখন তিনি ঘর থেকে বেরুবার উপক্রম করলেন, অমনই সাক্ষাৎ যম তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল।
“আমাকে ডাক্তার গোড়ায় সন্দেহ করেছিল কি না বলতে পারি না, কিন্তু যখন আমি পুলিসকে বললুম যে, ঐ জানলাটাই অশ্বিনীকুমারের মৃত্যুর কারণ, তখন সে বুঝলে আমি কিছু-কিছু আন্দাজ করেছি, সুতরাং আমারও ইহলোক ত্যাগ করবার খাঁটি অধিকার জন্মালো। কিন্তু ইহলোক ত্যাগ করবার জন্য আমি একেবারে ব্যগ্র ছিলুম না। তাই অত্যন্ত সবধানে দিন কাটাতে লাগলুম।
“তারপর পুলিস এক মস্ত বোকামি করে বস্ল, আমাকে গ্রেপ্তার করলে। যা হোক, কমিশনার সাহেব এসে আমাকে খালাস করলেন, আমি আবার মেসে ফিরে এলুম। ডাক্তার তখন স্থির বুঝলে যে, আমি গোয়েন্দা;–কিন্তু সে ভাব গোপন করে আমাকে রাত্রির জন্যে মেসে থাকতে দিয়ে ভারি উদরতা দেখিয়ে দিলে। উদারতার আড়ালে একটিমাত্র উদ্দেশ্য ছিল–কোনও রকমে আমাকে খুন করা। কারণ, তার বিষয়ে আমি যত কথা জানতুম, এত আর কেউ জানত না।
“ডাক্তারের বিরুদ্ধে তখন পর্যন্ত কিন্তু সত্যিকারের কোনও প্রমাণ ছিল না। অবশ্য তার ঘর খানাতল্লাসী করে কোকেন বার করে তাকে জেলে দেওয়া যেতে পারত, কিন্তু সে যে একটা নিষ্ঠুর খুনী, এ কথা কোনও আদালতে প্রমাণ হত না। তাই আমিও তাকে প্রলোভন দেখাতে শুরু করলুম। দরজার তালার পেরেক ফেলে দিয়ে আমিই সেটাকে খারাপ করে দিলুম। ডাক্তার খবর পেয়ে মনে মনে উল্লসিত হয়ে উঠ্ল–আমরা রাত্রে দরজা বন্ধ করে শুতে পারব না।
“তারপর আমরা যখন ওষুধ নিতে গেলুম, তখন সে সাক্ষাৎ স্বর্গ হাতে পেলে। আমাদের দু’জনকে দু’ পুরিয়া গুঁড়ো মর্ফিয়া দিয়ে ভাবলে, আমরা তাই খেয়ে এমন ঘুমই ঘুমুব যে, সে নিদ্রা মহানিদ্রায় পরিণত হলেও জানতে পারব না।
“তার পরেই ব্যাঘ্র এসে ফাঁদে পা দিলেন। আর কি?”
আমি বলিলাম,–“এখন উঠলুম ভাই। তুমি বোধ হয় উপস্থিত ওদিকে যাচ্ছ না?”
“না। তুমি কি বাসায় যাচ্ছ?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
“বাঃ! কেন আবার! বাসায় যেতে হবে না?”
“আমি বলছিলুম কি, ও বাসা তো তোমাকে ছাড়তেই হবে, তা আমার এখানে এলে হত না? এ বাসাটা নেহাৎ মন্দ নয়।”
আমি খানিক চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলাম,–“প্রতিদান দিচ্ছ বুঝি?”
ব্যোমকেশ আমার কাঁধে হাত রাখিয়া বলিল,–“না ভাই, প্রতিদান নয়। মনে হচ্ছে তোমার সঙ্গে এক জায়গায় না থাকলে আর মন টিকবে না। এই ক’দিনেই কেমন একটা ব-অভ্যাস জন্মে গেছে।”
“সত্যি বল্ছ?”
“সত্যি বল্ছি।”
“তবে তুমি থাকো, আমি জিনিসপত্রগুলো নিয়ে আসি।”
ব্যোমকেশ প্রফুল্লমুখে বলিল,–“সেই সঙ্গে আমার জিনিসগুলো আনতে ভুলো না যেন।”
(শেষ)
No comments:
Post a Comment