ব্রাত্য (প্রথমাংশ)
লেখক: নারায়ণ স্যান্যাল
প্রবীণ ডাক্তার পরমানন্দ চৌধুরীর হঠাৎ মনে হল দীর্ঘ জীবনটা তাঁর বুঝিবা ব্যর্থই হয়ে গেছে। খোলা খবরের কাগজটা পড়ে আছে অপঠিত, আধ খাওয়া কফির কাপের কোনায় মাছির জটলা। সিগারের আগুনটা যে বহুক্ষণ হল নিভে গেছে দৃঢ়নিবদ্ধ ওষ্ঠাধর বুঝি তা জানতে পারেনি এখনও। উদাস দৃষ্টি মেলে পরমানন্দ তাকিয়েছিলেন জানলার বাইরে। সকালের রৌদ্র বাঁকা হয়ে এসে পড়েছে ঘরের মেঝেতে। নন্দ-বেয়ারা এসে কফির কাপটা তুলে নিয়ে গেল। একবার ইতস্তত করে খাবারের প্লেটের সামনে দাঁড়িয়ে, তারপর কী মনে করে সেটাও তুলে নেয় হাতে।
হঠাৎ কী ভেবে ওকে ফিরে ডাকলেন চৌধুরীসাহেব। নন্দ নিশ্চয়ই এটা আশা করেনি--থমকে দাঁড়ানোর ভঙ্গিতেই বোঝা যায়। পরমানন্দ হেসে বলেন—ওটা নিয়ে যাচ্ছিস কেন রে? খাইনি আমি কিছু।
অত্যন্ত অপ্রস্তুত হয়ে নন্দ জবাবে বলে--একেবারে জুড়িয়ে গেছে স্যার, আমি আবার করিয়ে আনছি।
-- ওই টোস্ট আর পোচটা শুধু নিয়ে যা। ফ্রুট্স্-এর প্লেটটা রেখে যা বরং। আর পারিস তো কফি আর একবার করে পাঠিয়ে দিস।
কৃতার্থ হয়ে গেল নন্দ। খাবারের প্লেটটা আবার টিপয়ে নামিয়ে রেখে চলে যায় সে।
কয়েকটা আপেলের টুকরো তুলে মুখে দিলেন। ইচ্ছা করছে না--তবু খেতে হবে। প্লেটটাকে শেষ করতে হবে। না হলে ওরা মনে করবে সাহেব একেবারে ভেঙে পড়েছেন-- অন্নজল ত্যাগ করেছেন বুঝিবা। খেতে কিন্তু বিন্দুমাত্র ইচ্ছা করছে না-- জানলা দিয়ে ওগুলো বাইরে ফেলে দিয়ে প্লেটটা খালি করে রেখে দিতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু তা করার উপায় নেই। ধরণীর দৃষ্টি অতি তীক্ষ্ণ। ঠিক ধরে ফেলবে চালাকিটা। এখনই বাগান সাফ করতে এসে লক্ষ্য হবে তার। মন দিয়ে খেতেই শুরু করেন শেষ পর্যপ্ত।
তারপর হঠাৎ কী একটা কথা মনে হওয়ায় আবার থেমে যান।
সত্য কথাই কি বলেনি নীলা? এই তো একটা প্রত্যক্ষ প্রমাণ রয়েছে। বর্তমানে তিনি কী করছেন? ক্ষুধা নেই বিন্দুমাত্র-- তবু খাচ্ছেন। কেন? কারণ তিনি গোপন করতে চান তার মানসিক বিপর্যয়ের সংবাদটা। তিনি পছন্দ করছেন না—কেউ বুঝতে পারুক যে নীলার অবর্তমানে পরমানন্দের কর্মময় জীবনে বিন্দুমাত্র ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। না হয়নি! হতে পারে না! যে মেয়ে এই বৃদ্ধ বয়সে বাপকে ত্যাগ করে চলে যায় তার জন্য কোনো দুঃখ নেই পরমানন্দের, কোনো ক্ষোভ নেই। নীলার অনুপস্থিতিতে একচুল বিচ্যুত হবে না তাঁর কর্মব্যস্ত জীবনের গতি। তাই প্রাতরাশের টেবিলেই তিনি রেখে দিতে চান সেই সিদ্ধান্তের প্রথম স্বাক্ষর।
তা যেন বুঝলাম। তবু একটা কিন্তু রয়ে গেল যে। মেনে নিলাম তোমার যুক্তি। কিন্তু তা সত্ত্বেও ও যুক্তির মধ্যে একটা ফাঁক থেকে গেল না কি?
গত পনেরো-বিশ বছর ধরে তিনি এমন নিঃসঙ্গভাবে প্রাতরাশ সমাধা করেননি। টিপয়ের উপরে কফির পট আর দুটি কাপ নামিয়ে রেখে চলে যেত নন্দ। শ্রীমন্ত ঠাকুরের হেঁসেল থেকে নিয়ে আসত টোস্ট আর পোচ। তিনি ইজিচেয়ারটায় এলিয়ে বসতেন। বেতের হেলান-দেওয়া চেয়ারটায় এসে বসত নীলা। কফির ডিক্যানটার থেকে কফি ঢেলে, দুধ মেশাত, নিজের কাপে ফেলত টুকটুক করে সুগার-কেক, আর তাঁর কাপে স্যাকারিন। এর পর টোস্টে মাখন লাগাতে শুরু করলেই পরমানন্দ উৎকর্ণ হতে উঠতেন একটা ছোট্ট ধমকের জন্যে—কাগজটা এখন রাখ দিকিনি, খেয়ে নিয়ে যত ইচ্ছে পড়ো কোন মিটিঙে কোন মহাপ্রভু কী দেশাত্মবোধের বাণী ঝেড়েছেন। এখনই হয়তো ননীকাকা এসে টেনে নিয়ে যাবেন-- আর খাওয়া হবে না তোমার।
অগত্যা চশমাটা খুলতে হয় তাঁকে। নামিয়ে রাখতে হয় খবরের কাগজটা।
আজকের প্রাতরাশটা এ দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি নয়। এ একটা ব্যতিক্রম। শুধু ওধারের বেতের চেয়ারটা শূন্য আছে বলেই নয়-- বৈসাদৃশ্যটা আরও ব্যাপক। আজকে কফির পট আসেনি, আসেনি মিল্ক-পট, সুগার-পট। এসেছে তৈরি কফি। এটা শ্রীমন্ত ঠাকুরের কেরামতি নয়-- নন্দ-বেয়ারার দূরদৃষ্টির পরিচয়। সে বুঝেছে তৈরি কফি পাঠানোই আজ যুক্তিযুক্ত। তাই আজ টোস্টের উপরেও আগে থেকেই লাগানো আছে মোলায়েম মাখনের আস্তরণ। যেন এই প্রসঙ্গে কোনোক্রমেই না মনে পড়ে যায়-- দিদিমণির কথা। কাল রাত্রি থেকে এ বাড়িতে যে একটি লোক কমে গেছে এ সত্যটা ওরা প্রাণপণ চেষ্টায় গোপন রাখতে চায়।
কিন্তু যে কথা ভাবছিলেন। খেতে তাঁর ইচ্ছা হচ্ছে না--তবু খাচ্ছেন। ক্ষুধা না থাকার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। এ সময় এ খাদ্য তাঁর নিয়মিত তালিকাভুক্ত। তবে এ অরুচি কেন? নিঃসংশয়ে নীলার অনুপস্থিতিই এর কারণ। সত্যটা অনস্বীকার্য, অন্তত নিজের কাছে। তা হলে ইচ্ছার বিরুদ্ধেও যে তিনি খাচ্ছেন সেটা তো শুধু লোক দেখানো। অর্থাৎ প্রতিটি গ্রাসের বক্তব্য-- “তোমরা দেখো, আমি খাচ্ছি-দাচ্ছি, দিব্যি আছি। তোমাদের দিদিমণি থাক না থাক, আমার ভারি বয়েই গেল!” কথাটা মিথ্যা--তবু এ মিথ্যার আবরণের আশ্রয় তিনি নিয়েছেন শুধু লোক-দেখানোর জন্য। আর তাও কে সে লোক? না, ওই শ্রীমন্ত ঠাকুর, নন্দ বেয়ারা, আর ধরণী মালি! এদের চোখে একটা মিথ্যাস্বরূপ প্রতিষ্ঠিত করবার প্রয়াসেই কি তিনি খাচ্ছেন না আপেলের টুকরোগুলো?
-- এ যদি তুমি আদর্শের জব করতে বাবা, তা হলে আমি মেনে নিতাম...কিন্তু তা তো নয়.. তুমি শুধু সুনামের মোহে, শুধু প্রতিপত্তির লোভে, শুধু পদমর্যাদার মুগ্ধ মোহাবেশে ছুটে চলেছ এ পথে...কী করা উচিত তা আর তুমি ভাব না...কী করলে ওরা তোমার যশোগান করবে সেই চিন্তাতেই তুমি বিভোর।..তোমার অস্তিত্ব পর্যন্ত তুমি বিকিয়ে দিয়েছ ওদের ভালো-লাগা-না-লাগার বিচারে।
খাবারের প্লেটটা সরিয়ে রাখলেন পরমানন্দ।
নীলা অন্যায় করেছে। নীলার গৃহত্যাগে তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি, হতে পারেন না, হওয়া উচিত নয়। তবু এই যে অক্ষুধা, এই যে খাওয়ার অনিচ্ছা, এটা নিঃসংশয়ে নীলার অনুপস্থিতিজনিত। মিথ্যা দিয়ে কখনও কাউকে তিনি ভোলাননি। আজও ভোলাবেন না। নিজের মনকে আগে জয় করতে হবে। তারপর সেই কুলিশকঠোর মনের প্রতিচ্ছবি দেখতে দেবেন আর পাঁচজনকে।
নন্দ এসে কফির কাপটা নামিয়ে রাখে টেবিলে। সমস্ত দ্বিধাসংকোচ ত্যাগ করে, পরমানন্দ তাকে বলেন-- থাক, নিয়ে যা। ভালো লাগছে না এ-সব।
নন্দ বোধ হয় চমকে ওঠে। ঠিক লক্ষ করেননি উনি। নন্দর দিকে আর তাকিয়ে দেখা সম্ভব হয়নি তাঁর পক্ষে। তবু অনুভব করেন খাবারের প্লেট আর কফির কাপটা নিয়ে সে চলে যায়। যাবার সময় সে কি তাকিয়েছিল তার মনিবের দিকে! কী ছিল সে দৃষ্টিতে?
জীবনের চল্লিশটা বছর আজ এসে দাঁড়িয়েছে ভিড় করে ওঁর চোখের সামনে! কী তিনি সত্যি চেয়েছিলেন জীবনে? কী পেয়েছেন, কী পাননি, আর কী পেয়ে হারিয়েছেন? এতদিন তো সব আঘাত সব ক্ষয়ক্ষতি নির্বিচারে বুক পেতে গ্রহণ করেছেন। কোনো দুর্ঘটনাতেই তো এমন শূন্য মনে হয়নি জীবন। আর কী সব দুর্ঘটনা! সে-সবের তুলনায় নীলার এই সিনেমাসুলভ সংলাপ, এই নাটকীয় তিরোভাব তো হাস্যকর। নাটকে আর নভেলেই এ-সব ঘটে এতদিন এটাই ভেবেছিলেন। আজ তাঁর জীবনেই ঘটল এটা। অবাধ্য মেয়েটা বলে কিনা—তিনি চ্যুত হয়েছেন তার আদর্শ থেকে। ঔদ্ধত্যেরও একটা সীমা থাকা উচিত! নিজে থেকে চলে না গেলে হয়তো তাড়িয়েই দিতেন ওকে!
কিন্তু!
যৌবনে আর প্রৌঢ়ত্বে নিয়তির নির্মম কশাঘাতে জর্জরিত হয়েছেন বারেবারে। তাহলে আজ এত সামান্য আঘাতে এতটা বিচলিত বোধ করছেন কেন? অন্তরে কি সতাই দুর্বলতা এসেছে? ডাঃ পরমানন্দ চৌধুরীর অন্তরে দুর্বলতা! মনে মনেই হাসলেন তিনি। পূর্বপক্ষ আর উত্তরপক্ষ হঠাৎ চুপ করে গেল ওঁর মনের মধ্যে, থামাল তাদের ঝগড়া!
দশ বছর আগেকার কথা মনে পড়ছে।
জনপদের পশ্চিম প্রান্তে। কলকোলাহলমুখর প্রাণচঞ্চল শহরের মাঝখানে তিনি বাড়িটা করেননি ইচ্ছা করেই। তবু ভিড় জমে থাকে সামনের লনে সকাল থেকে। গাড়িতে, রিকশায়, সাইকেলে আসে রোগীরা অথবা তাদের আত্মীয়েরা। দোতলা বাড়ি--সামনে প্রকাণ্ড লন। কেয়ারি-করা ফুলের বাগান। মরশুমি ফুলই বেশি। একসার টবে-নানা জাতের ক্যাকটাস। আছে একটা জবা, আর একটা কাঞ্চনও। সামনের লাল কাঁকরের পথটা এসে পোর্টিকোর নীচে আশ্রয় খোঁজে। ফটকের উপর মর্নিং-গ্লোরি লতাটা নীলাম্বরী পরে প্রথমেই স্বাগত জানায়। গেটের ধারেই, অর্থাৎ প্রায় রাস্তার পরেই, একসার ঘর। রোগী দেখার ঘর, ডিস্পেন্সিং রুম, অপারেশন থিয়েটার, আর ছোট ছোট কেবিন। এ ছাড়াও আছে একটা ল্যাবরেটরি। রক্ত পরীক্ষা, মলমুত্রাদি পরীক্ষা তো বটেই, এমনকি এক্স-রে নেবার ব্যবস্থা পর্যন্ত আছে। ছোটখাটোভাবেই শুরু করেছিলেন আমেরিকা থেকে সার্জেন হয়ে ফিরে আসার পর। চেয়েছিলেন শহরের একান্তে নিরিবিলিতে বিকিয়ে দেবেন জীবনটা। ছোট্ট সংসারের বেড়া-দেওয়া পরিধিতে সীমিত করতে চেয়েছিলেন নিজেকে। বাইরের সমস্ত আঘাত থেকে আত্মগোপন করবার একটা শম্বুকবৃত্তি তাঁকে প্রবুদ্ধ করেছিল এই অন্তেবাসীর জীবনের দিকে। শুধু শহর কেন-- দেশের সঙ্গেই বিশেষ সম্পর্ক রাখেননি। বাড়িখানাও বানিয়েছিলেন ওদেশী ছাঁদে। না হলে রি-ইনফোর্সড কংক্রিটের এই যুগে কেউ কখনও বানায় অমন ঢালু ছাদের বাংলো বাড়ি? ছায়া-থমথম নির্জনতায় শহরতলির এই বাড়িটা যেন আর পাঁচখানা স্বগোত্রের সঙ্গে তফাত রচনা করতেই গায়ে জড়িয়েছে লাল ইটের পয়েন্টিং-করা কুর্তা; ওল্ড-ইংলিশ স্থপতিপর্যায়ের খিলানে খিলানে যেন ভূরু কুঁচকেই আছে; --স্কাইলাইট আর চিমনিতে যেন সে ভৌগোলিক বন্ধনটাকেও অস্বীকার করতে চায়। পথ-চলতি মানুষের স্বতই মনে হর বুঝিবা কোনো ইংরাজ দম্পতির আবাসস্থল-- কোনো রিটায়ার্ড সিভিলিয়ানের ডেরা।
কথাটা আধা-সত্য। ইংরাজ না হলেও আমেরিকান। দম্পতি না হলেও তার আধখানা। পরমানন্দ যেদিন গেটওয়ে-অফ-ইন্ডিয়ার তলা দিয়ে ফিরে এসেছিলেন পুণ্যভূমি ভারতবর্ষে সেদিন তার সহযাত্রিণী ছিলেন দুটি বিদেশী মহিলা। মিস ও’নীল অবশ্য তাঁর প্রাগ্বিবাহ পর্যায়ের সংজ্ঞা, এদেশের মাটিতে পা দেবার পূর্বেই তার নামান্তর হয়েছিল-- মিসেস আ্যারিআ্যাডনি চৌধুরী। ছাত্রাবস্থাতেই তাঁকে বিবাহ করেছিলেন পরমানন্দ। ঠিক ছাত্রাবস্থায় নয়--তখন তিনি যুক্ত ছিলেন শিক্ষানবীশ হিসাবে একটা হাসপাতালের সঙ্গে-- যে হাসপাতালে নার্স হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন তার ভাবী জীবনসঙ্গিনীর গড-মাদার মিস গ্রেহাম। নার্স গ্রেহামই ছিলেন সে দ্বন্দ-সমাসের হাইফেন। তারই মাধ্যমে চৌধুরীর হয়েছিল ও’নীলের সঙ্গে পরিচয়, প্রণয় ও পরিণামে পরিণয়।
ও’নীলের পূর্বপুরুষেরা আমেরিকায় এসেছিলেন আয়ার্ল্যান্ড থেকে। ওর মা ওঁকে মৃত্যুশয্যায় দিয়ে যান মিস গ্রেহামের হাতে। তখন কতই বা বয়স ওঁর? মিস গ্রেহাম ওঁকে মানুষ করেছিলেন--নিজের মেয়ের মতোই। ব্রোঞ্জের ক্রুশচিহ্নটার মতোই তাঁকে সর্বদা বুকে বয়ে বেড়াতেন। ওঁর বাপ ছিলেন নাবিক—সমুদ্রযাত্রা থেকে তিনি আর ফিরে আসেননি। পরমানন্দের হাতে তাঁকে সমর্পণ করে পরম আনন্দ না পেলেও পরম নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন গ্রেহাম। মেয়ে-জামাইকে বিদায় জানাবার সময় জামাই জিদ ধরে বসল মিস গ্রেহামকেও সঙ্গে যেতে হবে। শুনে হেসেই বাঁচেন না গ্রেহাম। বলেন-- এতদিন আমেরিকায় থেকেও তুমি খাঁটি ভারতীয় রয়ে গেলে চৌধুরী ! না হলে শাশুড়িকে কেউ হানিমুনে সঙ্গী হতে বলে?
চৌধুরী কিন্তু সে যুক্তি শোনেননি। মেয়েকে নিয়ে ফিরে আসার পর এই প্রৌঢ়া আজীবনকুমারীর নিঃসঙ্গ জীবনের গ্লানিকর অবসাদটা উপলব্ধি করেছিলেন তিনি। তাই একরকম জোর করেই নিয়ে এসেছিলেন তাকে এদেশে।
বাবা-মা দুজনেই তখন গত হয়েছেন। পরমানন্দের পিতা অঘোরানন্দ ধর্মত্যাগ করে ব্রাহ্ম হয়েছিলেন। সুতরাং গ্রামের বাস তাঁদের উঠেছিল একপুরুষ আগেই। ভারতবর্ষে এসে কোনো বড় শহরে বসতে পারতেন ডাক্তার চৌধুরী, কিন্তু কী জানি কেন, এই শহরটাকেই বেছে নিলেন উনি। শহরের সামাজিক জীবন থেকে একান্তে সরে থাকতে চান বলেই জনপদপ্রান্তে বানালেন এই বাংলোটা। এ বাড়ির ভিতের গাঁথনিতে রয়ে গেছে মিস গ্রেহামের স্বাক্ষর। আমেরিকান ডলারই ভারতীয় মুদ্রার বকযন্ত্রে চোলাই হয়ে রূপায়িত হল ইট-কাঠ-চুন-সুরকিতে। অবশ্য পরবর্তী যোজনা যা কিছু--তা পরমানন্দের উপার্জনেই।
এত অল্প সময়ে এতটা পশার হবে এ যেন কল্পনাই করা যায়নি। অবশ্য ওঁর উন্নতির মুলে ছিল বার্টন আ্যান্ড হ্যারিস কোম্পানির কারখানাটা। শহরের এ প্রান্তে হু হু করে বেড়ে উঠল কারখানাটা। এল নানাদেশী লোক-- ভারতীয় কর্মী আর বিদেশী অফিসার। সাহেবী কেতার মানুষ চৌধুরী ডাক্তারের সঙ্গে সাহেব মহলের অন্তরঙ্গতা হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারখানার কোয়াটার্স ছেড়ে মেমসাহেবদের একমাত্র বেড়াতে আসার স্থল ছিল এই বাংলোটা। চৌধুরী গোটা কারখানাটার পারিবারিক চিকিৎসক হয়ে পড়লেন ক্রমে। আউট-হাউসটা ভেঙে বড় করে অপারেশন থিয়েটার বানাতে হল। তৈরি করতে হল নার্সিং হোমের কেবিনগুলো। ওঁর হাসপাতালটা যেন কারখানার সঙ্গে হাত ধরাধরি করে গায়ে গায়ে বেড়ে উঠল-- বড় হয়ে উঠল।
আজ এই নার্সিং হোমের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই ডাক্তার চৌধুরীর—মালিক তো ননই। নার্সিং হোম তার নিকটতম প্রতিবেশী-- তার প্রতিষ্ঠাতার-- সঙ্গে সব সম্পর্ক আজ চুকিয়ে দিয়েছে। ওটা ফ্যাকটরির সম্পত্তি--অবশ্য কারখানার অন্যতম ডিরেক্টর আজ ডাক্তার পরমানন্দ।
আজ থেকে দশ বছর আগে কিন্তু সম্বন্ধটা ছিল অন্যরকম। তখন একনিষ্ঠকর্মী ডাক্তারটি ছিলেন এই সেবাসদনের প্রাণস্বরূপ। গুটিতিনেক জুনিয়ার ডাক্তার সহযোগী ছিলেন তাঁর। পরমানন্দের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল এর চিকিৎসা বিভাগে। মিস গ্রেহাম ছিলেন নার্সিং-ব্যবস্থার কর্ণধার-- আর সমস্ত কিছুর হিসাবনিকাশ থেকে শুরু করে এর সামগ্রিক পরিচালন-ব্যবস্থা ছিল মিসেস চৌধুরীর নখদর্পণে। উদয়াস্ত ওঁরা তিনজনে মেতে থাকতেন সেবাসদনের সেবার। সকাল-সন্ধ্যা মিসেস চৌধুরী এসে খোঁজ নিয়ে যেতেন আর্ত রোগীদের। কখনও ওদের শিয়রে বসে গল্প করতেন, কখনও সান্ত্বনা দিতেন, কখনও নিয়ে আসতেন ফুল-ফল।
না, ভুল হল পরমুানন্দের। দশ বছর আগেকার যে দিনগুলির কথা আজ তাঁর মনে পড়ছে তখন মিসেস চৌধুরীর যাতায়াত ছিল না হাসপাতালে। তার বহু পূর্বেই তিনি বিদায় নিয়েছেন এই দুনিয়া থেকে। মিসেস চৌধুরীর মৃত্যু হয়-- মনে আছে তাও চৌধুরীর-- যে বৎসর সম্রাট পঞ্চম জর্জের সিলভার জুবিলি হয় সেই বছর। ওই উৎসবে চৌধুরী সাহেব কয়েক হাজার টাকা খরচ করেছিলেন নার্সিং হোমের আলোকসজ্জা আর আতশবাজির আয়োজনে।
মিসেস চৌধুরী সুতরাং সেদিন ছিলেন না এ সংসারে। ছিল অসীম আর নীলা। অসীম তখন বোধহয় থার্ড ইয়ারের ছাত্র; আর নীলা মনে হচ্ছে সে বৎসরই ম্যাট্রিক দেবার আয়োজনে ব্যস্ত। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ তখন ভারতবর্ষের রঙ্গমঞ্চে প্রবেশের অপেক্ষায় উইংস-এর পাশে প্রতীক্ষা করছে। উনিশ শ বেয়াল্লিশের আগস্ট মাসের শেষাশেষি, না কি সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ? জাপানী আক্রমণের উৎকণ্ঠায় সারা দেশ তখন কন্টকিততনু। মিত্রশক্তি সংহত করতে চাইল ভারতবর্ষের জনশক্তিকে। সংঘাত বাধল ভারত সরকারের সঙ্গে জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃস্থানীয় কর্তাব্যক্তিদের। বোম্বাইয়ের জনসভায় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ সমবেত হলেন। কর্মসূচি ঘোষণা করার পূর্বেই সরকার চেপে ধরল জননায়কদের কন্ঠনালী। রাতারাতি কারারুদ্ধ হলেন সবাই। মহাত্মা, জওহরলাল, আজাদ, সরোজিনী। সমস্ত ভারতবর্ষের বিক্ষুব্ধ গণআত্মা নিরুদ্ধ আক্রোশ চাপতে না পেরে ফেটে পড়ল একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণের আকারে। জাতীয় কংগ্রেসের কী নির্দেশ ছিল, তা আর জানা গেল না! গুজব রটল মুখে মুখে। লুন্ঠিত হল রাজকোষ, অধিকৃত হল থানা আর ডাকঘর। টেলিগ্রাফের পোস্টগুলো পর্যন্ত মাটিতে লুটিয়ে পড়ল মুর্ছিত হয়ে। দেশের চিন্তাশীল ব্যক্তিরা দিশেহারা হয়ে পড়লেন। একদল বলে-- এ কখনও মহাত্মার নির্দেশিত পথ নয়। এ হিংসার রক্তস্রাবী পথ কখনও আন্তরিক অনুমোদন পেতে পারে না তাঁর। আর একদল বললে-- এই হচ্ছে বিক্ষুব্ধ অপমানিত ভারতবর্ষের গণআত্মার আদেশনামা--এবং যেহেতু মহাত্মাই এই জনগণমনের অধিনায়ক তাই তাঁরও অনুমোদন আছে এ গণবিক্ষোভে।
পরমানন্দের অন্তঃপুরেও এসে লাগল এই বিতর্কের তরঙ্গোচ্ছাস। শান্ত রাজভক্ত পরিবারটির মধ্যে দেখা দিল দুটি বিভিন্ন শিবির। স্কুলের দশম বার্ষিক শ্রেণীর দোলায়িতবেণী কিশোরী নীলার ধ্রুব বিশ্বাস-- এ বিপ্লব জাতীয় কংগ্রেসের কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত। অসীম তা অস্বীকার করে। নীলা সর্বান্তকরণে বর্জন করতে চায় ভারত সরকারকে -- মিত্রশক্তির যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে। অপরপক্ষে অসীম উদয়াস্ত পরিশ্রম করছে স্বেচ্ছাসেবক হয়ে। জাতীয়-রক্ষী-বাহিনী না কী যেন একটা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সে যুক্ত। শাসনশৃঙ্খলা যাতে ভেঙে না পড়ে, জাপানী আক্রমণের এই সংকটমুহূর্তে যাতে প্রশাসনিক ব্যবস্থা অক্ষত রাখা যায়, তাই স্থানীয় এস.ডি.ও. সাহেব আয়াঙ্গার শহরের রাজভক্ত প্রজাদের নিয়ে গড়ে তুললেন একটি আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠান। অসীম তারই একজন মেজ না সেজ ধরনের অফিসার। খাকি পোশাক পরে, মাথায় হেলমেট চাপিয়ে সেই কোন ভোরে উঠে চলে যায় প্যারেড গ্রাউন্ডে। দল বেঁধে কখনও বের হয় আবার রাজপথে। হাতে ঝাণ্ডা আর ফেস্টুন : আমাদের হাতে অস্ত্র দাও!
-- আমাদের হাতে অস্ত্র দাও! মনে মনে হাসতেন পরমানন্দ।
ভাইবোনে কেবলই তর্ক চলে সারাদিন। ওরা কখনও কখনও সালিশ মানে বাবাকে। পরমানন্দ জবাব দেন না। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে উপভোগ করেন প্রাতরাশের টেবিলে। মিস গ্রেহামও এ প্রসঙ্গে একেবারে নীরব থাকতেন।
ক্রমশ পরমানন্দ লক্ষ করলেন, ব্যাপারটা নিছক কৌতুকের সীমারেখা অতিক্রম করতে চলেছে। বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে পরিস্থিতিটা। জীবনে কোনোদিন কখনও তিনি ছেলেমেয়েদের ওপর নিজের মতামত আরোপিত করেননি; তাই মনে মনে উৎকঠিত হয়ে ওঠেন শুধু। মুখে কিছুই বলতেন না, কিন্তু তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে ঘটনাগুলি কিছুই এড়িয়ে যেতে পারে না। আর এ ঘটনাগুলো যে ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে চলেছে-- এটাও অনুমান করতে পারেন উনি।
নীলা আর অসীম দুজনে দুজনকে এড়িয়ে চলে। পনেরো-যোলো বছরের মেয়েটিকে হঠাৎ একদিন দেখা গেল খদ্দরমন্ডিত বেশে। ব্যাপারটা একেবারে অচিন্তনীয়। বিলাতী কেতার মানুষ রাজভক্ত পরমানন্দ চৌধুরীর অন্তঃপুরে খদ্দর! এ যেন পরম বৈষ্ণবাচার্যের আখড়ায় পাঁঠার মুড়িঘণ্ট! সকালবেলা প্রাতরাশের টেবিলে সে যখন এসে বসল সবুজ রঙের খদ্দরের শাড়ি পরে, তখন চমকে উঠেছিলেন উনি। চোখ তুলে একবার দেখেই মনোনিবেশ করলেন কাঁটা-চামচে।
ড্রইং আর ডাইনিং রুম দুটো পাশাপাশি। মাঝখানে একটা বড় আর্চওয়ালা ফোকর। দরজা নেই। মোটা পেতলের রড থেকে ঝুলছে একটা ভারী নেভি-ব্লু পর্দা। মাটির সঙ্গে সমান্তরাল পর্দার ওপর আর্চওয়ের অর্ধচন্দ্রাকৃতি ফোকরটা দিয়ে ড্রইং রুমের দেওয়ালটা দেখা যায়। সেই দেওয়ালের বড় ছবিটার ওপর নজর পড়ল পরমানন্দের। দিল্লী-দরবারের ছবি। প্রিন্স-অব-ওয়েলস্ দিল্লীর দরবারে এসেছেন। ডাইনিং রুমের বিভিন্ন আসবারের ওপরেও নজরটা বুলিয়ে নিলেন। স্বদেশী জিনিস কই নজরে এল না তো কিছু। ক্রকারিস বিলাতী, ফ্রিজিডেয়ার বিলাতী, মায় মীটসেফটা পর্যন্ত বিলাতী ফার্নিচারের দোকানের সীলমোহর নিয়ে এসেছে ললাটে। এর মাঝখানে চৌধুরীতনয়ার এ বিদ্রোহিণীর বেশ শুধু বিসদৃশ নয়, বিপ্লবাত্মক। পরমানন্দ মনে মনে ভ্রূকুঞ্চন করলেন। বাইরে তার অশান্ত সমাহিত মূর্তিতে কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যায় না। মিস গ্রেহাম একবার চোখ তুলেই মনোনিবেশ করলেন কফির পটে। প্রতিদিন এ কাজটা ছিল নীলার কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত; আজ কিন্তু আড়ষ্ট হয়ে বসে রইল সে।
অসীম বলে-- শীত তো এখনও তেমন পড়েনি, এরই মধ্যে গরম জামা বার করেছিস যে নীলা?
নীলা ওর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে নত করে দৃষ্টি। বলে-- এটা গরম জামা নয়, খদ্দর।
-- ওই একই কথা!
পরমানন্দ খবরের কাগজটা দিয়ে একটা ব্যবধান রচনা করলেন—যেন কাগজের দুর্গে আত্মরক্ষা করতে চাইলেন তাঁর বিদ্রোহী আত্মজার আসন্ন প্রত্যুত্তরের তিক্ততা থেকে।
নীলা কিন্তু স্বাভাবিক কণ্ঠেই জবাব দিল-- জামা মোটা-সরুর তো কোনো মাপ নেই দাদা-- ওটা আপেক্ষিক। আমার গায়ে এটা খুব মোটা কাপড়ের মনে হচ্ছে না। আবার হয়তো অনেক মোটা চামড়ার লোকের গায়ে বিলাতী সিল্কের জামাও অসহনীয় মনে হতে পারে।
অসীম অহেতুকভাবে তাঁর সিল্কের পাঞ্জাবির বোতামগুলো খুলতে খুলতে বলে-- তা ভালো, নরম চামড়া তোদের, এ চেঞ্জ-অফ-ক্লাইমেটের সময় ওই চটের জামা পরাই ভালো।
নীলা বলে-- চেঞ্জ-অফ-ক্লাইমেট নয় দাদা, চেঞ্জ-অফ-কন্ডিশন্স,...চেঞ্জ অফ আইডিওলজি।
পরমানন্দের গলায় কি রুটির টুকরোটা আটকে গেল! হঠাৎ কেশে উঠলেন উনি।
-- তোমাকে আর এক পীস কেক দেব নীলা?-- প্রশ্ন করলেন মিস গ্রেহাম। উদ্দেশ্য একই, অর্থাৎ প্রসঙ্গটা চাপা দেওয়া।
নীলা বেণীসমেত মাথাটা ঝাঁকিয়ে আপত্তি জানায়। খাওয়া তাঁর শেষ হয়ে গিয়েছিল। শাড়ির আঁচলটা সামলে নিয়ে সে চলে যায় ড্রইং রুমের দিকে। রেডিওতে সকালবেলাকার খবর পরিবেশিত হচ্ছিল সে ঘরে। হঠাৎ আর্তনাদ করে থেমে গেল সেটা। বোঝা গেল নীলা থামিয়ে দিল তাঁর যুদ্ধপ্রচারের প্রচেষ্টা।
পরমানন্দ একটি দীর্ঘনিশ্বাসের সঙ্গে বলেছিলেন-- ইটস্ এ ব্যাড ওমেন!
মিস গ্রেহাম কোনো জবাব দেননি, দিয়েছিল অসীম। হেসে বলেছিল—তুমি মিথ্যে ভয় পাচ্ছ বাবা। এ বয়সে ও রকম ভাবালুতা একটু-আধটু সবারই হয়। কদিন? শীতকালের কটা মাস কাটুক-- তারপর খদ্দর ছাড়তেই হবে। তা ছাড়া এখন সিনেমা বন্ধ-- পার্টি হয় না-- ফ্যাকটরির ক্লাবেও কোনো ফাংশান হচ্ছে না -- এখন খদ্দর চলতে পারে কিছুদিন। তাই বলে মেয়েমানুষ কখনও শাড়ি-গয়নার মোহ ছাড়তে পারে?
পরমানন্দ ওকে চোখের ইঙ্গিতে চুপ করতে বলেন। নীলা পাশের ঘরেই আছে। দুটি ঘরের মাঝখানে খোলা আর্চওয়ে দিয়ে এ পাশের কথা ও পাশ থেকে স্পষ্ট শোনা যায়। অভিমানিনী মেয়েটির কথা ভেবে শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন চৌধুরী। অসীম চুপ করে।
পরমানন্দের আশঙ্কা যে অমূলক নয়, অনতিবিলম্বেই তা বুঝতে পারা গেল। হঠাৎ ঘরে এসে ঢোকে বৈশাখী; মিস গ্রেহামকে উদ্দেশ্য করে বলে গ্র্যানী, শিগ্গির আসুন-- নীলা খেপে গিয়ে কী করছে, দেখুন।
ওরা সকলেই উঠে এসেছিলেন প্রাতরাশের টেবিল থেকে। বাড়ির ভিতরদিকের উঠোনে নীলা খান্ডবদাহন শুরু করেছে। আলমারি খুলে নিজের সমস্ত বিলাতী শাড়ি একত্র করে তাতে আগুন দিয়েছে। নন্দ-বেয়ারা দাঁড়িয়ে আছে বোকার মতো বারান্দার ও প্রান্তে। কোমরে হাত দিয়ে নীলাও দাঁড়িয়ে আছে সে অগ্নিকুণ্ডের সামনে-- যেন ওই হোমাগ্নির আলোক-উত্তাপে তাঁর চিত্তশুদ্ধির আয়োজন চলেছে গোপনে গোপনে।
মিস গ্রেহাম ছুটে এসে চেপে ধরেন নীলার হাত-- এ কী করছ নীলা! দুদিন পরে তোমার যে অনুশোচনার অবধি থাকবে না।
নীলা ছাড়িয়ে নেয় হাতখানা, বলে-- আমি দুঃখিত গ্র্যানী; জানি তোমার মনে আঘাত লাগবে। তবু এটা আমার কর্তব্য।
অগ্নিস্তূপের ভিতর থেকে কয়েকটা মূল্যবান শাড়ি বাঁচাবার জন্য ছুটে যায় অসীম আর বৈশাখী। পরমানন্দ বাধা দেন তাদের : ও জিনিসগুলো ওর নিজস্ব।
ধীরপদে ড্রইংরুমে ফিরে আসেন উনি।
মিস গ্রেহাম এতটুকু বেলা থেকে মানুষ করেছেন নীলাকে। চৌধুরী পরিবারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। আজ তাঁর হঠাৎ মনে হল-- যে পক্ষিশাবককে এত যত্ন-আদরে মানুষ করে তুলেছেন, আজ সে মুক্তপক্ষ নীলাকাশচারী। নীড়ের সঙ্গে সম্পর্কটা সে অস্বীকার করতে চায়। নীলা আর গ্রেহাম আর নাতনী-দিদিমা নয়-- দুটি ভিন্নদেশী নারী। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের! নেভার দ্য টোএন্ শ্যাল মীট্।
পরমানন্দ ওঁকে বলেন-- আশা করি তুমি ওকে ক্ষমা করেছ-- ও যা কিছু করছে উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে না ভেবেচিন্তেই করছে।
-- বাট্...বাট্..সাম অফ্ দেম আর হার মাদার্স মেমেন্টো।
কান্নার ভেঙে পড়েছিলেন গ্রেহাম। সত্য কথা। যে শাড়িগুলি জাত্যভিমানের বিদ্বেষ-বহ্নিতে পুড়ে ছাই হয়ে গেল-- সেগুলি যে শুধু বিলাতী মিলের তৈরি সেটাই তো শেষ কথা নয়। সেগুলি যে অন্য একটি অভারতীয় রমণীর স্মৃতিবিজড়িত। ওই শাড়িগুলি আহরণ করে এনেছিল যে নারী সে ছিল একদিন এই চৌধুরী পরিবারের একচ্ছত্র সম্রাজ্ঞী-- শুধু তাই নয়, এগুলি সে দিয়ে গিয়েছিল তারই আত্মজাকে। নীলা আজ শুধু গোটা পশ্চিম খণ্ডকে অপমান করেনি—সে ধূলায় টেনে এনে নামিয়েছে তাঁর মাতৃস্মৃতিকে। মিস গ্রেহামের মানসকন্যা মিসেস আ্যারিআ্যাডনি চৌধুরীর দ্বিতীয়বার মৃত্যু ঘটল আজ এ বাড়িতে-- এবং এবারকার মৃত্যুটা অপঘাতজনিত। পাকা আমটির মতো টুকটুকে গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে বুড়ি মেমের।
দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল একটা পরমানন্দের। কিন্তু বাধা তিনি দিতে পারেননি নীলাকে। কারও ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ।
স্কুল-কলেজ বন্ধ। আদালত-দোকান দীর্ঘদিন রুদ্ধদ্বার। শহরের বুকে চলেছে বিভীষিকার রাজত্ব। কখনও বন্দুকের আওয়াজ, লাঠি, মেদিনীবিকম্পিতকরা সদর্প সবুট পদক্ষেপ-- কখনও বন্দেমাতরম্-মন্ত্রোদ্ভাসিত নিরস্ত্র জনতাঁর মিছিল।
ড্রেসিং-গাউন-পরা পাইপমুখো চৌধুরীসাহেব দ্বিতলের ব্যালকনিতে অশান্ত চরণক্ষেপে পদাচরণ করে চলেন। তিনি কোনো পক্ষে নেই। এ সংগ্রামের গতি তিনি দ্রষ্টা সঞ্জয়ের মতো নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে লক্ষ করে চলেছেন শুধু। কোনো মতামত প্রকাশ করেন না কারও কাছে এ বিষয়ে কালপ্রবাহের উপকূলে বসে শুধু নিরীক্ষণ করে চলেছেন কালের গতি। সে প্রবাহে, লক্ষ করেছেন চৌধুরী, তাঁর পুত্রকন্যাও যাত্রা করেছে পালতোলা নৌকায়। দুজনে দু মুখে। একজন ভাঁটিতে, একজন উজানে।
ছেলেরা দল বেঁধে একদিন দেখা করতে এল ওঁর সঙ্গে। শহরের কয়েকজন নামকরা বিশিষ্ট ব্যক্তিও আছেন দলে।
-- কী চাই?
এতদিন যা করেছেন করেছেন, এবার আপনাকেও চালটা পালটাতে হবে।
-- অর্থাৎ?
-- স্বদেশী জিনিস আপনার বাড়িতে কোনোদিন আসেনি। সমস্ত বিলাতী জিনিস। এ-সব আপনাকে ত্যাগ করতে হবে।
-- রিয়ালি? তা আমি যে-সব জিনিস ব্যবহারে অভ্যস্ত তা আপনাদের দেশী কারখানায় বানিয়ে দিতে পারবেন তো?
-- না পারি ব্যবহার করবেন না তেমন জিনিস। দেশী জিনিসটাকে ত্যাগ না করে বদ অভ্যাসটাকেই ত্যাগ করুন না কেন।
-- আমি এ কৃচ্ছসাধনের বিনিময়ে কী পাব?
-- স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি।
হো হো করে হেসে ওঠেন পরমানন্দ!
শেষে হাসি থামিয়ে বলেন-এ প্রতিশ্রুতি তো নতুন নয়। প্রতিবারেই কতকগুলি ছেলে জেল খেটেছে-- বেশ কিছু মরেছে গুলি খেয়ে—অথরা ফাঁসিকাঠে; কত সংসার ছারখার হয়ে গেল। আবার সে প্রতিশ্রুতি কেন? হিমালয়ের চেয়ে বড় কিছু তো নজরে পড়ছে না-- তা সে হিমালয়ান ব্লান্ডারও তো হয়ে গেছে একদফা !
দলের সামনে যে ছেলেটি ছিল-- রুক্ষচুল, খদ্দরের পাঞ্জাবি পরা, সে বলে-- সেবার প্রতিশ্রুতি কেন রক্ষা করা যায়নি জানেন? কারণ সেবারকার সংগ্রামের সংবাদটা আমরা সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে পারিনি। আমাদের দেশে, জানেন তো, একজাতের শিক্ষিত মানুষ আছেন যাঁরা বছরে, মাত্র দুদিন খবরের কাগজের পাতা ওলটান। রাজার জন্মদিনে আর নববর্ষে। তাদেরই মহানুভবতায় আমাদের সংগ্রাম ব্যর্থ হয়ে গেছে বারে বারে।
যে সময়ের কথা তখন অনেকেই আশা করত আগামী বারে ডাক্তার পরমানন্দ চৌধুরীর নাম দেখা যাবে লিস্টে। খোঁচাটা তাই অনেকেই বেশ উপভোগ করলে।
শহরের আর একজন বয়স্ক ভদ্রলোক বললেন,-- আপনি আমাদের শহরের একজন নামকরা লোক। আপনার ঘরে আজকের দিনেও যদি ওই ছবিখানা টাঙানো থাকে তবে সেটা এ শহরেরই অপমান!
পরমানন্দ জবাবে কী যেন বলতে গিয়ে থেমে যান। হঠাৎ লক্ষ হল একটা চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে নীলা দিল্লী দরবারের ছবিখানি নামিয়ে রাখছে। পরমানন্দের দৃষ্টি অনুসরণ করে জনতার দৃষ্টি গিয়ে পড়ে নীলার ওপর। সদ্য স্নান করে এসেছে বোধ হয়-- খোলা চুল পিঠের উপর ছড়িয়ে পড়েছে। সর্বাঙ্গ শুভ্র খদ্দরে বিমণ্ডিত।
কে একজন আনন্দে চিৎকার করে ওঠে-- বন্দেমাতরম্!
বাইরে অপেক্ষমাণ জনতাঁর কণ্ঠে ওঠে প্রতিধ্বনি।
পরমানন্দ হাত দুটি বুকের কাছে যুক্ত করে বলেন : আশা করি আপনারা তৃপ্ত হয়েছেন। অর্থাৎ ভদ্রভাষায়-- এবার আপনারা যেতে পারেন।
সেই ছেলেটি বলে : আর একটা কথা। ওই যে বিদেশী মহিলাটি আপনার বাড়িতে আছেন-- ওঁকে এখান থেকে চলে যেতে হবে।
-- কেন?
-- কুইট-ইন্ডিয়া হচ্ছে আমাদের মন্ত্র। উনি বিদেশিনী।
-- উনি মানুষ।
কে একজন বলে-- কবি বলেছেন “দেশের কুকুর পূজি বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া-- ”
-- বটে! আমি তো জানতাম কবি বলেছেন “জগৎ জুড়িয়া আছে এক জাতি-- সে জাতির নাম মানুষ জাতি।”
সামনের ছেলেটি উদ্ধত ভঙ্গিতে বলে-- আমরা এখানে কবির লড়াই শুনতে আসিনি। আপনি ওঁকে তাড়াবেন কিনা বলুন?
-- না! আর শুধু না নয়, ও ভদ্রমহিলার সম্বন্ধে আমি আপনার কোনো অভদ্র ইঙ্গিত বরদাস্ত করতে রাজি নই। আপনারা এবার আসতে পারেন।
-- আপনি পছন্দ না করলেও এ বিষয়ে আমাদের আলোচনা চালাতে হবে। আপনি ওঁকে তাড়াতে রাজি না হলে বাধ্য হয়ে--
-- ব্যস্!
সেক্রেটারিয়েট টেবিলের টানা ড্রয়ার খুলে কালো রঙের ছোট জিনিসটা উনি তুলে নিলেন হাতে : আউট, আউট য়ু ভ্যাগাবন্ডস্!
-- ভ্যাগাবন্ডস্! আচ্ছা দেখা যাবে! লোকগুলো গালাগাল দিতে দিতে চলে।
মিস গ্রেহাম এসে বলেন-- তুমি কেন ওদের বললে না যে আমাকে কোনো ইংরাজ অথবা আমেরিকান আশ্রমে গৌছে দিলে আমি দেশে ফিরে যেতে রাজি আছি।
পরমানন্দ ওকে সান্ত্বনা দেন, বলেন-- এরা সব কাউয়ার্ডস্। আর ভিড়বে না এদিকে। ওদের কথায় কিছু মনে কোরো না।
তা আমি জানি। কিন্তু শুধু বাইরেই তো নয়-- ঘরেও যে আমি অবাঞ্ছিতা বিদেশিনী।
পরমানন্দ এ কথার জবাব দিতে পারেননি।
সে লোকগুলো সত্যিই আর ফিরে এল না। তবে দেখা করতে এলেন ননীমাধব রায়। বাটন আ্যান্ড হ্যারিস কোম্পানির বড়বাবু রাজভক্ত প্রজা তিনিও-- পরমানন্দের দীর্ঘদিনের বন্ধু। প্রথম থেকেই লেগে আছেন ফ্যাকটরিটার সঙ্গে। ওরই কল্যাণে ননীমাধবের সংসারের ও দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো। ইংরাজ অফিসারদের ঠিকমতো তোয়াজ করে আখের শুছিয়ে নিতে ভুল করেননি তিনি। শহরের অন্যতম বিশিষ্ট ব্যক্তি। বার্টন অ্যান্ড হ্যারিস কোম্পানিতে বাঙালি অফিসারদের মধ্যে সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত। কোম্পানির আদিপর্ব থেকে ধাপে ধাপে উঠে এসেছেন ওপরে-- এমনি একাদিক্রমে ঊর্দ্ধে উঠতে থাকলে স্বর্গারোহণ পর্বে সতাই স্বর্গে গিয়ে পৌছবেন একদিন! শুধু চৌধুরীর সঙ্গে নয়—চৌধুরী পরিবারের সঙ্গেই তাঁর ঘনিষ্ঠ হৃদ্যতা। সরকারি মহলে, থানায়, এস. ডি. ও. সাহেবের খাস কামরায়-- -অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিনা এত্তেলাতেই ঢুকে পড়েন তিনি। আর্দালিগুলো পর্যন্ত এমনই চিনে গেছে তাকে। .
রায়মশাই এসে সদুপদেশ বর্ষণ করতে শুরু করেন চৌধুরী সাহেবের ওপর। প্রতিবেশীর ছেলেটা যখন বখে যাবার পথে পা বাড়ায় তখন সে সংবাদটা তার কে জ্ঞাপন করে সদুপদেশ দিতে আসার মধ্যে অন্তত একটা তৃপ্তি আছে। ননীমাধব কি সত্যই হিতৈষী ছিলেন এ পরিবারের। উনি চৌধুরীকে জানালেন সব কথা। অসীমকে নাকি একটা আধময়লা পায়জামা পরে রীতিমতো কুলি বস্তিতে আজকাল ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে। এত বড় সম্ভ্রান্ত ঘরের ছেলের এ আচরণ ক্ষমা করা যায় না। বেশ ঘনিয়ে বসে শুরু করেন উনি-- সেদিন তো, বুঝলে, বড়-সাহেব আমাকে ডেকে বলেই বসলেন, “রায়, তুমি ডক্টর চৌধুরীকে, আমার নাম করে বুঝিয়ে বলো-- এটা বাড়াবাড়ি হয়ে পড়ছে। একটা সফিস্টিকেটেড ঘরের ছেলে শেষকালে কুলি ব্যারাকে গিয়ে ধর্মঘটের ইন্ধন জোগাবে? আমি বললাম, বুঝলে, এ তুমি কী বলছ সাহেব? চৌধুরী আমার বিশিষ্ট বন্ধু। ওদের সংসারের নাড়ি-নক্ষত্র পর্যন্ত আমার নখদর্পণে। ও-সব গান্ধাইট ফুলিশনেস ওদের বাড়ির ত্রিসীমানায় ঢুকতে পারে না। অসীমকে তুমি চেন না সাহেব। এস. ডি. ও. ওকে জাতীয় রক্ষী বাহিনীর কী যেন একটা করে দিয়েছেন। অসীম করবে ধর্মঘটের আয়োজন? ইম্পসিবল্! আ্যাবসার্ড। এই জনযুদ্ধ জেতবার জন্য ওদের উৎকন্ঠার শেষ নেই। ওদের পার্টি কখনও নেমকহারামি করবে না, দেখো! সাহেব, বুঝলে, মনে হল মেনে নিল আমার কথাটা। আর তা ছাড়া কথাটা তো মিথ্যাও নয়। কিন্তু আমি কী বলি জানো? জনযুদ্ধের কাজ করতে চাও তো ভদ্রভাবে করো না কেন? কাজটা তো ভালোই। আখেরে উপকার হবেই। বেটারা নির্ঘাত যুদ্ধ জিতবে-- সুতরাং যারা সাহায্য করবে তাদেরই হবে পোয়া বারো-- আর যারা এই বিপদের সময় পিছন পিছন ফেউ ডেকে বেড়াল তাদের দফা রফা হবে যুদ্ধ থামলে!
পরমানন্দ বোধহয় অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। আপনমনে কী একটা কথা ভাবছিলেন তিনি। সেটা লক্ষ্য হল ননীমাধবের। হঠাৎ গলাটা খাটো করে উনি বলতে শুরু করেন-- আমি কিন্তু তোমাকে অন্য একটা কথা বলতে এসেছিলাম ভাই। জানি না, তুমি কীভাবে নেবে কথাটা। তবু, বুঝলে, যেহেতু তোমাকে ভালোবাসি তাই কথাগুলো বলছি।...তুমি নীলাকে এবার সামলাও।
ননীমাধবের কাছ থেকে জানতে পারেন যে নীলা আজকাল রীতিমতো বাড়াবাড়ি শুরু করেছে নাকি। খদ্দর পরে ঘুরে বেড়ায় এখানে-ওখানে। সেদিন নাকি ছাত্রদের কোনো একটা মিটিঙেও তাকে উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে। ননীমাধব আরও বলেন-- থানার ও. সি. মজুমদার সেদিন আমাকে বললে তোমাকে একটু টিপে দিতে। বলে, তোমার ঘরের দিল্লী দরবারের ছবিখানা নাকি সে-ই সবার সামনে টেনে নামিয়েছে। তা, আমি বললুম-- তা ছাড়া আর কী করতে পারত সে? হাজারখানা লোক গিয়ে যদি কারও বাড়িতে চড়াও হয় তো মানুষে আর কী করবে? অত যদি আদিখ্যেতা তোমাদের তাহলে শহরে যে কজন রাজভক্ত প্রজা আছে তাদের বাড়ির সামনে পেট্রল গার্ড বসাও তোমরা।
এবারও জবাব দিলেন না পরমানন্দ।
-- ছবিখানা আর টাঙাওনি দেখছি।
-- না।
-- ভালোই করেছ। ও হাঙ্গামা-টাঙ্গামা চুকে যাক, তারপর আবার টাঙালেই চলবে! আমার বাইরের ঘর থেকেও, বুঝলে, রাজারানির ছবি দুটো খুলে এনে এনে শোবার ঘরের দেওয়ালে টাঙিয়েছি। আর একটা কথা ভাই, কিছু মনে কোরো না, ওই গ্রেহাম বুড়িকে কিছুদিনের জন্য কোনো বিলাতী হোটেলে-মোটেলে পাঠিয়ে দেওয়া যায় না?
পরমানন্দ হেসে বলেন-- না, যায় না।
কেন যায় না সে প্রশ্নটা আর করলেন না ননীমাধব। তবু অন্য প্রসঙ্গটা আর একবার উত্থাপন করেন উনি। বস্তুত নীলার ভবিষ্যৎ নিয়ে ননীমাধব অনেকদিন এগে থেকেই ভাবছেন। আকারে-ইঙ্গিতে জিনিসটা বুঝিয়েও দিয়েছেন চৌধুরীকে। মনে হয় তাঁর আগ্রহ আছে ওতে। না থাকবেই বা কেন? দীপক সবদিক থেকেই বাঞ্ছনীয় পাত্র। নীলা যদি পুত্রবধূরূপে আসে একদিন ননীমাধবের সংসারে তাহলে কোনো পক্ষের আপত্তি নেই। সুতরাং ননীমাধব নীলার প্রসঙ্গটা আবার উত্থাপন করেন-- কিন্ত নীলুমাকে তুমি একটু সাবধান করে দিয়ো ভাই।
পরমানন্দ এতক্ষণে পেশ করেন নিজের বক্তব্য-- তুমি ভুল করছ ননীমাধব। আমার বাড়িতে আমি ডিকটেটর নই-- এ ডেমোক্রাটিক সংসারে আমি ব্যক্তিস্বাতন্ত্রকে চিরকাল মেনে এসেছি। ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দিয়েছি, বুদ্ধি-বিবেচনা হয়েছে তাদের-- যে পথে তারা চলতে চায় চলুক, আমি বাধা দেব না। তবে কোন পথে চলার কী ফলাফল তা আমি ওদের বুঝিয়ে দিই। অপরের মত মাথা নত করে জীবনে কখনও মেনে নিইনি, অপরের উপরে কখনও নিজের মতামতও চাপাতে চাই না আমি।
ননীমাধব জেরা শুরু করেন : অপরের কথায় ছবিখানা কেন নামালে তাহলে দেওয়াল থেকে?
-- ছবিখানা আমি নামাইনি।
কিন্ত তুমিই তো গৃহকর্তা, তোমার অমতে তো –
-- না! আগেই বলেছি, এ সংসারের ডিকটেটর নই আমি। এ বাড়ির দেওয়ালে কোন ছবি টাঙানো হবে-- সেটা যদি একমাত্র আমার হুকুমেই স্থির করা তাহলে বাক্তিস্বাতন্ত্র আর মানলাম কোথায়?
এইসব ছেঁদো কথা বরদাস্ত হয় না ননীমাধবের। প্র্যাকটিক্যাল মানুষ তিনি। এ যেন বাড়াবাড়ি। ঘর-সংসার তো তিনিও করছেন-- তিনিও তো সন্তানের জনক। তবে এ-সব পাগলামি নেই। ছেলেমেয়ে হল দুষ্টু ঘোড়া, মুখে সব সময় কড়া লাগাম লাগিয়ে ছপটি উঁচিয়ে না থাকলেই ওরা বেচালে চলবে! এই তো দীপক, -- অসীমেরই সহপাঠী। তাঁর প্রতোকটি পদক্ষেপ, প্রতিটি বন্ধুর নামগোত্র হদিস-হিসাব ননীমাধবের নখদর্পণে। বাপের অমত তো দূরের কথা-- বাপ অপছন্দ করতে পারেন এমন কোনো কিছুর দুঃস্বপ্ন দেখবার সাহস নেই দীপকের। কিন্তু কী অদ্ভুত ওই লোকটি। নিজের ভালমন্দ বোঝে না। অনুধাবন করে না সন্তানের মঙ্গল হবে কিসে। সে কথাই বোঝাতে যান উনি-- কিন্তু ওটা তুমি ভুল করছ না কি চৌধুরী? ওরা অপরিণতবুদ্ধি। নিজের ইচ্ছায় ওদের চলতে দিলে ওর পথেও যেতে পারে।
পরমানন্দ জবাবে বলেন-- আমার বাবার সঙ্গে আমার মতের মিল হয়নি। যে পথে আমি চলতে চেয়েছিলাম তিনি সে পথে আমাকে চলতে দেননি। তাঁর মতটাও এদিকে গ্রহণ করতে পারিনি আমি মনেপ্রাণে। ফলে না রাম না রহিম, কোনো আদর্শই টিকিয়ে রাখতে পারিনি। সে ভুল আমি করব না আমার সন্তানের বেলায়!
ননীমাধব প্রশ্ন করেন-- কী চেয়েছিলেন তোমার বাবা?
-- আমি বড় ডাক্তার হব জীবনে।
-- আর তুমি কী চেয়েছিলে?
হাসলেন চৌধুরী ডাক্তার। ননীমাধব বুঝতে পারেন আরও বড় হবার আদর্শ ছিল নিশ্চয়ই পরমানন্দের। সে লক্ষ্যে তিনি পৌঁছতে পারেননি। পাছে হাস্যকর মনে হয় তাই সে কথা নিকট বন্ধুর কাছেও আজ স্বীকার করতে পারছেন না। তাই বলেন-- কিন্তু তুমি তো তোমার বাবার ইচ্ছা পূরণ করেছ। জীবন তোমার ব্যর্থ হয়নি ভাই। কোথাও কোনো অপূর্ণতা নেই তো তোমার জীবনে।
এবারেও হেসে নীরব রইলেন পরমানন্দ।
ননীমাধব বুঝতে পারেন মনের কোনো গোপন কন্দরে ব্যর্থতার বেদনা বয়ে বেড়াচ্ছেন ডাক্তার চৌধুরী। ধন-সম্পত্তি, প্রতিপত্তি, যশ-- সবই পেয়েছেন প্রচুর, তবু তৃপ্ত নন তিনি। আরও বড় কিছু হতে চেয়েছিলেন বোধ হয়। কী সে? আই.সি.এস. চাকরি? কাউন্সিলারশিপ? প্রসঙ্গটা পালটে নেন উনি আপাতত—আচ্ছা চৌধুরী, আমাকে একটা কথা সত্যি করে বলবে?
-- বলো।
-- মহাত্মা গান্ধী কি বলে গেছেন এইসব হাঙ্গামা করতে? এ কি সম্ভব? তোমার কী মনে হয়?
-- আমি জানি না কিছু।
-- আহা, তা তো বটেই। আমি বলছি, তোমার কী মনে হয়? আমাদের এখন কী করা উচিত?
-- -তোমার বিবেক যা বলে!
হঠাৎ চটে ওঠেন ননীমাধব-- এইজন্যেই তোমার উপর রাগ হয় চৌধুরী। প্রাণ খুলে কথা বলো না কেন তুমি?
আবার সেই গা-জ্বালানো হাসি!
দিন কেটে যায়।
অসীম একদিন বাপের হাতে এনে দিল একতাড়া কাগজ-- এগুলো নীলার বিছানার তলায় পাওয়া গেছে।
ভ্রূকুঞ্চিত হয় পরমানন্দের। নিষিদ্ধ প্রচার-পুর্তিকা। দেশব্যাপী গণবিক্ষোভ করার নির্দেশ আছে তাতে। কর্মসূচির একটা লম্বা ফিরিস্তি। তলায় কংগ্রেসের বড় বড় নেতার নাম। আন্ডারগ্রাউন্ড প্রেস থেকে ছাপা।
অসীম উত্তেজিত হয়ে বলে-- নীলাকে তুমি সাবধান করে দাও বাবা। তা ছাড়া আজকাল ও যে-সব জায়গায় যাতায়াত করে-- যাদের সঙ্গে মেশে-- তাতে আমার সন্দেহ হয় ও আমাদের বংশের নাম ডোবাবে। ওদের পার্টির কয়েকটি ছেলেও আসে এ বাড়িতে নীলার সঙ্গে গোপনে দেখা করতে।
পরমানন্দ বিচলিত হয়েছিলেন কিনা বোঝা যায় না কিন্তু উত্তেজিত তিনি হয়েছিলেন। প্রশ্ন করেছিলেন তিনি অসীমকে-- তুমি কী করে জানলে? তুমি নিজে দেখেছ?
-- না, আমি নিজে দেখিনি, বৈশাখী দেখেছে।
পরমানন্দ বৈশাখীকে ডেকে পাঠালেন। এসে দাঁড়াল মেয়েটি। নীলার চেয়ে বয়সে দু-এক বছরের বড়ই হবে! দেখলে কিন্তু নীলাকেই বড় বলে মনে হয়। নীলা ধীর, গম্ভীর-- বয়সের অনুপাতে গাম্ভীর্য তাঁর বেশি। এদিকে বৈশাখী চঞ্চলস্বভাবা, ওর খঞ্জন নয়ন দুটি সর্বদাই চঞ্চল হয়ে ঘুরছে আশেপাশে। এ পরিবারেরই মানুষ বৈশাখী। পরিচয় দিতে গেলে বলতে হয় সে পরমানন্দের হাসপাতালের বেতনভূক নার্স; কিন্ত তা ছাড়াও তাঁর একটা আলাদা পরিচয় আছে। সে পরিচয়ে বৈশাখী পরিবারভুক্ত লোক। আরও একটা পরিচয় আছে বৈশাখীর-- কিন্তু সে পরিচয় অসীম আর বৈশাখী ছাড়া আর কেউ জানত না।
পরমানন্দ দু-একটি প্রশ্ন করলেন ওকে। তারপর তাকে বিদায় দিয়ে ডেকে পাঠালেন নীলাকে। এসে দাড়াল নতনয়না মেরেটি। ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে কী দেখলেন পরমানন্দ। তারপর বললেন-- এ কাগজগুলো তোমার বিছানার তলা থেকে পাওয়া গেছে।
নীলা একবার চোখ তুলেই মুখটি নীচু করে। মুখটা রক্তশূন্য হয়ে যায় ওর।
-- এ-সব জিনিস অমন অসাবধানে রাখতে নেই। যাও।
ভয়ে নীল-হয়ে-যাওয়া নীলার হাতের মধ্যে গুঁজে দেন কাগজের বান্ডিলটা। নীলা চলে যায় দ্রুতপদে।
অসীম অনেকক্ষণ কোনো কথা খুঁজে পায় না। শেষে বলে-- এটা কি ঠিক হল? শেষে ওকেই দিলে কাগজগুলো?
-- তুমি যে বললে ওগুলো নীলার।
অসীমের বিস্ময় যেন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বলে,-- কিন্তু ওকে সাবধান করে দিলে না? শাসন করলে না?
-- সাবধানই তো করে দিলাম। আর শাসন আমি কাউকে করি না। তোমরা বড় হয়েছ, বুদ্ধি-বিবেচনা হয়েছে। নিজের বিবেক অনুযায়ী তোমরা যে যার আদর্শে চলবে এই আমি চাই।
-- তার মানে নীলার এ-সব অপকীর্তিতে তোমারও গোপন সমর্থন আছে?
-- না, নেই। যেমন নেই তোমার ‘জাপানকে রুখতে হবে’ যুক্তিতে। কিন্তু এ বাড়িতে কারো ব্যক্তিস্বাধীনতায় আমি হাত দিতে চাই না। যে যার কর্তব্য করে যাব আমরা।
অসীমের কন্ঠে এবার রূঢ়তার আমেজ-- বুঝলাম। এটা জানা ছিল না আমার। তুমিও তা হলে ওই দলে!
-- খোকা!
-- বেশ! কিন্তু আমার যদি মনে হয় নীলার এই খবরটা আমার পুলিশে দিয়ে আসা উচিত-- তাহলে আশা করি তুমি আপত্তি করবে না। আমার সে ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে না আশা করি।
পরমানন্দ মৃদু হেসে বলেন-- না।
-- ভালো কথা।
দুমদুম করে পা ফেলে অসীম চলে যায়।
মনে মনে এবার একটু বিচলিত হয়ে পড়েন পরমানন্দ। পাগল ছেলেটা সত্যিই একটা কেলেঙ্কারি করে বসবে না তো? বিশ্বাস হয় না তার। অসীম ছেলেমানুষ নয়। এ কাজের ফলাফল কী ভয়াবহ হতে পারে এ কথা না বুঝবার নয়। নিজের ওই বয়সটার কথা মনে পড়ে যায়। নিজের বাপের সঙ্গে আদর্শগত বিরোধ বেধেছিল তাঁরও। অসীমকে যতটা স্বাধীনভাবে পথ চলতে দিচ্ছেন তিনি অতটা স্বাধীনতা জোটেনি নিজের বেলা। য কিছু করতে হত-- তা গোপনেই সারতে হত। ডাক্তারি পড়বার জন্য যখন তিনি প্রবাসযাত্রা করেন তখনও তাঁর বাবা জানতে পারেননি কেন তিনি শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন ডাক্তারি পড়তে। কোনোদিনই তা আর জানতে পারেননি।
দিন কেটে যায়। বাড়ির আবহাওয়াটা অসহনীয়। নীলা আর অসীম পরস্পরকে এড়িয়ে চলে। প্রাতরাশের টেবিলে মিস গ্রেহামের কাছে শুনতে পান অসীম আগে খেয়ে নিয়েছে অথবা নীলা পরে খেতে আসবে। বস্তুত দুজনের কারো সাক্ষাৎ পান না পরমানন্দ। এ বাড়িতে এটা রীতিবিরুদ্ধ। দিনের মধ্যে দুবার এক টেবিলে আহার গ্রহণের একটা অলিখিত আইন অলঙ্ঘনীয় বলে মেনে নিয়েছিল এ সংসার। সকাল সাতটায় প্রাতরাশ এবং রাত্রি সাড়ে আটটায় ডিনার। মধ্যাহ্ন আহারটা অবশ্য একত্র সম্ভব ছিল না। ছেলেমেয়েরা সকালে খেয়ে স্কুল-কলেজে চলে যেত-- চৌধুরী খেতে আসতেন বেলা দ্বিপ্রহরে। এখন শুধু প্রাতরাশ নয়, রাত্রের ডিনার টেবিলেও একত্র আহারটা ঘটে ওঠে না দেখা যাচ্ছে। অসীমের রাত হয়-- কোনোদিন নটা দশটা, কোনোদিন বা আরও গভীর রাত্রে। নীলা যেন নিজেকে একেবারে গুটিয়ে ফেলেছে। পররমানন্দকে দুজনেই পরিহার করে চলেছে।
গ্রেহাম বুড়ি মাঝে মাঝে এসে বলে-- এবার আমাকে ছেড়ে দাও চৌধুরী। তোমার হাসপাতাল আমার মতো বুড়িকে বাদ দিয়ে চলতে পারবে এখন। এখন আমি অন্য কোথাও চলে যাই।
পরমানন্দ প্রতিবাদ করেন। বুড়ি মেম তখন আসল কথাটাই ভেঙে বলে -- আমাকে ভুল বুঝো না চৌধুরী, আমার অবস্থা হয়েছে ডাঙায় তোলা মাছের মতো। এখানে আমার নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়।
চৌধুরী আর আপত্তি করতে পারেন না। বেশ, শেষ জীবনটা তিনি যেখানে যেভাবে কাটাতে চান সেই মতোই ব্যবস্থা করা যাবে না হয়। যুদ্ধের ডামাডোলটা একটু কমলেই ওঁকে দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন।
পরবর্তী অংশ......
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment