পিলুর সুখ দুঃখ
লেখক: বুদ্ধদেব গুহ
মহুয়াটোলির স্কুলের ছুটির ঘন্টা বেজে গেছে অনেকক্ষণ। ছেলেরা এবং মাস্টারমশাইরাও প্রায় সকলেই চলে গেছেন। পিলু হেডস্যারের ঘর থেকে সবে বেরোল। স্কুলের কম্পাউণ্ডের মধ্যের সারি করে লাগানো ইউক্যালিপ্টাস্ আর কেসিয়া গাছেদের নীচ দিয়ে এসে সাইকেল স্ট্যাণ্ড থেকে সাইকেলটা তুলে নিল। তারপর বইয়ের থলেটা ক্যারিয়ারে বেঁধে নিয়ে বাড়ির দিকে বেরিয়ে পড়ল জোরে প্যাডল করে। বাড়ি ওদের অনেক দূরে। এই বুনো জায়গাতে আর ভাল স্কুল নেই কাছেপিঠে। তাই রোজ আট মাইল সাইকেল চালিয়ে আসে পিলু এবং আট মাইল ফেরে বনগাঁওের দিকে বুনো পথ ধরে। শীতের দিন বনের ছায়া ঘন হয়ে এসেছে পথের উপর। ছায়ারা দ্রুত লম্বা হয়ে যাচ্ছে পুবে। পুটুসের ঝাড় আর বুড়ো শালবনের গায়ের গন্ধে থমকে-থামা হাওয়া ম-ম করছে। পাখিরা আসন্ন রাতের ভয়ার্ত ডাক ডাকতে ডাকতে দ্রুত ডানায় ঘরে ফিরছে।
বুড়হাদেওয়ের ফাঁড়িতে পৌঁছেই গা ছমছম করে ওঠে পিলুর। রোজই। এইখানেই চারটে বুনো পথ এসে মিশেছে। বুড়হাদেওয়ের থান। মস্ত একটা সাজা গাছের নীচে। জায়গাটাতে দেওয়ের পায়ের গন্ধ পায় যেন।
পরবের সময় এইখানেই মেলা বসে। বুড়ির চুল, কাঁকোড়ের মেলা, গালা আর রুপোর গয়না, বগারি পাখি ভাজার দোকান, .... পুরি-কচৌরি-বালুসাই। খয়েরি-হলুদ-লাল-নীল কালো কাঁচের চুড়ি। বৈশাখী পূর্ণিমার চাঁদের আলোর মতো চকচকে রুপোর বাসন। লাল-নীল-সবুজ সিরাপ দেওয়া বরফের শরবত। সব কিছুরই দোকান বসে তখন। মানুষের গায়ের ঘামের গন্ধের সঙ্গে গোরু-ছাগল, মুরগি, তিতির, আসকল, বটেরের পালকের আঁশটে গন্ধ, বনপথের ধুলোর গন্ধ আর বনের গায়ের বুনো গন্ধ মিলে-মিশে যায়। মেলা, দিনের বেলায়। বহু দূর থেকে দেখা যায় লাল ধুলো উড়ছে এই ফাঁড়ির উপরে। রাতে, হ্যাজাক আর লগ্ঠনের আলোর আভাসে উপরের আলোকিত আকাশকে আরও বহু দূর থেকে দেখা যায়। টেবো নদীর গর্জনের মতো এই মেলার গর্জনও মিলিয়ে যেতে থাকে তখন দূর দুরান্তরের গ্রামের দিকে ধুলো-পায়ে হেঁটে যাওয়া বন-পাহাড়ের মানুষের কানে।
ওই সাতটি দিন ছাড়া বছরের অন্য. সময় জায়গাটা একেবারেই সুন-সান্নাটা থাকে। কোনও কোনও দিন ডি.এফ.ও - বা এস. ডি. ও. সাহেবের জিপ চলে যায় ধুলো উড়িয়ে গুড়গুড়ানি আওয়াজ তুলে। খাকি পোশাক পরা ফরেস্ট গার্ডরা সেজেগুজে দাঁড়িয়ে থাকে রেঞ্জ অফিসের সামনে। জিপের এঞ্জিনের শব্দের সঙ্গে মিশে-যাওয়া জিপের যাত্রীদের কথাবার্তার ছড়ানো-ছিটোনো টুকরো-টাকরা ঝুলে থাকে পথ-পাশের গাছে-পাতায় কিছুক্ষণ। তারপরই আবার ঝিঁঝিঁর ডাক। একটানা। গা-ছমছম। পাতারা পাতার সঙ্গে কথা বলে, ফুলেরা ফুলের সঙ্গে, পাখিরা পাখির....
পিলুর মনটা আজ খুবই খারাপ। হেড-স্যার শ্রীকৃষ্ণ নারায়ণ পাণ্ডে তাকে বকেছেন খুবই। টেস্ট পরীক্ষাতে পিলুর রেজাল্ট যতখানি ভাল হবে বলে তিনি ভেবেছিলেন, ততখানি ভাল হয়নি।
হেড-স্যারের এবং স্কুলের অন্য সব স্যারেরই খুব আশা ছিল যে, পিলু প্রি-ইউনিভার্সিটি পরীক্ষাতে স্ট্যান্ড করবেই। টেস্টের রেজাল্টে স্যারদের মনে সে-বিষয়ে গভীর সন্দেহ জেগেছে। স্যাররা অবশ্য পিলুর ভালই চান। পিলুও সেটা জানে। কিন্তু পিলু কি নিজেও তার ভাল চায় না?
ওর অসুবিধার কথা, সব যে বলতে পারে না ও সকলকে। সব কথা সকলকে বলা যায় না। বলতে যাওয়া বোকামিও। ওর নিজের ভালর জন্যে যে বকুনি মাস্টারমশায়দের কাছ থেকে আজ ওকে খেতে হল, তাতে ও দুঃখিতই হয়েছে শুধু। রাগ করেনি। অভিমানও করেনি কারও উপর। কারও উপর অভিমান করতে পারে, এমন মানুষ কি সকলেরই থাকে?
বাড়ি ফিরল যখন, তখন সন্ধে হয়ে এসেছে। ছোট ভাই নিলু ছাগলগুলোকে পাহাড়তলির ঝাঁটিজঙ্গল থেকে চরা-বরা করিয়ে বাড়ি ফিরল। নিলু এখনও গাঁয়ের পাঠশালাতেই পড়ে। পরের বছর থেকে যাবে স্কুলে। এমন কথা আছে। পিলুর শেষ হবে স্কুল। নিলুর শুরু হবে।
পিলু-নিলুর মা অন্ধকার ঘরের ভিতর থেকে নাকি-নাকি সুরে বললেন, “পিলু, এলি বাবা?” হ্যাঁ, মা।” বলেই, সাইকেল রেখে পিলু গিয়ে মায়ের পাশে বসল কিছুক্ষণ। জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছ আজ?” হ্যাঁ, মা।”
“আজ পূর্ণিমা। ব্যথাটা বেড়েছে বড়।”
“নিলুও খায়নি। নিলুকেও বলছি হাতমুখ ধুয়ে নিতে। খেয়েই আমি এসে তোমার পা টিপে দিচ্ছি”-- পিলু বলল।
“ভৈদ্-এর কাছে যাবি না একবার পিলু বেটা?”
“যাব মা। কাল তো স্কুল নেই। কালই যাব। মোটে বারো মাইল তো পথ। সাইকেলে একেবারে টিকিয়া-উড়নে যাব আর আসব। দেখো, কাল ঠিকই যাব। মাথার ব্যথাটা তোমার আজ হয়নি তো আর?”
“না।”
পিলু-নিলুর বাবা ছিলেন মহুয়াটোলির কাছেই যে শহর আছে চাকাকাট্টি, সেখানের এক মস্তবড় ঠিকাদারের বিশ্বস্ত কর্মচারী৷ তাঁদের বাড়ি ছিল চাইবাসায়৷ বছরের ন’মাসই কাটত তাঁর জঙ্গলে-জঙ্গলে। কিন্তু ঠিকাদার শ্রীকান্ত শর্মা খুবই ইজ্জত করতেন তার বাবাকে। বাবা থাকুন আর নাই-ই থাকুন, তাঁর জিপ অথবা ট্রাক এ-পথে গেলেই বরাবর খোঁজ নিয়ে যেত ওদের। কখনও মোরগ, কখনও জঙ্গলের মধ্যে থেকে শিকার করা শম্বর বা শুয়োরের মাংস, কখনও আওলার আচার, লাল আলু, বাখ্খরখানি রোটি, কালাকান্দ এবং আরও কত কী পাঠিয়ে দিতেন উনি পিলু-নিলুদের জন্যে।
পিলুর বাবা হঠাৎই মারা গেলেন একদিন জিপ-অ্যাকসিডেন্টে৷ টেবো ঘাটে বনের মধ্যে কাঠ আনবার জন্যে যে নতুন পথ বানালো হয়েছিল, সেই পথ থেকেই জিপ চাকা হড়কে নীচের গভীর খাদে গড়িয়ে পড়ল। তার কিছুদিন পরই ঠিকাদারি ব্যবসা উঠে গেল ফরেস্ট কর্পোরেশান হয়ে যাওয়াতে।
শ্রীকান্তবাবু ব্যবসা গুটিয়ে চলে গেলেন নেফাতে। হঠাৎই, বড় দুর্দশাতে পড়ল পিলুরা৷ নিলুর তখন দু’বছর বয়স মোটে। তবুও চালিয়ে নিচ্ছিল পিলু, কিছু গতবছর মায়ের হার্ট অ্যাটাক হওয়াতে মা প্রায় শয্যাশায়ীই হয়ে গেলেন। এখন জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলেন। পা টেনে-টেনে হাঁটেন বাথরুমে যাওয়ার সময়ে। রান্না অথবা অন্য কোনও কাজই করতে পারেন না। বলেন অবশ্য যে, বসে-বসে রান্নাটা করবেন। কিন্তু পিলুই দেয় না।
পিলুর বাবা নিজে বেশিদূর অবধি পড়াশুনো করার সুযোগ পাননি, কিন্তু পড়াশুনোতে তাঁর খুবই উৎসাহ ছিল। সব সময় বলতেন পিলু নিলুকে, যখনই ওঁদের কাছে থাকতেন বা ছুটিতে আসতেন বর্ষাকালে, “আমি যা হতে পারিনি, তোরা তাইই হোস। বড় হোস বাবা, অনেকদূর অবধি লেখাপড়া করিস। ভাল থাকিস। মানুষ হোস।”
বাবার জ্বর-জারি হলেই খুব কাহিল হয়ে পড়তেন উনি। পিলু যখন পা টিপে দিত ওর বাবার, বাবা ককিয়ে ককিয়ে বলতেন, মানুষ হোস বাবা। সবসময় মনে রাখিস যে, সবচেয়ে আগে চরিত্র, তারপরে পড়াশুনা, তারপর খেলাধুলো৷ যে মানুষ নয়, তার সব গুণই বৃথা।
ছেলেবেলা থেকেই নিলুটার লেখাপড়াতে বেশি মন নেই। ও বাঁশি বাজায়, বনে বনে ঘুরে বেড়ায়, প্রজাপতি ধরে, কাঠবিড়ালির বাচ্চা পোষে, মুণ্ডা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নদীপারে লুকোচুরি খেলে। মুন্ডারি গান গায়। মোষের পিঠে চরে বাঁশি বাজাতে বাজাতে চলে যায় সবুজ মাঠ পেরিয়ে নীল পাহাড়ের গভীরে। ও বলে, ও শহরে যাবে না। পড়াশুনো করবে না।
পিলু নিজে জানে যে, টেস্টে ইচ্ছে করেই সে খারাপ ফল করেছে। ওর মনের মধ্যে এখন যে ঝড়, যে আগুন, তা থামানো বা নিবোনোর সাধ্য ওর নেই। বড়ই সমস্যাতে পড়েছে পিলু।
বজরার রুটি দু'ভাই মিলে হাতে-হাতে গড়ে নিল। আমের আচার ছিল। মায়ের খাবার বেড়ে নিয়ে নিজেরাও বসল মায়ের পাশে, মেঝেতে। পা ছড়িয়ে বসে মায়ের সঙ্গে গল্প করতে করতে খেয়ে নিল ওরা।
মা যেন কেমন হয়ে গেছেন। হাসেনও না একটু। গরিবিতেও ওদের মনে আনন্দর অভাব ছিল না। কিন্তু অসুখের পরেই, মা অন্যরকম মানুষ। ডাক্তার বলেছেন পিলুকে, কখন কী হয় বলা যায় না।
নিলুটা খেতে খেতেই হাই তুলছিল। বলল, “জানিস দাদা। আজকে না তিড়িংকে হুড়ারে নিয়ে যাচ্ছিল আর একটু হলে। তাই? কোথায়? আতঙ্কিত গলায় বলল পিলু৷ এবং মাও।
হ্যাঁ। ঝিংরিঝারির নালার কাছে। একজোড়া মস্তবড় হুড়ার এসেছে। ছাগলের বাচ্চাদের মধ্যে তিড়িংটাই দুষ্টু সবচেয়ে বেশি। কেবলই এদিক-ওদিক চলে যায়।
বড় হুড়ার হলে তোকেও ধরতে পারে। একা-একা যাস না ঝিংরিঝারির দিকে। খাওয়াদাওয়ার পর মায়ের পা টিপল পিলু অনেকক্ষণ। নিলু ততক্ষণে মায়ের পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে কাদা। পিলুর অনেকই কাজ বাকি। উঠোনের দরজা বন্ধ করবে। মুরগি আর ছাগলদের ঘরে খিল দেবে ভাল করে। বেড়াটা ভেঙে গেছে পশ্চিমের দিকের। রাতে চিতা বা হুড়ার বাড়ির মধ্যেই চলে না আসে। বাবা বেশ কয়েক বছর হল গেছেন। সঞ্চয় যা ছিল মায়ের, সবই শেষ। পিলুর ছেলেবেলা বলতে সুখের কিছুই নেই আর। ছেলেবেলাতেই ও বুড়ো হয়ে উঠেছিল। তবু, মা’কে ও বুঝতে দেয় না যে, ওর কোনও অসুখ আছে। বুঝতে দেয় না ছোট ভাই নিলুকেও।
কাজ শেষ করেই পাশের ঘরে গিয়ে ঘুমোবে ঘণ্টা দুই। হাই ওরও ওঠে। কিন্তু মায়ের সামনে হাই তোলে না, পাছে ওর কষ্ট দেখে মায়ের কষ্ট বাড়ে। দুঘণ্টা ঘুমোবার পর উঠে পড়ে লম্ফ জ্বেলে পড়াশুনা করে ও। বাইরে বনের মধ্যের গা-ছমছম রাত তখন গভীর হয়ে আসে। শালবনের পাতা গড়িয়ে পড়ে নীচের ঝোপ-ঝাড়ে, শিশির পড়ার শব্দ ভূতুড়ে ফিসফিসানির মতো শোনায়৷ নানা রাত-পাখি রাত-পোকা ডাকে। নিশাচর জন্তু-জানোয়ারের পায়ের চাপে পুট্-পাট করে মরা-ঝরা ডাল ফাটে। নুড়িতে শব্দ ওঠে খুটখুট। কখনও-সখনও দুর-পাহাড় থেকে আসা বড় বাথের আওয়াজে গমগম করে ওঠে রাতের বন-পাহাড়। পড়া শেষ করে পিলু ঘুমোয় আবার, ভোরের মোরগার ও ময়ূরের ডাকে জেগে উঠবে বলে।
ঘুম ভেঙে গেল। মেঝেতেই বাঁশের চাটাই পেতে শুয়েছিল। গরম পড়লেই সাপের ভয়ে সাবধানে থাকতে হয়। তখন মাটিতে শোওয়া যাবে না। চিতি সাপেরই ভয় বেশি।
শেষ রাতে হঠাৎই ঘুম ভাঙল, বাবাকে স্বপ্ন দেখে। বাবা যেন পিলুর মুখের উপর মুখ নামিয়ে এনেছেন। কী যেন বলতে চাইছেন, কিন্তু বলতে পারছেন না। বারবার চেষ্টা করেও পারলেন না। বাবার যেন কষ্ট হচ্ছে খুব। কম্বল সরিয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়ল পিলু।
আজ পূর্ণিমা। শীতের পূর্ণিমায় রুপো থাকে না। আকাশ জঙ্গল সব হাল্কা-তুঁতে হয়ে যায়। শাড়ির মতো রাতকে জড়িয়ে থাকে সেই জ্যোৎস্না। কন্বলটা গায়ে ভাল করে জড়িয়ে মাটির দাওয়ায় এসে দাঁড়াল পিলু। বাড়ির বড় ছেলে ও। বাবা ওকে লেখাপড়া শিখতে, বড় হতে, মানুষ হতে বলেছিলেন। শিক্ষিত হওয়া, বড়লোক হওয়া, বড় হওয়া আর মানুষ হওয়ার মধ্যে কি কোনও তফাত আছে? ভাবছিল পিলু।
ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল ও। ওকে মাকে এখানে ফেলে রেখে টাটাতে গিয়ে কলেজে ভর্তি হতে হবে। বৃত্তি সে পাবেই। থাকা-খাওয়ার খরচ লাগবে না। কিন্তু মা’কে তো নিয়ে গিয়ে রাখতে পারবে না সেখানে। মা’কে এখানে ছেলেমানুষ, পাগলাটে, দায়িত্বজ্ঞানহীন নিলুর ভরসায় যদি রেখে যায়, তা হলে মায়ের যে কী হবে কেউ জানে না।
কে মাকে রেঁধে-দেবে? কে ওষুধ এনে দেবে?-ছাগলের দুধ বিক্রি বা মুরগির ডিম বিক্রির বন্দোবস্ত সব কে করবে? সামান্য জমিতে চাষবাসই বা কে দেখবে? তার নিজের তো ভালই চলে যাবে শহরে বৃত্তির টাকাতে। টাটা কোম্পানির অনেক আলাদা বন্দোবস্ত আছে ভাল ছেলেমেয়েদের জন্যে।
কিন্তু মা? নিলু? কী যে করবে ও তাই-ই ভেবে পাচ্ছে না। এতসব কথা তো মাস্টারমশায়দের বলা যায় না। অথচ এসব শুনলে ওরা দুঃখই পাবেন শুধু। কিছু করতেও পারবেন না। ওঁদের নিজেদের সংসারই চলে না। এই সব ভেবেই ও ইচ্ছে করে টেস্ট পরীক্ষাতে খারাপ করেছিল, যাতে ওঁরাই বলেন যে, এ-বছরে তুই বসিস না ফাইনালে পিলু। তোকে স্ট্যাণ্ড করতে হবে।
গত সপ্তাহে শ্রীকান্ত শর্মার বাড়ি গেছিল একবার। উনি ছিলেন না। ওঁর ভাই খুবই খারাপ ব্যবহার করলেন। বললেন, অনেকই তো নিয়েছ, তোমার বাবা আর তোমরা মিলে আমার দাদার কাছ থেকে? আর কেন? তংক্ মৎ করো! যাও!
মা’কে বলেনি একথা।
তারা-ভরা আকাশের দিকে চেয়ে রইল পিলু। কী যে করবে ও! উত্তর পেল না কোনও। তারপর বনকে শুধোল। সেও নিরুত্তর। তারও পর নিজের মনকে শুধোল পিলু এই কঠিন প্রশ্ন। শিশির ঝরছে বনে বনে। মুহুর্ত ঝরে যাচ্ছে শিশিরেরই মতো পিলুর জীবন থেকে। জানে ও কোনটা ঠিক? কোনটা ভুল? তা ঠিক করতে ভুল হয়ে গেলে জীবনটাই ভণ্ডুল। আর একটামাত্রই জীবন!
নীরবে পিলু আকৃতি করে বলল, “বলো বলো। তোমরা বলে দাও আমাকে কী হব আমি? জীবনে কী হব? কী করব?” হনুমানের দল দূরের, গহিন বনের গাছে গাছে ঝাঁপাঝাঁপি করে ডেকে উঠল।
হঠাৎই উত্তরটা ছুঁড়ে দিল তাকে বনের নীলচে ভেজা শীতজ্যোৎস্নাকে শাড়ির মতো পেঁচিয়ে-পরা নীলাভ অন্ধকার। বলল, “পিলু অন্য সবকিছু হওয়ার চেয়েই মানুষ হওয়া অনেক বেশি কঠিন। শিক্ষিত হওয়া সোজা, টাকা রোজগার করা সোজা, যশস্বী হওয়া সোজা, কিন্তু মানুষের মতো মানুষ হওয়া সবচেয়ে কঠিন। পিলু, তুমি তোমার মাকে ছেড়ে যেও না। তুমি চলে গেলে তোমার মা ভেসে যাবেন। মরে যাবেন দু-একমাসের মধ্যেই। মানুষ হোয়ো পিলু। মানুষের চেহারায় কোটি কোটি জীব আছে। কিন্তু মানুষের মতো মানুষ বড়ই কম এখানে”।
পিলুর মনে পড়ে গেল, বাবা বলতেন, “চরিত্র। চরিত্র সবচেয়ে আগে, তারপর সবকিছু। এই মানুষ হওয়ার আরেক নামই কি চরিত্র?”
পিলু দু’ঘরের মধ্যের দরজা দিয়ে মায়ের ঘরে গিয়ে মা’কে জড়িয়ে ধরল। মায়ের ছেঁড়া লেপের তলায় ঢুকে গেল ও। মায়ের গায়ের গন্ধ-মাখা ওমে নাক ভরে গেল। বাইরে তখন অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে। পাখপাখালি নড়ে-চড়ে বসছে। জেগে উঠছে পৃথিবী; ধীরে ধীরে। মা চমকে উঠে মুখ ফিরিয়ে বললেন, “কী হয়েছে রে পিলু? কী হয়েছে?”
পিলু বলল, “আমার বড় আনন্দ হচ্ছে মা, জানো! খুবই আনন্দ হচ্ছে”।
“কেন? আনন্দ’র কী হল হঠাৎ? এই সাতসকালে?”-- জড়িয়ে জড়িয়ে মা বললেন।
পিলু উত্তর দিল না কোনও।
মা বললেন, “কী হল রে? পিলু?”
পিলু তবু কিছু বলল না।
“বলবি না আমাকে? এ কেমন আনন্দ যে, মা’কেও বলা যায় না?”
“নাঃ। না মা। বলা যায় না। এই আনন্দের. কথা শুধু আমারই জানবার। আমার একার”।
মনে মনে বলল, সব কথা বলার জন্যে নয়।
মা বললেন, “কী জানি! বুঝি না তোকে। পাগল একটা। বলেই, কাঁপা-কাঁপা হাতখানি নিয়ে পিলুর মাথায় রাখলেন”।
একটু পরে পিলু বলল, “সকাল হল। এবারে উঠি মা। তোমার আর আমার জন্যে চা করি। নিলুর দুধ ফোটাতে হবে। ছাগল দুইতে হবে। আকোয়া-ভাইকে খবর দিতে হবে বয়েল দুটোর জন্যে। অনেকই কাজ”।
পিলু যখন বাইরে এসে দাঁড়াল তখন রোদ উঠে গেছে। সকালের রোদ পড়ে ঝলমল করছে লক্ষ কোটি শবনম্ পাতায় পাতায়, ঝোপে-ঝাড়ে; ঘাসে-ঘাসে। শিশিরের হিরে ঝরিয়ে দিয়ে একটি বুলবুলি উড়ল ভেজা গাছের পাতলা ডালে দোলা দিয়ে। শিস দিতে দিতে চলে গেল পুবে। রোদে পিঠ দিয়ে দাওয়ায় দাঁড়িয়ে পিলু ভাবছিল, টাটাতে গিয়ে পড়তে পারবে না ও? কত কীই না ভেবেছিল! ডাক্তার, হবে, মস্ত ডাক্তার।
হল না হওয়া।
কিন্তু নিজেকে কষ্ট দেওয়ার মধ্যে যে এতখানি আনন্দও থাকতে পারে, তা কখনওই পিলুর জানা ছিল না। নিজেকে ঠকানোর আনন্দে বুক ভরে গেল। কে জানে! যে নিজেকে ঠকায়, হয়তো সেইই জেতে আসলে।
সমাপ্ত
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment