লেখক: মহুয়া দাশগুপ্ত
বিচিং কথাটা আমাদের সময় চালু ছিল না। কিন্তু, তার ব্যবহারিক প্রয়োগ ভালোই চলত। সত্যি বলতে কী, এখন মাঝে মাঝে মনে হয় পুরো ডাক্তার সমাজটাকেই এই এক শব্দে বিশেষিত করা যেতে পারে। এ ওর নামে বলার সুযোগ পেলে একেবারে শতমুখে বলতে থাকে।
তা এই পেশার যদি এটা মুখবন্ধ হয় তবে তাতে তপতী একশোয় একশো। অবশ্য তার বিচিং করাটা শুধু একজনকে নিয়ে। তার নাম ইলোরা।
ইলোরাকে নিয়ে তপতীর সমস্যা অনেক, তা বুঝি। কিন্তু সে আর তপতী স্বর্ণময়ী হস্টেলের রুমমেট, অতএব, উঠতে বসতে তপতী ইলোরাময়ই হয়ে থাকে।
ইলোরা গেঁয়ো টাইপ, মুখ্যু, তেল মাখা চুলে স্কুলগার্লদের মতো লম্বা দু’বেণি করে, ছোট হাতা ঢোলা ব্লাউজ দিয়ে ডুরে শাড়ি পরে -- এসব তপতীর নালিশ।
সে নিজে অবশ্য বিলেতফেরত, ববড্ চুল আর পশ্চিমী পোশাকে সজ্জিত। কিন্তু তাতে কী? যে যার মতো থাকবে-।
সমস্যাটা আসলে একটু গভীরে। সমস্যার নাম সঞ্জয়।
- ওটা একটা আকাট মুখ্যু, ডান-বাঁ চেনে না, ডাক্তারি পড়বে কী? অ্যাপেনডিক্সের বদলে রেকটাম কেটে বসবে। তপতী হাত-পা নেড়ে বলে।
- কেন? কী হল? আমি জিজ্ঞেস করি।
- আরে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ-এর সামনে দাঁড়িয়ে বলে কি না এইটে তো কলেজ স্ট্রিট? একটু এগুলে কলেজ স্কোয়ারের পুকুর?
- পুকুরে ওর কী কাজ?
- সাঁতার কাটবে ভোরবেলা!
- পাঠিয়ে দিলি না কেন সোজা রাস্তায়? ঘুরে ঘুরে পৌঁছে যেত। শ্যামা বলে।
- ভাব তোরা! দু’ মাস হতে চলল, এখনও কলেজের রাস্তাগুলো চিনল না।
- আরে অমন একটা ব্যাপার হয়। সুশ্বেতা বলল। কী যেন জিনিসটা, ব্রেনে একটা ব্যাপার বুঝলি। টেম্পোরাল লোবে কী একটা হয়।
‘গ্রে’ অ্যানাটমির কত হাজারতম পৃষ্ঠার কত নিযুততম লাইনের ভিতর সূক্ষ্ম লাইন পড়েছে সুশ্বেতা তা সেই জানে। সে ‘গ্রে’ ভক্ত। বইটা পড়ে না কি ওর ‘গ্রে সেল’ গুলো চনমনে হয়ে ওঠে। কিন্তু যখন-তখন এ মেগা মহাভারতের ঘায়ে আমাদেরও ধরাশায়ী করার চেষ্টা করে, সেটাই বড় খারাপ।
সুশ্বেতা বাড়ি থেকে একটি ডেস্ক এনেছে, ঐ যেমন যাতে রেখে ঠাকুমা-দিদিমারা রামায়ণ বা মহাভারত পড়ে। ‘গ্রে’খানা তার উপর চাপিয়ে ও দুলে দুলে অ্যানাটমি পড়ে।
তুই থাম তো! চোথাই মুখস্থ হয় না, তুই গ্রে দেখাস নে। শ্যামলী বলে।
- অ্যানাটমি আবার গ্রে কী রে? ভীষণ ডার্ক, জয়তী বলে।
তপতী হঠাৎ উচ্ছসিত। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে সব্বাই চেঁচিয়ে উঠি, - ঐ তো সঞ্জয় আসছে, ওকেই জিগ্যেস কর না অসুখটা কী! আমরা গা ঠেলাঠেলি করে বলি।
তপতী দুদ্দাড় সঞ্জয়ের সামনে হাত নেড়ে বলে, - সঞ্জয়, অ্যাই সঞ্জয়।
সে বোধকরি অনুপের সঙ্গে ক্যান্টিনে যাচ্ছিল। এতগুলো মেয়ে তার পথের পাশে বসে সেদিকে সে দৃকপাতও করেনি! প্রয়োজনটাই বা কী?
- তপতীকে দেখ! পারেও বটে। জয়তী বলে।
- ওর আর দোষ কী? আমি ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। সঞ্জয়ের সিভিটা দেখ।
হ্যান্ডসাম, ব্রাইট, ন মেরিটোরিয়াস, বাপের পয়সা আছে, আবৃত্তি করে, ডিবেট করে - সুশ্বেতা কড় গুণে চলে।
- তোর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে, ওকে থামিয়ে দেয় শ্যামলী।
থরথর করে কেঁপে ওঠে ওর থলথলে শরীরটা, আবেগের গলায় বলে, - কে? সঞ্জয়?
গ্রে রঙের ঐ কাকটা, ওর মাথাতে চাঁটা কষায় জয়তী।
সত্যিই অ্যানাটমি ডিপার্টমেন্টের ছাতে বসা একটা ধূসর কাক সুশ্বেতার দিকে তাকিয়ে হাই তুলছিল।
- হেই সঞ্জয়। জয়তী হাঁকে। - পার্টে কত পেয়েছিস?
- তাতে তোর কি? মিষ্টি করে বলে সঞ্জয়।
জয়তী মোটা চশমা নাকে ঠেলে গম্ভীর হয়ে যায়।
তপতী গরগর করে। স্বভাবতই বাধা পেয়ে সে খুশি হয়নি, - ও হানড্রেড পারসেন্ট পেয়েছে! আচ্ছা সঞ্জয়, তুই ফ্রেশার্স ওয়েলকাম অরগানাইজিং কমিটিতে আছিস তো?
- ও! শুনলি তপতীর ডাকটা, শেলী ফুট কাটে। এমনটি সে কম কথা বলে। শেলী আমাদের ওয়াইজ ওল্ড আউল।
- হ্যাঁ। সঞ্জয় বলে।
- কবে যেন হচ্ছে?
- নেকী! জানে না যেন। সুশ্বেতা বলে।
- ২৮ আগস্ট। সঞ্জয় পা বাড়ায়।
তপতীও। অনুপ লেজুড় জুড়ে থাকে।
- দেখলি। জয়তী বলে।
- বরাবরই অমন। সুশ্বেতা নাক কুঁচকোয়। ও জানবে। তপতী আর ও স্কুলফ্রেন্ড। ওর একটা ন্যাচারাল অ্যাফিনিটি আছে-
- আবার? শ্যামলী বলে।
- কী আবার?
- বাংলায় বল না। গ্রে’ কে ছুটি দে একটু।
- গ্রে কোথায়? ইংরিজি বুঝিস না? আকর্ষণ রে, মাধ্যাকর্ষণ, ছেলেরা ওর অমন চারপাশে ঘুরপাক খায়।
- এখন তো উল্টোই দেখলাম। শেলী বলে।
- সঞ্জয়ের ফেরোমোনটা স্ট্রং। আমি হাওয়া শুঁকে বলি।
- এবার? এবারে কে গ্রে বলছে? সুশ্বেতা আমার দিকে হাত তুলে বলে।
আমাদের ব্যাচে দেড়শজন ছেলেমেয়ে। ডিসট্রিক্ট থেকে আসা ছেলেরা সংখ্যায় বেশি। অনুপ যেমন। ও মিদনাপুরের ছেলে। বেশ ভয়ানক। শুনেছি পড়ার সময় রাতের বেলা ও না কি দড়ি দিয়ে টিকি বেঁধে রাখে ফ্যানের সঙ্গে। যাতে ঘুমে ঝুঁকে পড়লেই টিকিতে টান পড়ে। আচ্ছা, বিদ্যাসাগর কি মিদনাপুরের লোক ছিলেন?
যাক্ গে এসব আমার শোনা কথা। যেসব ছেলে চামারি হোস্টেলে থাকে তারাই বলাবলি করে। শহরের নামীদামি স্কুল থেকে মোটে ক’জনা এসেছে। মেয়েদের ঝোঁক এদের দিকেই বেশি। ডিসট্রিক্টের ছেলেগুলো হালে পানি পায় না। শুধু পড়াশুনায় ভালো হলেই তো হবে না। স্মার্ট হতে হবে, শহুরে চিকনাই থাকতে হবে।
সঞ্জয় এমন একটা দামী মাছ। কত টোপ যে পড়েছে ওর জন্যে!
দু’দিন আগে ওকে সোনালির সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেছে। সোনালির দারুণ ফিগার। হাসলে গালে টোল পড়ে। রংটা অবশ্য কালো। গ্রেস দিয়ে মাজা মাজা বলা যায়।
সবাই সোনালিকে নিয়ে পড়ল।
- কী রে? মিঃ হ্যান্ডসামের সঙ্গে কী অত গুজুর গুজুর করছিলি?
- কোথায়? সোনালি খিলখিলিয়ে হাসে। যেন আমরা ওকে কাতুকুতু দিচ্ছি।
অ্যানাটমি ডিপার্টমেন্টের সামনে, আধঘন্টা ধরে।
- ও, সোনালি আকাশ থেকে পড়ে, ও তো ফ্রেশার্স ওয়েলকাম নিয়ে কথা হচ্ছিল। সঞ্জয় বলছিল সাড়ে পাঁচটায় রিহার্সাল -
সোনালি ড্রামা করবে।
- ব্যাস ওইটুকুই? তপতী ভুরু কুঁচকোয়।
- তোরা না, সোনালি হাসতে হাসতে, কোমর দুলিয়ে চলে গেল।
- চল চল, সুশ্বেতা কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখে বলে। সাঁতরার ক্লাসের সময় হয়ে গেল। দূরে ইলোরাকে দেখা গেল। দু বেণি দুলিয়ে আসছে। বুকের কাছে জড়ো করা কতগুলো বই। ক্যান্টিন থেকে অনুপ, তপতী, সঞ্জয়কেও আসতে দেখা গেল।
- অনুপটা গাধা। শেলী বলল। পড়াশুনা ছাড়া টিকি বেয়ে মাথায় আর কিছু ঢোকে না।
মাঝপথে চারজনের দেখা হল। - এইরে, শেলী বলল।
- আরে, ইলোরা? সঞ্জয়কে বেশ খুশি দেখাল। কী বই দেখি? ইলোরা বইখানা এগিয়ে দেয়।
- তুই গোল্ড ফিংগার পড়ছিস? জানিস তপতী, ইলোরা এবার পার্টে সবচেয়ে ভালো নম্বর পেয়েছে?
তপতী আবার জানে না! সেজন্যেই তো-
পালোধী তো খুব খুশি। বলছিল, কত বছর পর একজন ভালো মেয়ে আ্যানাটমিস্ট পাওয়া গেছে। কী রে, তুই প্রসেক্টরশিপ দিবি তো?
ইলোরা মাথা নাড়ে। ও আর সঞ্জয় অ্যানাটমি নিয়ে বকবক করতে করতে এগিয়ে যায়। তপতী গনগনে চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
ঝামেলাটা হয়েছে পার্ট-এর নম্বর বেরোনোর পরই। আমরা সবাই লাইব্রেরিতে বসেছিলাম। ইলোরাও ছিল উল্টোদিকের দূরকোনায়। হঠাৎ দরজা ঠেলে ঢুকেছিল সঞ্জয়, শাশ্বত, অর্ণব, ভেঙ্কি। দরজার মুখোমুখি ইলোরা। ইলোরা-সঞ্জয় চোখাচোখি।
- আরে ইলোরা। সঞ্জয় এগিয়ে এসেছিল। - কনগ্রাচুলেশন্স্।
আমরা সবাই উৎকর্ণ!
ইলোরা লাজুক হেসে বলল, - থ্যাংকস।
তপতী অস্ফুট বলল, - পারি না।
- কী ব্যাপার? শাশ্বত বলল।
- আরে ও পার্টে দারুণ করেছে। কী নিয়ে পড়বি? সার্জারি?
- জানি না। ইলোরা তখনও লাজুক লাজুক।
- মহিলা সার্জন? ওয়াউ! ভেঙ্কি ফরফর করে বলল।
- ইঃ সার্জারি! ডান-বাঁ চেনে না সার্জারি! তখনই ঝাল ঝেড়েছিল তপতী।
আমাদের ডিসেকশন হলটা পেল্লাই সাইজের। দোতলা। চারদিকে লোহার সিঁড়ি ঘুরে ঘুরে উপরে উঠেছে। মেয়েরা একতলায়। ছেলেরা সংখ্যায় বেশি তাই দুটো তলাতেই ওদের ব্যাচ থাকে।
হলের পূর্ব-পশ্চিম কোনা রহস্যময়। সে কথা পরে। ডিসেকশন হলের মেঝে আর দেওয়ালে ঝকঝকে সাদা টাইল, নিয়ন আলোয় হাড়ের মতো চকচকে। পরপর রাখা মার্বেল টেবিলে মড়াগুলো রাখা। সেগুলো দেখলে ঘেন্না-ভয়-ভক্তি কিছুই হয় না। মমিফায়েড কতগুলো কাঠের টুকরো। ব্যবচ্ছেদের বিভিন্ন পর্যায়ে, বিভিন্ন ভঙ্গিমায়। কোনটা ছেলে কোনটা মেয়ে হঠাৎ দেখলে বোঝা মুশকিল। হায়, সৌন্দর্যের জন্য জীবদ্দশায় মানুষের আকচা আকচি!
মেয়েরা সব একটাই ব্যাচ। সাঁতরার অধীনে। ছেলেদের চোখ টাটায়। ঐ আসছে কৃষ্ণ, বা আহারে লোকটার কী সুখ, বা হ্যাঁরে, হাত ধরে দেখিয়ে দেয় কোনখানটা কাটতে হবে? এমন গোছের কথা প্রায়ই শুনতে হয়।
সাঁতরা একটা কালো শুকনো মাংসখণ্ড নিয়ে এল। ‘ফিমেল পেরিনিয়ম’। ছোট টেবিলের তিনদিক ঘিরে বেঞ্চি। উপচানো ভিড়। যৌনাঙ্গ আর পায়ুদ্বারের মাঝখানে এত হাজার ঝামেলা? উপর-নীচ, ভিতর-বাহির, বাপরে! আমরা শাড়ির আঁচলে ঘাম মুছি। ইলোরা মন দিয়ে নোটস্ নেয়। সরু গলায় সাঁতরা চ্যাঁচায়, - মেয়েরা, বুঝেছ?
ক্লাস শেষ হয়ে গেলে ছেলেদের একটা দল এদিকে বেয়ে আসে। ফেরোমোন! তপতী সঞ্জয়ময়, সঞ্জয়, পুডেনডাল নার্ভটা বোঝাবি একটু? তোদের তো পেরিনিয়ম হয়ে গেছে?
- ফিমেল পেরিনিয়ম? ভেঙ্কি উচ্ছ্বসিত। যাও বস্ ভালো করে বুঝিয়ে দাও। খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে ওঠে সবাই।
সঞ্জয় ইলোরাকে দেখায়, - ওকে বল, বুঝিয়ে দেবে।
সাধে তপতী রাগ করে?
২৮ অগাস্ট। ফ্রেশার্স ওয়েলকামের আয়োজন হয়েছে অ্যাডমিনিষ্ট্রেটিভ ব্লকের তিনতলায়, লম্বা হলঘরে। ওয়েলকাম করবে সেকেন্ড ইয়ারের দাদা দিদিরা।
মাইকে সঞ্জয়। আবৃত্তি হবে।
দাদা-দিদিরা ওয়েলকাম নোট শুরু করল, -- সিটি, কাগজের দলা, ম্যাঁও ম্যাঁও, হুক্কা হুক্কা -সব বাদ্য বেজে উঠল।
সঞ্জয় খানিক ভাবল। তারপর শুরু করল, বাদুড় বলে, ওরে ও ভাই সজারু / আজকে রাতে দেখবি একটা মজারু।
তপতী ফিসফিসিয়ে বলে, - ওর না বনলতা সেন আবৃত্তি করার কথা ছিল?
- ঠিকই করছে, যা করছে, আমি বলি।
সঞ্জয় একা নয়, হলসুদ্ধু লোক প্রবল কলরোলে পুরো কবিতাটা ওর সঙ্গে আবৃত্তি করে তুমুল হাততালি দিয়ে ওকে বসিয়ে দিল।
এরপর ড্রামা!
সোনালি আর সোহিনী দুজনে ‘সিস্টার’ সেজেছে। গাছে না উঠতে হাফ কাঁদি! সিস্টার্স হস্টেলে গিয়ে অথেন্টিক পোশাকও পরে এসেছে।
ডায়াসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক সিটি, বেড়াল ডাকে কান পাতা দায়। নাটকটা যে কী তাই বোঝাও গেল না, শোনাও না।
সবার মুখে একটাই কথা-
রোগা সিস্টারটাকেই চাই, মোটাটাকে চাই না, চাই না।
সোনালির মুখ লাল। ঘেমে নেয়ে অস্থির। সোহিনী খেপে লাল। রেগেমেগে এক্সিট করে গেল।
তুমুল হাততালি।
এমন নানারকম এনটারটেইনমেন্টের পর মঞ্চে উঠল ইলোরা!
- ও কী করবে? তপতী ভুরু কুঁচকায়।
- গাইবে। কখন সঞ্জয় আমাদের পাশে টেবিলে এসে বসেছে, খেয়াল করিনি।
- ইলোরা গায়? জানতাম না।
- তোমার খোলা হাওয়া, সহজ সরল গান ধরল ইলোরা।
গুঞ্জন হতে হতে মিইয়ে গেল। সবাই তাল ঠুকে গান শুনল। গান শেষে এনকোর হল। ইলোরা অন্য গান ধরল।
তপতী উশখুশ করছিল।
- যাবি? সঞ্জয় উঠে দাঁড়াল। ওকে বেরোনোর জায়গা দিতে।
- না আর বসা যায় না। তপতী চুপচাপ হল ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
সঞ্জয় ফাংশন শেষে ইলোরাকে হস্টেলে পৌঁছে দিল।
তপতী তার জানলা দিয়ে তেমনই দেখেছে বলল।
প্রেমের জন্য মানুষ কী না করতে পারে? সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যায় তো বেশি কথা কি? তপতী ক’দিন ডিসেকশন হলের পূর্ব-পশ্চিম কোণায় খুব ঘোরাঘুরি করল।
প্রসেক্টরশিপ পরীক্ষা এসে গেছে। সঞ্জয় আর ইলোরা প্রতিদ্বন্দী। তপতী কি নেপথ্য নায়িকা? ডোমেদের সঙ্গে ওর অত কী কথা?
- কই কিছু না। যাবি না কি টাটকা মড়া দেখতে? কি করে এমবাম্ করা হয় দেখতে পাবি। তপতী বলে।
- থাক থাক, আমি সভয়ে বলি।
প্রসেক্টর পরীক্ষা খুব প্রেস্টিজিয়াস পরীক্ষা। অ্যানাটমির অবিসংবাদিত মাস্টার। তাদের নাম এ এল টিতে মার্বেল ফলকে খোদাই থাকে।
তিন ভাগে পরীক্ষা হয়। লিখিত, মৌখিক এবং প্র্যাকটিকাল। শেষোক্ত ব্যাপারটায় ডিসেকশনের ডেমো থাকে, কিছু অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আইডেনটিফাই করতে হয়।
লিখিত পরীক্ষায় জনা পনেরো বসেছিল। ছজনকে পাশ করানো হল। সঞ্জয় আর ইলোরা দুজনেই পাশ।
যুদ্ধক্ষেত্রে আমরা সবাই উপস্থিত ছিলাম। ইলোরা এল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
- কীরে নার্ভাস লাগছে? তপতী বলল।
- একটু একটু। ইলোরা ফিকে হাসল। কপালে দই-এর ফোঁটা কেটেছে দেখলাম।
- জল খাবি? ঠান্ডা জল আছে। তপতী খুব হেলপফুল।
তপতী একটা বোতল বাড়িয়ে দেয়।
ইলোরা দু ঢোঁক খেয়ে বলে, - কেমন গন্ধ!
- গন্ধ? ও, টমেটো জুস রাখা ছিল তো। গন্ধটা যায়নি বোধহয়। বোতল ধোয়া আছে। হেঁ হে বিদেশি জুস কি না!
ইলোরা কথা না বাড়িয়ে পুরো জলটা খেয়ে নিল। মুখ মুছে একটা ঢেঁকুর তুলল।
তারপর বলল, - মাথাটা কেমন টলছে রে!
- বসবি?
এমন সময় ডঃ পালোধী, সাঁতরা, ডঃ মীনা, ডঃ রায় সব্বাই হলে ঢুকল। ঘণ্টা পড়ল। ছজন ক্যান্ডিডেট কাবার্ডের উপর রাখা জারগুলোর দিকে এগিয়ে গেল।
- আইডেন্টিফাই। পালোধী বলল।
জারের মধ্যে ফর্মালিনে চোবানো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ।
একে একে পাঁচজনের পরীক্ষা হল। বাকি ইলোরা।
তার তখন বেশ টালমাটাল অবস্থা। দুলছে। চোখগুলো করমচার মতো লাল। আমি তপতীকে কানে কানে বলি, - কিছু খাইয়েছিস না কি?
- জল। তপতী সপাট বলে।
- বলো, এটা কী? পালোধী বলে।
ইলোরা ফোকাস করার চেষ্টা করে। তারপর বলে, -মটরশুঁটি।
- অ্যাঁ, কী বললে? পালোধী হতভম্ব। - আর ওটা, ইলোরা কাঁপা কাঁপা আঙুল তোলে, -ওটা শুঁয়াপোকা -
অ্যানাটমিস্টরা এ ওর মুখ চায়। তপতী রুমাল চাপা দিয়ে খুকখুক হাসে। সারা ক্লাসই হাসছিল। ইলোরার থামার লক্ষণ নেই। - আর স্যার, ওটা, ওটা স্যার কী বলুন তো, একদলা চর্বি লাগে! আর এইটে, - বলে ঘাড় বাঁকিয়ে থামে ইলোরা, - হয়েছে, এইটে স্যার রাবারের বল, কেমন ভাসতাছে দেখুন -হি হি।
ক্লাসশুদ্ধু সবাই হেসে ওঠে।
- সাইলেন্স, পালোধী গর্জায়, -ওয়াট ইজ দিস?
- নো চিংড়ি ফিশ স্যার, ইলোরা ঘুরে দাঁড়ায়, -ওটা কাউপারস গ্ল্যান্ড, তারপর এপিডিডিমিস, এটা থাইমাস গ্ল্যান্ড আর এটা স্পিলনের ম্যাজিটাল সেকশন।
সবাই চুপ। ইলোরা তপতীর দিকে তাকিয়ে চোখ মারে।
আমাদের ভুরু সটান ধনুকের মতো উপরে উঠে যায়। তপতীর মুখ ফ্যাকাশে।
পালোধী অবাক, এতক্ষণ কী সব বলছিলে?
- আসলে স্যার আমার অটোটোপ্যাগনসিয়া হয়ে গেছিল, মাঝে মাঝে হয়, ইলোরা সুশ্বেতার দিকে তাকিয়ে চোখ টেপে-গ্রে’র আ্যানাটমি পড়ে জেনেছি। টেম্পোরাল নয় প্যারাইটাল লোব।
বলাই বাহুল্য, ইলোরা সেবার প্রসেক্টর হয়েছিল।
গল্পের একটুই বাকি আছে। তপতীকে ডেকে ইলোরা বলেছিল, তার বাড়ি ভুটান সীমান্ত ঘেঁসা গ্রামে। তার বাবার আবগারির কারবার। একটু-আধটু তাদেরও চলে। টমেটো জুসটা উপকারেই এসেছে। থ্যাংকিউ।
তাছাড়া, তপতীর টেনশন করার কিছু নেই। সঞ্জয়কে ওর মোটেও হৃদয়ে ধরেনি, ওর বরং অনুপকেই পছন্দ!
শেষ
No comments:
Post a Comment