ব্রাত্য (শেষাংশ)
প্রথমাংশ
দ্বিতীয়াংশ
তৃতীয়াংশ
লেখক: নারায়ণ স্যান্যাল
তৃতীয় অংশের পর
-- ননীমাধবের বাড়ি থেকে আবার রিকশা চেপে বেরিয়ে পড়েন উনি। অনলবর্ষী সূর্য তখন ঢলে পড়েছেন পশ্চিম দিগন্তে। চারটে বেজে গেছে। ক্লান্ত দেহটা রিকশায় এলিয়ে দিয়ে আকাশপাতাল চিন্তা করতে থাকেন। চিন্তার আর পারম্পর্য থাকছে না। কখনও মনে পড়ছে অসীমকে-কখনও বৈশাখীকে, কখনও আ্যানির মুখখানা ভেসে উঠছে মনের পটে। নীলা? না, নীলার কথা আর তিনি ভাববেন না। যে মেয়ে তাঁর বাপের সম্মান ধুলোয় লুটিয়ে দিয়ে কুলি-ব্যারাকে গিয়ে আশ্রয় নিতে পারে তাঁর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই আর।
অরুণাভ তাহলে সত্যিই চুরি করেনি! এটা তাহলে ননীমাধবের একটা কারসাজি! ননীমাধব তাহলে ঠিকই চিনেছিলেন পরমানন্দকে! তাই আসল কথাটা তাঁর কাছেও গোপন রেখে গেছেন। প্রথমটা রাগ হয়েছিল ননীমাধবের ওপর—এই হীন কাজের জন্যে। এখন কিন্ত আর রাগটা নেই-মনে হচ্ছে ওই ননীমাধবই তো একমাত্র লোক যে সম্মান করেছে তাঁর আদর্শনিষ্ঠাকে। সাহস করে বলতেও পারেনি সাজানো চুরির কেসের কথাটা। কিন্তু অরুণাভ চুরি করুক আর নাই করুক- সে জন্য তো তাঁর আপত্তি নয়। তাঁর আপত্তি হচ্ছে অন্য কারণে। আজ তিনি আর অরুণাভ নন্দী এক নৌকার যাত্রী নন। তিনি চলেছেন ভাঁটিতে আর অরুণাভ উজানে। তিনি চাইছেন দেশের শিল্প-উন্নয়নের পথ প্রশস্ত করতে। শ্রমিক আর মালিক হাতে হাত মিলিয়ে গড়ে তুলবে নতুন নতুন শিল্পসম্ভার। বিদেশী মুদ্রা আহরণ করতে হবে। নামতে হবে বিদেশী পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায়। জাতীয় পরিকল্পনা রূপায়িত হবে শ্রমিক-মালিকের যৌথ প্রচেষ্টায়। এ জন্যে অবশ্য স্বার্থত্যাগ করতে হবে দু পক্ষকেই। শ্রমিককে দিতে হবে জীবনধারণের উপযুক্ত পরিবেশ। শুধু জীবনধারণ নয়-- উন্নততর জীবনযাপনের ওদের জীবনের মান উন্নয়ন করতে হবে। তাই তো উনি ব্যবস্থা করেছেন কুলি-ব্যারাকে পাকা রাস্তা, পাকা নর্দমা,-- ব্যবস্থা করেছেন প্রাথমিক শিক্ষার, স্বাস্থ্যরক্ষার। শ্রমিকও দেখবে বৈকি মালিকের স্বার্থ। ওঁর কারখানার লোকেরাও ওঁকে দেবতার মতো ভক্তি করে। চীপ ক্যান্টিন খোলার দিন ওঁকে ওরা পরিয়ে দিয়েছিল একটা মোটা গাদাফুলের মালা।
অরুণাভ কিন্তু ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখছে জিনিসটা। সে চায় ধর্মঘট করে, চাপ দিয়ে, শ্রমিক ইউনিয়ন পাকিয়ে মালিককে শায়েস্তা করতে। বন্ধুত্বের সম্পর্কটা সে স্বীকার করে না। শ্রমিক আর মালিক যেন খাদ্য আর খাদক! আশ্চর্য! সে কোনো আপস চায় না-- সে শুধু লড়তেই চায়। আর এই লড়াইয়ের জন্য যদি কারখানাটা বন্ধও থাকে কিছুদিন. দেশের শিল্প-উৎপাদন ব্যাহত হয়-- তাতেও সে দুঃখিত নয়।
এই আদর্শগত বিভেদের জন্যই আজ তিনি ক্ষমা করতে পারেন না অরুণাভকে। সহ্য করতে পারেন না তাঁর উদ্ধত বিদ্বোহীর ভঙ্গিটা।
-- এই রোখো! রোখো!
দাঁড়িয়ে গড়ে রিকশাটা। রিকশাওয়ালাকে বলেন হুডটা তুলে দিতে। পড়ন্ত রোদে বড় কষ্ট হচ্ছিল তাঁর। রিকশাওয়ালা হুডটা তুলে দেয়। গাড়িটা চলছিল পশ্চিমমুখো; সূর্য দিগ্বলয়ে হেলে পড়েছেন। হুড তুলে দেওয়াতেও রোদটা আটকাল না। সামনে থেকে রোদ লাগছে। রিকশাওয়ালা সামনের পর্দাটা ফেলে দেয়। ঘেরাটোপের মধ্যে বন্দি হয়ে পড়লেন উনি। হঠাৎ একটা কথা মনে হল তাঁর। রিকশাওয়ালাকে বললেন বাঁ দিকের রাস্তায় ঘুরে যেতে। কুলিবস্তিতেই যাবেন তিনি একবার। ঘেরাটোপের মানুষকে আর কে চিনবে? বরং রিকশা থেকে নামবেনই না; রিকশাওয়ালাকে দিয়েই খোঁজ নেবেন। বাঁ দিকের কাঁচা সড়কে নামল রিকশাটা। এঁকেবেঁকে চলল কুলি-ব্যারাকের দিকে। এ পথে তিনি কখনও আসেননি। ইতিপূর্বে আসবার প্রয়োজনও হয়নি। তিনি ওপরতলার বাসিন্দা-- নীচের মহলের খবরদারির প্রয়োজন হলে লেবার-- স্ট্যাটিসটিক্স-এর প্রোফর্মাটাই দেখেন। সেই চার্ট থেকেই জানতে পারেন লেবার ব্যারাকের সংবাদ। আজ এখানে তাঁকে আসতে হয়েছে প্রাণের দায়ে। মনে পড়ছে ঠিক এ পথে না এলেও এ পাড়ায় একদিন এসেছিলেন তিনি, যেদিন চীপ ক্যান্টিনটা খোলা হয়। তিনি একা নন-- অনেক গণ্যমান্য অতিথিই এসেছিলেন সেদিন। রাস্তাগুলো ছিল ঝকঝকে-নর্দমাগুলো ছিল পরিষ্কার। কিছু দূরে দূরে বসানো ছিল সাদা-কালো ডোরাকাটা ড্রাম-অর্থাৎ ডাস্টবিন। সমস্ত এলাকাটা লাগছিল যেন চিত্রকরের আঁকা একখানা সুন্দর ছবি। মনে আছে সেদিন মনে মনে তৃপ্তির হাসি হেসেছিলেন। বস্তিজীবনের যে চিত্র দেশী-বিদেশী উপন্যাসে পড়া ছিল-তাঁর সঙ্গে আসমান-জমিন পার্থক্য লক্ষ করেছিলেন তাঁদের কারখানার। খুশি হয়েছিলেন।
আজ বুঝতে পারছেন ভুলটা।
আবর্জনা এসে জমেছে পথে। নর্দমাগুলো ভরে আছে নীলচে কালো কাদা-জলে। একটা কালভার্ট মুখ থুবড়ে পড়ে আছে পথের ওপর। নামতে হল অগত্যা। জলপ্রবাহ আটকে গেছে এখানে। একটা কুকুর চাপা পড়েছে লরিতে। দুর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হয় চার-পাঁচ দিন পূর্বেই ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছে বেচারির-- যদিচ তার অন্তেষ্টিক্রিয়ার কোনো ব্যবস্থা হয়নি এখনও। পথে লোকজন নেই। কয়েকটা শকুন এসে নেমেছে এই সুযোগে। অনেক মড়াকাটার অভিজ্ঞতা ছাপিয়ে ডাক্তার চৌধুরীর গা গুলিয়ে উঠল। খালি পেটে আছেন বলে কি? হর্ন দিতে দিতে একখানা ময়লা-ফেলা লরি এসে পড়ল প্রায় ঘাড়ের ওপর। রিকশাটা কাদায় নেমে পাশ দিল। পাশ দিয়ে চলে গেল লরিটা। কয়েকটা কাদামাখা শালপাতা উড়ে এসে পড়ল রিকশায়-- ওঁর খদ্দরের সাদা পাঞ্জাবিটায় যেন রসিকতা করেই এঁকে দিল একটা কলঙ্কচিহ্ন। পরমানন্দ লক্ষ করে দেখলেন ময়লা-ফেলা লরিটার তলদেশ প্রায় ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছে। সমস্ত রাস্তায় দুর্গন্ধযুক্ত তরল পদার্থের একটা ধারাচিহ্ন আঁকা পড়ে যাচ্ছে-- গাড়িটার পেছন পেছন। সম্ভবত গন্তব্য স্থাবে পৌঁছবার পূর্বেই লরি ভারমুক্ত হবে!
এই তা হলে তাঁর কুলি-ব্যারাকের জীবনালেখ্য?
রিকশাটা দাঁড়িয়ে পড়ে একটা পথের বাঁকে। রিকশাচালক জানায় পি-নাইন ব্যারাকে এসে গিয়েছে গাড়ি। উনি তাকেই বলেন সামনের বাড়ির কড়া নাড়তে, লোক ডাকতে।
অল্প পরে লোকটা ফিরে আসে দুঃসংবাদ নিয়ে। এ বাড়ির বাসিন্দার চাকরি গিয়েছে। নোটিশ পেয়েছিল কোয়ার্টার ছেড়ে দিতে। কদিন আগে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে।
কী আশ্চর্য! এই সহজ কথাটা খেয়াল হয়নি তাঁর !
অল্পবয়সী দুটি ছোকরা এগিয়ে আসে রিকশা দেখে। খড়িওঠা রুক্ষ দেহ-ময়লা ভর্তি সারা গায়ে। উর্ধাঙ্গ নগ্ন-নিম্নাঙ্গে খাকি ধুলিমলিন হাফপ্যান্ট। এসে বলে : ওস্তাদদাকে খুঁজছেন?
-- -ওস্তাদদা! সে কে? আমি খুঁজছিলাম অরুণাভ নন্দীকে-- এই বাসাতেই থাকত না?
-- হ্যাঁ, ওকেই আমরা ওস্তাদদা বলি। ওস্তাদদাকে কোম্পানি তেড়িয়ে দিয়েছে। ওই শালা ম্যানেজার আর ওই হারামজাদা চৌধুরী ডাক্তারের দমবাজি।
চমকে ওঠেন পরমানন্দ। বলেন : চৌধুরী ডাক্তার কে?
-- কে জানে, হবে কোন...
কান ঝাঁ-ঝাঁ করে ওঠে। ও ছোকরা কি জানে ওই অশ্লীল শব্দটার অর্থ? ছেলেটি আবার বলে- তা আপনি বুঝি পার্টি অফিস থেকে আসছেন? ওস্তাদদার কাছে?
-- হ্যাঁ, কোথায় থাকে অরুণাভ বলতে পারো?
-- জানব না? আবে এ রিকশালা, সুন্!
ওরা রিকশাচালককে হদিসটা বাতলে দেয়। পরমানন্দ তখন অবাক হয়ে ভাবছিলেন এদের কথা। কতই বা বয়স ওদের? এখন থেকেই মনুষ্যত্বকে গলা টিপে ধরা হয়েছে। লেখাপড়া শিখবে না, ভদ্র কথা, ভদ্র আচার কাকে বলে জানবে না কোনোদিন। এই বিষবাষ্পের শ্বাসরোধী বাতাবরণে তিলে তিলে নীল হয়ে যাবে ওই অমৃতের পুত্রেরা। জীবনের চরম শিক্ষাই হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। ম্যানেজার ইতিমধ্যেই হয়ে উঠেছে নিকট কুটুম্ব আর মালিক…..
এই তাঁর কীর্তি!
এর জন্যে মনের গভীরে তিনি পোষণ করেন অহঙ্কার! শিল্পোন্নয়ন করছেন দেশের! গঠন করছেন জাতি! শ্রমিকদের জীবনের মান উন্নয়ন-- একমাত্র লক্ষ্য তাঁর!
রিকশাওয়ালা বেঁকে বসল। সেই কোন সকালে ওঁকে রিকশায় তুলেছে। এখনও একটা পয়সা হাতে পায়নি। ঘুরে মরছে সারা শহর। সে আর যাবে না। ওকে ভাড়া মিটিয়ে দেওয়া হোক এবার।
-- কত ভাড়া হয়েছে তোমার? প্রশ্ন করেন পরমানন্দ।
-- তা টাকা তিনেকের কম নয়।
একখানা পাঁচটাকার নোট ওর হাতে দিয়ে বলেন : চলো-- ওই যে কী বস্তির কথা বলল ওরা -- ওখানে চলো।
রিকশাওয়ালা নরম হয়। আবার প্যাডলে উঠে বসে। এঁকেবেঁকে ফিরে চলে। পিছন থেকে বস্তির ছোকরাটি মন্তব্য করে তার দোস্তকে : মালদার লোক মাইরি; দেখলি কেমন ঝড়াক্সে নিকলে দিলে কড়কড়ে নোটখানা!
*********************
রিকশাখানা যখন এসে পৌঁছল বস্তিটায় সূর্য তখন ক্লান্ত দেহে এলিয়ে পড়েছেন পশ্চিম দিগ্বলয়ে। আঁকাবাকা পথের দুধারে মেটে ঘর, খাপড়ার চাল। পথের পাশে টিউকলের সামনে লম্বা কিউ। জলে থিকথিক করছে সেখানটা। ঘিনঘিনে এলাকাটা পার হয়ে হঠাৎ একটা ফাঁকা মাঠে এসে পৌঁছল রিকশাটা। এখানেই বোধহয় মীটিং হবে। কীসের মীটিঙ? অনেক মেহনতী মানুষ জড়ো হয়েছে মাঠে। কয়েকটা ফেস্টুন দেখা যাচ্ছে। এঁকেবেকে আছে বলে লেখাগুলো এখন পড়া যাচ্ছে না। দরমা-চাটাইয়ের ওপর খবরের কাগজ এঁটে তার ওপর লাল কালিতে কী যেন লেখা আছে। বাঁশের খুঁটের মাথায় ওই দাবিটাকেই নিয়ে ঘাড়ে করে নিয়ে এসেছে মীটিং এ। ময়দানের মাঝখানে খানকয়েক চৌকি পাতা। পাশে একটা বংশদণ্ডে উড়ছে একটা নিশান। রক্তচক্ষু মেলে চেয়ে আছে পতাকাটা পরমানন্দের দিকেই।
রিকশাওয়ালাই খোঁজ নিতে নিতে এসে হাজির হল বাড়িটার সামনে। বাড়ি অবশ্য গৌরবে। আসলে খোলার চালার একটা কামরা। সেখানেও অনেক লোক জটলা করছে। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে তখন। রিকশা দেখে জনতা পথ দেয়। ত্রিচক্রযান এসে থামল চালাখানার সামনে।
-- ওস্তাদ? হ্যাঁ, এই বাড়িই। হ্যাঁ, আছেন ভেতরে। কে এসেছেন?
পর্দা সরিয়ে রিকশা থেকে নেমে আসেন পরমানন্দ।
ওরা যেন ভূত দেখল। একটা গুঞ্জন উঠল জনতার মধ্যে। ভ্রূক্ষেপ করলেন না। সোজা উঠে গেলেন খোলার ঘরখানিতে। প্রথমেই নীচু চালাতে একটা ঠোকর খেলেন মাথায়। সেটাও গ্রাহ্য করলেন না।
ঘরের ভেতরটা অন্ধকার। হ্যারিকেন জ্বলছে একটা। জনা আট-দশ লোক নিম্নস্বরে কী যেন আলোচনা করছে। আগন্তুককে দেখে চমকে ওঠে সবাই।
ঘরে কোনো আসবাব নেই। একপাশে দড়ির একটি খাটিয়া-- তার নীচে মাটির একটা কলসির মুখে চাপা দেওয়া এনামেলের একটি গ্লাস। ওপাশে একটি টিনের সুটকেস। দেওয়ালে দুখানা ছবি-একটি সুভাষচন্দ্রের, অপরখানা লেনিনের। দরমার দেওয়ালে কঞ্চির গোঁজে টাঙানো আছে একটি হ্যান্ডলুমের ময়লা হাফশার্ট। মেঝেতে তালপাতার একটি চাটাই পাতা। তার ওপরেই বসেছিল লোকগুলো পা মুড়ে। অরুণাভও ছিল ওদের মাঝখানে--পরনে তার পায়জামা আর হাতকাটা গেঞ্জি।
-- কাকে চাই?
-- তোমাকেই। কয়েকটা কথা ছিল।
-- বসুন।
পরমান্দ চাটাইয়ের ওপরেই পা মুড়ে বসে পড়েন। লোকগুলো উঠে দাঁড়ায় সরে বসে।
-- বলুন, কী বলতে চান-নির্বিকার কণ্ঠ অরুণাভের। তার সামনে খোলা একটি খাতা অথবা বই-তারই পাতা ওলটাতে ওলটাতে বললে কথাটি।
পরমানন্দ প্রত্যুত্তরে বলেন : শুধু তোমার সঙ্গে কথা আছে আমার -- নিভৃতে।
বইটা মুড়ে রেখে দেয় অরুণাভ। মুখোমুখি তাকায় এতক্ষণে পরমানন্দের দিকে। সোজা প্রশ্ন করে-- ফ্যাকটরির ধর্মঘট সম্বন্ধে কথা কি? তা হলে এঁদের সকলের সামনেই কথা বলতে হবে।
-- না, আমি তোমার সঙ্গে কয়েকটি ব্যক্তিগত কথা বলতে চাই। কারখানার স্ট্রাইকের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই।
-- ও!
অরুণাভ তাঁর অনুচরদের বলে বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করতে। অধিকাংশই উঠে দাঁড়ায়। অল্পবয়সী একটি ছেলে হঠাৎ বলে বসে-ওস্তাদ, এ কাজ তুমি কোরো না। ওদের কারসাজি বুঝতে পেরেছি আমরা।
-- বাদল, তুমি বাইরে যাও।
ছেলেটি একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে ওঁদের দুজনের দিকে। তারপর বলে ওস্তাদ! আগুন নিয়ে খেলা কোরো না তুমি। এতগুলো মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেললে তার ফল ভালো হয় না। এত সহজ কথাটাও বুঝতে পারব না আমরা ভেবেছ?
-- বাদল! তুমি যাবে কিনা। মুষ্টিবদ্ধ হয় অরুণাভের হাত।
বাদল একবার আশেপাশে তাকিয়ে নেয়। লক্ষ করে দেখে অনেকেরই নীরব সমর্থন আছে তার উদ্ধত্যে। পাশ থেকে মোটা ভাঙা ভাঙা গলায় রহমৎ বলে ওঠে-- লেকিন ওস্তাদ। তুমিই হিসাব জুড়ে লেও ভাই-- উর কুনো গোস্তাকি হল কিনা। তুমার সাথে মালিকের আর কুন কথা আছে? ই লোগদের মনে ধোঁকা লাগল তো কি ফিন অ্যান্যায় হল?
অরুণাভ উঠে দাঁড়িয়ে বলে : বড়ভাই। এটুকু বিশ্বাস যদি না থাকে তোমাদের -- তবে কেন আমার হাতে ঝান্ডা তুলে দিয়েছিলে? যদি মনে করে থাক- একলা পেয়ে এক টুকরো রুটির লোভ দেখিয়ে ওরা আমাকে ধোঁকাবাজি দেবে তবে আমাকে এ কাজের ভার দেওয়া ঠিক হয়নি। তুমি আজ বিশ বছর আছ এ কারখানায়-- তোমাকে আমি বড়ভাই বলেছি- তোমাকে না জানিয়ে কোনও গোপন শর্তে মালিকের সঙ্গে আমি হাত মেলাতে পারি?
রহমৎ তার প্রায় সাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলে-- খামোশ। ব্যস, খুব। আযাও ভাইসব।
অধিকাংশ লোকই বেরিয়ে যায় এ কথায়। শুধু বাদলের অগ্নিবর্ষী অক্ষিতারকা দুটি তখনও ভুলছিল জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো। রুখে ওঠে সে : বড়ভাই, আমি ঘরপোড়া গোরু। এর আগে পাঁচঘাটে জল খেয়েছি আমি। এ ব্যাপার আমার জানা আছে। আমি যাব না।
রহমৎ তার হাম্বরধরা লৌহকঠিন হাতখানা বাড়িতে দেয় সামনের দিকে। গেঞ্জি না হয়ে শার্ট হলে বোতামগুলো থাকত যেখানটায় বাদলের একমুঠো জামা সেখান থেকে আটকে পড়ে রহমতের বজ্রমুষ্টিতে। মুখে কিছু বলে না রহমত; বাঁ হাতখানা বাড়িয়ে দেয় বারের দিকে।
-- ঠিক হ্যায়। -- বেরিয়ে যায় বাদলও।
অরুণাভ ঝাঁপের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এসে বলল : বলুন এবার।
-- তুমি কি আশা করো এভাবে ধর্মঘট করে কোম্পানিকে জব্দ করতে পারবে?
ধর্মঘট সন্ধে আলোচনা করতে হলে আবার ওদের ফিরে ডাকতে হয়।
-- ও আচ্ছা। -- সামলে নেন পরমানন্দ নিজেকে। তারপর একটু ইতস্তত করে প্রশ্নটা সোজাসুজি করে বসেন-- নীলা কোথায়?
-- আমি জানি না।
-- জানো।
চোখ তুলে অরুণাভ ওর দিকে তাকায়। বলে -- চোখ রাঙাবেন না, এটা আপনার কারখানা নয়।
-- সে আজ তোমার এখানে আসেনি?
-- না।
-- না? আমি বিশ্বাস করি না।
-- সে আপনার মর্জি।
-- তোমাকে আমি পুলিশে দিতে পারি- তা জানো? জেল খাটাতে পারি-- সেটা মনে আছে?
-- আছে, কারণ যে পরিমাণ অর্থ থাকলে একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে জেলে পোরা যায় তা আপনার আছে, তা জানি। কিন্তু আপনি হিসাবে একটু ভুল করছেন; জেলখাটা জিনিসটাকে আজ আপনি যতটা ভয়াবহ মনে করছেন-আমি তা করি না। তাই তো সেদিন বলেছিলাম, অভাবেই শুধু স্বভাব বদলায় না ডক্টর চৌধুরী, প্রাচুর্যেও বদলায়।
-- আমি নিশ্চিত জানি-আমার বাড়ি থেকে চলে আসার পর সে তোমার এখানে এসেছিল।
-- ঠিকই জানেন আপনি। সে এসেছিল-তবে আজ নয়-- কাল রাত্রে। গভীর রাত্রে।
-- তারপর?
-- তারপর আর কী জানতে চান বলুন?
হঠাৎ ভেঙে পড়েন কুলিশকঠোর পরমানন্দ-- আর্তকণ্ঠে বলে ওঠেন অরুণ, আমি মিনতি করছি। তুমি জানো আমি কী জানতে চাইছি। বাপ হয়ে আর কীভাবে প্রশ্ন করতে পারি আমি?
অরুণাভ এক মুহূর্ত চুপ করে থাকে। তারপর বলে-হ্যাঁ জানি; আপনার প্রশ্নের উত্তরে তাই জানাচ্ছি ননীমাধববাবুর পক্ষে কোনো বাধা নেই আপনাকে বৈবাহিক বলে স্বীকার করায়।
নৈঃশব্দের একাধিপত্য পরের কয়েকটি মুহূর্তের ওপর! নীরবতা ভেঙে অরুণাভই আর একটু টুকরো খবর অবজ্ঞায় ছুঁড়ে ফেলে দেয় পরমানন্দের উৎসুক্যের সম্মুখে -- কাল রাত্রে সে এখানে থাকেনি-চলে গিয়েছিল আপনার গুরুদেবের কাছে। আজ সকালে সেখান থেকেও চলে গেছে-- কোথায় তা আমি জানি না। আর কিছু জানতে চান?
-- সে আজ সকালে সেখান থেকে চলে গেছে তা তুমি জানলে কী করে?
টাঙানো কামিজটার পকেট থেকে একটা বন্ধ ভারী খাম বার করে সেটা অরুণাভ ছুঁড়ে দেয় পরমানন্দের দিকে, বলে-- আজ সকালে আমার লোক এটা দিতে গিযেছিল-- জেনে এসেছে সে ওখানে নেই।
ভারী খামটার ওপর গোটা গোটা অক্ষরে নীলার নাম লেখা। নাড়াচাড়া করে বন্ধ খামটা পরমানন্দ ফেরত দেবার উপক্রম করেন। অরুণাভ বাধা দিয়ে বলে-- ওটা আপনার কাছেই রাখুন। যদি কোনোদিন নীলার সন্ধান পান-- তাকে দেবেন।
তারপর মুহূর্তখানেক ইতস্তত করে বলে-আপনিও পড়ে দেখতে পারেন, যে প্রশ্ন আপনি করতে পারলেন না, তার জবাব পাবেন ওটায়।
চিঠিখানা অগত্যা গ্রহণ করতে হয় পরমানন্দকে।
-- আর কিছু বলবার আছে কি?
-- হ্যাঁ, একটা কথা। একদিন তুমি আমাকে শ্রদ্ধা করতে। মেদিনীপুর থেকে খুঁজে খুঁজে এতদূর এসেছিলে শুধু আমাকে বিশ্বাস কর বলেই। তোমার সে বিশ্বাসের সে শ্রদ্ধার কণামাত্রও কি অবশিষ্ট নেই আজ?
ভেবেছিলেন খুব কঠিন প্রশ্ন করেছেন; কিন্তু জবাব দিতে মুহূর্ত বিলম্ব হল না অরুণাভের। বললে-- না। কারণ আপনি আর সেই মানুষ নন-আপনি আদর্শচ্যুত, আপনি ব্রাত্য।
-- এই জন্যেই কি নীলার আশ্রয় হয়নি কাল এ বাড়িতে?
-- না। সেটার কারণ বুঝতে পারবেন আমার চিঠিখানা পড়লেই। কিন্তু এবার আসুন আপনি। আমাদের মীটিঙ শুরু হবে এইবার। ওরা অপেক্ষা করছে আমার জন্য।
পরমানন্দ উঠে পড়েন। দ্বারের দিকে পা বাড়ান।
-- দাঁড়ান। আপনাকে বড় রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসব।
-- প্রয়োজন হবে না।
-- হবে। না হলে হয়তো আপনি সুস্থ শরীরে ফিরে যেতে পারবেন না এ পাড়া থেকে। যেতে হবে হাসপাতালে।
পরমানন্দ এতক্ষণে একটা জবাব দিতে পারেন-- হাসপাতাল জিনিসটাকে আজ তুমি যতটা ভয়াবহ মনে কর অরুণ, আমি ততটা করি না। সঙ্গে যাবার দরকার হবে না তোমার।
জামাটা গায়ে দিতে দিতে অরুণাভ বলে : একদিন ডাক্তার পরশুরাম চৌধুরী আমার চিকিৎসা করেই শুধু ক্ষান্ত হননি-- নিজে আমাকে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিলেন নিরাপদ আশ্রয়ে-- তাই আপনি না চাইলেও আমাকে সঙ্গে যেতে হবে। আমি জানি বাদলরা ওত পেতে বসে আছে আপনার প্রত্যাবর্তনের পথ চেয়ে। চলুন।
পরমানন্দ ওর প্রসারিত হাতটি গ্রহণ করে হঠাৎ বলে বসেন-- পরশুরাম চৌধুরীর ঋণ তুমি আজও মনে করে রেখেছে অরুণ?
ওঁর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে অরুণাভ বলে- ডাক্তার পরশুরাম চৌধুরীকে কোনো বিপ্লবী চেষ্টা করেও ভুলতে পারবে না-- তিনি আমার যে উপকার করেছেন তা ভুলে যাওয়া অসম্ভব আমার পক্ষে। শুধু আমাকে বাঁচাতে গিয়েই তিনি অকথ্য অত্যাচার সহ্য করেছেন; তিনি আমার পিতৃবন্ধু, তাকে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করি আমি! যেমন আন্তরিকভাবে ঘৃণা করি হবু এম. এল. এ. ডাইরেকটর পরমানন্দ চৌধুরীকে-- ঘিনি মজদুর-উত্থান দমন করতে অনায়াসে মিথ্যা চুরির কেস সাজান, যিনি সাধারণ মানুষকে ঢুকতে দেন না তাঁর বাড়ির ফটকের ভেতর!
পরমানন্দের মুঠি আলগা হয়ে যায়। পাশাপাশি পথে নেমে আসেন ওঁরা।
রিকশায় বসেন পরমানন্দ। রিকশার পাশে পাশে চলতে থাকে অরুণাভ। বড রাস্তা পর্যন্ত ওঁকে এগিয়ে দিয়ে অরুণাভ ফিরে যায়।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে তখন। শহরতলীর বস্তি অঞ্চল। রাস্তায় জ্বলছে বিজলী বাতি। কারখানা এলাকার জনাকীর্ণ পথ। সিনেমার শো শুরু হচ্ছে। বিকৃত যান্ত্রিক আর্তনাদে পরিবেশিতে হচ্ছে হিন্দি গান। রিকশাটা ভিড় বাঁচিয়ে এঁকেবেঁকে চলল শহরের অপর প্রান্তে।
বুক ঠেলে একটা কান্না আসছে। হেরে গেছেন। নিঃসংশয়ে হেরে গেছেন তিনি চূড়ান্তভাবে। শুধু নীলার দৃষ্টিতে নয়-- শুধু অরুণাভের চোখেই নয়-- সারা দুনিয়ার কাছে আজ তিনি আদর্শচ্যুত, তিনি পতিত। মজদুর-নেতা আজ আন্তরিক ঘৃণা করে তাঁকে! রহমৎ আর বাদলেরা তাঁর পথের পাশে আজ ওত পেতে থাকে। এমনকি বস্তির ওই বালকটা পর্যস্ত অশ্লীল বিশেষণ যুক্ত করে উচ্চারণ করে তাঁর নাম। কারখানার বস্তিজীবন আজ তিনি নিজের চোখে দেখে গেলেন- এই তাঁর কীর্তি! এত বড় কীর্তি প্রতিষ্ঠা করেও তিনি তৃপ্ত হননি। আরও বৃহত্তর ক্ষেত্রে নতুন কীর্তির সন্ধানে উঠে-পড়ে লেগেছেন এবার। বিনিময়ে কিশলয়বাবুর কয়েক শত একর জমির মূল্য বিশগুণ বাড়িয়ে দিতে হবে। গ্রামনগরীটা গড়ে তুলতে হবে এমন এলাকায় যেখানে সমস্ত জমির মালিক তাঁরই মতো আর একজন নিঃস্বার্থ দেশকর্মী! এই এঁদের দেশসেবা! এই তাঁদের মতো সমাজসেবকদের কুম্ভীরাশ্রু কৃষক-মজুরদের জন্য। দীপক পর্যন্ত মনে করেছে পরমানন্দই চুরির কেসটা সাজিয়েছেন। সত্যরক্ষার জন্য একদিন যিনি অন্ধকূপের অন্তরালে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন, একমাত্র পুত্রকে যিনি সত্যধর্মের যুপকাষ্ঠে স্বহস্তে বলি দিয়েছেন সেই পরমানন্দকে আজ কী চোখে দেখছে দুনিয়া! চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল তাঁর। ঠিকই বলেছে নীলা-- আর কোনো সংশয় নেই। তিনি আদর্শচ্যুত, তিনি ব্রাত্য।
***************
রিকশা এসে থামল বাড়ির সামনে।
সমস্ত বাড়িটা খাঁ খাঁ করছে। কত দিনের কত আনন্দঘন ইতিবৃত্ত জড়িয়ে আছে বাড়িটার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ওই কদম গাছটার ডালে একদিন দোলনা ঝুলিয়েছিলেন। তখন নীলাও হয়নি। শুধু অসীম এসেছে সংসারে। ফুটফুটে এতটুকু একটা বাচ্চা। দোলনায় বাচ্চাকে শুইয়ে অ্যানি দোল দিত। আর ঘুমপাড়ানিয়া গান গাইত- নার্সারি লালেবাই। ঘাসের ওপর বেতের ইজিচেয়ারটার গা এলিয়ে উনি চুরুট খেতেন আর বই পড়তেন। এই বড় লনটায় কতদিন শীতকালে হয়েছে ‘ওপন এয়ার বুফে লাঞ্চ’। অ্যানি আর মিস গ্রেহাম প্রাণান্ত পরিশ্রম করত অনুষ্ঠানকে সর্বাঙ্গসুন্দর করে তুলতে। কী মধুর সে-সব দিনগুলি। বিবাহবার্ষিকীতে বরাদ্দ ছিল একটা সান্ধ্য ভোজের ব্যবস্থা। ছেলেমেয়েরা বড় হবার পর খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা হত ওদের জন্মদিনে। অর্ধশতাব্দীর স্মৃতিবিজড়িত লাল পয়েন্টিং করা বাড়িটার সামনে আজও একটা বেতের চেয়ার টেনে বসে পড়লেন। সারাদিন অভুক্ত তিনি। প্রচণ্ড ক্ষিদে পেয়েছিল বিকেলে-- এখন যেন সে বোধটাও নেই। শুধু ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে পা দুটো।
নন্দ এসে ওঁকে ডাকে-- ঘরে যাবার জন্য।
ঘর? না থাক। ইচ্ছা করছে না আর এখন উঠতে। নন্দকে বলেন বাগানের আলোটা জ্বেলে দিতে। ওখানে বসেই তিনি ভারী খামটা খুলে ফেলেন। বার হয়ে পড়ে অরুণাভর অবরুদ্ধ বাণী।
“নীলা
এইমাত্র তোমাকে তোমার বাবার গুরুদেবের আশ্রমে পৌঁছে দিয়ে এলাম। মনে হচ্ছে সব কথা গুছিয়ে বলতে পারিনি। পারা সম্ভবও নয়। দীর্ঘ এক যুগ প্রতীক্ষা করে আছি তোমার আগমনের, সেই তুমি এসে দাঁড়ালে আজ আমার দরজায়; অথচ এমন দুর্ভাগ্য আমার, দ্বার থেকে ফিরিয়ে দিতে হল তোমাকে। তাই সব কথা বুঝিয়ে বলার মতো আমার মনের অবস্থা ছিল না-- সম্ভবত শোনার মতো মানসিক ধৈর্য্য ছিল না তোমার। তাই এ চিঠি দিচ্ছি।
তোমাকে আমার বাসার দ্বার থেকে ফিরে যেতে হয়েছে। উন্মুখ আগ্রহ নিয়ে তুমি এসেছিলে এই দরমার ঘরে-- বাকি জীবনের দিনগুলি এখানে বিকিয়ে দেবার সঙ্কল্প নিয়েই-- কিন্তু আমিই তা হতে দিইনি। তাই আমার কাছে তোমার একটা কৈফিয়তও পাওনা বৈকি।..
ছেলেবেলার কথা মনে পড়ছে। দুনিয়াটা আমার কাছে তখন ছিল অত্যন্ত সীমিত। বাবা ছিলেন-- তুমি তো জানোই-- বিপ্লবী। ইংরাজকে তাড়াবার মন্ত্রণার মেতে উঠেছিলেন তিনি। প্রাণ দিলেন ওই স্বপ্ন দেখতে দেখতেই। আমার মাকে আমি তখনও কাঁদতে দেখিনি। বাবা যখন মারা যান, আমি তখন ছোট। সব কথা মনে নেই। তারপর জ্ঞন হওয়ার পর তখনও তাঁকে কাঁদতে দেখিনি। আমাকে তিনি গল্প শোনাতেন-- শিবাজীর গল্প, রানা প্রতাপের গল্প, গুরু গোবিন্দের কথা, ক্ষুদিরামের কাহিনী। স্বামীকে হারিয়ে যে তিনি হতোদ্যম হয়ে পড়েননি, এটা প্রমাণ করতেই যেন আমাকে ওই পথের নির্দেশ দিলেন। আশ্চর্য মানুষ তিনি। তাঁরই হাতে গড়া মানুষ আমি। তারপর একদিন তিনিও অস্তমিত হলেন আমার জীবনদিগন্ত থেকে। তাঁর একটা কথা মনে আছে আমার : “যারা আমাদের মানুষ বলে মনে করে না-- যারা বাধ্য করছে আমাদের কুকুর/ বেড়ালের মতো জীবনযাপন করতে-- তাদের কখনও ক্ষমা করিস না অরু”। পরে ওই কথাগুলোই পড়েছিলাম ‘পথের দাবী’তে।
নীলা, আমার মা সম্ভবত ইংরাজ-শাসকদের উদ্দেশ্য করেই ও কথা বলেছিলেন-- অন্তত সে যুগে আমি সেই অর্থেই গ্রহণ করেছিলাম তাঁর উপদেশ। ক্রমে আমার চিন্তাশক্তির প্রসার হয়েছে-আজ মনে হয় কথাটা দেশকালের অত ক্ষুদ্র আবরণে আবদ্ধ নয়। তাই আজ ইংরাজ শাসকদের অবর্তমানেও আমাদের সংগ্রাম শেষ হয়ে যায়নি। আজ তোমার বাবা এবং আমি সে সংগ্রামে বিপক্ষ শিবিরের সৈনিক।
আজ তুমি ওপরতলার বাসিন্দা আর আমি থাকি নীচের মহলে। জানি, তুমি বলবে-- স্বেচ্ছায় ওই ওপরের মহল ছেড়ে নেমে এসেছ তুমি আমার সমতলে। পরমানন্দের প্রাসাদ ছেড়ে যখন পরমদুঃখীর কুটিরে এসে দাঁড়িয়েছে তখন ফিরে যাবার পথ যে তুমি রুদ্ধ করে দিয়েই এসেছে সেটা বোঝা শক্ত নয়। আমি অবাক হয়ে যাই তোমার বাবার কথা ভেবে। ভদ্রলোকের সবই ছিল-- সবই খুইয়েছেন; অথচ আশ্চর্যের কথা, আদর্শের কারবারে আজ যে তিনি দেউলিয়া এ খবরটাও তিনি জানেন না। সম্পদের সঙ্গে আদর্শের, চরিত্রের বোধহয় একটা নিত্যবৈরী আছে। কী একটা নাটকে পড়েছিলাম নায়কের বাইরের ঘরে টাঙানো থাকত বাইবেলের একটা বাণী : ‘সুচের ছিদ্রপথে উট গলে যেতে পারে-- কিন্তু কোনো বড়লোক কখনও স্বর্গে যেতে পারে না’। সম্পদ, প্রতিপত্তি, সম্মান মানুষের আদর্শকে পিষে মারে। অথচ মানুষ জানতেও পারে না যে সে আদর্শচ্যুত হয়েছে। তোমার বাবারও আজ সেই দশা। তুমিও তাঁর সাহচর্যে সে কথা বুঝবার মতো বোধশক্তি হারিয়েছ। আজ সাময়িক উত্তেজনাতে সব ছেড়ে তুমি আমার দ্বারে এসেছ দাঁড়িয়েছ এটা সত্য; কিন্তু জীবনটা তো নাটক নয়!
সিনেমায় আর রঙ্গমঞ্চে যেটা বেশ স্বাভাবিক, জীবনে তাই অবাস্তব। তুমি যখন গতকাল রাত্রে একা এসে দাঁড়ালে আমার দরজায়, ঠিক সেই মুহূর্তটিতে যদি পঞ্চম অঙ্কের শেষ যবনিকা নিশ্চিত পড়বে জানতাম তাহলে আমিও তোমার হাত দুটি ধরে ভাবতে পারতাম ‘এতদিন পরে এসেছে কি তার আজি অভিসার রাত্রি’। এটা নাটক হলে কোনো কথা ছিল না। নাটকের দর্শক খুশি মনে বাড়ি যেত। কিন্তু জীবনের দর্শক জানে নিষ্প্রভাত রাত্রি নেই। নিষককালো অমারাত্রির অন্ধকারে তোমার এ অভিসারের রোমান্টিকতার পরেও আছে সকালবেলার চড়া রোদ! সকাল হলে তুশি দেখতে পাবে এখানকার চৌকিতে গদি নেই, আছে ছারপোকা। কফির কাপের বদলে আছে মাটির ভাড়ে জোলো চা; ঈভনিং-ইন-প্যারী অথবা ক্যান্থারাইডিন নয়--পচা নর্দমার দুর্গন্ধে বাতাস এখানে উদ্ধন্ধনে আত্মহত্যা করেছে।
রাগ কোরো না নীলা। দোষ তোমার নয়। তুমি এ জীবনে অভ্যস্ত নও। তোমার শিক্ষা, দীক্ষা, রুচি গড়ে উঠেছে অন্য পরিবেশে। ঝোঁকের মাথায় তুমি সব ত্যাগ করে আসতে চাইছ; কিন্তু কাল সকালে তোমার অনুশোচনার অন্ত থাকবে না। কাল না হোক কালে এ কথা তোমার মনে হবেই। এই একটি মুহূর্তের ভুলের বোঝা বয়ে চলতে হত তোমাকে আজীবন। কারণ এ ঘরে একটা রাত্রিযাপন করা মানেই বাকি জীবনের রাত্রিগুলির মৃত্যুপরোয়ানায় সই দেওয়া।
ভুল বুঝো না আমাকে। আমি আজও তোমাকে তেমনিই ভালোবাসি। বছর দশেক আগে বিদায় দেবার সময় বলেছিলাম, “তোমার জন্য অপেক্ষা করে থাকব”। আজও বিদায় দেবার সময় বলছি ওই একই কথা। এ কথা বলছি না যে আমার সঙ্গে জীবন যুক্ত করা তোমার পক্ষে একান্ত অসম্ভব। তবে তার জন্য প্রস্তুতি চাই, শুধু মানসিক নয়, শারীরিকও। ঝোঁকের মাথায় সেটা যেন না হয়। আমি তোমাকে অনুরোধ করব-- নিজের মন তুমি ভালো করে যাচাই করে দেখো। যদি তোমার বাবার মেকি দেশসেবায় সত্যই অতিষ্ঠ বোধ করে থাকো, যদি ঐশ্বর্যের বেড়া ভেঙে নেমে আসতে চাও এই সংগ্রামময় জীবনের সমতলে, তাহলে কিছুদিন তোমাকে এ পথে চলবার শিক্ষানবিশি করতে হবে। আমি বলব স্বেচ্ছা-- দারিদ্রের মধ্যে বাস করতে হবে কিছুদিন তোমাকে। তোমার বাবার কাছ থেকে কোনো সাহায্য নিতে পারবে না। তোমার পরিচিত সমাজ থেকে এভাবে স্বেচ্ছা-- নির্বাসন নিয়ে যদি কয়েক মাস আমার জীবনের সুখ-- দুঃখের আস্বাদ নিতে পারো এবং তারপরেও অবিচলিত রাখতে পারো তোমার আজকের সংকল্প, তাহলেই সার্থক হবে আমার দীর্ঘ প্রতীক্ষা। বরণ করে তুলব সেদিন আমার জীবনলক্ষ্মীকে।
আরও একটা কথা। তুমি উচ্চশিক্ষিতা। ফিলসফিতে এম. এ. পাস করেছ তুমি। আমি কলেজের প্রথম বার্ষিক শ্রেণির ছাত্র ছিলাম যখন ধরা পড়ি। তারপর কলেজে শিক্ষালাভ ঘটেনি আমার। সহরাজবন্দিদের কল্যাণে সমাজদর্শন, অর্থনীতি বিষয়ে কিছু পড়াশুনা করেছি মাত্র। সুতরাং তোমার সঙ্গে আমার শিক্ষাগত একটা প্রভেদ আছে। এ কথাটাও তুমি বিচার করে দেখো।
শেষ কথা। তোমার সঙ্গে আমার একট প্রকাণ্ড প্রভেদ আছে। তুমি নাস্তিক, তুমি ঈশ্বরের অস্তিত্বে অবিশ্বাসী। আমি ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষ। দিনান্তে একবার তাঁকে স্মরণ না করলে মনে বল পাই না। আমি বিশ্বাস করি তিনি আছেন আনন্দঘন কল্যাণময়রূপে। এখানেও আমাদের অমিলটা অত্যন্ত ব্যাপক। যুক্তিতর্ক দিয়ে তোমাকে স্বমতে আনতে পারব না- তুমিও পারবে না। তোমার নাস্তিকতার গোলাবর্ষণে আমার এ বিশ্বাসদুর্গকে বিধ্বস্ত করতে।
জানি না ক্ষমা করতে পারলে কিনা আমাকে।
এ চিঠির প্রত্যুত্তর আমি আশা করছি না। আমি বিশ্বাস করব তুমি আত্মসমীক্ষণান্তে ফিরে আসবে ঠিক যেখান থেকে ফিরে যেতে হল সেখানে। যদি স্থির করো যে আসবে না-- তবে সে কথাও আমাকে জানিও না। সে কথায় আমার প্রয়োজন নেই কারণ অন্য কোনো জীবনসঙ্গিনী আমার কল্পনার বাইরে। না হয় অহেতুক আশাতেই কাটুক না আমার বাকি জীবন।
ইতি
অরুণাভ।”
-- স্যার!
-- হ্যাঁ।
-- আপনার তো আজ খাওয়া হয়নি সারাদিন।
নন্দর এ প্রশ্নের জবাবে এবার স্বীকার করেন পরমানন্দ -- না, সারাদিনে কোনো আহার্য জোটেনি তাঁর।
-- আপনার খাবার আনব?
-- আন। হ্যাঁ রে, ছোট মহারাজ আসেননি আর?
নন্দ জানায় যে ইতিমধ্যে ছোটমহারাজ এসে দিয়ে গেছেন একখানি চিঠি।
নন্দ খাবার আনতে যায়।
দ্বিতীয় চিঠিখানি খুলে বসেন পরমানন্দ। গুরুদেব লিখছেন :
“পরমকল্যাণীয়েযু,
নীলা-মার জন্য চিন্তা করিও না। সে আমার সহিত তীর্থভ্রমণে যাইতেছে। মানস পর্যন্ত যাইবার ইচ্ছা আছে। তোমাকে জানাইয়া যাওয়া সম্ভব হইল না-- কারণ তুমি জানিলে এরূপ কদর্পকহীন অবস্থায় আমাদের তীর্থযাত্রা সম্ভব হইত না। অপরপক্ষে তীর্থভ্রমণের রাজসিক ব্যবস্থা হইলে আমাদের এ যাত্রার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হইত। আমার না হইলেও নীলার হইত।
আশীর্বাদক। ইতি--”
চিঠিখানি শেষ করে মিনিটদশেক স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকেন পরমানন্দ। মনশ্চক্ষে ভেসে ওঠে তুষারাচ্ছাদিত এক সানুদেশ; সুদুর্গম যাত্রাপথে চলেছেন দুজন পথিক দূর দিগন্তে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে-- একজন জ্ঞানবৃদ্ধ সন্ন্যাসী, অপরজন অভিমানক্ষুব্ধ তাঁরই আত্মজা। চুম্বকখণ্ড তাহলে দিক পরিবর্তন করেছে; বিকর্ষণ রূপান্তরিত হয়েছে ঐকান্তিক আকর্ষণে! উপকরণের দুর্গপ্রাকার থেকে মুক্তি পেয়েছে নীলা। ঠিকই বলেছিলেন গুরুদেব-- নীলা এগিয়ে গেছে সাধনমার্গে তাঁকে পিছনে ফেলে।
উঠে পড়েন উনি। মনস্থির করেছেন এতক্ষণে! লেটার প্যাডটা কার করে সর্বপ্রথমেই লিখে ফেলেন একখানা চিঠি। শেষ করে আবার আদ্যোপান্ত পাঠ করেন। খামটা বন্ধ করে উঠে যান ওপরের ঘরে। সুটকেসটা টেনে নিয়ে গুছিয়ে তুলতে থাকেন,জামাকাপড়। প্যান্ট, শার্ট, টাই, গরম জামা, ড্রেসিং গাউন, শেভিং সেট, একে একে গুছিয়ে তোলেন। তারপর হঠাৎ কী ভাবেন কয়েকটা মুহূর্ত। আবার খালি করেন সুটকেসটা। নাঃ এ-সব নেবেন না তিনি। কিট-ব্যাগটায় ভরে নেন খানকয়েক ধুতি। খান দুই কম্বলও নেন, একটা লেডিজ গরম ওভারকোট ব্যাস, আর কিছু নয়।
বেশি সময় লাগল না গুছিয়ে,নিতে। টাইম-টেবিলটা দেখেন একবার হ্যাঁ, ট্রেন একটা আছে। এখনি বের হলে ধরতে পারবেন। এখনই যাবেন তিনি। টনকপুর স্টেশনে দেখা পাবেন ওঁদের নিশ্চিত।
খাবারের থালাটা হাতে নিয়ে নন্দ উঠে এসেছে দোতলায়-ডাইনিংরুম খালি রেখে।
-- ও-সব এখন থাক। তুই শিগগির একটা ট্যাকসি দেখ!
-- আপনি আগে খেয়ে নিন। -- নন্দ এবার একটু দৃঢ়কণ্ঠে বলে। কিন্তু পরমানন্দ তার চেয়েও দৃঢ়কণ্ঠে বলে ওঠেন-বিরক্ত করিস না নন্দ। যা বলছি কর। ট্রেনটা আমায় ধরতে দে।
নন্দ তাঁর মনিবকে চেনে। আর কোনো কথা না-বলে বেরিয়ে যায় ট্যাক্সি ডাকতে। বারান্দাটায় পায়চারি করতে থাকেন পরমানন্দ অস্থির পদবিক্ষেপে! না, হার তিনি স্বীকার করবেন না। ভুল মানুষ মাত্রেরই হয়। সে ভুলকে স্বীকার করে নেওয়ায় লজ্জা নেই। ভুলকে সংশোধন করা, তাকে জয় করাই মনুষ্যত্ব। পরমানন্দও প্রমাণ দেবেন তিনি আদর্শচ্যুত নন- আদর্শের জন্য তিনি আজও সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তত।
ট্যাকসিতে উঠবার সময় পিছনে এসে দাঁড়াল কালো রঙের হিন্দুস্থানখানা। নেমে এলেন হর্ষোৎফুল্ল ননীমাধব সুসংবাদটা দিতে- কংগ্র্যাচুলেশন্স! সব ঠিক হয়ে গেছে ভাই—কিশলয় গাঙ্গুলি হ্যাজ উইথড্রন—তোমার পথে আর কোনো বাধা নেই –
বাধা দিয়ে পরমানন্দ বলেন-- বেশি কথা বলার আমার সময় নেই ননীমাধব। আর আঠারো মিনিট মাত্র বাকি আছে ট্রেন ছাড়ার, আমি চললাম। এই চিঠিখানা তারিণীদাকে দিও-
ননীমাধবকে বস্তুত কোনো প্রত্যুত্তর করবার সুযোগ না দিয়েই রওনা হয়ে গেলেন তাঁর অভিন্নহৃদয় বন্ধু।
মুহূর্তখানেক ননীমাধব দাঁড়িয়ে থাকেন স্থাণুর মতো। তারপর অসীম কৌতুহল নিয়ে খামটা খুলে পড়তে থাকেন চিঠিখানা।
আশ্চর্য কাণ্ড। পরমানন্দ তাঁর তারিণীদাকে জানাচ্ছেন অনিবার্য কারণে তিনি নির্বাচন-প্রতিদ্বন্দিতা থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন। কারণটা কী তা লেখেননি। তবে শেষ দিকে লিখেছেন “অধ্যাপক গিরীন্দ্রবাবু আমার অপেক্ষা যোগ্যতর ব্যক্তি। দীর্ঘতর দিন তিনি যুক্ত ছিলেন আমাদের পার্টিতে। এখানে নমিনেশন না পাইয়া তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে দাঁড়াইয়াছেন। গিরীন্দ্রবাবুর বদলে আপনারা আমাকে মনোনীত করিয়াছিলেন এজন্য নয় যে আমি যোগ্যতর ব্যক্তি। কারণটা অর্থনৈতিক। এ ভোটযুদ্ধে পাড়ি দিতে আমি যে পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করিব-- অধ্যাপক বসু-মহাশয়ের পক্ষে তাহা করা সম্ভবপর নহে। অপ্রিয় হইলেও কথাটা সত্য। শেষ মুহূর্তে আমার এই আকস্মিক পশ্চাদপসরণে আপনারা বিব্রত বোধ করিতে পারেন-তাই প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ পার্টি-ফান্ডে জমা দিবার জন্য একটি ক্রস চেক এইসঙ্গে রাখিয়া গেলাম। আশা করি অতঃপর আপনারা আর গিরীন্দ্রবাবুকে অপাংক্তেয় মনে করিবেন না। ক্ষমাপ্রার্থী ইতি।।”
বিস্মিত বিমুঢ় ননীমাধব স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন চিঠিখানি হাতে করে। এ ছেলেমানুষির কোনো মানে হয়!
********************************
এখানেই আমার কাহিনী শেষ করেছিলাম। মনে হয়েছিল, এর পরবর্তী ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ নিতান্তই বাহুল্য। সংসারাভিজ্ঞ বুদ্ধিমান পাঠক অনায়াসেই সেটা অনুমান করতে পারবেন ভেবেছিলাম। কিন্ত দুর্ভাগ্যবশত এ উপন্যাসের পান্ডুলিপি যিনি প্রথম পড়লেন তিনি আমাকে বলে বসলেন যে কাহিনীটি সুসমাপ্ত নয়। আদর্শনিষ্ঠ পরমানন্দ তাঁর আদর্শে ফিরে গেলেন-- এটাই নাকি কাহিনীর শেষ কথা হতে পারে না। এর পরেও প্রশ্ন থেকে যায়-- অরুণাভের আদর্শের কথা, নীলার বিবাহের কথা। আমার মতে সে-সব কথা দ্বিতীয় একটি কাহিনীর বিষয়ভুক্ত হতে পারে মাত্র; এবং তা হলেও সে কাহিনীটি পুনরুক্তিদোষে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাবে শুধু। তবু প্রথম পাঠিকার অনুরোধে কয়েকটি স্থুল সংবাদ এখানে লিপিবদ্ধ করতে বাধ্য হলাম।
ডাক্তার পরমানন্দকে টনকপুর পর্যন্ত যেতে হয়নি, সাজাহানপুরেই তিনি দেখা পেয়েছিলেন গুরুদেবের। সে যাত্রায় বেশি কষ্ট পেতে হয়নি ভাকে। নীলা লক্ষ্মী মেয়েটির মতই ফিরে এসেছিল তাঁর সঙ্গে।
সেই একদিনের ছেলেমানুষির কথা মনে পড়লে আজ নিজের কাছেই নিজে লজ্জিত হন পরমানন্দ। সারাটা দিন যেন একটা ভূত চেপেছিল তাঁর ঘাড়ে। সেন্টিমেন্টাল হওয়াটা পাপ, সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেছেন তিনি; সেই একদিনের ছেলেমানুষির খেসারত হিসাবে অ্যাসেমব্লিতে যাওয়া পিছিয়ে গেছে বছর-পাঁচেকের জন্য। শুধু কী তাই? অহেতুক কতকগুলো টাকাও অর্থদণ্ড হল! অবশ্য হতোদ্যম হন নি তিনি মোটেই। কর্মবীর তিনি-- এত সহজেই ভেঙে পড়বেন কেন! ক্রমে ম্যানেজিং ডাইরেকটারশীপটাও হাতে এসেছে এতদিনে। প্রয়োজলাতিরিক্ত খরচ করে চলেছেন তিনি শ্রমিকদের পিছনে। আগামী বারে মজদুর-মহল্লার সব কটা ভোট তাঁকে পেতেই হবে! এই শুভকর্মে তিনি নিয়োজিত করেছেন উপযুক্ত লোককেই।
অরুণাভ নন্দীই এখন বার্টন গ্যান্ড হ্যারিস কোম্পানির লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসর। নীলাকে বধূরূপে গ্রহণ করার অর্থনৈতিক বাধাটা এখন আর নেই। মেহনতী মানুষের ভালো করার পূর্ণ দায়িত্ব অরুণাভের ওপরই ন্যস্ত করেছেন ম্যানেজিং ডাইরেকটর। মজুরদের জন্য ক্লাবঘরে এসেছে নতুন রেডিও, মজদুর-মন্ডলীর আসর শুনতে ওরা গোল হয়ে বসে। মেহনতী মানুষদের প্রভিডেন্ট-ফান্ড খোলার আয়োজন হচ্ছে, অসুস্থ মজুরও যেন মারা না পড়ে সে ব্যবস্থা হচ্ছে। আরও কত পরিকল্পনা রয়েছে। অরুণাভ বয়স্কদের জন্য নৈশ স্কুলও খুলতে চেয়েছিল, কিন্তু ওটাতে আপত্তি আছে কর্তৃপক্ষের। পরে অরুণাভও বুঝতে পেরেছে লেখাপড়া শিখিয়ে আর কী লাভ হবে ওদের- ওরা তো আর কেরানি হয়ে উঠবে না কোনোদিন! শিক্ষা ওদের কাছে আশীর্বাদ নয়, অভিশাপ! অরুণাভ আজও মনে প্রাণে মজদুরদরদী! যদিও অফিসার হওয়ার পর মজুরদের সঙ্গে তার অন্তরঙ্গ মেলামেশাটা এখন সম্ভবপর নয়, তবু মোটা অঙ্কের মাহিনা থেকে মাঝে মাঝে সরু-মোটা অঙ্কের চাঁদাই তাকে দিতে হয় পার্টি-ফান্ডে।
আগামী বিশ্বকর্মা পূজায় মজদুরদের চিত্ত বিনোদনের জন্য একটা নাটক সে মঞ্চ করবে মনস্থ করেছে। অশ্রুতপূর্ব তার মৌলিক পরিকল্পনা ! মজদুর, মসীজীবী এবং দু-একজন অফিসার পর্যন্ত নাকি একই মঞ্চে অভিনয় করবে এবার। সাম্যের এক চুড়ান্ত স্বাক্ষর সে রেখে যাবে রঙ্গমঞ্চের পাদপ্রদীপের সম্মুখে! ডাঃ পরমানন্দকে সে বুঝিয়ে দিয়েছিল তার পরিকল্পনার কথা। খুব উৎসাহিত হয়েছিলেন পরমানন্দ; বলেছিলেন, থিয়েটার আমিও এককালে খুব করতাম, কিন্তু এমন চিন্তা আমার মাথাতেও আসেনি।
অরুণাভ বলেছিল : তাহলে প্রধান চরিত্রটা আপনিই করুন না।
-- নাটকটা কী?
-- তারাশঙ্করবাবুর ‘দুই পুরুষ’, -আপনি নুটুবিহারীটা করুন।
পরমানন্দ হেসে বলেছিলেন : ও চরিত্রটাও এককালে আমি করেছি, তবে কী জানো-- আমাদের যুগ গত হয়েছে। তোমরাই এখন ও-সব করো। আমরা পেছনে আছি।
অগত্যা অরুণাভকেই রাজি হতে হয়েছে নুটুবিহারীর চরিত্র অভিনয় করতে। নাটকটা পুরাতন; বহুবার এ নাটকের অভিনয় সকলে দেখেছে। তবু নবীন অভিনেতা চরিত্রটা কেমন অভিনয় করে সেটা দেখবার জন্য সকলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে!
নীলা অবশ্য টিকতে পারেনি। সে নাকি আজকাল পণ্ডিচেরিতে থাকে!
সমাপ্ত
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment