সত্যি রাজা আর মিথ্যা দেবতার গল্প

লেখক: দেবীদাস আচার্য্য


আর কেউ নয় ইতিহাস একা জানে নজিরবিহীন এ কাহিনী। স্পেনীয় বীর কোর্টেস আর মেক্সিকোর রাজা মণ্টেজুমার সংঘর্ষের কাহিনী। ঠিক তা নয়, এ আসলে এক আসল রাজা আর নকল দেবতার যুদ্ধের খতিয়ান।


কতকগুলো ভুল আর অন্ধসংস্কার দিয়েই এ কাহিনীর সূত্রপাত। মেক্সিকোর সেনাশক্তির কথা যদি আগে জানতেন কোর্টেস তাহলে হয়তো দীর্ঘ সমুদ্রপথ পেরিয়ে হাজিরই হতেন না সেখানে। বরং কিউবাতে ছিলেন ভাল। কিউবা তো স্পেনের উপনিবেশ। একে বীর, তায় ধনী। সম্ভ্রমের চোখে দেখত সবাই। কি দরকার ছিল এ হিংস্র-সংস্কারের দেশে মৃত্যুর শঙ্কা সেধে সেধে মাথায় নেওয়ার।

আসলে অজানায় পাড়ি জমিয়েছিলেন কোর্টেস। ১৫১৯-এর ১০ ফেব্রুয়ারি। মেক্সিকো সম্বন্ধে কোন ধারণাই ছিল না। কিউবার শাসক ভেলাসকোয়েজের প্রতিনিধি হিসেবেই এ অভিযান। অবশ্য মনের গভীরে উচ্চাশা ছিল--নতুন দেশ জয় করে নিজেই হবেন নতুন শাসক। বশ্যতা? জানাতে হয় তো স্পেনের রাজার কাছে, কিউবার কাছে কখনোই নয়। এ গোপন বার্তা ভেলাসকোয়েজও অবশ্য জানতে পারলেন, কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে তখন।

ওদিকে শত শত মাইল সাগরজলের ওপারে, রাজা মণ্টেজুমাও কিন্তু জানলেন- কোর্টেস আসছেন। না কাকতলীয় নয়, কোন আকাশবাণী তাঁকে এ খবর জানায়ানি, পবিত্র ধর্মপুস্তকই তাকে সাবধান করেছিল। এমনকি ঠিক কবে কোথায় পৌঁছুবেন কোর্টেস, সে খবরও ছিল নিশ্চিত। মণ্টেজুমা ভালই জানতেন, স্পেনীয় লোকটি আসবে সামান্য লোকবল নিয়ে। তাঁর নিজের অগুনতি সেনা মুহূর্তে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে তাদের। তা জেনেও কিন্তু তাঁর সমস্ত শরীরে ভয়ের শিহরণ। পায়ের তলার নিরেট সোনার জুতোজোড়া থেকে শিরোভূষণের উষ্ণীষ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে এক অজানা আতঙ্কের রেশ।

কেন? তা জানতে ইতিহাসের হাত ধরে চলে যেতে হবে ষোড়শ শতাব্দীর মেক্সিকোতে।

মধ্য আমেরিকার আগ্নেয় পাহাড়ে ঘেরা অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করে মেক্সিকোবাসীদের আদি পূর্বপুরুষেরা। তবে সেজন্য লড়াই কম করতে হয়নি। আশপাশের অঞ্চলে অধিকার ছিল নানান ছোট্ট ছোট্ট আদিবাসী সভ্যতার। তবে মেক্সিকোবাসীদের সাহস, বুদ্ধি আর কৌশলের কাছে তাদের অধিকাংশই ধূলিসাৎ হয়োছল। চাষবাস আর নানান শিল্পে দিন দিন দক্ষ হয়ে উঠোছল মেক্সিকোর সাধারণ মানুষ। তৈরি করেছিল অপূর্ব অদ্ভুত এক দ্বীপনগরী। ঈর্ষণীয় সৌন্দর্য্যে ভরা মনোরম প্রাসাদ বানিয়োছিল। সুরক্ষার ব্যবস্থা ছিল নিশ্ছিদ্র। সব মিলিয়ে এক ভরে ওঠা সম্পদের দেশ। কিন্তু ছিদ্র ছল ধর্মের পথে। ধর্মই ডেকে আনল সর্বনাশ। এক সর্বনাশা পৈশাচিক সংস্কার আর অন্ধবিশ্বাস হাতে গোনা কিছু বিদেশীর কাছে নতজানু হতে বাধ্য করল।

মেক্সিকোবাসীদের ধর্মে দেবতাদের অভাব ছিল না। অভাব ছিল দেবতাদের মধ্যে সদ্ভাবের। সব দেবতাই যেন ক্রোধে অগ্নিশর্মা সব সময়েই। ঈর্ষা দ্বেষ ঢুকে বসেছিল দেব-স্বভাবের মধ্যে। তাই মানুষজন সব তটস্থ সবসময় দেবতাদের তুষ্টির জন্য। নইলে অনাবৃষ্টি, শস্যহানি, -- প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঢেউ এসে মুছে দেবে সভ্যতার রেশ।

দিগভ্রান্তের মত চিন্তা করে অবশেষে দেবতাদের খুশি করার পথ পাওয়া গেল। প্রিয় উপচার চাই। ধারালো পাথরের অস্ত্রে সদ্য হত্যা করা মানুষের বুক থেকে উপড়ে আনতে হবে ধকধকে হৃৎপিণ্ড। নৈবেদ্য হিসেবে সাজিয়ে দিতে হবে দেবতার মূর্তির সামনে বেদীর ওপর। প্রাণহীন ধড়টা ছিঁড়েখুঁড়ে খাবে শেয়াল কুকুরে। এভাবেই শোধা যাবে দেবতার ঋণ। আবার সম্পদ এসে ধরা দেবে হাতের নাগালে।

এভাবেই চলে আসছিল। দেবতাদের নৈবেদ্যের যোগান রাখতে পাশাপাশি অন্য জাতিগুলোর সঙ্গে যুদ্ধ চালাতে হত ক্রমাগত। বন্দীরাই হত দেবতার ভোজ্য। কিন্তু গোল বাধল এক বিদ্রোহী দেবতাকে নিয়ে। দেবরাজ্য থেকে নির্বাসিত হলেন বিদ্রোহী দেবতা কোয়েটজালকোট। নরশোণিতমাখা হৃদযন্ত্রে তাঁর চরম অনীহা। রুষ্ট হলেন মহা মহা দেবতারা।

দেবরাজ্য থেকে কেন এমন মানবোচিত আচরণ? কোয়েটজালকোটের দেব স্বভাব ঘুচে গেছে তবে! ফলে অবধারিত নির্বাসন।

স্বর্গরাজ্য থেকে ধীর ক্রুদ্ধ পদক্ষেপে সাগরের কোলে এসে দাঁড়ালেন কোয়েটজালকোট। চড়ে বসলেন ছোট্ট একটা মায়াবী নৌকোয়। তারপর সাগরের ঢেউ তাকে নিয়ে চলল দূরে........ দূরে। আর দেখা গেল না তাঁকে, শুধু থেকে গেল তাঁর প্রতিশোধের চরম প্রতিজ্ঞা। সাগর-ঢেউয়ের মাথায় চড়ে আবার তিনি আসবেন কোন এক ‘রীড’ বছরে।

আমাদের ‘লীগ ইয়ারের’ মতই মেক্সিকোদের রীড বছর। তবে তা এত ঘনঘন আসে মা। কত রীড বছরই চলে গেছে মনের আড়াল দিয়ে। কোয়েটজালকোটের চরমবার্তা মনে রাখেনি কেউ। তবে এই রীড বছর, মানে ১৫১৯ সাল যেন কি এক অশুভ ইঙ্গিত নিয়ে এল। জ্ঞানীগুণী ভবিষ্যদ্রষ্টা ব্যক্তিরা রাজা মণ্টেজুমাকে জানালেন সে অশুভ সংকেত। যা ছিল কেবল পবিত্র ধর্মগ্রন্থে লেখা, রাজা-প্রজা কেউই যাঁর খোঁজ রাখেনি সেই চরম সত্যই সূর্যালোকে চঞ্চল হয়ে উঠল আবার। এমনকি ফেরারী দেবতার ফিরে আসার দিনক্ষণ বলে দিলেন তাঁরা ধর্মপুস্তক ঘেঁটে। আমাদের ক্যালেন্ডার অনুসারে সে দিনটি ছিল ২২ এ্রপ্রিল। দেবতার দর্শনটি হবে ঠিক যেমন তার ছবিতে দেখা যায়L দীর্ঘ ঋজু শরীর, সর্বাংগ কালো পোশাকে ঢাকা, অতি গৌর মুখখানিতে ঘন কালো শ্মশ্রু--এসবই চিনিয়ে দেবে তাঁকে।

২২ এপ্রিলের সকালে ঠিক এমনি দর্শনধারী একজন এসে নামলেন মধ্য আমেরিকার সাগরবেলায়। সবসময়ই যে কোর্টেস কালো পোশাক পরতেন তা নয়, সে দিনটির ছিল ওটি বিশেষ পোশাক। সেদিন ছিল গুডফ্রাইডে। বীর হলেও ধর্মবিশ্বাসী কোর্টেস তাই নিজেকে সাজিয়েছিলেন শোকের প্রতীক নিকষ কালো পোশাকে। সঙ্গে এগারোটা জাহাজে ছিল ৫৫৩ জন। সেই সঙ্গে ঘোড়া আর কামান।

মণ্টেজুমার শরীর গোপনে কেঁপে কেঁপে উঠছে। দেবতার রোষ যে কি রূপ নিয়ে আসবে কে জানে! তবে মনের কোণে ক্ষীণ আশা আছে একটা, যদি সেবায় তুষ্ট করে সেই ক্রোধী দেবতাকে নগরে প্রবেশ করতে বিরত রাখা যায়!

‘কোয়েটজালকোট’ জাহাজ থেকে নেমে মাটিতে পা রাখতে না রাখতেই রাজার পাঠানো এক সেবাদল এসে অভ্যর্থনা জানাল তাঁকে। দলের পুরোভাগে একটা মোটা লোক থপথপে পায়ে হেঁটে এল। কোয়েটজালকোটের নৈবেদ্য হিসেবে একে পাঠিয়েছেন মণ্টেজুমা। তাঁর বিশ্বাস কোয়েটজালকোট এতদিনে নিশ্চয়ই রুচি পাল্টে তরতাজা মনুষ্য হৃদয়ের নৈবেদ্য গ্রহণ করতে শুরু করেছেন।

ব্যাপারটা আঁচ করে কোর্টেস বেশ রাগতভাবেই প্রত্যাখ্যান করলেন মণ্টেজুমার পূজার উপচার ঐ নধর মানুষটিকে।

এ খবর যখন পৌঁছল মণ্টেজুমার কাছে, তাঁর মনে আর কোন সন্দেহই রইল না যে এ বিদেশীই সেই নির্বাসিত দেবতা। প্রতিশোধের আগুন এতদিন ধিকধিক জ্বলেছে তাঁর অন্তরে। এখন সেই আগুনের খোরাক যোগাতেই ফিরে এসেছেন আবার। তাঁর কোপ থেকে মুক্তির আর বুঝি কোন উপায় নেই। তবুও শেষ চেষ্টা করে দেখতে হবে, মহামূল্য উপহারে যদি তাঁকে খুশি করা যায়, যদি তিনি দুর্গম পথ পেরিয়ে দ্বীপনগরীর দিকে আসার কষ্ট স্বীকার না করেন!

রাজার এ আশঙ্কার কথা যথাসময়ে পৌঁছল কোর্টেসের কানে। কোর্টেস ভাল করেই জানেন সুযোগের অপচয় কাপুরুষের কাজ। স্প্ষ্ট জানালেন, তিনি মণ্টেজুমার প্রাসাদে গিয়ে দেখা করতে চান তাঁর সঙ্গে। তবে তাড়াহুড়ো করলেন না একেবারে। সমুদ্রের উপকূলে যেখানে নেমেছেন এসে, সেখানটাতে বেশ পোক্ত ঘাঁটি বানালেন। শদেড়েক লোক থাকল সেখানে। বাকি চারশ লোকের দল নিয়ে বেশ প্রস্তুত হয়েই এগোলেন রাজধানী-নগরীর দিকে।

প্রস্তুতি বেড়ে গেল যাত্রা শুরু করতে না করতেই। উপকূলের বাসিন্দাদের চিরশত্রুতা মেক্সিকোবাসীদের সঙ্গে। তারা যথাসাধা সাহায্য এনে দিল কোর্টেসের কাছে। তবে বেশিদিন গা এলিয়ে থাকা গেল না। দুর্ধর্ষ টাক্সকালান উপজাতির যোদ্ধারা ঝাঁকে ঝাঁকে এসে ধুন্ধুমার বাধিয়ে দল একেবারে। একটু দুশ্চিন্তায় পড়লেন কোর্টেস। অন্তত হাজার ছয়েক সশস্ত্র টাক্সকালান যোদ্ধার মোকাবিলা করবে কিভাবে শচারেক সেনা। মণ্টেজুমার কাছে চলেছিলেন অন্য ভরসায় -- নকল দেবতা সেজে। কিন্তু এই দুর্বৃত্তদের নিবৃত্ত করবেন কিভাবে!

কৌশল বেরয়ে পড়ল অজান্তেই। সঙ্গের ঘোড়াগুলোই যুদ্ধ জিতিয়ে দিল। মধ্য আমেরিকার ঐ উপজাতি যোদ্ধারা দুর্ধর্ষ যতই হোক, ঘোড়া নামক প্রাণীটিকে চোখে দেখেনি কখনও। ফলে ঘোড়সওয়ার যোদ্ধারা অসম্ভব সম্ভ্রম আদায় করল তাদের কাছে। তাদের ছ হাজার সেনার মিলিত শক্তি এসে নতজানু হয়ে পড়ল গুটিকয় ঘোড়সওয়ারী আজবদর্শন যোদ্ধার কাছে। দলের মাত্র চোদ্দজন প্রাণ হারাল যুদ্ধে। এত সহজে এ যুদ্ধ জয় করা যাবে, ভাবেননি কোর্টেস। আর টাক্সকালানদের যুদ্ধগর্ব খর্ব হওয়ায় তারা এসে হাত মেলাল অমিতশক্তি এই বিদেশী বাহিনীর সঙ্গে।


রাজা মণ্টেজুমার কাছেও খবর পৌঁছল-- মাত্র শচারেক যোদ্ধা হারিয়ে দিয়েছে ছ হাজার সেনার টাক্সকালান বাহিনীকে। এতো মানুষের শক্তি নয়, দেবতার অমোঘ লীলা। যত বড় শক্তিধর বাহিনী বানাও না কেন তাঁর প্রতিশোধস্পৃহার কাছে বুদ্বুদের মত ক্ষণস্থায়ী হয়ে যাবে সব, তাই আবার রাজার দূত এল কোর্টেসের কাছে। এবারে তাদের সঙ্গে প্রচুর সোনা আর মিহি কাপড় উপহার হিসেবে। উপহার আরও আসবে, দ্বিগুণ চতুর্গুণ দশগুণ হবে শুধু যদি দয়া করে তিনি রাজধানীর দিকে পা না বাড়ান।


মনের গভীরে কোথায় যেন আস্থা পেয়েছেন কোর্টেস। এ যাত্রায় ভাগাদেবী সুপ্রসন্ন। সুযোগ হেলায় হারানো উচিত হবে না। একটা হেস্তনেস্ত না হলে শান্তি নেই। উপহার প্রত্যাখ্যান করে এগিয়ে চললেন লক্ষ্যপথে৷

নভেম্বর নাগাদ এসে পৌঁছলেন পাহাড়-ঘেরা সেই অঞ্চলে। উঁচু পাহাড়ী এলাকা থেকে এই প্রথম দেখলেন নিচে প্রায় পঞ্চাশ মাইল হ্রদের ঠিক মাঝখানে মেক্সিকোবাসীদের শহর। ঠিক যেন ছবির মত আঁকা আছে টলটলে জলের গায়ে। সারা স্পেন ঢুঁড়েও এ সৌন্দর্যের দোসর খুঁজে পাওয়া যাবে না। আরও কদিন এগিয়ে তবে এসে পড়লেন হ্রদের পাড়ে। কতকগুলো সরু, পাথরে বাঁধানো পথ জলের বুক চিরে চলে গেছে সেই দুর্গ-নগরী অবধি। এগুলো হাতেগড়া। প্রাকৃতিক কোন যোগ নেই দুদিকের মধ্যে।

সরু একটা পথ বেয়েই এগিয়ে চলল কোর্টেসের বাহন। প্রায় মাঝপথে গিয়ে কোর্টেস খবর পেলেন রাজা নিজে আসছেন তাঁর অভ্যর্থনার জন্য। আরো মাইলটাক এগিয়ে মুখোমুখি হলেন দুজনে। একজন সত্যি রাজা, আরেকজন মিথ্যে দেবতা।

ভয়ে ভক্তিতে কাতর মন্টেজুমা নিজেই কোর্টেসকে নিয়ে চললেন মেক্সিকো শহরে। স্পেনীয়দের পুরো বাহিনীই রাজ-অতিথি হয়ে জায়গা পেল প্রাসাদে। রাজমহল দেখে স্পেনীয়দের বিস্ময়ের অবধি থাকে না। এতবড় বাহিনীর প্রায় সকলেরই জায়গা হল আলাদা আলাদা ঘরে। সম্পদের প্রাচুর্য যেন ঘিরে রয়েছে সমস্ত প্রাসাদটাকে। শুধু তাই বা কেন, শহরের সর্বত্রই যেন লক্ষ্মীর উৎসব। ভবিষ্যতে কি হবে সে ভাবনা দূরে সরিয়ে আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠল সবাই।

আনন্দের এই রেশ কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী হল না। খবর এল উপকূলে রেখে আসা স্পেনীয়দের জীবন বিপন্ন। তাদের ওপর হামলা করেছে মণ্টেজুমার সেনারা। খবরটা সত্যি বটে, তবে মণ্টেজুমা ঘুণাক্ষরেও জানতেন না এ বিষয়ে। কিন্তু রাগে জ্বলে উঠল কোর্টেসের শরীর। আক্রমণের ইন্ধন যুগিয়েছিল যারা -- সেই সর্দার কজনকে বেঁধে এনে মেক্সিকোর প্রকাশ্য রাজপথে জনসমক্ষে পুড়িয়ে মারলেন। দেবতার রোষ নীরবে প্রত্যক্ষ করতে বাধ্য হলেন রাজা মণ্টেজুমা।

কোর্টেসের আদেশে মণ্টেজুমার স্থান হল স্পেনীয়দের অধিকৃত এক প্রাসাদে। রাজকীয় জিনিসপত্তর সবই থাকল সঙ্গে। তবে প্রকৃত অর্থে মণ্টেজুমা হলেন বন্দী।

মেক্সিকোবাসীরা কিন্তু এ ঘটনায় খুশি হতে পারল না মোটেই। প্রাচীনকাল থেকে আজ অবধি কই রাজার সঙ্গে দেবতার বিরোধের কথা শোনেনি তারা। মানুষের ওপর বিদ্রোহী দেবতার এ কেমন প্রতিশোধ! তবে কি মানুষকেই রুখে দাঁড়াতে হবে দেবতার বিরুদ্ধে!

ওদিকে স্পেনীয়দের আর একটা বড় দল বেশ কটা জাহাজ ভেড়াল মেক্সিকোর উপকূলে। এরাও এসেছে কিউবা থেকেই। ভেলাসকোয়েজ তাদের পাঠিয়েছেন কোর্টেসকে দেশে ফিরে যেতে বাধ্য করতে। কোর্টেসের মতলব একটু দেরিতে আঁচ করলেও স্থির থাকতে পারেননি তিনি। পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই তাই যথাযথ একটা ব্যবস্থা নিলেন।

সামনে উচ্চাশার চরম শিখর। না চাইতেই কোর্টেস হয়েছেন কোয়েটজালকোট। এখান কি আর ফিরে যাওয়া যায়? অগাধ ধনরত্ন এখন তাঁর দখলে। সেগুলোর কিছু কাজে লাগিয়ে বশ করলেন কিউবা থেকে আসা দ্বিতীয় দলটাকে।

তবে একদিকে সফল হলেও বিপদ এসে উঁকি দিল আরেক দিকে। কৌশলের কাজ করতে গিয়ে বেশ কটা সপ্তাহ মেক্সিকো শহর থেকে দূরে সমুদ্র উপকূলে কাটাতে হল। আর বিপদে ঘনিয়ে এল সেই ছিদ্রপথেই ৷

তাঁর অবর্তমানে স্পেনীয়দের সঙ্গে মেক্সিকোবাসীদের বিরোধ লেগেছে প্রতিদিনই। একসময় পরিস্থিতি বিস্ফোরকের রূপ নিয়েছে। পুরো শহরটাই যেন ঝাঁপিয়ে পড়বে এখুনি তাঁর লোকেদের ওপর। সাগরপারের এই বিদেশে নিশ্চিহ্ন করে দেবে তাঁদের মর্ত্যলীলা।

এই প্রথম এতবড় বিপদের মুখোমুখি হলেন কোর্টেস। বীর হলেও মিথ্যে জেদ নেই তাঁর। অনেক চিন্তা করে দেখলেন প্রাসাদে সৈন্য যা আছে তাতে করে রাগে ফুঁসে ওঠা পুরো একটা শহরের বাসিন্দাদের সঙ্গে যুঝে ওঠা স্বপ্নেও সম্ভব নয়। তার চেয়ে নীরবে নিঃশব্দে লোকজন নিয়ে দ্বীপ-নগরীর বাইরে চলে আসাই যুক্তিযুক্ত।

এমন একটা সম্ভাবনাই আঁচ করেছিল শহরের লোকেরা। বাইরে যাওয়ার সরু পথগুলো তাই আগলে রেখেছিল তারা। ফলে অবধারিত যা, যুদ্ধ বাধল মুখোমুখি। মেক্সিকো শহরের বুকে দাঁড়িয়ে এই প্রথম বুঝলেন কোর্টেস -- তিনি দেবতা নন, শুধুই মানুষ।

যুদ্ধে যা খোয়ালেন তা আর বলার নয়। সামান্য গুটিকয় লোকজন নিয়ে কোনরকমে হ্রদের পাড়ে এসে পৌঁছলেন। বন্দী হল যারা তাদের পরিণতিঃ দেবতার বেদীর সামনে তাদের ধকধকে হৃৎপিন্ডগুলো পড়ে রইল শুধু। বহুদূর থেকেও তাদের মৃত্যুন্ত্রণা যেন স্পষ্ট শুনতে পেলেন কোর্টেস। এই প্রথম নিজেকে বড় অসহায়, হতাশ মনে হল তাঁর।

নিঃসম্বল, নিঃসহায় হয়ে কোর্টেস ফিরে চললেন সমুদ্রের দিকে। এমন সময় ভাগ্যদেবী নিয়ে এলেন শেষ চমক। টাক্সকালানদের এলাকা পেরিয়ে উপকূলের পথ। টাক্সকালানরা কোর্টেসকে সাদরে নিয়ে গেল মহামান্য অতিথি করে। মাসের পর মাস আশ্রয় দিল তাঁকে আর তাঁর সঙ্গীসাথীদের। উদ্দেশ্য একটাই, কোর্টেস তাদের নিশ্চিন্ত করবেন। মেক্সিকোবাসীদের মুহূর্মুহূ আক্রমণের ইতি টেনে দেবেন একেবারে।

মনকে শক্ত করে তৈরি হচ্ছেন কোর্টেস। একবার শেষ চেষ্টা করতে হবে। নকল দেবতার মাঝে যে সত্যি বীরত্বটুকু লুকিয়ে আছে প্রাণপণে তাই টেনে আনছিলেন নিজের ভেতর থেকে। এমন সময় মেঘ না চাইতেই জল। আগের বাহিনীর দেরি দেখে আরও এক বিশাল সেনাবাহনী পাঠিয়েছেন ভেলাসকোয়েজ। সঙ্গে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র। এদের বশ করার পদ্ধতি তো ইতিমধ্যে আবিষ্কার করেছেন কোর্টেস। সুতরাং এবারে আর বেগ পেতে হল না। সময় নিয়ে তৈরি হয়েই শেষ অভিযানে বেরোলেন। সঙ্গে টাক্সকালানদের বিপুল বাহিনীও। মেক্সিকানদের সাজানো শহর এ আক্রমণ আর সইতে পারল না।

১৫২১-এর আগস্টে মেক্সিকোর পতন হল। স্পেনের রাজার হয়ে শাসনভার নিলেন কোর্টেস। দুঃসাহসিক এক অভিযাত্রীর শ্রেষ্ঠ শিরোপা। কেননা, ভাগ্যদেবী কেবল বীরদেরই সহায় হন চিরকাল। কোর্টেস প্রথমেই বিদায় করলেন সর্বনাশা সেই অন্ধ-ধর্মসংস্কার। রাজাদেশে এল নতুন ধর্ম-খ্রিস্টধর্ম। শুধু রাজার আদেশে নয় অবশ্য। কেন না তিনি যে কোয়েটজালকোট তা তো প্রমাণ হয়েই গেছে। বিবদমান দেবতারা স্বর্গচ্যুত হলেন সবাই। এল শান্তির ধর্ম--ভগবান যীশু আর মাতা মেরী। তবে হ্যাঁ, আজও মেক্সিকোর প্রত্যন্ত অঞ্চলে আরও এক দেবতা পূজা পান-- বীরত্বের পূজা -- দীর্ঘ ঋজু শরীর, স্পেনীয় গড়নের অতি-গৌর মুখখানিতে ঘন কালো শ্মশ্রু আর সর্বাঙ্গ ঢাকা গুডফ্রাইডের কালো পোশাকে।

সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment