প্রতিবন্ধী



লেখক: সমরেশ মজুমদার

ওকে প্রথম দেখেছিল রাহুল। যেদিন পায়ে ব্যথা বেশি লাগে, সেদিন দোতলার ব্যালকনিতে চুপচাপ ক্রাচ পায়ে রেখে বসে থাকে সে। ডক্টর সোমের সেইরকমই নির্দেশ।

তখন সকালবেলা। পড়ার সময় শেষ হয়ে গেছে৷ হোমের ছেলেমেয়েরা রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ব্যালকনিতে বসে রাহুল মাউথঅর্গানে জিভ ছোঁয়াচ্ছিল। তার পাশে বসে ছিল রুনা! রুনা চোখে দেখতে পায় না। রাহুলের সঙ্গে ওর খুব ভাব।

ডক্টর সোমের এই হোমে পাঁচরকমের প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রমে সাহায্য করা হয়। ডক্টর সোম প্রায়ই বলেন, ‘তোমরা কতটা অক্ষম, সেটার হিসেব না করে কতটা সক্ষম সেইটে জানতে হবে। প্রতিটি দিন যাতে সেই জানাটা এক জায়গায় থেমে না থাকে, তার চেষ্টা-করা মানে বেঁচে থাকা।’

এই হোমে আসার আগে রাহুলের মতো রুনাও ভাবতে পারেনি, তাদের সামনে একটা সুন্দর জীবনের ইঙ্গিত আছে। পাবলো বলে একটা বাচ্চাকে ওর বাবা-মা এখানে রেখে বিদেশে চলে গিয়েছিলেন। পাবলো না পারত কথা বলতে, না সে কানে শুনত। ছোট্ট একটা অপারেশনের পর ডক্টর সোম আর সুপ্রিয়াদিদি কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাবলোকে ‘মা’ বলতে শিখিয়েছেন।

পোলিওতে রাহুলের একটা পা অকেজো হয়ে গেছে। যে হাতটা দিয়ে সে মাউথঅর্গান বাজায়, সেটাকে কোনওমতে সে মুখ পর্যন্ত তুলতে পারে।

দেখতে পেয়ে রাহুল অবাক হয়ে বলেছিল, “এই দ্যাখ কে ঢুকছে হোমে !”

রুনার চোখে কালো চশমা, “আমি কী,করে দেখব ?”

রাহুল জিভ কাটল। তারপর সাত বছরের রুনার কাঁধে হাত রেখে বলল, “একটা বিরাট লম্বা কালো মানুষ। ‘টমকাকার কুটির’ বলে একটা বই আছে, সেই টমকাকার মতো।”

রুনার কপালে ভাঁজ পড়ল। “সেই যে লোকটা, যাকে মনিব চাবুক মারত, সে এসেছে?”

“দূর! সে তো বইয়ে আছে। এ অন্য লোক। ওইরকম দেখতে।”

ডক্টর সোম চিঠিটা পড়লেন। পাকা চুলে হাত বোলানো তাঁর অভ্যাস। বললেন, “আপনি এতদিন পুরুলিয়ার ইন্টারন্যাশনাল হোম ফর অর্ফান-এ কাজ করেছেন। ফাদার লিখেছেন, দেশে ফিরে যাওয়ার আগে আপনি কয়েকদিন প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কাটাতে চান। কিন্তু কেন?

লোকটির চেহারা বিশাল। গায়ের রঙে কালো বিদ্যুৎ যেন ঠিকরে ওঠে নড়াচড়া করলেই। মাথায় জমে-যাওয়া কোঁকড়া চুল। একটা ব্যাগ আর গিটারের বাক্স পাশে রাখা। লুথার হাসল, “ওয়েল ডক্টর, আমি এতদিন যে-সব বাচ্চাদের দেখেছি, তারা স্বাভাবিক প্রতিবন্ধী। ঈশ্বর কিংবা মানুষের অবহেলা যাদের ‘শারীরিক প্রতিবন্ধী’ করে রেখেছে, তাদের একটু কাছ থেকে জানতে চাই। সাতদিন থাকব এখানে, আমার দ্বারা যে-কাজ হবে বলে মনে করবেন, তা-ই করে দেব।”

ডক্টর সোম হাসলেন, “কিছু মনে করবেন না। আমরা ছেলেমেয়েদের বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে শিক্ষা দিই, যাতে তারা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে পারে। সে-ব্যাপারে আপনি কোনও সাহায্য করতে পারবেন না! কিন্তু ফাদার লিখেছেন, আপনি চমৎকার গিটার বাজিয়ে গান গাইতে পারেন। আপনি বাচ্চাদের ভাল রাখার গান গাইতে জানেন?”

লুথার মাথা নাড়ল। “আমি চেষ্টা করি গান গাইতে, কখনও-কখনও যখন ছেলে-বুড়ো সবার ভাল লাগে, তখন বুঝি, গানটা হল।”

কথাটার মানে ধরতে পেরে হেসে উঠলেন ডক্টর সোম। নিজের ভুল বুঝতে পেরে বললেন, “গুড! আমাদের একটা গেস্টরুম আছে। সেখানেই থাকবেন। অ্যাদ্দিন যখন পুরুলিয়ায় ছিলেন, তখন আমাদের খাবারে নিশ্চয়ই অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। আপনি যদি ওদের উদ্দীপ্ত করার গান শিখিয়ে দেন, কয়েকদিনে, খুশি হব। আসুন আমার সঙ্গে।”

লুথারকে নিয়ে ডক্টর সোম তাঁর অফিস থেকে বেরিয়েই সুপ্রিয়াকে দেখতে পেলেন। সুপ্রিয়া অমলের হুইলচেয়ার ঠেলতে-ঠেলতে আসছিল গল্প করতে করতে। ডক্টর সোম ডাকলেন, “সুপ্রিয়া, এদিকে এসো। ইনি লুথার। আমেরিকার ছেলে। পুরুলিয়ায় ফাদার ডিমকের হোমে ছিলেন। সাতদিন এখানে থেকে সবাইকে গান শোনাবেন।”

একজন নিগ্রোকে দেখে সুপ্রিয়া বিস্মিত হয়েছিল। বস্তুত এই প্রথমবার সে সামনাসামনি কোনও নিগ্রোকে দেখতে পেল। কাঁপা গলায় বলল, “নমস্কার।”

মাথা ঝাঁকাল লুথার। তারপর এগিয়ে গিয়ে পা মুড়ে নিলডাউন হল অমলের পাশে। “আমার নাম লুথার। তুমি?”

অত বিশাল একটা কালো মানুষকে তার কাছে এগিয়ে আসতে দেখে অমলের বুক ঢিপঢিপ করছিল। সে পেছন দিকে সিঁটিয়ে বসে রইল । ডক্টর সোম বললেন, “কেউ প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে হয়, অমল। নামটা বলো।”

আর সেইসময় লুথার হাসল। তার কালো মুখে মুক্তোর ছটা ছড়াল। অমলের মুখে নামটা শুনতে পেয়ে কয়েকবার শব্দটা নাড়াচাড়া করল লুথার, “ওমোল, ওমোল।”

নিজের নামটার অমন উচ্চারণ শুনে হাসি পেয়ে গেল অমলের। কিন্তু তখন লুথার বলল, “নাউ, ওমোল, উই আর ফ্রেন্ডস্। ডক্টর, আমি যদি ওমোলের সঙ্গে বেড়াতে যাই, আপত্তি আছে আপনার? ওমোল ক্যান ইন্ট্রোডিউস মি টু আদার্স।”

ডক্টর সোম বললেন, “নো আপত্তি।”

লুথার স্যুটকেসটাকে একপাশে সরিয়ে রেখে গিটারের বাক্সটার স্ট্র্যাপ বন্দুকের মতো কাঁধে ঝুলিয়ে হুইলচেয়ার সন্তর্পণে ঠেলতে লাগল। ওরা দৃষ্টির বাইরে যাওয়া মাত্র সুপ্রিয়া জিজ্ঞেস করল, “ব্যাপারটা কী ডক্টর? লোকটা কে?”

ডক্টর সোম বললেন, “ওর নাম লুথার। আমেরিকান। আন্তর্জাতিক অনাথ আশ্রমের ভলান্টিয়ার৷ এরকম মানুষ পৃথিবীতে আছে বলেই মানুষের নিঃশ্বাস এখনও স্বাভাবিক। তুমি ভেবে দ্যাখো সুপ্রিয়া, ওর পূর্বপুরুষকে ক্রীতদাস করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল হয়তো একদিন আমেরিকায়। অনেক বেত পড়েছে ওর পূর্বপুরুষের পিঠে। আর আজ ও পৃথিবীর অনাথদের সেবা করে চলেছে স্বার্থহীন ভাবে দেশে ঘুরে। ফেরার আগে লুথার আমাদের সঙ্গে ক’দিন থাকতে চায়। তুমি দেখো, ছেলেমেয়েরা যেন ওর সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে মেশে।”

লুথার হুইলচেয়ার ঠেলছিল। অমল সিঁটিয়ে বসে ছিল। ওর খুব ভয় করছিল। রাহুলের চেয়েও অমলের অবস্থা খারাপ। সে নিজের পায়ে উঠেও দাঁড়াতে পারে না। ওর দুটো পা’ই অকেজো হয়ে গেছে। কিন্তু হোমে আসার পর তার মনমরা ভাবটা অনেক কম। হঠাৎ লুথার দাঁড়িয়ে পড়ল। তার কানে মাউথঅগানের সুর এসেছে। মুখ তুলে চারপাশে দেখে লুথার জিজ্ঞেস করল, “কে বাজাচ্ছে ওমোল?”

“রাহুল,” অমল শুকনো গলায় উত্তর দিল।

“বিউটিফুল”, লুথার মাথা নাড়ল, “তুমি পারো না?”

“না। আমি ছবি আঁকতে পারি।”

“খুব ভাল। গান?”

“না। আমি তো কখনও গান শিখিনি।”

“ঠিক আছে, আমি তোমাকে গান শিখিয়ে দেব।”

“আমার গলায় গান হবে?”

“কেন হবে না? যত খারাপ হোক গলা, যদি বুকের ভেতর থেকে গাইতে পারো, তা হলে সেটা গান হবেই। এখানে তোমরা যারা আছ, তাদের অসুবিধে কী?”

অমলের ততক্ষণে মনে হয়েছে, এই মানুষটার সঙ্গে কথা বলা যেতে পারে। একে দেখতে পরিচিতদের মতো নয়। সাহেবদের যে চেহারা সে ছবিতে দেখেছে, তার সঙ্গেও মিল নেই। গায়ের রং এত কালো কী করে হয়? তবু তার কথা বলতে সঙ্কোচ হল না এখন। “আমি হাঁটতে পারি না, ওমর, রুনা চোখে দেখতে পায় না। কয়েকজন আছে, যারা কানেও শুনতে পায় না, কথাও বলতে পারে না। আবার কারও শরীরটা একটুও বড় হয়নি, মানে বাড়েনি, কিন্তু বুদ্ধি খুব পরিষ্কার। আবার কেউ-কেউ স্বাভাবিক লোকের মতো বড় হয়েছে, কিন্তু বুদ্ধি হয়নি।”

খবরটা ছড়িয়ে গিয়েছিল হোমে। নইলে দিদিদের কথা উপেক্ষা করেও সবাই এক জায়গায় জড়ো হবে কেন? দৃশ্যটা দেখে লুথার থমকে গেল। এত ছেলেমেয়ে, যাদের কারও বয়সই পনরোর উপরে নয়, প্রতিবন্ধী! সে মাউথঅর্গান হাতে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে হাসল, “তুমি রাহুল?”

রাহুল হতবাক। সে দাঁড়িয়ে ছিল একটা ক্রাচে ভর করে। অবাক হয়ে রুনার দিকে তাকাল সে। তারপর ফিসফিসিয়ে বলল, “এ কী রে! আমার নাম জানে!”

রুনা চশমা চোখে মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কী করে জানলে?”

লুথার হাসল, “আমি জানি। যারা সুর বাজায়, তারা আমার বন্ধু।”

অমল বলল, “তা হলে তখন তুমি আমাকে বন্ধু বললে কেন? আমি তো সুর বাজাতে পারি না।”

লুথার মাথা নাড়ল, “ঠিক, ঠিক৷ তবে সুর কি কেবল যন্ত্রে কিংবা গলায় বাজে? সুর বাজে আকাশে, বাতাসে, ঘাসে, গাছের পাতায়, এমনকী, মানুষের হাসিতে। যে পরিষ্কার হাসতে পারে, সে কেন বন্ধু হবে না?”

লুথার যুক্তি দিল বটে, কিন্তু অমলের মন খারাপই থেকে গেল। রাহুল একটু সাহস করে জিজ্ঞেস করল, “তুমি এমন বাংলা বলো কী করে?”

“আমি তো অনেকদিন আছি পুরুলিয়ায়। তবু আমার বাংলা ভাল না।”

“তোমার পিঠে ওটা কী?”

“এইটা?” স্ট্র্যাপটা হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বাক্স খুলল লুথার, “এটা আমার গিটার। আমি একে কখনও হাতছাড়া করি না। এ-ও সুর বাজায়, তাই আমার বন্ধু।”

রুনা এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল । লুথারের আকৃতি কিংবা রং সে দেখতে পাচ্ছে না। সে জিজ্ঞেস করল, “তুমি গিটার বাজাতে পারো?”

“একটু একটু। তোমরা শুনবে?”

রুনা একাই ঘাড় কাত করে টেনে হ্যাঁ বলল। চোখ বন্ধ করে গিটারের তারে আঙুল বোলাল লুথার। সঙ্গে-সঙ্গে সুর ছিটকে উঠল বাতাসে। যারা দূরে কিংবা আড়ালে ছিল, তারা এগিয়ে এল। যারা চোখে দেখতে পায়, তাদের আতঙ্কটা বেশি ছিল। লুথারের চেহারার মানুষের সঙ্গে যেহেতু ওদের কখনওই পরিচয় ছিল না, তাই আতঙ্ক। কিন্তু যারা চোখে দেখতে পায় না, যেমন রুনা কিংবা ওমর, সুর শোনামাত্র গুটিগুটি তারা এগিয়ে এল লুথারের পাশে। সুর মনে-মনে স্থির করে নিয়ে লুথার চাপা অথচ স্পষ্ট গলায় গাইল,

“গুড মর্নিং হোয়েন ইটস মর্নিং

গুড মর্নিং টু দি সানসাইন,

গুড ডে হোয়েন ইট’স লাইট,

গুড নাইট হোয়েন ইট’স নাইট ;

অ্যান্ড হোয়েন ইট’স টাইম টু গো অ্যাওয়ে,

গুড বাই--গুড বাই -- গুড বাই”।

যারা কথা বুঝল, তারা চমকিত হল। যারা বুঝল না, তারা সুরের নড়াচড়ায় দুলে উঠল। একই লাইন নানান সুরে গাইছে লুথার৷ হঠাৎ ভিন্ন বাজনা কানে আসতেই সে চোখ খুলে দেখল, রাহুল তার সুরে সুর মেলাচ্ছে মাউথঅগানে৷ সে গাইতে-গাইতে একটা হাতের মুঠোয় উৎসাহ প্রকাশ করল।

চব্বিশ ঘন্টা কাটল না, লুথার ডক্টর সোমের হোমের ছেলেমেয়েদের কাছের মানুষ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে মানসিক জড়বুদ্ধি-সম্পন্ন আর অন্ধদের খুব বন্ধু হয়ে গেল সে। ওর গিটারের ঠেলায় হোমের সমস্ত নিয়মশৃঙ্খলা বানচাল হওয়ার উপক্রম। কিন্তু ডক্টর সোম কোনও বাধা দিলেন না।

“নো বয়েজ, ইউ মাস্ট প্লে। পা নেই তো ঠিক হ্যায়, যে খেলা খেলতে পা লাগে না সেই খেলা খেলবে। নাউ টেল মি, কোন্‌ খেলায় পা লাগে না?”

একজন চেঁচিয়ে উঠল, “লুডো।”

কেউ বলল, “ক্যারম আর তাস।”

“ইয়েস,ইয়েস, সবাই ঠিক বলেছে, কিন্তু যে-খেলা এখন সমস্ত পৃথিবীতে জনপ্রিয়, সেই খেলাটার নাম হল চেস, দাবা। আন্ডারস্ট্যান্ড? বুদ্ধিমানদের খেলা। যত খেলবে তত তোমার চিন্তা করার ক্ষমতা বেড়ে যাবে।”

মানসিক জড়বুদ্ধিসম্পন্ন একজনকে দেখিয়ে রাহুল বলল, “ও তো চিন্তা করতেই পারে না। ও কী করে খেলবে?”

“ও দৌড়বে, আর গান গাইবে। তুমি এদিকে এসো। কাম।”

যাকে ডাকল লুথার, তার মুখে কোনও ভয়ের চিহ নেই। শুধু সকালবেলায় বাথরুমের পর্ব মিটে যাওয়ার পর থেকে ওর মুখে যে হাসি সেঁটে যায়, তা রাত্রে ঘুমোতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত মোছে না। বছর পনেরোর লম্বা শিশির এগিয়ে এল ইতস্তত করতে করতে। লুথার দৌড়ে তার হাত ধরে সবার সামনে নিয়ে এল। তারপর গিটারটা তুলে সুর ধরতেই শিশির মাথা নাড়ল খুশিতে। লুথার ঝুঁকে শিশিরের বুকে একটা আঙুল রেখে বলল, “তোমাকেও গাইতে হবে, আমার সঙ্গে।”

সুর বন্ধ হওয়ায় কপালে ভাঁজ পড়েছিল শিশিরের। লুথার আবার বলল, “গান গাইতে হবে৷ আণ্ডারস্ট্যাণ্ড ? গা--ন।”

শিশির এবার মাথা নাড়ল।

লুথার গাইল,

দি লাভ ইন ইওর হার্ট

ওয়াজন্ট পুট দেয়ার টু স্টে

লাভ ইজ’ন্ট লাভ

টিল ইটস গিভন অ্যাওয়ে।

বেশ কয়েকবারের চেষ্টায় শিশির প্রায় শোনা যায় না এমন স্বরে গানটা গাইবার চেষ্টা করল। কিন্তু আস্তে-আস্তে যখন মাঠের মাঝখানে দাঁড়ানো বা হুইলচেয়ারে বসা বাচ্চারাই গলা মেলাল, তখন সে সরব হল। নাচের ভঙ্গিতে বাচ্চাদের মধ্যে ঘুরে-ঘুরে গান গাইছিল লুথার গিটার বাজিয়ে। বাচ্চারাও জোর আনন্দ পেয়ে গেছে তখন। সুর স্থির থাকছে না, কিন্তু আবেগটা চিৎকারের পর্যায়ে চলে যাচ্ছিল।

ক্রমশ মিশে গেল লুথার। রুনা যখন তার পাশে বসে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কাবুলিওয়ালার গল্প জানো?” তখন মাথা নেড়ে ‘না’ বলে সে।

রুনা বলে, “তুমি মুখ দিয়ে জবাব দেবে, কেমন?”

লজ্জিত হয় লুথার, “আই অ্যাম সরি। মুখ তো ঈশ্বর দিয়েছেন কথা বলার জন্যে। আমি যে কেন ছাই সেটার ব্যবহার করতে পারি না সবসময়!”

রাহুল জিজ্ঞেস করল, “তুমি ‘আঙ্কল টম’স কেবিন’ পড়েছ?”

“হু ইজ আঙ্কল টম?”

রাহুল আর রুনা হাততালি দিয়ে উঠল, “এ মা, তুমি কিচ্ছু জানো না! আঙ্কল টম তোমার মতো দেখতে, আর তার গল্প পড়োনি?”

“আমার মতো দেখতে? গল্পটা বলবে ?”

রাহুল গল্পটা শুরু করল। সবাই ঘন হয়ে বসল। গল্প শেষ হতে সবাই লুথারের চোখে জল দেখতে পেল। অমল জিজ্ঞেস করল, “তুমি কাঁদছ? টমকাকার জন্যে কষ্ট হচ্ছে?”

লুথার মাথা নাড়ল, “না। টমকাকার গল্প এত দূরে বসেও তোমরা এমন ভাবে করছ বলে আনন্দ হচ্ছে।”

রুনা জিজ্ঞেস করল, “আনন্দে কেউ কাঁদে নাকি?”

“হাসতে হাসতে চোখ দিয়ে জল বের হয় না?” অমল জানিয়ে দিল।

লুথার হাতের পাতায় মুখ ঘষে জল সরিয়ে দিল, “ইউ মাস্ট ওভারকাম। তোমাদের মতো ভাল ছেলেমেয়েরা কখনওই সারেণ্ডার করবে না। খুব কষ্ট হবে, কিন্তু একটা দিন আসবেই, সেদিন তোমরা সুস্থ মানুষের চেয়ে কম কাজ করতে পারবে না। খুব কষ্ট করতে হবে, চেষ্টা করতে হবে, যাতে হাত, পা, চোখ কিংবা বুদ্ধির অভাবগুলো দূর হয়ে যায়। তোমরা কিছুতেই প্রতিবন্ধী নও।”

এই সময় সুপ্রিয়াকে দেখা যায় এগিয়ে আসতে, “মিস্টার লুথার, আপনাকে ডক্টর সোম ডাকছেন।”

“ডোন্ট কল মি মিস্টার, আমি শুধু লুথার। ওয়েল ফ্রেণ্ডস, তোমরা কথা বলো, আমি আসছি।”

ডক্টর সোম গম্ভীর মুখে বসে ছিলেন। তাঁর সামনে ফাদার ডিমকের একটা চিঠি খোলা। কিন্তু চিঠির দিকে নজর ছিল না তাঁর।

হঠাৎ দরজা থেকে চিৎকার ভেসে এল, “হাই ডক্‌। আপনি আমাকে ডেকেছেন? একটা চমৎকার গল্প শুনছিলাম রাহুলের কাছে। জানেন, এই ছেলেমেয়েদের কেউ কিছুতেই দাবিয়ে রাখতে পারবে না। ওরা সমস্ত রকমের প্রতিবন্ধকতা দূর করবেই।”

“থ্যাঙ্কস। বোসো।” ডক্টর সোম চেয়ারটা দেখিয়ে দিলেন।

“হোয়াটস দ্য ম্যাটার?” চেয়ার টেনে নিয়ে প্রশ্ন করল লুথার ।

“ফাদার ডিমক চিঠি দিয়েছেন। তিনি তোমাকে এখনই আমেরিকায় যেতে বলেছেন।”

“কেন? --আমার তো এখানে কিছুদিন থাকার কথা?”

“ছিল।”

“কেন, আমি কি কোনও অসুবিধে করছি আপনার?”

“নো নো, নট অ্যাট অল্। ফাদার ডিমক লিখেছেন, তুমি মাঝে-মাঝেই খুব অসুস্থ হয়ে পড়ছ। পুরুলিয়ার কোনও ডাক্তার রোগটা ধরতে পারছে না। অসুখটার চিকিৎসার জন্যে তোমার এখনই দেশে ফিরে যাওয়া উচিত।”

ঠোঁট কামড়াল লুথার, “আই আ্যাম অল রাইট। দশ-পনেরো দিনে কিছু হবে না।”

“নো, ইউ আর নট।” ডাক্তার সোম উত্তেজিত হলেন।

“ওয়েল, ডু ইউ থিংক আই অ্যাম ক্যারিয়িং সাম ইনফেকশাস ডিজিজ?”

“নো। সার্টেললি নট। আমি তোমার ভালোর জন্যেই বলছি। ইউ মাস্ট গো ব্যাক টু-মরো। তোমার টিকিট পাশপোর্ট আমাকে দাও । আমার এক পরিচিত ট্র্যাভেল এজেন্টকে দিয়ে কালকের টিকিট করিয়ে নিচ্ছি।”

সেই রাত্রে দুর্ঘটনা ঘটল। হুইলচেয়ার থেকে বিছানায় নিজে নিজে উঠতে গিয়েছিল অমল। সেই সময় ব্যালেন্স হারিয়ে মেঝেতে পড়ে যায়। মাথার পাশে এমন আঘাত লাগে যে, সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। সঙ্গে-সঙ্গে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। যে সিস্টার ওদের ডিউটিতে ছিলেন, তিনি জানান, অমল কিছুতেই তার কথামতো একটু অপেক্ষা করেনি। অন্য একটি ছেলেকে তিনি যখন সাহায্য করছিলেন, তখন অমল উৎসাহটা দেখায়। পড়ে যাচ্ছে দেখে ছুটে এসেও তিনি কিছু করতে পারেননি। অমলের বাবা-মা থাকেন শহরের এক প্রান্তে। খবর পেয়ে তাঁরাও ছুটে এসেছেন। ডক্টর সোম বিব্রত এবং চিন্তিত হয়ে পায়চারি করছেন বাইরে। সুপ্রিয়াকে হোমের দায়িত্বে রেখে তিনি এসেছেন। এরকম ঘটনার পেছনে যা-ই কারণ থাক না কেন, এটা তাঁর হোমের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা হিসেবেই প্রচারিত হবে। এবং তিনি দায়িত্ব অস্বীকার করছেনও না। অমলকে যারা পরীক্ষা করছিলেন, তাঁদের একজন সিনিয়ার ডাক্তার বাইরে বেরিয়ে এসে বললেন, “ভয়ের কিছু নেই বলে মনে হচ্ছে। কানের ওপরে স্কালে সামান্য চোট লেগেছে। এক্স-রে রিপোর্ট তা-ই বলছে। রাতটা দেখব। দরকার হলে সকালে অপারেশন করতে হবে।”

অমলের বাবা বললেন, “ও আমার একমাত্র সন্তান। যেমন করেই হোক.......... “

হসপিটালের ডাক্তার বললেন, “চিন্তা করবেন না । শুধু দু’বোতল রক্ত তৈরি রাখুন। ওর ব্লাড গ্রুপ একটু বাদেই বলে দিচ্ছি।”

অমলের বাবা মাথা নাড়লেন, “ওর আর আমার একই ব্লাড গ্রুপ। কিছুদিন আগে আমরা করিয়েছিলাম।”

ডাক্তার হাসলেন, “নট দ্যাট । আমাদের স্টক থেকে আমরা রক্ত দেব। শুধু আপনারা যে-কোনও গ্রুপের ব্লাড দিয়ে ওটাকে রিপ্লেস করে দেবেন।”

দূরে দাঁড়িয়ে শরীর কুঁকড়ে শুনছিল লুথার। এবার এগিয়ে এসে বলল, “ডক্টর, আমি রক্ত দিচ্ছি, এখনই নিয়ে নিন। আমি কাল চলে যাচ্ছি। কিন্তু আমার রক্ত এখানে থাক।”

ডক্টর সোম দ্রুত মাথা নাড়লেন, “নো। তা হয় না।”

“কেন হয় না ? ওই ছেলেমেয়েদের জন্যে আমি রক্ত দিতে না।”

“পারো না। তুমি পারো না”, ডক্টর সোম মাথা নাড়লেন।

“কিন্তু কেন? আমার অপরাধ কী?”

“জাস্ট ডোন্ট আস্ক মি। আমি বলতে পারব না।”

হোমে ফিরে এসে ঘুমোতে পারছিলেন না ডক্টর সোম। তার হোমের কোনও ছেলের এমন দুর্ঘটনা কখনও ঘটেনি। কাল সকালে যদি অমল সুস্থ না হয়? তিনি জানলা দিয়ে অন্ধকারের আকাশ দেখছিলেন। এবং তখনই-নজর গেল নিজের অফিসের দিকে। শোবার ঘর থেকে যে জানলাটা দেখা যায়, সেখানে আলো পড়েছে। অথচ তিনি ঘরের আলো নিভিয়ে এসেছিলেন। ডক্টর সোম নিঃশব্দে নেমে এলেন।

তাঁর অফিসঘরের দরজাটা ভেজানো। ধীরে-ধীরে চাপ দিতেই খুলে গেল। তিনি দেখলেন, একটা ফাইলের ওপর ঝুঁকে পড়েছে লুথার। ফাইলটাতেই তিনি ফাদার ডিমকের চিঠি রেখেছেন।

চিঠিটা খুঁজে পেয়ে দ্রুত পড়ে ফেলছিল লুথার৷ তারপর চিৎকার করে উঠল, “ও মাই গড!” ধপ করে বসে পড়ল সে চেয়ারে। বসে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল। ডক্টর সোম একটু ইতস্তত করে দরজাটা নিঃশব্দে ভেজিয়ে দিয়ে ফিরে চললেন শোওয়ার ঘরের দিকে।

বিকেলে চলে যাবে লুথার৷ একটু আগে খবর এসেছে, অমলের বিপদ কেটে গেছে। সে ভাল হয়ে উঠবে কিছুদিনের মধ্যেই। হোমের সমস্ত ছেলেমেয়ে মাঠে দাঁড়িয়ে ছিল। ডক্টর সোম লুথারকে তার ঘর থেকে নিয়ে এলেন। লুথারের এক হাতে স্যুটকেস, অন্য হাতে গিটারের বাক্স। সুপ্রিয়া ছেলেমেয়েদের বোঝাচ্ছিল কী করতে হবে। এদের দেখে কথা বন্ধ করল। হঠাৎ লুথার ডক্টর সোমকে বলল, “থ্যাঙ্কস, ডক্টর৷ কাল আমাকে রক্ত দিতে নিষেধ করে ভাল করেছেন। এই রক্ত কোনও সুস্থ মানুষকে দেওয়া যায় না।”

ডক্টর সোম বললেন, “আমেরিকায় এখন তো এর ট্রিটমেন্ট...”

“ইউজলেস,” বাধা দিল লুথার, “লিউকোমিয়া যখন প্রমাণিত, তখন আমার জীবন শেষ হয়ে এসেছে। ফাদার ডিমকের চিঠি কাল রাত্রে দেখেছি আমি, আপনাকে না-জানিয়ে। আমার ব্লাড রিপোর্টের কথা ফাদার আমাকে জানাননি। কিন্তু জেনে গেলাম। মাই ডেজ আর লিমিটেড। বাট নট দেয়ার্স। হেল্প দেম।”

লুথার যখন, ওদের সামনে এল, তখন সবক’টি গলা মাউথঅর্গানের সুরে সুরে মিলিয়ে গেয়ে উঠল, “গুড মর্নিং হোয়েন ইট’স মর্নিং/ গুড নাইট হোয়েন ইট’স নাইট/ অ্যাণ্ড হোয়েন ইট’স টাইম টু গো অ্যাওয়ে / গুডবাই-গুডবাই-গুডবাই।”

হঠাৎ লুথার চিৎকার করে কেঁদে উঠতেই সবাই থেমে গেল। ওরা অবাক হয়ে দেখল, পিঠ থেকে বাক্সটা খুলে নিয়ে লুথার রাহুলের হাতে ধরিয়ে দিল, “ইট’স মিউজিক, আমার অনুরোধ, নেভার সে গুডবাই টু ইট, ও কে?”

তারপর ধীরে-ধীরে গেটের বাইরে অপেক্ষার ট্যাক্সির দিকে পা বাড়াল লুথার।


।।সমাপ্ত।।

No comments:

Post a Comment