Showing posts with label জলে জঙ্গলে. Show all posts
Showing posts with label জলে জঙ্গলে. Show all posts

গজদানব


মোহন সর্দার স্তম্ভিত হয়ে গেল লোকটাকে দেখে!

নাঃ! একটা কিছু করা দরকার। আর দেরী করা চলে না।

লোকটার সর্বাঙ্গে রক্তের ছোপ, ধুতি ফালা-ফালা। বললে, ওর একজন সঙ্গীও ছিল। অভয়ারণ্যের সীমান্তের বাইরে দিয়েই দুজন হাটের পথে যাচ্ছিল। একেবারে বিনা নোটিসে জঙ্গল থেকে ছুটে বেরিয়ে আসে গজদানব। বিনা প্ররোচনায়। ওর সঙ্গীটির দেহ একেবারে কাদার দলায় রূপান্তরিত। লোকটা কোনক্রমে পালিয়ে এসেছে ছুটতে ছুটতে। মোহনসর্দারকে খবর দিতে।

কূকাল অভয়ারণ্যের ওয়ার্ডেন মোহন সর্দার রীতিমত বিচলিত হয়ে পড়ে। কূকাল ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারিতে তার সতেরো বছরের চাকরি। কিন্তু এমন অভিজ্ঞতা তার কখনো হয়নি। সরকারী হিসাবমত এ অরণ্যে সাতান্নটি বন্যহস্তী আছে। তারা আপন মনে থাকে। কখনো অরণ্যসীমানার বাইরে আসে না, কখনো মানুষজনকে আক্রমণ করে না। সরকারী কর্মীদের সঙ্গে তাদের হামেশাই দেখা হয়। কোন হাতিই কখন কাউকে তেড়ে আসেনি।

এই গজদানব এক ব্যতিক্রম!

মোহন সর্দার প্রশ্ন করে, - ও যে 'গজদানব' তা তুমি বুঝলে কেমন করে?

- ওর দাঁত জোড়া দেখে।

হ্যাঁ, দাঁত জোড়া হচ্ছে গজদানবের আইডেন্টিফিকেশন মার্ক! দশ-বিশখানা গাঁয়ের মানুষ তাকে দেখলেই চেনে। ঐ দাঁতের জন্য। সবাই ওর নাম দিয়েছে গজদানব।

দু-পাশের দুটি দাঁত বে-কায়দায় বাড়তে বাড়তে যেন পরস্পরকে স্পর্শ করেছে। ডক্টর রমেশচন্দ্রজী বলেছেন, ঐ দাঁত-জোড়ার জন্যেই একান্তচারী শান্ত হাতিটা মত্ত মাতঙ্গ হয়ে পড়েছে। দু পাশের দুটি দাঁত এমনভাবে বেঁকেছে যে, তার ফাঁক দিয়ে সে শুঁড়টাকে গলাতে পারছে না।

তার ফলে শুঁড়ের ডগা মুখের কাছে আসছে না আর। মাটি থেকে কিছু তুলে অথবা উঁচু গাছের ডালপালা ভেঙে সে খাবার মুখে পুরতে পারছে না! বেচারি গজদানব! বস্তুত অনাহারেই সে ক্ষিপ্ত!

এই সহজ কথাটা অঞ্চলপ্রধান বিনায়করাম বুঝতে নারাজ।

পঞ্চায়েত-বৈঠকে স্থির হয়েছে ঐ হাতিটাকে হত্যা করে অভয়ারণ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনতে হবে! এই নিয়ে গজদানব চার-চারটি গ্রাম্য-মানুষকে হত্যা করল এবং চারবারই অভয়ারণ্যের সীমার বাইরে এসে। ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারির যাবতীয় বন্যপ্রাণী, অভয়ারণ্যের সীমানা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল।

না জেনে বা ভুল করে কেউ সেই সীমানা অতিক্রম করে না। একমাত্র ব্যতিক্রম ঐ গজদানব। সে বারে বারে নির্দিষ্ট সীমারেখা অতিক্রম করে ঢুকে পরে আশপাশের গাঁয়ে। তার একমাত্র লক্ষ্য কলার গাছ। দশ-মাইলের মধ্যে, তাই কেউ সাহস করে কলার চাষ করে না!

এ নিয়েও মোহন সর্দার আলোচনা করেছে রমেশচন্দ্রজীর সঙ্গে। রমেশচন্দ্র সদর শহরের পশুচিকিৎসক। মোহনের সঙ্গে ছিল চন্দন, মোহনের সতের বছর বয়সের কৌতূহলী ছেলেটা।

সেই হঠাৎ বেমক্কা প্রশ্নটা পেশ করে বসেছিল, আচ্ছা ডাক্তার-সাব, ঐ পাগলা হাতিটা কলাগাছের নেশায় এমন মাতাল হয়ে পড়ে কেন?

ডাক্তারসাব বলেছিলেন, বুঝলি না? ওর শুঁড় তো মুখের কাছে আসে না? তাই। কলাগাছ উপড়ে নিতে পারলে ওকে অনাহারে থাকতে হয় না। সেটাকে এমন ভাবে শুঁড়ে জড়িয়ে নিতে পারে যাতে দূর থেকেই গাছটার অপরপ্রান্ত ওর মুখের কাছাকাছি চলে আসে।

যুক্তিপূর্ণ কথা। মোহন বুঝতে পেরেছিল। বোঝেননি বিনায়করাম। নিতান্ত অবুঝের মত বলেছিলেন, - ওসব জানি না। ঐ পাগলা হাতিটা এ তল্লাটের বদনাম করে ছেড়েছে। মানুষজন সাহস করে পথে বের হয় না। আমরা চাই ওটাকে মেরে এ রাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনতে।

মোহন সর্দার গড়িমসি করছিল এতদিন। দেশে পঞ্চায়েত-রাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; অঞ্চলপ্রধানের ইচ্ছা মানেই আদেশ। কিন্তু ঐ অতবড় প্রাণীটাকে হত্যা করতে.....

চতুর্থ নরহত্যার পর মোহন বাধ্য হয়ে উপর মহলে গজদানবকে হত্যা করার অনুমতি চেয়ে পাঠাল।

অচিরেই এসে গেল তা। বস্তুত উপর মহল সব খবরই জানতেন, বিনায়করামের কৃপায়। তাঁরা চাইছিলেন, মোহন সর্দার নিজে থেকেই ঐ অনুমতি চেয়ে পাঠাক!

কারণ বনবিভাগের মন্ত্রীমশাই প্রাণীহত্যার একেবারে বিরুদ্ধে। দরখাস্তটা নিচুমহল থেকে এলে কনজারভেটারের দায়িত্বটা কমে।

হত্যার পারমিট এসে যাবার পর চন্দন এল বাপের কাছে দরবার করতে। গজদানবের পক্ষ নিয়ে। মোহন বিরক্ত হল। বললে, - আমি কী করব? আমি কী করতে পারি?

তা বটে! চন্দন বাপকে চেনে। জানে, এ অরণ্যের প্রতিটি বন্যপ্রাণীকে মোহন প্রাণ দিয়ে ভালবাসে। নিতান্ত নিরুপায় হয়েই সে এই হত্যাদেশ আনিয়ে নিয়েছে।

পরদিন ভোর রাত্রে ওরা তিনজনে তিন-তিনটে রাইফেল লোড করে বার হয়ে পড়ল গজদানবের সন্ধানে। মোহন, চন্দন আর আলাগিরি। আলাগিরি বনরক্ষক। দুর্দান্ত সাহসী, অদ্ভুত তার টিপ। ইংরাজি V অক্ষরের নকশা এঁকে আকাশে যখন যাযাবর পাখির দল উড়ে যায় তখন সে বলে-বলে তিন বা চার নম্বর পাখিটাকে নামাতে পারে।

তখনও ভাল করে ভোরের আলো ফোটেনি! পুব আকাশে দপদপ্ করে জ্বলছে ভুলকো তারাটা! গজদানবের সন্ধান পেতে খুব দেরি হল না। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে একা-একা চরে বেড়াচ্ছে।

মোহন জানে, কোন্ পথে হাতিটা নেলী-ওদাই ঝরনায় জলপান করতে যাবে! ভোর রাতে হাতিরা একবার আকণ্ঠ জল পান করে।

ঝরনার কিনারে আছে প্রকাণ্ড একটা 'পার্চিং-স্টোন'! নিঃসঙ্গ প্রস্তর, অন্তত ছয় মিটার উঁচু! এরা তিনজনে অনেক কায়দা করে সেই দোতলা বাড়ির মত উঁচু পাথরটার মাথায় উঠে এল। সেখানে উঠে চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে মোহন গজদানবকে ভাল করে দেখল।

ডাক্তার-সাব যা বলেছিলেন সেটাই ঠিক। গজদানবের শুঁড় দুই দাঁতের ফাঁক দিয়ে মুখ-বিবর পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না। ও আরও দেখল, শুঁড়ের পাশ ছড়ে গেছে, রক্ত ঝরছে, নিজেরই দাঁতের ঘর্ষণে!

বেলা বাড়ল। গজদানব নদী কিনারে এল না। ক্রমে রোদের তেজ বাড়ল। প্রভাতী পাখির ডাক থেমেছে অনেকক্ষণ। তারপর প্রায় মধ্যদিনে গজদানব হেলতে-দুলতে নদীর দিকে এগিয়ে গেল। একদল হরিণ তার আগেই নদীকিনারে জলপান করতে এসেছিল। হরিণ হাতিকে ভয় পায় না। দু-জনেই তৃণভোজী, খাদ্য-খাদক সম্পর্ক নয়!

কিন্তু গজদানবকে দেখামাত্র হরিণের দল রুদ্ধশ্বাসে ছুটে পালিয়ে গেল। ওরাও কী জানি কী করে বুঝে নিয়েছে গজদানব ফাঁসির আসামী! সে স্বাভাবিক বন্যপ্রাণী নয়।

হঠাৎ গজদানব চঞ্চল হয়ে ওঠে! শুঁড় আকাশে তুলে বাতাসে কিসের গন্ধ শুঁকল। পরমুহূর্তেই সে বুঝে নিল জঙ্গলে মানুষ এসেছে! বুঝতে পারল তারা কোথায় ঘাপটি মেরে বসে আছে। ভীম বেগে সেই পাথরটার দিকে ছুটে এল গজদানব। পাথরটার ওপর একটা পা রেখে উপরে উঠবার চেষ্টা করল। পারল না।

সর্বশক্তি দিয়ে প্রচণ্ড ধাক্কা মারল পাথরটায়! তিলমাত্র নড়ল না সেই অনাদিকালের অনড় প্রস্তরখণ্ড!

গজদানব ওদের কাছ থেকে দু-আড়াই মিটার দূরত্বে! আলাগিরি তার রাইফেলটা উঁচু করে ধরতেই মোহন চাপা গর্জন করে ওঠে, - মৎ মারো।

আলাগিরি অবাক হয়। কিন্তু আদেশটাও মানে। রাইফেলটা নামায়।

একটা অদ্ভুত জিনিস নজরে পড়েছে মোহন সর্দারের। হাতিটার গজকুম্ভের ডানপাশে একটা ক্ষতচিহ্ন। প্রচণ্ড উত্তেজনায় গজদানব যখন কান নাড়াচ্ছে, তখন সেই ক্ষতচিহ্নটা দেখা যাচ্ছে।

মোহন আন্দাজে বুঝে নেয়, গজদানব যখন কোন গ্রামে কদলীবৃক্ষের সন্ধানে গিয়েছিল তখন কেউ ওকে গুলি করেছে! হয়ত বাক্-শট্, হয়ত নিতান্ত গাদা-বন্দুক!

সে যাই হোক, কানের পাশে নরম চামড়া ভেদ করে বুলেটটা এখন রয়েছে ওর দেহে। ঘা হয়েছে তাই। দগদগে ঘা। পূঁজ গড়াচ্ছে কান বেয়ে!

সন্ধ্যেবেলায় ওরা যখন ফিরে এল, তখন আলাগিরি জানতে চায়, এমন সুযোগটা পেয়েও কেন হাতিটাকে মারতে দিল না মোহনসর্দার।

মোহন বিস্তারিতভাবে জানাল - সে কী দেখেছে, কী বুঝেছে!

আলাগিরি বিরক্ত হয়ে বলে, - আরে বাবা কানে ঘা হয়েছে বলে কি ফাঁসির আসামীর ফাঁসির দিন পেছিয়ে যায় কখনো? না ফাঁসিটা মকুব হয়ে যায়?

মোহন বললে, - তোমার দিমাগ খারাপ হয়ে গেছে দোস্ত। তুমিও বাওরা হয়ে গেছ।

মোহন সর্দার সাতদিনের সময় চেয়ে উপর মহলে একটা টেলিগ্রাম পাঠাল।

তারপর সে রাত্রেই দশ মাইল সাইকেল চালিয়ে হাজির হল সদরে! ডাক্তার সাব-এর ডেরায়!

সব কথা শুনে ডাক্তার সা'ব বললেন, তুমি যা বলছ তা হতে পারে। গোদের ওপর বিষফোড়া! এমনিতেই বেচারির দাঁত-জোড়া এমন বেকায়দায় বেড়ে গেছে যে, ও অনাহারেই আছে প্রায়....

- ডাক্তার সা'ব! ওকে যদি 'ট্র্যাঙ্কুলাইজার' বুলেট দিয়ে অজ্ঞান করে দিই, আপনি ওর কানের পাশ থেকে বুলেটটা বার করে দিতে পারবেন?

ডাক্তার সা'ব চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়েন - ক্ষেপেছ!

ভেটেরনারি ডাক্তার তিনি, গরু, ঘোড়া, ছাগল, কুকুর নিয়েই তাঁর দিন কাটে! চিড়িয়াখানায় অবশ্য একবার হস্তিদেহেও অপারেশন করতে হয়েছে। কিন্তু এ যে মত্ত মাতঙ্গ! অরণ্যচারী হস্তিদানব!

- আমি ক্ষেপিনি ডাক্তার সাব! গজদানবও ক্ষেপেনি। আমরা তাকে ক্ষেপিয়ে তুলেছি। শুনুন। আলাগিরির টিপ অব্যর্থ! হাতির ছবি এঁকে ঠিক যেখানটায় ঢেরা-চিহ্ন দিয়ে দেবেন হুবহু সেইখানটাতেই গুলি করবে ও! হাতি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতে বাধ্য! ডোজ কতটা হবে তা আপনিই বাৎলে দেবেন! গজদানব ধরাশায়ী হলে অপারেশন করতে আপনার যে দশ-পনের মিনিট লাগবে তার ভিতর আমি করাত দিয়ে ওর অন্তত একটা দাঁত কেটে ফেলব। পারব না আমরা ওকে বাঁচাতে?

ডাক্তার রমেশচন্দ্র নীরবে কী যেন ভেবে নিলেন। জীবজন্ত পশুপাখিকে তিনি সত্যিই ভালবাসেন। তারপর বললেন, - ঠিক হ্যায়।

ট্র্যাঙ্কুলাইজারের ডোজটা তিনি নিজে হাতে তৈরি করে দিলেন! ঐ প্রকাণ্ড গজদানব সহজে অজ্ঞান হবে না! আর অপারেশন শেষ হবার আগেই যদি কুম্ভকর্ণের নিদ্রাভঙ্গ হয়, -- তাহলেই চিত্তির! তাই বেশ খানদানি ডোজই দরকার!

পরদিন ওরা আবার প্রবেশ করল অভয়ারণ্যে। আজ তিনজন নয়, চারজন। ডাক্তারবাবু সবার পিছনে, বিশ হাত তফাতে। মাঝে মাঝে দূরত্বটা আবার কমিয়েও আনছেন। কে জানে, বেটা পিছন দিক থেকে যে চড়াও হবে না এমন নিশ্চয়তা নেই।

অচিরেই গজদানবের সাক্ষাৎ পাওয়া গেল! কিন্তু আজ সে একটা ফাঁকা মাঠে বিচরণ করছে। ঘাস তার হাঁটু অব্দি। লুকিয়ে লুকিয়ে তার কাছাকাছি এগিয়ে যাওয়া সম্ভবপর নয়। অথচ কাছে যাওয়া নিতান্ত দরকার!

কারণ আজ তো আর রাইফেল নয়, সঙ্গে রয়েছে 'ডার্ট-গান', যা থেকে ঐ ঘুম-পাড়ানিয়া ইনজেশন ছোঁড়া যাবে। ডার্ট-গান যেটা ওরা সঙ্গে করে এনেছে তার রেঞ্জ মাত্র পঁচিশ মিটার।

সমস্ত দিন প্রতীক্ষা করেও দানবটাকে অত কাছে পাওয়া গেল না!

তারপরের দুটো দিন গজদানব কোথায় যে লুকিয়ে রইল তার সন্ধানই পাওয়া গেল না!

ডাক্তার সা'ব পালাতে পারলে বাঁচেন। বলেন, - মোহন। মৃত্যু ওকে টানছে রে। না হলে এভাবে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াবে কেন? আমি যাই। চার দিন হয়ে গেল। আর তো অপেক্ষা করা চলে না।

মোহন হাত দুটি জোড় করে বললে, - আপনি তো জানেনই ডাক্তার সা'ব, আর মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টা মেয়াদ আছে আমার। তার মধ্যে হল তো ভাল, না হলে হত্যাই করতে হবে ওকে।

হ্যাঁ, ডাক্তার সা'ব জানেন। ঐ আটচল্লিশ ঘন্টার হিসাবটা।

ইতিমধ্যে বনবিভাগের উপর মহল থেকে তারবার্তার জবাব এসে গেছে। যেমন করেই হোক সাত দিনের মধ্যে অভয়ারণ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রয়োজনে গজদানবকে হত্যা করেও! হিসাবমত আর দুটি দিন মাত্র বাকি।

পঞ্চম দিনে আবার তার খবর পাওয়া গেল। এ কয়দিন সে অরণ্যের ও-প্রান্তে চলে গিয়েছিল। আবার ফিরে এসেছে তার অভ্যস্ত এলাকায়। ওরা আবার গিয়ে আশ্রয় নিল সেই প্রকাণ্ড পাথরটার মাথায়!

কিন্তু গজদানব বোধহয় ওদের চালাকিটা সমঝে নিয়েছে। ঐ পাথরটাকে এড়িয়ে সে অন্য ঘাটে গিয়ে ঝরনা থেকে জলপান করে এল।

শেষ দিন। এবার মোহনও যেন মরিয়া হয়ে উঠল। বললে, - আমি একবার শেষ চেষ্টা করে দেখতে চাই। এই ঘাটেই কোন একটা গাছের ওপর লুকিয়ে বসে থাকব।

আলাগিরি বারণ করে। বলে, - গাছগুলো আমি পরখ করে দেখেছি। সব গাছই পলকা। গজদানব সজোরে ধাক্কা মারলে মড়মড়িয়ে ভেঙে পড়তে পারে!

-পড়ে তো পড়ুক! কিন্তু ধাক্কা মারার আগেই যদি গুলি করতে পারি তবে ও তো নিজেই মড়মড়িয়ে ভেঙে পড়বে।

চন্দন বললে, - ঠিক আছে। আমিও চড়ব আর একটা ডালে। তোমার হাতে থাকবে রাইফেল, আর আমার হাতে ডার্ট-গান। ডাক্তারসা'ব বসে থাকবেন ঐ বিশাল পাথরটার মাথায়।

ডাক্তারবাবু সভয়ে বলেন, - একা?

আলাগিরি বললে, - না, আমি থাকব আপনার পাঁজর ঘেঁষে। জায়গাটা ঐ দু-নম্বর ঘাট থেকে রাইফেল রেঞ্জ-এর ভিতর। মোহনদা যদি ফস্কায় তাহলে আমি দ্বিতীয় সুযোগটা পাব।

ডাক্তারবাবু বলেন, - আর তুমিও যদি ফস্কাও?

আলাগিরি জবাব দিল না। মৃদু হাসল।

মোহন বললে, - ডাক্তারসা'ব, আলাগিরির বন্দুকের সমুখ থেকে কোন চিড়িয়া কোনদিন ভাগতে পারেনি, আর এ তো প্রকাণ্ড দেহের হাতি!

সেই মতই ব্যবস্থা হয়েছে। যে-যার জায়গায় গুছিয়ে বসেছে। চন্দন বসেছে একটা কেঁদ গাছের ডালে, মাটি থেকে বারো চোদ্দ ফুট উঁচুতে। মোহন-সর্দার একটা অর্জুনগাছে। সেটাও গজদানবের নাগালের বাইরে। বেশ কিছুটা দূরে, নিরাপদ দূরত্বে, পাথরের মাথায় বসে আছেন ডাক্তারবাবু আর আলাগিরি।

আজ মোহন আর চন্দন নেংটিসার। বাপ-বেটায় সারা গায়ে মেখেছে পাঁক-মাটি। দেহের গন্ধটা চাপা দিতে! হাতির ঘ্রাণশক্তি অতি তীব্র!

মধ্যদিনে গজরাজ এলেন। বহুদূর থেকে দেখা যাচ্ছিল তাঁকে! হেলতে-দুলতে একটু খোঁড়াতে খোঁড়াতে সে এগিয়ে আসছিল।

হঠাৎ সে থমকে দাঁড়াল। গন্ধ শুঁকল শুঁড় আকাশে তুলে। কী আশ্চর্য। সে ওদের ছলচাতুরী বুঝে ফেলেছে। যতই গায়ে পাঁক-মাটি মাখো, ওকে ঠকাতে পারবে না! দুটো ঘাটের একটাতেও সে জলপান করতে নামল না!

অনেক দূরের একটা বন্যপথ দিয়ে সে এগিয়ে গেল ঝরনার কিনারায়। নেমে পড়ল নদীগর্ভে। এখানে জলটা একটা কুণ্ড মত তৈরি করেছে। হাঁটুজলে নেমে এল গজদানব। অবশ্য নদীতে জলও ঐ অতটাই। শুঁড়টা নামিয়ে জলপান করতে চেষ্টা করল সে! পারল না।

জোড়া-দাঁতে বাধা পাওয়ায় শুঁড়টা জলতল পর্যন্ত পৌঁছলোই না! এরপর সে বসে পড়ল জলে। এখন তার শুঁড় জলস্পর্শ করছে। শুঁড়ে করে সে জল ছিটিয়ে দিল সর্বাঙ্গে! এক ঝাঁক টীল সভয়ে উড়ে গেল আকাশে। গজদানবকে এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে সে মোহন সর্দারের রাইফেল রেঞ্জের ভিতর, কিন্তু চন্দনের 'ডার্ট-গান'-এর এক্তিয়ারের অনেক বাইরে।

দূরত্ব অন্তত পঁচাত্তর মিটার। মোহন আলাগিরির দিকে ফেরে। আলাগিরি নিঃশব্দে 'না'য়ের ভঙ্গিতে হাত নাড়ে, অর্থাৎ সে এখান থেকে গজদানবকে দেখতে পাচ্ছে না, মাঝখানে গাছপালার আড়াল পড়ায়।

মোহন রীতিমত উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। আজই তার শেষ দিন। রেঞ্জ-এর ভিতর পেয়েও সে যদি আজ গজদানবকে হত্যা না করে, তবে তাকে কৈফিয়ৎ দিতে হবে সরকারী আদেশ অমান্য করার অপরাধে। কাল পরশুর মধ্যে গজদানব যদি আবার কোন নরহত্যা করে বসে, তবে হয়ত তার সতেরো বছরের চাকরিটাই খতম হয়ে যাবে!

সে যে সুযোগ পেয়েও রাইফেল চালায়নি, সরকারি নির্দেশ পাওয়া সত্ত্বেও, এ ঘটনার দু-দুজন সাক্ষী রয়ে গেল, আলাগিরি আর ডাক্তারবাবু। এছাড়া চন্দন। সে অবশ্য বাপের বিরুদ্ধে...

কিন্তু কই? চন্দন কই?

মোহন দুরন্ত বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখে, কেঁদ গাছটার সেই নির্দিষ্ট ডালে চন্দন নেই।

শিকারীর সন্ধানী চোখ! পরমুহূর্তেই তার নজর হয়, চন্দন গাছ থেকে নেমে পড়েছে! তিল-তিল করে এগিয়ে যাচ্ছে গজদানবের দিকে। যে ভঙ্গিতে টিকটিকি এগিয়ে যায় ফড়িঙের দিকে। ঝোপজঙ্গল ভেদ করে। অথচ তিলমাত্র শব্দ হচ্ছে না। নিস্তব্ধ দ্বিপ্রহরে একটানা ঘুঘুর ডাকটাই শুধু শোনা যায়। কী দুঃসাহসী ছেলেটা!

মোহন বুঝে উঠতে পারে না, কী তার কর্তব্য। সে বসে আছে অর্জুনগাছের মগডালে, সেখান থেকে গজদানবকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আর স্নানরত মাতঙ্গটা আছে তার রেঞ্জের ভিতরেই। আলাগিরির মতো অব্যর্থসন্ধানী না হলেও মোহন সর্দারের টিপ্ ভালই!

অতবড় হাতিটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হবার সম্ভাবনা অল্প। কিন্তু যদি ফস্কায়? আলাগিরি জন্তুটাকে দেখতে পাচ্ছে না। মোহন লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়া মানে... চন্দনের যৌবনপুষ্ট দেহটা....

ঘরওয়ালীর কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল মোহনের। চন্দনের মা কি তাহলে ওকে কোনদিন ক্ষমা করতে পারবে? নিজের অজান্তেই মোহন নেমে পড়েছে গাছ থেকে। নিঃশব্দে।

গজদানব তো ছাড়, অগ্রবর্তী চন্দনও তা টের পায়নি। প্রায় পনের-বিশ মিটার পিছনে থেকে সে চন্দনের পথরেখা ধরেই অগ্রসর হতে থাকে। জমিতে নেমে আসার পর মোহন আর গজদানবকে দেখতে পাচ্ছে না। গাছপালায় আড়াল হয়ে গেছে।

চন্দন কিন্তু দেখতে পাচ্ছে। সে প্রায় নদীকিনারের কাছাকছি, তার সমুখে আর গাছপালার আড়াল নেই। গজাদানব এদিকে ফিরলেই চন্দনকে দেখতে পাবে।

মোহন নিঃশব্দে তার রাইফেলের সেফটি ক্যাচটা বন্ধনমুক্ত করে দিল। উঠে দাঁড়াল একটা উঁচু টিলার ওপর। - - হ্যাঁ, - এখন দুজনকেই দেখা যাচ্ছে। চন্দন আর গজদানব! রাইফেলটা উঁচু করে ধরল।

কিন্তু এ কী! তার হাত কাঁপছে কেন? মনকে শক্ত করল মোহন। সে শিকারী। সে মোহন-সর্দার। তার হাত কাঁপতে নেই।

কিন্তু কী শট নেবে? হেড-শট, না হার্ট-শট?

হৃৎপিণ্ডে গুলিবিদ্ধ হলে হাতি তৎক্ষণাৎ মরবে এমন কোন কথা নেই! নির্ভুল 'হার্ট-শট' সত্ত্বেও দেখা গেছে হাতি উঠে দাঁড়ায়, মরতে মরতেও তেড়ে আসছে।

সে তুলনায় 'হেড-শট' অনেক নিরাপদ। মস্তিষ্কে গুলিবিদ্ধ হলে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু। কিন্তু দু-একটি ক্ষেত্রে এমনও দেখা গেছে যে, হাতির শিরঃকঙ্কালে প্রতিহত হয়ে বুলেট বেঁকে পথে বেরিয়ে যায়!

তাহলে? কী স্থির হল? মস্তিষ্ক না হৃৎপিণ্ড?

তখনই মোহনের নজর হল চন্দনও তার ডার্ট-গানটা তুলেছে। টিপ করছে।

মোহন সিদ্ধান্তে এল। না! চন্দনকে তার সুযোগটা দিতে হবে।

চন্দন ফায়ার করল।

লেগেছে! গজদানব উঠে পড়ল জল থেকে। শত্রুকে সে দেখতে পেয়েছে! জলকাদা ভেঙে হাতিটা তীব্রবেগে ছুটে আসছে শত্রুর দিকে!

বেচারি গজদানব। সে জানে না, চন্দন তার শত্রু নয়, বন্ধু। পরম মিত্র। প্রাণদানকারী।

মোহন বন্দুকটা আবার উঁচু করে ধরে।

আঃ কী কেলেঙ্কারী। ওর সামনে চন্দন আর গজদানব একই সরলরেখায়। মানে, টিপ্ যদি ফসকায়, রাইফেলের মাছি যদি ফায়ার করার মুহূর্তে তিলমাত্র সরে যায় তাহলে গজদানবের পরিবর্তে চন্দনই লুটিয়ে পড়বে মাটিতে।

চন্দন রুদ্ধশ্বাসে পালাচ্ছে! গজদানব পশ্চাদ্ধাবন করছে তার।

কিন্তু কী মুশকিল! ওরা দুজনেই এগিয়ে আসছে মোহনের দিকে! একই সরলরেখায়!

তারপর হঠাৎ প্রচণ্ড বৃংহিত-ধ্বনিতে অরণ্য কম্পিত করে গজদানব দাঁড়িয়ে পড়ল। গজদানব টলছে! তার শূন্যে উৎক্ষিপ্ত শুঁড় ধীরে, অতি ধীরে, যেন স্লো-মোশনে নেমে এল।

গজদানব লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।

মোহন গুলি করল না। যদিও এখন চন্দন তার লক্ষ্যমুখে নয়।

তবু ফায়ার করল না সে। স্থির হয়ে দাঁড়িয়েই রইল রাইফেল উদ্যত করে। হ্যাঁ, তাই হয়েছে। ট্র্যাঙ্কুলাইজার তার কাজ করছে। গজদানব অচেতন হয়েছে।

ইতিমধ্যে ডাক্তারবাবুকে নিয়ে আলাগিরিও এসে পৌঁছেছে। ঝটপট্ ডাক্তার তাঁর যন্ত্রপাতি বার করে ফেললেন। অস্ত্রোপচার করলেন কানের পাশটায়। ফিনকি দিয়ে পূঁজ-রক্ত বার হয়ে এল। সে প্রায় এক বালতি! সেই সঙ্গে সোন্না দিয়ে বার করে আনলেন একটা সিসের গোলক। বুলেট! কী সব ইনজেকশনও দিলেন।

দাঁতটা কাটতে হল না। পতনজনিত আঘাতে পাথরে লেগে ওর বাঁদিকের দাঁতটা মড়াৎ করে ভেঙে গেছে! সব কিছু সেরে ওঁরা যখন নিরাপদ দূরত্বে পালিয়ে এলেন, তখনো কুম্ভকর্ণ অঘোর ঘুমে অচেতন।

ওরা তিনজনে বেশ বড় একটা পিপুল গাছে চড়ে বসল! টেনে তুলল ডাক্তারবাবুকেও। আরও আধঘণ্টা পরে গজদানবের দেহে চাঞ্চল্য দেখা গেল। সে উঠে বসল। দাঁড়ালো। মাথাটা ডাইনে-বাঁয়ে দোলালো। কান নাড়ল। শুঁড়টা এখন মুখবিবরে অনায়াসে পৌঁছে যাচ্ছে! চারিদিকে তাকিয়ে গজদানব কী যেন খুঁজল। হঠাৎ দেখতে পেল ওদের।

ধীর গজগমনে নির্ভয়ে এগিয়ে এল কয়েক পা। শুঁড়টা আকাশপানে তুলে বৃংহিত-ধ্বনি করল একবার। এবার যেন আনন্দে! তারপর হেলতে দুলতে মিলিয়ে গেল অভয়ারণ্যে।

চন্দন বললে, - ডাক্তারসা'ব! গণেশজী কী বলল জানেন? বললে, - থ্যাঙ্কু।


ডাক্তারসা'ব বলেন, - সেটা আমিও বুঝেছি। কিন্তু 'গজদানব' আজ হঠাৎ গণেশজী হয়ে গেল কেমন করে?

মোহন সর্দার বুঝিয়ে দেয়। যে হাতির ডানদিকের দাঁতটা ভেঙে গেছে, কিন্তু বাঁ-দিকেরটা আছে তাকে বলে 'একদন্ত'। আর যার বাঁদিকেরটা খোয়া গিয়ে শুধু ডান দিকের দাঁতটা আছে তাকে বলে - গণেশজী।

আইনমাফিক মোহন সর্দার সেই খণ্ডিত গজদন্তটি সরকারী মালখানায় জমা দিয়ে এসেছিল। কিন্তু বনমন্ত্রী খুশি হয়ে তরুণ চন্দন শিকারীকে সেটা উপহার দিয়েছিলেন।

কূকাল অভয়ারণ্যে যদি কখনো বেড়াতে যান, তাহলে হেড-ওয়ার্ডেনকে বলবেন, সে দেখিয়ে দেবে চন্দন সর্দারের সেই ট্রফি! মোহন সর্দার এখন অবসর নিয়েছে। চন্দন সর্দারই কূকাল অভয়ারণ্যের হেড ওয়ার্ডেন।

গজদানব, থুড়ি, গণেশজী আজও বেঁচে আছেন!

আর আছে চন্দন-সর্দারের অফিস ঘরে সেই গজদন্তটা, গণেশজীর প্রসাদী নির্মাল্য!


অক্ষিঃশ্রবা



লেখক: সুধাংশুকুমার দত্ত

সেদিন সলিলদের বৈঠকখানায় গল্পের আসরটা বেশ জমেছিল। কথক এক প্রবীণ শিকারী। নাম শুনলাম বরদাবাবু। তিনি তাঁর অতীতের শিকারী জীবনের কাহিনী বলছিলেন।

এক একটা কাহিনী শেষ হলেই সকলে আরেকটা, আরেকটা বলে ছেঁকে ধরছিল। ইতিমধ্যে আমি গিয়ে পৌছুলাম। প্রাথমিক আলাপের পর অনুরোধ করলাম, তাঁর শিকারী জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাহিনীটি বলবার জন্যে।

বরদাবাবু আমার দিকে চেয়ে একটু হেসে বললেন, আপনি যখন একটু বয়স্ক মানুষ, আপনার অনুরোধে আমি আমার নিজের চোখে দেখা একটি অলৌকিক ঘটনার কথা বলব। এইসব ছেলেরা হয়তো বিশ্বাস করবে না। কিন্তু আপনি একজন অভিজ্ঞ লোক হয়ে সেটা নিশ্চয়ই উড়িয়ে দেবেন না। বলে তিনি শুরু করলেন আসল গল্পটা। অবশ্য গল্প না বলে অভিজ্ঞতার কাহিনী বলাই ভাল।

অনেক বছর আগের কথা। তখনও সুন্দরবনে এরকম মানুষের বসতি হয়নি। সত্যিকারেরই বন ছিল এই বিখ্যাত সুন্দরবন, যেমন সৃন্দর তেমনই ভয়ঙ্কর। তখন এই বন ছিল রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের লীলাভূমি! আশেপাশের গ্রামের মানুষদের তখন এই ব্যাঘ্ররাজের দাপটে সন্ত্রস্ত হয়ে বেঁচে থাকতে হত। একবার তেমনই এক গ্রাম থেকে খবর এল যে, এক মানুষ-খেকো বাঘের উপদ্রব হয়েছে সেখানে। ফলে পোষা গরু, মহিষ, ছাগল, এমন কি মানুষও প্রায়ই নিখোঁজ হচ্ছে সেখান থেকে আর পরেরদিন অদূরেই পাওয়া যাচ্ছে তাদের ভূক্তাবশিষ্ট দেহের অংশ। এজন্যে সেখানে ভীষণ আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে! শুনেই আমার শিকারী মন নেচে উঠল। ব্যাপারটা আমার আরেক শিকারী বন্ধু প্রমোদকে বললাম।

প্রমোদ তো শুনেই এক পায়ে খাড়া। অতএব পরের দিনই দুজনে রাইফেল, কার্তুজ ও অন্যান্য রসদ নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম।

গ্রামের নাম মোহনপুর। একেবারে সুন্দরবনের গায়ে। যথাসময়ে সেখানে পৌঁছালাম। গ্রামবাসীদের কাছ থেকে শুনলাম, এ নরখাদকটি প্রায়ই শেষ রাত্রে নিঃশব্দে হানা দেয় আর তেমনই আশ্চর্য শব্দহীনতার মধ্যেই শিকার নিয়ে উধাও হয়! কোনওরকম গর্জন বা শব্দও করে না!

শুনে আশ্চর্য হলাম। বাঘ শিকার নিয়ে যায় অথচ কোনও রকম গর্জন বা শব্দ শোনা যায় না, এতো বড় বিচিত্র ব্যাপার! অবশ্য শিকার তুলে নেওয়াটা চতুর বাঘেরা নিঃশব্দেই সারে, তবু আগে কোনও গর্জন শোনা যায় না কেন? বাঘও কি বোবা হয়? সকলের সঙ্গে কথা বলে আমাদের এই- ধারণাই হল যে, আশেপাশে যে কোনও বাঘ আছে তা কেউ দেখেনি বা গর্জনও শোনেনি, কেবল জন্তু ও মানুষ উধাও হবার পর মাটিতে বাঘের থাবার চিহ্ন আর সকলের ধারণা যে এটি বাঘেরই কীর্তি!

সব শুনে আমরা একটু দ্বিধায় পড়লাম। অদৃশ্য আততায়ী বাঘই তো! যদি বাঘই হয় তাহলে তার অস্তিত্ব জানা যাবে কেমন করে? সে সময় বড় বড় শিকারীরা বাঘকে তাড়িয়ে আনার জন্যে একদল স্হানীয় লোকের সাহায্য নিতেন, তাদের বলা হত “বীটার্স”। ওরা কানেস্তারা পিটিয়ে ও অন্য শব্দ করে দল বেঁধে বাঘের সম্ভাব্য আস্তানার চারদিকে ঘিরে ধরত, ফলে বিরক্ত ও ভীত হয়ে বাঘমশাই সগর্জনে আত্মপ্রকাশ- করতেন এবং শিকারীর বন্দুকের নিশানা হতেন। আমরা কিন্তু সেরকম কিছুর চিন্তা না করে গ্রামবাসীদের বললাম একজন পথ-নির্দেশক দিতে যে বাঘের সঠিক আস্তানার কাছে আমাদের নিয়ে যেতে পারবে। শুনে ওরা তো প্রথমটা পরস্পরের মুখ-চাওয়া-চাউয়ি করতে লাগল।

তারপর হঠাৎ ওদের মধ্যে থেকে একজন মধ্যবয়স্ক লোক এগিয়ে এসে ইশারায় বলল, সে যেতে রাজি আছে। দেখে তো আমরা অবাক! বেশ বুঝলাম, লোকাঁটি বোবা ও কালা। ও কিভাবে সাহায্য করবে আমাদের? শেষটায় ওই না বাঘের শিকার হয়ে যায়! আমি অবশ্য এর আগে মন্ত্র পড়ে বাঘকে আকর্ষণ করার কথা শুনেছিলাম। কিন্তু এইরকম বোবা-কালা কি করে বাঘের নিশানা বলে দেবে? এ তো না পারে কিছু শুনতে, না পারবে বলতে! তবে অবশেষে গাঁয়ের এক বয়স্ক লোক বলল, বাবুরা, এর সঙ্গে যান আপনারা। এ শুনতে পায় না কানে, কিন্তু অন্যভাবে সব বুঝতে ও শুনতে পায়, আর তা আপনারদের চেয়েও বেশি! গেলেই বুঝতে পারবেন। তবে দেখুন, একে অবিশ্বাস করবেন না, তা হলে ফল হবে খারাপ!

অতএব সেদিনই সন্ধ্যার পর প্রস্তুত হয়ে দুই বন্ধু সশস্ত্র হয়ে রওনা হলাম অকুস্হলের দিকে। সঙ্গে সেই বোবা-কালা পথ-প্রদর্শক। মাচা বাঁধা ছিল -দু বন্ধু তাতে৷ ব্যাঘ্ররাজের আসার প্রতীক্ষায়। পথ-প্রদর্শকটির নাম জেনেছি মহেশ। সে এযাবৎ আকার ইঙ্গিতে বেশ পথ দেখিয়ে এনেছে। মাচা আগে থেকেই তৈরি করা ছিল। বোধ হয় এই লোকটির নির্দেশেই গ্রামবাসীরা এ কাজটি সেরে রেখেছে।

রাত্রি ক্রমে গভীর হল। সেই বিশাল অরণ্যে শুধু বাতাসে গাছের পাতা নড়ার শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই! গ্রামবাসীদের অনুরোধে মাচার নিচে যথারীতি একটি ছাগশিশুকে বেঁধে রাখা হয়েছিল বাঘ মশাইকে আকর্ষণ করার জন্যে। সে বেচারাও বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছিল ।

প্রায় ঘণ্টা দুই কেটে গেল। সেই বিভীষিকাময় গহন অরণ্য তখন যেন কোন অনাগত বিপদের পদধূলির প্রতীক্ষায় উৎকর্ণ হয়ে রয়েছে। সুন্দরবনের আত্মা যেন অতন্দ্র আঁখি মেলে রয়েছে কোন বিভীষণের অপেক্ষায়।

প্রমোদ এবার অধৈর্য হয়ে ফিস ফিস করে বলল, যত সব বোগাস! তুমিও যেমন, তাই ওদের কথায় বিশ্বাস করে এলে। হুঁ, বোবা-কালা আবার বাঘের সন্ধান দেবে! আমি চুপিচুপি ওর হাতে একটু চাপ দিয়ে বললাম, আহ! আজকের রাতটা দেখই না!

শেষে সেই বিভীষিকাময় রাতও শেষ হয়ে এল। পুব আকাশে দেখা গেল আসন্ন সূর্যোদয়ের রক্তিম আভাস। আমাদের পথ-প্রদর্শক মহেশ এতক্ষণ আমাদের মাচারই এক প্রান্তে বসে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল বনের দিকে। হঠাৎ তার সেই শাণিত দৃষ্টি যেন আরা শাণিত হল - মনে হল কিছু দেখার চেষ্টা করছে। ইতিমধ্যে অধৈর্য প্রমোদ বিরক্ত হয়ে মাচা থেকে নেমে প্রাকৃতিক ক্রিয়া সারতে উদ্যোগী হয়েছে। মহেশ চকিতে তার হাত ধরে ইঙ্গিতে নামতে নিষেধ করল। কিন্তু প্রমোদ - দুত্তোর! কোনও সাড়া নেই, শব্দ নেই, বাঘ অমনি উড়ে আসবে! বলে লাফ দিয়ে নেমে পড়ল। মহেশ তখনও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কি যেন দেখছে, অথচ আমার কিছুই দৃষ্টিগোচর হল না।

ওদিকে প্রমোদ বেশ নিশ্চিন্ত মনেই মাচার নিচে ফিরে এসে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। হাতে উদ্যত বন্দুক!

আমি ওর হাবভাব দেখে হতভম্ব হলাম। ওর মত অভিজ্ঞ শিকারীর পক্ষে এরকম আচরণ বিস্ময়কর। শিকারীর কোন অবস্হাতেই মাচার নিচে এভাবে বেশিক্ষণ থাকা উচিত নয়, বিশেষত সেই আলো আঁধারিভরা অস্ফূট ভোরের আলোয়। কিন্তু তখন কি জানতাম, ওটা তার নিয়তির নির্দেশ ছাড়া আর কিছুই নয়।

এই পর্যন্ত বলে একটু থামলেন বরদাবাবু। আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম, তারপর? তারপর?

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার শুরু করলেন বরদাবাবু -- ওদিকে মাচার ওপাশ থেকে মহেশ বার বার হাত নেড়ে প্রমোদকে উঠে আসতে বলছে। সে যেন কিছু দেখতে পেয়েছে। কিন্তু দেখলই বা কি? ভোরের অস্পম্ট আলোতে আমিও যা দেখছিলাম সে তার বেশি আর কি দেখবে? গাছের পাতাটিও নড়ছিল না, কোনও শব্দও তো শোনা যাচ্ছিল না। অথচ মহেশ যেভাবে হাত নাড়ছিল, মনে হল কিছু নিশ্চয়ই সে দেখেছে, বা শুনেছে! পরক্ষণেই মনে পড়ল, সে শুনবে কি করে, সে তো কালা! তাহলে? এই চিন্তাই হল কাল।

এই সব চিন্তা বোধ হয় কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আমার মাথায় খেলে গেল, তার পরেই হঠাৎ দেখলাম বনের মধ্যে থেকে যেন একটা হলুদ রঙের ঝড় এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রমোদের ওপর, আর পরমুহূর্তেই ওকে তুলে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল গহন বনের অভান্তরে! প্রমোদ বন্দুক তুলতেই পারল না, কিন্তু আমার রাইফেল গর্জন করে উঠল সেই হলুদ ঝড়ের দিকে লক্ষ্য স্হির করে। ততক্ষণে সে শিকার নিয়ে উধাও। মাচার ওপর তখন মহেশ দুহাতে কপাল চাপড়াচ্ছে! আমার অবশ হাত থেকে রাইফেল মাচার ওপর পড়ে গেল! কিছুক্ষণ অর্দ্ধমূর্ছিতের মত বসে রইলাম মাচার ওপর।

বরদাবাবু থামলেন ।

সকলে সমস্বরে প্রশ্ন করলাম, প্রমোদবাবু তাহলে --? না - উত্তর দিলেন বরদাবাবু, প্রাণে বেঁচে গেল। কিন্তু মহেশের অদ্ভুত পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাকে তাচ্ছিল্য করার জন্যে তাকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছিল। তার একটি হাত ও পা বাঘের দাঁত ও থাবায় ক্ষতবিক্ষত হওয়ায় কেটে বাদ দিতে হয়েছিল। আমার বন্দুকের গুলি বাঘের গলায় লেগেছিল, কিন্তু আহত বাঘ কীরকম ভয়ঙ্কর তা তো জানই! তাই মরার আগে সে প্রমোদের হাত ও পা প্রচন্ড রাগে আঁচড়ে কামড়ে ফালা ফালা করে দিয়েছিল। প্রমোদের ক্ষতবিক্ষত মূর্চ্ছিত দেহের পাশেই পড়েছিল সেই ব্যঘ্রপ্রবরের মৃতদেহ, সেটি লম্বায় প্রায় এগার ফুট। বাঘটি ছিল বোবা! গ্রামবাসীরা বাঘের উপদ্রব থেকে বেঁচেছিল। কিন্তু আসল কথাটাই বলা হয়নি। মহেশ কি করে বাঘের উপস্হিতি বুঝতে পেরেছিল তার গুপ্ত-রহস্য পরে, গ্রামবাসীদের কাছ থেকে শুনেছিলাম। আগে শুনলেই হত ভাল। তোমরা নিশ্চয়ই জান সাপের কান নেই, ওরা চোখ দিয়ে শোনে! তাই ওদের বলা হয় “অক্ষিঃশ্রবা"! মহেশও নাকি কানে কালা হলেও চোখ দিয়ে সেই ঘাটতি পূরণ করে নিত। অর্থাৎ সেও ছিল ‘অক্ষিঃশ্রবা’! প্রকৃতির রাজ্যে কত বিচিত্র ঘটনাই না ঘটে! সে যাই হোক, ওর ক্ষমতা ঠিকমত বুঝতে না পেরেই প্রমোদের প্রাণ যেতে বসেছিল।

বরদাবাবুর গল্প শেষ হল। আমরা অবাক বিস্ময়ে ভাবতে লাগলাম, এও কি সম্ভব?

সমাপ্ত

আইরাজ

লেখক: শিবশঙ্কর মিত্র

বেশ কিছুদিন আগের কথা। তখনও সুন্দরবনে ব্যাঘ্রপ্রকল্প চালু হয়নি। মানে, তখনও বাঘ মারার আইনত অধিকার ছিল, তবে অনুমতি নিতে হত, এই যা।

আর পুলিশ-কর্তাদের বনকর আপিস থেকে সে-অনুমতি পেতে তো কোনও বেগ পাবার কথা নয়। পেতেও হয়নি। জেলার পুলিশসাহেব ও বাসন্তী থানার দারোগাবাবু দু'খানা লঞ্চ নিয়ে দিব্যি চলেছেন সুন্দরবনের গভীরে। দু'জনের দু'খানা লঞ্চ হলেও পুলিশসাহেবের লঞ্চেই ডেকের ফাঁকা জায়গায় সকালের মিষ্টি রোদে আড্ডা জমিয়েছেন দু'জনে। দু'খানা লঞ্চ প্রায় পাশাপাশি চলেছে ঘুটঘুট করে। শিকার? না, ওঁদের জানা আছে এভাবে সুন্দরবনে শিকার হয় না। এমন নিরাপদে বসে সুন্দরবনে বাঘ-শিকার তো দূরের কথা, বাঘের দেখাও মিলবে না। তবে অনেক দূর থেকে হরিণের পালে কপাল-ঠুকে গুলি করলেও করা যেতে পারে। যেতে পারে বটে, কিন্তু চঞ্চল হরিণ আহত হয়েও কিছুটা বনের ভিতর যাবেই যাবে। বনের কিনারায় সেই আহত শিকার অনুসরণ করলে আচমকা আক্রান্ত হওয়া মোটেই বিচিত্র নয়। এমন ঘটনা হামেশাই ঘটে সুন্দরবনে। বাঘ এই সময় হরিণের মাংসের লোভ ছেড়ে মানুষের মাংসের জন্য দুর্দান্ত হয়ে ওঠে। যে-কোনও ঝুঁকি নেয় মানুষকে ঘায়েল করার জন্য।

ওদের লঞ্চ দুটি ছোট্ট খাল দুগ্যোদোয়ানি ছেড়ে গোমর নদীতে পড়ে তারপর কত নদী-নালা ডিঙিয়ে দক্ষিণে এগোল, তার হিসেব নেই। পিরখালি, আঁধারমানিক, খোলাখালি, চর গাজি, অবশেষে বড়গাজি খাল পেরিয়ে ন’বাকি দোয়ানিতে পড়েছে। দোয়ানি মানে, এই সব খাল বা নদী সাধারণত পুব-পশ্চিম টানা হয়ে দুটো উত্তর-দক্ষিণ টানা বড় নদী যোগ করে দেয়। ফলে দোয়ানির দু'মুখ দিয়েই একই সময়ে ঢোকে, তেমনই দু'মুখ দিয়েই ভাটির স্রোতও হড়হড় করে সমুদ্রগামী হয়ে বেরিয়ে যায়। এর ফলে নৌকো বা লঞ্চকে দোয়ানির দু'মুখে দু'রকম স্রোতের টানে পড়তে হয়। এতে অবশ্য যন্ত্রযানের ভাবনার বিশেষ কিছু ছিল না, অর্ধেক পথ স্রোতের টানে তাড়াতাড়ি যায়, কিন্তু বাকি অর্ধেক পথ স্রোত ঠেলে কষ্ট করে আস্তে আস্তে এগোতে হয়, এই যা। কিন্তু ডিঙি নৌকোকে বেশ অসুবিধায় পড়তে হয়।

পুলিশের কর্তাদের লঞ্চের গতি নিয়ে বিব্রত হওয়ার বিশেষ কারণ ছিল না। ওরা যাবেন ব্যাঘ্রসঙ্কুল চামটা বনের কাছাকাছি। ভাটি অঞ্চলে বিশাল গোসাবা নদী থেকে উঠে ন'বাকি দোয়ানি এঁকে-বেঁকে পুবে সমুদ্রগামী ঝিলা নদীতে পড়েছে। এই ঝিলা নদীর বেশ কিছুটা ভাটিতে বাঁ দিকে চামটা বন। এই সব এলাকায় প্লাবনের জল বনের অভ্যন্তর পর্যস্ত ছড়িয়ে পড়ে। কাজেই আশপাশের বনাঞ্চলে জীবজন্তুর ব্যবহারও ভিন্ন প্রকৃতির।

লঞ্চ দু'খানি এখন ন'বাকি দোয়ানির মধ্যভাগে। কতার্বাবুরা ডেকের উপর বসে সুন্দরবনের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করছেন আর নানারকম গল্পগুজব করছেন। ওরা সুন্দরবনের অভিজ্ঞ লোক হিসেবে সঙ্গে একজন বাউলে এনেছেন। বাউলে আবার তার এক অনুগত লোককে নিয়ে এসেছে সঙ্গে করে। তার নাম চিত্ত মের্ধা। এরাও মাঝে-মাঝে কতার্দের সঙ্গে টিপ্পনী কেটে চলেছে। হঠাৎ চিত্ত মের্ধা চিৎকার করে বলে ওঠে, “ওই, ওই যে, কুমির ভেসেছে ! ওই !” বলেই আঙুল দিয়ে দেখাবার চেষ্টা করে। মের্ধার চিৎকারের ধাক্কায় সবাই দ্রুত যে যার বন্দুক হাতড়াবার চেষ্টা করে। বাউলে একনজর দেখেই বলে, “না কর্তা এটা বোধহয় কুমির নয়।”

দু'জন কর্তাই প্রায় একসঙ্গে জোরে বলে ওঠেন, “কুমির নয় তো কী! কী হতে পারে?” বাউলে শান্তভাবেই উত্তর দেয়, “না বাবু, কুমির কি কখনও নদী পারাপার করার চেষ্টা করে! ও যে সোজা পার হতে চলেছে। কুমির কি অতখানি লম্বা হয়ে ভাসে ? কুমির লেজ কখনও ভাসায় না। পিঠের শিরদাঁড়া, চোখ আর উঁচু নাকটাই ভাসিয়ে রাখে। লেজ ওরা জলের তলায় রাখে। সাঁতরে এগোবার সময় হালের কাজ করে ওদের লেজ। অত লম্বাপানা হয়ে কুমির ভাসে না। কুমির নয় বাবু, অন্য কিছু”।

আরও উৎকঠিত হয়ে দারোগাবাবু বলেন, “তবে ওটা কী ? জলে আর কোন্‌ অমন লম্বা জন্তু আছে?” “কর্তা সাবধান ! আমরা বেকায়দায় পড়তে পারি। ওটা আর কিছু নয়, সুন্দরবনের সাঙ্ঘাতিক বিষধর সাপ। নিশ্চয়ই কোনও আইরাজ, নিশ্চয়ই... হয় ওকে আগে পার হয়ে যেতে দিন, না হয় আমাদের লঞ্চখানা আগেই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাক। ওর পারাপারের পথ আগলে ধরবেন না। চটপট যা হয় একটা কিছু করুন|” পুলিশসাহেব সারেঙকে আদেশ দিলেন, “জলদি স্পিড বাড়াও। খুব তাড়াতাড়ি সোজা বেরিয়ে যাও।” যথা আদেশ, সারেঙ লঞ্চে স্পিড দিলেন। কিন্তু স্পিড তেমন উঠছে না। ন'বাকির মাঝামাঝি অঞ্চল যে! কোনও স্রোতের বিশেষ টান নেই।

এদিকে আইরাজ এসে পড়েছে। বেগতিক দেখে বড়কর্তা চিৎকার করে ওঠেন, “লঞ্চ ঘুরিয়ে দাও, ঘোরাও !” একথা আবার একজন সারেঙকে তো বললে হবে না। দুটি লঞ্চই প্রায় পাশাপাশি চলেছে। তাই চিৎকার আর ইঙ্গিতে আদেশ দিলেন। দুই কর্তাই এখন লঞ্চের খুপরির ছাদে। বিপদ ছিল, স্পিড থামিয়ে হঠাৎ পাশাপাশি লঞ্চের গতিপথ কূল-বরাবর করতে গেলেই ঠোকাঠুকি হয়ে যেতে পারে। তবে সারেঙদের দক্ষতায় সেটা ঘটেনি বটে, কিন্তু এই সব করতে গিয়ে লঞ্চ দু'খানার পেছনটা আইরাজের লাইনে এসে পড়েছে। আইরাজ কোনও কিছুই ভ্রূক্ষেপ করে না, ঠিক সোজাসুজি নদী পার হবেই সে। ঝিরঝিরে হাওয়ায় নদীতে তখন তিরতিরে ঢেউ। আইরাজ সেই ঢেউয়ের মধ্যে মাথা উঁচু করে এগিয়ে আসছে। দেড় বিঘত ফণাকে পেখমের মতো বিছিয়ে ধরার চেষ্টা করছে। যেন সামনে পেলেই ছোবল মারবে। লঞ্চ বাঁ দিকে মোড় নিয়েছে, জলের তলার চাকাও তাদের স্তব্ধ। স্তব্ধ হলেও লঞ্চ দুটি গতিবেগের ঝোঁকে তীরের দিকে ছুটে চলেছে।

আইরাজও লঞ্চের পেছনে শাঁ শাঁ করে এগিয়ে আসছে। লঞ্চ দুটো বোধহয় ওর শত্রু। এদের ওপর তার ভয়ঙ্কর দাঁতের ছোবল মেরে মৃত্যু-বিষ ঢালতে চায়। এবার খলবল করে লেজ নাড়াচ্ছে। কোনওমতে উঁচু হয়ে ফণা শূন্যে তোলার চেষ্টা। কিন্তু জলের উপর তেমন করে শক্ত হয়ে উঁচিয়ে ফণা তুলতে পারছে না। আরোহীরা কেউ ডেকে, কেউ বা খুপরির ছাদে। এমন নিরাপদ আশ্রয়ে থেকেও কেউ নিশ্চিন্ত নন। জলের উপর আইরাজের কিলবিলে গতি আর আক্রোশ দেখে সকলের বেশ ভয়-ভয় করছে।

বাউলের মনে হঠাৎই আশঙ্কা জাগে লঞ্চের দু'পাশের নারকোল দড়ির গোছাগুলি নিয়ে। আইরাজ এগুলির সন্ধান পেলে নিশ্চিত বেয়ে উপরে উঠে আসবে। মাঝিমাল্লা যাকেই হাতের কাছে পেল তাকেই চিৎকার করে বলল, “শিগগির যা, কাতার গোছাগুলি টেনে উপরে – তোল। যা,যা, এক্ষুনি যা। কোনও কাছি জালির উপর দিয়ে যেন ঝুলে না থাকে। যা, এক্ষুনি যা।” হঠাৎ আইরাজকে আর দেখতে পাওয়া গেল না। আইরাজ অদৃশ্য। লঞ্চের মুখটা কূলের পলি-কাদায় আটকে যাবার উপক্রম দেখে সারেঙ আগেই লঞ্চের চাকা উলটোদিকে চালিয়ে দিয়েছে। পেছন-গিয়ারে চাকা বেগে চলেছে। তবুও লঞ্চ কুলের দিকে এগিয়ে চলে। এবার পুরোদমে পেছন-গিয়ার। লঞ্চের চাকা নদীর জল তীরে ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছে। আইরাজ ডুব দিয়েই বুঝি আতঙ্কের শিহরন এনে দিল গোটা লঞ্চে। একে তো বাউলে নারকোল-দড়ির গোছার কথা তুলে লঞ্চের সবাইকে দুর্ভাবনায় ফেলে দিয়েছে। তার উপর আইরাজ অদৃশ্য হয়ে আতঙ্ক চরমে তুলে দিল। মায় পুলিশ-কর্তা পর্যন্ত এবার চঞ্চল হয়ে উঠেছেন। দারোগাবাবুকে জিজ্ঞেসা করেন, “তোমার রাইফেলটা লোড করা আছে তো ?” খোঁজ নিলেন অবশ্য রাইফেল লোড আছে কি না, কিন্তু তাতেও ভরসা নেই বুঝে খুপরির ছাদে রাখা লগিগুলি হাতড়াতে থাকেন? আর ঝুঁকি মেরে দড়ির গোছাগুলি দেখবার চেষ্টা করেন। কাণ্ড দেখে বাউলে বলে, “না, বাবু. লগি দিয়ে খোঁচাখুঁচি করবেন না। ওতে হিতে বিপরীত হবে, আইরাজ আরও খেপে যাবে !”

জলের আথালি-পাথালি তোড়ের মধ্যে কোথায় গেল আইরাজ ? দেখতে-দেখতে পুরোদমে চালু চাকার ছুঁড়ে মারা জলের তোড়ের সঙ্গে তীরের ওপর ঝপাত করে পড়েছে কুন্ডলী পাকিয়ে। না, পরক্ষণেই টানটান হয়ে সামান্য জলে কূল-বরাবর এগিয়ে যায়। বাউলে আর দেরি করতে চায় না। হাতের বন্দুকে ছররা-টোটা ভরাই আছে। তাক করে ছুঁড়ে মারে। খুবই কাছে তো, লক্ষ্যভ্রষ্ট হবার কথা নয়। হয়ও না। আইরাজের শরীর থেকে রক্ত ফিনকি দিয়ে উঠল। আর কী আক্রোশ তখন আইরাজের ! শত্রুকে সামনে না পেয়ে চরের উপরই বিস্ফারিত ফণা তুলে ছোবল মারতে থাকে। মাজা-ভাঙা ক্লান্ত আইরাজকে কূল ঘেঁষে সামান্য জলে খলবল করে কোনওমতে আবার চলতে দেখে বাউলে মের্ধাকে ধমক দিয়ে বলল, “লগি দিয়ে চরে ঝাঁপিয়ে পড়, যা।” বলেই একহাতে বন্দুক নিয়ে অন্য হাতে চরের ওপর লগির ঠেকো দিয়ে লাফিয়ে পড়ে বাউলে। বাঘ-শিকারের মতো নিঃশব্দে এগোবার দরকার নেই। চরে পড়েই চিৎকার করে উঠে, “চিত্ত, বন্দুক নিয়ে নদী-বরাবর বনের কিনারা দিয়ে চল্‌। আমার দিকে তাকাবি না, শুধু দেখবি বনের দিকে। বড়মিঞা আবার আমাকে তাক না করে ! এমন সুযোগের সন্ধানে বড়মিঞা থাকেই, বুঝলি তো চিত্ত?” থপথপ্‌ করে দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকে। হাতের লগিখানা উদ্যতভাবে ধরাই আছে। বেশ কিছুটা এগিয়েও গেছে। এমন সময় হঠাৎ থমকে পড়ে সে, সামনেই আইরাজ। কেন জানি, এতক্ষণ পলির প্রলেপ দেওয়া চরে আইরাজ ওঠবার চেষ্টা করেনি। এবার আইরাজ চরে উঠবে নিশ্চয়ই। মাথা নিচু করেই বনের চত্বরের দিকে চর বেয়ে আস্তে আস্তে উঠতে থাকে। বাউলে মুখে আর কথা বলে না। শুধু আঙুলে তুড়ি মেরে মের্ধাকে ইশারা করে, আর এগোবি না, দাঁড়া ওখানে।

আইরাজ বনে উঠতে গিয়েও যেন থমকে যায়। বনের মুখে এখানে কূল-বরাবর একটা দীর্ঘ হেঁতালগাছের ঝাড়। জোয়ারের জল এসে এসে এই লম্বা ঝাড়ের তলদেশের মাটি ধুয়ে নিয়ে গেছে। ঝাড় ঝুঁকে পড়েছে চরের দিকে। বেশ দেখা যায়, হেঁতাল গাছের অজস্র ঘন বিন্যস্ত শিকড় জলে ধুয়ে যাওয়া ফাঁকা জায়গায় ঝুলে আছে। হঠাৎ আইরাজ সেই ঝুলন্ত শিকড়ের মধ্যে মাথাটা ঢুকিয়ে দিল। আহত আইরাজ হয়তো ছুটে আশ্রয় খুঁজছে। সঙ্গে সঙ্গে বাউলে ছুটে গিয়ে ফলক-কাটা লগির গোড়াটা দিয়ে রক্তঝরা মাজাটা সজোরে কাদার মধ্যে চেপে ধরল। অন্য সব কথা ভুলে বাউলের এখন লক্ষ আইরাজের দীর্ঘ লেজ। এই লজের আওতায় একবার পড়লে বাউলেকে জড়িয়ে চেপে হাড়গোড় গুঁড়ো করে দেবে। শত্রুর সঙ্গে লড়বার এ এক মহা অস্ত্র।

না, বাউলে প্রথমে দেখেই বুঝে নিয়েছে, সে-ভয়ের বোধহয় কারণ নেই। গুলির আঘাতে মাজা-ভাঙা লেজের আর তত ক্ষমতা নেই। কিন্ত হলে কী হবে, তবুও লেজ দিয়ে সে শত্রুকে খুঁজছে এদিক-ওদিক। লেজের পাশ থেকে নিজের দেহকে একটু সরিয়ে নিয়েই বাউলে চিৎকার করে উঠল, “মের্ধা শিগগির আয়, ছুটে আয়।” আর্তনাদ শুনেই মের্ধা হেঁতাল-ঝাড়টাড় ভেঙে লাফিয়ে পড়ল চরে। হাতের বন্দুক কাদায় পড়তে দেয়নি। বাউলে বলে ওঠে, “গুলি কর্‌, তুরন্ত চোট কর্‌! ছররা! ওই শিকড়-ঝাঁকের মধ্যে। নিরিখ করতে হবে না! শিগগির গুলি কর্‌! আন্দাজেই কর!” হাতের লগিতে চাপ রাখতে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে আদেশ দেয় সে। মের্ধা আদেশের সঙ্গে-সঙ্গেই একটা চোট করে, আরেকটার জন্য তৈরি। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি। এতক্ষণ লগির চাপের নীচে মৃত্যু-যন্ত্রণায় ক্ষীণভাবে নড়াচড়া করছিল। এখন শান্ত, নেতিয়ে পড়েছে। লেজের ডগাটা একটু-আধটু নড়াচড়া করতে থাকে। লগির চাপটা একবার শিথিল করে বাউলে বুঝে নেয় সত্যি-সত্যি নিস্তেজ হয়েছে কি না। নিশ্চিন্ত হয়েই মেধাকে বলে, আস্তে আস্তেই বলে, “যা এবার লঞ্চ থেকে দড়ি নিয়ে আয়।” বড়শি গিঁট মাজায় বেঁধে চর দিয়ে টেনে নিয়ে যেতে হবে। বাউলের সাবধানের শেষ নেই। এক ভয়ঙ্কর বিষধর আইরাজ নিয়ে কারবার করছে। মের্ধাকে দড়ি ধরে টেনে হেঁতাল গাছের তলা থেকে বের করে আনতে আদেশ দিল। আর নিজে বন্দুক নিয়ে তাক করে রইল ওর ফণার দিকে।

শেষপর্যন্ত আইরাজকে সবাই মিলে টেনে লঞ্চের ডেকে তুলল। কতার্বাবু তো ইঞ্চি মেপে আর ওজন করে দেখলেন, সাড়ে পনেরো ফিট লম্বা আর ওজনে প্রায় এক মণ। বাউলে বলল, “বাবু জানেন, আইরাজ সুন্দরবনে নরকমের আছে। এর নাম হল ধনীরাজ। দেখছেন তো কালচে রঙ। আর সাপেদের মধ্যে আইরাজেরই দাঁত খুব বড়, যেখানে ছোবল মারে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। আইরাজের মধ্যে দুধরাজ আর ভীমরাজও আছে। দুধরাজ দেখতে সাদা ধবধবে। কত বড় ফণা দেখেছেন। মাথায় এই দ্যাখেন বড় চক্র-চিহ্ন! দেখতে কী সুন্দর বলুন তো ! আর কী শক্তিধর, বাপ্‌ রে!”

বর্ণনার ঝোঁকে পুলিশসাহেবের দিকে তাকিয়ে বলে, “আচ্ছা কতসাহেব, শুনছি আপনারা কিছু দিনের মধ্যে সুন্দরবনে ব্যাঘ্র-প্রকল্প চালু করবেন। কিন্ত আপনারা কি সুন্দরবনে আইরাজ-প্রকল্প করতে পারেন না ? এদের ফণা দেখলে ভিরমি খেতে হয় বটে, কিন্তু দেখতে কী সুন্দর ! বাঘের মতো এরাও তো বনের রক্ষক, তাই না?” পুলিশ-কর্তা মৃদু হেসে বললেন, “তা তো হল! কিন্তু তুমি তো নিজেই আইরাজকে মারলে, তা আবার প্রকল্প করে ওদের বাঁচাতে বলছ।” বাউলে এবার মাথা নিচু করে বলল, “বাবু সাপটাকে আপনারা আগেই লঞ্চের চাকায় আধমরা করে ফেলেছেন। আমরা সাপকে কখনও আঘাত করি না, ওরাও আমাদের আমল না দিয়ে চলে যায়। সুন্দরবনের চালু নিয়ম, আঘাত করে কোনও সাপকে কোনওদিন ছেড়ে দিতে নেই, তাকে শেষ করে তবে বাঁচোয়া। নইলে এরা শোধ নেয়। আহত সাপ একদিন-না-একদিন শোধ নেবেই নেবে। শত্রুকে এরা চিনে রাখে।” তারপর আইরাজের গায়ে হাত ঠেকিয়ে আর নিজের কপালে হাত তুলে নমস্কার করে বাউলে দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বলল, “তা বাবু, আমরা সুন্দরবনের মানুষেরা সাপের আইন বড্ড মেনে চলি। আমাদের যে এদের সঙ্গেই বাস করতে হয় কি না।”

(শেষ)