ব্রাত্য (দ্বিতীয়াংশ)
প্রথমাংশ
লেখক: নারায়ণ স্যান্যাল
প্রথম অংশের পর
ঝনঝন করে টেলিফোনটা বেজে উঠল।
চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল চৌধুরীর। নিজেকে আবিষ্কার করলেন নিঃসঙ্গ প্রাতরাশের টেবিলে। ...ক্রিরিং… ক্রিরিং….উঠতে হল অগত্যা।
সিল্কের ড্রেসিং গাউনটার পাকানো কর্ডটা আলগা করে মাজায় বাঁধতে বাঁধতে চলে আসেন আর্চওয়ের তলা দিয়ে ড্রয়িং রুমে। রিসিভার থেকে তুলে নিলেন টেলিফোনটা।
-- চৌধুরী!
ও প্রান্ত থেকে ভেসে এল উদ্বিগ্ন ননীমাধবের উৎকণ্ঠ ব্যস্ততা-- বেশ যা হোক। আটটা বেজে গেল-- তোমার পাত্তা নেই। কী করছ? দেরি করছ কেন?
পরমানন্দ প্রতিপ্রশ্ন করেন-- কেন? কোথায় যাব?
-- কোথায় যাবে?-- ননীমাধব আর্তনাদ করে ওঠেন-- সে কী হে? কাল রাত্রে ক পেগে থেমেছিলে বলো তো? এখনও খোলসা হয়নি মাথা?
বিরক্ত বোধ করেন চৌধুরী। কাল রাত্রে সত্যই মাত্রাতিরিক্ত পান করেছেন নীলা চলে যাবার পর। কিন্তু সেজন্য বুদ্ধিভ্রংশ হয়নি ওঁর। এ নেশা ওঁর নূতন নয়। বললেন-- বাজে কথা বোলো না। কোথায় যেতে বলছ এখন?
ওঁর কণ্ঠস্বরে ননীমাধব কিন্তু বিচলিত হন না। বলেন,-- সকালবেলা উঠে এনগেজমেন্ট প্যাডটাও দেখনি খুলে? কেমন? শোনো, মুখস্থ বলে যাচ্ছি আমি-- সকাল সাড়ে আটটায় বোর্ড-অফ ডাইরেকটর্সদের মীটিঙ-- সাড়ে দশটায় জিতেনবাবুর বাসায় যাওয়ার কথা আছে-- -তাঁকে সঙ্গে করে এগারোটায় তারিণীদার বাসায়-- মধ্যাহ্ন আহারের নিমন্ত্রণ আছে তোমার সেখানে-- ও বেলায় ধরো, মিউনিসিপ্যাল হলে সাড়ে তিনটের শোকসভাতে গিয়ে একটা কাঁপা-কাঁপা গলায় ভাষণ দিতে হবে-- সেখানে থেকে সাড়ে চারটায় ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডে। মনে পড়ছে কিছু? তারপর ধরো... ,
ছি ছি ছি। কী মারাত্মক ভ্রান্তি। সব কথা মনে পড়ে যায় পরমানন্দের। তাঁর দিনগুলি কি আর তাঁর নিজের? আপন খেয়ালখুশিতে ফেলে-আসা দিনগুলোর উপর চোখ বুলিয়ে তন্ময় হয়ে যাবার অবকাশ কোথায়? প্রতিটি ঘণ্টা প্রতিটি মুহূর্ত যে কঠিন কর্মসূচির শৃঙ্খলে বন্দি! সামনের আয়নাটায় প্রতিবিম্ব পড়েছে নিজের। চমকে ওঠেন দেখে। দাড়ি কামানো হয়নি, স্নান হয়নি, জামাকাপড় বদলানো হয়নি। আশ্চর্য, এ-সব না সেরেই তিনি প্রাতরাশের টেবিলে এসে বসেছিলেন? জীবনে অনেক ভুল করেছেন তিনি -- ভুলের মাশুলও দিয়ে এসেছেন কড়াক্রান্তি হিসাবে; কিন্তু, মনে হল ডাক্তার চৌধুরীর, এত বড় ভ্রান্তি বুঝি এই প্রথম। ঘড়ির কাঁটার কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা দৈনন্দিন কর্মসূচি আজ বুঝি প্রথম আগল ভেঙে বেরিয়ে এসেছে অনিয়মের অরাজকতায়। নাঃ! এ দুর্বলতাকে কিছুতেই বরদাস্ত করা চলে না।
-- কী হল, তুমি আসবে না, না আমিই যাব তোমার ওখানে?
-- না, না, আমিই যাচ্ছি-- গাড়ি বার করতে বলছি।
-- যাক, গাড়িটা ফেরত পেয়েছ তা হলে?
-- ও না, গাড়ি তো এখানে নেই। তাহলে তুমিই বরং এসো, আমি ততক্ষণ তৈরি হয়ে নিচ্ছি।
-- তোমার কী হয়েছে বলো তো?
জবাব না দিয়ে টেলিফোনটা নামিয়ে রাখেন। নন্দ এসে দাঁড়িয়েছিল পাশে। তাকে বলেন একগ্লাস ঠান্ডা জল দিতে। ফ্রিজিডেয়ার খুলে জলের বোতল আর গ্লাসটা বার করে আনে নন্দ। ঢকঢক করে একগ্রাস ঠান্ডা জল খেয়ে নিলেন প্রথমেই।
তৈরি হয়ে নিতে অবশ্য সময় লাগল না। যন্ত্রের মতো কাজ করে গেলেন উনি। চাবি টিপে দেবার পর মেটিরিয়ালগুলো যেমন ‘কাটার’ থেকে ‘ক্রাশার’ যন্ত্রে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে--আর অনায়াস গতিভঙ্গে শেষ পর্যন্ত সুদৃশ্য মোড়কে বার হয়ে আসে ফিনিশড প্রডাক্ট হিসাবে -- কারখানার অন্যতম ডাইরেকটরও তেমনি মিনিট পনেরোর মধ্যে দাড়ি কামিয়ে, স্নানাদি সেরে সুদৃশ্য মোড়কে আপাদমস্তক মুড়ে এসে বসলেন ড্রয়িং রুমের শো-কেসে। বাথরুমেই নন্দ ইতিমধ্যে রেখে এসেছিল মীটিঙে যাবার পোশাক -- খদ্দরের পাঞ্জাবি, খদ্দরের ধুতি আর বিদ্যাসাগরী চটি। কী জানি কেন সাদা খদ্দরের টুপিটি আর আজকাল ব্যবহার করেন না উনি।
সারাদিনের মতো তৈরি হয়ে এসে বসলেন বাইরের ঘরে। নন্দ ফ্যানটা খুলে দিয়ে যায়। টেবিলের উপর নামিরে রাখে হ্যান্ডলুমের শান্তিনিকেতনী কাজ করা হ্যান্ডব্যাগটা। ওর গর্ভে আছে তাঁর ডায়েরি, কর্ম, চেকবই, লেটারহেড-প্যাড, নোটবই আর আছে তাম্রপাত্রের আধারে গোটা চারেক বর্মা চুরুট, একটা তোয়ালে, সাবান আর কিউটিকুরা পাউডার এক কৌটো। ঘামাচিতে বড্ড ভোগেন উনি।
অল্প পরেই ননীমাধবের হিন্দুস্থানখানা এসে দাঁড়াল পোর্টিকোর নীচে। ননীমাধব এসে প্রবেশ করেন। এসেই তাড়াহুড়া শুরু করেন-- অনেক দেরি হয়ে গেছে, বুঝেছ, ভয়ানক লেট করে ফেলেছ তুমি...আরে গাড়িটা যে এখনও ফেরত পাওনি তা আমাকে বলনি কেন?-- তারপর হঠাৎ চোখ দুটো ছোট করে কণ্ঠস্বর নীচু করে রসিকতার ভঙ্গিতে বলেন-- ওটার আশা ত্যাগ করো ভাই, বুঝলে, দেশের সেবায় তো অনেক কিছুই দান করেছ তুমি-- মনে করো ওটাও গেছে ওই খাতে। আর একখানা গাড়ি কেনো তুমি।
পরমানন্দের গাড়িটা আজ মাসাবধিকাল আছে তারিণীবাবুর হেপাজতে। তারিণীবাবু এ জেলার প্রায় সকলেরই তারিণীদা। বৃদ্ধ মানুষ-- আজীবন কুমার; জেলার নামকরা জননেতা। বহুবার জেল খেটেছেন -- বহু নির্যাতন সহ্য করেছেন জীবনে। চেষ্টা নয়-শুধুমাত্র ইচ্ছা করলেই একটা দামী গাড়ির শুধু দাম নয়, বনেটের সামনে পতাকাওয়ালা গাড়িই হয়তো তিনি জোগাড় করতে পারতেন সরকার থেকে-- কিন্তু তা তিনি করেননি। এই নিরলস অক্লান্ত দেশকর্মীটি আজও আঁকড়ে আছেন রাজনীতিকেই ৷ ইতিহাসে চিরকাল একশ্রেণির ক্ষণজন্মা পুরুষ থাকেন যাঁরা রাজ্যচালনা করেন না কিন্তু রাজাদের চালান-- তাদের বলে ‘কিং-মেকার’। তারিণীদা এ জেলার সেই শ্রেণির শীর্ষস্থানীয় জননায়ক। জনসেবার কাজে তাঁকে জেলার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে উদয়াস্ত ছোটাছুটি করে বেড়াতে হয়। আসন নির্বাচনের ব্যাপারে ছোটাছুটিটা বেড়ে গেছে তাঁর। পরমানন্দ একই রাজনৈতিক দলভুক্ত। তাই নিজের গাড়িটা দিয়ে রেখেছেন তাঁর তারিণীদাকে। প্রতিদানে,-- না প্রতিদানে কিছুই চাননি তিনি।
পরমানন্দ ধীরে ধীরে বলেন-- নীলা কাল রাত্রে চলে গেছে।
ব্যস্তবাগীশ ননীমাধব বলেন-- ও। তা আর দেরি করছ কেন? ওঠো, চলো যাই।
পরমানন্দ আবার উচ্চারণ করেন কথাগুলি-- আমার কথাটা তুমি কানে তোলনি ননীমাধব। নীলা কাল রাত্রে আমাকে ত্যাগ করে চলে গেছে।
এবার অর্থগ্রহণ হয় ননীমাধবের। বসে পড়েন একটা সোফায় : ত্যাগ করে চলে গেছে? মানে?
-- মানে, আমাদের বাপ-দাদাদের আমলে আমরা অন্যায় করলে ত্যাজ্যপুত্র হতাম; এখন যুগ পালটে গেছে। এখন বাপ অন্যায় করছে মনে করলে ছেলেমেয়েরা তাদের ত্যাজ্যপিতা করে।
ননীমাধব কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন; তারপর বলেন-- এ রকমটা যে একদিন ঘটবেই তা আমি জানতাম। তোমাকে কতবার সাবধান করেছি আমি—অত আশকারা দিও না। তুমি কান দাওনি।...যাই হোক, ও জন্যে ভাবনা কোরো না। রাগ পড়লেই ফিরে আসবে। যাবে আর কোথায়?
-- না, তাহলে তো তুমি খবর পেতেই। কোনো বান্ধবীর বাড়ি গিয়ে উঠেছে বোধহয়।
-- না! আমার মনে হয় সে গিয়ে উঠেছে পি নাইন ব্যারাকে।
চমকে ওঠেন ননীমাধব-- না, না, এতটা নীচে নামতে পারে না কখনও নীলা।
-- তুমি ‘উদয়ের পথে’ সিনেমাটা দেখেছিলে?
-- না। কেন?
-- ওরা একে নীচে নামা বলে না-- বলে, ওপরে ওঠা।
-- না, না, কী আবোল-তাবোল বকছ যা তা। চক্ষুলজ্জা বলেও তো একটা জিনিস আছে! এ বাড়ির মেয়ে কখনও আমাদের কুলিব্যারাকে গিয়ে উঠতে পারে? যাক, এ নিয়ে অবহেলা করাটা ঠিক নয়। মীটিঙ সেরেই সোজা চলে যাব জীবনবাবুর ওখানে। সেখান থেকে তারিণীদার বাসায় কাজ সেরেই দুপুরে একটু ফুরসত পাব। তখন খোঁজ করা যাবে। বাড়াবাড়ি হবার আগেই মিটিয়ে ফেলতে হবে ব্যাপারটা। ওঠো এখন। আটটা পঁচিশ হয়ে গেছে।
ননীমাধবের সঙ্গে পরমানন্দও এসে ওঠেন গাড়িতে।
হিন্দুস্থানখানা চলতে থাকে কর্দমাক্ত পথে-- পদাতিকদের গায়ে কাদা ছিটিয়ে।
আবার চিন্তার মধ্যে অবগাহন করতে থাকেন পরমানন্দ। ফেলে আসা দিনগুলোর কথাই ভাবছিলেন তিনি। কোথায় যেন চিস্তাসূত্র ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল? ঠিক মনে আসছে না। জীবনে এক-একটা মুহূর্ত আসে বড় অতর্কিতে। এগুলি মাহেন্দ্রক্ষণ। যেমন করে বাঁক নিচ্ছে গাড়িটা জীবনপথও এমনি হঠাৎ বাঁক নেয় এমন লগ্নে। সে রকম দুর্লভ মুহূর্ত বহুবার এসেছে তাঁর জীবনে। এই তো মাস-কয়েক আগে এসেছিল একটা চরম মুহূর্ত এই পথেই। সেদিনও এমনি জোরে ছুটছিল গাড়ি। তিনি ছিলেন ড্রাইভারের পাশের সীটে, পিছনের সীটে বসেছিল নীলা। হঠাৎ ফ্যাকটরির গেটের কাছে তাঁর মোটরের গতিপথের মাঝখানে এসে দাঁড়াল একটা লোক। ড্রাইভার অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতিতে ব্রেক না করলে হয়তো চাপাই পড়ত লোকটা। নীল পায়জামা পরা একজন কারখানার মজুর, একমুখ খোঁচা খোঁচা দাড়ি, হাফশার্টের গায়ে মবিলের মানচিত্র। রুক্ষ অবিন্যস্ত চুলগুলো টড়ছে হাওয়ায়। গাড়িটা দাঁড়িয়ে পড়তেই গেট থেকে ছুটে এসেছিল গুর্খা দারোয়ান-- ধরেছিল লোকটাকে। পরমানন্দও মুখ বার করে ধমক দিতে যান-- দেখতে পাও না! চাপা পড়ে মরতে যে!
-- এছাড়া তো আপনার সঙ্গে দেখবার উপায় ছিল না।
-- তোমার কী হয়েছে বলো তো?
লোকটাকে চিনতে পেরেছিলেন পরমানন্দ? মুহূর্তে মাথাটা টেনে নিয়ে ড্রাইভারকে বলেন-- চালাও!
গাড়ি কিন্তু চালানো যায়নি। ইতিমধ্যে অনেকগুলি লোক ঘিরে দাঁড়িয়েছে গাড়িটাকে। সকলেই কারখানার মেহনতী মানুষ। যাদের ভালো করবার শুভ উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি গ্রহণ করেছেন কোম্পানির পরিচালন-দায়িত্ব। হাফপ্যান্ট আর লুব্রিক্যান্ট-লাঞ্ছিত হাফশার্টের মিছিল।
লোকটা কাছে এগিয়ে এসে বলে-- আপনাকে এভাবে আটকাতে হল বলে দুঃখিত। আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা ছিল-- কারখানায় আমাকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। আপনার বাড়ির দরজা থেকে তিন দিন ফিরে এসেছি। কাজেই পথের মাঝখানে আপনাকে এভাবে বিরক্ত করছি।
-- এখন আমার সময় নেই। পরে দেখা কোরো। ড্রাইভার!
-- কবে, কখন, কোথায় বলে যান।
লোকটাকে এড়াবার জন্য উশখুশ করছিলেন পরমানন্দ। কী বলবেন ঠিক করে উঠতে পারেন না।
পিছনের সীট থেকে নীলা বলে ওঠে-- ও কে বাবা?
পরমানন্দ সে কথার জবাব না দিয়ে লোকটাকেই বলেন-- কাল সকাল দশটায় অফিসে দেখা কোরো।
ওরা তৎক্ষণাৎ পথ ছেড়ে দেয়। গাড়ি চলতে শুরু করে।
নীলা কিন্তু একই প্রশ্ন করে আবার-- লোকটা কে বাবা?
-- কী জানি! কারখানারই কোনো মজুর হবে বোধহয়।
নীলা চুপ করে যায়। স্বস্তির নিশ্বাস পড়ে একটা পরমান্দের।
তিনি কিন্তু ভুল করেছিলেন।
নীলা চিনতে পেরেছিল ওই লোকটাকে। কাল রাত্রে সে কথা জানতে পারেন পরমানন্দ। মনে পড়ে যায় গতকাল রাত্রে নীলার সঙ্গে উষ্ণ বাক্যবিনিময়--
-- মিথ্যা কথা আমি বলি না নীলা।
-- আগে বলতে না! কিন্তু..কিছু মনে কোরো না বাবা, কয়েক মাস আগে কারখানার গেটে যে লোকটি আমাদের গাড়ি আটক করে তাকে কি তুমি সত্যিই চিনতে পারনি সেদিন?
গাড়ি এসে দাঁড়ায় কারখানার গেটে। গেট খুলে দেয় গুর্খা দরোয়ান। লোহার মোটা মোটা গরাদ দেওয়া বিরাটকায় গেট যেন লৌহকারার প্রবেশপথ—গায়ে তার কাঁটাতারের নামাবলী। মুখব্যাদান করে অনায়াসে গিলে ফেলে কালো রঙের হিন্দুস্থানটাকে। মুখ বদ্ধ করে আবার। সশস্ত্র প্রহরা বসেছে গেটের পাশে। লক-আউট চলছে কারখানায়।
ওঁদের গাড়িটা আ্যাসফ্যাল্টের সড়ক বেয়ে এসে দাঁড়ায় গাড়ি-বারান্দার নীচে। বোর্ড-অফ-ডাইরেকটর্সদের জরুরি মীটিং। কলকাতা থেকে এসেছেন অন্যান্য ডাইরেকটররা। অধিকাংশই উত্তর-ভারতের লোক। ওঁদের মধ্যে একমাত্র বাঙালি কর্ণধার পরমানন্দ। ননীমাধব বর্তমানে ম্যানেজারের পদে উন্নীত হয়েছেন। বার্টন অ্যান্ড হ্যারিস কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা শ্বেতাঙ্গ অধিপতিরা এখন ইতিহাসের মহানেপথ্যে সরে গিয়েছেন। ভারতীয় ধনপতিরা এসে অধিকার করেছেন ওঁদের শুন্য আসন। রাস্তা আর পার্কের নাম বদল করলেও ইংরাজ কোম্পানির নাম সচরাচর বদলাতে ইচ্ছুক হন না ভারতীয় ব্যবসাদারেরা। হাজার হোক, বিলাতী নামটারও একটা মোহ আছে! অনেক কিছু বদলে গেছে কোম্পানির। অনেক পুরনো লোক বাতিল হয়ে গেছে-- এসেছে নতুন লোক। শিথিলতর হয়েছে শাসনব্যবস্থা, কারখানার প্রস্তুত জিনিসেরও হয়েছে অবনতি-- যদিচ সেটা স্বীকার করেন না ওঁরা! সে আমলের যে কয়জন মুষ্টিমেয় লোক আছেন ননীমাধব তাদের মধ্যে একজন। বেতনভূক পর্যায়ে বস্তুত সর্বোচ্চপদে অধিষ্ঠিত। দীপকও ঢুকেছে এ কারখানায়-- সেও একজন ছোটসাহেব। এঁদের সঙ্গে পরমানন্দের যথেষ্ট হৃদ্যতা, ঘনিষ্ঠতা। বন্তত ননীমাধবের সঙ্গে পরমানন্দ একটা কুটুম্বিতার সম্পর্কও স্থাপন করতে পারেন-- কারখানায় এমন গুজবও রটেছে। এ ক্ষেত্রে পরমানন্দকেও সহজে কেউ ঘাঁটাতে সাহস পান না। না হলে নিজ অংশের শেয়ারগুলি বিক্রি করে দিয়ে বহু পূর্বেই সরে আসতে হত চৌধুরী ডাক্তারকে।
পরমানন্দের সঙ্গে কোম্পানি আজ অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ। এর সূত্রপাত হয়েছিল যেদিন বার্টন অ্যান্ড হ্যারিস কোম্পানির ছোট তরফের ওয়ালটন হ্যারিস সাহেব মনস্থির করেন বাকি জীবনটা তাঁর ডিভনশায়ারের বাড়িতেই কাটাবেন। ওয়ালটন অত্যন্ত কৃতজ্ঞ ছিলেন ডাক্তার চৌধুরীর কাছে। বস্তুত চৌধুরী ছিলেন তাঁর জীবনদাতা। প্রতিদানে ওয়ালটন সাহেব স্বদেশযাত্রার প্রাক্কালে প্রায় নামমাত্র মূল্যে দিয়ে গিয়েছিলেন শেয়ারের একটা গোছা। ওয়ালটনের স্ত্রী ছিলেন মিস গ্রেহামের বান্ধবী। ফলে চিকিৎসার জন্য কোনো ফী গ্রহণ করেননি চৌধুরী। নিতে হল তাই শেয়ারের বান্ডিলটা। সৌভাগ্যের নবতম সূচনার এই হল আদি ইতিহাস। প্রতিষ্ঠাবান ডাক্তার হিসাবে পরিচিত ছিলেন তিনি-- এর পর তাঁর পরিচয় ছড়িয়ে পড়ল ক্রমশ জেলার বাইরেও-- বড় ডাক্তার বলে নয়-- বড় ব্যবসায়ী বলে।
যে প্রতিষ্ঠানটিকে একদিন তিলতিল করে গড়ে তুলেছিলেন রক্তের বিনিময়ে সেই হাসপাতাল, সেই সেবায়তন, তাঁর ঘরবাড়ি, যন্ত্রপাতি সবকিছু তিনি বিক্রি করে দিলেন কোম্পানিকে। নগদ টাকা অবশ্য পেলেন না-- হাতে এল আর এক গোছা শেয়ার। এটা প্রয়োজন ছিল-- না হলে ডিরেকটর হতে পারছিলেন না তিনি। নীলা আপত্তি করেছিল-- বোকা মেয়েটা ভেবেছিল বুঝি কোম্পানির ম্যানেজিং এজেপসিই লক্ষ্য তার-- বুঝি অর্থোপার্জনের মোহে তিনি হাসপাতাল বিক্রি করে বেশি লাভজনক কারবারে বিনিয়োগ করতে চাইছেন তাঁর সম্পত্তি। সে বোঝেনি এর পিছনেও আসল উদ্দেশ্য ছিল দেশসেবা। তিনি ছেড়ে দিলেন বলে তো আর হাসপাতাল উঠে গেল না; কিন্তু তিনি হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করলেন বলেই এতগুলি মেহনতী মানুষের ভালো করবার ক্ষমতা পেলেন তিনি।
ননীমাধব আর পরমানন্দ যখন এসে পৌছলেন তখন অন্যান্য সকলেই উপস্থিত হয়েছেন। সৌজন্য বিনিময় হল-- কিস্তু আন্তরিক আবেগ নেই সে কুশলপ্রশ্নের আদানপ্রদানে। সকলেরই মুখ গম্ভীর। শ্রমিকেরা ধর্মঘট ঘোষণা করেছে; লক-আউট চলেছে কারখানায়!
চতুষ্কোণ টেবিলটার চারদিকে ওরা ঘিরে বসেছেন। রুদ্ধদ্বার কক্ষে ধর্মঘটী শ্রমিকদের দাবিগুলি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেল। এ কারখানার ইতিহাসে এজাতীয় ঘটনা অভূতপূর্ব। মফস্বলের এ অঞ্চলে এতদিন এ-সব হাঙ্গামা ছিল না-- তা ছাড়া ননীমাধবের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল এ বিষয়ে। বিদ্রোহের কোনও শিশুতরু মাথা তুলছে দেখলেই যথোচিত ব্যবস্থা করতেন তিনি। যৌবনে একমাথা ঘন কালো চুল ছিল ননীমাধবের। তা নিয়ে রীতিমত গর্ব ছিল ওঁর। প্রৌঢ়ত্বের প্রারম্ভেই কানের পাশে দু-এক গোছা করে পাকতে শুরু করল। রায়মশাই তৎক্ষণাৎ সচেতন হয়েছিলেন। পাড়ার বাচ্চাদের সঙ্গে নাতি-নাতিনী সুবাদ বাধিয়ে লাগিয়ে দিলেন বালখিল্য বাহিনীকে। কাঁচা চুলের অরণ্য থেকে বেছে বেছে তামাটে রঙের চুলগুলোকে একটি একটি করে সমূলে উৎপাটিত করত ওরা। বিনিময়ে ঘুষ জোগাতে হত ননীমাধবকে-- কখনও লজেন্স, কখনও তাম্রখন্ড, কখনও বা সিনেমা দেখানোর প্রতিশ্রুতি।
কারখানাতেও একই পদ্ধতি চালিয়ে এসেছেন তিনি। নিকষ কালো সরল মানুষগুলোর মধ্যে এক-আধটা লোকের গায়ে যদি দেখা যেত তামাটে অথবা লালচে রঙের আমেজ অমনি সোন্না দিয়ে চেপে ধরতেন তাকে। সমূলে উৎপাটিত করতেন লালের আমেজ-মাখানো মানুষটিকে। এ জন্যও নতুন ধরনের লজেন্স জোগান দিতে হত এক শ্রেণির লোককে।
কিন্তু ননীমাধবের এত সতর্ক দৃষ্টির মধ্যেই গোপনে এসে শিকড় গাড়ল কোনো অলক্ষ্য ফাটলে এক শিশু-মহীরুহ। অনতিবিলম্বেই নজর পড়ল ম্যানেজারবাবুর-- তামাটে নয়, লোকটির রঙ রক্তের মতো লাল! বিষবৃক্ষকে সমূলে তুলে ফেরার ব্যবস্থা হল। হয়তো কঠিন হত এই অবাঞ্ছিত শ্রমিকনেতাকে ছাঁটাই করা, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে লোকটা ছিল চোর। ওর সেকশনে কতকগুলো যন্ত্রের পার্টস চুরি গেল আর হাতেনাতে ধরাও পড়ে গেল লোকটি। রেজিস্টার থেকে নাম কাটা গেল-- নোটিশ দেওয়া হল কুলি-ব্যারাকের ঘর ছেড়ে দেওয়ার। ননীমাধব আশা করেছিলেন-- ওই লোকটাকে কারখানার এলাকা থেকে একেবারে তাড়িয়ে দিতে পারলে মজদুর-মহলের ধূমায়িত অশান্তির বহ্নিশিখা স্তিমিত হয়ে আসবে। ভুল ভেবেছিলেন উনি। ওকে চুরির অভিযোগে বরখাস্ত করার পর উলটো প্রতিক্রিয়া দেখা দিল শ্রমিক মহলে। এত অল্প দিনের মধ্যেই লোকটা যে কুলি বস্তিতে এতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল তা আন্দাজ করতে পারেননি ওরা। লোকগুলো যেন খেপে গেল মুহুর্তে! রাতারাতি মীটিঙ করল ওরা, তৈরি করল একটি লম্বা ফিরিস্তি। তাদের প্রথম ও প্রধান দাবি হল বরখাস্ত মজুরটিকে কাজে পুনর্বহাল করা এবং অন্তর্বতী দাবি ইউনিয়নের স্বীকৃতি-- আর শেষ দাবি যে কোথায় গিয়ে থামবে তা আজ ওঁদের আন্দাজেরও বাইরে। অল্পেই ঘোলাটে হরে উঠল ব্যাপারটা। দোষ দুপক্ষেরই আছে। এঁরা ধর্মঘটের আশঙ্কা করে কয়েকজনকে সামান্য অজুহাতে সাসপেণ্ড করলেন-- ওরাও বিনা-নোটিশে অনুপস্থিত হল কাজে! ফলে অচিরেই ঘোলাটে হয়ে উঠল পরিস্থিতি। বর্তমানে এসে ঠেকেছে এ পক্ষের ধর্মঘটে আর ও পক্ষের লক-আউট ঘোষণায়। পরবতী কর্মপন্থা নির্ধারণ করবার শুভ উদ্দেশ্য নিয়ে আজ ওরা মিলিত হয়েছেন এই জরুরি মীটিঙে।
পরমানন্দ কিন্তু কিছুতেই মন দিতে পারছিলেন না। আজ যেন কী হয়েছে তার। শুধু রোমন্থন করে চলেছেন অতীত ইতিহাস। গত রাত্রে নীলার সঙ্গে যে কঠিন বাক্যবিনিময় হয়েছে-- বস্তুত বাদানুবাদ হয়েছে-- তার কথাই মনে পড়ছে বারবার। কোন আকাশস্পর্শী স্পর্ধায় সেই একফোঁটা মেয়েটা তাঁর মুখের উপর বলে গেল-- তিনি আদর্শচ্যুত। তিনি ব্রাত্য।
আদর্শ! ওই ছোট্ট কথাটির জন্য নির্যাতন তো তিনি কম ভোগ করেননি। আর শুধু তিনি কি একা? চৌধুরী পরিবারের প্রত্যেকটি মানুষ! যুগে যুগে আদর্শগত পার্থক্যে একই গৃহের অভ্যন্তরে রচিত হয়েছে ভিন্নমতাবলম্বী শিবির। পিতার সঙ্গে পুত্রের, পুত্রের সঙ্গে কন্যার, পুত্রকন্যার সঙ্গে তাদের মাতামহীর নীতিগত পার্থক্যের জন্য সংঘাত বেধেছে। কিপ্ত কই, কেউ তো কখনও এমন নির্লজ্জভাবে অপরকে আক্রমণ করেননি! একে অপরকে শ্রদ্ধা করেছেন। আদর্শগত বিরোধের চরমতম আঘাত সহ্য করেছে অসীম, করেছেন তিনি-- তবু অপরের প্রতি শ্রদ্ধা ছিল তাদের দুজনেরই। রাজনীতির উর্ধ্বে মানুষে-মানুষে যে আস্তিক বন্ধন তা অবিকৃতই ছিল। আজ তা হলে সেই পারিবারিক ইমারতের ভিত্তিমূলে এমনভাবে ফাটল আত্মপ্রকাশ করছে কেন? রাজনৈতিক মতের পার্থক্যে একজন কেন অপরজনের সান্নিধ্যে পর্যস্ত অসহ্য বোধ করছে?
বোর্ড অফ ডাইরেকটর্সের মীটিঙে ওদিকে আলোচনা চলেছে ঘোরালো হয়ে। একপক্ষ চাইছেন ধর্মঘটের প্রথমাবস্থাতেই ওদের ডেকে এনে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলতে-- অপরপক্ষ চাইছেন কঠোর হস্তে ওদের দমন করতে-- যাতে কোনোদিন আর মাথা তুলতে না পারে। পরমানন্দের কিন্তু এ-সব কথায় কান নেই। তিনি ডুবে আছেন অতীত জীবনের ফেলে-আসা দিনগুলিতেই।
ওঁর মনে পর্দার উপর তখন ধীরে ধারে ফুটে উঠছে একটি শারদ প্রভাত। যে রাজনীতিকে সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে চলতে চেয়েছিলেন বিদেশ থেকে ফিরে আসবার পর সেই সর্বনেশে রাজনীতিই চুপি চুপি এসে আশ্রয় নিয়েছিল সেই শরৎরাত্রির শেষপ্রহরে। বিদেশী ডিগ্রী নিয়ে ফিরে আসবার আগেই ওর বাবা-মা গত হয়েছেন। বিদেশী মেয়েকে বিবাহ করায় আত্মীয়স্বজনও সম্পর্ক রাখেননি তাঁর সঙ্গে। ভালোই হয়েছিল একপক্ষে। কৈশোরের এবং প্রথম যৌবনের ইতিবৃত্ত লোকচক্ষুর অন্তরালে ঢাকা পড়েছিল। কিন্তু এত করেও শেষরক্ষা হল না। পরমানন্দের জীবন গতি পরিবর্তন করল আবার।
সেদিনও উঠেছিল প্রচণ্ড কালবৈশাখী ঝড়। বিশাল বনস্পতিকে ধরে যেমন করে ঝাঁকানি দেয় হঠাৎ-আসা কালবৈশাখী তেমনি করেই নাড়া দিয়েছিল তাঁকে, কিন্তু না, সেদিন তিনি পরাজিত হননি। সমূলে উৎপাটিত করতে পারেনি মহীরুহকে। নিষ্ঠুর বাতাসের তাড়নে নিঃশেষিত হয়েছিল অরণ্য অধিপতির সবুজ পাতার সম্ভার -- ছিন্ন হয়েছিল কচি কিশলয়; কিন্তু রিক্তপত্র শাখার আন্দোলনে বিদ্রোহী বনস্পতি প্রতিবাদ জানিয়েছিল তবুও। তারপর নামল বজ্র। লুটিয়ে তিনি পড়েননি-- কিন্তু দাউদাউ করে জ্বলে ছাই হয়ে গিয়েছিল উদ্ধতশির পাদপ।
বিস্মৃতির কুয়াশা কেটে গিয়ে সেই ঘটনাগুলিই মনে পড়ছে আজকে। অক্টোবর মাস। বেয়াল্লিশ সালেরই কথা। নীলাকে যেদিন খদ্দরে মন্ডিত অবস্থায় প্রাতরাশের টেবিলে প্রথম দেখা গিয়েছিল তারই মাসখানেক পরের কথা। সন্ধ্যা থেকে অকাল-বর্ষণ চলেছে। সারা রাতই মেঘলা করে রয়েছে-- টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে মাঝে মাঝে। সমস্ত রাত্রি ভালো ঘুম হয়নি। আগের দিন অসীমের আচরণে বিরক্ত বোধ করেছেন তিনি। অসীম বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। বাড়ির শাসনশৃঙ্খলাকে সে মেনে চলছে না। কাল থেকে ছেলেটা বাড়ি ফেরেনি। কে জানে কোথায় রাত কাটাচ্ছে হতভাগা ছেলে। ইটালিয়ান কম্বলটার উত্তপও সহ্য হচ্ছিল না। বিনিদ্র রজনীর গ্লানিতে ভারাক্রান্ত মনে অবসন্ন দেহটা নিয়ে অতি প্রত্যুষেই তিনি শয্যাত্যাগ করেছিলেন। পুবের বারান্দায় ইজিচেয়ারটায় এসে বসেন। ধরান একটা সিগার। হঠাৎ মনে হল ন গাছটার তলায় নীলা কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। চমকে ওঠেন উনি। তখনও ভালো করে ফরসা হয়নি পুব আকাশটা। অন্ধকারের বুকের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে নূতন দিন-- তাঁর রাঙা লিপির আমন্ত্রণ ছড়িয়ে পড়েছে আকাশে-বাতাসে। সেই রাঙা রেখার আলিম্পন আঁকা হয়েছে যেন তার কিশোরী কন্যাটির মুখেও। সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটি অপরিচিত তরুণ যুবক। সর্বাঙ্গ কালো একটা কম্বলে ঢাকা। বছর বাইশ বয়স হবে। নীলার হাতে একটা ফুলের সাজি। রোজই এ সময়ে ফুল তুলতে ওঠে ও। মিস গ্রেহাম আর মিসেস আ্যানী চৌধুরীর প্রভাবটা তার উপর কার্যকরী হরনি। স্কুলের দিদিমণিদের কাছ থেকেই সে অনুপ্রেরণা পেয়েছে বেশি। ঠাকুর-দেবতা-বার-ব্রতে তার অগাধচ বিশ্বাস। সাধনার পথে সে খিচুড়িমার্গী। তেত্রিশ কোটি দেবতাতেও তার তৃপ্তি হয়নি -- দিদিমার কাছ থেকে আরও অনেকগুলি দেবদেবীর হদিস পেয়েছে সে -- মেরীমাতা, জিসাস্, সেন্ট জন, মায় মোসেস, জ্যাকব, সলোমন পর্যন্ত! ফলে চাল-তোলা মঙ্গলবারে ডিনার টেবিলে তাকে ডাকলে সে মনে মনে শিউরে পাপ স্থালনের জন্য বুকে আঁকে ক্রসচিহ্ন। এসব অভ্যাস তার কমে এসেছে -- বড় হওয়ার পর। এই অক্টোবরের ভোরবেলাতেই তার স্নান সারা হয়েছে। পিঠের উপর ছড়িয়ে দিয়েছে ভিজে চুল। পুজার ফুল তুলছে আ্যারিত্যাডনি-তনয়া নীলা। হাসি আসে চৌধুরীর।
শুধু সন্তান নয়-- কারো ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা পরমানন্দের প্রকৃতিবিরুদ্ধ। অপরের আচরণ সম্বন্ধে অহেতুক কৌতুহল ছিল না তাঁর। সেদিন কিন্তু তিনি আত্মসংবরণ করতে পারেননি। নীলা কি বিপ্লবী দলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রাখছে? না হলে এই বাঘের বিবরে কোন সাহসে মাথা গলায় ওই ছোকরা অকুতোভয়ে? এ দুর্জয় সাহস কী করে সংগ্রহ করল লোকটা? চকিতে মনে হয় পরমানন্দের-- ওই লোকটার আগমনের দুটি কারণ থাকতে পারে। হয় ওই ছেলেটি বিপ্লবী দলভুক্ত-- এসেছে নীলার কাছে তার প্রশ্রয় পেয়েই। অথবা ওদের সাক্ষাৎকারের পিছনে আছে কোনো বিদেহী দেবতার ইঙ্গিত। যৌবনের অন্য এক আকর্ষণের উন্মাদনায় ও এসে দাঁড়িয়েছে নীলার অত কাছে। এ ছাড়া তার ওই গোপন আবির্ভাবের আর কোনো কারণ থাকতে পারে না। উৎকর্ণ হয়ে ওদের কথোপকথনে মনোনিবেশ করেন তিনি।
নীলা বলছিল : এ সময়ে বাবা রোগী দেখেন না। আপনি এভাবে এসেছেন কেন?
না! ছেলেটিকে নীলা তাহলে চেনে না। কোনো অতনু দেবতার অনুপ্রেরণাতেও ওরা এখানে মিলিত হয়নি। তবে বেন এসেছে ও?
নীলা তখন বলছিল : আটটার পর তাঁর চেম্বারে আসবেন। ওই ঘরটায়। -- হাত বাড়িয়ে সে বাইরের দিকের নার্সিং হোমটা দেখিয়ে দেয়।
-- আটটা? আটটা পর্যন্ত বাঁচব তো? দেখুন, আপনি একবার দয়া করে ওঁকে গিয়ে বলুন যে বিশেষ কারণে তাঁর চেম্বারে আসা সম্ভব হবে না আমার পক্ষে।উপায় থাকলে আটটা পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করতাম, কিন্তু—
বাধা দিয়ে নীলা বলেছিল-- সারারাত বাবার ঘুম হয়নি। তাঁকে এ সময়ে আমি জ্বালাতন করতে পারব না।
-- জ্বালাতন! না, বিরক্ত তিনি কখনও হবেন না। আপনি বিশ্বাস করুন। বহুদূর থেকে আসছি আমি তাঁর সন্ধানে। আপনি আপনার বাবাকে যতটা চেনেন তার চেয়ে অনেক বেশি আমি চিনি তাঁকে। আপনি একবার দয়া করে তাঁকে খবর দিন।
কে ওই ছেলেটা? পরমানন্দ পিছনের স্পাইরাল সিঁড়ি বেয়ে নিঃশব্দে বাগানে নেমে আসেন।
নীলা বিরক্ত হয়ে বলে : আপনার সঙ্গে তর্ক করার আমার সময় নেই।
ছেলেটি হেসেছিল। না, অস্ফুট আলোয় হাসিটা তিনি স্পষ্ট দেখতে পাননি। তবু অনুমান করতে পারেন বিচিত্র একটা হাসি হেসে ও বলেছিল : আশ্চর্য! পূণ্যের লোভে এই দুরন্ত শীতে স্নান সেরে পূজার ফুল তুলতে এসেছেন- ডাক্তার পরমানন্দের কন্যা আপনি-- অথচ অদৃষ্টের কি বিড়ম্বনা, একটা হতভাগা মুমূর্ষু মানুষের পূণ্যটাও আপনি অনায়াসে প্রত্যাখ্যান করছেন—
এরপর আর তিনি স্থির থাকতে পারেন নি। ছেলেটার সামনে এসে বলেছিলেন-- কী চাও?
চমকে উঠেছিল নীলা।
ছেলেটি আপাদমস্তক তাঁকে দেখতে থাকে। বলে : আপনিই?
-- হ্যাঁ, ডাক্তার পরমানন্দ চৌধুরী, যাকে তুমি আমার মেয়ের চেয়েও ভালো করে চেন। বলো, কী চাও তুমি।
চারদিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে ছেলেটি বলে-- ভিতরে চলুন, বলছি।
ওর পতনোন্মুখ দেহটা বাপে আর মেয়েতে ধরাধরি করে নিয়ে আসে ড্রইংরুমে। বসিয়ে দেয় একটা গদি-আঁটা সোফায়।
চৌধুরী বলেন : এবার বলো, কেন এসেছ তুমি আমার কাছে।
ছেলেটি ইতস্তত করে বলে : আপনাকে নিভৃতে বলতে চাই।
-- এখানে নিভৃতই আছ তুমি -- বলো।
ও চুপ করেই থাকে। হঠাৎ উঠে পড়ে নীলা। ত্বরিতবেগে চলে যায় ঘর ছেড়ে। ছেলেটি ওর গমনপথের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে কয়েকটা মুহূর্ত। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে তার। তারপর হঠাৎ আত্মসচেতন হয়ে ফিরে তাকায় ডাক্তার চৌধুরীর দিকে। আস্তে আস্তে কম্বলটা উঁচু করে বাঁধন খুলে দেখায় দক্ষিণ জানুর ক্ষতচিহ্নটা। ভ্রূকুঞ্চিত হয় চৌধুরী ডাক্তারের। ক্ষতচিহ্নটার জাত আন্দাজ করেন মুহূর্তমধ্যে। ছেলেটি কিন্তু কোনো ইতস্তত করে না আর। স্পষ্টই স্বীকার করে অকুতোভয়ে : গুলিটা আপনি বার করে দিন ডাক্তারবাবু। পালাতে হয়তো পারব না, তবু আত্মরক্ষার শেষ অস্ত্রটাও যখন হাতছাড়া হয়ে গেল তখন একজোড়া সুস্থ সবল পাও কি পাব না আমি? আপনার মতো সার্জেন দেশে থাকতে?
ওর দুর্জয় সাহস দেখে স্তপ্তিত হয়ে গিয়েছিলেন পরমানন্দ। বলেন : কী করে এমন হল?
এত যন্ত্রণার মধ্যে ছেলেটি হাসলে। বললে : আপনাকে বলব না যে গেম-বার্ডস্ শিকার করতে গিয়ে ভুল করে লেগেছে। অথবা ডাকাত ধরতে গিয়ে লেগেছে।
-- তোমার নাম কী? আসছ কোথা থেকে?
একটু চুপ করে থাকে। তারপর বলে-- এ প্রশ্নটা করা কি উচিত হচ্ছে আপনার?
-- নিশ্চয়! রোগীর নাম-ধাম না জেনে, কেস-হিসট্রি না জেনে তো রোগীর দায়িত্ব নিতে পারি না আমি।
এক মিনিট দুজনেই নীরব। তারপর ছেলেটি আবার বলে -- আমি জানি আপনার বিপদের কথা। আপনার দায়িত্বের কথা। অপারেশন হয়ে গেলে একটা রাতও থাকব না আমি এখানে। আমার বন্ধুরা অপেক্ষা করছে শহরের প্রান্তে। সেখান থেকে আমি একা এসেছি। ওরা আমার জন্য দু দিন অপেক্ষা করবে—তার ভিতর ফিরে না গেলে ওরা ধরে নেবে যে আমি হয় ধরা পড়েছি নয় মারা গেছি। আপনি একটা দিন শুধু আমাকে আশ্রয় দিন। গুলিটা বার করে দিলেই আমি ফিরে যাব ওদের কাছে -- এ জন্মে কেউ কোনোদিন জানতেও পারবে না, কে বার করে দিল বুলেটটা।
ড্রইংরুমে বড় ওয়ালক্লকের পেন্ডুলামটার একাধিপত্য পরবর্তী নীরব মুহূর্তের নৈঃশব্দের উপর। পরমানন্দ তারপর বলেছিলেন-- তা আমি পারি না। আমি তোমার মতো দায়িত্বজ্ঞানহীন যুবক নই। আমার সন্তান আছে, সংসার আছে। তোমাকে ধরিয়ে আমি দেব না। কিন্তু আশ্রয়ও দিতে পারব না। এই মুহুর্তে তুমি চলে যাও আমার বাড়ি থেকে।
ছেলেটি স্তম্ভিত হয়ে যায়। ওর মুখভঙ্গি থেকে বোঝা যায় এটা সে একেবারেই আশঙ্কা করেনি। বলেও সে কথা-- এটা যে হতে পারে তা ভাবিনি। ভেবেছিলাম কোনোক্রমে আপনার এখানে এসে পৌঁছতে পারলেই আমার মুক্তি।
কিন্তু এটাই তো আশঙ্কা করা উচিত ছিল তোমার। আমার পরিচয় তো শহরসুদ্ধ লোকের অজানা নেই। আমি বিলাত-ফেরত, বিলাতী কেতার মানুষ। মেম বিয়ে করেছি-- আগামী বারে রায়বাহাদুর হব আমি—শোননি? তোমার বরং ভাবা উচিত ছিল আমি তোমাকে ধরিয়ে দেব!
মাসকয়েক আগে ওই বয়সেরই আর একটি উদ্ধত যুবকের একটা বাঁকা ইঙ্গিতের জবাব দিলেন নাকি ডাক্তার চৌধুরী?
ছেলেটি শান্তস্বরে শুধু বলে-শহরসুদ্ধ লোক আপনার যে পরিচয় জানে-- আমি তার কিছু বেশি জানি। না হলে সেই মহিষাদল থেকে এতদূর আসতাম না আপনার খোঁজে।
কোন মহিষাদল? মেদিনীপুর মহিষাদল? -- তারপরই হঠাৎ ধমক দিয়ে ওঠেন-- না না, আর কোনো কথা নয়। তোমার পরিচয় দিয়ে আমার কী প্রয়োজন? তুমি চলে যাও!
-- যাব তো বটেই-- তাড়িয়ে দিলে যেতে তো হবেই; কিন্তু একটা কৌতুহল চরিতার্থ না করে তো যেতে পারছি না ডাক্তারবাবু। আসি ভুল ঠিকানায় আসিনি তো? যেখান থেকে আজ আমাকে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সেটাই কি ডাক্তার পরশুরাম চৌধুরীর বাড়ি?
পরমানন্দ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। এ নাম কী করে জানল ও লোকটা? দুরন্ত কৌতুহল হয় জানতে-- কোন সূত্রে ওই নামটা সংগ্রহ করেছে ছেলেটা। পরশুরাম যে তাঁরই একটা নাম -- এটা ভুলেই গিয়েছিলেন তিনি। শতাব্দীর একপাদকাল কেউ ও নামে ডাকেনি তাঁকে। যে-সব খাতাপত্র, চিঠি অথবা ডায়েরিতে ওই নামের উল্লেখ ছিল তা পুড়ে নিঃশেষ হয়ে গেছে বিশ-পঁচিশ বছর আগে। সে যুগে তাঁর ওই নামটা জানত মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোক। আর তাদের অধিকাংশই আবার জানত না তাঁর আসল নাম। কিন্তু নাঃ, এ কৌতুহল চরিতার্থ করতে গেলেই ঘনিষ্ঠ হতে হবে ছেলেটির সঙ্গে; হয়তো জড়িয়ে পড়বেন আবার। আর বাড়তে দেওয়া উচিত নয়; আত্মসংবরণ করেন তিনি, নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলেন : দ্বিতীয় আর একটি কথা উচ্চারণ করলে আমি থানায় খবর দিতে বাধ্য হব।
ওকে যেন সহ্য করতে পারছেন না আর। হয়তো সংযম ভেঙে পড়বে—হয়তো জড়িয়ে পড়বেন আবার। রিসিভার থেকে টেলিফোনটা তুলে নেন হাতে। ফোন করবার উদ্দেশ্যে নয়-- এও একটা হুমকি। পরমানন্দ কি ভয় পেয়েছেন? না কি শুধু উত্তেজিত হয়েছেন? হাতটা কাঁপছে কেন তাঁর?
ছেলেটি উঠে দাঁড়িয়েছিল। বসে পড়ে আবার সোফায়। বলে : করুন টেলিফোন! সত্যিই আর বাঁচবার ইচ্ছে নেই ডাক্তারবাবু। কী হবে এই পোড়া দেশের জন্য বেঁচে? এ দেশ আর পরশুরামের দেশ নয়। এ এখন রামরাজ্য-- দেশজননী সীতাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে রামচন্দ্র অযোধ্যায় পরমানন্দে রাজৈস্বর্য ভোগ করছেন-- পরশুরামের কুঠারটায় ধরছে মরচে।
-- তুমি যাবে কি না?
-- না।
যন্ত্রণায় কাতরোক্তি করে সোফায় এলিয়ে দেয় ক্লান্ত দেহটা। কম্বলটা জড়িয়ে নিয়ে গুটি মেরে শুয়েই পড়ে একেবারে।
ও কি অনুমান করেছে পরশুরামের অন্তরের দুর্বলতা?
-- তুমি বিশ্বাস করতে পারছ না যে তোমাকে ধরিয়ে দিতে পারি আমি?
চোখ বুঁজেই ও জবাব দেয় : কেন পারব না? এমন কী দুঃসাহসিক কাজ সেটা আপনার পক্ষে?
-- তবে চলে যাচ্ছ না কেন?
-- চলে যাবার ক্ষমতা নেই বলে --
বিচিত্র হাসি হাসে ছেলেটা। এবার সে হাসিটা স্পষ্ট দেখতে পান উনি। বলে : বাঁচতে তো এমনিতেই পারব না। এই হতভাগা ঠ্যাঙখানাকে কাঁধে করে এতটা পথ এসেছি-- আবার সে পথে ফিরে যাবার আর ক্ষমতা নেই। তাঁর চেয়ে আপনি টেলিফোন করুন ডাক্তারবাবু। তবু আপনার দেশসেবার একটা পুরস্কার দিয়ে যেতে পারব ধরা পড়ার আগে। হাজার হোক, আপনিও তো এ হতভাগা দেশের জন্যে কম করেননি একদিন। তবু বুঝব আমার ধরা পড়ায় পরশুরাম চৌধুরী একটা খেতাব পেলেন।
-- কে পরশুরাম চৌধুরী? আমি চিনি না তাকে--
-- একশবার! আপনি কী করে চিনবেন তাকে! আপনি বিলাতফেরত বিলাতী কেতার মানুষ-- আপনি তো তাকে চিনবেন না ! অথচ ওই পরশুরামই একদিন বলেছিলেন শচীশ নন্দীকে-- পাঠকদার স্বপ্ন আমরা ব্যর্থ হতে দেব না। বলেছিলেন তিনি আমেরিকা থেকে জার্মানিতে যাবেন। পালিয়ে সেখান থেকে সংগ্রহ করবেন বিপ্লবের সরঞ্জাম। পরশুরাম অবশ্য জার্মানি যাননি! তাঁর আগেই চট্টলার পাহাড়ে সে প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছিল। এতদিন জানতাম জ্যোতির্ময় পাঠক আর শচীশ নন্দীই বুঝি আত্মাহতি দিয়েছেন সে ব্যর্থ প্রচেষ্টায়; -- কিন্তু না। আজ দেখছি পরশুরাম চৌধুরীও ওই সঙ্গে স্বর্গগত হয়েছেন?
পরমানন্দ ওর কাঁধ দুটি ধরে প্রচণ্ড ঝাঁকানি দিয়ে বলেন—কে? কে তুমি? কী করে জানলে এ-সব কথা?
বাবার ডায়েরিটা পুলিশের হাতে পড়েনি। মায়ের কাছ থেকে সেটা আমি পেয়েছিলাম। তাই আমার বড় ভরসা ছিল ভাক্তারবাবু -- এ শুধু আপনিই পারবেন। সেজন্যেই যে মেদিনীপুর থেকে এত দূর ছুটে এসেছি।
-- তুমি..তুমি জ্যোতির্ময়দার ছেলে?
না! আমার বাবার নাম শচীশ নন্দী। উনিশ শো ত্রিশে চট্টগ্রামে মারা যান তিনি…
ডাক্তার চৌধুরী এ বিষয়ে কী বলেন?
নিজের নামটা কানে যাওয়ায় যেন ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে ওঠেন পরমানন্দ। হ্যাঁ, ডিরেকটর্স বোর্ডের মীটিঙে উপস্থিত আছেন তিনি। অত্যন্ত অপ্রস্তুত বোধ করেন। আলোচনাটা কীসের তা তিনি বিন্দুমাত্র জানেন না। একবর্ণও শোনেননি। হঠাৎ লক্ষ্য হয় ঘরসুদ্ধ সকলেই তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
পরমানন্দ গম্ভীরভাবে বলেন : আপনারা পাঁচজনে যা স্থির করবেন তাই মেনে নেব আমি।
-- আমরা তো একমত হয়েছি-- ভয় আপনাকেই, আপনার তো আবার নানান আদর্শের বাতিক আছে।
ম্লান হাসেন চৌধুরী সাহেব।
-- দ্যাটস্ সেটলড দেন। কাম্ টু দ্য নেক্সট আইটেম অভ দি আ্যাজেন্ডা প্লীজ।
আবার শুরু হয়ে গেল আলোচনা। ধর্মঘটী মজুরদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বনের উপায় নির্ধারণ করতে থাকেন ওঁরা।
পরমানন্দ যথারীতি ডুবে যান অতীত চিন্তায়।
নিপুণ হস্তে অস্ত্রোপচার করেছিলেন সেদিন ডাক্তার চৌধুরী। সে কথা জানতে পেরেছিল বাড়ির তিনটি প্রাণী। পরমানন্দ গোপন করতে চেয়েছিলেন সকলের কাছ থেকেই! চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু কিশোরী আনাড়ি নীলার সহায়তায় অপারেশন করা সম্ভব হয়নি। বৈশাখীকে ডাকতে হয়েছিল ফলে। আর মিস গ্রেহামকে লুকিয়ে এ বাড়িতে কোনো কিছু করা সম্ভব ছিল না। ভালো করে সকাল হবার আগেই নিয়ে এসেছিলেন হতচেতন ,ছেলেটিকে ভিতর বাড়িতে। নার্সিং হোমে ওকে রাখা নিরাপদ নয়। বাড়ির ভিতরেও ওকে লুকিয়ে রাখা কঠিন। পরমানন্দ ওকে আশ্রয় দিলেন বৈশাখীর ঘরে। পশ্চিম দিকের ঘরখানা ছেড়ে বৈশাখী এসে সাময়িকভাবে আশ্রয় নিল নীলার শয়নকক্ষে।
নীলা অবাক হয়েছিল সবচেয়ে বেশি। ছেলেটি যে টেররিস্ট, আগস্ট আন্দোলনের বিপ্লবী, এটুকু সে আন্দাজ করেছিল অনায়াসে। তা ছাড়া পরমানন্দ সে কথা তাকে স্পষ্ট জানিয়েছিলেন-- সাবধান করে দিয়েছিলেন ওকে সংবাদটা গোপন রাখতে। মিস গ্রেহাম সমস্ত বুঝেও নীরব রইলেন। বৈশাখীকে ডেকে পরমানন্দ বুঝিয়ে দিলেন ব্যাপার গুরুত্ব ও গোপনীয়তা।
কদিন ছিল ছেলেটি? দিন তিন-চার হবে বোধ হয়। ঠিক মনে নেই আজ। শুধু এইটুকু মনে আছে-অপারেশনের পরে সে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। সমস্ত জীবনীশক্তিটুকু সে নিঃশেষ করে এসেছিল আহত অঙ্গটাকে নিয়ে এ বাড়িতে এসে পৌঁছনোর পথে। পরদিনই প্রতিশ্রুতিমতো সে চলে যেতে চেয়েছিল। অনুমতি দিতে পারেননি চৌধুরী ডাক্তার।
-- কিন্তু কথা ছিল আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে না ফিরলে ওরা ধরে নেবে আমি মারা গেছি অথবা ধরা পড়েছি।
-- তুমি ঠিকানা বলো- আমি খবর দিয়ে আসছি।
-- আপনি নিজে যাবেন সেখানে ?
-- কেন, বিশ্বাস করতে পারছ না আমায়?
ছেলেটি হেঁট হয়ে ওর পায়ের ধুলো নিয়ে বলেছিল-- আমার কটু কথাগুলো আপনি ভুলতে পারেননি দেখছি।
ওর সেবার ভার পড়েছিল নীলার ওপর। বৈশাখীকে নার্সিং হোমে তার দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। ফলে নীলাকেই নিতে হল সে দায়িত্ব। ঘড়ির কাঁটার হিসাবে সে পথ্য আর ওষুধ পরিবেশন করে। টেম্পারেচার রাখে। নিরলস অতন্দ্র সেবার সে পরিচর্যা করে চলে আগন্তুকের। ওদের অন্তরালের জীবনে কী কী ঘটনা ঘটেছিল জানা সম্ভব নয় পরমানন্দের পক্ষে। তবে একটা জিনিস তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়াতে পারেনি। নির্জন কক্ষের গোপনীয়তায় ওই কিশোরী নার্স আর তাঁর রোগী পরস্পরের খুব কাছাকাছি এসে পড়েছিল। পরমানন্দ একটু অস্বস্তি বোধ করেছিলেন। এত অল্প সময়ে এত সামান্য পরিচয়ে কী করে এত আকৃষ্ট হল নীলা ওই ছেলেটির দিকে? হয়তো বীরপূজার একটা সেন্টিমেন্টই ওর মনে অনুরাগ সঞ্চারিত হবার মতো একটা ক্ষেত্র পূর্বেই তৈরি করে রেখেছিল। বিপ্লবাত্মক মতবাদের প্রতি নীলার যে একটা অন্ধ আকর্ষণ জন্মেছিল তা ঠিকমতো বিকশিত হবার সুযোগ পায়নি চৌধুরীবাড়ির শৃঙ্খলায়িত বাতাবরণে। ওর দাদা, ওর বাবা, ওর দিদিমা ওকে বেঁধে রেখেছিল এতদিন। হঠাৎ ওর মনের নিরুদ্ধ কামনা মূর্তি পেল এবার। ওই বাইশ বছরের তারুণ্যের মধ্যেই সে দেখতে পেল বিপ্লবের একটা মূর্ত প্রতীক। এত কথা হয়তো তাঁর খেয়াল হত না-- হল বৈশাখীর কথায়।
অপারেশনের পর তৃতীয় দিনে বৈশাখী এসে বললে-- কাকাবাবু, এবার ওঁকে পাঠিয়ে দিন।
কথাটার মর্ম প্রথমটা অনুধাবন করতে পারেননি। তাই জিজ্ঞাসা করেছিলেন-- কার কথা বলছ তুমি?
-- অরুণাভবাবুর কথা।
-- অরুণাভ? কে সে?
-- ওই যে ছেলেটি আমার ঘরে আছেন আজ কদিন।
-- ও! ওর নাম বুঝি অরুণাভ? তা কেন, হঠাৎ ওকে সরিয়ে দিতে বলছ কেন? অসীম কি ফিরে এসেছে বাড়িতে?
-- না, তিনি ফেরেননি।
-- অসীম কোথায় গেছে জানো? হপ্তাখানেক হয়ে গেল আজ নিয়ে।
-- না, এক সপ্তাহ নয়, পাঁচ দিন, ছয় রাত্রি-- কোথায় গিয়েছেন জানি না।
পরমানন্দ একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। পুত্রের অনুপস্থিতি সম্বন্ধে তিনি অত্যন্ত উৎকঠিত। এতদিন ধারণা ছিল, সেজন্য তাঁর উদ্বেগই এ বাড়িতে সবচেয়ে বেশি -- তিনি বাপ। হঠাৎ অনুভব করলেন-- না, তাঁর চেয়েও অধীরতর উৎকণ্ঠায় আর একজন অপেক্ষা করছে অসীমের প্রত্যাবর্তন। তিনি দিন সাতেক পুত্রকে না দেখে বিচলিত হয়েছেন-- কিন্তু বৈশাখী প্রতীক্ষা করছে পাঁচ দিন ও ছয় রাত্রি।
-- ওঁর হাবভাব আমার ভালো ঠেকছে না-- শেষকালে নীলার না সর্বনাশ করে যান।
ভ্রূ কুঞ্চিত হয়েছিল পরমানন্দের। কথাটা তিনি বিশ্বাস করতে পারেননি। বিপ্লবপন্থীদের মর্মকথা তাঁর অজানা নয়। ও পথের অভিজ্ঞতা তাঁরও আছে। এই পথে যারা পা বাড়ায় তারা কখনও কোনো ছোট কাজ করে না। শচীশ নন্দীর ছেলে আর যাই করুক এত বড় উপকারের প্রতিদানে সে নীলার কোনো ক্ষতি করে যেতে পারে না। ইন্দ্রিয়ের ওপর এটুকু সংযম যার নেই সে কখনও এভাবে দেশের জন্যে জীবন উৎসর্গ করতে পারে? কিন্তু নীলা যে দিবারাত্রির সমস্তটা সময় ওর শয্যাপার্শ্বে লীন হয়ে আছে এটাও লক্ষ করেছেন তিনি। তা ছাড়া তিনি প্রতিদিন লক্ষ করেছেন-- যখন রোগীকে পরীক্ষা করতে যান, ড্রেসিং করে দেন ক্ষতস্থানটা, তখন কী অসীম আগ্রহে নীলা জানতে চায় রোগীর উন্নতির কথা। সেটাকে নারীর কোমল স্বাভাবিক হৃদয়বৃত্তি বলেই মনে করেছিলেন এতদিন-- তাঁর বেশি কিছু নয়।
পরমানন্দ জবাবে বলেছিলেন : কিন্তু ওকে এখন পাঠাতে পারি না আমি। আর কিছুদিন না গেলে ও উঠে দাঁড়াতে পারবে না।
-- তাহলে নীলাকে সরিয়ে ওঁর সেবার ভার আমার ওপরে দিন। নার্সিং হোম থেকে কদিন ছুটি দিন আমাকে।
আর একটা সম্ভাবনার কথা মনে হল পরমানন্দের। বাড়িতে দুটি রমণী, একটি বহিরাগত তরুণ যুবক। বিদেহী দেবতা কি এই সুযোগে একটা ত্রিভুজ রচনা করে বসলেন চৌধুরীবাড়ির অন্তঃপুরে? তখনও পরমানন্দ জানতেন না বৈশাখীর সঙ্গে অসীমের সম্পর্কটা। সেটা জেনেছিলেন অনেক পরে। সেটা প্রথম নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারেন যেদিন ঝড়ের পরে বর্ষণক্লান্ত দুর্যোগরজনীতে নেমে এসেছিল প্রচণ্ড বজ্র তাঁর উদ্ধত শিরে।
উনি ব্যবস্থাটা অগত্যা পালটে দিলেন। নীলাকে বোঝানো হল রোগীকে অভিজ্ঞ নার্সের হাতে রাখাই বাঞ্ছনীয়। নার্সিং হোম থেকে দিন তিনেকের ছুটি মঞ্জুর হল বৈশাখীর। সে আশ্রয় নিল তাঁর নিজের শয়নকক্ষে-- রোগীর পাশে।
পরের দিন আরও ঘোরালো হয়ে উঠল পরিস্থিতিটা। অসীম ফিরে এল পরের দিন। দিনসাতেক পরে বাড়ি ফিরছে সে। জলে কাদায় মলিন দেহ, অস্নাত রুক্ষ চুলগুলো পিছনে সরিয়ে দিতে দিতে লঘুপায়ে সে এসে হাজির হল বৈশাখীর ঘরে। রক্ষীবাহিনীর কাজেই তাকে বাইরে যেতে হয়েছিল হঠাৎ। যাবার সময় বাড়িতে কোনো খবর দিয়ে যেতে পারেনি তাড়াতাড়িতে। বাবা নিশ্চয়ই অসন্তুষ্ট হয়ে আছেন-- নীলা আছে উদ্বিগ্ন হয়ে-- সেজন্য উৎকণ্ঠা নেই অসীমের। তার ভয় ছিল বৈশাখীকে। বিনা সংবাদে এ কয়দিন তার অজ্ঞাতবাসের জন্য নিশ্চয়ই মর্মান্তিক অভিমান করে আছে বৈশাখী। প্রথমেই তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। দুটো মিষ্টি কথায় তার অভিমানকে করতে হবে দ্রব। বৈশাখীর ঘরটা বাড়ির একান্তে পশ্চিম কোনার পিছন দিকে। পা টিপে টিপে সকলের অলক্ষিতে অসীম এসে দাড়ায় ওর দ্বারের পাশে। দ্বার খোলাই ছিল-- ভেজানো। টোকা না দিয়েই বৈশাখীর ঘরে ঢুকবার অধিকার ছিল অসীমের-- ওদের সম্পর্কের জোরে। ওকে চমকে দেবে বলেই হঠাৎ দ্বার খুলে ঘরে ঢোকে। তারপর তাকে দাঁড়িয়ে পড়তে হয় চৌকাঠের ওপরেই।
বৈশাখীর খাটে শুয়ে আছে একটি অপরিচিত যুবক। খাটের পাশেই বিছানায় বসে আছে বৈশাখী-- যুবকটির মাথা দক্ষিণ বাহুতে আলিঙ্গন করে ধরে বাঁ হাতে ওর মুখের কাছে ধরে রেখেছে কী একটা পানীয়। আধশোওয়া লোকটা বৈশাখীর নরম বুকে মাথা হেলান দিয়ে তার হাতের গ্রাস থেকে পান করছে-- পানীয়টা কী তা বোঝা গেল না। মুহূর্তের জন্য স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে অসীম। ওরা দুজনেই মুখ তুলে তাকায়। বৈশাখীর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়।
ধরা পড়ার ছাপ সে মুখে স্পষ্ট। যেটুকু সন্দেহ ছিল অসীমের-- তা নিরসন হল ভয়ে-সাদা-হয়ে-যাওয়া বৈশাখীর চোখের দৃষ্টিটায় ! ছেলেটিও উৎকন্ঠিত হয়ে ওঠে ওর আকস্মিক আবির্ভাবে।
-- আয়াম সরি!
দ্বার ভেজিয়ে দিয়ে বেরিয়ে আসে অসীম।
পরমুহূর্তেই বের হয়ে আসে বৈশাখী : কখন এলে?
অসীম প্রতিপ্রশ্ন করে-- ভাগ্যবানটি কে?
বৈশাখী কৌতুক বোধ করে ওর প্রশ্নের ধরনে। অসীমের ঈর্ষাবহ্নিতে নূতন সমিধ সরবরাহ করে : আমার একজন ফ্রেন্ড!
-- ফ্রেন্ড! তোমার ফ্রেন্ড! মানে?
-- ফ্রেন্ড শব্দের অর্থ জানো না? তাই তো -- মানে, তোমাদের অভিধান অনুযায়ী যাকে বলে কমরেড!
অসীম জ্বলে উঠেছিল এ কথায়। বলে-রসিকতা রাখো। কিন্তু এ-সব বৃন্দাবনলীলা বাড়ির বাইরে হওয়াই ভালো নয় কি? এ বাড়ির একটা স্যাংটিটি আছে। নিজের বিছানায় বয়ফ্রেন্ডকে ডেকে আনার অধিকার তোমার নিশ্চয়ই আছে; কিন্তু এজন্যে হোটেলে তো সস্তায় ঘর ভাড়া পাওয়া যায়। নীলার চোখের সামনে এ বাড়তি রোজগারটুকু না করলেই নয়!
-- বাড়তি রোজগার?-- বৈশাখীর অস্ফুট কণ্ঠে ফুটে ওঠে ওর অবমানিত আত্মার আর্তি।
-- না তো কি! নার্সদের সম্বন্ধে অনেক কথা শুনেছিলাম-- কিন্তু তুমিও যে কোনো অনাত্মীয় যুবকের মাথা অমনভাবে বুকের ওপর টেনে নিয়ে ঢলামি করতে পারো-- তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।
বৈশাখী ভুলে যায়-- মুহূর্তপূর্বে সে নিজেই অসীমের ঈর্ষাবহ্নিতে ঘৃতাহুতি দিয়েছিল মজা করার জন্য। কঠিন স্বরে সে বলে-- ও, তাই বুঝি! এ বাড়িতে অনাত্মীয় কুমারী মেয়ের মাথা বুকে টেনে নিয়ে বৃন্দাবনলীলা করার অধিকার যে একমাত্র অসীমবাবুরই আছে তা জানা ছিল না আমার।
অসীম এক লহমা স্থির থেকে ধীরকণ্ঠে বলে : আমার ধারণা ছিল সে অধিকার তুমি আমাকে দিয়েছিলে—ভালোবেসেই -- তখন তোমার বয়ফ্রেন্ডদের কথা জানতাম না আমি। ভুলটা ভেঙে গিয়েছে আমার-- আমার পূর্ব আচরণের জন্য তাই মাপ চাইছি!
অসীম যাবার জন্য পা বাড়ায়। হাতটা চেপে ধরে তার বৈশাখী।
-- কী পাগলামি করছ! দেখছ না ও পেশেন্ট -- উঠে বসতে পারে না, তাই ওইভাবে খাইয়ে দিচ্ছিলাম ওকে।
-- পেশেন্ট ! কেন, কী হয়েছে ওর?
-- ওর পায়ে একটা অপারেশন করা হয়েছে?
-- তা এ ঘরে কেন? নার্সিং হোমে কি বেড নেই?
-- ওকে এ ঘরে এনে রেখেছেন কাকাবাবু।
-- কেন?
-- তা কী করে জানব-- তাঁকে জিজ্ঞাসা করো।
অসীম একমুহূর্ত কী ভাবে। তারপর বলে : কী হয়েছিল ওর পায়ে?
-- ডাকাতের গুলি লেগেছিল!
-- সত্যি বলছ? আমি কিন্তু,বাবাকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করব।
ওর হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে এনেছিল বৈশাখী জানলার ধারে, বলে—ওই দেখো পায়ের ব্যাণ্ডেজ।
লোকটা চোখ বুজে শুয়ে ছিল। অসীম চমকে ওঠে ওকে দেখে। এতক্ষণে ভালো করে লক্ষ করে সে বৈশাখীর পেশেন্টকে। এ তার চেনা মুখ। কোথায় দেখেছে, কোথায় দেখেছে? তারপরের মুহূর্তেই মনে পড়ে গিয়েছিল-- এই মুখের ফোটো দেখেছে সে। চিনতে পারে লোকটাকে। বৈশাখীর হাত ছাড়িয়ে সে ছুটে এসে হাজির হয় পরমানন্দের সামনে।
পিতাপুত্রের সে সাক্ষাৎটাও নাটকীয়।
-- বৈশাখীর ঘরে যে ছেলেটি আছে ও কে?
চশমাটা চোখ থেকে নামিয়ে রেখে পরমানন্দ প্রতিপ্রশ্ন করেন-- এ কদিন কোথায় ছিলে?
-- রক্ষীবাহিনীর কাজে বাইরে গিয়েছিলাম। কতকগুলো হুলিগান এসেছে এই এলাকায়। রেল-লাইনের ফিশ-প্লেট তুলে ফেলছে, টেলিগ্রাফের তার উপড়ে ফেলছে-- তাই আমাদের ডিউটি পড়েছিল পাহারা দেওয়ার...কিন্ত আমার কথাটা আপনি শুনতে পাননি।
-- শুনেছি, ও ঘরে আছে একটি পেশেন্ট-- -ওর পায়ে একটা অপারেশন করেছি আমি।
-- কিন্ত ও তোমাকে মিথ্যা কথা বলেছে। ডাকাতের গুলি নয়-- মহিযাদল থানা লুট কেসে ওই ছেলেটির নামে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা আছে।
-- ডাকাতের গুলি লেগেছে-এ কথা কে বলেছে তোমাকে?
-- বৈশাখী।
পরমানন্দ একবার ইতস্তত করেন। অদূরে বসে নীলা একটা উলের সোয়েটার বুনছিল। তার কাঁটা থেকে কয়েকটা ঘর পড়ে যায়। মিস গ্রেহাম উলের গুলি পাকিয়ে দিচ্ছিলেন ফেটি খুলে। জড়িয়ে জট পাকিয়ে যায় বাণ্ডিলটা।
পরমানন্দ দ্বিধাসংকোচ ঝেড়ে ফেলে শেষ পর্যন্ত বলেন- বৈশাখী ভুল বলেছে। ডাকাতের গুলি লাগেনি ওর।
-- তুমি তাহলে সব জানো?
-- জানি!
-- জানো? তবু আশ্রয় দিয়েছ ওকে?
ধীরকণ্ঠে পরমানন্দ বলেন-- তোমার রাজনীতিতে আমি কোনোদিন হস্তক্ষেপ করিনি। আমার চিকিৎসা ব্যাপারেও আমি আশা করব তুমি হস্তক্ষেপ করতে আসবে না।
অসীম বলে : এটা আমার আগেই অনুমান করা উচিত ছিল। সেদিন বুঝতে পারিনি, কিন্তু আজ নিঃসংশয়ে বুঝতে পারছি কেন তুমি নীলাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলে কাগজগুলো। তোমাকে উপদেশ দিতে যাবার ধৃষ্টতা আমার নেই, কিন্তু তুমি কি জানো, যে ছেলেটিকে তুমি আশ্রয় দিয়েছ সে একজন কর্তব্যরত সরকারি কর্মচারীকে খুন করে এসেছে? সে খুনি আসামি?
-- খোকা! থামিয়ে দিয়েছিলেন তিনি পুত্রকে। বলেছিলেন, আমার বিচার তুমি করতে বোসো না, আমার রাজনীতি তুমি বুঝবে না।
অসীম উত্তেজিত হয়ে বলেছিল : আজ তোমাদের গান্ধীজী জেলের বাইরে থাকলে এইসব নৃশংস কাজের প্রথম প্রতিবাদ তিনিই করতেন। এদিকে জাপান ডিমাপুরে এসে পড়েছে –ফ্যাসিস্ট বর্বরতার বিরুদ্ধে বিশ্বের জনশক্তি আজ সঙ্ঘবদ্ধ হচ্ছে-- আর তোমরা শুধু অন্তর্ঘাতী সংগ্রামে সে জনযুদ্ধকে সাবোটাজ করছ।
মিস গ্রেহাম শুধু বলেছিলেন- প্লীজ অসীম...
অসীম কর্ণপাতও করেনি, সমান তালে বলে চলে : কতকগুলো ফন্দিবাজ এজেন্ট -- প্রভোকেটর মিথ্যা গুজব রটিয়ে বেড়াচ্ছে আর তোমরা অন্ধের মতো...
-- শাট আপ!-- গর্জন করে উঠেছিলেন আগ্নেয়গিরির মতো পরমানন্দ : তোমার যা কর্তব্য মনে হয় তা করতে পার। কিন্তু এই অন্ধ বৃদ্ধের চোখ ফোটাবার চেষ্টা কোরো না। যাও--
-- আমার এক্ষেত্রে যা কর্তব্য তা করলে তার কী পরিণাম হবে জানো? সহ্য করতে পারবে তা?
অপরিসীম ধৈর্যে দ্বারের দিকে অঙ্গুলিসঙ্কেত করে শুধু বলেছিলেন -- যাও!
মুহূর্তখানেক অসীম দাঁড়িয়েছিল নিশ্চল হয়ে তা সত্তেও। তারপর বললে—বেশ যাচ্ছি! যা কর্তব্য মনে করছি তাই করব আমি।
চলে যাবার জন্য পা বাড়ায় অসীম।
পরমানন্দ আবার বলেন- দাঁড়াও! যা করতে চাও তার ফলাফল ভেবে নিয়ে কোরো। ঝোঁকের মাথায় কিছু করে বোসো না। এর পরিণাম সহ্য করবার শক্তি তোমার আছে কিনা ভেবে দেখো একবার।
‘তোমার’ কথাটার ওপর ঝোক পড়ে তাঁর।
মাথা খাড়া রেখেই চলে যায় অসীম।
মিস গ্রেহাম ওকে ফিরে ডাকেন। কর্ণপাত করে না সে।
নীল হয়ে বসে থাকে নীলা।
হনহন করে স্বল্পালোকিত করিডোরটা দিয়ে অসীম চলেছিল। হঠাৎ পিছন থেকে জামায় টান পড়ে ওর। অসীম দাঁড়িয়ে পড়ে।
-- কোথায় চলেছ?
অসীম আপাদমস্তক একবার দেখে নিল বৈশাখীকে। ছোপ-ছোপ জংলা রঙের একটা শাড়ি পরেছে সে। এলো করে বাঁধা ঢলকা খোঁপা ভেঙে পড়েছে কাঁধের ওপর। সেই ভাঙা খোঁপাতেই গোঁজা আছে একটা আধফোঁটা রক্তগোলাপ। একটু আগে বৈশাখীর শয়নকক্ষে রোগীর শয্যাপার্থে রাখা ফুলদানিটাতে যে রক্তগোলাপের গুচ্ছ দেখে এসেছিল-- তারই একটা।
-- কোথায় চলেছ? আবার প্রশ্ন করে বৈশাখী।
-- আয়াঙ্গারের বাংলোয়।
-- আয়াঙ্গার কে?
-- এস. ডি. ও.।
বৈশাখীর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়, বলে-- কী পাগলামি করছ তুমি! জানো এর কী পরিণাম হতে পারে?
অসীম ভ্রূ কুঁচকে প্রতিপ্রশ্ন করে-- কীসের কী পরিণাম হবে?
-- তুমি যদি ওর কথা বলে আসো গিয়ে তাহলে কাকাবাবুর অবস্থাটা কী হবে ভেবে দেখেছ?
-- কেন? ডাকাতের-গুলি-লাগা পেশেন্টের চিকিৎসা করায় তো কোনো অপরাধ হয় না।
-- ছেলেমানুষি কোরো না অসীম। ছেলেটির পরিচয় তুমি জানো!
-- জানি নাকি? তাহলে ডাকাতের কথা মিথ্যা করে বলেও তোমার বয়ফ্রেন্ডের পরিচয়টা গোপন রাখতে পারনি তুমি?
বৈশাখী উত্তরে বলে, -- না, মিথ্যা কথা আমি বলিনি। তুমিই বুঝতে পারনি। ইংরাজ শাসককে এ বাড়ির একটি প্রাণী ছাড়া সকলেই ডাকাত বলে মনে করে।
অসীম বলে-- রাজনীতির তর্ক তোমার সঙ্গে আমি করব না বৈশাখী। ইংরাজ শাসকদের মিত্র বলে আমিও মনে করি না-- কিন্তু এ কথাও আমি ভুলতে পারি না যে প্রভু হিসাবে ইংরাজদের চেয়ে জাপানীরা বেশি মনোরম হবে না। কিন্তু যাক ও কথা-ছাড়ো আমাকে, যেতে দাও।
অসীমের পাঞ্জাবির একটা প্রান্ত তখনও ধরা ছিল বৈশাখীর মুঠিতে। সে বুঝতে পারে অসীমকে ছেড়ে দিলে সে একটা সর্বনাশ করে বসবে এখন। বৈশাখীর উপরেই তার রাগটা হয়েছে সবচেয়ে বেশি,-- না হলে কখনও “বৈশাখী” বলে সম্বোধন করত না তাকে, ডাকত “সাকী” বলে।
বৈশাখী বলে-- এ বাড়ির মধ্যে যদি ও ধরা পড়ে তাহলে আমরা সকলেই ধরা পড়ব-- এটা ভেবে দেখেছ?
-- ধরা তো তুমি পড়ে গেছ বৈশাখী। নতুন করে আর কী ধরা পড়বে তুমি?
-- আমার কথা হচ্ছে না, কিন্তু তুমি কি অন্তত কাকাবাবুর কথাটা ভেবে দেখেছ?
-- বাবার কোনো বিপদ নেই এতে -- তিনি আমাকে যে কথা বোঝাতে চেয়েছেন সেই কথায় বলবেন। তিনি ওকে চিনতে পারেননি। ভেবেছিলেন সত্যিই বুঝি ডাকাতের গুলি লেগেছে ওর পায়ে। তারপর যে মুহূর্তে বুঝতে পেরেছেন ছেলেটি পলাতক রাজদ্রোহী সেই মুহূর্তেই তাঁর ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়েছেন এস.ডি. ও.-র কাছে। এতে তাঁর বিপদটা কোথায় তা তো বুঝছি না আমি।
বৈশাখী ওর হাত দুটি ধরে মিনতিমাখা কণ্ঠে বলে-- তোমার পায়ে পড়ি অসীম, এ কাজ তুমি কোরো না।
ভুরু কুঁচকে ওঠে অসীমের-- ব্যঙ্গের এক চিলতে একটা হাসিও খেলে যায় ওর ওষ্ঠে, বলে-- কিন্তু কেন বলো তো? এত কাতরভাবে প্রার্থনা করার আসল কারণটা কী?
-- আমার ভয় করছে! আমার মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে এই নিয়ে। কাকাবাবু ভীষণ আহত হবেন।
-- হওয়াই উচিত। তিনি ওকে বাঁচাবার চেষ্টা করছেন। সেটাকে তিনি কর্তব্য বলে মনে করেছেন। কিন্তু কর্তব্য কর্ম করার অধিকার তো তাঁর একলার এক্তিয়ারভুক্ত নয়। আমাকেও করতে হবে-যা আমি করণীয় মনে করছি। তুমি আমাদের বাড়ির আবহাওয়ার কথা জানো না। আমার আইডিওলজি আমি অনুসরণ করলে বাবা কখনোই কিছু মনে করবেন না।
-- তবু আমি তোমাকে মিনতি করছি অসীম...তা ছাড়াও মানে....ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারছি না তোমাকে আমার মনের আশঙ্কা..আমি মিনতি করছি অসীম...প্লীজ!
অসীম আর হাস্য সংবরণ করতে পারে না, বলে-- নবাবপুত্রী! এ উত্তম!
-- কী উত্তম অসীম?
-- নিশীথে একাকিনী বন্দিসহবাস নবাবপুত্রীর পক্ষে উত্তম!
-- এ সব কথার মানে?
-- মানে আয়েষা বেগমের এ অনুরোধ রক্ষা করা আপাতত ওসমানের পক্ষে অসম্ভব।
ওর হাত ছাড়িয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল অসীম।
বৈশাখীর সঙ্গে অসীমের এ সাক্ষাৎকার প্রত্যক্ষ করেননি পরমানন্দ। এ শুধু তাঁর অনুমান। এবং সেইটাই তাঁর সবচেয়ে বড় দুঃখ। তিনি যদি জানতে পারতেন যে অসীম আদর্শ প্রণোদিত হয়ে সংবাদ দিতে গিয়েছিল এস. ডি.ও.-র বাংলোতে তাহলে বোধকরি তিনি তাকে ক্ষমা করতে পারতেন। ক্ষমা না করলেও অন্তত এটুকু সান্ত্বনা তাঁর থাকত যে দুর্ঘটনাটা শুধুমাত্র পিতা-পুত্রের আদর্শগত বিরোধজনিত। কিন্তু আসলে কি তাই? অসীম কি খবর দিতে ছুটেছিল এস. ডি. ও.-কে ঈর্ষাপ্রণোদিত হয়ে? শুধু ক্ষণিক উন্মাদনায় কি এ কাজটা করে বসে ও? অবশ্য এ কথা নিশ্চিত যে তার ফলাফলটা যে এত ভয়ঙ্কর হতে পারে এ ছিল ওই নাবালক রাজনীতিকের দুঃস্বপ্নেরও অগোচর। বোকা ছেলে! সে তার বাপকে চিনতে পারেনি।
-- একটা সই লাগবে ডাক্তারসাহেব।
টাইপকরা একখন্ড কাগজ কে যেন বাড়িয়ে ধরে ওঁর সামনে। কীসের কাগজ ওটা? কে জানে। পরমানন্দ শুধু এইটুকুই দেখলেন একসার সই রয়েছে তাতে। অন্যান্য সব ডাইরেক্টরের দস্তখত করা আছে। না পড়েই একটা সই করে দিলেন পরমানন্দ। কাগজখানা চলে গেল পার্শ্ববর্তী ভদ্রলোকের হাতে।
তন্ময়তা ভাঙেনি পরমানন্দের। তিনি ভাবছিলেন সেদিন সন্ধ্যার কথা। অন্ধকার হয়ে এসেছে। ডাক্তার চৌধুরী নিজেই ড্রাইভ করে ফিরছিলেন বাংলোয়। কাঁকরবিছানো লাল পথ দিয়ে গাড়ি এসে দাঁড়াল গাড়িবারান্দার নীচে। ডাক্তার চৌধুরী গাড়ি থেকে নামলেন। একা। নেমেই দেখেন সন্ধ্যার অনালোকে বাইরে কয়েকখানি চেয়ার পাতা। বসে আছেন আধা-অন্ধকারে কয়েকজন ভদ্রলোক। অনুমান তাহলে তাঁর ঠিকই হয়েছিল। অসীম আছে, আছে নীলাও, এবং মিস গ্রেহাম। সেদিকে অগ্রসর হতেই এস. ডি. ও. মিস্টার আয়াঙ্গার বলেন-- গুড ইভনিং ডক্টর চৌধুরী।
প্রত্যভিবাদন করে চৌধুরী সাহেব এসে বসেন একটা বেতের চেয়ারে। মিস গ্রেহাম কয়েক গ্লাস পানীয় প্রস্তত করতে ব্যস্ত। নির্বিকার মূর্তি তাঁর। নীলা বসে আছে একটা অরেঞ্জ স্কোয়াশ হাতে! চাঁদ উঠেছে শুক্লা সপ্তমী কি অষ্টমীর। তারই ম্লান আলোয় রক্তশূন্য দেখাল নীলার মুখ। চোখাচোখি হতেই মনে হল কী একটা কথা বলবার জন্য সে যেন ছটফট করছে। চৌধুরী আন্দাজ করেন কথাটা কী। আয়াঙ্গার সাহেবকে দেখেই বুঝতে পেরেছেন তিনি-- অসীম কী কান্ডটা করে বসে আছে। অসীম বসে আছে সামনের চেয়ারটায়-- মেদিনীনিবদ্ধ দৃষ্টি।
-- কতদূর ঘুরে এলেন?
-- এই তো। অস্পষ্ট জবাব দিলেনন উনি সৌজন্যরক্ষার্থে। মিস গ্রেহাম প্রশ্ন করেন -- তাঁকেও একটা পানীয় দেওয়া হবে কিনা। ডাক্তার চৌধুরী সম্মতি জানান। আয়াঙ্গার সাহেব আর কাণবিলম্ব না করে সোজা নেমে আসেন আসল বক্তব্যে-- আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ডক্টর চৌধুরী। উপযুক্ত সময়েই আপনি খবর পাঠিয়েছিলেন অসীমবাবুকে দিয়ে। সমস্ত বাড়িটাই আমরা ঘিরে রেখেছি। অপারেশন করে আপনি ভালোই করেছেন-- আর তা ছাড়া ওর পরিচয় তো শুনলাম আপনি প্রথমে বুঝতেই পারেননি। সুতরাং আপনার কোনো আশঙ্কা নেই। নাউ কাম টু দ্য পয়েন্ট। কোথায় আছে আপনার পেশেন্ট?
পরমানন্দ একটু ইতস্তত করে বলেন-- নীলা, আমার চুরুটের প্যাকেটটা প্লীজ।
মিস গ্রেহাম উঠে পড়েন-- আমি দেখছি।
-- প্লীজ লেট হার সেন্ড ইট।
নীলা ধীরপদে উঠে যায়। ইঙ্গিতটা সে বুঝতে পেরেছে। চুরুটের প্যাকেটটা তাকে আনতে বলা হয়নি -- পাঠিয়ে দিতে বলা হয়েছে। নন্দ চুরুটের বাক্সটা এনে নামিয়ে রাখে টেবিলে। তাঁর থেকে একটা বার করে নিপুণভাবে ধরান ডাক্তার সাহেব। বাক্সটা এগিয়ে দেন আয়াঙ্গারের দিকে। তিনিও ধরান একটা।
-- কোন পেশেন্টের কথা বলছেন আপনি?
-- যার খবর দিয়ে আপনি আপনার ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন আমার কাছে।
-- আই থিঙ্ক য়ু আর মিস্টেকেন। আমি তো কোনো খবর পাঠাইনি। অসীম, এ-সব কী শুনছি?
অসীম চমকে ওঠে। কী বলবে তা বুঝতে পারে না। পরমানন্দ যে এটাকে বেমালুম অস্বীকার করে বসতে পারেন এটা তাঁর স্বপ্নেরও অগোচর। সে ভেবেছিল আয়াঙ্গার সাহেব যখন হাতেনাতে আসামিকে ধরে ফেলবেন-- তখন পরমানন্দের সামনে দ্বিতীয় কোনো পথ থাকবে না। তাঁর গায়ে কোনো আঁচড় লাগার কথা নয়। তিনিই ছেলেকে পাঠিয়েছেন আয়াঙ্গার সাহেবের কাছে, গোপনে সংবাদ দিয়ে। তিনি বিপ্লবীটিকে আশ্রয় দেননি-- আটকে রেখেছেন শুধু পুলিশ আসা পর্যন্ত। সুতরাং পরমানন্দের এতে বিপদ নেই বিন্দুমাত্র, বরং সরকার থেকে পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
কিন্তু কার্যকালে ঘটনাটা ঘটল অন্যরকম। সদলবলে আয়াঙ্গার সাহেব এসে ঘিরে ফেললেন বাড়িটা। চৌধুরী সাহেবকে পাওয়া গেল না বাড়িতে। গাড়ি নিয়ে একাই কোথায় রোগী দেখতে গিয়েছেন তিনি। তাঁর অনুপস্থিতিতেই বাড়ি সার্চ করা হয়ে গেছে। ছেলেটিকে পাওয়া যায়নি। নেই, কোথাও নেই-- সেই ছেলেটা।
অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে আয়াঙ্গার বলেন-- ডক্টর চৌধুরী! আগুন নিয়ে খেলা করবেন না আপনি। অরুণাভ নন্দী এ বাড়িতে এসেছিল-- চার-পাঁচ দিন এখানে ছিল -- তাঁর সন্দেহাতীত প্রমাণ আমরা পেয়েছি। অসীমবাবু সব কথা স্বীকার করেছেন আমার কাছে। আর আপনার বাড়ি সার্চ করেই পাওয়া গেছে এই অকাট্য প্রমাণ।
এক বাণ্ডিল কাগজ তিনি বার করে রাখেন সামনের টেবিলে। নিষিদ্ধ প্রচারপত্রের একতাড়া কাগজ। আন্ডার গ্রাউন্ড প্রেস থেকে ছাপা। নীলার বিছানার তলা থেকে যে কাগজগুলো একদিন উদ্ধার করেছিল অসীম।
আপনি নিশ্চয়ই বলবেন না যে এগুলি আপনার পুত্র অথবা কন্যার সম্পত্তি। সুতরাং অরুণাভ নন্দী আপনার বাড়িতে এসেছিল এটা আপনাকে মেনে নিতেই হবে।
কী জবাব দেবেন বুঝতে পারেন না চৌধুরীসাহেব।
এস. ডি. ও. আয়াঙ্গার কন্ঠস্বর নীচু করে বলেন-- ডক্টর চৌধুরী, আমি জানি ছেলেটিকে আপনি বাঁচাতে চাইছেন। হঠাৎ অসীমবাবুকে দিয়ে খবর পাঠিয়ে এখন আবার কেন তাকে বাঁচাতে চাইছেন তা অবশ্য জানি না। কিন্ত এখন আর উপায় নেই ডাক্তারসাহেব।
পরমানন্দ তখনও নীরব থাকেন।
-- আমার সন্দেহ হচ্ছে আপনিই অসীমবাবুকে পাঠিয়েছিলেন কিনা। সম্ভবত আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই খবর দিতে গিয়েছিলেন অসীমবাবু, তাই নয়?
অসীম তাড়াতাড়ি প্রতিবাদ করে-- না না, আমাকে উনিই পাঠিয়েছিলেন।
আয়াঙ্গার মুখ থেকে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বলেন-- সম্ভবত কথাটা সত্য নয় -- তবু আমি তাই ধরে নিতে রাজি আছি। কারণ আমি চাই না ডক্টর চৌধুরী এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র বিব্রত হন। নাউ প্লীজ-- কোথায় আপনার পেশেন্ট?
এতক্ষণে মনস্থির করেছেন পরমানন্দ। বলেন,-- বলছি, বসুন, আমি আসছি এখনি। -- উঠে পড়েন চৌধুরীসাহেব।
-- এক্সকিউজ মী! আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে কোথাও যেতে পারবেন না আপনি।
-- আ্যাম আই আন্ডার আ্যারেস্ট দেন?
আয়াঙ্গার আর একবার নিম্নকণ্ঠে উচ্চারণ করেন তাঁর শেষ সাবধানবাণী-- অনেক আগেই আমার উচিত ছিল আপনাকে আ্যারেস্ট করা। আমি তা করিনি। কারণ আমি ভুলতে পারছি না সেই রাত্রিটির কথা-- যে রাত্রে আমার বেবি টাইফয়েড-ক্রাইসিস পার হয়েছিল। আপনি সারারাত্রি ছিলেন আমার বাসায়। তবু সব জিনিসেরই একটা সীমা আছে ডক্টর চৌধুরী। আমি আপনাকে শেষবার প্রশ্ন করছি-- -গাড়ি করে কোথায় পৌঁছে দিয়ে এলেন আপনার পেশেন্টকে?
-- এর জবাব না পেলে আমাকে আপনি গ্রেপ্তার করবেন?
-- অ্যান্ড উইথ নো রিগ্রেট। কারণ আত্মরক্ষার পূর্ণ সুযোগ আপনাকে বারে বারে দেওয়া হয়েছে।
-- ওয়েল, দেন ডু আ্যারেস্ট মী। আপনাকে প্রশ্নের জবাব আমি দেব না।
চীৎকার করে ওঠে অসীম-- বাবা!
-- ইটস্ টু লেট খোকা! ভুলে যেও না-- আমাদের কৃতকর্মের ফলাফল সহ্য করবার জন্য আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। নীলা রইল, তোমার গ্র্যানী রইল!
আয়াঙ্গার শাহেবের দিকে মুষ্টিবদ্ধ হাত দুটি বাড়িয়ে দিয়ে পরমানন্দ বলেছিলেন-- আমি প্রস্তুত বন্ধু!
পরবর্তী অংশ.......
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment