Showing posts with label সামাজিক. Show all posts
Showing posts with label সামাজিক. Show all posts

ভয়ের খুব কাছে

লেখক: অনীশ দেব

 

ব্রিজেশ ঢেউ গুনছিলেন, আর মনে-মনে বেশ মজা পাচ্ছিলেন। বিনি মাইনের এই চাকরিটা শখের খেলা হিসেবে মন্দ না।

পুরীর সমুদ্র বরাবরই ব্রিজেশের খুব প্রিয়। কারণ, সমুদ্রের সৌন্দর্যের পাশাপাশি এর মধ্যে কোথায় যেন একটা একগুঁয়ে ফোর্স লুকিয়ে রয়েছে। বিউটির সঙ্গে ফোর্স মিশে গেলে তার আকর্ষণই আলাদা!

একটু আগেই সমুদ্রের ভেতর থেকে নতুন সূর্য উঠেছে। এখন তার লাল-কমলা আলো জলের ওপরে চকচক করছে। বহুদূরে দুটো নৌকো দেখা যাচ্ছে। একটু পরেই ওগুলো কালো ফুটকি হয়ে শেষে মিলিয়ে যাবে।

সমুদ্রের খুব কাছাকাছি ব্রিজেশ বসেছিলেন। লোকাল একজন মহিলা দশ টাকার বদলে প্লাস্টিকের চেয়ার ভাড়া দেয় - এক ঘণ্টার জন্য। তার কাছ থেকে দুটি চেয়ার ভাড়া নিয়েছেন --ছাই রঙের হাতলওয়ালা চেয়ার। একটায় ব্রিজেশ বসেছেন, আর তার পাশের চেয়ারে সানিয়া। ভাবতে অবাক লাগে, কতদিন পর ওঁরা স্বামী-স্ত্রী এমনভাবে পাশাপাশি বসেছেন, অলসভাবে সময় কাটাচ্ছেন।

সমুদ্রের হাওয়া চোখে-মুখে ঝাপটা মারছিল। সামনে সমুদ্রের অনন্ত বিস্তার, আর সঙ্গে ঢেউয়ের পরে ঢেউ। ব্রিজেশ চাইছিলেন, সময় এখন থেমে যাক, সমুদ্রের অদ্ভুত গন্ধটা চিরস্থায়ী পারফিউমের মতো শরীরে লেগে থাক।

গুনগুন গান কানে আসায় সানিয়ার দিকে মুখ ফেরালেন।

কপালের দু’পাশে চুল সাদা হয়ে গেছে, ত্বক আর আগের মতো মসৃণ নেই, কিন্তু গানের গলাটা একইরকম রয়ে গেছে। এই মেয়েটার সঙ্গে দু-দুটো যুগ কাটিয়ে দিয়েছেন ব্রিজেশ। ওঁর হাই প্রোফাইল করপোরেট লাইফে সানিয়া সবসময় সলাস আর স্টেবিলিটি জুগিয়েছেন - শান্তি আর স্থিতি। তাই এই কম-কথা-বলা মেয়েটাকে ব্রিজেশ এখনও পছন্দ করেন। কিন্তু মাঝে-মাঝে মনে হয়, অফিসে যেমন সাবঅর্ডিনেটরা ওপরওয়ালার মরজি মাফিক চলার চেষ্টা করে সানিয়া সেরকম কিছু করছেন না তো!

অফিসের কথা মনে পড়ল ব্রিজেশের। ওর আন্ডারে এমপ্লয়ির সংখ্যা একশো বারো। নট আ ম্যাটার অব জোক। ওই একশো বারোজন এমপ্লয়ি ব্রিজেশ দত্ত চৌধুরীর কথায় ওঠ-বোস করে।

কিন্তু এখন অফিস ভুলে থাকার সময়। তাই পুরী রওনা হওয়ার সময় থেকেই অফিশিয়াল মোবাইল ফোন বন্ধ। প্রাইভেট ফোনের নম্বরটা ব্রিজেশ শুধু কোম্পানির এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর সুনন্দন শর্মাকে দিয়ে এসেছেন। বলেছেন, একস্ট্রিম ইমার্জেন্সি ছাড়া ওঁকে যেন ফোন না করা হয়। কারণ, পুরীর এই তিনটে দিন তিনি পুরোপুরি অলসভাবে কাটাতে চান, জীবনের স্রোতে নিজেকে স্রেফ ভাসিয়ে দিতে চান।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ব্রিজেশ। চারপাশে তাকালেন। সি-বিচে মোটামুটি ভিড়। কাছে-দূরে কয়েকটা চায়ের দোকান। দোকানদাররা খদ্দেরদের জন্য কয়েকটা করে কাঠের বেঞ্চ পেতে রেখেছে। সেখানে টুরিস্টরা বসে চা খাচ্ছে, সমুদ্র উপভোগ করছে। জগন্নাথের ফ্রেমে বাঁধানো ফটো, মুক্তোর মালা বিক্রি করছে। ভোরবেলা থেকে এই একঘণ্টার মধ্যেই ওরা ব্রিজেশদের অন্তত বারচারেক বিরক্ত করে গেছে। হকারগুলো মহা নাছোড়। মুখের সামনে এসে এমন করতে থাকে যে, ব্রিজেশের মাঝে-মাঝে মনে হয়, ঠাস করে এক চড় কষিয়ে দেন।

অফিস হলে ব্যাপারটা এতক্ষণে ঘটে যেত। কিন্তু এটা তো আর অফিস নয়! সানিয়া গুনগুন গান থামিয়ে জিগ্যেস করলেন, - কোথায় চললে?

- কোথাও না। সাগরের জলে একটু পা ভিজিয়ে আসি!

- আজ সানরাইজ খুব ভালো দেখা গেছে, তাই না?

ব্রিজেশ ছোট্ট করে জবাব দিলেন, - হুঁ--। তারপর একটু থেমে আবার বললেন, হকারদের কাছ থেকে ফালতু জিনিস কিছু কিনে বোসো না যেন!

সানিয়া বললেন, - না, কিনব না।

‘স্বামী’ লোকটাকে দেখছিলেন সানিয়া। বয়েস পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন হলেও কম দেখায়। এই বয়সেও হালকা শরীরচর্চা ওর নেশা। চওড়া গোঁফ, কদমছাঁট চুল। অল্প-সল্প নেশা যে করেন সেটা চোখের কোল দেখলে বোঝা যায়। মুখে কেমন যেন একটা যান্ত্রিক শক্ত ভাব আছে। কিন্তু ওর হাসি এত সুন্দর-সরল যে, হাসলে ওঁর সাত খুন মাপ করে দেওয়া যায়। দু-যুগ আগে সানিয়া ওঁর এই হাসি দেখেই প্রেমে পড়েছিলেন।

ব্রিজেশের গায়ে লাল লোগো আঁকা একটা সাদা টি-শার্ট আর ছাই রঙা বারমুডা। বালির ওপরে পা ফেলে সমুদ্রের জলের দিকে এগোচ্ছিলেন। জল আসছে, যাচ্ছে -- তার সঙ্গে ভেসে আসছে রঙিন জেলিফিশ। গতকাল ভোরবেলা একটা বড় মাপের কচ্ছপও ভেসে এসেছিল। লোকাল জেলেগুলো বলছিল, কচ্ছপটা ভালোরকম চোট পেয়েছে, ওটা আর বাঁচবে না। কী করে চোট পেল সে-কথা জিগ্যেস করাতে ওরা বলেছে, হয়তো ওটা কোনও জাহাজের প্রপেলারে ধাক্কা খেয়েছে। কাল ভোরে কচ্ছপটাকে ঘিরে রীতিমতো ভিড় জমে গিয়েছিল। কেউ কেউ মোবাইলে ওটার ছবিও তুলছিল।

ব্রিজেশ জলের কিনারায় নেমে এলেন। পা ভেজালেন নোনা জলে। একপলকের জন্য মনে হল সমুদ্র ওর পা ধুয়ে দিচ্ছে। অফিসের ওই একশো বারোজনও কম-বেশি এই কাজটা করে থাকে। আর আশ্চর্য, ব্রিজেশ সেটা এনজয় করেন। যেমন এখন সমুদ্রের পা ধোয়ানোটা বেশ এনজয় করছেন।

সানিয়া স্বামীকে কিছুক্ষণ লক্ষ্য করছিলেন। কিন্তু ব্যাগের ভেতরে রাখা মোবাইল ফোন বেজে ওঠায় মনোযোগ সরে গেল। ছোট হাতব্যাগের মুখ খুলে ভেতরে উঁকি মারলেন। না, ব্রিজেশের ফোন নয়, সানিয়ার ফোনটাই বাজছে। ফোন ধরলেন। অপরূপার ফোন। লস এঞ্জেলিস থেকে।

ব্রিজেশ আর সানিয়ার একমাত্র মেয়ে। দু-বছর আগে বিয়ে হয়েছে। তারপর থেকেই স্টেটসে। যোগাযোগ বলতে দিনে দু-তিনটে ফোন। ব্যস।

একটা লম্বা শ্বাস ফেলে হ্যালো বললেন সানিয়া। চোখের কোণ দিয়ে ব্রিজেশকে একবার দেখলেন। জলের ওপরে আয়েসী পা ফেলছেন। তারপর অপরূপার সঙ্গে কথায় ডুবে গেলেন।

সমুদ্রের হাওয়া ব্রিজেশের ভালো লাগছিল। দেখছিলেন, হাওয়ার দাপটে দুটো পায়রা অনিচ্ছাসত্বেও তীরবেগে ভেসে চলেছে। ব্রিজেশও এখন ওদের মতো অলসভাবে প্রকৃতির হাত ধরে ভেসে চলেছেন। করপোরেট জীবনের কোনও বাঁধন নেই, শাসন নেই। ওই সূর্যের মতো তিনি স্বাধীন। কিংবা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো।

ঠিক তখনই একটা জিনিস ব্রিজেশের চোখে পড়ল।

একটা প্রকাণ্ড মাপের জিনিস, - একটা বস্তা কিংবা সেই জাতীয় কিছু, সমুদ্রের জলে ভেসে আসছে।

ব্রিজেশের কাছ থেকে পনেরো বিশ ফুট দূরে ভাসছে, অথবা, সাঁতার কেটে আসছে জিনিসটা।

আবার একটা উন্ডেড কচ্ছপ নাকি?

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই জিনিসটা ব্রিজেশের খুব কাছে এসে গেল। সমুদ্রের জল ওটাকে প্রায় ব্রিজেশের পায়ের কাছে জমা দিয়ে চলে গেল। আর বস্তাটা হামাগুড়ি দিয়ে বালির ওপরে অনেকটা উঠে এল। অন্য কেউ হলে অবশ্যই চিৎকার-চেঁচামেচি করে একলাফে ছিটকে সরে যেত, কিন্তু ব্রিজেশ অন্য ধাতুতে গড়া। একপলকেই প্রাণীটাকে তিনি যা দেখার দেখে নিয়েছেন।

না, প্রাণীটা কচ্ছপ নয়। এমন অদ্ভুত প্রাণী বোধহয় কেউ কখনও দেখেনি।

প্রাণীটার চেহারা কচ্ছপ আর শঙ্কর মাছের মাঝামাঝি। মাপে নেমন্তন্ন-বাড়ির নৌকোর মতো। মেটে রঙের শরীরে চাকা দাগ। শরীরটা মসৃণ নয়, এবড়ো-খেবড়ো। যেন খাবলা-খাবলা মাটি চাপিয়ে তৈরি। আর গায়ের চামড়াটা ব্যাঙের মতো খসখসে, তার ওপরে ডুমো-ডুমো আঁচিল।

প্রাণীটার পিছনদিকে অক্টোপাসের শুঁড়ের মতো গোটাচারেক লেজ, পাখনার মতো ছড়িয়ে আছে। চারটে শক্তপোক্ত পা। পায়ের আঙুলগুলো হাঁসের পায়ের পাতার মতো চামড়া দিয়ে জোড়া। আঙুলের ডগায় মোটা বাঁকানো নখ।

সবচেয়ে বীভৎস হল প্রাণীটার চোখ। অন্তত ব্রিজেশের তাই মনে হল।

চোখ তো নয়, যেন নীল রঙের দুটো টেনিস বল, তাও আবার শরীরের বাইরে উঁচু হয়ে আছে! এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, যেন কাউকে খুঁজছে।

প্রাণীটা নখ দিয়ে ভিজে বালির ওপরে খুব ধীরে ধীরে আঁচড় কাটছিল। বোধহয় অচেনা পরিবেশে আচমকা হাজির হয়ে ঠিক কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না।

ব্রিজেশ আর দেরি করলেন না। উদভ্রান্তের মতো এদিক-ওদিক তাকালেন। কাছেই একজন বৃদ্ধ লাঠি হাতে বালির ওপরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। চোখের পলকে ব্রিজেশ ছুটে গেলেন তার কাছে। “এক্সকিউজ মি” বলে এক ঝটকায় লাঠিটা প্রায় ছিনিয়ে নিলেন। তারপর ছুটে আবার প্রাণীটার কাছে চলে এলেন। কালীপুজোয় খাঁড়া উঁচিয়ে যেমন করে পাঁঠাবলি দেয় ঠিক সেইভাবে লাঠিটা শক্ত দু-হাতে তুলে ধরলেন মাথার ওপরে। এবং ভয়ংকর শক্তিতে প্রাণীটার মাথা তাক করে সেটা নামিয়ে আনলেন।

বেলুন ফাটার মতো শব্দ হল। একটা চিঁ-চিঁ শব্দও বেরিয়ে এল প্রাণীটার মুখ থেকে।

কিন্তু ব্রিজেশ বুঝলেন, লাঠির ঘায়ে প্রাণীটাকে সেরকম কাবু করা যায় নি।

চায়ের দোকানদারদের পেতে রাখা বাধা বেঞ্চিগুলোর দিকে চোখ গেল ব্রিজেশের। ওগুলো বেশ ভারী কাঠ দিয়ে তৈরি। সুতরাং লাঠিটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে একটা খালি বেঞ্চির দিকে ছুটে গেলেন।

প্রাণীটাকে ঘিরে ততক্ষণে ভিড় জমতে শুরু করেছে। কিন্ত সব দর্শকই ভয়ঙ্কর প্রাণীটার কাছ থেকে অনেকটা দূরত্ব বজায় রেখেছে।

বেঞ্চি কাঁধে নিয়ে ব্রিজেশ চিৎকার করে ছুটে এলেন। ওঁর মারমুখী চেহারা দেখে সবাই চটপট সরে গিয়ে ওঁকে পথ করে দিল।

প্রাণীটা তখন ওর লম্বা লাল জিভ বের করে ভিজে বালির ওপরে বোলাচ্ছে। ওর চারটে লেজ ছটফট করে লাফাচ্ছে। নীল চোখ এলোমেলো ঘুরপাক খাচ্ছে।

দর্শকদের গুঞ্জন জোরালো হল। আর ব্রিজেশ কাঠের বেঞ্চিটাকে গদার হতো ব্যবহার করলেন। সমস্ত শক্তি দিয়ে ওটা বসিয়ে দিলেন প্রাণীটার দেহে।

ওটার পিঠের চামড়া ফেটে গেল। কালচে তরল ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এল। প্রাণীটা ওর শরীর মোচড়াতে লাগল। চোখ উলটে পা ছুড়তে লাগল। চিঁ চিঁ শব্দটা আরও জোরালো হল।

ব্রিজেশ কিন্তু থামেননি। বেঞ্চিটাকে ঘাড়ে নিয়ে প্রাণীটাকে একের পর এক আঘাত করতে লাগলেন।

দর্শকদের একটা অংশ চেঁচিয়ে ব্রিজেশকে উৎসাহ জোগাতে লাগল। কেউ-কেউ ইস, আহা করতে লাগল।

হইচই আর ভিড় দেখে সানিয়া চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েছিলেন। অনেক মুখের মধ্যে স্বামীর মুখটা খুঁজছিলেন, কিন্তু দেখতে পাচ্ছিলেন না।

কাঠের বেঞ্চিটা ওঠা-নামা করাতে করাতে ব্রিজেশ হাঁপিয়ে পড়েছিলেন। যখন থামলেন তখন প্রাণীটা একেবারে থেঁতলে গেছে। নেহাত ওটার রক্ত লাল নয়, নইলে দৃশ্যটা অনেক বীভৎস দেখাত। প্রাণীটার গোটা শরীর ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেলেও চোখ দুটো অক্ষত ছিল। এখন সেই স্থির নীল চোখ দুটো কেমন শান্ত মায়াময় দেখাচ্ছিল।

মৃত প্রাণীটাকে ঘিরে জটলা বাড়ছিল। প্রাণীটার নাম কী, কোন জাতের, এইসব বিষয় নিয়ে জোরালো আলোচনা চলছিল। ব্রিজেশ বেঞ্চটা একপাশে নামিয়ে রেখে হাঁপাচ্ছিলেন।

অনেকেই ব্রিজেশের শক্তি আর সাহসের তারিফ করছিলেন। বলছিলেন, ব্রিজেশ প্রাণীটাকে খতম না করলে সি-বিচে ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটে যেতে পারত। কেউ কেউ গতকাল ভেসে ওঠা কচ্ছপটার কথা বলছিলেন।

সানিয়া ততক্ষণে ব্রিজেশকে দেখতে পেয়েছেন। কিন্তু সমুদ্রের কিনারায় জটলাটা ঠিক কীসের সেটা বুঝতে পারছিলেন না। তাই উদ্বিগ্ন হয়ে ব্রিজেশের নাম ধরে ডাকতে শুরু করলেন।

ব্রিজেশ সানিয়ার দিকে তাকালেন। উঁচুতে, বালির ওপরে দাঁড়িয়ে আছেন। ব্রিজেশ হাত তুলে ওঁকে আশ্বাস দিলেন। বোঝাতে চাইলেন যে, চিন্তার কিছু নেই, এখুনি তিনি স্ত্রীর কাছে ফিরে যাবেন।

কিন্তু ব্রিজেশের প্ল্যান ভেস্তে গেল একটা উটকো লোকের জন্য। লোকটা ভিড় ঠেলে সরিয়ে, বলতে গেলে আচমকাই, ব্রিজেশের সামনে এসে উদয় হল।

লোকটার গায়ের রঙ বেশ কালো। লম্বাটে মুখ। ঢ্যাঙা চেহারা। গায়ে পুলিশের খাকি উর্দি। মাথায় ক্রিকেটারদের কালো ক্যাপ। হাতে তামাটে রঙের ব্যাটন।

হয়তো ওর পুলিশের পোশাক আর হাতের লাঠি দেখেই জটলা পাকানো জনতার ভিড় বেশ কিছুটা পাতলা হয়ে গেল।

লোকটা পান চিবোচ্ছিল। প্রাণীটার ডেডবডির খুব কাছে এসে ও মুখ ছুঁচলো করে ‘পুচ’ করে ভিজে বালিতে পানের পিক ফেলল। তারপর লাঠিটা আলতো করে বাঁ-হাতের তালুতে ঠুকতে-ঠুকতে দাঁড়িয়ে থাকা মুখগুলোর ওপরে চোখ বুলিয়ে নিল।

লাঠিটা মরা প্রাণীটার দিকে তাক করে পুলিশটি বাতাসে রুক্ষ প্রশ্ন ভাসিয়ে দিল, - এটাকে কে মারল রে?

জনতার গুঞ্জন শুরু হল। দু-একজন একটু ইতস্তত করে ব্রিজেশের দিকে আঙুল তুলে দেখালেন।

ব্রিজেশও প্রায় একইসঙ্গে নিজের বুকে বুড়ো আঙুল ঠেকিয়ে বললেন, - আমি, আমি মেরেছি...।

লোকটা ব্রিজেশের দিকে দু-পা এগিয়ে এল। লাঠি উঁচিয়ে বেশ উদ্ধত-ভাবে জানতে চাইল, - কেন? মারলেন কেন?

- এ এমনি।

- এমনি মানে? ব্যঙ্গের হাসি হাসল পুলিশঃ সমুদ্রের মাছ-মছলি-বকচ্ছপ কি আপনার বাপের সম্পত্তি যে, এমনি-এমনি মেরে ফেললেই হল?

ব্রিজেশ একটা ধাক্কা খেলেন। লোকটা কী অভদ্রের মতো কথা বলছে! একটা পেটি কনস্টেবলের এত সাহস আর আস্পর্ধা। ব্রিজেশ দত্ত চৌধুরীর সঙ্গে এভাবে কথা বলছে! এখুনি দুটো ফোন লাগাবেন নাকি? কী করে এইসব চাকরবাকর মার্কা পুলিশের প্যান্ট খুলে নিতে হয় সেটা ব্রিজেশ ভালোই জানেন।

- কী হল? কেন মারলেন, বলুন? লোকটা পান চিবোতে চিবোতে জিগ্যেস করল।

- না, মানে..আ্যানিম্যালটা খুব ডেঞ্জারাস ছিল...।

- কী করে বুঝলেন ডেঞ্জারাস?

এইরকম একরোখা প্রশ্নের তোড়ের মুখে পড়ে ব্রিজেশ কেমন যেন থতমত খেয়ে গিয়েছিলেন। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বললেন, - মানে...ওটার চোখ দুটো কী বড়-বড়...।

- হ্যাঁ বড়-বড়। তাচ্ছিল্যের শব্দ করে মুখ বেঁকাল লোকটাঃ - আপনার চোখগুলোও তো খুব. বড়-বড়। তো তাই বলে আপনাকে আমি কি লাঠিপেটা করে মেরে ফেলব? বড়-বড় চোখ দেখলে কি আপনার অ্যালার্জি হয়, না পেটখারাপ হয়?

ব্রিজেশের প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল। এই পুলিশ কনস্টেবলটাকে এবার থামানো দরকার। পাবলিকের সামনে এইভাবে ব্রিজেশকে হেনস্থা করছে!

ব্রিজেশ সানিয়ার দিকে তাকালেন। সানিয়া এখনও উদ্বিগ্ন মুখে ব্রিজেশের দিকে তাকিয়ে আছেন। ব্রিজেশ ইশারায় ওঁকে কাছে ডাকলেন। ওঁর ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোনটা নেওয়া দরকার। প্রথম ফোনটা ব্রিজেশ করবেন লালবাজারে, ডেপুটি কমিশনারকে। তারপর দ্বিতীয় ফোনটা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিল্প-মন্ত্রীকে। গত এক বছর ধরে কোম্পানির মেগা-এক্সপ্যানশনের ব্যাপারে ওঁর সঙ্গে অনেকবার আলোচনায় বসেছেন ব্রিজেশ। ভদ্রলোক বেশ সেনসিবল আর পজিটিভ।

ব্রিজেশ হঠাৎই খেয়াল করলেন, ওঁদের ঘিরে থাকা ভিড়টা বেশ হালকা হয়ে গেছে। আর এখন যারা মরা প্রাণীটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে তারা নেহাতই বালক-বালিকা গোছের।

পুলিশটার শেষ মন্তব্যের কোনও জবাব দেননি ব্রিজেশ। কী-ই বা জবাব দেবেন! তিনি সানিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মোবাইল ফোনটা ক্রমশ ওঁর হাতের নাগালে আসছিল।

পুলিশ লোকটা বাতাসে লাঠি নেড়ে ভিড় ফাঁকা করতে লাগল। তারপর ব্রিজেশের নামিয়ে রাখা কাঠের বেঞ্চির আশপাশ থেকে পাবলিক হঠাতে লাগল। বেঞ্চিটা দেখিয়ে ব্রিজেশকে লক্ষ করে বলল, - এটা মার্ডার ওয়েপন। এভিডেন্স ডিসটার্ব করা ঠিক না।

- মার্ডার ওয়েপন! একটা সামুদ্রিক প্রাণীকে মেরেছেন বলে সেটাকে এই অসভ্য লোকটা “মার্ডার” বানিয়ে ফেলল!

“অসভ্য” লোকটা ততক্ষণে পকেট থেকে নোটবই আর পেন বের করে ফেলেছে। ঘাড় ঘুরিয়ে পানের পিক ফেলে ব্রিজেশকে লক্ষ করে প্রশ্ন শুরু করল।

- নিন, এবার আপনার নাম-ঠিকানা বলুন।

ব্রিজেশ দু-এক লহমা ইতস্তত করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর শান্ত গলায় নিজের নাম-ঠিকানা বললেন।

লাঠিটা বগলে চেপে ধরে লোকটা মনোযোগ দিয়ে সেটা নোট করে নিল।

- পুরীতে নিশ্চয়ই বেড়াতে এসেছেন? লিখতে-লিখতেই পরের প্রশ্নটা ছুড়ে দিল।

- হ্যাঁ?

- সঙ্গে আর কে-কে আছে?

- শুধু আমার ওয়াইফ, আর কেউ না।

সানিয়া ব্রিজেশের কাছে এসে পড়েছিলেন। তাই উত্তরটা দেওয়ার সময় ব্রিজেশ হাতের ইশারায় সানিয়াকে দেখালেন।

চোখ সরু করে সানিয়াকে দেখল পুলিশটা। তারপর বাঁকা সুরে বলল, - সত্যিকারের ওয়াইফ, নাকি বানানো প্যাঁচানো?

- তা-তার মানে! ব্রিজেশ উত্তেজনায় তোতলা হয়ে গেলেন।

- আ-আমাদের বয়েসটা দেখেছেন! এই বয়সে কেউ....!

হাত তুলে ব্রিজেশকে মাঝপথে থামিয়ে দিল লোকটা। বালিতে পানের পিক ছুঁড়ে দিয়ে বলল, - সেক্সের কেসে বয়েসটা ফ্যাক্টর নয়। পুলিশের লাইনে আমরা এরকম সুড্ডা-সুড্ডির কেস ঢের দেখেছি। যাকগে, ওয়াইফের নাম বলুন...।

ব্রিজেশ বললেন। ওঁর মুখে রক্তের আভা। কানের ডগা লালচে। সানিয়ার অবস্থাও একইরকম। ওঃ, এই ছোটলোকটাকে আর সহ্য করা যাচ্ছে না!

সানিয়ার কাছ থেকে নিজের মোবাইলটা চেয়ে নিলেন ব্রিজেশ। তারপর সবে ওটার বোতাম টিপতে শুরু করেছেন, কবজির ওপরে লাঠির আলতো টোকা পড়ল, - কাকে ফোন করছেন? এখন ফোন-টোন করা যাবে না, -- সব বন্ধ।

- তার মানে? রুক্ষ গলায় প্রতিক্রিয়া দেখালেন ব্রিজেশ, -ফোন করা যাবে না মানে?

হাসল উদ্ধত ছোটলোক পুলিশ। পেনটা পকেটে রাখল। তারপর হাতের এক ছোবলে ব্রিজেশের মোবাইলটা কেড়ে নিল। অনায়াসে ছুঁড়ে দিল সমুদ্রে, অনেক দূরে।

ব্রিজেশ প্রথমটা হতবাক হয়ে গেলেও তারপর ফুঁসে উঠলেন। আঙুল তুলে শাসানোর ভঙ্গিতে কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই লোকটা লাঠি উঁচিয়ে খেঁকিয়ে উঠল, - একদম গরম দেখাবেন না। মার্ডার করে আবার গরমবাজি! আবার বেচাল দেখলেই ডান্ডা মারতে-মারতে থানায় নিয়ে যাব।

লোকটার রাগী মারমুখী ভাব ব্রিজেশকে থামিয়ে দিল। সানিয়া ভয়ে ভয়ে বললেন, - প্লিজ, ওকে ছেড়ে দিন..।

লোকটা সানিয়ার দিকে তাকিয়ে হাসল। দাঁতে পানের লাল ছোপ।

- ম্যাডাম, আপনার হাজব্যান্ড একটু আগে সমুদ্রের ওই প্রাণীটাকে মার্ডার করে ফেলেছেন, - মরা প্রাণীটার দিকে লাঠির ইশারা করল লোকটা, - তাই নিয়ে আপনার হাজব্যান্ডকে গোটাকয়েক কোশ্চেন করতে চাইছিলাম - কিন্তু তিনি তো গরম খেয়ে বসে আছেন। তাঁর জন্যে আমার ইনভেস্টিগেশনের কাজটাই ঠেকে গেছে--।

সানিয়া স্বামীর বাহুতে হাত রেখে নিচু গলায় কীসব বললেন।

ব্রিজেশ চুপচাপ কয়েকবার মাথা নাড়লেন। মনে হল যেন সানিয়ার কথায় সায় দিলেন। তারপর পুলিশের লোকটাকে লক্ষ্য করে বললেন, - বলুন, কী জানতে চান..।

লোকটা চারপাশে ভিড় জমানো মানুষজনকে আচমকা খেঁকিয়ে উঠলঃ - কি চাই আপনাদের? যান, যান, নিজের নিজের কাজে যান। এখান থেকে ফুটুন --। কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে লোকটা শূন্যে লাঠি নাচিয়েছিল।

ওর ধমকে ভালোই কাজ হল। তা সত্ত্বেও একটু ফাঁকা জায়গায় সরে দাঁড়াল লোকটা। ব্রিজেশদেরও ইশারায় ডেকে নিল।

এবার ব্রিজেশের দিকে তাকাল পুলিশ, - একদম শুরু থেকে বলুন। আ্যানিম্যালটাকে প্রথম কখন দেখলেন? তখন ওটা কী করছিল?

ব্রিজেশ এতক্ষণ চুপচাপ থেকে নিজেকে ধাতস্থ করছিলেন। সানিয়ার দিকে একপলক তাকিয়ে প্রাণীটার সঙ্গে ওঁর “দেখা হওয়ার” ব্যাপারটা খুলে বললেন।

লোকটা চুপচাপ শুনতে লাগল। লাঠি বগলে রেখে ব্রিজেশের স্টেটমেন্ট টুকে নিল। তারপর নোটবই-পেন পকেটে রেখে হাতে হাত ঘষল।

- অ্যানিম্যালটা কি আপনাকে অ্যাটাক করতে এসেছিল?

ব্রিজেশ ইতস্তত করে বললেন, - না- মনে হয়...না।

- হুঁ। তা হলে ওটাকে আপনি মারতে গেলেন কেন?

- ওটা ওরকম বড়-বড় চোখে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে দেখে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মানে, না-নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম। তাই...!

- তাই আ্যাটাক করলেন?

ব্রিজেশ কেমন বিভ্রান্ত গলায় বললেন, -হ্যাঁ। মানে, ওরকমই বলতে পারেন।

চুপচাপ পান চিবোতে লাগল পুলিশ। তারপর শব্দ করে পানের পিক ফেলে বলল, - আচ্ছা, দেখুন, এমনও তো হতে পারে, আপনাকে দেখে ওই অ্যানিম্যালটা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ওটা...।

বাধা দিয়ে ব্রিজেশ বললেন, - ওটা দেখতে খুব বীভৎস...।

প্রাণীটার ডেডবডি লক্ষ্য করে তাকালেন ব্রিজেশ। ওটা ঘিরে এখনও লোকজনের ভিড়। সক্কালবেলা এরকম রোমাঞ্চকর দৃশ্য কে ছাড়ে! না, মানুষের ‘পাঁচিল’ ভেদ করে প্রাণীটাকে দেখা যাচ্ছে না।

পুলিশটা মুচকি হেসে ব্রিজেশকে বলল, - আমি যদি বলি, প্রাণীটা আপনার বীভৎস চেহারা দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল।

ব্রিজেশ থতমত খেয়ে গেলেন। এ আবার কেমন কথা! ব্রিজেশকে দেখতে বীভৎস? আশ্চর্য!

- আমাকে বীভৎস দেখতে?

- হ্যাঁ, হাসল পুলিশঃ ওই প্রাণীটার চোখে। আহা-হা, রাগ করবেন না, এরকম হতেও তো পারে। ফলে জানবেন, আপনার দেখার অ্যাঙ্গেলটাই সব নয়। অন্যদের আ্যাঙ্গেলটারও একটা দাম আছে।

সানিয়া ব্রিজেশের কাছ ঘেঁষে এসে স্বামীকে কানে-কানে কী যেন বললেন। ব্রিজেশ হাতের ইশারায় ওঁকে বোঝাতে চাইলেন, - ঠিক আছে, দেখছি।

দু-একবার ঢোঁক গিলে ব্রিজেশ পুলিশটাকে বললেন, - দেখুন, যা হয়ে গেছে, হয়ে গেছে। এখন ব্যাপারটা কীভাবে মেটানো যায় বলুন।

ভুরু কপালে তুলল পুলিশঃ - তার মানে? আমাকে কি আপনি ঘুষ খাওয়ানোর কথা ভাবছেন?

- না, না, সে-কথা বলিনি....।

একটা হাত কোমরে রাখল, অন্য হাতে লাঠিটা নাচাল।

- কী বলছেন আমি ভালোই বুঝেছি। চমৎকার! একে তো একটা নিরীহ প্রাণীকে বলা নেই কওয়া নেই অ্যাটাক করে খুন করলেন। তার ওপরে একজন সৎ পুলিশকর্মীকে অসৎ করার চেষ্টা করছেন?

সানিয়া কাঁদো-কাঁদো গলায় বলে উঠলেন, - প্লিজ, অফিসার। ওকে মাপ করে দিন। ও ভুল করে ফেলেছে। প্লিজ!

ব্রিজেশ স্ত্রীকে প্রায় খিঁচিয়ে উঠলেন, - হ্যাভ য়ু গন ক্রেজি, সানি? হোয়াই আর য়ু বেগিং টু আ পেটি কনস্টেবল?

- শাট আপ! লোকটা এমনভাবে চিৎকার করে ধমকে উঠল যে, ব্রিজেশের পিলে চমকে গেল। সানিয়ার দিকে তাকিয়ে লোকটা ঠান্ডা গলায় বলল, ম্যাডাম, - আপনার ইংলিশ মিডিয়াম স্বামীকে সামলে রাখুন। নইলে এখানেই ফেলে পেটাতে শুরু করব। পাছায় দু-ডান্ডা দিলে সিধে হয়ে যাবে। কথা বলতে বলতে লাঠিটা মারাত্মক ভঙ্গিতে উঁচিয়ে ধরল লোকটা। ওর চোখ লাল। মনে হচ্ছে যেন চোখ দিয়ে পান চিবিয়েছে।

ব্রিজেশ সঙ্গে-সঙ্গে আত্মরক্ষার ঢঙে দুহাত তুলে - সরি! সরি!বলে চেঁচিয়ে উঠলেন।

কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজের রাগ সামলে নিল পুলিশ। সানিয়াকে দেখে মায়া হল ওর। ব্রিজেশের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল, - আসলে কি জানেন, আপনাদের মতো প্রাণীদের প্রবলেম হল, যে-জিনিস আপনারা কখনও দেখেননি সেটা আপনাদের শক্র। আপনাদের চোখে সেটা বীভৎস, ডেঞ্জারাস। তাই তাকে দেখামাত্রই খতম করতে হবে। তক্ষুনি। আরও সহজ করে বলতে হলে, আপনাদের অপছন্দের জিনিসকে আপনারা সহ্য করতে পারেন না।

থু-থু করে পানের পিক ফেলল পুলিশটা। মাথার টুপিটা খুলে নিল। মাথায় হাত বোলাল। তারপর টুপিটা আবার মাথায় বসিয়ে বলল, - আমাদের স্বাধীনতার লড়াই লালমুখো ব্রিটিশদের পছন্দ ছিল না। তাই শালারা সেটা ধ্বংস করতে চেয়েছিল। সাঁওতাল-বিদ্রোহ কিংবা সিপাহি-বিদ্রোহের বেলায়ও তাই। ভিয়েতনামের স্বাধীনতা চাওয়ার লড়াই মার্কিন সরকার বা ফরাসি সরকারের পছন্দ ছিল না। তাই কত প্রাণ বেমালুম খরচ হয়ে গেল! তেমনই আপনি। ওই যে--মরে পড়ে আছে--ওই প্রাণীটা--, আঙুল তুলে ডেডবডি ঘিরে থাকা জটলার দিকে দেখাল পুলিশঃ -ওটা আপনার অপছন্দের ছিল, তাই আপনি ওটাকে সরাসরি খুন করলেন। কিন্তু আপনি কি জানেন, আপনাকে অনেকেই অপছন্দ করে? যেমন, ওই প্রাণীটা, বা আপনার অফিস কি ব্যবসায় জড়িয়ে থাকা অনেক লোক। সানিয়ার দিকে তাকিয়ে ইশারা করে হাসল, বলল, এমনকী আপনার ওয়াইফও হয়তো আপনাকে অপছন্দ করেন --।

ব্রিজেশ প্রতিবাদ করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ওকে হাত তুলে থামিয়ে দিল পুলিশ। খেঁকিয়ে উঠে বলল, - একদম চুপ। আপনার কথা ঢের শুনেছি -- এখন আপনি শুনুন। আপনাকে যারা-যারা অপছন্দ করে তারা কিন্তু এখনও আপনাকে খতম করেনি। এ প্রাণীটাও হয়তো আপনাকে আ্যাটাক করে ছিন্নভিন্ন করতে পারত, কিন্তু করেনি। এখন করেনি, কিন্তু পরে যে করবে না তার গ্যারান্টি কিন্তু কেউ দিতে পারবে না। আমিও না। তাই এখন থেকে সাবধান থাকবেন-- সিরিয়াসলি বলছি...।

সানিয়া স্বামীর হাত চেপে ধরলেন। ব্রিজেশ টের পেলেন সানিয়ার হাত কাঁপছে। সেই সঙ্গে ওঁর নিজেরও।

পুলিশটা ইউনিফর্মে হাত ঘষল। তারপর চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াল।

ব্রিজেশ চাননি, কিন্তু ওঁর মুখ দিয়ে হঠাৎই বেরিয়ে এল, থ্যাংকস...। সেইসঙ্গে বেরিয়ে এল একটা স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস। এতক্ষণ ওঁর বুকটা কেমন ধড়ফড় করছিল, বুকের ভেতরে টেনশান জমা হচ্ছিল।

হঠাৎই থমকে দাঁড়িয়ে গেল পুলিশ। - আজ সমুদ্রে খুব ভালো করে স্নান করবেন। সমুদ্র অনেক বড়। অনেক ময়লা ধুয়ে দেয়। আপনাকেও ধুয়েটুয়ে সাফ করে দেবে।

এই কথা বলে লোকটা চলে গেল।

ব্রিজেশ তাকিয়ে তাকিয়ে লোকটার চলে যাওয়া দেখতে লাগলেন।

অনেকক্ষণ পর চোখ সরিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকালেন। ওঁর মনে হল, সত্যি, বড় দেরি হয়ে গেছে। আজ সমুদ্রে খুব ভালো করে স্নান করবেন ব্রিজেশ।

শেষ

গ্রে'র অ্যানাটমি

লেখক: মহুয়া দাশগুপ্ত



বিচিং কথাটা আমাদের সময় চালু ছিল না। কিন্তু, তার ব্যবহারিক প্রয়োগ ভালোই চলত। সত্যি বলতে কী, এখন মাঝে মাঝে মনে হয় পুরো ডাক্তার সমাজটাকেই এই এক শব্দে বিশেষিত করা যেতে পারে। এ ওর নামে বলার সুযোগ পেলে একেবারে শতমুখে বলতে থাকে।

তা এই পেশার যদি এটা মুখবন্ধ হয় তবে তাতে তপতী একশোয় একশো। অবশ্য তার বিচিং করাটা শুধু একজনকে নিয়ে। তার নাম ইলোরা।

ইলোরাকে নিয়ে তপতীর সমস্যা অনেক, তা বুঝি। কিন্তু সে আর তপতী স্বর্ণময়ী হস্টেলের রুমমেট, অতএব, উঠতে বসতে তপতী ইলোরাময়ই হয়ে থাকে।

ইলোরা গেঁয়ো টাইপ, মুখ্যু, তেল মাখা চুলে স্কুলগার্লদের মতো লম্বা দু’বেণি করে, ছোট হাতা ঢোলা ব্লাউজ দিয়ে ডুরে শাড়ি পরে -- এসব তপতীর নালিশ।

সে নিজে অবশ্য বিলেতফেরত, ববড্ চুল আর পশ্চিমী পোশাকে সজ্জিত। কিন্তু তাতে কী? যে যার মতো থাকবে-।

সমস্যাটা আসলে একটু গভীরে। সমস্যার নাম সঞ্জয়।

- ওটা একটা আকাট মুখ্যু, ডান-বাঁ চেনে না, ডাক্তারি পড়বে কী? অ্যাপেনডিক্সের বদলে রেকটাম কেটে বসবে। তপতী হাত-পা নেড়ে বলে।

- কেন? কী হল? আমি জিজ্ঞেস করি।

- আরে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ-এর সামনে দাঁড়িয়ে বলে কি না এইটে তো কলেজ স্ট্রিট? একটু এগুলে কলেজ স্কোয়ারের পুকুর?

- পুকুরে ওর কী কাজ?

- সাঁতার কাটবে ভোরবেলা!

- পাঠিয়ে দিলি না কেন সোজা রাস্তায়? ঘুরে ঘুরে পৌঁছে যেত। শ্যামা বলে।

- ভাব তোরা! দু’ মাস হতে চলল, এখনও কলেজের রাস্তাগুলো চিনল না।

- আরে অমন একটা ব্যাপার হয়। সুশ্বেতা বলল। কী যেন জিনিসটা, ব্রেনে একটা ব্যাপার বুঝলি। টেম্পোরাল লোবে কী একটা হয়।

‘গ্রে’ অ্যানাটমির কত হাজারতম পৃষ্ঠার কত নিযুততম লাইনের ভিতর সূক্ষ্ম লাইন পড়েছে সুশ্বেতা তা সেই জানে। সে ‘গ্রে’ ভক্ত। বইটা পড়ে না কি ওর ‘গ্রে সেল’ গুলো চনমনে হয়ে ওঠে। কিন্তু যখন-তখন এ মেগা মহাভারতের ঘায়ে আমাদেরও ধরাশায়ী করার চেষ্টা করে, সেটাই বড় খারাপ।

সুশ্বেতা বাড়ি থেকে একটি ডেস্ক এনেছে, ঐ যেমন যাতে রেখে ঠাকুমা-দিদিমারা রামায়ণ বা মহাভারত পড়ে। ‘গ্রে’খানা তার উপর চাপিয়ে ও দুলে দুলে অ্যানাটমি পড়ে।

তুই থাম তো! চোথাই মুখস্থ হয় না, তুই গ্রে দেখাস নে। শ্যামলী বলে।

- অ্যানাটমি আবার গ্রে কী রে? ভীষণ ডার্ক, জয়তী বলে।

তপতী হঠাৎ উচ্ছসিত। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে সব্বাই চেঁচিয়ে উঠি, - ঐ তো সঞ্জয় আসছে, ওকেই জিগ্যেস কর না অসুখটা কী! আমরা গা ঠেলাঠেলি করে বলি।

তপতী দুদ্দাড় সঞ্জয়ের সামনে হাত নেড়ে বলে, - সঞ্জয়, অ্যাই সঞ্জয়।

সে বোধকরি অনুপের সঙ্গে ক্যান্টিনে যাচ্ছিল। এতগুলো মেয়ে তার পথের পাশে বসে সেদিকে সে দৃকপাতও করেনি! প্রয়োজনটাই বা কী?

- তপতীকে দেখ! পারেও বটে। জয়তী বলে।

- ওর আর দোষ কী? আমি ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। সঞ্জয়ের সিভিটা দেখ।

হ্যান্ডসাম, ব্রাইট, ন মেরিটোরিয়াস, বাপের পয়সা আছে, আবৃত্তি করে, ডিবেট করে - সুশ্বেতা কড় গুণে চলে।

- তোর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে, ওকে থামিয়ে দেয় শ্যামলী।

থরথর করে কেঁপে ওঠে ওর থলথলে শরীরটা, আবেগের গলায় বলে, - কে? সঞ্জয়?

গ্রে রঙের ঐ কাকটা, ওর মাথাতে চাঁটা কষায় জয়তী।

সত্যিই অ্যানাটমি ডিপার্টমেন্টের ছাতে বসা একটা ধূসর কাক সুশ্বেতার দিকে তাকিয়ে হাই তুলছিল।

- হেই সঞ্জয়। জয়তী হাঁকে। - পার্টে কত পেয়েছিস?

- তাতে তোর কি? মিষ্টি করে বলে সঞ্জয়।

জয়তী মোটা চশমা নাকে ঠেলে গম্ভীর হয়ে যায়।

তপতী গরগর করে। স্বভাবতই বাধা পেয়ে সে খুশি হয়নি, - ও হানড্রেড পারসেন্ট পেয়েছে! আচ্ছা সঞ্জয়, তুই ফ্রেশার্স ওয়েলকাম অরগানাইজিং কমিটিতে আছিস তো?

- ও! শুনলি তপতীর ডাকটা, শেলী ফুট কাটে। এমনটি সে কম কথা বলে। শেলী আমাদের ওয়াইজ ওল্ড আউল।

- হ্যাঁ। সঞ্জয় বলে।

- কবে যেন হচ্ছে?

- নেকী! জানে না যেন। সুশ্বেতা বলে।

- ২৮ আগস্ট। সঞ্জয় পা বাড়ায়।

তপতীও। অনুপ লেজুড় জুড়ে থাকে।

- দেখলি। জয়তী বলে।

- বরাবরই অমন। সুশ্বেতা নাক কুঁচকোয়। ও জানবে। তপতী আর ও স্কুলফ্রেন্ড। ওর একটা ন্যাচারাল অ্যাফিনিটি আছে-

- আবার? শ্যামলী বলে।

- কী আবার?

- বাংলায় বল না। গ্রে’ কে ছুটি দে একটু।

- গ্রে কোথায়? ইংরিজি বুঝিস না? আকর্ষণ রে, মাধ্যাকর্ষণ, ছেলেরা ওর অমন চারপাশে ঘুরপাক খায়।

- এখন তো উল্টোই দেখলাম। শেলী বলে।

- সঞ্জয়ের ফেরোমোনটা স্ট্রং। আমি হাওয়া শুঁকে বলি।

- এবার? এবারে কে গ্রে বলছে? সুশ্বেতা আমার দিকে হাত তুলে বলে।

আমাদের ব্যাচে দেড়শজন ছেলেমেয়ে। ডিসট্রিক্ট থেকে আসা ছেলেরা সংখ্যায় বেশি। অনুপ যেমন। ও মিদনাপুরের ছেলে। বেশ ভয়ানক। শুনেছি পড়ার সময় রাতের বেলা ও না কি দড়ি দিয়ে টিকি বেঁধে রাখে ফ্যানের সঙ্গে। যাতে ঘুমে ঝুঁকে পড়লেই টিকিতে টান পড়ে। আচ্ছা, বিদ্যাসাগর কি মিদনাপুরের লোক ছিলেন?

যাক্‌ গে এসব আমার শোনা কথা। যেসব ছেলে চামারি হোস্টেলে থাকে তারাই বলাবলি করে। শহরের নামীদামি স্কুল থেকে মোটে ক’জনা এসেছে। মেয়েদের ঝোঁক এদের দিকেই বেশি। ডিসট্রিক্টের ছেলেগুলো হালে পানি পায় না। শুধু পড়াশুনায় ভালো হলেই তো হবে না। স্মার্ট হতে হবে, শহুরে চিকনাই থাকতে হবে।

সঞ্জয় এমন একটা দামী মাছ। কত টোপ যে পড়েছে ওর জন্যে!

দু’দিন আগে ওকে সোনালির সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেছে। সোনালির দারুণ ফিগার। হাসলে গালে টোল পড়ে। রংটা অবশ্য কালো। গ্রেস দিয়ে মাজা মাজা বলা যায়।

সবাই সোনালিকে নিয়ে পড়ল।

- কী রে? মিঃ হ্যান্ডসামের সঙ্গে কী অত গুজুর গুজুর করছিলি?

- কোথায়? সোনালি খিলখিলিয়ে হাসে। যেন আমরা ওকে কাতুকুতু দিচ্ছি।

অ্যানাটমি ডিপার্টমেন্টের সামনে, আধঘন্টা ধরে।

- ও, সোনালি আকাশ থেকে পড়ে, ও তো ফ্রেশার্স ওয়েলকাম নিয়ে কথা হচ্ছিল। সঞ্জয় বলছিল সাড়ে পাঁচটায় রিহার্সাল -

সোনালি ড্রামা করবে।

- ব্যাস ওইটুকুই? তপতী ভুরু কুঁচকোয়।

- তোরা না, সোনালি হাসতে হাসতে, কোমর দুলিয়ে চলে গেল।

- চল চল, সুশ্বেতা কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখে বলে। সাঁতরার ক্লাসের সময় হয়ে গেল। দূরে ইলোরাকে দেখা গেল। দু বেণি দুলিয়ে আসছে। বুকের কাছে জড়ো করা কতগুলো বই। ক্যান্টিন থেকে অনুপ, তপতী, সঞ্জয়কেও আসতে দেখা গেল।

- অনুপটা গাধা। শেলী বলল। পড়াশুনা ছাড়া টিকি বেয়ে মাথায় আর কিছু ঢোকে না।

মাঝপথে চারজনের দেখা হল। - এইরে, শেলী বলল।

- আরে, ইলোরা? সঞ্জয়কে বেশ খুশি দেখাল। কী বই দেখি? ইলোরা বইখানা এগিয়ে দেয়।

- তুই গোল্ড ফিংগার পড়ছিস? জানিস তপতী, ইলোরা এবার পার্টে সবচেয়ে ভালো নম্বর পেয়েছে?

তপতী আবার জানে না! সেজন্যেই তো-

পালোধী তো খুব খুশি। বলছিল, কত বছর পর একজন ভালো মেয়ে আ্যানাটমিস্ট পাওয়া গেছে। কী রে, তুই প্রসেক্টরশিপ দিবি তো?

ইলোরা মাথা নাড়ে। ও আর সঞ্জয় অ্যানাটমি নিয়ে বকবক করতে করতে এগিয়ে যায়। তপতী গনগনে চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।



ঝামেলাটা হয়েছে পার্ট-এর নম্বর বেরোনোর পরই। আমরা সবাই লাইব্রেরিতে বসেছিলাম। ইলোরাও ছিল উল্টোদিকের দূরকোনায়। হঠাৎ দরজা ঠেলে ঢুকেছিল সঞ্জয়, শাশ্বত, অর্ণব, ভেঙ্কি। দরজার মুখোমুখি ইলোরা। ইলোরা-সঞ্জয় চোখাচোখি।

- আরে ইলোরা। সঞ্জয় এগিয়ে এসেছিল। - কনগ্রাচুলেশন্স্।

আমরা সবাই উৎকর্ণ!

ইলোরা লাজুক হেসে বলল, - থ্যাংকস।

তপতী অস্ফুট বলল, - পারি না।

- কী ব্যাপার? শাশ্বত বলল।

- আরে ও পার্টে দারুণ করেছে। কী নিয়ে পড়বি? সার্জারি?

- জানি না। ইলোরা তখনও লাজুক লাজুক।

- মহিলা সার্জন? ওয়াউ! ভেঙ্কি ফরফর করে বলল।

- ইঃ সার্জারি! ডান-বাঁ চেনে না সার্জারি! তখনই ঝাল ঝেড়েছিল তপতী।

আমাদের ডিসেকশন হলটা পেল্লাই সাইজের। দোতলা। চারদিকে লোহার সিঁড়ি ঘুরে ঘুরে উপরে উঠেছে। মেয়েরা একতলায়। ছেলেরা সংখ্যায় বেশি তাই দুটো তলাতেই ওদের ব্যাচ থাকে।

হলের পূর্ব-পশ্চিম কোনা রহস্যময়। সে কথা পরে। ডিসেকশন হলের মেঝে আর দেওয়ালে ঝকঝকে সাদা টাইল, নিয়ন আলোয় হাড়ের মতো চকচকে। পরপর রাখা মার্বেল টেবিলে মড়াগুলো রাখা। সেগুলো দেখলে ঘেন্না-ভয়-ভক্তি কিছুই হয় না। মমিফায়েড কতগুলো কাঠের টুকরো। ব্যবচ্ছেদের বিভিন্ন পর্যায়ে, বিভিন্ন ভঙ্গিমায়। কোনটা ছেলে কোনটা মেয়ে হঠাৎ দেখলে বোঝা মুশকিল। হায়, সৌন্দর্যের জন্য জীবদ্দশায় মানুষের আকচা আকচি!

মেয়েরা সব একটাই ব্যাচ। সাঁতরার অধীনে। ছেলেদের চোখ টাটায়। ঐ আসছে কৃষ্ণ, বা আহারে লোকটার কী সুখ, বা হ্যাঁরে, হাত ধরে দেখিয়ে দেয় কোনখানটা কাটতে হবে? এমন গোছের কথা প্রায়ই শুনতে হয়।

সাঁতরা একটা কালো শুকনো মাংসখণ্ড নিয়ে এল। ‘ফিমেল পেরিনিয়ম’। ছোট টেবিলের তিনদিক ঘিরে বেঞ্চি। উপচানো ভিড়। যৌনাঙ্গ আর পায়ুদ্বারের মাঝখানে এত হাজার ঝামেলা? উপর-নীচ, ভিতর-বাহির, বাপরে! আমরা শাড়ির আঁচলে ঘাম মুছি। ইলোরা মন দিয়ে নোটস্‌ নেয়। সরু গলায় সাঁতরা চ্যাঁচায়, - মেয়েরা, বুঝেছ?

ক্লাস শেষ হয়ে গেলে ছেলেদের একটা দল এদিকে বেয়ে আসে। ফেরোমোন! তপতী সঞ্জয়ময়, সঞ্জয়, পুডেনডাল নার্ভটা বোঝাবি একটু? তোদের তো পেরিনিয়ম হয়ে গেছে?

- ফিমেল পেরিনিয়ম? ভেঙ্কি উচ্ছ্বসিত। যাও বস্‌ ভালো করে বুঝিয়ে দাও। খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে ওঠে সবাই।

সঞ্জয় ইলোরাকে দেখায়, - ওকে বল, বুঝিয়ে দেবে।

সাধে তপতী রাগ করে?



২৮ অগাস্ট। ফ্রেশার্স ওয়েলকামের আয়োজন হয়েছে অ্যাডমিনিষ্ট্রেটিভ ব্লকের তিনতলায়, লম্বা হলঘরে। ওয়েলকাম করবে সেকেন্ড ইয়ারের দাদা দিদিরা।

মাইকে সঞ্জয়। আবৃত্তি হবে।

দাদা-দিদিরা ওয়েলকাম নোট শুরু করল, -- সিটি, কাগজের দলা, ম্যাঁও ম্যাঁও, হুক্কা হুক্কা -সব বাদ্য বেজে উঠল।

সঞ্জয় খানিক ভাবল। তারপর শুরু করল, বাদুড় বলে, ওরে ও ভাই সজারু / আজকে রাতে দেখবি একটা মজারু।

তপতী ফিসফিসিয়ে বলে, - ওর না বনলতা সেন আবৃত্তি করার কথা ছিল?

- ঠিকই করছে, যা করছে, আমি বলি।

সঞ্জয় একা নয়, হলসুদ্ধু লোক প্রবল কলরোলে পুরো কবিতাটা ওর সঙ্গে আবৃত্তি করে তুমুল হাততালি দিয়ে ওকে বসিয়ে দিল।

এরপর ড্রামা!

সোনালি আর সোহিনী দুজনে ‘সিস্টার’ সেজেছে। গাছে না উঠতে হাফ কাঁদি! সিস্টার্স হস্টেলে গিয়ে অথেন্টিক পোশাকও পরে এসেছে।

ডায়াসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক সিটি, বেড়াল ডাকে কান পাতা দায়। নাটকটা যে কী তাই বোঝাও গেল না, শোনাও না।

সবার মুখে একটাই কথা-

রোগা সিস্টারটাকেই চাই, মোটাটাকে চাই না, চাই না।

সোনালির মুখ লাল। ঘেমে নেয়ে অস্থির। সোহিনী খেপে লাল। রেগেমেগে এক্সিট করে গেল।

তুমুল হাততালি।

এমন নানারকম এনটারটেইনমেন্টের পর মঞ্চে উঠল ইলোরা!

- ও কী করবে? তপতী ভুরু কুঁচকায়।

- গাইবে। কখন সঞ্জয় আমাদের পাশে টেবিলে এসে বসেছে, খেয়াল করিনি।

- ইলোরা গায়? জানতাম না।

- তোমার খোলা হাওয়া, সহজ সরল গান ধরল ইলোরা।

গুঞ্জন হতে হতে মিইয়ে গেল। সবাই তাল ঠুকে গান শুনল। গান শেষে এনকোর হল। ইলোরা অন্য গান ধরল।

তপতী উশখুশ করছিল।

- যাবি? সঞ্জয় উঠে দাঁড়াল। ওকে বেরোনোর জায়গা দিতে।

- না আর বসা যায় না। তপতী চুপচাপ হল ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

সঞ্জয় ফাংশন শেষে ইলোরাকে হস্টেলে পৌঁছে দিল।

তপতী তার জানলা দিয়ে তেমনই দেখেছে বলল।



প্রেমের জন্য মানুষ কী না করতে পারে? সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যায় তো বেশি কথা কি? তপতী ক’দিন ডিসেকশন হলের পূর্ব-পশ্চিম কোণায় খুব ঘোরাঘুরি করল।

প্রসেক্টরশিপ পরীক্ষা এসে গেছে। সঞ্জয় আর ইলোরা প্রতিদ্বন্দী। তপতী কি নেপথ্য নায়িকা? ডোমেদের সঙ্গে ওর অত কী কথা?

- কই কিছু না। যাবি না কি টাটকা মড়া দেখতে? কি করে এমবাম্‌ করা হয় দেখতে পাবি। তপতী বলে।

- থাক থাক, আমি সভয়ে বলি।

প্রসেক্টর পরীক্ষা খুব প্রেস্টিজিয়াস পরীক্ষা। অ্যানাটমির অবিসংবাদিত মাস্টার। তাদের নাম এ এল টিতে মার্বেল ফলকে খোদাই থাকে।

তিন ভাগে পরীক্ষা হয়। লিখিত, মৌখিক এবং প্র্যাকটিকাল। শেষোক্ত ব্যাপারটায় ডিসেকশনের ডেমো থাকে, কিছু অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আইডেনটিফাই করতে হয়।

লিখিত পরীক্ষায় জনা পনেরো বসেছিল। ছজনকে পাশ করানো হল। সঞ্জয় আর ইলোরা দুজনেই পাশ।

যুদ্ধক্ষেত্রে আমরা সবাই উপস্থিত ছিলাম। ইলোরা এল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।

- কীরে নার্ভাস লাগছে? তপতী বলল।

- একটু একটু। ইলোরা ফিকে হাসল। কপালে দই-এর ফোঁটা কেটেছে দেখলাম।

- জল খাবি? ঠান্ডা জল আছে। তপতী খুব হেলপফুল।

তপতী একটা বোতল বাড়িয়ে দেয়।

ইলোরা দু ঢোঁক খেয়ে বলে, - কেমন গন্ধ!

- গন্ধ? ও, টমেটো জুস রাখা ছিল তো। গন্ধটা যায়নি বোধহয়। বোতল ধোয়া আছে। হেঁ হে বিদেশি জুস কি না!

ইলোরা কথা না বাড়িয়ে পুরো জলটা খেয়ে নিল। মুখ মুছে একটা ঢেঁকুর তুলল।

তারপর বলল, - মাথাটা কেমন টলছে রে!

- বসবি?

এমন সময় ডঃ পালোধী, সাঁতরা, ডঃ মীনা, ডঃ রায় সব্বাই হলে ঢুকল। ঘণ্টা পড়ল। ছজন ক্যান্ডিডেট কাবার্ডের উপর রাখা জারগুলোর দিকে এগিয়ে গেল।

- আইডেন্টিফাই। পালোধী বলল।

জারের মধ্যে ফর্মালিনে চোবানো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ।

একে একে পাঁচজনের পরীক্ষা হল। বাকি ইলোরা।

তার তখন বেশ টালমাটাল অবস্থা। দুলছে। চোখগুলো করমচার মতো লাল। আমি তপতীকে কানে কানে বলি, - কিছু খাইয়েছিস না কি?

- জল। তপতী সপাট বলে।

- বলো, এটা কী? পালোধী বলে।

ইলোরা ফোকাস করার চেষ্টা করে। তারপর বলে, -মটরশুঁটি।

- অ্যাঁ, কী বললে? পালোধী হতভম্ব। - আর ওটা, ইলোরা কাঁপা কাঁপা আঙুল তোলে, -ওটা শুঁয়াপোকা -

অ্যানাটমিস্টরা এ ওর মুখ চায়। তপতী রুমাল চাপা দিয়ে খুকখুক হাসে। সারা ক্লাসই হাসছিল। ইলোরার থামার লক্ষণ নেই। - আর স্যার, ওটা, ওটা স্যার কী বলুন তো, একদলা চর্বি লাগে! আর এইটে, - বলে ঘাড় বাঁকিয়ে থামে ইলোরা, - হয়েছে, এইটে স্যার রাবারের বল, কেমন ভাসতাছে দেখুন -হি হি।

ক্লাসশুদ্ধু সবাই হেসে ওঠে।

- সাইলেন্স, পালোধী গর্জায়, -ওয়াট ইজ দিস?

- নো চিংড়ি ফিশ স্যার, ইলোরা ঘুরে দাঁড়ায়, -ওটা কাউপারস গ্ল্যান্ড, তারপর এপিডিডিমিস, এটা থাইমাস গ্ল্যান্ড আর এটা স্পিলনের ম্যাজিটাল সেকশন।

সবাই চুপ। ইলোরা তপতীর দিকে তাকিয়ে চোখ মারে।

আমাদের ভুরু সটান ধনুকের মতো উপরে উঠে যায়। তপতীর মুখ ফ্যাকাশে।

পালোধী অবাক, এতক্ষণ কী সব বলছিলে?

- আসলে স্যার আমার অটোটোপ্যাগনসিয়া হয়ে গেছিল, মাঝে মাঝে হয়, ইলোরা সুশ্বেতার দিকে তাকিয়ে চোখ টেপে-গ্রে’র আ্যানাটমি পড়ে জেনেছি। টেম্পোরাল নয় প্যারাইটাল লোব।

বলাই বাহুল্য, ইলোরা সেবার প্রসেক্টর হয়েছিল।

গল্পের একটুই বাকি আছে। তপতীকে ডেকে ইলোরা বলেছিল, তার বাড়ি ভুটান সীমান্ত ঘেঁসা গ্রামে। তার বাবার আবগারির কারবার। একটু-আধটু তাদেরও চলে। টমেটো জুসটা উপকারেই এসেছে। থ্যাংকিউ।

তাছাড়া, তপতীর টেনশন করার কিছু নেই। সঞ্জয়কে ওর মোটেও হৃদয়ে ধরেনি, ওর বরং অনুপকেই পছন্দ!

শেষ




ব্রাত্য (শেষাংশ)



প্রথমাংশ

দ্বিতীয়াংশ

তৃতীয়াংশ

লেখক: নারায়ণ স্যান্যাল


তৃতীয় অংশের পর

-- ননীমাধবের বাড়ি থেকে আবার রিকশা চেপে বেরিয়ে পড়েন উনি। অনলবর্ষী সূর্য তখন ঢলে পড়েছেন পশ্চিম দিগন্তে। চারটে বেজে গেছে। ক্লান্ত দেহটা রিকশায় এলিয়ে দিয়ে আকাশপাতাল চিন্তা করতে থাকেন। চিন্তার আর পারম্পর্য থাকছে না। কখনও মনে পড়ছে অসীমকে-কখনও বৈশাখীকে, কখনও আ্যানির মুখখানা ভেসে উঠছে মনের পটে। নীলা? না, নীলার কথা আর তিনি ভাববেন না। যে মেয়ে তাঁর বাপের সম্মান ধুলোয় লুটিয়ে দিয়ে কুলি-ব্যারাকে গিয়ে আশ্রয় নিতে পারে তাঁর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই আর।

অরুণাভ তাহলে সত্যিই চুরি করেনি! এটা তাহলে ননীমাধবের একটা কারসাজি! ননীমাধব তাহলে ঠিকই চিনেছিলেন পরমানন্দকে! তাই আসল কথাটা তাঁর কাছেও গোপন রেখে গেছেন। প্রথমটা রাগ হয়েছিল ননীমাধবের ওপর—এই হীন কাজের জন্যে। এখন কিন্ত আর রাগটা নেই-মনে হচ্ছে ওই ননীমাধবই তো একমাত্র লোক যে সম্মান করেছে তাঁর আদর্শনিষ্ঠাকে। সাহস করে বলতেও পারেনি সাজানো চুরির কেসের কথাটা। কিন্তু অরুণাভ চুরি করুক আর নাই করুক- সে জন্য তো তাঁর আপত্তি নয়। তাঁর আপত্তি হচ্ছে অন্য কারণে। আজ তিনি আর অরুণাভ নন্দী এক নৌকার যাত্রী নন। তিনি চলেছেন ভাঁটিতে আর অরুণাভ উজানে। তিনি চাইছেন দেশের শিল্প-উন্নয়নের পথ প্রশস্ত করতে। শ্রমিক আর মালিক হাতে হাত মিলিয়ে গড়ে তুলবে নতুন নতুন শিল্পসম্ভার। বিদেশী মুদ্রা আহরণ করতে হবে। নামতে হবে বিদেশী পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায়। জাতীয় পরিকল্পনা রূপায়িত হবে শ্রমিক-মালিকের যৌথ প্রচেষ্টায়। এ জন্যে অবশ্য স্বার্থত্যাগ করতে হবে দু পক্ষকেই। শ্রমিককে দিতে হবে জীবনধারণের উপযুক্ত পরিবেশ। শুধু জীবনধারণ নয়-- উন্নততর জীবনযাপনের ওদের জীবনের মান উন্নয়ন করতে হবে। তাই তো উনি ব্যবস্থা করেছেন কুলি-ব্যারাকে পাকা রাস্তা, পাকা নর্দমা,-- ব্যবস্থা করেছেন প্রাথমিক শিক্ষার, স্বাস্থ্যরক্ষার। শ্রমিকও দেখবে বৈকি মালিকের স্বার্থ। ওঁর কারখানার লোকেরাও ওঁকে দেবতার মতো ভক্তি করে। চীপ ক্যান্টিন খোলার দিন ওঁকে ওরা পরিয়ে দিয়েছিল একটা মোটা গাদাফুলের মালা।

অরুণাভ কিন্তু ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখছে জিনিসটা। সে চায় ধর্মঘট করে, চাপ দিয়ে, শ্রমিক ইউনিয়ন পাকিয়ে মালিককে শায়েস্তা করতে। বন্ধুত্বের সম্পর্কটা সে স্বীকার করে না। শ্রমিক আর মালিক যেন খাদ্য আর খাদক! আশ্চর্য! সে কোনো আপস চায় না-- সে শুধু লড়তেই চায়। আর এই লড়াইয়ের জন্য যদি কারখানাটা বন্ধও থাকে কিছুদিন. দেশের শিল্প-উৎপাদন ব্যাহত হয়-- তাতেও সে দুঃখিত নয়।

এই আদর্শগত বিভেদের জন্যই আজ তিনি ক্ষমা করতে পারেন না অরুণাভকে। সহ্য করতে পারেন না তাঁর উদ্ধত বিদ্বোহীর ভঙ্গিটা।

-- এই রোখো! রোখো!

দাঁড়িয়ে গড়ে রিকশাটা। রিকশাওয়ালাকে বলেন হুডটা তুলে দিতে। পড়ন্ত রোদে বড় কষ্ট হচ্ছিল তাঁর। রিকশাওয়ালা হুডটা তুলে দেয়। গাড়িটা চলছিল পশ্চিমমুখো; সূর্য দিগ্বলয়ে হেলে পড়েছেন। হুড তুলে দেওয়াতেও রোদটা আটকাল না। সামনে থেকে রোদ লাগছে। রিকশাওয়ালা সামনের পর্দাটা ফেলে দেয়। ঘেরাটোপের মধ্যে বন্দি হয়ে পড়লেন উনি। হঠাৎ একটা কথা মনে হল তাঁর। রিকশাওয়ালাকে বললেন বাঁ দিকের রাস্তায় ঘুরে যেতে। কুলিবস্তিতেই যাবেন তিনি একবার। ঘেরাটোপের মানুষকে আর কে চিনবে? বরং রিকশা থেকে নামবেনই না; রিকশাওয়ালাকে দিয়েই খোঁজ নেবেন। বাঁ দিকের কাঁচা সড়কে নামল রিকশাটা। এঁকেবেঁকে চলল কুলি-ব্যারাকের দিকে। এ পথে তিনি কখনও আসেননি। ইতিপূর্বে আসবার প্রয়োজনও হয়নি। তিনি ওপরতলার বাসিন্দা-- নীচের মহলের খবরদারির প্রয়োজন হলে লেবার-- স্ট্যাটিসটিক্স-এর প্রোফর্মাটাই দেখেন। সেই চার্ট থেকেই জানতে পারেন লেবার ব্যারাকের সংবাদ। আজ এখানে তাঁকে আসতে হয়েছে প্রাণের দায়ে। মনে পড়ছে ঠিক এ পথে না এলেও এ পাড়ায় একদিন এসেছিলেন তিনি, যেদিন চীপ ক্যান্টিনটা খোলা হয়। তিনি একা নন-- অনেক গণ্যমান্য অতিথিই এসেছিলেন সেদিন। রাস্তাগুলো ছিল ঝকঝকে-নর্দমাগুলো ছিল পরিষ্কার। কিছু দূরে দূরে বসানো ছিল সাদা-কালো ডোরাকাটা ড্রাম-অর্থাৎ ডাস্টবিন। সমস্ত এলাকাটা লাগছিল যেন চিত্রকরের আঁকা একখানা সুন্দর ছবি। মনে আছে সেদিন মনে মনে তৃপ্তির হাসি হেসেছিলেন। বস্তিজীবনের যে চিত্র দেশী-বিদেশী উপন্যাসে পড়া ছিল-তাঁর সঙ্গে আসমান-জমিন পার্থক্য লক্ষ করেছিলেন তাঁদের কারখানার। খুশি হয়েছিলেন।

আজ বুঝতে পারছেন ভুলটা।

আবর্জনা এসে জমেছে পথে। নর্দমাগুলো ভরে আছে নীলচে কালো কাদা-জলে। একটা কালভার্ট মুখ থুবড়ে পড়ে আছে পথের ওপর। নামতে হল অগত্যা। জলপ্রবাহ আটকে গেছে এখানে। একটা কুকুর চাপা পড়েছে লরিতে। দুর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হয় চার-পাঁচ দিন পূর্বেই ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছে বেচারির-- যদিচ তার অন্তেষ্টিক্রিয়ার কোনো ব্যবস্থা হয়নি এখনও। পথে লোকজন নেই। কয়েকটা শকুন এসে নেমেছে এই সুযোগে। অনেক মড়াকাটার অভিজ্ঞতা ছাপিয়ে ডাক্তার চৌধুরীর গা গুলিয়ে উঠল। খালি পেটে আছেন বলে কি? হর্ন দিতে দিতে একখানা ময়লা-ফেলা লরি এসে পড়ল প্রায় ঘাড়ের ওপর। রিকশাটা কাদায় নেমে পাশ দিল। পাশ দিয়ে চলে গেল লরিটা। কয়েকটা কাদামাখা শালপাতা উড়ে এসে পড়ল রিকশায়-- ওঁর খদ্দরের সাদা পাঞ্জাবিটায় যেন রসিকতা করেই এঁকে দিল একটা কলঙ্কচিহ্ন। পরমানন্দ লক্ষ করে দেখলেন ময়লা-ফেলা লরিটার তলদেশ প্রায় ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছে। সমস্ত রাস্তায় দুর্গন্ধযুক্ত তরল পদার্থের একটা ধারাচিহ্ন আঁকা পড়ে যাচ্ছে-- গাড়িটার পেছন পেছন। সম্ভবত গন্তব্য স্থাবে পৌঁছবার পূর্বেই লরি ভারমুক্ত হবে!

এই তা হলে তাঁর কুলি-ব্যারাকের জীবনালেখ্য?

রিকশাটা দাঁড়িয়ে পড়ে একটা পথের বাঁকে। রিকশাচালক জানায় পি-নাইন ব্যারাকে এসে গিয়েছে গাড়ি। উনি তাকেই বলেন সামনের বাড়ির কড়া নাড়তে, লোক ডাকতে।

অল্প পরে লোকটা ফিরে আসে দুঃসংবাদ নিয়ে। এ বাড়ির বাসিন্দার চাকরি গিয়েছে। নোটিশ পেয়েছিল কোয়ার্টার ছেড়ে দিতে। কদিন আগে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে।

কী আশ্চর্য! এই সহজ কথাটা খেয়াল হয়নি তাঁর !

অল্পবয়সী দুটি ছোকরা এগিয়ে আসে রিকশা দেখে। খড়িওঠা রুক্ষ দেহ-ময়লা ভর্তি সারা গায়ে। উর্ধাঙ্গ নগ্ন-নিম্নাঙ্গে খাকি ধুলিমলিন হাফপ্যান্ট। এসে বলে : ওস্তাদদাকে খুঁজছেন?

-- -ওস্তাদদা! সে কে? আমি খুঁজছিলাম অরুণাভ নন্দীকে-- এই বাসাতেই থাকত না?

-- হ্যাঁ, ওকেই আমরা ওস্তাদদা বলি। ওস্তাদদাকে কোম্পানি তেড়িয়ে দিয়েছে। ওই শালা ম্যানেজার আর ওই হারামজাদা চৌধুরী ডাক্তারের দমবাজি।

চমকে ওঠেন পরমানন্দ। বলেন : চৌধুরী ডাক্তার কে?

-- কে জানে, হবে কোন...

কান ঝাঁ-ঝাঁ করে ওঠে। ও ছোকরা কি জানে ওই অশ্লীল শব্দটার অর্থ? ছেলেটি আবার বলে- তা আপনি বুঝি পার্টি অফিস থেকে আসছেন? ওস্তাদদার কাছে?

-- হ্যাঁ, কোথায় থাকে অরুণাভ বলতে পারো?

-- জানব না? আবে এ রিকশালা, সুন্!

ওরা রিকশাচালককে হদিসটা বাতলে দেয়। পরমানন্দ তখন অবাক হয়ে ভাবছিলেন এদের কথা। কতই বা বয়স ওদের? এখন থেকেই মনুষ্যত্বকে গলা টিপে ধরা হয়েছে। লেখাপড়া শিখবে না, ভদ্র কথা, ভদ্র আচার কাকে বলে জানবে না কোনোদিন। এই বিষবাষ্পের শ্বাসরোধী বাতাবরণে তিলে তিলে নীল হয়ে যাবে ওই অমৃতের পুত্রেরা। জীবনের চরম শিক্ষাই হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। ম্যানেজার ইতিমধ্যেই হয়ে উঠেছে নিকট কুটুম্ব আর মালিক…..

এই তাঁর কীর্তি!

এর জন্যে মনের গভীরে তিনি পোষণ করেন অহঙ্কার! শিল্পোন্নয়ন করছেন দেশের! গঠন করছেন জাতি! শ্রমিকদের জীবনের মান উন্নয়ন-- একমাত্র লক্ষ্য তাঁর!

রিকশাওয়ালা বেঁকে বসল। সেই কোন সকালে ওঁকে রিকশায় তুলেছে। এখনও একটা পয়সা হাতে পায়নি। ঘুরে মরছে সারা শহর। সে আর যাবে না। ওকে ভাড়া মিটিয়ে দেওয়া হোক এবার।

-- কত ভাড়া হয়েছে তোমার? প্রশ্ন করেন পরমানন্দ।

-- তা টাকা তিনেকের কম নয়।

একখানা পাঁচটাকার নোট ওর হাতে দিয়ে বলেন : চলো-- ওই যে কী বস্তির কথা বলল ওরা -- ওখানে চলো।

রিকশাওয়ালা নরম হয়। আবার প্যাডলে উঠে বসে। এঁকেবেঁকে ফিরে চলে। পিছন থেকে বস্তির ছোকরাটি মন্তব্য করে তার দোস্তকে : মালদার লোক মাইরি; দেখলি কেমন ঝড়াক্‌সে নিকলে দিলে কড়কড়ে নোটখানা!

*********************

রিকশাখানা যখন এসে পৌঁছল বস্তিটায় সূর্য তখন ক্লান্ত দেহে এলিয়ে পড়েছেন পশ্চিম দিগ্বলয়ে। আঁকাবাকা পথের দুধারে মেটে ঘর, খাপড়ার চাল। পথের পাশে টিউকলের সামনে লম্বা কিউ। জলে থিকথিক করছে সেখানটা। ঘিনঘিনে এলাকাটা পার হয়ে হঠাৎ একটা ফাঁকা মাঠে এসে পৌঁছল রিকশাটা। এখানেই বোধহয় মীটিং হবে। কীসের মীটিঙ? অনেক মেহনতী মানুষ জড়ো হয়েছে মাঠে। কয়েকটা ফেস্টুন দেখা যাচ্ছে। এঁকেবেকে আছে বলে লেখাগুলো এখন পড়া যাচ্ছে না। দরমা-চাটাইয়ের ওপর খবরের কাগজ এঁটে তার ওপর লাল কালিতে কী যেন লেখা আছে। বাঁশের খুঁটের মাথায় ওই দাবিটাকেই নিয়ে ঘাড়ে করে নিয়ে এসেছে মীটিং এ। ময়দানের মাঝখানে খানকয়েক চৌকি পাতা। পাশে একটা বংশদণ্ডে উড়ছে একটা নিশান। রক্তচক্ষু মেলে চেয়ে আছে পতাকাটা পরমানন্দের দিকেই।

রিকশাওয়ালাই খোঁজ নিতে নিতে এসে হাজির হল বাড়িটার সামনে। বাড়ি অবশ্য গৌরবে। আসলে খোলার চালার একটা কামরা। সেখানেও অনেক লোক জটলা করছে। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে তখন। রিকশা দেখে জনতা পথ দেয়। ত্রিচক্রযান এসে থামল চালাখানার সামনে।

-- ওস্তাদ? হ্যাঁ, এই বাড়িই। হ্যাঁ, আছেন ভেতরে। কে এসেছেন?

পর্দা সরিয়ে রিকশা থেকে নেমে আসেন পরমানন্দ।

ওরা যেন ভূত দেখল। একটা গুঞ্জন উঠল জনতার মধ্যে। ভ্রূক্ষেপ করলেন না। সোজা উঠে গেলেন খোলার ঘরখানিতে। প্রথমেই নীচু চালাতে একটা ঠোকর খেলেন মাথায়। সেটাও গ্রাহ্য করলেন না।

ঘরের ভেতরটা অন্ধকার। হ্যারিকেন জ্বলছে একটা। জনা আট-দশ লোক নিম্নস্বরে কী যেন আলোচনা করছে। আগন্তুককে দেখে চমকে ওঠে সবাই।

ঘরে কোনো আসবাব নেই। একপাশে দড়ির একটি খাটিয়া-- তার নীচে মাটির একটা কলসির মুখে চাপা দেওয়া এনামেলের একটি গ্লাস। ওপাশে একটি টিনের সুটকেস। দেওয়ালে দুখানা ছবি-একটি সুভাষচন্দ্রের, অপরখানা লেনিনের। দরমার দেওয়ালে কঞ্চির গোঁজে টাঙানো আছে একটি হ্যান্ডলুমের ময়লা হাফশার্ট। মেঝেতে তালপাতার একটি চাটাই পাতা। তার ওপরেই বসেছিল লোকগুলো পা মুড়ে। অরুণাভও ছিল ওদের মাঝখানে--পরনে তার পায়জামা আর হাতকাটা গেঞ্জি।

-- কাকে চাই?

-- তোমাকেই। কয়েকটা কথা ছিল।

-- বসুন।

পরমান্দ চাটাইয়ের ওপরেই পা মুড়ে বসে পড়েন। লোকগুলো উঠে দাঁড়ায় সরে বসে।

-- বলুন, কী বলতে চান-নির্বিকার কণ্ঠ অরুণাভের। তার সামনে খোলা একটি খাতা অথবা বই-তারই পাতা ওলটাতে ওলটাতে বললে কথাটি।

পরমানন্দ প্রত্যুত্তরে বলেন : শুধু তোমার সঙ্গে কথা আছে আমার -- নিভৃতে।

বইটা মুড়ে রেখে দেয় অরুণাভ। মুখোমুখি তাকায় এতক্ষণে পরমানন্দের দিকে। সোজা প্রশ্ন করে-- ফ্যাকটরির ধর্মঘট সম্বন্ধে কথা কি? তা হলে এঁদের সকলের সামনেই কথা বলতে হবে।

-- না, আমি তোমার সঙ্গে কয়েকটি ব্যক্তিগত কথা বলতে চাই। কারখানার স্ট্রাইকের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই।

-- ও!

অরুণাভ তাঁর অনুচরদের বলে বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করতে। অধিকাংশই উঠে দাঁড়ায়। অল্পবয়সী একটি ছেলে হঠাৎ বলে বসে-ওস্তাদ, এ কাজ তুমি কোরো না। ওদের কারসাজি বুঝতে পেরেছি আমরা।

-- বাদল, তুমি বাইরে যাও।

ছেলেটি একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে ওঁদের দুজনের দিকে। তারপর বলে ওস্তাদ! আগুন নিয়ে খেলা কোরো না তুমি। এতগুলো মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেললে তার ফল ভালো হয় না। এত সহজ কথাটাও বুঝতে পারব না আমরা ভেবেছ?

-- বাদল! তুমি যাবে কিনা। মুষ্টিবদ্ধ হয় অরুণাভের হাত।

বাদল একবার আশেপাশে তাকিয়ে নেয়। লক্ষ করে দেখে অনেকেরই নীরব সমর্থন আছে তার উদ্ধত্যে। পাশ থেকে মোটা ভাঙা ভাঙা গলায় রহমৎ বলে ওঠে-- লেকিন ওস্তাদ। তুমিই হিসাব জুড়ে লেও ভাই-- উর কুনো গোস্তাকি হল কিনা। তুমার সাথে মালিকের আর কুন কথা আছে? ই লোগদের মনে ধোঁকা লাগল তো কি ফিন অ্যান্যায় হল?

অরুণাভ উঠে দাঁড়িয়ে বলে : বড়ভাই। এটুকু বিশ্বাস যদি না থাকে তোমাদের -- তবে কেন আমার হাতে ঝান্ডা তুলে দিয়েছিলে? যদি মনে করে থাক- একলা পেয়ে এক টুকরো রুটির লোভ দেখিয়ে ওরা আমাকে ধোঁকাবাজি দেবে তবে আমাকে এ কাজের ভার দেওয়া ঠিক হয়নি। তুমি আজ বিশ বছর আছ এ কারখানায়-- তোমাকে আমি বড়ভাই বলেছি- তোমাকে না জানিয়ে কোনও গোপন শর্তে মালিকের সঙ্গে আমি হাত মেলাতে পারি?

রহমৎ তার প্রায় সাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলে-- খামোশ। ব্যস, খুব। আযাও ভাইসব।

অধিকাংশ লোকই বেরিয়ে যায় এ কথায়। শুধু বাদলের অগ্নিবর্ষী অক্ষিতারকা দুটি তখনও ভুলছিল জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো। রুখে ওঠে সে : বড়ভাই, আমি ঘরপোড়া গোরু। এর আগে পাঁচঘাটে জল খেয়েছি আমি। এ ব্যাপার আমার জানা আছে। আমি যাব না।

রহমৎ তার হাম্বরধরা লৌহকঠিন হাতখানা বাড়িতে দেয় সামনের দিকে। গেঞ্জি না হয়ে শার্ট হলে বোতামগুলো থাকত যেখানটায় বাদলের একমুঠো জামা সেখান থেকে আটকে পড়ে রহমতের বজ্রমুষ্টিতে। মুখে কিছু বলে না রহমত; বাঁ হাতখানা বাড়িয়ে দেয় বারের দিকে।

-- ঠিক হ্যায়। -- বেরিয়ে যায় বাদলও।

অরুণাভ ঝাঁপের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এসে বলল : বলুন এবার।

-- তুমি কি আশা করো এভাবে ধর্মঘট করে কোম্পানিকে জব্দ করতে পারবে?

ধর্মঘট সন্ধে আলোচনা করতে হলে আবার ওদের ফিরে ডাকতে হয়।

-- ও আচ্ছা। -- সামলে নেন পরমানন্দ নিজেকে। তারপর একটু ইতস্তত করে প্রশ্নটা সোজাসুজি করে বসেন-- নীলা কোথায়?

-- আমি জানি না।

-- জানো।

চোখ তুলে অরুণাভ ওর দিকে তাকায়। বলে -- চোখ রাঙাবেন না, এটা আপনার কারখানা নয়।

-- সে আজ তোমার এখানে আসেনি?

-- না।

-- না? আমি বিশ্বাস করি না।

-- সে আপনার মর্জি।

-- তোমাকে আমি পুলিশে দিতে পারি- তা জানো? জেল খাটাতে পারি-- সেটা মনে আছে?

-- আছে, কারণ যে পরিমাণ অর্থ থাকলে একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে জেলে পোরা যায় তা আপনার আছে, তা জানি। কিন্তু আপনি হিসাবে একটু ভুল করছেন; জেলখাটা জিনিসটাকে আজ আপনি যতটা ভয়াবহ মনে করছেন-আমি তা করি না। তাই তো সেদিন বলেছিলাম, অভাবেই শুধু স্বভাব বদলায় না ডক্টর চৌধুরী, প্রাচুর্যেও বদলায়।

-- আমি নিশ্চিত জানি-আমার বাড়ি থেকে চলে আসার পর সে তোমার এখানে এসেছিল।

-- ঠিকই জানেন আপনি। সে এসেছিল-তবে আজ নয়-- কাল রাত্রে। গভীর রাত্রে।

-- তারপর?

-- তারপর আর কী জানতে চান বলুন?

হঠাৎ ভেঙে পড়েন কুলিশকঠোর পরমানন্দ-- আর্তকণ্ঠে বলে ওঠেন অরুণ, আমি মিনতি করছি। তুমি জানো আমি কী জানতে চাইছি। বাপ হয়ে আর কীভাবে প্রশ্ন করতে পারি আমি?

অরুণাভ এক মুহূর্ত চুপ করে থাকে। তারপর বলে-হ্যাঁ জানি; আপনার প্রশ্নের উত্তরে তাই জানাচ্ছি ননীমাধববাবুর পক্ষে কোনো বাধা নেই আপনাকে বৈবাহিক বলে স্বীকার করায়।

নৈঃশব্দের একাধিপত্য পরের কয়েকটি মুহূর্তের ওপর! নীরবতা ভেঙে অরুণাভই আর একটু টুকরো খবর অবজ্ঞায় ছুঁড়ে ফেলে দেয় পরমানন্দের উৎসুক্যের সম্মুখে -- কাল রাত্রে সে এখানে থাকেনি-চলে গিয়েছিল আপনার গুরুদেবের কাছে। আজ সকালে সেখান থেকেও চলে গেছে-- কোথায় তা আমি জানি না। আর কিছু জানতে চান?

-- সে আজ সকালে সেখান থেকে চলে গেছে তা তুমি জানলে কী করে?

টাঙানো কামিজটার পকেট থেকে একটা বন্ধ ভারী খাম বার করে সেটা অরুণাভ ছুঁড়ে দেয় পরমানন্দের দিকে, বলে-- আজ সকালে আমার লোক এটা দিতে গিযেছিল-- জেনে এসেছে সে ওখানে নেই।

ভারী খামটার ওপর গোটা গোটা অক্ষরে নীলার নাম লেখা। নাড়াচাড়া করে বন্ধ খামটা পরমানন্দ ফেরত দেবার উপক্রম করেন। অরুণাভ বাধা দিয়ে বলে-- ওটা আপনার কাছেই রাখুন। যদি কোনোদিন নীলার সন্ধান পান-- তাকে দেবেন।

তারপর মুহূর্তখানেক ইতস্তত করে বলে-আপনিও পড়ে দেখতে পারেন, যে প্রশ্ন আপনি করতে পারলেন না, তার জবাব পাবেন ওটায়।

চিঠিখানা অগত্যা গ্রহণ করতে হয় পরমানন্দকে।

-- আর কিছু বলবার আছে কি?

-- হ্যাঁ, একটা কথা। একদিন তুমি আমাকে শ্রদ্ধা করতে। মেদিনীপুর থেকে খুঁজে খুঁজে এতদূর এসেছিলে শুধু আমাকে বিশ্বাস কর বলেই। তোমার সে বিশ্বাসের সে শ্রদ্ধার কণামাত্রও কি অবশিষ্ট নেই আজ?

ভেবেছিলেন খুব কঠিন প্রশ্ন করেছেন; কিন্তু জবাব দিতে মুহূর্ত বিলম্ব হল না অরুণাভের। বললে-- না। কারণ আপনি আর সেই মানুষ নন-আপনি আদর্শচ্যুত, আপনি ব্রাত্য।

-- এই জন্যেই কি নীলার আশ্রয় হয়নি কাল এ বাড়িতে?

-- না। সেটার কারণ বুঝতে পারবেন আমার চিঠিখানা পড়লেই। কিন্তু এবার আসুন আপনি। আমাদের মীটিঙ শুরু হবে এইবার। ওরা অপেক্ষা করছে আমার জন্য।

পরমানন্দ উঠে পড়েন। দ্বারের দিকে পা বাড়ান।

-- দাঁড়ান। আপনাকে বড় রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসব।

-- প্রয়োজন হবে না।

-- হবে। না হলে হয়তো আপনি সুস্থ শরীরে ফিরে যেতে পারবেন না এ পাড়া থেকে। যেতে হবে হাসপাতালে।

পরমানন্দ এতক্ষণে একটা জবাব দিতে পারেন-- হাসপাতাল জিনিসটাকে আজ তুমি যতটা ভয়াবহ মনে কর অরুণ, আমি ততটা করি না। সঙ্গে যাবার দরকার হবে না তোমার।

জামাটা গায়ে দিতে দিতে অরুণাভ বলে : একদিন ডাক্তার পরশুরাম চৌধুরী আমার চিকিৎসা করেই শুধু ক্ষান্ত হননি-- নিজে আমাকে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিলেন নিরাপদ আশ্রয়ে-- তাই আপনি না চাইলেও আমাকে সঙ্গে যেতে হবে। আমি জানি বাদলরা ওত পেতে বসে আছে আপনার প্রত্যাবর্তনের পথ চেয়ে। চলুন।

পরমানন্দ ওর প্রসারিত হাতটি গ্রহণ করে হঠাৎ বলে বসেন-- পরশুরাম চৌধুরীর ঋণ তুমি আজও মনে করে রেখেছে অরুণ?

ওঁর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে অরুণাভ বলে- ডাক্তার পরশুরাম চৌধুরীকে কোনো বিপ্লবী চেষ্টা করেও ভুলতে পারবে না-- তিনি আমার যে উপকার করেছেন তা ভুলে যাওয়া অসম্ভব আমার পক্ষে। শুধু আমাকে বাঁচাতে গিয়েই তিনি অকথ্য অত্যাচার সহ্য করেছেন; তিনি আমার পিতৃবন্ধু, তাকে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করি আমি! যেমন আন্তরিকভাবে ঘৃণা করি হবু এম. এল. এ. ডাইরেকটর পরমানন্দ চৌধুরীকে-- ঘিনি মজদুর-উত্থান দমন করতে অনায়াসে মিথ্যা চুরির কেস সাজান, যিনি সাধারণ মানুষকে ঢুকতে দেন না তাঁর বাড়ির ফটকের ভেতর!

পরমানন্দের মুঠি আলগা হয়ে যায়। পাশাপাশি পথে নেমে আসেন ওঁরা।

রিকশায় বসেন পরমানন্দ। রিকশার পাশে পাশে চলতে থাকে অরুণাভ। বড রাস্তা পর্যন্ত ওঁকে এগিয়ে দিয়ে অরুণাভ ফিরে যায়।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে তখন। শহরতলীর বস্তি অঞ্চল। রাস্তায় জ্বলছে বিজলী বাতি। কারখানা এলাকার জনাকীর্ণ পথ। সিনেমার শো শুরু হচ্ছে। বিকৃত যান্ত্রিক আর্তনাদে পরিবেশিতে হচ্ছে হিন্দি গান। রিকশাটা ভিড় বাঁচিয়ে এঁকেবেঁকে চলল শহরের অপর প্রান্তে।

বুক ঠেলে একটা কান্না আসছে। হেরে গেছেন। নিঃসংশয়ে হেরে গেছেন তিনি চূড়ান্তভাবে। শুধু নীলার দৃষ্টিতে নয়-- শুধু অরুণাভের চোখেই নয়-- সারা দুনিয়ার কাছে আজ তিনি আদর্শচ্যুত, তিনি পতিত। মজদুর-নেতা আজ আন্তরিক ঘৃণা করে তাঁকে! রহমৎ আর বাদলেরা তাঁর পথের পাশে আজ ওত পেতে থাকে। এমনকি বস্তির ওই বালকটা পর্যস্ত অশ্লীল বিশেষণ যুক্ত করে উচ্চারণ করে তাঁর নাম। কারখানার বস্তিজীবন আজ তিনি নিজের চোখে দেখে গেলেন- এই তাঁর কীর্তি! এত বড় কীর্তি প্রতিষ্ঠা করেও তিনি তৃপ্ত হননি। আরও বৃহত্তর ক্ষেত্রে নতুন কীর্তির সন্ধানে উঠে-পড়ে লেগেছেন এবার। বিনিময়ে কিশলয়বাবুর কয়েক শত একর জমির মূল্য বিশগুণ বাড়িয়ে দিতে হবে। গ্রামনগরীটা গড়ে তুলতে হবে এমন এলাকায় যেখানে সমস্ত জমির মালিক তাঁরই মতো আর একজন নিঃস্বার্থ দেশকর্মী! এই এঁদের দেশসেবা! এই তাঁদের মতো সমাজসেবকদের কুম্ভীরাশ্রু কৃষক-মজুরদের জন্য। দীপক পর্যন্ত মনে করেছে পরমানন্দই চুরির কেসটা সাজিয়েছেন। সত্যরক্ষার জন্য একদিন যিনি অন্ধকূপের অন্তরালে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন, একমাত্র পুত্রকে যিনি সত্যধর্মের যুপকাষ্ঠে স্বহস্তে বলি দিয়েছেন সেই পরমানন্দকে আজ কী চোখে দেখছে দুনিয়া! চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল তাঁর। ঠিকই বলেছে নীলা-- আর কোনো সংশয় নেই। তিনি আদর্শচ্যুত, তিনি ব্রাত্য।

***************

রিকশা এসে থামল বাড়ির সামনে।

সমস্ত বাড়িটা খাঁ খাঁ করছে। কত দিনের কত আনন্দঘন ইতিবৃত্ত জড়িয়ে আছে বাড়িটার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ওই কদম গাছটার ডালে একদিন দোলনা ঝুলিয়েছিলেন। তখন নীলাও হয়নি। শুধু অসীম এসেছে সংসারে। ফুটফুটে এতটুকু একটা বাচ্চা। দোলনায় বাচ্চাকে শুইয়ে অ্যানি দোল দিত। আর ঘুমপাড়ানিয়া গান গাইত- নার্সারি লালেবাই। ঘাসের ওপর বেতের ইজিচেয়ারটার গা এলিয়ে উনি চুরুট খেতেন আর বই পড়তেন। এই বড় লনটায় কতদিন শীতকালে হয়েছে ‘ওপন এয়ার বুফে লাঞ্চ’। অ্যানি আর মিস গ্রেহাম প্রাণান্ত পরিশ্রম করত অনুষ্ঠানকে সর্বাঙ্গসুন্দর করে তুলতে। কী মধুর সে-সব দিনগুলি। বিবাহবার্ষিকীতে বরাদ্দ ছিল একটা সান্ধ্য ভোজের ব্যবস্থা। ছেলেমেয়েরা বড় হবার পর খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা হত ওদের জন্মদিনে। অর্ধশতাব্দীর স্মৃতিবিজড়িত লাল পয়েন্টিং করা বাড়িটার সামনে আজও একটা বেতের চেয়ার টেনে বসে পড়লেন। সারাদিন অভুক্ত তিনি। প্রচণ্ড ক্ষিদে পেয়েছিল বিকেলে-- এখন যেন সে বোধটাও নেই। শুধু ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে পা দুটো।

নন্দ এসে ওঁকে ডাকে-- ঘরে যাবার জন্য।

ঘর? না থাক। ইচ্ছা করছে না আর এখন উঠতে। নন্দকে বলেন বাগানের আলোটা জ্বেলে দিতে। ওখানে বসেই তিনি ভারী খামটা খুলে ফেলেন। বার হয়ে পড়ে অরুণাভর অবরুদ্ধ বাণী।

“নীলা

এইমাত্র তোমাকে তোমার বাবার গুরুদেবের আশ্রমে পৌঁছে দিয়ে এলাম। মনে হচ্ছে সব কথা গুছিয়ে বলতে পারিনি। পারা সম্ভবও নয়। দীর্ঘ এক যুগ প্রতীক্ষা করে আছি তোমার আগমনের, সেই তুমি এসে দাঁড়ালে আজ আমার দরজায়; অথচ এমন দুর্ভাগ্য আমার, দ্বার থেকে ফিরিয়ে দিতে হল তোমাকে। তাই সব কথা বুঝিয়ে বলার মতো আমার মনের অবস্থা ছিল না-- সম্ভবত শোনার মতো মানসিক ধৈর্য্য ছিল না তোমার। তাই এ চিঠি দিচ্ছি।

তোমাকে আমার বাসার দ্বার থেকে ফিরে যেতে হয়েছে। উন্মুখ আগ্রহ নিয়ে তুমি এসেছিলে এই দরমার ঘরে-- বাকি জীবনের দিনগুলি এখানে বিকিয়ে দেবার সঙ্কল্প নিয়েই-- কিন্তু আমিই তা হতে দিইনি। তাই আমার কাছে তোমার একটা কৈফিয়তও পাওনা বৈকি।..

ছেলেবেলার কথা মনে পড়ছে। দুনিয়াটা আমার কাছে তখন ছিল অত্যন্ত সীমিত। বাবা ছিলেন-- তুমি তো জানোই-- বিপ্লবী। ইংরাজকে তাড়াবার মন্ত্রণার মেতে উঠেছিলেন তিনি। প্রাণ দিলেন ওই স্বপ্ন দেখতে দেখতেই। আমার মাকে আমি তখনও কাঁদতে দেখিনি। বাবা যখন মারা যান, আমি তখন ছোট। সব কথা মনে নেই। তারপর জ্ঞন হওয়ার পর তখনও তাঁকে কাঁদতে দেখিনি। আমাকে তিনি গল্প শোনাতেন-- শিবাজীর গল্প, রানা প্রতাপের গল্প, গুরু গোবিন্দের কথা, ক্ষুদিরামের কাহিনী। স্বামীকে হারিয়ে যে তিনি হতোদ্যম হয়ে পড়েননি, এটা প্রমাণ করতেই যেন আমাকে ওই পথের নির্দেশ দিলেন। আশ্চর্য মানুষ তিনি। তাঁরই হাতে গড়া মানুষ আমি। তারপর একদিন তিনিও অস্তমিত হলেন আমার জীবনদিগন্ত থেকে। তাঁর একটা কথা মনে আছে আমার : “যারা আমাদের মানুষ বলে মনে করে না-- যারা বাধ্য করছে আমাদের কুকুর/ বেড়ালের মতো জীবনযাপন করতে-- তাদের কখনও ক্ষমা করিস না অরু”। পরে ওই কথাগুলোই পড়েছিলাম ‘পথের দাবী’তে।

নীলা, আমার মা সম্ভবত ইংরাজ-শাসকদের উদ্দেশ্য করেই ও কথা বলেছিলেন-- অন্তত সে যুগে আমি সেই অর্থেই গ্রহণ করেছিলাম তাঁর উপদেশ। ক্রমে আমার চিন্তাশক্তির প্রসার হয়েছে-আজ মনে হয় কথাটা দেশকালের অত ক্ষুদ্র আবরণে আবদ্ধ নয়। তাই আজ ইংরাজ শাসকদের অবর্তমানেও আমাদের সংগ্রাম শেষ হয়ে যায়নি। আজ তোমার বাবা এবং আমি সে সংগ্রামে বিপক্ষ শিবিরের সৈনিক।

আজ তুমি ওপরতলার বাসিন্দা আর আমি থাকি নীচের মহলে। জানি, তুমি বলবে-- স্বেচ্ছায় ওই ওপরের মহল ছেড়ে নেমে এসেছ তুমি আমার সমতলে। পরমানন্দের প্রাসাদ ছেড়ে যখন পরমদুঃখীর কুটিরে এসে দাঁড়িয়েছে তখন ফিরে যাবার পথ যে তুমি রুদ্ধ করে দিয়েই এসেছে সেটা বোঝা শক্ত নয়। আমি অবাক হয়ে যাই তোমার বাবার কথা ভেবে। ভদ্রলোকের সবই ছিল-- সবই খুইয়েছেন; অথচ আশ্চর্যের কথা, আদর্শের কারবারে আজ যে তিনি দেউলিয়া এ খবরটাও তিনি জানেন না। সম্পদের সঙ্গে আদর্শের, চরিত্রের বোধহয় একটা নিত্যবৈরী আছে। কী একটা নাটকে পড়েছিলাম নায়কের বাইরের ঘরে টাঙানো থাকত বাইবেলের একটা বাণী : ‘সুচের ছিদ্রপথে উট গলে যেতে পারে-- কিন্তু কোনো বড়লোক কখনও স্বর্গে যেতে পারে না’। সম্পদ, প্রতিপত্তি, সম্মান মানুষের আদর্শকে পিষে মারে। অথচ মানুষ জানতেও পারে না যে সে আদর্শচ্যুত হয়েছে। তোমার বাবারও আজ সেই দশা। তুমিও তাঁর সাহচর্যে সে কথা বুঝবার মতো বোধশক্তি হারিয়েছ। আজ সাময়িক উত্তেজনাতে সব ছেড়ে তুমি আমার দ্বারে এসেছ দাঁড়িয়েছ এটা সত্য; কিন্তু জীবনটা তো নাটক নয়!

সিনেমায় আর রঙ্গমঞ্চে যেটা বেশ স্বাভাবিক, জীবনে তাই অবাস্তব। তুমি যখন গতকাল রাত্রে একা এসে দাঁড়ালে আমার দরজায়, ঠিক সেই মুহূর্তটিতে যদি পঞ্চম অঙ্কের শেষ যবনিকা নিশ্চিত পড়বে জানতাম তাহলে আমিও তোমার হাত দুটি ধরে ভাবতে পারতাম ‘এতদিন পরে এসেছে কি তার আজি অভিসার রাত্রি’। এটা নাটক হলে কোনো কথা ছিল না। নাটকের দর্শক খুশি মনে বাড়ি যেত। কিন্তু জীবনের দর্শক জানে নিষ্প্রভাত রাত্রি নেই। নিষককালো অমারাত্রির অন্ধকারে তোমার এ অভিসারের রোমান্টিকতার পরেও আছে সকালবেলার চড়া রোদ! সকাল হলে তুশি দেখতে পাবে এখানকার চৌকিতে গদি নেই, আছে ছারপোকা। কফির কাপের বদলে আছে মাটির ভাড়ে জোলো চা; ঈভনিং-ইন-প্যারী অথবা ক্যান্থারাইডিন নয়--পচা নর্দমার দুর্গন্ধে বাতাস এখানে উদ্ধন্ধনে আত্মহত্যা করেছে।

রাগ কোরো না নীলা। দোষ তোমার নয়। তুমি এ জীবনে অভ্যস্ত নও। তোমার শিক্ষা, দীক্ষা, রুচি গড়ে উঠেছে অন্য পরিবেশে। ঝোঁকের মাথায় তুমি সব ত্যাগ করে আসতে চাইছ; কিন্তু কাল সকালে তোমার অনুশোচনার অন্ত থাকবে না। কাল না হোক কালে এ কথা তোমার মনে হবেই। এই একটি মুহূর্তের ভুলের বোঝা বয়ে চলতে হত তোমাকে আজীবন। কারণ এ ঘরে একটা রাত্রিযাপন করা মানেই বাকি জীবনের রাত্রিগুলির মৃত্যুপরোয়ানায় সই দেওয়া।

ভুল বুঝো না আমাকে। আমি আজও তোমাকে তেমনিই ভালোবাসি। বছর দশেক আগে বিদায় দেবার সময় বলেছিলাম, “তোমার জন্য অপেক্ষা করে থাকব”। আজও বিদায় দেবার সময় বলছি ওই একই কথা। এ কথা বলছি না যে আমার সঙ্গে জীবন যুক্ত করা তোমার পক্ষে একান্ত অসম্ভব। তবে তার জন্য প্রস্তুতি চাই, শুধু মানসিক নয়, শারীরিকও। ঝোঁকের মাথায় সেটা যেন না হয়। আমি তোমাকে অনুরোধ করব-- নিজের মন তুমি ভালো করে যাচাই করে দেখো। যদি তোমার বাবার মেকি দেশসেবায় সত্যই অতিষ্ঠ বোধ করে থাকো, যদি ঐশ্বর্যের বেড়া ভেঙে নেমে আসতে চাও এই সংগ্রামময় জীবনের সমতলে, তাহলে কিছুদিন তোমাকে এ পথে চলবার শিক্ষানবিশি করতে হবে। আমি বলব স্বেচ্ছা-- দারিদ্রের মধ্যে বাস করতে হবে কিছুদিন তোমাকে। তোমার বাবার কাছ থেকে কোনো সাহায্য নিতে পারবে না। তোমার পরিচিত সমাজ থেকে এভাবে স্বেচ্ছা-- নির্বাসন নিয়ে যদি কয়েক মাস আমার জীবনের সুখ-- দুঃখের আস্বাদ নিতে পারো এবং তারপরেও অবিচলিত রাখতে পারো তোমার আজকের সংকল্প, তাহলেই সার্থক হবে আমার দীর্ঘ প্রতীক্ষা। বরণ করে তুলব সেদিন আমার জীবনলক্ষ্মীকে।

আরও একটা কথা। তুমি উচ্চশিক্ষিতা। ফিলসফিতে এম. এ. পাস করেছ তুমি। আমি কলেজের প্রথম বার্ষিক শ্রেণির ছাত্র ছিলাম যখন ধরা পড়ি। তারপর কলেজে শিক্ষালাভ ঘটেনি আমার। সহরাজবন্দিদের কল্যাণে সমাজদর্শন, অর্থনীতি বিষয়ে কিছু পড়াশুনা করেছি মাত্র। সুতরাং তোমার সঙ্গে আমার শিক্ষাগত একটা প্রভেদ আছে। এ কথাটাও তুমি বিচার করে দেখো।

শেষ কথা। তোমার সঙ্গে আমার একট প্রকাণ্ড প্রভেদ আছে। তুমি নাস্তিক, তুমি ঈশ্বরের অস্তিত্বে অবিশ্বাসী। আমি ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষ। দিনান্তে একবার তাঁকে স্মরণ না করলে মনে বল পাই না। আমি বিশ্বাস করি তিনি আছেন আনন্দঘন কল্যাণময়রূপে। এখানেও আমাদের অমিলটা অত্যন্ত ব্যাপক। যুক্তিতর্ক দিয়ে তোমাকে স্বমতে আনতে পারব না- তুমিও পারবে না। তোমার নাস্তিকতার গোলাবর্ষণে আমার এ বিশ্বাসদুর্গকে বিধ্বস্ত করতে।

জানি না ক্ষমা করতে পারলে কিনা আমাকে।

এ চিঠির প্রত্যুত্তর আমি আশা করছি না। আমি বিশ্বাস করব তুমি আত্মসমীক্ষণান্তে ফিরে আসবে ঠিক যেখান থেকে ফিরে যেতে হল সেখানে। যদি স্থির করো যে আসবে না-- তবে সে কথাও আমাকে জানিও না। সে কথায় আমার প্রয়োজন নেই কারণ অন্য কোনো জীবনসঙ্গিনী আমার কল্পনার বাইরে। না হয় অহেতুক আশাতেই কাটুক না আমার বাকি জীবন।

ইতি

অরুণাভ।”

-- স্যার!

-- হ্যাঁ।

-- আপনার তো আজ খাওয়া হয়নি সারাদিন।

নন্দর এ প্রশ্নের জবাবে এবার স্বীকার করেন পরমানন্দ -- না, সারাদিনে কোনো আহার্য জোটেনি তাঁর।

-- আপনার খাবার আনব?

-- আন। হ্যাঁ রে, ছোট মহারাজ আসেননি আর?

নন্দ জানায় যে ইতিমধ্যে ছোটমহারাজ এসে দিয়ে গেছেন একখানি চিঠি।

নন্দ খাবার আনতে যায়।

দ্বিতীয় চিঠিখানি খুলে বসেন পরমানন্দ। গুরুদেব লিখছেন :

“পরমকল্যাণীয়েযু,

নীলা-মার জন্য চিন্তা করিও না। সে আমার সহিত তীর্থভ্রমণে যাইতেছে। মানস পর্যন্ত যাইবার ইচ্ছা আছে। তোমাকে জানাইয়া যাওয়া সম্ভব হইল না-- কারণ তুমি জানিলে এরূপ কদর্পকহীন অবস্থায় আমাদের তীর্থযাত্রা সম্ভব হইত না। অপরপক্ষে তীর্থভ্রমণের রাজসিক ব্যবস্থা হইলে আমাদের এ যাত্রার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হইত। আমার না হইলেও নীলার হইত।

আশীর্বাদক। ইতি--”

চিঠিখানি শেষ করে মিনিটদশেক স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকেন পরমানন্দ। মনশ্চক্ষে ভেসে ওঠে তুষারাচ্ছাদিত এক সানুদেশ; সুদুর্গম যাত্রাপথে চলেছেন দুজন পথিক দূর দিগন্তে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে-- একজন জ্ঞানবৃদ্ধ সন্ন্যাসী, অপরজন অভিমানক্ষুব্ধ তাঁরই আত্মজা। চুম্বকখণ্ড তাহলে দিক পরিবর্তন করেছে; বিকর্ষণ রূপান্তরিত হয়েছে ঐকান্তিক আকর্ষণে! উপকরণের দুর্গপ্রাকার থেকে মুক্তি পেয়েছে নীলা। ঠিকই বলেছিলেন গুরুদেব-- নীলা এগিয়ে গেছে সাধনমার্গে তাঁকে পিছনে ফেলে।

উঠে পড়েন উনি। মনস্থির করেছেন এতক্ষণে! লেটার প্যাডটা কার করে সর্বপ্রথমেই লিখে ফেলেন একখানা চিঠি। শেষ করে আবার আদ্যোপান্ত পাঠ করেন। খামটা বন্ধ করে উঠে যান ওপরের ঘরে। সুটকেসটা টেনে নিয়ে গুছিয়ে তুলতে থাকেন,জামাকাপড়। প্যান্ট, শার্ট, টাই, গরম জামা, ড্রেসিং গাউন, শেভিং সেট, একে একে গুছিয়ে তোলেন। তারপর হঠাৎ কী ভাবেন কয়েকটা মুহূর্ত। আবার খালি করেন সুটকেসটা। নাঃ এ-সব নেবেন না তিনি। কিট-ব্যাগটায় ভরে নেন খানকয়েক ধুতি। খান দুই কম্বলও নেন, একটা লেডিজ গরম ওভারকোট ব্যাস, আর কিছু নয়।

বেশি সময় লাগল না গুছিয়ে,নিতে। টাইম-টেবিলটা দেখেন একবার হ্যাঁ, ট্রেন একটা আছে। এখনি বের হলে ধরতে পারবেন। এখনই যাবেন তিনি। টনকপুর স্টেশনে দেখা পাবেন ওঁদের নিশ্চিত।

খাবারের থালাটা হাতে নিয়ে নন্দ উঠে এসেছে দোতলায়-ডাইনিংরুম খালি রেখে।

-- ও-সব এখন থাক। তুই শিগগির একটা ট্যাকসি দেখ!

-- আপনি আগে খেয়ে নিন। -- নন্দ এবার একটু দৃঢ়কণ্ঠে বলে। কিন্তু পরমানন্দ তার চেয়েও দৃঢ়কণ্ঠে বলে ওঠেন-বিরক্ত করিস না নন্দ। যা বলছি কর। ট্রেনটা আমায় ধরতে দে।

নন্দ তাঁর মনিবকে চেনে। আর কোনো কথা না-বলে বেরিয়ে যায় ট্যাক্সি ডাকতে। বারান্দাটায় পায়চারি করতে থাকেন পরমানন্দ অস্থির পদবিক্ষেপে! না, হার তিনি স্বীকার করবেন না। ভুল মানুষ মাত্রেরই হয়। সে ভুলকে স্বীকার করে নেওয়ায় লজ্জা নেই। ভুলকে সংশোধন করা, তাকে জয় করাই মনুষ্যত্ব। পরমানন্দও প্রমাণ দেবেন তিনি আদর্শচ্যুত নন- আদর্শের জন্য তিনি আজও সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তত।

ট্যাকসিতে উঠবার সময় পিছনে এসে দাঁড়াল কালো রঙের হিন্দুস্থানখানা। নেমে এলেন হর্ষোৎফুল্ল ননীমাধব সুসংবাদটা দিতে- কংগ্র্যাচুলেশন্স! সব ঠিক হয়ে গেছে ভাই—কিশলয় গাঙ্গুলি হ্যাজ উইথড্রন—তোমার পথে আর কোনো বাধা নেই –

বাধা দিয়ে পরমানন্দ বলেন-- বেশি কথা বলার আমার সময় নেই ননীমাধব। আর আঠারো মিনিট মাত্র বাকি আছে ট্রেন ছাড়ার, আমি চললাম। এই চিঠিখানা তারিণীদাকে দিও-

ননীমাধবকে বস্তুত কোনো প্রত্যুত্তর করবার সুযোগ না দিয়েই রওনা হয়ে গেলেন তাঁর অভিন্নহৃদয় বন্ধু।

মুহূর্তখানেক ননীমাধব দাঁড়িয়ে থাকেন স্থাণুর মতো। তারপর অসীম কৌতুহল নিয়ে খামটা খুলে পড়তে থাকেন চিঠিখানা।

আশ্চর্য কাণ্ড। পরমানন্দ তাঁর তারিণীদাকে জানাচ্ছেন অনিবার্য কারণে তিনি নির্বাচন-প্রতিদ্বন্দিতা থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন। কারণটা কী তা লেখেননি। তবে শেষ দিকে লিখেছেন “অধ্যাপক গিরীন্দ্রবাবু আমার অপেক্ষা যোগ্যতর ব্যক্তি। দীর্ঘতর দিন তিনি যুক্ত ছিলেন আমাদের পার্টিতে। এখানে নমিনেশন না পাইয়া তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে দাঁড়াইয়াছেন। গিরীন্দ্রবাবুর বদলে আপনারা আমাকে মনোনীত করিয়াছিলেন এজন্য নয় যে আমি যোগ্যতর ব্যক্তি। কারণটা অর্থনৈতিক। এ ভোটযুদ্ধে পাড়ি দিতে আমি যে পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করিব-- অধ্যাপক বসু-মহাশয়ের পক্ষে তাহা করা সম্ভবপর নহে। অপ্রিয় হইলেও কথাটা সত্য। শেষ মুহূর্তে আমার এই আকস্মিক পশ্চাদপসরণে আপনারা বিব্রত বোধ করিতে পারেন-তাই প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ পার্টি-ফান্ডে জমা দিবার জন্য একটি ক্রস চেক এইসঙ্গে রাখিয়া গেলাম। আশা করি অতঃপর আপনারা আর গিরীন্দ্রবাবুকে অপাংক্তেয় মনে করিবেন না। ক্ষমাপ্রার্থী ইতি।।”

বিস্মিত বিমুঢ় ননীমাধব স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন চিঠিখানি হাতে করে। এ ছেলেমানুষির কোনো মানে হয়!



********************************

এখানেই আমার কাহিনী শেষ করেছিলাম। মনে হয়েছিল, এর পরবর্তী ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ নিতান্তই বাহুল্য। সংসারাভিজ্ঞ বুদ্ধিমান পাঠক অনায়াসেই সেটা অনুমান করতে পারবেন ভেবেছিলাম। কিন্ত দুর্ভাগ্যবশত এ উপন্যাসের পান্ডুলিপি যিনি প্রথম পড়লেন তিনি আমাকে বলে বসলেন যে কাহিনীটি সুসমাপ্ত নয়। আদর্শনিষ্ঠ পরমানন্দ তাঁর আদর্শে ফিরে গেলেন-- এটাই নাকি কাহিনীর শেষ কথা হতে পারে না। এর পরেও প্রশ্ন থেকে যায়-- অরুণাভের আদর্শের কথা, নীলার বিবাহের কথা। আমার মতে সে-সব কথা দ্বিতীয় একটি কাহিনীর বিষয়ভুক্ত হতে পারে মাত্র; এবং তা হলেও সে কাহিনীটি পুনরুক্তিদোষে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাবে শুধু। তবু প্রথম পাঠিকার অনুরোধে কয়েকটি স্থুল সংবাদ এখানে লিপিবদ্ধ করতে বাধ্য হলাম।

ডাক্তার পরমানন্দকে টনকপুর পর্যন্ত যেতে হয়নি, সাজাহানপুরেই তিনি দেখা পেয়েছিলেন গুরুদেবের। সে যাত্রায় বেশি কষ্ট পেতে হয়নি ভাকে। নীলা লক্ষ্মী মেয়েটির মতই ফিরে এসেছিল তাঁর সঙ্গে।

সেই একদিনের ছেলেমানুষির কথা মনে পড়লে আজ নিজের কাছেই নিজে লজ্জিত হন পরমানন্দ। সারাটা দিন যেন একটা ভূত চেপেছিল তাঁর ঘাড়ে। সেন্টিমেন্টাল হওয়াটা পাপ, সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেছেন তিনি; সেই একদিনের ছেলেমানুষির খেসারত হিসাবে অ্যাসেমব্লিতে যাওয়া পিছিয়ে গেছে বছর-পাঁচেকের জন্য। শুধু কী তাই? অহেতুক কতকগুলো টাকাও অর্থদণ্ড হল! অবশ্য হতোদ্যম হন নি তিনি মোটেই। কর্মবীর তিনি-- এত সহজেই ভেঙে পড়বেন কেন! ক্রমে ম্যানেজিং ডাইরেকটারশীপটাও হাতে এসেছে এতদিনে। প্রয়োজলাতিরিক্ত খরচ করে চলেছেন তিনি শ্রমিকদের পিছনে। আগামী বারে মজদুর-মহল্লার সব কটা ভোট তাঁকে পেতেই হবে! এই শুভকর্মে তিনি নিয়োজিত করেছেন উপযুক্ত লোককেই।

অরুণাভ নন্দীই এখন বার্টন গ্যান্ড হ্যারিস কোম্পানির লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসর। নীলাকে বধূরূপে গ্রহণ করার অর্থনৈতিক বাধাটা এখন আর নেই। মেহনতী মানুষের ভালো করার পূর্ণ দায়িত্ব অরুণাভের ওপরই ন্যস্ত করেছেন ম্যানেজিং ডাইরেকটর। মজুরদের জন্য ক্লাবঘরে এসেছে নতুন রেডিও, মজদুর-মন্ডলীর আসর শুনতে ওরা গোল হয়ে বসে। মেহনতী মানুষদের প্রভিডেন্ট-ফান্ড খোলার আয়োজন হচ্ছে, অসুস্থ মজুরও যেন মারা না পড়ে সে ব্যবস্থা হচ্ছে। আরও কত পরিকল্পনা রয়েছে। অরুণাভ বয়স্কদের জন্য নৈশ স্কুলও খুলতে চেয়েছিল, কিন্তু ওটাতে আপত্তি আছে কর্তৃপক্ষের। পরে অরুণাভও বুঝতে পেরেছে লেখাপড়া শিখিয়ে আর কী লাভ হবে ওদের- ওরা তো আর কেরানি হয়ে উঠবে না কোনোদিন! শিক্ষা ওদের কাছে আশীর্বাদ নয়, অভিশাপ! অরুণাভ আজও মনে প্রাণে মজদুরদরদী! যদিও অফিসার হওয়ার পর মজুরদের সঙ্গে তার অন্তরঙ্গ মেলামেশাটা এখন সম্ভবপর নয়, তবু মোটা অঙ্কের মাহিনা থেকে মাঝে মাঝে সরু-মোটা অঙ্কের চাঁদাই তাকে দিতে হয় পার্টি-ফান্ডে।

আগামী বিশ্বকর্মা পূজায় মজদুরদের চিত্ত বিনোদনের জন্য একটা নাটক সে মঞ্চ করবে মনস্থ করেছে। অশ্রুতপূর্ব তার মৌলিক পরিকল্পনা ! মজদুর, মসীজীবী এবং দু-একজন অফিসার পর্যন্ত নাকি একই মঞ্চে অভিনয় করবে এবার। সাম্যের এক চুড়ান্ত স্বাক্ষর সে রেখে যাবে রঙ্গমঞ্চের পাদপ্রদীপের সম্মুখে! ডাঃ পরমানন্দকে সে বুঝিয়ে দিয়েছিল তার পরিকল্পনার কথা। খুব উৎসাহিত হয়েছিলেন পরমানন্দ; বলেছিলেন, থিয়েটার আমিও এককালে খুব করতাম, কিন্তু এমন চিন্তা আমার মাথাতেও আসেনি।

অরুণাভ বলেছিল : তাহলে প্রধান চরিত্রটা আপনিই করুন না।

-- নাটকটা কী?

-- তারাশঙ্করবাবুর ‘দুই পুরুষ’, -আপনি নুটুবিহারীটা করুন।

পরমানন্দ হেসে বলেছিলেন : ও চরিত্রটাও এককালে আমি করেছি, তবে কী জানো-- আমাদের যুগ গত হয়েছে। তোমরাই এখন ও-সব করো। আমরা পেছনে আছি।

অগত্যা অরুণাভকেই রাজি হতে হয়েছে নুটুবিহারীর চরিত্র অভিনয় করতে। নাটকটা পুরাতন; বহুবার এ নাটকের অভিনয় সকলে দেখেছে। তবু নবীন অভিনেতা চরিত্রটা কেমন অভিনয় করে সেটা দেখবার জন্য সকলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে!

নীলা অবশ্য টিকতে পারেনি। সে নাকি আজকাল পণ্ডিচেরিতে থাকে!


সমাপ্ত

ব্রাত্য (তৃতীয়াংশ)



প্রথমাংশ

দ্বিতীয়াংশ

লেখক: নারায়ণ স্যান্যাল
 

দ্বিতীয় অংশের পর

ননীমাধব বলেন-- চলো, এবার ওঠা, যাক। ওঃ! সাড়ে দশটা বাজে! চলো, চলো।

যন্ত্রচালিতের মতো ননীমাধবের সঙ্গে আবার এসে বসলেন মোটরে। এতক্ষণে আবার বর্তমানে ফিরে এসেছেন তিনি। মনে পড়ে যায়-- ধর্মঘটের জন্য জরুরি মীটিঙে এসে বসেছিলেন তিনি। মনে পড়ে যায় নীলা চলে গেছে বাড়ি ছেড়ে। কিন্তু একী হচ্ছে? এতবড় জরুরি মীটিঙে উপস্থিত থাকলেন পুরো দুটি ঘন্টা অথচ তিনি কিছুই জানেন না। কী সিদ্ধান্ত হল ডিরেকটরদের সমাবেশে? লকআউট চলতে থাকবে? একবার মনে হল ননীমাধবকে প্রশ্নটা করেন। তারপর নিজেরই কেমন সঙ্কোচ হল। নাঃ, এ রকম মানসিক অবস্থায় ছোটাছুটি করে বেড়ানোর কোনো অর্থ হয় না। আগে তাঁকে স্থির হতে হবে। তারপর কাজ।

-- এখান থেকে সোজা জিতেনদার ওখানে যাবে তো?

-- না, আমি একবার গুরুদেবের আশ্রমে যাব।

-- সে কী? সাড়ে দশটায় জিতেনদার বাসায় জরুরি আ্যাপয়েন্টমেন্ট। কিশলয় গাঙ্গুলিরও সেখানে আসবার কথা। এত বড় একটা সিরিয়স এনগেজমেন্ট!

সব কথা মনে পড়ে যায় পরমানন্দের! কিশলয়বাবু ভোটযুদ্ধের একজন যোদ্ধা। পরমানন্দের কনস্টিটুয়েন্সি থেকেই অবতীর্ণ হচ্ছেন বিপক্ষ শিবির থেকে—তাঁর পিছনে সম্মিলিত কয়েকটি দলের শক্তি। এই আসনে হয় তিনি অথবা কিশলয়বাবু নির্বাচিত হবেন। আরও একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী আছেন, অধ্যাপক গিরীন্দ্র বসু। সকলে মনে করেছিল তিনিই নমিনেশন পাবেন পরমানন্দের বদলে। দীর্ঘদিন জেলে জেলে কেটেছে তার। আকৈশোর দেশসেবায় যুক্ত আছেন তিনি। শেষ পর্যন্ত কিন্তু তাঁর বদলে পরমানন্দকেই নমিনেশন দেওয়া হয়েছে। গিরীন্দ্রবাবু অকৃতদার সন্ন্যাসী। মানুষ ভোটযুদ্ধে পাড়ি দেবার মতো আর্থিক সঙ্গতি তাঁর নেই। ফলে সকলেই মনে করে এ আসনের জন্য হবে একটা দ্বৈরথ সমর। ধুরন্ধর কয়েকজনের প্রচেষ্টায় কিশলয়বাবুর নাম প্রত্যাহারের একটা সম্ভাবনা দেখা গিয়েছে। কথা আছে জিতেনবাবুর মধ্যস্থতায় আজই একটা বোঝাপড়া হয়ে যাবে। শোনা যাচ্ছে কয়েকটি শর্তে কিশলয়বাবু সরে দাঁড়াতে রাজি আছেন। জিতেন বাঁড়ুজ্জে কোনো রাজনৈতিক দলভুক্ত নন। স্থানীয় বারের একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ উকিল। ক্রিমিনাল সাইডের সবচেয়ে নামকরা আইনজীবী। ভোট প্রার্থীদের যদিও ঠিক ক্রিমিনাল পর্যায়ভুক্ত করার কোনো নজির নেই-- তবু ওই জিতেন বাঁড়ুজ্জের মাধ্যমেই একটা সমাধানে আসার চেষ্টা করছেন দুপক্ষ। এ কথাও আছে যে, জিতেনবাবুর বাসায় যদি দুপক্ষ একটা মোটামুটি সিদ্ধান্তে আসতে পারেন তখন সকলে আসবেন তারিণীদার কাছে। ওরা সকলেই জানেন যে তারিণীদা ভোটযুদ্ধে যদিও নিজে নামেননি তবু তিনিই সুইচ-বোর্ড কন্ট্রোল করেন-- সে পরিচয়ে পরমানন্দ ল্যাম্পপোস্ট মাত্র।

-- তোমার গুরুদেবের কাছে যেতে চাইছ কেন?

-- যদি ও তাঁর কাছে গিয়ে থাকে? .

-- কে? নীলা? পাগল হয়েছ! সে যাবে তোমার গুরুদেবের কাছে? তোমার গুরুদেবকে কত ভক্তি করে সে তা মনে নেই? সেবারকার কথা ভুলে গেছ নাকি?

-- কিন্তু তাহলে কোথায় গেল ও? ব্যারাকে খোঁজ নেব?

-- সে-সব পরে হবে। এখন চলো তো জিতেনদার ওখানে--

স্টিমারের সঙ্গে বাঁধা গাধাবোটের মতোই ননীমাধবের সঙ্গে চললেন পরমানন্দ। জিতেন বাঁড়ুজ্জের বাসায় হবে বুদ্ধির প্রতিযোগীতা। নাম প্রত্যাহারের শেষ সময় ঘনিয়ে আসছে -- সুতরাং প্রতিটি সেকেন্ড মূল্যবান। কিশলয়বাবু তীক্ষ্ণধী রাজনীতিক, বাঘাডাঙা কলোনির সলিড ভোট তাঁর মূলধন। তা ছাড়াও আছে কয়েকটি বিরুদ্ধ পাটির সম্মিলিত শক্তি। যুদ্ধজয়ের সম্ভাবনা তাঁরও অল্প নয়। অথচ তিনি সরে দাঁড়ালে পরমানন্দের জয়যাত্রার পথ নিরঙ্কুশ। ফলে কিশলয়বাবু আদৌ সরে দাঁড়াতে রাজি হবেন কিনা বলা শক্ত-হলেও তাঁর শর্তগুলি খুব সহজপাচ্য হবে না। কিন্তু সম্মত তাঁকে করাতেই হবে। পরমানন্দকে যেতেই হবে অ্যাসেমব্লিতে। না হলে দেশের কতটুকু সেবা তিনি করতে পারবেন এখান থেকে? যে আইনের বলে দেশ চালিত হবে সেই আইন যেখানে জন্ম নেবে, বিভিন্ন খাতে সরকার কত টাকা ব্যয়বরাদ্দ নির্ধারিত করবেন তা যেখানে স্থির করা হবে, সেখানে যেতেই হবে তাঁকে। তাঁর দেশসেবাকে বৃহত্তর পরিধিতে বিস্তৃত করে দিতে হবে। আইনসভার মহাযন্ত্রে ঋত্বিক না হতে পারলে তাঁর দেশসেবার বাসনা তৃপ্ত হবে না। এতদিন পরে পার্টি তাঁকে নমিনেশন দিয়েছে - দুর্লভ এ সৌভাগ্য। এত বড় সুযোগের সদ্ব্যবহার যদি না করতে পারেন তবে আর ভবিষ্যতে আশা নেই। পারবেন, নিশ্চরই পারবেন তিনি কিশলয়বাবুকে রাজি করাতে-- উঠতেই হবে তাঁকে সাফল্যের শিখরচূড়ায়। ওখানেই যে যাত্রা শেষ হবে তাঁর তাই বা কে বলতে পারে? যেতে পারেন ক্যাবিনেটেও একদিন!

..আর হতভাগা মেয়েটা বলে কিনা তিনি লক্ষ্যভ্রষ্ট! তিনি স্বার্থপ্রণোদিত হয়ে ছুটে চলেছেন একমুখো। দেশের কথাই তাঁর কাছে নাকি শেষ কথা নয়-- নিজের কথাই তিনি শুধু ভাবেন। নিজের কী কথা? কোন স্বার্থ? অন্যায়ভাবে তিনি কি জীবনে একটি রজতখণ্ডও উপার্জন করেছেন? অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আজ তিনি যুক্ত। অনেক ক্লাবের পেট্রন, কয়েকটির উপদেষ্টা, কিছুসংখ্যকের কোষাধ্যক্ষ। একটি পয়সাও কখনও এদিক ওদিক হয়েছে তাঁর হাতে? তবে স্বার্থ! কোন স্বার্থে প্রণোদিত হয়ে তিনি অরুণাভ নন্দীর সন্ধান দিতে অস্বীকার করেছিলেন সেদিন? আয়াঙ্গারকে যদি সেদিন তিনি বলে দিতেন সেই সন্ধ্যায় কোন পথের কোন বাঁকে কাদের জিম্মায় নামিয়ে দিয়ে এসেছিলেন সেই অসুস্থ মানুষটাকে তাহলে এত নির্ধাতন সহ্য করতে হত না তাঁকে।

নির্যাতন! কী অপরিসীম যন্ত্রণাময় সে দিনগুলো!

দীর্ঘ দিন বিনা বিচারে আটক ছিলেন তিনি। রাজদ্রোহের অপরাধে তখন প্রকাশ্য বিচারের ব্যবস্থা ছিল না। নিরাপত্তার আইনেই আটক ছিলেন দীর্ঘদিন। অকথ্য অত্যাচার হয়েছিল বৃদ্ধের ওপর-- তবু একটি কথাও বার হয়নি তাঁর মুখ দিয়ে। হ্যাঁ, অসীম ঠিকই বলেছে। অরুণাভ নন্দী নামে একটি ছেলে আশ্রয় নিয়েছিল তাঁর বাড়িতে। তার পায়ে তিনি অপারেশনও করেছিলেন। সন্দেহ হওয়ায় ছেলেকে পাঠিয়ে এস. ডি. ও.-কে খবর দিয়েছিলেন। তারপর কী করে সে তাঁর বাড়ি থেকে পালিয়ে গেল তা তিনি জানেন না। এই তাঁর জবানবন্দি।

অসীম পাগলের মতো ছোটাছুটি করতে থাকে। ঘরে-বাইরে অপমানের চূড়ান্ত হল তার। সেই নাকি বাপকে ধরিয়ে দিয়েছে। তবু অসীমের ঐকান্তিক প্রচেষ্টাতেই বিচার উঠল আদালতে। বোকা ছেলে! কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে বের হয়ে পড়ল সাপ। সন্ধানী পুলিশের তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে উদঘাটিত হল পরশুরাম চৌধুরীর জীবনবৃত্তান্ত। প্রমাণিত হল পরশুরাম আর পরমানন্দ অভিন্ন ব্যক্তি। যেটুকু আশা ছিল পরিত্রাণের নির্মূল হল তা। যারা ওর “জাপানকে রুখতে হবে” চীৎকারে ছিল বিরক্ত তারা বললে অসীমই প্রকাশ করে দিয়েছে বাপের বিপ্লবী জীবনের গোপন ইতিহাস। কথাটা পরোক্ষভাবে সত্য। বিচারের প্রচেষ্টা না করলে হয়তো তাঁর যৌবনের ইতিহাস এমনভাবে জানাজানি হয়ে পড়ত না। চিহ্নিত হয়ে পড়লেন পরমানন্দ – বিপ্লবীর সহকারী বলে নয়- স্বয়ং রাষ্ট্রদোহী বলে।

ধরা পড়েছিল অরুণাভও। সে কিন্তু তাঁর জবানবন্দিতে অস্বীকার করেছিল পরমানন্দের পরিচয় না, তাঁর পায়ের উপর পরমানন্দ অপারেশন করেননি। কে করেছিল? তা সে বলবে না।

অসীমের অবস্থাটা কল্পনা করা শক্ত নয়। বেয়াল্লিশের আন্দোলন তখন অতীত ইতিহাসের পর্যায়ভুক্ত। লালকেল্লায় ঐতিহাসিক বিচার তখন চলছে আজাদ হিন্দ নেতাদের। জাপানকে রুখবার জন্য কয়েক বছর আগে যারা উঠেপড়ে লেগেছিল -- তারা আত্মপক্ষ সমর্থন করা কষ্টকর বোধ করছে। অসীমের অবস্থা আরও করুণ। বাড়িতে কেউ তার সঙ্গে কথা বলে না। নীলা তো নয়ই, মিস গ্রেহামও নয়। বৈশাখী পর্যন্ত ঘৃণায় মুখ ঘুরিয়ে নেয়। নন্দ-বেহারাও ওর মুখের দিকে চোখ তুলে তাকায় না। মামলার জন্য তদ্বির তদারক সমস্ত করতেন ননীমাধব। বন্ধুর কর্তব্যে ত্রুটি হয়নি তাঁর। এমনকি এজন্য রাজরোষে পড়বার সম্ভাবনা থাকা সত্বেও তিনি বিরত হননি বন্ধুকৃত্য থেকে। সংসারের সমস্ত দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল নীলা। মিস গ্রেহাম শয্যা গ্রহণ করলেন। এই শয্যাগ্রহণই তাঁর শেষ শয়ন। দেশে আর ফিরে যেতে পারেননি তিনি। দীপক আসত সকাল-সন্ধ্যায়। নীলার সঙ্গে পরামর্শ করত। মামলা-সংক্রান্ত কথাবার্তা হত। কখনও বসত মিস গ্রেহামের শষ্যাপার্শ্বে। বৈশাখীকে ডেকে হয়তো দুটো পরামর্শ দিত। তারপর যাবার সময় বারান্দা থেকেই দেখে যেত অসীম বসে আছে নিজের ঘরে জানলা দিয়ে একদৃষ্টে বাইরের দিকে চেয়ে। কখনও কখনও সিঁড়ির মুখে মুখোমুখি দেখা হয়েছে দুজনের। দীপক মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চলে গেছে নীরবে। দীপক অসীমের সহপাঠী ছিল একদিন!

যেদিন মামলার দিন পড়ত সেদিন দেখা যেত অসীমকে আদালতের কামরায়। কেউ তাকে ডেকে নিয়ে যেত না, কেউ তার সঙ্গে একসঙ্গে ফিরত না। ও নিজেই খবর রাখত মামলার দিন কবে পড়েছে। ঠিক সময়ে ম্লান মুখে এসে দাঁড়াত জনারণ্যের একান্তে। হয়তো কেউ চিনে ফেলত তাকে-- ওর দিকে আঙুল দেখিয়ে ওরা কী যেন বলাবলি করত। কী যে ওরা আলোচনা করে তা আন্দাজ করতে পারত অসীম-- তাই চোখ তুলে তাকাত না কখনও তবু না গিয়েও পারত না, ওইখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই সে দেখতে পেত সামনের একখানা বেঞ্চিতে ননীমাধব, দীপক আর নীলা বসে আছে উকিলবাবুর কাছে। দেখত চোখ তুলে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়ানো লোকটাকে! একদৃষ্টে চেয়ে থাকত সেদিকে। তারপর কোর্ট বন্ধ হলে জনারণ্যে মিশে যেত -- পাছে ওকে কেউ ডাকে একসঙ্গে বাড়ি যেতে। যদি চোখাচোখি হয়ে যায় নীলা অথবা ননীমাধবের সঙ্গে।

একদিন সাহসে ভর করে সে গিয়ে হাজির হয়েছিল ননীমাধবের বাসায়। ননীমাধব ওর মুখের ওপরেই দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

অসীম কাঁদেনি। কিন্ত ভেতরে ভেতরে পুড়ে শেষ হয়ে গিয়েছিল সে। নিজের ঘরে বসে থাকত দিনরাত। কদাচিৎ বার হত ঘর থেকে। লোকচক্ষুর অন্তরালেই সঙ্গোপনে উদযাপিত হত তাঁর স্বেচ্ছাবন্দি জীবনের দিনগুলি। নন্দ তার ঘরে পৌছে দিয়ে যেত চা, খাবার, ভাতের থালা। একসঙ্গে ডিনার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে বহুদিন। খাবার অভুক্ত পড়ে থাকলেও কেউ এসে অনুযোগ করত না। উঠিয়ে নিয়ে যেত অভুক্ত থালাখানা। বাপের মামলায় সাক্ষ্য দিতে হয়েছিল তাকেও। কী বলেছিল তার মনে নেই। মাটির দিকে তাকিয়ে প্রশ্নের জবাব দিয়ে গিয়েছিল।

দীর্ঘদিন চলে মামলা। নীলা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে, বৈশাখী না থাকলে বোধহয় মারাই পড়ত বেচারি। নীলার সঙ্গে কথা বলার জন্য ছটফট করত অসীম। দিন দিন ম্লান-হয়ে-আসা ছোট বোনটির চেহারা দেখে হু-হু করে উঠত অসীমের সারা অন্তঃকরণ-- কিন্তু উপায় নেই। ছোট বোনটির মাথায় হাত বুলিয়ে দুটো সান্ত্বনার কথা বলার অধিকার থেকে সে বঞ্চিত।

তারপর মামলার রায় বের হয়ে এল একদিন!

রাজদ্রোহী পরশুরাম চৌধুরীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে।

যাবজ্জীবন কারাদণ্ড! ওই বৃদ্ধের!

অবিচলিত চিত্তে সে আদেশ গ্রহণ করলেন পরমানন্দ।

অসীম ছিল আদালতে। থরথর করে কেঁপে উঠল সে দন্ডাদেশ শুনে। বসে পড়ল ধুলার ওপরেই। চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে এল পৃথিবী!

সম্বিৎ যখন ফিরে এল তখন, আদালত জনশূন্য। ঝাডুদার ঝাঁট দিচ্ছে বারান্দাটায়। একটা পেয়াদা শ্রেণির লোক একগোছা চাবি হাতে ঘরে ঘরে তালা লাগিয়ে চলেছে। তারই ডাকে সম্বিৎ ফিরে আসে অসীমের। ফ্যালফ্যাল করে চারদিকে তাকায় সে। কোথায় গেল এতগুলো লোক? সন্ধ্যা নেমে এসেছে পৃথিবী জুড়ে। রাস্তায় জুলে উঠেছে বিজলী বাতি।

অসীম উঠে দাঁড়ায়। ঝাডুদার থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। চাবি হাতে পেয়াদাটা তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। আদালতের কার্ণিসে একজোড়া পায়রার নিভৃত কূজন ছাড়া চরাচর স্তব্ধ। মাতালের মতো টলতে টলতে চওড়া সিঁড়িটা বেয়ে নীচে নেমে আসে। অনেকক্ষণ তাহলে বসে ছিল সে ওই ধুলার ওপর। আজ আদালতে নীলা এসেছিল—ছিলেন ননীমাধব আর দীপক। তারা কখন গেল? যাবার সময় নিশ্চয় তারা দেখেছিল দ্বারের পাশে মাটিতে বসে আছে অসীম। আশ্চর্য! আজকের দিনেও তারা প্রয়োজন বোধ করল না তাকে ডেকে নিয়ে যাওয়ার। কেন? সেও কি ওই পরমানন্দের সন্তান নয়? তার বুকের ভেতরটাও কি পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে না আজ? সে কি ইচ্ছা করে এই সর্বনাশ ডেকে এনেছে! এ যে নিয়তির একটা চরম নিষ্ঠুর পরিহাস তা কি কেউ একবার ভেবে দেখবে না! না, অসীমের চোখ দিয়ে কেউ দেখল না একবার বিয়োগান্ত নাটকের এ দিকটা!

হাঁটতে হাঁটতে একসময়ে অসীম এসে পৌছয় সেই পরিচিত পয়েন্টিং-করা লাল বাড়িটার সামনে। প্রেতমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে দুর্গের আকারের ওই বাড়িটা। আলো জ্বলছে না সামনের কোনো জানলায়। কোথাও কোনও প্রাণের সাড়া নেই। সদ্যোবিধবার মতো মূর্ছাতুর প্রাসাদটা আজ মৌন-- স্তব্ধ। গেট খোলাই ছিল। চিরদিনের মতো গেটের ডান পাশে দারোয়ানের ছোট্ট ঘরটার সামনে চারপাইয়ে বসেছিল দারোয়ান উদাস দৃষ্টি মেলে। ব্যতিক্রমের মধ্যে আজ আর সে উঠে দাঁড়াল না তার ছোট হুজুরকে দেখে। হয়তো ওইটুকু অসম্মানের মধ্যে বেচারী জানাতে চাইল তার প্রতিবাদ। অপমানটা বাজল না অসীমের। সে লক্ষ করেনি এ-সব। লাল কাঁকর-বিছানো পথটাও যে ওর প্রতি পদক্ষেপে অব্যক্ত ভাষায় প্রতিবাদ জানাল তাও কানে বাজে না তার। অবশেষে এসে পৌঁছয় গাড়িবারান্দার তলায়। ভিতরে প্রবেশ করতে মন হল না। বসে থাকে ঘারের পাশে মেজের ওপরেই।

বাড়ির গাড়িটা এসে পৌঁছয় অল্প পরেই। ধরাধরি করে ওরা নামাল নীলাকে। আদালত থেকে ফিরছে সে। এত দেরিতে? হবে না? দণ্ডাদেশ শুনে নীলা সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে। আদালত থেকে তাই ওকে নিয়ে যাওয়া হয় ননীমাধবের বাড়িতে। সেটা আদালত থেকে কাছে। এতক্ষণ সেখানেই ছিল সে। অল্প সুস্থ হওয়ার পর ওকে নিয়ে আসা হচ্ছে। দীপক আর ননীমাধবের সাহায্যে টলতে টলতে নীলা নেমে এল গাড়ি থেকে। উদভ্রান্ত দৃষ্টি তার। খোঁপাটা ভেঙে পড়েছে পিঠের ওপর। কাপড় ও ব্লাউসের অনেকটা ভেজা। মুখ আর মাথাও। বোধহয় জলের ঝাপটা দেওয়া হয়েছিল-- শুকোয়নি এখনও। চোখ দুটো অস্বাভাবিক রকমের লাল। কোনোদিকে তাকায় না নীলা। লক্ষ্য হয় না অসীমকে। সে উঠে দাঁড়িয়েছিল দেওয়াল ঘেঁষে। দেওয়ালের সঙ্গে যেন মিশে যেতে চায়। ওকে কেউই গ্রাহ্য করে না। নীলাকে ওরা নিয়ে এসে শুইয়ে দেয় ড্রইংরুমের একটা সোফায়।

অসীম ভয়ে ভয়ে নন্দকে প্রশ্ন করে-- ডাক্তার দেখানো হয়েছে?

নন্দ একবার থেমে পড়ে। কী যেন বলতে যায়। তারপর কিছু না বলেই চলে যায় ভেতরে।

অসীম বসেই থাকে বাড়ির প্রবেশপথের ধারে।

এ বাড়িতে সে অপ্রয়োজনীয় শুধু অপ্রয়োজনীয় নয়-- অবাঞ্ছনীয়। এ বাড়ির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই তার। সম্পর্ক নেই বা কেন? সবাই জানে সে-ই এ চরম সর্বনাশের মূল! সমস্ত জেনেশুনেও নাকি বাপকে ধরিয়ে দিয়েছে সে! কলঙ্কের বোঝা নিয়ে কেমন করে দাঁড়াবে অসীম দুনিয়ার সামনে? এত বড় লঙ্জার বোঝা বহন করা মানুষের পক্ষে সম্ভব?

দীপক বেরিয়ে আসে একটু পরেই। গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায়। কে জানে কোথায় গেল ও।

অসীম মনে মনে বলতে থাকে : তুমি তো জানতে এ আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। কেন এমন করে দলিত মথিত করে রেখে গেলে আমাকে? কেন সমস্ত অপরাধের বোঝা এমন করে তুলে নিলে নিজের মাথায়? কেন গোপন করেছিলে আমাদের কাছে তোমার যৌবনের ইতিহাস? কেন, কেন, কেন..?

... আচ্ছা, বাবা এখন কী করছেন? খুব কি ভেঙে পড়েছেন? দণ্ডাদেশ উচ্চারিত হবার পর সে যেমন ধুলার উপর বসে পড়েছিল তিনিও তেমনি করে ভেঙে পড়েছিলেন? যাবজ্জীবন কারাদণ্ড! অর্থাৎ লৌহকপাটের ওপারেই ফেলতে হবে তাকে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস! তাঁর পায়ের ওপর মুখ রেখে জীবনের শেষ ক্ষমা চেয়ে নেবার সুযোগ আর আসবে না অসীমের জীবনে !...আচ্ছা, চুরুট না খেয়ে কেমন করে আছেন তিনি। রাজবন্দিদের কি চুরুট খেতে দেয়? ওঁকে কি সেই ডোরাকাটা জামা একটা পরিয়ে দিয়েছে! শিউরে উঠল অসীম। স্পষ্ট দেখতে পেল অসীম বাপের সেই মূর্তিটা। নীল-সাদা ডোরাকাটা একটা হাতকাটা জামা, আর হাফপ্যান্ট পরা ডাক্তার পরমানন্দ চৌধুরী দাড়িয়ে আছেন লোহার গরাদ দুটো ধরে-- দুই গরাদের ফাঁকে চেপে ধরেছেন গলাটা।

আর্তনাদ করে ওঠে অসীম-- বাবা!

হঠাৎ দুই হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে ছেলেমানুষের মতো।

কতক্ষণ ওইভাবে বসেছিল খেয়াল নেই। গাড়ির শব্দে আবার মুখ তুলে তাকায়। গাড়িটা এসে দাঁড়িয়েছে দরজার সামনে। ডাক্তারবাবুকে নিয়ে দীপক নেমে আসে। পাশ দিয়ে চলে যায় ওরা ভেতরে। ওকে অন্ধকারে ওভাবে বসে থাকতে দেখে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন ডাক্তারবাবু : এ কে? এমনভাবে বসে আছেন কেন ওখানে?

-- ও অসীম। ডাক্তার চৌধুরীর ছেলে। +

-- আই সী! দ্যাট সান্?

-- হ্যাঁ, আপনি ভেতরে আসুন।

ওরা চলে যায়।

-- দ্যাট সান্! সেই ছেলে! যে ছেলে পিতৃঋণ শোধ করেছে বাপকে জেলে পাঠিয়ে! যে ছেলে...

না! আর পারবে না অসীম। একটা কিছু এখনি করতে হবে।

হঠাৎ ওর বাহুমূল ধরে কে যেন আকর্ষণ করে।

-- কে? ও, বৈশাখী!

-- ওপরে যাও!

-- কেন?

পথের উপর এমনভাবে বসে থেকে একটা সীন কোরো না!

টলতে টলতে উঠে যায় অসীম দোতলায় নিজের ঘরে।



নামো এবার।

নেমে আসেন পরমানন্দ ননীমাধবের অনুরোধে। জিতেন বাঁডুজ্জের বাড়ির সামনে এসে পৌছেছেন ওঁরা। এইবার শুরু হবে রাজনৈতিক বুদ্ধির লড়াই। সাদরে ওঁদের ঘরের ভিতরে নিয়ে গিয়ে বসান জিতেনবাবু। বড় ঘর। চতুর্দিকে আলমারি-ভর্তি আইনের বই। পেছনের দেওয়ালে বিরাট বড় একটা বাঁধানো ফোটো সম্ভবত জিতেনবাবুর স্বর্গগত পিতৃদেবের। তিনিও নামকরা উকিল ছিলেন বোধহয়। উকিলের পোশাকেই তোলা ছবি। কিশলয়বাবুও এসেছেন। একক। আবার মামুলি সৌজন্য বিনিময়ের পালা। কিন্তু সময় অল্প, সুতরাং সোজা আলোচনা শুরু করতে হয়। পাটোয়ারী বুদ্ধিতে কিশলয়বাবু কিন্তু কম যান না। তবে পরমানন্দের পক্ষেও আছেন ননীমাধব। তিনি লক্ষ করেছেন পরমানন্দের ভাবান্তর। এজাতীয় সেন্টিমেন্টাল লোক নিয়ে ভারি মুশকিল। নসীমাধবই আলোচনা চালান বন্ধুর পক্ষ থেকে।

কিশলয়বাবু পশ্চাদপসরণ করতে গররাজি নন এবং শর্তও তাঁর মাত্র একটি। সমাজ- উন্নয়ন-পরিকল্পনার জন্য এ জেলায় একটি গ্রামনগরী স্থাপনের কথা। দুটি স্থানের মধ্যে চূড়ান্ত নির্বাচন এখনও সমাপ্ত হয়নি। রতনপুর আর বাঘডাঙা। রতনপুর এককালকার বর্ধিষ্ণু অঞ্চল অর্থাৎ বর্তমানকার ক্ষয়িষ্ণু প্রাম। বড় বড় মোটা থামওয়ালা ছোট-ছোট পাতলা ইঁটের প্রাসাদ হৃতগৌরব জমিদারদের শেষ স্মৃতি বহন করছে। সেখানকার ভূতপূর্ব রায়সহেব আর রায়বাহাদুর জমিদারেরা তদ্বির-তদারক করছেন রতনপুরেই গ্রামনগরী প্রতিষ্ঠা করার। অপরপক্ষে বাঘডাঙা হচ্ছে মাঠের মাঝখানে হঠাৎ-গড়ে-ওঠা গ্রাম-- পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু এসে বসেছে সেখানে দলে দলে। কিশলয়বাবু এই জনপদের প্রতিষ্ঠাতা। অল্পমূল্যে এই ডাঙাজমিটি তিনি ক্রয় করে উদ্বাস্তু পত্তন করেছেন। কিশলয়বাবু এবং তাঁর পার্টি চান এই বাঘডাঙাতেই প্রতিষ্ঠিত হোক প্রস্তাবিত গ্রামনগরী। কিশলয়বাবু প্রতিদ্বন্দিতা থেকে সরে দাঁড়াতে রাজি আছেন যদি তাঁকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় যে তাঁদের পছন্দমত বাঘডাঙাতেই নতুন গ্রামনগরী গড়ে তোলার অনুমোদন দেওয়া হবে।

দেশবিভাগের আগে পূর্ববঙ্গে রাজনীতির সঙ্গে কিশলয়বাবু যুক্ত ছিলেন-- এখনও আছেন। তাঁরই প্রচেষ্টায় অনেক পরিবার এসে বসেছে বাঘডাঙায়। একটা অবলা আশ্রমও করেছেন ওখানে কিশলয়বাবু-- মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন। এদের নূতন জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টায় মেতে আছেন উনি। কো-অপারেটিভও গড়ে তুলেছেন একটা ওদের নিয়ে। বাঘডাঙা সমাজ-উন্নয়নের কেন্দ্রস্থল নির্বাচিত হলে এই উদ্বাস্তু নরনারীগুলির অশেষ উপকার হয়। গ্রামনগরীর অচ্ছেদ্য অংশরূপে আসবে স্বাস্থ্যকেন্দ্র, পুলিশ ফাঁড়ি, কমিউনিটি হল, বাজার, ছোটখাট শিল্পপ্রচেষ্টা। জমজমাট হয়ে উঠবে অঞ্চলটা। এ-সবই জানেন পরমানন্দ। কিশলয়বাবু যে ওই উদ্বাস্তু নরনারীগুলির স্বার্থে এতবড় আত্মত্যাগ করছেন এতে মনে মনে খুশিই হলেন তিনি। তবু বলেন : কিন্তু এ বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেবার কতটুকু অধিকার আছে আমার? আমি যদি রিটার্নডও হই-- তবু আমার ইচ্ছায় তো সি. ডি. পি. টাউনশিপের স্থান নির্বাচন হবে না।

কিশলয়বাবু হেসে বলেন : অঙ্গাঙ্গিভাবমজ্ঞাত্বা কথং সামর্থ্যনির্ণয়ঃ? আপনার ক্ষমতা কী? আপনি তো ল্যাম্পপোস্ট মাত্র!

-- তাহলে এ অন্যায় অনুরোধ করছেন কেন?

-- ডাক্তার চৌধুরী, আমি ছেলেমানুষ নই। রাজনীতি করে আমারও চুল পেকেছে। ওই লোকগুলো ল্যাম্পপোস্টকেই ভোট দিয়ে আসে কেন জানেন? কারণ তারা জানে যে ওই চলৎশক্তিহীন একেবারে খাড়া ল্যাম্পপোস্টগুলোর সঙ্গে ক্ষীণ যোগাযোগ আছে এক গোছা তারের। সে তারের মধ্যে দিয়ে যে বিদ্যুৎ বয়ে যায় তাতে ৪৪০ ভোল্ট কারেন্ট। শুধু এখানেই শেষ নয়-- সে তার আবার যুক্ত আছে কে. ভি. লাইনের সঙ্গে। তার সঙ্গে যোগাযোগ আছে মেন গ্রিড সিস্টেমের। ল্যাম্পপোস্ট নড়ে বসতে পারে না-- কিন্তু তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত আছে যে বৈদ্যুতিক তার-- তার ক্ষমতা অসীম।

পরমানন্দ কী একটা জবাব দিতে যাচ্ছিলেন, তাঁর আগে ননীমাধব বলেন-- তাহলে সেই প্রাইম-মুভারের সঙ্গে পরামর্শ না করে কী করে আমরা প্রতিশ্রুতি দিই বলুন?

-- সে তো বটেই। তবে আপনারা না পারলেও আপনাদের কিং-মেকার-অভ- দি-ডিস্ট্রিক্ট এ বিষয়ে আমাকে কথা দিতে পারেন। অন্তত একটা ট্রাঙ্ক কল করার পর তিনি জানাতে পারেন।

হা-হা করে হাসতে থাকেন কিশলয় গাঙ্গুলি।

-- বেশ, তবে তাঁর কাছেই চলুন যাওয়া হোক। পরমানন্দ বলেন।

বাধা দিয়ে ননীমাধব বলেন-- কিন্তু তাহলে আপনাকেও একটা প্রতিশ্রুতি দিতে হবে কিশলয়বাবু। আরও একটি কাজ আপনার করতে হবে এই সঙ্গে।

-- বলুন।

-- আমাদের ফ্যাক্টরির ধর্মঘটটা তুলে নিতে হবে। বাঘডাঙা বিষয়ে নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি পেলে আপনাকে বিনা শর্তে ধর্মঘটটা বন্ধ করতে হবে।

-- এ আপনি কী বলছেন ননীমাধববাবু! আপনাদের কারখানার স্ট্রাইকের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী? আমার ক্ষমতাই বা কতটুকু?

পরমানন্দের কাছে কথাটা খুবই যুক্তিযুক্ত মনে হয়। কারখানার শ্রমিকেরা কোনো রাজনৈতিক দলভুক্ত নয়। ওদের কোনো স্বীকৃত মজদুর ইউনিয়নও নেই। সুতরাং কিশলয়বাবু কেমন করে এজাতীয় প্রতিশ্রুতি দেবেন? সে কথাই হয়তো বলতে যাচ্ছিলেন তিনি, কিন্তু তাঁর আগেই ননীমাধব বলে ওঠেন-- মিস্টার গাঙ্গুলি, ছেলেমানুষ আমরাও নই। আপনি তো সামান্য চড়াই পাখি। কতটুকু ক্ষমতা আপনার? তবু ওই সংস্কৃত শ্লোকটাই বলছে নাকি যে সামান্য টিট্টিভ পক্ষীও সমুদ্রকে ব্যাকুল করে তুলতে পারে! আপনার পার্টি টাকা না ঢাললে একাদিক্রমে বাইশ দিন স্ট্রাইক চালাতে পারে কোনো শ্রমিকদল-- যাদের ইউনিয়ন পর্যন্ত নেই? অবশ্য আপনি বলতে পারেন নিজ দায়িত্বে এ প্রতিশ্রুতি দেওয়া আপনার পক্ষে সম্ভবপর নয়-- তা, কী বলে ভালো, আপনাদেরও একজন লীডার-অভ-দি-অপোজিশন পার্টিমেকার আছেন এ জেলায়-- তাঁর সঙ্গেই না হয় একটু কথাবার্তা বলে নিন টেলিফোনে।

কিশলয়বাবুর হা-হা-করা হাসিটা এতক্ষণে প্রতিধ্ব নিত হয়ে ওঠে ননীমাধবের ওঠে।

ভালোমানুষ জিতেন বাঁড়ুজ্জে বলেন-- একটু চা হোক এবার?

কেউ কর্ণপাত করে না কথাটায়।

কিশলয় বলেন-- - আপনার সঙ্গে কথা বলে সুখ আছে মশাই। আমি এই রকম খোলাখুলি কথাই ভালোবাসি। এককালে ফ্লাশ খেলতাম, জানেন, কিন্তু ব্লাইন্ড খেলিনি কোনোদিন। পাওয়া মাত্র তাস তিনখানা টিপে টিপে দেখে নিতাম-- তারপর হাত বুঝে স্টেক করতাম।

-- আপনি খেলেন না কি তেতাশ? তাহলে আসবেন না আমাদের বোর্ডে। আমরা তো রোজই সন্ধ্যার পর...

ননীমাধবকে থামিয়ে দিয়ে কিশলয়বাবু হেসে ওঠেন : সীয়ারাম, সীয়ারাম! ভুলে যাচ্ছেন কেন আমরা বিপক্ষ শিবিরের লোক। আমরা সর্বহারার দলে আর আপনারা হচ্ছেন ক্যাপিটালিস্ট বুর্জোয়া শ্রেণির লোক। আপনাদের ক্লাবঘরের দরজায় মাথা গলাতে দেখলে যে আমাদের আর লোকে বিশ্বাসই করতে চাইবে না।

-- আহা, সেইজনোই তো ক্লাবঘরে একটা পেছনের দরজা বানানো হয়েছে।

দুজনেই হেসে ওঠেন আবার।

...কিন্ত যে কথা হচ্ছিল। আপনাদের স্ট্রাইকের কথা। হ্যাঁ, ওটার ব্যবস্থাও হতে পারে-- কিপ্ত একেবারে মৌফতসে ওটা কী করে আশা করেন আপনি ননীবাবু? বাঘডাঙার এক্সচেঞ্জে আমি উইথড্র করতে রাজি আছি। দ্য ডীল ইজ্‌ কমপ্লীটেড। এই একই ট্র্যানজাকশনে যদি আপনাদের ধর্মঘটটাও জুড়ে দিতে চান তবে আমার তরফেও একটা এন্ট্রি হওয়া উচিত, নয় কি? ফর এভরি ডেবিট দেয়ার শ্যুড বি এ ক্রেডিট-- না হলে ব্যাল্যান্স শীট মিলবে কেন—অ্যাঁ?

যেন চরম রসিকতা হল একটি। দুজনেই আবার হেসে ওঠেন।

অস্বস্তি বোধ করতে থাকেন পরমানন্দ। এ কী মেছোহাটায় এসে পড়েছেন তিনি! দুজনেই দেশসেবা করতে চান-- অথচ রাষ্ট্রের আইনে একজনই পেতে পারেন সে অধিকার। সুতরাং একজন যাবেন আইনসভায়-- অপরজন তাকে স্থান ছেড়ে দেবেন। যিনি স্বার্থত্যাগ করছেন তিনি কতকগুলি সুবিধা পাবেন ; কিন্তু সে সুবিধা আদর্শগত, নীতিগত হবে এটাই পরমানন্দের আশা ছিল। কিন্তু ব্যাপারটা তো সেই নৈর্ব্যক্তিক স্থুলতামুক্ত থাকছে না।

-- বেশ বলুন, কেমন করে ব্যাল্যান্স শীট মেলানো যায়। প্রশ্ন করেন ননীমাধব।

কিশলয়বাবু চামড়ার হ্যান্ডব্যাগ থেকে বার করেন একটি নীল কাগজের ব্লু-প্রিন্ট। বাঘডাঙা মৌজার সেটেলমেন্ট ম্যাপ। প্রস্তাবিত গ্রামনগরীর এলাকাটায় একটা লাল দাগ দেওয়া। তাঁর ভেতরে রেল-লাইনের বরাবর সমান্তরাল লম্বা একটি ফালি জমির ওপর নীল পেন্সিলের ডোরা কাটা।

কিশলয় গাঙ্গুলি বলেন-- প্রস্তাবিত টাউনশিপের সীমানা হচ্ছে এই লাল-পেন্সিলের অংশটা। তাঁর ভেতর এই নীল-পেন্সিলের দাগ দেওয়া এই কটা প্লট ডি-রিকুইভিশন করিয়ে দিতে হবে।

-- কতটা জমি হবে ওটা?

-- দাগ নম্বর ১১০৭ থেকে ১১১৩, একুনে তেতাল্লিশ একর।

-- ব্রেভো! হেসে ওঠেন ননীমাধব। বেশ, চলুন তাহলে, আর দেরি করা নিরর্থক।

ওরা উঠে পড়েন। সদলবলে রওনা হয়ে পড়েন তারিণীদার আস্তানার উদ্দেশ্যে।



কিছুই ভালো লাগছিল না পরমানন্দের। কোথায় যেতে পারে মেয়েটা? সত্যিই কি কুলিব্যারাকে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে সে? এতটা নীচে সে নেমে যাবে? সকলেই চেনে তাকে-- ডাক্তার চৌধুরীর কন্যা বলে। ওখানে গিয়ে যদি আশ্রয় নিয়ে থাকে তাঁর বিদ্রোহী আত্মজা তাহলে লোকসমাজে তিনি মুখ দেখাবেন কী করে? মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন, মানুষ করে তুলেছেন। ফিলসফিতে এম. এ. পাস করেছে নীলা। বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন – নীলা রাজি হয়নি। কারণটা জানা ছিল না এতদিন-- সম্প্রতি জেনেছেন। অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল প্রথমটা। তারপর বুঝেছেন এ দুনিয়াতে বিশ্বাসের অতীত সত্যই কোনো কিছু নেই হয়তো। কৈশোরে যে মেয়েটির দেব-দ্বিজে ভক্তির ছিল বাড়াবাড়ি – পরবর্তী জীবনে সেই হয়ে উঠেছিল নাস্তিকতার কালাপাহাড়। অথচ কী আশ্চর্য, শৈশবে কৈশোরে সে মানুষ হয়েছিল বিজাতীয় আবহাওয়ায়। মায়ের ও দিদিমার প্রভাবে তার পক্ষে বার-ব্রত-পূজা-অর্চনার দিকে ঝোঁকাটা সে যুগেই ছিল অস্বাভাবিক। কিন্তু তা সত্বেও সে মেতেছিল ওই-সব নিয়ে। হয়তো তার ওই-সব ব্রতপূজার জন্য ব্যঙ্গবিদ্রূপ করা হত বলেই সে বেশি জোর দিয়ে করত সেগুলো। বরাবরই একটা বিদ্রোহের ভাব ছিল তার রক্তে। স্কুলের দিদিমণিদের কাছ থেকে শেখা গঙ্গাস্তোত্র আওড়াতে আওড়াতে বাথরুমে সে জল ঢালত মাথায়। আজও স্পষ্ট মনে আছে পরমানন্দের-- বাথরুমের দরজা ভেদ করে বেরিয়ে আসত শীতে-কাঁপুনি-ধরা নীলার কাঁপা কণ্ঠ-- “মাতর্গঙ্গে তে যো ভক্তঃ”।

আরও একদিনের ঘটনার কথা মনে পড়ছে আজ। তখন বোধহয় নীলা ফিফথ ক্লাসে পড়ত। ফিফথ ক্লাস তো নয়, ওরা বলত ক্লাস সিক্স। অর্থাৎ ম্যাট্রিক দেবার তখনও বছরচারেক বাকি। একদিন হাউ-হাউ করতে করতে নীলা এসে হাজির বাপের দরবারে। কী ব্যাপার? না, দাদা আমার পুন্যিপুকুর নষ্ট করে দিয়েছে! কী পুকুর? না, পুন্যিপুকুর। পুন্যিপুকুর আবার কী রে বাবা? অনুসন্ধান করতে হয় ব্যাপারটা। তদন্তের পর বোঝা গেল বাগানের এককোনায় আছে একটা ছোট্ট গর্ত। তার চারপাশে কিছু শুকনো ফুল, বেলপাতা। আর পুকুরের মাঝখানে কিছু মুরগির পালক-- মাটিচাপা দেওয়া। জরুরি আদালত বসেছিল সেদিন বাড়িতে। বাদী নীলা, আসামী অসীম, সাক্ষী নন্দ বেয়ারা আর বিচারক স্বয়ং পরমানন্দ। আসামী দোষ অস্বীকার করে বসায় মামলাটা বাঁকা পথ ধরল। জবানবন্দিতে আসামি বলে-- হ্যাঁ, মুরগি একটা কেটে খেয়েছিল বটে ওরা কজন বন্ধু মিলে। বেওয়ারিশ মুরগি, কার তা জানে না, -- উড়ে এসে পড়েছিল বাগানে। তার ঠ্যাং আর পালকগুলো তাড়াতাড়ি সমাধিস্থ করার প্রয়োজন বোধ করেছিল ওরা। তৈরি গর্ত পাওয়ায় পরিশ্রমটা লঘু হয়েছিল তাদের। পুন্যিপুকুর কী তা তারা জানে না। তা তো স্বয়ং বিচারকও জানেন না। বাদী তখন বিচারককে বুঝিয়ে দেয় পুন্যিপুকুরের মাহাত্ম্য কী যেন শোলোকটা? মনে নেই এতদিন পরে। খালি একটা কথা মনে আছে-- ‘আমি সতী লীলাবতী!’ ওই কথাটা তাঁর বেণীদোলানো মেয়েটির মুখে শুনে হো-হো করে হেসে উঠেছিলেন সেদিন। বিচারকের এই ব্যবহারে আদালত অবমাননার ভয় না করে বাদী সেদিন সভাত্যাগ করেছিল প্রতিবাদে।-- বেশ! বুঝলাম! তুমিও তাহলে ওই দলে! বারবার ওকে ফিরে ডেকেছিলেন। ফেরেনি অভিমানিনী মেয়েটি-- না! শুনব না আমি তোমার কথা। তুমিও ওই দলে!

তুমিও ওই দলে!

কোন দলে? সেদিন বালিকাবয়সী নীলা বলেছিল-- তুমি ওই দলে। অর্থাৎ দাদার মতো নাস্তিকদের দলে-- যারা পুন্যিপুকুরের মাহাত্ম্য অবিশ্বাসী। শুনে হেসেছিলেন তিনি। আরও বছর পাঁচেক পরে ওই একই অভিযোগ এনেছিল অসীম।-- বলেছিল—‘তুমিও তাহলে ওই দলে!’ অর্থাৎ নীলার দলে, বিপ্লব-অনুরাগীদের দলে। সেবারও তিনি হেসেছিলেন। আজ আবার নীলা বলছে ওই কথাই-- তুমিও ওই দলে। এবার ওই দল হচ্ছে স্বার্থপর আত্মভোগীদের দল।

এবারও হেসে উড়িয়ে দেবেন পরমানন্দ।

চিরদিন তিনি একটিমাত্র দলেই আছেন-- সত্যধর্মের দলে। বিবেকবুদ্ধি যা ভালো বলে বুঝেছে-- তাই সবলে আঁকড়ে ধরেছেন। একচুলও বিচ্যুত হননি নিজের দৃঢ়মত থেকে। সে কথা নীলা জানে। তাই এ কথাও তার বোঝা উচিত ছিল যে, হুমকি দেখিয়ে কোনো লাভ হবে না। নীলা যদি তাঁকে ত্যাগ করে ওই কুলি-বস্তিতেই গিয়ে আজ আশ্রয় নেয়-- তো নিক। সেই ভয়ে তিনি পশ্চাদপসরণ করবেন না নিজ আদর্শ থেকে। যে পথে বৃহত্তর মানবসমাজের, প্রভূতের কল্যাণ করতে পারবেন-- সেই পথেরই অভিযাত্রী আজ তিনি। মেয়ের হুমকিতে সে পথ ত্যাগ করে আসার মানুষ তিনি নন।

প্রথম যৌবনে লক্ষ্য ছিল, বন্ধনদশা থেকে দেশমাতৃকাকে উদ্ধার করবেন। বিদেশী শাসনভার থেকে শৃঙ্খলমুক্ত করবেন দেশকে। একদল বিপ্লববাদীর সঙ্গে গোপন যোগাযোগ হয়েছিল তাঁর; তখন তিনি কলকাতায় মেডিকেল কলেজের প্রথম বার্ষিক শ্রেণির ছাত্র। ওঁর বাবা হঠাৎ টের পেয়ে গেলেন। পিতাপুত্রে একটা সম্মুখযুদ্ধ হবার উপক্রম হল। পরমানন্দের বাবা কলকাতার এই পরিবেশ থেকে ছেলেকে সরিয়ে নেবার জন্যই তাকে বিলাত পাঠালেন। খুশি হয়েছিলেন তাতে পরমানন্দ। দলপতি জ্যোতির্ময় পাঠক বলেছিলেন-- এ শাপে বর হল, আমরা বিশ্বস্ত একটি লোককে ভারতের বাইরে পাঠাতে চাইছিলাম। ভালোই হবে-- তোমাকে দিয়েই কাজটা হবে-- অথচ খরচ দেবেন তোমার বাবা!

তারপর দ্রুত পরিবর্তন হয়ে গেল দেশের ইতিহাসে। ভারতজোড়া বিপ্লবজাল মুহূর্তে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। পাঞ্জাব থেকে চট্টগ্রাম – জাল গুটিয়ে অনেককেই ধরে ফেলল ওরা। কেউ মরল গুলি খেয়ে, কেউ ফাঁসির মঞ্চে। অত্যন্ত সুকৌশলে অতীত জীবনের ইতিহাসকে লুকিয়ে ফেললেন পরমানন্দ অপ্রকাশের অনালোকে। শতাব্দীর দীর্ঘ পঞ্চমাংশ তাঁর জীবনে রাজনীতির কোনো স্থান ছিল না। ছিল না প্রকাশ্যে-- কিন্তু অন্তরের নিভৃতলোকে নিশ্চয়ই বয়ে চলেছিল বিদ্রোহের ফল্গুধারা। হঠাৎ নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের মতোই একদিন পাষাণকারা ভেদ করে বের হয়ে এল সে। উপায় ছিল না। শচীশ নন্দীর ছেলের সন্ধান-বলে দেওয়া অসম্ভব ছিল সেদিন তাঁর পক্ষে। পঁচিশ বছর আগে গীতা হাতে দলপতির কাছে যে গোপনীয়তার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তা ভাঙতে পারেননি তিনি। কারারুদ্ধ ছিলেন দীর্ঘদিন। হয়তো বাকি জীবনটাই কেটে যেত সেই অন্ধকারার অন্তরালে। অন্তত সেদিন মনে হয়েছিল এটাই অনিবার্য নিয়তি। দেশ স্বাধীন না হলে এই পরিণতিই ছিল অবধারিত।

জেলে থাকতেই দুঃসংবাদটা পেয়েছিলেন। প্রচণ্ড কালবৈশাখী ঝড়ে তাঁকে কাবু করতে পারেনি-- পুলিশী অত্যাচারে তিনি ভেঙে পড়েননি-- মাথা সোজা রেখেই গ্রহণ করেছিলেন মিস গ্রেহামের হার্টফেল করার সংবাদ। কিন্তু এ সংবাদটা বজ্রাঘাতের মতো দাউদাউ করে জ্বালিয়ে দিয়েছিল তাঁর অন্তঃকরণ!

অসীম শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছিল!

নীলাকে আশ্রয় দিতে চেয়েছিলেন ননীমাধব। সে রাজি হয়নি। এ বাড়ি ছেড়ে সে কোথাও গিয়ে থাকতে পারবে না। মিস গ্রেহাম গত হয়েছেন, অসীম নেই, বাবা নেই, বৈশাখী কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে। পুরনো আমলের লোক একমাত্র মাটি কামড়ে পড়ে আছে নন্দ-বেয়ারা। বোধকরি নিয়মমত মাহিনা না পেলেও সে চলে যেত না। দৈনন্দিন আহার না জুটলেও। এ বাড়ির অনেক সুখ-দুঃখের ইতিহাসে সে ছিল নীরব সাক্ষী। দিদিমণিকে সে ছেড়ে যায়নি।

নীলা অসীম ধৈর্যে নিজেকে সংহত করেছিল। অসীমের মৃত্যুর পর প্রথম কয়েক মাস সে কেমন আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। তারপর ধীরে ধীরে সে নিজেকে সংযত করে তোলে। পড়াশুনা শুরু করে আবার। বাবা ফিরে আসবেন না-- আর কেউ নেই তার। নিজের পায়ে উঠে দঁড়াতে হবে। ধাপে ধাপে পার হয়ে গেল কলেজের সোপানশ্রেণি। সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে। অন্ধকারার অন্তরাল থেকে যেদিন বার হয়ে এলেন পরমানন্দ, সেদিন নীলাকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। অদ্ভুত পরিবর্তন হয়ে গেছে নীলার। দেহে এবং মনে। অনেক বড় হয়ে গেছে—অনেক ভারিক্কে। বৃদ্ধ বাপকে সে ছোট্ট শিশুর মতোই টেনে নিল নিজ ক্রোড়ে।

তাঁর অবর্তমানে নীলার জীবনযাত্রা সম্বন্ধে কিছু সংবাদ পেয়েছিলেন নন্দ বেয়ারার কাছ থেকে, কিছুটা ননীমাধব অথবা দীপকের মারফত। নীলা ঘোর নাস্তিক হয়ে উঠেছিল দিনে দিনে। ঈশ্বরের অস্তিত্ব সে স্বীকার করে না। এ বিশ্বব্রহ্মান্ডের উপর আনন্দঘন কোনো সত্তার কথা সে স্বীকার করতে নারাজ। যে সর্বশক্তিময় সত্তা তাঁর সুখের সংসারকে ছারখার করে দিয়েছে-- তাঁর বাবাকে করেছে নির্যাতন -- তাঁর নিরপরাধ ভাইকে নিষ্ঠুর নিয়তির নিষ্পেষণে দলিত মথিত করে ঠেলে দিয়েছে অবমাননাকর মৃত্যুর মুখে-- তাকে মঙ্গলময় বলে স্বীকার করে না নীলা, করবে না কখনও।

কিন্তু পরমানন্দ তখন একটা অবলম্বন খুঁজছেন। জীবনের তিনপোয়া অংশে ঈশ্বরের কোনো প্রয়োজন বোধ করেননি। তিনি থাকেন ভালো,-- না থাকেন বয়ে গেল-- ভাবটা ছিল এই। এখন কিন্তু জীবনের সায়াহ্নে এসে একটা কিছু আঁকড়ে ধরতে চাইছিলেন তিনি। ফিরে এসে বুঝতে পেরেছিলেন সংসারে তাঁর প্রয়োজন ফুরিয়েছে। তাঁর অবর্তমানে নার্সিং হোম উঠে যায়নি। ননীমাধবের তত্ত্বাবধানে সেটা চলছে ঠিকই। তাঁর নিজস্ব সংসারেও তিনি বাহুল্যমাত্র। শেয়ারের ডিভিডেন্ড আর বাড়িভাড়া থেকে সংসার-রথচক্রে ঠিকমতো রসদ জোগান দেয় নীলা। কোথাও সংসার তাকে দেখে বললে না-- এই যে এসো! কোনো দাবি নেই বৃদ্ধের। সকালে খবরের কাগজ পড়তে পারো, দুপুরে নিদ্রা যাও না কেন? বিকালে একটু সান্ধ্য ভ্রমণ করলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে। রাত্রে-- না, এই বয়সে বেশি রাত জাগা ভালো নয়-- সকাল সকাল খেয়ে শুয়ে পড়ো বরং। ব্যবস্থাটায় প্রথমে আহত বোধ করেছিলেন। তারপর মনে হল-- এই তো দুনিয়া। একদিন তিনি ছিলেন এ সংসারের কেন্দ্রস্থলে-- তিনিই ছিলেন এর কর্ণধার। তাঁর দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে গড়ে উঠেছে নতুন ব্যবস্থা-- এই তো স্বাভাবিক। আবার কেন সে-নতুন ব্যবস্থায় আঘাত হানবেন উনি? পরমানন্দ অপ্তরে অন্তরে বিদায় নিলেন সংসার থেকে।

এই সময়েই তিনি দীক্ষা নেন গুরুদেবের কাছে। উদাসীন সন্ন্যাসী মানুষ। সাক্ষাৎ পান হরিদ্বারের আশ্রমে। কোনো জাগতিক বন্ধন নেই। দৃষ্টি তাঁর কোন দুরনিরীক্ষ্য দিগন্তে ফেরানো। তাঁর সঙ্গে কথা বলে অদ্ভুত সান্ত্বনা পেলেন পরমানন্দ-- অভিভূত হয়ে পড়লেন। মনে হল ইনিই তাকে দেখাবেন পথ। গুরুদেবের উপদেশমতো সাধনমার্গের পথে শুরু হল তাঁর নূতন অভিযাত্রা। অপূর্ব আনন্দের আস্বাদ পেলেন তাঁরই প্রসাদে। নূতন লক্ষ্যের দিকে নূতনতম অভিযান। জানতে হবে তাঁকে-যাঁকে পাওয়ার পর অন্য সমস্ত পাওয়াকে মনে হয় তুচ্ছ অকিঞ্চিৎকর। গুরুদেবের আশ্রম শহরের অপর প্রান্তে গুটি তিন-চার অনুরাগী শিষ্য আছে-- তাদের আছে অনুসন্ধিৎসা, আছে নিষ্ঠা-- নেই আড়ম্বর, নেই উপকরণের বাহুল্য। সন্ধ্যাবেলা ওদের সঙ্গেই এসে বসতেন গুরুদেবের কাছে। বর্ষায় ও শীতে খড়ে-ছাওয়া মেটে ঘরের প্রদীপজ্বালা আধো-অন্ধকারে; অন্যান্য ঋতুতে বাগানের ছাতিমগাছ তলায়। গুরুদেবের কন্ঠে ছিল ঈশ্বরদত্ত মাধুর্য—গানই করুন, কথকতাই করুন, অথবা পাঠই করুন গীতা অথবা উপনিষদ-- তন্ময় হয়ে শুনতে শুনতে অভিভূত হয়ে পড়ত শ্রোতা। সংস্কৃতটা ভালো জানা নেই পরমানন্দের-- তাই যখন ভাষ্য না করে শুধু ব্রহ্মসূত্র আওড়ে যেতেন তখন অর্থগ্রহণ হত না-- কিন্তু অভিভূত হয়ে থাকতেন তখনও! ছন্নছাড়া জীবনে শান্তি পেলেন তিনি।

নীলাকেও তিনি নিয়ে আসতে চাইতেন এই সুশান্ত পরিবেশে। পরমানন্দ জানতেন নীলার মনের দুঃখের দাহন-- তাই তাকেও আনতে ইচ্ছা হত সঙ্গে করে। নীলা রাজি হত না। এনিয়ে মতান্তর হয়েছিল পিতা-পুত্র, মনান্তর হতে পারেনি। কারণ সংসারের চতুঃসীমায় অপরের মতকে সহ্য করবার যে অলিখিত আইন ছিল সেটা অতিক্রম করেনি কোনো পক্ষই। কালাপাহাড় কন্যা ও ভক্ত পিতার মধ্যে কোনো ফাটল দেখা দেয়নি এইজন্য। এই কারণে একজন অপরের সান্নিধ্য ত্যাগ করার কথা কল্পনা করেননি।

দিন কেটে যায়।

হঠাৎ একদিন উপলব্ধি করলেন পরমানন্দ বানপ্রস্থ নেবার মতো মানসিক প্রস্তুতি হয়নি তার। জাগতিক প্রয়োজন তাঁর ফুরিয়ে যায়নি। কর্মযোগ ত্যাগ করে ভক্তিযোগে তাঁকে পাওয়ার চেষ্টাটা তাঁর ঠিক হয়নি। দেশ স্বাধীন হয়েছে, সফল হয়েছে তাদের স্বপ্ন; কিন্তু কই, দেশজননীর অভাব-অনটন তো দূর হয়নি! অনাহার, অশিক্ষা, স্বাস্থ্যহীনতা তো তেমন করেই চেপে ধরে আছে হতভাগ্য দেশের কণ্ঠনালি। তবে বৈরাগ্যসাধনের পথে কেন মুক্তির সন্ধানে তিনি মুমুক্ষু আজ? নানান প্রতিষ্ঠান থেকে এই নির্যাতিত দেশকর্মীটির আহ্বান আসতে শুরু করল। হিন্দু সৎকার সমিতি হবে, মেয়েদের স্কুল হবে, হরিজন পল্লীতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভিত্তি গাড়া হবে:-- সবাই ডাকে পরমানন্দকে। তাঁর গলায় পরিয়ে দেয় ফুলের মালা-- প্রশস্তি পড়ে শোনায়। তাঁকে পুরোভাগে রেখে চলতে চায় ওরা। এ আহ্বানকে তিনি উপেক্ষা করবেন কীসের জোরে? ক্রমে ক্রমে কখন বন্ধ হয়ে গেল গুরুদেবের আশ্রমে যাতায়াত-- নিজের অজান্তেই নেমে এলেন তিনি সমাজসেবার কাজে,-- সেখান থেকে আর এক ধাপ- সক্রিয় রাজনীতিতে।

এই সময়েই বার্টন অ্যান্ড হ্যারিস কোম্পানির একগোছা শেয়ার চলে এল তাঁর হাতে। পরমানন্দ বুঝতে পেরেছিলেন শিল্পের উন্নয়ন না করতে পারলে অর্থনৈতিক বন্ধনদশা ঘুচবে না দেশের। আত্মনিয়োগ করলেন তিনি শিল্পক্ষেত্রে। একনিষ্ঠ সেবায়, অনলস পরিশ্রমে অনতিবিলম্বেই অনেকগুলি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত হয়ে পড়লেন। প্রতিষ্ঠা হল; শুধু নির্যাতিত দেশকর্মী বলে নয়-- ভূতপূর্ব রাজবন্দি বলে নয়-- প্রতিষ্ঠাবান শিল্পপতি বলে।

কিন্তু একটা কাজ অসমাপ্ত রয়ে গেছে-- এটা ভুলতে পারেননি। নীলাকে সংসারী করা হয়নি। বয়স হয়েছে মেয়ের-- শিক্ষাও শেষ করেছে সে। মনোনীত পাত্রটি অবশ্য বরাবরই রয়েছে হাতের মুঠোয়। শুধু দু হাত এক করে দেওয়া। শুধু পরমানন্দ আর ননীমাধবই নয়-- নীলাও নিশ্চয় পছন্দ করে ওকে। না হলে এ দীর্ঘদিন ওর সঙ্গে কখনও এত ঘনিষ্ঠভাবে মিশত না। বন্ধু বলতে একমাত্র সেই আসে নীলার কাছে।

কথাটা একদিন পাড়লেন তিনি। নীলা শুধু বললে-- সে হবার নয়।

-- হবার নয়! কেন? অমতটা কার? তোমার না দীপকের?

-- ওটা অবান্তর প্রশ্ন। দীপক জানে তার সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়া অসম্ভব।

-- এর পর দীপককেই প্রশ্নটা করতে হয়েছিল। স্পষ্টই তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন : তুমি কি নীলাকে তোমার যোগ্য মনে করো না?

-- জবাবে দীপক বলেছিল-- নীলাকে অযোগ্য মনে করবে এমন পুরুষমানুষ তো কই আজও নজরে পড়ল না। কিন্তু এ হবার নয় জ্যাঠামশাই।

-- হবার নয়! কেন?

-- কারণ নীলার মন অন্যত্র বাঁধা আছে।

পরমানন্দ চুপ করে গিয়েছিলেন। নীলার মন অন্যত্র বাঁধা আছে! অর্থাৎ নীলা অন্য একটি যুবকের প্রতি আসক্ত। কে সে? সমস্ত পরিচিত দুনিয়া তন্নতন্ন করে হাতড়াতে থাকেন। না, সম্ভাব্য কাউকেই মনে পড়ে না। কিন্তু তাই বা স্থির নিশ্চয় হন কী করে তিনি। তাঁর দৃষ্টির অন্তরালে নীলা অতিবাহিত করেছে জীবনের রক্তঋতুর দিনগুলি! কে জানে কোন রক্তিম ইতিহাস লেখা হয়ে গেছে সেই জীবনবসন্তে। পরমানন্দ কেমন করে জানবেন জীবনের কোন মধুপ এসেছিল গোপনে সে যৌবনের মৌবনে।

..আজ আর ওটা অজানা নয়! আজ তিনি জানতে পেরেছেন কার প্রত্যাশায় শবরীর প্রতীক্ষায় দিন গুনছিল তাঁর আত্মজা। কিন্ত এ যে অসম্ভব আজ! ঘুঁটেকুড়ুনির ছেলের সঙ্গে কুঁচবরণ রাজকন্যের বিবাহ হত যে যুগে তা গত হয়েছে ঘিয়ের প্রদীপজ্বালা সন্ধ্যাবেলা-গুলোর সঙ্গেই। মিরাকল-এর যুগ এ নয়। জীবনটা নাটক নয়-- নভেল নয়। অসম্ভবের স্থান নেই জীবনে। আর সবচেয়ে বড় কথা তফাতটা অর্থনৈতিক নয়-তা হলে সহজেই সমাধান করতে পারতেন, জাতের নয়-- তাহলে উপেক্ষা করতেন। বাধাটা শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, জীবনদর্শনে-- বাধাটা নীতিগত। ওরা সমাজের বিভিন্ন স্তরের বাসিন্দা। একজন কারখানার সর্বশক্তিমান ডিরেকটার-তনয়া-- অন্যজন সেখানকার পদচ্যুত মেহনতী মানুষ-- চুরির দায়ে যাকে বরখাস্ত করা হয়েছে।

ছিছিছিছি!

************************

পরমানন্দ প্রায় জোর করেই নেমে গেলেন মাঝপথে। ননীমাধবকে বললেন তারিণীদার কাছে গিয়ে আলাপ-আলোচনা চালাতে। তিনি গুরুদেবের আশ্রমটা ঘুরে একটু পরেই আসবেন ওখানে। ননীমাধব প্রথমটা পীড়াপীড়ি করতে থাকেন সঙ্গে যাবার জন্য-- কিন্ত একগুঁয়ে বন্ধুর প্রকৃতি তাঁর জানা ছিল ভালো রকমই। তাই শেষ পর্যন্ত বলেন-- না হয় চলো তোমাকে আশ্রমে নামিয়ে দিয়ে যাই।

-- না, তাতেও আপত্তি পরমানন্দের। এটুকু পথ হেঁটেই যেতে পারবেন তিনি। অগত্যা পাকা রাস্তা থেকে কাঁচা মেঠো রাস্তাটা যেখানে বাঁক ঘুরে যাত্রা করেছে ওই নির্জন আশ্রমটির দিকে, সেই পথের মোড়ে তাকে নামিয়ে দিয়ে ওঁরা চলে যান।

মুক্তির নিঃশ্বাস পড়ে একটা। একটু নির্জন অবকাশই খুঁজছিলেন এই মুহূর্তটিতে। ভালোই হয়েছে। নীলা যদি এখানে এসে থাকে ভালোই-- না হলেও দীর্ঘদিন পরে আজ গুরুদেবের সঙ্গে আলোচনা করে মনটা হালকা করে নেবেন। এই শান্ত মনোরম বাতাবরণে মনটাকে স্নিগ্ধ কুরে নেবেন। নীলা কি এখানে এসেছে? সম্ভবত নয়। নীলা এখানে আসবার মেয়ে নয়। সে সহ্য করতে পারে না ওঁর গুরুদেবকে। একদিন তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধেই প্রায় জোর করে ওকে নিয়ে এসেছিলেন গুরুদেবের কাছে। আশা করেছিলেন ওর প্রভাবে হয়তো অবিশ্বাসের অচলায়তন ভেঙে পড়বে নীলার। তা কিন্তু বাস্তবে হয়নি। রীতিমতো সমকক্ষের মতো তর্ক করেছিল নীলা, শুধু তর্ক নয়-- খানিকটা উপেক্ষা, খানিকটা ব্যঙ্গও ছিল সেই তর্কের সঙ্গে। গুরুদেব অবশ্য কিছু মনে করেননি-- কিন্তু লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন পরমানন্দ।

বেলা বারোটা বাজে। অন্যমনস্ক হয়ে কাঁচা সড়কটা ধরে পায়ে পায়ে চলেছেন তিনি আশ্রমের দিকে। আশেপাশে নজর পড়ল হঠাৎ। আশ্চর্য মিষ্টি লাগল পরিবেশটা। শহরতলীর মাধূর্যে মোহিত হয়ে গেলেন যেন। স্তব্ধ মধ্যাহ্নের অভ্ররৌদ্র বন্দি হয়েছে ঘন কাঁঠালপাতার ঠাসবুননিতে—মাঝে মাঝে পথের ধুলায় পড়েছে পাতার ফাঁক দিয়ে চুরি করে আসা টাকা-টাকা রোদের ছাপ। ধুলোর গন্ধ এসে মিশেছে বনতুলসীর সৌরভে। পথের ধারে নয়ানজুলির বদ্ধ জলের ঘিয়ে রঙের কাদায় গা এলিয়ে নিশ্চিন্ত আবেশে পড়ে আছে একটা মিশকালো মোষ। রাস্তার ওধারে মেঠো ঘরে ঘুম নেমে আসছে কোনো দামাল ছেলের আধবোজা চোখের পাতায়-- গাঢ় কালো নিথর ঘুম। ওর মায়ের সুরেলা কণ্ঠের ঘুমপাড়ানিয়ার সঙ্গে সঙ্গত জমিয়েছে বিরলপত্র বাবলা গাছের ঘুঘুটা।

এমন কিছু বিরলসন্ধান দুর্লভ দৃশ্য নয়। পথের ধারে এমনি করেই চিরকাল ফুটে আছে এ দৃশ্য শহরতলীর দেশে। তবু যেন হুহু করে উঠল ওঁর মনের মধ্যে। কেমন যেন বঞ্চিত মনে হল নিজেকে-- কে যেন এই পল্লীর শান্ত দৃশ্যটিকে সরিয়ে রেখেছিল তাঁর দৃষ্টি থেকে। দ্রুতগতি মোটরের জানলায় এ দৃশ্য ধরা দেয়নি এতদিন তাঁর কাছে। এতদিন উপকরণের দুর্গে অবরুদ্ধ ছিলেন তিনি-- ঐশ্বর্যের ঠুলি এঁটে দিয়েছিল কে যেন তাঁর চোখ দুটিতে।

পায়ে পায়ে উনি এসে পৌঁছলেন আশ্রমে।

গুরুদেবের সঙ্গে দেখা হল না কিন্তু। তিনি সকালের ট্রেনে কোথায় যেন চলে গিয়েছেন। কোথায় গেছেন কেউ বলতে পারল না। যাবার আগে না কি একখানা চিঠি লিখে গেছেন পরমানন্দের নামে। চিঠিখানাও পেলেন না। সেখানা নিয়ে নাকি ছোট মহারাজ সকালবেলাতেই বার হয়েছেন-- তাঁকেই চিঠিখানা পৌঁছে দেবার জন্য। এখনও ফিরে আসেননি।

পরমানন্দকে মৃগচর্মের একটি আসন এনে দিল আশ্রমের একটি ভৃত্য। গুরুদেবের সেবার জন্য তিনিই বহাল করেছেন ছেলেটিকে-- মাহিনাও তিনিই দেন। আর কেউ নেই আশ্রমে। উনি বসে অপেক্ষা করতে থাকেন। যদি ফিরে আসেন ইতিমধ্যে ছোট মহারাজ।

সৌম্য শান্ত আশ্রমের বাতাস। ছোট্ট একটা বাগান পাঁচিলঘেরা আঙিনায়। হ্যাঁ, পাঁচিলটা তিনিই খরচ করে গেঁথে দিয়েছেন। সিমেন্ট দিয়েই গেঁথে দেবার ইচ্ছা ছিল-- কিন্তু কালোবাজার ছাড়া ও দ্রব্যটি পাওয়ার উপায় নেই। কারখানার এক্সটেনশনটার বেলায় যা করেছেন-- তাই বলে ওই ভাবে জোগাড়-করা সিমেন্ট দিয়ে তো তিনি আশ্রমের পাঁচিল গাঁথতে পারেন না। তাই চুন-সুরকি দিয়েই গেঁথে দিয়েছেন প্রাচীর। কী যেন ভাবছিলেন! হ্যাঁ বাগান-- সুন্দর ফুলের বাগান! পূজার ফুলের জন্য অসুবিধা হয না আর গুরুদেবের। ..বড্ড গরম লাগছে! বিজলী নেই আশ্রমে-- সুতরাং ফ্যানও নেই। পরমানন্দ ইলেকট্রিক কনেকশন করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন-- কত আর খরচ হত? আর, হত তো হত। পরমানন্দের মতো শিষ্য থাকতে গুরুদেব কষ্ট পাবেন গরমে?

কিন্তু গুরুদেবই রাজি হননি।

পরমানন্দ খদ্দরের পাঞ্জাবিটা খুলে আরাম করে বসেন। এই আশ্রমেও আজকাল আর আসা হয়ে ওঠে না তাঁর। অথচ বছর কয়েক আগে ঝড়বৃষ্টিমথিত কোনো একটি সন্ধ্যাবেলায়ও যদি এখানে না আসতে পারতেন তো মনে হত একটি দিন বৃথা গেল। আর আজ বোধহয় কয়েক মাস পর আসছেন তিনি এ আশ্রমে। সরে গেছেন, উপকরণের দুর্গে বন্দি হয়ে পড়েছেন নিজের অজান্তেই। শেষ কবে এসেছিলেন এ আশ্রমে? হ্যাঁ, মনে পড়েছে,-- নমিনেশন যেদিন পেলেন সেদিন এসেছিলেন গুরুদেবকে প্রণাম করতে। মনে পড়ল সেদিনকার ঘটনাটা।

সেদিন নিভৃতেই পেয়েছিলেন গুরুদেবকে জনান্তিক অবকাশে। সামনের ওই যে তালাবদ্ধ ঘরটা দেখা যাচ্ছে ওইখানে একটা প্রদীপ জেলে বসে বসে কী একখানা গ্রন্থ পড়ছিলেন তিনি। পরমানন্দ এসে বসলেন তাঁর পায়ের কাছে, প্রণাম করলেন। গ্রন্থথানি মুড়ে রেখে গুরুদেব জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকালেন শিষ্যের দিকে।

লঙ্জিত বোধ করেছিলেন সেদিন সে দৃষ্টির সামনে। নীরব দৃষ্টির জিজ্ঞাসা—কী ব্যাপার? দীর্ঘদিন পরে এমন হঠাৎ?

পরমানন্দ বলেছিলেন নমিনেশন তিনিই পেয়েছেন। এবার ভোটযুদ্ধে নেমে পড়বেন। তাই সংগ্রামে সক্রিয় অংশ নিতে যাবার আগে আশীর্বাদ ভিক্ষা করতে এসেছেন।

মনে আছে, গুরুদেব হেসে বলেছিলেন-- হঠাৎ অ্যাসেমব্লিতে যেতে বাসনা হল যে?

সত্য কথাই স্বীকার করেছিলেন তিনি। বৃহত্তর ক্ষেত্রে প্রসারিত করে চান নিজ কর্মক্ষেত্র। এই শহরের ছোট্ট গণ্ডীর চতুঃসীমায় তাঁর দেশসেবার ঐকান্তিকতাকে তিনি সীমিত হতে দেবেন না। সমগ্র দেশের ভালোমন্দ নির্ভর করে যে আইনসভার নির্দেশে সেখানকার মণিকার হবেন তিনি-- সে আহ্বান তিনি শুনতে পেয়েছেন-- আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজের নিমন্ত্রণ এসেছে-- আরও বড়ধরনের কাজ!

-- এখানকার কাজ কি তোমার শেষ হয়ে গিয়েছে?

কী শিশুর মতো সরল প্রশ্ন! কাজের কি শেষ আছে, যে শেষ হবে? এখানকার কাজ তো আছেই-- আরও গুরুতর কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে চান তিনি। কর্মযোগী পরমানন্দকে দেশ ডাকছে নির্দেশ দেবার জন্য, সে আমন্ত্রণ এসে পৌছেছে তাঁর কর্ণকুহরে। তাই রাজি হয়েছেন ইলেকশনে দাঁড়াতে। নূতন যাত্রাপথে অভিযাত্রার মঙ্গলমুহূর্তে তিনি উপদেশ নিতে এসেছেন গুরুদেবের পায়ের তলায় বসে।

উপদেশ দিয়েছিলেন গুরুদেব। কিন্তু খুব ভালো লাগেনি সেদিন কথাগুলি। বস্তুত তিনি আহতই হয়েছিলেন। কী ভাবেন আসলে গুরুদেব! হঠাৎ ও কথা বললেন কেন? পরমানন্দের অন্তরবাসী নির্লিপ্ত ত্যাগব্রতীর স্বরূপটা কি গোপন রইল গুরুদেবের মর্মভেদী দৃষ্টিতেও-- তিনি কি দেখলেন শুধু অহমিকায় ভরা মোহান্ধ একজন ক্ষমতালিপ্সু সাধারণ ভোগীকেই? সেদিন তিনি নীরবে উঠে গিয়েছিলেন প্রণাম সেরে-- খানিকটা আহত হয়েই। আজ মনে হয়, কিছুটা প্রয়োজন বোধ হয় ছিল তাঁর সেই উপাখ্যান পরিবেশনে। নীলাও তো ওই একই কথা বলে গেল।

-- স্বার্থ বলতে আমি স্থূল কিছু বোঝাতে চাইছি না বাবা। টাকা-পয়সা বাড়ি-গাড়ি হচ্ছে স্থুল স্বার্থ-- হয়তো সে লোভকে তুমি জয় করেছ-- করেছ কিনা তা তুমিই জানো! আমি ‘স্বার্থ’ শব্দটা অন্য অর্থে ব্যবহার করেছি। অপরের চোখে নিজেকে মহৎরূপে প্রতিপন্ন করাও স্বার্থেরই অভিব্যক্তি। প্রতিপত্তি, প্রতিষ্ঠা, সুনাম-- এগুলোও কি স্বার্থ নয়, অহমিকার প্রকাশ নয়?

গুরুদেবের কাহিনীটা আবার মনে করতে লাগলেন। না, ভোলেননি তিনি। ভালো কথক ওঁর গুরুদেব। সামান্য উপাখ্যানও বাচনভঙ্গির গুণে হৃদয়গ্রাহী হয়ে ওঠে ওঁর শ্রীমুখে। সেদিনকার গল্পটা মনে পড়েছে।

বলেছিলেন-- প্রজাপতি ব্রহ্মার আদেশে বিশ্বকর্মা পৃথিবী সৃষ্টি করলেন, ফুল-ফল-পশু-পক্ষীতে সুন্দর সুষমায় পূর্ণ হয়ে উঠল সৃষ্টি। ক্রমে সৃজন করলেন মানুষ। ষোলো কলার যোড়শ কলা যেন! নিপুণ চিত্রকর যেমন অনিমেষ নয়নে চেয়ে দেখে তাঁর সদ্য-শেষ করা আলেখ্য-- তেমনি একদৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে দেখলেন বিশ্বকর্মা তাঁর সুসমাপ্ত শিল্পকর্মের দিকে। মুগ্ধ হয়ে গেলেন তিনি। কী অপূর্ব তাঁর এ সৃষ্টি! তুষারশুভ্র ধ্যানস্তিমিত গিরিশৃঙ্গমালার স্তব্ধ গাম্ভীর্য, সমুদ্রমেখলা বেলাভূমির স্বর্ণসম্তার, গহন অরণ্যের যোগমগ্ন মুনি, মৌন শান্ত জনপদ-- অপূর্ব, অপূর্ব! মানুষের মুখে মাধুর্য, বুকে স্নেহ-প্রেম-ভালোবাসা। মায়ের বুকে মধুক্ষরা স্নেহধারা, বাসরঘরের দ্বারপ্রান্তে নববধূর লঙ্জাজড়িত চরণক্ষেপ-- আর শিশুর নিষ্পাপ সরল দৃষ্টি! তাঁর সৃষ্ট জগৎ বুঝি স্বর্গকেও অতিক্রম করে গিয়েছে। নিজের প্রভূত সাফল্যে বিশ্বকর্মার মনে দেখা দিল অহঙ্কার। মনে হল, যে শিল্পচাতুর্য তিনি দেখিয়েছেন তা বুঝি স্বয়ং পরিকল্পনাকার প্রজাপতি ব্রহ্মার কল্পনাকেও অতিক্রম করে গেছে। জগৎ সৃষ্টির কাজ সুসম্পন্ন করার সংবাদ নিয়ে বিশ্বকর্মা এলেন ব্রহ্মালোকে-স্বয়ং ব্রহ্মার কাছে।

ভগবান প্রজাপতি বললেন-- সৃষ্টি শেষ হয়েছে?

করজোড়ে বিশ্বকর্মা নিবেদন করলেন-হ্যাঁ প্রভু। আমার শিল্পকর্ম অসম্পূর্ণ থাকতে আমি কখনও তৃপ্ত হতে পারি না। কোথাও কোনো খুঁত রাখিনি আমি। শ্রেষ্ঠ সাধনায় আমি উত্তীর্ণ হয়েছি। আমাকে আশীর্বাদ করুন।

ব্রহ্মা বললেন-- মুঢ়! এত অল্পেই তোমার অহঙ্কার হয়েছে! মোহান্ধ হয়েছ বলে এতদূর থেকে ওই শিল্পকর্মের দোষত্রুটি তোমার নজরে আসছে না। তাই ওই পৃথিবীতেই তোমাকে নির্বাসিত করলাম। যাদের তুমি তৈরি করেছ-- তাদের মধ্যে গিয়ে তুমি জন্ম নাও। তাদের জীবনের অপূর্ণতার বিষয়ে অবহিত হও—সেটা সংশোধনের চেষ্টা করো।

বিশ্বকর্মা মর্মাহত হলেন ; আর্তকণ্ঠে প্রশ্ন করেন, তা হলে কি কোনদিন আর স্বর্গরাজ্যে ফিরে আসতে পারব না?

-- যেদিন ‘অহংজ্ঞান থেকে তোমার মুক্তি হবে-- যেদিন বুঝতে পারবে নিজের ক্ষমতার সীমানা আর জাগতিক দুঃখ অতিক্রমণের উপায়—সেদিন স্বর্গরাজ্যের দ্বারে এসে করাঘাত কোরো। আমি তোমায় পরীক্ষা করব। উত্তীর্ণ হলে ফিরে পাবে স্বর্গবাসের অধিকার।

নির্বাসিত হলেন বিশ্বকর্মা। জন্ম নিলেন সাধারণ মানুষের ঘরে। দেখলেন তার সৃষ্ট জগতে কোথায় কোথায় অপূর্ণতা রয়েছে। রোগ-শোক-মৃত্যুকে দেখলেন, লোভ-হিংসা-কামকে উপলব্ধি করলেন। সংসারের শত দুঃখকষ্টের মধ্যে জাগতিক যন্ত্রণার উপলদ্ধি হল তাঁর। দূর থেকে যা মনে হয়েছিল চাঁদের মতো সুন্দর, কাছে এসে দেখলেন সেটা সমতল নয় মোটেই-- সেখানে আছে উবড়োখাবড়া গর্ত, প্রতি পদক্ষেপে-- চাঁদের কলঙ্ক!

বিশ্বকর্মা অত্যন্ত লজ্জিত হলেন। কঠিন তপস্যায় আত্মনিয়োগ করলেন। এই রোগ-শোক-জরা-মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্তির উপায় উদ্ভাবনে কঠিন তপশ্চর্যায় নিমগ্ন হয়ে রইলেন। দীর্ঘ তপস্যার পর উপলব্ধি হল পরমব্রহ্মের পদে পূর্ণ আত্মনিবেদন করতে পারলেই এগুলি থেকে মুক্তি সম্ভব।

ফিরে গেলেন তিনি স্বর্গদ্বারে। করাঘাত করলেন সিংহদরজায়। ভিতর থেকে প্রশ্ন হল-- কে তুমি?

বিশ্বকর্মা বললেন- আমি বিশ্বকর্মা, পৃথিবী সৃজন করেছি। আমার সে সৃষ্টিকার্যের অপূর্ততার কথা আমি জানতে পেরেছি। সেই অপূর্ণতার হাত থেকে মুক্তির উপায়ও উপলব্ধি করেছি। দ্বার খুলুন প্রভু।

অবরুদ্ধ স্বর্গদ্বার উন্মোচিত হল না।

বিশ্বকর্মা বিস্মিত হলেন। নিশ্চয় কিছু ভুল হয়েছে। উত্তীর্ণ হতে পারেননি পরীক্ষায়। ফিরে এলেন তিনি। কঠিনতর তপস্যা করলেন। অন্নজল ত্যাগ করলেন-- শুধু বায়ুভুক হয়ে সাধনায় মগ্ন রইলেন এক কল্পান্ত। ধীরে ধীরে নিজের ভুল আবার বুঝতে পারলেন। হ্যাঁ, ভুলই হয়েছিল তাঁর। ‘আমি পৃথিবী সৃজন করেছি’ এ জ্ঞান তো তখনও ছিল! আমি কে?

আবার ফিরে গেলেন স্বর্গের প্রবেশ তোরণে। করাঘাত করলেন দ্বারে।

ভিতর থেকে প্রশ্ন হল- কে এসেছ?

বিশ্বকর্মা বললেন : আমি বিশ্বকর্মা-- আপনি আমাকে নিমিত্ত মাত্র করে যে পৃথিবী সৃজন করেছেন-তার ভিতর আমার ভুলে কিছু ক্রটি রয়ে গেছে। তাই আমার দোষে আপনার সৃষ্ট জগতে দেখে এলাম রোগ-শোক-জরা-মৃত্যুর যন্ত্রণা। কিন্তু সে যন্ত্রণার হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার পথের সন্ধান আমি পেয়েছি প্রভু। দ্বার খুলুন।

দ্বার অবরুদ্ধই রইল।

স্তম্ভিত হলেন বিশ্বকর্মা। এ কী! এখনও কি পূর্ণজ্ঞান হয়নি তাঁর? ফিরে এলেন মর্তে। এবার যে তপশ্চর্যা করলেন তার আর তুলনা নেই। বায়ু পর্যন্ত গ্রহণ করলেন না। নির্বিকল্প সমাধিতে ধ্যানমগ্ন হয়ে রইলেন যুগযুগান্ত। কঠিনতম যোগাভ্যাসে জ্ঞানমার্গের শিখরচূড়ায় উঠলেন অবশেষে। বুঝলেন কোথায় ভুল হচ্ছিল। যে জাগতিক দুঃখকষ্টকে তার শিল্পকর্মের ত্রুটি বলে মনে হয়েছিল-আসলে তাও বিশ্বনিয়ন্তার সুপরিকল্পিত জগব্যবস্থার একটি পর্যায়। মায়ায় বদ্ধ মানুষ, অহংবোধের বেড়াজালে আবদ্ধ জীব এগুলিকে দুঃখকষ্ট বলে মনে করে মাত্র। অসীম নিয়ে যাঁর কারবার তাঁর হিসাবে লাভও নেই, লোকসানও নেই- না-যোগ, না-বিয়োগ, কিছুতেই তাঁর কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। পূর্ণের পুঁজি থেকে গোটা পূর্ণ বিয়োগ দিয়ে দিলেও সেই পূর্ণই অবশিষ্ট থাকবে। তিনি বুঝলেন শুধু আনন্দই আছে-- আর কিছু নেই। তবে সে আনন্দের মূল উৎস-- সেই সচ্চিদানন্দই!

বিশ্বকর্মা এবার দৃঢ়বিশ্বাস নিয়ে এসে দাঁড়ালেন স্বর্গদ্বারে। করাঘাত করামাত্র ভিতর থেকে অর্গল মোচনের শব্দ শোনা গেল। আশান্বিত হলেন বিশ্বকর্মা দ্বার। কিন্তু খুলল না; ভিতর থেকে প্রশ্ন হল- কে এসেছ?

-- আমি বিশ্বকর্মা! প্রভু, আমি মুক্তির উপায় খুঁজে পেয়েছি। এবার আর কোনো ভুল নাই। শুনুন--

সশব্দে অর্গল পুনরায় বন্ধ হয়ে গেল। দূরে মিলিয়ে গেল কার যেন পদধ্বনি। বিশ্বকর্মার বক্তব্য পর্যন্ত শুনলেন না এবার প্রজাপতি ব্রহ্মা!

পরমানন্দ আর স্থির থাকতে পারেননি। ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করেছিলেন- কেন এবার কী ভুল হল বিশ্বকর্মার?

হেসে বক্তা বললেন-- সেই কথাই ভাবলেন বিশ্বকর্মা। কোথায় ভুল হচ্ছে? কেন প্রশ্নের সমাধান পর্যন্ত শুনতে রাজি হলেন না প্রজাপতি ব্রহ্মা? ধীরে ধীরে দ্বিতীয়ার চাঁদের মতো একখানি হাসি ফুটে উঠল তাঁর ওষ্ঠপ্রান্তে। পুনরায় আঘাত করলেন তিনি দ্বারে।

যথানিয়মে ভিতর থেকে প্রশ্ন হল : কে এসেছ?

বিশ্বকর্মা হেসে বললেন : প্রভু। তুমি এসেছ!

আর কিছু বলতে হল না। দ্বার খুলে গেল!

পরমানন্দ ব্যগ্র উদ্দীপ্ত দু চোখ মেলে বসে থাকেন।

গুরুদেব বলেন : পরমানন্দ, এই হচ্ছে অহং থেকে মুক্তি। বিশ্বকর্মা শেষ পর্যায়ে উপলব্ধি করেছিলেন যে তিনি উপলক্ষ্য মাত্র, তিনি অতি অকিঞ্চিৎকর, সমস্তই সেই অনাদি-অনন্তের লীলা। এ জগৎ-ব্রহ্মান্ডের সাফল্যেও তাঁর কৃতিত্ব নেই-এর আপাত দোষক্রটিতেও নেই তাঁর লঙ্জিত হবার কোনো কারণ। এ পর্যন্ত তিনি ঠিকই বুঝেছিলেন-- বাকি ছিল যেটুকু বোঝা যে তিনি নিজেও ওই সৃষ্টিকর্তারই একটি শিল্পকর্ম। তিনিও এ জগৎব্যাপারের একটি নিমিত্তরূপে সৃষ্ট হয়েছেন ওই প্রজাপতি ব্রহ্মার ইচ্ছায়। তিনিও তাই তাঁরই অংশ। তাই যখন ‘আমি এসেছি’ এ ভ্রান্তি পর্যন্ত অপনোদিত হল-- তখনই তিনি স্বর্গরাজ্যে ফিরে যাবার অধিকার পেলেন।

-- পরমানন্দ, এই হচ্ছে জ্ঞানযোগীর শেষ শিক্ষা। এই হচ্ছে অহংজ্ঞান থেকে প্রকৃত মুক্তি!



**********************

সাহেব!

তন্দ্রার ঘোর থেকে জেগে ওঠেন যেন পরমানন্দ : কে?

-- এটা খেয়ে নিন স্যার!

-- কী ওটা?

-- ডাবের জল।

আশ্রমের যে ভৃত্যটি ওঁকে মৃগচর্মের আসনে সমাদর করে বসিয়েছিল, মাসান্তে যে তাঁর কাছ থেকে নিয়ে যায় মাহিনা, সেই ছেলেটিই নিয়ে এসেছে কালো একটি পাথরের গেলাসে ডাবের জল। অত্যন্ত তৃষ্ণা পেয়েছিল। তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে ওটা গ্রহণ করেন। পানীয়টিতে শরীর শীতল হল।

হঠাৎ হাসি পেল পরমানন্দের। তাঁর পরিধানে খদ্দের ধুতি-পাঞ্জাবি-পায়ে বিদ্যাসাগরী চটি-- মৃগচর্মের আসনে তিনি বসে আছেন এক সন্ন্যাসীর আশ্রমে। তবু তাঁর পরিচয় হল ‘সাহেব’, ‘স্যর’! উপকরণের যে দুর্গে তিনি বন্দি হয়ে আছেন এত সহজে সেখান থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না। শুধু বাইরের খোলসটাকে বদলালে যে কোনো লাভ হবে না-- এই শিক্ষাই যেন দিতে এসেছিল ওই চাকরটি একগ্লাস ডাবের জল নিয়ে। যাঁর আশ্রমে এসে বসে আছেন এ তাঁরই সংঘটন। আনন্দস্বরূপ মাধবের পায়ে পূর্ণ আত্মনিবেদন করতে হবে-- অহংজ্ঞান থেকে মুক্ত হতে হবে একেবারে ওই বিশ্বকর্মার মতোই। না হলে মুক্তি নেই!

আশ্রমের ভৃত্যটিকেই ডেকে জিজ্ঞাসা করেন, ছোট মহারাজ কখন বেরিয়েছেন?

-- ঠাকুর দিদিমণিকে নিয়ে রওনা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই উনি বেরিয়েছেন স্যার।

-- দিদিমণি! কোন দিদিমণি?

-- কেন, আমাদের দিদিমণি-- নীলা দিদিমণি। কাল রাতে তো তিনি এখানেই ছিলেন। আজ এখানেই ছিলেন। আজ খুব ভোরে উঠে ঠাকুরের সঙ্গে কোথায় চলে গেলেন।

-- নীলা কাল রাত্রে এখানে ছিল! আজ সকালে উঠে চলে গেছে গুরুদেবের সঙ্গে! কোথায় গেছে?

-- তা তো জানি না স্যার। ছোট মহারাজ জানেন। সেই তো চিঠি নিয়ে বেরিয়েছেন তিনি-- আপনার ওখানেই গেছেন।

অনেকক্ষণ চুপ করে থাকেন পরমানন্দ। বুকের একটা পাষাণভার নেমে গেল। যাক, মেয়েটা তাহলে ওখানে যায়নি। তা কি যেতে পারে! হাজার হোক তাঁরই মেয়ে তো। মুখে গরম গরম বললেও সত্যিই কখনও লজ্জার মাথা খেয়ে ওই চোর-মাতাল-বদমায়েশগুলোর আড্ডায় গিয়ে রাত্রিযাপন করতে পারে?

-- কাল রাত্রে সে কোন ঘরে ছিল?

চাকরটি ওঁকে নিয়ে যায় গুরুদেবের পাশের ঘরটিতে। ছোট্ট একখানি ঘর। একপাশে একটি চৌকি পাতা। গদি-তোষক নেই, শুধু সতরঞ্চির ওপর একটি সাদা চাদর পাতা। খেয়াল হল গদির কথা যখন অন্যমনস্কের মতো বসলেন চৌকিটাতে। বালিশটার মাঝখানে একটু বসে গেছে। কোলে তুলে নিলেন সেটা-- মাথার তেলের একটি মৃদু সৌরভ। বিছানায় পড়ে রয়েছে একটা লোহার কাঁটা। খোঁপায় গোঁজার মাথার কাঁটা। তুলে নিয়ে বুক পকেটে রাখেন সেটাকে। অনেকদিন আগে তিনি মাঝে মাঝে এখানে এসে রাত্রিবাস করতেন। এ ঘরেই থাকতেন তিনি তখন।

চাকরটাকে বললেন : এ ঘরে গদি-আঁটা যে পালঙ্কটা ছিল-- সেটা কোথায়?

-- গুদামঘরে আছে স্যার!

-- ও!

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ে। আশ্চর্য। নীলা শেষ পর্যস্ত কাল রাত্রে আশ্রমে এসে আশ্রয় নিয়েছিল! এ কথা কল্পনাও করেননি তিনি। কী করে করবেন-- তিনি তো জানতেন গুরুদেবকে একেবারেই সহ্য করতে পারত না নীলা। ঈশ্বরবিশ্বাসী ওই উদাসীনের প্রতি তার ছিল একটি তীব্র অনীহা। একবার জোর করে মেয়েকে আশ্রমে নিয়ে এসেছিলেন। নীলা আসতে চায়নি, তিনিই বলে-কয়ে রাজি করিয়েছিলেন। নাস্তিক কন্যাটিকে সাধুসঙ্গে সংশোধিত করতে চেয়েছিলেন। লাভ হয়নি। সে এসে মুখে মুখে তর্ক করেছিল সংসারত্যাগী সন্ন্যাসীর সঙ্গে।

-- আপনি ব্রহ্মকে প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করেছেন?

-- না মা!

-- তবে যাকে জানেন না, যাকে উপলব্ধি করেননি, তার কথা পাঁচজনকে বলেন কেন? যা আছে কি নেই-তা আপনি নিজেই জানতে পারেননি-- তার দিকে লোককে আকৃষ্ট করেন আপনি কোন অধিকারে?

-- আমি তাঁকে পাইনি; কিন্তু তিনি তো অলভ্য নন। তাঁকে পাওয়া যায়।

-- কেমন করে জানলেন?

-- এমন মহাপুরুষ আছেন যিনি তাকে উপলব্ধি করেছেন। সেই জ্যোতির্ময় পুরুষের স্বরূপ সমস্ত চৈতন্য দিয়ে অনুভব করেছেন।

-- কে সে? উদাহরণ দিন।

-- আমাদের দেশের মন্ত্রদ্রষ্টা ঝষিরা তাঁকে জেনেছিলেন, মা। যাঁরা উপনিষদের সামগান গেয়ে গেছেন-- সেই দ্রষ্টা আর্যঋষিরা। যাঁরা বলতে পেরেছিলেন ‘বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তম্‌ আদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ’।

-- আর আমি যদি বলি তাঁরাও প্রকৃত সেই আদিত্যবর্ণ পুরুষকে জানতে পারেননি? যদি বলি তাঁরা দল ভারী করবার উদ্দেশ্যে অনৃতভাষণ করেছিলেন?

শিউরে উঠেছিলেন পরমানন্দ। এ কী ভয়ঙ্কর কথা উচ্চারণ করল নীলা তর্কের ঝোঁকে। উদাসীন সন্ন্যাসী কিন্তু তিলমাত্র বিচলিত হন না, বলেন-- তোমার এ কথা মনে হওয়ার হেতু?

-- হেতু এই যে ওই মন্ত্রদ্রষ্টা খষিরাই বলেছেন ‘যন্মনসা ন মনুতে, যেনাহুর্মনোমতম্’ -- মন দিয়ে তাঁকে জানা যায় না। বলেছেন ‘ন তত্র চক্ষুর্গচ্ছতি ন বাগ্গচ্ছতি নো মনঃ, ন বিদ্ম ন বিজানীমো’ -- তিনি অজ্ঞেয়, তিনি অবাঙমানসগোচর -- সুতরাং হঠাৎ ভেলকি লাগাবার জন্য উপনিষদকার যদি বলে বসেন ‘বেদাহমেতং’ -- তা তো আমি মেনে নেব না। আমি তাঁকে প্রশ্ন করব—কোনটা মিথ্যা আর কোনটা সত্য?

-- দুটোই সত্য নীলা। দুটোই আপেক্ষিক সত্য। একটি সত্য তোমার-আমার প্রতি প্রযোজ্য-- যারা সাধনার শেষ সোপান পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি তাদের কাছে তিনি ‘যন্মনসা ন মনুতে’ আবার আর্যঋষিদের কাছে...

বাধা দিয়ে নীলা বলেছিল : সত্য আপেক্ষিক জাগতিক বিষয়বস্তুর। যেখানে বিচার্য বিষয় নিত্যসত্য - সেখানে আপেক্ষিকতার প্রশ্ন আসে না। যিনি অমৃতের পুত্রদের ডেকে সগর্বে ঘোষণা করেছিলেন-- তোমরা শোনো, আমি তাঁকে জেনেছি, তাঁর নাগাল পেলে তাঁরই তৈরি কেনোপনিষদের আর একটি মন্ত্র তাঁকে আমি শোনাতাম—‘যদি মন্যসে সুবেদেতি - দভ্রমেবাপি, নূনং তং বেথ্ম ব্রহ্মণোরূপম। যদস্য ত্বং যদস্য দেবেষ্বথ নু মীমাংস্যমেব তে মন্যে বিদিতম্‌’। তুমি যদি মনে কর যে আমি তাঁকে জেনেছি- তাহলে আমি বলব সে জ্ঞান তোমার দভ্র- অল্পমাত্র; কারণ ব্রহ্মের যে রূপ উপলব্ধিগোচর তা সামান্যতম অংশমাত্র-- অতএব তোমার ব্রহ্মজ্ঞান, যা নিয়ে তুমি ‘বেদাহমেতং’ বলে বড়াই করছ, তাও মীমাংসার অপেক্ষা রাখে।

নীলার সামনেই পরমানন্দ গুরুদেবের চরণ স্পর্শ করে ক্ষমা চেয়েছিলেন। বলেছিলেন : অপরাধটা আমারই। আমি স্বপ্নেও ভাবিনি ও এসে এভাবে আপনার সঙ্গে তর্ক করতে বসবে। আমি বুঝতে পারিনি যে আপনার উপদেশ শুনতে আসার যোগ্যতাও অর্জন করেনি নীলা।

গুরুদেব হেসে বলেছিলেন-- তুমি ভুল করছ পরমানন্দ। নীলা তোমার চেয়েও আর এক ধাপ এগিয়ে আছে সাধনমার্গে। ওর অন্তরে সঞ্চারিত হয়েছে চৌম্বকবৃত্তি। যে আকর্ষণে জীবাত্মা ছুটে যায় পরমাত্মার দিকে সেই শক্তি সঞ্চারিত হয়েছে ওর অন্তরে-- শুধুমাত্র বিপরীত দিকে মুখ ফিরিয়ে আছে চুন্বকখণ্ড। একদিন নেমে আসবে চরম আঘাত - দিক-পরিবর্তন করবে ওর মনের চুম্বক- বিকর্ষণ পরিণত হবে আকর্ষণে। সেই শুভ দিনের প্রতীক্ষাতেই আমি প্রহর গুণব নীলা-মা। তাই আজ তোমার প্রশ্নের জবাব আমি দেব না।

নীলার ওষ্ঠপ্রান্তে ফুটে ওঠে অপ্রত্যয়ের একচিলতে হাসি। ব্যঙ্গবিদ্রূপের কি? হাতদুটি এক করে সে নমস্কার করে উঠে দাঁড়ায়। ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করে না।

গুরুদেব বলেছিলেন-- আর কিছু বলবে আমায়?

-- বলব। শুধু বলব ‘নেদং যদিদমুপাসতে!’

মাটির সঙ্গে লঙ্জায় মিশে গিয়েছিলেন পরমানন্দ, বিদ্রোহী আত্মজার এই স্পর্ধায়।

গুরুদেব এবারও হেসে প্রত্যুত্তর করেছিলেন-- আর আমি বলব :

অগ্নে নয় সুপথা রায়ে অস্মান্‌ / বিশ্বানি দেব বয়ুনানি বিদ্বান্‌। / যুযোধ্যস্মজ্জুহুরাণমেনো / ভূয়িষ্ঠাং তে নম-উক্তিং বিধেম।।

দুঃখের আগুনে আগুনে আমাদের অন্তরের সমস্ত কলুষ তুমি পুড়িয়ে ছাই করে দাও, হে অগ্নিদেব। আমাদের কুটিল মনের সমস্ত পাপের সন্ধানই তো তুমি জানো -- এ থেকে আমাদের তুমি মুক্ত করো-- তোমাকে আমরা বারংবার প্রমাণ করছি।

যুক্ত কর তিনি ললাটে স্পর্শ করেছিলেন মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে।

সেই নীলা কি শেষ পর্যস্ত এখানে এসেছে আশ্রয়ের অনুসন্ধানে? চরম আঘাতটা সে পেল কখন- না হলে চুম্বকখণ্ড দিক পরিবর্তন করে কেমন করে? কোন দুঃখের আগুনে ওর অস্তঃকরণের সমস্ত কুটিল পাপ পুড়ে ছাই হয়ে গেল?

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন একবার। না, আর অপেক্ষা করা চলে না। বেলা একটা বাজে। উঠলেন। পাঞ্জাবিটা গায়ে চড়িয়ে আবার নেমে পড়লেন রৌদ্রদীপ্ত পথে। বাড়িতেই ফিরে যেতে হবে তাঁকে। ছোট মহারাজের সঙ্গে এই মুহূর্তে সাক্ষাৎ করার প্রয়োজন।

খর রৌদ্রের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে মেজাজটা আবার বিগড়ে গেল। কী ক্লান্তিকর এই পথটা। এখনও হয়তো বাবলা গাছের ঘুঘুটা চুপ করেনি। মেঠো ঘরের ঘুমপাড়ানিয়ার রেশ নিঃশেষিত হয়নি। স্তব্ধ মধ্যাহ্নের অনলবর্ষী আকাশে বাতাসে! মিশকালো মোষটা তখনও পড়ে ছিল গা এলিয়ে নয়ানজুলির ঘিয়ে রঙের কাদায়। পরমানন্দের কিন্তু দৃষ্টিগোচরই হল না এ-সব। মিহি খদ্দরের সুবাসিত রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে কাঁচা পথটা পার হয়ে এসে উঠলেন পিচগলা বড় রাস্তায়।

-- এই রিকশা!

বাঁচা গেল। আর হাঁটতে হবে না তাহলে বাড়িই ফিরে চললেন অবশেষে।

একটা কথা তাঁর বার বার মনে হচ্ছে আজকে। রিকশায় বসে কথাটা ভালো করে ভেবে দেখবার চেষ্টা করলেন। দুর্লভ প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। যাতে হাত দিয়েছেন -- সোনা ফলিয়ে ছেড়েছেন। অদ্ভুত দৃঢ়তাও ছিল তাঁর চরিত্রে। যা ভালো বুঝেছেন তাই করে এসেছেন আজীবন। কিন্তু তবু-- নিশ্চয়ই কোথাও ফাঁকি ছিল। নিশ্চয়ই নিষ্ঠার অভাব ছিল তাঁর। এতদিন মনকে বলে এসেছেন-- পেয়েছি! পেয়েছি! যা পেতে চেয়েছি জীবনে তা লাভ না করা পর্যন্ত তৃপ্ত হইনি কোনোদিন! ...আজ হঠাৎ মনে হল সত্যিই কি তাই? -- কী পেয়েছেন তিনি? কিছুই তো পাওয়া হয়নি। প্রথম যৌবনে মিশেছিলেন বিপ্লবীদের দলে-- দেশোদ্ধারের মহান উদ্দেশ্যে আত্মোৎসর্গের সঙ্কল্প করেছিলেন; কিন্তু কী হল? প্রবাসে গিয়ে সে পথ ছাড়তে বাধ্য হলেন। শল্য-চিকিৎসার ডিগ্রী নিয়ে ফিরে এলেন ভালোমানুষের মতো! তারপর স্থির করলেন রাজনীতিকে সম্পূর্ণ পরিহার করে চলবেন জীবনে। স্ত্রী-পুত্র-পরিবার নিয়ে রীতিমত সংসারী হবেন তিনি। দেশের সেবা করবেন-আরোগ্য-নিকেতনে। রোগীর রোগমুক্তিতে, আর্তের সেবায় তৃপ্ত হবে তাঁর দেশসেবার কামনা। মিস গ্রেহাম আর আ্যানির সাহচর্যে গড়ে তুললেন এক অপরূপ আরোগ্য-নিকেতন। বুকের পাঁজরের চেয়েও ভালোবাসলেন তাকে। প্রতিজ্ঞা করলেন এই হবে তাঁর স্বপ্ন, সাধনা! পারলেন? এখানেও ব্যর্থ হলেন তিনি। আরোগ্য-নিকেতন আজ কোম্পানির সম্পত্তি। নার্সিং হোম আজও আছে: কিন্তু তাঁর স্বপ্নসাধনার শেষবিন্দু পর্যন্ত বিকিয়ে গেছে। রাজনীতিকে পরিহার করবার সঙ্কল্পও রক্ষিত হল না। কারাজীবন শেষ করে এসে স্থির করলেন ধর্মকর্মে শেষ জীবনটা কাটিয়ে দেবেন। মেতে রইলেন কিছুদিন গুরুদেব আর তাঁর আশ্রম নিয়ে। কিন্তু টিকে থাকতে পারলেন না। ফিরে যেতে হল কর্মক্ষেত্রে- রাজনৈতিক চক্রে। এখন তিনি পুরোপুরি ভোগী। মুখে বলেন বটে যে দেশসেবাই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য-- কিন্তু সত্যিই কি তাই?

-- হ্যাঁ নিশ্চয়ই!

পূর্বপক্ষের জবাব দিতে উত্তরপক্ষ উঠে বসল কোমর বেঁধে ওর মনের মধ্যে। -- কেন নয়? এই যে দিনের মধ্যে বারো চোদ্দ ঘন্টা তাঁকে পরিশ্রম করতে হয়-এর কী উদ্দেশ্য? কেন তিনি যুক্ত আছেন বার্টন আ্যান্ড হ্যারিস কোম্পানির সঙ্গে? ডিভিডেন্ডের লোভে? এককালে ম্যানেজিং ডাইরেকটরশীপ হাতে আসবে এই সুখস্বপ্নে বিভোর হয়ে? তা তো নয়। তিনি চাইছেন এটাকে একটা আদর্শ কারখানাতে রূপান্তরিত করতে। কুলি-ব্যারাকে ইলেকট্রিক বাতির ব্যবস্থা আছে কটা ফ্যাকটরিতে? কিন্তু আছে সে ব্যবস্থা ওঁদের এখানে। তিনিই এটা বাধ্য করেছিলেন বোর্ডকে মেনে নিতে। ওদের চীপ ক্যান্টিনটাও তাঁর প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে। কোম্পানি সাবসিডি দেয় ক্যান্টিনকে। কেন দেয়? কে সে ব্যবস্থা করেছে? মনে পড়ছে, ওই স্বল্পমূল্যের ক্যান্টিনটি যেদিন খোলা হয় সেদিন অনেক বড় বড় লোক এসেছিলেন নিমন্ত্রিত হয়ে। ক্যান্টিনের সঙ্গে ক্লাবঘরও আছে- সেখানে আছে রেডিও, সংবাদপত্র, নানা রকম খেলার সরঞ্জাম, ব্যায়ামাগার। মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন অভ্যাগতরা। এমন কুলি-ব্যারাক সত্যই দেখা যায় না কোথাও। শ্রমিকেরা ক্যারাম খেলছে, তাশ খেলছে, ঢোল, খঞ্জনি, করতাল দেওয়া হয়েছে ওদের। ব্যায়ামাগারে ব্যায়াম করছে স্বাস্থ্যবান শ্রমিকেরা। সকলে উচ্ছসিত প্রশংসা করেছিলেন সেদিন পরমানন্দকে-- তিনিই এ-সব করিয়েছেন কোম্পানিকে দিয়ে। যারা এ কারখানার প্রাণ সেই মেহনতী মানুষরাই যদি ভালোভাবে না বাঁচতে পারল তবে কী দেশের সেবা করছেন তিনি এ কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হয়ে?

সেই দেশসেবাকেই বিস্তৃততর করে দেবেন তিনি আ্যাসেমব্লিতে গিয়ে- এই ছিল কামনা।

মনে আছে নীলা এই সেদিন বলেছিল- আচ্ছা বাবা, তুমি তো সারাদিন খদ্দর পর না, তাহলে মীটিঙে যাবার সময় এগুলো বার করে পর কেন?

রক্ষস্বরে উনি প্রতিপ্রশ্ন করেছিলেন : কেন, তাতে কী হয়েছে?

-- তুমি কি এটাকে একটা অন্যায় মনে করো না? এটা কি একটা লোকদেখানো ‘শো’ নয়?

-- না নয়! যুদ্ধক্ষেত্রে ইউনিফর্ম পরতে হয় বলে সৈনিকেরা কিন্তু গার্হস্থ্য জীবনেও ইউনিফর্ম পরে থাকে না। বিচারালয়ে গাউন আর উইগ পরতে বলে সারাদিন সেটা পরিধান করে থাকার কোনো যুক্তি নেই।

রিকশাখানা শেষ পর্যন্ত এসে দাঁড়ায় ওঁর বাড়ির সামনে। নন্দ বেয়ারা ছুটে আসে কাছে।

-- আমার সঙ্গে কেউ দেখা করতে এসেছিল?

-- হ্যাঁ স্যার, আশ্রম থেকে ছোট মহারাজ এসেছিলেন। তা আমি বললাম, আপনি কাকাবাবুর গাড়িতে বেরিয়েছেন-- শুনে উনি সেখানেই গেলেন।

-- সেখানে মানে?

-- কাকাবাবুর বাসায়।

-- হুঁ! একখানা চিঠি রেখে গেছেন কি?

-- আজ্ঞে না।

-- ইডিয়ট!

নন্দ চমকে উঠে। বুঝতে পারে না গালাগালটা কার উপর বর্ষিত হল। পরমানন্দ রিকশাওয়ালাকে বলেন : ঘোরাও!

-- আপনার লাঞ্চ? ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করে নন্দ।

-- ছোট মহারাজ যদি আবার আসেন তবে চিঠিখানা চেয়ে রাখিস।

-- রাখব স্যার। আপনি খেয়ে যাবেন না?

-- না, চলো।

রিকশা বেরিয়ে এল আবার রাস্তায়। চলল ননীমাধবের বাড়ির দিকে।

হাতঘড়িটার দিকে একবার তাকালেন। দুটো পাঁচ। আশ্চর্য! এখনও কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না মেয়েটার! কালরাত্রে সে আশ্রমে ছিল- কতকটা নিশ্চিন্ত। কিন্তু আজ সকালে উঠে কোথায় গেল? আত্মীয়বন্ধু কারও কথা মনে পড়ল না পরমানন্দের যেখানে গিয়ে সাময়িকভাবে আশ্রয় নিতে পারে নীলা। এক ছিল ননীমাধবের বাড়ি। কিন্তু সেখানে সে যায়নি। গেলে উনি সংবাদ পেতেন।

.. হ্যাঁ, আর একটা সম্ভাবনা আছে। পি-নাইন ব্যারাক। কথাটা মনে হতেই আপাদমস্তক জ্বালা করে ওঠে ওঁর। মনে পড়ে গেল সেই উদ্ধত ছেলেটির বিদ্রোহী মূর্তি। একমাথা রুক্ষ চুল। পরিধানে একটা নীল পায়জামা। চেককাটা একটা হাফশার্ট গায়ে-- কাঁধের কাছে ফেঁসে গেছে। শার্টের নীচে যে গেঞ্জি নেই-তা বোঝা যায় ওই ছিন্ন অংশটা দিয়ে। চেককাটা হ্যান্ডলুমের সস্তা কামিজটায় লেগেছে ছোপ-ছোপ মবিল কিংবা গ্রীজ-চটচট করছে সেটা। একমুখ খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, দু হাতে ময়লা।

অফিস ঘরে ওঁর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল ওই অপরূপ মূর্তিটা।

-- কাল আমার গাড়ি আটক করে কী বলতে চেয়েছিলেন?

লোকটা চেপে বসে ভিজিটার্স চেয়ারে। আশ্চর্য সাহস তো! উনি ইচ্ছা করেই ‘আপনি’ বলে কথা বলেছিলেন। সম্মান দেখাতে নয়-- কারখানার কোনো মেহনতী মানুষের সঙ্গেই এ ভাষায় তিনি কথা বলেন না। লোকটা যদিও পদচ্যুত কর্মী, কারখানার মজুর আর সে নয়; কিন্তু সেজন্যও ‘আপনি’ বলে কথা শুরু করেননি তিনি। তিনি শুধু একটু দূরত্ব রাখতে চেয়েছিলেন মাত্র-- পাছে ‘তুমি’ বলে কথা বললে সে পূর্বপরিচয়সূত্র ধরে ঘনিষ্ঠ হতে চায়। লোকটা এই সুযোগে অম্লানবদনে বসে পড়ল সামনের চেয়ারে। বসে যখন পড়েইছে তখন আর উঠতে বলা যায় না।

-- আমার ওপর অবিচার করা হয়েছে। তাই আপনার কাছে আমি সুবিচার চাইতে এসেছি। আমাকে ডিসচার্জ করা হয়েছে অন্যায়ভাবে।

-- না। তোমার কেসটা আমি নিজে দেখেছি। এ অপরাধে কর্মীকে পদচ্যুত না করলে কারখানা চালানো যায় না। তোমার বিরুদ্ধে চুরির চার্জ আছে-এবং তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ আছে।

-- আপনি এটা বিশ্বাস করেন?

-- আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন উঠছে না। মেশিন পার্টসগুলো তোমার ঘর সার্চ করবার সময় পাওয়া গেছে। অন্তত দশ-পনেরো জন সাক্ষী ছিল সার্চ করার সময়। অন্য কেউ চুরি করে তোমার ঘরে ওভাবে সেগুলি লুকিয়ে রাখতে যাবে কেন? এর চেয়ে ডাইরেক্ট এভিডেন্স আর কী হতে পারে?

-- এভিডেন্সের কথা হচ্ছে না। আমার প্রশ্ন, আপনি এটা অন্তর থেকে বিশ্বাস করেছেন কিনা? আপনি আমার পূর্ব-ইতিহাস জানেন-তাই জিজ্ঞাসা করছি, আপনি কি বিশ্বাস করেন যে এ কাজ আমার দ্বারা সম্ভব?

-- করি। বিশ্বাস করি। অভাবে স্বভাব নষ্ট -- কথাটার তুমি একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

-- শুধু অভাবেই স্বভাব নষ্ট হয় না ডক্টর চৌধুরী- প্রাচুর্যেও সেটা নষ্ট হয়ে থাকে -- তারও উজ্জ্বলতম প্রমাণ আমি দেখাতে পারি। কিন্তু সে কথা যাক। আমি বলছিলাম- যে উদ্দেশ্য নিয়ে আপনারা এই চুরির কেসটা সাজিয়েছেন সে উদ্দেশ্য কিন্তু এতে সিদ্ধ হবে না।

-- তোমার বক্তব্য শেষ হয়েছে আশা করি। তুমি যেতে পারো।

-- না হয়নি। আমি শেষবারের মতো আপনাকে জানাতে এসেছি আমাদের মাথায় পা দিয়ে এভাবে চিরকাল আপনারা চলতে পারবেন না। আমাকে আপনার বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি, কারখানা থেকেও কৌশলে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন আপনি। কারখানার আপনি মালিক, আমাকে যে কোনো অজুহাতে আপনি তাড়াতে পারেন, কিন্তু তা হলেও এ শহর ছেড়ে আমি চলে বাব না। এতে আপনার এবং আপনার বন্ধুর কারও উদ্দেশ্যই সফল হবে না।

ওর দুর্জয় স্পর্ধা দেখে মনে মনে হেসেছিলেন। মুখে বলেছিলেন -- তাই না কি? তা কে আমার বন্ধু? আর আমাদের দুজনের উদ্দেশ্যই বা কী?

-- আপনার বন্ধু ননীমাধব মনে করেছেন আমাকে তাড়াতে পারলে মজদুর ঐক্য ভেঙে পড়বে-- ইউনিয়ন গঠনের দাবিটা চাপা দিতে পারবেন। আর আপনি ভেবেছেন আমাকে আপনার কন্যার চোখের আড়ালে-

-- শাট আপ! য়ু স্কাউন্ড্রেল! বেরিয়ে যাও তুমি এই মুহূর্তে।

-- যাচ্ছি। তবে যাবার আগে একটা কথা বলে যাই আপনাকে। বিদ্রোহী মজদুরই বলুন আর বিদ্রোহী আত্মজাই বলুন-- মিটমাট করবার দিন আপনাকে ফিরে ডাকতে হবে এই অরুণাভ নন্দীকেই!

ইলেকট্রিক কলিং বেলটার গলা টিপে ধরেছিলেন পরমানন্দ। একটানা আর্তনাদ করে চলেছিল কলিং বেলটা-মৃত্যুযন্ত্রণায়। এক সঙ্গে তিনজন বেয়ারা এসে ঢুকল ঘরে-- সাহেবের খিদমত করতে। ওরা এসে দেখে সাহেব একদৃষ্টে চেয়ে আছেন সুইং-ডোরটার দিকে। ঝোড়ো হাওয়ায় ঝাউপাতার মতো কাঁপছে সেটা। আর কেউ নেই ঘরে।

ওই হতভাগাটার কাছে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে নীলা! এ কি বিশ্বাস্য?

ননীমাধবের বাড়িতে এসে দেখেন গৃহকর্তা তখনও ফিরে আসেননি। দীপক ছিল। সে বলে-- এ কী, আপনি? একা?

-- হ্যাঁ, ছোট মহারাজ এসেছিলেন আমার খোঁজে?

দীপকের কাছে জানা গেল তিনি এখানেও এসেছিলেন পরমানন্দের সন্ধানে, দেখা না পেয়ে ফিরে গেছেন। চিঠি? না কোনো চিঠি রেখে যাননি।

ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে চাইছে শরীর। সকাল থেকে পাগলের মতো কেবল ছোটাছুটিই করে বেড়াচ্ছেন। একটা সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বসে পড়েন: তোমার সঙ্গে কয়েকটা কথা ছিল, বোসো।

সামনের সোফাটায় বসে দীপক প্রতিপ্রশ্ন করে-আপনার আহারাদি হয়েছে তো?

-- না, এবার বাড়ি গিয়ে খাব।

- সে কী, তারিণীদার ওখানে না আজ আপনার মধ্যাহ্ন আহারের ব্যবস্থা? বাবা তো তাই বলে গেলেন।

ঠিক কথা। মনে পড়ে গেল পরমানন্দের। বাড়িতে সে কথা বলতে ভুলে গিয়েছেন। দীপককে বলেন-তুমি তারিণীদাকে একটু ফোন করে জানিয়ে দিও-- একটা বিশেষ জরুরি কাজে আমি আটকে পড়েছি। যেতে পারব না।

-- বেশ, বলে দেব। আমার সঙ্গে কী কথা আছে বলছিলেন?

-- হ্যাঁ, নীলা কি কাল রাতে অথবা আজ সকালে এখানে এসেছিল?

-- কই না তো, কেন বলুন তো?

-- নীলার সঙ্গে তোমার শেষ কখন দেখা হয়েছে?

-- তা চার-পাঁচ দিন হবে। কেন?

একটু চুপ করে থাকেন। তারপর বলেন-অনেকদিন আগে তুমি বলেছিলে নীলার মন অন্যত্র বাঁধা আছে। জিনিসটা আমি আর একটু বিস্তারিত জানতে চাই।

এইবার চুপ করে থাকার পালা দীপকের। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই সে নিজেকে সামলে নেয়। তারপর জানলার বাইরে কোনো দুর্নিরীক্ষ্য দিগন্তের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে আত্মগতভাবে বলে যায় বক্তব্য তার : জিনিসটা আরও আগে হয়তো আপনাকে জানানো উচিত ছিল আমার। আকারে-ইঙ্গিতে অবশ্য জানিয়েছি। স্পষ্ট করে বলিনি-দুটো কারণে, প্রথমত আমি ভেবেছিলাম আপনি সবই জানেন-- কিছুই অজ্ঞাত নেই আপনার কাছে। দ্বিতীয়ত আমি মনে করেছিলাম প্রসঙ্গটা আমার তরফে সঙ্কোচের, লজ্জার। কিন্তু পরে আমার মনে হয়েছে, সত্যিই আমার লজ্জা পাওয়ার কিছু ছিল কি? আমি নীলাকে ভালোবাসতে পেরেছিলাম-- এটা নিশ্চয়ই আমার পক্ষে লজ্জার কথা নয়। সে পারেনি, সেটা আমার অপরাধ নয়। কিন্তু ওর মন কোথায় বাঁধা আছে তা অনেক অনেক দিন আগে থেকেই জানতে পেরেছিলাম আমি। আপনাকে জানানো কর্তব্য ছিল আমার। জানাইনি, কারণ আমি আশা করেছিলাম, ওর মন বদলে যাবে। সে মানুষটা নেপথ্যে রয়ে গেল চিরকাল- তার এক সপ্তাহের উপস্থিতির প্রভাব আমি কাটিয়ে উঠতে পারব না, এক যুগের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যেও? কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার, অকৃতকার্য হয়েছিলাম আমি। তারও কারণ ছিল। অসীমের শূন্য স্থানটা পূর্ণ করার একটা অবচেতন প্রেরণা ছিল নীলার মনের অন্তরতম কোণে। আমাকে তাই এনে বসিয়েছিল সেই শূন্য আসনে। তাই আমার সঙ্গে সে ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছে, বন্ধুত্ব বজায় রেখেছে, প্রীতি-সৌহার্দ্যের আদান-প্রদান চলেছে, কিন্তু সেই নেপথ্যবাসীকে একচুল বিচ্যুত করতে পারিনি আমি। এ-সব আপনাকে কেমন করে বলি? তবু হয়তো সব কথা একদিন খুলে বলতাম-যদি না শেষদিকে খবর পেতাম অরুণাভের প্রতি আপনাদের সাম্প্রতিক আচরণের কথা। বাবার কাছে আমি শুনলাম দীর্ঘ কারাবাসের পর সাত রাজ্য ঘুরে অরুণাভ এখানে এসে পৌঁছেছিল। সে নাকি প্রথমেই আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসে-কিন্তু আপনি দেখা করেননি। আপনার বাড়ির দরজা থেকে অরুণাভ ফিরে যায়। যে ছেলেটির জন্যে আপনি সব কিছু একদিন ত্যাগ করেছিলেন, কেন তাকে আপনি বাড়িতে ঢুকতে দিলেন না, তা আমি আজও জানি না। প্রথমে মনে হয়েছিল বুঝি দুরন্ত অভিমানেই এই অপমান করেছিলেন তাকে। ওই ছেলেটির জন্যেই আপনার সুখের সংসার ভেঙে গিয়েছিল-ওর জন্যেই প্রাণ দিতে হয়েছে অসীমকে-- তাই ওকে সহ্য করতে পারেননি আপনি। কিন্তু পরে মনে হয়েছে, সেটা আসল কারণ নয়-আপনি ওকে নীলার সান্নিধ্যে আসতে দেননি। তাই ভেবেছিলাম- আজ আপনি আমাকে যে প্রশ্ন করছেন সেটা বাহুল্য মাত্র। তবু প্রশ্ন যখন আজ আপনি করেছেন তখন আমাকে ধরে নিতে হবে যে নীলার মন কোথায় বাঁধা পড়েছে তা আপনার অজানা। আমি কিন্তু প্রথম থেকেই সব জানতাম। নীলার সঙ্গে ওর গোপন পত্রালাপ চলত কিনা আমি জানি না, শুধু এটুকুই জেনেছিলাম যে অপেক্ষা করবে বলে ওরা পরস্পরের কাছে প্রতিশ্রুত ছিল। মাত্র সাতদিনের সান্নিধ্যে কেমন করে ওরা এত দ্রুত এত গভীরভাবে পরস্পরকে ভালোবাসতে পারল তাও আমার ধারণার বাইরে, কিন্তু এ কথা নিশ্চিত যে সেদিন থেকে ওর মন দিগদর্শন যন্ত্রের কাটার মতো একমুখে প্রতীক্ষা করছিল অরুণাভের প্রত্যাবর্তনের। তাঁর পরের ঘটনা আপনি ভালো করেই জানেন, হয়তো আমার চেয়ে বেশিই জানেন। অরুণাভ আপনার বাড়িতে ঢুকতে পারেনি, কিন্তু ঢুকেছিল কারখানায়। নাম লেখায় সে ফ্যাকটরির মজদুর লিস্টের রেজিস্টারে। শুধু যে রোজগারের ধান্দাতেই সে এসেছিল এ কথা মনে করি না। অবশ্য তার আসল লক্ষ্যটা কিসের ওপর ছিল সে কথাও ঠিক জানি না। সম্ভবত অর্ধেক রাজত্ব এবং রাজকন্যা দুটির ওপরই ছিল তার সমান লোভ। জিনিসটা ঘনিয়ে উঠছিল অলক্ষ্যে। প্রথম নজরে পড়ে বাবার। তিনিই তাকে প্রথম চিনতে পারেন। অবশ্য তার আগেই তাকে চিনতে পেরেছিল নীলা। সে যাই হোক, দেখলাম বাবা ওকে তাড়াবার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছেন। আপনার সঙ্গে তাঁর কী কথাবার্তা হয় তা আমি জানি না, কিন্তু দেখলাম ছেলেটিকে তাড়ানোর ব্যবস্থাটা পাকা হল। চুরির দায়ে ধরা পড়ল শ্রমিকনেতা। বাবার ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি থাকে না-- প্রমাণিত হয়ে গেল অরুণাভ নন্দী একজন চোর।

পরমানন্দ ওকে থামিয়ে দিয়ে বলেন : এ কথার মানে? তুমি কি বলতে চাও চুরির কেসটা সাজানো? ননীই ওটা সাজিয়েছে?

-- বাবা সাজিয়েছেন কি আপনি সাজিয়েছেন তা নিশ্চিত কেমন করে বলব বলুন-- তবে এটা তো আপনিও স্বীকার করবেন যে অরুণাভ নন্দী আর যাই করুক চুরি করবে না!

স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন বৃদ্ধ।

নীরবতা ভঙ্গ করে দীপকই আবার; ক্ষোভম্লান কণ্ঠে যেন নিজেকেই ধিক্কার দিয়ে ওঠে: আমার সবচেয়ে দুঃখ হয় যখন বুঝতে পারি যে শুধু শ্রমিকবিদ্রোহ এড়াবার জন্যে বাবা এ কাজটা করেননি তিনি এ অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়েছেন আরও জঘন্য স্বার্থের খাতিরে। তাঁর মধ্যে নিজেকে জড়িত বুঝতে পেরে আমি নীলার দিকে মুখ তুলে চাইতে পারি না।

-- তুমি কী বলতে চাইছ দীপক?

আমি বলছি-এই চুরির কেসটা সাজানোর ব্যাপারে আপনার যে অবদান তার তবু একটা অর্থ হয়। নীলাকে রক্ষা করা আপনার কর্তব্য, হয়তো সেইজন্য এ অন্যায়ের আশ্রয় নিয়েছেন আপনি। কিন্তু বাবা? তিনি ওকে তাড়াতে চেয়েছেন শ্রমিকবিদ্রোহের কথা ভেবে নয়-- আমার জন্যে! এ লঙ্জা আমি ভুলি কী করে?

পরমানন্দ ধীরে ধীরে বলেন-- নীলা বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে দীপক!

-- চলে গেছে! মানে? কখন? কোথায়?

ওর কাছে বুকের ভার নামাতে থাকেন পরমানন্দ। উনি বুঝতে পেরেছেন এ ছেলেটি সত্যিই ভালোবাসে নীলাকে। দীপক চুপ করে শোনে সব কথা।

পরমানন্দ শেষে জিজ্ঞাসা করেন : তোমার কি মনে হয় ও অরুণাভের ওখানে গিয়েছে?

-- অসম্ভব নয়।

-- তবে সেখানেই চললাম আমি।

দীপক উত্তেজিতভাবে ওঁকে বাধা দেয়-অমন কাজও করবেন না জ্যাঠামশাই। ওরা ধর্মঘট করেছে-এখানে-ওখানে মীটিঙ হচ্ছে। আপনাকে একলা পেলে ওরা ভালোমন্দ কিছু একটা করে বসতে পারে। আপনি বরং বাড়ি ফিরে যান। আমি খোঁজ নিচ্ছি লোক পাঠিয়ে।

শেষাংশ..