অক্ষিঃশ্রবা
লেখক: সুধাংশুকুমার দত্ত
সেদিন সলিলদের বৈঠকখানায় গল্পের আসরটা বেশ জমেছিল। কথক এক প্রবীণ শিকারী। নাম শুনলাম বরদাবাবু। তিনি তাঁর অতীতের শিকারী জীবনের কাহিনী বলছিলেন।
এক একটা কাহিনী শেষ হলেই সকলে আরেকটা, আরেকটা বলে ছেঁকে ধরছিল। ইতিমধ্যে আমি গিয়ে পৌছুলাম। প্রাথমিক আলাপের পর অনুরোধ করলাম, তাঁর শিকারী জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাহিনীটি বলবার জন্যে।
বরদাবাবু আমার দিকে চেয়ে একটু হেসে বললেন, আপনি যখন একটু বয়স্ক মানুষ, আপনার অনুরোধে আমি আমার নিজের চোখে দেখা একটি অলৌকিক ঘটনার কথা বলব। এইসব ছেলেরা হয়তো বিশ্বাস করবে না। কিন্তু আপনি একজন অভিজ্ঞ লোক হয়ে সেটা নিশ্চয়ই উড়িয়ে দেবেন না। বলে তিনি শুরু করলেন আসল গল্পটা। অবশ্য গল্প না বলে অভিজ্ঞতার কাহিনী বলাই ভাল।
অনেক বছর আগের কথা। তখনও সুন্দরবনে এরকম মানুষের বসতি হয়নি। সত্যিকারেরই বন ছিল এই বিখ্যাত সুন্দরবন, যেমন সৃন্দর তেমনই ভয়ঙ্কর। তখন এই বন ছিল রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের লীলাভূমি! আশেপাশের গ্রামের মানুষদের তখন এই ব্যাঘ্ররাজের দাপটে সন্ত্রস্ত হয়ে বেঁচে থাকতে হত। একবার তেমনই এক গ্রাম থেকে খবর এল যে, এক মানুষ-খেকো বাঘের উপদ্রব হয়েছে সেখানে। ফলে পোষা গরু, মহিষ, ছাগল, এমন কি মানুষও প্রায়ই নিখোঁজ হচ্ছে সেখান থেকে আর পরেরদিন অদূরেই পাওয়া যাচ্ছে তাদের ভূক্তাবশিষ্ট দেহের অংশ। এজন্যে সেখানে ভীষণ আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে! শুনেই আমার শিকারী মন নেচে উঠল। ব্যাপারটা আমার আরেক শিকারী বন্ধু প্রমোদকে বললাম।
প্রমোদ তো শুনেই এক পায়ে খাড়া। অতএব পরের দিনই দুজনে রাইফেল, কার্তুজ ও অন্যান্য রসদ নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম।
গ্রামের নাম মোহনপুর। একেবারে সুন্দরবনের গায়ে। যথাসময়ে সেখানে পৌঁছালাম। গ্রামবাসীদের কাছ থেকে শুনলাম, এ নরখাদকটি প্রায়ই শেষ রাত্রে নিঃশব্দে হানা দেয় আর তেমনই আশ্চর্য শব্দহীনতার মধ্যেই শিকার নিয়ে উধাও হয়! কোনওরকম গর্জন বা শব্দও করে না!
শুনে আশ্চর্য হলাম। বাঘ শিকার নিয়ে যায় অথচ কোনও রকম গর্জন বা শব্দ শোনা যায় না, এতো বড় বিচিত্র ব্যাপার! অবশ্য শিকার তুলে নেওয়াটা চতুর বাঘেরা নিঃশব্দেই সারে, তবু আগে কোনও গর্জন শোনা যায় না কেন? বাঘও কি বোবা হয়? সকলের সঙ্গে কথা বলে আমাদের এই- ধারণাই হল যে, আশেপাশে যে কোনও বাঘ আছে তা কেউ দেখেনি বা গর্জনও শোনেনি, কেবল জন্তু ও মানুষ উধাও হবার পর মাটিতে বাঘের থাবার চিহ্ন আর সকলের ধারণা যে এটি বাঘেরই কীর্তি!
সব শুনে আমরা একটু দ্বিধায় পড়লাম। অদৃশ্য আততায়ী বাঘই তো! যদি বাঘই হয় তাহলে তার অস্তিত্ব জানা যাবে কেমন করে? সে সময় বড় বড় শিকারীরা বাঘকে তাড়িয়ে আনার জন্যে একদল স্হানীয় লোকের সাহায্য নিতেন, তাদের বলা হত “বীটার্স”। ওরা কানেস্তারা পিটিয়ে ও অন্য শব্দ করে দল বেঁধে বাঘের সম্ভাব্য আস্তানার চারদিকে ঘিরে ধরত, ফলে বিরক্ত ও ভীত হয়ে বাঘমশাই সগর্জনে আত্মপ্রকাশ- করতেন এবং শিকারীর বন্দুকের নিশানা হতেন। আমরা কিন্তু সেরকম কিছুর চিন্তা না করে গ্রামবাসীদের বললাম একজন পথ-নির্দেশক দিতে যে বাঘের সঠিক আস্তানার কাছে আমাদের নিয়ে যেতে পারবে। শুনে ওরা তো প্রথমটা পরস্পরের মুখ-চাওয়া-চাউয়ি করতে লাগল।
তারপর হঠাৎ ওদের মধ্যে থেকে একজন মধ্যবয়স্ক লোক এগিয়ে এসে ইশারায় বলল, সে যেতে রাজি আছে। দেখে তো আমরা অবাক! বেশ বুঝলাম, লোকাঁটি বোবা ও কালা। ও কিভাবে সাহায্য করবে আমাদের? শেষটায় ওই না বাঘের শিকার হয়ে যায়! আমি অবশ্য এর আগে মন্ত্র পড়ে বাঘকে আকর্ষণ করার কথা শুনেছিলাম। কিন্তু এইরকম বোবা-কালা কি করে বাঘের নিশানা বলে দেবে? এ তো না পারে কিছু শুনতে, না পারবে বলতে! তবে অবশেষে গাঁয়ের এক বয়স্ক লোক বলল, বাবুরা, এর সঙ্গে যান আপনারা। এ শুনতে পায় না কানে, কিন্তু অন্যভাবে সব বুঝতে ও শুনতে পায়, আর তা আপনারদের চেয়েও বেশি! গেলেই বুঝতে পারবেন। তবে দেখুন, একে অবিশ্বাস করবেন না, তা হলে ফল হবে খারাপ!
অতএব সেদিনই সন্ধ্যার পর প্রস্তুত হয়ে দুই বন্ধু সশস্ত্র হয়ে রওনা হলাম অকুস্হলের দিকে। সঙ্গে সেই বোবা-কালা পথ-প্রদর্শক। মাচা বাঁধা ছিল -দু বন্ধু তাতে৷ ব্যাঘ্ররাজের আসার প্রতীক্ষায়। পথ-প্রদর্শকটির নাম জেনেছি মহেশ। সে এযাবৎ আকার ইঙ্গিতে বেশ পথ দেখিয়ে এনেছে। মাচা আগে থেকেই তৈরি করা ছিল। বোধ হয় এই লোকটির নির্দেশেই গ্রামবাসীরা এ কাজটি সেরে রেখেছে।
রাত্রি ক্রমে গভীর হল। সেই বিশাল অরণ্যে শুধু বাতাসে গাছের পাতা নড়ার শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই! গ্রামবাসীদের অনুরোধে মাচার নিচে যথারীতি একটি ছাগশিশুকে বেঁধে রাখা হয়েছিল বাঘ মশাইকে আকর্ষণ করার জন্যে। সে বেচারাও বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছিল ।
প্রায় ঘণ্টা দুই কেটে গেল। সেই বিভীষিকাময় গহন অরণ্য তখন যেন কোন অনাগত বিপদের পদধূলির প্রতীক্ষায় উৎকর্ণ হয়ে রয়েছে। সুন্দরবনের আত্মা যেন অতন্দ্র আঁখি মেলে রয়েছে কোন বিভীষণের অপেক্ষায়।
প্রমোদ এবার অধৈর্য হয়ে ফিস ফিস করে বলল, যত সব বোগাস! তুমিও যেমন, তাই ওদের কথায় বিশ্বাস করে এলে। হুঁ, বোবা-কালা আবার বাঘের সন্ধান দেবে! আমি চুপিচুপি ওর হাতে একটু চাপ দিয়ে বললাম, আহ! আজকের রাতটা দেখই না!
শেষে সেই বিভীষিকাময় রাতও শেষ হয়ে এল। পুব আকাশে দেখা গেল আসন্ন সূর্যোদয়ের রক্তিম আভাস। আমাদের পথ-প্রদর্শক মহেশ এতক্ষণ আমাদের মাচারই এক প্রান্তে বসে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল বনের দিকে। হঠাৎ তার সেই শাণিত দৃষ্টি যেন আরা শাণিত হল - মনে হল কিছু দেখার চেষ্টা করছে। ইতিমধ্যে অধৈর্য প্রমোদ বিরক্ত হয়ে মাচা থেকে নেমে প্রাকৃতিক ক্রিয়া সারতে উদ্যোগী হয়েছে। মহেশ চকিতে তার হাত ধরে ইঙ্গিতে নামতে নিষেধ করল। কিন্তু প্রমোদ - দুত্তোর! কোনও সাড়া নেই, শব্দ নেই, বাঘ অমনি উড়ে আসবে! বলে লাফ দিয়ে নেমে পড়ল। মহেশ তখনও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কি যেন দেখছে, অথচ আমার কিছুই দৃষ্টিগোচর হল না।
ওদিকে প্রমোদ বেশ নিশ্চিন্ত মনেই মাচার নিচে ফিরে এসে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। হাতে উদ্যত বন্দুক!
আমি ওর হাবভাব দেখে হতভম্ব হলাম। ওর মত অভিজ্ঞ শিকারীর পক্ষে এরকম আচরণ বিস্ময়কর। শিকারীর কোন অবস্হাতেই মাচার নিচে এভাবে বেশিক্ষণ থাকা উচিত নয়, বিশেষত সেই আলো আঁধারিভরা অস্ফূট ভোরের আলোয়। কিন্তু তখন কি জানতাম, ওটা তার নিয়তির নির্দেশ ছাড়া আর কিছুই নয়।
এই পর্যন্ত বলে একটু থামলেন বরদাবাবু। আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম, তারপর? তারপর?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার শুরু করলেন বরদাবাবু -- ওদিকে মাচার ওপাশ থেকে মহেশ বার বার হাত নেড়ে প্রমোদকে উঠে আসতে বলছে। সে যেন কিছু দেখতে পেয়েছে। কিন্তু দেখলই বা কি? ভোরের অস্পম্ট আলোতে আমিও যা দেখছিলাম সে তার বেশি আর কি দেখবে? গাছের পাতাটিও নড়ছিল না, কোনও শব্দও তো শোনা যাচ্ছিল না। অথচ মহেশ যেভাবে হাত নাড়ছিল, মনে হল কিছু নিশ্চয়ই সে দেখেছে, বা শুনেছে! পরক্ষণেই মনে পড়ল, সে শুনবে কি করে, সে তো কালা! তাহলে? এই চিন্তাই হল কাল।
এই সব চিন্তা বোধ হয় কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আমার মাথায় খেলে গেল, তার পরেই হঠাৎ দেখলাম বনের মধ্যে থেকে যেন একটা হলুদ রঙের ঝড় এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রমোদের ওপর, আর পরমুহূর্তেই ওকে তুলে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল গহন বনের অভান্তরে! প্রমোদ বন্দুক তুলতেই পারল না, কিন্তু আমার রাইফেল গর্জন করে উঠল সেই হলুদ ঝড়ের দিকে লক্ষ্য স্হির করে। ততক্ষণে সে শিকার নিয়ে উধাও। মাচার ওপর তখন মহেশ দুহাতে কপাল চাপড়াচ্ছে! আমার অবশ হাত থেকে রাইফেল মাচার ওপর পড়ে গেল! কিছুক্ষণ অর্দ্ধমূর্ছিতের মত বসে রইলাম মাচার ওপর।
বরদাবাবু থামলেন ।
সকলে সমস্বরে প্রশ্ন করলাম, প্রমোদবাবু তাহলে --? না - উত্তর দিলেন বরদাবাবু, প্রাণে বেঁচে গেল। কিন্তু মহেশের অদ্ভুত পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাকে তাচ্ছিল্য করার জন্যে তাকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছিল। তার একটি হাত ও পা বাঘের দাঁত ও থাবায় ক্ষতবিক্ষত হওয়ায় কেটে বাদ দিতে হয়েছিল। আমার বন্দুকের গুলি বাঘের গলায় লেগেছিল, কিন্তু আহত বাঘ কীরকম ভয়ঙ্কর তা তো জানই! তাই মরার আগে সে প্রমোদের হাত ও পা প্রচন্ড রাগে আঁচড়ে কামড়ে ফালা ফালা করে দিয়েছিল। প্রমোদের ক্ষতবিক্ষত মূর্চ্ছিত দেহের পাশেই পড়েছিল সেই ব্যঘ্রপ্রবরের মৃতদেহ, সেটি লম্বায় প্রায় এগার ফুট। বাঘটি ছিল বোবা! গ্রামবাসীরা বাঘের উপদ্রব থেকে বেঁচেছিল। কিন্তু আসল কথাটাই বলা হয়নি। মহেশ কি করে বাঘের উপস্হিতি বুঝতে পেরেছিল তার গুপ্ত-রহস্য পরে, গ্রামবাসীদের কাছ থেকে শুনেছিলাম। আগে শুনলেই হত ভাল। তোমরা নিশ্চয়ই জান সাপের কান নেই, ওরা চোখ দিয়ে শোনে! তাই ওদের বলা হয় “অক্ষিঃশ্রবা"! মহেশও নাকি কানে কালা হলেও চোখ দিয়ে সেই ঘাটতি পূরণ করে নিত। অর্থাৎ সেও ছিল ‘অক্ষিঃশ্রবা’! প্রকৃতির রাজ্যে কত বিচিত্র ঘটনাই না ঘটে! সে যাই হোক, ওর ক্ষমতা ঠিকমত বুঝতে না পেরেই প্রমোদের প্রাণ যেতে বসেছিল।
বরদাবাবুর গল্প শেষ হল। আমরা অবাক বিস্ময়ে ভাবতে লাগলাম, এও কি সম্ভব?
সমাপ্ত
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment